ফকির ইলিয়াস এর সকল পোস্ট

ফকির ইলিয়াস সম্পর্কে

কবিতা লিখি, থাকি নিউইয়র্কে।

কবিরা এরকমই যায়

[ খোন্দকার আশরাফ হোসেন- আপনাকে ]

দুহাতে তুলে রাখি কিছু বনঢেউ। আজ আমি কিছুই সাজাবো না।
না আকাশ, না পুষ্প, না আগুন। কারো গায়েই পরাবো না
নতুন কোনো পোশাক। কিছু অন্ধকার আমার প্রিয় হোক, কিছু
বিচ্ছেদ ছিন্ন-বিছিন্ন করুক আমার পাঁজর – এমন প্রত্যয় নিয়ে
আজ আমি নগরে বেরোবো যারা এর আগে দেখেছে মৃত্যু, যারা
এর আগে প্রেমকে পরিত্যক্ত ভেবে হারিয়েছে নিরুদ্দেশ, আমি
তাদের তালিকা বানাবো। তারপর এই জীবনকে বিদায় জানিয়ে
খুঁজে নেবো সমুদ্রজীবন। এই আয়ুকে মিশিয়ে দেবো কবিত্বের একক
অহংকারের সাথে। আর কবিতার বই খুলে সেরে নেবো কাটাকুটি।

জানি, কবিরা এরকমই যায়। কেউ জানে- কেউ জানে না। কেউ
ছায়া দেখে। কেউ খুঁজে পায়না রেখে যাওয়া মায়াচিহ্ন। কবিকে
শেষ পর্যন্ত যেতেই হয়। ঘুমে- ঘোরে আর ঘরের অদূরে। সে পংক্তি
আমিও লিখছি- ঠিক তার বিপরীতে, দেখা হবে অন্য কোনো ভোরে!

জলপাহাড়

এত বৃষ্টি চারদিকে,
তবু ধুয়ে নিতে পারছে না আমাদের সম্মিলিত পাপ…
এত আগুন চারদিকে
তবু পুড়ে যাচ্ছে না অজগরের লকলকে জিভ

ঘূর্ণির প্রতিবেশী হয়ে থাকি
তবু উড়িয়ে নেবার শক্তি দেখি না
সবাই আমার চোখের দিকেই তাকায়
তবু পরিচিত কোনও মানুষ দেখি না…

মেঘ নেই, মোহ নেই

খুব বেশি মেঘ নেই তবুও আকাশটা আঁধার
হয়ে, আমাকেও দিয়ে যায় ধার
দেনা করে শোধ করি মৌরশী ঋণ
এভাবেই দায় নিয়ে কেটে যাবে অনাগত দিন!

এভাবেই আসবে শীত, পৌষের কুয়াশা
মিশিয়ে কেউ লিখবে গান- বুকে রেখে আশা
মাঝিও ফলাবে ফসল উজানের চরে
শস্যদানার ঘ্রাণে উন্মত্ত দুপুর পাবে ফিরে

সোনালী অতীত তার, লিখিত সুরের মোহে
র’বে ভুল তবু, জানি প্রেম-ছুঁবে বুক দ্রোহে।

এত রক্তপাতের পরও

যে কাঁটা গলায় বিঁধার কথা ছিল, তা বিঁধেছে চোখে
কিছুই দেখছি না আর,
কিছুই মনে করতে পারছি না, আদৌ
মানুষ ছিলাম কী না, কোনো জনমে
দাঁড়িয়েছিলাম কী না- কোনো মানুষের পাশে।

উড়ে যাচ্ছে পাথর। উড়ছে রক্ত- বাষ্প হয়ে
তারপরও আমাদের নিষ্ক্রিয় নাসারন্ধ্র, পাচ্ছে না
কোনো গন্ধ, পরখ করতে পারছে না বর্ণের ভাষা।
আর আমাদের পবিত্র(!) জনেরা বসে আছেন
যে পিঁড়িতে,
সে স্থান বড় উঁচু, যেখান থেকে মোটেও
দেখা যায় না সমতল পৃথিবী। তাদের মুখে
এঁটে আছে যে কুলুপ, সেটাও প্রাগৈতিহাসিক,
কালো কোনো দৈত্যের মৃত দাঁতখণ্ড।

বিশ্বস্ত বন্ধুদের প্রতি

এখন রপ্ত করতে চাই কীভাবে পালাতে হয়, কীভাবে দীর্ঘ করা যায়
বিভিন্ন ছুটিদিবস- কীভাবে অন্য কোনো গ্রহে পৌঁছে নেয়া যায়
মুক্ত নিশ্বাস। জানি সেদিন হয়তো থাকবে না আর এই শ্বাসকষ্ট,
এই পোড়ামাটিচিহ্ন লেগে থাকবে না আমার হাতে, অথবা যে ছবিগুলো
একদিন ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, সেগুলোও জোড়া লাগাবার প্রয়োজন
পড়বে না আর।

এবার শিখে নিতে চাই নাম-নিশানা মুছে ফেলার কৌশল, কেউ
জানবে না এই নগরের ভোটার তালিকায় আমারও নাম ছিল,
একদিন কলমও ছিল আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আর কাগজে
যে কাটাকুটিগুলো আমার পাঁজর ছিল- মূলত এরাই ছিল আমার কবিতা।

আমি পালিয়ে যেতে চাই,
মানুষ আমাকে পরাজিত পথিক বলুক
তারপরও,
যেতে চাই এই নগর থেকে অন্য কোথাও
যেখানে কেউ আমাকে আর চিনবে না
কেউ জানবে না পূর্বজনমে আমি আদৌ মানুষ ছিলাম কী না !

বিজ্ঞাপন

দুটো ডলারের জন্যে তুমি হাত
পাতছো, কর্পোরেট কচ্ছপের কাছে-
মাত্র কয়েকশ’ ডলারের জন্যে,
তুমি সারমেয় হয়ে বসে আছো
ভাড়াটে ইমিগ্রেশন দালালের পায়ের কিনারে…
মাঝে মাঝে হয়ে যাচ্ছো
মুরগী বিক্রেতার খামারী ফড়িয়া!

আর যাকে গলা টিপে হত্যা করতে
চাইছো,
তার কাছ থেকেও ভিক্ষে করে চেয়ে নিচ্ছো ফুলপেজ বিজ্ঞাপন।

কী অদ্ভূত সরীসৃপ আজ জড়িয়ে
ধরেছে তোমার গলা!
কয়েকটি মরা কাকের পালক,
তোমার জীবন্মৃত সমাধি ঢেকে
দেবে বলে, শল্লা-পরামর্শ করছে
তোমার কাছে দাঁড়িয়েই,

আর তুমি কামেল’স বিরিয়ানীর
পাতলা ডালের হালকা বিজ্ঞাপনী
সমর্থনপত্র ফেসবুকে লিখতে লিখতে,
ধরছো ফ্লাশিংগামী ট্রেন!

বায়বীয় সম্পাদক হে! তোমার তো
ভুলে যাবার কথা নয়,
কবিতার শক্তির কাছে কত পরাশক্তিই মেনেছে হার,
এভাবেই মিথ্যার প্রতি ঘৃণা ছড়িয়েছেন আল্যেন গীনসবার্গ,
আমিরী বারাকা থেকে
নমস্য শামসুর রাহমান !

মাদুলী ও বৃক্ষমাটি

qBS

মাটির নীচ থেকে পাওয়া মাদুলী’টি হাতে নিয়ে দেখি
তাতে কারো নাম লেখা। দেখি-এটি একদিন যে কারও
গলায় ছিল, সেই কন্ঠদাগও লেগে আছে রূপোর গায়ে।

আমি বৃক্ষের শিথান থেকে পৈথানে যাবার জন্য উঠে
দাঁড়াই। এ বৃক্ষটি গতরাতেই কেটে গেছে কেউ! তার
প্রশাখাগুলো সাক্ষী দিচ্ছে, এই বন দিয়ে হেঁটেছে করাত।

আমি করাতের দাঁতগুলো কল্পনা করার চেষ্টা করি।
দেখি- একটি কঙ্কাল এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে।
এবং বলছে, যে তুমি যাদু-টোনা জানো না, তার আবার
প্রেমপতি হবার দরকার কী ! কী দরকার মাটি খুঁড়ে
খোঁজার- কারও কররেখা ! আমি মাদুলী’টি নদীতে
ছুঁড়ে দেবো বলে পথ হাঁটি। একটি ছায়া আমার পথ আগলে দেয়।

আমার জীবনের ভেতর

qBS

অনেকগুলো জীবন লুকিয়ে থাকে আমার জীবনের ভেতর
অনেকগুলো সবুজ চারা, জাগিয়ে রাখে এই নবীন চর
অনেকগুলো পাখি নির্বিঘ্নে পালক ফেলে ফেলে
ঢুকে পড়ে অরণ্যে, আশ্বিনের মেঘজোসনাজলে।

যায় কোথায় তারা ! কে লিখে ওড়ার ইতিহাস
কিংবা যারা আজীবন পথে পথে, থাকে মায়াদাস
তাদের ছায়া কি সাথে যায় কবিতার অক্ষরে অক্ষরে
কেউ কি জানে, বেদনার বেহালা কাঁদে কার স্বরে!

তারার আলেখ্য আলোয় অগণিত ঘোরবাজি সেরে
যারা দেশান্তরি হয়, তারা কি আর নিজ ডেরায় ফেরে
সাক্ষী থাকে বৃক্ষ, ফুল, তৃণ- আর দুটি চোখ
আর থাকে ভালোবাসা, জগতের বেদনা প্রমুখ।

তবে কথা হোক

isto

কথা হোক বনের আলোতে
জোসনায়-ভেজা চুলের স্মৃতি শুকাতে শুকাতে
বেদনায়,
বৃষ্টির লালিমায় মেঘ যেমন মুখ লুকোয়-
পরিণত ভোরগুলো গেয়ে যায় জীবনের জয়।

কথার আড়ালে থাকুক, অনেক কথার পাহারা
নিতে নিতে বর্ণময় নিশ্বাস-
জলের সমান্তরালে জল
ফুলের সমান্তরালে ফুল
সাজিয়ে আসুক কাছে,
জ্যোৎস্নাগন্ধ পেতে চায় যারা।

কথা হোক, রাত্রির বাহুতে রেখে চোখ
প্রতিবেশী পরাগেরা –
প্রণয়ের চিরসাথী হোক।

অন্যদিন ধূসর পাহাড়ে

এখানে কোনো সবুজই থাকবে না-
এখানে থাকবে না কোনো আগুন,
আগুনের উত্তাপ,
মানুষের প্রেম,
চুমুর দৃশ্য,
সবুজের আলিঙ্গন,
থাকবে না হাত ধরে গারো মেয়েদের মিছিল।

কিছুই থাকবে না অবশেষে। একটি আলখেল্লা
শুধুই হাত বুলাতে বুলাতে দখল করে নেবে সব
হ্যাঁ- সব।
শিশুদের হস্তরেখা, গাভীর ওলানের দুধ,
বনফুলের পরাগ, যাত্রীর বাইসাইকেল
ফেরিঅলা’র হাতের সংবাদপত্র
সাংবাদিকের হাতের ক্যামেরা….

কেড়ে নিতে নিতে ওরা শুধু হাসবে। আর আমরা
যারা সুখিয়া রবিদাস-এর জন্য নিভৃতে কেঁদেছিলাম
তারা ঠাঁই খুঁজবো অন্য কোনও পাহাড়ে,
অন্য কোনও দিনকে নিজেদের জন্মদিন ভেবে ওড়াবো
ধূসর পাতার উড়োজাহাজ। দেশান্তরি না হয়েও
যারা মৃতের মত বেঁচে থাকে,
পড়বো তাদের প্রথম জানাজা।

ঘর কিংবা মাটির মমত্ব

কতদূর পরিণত ঘর, কতদূর নীল হাড়ের অস্তিত্ব
তা খুঁজতে খুঁজতে একদিন মধ্যযৌবনের মুখোমুখি
দাঁড়াই। দেখি একটি কালোচিল গলা বাড়িয়ে দেখছে
আমাকে। দেখছে বনের ভেতরের হলুদ ফুল— আর
তরুলতাকে জড়িয়ে ধরা মাটির মমত্ব। মাঝে মাঝে
চোখ ঘুরিয়ে দেখছে— বহুদিন পর এই লোকালয়ে
বৈশাখি ঝড় কীভাবে তছনছ করে দিয়েছে সকাল।
কতদূর সুর্যের ঝিলিক, কতদূর প্রেমের রোদগোলাপ
সেই চুম্বনদৃশ্যের অঙ্কন খুঁজতে খুঁজতে আমি যখন
প্রমত্ত পদ্মার তীরে ফিরি— দেখি, কয়েকটি সম্মিলিত
বিরহের ভাঁজচন্দ্র তাকিয়ে আছে বোকার মতো, ঠিক
আমাদের দিকেই। আমরা ভুলে যাচ্ছি হাত ধরাধরি।

জর্জ ফ্লয়েড

ভারোত্তোলনের গল্প শুনলেই আমাদের পাহাড়ের কথা
মনে পড়ে। যারা পর্বত কাঁধে নিয়ে ঘুরে-
তাদের কাছে আকাশকে খুবই তুচ্ছ মনে হয়।
তারা জানে, মানুষের রক্তের রং চিহ্নিত করেই
এই বিশ্বে একদিন উড়েছিল সাম্যবাদের পতাকা।

তারপরও সকলের ভোটের মূল্য সমান নয়-
জানতে জানতেই এই পৃথিবীতে বেড়ে উঠে শিশু,
শত চেষ্টা করেও রাজনীতিকরা বদলাতে পারেন না
গণমানুষের ভাগ্য,বদলাতে পারেন না শোষকের
কালো হাত।অথচ প্রতিটি সুস্থ মানুষের দু’টো হাত থাকে!

পাথর ভাঙবে বলে এরপরও মানুষ সাহসী হয়।
শিকল ভাঙবে বলে এরপরও মানুষ হাত উঁচু করে।
ভাঙনকে ঠেকাবে বলে মানুষ নির্মাণ করে বাঁধ।

সেই সাহসের প্রজ্ব্বলিত আকাশে বার বার
চাঁদ বদল হয়। বার বার বদল হয় সূর্য।
একজন জর্জ ফ্লয়েড ঠিক দাঁড়িয়ে থাকেন
চন্দ্র-সূর্যের মধ্যবৃত্তে।

জলস্তম্ভ ও জীবনেরা

আমরা নদীতীরে দাঁড়িয়ে যখন বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলাম,
তখন আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটি শান্ত বাঘ,
তার হলুদ-কালো গায়ের চামড়ায় ডুবেছিল দুপুরের রোদ
কয়েকজন রাখাল, বাঘটিকে চরাতে চেয়েছিল ধূসর মাঠে।

মাঝে মাঝে বন্যপ্রাণীরা তৃষ্ণার্ত হয়ে লোকালয়ে ছুটে আসে,
জীবনের জন্য নির্মিত জলস্তম্ভের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ওরা চায়,
সবুজ নিঃশ্বাস। মানুষেরা কার্বন-কোলাহলে,
বর্জ্যময় হ’তে হ’তে, ভুলে যায় প্রকৃতি ও প্রাণের ভারসাম্য।

মৃত ঘোড়ার মুখ দেখে

হর্সরেস শেষ হয়ে গেছে বেশ আগেই। যারা দেখতে এসেছিল ঘোড়দৌড়
তারা সবাই ফিরে গেছে নিজ নিজ গন্তব্যে। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি।
আমার নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য না থাকায়— পথ থেকে পথে দীর্ঘদিন বড়
সুখে বাজিয়েছি সানাই। উৎসব নয়, তবু আনন্দে নেচেছি নদীর মতো।
আর আকাশের সীমানা থেকে ধার নিয়ে কিছু ছায়া, সাজিয়েছি নিজের
চৌহদ্দি।খুঁটি ও খড়ম দেখে যে পুরুষ নির্ণয় করতেন নিজের নিশানা—
ঠিক তার মতোই পিছু হাত দিয়ে তাকিয়েছি তারাবিহীন রাতের দিকে।

এই ঘোড়দৌড়ে এসেও আমি দেখতে চাইনি হার-জিতের ক্ষুদ্রতালিকা।
তাকিয়েছি লাগাম ধরা সওয়ারের দিকে। যে তার নিজের গন্তব্য জানে না,
তার ললাট লিখন দেখে হেসেছি অনেক ক্ষণ। তৃষ্ণায় কাতর ঘোড়াটির
হ্রেষাধ্বনি শুনে ভেঙেছে আমার পাঁজর। তারপর দেখেছি মাঠের মধ্যখানেই
হঠাৎ থেমে গেছে ঘোড়টির বুকের স্পন্দন। ধরাধরি করে ওরা সরিয়ে
নিয়েছে লাল অশ্বদেহ। আর দূরে পড়ে আছে শতবর্ষের পুরনো লাগাম।

মৃত ঘোড়ার মুখ দেখে নিজেকেই পরাজিত মনে হয়েছে বার বার।যে দৌড়
আজ থেকে অর্ধশতক আগে আমি দিয়েছিলাম— সে দিনটি কি বুধবার ছিল !

যে পরাগ হাওয়ায় ওড়ে

তবুও বৃষ্টিভরসায় জাগবে মাটি
জাগবে কালের উত্থান-
আবার এই আকাশ ছুঁয়ে উড়ে যাবে পাখি দু’টি
আমরা দেখবো চেয়ে অন্য কোনো বাউল
বেহালা হাতে গেয়ে যাচ্ছে ফকির আরকুম শাহ’র গান…

মৌন গোলাপেরা ঘুমোচ্ছে অর্জিত স্মৃতিসমস্তের ভেতর
কে বানাচ্ছে ঘর, কে ভাঙছে পুরনো কাঠের দেয়াল,
কার মন আজ ভেসে ভেসে,
. প্রদক্ষিণ করছে এই মেঘের নগর।

আজীবন অপেক্ষায় থেকে একদিন গৌরবে,
যে পরাগ হাওয়ায় ওড়ে…
মানুষ তো চিরকালই প্রহরী থেকে যায়, প্রেমে
বিজলীঘেরা কালের শিকড়ে।