ফকির আবদুল মালেক এর সকল পোস্ট

ফকির আবদুল মালেক সম্পর্কে

কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লেখক।

মায়াবন-বিহারিণী (১-৫)

১.
হেলালউদ্দিন ঢালী হোটেলে ফিরে এলেন। বাসার খুজে বেরিয়েছিলেন। কক্সবাজারের সমুদ্রের পার ঘেষে চমৎকার পরিবেশের বাড়িটি তার পছন্দ হয়েছে। হোটেলে ফিরে এসে স্ত্রী-সন্তানদের না দেখে একটু চিন্তিত হয়ে উঠলেন। পুলিশের মতো পোশাকের ফিটফাট দারোয়ানের নির্দেশনায় তিনি সমুদ্র সৈকতের দিকে এলেন।
‘‘মাই লাভ, কতদুর চলে এসেছো! টেনশনে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো’ মি: হেলালউদ্দিন বললেন বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে। তার স্ত্রী গভীর মনযোগে বই পড়ে যাচ্ছে, আর কাজের মেয়েটির সাথে বাচ্চা তিনটি মেতে উঠেছে উল্লাসে।
হেলাল সাহেবের স্ত্রী, লুবাবা মিমি বই থেকে চোখ ফেরালেন। জাগ্রত স্বপ্ন থেকে ফিরে এসে বললেন ‘হ্যা, সেই কখন গেলে! বদ্ধ হোটেলে আমার একেবারেই পছন্দ নয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। তবু আমি দুঃখিত! আমাকে কি তোমার দরকার? এখনি?’
– না, না, সেসব কথা হচ্ছে না। আমি যখন কোন কিছু পছন্দ করি তখন তোমার রুচিতে ঠিক ভাল ঠেকে না। দয়া করে আমার সাথে কি আসবে? একটা বাড়ী পছন্দ হয়েছে আমার কিন্তু রুম কম। তবু এখানে যাওয়া যেতে পারে, পুরো শহরটা মানুষে গিজগিজ করছে…

এই দম্পতির দুজনের প্রকৃতি আলাদা। বয়সটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যক্তিগত ব্যবহার উভয়েরই চমৎকার। কোন অভাব এসে হানা দেয় না সংসারে। অর্থনৈতিক টানাপোড়নের যে খুনসুটি এখানে তা অনুপস্থিত। চিৎকার চেচামেচি ঝগড়া কখনও শোনা যায়নি এখানে। হেলাল সাহেব শক্ত নার্ভের লোক, সব কিছু ম্যানেজ করে চলতে পারেন আর তার মিসেস অনেকটাই ইমোশনাল, সামান্য ব্যাপারে অতিরিক্ত টেনশন আর উত্তেজিত হয়ে যাওয়া তার প্রকৃতিজাত। হেলাল সাহেব তা জানেন, তিনি স্ত্রীর পছন্দের মূল্যায়ণ করেন। আর মিসেস হেলাল ও সবকিছু মানিয়ে নিয়েই সংসার করে আসছে। তার স্বামীর ব্যবসার ধরনটা আলাদা। তিনি অস্ত্র ব্যবসা করেন, রাজধানীর বুকে পুরান ঢাকার দিকে তার একটি ‘বন্দুকের দোকান’ আছে। এখানটাই মিসেস হেলাল, লুবাবা মিমি’র বিশাল আপত্তি। সে গভীর ভাবুক প্রকৃতির। তার ভাবনায় কিছুতেই এমন একটি বেচা কেনাকে সমর্থন করতে পারে না যা শেষ পর্যন্ত মানুষ হত্যা ডেকে আনে। মানুষের উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে তাদের হাতে মৃত্যুর হাতিয়ার তুলে দেয় যে ব্যবসা তা কিছুতেই সে সমর্থন করতে পারে না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মেনে নেন দুটি যুক্তিতে, এক, ব্যবসাটি অবৈধ নয়, সরকার অনুমোদিত। দুই- অনেক বিষাক্ত ক্ষতিকর জীবজন্তু জানোয়ারের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

২.
বিয়ের আগে , মিমি বাবা’র পছন্দের পাত্র দেখে মোটামুটি উল্লাসিত ছিল। উচা-লম্বা-ফর্সা-স্মার্ট। সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার বাচন ভঙ্গি। গুছিয়ে সুন্দর আস্তে ধীরে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করতে পারে আর যে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে। এ তো স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র। কিন্তু বিয়ের পর যখন স্বামীর পেশা জানতে পারে যে সরকারী অনুমোদনের বাইরে তার কিছু লেনদেন আছে তখন মিমি হোঁচট খায়। মিমি স্বামীর তুলনায় একটু খাটো দেখতে হলেও মায়াবী চেহারা আর আকর্ষণীয় ফিগার যে কাউকে মোহিত করে রাখতে পারে। হেলাল সাহেব সুদক্ষ নাবিকের মতো মিমির দেহ নিয়ে পাড়ি দিয়েছে ঝড়-তাণ্ডবের করাল সমুদ্র। তার এই পদচারনা বাস্তব ভিত্তিক। দেখতে যেমন সুন্দর শরীর বিষয়ক কলা কৌশলে সে তেমনি পারদর্শী সফল পুরুষ।

মিমি তার বিপরীত প্রান্তে বসবাস করতে থাকে। তার হৃদয়ে বয়ে চলে একটি অনুশোচনা। স্বামীর পেশার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ও করেছিল মৃদু উচ্চারনে কিন্তু হেলাল সাহেবের যুক্তি আর উপস্থাপনায় হার মেনেছে। সবকিছু ভুলে গিয়ে তাই মিমি নানারূপ দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে। যার ইন্ধন যোগাতে থাকে বই। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ আর কবিতা সব বিষয়েই তার পদচারনা। কবিতার প্রতি তার রয়েছে আলাদা দুর্বলতা।
স্বামী-স্ত্রী দু’জন হেটে হেটে যে বাড়িটির দিকে গেল তার একটি দিক সমুদ্রের দিকে খোলা। প্রায় সমুদ্রের পাড় ঘেষেই উঠেছে বাড়িটি। তারা পরস্পর হাত ধরাধরি করে গৃহকর্ত্রী মুখোমুখি দাড়াল।

৩.
গৃহকর্ত্রী, ভদ্রলোকে প্রত্যাবর্তন অবলোকন করছিলেন, তাদের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে এলেন এবং রুমগুলো দেখালেন। তিনি জানালেন যে, তিনি একজন বিধবা, হঠাৎ স্বামী বিয়োগে অভাবী এখন, তাই বাড়ি ভাড়াই এখন চলার একমাত্র অবলম্বন। লুবাবা মিমি জানালো যে পরিবেশ তার পছন্দ হয়েছে কিন্তু তার সবগুলো কামরাই প্রয়োজন। গৃহকর্ত্রী গভীর ভাবনা ভাবলেন এবং দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন যে, তিনি চান না যে যারা তার ভাড়াটিয়া হিসাবে থাকবেন তারা কোন অসুবিধা বোধ করেন। কিন্তু তিনি নিরুপায়। একটি কামরা একজন ব্যাচেলার ভদ্রলোকের নিকট ভাড়া দিয়েছেন। আর সত্যি কথা এই যে, তিনি এই মৌসুমী চড়া ভাড়া দেন না বটে কিন্তু তিনি সারা বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন। আর ভদ্রলোক অনেক অনেক ভাল ও রহস্যময় যুবক। কোন সমস্যা তৈরি করেনি কখনো। গৃহকর্ত্রী এই একমাসের বাড়তি ভাড়ার জন্য চান না তার স্থায়ী ভাড়াটিয়া উঠে যাক।

তারা সবই শুনলেন এবং হোটেলে ফিরে এসে লোক নিয়োগ করে দিলেন বাসা খুঁজে বের করার জন্য। যখন তারা বৈকালিক চা পানে মত্ত তখন গৃহকর্ত্রীর কল এলো। তিনি বললেন যে, ভদ্রলোক হতে তিন থেকে চার সপ্তাহের জন্য রুমগুলো ব্যবহারের অনুমতি নেয়া যেতে পারে।
‘তা হলেতো ভালই হতো, কিন্তু আমরা ভদ্রলোককে কোনপ্রকার অনুরোধ করতে পারব না।’ -হেলাল সাহেব বললেন।
‘অ, আপনাদের কোন অনুরোধ করতে হবে না’ গৃহকর্ত্রী বললেন, ‘দেখুন, ভদ্রলোক অন্য সবার চেয়ে আলাদা- স্বাপ্নিক, স্বাধীনচেতা, একাকিত্ব প্রিয় মানুষ। তিনি সাধারনত এই সময়টা, যখন লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে সমুদ্র সৈকত তখন দূরে চলে যান। তিনি এখন এখানে আসবেন না, তিনি টেকনাফের দ্বীপে এক কুটিরে আছেন। তার রুমটি এখন ব্যবহার করা যেতে পারে।’-এই বলে গৃহকর্ত্রী আশা পোষন করেন যে, তারা বাসাটি ভাড়া নিবেন।

৪.
ঢালী পরিবার পরের দিন বাড়িটিতে গিয়ে উঠলে, বাসস্থানটি তাদের কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হলো। দুপুরের খাবারের পর মি. হেলাল বেরিয়ে গেলেন কি কাজ আছে বলে। মিসেস ঢালী বাচ্চাদের বালিতে ছুটাছুটির অবকাশ দিয়ে দিলেন। সবকিছু থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে গত কয়েকদিন যাবৎ পড়তে থাকা আর্টিক্যালে মনোনিবেশ করল।

কিছুক্ষণ পর সে রুমে চলে এলো যেখানে অবিবাহিত যুবকটি ব্যবহার করে। দেখা গেল রুমটি অগোছালো, এলোমেলো পরে আছে নানা বই-পত্র। কিছু পুরাতন বই, যা সচরাচর পাওয়া যায় না স্তূপাকারে পুঞ্জিভূত হয়ে আছে ঘরটির এক কোনায়। এই মৌসুমে যদি অন্য কেহ বাড়িটি ভাড়া নিত তবে বইগুলো যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাতে তার কিছু ক্ষতি হয়ে যেতে পারত ভেবে শংকিত হয়ে উঠল লুবাবা মিমি।
‘আমি একে আমার নিজের রুম করে নিব’ গৃহকর্ত্রীকে বলল মিমি,‘ তার কারণ বই গুলি। বাই দা ওয়ে, মনে হচ্ছে যে লোকটি এখানে থাকেন তিনি খুবই ভাল। আমি বইগুলি পড়লে তেমন কিছু খারাপ ভাববেন না, কি বলেন?’
গৃহকর্ত্রী বললেন,‘হ্যাঁ, সে যথেষ্ঠ ভাল। তুমিতো দেখতেই পারছো সে শিক্ষিত লোক। সাধারণ শিক্ষিত নয়, তুমি হয়ত একটু অবাক হবে, সে একজন কবি। সে একজন আপাদমস্তক কবি। তার পৈতৃক কিছু সম্পত্তি আছে যার থেকে ভালই ইনকাম আছে। সে এলোমেলে জীবন যাপন করে আর শুধু লেখালেখিই করে।
– কবি! অহ্ আমি জানতাম না।

মিমি দু’একটা বই নাড়াচাড়া করতেই বুঝে গেল যে, এখানে যিনি থাকেন তিনি আলতাফ হোসেন বৈরাগী। মিমি বৈরাগীর লেখার সাথে গভীর ভাবে পরিচিত। বিস্ময়ের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেল মনে হয়। স্তম্ভিত হয়ে সে বারবার ভাবতে লাগল বৈরাগী যে রুমটাতে থাকে এটা সেই রুম যেখানে মিমি বসে আছে!
গৃহকর্ত্রী চলে গেলে মিমি একা বসে রইল। আলতাফ মাহমুদ বৈরাগীকে ভাবছিল সে। এই গভীর আগ্রহের পিছনের ইতিহাসটি তার এই ধরনের বিস্মিত হবার কারণটি ব্যাখ্যা করতে পারে। মিমি এক হাইস্কুলের হেডমাষ্টারের একমাত্র কন্যা। লেখাপাড়ার প্রতি গভীর আগ্রহটা তার পিতা থেকে পাওয়া। পিতার ব্যক্তিগত সংগ্রহের গ্রন্থাগারে বসে বসে বই পড়ে তার কেটে গেছে দীর্ঘসময়। একসময় মিমি কবিতা লিখতে শুরু করল। সেই সব কবিতাগুলো ছদ্মনামে ছোট কাগজে ডাকে পাঠাতো এবং তা প্রায় ছাপা হতো। তার বেশ কিছু কবিতা নামকরা ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। দেখা যেত ঐ সব ম্যাগাজিনে আলতাব মাহমুদ বৈরাগীর কবিতা ছাপা হতো। তখন থেকেই বৈরাগীর লেখার সাথে মিমি পরিচিত। জাতীয় ঘটনাগুলো তাদের প্রভাবিত করত। একবার এক জাতীয় দৈনিকে জাতীয় এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষাপটে রচিত তাদের দুজনের দুটি কবিতা পাশাপাশি ছাপা হলো। এর পর হতে বৈরাগীর কোন লেখাই মিমির অপাঠ্য থাকেনি।

৫.
যখন বৈরাগীর ‘আমি শহরের অন্দর মহলে ঢুকে পড়ি’ কবিতাটি প্রকাশিত হলো তখন মোটামুটি আলোচনায় চলে আসে কবিতাটি। প্রচলিত ধারায় রচিত নয় কবিতাটি। ছন্দ মানা হয়নি, এমনকি কিছুটা যৌনতাকে উপমা হিসাবে নিয়ে কবি শহরের অন্তসার শূন্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। একজন সমালোচক কবিতার অবক্ষয় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বৈরাগীর কবিতাটি তুলে ধরেন। তিনি কবিতাটিকে অশ্লীল বলে আখ্যা দেন এবং বলেন তেলাপোকাকে দোয়াতে চুবিয়ে সাদা কাগজে ছেড়ে দিলে একটি চিত্রকর্ম হয়, কাকতালীয়ভাবে তা চমৎকার দেখতে হয়ে উঠতে পারে । এই কবিতাটি তেমনি এক শিল্পকর্ম। এই সমালোচনার জবাবে মিমি তার ছদ্মনামে একটি প্রবন্ধ লিখে যাতে এই কবিতাটি সহ বৈরাগীর কিছু কবিতা তুলে আনে। সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারটি কাব্য গ্রন্থকে গদ্য-কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করে এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র উদাহরন তুলে ধরে বলেন এই কবিতাটি ও তেমনি এক গদ্য-কবিতা।

প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে একদিন মিমি তার নামে একটি চিঠি পান যাতে বৈরাগীর ধন্যবাদসূচক বক্তব্য ছিল এবং বর্ণনা ছিল কত কষ্ট করে সম্পাদকের মাধ্যমে তার ঠিকানা জোগাড় করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রিয় কবির চিঠি পেয়ে এবং তার প্রসংশা পেয়ে মিমি মূলধারার কবিতা ব্যাপকভাবে পড়তে থাকে। নিজের লেখা কবিতাগুলো যে কতটা মানহীন আর দুর্বল গাঁথুনিতে লিখা তা উপলব্ধি করতে থাকে। সে মুলত বৈরাগীর কবিতাকে অনুসরন করতে থাকে। এভাবে যদিও সবগুলো লেখা ছাপার অক্ষরের মুখ দেখতে পায় নি তবে বেশ কিছু কবিতা জমা হতে থাকে তার। এরপর সবগুলো লেখা যা কোথাও প্রকাশিত হয়েছে আর যা প্রকাশ হয়নি সব একত্রে করে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরী করে ফেলে। সে প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করে । প্রকাশকরা নতুনদের কবিতার বই প্রকাশ করতে চান না কারণ এত ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়। মিমি নিজ খরচে বইটি বের করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একজন লেখককে দিয়ে একটি রিভিউ তৈরী করে প্রকাশ করে। কিন্তু বইটি পাঠক মহলে গৃহীত হলো না, কেউ বইটি নিয়ে আলোচনা করল না, কেউ বইটি কিনেন না।

চলবে…..

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা (শেষ পর্ব)

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা
ভূমিকাঃ সূচনা পর্ব।

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ, সম্ভবনা
বিকাশ পর্ব-০১

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ, সম্ভবনা
বিকাশ পর্ব-০২

শেষ পর্বঃ

এই পর্বে যা পাবেন:
আধনিকবাদের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা লাভের সময়টাতে কি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কি আত্মনিমগ্ন থেকেছেন?
আধুনিক কবিতা ও গদ্য কবিতা:
সম্ভবনা

আধনিকবাদের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা লাভের সময়টাতে কি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ?

১৯৩৩ অব্দে প্রকাশিত হয় ‘পুনশ্চঃ’, ১৯৩৬-এ শেষ সপ্তক, ১৯৩৬-৩৭ এ ‘পত্রপুট’, ১৯৩৭-এ ‘শ্যামলী’ প্রকাশিত হয়। মোটামোটি বলা চলে কবিতায় এই সময়টাতে রবীন্দ্রনাথ এ কাজগুলি করছিলেন।

‘পুনশ্চঃ’ কাব্যের কবিতাগুলো নিয়ে তিনি লিখেন-
“যখন কবিতাগুলো পড়বে তখন পূর্বাভাস মতো মনে করো না এগুলো পদ্য। অনেকে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে রুষ্ঠ হয়ে ওঠে। গদ্যের প্রতি গদ্যের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিত। পুরুষকে সুন্দরী রমণীর মতো ব্যবহার করলে তার মর্যাদাহানি হয়। পুরুষেরও সৌন্দর্য আছে, সে মেয়ের সৌন্দর্য নয়।

‘পুনশ্চঃ’ কবিতাগুলোকে কোন সংজ্ঞা দেবে? পদ্য নয়, কারণ পদ নেই। গদ্য বললে অতিব্যপ্তি দোষ ঘটে। পঙ্খিরাজ ঘোড়াকে পাখি বলবে না ঘোড়া বলবে? গদ্যের পাখা উঠছে এ কথা যদি বলি তবে শক্রপ বলে বসবে ‘পীপিলিকার পাখা গজে মরিবার তরে’। জলে স্থলে যে সাহিত্য বিভক্ত, সেই সাহিত্যে এই জিনিসটা জল নয়, তাই বলে মাটিও নয়। তাহলে খনিজ বলতে দোষ আছে কি? সোনা বলতে পারি এমন অহংকার যদি বা মনে থাকে, মুখে বলবার জো নেই। না হয় তাঁমাই হলো, অর্থাৎ এমন কোন ধাতু যা দিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ চলে। গদাধরের মূর্তিও হতে পারে, তিলোত্তমাও হতে হয়। অর্থাৎ রূপরসাত্মক গদ্য, অর্থ ভারবহ গদ্য নয়, তৈজস গদ্য।”

‘শেষ সপ্তক’ প্রসঙ্গে কবি লিখেন-
সম্প্রতি কতগুলো গদ্য কবিতা জড়ো করে ‘শেষ সপ্তক’ নাম দিয়ে একখানি বই বের করেছি। সমালোচকরা ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কি বলবেন। আমি কাব্যের পসারি, আমি শুধাই- লেখাগুলোর ভিতর কি স্বাদ নেই, ভঙ্গি নেই, থেকে থেকে কটাক্ষ নেই, সদর দরজার চেয়ে এর খিড়কির দুয়ারের দিকেই কি ইশারা নেই, গদ্যের বকুনির মুখে রাশ টেনে তার মধ্যে কি কোথাও দুলকির চাল আনা হয়নি, চিন্তাগর্ভ কথার মুখে কোনখানে অচিন্ত্যের ইঙ্গিত কি লাগল না, এর মধ্যে ছন্দোরাজকতার নিয়ন্ত্রিত শাসন না থাকলেও আত্মরাজকতার অনিয়ন্ত্রিত সংযম নেই কি? সেই সংযমের গুনে থেমে-যাওয়া কিংবা বেকে-যাওয়া কথার মধ্যে কোথাও কি নীরবের সরবতা পাওয়া যাচ্ছে না? এই সকল প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে এর সমালোচনা।

১৯৩৬-৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পত্রপুট’।
তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘পৃথিবী’ এই কাব্যের অন্তর্ভূক্ত। ‘পৃথিবী’তে তাঁর দক্ষতার অসাধারণ পরিচয় মিলে। তাঁর চিন্তা-চেতনা, ভাষা বিন্যাস, শব্দ চয়নে, রূপকে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা বিরলঃ

আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণ হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে;
চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;
বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য্য হারিয়েছি
অকস্মাৎকল্লোলোচ্ছ্বাসে

‘শ্যামলী’তে যুক্ত হয় আমি, বাঁশিওয়ালা, ‘হঠাৎ দেখা’ প্রভৃতি অসাধারন কবিতা।

আধুনিক কবিতা ও গদ্য কবিতা:

আধুনিক কবিতা মূলত তার অভিব্যক্তির জন্য বৈশিষ্ট্যময় আর গদ্য কবিতা তার আঙ্গিক গঠনে। গদ্যে আধুনিক কবিতা লিখা যেতে পারে যেমন পারা যায় রোমান্টিক ধারার কবিতা, তখন তাকে গদ্য-কাব্যই বলা যাবে কিন্তু গদ্য-কাব্য হলেই তাকে আধুনিক কবিতা বলা যায় না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য-কবিতা। জীবনানন্দ দাস কিছু অসাধারন গদ্য কবিতা লিখেছেন যা সম্পূর্ন আধুনিক ধারার স্বার্থক কবিতা। আধুনিক কবিতা ছন্দে লিখা যায় কিন্তু গদ্য কবিতা ছন্দ মুক্ত থাকে।

কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কি আত্মনিমগ্ন থেকেছেন?

যে অসময়টাকে সারা পৃথিবীর কাব্যজগত কেঁপে উঠেছিল ‘আধুনিকবাদ’ কবিতায় তিনি কি ঐ ধারাকে ঠিক আত্মস্থ করতে পারেনি? নাকি তিনি সচেতনভাবেই সেই ধারাকে উপেক্ষা করে গেছেন আর দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, আগামী দিনের কাব্য হবে গদ্য-কাব্য !
আধুনিক ধারার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা তাকে এনে দিয়েছে অনন্য অবস্থান। রবীন্দ্রনাথের পরে, এমনকি কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ সহ বিচার করেও জীবনানন্দ দাশকে বাংলা কবিতায় দেন শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান। শিল্পকলায়, কবিতার সাথে কামের রয়েছে একটি গভীর সম্পর্ক, কোন কিছুই উৎকৃষ্ট শিল্পকলা হয়ে উঠে না যদি না তার ভেতর বয়ে চলে কামের উজ্জ্বল ধারা। যৌবন, যৌনতা, সৃষ্টিশীলতা উৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। যৌবনে রবীন্দ্রনাথ যে সৃষ্টিশীলতায় মেতে উঠেছিলেন ‘সোনার তরী’ ‘চিত্রা’কাব্যে, মধ্য বয়সে ‘ক্ষণিকা’ আর ‘বলাকা’য় এবং গানের ভুবনে যে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন শেষ জীবনে এসে আধুনিকবাদের তোলপাড় করা ভাঙ্গাচূড়ার সময়টাতে তিনি যে কাব্যচর্চা করেছেন তা অসাধারণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেও তা রবীন্দ্রনাথের মানের সাথে তাল মেলাতে পারেনি বলে বলা যায়। গদ্য কাব্যে রবীন্দ্রনাথ যেন এক নেতা, পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, সৃষ্টিশীলতার যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি হয়ে লড়তে পারেননি। পক্ষান্তরে প্রায় একই সময়ে অনন্য কবি প্রতিভা জীবনানন্দ দাশ যৌবনের সৃষ্টিশীলতার গগনচুম্বী অবস্থানে আধুনিক ধারায় আরো স্পষ্ট করে বললে রবীন্দ্র বলয় থেকে বাইরে এসে লিখেছেন ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) আর আরো কিছু পরে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭)।

জীবনানন্দ দাশ সহ আরো যারা আধুনিক ধারায় চর্চা করেছিলেন, তারা এক একজন অনন্য কবি প্রতিভা, উচ্চ শিক্ষিত, সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যে যারা সাবলীল বিচরণ করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথকে নেতা মেনে তার কমান্ডে বা দেখানো পথে কবিতা চর্চা করেননি। ফলে গত শতাব্দীর মধ্যে থেকে শেষের দিকে আধুনিক কবিতার ব্যাপক চর্চা হয়। ছোট বা বড় অনেক কবিই আধুনিক ধারায় লিখেন এবং সফল হন। তাই বলা চলে গদ্য কাব্য তেমনভাবে চর্চা হয়নি যদিও আধুনিক ধারার অনেক কবিই তাদের কাব্যগ্রন্থে দু’চারটি গদ্য কাব্য লেখার চেষ্টা করেন।

স্পষ্টত: বলা চলে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যে গদ্য-কাব্যের ধারা তৈরী করার পথ দেখিয়েছিলেন আধুনিক কবিতার ব্যাপক প্রভাবে তা স্থবির হয়ে পড়ে।

সম্ভবনাঃ

বিশ্ব সাহিত্যেও নানা চড়াই উৎরাইয়ের পর এক পর্যায়ে গদ্য-কাব্য স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে Simic তার গদ্য-কাব্যের বই The World doesn’t End পুলিৎজার পুরস্কার পাবার পর আবার গদ্য-কাব্যের নানা সংস্করণের প্রকাশনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইতিহাসের প্রায় প্রতি অধ্যায়েই গদ্য-কাব্য ছিল পরীক্ষামূলক বা বিকল্প ধারার সাহিত্য চর্চা কিন্তু বর্তমানে তা এখন মূলধারায় প্রতষ্ঠিত রূপ নিচ্ছে। বর্তমানে গদ্য-কাব্যের সংকলন প্রায়ই চোখে পরে। এখন প্রায়শই দেখা যায় মূলধারার কবিরা গদ্য-কাব্যের পূর্ণ বই লিখছেন। ১৯৮০ সালের শেষের দিকে এই ধারার লেখা জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয় এবং বিশ্ব সাহিত্যের বিভিন্ন নামী দামী জার্নালে যারা পূর্বে গদ্য কবিতাতে মনোনিবেশ করেননি তারাও গদ্য কবিতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

যারা প্রতিভাবান, বয়সে তরুণ, যৌবনের সৃষ্টিশীলতায় উদ্দীপ্ত তারা গদ্য কাব্যের এই ধারাটিকে আত্মস্থ করে চর্চা করতে পারেন। হয়ত এতে কবিতারই জয় হবে। তবে স্মরণ রাখতে হবে গদ্য কাব্য যেহেতু ছন্দের স্বাধীনতা নিয়ে কাব্য চর্চা করে তাই যথেচ্ছার ভাবে অযোগ্য লোকের দ্বারা হাস্যস্পদ উপাদানে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে পুনরাবৃত্তি করেই এই প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই-

ছন্দে লেখা রচনা কাব্য হয়নি তার হাজার প্রমাণ আছে, গদ্য রচনাও কাব্য নাম ধরলেও কাব্য হবে না তার ভুরি ভুরি প্রমাণ জুটতে থাকবে। গদ্য সহজ সেই কারণেই গদ্যছন্দ সহজ নয়। সহজের প্রলোভনেই মারাত্মক বিপদ ঘটে, আপনি এসে পড়ে অসতর্কতা। অসতর্কতাই অপমান করে কলালক্ষীকে, আর কলালক্ষী তার শোধ তোলেন অকৃতার্থতা দিয়ে। অসতর্ক লেখকদের হাতে গদ্যকাব্য অবজ্ঞা ও পরিহাসের উপাদান স্তুপাকার করে তুলবে এমন আশঙ্কার কারণ আছে। কিন্তু এই সহজ কথাটা বলতেই হবে, যেটা কাব্য সেটা পদ্য হলেও কাব্য, গদ্য হলেও কাব্য।

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা ( বিকাশ পর্ব -০২)

এ পর্বে যা পাবেন:
আত্মজীবনীতে নেরুদার চমকপ্রদ এক ঘটনা
আধুনিক কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা

কবিতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আত্মজীবনীতে নেরুদার চমকপ্রদ এক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন-
এলিয়টকে তো সবাই জানেন। অলঙ্করণবিদ ও নাট্যকার এবং অত্যুজ্জ্বল সমালোচক হওয়ার আগে তিনি আমার কবিতা পড়তেন। জেনে কৃতার্থ বোধ করছি। তাঁর চেয়ে ভাল বোদ্ধা আর কে? তারপর একদিন হলো কি, তিনি আমাকে তাঁর কবিতা পড়ে শোনাতে লাগলেন। আমি স্বার্থপরের মতো দৌড়ে পালাতে থাকি : –পড়বেন না, পড়বেন না, শোনাবেন না আমাকে। আমি বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিই কিন্তু এলিয়ট দরজার বাইরে দাড়িয়ে পড়েই যাচ্ছেন। আমার মনটা দমে গেল। ওদিকে ফ্রজার, স্কটল্যান্ডের কবি বলে উঠলেন—-এলিয়টের সাথে আপনার এ কেমন ধারার ব্যবহার? আমি তখন উত্তর দেই: শুনুন, আমি আমার পাঠক হারাতে চাই না। তাকে আমি সযত্নে ধীরে ধীরে তৈরী করেছি। সে আমার কবিতার চামড়ার কোঁচকানো বলিরেখা পর্যন্ত দেখতে পায়। এলিয়টের প্রতিভা কত্ত দিকেই না। তিনি আঁকতে পারেন, প্রবন্ধ লেখেন তিনি। কিন্তু আমি যে আমার পাঠক ধরে রাখতে চাই। ফেজার, প্লিজ আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন।

এরপর প্রসঙ্গের ইতি টেনেছেন এই বলে যে, কারণ হলো, সত্যি সত্যি এমনটাই যদি ঘটতে থাকে কবিরা কেবল লিখবেন অন্য কবিদের জন্য, তো হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা, কবি কবিতা লিখে যাচ্ছেন অন্য কবিদেরই জন্য, এইটা আমাকে টানে না…….. কবিতা তার পাঠকের সাথে সম্পর্ক হারিয়ে বসে আছে, কোন পাঠকই আর ধারে কাছে নেই……. তাকে কিন্তু ফিরিয়ে আনতে হবে……… কেবল তখনই আমরা সত্যিকার কবি হয়ে উঠব…….. কবিতাতো বাঁচবে এ লক্ষ্য নিয়েই।

আধুনিক কবিতা:

আধুনিক কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চের, যার নাম আধুনিকতা বা আধুনিকবাদ, যার উদ্ভব ঘটে পশ্চিমে এবং ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র গ্রহব্যাপী। রোমান্টিক আন্দোলনের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল সাহিত্য শিল্পান্দোলন আধুনিকতা বা আধুনিকবাদ, যা সারা পৃথিবী জুড়ে সৃষ্টি করেছে অসামান্য সাহিত্য ও শিল্পকলা। আধুনিকতাবাদ এক বহুমাত্রিক শিল্প-সাহিত্যান্দোলন, যার বিকাশ ঘটেছে নানা রূপে, নানা রীতিতে। আধুনিকতাবাদেও চরিত্র হচ্ছে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রথাগত রাষ্ট্রসীমা ভেঙ্গে ফেলা; এর স্বভাব আন্তর্জাতিকাবাদ। আধুনিকতাবাদের আগে, পশ্চিমে, শিল্পকলার জগতে বিপ্লব ঘটেছে প্রত্যেক শতকেই, বদলও ঘটেছে সংবেদনশীলতার, কিন্তু তা কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি, ওই বদল ঘটে স্বাভাবিকভাবে, আধুনিকতা আসে এক মহা বিপর্যয় রূপে, যা আগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণভাবে। এর স্বভাব বিপর্যয়কর।

১৮৮০ সালকে মনে করা হয় আধুনিকতার সূচনাকাল, যখন দেখা দেন প্রথম আধুনিকেরা- মালার্মে, গতিয়ে, বদলেয়ারের কাছে। পশ্চিমে এ সময়, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ঈশ্বরকে বাজে কথায় পরিনত করা হয়। কতগুলো বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিসকে কেন্দ্র গড়ে উঠা মতবাদের প্রভাবে তারা ঈশ্বর বিমুখ হয়ে পড়েন, তারা সমালোচনা করেন বুর্জোয়া সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের; এবং চারপাশের সমাজ তাদের মনে শুধু বমনের উদ্রেগ করে। তারা শুরু থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী, শ্রদ্ধেয় ছিলেন না, তাদের লেখা অর্জন করে কেলেংকারির ও শিল্পকলায় সাফল্য। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ সালকে মনে করা হয় আধুনিকবাদের শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়ে বিশ শতক দগ্ধ হয় অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুনে, প্রথম মহাযুদ্ধে, মেতে উঠে রক্তপাতে, যুদ্ধের পর অসীম অবিশ্বাস আর হতাশা থেকে জন্ম নেয় বিশ শতকের শিল্পকলা, যার মধ্যে আধুনিক কবিতা প্রধানতম। আধুনিকবাদের নিজের বছর হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ১৯২২ কে যে বছর এলিয়টের পোড়ামাটি, রিলকের অর্ফিয়ুসের প্রতি সনেটগুচ্ছ, জয়েসের ইউলিসিস, লরেন্সের অ্যারন্স রড পভৃতি।

বাংলা সাহিত্যের তিরিশের দশকের অতি আধুনিকদের মধ্যে দু’জন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে- টি. এস. এলিয়টের কাব্যভাবনা, কবিতাশৈলী ও কাব্যভাষার মধ্যে দিয়ে তাদের নির্মাণ ও সৃষ্টির প্রভাময় উদ্যানকে করে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ। বাংলায় ১৯২৫ ‘আধুনিকবাদ’-এর সূচনা বছর; আর কয়েক বছর পরই বেরোয় পরিপূর্ণ আধুনিক চেতনা সম্পন্ন কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০), জীবনান্দ দাসের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), অমিয় চক্রবর্তীর ‘খসড়া” (১৯৩৮)। পশ্চিমে আধুনিকবাদ আসে দীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কিন্তু বাংলায় ছিলনা কোন রকম প্রস্তুতি। আধুনিকতা পূর্ব বাংলা কবিতা সরল আবেগের কবিতা, কৈশোর বা প্রথম যৌবনের আবেগ, স্বপ্ন কাতরতাই বিষয় প্রথাগত বাঙলা কবিতার; আর ওই কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যে অভিজ্ঞতা, তা সার্বজনীন অভিজ্ঞতা, তা শুধু কবির নয়, পাঠকেরও অভিজ্ঞতা। আধুনিক বাঙলা কবিতা সার্বজনীন সাধারণ অভিজ্ঞতার বদলে প্রকাশ করে কবির অনন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যা অধিকাংশ সময়ই মানসিক; আর আধুনিক কবিতা তা প্রকাশ করেছেন অভিনব ভাষায় ও অলংকারে। বিশ দশকে সূচনা ঘটে যে কবিতা, আর ষাটের দশকে ঘটে যে ধারার কবিদের শেষ উন্মেষ, সে কবিতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ ধারায় প্রথম পাঁচ জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু,বিষ্ণু দে-এ ধারায় শ্রেষ্ঠ কবি। আধুনিক ধারার কবিরা বাংলা কবিতায় এনে দিয়েছে অনেক সমৃদ্ধি এবং নিয়েছে পাঠকহীনতার দুর্নাম। এই ধারার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশই একমাত্র কবি যিনি গেঁয়ো, শব্দ ব্যবহারে অসংযমী, এই অঞ্চলের প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে গিয়ে গহীন ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে কবিতা লিখেছেন। আর এই কারণেই সময়ের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি হয়ে উঠেছেন আরো গ্রহণীয়।

রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতা:

আধুনিকবাদের মূল সূর যে প্রথাকে অস্বীকার করা তার চর্চা রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন করলেও আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘পূর্ববর্তী কাব্যচেতনাকে সম্পূর্ন রূপে অস্বীকার করা’ তার সাথে তিনি একমত পোষণ করেননি।
১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে বলেন –
মডার্ন বিলিতি কবিদের সম্বন্ধে আমাকে কিছু লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। কাজটা সহজ নয়। কারণ, পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে কে। এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও বারবার সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডার্ণ। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।

প্রথম বয়সে যে ইংরেজ কবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল তাঁরা বাহিরকে নিজের অন্তরের যোগে দেখেছিলেন; জগৎটা হয়েছিল তাঁদের নিজের ব্যক্তিগত। আপন কল্পনা মত ও রুচি সেই বিশ্বকে শুধু যে কেবল মানবিক ও মানসিক করেছিল তা নয়, তাকে করেছিল বিশেষ কবির মনোগত।

ওয়ার্ডসওয়ার্থের জগৎ ছিল বিশেষভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থীয়, শেলীর ছিল শেলীয়, বাইরনের ছিল বাইরনিক। রচনার ইন্দ্রজালে সেটা পাঠকেরও নিজের হয়ে উঠত।
দেখা যাচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজী কাব্যে পূর্ববর্তীকালের আচারের প্রাধান্য ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের দিকে বাঁক ফিরিয়েছিল। তখনকার কালে সেইটাই হল আধুনিকতা। কিন্তু, আজকের দিনে সেই আধুনিকতা মধ্য ভিক্টোরিয়া প্রচীনতা সংজ্ঞা দিয়ে তাকে পাশের কামরায় আরাম-কেদারায় শুইয়ে রাখাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনকার দিনে ছাঁটা কাপড় ছাঁটা চুলের খট্খটে আধুনিকতা। আধুনিক কালের মনের মধ্যেও তাড়াহুড়া, সময়ের অভাব। জীবিকা জিনিসটা জীবনের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। তাড়া-লাগানো যন্ত্রের ভিড়ের মধ্যেই মানুষের হু হু করে কাজ করে, হুরমুর করে আমোদ-প্রমোদ।

গত য়ুরোপীয় যুদ্ধে মানুষের অভিজ্ঞতা এত কর্কশ, এত নিষ্ঠুর হয়েছিল, তার বহুযুগ প্রচলিত যত-কিছু আদব আব্র“ তা সাংঘাতিক সংকটের মধ্যে এমন অকস্মাৎ ছারখার হয়ে গেল; দীর্ঘকাল যে-সমাজস্থিতিকে একান্ত বিশ্বাস করে সে নিশ্চিত ছিল তা একমুহূর্তে দীর্ণবিদীর্ণ হয়ে গেল; মানুষের যে শোভনরীতি কল্যাণনীতিকে আশ্রয় করেছিল তার বিধ্বস্ত রূপ দেখে এতকাল যা-কিছুকে সে ভদ্র বলে জানত তাকে দুর্বল বলে, আত্মপ্রতারণার উপায় বলে, অবজ্ঞা করাতেই যেন সে এক উগ্র আনন্দবোধ করতে লাগল; বিশ্বনিন্দুকতাকেই সে সত্যনিষ্ঠতা বলে আজ ধরে নিয়েছে। মধ্য ভিক্টোরীয় যুগ বাস্তবকে সম্মান করে তাকে শ্রদ্ধেয়রূপেই অনুভব করতে চেয়েছিল, এ যুগ বাস্তবকে অবনামিত করে সমস্ত আব্র“ ঘুচিয়ে দেওয়াকেই সাধনার বিষয় বলে মনে করে। অতএব মধ্য-ভিক্টোরীয় যুগকে যদি অতিভদ্রয়ানার পান্ডা বলে ব্যঙ্গ কর তবে এডায়ার্ডি যুগকেও ব্যঙ্গ করতে হয় উল্টো বিশেষণ দিয়ে। ব্যাপারখানা স্বাভাবিক নয়, অতএব শাশ্বত নয়। সায়েন্সেই বল আর আর্টেই বল, নিরাসক্ত মনই সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন; য়ুরোপ সায়েন্সে সেটা পেয়েছে কিন্তু সাহিত্যে তা পায় নি।”

রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা:

গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক সমস্ত মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ সফল। কিন্তু তার সেরা সফলতা ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজী অনুবাদ যা তাঁকে এনে দিয়েছিলো বিশ্ব স্বীকৃতি। ‘গীতাঞ্জলী’র কবিতাগুলি অনুবাদ করার সময় এবং পরবর্তীতে তার প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গদ্য-কবিতা লেখায় মূল উৎসাহ যোগায়। তিনি বলেন –
‘গীতাঞ্জলি’র গানগুলি ইংরেজী গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। এই অনুবাদ কাব্য শ্রেণীতে গন্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্য ছন্দের সুষ্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা।

চলবে….।

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ, সম্ভবনা ( বিকাশ পর্ব-০১)

এই পর্বে যা পাবেন:

গদ্য কবিতা কি?

গদ্য কবিতা কি কবিতা?

হুইট ম্যানের সংক্ষিপ্ত জীবনী।

রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক অনুবাদকৃত হুইটম্যানের একটি কবিতা ও পদটিকা।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি প্রতিভা পাবলো নেরুদা।

গদ্য কবিতা কি ?

গদ্য কবিতা সে-ই কবিতা যা গদ্যে লিখিত হয়; অন্য কথায় পদ্য ও গদ্যের সংমিশ্রত উৎকৃষ্ট জাতীয় কবিতার নাম গদ্য কবিতা। প্রকৃতির বাস্তবতার কাব্যিক ব্যঞ্জনার নাম গদ্য কবিতা। গদ্য কবিতা প্রচীন যুগে হিব্রু স্কলারদের দ্বারা প্রথম লিখিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে নাম-না-জানা কয়েকজন লেখক ইংরেজীতে গ্রীক ও হিব্রু বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন। স্বীকার না করে উপায় নেই যে, সলোমনের গান ডেভিডের গাথা সত্যিকার কাব্য। এই অনুবাদের ভাষায় আশ্চর্য শক্তি এদের মধ্যে কাব্যের রস ও রূপকে নিঃসংশয়ে পরিস্ফুট করেছে। এই গানগুলোতে গদ্যছন্দের মুক্ত পদপেক্ষ লক্ষণীয়। তথাপিও বলা যায় ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হয় Aloysius Bertand -এর Gespard La nuit যা গদ্য কবিতাকে প্রথম স্বীকৃতি এনে দেয়। এর ছন্দোময় ও কাব্যিক ভাষা পরবর্তীতে অনেককে এই ফরমেটে কবিতা লেখাতে আগ্রহী করে তুলে। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয় Bandelaire-এর Petis poems en Prose. অন্য লেখকদের মধ্যে Rimbond এবং Oscar Wilde, Amy Lowell এই ধারায় লেখার প্রয়াস পান। Virginia Wolf কমপক্ষে একটি উপন্যাস এই ধারায় অনুসরণ করেন যেমন করেন Gertrnde Stien- Tender Buttons-এ। এর শুরু হয় ফ্রান্স থেকে এবং পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সাউথ আমেরিকায় Pablo Neruda এবং Borges, রাশিয়ার Turgenev, ইতালীতে Marinetti এবং ডেনমার্কে J. B. Jacobson, উত্তর আমেরিকায় Whitman, Robert Bly, W. S. Merwin প্রমুখ এই ধারার স্বার্থক ও প্রমাণিত কবি।

গদ্য কবিতা কি কবিতা?

এই বিষয়ে তর্কের শেষ নেই। কারো মতে গদ্য কবিতা একটি বিশেষ ধারার কবিতাই বটে কেননা এটা রূপক ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। অপর কারো মতে গদ্য কবিতা গদ্য। আধুনিকবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী T. S. Eliot গদ্য কবিতার বিপক্ষে জোড়ালো বক্তব্য তুলে ধরেন যদিও তিনি নিজে দু-একটি চেষ্টাও করেছেন এই ধারায়। বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশক যিনি তার কর্মের মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্যে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রসঙ্গে বলেছেন -গদ্যকাব্য নিয়ে সন্দিগ্ধ পাঠকের মনে তর্ক চলছে। এতে আশ্চর্যের বিষয় নেই। ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাত রসগর্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে, মনকে দুলিয়ে তোলে , এ কথা স্বীকার করতে হবে। তবে ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে রসে, ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় তার আনুসঙ্গ হয়ে। সহায়তা করে দুই দিক থেকে। এক হচ্ছে স্বভাবতই তার দোলা দেবার শক্তি আছে, আর- এক হচ্ছে পাঠকের চিরাভ্যস্ত সংস্কার। এই সংস্কারের কথাটা ভাববার বিষয়।
একদা নিয়মিত অংশে বিভক্ত ছন্দই সাধু কাব্য ভাষায় একমাত্র পাঙ্ক্তেয় পদ্য ছিল। তখন ছন্দে মিল রাখাও ছিল অপরিহার্য। এমন সময় মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে আমাদের সংস্কারের প্রতিকুলে আনলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। তাতে রইল না মিল। তাতে লাইনের বেড়াগুলি সমানভাবে সাজানো বটে, কিন্তু ছন্দের পদক্ষেপ চলে ক্রমাগত বেড়া ডিঙিয়ে। অর্থাৎ এর বঙ্গি পদ্যের মতো কিন্তু ব্যবহার চলে গদ্যের চালে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের মিলবর্জিত অসমতাকে কেউ কাব্যরীতির বিরোধী বলে কাজ মনে করেন না। অথচ পুর্বতন বিধানকে এই ছন্দ বহুদূর লঙ্ঘন করে গেছে। কাজটা সহজ হয়েছিল, কেননা তখনকার ইংরেজী শেখা পাঠকেরা মিল্টন , শেক্স-পিয়ারের ছন্দকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কী হতে পারে এবং হতে পারে না, তা হওয়ার উপরই নির্ভর করে, লোকের অভ্যাসের উপর করে না, এ কথাটা ছন্দই পূর্বেই প্রমাণ করেছে। আজ গদ্যকাব্যের উপর প্রমাণের ভার পড়েছে যে, গদ্যেও কাব্যের সঞ্চরণ অসাধ্য নয়।
সবশেষে এই একটি কথা বলবার আছে, কাব্য প্রত্যহিক সংসারের অপরিমার্জিত বাস্তবতা থেকে যতদূরে ছিলো এখন তা নেই। এখন সমস্তকেই সে আপন রসলোক উত্তীর্ণ করতে চায়, এখন সে স্বর্গারোহন করবার সময়ও সংগের কুকুরটিকে ছাড়ে না। বাস্তব জগৎ ও রসের জগতের সমন্বয় সাধনে গদ্য কাজে লাগবে; কেননা গদ্য সুচিবায়ুগ্রস্ত নয়।

আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে গদ্যে কাব্য রচনা ওয়াল্ট হুইটম্যান।
তিনি ১৮১৯ সালের ৩১ মে নিউ ইয়র্কের ওয়েষ্ট হিলে জন্মগৃহণ করেন। তার মা ছিলেন ডাচ্ বংশদ্ভোত কোর্য়াকার (জর্জ ফান কর্তৃংক প্রতিষ্ঠিত খ্রিষ্টধর্ম সম্প্রদায় বিশেষ) বিশ্বাসী ও ধর্মের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা ছিল, আর ছিলেন স্বল্প- শিক্ষিত, হুইটম্যানের মা তাঁর কবিতা কখনো পড়েননি কিন্তু তিনি তাকে দিয়েছেন শর্তহীন ভালোবাসা। পিতা কাঠ ও রাজমিস্ত্রি ছিলেন। সন্দেহ কারার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, হুইটম্যানের পিতা কখনো তার কবিতা পড়েছেন কিনা কিম্বা পড়লেও বুঝতেন কিনা। তিনি নয় সন্তানের জনক ছিলেন এবং সংসার নিয়ে বিব্রত ছিলেন।
নয়জনের দ্বিতীয়, বালক ওয়াল্ট হুইটম্যান এগারো বছর বয়সে ছাপার জগতের সাথে যুক্ত হন উপার্জনের তাগিদে এবং লিখা ও ছাপার অক্ষরের প্রেমে পড়ে যান। তিনি মূলত ছিলেন স্ব-শিক্ষিত এবং ক্ষুধার্ত পাঠক। জীবনের শুরুতেই তিনি হোমার, দান্তে, শেক্সপিয়ার ও স্কট প্রমুখের লেখার সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি বাইবেল বিস্তারিত অধ্যয়ন করেন এবং ঈশ্বর-প্রেমিক কবিদের মতো ধর্ম ও মানবতার বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ রচনা করতে চাইতেন।
সম্পূর্ণভাবে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়ার পূর্বে তিনি ভিন্ন ধারার শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। Brooklyn Free man নামে বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় -মুক্ত মানবের ছোট নদী- একটি পত্রিকা তিনি প্রকাশ করেন। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৫ সালের মধ্যে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম Leves of gress-এর কবিতাগুলো প্রকাশ করেন। তার দ্বারা পাবলো নেরুদা ব্যাপকভাবে আলোড়িত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তার -শেষ সপ্তক–এর গদ্য কবিতাগুলো লিখছিলেন তখন তার দ্বারা প্রভাবিত হন বলে ধারনা করা যায়। তিনি Leves of gress কাব্যের I saw in Lonisiana a Live-oak growing কবিতা অনুবাদ করেন। তরজমাটা নিম্নরূপ-
লুইসিয়ানাতে দেখলুম একটি ওকগাছ বেড়ে উঠছে;
একলা সে দাঁড়িয়ে, তার ডালগুলো থেকে শ্যাওলা পড়ছে ঝুলে।
কোন দোসর নেই তার, ঘন সবুজ পাতায় কথা কইছে তার খুশিটি।
তার কড়া খাড়া তেজালো চেহারা মনে করিয়ে দিলে আমারই নিজেকে।
আশ্চর্য লাগল কেমন করে এ গাছ ব্যক্ত করছে খুশি-ভরা
আপন পাতাগুলো যখন না আছে ওর বন্ধু, না আছে দোসর।
আমি বেশ জানি আমি তো পারতুম না।
গুটিকতক পাতাওয়ালা একটি ডাল তার ভেঙে নিলেম,
তাতে জড়িয়ে দিলেম শ্যাওলা।
নিয়ে এসে চোখের সামনে রেখে দিলেম আমার ঘরে;
প্রিয় বন্ধুদের কথা স্মরণ করাবার জন্যে সে তা নয়।
(সম্প্র্র্রতি ঐ বন্ধুদের ছাড়া আর কোন কথা আমার মনে ছিল না।)
ও রইল একটি অদ্ভুত চিহ্নের মতো,
পুরুষের ভালোবাসা যে কী তাই মনে করাবে।
তাই যাই হোক, যদিও সেই তাজা ওকগাছ
লুইসিয়ানার বিস্তীর্ণ মাঠে একলা ঝল্মল্ করছে,
বিনা দোসরে খুশিতে ভরা পাতাগুলো প্রকাশ করছে চিরজীবন ধরে,
তবু আমার মনে হয় আমি তো পারতুম না।

কবিতাটি তরজমা শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখেন- এক দিকে দাঁড়িয়ে আছে কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ ওকগাছ, একলা আপন আত্মসম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতায় আনন্দময়, আর একদিকে একজন মানুষ, সেও কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ, কিন্তু তার আনন্দ অপো করছে প্রিয় সঙ্গের জন্য এটি কেবলমাত্র সংবাদরূপে গদ্যে বলবার বিষয় নয়। এর মধ্যে কবির আপন মনোভাবের একটি ইশারা আছে। একলা গাছের সঙ্গে তুলনায় একলা বিরহী-হৃদয়ের উৎকন্ঠা আভাসে জানানো হল। এই প্রচ্ছন্ন আবেগের ব্যঞ্জনা, এই তো কাব্য; এর মধ্যে ভাব বিন্যাসের শিল্প আছে, তাকেই বলব ভাবের ছন্দ।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি প্রতিভা পাবলো নেরুদা। কবিতা-নির্মাণ-কুশলতায় কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য এবং নিসর্গ এবং ঐতিহ্যের চেতনায় বলীয়ান হয়ে তিনি যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন আন্তর্জাতিক কবিতা অঙ্গনে এ আজ পরম বিস্ময়ের বিষয়। এই কবির জন্ম ১৯০৪ সালে চিলিতে এক রেলশ্রমিক ও স্কুল শিক্ষিকার ঘরে। তার শৈশব কেটেছে কোন্সেপ্সিওন্ প্রদেশে দক্ষিণে। বন্যা, প্রবল বর্ষণ, নিসর্গ, নদী, ঘন বন এই অঞ্চলের প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। শৈশবের নদী, নিসর্গ ও জীববৈচিত্র্য তার জীবনচর্যায় প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কুড়িটি প্রেম এক্ষং একটি বিরহের গান- নামক কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সাথে সাথেই সমঝদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল চিলির এক অখ্যাত লেখকের দিকে, ইনি নিজের পরিচয় দিতেন পাবলো নেরুদা রূপে।
কুঁড়িটি…………….গান বইখানিতে কোন আড়ম্বর ছিলনা, কিন্তু যারা এই বইটি পড়ল তারাই বুঝল যে, এমন একজন কবির জন্ম হয়েছে, তিনি বাঁধাধরা নিয়ম থেকে নিজেকে মুক্ত করবেন, নিজের পথ খুঁজে বের করে নিতে পারবেন।
পাবলো নেরুদা এমন মহৎ কবি যিনি জীবদ্দশায় হয়ে উঠেছিলেন নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে সত্যিকার অর্থেই কিংবদন্তিতুল্য। ১৯৭১ সালে নোবেল পুরস্কার পান। আর সেই বছর তিনি যে নোবেল ভাষণ দেন তাতে তাঁর কবিতা রচনার জন্য যে ভেতরমুখী তাগিদ কাজ করছিল, তার উল্লেখ আছে। সেই বক্তৃতায় তিনি বলেন-
ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, আমি কোন বই পড়ে কবিতা লিখতে শিখিনি। কাউকে আমি শিখাতেও পারবো না কি করে কবিতা লিখতে হয়। আজকের এই পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সেই দিনটার কথা মনে করলে কিছু ভাবনার সৃষ্টি হয়। সেই ভাবনাগুলো আমি ভেজাল শব্দ দ্বারা প্রকাশ করিনা, কিন্তু নিজের কাছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। তাই আমার পথ চলার কাহিনী দিয়ে একটি কবিতা তৈরী হয়ে যায়। তাতে আমি মাটি থেকে উপাদান নেই। আমার কাছে একাকীত্ব, ভাবনার বিশ্বস্ততা, আবেগ ও গতি, নিজের কাছে আসা, মানুষের কাছে আসা, প্রকৃতির গোপনীয়তা প্রকাশ, আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি মানুষ তার ছায়ার সাথে, আচরনের সাথে কবিতার সাথে যে আটকে আছে, মানুষের যে সমাজবদ্ধতার চেতনা, তা সম্ভব হয়েছে কারণ মানুষের প্রচেষ্টা আছে স্বপ্ন আর বাস্তবকে একসাথে মেলাবার। কবিতা এই স্বপ্ন আর বাস্তবকে মেলাবার কাজটা করে।

হুইটম্যানকে তিনি মিলিয়ে নিয়েছিলেন গভীরভাবে তাঁর সত্ত্বার সাথে। সে কথা বারবার বলেছেন নানা সাক্ষাৎকারে। হুইটম্যানের কাব্যকৃতিকে তিনি মান্য করতেন। ১৯৯৬ সালে ১২ জুলই নিউ ইয়র্কে নেরুদা এক সাক্ষাৎকারে রবার্ট ব্লাইকে বলেন–
দক্ষিন আমেরিকার কবিতা কিন্তু পুরোপুরি অন্যরকম ব্যাপার। জানেনইতো আমাদের দেশগুলোয় এমন অনেক নদী আছে যাদের কোন নাম নেই, আছে এমন অনেক গাছ যাকে কেউই জানেনা, আছে এমন অনেক পাখি যাদের কেউই কখনো বর্ণনা দেয়নি। আমাদের পক্ষে বরং পরাবাস্তবিক হয়ে উঠাই সহজ, কারণ আমরা যা যা জানি সবই নতুন। আমরা যেভাবে বুঝেছি, আমাদের কাজ তাই মনে হয় যার কথা কেউ কখনও শোনেনি তারই কথা শোনালেন। সবকিছুই আঁকা হয়ে গেছে ইউরোপে, সবকিছুই গান গাওয়া হয়ে গেছে ইউরোপে কিন্তু আমেরিকায় তা নয়। সেই অর্থে, হুইটম্যান ছিলেন মহান শিক্ষক। কারণ হুইটম্যান আসলে কী বা কে? তিনি শুধু প্রখরভাবে সচেতনই ছিলেন না, ছিলেন দুচোখ খোলা মানুষ। তাঁর ছিল বিশাল ডাগর দুই চোখ, সবকিছু দেখার জন্য উৎসুক তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন কেমন করে কিছু দেখতে হয়। তিনি আমাদের কবি।
তাছাড়া অনেক মার্কিন কবি শুধু এলিয়টকে অনুসরণ করেই ভেবেছিলেন হুইটম্যান ছিলেন বড্ড গেঁয়ো, বড্ড আদিম, অথচ তিনি আদপেই কিন্তু সহজ সরল কিছু নন। হুইটম্যান-তিনি ছিলেন আন্তর্গূঢ় জটিল মানুষ, আর যেখানেই তিনি সেরা সেখানেই সবকিছু জটিলতায় ভরা। তার চোখ ছিল জগতের দিকে খোলা, আর তিনিই আমাদেরকে কবিতা সম্বন্ধে শিখিয়েছেন, আরো কতোকিছু শিখিয়েছেন। আমরা তাকে খুব ভালোবাসতাম। আমাদের উপর এলিয়টের প্রায় কোন প্রভাবই পড়েনি। হয়ত তিনি খুবই বুদ্ধিবাদী বলেই, আর আমরাতো খুবই সেকেলে, আদিম। তাছাড়া প্রত্যেককেইতো নিজের নিজের পথ বেছে নিতে হয় -সে কি হবে সূক্ষ্ম, বুদ্ধি নির্ভর পথ, নাকি অনেক খোলামেলা, ভাই-বন্ধুতে ভরা, সাধারণ মানুষের পথ, যে চেষ্টা করেছে তার চারপাশের জগৎটাকে বুকে টেনে নিতে, নতুন জগৎটাকে আবিস্কার করতে?

চলবে…. আশা করি সাথেই পাব।
ধন্যবাদ।

গদ্য কবিতা: সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা ( প্রথম অংশ)

কবিতা কি?

ড. হুমায়ুন আজাদ তার -আমার অবিশ্বাস- গ্রন্থে কবিতাকে নির্ণয় করতে বর্ণনা করেছেন — যা কিছু প্রিয় আমার, যা কিছুর জন্য নিরর্থক জীবনধারনকে তাৎপর্য মনে হয়, বেঁচে থাকাকে সুখকর মনে হয়, তা রাষ্ট্র নয় সংঘ নয় সুধীদের কর্মীদের রাজনীতিবীদদের বিবর্ণতা নয়, সেগুলো খুবই সামান্য ব্যাপার, আর সে শুরুতেই রয়েছে কবিতা। সমাজ, বিশেষ করে রাষ্ট্রের কবিতার দরকার নেই; কোন রাষ্ট্রই মনে করেনা যে তার সুষ্ঠু পরিচালনের জন্য কবিতা দরকার, দরকার কবি। ১০০০ মানুষের জন্য আমাদের ৫০ জন চিকিৎসক দরকার, এক জেলার জন্য দরকার ১০০ প্রকৌশলী, ৩০০ নির্বাহী কর্মকর্তা, ৪টি নির্বাচিত ১টি মনোনীত প্রতিনিধি এবং ১৫০০ পতিতা কিন্তু কোন কবির দরকার নেই। তবে ব্যক্তির দরকার কবিতা, সমাজের দরকার কবিতা, সভ্যতার দরকার কবিতা। মানুষ সৃষ্টিশীল, তার সম্ভাবনা অশেষ, কবিতা মানুষের সৃষ্টিশীলতার এক শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।

কিভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা? কি থাকে কবিতায়?

কবিতায় কি থাকে, তা খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়, মানবিক-অমানবিক সব কিছুইতো থাকে কবিতায়, থাকে ভাষার ইন্দ্রজাল, অপরিসীম কল্পনা; কিন্তু কিভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা, তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারিনা। … কবিতার কাঠামো, তার ছন্দ ও মিল বা অমিল সম্পর্কে কিছুটা শিক্ষা দেয়া সম্ভব কিন্তু প্রতিটি প্রকৃত কবিতাই অভূতপূর্ব, রচিত হওয়ার আগে তার রচয়িতাও সেটি সম্পর্কে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পরই শুধু উপলব্ধি বা অনুভব বা বিচার করে দেখা সম্ভব সেটা কবিতা হয়েছে কিনা, বা হয়েছে কতটা অসাধারণ।….

মানুষ তার আপন মনের ভাবনাকে প্রথমত শারিরীক অঙ্গ-ভঙ্গির মাধ্যমে অন্যজনকে প্রকাশ করে, অত:পর নানাবিধ ধ্বনির সাহায্যে। যেহেতু ধ্বনি একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রতিস্থাপিত হয় ইথারের স্পন্দনের মাধ্যমে তাই সেই ধ্বনিকে একটি নির্দিষ্ট গাথুনিতে বেধে দিয়ে তৈরি করা যায় একটা রিদম। ভাষার উৎপত্তির শুরু থেকে মানুষের সৃষ্টিশীল ভাবনা এই ধ্বনিগুচ্ছ নানাবিধ গাথুনিতে গেথে অন্যজনে পৌছে দিত। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষায়ই তাই প্রথম উদ্ভব হতে দেখা যায় পদ্য বা গান। মানুষের মস্তিষ্ক অন্তঃস্থিত যে মেমোরি সেল রয়ে গেছে সেখানে শ্রুতি বা দৃশ্য দর্শনের মাধ্যমে যেসব তথ্য পাঠানো হয় তাকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে স্মরণযোগ্য করে রাখার জন্য এবং প্রয়োজনীয় সময়ে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি সুনির্দিষ্ট গাথুনি বা ঘটনার পরস্পরা। একটি ছন্দময় গাথুনি দিয়ে বেধে ধ্বনিপুঞ্জকে যদি মস্তিষ্কে প্রেরণ করা যায় তবে তা সহজেই স্মরণে রাখতে পারে।

ধ্বনিগুলোকে ক্রমাগত সাজিয়ে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে, কথা বলে। কিন্তু কথ্য ভাষার সকল শব্দই একটি নির্দিষ্ট রিদমে ফেলা যায় না। যে সমস্ত ধ্বনি সমষ্টি একটি নির্দিষ্ট রিদমে গেথে মনের ভাবকে প্রকাশ করা যায় সেই সকল ধ্বনি সমষ্টিকে ক্রমাগত সাজিয়ে পদ্য রচিত হয় যা দ্বারা মনের আবেগকে অন্যের মাঝে সঞ্চারিত করা যায়। কিছু কিছু ভাব বিন্যাস শব্দের গাথুনিতে এতোটাই মাধুর্যমন্ডিত হয়ে উঠে যে, মস্তিষ্কে তা গেথে যায় এবং বারবার উচ্চারিত হয়ে আনন্দিত হয়।

মনের ভাবকে প্রকাশ করার জন্য বা মানুষের অভিজ্ঞতাকে অন্যের মাঝে বর্ণনা করার জন্য প্রয়োজন হয়ে উঠে রূপকের। একটি অজানা বস্তুকে বুঝাবার জন্য জানা বস্তুর সাথে বা অজানা ভাবকে বুঝাবার জন্য জানা ভাবকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কখনো কখনো এই সকল রূপক শ্রুতিমধুর ধ্বনিপুঞ্জের সাহায্যে কেবল তথ্য বা খবরের সন্ধান দেয় না, তৈরী করে এক ধরনের অনির্বচনীয় আবেগ, আপ্লুত করে মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে। নির্মল আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে মানুষের মন।

মানুষের মস্তিষ্কের প্রকৃতিই এমন যে, প্রথম অভিজ্ঞতায় সে যে আনন্দে ভেসে যায় তার বহু ব্যবহারে সে বিরক্ত হয়ে উঠে। তার সৃষ্টিশীলতা নতুন অভিজ্ঞতাকে প্রয়োজনীয় করে তুলে। মানুষের মস্তিষ্ক একস্থানে স্থির অবস্থান নেয়না কখনো। তার পর্যবেক্ষণ তাকে ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে চলে। নানবিধ পর্যবেক্ষণে প্রকৃতির নানা রীতিনীতকে আত্মস্থ করে তার জ্ঞানের উন্মেষ ঘটতে থাকে। বদলে যেতে থাকে জীবন যাত্রার মান। জটিল থেকে জটিলতর সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে এগুতে থাকে মানুষ। এই যে মানুষের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম পদ্য বা কবিতা তাও নানারূপ ছন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুতে থাকে। রূপকে আসতে থাকে নানা বৈচিত্র্য। ভাবে চলে আসে সমৃদ্ধি। তৈরী হতে থাকে কাব্য চেতনা। তৈরী হয় অসাধারণ ভাবের প্রকাশ, শব্দের নানাবিধ বিন্যাসে। ছন্দগুলো সরলীকরণের পথ অতিক্রম করে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। চলে আসে মাত্রায় গাণিতিক প্রয়োগ।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চেতনায় এনে দেয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চলে আসে লিখিত অবয়ব। যে ছন্দগুলো ধ্বনিপুঞ্জের তালের সাহায্যে এগুতে ছিল তা-ই এক পর্যায়ে অক্ষর মাত্রায় রূপান্তরিত হয়।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড পরিচালনা হতে জন্ম নেয় এক ধরনের ভাষা যাকে গদ্য বলা হয়। পরিবর্তিত পৃথিবী অনেক যুদ্ধ, প্রতিহিংসা, সামাজিক অনাচার আর বিপ্লবের মাধ্যমে এগুতে থাকে। কিন্তু মানুষের সৃষ্টিশীলতা থেমে থাকেনি। তার সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের জন্য তৈরী হতে থাকে শক্তিশালী বাঁধন, গদ্যের বাঁধন। ভাব প্রকাশের যে মাধ্যমটি ছিলো নারীর মতো কোমল, স্নিগ্ধ, রিদমিক তা কঠিন প্রকৃতির মতো গদ্যে রূপান্তরিত হতে থাকে। তৈরী হতে থাকে এক পৌরুষদীপ্ত ফরমেট। জন্ম নেয় গল্প, ছোট গল্প, উপন্যাসের মতো শক্তিশালী মাধ্যম। পদ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্বিত হয়। কল্পনাপ্রবণ মানুষ সৃষ্টিশীলতাকে নিবেদন করতে থাকে নানামুখী ফরমেটে। পদ্যের শারিরীক কোমল গঠনের কারণে যেখানে সে স্থবির থাকে আর এগুতে পারেনা, সেখানে গদ্য তার ভূমিকায় অনন্য হয়ে উঠে। মানুষের জীবনে জটিলতাকে অত্যন্ত শক্তিশালী দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা চেতনার সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে থাকে।
মানবজাতির সূচনার সেই সহজ-সরল অভিব্যক্তি ছন্দের তালে তালে যে স্পন্দিত হতে ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে সেও তার ফরমেটে পরিবর্তন নিয়ে আসে। কেননা সৌন্দর্য আর মননশীলতা প্রকাশের এই যে অনন্য মাধ্যম পদ্য বা কবিতা তার ভিতর রয়ে গেছে এক ধরনের মাদকতা যাকে কোন কালেই মানুষ হারাতে পারেনি। কবিতায় ক্রমে ক্রমে ভাষাগত ছন্দের আঁটা-আঁটির সমান্তরে ভাবগত ছন্দ উদ্ভাসিত হয়েছে। তার শ্রাব্য সীমারেখা ছাড়িয়ে হয়ে উঠে প্রধানত পাঠ্য। যে সুনিবিড় সুনিয়মিত ছন্দ আমাদের স্মৃতির সহায়তা করে তার অত্যাবশ্যকতা হারিয়ে গেছে। একদিন খনার বচনে চাষাবাদের পরামর্শ লেখা হয়েছিল ছন্দে। আজকালকার বাংলায় যে -কৃষ্টি- শব্দের উদ্ভব হয়েছে, খনার এই সমস্ত কৃষ্টির ছড়ায় তাকে নিশ্চিত এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের কৃষ্টি প্রচারের ভার আজকাল গদ্য নিয়েছে। ছাপার অক্ষর তার বাহন, এই জন্য ছন্দের পুঁটুলিতে ঐ বচনগুলো মাথায় করে বয়ে বেড়াবার দরকার হয় না। কাব্য, বুদ্ধির সাথে এর বোঝাপড়া নয়, একে অনুভব করতে হয় রসবোধে। আর এই কাব্য রসবোধকে সুসমন্নত রেখে শুরু হয় গদ্যে কাব্য রচনা।

চলবে….

প্রকৃতি দেখ খেয়ালী কেমন

প্রিয়তমা সঙ্গিনী বাহুলগ্না। শৃঙারে শৃঙারে কামুক করে তুলেছি,
চৈত্রের খরায় বাংলার বিলের জলের মতো লজ্জা তার লাপাত্তা।
ক্ষীরের মতো নরম স্পর্শকাতর কর্দমাক্ত জমিনটুকু সদ্য প্রসবিত
ডিমের উমের কুমকুম গরম। এখন তার প্রতিটি লোমকুপ ভেঙ্গে
যেতে উম্মুখ।

আমার সবচেয়ে নিরীহ অঙ্গখানি ইস্পাত কঠিন,
বুকে তার অসুরের ব্যঞ্জনা,
প্রিয়ার তুলতুলে নরমে আঁকে ঝড়ের আলপনা।

মহাবিশ্বের সবখানে এই লীলা বহমান।
একজন ঝড় তুলে, হায়! ভাঙ্গে অন্যজন।
তবু প্রকৃতি দেখো খেয়ালী কেমন
ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে গায় সৃষ্টির গান।

খুল যা সিম সিম…টিনের চালে কাক, গেদুতো অবাক

দূরে কাছে যে যেখানে আছেন সকলকে প্রাণ ঢালা শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি খুল যা সিম সিম এর আজকের পর্ব। প্রিয় বন্ধুরা আপনাদের মনে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গল্প ইচ্ছাপূরণ। আরে হ রে ভাই ঐ যে বাবা আর ছেলের পাল্টাপাল্টি হয়ে যাওয়া, অর্থাৎ কিনা বাবা ছেলে হয়ে যাওয়া আর ছেলে বাবা হয়ে যাওয়া। কি মজার কা বাত হায়। আপনারা ভুলে গেছেন কিন্তু গেদুর খুব মনে আছে।

তো সেদিন গেদুর সাথে মুরব্বীর দেখা। এই ইচ্ছাপূরণ নিয়ে নানান কথা।
গেদু বলল ঃআমার জীবনে একটা ইচ্ছাও পূরণ হল না। আচ্ছা ভাই মুরব্বী আপনার কোন ইচ্ছা পূরণ হয়েছে?
বিশিষ্ট ভদ্রলোক মুরব্বী বললেনঃ হয়েছে, ছোটবেলায় স্যারের হাতে চুল টানা খেতে খেতে ভাবতাম চুলগুলো না থাকলেই বুঝি ভালো হত। এখন দেখ, মাথায় একটাও চুল নেই।

গেদু বলল এটা কিভাবে হলো? বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে মুরব্বী এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, গেদু বলল কি ব্যাপার?
মুরব্বী বললেন, না তেমন কিছু না, আশেপাশে মুরব্বীনি নাই তো!!

টিনের চালে কাক গেদুতো অবাক!!!

গেদুর সাথে সেদিন খালিদ ওমর ভাইয়ের দেখা। গেদু রাস্তায় দাড়িয়ে কাদছে। খালিদ ভাই বললেনঃ – কিরে কাঁদিস কেন?
গেদু বললঃ দেয়ালে পেরেক মারতে গিয়ে মুরব্বী মাথা ব্যাথা পেয়েছে।
খালিদ ভাই বললেন ঃ কাদার কি আছে? পুরানো টাক, এটুকু ব্যাথায় তার কিছু হয়?
গেদু বললঃ আমিতো প্রথমে হেসেইছিলাম… সেজন্যইতো আমাকে…

মুরব্বী শক্ত পুরানো টাক, গেদুতো অবাক।

মিতা আর গেদুর বাড়ি পাশাপাশি। এলেবেলে লিখে মিতা এখন শব্দনীড় ষ্টার। গেদু আর মিতার কিছু এলেবেলে কথা আমরা গোপন ক্যামেরায় রেকর্ড করেছি। প্রিয় পাঠক আসুন সংলাপগুলো একটু ভাবি…

মিতাঃ ভাই আপনার জন্মদিন কবে?
গেদুঃ কেন ভাই, জন্ম দিন জেনে কি করবেন?
মিতাঃ না মানে, আপনাকে একটা পর্দা gift করতাম আর কি। কারন জানালা দিয়ে প্রতিদিন আপনাদের রোমান্স দেখে দেখে bore হয়ে গেছি।
গেদু ঃ আপনার জন্ম দিন কবে?
মিতাঃ আগামী সপ্তাহে। কেন?
গেদু ঃ আপনাকে একটা দূরবিন gift করব যাতে আপনি দেখতে পারেন যে wife টা কার!!!

প্রিয় দর্শক শ্রোতা পাঠক / পাঠিকা গেদু খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। গেদুকে পাওয়া না গেলে অনুষ্ঠান চালাই কিভাবে?

খোদা হাফেজ।

কবির জগত

কবিদের জগতটা আলাদা। যখন রাত্রির মৃত্যু নেমে আসে সমস্ত চরাচরে, গভীর আধার এব ভর করে. পৃথিবীর তীব্র আলোচ্ছটা হারিয়ে যায়, হয়তবা চন্দ্রিমার কোমল আলো এক যাদুকরী মমতায় ঢেকে দেয় পৃথিবীর প্রান্তর, কিম্বা ভোরের প্রস্ফুটিত আলোয় শিশুর মতো প্রাণবন্ত থাকে পৃথিবী, তখন কবিদের হৃদয়ে এক একটা ধারণা নিক্ষেপ করে প্রকৃতি, তখন শব্দ তুলিতে যে চিত্র আকা হয়ে যায় তা হয়তবা মিথ্যার আবরনে ঢাকা থাকে, থাকে কোন উপমার চিক্রকল্প, হয়ত কোন স্মৃতির মনিকোটায় কোন দৃশ্য সুপ্তাবস্থা হতে সামনে চলে আসে জনসমক্ষে কিন্তু তা সমকালীনকে নিয়ে যায় চিরকালীনের দ্বার প্রান্তে। এক অতীন্দ্রিয় অনুভুতির তীব্র যন্ত্রনায় কবি কাপতে থাকে। সাধারনেরা অনেক সময় তাই তাদের কর্মকান্ড বুঝে উঠতে পারে না —-

একটি সিনেমেটিক গল্প

ওরা সুখের লাগি চাহে প্রেম

ফকির আবদুল মালেক

১. ব্যাক্তিগত পরিচয়ের সুত্র ধরে একজন পত্রিকার রিপোর্টারের সাথে, যার দু’টি ফ্রি-পাস ছিল, কয়েকদিন আগে একটি সঙ্গীত সন্ধ্যা উপভোগের সুযোগ পাই।
চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, উজ্জ্বল চেহারা, জ্বল-জ্বল করে জ্বলতে থাকা দৃষ্টিনন্দন চোখ, ঝাকড়া-লম্বা চুলের বর্তমান সময়ের আলোচিত একজন শিল্পী তার নিজস্ব ঢং-এ সঙ্গীত পরিবেশন করছিল। একটি পাশ্চাত্য ক্লসিক সুর আর মিউজিক কম্পোজিশনের চমৎকার মাধুর্যতায় সমস্ত অর্ডিয়েন্স স্তম্ভিত মুগ্ধতার স্থবির হয়ে আছে।
“একটি গল্প আছে এই লোকের,” রিপোর্টার বলছিল,“পত্রিকা থেকে এই শিল্পীর উপর একটি ফিচার তৈরী করার নির্দেশ পাই। সঙ্গীত নিয়ে তিনি এক ধরনের পরীক্ষায় নেমেছেন। পশ্চিমের ক্লাসিক ধারার গানের মুল থিমটি আয়ত্বে এনে তিনি বাংলা গানে তার প্রয়োগ করছেন। বলার অপেক্ষা কি, তিনি সফলতা পাচ্ছেন। আমি তার বাড়ি যাই, তার জীবনের ঘটনাটি আমাকে বিস্মিত করে। তুমি তো জানো বর্তমানে হাসির নাটকের কি কদর টিভিতে। সিরিয়াস কোন নাটকই এখন আর পাবলিক খাচ্ছে না। এখন আমি একটি হাসির সিরিয়াল করছি, তুমি জান। না হলে তাদের জীবন নিয়ে একটা নাটক হতে পারত। তুমিতো ট্রেজেডি গল্প লিখ, হয়ত কোন গল্পের ক্লু খুজে পেতে পারো। আমি তোমাকে
বিস্তারিত বলব।”
সেই সন্ধ্যার পর আমার বন্ধু, পত্রিকার রিপোর্টার কাম টিভি’র কামিক সিরিজ কাহিনীকার আমাকে বিস্তারিত বলে।
“আমি কোন কারন খুজে পাই না” বলি আমি, যখন সে উপসংহারে চলে আসে, “ কেন তা একটি কৌতুকপূর্ণ কাহিনী হবে না! ঐ তিনজন কোন অবস্থাতেই এতটা উদ্ভট, অয়ৌক্তিক চরিত্রে এত সুন্দর অভিনয় করতে পারত না, যদি তারা সত্যিকারের নামী দামী অভিনেতা হতেন। আমি সত্যি ভয় পাই, মনে হয়, যেভাবেই হোক পৃথিবীটা একটা মঞ্চ আর সমস্ত নর-নারী এক একজন দক্ষ কমেডি অভিনেতা। এটা সত্যি একটা প্রাকৃতিক প্রহসন হবে।”
“চেষ্টা করে দ্যাখো… ” বন্ধু বলে।

২. নারায়ণগঞ্জ চেম্বার রোডে বাড়িটি অবস্থিত। গত পঁচিশ বছর যাবৎ এর নিচ তলায় একটি বেশ বড় শো-রুম দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য নিয়ে চলে আসছে যেখানে নানা ধরনের বুটিকস্ এর পোশাক বিক্রি করা হয়।
বিশ বছর আগে খুব সাদামাটা বিয়ের অনুষ্টান অনুষ্ঠিত হয় এই শো-রুমটির উপরের তলায়। বিধবা তাহমিনা বাড়িটি ও শো-রুমের মালিক। তার কন্যা হেলেন ও বাশেদুল বারী রাশেদ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তানভীর আহমেদ তুহিন এক প্রাণবন্ত যুবক, ব্যবহারে, সৌন্দর্যে আর অর্থবিত্তে, সমস্ত অনুষ্ঠানটি অলোকিত করে রাখে নানা কৌতুকে। হেলেন তখন আঠার, শহরে শিক্ষিতা, কন্ঠশিল্পী আর সুন্দরী হিসাবে যার সুনাম ছড়িয়ে পরেছিল।
রাসেদ ও তুহিন দুজ’ন ঘনিষ্ট বন্ধু যারা একটি নাট্যদল ও সঙ্গীত একাডেমী প্রতিষ্ঠা করে বেশ সুনাম অর্জন করে। দুহাতে পয়সা খরচ করে তারা যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। এই গল্পের মজার দিকটি এখান থেকেই শুরু। দুজনেই হেলেনের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল। যখন রাশেদ জয়ী হয়ে যায়, তুহিন তাকে স্বাগত জানায়, বুকে জড়িয়ে ধরে ক্লেশহীন ভাবে।
বিয়ের পর পরই নব-দম্পতি পাহাড়ের দিকে খুব সম্ভবত: বান্দরবনের দিকে চলে যায় যেন তারা ভ্রমনের পোষাকেই বিয়ে করে। একদিন রাশেদ একটু বাইরে গেছে, কি যে পাগল লোকটা আদিবাসীদের সাথে কথা বলতে গেছে, ওদিকে হেলেন আজ সেজেছে দারুন করে, একটা পাহাড়ী ফুল চুলে গুজিয়ে দিয়েছে , একটু যতœ করে পরিচ্ছন্ন হয়ে রাসেদের জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় হঠাৎ আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলতে জ্বলতে তুহিন কটেজে প্রবেশ করে, সে ছিল উদভ্রান্ত, চোখদু’টি সিদুরের মতো লাল ছিল তার, সে পাগলের আচরণ করছিল, চিৎকার চেচামেটি করে এই নিরব প্রকৃতিকে বাজারে পরিনত করে তুলেছিল, বলছিল,“ আমি সব হারিয়ে ফেলেছি, হেলেন, আমি তোমাকে ছাড়া নি:স্ব একা। এসো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই, আমি তোমাকে ছাড়া বাচব না”
৩. হেলেন ভয়ে পাংশু ছিল। ক্রোধে তার চোখ দুটি জ্বলছিল, একরাশ ঘৃণা নিয়ে বলেছিল ‘ভদ্রেলোকের মতো’ কথা বলতে। কিছুক্ষণের ভিতর সে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নেয়। সে বিনম্র আচরণ করে, তুহিনের ছেলেমানুষি আচরণের ভিতর গহীন ভালবাসা দেখতে পায় আর বলে যে, “ তোমার হৃদয় নিসৃত আবেগ আমার স্মৃতিতে সারাজীবনের কান্না হয়ে থাকবে” এবং দ্রুত তাকে চলে যেতে বলে।
“আমি চলে যাব” তুহিন বলে,“ পৃথিবীর অন্য প্রান্তে । আমি কিছুতেই থাকব না যেখানে তুমি অন্য কারো হবে। আমি অন্য কোথাও চলে যাব আন্য কোন পরিবেশে অন্য জীবন খুজে নিব, কিন্তু তোমাকে কোনদিন ভুলে যেতে পারব না” বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
“খোদার দোহাই তোমার” হেলেন বলে, “কেউ হয়ত এদিকটায় আসছে।” তারপর নাটকীয়ভাবে হাটুর উপর বর দিয়ে তার ফর্সা নরম হাতখানি মেলে ধরে। তুহিন তার বাড়িয়ে দেয়া হতে চুম্বনে সিক্ত করে দিল।
বিদায়ী চুম্বনখানি হেলেনের হাতে চিত্রময় হয়ে রইল এবং সে জানালা দিয়ে প্রস্থান করল আর হেলেনের জীবন থেকে হারিয়ে গেল।

৪. পাঠক, দৃশ্যগুলো কল্পনা করতে পারেন। জীবন নাটকের যেসব দৃশ্যগুলো চলে স্বাভাবিক, সচল, মন্থর গতিতে তা যখন স্মৃতিতে চলে আসে তখন আনন্দের দৃশ্যগুলো কান্না তৈরি করতে পারে। ধরা যাক, ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজছে, বেহালার করুন সুর, বাশির তীব্র ব্যাথা জাগানিয়া চিক্কণ সুমধুর তান। তার মাঝখানে আমরা দৃশ্যগুলো সম্পাদানা করে নেই।
রাশেদ, একজন সহজ সাধারণ মানুষ। গান গাওয়ার চেষ্টা করছে হারমোনিয়ামে। সা রে গা মা…। না হচ্ছে না কিছুতেই। হেলেন শুধরে দেয়ার চেষ্টা করছে। বার বার ছুয়ে যাচ্ছে আঙুল, হেলেনের কাঁদ ঝুকে এসে স্পর্শ করছে রাশেদের কাঁদ, আর হৃদয় দুটি কাপছে ভালবাসার গহীনতম ঝড়ে। কিম্বা ব্যাকগ্রাউন্ডে পাহাড়ের স্তব্ধতা, বাতাসের হু হু রোমান্থন আর কটেজের ভিতর যৌনাবেগ কম্পমান দুটি নর-নারী। কিছুতেই বাধ মানতে চাইছে না রাশেদের অথচ প্রকৃতির হেয়ালীপনার এক সপ্তাহের মেয়েলি রক্তাক্ত অবস্থার প্রতিবন্ধকতা। অবশেষে গোছলে শুদ্ধ হয়ে প্রতীক্ষায় ছিল হেলেন। কোথা থেকে পাগলের মতো তুহিনের আগমন, উদভ্রান্ত প্রেম নিবেদন, শান্ত হয়ে ফিরে যাওয়া। হেলেনের দুজন প্রেমিক একজন তার স্বামী, আর একজন স্বামীর বন্ধু কেউ আর ফিরে এলো না দৃশ্যপটে….
এবং এখন যেহেতু নাটকের দৃশ্যপট বদলে গেছে, বিশ বছরে বাস্তব পৃথিবীতে ঘটে গেছে অনেক বিয়ে,মৃত্যু, জন্ম,,ধনী-গরীব, সুখী আর দু:খীদের পদচারনায় অত্যন্ত মন্থর গতিতে এগিয়ে গেছে, হেলেনের জীবনের নাটক থেমে ছিল বিশটি বছর, বিশ বছর পর আবার পর্দা উঠল মঞ্চের।
একজন সুন্দরী যে শহরের কন্ঠশিল্পী হিসাবে পরিচতি ছিল, এই আটত্রিশে এসে এখনও আকর্ষনীয় যৌনাবেদনময়ী, সুন্দরী রমনীকে গত বিশটি বছরের অনেক অযাচিত প্রশংসা শুনতে হয়েছে, অনেক আকারে ইঙ্গিতে গোপন লালসার কথা হজম করতে হয়েছে কিন্তু হেলেন শান্ত, স্থির আর হৃদয় নিংড়ানো প্রতীক্ষা করে কাটিয়ে দিয়েছে এতগুলো বছর।

৫. বাড়িটি তিন তলা। গ্রাউন্ড ফ্লোরে শো-রুম যার পিছনের দিকে সংযুক্ত সিড়ি দ্বারা দোতলা, যেখানে একটি বড় রুমে হেলেন থাকে। রুমখানিতে যে সব আসবাবপত্র আছে, যেমন বেড,ওয়ারড্রপ, ড্রেসিং টেবিল, রিডিং টেবিল সবই ব্যাচেলারের মতো একজনের, পরিচ্ছন্ন গুছানো। সিড়ি দিয়ে নেমে শো-রুম, কাউন্টারে বসা আর দিন শেষে উপরে চলে আসা, এই তার বিশ বছরের জীবন।
বহুপূর্ব হতেই তিন তলাটা ভাড়া দেয়া হতো। হেলেনের মা তাহমিনা খুবই খুতখুতে মহিলা, প্রায়ই ভাড়াটিয়া বদল হতে দেখা যায়। এবার তিন তলাটা যে ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছেন তিনি বর্তমানে বেশ আলোচিত, তার ম্যানেজার খবর দেন যে তার স্যার এখানে একটি সঙ্গীত একাডেমি খুলবেন। হেলেন বেশ আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটা খেয়াল করতে থাকে। কিন্তু যে দিন হেলেন প্রথম ভদ্রলোককে দেখল তার হৃদয়ের গহীনে একটা শির শিরে তীব্র শিহরণ বয়ে যেতে লাগল। ‘কি জানি কিসের লাগি’ তার এতটা উচ্ছ্বাস, বাধ ভাঙ্গা এক প্লাবনে তার সমস্ত অন্তরাত্মা কম্পিত হয়ে উঠল। আর যেদিন প্রথম তার সাথে কথা হলো ভদ্রলোকের চোখের চাহুনিতে কি ছিল কে জানে তার বারবার মনে হতে থাকল তার রাসেদ ফিরে এসেছে। তার হৃদয় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে, বারবার হেলেন বিশ বছর আগে ফিরে যেতে থাকলো। বারবার এই অনুভুতি ফিরে ফিরে আসতে লাগল আর ক্রমাগত তাড়নায় সে বিশ্বাস করতে শুরু করল, এ তার রাশেদ। সেই কন্ঠস্বর, সেই হাসি, সে চাহুনি , চোখের ভাষায় প্রকাশিত ভালবাসার সুষ্পষ্ট ছাপ যা কোন নারীর চোখ এড়াতে পারে না, তাকে এ বিশ্বাসের দিকে ক্রমাগত ছুটিয়ে নিয়ে গেল যে, গত বিশটি বছর সে একাকী নিভৃতে তারই প্রতীক্ষা করছিল।

৬. কিন্তু হেলেন কিছুই প্রকাশ করে নি। তার ভিতর ঘুমরে উঠেছিল অভিমান। একজন স্বামী যে কিনা বিশ বছরের জন্য কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল, ফিরে এলো কোথা থেকে, একবারও খুজ করে দেখল না। মানুষতো পায়ের সেন্ডেল হারিয়ে গেলেও খুজ করে, চুরুট জ্বালাবার জন্য ম্যাচ লাইট হারিয়ে গেলেও তার খুজ নেয়ার প্রয়োজন পরে। পরে না? কোথায় থাকবে অনুতাপ আর নম্রভাবে প্রত্যাবর্তন, হেলেনতো মাথার মুকুট করে রাখতে চায়। তাই সে তার জানাকে বা সন্দেহকে প্রকাশ করে নি।
এক সন্ধ্যায় ভদ্রলোক হেলেনের আফিস-কাম বেড রুমে আসে। অনুমতিতো মনে মনে আগেই দিয়ে রেখেছিল তারপর যখন ভদ্রলোক অনুমতি চাইল তখন হেলেন আর নিজের ভিতর থাকতে পারল না। ভদ্রলোক নিজের নাম প্রকাশ করে রাজিব খান বলে। তিনি অতিশয় আবেগ প্রবন হয়ে কথা বলছিলেন। তার কথাগুলো স্বার্গীয় আলোর মতো ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসছিল, একজন আবেগ প্রবন স্বপ্নাপ্লুত মানুষের হৃদয়ের গহীন উচ্চারণের মতো মনে হচ্ছিল তার কথা।
“কিন্তু তোমার উত্তর পাবার আগে” রাজিব খান বলছিল, “ আমাকে বলতেই হবে, রাজিব খান একটি নাম মাত্র যে তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব করছে। আমার ম্যানেজার এই নামটি দেয়। আমি জানি না কে আমি কোথা থেকে আমি এসেছি। প্রথম আমি চোখ মেলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করি। তারা আমাকে বলে আমার মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিলাম আমি। রাস্তার উপর পরে ছিলাম। তারা একটি এম্বুলেন্সে করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। হেই শোন আমি তোমার নাম জানি না, আমার কাছে তোমার নাম শুধু ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’। যখন প্রথম আমি তোমাকে দেখি তখনই আমি বুঝতে পারি, তুমিই একমাত্র নারী যে আমার জন্য সারা জীবন প্রতীক্ষা করে আছ , সারাজীবন….” এই জাতীয় আরো অনেক কথা।

৭. হেলেন পুনরায় নিজের ভিতর যৌবন ফিরে পায়। প্রথমত: একটি গর্বের দোলা এবং একটি রোমাঞ্চকর কম্পন তার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে বইতে থাকে। রাজিব খানকে সে এখন অন্য চোখে দেখতে থাকে এবং তার হৃদয়ের কম্পন, হৃদয়ে ধুকধুকানি শুনতে পায়। সে নিজেই বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করল যে এই মিউজিশিয়ান তার জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠছে যাকে কোন মতেই এড়াতে পারছে না। কিন্তু হেলেন তাকে প্রত্যাখ্যান করল যখন সে আত্মস্ত হতে পারল যে সে মনে প্রাণে ভাবছে এই তার রাসেল কিন্তু এ-তো তা নয়। সে বলল,“ রাজিব সাহেব, আমি সত্যিই দু:খিত, কিন্তু আমি তো বিবাহিতা।” সে নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার হতে চাইল। তারপর তার জীবনের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।
রাজিব সাহেব কিছুই বললেন না, ব্যথিত চিত্ত নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।

জীবনটা এমনই। যখন কোন ঘটনা ঘটে না তখন হয় পানসে ধীর গতি আর যখন নাটকীয়তা ভর করে জীবনে তখন একটা পর একটা নাটকীয়তা রচিত হতে থাকে। যখন সে নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে করতে রাজিব সাহেবের দিকে ঝুকে যাচ্ছিল এক উদভ্রান্ত আগুন্তুকের আগমন ঘটে। অস্থির চিত্ত নিয়ে হেলেনের পাশে এসে বসে, প্রর্থণার ভঙ্গিতে বলতে থাকে,“ হেলেন তুমি কি আমাকে মনে করতে পারো। তুমি কি গত বিশ বছরে একটি বারের জন্য তোমার ভালবাসাকে ভুলতে পেরেছে? আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি, আমি ভয়ে তোমার কাছে আসতে পারি নি। কিন্তু আমার ভালবাসা আমাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে এনেছে, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে?”
উত্তেজনায় হেলেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

৮. হেলেন তার দ্বি-খন্ডিত হৃদয়কে দেখতে পায়। এদিকে তার বিশুদ্ধ, ভুলতে না পারা, স্বামীর প্রতি গভীর অনুরাগ আর অন্যদিকে এতদিন পর রাজিব সাহেবের প্রতি তার গহীন ভালবাসা,এই দুইয়ের দ্বন্ধে হেলেন অস্থির হয়ে উঠে। যখন হেলেন দ্বিধাগ্রস্ত, পাশের ফ্লাট থেকে একটি মৃদু, বেদনাঘন, মন পাগল করা ভায়োলিনের সুর ভেসে আসে। এই গুঞ্জরন এই সম্ভ্রান্ত মহিলাকে ডাইনীতে রূপান্তরিত করে।
সেই সুর আর গায়ক তাকে ডাকতে থাকে যাদুকরের মতো। অন্যদিকে পুরানো ভালবাসা এতদিন পর এসে হাটু গেড়ে তার কাছে প্রর্থনা করতে থাকে।
“ আমাকে ক্ষমা করো” সে বলতে থাকে।
“দীর্ঘ বিশটি বছর কোথায় ছিল তোমার এত ভালবাসা যেই ভালবাসার দাবী নিয়ে এত কাঁদছো” হেলেন বলে।
“কিভাবে তোমাকে বলি?” সে করুণা ভিক্ষা করে আর বলতে থাকে,“ আমি তোমাকে কিছুই লুকাব না। সে সন্ধ্যায় আমি তাকে অনুসরণ করি। আমি পাগল আর ঈর্ষায় কাতর ছিলাম। পাহাড়ের উচু হতে সে নামছিল, যখন অন্ধাকার ঘনিয়ে আসছিল আমি তাকে ধাক্কা দেই। বিশ্বাস কর আমি তাকে মারতে চাই নি। আমি তোমার ভালবাসায় পাগল আর অন্ধ ছিলাম। আমি লুকিয়ে দেখেছি একটি এম্বুলেন্স তাকে নিয়ে চলে যায়। তারপর তাকে নানা হাসপাতালে আমি খুজেছি কোথায় ও পাই নি। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে?…..”
শেষ করতে পারে নি সে। হেলেন পাগলীনির মতো তাকে খামছে ধরে বলতে থাকে, “ কে তুই?”
“তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। হেলেন যে তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, সব সময়। আমি তুহিন। যদি তুমি আমাকে ক্ষমা করো…..”

৯. কিন্তু সে লাফিয়ে উড়ে উড়ে ছুটে যেতে থাকে আর আছড়ে পড়ে গানের দিকে, গায়কের দিকে যার স্মৃতিতে হেলেনের স্ত্রীরূপটি হারিয়ে গেছে কিন্তু যে তার উভয় সত্ত্বাতেই কেবল হেলেনকে জেনেছে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে..“ রাশেদ, রাশেদ, রাশেদ”

গল্পটি শেষ করে আমি আমার বন্ধু পত্রিকার রিপোর্টার কাম টিভি সিরিয়ালের কাহিনীকারকে দেখাই। সে বলতে থাকে “তোমার এই গল্পের চিত্রনাট্য দিয়ে কোন টিভি নাটক হয়ত হতে পারে না কিন্তু সিনেমা হতে পারে। গত এক’শ বছরে এ ধরনের কাহিনী নিয়ে বহু সিনেমা তৈরী হয়েছে, বাংলা, হিন্দি সহ নানা ভাষায়। তোমার এই গল্পটি তারই একটি পুনরাবৃত্তি বই কিছুই নয়। তবে তোমার গল্পের হাত ভাল, ভাষা চমৎকার, চেষ্টা চালিয়ে যাও, হয়ত কিছু ভাল গল্প তুমি লিখতে পারবে।”

গৃহপালিত শিক্ষক

গৃহপালিত শিক্ষক

আকাশ কালো মেঘে ডাকা। কয়েক দিন যাবত বর্ষণ চলছে। জলের ধারা বইছে অবিরল ধারায়। বাংলার বর্ষা এমন ঋতু সৌন্দর্য যার স্পষ্ট হয়ে উঠে সকলের কাছে। এ যেন যৌবনের সৌন্দর্য। ঝটপট গোসল করে নাও জলের ধারায়, উদ্দম গতিতে ছুটে চলো যেখানে মৃত্যু এসে হানা দিয়েছে নানা রূপে তাকে ভিজিয়ে দাও, সৃষ্টিশীলতার উদ্দমতা দেখতে পাও। এই তো বর্ষা, এইতো যৌবন। এখানে রূপের চর্চা করতে হয় না কৌটা কৌটা কুয়াশার প্রসাধনে।

সদ্য ভিজা প্রকৃতির মতো লাবন্যতা আফসানার ত্বকে, রঙটা শ্যামলা, উজ্জল শ্যাম যাকে বলা যায়। কৃশকায় মেয়েরা প্রসাদনের প্রলেপে নিজেকে যেভাবে পন্যের বিজ্ঞাপনের মডেলদের মতো বানিজ্যিক আবয়বে গড়ে তুলে আফসানা সেভাবে সাজে না কখনো, একটু মোটা বলা যায়, গোলগাল, হাসলে চমৎকার টোল পরে গালে। একটু আগে পরিচ্ছন্ন হয়েছে, কোন প্রসাদনী মাখেনি চেহারায়, যেন ভিজা কচু পাতার টলটলে পবিত্রতা ফুটে উঠেছে সারা অঙ্গ জুড়ে। লম্বা ঘন কালো চুলে ফিতার বন্ধনের শৃঙ্খলা টেনে দেয়নি, চিরুনীর আচড়ে পরিপাটি করে ছেড়ে দিয়েছে পিঠের উপর। বাইরের প্রকৃতির এক অনবদ্য সংস্করণ হয়ে বসে আছে স্থির। বাইরে যে কেউ দেখলে হয়ত ভাববে একটানা বর্ষনের পর সৌম্য প্রকৃতির মতো শান্ত সে কিন্তু তার হৃদয়ে বয়ে চলছে অস্থিরতা। সন্ধ্যার পর এই সময়টাতে এই অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসে। দেয়াল ঘড়িটার দিকে কিছুক্ষণ পর পর তাকায় যেন সেকেন্ডের কাটাটা মিনিটের কাটা হয়ে যায়। ঠিক সাতটয় স্যার আসবেন, সময় যায় সে তো আর আসে না।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল জ্যামিতি পাঠ নিতে গিয়ে। জ্যামিতির সম্পাদ্য আকার সময় একটু ছুয়ে যায় হাত স্যারের হাতে, একটা বিদ্যুত তরঙ্গ বয়ে চলে, সরিয়ে নেয় না আফসানা। আর স্যারটাও হঠাৎ সম্পাদ্য শিখানোর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে প্রবল ভাবে। একদিন এমনি ছল করে হাত ছুতে ছুতে ধরে রাখে আফসানার হাত।

এক শীত সন্ধ্যায় ঘটে এমনি ক্ষুদ্র আর একটি ঘটনা। ফ্লোরটা ঠান্ডা ছিল। পা দু’টি কোথায় রাখবে খুজে পায় না আফসানা। টেবিলের নিচে আর একজোড়া পা ছিল স্থির। পা দুটি রাখতে রাখতে সেই পায়ের উপর গিয়ে পড়ে, গরম, শীত প্রতিরোধক। সরিয়ে নেয় না পা গরম পা দুটি। এভাবে দুটি দেহের প্রধান কিছু অংশ পরস্পরকে উত্তাপ দিতে থাকে।

ন্ধদয় কি কিছু হয়েছিল বিনিময়? আফসানা জানে না। শুধু এক একটা দুপুর আসে কখনও, আব্বু অফিসে যান, আর আম্মু থাকেন আহার পরবর্তী নিদ্রায় আর ছোট ভাইটা থাকে কোন মাঠে খেলায় মগ্ন , সেই সব নিরব সময়ে তার রবীন্দ্র সংগীত বড় ভালো লাগে আর তার স্যারকে বড় দেখতে ইচ্ছা করে, বড় দেখতে ইচ্ছা করে। এইসব ভালো লাগা আর হৃদয়ের অস্থিরতাগুলো সযতনে লুকিয়ে রাখে আফসানা। কিন্তু সেই কোন দুরে সমুদ্রে বয় লঘু চাপ আর তার প্রভাবে ঝড়ের তান্ডবে মেতে উঠে সমস্ত তীরাঞ্চল তেমনি আফসানার হৃদয়ের অবস্থাটা লুকিয়ে রাখতে পারে না কামরুন আন্টির কাছে। ঠিক টের পেয়ে যান।

এই আন্টি পান খেয়ে ঠোট লাল করে রাখেন না, বয়সের প্রভেদটাও আফসানার চেয়ে খুব বেশী নয়, আফসানার বান্ধবী সমতুল্য, বুঝতে পারে আফসানা একটা অস্থিরতার ভিতর দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। তিনি টের পান একটা হৃদয় ঘটিত কুয়াশা তাকে ঢেকে রেখেছে, তিনি ভুমিকা নেন সুর্য্যের তাপের। হায় সূর্য্য! কখনো কখনো তুমি নাও খল নায়কের ভুমিকা। কুয়াশার মায়ায় যখন সারা প্রকৃতি মোহাচ্ছন্ন তখন তোমার তাপে কেটে দাও সেই সব মোহগ্রস্থতা।

একদিন আকাশে চাঁদ উঠেছে বাহারী। আর বাতাস বইছিল মৃদুমন্দ। আন্টি আফসানকে নিয়ে যান ছাদে। বলেন: ভালোবাসিস কাউকে? আমাকে লুকাবি কি? বলে রাখি পস্তাবি বহুত। এইসব গৃহ পালিত শিক্ষকদের তো চিনি, টিউশনি করতে এসে পটিয়ে ফেলে ছাত্রীকে, তারপর ! তারপর ? বল, তোর বাপকি রাজি হবে, হবে না । পালিয়ে যাবি? কোন দিন কি সে দিতে পারবে তোর মতো মেয়ের যথার্থ মর্যদা। পরবে না। কোন দিন পারবে না।
আফসানা কোন উত্তর দেয় নি, আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাসভাবে শুধু বলেছিল- কেন তার জীবনটা এমন হলো? একজন গৃহপালিত শিক্ষক যে মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, মিশতে পারে না, জোর করে দখল নিতে পারে না তার জন্য কেন সে এতটা কান্না কাঁদবে। কিছু না শুধু একবার হাত ধরতে চয়েছিল সে, আফসানা সরিয়ে নিয়েছিল। কি বুঝেছিল, এর পর আর একটি বারের জন্য আসেনি পড়াতে। বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছিল আফসানা , জানতে পায় সে চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, কোন যোগাযোগ আর রাখলো না।

এক একবার মনে হয় হলে গিয়ে উঠবে সে, কি অবাক হবে, হাত বাড়িয়ে বলবে , ধরো হাত হে আমার গৃহপালিত শিক্ষক, সারাজীবনের জন্য ধরে রেখো, পারবে তো? পরক্ষনে আবার ভাবে থাক না হৃদয়ের ভিতর কিছু ক্ষত আজন্মের, মাঝে মাঝে খুটিয়ে খুটিয়ে বেদনা জাগিয়ে তুলবে আর প্রাণ ভরে কাঁদবে একাকী নিভৃতে।

গোল-কিপার নম্বার টু

গোল-কিপার নম্বার টু
ফকির আবদুল মালেক

হেমন্তের বিকেল। নরম রোদ পৌঢ়া বিধবার হৃদয়ের মত ম্লান। নদীর ওপারে চরে কাশফুলের মেলা। সাদা সাদা আরো সাদা। বাতাস বইয়ে নিয়ে আসে কাশফুলের পেলব কেশর এই পারেও। শহরের ব্যস্ততার মাঝে এইসব ঋতুময় চিহ্নগুলো হারিয়ে যায়। কেউ তার খোঁজ রাখে না। তবু প্রকৃতি তার উপস্থিতির সংকেত পাঠায়। বাতাস তেমনি এক আবহ নিয়ে আসে শীতের । একটা ঠান্ডার আমেজে দেহে নিয়ে আসে প্রফুল্ল আমোদ। নদীর পাড়ে বেড়াতে আসা মানুষগুলি আনন্দিত হয়, বিনোদিত হয় ।

এরই মাঝে ব্যবসা চলে। কত ধরনের জীবিকা যে মানুষ গ্রহন করে ! ক্যানভাসাররা নানা রকম পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে আসে অভিনব পন্থায়। প্রথমে সাপের খেলা। ও বিধির কি….হইল……. । বীণ বাজে……..। তারপর লোক জড়ো হলে তাদের নানা রকম তাবিজ বিক্রির পায়তারা চালায়। এমনি একটা জটলা জমেছে নদীর পার ঘেষা ফাঁকা প্রান্তরে। বড় বড় মানুষের ভিড় ঠেলে সামনের দিকে চলে আসে বার-তোর বছরের এক বালক। তন্ময় হয়ে সাপ খেলা দেখতে থাকে।

ছেলেটির নাম শাওন। স্বাভাবিক আচরন করে না সে। এই বয়সে একজন ছেলে হবে চটপটে, দুরন্ত- সে তা নয়, অন্যের সাথে মিশতে পারে না। সামাজিক আচরণগত সমস্যা আছে তার। অন্য যতগুলো বালক এই জটলায় দাড়িয়ে আছে তারা খুব মজা পাচ্ছে । শাওনা পাচ্ছে না। একাগ্র চিত্তে সে খেয়াল করছে ক্যানভাসারের বক্তব্য। লোকটি বলে যাচ্ছে তার হাতে যে শিকড় আছে তা এক ধরনের দুর্লভ বনজ গাছের শিকড়। যে কোন বিষাক্ত সাপের সামনে ধরলেই সে সাপ দৌড়ে পালায়। সাপের সামনে শিকড়টি ধরতেই সাপটি উল্টোদিকে দৌড়ে পালালো।
শাওন খুব মনোযোগের সঙ্গে পুরো ব্যাপরটি লক্ষ্য করছিল। বীন বাজাবার সময় সাপ টা যে দিকে বীন যায় সে দিকে নড়ে উঠছে তার সামনের দিকে গেলেই ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ শাওন বলে উঠলো, সাপগুলোর সামনে যে কোন লতা ধরলেই পালাবে। কোত্থেকে জানল সে? বলতে পারে না। গভীরভাবে সে যখন কোন কিছুর প্রতি মনোযোগ দেয় তখন তার নিকট সব কিছু কেমন যেন পরিস্কার হয়ে ওঠে। কোন রহস্যই প্রকৃত ঘটনাকে ঢেকে রাখতে পারে না।

সাপুড়ে ক্ষেপে গেল। তাকে আহ্বান জানালো যে কোন লতা নিয়ে সাপের সামনে আসতে।
কোন দিকে খেয়াল করল না শাওন, সে কিছু দেখতেও পারল না তার চারপাশের পরিবেশ। একটা শুকনো লতা নিয়ে সাপের সামনে ধরতেই সাপটা পালাল। মজমায় একটা শোরগোল বেঁধে গেল। জমজমাট এই লোক সমাগম মুহুর্তে খালি হয়ে গেল।

সাপুড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার চল্লিশ বছরের ব্যবসার জীবনে এধরনের ধাক্কা সে খায় নি কখনো। শাওন তার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ সাপুড়ে গুরু বলে তাকে প্রনাম করতে এলো । বিস্ময়ের ধাক্কাটা সমালাতে পারলো না শাওন। দৌড়ে পালাল। দে দৌড়… দে দৌড়…।

হাপাতে হাপাতে সে খেলার মাঠের দিকে চলে এলো । তার স্কুলের ফুটবল টীম প্রেকটিস করছে। শওকত স্যার তাদের নানা ধরনের কৌশল দেখাচ্ছেন। ফুটবল টুর্ণামেন্ট চলছে। জমজমাট আয়োজন। কতদিন শাওন মনে মনে ভেবেছে সে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বল নিয়ে, সমস্ত দর্শক হৈ হৈ করে উঠছে। একজন, দুজনকে কাটিয়ে গোলপোষ্টে কিক, চারিদিকে হৈ হৈ আওয়াজ গোল… গো…..ল………। এমনই ভাবুক হয় সে মাঝে মাঝে।

তাদের স্কুলের সেরা স্ট্রাইকার রাইসুল তার প্রিয় খেলুয়াড়। শুধু তার একার নয়, পুরো টুর্নামেন্টেরই সে সেরা খেলুয়াড়। একটার পর একটা গোল করে তাদের স্কুলের সম্মান বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাইসুল শাওনকে খুব আদর করে। কারো সাথে মিশতে না পারা শাওনকে রাইসুল প্রায়ই কাছে ডাকে। আজকেও রাইসুলই দেখলো তাকে। দেখেই হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। স্যারের সাথে কি পরামর্শ করল।
স্যার বললেন: খেলবে?
কোন কথা বলল না সে , মাথা নুইয়ে ইঙ্গিতে বললো- হ্যাঁ।

তার কি যে আনন্দ লাগছে তা কাউকে বুঝাতে পারবে না সে। তাকে বলা হলো গোল কিপারে দাড়াতে। আসলে ব্যাপার হলো তাদের সেরা একাদশে যে গোল-কিপার আছে প্র্যাকটিসের সময় সে তো আছেই কিন্তু দুই নম্বার গোল কিপারের জ্বর । কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না তাই তাকে প্রক্সি দিতে ডাকা হলো। শাওন মহা খুশি । প্র্যাকটিসের সময় দুই দলে ভাগ করে খেলা হয়। রাইসুলের দলে থাকতে চাইল সে কিন্তু তাকে দেয়া হলো রাইসুলের বিপরীত দলে। এবং মজার ব্যাপার এই যে রাইসুলের কয়েকটি কড়া শট ফিরিয়ে দিয়ে স্যারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে ফেললো।

প্রতিদিন প্র্যাকটিসে যায় শাওন কিন্তু টুর্ণামেন্টের কোন খেলায়ই চান্স পায় না। তাদের স্কুল দুর্দান্ত সফলাতা পেয়ে ফাইনালে উঠে গেল। রাইসুল একক ভাবে পুরো টুর্ণামেন্টে বারটি গোল করে বিশাল স্টার হয়ে উঠেছে। শাওন মনের ভাবাকে কখনও কাউকে বলতে পারেনি। তবু একদিন বলল-রাইসুল ভাই আমাকে একদিনও চান্স দিলেন ন। রাইসুল বলল- প্রতিদিন প্র্যাকটিশ কর- সুযোগ এলেই দলে নিব।

তারপর একদিন সুযোগ এলো, সে আবার ফাইনালের দিন। সেমি-ফাইনালের দিন প্রথম গোল-কিপার জাম্প করতে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেয়েও খেলা শেষ করেছে বটে কিন্তু আজ ফাইনালের দিন কিছুতেই হাত নাড়তে পারছে না। ডাক পড়ল শাওনের। কি যে উত্তেজনা তার হৃদয়ে বইয়ে যাচ্ছে কাউকে বোঝাতে পারবে না সে। কিন্তু স্কুলের সব কর্মকর্তা বিশেষ করে শওকত স্যারের মনটা ভীষন খারাপ। পুরো টুর্ণামেন্ট অসম্ভব ভালো খেয়ে যে গোল-কিপার সেরা খেলোয়াড় হওয়ার জন্য রাইসুলের সাথে প্রতিযোগীতা করছে সে-ই গোল-কিপার ছাড়া গুরত্বপূর্ণ ফাইনাল কিভাবে সম্ভব?

শুধু একজন। সে রাইসুল। সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে। কাঁধে হাত রেখে শুধু বলল- শাওন এই খেলাটা শুধু খেলা নয়। এটা আমাদের স্কুলের সম্মান। শাওন একফোটা চিন্তিত হলো না। দাড়িয়ে গেল। যে ভাবেই হোক স্কুলের সম্মান তাকে রাখতেই হবে। যে ভাবেই হোক রাইসুল ভাইকে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পুরস্কারটা এনে দিতেই হবে।
খেলা শুরু হলো। দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলছে খেলা।

রাইসুল, কাজল, স্বপন তিনজন ফরোয়ার্ড। ছোট ছোট পাসে খেলা শুরু করল। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই রাইসুলের দেয়া গোলে এগিয়ে গেল শাওনদের স্কুল। চারিদিকে হৈ হৈ , চিৎকার চেচামেচি। কিন্তু এরপর প্রতিপক্ষ নিয়েছে এক কৌশল- যখনই রাইসুল বল ধরতে গেছে পেছন থেকে কিম্বা সামনে থেকে ফাউল করে ফেলে দিচ্ছে। কাজল মাঝে মাঝে টান দিয়ে নিয়ে গেছে বটে কিন্তু কিছুতেই আর গোলের দেখা পাচ্ছে না। হঠাৎ প্রতিপক্ষ দু চারটা শট নিয়েছে, বেশীর ভাগ সটই গোলবারের উপর দিয়ে গেলেও শাওন রক্ষা করেছে কমপক্ষে একটি নিশ্চিত গোল। দর্শকের এদিকে খেয়াল থাকার কথা নয়। তারা গোল চায়। রাইসুল বল পায়ে পেলেই চিৎকার করে উঠে। প্রথমার্ধ শেষ হয় ১-০ গোলে।

বিরতির পর খেলা যেন পাল্টে গেল। রাইসুল আর দাড়াতেই পারছে না। বল কেবল শাওনদের সীমানাতেই গড়াগড়ি করতে থাকে। হঠাৎ প্রতিপক্ষের দুর্দান্ত আক্রমনে গোল খেয়ে ফেলে শাওন। পিছন থেকে সকলে হতাশ। ১-১ গোলে খেলা শেষ। আতিরিক্ত সময়ে আর কেউ গোল করতে পারেনি।

খেলা চলে গেল টাইব্রেকারে।
শাওনের দল প্রথমে শট নিলো। গোল । ১-০ গোলে এগিয়ে গেল তারা।
এবার শাওনের পালা।
শাওন দাড়িয়ে আছে বারে। । গোল। ১-১ এ সমতা।
এবার রাইসুল শট নিতে যাবে। সকলে প্রস্তুত । বারের উপর দিয়ে চলে গেল। গোল থেকে গেল ১-১ ।
মাঠে পিন পতন নিস্তব্ধতা। এবার শাওন দাড়িয়ে আছে বারে। বল চলে গেল বারের উপর দিয়ে। ১-১।
এভাবে চলতে চলতে খেলা চলে এলো এক চরম উত্তেজনা কর পরিস্থিতিতে। শাওনের দল ৩-২ গোলে এগিয়ে । প্রতিপক্ষের সর্বশেষ শট নিতে প্রস্তুত । মাত্র একটি শট ফিরিয়ে দিতে পারলেই জয় পাবে শাওনেরা।

দাড়িয়ে আছে শাওন। পৃথিবীর কোন দিকে তার কোন খেয়াল নেই। সমস্ত দৃষ্টি বলের দিকে। রাইসুল এসে বলল তোমার উপর সব নির্ভর করছে আমাদের জয়-পরাজয়। বারবার শওনের মনে হতে লাগল রাইসুলের ভালোবাসার কথা আর স্কুলের সম্মান এখন তার হাতে। ছুটে আসছে প্রতিপক্ষের সবচেয়ে কৌশলী খেলোয়াড়। ডজ্ দিতে তার জুড়ি নেই। মনে হচ্ছে ডানদিকে সট নিবে, কিন্তু নিলো ঠিক বাম দিকে ক্রশবারের বরাবর। শাওন খোলোড়ারের কৌশলে বিভ্রান্ত হলো না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বলের দিকে। রাইসুলের প্রতি ভালবাসার মুল্য দিতে আর স্কুলের সম্মান বাঁচাতে সে জানবাজি রেখে জাম্প করল। বল হাওয়ায় উড়ছে, শাওন উড়ছে। হঠাৎ থমকে গেল বলের গতি, জমে গেল শাওনের হাতে।
হৈ হৈ চিৎকারে মাঠ কেঁপে উঠলো। শওকত স্যার দৌড়ে এলো শাওনের দিকে, আনন্দে কাঁধে তুলে নিলেন। কাঁধে চড়ে শাওন খেয়াল করল, রাইসুলের চোখ চকচক করছে বিজয়ের আনন্দে।

ভালোবাসর কাছে হেরে গেল প্রতিপক্ষের সমস্ত কৌশল।

বিরোধ

বিরোধ

আমি যখন গ্রামের পথ ধরে হাটছি তখন প্রায় সন্ধ্যা।
একটু আনমনা হয়ে পথ হাঁটছিলাম।
: কি মিয়া আছো কেমন?
তাকিয়ে দেখি দাদার এক শিষ্য। মাহফিল উপলক্ষ্যে প্রতি বছর এই সময়টাতে সকলে এসে জড়ো হয়।
ঃ ভাল… আপনি?
ঃ গতিক ভালা ঠেকতাছে না। বুঝলা মিয়া। খবর পাইলাম এইবার সব পেন্ডেল ভাঙ্গা হবে। আমরা দুর দুরান্ত থেকে তোমাগো এলাকায় আহি। এইবার দেহি বিপদে পইরা যাইব। তুমি আইয়া পড়ছো , মনে একটু শক্তি পাই। যাও ফকির সাবকে বড় অস্থির দেইখা আইলাম। তোমার কথা বারবার জিগাইতেছিল।
গ্রামের এই পশ্চিম দিকটার খোলা মাঠে আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। পেন্ডেল টানানো হয়েছে। মঞ্চ তৈরী হয়েছে। প্রতি বছর এখানে মারফতী আর বাউল গানের উৎসব চলে । সকাল থেকে শুরু হয় ভোজের আয়োজন। ডেকের পর ডেক খিচুরি রান্না হয়। ছন্নছাড়া, ভিক্ষুক, ভবঘুরের দল পেট পুরে খায়। সাথে বাউল আর ফকিরের দল। গ্রামের মধ্যে পড়ে যায় উৎসবের সাজ সাজ রব। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দাদার শিষ্যরা আসেন। রাতে গানে গানে মেতে ওঠে সকলে। শেষ রাতে দাদার সুর মূর্ছুনায় মাতাল থাকে সমস্ত অর্ডিয়েন্স।

বাড়ির উঠানে পা দিতেই টের পাই, একটা চাপা উত্তেজনা। কয়েকজন আমাকে ঘিরে ধরলো,ি
বলল: শুন মিয়া এর একটা বিহিত করতে হবে।
: এবার রক্তারক্তি হইয়া যাইবো। আমরা পিছপা হবো না।

আমি চুপ করে থাকি। দাদার ঘরের দিকে পা বাড়াই।
চোখ বুজে আছেন ফকির সাহেব। শান্ত চেহারা। উত্তেজনার লেশ মাত্র তাঁর মুখবায়বে পড়ে নি। আমি পায়ের কাছে বসি ।

আফসার উদ্দিন ফকির। সকলে আছু ফকির বলে ডাকে। মাটি থেকে উঠে আসা এক সাধক পুরুষ। তার পূর্বপুরুষ সামর্থবান গৃহস্থ ছিলেন। গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু- এই প্রবাদের তারা ছিলেন স্বার্থক চিত্ররূপ। বালক বেলা থেকে ফকির ছিলেন উদাসীন। ভাইয়েরা জমিতে লাঙ্গল নিয়ে করতো চাষের আয়োজন, পিছন থেকে পালিয়ে ফকির চলে যেতেন গানের আয়োজনে। শাস্ত্রীয় কোন গান বাজনা নয় , মাটির গান, সহজ সরল তার কথা আর সুর । আবাল্য থেকেছেন গানের সাথে মিশে । যৌবনে এসে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি কখনো এব্যাপারে কথা বলেননি। শুনেছি তাঁর শিষ্যদের কাছ থেকে। বছুরউদ্দিন মুন্সি নামে এক কামেল ফকির তার সমস্ত সত্তা কেড়ে নেন। মারফতের গোপন সাধনার দীক্ষা নেন। সমস্ত জীবন এই সাধনায় কাটিয়ে দিবার ব্রত নেন। কিন্তু একদিন মুন্সি বললেন- আছু বাড়ি যা সংসার কর, সংসার তোরে ডাক দিয়েছে। তারই ফলশ্র“তিতে আমার পিতা আসেন পৃথিবীতে। এপর্যায়ে কিছুকাল গৃহস্তিতে মন দেন। কিন্তু গানের নেশা ছাড়তে পারেন নি। আস্তে আস্তে তার ভক্ত বাড়তে লাগলো। সারাদিন ভক্তদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। রাতে চলে গভীর সাধনা, একে একে রচনা করতে থাকলেন গানের পর গান।

আমার পিতার রক্তে তার রক্ত যেন বইল না। তিনি বিষয়ী লোক । ব্যবসাটা বুঝে নিয়েছিলেন খুবই ভাল। ক্রমে ক্রমে তার সহায় সম্পত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকলো । আর সব ধনীদের মতো তিনিও আমাদের নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে পারি দেন। সেই সব অনেক দিন আগের কথা।

চোখ মেলে তাকালেন ফকির। আমাকে দেখে বললেন-
ঃ ভ্রমনের কান্তি তোমার চোখে মুখে। হাত মুখ ধোও , খাওয়া দাওয়া সারো। কথা আছে।
ঃ আমি তেমন ক্লান্ত নই। চারিদিকে একটা চাপা উত্তেজনা। যে কোন সময় একটা হুলস্থুল লেগে যেতে পারে! দৃঢ় ভাবে এটা থামানো দরকার। আমরা এর দায় ভার নিতে পারি না।

ফকির পূর্ববৎ স্থির হয়ে আছেন। তবে আমি ল্ক্ষ্য করলাম তারচেহারায় বিষাদের ছায়া। অন্তরের গভীর ভালোবাসার জায়গায় আঘাতে আহত হলে মানুষের দু:খ-মিশ্রিত ভাবাবেগে একধরনের প্রতিবাদ জন্ম লয়, তেমনি এক গহীন উচ্চারণে ফকির বললেন-
ঃ গান করে কি গভীর অপরাধ করেছি? বলো কবি, আমার কবি, তুমি যে কবিতা লিখ সেখানে কি তাল, ছন্দ নেই? ঐ যে পাখি ডাকে, হু হু বাতাস বহে সেখানে কি সুর তুমি খুজে পাও না ? আমি তো এদেশের মাটির সন্তান, বর্ষকালে ভেজা মাটির বুকে হেটে যাই একা একা , কান পেতে শুনি , সৃষ্টির উন্মাদনা তার পরতে পরতে, আমি হাটি আর মাটি তার রহস্যের পর্দা খুলে দেয়, আমি মুগ্ধ হই, দুলতে থাকি প্রকৃতির ছন্দে , বাতাস এসে সুর দিয়ে যায়, আমি শুধু আমার ছন্দে তাদের কথা বলি। বলো কি আমার অপরাধ? কেন তারা আমার এই মিলন মেলা ভেঙে দিবে? গান অপরাধ! এই যে লেংটা পোলাপান পেট পুরে খায়, তার কি কোন মূল্য নেই?
নিশ্চুপ থাকি আমি।
ঃ ঐ যে বেটারা আমাদের হুমকি ধমকি দিতাছে, আমি এর জবাব দিতে পারি , দাতভাঙ্গা জবাব। আমি তার জবাব দিব না। জবাব দিবে তুমি , তোমার মতো করে।

বলে হাতের ইশারায় সকলকে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন। শুধু আমি আর ফকির। জানালার পাশ দিয়ে পূর্নিমার চাঁদ এসে উঁকি মারলো। জোৎস্নার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত প্রাঙ্গন। রূপালী আলোতে মায়ার পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল আমাদের। জানালাটা বন্ধ করার ইশারা পেয়ে আমি জানালাটা বন্ধ করে দেই। একটা থমথমে নিথর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অন্ধকারে মনে হলো ফকির তার চোখ বন্ধ করে আছেন। আমি কোন শব্দ উচ্চারণ করলাম না।

হঠাৎ যেন এক আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ দূর থেকে ডাক পাঠালো আমাকে ।
বললেন: কাছে এসো।
আমি কাছে গেলাম।
বললেন: চোখ বন্ধ করো।
চোখ বন্ধ করলাম। হঠাৎ বুক জুড়ে এক বাহুবন্ধনের মর্মস্পর্শী চাপ অনুভব করলাম। এ কেমন অনুভুতি আমি এর কোন ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারব না। আমি আমাতে থাকতে পারছি না। আমার সমস্ত আমি ক্রমাগত লীন হতে থাকলাম। লীন হতে হতে আমি মিশে যেতে থাকলাম সমস্ত প্রকৃতির সাথে। এই পাড়াগাঁ, শহর , বন্দর, দেশ, মহাদেশ হতে হতে আমি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরের সমস্ত অস্তিত্বের সাথে মিশে যেতে থাকলাম। নিজেকে বড়ই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হতে থাকলো। যেন আমি বিন্দুর বিলিয়াংশের চেয়ে ক্ষুদ্র এক অস্তিত্ব। সমগ্র ইতিহাস মানুষের-প্রগতি আর যুদ্ধকে শুন্য মনে হলো। মানুষের সমস্ত বিজয় মুহুর্তের মধ্যে এতটা নগন্য মনে হতে থাকলো যেন গো-খুড়ের আঘাতাক্রান্ত ধূলি। তারপর আমি মিশে যেতে থাকলাম সমস্ত প্রকৃতির সাথে। একফোটা জল যেমন সমুদ্রের অংশ তেমনি আমি নিজের মাঝে উপলব্ধি করতে লাগলাম সমস্ত প্রকৃতিকে। এক অভাবনীয় ক্ষমতা উপলব্ধি করলাম নিজের মাঝে।
বাহু বন্ধন শিথিল হয়ে এলো। আমি থমকে দাঁড়ালাম। সমস্ত শরীর থরো থরো কম্পমান।
আমি পুরোপুরি হিপনোটাইজ হয়ে গেলাম। ক্ষণে ক্ষণে নানা অনুভূতি আমার মাধ্যে উৎঘাটিত হতে থাকলো। আর সব অনুভূতিকে ছাপিয়ে আমার একটি কথা বারবার মনে হতে থাকলো আজকের এই যে হামলা তা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত লোক-সংস্কৃতির যে ধারা বহমান এ হামলা তার স্রোতকে থমকে দিবার প্রাথমিক পদক্ষেপ। এ হামলা পরিকল্পিত কিনা তা বুঝতে না পারলেও তা প্রতিহত করার এক ব্যাপক তাগিদ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে থাকলাম।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। উঠান জুড়ে লোকে লোকারন্য। বুঝতে পারি একটা সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় দন্ডায়মান সকলে। মহিলারা হলুদ , মরিচ, পেয়াজ-রসুন বাটা স্থগিত করে দিয়েছে। বিশাল আয়োজন হয় প্রতিবছর। এবারও তার সমস্ত প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে আনা হয়েছিল। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সকলেই স্তম্ভিত।
আমি ইশারা দিতেই সকল মহিলারা আপন আপন কাজ শুরু করে দিল। সারারাত ধরে চলবে এসব প্রস্তুতি পর্ব। শেষ রাতের দিকে লাকড়ির চুলায় রান্না শুরু হবে। আমার ইশারায় স্থগিত হয়ে যাওয়া সকল কর্মকান্ড পুনরায় শুরু হয়ে গেল।

একা একা হাটতে হাটতে আমি পুবের ক্ষেতের দিকে চলে এলাম । জোৎস্নার প্লাবনে থই থই করছে সমস্ত প্রান্তর আর আমার বুক জুড়ে চলছে সুর্যের অন্তর্গত বিস্ফোরনের অগ্নিবান। নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রন রাখতে পারছি না। হেলোসিনেসন হচ্ছে হয়তো। একটার পর একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি-

একটা বিকট আওয়াজ। ছিন্নভিন্ন মানুষের দেহাংশ, এবরো থেবরো এখানে সেখানে কাঁপছে । ছোপ ছোপ রক্ত। এলোপাথারি ছুটাছুটি, কান্নার আহাজরী।

লাঠির আঘাতে আহত একজন যুবক। আর একটি, আর একটি। পতন। এক,দুই, তিন অসংখ্য আঘাত। রক্ত, নিথর দেহ। লাশের উপর মানুষের উল্লাস।

পাথরের তৈরী মূর্তিতে দড়ি দিয়ে বেধে টান। টান মারো টান, হইয়ো…… । পাথরের তৈরী খন্ডিত একতারা। মুখমন্ডল খানি যেন ফকিরের, দাড়িওয়ালা, মাথায় পাগড়ী।

না , না বলে চিৎকার করতে করতে দৌঁড়াতে শুরু করি। সরাসরি ফকিরের পা আকড়ে ধরি। কাঁপতে কাঁপতে বলি- আমার ভিতর থেকে সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তিকে তুলে নিন। আমি কিছুই দেখতে চাই না। আমি কিছু দেখতে চাই না।

আরেক পূর্ণিমা

আরেক পূর্ণিমা
১.
রহিম শেখর ব্যবসাটা পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। সম্প্রসারিত ব্যবসার কর্ণধার হয়ে ওঠা বংশানুক্রমিকভাবে। যখন লাভজনক, মহা আনন্দ। ইয়ার বন্ধুদের আড্ডায় সময় কাটানো, জুয়া খেলায় প্রচন্ড ঝুকি নেয়া। গাজা আর মদের নেশার সাথে মেয়ে মানুষের দোষও আছে তার। কিন্তু এখন খারাপ সময়! পাঁচটা ইটের খোলায় উৎপাদিত ইটে বিশাল লোকসানের আশংকা দেখা দিয়েছে। ইটের কোয়ালিটির কারণে যে সব পার্টি থেকে সে এডভান্স নিয়েছে তারাও ইটের ডেলিভারী নিতে চাইছে না। একটি বিশাল লোকসানের আশংকায় রহিম শেখ অস্থির হয়ে আছে।

পীর ফকিরের দোয়া সে কম নেয় নি। পানি পড়া, তাবিজ কবজ দিয়েছে বহুত। আজকে সে ফকির বাবার কাছে এসেছে একটা হেস্ত নেস্ত করতে । রহিম শেখ কোন ধর্মীয় বা আত্মাতিকতার খুজে এখানে আসে না, এখানে আসে বৈষয়িক লাভের আশায়। কিন্তু আজকে ফকির বাবা যা বললেন তাতে রহিম শেখ কেঁপে উঠল। সে সিগারেটের প্যাকেটে হাত দিল। আছে, সিগারেটের সাথে একটাঁ বোঁচা সিগারেটও আছে। সিগারেটের ছুক্কায় গাজা মিশিয়ে খালি ঠোসের ভিতর ভরে রাখে। তারই একটি বের করে কষে দুটি টান দিল সে। আরো কয়েকটি। মাথাটা পরিস্কার হয়ে গেল।

সস্তা নেশা গাজা। মদ, ফেনসিডিলের নেশা করলেও গাজাকে সে ত্যাগ করতে পারেনি। আরো কয়েকটি জোড়ে টান দিল। ফকিরের আখড়া থেকে বের হয়ে তার গাড়ীর দিকে যেতে যেতে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল শেষ চেষ্টাটা সে করবেই।
পুরানো মডেলের গাড়ীটি সে বদলাতে পারে নি। কতদিন সে ভেবেছে এই মওসুমটা শেষ হলেই নতুন মডেলের গাড়ি কিনবে কিন্তু দিন যায়, গাড়ী পুরানো হয়, নতুন মডেল আর আসে না। এবার হবে, পীর বাবার শেষ চেষ্টায় এবার হবে। সে হাটতে হাটতে গাড়ীতে উঠল।
ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল ’’ কোন দিকে যাব, স্যার”
রহিম শেখ শুধু বলল- জাহান্নামে…
স্যারের এই গতিবিধি ড্রাইভারের চেনা। সে গাড়ীতে ষ্ট্রাট দিল।
২.
একটা ঘুঘু একটানা ডেকে যাচ্ছে হিজল গাছটার ডালে। হাম্বা হাম্বা স্বরে গরু যাচ্ছে মাঠে কৃষাণের পাজনের তাগাদায়। স্বামীর ঘরহারা এক মেয়ে নিচু জমিটাতে রঙিন সুতা শুকাচ্ছে। এটা তাতী এলাকা। বান্ডিল বান্ডিল সুতা এখানে হাতে রঙ করা হয়, তারপর বাঁশের তৈরি মাচায় বিছিয়ে দেয়া হয় রোদে শুকানোর জন্য।
নিচু জমিটার পাশ দিয়েই চলে গেছে উচু মাটির রাস্তা, রাস্তার পাশেই মুদির দোকান। গ্রামের সমস্ত আড্ডার কেন্দ্র বিন্দু এই মুদির দোকানটি। আর এই দোকানটিই হচ্ছে এই গ্রামের রাজনীতির মুল আড্ডা। মসজিদ কমিটির লোকদের প্রতি পদে পদে যে দোষগুলো ভেসে ওঠে তা দৃশ্যমান হয় এই আড্ডা থেকে। গ্রামে কোন মেয়ে কার সাথে শুইল আর ধরা খেয়ে নাজেহাল হলো সব খবর পাওয়া যাবে এখানে এলে।
এইসব চর্চার বাইরে তোতা মিয়া তাদের এক বিনোদন। ছেলেটি শরীরে বৃদ্ধি পেলেও মানসিক ভাবে বৃদ্ধি পায়নি। তার শিশু সলুভ কথাবার্তা সকলে উপভোগ করে। রহিম শেখের পৈত্রিক ভিটা বাড়িটা এই গ্রামে। তোতা মিয়ার বাবা এই বাড়িটি দেখাশোনা করে।
অন্যান্য দিনের মতো দিনটি শুরু হলেও এখন বইয়ে চলছে আনন্দ হিল্লোল। তিনটি হিজড়ার আগমন গ্রামখানিকে হাসিতে আলোকিত করে তুলছে। সকলেই মগ্ন ছিল চা পানে আর প্রতি দিনকার চর্চায়। হঠাৎ একজন এসে তোতা মিয়া পাশে বসে পড়লো, হাতে তালি দিয়ে, পুরুষ কন্ঠের নারী সলুভ ভঙ্গিতে বলল-ওরে আমার নাগর রে, বলনা কি নাম?
– তোতা..
– আরে আমার তোতা পাখি, বল না, তোরে কি নামে ডাকি, উড়াল দিবি নাতো।
মুহুর্তের মধ্যে এক আনন্দের শোরগোল পড়ে গেল। আজকের এই দিনটাতে সমস্ত গ্রাম থেকে কোন্দল উঠে গেল, কোন মেয়ে কার সাথে লটর পটর করল তার আলোচনা স্থগিত হয়ে পড়ল, ঐ যে বৃদ্ধা বসুর মা লাঠিতে বর করে হাটে, সেও এসে ফোকলাপ দাতে কয়-
– এই ছিনালরা তগো লাজ শরম নাই, বেহাইয়া যত…
– ওলো বুড়ি , আমার জান, ও মোরে প্রাণ… বলে বুকে হাত রেখে বলে- সবগুলো বুক দেখতাছ বুড়ি , সবগুলা কাগজের ফুল। আমাগো কাহিল নাই, সাইট নাই , বাড়া বানবো কইলো সই….
বলে তোতা মিয়াকে জড়িয়ে ধরে। একটা অট্টহাসির হিল্লোল বয়ে চলে। এই দলটি যেখানেই যায় তোতা মিয়াকে সাথে নিয়ে যায় আর ছড়িয়ে দিতে থাকে হাসির ফোয়ারা।
হঠাৎ তোতা মিয়া খেয়াল করল সে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে। জনহীন প্রান্তরে যে দিকটায় রহিম শেখের ইটের খোলা সে দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমে এলো প্রায়। তোতা মিয়ার কোন পরিবর্তন খেয়াল করা গেল না সে হেসে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু হিজড়া তিনটির প্রকৃতি বদলে গেল, তারা বেশ চঞ্চল হয়ে পরস্পর কথা বলতে লাগল।

৩.
রাত্রি দ্বিপ্রহর। পুর্ণিমার চাঁদ মধ্য গগনে আকাশের একটা চোখ হয়ে জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকলো। সাঁই সাঁই শব্দে বাদুর উড়ে গেল। আরো দুরের গোরস্থান থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ভেসে আসছে।

তোতা মিয়ার হাত-পা বাঁধা। চিৎ হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে মাটিতে। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে এখানে পড়ে আছে সে। মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে … মা , মাগো…।
দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে অনবরত। ওরা তিনজন যখন তোতাকে বেধে ফেলেছিল তখন সে বার বার অবাক বিস্ময়ে বলছিল- আমারে বানছেন কেন্ ? আমারে কোরবানীর গরুর মতো বানছেন কেন্?

একজন বলল- তোকে কোরবানী দেয়া হবে, আল্লা খোদার নাম নে। আর আমাগো মাপ করে দিস…
ভয়ে থরো থরো কাঁপছে তোতা মিয়া। মাঝে মাঝে শুধু বলছে… মা, মাগো…
আকাশে পূর্নিমার চাঁদখানি চামৎকার হাসছিল। হঠাৎ একটি রক্তের ফিনকি এসে পড়ল ুনাকি তার শরীরে ? অবাক বিস্ময়ে আর আহত দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে খোলা এই প্রান্তরটি দিকে। এক টুকরা মেঘ ভেসে গেল তার উপর দিয়ে । নিচ থেকে দেখলে মনে হতে পারে চাঁদখানি থরো থরো কাঁপছে।

৪.
গত মওসুমটা শেষ পর্যন্ত বেশ ভালো গেল রহিম শেখের। হঠাৎ ইটের দাম বেড়ে গেল। তার যে ইট জমা পড়ে ছিল, বিক্রি করতে পারছিল না তা-ই শেষ পর্যন্ত তার হাতে প্রচুর টাকা এনে দিল।
ড্রাইভার ইটের খোলার পাশে এসে গাড়ীটা থামাল। পুরানো মডলের গাড়ি। নতুন গাড়ি কবে হবে কে জানে!
আরেক পূর্ণিমা। থৈ থৈ জোস্নার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত প্রকৃতি। গাড়ী থেকে রহিম শেখ ও ফকির বাবা নামল।
ফকির বলছেন- এই বার এমন তাবিজ দিব আপনার সব ফাড়া দুর হইয়া যাইব।
রহিম শেখ হাসছে, তার কানে ভাসছে গত মওসুমে বলা ফকিরের কথা…
নর-বলী দাও। মানুষের রক্তে তাজা হয় অর্থ আর ক্ষমতা।
ঘোরতর বিশ্বাসে রহিম শেখ ভাবে, এবার তবে চলুক নিজ হাতে রক্তপ্লাবন।

রহিম শেখ আর ফকির এগিয়ে চলছে। বেশ দুরে তাদের পিছন পিছন আসছে ড্রাইভার। তার হাতে একটা ব্যাগ। হাঠাৎ হাত দিয়ে ড্রাইভার ব্যাগটা পরীক্ষা করল। কোরবানীর ছুরিটা আর দড়িগুলো ঠিক মতোই আছে। দূর হতে কয়েকটি খিল খিল হাসি ভেসে আসলো। দাঁড়ালো ড্রাইভার। চারিদিকে খেয়াল করল সে। না, কোথাও কেউ নেই …

লড়াই- শেষ পর্ব

লড়াই- পর্ব ০১ এরপর।

দিনগুলো সোনার খাচায় বন্দি থাকে না! এই পড়ন্ত বেলায়, স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে টম। সে ছিল পূর্ণ যৌবনে, উঠতি সময়ে আর তারা ছিল অস্তমিত সময়ে। অনেক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তারা মুখোমুখি হয়েছিল টমের। টম মনে করতে পারছে সেই দিনের দৃশ্যকে, বাচ্চা ছেলের মতো ড্রেসিং রুমে কেদেছিল টসার বিল, আঠারতম রাউন্ডে টমের হুকে পরে গিয়ে বিল আর উঠতে পারে নি। ‘‘টসার বিল! বাড়ি ভাড়া বাকি পরেছিলো তোমার? তোমার স্ত্রী আর সন্তানদের খাদ্যাভাব তোমাকে বিষন্ন করে রেখেছিল? কিছু মাংসের জন্য কি হাহাকার করছিল তোমার ক্ষুধার্ত অনুভুতি?’’ স্মৃতিতে সাতার কাটতে কাটতে টম, বিলকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। টম এখন দেখতে পাচ্ছে, বিশ বছর আগে টম লড়ছিল সম্মানের জন্য আর সহজ উপায়ে টাকা উপার্জনের জন্য আর টসার বিল! কেন লড়ছিল সেদিন? কেন পরাজয়ের পর ড্রেসিং রুমে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদেছিলো!

শুরু থেকেই মানুষকে লড়াই করেই এগুতো হয়। এটাই প্রকৃতির এক দৃঢ় কঠিন নির্দেশনা। শুক্রানু থেকেই শুরু এই লড়াইয়ের। তারপর প্রতিটি পদক্ষেপ সামনে এগুতেই একটি তীব্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়। কেউ দীর্ঘ সময় লড়াইয়ে জয়ী হয়ে টিকে থাকে, কেউ হয়ত কিছুটা কম কিন্তু একসময় এই লড়াইয়ে হারতেই হয়। এই হেভী ওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা যদিও একটি খেলা, এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। কেউ হয়ত একশটি কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, কেউ হয়ত মাত্র বিশটি। এটি একেক জনের অন্তর্গত শারিরীক দক্ষতার উপর নির্ভর করে। হ্যা, টম অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই লড়েছে। অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ ও কঠিন লড়াইয়ে সে টিকে আছে। তার সমকালীন আর কেউই রিং-এ নেই। সে প্রবীণদের শেষ প্রহরী। সে তাদের সকলের শেষ হয়ে যাওয়া অবলোকন করেছে এবং কাউকে কাউকে সে নিজ হাতে ধ্বংস করেছে।

প্রতিষ্ঠিতদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তাকে এবং একে একে সব প্রতিষ্ঠিতদেরকে বিদায় করে দিয়েছে সে- প্রতিটি বিজয় এনে দিয়েছে ভরপুর আনন্দ আর হাসির উপলক্ষ্য, টম তখন হাসছিল যখন বিল ডেসিংরুমে বসে কেঁদেছে। এখন টম পুরানো প্রতিষ্ঠিত ফাইটার, নতুনদেরকে তার বিরুদ্ধে লড়েই এগুতে হবে। যেমন আজকের প্রতিদ্বন্ধী স্যান্ডেল। সে নিউজিল্যান্ড থেকে এখানে এসেছে, ওখানে তার স্মরনীয় রেকর্ড রয়ে গেছে কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে সে নতুন, অপরিচিত। তাকে পুরানো টমে মুখামুখি হতে হবে। যদি স্যান্ডেল দক্ষতার পদর্শনী দেখাতে পারে, তার সামনে এসে যাবে আরো বড় ধরনের সুযোগ, আরো বৃহত্তর প্রদর্শনীর। এটা নির্ভর করছে তার উপর সে কতটা দক্ষ লড়াকু, তা প্রমাণের উপর। সে ছিনিয়ে নিতে পারে অনেক কিছু- টাকা, সুনাম আর ক্যারিয়ার। আর টম কাটিয়ে এসেছে এ সব পদক্ষেপ, এখন এই ফাইট হতে তার কিছু অর্থ হস্তক্ষেপ হওয়া ছাড়া কিছুই পাবার নেই, যা দ্বারা সে বাড়িভাড়া ও দোকান বাকি পারিশোধ করবে। এবং যেহেতু টম স্মৃতি রোমান্থন করছে যৌবনের, যৌবনের রূপরেখা দেখা দেয় তার মানসপটে। যৌবন, সম্মানিত যৌবন, উৎফুল্লতায় মাধুর্যমণ্ডিত, অজেয়, মসৃন মাংসপেশী, টসটসে ত্বক, প্রাণবন্ত ফুসফুস, যাকে ক্লান্তি এসে কাবু করতে পারে না, হৃদয়োত্থিত কান্না থমকে থমকে হানা দেবার অবসর পায় না স্রোতস্বীনি হাসির স্রোতের গতিময়তায়। হ্যা, যৌবন ধ্বংসপ্রবন, সে ধ্বংস করে পুরাতন জং ধরা স্থবিরতাকে আর যদি তেমন না করে তবে সে ধ্বংস করে নিজেকে। যৌবন সর্বদাই উদ্দ্যেমী। পৃথিবীটা যৌবনের, উদ্যমের আর বিজয়ের। যৌবন কখনো পুরানো হয় না, মানুষের বয়সটা কেবল ক্রমাগত পরিণতির দিকে ধাবমান।

যখন টম কিং মঞ্চে প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে, যুবকদের চিৎকার ধ্বনি শুনতে পায় সে। সে শুনতে পায় একজন আরেকজনকে বলছে, ‘‘দেখো, দেখো, টম কিং। দ্যা, টম কিং’’

টম যখন তার ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করল, ক্লাবের সেক্রেটারী তাকে স্বাগত জানাল, বলল, ‘‘কেমন বোধ করছো, টম?’’
‘‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত আমি’’ টম বলল যদিও সে জানে সে সত্যটা বলছে না, বলছে না যে, এখন তার হাতে কিছু টাকা থাকলে সে কয়েক টুকরা ফ্রেস মাংস খেয়ে নিত।

ড্রেসিং রুম ছেড়ে টম কিং যখন মঞ্চে এসে দাড়াল তখন একটি হর্ষধ্বনি গমগম করতে লাগল সমস্ত গ্যালারী জুড়ে। প্রবেশ পথে কেউ কেউ হাত মিলাল। কিং লক্ষ্য করল যে, যারা তার সাথে হাত মিলাচ্ছে তার প্রায় সকলেই নবীন। টম কিং যখন প্রথম লড়াইয়ে নামে এবং জিতে যায় তখন এসব নবীনের অনেকে জন্মায়নি। মঞ্চে উঠে টম কিং ও প্রবীণ রেফারী, যিনি দশ বছর রিং-এ নেই, কিং- এর অনেক জানাশোনাও বটে, পরস্পর হাত মিলাল।

এরই মাঝে প্রবলতর গুঞ্জনধ্বনি, চিৎকার, হৈ চৈ-এর মাধ্যে দিয়ে আগমন ঘটল, টম কিং-এর আজকের প্রতিদ্বন্ধী স্যান্ডেলের। টসটসে ত্বক, দৃঢ় গাথুনি, চেহারায় একটি স্পষ্ট মায়াবী ভাব লক্ষ্য করল টম। টম কিং, নিজের প্রথম লড়াইয়ে ফিরে গেল স্মৃতিতে। মাত্র পাঁচ রাউন্ড টিকেছিল তার প্রতিদ্বন্ধী, নক আউট করে দিয়েছিল সে। তার দীর্ঘ লড়াইয়ের ময়দানে বহু প্রতিদ্বন্ধীকে নক-আউট করে দিয়েছে টম, তার হুকগুলো দুর্ধর্ষ, খুব কম ফাইটার তার প্রচন্ড আঘাতের পর উঠে দাড়াতে পারে।

ভাষ্যকারের নানা ধরনের উপস্থাপনার পর, ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল। প্রথম দুই রাউন্ড পুরোটাই স্যান্ডেলের। টম কিং সমর্থকরা হতাশ হয়ে যাচ্ছে প্রথমেই কিন্তু টম কিং মোটেও নয়। সে প্রথম দুই রাউন্ড স্যান্ডেলকে লাফাতে দিয়েছে, যাতে শক্তির প্রাথমিক কিছুটা ক্ষয় হয়। টম কিং জানে শক্তিমত্তায় নবীনদের সাথে পেরে উঠা দুষ্কর কিন্তু অভিজ্ঞতা আর ব্রেনকে কাজে লাগাতে জানে টম কিং।

প্রথম দুই রাউন্ড শুধু নিজেকে বাচিয়ে স্যান্ডেলকে লড়তে দিয়েছে। দর্শকের চিৎকার আর হৈ চৈ এ স্যান্ডেল উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে বার বার। তৃতীয় রাউন্ডে এসে টম কিং পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল, যখন সে প্রচন্ড আঘাতে স্যান্ডেলকে ধরাশায়ী করে ফেলে। দর্শকের মাঝে সাঝ সাঝ রব উঠে গেল। একজন বাচ্চা ছেলে পিছল খেয়ে পরে গিয়ে পর মূহুর্তেই দাড়িয়ে যেমন আবার দৌড়াতে থাকে, স্যান্ডেল তেমনি এক ঝটকায় উঠে দাড়াল। তবে স্যান্ডেল সতর্ক হয়ে গেল, বুঝে গেল সে একজন কঠিন প্রতিদ্বন্ধীর মোকাবেলা করছে।

নবম, দশম রাউন্ডে এসে বোঝার কোন উপায় রইল না কে এগিয়ে রইল। টম অবশ্য বুঝতে পারছে যে সে কিছু পয়েন্টে পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ লড়াই চলল প্রায় সমানে সমানে। তরুন আর বুদ্ধি দীপ্ত প্রবীণ সফল লড়াকুর মধ্যে এই লড়াইয়ে সমস্ত গ্যালারী উল্লাসিত।

সতেরতম রাউন্ড স্যান্ডেল একটু বেশিই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। টম কিং লক্ষ্য করল এবং কিছুটা সুযোগ করে দিল টমকে আঘাত করার জন্য। বেশ কয়েকটি আঘাতের পর স্যান্ডেল জয়ের গন্ধ শুকতে শুরু করল আর একটু অমনোযোগিতা আর ঢিলামি পেয়ে বসল তাকে। টম এটার অপেক্ষায় ছিল। টম জানে প্রতিপক্ষ যদি একটু অসতর্ক হয়ে উঠে, তার হুকগুলোর আঘাতটা যদি সঠিক শক্তিতে পাঞ্চ করতে পারে, কারো সামর্থ্য নেই উঠে দাড়ানোর। জীবনে বহুবার টম পয়েন্টে পিছিয়ে পরে তার এই হুকে নক-আউট করে দিয়েছে অনেক প্রতিপক্ষকে।

সমস্ত গ্যালারী স্তব্ধ হয়ে আছে যেন একটি নিরবতা এসে ভর করেছে। টমের কানে কোন শব্দ প্রবেশ করছে না। এই লড়াইয়ের শেষ দিকে টম এই প্রত্যাশা করছিল। স্যান্ডেলের অতিরিক্ত আত্ম-বিশ্বাস আর অসতকর্তা। পর পর তিনটি আঘাত করল টম, সমস্ত শক্তি দিয়ে। তার অতীত অভিজ্ঞতা এই যে, কেউ উঠে দাড়াতে পারে নি। এবার টম প্রকৃতস্থ হলো, এবার সমস্ত গ্যালারী পিন পতন স্তব্দতা। রেফারী গুনছে এক, দুই, তিনৃ দর্শকের একাংশ সমস্বরে উচ্চারন করছে এক, দুই, তিন, চারৃ.. জয় থেকে টম আর মাত্র কিছু সময় দুরৃ. সাত, আট, নয়ৃ. আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড..

কিন্তু একমাত্র যৌবন উঠে দাঁড়াতে পারে। স্যান্ডেল, উঠে দাড়াল। স্তব্ধ টম, তার সমস্ত শক্তি নি:শেষ করে সবশেষ আক্রমন করেছে সে। কেউ যারা তার পূর্বসূরী, আর যারা তার সম-সাময়িক কেউ উঠে দাড়াতে পারেনি। কিন্তু নবীন উঠে দাড়ায়। তারুন্য উঠে দাড়াল। স্যান্ডেল আরো তীব্র হয়ে উঠল, টম কিং জানে, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন তারুন্য আরো দারুন উদ্দিপীত হয়ে উঠে, বরং যত বেশি প্রতিকুলতা এসে ভর করে তত বেশি উদ্দীপনা কাজ করতে থাকে। আর প্রবীনের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন তাকে বিদায় নিতে হয়।

পরবর্তী দুই রাউন্ড টম কিং একটি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সৈনিক যেন। কেবল নক আউট হতে বেচে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল। যদিও সর্বশেষ রাউন্ডে টম কিং, দ্যা টম কিং আরো একটি আক্রমন হানলো। আর স্যান্ডেল ছিটকে পরল, আছড়ে পরল মঞ্চে, কিন্তু উঠে দাড়াতে বেগ পেতে হয় নি স্যান্ডেলের।

খেলা শেষ। পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত টম সমস্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে হেলান দিয়ে বসে রইল। সকলেই ফলাফলের প্রতীক্ষায় অস্থির সময় কাটাচ্ছে। অবশেষে ভাষ্যকার মঞ্চে এলো। ভাষ্যকার বললেন,‘ প্রিয় দর্শক, যে লড়াই আজ আমরা দেখলাম, ইয়ং স্যান্ডেল আর ওল্ড টম কিং-এর মাঝে, দীর্ঘ দিন এমন লড়াই দেখা যায়নি। আমার দৃষ্টিতে এ লড়াই এ মঞ্চে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে শ্রেষ্ট। কিন্তু আমাকে ফলাফল ঘোষনা করতে হবে।’’

রেফারী দুইজন প্রতিদ্বন্ধীর দুই হাত ধরে আছে, আর প্রতীক্ষা করছে যার নাম ঘোষনা হবে তার হাত উচিয়ে ধরবেন।
ভাষ্যকার ঘোষনা করলেন, ‘‘বিচারকের দৃষ্টিতে আর তাদের বিচারে অতি সামান্য ব্যবধানে জয়ী হয়েছে স্যান্ডেল।

সমস্ত গ্যালারী আবারো থমকে গেল। ফলাফল ঘোষনার পর চেচামেচিতে গ্যালারী উল্লাসিত থাকে কিন্তু সকলেই থমকে গেল যেন। স্যান্ডেল, এই মঞ্চে প্রথম বিজয় তার, আনন্দিত বটে কিন্তু সে ভাষ্যকারের হাত হতে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল,‘‘ বিচারকের দৃষ্টিতে আমি জিতেছি, আমি আনন্দিত। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এই লড়াইয়ে জয়ী টম কিং, দ্যা টম কিং’’

সমস্ত গ্যালারী টম কিং-টম কিং চিৎকারে কেপে উঠল। স্যান্ডেল এসে টমকে জড়িয়ে ধরল। টম তার হাতে হাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এলো। সে মঞ্চ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। পিছন থেকে ভাষ্যকারে উচ্চারণ শুনা গেল, বলছেন,‘‘ টম কিং, দ্যা টম কিং, আ গ্রেট ফাইটার, হেরে গিয়েও যিনি সকলের হৃদয় জয় করে গেছেন।’’

অনেকেই টমের সাথে কথা বলতে চাইল, এক জন সাংবাদিক, ক্লাব সেক্রেটারীসহ আরো অনেকে কিন্তু টম সোজা বেরিয়ে এলো ড্রেসিং রুম থেকে। হাটতে হাটতে একটি নির্জন পার্কে এসে বসল টম। একটি অবিশ্রান্ত ক্লান্তি এসে ভর করল তার সমস্ত দেহ জুড়ে। টম কিং ভাবল, মঞ্চটা সব সময় কি আনন্দঘন! কিন্তু যারা মঞ্চায়িত করে এ আনন্দ দৃশ্যপট, তাদের মাঝে কত উত্থান আর পতন। শুধু থেকে যায় কিছু লড়াকু দৃশ্যায়নের ইতিহাস। কিন্তু যখন এই মঞ্চ হতে বিদায় নেয় একজন লড়াকু, কি নিঃস্ব আর একা।

মুখ ঢেকে ফেলল টম কিং, তার প্রিয়জনদের মুখ ভেসে উঠল, তার স্ত্রী, বহুদিনের পুরানো বন্ধু, দুই সন্তানের মুখ ভেসে উঠল। টম কিং, দ্যা টম কিং, কি নি:স্ব আর অসহায় তার ফিরে যাওয়া। মুখ ঢেকে টম হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

আর টম কিং এর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল কেন বিশ বছর আগে টসার বিল ড্রেসিং রুমে বসে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদেছিলো!

লড়াই

লড়াই
ফকির আবদুল মালেক

নৌকার পাটাতনে সেজদাবনত আত্মসমর্পিত মাঝি।
ছিটকে পড়ার মুহূর্তে আঁকড়ে ধরলাম। বললাম- ওঠ, হাল ধরো।
ফুঁসে উঠা প্রতিকূল স্রোতে ডিঙিখানি ডুবে যাওয়া আর
ভেসে উঠার ঠিক মাঝামাঝি,
আর প্রতিটি মুহূর্ত জীবন আর মৃত্যুর সীমারেখায় দুদোল্যমান।

সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা ছিল। ভ্রুক্ষেপ করিনি, পেয়েছিল শিকারের নেশা।
দীর্ঘকাল আমরা সমুদ্রে ভাসমান।
পরিপূর্ণ রূপার থালার মতো চাঁদ ভেসেছিল আকাশে,
হু হু হাওয়া হৃদয় ছিড়ে চেয়েছিল নিতে সুন্দরের মায়াবী পথে।
আমরা মাতাল থেকেছি সৌন্দর্য অবগাহনে আর জাল ছিল মাছ শুন্য।
যখন সমুদ্র তার মোহনীয় রূপ ছেড়ে ক্রমাগত উত্তাল হতে থাকলো,
যখন বাযু তার গতিকে ঝঞ্জাক্ষুব্ধ প্রলয়ংকরী করে তুলেছিল,
ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা পড়তে থাকলো ।
পেছনে পড়ে রইল আপনজনের উৎকন্ঠা আর মহাজনের লোলুপ দৃষ্টি।
সমস্ত স্বার্থবুদ্ধি অমাবস্যার চাঁদের মতো অদৃশ্যমান।

হাল ধরলো মাঝি।
বলল- স্রোতের অনুকূলে যদি ভাসি, তীরে
আছড়ে পড়বো, হারাবো অর্জন।
প্রতিকূলে পাল্টা প্রতিরোধে! একসময় সমুদ্র স্থির হবে,
আমাদের স্বপ্নে আপ্লুত হবে সমস্ত তীরাঞ্চল।

লড়াই করো মাঝি, লড়াই করো
এসো লড়তে লড়তে মস্তিষ্কে দৃঢ় চিত্র আঁকি কাঙ্খিত স্বপ্নের
যদি পরাজিত হই, পরাজিত হয় না লড়াকু দৃশ্যায়ন-
প্রজ্জ্বলিত রক্তাক্ষরে প্রস্ফুটিত জীবন কানন।