বিনয় গল্প লেখে। কবিতাও লেখে। ওর চেনা জানা অনেকে সেসব লেখা পড়ে। কেউ ভাবে উচ্চ দরের লেখা। কেউ ভাবে কেন যে এসব লেখে? তাই কেউ লেখা পড়ে তেমন কোন মন্তব্য করে না।
আবার যারা চেনে না জানে না তারাও এ লেখা পড়ে অথবা পড়ে না। বলে – আপনার লেখা দেখলাম। বেশ লেখেন তো।
এই পর্যন্ত। তবে বিনয় লেখে। নিজে ছোটখাটো এক অফিসে কাজ করে। বাড়ি ফিরে কিছু সময় ছেলেমেয়েকে পড়ায়। তারপর লেখে। লেখার কথা ভাবে। কোন চায়ের ঠেকে যায় না। তাস পেটাতে ভাল লাগে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাজে তর্ক করতে ভাল লাগে না। তাই সময় পেলে লেখে।
মুশকিল হচ্ছে লেখার প্যাঁচ জানে না, উপস্থাপনা জানে না। কবিতার মত উদ্দাত্ত আলোড়ন তুলতে পারে না। এসব বিনয় ব্যাগ কাঁধে মোটা মোটা বই নিয়ে ঘোরা কিছুজনের কাছে শুনেছে।
ফলে বিনয়ের লেখা ওই পর্যন্ত।
বিনয়ও ভাবে তাহলে লিখে কি হবে? আবার ভাবে ঠিকই তো লিখেছি কিন্তু সত্যিই কি গল্পের আকার নেই? সত্যিই কি কবিতার ঝংকার নেই? তাহলে কি এসব ছেড়ে গুলতানীতে যাওয়া ঠিক? ঠেকে যাওয়া ঠিক?
বিনয় ভাবতে থাকে। অফিসে পরিতোষ একদিন বলল – দাদা, আপনি লেখক? আপনার লেখা পড়েছি।
পড়েছেন? কেমন লাগলো? এসব জিজ্ঞেস করার সাহস পায় নি বিনয়।
বাড়িতে বউ বলে – বেশ তো লিখছো। লেখো। লিখতেই থাকো।
বিনয় তাই লেখে। লিখতেই থাকে।
দীপঙ্কর বেরা এর সকল পোস্ট
গল্প চর্চা
গল্প আমাদের জীবনের চেনা জানা দেখা বলা ভাবা চলার ক্ষেত্রে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। হাটে বাজারে মাঠে ঘাটে ফুটপাতে আলিশানে সর্বত্র গল্প বসে থাকে, গল্প ঘুরে বেড়ায়, গল্প দেখে, গল্প ভাবে, গল্প আপনাকে আমাকে নিয়েই গল্প করে। এই গল্পকে বাদ দিয়ে কোন জীবনী নয়, কোন রচনা নয়, কোন আগামী নয়, কোন যুগ নয়।
আবার সাহিত্য ধারায় গল্প আপামর মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়। গল্প পড়ার ছলে, গল্প করার ছলে, গল্প ভাবার ছলে গল্প দেখার ছলে যে কেউ যখন তখন দু এক কলি গান গেয়ে ওঠে, কবিতা মনে পড়ে যায়, মনে মনে আকাশের কুসুম নামিয়ে ছবি আঁকে আর পাশের কোন মানুষকে সহজ করে বুঝতে পারে। অর্থাৎ সমস্ত ধারার মাঝে গল্প আছে। গল্পের মাঝে সমস্ত ধারা আছে। গানে আছে, কবিতায় আছে, উপন্যাসে আছে, বক্তব্যে আছে, প্রবন্ধ আছে, বইয়ে আছে, প্রতিটি মানুষের সাথে আছে। শুধু গল্প এবং শুধু গল্প আছে।
গান শুনতে শুনতে বা গান গাইতে গাইতে আপনি মনে মনে যে চিত্র আঁকেন তা একটা গল্প। তাই আপনার চোখে জল আসে, আপনি হেসে ওঠেন বা ভাবেন।
কবিতা পড়ার সাথে সাথে বা কবিতা লেখার সাথে সাথে যে চিত্র আপনার চোখে ভেসে আসে বা অন্যকে যে চিত্র ভাবাতে বাধ্য করান তা অবশ্যই কোন গল্প ভাবনা। উপন্যাসের এক একটা অংশ ছোট ছোট উপজীব্য গল্প। তারপর তোমার আমার দেখা কোন বড় একজন।
প্রবন্ধে যা আপনার ব্যাখ্যার বিষয় তাতে অবশ্যই সমাজের দেখা কোন কল্প কথার বিস্তৃত গল্পের রূপ। যাকে নিয়ে ভাবতে ও ভাবাতে চাইছেন তা অবশ্যই কোন ব্যাখ্যার গল্প।
অর্থাৎ গান কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধ বা সাহিত্যের যে কোন ধারায় আপনি যদি গল্পের আকারে সেই ভাবনা নিজে ভাবতে না পারেন বা অন্যকে ভাবেতে না পারেন তাহলে সেই গান কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধ বা অন্য কোন সাহিত্যধারা জনমানসে উপজীব্য হবে না।
সেটা গানের মত, কবিতার মত, উপন্যাসের মত, প্রবন্ধের মত বা সাহিত্যের অন্য কোন ধারার মত হবে। সাহিত্য ধারা নাও হতে পারে। যদি হয়ও তাহলে তা কখনওই সুদূর প্রসারী হবে না।
অর্থাৎ গল্পই হল সাহিত্য। সাহিত্যের মাঝে গল্পের অনাবিল ভাবধারা। গল্প ভাবনা উপেক্ষা করে সাহিত্য সৃষ্টি কখনই সম্ভব নয়।
কি হবে কবিতায়
মায়ের হাতের রান্না
আর বাবার করা হাট বাজার
আমার পড়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য।
সে সব ছেড়ে মিথ্যে কবিতার পেছনে
আমার দিনরাত
আমাকে পরিশ্রান্ত করে
অবসন্ন করে।
তারপর মা বাবার ভূমিকায় আমি
লিখতে থাকি ছোট ছোট কবিতা
জীবনের আদর অনাদর আবদার।
ভাবনা
আপনার ভাবনাকে আপনি কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন? যতদূর আপনি ভাবনার গণ্ডি তৈরি করতে পারবেন।
এই ভাবনার গণ্ডি আপনি কতদূর প্রসারিত করতে পারবেন? যতদূর আপনি আপনার জ্ঞান বোধ বুদ্ধি প্রসারিত করতে পারবেন।
এই জ্ঞান বোধ বুদ্ধি আপনি কতদূর প্রসারিত করতে পারবেন? যতদূর যত বেশি আপনি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন।
এই শিক্ষা আপনি কতদূর কতটা বেশি প্রসারিত বা জমা করতে পারবেন। যতদূর বা যতটা বেশি আপনি প্রকৃতির থেকে মানুষের থেকে বই থেকে আপনার দুচোখ খোলা জীবন থেকে গ্রহণ করতে পারবেন।
ভাবনা হল পুঞ্জীভূত জীবনের দু এক ফোঁটা রস। সেই ভাবনার মধ্যে সৃষ্টি থাকলে অথবা সৃষ্টিমূলক কিছু ভাবলে তার অনেকদিক অনেক মুখ তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু ভাবনার মধ্যে ধ্বংসমূলক কিছু থাকলে তার মুখ একটা। শুধু ধ্বংস বা শেষ। যার আর অন্য কোন ভাবনা নাই। দিক নাই। দিশা নাই।
কিন্তু সৃষ্টির শুরু নাই শেষ নাই শুধু তৃপ্তি আছে। আদিগন্ত জীবন আছে। তাই ভাবুন। ভাবার জন্য জীবন সঞ্জয় করুন। তার থেকে ভাবনার নির্যাস বের করে জীবনকে রসসিক্ত করুন।
গোলাপ বাগান
হঠাৎ পলাশ একটা গোলাপ কিনে ফেলল। ঘরে ফিরে বিহনীর হাতে দিয়ে বলল – আই লাভ ইউ।
বিহনী দাঁড়িয়ে পড়ল আর গোলাপ হাতে নিয়ে কিছুটা অবাক সুরে হেসে উত্তর দিল – আই লাভ ইউ টুউ।
তারপর আশ্লেষে পলাশ বিহনীকে জড়িয়ে ধরল। হাসি মুখে দুজন দুজনের দিকে তাকাল। বিহনী বলল – তুমি বসো, আমি চা করে আনছি।
পলাশ বিহনীর হাত ধরে আবার সোফায় বসিয়ে দিল। বলল – না, আজ তুমি বসো, আমি চা করে আনছি। আর চা খেতে খেতে আমরা খুব গল্প করব।
বিহনী সোফাতে বসে পড়ল। যেমন টিভি দেখছিল তেমন দেখতে লাগল।
অনেককটা বসন্ত পেরিয়ে এসেছে। তখন পলাশকে চিনত না জানত না। বাবার পছন্দ মেনে নিয়ে এই সংসারে প্রবেশ। গান করার ইচ্ছে ছিল তাও টুকটাক চলছে। মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। আঁকার ইচ্ছে ছিল এখনও মাঝে মাঝে ছেলের সঙ্গে আঁকতে বসে। রবীন্দ্রনাথ সুকুমার রায়ের অনেক কবিতা মুখস্থ বলতে পারে। আঁকা গান আবৃত্তি এসবে পেশাদার হওয়া তো অত সহজ না। অনার্স টেকে নি। তাই পড়াশুনা আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল। চাকরীর চেষ্টাও জারি ছিল জোটাতে পারে নি।
পলাশ এ সব কোন কিছুতেই বাধা দেয় নি। বরং প্রায়ই উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু বিহনী তার নিজের ক্ষমতা জানত। বরং বাবা বলত এ সব একটু আধটু জানলেই হবে। অত মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এখন বিহনী বুঝেছে সংসার সামলিয়ে অনায়াসে এসব করা যায়। কিন্তু তার জন্য নিজস্ব এবিলিটি থাকা দরকার। তাই সাংসারিক প্রবাহে চলমান থেকেছে বিহনী। তাই পলাশের সাথে সাথে বিহনীও এ সংসারের নিজস্ব হতে পেরেছে।
ছেলে একটু আগে ফোন করেছিল। ভালই আছে। কাল থেকে ইন্টার্নশিপ শুরু হবে।
আজ কি দিন কি বার মনে নেই বিহনীর। চায়ের এত অপূর্ব স্বাদ বিহনীর জীবনের বয়স কমিয়ে দিয়েছে।
তাই হাতের পাপড়ি মেলা গোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকল।
ওরা যারা
যারা ক্ষুধার্ত পায় না খেতে চাইছে ভাত
যারা আর্ত বাঁচার জন্য বাড়িয়েছে হাত
যারা অর্ধনগ্ন একটুও নেই শীত পোশাক
যারা বাস্তুহীন প্রতি মুহূর্ত যাদের দুর্বিপাক
তারা কি কেউ ভাবে আর যেন তারা না বাড়ে
আর যেন কেউ জন্ম না নেয় এমন কষ্ট আঁধারে?
একটু টুকরো রুটি যেন ভাগ না হয় হাজারে
ঠাঁই যেন হয় সবার জীবন পরিমিত জন্মহারে।
তা তো নয়? মানুষ সংখ্যা বাড়ছে আর্তের ঘরে
বাড়ুক কষ্ট তবু আমরা বাড়বো এমন করে।
ওই তো পাচ্ছি অনুদান, আরো পাব বেশি করে
জায়গা করে নিচ্ছি আমরা মানবাধিকার অন্তরে।
এখনো বেঁচে আছে পৃথিবী তাই নিজের আর্তস্বরে।
অণুগল্পের পাঠক প্রিয়তা
এটা ঠিক আজকাল প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় অণুগল্প লেখা হচ্ছে। অণুগল্পের বই বের হচ্ছে। খুবই ভাল খবর। বাংলা সাহিত্যের একটা দিক।
এই অণুগল্প কবে লেখা শুরু হয়েছিল, কে শুরু করেছিল, কোন লেখা অণুগল্প, কোন লেখা অণুগল্প নয় – এসবের চেয়ে খুব জরুরী যেটা সেটা হল এই অণুগল্পকে কিভাবে আরও ভালভাবে বেশি দিকে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কিভাবে সাহিত্যধারায় সম্পৃক্ত করা যায়। কিভাবে সাহিত্যধারায় স্পষ্ট উচ্চারিত করা যায়। সেই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা উচিত। তার জন্য যারা অণুগল্প লিখছে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে সবচেয়ে বেশী।
এই অণুগল্প লিখিয়েদের লেখায় বহু এক্সপেরিমেণ্ট দেখা যাচ্ছে। এই এক্সপেরিমেণ্ট অনেক পাঠকের বোধগম্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার সেই লেখা কিছু পাঠক বলছে অসাধারণ, এটাই হল আসল অণুগল্প।
উভয় ক্ষেত্রে লেখকই কিন্তু পাঠক। যারা শুধু পাঠক তারা এ রকম ‘গল্প নয় অথচ অণুগল্প’কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অথবা পড়ছে না মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
আবার সেইসব শুধু পাঠক ছোট ছোট লেখা, দীপ্ত লেখা, মনগ্রাহী লেখা, অন্যভাবনার লেখা, ভাল বিষয় ভাবনার লেখা ঠিক পড়ছে। প্রশ্নোত্তর করছে। সেগুলো অণুগল্প কি না, গল্পের ফরম্যাটে আছে নাকি অণুগল্পের নিয়ম মানছে না, অণুগল্পের নিয়মটা কি ইত্যাদি নিয়ে সেইসব সাধারণ পাঠক বা শুধু পাঠক মাথা ঘামাচ্ছে না। তারা শুধু ভাল লাগা দেখছে।
কবিতার ক্ষেত্রে যেদিন থেকে জটিলতা, গদ্যের ঝলক, শব্দের ধাঁধা ইত্যাদি এল সেদিন থেকে কবিতার দিক থেকে অনেক পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেরকম ভাবে অণুগল্পের ক্ষেত্রে গল্প কিন্তু গল্প নয় এটা অণুগল্প, আখ্যান কিন্তু আখ্যান নয় এটা অণুগল্প, এটি গল্পের মত বলেছি কিন্তু হাজার দিকের কথা বলা আছে তাই এটা অণুগল্প – ইত্যাদি গোলকধাঁধাঁয় পাঠক হাবুডুবু খেতে চায় কি?
যদি এই গোলকধাঁধাঁয় সে এখন হাবুডুবু খায়ও এক সময় সে যে মুখ ফিরিয়ে নেবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? যেমন কবিতার ক্ষেত্রে অনেক পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার জন্য অবশ্য অনেক লেখক পাঠককেই দায়ী করে। তাতে সাহিত্যের কি লাভ?
মোদ্দা কথা হল সহজ সরল সাধারণ লেখাই আসল লেখা। সহজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মগজমারি। সে লেখকের দিক থেকে যেমন পাঠকের দিক থেকে তেমনি।
ছোট কিন্তু সহজ সরলভাবে সুনির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে ভাবনার আড়ালে তুলে ধরার চেষ্টাই সাহিত্য। পড়ার সময় যেন সমস্ত শ্রেণির পাঠকের বুঝতে কোন অসুবিধা না হয়। আবার পড়ার পরে বিষয়ের গভীরে পাঠক যেন সহজেই ঢুকতে পারে। সেই লেখাই সাহিত্য। না হলে পড়তে পড়তে কিছুই বুঝতে পারলাম না আবার পড়ে তবে বুঝতে হবে তাহলে পাঠক সে লেখা আর পড়বে কি?
এক পাঠক কবিতা বুঝতে পারে নি বলে শ্রীজাত বলেছেন – “অসুবিধে নেই কিছু। আমিও মেটাফিজিক্স বুঝি না।”(ফেসবুক থেকে)। অণুগল্পের লেখকও এমন বলতে পারেন। কিন্তু ওই যে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া পাঠক কি আর ফিরবে?
তাই অণুগল্পের ক্ষেত্রে সমস্ত এক্সপেরিমেনণ্ট একটা অবস্থানে জুড়ে যাক যেটা হল সমস্ত শ্রেণীর পাঠকের কাছাকাছি হওয়া। অণুগল্পের অস্তিত্বকে আরও পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়া। যে কোন অবস্থানে গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ সাহিত্যধারায় আজও সমান জনপ্রিয়। কেন না তার সহজতা সরলতা পাঠকপ্রিয়তা। খুব বেশী এক্সপেরিমেণ্ট, খুব বেশি এটা নয় ওটা দারুণ, এটা অণুগল্প নয়, ওটাতে আপনি এটা দেন নি, এ করেন নি ও করেন নি ইত্যাদি (এসব তো চলতেই থাকবে) ভাবার চেয়ে বলার চেয়ে গভীর কিছু সহজ করে সাধারণভাবে সবাই লিখুক সবাই পড়ুক। সবগুলোই হোক অণুগল্প কিংবা অণুগল্প নয়।
লেখক নিজের শিক্ষা নিজে শিখুক। পাঠকের কাছে পৌঁছে যাক। সাহিত্য পাঠ করার সময় পাঠক কি ভাবে? এটা গল্পের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা উপন্যাসের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা প্রবন্ধের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা কবিতার মত পড়ব বা পড়েছি কিংবা এটা অণুগল্পের মত পড়ব বা পড়েছি। তা কিন্তু পাঠক ভাবে না। পাঠক বিষয় ভাবনায় ডুবে যায়, ভাবনার আবেশে আবেশিত হয়, বিষয় ভাবনায় উদ্বেলিত হয়। সহজ পাঠের গভীর উপলব্ধিতে আরও সাহিত্য জীবন গড়ে তোলে। আরও বেশি সাহিত্য পাঠ করার আকাঙ্খা খুঁজে পায়।
তাহলে? সেই আরও বেশি সাহিত্য জীবনে, আরও বেশি সাহিত্য আকাঙ্খায় অণুগল্প তার অবস্থান আরও প্রসারিত করুক। সেই ভাবনাকে সামনে রেখে লেখা হোক আরও আরও অনেক অনেক অনেক অণুগল্প।
মানুষ পরিচিতি
সবাই সব কথা বলে না
আমিও সবাইকে সব কথা বলতে পারি না
সবার সব কথা আমি বুঝতে পারি না
আমিও সবাইকে সব কথা বোঝাতে পারি না।
সবাই অনেকটা আমার মত কথা বলে
আমিও অনেকটা সবার মত কথা বলি।
তবু সবাই সবার কাছে
অচেনা আলাদা আলাদা এক একটা মানুষ।
পরিচিতি যেন প্রেমে অপ্রেমে
হাত না বদলায়
মানুষের কাছে মাথা যেন হেঁট হয়ে না যায়।
ঘরনী
– বউমা, ক’দিন ধরে লক্ষ্য করছি কোথাও বেরোচ্ছ না অথচ ঘরের মধ্যে সেজে গুজে ফুলবউ হয়ে থাকছ। ব্যাপারটা কি?
– কেন মা? আমি তো রান্নাবান্না ঘরের দেখাশুনা সবই করছি। তাহলে?
– তা করছো। তবে বাইরে বেরনো পোশাক আশাক সব বের করে উগ্র সাজ পরে আছো। কেন?
– কোথায় উগ্র মা। এভাবেই তো মেয়েরা সুন্দর।
– তা সুন্দর। তুমিও আমার সুন্দরী বউমা। তবে ঘরে এমন পোশাক কেন পরছো। কেউ কি আসবে?
শাশুড়িকে জড়িয়ে অগ্রণী বলল – আসবে মা আসবে। আপনার ছেলে।
শাশুড়ি শান্তাদেবী আঁৎকে ওঠেন। বলেন – সে কি? তাহলে কি শিবু তোমাকে আর ভালোবাসে না?
অগ্রণী এবার প্রাণের হাসি হেসে বলে – বাসে মা। খুবই ভালোবাসে। তাই তো তাকেই আমার সেরা আরও সৌন্দর্য রূপ দেখাতে হবে। বাইরের জন্য যা তা ঘর থেকে শুরু করা দরকার। তাই পরকে দেখানোর প্রাপ্য ঘরের মানুষ কেন বঞ্চিত হবে? মাঝে মাঝে এ রকম আমাকে দেখে আমার ঘরের মানুষ প্রেমে বলে উঠুক – তোমাকে দারুণ লাগছে। আই লাভ ইউ। তাই না মা?
শাশুড়ি কিছু বলল না। কটমট করে তাকিয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। খুব রেগে গেল কি? অগ্রণী বুঝতে পারল না।
পরদিন বিকেলে বারান্দায় শ্বশুর মশাইয়ের পাশে ঝকঝকে ফুল বউ শান্তাদেবীকে দেখে অগ্রণীর চোখ ছানাবড়া।
চা দেওয়ার সময় শান্তাদেবী অগ্রণীর কানে কানে বলল – অনেকদিন পরে তোমার শ্বশুরমশাই আজ আমাকে বলেছে – তোমাকে দারুণ লাগছে। আই লাভ ইউ।
ছেলেকে পড়াতে হবে তাই হাসতে হাসতে অগ্রণী নিজের ঘরে চলে এল।
দেশ গড়ার রাস্তা
স্টোন-চিপস মোরাম পিচ ধোঁয়া
রোড রোলার আর লেবারের সাথে
পাশের ভাঙাচোরা রাস্তায় আমাদের প্রতিনিধি
মুদি দোকানদার মদনদাকে দেখে
জিজ্ঞেস করলাম – খুব যে কাজ হচ্ছে !
-কেন ? ভোট আসছে । তার আগেই জনগণকে
রাস্তা দেখাতে হবে , আমিও যে দেশ গড়ার ডাক পেয়েছি ।
তারপর সেই রাস্তায় আমার বৃদ্ধ বাবা
খুব আরামে লাঠি ঠুকে ঠুকে
ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছিল ।
এসেই বলেছিল – কাল থেকে এই সুন্দর দেশের
সকালের মধুরতায় মর্নিং ওয়াক করব ।
মাস খানিক বাদে সেই রাস্তার গাড্ডায়
মদনদা নিজেই পড়ে পা ভাঙল ।
বললাম – তোমার হাতে আমাদের দেশ ভাঙছে কেন ?
বলল – আমি কি একা ? ওই দেখুন ……।
আমি আরো বড় রাস্তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখি
আর খুব চিনতে শিখি
আমাদের গণতন্ত্রের দেশ ।
শান্তির ব্যবচ্ছেদ
মনের ভেতরে যাদের হয় নি কোন ঠাঁই
তারাও রোজ টোকা দেয়, আসব ভাই?
উঁচু নীচু জীবনের এমনই পদচারণায়
জায়গা করে আবর্জনা ঠিক বসে যায়,
চাইলেও পারি না তো তাদের বিচ্ছেদ
মন তাই করেই যায় শান্তির ব্যবচ্ছেদ।
প্রাণের রবি
বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক বাঙালি জাতি
যাদের আছে রবীন্দ্রনাথ জ্বালিয়ে ভাবের বাতি
ধনী গরীব পণ্ডিত মূর্খ সবার প্রাণের রবি
সবার জন্য সাজিয়ে গেছেন ভাবের ডালি সবই।
সুখে দুঃখে হাসি কান্নায় সব সময়ের সাথি
হারিয়ে যাওয়া পায় যে ফিরে কাটিয়ে ভগ্ন রাতি।
আমার কথা আমার মত তোমার কথা তোমার যত
সবই তারই ভাব আঙিনায় করেছে খেলা অবিরত।
ভাবের তিনি যুগ স্রষ্টা সব জীবনের বাঁধন হারা
সবার হৃদে গড়ে গেছেন অনন্তের ঐ গ্রহ তারা।
বিশ্ব প্রাণের সেই সীমানায় আছে ভাবের তপন
যেমন আছে পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ।
পরিবর্তনমুখী
পুরো সাদা হ্যাট কোট বুট পরে ঠিক একটার সময় এক্সাইডের ফাইভ স্টার রেস্টুরেণ্টে ঢোকে স্বপন(পদবী মনে নেই)। দারোয়ান সেলাম ঠুকে আগে থেকে বুক করা সিট দেখিয়ে দেয়।
ঠিক বিকেল তিনটে নাগাদ ময়লা ছেঁড়া কটূ গন্ধ জামা প্যাণ্ট পরে ধর্মতলায় ভিক্ষে করে সত্তু।
আমি চিনি। বলল – দাদা, ইদানিং সুখভোগে মন দিয়েছি। কাটমানি খেপমারির চেয়ে তো ভাল।
– আর ওসব।
– ওসব ভুলে গেছি।
পথ চলতি সবাইকে দেখিয়ে স্বপন ওরফে সত্তু আমাকে বলল – দুটো ভিক্ষে দেন, বাবু। কতদিন খাই নি।
প্রাণচরিত
যে প্রাণচরিত্র উঁচু ছাদে পায়চারি করে
সে জানে বাবা মায়ের প্রত্যাশায়
পরীক্ষার নম্বরের সাথে কিছু হৃদয় ছিল,
তখনকার মনে হওয়া কঠোর কিছু
আজ ছাদের শক্ত ভিত।
বড় হওয়া ব্যবস্থায়
ধাপে ধাপে অর্জিত
প্রাণচরিত্রে প্রনবেশ হতে শেখায়
নিয়মিত নজরদারীর পর্যবেক্ষণ পরিবেশ
তাতে বাবা মা হাত লাগায়;
কখনও ভাবতে শিখিও না
চাপিয়ে দেওয়া গাধা খাটুনির
আকাশ চর্চা।
কালো অক্ষরেই যে কোন প্রাণ প্রতিষ্ঠার মুখ
আর সব একটু লুকোচুরি
মাঠ ফুল পাখি ঘাসবনে কাদা জল ঘরে ফেরা
ওগুলো সব প্রাণের ভেতর যাতায়াত
মনুষ্যরীতির প্রাণচরিত।
নীরবে
নীবর থাকার চেয়ে ভালো উত্তর আর হয় না
ঝাঁপিয়ে পড়া উচ্চ স্বরে দখিনা বাতাস বয় না
ফুল ফোটা গন্ধ বকুল কারো প্রত্যাশা করে না
জ্বলন্ত ধূপের সুভাসিত আশা কখনো ঝরে না।
যে কোনো প্রশ্নের দিকে জিজ্ঞাসা মুখ বাড়িয়ে
যা কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যায় ভঙ্গিমাতে জড়িয়ে
ভাবনা যেমনই হোক কথা সবই তো তারই মত
আমি তাই আপ্রাণ চেষ্টায় থাকি নীরব অবিরত।