শংকর দেবনাথ এর সকল পোস্ট
কিম্ভূতকিমাকার ছড়া ১
দিল্লি ঘুরে বিল্লি যখন
আসলো ফিরে বঙ্গে,
মোরগপানা মুখখানা সে
আনলো করে সঙ্গে।
ম্যাঁও ভুলে সে দু’ঠোট খুলে
জোরসে ডাকে কুঁক্কুঁ,
ও’রোগ দেখে মোরগ-বিড়াল
কেবল করে দুক্ষু।
পেঁয়াজ একাই দেড়শো
পেঁয়াজ একাই দেড়শো এখন
কে আজ ছোঁবে তাকে,
রাজার বেশে বাজারে সে
দেমাগ নিয়েই থাকে।
মাংসাশীদের দুঃখটা ঢের
ভাত রোচে না কারো,
মুরগী-খাসির মুখে হাসি
বাঁচবে ক’দিন আরো।
টুনটুনি আর বিড়ালের কথা
টুনটুনি আর বিড়ালের কথা
শংকর দেবনাথ
গেরস্তের এক ঘরের পাশের ছোট্ট বেগুনগাছে-
পাতায় পাতায়
জড়িয়ে আশা,
ছড়িয়ে প্রাণের
ভালোবাসা-
টুনটুনি বউ বানিয়ে বাসা খুব আয়েসে আছে।
সদ্য ফোটা পদ্য যেন তিনটে ছোট ছানা-
বাসার ভিতর
চিঁ চিঁ স্বরে,
খাবার আশায়
কেবল করে-
দু’ঠোট ফাঁক আর মা তার খাওয়ায় বেড়ে ওঠার দানা।
চোখ ফোটেনি, লোম ওঠেনি, বোল ফুটেছে খালি,
মায়ের বুকের
নরম লোমে,
ভালই কাটে
স্নেহের ওমে।
টুনির চোখে কেবল ঢোকে ভয়ের গাঢ় কালি।
দুষ্টু ভারি বাবুর বাড়ির বিড়াল মহারানি,
জিভ চাটে আর
কেবল ভাবে,
কেমন করে
কখন খাবে-
আচ্ছা মজায় টুনির বাচ্চা ভেঙেই বাসাখানি।
একদিন সেই বিড়াল এসেই বেগুনগাছের কাছে,
দাঁড়িয়ে ডাকে
বাড়িয়ে গলা-
একটু করে
ছলাকলা-
টুনটুনি লা, করিস কী অ্যাঁ? একলা বসে গাছে?
টুনটুনি তার স্বর শুনিয়া ভীষণরকম ত্রাসে,
কাঁপতে থাকে,
ভাবতে থাকে-
কেমনে বাঁচায়
তার ছানাকে?
বুদ্ধি ভেজে তাই তো সে যে – মিষ্টি করে হাসে।
তারপরে সে নরম স্বরে বললো ধীরে ধীরে-
পেন্নাম হই
মহারানি,
আপনি মহান
আমরা মানি।
শুনেই বিড়াল ফুলিয়ে গাল খোশ্ মনে যায় ফিরে।
খাবার লোভে আবার আসে বিড়াল বেগুন- তলে,
মিষ্টি কথায়
বারেবারে,
টুনটুনি মা
ফিরায় তারে
হয় না খাওয়া, আসা যাওয়া নিত্যদিনই চলে।
কথার পাঁকে বিড়ালটাকে আটকে রেখে রেখে,
টুনটুনিটার
ছোট্ট ছানা,
বাড়তে থাকে
তাইরে না না।
গজায় পাখা স্বপ্নমাখা উড়ানখুশি এঁকে।
টুনটুনি মা তার ছানাদের বলল ডেকে- তোরা
এখন হ’লি
অনেক বড়ো,
বাসার কোণে
জড়োসড়ো-
আর না থেকে বার হয়ে শেখ ইচ্ছেমতন ওড়া।
ছানারা কয় – নেই ভয় আর, উড়বো ডানা মেলে।
মা হেসে কয়-
ওই যে দূরে,
তালের গাছে
যা তো উড়ে।
ঝাঁপটে ডানা যায় ছানারা পৌঁছে অবহেলে।
তাই দেখে মা টুনটুনিটা ভীষণ খুশি মনে,
সাহস বুকে
বললো হেসে,
করবে কী আর
বিড়াল এসে?
তোয়াজ তো আজ করবো না আর, পালিয়ে যাবো বনে।
একটু পরেই বিড়াল এসে লোভের স্বরেই ডাকে-
করিস কী লা
টুনটুনি বউ?
নেই মুখে আর
আগের সে মউ-
দেখিয়ে লাথি খেঁকিয়ে উঠে টুনটুনি কয় তাকে-
দুষ্টু পাজি বিড়াল আজি দূর হ’ লক্ষ্মীছাড়ী,
মন ভরা তোর
হিংসা খালি,
দিলাম তোর ওই
গুঁড়েই বালি।
বলেই ওড়ে ফুড়ুৎ করে গুঁটিয়ে পাততাড়ি।
দুঃখ ক্ষোভে রুক্ষ মেজাজ দাঁত খিঁচিয়ে এসে-
বিড়াল ওঠে
লাফিয়ে গাছে।
কাঁটার খোঁচায়
নাকাল, পাছে-
থোঁতা মুখটা ভোঁতা করেই ফিরলো ঘরে শেষে।
★উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প অবলম্বনে ছড়াক্কা।
তোমায় ছোঁবো ব’লে
দু’চোখ বেঁধে আমার,
তুমি
দাঁড়িয়ে থাকো দূরে,
তোমায় ছোঁবো ব’লে,
আমি
বেড়াই ঘুরে ঘুরে।
একটু কাছে এসে,
টুকি
দিয়েই পড়ো স’রে,
হাতড়ে মরি আমি,
শুধু
তোমারই খোঁজ ক’রে।
তোমায় ছোঁবার মোহে,
ঘুরি
ভালবাসার ঘোরে,
মুচকি হেসে হেসে,
তুমি
যাওগো দূরে স’রে।
তোমার আমার মাঝে,
এমন
কানামাছির খেলা,
নৃত্যসুখে মেতে,
চলে
নিত্য সারা- বেলা।
কবিতা আসে না ছড়াও হাসে না
কবিতা আসে না- ছড়াও হাসে না
শব্দ মরছে গুমরে,
খন্দ-খানায় ছন্দরা পড়ে
যাচ্ছে মুচড়ে দুমড়ে।
ড্যাবডেবে চোখে ভাব চেয়ে থাকে।
হাবভাব ভয়ে আর্ত,
বিষয় কোথায়? বিষের সোঁতায়
খাবি খায় বারবার তো।
স্বস্তি নাস্তি। অস্থির বুকে
সব হারানোর স’ন্দ,
পর্ণশালায় বর্ণমালার
দু’চোখ বুঝিবা অন্ধ।
তরাসে ভরা সে জীবনযাপণ
কাঁপন বাক্যবন্ধে,
কবিতা আসে না – ছড়াও হাসে না
নিটোল ছন্দে-গন্ধে।
হেমন্ত কি এলো?
বিলের জলে নীলশালুকের
খিলখিলানো হাসি-
ধানজননীর আনমনা বুক
বাজায় সোনার বাঁশি।
কৃষক-বউয়ের কী শখ জাগে!
টকটকে লাল সিঁথি-
উঠোন-বাড়ি নতুন শাড়ির
ছড়ায় ঘ্রাণের প্রীতি।
অল্প হিমের গল্প -ছড়া
কল্পবায়ে ওড়ে-
মন-হারানো কোন বাউলা
বনের পথে ঘোরে।
স্বপ্ন-নিশির রূপোর শিশির
ছড়ায় ঘাসে কে লো?
এ’মন করে কেমন তো রে
হেমন্ত কি এলো?
আগ্নেয়াস্ত্র
কখনও তোমার সাথে শত্রুতা করিনি-
পাকাধানে মই কিংবা বাড়াভাতে ছাই
কখনও দিইনি। তবু ঘিরে দিলে তুমি
তোমার চৌহদ্দি- আর সুতীক্ষ্ণ প্রহরা
সীমান্তরক্ষীর চোখে সেঁটে দিলে কেন?
কবিতার খাতা ছিঁড়ে যখন শব্দরা
যুদ্ধক্ষেত্রে যায় কিংবা বাণপ্রস্থবনে
তখনও তোমার জন্যে ফাঁসিতে ঝুলেছি-
অথচ এখন আমি ব্রাত্যধুলো মেখে
তোমার উঠোন খুঁজি শিশুর মতন।
সীমান্তরক্ষীর চোখে ধুলো দিয়ে আসে
তোমার গায়ের গন্ধ আমাকে কাঁদাতে-
যন্ত্রণা ঝরাতে আসে পূর্বজন্ম ক্ষতে।
আমি কাঁদি-তুমি কাঁদো? ইছামতী ভাসে…
আমার ঘুমের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাসে।
মুরগীমায়ের হাঁসছানা
ছানাদের নিয়ে মুরগী মা এই প্রথম পুকুরপাড়ে এলো। মালিকের বাড়ির পেছন দিকে বেশ বড় একটা পুকুর। ঘাট বাঁধানো। তিনপাড় জুড়ে সারিসারি নারকেল গাছ। নির্জন ছায়াঘেরা।
গরমের দুপুরে একটু আরামে ছানাদের নিয়ে বিশ্রাম নেবে ভেবে ছানাদের বলে- আয় সোনারা, এই ছায়ায় আমার পাশে তোরা একটু শো। এই গরমে আর ঘোরাঘুরি করিসনে।
ছানারা মায়ের কাছে আসে। দু’একটি শুয়েও পড়ে। হঠাৎ একটি ছানা পুকুরের দিকে তাকায়। চোখে পড়ে টলটলে জল। আর জল দেখেই ছানাটির বুকের ভেতরে যেন জেগে ওঠে এক অদম্য উচ্ছ্বাস। মনটা যেন আইডাই করে ঝাঁপ দিতে ওই জলরাশির মধ্যে।
চিৎকার করে অন্য ছানাদের বলে- এই, দেখ, দেখ, কত জল ওই পুকুরে।
সাথে সাথে অন্য ছানারা তাকায় পুকুরের জলের দিকে। সব ছানারই মনের ভেতর অনুভূত হয় এক ভিন্নতর সুখ। মনে হয়, কতদিন ধরে তারা যেন এই প্রিয় জলের খোঁজেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এক্ষুনি তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় জলে।
অতি আবেগে সোৎসাহে একসঙ্গে সবাই মাকে বলে- মা, আমরা একটু পুকুরের জলে নামতে চাই। ডুব-সাঁতার খেলতে চাই।
মার বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁত করে ওঠে। এই ভয় তো মুরগী মা’র মনে সবসময়ই ছিল। যেদিন ডিম ফুটে প্রথম ছানাটি বেরিয়েছিল, তখন সেই ছানাটির চেহারা দেখেই বুঝেছিল- গিন্নিমা ওকে ফাঁকি দিয়ে হাঁসের ছানা ফুটিয়ে নিচ্ছে। ওর ডিমগুলো সরিয়ে রেখে সেখানে রেখেছে হাঁসের ডিম। আর সেগুলোই এতদিন ধরে তা দিয়ে এসেছে সে।
মনেমনে প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল সেদিন মুরগীটির। দুঃখে ক্ষোভে বাকি ডিম না ফুটিয়েই বেরিয়ে আসার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু না, শেষপর্যন্ত আর সেটা পারেনি। একটা ভালবাসা অনুভব করেছিল হৃদয়ে। এতদিন ধরে বুকের ভালবাসার ওমে জড়িয়ে রাখা ডিমগুলো ফেলে উঠে আসার মত মনের জোর তার হয়নি।
একে একে দশদশটি হাঁসের ফুটফুটে ছানা আলতো ভালবাসার ঠোঁটে ঠুকরে ঠুকরে ফুটিয়েছিল। হাঁসের ছানারা কখনই বুঝতে পারে নি মুরগী মা তাদের প্রকৃত মা নয়। আর তারা জানবেই বা কী করে? তারা তো কখনও তাদের স্বজাতির চেহারা দেখেইনি।
মুরগী মা ছানাদের লালনপালন করতে করতে ভুলেই গিয়েছিল ছানারা আসলে ওর নয়।
কিন্তু মুরগী জানতো একদিন ওরা ওদের জীবনে চলে যাবে। ভুলে যাবে ওদের বিজাতীয় মায়ের কথা। যতই ভালবাসা দাও না কেন, পর কখনও সত্যিকারের আপন হয় না।
– ওমা মা, আমরা একটু জলে নামি!- ছানারা আবার সমস্বরে আবদার করে মাকে।
-ডুবে যাবি বাছারা। পুকুরে অনেক জল যে।
– না মা, ডুববো না।
-সাঁতার না জানলে ডুবে যেতে হয়।
পুকুরে নামা থেকে বিরত রাখার জন্য মুরগী মা বলে। যদিও মুরগী জানত- হাঁসেরা জন্মসুত্রেই সাঁতারু। জলই ওদের প্রিয় বিচরণক্ষেত্র।
-আমরা তো সাঁতার জানি বলেই মনে হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় ছানাটি বলে। আর একসাথে সব ছানাই তাকে সমর্থন করে।
মুরগী মা আর ছানাদের আটকায় না।
– যা। তবে সাবধান।
– তুমি একদম ভয় পেয়ো না মা। আমরা ডুববো না।
– আচ্ছা যা, তবে তাড়াতাড়ি উঠে আসিস।
হাঁসছানারা সানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। মেতে ওঠে জলকেলীতে। এতদিন পরে ওরা যেন স্বাদ পায় নিজস্ব আর প্রকৃত জীবনানন্দের।
মুরগী মা অপলক দৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে- কখন তার কোলে ফিরে আসবে ছানারা।
চুম্বনের ক্ষত
একপাশে আমি আর অন্যপাশে
স্বর্গ শুয়ে আছে- মাঝখানে ভালবাসা…
ভালবাসা ডিঙোতে পারিনে…
আজন্ম প্রেমিক আমি- সবকিছু
তুচ্ছ করে উচ্চস্বরে কেবল বলতে
পারি- ভালবাসি…
ঘর ছেড়ে গাছের তলায় বসে
এঁকে গেছি পাণ্ডু নয় সবুজাভলিপি…
প্রেমিকের ঘর নেই- দেশ নেই-
স্বর্গ নেই- আছে শুধু চুম্বনের ক্ষত…
আমার সমস্ত ভুল… ভালবাসা…
কবিতার কাছে অবনত…
পেঁয়াজ ও আদা
পেঁয়াজ!
তোমায় ছোঁবে কে আজ?
তোমার ঝাঁজে
চোখের মাঝে
কান্না নাচে যে আজ।
আদা!
শিলনোড়া সব হাঁদা।
রান্নাঘরে
যান না এখন
ভালই আছেন দাদা!
অথঃ স্বামি স্ত্রী কথনম
স্ত্রীঃ
ভাল্লাগে না নারীজনম
দেয় না তো কেউ দামই,
ইচ্ছে মনে পরের জন্মে
পুরুষ হবো আমি।
স্বামিঃ
পুরুষ হয়ে জন্মাবো আর
নই তো তেমন বোকা,
ইচ্ছে আছে পরের বারে
হবোই তেলাপোকা।
স্ত্রীঃ
এত সাধের মানব জনম
ছেড়ে দিয়েই সোজা,
তেলাপোকা হওয়ার কারণ
যাচ্ছে না ঠিক বোঝা।
স্বামিঃ
বলছি কারণ, তোমার যখন
শোনার এত তাড়া,
পাও না তো ভয় কাউকে তুমি
ওই পোকাটা ছাড়া।
পরীর বন্ধুরা
কোলকাতা থেকে বাড়ি ফিরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে পরী। বাব্বা রে। কী ভীড়! কী ভীড়! গাড়ির শব্দে কান একেবারে ঝালাপালা! রাতদিন ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা কাঁহাতক ভাল লাগে? গাছপালা নেই, ফুল-পাখি-প্রজাপতি নেই। হাওয়া আছে কিন্তু সে ফ্যান ঘুরিয়ে। পরীর দম আটকে যায় আর কী।
গরমের ছুটিতে পিসতুতো দাদা এসে নিয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়িতে। তিনদিন যেতে না যেতেই বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে পরী। অগত্যা ফোন পেয়ে বাবা নিয়ে আসেন বাড়িতে।
জামা কাপড় ছেড়ে সবে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে পরী। হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধ। বাইরে বাগানের দিকে তাকায় পরী। দেখে, জুঁইফুলেরা সাদা পাপড়ি নেড়ে নেড়ে তাকে ডাকছে- এসো বন্ধু। কতদিন তোমার ভালবাসার পরশ পাই নে।
-আসছি।
একছুটে বাগানে চলে যায় পরী। পাপড়িগুলোয় কোমল হাত বুলায়।
– আমারও তো তোমাদের ছাড়া ভাল লাগেনা বন্ধু । শহরের ওই জনারণ্যে আমার দম আটকে আসছিল। তাইতো ফিরে এলাম আমার আপন গাঁয়ে। তোমাদের কাছে। তোমরা আমার পাশে না থাকলে আমি যে একটুও ভাল থাকতে পারিনে জুঁই।
জুঁইফুলেরা হাসে। ঘ্রাণে ঘ্রাণে ভরে দেয় পরীর মন।
রঙিন পাখা মেলে প্রজাপতি উড়ে আসে। জুঁইয়ের পাতায় বসে। পরী ভালবেসে ওর গায়ে হাত বুলাতে চায়। প্রজাপতি দুষ্টুমিভরা চোখে হাসে। উড়ে গিয়ে পাশের ডালে বসে।
পরী বলে- ও বুঝেছি। অামার উপর তোমার ভারি অভিমান হয়েছে। তোমাদের ছেড়ে চলে গেছিলাম তো, তাই।
প্রজাপতি নকশাকরা পাখা নেড়ে পরীর চারপাশে ঘুরতে থাকে। পরীও ওকে ধরতে চায়। দু’জনের এই দুষ্টু-মিঠা লুকোচুরি দেখে টুনটুনি পাখি দুটো পাশের পেয়ারা গাছে উড়ে এসে বসে। টুইট টুইট করে পরীকে জানান দেয় ওরাও এসে গেছে।
পরী বলে- তোমাদের ছাড়া আমার একদম ভাল লাগে না বন্ধু। ডাকো, আবার ডাকো।
-টুইট, টু-ই-ট।
টুনটুনিরা প্রিয়বন্ধুকে পাওয়ার আনন্দে গান গায়। উড়ে এসে বসে জুঁইয়ের ডালে।
শনশন সুরে বাতাসও ছুটে আসে। আলতো পরশ বুলিয়ে দেয় পরীর সারাগায়ে। আনন্দে পরীর দেহে মনে শিহরণ খেলে যায়।
– তুমিও এসেছো বন্ধু?
বাতাসি আবেগে গাছের ডাল নুয়ে এসে পরীর শরীর ছুঁয়ে দেয়।
ছয় বছরের ছোট্ট পরীর চারপাশে এখন তার বন্ধুরা। গাছ। ফুল। পাখি। প্রজাপতি। বাতাস। সবাই।
প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় পরী।
পাটক্ষেত
-মমিন, ও মমিন।
-কে? ও চাচা? আসেন। বসেন।
মমিন বারান্দায় একটা চৌকি পেতে দিতে দিতে বলে- তা, চাচা, এহেবারে বিহানবেলায়!
জমিজিরাত না থাকায় মমিন জনমজুরি করে পরের ক্ষেতে। আর চাচা মানে রহমত মালিতা এলাকার ধনী কৃষক। অনেক জমি আছে তার মাঠে। রহমত চাচার ক্ষেতেই বেশিরভাগ সময় কাজ করে মমিন।
রহমত চাচা বলেন- বলতিছি কি, দক্ষিণির মাঠের পাটগুলোন তো কাটার দরকার। আজ থেকে তাহলি লেগে যা মমিন। আব্দুলকেও বলিছি। তুই আর আব্দুল দুইজনে কাটবি।
পাটক্ষেতের কথা শুনেই মমিনের বুকের ভেতরে যেন ছ্যাঁত করে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে চারবছর আগের এক করুণ ছবি।
সেও এই রহমতচাচার পাটক্ষেত। পাটগাছ কাটতে গিয়েছিল মমিন আর পাশের বাড়ির দিলু। পাটক্ষেতের কাছে যেতেই একটা পচা দুর্গন্ধ তাদের নাকে এল। দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে সেদিন তারা যা দেখেছিল, সেই মর্মান্তিক দৃশ্য আজও ভুলতে পারেনি। তারপর থেকে মমিন আর কোনোদিন পাট কাটতেও যায়নি কারো ক্ষেতে। পাটক্ষেতের নাম শুনলেই তার মুখটা যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তাকাতে পারে না কোনো পাটক্ষেেতের দিকে। একটা বিভৎস্য ভয়, একটা অসহ কষ্ট তার বুকে চেপে বসে যেন।
অল্পবয়েসের একটা মেয়ের নগ্ন পচাগলা দেহ। গলায় ওড়নার ফাঁস। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঁচড়ের দাগ। পেট, মুখ, বুক যেন কোনো হিংস্র পশু বিষাক্ত দাঁত দিয়ে খুবলেছে। পুলিশ এসেছিল। জানা গিয়েছিল মেয়েটা দূরের কোনো এক গাঁয়ের। যারা ওকে রেপ করে এভাবে খুন করেছিল তাদের শেষপর্যন্ত পুলিশ খুঁজে পেয়েছিল কিনা সে খবর আর পাওয়া যায়নি। তবে প্রথম প্রথম ওদেরও কয়েকবার থানায় যেতে হয়েছিল।
-কি হল, কতা বলতিছিস নে কেন? কী ভাবতিছিস মমিন?
এতক্ষণ মমিন সেই চার বছর আগেকার ভয়ঙ্কর স্মৃতির মধ্যেই ডুবেছিল। চাচার ডাকে স্বাভাবিক হল। ফিরে এল বর্তমানে।
অস্ফূট ভয়ার্ত কণ্ঠে “অ্যাঁ” উচ্চারণ করে মমিন।
-বলতিছি, তা’লি যাচ্ছিস তো পাট কাটতি?
মমিন আস্তে আস্তে বলল- শরীরডা ভাল না চাচা।
পাশের বাড়ির দাসের বউ
-ও দিদি,দিদি…
-কে, রাজুর মা?
-হ্যাঁ গো,আমি। দাদা বাড়ি আছেন?
-হ্যাঁ, আছেন।
-আমার খাতাটা একটু হিসেব করতে হবে।
-এসো, বসো।
বারান্দায় এসে মেঝেতে বসে রাজুর মা। পাশের বাড়ির দাসের বউ।
বিড়ির খাতায় কত টাকার কাজ হয়েছে সেই হিসেব করতে এসেছে।
দুপুরে খেয়েদেয়ে ভোলা একটু শুয়েছে। পাশে বউও। ছেলেমেয়ে দুটো স্কুলে।
দাসের বউটা ভারি মিষ্টি। বড্ড নাদুসনুদুস। হলুদ শাড়ি পরে যখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, চুপিচুপি তাকিয়ে থেকে ভোলা মনেমনে কী যেন চেটে যায়। কিংবা যখন বিড়ির কুলো নিয়ে ভোলার বাড়ির সিঁড়ির পরে বসে। তার বউয়ের সাথে গল্প করে। তখন ভোলা গোপনে বসে কল্পনার মউয়ে জিভ চোষে।
বউ বলে- শুনছো, তুমি একটু রাজুর মায়ের বিড়ির খাতাটা হিসেব করে দিয়ে আসো না।
ভোলা বারান্দায় যায়।।
হলুদ শাড়ি আর হাতাকাটা ব্লাউজ। উঃ অসহ্য! ভোলা ভাবে- সুপ্রিমকোর্ট তো পরকীয়ার পক্ষে রায় দিয়েই দিয়েছে। ভয় কী? তাছাড়া স্বামীটাও তো থাকে কেরালায়। একবার এই সুযোগে… বউটাও শুয়ে আছে ঘরে।
ভোলা পাশে গিয়ে বসে।
– কই, দাও।
মুচকি হাসে দাসের বউ- দেখুন তো দাদা, ক’টাকা হলো এ’মাসে বিড়ি বেঁধে।
খাতা এগিয়ে দিতে হাত বাড়ায় বউটা।
কী গোলগাল হাতখানা। একটু চেপে…
ভোলা ঘরে শোয়া বউয়ের দিকে একবার তাকায়। না, শুয়েই আছে। আরো একবার দেখে। তারপর ধীরেধীরে লোভার্ত হাতটা বাড়ায়।
– আমার খাতাটাও তাহলে একবারে হিসেব করে দাও।
পরকীয়া-প্রত্যাশায় ভোলা এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, বউ কখন যে গুটিগুটি পায়ে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। বউয়ের দিকে ভোলা আশাহত দৃষ্টিতে তাকায়।
স্বামির বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নিজের খাতাটা ধরিয়ে দেয় ভোলার বউ।