রোমেল আজিজ এর সকল পোস্ট

রোমেল আজিজ সম্পর্কে

শখের বশে কবিতা লেখা শুরু, কিন্তু নিজেকে কবি বলে পরিচয় দেন না। প্রচুর বই পড়েন, বই পড়া পছন্দ করেন, শুধুমাত্র কবিতার বই নয় যেকোন বই। আর মাঝে মধ্যে টুকিটাক লেখালেখি। বর্তমানে শখের বশেই সম্পাদনার সাথে যুক্ত আছেন "দ্বিপ্রহর" কবিতা ও গল্প সংকলন এবং "দ্বিপ্রহর" ম্যাগাজিনের সাথে। প্রিয় কবি জীবননান্দ দাশ, এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, হেলাল হাফিজ, শামসুর রাহমান, সুনীল, আবুল হাসানের কবিতাও প্রিয়। প্রিয় উপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পড়ালেখা ছাড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, পছন্দ করেন একা একা বেড়াতে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ঘুম আর অপ্রিয় জিনিস ধর্মীয় তর্ক....

নিঃসঙ্গতার গান

ঘুম ভাঙা মাঝরাতে 
উথালপাথাল বৈশাখী বাতাসের
প্রতিটা আলোড়নই,
যেভাবে হাহাকার বয়ে দিয়ে যায়।
রাত্রি দ্বিপ্রহরের
দক্ষিণ আকাশে তারা বিহীন চাঁদটার
প্রতিটা আলোর বিন্দু
ঠিক সেভাবেই গেয়ে যায়
একাকী নিঃসঙ্গতার গান…

বিভক্তি না অনুসৃতা ?

গুনগুনিয়ে অনেকক্ষণ থেকেই মুখস্থ করছিলাম
‘বিভক্তিহীন নাম শব্দকে প্রাতিপাদিক বলে’।
প্রাতিপাদিক তো ঢের দূরের জিনিস
আজো বুঝলাম না বিভক্তির রহস্য।

আচ্ছা বিভক্তি কি মানুষের সম্পর্কের মতো?
যেখানে বয়ে গেছে অচিন নদী
ত্রস্ত স্রোতের মায়াজাল বিছিয়ে,
তোর আর আমার মাঝে?

জানিস অনুসৃতা;
বৃদ্ধ মৃত নদীকে বাঁধ দিয়ে
বশ মানাতে যায় না কেউ,
বশ মানানো হয় –
স্রোতস্বিনী চঞ্চলা নদীকে …

অভিযোজন

ছাদ-জানালা-দরোজা বিহীন ঘরকে কি
অন্তঃপুর যায় বলা ?
তবে এ কোন অপার্থিব অনুভূতি ছিল,
যখন সেই অন্তঃপুরে –
রাতদিন তোমায় থাকতাম ঘিরে ?
.
চলে যাওয়ার ক্ষণিক সময়টাতেও
তুমি বলেছিলে, “ভালোবাসি”
আমি বলেছিলাম, “বন্ধুত্ব?”
তোমার উত্তরে ছিল শুধু –
অধর বেয়ে বয়ে চলা জল!
.
তুমি চলে যাওয়ার পর –
কেটে গেছে অনেক সময়।
যেই কণ্ঠ না শুনে
একটা দিনও কাটতো না,
এখন তাকেই আর
কিছুই মনে হয় না।
.
জানিনা কীভাবে হলো শেষটা !
ভেবোনা তুমি,
কঠোরতায় এখনো ছাড়াইনি তোমায়।
তাই এখনো বুঝতে পারি
মিথ্যা বলা কতটা সহজ ;
ভুল নিয়মে মেনেছি তাই
স্বার্থপরতার অভিযোজন …

অনুশোচনা

আততায়ীর তপ্ত বুলেট
মেহেদী রাঙ্গা না হলেও,
রঙ যে হারায় লোহিতে।

কামারের হাপড়ের মত
আচমকা থামে হৃদকম্পন।
অশ্রুসজল চোখে ভাসে
চক, ড্রাস্টার, ব্ল্যাকবোর্ড;
পুকুর ভর্তি স্বচ্ছ জল।
চিনচিনে তীব্র ব্যাথা
মস্তিষ্কে বার্তা পাঠায়,
সময় হয়েছে তোর।

এইতো সেদিনও তুই ছিলি
হাসিমুখে থাকা নোংরা মিথ্যুক,
আজকেও কী তুই তা ছিলি না!

শুভ্র পোষাক গায়ে জড়ালে তো
মনের কদর্যতা যায় না ঢাকা।
লাল সাদা কণিকা গুলোরও
এবার সময় হয়েছে বিশ্রামের;
পুকুর ভর্তি স্বচ্ছ জল
চক, ড্রাস্টার, ব্ল্যাকবোর্ড,
ব্ল্যাকবোর্ড, চক, ড্রাস্টার…..

বিষণ্নতায় আক্রান্ত সময়

জীবন একটা বিষণ্ণ ফুটবল,
কখনো সট্রাইকারে মুখে
গোল পাওয়ার হাসি ;
কখনোবা ডিফেন্ডারের লাথি !
কখনোবা আবার জড়ায়ে বুকে
গোলকিপারের মতো
পিঠে ফের কষায় লাথি।

ঘুরে সময়, গড়ায় জীবন
কমে না অহংকারীর আস্ফালন ।
এরই মাঝে কেটে যায়
কিছু নিরহংকারীর দিন,
অফসাইডের নিয়ম গলে –
রোদ -বৃষ্টিতে ভিজে পুড়ে
ফুটো হওয়া ফুটবলের মতোই
ধুঁকে ধুঁকে গড়ায়ে।

স্বাধীন দেশে শকুনের রাজত্বে

সভ্যতার বোতলে বন্দী
অসহায় বলগা হরিণ,
মুক্ত আকাশে উড়ে
শকুনের দল সীমাহীন।
.
ঢেকে যায় চরাচর
চেতনা তো অসীম,
তারা কিছু পায় না
যারা করে স্বাধীন।
.
ময়ূর পুচ্ছ্ব যদি থাকে
কিসের আবার দুর্দিন,
কাক ময়ূর একাকার
দেশটাতো স্বাধীন।
.
শকুনের হাতে উড়ে
লাল সবুজ বাঁধাহীন,
চেয়ে রয় নির্বাক
শহীদ জননী ভাষাহীন।
.
এদেশ তো ভুলে গ্যাছে
প্রাণ দিল যারা প্রতিদানহীন,
তালে তেলে সয়লাব
দেশটাতো স্বাধীন !

এখন এখানে

এই নির্জন চরাচরে রাত দশটা মানে,
এখানে এখন নিঝুম গভীর রাত।

দূরের ট্রেনের হুইসেল
জোনাক জ্বলা খোলা মাঠ,
আলো আঁধারে শূণ্য পথ ঘাট
ছুটে চলা মেঘফুল,ক্লান্ত কাশবন
হারায় অতীতের প্রমিত নিঃসঙ্গতায়।

ঝরে চুন সুরকি,
উড়ে নীরবতা
অশ্রু অধর গড়ায়।
এখানে দেখে না কেউ,
এখানে দেখার কেউ নেই,
এখানে ভুল স্বপ্নে কেটে যায়
অবিরত হাজার জীবন অসহায়…

তুমি চলে যাওয়ার পর

তুমি চলে যাওয়ার পর,
আমি দিন দিন একটা
জীবন্ত বৃক্ষে পরিণত হয়েছি ।
.
পাহাড়ি বৃষ্টি, বসন্তের বাতাস
কিংবা ভোরের কুসুম আলো,
একাকী কিছুই ভালো লাগে না আর ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী জেগে থাকা
প্রাচীন নিঃসঙ্গ তারাগুলোর মতোই,
নিজেকে একাকী মনে হয় ।
.
সময়ের সাথে সাথে বৃক্ষ-
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়,
বৃদ্ধ বৃক্ষ অফুরান ছায়া দিয়ে যায়
কাউকে দেয় নিরাপদ আশ্রয়,
তবুও কিছু ডাল শূণ্যই থেকে যায়
হারানো পাখি ফেরার আশায়;
একাকী অপেক্ষায়, যায় কেটে সময়
প্রাচীন বৃক্ষ আরো প্রাচীনতর হয়…

নিষিদ্ধ ঘাসফুল

ধূসর নগরের হাজার ব্যস্ততার ভিড়ে
ফুটেছে দুটি ঘাসফুল
রাস্তার দ্বিভাজকের উপরে।

যেন ডাস্টবিনে পরিত্যক্ত নবজাতকের
ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি ফুটেছে,
বন্য ওই দুটি ঘাসফুলে।

এই ফুল পাবে না কখনো শোভা
কোন প্রেমিকার খোঁপায়,
যেভাবে পায় না আদর পরিত্যক্ত শিশু,
পায় না কোলে একটু স্থান
অভিশপ্ত এক হৃদয়হীনা মায়ের।

অগাস্ট ১৩, ২০১৪

এক অচেনা রাতের গল্প

কাফনে মোড়া লাশের মিছিল
চলছে এগিয়ে,
অস্পষ্ট এই রাতের আঁধারে।
যেন দেবদূতেরা সব
এসেছে নেমে
মিথ্যায় ভরা এ শহরে …
.
এ এক অচেনা রাত
এক অপার্থিব বর্ষা ঝরা রাত,
যে রাতের পরে রাত নামে
আসেনা আর প্রভাত !
.
যে রাতে ফুল হাসে না
দু’চোখ জাগে একাকী নির্ঘুম,
যে রাতে স্মৃতিরা আসে নূপুর পায়ে,
কানে বাজে অবেলায়
শুধুই, রুমঝুম রুমঝুম …

পশু না পুরুষ ?

অন্ধকারে সমুদ্রের গর্জনকে
এখন আর অপার্থিব মনে হয় না ;
আদিম সমাজের তিমির রাত গুলো
এ পৃথিবীতে আবার আসছে ফিরে !

ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে উল্টা পথে,
পুরুষ আর পশুর ব্যবধান
ক্রমশই যাচ্ছে কমে।
জীবনবোধ চাপা পড়েছে আজ
কলুষতার জাঁতাকলে।
চারিদিকে শুধু জয়গান হতাশার
শুধু অজস্র ভাঙনের সুর।

কিছু পুরুষ এখন আর মানুষ না,
পশুর চেয়েও অধম ;
তাই নারী আজ নারী না,
কামনার বস্তু স্বরূপ রয়ে গিয়েছে
পুরুষরূপী কিছু পশুর চোখে !

সময়ের অন্তরালে

দূরে নিঃশব্দে
হয় পতন বৃদ্ধ বৃক্ষের,
নিজের ছড়ানো শেকড়গুলো
ছেড়ে দেয় মাটির বন্ধন।
পড়ে রয় মৃত বৃক্ষ
করুণা নয় অবহেলায়!
.
একদিন ছিল সব,
ছোট ছোট ছেলে মেয়ে
থাকতো নিরাপদ আশ্রয়ে,
তাঁর কাছে একদিন।
চতুর লোক কতনা
দিয়ে যেত ধোঁকা,
নিরীহ মুসাফিরের বেশে।
.
তবুও তো ছিল সব,
উচ্ছ্বল সময় আর
কতগুলো হাসিমুখ।
সময় গড়ায়, সবই হারায়
দেয় ছুঁড়ে ফেলে,
একসময় উত্তরসুরি
বৃদ্ধ বৃক্ষ আজ অকর্মণ্য বলে।
.
হাজারো বৃক্ষের এখন
হয় এভাবে পতন,
আপন সুতো ছিঁড়ে
নিঃশব্দে, সময়ের অন্তরালে।

মেঘনাদ বধের পর

জেগে থাকলে যে রাবন,
ঘুমিয়ে থাকলেও সেই রাবনই।
.
রাম – লক্ষণ – হনুমান
আগুন লাগায় লঙ্কায়,
নিজ ক্রোধেই পুড়ে হায়
নিজেদেরই দেবালয়।
.
যুক্তিবিদ্যার সূত্র ঢেলে
বাঘ-বেড়াল এক করা যায়,
কিন্তুু সীতারাই বন্দী থাকে
সমুদ্র কন্যার দেশে।
সীতারাই হারায় শেষে
অনাস্থার লেলিহান শিখে…
.
মেঘনাদ বধ হয়
কিন্তুু হয় না বধ মন
তাইতো রামেরাই থাকে বেঁচে,
সীতাদেরই পোড়ায় অনল। 
.
দুইয়ে দুইয়ে চার হাত
হয়না যে আর এক সাথ,
তাই হয়তোবা দেবালয়
বিশ্বাসের অনলে পুড়ে,
আর অবিশ্বাসের অনলে হৃদয়।

শব্দ তিনটা মিথ্যে ছিল না

আমি জলকে বলছিলাম –
‘জানিস মাত্র তিনটা শব্দ বলার জন্য
আমার মৃত্যু দন্ড হয়েছিল ‘।
.
মাটি তখন আড়ি পেতে শুনছিল,
আমাদের কথোপকথন।
.
অবাধ্য মাটি চুপ করে থাকতে না পেরে
এক সময় ফস করে বলে ফেলল –
শব্দ তিনটা কী ছিল?
চরম বিরক্ত আমি মাটিকে,
ধমকাতে গিয়েও থমকে গেলাম।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে,
মাটি আর জলকে শুধু বললাম —
শব্দ তিনটি মিথ্যে ছিল না।