মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ-আমাদের এইসব দিনরাত্রি-৭ (এপার ওপার)

195347ID - Copy

মুখে বলিঃ গেলুম, খেলুম, এলুম, দেখলুম, গেলাম, আসলাম, খাইলাম, দেখলাম
খাইঃ ইলিশ মাছ, পুই ডাটা, চিংড়ী মাছের মালাই কারি, টেংড়া পুটি আর পাবদা মাছের ঝোল, খিচুরি আর ডিমভাজি
পরিধান করিঃ ধুতি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, শারি-ব্লাউজ
বই পড়িঃ সমরেশ, নিমাই, মানিক, জসিম উদ্দিন, জীবনানন্দ, হুমায়ুন, সুনীল, মিলন, খালিদ উমর।
কালপুরুষ, সাড়েচুয়াত্তর, চৌরঙ্গী, পদ্মা নদীর মাঝি, নক্ষত্রের গোধূলি।
ছড়া পড়িঃ আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা মামা বাড়ি যাই, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
গান গাইঃ এসো হে বৈশাখ, আকাশে হেলান দিয়ে পাহার ঘুমায় ওই, কফি হাউজের আড্ডা, একটা গান লিখ আমার জন্য, কারর ঐ লৌহ কপাট
ভাবনাঃ মা-বাবা, ভাই-বোন সংসার সুখের করতে হবে

এ ব্যাপারে আপনার ভাবনা কি?

শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ-আমাদের এইসব দিনরাত্রি-৮ (অফিস নাকি খিচুরি) —

6212958942_1da7f94202_b

আচ্ছা, ভাবতে পারেন, অফিসে যাবেন বলে বাড়ি থেকে বের হবেন এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। আহ! কতদিন পরে এমন রিমঝিম বৃষ্টি! এমন দিনে একটু রোমান্স না হলে কি হয়? তার সাথে দুপুরে খিচুরি আর ইলিশ ভাজা! কিন্তু অফিস! মাত্র সেদিন ছুটি নেয়া হয়েছে বলে আজও যে ছুটি নিবেন তেমন সাহসও নেই। ঘরে একটা ছাতি অবশ্য আছে কিন্তু তাতে এই বৃষ্টির একটা ফোটাও ঠেকাতে পারবে না আবার ওদিকে দুই এক ঘণ্টার মধ্যে এই বৃষ্টি থামবে তেমন কোন আশা নেই।
এই অবস্থায় কি করবেন? রোমান্স আর ইলিশ খিচুরি নাকি অফিস?

মমচিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৫

Cover Momo Chittey

টাকার নোট গুলি ঘড় ভরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলো। তার পিছনে কিউতে দাঁড়ানো পাকিস্তানি লোকেরা তামাশা দেখছিল। নিশাত স্থির থাকতে পারেনি, কাচের কাউন্টারের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটার মাথার চুল টেনে ধরে বলেছিল ‘কিউ নেহি যায়গা ইয়ে তেরা বাপকা রুপিয়া হায় কিয়া দিখা তেরা সরকারি হুকুম দিখা। পিছন থেকে এক পাঞ্জাবি লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো কিতনা রুপিয়া? যাদা নেই স্রেফ ৫০ রুপিয়া। শুনে সে কেরানীকে বলে বুঝিয়ে তারপর সে টাকা পাঠায়। সেই দিনই বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতা আমরা এখনো পাইনি। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে। মামার বাসায় ২/১ দিন থেকে তারা সোজা চলে এসেছিলো ঢাকা ছেড়ে মানিকগঞ্জের অদূরে ছয়য়ানি গালা নামের ছোট্ট এক গ্রামে। মামার গাড়িই তাদের মালামাল সহ বানিয়া জুরি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলো। বর্ষা কাল বলে গাড়ি আর যেতে পারেনি। সেখানে থেকে নৌকায় করে এসেছিলো গালা ইউনিয়নের ছয় আনি গালা গ্রামে। তখন মুক্তি যুদ্ধের তোলপাড়। নিশাত সেই পোস্ট অফিসের ক্ষত এখনো ভুলেনি। গ্রামে তার সমবয়সী চাচা, অন্যান্য চাচাত ভাইদের সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করে মুক্তি যুদ্ধে যাবার দিন তারিখ ঠিক ঠাক করে ফেললো। গোপন চুক্তি হলো। কে কে যাবে, কখন কোথা থেকে কি ভাবে যাত্রা শুরু হবে সব পরিকল্পনা অত্যন্ত চুপি চুপি করা হলো। কাক পক্ষীতেও টের পায়নি।
লুঙ্গী, গামছা, গুড় চিরা সব কিছুই বেধে রেডি। রাত ১২টায় চাচাতো ভাই শিহাব আরও কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে আসলে এক সাথে রওয়ানা হবে। রাত জেগে বসে রইলো, এক সময় মোরগে বাগ দিল, কাকের কা কা ডাক শুরু হলো, পাখীরা কিচির মিচির করতে করতে বাসা ছেড়ে রওয়ানা হলো, ঘড়ের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভোরের মৃদু আলো এসে ঢুকল কিন্তু শিহাব এলো না। তার বদলে এলো বাবা।
কি, মুক্তি যুদ্ধে যাওয়া হলো না?

বাবা টের পেলেন কি ভাবে? কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না! কি জানি কোথায় কোন ভুল করে ফেলেছি সব পরামর্শ ফাঁস হয়ে গেছে! বাবা বললেন
তুমি কখনো গ্রামে থাকনি, গ্রামের কাচা রাস্তায় খালি পায়ে হাটনি, গাছে উঠতে পারো না, সাতার জানো না তুমি মুক্তি যুদ্ধ করবে কি ভাবে, তার চেয়ে চল বিজয় নগরে সুশীল বাবুর কাছে নিয়ে যাই উনি অন্তত তোমাকে মুক্তি যোদ্ধা না হোক উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে তাদের সহকারী বানিয়ে দিবেন। এই দিয়েই মোটা মুটি দেশের কাজ করার সুযোগ পাবে।
যুদ্ধে যাওয়া হলো না বলে যতটা খারাপ লাগছিল নিজেকে যতটা নিঃস্ব মনে হচ্ছিলো, অকর্মণ্য মনে হচ্ছিলো বাবার কথা শুনে তা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলো। তখনই সুশীল বাবুর বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। পনের বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। এখানে এসে দেখে তার মত অনেকেই সেখানে উপস্থিত এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো শিহাবও ওখানে রয়েছে। শিহাবের সাথে চোখা চোখি হতেই একটা ষড়যন্ত্রের আভাস দেখতে পেলো ওর চোখে মুখে। ও! আচ্ছা, তাহলে তুমিই এই কাজ করেছ?

স্কুলে যেমন স্কাউটিংয়ের ক্লাস হোতো, সুশীল বাবুও সেই ভাবে তার হবু মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহকারীদের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে একটা রাইফেলের মত কি এক অস্ত্র নিয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। পাশে মেশিন গান রাইফেল এইগুলিও রয়েছে, পরে জেনেছে ওটার নাম স্টেন গান। বাবা আর সুশীল বাবু একই স্কুলে পড়তেন। বাবাকে দেখেই সুশীল বাবু থেমে গেলেন। এসো বাদশা, বাবার গ্রামের নাম বাদশা। বাবা নিশাতকে দেখিয়ে বললেন এই হলো আমার বড় ছেলে, একে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম কাজে লাগাবেন। ওর খুব ইচ্ছা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে। সুশীল বাবু খুশি হয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন এমন ছেলেই আমার দরকার, যাও বাবা ওই ওখানে বস বলে হাত দিয়ে তার সামনের ব্যাটেলিয়ন যে খেজুর পাতার মাদুরে বসেছে সে দিকে দেখিয়ে দিলেন, বাবাও এক পাশে বসলেন। সুশীল কাকা আবার শুরু করলেন। কি ভাবে শত্রু পক্ষের এলাকা পার হয়ে নিজ দলের কাছে পৌঁছান যায়, কি ভাবে শত্রুকে আক্রমণ করতে হয়, নিজেকে রক্ষা করা, অস্ত্র রক্ষা করার নানা খুঁটিনাটি কৌশল তিনি বলে যাচ্ছেন। এই ভাবেই বেশ কয়েকদিন গেল। ভোরে আজানের পর থেকেই শুরু হয় আর বেলা একটু উপরে উঠলে যখন মানুষের চলা ফেরা শুরু হয় তখন শেষ হয়।

নিশাতের সারা দিন কাটে এ গ্রামে ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে, সুযোগ পেলেই শিহাবদের বাড়ি। ওই বাড়িতে কি যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাধা কি একটা আকর্ষণ আছে যা এখনো বুঝে উঠেনি। এদিকে শিহাবও ওর ঘনিষ্ঠ জনদের মধ্যে এক জন। ওই ঘটনার পর থেকে শিহাবের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। একটু দূরে দূরেই থাকে। বুঝতে পেরে শিহাবই একদিন এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে বলল দেখ তুই আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে কাজ করতে পারবি না জেনে বুঝেই আমি মইন চাচার সাথে পরামর্শ করে চাচাকে বলে দিয়েছিলাম। আমাকে ভুল বুঝবি না, তার চেয়ে এটাই ভালো হয়েছে এখানেও আমরা সবাই এক সাথে থাকতে পারবো।
নিশাতদের একটা চার ব্যান্ডের ট্রানজিস্টার ছিল। সন্ধ্যা হলেই পাড়ার প্রায় সবাই এসে জমা হতো ওদের বাড়ি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য। নিশাত, শিহাব, মইন চাচা এরাও শুনত। বিশেষ করে চরম পত্র আর দেশাত্মবোধক গানগুলি।

দেশ স্বাধীন হবার আশা নিরাশার স্বপ্ন আর নানান আলাপ আলোচনার মাঝে দিনগুলি বৈশাখী ঝড়ের মত উত্তাল গতিতে ছুটে চলেছিল। সুশীল বাবুর দেয়া ট্রেনিং শেষ এখন তা কাজে লাগাবার পালা। এখন তার আদেশে সঙ্গী সাথিদের সাথে নিয়ে গোলা বারুদ, সংবাদ, রসদ ইত্যাদি পৌঁছানোর কাজ চলছিল। সুশীল বাবু নিশাতকে দূরে কোথাও পাঠাতেন না। তাই কাজ শেষ হতেই শিহাবদের বাড়ি। ওখানে না গেলে কি জানি কি একটা অপূর্ণ থেকে যায়, নানা ছল ছুতায় ও বাড়িতে যেতেই হয়। মূলত এই এখন থেকেই শিহাব আর যুঁইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা। ও বাড়ি গেলেই যুঁইয়ের লাগামহীন ইয়ার্কি ফাজলামি সত্যেও যেতে হয়। বেশি দূরে না, ওদের বাড়ি থেকে দেখা যায়। মাত্র কয়েক পা পথ। পথই যেন কেমন করে টেনে নিয়ে যায়, সারা দিন যেখানে যাই হোক দিনের শেষে এক বার অন্তত যেতেই হয়। গায়ের সবুজ প্রান্তর, খোলা আকাশ, খোলা বাতাস নিশাতকে কানে কানে বলে যায় কি হলো নিশাত আজ তুমি এখনো যাওনি! বেচারা নিশাত আর কি করে তাই যায়। কাউকে কিছু বলতেও পারে না। এই যে মইন চাচা এতো কাছের মানুষ কোথায় কি হচ্ছে কি করছে তার সব কিছু চাচার কাছে না বলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই সেই মইন চাচাকেও বলতে পারছে না। যা আছে তা শুধু তার একান্ত আপন মনেই আছে। কারো কাছেই তা প্রকাশ করতে পারছে না, কেমন একটা চাপা অস্থিরতা নিয়েই দিন গুলি চলে যাচ্ছে।

দিন কারো জন্যই থেমে থাকছে না। নিশাতের দিন গুলিও থেমে নেই, চলে যাচ্ছে। সুশীল বাবুর নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে এলাকার অনেক কিছুই চেনা হয়ে যাচ্ছে, অনেক লোক জনের সাথে আলাপ পরিচয় হচ্ছে। এই ভাবেই এক দিন দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তানিরা মিত্রবাহিনী ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করল। রেডিওতে খবর শুনে সবাই একে একে জড়ো হলো সুশীল বাবুর বাড়িতে। বিজয় পতাকা ওড়াতে হবে। আনন্দ হবে, উৎসব হবে, স্বাধীনতার উৎসব। বাসি স্বাধীনতার উৎসব নয়। স্বাধীনতা বার্ষিকী নয় একেবারে জীবন্ত স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীনতার উৎসব। এর কি কোন তুলনা আছে না কারো সাথে এর তুলনা করা চলে! কয়জনের ভাগ্যে এই উৎসব জোটে? এই দেশে আরও কত কোটি কোটি মানুষের জন্ম হবে কত কি হবে কিন্তু আজকের এই দিনের স্বাদ কজনে দেখবে? সুশীল বাবু নিশাতের হাতে এক টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন যাও ঝিটকা থেকে বাংলাদেশের পতাকা কিনে আন। কোন রকম টাকাটা হাতে নিয়েই দৌড়। দেড় মাইল পথ প্রায় দৌড়েই এলো। একটা মুহূর্ত নষ্ট করার উপায় নেই। উল্লাস কমে যাবে, আনন্দের গতি ধীর হয়ে যাবে। সুখের স্রোতে ভাটা পরে যাবে। পতাকা কিনেই তা বগল দাবা করে আবার দৌড়। বাজার থেকে বেড় হয়ে এসে পথে গ্রামের মেঠো পথের পাশে সবুজ গম খেতের গমের শীষে বেধে কখন যে পতাকাটা আটকে রয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি। বাড়ির কাছে এসে যখন দেখে বগলের পতাকা নেই, কি হলো? আবার উলটো দৌড়। বেশ খানিকটা পথ এসে দেখে গমের শীষের সাথে পতাকা ঝুলছে। নিয়ে আবার দৌড়। বাড়িতে এসে দেখে বিশাল আয়োজন। সমস্ত এলাকার মানুষ চলে এসেছে। সবুজের মাঝে রক্ত লাল আর তার মাঝে দেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা বাঁশের তৈরি মাস্তুলের মাথায় বেধে ওড়ানো হলো। হারমোনিয়াম তবলা রেডি ছিল, পাশে দাঁড়িয়ে সবাই স্বাধীন ভাবে, মনের উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে এক সুরে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইল। সে যে কি শান্তি, কি উল্লাস তা কি আর ভাষায় বলা যায়? সে শুধু অনুভূতি দিয়ে অনুভবের। জাতীয় সঙ্গীতের পর আরও দেশাত্মবোধক গান হলো। কে যেন কলতা বাজার থেকে মিষ্টি এনেছিল। গানের পরে মিষ্টি বিলানো হলো। সুশীল কাকার বাড়িতে খেজুরের গুড় দিয়ে ক্ষীর রান্না হয়েছিল কলাপাতায় করে সে ক্ষীর বিলানো হলো। হৈ চৈ শেষ করে গভীর রাতে শিহাব এবং মইন চাচার সাথে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। পথে আসতে আসতে ভাবছিল এমন দিনে নিরুকে এক নজর না দেখলে কি আর স্বাধীনতার সুখ পূর্ণ হয়? যে করেই হোক একবার যেতেই হবে। কি ছুতা ধরে এই এতো রাতে যাওয়া যায় তাই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল।

বেশি ভাবতে হলো না। বাড়ির কাছে আসতে শুনতে পেল ওই শিহাবদের বাড়ি থেকেই গানের সুর ভেসে আসছে। স্বাধীনতার উৎসবের ঢেউ এখানেও তোলপাড় হচ্ছে। জোসনা রাতে দুয়ারে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে তাতে বসে সব বোনেরা মিলে গাইছে। সবার মাঝে বসা নিরুর কণ্ঠটাই বেশি করে কানে বাজছে। যে গান শুনে বাঙ্গালির রক্তে উত্তাল স্রোত বেয়ে উঠেছিল, যে গান শুনে বাঙ্গালি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সেই সব গান। বোনেরা হাতে তালি বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছিল। নিশাতরাও এসে যোগ দিলো পাটির এক পাশে বসে। শিহাব তাড়া দিলো ‘এই এইভাবে শুধুই হট্টগোল করে গান গেয়ে কি উৎসব হয়, যা চা নিয়ে আয়। শুনেই নিরু মাঝখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই কয়েকটা কাপ, জগ ভরে চা আর তার সাথে এক গামলা গুর মুড়ি নিয়ে এলো এক এক করে। গুড় মুড়ি শেষ হলে আবার মেঘ বিহীন আকাশে বৃষ্টির মত সুরের ঝঙ্কার। চারিদিকে শীতের কুয়াশা ঢাকা মেঠো পথ বেয়ে সে ঝংকার ছড়িয়ে গেল দূরে অনেক দূরে। আজ যে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উল্লাস!
[চলবে]

শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ-আমাদের এইসব দিনরাত্রি-৬ (অফিস সিডিউল)

Crazy Boss Yelling at Employees
Crazy Boss Yelling at Employees

প্রাইভেট কোম্পানির মালিক বা অ-নে-ক বেতনের ঈমানদার, দক্ষ, কর্মঠ এবং উপযুক্ত কর্মচারিরা অ-নে-ক টাকা বেতন পেয়ে ভোরে উঠে অফিসের দেয়া গাড়ি হাকিয়ে অফিসে চলে যান আবার কোম্পানির উন্নতি করে করে রাতের ১২্টা বাজিয়ে সেই কোম্পানির দেয়া গাড়ি হাকিয়ে বাড়ি ফিরেই বিছানায় আছড়ে পরেন। তারা বাড়িতে সংসারের নানা কাজ যেমন বাজার করা, ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা নেয়া, বিদ্যুৎ বিল দেয়া এবং সাংসারিক কাজের জন্য নানা ধরনের কাজের মানুষ কিংবা পোষ্য রাখতে পারেন।

মূল কথা হলো তার সংসারের জন্য বা ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক জীবনের জন্য কোন ভাবনা নেই। অথচ ২০, ২৫, ৩০, বা ৪০ হাজার টাকার সহকারিদেরও তাদের সাথে ওই রাতের ১২টা পর্যন্ত আটকে রাখেন এদের কিন্তু সংসারের বাজার করা ইত্যাদির জন্য কোন লোক নেই সবই এদের নিজেকেই করতে হয়।

কোন কাজ নির্দিষ্ঠ সময়ে শুরু করা একটি প্রয়োজনীয় ব্যাপার আবার নির্ধারিত সময়ে শেষ করাও যোগ্যতার বিষয়। আমার মনে হয় যারা নির্দিষ্ঠ সময়ে কাজ শেষ করতে পারেন না, টেবিল গুছিয়ে না রেখে নানা রকম ফাইলপত্র কাগজ ইত্যাদি দিয়ে টেবিলে স্তুপ করেন তারা সবচেয়ে অযোগ্য। যদিও মালিক মনে মনে ভাবেন বাহ! আমার ধনু মিয়া কত কাজ ক–রে—রে!

মালিক অফিসে এসে কম্পিউটার খুলে দুই একটা মেইলের জবাব দিয়েই শুরু করে মোবাইলে বা সামনে বসে থাকা বন্ধুজন অথবা চাটুকারদের নিয়ে আড্ডা। সারাদিন আড্ডা সেরে বিকেল ৪ টায় শুরু করেন অফিসের কাজ। এর কারণ কি? সন্ধ্যার পর অফিসে আলো জ্বেলে অফিস করার মানে কি? আমার মনে হয় যাদের চুরি করার ধান্দা আছে তারাই কেবল রাতের অন্ধকারে অফিসে আলো জ্বেলে কাজ করে এবং কর্মচারিদের ধরে রাখে। মালিকের বা চামচা বড় বস এর বৌ-পোলাপান বাগি দিয়া আইছে কিন্তু কর্মচারিরা যে এই বৌ-সন্তানের মাঝেই শান্তি খুজে পেতে চায়, চায় জীবনের আলো! স্ত্রী সন্তান সারাদিন পথের দিকে চেয়ে থাকে কখন স্বামী বা বাবা আসবে!

কর্মচারিদের কি স্ত্রী-সন্তান নেই? তারা কেন ওদের অযোগ্যতা, খামখেয়ালী বা চুরির ভাগিদার হবে?

অফিসে রাতে বাতি জ্বালিয়ে কাজ করে কে?
১। যারা সময় মত নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে পারে না।
২। যার ঘরে শান্তি নেই অর্থাৎ সহজ কথায় স্ত্রীর সাথে বনিবনা নেই।
৩। যারা নিজের কাজ কি এটাই বুঝতে পারে না।
৪। যারা কাজের সময় আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে সময় নষ্ট করে।

এইসব উচ্চপদস্থ কর্মচারি বা মালিকদের ব্যাপারে আপনার কি মনে হয়?

মমচিত্তে নিতি নৃত্যে-[২৭]-৪

Cover Momo Chittey

মাস্কাট আউটার এঙ্কারেজে পৌঁছে ফরিদাকে খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হলো না। ফরিদার এক মাইলের মধ্যে ওদের দেয়া ইটিএ অনুযায়ী ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় নোঙ্গর করে রেডিওতে গ্রে বাহরাইনকে জানিয়ে দিল।
ব্রিজের টুকিটাকি কিছু গোছগাছ করতে করতে সকাল ছয়টা বেজে গেল। ব্যাস, এখনকার মত ওর ডিউটি শেষ। এবার নিজের রুমে গিয়ে পোশাক বদলে আবার গরম গোসল দিয়ে একটু আগে তারেকের বানানো বিরাট দুই স্যান্ডউইচ খেয়ে আর ক্ষুধা নেই বলে সরাসরি বিছানায়। এয়ারকন্ডিশন রুমে কম্বল গায়ে শোবার প্রায় সাথে সাথেই ঘুম।

ঘুম ভাঙল দুপুর একটায়। উঠে সবাইকে ফরিদার নিমন্ত্রণের কথা জানালো।
অরুণ’দা বলল সবাই কি আর যেতে পারবো জাহাজ নোঙ্গরে রয়েছে জাহাজে থাকবে কে?
শুনে তারেক বলল আপনারা সবাই যান আমি থাকবো। শফিক ভাইর সাথে আমার একটু দরকার ছিল তা রাতে রেডিওতে কথা বলে সেরে নিয়েছি।
আচ্ছা বেশ তাহলে তুমি থাক।
নিশাত আবার এই সব সামাজিকতা নিয়ে বেশ সতর্ক। দেশে সব আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখার কাজটা সে নিরলস ভাবে নিয়মিত করে যেত। এটা ওর কাছে একটা দায়িত্বের মত মনে হতো। কারো কোন নিমন্ত্রণে সময় মতো হাজির হতো, বলতো অবশ্যই যাবো। যাবো না কেন, সমাজে বাস করি না? আমরা সামাজিক জীব না? এক জন আরেক জনের কাছে না গেলে কি হয়? অবশ্যই যেতে হবে!

বিকেলে জাহাজের ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে নিলো। দুপুরে খাবারের পর শাহিনকে নিয়ে ওদের জাহাজে ইঞ্জিন চালিত রাবারের ডিঙ্গি পাম্প করে, ইঞ্জিনে তেল ভরে টেস্ট করে লাইফ জ্যাকেট, রেফট নিয়ে রেডি করে রেখেছিল। ক্রেন দিয়ে ডিঙ্গি নামিয়ে তাতে করে ফরিদায় এসে পৌঁছল। তারেক রেডিওতে বলে দিয়েছিল। কাছে এসে দেখে ওখানকার সবাই এসে জাহাজে ওঠার জন্য সিঁড়ি নামিয়ে জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইমরান, শফিক, হাবিব সবাই।
হাবিব এবার বল কি আয়োজন করেছিস।
আরে মাত্র এলি এখনি কি একটু ধৈর্য ধর দেখবি কি করেছি।
না তুই আগে বল, তুই তো জানিস আমার সমস্যা কোথায়, কত রিস্ক নিয়ে ডিঙ্গিতে করে এসেছি। শুধু তোদের ডিঙ্গি নেই বলে এসেছি না হলে কি আমাকে আনতে পারতি?
আরে বেকুব দেখ এই সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখ কোন কিনারা দেখা যায়?
নতুন করে আবার কি দেখতে বলছিস, আমি সাগরে বাস করি না কি আকাশে বাস করি?
আচ্ছা এখন বল এই কুল কিনারাহীন সাগরে সাতার জানলেই কি আর না জানলেই কি! তুই যদি সাতার জানতি তাহলে সাতরে কোথায় যেতে পারতি কোথায় গিয়ে উঠতি?
জ্ঞান দিয়ে ভুলাতে পারবি না, মাস্টারি করিস না বল কি করেছিস।
আরে পাগল এখনি কি এখন একটু ড্রিঙ্কস খা খাবার সময় হোক তখনই দেখবি।
না তুই বল।
তাহলে চল গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) চল, নিজেই দেখ।
সত্যিই গ্যালিতে গিয়ে দেখেত নিশাতের মাথা খারাপ হবার অবস্থা। চিংড়ি ভর্তা, শুঁটকির ঝুরি, রূপ চান্দা মাছ ভাজি, তাজা ম্যাকারেল মাছ ভুনা, মাংস ভুনা আর পাতলা ডাল।
রূপ চান্দা কোথায় পেলি?
বলিস না কুয়েত থেকে আসার পথে দেখি জেলেরা ফিশিং ট্র্যাপ ফেলে রেখেছে, জাহাজ কাছে নিয়ে ক্রেন দিয়ে সেই ট্র্যাপ উঠিয়ে দেখি বোঝাই মাছ। সব নিয়ে এসেছি। এই ম্যাকারেলও। অনেক মাছ ছিল। তোরা যাবার সময় কিছু নিয়ে যাবি।
নিশাত এবার একটু শান্ত হলো।
চল এবার সেলুনে চল।
কেক আর কোক খেতে খেতে হৈ চৈ। শাহিন মহসিনের নাচা নাচি, টেবিল ঠুকে তবলা বাজিয়ে গান সবই হলো।
চল এবার খেতে যাই।
হ্যাঁ যাবো তবে তারেক একা রয়েছে ওর জন্য আগে কিছু দিয়ে দে না হলে পরে মনে থাকবে না।
সত্যিই হাবিব কয়েকটা প্যাকেটে করে তারেকের জন্য এই সব অমূল্য খাবার আর ফ্রিজ খুলে দুই বালতি ভরা মাছ ওদের ডিঙ্গিতে নামিয়ে রেখে এলো। এবার সবাই খেতে বসল। ফরিদার বাঙ্গালি কুক চিটাগাংয়ের আব্দুল হাই, চমৎকার সব রান্না করেছে। নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার এক তরফা আড্ডা দিয়ে রাত নয়টায় জাহাজে ফিরে এলো।

২।
ফরিদা থেকে ফিরে এসেই কম্বল গায়ে বিছানায় শুয়ে পরেছে। রাত বারোটায় ডিউটি। যদিও নোঙ্গর করা অবস্থায় ডিউটি তেমন কিছু না শুধু কয়েকটা বিয়ারিং দেখা এবং রাডারে চোখ রাখা। নোঙ্গর পিছলে জাহাজ সরে যাচ্ছে কি না তাই লক্ষ রাখা। চা, কফি, জুস কোক যা খুশি যত খুশি খাও। ব্রিজে বসে যা খুশী কর কোন বাধা নেই শুধু নিদ্রা দেবীর আরাধনায় মগ্ন না হলেই হলো। সেই রকম শিক্ষাই দিয়েছে তাদের বিভিন্ন ক্যাপ্টেন। বলতেন ইউ আর গোইং টু বি এ কিং অফ এ স্মল কিংডম সো, ইউ স্যুড গ্রো দ্যাট ওয়ে, আই ডিজায়ার দিস। ইওর এটিচুড, ইওর ম্যানার স্যুড বি লাইক দ্যাট, ইউ স্যুড নট বি এন অর্ডিনারি ম্যান ইউ স্যুড বি এ পারফেক্ট জ্যান্টল ম্যান, দিস ইস মাই ড্রিম। ঠিক এই রকম কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থেকে নিশাত হয়ে উঠেছে একজন আদর্শ মানুষ।

অথচ সে সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘড়ের ছেলে। জন্ম নানা বাড়ি ঢাকা শহরের অদূরে। বাবা মার প্রথম সন্তান হিসেবে বেশ আদর যত্নেই বেড়ে উঠেছে। ছোট বেলা থেকেই সৌখিন জীবন যাপন তার পছন্দ। তবে বাবার সাধ্য সীমার বাইরে কখনো কিছু দাবী করেনি। পোশাক আসাক যাই ছিল তা চকচকে ইস্ত্রি করা ছাড়া কোন পোশাক তাকে কেও কখনো পড়তে দেখেনি। পায়ের জুতা জোড়াও সবসময় চকচক করতো। সেই ছোট বেলায় যখন সে মাত্র থ্রিতে পড়তো তখন থেকেই নিজের কাপর কয়লার ইস্ত্রিতে পাখা দিয়ে বাতাস করে কয়লা জ্বালিয়ে ইস্ত্রি করে পড়তো। নিজের জিনিষ পত্র ঘড় দরজা নিজেই গুছিয়ে পরিষ্কার করে রাখতো। নিজের স্কুলের কাপর চোপর ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে গুছিয়ে রাখতো, সাথে বাবা মার কাপরও ইস্ত্রি করে দিত মাঝে মাঝে। তবে জুতা পালিশের ব্যাপারে তার একটা খুঁতখুঁতানি ভাব থেকেই যেত। এই কাজটাতে সে কখনোই তৃপ্তি পেত না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে জুতা পালিশ ওয়ালাদের দেখত কেমন করে তারা জুতা পালিশ করছে। আবার বাড়ির কাছের লন্ড্রির সামনে দাড়িয়েও দেখত তারা কোন কাপর কি ভাবে ইস্ত্রি করছে। বাসায় এসে সেই ভাবে চেষ্টা করতো। এভাবেই অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলো। কুলি মজুর, ঠ্যালা গাড়ি ওয়ালা, কাঠ মিস্ত্রী, আকাশ, বাতাস, নীল প্রশান্ত সাগর, মাটির ধরণী, কারো কাছ থেকে শেখার কিছু বাকী রাখেনি। ওর বিশাল কৌতূহলী মন যার কাছে যা পেত তাই ধরে রাখত। মা যখন সেলাই মেশিন নিয়ে বসতেন তখন তার কাছে বসে দেখত মা কি ভাবে কেঁচি দিয়ে কাপর গুলি কেটে তা আবার সেলাই করে কি সুন্দর জামা পাজামা বানিয়ে ফেলছে। ওর অবাক চোখ শুধু বিস্মিত হত।

সব কাজের লোকদের বেশ সমীহ করে চলতো, কখনো কাউকে ছোট ভাবতে পারতো না। এরা কি সুন্দর করে সব কিছু বানিয়ে ফেলছে এই থেকে তাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা বোধ আসতো ওর মনে। সংসারের কাজ মা একাই করতেন বাসায় কোন কাজের মানুষ ছিল না তাই সবসময় মাকে এটা ওটা কাজে সাহায্য করত। আটা মাখা, ঘড় ঝাড়ু দেয়া, কাপর গুছিয়ে রাখা থেকে শুরু করে ছোট ভাই বোনদের কান্না থামানো এমনকি রান্নার কাজেও মাকে সাহায্য করতো। সার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে কিংবা কোথাও একটু সেলাই খুলে গেলে নিজেই ঠিক করে নিতো মাকে কখনো বলতো না। এই ভাবেই ধীরে ধীরে কখন যেন সংসার নামের বিশাল নাট্য মঞ্চের সকল কুশীলবের অভিনয় তার মুখস্থ হয়ে গেছে তা সেও বুঝতে পারেনি। মা শেখাতেন কি ভাবে বাজার থেকে তাজা সবজী চিনে কিনতে হয়, কি ভাবে তাজা মাছ চেনা যায়, বাসায় নতুন অচেনা কোন অতিথি এলে তার পরিচয় কিভাবে জানতে হয়, কি ভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়, কোথায় কখন কি খেতে হয় কি খেতে হয় না। সব কিছু।

বাবা মাসের প্রথমে বেতন পেয়ে বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাজারে যাবার সময় নিশাতকে সাথে নিয়ে যেতেন। সেদিন সকাল থেকে মাকে দেখত তেলের বোতল, বাজারের ব্যাগ ধুয়ে মুছে শুকিয়ে রাখতে, বাজারের লিস্ট করতে আর তাই দেখে নিশাত বুঝতে পারতো আজ মাসের প্রথম, নিশ্চয়ই বাবা বাজারে যাবেন। বাবার সাথে বাজারে যেয়ে লক্ষ করতো বাবা কোন দোকান থেকে কি কিনছে, কি ভাবে দামাদামি করছে, কোন দোকানে কি জিনিষ পাওয়া যায়। বাজার শেষ করে সাইকেলের চার চাকার ঠ্যালা গাড়িতে মালামাল উঠিয়ে দিয়ে বাসার ঠিকানা দিয়ে দিতেন গাড়ি ওয়ালাকে। সে বাসায় মাল পৌঁছে দিত। আর ওদিকে বাবা তাকে নিয়ে যেতেন মিষ্টির দোকানে। দেখ বাবা তোমার কি পছন্দ। নিশাত ঘুরে ঘুরে চানাচুর, ডাল ভাজা কিংবা বাদাম ভাজা দেখিয়ে দিত আর তাই দেখে বাবা রসিকতা করেই বলতেন তোমাকে নিয়ে এলাম মিষ্টি কিনতে আর তুমি এসব কি দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ মা তো মিষ্টি খায় না তাই মায়ের জন্য এগুলি নিবেন।
ও আচ্ছা আচ্ছা বেশ তাহলে বল তোমার জন্য কি নিবে?
একটা কিছু হলেই হবে।
মিষ্টি আর ঝাল কিছু নিয়ে বাবার হাত ধরে বাসায় এসেই মার হাতে ঠোঙ্গাটা দিয়ে দিত। বাবা সরকারি চাকরী করতেন কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায় পরায়ণ লোক, কোন অসদুপায় অবলম্বন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যা বেতন পেতেন সচ্ছল ভাবে না হোক মোটা মুটি ভাবেই চলে যেত, বিলাসিতা করা হয়ে উঠত না। এখনো নিশাতের পরিষ্কার মনে আছে যখন সে ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছিল তখন স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বাবার হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে একটা ইলেকট্রিক ইস্ত্রি কিনে আনার জন্য বলেছিল। বাবা তাই দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি এতো টাকা কোথায় পেলে? যাই হোক সেই দিনই বাবা সন্ধ্যায় দোকানে গিয়ে একটা ইস্ত্রি কিনে এনেছিলেন। নতুন চকচকে ইস্ত্রি পেয়ে নিশাতের আনন্দ দেখে কে, বারবার উলটে পালটে দেখছে। প্লাগে কানেকশন দিয়ে দেখে নিলো গরম হচ্ছে কি না। গরম হতে দেখে সে যে কি খুশী। সাথে সাথেই নিজের স্কুলের জামা প্যান্ট, বাবার জামা মায়ের শাড়ি সব ইস্ত্রি করে ফেললো।

পাকিস্তানের করাচী শহরেই এতদিন বড় হয়েছে। সবে মাত্র স্কুল ফাইনাল শেষ হবার পর পরই শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালীন জুলাই মাসে ওরা করাচীর সব ছেড়ে চলে এলো নিজ দেশে। ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার আগেই প্লেনের জানালা দিয়ে দেখতে পেল পাকিস্তানি আর্মিরা নানা রকম অস্ত্র হাতে এয়ারপোর্ট ঘিরে রেখেছে। দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল। বাবা মা যেতে দিক বা না দিক আমিতো অবশ্যই মুক্তি বাহিনীতে যাব, তখন দেখবি মজা। ব্যাটারা পরের দেশ দখল করে রেখেছ আবার অস্ত্র দেখাচ্ছ? এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখে মেঝ মামা দড়িয়ে আছেন। বাবা আগেই টেলিগ্রাম করে জানিয়ে রেখেছিলেন।
মামার গাড়িতে করে তার ধানমন্ডির বাসায় এলো। পথে বৃষ্টি ভেজা, কাদা মাখা চাপা রাস্তা, শেওলা ধরা দালান কোঠা দেখে মনটা দমে গেল। পরক্ষনেই আবার মনে জোড় ফিরে এলো যাই হোক এই হলো আমার নিজ দেশ। পরের চাকচিক্য দেখে ভুলে থাকলে চলবে না, নিজের যা আছে তাই নিয়েই মাথা উঁচু করে বাচতে হবে, এরই নাম জীবন, এরই নাম স্বাধীনতা। আবার মনে হলো এইতো যুদ্ধ শুরু হবার পর এখানে আসার মাস দুয়েক আগে বাবা দাদির জন্য কিছু টাকা পাঠাতে দিয়েছিলেন। করাচী শহরে তাদের স্থানীয় পোস্ট অফিসে গিয়ে টাকা সহ মানিঅর্ডার ফরমটা পোস্ট অফিসের কেরানির হাতে দেয়ার পর যখন সে দেখল ইস্ট পাকিস্তানে যাবে তখনই সে ফরমটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো মুখে বলেছিল ইস্ট পাকিস্তানমে রুপিয়া নেহি যায়গা, ভাগো ইহাছে।
[চলবে]

মমচিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৩

Cover Momo Chittey

আমাদের দেশের কেউ যদি এই ভাবে কোন দেশে পৌছাতে পারত তাহলে আমরাও আজ বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করে বেড়াতাম। কি জানি তারা কেউ কি এভাবে চিন্তা করেছিলো? মনে হয় না। কারণ ইতিহাস দেখলে দেখা যায় আমাদের দেশের কোন নাবিক টেন্ডল বা সারেঙ্গের উপরে যেতে পারেনি। তাদের কারো কি ক্যাপ্টেন হবার সাধ জাগেনি? জাগলে কি আর এমন হতো! নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়। হঠাৎ করেই ওর ভাবনার তার ছিড়ে যায়। এতক্ষণে কফি শেষ হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ খালি কফির কাপ স্ক্রিনের এক পাশে না নামিয়ে রেখে হাতেই ধরে বসে সামনে তাকিয়ে ভাবছিল।
ঘড়ির দিকে তাকাল, পরবর্তী পজিশন নেয়ার সময় হয়েছে। এবার উঠে এলো। রাডারের পর্দায় চেয়ে দেখে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে সামনের পাঁচ ডিগ্রি ডানে একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে আবার সময় দেখে চার্ট টেবিলের কাছে এসে পজিশন নিয়ে নিলো। জাহাজ কোন দিকে ড্রিফট করেনি। স্টিয়ারিং হুইলের সামনে জাইরো কম্পাসের মনিটরে তার নিজের হেড দেখে নিলো, জাহাজ কত ডিগ্রী কোর্সে চলছে। কোর্স ঠিক আছে। একটু পরে আবার রাডারের পর্দা। যে জাহাজ দেখা গিয়েছিল সেটা তাদের স্টার বোর্ড (ডান) সাইড দিয়ে পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে। আজকের মত ছয়টা বেজে গেল, আবার অরুণ এলো।

তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল, তার এই সময়ের মধ্যে জাহাজ তেমন কিছু ড্রিফট করেনি। শান্ত সাগরে ড্রিফট করবেই বা কেন তা ছাড়া তারেক ভালো স্টিয়ারিং করে। নিজের রুমে এসে পোশাক বদলে গোসল দিয়ে চলে গেল সোজা কিচেনের পাশে ডাইনিং রুমে। খেয়ে দেয়ে এসে কিছুক্ষণের জন্য সেলুনে বসল। সাগরের মাঝে কোন টিভি চ্যানেল পাবে না। জাহাজ চলছে, সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত নয়ত ঘুমে। সেলুনে দাবা, তাস বা সময় কাটাবার মত অনেক কিছুই আছে ওগুলি সে কোনটা পছন্দ করে না। কোন রকমে এক বোর্ড খেলেই আর দাবার চাল দিতে পারে না কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। ঘোড়া চালিয়ে দেয় সোজা কিংবা নৌকা চালায় ঘোড়ার মত আড়াই ঘর পাশে আর তাস দেখলেই মাথা ঘুরে।
প্রজেক্টরে একটা সিনেমা চালাল কিন্তু, বেশিক্ষণ বসা যাবে না নাইট নেভিগেশন আছে। চলন্ত জাহাজে ডিউটির সময় ঝিমানোর কোন উপায় নেই। তাড়াতাড়ি ঘুমুতে হবে। বিশ পঁচিশ মিনিট দেখে এসে শুয়ে পরল। কখন যে কি কি সব আজগুবি ভাবনা কোথা থেকে যে উড়ে এসে মাথায় ভিড় করে কে জানে। দিনের ভাবনার মধ্যে অনেকটাই নিরুর দখলে থাকে। তারপর আবার নতুন যোগ হয়েছে লাল পাড় নীল শাড়ি। মনে হচ্ছিল গভীর নীল সাগরের পাশ দিয়ে লাল স্রোতের একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই মেয়েটি, যার জন্য শাড়িটি কিনেছে তাকে এই শাড়িটা কি বলে দিবে? আদৌ কি দেয়া হবে তাই ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত পৌনে বারোটায় শাহিন এসে ডেকে দিল। জাহাজে এই নিয়ম। পরবর্তী ডিউটির লোকদের ঘুম থেকে ডেকে দেয়া। উঠে চোখ মুখ ধুয়ে ডিউটির পোশাক বদলে হাতে একটা সোয়েটার নিয়ে এলো। রাতের খোলা সাগরে শীত লাগতে পারে। তারেককে নিয়ে এক সাথে ব্রিজে এলো। ওদের দেখে অরুণ’দা হেসে ইয়ার্কি করে বলল গুড মর্নিং ক্যাপ্টেন নিশাত, ওরা দুই জনেই এক সাথে তার জবাবে বলল
গুড মর্নিং টু ইউ। ওকে স্যার- নাউ ইউ ক্যান গো টু বেড এন্ড হ্যাভ এ গুড ড্রিম।
অরুণ’দা নিশাতের সিনিয়র কিন্তু হাসি তামাশা ইয়ার্কি ফাজলামি সমানে চলে। তারেক এগিয়ে গেল মিজানের স্টিয়ারিং সিটের পাশে। মিজান চলে গেল তারেক ওর সিটে বসল স্টিয়ারিং হুইল ধরে।
নাও দেখ চার্ট দেখে নাও বলে অরুণ’দা চার্ট টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল ঘণ্টা খানিক পর কোর্স চেঞ্জ করতে হবে।
চার্টে রুট প্ল্যান দেখে নিশাত বলল আচ্ছা ঠিক আছে। কোর্স কত চলছে?
বলেই কম্পাসের দিকে দেখে নিলো।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যেতে পারেন, নাকি একটু কফি খেয়ে যাবেন?
তুমি যা বল না! এখন যাবো ঘুমাতে আর তুমি বলছ কফি খেতে!
তাতে কি, সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখবেন জাহাজ মাস্কাটের আউটারে নোঙ্গর করে আছে। আচ্ছা গ্রে বাহরাইনকে কি আমাদের স্পেন ইটিএ (এস্টিমেটেড টাইম অফ এরাইভ্যাল) জানিয়েছেন?
হ্যাঁ, সে তো বাহরাইন থেকে ছাড়ার সময় বলেছিলাম।
ওরা তো জাহাজ না পৌঁছা পর্যন্ত অস্থির হয়ে থাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, একটা মজার ব্যাপার কি জানেন কাল আমার ডিউটিতে একবারও ডাকেনি।
এখনো আমি ডাকিনি ওরাই ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলো।
ইটিএ কত দিয়েছেন?
মাদ্রিদ ফেয়ার ওয়ে বয়া আগামী ১৮তারিখ ভোর সাড়ে পাঁচটা। নাও আর পণ্ডিতি করতে হবে না সময় মতো জাহাজ পৌঁছে দিও। আমি যেন উঠে দেখি জাহাজ নোঙ্গরে। এখন জাহাজ চালাও আর কফি খাও আমি চললাম বলেই ব্রিজ ছেড়ে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল।

নিশাত যথারীতি রাডার, জাহাজের হেড এর পজিশন, কোর্স সহ সব কিছু রুটিন চেক আপ করে ইলেকট্রিক জগে কফির পানি গরম দিল। কালো কফি। কাল কফির পোড়া পোড়া গন্ধটা নিশাতের দারুণ ভালো লাগে। সাথে সামান্য চিনি। মিষ্টি বেশি খায় না, ভালো লাগে না। রাতে চলন্ত জাহাজে ব্রিজের এই ডিউটিতে কালো কফি এক দারুণ জিনিস। কে যে এই কফি আবিষ্কার করেছিলো তাকে পেলে অন্তত একটু ধন্যবাদ জানান উচিত! কফি বানিয়ে এক কাপ তারেকের হাতে দিয়ে নিজে একটা নিয়ে আবার তার প্রিয় সেই স্টার বোর্ড সাইডের সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর বসল। এতক্ষণে ব্যস্ততার জন্য লক্ষ করেনি এখন চোখ পরল সামনের সাগরের দিগন্ত রেখা থেকে জেগে উঠছে বিরাট চাঁদ। চাঁদ থেকে চকচকে একটা রূপালী মেঠো পথের মত এসে পৌঁছেছে ওদের জাহাজের সামনে।
তারেক চাঁদটা দেখেছ?
তাই দেখছি।
কি সুন্দর তাই না?
হ্যাঁ।
ইস আমি যদি এখন এই পথ দিয়ে হেঁটে যেতে পারতাম!
মনে মনে এই পথ বেয়ে চলে গেল অনেক দূরে। হাতের কফির কাপে এখনো একটা চুমুকও দেয়া হয় নি। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কাপটা হাতেই ধরা রয়েছে। রাতের এই তারা ভরা খোলা আকাশের নিচে সাগর বুকে চাঁদ থেকে বয়ে আসা এমন পথে কার না একটু হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছা করে! নিশাতের কি দোষ? সে তো এমন দায়িত্ব জ্ঞান হীন না। সে যতই ভাবুক না কেন কাজের দিকে তার পুরো খেয়াল। সাগর যতই উত্তাল মাতাল হোক না কেন তার ডিউটির সময় জাহাজ এক আধ মাইলের বেশি ড্রিফট হবে না। লোড আনলোডের সময় তো পাইপ লাইন, পাম্প, প্রত্যেকটা ভাল্ব, জয়েন্ট লিক করছে কি না, টেম্পারেচার ঠিক আছে কি না, পাম্পিং প্রেসার ঠিক আছে কি না, কোন গ্রেডের তেল কোন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে, এক ট্যাঙ্কের তেল লিক করে ভিন্ন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে কি না সব তার নখ দর্পণে।
এক হাতে কফির কাপ আরেক হাতে টর্চ থাকবেই, তার বয়লার স্যুটের পকেটে আস্ত এক ওয়ার্কশপ। বার বার করে তার চোখ সব কিছুর উপর দিয়ে ঘুরছে। সে নিজে ঘুরছে ডেকের এ মাথা থেকে ও মাথা। কখনো কোন গাফিলতি বা অবহেলা বা অমনোযোগ নেই। সম্পূর্ণ দায়িত্ব সচেতন। তবে খোলা সাগরে ব্রিজে ডিউটির সময় কিংবা অবসর সময় কিংবা বহির্নোঙরে নোঙ্গর করে থাকার সময় যখন ডিউটি করে তখন তার বিস্মিত চোখ অবাক হয়ে বারবার নতুন সব দৃশ্য দেখে নেয় আর ভাবে বিধাতার কি অপূর্ব সৃষ্টি যা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা কত কঠিন!

এখন জাহাজ চলছে। এখন কোন অবস্থায় সাগর বুকে চাঁদের বিছান পথে কোন ভাবেই বেড়ানো চলবে না। আবার জাহাজে ফিরে এলো। কাপে চুমুক দিয়ে দেখে ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেছে। উঠে এসে আবার পানি গরম দিল, তারেককে জিজ্ঞেস করলো আর এক কাপ চলবে কিনা।
নিশাত ভাই আমি এখন আর না।
আচ্ছা বলে সে নিজে এক কাপ নিয়ে এবার ব্রিজের ভিতরে বসল। বাইরে ঠাণ্ডা লাগছে। বসে তারেকের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ। কখনো নিজ দেশের আবহাওয়া, রাজনীতি, দেশি খাবার, প্রেম ইত্যাদি। হঠাৎ করেই একেক প্রসঙ্গ আসে আবার তা হঠাৎ করেই মিলিয়ে যায়।
দেখলাম কাল তোমার চিঠি এসেছে তা বাড়ির কি খবর?
না নিশাত ভাই তেমন কোন বিশেষ খবর নেই, এই কেমন আছ, আমরা ভালো আছি এই সব যা গতানুগতিক তাই।
হ্যাঁ তাইতো হবে, তুমি আর কি চাও?
কেন এর বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না তাই আর কি। আচ্ছা নিশাত ভাই, ফরিদাকে (একটা জাহাজের নাম) একটু ডেকে দেখেন তো পান কিনা, শুনলাম ওরা নাকি মাস্কাটে আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আপনি যখন বাইরে ছিলেন তখন আমি শুনেছি ওরা গ্রে বাহরাইনের সাথে কথা বলছিল।
আচ্ছা দাঁড়াও এখনি ডাকছি।
বলে উঠে এসে রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকতে শুরু করলো
‘ফরিদা ফরিদা দিস ইস প্যাসিফিক ম্যারিনার কলিং’
সাগর বুকে ইথার এর মাধ্যমে হাবিবের কণ্ঠে ভেসে এলো ফরিদার জবাব
‘ইয়েস প্যাসিফিক দিস ইস ফরিদা প্লিজ কাম ডাউন টু চ্যানেল ১৯’
চ্যানেল পরিবর্তন করে ১৯ এ এসে আবার ডাকল ফরিদাকে। ওপাশ থেকে এলো হাবিবের কণ্ঠ,
কিরে নিশাত তোদের মাস্কাট ইটিএ আমি জানি তা তোরা কি শিডিউলে আছিস নাকি চেঞ্জ হবে?
না, উই আর ইন শিডিউল!
আচ্ছা তোরা এখান থেকে শুধু ফ্রেশ ওয়াটার নিবি নাকি বাঙ্কারও (জ্বালানি তেল) নিবি?
দুইটাই লাগবে, আজ সী খুবই শান্ত কাজেই আমরা একেবারে কাটায় কাটায় পৌছাতে পারবো, এইতো আর মাত্র ৩৫ মাইল দূরে আছে, মাস্কাটের লাইট দেখা যাচ্ছে। ওদিকে আবার অরুণ’দা বলে গেছে তাকে যেন সকালে ব্রিজে আসতে না হয় তার আগেই যেন আমি নোঙ্গর করে রাখি। তাছাড়া আমরা যে ইটিএ দেই তা সাধারণত মেইনটেইন করি, আমরা তোদের মত নাকি? মনে নেই ওই যে রাস্তানুরাহ থেকে ইটালি ফেরার পথে কি কাণ্ড করেছিলি?
না রে সে তো হঠাৎ একটা দুর্যোগের কারণেই হয়ে গিয়েছিল।
আচ্ছা শোন, মনির কি ফ্লাই করতে পেরেছে খবর পেয়েছিস?
হ্যাঁ ও এতো দিনে বাংলাদেশে পুরোন হয়ে গেছে।
যাক ভালো হয়েছে, আমার সাথে মানামাতে দেখা হয়েছিল।
হ্যাঁ বলেছে, ওরা যেদিন দুবাই আসছিল সেদিন আমরা কুয়েত থেকে এখানে আসছিলাম তখন আমার সাথে কথা হয়েছে।
তাহলে তোরা এখানে কত দিন যাবত আছিস?
এইতো আজ কয়েক দিন হবে, তোদের ও এখানে দেরি হবে আমাদের পরে তোরা বের হবি কাজেই তোরা সবাই আজ বিকেলে আসবি আমাদের জাহাজে।
সেতো আসব কিন্তু এত দেরি কেন?
এদের ফ্রেশ ওয়াটারে কি যেন সমস্যা তাই
এখানে আয় আলাপ হবে তখন সব জানবি, আসবিতো?
নিশাত আমতা আমতা করছে দেখে হাবিব বলে দিল ভয় করিস না লাইফ জ্যাকেট পরে আসবি আর এক্সট্রা রেফট নিয়ে আসবি।
আচ্ছা ঠিক আছে আসবো। তোরা কোথায় নোঙ্গর করেছিস?
আমরা একটু সাউথে আছি।
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে, আমি তোদের কাছাকাছি এঙ্কর ড্রপ করবো।
হ্যাঁ তাই করিস।
আচ্ছা শোন, তারেক মনে হয় শফিক ভাই এর সাথে কথা বলবে, উনি কি ডিউটিতে?
হ্যাঁ আছে দে ওকে।

নিশাত গিয়ে স্টিয়ারিং ধরে তারেককে কথা বলার জন্য পাঠিয়ে দিল। তারেকের কথা শেষ হলে বলল নিশাত ভাই আপনি আরও একটু থাকেন আমার ক্ষুধা লেগেছে কিছু খেয়ে আসছি।
শোন আমারও ক্ষুধা পাচ্ছে মনে হয় আমার জন্যও কিছু নিয়ে এসো।
কি খাবেন?
তুমি যা খাও তাই নিয়ে এসো।
কিছুক্ষণ পর তারেক গরম দুইটা স্যান্ডউইচ আর এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসে চার্ট টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল
দেন এবার আমার হাতে দেন আপনি খেয়ে নেন।
[চলবে]

মমচিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২

Cover Momo Chittey

কয়েকদিন পরেই নিশাত তাদের বাড়ির পাশেই পথের পাড়ে বিরাট এক লেবু গাছের নিচে বসে সমবয়সী মইন চাচার সাথে গল্প করছিলো এমন সময় ওরা কয়েক জন এক সাথে ওই পথেই স্কুলে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখে চোখ পরে গেল। কি কথা হলো কি না হলো কে জানে! ওর পথ চলা থেমে গেল। ইতিমধ্যে সাথের সঙ্গীরা সবাই কিছুটা এগিয়ে গেছে, চট করে প্রায় দৌড়ের মতই এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে মিশে গেল। জাহাজে চাকরীতে আসার আগে সামান্য কথা হয়েছে তারপরে প্রথম ভয়েজ করে দেশে ফেরার পর সে আলাপ কিছুটা গাড় হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সময় থেকে শুরু করে যতদিন দেশে ছিল ততদিন প্রতিদিন একবার হলেও দেখা হয়েছে দুইজনে একসাথে বেড়িয়েছে ছবি তুলেছে। সে ছবি নিশাতের কেবিনে সাজিয়ে রেখেছে এই এর জন্যই তাহলে নিয়ে নিই, নাকি? নিজেকেই প্রশ্ন করল! গায়ের রঙ ফর্সা, গোল ধরনের চেহারা, গালের ডানপাশের তিল আর থুতনির নিচের আঁচিলটা চোখে পরার মত, দীর্ঘ এক হারা গড়ন, চোখে পরার মত সুন্দরী বলা চলে। নীল জমিনে লাল পাড় শাড়ি মানাবে ভালো। কিন্তু!! না, কোন কিন্তু নয়! যে করেই হোক এ শাড়ি তাকে দিতেই হবে। যে যা বলে বলুক। গতবার কত কি কিনে দিতে চেয়েছে কিন্তু আপার ভয়ে লোকলজ্জার ভয়ে কিছুই নিতে চায়নি। প্রথম ভয়েজেও যা নিয়েছিল তার কিছুই নেয়নি। সেগুলি নিশাতের আলমারিতেই তোলা রয়েছে। যাক, যদি নাই নেয় তাহলে এটাও আলমারিতে তুলে রাখবে।
শেষ পর্যন্ত নিশাতই কিনে নিয়ে দোকান থেকে বেড় হয়ে দেখে মনির তখন বাইরে দাঁড়ানো।
কিরে, তোর হাতে এটা কি, কী কিনলি?
না, কিছু না।
চল, ওই দোকানে দেখি।
না রে মনির, আমার ভালো লাগছে না, আমি জাহাজে চলে যাব, তুই যা।
বলেই বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলো। পিছন থেকে মনির ডাকল কিন্তু সে ডাক নিশাতকে ফেরাতে পারলো না।

কিছু দূর গিয়ে বুঝতে পারলো ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। পাশের দোকান থেকে এক ক্যান ঠাণ্ডা আপেল জুস নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। কি হলো আজ? নিশাতের কিছুই ভালো লাগছে না। এই নিশাত পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, ছিপছিপে গড়নের কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ, সেই নিশাতের কি হলো আজ? সারাদিন বাইরে ঘুরবে, বাইরে খাবে এই মনে করেই তো বেড় হয়েছিলো। এখন তার সব কিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেছে কিছুই মনে করতে পারছে না।

এক হাতে শাড়ির প্যাকেট আর এক হাতে জুসের ক্যান, আর মন চলে গেছে সেই ঢাকা শহরে সোবহান বাগের বীণা আপার বাড়িতে যেখানে আছে নিরু নামের সেই মেয়েটি। ও কি এখন বই খাতা হাতে ক্লান্ত দেহে কলেজ থেকে রিকশায় চেপে বাড়ি ফিরছে, না কি আজ ক্লাস বন্ধ বলে আপার সাথে আপার ঘর সংসার সামলাচ্ছে? কি রঙের কামিজ পরেছে আজ, দেখতে কেমন লাগছে? এই শাড়িতে কি ওকে মানাবে? শাড়িটা দেবার সময় কি বলবে? এই সব ভাবনায় যখন সে হারিয়ে গেছে তখন একটা বাস এসে দাঁড়ালো। কোথাকার বাস কোথায় যাবে তা কিছু না দেখেই পকেট থেকে বাস ভাড়া ২৫ ফিলস ভাংতি বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে টিকেট নিয়ে পিছনের একটা সিটে বসে পড়লো। বাস এসে দাঁড়ালো মোহাররেকে। নেমে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে খেজুর বাগানের মধ্যে গিয়ে বাগানের ছায়ায় বসে পড়লো।

বেশ গরম আজ, এপ্রিল মাস। এখনই এমন গরম জুন জুলাই মাসে কি হয় কে জানে! ওর পরনে লেভীস এর নীল জিনস, গায়ে হালকা আকাশ নীল টি শার্ট আর পায়ে ইতালির আরাম দায়ক জুতা তবুও ঘেমে ভিজে গেছে। বাগানের ছায়ায় কিছুক্ষণ বসে থেকে জুড়িয়ে নিলো। হাতের জুস তখন শেষ হয় নি। ঘাম শুকানোর পরে উঠে একটু হেঁটে সাগর পাড়ে একটা বড় পাথর পেয়ে তাতে বসে সাগরের দুর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। হাতের কাছে পাওয়া দুই একটা ঝিনুক কুড়িয়ে সাগরের পানিতে ছুড়ে দিল, আর একটা ঝিনুক নিয়ে উঠে গিয়ে বসল সাগরের ঢেউ যেখানে আসছে যাচ্ছে সেখানে।

বসে বসে ঝিনুক দিয়ে বালুকা বেলায় সেই মেয়েটির নাম লিখল। নিরু। তার বুকের ভিতরে যে নাম লিখা রয়েছে যা কেউ জানে না, শুধু সে একাই বয়ে বেড়াচ্ছে। একটু পরেই ঢেউ এসে সে নাম মুছে দিল। আবার লিখল আবার মুছে দিল। এই এক খেলা পেয়ে বসল নিশাতকে। নাম লিখছে আর ঢেউ এসে তা মুছে দিচ্ছে। মনে মনে হেমন্ত কুমারের গাওয়া সেই গান গুন গুন করছে “এই বালুকা বেলায় ……………” কত দিন থেকে ভাবছে এই নাম? না, মনে পরছে না। হয়ত সেই ছোট বেলায় যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেত আর ওকে দেখত চঞ্চলা হরিণীর মত দৌড়ে বেড়াতে। জাম গাছে উঠে জাম পেড়ে সবাইকে বিলাত নিশাতকেও দিতো। ওদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে কুয়ার পাড়ে একটা জাম গাছ ছিল, এখন নেই। পুকুর পাড়ের গাব গাছে উঠে পাকা টস টসে হলুদ গাব পেড়ে এনে নিশাতকে দিতো, আহা সেই গাবের সে কি ঘ্রাণ এখনো মনে আছে। বাড়ির পূর্ব পাশে ছিল ঈদগাহ, ওদেরই পূর্ব পুরুষদের ওয়কফ করা। ঈদগাহের উত্তর পাশেই একটা বিশাল বকুল গাছ ফুলে ফুলে একাকার হয়ে যেত আর তার গন্ধে পুরো এলাকাটাই বদলে যেত।

শহরে থাকা নিশাত বকুলের গন্ধ নেয়ার জন্য গাছের কাছে দাঁড়াত আর বাতাস তার কানে কানে বলত, শুধুই কি বকুলের গন্ধ নেবার জন্য এখানে এসেছ? একটু এগিয়ে দেখ আরও কিছু আছে। বালক নিশাত অনভ্যস্ত বন পথে পায়ে পায়ে ঝোপ ঝাড় ডিঙ্গিয়ে দেখতে পেল সেই মেয়েটি আপন মনে কুড়ানো বকুল ফুলের মালা গাঁথছে। কি করবে এই মালা দিয়ে? ভোর বেলা অনেকক্ষণ ধরে বালিকার মালা গাথা দেখল, সেই তখন থেকেই কিনা! কোন ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার পাতায় সে দিন তারিখের কথা লেখা নেই। ওই নাম নিশাতের বুকের ভিতর কোন এক গোপন ভল্টে লিখা হয়ে গিয়েছিল নিশাতের অজান্তে যা সে জানতেও পারেনি। এই নামটা যে কে লিখে রেখেছে তা কেউ জানে না। নিশাত নিজেও না। তখন শিহাব বা যুঁই কারো সাথে তেমন একটা ভাব জমে উঠেনি।

এই গোপন ভল্টের চাবি নিশাত ছাড়া কারো কাছেই নেই। যখন মনে হয় গোপন ভল্টের গোপন চাবি দিয়ে সে নিজেই শুধু খুলে দেখে সে সব স্মৃতি গুলি, বার বার, এ ভাবে ও ভাবে উলটে পালটে। আচ্ছা, নিরু কি জানে এই গোপন ভল্টের কথা? কেন জানে না, কেন? কখন যেন আবার ওই পাথরের উপর গিয়ে বসেছে। বসে বসে সূর্য ডোবা দেখল। উঠতে মন চাইছে না। সাগরের নোনা জলের কণায় আকাশ লাল হয়ে গেছে। দিনের আলো নিভে গেছে। দূর দিয়ে চলে যাওয়া জাহাজের নেভিগেশন বাতি দেখা যাচ্ছে, পিছনে ঘুরে দেখে শহরের আলোর ঝলকানি জ্বলে উঠেছে। এতক্ষণে মনে হলো ক্ষুধা লেগেছে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে এসে বাসে করে জাহাজে চলে এলো।

মনে একটা বিষণ্ণ ভাব নিয়ে নিশাত জাহাজে ফিরে এসে দেখে শাহিন, জয়নুল ওরা সবাই রাতের খাবার খেয়ে সেলুনে বসে টিভি দেখছে, এরামকো চ্যানেলে একটা ডকুমেন্টারি ছবি চলছে। ওর প্রিয় সিরিজ কিন্তু আজ কোন আগ্রহ নেই। সেলুনে উঁকি দিয়ে দেখেই ফিরে এলো নিজের রুমে। পিছন থেকে শাহিন ডাকল কিন্তু তার কোন জবাব দিল না। কাপড় বদলে গরম জলে ঝারা একটা গোসল দিয়ে খেয়ে দেয়ে এসে আবার বসল সেলুনে। এর মধ্যে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।
সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ওদের সাথে টিভি দেখল। জয়নুল বার বার জিজ্ঞেস করল কি কি করলে, কোথায় গেলে কিন্তু তার কোন জবাব নেই। ওরা আর চাপাচাপি করল না। জানে, নিশাত মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়, তখন হাজার ডাকাডাকি করেও ওকে ফেরান যায় না। আপন মনে বিভোর হয়ে থাকে। রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত টিভি দেখে উঠে এলো। বারোটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি। ডিউটির পোশাক পরতে হবে।

তার পরে ওরা বাহরাইনে তিন দিন ছিল এর মধ্যে আর কোথাও যায়নি। তৃতীয় রাতে সিতরা ট্যাংকার বার্থের আউটার এঙ্কারেজে এসে নোঙ্গর করলো। আধা ঘণ্টা পর পাইলট এসে জাহাজ জেটিতে নিয়ে গেল। এই জেটি কিনারা থেকে দশ মাইল সমুদ্রের দিকে। জেটিতে ভেরার পর ট্যাঙ্কে গ্যাস আছে কিনা বা পাইপ লাইনে কোন লিক আছে কি না, লিক করে সমুদ্রে তেল ভেসে যাবে কি না তা দেখার জন্য জেটি কর্তৃপক্ষের লোকজন এলো। তাদের সাথে হাই হ্যালো করে সাথে নিয়ে দেখাল। একটু পরেই আবার আসবে ইমিগ্রেশন, কাস্টমের লোকজন। তাদের অপেক্ষা। এই দেশে ওদের কোম্পানির রিজিওনাল হেড অফিস। তাছাড়া এখানে ওরা প্রায়ই আসে বলে কাস্টম ইমিগ্রেশন তেমন কোন ঝামেলা করে না। শুধু নিয়ম পালনের জন্য এসেই কাগজ পত্রে সই স্বাক্ষর করে চলে যায়। তবুও এই ফর্মালিটি গুলি শেষ না হলে জাহাজ লোড শুরু করতে পারে না। এক সময় সব কিছু হয়ে গেলে জাহাজ লোডিং শুরু হলো। লোডিং এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব ওর। ক্রুড ওয়েল লোড করে স্পেন নিয়ে যাবে। লোডিং এবং তার পরে মাপজোক হিসাব নিকাশ ইত্যাদি ফর্মালিটি সারতে সারতে সকাল দশটা বেজে গেল। এখন পাইলটের অপেক্ষা। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পাইলট এসে ওদের জাহাজ জেটি থেকে বের করে আউটার এঙ্কারেজে পৌঁছে দিয়ে নেমে পাইলট লঞ্চে করে চলে গেল আর ওরা যাত্রা শুরু করলো স্পেনের দিকে। কয়েক দিনের পথ।

জাহাজ চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পিছনে ফেলে আসা মুক্তা দ্বীপের দেশ বাহরাইন দিগন্ত রেখার সাথে মিশে গেল। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি, অথৈ নীল সাগরের বুক চিড়ে এগিয়ে চলছে। এই সময় সাধারণত সাগর কিছুটা উত্তাল থাকে কিন্তু আজ বেশ নীরব শান্ত। সাগর কি নিশাতের মনের কথা জানতে পেরেছে? পারার তো কথা, সেদিন বার বার করে সাগরের বালুকা বেলায় লিখা নাম মুছে দিচ্ছিল তখন কি আর পড়ে দেখেনি কার নাম মুছে দিচ্ছে! দুপুর বারোটা বেজে গেছে, নিশাত ব্রিজে এলো।
ব্রিজ হলো জাহাজের সব চেয়ে উঁচু অংশ যেখান থেকে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে নেভিগেশন সহায়ক নানা ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সাজান থাকে। হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও, ওয়ারলেস, ম্যাগনেটিক কম্পাস, জাইরো কম্পাস, স্টিয়ারিং ইন্ডিকেটর, ট্রিমিং ইন্ডিকেটর, ইকো সাউন্ডার, রাডার, থার্মোমিটার, হাইগ্রমিটার, আর থাকে লঙ্গিচুড ল্যাটিচুড মেপে জাহাজের অবস্থান দেখার জন্য ডেকা ন্যাভিগেটর, জিপিএস, নেভিগেশন লাইটের ইন্ডিকেটর, চার্ট(সামুদ্রিক ম্যাপ) ইত্যাদি নানা কিছু। জাহাজ চলন্ত অবস্থায় প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার পজিশন দেখে চার্টে চিহ্ন দিয়ে রাখতে হয়, এতে তার গতি সম্পর্কেও জানা হয়ে যায় এবং বিগত এক ঘণ্টায় কত দূর ক্রুজ করেছে এবং ডানে বা বামে কোন দিকে ড্রিফট করছে কি না তাও বোঝা যায়। ওদের জাহাজে ওরা পাঁচ জন বাঙ্গালি। ওদের সাথে আছে দুই জন ইরানি, পাঁচ জন ইন্দোনেশিয়ান এবং তিন জন ব্রিটিশ।

নিশাত ডিউটিতে এসে চিফ অফিসার অরুনের কাছ থেকে সব কিছু বুঝে নিলো। অভ্যাস মত এক বার রাডারের পর্দা দেখে নিলো, চার্টে এক নজর চোখ ঘুড়িয়ে আনল। রুটিন মাফিক যা যা দরকার সব দেখে দুই কাপ কাল কফি বানিয়ে তারেককে এক কাপ দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে ব্রিজের বাইরে সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর যেয়ে বসল। সব ঠিক আছে। আশে পাশে ৫০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে কোন জাহাজ নেই।
স্টিয়ারিং করছিলো তারেক। জাহাজে এসে নেভিগেশনের সাথে দায়িত্ব বোধ, কঠিন নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, মার্জিত আচরণ, পরিচ্ছন্নতা সব কিছুই শিক্ষা পেয়েছে স্কটিশ ক্যাপ্টেন আলস্টার ক্যাম্পবেল, নেভিগেশন বিশেষজ্ঞ সাবেক সাউদি নেভীর সিএনসি ইংলিশ ক্যাপ্টেন মার্টিন, সীম্যানশীপ বিশেষজ্ঞ ডাচ ক্যাপ্টেন হ্যাগওয়েল এর কাছে। অনেক কিছুই শিক্ষা পেয়েছে। সে এখন দক্ষ নাবিক, কদিন পরেই হবে এই রকম কোন এক জাহাজের কর্ণধার বা ক্যাপ্টেন। পরিচালনা করবে জাহাজের সার্বিক দায়িত্ব। বয়সে তরুণ, মনে রঙ্গিন স্বপ্ন। নিশাতের মনে আবার একটু ভিন্ন ধরনের স্বপ্ন।
সে ভাবে কি ভাবে মানুষের জন্য, দশের জন্য, দেশের জন্য কিছু করা যায় বড় কিছু। অনেক বড়। নিজের না হোক মানুষের মঙ্গল হবে এমন কিছু। ও ভাবে এক সময় এই পথে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা শুধু মাত্র একটা ড্রাই কম্পাস সম্বল করে আকাশের সূর্য তারা নক্ষত্র আর দিগন্ত রেখা দেখে অনুমান করে নিজের অবস্থান নিরূপণ করে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের উপর ভিত্তি করে পালের জাহাজ নিয়ে কি ভাবে এই সাগর পাড়ি দিয়েছে আজ আমরা জিপিএস ব্যবহার করেও হিম সিম খাচ্ছি। যে জিপিএস মাত্র তিন মিটার এদিক সেদিক হয়। এই বিশাল কুল কিনারা বিহীন সাগরের মধ্যে তিন মিটার এমন কিছু নয়। তবুও কেমন দিশা হারিয়ে ফেলি। অথচ ক্যাপ্টেন কুক কি ভাবে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছল, কলম্বাস কি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছল নিশাতের কাছে এ এক বিস্ময়!
[চলবে]

মমচিত্তে নিতি নৃত্যে-[২৭]-১

Cover Momo Chittey

১।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিশাতের মনে কেন যেন বেশ একটা চক চকে ঝরঝরে ভাব। ভীষণ ভাল লাগছে। কিন্তু, কি যে সে কারণ তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। বাইরে যাবে, নিজের খেয়াল মত ঘুরবে, বেড়াবে এই জন্য না কি বিশেষ কারো কথা মনে পরেছে! যাই হোক, সে কারণ খোঁজার কি এমন প্রয়োজন? মন ভালো আছে, ভালো লাগছে এইতো বেশ! আর কি আছে এই বিদেশে? মরুভূমির দেশে সাগরে ভেসে থেকে এর চেয়ে আর কি চাইতে পারে? এই যথেষ্ট। সকালের টুকিটাকি কিছু কাজ ছিল, সেগুলি সেরে চিফ অফিসারকে বলে জাহাজ থেকে নেমে গেল। আজ তার শোর লিভ। মানে, আজ তার ছুটি। সাগর ছেড়ে মাটিতে চলার অনুমতি। নোনা জলের সাগর ছেড়ে সে আজ সারা দিন মাটির উপর ঘুরে বেড়াবে। এরাবিয়ান গালফের ছোট্ট দ্বীপ বাহরাইনের মানামা শহর। এখানে তার ব্রিটিশ পতাকাবাহী ‘প্যাসিফিক মেরিনার’ তেল বাহি ট্যাংকার জাহাজ রুটিন মেইনটেন্যান্স এর জন্য এসেছে।

তিন দিন থাকবে, তারপর আবার চলে যাবে এশিয়া কিংবা ইউরোপের এ বন্দর ছেড়ে ও বন্দরে । ওরা কোন বন্দরে লোড বা আনলোড করার জন্য দুই তিন দিনের বেশি সময় পায় না। কোথাও আবার সাগর পাড় থেকে পাঁচ দশ মাইল দূর থেকেই লোড আনলোড করে চলে যেতে হয়। তখন দূরের শহরের বাতি নয়তো প্রায় আকাশের কাছে পৌঁছে যাওয়া দালান গুলি দেখে স্বপ্নের কোন দেশের মত মনে হয়। আজ নিশাতের মনে খুবই আনন্দ। সাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপ শহরে সারা দিন একা একা ঘুরে বেড়াবে। কখনো বাসে চেপে, কখনো ট্যাক্সিতে কিংবা পায়ে হেঁটে।

সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাঁকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় সাদা ফেনার লুকোচুরি নিশাতের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। আজ একটু ভিন্ন রকম। আজ সাগর ছেড়ে সে নেমে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। মাটির গন্ধ নেয়ার জন্য, মাটির ছোঁয়া পাবার জন্য।

জাহাজ থেকে নেমে হেঁটে ডকের বাইরে এসে পাশের স্টোর থেকে এক ক্যান ঠাণ্ডা জিঞ্জার এল কিনে মুখটা খুলে এক চুমুক দিয়ে ক্যান হাতে পাশের বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল।
হঠাৎ মন পরিবর্তন করল। না, আজ কোন বাস ট্যাক্সি নয়, আজ শুধু হাঁটবে। হাটতে হাটতে চলে এলো মানামা শহরে। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত এলো চেনা পাকিস্তানি সিঙ্গারার দোকানে। এখানে ১০০ ফিলসে কাগজের প্লেটে চারটা সিঙ্গারা আর তার সাথে চাটনি। সাধারণ আলুর সিঙ্গারা কিন্তু কি ভাবে বানায় কে জানে, ভীষণ মজা। আর তার সাথের চাটনিটা আরও বেশি মজার। বিশেষ করে এই চাটনির লোভটাই বেশি। বাহরাইনে এলেই এই সিঙ্গারা তার চাই। নিজে যেতে না পারলেও যেই যাক তাকেই বলে দেয় আমার জন্য সিঙ্গারা এনো। আরও একটু চাটনি চেয়ে নিলো। দোকানে কোন বসার জায়গা নেই, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে খেতে হয়, কোন পানিও নেই। আলাদা করে পানি বা সফট ড্রিঙ্ক যার যা পছন্দ তা কিনে নেয়, এ জন্য আলাদা ৫০ ফিলস। তার হাতে এখনো সেই জিঞ্জার এলের ক্যান রয়েছে। ক্যানটা দোকানের কাউন্টার টেবিলের উপর রেখে এক হাতে প্লেট ধরে আর এক হাতে খাচ্ছিল। সিঙ্গারা শেষ হলে হাতের খালি প্লেট বিনে ফেলে দিয়ে শেষ চুমুক দিয়ে ক্যানটাও বিনে ফেলে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো।

উদ্দেশ্য হীন ভাবে। কোন গন্তব্য নেই। মার্কেটে মানুষ গিজ গিজ করছে। প্রায় সবাই যার যার গাড়ি রেখে এসেছে শহরে ঢোকার আগে ওই সাগর পাড়ের পার্কিং এলাকায়। কেউ জোড়ায় জোড়ায়, কেউ তার মত একা। শিশু, কিশোর, তরুণ তরুণী, যুবক বৃদ্ধ, কালো, ককেশিয়ান, সাদা নানা রকমের নানা রঙের মানুষের ভিড়। আমাদের দেশের ছোট ছোট চায়ের দোকানের মত বাইরে সামিয়ানা টানান রয়েছে তার নিচে বয়স্ক লোকেরা টেবিলের চার পাশে বসে বিশাল কলকির হুক্কা টানছে আর গাওয়া (এক ধরনের কাল কফির মত) খাচ্ছে, হুক্কার নল এর হাত থেকে ওর হাতে বদল হচ্ছে। কেউ দোকানির সাথে দামাদামি করছে, কেউ কিনছে, আবার তার মত কেউ শুধু দেখছে।

সাজানো দোকান পাট তো রয়েছেই তার পাশে আমাদের দেশের ফুটপাতের মত ক্যানভাসের চাদর বিছিয়ে খোলা দোকানও আছে। বাচ্চাদের খেলনা, তৈরি পোশাক, ঘর সাজাবার নানা রকমের সৌখিন জিনিসপত্র, পারফিউম, আতর, মশলা রাখার সুন্দর রেকাবি, মোম দানি, নানা রকম কারু কাজ করা ছবি বাধানোর ফ্রেম, আরও কত কি। হঠাৎ তার চোখে পরল এই রকম এক খোলা দোকানের এক দোকানি মিসরিয় কারুকাজ করা ধুপ দানির মত একটা পাত্রে ছোট ছোট কাঠের টুকরোর মত কি যেন জ্বলন্ত কয়লার আগুনে ছেড়ে দিতেই ধোয়ার সাথে ভুর ভুর করে একটা মন মাতানো সুগন্ধ ভেসে এলো ওর নাকে। জাহাজ থেকে নামার সময় স্যেনেল ফাইভ স্প্রে করে এসেছে এ গন্ধ সে গন্ধকেও হার মানানো গন্ধ। মনে কৌতূহল হলো, এটা কী? জিজ্ঞেস করবে কিন্তু নিশাত আরবি তেমন জানে না। তার ছোট বেলা কেটেছে করাচী শহরে তাই উর্দু ভালোই জানে। তারপর আবার জাহাজে চাকরী করতে এসে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরতে গিয়ে ইংরেজিটাও ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে। কাজেই, কোথাও তেমন অসুবিধা হয় না। তবুও এগিয়ে গিয়ে আরবি যা জানে তাই আর উর্দু হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো।
ইয়েমেনি দোকানিও সেই ভাবে জবাব দিল।
কেন, আগে দেখনি? এগুলির নাম হলো আগর, বাংলাদেশ থেকে আসে। বিশাল একটা গাছ থেকে মাত্র চার বা পাঁচশ গ্রাম আগর বের হয় বলে খুব দামী জিনিষ।
কত দাম?
পাঁচ গ্রামের এই প্যাকেটের দাম দশ দিনার।

নিশাত ভেবে দেখল যাদের পকেটে এতো দিনার বা ডলার আছে, যাদের পকেটের দিনার বা ডলার দিয়ে ব্যাঙ্ক গুলি চলছে তারা ছাড়া এগুলি আর কে ব্যবহার করবে! তাদের ঘরের স্বপ্নিল আবেশ তৈরির জন্য কিংবা রাতের মোহময়তা বাড়াবার জন্য তারাই এগুলি জ্বালাতে পারে। আমার দেশেও এমন জিনিষ আছে যা আমার জানা ছিল না অথচ এই পেট্রো ডলারের দেশের ধনী লোকেরা তা ব্যবহার করছে! কি বিচিত্র এই পৃথিবী!
আগরের খবর জেনে খুশি মনে আবার চলল উইন্ডো শপিং করতে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আজকালের ব্যস্ত মানুষের জীবন সহজ করার জন্য কি কি আবিষ্কার করেছে! বাজারে কি কি নতুন জিনিষ এসেছে তাই দেখার জন্য। ইলেকট্রনিক্সের দোকান, নানা ধরনের যন্ত্রপাতির দোকান, তৈজস পত্রের দোকান দেখে বের হয়ে কাপড়ের দোকানে ঢোকার পথেই মনিরের সাথে দেখা। মনির নিশাতের সাথে নিশাতের ২য় ভয়েজে এক জাহাজে ছিল সেই থেকেই বন্ধুত্ব। এখন ও অন্য আর এক জাহাজে আছে, সেও শোর লিভ নিয়ে কেনা কাটা করার জন্য এসেছে।
কিরে নিশাত, কেমন আছিস?
ভালো, তোর কি খবর, ইস তোকে দেখে হিংসা হচ্ছে রে!
কেন, হিংসা কেন?
ভয়েজ শেষ করে দেশে যাচ্ছিস হিংসা হবে না?
তুইও তো আর কদিন পর যাচ্ছিস।
না, আমার দেরি হবে কারণ আমার রিলিভার না এলে আমাকে ছাড়বে না বলেছে, আবার ওদিকে চিটাগাংয়ের এজেন্ট রিলিভার পাচ্ছে না।
যাক আর কিছু দিন থাক, অসুবিধা কি তোর জন্যে কি আর কেউ পথ চেয়ে বসে আছে?
যাক বাদ দে ওসব, এখন বল কি করবি?
কিছু কেনা কাটার জন্য এসেছি।

তোরা না কাল দুবাই যাচ্ছিস তাহলে এখান থেকে কিনবি কেন, এখানে তো দাম বেশি।
না, দুবাই পৌঁছবো রাতে আর আমার ফ্লাইট সকালে, টিকেট করে ফেলেছে শুনেছি, তাই ওখানে সময় পাবো না। বেশি কিছু কেনার নেই শুধু ভাবীর জন্য একটা শাড়ি।
ও তাহলে চল।
না তোর সাথে এতো দিন পর দেখা হলো চল আগে কিছু খেয়ে নিই।
কি খাবি, আমি এই মাত্র সিঙ্গারা খেয়ে এসেছি।
হ্যাঁ আমিও ভেবেছি তুই বাহরাইন এসেছিস আর এখনো সিঙ্গারা খাসনি এ হয় কি করে?
চল তুই খেয়ে নে।
না থাক, ভাবীর শাড়িটা আগে কিনে নেই তার পর দেখবো।
বা হাতে এক দোকান দেখে, এই দোকানই তো।
দুজনে দোকানে ঢুকে এদিক ওদিক খুঁজে যেখানে শাড়ি রয়েছে সেখানে গেল। অনেক শাড়ি দেখল কিন্তু কোনটাই মনিরের পছন্দ হচ্ছে না।
দেখ নিশাত এই সব মেয়েলি কেনা কাটা আমার কাজ না, তুই একটা দেখে দে।
বারে, এ আবার কি ধরনের কথা বলছিস, আমি কি তোর ভাবীকে দেখেছি? যাকে দেখিনি তার জন্য কি পোশাক বাছাই করা যায়?
শেষ পর্যন্ত নিশাতকেই একটা বাছাই করে দিতে হলো।
লাল পাড় নীল শাড়ি।
পছন্দ হয়েছে তোর?
হ্যাঁ খুব!
তাহলে দেখ দাম কত। দোকানির সাথে দামাদামি ঠিক হলো। মনির পকেটে হাত দিয়েছে দিনার বের করবে। হঠাৎ পকেট থেকে হাত বেড় করে বলল,
নারে নিশাত ভাবীর এই শাড়ি পছন্দ হবে না, এটা নেয়া যাবে না।
কি হলো, আবার এ সিদ্ধান্ত কেন?
ভাবির নীল রঙ পছন্দ না।
তাহলে এ কথা আগে মনে করিসনি কেন, এখন দোকানি বলবে কি? আমি বলছি তুই এটা নিয়ে নে, পছন্দ না হলে দেশ থেকেই না হয় আর একটা কিনে দিবি আর এটা অন্য কাউকে দিবি। তাছাড়া বিদেশ থেকে মনে করে নিচ্ছিস এটা কি কম? আমার তো মনে হয় ভাবী এতো অবিবেচক না, উনি খুশিই হবেন। নিয়ে নে, নাহয় আর একটা দেখ।
না চল অন্য দোকানে যাই।

মনির তো বলেই হাঁটা শুরু করে দিল। নিশাত তা পারলো না। নিশাত পরে গেল এক সমস্যায়। এখন কি করে! তার শাড়ি পরার মত এক মা ছাড়া আর কেউ নেই। মার জন্য এই শাড়ি চলে না। বোন আছে এক জন কিন্তু, সে এখনো ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরার মত হয়ে উঠেনি। এদিকে দোকান থেকে বেড় হয়েও আসতে পারছে না। দোকানে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে যার কথা মনে হলো তাকে কি এই শাড়ি দেয়া যায়? কি ভাবে দিবে? কি বলে দিবে? যার সাথে আলাপ মাত্র শুরু হয়েছে এই তাকে কি করে এই শাড়ি দিবে? সে কি এই শাড়ি নিবে ওতো কিছুই নিতে চায় না!

গ্রামে যখন যেত তখন তাদের বাড়িতে ছিল নিশাতের বেশি যাতায়াত। ওর বড় চাচাত ভাই শিহাব আর বোন যুঁই ছিল নিশাতের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সুবাদে না কি যেন কোন সুবাদে ওই বাড়িতেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত। ও বাড়িতে গেলেই যুঁই ছোট বোনকে ডেকে বলতো দেখ কে এসেছে! তোর হবু বর এসেছে যা বরন কর গিয়ে! ছোট বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে যুঁই এর মুখে একটুও আটকাত না। যা মনে আসে তাই বলে ফেলে। নিশাতও তার প্রতিটি পা ফেলার শব্দ বুঝতে পারতো, আসে পাশেই আছে। নীরবে নিভৃতেই তা অনুভব করতো। কাউকে কখনো সে কথা বলতে পারেনি। ওর সাথে কথা যা হয়েছে তা শুধু চোখে চোখে। তবে নিশাত এখনো নারী চোখের ভাষা বোঝার মত জ্ঞানী হয়ে উঠে নি। বরাবরই সে একটু উদাসীন, ভাবুক প্রকৃতির। এক দিন সকাল থেকে ফিজিক্সের কি একটা কঠিন চ্যাপ্টার নিয়ে ওরা তিন জন মাথা ঘামাচ্ছিল, এর মধ্যে দুপুরের খাবার সময় বয়ে যাচ্ছে তাই যুঁই বলল এখন আর বাড়ি যাবি কেন চল এখানে খেয়ে নে। নিশাত রাজী হয়ে ওদের সাথেই খেতে বসে গেল। আর যেন কি কি ছিল মনে নেই তবে বাতাসি মাছ আর বেগুনের চচ্চড়ি মুখে দিয়েই বলল বাঃ চমৎকার হয়েছে। আর যায় কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে যুঁই বলে উঠলো, হবে না, রেঁধেছে কে জানিস? তোর বৌ রেঁধেছে! নে খা, খেয়ে অভ্যাস কর বলেই আর এক চামচ উঠিয়ে নিশাতের পাতে দিয়ে দিল।

লজ্জায় নিশাতের নাক কান যেন গরম হয়ে উঠলো। কেন বোকার মত এ কথা বলতে গেল ভেবে নিজেকে মনে মনে বকল। সেদিন আর কোন কথা না বলে চুপ চাপ খেয়ে বাড়ি চলে এসেছিলো।
[চলবে]

শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ-আমাদের এইসব দিনরাত্রি-৫ (Home delivery)

Home-delivery

একটা ভাবনা বেশ কয়েকদিন থেকেই মনে দোলা দিচ্ছে!
কখনও ভেবে দেখেছেন বাড়িতে রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া কত্ত ঝামেলার ব্যাপার! বাজার করা, তারপর সেগুলি বাজার থেকে বাড়িতে এনে জায়গামত তুলে রাখা, রান্নার আগে পানি খরচ করে ধুয়ে কাটিকুটি করা তারপর সবার শেষে এই গরমের মধ্যে গনগনে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে রান্না করা। কি মহাযজ্ঞরে বাবা!
এত ঝামেলার দরকার কেনরে ভাই?

খুব সহজে আজকালের সবকিছুর মত যেমন কমুনিটি হল, ইভেন্টস ম্যানেজমেন্ট টিম, অফিস পাড়ায় টেবিলে টেবিলে সময়মত খাবার পৌছে দেয়া বা এমনি কত কি প্রচলন শুরু হয়েছে কাজেই এত ঝামেলায় না গিয়ে হোটেল/রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে এনে খেলেইতো চলে যায়! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবারও দরকার কী? গিয়ে আনারও দরকার নেই, Home delivery ও আছে শুধু একটা ফোন করলেই ঘরে খাবার হাজির, তাই না? পিঠা খেতে ইচ্ছা করছে তাতেও সমস্যা নেই, পিঠা, পিজা, পান্তা ভাত, নানা রকম বাহারি ভর্তা কি না পাবেন? বাসন পেয়ালা ধোয়ার দরকার নেই, কাজের বুয়া রহিমার মায়ের পায়ে ধরারও দরকার নেই!

আপনি এ ব্যাপারে কি ভাবছেন?

9

** লেডিস ফার্স্ট **

LadiesFirst_logo_pink

টোনা এবং টুনির মাঝে গভীর প্রেম। কেও কাওকে ছাড়া থাকতে পারে না। এমনকি তারা এক সাথে থাকবে বলে একই কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে যাতে করে অন্তত কাজের সময় দুইজনকে খুব একটা বেশী সময় ধরে দূরে থাকতে না হয়।
একদিন তারা উভয়ে কাজ শেষ করে একটা পাব এ গিয়ে বসল অনেকদিন পরে দুই জনে এক সাথে একটু সুরা পান করবে।
টোনা জিজ্ঞেস করল তুমি কি খাবে?
একটু সাদা ওয়াইন হলেই হবে।

টোনা টুনির ইচ্ছা জেনে বার কাউন্টারে গিয়ে টুনির জন্য একটা সাদা ওয়াইন আর নিজের জন্য এক পাইন্ট লাগার নিয়ে এসে টুনির পাশে বসে ওয়াইনের গ্লাসটা টুনির দিকে এগিয়ে দিল।
চিয়ার্স করে একটু একটু চুমুক দিচ্ছে আর অতীত, ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে নানা রকম গল্প করছে আর গ্লাস ফুরিয়ে গেলে আবার বার এ গিয়ে নতুন করে গ্লাস ভরে আনছে। এভাবে অনেকক্ষণ ধরে অনেক পান করে সবারই মাথা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল।
টোনার সামান্য এক কথায় টুনি এমন রেগে গেল যে আত্মবিসর্জন দিবে বলে টোনাকে জানিয়ে দিল।
এতদিন ধরে আমরা একসাথে রয়েছি আর আজ তুমি আমাকে এই কথা বললে? আমি আর বেচে থাকতে চাই না। বলেই পাব ছেড়ে ঝরের মত বের হয়ে গেল।
তার পিছনে টোনা অসমাপ্ত গ্লাস ফেলে দৌড় দিল।

টুনি দৌড়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে তাতে উঠতে যাবে এমন সময় টোনাও টুনির সাথে ট্যাক্সিতে উঠেই বলল টুনি প্লিজ তুমি একা যেয়ো না দরকার হলে আমরা একসাথেই মরব।
এর মধ্যে টুনি ড্রাইভারকে বলল কাছের পাহারের নিচে যেতে, গন্তব্য শুনেই ড্রাইভার পাহারের দিকে ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ার এবং অবশেষে ফোর্থ গিয়ারে দিয়ে ফুল স্পীডে ছুটে চলল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহারের নিচে এসে উপস্থিত।
টুনি পার্স খুলে মিটার দেখে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দুর্বার গতিতে পাহার বেয়ে উপরে উঠছে আর তার পিছু পিছু টোনাও।

পাহারের চূড়ায় উঠে টোনা বলল চল আমরা একসাথে লাফ দেই!
না, পাব থেকে যেমন আমি আগে বের হয়েছি তেমনি আমি আগে লাফ দিব।
না না তা কি করে হয়? তার চেয়ে আমিই আগে লাফ দেই।
না, আমি আগে লাফ দেব।
না, তা হতেই পারে না, আমি বলছি চল আমরা এক সাথে হাত ধরে লাফ দেই।
অসম্ভব, আমার পক্ষে তোমার হাত ধরা আর সম্ভব নয়।
তাহলে ঠিক আছে, দেখ আমিই আগে লাফ দিচ্ছি কারণ আমি সত্যিই তোমাকে খুব ভালবাসি।
বলেই টোনা লাফ দিল আর অবধারিত ভাবে নিচে পরে গিয়ে মৃত্যুর সাথেই আলিঙ্গন করল। টুনি যেমন পাহারের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে টোনার মৃত্যুর দৃশ্য দেখে নিশ্চিত হয়ে আস্তে আস্তে পাহার থেকে নেমে বাসায় ফিরে গেল।

ঘটনাক্রমে ওই পাহার চূড়ায় এক দাঁড়কাক বিকেল বেলা হাওয়া খেতে এসেছিল এবং টোনা টুনির এই কথোপকথন এবং তাদের কার্যকলাপ সবই দেখছিল শুনছিল। তবে সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি যে, টোনাই আগে লাফ দিবে। দাঁড়কাক ভাবল এভাবে যদি টুনি টোনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তাহলে একটা কথা চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে যে, “লেডিস ফার্স্ট” তাহলে মহিলারা অত্যন্ত পুলকিত হবে এবং অন্তত তারা আর এভাবে কারো সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ পাবে না।

ইন্টারাপ্টার

IMG_1538

সত্যি কথাই বলছি। আমাকে কিন্তু আপনারা কেও চিনতে পারবেন না। আপনাদের সাথে আমার তেমন করে আলাপ পরিচয় হয়নি তবে আমার নানা ভাইয়াকে আপনারা ভাল করেই জানেন, তার সাথে আপনাদের বেশ সখ্যতা আছে আমি জানি। যখন তিনি ল্যাপটপ দিয়ে আপনাদের জন্য গল্প লেখেন আবার এখানে পোস্ট করেন তখন আমি কাছে এলেই তিনি তার যত রকমের বাধা দেয়ার কৌশল জানা আছে সবই করেন। আমাকেও যে ল্যাপটপে কাজ করতে দিতে হবে তা তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না। তিনি অবশ্য তার একটা ল্যাপটপ আমাকে দিয়েছেন কিন্তু এটার মনিটরে কোন আলোতো জ্বলেই না, কী বোর্ড বা মাউস প্যাডের সাথে কুস্তী করেও কিছু হয় না, পরে বুঝলাম ওটা তার বাতিল নষ্ট ল্যাপটপ।

তবুও কিছু কথা আপনাদের না জানালে আমি অস্বস্তি বোধ করছি, কথাগুলি আমার পেটের ভিতর শুধু টগবগ করে ফুটছে কিছুতেই আটকে থাকতে চাইছে না। আমিওতো আপনাদের সাথে পরিচিত হতে চাই, শব্দনীড়ের জন্য কিছু লিখতে চাই। আমার নানা আমাকে শোনান “ থাকবোনাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগতটাকে” কিন্তু যখনই আমি নানার সাথে ঘরের বাইরে যেতে চাই তখনই তিনি বিরক্ত হন। কোমরে ব্যথা, পায়ে ব্যথা এমনি নানা রকম অজুহাত দাড় করেন। তবুও কখনও বাইরে নিয়ে গেলে আমি যখন চারিদিকের নানা কিছু দেখে সব কিছু জানতে চাই তখনও তিনি বিরক্ত হন। এইতো সেদিন আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ির কাছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তখন শুনলাম রাস্তার মাঝের ম্যান হোল থেকে শব্দ আসছে। আমি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে জানতে চাইলাম এটা কিসের শব্দ? নানা ভাই আমাকে বুঝিয়ে দিলেন এটা ম্যান হোল, এখান দিয়ে প্রতিটি বাড়ির নোংড়া পানি সহ বৃষ্টির পানি নিষ্কাসিত হয়, একটু আগে যে বৃষ্টি হয়েছে সেই পানি যাচ্ছে বলে শব্দ হচ্ছে।

আবার ছাদে যেয়ে যখন টবে পানি দেয়ার বালতি হাতে পানির ট্যাংক এর কাছে যেতে চাইলাম তখন বাধা দিয়ে বললেন না না তোমাকে এ কাজ করতে হবে না। আচ্ছা ঠিক আছে করলাম না। তার পরে ছাদের একটা চেয়ার টেনে আম গাছটার নিচে নিতে চাইলাম তাতেও তার নিষেধাজ্ঞা, বলে কিনা “এই পণ্ডিত ওটা ধরবে না ব্যথা পাবে”। আচ্ছা বলতে পারেন এতসব বাধা বিপত্তি এড়িয়ে আমি কেমন করে সত্যিকারে পণ্ডিত হতে পারি?
সেদিন নানা ভাই ইনসুলিন নিচ্ছিলেন। আমি তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে তার কাছে গিয়ে মাত্রই ইনসুলিনের বাক্সটা ধরেছি আর ওমনি তিনি চ্যাচিয়ে আমার মাকে ডেকে বললেন ওকে ধর। কিন্তু আমিও নাছোড় বান্দা, না আমার হাতে ওই বাক্স দিতেই হবে, না তিনি তা দিলেন না। এর মধ্যে ইনসুলিন নিয়ে আমার হাতে তুলার টুকরা দিয়ে বললেন যাও এটা বিনে ফেলে দাও, যাক এতেই আমি খুশি কিন্তু তাকে ইনসুলিন দিতে না পারার একটু দু:খ মনের কোণে রয়েই গেল।

আর একদিন সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে যেতে চাইছিলাম তখন আমাকে দেখেই ভাইয়া দৌড়ে এসে বাধা দিলেন, বলে কিনা আমি নাকি পরে গিয়ে ব্যথা পাব! এমনি যখন যাই করতে চাই সব কিছুতেই আমাকে interrupt করেন। সেদিন দেখলাম মা রান্না ঘরে চুলা জ্বেলে কি যেন রান্না করছিল, মা তখন সিংকে কি ধোয়ার কাজে ব্যস্ত। ভাবলাম আমার একটু গরম পানি দরকার তাই আমার পানির ফিডারটা নিয়ে মাত্রই চুলার উপরে ধরতে গেছি আর অমনি ভাইয়া এসে আমাকে চিলের মত ছো দিয়ে নিয়ে এলো। জ্বলন্ত চুলার উপরে আমার ফিডারটা ধরতেই পারলাম না, মা পিছনে ঘুরে দেখে অবাক হয়ে আমার দিয়ে তাকিয়ে রইল।

নানা ভাই অফিস থেকে ফিরলেই আমি তার জুতা মুজা খুলে রাখার জায়গা দেখিয়ে আবার ঘরে স্যান্ডেল কোথায় আছে তাও দেখিয়ে দেই তারপরে তার কোলে উঠে হাতের ইশারায় গেট দেখিয়ে বলি আমাকে নিয়ে এখন একটু বাইরে চল।

কয়েকদিন আগে নানা ভাই পাশের রেজা ভাইয়ের দোকান থেকে মসুর ডাল, সাবান, চিনি এরও কত কি আনতে গেল সাথে আমাকে কোলে নিয়ে গেল, সবকিছু মিলিয়ে প্যাকেটটা অনেক বড় হয়ে গেল তাই আমি ভাবলাম অন্তত মসুর ডালের প্যাকেটটা আমার হাতে নিই নানা ভাইয়ের কোলে বসে মসুর ডালের প্যাকেট হাতে করে এনে নানুর হাতে দিলাম, আর নানু যে কী খুশি হলো তা আর বলার নয়। আমার যে সংসারের অনেক কাজ করতে ইচ্ছা হয়, মনে হয় আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকি। সারাদিন কি আর পড়াশুনা এবং খেলাধুলা করা যায়? যদিও নানা ভাইয়া আমাকে অনেক বই আর খেলনা কিনে দিয়েছেন। কিন্তু কিছু করতে গেলেই তিনি আমাকে ভীষণভাবে interrupt করেন তাহলে আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বাড়বে কেমন করে? আমার বয়স এখন দেড় বছর, এখন থেকেই যদি এই ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর সবকিছু এক এক করে শিখে না নেই তাহলে আমি সত্যিকারে শিক্ষিত হব কি করে? আমার নানা ভাই এ কথা কেন বুঝতে চায় না বুঝি না!

আপনারা একটু আমার নানা ভাইয়াকে বলে দিবেন তিনি যেন আমার ইন্টারাপ্টার না হন।
IMG_1562

তাহলে এবার আপনাদের সাথে পরিচয়ের পালাটা সেরে ফেলি, আমি রিজভান রিহান, আমার নানা ভাইয়া জনাব খালিদ উমর। ছবিতে আমি ছাদের উপর টবে পানি দিতে চাইছিলাম কিন্তু ভাইয়া আমাকে দিতে দেয়নি! এমনি করেই তিনি আমাকে সব কাজে বাধা দেন।

কর্মকাল

stock-vector-cartoon-father-scolding-unhappy-boy-isolated-267276749

আমাদের এই বেকারের দেশে নিজের ক্ষুধা নিবারণের জন্য, পরিবারের ভরন পোষণের জন্য, সাময়িক সুখের সন্ধানের জন্য লক্ষ লক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নেয়া বা এক কথায় বলা যায় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক যুবতী একটি কর্ম সংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। হ্যাঁ এ কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের অভাব রয়েছে বা কেহই এই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী নয়। তারচেয়ে অফিসে বসে কলম ঘষাঘষি করাতেই তৃপ্তি। হাতের কাজ? সেতো ভাবতেও ঘেন্না করে!

আবার আর এক দিকে যারা বিশেষ কোন ভাবে সে পিতার সম্পত্তির জোরে কিংবা আত্মীয়তার জোরে কিংবা চাটুকারিতার জোর যেভাবেই হোক কর্মক্ষেত্র তৈরি করে নিতে পেরেছে বা অন্যের কর্মক্ষেত্রে বস হয়ে বসেছে তারা নিজেরা না জুটিয়েছে শিক্ষা না পেয়েছে দীক্ষা। ভদ্রতা সভ্যতা বলতে কি বোঝায় তাই জানে না। কার সঙ্গে কি ভাবে কী কথা বলতে হয় জানে না তারা উপযুক্ত কাজের জন্য অপ্রাসঙ্গিক জনকে নিয়োগ দিয়ে কাজের বারোটা বাজিয়ে দেন। মালিক বা বস নিজেই জানে না এই কাজের জন্য উপযুক্ত কর্মী কে? তার কি যোগ্যতা প্রয়োজন। যেমন ডাক্তারকে নিয়োগ দিচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারের পদে, ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়োগ দিচ্ছে পরিবহন কাজের এস্টিমেট করার কাজে আবার প্রশাসনিক কাজ দেখার জন্য নিয়োগ দিচ্ছে হিসাব বিজ্ঞান পড়া লোককে। বিস্কুটের দোকানের ম্যানেজারকে নিয়োগ দিচ্ছে হিসাব দেখার জন্য আবার ট্রাক মালিকের সুপারভাইজারকে নিয়োগ দিচ্ছে জাহাজ পরিচালনার কাজে। এর ফলাফল কি হচ্ছে তা আমরা চারিদিকেই দেখতে পাচ্ছি।

একজনকে দিয়ে ৫ জনের কাজ আদায় করে নেয়া একটা যোগ্যতা এবং শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। মালিকের মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষে একজনকে দিয়ে যদি পাঁচ জনের কাজ আদায় করিয়ে নেয়া যায় মন্দ কি? আল্লাহত’আলা কাজকর্ম কিংবা জীবন ধারণ কিংবা খেয়ে পরে জীবন বাঁচাবার জন্য দিনকে নির্ধারণ করেছেন আর বিশ্রামের জন্য রাত। এই বিধান কি জন্য করেছেন? এমনিতেই ধীরে ধীরে মানুষের মন, মানসিকতা, বিবেক, ধৈর্য-সহ্য অর্থাৎ মানবিক গুণের পচন ধরছে। এগুলি দেখার মত বা উপযুক্ত বিচার করার মত ব্যবস্থা থাকলেও তা মানা হয় না। শ্রম দপ্তর নামে একটি দপ্তর নামে থাকলেও কাজে এর কোন অস্তিত্ব নেই সম্ভবত তাহারা সরকারি অর্থের সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত থাকেন।

যিনি কাজ করবেন তাকে দিয়ে কাজ করাতেই থাকবে, লাথি গুঁতা, চোটপাট সবই তার প্রাপ্য কিন্তু প্রমোদে মন ঢালিয়া অফিসে বসে facebook চালাইবেন বা you tube এ সিনেমা দেখিবেন তিনিই উত্তম এবং যোগ্য কর্মচারী বলে বিবেচিত হবেন, সবসময় বাহবা পাবেন, এমনটাই কি রীতি?
সরকার যখন তার কর্মচারীদের পে-স্কেল বাড়িয়ে দিচ্ছেন তার ফলে সারা দেশে সমস্ত কিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকার শুধুমাত্র ২০/২৫ লক্ষ মানুষের কথা ভেবে অস্থির অথচ বেসরকারি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে তাদের বেতন স্কেলের কথার কোনও উল্লেখ থাকে না তাহলে কি চাকুরীজীবী বলতে ওই সরকারি কর্মচারীদেরকেই বোঝায়? এমনিতেই বেসরকারি কর্মজীবীরা নিয়মিত ভাবে বেতন তো পায়ই না বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট তো দূরের কথা। ৫/৭ বছর চাকরি করেও ইনক্রিমেন্টের কোন দেখা নেই। তাহলে তারা সরকারি চাকুরেদের সাথে তাল মিলিয়া সংসার কি ভাবে ম্যানেজ করছে? এর জবাব কি কেও কোনদিন ভেবে দেখেছে না ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেছে?

কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করাটাও যেমন যোগ্যতা আবার সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারাটাও অযোগ্যতা এমন করে কি কেও ভাবেন? দিনে কাজ করবে রাতে বিশ্রাম নিবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু যারা সন্ধ্যার পর অফিসে বাতি জ্বালিয়ে কাজ করে তারা কারা? কেন করে এমন? টেবিলে ফাইল, কাগজপত্র এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে চিঠিপত্র নির্দিষ্ট ফাইলে না রেখে যেখানে খুশী সেখানে রেখে সময়মত খুঁজে না পাওয়াকে মালিক বা বস মনে করে এরাই ব্যস্ত মানুষ, এরাই ভাল কাজ করছে! ইহা কি যথেচ্ছাচারিতা নয়?

অফিসে রাতে বাতি জ্বালিয়ে কাজ করে কে?
১। যারা সময় মত নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে পারে না।
২। যার ঘরে শান্তি নেই অর্থাৎ সহজ কথায় স্ত্রীর সাথে বনিবনা নেই।
৩। যারা নিজের কাজ কি এটাই বুঝতে পারে না।
৪। যারা কাজের সময় আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে সময় নষ্ট করে।

সময়মত অফিসের কাজ শেষ করে সময়মত বাড়িতে ফিরে এসে নিজের পরিবারকে সময় দেয়া, তাদের সাথে সুখ দু:খের কিংবা কোন স্বপ্ন দেখা বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া, বাড়ির বাজার বা প্রয়োজনীয় কেনা কাটা করে, চিকিৎস্য করে, প্রয়োজনীয় ওষুধ-পথ্য কিনে এনে পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদের ভালবাসা স্নেহ-মমতা নিয়ে রাতে ভাবনা হীন একটা সুখ নিদ্রা দিয়ে ভোরে এক্কেবারে তরতাজা হয়ে উঠতে পারে তাহলে যে সে কতখানি কর্মশক্তি যোগাতে পারে তা কেন এই মহাপন্ডিত জন মালিক বা কথিত বস সম্প্রদায়ের রোবটগুলি বুঝতে পারে না সে প্রশ্নের জবাব কে দিতে পারে?

ডাক্তার

depositphotos_8033220-stock-illustration-cartoon-doctor-attending-a-young

ডাক্তার সাব, কনতো দেখি আমি এখন উপায় করি কি
খেতে মোটেই পারিনা যে মণ্ডা মিঠাই, নিমাই বাবুর ঘি।
বয়স আমার বাইশ, চুলেতে পাক ধরেছে ঘুম হয় না গাড়
পেটে ক্ষুধা চোখে ঘুম মাথায় পাকা চুল, দাঁতে বেজায় ধার।

একটু হা করুণ, জিহ্বা দেখি হাতটা কোথায় দেখতে হবে নাড়ী
নিজেই সব দেখি আমি, নার্স আর কম্পাউন্ডেরা বড্ড আনাড়ি।
ওরে হেকমত আলি, থাক কোথায় এস কাছে কর কিছু কাজ
রুগী এলো চেম্বারে তাই ইনকাম হবে মস্ত ভারী আজ।

ইলিশ কিনব এক জোড়া, ভাজি হবে আরও হবে দোপেয়াঁজি
গিন্নিকে বলব আরও করতে একটু সরষে ইলিশ পটল ভাজি।
ডাক্তার বাবু, এইতো আমি হেথায় আছি দরজারই পাশে
দরকার হলে ডাকবেন আমায় একটু জোরে কেশে।

আন দেখি থার্মোমিটার, টেথিস্কোপ আর একটা ছুরি
দেখব কেটে পেটের ভিতর হয়েছে কি বিশাল কোন ভুঁড়ি!
সাড়াশিটা দাওতো দেখি ফেলতে হবে দাঁত, দুই তিন চারি
হাতটা তুমি ধর কষে বাকী যা আছে সবই আমি পারি।

এই তল্লাটে সবাই বলে ডাক্তার আমি অতি সরস জুরি মেলা ভার
এসেছেন আপনি সঠিক জাগায় চিকিৎসা পাবেন অতি চমৎকার।
ওহে বাবু অসুখ আমার পেটে, চোখে, মাথার চুলে লাগবে কেন ছুরি
আমায় বুঝি কেটে কুটে মেরে ফেলার ছল করছেন, এটা কোন চাতুরী?

কোন একদিন

Flower Shapla (2)

শতেক বছর পরে দেশে গাও গেরাম আর থাকবে না
বৌ কথা কও সুরে পাখি সকাল সাঁঝে ডাকবে না।

বিজলী বাতি কেড়ে নিবে চাঁদের হাসি তারার মেলা
কলসী কাঁখে জল ভরিতে আসবে না আর পল্লী বালা,
মাটির প্রদীপ জ্বেলে কেহ পথ চেয়ে আর থাকবে না।

লতায় ঘেরা সবুজ বনে ছোট্ট পাখি হলদে ফুল
ঝিলের জলে শাপলা শালুক শান্ত দিঘী নদীর কূল,
থাকবে সবই এই দেশেতে চোখ মেলে কেও দেখবে না।

শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ-আমাদের এইসব দিনরাত্রি-৪ (ফ্ল্যাট বাড়ি)

A

আচ্ছা বলুনতো নাগরিক বসবাসে ফ্ল্যাট বন্দী জীবন আর গ্রামে বা শহরের নিজ বাড়িতে মুক্ত জীবনে কি কোন ব্যবধান আছে?
আপনি কি মনে করেন?

10856638523_561ee54f3d_b