সালজার রহমান সাবু এর সকল পোস্ট

সালজার রহমান সাবু সম্পর্কে

মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জ্যবোধ করি....!

অর্থনীতি – পর্ব -০২

প্রথম পর্বের পরে…………..
একজনের হাত থেকে অন্য জনের হাতে হস্তান্তর, অর্থাৎ গতিশীলতা। প্রতিটি হস্তান্তর যত দ্রুত হতে থাকবে তত বেশি সংখ্যক লোক ঐ একই সম্পদ থেকে লাভবান হতে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ধরুণ একটা এক টাকার নোট। এই নোটটা যার হাতেই পোড়ল, সে যথা সম্ভব শীঘ্র সেটা খরচ করে ফেলল। সে খরচ যেমন করেই হোক, কোনো কিছু কিনেই হোক বা দান করেই হোক বা কাউকে ধার দিয়েই হোক বা কোনো ব্যবসাতে বিনিয়োগ করেই হোক। ঐ নোটটা যদি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দশজন লোকের হাত বদলায় তবে ঐ এক দিনে নোটটা দশজন লোককে লাভবান করবে। আর যদি একশ’ জনের হাত বদলায় তবে একশ’ জনকে লাভবান করবে। কারণ প্রতিবার হাত বদলাবার সময় দু’জনের মধ্যে একজনকে অবশ্যই লাভবান হতেই হবে। ঐ সীমিত সম্পদটা অর্থাৎ ঐ এক টাকার নোটটা যত দ্রুত গতিতে হাত বদলাবে, যত দ্রুত গতিতে সমাজের মধ্যে চালিত হবে তত বেশি সংখ্যক লোককে লাভবান করবে; তত বেশি সংখ্যক লোক অর্থনৈতিক উন্নতি করবে এবং পরিণতিতে সমস্ত সমাজকে অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত করবে, সম্পদশালী করবে।

ঐ গতিশীলতার জন্য যে কোনো পরিধির সীমিত সম্পদ সমাজে নিজে থেকেই সুষ্ঠুভাবে বণ্টন হয়ে যাবে কোথাও পুঞ্জীভূত হতে পারবে না এবং হবার দরকারও নেই। সম্পদের এই গতিশীলতার জন্য নিজে থেকেই সুষম-সুষ্ঠু বণ্টন হয়ে যাবার কারণে একে রাষ্ট্রায়াত্ব করার কোনো প্রয়োজন নেই, ব্যক্তির মালিকানাকে নিষেধ করারও কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যক্তি মালিকানা নিষিদ্ধ করার কুফল সাংঘাতিক, যে কুফলের জন্য রাশিয়া আজও খাদ্যে-পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে নি এবং আজও আমেরিকা থেকে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়। যা হোক, উদাহরণস্বরূপ যে এক টাকার নোটের কথা বললাম, সেই নোটটা যদি সমস্ত দিনে কোনো হস্তান্তর না হয়ে কোনো লোকের পকেটে বা কোনো ব্যাংকে পড়ে থাকে তবে ওটার আসল মূল্য এক টুকরো বাজে ছেঁড়া কাগজের সমান। কারণ সারাদিনে সেটা সমাজের মানুষের কোনো উপকার করতে পারল না, কারো অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারল না। আবার বলছি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের অর্থনীতির বুনিয়াদ-ভিত্তি হলো সম্পদের দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিশীলতা (Fast and still faster circulation of wealth)।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলনীতি হচ্ছে সুদ ভিত্তিক পুঁজিবাদ, পরিণাম হচ্ছে নিষ্ঠুর, অমানবিক অর্থনৈতিক অবিচার, একদিকে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিপুল সম্পদ, তাদের সীমাহীন ভোগ বিলাস; অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের কঠিন দারিদ্র্য, অর্ধাহার-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলনীতি হচ্ছে সমস্ত সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত করে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার হরণ করে সম্পদ বণ্টন। এ বণ্টন শুধু মৌলিক প্রয়োজনের এবং তা-ও ঐ মানুষের শ্রম ও উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে। পরিণাম হচ্ছে খাদ্য, বস্ত্র, ও ক্ষুদ্র বাসস্থানের বিনিময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের আত্মাহীন যন্ত্রে পরিণত হওয়া ও মুষ্টিমেয় নেতৃবৃন্দের ভোগ-বিলাস ও প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করে ঐ বঞ্চিত কৃষক শ্রমিক জনসাধারণের নেতৃত্ব করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। ঐ দুই ব্যবস্থাই মানুষের-গায়রুল্লাহর সৃষ্টি এবং দুটোরই পরিণাম বৃহত্তর জনসাধারণের উপর নিষ্ঠুর অবিচার, বঞ্চনা। শেষ দীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলনীতি হচ্ছে সমস্ত সম্পদকে যত দ্রুত সম্ভব গতিশীল করে দেওয়া এবং অর্থনীতিকে স্বাধীন-মুক্ত করে দেওয়া। প্রত্যেক মানুষের সম্পদ সম্পত্তির মালিকানা স্বীকার করা, প্রত্যেকের অর্থনৈতিক উদ্যোগ-প্রচেষ্টাকে শুধু স্বীকৃতি দেওয়া নয় উৎসাহিত করা (সুরা আল-বাকারা ২৭৫)। একদিকে অর্থনৈতিক উদ্যোগ প্রচেষ্টা অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকে আল্লাহ উৎসাহিত করছেন অন্যদিকে ক্রমাগত বলে চলেছেন খরচ করো, ব্যয় করো। উদ্দেশ্য সেই গতিশীল সম্পদের নীতি। পরিণাম সমাজের সর্বস্তরে সম্পদের সুষ্ঠু-সুষম বণ্টন, দারিদ্র্যের ইতি।

(শেষ)

অর্থনীতি – পর্ব -০১

Untitled-81-300x167অর্থনীতি জাতীয় জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটি জাতির উন্নতি, প্রগতি ইত্যাদি অনেকাংশেই যেমন নির্ভর করে তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর তেমনই ত্রুটিযুক্ত অর্থনীতি প্রয়োগের ফলে সমাজ অন্যায়, অবিচারে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

এই দীনের (ইসলামের) অর্থনীতির মূল ভিত্তি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা’ল্লাহ। ভিত্তি বলতে আমি বোঝাচ্ছি-নীতি, যে নীতির উপর একটা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদ, ধনতন্ত্রের নীতি হলো জনসাধারণের সম্পদ সাপটে এনে এক বা একাধিক স্থানে জড়ো করা। সমাজতন্ত্রের নীতি হলো জনসাধারণের সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে তুলে নেওয়া। মূলে একই কথা, দু’টোই জনসাধারণকে বঞ্চিত করা। পুঁজিবাদে দেশের, জাতির সম্পদ পুঞ্জীভূত করে সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের হাতে ব্যাংক, বীমা ইত্যাদির মাধ্যমে। যার ফলভোগ করে অতি অল্পসংখ্যক লোক এবং তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বঞ্চিত করে বিরাট ধনী হয়ে যায়। আর সমাজতন্ত্র দেশের, জাতির সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাষ্ট্রের হাতে। জনসাধারণকে দেয় শুধু খাদ্য, পরিধেয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো প্রাথমিক, মৌলিক প্রয়োজনগুলি, যদিও কার্যক্ষেত্রে তাও সুষ্ঠুভাবে করতে ব্যর্থ হয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্পদ পুঞ্জীভূত করে হাতে গোনা কতকগুলি কোটিপতি সৃষ্টি হয়, বাকি জনসাধারণ জীবনের প্রাথমিক মৌলিক প্রয়োজনগুলি থেকেও বঞ্চিত হয়।

এই ব্যবস্থা যতটুকু পরিধিতে প্রয়োগ করা হবে ততটুকু পরিধিতেই ঐ ফল হবে। একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে (Nation State) এ ব্যবস্থা প্রয়োগ করলে যেমন ঐ রাষ্ট্রের জনসাধারণের ভীষণ দারিদ্রের বিনিময়ে মুষ্টিমেয় কোটিপতি সৃষ্টি হবে ঠিক তেমনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পৃথিবীময় প্রয়োগ করলে কয়েকটি ভৌগোলিক রাষ্ট্র বিপুল ধনী হয়ে যাবে আর অধিকাংশ রাষ্ট্র চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হবে যেমন বর্তমানে হয়েছে। এর কারণ হলো একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রের সম্পদ যেমন সীমিত- তেমনি পৃথিবীর সম্পদও সীমিত। সীমিত যে কোন জিনিসকেই কোথাও একত্রিত করা, পুঞ্জীভূত করা মানেই অন্যস্থানে অভাব সৃষ্টি করা। একটা রাষ্ট্রের ভেতরই হোক, আর সমস্ত পৃথিবীতেই হোক, সেটার সম্পদ, যা সমস্ত মানব জাতির মধ্যে ছড়িয়ে থাকার কথা, সেটাকে যদি কোথাও পুঞ্জীভূত করা হয় তবে অন্যত্র অভাব সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। সমাজবাদী, পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী (Socialist, Capitalist & Communist) এই সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই মানুষের তৈরি, গায়রুল্লাহর ব্যবস্থা।

সুতরাং এর পরিণাম অবশ্যই অন্যায়-অবিচার। অন্যদিকে শেষ জীবন-ব্যবস্থায় অর্থনীতির প্রণেতা স্বয়ং স্রষ্টা, আল্লাহ। এই ব্যবস্থার ভিত্তি নীতি হচ্ছে সম্পদকে মানুষের মধ্যে দ্রুত গতিতে চালিত করা, কোথাও সঞ্চিত হতে না দেওয়া। পুঁজিবাদ বলেছে সম্পদ খরচ না করে সঞ্চয় কর; সবার সঞ্চয় একত্র কর, পুঞ্জীভূত কর (ব্যাংকে), আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন খরচ কর, ব্যয় কর, সম্পদ জমা করো না, পুঞ্জীভূত করো না। অর্থাৎ ইসলামের অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতির ঠিক বিপরীত। একটায় সঞ্চয় কর অন্যটায় ব্যয় কর। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রী সাম্যবাদী অর্থনীতি ব্যক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ করে জাতির সমস্ত সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে পুঞ্জীভূত করে। এটাও ইসলামের বিপরীত। কারণ, ইসলাম ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণ স্বীকার করে এবং রাষ্ট্রের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত করে না। পুঁজিবাদের ও সমাজতন্ত্রের যেমন আলাদা নিজস্ব অর্থনীতি আছে তেমনি ইসলামের নিজস্ব অর্থনীতি আছে। এককথায় বলতে হয় সেটা হচ্ছে সম্পদকে যত দ্রুত সম্ভব চালিত করা, কোথাও যেন সেটা স্থবির-অনঢ় না হতে পারে। এ জন্যই কোর’আনে এই অর্থনীতির বিধাতা, বিধানদাতা বহুবার তাগিদ দিয়েছেন খরচ কর, ব্যয় কর, কিন্তু বোধহয় একবারও বলেন নি যে, সঞ্চয় কর। যাকাত দেয়া, খারাজ, খুমস ও ওশর দেয়া এবং তার উপর সাদকা, দান ইত্যাদি খরচের কথা এতবার তিনি বলেছেন যে, বোধহয় শুধুমাত্র তওহীদ অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহকে প্রভু, হুকুমদাতা, এলাহ বলে স্বীকার ও বিশ্বাস করা এবং জিহাদ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে এতবার বলেন নি। কারণ, একটা জাতির এবং পরবর্তীতে সমগ্র পৃথিবীতে অর্থাৎ যে কোন পরিধিতে সম্পদ যথাযথ বণ্টনের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ব্যয়, সঞ্চয় নয়।

ধর্ম-অধর্ম ও শান্তি-অশান্তির চিরন্তন দ্বন্দ্ব

দিন দিন মানুষ নামের প্রাণীটি যেন অন্য রূপ ধারণ করছে। অন্য রূপ মানে অন্য চরিত্র, অন্য স্বভাব, অন্য বৈশিষ্ট্য। মানুষ কাকে বলে, কী করলে মানুষ হওয়া যায়, শুধু মানুষের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় কিনা- প্রশ্নগুলো এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তরও রয়েছে, তবে বিবিধ। মানুষ শব্দটি এসেছে মনুষ্য থেকে, ডিকশনারিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এমন- “যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে সে-ই মানুষ। মনুষ্যত্ব হলো মানুষের চিরাচরিত বা শাশ্বত স্বভাব বা গুণ।” যেমন দয়া-মায়া, ভালোবাসা, পরোপকারিতা, সহানুভূতি, সম্প্রীতি, ঐক্য ইত্যাদি। যুগে যুগে মানবজাতি তাদের বাস্তব জীবনে এই গুণগুলোর যথাসাধ্য প্রয়োগ ঘটিয়েছে। মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে সবাই নয়। ভালো-মন্দ, কৃতজ্ঞ-কৃতঘ্ন, পরোপকারী-স্বার্থবাদী দুই ধরনের মানুষেরই পদচারণা ঘটেছে এই নিখিল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে। তারা সকলেই মানবতা-মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদেরকে মানুষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয় নি। যাদের কর্মকাণ্ডে মনুষ্যত্বের চিরন্তন-সনাতন প্রতিফলন ঘটে নি তারা মনুষ্যত্বহীন, তথা ধর্মহীন। আর ধর্মহীন মানবসন্তানকে কখনই মানুষ বলা যায় না, মানুষ নামের মর্যাদা তার শোভা পায় না। যারা কাজে-কর্মে মনুষ্যত্বের পরিচয় প্রদান করতে পারে কেবল তারাই মানুষ নামে পরিচিত হবার যোগ্য। তাদের সম্মান অতি উচ্চ। স্বয়ং স্রষ্টার গুণ প্রকাশিত হয় তাদের মধ্য দিয়ে। জগতে তারা নন্দিত হন ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ বলে। তাদের উপস্থিতি পৃথিবীকে আলোকোজ্জ্বল করে। ধর্মানুরাগীদের সঠিক মার্গ প্রদর্শন করে ও অধার্মিকদের দণ্ড প্রদান করে তারা পৃথিবীকে শান্ত রাখেন। অর্থাৎ মানুষ ও অমানুষ বলতে যথাক্রমে ধার্মিক ও অধার্মিককে বোঝায়। যে ব্যক্তি মনুষ্যত্ব বা মানবতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সেই প্রকৃত ধার্মিক, অন্যদিকে যে ব্যক্তির মাঝে মানবতা নেই সে অধার্মিক। একইভাবে যে ব্যক্তি ধর্মের পথে চলে সে-ই মানুষ, আর যে অধর্মের পথে চলে সে অমানুষ।

এই ধর্ম ও অধর্মের দ্বন্দ্বই মানবজাতির প্রকৃত অতীত। বর্তমানও তাই। ভবিষ্যতেও এরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এরই অংশ হিসেবে কালচক্রে এমন সময় এসেছে যখন সমাজ পুরোপুরিই ধর্মাবৃত হয়ে গেছে। অধর্ম পুরোপুরি নাশ হয়েছে। সমাজ শান্তি-সমৃদ্ধি-সৌহার্দ্য, মানবতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। স্বর্গের মতো অবারিত সুখ-শান্তির দ্বার খুলে গেছে, যে ইতিহাসগুলো আজকাল রূপকথার মতো শোনায়। আবার এমনও হয়েছে যে, সমাজে অধর্মের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যার কারণে ধর্মকে থাকতে হয়েছে কোণঠাসা হয়ে।

এখানে একটি কথা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। অধর্মের মাত্রা বৃদ্ধি পায় কীভাবে? সাধারণভাবে মনে হতে পারে- ধার্মিক লোক কমে যাওয়া, সকলে ধর্মকর্ম পরিত্যাগ করে অধর্মের পথে ধাবিত হওয়া। কিন্তু আসলে তা নয়। ইতিহাস এটাই বলছে যে, ধার্মিক সকল সমাজে, সকল জাতিতেই ছিল, কিন্তু তথাপি অন্যায়-অবিচার, অশান্তি, অধর্ম বেড়ে যাবার কারণ হলো ঐ ধার্মিকরা ধর্ম মনে করে যা করেছে তা আসলে প্রকৃত ধর্ম নয়। তারা প্রকৃত ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে বিকৃত ধর্ম পালনে নিয়োজিত হয়েছে। কিন্তু বিকৃত ধর্ম যখন শান্তি আনয়নে ব্যর্থ হয়েছে তখনই ঘটেছে যত অশুভ, অকল্যাণকর কর্মকাণ্ড, ভোগ করতে হয়েছে অনিবার্য পরিণতি।

ইহুদিদের নবী রাজা দাউদ বা কিং ডেভিড (আ:) এর সময় যে শান্তির রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল তা ছিল সত্যধর্মের অনুসরণের ফল। হিন্দুশাস্ত্রে রামরাজত্বের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাও ছিল ঐ সত্যধর্মের অনুসরণের ফল। আবার মুসলিমদের স্বর্ণযুগখ্যাত ইসলামের প্রাথমিক যুগে অর্ধপৃথিবীব্যাপী যে অকল্পনীয় শান্তি-সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাও ছিল সত্যধর্মের বিধান অনুযায়ী চলার ফল, মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করার পুরস্কার। কিন্তু ইউরোপের মধ্যযুগের যে বর্বরতা মানবজাতির ইতিহাসে আজও কলংক হয়ে আছে সেটা ধর্মের ফল ছিল না, শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী মুসলিম সমাজে যে বিভেদ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অন্ধত্ব, পশ্চাদপদতা ইত্যাদি গ্রাস করে আছে সেটাও ধর্মের ফল নয়। এগুলো বিকৃত ধর্মের পরিণতি। যখন ধার্মিকরা অধর্মকেই ধর্মকর্ম সাব্যস্ত করে ধর্মীয় মর্যাদায় সেগুলো পালন করে চলে তখনই জন্ম হয় এমন অশান্তির।

বস্তুত কোনো সমাজে ধর্ম আছে কিনা তা যাচাই করার প্রথম ও প্রধান উপায় হলো সে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত আছে কিনা তা দেখা। ধর্মের ফল শান্তি, অধর্মের ফল অশান্তি। এ কারণে শেষ নবীর আনীত সত্যদীনের নাম ‘ইসলাম’, যার শাব্দিক অর্থই হলো শান্তি। অর্থাৎ সেটাকে প্রতিষ্ঠা করলে তার অনিবার্য ফলাফল হবে অনাবিল শান্তি। যুগে যুগে যতো নবী-রসুল-অবতার এসেছেন, যত দীন, শাস্ত্র বা জীবনব্যবস্থা এসেছে তার সবগুলোই ছিল ইসলাম। কারণ- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল জীবনব্যবস্থারই ফলাফল হচ্ছে শান্তি। তাই আল কোর’আনে আল্লাহ বলছেন- আমার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) হলো ইসলাম (শান্তি)। (সুরা আল এমরান, ১৯) এর মর্মার্থ এই যে, তিনি যুগে যুগে যে দীনগুলো পাঠিয়েছেন এবং যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে- সেই জীবনব্যবস্থাগুলোই কেবল তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য। এর বাইরে যে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে শান্তির পরিবর্তে মানবসমাজে কেবল অশান্তিই বৃদ্ধি পায় সেগুলো অগ্রহণযোগ্য, সেগুলো ইসলাম নয়।

আজ সমস্ত পৃথিব্যাপী অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। চারদিকে অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধ-রক্তপাত, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-মারামারি, শোষণ, বঞ্চনা আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, শোষিত আদম সন্তানের ক্রন্দন আর হাহাকারে পৃথিবী পরিণত হয়েছে এক অভিশপ্ত আতঙ্কের পুরীতে। কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা জাতি নয়, সকল ধর্মের অনুসারীই এই আতঙ্কপুরীতে মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে আছে। অর্থাৎ প্রচলিত কোনো ধর্মই মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না। এর কারণ এই সব জাতিগুলোই তাদের নবী-রসুল-অবতারগণের আনীত সত্যধর্ম থেকে, প্রকৃত শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে গেছে। তারা কার্যত কেউই প্রকৃত ধর্মের অনুসারী নয়। তারা ধর্মের খোলসে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে অধর্মের বীজ বপন করে চলেছে। অর্থাৎ মানুষ অধর্মকেই ধর্ম মনে করে পালন করছে আর ভাবছে- ‘আমরা বুঝি খুব ধর্মকর্ম করছি, স্রষ্টা আমাদের প্রতি অতি প্রসন্ন রয়েছেন, স্বর্গ হতে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করছে।’ কিন্তু বাস্তবে তারা অধর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে স্রষ্টার ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়েছে।

এই পার্থিব নরক থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় একটিই- প্রকৃত ধর্মকে বরণ করে নেওয়া। ধর্মের নামে অধর্মের ডালপালা বিস্তার বন্ধ করা। মানবসমাজে একটি ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে, ‘পৃথিবীতে এতগুলো ধর্মের মধ্যে মাত্র একটি ধর্ম সত্য হতে পারে (!) অন্য সকল ধর্ম মিথ্যা এবং ঐ সত্য ধর্মই কেবল মানুষকে মুক্তি দিতে সক্ষম।’ এ ধারণা প্রচলিত থাকায় সকল ধর্মের অনুসারীরাই দাবি করে যে, কেবল তাদের ধর্মই সত্যধর্ম। এটা ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম মেনে চলে স্বর্গে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল ধর্মই সত্যধর্ম। এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর যে কোনোটি মানুষ মেনে চলতে পারে। তবে মানতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। জাতীয় ও ব্যক্তিগত উভয় জীবনে একমাত্র স্রষ্টাকেই সার্বভৌম বিধানদাতা হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করলে যে কোনো ধর্মের মানুষই শান্তি পাবে। সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূরিভূত হবে। কেবল তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে খ্রিস্টানদের কাক্সিক্ষত কিংডম অব হ্যাভেন, হিন্দুদের কাক্সিক্ষত রামরাজত্বের শান্তি তথা সত্যযুগের পুনরাবৃত্তি এবং মুসলিমদের কাক্সিক্ষত স্বর্ণযুগের শান্তি। শান্তি-অশান্তি, সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্বে তখন জয় হবে সত্যের, জয় হবে ধর্মের, জয় হবে শান্তির।

সিদ্ধান্ত-সূত্র – পর্ব – শেষ

(মূল লেখা এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী থেকে সংক্লিত)

যেটা নেই (স্রষ্টা) তাকে মানুষ সেই প্রাক-ঐতিহাসিক সময়ে কল্পনা কোরে নিলো, শুধু কল্পনা কোরে নিলো না, সেটা কী রকম তার একই রকম বি¯তৃত বিবরণ পৃথিবীর এধার থেকে ওধার পর্য্যন্ত বিশ্বাস কোরে নিলো- কিন্তু যেটা আছে (মাধ্যাকর্ষণ) সেটাকে মানুষ হাজার হাজার বছরেও আবিষ্কার কোরতে পারলো না- এ কেমন কথা? এর জবাব হোচ্ছে- স্রষ্টা তার প্রেরিতদের দিয়ে সেই প্রথম মানুষটি থেকেই তার অস্তিত্ব ও গুণাবলী অর্থাৎ তিনি কেমন তা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন বোলেই মানুষ তার সম্পর্কে জানে, আর মধ্যাকর্ষণ সম্বন্ধে নিউটনের আগে কাউকে জানান নি বোলেই মানুষ তা জানতে পারে নি। স্রষ্টা যদি মানুষ সৃষ্টি কোরে, তাকে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হোতেন, প্রেরিতদের দিয়ে নিজের সম্বন্ধে কিছু না জানাতেন তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মানুষ আজও তার সম্বন্ধে কিছু জানতো না- কিংবা স্রষ্টা কেউ একজন হোতে পারেন ভাবলেও তার গুণাবলী, সিফত সম্বন্ধে কোন ধারণা কোরতে পারতো না। নাস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্বের যে প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুষ প্রমাণ চান, ওরকমের প্রমাণহীন বহু লক্ষ জিনিষকে, ব্যাপারকে তারা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন। তারা যার যার বাপকে বাপ বোলে বিশ্বাস করেন, কিন্তু এর কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই- প্রতিবেশীর ছেলের চেহারা বাপের মত, শুধু এইটুকুর উপর নির্ভর কোরেই তারা তাদের সত্যই বাপ ও ছেলে বোলে বিশ্বাস করেন। এ বিশ্বাসগুলো সব অবস্থাগত, আনুষাঙ্গিক । কিন্তু স্রষ্টার প্রমাণ তারা চান প্রত্যক্ষ, চাক্ষুষ।

আসল কথা – স্রষ্টা আছেন কিন্তু তিনি আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবেন না বা তার ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগ কোরে মানুষকে তার প্রতি বিশ্বাস এনে দেবেন না। কারণ তা কোরলে মানুষকে বিচার কোরে শাস্তি বা পুরস্কার দেবার আর কোন অর্থ থাকবে না। মানুষ তা হোলে গাছ-পাথর, পাহাড়-পর্বতের মত তার আরেকটি সৃষ্টি মাত্র হতো, তার নিজের হাতের তৈরী যুক্তি, বুদ্ধিসহ সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টি হতো না।

স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার কোরে নেওয়া হলো। প্রশ্ন হোচ্ছে আমরা কি তাকে ধারণা কোরতে পারি? তিনি নিজে বোলেছেন- না, তোমরা পারো না। কেন পারি না? পারি না- কারণ আমরা সৃষ্ট, আমাদের সমস্ত শক্তি সীমিত। ধারণার শক্তিও সীমিত; স্রষ্টা অসীম। স্রষ্টাকে কেন, এই মহাসৃষ্টির একটা সামান্য অংশকেও আমরা ধারণায় আনতে পারি না। স্থান (ধারণা কোরতে চেষ্টা কোরলে মোটামুটি আমরা কয়েক মাইলের দুরত¦ ধারণা কোরতে পারি। আমাদের পৃথিবীরই এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশের দূরত্ব চিন্তা কোরতে গেলে মাথা গুলিয়ে যেতে চায়। আর এই সৌর জগত, তারপর এধষধীু তারপর মহাশূণ্যের অগণ্য আলোক-বর্ষের দূরত্ব ধারণা করা মানুষের অসাধ্য। ঠিক তেমনি সময় সম্বন্ধে ধারণা কোরতে চেষ্টা করলে আমরা কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের সময় আমাদের ধারণার মধ্যে আনতে পারি। একটা সম্পূর্ণ মাসের সময়টাও আমার মনে হয় কেউ সম্যকভাবে ধারণার ভেতর আনতে পারবে না। বিগত এবং ভবিষ্যতের কোটি কোটি বৎসরের সময় ধারণার মধ্যে আনা অসম্ভব। যদি সৃষ্টির একটা অতি, অতি ক্ষুদ্র অংশই মানুষের ধারণা করার শক্তি না থাকে তবে সেই সৃষ্টির স্রষ্টাকে ধারণা করা যে যাবে না তা অতি পরিষ্কার।

তাহলে পৃথিবীতে মানব জাতির যে চিরন্তন সমস্যা- অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তারক্তি, না কোরে শান্তিতে বসবাস করার পথ খুঁজে বার কোরতে যেয়ে প্রথম যে প্রশ্নের সমাধান অর্থাৎ স্রষ্টা আছেন কিনা, এর জবাব আমরা এখন নিশ্চয়ই ধোরে নিতে পারি যে- স্রষ্টা আল্লাহ, আছেন। এখন থেকে এ কথাটা সর্বক্ষণ মনে রাখতে হবে যে স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং তার গুণাবলী, সিফতসমূহ হবে এরপর থেকে সমস্ত চিন্তাধারার ভিত্তি, সিদ্ধান্ত সূত্র। এই সিদ্ধান্ত-সূত্র থেকে যেখানেই পদস্খলন হবে সেখানেই সিদ্ধান্ত ভুল হবে। চিন্তা-ধারার মধ্যে যেখানেই এই ভিত্তিকে ভুলে যাব সেখানেই পথ হারিয়ে যাব এবং ভুল সিদ্ধান্তে যেয়ে পৌঁছব। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক, আজ-কালকার মহাশূন্য গবেষণা বা যাত্রা । যে সব অংক কোষে মানুষ ঠিকমত চাঁদে গেছে, সেখান থেকে ফিরেও এসেছে- সে সব হিসাবপত্রের মূল ভিত্তি, সিদ্ধান্ত-সূত্র হলো এলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব । কোন মহাশুন্য বিজ্ঞানীকে প্রশ্ন কোরে দেখুন যে এই আপেক্ষিক তত্ত্বকে বাদ দিয়ে হিসাব কোরলে কি ফল হবে? তার সোজা জবাব হবে- সমস্ত বিপর্যস্ত হোয়ে যাবে। এই যে প্রায় কয়েক হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই যে রকেটগুলো মঙ্গলগ্রহ, শুত্র“গ্রহ পর্য্যন্ত ঠিকমত পৌঁছে পৃথিবীতে নানারকম বৈজ্ঞানিক তথ্য পাঠাচ্ছে- এর কোন কিছুই সম্ভব হোত না যদি আইনস্টাইনের এই GB E=Mc2 কে ভিত্তি হিসাবে না নেয়া হোত। অর্থাৎ যে কোন হিসাবপত্র বা চিন্তাধারাতে আসল ভিত্তি সিদ্ধান্ত সূত্র কে যখনই ভুলে যাওয়া বা অগ্রাহ্য করা হবে, তখনই হিসাবে বা চিন্তাধারাতে ভুল হোতে বাধ্য। আপেক্ষিক তত্বের উপর নির্ভর না কোরে হিসাব কোরে চাঁদ অভিমুখে রকেটে চড়ে রওনা হোলে যেমন মানুষ চাঁদে না পৌঁছে মহাশূণ্যে হারিয়ে যাবে, তেমনি স্রষ্টার অস্তিত্বকে হিসাবে না রেখে মানুষ তার জীবন ব্যবস্থা নির্দ্ধারণ বা তৈরী কোরে নিলে সে অবশ্যম্ভাবীরূপে বিপর্যস্ত হবে- যেমন আজ হোচ্ছে।

(*** শেষ ***)

সিদ্ধান্ত-সূত্র – পর্ব -০২

আমরা কোটি কোটি নয় অসংখ্য আচম্বিত ঘটনার মধ্যে মাত্র দশটির প্রতীক নিয়েছিলাম। তাতেই এই সংখ্যার সম্ভাবনা পাচ্ছি। তাহলে কোটি কোটি নিলে দেখা যাবে, যে সৃষ্টি আচম্বিতে হোয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অসীম সংখ্যার, অর্থাৎ যে সংখ্যার শেষ নেই, তার মধ্যে একবার- অর্থাৎ অসম্ভব। এখন- দু’টো সম্ভাবনার মধ্যে একটি অসম্ভব বোলে বাদ পড়লে বাধ্য হোয়ে দ্বিতীয়টিকে গ্রহণ কোরতে হবে, এবং সেটা পরিকল্পিত এবং পরিকল্পিত মানেই স্রষ্টা। তৃতীয় আর কোন থিওরীর সম্ভাবনা কিছুই নেই। এই একই হিসাব ঠিক উল্টো দিক থেকেও করা যায়। যেমন যে কোটি কোটি আচম্বিত ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে আসার দরুণ আজ আমরা এই বর্ত্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছি- ঠিক তেমনি কোটি কোটি অন্য রকম আচম্বিত ঘটনা (অপপরফবহঃ) এই মহাকালের মধ্যে ঘোটতে পারতো। যার একটি মাত্র ঘটনাও সমস্ত লণ্ডভণ্ড কোরে দিতে পারতো। কিন্তু তেমন একটি মাত্র ঘটনাও ঘটেনি। যেমন ধরুন- উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর জমানো বরফ যদি গলে যেতো বা যায় তবে বিজ্ঞানীদের মতে, পাহাড়-পর্বত ছাড়া সমস্ত পৃথিবী পানিতে ডুবে যাবে। ঘোটতে পারতো, ঘটেনি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অংকের হিসাবে, স্রষ্টার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যে কোন চিন্তাশীল মানুষ এই বিশাল সৃষ্টির দিকে চেয়ে দেখলে এর মধ্যে এক বিরাট পরিকল্পনা দেখতে পাবেন যেটাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। জ্ঞানের অভাবে যারা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, অর্থাৎ নাস্তিক, তারা ধারণা করেন যে, মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে, ভয় দেখাতে, স্রষ্টাকে সৃষ্টি করা হোয়েছে। এই ধারণাটা বিশ্লেষণ করা যাক। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্রষ্টার ধারণা আজকের নয়। ইতিহাসের অনেক আগে, যখন থেকে মানুষ সম্বন্ধে জানা যায় তখন থেকেই মানুষ একজন স্রষ্টার ব্যাপারে সচেতন ছিলো। প্রতœতাত্বিকেরা মাটি খুড়ে হাজার হাজার বছর আগের যে সব জনবসতির খোঁজ পেয়েছেন, দেখেছেন সবখানেই ধর্মের অর্থাৎ স্রষ্টার কোন না কোন রকমের ধারণা ছিলো। বিভিন্ন মহাদেশে, পৃথিবীর যেখানেই কোন প্রাক-ঐতিহাসিক জনপদের সন্ধান পেয়েছেন সেখানেই তারা পেয়েছেন উপাসনার, ধর্মের চিহ্ন। অর্থাৎ স্রষ্টা সম্বন্ধে একটা ধারণা, একটা চেতনা পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিলো এটা সন্দেহাতীত। পৃথিবীর প্রধান ভূ-ভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়াতেও যেসব প্রাক-ঐতিহাসিক মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে সে সবগুলিতেও তাই। যখন এইসব বিভিন্ন জনসমষ্টির মধ্যে কোন সংযোগ, আদান-প্রদান ছিলো না, ভাষা, সংস্কৃতি সব কিছুই ছিলো ভিন্ন, একে অন্যের অস্তিত্ব পর্য্যন্ত জানতো না, তখন ঐ একটি ব্যাপারে সবাই সচেতন ছিলো এটা কেমন কোরে হলো? পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা এই জনসমষ্টিগুলি শুধু যে স্রষ্টার ব্যাপারে সচেতন ছিলো তাই নয়- তারা ঐ স্রষ্টার গুণাবলী- আমরা যেটাকে বলি সিফত- একই বোলে কেমন কোরে স্থির কোরল? অর্থাৎ স্রষ্টা মহা-শক্তিশালী, সর্বব্যাপী, দয়ালু, যা ইচ্ছা কোরতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষ যদি স্রষ্টার ধারণাকে সৃষ্টি কোরে থাকে তবে স্বীকার কোরে নিতে হবে যে বহু আগে- কত আগে কেউ বোলতে পারবে না, তবে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগে, সমস্ত পৃথিবীময় বিছিন্ন, বিভিন্ন স্থানে মানুষ একটা জুজুর ভয় সৃষ্টি করলো, যে জুজুটার গুণাবলী অকস্মাৎ কেমন কোরে একই হোয়ে গেলো- অর্থাৎ ঐ জুজুটা সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞানী, অসীম ক্ষমাশীল, দয়াময়, ইত্যাদি। এবার দেখা যাক এটা কতখানি সম্ভব।
পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে এ কথা প্রতিষ্ঠিত সত্য- এবং এটা আছে পৃথিবীর সৃষ্টির একদম প্রথম থেকে এ কথাও প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ পৃথিবী স্রষ্টাই তৈরী কোরে থাকেন আর আচম্বিতে নিজেই সৃষ্টি হোয়ে থাক, এই মধ্যাকর্ষণ পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম মুহূর্ত্ত থেকে আজ পর্য্যন্ত এই পৃথিবীর সমস্ত জিনিষের, পাহাড়-পর্বত, নদী, সমুদ্রের এক কথায় প্রত্যেক জিনিষের প্রতিটি অণুপরমানুকে নিচের দিকে টেনে রাখছে। আপনার আমার দেহের প্রতিটি অণু-পরামাণুকেও টেনে পৃথিবীতে ধোরে রেখেছে। সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ পর্য্যন্ত এক সেকেণ্ডের এক ভগ্নাংশের জন্যও কখনো বিরতি দেয়নি। যে মস্তিষ্ক দিয়ে মানুষ চিন্তা করে, অনুভব করে, সেই মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ কেও সেই অনাদিকাল থেকে এই মধ্যাকর্ষণ অবিরতভাবে টেনে রেখেছে। কিন্তু মানুষ এই সর্বব্যাপী শক্তির কথা জানতো না। কোনদিন একে আবিষ্কার কোরতে পারে নি, একে ধারণাও কোরতে পারে নি। মাত্র সেদিন নিউটন একে আবিষ্কার কোরলেন। কেন? এতদিন কি মানুষ তার মগজ মস্তিষ্ক ব্যবহার করে নি? নিশ্চয় কোরেছে। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের আগে মানুষ বহু কিছু আবিষ্কার কোরেছে, পিরামিডের মত কালজয়ী সৌধ তৈরী কোরেছে, কিন্তু যে শক্তির অধীনে থেকে তার জীবনের প্রতি মুহূর্ত্তে কাটছে, যে শক্তি এক মুহূর্ত্ত বিরতি দিলে সে পৃথিবীর বহির্মূখ, অপকেন্দ্রীক শক্তির ফলে ছিটকে মহাশূণ্যে নিক্ষিপ্ত হবে সে শক্তি সম্বন্ধে সে ছিলো সম্পূর্ণ অজ্ঞ- মাত্র কয়েক বছর আগে পর্য্যন্ত।

চলবে……….

সৃষ্টিগতভাবে নারী শান্তির প্রতীক

মানবসমাজের দেহ যদি পুরুষ হয় তবে নারী সে দেহের আত্মা বা প্রাণ। যে ঘরে, সমাবেশে, যে কর্মকাণ্ডে নারী নেই, যে মসজিদে, সে সালাতে নারী নেই, যে হজ্বে নারী নাই সেটা প্রাণহীন ও অপূর্ণ। তাদের আগমনেই মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন শান্তিময় হয়ে উঠবে।

আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টি মানুষ। সেই মানুষের মধ্যে দু’টি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সৃষ্টি হচ্ছে পুরুষ এবং নারী। তাদের উভয়কেই আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসাবে সৃষ্টি করলেও নারী ও পুরুষ হিসাবে তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পৃথক। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টির পর জান্নাতের অঢেল সুখ ও শান্তিময় পরিবেশে বসবাস করতে দিলেন। সেখানে তাঁর ছিল যেখানে খুশি যাওয়ার, যা খুশি খাওয়ার, যা খুশি করার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কিন্তু এত কিছু পেয়েও আদম (আঃ) এর হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এক অদ্ভূত শূন্যতার অনুভূতি। সব আছে তবু কি যেন নেই। জান্নাতের এত সুখ-সম্ভোগ ও রঙ-রূপ-রসও তাঁকে আনন্দ দিতে পারছে না, সব কিছু অর্থহীন, বিবর্ণ, নিরস মনে হয়। তখন আল্লাহ তাঁরই পাঁজড়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন তাঁর সঙ্গিনী এবং সাহায্যকারী হাওয়াকে (বাইবেল- জেনেসিস ২:২২)।
হাওয়াকে পেয়ে শান্তির সুধারসে আদমের হৃদয় পূর্ণ হয়ে গেল, তিনি বুঝতে পারলেন কিসের অভাবে তিনি এতকাল সব পেয়েও বিমর্ষ ছিলেন। এভাবে জান্নাতেই নির্ধারিত হয়ে গেল পুরুষ ও নারীর সৃষ্টিগত উদ্দেশ্য। আল্লাহর একটি হুকুম অমান্য করায় আল্লাহ তাঁদের উভয়কে শাস্তি-স্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। শাস্তি হলো, পুরুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে পরিবারের ভরণপোষণ করবে আর নারী গর্ভযাতনা সহ্য করবে, সন্তান লালন পালন করবে (বাইবেল- জেনেসিস ৩:১৬-১৭)। এভাবে তারা বেঁচে থাকবে কিন্তু তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য কিন্তু এটা নয়। আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসাবে তাদের উভয়েরই জীবনের লক্ষ্য আল্লাহ ঠিক করে দিলেন তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কেবল পারিবারিক জীবনেই নয়, জীবনের সর্ব অঙ্গনের জন্য আল্লাহ নারীকে পুরুষের সঙ্গী এবং সাহায্যকারী হিসাবে নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি নারীকে সৃষ্টিই করেছেন রহমত, বরকত ও নেয়ামতে পূর্ণ করে। সে নিজেই এমন এক শান্তিময় সৃষ্টি যাকে ছাড়া জান্নাতও মানুষকে শান্তি দিতে পারে নি, পারবেও না। পৃথিবীর জীবনেও তাই নারী ছাড়া শান্তি কল্পনা করা যায় না। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে থেকে সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ কর এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া।” (আর-রূম ৩০:২১) আর আল্লাহর রসুল বলেছেন, সমগ্র পৃথিবী আল্লাহর নেয়ামত আর সম্পদরাশিতে পূর্ণ এবং সেই সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে মঙ্গলময় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ও নেয়ামত হচ্ছে সেই স্ত্রী যে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সদা সতর্ক (সহীহ মোসলেম, ২য় খণ্ড ৩৪৫৬)। এই হচ্ছে নারীকে আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টিগত মর্যাদা।

নারী কেবল তার স্বামীর জন্য শান্তির প্রতিমূর্তি নয়, জান্নাতকে যেভাবে সে শান্তিময় করে তুলেছে ঠিক সেভাবে মানবসমাজের প্রতিটি অঙ্গনে যেখানেই সে যাবে সেখানেই সে শান্তির সুবাস ছড়িয়ে দেবে। সে মা হিসাবে সন্তানের জন্য মমতার আশ্রয়, বোন হিসাবে ভাইয়ের জন্য আদরিনী আর স্নেহের আধার, স্ত্রী হিসাবে সে স্বামীর জন্য প্রেমময়, ঘরের কর্ত্রী, বার্ধক্যের অবলম্বন। কন্যা হিসাবে সে পিতা-মাতার জন্য নিরন্তর আনন্দের ফল্গুধারা। মানবসমাজের দেহ যদি পুরুষ হয় তবে নারী সে দেহের আত্মা বা প্রাণ। যে ঘরে, সমাবেশে, যে কর্মকাণ্ডে নারী নেই, যে মসজিদে, সে সালাতে নারী নেই, যে হজ্বে নারী নাই সেটা প্রাণহীন ও অপূর্ণ। তাদের আগমনেই মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন শান্তিময় হয়ে উঠবে। সেই নারীদেরকে আজ কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার ভিতরে মনুষ্যত্ব আছে তার পক্ষে সম্ভব নয় একটি প্রস্ফুটিত গোলাপকে জুতার তলায় মাড়িয়ে যাওয়া, অথচ আজ অতুলনীয় সৌন্দর্য ও শান্তির উৎস যে নারী, সেই নারীকে আজ দাসী হিসাবে গণ্য করা হয়। তাদের উপর নির্মম পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়, তাদের দেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, এসিড নিক্ষেপ করা হয়। এমন কি মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে তাদের উপর নির্যাতনও চালানো হয়। এই যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এর সূত্রপাত কোথায়?

আদমের (আ:) পর থেকে পৃথিবীতে যখন মানুষের বিস্তার হলো আল্লাহ তাদের শান্তিতে জীবনযাপনের জন্য নবী রসুলদের মাধ্যমে তাঁর বিধান পাঠাতে থাকলেন। সেই বিধানগুলি মানুষ যখন মেনে চোলত তাদের সমাজে অনাবিল শান্তি বিরাজ কোরত। কিন্তু নবীদের প্রস্থানের পর একটি শ্রেণির জন্ম হয়েছে প্রতিটি জাতির মধ্যে যারা ঐ বিধানের অর্থাৎ ধর্মের ধারক বাহক সেজে বসেছে। তারা নিজেদের পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর বিধানকে বিকৃত করে ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে। ফলে ধর্মই হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্ঠুর নির্যাতনের কল। সেই বিকৃত বিধানের ফলে সমাজের শান্তিময় পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। যেহেতু নারীরা চিরকালই পুরুষদের অধীন ছিল তাই স্বভাবতই তারা নিষ্ঠুরতার প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছে। যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম বিপন্ন হয় সেই পরিবেশের কোমলতর সৃষ্টিগুলি। শীতের আবির্ভাবে যেমন প্রকৃতি তার রঙ রূপ রস হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়, তেমনি সমাজে অমানবিকতা সৃষ্টি হলে কোমলতর সৃষ্টি হিসাবে নারী সর্বপ্রথম তার বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য্য হারায়। পুরুষ সমাজ যদি নারীকে রুজি রোজগারের জন্য কঠোর পরিশ্রমের কাজের দিকে, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার দিকে ঠেলে দেয় যা তার দেহ কাঠামো ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার চরিত্রে কোমলতার বদলে আসে পুরুষালী রুক্ষতা, তার কীন্নর কণ্ঠ হয়ে যায় কর্কশ।

শান্তির প্রতীক নারীই আল্লাহর সার্বভৌমত্বহীন বস্তুবাদী ভারসাম্যহীন জীবন ব্যবস্থার প্রভাবে সাক্ষাৎ ডাইনীতে রূপান্তরিত হয়। ফুলের বাগান মরুভূমি হয়ে যায়। যার উদাহরণ আমাদের আজকের পৃথিবী। ‘আধুনিক’ পশ্চিমা সমাজের নারী পুরুষরা এখন মানুষের জীবন বাদ দিয়ে জীবজন্তুর মত ইন্দ্রিয়সম্ভোগের জীবন বেছে নিয়েছে। আমাদের এখানেও এখন সেটাকেই আধুনিকতা ও বন্ধনমুক্তির পথ বলে প্রচার করা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদী খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র বস্তুবাদী জীবনের আকর্ষণ, সম-অধিকার, স্বাধীনতা জাতীয় প্রহেলিকামূলক মতবাদ, আর্থিক উৎকর্ষের পেছনে ছুটে ছুটে আমাদের নারী সমাজের বড় একটি অংশও তাদের সৃষ্টিগত আত্মিক ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছেন, তাদের সৌন্দর্য্য, করুণা, দয়া-মায়া, শিষ্টাচার, নম্রতা, লাজ-লজ্জা সবই প্রায় খুইয়েছেন। নিজেদের পরিবারে তারা একেকজন অশান্তির আকর। এটা সাধারণ জ্ঞান যে, যে নারী তার পরিবারের জন্য অশান্তির কারণ, সেই নারী তার সমাজের জন্য কখনোই শান্তির কারণ হোতে পারে না। নারীর এই যে বিবর্ণতা এর পেছনে প্রাথমিকভাবে দায়ী কিন্তু পুরুষ সমাজই। যদি আপনি একটি মনোরম ফুলের বাগান তৈরি করেন, সেই বাগানের পরিচর্যা করার দায়িত্বও কিন্তু আপনার। আপনি যদি সেই বাগানে পানি না দেন গাছগুলি শুকিয়ে যাবে, ফুলগুলো বিবর্ণ হয়ে যাবে। এজন্য কি ফুলকে দায়ী করা যাবে? যে নারীকে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন রহমত, বরকত ও শান্তির আধার হিসাবে সেই নারীকে তার উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত করে তাকে সার্বিক সৌন্দর্য্যময় ও সুষমামণ্ডিত করে রাখার দায়িত্ব ছিল পুরুষের। কিন্তু পুরুষ তার এই দায়িত্ব পালনে প্রথম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে নারীও তার মর্যাদা, সৌন্দর্য্য, সম্মান হারিয়ে প্রায় ক্যাকটাসে পরিণত হয়েছে। ক্যাকটাসের ভিতরেও তবু কিছু পানি থাকে, কিন্তু দাজ্জালের তৈরি নারী প্রকৃতিতে যেন কেবলই শীতের শুষ্কতা আর গ্রীষ্মের খরতাপ।

সিদ্ধান্ত-সূত্র – পর্ব -০১

(মূল লেখা এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী থেকে সংক্লিত)

এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা আছেন কি নেই- এ প্রশ্নের বিচার করার আগে প্রথমেই বোলে নেই যে, প্রমাণ বোলতে চাক্ষুষ প্রমাণ বোঝালে তা নেই এবং তা থাকতেও পারে না। তিনি যদি থেকে থাকেন তবে কোনদিন তিনি এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন নি যে- এই যে আমি তোমাদের স্রষ্টা এবং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোনদিন তিনি দাঁড়াবেন না। কারণ, তাহলে মানুষ নামের এই বিশেষ সৃষ্টিটি অর্থহীন হোয়ে যেতো, আমরা গাছ-পাথর, হাতী-ঘোড়ার মত শুধু আরেকটি সৃষ্টি হোয়ে যেতাম। দ্বিতীয়তঃ আমাদের বিশ্বাস জন্মানই যদি কথা হোয়ে থাকে তবেও তাকে নিজে দেখা দিয়ে চাক্ষুষ প্রমাণ দেয়ার দরকার নেই। কারণ তিনি সর্বশক্তিমান স্রষ্টা হোয়ে থাকলে তিনি ইচ্ছা কোরলেই তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এই মুহূর্ত্তে তাকে না দেখেই বিশ্বাস কোরবে। তাকে সামনে এসে দাঁড়াবার প্রয়োজনই হবে না। এতে প্রমাণ হোচ্ছে যে স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন তবে তিনি নিজে দেখা দিয়ে বা ইচ্ছে কোরে আমাদের মনে তার অস্তিত্বের বিশ্বাস এনে দিতে চান না। তিনি দেখতে চান তিনি যে একটি মাত্র সৃষ্টিকে বুদ্ধি, যুক্তির শক্তি, উপলব্ধির শক্তি (Intellect, Reason, Rationality) দিয়ে সৃষ্টি কোরলেন সেটা অর্থাৎ মানুষ তার ঐ শক্তিগুলি দিয়ে চাক্ষুষ নয়, তাকে উপলব্ধি করে কি করে না। এ জন্য তিনি লক্ষ রকমের চিহ্ন, যুক্তি দিয়েছেন। মানুষকে এ কথা, এ যুক্তি বোঝার শক্তি (Inference) দিয়েছেন যে, ধোঁয়া থাকলেই আগুন থাকবে। এখন আমাদের দেখতে হবে ধোঁয়া অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্বের এই ধরনের প্রমাণ আছে কিনা।

আরেকটি কথা- স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা কোরতে গেলে বইয়ের পর বই লেখার প্রয়োজন হোয়ে পড়বে- আমার উদ্দেশ্যও তা নয়। আমি শুধু মৌলিক দু’একটি কারণ ও যুক্তি এখানে উল্লেখ করবো যা উন্মুক্ত মনের মানুষের কাছে যথেষ্ট। এতে যাদের প্রত্যয়ের উন্মেষ হবে না, হাজার বই লিখেও, লক্ষ যুক্তি দিয়েও তাদের বোঝানো যাবে না।

প্রথমতঃ যুক্তির গোড়ার কথায় যদি যাই- অর্থাৎ ধোঁয়া থাকলে আগুন থাকতেই হবে তবে যেহেতু সৃষ্টি আছে কাজেই স্রষ্টা অনিবার্য্য। তবুও এ প্রশ্নে আরও এগুনো যাক এবং স্বভাবতঃই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এগুতে হবে। মহা বিশ্বের (Universe) সৃষ্টি কেমন কোরে হোয়েছে সে সম্বন্ধে মানুষ আজও অজ্ঞ, যদিও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ (Big Bang), স্থিতাবস্থা (Oscillating), স্পন্দনশীল (Oscillating) ইত্যাদি বিজ্ঞানীদের কয়েকটি ধারণা (Theory) আছে। কিন্ত আজও কোনটাই প্রমাণিত হয় নি এবং বিজ্ঞানীরা নিজেরাই একমত নন। কিন্তু মতবিরোধ যাই থাকুক একটা কথা অনস্বীকার্য্য এবং তারাই স্বীকার কোরেছেন যে, গোড়ার কথায় গেলে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির মাত্র দু’টি সম্ভাবনা আছে। যেহেতু সৃষ্টি হোয়েছে এবং আছে সুতরাং ঐ দু’টি সম্ভাবনার মধ্যে একটি অবশ্য (Must) হোতেই হবে- তৃতীয় কোন সম্ভাবনাই নেই। এই দু’টির একটি – এই বিশাল সৃষ্টি নিজে থেকেই আচম্বিতে হোয়ে গেছে (Accidental) দ্বিতীয়টি পরিকল্পিত (Planned) ।

প্রথমে দেখা যাক আচম্বিতের ধারণা। এই থিওরী মতে মহাশুন্য [মহাশুন্য (Space) কি তা কিন্তু তারা বিশ্লেষণ কোরতে পারেন না] শুধু গ্যাস (Gas) আর ধুলিকণা (Dust) দিয়ে পূর্ণ ছিলো। এই গ্যাস আর ধূলিকণা কোথা থেকে এলো এ কথার তারা কোন উত্তর দিতে পারেন না- শুধু বলেন এগুলো আগে থেকেই ছিলো। তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম ওগুলো আগে থেকেই ছিলো- যদিও স্রষ্টা ছাড়া ওগুলোর সৃষ্টি কেমন কোরে, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। যাই হোক, এখান থেকেই অর্থাৎ এই উপাদান থেকেই মহা-বিশ্বের সৃষ্টি আরম্ভ এবং ক্রমে ক্রমে কোটি কোটি, অর্বুদ অর্বুদ বছর ধরে নানা রকম আচম্বিত ঘটনার (Accidents) মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্য্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কেমন কোরে কি কি ঘটনার মধ্য দিয়ে এখানে পৌঁছলাম তা নিয়ে বহু মতবিরোধ রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। এই আচম্বিতের থিউরী মতে অর্বুদ অর্বুদ বছর আগে থেকে আজ পর্য্যন্ত সৃষ্টিতে যা কিছু হোয়ে আসছে তাতে কোন পরিকল্পনা (Plan) নেই- কারণ স্রষ্টাই তো নেই, সব হোয়েছে এবং হোচ্ছে আচম্বিতে (Accidentally) । পরিকল্পনার কথা আসলে তো অবশ্যই স্রষ্টা এসে যান। এখন থেকে এগুবার আগে আরেকটা কথা জেনে নিতে হবে।

সেটা হোচ্ছে- এই যে আচম্বিতে ঘটনাগুলো ঘোটেছে এবং ঘোটছে এগুলো যেখানে খুশী, যখন খুশী ভাবে ঘটে নি। এগুলোকে ঘোটতে হোয়েছে ধারাবাহিক ভাবে । একটা আচম্বিত ঘটনা যখন ঘটেছে বোলে মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু ইত্যাদি বেঁচে আছে, ঐ ঘটনাটা তখন না ঘটে যদি তার আগে বা পরে ঘোটতো তবে কোন প্রাণী পৃথিবীতে থাকতো না, হয়ত জন্মই হতো না, এই সৃষ্টিও আজ যা দেখছি তা হোতনা, হয়ত মোটেও হতো না। কাজেই আচম্বিত ঘটনা ঘটেছে এবং ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে। এইরূপ ঘটনাগুলির সংখ্যা কোটি কোটি- অগুণতি। এইবার দেখা যাক এটা কতটুকু সম্ভব। ঠিক একই আকারের টাকা বা আধুলির মত গোল দশটি ধাতব বা প্লাষ্টিকের চাকতি নিন এবং এগুলোর উপর এক থেকে দশ সংখ্যা লিখুন। মনে রাখবেন এই চাকতিগুলি সেই কোটি কোটি আচম্বিত ঘটনাগুলোর মাত্র দশটি প্রতীক এবং সংখ্যাগুলো ওগুলোর ধারাবাহিকতা, যার কথা বোলে এলাম। এই চাকতি দশটি আপনার পকেটে রেখে নেড়েচেড়ে মিলিয়ে দিন। এইবার আপনি চোখ বুজে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি চাকতি বের কোরুন। এই চাকতিটি এক থেকে দশ নম্বরের যে কোনটি হোতে পারে এবং প্রথম বারেই এক সংখ্যার চাকতিটি আপনার হাতে উঠে আসার সম্ভাবনা দশের মধ্যে এক (১:১০)। ধরুন প্রথমবারেই আপনার হাতে এক নম্বর চাকতিটি উঠলো। এবার ওটা পকেটে ফেরৎ রেখে নেড়েচেড়ে মিশিয়ে দিয়ে আরেকটি চাকতি বের কোরে নিন। দ্বিতীয় বারে আপনার হাতে দুই নম্বর দেয়া চাকতিটি উঠে আসার সম্ভাবনা একশ’র মধ্যে এক। অর্থাৎ আপনি যদি একশ’বার পকেট থেকে একটা একটা কোরে চাকতি বের করেন তবে এক নম্বর ওঠাবার ঠিক পরের বারে দুই নম্বরের চাকতি উঠে আসার সম্ভানা থাকবে একশ’বারের মধ্যে এক বারের, অর্থাৎ (১:১০১০=১০০)। ঠিক তেমনিভাবে তৃতীয় বারের তিন নম্বর চাকতি উঠার সম্ভাবনা এক হাজার বারের মধ্যে একবার (১:১০০১০=১০০০), অর্থাৎ আপনি দশবার পকেট থেকে চাকতি উঠালেন। এক থেকে ধারাবাহিকভাবে দশ পর্য্যন্ত উঠার সম্ভাবনা এক হাজার কোটি বারের মধ্যে একবার (১:১০০০০০০০০০০)।

চলবে —-

প্রশ্ন……..??

ষষ্ঠ শ্রেনীর একজন শিক্ষার্থীকে শিখানো হচ্ছেঃ
ইসলাম শিক্ষাঃ সমস্ত শক্তির মালিক আল্লাহ।
সামাজিক বিজ্ঞানঃ জনগন ই সকল ক্ষমতার উৎস।
সাধারন বিজ্ঞানঃ সমস্ত শক্তির উৎস সুর্য্য।
গনিতঃ ৩% হারে ৫০০০ টাকা কত বছরে সুদে আসলে ৬৫০০ টাকা হবে।
ইসলাম শিক্ষাঃ সুদ সম্পর্কিত ১০ ব্যক্তি জাহান্নামী।

কেন এই দ্বিমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা ? এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে, কেন, কোথা থেকে আসল ?

প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং আত্মিক অধঃপতন

ব্রিটেনের বিচার মন্ত্রণালয় ও জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ কিছুদিন আগে এক ভয়ঙ্কর তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, প্রতিবছর ইংল্যান্ডে ৮৫ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এছাড়া আরও ৪ লাখ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, ২০১৩/১৪ সালে ৪৫ ভাগ যৌন অপরাধ ঘটেছে শিশুদের বিরুদ্ধে, যাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ব্রিটেনের ৯০ ভাগ নারীই পরিচিত লোকদের লালসার শিকার। শুধু খোদ ব্রিটেন নয় পশ্চিমা সভ্যতার ধারক-বাহক প্রায় দেশেই একই অবস্থা। আমেরিকার জাতীয় আইন বিভাগের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সেখানে প্রতি বছর ২ লক্ষ ৩৭ হাজার ৮৬৮ জন নারী ধর্ষিত হয়। উপরোক্ত পরিসংখ্যান যে কোন সুস্থ ও চিন্তাশীল মানুষকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। আর মানবজাতির জন্য এ এক বিরাট লজ্জা।

এই অবস্থার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে স্মার্ট ফোন ও ল্যাপটপে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা। ৬৫ ভাগ কিশোর পর্নোগ্রাফিতে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। যান্ত্রিক প্রযুক্তি একদিকে যেমন জীবনকে সহজলভ্য করছে অন্যদিকে এর অপব্যবহার মানুষকে পশুবৎ আচরণ করতে বাধ্য করছে। কোন জিনিস ভালো কি মন্দ তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে সেই জিনিসের ব্যবহারের ওপর। একটা অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি বা খুন করা যায়, সেই অস্ত্রই খুনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে অসহায়কে রক্ষা করা যায়। অস্ত্র নিজে দায়ী নয়, যে সেটাকে ব্যবহার করবে সে দায়ী। পাশ্চাত্য সভ্যতা বর্তমানে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে অন্যায়ভাবে। রেডিও-টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি মানুষকে ভালো অনেক কিছুই শিক্ষা দিতে পারত কিন্তু এগুলি বর্তমানে মানুষকে হত্যা, সহিংসতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অপরাধ, নগ্ন যৌনতা ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে তাকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে দিচ্ছে।

এই যৌনতা, নগ্নতা, বেহায়পনা, শিশু নির্যাতন-এক কথায় সমস্ত রকম অশ্লীল কার্যকলাপ বন্ধের জন্য অনেক সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, র‌্যালি, সমাবেশ, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টকশো প্রভৃতি করা হচ্ছে, বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, প্রচলিত আইন কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে দিন দিন তা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। আলোচকগণের সামনে ভয়ঙ্কর রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও তারা প্রচলিত মূল্যবোধের বাইরে কোন কথা বলেন না। প্রচলিত মূল্যবোধে কখনও বর্তমানের এ সমস্ত অশ্লীল কার্যকলাপ বন্ধ হবে না। তার প্রমাণ পরিসংখ্যান। অথচ আমরা যদি একটু পিছন দিকে তাকাই, যে সময় স্রষ্টার দেওয়া মূল্যবোধ পৃথিবীতে কার্যকর ছিল তখন যুবতী নারী গায়ে স্বর্ণের অলঙ্কার আচ্ছাদিত করে শত শত মাইল নির্ভয়ে অতিক্রম করত। বর্তমানে যা কল্পনাও করা যায় না। কল্পনা করা যাক বা না যাক, স্বীকার করা হোক বা নো হোক- এর পরিণতি থেকে আমরা রেহাই পাচ্ছি না। বাইরে আমরা খুবই চাকচিক্য চেহারা আর সুখী সুখী ভাব দেখালেও অন্তরের দিক থেকে চূড়ান্ত দৈন্যতায় ভুগছি।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর আত্মহত্যার তালিকার দিকে তাকালেই আমরা এই বাস্তবতা টের পাই। মানুষ সাধারণত পরিসংখ্যান দেখে চোখ ছানাবড়া করে ফেলে, কিন্তু পরিবেশের সাথে মিশে থাকায় উপলব্ধি করে কম। যার কারণে মানুষের ঐ শক্তিটুকু ক্রমশ ভোঁতা হয়ে যায়। কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে এই সভ্যতার ভেতরটা এতই ফাঁপা হয়ে গেছে যে সামান্য বাতাসেই এটি যে কোন সময় ধূলিস্মাৎ হয়ে যেতে পারে।

বর্তমানে নৈতিকতাহীনতার এই নারকীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে, সভ্যতাকে পুনর্গঠন করতে হলে প্রচলিত মূল্যবোধ ত্যাগ করে মানুষের সামনে স্রষ্টার দেওয়া মূল্যবোধ গ্রহণের বিকল্প কিছু নেই।

গভীরে যে ভাঙন চলছে তা রোধ করার উপায় কি?

একজন দাগী অপরাধী কিংবা একজন কুষ্ঠরোগী, যাকে সমাজের সবাই ঘৃণা করে বা দূরে থাকতে চায়, তারও একটি আশ্রয় থাকে। সেই আশ্রয়ের নামই পরিবার। অথচ মানবসভ্যতার আজকের এই পর্যায়ে এসে আমরা প্রত্যক্ষ করছি এমন বিস্ময়কর সব ঘটনা যা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।

প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই সংবাদ পাই, সদ্যজাত সন্তানকে মা পলিথিনে মুড়িয়ে ডাস্টবিন বা নর্দমায় ফেলে রেখে যাচ্ছেন কিংবা ছাদ থেকে ছুড়ে মারছে। শিশুটির মৃত্যু হওয়ার আগেই কুকুর-বেড়াল তার হাত-পা খুবলে খেতে শুরু করছে। বাবা সন্তানকে হত্যা করছে, কুপিয়ে, বিষ খাইয়ে, শ্বাসরোধ করে ইত্যাদি নানা উপায়ে। কখনো আবার সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করছে। ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর খুনোখুনিতো একেবারে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ কোন সমাজরে ভাই?

যারা গভীরভাবে ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন তারা আতঙ্কিত না হয়ে পারবেন না। এটা সুস্থ মানবসমাজের চিত্র হতে পারে না। এমনকি পশুদের সমাজেও এটা অতি বিরল ঘটনা যে মা-বাবা শিশু শাবককে হত্যা করছে।

জরবাদী, ভোগনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দুইয়ে মিলে মানুষকে এতটাই লোভী, স্বার্থ পর, আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে যে, ব্যক্তিগত সুখ-সম্ভোগের জন্য রাষ্ট্র কিংবা সমাজের স্বার্থ তো দূরের কথা মানুষ তার পরিবারের স্বার্থও ভুলতে শুরু করেছে। অন্যদিকে অন্যায় ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, জীবনের নির্মম বাস্তবতা তাকে হতাশ, অস্থির, অসামাল করে তুলছে। ফলে সে জিঘাংসা আর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজ সন্তানের মাথায় বাড়ি দিতে যেমন দ্বিধা করছে না, নিজের গলায় দড়ি নিতেও দ্বিতীয়বার ভেবে দেখছে না। একেবারে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।

পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমরা বিশ্বাস করছি যে, বস্তুগত এই উন্নতিই আমাদের সকল সুখের আধার। আমাদের সরকার রাস্তাঘাট খুরতে খুরতে একাকার করে ফেলছে। আমাদের বাচ্চাগুলো পড়তে পড়তে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আমাদের মায়েরা বাচ্চার স্কুলের গেটের বাইরে বেঞ্চে বসে থেকে মাজা ব্যথা করে ফেলছে। কিন্তু এই ‘উন্নতি’র দৌড় যে মাকাল ফলের মতো প্রতারণায় পূর্ণ তা কে বুঝবে? আমাদের হাজার বছরের বিশ্বাসভিত্তিক জীবনাচরণ, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের ধর্মভিত্তিক নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে কেবল বস্তুগত উন্নতি আমাদের সুখ দিতে পারবে না। তা তাদের মতো কেবল উপভোগ করতেই শেখাবে, সুখী হতে নয়।

হাস্যকর লাগে যখন দেখি আজও আমাদের বুদ্ধিজীবী, সমাজচিন্তকরা সেই প্রভু পশ্চিমা পণ্ডিতদের অমুক অমুক বইয়ের উদ্ ধৃতি দিয়েই এই সংকটের সমাধান দিচ্ছেন। আর দুঃখ লাগে যখন আমাদের সরকারের মন্ত্রীরা বলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ। নতুন আইনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। তারা সমাজের অবক্ষয় রোধ করবেন আইন দিয়ে! সুস্থ মানুষ এমনটা ভাবে কিভাবে? কথিত বুদ্ধিজীবী আর শাসকদের এই অন্ধত্ব আর মানসিক দাসত্ব যতদিন না ঘুচবে কোনভাবেই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়।

ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে!

(গত ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০১৭ইং তারিখে “ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে” এই শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম অনেকেই মন্তব্য করেছে যে লেখাটি অতি সংক্ষিপ্ত বা সারসংক্ষেপ হয়েছে ও লেখাটি আরও বিস্তারিত হওয়া দরকার। মন্তব্যর পরিপেক্ষিতে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করলাম।)

বর্তমান সময়ে চলমান মহাসংকটের পরিধিকে একত্রে চিন্তা করতে গেলে কোনো বিবেকবান চিন্তাশীল মানুষ স্থির থাকতে পারে না। মানবজাতি তার ভিতরে, আত্মিকভাবে দেউলিয়া, বাইরে সর্বপ্রকার বিপর্যয়ের শিকার। কারো কোনো নিরাপত্তা নেই, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছে, শোষণমূলক পুঁজিবাদ মাত্র আটজন ব্যক্তির হাতে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সম্পদ তুলে দিয়েছে, দুর্বৃত্তরা সম্মানের আসন পাচ্ছে, শিক্ষক ছাত্রের হাতে মার খাচ্ছে, সৎ ব্যক্তি জীবনমানের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ে সর্বত্র পিছিয়ে পড়ছে। সমস্ত দুনিয়াটা যেন এক নরককুপে পরিণত হয়েছে।

পৃথিবীর চারদিক থেকে আর্ত মানুষের হাহাকার উঠছে- শান্তি চাই, শান্তি চাই। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের ওপর ধনীর বঞ্চনায়, শোষণে, শাসিতের ওপর শাসকের অবিচারে, ন্যায়ের ওপর অন্যায়ের বিজয়ে, সরলের ওপর ধুর্তের বঞ্চনায়, পৃথিবী আজ মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নিরপরাধ ও শিশুর রক্তে আজ পৃথিবীর মাটি ভেজা। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি সর্বরকম অপরাধ প্রতি বছর বেড়ে চলেছে ববং বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর শেষ কোথায়? এর পরিণতি চিন্তা করে সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ আজ দিশাহারা। এর ওপর আবার ভয়াবহ বিপদ দাঁড়িয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের যা যে কোনো মুহূর্তে সমস্ত মানবজাতিসহ পৃথিবী গ্রহটাকেই ভেঙে ফেলতে সক্ষম।

আমাদেরকে যেমন মানবজাতি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে তেমনি বাঙালি জাতিকে নিয়েও চিন্তা করতে হবে, মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়েও চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশের বাসিন্দাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে এ দেশের ৯০% জনগণ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান আর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো চলমান সভ্যতার সংঘাতে একটার পর একটা মুসলিমপ্রধান দেশ ধ্বংস করছে, দখল করে নিচ্ছে, তাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করছে, কোটি কোটি জনগণকে উদ্বাস্তু করছে। বাংলাদেশকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলমান আছে বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বারংবার উল্লেখ করেছেন।

বর্তমানে বিশ্বে ধর্ম প্রধান ইস্যু, ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ধর্মবিশ্বাস ও ইসলাম-বিদ্বেষকে রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ড হিসাবে ব্যবহার করছে। এই ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে ধর্ম নিয়ে এখন সবাইকে কথা বলতে হবে, নইলে দেশ রক্ষা করাই মুশকিল হয়ে যাবে।

ইউরোপের রেনেসাঁ ও বর্তমান সংকট:

আমরা যদি অতীতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি দেখতে পাব যে, ঠিক এমনই সঙ্কটময় কালে ইউরোপে রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়েছিল, যে সময়টিকে আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতার সময় বলে আখ্যায়িত করি। সেখানে ধর্মযাজক ও রাজতন্ত্রের যৌথশাসন মানুষের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। ধর্মের নামে যাবতীয় অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, কূপমন্ডকতা, অন্ধত্বের প্রসার চূড়ান্তরূপ ধারণ করেছিল। কোনো চিন্তাশীল মানুষ, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী বা যে কোনো পরিবর্তনকামী মানুষ গির্জার অনাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দ করলেই তাকে পুড়িয়ে মারা হতো, শূলে চড়ানো হতো, গিলোটিনে শিরচ্ছেদ করা হতো, ফুটন্ত তেলের পাত্রে ফেলে দেওয়া হতো। ধর্মের নামে পৈশাচিক বর্বরতা ও অভিজাত শ্রেণির শোষণ থেকে মুক্তির জন্য পথের সন্ধান করতে লাগল মানুষ। তারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণা উদ্ভাবন করলেন। প্রস্তাব করলেন শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। শিল্পীরা তাদের ছবি ও ভাস্কর্যের মধ্যে এমন বিস্ময়কর মেধার প্রতিফলন ঘটালেন যা শত শত বছর পরেও গবেষণার বস্তু হয়ে আছে। নাট্যকারেরা অচলায়তন ভাঙার নাটক লিখলেন, সাহিত্যিকরা লিখলেন কবিতা, উপন্যাস। সবকিছুর উদ্দেশ্য ছিল একমুখী – এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা যেখানে মানুষ কেবল পরকালের সুখের প্রলোভনে পৃথিবীতে অবর্ণনীয় দুঃখ সহ্য করবে না বরং পার্থিব জীবনেই স্বর্গসম শান্তিময়, নিরাপদ জীবন যাপন করবে, বাকস্বাধীনতাসহ সকল মানবাধিকার পূর্ণরূপে উপভোগ করবে। রেনেসাঁর একটি অর্থ হচ্ছে পুনর্জন্ম। রেনেসাঁ মধ্যযুগীয় বর্বরতার মহাশ্বশ্বানে নতুন ফুল ও ফসলের আগমনী গান শোনালো। উদারনৈতিক গণতন্ত্র, সাম্যবাদসহ বিভিন্ন মতবাদের জন্ম হল, সমাজ ব্যবস্থায় ভাঙাগড়া চলতে লাগল। সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র পৃথিবীতে এমনকি আমাদের এখানেও। কিন্তু পরিণামে আমরা কী দেখতে পেলাম? আমরা অনেক প্রযুক্তি পেলাম, বস্তুগত অগ্রগতি পেলাম কিন্তু শান্তি পেলাম না। মানুষ ভেবেছিল এমন একটি পৃথিবী পাবে যেখানে শাসনব্যবস্থায় তার অংশগ্রহণ থাকবে, মন খুলে কথা বলতে পারবে, তার পরিপূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকবে। অথচ বাস্তবে কী দেখছি? সেই দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা। যেভাবে আজ আকাশ থেকে বোমা ফেলে, মিসাইল ছুঁড়ে ইরাকসহ একটার পর একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে নানা প্রকার অজুহাত দাঁড় করিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে তাতে ব্যক্তি স্বাধীনতা দূরের কথা, দেশ রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রের সীমানারও বিশেষ কোনো তাৎপর্য আর থাকে না। কেবল চোরাকারবারীদের মাদকদ্রব্য, গরু ইত্যাদি পাচার নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ অভিবাসী আখ্যা পাওয়া উদ্বাস্তু অসহায় জনতাকে বাধা দেওয়ার কাজে সীমান্ত কাঁটাতার ব্যবহৃত হচ্ছে। রেনেসাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত সভ্যরাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করার মধ্য দিয়ে যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে সেটার পর যে স্বপ্ন নিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের রেনেসাঁ ঘটেছিল সেই স্বপ্ন ধূলায় মিশে যায়। তখন থেকে আর কোনো মানবতাবাদী শান্তিদায়ক আদর্শ পৃথিবীতে আধিপত্য করছে না, তখন থেকে চলছে জবরদস্তিমূলক শাসন, পারমাণবিক অস্ত্রের শাসন।

জঙ্গিবাদ ইস্যুটি একটি অতি কার্যকর পন্থা যাকে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্র তথা অস্ত্রের বাজার সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে তারাই কয়েকটি ধর্মব্যবসায়ী আরব রাষ্ট্রের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় শত্রুরূপে সৃষ্টি করছে।

জেহাদ-কেতাল, উন্মাদনা ও জঙ্গিবাদ

অনেকেই জঙ্গিবাদের উৎপত্তির দায় কোর’আনের উপর চাপাতে ব্যস্ত থাকেন। অথচ জেহাদ আর সন্ত্রাস কখনও এক নয়। প্রতিটি মানুষকে এখন এই ফারাক বুঝতে হবে যেন কেউ কোর’আন দেখিয়ে জেহাদের কথা বলে কাউকে সন্ত্রাসে লিপ্ত করতে না পারে। একইভাবে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে উস্কানি দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলে দাঙ্গা পরিস্থিতি (গড়ন) সৃষ্টি করা, অপর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর ধর্মীয় নৃশংসতায় হামলা চালানো আর ইসলামের জেহাদ-কেতাল এক বিষয় নয়, এদের মধ্যে সামান্যতম সংশ্লিষ্টতাও নেই।

কেবল মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করেই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী দুর্বলের উপর ফতোয়াবাজি করে উশৃঙ্খল জনতাকে ‘তওহীদী জনতা’ আখ্যা দিয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। আবার ভিন্নমতের মানুষকে গুপ্তহত্যা করারও কোনো বৈধতা আল্লাহ-রসুলের ইসলাম দেয় না। তবু জেহাদের নাম দিয়ে সেটা বেশ জোরেসোরেই চালিয়ে যাচ্ছে কিছু গোষ্ঠী। ধর্মের নামে চলা এসব ভয়ঙ্কর অপকর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে মানুষের মনকে দিন দিন বিষিয়ে তুলছে, মুসলিমদেরকে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করছে। আমরা অকাট্য যুক্তি, দলিল ও প্রমাণসহকারে এসবের বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই করে যাচ্ছি, যেন এসব ভ্রান্ত ব্যাখ্যার বিষয়ে এ দেশের আপামর ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠী সোচ্চার হয়। আমরা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলছি, এগুলো একটাও ইসলাম নয়।

হুজুগনির্ভর ধর্মোন্মাদনা ইসলামে নেই:

এটা সরল সত্য যে গুজব বা হুজুগ কখনওই কোনো শুভফল বয়ে আনতে পারে না। বরং এ দুটোকে ব্যবহার করে সর্বযুগে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে কিছু মহল। ভাবতে অবাক লাগে মুসলমানেরা কী করে হুজুগ আর গুজবে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো! একটা গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় আর মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ হৈ হৈ রৈ রৈ করে ধ্বংসাত্মক ও সহিংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এতে বদনাম হয় ধর্মের, অবমাননা হয় আল্লাহর, রসুলের। শোনা কথায় কান দিয়ে আকস্মিক আবেগের বশে কোনো কাজ করা আল্লাহর সরাসরি নিষেধ, ইসলাম এর ন্যূনতম সম্ভাবনাকেও প্রশ্রয় দেয় না বরং নির্মূল করে দেয়। উড়ো কথা প্রচার করা বা কারো উপর অপবাদ আরোপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে দ-নীয় অপরাধ।

রসুলাল্লাহর জীবনে এমন একটি ঘটনাও নেই যেখানে সাহাবীরা গুজবে মেতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করেছেন। তিনি দাঙ্গাবাজ ছিলেন না, তিনি ছিলেন যোদ্ধা। তিনি চিরকাল নিজের সেনাবাহিনীর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আর দুর্বল শত্রুকে ক্ষমা করেছেন, এটাই তাঁর জীবনে আমরা বার বার দেখতে পাই। এটাই হচ্ছে বীরত্বের নিদর্শন। বীর যুদ্ধ করে, কাপুরুষ দাঙ্গা করে।

ফতোয়াবাজ কথিত আলেমরা আজ হিন্দুর বিরুদ্ধে, কাল কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে, পরশু অমুক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নাস্তিকতা বা কাফের-মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে গলা ফাটিয়ে ওয়াজ করে একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করে দেন। ফলে কোনো সংখ্যালঘু দুর্বল শ্রেণি ধর্মোন্মাদ তওহীদী জনতার রোষাণলে ভস্মীভূত হয়ে যায়। বিগত সময়ে কত মানুষকে তারা হত্যা করেছে, কত মানুষের বাড়িঘর তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এটাই হচ্ছে ফিতনা। যখন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে তখন তা চলে যায় স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে। তারা এটা নিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতে ওঠে।

এই ফেতনা সৃষ্টিকারীদের পরিণতি কী হবে?

আল্লাহর রসুল এ কথাটিও সুস্পষ্টভাবে বলে গেছেন যে তাঁর উম্মাহর মধ্যে কারা ফেতনা সৃষ্টি করবে। তিনি বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন- (১) ইসলাম শুধু নাম থাকবে, (২) কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, (৩) মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, (৪) আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব, (৫) তাদের তৈরি ফেতনা তাদের ওপর পতিত হবে। [আলী (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত]
যারা ধর্মের শিক্ষা দিয়ে, ধর্মের কাজ করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করে, ধর্মকে জীবিকার হাতিয়ারে পরিণত করে তারা সমাজে প্রচলিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যভাষণের শক্তি ও যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। সে যখন একজন অসাধু ব্যক্তির থেকে সুবিধা গ্রহণ করে তখন তার মস্তক সেই টাকার কাছে বিকিয়ে যায়, সেই সাথে ধর্মও বিক্রি হয়ে যায়।

সুতরাং এখনও সময় আছে ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে ধর্মানুভূতির নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিতে হবে, মানুষকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হবে যেন তারা আর কারো দ্বারা প্রতারিত না হয়। এই ক্ষেত্রটিতে গণমাধ্যমগুলোর কার্যকর ভূমিকা নেওয়া অপরিহার্য বলে আমরা অনুভব করি। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে ধর্মের বিরোধিতা করে, ধর্মবিদ্বেষ প্রচার করে এই সন্ত্রাসকে রোখা যাবে না। ধর্মীয় দলিল দিয়ে করতে হবে, ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরার মাধ্যমেই বিকৃত শিক্ষার অপনোদন অপসারণ করতে হবে। আল্লাহর দয়ায় সেই আদর্শ আমরা লাভ করেছি এবং সেটা প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের নামে প্রচলিত ভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা করছি।

আমরা সকল অধর্মের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, কূপমন্ডকতকার বিরুদ্ধে যে মহাজাগরণ সৃষ্টির চেষ্টা করছি, সেই রেনেসাঁ ঘটানোর সংগ্রামে আপনারা যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য ব্লগে লেখালেখি করছেন তাদেরকে আমাদের সাথে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, সেটা আপনারাই আপনাদের লেখুনির মাধ্যমে ঘটাবেন। আমরা মাঠের মানুষ, মাঠে কাজ করছি। আপনারা যে দায়িত্বশীল অবস্থানে আছেন সেখান থেকেই এ লড়াইতে আমাদের সহযোগিতা করবেন বলে আশা করি। নব্বই দশকে আফগানিস্তান যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আমাদের দেশেও একটি শ্লোগান বারবার শোনা গেছে যে, “আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান”। নানা কারণে এ জাতীয় শ্লোগান এখন আর রাজপথে দেওয়া না হলেও সেই চেতনা কিন্তু অদৃশ্য হয়ে যায় নি, বরং বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রসারিত হয়েছে। আমরা হেযবুত তওহীদ তালেবান হতে চাই না, বাংলাকেও আফগান বানাতে চাই না। আমরা জানি আফগান এখন বোমায় চষা জমি, পুরো দেশটা একটি বৃহৎ গণকবরের রূপ নিয়েছে। তাদের দেশের লক্ষ লক্ষ শিশু প্রতিবন্ধী হয়েছে, লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছে, তালেবানরা তাদের রক্ষা করতে পারে নি। আমরা নিয়তিবাদী নই, আমরা বিশ্বাস করি মানুষ যতটুকু চেষ্টা করে ততটুকুই সে ফল লাভ করে। এজন্য আমাদের এখন সম্মিলিতভাবে জাতির অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতে হবে। এটা পরিবর্তনের সময়, এটা মহাকালের যুগসন্ধিক্ষণ।

ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে……!

বর্তমান সময়ে চলমান মহাসংকটের পরিধিকে একত্রে চিন্তা করতে গেলে কোনো বিবেকবান চিন্তাশীল মানুষ স্থির থাকতে পারে না। মানবজাতি তার ভিতরে, আত্মিকভাবে দেউলিয়া, বাইরে সর্বপ্রকার বিপর্যয়ের শিকার। কারো কোনো নিরাপত্তা নেই, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছে, শোষণমূলক পুঁজিবাদ মাত্র আটজন ব্যক্তির হাতে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সম্পদ তুলে দিয়েছে, দুর্বৃত্তরা সম্মানের আসন পাচ্ছে, শিক্ষক ছাত্রের হাতে মার খাচ্ছে, সৎ ব্যক্তি জীবনমানের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ে সর্বত্র পিছিয়ে পড়ছে। সমস্ত দুনিয়াটা যেন এক নরকুপে পরিণত হয়েছে।

পৃথিবীর চারদিক থেকে আর্ত মানুষের হাহাকার উঠছে- শান্তি চাই, শান্তি চাই। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের ওপর ধনীর বঞ্চনায়, শোষণে, শাসিতের ওপর শাসকের অবিচারে, ন্যায়ের ওপর অন্যায়ের বিজয়ে, সরলের ওপর ধুর্তের বঞ্চনায়, পৃথিবী আজ মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নিরপরাধ ও শিশুর রক্তে আজ পৃথিবীর মাটি ভেজা। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি সর্বরকম অপরাধ প্রতি বছর বেড়ে চলেছে ববং বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর শেষ কোথায়? এর পরিণতি চিন্তা করে সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ আজ দিশাহারা। এর ওপর আবার ভয়াবহ বিপদ দাঁড়িয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের যা যে কোনো মুহূর্তে সমস্ত মানবজাতিসহ পৃথিবী গ্রহটাকেই ভেঙে ফেলতে সক্ষম।

আমাদেরকে যেমন মানবজাতি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে তেমনি বাঙালি জাতিকে নিয়েও চিন্তা করতে হবে, মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়েও চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশের বাসিন্দাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে এ দেশের ৯০% জনগণ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান আর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো চলমান সভ্যতার সংঘাতে একটার পর একটা মুসলিমপ্রধান দেশ ধ্বংস করছে, দখল করে নিচ্ছে, তাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করছে, কোটি কোটি জনগণকে উদ্বাস্তু করছে। বাংলাদেশকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলমান আছে বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বারংবার উল্লেখ করেছেন।

বর্তমানে বিশ্বে ধর্ম প্রধান ইস্যু, ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ধর্মবিশ্বাস ও ইসলাম-বিদ্বেষকে রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ড হিসাবে ব্যবহার করছে। এই ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে ধর্ম নিয়ে এখন সবাইকে কথা বলতে হবে, নইলে দেশ রক্ষা করাই মুশকিল হয়ে যাবে।

উপলব্ধি ……

ডিম থেকে মাত্র বের হওয়া হাঁসের বাচ্চাকে পানিতে ছেড়ে দিলে এটি সাতরে ডাঙায় চলে আসে। মাত্র পৃথিবীর আলো দেখেছে যে মুরগী ছানাটি সেও ঠুকরে শস্যদানা খেতে পারে। মাত্র ভূমিষ্ট হওয়া গরু, ছাগল, ঘোড়ার বাচ্চা নিজে থেকেই দুধ পান শুরু করে দেয়, কিছু সময়ের মধ্যে দৌড়া-দৌড়ি শুরু করে। অথচ মানুষ কী অসহায় হয়ে পৃথিবীতে আগমন করে! কান্না ছাড়া সে কিছুই করতে পারে না। স্বাবলম্বী হতে লেগে যায় জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় (আসলে সে কখনোই স্বাবলম্বী হয় না, অন্যের সহযোগিতা ছাড়া সে একটা দিনও চলতে পারে না)। এর কারণ কী, আল্লাহ মানুষকে এত অসহায় করে সৃষ্টি করলেন কেন?
.
আল্লাহ চান সমাজে বসবাসরত প্রতিটা মানুষ অন্য মানুষের কাছে ঋণের জালে আবদ্ধ হোক, তার হৃদয়ে যেন এই চেতনা জাগ্রত হয় যে- সে বহু মানুষের ভালোবাসা, সহযোগিতা, করুণা, দয়ার কারণে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে সুতরাং সমাজের অন্যান্য মানুষের প্রতিও তার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
.
সমাজ টিকে থাকে সামাজিক বন্ধনের উপর। এই বন্ধনগুলো দৃঢ় হয় পারস্পরিক সহযোগিতা ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। একসাথে বসবাস করতে গিয়ে একে অন্যকে যখন সহযোগিতা করে তখন তারা কৃতজ্ঞতা ও কর্তব্যের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন সন্তান বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও কর্তব্যের জালে আবদ্ধ। কর্তব্য পালন না করতে পারলে সে অনুশোচনার গ্লানিতে দগ্ধ হয়। এটা মানুষের চিরাচরিত সনাতন ধর্ম, মনুষ্য ধর্ম। এটা হারালে মানুষ আর মানুষ থাকে না।
.
আপনি আজ হয়ত বিরাট বড় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি কিন্তু এক সময় আপনিও ছিলেন ছোট্ট শিশু। কান্না বাদে কিছুই করতে পারতেন না। এই অবস্থানে আসতে বহু জনের কাছে ঋণের জালে আবদ্ধ হয়েছেন।

উপাসনাসর্বস্ব ব্যক্তিজীবনকেন্দ্রিক ধর্মের যে রূপটি বর্তমানে দাঁড়িয়েছে তা কোথা থেকে আসলো?

16830887_1441769379190764_1571831122358442782_nযুগে যুগে মহান আল্লাহর নিকট থেকে আসা প্রতিটি ধর্মই ছিল পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সার্বিক জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে তার পথনির্দেশই ছিল ধর্ম। প্রতিটি ধর্মেই আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতিসহ যাবতীয় বিষয়ের নির্দেশনা ছিল। প্রতিটি ধর্মের নামও ছিল ইসলাম (শান্তি) আর ফলও ছিল শান্তি। প্রতিটি ধর্মের ভিত্তি ছিল তওহীদ (আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা নেই)। এই শেষ ইসলামের সাথে অন্যগুলোর পর্থক্য হলো এই যে, অন্য ধর্মগুলো ছিল একটি নির্দিষ্ট এলাকা ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযোজ্য আর শেষ ইসলাম হলো কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য।
.
বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মভিত্তিক জাতি হলো খ্রিষ্টান। এই খ্রিষ্টধর্ম কীভাবে সৃষ্টি হলো সে সম্পর্কে দুটি কথা এখানে বলে নিতে চাই-
—-
ইহুদি আলেমরা (রাব্বাই, সাদ্দুসাইরা) মুসা (আ.) এর ধর্মগ্রন্থ তৌরাত এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তা প্রয়োগ করত এবং এই ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করত। তৌরাতের বিধি-বিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি তখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে ইহুদি জাতির জন্য প্রযোজ্য ছিল কিন্তু তা নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অতি বিশ্লেষণের ফলে সেই ধর্ম মানুষকে শান্তির পরিবর্তে চরম অশান্তিতে ফেলেছিল। তখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল রাব্বাই, সাদ্দুসাইদের বাড়াবাড়ি ও অতিবিশ্লেষণের হাত থেকে ধর্মকে তার সরলরূপে ফিরিয়ে আনা, তবেই কেবল সমাজে শান্তি আসবে। তখন মহান আল্লাহ ইহুদি জাতির জন্য পাঠালেন নবী ঈসাকে (আ.)।
.
ঈসা (আ.) এসে ঘোষণা দিলেন, “আমি বনী-ইসরাইলের পথভ্রষ্ট মেষগুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি এসেছি।” যেহেতু তখনও ইহুদিদের দীন (জীবনব্যবস্থা) অবিকৃতই ছিল তাই তিনি নতুন কোনো দীন (জীবনব্যবস্থা) নিয়ে আসলেন না। তিনি কেবল কিছু উপদেশ নিয়ে আসলেন যেন মানুষ সেগুলো অনুসরণ করে সৎচরিত্রবাণ হতে পারে এবং ধর্মের সঠিক উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। ইহুদিরা যদি ঈসা (আ.) এর ঐ উপদেশগুলো গ্রহণ করত তবে ইহুদি ধর্ম পূর্ণাঙ্গতা পেত, তৌরাত ও ঈসা (আ.) এর উপদেশগুলো একত্র হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ দীন তৈরি হতো।
.
কিন্তু ইহুদিরা ঈসা (আ.) এর উপদেশ গ্রহণ করার পরিবর্তে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। ঈসা (আ.) এর অন্তর্ধানের পর ‘পল’ নামে একজন লোক ঈসা (আ.) এর আদর্শের প্রতি ঈমান আনল এবং ঈসা (আ.) এর কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে ইউরোপে এই ধর্ম প্রচার শুরু করল যদিও ইহুদিদের বাইরে এই আদর্শ প্রচার করা ঈসা (আ.) এর কঠোর নিষেধ ছিল। ঈসা (আ.) এর উপদেশগুলো তখনকার সময়ের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী ও হৃদয়গ্রাহী ছিল কিন্তু তা মোটেও পূর্ণাঙ্গ দীন (জীবনব্যবস্থা) ছিল না, সেগুলো ছিল কেবল চরিত্র সৃষ্টির প্রেরণা ও উপাসনাসর্বস্ব। এই ধর্ম ইউরোপে ব্যাপকভাবে গৃহীত হলো ঠিকই কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল যখন এই ধর্ম দিয়ে সমাজ পরিচালনা করতে যাওয়া হলো। যেহেতু সমাজ পরিচালনার নীতিমালা এই উপদেশগুলোর মধ্যে ছিল না তাই ধর্মযাজকরা বাধ্য হয়ে নিজেদের মনগড়া ফতোয়া (বিধি-বিধান) দিয়ে সমাজ পরিচালনা করতে লাগল। সমাজে নেমে আসল অন্যায়-অবিচার।
.
এর ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগে এসে ইউরোপ এমন বর্ববর হলো যে, ধর্মের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারা, ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে মধ্যে ফেলে দেওয়া, মৃত পশুর পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে, হিংস্র জন্তু দিয়ে খাওয়ানোসহ বহু অমানবিক কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠিত হলো। একদিকে রাজা ও সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার অন্যদিকে ধর্মযাজকদের নির্যাতনে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো। তখন কিছু চিন্তাশীল মানুষ সিদ্ধান্ত নিল যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মকে আর ব্যবহৃত হতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সেটার সিদ্ধান্ত নেবে মানুষ আর ধর্ম কেবল ব্যক্তিগতভাবে পালন করা যাবে।
.
১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ৮ম হেনরির রাজত্বকালে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। জন্ম হলো ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদের। ধর্মের নামে স্থবিরতা, অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতা অনেকাংশেই দূর হতে থাকল। এটিই ছিল ইউরোপে রেনেসার মূল ভিত্তি। ধর্মের নামে বহু মিথ্যা খ্রিষ্ট ধর্মের মধ্যে প্রচলিত হয়েছিল, কিন্তু মানুষ ধর্মের সেই মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারত না ধর্মযাজকদের ভয়ে। ধর্মের সাথে বৈপরিত্ব আছে এমন বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ করার কারণে বহু বৈজ্ঞানিককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার ফলে মানুষের উপর থেকে ধর্মের আইনী বিধিনিষেধ লোপ পেল এবং সমাজে প্রচলিত অনেক মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হলো, বৈজ্ঞানিক সত্য উদ্ঘাটনের সুযোগ সৃষ্টি হলো, মানুষের প্রতিভা বিকশিত হবার পরিবেশ তৈরি হলো। শুরু হলো নব নব আবিষ্কার, সূচনা হলো নতুন যুগের। এই পরিবর্তনের হাওয়া লাগল সমগ্র পাশ্চাত্য দুনিয়াই। মানুষ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে আকৃষ্ট হতে লাগল ধর্মনিরোপেক্ষতার প্রতি।
.
এখানে মনে রাখতে হবে ধর্মনিরোপেক্ষতার জন্ম হয়েছে খ্রিষ্টধর্মের সেই সমস্ত মিথ্যা ও জবরদস্তিমূলক নীতির বিরুদ্ধে যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কোনো নীতি নয়, বরং খ্রিষ্টান পোপদের তৈরি বানোয়াট ফতোয়া। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা নীতি যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় তবে কখনোই তা মানুষের অশান্তির কারণ হবে না, সেখানে জবরদস্তি থাকবে না। ইউরোপে যখন মধ্যযুগের বর্ববরতা চলছে মুসলিম দুনিয়ায় তখন শান্তির সুশীতল বাতাস বইছে। মুসলমানরা সম্পদের প্রাচুর্যে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্প-সংস্কৃতিতে, চরিত্রিক গুণাবলিতে, সামরিক শক্তিতে এক কথায় সমস্ত দিক দিয়ে তখন উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে। পৃথিবীর শিক্ষকের জাতি, অনুকরণীয় জাতি, অনুসরণীয় জাতি তখন মুসলিমরা। আর এর মূল ভিত্তি ছিল ত্রুটিহীন পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ‘ইসলাম’।
.
কাজেই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার নীতি তথা ধর্মনিরোপেক্ষতা খ্রিষ্টধর্মের জন্য প্রযোজ্য হলেও ইসলাম নামক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার জন্য প্রযোজ্য নয়। কেবল ব্যক্তিজীবনকেন্দ্রিক উপসনা সর্বস্ব ধর্মের যে রূপটি আমরা দেখতে পাই তা ধর্মনিরোপেক্ষতার জন্মের পর থেকেই প্রচলিত হয়েছে এবং এটা মূলত খ্রিষ্টধর্মের জন্যই প্রযোজ্য। ইসলাম, সনাতন, ইহুদি ইত্যাদি ধর্মের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।

মানবজাতী আজ মহা সংকটে ……..!

প্রতিটি সংকট মানুষকে দু’টো সম্ভাবনার মুখোমুখী দাঁড় করায়। হয় সে সংকট উত্তরণের পথ উদঘাটন করে নিজেকে অধিকতর উন্নত অবস্থানে নিয়ে ইতিহাসের অংশ হয় অথবা সেই সংকটে নিমজ্জিত হয়ে কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। মানবজাতির সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের বাঙালি জাতিও আজ তাদের সুদীর্ঘ কণ্টকময় পথ পরিক্রমার অন্ত্যে এমন একটি যুগসন্ধিক্ষণে (Crossroads in time) এসে উপনীত হয়েছে যেখানে তাদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা চলমান বিশ্বের বহুমুখী সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোন দিকে পা বাড়াবে।

বর্তমান সময়ে চলমান মহাসংকটের পরিধিকে একত্রে চিন্তা করতে গেলে কোনো বিবেকবান চিন্তাশীল মানুষ স্থির থাকতে পারে না। আমরা তাদের কথা বলছি না যাদের দৃষ্টি আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতায় অন্ধ হয়ে গেছে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে চিন্তা করার শক্তি লুপ্ত হয়ে গেছে।

আমরা মুখ থাকতেও যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে মূক ও বধির হয়ে থাকে তার কথা বলছি না। আমরা সেই উন্নত প্রাণীর কথা বলছি সমাজের অধিকারবঞ্চিত দুর্বল মানুষের দীর্ঘশ্বাস যার হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে; যার কান দিয়ে সে ধর্ষিতার ক্রন্দন, বাস্তুহারার হাহাকার শুনতে পায়। আমরা জড়বুদ্ধি, কূপমণ্ডুক চিন্তাহীন প্রাণীর কথা বলছি না, বরং সেই প্রাণীর কথা বলছি যে সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছে তার অসাধারণ মেধাসম্পন্ন মস্তিষ্কের আশীর্বাদে যার দ্বারা সে অতীতে অসংখ্য মহাসঙ্কটের সমাধান আবিষ্কার করেছে।

আজ মানবজাতি তার ভিতরে দেউলিয়া, বাইরে সর্বপ্রকার বিপর্যয়ের শিকার। কারো কোনো নিরাপত্তা নেই, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছে, শোষণমূলক পুঁজিবাদ মাত্র আটজন ব্যক্তির হাতে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সম্পদ তুলে দিয়েছে, দুর্বৃত্তরা সম্মানের আসন পাচ্ছে, শিক্ষক ছাত্রের হাতে মার খাচ্ছে, সৎ ব্যক্তি জীবনমানের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ে সর্বত্র পিছিয়ে পড়ছে। সমস্ত দুনিয়াটা যেন এক নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছে।

আমরা ধর্মগ্রন্থে নরকের বর্ণনা পড়েছি, রেনেসাঁযুগের শিল্পি বত্তিচেল্লির রংতুলিতে দান্তের ইনফার্নো দেখেছি, কিন্তু আজ সেই নরককুণ্ড নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছি, আলাদা করে আর নরক দেখার প্রয়োজন নেই। এখন এই নরক থেকে বের হওয়ার জন্য আপাতত স্বার্থচিন্তা ত্যাগ করে সকল চিন্তাশীল মানুষের চিন্তা করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।