-বারবার আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখছো গো অমন করে?- পানকৌড়ি-বউ জানতে চায় পানকৌড়ির কাছে।
-ও, কিছু না। এমনি….
-কিছু না বললে হলো। আমি আজ ক’দিন ধরেই তো দেখছি তোমার হাবভাব। মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন খুঁজছো তুমি। বল না কি হয়েছে?
শীতের হালকা পরশ লাগতেই পানকৌড়ির মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। বারবার আকাশের দিকে তাকায় কার যেন আসার পথ চেয়ে।
পানকৌড়ি মুখ খোলে।
-বউ, তোর বুঝি মনে নেই আমাদের সেই বন্ধুর কথা।
-বন্ধুর কথা? ও সেই বুনোহাঁস।
-হ্যাঁ, বন্ধু কী বলেছিল তোর মনে নেই?
-আছে তো। সে তো বলেছিল শীত এলে আবার সে আসবে আমাদের সাথে দেখা করতে।
– শীত তো পড়ে গেল। তাই মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে উঠছে বন্ধুকে দেখার জন্য।
– ওর কি আর আমাদের কথা মনে আছে?
– নিশ্চয় আছে। দেখবি ও ঠিক আসবে।
একবছর আগে এমনি এক শীতের বিকেল। রক্তাক্ত অবস্থায় বুনোহাঁসটি এসে পড়েছিল এই পোলতার বাঁওড়ের কচুরীপানার উপর। পাশের ফাঁকা জলে ডুব-সাঁতারের খেলায় মেতে থাকা পানকৌড়ি ও তার বৌ দেখে এগিয়ে গিয়েছিল কাছে। বুনোহাঁসটিকে দেখেই বুঝতে পেরেছিল শিকারীর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তার দেহ। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়েছিল তাকে।
আসলে সুদূর শীতের দেশ থেকে হাঁসের একটি দল টানা উড়ে এসেছিল সাঁতরাগাছির বিলে। সেখান থেকে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিল এই হাঁসটি। শিকারীর বন্দুক যে তাকে তাক করে আছে, সে বুঝতে পারেনি। তারই আঘাতে আহত হয়ে হাঁসটি এসে পড়েছিল এই বনগ্রামের পোলতার বাঁওড়ে।
পানকৌড়িদের টানা শুশ্রূষায় ধীরেধীরে সুস্থ হয়ে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় বুনোহাঁস।
পানকৌড়িদের সেবা আর ভালবাসার আশ্রয় না পেলে বুনোহাঁসটি কিছুতেই হয়তো বাঁচতে পারতো না। ওরা যেভাবে এই বিদেশী অচেনা হাঁসটিকে আগলে রেখে খাইয়ে দাইয়ে সুস্থ করে তুলেছিল তাতে অভিভূত ও কৃতজ্ঞ হয়ে বুনোহাঁসটি বারবার সজলচোখে ঋণ স্বীকার করেছিল। আর সঙ্গীদের মাঝে ফিরে যাবার আগে কথা দিয়ে গিয়েছিল আগামি শীতে এসে দেখা করে যাবে পানকৌড়িবন্ধুর সাথে। থাকবেও কিছুদিন ওদের সাথে।
পানকৌড়ি-বৌ হঠাৎ বলে ওঠে – ওই দেখ, দু’টো হাঁস যেন এদিকেই উড়ে আসছে। দেখ, দেখ।
পানকৌড়ি আকাশের দিকে তাকায়- তাই তো। কিন্তু দু’টো যে। তাহলে হয়তো আমাদের বন্ধু নয়। অন্য কোনো…
পানকৌড়ির কথা শেষ হবার আগেই ঝপাৎ করে জলে এসে পড়ে হাঁসদু’টি।
-আরে এই তো আমার বন্ধু! পানকৌড়ি আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারে। বলে ওঠে – বলেছিলাম না বন্ধু ঠিকই আসবে।
পানকৌড়ির গলা আর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বুলাতে বুলাতে বুনোহাঁসটি গদগদ গলায় বলে- বন্ধু, কেমন আছো তোমরা?
তারপর পানকৌড়ি-বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে- একেবারে সোজা আমাদের দেশ থেকে এখানেই চলে এসেছি দিদি। আর সাথে করে নিয়ে এসেছি তোমার বোনকেও।
হাঁসিনী পানকৌড়ি-বৌয়ের পাশে যায়। বলে- তোমাদের দু’জনের কথা ও যে কতবার আমাকে বলেছে তার ইয়ত্বা নেই। আর সারাবছর ধরে আমিও অপেক্ষা করে ছিলাম, কবে তোমাদের দেখব।
-তুমি খুব ভাল বোন। এই যে এলে এতে আমি ভারি খুশি হয়েছি। তা গতবার তুমি এদেশে আসো নি? হাঁসভাই একাএকা বেরিয়ছিল?
হাঁসিনী বলে- এসেছিলাম। তবে পথের ক্লান্তিতে সেদিন আমার শরীরটা একটু ম্যাজমেজে ছিল বলে ওর সাথে বের হইনি। ও একাই একটু বেরিয়েছিল বাইরেটা দেখতে। তারপরেই বিপদ। আমি পথ চেয়েচেয়ে কেঁদেকেটে ক্লান্ত হয়ে ওর আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম শিকারীর বন্দুক হয়তো ওকে-… বলেই কেঁদে ফেলে হাঁসিনী। তারপর সকৃতজ্ঞ স্বরে বলে- দিদি, আপনারা আশ্রয় আর সেবা না দিলে….
পানকৌড়ি-বৌ হাঁসিনীর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বলে- জানো, তোমাদের জন্য আমরা সেই শীতের শুরু থেকেই পথ চেয়ে আছি। কী যে আনন্দ হচ্ছে আজ!
পানকৌড়ি হাঁসিনীর দিকে তাকিয়ে বলে- জানতাম, আমাদের বন্ধু নিশ্চয়ই আসবে। কথার খেলাপ করবে না।
বুনোহাঁসের কন্ঠস্বরে কৃতজ্ঞতার সুর- দেশে ফিরে যাবার পর প্রতিমুহূর্তে তোমাদের মনে করেছি। তোমরা যে আমার জীবনদাতা। যতদিন বেঁচে থাকব, এভাবেই প্রতিশীতে আসব।
হাঁসিনী বলে- আর এখানেই থাকব সারাশীতকাল।
পানকৌড়ি-বৌ সহাস্যে বলে- কী মজা! কী আনন্দ! আমরা একসঙ্গে খাবো দাবো, খেলা করবো। গল্প করবো। চল তাহ’লে…..
চারজন ডুব-সাঁতারের খেলায় মেতে ওঠে।