রিয়া রিয়া এর সকল পোস্ট

আমার পৃথিবী

আমার পৃথিবী

প্রকৃতিতে ফাগুনের জোয়ার এলেই,
আমার বেঁধে রাখা, লুকিয়ে রাখা প্রেম,
সমস্ত শিকল ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসতে চায়।
চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে চায় যত মন।
আর তখনই আমার সর্বক্ষণ কল্পনায় শান্ত থাকা
অনু পরমাণু গুলো খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসে।
দারুন বিদ্রোহে ঝড় তোলে, তছনছ করে দেয় সব।

আমার চোখে তখন পলাশের সমারোহ,
শরীরের উজান বেয়ে নামে লাভার স্রোত,
তুমুল বৃষ্টি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
জেগে উঠি বৃষ্টি স্নাত হয়ে, বুকে তখন
ছলাৎ ছলাৎ, উথাল পাথাল ঢেউ।
তুফান তখন নিশ্বাস প্রশ্বাসে, শিরায় শিরায়।
গিরি গুহা উপচে পড়ছে ম্যাগমা প্রপাতে।

ধীর লয়ে বেজে চলেছে মোৎজার্ট, সোনাটা।
চারিদিকে থৈ থৈ ভিজে ভিজে পরাগ রেণু।
তারপর পৃথিবী ক্লান্ত হলে, রণক্লান্ত সময়ে,
ভেঙে যায় বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা,
অভিমানের যত বাঁধ, ভেসে যায় ফাগুন।

এই তো ধরেছি হাত

আজ প্রেমের দিন। বানিজ্যিক সংস্থারা এই দিনটিও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। প্রেম আছে কি নেই, আমার জীবনে তার প্রভাব নিয়ে রচনা লিখতে যাচ্ছি না। আসুন আজকের দিনে একটা প্রেমের কবিতা পড়ি।
***************

এই তো ধরেছি হাত

এইতো ধরেছি হাত চলো
হেঁটে যাই মোহনায় সুখে
এইতো এসেছি কাছে বলো
যা কিছু জমানো আছে বুকে

মোহনায় স্রোত আছে যতো
তারা কি আমায় কাছে ডাকে?
পরিযায়ী পাখিদের মতো
মেঘ জমে প্রিয় মৌচাকে?

হঠাৎ বালিশে ঘুম নামে
সারারাত একা বসে থাকা
জেগে আছো এই মধ্যযামে?
এই পথ শুধু আঁকাবাঁকা?

একফোঁটা আলো ফেলে মনে,
রামধনু থমকে মিনারে
আধোসুখে জলছবি এঁকে
সুখ ভাসে মেঘের কিনারে।

ঝিরিঝিরি নদীটির বাঁকে,
রাত নামে নিয়ে অবসর
কেউ কি রেখেছে মনে আজও?
রাত জাগা চোখের খবর।

পথ ভোলা অন্ধকার রাতে
নাভি ঘেঁষে চাঁদ ওঠে দেখো,
উদাসীন এলোমেলো সুখে,
এ ভাবেই হাতে হাত রেখো।

_________
রিয়া চক্রবর্তী।

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – শেষ পর্ব

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – পর্ব ৩

এখন আরও কিছু প্রতিভাবান ব্যাক্তিদের কথা বলবো যারা এই রকম রোগের শিকার হয়েছেন। মায়াকোভিস্ক, আইজাক নিউটন, মারিনা স্ভেতায়েভা, এমিলি ডিকিনসন।

শতাব্দির শুরুতে রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত মায়াকোভস্কিকে বলা হয় রাশিয়ান কবিতার ‘raging bull’. ওভারকোট আর হ্যাট মাথায় দীর্ঘদেহী এক মানুষ। যিনি পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ, মানুষে মানুষে ঘৃণা, অসাম্যের কথা বলেছেন তাঁর কবিতায়। অসাধারণ সুন্দর আবৃত্তি করতেন মায়াকোভস্কি, তাঁর কবিতায় রয়েছে এক ধরনের বিমর্ষ চিৎকার। মায়াকোভস্কির জীবনের শেষ বছরটি ছিল খুবই ঝঞ্ঝাময়। তাঁর স্ত্রী লিলি ব্রুকের মতে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি তার স্বভাবজাত ছিল। তিনিও নানান কারনে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি তাতিয়ানা নামের এক মডেলের প্রেমে পড়েন, তাতিয়ানা একজন ফ্রেঞ্চকে বিয়ে করায় তিনি মানসিক অবসাদে ভোগেন। এছাড়াও যে আদর্শের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন তার অবনমন তাঁকে ব্যাথিত করে তুলেছিল। এসব বিবেচনা করে অনেকে মনে করেন যে তিনিও সম্ভবত বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগেছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৪ এপ্রিল সকাল ১০:১৭ তে মায়াকোভস্কি নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।

মারিনা স্ভেতায়েভা কবির ইংরেজি প্রতিবর্ণীকরনে কবির পূর্ণ নাম – Marina Ivanovna Tavetaeva. এটি মূল রুশ উচ্চারণের প্রায় কাছাকাছি। বাংলায় রুশ উচ্চারণ অনুসারে পদবীর উচ্চারণ করলে সেটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। মারিনা স্ভেতায়েভার শহর ছিল মস্কো। এটা যেন তাঁর শহর, একান্ত নিজের। এই শহর যেন তাকে কোন জাদু করেছিল। এই ভাললাগা ছিল তাঁর নিজস্ব ও ব্যাক্তিগত। রাশিয়ার বিখ্যাত কবিদের মধ্যে তিনি একজন। আখমাতোভা, মায়াকোভস্কি, ও অন্যান্য কবিদের সাথে তাঁর নাম ও সমান ভাবে উচ্চারিত হতো। তথাপি তাঁর ব্যাক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। বহুবার ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছেন। খুব দারিদ্রের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন। এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মারিনা স্ভেতায়েভার কোনোদিনই নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেন নি। অসহায়তায়, অক্ষম সমর্পণে ছিল তাঁর তীব্র অনীহা। এই সবের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা। একটু শান্তির জন্য তিনি এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। দু’বেলা অন্নের জন্য তিনি লড়াই করেছেন। হয়ত পুরোপুরি সফল হন নি। সেটা বড় কথা নয়। দুঃখভার সইবার শক্তি ছিল তাঁর অসীম। কিন্তু আমাদের এই প্রিয় কবিও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন। ১৯৪১ সালের ৬ই অগস্ট কামা নদীর তীরে এলাবুগা নামক একটি জীর্ণ, পোড়ো এক শহরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ফাঁসের জন্য ব্যাবহার করেছিলেন শণের দড়ি।

এমিলি ডিকিনসনকে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা কবিদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। ছোটবেলায় এমিলি নিজেকে মেধাবী ছাত্রী ও বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবে প্রমাণ করেন। ছড়ায় ছড়ায় গল্প লিখে তিনি তার সহপাঠীদের আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন। সমাজ জীবন থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে একাকিত্বের ঘেরাটোপে আটকে রেখে এক অস্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন তিনি, একেবারেই সাদামাটা ও নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। ডিকিনসন এক অজানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই, সম্ভবত রোগটি ছিল মানসিক বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ বা স্থায়ী বিষাদগ্রস্ততা। তিনি নানদের মতো সাদা পোশাক পরতেন। তিনি মৃগী রোগে মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যেতেন। এবং এই মৃগী রোগের কারনেই তিনি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন।

সেরা বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের ব্যক্তিত্ব ও কিছু ব্যবহার ছিল বেশ অদ্ভূত এবং পাগলাটে। নিউটনের সময়ে আলো নিয়ে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় নি। চোখ কি নিজে আলো তৈরি করে, না কি সংগ্রহ করে এ বিষয়টা স্পষ্ট ছিল না মানুষের কাছে। সেই কারনে তিনি নিজের ওপরই একটা পরীক্ষা করে দেখেন। অপটিক্স নিয়ে নিজেই নিজের গিনিপিগ হন এবং তার নোটবুক থেকে একটা পরীক্ষার কথা পাওয়া যায়, যেখানে তিনি তার দুই চোখের মাঝখানের হাড়টিতে একটা ভোঁতা সুঁচ দিয়ে খোঁচা মেরে দেখেছিলেন রংয়ের অনুভূতিটা কেমন। ১৬৭৮ সালে তাঁর আলোকবিদ্যার (থিওরি অব অপটিক্স) বিভিন্ন দিক নিয়ে এক বিতর্কে জড়ানোর পর, তিনি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। ১৬৯৩ সালে দ্বিতীয়বার এমন হয়েছিল তিনি আবারও মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন তারপর তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে অবসর নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারের মানসিক ভেঙে পড়ার পেছনে কম ঘুমকে দায়ী করেছেন নিউটন। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা অন্যান্য সম্ভাব্য কারণের কথা বলেছেন। গবেষণার সময় রাসায়নিক দ্রব্যাদির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং দীর্ঘকালীন মানসিক দুর্বলতা ও বিষন্নতার সম্মিলিত কারণে এটা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষকেই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যারা এই অসুখে ভুগছেন। ২০০৭ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক উইলিয়ামস দেখেন মেডিটেশন বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে কাজ করেছে। কেমিব্রিজ ইউনির্ভার্সিটির জন টিসডেল ক্রনিক বিষন্নতা গ্রস্ত রোগীদের ওপর মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশনের প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেন, এদের মধ্যে পুনরায় বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার হার অর্ধেক কমেছে। ২০০৮ সালে বিজ্ঞানী প্রোলাক্স দেখেন মেডিটেশনের ফলে এই ৪০% রোগীর উন্নতি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে সানডিয়েগোর ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানী সানহফ খালসা দেখেন, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও মেডিটেশন কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে, হতে হবে সংযমী। আমরা আমাদের মন কে পুরোপুরি জয় করতে না পারলেও তাতে লাগাম দেয়ার চেষ্টা তো অবশ্যই করতে পারি। আর এই চেষ্টার ফলে যদি আমাদের কিছু অন্যায় ইচ্ছে বা মুড প্রশমিত হয় তাহলে আমরাই উপকৃত হবো। আমাদের জীবন তখন হয়ে উঠবে সুখী-সুন্দর ও নির্মল। এর ফলে মন-প্রাণ সুন্দরের সৌরভে ভরে যাবে জীবনে ছড়িয়ে পড়বে শান্তি।

(সমাপ্ত)

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – পর্ব ২

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – ২

এর আগেই আমরা জেনেছি যে প্রতিভাবান ও সৃজনশীল মানুষেরা বাইপোলার ডিসঅর্ডার নামক মানসিক রোগের শিকার হয়ে থাকেন। ইতিমধ্যেই আমরা কিছু সাহিত্যিক ও সৃজনশীল ব্যাক্তিত্বদের সম্বন্ধে (যেমন ভ্যান গঘ, সিলভিয়া প্লাথ, ভার্জিনিয়া উল্ফ, এডগার অ্যালান পোর মতো খ্যাতিমান ব্যাক্তিদের সম্বন্ধে) জেনেছি।

আজ প্রথমেই যেটা জানবো সেটা হল বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি? আমরা জানি শরীর ও মন একে অপরের জন্য অপরিহার্য। মন ভাল না থাকলে শরীর ভাল থাকে না। তেমনি শরীর ভাল না থাকলে মনও ভাল থাকে না। আপনাকে সুস্থ থাকতে হলে শরীর ও মন দুটোতেই সুস্থ থাকতে হবে। কিন্তু শরীরের অসুখ হলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি এবং চিকিৎসক এর কাছে গিয়ে নিজেরাই চিকিৎসা করাতে পারি। মনের অসুখ হলেও তা পারি কি? হ্যাঁ আমরা তাও পারি, তবে তার আগে মনের অসুখ হয়েছে কি না, সেটার গুরুত্ব দেওয়ার উপর নির্ভর করে আমরা মনের অসুখের জন্য চিকিৎসকের কাছে যাবো কি না। বেশীর ভাগ সময় আমরা বুঝতেই পারি না যে আমাদের মনের সমস্যা আছে এবং চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

তাছাড়া মনোরোগ শুরুতেই বুঝতে পারলে এর ক্ষতিগ্রস্ততা কম হয়, কারণ তাতে চিকিৎসা করে অথবা সাবধান হয়ে রোগটি সাড়ানো যায়। মনের অসুখ সারাতে মেডিটেশন খুবই দরকারি। আমরা অনেকেই কম বেশী মেডিটেশন সম্পর্কে জানি যে কিভাবে মেডিটেশন করতে হয়। স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা, হতাশা, বিষণ্নতার পাশাপাশি অন্যান্য মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও মেডিটেশন কার্যকরী। অনেক সাইকিয়াট্রিস্টই এখন অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, মনোযোগের বিক্ষিপ্ততা, হাইপার এক্টিভিটি ডিসঅর্ডার, এবং সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে মেডিটেশন করাকেই যুক্তি সঙ্গত বলে মনে করেন।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার হলো হঠাৎ করে কোন ইচ্ছের বা মুডের ফলে যে মানসিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়, একে ‘ম্যানিয়া’ও বলা হয়। বাইপোলার ডিসঅর্ডার এক ধরনের গুরুতর আবেগজনিত মানসিক রোগ, এর এক দিকে থাকে ‘ডিপ্রেশন’ বা বিষণ্নতা এবং অন্য দিকে থাকে ম্যানিয়া। ডিপ্রেশনে মনের আবেগের উদ্দীপনা কম থাকে। মনে বিষণ্ণতা অনুভব হয়। কোনো কাজ ভালো লাগে না। শরীরে ও মনে অবসাদ অনুভব হয় আর অন্যদিকে ম্যানিয়াতে মনের আবেগের উদ্দীপনা অতিরিক্ত অনুভূত হয়। সব কিছু বেশি বেশি ভালো লাগে মনে অতিরিক্ত উত্তেজনা কাজ করে ইত্যাদি।

এ রোগের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হলো রোগী হঠাৎ করে আত্মহত্যা করতে পারে। বাইপোলার ডিপ্রেশনে থাকাকালীন সময়ে আত্মহত্যার সম্ভাবনা প্রায় ৪০% হতে পারে। ম্যানিক ডিসঅর্ডারেও প্রায় ১০% রোগী আত্মহত্যা করতে পারে। অধিক উত্তেজনার কারণে অনেক সময় কাউকে মেরেও ফেলতে পারে। জিনিসপত্র ভাঙচুর বা অন্য কাউকে শারীরিকভাবে আঘাতও এ রোগের অন্যতম ঝুঁকি। তাছাড়া ম্যানিক রোগগ্রস্ত অবস্থায় অনেকের বেশি টাকা-পয়সা খরচের প্রবণতা বেড়ে যায়। এ সময় হঠাৎ করে বিভিন্ন ব্যাবসায় অর্থ বিনিয়োগ করে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। বাইপোলার ডিসঅর্ডারে রোগীর জীবনের একটা বড় কার্যক্ষম সময় নষ্ট হয়ে যায়। তাই রোগী বিভিন্ন সময় নানারকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত থাকে এমনকি বহু ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে আকৃষ্ট হতে পারে।

চলবে …

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা

প্রতিভাবানব্যক্তি দের মানসিক সমস্যা

প্রতিভাবানদের মধ্যে ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ বা ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’ এর নজির দেখা গেছে হাজার হাজার বছর ধরেই। ভান গঘ, সিলভিয়া প্লাথ কিংবা ভার্জিনিয়া উল্ফে’র মতো খ্যাতিমান চিত্রকর-কবি-লেখকদের জীবনযাপন দেখে সহজেই তা বোঝা যায়। অ্যারিস্টটল, প্লেটো ও সক্রেটিসের জীবন কথায়ও এইরকম উল্লেখ আছে। অ্যারিস্টটল একসময় দাবি করেছিলেন, “পাগলামির ধাত্ ছিল না – অদ্যাবধি কোনো মহান প্রতিভাধরের জন্ম হয়নি।” কিন্তু, পাগলামি-ক্ষ্যাপামি-বিষাদগ্রস্ততা বা ইত্যকার সব বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে প্রতিভার যোগসূত্রের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা এতোদিন দুর্বলই ছিল। লন্ডনের কিংস কলেজের ‘ইন্সটিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি’র গবেষকরা স্টকহোমের কারোলিনস্কা ইন্সটিটিউটের গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন। ভ্যান গঘ -এর আঁকা বিখ্যাত সূর্যমুখী ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ স্থায়ী বিষাদগ্রস্ততা বা ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’ হিসেবে পরিচিত। ‘মুড’ বা ভাবের পরিবর্তনে ম্যানিয়া বা ‘ইলেশন’ থেকে সহজেই ‘ডিপ্রেশন’-এ চলে যেতে পারেন এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা। ম্যানিক পর্যায়ে এঁরা নিজের সক্ষমতা বা অক্ষমতা সম্পর্কে অতিশয়োক্তিতে ভোগেন, কথাবার্তায় অভাবনীয় চাতুর্যের পরিচয় দেন এবং বিশ্রামহীন হয়ে পড়েন, অনিদ্রায় ভুগতে শুরু করেন।

১৯ শতকের মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’-এ ভুগেছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। পো একবার বলেছিলেন, “লোকে আমাকে পাগল বলে। কিন্তু পাগলামিতেই বুদ্ধিবৃত্তির সবচেয়ে শিখরস্পর্শী অবস্থান নিহিত কিনা সেই প্রশ্নের এখনও সুরাহা হয়নি। ”জীবনভর মানসিক অস্থিতিশীলতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। অনেক জীবনীকাররই লিখেছেন, ভান গখ ডিপ্রেশন ও বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগেছেন। ১৮৮৮ সালে মানসিক আঘাতের চরম পর্যায়ে আর একটু হলেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু পল গঁগার জীবননাশ করতে চলেছিলেন তিনি। ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে এক নারীকে নিজের কানের একাংশ কেটে উপহার দেন তিনি। কবি সিলভিয়া প্লাথ নিজেকে সামলাতে ভয়াবহ যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন বারবার। আত্মহত্যার প্রবণতা, নিজেকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া থেকে শুরু করে কী করেন নি তিনি। এসব কারণে তাঁর কোনো সম্পর্কই টেকেনি। শেষপর্যন্ত গ্যাস-ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে আত্মহত্যার পর প্লাথের এই চরম আত্মঘাতী প্রবণতার রহস্য নিয়ে বহু জল্পনা-কল্পনা করেছেন পাঠকরা। গবেষকরা বলছেন, সম্ভবত বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগেছিলেন প্লাথও। ভার্জিনিয়া উল্ফ ১৯১৩ সালে জীবনের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ভয়েজ আউট’ শেষ করার পরপরই ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। উল্ফ নিজেই লিখেছেন, ‘”আমি বিয়ে করে ফেললাম এবং আমার মাথায় যেন আতশবাজির আগুনের ফুলকি ফুটতে শুরু করল। পাগলামির অভিজ্ঞতাটা আসলেই ভয়াবহ ভীতিকর৷ কিন্তু, আমি এখনই খুঁজে পাই যে, আমি যা কিছু লিখেছি, যেসব নিয়ে লিখেছি তা ওই আগুনের লাভাতেই জন্ম নিয়েছিল।”

প্রতিভাবানদের মধ্যে পাগলামির এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মনোবিশ্লেষক, মনস্তত্ত্ববিদ এবং মনরোগবিশষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিভাবানদের সঙ্গে পাগলামির যোগসূত্রটা আসলে এক ধরণের স্নায়বিক ভারসাম্যহনীতার মধ্যে নিহিত। ইন্সটিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি’র সিনিয়র লেকচারার ড. জেমস ম্যাকাবে এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সুইডেনের ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সি স্কুলছাত্রছাত্রীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সমীক্ষা চালান তারা। এইসব ছাত্রছাত্রীদের কতজন ৩১ বছর বয়সের মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণে চিকিৎসা নিতে গিয়েছে হাসপাতালের রেকর্ড থেকে তাও দেখা হয়েছে। গবেষকরা জানান, উচ্চ প্রতিভাবানরা যেমন মানসিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন তেমনি এই ঝুঁকি রয়েছে স্কুলে খুব খারাপ ফলাফলকারীদেরও। আর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যা করতে না পারলেও দেখা গেছে নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে এমন পাগলামি জেগে ওঠার সম্ভাবনা বেশি।

চলবে …

আমার সরস্বতী পুজো

আমার সরস্বতী পুজো

মাঘী পূর্ণিমা শুক্লা পঞ্চমীতে সরস্বতী পূজা হয়। শ্বেত পদ্মাসনা, শুভ্র-বসনা বিদ্যার দেবী সরস্বতী বাহন শ্বেত হংস। শিশির-স্নাত, কুয়াশা ভেজা ঊষালগ্নে দেবীকে তাঁর অগণিত ভক্ত আবাহন করেন। মৎস্যপুরাণে বলা আছে, পরমাত্মার মুখ থেকে নির্গত শক্তিদের মধ্যে দেবী সরস্বতী সর্বশ্রেষ্ঠা। তাঁর রূপ দেবীর মতো শ্রর্দ্ধাহা হয়েও প্রাপণীয়ার মতো আর্কষক। তিনি সর্বশুক্লা বা মহাশ্বেতা, বীণাধারিণী, কেশরাজিতে চন্দ্রশোভাময়ী, শ্রুতি ও শাস্ত্রে পারঙ্গমা এবং সৃজন-প্রেরণদাত্রী ও পদ্মাসনা।

আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে কত রকমের পালা পার্বণ, কত ধরনের যে উৎসব আছে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। হিন্দুদের বারোমাসে তেরো পার্বণের কথা প্রবাদের মত হয়ে গেছে। তেত্রিশ কোটি দেব দেবী নিয়ে আমাদের জীবন। তেত্রিশ কোটি না হোক, তেত্রিশ দেবতাকে পূজা দিতে গেলেও প্রতি মাসে গড়ে তিনটি করে পূজা পার্বণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। জীবনের প্রতিটি পর্বে একজন করে নিয়ন্ত্রক (দেব দেবী) থাকেন, যিনি স্বর্গ থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। শিবঠাকুরতো ভোলানাথ হয়ে সব ভুলে বসে থাকেন, দেবী দূর্গাকেই জাগতিক সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। সব খেয়াল করতে গিয়ে দেবী দূর্গা অধঃস্তনদের মধ্যে দপ্তর বন্টন করে দিয়েছেন। দপ্তর বন্টন পর্বে কন্যা সরস্বতীকে দিয়েছেন ‘শিক্ষা ও শিল্পকলা’ দপ্তর। কন্যাটিকে উনি জানিয়ে দিয়েছেন বাংলা বছরের মাঘমাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথিতে যেন বাংলার মাটিতে একবার করে ঘুরে যান।

মনে পড়ে, স্কুলে যখন নীচের ক্লাসে পড়তাম, সরস্বতী পূজা আসলেই মন আমার আনন্দে নেচে উঠতো। মা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠিয়ে হলুদ মেখে স্নান করিয়ে দিতেন। তারপর শুরু হতো চুনোপুঁটির রাঘব বোয়ালের সাইজের শাড়ি পড়ার পালা। তারপর দাদু পুজোয় বসতেন আর আমি তার পাশে। পুজোর আগে শুরু হতো দেবীর পায়ের কাছে বই খাতা কলম রেখে দেয়ার হিড়িক। এটা একটা রীতি যে সরস্বতী পূজার দিনে পড়তে নেই, বই খাতা দেবীর পায়ের নীচে দিয়ে রাখলে দেবী খুশী হয়ে বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে থাকেন ঐ বইয়ের ভেতর। দেবীর পূজার ফুল বেলপাতা বইয়ের ভেতর গুঁজে রাখলেই পরীক্ষায় ভালো ফল করা যাবে। এমনিতে সাধারন নিয়ম অনুযায়ী সব পূজার আচারেই একেকটা নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। যেমন সরস্বতী পূজাতে ‘খাগের কলম ও দুধজলে ভরা কালির দোয়াত’ লাগেই লাগে। আরও লাগে পলাশ ফুল, কুল, নিমপাতা কাঁচা হলুদ তাছাড়া পরের দিন দই মুড়ি, চিড়া, সন্দেশ, মিষ্টিতো আছেই।

আরেকটু যখন বড় হলাম, স্কুলের সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত, তখন তো মাতব্বরী করার অধিকার অর্জন করে ফেলেছি। তাছাড়া পুরো স্কুল জানতো আমি মোটামুটি আঁকতে পারি তাই আলপনা দেবার ভারও আমার ওপরেই থাকতো। তবে আমি একটু ডাকাবুকো ছিলামনা যে তা নয়, নেতাগিরি করতাম ছোটদের ওপরে, পুজোর দিন শিক্ষিকাদের ওপরেও।

শাড়ী পড়ে বড় সাজার হাস্যকর চেষ্টা। শাড়ি পড়তাম, বড়দের মতো করে চুল বাঁধতাম, এটাইতো কৈশোরের এক দুরন্ত মজার ব্যাপার। স্কুলটা ছিল আমার রাজত্ব। কলেজে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে টের পেতামনা। সরস্বতী পূজা হয়েছিল নিশ্চয়ই, তবে আমার স্মৃতিতে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই।

এই তো কিছু বছর আগের কথা তখনও তো আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব মানে ছিল, সেখানে কোন শঠতা ছিলনা, চরিত্রে নির্মলতা ছিলো, কোন কলুষতা ছিলোনা, আচরণে স্থিরতা ছিলো, কোন রকম অধৈর্য্যতা বা অস্থিরতা ছিলনা, অভিমান ছিল কিন্তু অভিনয় ছিলনা। তখন অবশ্য এখনকার মতো মোবাইল ফোন ছিলনা তখন, কম্পিউটারও ছিলনা, ফেসবুক ছিলো না এটুকুই তফাৎ। তাহলে কি প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে মানুষের আচরনের বৈরীতা আছে! এখন কাউকে বন্ধু ভাবার আগে দশবার ভাবতে হবে? বন্ধু ভেবে কাউকে কিছু ঘরে বানিয়ে খাবার দিতে গেলে (যেহেতু আগে খাওয়াবে কথা দিয়েছিল) সে যখন ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যায়, তখনই প্রশ্ন ওঠে বন্ধুত্ব নিয়ে। তাহলে কি কোনো বন্ধুত্ব ছিলোই না? পুরোটা অভিনয় ছিলো? নাকি অন্য রিলিজিয়ন বলে? নাকি খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারা যায় সেইভেবে? আর যাইহোক ভার্চুয়াল জগতে বন্ধু হয় না। অন্তত আমি আর কাউকে বন্ধু ভাবতে পারবো না। অপমান সূঁচের মতো বিঁধে যায়। আর সেই ক্ষত কোনোদিন শুকোবে না।

যাইহোক সরস্বতী পুজোয় ফিরে আসি। কালির দোয়াতে খাগের কলম ডুবিয়ে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ, কালিদাস,ভারবি আরও অনেক মহাকবিরা। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের খাগের কলমের বদলে ‘ফাউন্টেন পেন’, তারপরে এলো ‘বলপেন’, তারপরে এলো ‘জেল পেন’ এরও পরে এলো কম্পিউটার, ল্যাপ্টপ আর কীবোর্ড। এখন আর আমাদের কলম না হলেও চলে, আমরা ল্যাপটপ, আইপ্যাড, ই-বুক নামের ইলেকট্রনিক বই ব্যাবহার করি। এখন কেউ আর রবীন্দ্র নজরুল হতে চায়না, এমনকি আইন্সটাইনও নয়।

বিদ্যালয়গুলোতেও এক অদ্ভুত অস্থিরতা, মানুষ গড়ার কারিগররা আজ অনেকেই বিদ্যা নিয়ে ব্যাবসায় নেমেছেন, তবে কি এই সব দেখেই সরস্বতী দেবীও ভয় পেয়ে গেছেন? হয়তো পেয়েছেন না হলে বিদ্যার দেবী কি করে প্রেমের দেবীতে রূপান্তর হচ্ছেন…!

কং সি ফা চাই

কং সি ফা চাই

চন্দ্র বর্ষের প্রথম দিনটিকে চীনারা নববর্ষ হিসেবে পালন করে থাকে।

এই উৎসবকে বলা হয় ‘চুন জি’। ইংরেজিতে যা ‘স্প্রিং ফেস্টিভাল’ নামে পরিচিত। চীনারা তাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে। নতুন বছর আসলে কোন তারিখ থেকে শুরু হবে এর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কারণ এই তারিখ প্রতি বছর পরিবর্তন হয়! এই বছর আজকের দিন থেকে শুরু হচ্ছে ওদের নতুন বছর। অর্থাৎ ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে।

ওদের নববর্ষ আর বসন্ত দু’টোরই আগমন হয় একই সময়ে। উৎসব শুরু হয় বছরের শেষ মাসের মাঝামাঝি, শেষ হয় নতুন বছরের প্রথম মাসে। এই উৎসবকে তারা বসন্ত উৎসবও বলে থাকে। চীনের নববর্ষ তাদের নিজস্ব রীতিতে হয়। নতুন বছরকে তারা একটি প্রাণীর নামে নামকরণ করে থাকে। নির্দিষ্ট ১২টি প্রাণীর নাম ঘুরেফিরে রাখা হয় একেক বছর। এ বছরকে চীনা ক্যালেন্ডারে শূকর বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাকি ১১টি প্রাণী হচ্ছে: ইঁদুর, ষাঁড়, বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ভেরা, মোরগ, কুকুর এবং ভল্লুক। গত বছর ছিলো কুকুর বর্ষ।

নববর্ষের আনন্দ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রাণীর যোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে চীনা নববর্ষে। চীনে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ তাদের পরিবারের সাথে নতুন বছর উদযাপনের জন্য বহু পথ পাড়ি দেয়। বছরের এই সময়টাতে চীনে এতো মানুষ ভ্রমণ করে যে এটাকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় বার্ষিক মনুষ্য ভ্রমণ বলে আখ্যা দেয়া হয়। দীর্ঘদিন জমজমাট বসন্ত পালনের পর যে যার স্থানে ফিরে যান। একে বলা হয় চুনইয়ুন। উৎসব শুরুর আগে নিজেদের বাড়িঘর পরিষ্কারের ধুম পড়ে যায় চীনের ঘরে ঘরে। অনেক বাড়িতে বিশেষ করে দরজা, জানালায় লাল রঙের নতুন প্রলেপ দেয়া হয়। লাল রঙের গৃহসজ্জা সামগ্রী, বিশেষ ঐতিহ্যবাহী প্রবাদ, উপদেশ ও ধর্মীয় বাণী বা চিহ্নসংবলিত লাল ব্যানারে ভরে ওঠে চীনের বাড়িঘর।

বেইজিংয়ের হোইহাই হ্রদে মন্দিরের মেলায় ভিড় জমান উৎসাহীরা। নববর্ষের প্রথম দিনে ধর্মীয় আচার দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসব গড়ায় ১৫ দিন পর্যন্ত। শেষ হয় ১৫তম সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বলন উৎসবের মধ্যে দিনে। চীনারা বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। যেমন – সিংহ নাচ, ড্রাগন নাচ, লাল লণ্ঠন, পটকা, আতশবাজি, লাল কাপড় আর বিভিন্ন রকমের খাবার থাকে উৎসব উদযাপনে। বিশাল ভোজ, পথঘাট সাজসজ্জার পাশাপাশি দেশটির অধিবাসীরা নতুন সাজে নিজেদের সাজিয়ে নেন। লাল খামে করে বাচ্চাদের টাকা দেয়া হয় বর্ষবরণ উৎসবে। লাল প্যাকেটে কমলা লেবু উপহার দেয়া হয় পরস্পরকে। আর বাজি পোড়ানো হয় ভূতপ্রেত তাড়ানোর জন্য৷ চিনের প্রাচীরের একটি অংশে এই দিন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

মুঠি নামা

মুঠি নামা

এক মুঠিতে স্বপ্ন ছিলো, আরেক মুঠি ভয়।
স্বপ্ন মুঠি ধুয়েই গেছে, কি জানি কি হয়!

দিন দুপুরে মন পুকুরে, বিষণ্নতার রেশ।
স্বপ্নমাখা বিকেল বুঝি বিসর্জনেই শেষ!

ডুব দিয়েছি নদীর ঘাটে, কালচে গভীর জল।
কালচে জলের মুখোশজুড়ে অভিনয়ের ছল।

এক মুঠিতে বাতাস আমার, আরেক মুঠি জল।
জলের তবু নদী আছে, নদীর আছে তল।

অনেক ডাকি, সব ভুলে মন একটু কথা বল।
কথার তবু ছন্দ আছে, ছন্দে ভাসি চল।

চোখ ছলছল, আর্শি নগর, ভিজলো সাঁঝের পর।
মন নিকানো, ঘাস বিছানো, আলতা রঙা ঘর।

নে চিনে মন, আরেকটু রঙ, বেলাশেষের দিনে!
আলো ঝলমল, রং টলমল, আকাশ কুসুম চিনে।

মনরে তবু তুই তো আছিস, আর সম্বল গান।

হাতের তবু মুঠি আছে, মুঠির আছে মান।
এক মুঠিতে শ্রাবণ আমার, অন্য মুঠি রোষ।

শ্রাবণ মেঘে প্লাবন আনে, অনেক কথার দোষ।
দোষ করেছিস রোষ পেয়েছিস, চুপটি করে বোস।

রোষ হয়েছে, বেশ হয়েছে, পদ্ম পাতায় জল।
কোন কথাতে, কোন ব্যাথাতে মন হল ছলছল?

অভিমানের মন কেমনে, চোখ টলটল মানি!
দিনজুড়োবে, মন পুড়োবে, ফিনিক্স হব জানি !

নদীর তবু জোয়ার আসে, জোয়ার ভাটায় ক্ষণ ।
পলাশ বনে, আগুন রঙে, পুড়ুক না হয় মন।

কান ফুসফুস, মন চুপচুপ, কি জানি কি হয়,
বিসর্জনের ঢাকের বোলে, সব হারানোর ভয়!

আর আছে এক বন্ধ মুঠি, খোঁজ পায়নি কেউ।

বুক কাঁপেনি? একটুও না; মন কেঁপেছে?কই?
অনেক হল, এবার নাহয় চুপটি করে রই।

অবশেষ

অবশেষ

রক্তের শেষ দাগটুকু ধুয়ে দিয়েছি।
প্রতীক্ষা নতুন রক্তপাতের।
শেষ স্বপ্নের চিহ্নও মুছে ফেলেছি।
অপেক্ষা নতুন আঘাতের।

একলা চলো হাত, একলা চলো মন
আছে ধুসর, বিষণ্ণ সাম্পান।
ভুলবো যত অতীত নিশিযাপন
ভাসিয়ে দিলাম দুঃখ অভিমান।

জীবনও অনেকটা এইরকম

জীবনও অনেকটা এইরকম

ভোরের নরম রোদ এক সময় হারিয়ে যায়, সূর্য যখন তীব্র তেজে জ্বালিয়ে দেয় চারপাশ। আবার বিকেলের দিকে ধীরে ধীরে সে ক্লান্ত হয়ে যায়, তার উত্তাপ ক্রমে ম্লান হয়, তখন গোধূলিবেলা। কনে দেখা আলো মাখিয়ে দেয় আশেপাশের এলাকায়।

জীবনেও অনেকটা এইরকম। কষ্ট, তীব্রতা, আকাঙ্ক্ষা থাকে, তারপর ধীরে ধীরে ঝরে যায়। ম্লান হয়ে যায়। কোনো সম্পর্ক স্থায়ী হয় না। সব সম্পর্কের একটা expiry date থাকে। হাতের মুঠো থেকে একে একে ঝরে যায় সবই। কোনো কিছু জোর করে আটকে রাখা মানে সেই সম্পর্ককে দম বন্ধ করে মেরে ফেলা। জীবন তো সেই সূর্যের মতোই। যার শুরু থেকে শেষ আছে। একদিন আমরাও ওভাবেই মিলিয়ে যাব জীবন দিগন্তে। প্রতিটি জীবনই একেকটা উপন্যাস। একটা সময় আসে যখন মানুষ মুগ্ধ হতে ভালোবাসে আবার এক একটা সময় আসে, যখন সে আর কিছুতেই মুগ্ধ হয়না। তারমধ্যে তখন একটা শান্ত ভাব কাজ করে। নাহ! কোনো বিশেষ ব্যাপার নেই। কেবল পেরিয়ে যাওয়া সময়ের কঠিন অভিজ্ঞতারাই মানুষকে ‘ম্যাচিউর’ করে তোলে। খুব বেশি হারানোর কিছু আছে কী?

থমকে থাকা সময়

থমকে থাকা সময়

এখন অনেকটা পুড়ে গেছে মন, অনেকটা ধুয়ে গেছে মন। বার বার ভুলে গেছে ভুলে যেতে। জানি অনেক লেখার মতন এ লেখাও ঠাঁই পাবে waste paper basket এ। চোখ দুটো আজ টলটলে দিঘী। ডুব জলে সেই কবে মন কেমন অবগাহন। ভালো লাগা গুলো পলির মতো জমে মনের মোহনায়। সেই পলি ছেঁচে নিয়ে চোখ আঁকে খরস্রোতা ছলাৎছলাৎ। এখন একা হওয়া সময় গুলোতে আর যাওয়া হয়না ছাতের সে কার্ণীশ বেয়ে। মেঘেরা আজও আসে একবার করে শার্সীর আর্শীতে আর্জি জানিয়ে যায় আমাকে ভেজাতে চাওয়ার, ভিজে যায় মন-চোখ-শরীর। দৃষ্টির এতটুকু আকাশ, চাইতে গিয়ে গুটিয়ে গিয়েছি নিজেকে নিজের কোলের ভিতরে।

আজকাল আমি রাতের পর রাত নিজেকে নিজেরই কোল পেতে ঘুম পাড়াই। মন এখন অগুন্তি তারার গাঢ় পর্দার ওদিকে। আস্তে আস্তে বড় হয় দীর্ঘশ্বাস। একটু একটু করে নীল রঙা রাতভোর। আর শিশির ভেজা মাটির গন্ধের মতোই একটু একটু করে রোদ পেয়ে মুছে স্বপ্নগুলো। আমার এইসব হেঁয়ালি উদবৃত্ত বড়। উপাচারে যেমন অসম্মানিত ঈশ্বর, অবহেলায় তেমনি মনের বিসর্জন।

এখনও আমি হারিয়ে যাওয়া আমাকে খুঁজি রোজ। ঝরে পরা পাতাদের কানে কানে রোজ বলি, ভালো থেকো, আমিও তোমাদের একজন। ডাল ভেঙে এক ঝড়ের তান্ডবে ঝরে গেছি। আজও নদী খুঁজি রোজ, চুপি চুপি আনমনে, শহরের পথে পথে, মনে মনে, বিসর্জনের সময় এসেছে বোধে-অবোধে। বুঝতে কি চেয়েছে কেউ? বা আমি? পাঁজরের খাঁচার একটা একটা করে আগল উপড়ে নিচ্ছি রোজ। আর একটু একটু করে নিজেকে রোজ ভাসান দিচ্ছি ঘোলা জলে। বৃষ্টির সামনে রোজ হাঁটু গেড়ে বসি, দুহাত পেতে ভিখারির মতোই বলি, নদী দে, ভাসিয়ে নিয়ে যাক। নদী দে আরোও একবার।

তোমাকে চাই ২

তোমাকে চাই

তোমাকে শুধু একবার ছুঁতে চাই
শুধু একবার।

ওই দূরের পাহাড়ের মতো কতবার
আলতো ভাবে ছুঁয়েছি তোমায়।
বহুবার, বহুভাবে।
শুধু আমিই জানি, যখন তখন।
মন গুটিয়ে নিয়ে আবার ছড়িয়ে দিয়েছি
তোমার দিকেই।

নদীর বুক জুড়ে তোমার চলাচল।
তোমার নামেই চলে শ্বাস প্রশ্বাস।
তোমায় ছাঁয়ায় বাঁচি, অবরে সবরে।
ছুঁয়ে যেতে চাই আরও গভীর থেকে গভীরে
মিশে যাবো বলে

সেই আলোক বিন্দুতে, যেখানে অন্ধকারের শেষ।
রামধনু রং মেখে সাতটি তারা মিশে গেছে
আমার অস্তিত্বে। আমার চেতনায়।
তবু তুমি অধরাই থেকে গেছো।

শুধু একবার কাছে এসো, ছুঁয়ে দেখি
তারপর বৃন্দাবনে আলোর আভাস।।

স্বপ্ন পরিযায়ী

স্বপ্ন পরিযায়ী

সময়ে অসময়ে মনের মধ্যে বাসা বাঁধে সমুদ্রের উচ্ছ্বাস। দলছুট কোন ঢেউ তীরে এসে সুর তোলে ছলাৎ ছলাৎ। নীল জলে স্বপ্নভ্রূণ উল্লাস, অন্ধিতে, সন্ধিতে খোঁচা দেয় শীতের আগমনের। পর্বতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে উড়ে যায় এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি। সর্বস্ব পেছনে ফেলে নতুন ভূগোলে এসে সংসার পাতে তারা। যার সাক্ষী ইতিহাস যুগ যুগ ধরে।

বুক তোলপাড় করে চলে ইচ্ছেদের সাথে স্বপ্নের কথোপকথন। আকাশের সন্ধ্যে পাড়ায় তারাদের চঞ্চল আগমন। এই তারাগুলোও কিন্তু পরিযায়ী। আজ একজায়গায় তো কাল অন্য জায়গায়। স্বপ্নরাও পরিযায়ী। ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মতো চলে যায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। শুনেছি স্বপ্নেরা সুন্দর হয়, জন্ম হয় শীতল মনের আতুর ঘরে। আবার যখন ছেড়ে চলে যায়,চোখ চঞ্চল হয় একফোঁটা অথবা দুফোঁটা জলকণায়।

পরিযায়ী শব্দটি সম্ভ্রমে মাথা নীচু করে একমাত্র মেয়েদের কাছে। সে ঘুরে বেড়ায় বাবার ঘর থেকে বৃদ্ধাশ্রম পর্যন্ত। একজন মেয়ে বউ হয়, মা হয়। নতুন ভুগোলে এসে সে ভুলেই যায় সে অতীতে কি পড়তো, কি ভাবতো বা কি খেতো। কবে সে কোন বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলনা বাটি খেলেছে। আড্ডায় কি রঙের জামা পড়ে ভেসেছে, হেসেছে, কেঁদেছে! যখন তার মন কষ্টে নীল হয়, একটাও কোল সে পায়না যেখানে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে পারবে। নীরব নিষ্প্রাণ বালিশ গুলো তার নোনা জলের সাক্ষী।

যখন ঋতু বদল হয়, তখন কতবার তার মুড’ও বদলেছে ঐ ঋতুর সাথে পাল্লা দিয়ে, পরিযায়ী তাই তার খেয়াল রাখেনা কেউ। মেয়েটি একদিন সত্যিই বদলে যায় যখন এক নতুন অতিথি আসে তার কোল জুড়ে। ইতিহাস সাক্ষী এই বদলের যুগ যুগ ধরে।

পোষ পার্বণ

পোষ পার্বণ

আজকের দিনটা এলেই মন ছুটে চলে যায় সেই ছোটবেলায়। বড় হয়েছি যৌথ পরিবারে। প্রতিটি পার্বণের ছিলো আলাদা আলাদা আনন্দ। এই মকরসংক্রান্তি এলেই বাড়িতে সাজো সাজো রব পড়ে যেতো। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিয়েই স্নানের পর্ব শেষ করে দিতো বাড়ির লোকজন। তারপর রান্নাবান্না সংক্ষেপে সেরে নেওয়া হতো। ভোরবেলা উঠে ঠাম্মা চাল ভিজিয়ে রাখতেন। আমাদের তখন মিক্সার গ্রাইন্ডার ছিলো না। শিল নোড়াই ভরসা। মা, বড়মা সারা দুপুর ধরে সেই ভেজানো চাল বাটতেন। কত পিঠে হবে, পাটি সাপটা, গোকুল পিঠে, মুগপুলি, রাঙা আলুর পান্তুয়া নারকেল পুর দিয়ে, দুধ পুলি, সরু চাকলি, আসকে পিঠে, সেদ্ধ পিঠে, নতুন গুড়ের পায়েস, আরও কত কি! বিকেলে ঠাম্মার সাথে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে খাটালে যেতাম খাঁটি দুধ আনতে। সেইদিন দুধ পাওয়া মুশকিল হতো বলে, আমাদের রোজকার গয়লা চাচাকে বলে রাখা হতো দুধের জন্য। দুধ নিয়ে এসে সন্ধ্যেবেলা ঠাম্মা বসতেন পিঠে বানাতে। সন্ধ্যেবেলা থেকেই কত মানুষজন আসবে বাড়িতে পিঠে খেতে। কাকার বন্ধুরা, বাবার বন্ধুরা। আশেপাশের বাড়িতেও দেওয়া নেওয়া হতো পিঠে। আমরা ভাইবোনেরা যে ভীষণ পিঠে ভক্ত ছিলাম তা কিন্তু নয়। আমাদের ওই হৈচৈ করাতেই আনন্দ ছিলো। রাতে খুব বকে মেরে হয়তো একটা পিঠে খাওয়াতে পারতো। তাও মিষ্টি পিঠে নয়। নোনতা পিঠে। এই ছিলো আমার বাবার বাড়ি যেখানে প্রতিটি নিয়ম মেনে চলা হয়। নিয়ম নিষ্ঠা ভরে পুজো করা হয়।

কুড়ি বছর বয়সে যখন আমার বিয়ে দেওয়া হলো দাশগুপ্ত বাড়িতে। ভীষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম না জানি এদের কতো নিয়ম থাকবে। যখন জানলাম দুর্গা পুজো, কালি পুজো ছাড়া এইসব পার্বণ জরুরী নয় এই বাড়িতে। আমি চিরদিনই ঘরকুনো। সমুদ্রে, পাহাড়ে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি ভীষণ। কিন্তু এদিক সেদিক টই টই পছন্দের নয়। সেই আমি বিয়ের পরে একজন বন্ধু পেলাম আমার শাশুড়ি মা কে। তারপর বন্ধু হলেন আমার কাকা শশুর। একেবারে সমবয়সী বন্ধু যেন। আমার শাশুমা কে তিনি বলতেন ‘বৌদি রিয়া একেবারে খাঁটি সোনা, ওকে যে একবার চিনতে পারবে, সে ওকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না।’ আমাকে বলতেন, ‘এভাবেই মনটাকে সরল রেখো রিয়া, নিষ্পাপ মন তোমার।’ তারপর বন্ধু হলেন কাকি শাশুড়ি মা। মালপোয়া, পাটিসাপটা, মাছের নানান পদ, কোন মাছে পেঁয়াজ, রসুন দেবে আর কোন মাছ কালোজিরে কাচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে রান্না হবে সব তাঁর কাছেই শেখা। আমি সকালের জলখাবার না খেলে কাকুও খেতেন না, আমার শাশুমা আমাকে শিখিয়েছেন নিরামিষ সব পদ। বাড়ির সবথেকে ছোট বলে এদের স্নেহের প্রশ্রয় আমার বাড়ির বউ থেকে বাড়ির মেয়ে হয়ে ওঠা।

আজ এই পোষ পার্বণে যখন ঘরে বসে আছি মন খারাপ করে, কারণ প্রতি বছর এই দিনে বাবার বাড়িতে চলে যেতাম যে। এই বছর অশৌচ। কাকা মারা গেছেন যে। তাই এই বছর কোনো পুজো, অনুষ্ঠান হবেনা। তাই বাড়িতেই সামান্য আয়োজন যতটুকু শিখেছি আমার বটবৃক্ষদের কাছ থেকে তারই কিছু উদযাপনের চেষ্টা। যদিও সাঙ্ঘাতিক জ্বরের মধ্যে এইসব প্রচেষ্টা।

অনুলিখন : সায়নি

সায়নি

সায়নিকে হঠাৎই সেদিন শুনতে হলো – “কেত মেরে সেলফি পাবলিক পোস্টাবি আবার পাবলিক এডমায়ার করলেও দোষ”। অবাক হয়ে গেলো সায়নি। আবারও যখন পম্পা বলে উঠলো – “আরে আকর্ষণের গ্রাফ নামছে না উঠছে এটা জানতে হবে তো”। সেদিন অপমানে সারা তার দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না। ক্রমশ স্মৃতির ভীড়ে হারিয়ে গেলো ও। পম্পা কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লো। অথচ সায়নি কতো বোকা পম্পাকে বন্ধু ভেবেছিল। আজ সায়নীর বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। তবে তার শরীরের বাঁধন ভালো। বয়স বোঝা যায় না। একদিন সে সত্যিই সুন্দরী ছিলো। কোমর ছাপানো লম্বা চুল, টানা টানা চোখ, পদ্মকলির মতো ঠোঁট। ছিপছিপে চেহারা। সবই ছিলো জীবনে ভালোবাসা ছাড়া। বাবা বিয়ে দিলেন বিশাল পয়সাওয়ালা এক বিজনেস ম্যানের সাথে। বিয়ের পরে জানতে পারলো তার স্বামী একাধিক নারীতে আসক্ত। কিন্তু বড্ডো দেরী করে জানলো সে, ততদিনে তার কোল জুড়ে ফুটফুটে এক সন্তান। তবুও সে তার স্বামীর বদগুণগুলো মেনে নিতে পারে নি, পঁচিশ বছর বয়স যখন স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে গেলো, সমস্ত ভালোবাসা উজার করে দিলো তার সন্তানকে, আদরে, যত্নে তাকে বড় করতে লাগলো। সায়নী ভাবলো ওই পঁচিশ বছর বয়সে যখন সত্যিই সে কাউকে আকর্ষিত করতে পারতো, তখনই করেনি, চেষ্টাও করেনি আর আজ প্রৌঢ়ত্বের দোড়গোড়ায় এসে আকর্ষণ করবে? এতো দুর্দিন তার এসেছে! সেতো ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে অন্য কারণে, একদিন সে থাকবে না এই পৃথিবীতে, অথচ তার ছবিগুলো থেকে যাবে।

সায়নি জানে তাকে বোঝার মতো কেউ নেই। তার বন্ধু কেউ নেই। বড্ডো একা সে ভীড়ের মধ্যে। অথচ কতো প্রলোভন ওর সামনে ছিলো! কেউ বলেছিল সায়নিকে সে রানীর মতো রাখবে, তার বাড়ি, গাড়ি সব সায়নির নামে লিখে দেবে। শুধু একবার সায়নি তাকে বলুক ভালোবাসে। নাহ্ সায়নি সেদিন প্রলোভনের হাতছানিতে ভেসে যায় নি। সে কারো সংসার ভাঙতে চায় নি। সে কাউকে কখনও বলেনি ভালোবাসে। সে কাউকে ভালোবাসতে পারে না। তাকেও কেউ ভালোবাসতে পারে না। এতোগুলো বছর যে একা চলেছে সমস্ত ভীড় থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে আর আজ এই বয়সে এসে তাকেই শুনতে হলো ছবি পোস্টায় পাবলিককে আকর্ষণ করার জন্য! ছিঃ ছিঃ এর থেকে সায়নির মৃত্যুও ভালো ছিলো! সেদিন সায়নি সারারাত ভাবলো, যদি সত্যিই একাধিক পুরুষ তার জীবনে থাকতো, তাহলে বোধহয় ভালোই হতো। সে শুধু ভালোবাসাকে ভয় পেয়ে গেলো সারাজীবন।