মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

নক্ষত্রের গোধূলি-২৪

৩৬।
ওরা বের হয়ে কাছের যে টিউব স্টেশন সেটা ফিরোজের বাড়ি থেকে মাত্র দুই মিনিটের পথ, ওখানে যেয়ে ফিরোজের কথা মত দুইটা ডে টিকেট নিয়ে একটা টিউব ম্যাপ নিয়ে সেন্ট্রাল লাইনে চেপে বসল। ইস্ট একটন স্টেশনটা টিউব স্টেশন হলেও মাটির উপরে। তবে ট্রেন মিনিট তিন চারেক চলার পরেই সুরঙ্গের মত লাইনে ঢুকে পরে। ওখান থেকে স্টার্টফোর্ড স্টেশনে নেমে জুবিলী লাইন ধরে ক্যানিং টাউন স্টেশনে নেমে উপরে উঠে ভদ্র মহিলার কথামত পূর্ব দিকে কিছুটা যাবার পর ম্যাকডোনাল পার হয়ে চার মিনিট হেঁটে বাসা পেল।
-মনিরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো তুমি চিনলে কি ভাবে?
-তুমি তো হারিয়ে যাবার ভয়ে আমার সাথে আসতেই চাইছিলে না। এখন বল তোমাকে অযথা হাঁটিয়েছি?
-না।
-তাহলে আসতে চাওনি কেন? মনে নেই সেবার কলকাতায় কি করেছিলে? ওই যে চুরির দোকান থেকে ভিড়ের জন্য বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর তুমি আমাকে দোকানের ভিতর না দেখে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে এসেছিলে, মনে আছে?
-সেই কথা বলছ? ইস সেদিন যে আমি কি ভয় পেয়েছিলাম!
-তুমি ভাবলে কি করে তোমাকে ফেলে আমি চলে যাব? এত ভয় কিসের?

পথে যে স্টেশনেই থেমেছে বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন গড়নের, বিভিন্ন ভাষার মানুষ শুধু দৌড়াচ্ছে। কারো এক মুহূর্ত সময় নেই। এই বুঝি কি যেন চলে গেলো এমন ভাব। ট্রেনে উঠে সবাই যার যার মত হাতের ব্যাগ থেকে বের করে বই বা পত্রিকা পড়ছে। কারো অন্য দিকে তাকাবার মত সময় বা ইচ্ছা কোনটাই নেই প্রয়োজনও নেই অবাঞ্ছিত কৌতূহলও নেই।
-মনিরা জিজ্ঞেস করলো ওরা দৌড়াচ্ছে কেন?
-ওদের কাজ আর কাজ, একটা মুহূর্ত নষ্ট করার মত এতো সময় ওদের নেই তাই এমন করে দ্রুত হাঁটছে দৌড়াচ্ছে না। আশে পাশে কে কি করছে তা দেখার মত সময় বা ইচ্ছা কোনটাই ওদের নেই সবাই নিজের মাথা ব্যথা নিয়েই ব্যস্ত। দেখেছ, পুরুষ মহিলার মধ্যে কোন তফাত আছে? সবাই সমান তালে হাঁটছে। বাড়ি থেকে নাশতা করার সুযোগ বা সময় পায়নি তো কি হয়েছে, স্টেশনের দোকান থেকে স্যান্ডউইচ বা অন্য কিছুর সাথে একটা পানীয় কিনে খেতে খেতে হাঁটছে, কোথাও বসে খেতে গেলে সময়ে কুলাবে না। এটা তো আর আমাদের ঢাকা শহর নয়, এটা হচ্ছে লন্ডন মহা নগরী!

নক্ষত্রের গোধূলি-২৩

৩৫।
কথা বলতে বলতে ফিরোজের ছোট বোন সুইটি ভাইয়ের বন্ধু এসেছে তাই দেখা করতে এসেছে। এসেই সরাসরি বললো ভাবী, ভাই ভাবীকে নিয়ে আমার বাসায় চলো। রাশেদ সাহেবের কোন আপত্তি নেই। সুইটির গাড়িতেই চলে গেলো সবাই। রাশেদ সাহেব মনিরাকে খোঁচা দিয়ে কানে কানে বললো নিজের পয়সা খরচ করে বেড়ানোর চেয়ে চলো ঘুরেই আসি। সুইটি তার বাড়িতে এনে অনেকক্ষণ গল্প গুজব করে বিশাল আয়োজনের চা নাস্তা খাইয়ে আবার এনে দিয়ে গেলো। ওর বাড়িটাও সুন্দর।
পরদিন ফিরোজ কি একটা কাজে বাইরে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো
-আমার ফিরতে বিকেল হবে, আমি এসেই গ্লস্টার যাব এই ফাঁকে তোমরা ঘুরে আসতে পার। পাশের টিউব স্টেশন দেখেছ। এই নাও লন্ডনের ম্যাপ। টিউবের ম্যাপ স্টেশনেই পাবে, ওখান থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে নিও তাতে কোথায় কোন লাইন চেঞ্জ করতে হবে বুঝতে পারবে আর জোন এক দুইয়ের ডে টিকেট নিবে তাতে ভাড়া কম লাগবে, সারাদিন ভরে এক দুই নম্বর জোনে ঘুরতে পারবে।

ফিরোজ বের হয়ে যাবার পর কায়সার বেয়াইর কথা মনে হলো। সে যেখানে আসবে বলে ফোন নম্বর দিয়েছে সেখানে ফোন করলো। ফোন ধরল বাড়ির কর্ত্রী। রাশেদ সাহেব জানতে চাইল
-কায়সার সাহেব এসেছে কি না।
-ওপাশ থেকে জবাব এলো, উনি আজ সকালে এসেছেন।
কায়সার সাহেবকে খুঁজছে জেনে নিতান্ত কৌতূহল বসে ভদ্র মহিলা জানতে চাইল।
-ভাই আপনার বাড়ি কোথায়?
-মানিকগঞ্জ।
-তাই নাকি? আমাদের বাড়িও মানিকগঞ্জ।
এ কথা সে কথায় জানা গেলো মনিরা যে স্কুলে পড়েছে এই ভদ্র মহিলাও সেই স্কুলের ছাত্রী।
-ভাই তাহলে আমাদের এখানে আসবেন না?
বলেই তার বাড়ির ঠিকানা সহ কোন লাইনের টিউবে কি ভাবে যেতে হবে কোথায় নামতে হবে সব হর হর করে বলে দিল।
-আচ্ছা ঠিক আছে দেখি যদি পারি তাহলে আসব তবে আমাদের বিকেলের আগেই ফিরতে হবে, আমরা আবার গ্লস্টার যাবো।
-আপনারা আসুন আমি কায়সার ভাইকে বলে রাখছি।
-বলবেন আমরা বিকেলে গ্লস্টার যাবো উনি চিনে সে জায়গা, গত বৎসর বেয়াইনকে নিয়ে এসেছিলেন তখন গিয়েছিলেন।
-আচ্ছা বলবো, আপনারা এখনই চলে আসেন।
ফোন রেখে রাশেদ সাহেব মনিরাকে বললো চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। মনিরাকে চমকে দেয়ার জন্য আসল কথা চেপে গেলেন।
-না ভাবীকে ছাড়া আমি কোথাও যাব না, যেতে চাইলে তুমি একা যাও।
-আরে আমি তো থাকছি, তুমি চলে যাবে বলে একটু দেখে যাও, না হলে দেশে গিয়ে মেয়েদের বলবে কি?
ভাবী বললো-
-যান না ভাবী, ভাই কি আর আপনাকে হারিয়ে রেখে আসবে? বাব্বাহ যে টান! এই মানুষ কি আপনাকে বদলিয়ে বিলাতি মেম নিয়ে ফিরতে পারবে? তাহলে ভয় কিসে? যান ঘুরে আসেন। শুনেছি ভাই তো সারা জীবন প্রায় বিদেশেই কাটিয়েছে সে কি আর হারিয়ে যাবে? আপনি নিশ্চিন্তে যান। বিকেলে তো আমি যাচ্ছি, আমাকেই ড্রাইভ করতে হবে সারা পথ, আমার সাথে বের হলে ও ড্রাইভ করতে চায় না। আপনারা যান ঘুরে আসেন আমি রান্না বান্না দেখি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেন, বাইরে কিন্তু বেশ ঠাণ্ডা।

নক্ষত্রের গোধূলি-২২

৩৪।
আজ সারা দিন গল্প গুজব করেই কেটে গেলো। ইফতার করে সন্ধ্যার পর রাশেদ সাহেব মনিকে বললো ,
-আচ্ছা, ছোট ভাই বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক তার ওখানে যেতে নিষেধ করেছে, তাই বলে কি আমরা এতো দূর এসে ওদের না দেখে বিশেষ করে মেয়েটাকে না দেখা কি উচিত হবে?
-হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি। এদিকে ওদের নীরবতা আবার এতো দূর এসে না দেখা তারপর ওদের জন্য যা আনা হয়েছে সে গুলিও তো দিতে হবে, ব্যাপারটা কেমন হয়!
-আমার মনে হয় চলো যাই দেখি কি অবস্থা। তেমন মনে হলে এখানে আবার ফিরে আসব।
মনিরা জানতে চাইল -কত দূর?
-সে অনেক দূর। কোচ কিংবা ট্রেনে যেতে হবে। প্রায় তিন ঘণ্টার পথ।
-তুমি চিনে যেতে পারবে?
-কী যে বল, পারবো না কেন?
-গিয়ে যদি আবার ফিরে আসতে হয়, তাহলে এই শীতের মধ্যে! আমার মনে হয় যাবার আগে এক বার ফোন করে খোঁজ নিয়ে দেখ।
-না ফোনে নয়, একেবারে সশরীরে উপস্থিত হলে ব্যাপারটা অন্য রকম হবে না? দেখ চিন্তা করে।

রাতে ফিরোজের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ হলো। ফিরোজের একই কথা।
-কোথায় যেন থাকে?
-গ্লস্টারের কাছে।
-তুমি চিনে নিতে পারবে?
-হ্যাঁ, স্ট্রাউড পর্যন্ত গেলে ওখান থেকে আমি চিনতে পারব।
-তাহলে চলো, আমরাও ওদিকে যাইনি তোমাদের নিয়ে আমরাও ঘুরে আসি। তোমার ভাবী আবার লং ড্রাইভ পছন্দ করে।

নক্ষত্রের গোধূলি-২১

৩৩।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করলো
-এবার বল দেখি কি ব্যাপার, হঠাৎ করে চলে এলে, নাকি কোন কাজ আছে? কামরুলের কাছে শুনেছি তুমি তো ভাল চাকরি করতে তারপর আবার বিরাট ব্যবসা করছিলে।
-সে ব্যবসা আর নেই সব শেষ, সেই জন্যই তো আসা। একটা কাজকর্ম কিছু যোগাড় করে দাও। সম্ভব হলে দুজনকেই নয়তো অগত্যা আমার যা হোক একটা কিছু।
সব খুলে বললো । শুনে ফিরোজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো-
-এই ব্যাপার! আমি তো ভাবতেও পারছি না তোমার এমন হলো কি করে। যোগাযোগ বা দেখা না হলে কি হবে আমি তোমার সব খবরই জানি। তুমি মালেকের বোনকে বিয়ে করেছ এ ও জানি তবে তোমার এই শেষ দিকের কিছু জানার সুযোগ পাইনি।
একটু ভাবল।
-ঠিক আছে এই অবস্থায় এসেছ যখন কিছু একটা করতে হবেই। তবে শুধু তোমার জন্য, ভাবীর জন্য কোন অবস্থাতেই না। সে কিছু দিন বেড়িয়ে দেশে চলে যাক ওখানে তোমার মেয়েরা রয়েছে। যদিও তারা বড় হয়েছে তবুও তাদের মা কাছে থাকা দরকার। তুমি থাক।
এমন সময় শেফালি ভাবীর কাছে ড্রাইভিং শিখছে এমন এক ছাত্রী ফোন করে জানতে চাইল সে কখন যাবে। বাংলাদেশ থেকে মেহমান এসেছে বলে আজ যাবে না জানিয়ে দিল। ফিরোজও সেদিন কাজে গেলো না।
ফিরোজের মা এসে বললো যাও ওকে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আস।
তারাও এর মধ্যে মনিরার কাছে ওদের আসার উদ্দেশ্য সব শুনেছে।
-এসেছ কদিন বেড়িয়ে লন্ডন দেখে নাও, ভাবীকেও দেখিয়ে দাও তারপর দেখি কি করা যায়।
শুনে ওরা উভয়েই যেন হাতে স্বর্গ পেলো। মনিরা বললো-
-দেখেন ভাই যে করেই হোক ওর যেমন তেমন একটা কিছু না হলে যে আর কোন উপায় নেই।
-চিন্তা করবেন না কিছু একটা হয়ে যাবে, এখন চলেন একটু ঘুরে আসি। আপনার ভাবী আবার ফার্স্ট ক্লাস ড্রাইভার।
-হ্যাঁ সেতো কালই দেখলাম। তবে আজ না ভাই। শরীর এখনও টলমল করছে। কাল না হয় যাওয়া যাবে, আজ ঘরেই থাকি।

মনি তো বেড়াতে আসেনি। ওর মনে চলছে সেই ঝড় যে ঝড় তাদের এখানে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। তার পাগল আজ ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া, দেউলিয়া। কি করে ঋণ শোধ হবে, মেয়েদের মানুষ করবে, তার রাশেদ কি ভাবে একা এখানে থাকবে এই সব চিন্তায় সে জর্জরিত। তার এখন বেড়াবার মত মন নেই। এ কথা কি আর বলা যায়? এ যে তার একান্ত নিজের যন্ত্রণা। সুখ কারো সাথে ভাগ করে নেয়া যায় কিন্তু দুঃখ? সে তো একান্ত আপনার। সে ভাগ কাউকে দেয়া যায় না! আনন্দ করতে হয় সবাইকে নিয়ে, কাঁদতে হয় নীরবে, একা একা।

নক্ষত্রের গোধূলি-২০

৩১।
রাশেদ আর ফিরোজ একই স্কুলে পড়েছে। স্কুল ছাড়ার পর এই প্রথম দেখা। লন্ডন আসার দিন ঠিক হবার পর কামরুলের কাছ থেকে ফিরোজের ফোন নম্বর, মেইল ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করেছিলো। প্রায় ত্রিশ বছর পর দেখা। খেতে বসে আরও আলাপ হলো। শেফালি ভাবী একটা ড্রাইভিং স্কুল চালায়। মনিরা যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। মনিরা জানে ওর সব বন্ধুরাই এমন। একেক জনের সাথে বিশ, পঁচিশ বা ত্রিশ বৎসর পরে দেখা হলেও কারো ভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে এতো দিন পর দেখা হয়েছে, এমনকি এর মধ্যে এদের কারো সাথে কোন যোগাযোগও নেই তবুও কেও কাউকে কোন অবহেলা করে না ভুলে যায় না। সবাই একই রকম, আন্তরিকতায় কেও কম না। আনন্দে, কৃতজ্ঞতায়, পাগল স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় মনিরার চোখ ভিজে উঠলো।
-সত্যিই ভাবী আমি যে এখানে এসে এমনটা পাব তা কল্পনাও করতে পারিনি। মনে হচ্ছে আপনি আমার কত দিনের চেনা, কত আপন, বলেই শেফালিকে জড়িয়ে ধরল।
-না ভাবী আপনার ভাই শুধু বলেছে ওর অনেক দিনের পুরনো এক বন্ধু বৌ নিয়ে আসছে। আমাকে আর কিছু বলেনি।
-মনিরা বলে উঠলো তাহলে দুইজনে একই রকম?
-শেফালি বললো তা না হলে বন্ধুত্ব হবে কি করে?
মনিরার চোখ এর পরে আর পানি সামলাতে পারেনি ফোটা ফোটা করে গড়িয়ে পরছে।
তাই দেখে ফিরোজের মা বললো
-ওকি মা তুমি কাঁদছ কেন? আমি তো জানতাম না যে তুমি আমাদের আপন জন। ফিরোজ আমাকেও কিছু বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করাতে শুধু বলেছিলো তোমাদের পাশের গ্রামেই।
-তা বলত মা গ্রামের কি অবস্থা, কে কেমন আছে, কোথায় কি হচ্ছে, কৌড়ির ব্রিজটা কি হয়েছে, ঢাকা থেকে ঝিটকা যেতে এখন রাস্তার কি অবস্থা? এরকম আরও নানা কৌতূহল। তোমার ছেলে মেয়ে কজন, বাড়িতে কে কে আছে, তোমার বাবা চাচার কি অবস্থা?
-আমার বাবা তো অনেক আগেই চলে গেছেন ফুফু, চাচাও এইতো কয়েক বৎসর হলো। কাসেম চাচাকে কিছু দিন আগে দেখেছিলাম, আমাদের বাড়ি এসেছিলো। আমিও ফুফু আম্মা আপনার মতই প্রায়, দেশে থেকেও গ্রামে খুব একটা যেতে পারি না
-আচ্ছা চলো শুয়ে পর আজ আর না কাল গল্প করব, এতদিন পর গ্রামের মেয়ে পেলাম আমার যে কি ভালো লাগছে মা। আজ তোমরা ক্লান্ত, যাও বিশ্রাম নাও।
-ভাবী চলেন। এখানে কিন্তু আপনাদের ঢাকার মত বড় বড় ঘর নেই। ছোট ঘর, শীতের দেশে ঘর গরম রাখতে গেলে বড় ঘরে অনেক খরচ হয় তাই সবাই ছোট ছোট ঘর বানায়।
-কি যে বলেন ভাবী, ছোট আর বড়। আমি যে কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় থাকবো আমি তো আসতেই চাইছিলাম না। শুধু ওর পাগলামির জন্য আসা।
-এসে ভালো করেছেন, এর পরে আপনি যে কোন সময় আসতে পারবেন।

৩২।
মনিরা আর রাশেদ সাহেব আপাতত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে তাদের ঘরে চলে এলো। ছোট্ট একটা ঘর, সিঙ্গেল একটা খাট। এর মধ্যেই তাদের দুজনকে থাকতে হবে। রাশেদ সাহেব বাঙ্গালির স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি লম্বা বলে দেশের বাজারে যে মাপের খাট তৈরি হয় তাতে শুতে পারে না। নিজে কাঠ কিনে এনে বাড়িতে মিস্ত্রী ডেকে তার নিজের মাপ মত খাট বানিয়ে নিয়েছেন। আজ এই ছোট্ট খাটে দুজনকে শুতে হবে। মনির দিকে চেয়ে হেসে বললেন কি করবে, এর মধ্যেই শুয়ে পর। লম্বা জার্নি করেছ তুমি ক্লান্ত। খাটের দিকে চেয়ে লাভ নেই। এখানে যা পেয়েছ তাতেই শোকর কর। না হলে এতক্ষণে ভিক্টোরিয়া স্টেশনের কাছা কাছি বা হোয়াইট চ্যাপেলের কাছে কম দামের ‘বেড এন্ড ব্রেক ফাস্ট’ খুঁজতে হতো। অনেক পেয়েছি এখানে।
দেখেছ, ফিরোজের বোন, বোন জামাই আমাদের জন্য এই ঘর ছেড়ে অন্য বাসায় গিয়ে থাকছে। এদেশে যার যার নিজের যতটুক দরকার ততটাই ঘর কিনে। এতো বড় ঘর দিয়ে কি করবে? এটাই এই লন্ডনের জীবন। দেশের মানুষ যেমন ভাবে যারা লন্ডন থাকে তারা না জানি কত সুখে আছে আসলে তা নয়। হ্যাঁ রোজগার ভাল কিন্তু জীবনের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় এখানে। ক’দিন থাক দেখবে, এখানকার জীবন কেমন।
এই যে এই জানালা দেখছ দেখ এতে মোটা দুইটা কাঁচ লাগানো রয়েছে, এর নাম হচ্ছে ডাবল গ্লেজিং যাতে শীতের তাণ্ডব দ্বিতীয় কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকতে না পারে। শীত বল আর গরম বল কখনোই জানালা খুলে রাখতে পারবে না। আমাদের দেশের মত বারান্দায় বসা কাকে বলে এরা জানেই না। কাল দিনে দেখবে বাড়ি ঘর একেকটা একেক দিকে মুখ করা। দক্ষিণ মুখী হতে হবে নয়তো একান্ত পূর্ব মুখী না হলে বাতাস এসে দেহ মন জুড়িয়ে দিবে এদের এমন ভাবনা নেই। আরও দেখবে, এখানে কেও কারো নয়। কেও কাউকে এক কাপ চাও খেতে বলে না নিতান্ত কোন উদ্দেশ্য না থাকলে। তবুও যা করেছে আমি ভাবতেও পারিনি। সেই কবে স্কুল ছেড়ে আসার পর আর দেখা হয়নি, জানা না থাকলে ওকে দেখে হয় তো চিনতেও পারতাম না। ও যা করেছে সে ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারব কিনা জানি না। ওর বৌ যদি এমন না হতো তাহলে হয়ত ফিরোজের পক্ষে এতটা সম্ভব হতো না।

সবই আল্লাহর ইচ্ছা নয়তো এমন জামাই আদর? অসম্ভব। আমি তো ভাবতেই পারিনি, শুনেছি এদেশের মেয়ে তাই ভেবেই নিয়েছিলাম সাদা কেও হবে, এতো দিন তাই মনে করেছি। নিজের আপন ভাই তো রয়েছে তাকে তো জানাতেও পারিনি। যাক কাল থেকেই সব দেখতে পাবে। এখন শুয়ে পর, আমরা তো আর হানিমুন করতে আসিনি বা সখ করে বেড়াতে আসিনি। আমাদের ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছে এখানে।
ভোরে সেহরি খাবার জন্য উঠেছিলো, কোন রকম সেহরি খেয়েই আবার ঘুম। সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক দেরীতে। ভাবী বা ফিরোজ কেও ইচ্ছা করেই ডাকেনি।
মনিরার সাড়া পেয়ে ভাবী উপরে এসে জিজ্ঞেস করলেন -কি ভাবী ঘুম হয়েছে?
-হ্যাঁ ভাবী দুই দিন পথে থেকে ভীষণ টায়ার্ড ছিলাম শোবার সাথে সাথেই ঘুম কোথা দিয়ে এত বেলা হয়েছে বুঝতেই পারিনি।

নিচে নেমে সবাই গল্প করছে। চলো দেখি তোমাদের জায়গাটা কেমন দেখায়। ঘরের বাইরে বের হলো, প্রচণ্ড শীত, গরম কাপড় গায়ে তবুও কাঁপুনি লাগছে। ওর বাড়িটা বেশ সুন্দর। সামনে একটু ফুলের বাগান, এখন শীত বলে কোন ফুল নেই শুধু গাছ গুলি দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেই বাচ্চাদের খেলাধুলার একটু জায়গা। আবার তার পরেই রাস্তা। কাল যে গাড়িতে করে এসেছে সেটা রাস্তার পাশেই ওর বাড়ির সামনে রেখেছে। ফিরোজ বললো ওটা শেফালির।
-তোমার কোনটা?
-ওই তো ওর পিছনের টা।
শীত সহ্য করতে না পেরে মনি ভিতরে চলে এলো। বাড়ির পিছনে শাক সবজি করার মত খানিকটা মাটি, চারদিকে কাঠের বেড়া দেয়া। এক কোনায় একটা আপেল গাছ। নীচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘরে আবার ছোট একটা খাবার টেবিল পাতা আছে, ছোট একটা টয়লেট আর একটা ঘর যেখানে ওর মা থাকে। উপরে দোতলায় দুইটা ঘর, বাথরুম টয়লেট, তিনতলায় চিলে কোঠার মত একটা ঘর। বেশ ছিম ছাম করে সাজানো। সারা বাড়িতে মোটা কার্পেট বিছানো। এমনকি বাথরুমেও। বাথরুমের এক পাশে পর্দা ঘেরা বাথ টাব। এখানে আমাদের দেশের মত ঘরে ঘরে জনে জনে একটা করে বাথরুম নেই। অতিরিক্ত কোন ঘর নেই। এখানে একটা বাড়ি আছে এই যথেষ্ট। বিলাসিতা করার মত বা অনর্থক খরচের বোঝা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। শীত কালে বাড়ি গরম রাখার জন্য যথেষ্ট গ্যাস বিজলী খরচ হয়ে যায়। এর নাম লন্ডন শহর। সারা দিন কাজ আর কাজ, বাড়িতে কতক্ষণই থাকার সুযোগ পায়। রাতে কোন রকমে শরীরটাকে একটু বিছানায় ফেলে দেয়া।
বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং চলছে তবুও বসার ঘরে আলাদা একটা হিটার চলছে। নভেম্বরের প্রথম, এর মধ্যে লন্ডন শহরে আর কেও জায়গা পাক আর না পাক শীত মহোদয় তার আসন পেতে নিয়েছে। ফিরোজের মা মনিকে ডেকে পাশের রান্না ঘরে গেলো।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৯

৩১।
রাশেদ আর ফিরোজ একই স্কুলে পড়েছে। স্কুল ছাড়ার পর এই প্রথম দেখা। লন্ডন আসার দিন ঠিক হবার পর কামরুলের কাছ থেকে ফিরোজের ফোন নম্বর, মেইল ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করেছিলো। প্রায় ত্রিশ বছর পর দেখা। খেতে বসে আরও আলাপ হলো। শেফালি ভাবী একটা ড্রাইভিং স্কুল চালায়। মনিরা যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। মনিরা জানে ওর সব বন্ধুরাই এমন। একেক জনের সাথে বিশ, পঁচিশ বা ত্রিশ বৎসর পরে দেখা হলেও কারো ভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে এতো দিন পর দেখা হয়েছে, এমনকি এর মধ্যে এদের কারো সাথে কোন যোগাযোগও নেই তবুও কেও কাউকে কোন অবহেলা করে না ভুলে যায় না। সবাই একই রকম, আন্তরিকতায় কেও কম না। আনন্দে, কৃতজ্ঞতায়, পাগল স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় মনিরার চোখ ভিজে উঠলো।
-সত্যিই ভাবী আমি যে এখানে এসে এমনটা পাব তা কল্পনাও করতে পারিনি। মনে হচ্ছে আপনি আমার কত দিনের চেনা, কত আপন, বলেই শেফালিকে জড়িয়ে ধরল।
-না ভাবী আপনার ভাই শুধু বলেছে ওর অনেক দিনের পুরনো এক বন্ধু বৌ নিয়ে আসছে। আমাকে আর কিছু বলেনি।
-মনিরা বলে উঠলো তাহলে দুইজনে একই রকম?
-শেফালি বললো তা না হলে বন্ধুত্ব হবে কি করে?
মনিরার চোখ এর পরে আর পানি সামলাতে পারেনি ফোটা ফোটা করে গড়িয়ে পরছে।
তাই দেখে ফিরোজের মা বললো
-ওকি মা তুমি কাঁদছ কেন? আমি তো জানতাম না যে তুমি আমাদের আপন জন। ফিরোজ আমাকেও কিছু বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করাতে শুধু বলেছিলো তোমাদের পাশের গ্রামেই।
-তা বলত মা গ্রামের কি অবস্থা, কে কেমন আছে, কোথায় কি হচ্ছে, কৌড়ির ব্রিজটা কি হয়েছে, ঢাকা থেকে ঝিটকা যেতে এখন রাস্তার কি অবস্থা? এরকম আরও নানা কৌতূহল। তোমার ছেলে মেয়ে কজন, বাড়িতে কে কে আছে, তোমার বাবা চাচার কি অবস্থা?
-আমার বাবা তো অনেক আগেই চলে গেছেন ফুফু, চাচাও এইতো কয়েক বৎসর হলো। কাসেম চাচাকে কিছু দিন আগে দেখেছিলাম, আমাদের বাড়ি এসেছিলো। আমিও ফুফু আম্মা আপনার মতই প্রায়, দেশে থেকেও গ্রামে খুব একটা যেতে পারি না
-আচ্ছা চলো শুয়ে পর আজ আর না কাল গল্প করব, এতদিন পর গ্রামের মেয়ে পেলাম আমার যে কি ভালো লাগছে মা। আজ তোমরা ক্লান্ত, যাও বিশ্রাম নাও।
-ভাবী চলেন। এখানে কিন্তু আপনাদের ঢাকার মত বড় বড় ঘর নেই। ছোট ঘর, শীতের দেশে ঘর গরম রাখতে গেলে বড় ঘরে অনেক খরচ হয় তাই সবাই ছোট ছোট ঘর বানায়।
-কি যে বলেন ভাবী, ছোট আর বড়। আমি যে কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় থাকবো আমি তো আসতেই চাইছিলাম না। শুধু ওর পাগলামির জন্য আসা।
-এসে ভালো করেছেন, এর পরে আপনি যে কোন সময় আসতে পারবেন।

৩২।
মনিরা আর রাশেদ সাহেব আপাতত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে তাদের ঘরে চলে এলো। ছোট্ট একটা ঘর, সিঙ্গেল একটা খাট। এর মধ্যেই তাদের দুজনকে থাকতে হবে। রাশেদ সাহেব বাঙ্গালির স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি লম্বা বলে দেশের বাজারে যে মাপের খাট তৈরি হয় তাতে শুতে পারে না। নিজে কাঠ কিনে এনে বাড়িতে মিস্ত্রী ডেকে তার নিজের মাপ মত খাট বানিয়ে নিয়েছেন। আজ এই ছোট্ট খাটে দুজনকে শুতে হবে। মনির দিকে চেয়ে হেসে বললেন কি করবে, এর মধ্যেই শুয়ে পর। লম্বা জার্নি করেছ তুমি ক্লান্ত। খাটের দিকে চেয়ে লাভ নেই। এখানে যা পেয়েছ তাতেই শোকর কর। না হলে এতক্ষণে ভিক্টোরিয়া স্টেশনের কাছা কাছি বা হোয়াইট চ্যাপেলের কাছে কম দামের ‘বেড এন্ড ব্রেক ফাস্ট’ খুঁজতে হতো। অনেক পেয়েছি এখানে।
দেখেছ, ফিরোজের বোন, বোন জামাই আমাদের জন্য এই ঘর ছেড়ে অন্য বাসায় গিয়ে থাকছে। এদেশে যার যার নিজের যতটুক দরকার ততটাই ঘর কিনে। এতো বড় ঘর দিয়ে কি করবে? এটাই এই লন্ডনের জীবন। দেশের মানুষ যেমন ভাবে যারা লন্ডন থাকে তারা না জানি কত সুখে আছে আসলে তা নয়। হ্যাঁ রোজগার ভাল কিন্তু জীবনের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় এখানে। ক’দিন থাক দেখবে, এখানকার জীবন কেমন।
এই যে এই জানালা দেখছ দেখ এতে মোটা দুইটা কাঁচ লাগানো রয়েছে, এর নাম হচ্ছে ডাবল গ্লেজিং যাতে শীতের তাণ্ডব দ্বিতীয় কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকতে না পারে। শীত বল আর গরম বল কখনোই জানালা খুলে রাখতে পারবে না। আমাদের দেশের মত বারান্দায় বসা কাকে বলে এরা জানেই না। কাল দিনে দেখবে বাড়ি ঘর একেকটা একেক দিকে মুখ করা। দক্ষিণ মুখী হতে হবে নয়তো একান্ত পূর্ব মুখী না হলে বাতাস এসে দেহ মন জুড়িয়ে দিবে এদের এমন ভাবনা নেই। আরও দেখবে, এখানে কেও কারো নয়। কেও কাউকে এক কাপ চাও খেতে বলে না নিতান্ত কোন উদ্দেশ্য না থাকলে। তবুও যা করেছে আমি ভাবতেও পারিনি। সেই কবে স্কুল ছেড়ে আসার পর আর দেখা হয়নি, জানা না থাকলে ওকে দেখে হয় তো চিনতেও পারতাম না। ও যা করেছে সে ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারব কিনা জানি না। ওর বৌ যদি এমন না হতো তাহলে হয়ত ফিরোজের পক্ষে এতটা সম্ভব হতো না।

সবই আল্লাহর ইচ্ছা নয়তো এমন জামাই আদর? অসম্ভব। আমি তো ভাবতেই পারিনি, শুনেছি এদেশের মেয়ে তাই ভেবেই নিয়েছিলাম সাদা কেও হবে, এতো দিন তাই মনে করেছি। নিজের আপন ভাই তো রয়েছে তাকে তো জানাতেও পারিনি। যাক কাল থেকেই সব দেখতে পাবে। এখন শুয়ে পর, আমরা তো আর হানিমুন করতে আসিনি বা সখ করে বেড়াতে আসিনি। আমাদের ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছে এখানে।
ভোরে সেহরি খাবার জন্য উঠেছিলো, কোন রকম সেহরি খেয়েই আবার ঘুম। সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক দেরীতে। ভাবী বা ফিরোজ কেও ইচ্ছা করেই ডাকেনি।
মনিরার সাড়া পেয়ে ভাবী উপরে এসে জিজ্ঞেস করলেন -কি ভাবী ঘুম হয়েছে?
-হ্যাঁ ভাবী দুই দিন পথে থেকে ভীষণ টায়ার্ড ছিলাম শোবার সাথে সাথেই ঘুম কোথা দিয়ে এত বেলা হয়েছে বুঝতেই পারিনি।

নিচে নেমে সবাই গল্প করছে। চলো দেখি তোমাদের জায়গাটা কেমন দেখায়। ঘরের বাইরে বের হলো, প্রচণ্ড শীত, গরম কাপড় গায়ে তবুও কাঁপুনি লাগছে। ওর বাড়িটা বেশ সুন্দর। সামনে একটু ফুলের বাগান, এখন শীত বলে কোন ফুল নেই শুধু গাছ গুলি দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেই বাচ্চাদের খেলাধুলার একটু জায়গা। আবার তার পরেই রাস্তা। কাল যে গাড়িতে করে এসেছে সেটা রাস্তার পাশেই ওর বাড়ির সামনে রেখেছে। ফিরোজ বললো ওটা শেফালির।
-তোমার কোনটা?
-ওই তো ওর পিছনের টা।
শীত সহ্য করতে না পেরে মনি ভিতরে চলে এলো। বাড়ির পিছনে শাক সবজি করার মত খানিকটা মাটি, চারদিকে কাঠের বেড়া দেয়া। এক কোনায় একটা আপেল গাছ। নীচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘরে আবার ছোট একটা খাবার টেবিল পাতা আছে, ছোট একটা টয়লেট আর একটা ঘর যেখানে ওর মা থাকে। উপরে দোতলায় দুইটা ঘর, বাথরুম টয়লেট, তিনতলায় চিলে কোঠার মত একটা ঘর। বেশ ছিম ছাম করে সাজানো। সারা বাড়িতে মোটা কার্পেট বিছানো। এমনকি বাথরুমেও। বাথরুমের এক পাশে পর্দা ঘেরা বাথ টাব। এখানে আমাদের দেশের মত ঘরে ঘরে জনে জনে একটা করে বাথরুম নেই। অতিরিক্ত কোন ঘর নেই। এখানে একটা বাড়ি আছে এই যথেষ্ট। বিলাসিতা করার মত বা অনর্থক খরচের বোঝা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। শীত কালে বাড়ি গরম রাখার জন্য যথেষ্ট গ্যাস বিজলী খরচ হয়ে যায়। এর নাম লন্ডন শহর। সারা দিন কাজ আর কাজ, বাড়িতে কতক্ষণই থাকার সুযোগ পায়। রাতে কোন রকমে শরীরটাকে একটু বিছানায় ফেলে দেয়া।
বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং চলছে তবুও বসার ঘরে আলাদা একটা হিটার চলছে। নভেম্বরের প্রথম, এর মধ্যে লন্ডন শহরে আর কেও জায়গা পাক আর না পাক শীত মহোদয় তার আসন পেতে নিয়েছে। ফিরোজের মা মনিকে ডেকে পাশের রান্না ঘরে গেলো।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৮

৩০।
আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফিরোজ এসে ওকে খুঁজে পেয়ে বললো তাড়াতাড়ি চলো যেখানে গাড়ি রেখে এসেছি ওখানে বেশিক্ষণ রাখা যায় না। তাড়াতাড়ি করে একটা ট্রলি এনে ফিরোজ সহ মালপত্র উঠিয়ে বাইরে এসে দেখে ফিরোজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ওর স্ত্রী বসে আছে। ওদের দেখে নেমে এলো। এর আগে ফিরোজের স্ত্রীর সাথে দেখা হয়নি। দ্রুত পরিচয় পর্ব সেরে মাল গুলি গাড়ির পিছনে রেখে গাড়িতে উঠে বসার সাথে সাথেই ফিরোজের স্ত্রী শেফালি, চিটাগাং এর মেয়ে লিভারপুলে জন্ম এবং বেড়ে উঠা, গাড়ি স্টার্ট দিল। টার্মিনাল থেকে বের হয়ে এই সামান্য একটু হেঁটে গাড়িতে আসতেই মনিরা শীতে কেঁপে উঠলো।
-ভাবী হিটার বাড়িয়ে দেন।
-হ্যাঁ ভাই দিচ্ছি। একটু রসিকতা করে বললো কি ভাবী আগুনের কাছে বসেও শীত লাগছে?
রাশেদ নিজের কোট খুলে মনির গায়ে জড়িয়ে দিল। একটু পরেই গাড়ি গরম হলে মনি একটু স্বস্তি পেল। ফিরোজ আর রাশেদ সাহেবের হাসি তামাশা আর ওদের দুজনের আন্তরিকতা দেখে মনি অবাক হলো। এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু এরা! হিথরো এলাকা ছাড়িয়ে এসে গাড়ি মটর ওয়ে ধরে ওদের বাড়ির দিকে চলছে। ভাবী গাড়িও চালাচ্ছে আবার ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলছে। মনিরা ওদের এই সব কাণ্ড দেখে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে, মুখে হাসির আলো দেখা যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা খানিক ড্রাইভ করে রাত আটটার দিকে ওদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।
ফিরোজের নিজের বাড়ি। বাড়িতে মা, বোন, বোন জামাই আর ওদের দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে ফিরোজের সংসার। মালপত্র নামিয়ে ভাবী দোতলায় ওদের জন্য বরাদ্দ করা ঘরে রেখে এসে বসার ঘরে বসল।
ফিরোজের মা বললো তোমাদের বড় মেয়ে ফোন করেছিলো। তোমরা পৌঁছেছ কি না জানতে চেয়েছিলো, ওদের একটা ফোন করে জানিয়ে দাও, চিন্তায় আছে।
ফিরোজ উঠে গিয়ে লাইন ধরে দিল।
মনি কথা বললো, হ্যাঁ মা আমরা এই মাত্র পৌঁছলাম। তোমার চাচা চাচী দুজনেই গিয়েছিলো, তোমরা কেমন আছ? আচ্ছা সাবধানে থেক, রাখি তাহলে।
বাড়ির সবার সাথে আলাপ পরিচয় হবার পর শেফালি ভাবী বললো-
-ভাবী কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেন, আমার মনে হয় গোসল করলেই ভাল হবে। আপনার রুমের পাশেই বাথরুম। লম্বা জার্নি করে এসেছেন আজ আর বেশি কথা না, খেয়ে দেয়ে রেস্ট করেন কাল কথা হবে
শেফালির আন্তরিকতা দেখে মনিরা একটু অবাক হলো। লন্ডনের মত শহরে যেখানে সব কিছু মাপা এমনকি মুখের হাসিটাও। মনিরা এ কয়দিন জেনে এসেছে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে সেখানে প্রথম দেখাতেই এমন আপন করে নেয়াতে মনিরার কাছে অবাক লাগারই কথা।
ভাবীর কথা শুনে ওরা দুই জনেই উঠে গেলো। মনিরা বললো সে গোসল করবে।
-করে ফেল ভাল লাগবে, আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলেই হবে।
সুটকেস খুলে মনিরা কাপড় বের করে গোসল করে এলো। রাশেদ সাহেব হাতমুখ ধুয়ে এসে বললো-
-ফিরোজের জন্য কাসুন্দি, ঝিটকার পিঁয়াজ আর ওগুলি এনেছি ওগুলি বের কর।
মনিরা ভাবল তাহলে ও আগে থেকে জানতো এখানে আসবে। আমাকে তো শুধু বলেছিলো ফিরোজকে মেইল পাঠাবে, তা ওর এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথচ এতদিন কিছু জানতে পারিনি, আমাকে তো কোনদিন কিছু বলে নি। শুধু বলেছে ফিরোজের বাড়ি উঠবে সে ফিরোজের সাথে যে ওর এত ঘনিষ্টতা তা কিছুই বলেনি। যাক ওদের বন্ধুত্বের ভাব দেখে মনটা বেশ প্রফুল্ল হলো। ভাবতে ভাবতে সব কিছু বের করে একটা ব্যাগে ভরে নিচে নেমে এলো।
শব্দ পেয়ে ভাবী ডেকে বললো-
-ভাবী এদিকে কিচেনে আসুন খাবার রেডি।
মনি এগিয়ে কিচেনে গিয়ে ভাবীর সামনে ব্যাগটা নামিয়ে দিয়ে বললো-
-এই যে ভাবী আপনার ভাই তার বন্ধুর জন্য এনেছে।
-ওতে কি পিঁয়াজ আছে?
-হ্যাঁ।
-আমি জানি পিঁয়াজ থাকতে হবে।
-কেও এলেই তার আর কিছু না, শুধু এই পিঁয়াজ আনতে বলবেই। যাক, ভাবী গোসল করেছেন মনে হচ্ছে!
-হ্যাঁ ভাবী, গোসল করে ফেললাম।
-ভাল করেছেন। কি, এখন শীত লাগছে?
-না বেশ তো ভালই লাগছে।
-নেন এবার খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরুন।
-শুনলাম আপনি এদেশে জন্মেছেন, এদেশে বড় হয়েছেন অথচ এত সুন্দর বাংলা বলেন আমার কাছে অবাক লাগছে।
-ওমা, কি বলেন! এদেশে জন্মেছি বলে কি আমরা বাঙ্গালি না?
-আপনাকে পেয়ে খুব ভাল লাগছে।
ভাবী অনেক কিছু রান্না করেছে। বিরিয়ানি, রোস্ট, কাবাব, চিকেন গ্রীল। খেতে বসে ফিরোজের মা মনিকে বললো-
-রাশেদের বাড়ি তো শুনলাম আমাদের পাশেই তা তোমার বাবার বাড়ি কোথায়?
-ওখানেই। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, -আপনাদের বাড়ির পাশেই! আপনার বাড়ি কোথায়?
ফিরোজের মা তার বাবার বাড়ির ঠিকানা বলতেই মনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল,
-ও! আপনি কাসেম চাচার বোন? এই ব্যাপার! অথচ দেখেন আমাকে এতো দিন কিচ্ছু বলেনি, তাহলে তো আপনি আমাদের ফুফু হন। আমাদের গ্রাম গালা আর আমার বাবার নাম আঃ সোবহান, আপনি আমার বাবাকে চিনতে পেরেছেন?
-তুমি তাহলে সোবহানের মেয়ে!
-হ্যাঁ। আর আমি ভাবছিলাম কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় থাকবো কি করবো কত কি ভেবে আমি অস্থির ছিলাম এ কয় দিন।
ফিরোজ এলো একটু পরে, এসে পিঁয়াজ দেখেই বললো, -কি রাশেদ, পিঁয়াজ এনেছ তাহলে?

নক্ষত্রের গোধূলি-১৭

২৯।
রাশেদ সাহেব ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আর ডাকতে পারলো না। কাত হয়ে থাকা মনির মাথাটা টেনে নিজের বুকে এনে নিলেন, মনি একটু কাত হয়ে রাশেদ সাহেবের বুকে ঘুমাচ্ছে। মনির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন সে কত সুখী। মনির মত স্ত্রী পেয়েছে। যে তার সমস্ত সত্তা দখল করে রয়েছে, ওকে ছাড়া একটা দিন তো দূরের কথা একটা বেলাও চলে না। তার মনের কথা গুলি কেমন করে যেন সব ঠিক ঠিক বুঝে ফেলে। অবাক লাগে। ভালবাসা কি এমনই গভীর? কত গভীরে গেলে এমন হতে পারে? কই আমি তো পারি না! ভাবতে ভাবতে সেও এক সময় ঘুমিয়ে পরে। হঠাৎ মাইকে এয়ার হোস্টেস এর কণ্ঠে চমকে উঠলেন, প্লেন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হিথরো এয়ারপোর্টে নামবে, সেখানকার তাপ মাত্রা দুই ডিগ্রী এবং আবহাওয়া সম্পর্কে জানিয়ে যাত্রীদের সেই অনুযায়ী পোষাক পরে নেবার কথা জানিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে নেবার অনুরোধ জানালো। মনিরার ঘুম তখনও ভাঙ্গে নি। রাশেদ সাহেব আস্তে করে ডাকলেন, মনি ওঠ, লন্ডন এসে গেছে! মনির সিট বেল্ট বেঁধে নিজেরটাও বেঁধে নিলেন।
আবার ডাকলেন, মনি ওঠ!
মনি চোখ মেলে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো
-কি হয়েছে?
-লন্ডন এসে পরেছি প্লেন নামছে।
মনি জানালা দিয়ে দেখল। ছবির মত সাজান সুন্দর বাড়ি ঘর, টেমস নদী, আই অফ লন্ডন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনের চাকা মাটি ছুঁয়ে গেলো। একটু পরেই প্লেন হিথরো এয়ারপোর্টের তিন নম্বর টার্মিনালের সামনে থেমে গেলো। রাশেদ সাহেব ব্যাগ থেকে মনির গরম কাপড় বের করে মনিকে পরিয়ে দিলেন, পায়ে মুজা বদলে গরম মুজা পরিয়ে দিলেন, এছাড়া হ্যান্ড গ্লোভস আর গলার মাফলার মনির হাত ব্যাগে ভরে দিলেন।
গ্যাং ওয়ে টেনে প্লেনের দরজার সামনে আনতে দরজা খুলে দিল। যাত্রীরা একে একে সবাই নেমে গেলো। টার্মিনালের দোতলার উপর বেশ অনেকটা পথ হেঁটে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বেশ দীর্ঘ কিউর পিছনে। তাদের পালা এলে কাল ইমিগ্রেশন অফিসার তাদের পাসপোর্ট দেখে সিল দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। রাশেদ সাহেব এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে মনিরার হাত ধরে লাগেজ কনভেয়ারের কাছে এসে দাঁড়ালো। ওদের মালামাল কোন বেল্টে আসছে তা মনিটরে দেখে নিয়ে সেখানে যেয়ে দাঁড়ালেন। ওদের মাল আসতেই বেল্ট থেকে নামিয়ে কাস্টমের সবুজ গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরে যেখানে যাত্রীদেরকে রিসিভ করার জন্য সবাই এসে অপেক্ষা করে সেখানে এসে ফিরোজকে খুঁজে না পেয়ে মনিরাকে বললো তুমি এখানে এগুলি নিয়ে বসে থাক আমি ফিরোজকে খুঁজে বের করি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ফিরোজকে না পেয়ে আবার মনির কাছে ফিরে এলেন।
মনি জিজ্ঞেস করলো, পেলে না?
-দেখছি না।
-তাহলে কি আসে নি?
-না আসলেও আসবে।
-তুমি কি ঠিক ভাবে জানিয়েছিলে?
-কি যে বল, তারিখ, ফ্লাইট নম্বর, সময় সব জানিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে ওরা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে আটকে রয়েছে।
-এখানেও ট্রাফিক জ্যাম আছে নাকি?
-থাকবে না মানে, এখন পুরো পিক টাইম! দাঁড়াও আর একটু দেখি, তারপর ফোন করি।
বলেই তিনি মনির পাশে বসলেন।
-আমার কিন্তু ভয় করছে আসবে কি না, যদি না আসে তাহলে কি করবে এখন?
-কী যে বল তুমি আসবে না কেন, অবশ্যই আসবে। একটু অপেক্ষা কর।
প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেলো এর মধ্যে ওকে না দেখে এবার রাশেদ সাহেবও একটু চিন্তিত হলেন। উঠে গিয়ে দোকান থেকে সাথে থাকা পাউন্ড ভাঙ্গিয়ে এনে ফিরোজের বাসায় ফোন করলেন।
ফিরোজের মেয়ে জানাল আব্বু আম্মু দুজনেই আপনাদের রিসিভ করতে চলে গেছে, আম্মু একটু বাইরে কাজে গিয়েছিলো ফিরতে দেরি হওয়াতে দেরি হয়েছে।
-আচ্ছা ঠিক আছে তা হলে আমি ওকে মোবাইলে ফোন করছি।
লাইন কেটে দিয়ে আবার মোবাইলে ফোন করে সরাসরি ফিরোজের সাথে কথা হলো।
-হ্যাঁ রাশেদ আমরা আসছি, তোমরা কি তিন নম্বর টার্মিনালে আছ?
-হ্যাঁ।
-তাহলে ওখানেই থাক আমাদের আরও আধা ঘণ্টা লাগবে।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৬

২৮।
একটু পরেই দেখলো তারা যে গেট দিয়ে লন্ডন যাবার প্লেনে উঠবে সেখানে এক বিশাল ৭৪৭ বোইং এসে দাঁড়ালো। দেখ, দেখ মনি আমরা এই প্লেনে লন্ডন যাব। ঘণ্টা খানিক পর লন্ডনের যাত্রীদের প্লেনে ওঠার জন্য C গেটে যাবার ঘোষণা শুনে তারা এগিয়ে গেলো। ওদের বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট দেখে যথারীতি অন্যান্য এয়ারপোর্টের মত এখানেও বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও রক্ষা যে ওদের বেশ মোটা এবং পুরাতন পাসপোর্ট এবং রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টে ইতিপূর্বে ব্রিটেন ভ্রমণের ভিসা দেখে তেমন কোন ঝামেলা করেনি। এক সময় সব ঝামেলা শেষ করে প্লেনে উঠে সিট খুঁজে বসে পরলেন। এবারেও মনি জানালার পাশে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই প্লেন ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, সামনের জিপিএস এর স্ক্রিনে দেখছে। জানালা দিয়ে নিচে নীল সাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় সাদা ফেনা আরও বেশি সুন্দর ছবির মত দেখাচ্ছে, মাঝে মাঝে টুকরো মেঘ গুলির উপর দিয়ে যাচ্ছিল। সাগর পাড়ি দেয়ার পর যে শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছে রাশেদ সাহেব বলে যাচ্ছেন কবে এই শহরে এসেছিলেন, দেখ দেখ মনি আমি এই এই শহরে এসেছিলাম দেখ উপর থেকে দেখ কেমন দেখাচ্ছে! ওইসব শহরের নানা গল্প বলছিলেন। তার কোনটা মনিরার কানে যাচ্ছে কোনটা যাচ্ছে না। সে শুধু অবাক হয়ে রাশেদ সাহেবের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে যেন তাকে এই প্রথম দেখছে।

কুয়ালালামপুর থেকে লন্ডন দীর্ঘ চৌদ্দ ঘণ্টার পথ। কম না। মাঝে দুই বার খাবার দিয়েছে, দুই বার হালকা নাশতা আর চা কফি বা পানীয় তো আছেই। যে যখন যা চাইছে। রাশেদ সাহেব মনিরা কে জোর করে বার বার পানীয় দিচ্ছে যাতে ডি-হাইড্রেশন হয়ে এয়ার সিকনেস না ধরে। মাঝে মাঝে উঠে এলি ওয়েতে হাঁটা হাটি করতে বলছে নিজেও করছে। রাশেদ সাহেবকে যেন আজ মনিরার কাছে নতুন লাগছে। এর আগেও তো কত বার প্লেন জার্নি করেছে তখন তো এতো এমন করেনি, এ যেন অন্য কোন নতুন রাশেদ সাহেব।

মনিরার ভাবনা শুধু একটাই, যে জন্য আসা তার কতটা কি হবে, কোন কাজকর্ম পাবে কি না, কি করবে, মনি যখন চলে যাবে তখন এই আত্মভোলা মানুষটা কি ভাবে থাকবে, কি করবে এই সব সাত পাঁচ ভেবে নানা আশঙ্কায় মনিরার মন বিষণ্ণ হয়ে রয়েছে। না কি আবার দেশে ফিরে যেতে হবে। এমন যদি হয় তাহলে কি উপায় হবে, নানা কিছু। আবার এটাও ভাবছে দেশ ছেড়ে যখন বের হয়ে এসেছে নিশ্চয়ই একটা গতি হবে। এতো বড় এই ইংরেজদের রাজ্যে কি ওর জন্য একটা কাজও জোগাড় হবে না? নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আশা নিরাশার অনিশ্চয়তা আর গতরাতের অনিদ্রায় ক্লান্ত হয়ে মনিরা ঘুমিয়ে পড়েছে।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৫

২৭।
আজও মানুষটা সংসারী হতে পারল না। আজ ছাব্বিশটা বছর ধরে দেখে আসছে সংসার সম্পর্কে কি উদাসীন। নিজের কথা আর কোন দিন ভাবতে পারবে না। এমনি কি আর বলে, তুমি না হলে আমি কবে বাতাসে উড়ে যেতাম। যদি মনি নিজে যদি শক্ত করে হাল না ধরত তাহলে কি যে হোত কে জানে! মানুষটার মনে সারাক্ষণ শুধু দেশ, সমাজ, প্রতিবেশী, বাবা মা ভাই বোন। কোন সময় একবার ভুলেও নিজের কথা ভাবতে দেখেনি। বাজারে গেলে দুটার বেশি তিনটা জিনিসের কথা বলে দিলে আর মনে রাখতে পারে না, লিখে দিতে হয়। টাকা, ব্যাগ আর লিস্ট লিখে বাজারে পাঠালে কখনো দেখা যায় যে খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে। কি হলো, বাজারে যাওনি? না, ওই ভ্যান ওয়ালাটা বললো ওর মেয়ের অসুখ তাই ওকে ওষুধ কেনার জন্য টাকা দিয়ে দিলাম। আমাদের তো আছে, চলবে না? এই মানুষকে আর কি বলবে। ছাব্বিশ বছর ধরে এই দেখে আসছে।
রাগা রাগিও করা যাবে না, ওই ড্রইং রুমে টিভির সামনে বসে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আদর সোহাগ করে না আনা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কিচ্ছু খাবে না। এই পাগলকে বুকে নিয়েই মনি চলছে। মনটা শিশুর মত সরল আর সাগরের মত বিশাল। থাকুক, আমার পাগল আমার বুকেই থাক এতেই আমার পরম শান্তি। কত বলেছে ভবিষ্যতের জন্য কিছু ভাব, সে কথা কোন দিন কানে নেয়নি। অফিসের বেতন তোলার সময় চেক লিখে তার পিওন সুনীলের হাতে দিয়ে দিত। সুনীল আবার সেই টাকা এনে মনির কাছে দিয়ে যেত। কোন দিন জিজ্ঞেসও করেনি সুনীল কত টাকা দিয়েছে। সেই জিজ্ঞেস করে নিত আজ কত টাকার চেক লিখেছিলে মনে আছে? না। চেকের মুড়ি দেখে মনিকেই তা সামাল দিতে হতো। যদিও জানে সুনীল খুবই বিশ্বাসী তবুও। ওর নিজের কখনো টাকার দরকার হলে মনির কাছে চেয়ে নিত। মনি আমাকে পঞ্চাশ টা টাকা দিতে পারবে? তার নিজের রোজগারের টাকা সে চাইছে বলে মনি কোন দিন জিজ্ঞেস করেনি টাকা দিয়ে কি করবে? মনি নিজেই এর মধ্যে থেকে সংসার চালিয়ে যা কিছু সঞ্চয় করতে পেরেছে তাই তার সম্বল।
-খুব ক্ষুধা লেগেছে মনি।
মনি ব্যাগ খুলে ঢাকা থেকে বড় মেয়ের দেয়া সেদ্ধ আটার রুটি আর শামী কাবাব বের করে দিয়ে খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতলটা ভরে এনে দিল।
-নাও খাও।
-তুমি খাবে না, তোমারও তো ক্ষুধা লেগেছে।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৪

২৫।
চেক ইন, ইমিগ্রেশনের ঝামেলা সেরে ওয়েটিং লাউঞ্জ। কিছুক্ষণ বসেই রাশেদ সাহেব পাশে বসা মনির হাত ধরে আবার গেয়ে উঠলেন ‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে—–———। মনিরা শুকনো কাঠের মত একটু হেসে হাতটা ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে বাসায় ফোন করে খবর নিয়ে এলো গাড়ি পৌঁছেছে কি না। ওদের পৌঁছার খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো। মাইকে নারী কণ্ঠের ঘোষণা ভেসে এলো। উঠে প্লেনে উঠার গ্যাং ওয়ের গেটের কাছে এসে কিউতে দাঁড়ালেন। বোর্ডিং কার্ড চেক হবার পর শেষ বারের মত সিকিউরিটি চেক সেরে আস্তে আস্তে গ্যাং ওয়ে দিয়ে প্লেনের ভিতর এসে সিট নম্বর খুঁজে বসে পড়লো।
মনিরা জানালার পাশে তার পাশে রাশেদ সাহেব। রাশেদ সাহেব মনির হাত ধরে গুনগুনিয়ে আবার সেই গান গাইছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সব যাত্রী ওঠা হলে মাইকে বিমান বালার কণ্ঠ ভেসে এলো, যাত্রী দের সিট বেল্ট বাঁধার অনুরোধ এবং ঢাকা বিমান বন্দর ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে জানিয়ে দিল। একটু পরেই প্লেন টারমাক ছেড়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে ছুটে চলে এক সময় ঢাকা বিমান বন্দরের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে গেলো। নিচে রাশেদ সাহেবের অপূর্ণ সব স্বপ্নের সাথে রাতের ঢাকা শহরের ঝকমকে নানা রঙের বাতি পরে রইলো।
রাশেদ সাহেবের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এই ঢাকা শহর আমাকে একটু জায়গা দিতে রাজী হলো না। আমার নিজের শহর, নিজের দেশ ছেড়ে আমাকে যেতে হচ্ছে ভিন্ন দেশের ভিন্ন শহরে। মনি রাশেদ সাহেবের এই পরিবর্তন দেখে তার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো, -মন খারাপ করবে না, এইতো ক’দিন দেখতে দেখতে চলে যাবে তার পরে তো আবার আসবে। ততক্ষণে প্লেন অনেক উপরে উঠে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরের দিকে উড়ে চলেছে। নিচে তখন কিছু কিছু ছিটে ফোটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জানালা দিয়ে নিজ দেশের শেষ বিন্দুটা দেখে নিতে চাইলেন কিন্তু আর সে সময় পেলেন না। প্লেন ততক্ষণে বাংলাদেশের স্থল সীমা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে।

২৬।
রাশেদ সাহেব অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ মুহূর্তে নিজ দেশের শেষ কণাটা দেখতে না পেরে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেলো। মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মনিরা দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তার নিজ মনের বিষণ্ণতা, যাতনা কষ্ট সব চেপে রেখে হেসে ফেলল। কি হয়েছে তাই, এমন মন খারাপ করছ কেন?
মানুষটা এইতো এতোক্ষণ কি আনন্দে ছিলো। হঠাৎ করেই কেমন নিভে গেলো। মনি সব বুঝতে পারল। বুঝেও না বোঝার ভান করে তার কাঁধে স্বামীর মাথা টেনে নিয়ে বললো দেখ একটু ঘুমাতে পার কি না। রাশেদ সাহেব কিছু না বলে সুবোধ বালকের মত স্ত্রীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। কখন যেন একটু তন্দ্রার মত এসেছিলো বুঝতে পারেনি। মনির কথার শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে মনির দিকে তাকিয়ে দেখে মনি কার সাথে কথা বলছে। এ পাশে চেয়ে দেখে মালয়েশিয়ান এয়ারহোস্টেস খাবার মেনু নিয়ে এসেছে, তারা কি খাবে মনি তাই বলে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির হাত চেপে ধরে আবার গেয়ে উঠলো সেই গানটা। মনি আবার একটু হাসল। এই হাসির আড়ালে কত কষ্ট চেপে রেখেছে তা শুধু মনিই জানে। স্বামীকে বুঝতে দেয়নি। কত দিন পরে সে তার স্বামীকে একটু হাসি খুশি দেখছে, তার ভাল লাগা দেখছে। তাকে আর বিব্রত করা কেন? থাক না তার কষ্ট চাপাই থাক। ওকে আর জানাবার কি এমন দরকার? তার ভাল লাগায় বিঘ্ন ঘটাবার কোন ইচ্ছা হলো না, যে ভাবে চলছে চলুক। নিয়তি যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকেই চলুক।

খাবার পরে চা খেয়ে রাশেদ সাহেব আবার মনির কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজলেন। কতক্ষণ এভাবে ছিলো তা বুঝতে পারেনি। হঠাৎ মাইকে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে নামার ঘোষণা শুনেই চমকে উঠলেন।
-একি মনি, তুমি আমাকে একটু ডাকবে না? তুমি একটু চোখ বন্ধ করতে পারতে। এভাবে সারা রাত জেগে রইলে কেন?
-কেন আবার, দেখলাম তোমার নাক ডাকছে, কত দিন পর তুমি একটু ঘুমিয়েছ তাই আর ডাকিনি। বেয়াই এক বার এসেছিলো খোঁজ নিতে। ওনার সিট সামনের দিকে, তোমাকে ঘুমে দেখে কিছু বলেনি চলে গেছে। আমারও চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো।
-নাও রেডি হয়ে নাও।
জানালা দিয়ে দেখলেন মালয়েশিয়ার আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। নিচে পাম বাগানের সারি দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি লাল মাটির বুকে পাম গাছ গুলি দেখতে বেশ লাগছিলো।
-দেখ মনি একে বারে ঠিক আমাদের সাভারের মত তাই না?
মনি জানালা দিয়ে দেখে বললো-
-হ্যাঁ তাইতো!
একটু পরেই প্লেন নেমে মাটি স্পর্শ করে মটরিং করে ধীরে ধীরে টারমাকের দিকে এগিয়ে এসে থেমে গেলো। দরজা খুলে দেয়ার পর যাত্রীরা সিট বেল্ট খুলে একে একে যার যার সিট ছেড়ে নেমে গেলো। রাশেদ সাহেবরাও নেমে এসে ট্রান্সফার ডেস্ক খুঁজে তাদের টিকেট দেখিয়ে বসার যায়গা এবং পরবর্তী ফ্লাইটের ডিপার্চার গেট জেনে নিয়ে বসে পরল। কায়সার বেয়াই এলো একটু পরেই।
-আসেন বেয়াই।
-আমি এখানে দুই দিন থাকবো, আপনারা চলে যান লন্ডনে গিয়ে দেখা হবে।
-লন্ডনে আপনি কোথায় থাকবেন ফোন নম্বরটা দিয়ে যান।
ফোন নম্বর নিয়ে সে যেখানে থাকবে সে বাসার ঠিকানা দিয়ে চলে গেল।

এখানে দশ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে।
-চলো না মনি বাইরে যেয়ে কুয়ালালামপুরে একটু বেড়িয়ে আসি। তুমি ভয় পেয়ো না, আমি এখানে সব চিনি। এয়ারপোর্টে এই দশ ঘণ্টা কি করবো?
মনি খরচের কথা ভেবে বললো-
-না আমার ভাল লাগছে না। তার চেয়ে চলো ভেতরেই হাঁটা হাটি করি। চারিদিকে তো কাঁচের দেয়াল সবকিছুই দেখা যায়। বাইরে গিয়ে আবার কি দেখবে? তারপরে আবার তো চৌদ্দ ঘণ্টার জার্নি রয়েছে, শুধু শুধু ক্লান্তি বাড়ানোর কি দরকার? চলো একটু হেঁটে দেখি।

বলেই মনিরা উঠে গিয়ে একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাদের হাতের ব্যাগ গুলি ট্রলিতে নিয়ে এগিয়ে বললো এসো, ঘুরে দেখি। রাশেদ সাহেব মনির পিছনে উঠে গেলেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যত দোকান পাট যা আছে সব ঘুরে ঘুরে দেখে এক সময় ক্লান্ত হয়ে আবার এসে বসলেন তাদের লন্ডনের প্লেন যেখান থেকে ফ্লাই করবে সেই C গেটের কাছে। মনিরা খরচের কথাটা রাশেদ সাহেবকে বুঝতেই দেয়নি যে সে খরচের কথা ভেবে বাইরে যেতে চায়নি। এখানে বাইরে গেলেই অন্তত সত্তর ডলার বা পঞ্চাশ পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে। সে জানে তার পাগল খেয়ালের বসে যা মনে আসছ তাই বলছে। সেও যদি আবেগের বশে তাই রাজী হয়ে যায় তাহলে কি আর চলে? মামার কাছ থেকে আনা টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনে এনেছে। তাকে যে আবার এই টাকা ফেরত দিতে হবে। লন্ডনে গিয়ে কি হবে না হবে তার কি কিছু ঠিক আছে?

নক্ষত্রের গোধূলি-১৩

২৫।
চেক ইন, ইমিগ্রেশনের ঝামেলা সেরে ওয়েটিং লাউঞ্জ। কিছুক্ষণ বসেই রাশেদ সাহেব পাশে বসা মনির হাত ধরে আবার গেয়ে উঠলেন ‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে—–———। মনিরা শুকনো কাঠের মত একটু হেসে হাতটা ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে বাসায় ফোন করে খবর নিয়ে এলো গাড়ি পৌঁছেছে কি না। ওদের পৌঁছার খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো। মাইকে নারী কণ্ঠের ঘোষণা ভেসে এলো। উঠে প্লেনে উঠার গ্যাং ওয়ের গেটের কাছে এসে কিউতে দাঁড়ালেন। বোর্ডিং কার্ড চেক হবার পর শেষ বারের মত সিকিউরিটি চেক সেরে আস্তে আস্তে গ্যাং ওয়ে দিয়ে প্লেনের ভিতর এসে সিট নম্বর খুঁজে বসে পড়লো।
মনিরা জানালার পাশে তার পাশে রাশেদ সাহেব। রাশেদ সাহেব মনির হাত ধরে গুনগুনিয়ে আবার সেই গান গাইছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সব যাত্রী ওঠা হলে মাইকে বিমান বালার কণ্ঠ ভেসে এলো, যাত্রী দের সিট বেল্ট বাঁধার অনুরোধ এবং ঢাকা বিমান বন্দর ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে জানিয়ে দিল। একটু পরেই প্লেন টারমাক ছেড়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে ছুটে চলে এক সময় ঢাকা বিমান বন্দরের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে গেলো। নিচে রাশেদ সাহেবের অপূর্ণ সব স্বপ্নের সাথে রাতের ঢাকা শহরের ঝকমকে নানা রঙের বাতি পরে রইলো।
রাশেদ সাহেবের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এই ঢাকা শহর আমাকে একটু জায়গা দিতে রাজী হলো না। আমার নিজের শহর, নিজের দেশ ছেড়ে আমাকে যেতে হচ্ছে ভিন্ন দেশের ভিন্ন শহরে। মনি রাশেদ সাহেবের এই পরিবর্তন দেখে তার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো, -মন খারাপ করবে না, এইতো ক’দিন দেখতে দেখতে চলে যাবে তার পরে তো আবার আসবে। ততক্ষণে প্লেন অনেক উপরে উঠে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরের দিকে উড়ে চলেছে। নিচে তখন কিছু কিছু ছিটে ফোটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জানালা দিয়ে নিজ দেশের শেষ বিন্দুটা দেখে নিতে চাইলেন কিন্তু আর সে সময় পেলেন না। প্লেন ততক্ষণে বাংলাদেশের স্থল সীমা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে।

২৬।
রাশেদ সাহেব অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ মুহূর্তে নিজ দেশের শেষ কণাটা দেখতে না পেরে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেলো। মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মনিরা দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তার নিজ মনের বিষণ্ণতা, যাতনা কষ্ট সব চেপে রেখে হেসে ফেলল। কি হয়েছে তাই, এমন মন খারাপ করছ কেন?
মানুষটা এইতো এতোক্ষণ কি আনন্দে ছিলো। হঠাৎ করেই কেমন নিভে গেলো। মনি সব বুঝতে পারল। বুঝেও না বোঝার ভান করে তার কাঁধে স্বামীর মাথা টেনে নিয়ে বললো দেখ একটু ঘুমাতে পার কি না। রাশেদ সাহেব কিছু না বলে সুবোধ বালকের মত স্ত্রীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। কখন যেন একটু তন্দ্রার মত এসেছিলো বুঝতে পারেনি। মনির কথার শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে মনির দিকে তাকিয়ে দেখে মনি কার সাথে কথা বলছে। এ পাশে চেয়ে দেখে মালয়েশিয়ান এয়ারহোস্টেস খাবার মেনু নিয়ে এসেছে, তারা কি খাবে মনি তাই বলে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির হাত চেপে ধরে আবার গেয়ে উঠলো সেই গানটা। মনি আবার একটু হাসল। এই হাসির আড়ালে কত কষ্ট চেপে রেখেছে তা শুধু মনিই জানে। স্বামীকে বুঝতে দেয়নি। কত দিন পরে সে তার স্বামীকে একটু হাসি খুশি দেখছে, তার ভাল লাগা দেখছে। তাকে আর বিব্রত করা কেন? থাক না তার কষ্ট চাপাই থাক। ওকে আর জানাবার কি এমন দরকার? তার ভাল লাগায় বিঘ্ন ঘটাবার কোন ইচ্ছা হলো না, যে ভাবে চলছে চলুক। নিয়তি যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকেই চলুক।

খাবার পরে চা খেয়ে রাশেদ সাহেব আবার মনির কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজলেন। কতক্ষণ এভাবে ছিলো তা বুঝতে পারেনি। হঠাৎ মাইকে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে নামার ঘোষণা শুনেই চমকে উঠলেন।
-একি মনি, তুমি আমাকে একটু ডাকবে না? তুমি একটু চোখ বন্ধ করতে পারতে। এভাবে সারা রাত জেগে রইলে কেন?
-কেন আবার, দেখলাম তোমার নাক ডাকছে, কত দিন পর তুমি একটু ঘুমিয়েছ তাই আর ডাকিনি। বেয়াই এক বার এসেছিলো খোঁজ নিতে। ওনার সিট সামনের দিকে, তোমাকে ঘুমে দেখে কিছু বলেনি চলে গেছে। আমারও চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো।
-নাও রেডি হয়ে নাও।
জানালা দিয়ে দেখলেন মালয়েশিয়ার আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। নিচে পাম বাগানের সারি দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি লাল মাটির বুকে পাম গাছ গুলি দেখতে বেশ লাগছিলো।
-দেখ মনি একে বারে ঠিক আমাদের সাভারের মত তাই না?
মনি জানালা দিয়ে দেখে বললো-
-হ্যাঁ তাইতো!
একটু পরেই প্লেন নেমে মাটি স্পর্শ করে মটরিং করে ধীরে ধীরে টারমাকের দিকে এগিয়ে এসে থেমে গেলো। দরজা খুলে দেয়ার পর যাত্রীরা সিট বেল্ট খুলে একে একে যার যার সিট ছেড়ে নেমে গেলো। রাশেদ সাহেবরাও নেমে এসে ট্রান্সফার ডেস্ক খুঁজে তাদের টিকেট দেখিয়ে বসার যায়গা এবং পরবর্তী ফ্লাইটের ডিপার্চার গেট জেনে নিয়ে বসে পরল। কায়সার বেয়াই এলো একটু পরেই।
-আসেন বেয়াই।
-আমি এখানে দুই দিন থাকবো, আপনারা চলে যান লন্ডনে গিয়ে দেখা হবে।
-লন্ডনে আপনি কোথায় থাকবেন ফোন নম্বরটা দিয়ে যান।
ফোন নম্বর নিয়ে সে যেখানে থাকবে সে বাসার ঠিকানা দিয়ে চলে গেল।

এখানে দশ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে।
-চলো না মনি বাইরে যেয়ে কুয়ালালামপুরে একটু বেড়িয়ে আসি। তুমি ভয় পেয়ো না, আমি এখানে সব চিনি। এয়ারপোর্টে এই দশ ঘণ্টা কি করবো?
মনি খরচের কথা ভেবে বললো-
-না আমার ভাল লাগছে না। তার চেয়ে চলো ভেতরেই হাঁটা হাটি করি। চারিদিকে তো কাঁচের দেয়াল সবকিছুই দেখা যায়। বাইরে গিয়ে আবার কি দেখবে? তারপরে আবার তো চৌদ্দ ঘণ্টার জার্নি রয়েছে, শুধু শুধু ক্লান্তি বাড়ানোর কি দরকার? চলো একটু হেঁটে দেখি।

বলেই মনিরা উঠে গিয়ে একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাদের হাতের ব্যাগ গুলি ট্রলিতে নিয়ে এগিয়ে বললো এসো, ঘুরে দেখি। রাশেদ সাহেব মনির পিছনে উঠে গেলেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যত দোকান পাট যা আছে সব ঘুরে ঘুরে দেখে এক সময় ক্লান্ত হয়ে আবার এসে বসলেন তাদের লন্ডনের প্লেন যেখান থেকে ফ্লাই করবে সেই C গেটের কাছে। মনিরা খরচের কথাটা রাশেদ সাহেবকে বুঝতেই দেয়নি যে সে খরচের কথা ভেবে বাইরে যেতে চায়নি। এখানে বাইরে গেলেই অন্তত সত্তর ডলার বা পঞ্চাশ পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে। সে জানে তার পাগল খেয়ালের বসে যা মনে আসছ তাই বলছে। সেও যদি আবেগের বশে তাই রাজী হয়ে যায় তাহলে কি আর চলে? মামার কাছ থেকে আনা টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনে এনেছে। তাকে যে আবার এই টাকা ফেরত দিতে হবে। লন্ডনে গিয়ে কি হবে না হবে তার কি কিছু ঠিক আছে?

নক্ষত্রের গোধূলি-১২

২৩।
সামনে আর মাত্র দুই দিন বাকী আছে। বিকেলে মামিকে নিয়ে মামা এলেন। মামা মামি দুজনেই বোঝালেন।
-মনে কর ও যাবার পর কোন অসুখে পরলে তখন কি হবে, অন্তত তুমি যদি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পার তাহলে কেমন হবে আর যদি কেও কাউকে দেখতে না পার তাহলে কেমন হবে? মন স্থির কর, ওখানে তোমাকে কাছে পেলে ওর শক্তি সাহস বেড়ে যাবে কয়েক গুন। ওর শরীর চেহারা কেমন হয়েছে দেখছ না? এরকম অবস্থায় তোমাকেই সব চেয়ে বেশি দরকার। তুমিই পার ওকে আগের সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। কাজেই মন খারাপ না করে কে কি ভাবল তা চিন্তা না করে ওর সাথে যাওয়াই মঙ্গল। লোক লজ্জা নিন্দা যা আসে তা আমি দেখবো। এসব নিয়ে তুমি ভেবো না।

এই মামাই রাশেদ সাহেবের সুখ দুঃখের খবরাখবর রাখেন, বিপদ আপদে সাহায্য সহযোগিতা করেন, পরামর্শ দেন। তার কথা মনি ফেলতে পারলো না। মনে মনে প্রস্তুত হলো, মুখে কিছুটা হলেও শ্রাবণ আকাশের বৃষ্টির পর মেঘের ফাঁকে যেমন একটু খানি রোদের ঝিলিক দেখা যায় তেমনি একটু হাসি ফুটে বের হলো, বিশেষ করে মামার অনুরোধ বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলো। তবুও পদ্ম পাতার পানি যেমন টলমল করে তার মনের তেমন দোদুল্যমান ভাবটা কিছুটা হলেও রয়ে গেলো।

মামাতো ঠিকই বলেছেন। ওখানে যাবার পর যদি ওর কিছু হয়েই যায় তখন কি উপায় হবে? তার চেয়ে ওর সাথে এক বার যেয়ে আমার যাতায়াতের পথটা খুলে দেয়াই ভাল। রাতের খাবার খেয়ে মেহমানরা সবাই চলে গেলে মনি রাশেদকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বসল আলাপ করার জন্য। রাশেদ মনির এই পরিবর্তন দেখে মহা খুশি। মনের আনন্দে মনির হাত ধরে গেয়ে উঠলো-
‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে, ভিসা করছি টিকেট করছি উইরা যাইমু পেলেনে’।
শুনে মনিরা হেসে উঠলো।
সে হাসিতে যে একটু অবাক মাখানো চমক ছিলো তা এক মাত্র রাশেদ সাহেবই টের পেলেন। আজ কতদিন পর যেন মনির হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট বেলার হাসিটা দেখতে পেলেন। দুজন দুজনকে ছুঁয়ে হাস্না হেনার টবের পাশে বেঞ্চে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। উভয়েই উভয়ের উষ্ণ স্পর্শে কত দিন পর যেন সেই ঝর্ণা ধারায় স্নান করছিলেন। সে রাত আর রাত রইলো না হয়ে গেলো মধু যামিনী।
কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলো সেদিকে কোন খেয়াল ছিলো না। হঠাৎ করেই একটু একটু বৃষ্টি নামছে দেখে মনি উঠে রাশেদের হাত ধরে নিয়ে নিচে নেমে শুয়ে পড়লো। মধু মাখা এই রাতটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো দুজনের কেওই টের পায় নি। ভোর হতে পাশের মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলো। চলো মনি গোসল করে আসি, ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। চলো। গোসল করে এসে নামাজ পরে মনি চলে গেলো রান্না ঘরে।
নাশতা খাবার পর রাতের এই ক্ষণিকের মধু মাখা বসন্তের আমেজ বেশিক্ষণ রইলো না। পৃথিবীর সব অনর্থের মূল এই অর্থ। অভাবের গ্লানি আর দুশ্চিন্তার ছায়া যার চারিদিকে তার কীইবা করার আছে। মধু বসন্ত সারা জীবনের জন্য আসেনি, এসেছিলো ক্ষণিকের জন্য। চোখের পলকেই যেন আবার কোথায় হারিয়ে গেলো, মিলিয়ে গেলো দূর দূরান্তের স্বপ্নে দেখা গভীর প্রশান্তির অতলে। সেখানে জায়গা করে নিল ঘন কুয়াশা ঢাকা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কি হবে কি হবে না তাই ভেবে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে নারকেল গাছের মাথায় যে সিনেমা দেখেছিলো সেই কথা মনে এসে ভিড় করলো আবার।

২৪।
লন্ডন যাবার প্রস্তুতি শেষ। নেহায়েত যা একান্ত দরকার তাই কেনা কাটা করা বা পাসপোর্টে পাউন্ড এন্ডোর্স করা সবই করে ফেলেছে যাবার আগে যাতে কোথাও বের হতে না হয়। আজ মেয়েরা কেও স্কুল কলেজে যায়নি। মেয়েরা সবাই উঠে নাশতা সেরে বাবা মাকে নিয়ে বসল। এ গল্প সে গল্প, আশা আকাঙ্ক্ষা কত কি এলো মেলো কথা হলো। আড্ডা জমে উঠে এতো দিনের গুমোট বাঁধা ভাবটা কেটে গিয়ে যেন বাড়িটা আবার প্রাণ চঞ্চলে ভরে উঠলো। বাড়িটা হাসি খুশিতে ভরে গেলো। মেয়েরা সবাই বায়না ধরল মা আজ খিচুড়ি রান্না কর, বাবা পছন্দ করে সবাই মিলে এক সাথে খাব। বড় মেয়ে বললো না মা তুমি থাক আজ আমি রান্না করি।
দুপুরে ডিম ভাজি দিয়ে খিচুড়ি খেতে বসে মেঝ মেয়ে বললো মাংস হলে ভাল হতো। ছোট মেয়ে বলে উঠলো যা হয়েছে তাই যথেষ্ট হয়েছে। শুনে মেঝ মেয়ে আবার বললো হ্যাঁ তাই, ভাগ্যে থাকলে আবার হবে ইনশাল্লাহ। মেয়েদের এই সব বিচক্ষণতা দেখে রাশেদ সাহেব মনির মুখের দিকে তাকালেন। মেয়ে গুলি হয়েছে একেবারে মায়ের মত। কোন বায়না নেই, কোন চাহিদা নেই, কোন চাওয়া নেই, কোন দাবী নেই। যা পাচ্ছে তাতেই খুশী। না পেলেও কোন আফসোস নেই। খাবার পর মেয়েদের নিয়ে আবার বসলেন। ওরা যাবার পর মেয়েরা কি ভাবে চলবে সে ব্যবস্থা মোটামুটি করে রেখেছিলেন।
বড় মেয়ের হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলে দিল এর পরেও যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে মামা অর্থাৎ তোমাদের দাদাকে ফোন করে জানাবে। আমি মামাকে বলেছি, উনি দেখবেন। ছোট মেয়ে জানতে চাইল
-আব্বু তোমরা এয়ারপোর্টে যাবে কি ভাবে?
-আমি তো ভেবে রেখেছি আমি আর তোমার মা একটা স্কুটার নিয়ে চলে যাব। তুমি কি কিছু বলতে চাও?
মনিরা বললো, -তা কি করে হয়?
-তাহলে কি করতে চাও?
মনি একটু দ্বিধার সাথে বললো-
-ওদের বাবা মা দুজনেই চলে যাচ্ছে ওরা যদি একটু এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে বিদায় দিয়ে আসতে পারে তাহলে মনে হয় ওদের ভাল লাগবে।
-কিন্তু সে রকম গাড়ি ভাড়া করার মত টাকা কোথায়? আগে বললে হয়ত কিছু খরচ কমিয়ে ব্যবস্থা করতে পারতাম।
-আচ্ছা সে আমি ব্যবস্থা করছি তুমি ভেবো না।
-দেখ যদি পার কর। আমারও তো মনে হয় যাবার আগে সবার মুখে একটু হাসি দেখে যেতে পারলে ভালো লাগতো। দেখ যদি পার কর সবার হাসি মুখ দেখে যাই। আবার কবে ফিরে আসি না আসি তা কি বলা যায়?

রাশেদ সাহেব কোন বাঁধা দিলেন না। মনিরা তার হাতের শেষ সম্বল ভেঙ্গে সেঝ দেবরকে দিয়ে এয়ারপোর্টে যাবার জন্য একটা মাইক্রো ভাড়া করার ব্যাবস্থা করল। যাবার সন্ধ্যায় সব কিছু রেডি। গাড়ি এসে অপেক্ষা করছে। মনির মা, বড় বোন, ছোট বোন এসেছে। তারাও এয়ারপোর্টে যাবে। রাশেদ সাহেবের সেঝ ভাই ছোট ভাই আর মেয়েরা সবাই যাবে। মালামাল গাড়িতে তোলা হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হবার আগে বাবাকে সালাম করে বিদায় নিতে এলেন।
-আব্বা এর আগেও আমি অনেক বার এরকম যাত্রা করেছি কিন্তু সে সব যাত্রা আর আজকের এই যাত্রার মধ্যে অনেক পার্থক্য। জানি না এটাই আমার শেষ যাত্রা কিনা। ভুল ভ্রান্তি অনেক করেছি, অনেক বেয়াদবিও হয়ে গেছে মাফ করার যোগ্য মনে হলে মাফ করে দিবেন। আমি তো বাড়ি ছাড়া, দেশ ছাড়া হলাম আমার মেয়েরা রইলো।
মনে মনে ভাবলেন বাবা আপনাকে আবার দেখতে পাব কিনা জানি না। এই বলেই ভেজা চোখে বেড় হয়ে গাড়িতে উঠলেন। এয়ারপোর্টে পৌঁছে সবার কাছ থেকে একে একে বিদায় নিলেন। শাশুড়ি, বড় আপা, ছোট শ্যালিকা। শ্যালিকার গাল টেনে একটু রসিকতা করলেন, ছোট ভাই, সেঝ ভাই, সবার শেষে মেয়েদের কাছে। মনি মেয়েদের বোঝাচ্ছে কাঁদে না মা আমি তো কয়েক দিন পরেই আসছি। মেয়েদের একে একে সবাইকে বুকে নিয়ে মন শক্ত করার কথা বলে মনিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
এয়ারলাইন্সের চেক ইন কাউন্টারে এসেই কায়সার বেয়াইর সাথে দেখা।
-আরে বেয়াই আপনি এখানে?
-লন্ডন যাচ্ছি। আপনারা?
-আমরাও তো ওখানেই যাচ্ছি।
-যাক ভালোই হলো
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-১১

২২।
বাড়ির কাউকে কিছু না বলে বুধবার সকাল সাড়ে সাতটায় রাশেদ সাহেব মনিরাকে নিয়ে বারিধারা ব্রিটিশ হাই কমিশনে গিয়ে অপেক্ষা করছিলো। অফিস খুলতেই গেটের সাথে ভিসা এক্সপ্রেসে রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টের সাথে মনির পাসপোর্ট, আবেদন ফি সহ ফর্ম জমা দেয়ার পর রাশেদ সাহেবের পাসপোর্ট একটু উল্টেপাল্টে দেখে হাতে একটা টোকেন দিয়ে বলে দিল আগামী কাল সারে এগারোটায় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন। রাশেদ সাহেবের বিশ্বাস হচ্ছিল না। কোন রকম ইন্টার্ভিউ ছাড়াই মনির ভিসা! বিশ্বাস করবে কি করবে না এমন দুরুদুরু ভাব নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো।
পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় আবার এসে ভিসা এক্সপ্রেসে ওদের টোকেন দেখানর পর খুঁজে ওদের পাসপোর্ট দিয়ে দিল। বাইরে এসে খুলে দেখে মনিরার এবং রাশেদ সাহেবের ভিসা দিয়ে দিয়েছে। আনন্দে রাশেদ সাহেব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কেঁদে ফেললেন। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই ভাবে কোন ইন্টার্ভিউ ছাড়া, উৎকণ্ঠা নিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে থাকা ছাড়া মনির ভিসা এত সহজে পাবে, এতো স্বপ্নাতীত। মনিও কেঁদে ফেললো। মনিরা কাঁদতে কাঁদতে বললো-
-তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্যই আমি যাচ্ছি। আমি জানি অনেক আলোচনা সমালোচনা হবে, অনেক ঝড় উঠবে, অনেক গঞ্জনা যন্ত্রণা পোহাতে হবে তবুও শুধু তোমার জন্য আমি সব মেনে নিতে প্রস্তুত।

মনে মনে খোদাকে ডেকে বললেন ‘হে খোদা তোমার দরবারে শোকর জানাবার ভাষা আমার মনে আসছে না, তুমি তো সবই জান, তোমার মনিকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না, নিশ্চয়ই তুমি এটা জান বলেই আমার প্রতি এই রহমত করেছ।
একটু শান্ত হয়ে মামাকে ফোন করে জানিয়ে বাড়িতে মেয়েদের জানালেন।
-মামা বললেন তাহলে তোরা দেরি করবি না।
একটা ঠিকানা দিয়ে বলে দিলেন এই ঠিকানায় যেয়ে আমার কথা বলে টিকেট ফাইনাল করে এক বারে বাসায় যাবি, আমি ওদেরকে বলে দিচ্ছি।
মামার কথা মত ওরা একটা স্কুটার নিয়ে মতিঝিলের একটা ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে এসে টিকেট কনফার্ম করে পাসপোর্ট দিয়ে চলে এলো। আগামী বুধ বারে রাত এগারোটায় ফ্লাইট। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে লন্ডন। পরশু এসে পাসপোর্ট টিকেট নিয়ে যেতে বলে দিল। বাড়িতে ফেরার পথে স্কুটারে বসে মনির মুখের দিকে চেয়ে দেখে মনির ঠোট নীল হয়ে গেছে, চেহারা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।
-কি ব্যাপার মনি তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন, কি হয়েছে?
-সাধে কি আর তোমাকে আমি নাদু গোপাল বলি?
-কেন কি হয়েছে?
আমাকে তো নিচ্ছ কিন্তু যেয়ে থাকবো কোথায়? তুমি একা পুরুষ মানুষ যেখানে সেখানে থাকতে পারতে।
-আরে বোকা এ হচ্ছে লন্ডন এখানে কি ভেবেছ মানুষ ফুটপাথে বা রেল স্টেশনে থাকতে পারে? ওটা শীতের দেশ না? ওখানে কেও ফুটপাথে থাকে না। আমার ভাই তার ওখানে যেতে নিষেধ করেছে বলে কি ভেবেছ আমার কোন জায়গা নেই? তুমি জান না, সারা পৃথিবীতে আমার সব বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে? আর আমার বন্ধুদের তো জানই তারা কেমন।
-ওখানে কে আছে?
-আছে, আছে। ভেবো না
-বল না কে আছে।
ওখানে ফিরোজ আছে, শাহিনের বোন আছে। ফিরোজকে আজই মেইল পাঠাবো।
-কোন ফিরোজ?
-তুমি চিনবে না।
-আমার ভয় করছে!
-আরে পাগল নাকি? কি যে বল, আমি আছি না? সারা জীবন দেশের বাইরে কাটান স্বামীর স্ত্রী তুমি, আর তুমি আমার উপর এটুকু আস্থা রাখতে পারছ না?
কথা বলতে বলতে বাড়িতে এসে পৌঁছে গেলো। বাড়িতে এসে সবাইকে জানিয়ে দিল, মনিও যাচ্ছে আমার সাথে। বৌ যাচ্ছে, ভাবী যাচ্ছে শুনে সবাই অবাক!
-এতো টাকা পেলেন কোথায়?
-টাকা কি আর পাওয়া যায়, ম্যানেজ করেছি।
এই শুরু হলো সন্দেহের আর এক স্তর যা রাশেদ সাহেবের সরল মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকল না।
ঘনিষ্ঠ দুই এক জন আত্মীয় স্বজনকে জানিয়ে দিল। মনের ভিতর একটা করুণ বেহাগের সুর বাজিয়ে আস্তে আস্তে বাঁধা ছাঁদার কাজ করছে। মনিরার মন থেকে অজানা আতংক কোন ভাবেই দূর হচ্ছে না। সব সময় তার মনে হচ্ছে কি জানি কখন কোথা থেকে কি হতে কি হয়ে যায়। রাশেদ সাহেব তাকে অভয় দিয়ে বুঝিয়ে যাচ্ছেন আর যা যা নিয়ে যেতে হবে তা সংগ্রহ করছেন। দু এক জন আত্মীয় এসে দেখা করে তাদের মত করে কিছু পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। এক দিন বিকেলে মনিরার বড় বোন আর দুলাভাই এলেন। তারাও মনিরাকে বোঝালেন।
-এ তো ভালোর জন্যই হয়েছে। তুমি ওকে হতাশ করে দিও না। ও যা বলে সেই ভাবে চলো। মনে সাহস সঞ্চয় কর। যে যাই বলে বলুক এখন তোমার সেদিকে মন দিলে চলবে না। তুমি শুধু রাশেদের কথা ভাব। বাসায় মেয়েদের জন্য চিন্তা করো না। ওদের চাচী থাকছে তাছাড়া ফুফু, নানী, খালা যে যখন পারে এসে থাকবে। মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার। তুমি তো আবার চলেই আসবে।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-১০

২১।
সন্ধ্যায় নেয়া ছোট ভাইয়ের দেখান সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে আর কি করবে? কিন্তু তার পরেও একটা কাটার খোঁচা তার মনে বিঁধেই রইলো। মনি। মনিকে ছাড়া সে থাকবে কি ভাবে? আর মনিই বা থাকবে কি ভাবে? হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো। আচ্ছা মনিকে যদি সে এবার সাথে নিয়ে যায় তাহলে তো মনি অন্তত বছরে একবার করে যেতে পারলেও এতটা অসহ্য মনে হবে না। ওর সাথে যদি মনির ভিসার জন্য এপ্লাই করে তা হলে কোন সমস্যা নেই, ভিসা পেয়ে যাবে।
হ্যাঁ, তাইতো এই কথাই ঠিক। কিন্তু, এতো টাকা পাবে কোথায়? তার নিজের ভাড়ার টাকার কোন হদিশ নেই, মনির জন্য কোথায় পাবে? তাছাড়া বাড়ির সবাই ভাববে, ভাত জোটে না আবার বুড়ো বয়সে হানিমুন করতে বিলাত যাচ্ছে! কিন্তু কিন্তু করতে করতেই রাশেদ সাহেব ভেবে নিয়েছে, এই ই করতে হবে। মনি যদি বৎসরে এক বারও যেতে পারে তা হলেও অন্তত এই দীর্ঘ চার বৎসরের বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা পোয়াতে হবে না। আর একটা কথা হচ্ছে এখন মনে হচ্ছে চার বৎসর, আসলে যে এর চেয়ে বেশি হবে না তাই বা কে জানে।
-মনি, ঘুমিয়েছ?
-না, তুমি যেভাবে ধরে রেখেছ তাতে ঘুম আসে?
-এই সংলাপ আবার কবে আমদানি করলে, আমি কি এই নতুন ধরে রাখলাম, ধরে তো রয়েছি আজ ছাব্বিশ বছর ধরে।
-কিছু বলবে?
-হ্যাঁ, বলছিলাম কি, একটু আমতা আমতা করে বলেই ফেললো, তুমিও চলো না আমার সাথে
মনিরা কিছু না বুঝে বললো-
-সাধে কি আর আমি পাগল বলি?
-না সাধে বলবে কেন আমি তো পাগল, আর এজন্য তো তুমিই দায়ী, তুমিই আমাকে পাগল বানিয়েছ।
-আচ্ছা ঠিক আছে এজন্য যে শাস্তি দিতে চাও কাল দিও এখন ঘুমাও।
বলেই শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে স্বামীর গায়ে মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিল।
সকালে উঠে আবার মনিকে কাছে ডেকে নিয়ে বললো-
-তুমি তো পাগল বলেই খালাস, আমার কথাটা একটু মন দিয়ে শোন।
-বল।
রাশেদ সাহেব রাতের ভাবনা গুলি আবার বুঝিয়ে খুলে বললো । আরও বললো যে নয়া মামার অনেকের সাথে জানা শোনা আছে তাদের কারো ট্রাভেল এজেন্সি আছে, তাকে বলে দেখি যদি বাকিতে বা অন্য কোন ভাবে দুইটা টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারে।
শুনে মনিরা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-টিকেট দুইটা কেন?
-বারে, রাতে কি বললাম আর এতক্ষণে বা কি বললাম?
-না, না, তা হবার নয়। তুমি এভাবে ভেবো না, এসব এই মুহূর্ত সম্ভব নয়, সবাই বলবে কি?
-সবার কথা বাদ দাও, আমি তো তোমাকে নিয়ে হানিমুন করতে বা রং ঢং করতে যাচ্ছি না, শুধু তোমার ভিসার একটা ব্যবস্থা হয় এই জন্য। তুমি যেয়ে অন্তত এক সপ্তাহ থেকে এলেও হবে। এবার আমার সাথে গেলে যত সহজে ভিসা হবে পরে এমন সহজে আর হবে না। দেখ এক নাগারে এতো দিন আমি আমার মনিকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবো না।
-থাকতে কি আমিও পারবো?
-তাহলে আর এমন করে বলছ কেন?
মনিরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হলো না।
-দেখ মনি, আমি যদি এতো দিন তোমাকে ছাড়া থাকি তাহলে আর আমাকে সুস্থ ফেরত পাবে না, নিশ্চয়ই আমি পাগল হয়ে যাব। তুমি কি বাকী জীবন এক জন পাগলকে নিয়ে চলতে পারবে?
শেষ পর্যন্ত মনিরাকে হার মানতেই হলো।
নাশতা খেয়ে রাশেদ সাহেব বের হয়ে সোজা মামার অফিসে গিয়ে সব খুলে বললেন।
শুনে মামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন-
-ঠিক বুদ্ধি করেছিস। তুই তোদের ভিসার জন্য প্রসেস কর আমি টিকেটের ব্যবস্থা করে দিব, আজ রাতেই তোকে ফোনে জানাব, টিকেট নিয়ে তুই ভাবিস না। এখনই বাসায় গিয়ে ওয়েব সাইট থেকে ভিসা ফর্ম নিয়ে ফিল আপ করে কালই দিয়ে আসবি। এপ্লাই করার টাকা আছে?
-না।
-তাহলে সে কথা বলছিস না কেন? একটু অপেক্ষা কর, টাকা নিয়ে যা।
একমাত্র মামাই তার যন্ত্রণা বুঝতে পারলেন। মামা হলেও প্রায় সম বয়সী, এক সাথে বিড়ি সিগারেট খায়। মামাই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দেয়, নে। এজন্যেই মামা বুঝতে পেরেছেন। মামার অফিস থেকেই ফোন করে মনিকে জানালেন। সবাই যখন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন একমাত্র এই মামাই তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
-কিছু খাবি?
-না, এইতো নাশতা করে এসেছি।
-তা হলে একটু চা খা এই ফাঁকে আমি কবিরকে ব্যাংকে পাঠাই?
-তা করা যায়।
কলিং বেল টিপে কবিরকে চা দিতে বলে ব্রিফ কেস থেকে চেক বই বের করে লিখে রাখলেন। কবির চা নিয়ে এলে তার হাতে চেকটা দিয়ে দিলেন। চা খেতে খেতেই কবির টাকা নিয়ে এলো।
টাকা নিয়ে খুশি মনে মামার অফিস থেকে বের হয়ে সোজা বাড়িতে এসে ছোট ভাইয়ের কম্পিউটার অন করে ব্রিটিশ হাই কমিশনের ওয়েব সাইটে খুঁজে খুঁজে ভিসার ফর্ম বের করে প্রিন্ট করে তা পূরণ করে মনিরাকে ডেকে সই স্বাক্ষর দিতে বললো ।
মনি ইতস্তত করছে দেখে রাশেদ সাহেব বললো-
-নাও সই কর, ভয় কিসের তোমার সতীন আনতে যাচ্ছি না তোমাকে নিয়েই রংগ লীলা করতে যাচ্ছি ভয় পেয়ো না।
-আমি সে ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি আমাকে আল্লাহর রহমতে সতীনের মুখ দেখতে হবে না, সে ব্যাপারে আমার কোন ভয় নেই। আমি ভয় পাচ্ছি অন্য কারণে।
-আহা সই করতো, ভয়ের কোন কারণ নেই, যা হবার হোক। কাল সকালে চলো এগুলি জমা দিয়ে আসি।
-না কাল না।
-তাহলে?
-বুধবারে চলো।
-মানে আজ সোম বার, তুমি পরশুর কথা বলছ?
-হ্যাঁ, তোমার সব শুভ কাজ বুধ বারেই হয়, এ যাবত তাই দেখে আসছি।
-আচ্ছা বুঝেছি, তাহলে তাই হবে পরশুই চলো।
রাতে মামা ফোন করে রাশেদকে চাইলেন, রাশেদ ফোন ধরতেই ও পাশ থেকে মামা বললেন
-হাই কমিশনে গিয়েছিলি?
-না।
-কেন?
-মনি রেডি ছিলোনা তাই কাল যাব।
-আচ্ছা ঠিক আছে। টিকেটের ব্যাপারে কথা বলেছি। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে পাওয়া যাবে কিন্তু শর্ত হচ্ছে এক মাসের মধ্যেই টাকা দিতে হবে। কি করবি, পারবি?
-হ্যাঁ তা পারা যাবে।
-তাহলে তোরা কালই যা দেখ কি হয়, আমাকে জানাবি।
[হেমন্তের এই শিশির ভেজা পথে রাশেদ সাহেবের চলার সাথে সাথে এই উপাখ্যান চলবে]