সৌমেন কুমার চৌধুরী এর সকল পোস্ট

সৌমেন কুমার চৌধুরী সম্পর্কে

পেশাগত কর্মের বাইরে একমাত্র নেশা লেখালিখি। ছোট থেকেই কবিতা লেখা ও পড়ার নেশা। আজও অব্যাহত...

প্রাপ্তির ঘরে শূণ্য

চারপাশে ভীড় আত্মার জন
কাটাছেঁড়ায় মত্ত পাপ না পূণ্য,
ডেবিট ক্রেডিট মেলেনি তাঁর
ব্যালেন্সসীটে প্রাপ্তি শুধুই শূন্য!

ট্রায়াল ব্যালেন্সের কেবল প্রফিট
জমা পড়েছিলো জীবনের শ্রম,
ছেলের ভবিষ্যত গড়া হলে’পর
নিজের ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রম!

আধুনিক ফ্ল্যাটে হয়নি জায়গা
ঝকঝকে সব দামী নবীন,
ডাস্টবিনটাও বিদেশ থেকে
সেথায় তিনি বড্ড মলিন!

সেজেছেন জীবনের সেরা সাজে
ফুল মালা আর চন্দনে,
শীততাপ ছিল জীবনে ব্রাত্য
আজ সেখানেই শয়নে!

মিথ্যা আশ্বাসে শবযান ছোটে
সাইরেনে বাড়ায় গতি,
জীবনের গতি হয়েছে স্তব্ধ
ছেলের কবে হবে মতি!

শব্দমুক্তি

নিশুতি রাতে শব্দগুলি
আমার ঘরে বন্দি,
তাই না দেখে মাথায়
জন্মালো এক ফন্দি।
সাজাতে গিয়ে শব্দ
হলাম বেশ জব্দ,
শেষে ছেড়ে হাল
মুক্তি শব্দের পাল।
নিদ্রা দেবীর করি আরাধনা,
কাব্য লেখা সোজা কাজ না।

কেমন আছো কলকাতা?


কেমন আছো কলকাতা?
– আমি ভালো নেই!
বিষাক্ত কার্বনমনোক্সাইডের গন্ধে
আমার ফুসফুস আক্রান্ত,
ডেঙ্গু -ম্যালেরিয়ায় আমার শরীর জরাগ্রস্ত ;
প্রতিনিয়ত শান্তির অভাবে ধুঁকছি।
প্রাণবায়ু কেড়ে নিতে সর্বক্ষণ চলছে ষড়যন্ত্র,
আমাকে কলুষিত করতে চলছে নিত্য পরিকল্পনা ;
আমার চরিত্রে দাগ দিতে চলছে রমরমিয়ে মধুচক্র।
ধনী গরীব নেই কোন হুঁশ
মধুর লোভে এরা সেজেছে আদিম মানুষ!
মধুচক্রে সামিল কত নেতা ও আমলা
অসহায় চোখে দেখি সকাল-সন্ধ্যাবেলা
রক্ষী আজ নিজেই অরক্ষী
তাকে কে করবে রক্ষা?
দিনে রাতে চলে ধর্ষণ এখানে
সমাজে ঢুকে গেছে যক্ষ্মা!

একদা এখানে ছিল মানুষ
সত্যিকারের সভ্য,
রচনা করেছে কত উপন্যাস
কত না নামী কাব্য।

তোমারা আমায় দেবে সম্মান
আমি নাকি সাহিত্য নগরী,
অশ্লীলতায় ভরেছে গেছে শহর
পাচ্ছে না বিচার ধর্ষিতা নারী!

কি করে ভালো থাকবো
কেই বা ভালো রাখবে?
সবাই নিজের আখের গোছায়
আমায় কে এখন দেখবে!

মিছিল নগরীর ঐতিহ্য হারিয়েছি
এখন যা হয় দম্ভ,
ব্রিগেডের ডাকে ভরে না মাঠ
দেখাই অষ্টরম্ভ!

ফুটপাত আজ উধাও হয়েছে
পাত আছে নেই ফুট,
ভোটের মায়ায় চলছে এসব
এতে নেই কোন ঝুট!

রাতের আমি নেই মোহময়ী
সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ,
নিরাপত্তায় ভোগে মহিলারা সব
অখ্যাত বা বিখ্যাত!

তোমরাই বলো আমি কি আছি ভালো?
রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষের হাওয়ায় চারিপাশ ঘন কালো!

দেবযানী

প্রেমের প্রতীক তুমি দেবযানী
ত্যাগের প্রতীক তুমি দেবযানী
ব্যাথার নাম তুমি দেবযানী
ছলনার শিকার তুমি দেবযানী।

অপেক্ষার আর এক নাম দেবযানী
বঞ্চিতার আর এক নাম দেবযানী
করুণার আর এক নাম দেবযানী
ভালোবাসার আর এক নাম দেবযানী।

উপেক্ষিতা নায়িকা তুমি মহাকাব্যের পাতায়
কাটিয়েছ বড়ো দীর্ঘ সময় আশায় আশায়
মগ্ন ছিলে মধুর স্বপ্নে দিবস-যামিনী-ভোর
ছিন্ন হলো স্বপ্ন তব কাটিলো যখন ঘোর।

হতাশার আলো পিছনে ঢেলে
ব্যার্থতার গ্লানি ঝেড়ে ফেলে
আশার আলো সামনে মেলে
ক্ষমার প্রদীপ সামনে জ্বেলে
এগিয়ে চলবে জানি-
আমার প্রিয়তমা দেবযানী।

নো ভ্যাকান্সি

জীবনের গাড়ী হঠাৎ এসে দাঁড়ালো
“কর্ম” নামক স্টেশনে।
যারা নামলো, তারা কোলাহল করতে
করতে নব আনন্দে কর্মের প্ল্যাটফর্মে
ছোটাছুটি করতে লাগল।
রসদ হিসাবে আনা ডিগ্রীগুলি নিয়ে পানীয়ের সন্ধানে বিভিন্ন অফিসে
ছোটাছুটি করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ডিগ্রীগুলির দিকে
ঘৃণাভরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো-
সত্যিই কি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক?
কি পেলাম স্বাধীনতার এতগুলি বছর পর?
গভীর হতাশায় ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেললো ডিগ্রীর ঝুলি!

ঠিক তখনই, সামনে দিয়ে এগিয়ে আসে ভুখা মানুষের বিশাল মিছিল,
শ্লোগানে শ্লোগানে ভরে ওঠে চতুর্দিক:
আমাদের দাবী মানতে হবে,
বেকারদের কর্মসংস্থান করতে হবে, শূণ্যপদ পূরণ করতে হবে, ইত্যাদি…
কে শুনবে এই ভুখা মানুষের কথা?
নিজেদের আখের গুছাতে গিয়ে কখন যেন ভুলে গেছে ওদের কথা!
সময় কোথা এদের কথা ভাববার!

চারিদিকে একের পর এক বন্ধ কলকারখানা,
অফিসে অফিসে টাঙানো বোর্ড –
“নো ভ্যাকান্সি”।

মেয়েদের বায়না,ছেলেদের আবদার,
আনতে স্ত্রীর স্যাটিস্ ফ্যাকশন,
কোথায় যেন চাপা পড়ে গেছে
বেকারদের ঐ অ্যাপ্লিকেশন!
মিটিং -মিছিলের বক্তৃতায়
গুরুগম্ভীর আলোচনা,
সঙ্গে সমান তালে চলে
বিপক্ষ দলের সমালোচনা।

নিভৃতে কোনদিন ঘন একান্তে
জিজ্ঞাসো যদি-
বেকার সমস্যায় কেন অরাজি?
বলবে তখন- দূর্ বোকা,
এতকাল জিতেছি খাইয়ে ওদের ধোঁকা!
চাকরি পেলে কেউ কি আর
ভোটের সময় লড়বে?
ওরা যে তিমিরে আছে
সেই তিমিরেই থাকবে!
সুতরাং –
ওদের সমস্যাটা নয় এমার্জেন্সী,
সর্বত্রই টাঙানো থাকবে-
নো ভ্যাকান্সি!

রাজার ঘুম

সমাজ গড়ার কারিগররা আজ
অধিকারের অনশন মেলায়,
রাজা আছেন দিবানিদ্রায়
মাথা ব্যাথা নেই এই খেলায়!

রাজা তোর ঘুম ভাঙবে কবে?
কবেই বা তুই সভায় বসবি?
হাহাকার ভরা তোর রাজ্যে
শিল্প তাড়িয়ে চাকরি দিবি!

রাজা এবার ঘুম থেকে ওঠ
প্রজাদের সুখ দুঃখটা দেখ্
পারিষদরা সব সভায় ঢোলে
কাটমানি খেকোদের নামটা লেখ্!

রাজ্য জুড়ে মেলা অনাসৃষ্টি
নেইকো কোথাও একটু বৃষ্টি
মাঠে পুকুরে নেইকো জল
রাজ্যের রাজা ঘুমে অতল!

কেমন আছো কবি?


কেমন আছো কবি?
তুমি কি এখনও লেখ কবিতা?
এখনও কি সমান ধার তোমার লেখনীতে?
কি সব ছাইপাঁশ লেখ বলতো-
কেউ কি পড়ে তোমার কবিতা?
কি লাভ এসব লিখে?
পারবে তুমি সমাজকে বদলাতে?

তোমার নাকি বিদ্রোহী মন
সমাজের বুকে ঘটে যাওয়া
অসামাজিক কাজের বিরুদ্ধে ঝলসে ওঠে তোমার কলম;
প্রতিবাদের ভাষায় রচনা ক’র কবিতা।

তোমার প্রতিবাদ প্রতিনিয়ত দলিতমথিত হচ্ছে,
প্রতিনিয়ত সমাজের বুকে ধর্ষিতা হচ্ছে
আমাদের মা-বোন;
রক্তে রাঙা আমাদের মাটি
স্বজন হারানো স্বজনের বিলাপে
বাতাস আজ ভারাক্রান্ত।

তবুও তুমি লিখে চলেছ কবিতা!
তোমার কবিতায় – মা কাঁদছে,
বোন কাঁদছে,পুত্রহারা পিতা কাঁদছে –
তাদের কান্নার ধ্বনি, চোখের জল
উঁচুর দিকে ধায় না,নিচুর দিকেই ধাবমান,
উঁচুর দিকে যে তেনাদের বাস!

আমি ভালো নেই,
তুমি কেমন আছো কবি?

শ্রাবণে আশা


আষাঢ়ের শেষ বৃষ্টির ফোঁটাগুলি
শ্রাবণের বার্তা বয়ে নিয়ে এলো,
বারান্দায় শেষ বিকেলে একলা বসে
উতলা মন যেন শ্রাবণকেই চাইছিল।
নূতনের আহ্বান, পুরাতনের দীর্ঘশ্বাস
এটাই পরিবর্তনের ইতিহাস!

শ্রাবণের বারিধারা ঝরবে ঝরঝর
আশায় আশায় কৃষকের দল,
আরও প্রাপ্তির আশা নিয়ে আছে
দাবদাহে অবগাহিত বৃক্ষদল।
আশা নিয়ে জমা রেখেছে শক্তি
মিলবে শ্রাবণে ভেকের মুক্তি!

অফিসের বাবুরা রয়েছে তাকিয়ে
কখন আসিবে শ্রাবণ,
রাস্তার জমা জলে বন্ধ যান
অফিসে লাগবে গ্রহন!
কেরানীর আশা শ্রাবণ এলেই কামাবে,
ভেজাবাবুদের থেকে উপরিটা জমাবে।

শ্রাবণের দিকে চেয়ে আছে শুভাকাঙ্ক্ষী
ধুয়ে মুছে পাপ
হয়ে যাবে সাফ
চাইছে সমাজের যত হিতাকাঙ্ক্ষী।

প্রস্তুতি

সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে
খোলা আকাশের নীচে ছাদের কার্নিশের
রেলিং-এ ভর দিয়ে সে এসে দাঁড়ালো;
এলোমেলো কিছু বাতাস তাকে সঙ্গ দিল।
ফুসফুসে কিছু টাটকা খাবার চালান দিয়ে
রসিদের জন্য কর্মরত চাঁদের দিকে
তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো।

আজ সারাদিন তার এতটুকুও বিশ্রাম মেলেনি।
অসুস্থ স্ত্রীর পরিচর্যায়,ছোট্ট শিশুটির দেখাশোনায়,
কোথায় কোনদিক দিয়ে কেটে গেছে
কর্মব্যস্তময় দিনটি-
সে বুঝতেই পারেনি!
অবশেষে-
রুগ্ন স্ত্রীকে দিনের শেষ ওষুধটি খাইয়ে,
ছোট্ট শিশুটিকে ঘুম পাড়িয়ে
সে এসে দাঁড়ালো…..

মুখের সিগারেট থেকে একরাশ ধোঁয়া
বাতাসকে ধরতে দিয়ে সে শরীরকে রেলিং-এর
উপর ছেড়ে দিল;
উড়ে যাওয়া ধোঁয়ার সঙ্গে সারাদিনের ক্লান্তি
নিমেষে মিলিয়ে গেল।

প্রস্তুত হলো সে আগামী দিনের জন্য….

images

ভয়

গঙ্গানদীকে একবার ডেকে জিগ্যেস্ করেছিলাম-
তুমি তাকে আমার কাছে এনে দেবে?
জানো- সে আমারই, শুধু আমারই।
গঙ্গানদী আমাকে বলেছিল-
অপেক্ষা ক’র।

যে পাড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, সে পাড়-
ক্রমশঃ ক্ষয়ে ক্ষয়ে আমাকে সরিয়ে দিল পিছনে।
তবু প্রতিদিন আমি অধীর আগ্রহে উত্তরের অপেক্ষায় থাকি।
ক্লান্ত হয়ে একদিন বলি-
আমার কথা মনে আছে নদী?
নদী বললো-
সবাই তো কোলাহল করছে,অপেক্ষা ক’র-
আরও বলল-তিনমাস অপেক্ষা করতে পা’র?
বললাম- তাই হবে, কিন্তু পাবতো আমার প্রিয়াকে?

নদী কথা রেখেছিল, ঠিক তিনমাস পর-
প্রিয়াকে এনেছিল আমার কাছে,
হাতে ছিল তার ফুটন্ত গোলাপ,
মুখে ছিল মোনালিসার হাসি।
দেখেই চমকে উঠেছিলাম, তারই দেওয়া
গোলাপটির দিকে তাকিয়ে ভয় হয়েছিল মনে,
কখনও এর কাঁটা বিঁধবে না তো আমার বুকে?

পাপের বাজার

নানান ধর্মের, নানান বর্ণের, নানান আকারের
মানুষের ভীড়ে জমজমাট বাজার;
কোলাহলে পরিপূর্ণ বাজারে চলছে প্রতিযোগিতা
সেরা জিনিসটি নিজের কব্জাবদ্ধ করার!

এখানে অশ্লীলতার পসরা সাজিয়েছে ব্যাপারীরা,
ওখানে খুলেছে দোকান পাপাচারের কারবারীরা;
কোন দোকান পায়নি যারা
টুসকি মেরে ডাকে তারা,
খদ্দের সব এদিকে আসুন-
সেল ধামাকা চলছে দেখুন!
সস্তায় পাবেন অবৈধ মাল
নেতা, মন্ত্রী কিংবা আঁতেল,
এই বাজারে সবাই সমান
বজায় থাকে মান সন্মান।
এখানে ব্যবসার মূল মন্ত্র গোপনীয়তা,
নেইকো ত্রুটি মিলবে চরম আতিথেয়তা!

পাপাচারের দোকানগুলিতে আজ চলছে জোর বিকিকিনি
হবে নাই বা কেন-
কান পাতলেই শোনা যায় পাপাচারের জয়ধ্বনি!

download

নকল ভালোবাসা

তোমার সুন্দর মুখখানির দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম-
বল প্রিয়ে, কিবা তব প্রয়োজন?
বলেছিলে তুমি: হে আমার রাজন-
দেহ মোরে এক বচন, মম নাহি প্রয়োজন,
তবু তুমি কর রোজগারের আয়োজন।

তোমার দীঘল হরিণ নয়নের দিকে
তাকিয়ে বলেছিলাম-তোমার কি দরকার?
নয়নে নয়ন দিয়ে উত্তরিলে-শুধু তোমার রোজগার!

তোমার রক্তিম দুটি ওষ্ঠের দিকে তাকিয়ে
জিজ্ঞাসিলাম-বল প্রিয়ে,তোমার চাহিদা?
রাঙা দুটি ওষ্ঠের অল্প ফাঁকে দিলে উত্তর-
জগতের আকাঙ্খিত বস্তুটিতে মিটিবে সব আশা,
বুঝলে আমার সোনামনি-
তোমার পকেটে দেখতে চাই মানি, মানি আর মানি।

টাকার কাছে সেইদিন হার মানলো ভালোবাসা,
পেলাম ব্যাথা,বুকে গভীর হতাশা,
মনে মনে করিলাম কঠিন পণ,
আজি হতে টাকাই আমার হোক্ ধ্যান-জ্ঞান।
চাই না আমি নকল ভালোবাসা
প্রেম থাক্ দেবতা হয়ে বাকী সব কুয়াশা।

জীবন জিজ্ঞাসা

মানুষটা যে ছিল-কি তার প্রমাণ?
প্রমাণ আছে ওর ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে।
নিত্য আসা-যাওয়া সময়ের ব্যবধান
তারও তো দরকার-শুধু সময়ের তালে তালে।
কি নাম? বাপ-মায়ের আদরের ডাকা
স্নেহ ভালোবাসা, নয় সে তো অবাঞ্ছিত কারো,
কর্মের বন্ধনে বেঁচে থাকা, তা না হলে ফাঁকা।
শূণ্যতার আঁচলে বাঁধা বুঝি গেরো-
তবুও তো তাকে বেঁধে রাখা দায়,
পশ্চিম আকাশে দে’খ আবছা আঁধার
পায়ে পায়ে ধেয়ে সময় কি চলে যায়?
ওই সুর্য অস্তাচলে; হাসা কাঁদা সবই সার।

শ্লীলতাহানির পরে

বড়বাবু-মেজোবাবু-ছোটবাবু একে একে
সকলেই এলেন, খবরের গন্ধে হাজির
একদল রিপোর্টারও। কি হয়েছে? ধর্ষণ?
একজন না অনেক? ও, অনেক?
তাহলে বল্ গণধর্ষণ? থাকিস কোথায়?
– ফুটপাতে? চল্-ডাক্তারের কাছে,
রিপোর্ট চাই-রিপোর্ট!
ডাক্তারবাবুর কাছে ভীড় করে রিপোর্টাররা।
জানতে চায় সমস্ত ঘটনা।
খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হবে-
“ফুটপাতে গণধর্ষণ”।
আর্কষণ আনতে বক্স করে দেওয়া হবে।
পাবলিক ট্যারা চোখে ঠিক খবরটা গিলে খাবে।
সমান তালে উঠেপড়ে লাগে রাজনৈতিক নেতারা;
প্রতিযোগিতা চলে-কে আগে ধর্ষিতার গায়ে তার
দলের ষ্ট্যাম্প লাগাতে পারে!
দাবী ওঠে: তদন্ত চাই-তদন্ত চাই।
চাপে পড়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দিয়ে সরকার
গড়লো-তদন্ত কমিশন!
চলল অবিশ্রান্ত তদন্ত!

মাস যায়,বছর পেরিয়ে যায়-
সরকারী কোষাগার থেকে অক্লেশে পাশ হয়ে
বেরিয়ে যায় কত বিল-প্লেন, ফাইভ স্টার হোটেল,
রঙ্গিন জল, আরও কত কি!
কমিশনের রিপোর্ট আর জমা পড়ে না।
ধর্ষণকারীরা সাজা পাবে ভেবে ধর্ষিতার মনে
বেড়ে ওঠা আশার চারাগাছটি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে লাগলো।
নতুন ঘটনা পেয়ে রিপোর্টাররা তাকে যেন বেমালুম ভুলে গেল।
দাদারা নিজেদের দলের স্বার্থে ভাইদের ছোট ভুলকে চাপা দেওয়ার
জন্য উঠেপড়ে লাগলো।

ডান-বাম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল!
বেচারা মেয়েটি চিনলো কঠোর বাস্তব ও নির্মম সত্যকে,
মনের সমস্ত আব্রু ধর্ষণকারীদের কাছে হারিয়ে এক
গলিতে চায়ের দোকান খুলে বসে; পিছনে চলে
দেশী মদের রমরমা কারবার ও রাতভর দেহব্যবসা।
বিনামূল্যে হারানো আব্রুর বদলা নিতে দেহব্যবসা করে
সমাজের কাছ থেকে সে আদায় করে তার পারিশ্রমিক!
হায় রে-আমার স্বদেশ!

সত্য সেলুকাস-কি বিচিত্র এই দেশ!

বিটি

বিটি

পলাশডাঙার আদিবাসী পাড়ার একটা ঘরে
আজ কুন আলো জ্বলেকনি,
তুলসীতলায় কুন পিদিম জ্বলেকনি,
জ্বইলবেক বা কেনে-
এক বছর ধরে তিল তিল করে গড়া স্বইপ্নো
ভেঙে ধূলায় গড়ায় গেছে।
অইন্ধোকার দাওয়াতে এইক কোণে বুইসে
গালে হাইত দিয়ে শিবু সোরেন ভাবে-
বউটা মোরে ঠকাইছে বটে! ব্যাটা দিব বুলে শ্যাষে
বিটিটা দিলো! বংশের বাতিটা এখুন জ্বালাইবেক কে?

মনে পড়ে-
একদিন কলের লাঙল চালাবার ফাঁকে চৌধুরীবাবু কয়েছিলেন-
শিবু, ব্যাটা হ’ল গিয়ে বংশের বাতি। ব্যাটা না থাইকলে বংশের
কি রইল শুনি!
অবাক চোখে শিবু ফ্যালফ্যাল করে তাকায়ে ছিল।
রেতে বউটারে সোহাগভরে কইছিল-
ফুলমণি-আমার ব্যাটা চাই, ব্যাটা। বংশের পিদিম-

ভাঙাঘরের টিনেরচালের ফুটো দিয়ে পূর্ণিমার আলো
এসে পড়ে ফুলমণির সদ্যজাত বিটির মুখে,
চাঁদপানার মতো মুখ, হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে।
আদর করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ফুলমণি।
হলই বা বিটি, বিটিই বা কম কিসে?
ওরে আমি পড়ামু-বড়ো হয়ে অনেক লেকাপড়া করবেক,
চাকরি করবেক। সকইলকে ডেকে কমু-
দ্যাখো-আমার বিটি কত বড়ো হইছে!
শিবুর মুখটা ভেসে উঠতেই থম্ মেরে যায় ফুলমণি।
না-মরদটারে সে কুথা দিয়ে কুথাটা রাইখ্তে পারে নাই।
মরদটা তার ব্যাটা চেয়েছিল, সে ব্যাটা দিতে পারে নাই।
তাই তার ঘরটাতে পিদিম জ্বলে নাই, অইন্ধোকার-
শুধুই অইন্ধোকার।

বিটিটার কান্না শুনে বাপের মনটা কেঁদে ওঠে,
ছুটে গিয়ে কোলে করতে চায়-আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে চায়-
উঠতে গিয়েও বসে পরে শিবু। দু’টো হাঁটুর ভাঁজে মাথাটা গুঁজে
চৌধুরীবাবুর কুথাটো ভাবে-
ব্যাটা তো সত্যিই পিদিম, ব্যাটা বড়ো হবেক-
কাজ করবেক, আমার মুতন কলের লাঙল চালাইয়ে
পয়সা কামাবেক, বাপ-মা রে খাতির করবেক-

ফুলমণি অবাক চোখে বিটিটার দিকে তাকায়,
বিটির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে যেন ফুলমণিকে
দেখছে আর বলছে-
মা, আমি এসেছি-
তুমি খুশি হও লাই! বুঝেছি-
আমি বিটি, তাই! কিন্তু মা-তুমিও তো বিটি,
তুমার মা-ওতো বিটি, বাপের মা-
সে ওতো বিটিই ছিলো, তাহলে?
বিটিরা না জন্মালে
তুমাদের জন্ম হতো ক্যামনে?
দুচোখ জলে ভরে ওঠে ফুলমণির।

ঢাকের শব্দে, বাজির শব্দে হুঁস ফেরে শিবুর।
দূরে আলোর রোশনাই, চৌধুরীবাড়ী সেজে উঠেছে,
আজ যে মায়ের বোধন!

ছুটে ঘরে ঢুকে শিবু বিটিকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে।
খিল্ খিল্ করে বিটি হাসে, ফুলমণি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।
আনন্দে শিবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
শিবু কয়-
ফুলমণি, আমি ভুলটা বুঝতে পারিছি রে-
এখুন আমার কুনো রাগ নাই,
কুনো রাগ নাই।
চৌধুরীবাবুটা মোরে মিছে কুথা কইছিল বটে!
বিটি যদি পিদিম না হবেক তো চৌধুরীবাবুর বাড়িতে
এত্তো আলো ক্যানে? এত্তো বাদ্দি-এত্তো বাজি-
মা দুগ্গাও তো বিটি বটে!

ফুলমণি অবাক চোখে তার মরদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাপের কোলে বিটি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
বোধনের বাজনা বাজে, বোধন শুরু হয় চৌধুরীবাড়ীতে।