১.
হেলালউদ্দিন ঢালী হোটেলে ফিরে এলেন। বাসার খুজে বেরিয়েছিলেন। কক্সবাজারের সমুদ্রের পার ঘেষে চমৎকার পরিবেশের বাড়িটি তার পছন্দ হয়েছে। হোটেলে ফিরে এসে স্ত্রী-সন্তানদের না দেখে একটু চিন্তিত হয়ে উঠলেন। পুলিশের মতো পোশাকের ফিটফাট দারোয়ানের নির্দেশনায় তিনি সমুদ্র সৈকতের দিকে এলেন।
‘‘মাই লাভ, কতদুর চলে এসেছো! টেনশনে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো’ মি: হেলালউদ্দিন বললেন বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে। তার স্ত্রী গভীর মনযোগে বই পড়ে যাচ্ছে, আর কাজের মেয়েটির সাথে বাচ্চা তিনটি মেতে উঠেছে উল্লাসে।
হেলাল সাহেবের স্ত্রী, লুবাবা মিমি বই থেকে চোখ ফেরালেন। জাগ্রত স্বপ্ন থেকে ফিরে এসে বললেন ‘হ্যা, সেই কখন গেলে! বদ্ধ হোটেলে আমার একেবারেই পছন্দ নয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। তবু আমি দুঃখিত! আমাকে কি তোমার দরকার? এখনি?’
– না, না, সেসব কথা হচ্ছে না। আমি যখন কোন কিছু পছন্দ করি তখন তোমার রুচিতে ঠিক ভাল ঠেকে না। দয়া করে আমার সাথে কি আসবে? একটা বাড়ী পছন্দ হয়েছে আমার কিন্তু রুম কম। তবু এখানে যাওয়া যেতে পারে, পুরো শহরটা মানুষে গিজগিজ করছে…
এই দম্পতির দুজনের প্রকৃতি আলাদা। বয়সটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যক্তিগত ব্যবহার উভয়েরই চমৎকার। কোন অভাব এসে হানা দেয় না সংসারে। অর্থনৈতিক টানাপোড়নের যে খুনসুটি এখানে তা অনুপস্থিত। চিৎকার চেচামেচি ঝগড়া কখনও শোনা যায়নি এখানে। হেলাল সাহেব শক্ত নার্ভের লোক, সব কিছু ম্যানেজ করে চলতে পারেন আর তার মিসেস অনেকটাই ইমোশনাল, সামান্য ব্যাপারে অতিরিক্ত টেনশন আর উত্তেজিত হয়ে যাওয়া তার প্রকৃতিজাত। হেলাল সাহেব তা জানেন, তিনি স্ত্রীর পছন্দের মূল্যায়ণ করেন। আর মিসেস হেলাল ও সবকিছু মানিয়ে নিয়েই সংসার করে আসছে। তার স্বামীর ব্যবসার ধরনটা আলাদা। তিনি অস্ত্র ব্যবসা করেন, রাজধানীর বুকে পুরান ঢাকার দিকে তার একটি ‘বন্দুকের দোকান’ আছে। এখানটাই মিসেস হেলাল, লুবাবা মিমি’র বিশাল আপত্তি। সে গভীর ভাবুক প্রকৃতির। তার ভাবনায় কিছুতেই এমন একটি বেচা কেনাকে সমর্থন করতে পারে না যা শেষ পর্যন্ত মানুষ হত্যা ডেকে আনে। মানুষের উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে তাদের হাতে মৃত্যুর হাতিয়ার তুলে দেয় যে ব্যবসা তা কিছুতেই সে সমর্থন করতে পারে না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মেনে নেন দুটি যুক্তিতে, এক, ব্যবসাটি অবৈধ নয়, সরকার অনুমোদিত। দুই- অনেক বিষাক্ত ক্ষতিকর জীবজন্তু জানোয়ারের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
২.
বিয়ের আগে , মিমি বাবা’র পছন্দের পাত্র দেখে মোটামুটি উল্লাসিত ছিল। উচা-লম্বা-ফর্সা-স্মার্ট। সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার বাচন ভঙ্গি। গুছিয়ে সুন্দর আস্তে ধীরে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করতে পারে আর যে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে। এ তো স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র। কিন্তু বিয়ের পর যখন স্বামীর পেশা জানতে পারে যে সরকারী অনুমোদনের বাইরে তার কিছু লেনদেন আছে তখন মিমি হোঁচট খায়। মিমি স্বামীর তুলনায় একটু খাটো দেখতে হলেও মায়াবী চেহারা আর আকর্ষণীয় ফিগার যে কাউকে মোহিত করে রাখতে পারে। হেলাল সাহেব সুদক্ষ নাবিকের মতো মিমির দেহ নিয়ে পাড়ি দিয়েছে ঝড়-তাণ্ডবের করাল সমুদ্র। তার এই পদচারনা বাস্তব ভিত্তিক। দেখতে যেমন সুন্দর শরীর বিষয়ক কলা কৌশলে সে তেমনি পারদর্শী সফল পুরুষ।
মিমি তার বিপরীত প্রান্তে বসবাস করতে থাকে। তার হৃদয়ে বয়ে চলে একটি অনুশোচনা। স্বামীর পেশার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ও করেছিল মৃদু উচ্চারনে কিন্তু হেলাল সাহেবের যুক্তি আর উপস্থাপনায় হার মেনেছে। সবকিছু ভুলে গিয়ে তাই মিমি নানারূপ দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে। যার ইন্ধন যোগাতে থাকে বই। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ আর কবিতা সব বিষয়েই তার পদচারনা। কবিতার প্রতি তার রয়েছে আলাদা দুর্বলতা।
স্বামী-স্ত্রী দু’জন হেটে হেটে যে বাড়িটির দিকে গেল তার একটি দিক সমুদ্রের দিকে খোলা। প্রায় সমুদ্রের পাড় ঘেষেই উঠেছে বাড়িটি। তারা পরস্পর হাত ধরাধরি করে গৃহকর্ত্রী মুখোমুখি দাড়াল।
৩.
গৃহকর্ত্রী, ভদ্রলোকে প্রত্যাবর্তন অবলোকন করছিলেন, তাদের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে এলেন এবং রুমগুলো দেখালেন। তিনি জানালেন যে, তিনি একজন বিধবা, হঠাৎ স্বামী বিয়োগে অভাবী এখন, তাই বাড়ি ভাড়াই এখন চলার একমাত্র অবলম্বন। লুবাবা মিমি জানালো যে পরিবেশ তার পছন্দ হয়েছে কিন্তু তার সবগুলো কামরাই প্রয়োজন। গৃহকর্ত্রী গভীর ভাবনা ভাবলেন এবং দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন যে, তিনি চান না যে যারা তার ভাড়াটিয়া হিসাবে থাকবেন তারা কোন অসুবিধা বোধ করেন। কিন্তু তিনি নিরুপায়। একটি কামরা একজন ব্যাচেলার ভদ্রলোকের নিকট ভাড়া দিয়েছেন। আর সত্যি কথা এই যে, তিনি এই মৌসুমী চড়া ভাড়া দেন না বটে কিন্তু তিনি সারা বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন। আর ভদ্রলোক অনেক অনেক ভাল ও রহস্যময় যুবক। কোন সমস্যা তৈরি করেনি কখনো। গৃহকর্ত্রী এই একমাসের বাড়তি ভাড়ার জন্য চান না তার স্থায়ী ভাড়াটিয়া উঠে যাক।
তারা সবই শুনলেন এবং হোটেলে ফিরে এসে লোক নিয়োগ করে দিলেন বাসা খুঁজে বের করার জন্য। যখন তারা বৈকালিক চা পানে মত্ত তখন গৃহকর্ত্রীর কল এলো। তিনি বললেন যে, ভদ্রলোক হতে তিন থেকে চার সপ্তাহের জন্য রুমগুলো ব্যবহারের অনুমতি নেয়া যেতে পারে।
‘তা হলেতো ভালই হতো, কিন্তু আমরা ভদ্রলোককে কোনপ্রকার অনুরোধ করতে পারব না।’ -হেলাল সাহেব বললেন।
‘অ, আপনাদের কোন অনুরোধ করতে হবে না’ গৃহকর্ত্রী বললেন, ‘দেখুন, ভদ্রলোক অন্য সবার চেয়ে আলাদা- স্বাপ্নিক, স্বাধীনচেতা, একাকিত্ব প্রিয় মানুষ। তিনি সাধারনত এই সময়টা, যখন লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে সমুদ্র সৈকত তখন দূরে চলে যান। তিনি এখন এখানে আসবেন না, তিনি টেকনাফের দ্বীপে এক কুটিরে আছেন। তার রুমটি এখন ব্যবহার করা যেতে পারে।’-এই বলে গৃহকর্ত্রী আশা পোষন করেন যে, তারা বাসাটি ভাড়া নিবেন।
৪.
ঢালী পরিবার পরের দিন বাড়িটিতে গিয়ে উঠলে, বাসস্থানটি তাদের কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হলো। দুপুরের খাবারের পর মি. হেলাল বেরিয়ে গেলেন কি কাজ আছে বলে। মিসেস ঢালী বাচ্চাদের বালিতে ছুটাছুটির অবকাশ দিয়ে দিলেন। সবকিছু থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে গত কয়েকদিন যাবৎ পড়তে থাকা আর্টিক্যালে মনোনিবেশ করল।
কিছুক্ষণ পর সে রুমে চলে এলো যেখানে অবিবাহিত যুবকটি ব্যবহার করে। দেখা গেল রুমটি অগোছালো, এলোমেলো পরে আছে নানা বই-পত্র। কিছু পুরাতন বই, যা সচরাচর পাওয়া যায় না স্তূপাকারে পুঞ্জিভূত হয়ে আছে ঘরটির এক কোনায়। এই মৌসুমে যদি অন্য কেহ বাড়িটি ভাড়া নিত তবে বইগুলো যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাতে তার কিছু ক্ষতি হয়ে যেতে পারত ভেবে শংকিত হয়ে উঠল লুবাবা মিমি।
‘আমি একে আমার নিজের রুম করে নিব’ গৃহকর্ত্রীকে বলল মিমি,‘ তার কারণ বই গুলি। বাই দা ওয়ে, মনে হচ্ছে যে লোকটি এখানে থাকেন তিনি খুবই ভাল। আমি বইগুলি পড়লে তেমন কিছু খারাপ ভাববেন না, কি বলেন?’
গৃহকর্ত্রী বললেন,‘হ্যাঁ, সে যথেষ্ঠ ভাল। তুমিতো দেখতেই পারছো সে শিক্ষিত লোক। সাধারণ শিক্ষিত নয়, তুমি হয়ত একটু অবাক হবে, সে একজন কবি। সে একজন আপাদমস্তক কবি। তার পৈতৃক কিছু সম্পত্তি আছে যার থেকে ভালই ইনকাম আছে। সে এলোমেলে জীবন যাপন করে আর শুধু লেখালেখিই করে।
– কবি! অহ্ আমি জানতাম না।
মিমি দু’একটা বই নাড়াচাড়া করতেই বুঝে গেল যে, এখানে যিনি থাকেন তিনি আলতাফ হোসেন বৈরাগী। মিমি বৈরাগীর লেখার সাথে গভীর ভাবে পরিচিত। বিস্ময়ের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেল মনে হয়। স্তম্ভিত হয়ে সে বারবার ভাবতে লাগল বৈরাগী যে রুমটাতে থাকে এটা সেই রুম যেখানে মিমি বসে আছে!
গৃহকর্ত্রী চলে গেলে মিমি একা বসে রইল। আলতাফ মাহমুদ বৈরাগীকে ভাবছিল সে। এই গভীর আগ্রহের পিছনের ইতিহাসটি তার এই ধরনের বিস্মিত হবার কারণটি ব্যাখ্যা করতে পারে। মিমি এক হাইস্কুলের হেডমাষ্টারের একমাত্র কন্যা। লেখাপাড়ার প্রতি গভীর আগ্রহটা তার পিতা থেকে পাওয়া। পিতার ব্যক্তিগত সংগ্রহের গ্রন্থাগারে বসে বসে বই পড়ে তার কেটে গেছে দীর্ঘসময়। একসময় মিমি কবিতা লিখতে শুরু করল। সেই সব কবিতাগুলো ছদ্মনামে ছোট কাগজে ডাকে পাঠাতো এবং তা প্রায় ছাপা হতো। তার বেশ কিছু কবিতা নামকরা ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। দেখা যেত ঐ সব ম্যাগাজিনে আলতাব মাহমুদ বৈরাগীর কবিতা ছাপা হতো। তখন থেকেই বৈরাগীর লেখার সাথে মিমি পরিচিত। জাতীয় ঘটনাগুলো তাদের প্রভাবিত করত। একবার এক জাতীয় দৈনিকে জাতীয় এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষাপটে রচিত তাদের দুজনের দুটি কবিতা পাশাপাশি ছাপা হলো। এর পর হতে বৈরাগীর কোন লেখাই মিমির অপাঠ্য থাকেনি।
৫.
যখন বৈরাগীর ‘আমি শহরের অন্দর মহলে ঢুকে পড়ি’ কবিতাটি প্রকাশিত হলো তখন মোটামুটি আলোচনায় চলে আসে কবিতাটি। প্রচলিত ধারায় রচিত নয় কবিতাটি। ছন্দ মানা হয়নি, এমনকি কিছুটা যৌনতাকে উপমা হিসাবে নিয়ে কবি শহরের অন্তসার শূন্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। একজন সমালোচক কবিতার অবক্ষয় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বৈরাগীর কবিতাটি তুলে ধরেন। তিনি কবিতাটিকে অশ্লীল বলে আখ্যা দেন এবং বলেন তেলাপোকাকে দোয়াতে চুবিয়ে সাদা কাগজে ছেড়ে দিলে একটি চিত্রকর্ম হয়, কাকতালীয়ভাবে তা চমৎকার দেখতে হয়ে উঠতে পারে । এই কবিতাটি তেমনি এক শিল্পকর্ম। এই সমালোচনার জবাবে মিমি তার ছদ্মনামে একটি প্রবন্ধ লিখে যাতে এই কবিতাটি সহ বৈরাগীর কিছু কবিতা তুলে আনে। সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারটি কাব্য গ্রন্থকে গদ্য-কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করে এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র উদাহরন তুলে ধরে বলেন এই কবিতাটি ও তেমনি এক গদ্য-কবিতা।
প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে একদিন মিমি তার নামে একটি চিঠি পান যাতে বৈরাগীর ধন্যবাদসূচক বক্তব্য ছিল এবং বর্ণনা ছিল কত কষ্ট করে সম্পাদকের মাধ্যমে তার ঠিকানা জোগাড় করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রিয় কবির চিঠি পেয়ে এবং তার প্রসংশা পেয়ে মিমি মূলধারার কবিতা ব্যাপকভাবে পড়তে থাকে। নিজের লেখা কবিতাগুলো যে কতটা মানহীন আর দুর্বল গাঁথুনিতে লিখা তা উপলব্ধি করতে থাকে। সে মুলত বৈরাগীর কবিতাকে অনুসরন করতে থাকে। এভাবে যদিও সবগুলো লেখা ছাপার অক্ষরের মুখ দেখতে পায় নি তবে বেশ কিছু কবিতা জমা হতে থাকে তার। এরপর সবগুলো লেখা যা কোথাও প্রকাশিত হয়েছে আর যা প্রকাশ হয়নি সব একত্রে করে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরী করে ফেলে। সে প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করে । প্রকাশকরা নতুনদের কবিতার বই প্রকাশ করতে চান না কারণ এত ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়। মিমি নিজ খরচে বইটি বের করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একজন লেখককে দিয়ে একটি রিভিউ তৈরী করে প্রকাশ করে। কিন্তু বইটি পাঠক মহলে গৃহীত হলো না, কেউ বইটি নিয়ে আলোচনা করল না, কেউ বইটি কিনেন না।
চলবে…..