রোমেল আজিজ এর সকল পোস্ট

রোমেল আজিজ সম্পর্কে

শখের বশে কবিতা লেখা শুরু, কিন্তু নিজেকে কবি বলে পরিচয় দেন না। প্রচুর বই পড়েন, বই পড়া পছন্দ করেন, শুধুমাত্র কবিতার বই নয় যেকোন বই। আর মাঝে মধ্যে টুকিটাক লেখালেখি। বর্তমানে শখের বশেই সম্পাদনার সাথে যুক্ত আছেন "দ্বিপ্রহর" কবিতা ও গল্প সংকলন এবং "দ্বিপ্রহর" ম্যাগাজিনের সাথে। প্রিয় কবি জীবননান্দ দাশ, এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, হেলাল হাফিজ, শামসুর রাহমান, সুনীল, আবুল হাসানের কবিতাও প্রিয়। প্রিয় উপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পড়ালেখা ছাড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, পছন্দ করেন একা একা বেড়াতে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ঘুম আর অপ্রিয় জিনিস ধর্মীয় তর্ক....

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ১০

-বিশুর পড়ার রুমের পেছনের আম গাছটা
কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে যে, অরুণ।

-কেন, নতুন কুড়াল কিনেছিস নাকি,
না ঐ গাছটার আম টক?

– সে সব কিছু না

– তাহলে?

– আম গাছটার জন্যে জানালা দিয়ে
বিপাশাকে ঠিক মতো দেখা যায় না!

– গাছটা তো তাহলে তোর জন্য
আশীর্বাদ রে, নিরঞ্জন।

– তোর এমন মনে হলো কেন?

– জানালাটা তো তোর না, বিশুর!

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ৯

সেদিনও বৈশাখের প্রথম দুপরটাতে
আকাশ ভাঙা রোদ্দুর ফুটেছিলো।
বটতলার মেলায় উঠেছিল
মুড়ি-মুড়কি, মাটির পালকি
সানকিতে সানকিতে পান্তা ইলিশ।

দু’হাত ভরা সবুজ কাঁচের চুড়ি
পরনে লাল পারের সাদা শাড়ি,
যত্নে বাঁধা কালো খোঁপায় গোঁজা
টকটকে রক্তজবা।
আমি বাহ বলতেই-
দু’চোখে আগুন নিরঞ্জনের!

নিজেকে সামলে শুধু বললো-
” বিপাশার দিকে তোর কি
না তাকালেই নয়, অরুণ?”

মানুষের গল্প-৪

পীত সাগরের তীরে আবীর রাঙা আকাশটা
যেমন রংধনুর নিশ্চয়তা দেয় না, তেমনি
পৃথিবীর সব কলি শেষ পর্যন্ত ফুল হয় না।

প্রতিটা নতুন সম্ভাবনাই আমাদের
নতুন করে বেঁচে থাকার আশা যোগায়,
তাপমাত্রা যদিও বদলায় ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।
সংজ্ঞাহীন অলীক ভাবনায়
যুধিষ্ঠিরও আপন পথ হারায়।

ব্যার্থতা আছে বলেই
মানুষ সামনে এগোয়,
মিথ্যা আছে বলেই
সুখ তব শুধু সত্যেই…

মানুষের গল্প-৩

প্রণয়ে মত্ত মানুষ ঠিকই জানে
মৃত সাপেরও লেজ ধরতে নেই,
মেহেদী-হলুদ কিংবা অগ্নি স্বাক্ষী
ধাপে ধাপে করে পার,
জড়ায় সেই মানুষই আবার
অচেনা এক আলোকিত অন্ধকারে !

আসে মিথ্যার ঝড়
ভাঙে খেলাঘর ;
স্বপ্নগুলো যায় রয়ে
সময়ের সব অপূর্নতায়।
তবুও সেই মানুষই
দেখে নতুন স্বপ্ন,
হাজার আশা-নিরাশার
দোলাচলে …

মানুষের গল্প-২

এ শহরের ল্যাম্পপোস্ট গুলো
কখনো ঘুমায় না জানি,
ঝড় – বৃষ্টি – রোদে পুঁড়ে
কাটায় জীবন একাকী,
কখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে
কখনোবা সে নিজেই হয়
এক নিশ্চুপ ইতিহাস।

সকালে যার পায়ের কাছে
বসে খোলা হাট-বাজার
সেখানেই আবার গভীর রাতে
শোনা যায় কাঁচের চুড়ির ঝঙ্কার।

মানুষ আজ রাস্তায় বিকায়
মানুষ মানেই পাপ,
মানুষের কাছেই
মানুষ যে আজ ;
অর্থহীন অভিশাপ !

মানুষের গল্প-১

অন্ধকার কোলাহল থামলো বটে,
মানুষ তো আজো হয়নি মানুষ।
নীরবতা তো মৌন সম্মতি নয়
তবে কেন শুনি আর্তনাদ?
.
ক্রিয়া সমাপিকা কিংবা অসমাপিকা
হলেওবা কী যায় আসে ইতিহাসের,
ঝরাপাতার গল্পতো মর্মরই হয়।
সমুদ্র আছে বলেই
মানুষ হারায় বিশালতার মাঝে,
মরুভূমির তাতে থোড়াই কেয়ার!
.
পরাজয় আছে বলেই
জয়ী হতে চায় মানুষ,
আবার মৃত্যু আছে বলেইতো
মানুষই সাজায় জীবন …

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ৮

সৌমেনদের বাড়ির পেছনের ঝিলটা
বরাবরই নিস্তব্ধ থাকতো,
কেউ খুব একটা যেতোনা ওদিকটায়।

কালীপুঁজো শেষে
যেদিন স্কুল খুললো,
সেদিন সব মেয়েরা
ছেলেদের ভাই ফোঁটা দিচ্ছে।
চন্দন বাটিটা সামনে আসতেই
হঠাৎ নিরঞ্জনের ঝড়,
অপ্রস্তুত বিপাশার দু’চোখ
তখন জলে থৈ থৈ!

স্কুল শেষে ঝিমমারা বিকেলটায়
শতবর্ষী বটগাছটার নিচে বসে
সেদিন, দেখছি আর ভাবছি…
কার ধৈর্য্য বেশি, নিরঞ্জন
না ওই নিঃসঙ্গ মাছরাঙাটার?

ঝিলপাড়ের নীরবতা ভেঙে
বলেই ফেললাম –
“তুই না বিপাশাকে কাঁদাতে চাস না,
চন্দন বাটিটা উল্টে ফেললি কেন?”
দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে, শুধু বললো-
“ভালোবাসি বলেই না কষ্ট দেই,
ভালোবাসি বলেইতো কষ্ট পাই !”

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ৭

ব্যাকরণ ক্লাসটা বরাবরই
বিরক্তিকর লাগতো আমাদের,
কারক-বিভক্তির মারপ্যাঁচে
জীবনটা তখন ওষ্ঠাগত।

এমন এক ক্লাস শেষে,
কপট রাগ মিশ্রিত কন্ঠের
অনুরোধাক্রান্ত সাবধান বানী-
“এ-পাড়ায় তোরা আর
ঘুরঘুর করিসনে অরুণ,
মেঝ’দা সামনে পেলে
তোদের ঠ্যাঙাবে।”

সন্ধ্যায় নিরঞ্জনকে,
বিপাশার কথাটা বলতেই-
শান্ত ছেলেটা হঠাৎই রেগে বুম…
“যা ব্যাটা ভীতু কোথাকার,
শুধু সাবধান বানীটাই দেখলি
ভালোবাসাটা বুঝলি না।”

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ৬

চৈত্র শেষে বৈশাখ
আসি আসি করছিলো।

তখন বিকেল গুলোকে
শুধু মনে হতো,
ক্ষুদ্র একটা বিন্দু ;
আর রাতগুলোকে
সুদীর্ঘ সরলরেখা।

কালবৈশাখী ঝড়ের আগে
গুমোট ধরা এক বিকেলে,
ছোটনদের পুকুরে জুড়ে
ঢিল ছুঁড়তে ছিলাম,
পাড়ে বসা নিরঞ্জন
নিষ্পলক শুধু দেখেছিল;
পুকুর জলে মিলিয়ে যাওয়া
অর্থহীন ঢেউ গুলো।

ঈশান কোণে মেঘ জমতে দেখে
বললাম, ” চল বাড়ি যাই-
ঝড় আসবে, তবুও বিপাশা না।”

আহত চোখে একবার চেয়ে
ক্ষীণ স্বরে শুধু বলেছিল –
“জানিস,
ভালোবাসতে হয় ঝড়ের মতন
যা মেঘ-ধূলো সব এক করে দেয়,
ভালোবাসতে হয় বাঁধ ভাঙা জলের মতন
যা প্লাবন হয়ে দিগ্বিদিক ভাসিয়ে নেয়।”

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ৫

নো ম্যান্স ল্যান্ডস্-এ গিয়ে বলটা পড়লো,
ব্যাটসম্যান আম্পায়ার সবাই নিশ্চুপ!
রান হলো না, আউটও না, এটাই নিয়ম
নো ম্যান্স ল্যান্ডস্ যে বিপাশাদের উঠোন।

এপারে তড়পায় হৃদয়
ওপারে শূণ্য উঠোন,
মাঝখানে অদৃশ্য কাঁটাতার
নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে
আমাদের নিরঞ্জন …

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ৪

পৃথিবীটা গোল থেকে গোলতর
হয়ে যাচ্ছিলো সে সময়, মাঠগুলো
ছুটতো সমান থেকে সমান্তরাল।

তখন আমরা এক সংগেই
ত্রিকোণমিতি করতাম;
“একটি গাছের শীর্ষ বিন্দুতে
সূর্যের অবনতি কোণ ষাট ডিগ্রী,
গাছের উচ্চতা দশ মিটার হলে
ছায়ার দৈর্ঘ্য কত? ”

নিরঞ্জনের দেখাদেখি লিখলাম–
ট্যান সিক্সটি ইকুয়াল টু
উচ্চতা বাই ভূমি …
সমাধান প্রায় শেষ…
দেখি তখন নিরঞ্জন
একই উচ্চতায় ভূমিহীন,
নির্লিপ্ত চোখ দুটি
বিপাশায় বিলীন।

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ৩

শেষ কবে চাঁদের ভরা আলোয়,
একাকী হেঁটেছি মনে নেই।

বিপাশার বাড়ির পথ,
অমাবশ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারেও
ভুল হতো না নিরঞ্জনের।

শীতের শেষে শিউলী ঝরা
এক নিঝুম ভোরে-
নিরঞ্জনের হঠাৎ আগমন,
চোখে সারা রাত্রি জাগা ছাপ।

হেতু কি জানতে চাইলাম,
যথারীতি নিরঞ্জন নিশ্চুপ।

ঈষৎ কাঁপা গলায় শুধু বললো-
সারমেয় এনে কি লাভ বল,
বাঁকা লেজটাই শুধু দেখলো
চোখের নির্ভরশীলতা টুকু দেখলো না…

তিয়াস

– আমার ছুঁড়ির একটা নেশা আছে, জানোস মতি?
.
– কি নেশা, বাংলা না গাঞ্জা, মজিদ ভাই।
.
– মসকরা করার কথা কই নাই মতি, রক্তের তিয়াস অনেক আজিবরে মতি, বড়ই আজিব।
.
ভাড়াটে খুনি হওয়ার আগে থেকেই মজিদের পকেটে ছোট্ট একাট্টা ফ্লোডিং ছুঁড়ি থাকতো। বৈশাখে হাওলাদারদের বাগানের কাঁচা আম কচ কচ করে কাটার নেশায় ছুড়িটা সাথে থাকতো সারা বছর। কোথায় যেন শুনেছিল, কাঁচা আম কাটলে ছুঁড়ির ধার বাড়ে।একদিন কাঁচা আম কাটার সময় অসাবধানতাবশত আঙ্গুল কেটে যায়। সেদিন বিকেলবেলা ঝোঁপের ভিতরে কি যেন নড়ছে দেখে ছুঁড়িটা সাঁই করে ছুঁড়ে মারে। ডানা ঝাপটানোর শব্দ বরাবর ঝোঁপ সরিয়ে দেখে অদ্ভুত এক নীলচে সবুজ পাখির হৃদপিন্ডের একটু নীচে ছুঁড়িটা গেঁথে আছে। সেই থেকে শুরু, মজিদের ছুঁড়ির রক্তের পিপাসা আর মেটেনি কোন দিন। চোদ্দ বছর আগে খুন করা নাম না জানা পাখিটার জন্য আজো মন কাঁদে মজিদের।
.
গত পরশু বেলালের কানের নিচ দিয়ে ছুঁড়িটা ঢুকানোর সময় চোখে অনেক মায়া দেখছিল, হাত পা, মুখ বাঁধা থাকায় কোন শব্দই করতে পারেনি। ছটফট করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না বেলালের।
.
– বুঝলা মতি মিয়া, এই দ্যাখ, এই ছুঁড়িটাই আমার সব। এইটা যতক্ষণ আমার কাছে থাকবো ততক্ষণ আমার কিচ্ছু হইবো না।
.
– কী কন ওস্তাদ!
.
– হ, তুই কহনো আমারে মানুষ মারতে গিয়া বিপদে পড়তে দেখছস?
.
-না ওস্তাদ।
.
– তুই কি আমারে অহন ডরাইতাছস?
.
– আপনের লগে থাকলে ডরামু ক্যান ওস্তাদ।
.
– মিছা কতা কইবি না, মিছা কতা হুনলে আমার ছুঁড়ির তিয়াস বাড়ে।
.
-মিছা কতা আবার কহন কইলাম, ওস্তাদ।
.
– একটা জিনিস খেয়াল করছি, তুই ডরে থাকলে আমারে মজিদ ভাই না ডাইকা বারবার ওস্তাদ, ওস্তাদ ডাকস। প্রত্যেকটা অপারেশনের আগে তুই আমারে ওস্তাদ কইয়া ডাকা শুরু করস। তোর মতন গর্দভরে লগে রাহনই ঠিক না।
.
-আর কোন দিন মিছা কতা কমু না ওস্তাদ!
.
– আইজ তো কোন কাম নাই, কি আর করুম। তুই আয়, তোর বাম কানের লতিডা একটু কাইট্টা ছুঁড়িটার আজ রাইতের তিয়াস মিটাই।

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ২

গৌতম বুদ্ধের ঘর ছাড়ার রহস্যটা
আজো অজানাই রয়ে গিয়েছে,
অনেকটা নিরঞ্জনের না বলা
কথাগুলোর মতোই।
.
উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস শেষে
একে একে বাড়ি ফিরতো সবাই,
শুধু একজন ছাড়া।
চৈত্র-বর্ষার রোদ বৃষ্টি গায়ে মেখে
ছুটতো বিপাশার পেছন পেছন!
.
দেখে আমরা হাসতাম…
.
ইকোনমিক্স ক্লাস শেষে
একদিন জিজ্ঞেস করে ফেললাম —
‘তোর নিরপেক্ষ রেখায়
বিপাশা পৌঁছুতে আর কত দেরী?’
.
নিরঞ্জনের শান্ত উত্তর –
‘বিন্দুকে স্পর্শ করা না,
পরিধির নিয়ম হলো
বিন্দুর চারপাশটা
পরম মমতায় ঘিরে থাকা …’