ফকির আবদুল মালেক এর সকল পোস্ট

ফকির আবদুল মালেক সম্পর্কে

কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লেখক।

মানুষ

কতটুকু উদাস হলে মানুষকে কবি বলা যায়
কতটুকু দেশপ্রেম হলে মানুষকে নেতা বলা যায়
কতটুকু তাত্ত্বিক মানুষকে কমিউনিস্ট বলা যায়
কতটুকু ধুতি জড়ালে মানুষকে বাঙালি বলা যায়
ফকির মালেক ভেবে কয়
কতটুকু মানুষ হলে মানুষকে মানুষ বলা যায়!

কতটুকু সম্পদ হলে মানুষকে ধনী বলা যায়
কতটুকু ক্ষমতা পেলে মানুষকে মহামান্য বলা যায়
কতটুকু দান করলে মানুষকে দান বীর বলা যায়
কতটুকু চতুর হলে মানুষকে ব্যবসায়ী বলা যায়
ফকির মালেক ভেবে কয়
কতটুকু মানুষ হলে মানুষকে মানুষ বলা যায়!

কতটুকু শিক্ষিত হলে মানুষকে পন্ডিত বলা যায়
কতটুকু ডিগ্রি নিলে মানুষকে ডক্টর বলা যায়
কতটুকু সুরেলা হলে মানুষকে গায়ক বলা যায়
কতটুকু অভিনেতা হলে মানুষকে নায়ক বলা যায়
ফকির মালেক ভেবে কয়
কতটুকু মানুষ হলে মানুষকে মানুষ বলা যায়!

কতটুকু ঈমান হলে মানুষকে পরহেজগার বলা যায়
কতটুকু শরীর ঢাকলে মানুষকে পর্দাশীন বলা যায়
কতটুকু বড় পাঞ্জাবী হলে মানুষকে সুন্নতি বলা যায়
কতটুকু ‘বালেগাল ওলা’ বললে আশেক বলা যায়
ফকির মালেক ভেবে কয়
কতটুকু মানুষ হলে মানুষকে মানুষ বলা যায়!

হৃদয়, বিদায় এবার তোর কাছে

সারা দিন দেখি উড়ছে কাক,
সারা রাত শুনি পেচার ডাক।
চাঁদ ডুবে যায় পশ্চিম সাগরে,
পূবে সুর্য উঠে পাহাড়ের ধারে
পাতা ঝরে, রেণু উড়ে চারি ধার-
বসন্ত পুস্প মুকুল অথবা তুষার?

হৃদয়, বিদায় এবার তোর কাছে-
দেরি হয়ে গেল, সময় কি আছে?
নিথর হয়ে একদিন সুখী হবে তবু-
এত যে ভালোবাসা ভুলবে কি কভু!

ভেবে দেখেছো কিঃ ২

বাংলাদেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মালিক নুরুল ইসলাম বাবুল মারা গেছেন। দৈনিক যুগান্তর, যমুনা টেলিভিশন এবং যমুনা ফিউচার পার্ক এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন।

গত ১৪ জুন ২০২০ নুরুল ইসলামের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। ওইদিনই তাকে এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। করোনা ভাইরাসে তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে ১০ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা চলছিল। তিনি ৩৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন বলে জানা গেছে।

দেশবরেণ্য শিল্পপতি, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের মৃত্যুতে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দেশের কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও নারী নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান সব সময় দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। দেশের শিল্প উন্নয়নে তার বিশাল ভূমিকা রয়েছে, বিশেষ করে তার মেধা, দক্ষতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আধুনিক চিন্তার সাহসী উদ্যোক্তা ছিলেন। শত পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সেখানে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি দেশের অর্থনীতির একজন নক্ষত্র ছিলেন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন স্বপ্নদ্রষ্টা শিল্পোদ্যোক্তাকে হারিয়েছে

তাকে নিয়ে ফরাবী হাফিজ, সংবাদ পাঠক, চ্যানেল ২৪ –
এর একটি লেখা বেশ ভাবিয়ে তুলছে আমাকে। কিছুটা সংক্ষেপে নিচে উদ্ধৃত করলাম। ফেসবুকের এক স্ট্যাটাস থেকে পাওয়া লিখাটি। (লেখাটি আমার নয়)


……….
বাঁচার অনেক আকুতি ছিল যমুনা গ্রুপের
চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের!!

শেষ সময়ে উনি স্টিভ জবসের মতো যেই ডাক্তারকে দেখতেন তাকেই বলতেন,”আমার সব সম্পদ দিয়ে দিবো। শুধুমাত্র আমার কষ্টটা একটু কমিয়ে দাও! আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।”

তিনি যখন এ্যাপোলোর আইসিইউতে, হস-পিটাল ম্যানেজমেন্ট এর কার্যক্রম দেখে মনে হয়েছে পুরো হসপিটালেই একজন রোগী।

হবারই কথা! আফসোস করছিলাম আর কথা বলছিলাম এক ডাক্তারের সাথে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে এয়ার এম্বুল্যান্সে চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০/১২ জন ডাক্তার আনা হলো। কিছুতে কিছুই হলো না।
কি কঠিন মৃত্যু!

মৃত্যুর সময়ে একজন কাছের মানুষের হাতের স্পর্শও পান নি! কারো সাথে বিদায় শব্দটি বলতে পারেন নি! পরিবার প্রিয়জন কেউই পাশে ছিলো না, থাকার সুযোগও নেই। ভিষণ নিঃস্তব্দ সেই রুমটায় আমি গতকাল গিয়েছিলাম। ভুতুড়ে পরিবেশ, আধো আলো। চারপাশে সবাই অর্ধমৃত মানুষ! আহারে… সম্পুর্ণ সুস্থ লোকটি হঠাৎ এক অজানা ভাইরাস করোনার আঘাতে ২৫ দিনের মধ্যে নাই হয়ে গেলো।

ভেবে দেখেছো কি, কার জন্য কিসের জন্য এতো প্রতিযোগিতা ও পরিশ্রম?

সস্তা এবং বাজারি লেখালেখিঃ হুমায়ূন আহমেদ থেকে কাশেম বিন আবুবাকারঃ শেষ পর্ব

সস্তা এবং বাজারি লেখালেখিঃ
হুমায়ূন আহমেদ থেকে কাশেম বিন আবুবাকারঃ প্রথম পর্ব।

যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন।

আমাদের আলোচনা কোন মহান, মুক্তবুদ্ধি, কমিটেড, সত্যসন্ধানী লেখক নিয়ে নয়। আমরা বাজারি লেখকদের নিয়ে আলোচনায় করছি এবং এক আত্মস্বীকৃত বাজারে লেখক হুমায়ূন আহমেদকে বিশ্লেষণ করেছি। এবার অন্যদিকে যেতে চাই।

এই সময়ে যে লেখক সবচেয়ে আলোচিত তিনি হুমায়ূন আহমেদ নন, তিনি কাশেম বিন আবুবাকার। এএফপি তাকে নিয়ে নিউজ করার আগে আমরা শুদ্ধবাধি লেখকরা অনেকেই তার নামই শুনি নি।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, কাসেম বিন আবুবাকার ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে একজন বই বিক্রেতা হিসেবে প্রায় সব উপন্যাসের মধ্যে শুধু শহুরে অভিজাতদের জীবনযাত্রার কথা দেখতে পেয়ে নিজেই হাতে কলম তুলে নেন।

ইসলামী মূল্যবোধকে সামনে রেখে কাসেমের লেখা একের পর এক প্রেমের উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে। এসব উপন্যাস দ্রুতই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লাখ লাখ পাঠকের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে তার উপন্যাস।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেক্যুলার লেখকরা এমন এক দুনিয়ার গল্প বলেছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধান অংশের গ্রামীণ ও ধর্মীয় জীবনের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয়েছে। কাসেম এ শূন্যতার বিষয়টি অনুধাবন করে তার উপন্যাসের বাজার গড়ে তুলেছেন।

অনেকে আকাশ থেকে পড়ছি, কাশেম বিন আবুবাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় , কীভাবে? সত্যিটা হচ্ছে, পৃথিবীর সবদেশে সবসময় কাটতি বেশি যথাক্রমে রেসিপি, পর্নোগ্রাফিক এরপর ধর্মীয় বই।

গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার অরিজিত রায়চৌধুরী একবার বলেছিলেন প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে পঞ্জিকা অন্তত বিশ লাখ কপি বিক্রি হয় । অথচ বাংলা উপন্যাস পাঁচ হাজার বিক্রি হলেই বেস্টসেলার – আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্র বলেছিলেন সেবারই।

প্রশ্ন হচ্ছে কাশেম বিন আবুবাকার এর যে লেখাগুলি এত এত কপি বিক্রি হয় তা কি রেসিপি, পর্ণোগ্রাফি, ধর্মীয় পুস্তক বা পঞ্জিকা। এসব কিছুই নয়, এমনকি এগুলি হুমায়ূন আজাদের ভাষায় অপন্যাস ও নয়, এগুলিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ইসলামি উপন্যাস হিসাবে।

বেশি বিক্রি হওয়া উপন্যাসের মধ্যে একটি ক্যাটাগরি হচ্ছে রোমান্স উপন্যাস।

রোম্যান্স উপন্যাস বা রমন্যাস পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে, বিশেষত ইংরেজি-ভাষী জগতে বিকশিত একটি সাহিত্যধারা। এই বর্গের উপন্যাসগুলির মূল উপজীব্য দুই ব্যক্তির প্রেম ও প্রণয়সম্পর্ক, যার পরিসমাপ্তি হবে “সর্বদা মানসিকভাবে সন্তুষ্টিবিধায়ক ও আশাব্যঞ্জক”

১৯৭২ সালে অ্যাভন বুকস প্রকাশিত ক্যাথলিন উইডিউইস রচিত দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ার উপন্যাসটি আধুনিক রোম্যান্সের সূচনা করে। এটিই ছিল মূল পেপারব্যাক আকারে প্রকাশিত প্রথম সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্স উপন্যাস। ১৯৮০-এর দশকে এই ধারাটি সমৃদ্ধিলাভ করে। অনেকসংখ্যক ক্যাটেগরি উপন্যাসের পাশাপাশি সিঙ্গল-টাইটেল উপন্যাসের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। জনপ্রিয় লেখকগণ এই ধারার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্লট ও চরিত্রচিত্রণে আধুনিকতার ছোঁওয়া লাগে।

উত্তর আমেরিকায় ২০০৪ সালে বিক্রীত সমস্ত পেপারব্যাক বইয়ের ৫৫% রোম্যান্স উপন্যাস। এই অঞ্চলে আধুনিক সাহিত্যে জনপ্রিয়তম ধারা তাই এইটিই।

রোমান্স ক্যাটাগরীর উপন্যাসের মধ্যে যৌনতা, নগ্নতা ইত্যাদিও ব্যবহৃত হতে দেখা যায় যা অনেক সময় পর্ণগ্রাফির পর্যায়ে পরে। তবে এর বিপরীতে ধর্মীয় ভাবধারায় ও রচিত হতে দেখা যায় অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স উপন্যাস যে সব উপন্যাস বিক্রির দিক থেকে সফল হতে দেখা যায়।

বর্তমান বিশ্ব বাজারে বিদ্যমান অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স উপন্যাসগুলি খ্রিস্টান ভাবধারা ও প্রণয়সম্পর্কের বিকাশ কেন্দ্রিক কাহিনির সংমিশ্রণ। ২০০৪ সালে, এই উপবর্গে ১৪৭টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। এই উপন্যাসে সাধারণত অপ্রয়োজনীয় হিংসাত্মক কার্যকলাপ বা অশ্লীল বাক্যাদি ব্যবহৃত হয় না। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির প্রণয় হয় সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। যৌনতার উল্লেখ যদি বা থাকে, তবে তা ঘটে বিবাহের পর এবং তার বিস্তারিত বর্ণনাও বাদ রাখা হয়। অনেক উপন্যাসেই নায়ক বা নায়িকার বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়। যার হলে প্রেমকাহিনিটি পরিণত হয় “নায়ক, নায়িকা ও ঈশ্বরের সহিত তাদের সম্পর্ক নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ত্রিভূজ”-এ। ক্ষমা, সততা ও বিশ্বাস এই উপবর্গের সাধারণ কয়েকটি থিম।

স্পষ্টত কাশেম বিন আবুবাকার এর উপন্যাসগুলি অনুপ্রেরণামূলক রোমান্স উপন্যাস। প্রশ্চাত্য জগতে খ্রীষ্টান ভাবধারায় রচিত হয়, আর বাংলাদেশে কাশেম বিন আবুবাকার রচনা করেছেন ইসলামি ভাবধারায় এবং তিনি ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছেন।

পৃথিবীব্যাপী ইসলামি ভাবধারার উপন্যাস সাহিত্যের অবস্থান একটু পর্যালোচনা করে নেই।

শাহনেওয়াজ বিপ্লবের লেখা আধুনিক আরবি উপন্যাস ঃ মহাকাব্যের প্রতিচ্ছবি হতে উদ্ধৃতি করছি, একটু সময় দেই লেখাটিতে।

‘উপন্যাস’ নামের আধুনিককালের জনপ্রিয় সাহিত্য আঙ্গিকটি পশ্চিম ও লাতিন আমেরিকার পরম্পরায় চিরঋণী যাঁদের কাছে, তারা হলেন আরব দেশের আরবি ভাষার মানুষ। বসবাস তাঁদের আলজেরিয়া, বাহরাইন, কমেরো, জিবুতি, মিসর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, ফিলিস্তিন, কাতার, সৌদি আরব, সুদান, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, আরব আমিরাত ও ইয়েমেন; এক কথায় যেসব দেশ আরব বিশ্ব বা আরবি ভাষাভাষী হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। মানব সভ্যতায় পুরো মধ্যযুগ ধরে যখন পদ্য, পয়ার আর কবিতার দোর্দণ্ড প্রতাপ চলেছে, ঠিক তখন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আরবরাই উপহার দিয়েছেন আরব্য উপন্যাস, ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ বা এক হাজার এক রাতের গল্প, যা পুরো বিশ্বকে তুমুল আলোড়িত করে রেখেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। আরব্য উপন্যাসের বৈচিত্র্যময় সিন্দবাদ, আশ্চর্য প্রদীপের মালিক আলাদীন অথবা আলীবাবা ও ৪০ চোরের বিস্মৃত গল্প-পথ ধরে আজকের আধুনিক সাহিত্যাঙ্গিক গল্প ও উপন্যাসের জন্ম, ব্যবধান শুধু এতটুকুই যে মধ্যযুগের আরব্য উপন্যাস রচিত হয়েছিল দৈত্যদের নিয়ে, পরীদের নিয়ে, রাজা-বাদশা বা অসাধারণদের নিয়ে। আর আধুনিক উপন্যাসে আধিপত্য অতিসাধারণ মানুষের সাবঅলটার্ন মানুষদের নিয়ে। আধুনিক ঔপন্যাসিকরা আবিষ্কার করেন যে মানুষের মধ্যেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি গল্প; তার ঘরে, তার মনে, তার চারদিকে, তাকে ঘিরে আছে গল্প এবং তা শোনার মতো, তা উপন্যাস হয়ে ওঠার মতো।

কাশেম বিন আবুবাকার অনুপ্রেরণামূলক রোমান্স ধারায় ইসলামি ভাবধারায় উপন্যাস লিখে ব্যাপক সফলতা পান।

পুস্তক বিক্রির দিক দিয়ে কাশেম বিন আবুবাকার অত্যন্ত সফল কিন্তু প্রচারনামূলক হওয়ায় তা সাহিত্যের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ। এ ধারার উপন্যাসগুলি সকল সময়ই মূল ধারায় উপহাসিত, নিন্দিত, হাস্যরস সৃষ্টিকারী হয়ে থাকে, আবুবাকার এর ব্যতিক্রম নন। তাই বলে তিনি ব্যর্থ তা বলা যাবে না, তিনি পাঠকের কাছে কিছু ম্যাসেজ পৌছে দিতে চেয়েছেন তা তিনি পৌছে দিতে পেরেছেন এবং ব্যাপকভাবে তা পেরেছেন।

সস্তা ও বাজারি লেখক হওয়া সত্ত্বেও হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলি সকলকে নির্মল আনন্দ দেয় এবং কিছু প্রচার করেন না। তাই আমাদের বিবেচনায় তিনি অনেক বোদ্ধাদের দ্বারা অপন্যাসিক অাখ্যা পেলেও কালের বিচারে হয়ত তিনি টিকে থাকবেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের পাঠকদের হৃদয়ে।

সস্তা এবং বাজারি লেখালেখিঃ হুমায়ূন আহমেদ থেকে কাশেম বিন আবুবাকারঃ প্রথম পর্ব

নিজে টুকটাক লেখালেখি করি বলে, আমাকে অনেকবার হতাশ কন্ঠের এই কথাগুলি শুনতে হয়েছে, ‘লেখালেখি করে কী হবে? কবি, সাহিত্যিকদের জীবনে টাকা-পয়সা হয় না। শেষে না হবে সংসার, না হবে সুন্দর জীবন।’

আসলেই তাই। অনেক বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিকদের কষ্টে দিন কাটানোর ইতিহাস আমাদের সামনে গর্বের সাথে উপস্থাপন করা হয়। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণও করেছেন কেউ কেউ। তবে বর্তমানে এ অবস্থা কিছুটা বদলেছে। পরিস্থিতির ততোটা উন্নতি এখনও হয়নি যতোটা হলে লেখালেখিটাকে এ দেশে প্রধান পেশা হিসেবে নেয়া যায়। ব্যতিক্রম কিছু আছে। আমাদের এই আলোচনা তেমনি দুই জন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুপার ডুপার হিট লেখককে নিয়ে। একজন হুমায়ূন আহমেদ আর অন্যজন কাশেম বিন আবুবাকার।

পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রফেশনাল রাইটার আছেন। তারা লেখালেখি ছাড়া আর কিছুই করেন না। এবং এ করেই তাদের দিন দিব্যি কেটে যায়। এমনকি এদের কেউ কেউ চমকে ওঠার মতো ধনীও বটে। তাদের বই বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়। বই বিক্রির রেকর্ডও গড়েছেন অনেকে। ফলে লেখক স্বত্ব নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। তারা লিখেই কোটিপতি।

বিশ্ব লেখালেখি থেকে আয়ের বিবরণ শুনে দেশে ফিরে আসব। ক’জন ধনী লেখককে নিয়ে লিখেছেন সাইফ বরকতুল্লাহ। আমরা তার থেকে নির্যাসটুকু দেখে নেই। লেখালেখি থেকে আয় ব্যাপারটা বেশ মজার, কি বলেন!

ধনী লেখকের কথা উঠলেই জে কে রাউলিংয়ের নাম উঠে আসে। তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী লেখক। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্যে জন্ম নেয়া এই লেখকের আয় কত অনুমান করুন তো? জানি পারবেন না! তাহলে শুনুন তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি টাকায় ১০৮ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৩৫ টাকা। কী, চোখ কপালে উঠে গেল! এবার আপনিই হিসাব করে তার দৈনিক আয় কত হয় বের করুন। আরেকটি মজার তথ্য দেই, তার এই আয় কিন্তু মোটামুটি একটি সিরিজ দিয়েই। নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন কোন সিরিজ? ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ লিখেই তিনি এ পরিমাণ আয় করেন।

পাঠক চলুন, আমরা লেখক স্টিফেন কিংয়ের গল্পটা শুনি। আমেরিকায় জন্ম নেয়া স্টিফেন কিং-ও ধনী লেখকদের একজন। এই লেখকের ৫০টিরও অধিক বেস্ট সেলার উপন্যাস রয়েছে। যা থেকে আয় হয়েছে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া সিনেমার স্ক্রিপ্ট ও অন্যান্য লেখা মিলিয়ে স্টিফেন কিং ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। এক হিসাব অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ১৩২ কোটি ২ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৬ টাকা।

জেমস প্যাটারসনকে বলা হয়, তার বই নাকি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এ কি শুধুই কথার কথা? তা নয়, ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুদ্রিত বই বিক্রির পরিসংখ্যান টেনে প্রকাশনা বিশ্লেষক সংস্থা নিলসেন এই তথ্য দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রাউলিংয়ের বই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণে বিক্রি হলেও, এখানে প্যাটারসন এগিয়ে। প্যাটারসনের বিগত ১৫ বছরে লেখা বইগুলো বাজারে হট কেক হিসেবে বিক্রি হয়েছে। তার গোয়েন্দা ধারাবাহিক ‘এলেক্স ক্রস’ এ পর্যন্ত তিন কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। ভাবা যায়! যেখানে এই বাংলাদেশে ৫০০ কপি বই বিক্রি করতে প্রকাশকদের নিরন্তর ঘাম ঝড়াতে হয়। জেমস প্যাটারসনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ, নিউইয়র্কে। তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ৬৯১ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার ৭৯৬ টাকা।

হুমায়ুন আহমেদের মতন জনপ্রিয় সাহিত্যিক এই বাংলাদেশে জন্মেনি, তা চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়। হুমায়ূন আহমেদের বই মানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ব্যাপকভাবে বিক্রিত হয় তার বই। এই বিক্রি হওয়াটা অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে ভিন্নভাবে। আসিফ মহিউদ্দিনে লেখা হতে কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি।

” আমাদের দেশে বই প্রকাশ এবং বই বিক্রি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। পাঠক তৈরি এবং প্রতিবছর টন টন বই উৎপাদন করে আমাদের সাহিত্যিকগণ বর্তমানে প্রচুর টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন, লেখালেখিকে একটি লাভজনক ব্যাবসায় পরিণত করেছেন। একটা সময়ে আমরা বই কিনতাম নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা জানার জন্য, ইতিহাস দর্শন সাহিত্যের চমৎকার সব অংশকে ভালভাবে বোঝার জন্য। কিন্তু বর্তমানে বই প্রকাশ একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ বাণিজ্য, সাহিত্য রীতিমত একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে। এখন আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ বই কেনে ঘর সাজাবার উদ্দেশ্যে, দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া করে হালকা চটুল সুড়সুড়িমার্কা বিনোদন পেতে। হুমায়ুন আহমেদ-ইমদাদুল হক মিলন এরা বহুদিন ধরেই এই ধরণের পাঠক ধরবার চেষ্টায় লিপ্ত, এই ধরণের মানুষের সংখ্যা বেশি হবার কারণে সাহিত্যের সত্যিকারের পাঠকদের কথা বিবেচনা না করে আমাদের জনপ্রিয় সাহিত্যিকগণ বর্তমানে জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন। শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ যার নাম দিয়ে ছিলেন ‘অপন্যাস’, আর এই ধরণের সাহিত্যিকের নাম দিয়েছিলেন ‘অপন্যাসিক’

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খুব শিক্ষিত নয়। তারা জটিল কথাবার্তা বোঝে না, সহজ সাধারণ জীবন যাপন করেন। এই ধরণের মানুষের মনস্তত্ত্বে হুমায়ুন আহমেদ নাড়া দিতে পারবেন খুব সহজেই। আসলে এই ধরণের পাঠক আকর্ষণ করতে খুব মেধাবী সাহিত্যিকের প্রয়োজন নেই, হুমায়ুন আহমেদের মেধা যে তাই অপাত্রে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

আমাদের দেশে বই বিক্রি আর সাহিত্যকে ব্যবসায় পরিণত করার জন্যেও হুমায়ুন আহমেদকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়। তিনি জনপ্রিয় থাকতে চেয়েছেন, সকল ধরণের পাঠক সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে অনেক পানি ঘোলাও করেছেন। আমরা বুঝি, জনপ্রিয়তার নেশা কাটানো মুশকিল, এবং দেশের প্রগতিশীলদের থেকে শুরু করে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হবার তার আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে তাকে একজন পতিত বুদ্ধিজীবীতে পরিনত করছে কিনা, সেটাও ভেবে দেখবার সময় হয়েছে।”

আসিফ মহিউদ্দিন এর লেখা থেকে বুঝা যাচ্ছে শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদকে সস্তা লেখক বলেছেন, বলেছেন অপন্যাসিক। আজাদ স্যার বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন, প্রতিভাবান, পন্ডিত মানুষ ছিলেন তিনি খুব সহজেই যে কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেই পারেন। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তিনি সকলকেই হেয় জ্ঞান করতেন। আমি সেদিকে যেতে চাই না। আমি যে বিষয়টিতে দৃষ্টি দিতে চাই তা হলো হুমায়ূন আহমেদের পাঠকের কোয়ালিটি নিয়ে। আসিফ মহিউদ্দিনের ভাষায় এরা সকলে সহজ সরল, অল্প শিক্ষিত, জটিলতা বুঝার ক্ষমতা তাদের নাই।

ওদিকে আরেক বিদগ্ধ সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন হুমায়ূন আহমেদের মুত্যু পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশি পাঠকদের কোয়ালিটি নিম্নমানের বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই তুলনায় কলিকাতার পাঠকরা বিদগ্ধ বলেছেন কারণ বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ কিংম্বদন্তিতুল্য জনপ্রিয়, পক্ষান্তরে সুনীল, শীর্ষেন্দুর অনেক প্রচেষ্টার পরও ওপার বাংলায় তেমন পাঠকপ্রিয়তা পান নি।

এ প্রসংগে সাদত হোসাইনের একটি লেখা থেকে কিছু নির্বাচিত অংশ কোড করছি।

“হুমায়ূন আহমেদ এর ‘সস্তা’ এবং ‘বাজারি’ লেখালেখি নিয়ে ‘সাহিত্য পণ্ডিত’ এবং ‘বোদ্ধাদের’ তুমুল সমালোচনা দেখে যারপর নাই আপ্লুত। হুমায়ূন আহমেদ নাকি তরল সাহিত্য রচনা করেছেন, যার ফলে দেশে অজস্র তরল পাঠকের সৃষ্টি হয়েছে, সেইসব তরল পাঠক ‘বিদগ্ধ’ সাহিত্যিকদের আগুন গরম সাহিত্য পাঠ করতে গেলে সেইসকল সুগভীর, আগুন-গরম, ক্ল্যাসিক এবং একই সাথে ধ্রুপদী সাহিত্যের তাপে নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে মিলিয়ে যাবেন-

এইবার আলোচনায় আসি, হুমায়ূন আহমেদ নিজে কি কখনোই দাবী করেছেন যে তিনি কালজয়ী সাহিত্যিক?

করেন নি। তিনি বরং অকপটে তার সাহিত্য নিয়ে হাস্যরস করেছেন। প্রকাশ্যে বলেছেন, জ্বী জনাব, আমি বাজারী লেখা লিখছি, সস্তা উপন্যাস লিখছি।”

বিঃদ্রঃ হুমায়ূন আহমেদ একবার বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপক, বিদগ্ধ সমালোচককে তার একটি গল্প পড়তে দিয়ে মতামত জানতে চাইলেন। অধ্যাপক গল্পটি পড়ে বললেন, ‘মন্দ নয়। তবে এতে গভীরতা কম’।

হুমায়ূন আহমেদ পাণ্ডুলিপিটি ফেরত নিয়ে পকেটে ভরতে ভরতে বললেন, ‘গল্পটি আমার নয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমি চরিত্রের নাম পাল্টে কপি করে দিয়েছিলে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরতার অভাব, তখন আমার লেখা অগভীর হলে আমার দুঃখ নেই’।

সাহিত্যের সস্তা পাঠক হিসেবে একটা সস্তা কথা বলি? – ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়’।**এবং ‘কারও মনোরঞ্জন করাও সাহিত্যের কাজ নয়, কাউকে শিক্ষা দেওয়াও নয়। সাহিত্য ছেলের হাতের মোয়াও নয়, গুরু হাতের বেতও নয়’।**

আপনারা আসলে চাচ্ছেন, সাহিত্য রচিত হোক কেবল মাত্র আঁতেল এবং বোদ্ধা শ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্য, কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন চর্চা ও শিক্ষণীয় মেসেজ প্রদানের জন্য। এটি আসলে আধিপত্যবাদি হেজেমনিক প্রক্রিয়ায় একধনের ডিসকোর্স তৈরির চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না।

বিঃদ্রঃ উপরের স্টার (**) চিহ্নিত উদ্ধৃতি দুটো আমার মতো সস্তা বাজারি পাঠকের নয়। উহা প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ থেকে নেয়া। কিঞ্চিত আশংকায় আছি, আপনাদের বিদগ্ধ মননশীলতায় এখন প্রমথ চৌধুরীও না আবার ‘সস্তা’ হয়ে যান!”

হুমায়ূন আহমেদ এর কাঠপেন্সিল থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি- তিনি লিখেছেন,
‘বাজারি লেখক- বিষয়টা আরও পরিস্কার করা দরকার। তেল-সাবান- পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন।

বাংলা উপন্যাসের জন্ম হয় পাশ্চাত্য প্রভাবে। এর আদর্শ-ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পায় বঙ্কিমের হাতে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি উপন্যাস রাজর্ষি ও বউঠাকুরানীর হাট বঙ্কিম-প্রভাবিত। বাংলা উপন্যাস নতুন বাঁক নেয় চোখের বালির মাধ্যমে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে যোগ করেন নতুন মাত্রা। বঙ্কিমীধারার লেখক মীর মশাররফ হোসেন। মীর মশাররফ হোসেন অসাধারণ জীবনচেতনার বৃহত্তর সমাজ কাঠামোকে উপন্যাসে আনেন।

বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিভাবান লেখকদের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যে -বিস্তৃতিও ঘটেছে অনেকদূর। সামাজিক বৈষম্য, বংশাভিমান, ভেদবিরোধী ব্যাপার, পীরপ্রথা, রোমাঞ্চকর অলৌকিকত্ব, ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃৃতি, অস্পৃশ্যতা, ধর্মন্ধাতা, অবরোধ, নারীনির্যাতন, কর্পোরেট পুঁজি ও অন্তর্জালবিষয়ক জটিলতা এ শতকে বাঙালি লেখকরা নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমাজচিন্তায় শৈথল্য এসেছে। সংস্কৃতি পাল্টেছে।

একুশ শতকের উপন্যাস এখন আরও জটিল বাস্তবতামুখর। এতে ধর্মান্ধতা, মনস্তত্ত্বও ভিন্ন মাত্রায় উপন্যাসে যুক্ত হয়েছে। ফলে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র উপন্যাসের কমেনি। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। তিনি বাঙালি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখতে পেরেছিলেন। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারে, শ্যামল ছায়া, কোথাও কেউ নেই, শ্রাবণ মেঘের দিন, এইসব দিনরাত্রি, আগুনের পরশমণি, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি ব্যাপকভাবে পাঠকনন্দিত উপন্যাস।

কিন্তু এই সময়ে যে লেখক সবচেয়ে আলোচিত তিনি হুমায়ূন আহমেদ নন, তিনি কাশেম বিন আবুবাকার। এএফপি তাকে নিয়ে নিউজ করার আগে আমরা শুদ্ধবাধি লেখকরা অনেকেই তার নামই শুনি নি।

পরবর্তী পর্বে যা থাকবে

ব্যাপক জনপ্রিয় আরব্য উপন্যাস আলিফ লায়লা, সিন্দাবাদ, আলীবাবার চল্লিশ চোর
অনুপ্রেরনামূলক রোমান্স উপন্যাস
কাশেম বিন আবুবাকারের উপন্যাসের ক্যাটাগরী
হুময়ূন আহমেদ ও কাশেম বিন আবুবাকারের লেখা লেখির তুলনামূলক বিশ্লষণ
উপসংহার

সস্তা এবং বাজারি লেখালেখিঃ হুমায়ূন আহমেদ থেকে কাশেম বিন আবুবাকার

হুমায়ুন আহমেদের মতন জনপ্রিয় সাহিত্যিক এই বাংলাদেশে জন্মেনি, তা চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়। আমার এই লেখার শুরুতেই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর চার পূর্তি উপলক্ষে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে সাদত হোসাইন -এর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেবার লোভ সমলাতে পারছি না।

“হুমায়ূন আহমেদ এর ‘সস্তা’ এবং ‘বাজারি’ লেখালেখি নিয়ে ‘সাহিত্য পণ্ডিত’ এবং ‘বোদ্ধাদের’ তুমুল সমালোচনা দেখে যারপর নাই আপ্লুত। হুমায়ূন আহমেদ নাকি তরল সাহিত্য রচনা করেছেন, যার ফলে দেশে অজস্র তরল পাঠকের সৃষ্টি হয়েছে, সেইসব তরল পাঠক ‘বিদগ্ধ’ সাহিত্যিকদের আগুন গরম সাহিত্য পাঠ করতে গেলে সেইসকল সুগভীর, আগুন-গরম, ক্ল্যাসিক এবং একই সাথে ধ্রুপদী সাহিত্যের তাপে নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে মিলিয়ে যাবেন…

এইবার আলোচনায় আসি, হুমায়ূন আহমেদ নিজে কি কখনোই দাবী করেছেন যে তিনি কালজয়ী সাহিত্যিক?

না, করেন নি। তিনি বরং অকপটে তার সাহিত্য নিয়ে হাস্যরস করেছেন। প্রকাশ্যে বলেছেন, জ্বী জনাব, আমি বাজারী লেখা লিখছি, সস্তা উপন্যাস লিখছি।”

তার লেখা থেকে আর একটু উদ্ধৃতি করেই চলে যাব আমার মূল আলোচনায়। সত্যি কি মিথ্যা তা জানি না, আমি বেশ মজা পেয়েছি। যদি রসবোধ থাকে তবে আপনিইও একটু মজা নিয় নিন। সাদাত হোসাইন সবশেষে লিখেনঃ-

বিঃদ্রঃ হুমায়ূন আহমেদ একবার বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপক, বিদগ্ধ সমালোচককে তার একটি গল্প পড়তে দিয়ে মতামত জানতে চাইলেন। অধ্যাপক গল্পটি পড়ে বললেন, ‘মন্দ নয়। তবে এতে গভীরতা কম’।

হুমায়ূন আহমেদ পাণ্ডুলিপিটি ফেরত নিয়ে পকেটে ভরতে ভরতে বললেন, ‘গল্পটি আমার নয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমি চরিত্রের নাম পাল্টে কপি করে দিয়েছিলে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরতার অভাব, তখন আমার লেখা অগভীর হলে আমার দুঃখ নেই’।

প্রথমে একটু হাস্যরসের দিয়ে শুরু করে গভীরে যাওয়া যাবে। আর কে না জানে যতই গভীরে যাই ততই মধু। রাম, সাম, যদু বধু একটু অপেক্ষা করুন গভীরে যাওয়ার আগে আর একটু চটুল কথা শুনে নেই। সাদত হোসাইন থেকে-

“সাহিত্যের সস্তা পাঠক হিসেবে একটা সস্তা কথা বলি? – ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়’।**
এবং ‘কারও মনোরঞ্জন করাও সাহিত্যের কাজ নয়, কাউকে শিক্ষা দেওয়াও নয়। সাহিত্য ছেলের হাতের মোয়াও নয়, গুরু হাতের বেতও নয়’।**

আপনারা আসলে চাচ্ছেন, সাহিত্য রচিত হোক কেবল মাত্র আঁতেল এবং বোদ্ধা শ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্য, কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন চর্চা ও শিক্ষণীয় মেসেজ প্রদানের জন্য। এটি আসলে আধিপত্যবাদি হেজেমনিক প্রক্রিয়ায় একধনের ডিসকোর্স তৈরির চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না।

বিঃদ্রঃ উপরের স্টার (**) চিহ্নিত উদ্ধৃতি দুটো আমার মতো সস্তা বাজারি পাঠকের নয়। উহা প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ থেকে নেয়া। কিঞ্চিত আশংকায় আছি, আপনাদের বিদগ্ধ মননশীলতায় এখন প্রমথ চৌধুরীও না আবার ‘সস্তা’ হয়ে যান!”

কে এই সাদাত হোসাইন যার লেখা থেকে উদ্ধৃতি করছি? নাম শুনেছেন কখনও? নাম না শুনলেও ক্ষতি নেই। এমন কেউতো আছেন যার নাম শুনিনি তবু তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এএফপি সংবাদ পরিবেশন করে, সে কথা পরে আসছি, তার আগে জানাশুনা প্রমথ চৌধুরী দুটি ভাল করে বুঝে নেই। খুব খেয়াল সামনে কাজে লাগতে পার।

প্রথম কথা হচ্ছে সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেয়া, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সাহিত্য শিক্ষামূলক ক্লাস নয়। সকলকে আনন্দ দেয়াই সাহিত্য! নিজের কিছু অর্জন নয়?

আমাদের দেশে অনেকেই হতাশ কণ্ঠে উপদেশ দেন, ‘লেখালেখি করে কী হবে? কবি, সাহিত্যিকদের জীবনে টাকা-পয়সা হয় না। শেষে না হবে সংসার, না হবে সুন্দর জীবন।’
আসলেই কি তাই? আমরা জানি, অতীতে অনেক বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিকদের কষ্টে দিন কেটেছে। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণও করেছেন কেউ কেউ। তবে এখন দিন কিছুটা বদলেছে। তবে পরিস্থিতির ততোটা উন্নতি এখনও হয়নি যতোটা হলে লেখালেখিটাকে এ দেশে প্রধান পেশা হিসেবে নেয়া যায়। ব্যতিক্রম হয়তো আছে কিন্তু তাদের নাম আঙুলের কর গুনে বলে দেয়া যায়।

বিদেশে এ চিত্র কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রফেশনাল রাইটার আছেন। তারা লেখালেখি ছাড়া আর কিছুই করেন না। এবং এ করেই তাদের দিন দিব্যি কেটে যায়। এমনকি এদের কেউ কেউ চমকে ওঠার মতো ধনীও বটে। তাদের বই বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়। বই বিক্রির রেকর্ডও গড়েছেন অনেকে। ফলে লেখক স্বত্ব নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। তারা লিখেই কোটিপতি।

বিশ্ব লেখালেখি থেকে আয়ের বিবরণ শুনে দেশে ফিরে আসব।ক’জন ধনী লেখককে নিয়ে লিখেছেন সাইফ বরকতুল্লাহ। আমরা তার থেকে নির্যাসটুকু দেখে নেই। লেখালেখি থেকে আয় ব্যাপারটা বেশ মজার, কি বলেন।

ধনী লেখকের কথা উঠলেই জে কে রাউলিংয়ের নাম উঠে আসে। তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী লেখক। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্যে জন্ম নেয়া এই লেখকের আয় কত অনুমান করুন তো? জানি পারবেন না! তাহলে শুনুন তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি টাকায় ১০৮ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৩৫ টাকা। কী, চোখ কপালে উঠে গেল! এবার আপনিই হিসাব করে তার দৈনিক আয় কত হয় বের করুন। আরেকটি মজার তথ্য দেই, তার এই আয় কিন্তু মোটামুটি একটি সিরিজ দিয়েই। নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন কোন সিরিজ? ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ লিখেই তিনি এ পরিমাণ আয় করেন।

পাঠক চলুন, আমরা লেখক স্টিফেন কিংয়ের গল্পটা শুনি। আমেরিকায় জন্ম নেয়া স্টিফেন কিং-ও ধনী লেখকদের একজন। এই লেখকের ৫০টিরও অধিক বেস্ট সেলার উপন্যাস রয়েছে। যা থেকে আয় হয়েছে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া সিনেমার স্ক্রিপ্ট ও অন্যান্য লেখা মিলিয়ে স্টিফেন কিং ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। এক হিসাব অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ১৩২ কোটি ২ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৬ টাকা।

জেমস প্যাটারসনকে বলা হয়, তার বই নাকি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এ কি শুধুই কথার কথা? তা নয়, ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুদ্রিত বই বিক্রির পরিসংখ্যান টেনে প্রকাশনা বিশ্লেষক সংস্থা নিলসেন এই তথ্য দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রাউলিংয়ের বই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণে বিক্রি হলেও, এখানে প্যাটারসন এগিয়ে। প্যাটারসনের বিগত ১৫ বছরে লেখা বইগুলো বাজারে হট কেক হিসেবে বিক্রি হয়েছে। তার গোয়েন্দা ধারাবাহিক ‘এলেক্স ক্রস’ এ পর্যন্ত তিন কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। ভাবা যায়! যেখানে এই বাংলাদেশে ৫০০ কপি বই বিক্রি করতে প্রকাশকদের নিরন্তর ঘাম ঝড়াতে হয়। জেমস প্যাটারসনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ, নিউইয়র্কে। তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ৬৯১ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার ৭৯৬ টাকা।

হা হা হা। ভাবছেন এত টাকা পয়সা দেখে পাগল হয়ে গেলাম নাকি? না না পাগল হইনি জনাব, তবে গোপনে একটা সত্যি কথা বলি, কাউকে বলনেন যেন! আমিও নিজেকে লেখক মনে করি। ব্লগে কিছু কবিতা পোষ্ট করেছিলাম, কেউ বলল দারুন, কেউ বলল অসাধারণ। আর যাই কই, ব্লগারস ফোরামের ব্যানারে নিজের একটি কবিতার বই বের করলাম। মাত্র ২০০ কপি ছাপা হয়েছিল, বই মেলায় বিক্রি হয়েছে ৮০ কপি। হা হা হা। আবারও হাসলাম। ভাবছেন ব্যাপার কি! হাসছি আপনি যে এখনও লেখাটি পড়ে যাচ্ছেন, আপনি জানেন কি আমি এই লেখার ভূমিকাটুকু এই মাত্র শেষ করেছি।

এতটুকু কষ্ট করে লেখাটির সাথে লেগে আছেন, পারেনও বটে!, আচ্ছা, আসেন একটু সামনে বারি। আপনারা সাহিত্যের বড় বড় উপন্যাস পড়তে পারেন আর আমার এই লেখাটি পড়বেন না এতটা হতাশবাদী আমি নই।

বাংলা উপন্যাসের জন্ম হয় পাশ্চাত্য প্রভাবে। এর আদর্শ-ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পায় বঙ্কিমের হাতে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি উপন্যাস রাজর্ষি ও বউঠাকুরানীর হাট বঙ্কিম-প্রভাবিত। বাংলা উপন্যাস নতুন বাঁক নেয় চোখের বালির মাধ্যমে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে যোগ করেন নতুন মাত্রা। বঙ্কিমীধারার লেখক মীর মশাররফ হোসেন। মীর মশাররফ হোসেন অসাধারণ জীবনচেতনার বৃহত্তর সমাজ কাঠামোকে উপন্যাসে আনেন।

বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যে -বিস্তৃতিও ঘটেছে অনেকদূর। সামাজিক বৈষম্য, বংশাভিমান, ভেদবিরোধী ব্যাপার, পীরপ্রথা, রোমাঞ্চকর অলৌকিকত্ব, ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃৃতি, অস্পৃশ্যতা, ধর্মন্ধাতা, অবরোধ, নারীনির্যাতন, কর্পোরেট পুঁজি ও অন্তর্জালবিষয়ক জটিলতা এ শতকে বাঙালি লেখকরা নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমাজচিন্তায় শৈথল্য এসেছে। সংস্কৃতি পাল্টেছে। একুশ শতকের উপন্যাস এখন আরও জটিল বাস্তবতামুখর। এতে ধর্মান্ধতা, মনস্তত্ত্বও ভিন্ন মাত্রায় উপন্যাসে যুক্ত হয়েছে। ফলে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র উপন্যাসের কমেনি। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। তিনি বাঙালি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখতে পেরেছিলেন। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারে, শ্যামল ছায়া, কোথাও কেউ নেই, শ্রাবণ মেঘের দিন, এইসব দিনরাত্রি, আগুনের পরশমণি, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি ব্যাপকভাবে পাঠকনন্দিত উপন্যাস।

হুমায়ূন আহমেদের বই মানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ব্যাপকভাবে বিক্রিত হয় তার বই। ব্যাপারটি দৃষ্টিগোচর হয় সকলের। অনেক সমালোচক যিনি আমাদের মতো লেখকও বটে তারা বিশুদ্ধ ধারার। আসুন শুনি আসিফ মহিউদ্দিন তার এক ব্লগে লিখেনঃ

আমাদের দেশে বই প্রকাশ এবং বই বিক্রি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। পাঠক তৈরি এবং প্রতিবছর টন টন বই উৎপাদন করে আমাদের সাহিত্যিকগণ বর্তমানে প্রচুর টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন, লেখালেখিকে একটি লাভজনক ব্যাবহায় পরিণত করেছেন। একটা সময়ে আমরা বই কিনতাম নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা জানার জন্য, ইতিহাস দর্শন সাহিত্যের চমৎকার সব অংশকে ভালভাবে বোঝার জন্য। কিন্তু বর্তমানে বই প্রকাশ একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ বাণিজ্য, সাহিত্য রীতিমত একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে। এখন আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ বই কেনে ঘর সাজাবার উদ্দেশ্যে, দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া করে হালকা চটুল সুড়সুড়িমার্কা বিনোদন পেতে। হুমায়ুন আহমেদ-ইমদাদুল হক মিলন এরা বহুদিন ধরেই এই ধরণের পাঠক ধরবার চেষ্টায় লিপ্ত, এই ধরণের মানুষের সংখ্যা বেশি হবার কারণে সাহিত্যের সত্যিকারের পাঠকদের কথা বিবেচনা না করে আমাদের জনপ্রিয় সাহিত্যিকগণ বর্তমানে জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন। শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ যার নাম দিয়ে ছিলেন ‘অপন্যাস’, আর এই ধরণের সাহিত্যিকের নাম দিয়েছিলেন ‘অপন্যাসিক’।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খুব শিক্ষিত নয়। তারা জটিল কথাবার্তা বোঝে না, সহজ সাধারণ জীবন যাপন করেন। এই ধরণের মানুষের মনস্তত্ত্বে হুমায়ুন আহমেদ নাড়া দিতে পারবেন খুব সহজেই। আসলে এই ধরণের পাঠক আকর্ষণ করতে খুব মেধাবী সাহিত্যিকের প্রয়োজন নেই, হুমায়ুন আহমেদের মেধা যে তাই অপাত্রে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

আমাদের দেশে বই বিক্রি আর সাহিত্যকে ব্যবসায় পরিণত করার জন্যেও হুমায়ুন আহমেদকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়। তিনি জনপ্রিয় থাকতে চেয়েছেন, সকল ধরণের পাঠক সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে অনেক পানি ঘোলাও করেছেন। আমরা বুঝি, জনপ্রিয়তার নেশা কাটানো মুশকিল, এবং দেশের প্রগতিশীলদের থেকে শুরু করে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হবার তার আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে তাকে একজন পতিত বুদ্ধিজীবীতে পরিনত করছে কিনা, সেটাও ভেবে দেখবার সময় হয়েছে।

আসিফ মহিউদ্দিন এর লেখা থেকে বুঝা যাচ্ছে শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদকে সস্তা লেখক বলেছেন, বলেছেন অপন্যাসিক। আজাদ স্যার বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন, প্রতিভাবান, পন্ডিত মানুষ ছিলেন তিনি খুব সহজেই যে কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেই পারেন। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তিনি সকলকেই হেয় জ্ঞান করতেন। আমি সেদিকে জেতে চাই না। আমি যে বিষয়টিতে দৃষ্টি দিতে চাই তা হলো হুমায়ূন আহমেদের পাঠকের কোয়ালিটি নিয়ে। আসিফ মহিউদ্দিনের ভাষায় এরা সকলে সহজ সরল, অল্প শিক্ষিত, জটিলতা বুঝার ক্ষমতা তাদের নাই।

ওদিকে আরেক বিদগ্ধ সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন হুমায়ূন আহমেদের মুত্যু পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশি পাঠকদের কোয়ালিটি নিম্নমানের বলে আক্ষা দিয়েছেন। এই তুলনায় কলিকাতার পাঠকরা বিদগ্ধ বলেছেন কারণ বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ কিম্বদন্তিতূল্য জনপ্রিয়, পক্ষান্তরে সুনীল, শীর্ষেন্দুর অনেক প্রচেষ্টার পরও ওপার বাংলায় তেমন পাঠকপ্রিয়তা পান নি।

হুমায়ূন আহমেদের এক লেখা থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি করা যেতে পারে। হুমায়ূন আহমেদ এর কাঠপেন্সিল থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি- তিনি লিখেছেন,

‘বাজারি লেখক- বিষয়টা আরও পরিস্কার করা দরকার। তেল-সাবান- পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমনের নমুনা, ‘অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎ সাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না।… ”

আমি নিজেকে এক মহান লেখক ভেবেছি, কারণ আমি মনে করি আমি কিছু কালজয়ী কবিতা লিখেছি। আমার বই বিক্রির পরিসংখ্যান তো আগেই দিয়েছি। ভাবছেন এই আলোচনায় কেন আমি নিজের কথা বলছি? শুনতে পাই যারা বিদগ্ধ লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত তাদের কারও কারও অবস্থা নাকি আমার চেয়েও করুণ। হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকে আবারো কোড করে এ প্রসঙ্গেটার ইতি টানতে চাই।

যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন।

আমাদের আলোচনা কোন মহান, মুক্তবুদ্ধি, কমিটেড, সত্যসন্ধানী লেখক নিয়ে নয়। আমরা বাজারি লেখকদের নিয়ে আলোচনায় করছি এবং এক আত্মস্বীকৃত বাজারে লেখক হুমায়ূন আহমেদকে বিশ্লষণ করেছি। এবার অন্যদিকে যেতে চাই।

এই সময়ে যে লেখক সবচেয়ে আলোচিত তিনি হুমায়ূন আহমেদ নন, তিনি কাশেম বিন আবুবাকার। এএফপি তাকে নিয়ে নিউজ করার আগে আমরা শুদ্ধবাধি লেখকরা অনেকেই তার নামই শুনি নি।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, কাসেম বিন আবুবাকার ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে একজন বই বিক্রেতা হিসেবে প্রায় সব উপন্যাসের মধ্যে শুধু শহুরে অভিজাতদের জীবনযাত্রার কথা দেখতে পেয়ে নিজেই হাতে কলম তুলে নেন।

ইসলামী মূল্যবোধকে সামনে রেখে কাসেমের লেখা একের পর এক প্রেমের উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে। এসব উপন্যাস দ্রুতই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লাখ লাখ পাঠকের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে তার উপন্যাস।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেক্যুলার লেখকরা এমন এক দুনিয়ার গল্প বলেছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধান অংশের গ্রামীণ ও ধর্মীয় জীবনের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয়েছে। কাসেম এ শূন্যতার বিষয়টি অনুধাবন করে তার উপন্যাসের বাজার গড়ে তুলেছেন।

অনেকে আকাশ থেকে পড়ছি, কাশেম বিন আবুবাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় , কীভাবে? সত্যিটা হচ্ছে, পৃথিবীর সবদেশে সবসময় কাটতি বেশি যথাক্রমে রেসিপি, পর্নোগ্রাফিক এরপর ধর্মীয় বই।

গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার অরিজিত রায়চৌধুরী একবার বলেছিলেন প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে পঞ্জিকা অন্তত বিশ লাখ কপি বিক্রি হয় । অথচ বাংলা উপন্যাস পাঁচ হাজার বিক্রি হলেই বেস্টসেলার – আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্র বলেছিলেন সেবারই।

প্রশ্ন হচ্ছে কাশেম বিন আবুবাকার এর যে লেখাগুলি এত এত কপি বিক্রি হয় তা কি রেসিপি, পর্ণোগ্রাফি, ধর্মীয় পুস্তক বা পঞ্জিকা। এসব কিছুই নয়, এমনকি এগুলি হুমায়ূন অহমেদের অপন্যাস ও নয়, এগুলিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ইসলামি উপন্যাস হিসাবে।

বেশি বিক্রি হওয়া উপন্যাসের মধ্যে একটি ক্যাটাগরি হচ্ছে রোমান্স উপন্যাস।
রোম্যান্স উপন্যাস বা রমন্যাস পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে, বিশেষত ইংরেজি-ভাষী জগতে বিকশিত একটি সাহিত্যধারা। এই বর্গের উপন্যাসগুলির মূল উপজীব্য দুই ব্যক্তির প্রেম ও প্রণয়সম্পর্ক, যার পরিসমাপ্তি হবে “সর্বদা মানসিকভাবে সন্তুষ্টিবিধায়ক ও আশাব্যঞ্জক”

১৯৭২ সালে অ্যাভন বুকস প্রকাশিত ক্যাথলিন উইডিউইস রচিত দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ার উপন্যাসটি আধুনিক রোম্যান্সের সূচনা করে। এটিই ছিল মূল পেপারব্যাক আকারে প্রকাশিত প্রথম সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্স উপন্যাস। ১৯৮০-এর দশকে এই ধারাটি সমৃদ্ধিলাভ করে। অনেকসংখ্যক ক্যাটেগরি উপন্যাসের পাশাপাশি সিঙ্গল-টাইটেল উপন্যাসের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। জনপ্রিয় লেখকগণ এই ধারার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্লট ও চরিত্রচিত্রণে আধুনিকতার ছোঁওয়া লাগে।

উত্তর আমেরিকায় ২০০৪ সালে বিক্রীত সমস্ত পেপারব্যাক বইয়ের ৫৫% রোম্যান্স উপন্যাস। এই অঞ্চলে আধুনিক সাহিত্যে জনপ্রিয়তম ধারা তাই এইটিই।

রোমান্স ক্যাটাগরীর উপন্যাসের মধ্যে যৌনতা, নগ্নতা ইত্যাদিও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। তবে ধর্মীয় ভাবধারায় ও রচিত হতে দেখা যায় অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স উপন্যাস যে সব উপন্যাস বিক্রির দিক থেকে সফল হতে দেখা যায়।

বর্তমান বিশ্ব বাজারে বিদ্যমান অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স উপন্যাসগুলি খ্রিস্টান ভাবধারা ও প্রণয়সম্পর্কের বিকাশ কেন্দ্রিক কাহিনির সংমিশ্রণ। ২০০৪ সালে, এই উপবর্গে ১৪৭টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। এই উপন্যাসে সাধারণত অপ্রয়োজনীয় হিংসাত্মক কার্যকলাপ বা অশ্লীল বাক্যাদি ব্যবহৃত হয় না। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির প্রণয় হয় সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। যৌনতার উল্লেখ যদি বা থাকে, তবে তা ঘটে বিবাহের পর এবং তার বিস্তারিত বর্ণনাও বাদ রাখা হয়। অনেক উপন্যাসেই নায়ক বা নায়িকার বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়। যার হলে প্রেমকাহিনিটি পরিণত হয় “নায়ক, নায়িকা ও ঈশ্বরের সহিত তাদের সম্পর্ক নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ত্রিভূজ”-এ। ক্ষমা, সততা ও বিশ্বাস এই উপবর্গের সাধারণ কয়েকটি থিম।

স্পষ্টত কাশেম বিন আবুবাকার এর উপন্যাসগুলি অনুপ্রেরণামূলক রোমান্স উপন্যাস। প্রশ্চাত্য জগতে খ্রীষ্টান ভাবধারায় রচিত হয়, আর বাংলাদেশে কাশেম বিন আবুবাকার রচনা করেছেন ইসলামি ভাবধারায় এবং তিনি ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছেন।

রোমান্স উপন্যাস

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, কাসেম বিন আবুবাকার ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে একজন বই বিক্রেতা হিসেবে প্রায় সব উপন্যাসের মধ্যে শুধু শহুরে অভিজাতদের জীবনযাত্রার কথা দেখতে পেয়ে নিজেই হাতে কলম তুলে নেন। এরপর ১৯৭৮ সালে কাসেম তার প্রথম উপন্যাস ‘ফুটন্ত গোলাপ’ লেখেন। তবে ‘মোল্লার উপন্যাস বিক্রি হবে না’ বলে এটি প্রকাশকের নজর কাড়তে প্রায় এক দশক সময় লাগে। ওই প্রকাশকের কাছে মাত্র এক হাজার টাকায় এটির স্বত্বও বিক্রি করে দেন তিনি। এরপর ইসলামী মূল্যবোধকে সামনে রেখে কাসেমের লেখা একের পর এক প্রেমের উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে। এসব উপন্যাস দ্রুতই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লাখ লাখ পাঠকের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে তার উপন্যাস।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেক্যুলার লেখকরা এমন এক দুনিয়ার গল্প বলেছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধান অংশের গ্রামীণ ও ধর্মীয় জীবনের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয়েছে। কাসেম এ শূন্যতার বিষয়টি অনুধাবন করে তার উপন্যাসের বাজার গড়ে তুলেছেন। এছাড়া কাসেমের এ প্রচেষ্টা থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক বাংলাদেশি লেখক অনুপ্রাণিত হয়ে সমকালীন ‘ইসলামী উপন্যাস’ লিখে সাফল্যের পথ খুঁজে পেয়েছেন। এদের মধ্যে আবদুস সালাম মিতুল, কাউসার আহমেদ এবং আবদুল আলিমের মতো লেখক উল্লেখযোগ্য।

তিনি বলেন, “মেইনস্ট্রীমের বাইরে একজন বড় জনগোষ্ঠী আছে এবং সেখানে বয়সেরও একটা বিষয় আছে। কাশেম বিন আবু বাকার সেই জায়গাতেই আঘাত করেছেন। আমাদের দেশে যখনি কোন সাহিত্যিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে যেমন হুমায়ুন আহমেদ কিংবা কাজী আনোয়ার হোসেনকে নিয়েও বিতর্ক হয়েছে বিভিন্ন সময়। এতে তাদের কিছু আসে যায়নি””।
মিস্টার আহমেদ বলেন সুশীল সাহিত্য সমাজ কিংবা সমালোচক কি গ্রহণ করলো আর না করলো তাতে আগেও কাসেম বিন আবু বাকারের কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি সফল লেখক এটা বলতেই হবে।
আর তাঁর এই জনপ্রিয়তার কারণ কি? জবাবে কাসেম বিন আবুবাকার নিজেই বিবিসিকে বলেছেন যে ইসলামী ভাবধারায় এই মূল্যবোধ-নির্ভর সাহিত্যই তার পাঠকপ্রিয়তার আসল রহস্য বলে মনে করেন তিনি।

তবে এর সাথে মোটেও একমত নন ইসলামপন্থীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় মাসিক মদিনা পত্রিকার সম্পাদক আহমদ বদরুদ্দিন খান।
তিনি বলেন, “উনার একটা উপন্যাস বোরকা পড়া সেই মেয়েটি। মেয়েটিকে বোরকা পড়িয়েছেন পাশাপাশি মেয়েটিকে তিনি এমন প্রেমে জড়িয়েছেন তার গল্পের মাধ্যমে সেটা ইসলামে অবৈধ। প্রেম নামে যে জিনিসটাকে ইসলামি মোড়কে তুলে আনছেন সেটা আপত্তিজনক”।

“বর্তমান যুগের নররা দিব্যি মাথায় হ্যাট, গলায় নেকটাই, পায়ে মোজা এবং ফুলপ্যান্ট ও ফুলশার্ট পরে শরীরের কোন অংশই মেয়েদের দেখাতে চায়না। অপরদিকে নারীকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় সাথে সাথে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। নারীদের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে, তারা জাঙ্গিয়া ও বেসীয়ার পরে বেড়াতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। আর সেই কারণে পৃথিবীর সব দেশে মেয়েদের কদর কমে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহ রাসুল (দঃ) মেয়েদের কিমতি (দামী) জিনিস বলে উল্লেখ করেছেন। একটু বিবেচনা করলে বুঝতে পারবেন। কেউ দামী জিনিসকে যেখানে সেখানে উন্মুক্ত করে ফেলে রাখে না। ফেলে রাখলে তার কি অবস্থা হবে সবাই জানে। ভালো জিনিস দেখলে কার না লোভ হবে। যেই সুযোগ পাবে সেই হাত বাড়াবার চেষ্টা করবে। ফলে নানারকম অশান্তি সৃষ্টি হবে। নারী স্বাধীনতার নাম করে করে মেয়েরা যে সর্বক্ষেত্রে পর্দা না মেনে যত্রতত্র অবাধ বিচরণ করছে, তার ফলাফল যে কত বিষময়, তা তো অহরহ গ্রামে গঞ্জে ও শহরে এবং খবরের কাগজে দেখতে পাচ্ছি।”

প্যাকেট ছাড়া লজেন্স অথবা পাহারাদার ছাড়া তেঁতুল গাছ অথবা সিন্দুক ছাড়া গয়না ফেলে রাখলে কি হতে পারে সেটা আমরা সবাই জানি। লেখক বারবার আমাদেরকে সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে দেশের মেয়েরা জাঙ্গিয়া ও বেসীয়ার পরে ঘুরতে পারে এটা কল্পনা করে লেখক একই সাথে আনন্দে ও ভয়ে শিউরে উঠছেন। সেইসাথে ভালো জিনিস দেখলে যে কারোরই লোভ হতে পারে, সেটা লোভির দোষ নয় বরং জিনিসের দোষ সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পেন্টি, ব্রা, বেসিয়ার, জাঙ্গিয়া এই শব্দগুলা এক বিশেষ শ্রেণীর সহিহ লোকজন বেশ আরামের সাথে উচ্চারণ করে থাকেন। শব্দগুলা উচ্চারণের সময় বস্তুগুলা কল্পনা করে তাদের চোখ আমোদে বুদ হয়ে যায়। লেখক তার লেখার পরতে পরতে এই আমোদের যোগান দিয়েছেন।

ঘটনা আরও এগুলে আমরা লাইলীর গুনাগুন সম্পর্কে আরও জানতে পারি। লাইলী চমৎকার গান গায়। তবে হিন্দু ইহুদী নাছারাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত না। একেবারে সহিহ উর্দু গজল। “নেগাহুকী সাদমে বেখুদ বানাদে, মুঝে সোফিয়া জামে ওহদাৎ পিলাদে” গেয়ে সে সবাইকে পাগল করে দেয়। পাঠক হিসেবে গজলের মানে পুরো না বুঝলেও ধারণা করতে পারি এখানে সোফিয়ার দেয়া জাম খেয়ে স্বাদে পাগল হয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে এখানে। তার গান শুনে তাকে টিভি রেডিওতে গান গাওয়ার কথা বলা হলে লাইলী ঝাড়ি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়, ইসলামে গান বাজনা হারাম। মনে পরে যায় আমার এক সহিহ শিক্ষকের কাহিনী। যিনি গান শুনে একটি মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। তারপর ফতোয়া দিয়েছিলেন, গান বাজনা হারাম, শুধু বেডরুমে চলতে পারে, এর বাইরে না। লাইলীও প্রায় একই কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বেডরুমে গান গাওয়া সুবিচার, আর রেডিও টিভিতে গাওয়া ব্যভিচার।

সে যাই হোক, ফুটন্ত গোলাপের রিভিউ লিখতে থাকলে দেখা যাবে সেই বিষয়ে আলাদা একটা বইই লিখে ফেলেছি। গবেষণা করার মতো সেই পরিমাণে মণিমুক্তা এই বইতে আছে। তারচেয়ে বরং আমি এইখানেই ক্ষ্যামা দেই এই অনুরোধ করে, আজই বইখানা পড়ে দেখুন। রিভিউ শেষে একটি কথা বলেই শেষ করি। কাসেম বিন আবুবাকারের পাঠক কারা সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না। কেন এই দেশে তার বই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয় সেটাও বুঝতে সমস্যা হয়না। এই পাঠকেরাই বই পড়তে পড়তে স্বপ্ন দেখে, লাইলির মতো একটি ফুটন্ত গোলাপ তারা একদিন পাবে। এবং সেই গোলাপ একান্ত তারই হবে। একেবারে প্যাকেট করা অবস্থায়, আলো বাতাস মুক্ত অবস্থায় সেই গোলাপ তার সিন্দুকে থাকবে। সেই গোলাপের হাত পা মুখ কিছুই থাকবে না, শুধু গন্ধ থাকবে। এই পাঠকেরাই অফলাইনে গিয়ে ওড়না সরে যাওয়া কিশোরীটিকে দেখে লালা ফেলে, তারপর আবার গালি দেয় ওই মাগি তোর বুকে ওড়না কই। এই পাঠকেরাই অনলাইনে এসে সাকিব আল হাসানের সদ্য জন্মানো ফুটফুটে মেয়েটিকে কুৎসিত ভাষায় গালি দেয়। এরাই মুশফিকুর রহিমের হাস্যোজ্জ্বল বাবা মায়ের ছবিতে অকল্পনীয় নোংরা গালি দেয় তার বৃদ্ধা মা বোরখা পরেনি বলে। এই পাঠকেরাই একই সাথে ধর্মগ্রন্থের বাণী আর চটি পছন্দ করে। এই পাঠকেরাই মেয়েদের সামলে চলার উপদেশ দেয়। আপনি যেমন হয়তো জানেন না কাসেম বিন আবুবাকার দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তেমনি হয়তো জানেন না তার লক্ষ লক্ষ পাঠকেরা এভাবেই ভাবে, এভাবেই চায়, এভাবেই ফুটন্ত গোলাপের স্বপ্ন দেখে, এভাবেই লোল ফেলে।

হুমায়ুন আযাদ হুমায়ুন আহমেদকে পছন্দ করতেন না। একবার লিখলেন- হুমায়নু আহমেদ হলেন বাজারী লেখক। আর উনার নাটকগুলো কাজের মেয়েরাই বেশী পছন্দ করে।

আসিফ মহিউদ্দিন
_–_————++——

আমাদের দেশে বই প্রকাশ এবং বই বিক্রি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। পাঠক তৈরি এবং প্রতিবছর টন টন বই উৎপাদন করে আমাদের সাহিত্যিকগণ বর্তমানে প্রচুর টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন, লেখালেখিকে একটি লাভজনক ব্যাবহায় পরিণত করেছেন। একটা সময়ে আমরা বই কিনতাম নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা জানার জন্য, ইতিহাস দর্শন সাহিত্যের চমৎকার সব অংশকে ভালভাবে বোঝার জন্য। কিন্তু বর্তমানে বই প্রকাশ একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ বাণিজ্য, সাহিত্য রীতিমত একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে। এখন আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ বই কেনে ঘর সাজাবার উদ্দেশ্যে, দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া করে হালকা চটুল সুড়সুড়িমার্কা বিনোদন পেতে। হুমায়ুন আহমেদ-ইমদাদুল হক মিলন এরা বহুদিন ধরেই এই ধরণের পাঠক ধরবার চেষ্টায় লিপ্ত, এই ধরণের মানুষের সংখ্যা বেশি হবার কারণে সাহিত্যের সত্যিকারের পাঠকদের কথা বিবেচনা না করে আমাদের জনপ্রিয় সাহিত্যিকগণ বর্তমানে জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন। শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ যার নাম দিয়ে ছিলেন ‘অপন্যাস’, আর এই ধরণের সাহিত্যিকের নাম দিয়েছিলেন ‘অপন্যাসিক’।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খুব শিক্ষিত নয়। তারা জটিল কথাবার্তা বোঝে না, সহজ সাধারণ জীবন যাপন করেন। এই ধরণের মানুষের মনস্তত্ত্বে হুমায়ুন আহমেদ নাড়া দিতে পারবেন খুব সহজেই। আসলে এই ধরণের পাঠক আকর্ষণ করতে খুব মেধাবী সাহিত্যিকের প্রয়োজন নেই, হুমায়ুন আহমেদের মেধা যে তাই অপাত্রে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

এই সাধারণ মানের পাঠকদের প্রভাবিত করবার ক্ষমতা হুমায়ুন আহমেদের রয়েছে, আর তাই হুমায়ুন আহমেদ একটি ভিন্ন আঙ্গিকে গুরুত্ত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছেন। তার যেকোন কর্মকান্ড তাই সাধারণ মানুষের চিন্তা চেতনার উপরে প্রভাব ফেলতে পারে, আর তাই তার থেকে দায়িত্বশীলতা আশা করাটাও আমাদের কোন অযৌক্তিক দাবী নয়।

আমাদের দেশে বই বিক্রি আর সাহিত্যকে ব্যবসায় পরিণত করার জন্যেও হুমায়ুন আহমেদকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়। তিনি জনপ্রিয় থাকতে চেয়েছেন, সকল ধরণের পাঠক সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে অনেক পানি ঘোলাও করেছেন। আমরা বুঝি, জনপ্রিয়তার নেশা কাটানো মুশকিল, এবং দেশের প্রগতিশীলদের থেকে শুরু করে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হবার তার আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে তাকে একজন পতিত বুদ্ধিজীবীতে পরিনত করছে কিনা, সেটাও ভেবে দেখবার সময় হয়েছে।

ঘরে-বাইরে হুমায়ূন আহমেদ হাজার প্রশ্ন’ বইটিতে ‘সমাজ ও রাজনীতি’ অধ্যায়ে তিনি বলেন,

“মুক্তিযুদ্ধেও সময় যারা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেছেন তাদের মধ্যে আমার নানাও একজন, যিনি মুক্তিযুদ্ধাদের হাতে মারা গেছেন। আমার এই নানার মতো, মামার মতো ভদ্রলোক, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এত পরিপূর্ণ ভদ্রলোক এই জীবনে দেখিনি।
(অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া মানুষগুলো পরিপুর্ণ ভদ্রলোক হতে পারে! তারা খুব ভাল মানুষ হতে পারেন! হ্যা, এটা হতেই পারে, তবে এটা যখন প্রপাগান্ডা হিসেবে ব্যাবহৃত হবে, তখন সেটা জনগনের ভেতরে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিও সৃষ্টি করতে পারে!)।

আমার নানা একটি আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছেন। একটি পূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। কারণ বড় হওয়ার সময় এই অঞ্চলের হিন্দুদের দ্বারা প্রচণ্ড নির্যাতিত হয়েছিলেন। কোনো মিষ্টির দোকানে গেলে তাদের প্লেটে করে মিষ্টি দেয়া হতো না। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাদের হাতে দেয়া হতো। এটা শুধু মুসলমানদের সঙ্গেই না, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গেও করতো। এটা ছিল হিন্দুদের কাস্ট সিস্টেম। এসব দেখে দেখে সে সময়ের মুসলমানরা বড় হয়েছেন এবং তাদের মনে হয়েছে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রয়োজন। অনেক যুদ্ধের পর তারা তা পেয়েছেন। যখন তারা দেখলেন চোখের সামনে দিয়ে সেই রাষ্ট্র ভেঙে যাচ্ছে, তখন তারা মনে করেছেন আবার হিন্দু রাজত্ব শুরু হয়ে যাবে। তখন পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা শুরু করেন। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির অন্যায়গুলো ক্রমেই চোখে পড়তে থাকে। তারা দেখলেন পাকিস্তানি আর্মিরা তো কেবল হিন্দু মারছে না, সমানে মুসলমানদেরও খুন করছে। আমার নানা দেখলেন , তার অতি আদরের বড় মেয়ের পুলিশ অফিসার স্বামীকে (আমার বাবা) বেধে নিয়ে আর্মিরা গুলি করে মেরে মেরে ফেলল। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। কি হচ্ছে এসব? কোনদিকে যাবেন? তিনি কি পাকিস্তান আর্মির সঙ্গেই থাকবেন , নাকি কমন যে স্রোত আছে তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন?

এই নিয়ে কনফিউশন তৈরি হলো তার মধ্যে। তিনি এই কনফিউশন দূর করতে পারলেন না।
(তিনি কনফিউসড ছিলেন নাকি পাক আর্মীকেই সমর্থন করে গেছেন শেষ পর্যন্ত, সেটাকে হুমায়ুন আহমেদ খানিকটা টুইস্ট করে বলেছেন।)

এক্ষেত্রে তার যেমন দোষ ছিল, আমাদেরও ছিল। কারণ আমরা তাদের বোঝাতে পারিনি। কনফিউশন দূর করাতে পারিনি। তিনি মারা গেলেন মুক্তিযুদ্ধাদের হাতে। এখন আমরা তাকে ক্ষমা করব কি করব না সেই প্রশ্ন। শেখ মুজিব সাহেব তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমি ক্ষমার পক্ষপাতি। ”(ঘরে-বাইরে হুমায়ূন আহমেদ হাজার প্রশ্ন, পৃ.৩১-৩২)

মুক্তিযোদ্ধা পিতা এবং রাজাকার নানার চরিত্র হুমায়ুন আহমেদের ভেতরে চমৎকার ভাবে মিলে মিশে ঢুকে গেছে বললে সম্ভবত খুব ভুল বলা হবে না।

হুমায়ুন আহমেদ জনপ্রিয়তা রক্ষার কলাকৌশল খুব ভাল ভাবেই রপ্ত করেছেন। তার সাহিত্যের মান এখন কতটা উন্নত, তা সাহিত্যবোদ্ধাদের হাতে ছেড়ে দিতে হচ্ছে, তবে প্রতিবছর তিনি যেই হারে কেজিদরে একই জিনিস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাঠককে খাওয়াচ্ছেন, তা দেখে তার নির্লজ্জ ব্যাবসাবুদ্ধি এবং নিজের নাম ভাঙ্গিয়ে পাঠকের সাথে প্রতারণার দায়ে তাকে অবশ্যই অভিযুক্ত করা যায়। তার এক শ্রেনীর ভক্ত তৈরি হয়ে গেছে, তারা তাকে রীতিমত পীর পুজা শুরু করে দিয়েছে। কোথাও হুমায়ুন আহমেদের কোনরুপ সমালোচনা হওয়া মাত্রই তারা জিহাদী জোশে সমালোচকের উপরে ঝাঁপিয়ে পরছে, তাকে আক্রমন করছে। এটা কোন সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থা নয়।

সবশেষে হুমায়ুন আহমদেরই গুরু, তাকে তুলে নিয়ে আসায় যার অবদান অনস্বীকার্য, সেই প্রয়াত বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার একটি সাক্ষাৎকারের অংশ তুলে দিতেই হচ্ছে।

আহমদ ছফাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি কী মনে করেন হুমায়ুন আহমেদ এখন শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের সমান জনপ্রিয় লেখক?”
জবাবে আহমদ ছফা মুচকি হেসে বলেছিলেন, “হুমায়ুন আহমেদ এখন শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের চেয়েও জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু মেরিটের দিক দিয়ে সে নিমাই ভট্টাচার্যের সমান। হি রাইটস ওনলি ফর বাজার!”

————–

মায়ূন আহমেদ চলে গেছেন চার বছর হলো। কিন্তু আদৌ কি তিনি নেই? কোথায় নেই তিনি! এখনো মুগ্ধতার ঐন্দ্রজালিক জালে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন তাঁর পাঠকদের। তিনি কালোত্তীর্ণ সাহিত্যিক কিনা তা বিচার করবে ইতিহাস। তবে হুমায়ুন আহমেদের মতন জনপ্রিয় সাহিত্যিক এই বাংলাদেশে জন্মেনি, তা চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়। এগিয়ে চলো পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে এই শব্দের জাদুকরকে।

লিখেছেন- সাদাত হোসাইন

_ _ _ _ _ _

মায়ূন আহমেদ এর ‘সস্তা’ এবং ‘বাজারি’ লেখালেখি নিয়ে ‘সাহিত্য পণ্ডিত’ এবং ‘বোদ্ধাদের’ তুমুল সমালোচনা দেখে যারপর নাই আপ্লুত। হুমায়ূন আহমেদ নাকি তরল সাহিত্য রচনা করেছেন, যার ফলে দেশে অজস্র তরল পাঠকের সৃষ্টি হয়েছে, সেইসব তরল পাঠক ‘বিদগ্ধ’ সাহিত্যিকদের আগুন গরম সাহিত্য পাঠ করতে গেলে সেইসকল সুগভীর, আগুন-গরম, ক্ল্যাসিক এবং একই সাথে ধ্রুপদী সাহিত্যের তাপে নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে মিলিয়ে যাবেন…

এইবার আলোচনায় আসি, হুমায়ূন আহমেদ নিজে কি কখনোই দাবী করেছেন যে তিনি কালজয়ী সাহিত্যিক?

না, করেন নি। তিনি বরং অকপটে তার সাহিত্য নিয়ে হাস্যরস করেছেন। প্রকাশ্যে বলেছেন, জ্বী জনাব, আমি বাজারী লেখা লিখছি, সস্তা উপন্যাস লিখছি।

এই বাজারি লেখক বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর কাঠপেন্সিল থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি- তিনি লিখেছেন, ‘বাজারি লেখক- বিষয়টা আরও পরিস্কার করা দরকার। তেল-সাবান- পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমনের নমুনা, ‘অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎ সাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না।… কালজয়ি এইসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশিরভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাঁরা বিচলিত বোধ করেন। কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট না। এমন একজনের সাথে কথোপকথনের নমুনা-
কালজয়ীঃ কেমন আছেন?
আমিঃ জি ভালো।
কালজয়ীঃ ইদানীং কিছু কি লিখছেন?
আমিঃ একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি।
কালজয়ীঃ (গম্ভীর)
আমিঃ আপনি কি মহান কোন লেখায় হাত দিয়েছেন?
কালজয়ীঃ আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে’।
—————————-
জ্বী জনাব, হুমায়ূন আহমেদ এর রসবোধ ভালো!
এইবার আসি বাংলা ভাষার তথাকথিত কালজয়ী লেখকদের প্রসঙ্গে। বিদগ্ধ সমালোচক পাঠকদের বিষয়ে পরে আসি।।

বাংলাদেশের বাংলা ভাষার কালজয়ী কথাসাহিত্যিক কারা? উত্তরটা শুনতে আমি ব্যাক্তিগতভাবে খুবই আগ্রহী… কে কিংবা কারা কালজয়ী লেখক? জহির রায়হান? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস? আহমদ শরিফ? শহিদুল জহির? শাহাদুজ্জামান? রশিদ করিম? হাসান আজিজুল হক? আবদুল মান্নান সৈয়দ? হুমায়ূন আজাদ? সৈয়দ শামসুল হক? আহমদ ছফা? শহিদুল্লাহ কায়সার? ইমদাদুল হক মিলন?

আমি জানি না, বিদগ্ধ পাঠকদের প্রিয় কোন কালজয়ী কথা সাহিত্যকের নাম বাদ পড়ে গেল কিনা? যদি বাদ পড়ে যেয়ে থাকে, তাহলে নিজ গুণে আমাকে ক্ষমা করবেন, এবং সেই নামটি আমাকে জানাবেন।

এইবার গিলতে কিংবা হজম করতে কষ্ট হবে এমন একটা কথা বলব। উপরের লেখকদের মোটামুটি সকলের লেখাই কম বেশি পড়বার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কার লেখা কেমন সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার মতো দুঃসাহস কিংবা ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে একজন নগন্য পাঠক হিসেবে উনাদের অনেকের লেখা পড়েই মুগ্ধ হয়েছি। আবার কারো কারো লেখা যখন হৃদয়ঙ্গম করতে পারি নি, তখন ধরে নিয়েছি, সেই লেখা বুঝবার মতন মানসিক পরিপক্কতা এখনও অর্জন করতে পারি নি। কিন্তু কখনোই ঠোঁট উল্টে বলি নি, আরে ধুর, এই লোক কী লেখে! এর লেখা কিছু হয়? হয় না। যত্তসব!

নাহ, এই রকম কোন কথা বলবার ধৃষ্টতা কখনও হয় নি। আজকালকার বেশিরভাগ পাঠক এবং দর্শকদেরই দেখি, কারো লেখা ভালো না লাগলেই তারা অবলীলায় বলে ফেলেন, ‘এই লোক কিসের লেখক? কিসের ফিল্ম মেকার? কি লেখে, কি বানায় এইসব? এর চেয়ে ভালো পারে অমুকেও… ধুর…! আরও নানান মন্তব্য!

কিন্তু আমি পুরনো ধাঁচের মানুষ, এমন ঠোঁট উল্টে নাকচ করে দেয়ার মতন ঔদ্ধত্য কিংবা পাণ্ডিত্য কিছুই অর্জন করতে পারি নি। ফলে কিছু ভালো না লাগলেও ধরে নেই, সেটি পাঠক বা দর্শক হিসেবে সম্ভবত আমার ব্যর্থতা, আমার অনুধাবনের সীমাবদ্ধতা। হয়তো আমার বোঝাবুঝি আরও সমৃদ্ধ হওয়া জরুরী।

যেমন শাহদুজ্জামান এবং শহিদুল জহির যেমন মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। তেমনই আবার কিংবদন্তী কিংবা প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় অনেক লেখকের লেখা পড়েও মুগ্ধ হতে পারি নি। তখন ধরে নিয়েছি, সেটি আমার বোঝাবুঝির সীমাবদ্ধতা! যেমন সৈয়দ হক এর ‘খেলারাম খেলে যা’ পড়ে আমি বিশেষ কিছুই বুঝি নি, বুঝি নি এই উপন্যাস কিভাবে তার লেখালেখির খুব উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হয়েছে! কিন্তু আমি বুঝি নি বলেই যে সেই গ্রন্থ আসলেই বিশেষ কোন গ্রন্থ নয়, এটি আমি মনে করি না। আমি মনে করি, আমাকে আরও বুঝতে হবে, জানতে হবে, পড়তে হবে এবং অনুধাবন করতে হবে।

আহমদ ছফা এবং হুমায়ূন আজাদ নিয়ে আমার একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনা রয়েছে। সেই ভাবনা এখানে প্রকাশ করা ঠিক কি না আমি জানি না। তবে আজকাল যেসকল বিদগ্ধ পাঠক ‘সস্তা এবং বাজারি’ লেখক হুমায়ূন আহমেদকে গালি দেয়াকে ফরজ বলে ধরে নিচ্ছেন, না হলে বাংলা সাহিত্যের মানমর্যাদা সকলি ধুলোয় লুটাবে বলে হাপিত্যেশ করেন, সেই সকল পাঠকরা প্রায়শই ‘হুমায়ূন আজাদ’ এবং আহমদ ছফা’র দৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদকে মুল্যায়িত বা পোর্ট্রে করার চেষ্টা করেন। তারা প্রায়ই উদ্ধৃতি টানেন যে, হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে আহমদ ছফা অমুক বলেছেন, হুমায়ূন আজাদ তমুক বলেছেন… এবং তেনারা যেহেতু বলেছেন, তার মানে হল, ‘হুমায়ূন আহমেদ আসলেই তাই’।

আমার তখন খুব বলতে ইচ্ছে করে,, হুমায়ূন আজাদের কোন মহান সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি হুমায়ূন আহমেদকে ইচ্ছে মত ডিফাইন করবার অধিকার রাখেন! সংজ্ঞায়িত করার ক্ষমতা রাখেন? কি কারণে? তিনি কোন কালজয়ী-ভুবনজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন? সমাজতত্ব, মনস্তত্ব, ভাষা, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন আর এসকল বিষয়ে গুরুগম্ভীর বিশ্লেষণ, সুকঠিন বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদানই কালজয়ী সাহিত্যের কাজ?

কালজয়ী সাহিত্যকদের কাজ?
আপনি কি তাই মনে করেন?
তাহলে আর কিস্যু বলার নেই… কি বলার থাকতে পারে!!!

আহমদ ছফার কোন বই পড়ে আমার মনে হয় নি তিনি বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক? হ্যাঁ, তিনি চমৎকার কিছু লেখা লিখেছেন, তার উপন্যাসগুলোর ভাষা ক্ষুরধার, বিসয়বস্তুও সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তার কেনান আলীর উপাখ্যান, গাভী বিত্তান্ত, অর্ধেক নারী তুমি অর্ধেক ঈশ্বরী পড়ে ভাবনার জগতে আলোড়িতও বোধ করেছি, কিন্তু তারপর ভুলেও গেছি। গভীরতম অনুভূতির তাড়না অনুভব করি নি, যার রেশ স্থায়ী হয় নি। আমার হয় নি বলে যে কারোই হয় নি, তাও না। তবে আমি এইটুকু মনে করি, ‘তিনি যখন যাহা বলিবেন, হুমায়ূন আহমেদ তখনই তাহা’, কেন? হ্যাঁ, তিনি বাঙ্গালীর মনস্তত্ব নিয়ে অসাধারণ সব প্রবন্ধও লিখেছেন। সেগুলোও নিঃসন্দেহে অসাধারণ, কিন্তু তারপরও আমার ছোট্ট পাঠক মন একটা কথাই বারবার ভেবেছে, ‘আহমদ ছফা যতবড় সংগঠক, তিনি কি ঠিক ততবড় সাহিত্যিক? তার সাহিত্যিক পরিচয়ের চেয়ে কি তার সংগঠক পরিচয়ই অধিকতর শক্তিশালী নয়?’

মাফ করবেন, ভুল কিছু বলে থাকলে, এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত বোঝাবুঝি।
দয়া করে ক্ষেপে যাবেন না, ক্ষেপে গিয়ে আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে গালি গালাজ করবেন না, দুইদিনে বৈরাগী, ভাতেরে কয় অন্ন টাইপ সংলাপও দিবেন না প্লিজ, কারণ আমি এখানে অতি সাধারন এক পাঠক হিসেবেই কথা বলছি। শ্রেফ পাঠক।

হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আমি আর কি পড়েছি, নিশ্চয়ই এতক্ষণে এই প্রশ্নও এসেছে? জ্বী, আপনাদের উন্নাসিকতাটাই এখানে। আপনাদের কথা হচ্ছে, যেই পাঠক হুমায়ূনে বুঁদ হয়ে থাকে তার পক্ষে সত্যিকারের সাহিত্যের রস আস্বাদন করা অসম্ভব! তাইতো। এইবার বলেন সত্যিকারে ধ্রুপদী সাহিত্য কি? কে সেই ধ্রুপদী সাহিত্যিক? সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ? সৌমেন চন্দ, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর? (লিখলে অসংখ্য নাম লেখা যাবে) এদের মধ্যে কাউকে পান যিনি আপনার দৃষ্টিতে ধ্রুপদী কালজয়ী কথা সাহিত্যিক? পাচ্ছেন না? নাকি পেয়েছেন? পেয়ে থাকলে শোকর আলহামদুলিল্লাহ। এদের লেখা অল্পবিস্তর পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তারপরও আমার মনে হয়েছে এবং হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের অসীম ক্ষমতাবান একজন লেখক। লেখার অপার্থিব ক্ষমতা নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন, এবং সেই ক্ষমতার ‘ক্ষমতা’ তিনি দেখিয়েছেন। যিনি কালের আবর্তে হারিয়ে যাবেন না, কালজয়ী হয়েই থাকবেন। হারিয়ে যাবেন আপনি কিংবা আমার মতন বিদগ্ধ সমালোচক নাক সিটকানো ‘কালজয়ী পাঠক কিংবা সমালোচকরা’।

আপনাদের দুর্ভাগ্য, হুমায়ূন আহমেদকে আপনারা আর কি কি বলে নাকচ করবেন? উপেক্ষা করবেন? গালিগালাজ করবেন? সেসব তিনি নিজের সম্পর্কে নিজেই বলে গেছেন। তিনি বলে গেছেন, তিনি পাঠ্যবই রচনা করেন নি। তার বইতে শিক্ষণীয় কিছু খুঁজতে মানা করে গেছেন। তিনি কারো মনোরঞ্জন করতে লেখেন নি। তিনি লিখেছেন নিজের আনন্দের জন্য। আপনাদের কালজয়ী লেখকরা কালজয়ী, কারণ তেনাদের লেখায় মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ব, রাষ্ট্রতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন সর্বোপরি বিশেষ ‘মেসেজ’ থাকে, শিক্ষণীয় উপকরণ থাকে… তাইতো?

এই সস্তা পাঠক মনে করেন, হুমায়ূন আহমেদ নামক বাজারি লেখকের লেখা সকলকে প্রভুত আনন্দ দিয়েছে, অনুভূতিকে ছুঁয়ে দিতে পেরেছে গভীরতম গভীরতায়। আনন্দ কিংবা কান্নায়। তিনি কারো মনরঞ্জনের জন্য সাহিত্য রচনা করেন নি। লিখেছেন নিজের আনন্দে। যেহেতু এতো কিছুর পরও আমি হুমায়ূন আহমেদ এর মাতাল পাঠক, সেহেতু আপনাদের মতন বিদগ্ধ বিশেষজ্ঞ পাঠকদের কাছে নিশ্চয়ই আমি একজন সস্তা পাঠক। সেই বাজারি লেখকের বাজারি সাহিত্যের সস্তা পাঠক হিসেবে একটা সস্তা কথা বলি? – ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়’।**
এবং ‘কারও মনোরঞ্জন করাও সাহিত্যের কাজ নয়, কাউকে শিক্ষা দেওয়াও নয়। সাহিত্য ছেলের হাতের মোয়াও নয়, গুরু হাতের বেতও নয়’।**

আপনারা আসলে চাচ্ছেন, সাহিত্য রচিত হোক কেবল মাত্র আঁতেল এবং বোদ্ধা শ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্য, কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন চর্চা ও শিক্ষণীয় মেসেজ প্রদানের জন্য। এটি আসলে আধিপত্যবাদি হেজেমনিক প্রক্রিয়ায় একধনের ডিসকোর্স তৈরির চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না।

বিঃদ্রঃ উপরের স্টার (**) চিহ্নিত উদ্ধৃতি দুটো আমার মতো সস্তা বাজারি পাঠকের নয়। উহা প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ থেকে নেয়া। কিঞ্চিত আশংকায় আছি, আপনাদের বিদগ্ধ মননশীলতায় এখন প্রমথ চৌধুরীও না আবার ‘সস্তা’ হয়ে যান!

সরি প্রমথ চৌধুরী, মাফ করবেন।

বিঃদ্রঃ হুমায়ূন আহমেদ একবার বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপক, বিদগ্ধ সমালোচককে তার একটি গল্প পড়তে দিয়ে মতামত জানতে চাইলেন। অধ্যাপক গল্পটি পড়ে বললেন, ‘মন্দ নয়। তবে এতে গভীরতা কম’।

হুমায়ূন আহমেদ পাণ্ডুলিপিটি ফেরত নিয়ে পকেটে ভরতে ভরতে বললেন, ‘গল্পটি আমার নয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমি চরিত্রের নাম পাল্টে কপি করে দিয়েছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরতার অভাব, তখন আমার লেখা অগভীর হলে আমার দুঃখ নেই’।

আমরা যারা অতি সাধারণ পাঠক, তাদেরও দুঃখ নেই। আমরা জানি, হুমায়ূন আহমেদ মরেন নি, আজ কেবল তার শারীরিক প্রয়াণের দিবস, তার সৃজনশীলতা, চিন্তা আর নান্দনিকতা সদর্পে বেঁচে আছেন, তার কোন মৃত্যু নেই। তা বেঁচে থাকবে আরও বহু বহু বহুকাল। অনুভবে যে থাকে, তার আর অবয়বের প্রয়োজন কী!

শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ…

ব্রাত্য রাইসু লিখেছেন, কাসেম বিন আবু বাকারের সমস্যা এই যে তিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুসলমান অংশের লেখক। বাংলায় হিন্দু বা খ্রিস্টানদের মধ্যে এরকম সমস্যাযুক্ত লেখক কে কে আছেন?
রবীন্দ্রনাথ কি বেসিক্যালি হিন্দুদের লেখক নন? তো তার হিন্দুবাদী লেখারে সমালোচনা করা গেলে কাসেমের মুসলমানবাদী অবস্থানরে কেন সমালোচনা করা যাবে না? লেখকরা সকলের নন, সে ঠিক আছে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর লেখকরে তার জনগোষ্ঠীর আলোকেই বিচার করতে হবে।
আমি এই ধরনের লেখকদেরকে কূপমণ্ডুক বলতে রাজি আছি।
মাসুদা ভাট্টি লিখেছেন, এবার হয়তো কাসেম বিন আবু বক্কর হওয়ার জোর চেষ্টা চালাবেন কেউ কেউ, তাতে হয়তো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নাম নেবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নাম লেখানোর দুটো উপায় এক. ধর্মকে গালি দেওয়া, দুই. হালাল উপন্যাস লেখা; এর মাঝে যারা আছেন তারা বাংলা সাহিত্যের খুঁদ-কুড়ো কুড়িয়ে জীবন পার করার জন্য তৈয়ার থাকুন।

সেন, মীর মশাররফ (১৮৪৭-১৯১২) ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক। ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়ায় তাঁর জন্ম। পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন জমিদার। নিজগৃহে মুনশির নিকট আরবি ও ফারসি শেখার মাধ্যমে মশাররফ হোসেনের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। পরে পাঠশালায় গিয়ে তিনি বাংলা ভাষা শেখেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কুষ্টিয়া স্কুলে। পরে তিনি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হন; কিন্তু লেখাপড়া আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।

কর্মজীবনের শুরুতে মশাররফ হোসেন পিতার জমিদারি দেখাশুনা করেন। পরে তিনি ফরিদপুর নবাব এস্টেটে চাকরি নেন এবং ১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার হন। এক সময় এ চাকরি ছেড়ে তিনি লাহিনীপাড়ায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পরে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় গিয়ে ১৯০৩-০৯ পর্যন্ত অবস্থান করেন।

মশাররফ হোসেন ছাত্রাবস্থায় সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১) ও কুমারখালির গ্রামবার্তা প্রকাশিকা-র (১৮৬৩) মফঃস্বল সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। এখানেই তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরু। গ্রামবার্তার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ ছিলেন তাঁর সাহিত্যগুরু। পরে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী বিবি কুলসুমও এক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। মশাররফ আজিজননেহার (১৮৭৪) ও হিতকরী (১৮৯০) নামে দুটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। মীর মোশাররফ ছিলেন বঙ্কিমযুগের অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ।

বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পর মশাররফের প্রথম উপন্যাস রত্নবতী (১৮৬৯) প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি একে একে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা হলো: গোরাই-ব্রিজ অথবা গৌরী-সেতু (১৮৭৩), বসন্তকুমারী নাটক (১৮৭৩), জমিদার দর্পণ (১৮৭৩), এর উপায় কি (১৮৭৫), বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১), সঙ্গীত লহরী (১৮৮৭), গো-জীবন (১৮৮৯), বেহুলা গীতাভিনয় (১৮৯৮), উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০), তহমিনা (১৮৯৭), টালা অভিনয় (১৮৯৭), নিয়তি কি অবনতি (১৮৮৯), গাজী মিয়াঁর বস্তানী (১৮৯৯), মৌলুদ শরীফ (১৯০৩), মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা (দুই ভাগ ১৯০৩, ১৯০৮), বিবি খোদেজার বিবাহ (১৯০৫), হযরত ওমরের ধর্মজীবন লাভ (১৯০৫), মদিনার গৌরব (১৯০৬), বাজীমাৎ (১৯০৮), আমার জীবনী (১৯০৮-১৯১০), আমার জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুম (১৯১০) ইত্যাদি। তাঁর অমর কীর্তি বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসে কারবালার বিষাদময় ঐতিহাসিক কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তবে অনেক ঘটনা ও চরিত্র সৃষ্টিতে উপন্যাসসুলভ কল্পনার আশ্রয়ও নেওয়া হয়েছে। তাঁর জমিদার দর্পণ নাটকটি ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজগঞ্জে সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত।

মশাররফ হোসেন গতিশীল গদ্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। নাটক ও আত্মজৈবনিক উপন্যাসগুলিতে তিনি সমকালীন সমাজের অসঙ্গতি ও সমস্যার ওপর তীক্ষ্ণ কটাক্ষপাত করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। উদার দৃষ্টিকোণ থেকে ‘গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ প্রবন্ধ লিখে তিনি স্বসমাজ কর্তৃক নিগৃহীত হন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯১২ সালে তাঁর মৃত্যু হয় এবং পদমদীতে তিনি সমাহিত হন। [বিমল গুহ]

মীর মশাররফ হোসেনের পূর্বে, বাংলা সাহিত্যে কোনো উল্লেখযোগ্য মুসলিম সাহিত্যসেবী দেখা যায় না। মুসলমানদের মধ্যে তিনি আধুনিক সাহিত্যের প্রথম সার্থক সাধক ও স্রষ্টা। তার সাহিত্যের ভাষা প্রাণোচ্ছল ও বেগবান। আধুনিক যুগের মুসলিম বাংলা সাহিত্যের বহু প্রতিভার অধিকারী, সমাজ হিতৈষী মীর মশাররফ হোসেন তার নানা কাব্য ও সাহিত্যে বাংলার মুসলমানকে প্রাচীন মুসলিম গৌরব ও ঐতিহ্যে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, জীবনীকার ও শ্রেষ্ঠ সমাজ সচেতন ব্যক্তি।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, মুসলমান সমাজের পথ প্রদর্শক মীর মশাররফ হোসেন ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর প্রায় ৬৪ বছর বয়সে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।

হক, কাজী ইমদাদুল (১৮৮২-১৯২৬) শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক। ১৮৮২ সালের ৪ নভেম্বর খুলনা জেলার গোদাইপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা কাজী আতাউল হক প্রথমে আসামে জরিপ বিভাগে চাকরি করতেন, পরে খুলনার ফৌজদারি আদালতে মোক্তার হন। ইমদাদুল হক ১৯০০ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর দীর্ঘকাল পরে ১৯১৪ সালে তিনি বিটি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন।

ইমদাদুল হক ১৯০৪ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯০৬ সালে তিনি আসামের শিলং-এ শিক্ষা বিভাগের উচ্চমান সহকারী হন। পরের বছর তিনি ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯১১ সালে ঢাকার শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে ভূগোলের অধ্যাপক, ১৯১৪ সালে ঢাকা বিভাগের মুসলিম শিক্ষার সহকারী স্কুল-পরিদর্শক এবং ১৯১৭ সালে কলকাতা ট্রেনিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯২১ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের প্রথম কর্মাধ্যক্ষ হয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উক্ত পদে বহাল ছিলেন।

১৯২০ সালের মে মাসে ইমদাদুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় শিক্ষাবিষয়ক মাসিক পত্রিকা শিক্ষক। পত্রিকাটি তিন বছর চালু ছিল। তিনি কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিক্ষা ও নীতিমূলক শিশুসাহিত্য রচনায় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ: অাঁখিজল (১৯০০), মোসলেম জগতে বিজ্ঞান চর্চা (১৯০৪), ভূগোল শিক্ষা প্রণালী (দু ভাগ, ১৯১৩, ১৯১৬), নবীকাহিনী (১৯১৭), প্রবন্ধমালা (১৯১৮), কামারের কান্ড (১৯১৯) ও আবদুল্লাহ (১৯৩২)। আবদুল্লাহ উপন্যাসের লেখক হিসেবেই তাঁর সমধিক পরিচিতি। এতে তৎকালীন মুসলিম সমাজের নানা দোষত্রুটি অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে তিনি তুলে ধরেন।

বাঙালি মুসলমান সমাজের কল্যাণসাধন ছিল ইমদাদুল হকের সাহিত্য সাধনার মূল লক্ষ্য। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (১৯১৮) প্রকাশনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। অত্যন্ত যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব পালন করায় সরকার তাঁকে ১৯১৯ সালে ‘খান সাহেব’ এবং ১৯২৬ সালে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯২৬ সালের ২০ মার্চ কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। [খোন্দকার সিরাজুল হক]

জনপ্রিয় উপন্যাসের তালিকা

http://www.somewhereinblog.net/blog/mahbubmoreblog/29345566।

সমালোচনা সম্পাদনা

পুরুষদের অ্যাডভেঞ্চার, কল্পবিজ্ঞান বা ওয়েস্টার্ন ইত্যাদি অন্যান্য জনপ্রিয় সাহিত্যধারার তুলনায় রোম্যান্স এতদিন সর্বসমক্ষে উপহাসিত ও সমালোচকদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েই আসছিল। সাম্প্রতিককালের ধ্যানধারণার পরিবর্তন ও অন্যান্য বর্গের সঙ্গে রোম্যান্সের সংযুক্তির ফলে এই ধারার প্রতি অসম্মানজনক মনোভাবটি শক্তিশালী হয়েই থেকে যায়। কারণ কেউ কেউ মনে করেন রোম্যান্স ক্রয় বা পাঠের কথা স্বীকার করা পাঠকদের কাছে খানিক বিব্রতকর।[৪] অবশ্যই এর অন্যতম কারণ বছরের পর বছর রোম্যান্স উপহাসিত, সন্দেহ ও সমালোচনার বিষয়বস্তু। কোনো কোনো সমালোচক এই ধারায় সাসপেন্সের ঘাটতির কথা বলেন। নায়ক বা নায়িকা যে রহস্য সমাধান করে ফেলবেন তা এই গল্পে অবধারিত থাকে। তাই কেউ কেউ এই রকম অসম্ভব গ্ল্যামারযুক্ত প্রেমকাহিনির পিছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করা মেয়েদের পক্ষে কতটা লাভজনক তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।[৪] লেখক মেলিসা প্রিচার্ডের মতে রোম্যান্স উপন্যাস সামান্য বিপজ্জনক উপজীব্য নিয়ে লেখা। এই উপজীব্যটি হল একটি নিখাদ প্রেমের কথা, যা পাঠককে নিজেকে ভালবাসার পরিমণ্ডল থেকে বের করে আনে।[১০২]

যদিও জনপ্রিয় সংস্কৃতিচর্চার সূত্রপাতের ফলে রোম্যান্স ও অন্যান্য জনপ্রিয় ধারা সম্পর্কেও আকাদেমিক দৃষ্টি আকর্ষিক হতে থাকে। যদিও এর সম্মান খুব একটা বাড়ানো যায়নি, তবুও জেনিস রাডওয়ে, ন্যান্সি চোডোরো এবং অ্যান ডগলাসের মতো গবেষক উপন্যাসগুলির বৃহত্তর সামাজিক দিকটি খতিয়ে দেখেন, যেমনটি অন্যান্য গবেষকরা সোপ অপেরা, ওয়েস্টার্ন উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান ও অন্যান্য জনপ্রিয় বিনোদনধারায় করে থাকেন। এই গবেষণার ফলে রোম্যান্সের আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যগুলি উঠে আসে। যেমন, পাঠকরা মনে করেন, এই ধারার যাবতীয় অসম্মানের কারণ এগুলি মেয়েরা কেবলমাত্র মেয়েদের জন্য লেখেন।[৪] কেউ কেউ বলেন রোম্যান্সের উপেক্ষিত হবার কারণ, গল্পগুলির তীব্র আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। রোম্যান্স ঔপন্যাসিক জেনিফার ক্রুজ এর বিপরীতে মনে করেন, একটি আধুনিক রোম্যান্স উপন্যাসে “এক নারী কেবল তখনই শর্তহীন প্রেম দ্বারা পুরস্কৃত হন, যখন তিনি নিজের প্রতি সত্যবদ্ধ থাকেন।” [৭৪] কিন্তু ঔপন্যাসিক সুসান এলিজাবেথ ফিলিপস মনে করেন রোম্যান্স উপন্যাসের জনপ্রিয়তার কারণ এই যে নায়িকা শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে শেষমেশ জিতে যান।[২৪]

অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স সম্পাদনা
বর্তমান বাজারে বিদ্যমান অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স উপন্যাসগুলি খ্রিস্টান ভাবধারা ও প্রণয়সম্পর্কের বিকাশ কেন্দ্রিক কাহিনির সংমিশ্রণ।[২৭] ২০০৪ সালে, এই উপবর্গে ১৪৭টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল।[৩০] এই উপন্যাসে সাধারণত অপ্রয়োজনীয় হিংসাত্মক কার্যকলাপ বা অশ্লীল বাক্যাদি ব্যবহৃত হয় না। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির প্রণয় হয় সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। যৌনতার উল্লেখ যদি বা থাকে, তবে তা ঘটে বিবাহের পর এবং তার বিস্তারিত বর্ণনাও বাদ রাখা হয়। অনেক উপন্যাসেই নায়ক বা নায়িকার বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়। যার হলে প্রেমকাহিনিটি পরিণত হয় “নায়ক, নায়িকা ও ঈশ্বরের সহিত তাদের সম্পর্ক নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ত্রিভূজ”-এ।[৪৫] ক্ষমা, সততা ও বিশ্বাস এই উপবর্গের সাধারণ কয়েকটি থিম।[৪৬]

১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর শিলোট তাদের শিলোট ইন্সপিরেশন্যাল লাইন প্রকাশ করলে প্রথম অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স প্রকাশিত হয়। বইগুলির লক্ষিত পাঠক ছিলেন পুনর্জাত খ্রিস্টানরা এবং বইগুলি পাওয়া যেত কেবলমাত্র ধর্মীয় পুস্তকের দোকানে। ১৯৮৪ সালে শিলোট অলাভজনক ঘোষিত হলে হার্লেকুইন শিলোট অধিগ্রহণ করে। তখন শিলোট ইন্সপিরেশন্যাল লাইনও বন্ধ হয়ে যায়।[৪৭] যদিও খ্রিস্টান প্রকাশকেরা ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক রোম্যান্স উপন্যাস প্রকাশ করতে থাকেন।

রোম্যান্স উপন্যাস বা রমন্যাস[১] পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে, বিশেষত ইংরেজি-ভাষী জগতে বিকশিত একটি সাহিত্যধারা। এই বর্গের উপন্যাসগুলির মূল উপজীব্য দুই ব্যক্তির প্রেম ও প্রণয়সম্পর্ক, যার পরিসমাপ্তি হবে “সর্বদা মানসিকভাবে সন্তুষ্টিবিধায়ক ও আশাব্যঞ্জক”।[২] বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে এই উপন্যাসগুলিকে দুটি প্রধান বাণিজ্যিক বিভাগে বিভক্ত হতে দেখা যায় : (১) ক্যাটেগরি রোম্যান্স, যেগুলি ছোটো আকারের বই এবং মাত্র একমাস দোকানে পাওয়া যায় এবং (২) সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্স, যেগুলি সাধারণত বৃহদাকার ও অনেক বেশি দিন দোকানে পাওয়া যায়। বিষয়গত বৈচিত্র্যের দিক থেকে অবশ্য রোম্যান্স বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যথা : সমসাময়িক, ঐতিহাসিক, কল্পবিজ্ঞান বা অতিলৌকিক রোম্যান্স।

১৭৪০ সালে রচিত স্যামুয়েল রিচার্ডসনের পামেলা, অর ভার্চু রিওয়ার্ডেড উপন্যাসটি প্রথম যুগের রোম্যান্স উপন্যাসের একটি নিদর্শন। দুইটি কারণে এই বইখানি ছিল যুগান্তকারী : প্রথমত, সমগ্র উপন্যাসটির উপজীব্য বিষয় ছিল কোর্টশিপ বা প্রণয়-যাঞ্ছা এবং দ্বিতীয়ত, বইটির মূখ্যচরিত্র ছিলেন এক নারী, যাঁর দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখক গল্পটি উপস্থাপনা করেন। পরবর্তী শতকে জেন অস্টিন এই শাখাটিকে পরিবর্ধিত করেন। তাঁর রচিত প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস উপন্যাসখানিকে রোম্যান্স সাহিত্যধারার সর্বোৎকৃষ্ট কীর্তি বলে মনে করা হয়। অস্টিনের রচনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জর্জেট হেয়ার ১৯২১ সালে ঐতিহাসিক রোম্যান্সের সূচনা ঘটান। এর প্রায় এক দশক পর থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি মিলস অ্যান্ড বুন প্রথম ক্যাটেগরি রোম্যান্স উপন্যাস প্রকাশ করতে শুরু করেন। উত্তর আমেরিকায় হারলেকুইন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড এই বইগুলি পুনরায় বিক্রি করতে থাকেন। এর ফলে পাঠকদের কাছে এই বইগুলির প্রত্যক্ষ বাজার সৃষ্টি হয় এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও বইগুলি বিক্রি করতে থাকেন।

১৯৭২ সালে অ্যাভন বুকস প্রকাশিত ক্যাথলিন উইডিউইস রচিত দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ার উপন্যাসটি আধুনিক রোম্যান্সের সূচনা করে। এটিই ছিল মূল পেপারব্যাক আকারে প্রকাশিত প্রথম সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্স উপন্যাস। ১৯৮০-এর দশকে এই ধারাটি সমৃদ্ধিলাভ করে। অনেকসংখ্যক ক্যাটেগরি উপন্যাসের পাশাপাশি সিঙ্গল-টাইটেল উপন্যাসের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। জনপ্রিয় লেখকগণ এই ধারার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্লট ও চরিত্রচিত্রণে আধুনিকতার ছোঁওয়া লাগে।

উত্তর আমেরিকায় ২০০৪ সালে বিক্রীত সমস্ত পেপারব্যাক বইয়ের ৫৫% রোম্যান্স উপন্যাস। এই অঞ্চলে আধুনিক সাহিত্যে জনপ্রিয়তম ধারা তাই এইটিই। ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়াতেও এই ধারা বিশেষ জনপ্রিয়। ৯০টি ভাষায় প্রকাশিত হয় রোম্যান্স উপন্যাস। এর অধিকাংশই অবশ্য ইংরেজিভাষী দেশগুলিতে অ্যাংলো-স্যাক্সন দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত। জনপ্রিয়তা ও বহুল বিক্রি সত্ত্বেও এই সাহিত্যধারাটি ব্যাপকভাবে উপহাসিত, নিন্দিত ও সমালোচিত হয়ে থাকে।

আধুনিক রোম্যান্সের জন্ম সম্পাদনা
১৯৭২ সালে অ্যাভন বুকস ক্যাথলিন উডিউইস রচিত দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ার প্রকাশ করলে আধুনিক রোম্যান্সের জন্ম হয়। এটিই ছিল “শয্যাকক্ষের নীতি (অনুসরণকারী) প্রথম উপন্যাস”।[৬৭][৬৮] উপাদান ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণে বইটি ছিল যুগান্তকারী। এটিই প্রথম সিঙ্গল টাইটেল রোম্যান্স যা ক্যাটেগরি রোম্যান্সের রীতি লঙ্ঘন করে হার্ডব্যাকের বদলে প্রথমে পেপারব্যাক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। ঔষধ-বিক্রেতা এমনকি অনেক সাধারণ দোকানিও বইটি দোকানে রাখতেন।[৬৯] বইটির ২.৩৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল।[৭০] এর পরপরই অ্যাভন উডিউইসের দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য উলফ অ্যান্ড দ্য ডোভ এবং নবাগত রোজমেরি রজার্স রচিত দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে ১৯৭৪ সালে। রজার্সের উপন্যাসদুটির মধ্যে একটি ছিল ডার্ক ফায়ারস। প্রথম তিন মাসে বইটির দুই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। ১৯৭৫ সালের পাবলিশার্স উইকলি প্রদত্ত রিপোর্ট অনুসারে “অ্যাভন ওরিজিন্যাল” উপন্যাসগুলি সম্মিলিতভাবে ৮ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়।[৬৯] পরের বছর প্রকাশিত ১৫০টি ঐতিহাসিক রোম্যান্সের ৪০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়।[৭০] এগুলির অনেকগুলিই ছিল পেপারব্যাক।

এই উপন্যাসগুলির জনপ্রিয়তা নতুন ধরনের রোম্যান্স লেখার প্রবণতার জন্ম দেয়। এগুলির দৃষ্টি প্রাথমিকভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাসে নিবদ্ধ থাকত। নায়কের কারণে নায়িকা এখানে বিপদে পড়ত। এবং নায়কই নায়িকাকে বিপন্মুক্ত করে আনত। নায়ক ও নায়িকার একগামী কাহিনিই এখানে মূল উপজীব্য ছিল।[৭] এই উপন্যাসগুলির প্রচ্ছদে দেখা যেত স্বল্পবাস নায়িকাকে নায়ক জড়িয়ে ধরে আছে। সেই কারণে এই বইগুলিকে বলা হয় “বডিশ-রিপার” বা “উর্ধ্ববাস-ছিন্নকারী”।[৬৭] ১৯৮০ সালে একটি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল নিবন্ধে এই ধরনের বডিশ রিপার সম্পর্কে বলা হয় : “বিগ ম্যাককে দেওয়া প্রকাশকের উত্তর: এগুলি রসালো, সস্তা, গতানুগতিক এবং এগুলির ভক্তেরা এগুলিকে গোগ্রাসে পড়ে।” [৭১] অনেক রোম্যান্স প্রকাশনা শিল্পে এখন এই বডিশ-রিপার শব্দটি ঘৃণাবাচক বলে বিবেচিত হয়।[৬৭]

এই ধরনের নতুন ঐতিহাসিক রোম্যান্সে নায়িকারা ছিলেন স্বাধীন ও দৃঢ়চেতা। এদের নায়কেরা অনেক সময়েই হতেন সেই ধরনের পুরুষ যারা ভালবাসতে জানেন ও অনুভূতিপ্রবণ।[৭২] এটি সমসাময়িক রীতির লঙ্ঘন বলে গণিত হত। প্রচলিত রীতিতে দেখা যেত দুর্বল মেয়েরা বদরাগী আলফা পুরুষদের প্রেমে পড়ছে।[৭৩] প্লটে এই নায়িকাদের ভূমিকা মুখ্য হলেও “নায়কের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরা ছিল গৌণ”।[৭৪] সমগ্র উপন্যাসধারায় দেখা যেত নায়িকাদের বয়স ষোলো থেকে একুশের মধ্যে ও নায়কের বয়স তিরিশের কাছাকাছি। মেয়েরা ছিল কুমারী, যদিও পুরুষেরা কৌমার্যের ধার ধরত না। আর যুগলের দুই জনই হত সুদর্শন।[৭৫]

ক্যাটেগরি রোম্যান্সের রূপান্তর সম্পাদনা
ঐতিহাসিক রোম্যান্স উপবর্গটিকে স্থানচ্যুত করা কয়েকটি পরিবর্তন অনেক দেরিতে ক্যাটেগরি রোম্যান্সে গৃহীত হয়েছিল। একটি উত্তর আমেরিকান কোম্পানি মিলস অ্যান্ড বুন কিনে নিলেও এই ধারায় ১৯৭৫ সাল অবধি কোনো আমেরিকান লেখক উঠে আসেননি। এরপরই হার্লেকুইন জেনেট ডেইলে রচিত একটি উপন্যাস কিনে নেয়।[৭৬][৭৭] ডেইলের রোম্যান্স উপন্যাস সম্পর্কে বলা হয় এগুলি “মার্কিন অনুভূতি, ধ্যানধারণা, ইতিহাস, এবং সর্বোপরি মার্কিন প্রেক্ষাপটে লেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংঘটিত নায়ক, নায়িকা এবং কোর্টশিপের উপর আধারিত প্রথম রোম্যান্স।” [৭৮] এই ধরনের বইয়ের বাজার চাহিদা কি হবে তা নিয়ে হার্লেকুইনের দ্বিধা ছিল। তাই এই ধারাটিকে তারা সেইভাবে গ্রহণ করেনি। সত্তরের দশকের শেষের দিকে হার্লেকুইনের সম্পাদক সেই সময়কার সেরা বেস্টসেলিং লেখকদের একজন নোরা রবার্টস রচিত একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি এই মর্মে প্রত্যাখ্যান করে যে তাদের নিজস্ব মার্কিন লেখক আছে।[৭৯]

১৯৮০ সালে সিমোন অ্যান্ড স্কাস্টার একযোগে স্থাপন করে শিলোট বুকস। মার্কিন লেখকদের অনালোকিত প্রতিভার সুযোগ গ্রহণ করে তারা।[৮০] তারা অনেকগুলি ক্যাটেগরি রোম্যান্স চালু করে এবং অনেক বেশি দৃঢ়চেতা নায়িকা ও অপেক্ষাকৃত কম কর্তৃত্ববাদী নায়কদের সম্পর্কে লিখতে লেখকদের উৎসাহিত করে। স্থান বুঝে সমসাময়িক ইস্যুগুলিও তুলে ধরার কথা লেখকদের বলা হয়।[৮১] শিলোটের মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৪ সালে হার্লেকুইন তাদের কিনে নেয়। অধিগ্রহণ সত্ত্বেও শিলোট তাদের সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এবং বেশ কয়েকটি লাইন নিজেদের মুদ্রণ থেকে প্রকাশ করে।[৬৫]

পাঠকেরা যে অনেক খোলামেলা যৌনদৃশ্য সংবলিত রোম্যান্সের দিকে ঝুঁকছিল তা বুঝতে পারেনি হার্লেকুইন। ১৯৮০ সালে অনেক প্রকাশক ক্যাটেগরি রোম্যান্সের লাইনে চলে আসে এই ফাঁকটি পূরণ করার জন্য। এই বছর ডেল এমি লরিন রচিত দ্য টাউনি গোল্ড ম্যান সহ ক্যান্ডেললাইট এক্সট্যাসি লাইন প্রকাশ করেন। নায়িকাকে সতী হতেই হবে, সেই ধারণা এই লাইন থেকেই অচল হয়ে পড়ে। ১৯৮৩ সালের শেষাশেষি ক্যান্ডেললাইট এক্সট্যাসি লাইনের বিক্রি ছিল ৩০ মিলিয়ন ডলার। শিলোটও একই রকমের দুটি লাইন বাজারে আনে – ডিজায়ার (যৌন-উদ্দীপনামূলক) ও স্পেশাল এডিশন (যৌন-উদ্দীপনামূলক ও আড়াইশো পাতা অবধি বড় গল্প)। প্রতিটির বাজারে বিক্রির হার প্রতিমাসে ছিল ৯০-১০০%।[৮২]

১৯৮২ সালের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, রোম্যান্স ধারায় নতুন ধরনের লেখালিখি অনেক নতুন পাঠককে এই ধারার দিকে টেনে আনছে। সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৭৭ সালের পর থেকে রোম্যান্স পড়া শুরু করেছেন এমন পাঠক ৩৫%। ৩১% শতাংশ পাঠক ছয় থেকে দশ বছর রোম্যান্স পড়ছেন। অর্থাৎ, তাঁরা রোম্যান্স পড়া শুরু করেছিলেন ১৯৭২ সালে উডিউইসের বিখ্যাত উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পর থেকে। এর অর্থ রোম্যান্স পাঠকদের দুই-তৃতীয়াংশই রোম্যান্সের প্রতি আকৃষ্ট হন পরিবর্তন আসার পর থেকে।[৮৩]

ক্যাটেগরি রোম্যান্স লাইনের সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। ১৯৮৫ সাল নাগাদ ১৬টি পৃথক লাইন ৮০টি উপন্যাস প্রকাশ করে।[৮৪] এর ফলে নতুন ধারায় লেখকদের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। এবং বাজার চাহিদা তুঙ্গে থাকার ফলে প্রকাশিত উপন্যাসগুলির মানও নিম্নগামী হতে শুরু করে। ১৯৮৪ সাল নাগাদ বাজার ক্যাটেগরি লাইনে ছেয়ে যায় এবং পাঠকরা প্লট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন।[৮৫] এই তীব্র অসন্তোষের ফলে পরের বছর থেকে সিরিজ রোম্যান্স লাইনে পঠিত উপন্যাসের সংখ্যা কমে যায়।[৮৬] হার্লেকুইনের রিটার্ন রেট যা ১৯৭৮ সালে ক্যাটেগরি রোম্যান্সের মুখ্য সরবরাহকারী থাকার সময় ২৫ শতাংশের কম ছিল তা ৬০ শতাংশ হয়ে যায়।[৮৭]

আমেরিকার রোম্যান্স লেখকদের মতে, একটি রোম্যান্স উপন্যাসের কেন্দ্রীয় প্লট অবশ্যই দুজনের প্রেম ও প্রণয়সম্পর্ককে ঘিরে গড়ে উঠতে হবে। উপন্যাসের সংঘাত বা কনফ্লিক্ট ও সংকট বা ক্লাইম্যাক্স এই প্রেমসম্পর্ক গড়ে ওঠার মূল থিমটির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকবে। যদিও এই মূল গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত নয় এমন সাবপ্লট বা উপকাহিনির অবতারণা উপন্যাসে থাকতেই পারে। অধিকন্তু রোম্যান্স উপন্যাসের পরিসমাপ্তিতে হবে “সর্বদা মানসিকভাবে সন্তুষ্টিবিধায়ক ও আশাব্যঞ্জক”। এদিকে বার্কলে বুকস গোষ্ঠীর কর্ণধার লেসি জেলম্যান সহ অনেকেই অপেক্ষাকৃত ছোটো সংজ্ঞা ব্যবহারের পক্ষপাতী। তাঁদের মতে, “(রোম্যান্স) গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু হবে… নায়ক ও নায়িকার প্রণয়সম্পর্ক।[৩] সাধারণভাবে, রোম্যান্স উপন্যাসে সৎ চরিত্রগুলি পায় পুরস্কার ও অসৎ চরিত্রগুলি পায় শাস্তি। আর যে প্রণয়ীরা তাদের সম্পর্কে বিশ্বাস রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যায়, তারা পায় নিঃশর্ত প্রেমের পারিতোষিক।[২] “বইগুলি প্রেমে পড়া, আবেগবিহ্বলতা, পারস্পরিক সম্পর্কবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং যা কিছু আমরা সত্যিই চাই, তার উদযাপন।” রোম্যান্স উপন্যাসকে এইভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন জনপ্রিয় লেখিকা নোরা রবার্টস।[৪] চিক লিট সহ মেয়েলি কথাসাহিত্য অবশ্য রোম্যান্স সাহিত্যবর্গের কোনো প্রত্যক্ষ উপবর্গ নয়। কারণ মেয়েলি সাহিত্যে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নায়িকার সম্পর্ক, নায়কের সঙ্গে তার সম্পর্কের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।[৩]

আমাদের দেশে অনেকেই হতাশ কণ্ঠে উপদেশ দেন, ‘লেখালেখি করে কী হবে? কবি, সাহিত্যিকদের জীবনে টাকা-পয়সা হয় না। শেষে না হবে সংসার, না হবে সুন্দর জীবন।’
আসলেই কি তাই? আমরা জানি, অতীতে অনেক বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিকদের কষ্টে দিন কেটেছে। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণও করেছেন কেউ কেউ। তবে এখন দিন কিছুটা বদলেছে। তবে পরিস্থিতির ততোটা উন্নতি এখনও হয়নি যতোটা হলে লেখালেখিটাকে এ দেশে প্রধান পেশা হিসেবে নেয়া যায়। ব্যতিক্রম হয়তো আছে কিন্তু তাদের নাম আঙুলের কর গুনে বলে দেয়া যায়।

বিদেশে এ চিত্র কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রফেশনাল রাইটার আছেন। তারা লেখালেখি ছাড়া আর কিছুই করেন না। এবং এ করেই তাদের দিন দিব্যি কেটে যায়। এমনকি এদের কেউ কেউ চমকে ওঠার মতো ধনীও বটে। তাদের বই বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়। বই বিক্রির রেকর্ডও গড়েছেন অনেকে। ফলে লেখক স্বত্ব নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। তারা লিখেই কোটিপতি। এমনই ক’জন ধনী লেখককে নিয়ে লিখেছেন সাইফ বরকতুল্লাহ।

ধনী লেখকের কথা উঠলেই জে কে রাউলিংয়ের নাম উঠে আসে। তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী লেখক। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্যে জন্ম নেয়া এই লেখকের আয় কত অনুমান করুন তো? জানি পারবেন না! তাহলে শুনুন তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি টাকায় ১০৮ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৩৫ টাকা। কী, চোখ কপালে উঠে গেল! এবার আপনিই হিসাব করে তার দৈনিক আয় কত হয় বের করুন। আরেকটি মজার তথ্য দেই, তার এই আয় কিন্তু মোটামুটি একটি সিরিজ দিয়েই। নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন কোন সিরিজ? ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ লিখেই তিনি এ পরিমাণ আয় করেন।

জে কে রাউলিংয়ের পুরো নাম জোয়ান ক্যাথলিন রাউলিং। জাদুকরদের এক দুনিয়ার নানা কাল্পনিক কাহিনি নিয়ে হ্যারি পটার সিরিজের সাতটি বই লিখেছেন তিনি। এই সাতটি বই এক সময় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। চলুন শুনি তার লেখক হওয়ার গল্প।

১৯৯০ সাল। একদিন রাউলিং ম্যানচেষ্টার থেকে লন্ডন যাচ্ছিলেন পাতাল ট্রেনে চড়ে। ট্রেনটিতে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড়। এ সময় ট্রেনে এক অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। এই ট্রেনেই দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা অতিবাহিত করতে হয়েছে রাউলিংকে। এ সময় তিনি চিন্তা করছিলেন নতুন কোনো একটি লেখা নিয়ে। হঠাৎই তাঁর মনের জানালায় কড়া নাড়ে এক এতিম ছেলে। যে ছেলেটি পালিত হচ্ছে তার ফুফু ও ফুপার কাছে। যারা দুজনই খুব নীচু মনের অধিকারী। ছেলেটি শত অন্যায় অত্যাচার সহ্য করে সেখানে, কিন্তু সে জানে না, তার মধ্যে রয়েছে এক মায়াবী জাদুকরী ক্ষমতা।

রাউলিং ওই ট্রেনে বসেই মনের ক্যানভাসে এঁকে ফেলেন সেই এতিম ছেলেটির মুখাবয়ব। মোটা ফ্রেমের চশমা, পরিচিত কালো চুলের হ্যারিকে নিয়ে এরপর থেকেই লেখা শুরু করেন রাউলিং। অবশেষে ১৯৯৫ সালে শেষ করেন হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম উপন্যাস। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সাতটি বইয়ের প্রথম ছয়টি ৩২৫ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। এ থেকে প্রাপ্ত অর্থে রাউলিং হয়ে ওঠেন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী লেখক।

রাউলিংয়ের বাবা-মা দুজনই ছিলেন পেশাজীবী। তাই রাউলিং ও তার বোনকে একা সময় কাটাতে হতো। এই একাকীত্ব দূর করতে তাদের বাবা-মা দুই বোনকে মজার মজার সব গল্পের বই কিনে দিতেন। সেই ছোট্ট বয়স থেকেই মজার মজার গল্প লিখতেন তিনি। গল্পগুলো লিখতেন তিনি ছোট্ট বোনকে পড়ে শোনানোর জন্য। এভাবেই তার মনের মধ্যে বাসা বাঁধে লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন। তার স্বপ্ন ছিল, তার লেখা বই দোকানে আসা মাত্র পাঠক লুফে নেবে। বলতেই হচ্ছে, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার।

রাউলিংয়ের বিবাহ বিচ্ছেদের পর চরম দারিদ্র্য এসে ভর করে জীবনে। প্রথম দিকে তো বাচ্চার খরচ সামলানোই তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তিনি বাধ্য হয়ে সরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হন। আর এর ফাঁকে চলতে থাকে লেখার কাজ। পরে অবশ্য তিনি একটি স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতার কাজ পান। লেখালেখি কিন্তু থেমে থাকেনি। কখনো কখনো ক্যাফেতে বসেও খুব দ্রুত লিখতেন তিনি। সেসময় হয়তো ছোট্ট মেয়ে জেসিকা ঘুমিয়ে থাকতো তার পাশে। আর এ ভাবেই জে কে রাউলিংয়ের কলমে এক সময় জন্ম নিলো ইংরেজি শিশুসাহিত্যের অমর চরিত্র হ্যারি পটার।

পাঠক চলুন, আমরা লেখক স্টিফেন কিংয়ের গল্পটা শুনি। আমেরিকায় জন্ম নেয়া স্টিফেন কিং-ও ধনী লেখকদের একজন। এই লেখকের ৫০টিরও অধিক বেস্ট সেলার উপন্যাস রয়েছে। যা থেকে আয় হয়েছে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া সিনেমার স্ক্রিপ্ট ও অন্যান্য লেখা মিলিয়ে স্টিফেন কিং ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। এক হিসাব অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ১৩২ কোটি ২ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৬ টাকা।

পাঠক চলুন, আমরা লেখক স্টিফেন কিংয়ের গল্পটা শুনি। আমেরিকায় জন্ম নেয়া স্টিফেন কিং-ও ধনী লেখকদের একজন। এই লেখকের ৫০টিরও অধিক বেস্ট সেলার উপন্যাস রয়েছে। যা থেকে আয় হয়েছে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া সিনেমার স্ক্রিপ্ট ও অন্যান্য লেখা মিলিয়ে স্টিফেন কিং ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। এক হিসাব অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ১৩২ কোটি ২ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৬ টাকা।

স্টিফেন এডউইন কিংয়ের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। তিনি মূলত হরর গল্প ও উপন্যাসের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া তিনি একজন ছোট গল্পকার ও কলাম লেখক। রূপকথা ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও লিখেছেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশন মেডেল পান তিনি। স্টিফেন কিংয়ের লেখা বই ৩৫০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। তিনি উপন্যাস লিখেছেন ৫৪টি, ছোটগল্প ২০০টি।

মজার ব্যাপার হলো, সাহিত্যিক, লেখক স্টিফেন কিং এক সময় লেখক হতে চাননি। এক সময় তো পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কেউ তার বই প্রকাশ করতে চায়নি। প্রকাশকদের মতে তার লেখার মান নাকি ছিল খুবই নিম্নমানের। রাগের মাথায় নিজের লেখা প্রথম পাণ্ডুলিপি ডাস্টবিনে ফেলে দেন। ভাগ্যিস তার স্ত্রী এটা দেখেছিলেন। তিনি স্বামীর পাণ্ডুলিপি কুড়িয়ে এনে যত্ন করে রেখে দেন। এবার কিং একা নন, স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে খুঁজতে থাকেন প্রকাশক। অনেক কষ্টে এক প্রকাশককে তারা রাজীও করে ফেলেন। অবশেষে প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই। এরপর বদলে যায় এই লেখকের জীবন।

জেমস প্যাটারসনকে বলা হয়, তার বই নাকি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এ কি শুধুই কথার কথা? তা নয়, ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুদ্রিত বই বিক্রির পরিসংখ্যান টেনে প্রকাশনা বিশ্লেষক সংস্থা নিলসেন এই তথ্য দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রাউলিংয়ের বই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণে বিক্রি হলেও, এখানে প্যাটারসন এগিয়ে। প্যাটারসনের বিগত ১৫ বছরে লেখা বইগুলো বাজারে হট কেক হিসেবে বিক্রি হয়েছে। তার গোয়েন্দা ধারাবাহিক ‘এলেক্স ক্রস’ এ পর্যন্ত তিন কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। ভাবা যায়! যেখানে এই বাংলাদেশে ৫০০ কপি বই বিক্রি করতে প্রকাশকদের নিরন্তর ঘাম ঝড়াতে হয়। জেমস প্যাটারসনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ, নিউইয়র্কে। তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ৬৯১ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার ৭৯৬ টাকা।

কেন সেরা প্যাটারসন? কারণ তার ‘অ্যালেক্স ক্রস’সিরিজের বইগুলো প্রায় ২৫ বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। তার প্রত্যেকটি বই সব সময় বেস্ট সেলার হয়। তবে এর মধ্যে ‘অ্যালং কেম এ স্পাইডার’বইটি অন্যতম। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পাঠকদের জন্য একবার বেস্ট সেলার লেখকদের অর্থায়নে পৃষ্ঠাজুড়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। বিজ্ঞাপনে লেখকদের তালিকায় জে কে রাওলিং-এর ওপরে জেমস প্যাটারসনের নাম ছিল। তাই বলা হয়, রাউলিং-এর চেয়ে জেমস প্যাটারসনই বেশি জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী ও ধনী লেখক।

চলুন, যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ধনী লেখক জন গ্রিশামের গল্প শুনি। ১৯৫৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। তিনিও অনেক বেস্ট সেলার বইয়ের স্রষ্টা। যদিও তিনি একাধারে আইনজীবী ও রাজনীতিক। পুরো নাম জন গ্রিশাম জুনিয়র। থ্রিলার সাহিত্যে তিনি অবশ্য ‘জন গ্রিশাম’ নামেই পরিচিত। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় জন গ্রিশামের প্রথম লিগ্যাল থ্রিলার ‘টাইম টু কিল’। জ্যাক ব্রিগেন্স নামক এক অসাধারণ প্রতিভাধর উকিল তার বইয়ের মূল চরিত্র ছিল।

বইটি প্রকাশের পর ৫ হাজার কপিও বিক্রি হয়নি পরবর্তী দুই বছরে। কিন্তু ১৯৯১ সালে প্রকাশিত একটি বই তার ভাগ্য খুলে দেয়। ‘দ্য ফার্ম’ নামক সেই বইটি বিশ্বে হইচই ফেলে দেয়। তিনি দ্রুত খ্যাতির শীর্ষে চলে আসেন। এক বছরে বইটি ১৫ লাখ কপি বিক্রি হয়। সেসময় ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ বেস্ট সেলার লিস্টে ৪৪ সপ্তাহ ধরে এই বইয়ের নাম ছিল। জন গ্রিশামের বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ১৩৯ কোটি ৭৯ লাখ ৪৬ হাজার ৯০৩ টাকা।

জন গ্রিশাম লেখালেখি করে জনপ্রিয়তা পান প্রায় মধ্য বয়সে এসে। কেননা আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তী এক দশক ক্রিমিনাল ল প্র্যাকটিস করেন তিনি। এরপর ১৯৮৪ সালে এসে বদলে যায় তার জীবন। এ বছরের কোনো এক সময় একটি মামলা দেখতে তিনি কোর্টরুমে বসেছিলেন। এক ধর্ষিতা কিশোরীর খুনী পিতার মামলা। তিনি মামলার কার্যকলাপ দেখে এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে, বিষয়টি নিয়ে একটা কোর্টরুম থ্রিলার লেখা শুরু করে দেন। প্রায় চার বছর ধরে চলতে থাকে উপন্যাসের কাজ। এরপর প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি নিয়ে দেখালে অনেকেই তা নাকচ করে দেয়। অবশেষে ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় বইটি। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৯১ সালে ‘দ্য ফার্ম’, ৯২ সালে ‘দ্য পেলিকান ব্রিফ’, ৯৩ সালে ‘দ্য ক্লায়েন্ট’, ৯৫ সালে ‘দ্য চেম্বার’ এবং ৯৬ সালে ‘দ্য রানওয়ে জুরি’ প্রকাশিত হয়। তার প্রতিটি বই বেস্টসেলিং লিস্টের এক নাম্বারে ছিল।

স্টিফেন মেয়ার আমেরিকান লেখিকা। জন্ম ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর, হার্টফোর্ডে। পাঠকের কাছে এই নাম অপরিচিত হওয়ার কথা নয়। কেননা ‘ট্যুলাইট’ সিরিজ লিখে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন তিনি। এর কাহিনি রচিত হয়েছে ফরকস নামক ছোট্ট এক শহরের দুই তরুণ-তরুণীকে কেন্দ্র করে। অ্যাডওয়ার্ড কুলিন এক তরুণ ভ্যাম্পায়ার আর বেলা সোয়ান আকর্ষণীয়া, সুন্দরী তরুণী। অসম চরিত্রের এই দুই তরুণ-তরুণী জড়িয়ে পড়েছে ভালোবাসার বন্ধনে। এটা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা আর রহস্য। ওদিকে বেলাকে তাড়া করে ফিরছে আরেক ভ্যাম্পায়ার জেমস। এ নিয়েই উপন্যাসের কাহিনি। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ১০০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। অনুবাদ হয় বিশ্বের ৩৭টি ভাষায়।

যে কারণে ২০০৮ সালের ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় স্টিফেন মেয়ারের নাম উঠে আসে। তিনি ৪৯ নাম্বারে ছিলেন। এই লেখিকার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ১০৮ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৩৫ টাকা।

২০০৩ সালের জুনের ২ তারিখ। এই দিনটি স্টিফেন মেয়ার কখনও ভুলবেন না। কেননা এ দিন একজন আন্তরিক ও বড় লেখক হবার স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে তোলে। নতুন স্বপ্ন আর অনুপ্রেরণায় ট্যুইলাইট সিরিজের লেখা শুরু করেন। তিন মাসের মধ্যে ৫০০ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিও তৈরি হয়ে গেল। এরপর অনুসন্ধান শুরু করলেন প্রকাশকের। ২০০৫ সালে বইটি যখন প্রকাশিত হয়, বদলে যায় স্টিফেন মেয়ারের জীবন।

ইসলামী সাহিত্য
ইসলামী সাহিত্য হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ইসলামী উদ্দেশ্যে মুসলিমদের দ্বারা রচিত সাহিত্যকর্ম। ইসলামী সাহিত্যের ব্যপ্তি এত বিস্তৃত যে একে স্বল্পপরিসরে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়।

খুরশিদবানু নাতাভান, কারাবাখ খানাতের শেষ শাসক মেহদি গুলু খানের কন্যা, তাকে আজারবাইজানের অন্যতম সেরা কবি হিসেবে গণ্য করা হয়
ইসলামী বিশ্বের সব থেকে সুপরিচিত কল্পকাহিণী হচ্ছে “এক হাজার এক রাতের বই” “‘(আরব্য রজনী)”’, পারস্যের রাণী শেহেরজাদের বলা প্রাচীন লোকগল্পের সংকলন। গল্প গুলোর বিস্তৃতি ১০ম শতাব্দী থেকে ১৪ শতাব্দী পর্যন্ত। তবে সংগৃহীত আরব্য রজনীর বিভিন্ন পান্ডুলিপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এক পান্ডুলিপি থেকে অন্য পান্ডুলিপিতে গল্পের সংখ্যা এবং ধরন ভিন্ন ভিন্ন পাওয়া গেছে।[১] সকল আরবীয় কাল্পনিক (ফ্যান্টাসি) গল্পসমূহ ইংরেজীতে অনুবাদকালে আরব্য রজনী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।[১]

নেকে আমাকে প্রশ্ন করে, লেখা শেখা যায় কীভাবে? লেখক হওয়া যায় কোন্ পথে? আমি তাদের কখনো বলি ভাষার নিয়ম ও ব্যাকরণের কথা, কখনো শব্দবৈচিত্র ও বাক্যসৌন্দর্যের কথা; কখনো সাহিত্যের অলঙ্কার ও কবিতার ছন্দ-মাধুর্যের কথা! অনেক কথাই বলি, কিন্তু আসল রহস্য প্রকাশ করি না এবং হৃদয়ের ‘বদ্ধ দুয়ার’ উন্মুক্ত করি না। কেননা চারপাশে আমার যদিও অনেক কোলাহল এবং উপচে পড়া কৌতূহল; যদিও সবার হাতে কাগজ-কলম এবং লেখালেখির উৎসাহে কমতি নেই কোনরকম, কিন্তু মর্মজ্বালা যদি প্রকাশ করতে দাও তাহলে বলবো, আমি অপেক্ষা করেছি, প্রতীক্ষার প্রহর গুণেছি এবং ‘আকাশের’ কাছে প্রার্থনা করেছি, কিন্তু একটি উন্মুক্ত বক্ষের এবং একটি প্রস্ফুটিত হৃদয়ের সন্ধান আজো পাইনি।
মেঘ না হলে তো বৃষ্টি হয় না, বাগান না হলে তো বসন্ত আসে না এবং প্রস্ফুটিত হৃদয় না হলে তো হৃদয় থেকে রহস্য উন্মোচিত হয় না। হৃদয়ের ভাব হৃদয়ে তখনই প্রবেশ করে এবং হৃদয়ের মিনতি হৃদয়কে তখনই স্পর্শ করে যখন হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলন ঘটে। কিন্তু সেই শুভলগ্ন এখনো আসেনি আমার জীবনে।
নিঃসঙ্গ জীবনের এ বিষণ্ন সন্ধ্যায় আজ আমি ভাবছি, আমার দৃষ্টি-সীমার বাইরে দূর দিগন্তে- যেখানে আকাশ নেমে এসেছে পৃথিবীর কোলে- সেখানে নিশ্চয় আছে এমন কোন তরুণ, যার আত্মার আকুতি এবং হৃদয়ের মিনতি আমি শুনতে পাই না, কিন্তু সাহিত্যের সাধনায় সে উৎসর্গিত হতে চায় এবং আগামী দিনের কলম-জিহাদের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চায়। হে তরুণ! হে নবারুণ! তোমারই উদ্দেশ্যে আমার আজকের এ নিবেদন।
তুমি সাহিত্যের সাধক হতে চাও! সাহিত্যের অনন্ত জগতে প্রবেশ করতে চাও! তাহলে দুয়ার খোলো, হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার। শব্দের রাজ্য জয় করে হৃদয়ের পথে প্রবেশ করো ভাবের জগতে। কেননা শব্দের রাজ্যে তুমি পাবে শুধু লেখার উপাদান, আর ভাবের জগতে পাবে সাহিত্যের সন্ধান। চিন্তার সংকীর্ণতা বর্জন করো এবং হৃদয়ের উদারতা অর্জন করো। কেননা উদার হৃদয়েই শুধু ভাবের আবির্ভাব হয়, সংকীর্ণ হৃদয়ে নয়।
তোমাকে যারা কষ্ট দেয় তাদের তুমি ক্ষমা করো; তোমার চোখ থেকে যারা অশ্রু ঝরায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। আঘাতকে হাসিমুখে বরণ করো এবং ছুঁড়ে দেয়া পাথরকে ফুলরূপে গ্রহণ করো। তখন তোমার চোখের অশ্রু কলমের কালি হয়ে ঝরবে; তোমার কলমের ‘অশ্রুবিন্দু’ শব্দের মুক্তা হয়ে বর্ষিত হবে।
তোমার চিন্তায় যেন ঈর্ষা ও বিদ্বেষ না থাকে; তোমার হৃদয়ে যেন সবার প্রতি ভালবাসা থাকে, যে ভালোবাসা হবে জাগতিক সকল চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে; যে ভালোবাসা শুধু দান করে এবং দানের আনন্দেই তৃপ্ত থাকে, কখনো প্রতিদান কামনা করে না; যে ভালোবাসা শুধু বিলিয়ে দেয়, কিছু কুড়িয়ে নেয় না; বিলিয়ে দেয়ার উচ্চতা থেকে কুড়িয়ে নেয়ার নীচতায় নেমে আসে না।
শত্রুকে যেন তুমি ক্ষমাসুন্দর হাসি উপহার দিতে পারো; সকল ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তুমি যেন উঠতে পারো। তখন প্রকৃতির কাছ থেকে তুমি একটি তন্ময়তা লাভ করবে। তোমার উপর ‘পরম সত্তা’র অনুগ্রহ বর্ষিত হবে। তোমার হৃদয় থেকে ভাবের অনিঃশেষ ঝর্ণাধারা উৎসারিত হবে। স্রষ্টার আদেশে সৃষ্টিজগৎ তাদের অকৃপণ দানে তোমাকে ধন্য করবে। তখন পাতার সবুজ থেকে, ফুলের সুবাস থেকে, পাখির গান থেকে, নদীর কল্লোল থেকে এবং বৃষ্টির রিমঝিম থেকে তুমি লেখার প্রেরণা পাবে।
ভোরের আলো থেকে, সন্ধ্যার আঁধার থেকে, দিগন্তের লালিমা থেকে, আকাশের নীলিমা থেকে, মেঘের আল্পনা থেকে, চাঁদের জোসনা থেকে, তারকার ঝিলিমিলি থেকে এবং জোনাকির আলোকসজ্জা থেকে তুমি চিন্তার স্নিগ্ধতা লাভ করবে।
যখন আঘাত আসে, যখন ব্যথা জাগে তখন প্রত্যাঘাত না করে, কোন অভিযোগ না তুলে তুমি শান্ত হও, সংযত হও এবং তোমার কলমের আশ্রয় গ্রহণ করো। কলম তোমাকে শব্দের ফুল দিয়ে লেখার মালা গেঁথে পরম সান্ত্বনা দান করবে। আর কলমের যা কিছু দান তা রাব্বুল কলমের ইহসান। কারণ মানুষকে তিনি শিক্ষা দান করেছেন কলমের মাধ্যমে। সুতরাং কলমের দান পেতে হলে তোমাকে যেতে হবে রাব্বুল কলমের দুয়ারে, চাইতে হবে দু’হাত পেতে।
শোনো বন্ধু! তুমি যদি শুধু কলম চালনা করো, তাহলে কলম তোমাকে পরিচালনা করবে, কখনো এদিকে, কখনো সেদিকে, কখনো ঠিক পথে, কখনো ভুল পথে। কলমের অনুশীলনে তুমি শুধু লেখক হতে পারো, সাহিত্যের সাধক হতে পারো না। এ জন্য প্রয়োজন কলমের সঙ্গে কলবের বন্ধন। কলম ও কলব, এদু’য়ের শুভমিলনেরই নাম সাহিত্যের সাধনা। তুমি যদি হতে পারো এদু’য়ের মিলনক্ষেত্র তাহলে তুমি পেয়ে গেলে মহাসত্যের আলোকরেখা। তোমাকে করতে হবে না আর পথের সন্ধান। পথ নিজে ডাকবে তোমাকে। তুমি শুধু চলবে সামনে, আরো সামনে এবং পৌঁছে যাবে আলোর ঝর্ণাধারার নিকটে। তোমার কলম থেকে ঝরবে আলোর শব্দ, আলোর মর্ম।
কারণ লেখা তো কিছু নয়, শুধু রেখা। তাতে তুমি পারে না সত্যের দেখা। জীবনসফরে কলমের পথে সত্যের দেখা যদি পেতে চাও তাহলে আগে, সবার আগে কলমের স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন করো।
হৃদয় যদি স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিতে পারে এবং হৃদয় যদি সৃষ্টির সৌন্দর্যের বাণী শ্রবণ করতে পারে তাহলে তোমার সামনে পরম সত্যের প্রকাশ এবং সুপ্ত রহস্যের উদ্ভাস ঘটবে। তোমার কলম জীবন্ত হবে, সৃজনশীল হবে। সাহিত্যের সাধনায় তুমি সফল হবে। তোমার সাহিত্য সত্য ও সুন্দরের এবং শুভ ও কল্যাণের ধারক হবে।
সূত্রঃ দারুল কলম প্রকাশিত “এসো কলম মেরামত করি” গ্রন্থ।

আমি এক মযলূম ভাষা, আমি বাংলাভাষা, আমার বুকে লুকিয়ে আছে অনেক ব্যথা, অনেক যন্ত্রণা। বুকের ভিতরে আর কত দিন লুকিয়ে রাখবো বুকের বেদনা! নীরবে আর কতকাল সয়ে যাবো এ জ্বালা-যন্ত্রণা! কোন দিন কি আমি খুঁজে পাবো না একজন দরদী বন্ধু, যে শোনবে আমার ব্যথা ও যন্ত্রণার কথা, আমাকে দেবে একটু সামান্য শান্তি ও সান্ত্বনা!
ভাষা হলো ভালোবাসার মাধ্যম, ভাষা হলো চিন্তা ও চেতনার বাহন। আমার স্বপ্ন ছিলো, আমি হবো তোমাদের মুখের এবং কলমের ভাষা। আমার পঞ্চাশটি বর্ণ দ্বারা তোমরা লিখবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসার কথা; সেই ভালোবাসায় সিক্ত হবে তাদের হৃদয় যারা বাংলাভাষায় কথা বলে। আমার স্বপ্ন ছিলো, আমি হবো সত্যের, কল্যাণের এবং ন্যায়ের বাহন। আমার মাধ্যমে এদেশে এই সমাজে তোমার সত্যের চিন্তা প্রচার করবে, কল্যাণের ভাবনা ছড়িয়ে দেবে এবং ন্যায়-চেতনার বিস্তার ঘটাবে। আমি হবো পৃথিবীর সুখী ও সমৃদ্ধশালী এক ভাষা, যেমন ইরানের ফারসি এবং হিন্দুস্তানের উর্দূ ভাষা।
আমার কি যোগ্যতার অভাব ছিলো? ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের কমতি ছিলো? ভূষণে, অলঙ্কারে ও ধ্বনি-মাধুর্যে আমি তো ছিলাম অনন্য! তবু আমি পেলাম না তোমাদের যত্ন-ভালোবাসা! আদর পরিচর্যা!
আমার বাগানে কি ফুল ছিলো না! আমার ফুলে কি সুবাস ছিলো না! তবু তোমরা আমার কাছে এলে না, ফুল তুলে মালা গাঁথলে না।
আমি এক মযলূম ভাষা, আমি বাংলাভাষা! আমার বুকে এখন শুধু হতাশা! আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, পরম সমাদরে তোমরা আমাকে গ্রহণ করবে এবং ন্যায় ও সত্যের পথে আমাকে ব্যবহার করবে। তোমরা যখন বাতিলের বিরুদ্ধে লড়বে, তোমাদের কলম থেকে আমি আগুন হযে ঝরবো। কিন্তু তোমরা আমাকে গ্রহণ করলে না, বরং তুলে দিলে ইসলামের যারা শত্রু তাদের না-পাক হাতে। ওরা আমাকে বানালো নগ্নতা ও অশ্লীলতার বাহন এবং ভ্রান্তি ও গোমরাহির অন্ধকার ছড়ানোর মাধ্যম। মুখে ও কলমে ওরা আমার বুকে বিষ ছড়ালো। বিষে বিষে আমি হলাম জর্জরিত এবং আমার দ্বারা সমাজ হলো বিষাক্ত।
আামি এক মযলূম ভাষা, আমি বাংলাভাষা! আমার সর্বাঙ্গে এখন পচন-ধরা ঘা। বিষের জ্বালায় আমি এখন শুধু ছটফট করি, আর আর্তনাদ করি। বিশ্বাস ছিলো একদিন তোমাদের কানে পৌঁছবে আমার আর্তনাদ। ফিরে আসবে তোমাদের চেতনা ও গায়রাত। বিলম্বে হলেও তোমরা এগিয়ে আসবে বাতিলের থাবা থেকে আমাকে উদ্ধার করতে। কিন্তু তোমরা এলে না, তোমরা জাগলে না। আমি লাঞ্ছিত হলাম; একদল পশুর হাতে আমি ধর্ষিত হলাম।
ফল কী হলো আমার প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞার! দেশ ও সমাজের কাছে তোমরাও হলে অবহেলা ও অবজ্ঞার পাত্র! এমনই হয়, মায়ের ভাষাকে যারা অবজ্ঞা করে দেশ ও সমাজের কাছে তারা নিজেরাই হয়ে পড়ে অবজ্ঞার পাত্র।
আর কতকাল থাকবে অচেতন গাফলাতের ঘুমে? একদিন তো দাঁড়াতে হবে আল্লাহর সামনে। সেদিন আমি ফরিয়াদ জানাবো আল্লাহর কাছে। সেদিন আমি নালিশ দায়ের করবো তোমাদের নামে, ‘হে আল্লাহ, তুমি তো কাওমের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছো তাঁর মুখে তাঁর কাওমের ভাষা দিয়ে, যেন তিনি তাদের সামনে প্রচার করতে পারেন হকের দাওয়াত এবং সত্যের বাণী। কিন্তু এরা আমাকে পরিত্যাগ করেছিলো হে আল্লাহ! ফলে তোমার দুশমনদের হাতে আমার ইজ্জত-আবরু হয়েছে লুণ্ঠিত! আমি হয়েছি জাহেলিয়াতের বাহন। হে আল্লাহ আমি বিচার চাই, আমি ইনছাফ চাই।’
তখন কী কৈফিয়ত পেশ করবে তোমরা আল্লাহর কাছে? কী জবাব আছে তোমাদের কাছে আমার নালিশের?
এখনো সময় আছে। ওঠো, জাগো। আমার বর্ণমালাকে গ্রহণ করো, আমার শব্দমালাকে বরণ করো। অন্যায় ও বাতিলের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করো। ন্যায় ও সত্যের বাহনরূপে আমাকে ব্যবহার করো। তাদের হাতে আছে ‘কলমের দড়ি’, তোমরা হাতে নাও ‘কলমের লাঠি’। দেখবে, বাতিলের সব জাদু-কারসাজি হয়ে যাবে নাস্তানাবুদ। মিথ্যার অন্ধকার বিদূরিত হবে এবং সত্যের আলোতে সমাজ আলোকিত হবে। দ্বীনের চূড়ান্ত বিজয় হবে এবং তোমাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে দেশে, সমাজে এবং মানুষের হৃদয়ে। তোমরা আমাকে উদ্ধার করো এবং প্রতিষ্ঠিত করো আমার প্রাপ্য মর্যাদায়; আমি তোমাদের সমাসীন করবো সমাজের নেতৃত্বের আসনে। যদি না করো তাহলে দুনিয়াতে পাবে শুধু যিল্লতি ও লাঞ্ছনা, আর আখেরাতে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে আসামীর কাঠগড়ায়।
সূত্রঃ দারুল কলম প্রকাশিত “এসো কলম মেরামত করি” গ্রন্থ।

বাংলা উপন্যাসের জন্ম হয় পাশ্চাত্য প্রভাবে। এর আদর্শ-ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পায় বঙ্কিমের হাতে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি উপন্যাস রাজর্ষি ও বউঠাকুরানীর হাট বঙ্কিম-প্রভাবিত। বাংলা উপন্যাস নতুন বাঁক নেয় চোখের বালির মাধ্যমে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে যোগ করেন নতুন মাত্রা। বঙ্কিমীধারার লেখক মীর মশাররফ হোসেন। মীর মশাররফ হোসেন অসাধারণ জীবনচেতনার বৃহত্তর সমাজ কাঠামোকে উপন্যাসে আনেন। মুসলিম ঔপন্যাসিকদের যাত্রাও মূলত মশাররফ-পরবর্তী থেকেই। এ প্রবন্ধে মূলত মুসলিম লেখকদের উপন্যাসের যাত্রা ও পাঠকপ্রিয়তার ব্যাপারটিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

মুসলিম লেখক হিসেবে মীর মশাররফ হোসেন উপন্যাস রচনায় অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এর কারণ, মুসলমানদের উগ্রতা ও সংস্কারচেতনা বিপুলভাবে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বজায় ছিল। সেজন্য বিষাদ-সিন্ধুর মতো মহাকাব্যিক উপন্যাসও তিনি রচনা করতে পেরেছিলেন। এবং তা জনপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী লাভ করেছিল। ভারতবষের্র মুসলমানদের বিকশিত হওয়ার পথ নানাভাবে অবমুক্ত হলেও বাঙালির অস্তিচেতনা নিয়ে তখনও গণমানুষের মধ্যে সংকট কাটেনি। এ পর্যায়টিতে তারা বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত অপেক্ষাপূর্ণ ছিলেন।

মীর মশাররফ হোসেন যেমন এগিয়েছেন স্বীয় প্রতিভাবলে। প্রকৃত অর্থে তখন সে পরিবেশটি ছিল না, সৃষ্টি হয়নি কোনো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। ফলে মুসলমানরা জেহাদে অংশ নেয়, মফস্বলে থেকে নানামুখী বিষয়ে ইন্ধন জোগায়। একাধারে উনিশ শতকীয় দ্বিধা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক শূন্যতা উপনিবেশবাদী শাসনকর্তাদের সুযোগ এনে দেয়। তাদের হাতে যা লেখা হয় তা নিছক চালচিত্র বা জীবনের সরল বৃত্তান্ত। কখনও বা তা সমাজরীতি পরিশ্রুত গতানুগতিক জীবনচিত্র। একমাত্র মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন ব্যতিক্রম। কারণ, বাঙালি মুসলমানদের গতানুগতিকতার বদলে বড়শিল্পী হিসেবে তিনি জায়গা খুঁজে নেন। পরবর্তী মুসলিম লেখকদের মধ্যে অনেকেই তেমন অগ্রসর হতে পারেননি। একদিকে তাদের ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিল অসহায়ত্ব, শূন্যতা; অন্যদিকে তেমনি সমাজেরও নির্ধারিত বাস্তবতাও ছিল- যা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। তার উদাসীন পথিকের মনের কথা, গাজী মিঞার বস্তানি বিখ্যাত গদ্য রচনা। রত্নবতী তার উপন্যাস।

মোজাম্মেল হক কবি হিসেবে পরিচিত হলেও উপন্যাস-রচনাতেও তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। তার জোহরা পাঠকনন্দিত উপন্যাস ছিল। সে সময়কালের মুসলিম সমাজচিত্র উপন্যাসটির প্রধান উপজীব্য। জোহরায় বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলার প্রভাবে রোমাঞ্চের আধিক্য ঘটেছে। সমাজচিত্রটিও নির্মিত হয়েছে কপালকুণ্ডলার অনুসৃতে। একসময় মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের মতামত বা ইচ্ছে কোনো মূল্য বহন করত না। জোর করে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পরিবারের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিবাহ দেয়া হতো। এতে নারীর জীবনে দুঃসহ বেদনার যে করুণ পরিণতির জন্ম হতো এ উপন্যাসে সে চিত্রই উপস্থাপিত হয়েছে।

শেখ ফজলল করিমের লায়লী মজনু শিল্পোৎকর্ষ সমৃদ্ধ উপন্যাস না হয়েও এর ভাগ্যে পাঠকপ্রিয়তা জুটে যায়। লায়লী-মজনু (কায়েস)-র অমর প্রেম কাহিনী মানুষের কাছে চির পরিচিত। এর আবেদন চিরন্তন ও সর্বজনীন। যে কারণে এ উপন্যাস সহজেই পাঠকপ্রিয়তা লাভে সক্ষম হয়। পরিচ্ছন্ন ও আবেগময় ভাষার কারণেও উপন্যাসটি পাঠকের সমাদর লাভ করে।

উপন্যাসে প্রকৃত রূপটির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে ইসমাইল হোসেন শিরাজীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। তার উপন্যাস হল: তারাবাঈ (১৯০৮), ঈশা খাঁ বা রায়-নন্দিনী, ফিরোজা বেগম ও নূরুদ্দিন। শিরাজীর উপন্যাসে সমাজের ভেদবিচারের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ। বঙ্কিমচন্দ্র অনুসরণে কিংবা প্রতিকারের ভিত্তিতে তিনি উপন্যাস রচনা করেন। এ পর্যায়ে উল্লেখ করা যেতে পারে তারাবাঈ উপন্যাসের কথা। তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল রায়-নন্দিনী। বিশেষ করে সেকালের মুসলিম সমাজ এ উপন্যাসটিকে তাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করত। শিরাজীর ভাষায় শক্তি ছিল।

শিরাজীর উপন্যাসে হিন্দু-মুসলমান বলে কিছু নয়, গুরুত্ব পেয়েছে প্রকৃত ধারার ঐতিহ্যিক আদর্শ। যেটি প্রত্যেক বড় লেখকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এভাবে প্রধানত জাতীয় চেতনার পরিপ্রেক্ষিতটিই তিনি উপন্যাসে তুলে আনেন। তবে মুসলিম নায়ক আর হিন্দু নায়িকার আন্তঃপ্রণয়ের চিত্রে তিনি মুসলমানদের গৌরবান্বিত করে তোলেন। প্রায় প্রত্যেক উপন্যাসে এরূপ প্রণয়ের চিত্র বর্ণনা করেছেন তিনি। এরূপ চিত্র একইভাবে মোজাম্মেল হকের জোহরা, শেখ মোহাম্মদ ইদরিস আলীর বঙ্কিমদুহিতা (১৯১৭) উপন্যাসেও পরিলক্ষিত। সেখানে বঙ্কিম উপন্যাসের প্রতিক্রিয়ায় কাহিনী বিন্যস্ত করা হয়েছে।

শিরাজীর সময়কাল রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উপন্যাসে নতুনমাত্রা হিসেবে যুক্ত হয় পর্দাপ্রথার অন্ধকারে নারী সমাজের অবরুদ্ধতা ও অশিক্ষা এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার মন্ত্রবীজ। এ চেতনাপ্রসূত থেকেই তার মতিচুর, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ প্রভৃতি উপন্যাস রচিত হয়েছে। তার সব উপন্যাসেই প্রধান উপজীব্য পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমান নারীদের দুর্দশার চিত্র এবং জাগরণের মন্ত্র উচ্চারণ। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের মাধ্যমেই নারী শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে পদ্মরাগ উপন্যাসের মূল মেসেজ এটি। অবরোধবাসিনী উপন্যাসে পর্দাপ্রথার ভয়ঙ্কর অন্ধকারে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই আবিষ্কৃত হয় কুসংস্কারের ভয়ালরূপটি, উচ্চারিত হয় নারী মুক্তির মন্ত্র- উদিত হয় জাগরণের আলোকবার্তা।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার কৃতিত্বপূর্ণ অবস্থান। উপন্যাস-সাহিত্যেও তার পদচারণা রয়েছে। তিনি নদীবক্ষে উপন্যাস লেখেন। মননশীল প্রবন্ধের লেখক হিসেবে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। তবে মোহাম্মদ নজিবর রহমান এক্ষেত্রে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পীরপ্রথা বা পীরদের ক্ষমতা, কৌশল বা আধিপত্য নিয়ে তিনি বেশকিছু উপন্যাস রচনা করেছেন। তার গরীবের মেয়ে, পরিণাম ও প্রেমের সমাধি উপন্যাসে পীরের মর্যাদার প্রশ্নটি উঠে এসেছে। এ লেখক প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়ে যান এসব উপন্যাস রচনা করে। প্রাসঙ্গিকভাবে নিশ্চয়ই আনোয়ারা-র কথা বলতে হয়। এসব উপন্যাসে ধর্মচর্চা, মুসলিম রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, আদেশ-উপদেশ-নির্দেশ অনুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন করেছেন। এসব উপন্যাসে ধর্মচর্চার বিষয় পারিবারিক জীবনাগ্রহে ব্যক্ত করেছেন। এভাবে মুসলিম ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রটি রচিত হয়।

এমএ হাশেম খানের ‘আলোর পরশ’ জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি উপন্যাসের একটি। মোহাম্মদ কোরবান আলীর মনোয়ারাও পাঠকনন্দিত উপন্যাস। এ উপন্যাসটি আনোয়ারা প্রভাবিত হয়েও ব্যাপক পাঠকের আনুকূল্য লাভ করেছিল।

কাজী নজরুল ইসলামেরও প্রধান খ্যাতি কবি হিসেবে। ‘বিংশ শতকে মুসলমানদের মধ্যে একাধিক বিস্ময়কর প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল, নিঃসন্দেহে নজরুল ছিলেন তাদের মধ্যে সেরা।’ কাজী নজরুল ইসলাম এ সময়পর্বে উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় না হলেও যে বিপ্লব চেতনার প্রতীক রূপে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন সেটাই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে তার উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে। কুহেলিকা উপন্যাসে নর-নারীর প্রেম ও ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবকে একইসঙ্গে তুলে ধরে পাঠকের বিশেষ আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছিলেন। নজরুলের পত্রোপন্যাস বাঁধন-হারা উপন্যাসে আবেগদীপ্ত ভাষা প্রেম ও প্রত্যয়ের দীপ্তিতে প্রকটিত। নজরুলের উপন্যাসের জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে তার অবিসংবাদিত কবিখ্যাতি যুক্ত ছিল। নজরুলের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে যেমন তার অবিশ্বাস্য কবিখ্যাতি, ঔপন্যাসিক হিসেবে জসীমউদ্দীনের জনপ্রিয়তা লাভের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি প্রায় একইধারায় পর্যবসিত। জসীমউদ্দীনের উপন্যাস বোবাকাহিনী প্রকাশের বহু আগেই তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান। বোবাকাহিনী রচিত হয়েছে মুসলমান কৃষকদের জীবন-কাহিনী নিয়ে। উপন্যাসটিতে অত্যন্ত দরদের সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে গ্রাম-জীবনের সামগ্রিক চিত্র।

সিকান্দার আবু জাফর কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ। তার মাটি আর অশ্রু, নতুন সকাল সাড়া জাগানো উপন্যাস। আবুল ফজলের চৌচির উপন্যাসে মুসলিম জীবনাগ্রহের পরিচয় বিধৃত। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের কথা আছে তার জীবন পথের যাত্রী উপন্যাসে। এ উপন্যাসে বৃহত্তর সামাজিক পটভূমি অনুপস্থিত, ব্যক্তি মানুষের উপলব্ধি বাস্তবায়নের পথ ধরে উপন্যাসটির কাহিনী নির্মিত হয়েছে। তার অন্য উপন্যাস রাঙ্গাপ্রভাত-র পটভূমি দেশবিভাগের বিক্ষুব্ধ সময়কাল। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা উপন্যাসে বিস্ময়কর প্রতিভা। তার লাল সালু এক অসামান্য সৃষ্টি। কাঁদো নদী কাঁদো, চাঁদের অমাবস্যা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে নতুন বাঁক ঘটিয়ে দিয়েছিল। পাঠকের মনে-মননে-চিন্তায় শাণিত স্রোতের মতো এসব উপন্যাস আঘাত করেছিল।

বাংলা উপন্যাসে জনপ্রিয়তার ধারায় ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ জীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে একজন সুদক্ষ শিল্পীর মতো তিনি তার উপন্যাসে এঁকেছেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর নেতাদের চরিত্রচিত্রণের প্রেক্ষাপটে তিনি উপন্যাস রচনা করে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অবাঞ্ছিত, কি পাইনি, দু’দিনের খেলাঘরে, দুষ্টক্ষত, নতুন পৃথিবী, মেঘ বিজলি বাদল তার বিখ্যাত উপন্যাস। আকবর হোসেনের উপন্যাসসমূহ জনপ্রিয় হওয়ার অপর কারণ উঠতি নগরের মধ্যবিত্ত জীবন তার উপন্যাসে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে।

বিভাগোত্তর পূর্ব-বাংলায় তথা বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি বাগদাদের পটভূমিকায় উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠলেও প্রচ্ছন্নভাবে লেখকের রাজনৈতিক চেতনার এক চমৎকার উদ্ভাসন এখানে নজরে পড়ে। শওকত ওসমান প্রতীকী এ উপন্যাসে হারুনর রশীদের প্রতীকায়নে পাকিস্তানের একনায়ক স্বৈরশাসক আইয়ুবের চিত্র অঙ্কন করে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদকে তাতারীর মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন। জননী উপন্যাসও বাংলাসাহিত্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসটিতে মাতৃত্বের অনবদ্য ও চিরকালীন মাতৃসত্তার পরিচয়বিধৃত। জীবনের থেকেও সন্তানই যে জননীর কাছে বড়- সে সত্য এখানে শিল্পগুণে উপস্থাপিত হয়েছে। সে কারণে বাঙালি পাঠকের কাছে জননী বিশেষ গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস চারটি। জাহান্নাম হইতে বিদায়, নেকড়ে অরণ্য, দুই সৈনিক ও জলাঙ্গী। উপন্যাসগুলো পাঠকসমাদৃত। এছাড়াও তার বনী আদম, পতঙ্গ পিঞ্জর, রাজসাক্ষী, পিতৃপুরুষের পাপ ইত্যাদি বাংলা উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তার উপন্যাসে পাকিস্তানের দুঃশাসন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতির ভেতর-বাহির, সমাজের দগদগে ঘা বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছে।

শহীদ আশরাফ একসময় বেশ জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন। তিনি প্রায় বিশটি মতো উপন্যাস লিখেছেন। তার অপরাজিতা, মন মহুয়া বন, হারানো সুর, শিল্পী, গোপন চারিনী, প্রেম পিয়াসী ইত্যাদি পাঠকপ্রিতা পেয়েছিল। পূর্ব-বাংলার ভাষা আন্দোলন নিয়ে জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন জনপ্রিয় উপন্যাস। এর প্রধান উপজীব্য রাজনীতি। এ উপন্যাসে লেখকের ভাষাগুণে যে আঙ্গিক নির্মাণ হয়েছে তা প্রজন্মান্তের রাজনীতির বার্তাকে যেমন বিবেচনায় এনেছে তেমনি শিল্পক্ষুধাও মেটাতে সক্ষম হয়েছে, সন্দেহ নেই।

জহির রায়হানের অন্য উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে, আর কতদিন, তৃষ্ণা, কয়েকটি মৃত্যু।

জহির রায়হানের অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার পেশাগত জীবনে সাংবাদিক হলেও উপন্যাস লিখে তিনি কালজয়ী শিল্পশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। সারেং বৌ ও সংশপ্তক তার বিখ্যাত দুটি উপন্যাস। সারেং বৌ জনপ্রিয় উপন্যাস। জনপ্রিয়তার কারণও স্পষ্ট। কদম সারেং ও নবিতুনের প্রতিজ্ঞাপ্রসূত প্রেম- উপন্যাসে যা সারাক্ষণই বাধাগ্রস্ত হয়েছে ভোগবাদী শক্তির দ্বারা, এবং একইসঙ্গে নবিতুনও প্রতিরোধে হয়ে উঠেছে সর্বসংহা শাশ্বত নারী।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জীবনের নানা বৈচিত্রতা এনে উপন্যাসে নতুন প্রাণ দিয়েছেন। তার উপন্যাস রজনীর চাঁদ, নীল যমুনা। শামসুদদীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা বহুল পঠিত উপন্যাস। আবুল মনসুর আহমদের জীবন-ক্ষুধা উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক-রাজনীতির অনুপম এক চিত্র ফুটে উঠেছে। জোবেদা খানমের উপন্যাস প্রেম-প্রকৃতি ও রোমান্সনির্ভর। তার দু’টি পাখি দু’টি তারা, অনন্ত পিপাসা, অভিশপ্ত প্রেম নর-নারীর স্বাভাবিক প্রেম-প্রণয় পারিবারিক-সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতের ছবি। সাধারণ পাঠকের মনকে যা সহজেই স্পর্শ করতে পেরেছিল। রশিদ করিমের প্রেম একটি লাল গোলাপ পাঠক হৃদয়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করা উপন্যাস।

সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী লেখক হলেও উপন্যাস রচনায় তিনি অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। তার অনেক উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। এক মহিলার ছবি, খেলারাম খেলে যা, নিষিদ্ধ লোবান পাঠকনন্দিত উপন্যাস। তিনি অসংখ্য উপন্যাসের স্রষ্টা। সৈয়দ হকের উপন্যাসে স্বাধীনতা-পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ে ক্রমবিকশিত মধ্যবিত্তের মনোজগত, বিকারগ্রস্ততা, যৌনতা, অঢ়রিতার্থতা, আত্মকূলায়ন, স্ববিরোধিতা বিচিত্রভাবে নিরীক্ষিত হয়েছে।

রাবেয়া খাতুন বাংলা উপন্যাসে এক নতুন প্রবাহ তৈরি করেছেন। মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি- আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী অবস্থা, স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ তার উপন্যাসের বিশেষ দিক। তার অসংখ্য উপন্যাস পাঠকনন্দিত। মন এক শ্বেত কপোতী, ই ভরা ভাদও মাহ ভাদও, বায়ান্ন গলির এক গলি, ফেরারি সূর্য, জীবনের আর এক নাম দিবস রজনী প্রভৃতি।

মুক্তিযুদ্ধের পর সেলিনা হোসেন জনপ্রিয় হন। তার উপন্যাসের প্রধান অনুষঙ্গ রাজনৈতিক চেতনা। কাহিনী ও চরিত্রের মধ্যে সময়ের একটি বিবেচনা সারাক্ষণ কাজ করে। লেখক রাজনীতিকে জড়ান সময়ের ভেতরের মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি অসংখ্য অসামান্য উপন্যাস লিখেছেন। হাঙর নদী গ্রেনেড, যাপিত জীবন, গায়ত্রীসন্ধ্যা, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, কাঁটাতারে প্রজাপতি, কালকেতু ও ফুল্লরা, মগ্ন চৈতন্যে শিস, খুন ও ভালোবাসা, ভালোবাসা প্রীতিলতা টানাপড়েন, মর্গের নীল পাখি ইত্যাদি তার অসামান্য সৃষ্টি। তার উপন্যাস পাঠকসমাজে যেমন বহু পঠিত, সমাদৃত এবং একইসঙ্গে চেতনায় অগ্নিকা বারুদ জ্বালিয়ে দেয়। তার উপন্যাসের শক্তিটাই বিশেষ রকমের।

মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমুখীনতা ও বহির্মুখিনতাকেন্দ্র করে শহীদ আখন্দ লিখেছেন পান্না হলো সবুজ, ভালোবাসার বসবাস, দুদণ্ড শান্তি প্রভৃতি। দিলারা হাশেম প্রথম উপন্যাস ঘর মন জানালা লিখেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার অন্য উপন্যাসগুলোও পাঠককে বেশ আকৃষ্ট করেছে। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে আহমদ ছফা বিশেষ একটি নাম। ওঙ্কার, সূর্য তুমি সাথী, মরণবিলাস, পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন ভিন্ন ধরনের উপন্যাস। এটি সিরিয়াস রচনা হলেও বেশ জনপ্রিয়।

প্রদোষে প্রাকৃতজন ইতিহাসের পৃষ্ঠে বাধা কিছু মানুষের রাজনৈতিক চেতনার পুনর্মূল্যায়ন। চলমান সময় ও সমাজ বাস্তবতায় লেখকের এ প্রবণতা একদিকে যেমন জীবন অনুষঙ্গ অন্যদিকে তেমনি নতুন পথের বার্তাবাহী।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই বাংলাদেশের তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস। মঞ্চেও প্রতিষ্ঠিত। জনপ্রিয়ও বটে। তার অন্য উপন্যাস খোয়াবনামা। এ উপন্যাস লিখে তিনি উঁচুমাপের শিল্পদক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় উপন্যাস। চরিত্র-কাহিনী বিষয়বস্তুতে এক নতুন ধারা এ উপন্যাসে লক্ষণীয়। পাঠককে যা বিশেষভাবে টানে। মাহবুব তালুকদারের আরেকজন আমি, পলাশ ও শিমুলের গল্প, ক্রীড়নক উপন্যাস। তার উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের আবেগকে কাহিনী করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যে এ ধারা অব্যাহত আছে। ক্রম-বিস্তৃতিও ঘটেছে অনেকদূর। সামাজিক বৈষম্য, বংশাভিমান, ভেদবিরোধী ব্যাপার, পীরপ্রথা, রোমাঞ্চকর অলৌকিকত্ব, ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃৃতি, অস্পৃশ্যতা, ধর্মন্ধাতা, অবরোধ, নারীনির্যাতন, কর্পোরেট পুঁজি ও অন্তর্জালবিষয়ক জটিলতা এ শতকে বাঙালি লেখকরা নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমাজচিন্তায় শৈথল্য এসেছে। সংস্কৃতি পাল্টেছে। একুশ শতকের উপন্যাস এখন আরও জটিল বাস্তবতামুখর। এতে ধর্মান্ধতা, মনস্তত্ত্বও ভিন্ন মাত্রায় উপন্যাসে যুক্ত হয়েছে। ফলে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র উপন্যাসের কমেনি। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। তিনি বাঙালি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখতে পেরেছিলেন। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারে, শ্যামল ছায়া, কোথাও কেউ নেই, শ্রাবণ মেঘের দিন, এইসব দিনরাত্রি, আগুনের পরশমণি, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি ব্যাপকভাবে পাঠকনন্দিত উপন্যাস। অসংখ্য উপন্যাস-গ্রন্থের স্রষ্টা ইমদাদুল হক মিলনের নামটিও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে বিচিত্ররকম মানুষকে কাহিনীতে এনেছেন তিনি। গ্রাম ও নগরের জীবনাচার গভীর দৃষ্টিচেতনায় প্রোথিত করে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কয়েক দশক ধরে এদেশের পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনি ধরে রেখেছেন। তার সুদীর্ঘ কলেবরে রচিত নূরজাহান একটি অসামান্য উপন্যাস হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। ইমদাদুল হক মিলনের নূরজাহান গুণগতমান, শিল্পমূল্য ও পাঠকপ্রিয়তায় বাংলাসাহিত্যে এক অমর সৃষ্টি। এ উপন্যাসে নারীর রূপান্তরিত বিদ্রোহীসত্তা কাঠামোবন্দি হয়েছে।

শহিদুল জহির শক্তিশালী ঔপন্যাসিক। তার সে রাতে পূর্ণিমা ছিল বিখ্যাত উপন্যাস। আনিসুল হক এ সময়কালে পাঠকপ্রিয়তায় একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। মা তার বিশেষ উপন্যাস। এ ছাড়াও তার অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস রয়েছে। অরুণ চৌধুরীর ছায়াবন্দি, আবদুল মান্নান সৈয়দের ক্ষুধা প্রেম আগুন, আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, অন্ধকার, হরিপদ দত্তের অজগর ও জন্ম জন্মান্তর, তসলিমা নাসরিনের অপর পক্ষ ও লজ্জা, মঞ্জু সরকারের প্রতিমা উপাখ্যা, আতা সরকারের একদা অনঙ্গ বউ, তিতুর লেঠেল, সোনাই সরদারের ঢাকা অভিযান, মঈনুল আহসান সাবেরের পাথর সময়, কেউ জানে না, আদমের জন্য অপেক্ষা, আগামী দিনের গল্প, এখনও পাঠকের আগ্রহের বিষয়। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসনাত আবদুল হাই, ইসহাক খান, নাসরীন জাহান, মঈনুদ্দীন কাজল, মোস্তফা কামাল, মোহিত কামাল, জুলফিকার মতিন, ওয়াহিদ রেজা, আফসান চৌধুরী, নিশাত চৌধুরী, বুলবুল চৌধুরী, সামস্ রাশীদ, রেজানুর রহমান, রেজোয়ান সিদ্দিকী, রফিকুর রশীদ, মহসিন শস্ত্রপাণি, মাফরুহা চৌধুরী, মালিহা খাতুন প্রমুখের উপন্যাসও পাঠকমহলে সমাদৃত।

এ নিবন্ধের পরিধির স্বল্পতার কারণে অনেক ঔপন্যাসিকের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি; কিন্তু তাদেরও বিশেষ কোনো না কোনো উপন্যাস পাঠকের আগ্রহ তৈরি করেছে।

আধুনিক সমাজে অনেক মুসলিম লেখক নানাবিধ সমস্যা নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। এবং এখনো লিখছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক কালে প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি নবীনদের পদচারণাও লক্ষ্য করার মতো। উপন্যাসের জনপ্রিয় এ ধারাবাহিকতায় এখন ক্রমপ্রবহমান এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে- এ নিয়ে ভিন্ন পর্যবেক্ষণের উপন্যাসও লেখা হচ্ছে। তবে বাঙালি মুসলমান নয় বাংলাদেশের জাতি, ধর্ম-বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে লেখকরাই এ ধারায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং সাফল্যও পেয়েছেন।

লেখালেখি করে বিশ্বের অনেক লেখক-লেখিকাই আয় করছেন কোটি কোটি ডলার। আর এ ক্ষেত্রে কোন কোন লেখক এগিয়ে আছেন তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস। সাময়িকীটি বলছে, বিশ্বের নামকরা লেখক জেমস পিটারসন ও জর্জ আর আর মার্টিন দুজন মিলে ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত করপূর্ব আয় করেছেন ৩৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৭৭.৭৪ টাকা ধরে)। লেখকদের এই আয়ের হিসাব হচ্ছে, তাঁদের প্রিন্ট করা বই, ই-বই, অডিও বইয়ের হিসাব করে। টাকার অঙ্কের এই হিসাব বের করেছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নেলসন। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে লেখকদের ব্যবহৃত লেখার হিসাব ও লেখক, এজেন্ট, প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে ও তাঁদের কর হিসাব থেকে এই টাকার অঙ্ক বের করা হয়। তালিকার শীর্ষ পাঁচ হচ্ছেন:
জেমস পিটারসন: ফোর্বস-এর তালিকায় প্রথম স্থানে আছেন আমেরিকান বিখ্যাত লেখক জেমস পিটারসন। প্রকাশনার দিক থেকে তিনি বিশ্বের সব লেখককে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁর আয় ৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৬৯২ কোটি টাকা প্রায়। ব্যস্ত এই লেখক এক বছরে সহলেখকের সহায়তায় ১৬টি বই প্রকাশ করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেশি বিক্রি হওয়ার হিসাব বলছে জীবিত লেখকদের মধ্যে পিটারসনের সবচেয়ে বেশি শিশুতোষ বই বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া কিশোর উপন্যাস বিক্রি হয়েছে তিন কোটির বেশি।
জন গ্রিন: সেরা আয়ের লেখক হিসেবে নাম এসেছে মার্কিন তরুণ লেখক জন গ্রিনের। তিনি আয় করেছেন ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২০২ কোটি টাকা। তাঁর লেখা উপন্যাস দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস ৩৫ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর তৃতীয় উপন্যাস পেপার টাউনস থেকে তৈরি চলচ্চিত্র সারা বিশ্বে আয় করেছে ৩০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
ভেরোনিকা রথ: মার্কিন এই লেখিকার বয়স কত জানেন? মাত্র ২৬ বছর! ফোর্বস-এর শীর্ষ তালিকায় তিনিই সবার ছোট! অল্প সময়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই লেখিকার আয় ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৯৪ কোটি টাকা প্রায়। শুধু গত বছরে তাঁর লেখা জনপ্রিয় ট্রিলোজি ডাইভারজেন্ট থেকে আয় হয়েছে ৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর তাঁর লেখা থেকে তৈরি ইনসারজেন্ট চলচ্চিত্র তো সারা বিশ্ব থেকে আয় করেছে ২৯৫ মিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
ড্যানিয়েল স্টিল: মার্কিন এই লেখিকাও জনপ্রিয়তার কোনো অংশে কম নন। তাঁর আয় ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ১৯৪ কোটি টাকা প্রায়। তিনি ১৯৭৩ সালে লেখক হিসেবে পেশা শুরুর পর থেকে প্রকাশ করেছেন ৯৪টি উপন্যাস। তাঁর বই মিলবে বিশ্বের ৪৭টি দেশে আর ২৮টি ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে।
জেফ কিনি: বিশ্বের তুমুল জনপ্রিয় শিশুতোষ বই ডায়েরি অব এ উইমপি কিড বইয়ের লেখক জেফ কিনি আয় করেছেন ২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৭৮ কোটি টাকা প্রায়। তাঁর ওই বই থেকে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও। সেটিও নন্দিত হয়েছে। সেই বই ও চলচ্চিত্র থেকে তিনি আয় করেই যাচ্ছেন। তাঁর সর্বশেষ লেখা শিশুদের বই দ্য লং হাউল গত বছরে দেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। বিশ্বের ৪৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই লেখকের বই।
এর বাইরে ৬ নম্বরে আছেন জেনেট ইভানোভিচ (২১ মিলিয়ন বা ১৬৩ কোটি টাকা), সপ্তম তালিকায় হ্যারি পটার বইয়ের লেখিকা জে কে রাওলিং (১৯ মিলিয়ন বা ১৪৭ কোটি টাকা), অষ্টম স্টিফেন কিং (১৯ মিলিয়ন বা ১৪৭ কোটি টাকা), নবম স্থানে নোরা রবার্টস (১৮ মিলিয়ন বা ১৪০ কোটি) এবং দশম স্থানে আছেন জন গ্রিসাম (১৪ মিলিয়ন বা ১১০ কোটি টাকা প্রায়)।

২৫ বছর বয়সেই ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেমের ঔপন্যাসিক আপডেট: ০৭:৩৯, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

শিল্প-সাহিত্য ডেস্ক: তাঁর নাম নিকিতা সিং, বয়স মাত্র ২৫ বছর। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী, এবং এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। অথচ এ বয়সেই তিনি ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেমের উপন্যাস লেখিকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন।

নিকিতা ২০১১ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথমবার বই লেখেন, যেটার নাম ‘লাভ@ফেসবুক’। নিজের বয়সিদের কথা মাথায় রেখেই লিখেছিলেন বইটি। কিন্তু, নজর কাড়েন বয়সের সীমা ছাড়িয়ে আরো অনেকেরই।

সে-বইয়ের পরে এই ছয় বছরে তাঁর আরো ৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে। চলতি ২০১৭ সালে তাঁর লেখা ‘এভরি টাইম ইট রেইনস’ বইটি তাঁর অন্যান্য বইয়ের মতোই দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আপাতত এটিই তাঁর লেখা সর্বশেষ উপন্যাস।

নিকিতা বলেন, ১৯ বছর বয়সে এক নামী লেখকের একটি রোম্যান্টিক নভেল পড়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে, তিনি নিজে এর থেকে ভালো লিখতে পারবেন। তখন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু।

বিশ্বস্ত বুদ্ধিজীবী-পাঠকবোদ্ধাদের মাধ্যমে জানলাম, বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লেখা বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাস নিয়ে হলিউডে ছবি হয়েছে। বিষয়টি মারাত্মক ভাবে অানন্দিত ও অবাক করেছে আমাকে।
জানার খুব ইচ্ছা, এসব ছবিতে কি ড. জাফর ইকবাল স্যারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এটা খুবই অন্যায় । তারা স্যারের উপন্যাস নিয়ে ছবি বানাবে; কিন্তু ক্রেডিট দেবে না। খুবই আপত্তির কথা।
যে তালিকা জানা গেছে, সেটি দেয়া হল। বোদ্ধা বুদ্ধিজীবীরা ছবি ও উপন্যাস মিলিয়ে দেখে পিএইচডি ডিগ্রি করতে পারেন।

১. ট্রাইটান একটি গ্রহের নাম
সিনেমা Alien (1979)।
২. অবনীল
সিনেমা Pitch Black (2000)।
৩. নিতু আর তার বন্ধুরা
সিনেমা Matilda (1996)।
৪. মেকু কাহিনী
সিনেমা Baby’s Day out (1994)।

৫. আমি তপু
A Child Called it(Dave Pelzer : 1995)

logo
আপডেট : ১০ জুন, ২০১১ ০০:০০
আধুনিক আরবি উপন্যাস
মহাকাব্যের প্রতিচ্ছবি
শাহনেওয়াজ বিপ্লব
মহাকাব্যের প্রতিচ্ছবি

অলংকরণ : দেওয়ান আতিকুর রহমান
‘উপন্যাস’ নামের আধুনিককালের জনপ্রিয় সাহিত্য আঙ্গিকটি পশ্চিম ও লাতিন আমেরিকার পরম্পরায় চিরঋণী যাঁদের কাছে, তারা হলেন আরব দেশের আরবি ভাষার মানুষ। বসবাস তাঁদের আলজেরিয়া, বাহরাইন, কমেরো, জিবুতি, মিসর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, ফিলিস্তিন, কাতার, সৌদি আরব, সুদান, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, আরব আমিরাত ও ইয়েমেন; এক কথায় যেসব দেশ আরব বিশ্ব বা আরবি ভাষাভাষী হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। মানব সভ্যতায় পুরো মধ্যযুগ ধরে যখন পদ্য, পয়ার আর কবিতার দোর্দণ্ড প্রতাপ চলেছে, ঠিক তখন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আরবরাই উপহার দিয়েছেন আরব্য উপন্যাস, ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ বা এক হাজার এক রাতের গল্প, যা পুরো বিশ্বকে তুমুল আলোড়িত করে রেখেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। আরব্য উপন্যাসের বৈচিত্র্যময় সিন্দবাদ, আশ্চর্য প্রদীপের মালিক আলাদীন অথবা আলীবাবা ও ৪০ চোরের বিস্মৃত গল্প-পথ ধরে আজকের আধুনিক সাহিত্যাঙ্গিক গল্প ও উপন্যাসের জন্ম, ব্যবধান শুধু এতটুকুই যে মধ্যযুগের আরব্য উপন্যাস রচিত হয়েছিল দৈত্যদের নিয়ে, পরীদের নিয়ে, রাজা-বাদশা বা অসাধারণদের নিয়ে। আর আধুনিক উপন্যাসে আধিপত্য অতিসাধারণ মানুষের সাবঅলটার্ন মানুষদের নিয়ে। আধুনিক ঔপন্যাসিকরা আবিষ্কার করেন যে মানুষের মধ্যেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি গল্প; তার ঘরে, তার মনে, তার চারদিকে, তাকে ঘিরে আছে গল্প এবং তা শোনার মতো, তা উপন্যাস হয়ে ওঠার মতো। তাই বলা যায়, আধুনিক আরবি উপন্যাস পৃথিবীর অন্য দেশের উপন্যাসের মতো হঠাৎ করে সাহিত্যে এসে জায়গা করে নেয়নি, বরং এর রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারা। যদিও লিখিত আরব্য উপন্যাস পাওয়া গেছে ১৪ শতকে, কিন্তু আরব্য উপন্যাসের অনেক গল্প, সাহিত্যসমালোচকরা বলছেন, ইসলাম কায়েমের বহু আগেই মুখে মুখে ছড়িয়েছিল আরবিভাষীদের মধ্যে। এমনকি আধুনিক উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর ব্যাপ্তি, গল্প বলার ঢং এবং বিস্তৃত উপাখ্যানকে বিবেচনায় আনলে আরব্য উপন্যাসের ভেতর পাওয়া যায় বরং আধুনিক উপন্যাসেরই কাঠামো। তা ছাড়া আধুনিক যে রহস্য উপন্যাস তারও পূর্বপুরুষ আরব্য উপন্যাস। রহস্য উপন্যাসের উপাদান ও চারিত্র্য বিবেচনায় শাহেরজাদীর মুখে বর্ণিত ‘তিন আপেল’ গল্পটি একটি বড় উদাহরণ : ‘এক জেলে একটি ভারী সিন্দুক পেয়েছিল টাইগ্রিস নদীতে। জেলে সেটি অব্বাসীয় খলিফা হারুন-আল-রশীদের কাছে বিক্রি করে। তারপর খলিফা সিন্দুকটি ভাঙলে ভেতরে পান মৃত এক মহিলার লাশের বেশ কয়টি টুকরো। হারুন-আল-রশীদ হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তার সেনাপতি জাফর ইবনে ইয়াহিয়াকে তিন দিনের সময় বেঁধে দেন এবং হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে ব্যর্থ হলে তাঁকে হত্যা করা হবে বলে জানান।’ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে গল্পের ক্রমঅগ্রসরতায় তিন আপেলের কাহিনী পৃথিবীর অন্যতম সেরা রহস্য উপন্যাস বলেই দাবি করেন সাহিত্যবোদ্ধারা। আধুনিক অ্যাডভেঞ্চারাস উপন্যাসের জনকও আরবি ঔপন্যাসিক ইবনে তোফায়েল। তিনি তাঁর ‘ফিলোসোফাস আটোডিডাকটাস’ উপন্যাসের নায়ককে ছেড়ে দিয়েছিলেন নির্জন একাকী মরুভূমিতে। যার অনুকরণে পরে ডানিয়েল ডিফোর উপন্যাস ‘রবিনসন ক্রুসো’ এবং রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘জাঙ্গল বুক’_যেখানে টারজান নামের শিশুটি বনে পরিত্যক্ত হয়ে একটি ভল্লুকের স্নেহ-পরিচর্যায় বড় হয়েছিল। মধ্যযুগের আরব্য উপন্যাসকে কেন্দ্র করে রহস্য উপন্যাস বা অভিযাত্রার রোমাঞ্চ উপন্যাসসহ আধুনিক নানা উপন্যাস ধারার সৃষ্টি হলেও আরব বিশ্বে আধুনিক কোনো উপন্যাস নিয়ে হৈ চৈ হতে দেখি না আমরা মিসরের ঔপন্যাসিক নাগিব মাহফুজের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত। অথচ যুদ্ধ আর সংঘাতে বিক্ষুব্ধ আরব দেশগুলো থেকেই জন্ম হওয়ার কথা ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। তেলের খনি পাওয়ার পর আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স অথবা ইউরোপের অন্য দেশগুলো হঠাৎ করে আরব দেশগুলোর ওপর লোলুপ দৃষ্টি, বেদুইন এবং স্বজাতির সংস্কৃতি বাতিল করে দিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমদানির দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ফুটিয়ে তোলার জন্য, বিশাল আরব বিশ্বে যে প্রচুর শক্তিশালী আধুনিক ঔপন্যাসিকের জন্ম হওয়ার দরকার ছিল_ওই রকম হয়নি। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে মিসরীয় ঔপন্যাসিক নাগিব মাহফুজ তাঁর ‘কায়রো ট্রিলজি’ উপন্যাসের জন্য নোবেল পুরস্কার পেলে বিশ্ব প্রথমবারের মতো দৃষ্টি ফেরায় আধুনিক আরবি উপন্যাসের ওপর। নাগিব মাহফুজের আগ পর্যন্ত পুরো বিশ শতকে, অন্য আরবিভাষী ঔপন্যাসিকদের ব্যর্থ হওয়ার যেটি প্রধান কারণ সেটি হচ্ছে, বিশ শতকের আধুনিক আরবি ঔপন্যাসিকরা আরব্য উপন্যাসের চিরকালীন ধারাকে তাঁদের প্রধান পথ বলে মনে করেছিলেন। এর ভেতর শুধু ছোট্ট একটি অংশ ‘নিউ লিট্যারারি মুভমেন্ট’ নাম দিয়ে পাশ্চাত্য দর্শন, ধ্যান-ধারণাকে আরবিতে আত্মস্থ করতে শুরু করেন। চলি্লশের দশক মূলত আরবি আধুনিক উপন্যাসের সূচনাকাল। ঔপনিবেশিক শোষণ, জাতীয়তাবাদ, নারীবাদ, নির্বাসন, অভ্যুত্থান এবং যুদ্ধই আধুনিক আরবি উপন্যাসের উপাদান। এসব বিষয়কে কেন্দ্রে রেখে আধুনিক আরবি উপন্যাস রচনায় যাঁরা দক্ষতা দেখিয়েছেন, তাঁদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নিচে দেওয়া হলো : নাগিব মাহফুজ (জন্ম ডিসেম্বর ১১, ১৯১১, মৃত্যু : আগস্ট ৩০, ২০০৬) : আধুনিক আরবি উপন্যাসের যা কিছু অর্জন তার অনেকটাই নাগিব মাহফুজের হাত ধরে এসেছে। মিসরের এ ঔপন্যাসিক লিখেছেন ৫০টিরও বেশি উপন্যাস। আধুনিক আরবি উপন্যাসে ‘অস্তিত্ববাদ’কে তিনি এবং তাওফিক আল হাকীমই প্রথম নিয়ে এসেছিলেন। ‘কায়রো ট্রিলজি’ (১৯৫৬-৫৭) নাগিব মাহফুজের বিখ্যাত উপন্যাস। উপন্যাসটি তিনি তিন ভাগে বিভক্ত করে লিখেছিলেন। তিন ভাগের নাম দিয়েছিলেন যথাক্রমে ‘প্যালেস অব ওয়াক’, ‘প্যালেস অব ডিজায়ার’ এবং ‘সুগার স্ট্রীট’। মৌলভী এল সাইদ আহম্মেদ আবদেল গাওয়ার এবং তাঁর পরিবার ও তিন প্রজন্মের ঘটনা (যার সময়টা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত) নিয়েই ‘কায়রো ট্রিলজি’ উপন্যাস। মহৎ এ উপন্যাসটির জন্য মাহফুজকে বালজাক, ডিকেন্স, তলস্তয় এবং গলসওয়ার্থির সঙ্গে তুলনা করা হয়। তবে নাগিব মাহফুজের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘চ্যাটার অব দি নাইল’ (১৯৬৬)। এ উপন্যাসে তিনি বলেছেন যৌনতার কথা; সমকাম আর সমাজতন্ত্রের জয়গানও গেয়েছেন। উপন্যাসটিতে সেনাশাসক জামাল আবদুল নাসেরের সময়ের সমালোচনা করা হয়েছে, যে জন্য নাসেরের পর ক্ষমতায় আসা আনোয়ার সাদাত উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন অনেক দিন। নাগিব মাহফুজের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘চিলড্রেন অব জেবেলরি’ (১৯৫৯)। ধর্মের অবমাননার অভিযোগে ব্লাসফেমি আইনে লেবানন ব্যতীত পুরো আরব বিশ্বে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। এ উপন্যাসে জেবেলরির সন্তানরা একই সঙ্গে বিশ্বাস রেখেছে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মে। নাগিব মাহফুজের অন্য উপন্যাসগুলোতে ঘুরে-ফিরে এসেছে মূলত কায়রোর নাগরিক জীবনের নানা দ্বন্দ্ব। কায়রোর আধুনিকায়নে সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও সে পরিপ্রেক্ষিতে নানা সংঘাত এবং পশ্চিমা মূল্যবোধের আগমনে আরব মূল্যবোধের বিলুপ্তির আশঙ্কা। ইলিয়াস খৌরি (জন্ম ১২ জুলাই ১৯৪৮, বৈরুত, লেবানন) : নাগিব মাহফুজের পর আধুনিক আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে সেরা ঔপন্যাসিক। বিশ্বের বহু ভাষায় তাঁর উপন্যাস অনূদিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘দি লিটল মাউন্টেন’ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে লেবাননের বিভীষিকাময় গৃহযুদ্ধ। এ ছাড়া ‘দি জার্নি অব লিটল গান্ধী’ তাঁর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস, যেখানে গান্ধীর মতোই অহিংস চিন্তার নেতারা উপন্যাসের নায়ক হয়ে গ্রাম থেকে অভিবাসী হয়েছে বৈরুত শহরে। তবে ‘গেট অব দি সান’ (১৯৯৮) ইলিয়াস খৌরির সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস, যা তাঁকে বিশ্বে বিপুল পরিচিতি এনে দিয়েছে। উপন্যাসটির বিষয় এক ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু, যে লেবাননে বসবাস করছে ১৯৪৮ সালের নাকবা যুদ্ধের পর থেকে। পরে মিসরীয় পরিচালক ইয়োসরি নসরুল্লাহ উপন্যাসটির ওপর ছবি তৈরি করে জনপ্রিয়তা এনে দেন ইলিয়াস খৌরিকে। খৌরির অন্যান্য উপন্যাসেও উঠে এসেছে মানুষের আচরণের রক্ষণশীলতা ও রাজনীতি। উপন্যাস বর্ণনায় তিনি প্রমিত আরবীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এমিল হাবিবি (জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯২২-মৃত্যু ২ মে ১৯৯৬) : ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি সিক্রেট লাইফ অব সাঈদ : দি পেসঅবটিমিস্ট’ ধ্রুপদি আধুনিক আরবি উপন্যাস। ওই উপন্যাস মূলত সাঈদ নামের এক ইসরায়েলি আরবিভাষীর জীবনচিত্র। উপন্যাসে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বাস করা আরবিভাষীদের সঙ্গে ইহুদিদের সহাবস্থান প্রাধান্য পেয়েছে। উপন্যাসটির জন্য এমিল হাবিবি একই সঙ্গে পিএলওর ‘আলকুদস’ পুরস্কার এবং ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ‘ইসরায়েল প্রাইস ফর লিটারেচার’ পান। আবদুর রহমান মুনিফ (জন্ম ১৯৩৩-মৃত্যু ২৪ জানুয়ারি ২০০৪) : বিশ শতকের সেরা ইরাকি ঔপন্যাসিক। তিনি লিখেছিলেন ১৫টি উপন্যাস। তাঁর সবচেয়ে সেরা উপন্যাস ‘সিটিজ অব সল্ট’ (১৯৮৭)। আরবের বেদুইন সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক তেলসমৃদ্ধ সংস্কৃতির সংঘাত চিত্রিত হয়েছে এ উপন্যাসে। এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, ‘সিটিজ অব সল্ট’ হচ্ছে আরবি সাহিত্যে সিরিয়াস ধারার একমাত্র আধুনিক উপন্যাস, যেখানে তেল ঘিরে বিদেশিদের লোলুপ দৃষ্টি এবং তেল পাওয়ার পর আরববিশ্বের বদলে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সোনাল্লা ইবরাহিম (জন্ম ১৯৩৭) : আধুনিক আরবি সাহিত্যে বামপন্থী ঔপন্যাসিক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর ব্যক্তিগত বাম-পক্ষপাত ব্যক্ত হয়েছে তাঁর উপন্যাসেও। ইবরাহিমের উপন্যাস ভিন্ন রকম। উপন্যাসের ঘটনা তিনি ব্যক্ত করেন প্রথম পুরুষে, অনেকটা সংবাদপত্রের রিপোর্টের আদলে। তাঁর সব উপন্যাসের মূল বিষয় বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলো কর্তৃক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা নিয়ে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘অনার’। তায়েব সালিহ (জন্ম ১৯২৯-মৃত্যু ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৯) : সুদানি ঔপন্যাসিক। সালিহর বিখ্যাত উপন্যাস ‘সিজন অব মাইগ্রেশন টু দি নর্থ’ (১৯৬৯) প্রথম প্রকাশিত হয় বৈরুতে। ২০০৬-এ আরব লিটারারি একাডেমী এই উপন্যাসকে ২০ শতকের সেরা আরবি উপন্যাস বলেই স্বীকৃতি দিয়েছে। ঔপনিবেশিক শোষণ তাঁর উপন্যাসের অন্যতম বিষয়। সুদানের খার্তুমের এক উপজাতির বেওয়ারিশ শিশুর কলোনিতে বেড়ে ওঠার ইতিহাস, কাম এবং প্রতিশোধ স্পৃহার গল্প। যেন আরব্য রজনীরই অপার স্টোরি এই উপন্যাস। আহলাম মোসতেনঘানেমি : আলজেরিয়ান ঔপন্যাসিক। বিখ্যাত উপন্যাস ‘মেমোরি অব দ্য ফ্ল্যাশ’ (১৯৯৩)। যে উপন্যাসে ঔপনিবেশিক শোষণ এবং আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম বর্ণিত হয়েছে। হানড়বা মিনা (জন্ম ১৯২৪) : বিখ্যাত সিরিয়ান ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাস ব্যক্তিগত সামাজিক বাস্তবতা ও শ্রেণীসংগ্রামকে কেন্দ্র করে। তাওফিক আল হাকীম (জন্ম ১৮৯৮-মৃত্যু ১৯৮৭) আধুনিক আরবের অন্যতম ঔপন্যাসিক। তাঁর ‘এ স্প্যারো ফ্রম দি ইস্ট’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। এ ছাড়া আধুনিক আরবি উপন্যাস লিখে চলেছেন এমন কয়েকজনের ভেতর মে জিয়াদে, হানরবা আল সাঈদ, জাকারিয়া টেমার, আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ অন্যতম। বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের আধুনিক উপন্যাসের সঙ্গে আধুনিক আরবি উপন্যাসের তুলনা করলে তেমন বেশ ঐশ্বর্যশালী মনে হয় না আরবি উপন্যাসকে। এর কারণ ২০ শতকে পৃথিবীর চারদিকে, জীবনে ও শিল্পে যখন ছড়িয়ে পড়ছিল আধুনিক চেতনা, আধুনিক বিশ্বসাহিত্য যখন নিত্যনতুন ধারার উপন্যাস রচনায় ব্যস্ত, আরবি সাহিত্য তখন ব্যস্ত মধ্যযুগ পরিক্রমায়। তাই পুরো ২০ শতকে মানব সভ্যতার আধুনিককালের উন্মেষের সময়টাতে আধুনিক চেতনার কোনো বিকাশ ঘটেনি আরবি সাহিত্য তথা আরবি কবিতা-গল্প-উপন্যাস_কোনোটাতেই। ফলে আধুনিক আরবি উপন্যাসগুলো পড়লে মনে হয়, এগুলো শুধু আরবদের জন্য মুসলমানদের লেখা উপন্যাস। আরব ও মুসলমানের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বমানের আধুনিক উপন্যাসের জন্য আমাদের তাই অপেক্ষা করতেই হবে, আগামী দিনের আরবি ঔপন্যাসিকদের পথ চেয়ে।

যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে সর্বত্র তখন এই বার্তা আগত হয়

যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে সর্বত্র তখন এই বার্তা আগত হয়

অতিন্দ্রিয় এক বার্তা কিভাবে আসে আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি যখন অন্ধাকার ঘনিয়ে আসে সর্বত্র তখন এই বার্তা আগত হয়। বলে-“ জাগো আনন্দোৎসবে আর প্রস্তুত হও, দ্যাখো বসন্ত আসছে অই আর শোন গ্রীষ্মের আগমনী সংগীত। শুন, শীত আজ মৃত।” সুতরাং বার্তা এসে গেছে, বসন্তের আমেজ সারা বন-প্রান্তরে।

এবং মনে হতে তো পারেই, পৃথিবী জীবনের নব-জাগরনে উঠেছে জেগে। যে পাখি ডাকেনি আগে কখনো ডেকে উঠলো। শীতের তীব্র মৃত হীম হাওয়া উধাও এবং গাছেরা সবুজ শাড়ীতে আবৃত হয়ে নব-বধুর সাজে সলজ্জ সজ্জিত। ফুলেরা উকি মেরে দেখছে শীত গিয়াছে কিনা, তারা প্রস্ফুটিত হতে চায় লাজ-রাঙা সাজে খুলে ফেলে অবগুন্ঠন।

এবং আরেক বার্তা এসে যায়। একমাত্র এই সময়ে সে বলে,“ তোমার প্রস্তুতি শেষ করো, সামনে এগিয়ে যাও, এলো গ্রীষ্ম তার সাথে সাক্ষাত করো।” এবং তাইতো পাখিরা, গাছেরা আর ফুলেরা সামনে এগিয়ে যায়, গোল হয়ে নৃত্য করে গ্রীষ্মের দরবারে আর গ্রীষ্ম তার উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়, তাদের সকলকে জড়িয়ে ধরে।

এবং আরেক বার্তা এসে যায়। সকলের হৃদয়ে দু:খ ছড়িয়ে দিয়ে বলে,“ বল বিদায় হে গ্রীষ্ম আর হেমন্তের সাজে নিজেকে সাজিয়ে নাও।” এবং তারা জেনে যায় শীতের আর দেরী নাই,সেইসব ঔষধি ফলন ফলে যায় , ফলেনি যা আগে। আর তারা জেনে যায়, সময় হলো তাদের বিয়োগের তাই তারা বীজের মাঝে নিজের অস্তিত্বকে স্থানান্তরিত করে নেয়। গাছেরা নেয় উজ্জ্বল রূপ গ্রীষ্মকে প্রলুব্ধ করতে। এখন সময় মহান উৎসবের, বছরের অল্প সময়ে যা দৃশ্যমান হয়। সমস্ত জল-জঙ্গল গ্রীষ্ম রাজের শেষ রাজস্ব দিয়ে যায়, শীতের ভয়াল থাবায় লগ্নী হওয়ার আগে শেষ মুক্ত নি:শ্বাস নিয়ে নেয় তারা।

এবং নদীর জলের থেকে আলাদা হয়ে যায় ডোবা আর পুকুরগুলো; এখন তারা স্বতন্ত্র আর শূণ্য নয়, এখন তারা বিস্মিত সুন্দর। গাছের উজ্জ্বল পাতারা ঝরে পরে পুকুরের জলে, কাদারাঙা জলের মাঝে একটা রঙের আচড় টেনে যায় এবং সমভূমিগুলো ঝরা পাতার রঙে চিত্রময় হয়ে উঠে। বাতাসে মচমচ আনন্দ আর সূর্য্যের আলোর ফোকাসে চিক চিক আলো-স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। গাছের ডালে পাখিরা দৃশ্যমান হয়ে উঠে, কাঠবিড়ালী আর খরগোশেরা আর লুকোতে পারে না পাতার আড়ালে।

এবং শীত আসে কুয়াশার চাদর আর বরফের স্বচ্ছতা নিয়ে। শিশিরের ছোঁয়া আর বরফের আচ্ছাদনে শীতও অনন্য সৌন্দর্য্য নিয়ে আসে হৃদয়ে যখন সূর্য্য উকি দেয় চিক চিক আলো নিয়ে। কিন্তু জঙ্গলের প্রাণীরা সে সৌন্দর্য্যে মেতে উঠে না। ঠান্ডা মৃত্যু আর তারা ক্ষুধার্ত। তারা বসন্তের আগমনী বার্তার অপেক্ষা করতে থাকে। অতিন্দ্রিয় এক বার্তা কিভাবে আসে আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি যখন অন্ধাকার ঘনিয়ে আসে সর্বত্র তখন এই বার্তা আগত হয়। বলে-“ জাগো আনন্দোৎসবে আর প্রস্তুত হও, দ্যাখো বসন্ত আসছে অই আর শোন গ্রীষ্মের আগমনী সংগীত। শুন, শীত আজ মৃত।” সুতরাং বার্তা এসে গেছে, জীবনের আমেজ সারা বন-প্রান্তরে।

মূর্তি

বলেছেন: দেশে এখন মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে উত্তেজনা চলছে। বিষয়টির সঙ্গে হেফাজতিরা ইসলামকে জড়িয়ে ফেলেছে। তাই চলুন আমরা সূত্র ধরে দেখি এ ব্যাপারে কোরান, হাদিস, সিরাত (ইবনে হিশাম ইবনে ইবনে ইসহাক), তারিখ আল তারারি ও অন্যান্য দলিল কী বলে।

প্রথমেই তিনটে শব্দ বুঝে নেওয়া যাক: প্রতিমা, ভাস্কর্য ও মূর্তি। প্রতিমা হল মানুষ যার আরাধনা উপাসনা করে, ইহকালে-পরকালে মঙ্গল চায়, ভুলের ক্ষমা চায় ইত্যাদি। ভাস্কর্য্য হল মানুষসহ কোনো প্রাণী বা কোনো কিছুর মূর্তি যাকে মানুষ রাখে সম্মান দেখতে বা সৌন্দর্য্য বর্ধন করতে, যার মানুষ আরাধনা বা উপাসনা করে না। এবারে অন্যান্য দলিলের দিকে তাকানো যাক, সেখানে আমরা দেখব হযরত মুহাম্মদের (সা.) বাড়িতে মূর্তি ছিল তাঁর সম্মতিক্রমেই। সব দলিলের শেষে আমরা কোরানে যাব এবং দেখতে পাব আল্লাহর নির্দেশেই এক পয়গম্বরের প্রাসাদে ভাস্কর্য ছিল।

কোরানে যাওয়ার আগে প্রথমেই হাদিস ও অন্যান্য দলিল। কাবাতে রাসূল (সা.) লাত, মানাত, উজ্জা, হোবল, ওয়াদ ইত্যাদির প্রতিমা ভেঙেছিলেন, এগুলোর আরাধনা করা হত বলে। ভাস্কর্য ও মূর্তির বিপক্ষে কিছু হাদিস আছে, কিন্তু সাধারণত বিপক্ষের দলিলে আমরা ব্যক্তির নাম ও ঘটনার বিবরণ পাই না, যা পক্ষের হাদিসগুলোতে পাই। পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ।

(ক) সহি বুখারি ৮ম খণ্ড হাদিস ১৫১:
আয়েশা বলিয়াছেন, আমি রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুলগুলি লইয়া খেলিতাম এবং আমার বান্ধবীরাও আমার সহিত খেলিত। যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার খেলাঘরে প্রবেশ করিতেন, তাহারা লুকাইয়া যাইত, কিন্তু রাসুল (সা.) তাহাদিগকে ডাকিয়া আমার সহিত খেলিতে বলিতেন।

(খ) সহি আবু দাউদ বুক ৪১ হাদিস নং ৪৯১৪:
বিশ্বাসীদের মাতা আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন, যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাবুক অথবা খাইবার যুদ্ধ হইতে ফিরিলেন তখন বাতাসে তাঁহার কক্ষের সামনের পর্দা সরিয়ে গেলে তাঁহার কিছু পুতুল দেখা গেল। তিনি [(রাসুল (সা.)] বলিলেন, “এইগুলি কী?” তিনি বলিলেন, “আমার পুতুল।” ওইগুলির মধ্যে তিনি দেখিলেন একটি ঘোড়া যাহার ডানা কাপড় দিয়া বানানো হইয়াছে এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি যাহা উহার উপর রহিয়াছে?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “দুইটি ডানা।” তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডানাওয়ালা ঘোড়া?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “আপনি কি শোনেননি যে সুলেমানের ডানাওয়ালা ঘোড়া ছিল?” তিনি বলিয়েছেন, ইহাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) এমন অট্টহাসি হাসিলেন যে আমি উনার মাড়ির দাঁত দেখিতে পাইলাম।”

(গ) সহি মুসলিম – বুক ০০৮, নং ৩৩১১:
আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন যে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁহাকে সাত বৎসর বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন (যদিও অন্য রেওয়াতে আমরা পাই ছয় বছর: হাসান মাহমুদ) এবং তাঁহাকে নয় বৎসর বয়সে কনে হিসেবে তাঁহার বাসায় লইয়া যাওয়া হয়, এবং তাঁহার পুতুলগুলি তাঁহার সাথে ছিল এবং যখন তিনি দেহত্যাগ করিলেন তখন তাঁহার বয়স ছিল আঠারো।

(ঘ) সহি মুসলিম – বুক ০৩১ নং ৫৯৮১:
আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন যে তিনি আল্লাহর রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুল লইয়া খেলিতেন এবং যখন তাঁহার সঙ্গিনীরা তাঁহার কাছে আসিত তখন তাহারা চলিয়া যাইত। কারণ তাহারা আল্লাহর রাসুলের (সা.) জন্য লজ্জা পাইত। যদিও আল্লাহর রাসুল (সা.) তাহাদিগকে তাঁহার কাছে পাঠাইয়া দিতেন।

সহি বুখারির ব্যাখ্যা শুনুন। হাদিসটার ফুটনোটে ‘ফতহুল বারি’র লেখক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর উদ্ধৃতি: “পুতুল ও একই রকম ইমেজ অবৈধ কিন্তু ইহা বৈধ করা হইয়াছিল তখন আয়েশার (রা.) জন্য। কারণ তিনি ছিলেন ছোট বালিকা, তখনও তিনি বয়স্কা হননি।” (ফতহুল বারি, পৃষ্ঠা ১৪৩, ১৩ খণ্ড)

নবী (সা.) পুতুল বৈধ করেছিলেন এটাই আসল কথা। কী কারণে করেছিলেন সেটা ইমামের জানা সম্ভব নয়। কারণ তিনি রাসুলের (সা.) ৮০০ বছর পরের হাজার মাইল দূরে মিসরের লোক, রাসুলের (সা.) সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি। ওটা তাঁর ব্যক্তিগত মত মাত্র।

এবারে আরও কিছু সংশ্লিষ্ট দলিল।

তখন কাবার দেয়ালে ৩৬০টি মূর্তি (বুখারি ৩য় খণ্ড – ৬৫৮) ও অনেক ছবির সঙ্গে ছিল হযরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবিও। উদ্ধৃতি দিচ্ছি, “রাসুল (সা.) হযরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবি বাদে বাকি সব ছবি মুছিয়া ফেলিতে নির্দেশ দিলেন।” (সিরাত (ইবনে হিশাম/ইবনে ইশাক-এর পৃষ্ঠা ৫৫২)

এবারে সাহাবি ও খলিফারা।

দুনিয়ার প্রায় এক চতুর্থাংশ জয় করেছিলেন মুসলিমরা। সবই অমুসলিমের দেশ এবং সেখানেও নিশ্চয়ই অনেক প্রতিমা-ভাস্কর্য ছিল, সেগুলোর তো সবই ভেঙে দেওয়ার কথা। কিন্তু সেখানেও আমরা তেমন দলিল পাই না। ৭১০ সালে হিন্দু রাজা দাহিরের দেশ সিন্ধু জয় করার পর কয়টা মূর্তি ভেঙেছিলেন মুহম্মদ বিন কাশেম? ভাস্কর্য-মূর্তি তো দূরের কথা কোনো প্রতিমাও ভেঙেছেন বলে জানা যায় না।

রাসুলের (সা.) অজস্র ছবি স্বচক্ষে দেখতে চাইলে ইরানে চলে যান। দেখবেন দেয়ালে ঝুলানো সুদৃশ্য কার্পেটে আছে মা আমিনার কোলে শিশু নবী (সা.), সাহাবি পরিবেষ্টিত নবীজি (সা.), আসমানে বোরাখে উপবিষ্ট নবীজি (সা.) ইত্যাদি।

গুগল করলেই পেয়ে যাবেন– সবই কাল্পনিক ছবি অবশ্য– হাজার বছর ধরে আছে ওগুলো। ইরান এখন তো শিয়া দেশ, কিন্তু ৭৫০ সালে আব্বাসিরা দখল করার আগে পর্যন্ত ওটা সুন্নি উমাইয়াদের রাজত্ব ছিল।

এবারে সাম্প্রতিক কাল। ছবি তো ছবি, নবীজির (সা.) আট ফুট উঁচু, ১০০০ পাউণ্ড ওজনের মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যও ছিল দীর্ঘ ৫৩ বছর। ১৯০২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ২৫ নং স্ট্রিট ম্যাডিসন এভিনিউতে অবস্থিত ম্যাডিসন পার্কের মুখোমুখি নিউইয়র্ক আপিল বিভাগের কোর্ট দালানের ছাদে। ইতিহাসের আরও নয়জন আইনদাতাদের সঙ্গে নবীজির (সা.) আট ফুট উঁচু মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যও রাখা ছিল সসম্মানে।

গুগলে ‘এ স্ট্যাচু অব মুহাম্মদ’ সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। মুসলিম সমাজ ও দেশগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ওটা সরানো হয়েছে। এখন ইতিহাসের বাকি নয়জন আইনদাতার ভাস্কর্য রাখা আছে। কোর্টের ভেতরের দেয়ালে ওই দশজনের সঙ্গে তাঁর ভাস্কর্য এখনও আছে কি না জানি না। ওটার ছবি এখনও আছে কি না জানি না।

কোরান-রাসুল (সা.)-সাহাবি-খলিফা-সাম্প্রতিক কাল তো অনেক হল, মধ্যপ্রাচ্যের কী খবর? হাঙ্গামা করার আগে বাংলাদেশের ইমামদের ভেবে দেখা দরকার কেন মধ্যপ্রাচ্যের ইমামেরা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে নন। সৌদি আরবেও বহু ভাস্কর্য আছে। গুগল করুন ‘স্ট্যাচু ইন মুসলিম ওয়ার্ল্ড’ কিংবা ‘স্ট্যাচু ইন সৌদি আরব’– রাস্তার মোড়ে মোড়ে উটের, কবজি থেকে হাতের আঙুলের, মুসলিম বীরদের এবং আরও কত ভাস্কর্য। সেখানকার মওলানারা জানেন কোরান ও রাসুল (সা.) সুস্পষ্টভাবে প্রতিমাকে নিষিদ্ধ করে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে বৈধ করেছেন। তাই তাঁরা মুসলিম বিশ্বে অজস্র মূর্তি ও ভাস্কর্যকে অস্বীকৃতি জানাননি।

এবারে কোরান। কোরানে সুস্পষ্ট বলা আছে: (ক.) মূর্তিপূজা শয়তানের কাজ (মায়েদা ৯০) এবং (খ.) “এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ?” (আম্বিয়া ৫২)।

অর্থাৎ কোরানের নিষেধ মূর্তিপূজা, উপাসনা-আরাধনা-ইবাদত সম্পর্কে। কারণ, মূর্তি স্রষ্টার অংশীদার অর্থাৎ শরিক হয়ে দাঁড়ায়। এটাই মানুষকে মুশরিক বানায়। তাহলে যে মূর্তিকে আরাধনা ইবাদত করা হয় না, যে মূর্তি সৌন্দর্য্য বাড়ায়, সুসজ্জিত করে সে ব্যাপারে কোরান কী বলে? এখানে আমরা অবাক হয়ে দেখব কোরান সুস্পষ্ট ভাষায় ভাস্কর্যের অনুমতি দেয়। উদ্ধৃতি:

“তারা সোলায়মানের (আ.) ইচ্ছানুযায়ী দূর্গ, মূর্তি, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত।” (সুরা সাবা, আয়াত ১৩)

নবীজি (সা.) মূর্তি-ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সেটা কোরানের ওই আয়াতের বিরুদ্ধে যেত, সেটা সম্ভব নয়। আরাধনা করলে সেটা হয় প্রতিমা আর না করলে হয় ভাস্কর্য (মূর্তি)। ইসলাম প্রতিমার বিরুদ্ধে, ভাস্কর্য ও মূর্তির বিরুদ্ধে নয়।

আদি থেকে মানুষ স্রষ্টা খুঁজেছে, সূর্য-চন্দ্র থেকে শুরু করে পশু-পাখিকে, এমনকি নিজেরাই মূর্তি বানিয়ে আরাধনা করেছে। যে হযরত মুসা (আ.) মানুষকে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টার দিকে ডেকেছেন তাঁর বিশ্বাসীরা বাছুরের মূর্তির আরাধনা করেছে। যে ঈসা (আ.) মানুষকে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টার দিকে ডেকেছেন তাঁর বিশ্বাসীরা তাঁর তো বটেই, তাঁর মায়েরও (মাতা মেরি) মূর্তি বানিয়ে আরাধনা শুরু করেছে। যে গৌতম বুদ্ধ স্রষ্টার ধারণা ত্যাগ করে কর্মফলের কথা বলেছেন, তাঁর অনুসারীরা তাঁর মূর্তি বানিয়ে আরাধনা শুরু করেছে। এখানেই ইসলামের আপত্তি: ইসলাম আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক বা অংশীদার করার ঘোর বিপক্ষে।

তাই হয়তো অতীত বর্তমানের কিছু ইমাম সরাসরি মূর্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিমা ও ভাস্কর্যের পার্থক্য উপেক্ষা করছেন। ইমামেরা প্রতিমার বিরুদ্ধে বলুন অসুবিধা নেই, কিন্তু ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সেটা কোরান-রাসুলের (সা.) বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হয় কি না, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন। কারো দরকার হলে উপরোক্ত সূত্রগুলোর কপি দেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মৃতিকে লালন করার জন্য এবং পরবর্তি প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার চেতনাকে প্রবাহিত করার জন্য। স্বাধীনতাযুদ্ধ স্মরণে নির্মিত এসব ভাস্কর্য রাজধানী শহর ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্রই প্রায় রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের বাইরে, বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলেও রয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের এসব ভাস্কর্য।

জাগ্রত চৌরঙ্গী
মূল নিবন্ধ: জাগ্রত চৌরঙ্গী

জাগ্রত চৌরঙ্গী, জয়দেবপুর চৌরাস্তা
মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য আত্মত্যাগের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য। ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক জাগ্রত চৌরঙ্গীর ভাস্কর। এটি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় নির্মিত এটিই প্রথম ভাস্কর্য।[১] ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চের আন্দোলন ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। আর এই প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ হুরমত উল্যা ও অন্য শহীদদের অবদান এবং আত্মত্যাগকে জাতির চেতনায় সমুন্নত রাখতে জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে স্থাপন করা হয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম জাগ্রত চৌরঙ্গী। [১][২][৩]

জাগ্রত চৌরঙ্গী

কিভাবে যাওয়া যায়:
জিরো পয়েন্ট হতে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে গাজীপুর গামী বাসে আসা যায়।
জয়দেবপুর চান্দনা চৌরাস্তা, গাজীপুর-এ অবস্থিত। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম স্মারক ভাস্কর্য হলো জাগ্রত চৌরঙ্গী মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ১৯৭১ সালে ১৯ শে মার্চ গাজীপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের চেতনার আলোকে ও শহীদ হুরমত আলীসহ অন্যান্য শহীদদের স্মরনে নির্মিত হয় জাগ্রত চৌরঙ্গী। ভাস্কর্যটির উচ্চতা মাটি থেকে ১০০ (একশত) ফুট। দুপাশে ১৬ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১১ নং সেক্টরের ১০৭ জন এবং ৩নং সেক্টরের ১০০ জন শহীদ সৈনিকের নাম খোদাই করা রয়েছে।

সংশপ্তক l

সংশপ্তক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতর্পণমূলক ভাস্কর্যগুলোর অন্যতম। এই ভাস্কর্যটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। এর স্থপতি শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। [১][২][৩]

অবস্থান
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে এ ভাস্কর্যটি।১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন জাবির উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহম্মেদ।[১][২][৩]

আকার
মূল ভূমি থেকে ভাস্কর্যটির ঊচ্চতা ১৫ ফুট। মূল ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি। এছাড়া এটি নির্মানে লাল সিরামিক ইট ব্যবহার করা হয়েছে।[১]

স্থাপত্য তাৎপর্য
১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের তাঁজা প্রাণ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালি জাতি। তাদের এ আত্মত্যাগের বিনিময়ে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের বিজয় দিবস কে স্মরণ রাখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ । সেই রকম ভাবে বাঙালি জাতির এই গৌরব ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজ্জল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে এতে দৃশ্যমান করা হয়েছে।‘ সংশপ্তক’ হলো ধ্রুপদী যোদ্ধাদের নাম। মরণপন যুদ্ধে যারা অপরাজিত। এ ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার বীর সন্তান। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা যাদের স্বপ্ন, শত্রুর বুলেটের সামনেও জীবন তাদের কাছে তুচ্ছ। সংশপ্তকের গায়ে প্রতিফলিত হয়েছে ধ্রুপদী যোদ্ধাদের দৃঢ় অঙ্গীকার। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও লড়ে যান যে অকুতোভয় বীর সেই সংশপ্তক। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেতনাকে দৃশ্যমান করার লক্ষেই ‘সংশপ্তক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরদের স্মরণেও এটি নির্মাণ করা হয়েছে।[১][২][৩]

মূল নিবন্ধ: সংp)

সংশপ্তক ভাস্কর্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ নির্মিত হয়েছিল স্মারক ভাস্কর্য সংশপ্তক। এ ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার বীর সন্তান। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও লড়ে যান যে অকুতোভয় বীর সেই সংশপ্তক। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যটি। এর ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান।[৪][৫][৬]

অপরাজেয় বাংলা
মূল নিবন্ধ: অপরাজেয় বাংলা

অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকা তিন নারী-পুরুষের ভাস্কর্য যেটি সর্বসত্মরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সেটি ‘অপরাজেয় বাংলা’। এর তিনটি মূর্তির একটির ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তযোদ্ধা বদরম্নল আলম বেনু। থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সাবলীল ভঙ্গিতে দাঁড়ানো অপর মূর্তির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারী মূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ। ১৯৭৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পূর্ণোদ্যমে অপরাজেয় বাংলার নির্মাণ কাজ শুরম্ন হয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় এ ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়। তবে অপরাজেয় বাংলার কাছে ভাস্করের নাম খচিত কোন শিলালিপি নেই। স্বাধীনতার এ প্রতীক তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন গুণী শিল্পী ভাস্কর সৈয়দ আব্দুলস্নাহ খালিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের বেদিতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি যেন অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠার গান গাইছে। এ ভাস্কর্যে সব শ্রেণীর যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। [৪]

স্বোপার্জিত স্বাধীনতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পশ্চিম পাশে ডাসের পেছনে অবস্থিত এ ভাস্কর্য অন্যায়-অত্যাচারের বিরম্নদ্ধে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যোগায়। একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একাত্তরে পাকিসত্মানী হানাদারের অত্যাচারের একটি খণ্ড-চিত্র। ১৯৮৭ সালের ১০ নবেম্বর এর নির্মাণ কাজ শুরম্ন হয়। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটির কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয়। এটি গড়েছেন অন্যতম কীর্তিমান ভাস্কর শামীম সিকদার। এটির চৌকো বেদির ওপর মূল ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। [৪]

সাবাস বাংলাদেশ
মূল নিবন্ধ: শাবাশ বাংলাদেশ

শাবাশ বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে নিতুন কুণ্ডুর তৈরি ‘সাবাস বাংলাদেশ’ নামের ভাস্কর্য দেখা যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক শিক্ষক-ছাত্র শহীদ হওয়ায় এর স্মৃতিকে চির অমস্নান করে রাখার জন্য উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ করা হয় সিনেট ভবনের দক্ষিণে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রম্নয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর উপস্থাপনায় নির্মাণ কাজ শুরম্ন হয়। নির্মাণ কাজ শেষে ফলক উন্মোচন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ভাস্কর্যটি দাঁড়িয়ে আছে ৪০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে, যেখানে রয়েছে দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি। একজন রাইফেল উঁচু করে দাঁড়িয়ে আর তার বাঁ বাহুটি মুষ্টিবদ্ধ করে জাগানো। অন্যজন রাইফেল হাতে দৌড়ের ভঙ্গিতে রয়েছে; যার পরনে প্যান্ট, মাথায় এলোমেলো চুলের প্রাচুর্য যা কিনা আধুনিক সভ্যতার প্রতীক। এ দু’জন মুক্তিযোদ্ধার পেছনে ৩৬ ফুট উঁচু একটি দেয়ালও দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালের উপরের দিকে রয়েছে একটি শূন্য বৃত্ত, যা দেখতে সূর্যের মতোই। ভাস্কর্যটির নিচের দিকে ডান ও বাম উভয়পাশে ৬ ফুট বাই ৫ ফুট উঁচু দু’টি ভিন্ন চিত্র খোদাই করা হয়েছে। ডানদিকের দেয়ালে রয়েছে দু’জন যুবক-যুবতী। যুবকের কাঁধে রাইফেল, মুখে কালো দাড়ি, কোমরে গামছা বাঁধা, যেন বাউল। আর যুবতীর হাতে একতারা। গাছের নিচে মহিলা বাউলের ডান হাত বাউলের বুকে বাম দিকের দেয়ালে রয়েছে মায়ের কোলে শিশু, দু’জন যুবতী একজনের হাতে পতাকা। পতাকার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গেঞ্জিপরা এক কিশোর। শিল্পী নিতুন কুণ্ডু তার মনতুলি দিয়ে এমনভাবে ভাস্কর্যটি চিত্রিত করেছেন দেখলে মনে হয় যেন ১৯৭১ সালেরই অর্জিত স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি। [৪]

বিজয় ‘৭১’

‘বিজয় ‘৭১’ ভাস্কর্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
মূল নিবন্ধ: ‘বিজয় ‘৭১'(ভাস্কর্য)
১৯৭১ সালের মহান মুক্তি সংগ্রামে বাংলার সর্বসত্মরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মূর্ত প্রতীক হয়ে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘বিজয় ‘৭১’। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ‘বিজয় ‘৭১’। ভাস্কর্যে একজন নারী, একজন কৃষক ও একজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার নজরকাড়া ভঙ্গিমা বার বার মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে নিয়ে যায় দর্শনার্থীদের। একজন কৃষক মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেছে আকাশের দিকে। তার ডান পাশেই শাশ্বত বাংলার সর্বস্বত্যাগী ও সংগ্রামী নারী দৃঢ়চিত্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছেন। যার সঙ্গে আছে রাইফেল। অন্যদিকে একজন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে গ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গিমায় বাম হাতে রাইফেল নিয়ে তেজোদীপ্তচিত্তে দাঁড়িয়ে । বিখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী শ্যামল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ‘বিজয় ‘৭১’ ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ ২০০০ সালের জুন মাসে শেষ হয়। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টাকা। ‘বিজয় ‘৭১’ ভাস্কর্য দেখতে প্রতিদিন অগণিত মানুষ ক্যাম্পাসে ভিড় জমায়।[৪][৭][৮]

সক্রেটিসের মৃত্যুদ-ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে আলবেরুনীর ভারততত্ত্বে। তথ্যনির্ভর এ পুস্তকটি প্রাচীন ভারতবর্ষের ওপর রচিত প্রথম গবেষণাধর্মী কিতাব। আন্তর্জাতিকভাবে বইটি পঠিত, গৃহীত এবং স্বীকৃত। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে বইটি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তও বটে। বইটির রচনাকাল ১০৩১ খ্রিস্টাব্দ। গ্রন্থনা করেন দ্বাদশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মহাজ্ঞানী আবু রায়হান মুহাম্মাদ বিন আহমদ। জনসমাজে খ্যাত আলবেরুনী নামে। তিনি লিখেছেন, ‘সক্রেটিস নিজে যখন জনসাধারণের মতের বিরুদ্ধে মূর্তিপূজার প্রতিবাদ করেছিলেন এবং গ্রহনক্ষত্রকে ওদের ভাষায় ভগবান বলতে অস্বীকার করেছিলেন। তখন এথেন্সের ১২ জন বিচারকম-লীর মধ্যে ১১ জনই তাকে মৃত্যুদ- দিতে একমত হয়েছিল। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছিল। ভারতবর্ষে এইরূপ দার্শনিকের মতো কোনো লোক জন্মায়নি যার দ্বারা জ্ঞানের তেমন উৎকর্ষ সাধন হতে পারত। (আলবেরুনির ভারততত্ত্ব, বাংলা একাডেমি, টিকা ১৯, পৃ: ৮)
অতএব, দেখা যায় দুটি কারণে সক্রেটিসকে মৃত্যুদ- দেয় এথেন্স আদালত। এক. ভাস্কর্য, মূর্তি, ম্যুরাল, প্রতিমা তৈরি ও পূজার প্রতিবাদ করেছিলেন; দুই. গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, প্রকৃতিকে ভগবান, স্রষ্টা বলতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ স্রষ্টা তো একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আলবেরুনী বলেছেন, সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই সক্রেটিসের মৃত্যুদ- হয়। কী সেই সত্য? সত্যটা হলো মূর্তির বিরোধিতা। প্রতিমা, প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠায় প্রতিরোধ গড়া। সক্রেটিসের মৃত্যু প্রমাণ করে মাটি বা ইট-পাথরের ভাস্কর্য ম্যূরাল নির্মাণ, স্থাপন মিথ্যা প্রতিষ্ঠারই নামান্তর। সোজাসুজি বলতে গেলে মূর্তির স্বপক্ষশক্তি অসত্যের পক্ষভুক্ত। আর বিরোধিতাকারীরাই সত্যের পক্ষে। – See more at: https://www.dailyinqilab.com/article/71046/#sthash.8pSXPKBM.dpuf

প-িত জওহরলাল নেহেরু বিষয়টি নিয়ে আলাদা এক ইতিহাসের অবতারণা করেছেন। তিনি ১৯২৮ সালে লিখেন, আদিম যুগের মানুষেরা অনেক প্রাকৃতিক ঘটনার কারণই ঠিক ঠাক বুঝতে না পেরে ভয় পেত। … নদী, পাহাড়, সূর্য, গাছ, পশু এদের সবকিছুকেই প্রাচীন মানুষেরা দেব-দেবী বলে মনে করত; কতগুলো ছিলো আবার অদৃশ্য মনগড়া ভূত। ভয় তাদের মনে লেগেই ছিলো, কাজেই তারা মনে করত দেবতা বুঝি তাদের শাস্তি দেবার জন্যই সব সময় ব্যস্ত। তারা ভাবত দেবতা বুঝি তাদেরই মতো কর্কশ আর নিষ্ঠুর; কাজেই একটা পশু, পাখি অথবা মানুষ বলি দিয়ে তারা চাইত দেবতাকে খুশি রাখতে। এই দেবতাদের পূজার জন্য ক্রমে ক্রমে মন্দির গড়ে ওঠতে লাগল। মন্দিরের মধ্যে একটা বিশেষ স্থান ছিল যাকে বলা হত ‘পূজা-ঘর’। সেখানে তাদের আরাধ্য দেবতার মূর্তি থাকত। চোখের সামনে কিছু না দেখে আর কেমন করে পূজা করবে? সেটা কঠিন। (জওহরলাল নেহেরু: পৃথিবীর ইতিহাস, অধ্যায় ২৫, পৃ: ১১১) – See more at: https://www.dailyinqilab.com/article/71046/#sthash.8pSXPKBM.dpuf

আভিধানিক অর্থে ভাস্কর্য :
ভাস্কর্য অর্থ : Sculpture (স্কালপচার)। যে আকৃতি বা ছবি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা-ই ভাস্কর্য। যেমন বলা হয় ‘ভাস্কর্য বিদ্যা’ এর অর্থ, The art of carving বা খোদাই বিদ্যা। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছেন তাকে বলা হয় ভাস্কর (Sculptor) অর্থাৎ যিনি খোদাই করে আকৃতি বা ছবি নির্মাণ করেন। যেমন আছে অক্সফোর্ড অভিধানে- One who carves images or figures. অর্থাৎ যে ছবি অথবা আকৃতি খোদাই করে তৈরি করে। পক্ষান্তরে মূর্তি অর্থ ছায়া বা এমন আকৃতি-শরীর, যার ছায়া আছে।
ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক অর্থে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেল। এককথায় যে সকল আকৃতি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা ভাস্কর্য- রৌদ্র বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া পড়ে না। আর যে সকল আকৃতি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, রৌদ্রে বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া প্রকাশ পায়, তা হল মূর্তি। বিভিন্ন অভিধানে এভাবেই বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় উত্তরের জবাবে বলতে চাই, আপনারা যেমন মনে করেছেন যে, পারিভাষিক অর্থে, যে আকৃতির পূজা করা হয় সেটি মূর্তি। আর যার পূজা করা হয় না সেটি ভাস্কর্য। আপনাদের এ ব্যাখ্যা কোথাও প্রচলিত নয়। যা প্রচলিত নয়, তা কখনো পারিভাষিক অর্থ বলে গণ্য হয় না। বরং ছায়া আছে এমন সকল আকৃতিকে মূর্তি বলে মানুষ জানে ও জানায়। যেমন আমরা দেখেছি যখন লেলিনের দেহটি টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলেছে ‘লেলিনের মূর্তি ..’ এমনিভাবে যখন সাদ্দামের আকৃতি টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলল, ‘সাদ্দামের মূর্তি নামিয়ে ফেলা হয়েছে।’ তখন কেউ ভাস্কর্য বলেছে বলে শুনিনি। এমনিভাবে লোকে বলে ফেরআউনের মূর্তি, আব্রাহাম লিঙ্কনের মূর্তি ইত্যাদি। এ দুটো উদাহরণে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, ওই আকৃতিগুলোর ছায়া ছিল ও খোদাই করে নির্মিত নয় বলে ওগুলো মূর্তি। আর ওগুলো পূজার জন্য স্থাপন করা হয়নি, তবু তা মূর্তি। অতএব দেখা গেল, ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক অর্থই পারিভাষিক অর্থ হিসাবে প্রচলিত। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। পূজার জন্য হলেও মূর্তি, পূজার জন্য না হলেও মূর্তি। এখানে আমাদের বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের জ্ঞানের দৈন্যতার আরেকটি প্রকাশ! তাদের প্রতি করুণা হয়!

ভাস্কর্য মূলত তিন ধরনের। রিয়েলিস্টিক বা মূর্ত ভাস্কর্য, অ্যাবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত ভাস্কর্য ও রিলিফ অর্থাৎ টু ডাইমেনশনাল ভাস্কর্য। বাংলাদেশে এই তিন ধরনের ভাস্কর্যের প্রচলন থাকলেও অন্য দু’টির তুলনায় রিয়েলিস্টিক বা মূর্ত ভাস্কর্যের প্রচলন সর্বাগ্রে। এই রিয়েলিস্টিক ভাস্কর্যকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি, গোছালো মূর্ত ভাস্কর্য, অন্যটি অগোছালো মূর্ত ভাস্কর্য। বাংলাদেশে গোছালো মূর্ত ভাস্কর্য অধিক সমাদৃত। যা অর্ধশিল্পসমৃদ্ধ। ‘অর্ধ’ শব্দটির ব্যবহার এই কারণে যে, শিল্পবোধ ব্যাপারটা প্রাকৃতিক। প্রকৃতি গোছালো নয়, বরং অগোছালো সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। সুতরাং শিল্প অগোছালো সৌন্দর্যকেই দাবি করে। নিরলঙ্কার পরিচ্ছন্ন বাণীর মতোই গোছালো ভাস্কর্য শিল্পের মূল সৌন্দর্যকে ব্যাহত করে। এখানে রাফ অর্থে অগোছালো শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি বাণী বা কবিতার পঙক্তি যদি স্টেটমেন্ট বা বিবরণমূলক হয়, তাহলে তার আবেদন তাৎক্ষণিক। আর যদি তা তীর্যক বা ঘুরিয়ে বলা হয়, তখন তা বহুরৈখিক ভাবনার উদ্রেক করে। যাকে শিল্পোত্তীর্ণ বলা হয়। এই বহুরৈখিকতাই শিল্পের মূলমন্ত্র। মূলত শিল্প তাই, যা মানুষকে ভাবতে এবং সৌন্দর্য উপলব্ধি করাতে বাধ্য করে। কোনো কোনো ভাস্কর্য রয়েছে যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে চমকে উঠতে হয়। এই চমকানোটাই প্রকৃত শিল্পের ইঙ্গিত করে।

themise57e77c1 থেমিস কে ছিলেন?
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি ছিলেন প্রাকৃতিক নিয়মকানুন নিয়ন্ত্রণকারিণী দেবী। ইনি ইউরেনাসের ঔরসে গেইয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বংশের বিচারে ইনি ১২ জন টাইটানের একজন। ভবিষ্যৎ-বাণী করার ক্ষমতা পেয়েছিলেন গেইয়ার কাছ থেকে। পরে এই ক্ষমতা ফিবিকে প্রদান করেছিলেন। দেবরাজ জিউসের ঔরসে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন হোরায়ে (ঋতু নিয়ন্ত্রণের তিন দেবী) এবং মোইরায়ে (ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের তিন দেবী। রোমান পুরাণে এর নাম জাস্টিয়া (Justitia)।

ইউরোনোমে এই থেমিস এবং ইউরিমেডোন-কে বৃহস্পতি গ্রহ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন।

আদি রোমানরা গ্রিক মিথ এর কথিত দেবী জাস্টিসিয়াকে বিচারের প্রতীক হিসেবে মনে করতো।

প্রাচীন রোমে বিচার বা সামাজিক ব্যবস্থা কেমন ছিলো সেটা মনে করতে গ্লাডিয়েটর মুভির কথা মনে করে দেখা যেতে পারে।যেখানে দাসদের আটকে রেখে হিংস্র পশুর সাথে যুদ্ধ করতে দেওয়া হতো, আর সেই জঘন্য দৃশ্য দেখে মজা নিতো সম্রাট ও সাধারণ জনগন।
৫০০০ বছর আগে বর্বর রোমানরা কি কল্পকাহিনী বিশ্বাস করতো, সেটাকে একেবারে সুপ্রীম কোর্টের নাকের ডগাতে বসাতে চাইছে আধুনিকতার নামে, কি বিস্ময়কর!

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এখনও অনেক সেকেলে অন্ধকারে আছে। আড়াইশ’ বছর আগে ব্রিটিশ জলদস্যুরা যে কুসঙ্কারাচ্ছন্ন আইন শিখিয়ে দিয়ে গেছে সেটাই এখন মুর্খের মত ফলো করে যাচ্ছে উকিল-জাস্টিসরা।

প্রধান বিচারক মাথায় উলের টুপি পড়ে মা-ভেড়া সেজে থাকে, দাবি করে- সে মা ভেড়া তার সামনে সবাই সমান। এখনও উকিলরা জাস্টিসদের দেখলে ব্রিটিশ নিয়মে ‘মাই লর্ড’ ‘মাই লর্ড’ (আমার প্রভু, আমার প্রভু) করে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এতটাই অন্ধ অনুকরণপ্রিয় যে, ব্রিটেনে তীব্র শীত পরার কারণে উকিল-জাস্টিসরা কোর্ট, গাউন পরে থাকে। আর বাংলাদেশে সেই অণুকরণে গরমকালে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে শত শত লোকের মধ্যে ভ্যাপসা আবহাওয়ায় উকিল-জাস্টিসরা কোর্ট-গাউন পরে থাকে। দরদর করে ঘামতে থাকে, কিন্তু ব্রিটেনের অন্ধ অনুকরণ বলে কথা!!

দুঃখের কথা- ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৬৫ বছর হয়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৪৫ বছর, কিন্তু এখনও বিচারবিভাগ সেই ব্রিটিশ ভাষা থেকে বের হতে পারলো না। এখনও সুপ্রীম কোর্টে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ অচল।

কথাগুলো এ কারণে বললাম- সবাই যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা যেন আরো উল্টো পথে হাটছে। এতদিন ২৫০ বছর আগের ব্রিটিশ জলদস্যুদের ফলো করতো, আর এখন আরো পিছিয়ে গিয়ে ৫০০০ বছর আগে রোমান বর্বরদের কাল্পনিক বিষয় ঘেটে সুপ্রীম কোর্টের নাকের ডগায় বসাচ্ছে।

উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা এখানে থাকা উচিত নয়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের হাইকোর্টের সামনে গ্রিক থেমেসিসের এক মূর্তি লাগানো হয়েছে। সত্য কথা বলতে কি, আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। কারণ গ্রিক থেমেসিসের মূর্তি আমাদের এখানে কেন আসবে। এটাতো আমাদের দেশে আসার কথা না। আর গ্রিকদের পোশাক ছিল একরকম, সেখানে মূর্তি বানিয়ে তাকে আবার শাড়িও পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাও একটা হাস্যকর ব্যাপার করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা কেন করা হলো, কারা করল, কীভাবে—আমি জানি না। ইতিমধ্যেই আমাদের প্রধান বিচারপতিকে আমি এই খবরটা দিয়েছি এবং খুব শিগগিরই আমি ওনার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বসব। আলোচনা করব এবং আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা এখানে থাকা উচিত নয়।

আশা করা যায় মূর্তি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে তার অবসান হবে।themise57e77c1

আবেদনের যুক্তিতে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের সামনে মূর্তি স্থাপন সংবিধানের ১২ ও ২৩ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এই দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান। ইসলাম মূর্তির উপাসনাকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের পাশেই জাতীয় ঈদগাহ ময়দান রয়েছে। এখানে মূর্তি স্থাপনের মাধ্যমে দেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়েছে। তাই এই মূর্তি অপসারণ চাওয়া হয়েছে।

সর্বোচ্চ আদালতে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য স্থাপন উপমহাদেশে বাংলাদেশেই প্রথম। পাশের দেশ ভারতে পৌত্তলিকতার প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে নেই এই প্রতীক। পাকিস্তানে তো এই ধরনের কিছু স্থাপনের প্রশ্নই আসে না। একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালেও নেই এই দেবীর মূর্তি। এমনকি শ্রীলঙ্কা-মিয়ানমারেও নেই তথাকথিত ন্যায়বিচারের এই প্রতীক। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরানে ১৯৬৪ সালে কুখ্যাত শাহ প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের সামনে পাশ্চাত্যের অনুকরণে গ্রিক বিচারের দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন করেছিল। একমাত্র এ উদাহরণটি বাদে এ পর্যন্ত মুসলিম দেশের শাসকরা যত মন্দই হোক না কেন আদালতের সামনে দেবীমূর্তি স্থাপনের মতো চরম ইসলামবিরোধী কর্মটি করেননি বা করতে সাহস পাননি। অথচ বাংলাদেশের মতো দ্বিতীয় একটি মুসলিম রাষ্ট্রে আজ দুঃসাহসিক এই অপকর্মটি করা হলো। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো কিছু করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এই সরকারের আমলে এমন কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কাজ কিভাবে হলো সে জবাব এই সরকারকে একদিন না একদিন দিতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের ফুল কোর্টে আলোচনাও হয়েছে বলে একটি সূত্রে জানা যায়। সেখানেও ভাস্কর্য স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত আসে। এরপর ভাস্কর্যটি নির্মাণে দেশের স্বনামধন্য ভাস্কর মৃণাল হককে দায়িত্ব দেয়া হয়। চলতি বছর শুরুর দিকে ভাস্কর্যটির নমুনা সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে দেখান ভাস্কর মৃণাল হক। সুপ্রিমকোর্ট বিষয়টি দেখে অনুমোদন দেয়ার পর গত ১৮ ডিসেম্বর কোর্টে মূল ভবনের সামনে ফোয়ারার মধ্যে এটি স্থাপন করা হয়। গত ২৪ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় সম্মেলন ২০১৬ এর সাজ সজ্জায় স্থান পায় ভাস্কর্যটির। মূল মঞ্চের দু’পাশে দুটি ভাস্কর্য বসানো হয়।
ভাস্কর্যটি বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা। স্টেইলনেস স্টিলের বিভিন্ন আকারে পাইপ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ভাস্কর্যটির রাতের অন্ধকারে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হবে। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে ভাস্কর্যটি সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে বুঝিয়ে দিলে এর একটি নাম দেয়া হবে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। জানা যায়, আদালত প্রাঙ্গণে কোনো ভাস্কর্য এই প্রথম। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সুপ্রিমকোর্টের সামনে নেই কোনো ভাস্কর্য।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য অপসারণের দাবিটি আক্রোশের বসে তোলা হয়েছে। প্রথম কথা হলো, হেফাজতে এটা করছে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার আমরা চাচ্ছি সেটাকে বন্ধ করার জন্য বা অন্যদিকে সরানোর জন্য। কারণ আক্রোশটা সুপ্রিম কোর্টের উপর। সুপ্রিম কোর্টই যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তারা এটাকে মূর্তি বলছে। কিন্তু এটা মূর্তি নয়, এটা ভাস্কর্য। পৃথিবীর বহু দেশে এই জাস্টিশিয়ারি ভাস্কর্য রয়েছে। সৌদি আরব থেকে শুরু করে, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বহু মুসলিমপ্রধান দেশে এই ভাস্কর্য আছে।

৭ ফেব্রুয়ারী প্রথম আলো

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে বিবিসিকে বলেন, ‘এটা তো মূর্তি না, এটা তো স্কাল্পচার (ভাস্কর্য)। আর এখানে দেখানো হয়েছে তিনটা জিনিস। একটা হলো দাঁড়িপাল্লা, ন্যায়বিচারের একটা সূচক। আর হাতে একটা তলোয়ার। দণ্ড বা শাস্তির সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তলোয়ার। তৃতীয়ত, চোখটা বাঁধা। অর্থাৎ একদম নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বিচারের নিরপেক্ষতা তুলে ধরা হয় এই স্কাল্পচার দিয়েই।’ হেফাজতের দাবির প্রতি কান দেওয়া ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক বিবৃতিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হুমকির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও বিচারব্যবস্থার প্রতি হুমকি প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই ভাস্কর্যকে মূর্তি বা প্রতিমা বলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক এবং নির্জলা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এই ভাস্কর্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বহু দেশের উচ্চতর আদালতে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

সুুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত ভাস্কর্যটি নিয়ে ইসলামী দলগুলোর বিরোধীতা এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন ভাস্কর্যটির নির্মাতা মৃণাল হক। তার মতে এই ভাস্কর্য কোনো গ্রিক দেবীর মূর্তি নয়। মানুষের আকৃতিতে তৈরি যেকোনো ভাস্কর্যকে মূর্তি হিসেবে দেখে তা সরানোর দাবি মেনে নিলে সেটা ‘আত্মসমর্পণ’ হবে বলে মন্তব্য করেছেন এই ভাস্কর।

সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যটি সরাতে ইসলামী দলগুলোর চাপ এবং এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে নিজের এই মতামত তুলে ধরেছেন ভাস্কর মৃণাল।

রাজধানীতে আরও কয়েকটি ভাস্কর্যের নির্মাতা তার এই ভাস্কর্যটিতে শাড়ি পরা নারীর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।

ভাস্কর মৃণাল হক
তিনি বলেন,‘এটা কোনো গ্রিক দেবীর মূর্তি নয় বরং বাঙালি নারীর ভাস্কর্য। ন্যায় বিচারকের ভূমিকায় বাঙালি নারীর অবয়ব দেখাতে চেয়েছি এই ভাস্কর্যে। বিশ্বজুড়ে বিচারালয়ে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে একটি ভাস্কর্য প্রচলিত আছে। উচ্চ আদালত কর্তৃপক্ষ সেই ভাস্কর্যটির মতো একটি ভাস্কর্য এখানে বানাতে বলেছিলো। সেটা করলে আরও বেশি বিতর্ক হতো। তখন বলা হতো এই ভাস্কর্য আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায়না। তাই বিতর্ক থেকে মুক্ত থাকতেই বাঙালি নারীর বেশে ভাস্কর্যটি তৈরি করি।’

শাড়ি পড়া থেমিসের মূর্তিটি সরিয়ে ফেলাই যুক্তিযুক্ত

১৯২৮ সালে লিখিত পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুঃ পৃথিবীর ইতিহাস, অধ্যায় ২৫, পৃঃ ১১১ – এ এক ইতিহাসের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেন, “আদিম যুগের মানুষেরা অনেক প্রাকৃতিক ঘটনার কারণই ঠিক ঠাক বুঝতে না পেরে ভয় পেত। … নদী, পাহাড়, সূর্য, গাছ, পশু এদের সবকিছুকেই প্রাচীন মানুষেরা দেব-দেবী বলে মনে করত; কতগুলো ছিলো আবার অদৃশ্য মনগড়া ভূত। ভয় তাদের মনে লেগেই ছিলো, কাজেই তারা মনে করত দেবতা বুঝি তাদের শাস্তি দেবার জন্যই সব সময় ব্যস্ত। তারা ভাবত দেবতা বুঝি তাদেরই মতো কর্কশ আর নিষ্ঠুর; কাজেই একটা পশু, পাখি অথবা মানুষ বলি দিয়ে তারা চাইত দেবতাকে খুশি রাখতে। এই দেবতাদের পূজার জন্য ক্রমে ক্রমে মন্দির গড়ে ওঠতে লাগল। মন্দিরের মধ্যে একটা বিশেষ স্থান ছিল যাকে বলা হত ‘পূজা-ঘর’। সেখানে তাদের আরাধ্য দেবতার মূর্তি থাকত। ”

সহজ সরল ভাবে আরাধ্য দেবতাদের ইতিহাস এই।

প্রাচীন গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী খুজলে অনেক দেব দেবীদের সন্ধান মিলে। এমনি এক দেবী নাম থেমিস।

থেমিস কে ছিলেন?

গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি ছিলেন প্রাকৃতিক নিয়মকানুন নিয়ন্ত্রণকারিণী দেবী। ইনি ইউরেনাসের ঔরসে গেইয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বংশের বিচারে ইনি ১২ জন টাইটানের একজন। ভবিষ্যৎ-বাণী করার ক্ষমতা পেয়েছিলেন গেইয়ার কাছ থেকে। পরে এই ক্ষমতা ফিবিকে প্রদান করেছিলেন। দেবরাজ জিউসের ঔরসে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন হোরায়ে (ঋতু নিয়ন্ত্রণের তিন দেবী) এবং মোইরায়ে (ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের তিন দেবী। রোমান পুরাণে এর নাম জাস্টিয়া (Justitia)।

ইউরোনোমে এই থেমিস এবং ইউরিমেডোন-কে বৃহস্পতি গ্রহ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন।

আদি রোমানরা গ্রিক মিথ এর কথিত দেবী জাস্টিসিয়াকে বিচারের প্রতীক হিসেবে মনে করতো ।

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এমন লোক নাই বললেই চলে যিনি বা যারা গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটু, এরিস্টেটল এর নাম শুনেননি বা তাদের চিন্তা চেতনায় কোন না কোনভাবে প্রভাবিত নন।

দ্বাদশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মহাজ্ঞানী আবু রায়হান মুহাম্মাদ বিন আহমদ। জনসমাজে খ্যাত আলবেরুনী নামে। ১০৩১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ভারতবর্ষের ওপর একটি তত্ত্ববহুল গবেষণাধর্মী পুস্তক রচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘সক্রেটিস নিজে যখন জনসাধারণের মতের বিরুদ্ধে মূর্তিপূজার প্রতিবাদ করেছিলেন এবং গ্রহনক্ষত্রকে ওদের ভাষায় ভগবান বলতে অস্বীকার করেছিলেন। তখন এথেন্সের ১২ জন বিচারকমন্ডলীর মধ্যে ১১ জনই তাকে মৃত্যুদন্ড দিতে একমত হয়েছিল। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছিল। ভারতবর্ষে এইরূপ দার্শনিকের মতো কোনো লোক জন্মায়নি যার দ্বারা জ্ঞানের তেমন উৎকর্ষ সাধন হতে পারত। (আলবেরুনির ভারততত্ত্ব, বাংলা একাডেমি, টিকা ১৯, পৃ: ৮)

অতএব, দেখা যায় দুটি কারণে সক্রেটিসকে মৃত্যুদন্ড দেয় এথেন্স আদালত। এক. ভাস্কর্য, মূর্তি, ম্যুরাল, প্রতিমা তৈরি ও পূজার প্রতিবাদ করেছিলেন; দুই. গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, প্রকৃতিকে ভগবান, স্রষ্টা বলতে অস্বীকার করেছিলেন। আলবেরুনী বলেছেন, সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড হয়।

প্রাচীন রোমে বিচার বা সামাজিক ব্যবস্থা কেমন ছিলো সেটা মনে করতে গ্লাডিয়েটর মুভির কথা মনে করে দেখা যেতে পারে।যেখানে দাসদের আটকে রেখে হিংস্র পশুর সাথে যুদ্ধ করতে দেওয়া হতো, আর সেই জঘন্য দৃশ্য দেখে মজা নিতো সম্রাট ও সাধারণ জনগন।
৫০০০ বছর আগে বর্বর রোমানরা কি কল্পকাহিনী বিশ্বাস করতো, সেটাকে একেবারে সুপ্রীম কোর্টের নাকের ডগাতে বসাতে চাইছে আধুনিকতার নামে, কি বিস্ময়কর!

বলা হয়, এ ন্যায়ের প্রতীক এবং অনেকেই বলে থাকেন এ মূর্তি নয় ভাস্কর্য।

আাসুন দেখে নেই মূর্তি আর ভাস্কর্য কি?

আভিধানিক অর্থে ভাস্কর্য :
ভাস্কর্য অর্থ : Sculpture (স্কালপচার)। যে আকৃতি বা ছবি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা-ই ভাস্কর্য। যেমন বলা হয় ‘ভাস্কর্য বিদ্যা’ এর অর্থ, The art of carving বা খোদাই বিদ্যা। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছেন তাকে বলা হয় ভাস্কর (Sculptor) অর্থাৎ যিনি খোদাই করে আকৃতি বা ছবি নির্মাণ করেন। যেমন আছে অক্সফোর্ড অভিধানে- One who carves images or figures. অর্থাৎ যে ছবি অথবা আকৃতি খোদাই করে তৈরি করে। পক্ষান্তরে মূর্তি অর্থ ছায়া বা এমন আকৃতি-শরীর, যার ছায়া আছে।

ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক অর্থে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেল। এককথায় যে সকল আকৃতি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা ভাস্কর্য- রৌদ্র বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া পড়ে না। আর যে সকল আকৃতি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, রৌদ্রে বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া প্রকাশ পায়, তা হল মূর্তি। বিভিন্ন অভিধানে এভাবেই বলা হয়েছে।

পারিভাষিক অর্থে, যে আকৃতির পূজা করা হয় সেটি মূর্তি। আর যার পূজা করা হয় না সেটি ভাস্কর্য। এ ব্যাখ্যা প্রচলিত নয়। যেমন আমরা দেখেছি যখন লেলিনের আকৃতিকে টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলেছে ‘লেলিনের মূর্তি ..’ এমনিভাবে যখন সাদ্দামের আকৃতি টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলল, ‘সাদ্দামের মূর্তি নামিয়ে ফেলা হয়েছে।’

এই দুইটি প্রতিকৃতি উপাসনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়নি, তবু এগুলি মূর্তি হিসাবেই প্রচলিত ছিল।

বাংলাদেশে ভাস্কর্যের উদাহরণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মৃতিকে লালন করার জন্য এবং পরবর্তি প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার চেতনাকে প্রবাহিত করার জন্য। স্বাধীনতাযুদ্ধ স্মরণে নির্মিত এসব ভাস্কর্য রাজধানী শহর ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্রই প্রায় রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের বাইরে, বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলেও রয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের এসব ভাস্কর্য।

কয়েকটি বিখ্যাত ভাস্কর্য নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।

অপরাজেয় বাংলা

অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকা তিন নারী-পুরুষের ভাস্কর্য যেটি সর্বসত্মরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সেটি ‘অপরাজেয় বাংলা’। এর তিনটি মূর্তির একটির ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তযোদ্ধা বদরম্নল আলম বেনু। থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সাবলীল ভঙ্গিতে দাঁড়ানো অপর মূর্তির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারী মূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ। ১৯৭৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পূর্ণোদ্যমে অপরাজেয় বাংলার নির্মাণ কাজ শুরম্ন হয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় এ ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়। তবে অপরাজেয় বাংলার কাছে ভাস্করের নাম খচিত কোন শিলালিপি নেই। স্বাধীনতার এ প্রতীক তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন গুণী শিল্পী ভাস্কর সৈয়দ আব্দুলস্নাহ খালিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের বেদিতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি যেন অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠার গান গাইছে। এ ভাস্কর্যে সব শ্রেণীর যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে।

সংশপ্তক l

সংশপ্তক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতর্পণমূলক ভাস্কর্যগুলোর অন্যতম। এই ভাস্কর্যটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। এর স্থপতি শিল্পী হামিদুজ্জামান খান।
এক পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা এ ভাস্কর্যটি ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ স্থাপন করা হয়।
মূল ভূমি থেকে ভাস্কর্যটির ঊচ্চতা ১৫ ফুট। মূল ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি।

স্থাপত্য তাৎপর্য
১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের তাঁজা প্রাণ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালি জাতি। । হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজ্জল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে এতে দৃশ্যমান করা হয়েছে।‘ সংশপ্তক’ হলো ধ্রুপদী যোদ্ধাদের নাম। মরণপন যুদ্ধে যারা অপরাজিত। এ ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার বীর সন্তান।

এই সকল স্থাপত্যগুলি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগকে চিত্রায়িত করে। আমার একটি স্বাধীন জাতি বটে কিন্তু বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এখনও অনেক সেকেলে অন্ধকারে আছে। আড়াইশ’ বছর আগে ব্রিটিশ জলদস্যুরা যে কুসঙ্কারাচ্ছন্ন আইন শিখিয়ে দিয়ে গেছে সেটাই এখন মুর্খের মত ফলো করে যাচ্ছে উকিল-জাস্টিসরা।

প্রধান বিচারক মাথায় উলের টুপি পড়ে মা-ভেড়া সেজে থাকে, দাবি করে- সে মা ভেড়া তার সামনে সবাই সমান। এখনও উকিলরা জাস্টিসদের দেখলে ব্রিটিশ নিয়মে ‘মাই লর্ড’ ‘মাই লর্ড’ (আমার প্রভু, আমার প্রভু) করে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এতটাই অন্ধ অনুকরণপ্রিয় যে, ব্রিটেনে তীব্র শীত পরার কারণে উকিল-জাস্টিসরা কোর্ট, গাউন পরে থাকে। আর বাংলাদেশে সেই অণুকরণে গরমকালে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে শত শত লোকের মধ্যে ভ্যাপসা আবহাওয়ায় উকিল-জাস্টিসরা কোর্ট-গাউন পরে থাকে। দরদর করে ঘামতে থাকে, কিন্তু ব্রিটেনের অন্ধ অনুকরণ বলে কথা!!

দুঃখের কথা- ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৬৫ বছর হয়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৪৫ বছর, কিন্তু এখনও বিচারবিভাগ সেই ব্রিটিশ ভাষা থেকে বের হতে পারলো না। এখনও সুপ্রীম কোর্টে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ অচল।

কথাগুলো এ কারণে বললাম- সবাই যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা যেন আরো উল্টো পথে হাটছে। এতদিন ২৫০ বছর আগের ব্রিটিশ জলদস্যুদের ফলো করতো, আর এখন আরো পিছিয়ে গিয়ে ৫০০০ বছর আগে রোমান বর্বরদের কাল্পনিক বিষয় ঘেটে সুপ্রীম কোর্টের নাকের ডগায় বসাচ্ছে।

এই মূর্তিটি কোনভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উপস্থাপন করে না বা আমাদের স্বাধীন দেশে ন্যায় বিচারের ভাস্কর্য হতে পারে না, এমন কি এটি গ্রীক দেবীকেও সঠিকভাবে উপস্থাপন করে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একে শাড়ি পড়িয়ে হাস্যকর করে তুলা হয়েছে, একে সরিয়ে ফেলাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন।

আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সঠিক মনে করি, আমার এই দীর্ঘ আলোচনা এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করে।

আমি খামচে ধরি বাংলাদেশ

আমি খামচে ধরি বাংলাদেশ

যেন আমি ক্রুশবিদ্ধ যীশু;
আমাকে পাগল-সাব্যস্থ এবং শিকলবন্ধী করা হলো
নির্জন প্রান্তরের বটবৃক্ষে উচু হয়ে উঠা শিকরে-
আমার অসম সাহসে তারা বিভ্রান্ত।
যে-ই আমি তাহাদ আলীর নিকট
বিনা লড়াইয়ে বিসর্জন দিয়েছি আয়েশাকে,
যেবার আয়েশাকে জোড় করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে
একটি টু-নট-টু পিস্তলের মুখে আমি কম্পমান ছিলাম, টু শব্দটি করিনি;
সেই আমিই মাটির বুকে উবুর হয়ে পড়ে থাকা
তাহাদ আলীর লাশের পাশে দাড়িয়ে চিৎকার করছি-
কোন ক্রশফায়ার হয়নি এখানে,
তাকে হত্যা করা হয়েছে;
তাহাদ আলী আমাদের উপর জুলুম করেছে-
কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে;
সামাজিক জুলুমের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় জুলুম…

ওরা আমার অসম সাহসে বিভ্রান্ত
ওরা আমাকে খাবার দেয়নি, না পানি একফোঁটা।
ক্ষুধার যন্ত্রনা তীব্র হতে হতে উড়ে গেছে বহুক্ষণ আগে
লোভ, ঘৃণা, ক্রোধ, প্রতিহিংসা লুপ্ত হয়ে উঠে গেলাম
মানবীয় স্তর হতে প্রকৃতিক স্তরে
সারারাত আমি প্রকৃতিতে একাত্ম ছিলাম।

পুর্নিমার চাঁদ জ্যোৎস্নার পাল তুলে ভেসে গেলো
আকাশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে
তারপর আমাকে চুমু দিয়ে টুপ করে ডুবে গেল দিগন্তে;
কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়েছিল যে বিষধর সাপ আমার পায়ের পাশে গর্তে
সূর্যের আগমনী আলোর প্রকাশে এঁকে বেঁকে চলে গেল নি:শব্দে;
সুবেহ্ সাদিকের সময় যখন
মানুষের স্বপ্নগুলি সত্য হয় বলে কিংবদন্তী আছে;
ভুতগ্রস্থের মতো দেখি তাহাদ আলী
নূর হোসেনের হাতে হাত ধরে, গোল হয়ে,
নেচে চলছে উদভ্রান্ত ব্রাজিলীয় স্বাম্বু নৃত্যে- আমার মস্তিস্কের উদ্যানে।

এইসব অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গজিয়ে উঠা নখে তাদের ধরতেই-
আমি খামচে ধরি বাংলাদেশ।

বন্ধুকের নলে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’-এর গায়ে
চাপ চাপ রক্ত ঝরছে অবিরল ধারায়
সাদা হাইকোর্টের ‌’চির উন্নত মম শির’
তাহাদ আলীর লাশের পাশে লজ্জায় নীল।

খুল যা সিম সিমঃ গেদু, দীলখুশ ও খেয়ালী মন

দূরের কাছের সকল পাঠক দর্শকবৃন্দ আপনাদের সকলকে জানাই আশু নব বর্ষের শুভেচ্ছা। দিনে দিনে অনেক সময় বয়ে যাচ্ছে, শব্দনীড়ে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসছেন অনেকই। খুল যা সিম সিম এ পক্ষ থেকে অভিবাদন জানিয়ে শুরু করছি আজকের পর্ব।

চিঠি চালাচালি নিয়ে নতুন আইডিয়া নিয়ে এসেছেন খেয়ালি মন। ঐদিকে দীলখুশ মিঞা হাই হ্যালো চালিয়ে যাচ্ছেন বেশ।

তো দীলখুশ মিঞা খেয়ালীমনকে চিঠি দিলো।

চিঠিতে লেখা, ‘ প্রিয় খেয়ালিমন, আমি একটা মহা ঝামেলায় পড়েছি, একমাত্র তুমিই পার এই ঝামেলা থেকে আমাকে মুক্তি দিতে। দয়া করে যদি তুমি আমাকে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দাও, তাহলে বর্তে যাই আমি। ছয় মাস পরই ধারের টাকা শোধ করে দেব।’

এই চিঠি পেয়ে খেয়ালী মন পরে গেলেন মহা ফ্যাশাদে ওই ব্যাটা দীলখুশ যে একটা ফাকিবাজ ভালো করেই জানে খেয়ালী মন, মরে গেলেও দীলখুশ মিঞা কিছুতেই এ টাকা শোধ করবে না।
মহা চিন্তায় পড়ল, ভাবতে ভাবতে হুট করেই বুদ্ধি করল, এবার তাকে একটা পাল্টা চিঠি পাঠিয়ে দিই।
খেয়ালী মন চিঠির উত্তর লিখে দিল, ‘ভাই , আমি খুবই দুঃখিত যে, তুমি ১০ হাজার টাকা চেয়ে যে চিঠিটি আমার ঠিকানায় পাঠিয়েছ, তা হয়তো ভুল করে অন্য কারও কাছে গেছে। তাই সেই চিঠিটি এখনো আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি। তাই তোমাকে টাকাটা দিতে পারলাম না বলে ক্ষমা কোরো।’

আরে সাব্বাস। সাব্বাস, সাব্বাস।

এদিকে গেদুর সাথে দীলখুশ মিঞার সাথে দেখা।

দীলখুশ মিঞা গেদুকে বললঃ গেদু তুমি কি বিয়ে করেছো?
গেদুঃ হ্যা।
দীলখুশঃ কাকে ?
গেদুঃ একটা মেয়েকে।

দীলখুশ ভাবল এইতো সুযোগ গেদুকে বেকায়দা ফেলার, বললঃ কেউ কি ছেলেকে বিয়ে করে?

গেদু বললঃ হ্যাঁ, করে। গত বছর আমার বোন একটা ছেলেকে বিয়ে করেছিল।

গেদু বললঃ হায়রে হাই হ্যালো, তুমি চলো শিকরে শিকরে আমি চলি পাতায় পাতয়, তুমি বলো হ্যালো হাই, আমি বলি বাই বাই।

আজ এ পর্যন্ত। আল্লাহ হাফেজ।

আনন্দঘন হোক পহেলা বৈশাখের উৎসব

মধ্যযুগে বাংলা সনের প্রচলনের আগে কৃষি ও ভূমি কর বা খাজনা আদায় করা হতো ইসলামিক হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে। কিন্তু চাষাবাদ করা হতো সৌর বছর অনুযায়ী। কারণ চন্দ্র ও সৌর বছরের মধ্যে ১১ বা ১২ দিনের পার্থক্য ছিল। ফলে ৩১ টি চন্দ্র বছর ৩০ টি সৌর বছর এর সমান হয়ে যেতো। তাতে কৃষিজীবীদের ফসলহীন ঋতুতে কর বা খাজনা দেবার জন্য বাধ্য করা হতো।

সম্রাট আকবর তাঁর শাসনের প্রথমেই এই সমস্যা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং এর একটি বৈজ্ঞানিক কিন্তু কার্যকর সমাধান খুঁজছিলেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মুঘল সম্রাট আকবর (শাসনকাল ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ হতে ১৬০৫ খৃষ্টাব্দ) বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী ও রাজকীয় জ্যোর্তিবিদ আমির ফতেউল্লাহ্ সিরাজী চান্দ্রমাস নির্ভর হিজরি বর্ষপঞ্জি এবং সৌরমাস নির্ভর হিন্দু বর্ষপঞ্জি গবেষণা করে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি প্রস্তাব করেন। এর ফলেই সূচনা হলো বাংলা বর্ষপঞ্জির বা বাংলা সনের। বাংলা সনের সূচনা হয় ফসল তোলার সময়ে যখন কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে বছরের অন্য সময়ের চাইতে সচ্ছল থাকে। নতুন বর্ষপঞ্জি প্রথম দিকে ফসলী সন হিসেবে পরিচিত ছিল।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যুগ ধরে চৈত্র মাসের শেষ দিনে চৈত্র সংক্রান্তি পূজা’ উদযাপন করে আসছে । বাংলা উইকিপিডিয়াতে প্রদত্ত তথ্য থেকে দেখা যায় হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, এ দিনে স্নান, ব্রত, উপাসনা প্রভৃতি ক্রিয়াকর্ম পূণ্য জনক।

এ ছাড়া বাংলা পিডিয়াতে আরো বলা হয়েছে, “চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাংলায় শিব কেন্দ্রিক একটি বিশেষ উৎসব পালিত হয়। এটি “চড়ক পূজা” নামে পরিচিত। চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিন এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে।”

“চড়কপূজা উপলক্ষ্যে, আগের দিন চড়ক গাছকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। তারপর এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয় যা পূজারীদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত। পতিত ব্রাক্ষণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করে। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হল, কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির উপর লাফানো, শিবের বিয়ে, অগ্নি নৃত্য, চড়কগাছে দোলা ইত্যাদি। এইসব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের উপর বিশ্বাস। এর অনুষ্ঠানাবলী প্রাচীন কৌম সমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা “চড়ক সংক্রান্তি” বা “চৈত্র সংক্রান্তির মেলা” নামে পরিচিত।”

পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেন। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেন। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেন।

নানা অানুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বাংলা বর্ষবরণকে সাজায় বিশ্বের নানা প্রান্তের বাঙালীরা।

বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের উৎসব নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে এবং এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাত্রা।

গত বিশ বছর আগেও শহুরে মধ্যবিত্ত বাংলা নববর্ষ তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখতো না আর উচ্চবিত্তরাতো নাই ই। বাংলা সন ছিলো গ্রামের মানুষের (চাষাভূষার) সন। তাদের মহাজনের সাথে ঋনের হিসাব করা – ব্যবসায়ীদের হালখাতা করা আর কৃষকদের খাজনা দেওয়ার জন্যে অবশ্যই এই দিনটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন ছিলো।

ছায়ানট মুলত একে টেনে এনেছে শহরে – রবীন্দ্রনাথকে ভর করে মধ্যবিত্তের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে এই নববর্ষ। ১৯৬৭ সালে প্রথম ছায়ানট রমনার বটমুলে গানের আসর করে – স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এর পরিধি বাড়ছে। আর মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সাল থেকে – এর উদ্যোক্তার এইটাকে সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

নাগরিক আবহে সার্বজনীন পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়৤ ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। সে বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থীগন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ প্রতি বছর অব্যাহত রাখে৤।

১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়।

শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং বেরংয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়।

জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা বা ইনট্যানজিবল (ইং: Intangible ) সাংস্কৃতিক ঐতিহ‌্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

গ্রামের “বছর পয়লা” শহরে এসে পহেলা বৈশাখ হওয়ার সাথে সাথে নতুন একটা উপসর্গ এসে জড়িয়ে গেছে – তা হলো পান্তা-ইলিশ। বিত্তবানদের ইলিশ কেনার প্রতিযোগীতা আর তার ছবি ফেইসবুকে দেওয়ার রেওয়াজটা যে হাজার বছরের সংস্কৃতি না এইটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিত্তবানদের সম্পদের প্রদর্শনী শুধু যে পহেলা বৈশাখেই হয় তা না -হয় ধর্মীয় উৎসবেও। যাদের অনেক আছে তারা দেখাবে – আর যাদের নাই তারা দেখবে – এইটা অবশ্য হাজার বছরের ঐতিহ্য।

রমজান, ঈদ আর শবেবরাতে এর চেয়ে অনেক বেশী অনিয়ম হয় – যা ইসলামের দৃষ্টিতে কঠিন অন্যায় – আমার মনে হয় যারা ইসলাম নিয়ে ভাবেন – তারা আগে নিজের ঘর সাফ করা উচিত।

পহেলা বৈশাখ ধর্মীয় উৎসব না – সেখানে ধর্ম পালন করতে কেউ যায় না। তার বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া মানেই হলো সীমার বাইরে যাওয়া।

অন্যদিকে বাংলাদেশে ধর্মনিরপক্ষবাদীদের মধ্যে নাস্তিকপন্থীরা ইসলামধর্মের প্রতি এতোটাই অসহিষ্ণু যে – কোন অনুষ্টানের আগে এরা নিশ্চিত করে এই ধর্মের অনুসারীরা যথেষ্ঠ বিরক্ত হয়েছে কিনা! এটা খুবই দুঃখজনক আর চরম বাড়াবাড়িও বটে।

আর প্রতিটি বাড়াবাড়ি নিয়ে আসে বেদনাদায়ক ঘটনা। আমরা সব ধরণের বাড়াবাড়ি পরিহার করে আনন্দঘন পরিবেশে পহেলা বৈশাখের উৎসব পালনের আহ্বান জানাই।

মায়াবন-বিহারিণী (৬-৮)

৬.
এ পর্যায়ে লেখালেখি হতে দূরে সরে যায় মিমি। তার ভাবনা ঘর-গৃহস্থালীতে মগ্ন হয়ে উঠে। দামী এপার্টমেন্ট, দামী গাড়ীর দিকে তার দৃষ্টি হারিয়ে যায়। তার স্বামী প্রকাশকের বিলটি পরিশোধ করে দেন। এভাবে সংসার তার হতাশায় মিমি’র লেখক স্বত্ত্বা হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লেখালেখি এমন এক নেশা যা একবার কারো হৃদয়ে গভীরে ঢুকে গেলে আর কখনো ত্যাগ করা যায় না। আর সফল লেখকদের চাইতে ব্যর্থ লেখকদের লেখার প্রতি ভালবাসাটা প্রবল হয়। মিমি’র পুরানো ভালবাসা ফিরে আসছিল। আর কাকতালীয়ভাবে এখানে এসে বৈরাগীর অদৃশ্য ছোঁয়াতে নিজেকে আবার পুরানো অবস্থায় ফিরে পেল। বৈরাগীর প্রতি তার আগ্রহটা নানাভাবে প্রকাশিত হতে থাকল।

গৃহকর্ত্রীকে নানাভাবে প্রশ্ন করতে থাকল তার জবাবে তিনি বলেন,‘‘ খুব ভাল লেগেছে যে, তুমি কবির প্রতি খুব আগ্রহ দেখাচ্ছো। কিন্তু সে অন্তর্মূখী মানুষ। যদি তুমি তাকে সমনাসামনি দেখতে পেতে , বুঝতে কি লাজুক সে। আমিতো তাকে প্রায় দুই বছর যাবৎ দেখছি। সে লোকালয় এড়িয়ে চলে। এই রুম দু’টি সে সারা বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে রেখেছে, যখন মন চায় চলে আসে, বুকে সমুদ্রের বাতাসের স্পর্শে কেপে উঠে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো নেচে উঠে হয়ত তার মন। আর সারাক্ষন কেবল পড়ে বা লেখে। আর সত্যি বলছি এত বড় মনের মানুষ তুমি প্রতিদিন দেখতে পাবে না…..’’
-‘তিনি বড় মনের আর খুব ভাল!’
‘‘ হ্যাঁ, আমি যখন তার সাথে গল্প করতে চাই,’ গৃহকর্ত্রী বলেন,‘ সে সময় দেয়। তার কোন লেখা যা প্রকাশিত হয়নি, ভেবে দেখো, আমি পড়তে চাইলে তেমন লেখাও পড়তে দেয়। জানো একবার সে বলছে, কিছুই লিখতে পারছে না। আমি বললাম, স্থান পরিবর্তন করো, নতুন পরিবেশে যাও। তারপর প্রায় দুই তিন মাস তার দেখা মেলেনি। ফিরে এসে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল যে, আমার পরামর্শে সে দারুন গতিতে আছে….”

৭.
‘ও আচ্ছা, তাহলে তিনি একটি স্পর্শকাতর চরিত্র, কি বলেন?’
‘হ্যা, ঠিক আছে। তবে মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরন করে যা সত্যিই স্পর্শকাতর। স্পর্শকারত! বাহ ভাল শব্দ ব্যবহার করেছো। একদিন রাতে সম্ভবত কোন কবিতা শেষ করেছে সে তারপর সারারাত জোরে জোরে গলা ফাটিয়ে আবৃতি করে চলেছে। জানো তো, আমার থাকার জায়গা থেকে এখানকার যে কোন জোরে উচ্চারিত শব্দ শোনা যায়। তারপর হলো কি, সে আমাকে ডেকে আনলো, ঘুম জড়ানো চোখ আমার বুঝ অবস্থা…। আমাকে কিনা শুনতে হবে তার কবিতা.. এত রাতে!!…’’
একজন উঠতি কবিকে নিয়ে নানা কথোপকথোনের এসব অংশ বিশেষ মাত্র। একদিন গৃহকর্ত্রী মিমির দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওয়াল পেপারের দিকে যা কিনা বিছানার পিছনে ছিল বলে দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। মিমি বলল,‘দেখি দেখি’।

‘এগুলো’ গৃহকর্ত্রী বললেন, মহিলাসুলভ চপলতা নিয়ে যেন গহীন গোপন ব্যাপারটি জেনে গেছেন,‘ যা ওয়াল পেপারে বা ও দেখ, ক্যালেন্ডারেও লিখা, এগুলো সবই তার কবিতার লাইনের প্রাথমিক অবস্থা। এগুলো আর এরকম থাকেনি কিন্তু ইচ্ছা করলে পড়ে দেখতে পারো। আমার ধারণা সে সারা রাত হেটে বেড়ায়, পায়চারি করতেই থাকে, কোন ভাবনা চলে এলে সাথে সাথে লিখে রাখে দাড়িয়ে দাড়িয়ে, সকালে আবার মাথা থেকে হারিয়ে যায় এই ভয়ে। আমি অনেক লাইন এখানে লেখা দেখেছি যা পরে ম্যাগাজিনে ছাপার অক্ষরে দেখেছি। আবার কোন কোনটি কোথাও দেখিনি। আর কিছু দেখছি নতুন। দেখো দেখো এগুলো আগে কোথাও দেখিনি। নিশ্চয়ই এগুলো কিছুদিন আগে লিখা।’’
‘ও আচ্ছা…’ মিমি বলে।

এসব কথা শুনতে শুনতে সে আরো আবেগ প্রবন হয়ে উঠল। লেখালেখির দিকে গভীর ভাবে ঝুকে পরে।,সে ভিতরের আবেগকে গভীর ভাবে উপলব্দি করতে লাগল।

৮.
হেলালউদ্দিন ঢালী ট্রলারে টেকনাফের দিকে যাওয়াটা বেশ উপভোগ করেন। চাদনী রাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের যে অসাধারন রূপ ধরা দেয় সে দিকে তার খেয়াল নেই কিন্তু তিনি উপভোগ করেন যখন ঢেউয়ে এদিক ওদিক হেলে উঠে যানটি তখনকার ভয় পাওয়া মানুষগুলো, দেখতে তার বেশ ভাল লাগে। তিনি উপভোগ করেন প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী কিভাবে ভয়ে পরস্পর জড়িয়ে ধরে। তার ইচ্ছা করে মিমিকে নিয়ে পাবলিক ট্রলারে করে সমুদ্র ভ্রমনে যেতে। কিন্তু মিমি এসব পছন্দ করে না, কোন থ্রিল নেই তার মনে, সে আতংকগ্রস্থ হয়ে পরে। ফলে তাকে একাই যেতে হয়।

ভ্রমনে আনন্দ পাওয়া নিয়ে দুজনের মতবিরোধের কারনে মিমি সমুদ্রে স্নান আর সৈকতে হেটে তার দীর্ঘসময় কাটিয়ে দেয়। সন্তানদের দেখাশুনা করার বাইরে তার হাতে চলে আসে অনেক অলস সময়। তার ভিতরকার লেখক স্বত্ত্বাটি জেগে উঠে প্রবল ভাবে।

বৈরাগীর কবিতা তাকে কেবল টানতেই থাকে। মাঝে মাঝে তার কবিতাগুলো নিজে লেখার প্রতিদ্বন্ধী হিসাবে দাড় করায়। নিজের লেখাকে যখন তার লেখার সামজনে দাড় করায় তখন নিজেকে হাস্যকর মনে হয় আর গোমরে গোমরে ফুপিয়ে কেদে উঠে। তার ভোগবাদী জীবন, না এই উন্নত ভাববাদী জীবন , এই দুইয়ের সংকটে ভুগতে থাকে সে। হৃদয়ের এই অন্তর্দ্বন্ধের কারনে সে নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গভীর মনোনিবেশ করে। তার কানে কানে বৈরাগী কথা কয়, প্রতি মুহুর্তে যেন এই ফিসফিসানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এই কবিকে সে কখনো দেখেনি। সব ইমোশন কি বাস্তবতা খুজে পায়- নিজেই নিজেকে শুধায়।

এই দ্বিমূখী দ্বন্ধে তার স্বামীর ভোগ বিলাসপূর্ণ জীবন হেরে যায়, তার স্বামীর প্রতি ভালবাসাটুকু ক্ষীন হতে হতে শুণ্যতে নেমে আসে। এখন স্বামী-স্ত্রী যেন উপকারী বন্ধু পরস্পর, আর্থিক ও দৈহিক।

চলবে——

মায়াবন-বিহারিণী (১-৫)

১.
হেলালউদ্দিন ঢালী হোটেলে ফিরে এলেন। বাসার খুজে বেরিয়েছিলেন। কক্সবাজারের সমুদ্রের পার ঘেষে চমৎকার পরিবেশের বাড়িটি তার পছন্দ হয়েছে। হোটেলে ফিরে এসে স্ত্রী-সন্তানদের না দেখে একটু চিন্তিত হয়ে উঠলেন। পুলিশের মতো পোশাকের ফিটফাট দারোয়ানের নির্দেশনায় তিনি সমুদ্র সৈকতের দিকে এলেন।
‘‘মাই লাভ, কতদুর চলে এসেছো! টেনশনে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো’ মি: হেলালউদ্দিন বললেন বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে। তার স্ত্রী গভীর মনযোগে বই পড়ে যাচ্ছে, আর কাজের মেয়েটির সাথে বাচ্চা তিনটি মেতে উঠেছে উল্লাসে।
হেলাল সাহেবের স্ত্রী, লুবাবা মিমি বই থেকে চোখ ফেরালেন। জাগ্রত স্বপ্ন থেকে ফিরে এসে বললেন ‘হ্যা, সেই কখন গেলে! বদ্ধ হোটেলে আমার একেবারেই পছন্দ নয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। তবু আমি দুঃখিত! আমাকে কি তোমার দরকার? এখনি?’
– না, না, সেসব কথা হচ্ছে না। আমি যখন কোন কিছু পছন্দ করি তখন তোমার রুচিতে ঠিক ভাল ঠেকে না। দয়া করে আমার সাথে কি আসবে? একটা বাড়ী পছন্দ হয়েছে আমার কিন্তু রুম কম। তবু এখানে যাওয়া যেতে পারে, পুরো শহরটা মানুষে গিজগিজ করছে…

এই দম্পতির দুজনের প্রকৃতি আলাদা। বয়সটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যক্তিগত ব্যবহার উভয়েরই চমৎকার। কোন অভাব এসে হানা দেয় না সংসারে। অর্থনৈতিক টানাপোড়নের যে খুনসুটি এখানে তা অনুপস্থিত। চিৎকার চেচামেচি ঝগড়া কখনও শোনা যায়নি এখানে। হেলাল সাহেব শক্ত নার্ভের লোক, সব কিছু ম্যানেজ করে চলতে পারেন আর তার মিসেস অনেকটাই ইমোশনাল, সামান্য ব্যাপারে অতিরিক্ত টেনশন আর উত্তেজিত হয়ে যাওয়া তার প্রকৃতিজাত। হেলাল সাহেব তা জানেন, তিনি স্ত্রীর পছন্দের মূল্যায়ণ করেন। আর মিসেস হেলাল ও সবকিছু মানিয়ে নিয়েই সংসার করে আসছে। তার স্বামীর ব্যবসার ধরনটা আলাদা। তিনি অস্ত্র ব্যবসা করেন, রাজধানীর বুকে পুরান ঢাকার দিকে তার একটি ‘বন্দুকের দোকান’ আছে। এখানটাই মিসেস হেলাল, লুবাবা মিমি’র বিশাল আপত্তি। সে গভীর ভাবুক প্রকৃতির। তার ভাবনায় কিছুতেই এমন একটি বেচা কেনাকে সমর্থন করতে পারে না যা শেষ পর্যন্ত মানুষ হত্যা ডেকে আনে। মানুষের উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে তাদের হাতে মৃত্যুর হাতিয়ার তুলে দেয় যে ব্যবসা তা কিছুতেই সে সমর্থন করতে পারে না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মেনে নেন দুটি যুক্তিতে, এক, ব্যবসাটি অবৈধ নয়, সরকার অনুমোদিত। দুই- অনেক বিষাক্ত ক্ষতিকর জীবজন্তু জানোয়ারের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

২.
বিয়ের আগে , মিমি বাবা’র পছন্দের পাত্র দেখে মোটামুটি উল্লাসিত ছিল। উচা-লম্বা-ফর্সা-স্মার্ট। সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার বাচন ভঙ্গি। গুছিয়ে সুন্দর আস্তে ধীরে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করতে পারে আর যে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে। এ তো স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র। কিন্তু বিয়ের পর যখন স্বামীর পেশা জানতে পারে যে সরকারী অনুমোদনের বাইরে তার কিছু লেনদেন আছে তখন মিমি হোঁচট খায়। মিমি স্বামীর তুলনায় একটু খাটো দেখতে হলেও মায়াবী চেহারা আর আকর্ষণীয় ফিগার যে কাউকে মোহিত করে রাখতে পারে। হেলাল সাহেব সুদক্ষ নাবিকের মতো মিমির দেহ নিয়ে পাড়ি দিয়েছে ঝড়-তাণ্ডবের করাল সমুদ্র। তার এই পদচারনা বাস্তব ভিত্তিক। দেখতে যেমন সুন্দর শরীর বিষয়ক কলা কৌশলে সে তেমনি পারদর্শী সফল পুরুষ।

মিমি তার বিপরীত প্রান্তে বসবাস করতে থাকে। তার হৃদয়ে বয়ে চলে একটি অনুশোচনা। স্বামীর পেশার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ও করেছিল মৃদু উচ্চারনে কিন্তু হেলাল সাহেবের যুক্তি আর উপস্থাপনায় হার মেনেছে। সবকিছু ভুলে গিয়ে তাই মিমি নানারূপ দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে। যার ইন্ধন যোগাতে থাকে বই। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ আর কবিতা সব বিষয়েই তার পদচারনা। কবিতার প্রতি তার রয়েছে আলাদা দুর্বলতা।
স্বামী-স্ত্রী দু’জন হেটে হেটে যে বাড়িটির দিকে গেল তার একটি দিক সমুদ্রের দিকে খোলা। প্রায় সমুদ্রের পাড় ঘেষেই উঠেছে বাড়িটি। তারা পরস্পর হাত ধরাধরি করে গৃহকর্ত্রী মুখোমুখি দাড়াল।

৩.
গৃহকর্ত্রী, ভদ্রলোকে প্রত্যাবর্তন অবলোকন করছিলেন, তাদের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে এলেন এবং রুমগুলো দেখালেন। তিনি জানালেন যে, তিনি একজন বিধবা, হঠাৎ স্বামী বিয়োগে অভাবী এখন, তাই বাড়ি ভাড়াই এখন চলার একমাত্র অবলম্বন। লুবাবা মিমি জানালো যে পরিবেশ তার পছন্দ হয়েছে কিন্তু তার সবগুলো কামরাই প্রয়োজন। গৃহকর্ত্রী গভীর ভাবনা ভাবলেন এবং দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন যে, তিনি চান না যে যারা তার ভাড়াটিয়া হিসাবে থাকবেন তারা কোন অসুবিধা বোধ করেন। কিন্তু তিনি নিরুপায়। একটি কামরা একজন ব্যাচেলার ভদ্রলোকের নিকট ভাড়া দিয়েছেন। আর সত্যি কথা এই যে, তিনি এই মৌসুমী চড়া ভাড়া দেন না বটে কিন্তু তিনি সারা বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন। আর ভদ্রলোক অনেক অনেক ভাল ও রহস্যময় যুবক। কোন সমস্যা তৈরি করেনি কখনো। গৃহকর্ত্রী এই একমাসের বাড়তি ভাড়ার জন্য চান না তার স্থায়ী ভাড়াটিয়া উঠে যাক।

তারা সবই শুনলেন এবং হোটেলে ফিরে এসে লোক নিয়োগ করে দিলেন বাসা খুঁজে বের করার জন্য। যখন তারা বৈকালিক চা পানে মত্ত তখন গৃহকর্ত্রীর কল এলো। তিনি বললেন যে, ভদ্রলোক হতে তিন থেকে চার সপ্তাহের জন্য রুমগুলো ব্যবহারের অনুমতি নেয়া যেতে পারে।
‘তা হলেতো ভালই হতো, কিন্তু আমরা ভদ্রলোককে কোনপ্রকার অনুরোধ করতে পারব না।’ -হেলাল সাহেব বললেন।
‘অ, আপনাদের কোন অনুরোধ করতে হবে না’ গৃহকর্ত্রী বললেন, ‘দেখুন, ভদ্রলোক অন্য সবার চেয়ে আলাদা- স্বাপ্নিক, স্বাধীনচেতা, একাকিত্ব প্রিয় মানুষ। তিনি সাধারনত এই সময়টা, যখন লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে সমুদ্র সৈকত তখন দূরে চলে যান। তিনি এখন এখানে আসবেন না, তিনি টেকনাফের দ্বীপে এক কুটিরে আছেন। তার রুমটি এখন ব্যবহার করা যেতে পারে।’-এই বলে গৃহকর্ত্রী আশা পোষন করেন যে, তারা বাসাটি ভাড়া নিবেন।

৪.
ঢালী পরিবার পরের দিন বাড়িটিতে গিয়ে উঠলে, বাসস্থানটি তাদের কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হলো। দুপুরের খাবারের পর মি. হেলাল বেরিয়ে গেলেন কি কাজ আছে বলে। মিসেস ঢালী বাচ্চাদের বালিতে ছুটাছুটির অবকাশ দিয়ে দিলেন। সবকিছু থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে গত কয়েকদিন যাবৎ পড়তে থাকা আর্টিক্যালে মনোনিবেশ করল।

কিছুক্ষণ পর সে রুমে চলে এলো যেখানে অবিবাহিত যুবকটি ব্যবহার করে। দেখা গেল রুমটি অগোছালো, এলোমেলো পরে আছে নানা বই-পত্র। কিছু পুরাতন বই, যা সচরাচর পাওয়া যায় না স্তূপাকারে পুঞ্জিভূত হয়ে আছে ঘরটির এক কোনায়। এই মৌসুমে যদি অন্য কেহ বাড়িটি ভাড়া নিত তবে বইগুলো যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাতে তার কিছু ক্ষতি হয়ে যেতে পারত ভেবে শংকিত হয়ে উঠল লুবাবা মিমি।
‘আমি একে আমার নিজের রুম করে নিব’ গৃহকর্ত্রীকে বলল মিমি,‘ তার কারণ বই গুলি। বাই দা ওয়ে, মনে হচ্ছে যে লোকটি এখানে থাকেন তিনি খুবই ভাল। আমি বইগুলি পড়লে তেমন কিছু খারাপ ভাববেন না, কি বলেন?’
গৃহকর্ত্রী বললেন,‘হ্যাঁ, সে যথেষ্ঠ ভাল। তুমিতো দেখতেই পারছো সে শিক্ষিত লোক। সাধারণ শিক্ষিত নয়, তুমি হয়ত একটু অবাক হবে, সে একজন কবি। সে একজন আপাদমস্তক কবি। তার পৈতৃক কিছু সম্পত্তি আছে যার থেকে ভালই ইনকাম আছে। সে এলোমেলে জীবন যাপন করে আর শুধু লেখালেখিই করে।
– কবি! অহ্ আমি জানতাম না।

মিমি দু’একটা বই নাড়াচাড়া করতেই বুঝে গেল যে, এখানে যিনি থাকেন তিনি আলতাফ হোসেন বৈরাগী। মিমি বৈরাগীর লেখার সাথে গভীর ভাবে পরিচিত। বিস্ময়ের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেল মনে হয়। স্তম্ভিত হয়ে সে বারবার ভাবতে লাগল বৈরাগী যে রুমটাতে থাকে এটা সেই রুম যেখানে মিমি বসে আছে!
গৃহকর্ত্রী চলে গেলে মিমি একা বসে রইল। আলতাফ মাহমুদ বৈরাগীকে ভাবছিল সে। এই গভীর আগ্রহের পিছনের ইতিহাসটি তার এই ধরনের বিস্মিত হবার কারণটি ব্যাখ্যা করতে পারে। মিমি এক হাইস্কুলের হেডমাষ্টারের একমাত্র কন্যা। লেখাপাড়ার প্রতি গভীর আগ্রহটা তার পিতা থেকে পাওয়া। পিতার ব্যক্তিগত সংগ্রহের গ্রন্থাগারে বসে বসে বই পড়ে তার কেটে গেছে দীর্ঘসময়। একসময় মিমি কবিতা লিখতে শুরু করল। সেই সব কবিতাগুলো ছদ্মনামে ছোট কাগজে ডাকে পাঠাতো এবং তা প্রায় ছাপা হতো। তার বেশ কিছু কবিতা নামকরা ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। দেখা যেত ঐ সব ম্যাগাজিনে আলতাব মাহমুদ বৈরাগীর কবিতা ছাপা হতো। তখন থেকেই বৈরাগীর লেখার সাথে মিমি পরিচিত। জাতীয় ঘটনাগুলো তাদের প্রভাবিত করত। একবার এক জাতীয় দৈনিকে জাতীয় এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষাপটে রচিত তাদের দুজনের দুটি কবিতা পাশাপাশি ছাপা হলো। এর পর হতে বৈরাগীর কোন লেখাই মিমির অপাঠ্য থাকেনি।

৫.
যখন বৈরাগীর ‘আমি শহরের অন্দর মহলে ঢুকে পড়ি’ কবিতাটি প্রকাশিত হলো তখন মোটামুটি আলোচনায় চলে আসে কবিতাটি। প্রচলিত ধারায় রচিত নয় কবিতাটি। ছন্দ মানা হয়নি, এমনকি কিছুটা যৌনতাকে উপমা হিসাবে নিয়ে কবি শহরের অন্তসার শূন্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। একজন সমালোচক কবিতার অবক্ষয় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বৈরাগীর কবিতাটি তুলে ধরেন। তিনি কবিতাটিকে অশ্লীল বলে আখ্যা দেন এবং বলেন তেলাপোকাকে দোয়াতে চুবিয়ে সাদা কাগজে ছেড়ে দিলে একটি চিত্রকর্ম হয়, কাকতালীয়ভাবে তা চমৎকার দেখতে হয়ে উঠতে পারে । এই কবিতাটি তেমনি এক শিল্পকর্ম। এই সমালোচনার জবাবে মিমি তার ছদ্মনামে একটি প্রবন্ধ লিখে যাতে এই কবিতাটি সহ বৈরাগীর কিছু কবিতা তুলে আনে। সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারটি কাব্য গ্রন্থকে গদ্য-কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করে এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র উদাহরন তুলে ধরে বলেন এই কবিতাটি ও তেমনি এক গদ্য-কবিতা।

প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে একদিন মিমি তার নামে একটি চিঠি পান যাতে বৈরাগীর ধন্যবাদসূচক বক্তব্য ছিল এবং বর্ণনা ছিল কত কষ্ট করে সম্পাদকের মাধ্যমে তার ঠিকানা জোগাড় করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রিয় কবির চিঠি পেয়ে এবং তার প্রসংশা পেয়ে মিমি মূলধারার কবিতা ব্যাপকভাবে পড়তে থাকে। নিজের লেখা কবিতাগুলো যে কতটা মানহীন আর দুর্বল গাঁথুনিতে লিখা তা উপলব্ধি করতে থাকে। সে মুলত বৈরাগীর কবিতাকে অনুসরন করতে থাকে। এভাবে যদিও সবগুলো লেখা ছাপার অক্ষরের মুখ দেখতে পায় নি তবে বেশ কিছু কবিতা জমা হতে থাকে তার। এরপর সবগুলো লেখা যা কোথাও প্রকাশিত হয়েছে আর যা প্রকাশ হয়নি সব একত্রে করে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরী করে ফেলে। সে প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করে । প্রকাশকরা নতুনদের কবিতার বই প্রকাশ করতে চান না কারণ এত ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়। মিমি নিজ খরচে বইটি বের করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একজন লেখককে দিয়ে একটি রিভিউ তৈরী করে প্রকাশ করে। কিন্তু বইটি পাঠক মহলে গৃহীত হলো না, কেউ বইটি নিয়ে আলোচনা করল না, কেউ বইটি কিনেন না।

চলবে…..