বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

এদেশ ওদেশ ১

(শুরু করছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। বুঝতেই পারছেন লেখাটি সামান্য বড়, তাই কয়েক পর্বে এখানে দেব।)

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই চব্বিশ বছর পাকিস্তান শাসনে ছিল বিভক্ত বাংলার টুকরো। পূর্ব ও পশ্চিম নামকরণেই ছিল বিচ্ছিন্নতার আভাস। আসলে পাকিস্তানের শাসকেরা কখনোই পূর্বপ্রান্তের এই ভূমিকে তাদের উপনিবেশের বেশী কিছুই ভাবতে পারত না। আর এর কারনও ছিল বহুমুখী। ভাষাগত, খাদ্যাভ্যাসগত, সংস্কৃতিগত পার্থক্য কোনোদিনই দুই প্রান্তকে কাছে তো আনেইনি, উল্টে শাসকের অহমিকায় দূরে ঠেলে দিয়েছিল।

আপাদমস্তক গরীব এই অঞ্চল থেকেই চব্বিশ বছর পাকিস্তান লুঠ করে তাদের রাজধানীতে নিয়ে যেত শষ্যসম্পদ থেকে জাত বিপুল পরিমাণে কর। অথচ উন্নয়ণের জন্য ফেরত আসত না কিছুই।

সাম্রাজ্যবাদী শাসকের শাসনযন্ত্রের নিয়মে পূর্ব পাকিস্তানে তখন বাসা বেঁধেছিল মূল পাকিস্তান ভূখণ্ডের কিছু লোক আর সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়ে ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশের কিছু মানুষ। কিন্তু পূর্বপ্রান্ততে বাসা বাঁধলেও, তারা উর্দু, আরবী বা ফার্সি না জানা বা বলা বাঙালিদের মানুষ বলে মনেই করত না। তারা ছিল মূল শাসকদের এজেন্ট। এরাই পরবর্তীতে রাজাকার, আলবদর এর মত কুখ্যাত হত্যাকারী সংগঠনগুলির স্রষ্টা।
মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিবরের নেতৃত্বেই যে প্রথম ওপারের বাঙালি মাথা তুলেছিল তা নয়। তাদের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ছিল ভাষা আন্দোলন। এরপরও ছোটখাটো কিছু আন্দোলন দানা বাঁধলেও বিস্ফোরণ ঘটলো ১৯৭০ এ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রায় কে গায়ের জোরে পাকিস্তানি শাসকেরা রদ করতে চাওয়ায়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিম্বা তার আগের ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্য এই প্রতিবেদন নয়। ইতিহাস সবার জানা, বহু চর্চিত। আমরা শুধু প্রেক্ষাপট বুঝতে বেশ কিছুটা পেছনে একটু অনুসন্ধানে যাই।

উনবিংশ শতকে অনেকগুলি ঘটনা ইংরেজ শাসকদের চিন্তিত করেছিল। একের পর এক বিদ্রোহ আর তার ফলস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে রাজশক্তির ভারত অধিগ্রহণ। এই বিক্ষোভের মাত্রা কমানোর উদ্দেশ্যেই ১৮৮৫ তে অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম কে দিয়ে তৈরী করা হল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে ধামাধরা সংগঠনের। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রশমনের উদ্দেশ্যে এই সংগঠন কাজ করবে নরম পন্থায় তা ধরেই নেওয়া হয়েছিল। আর কার্যত হয়েছিল তাই।

বলতে কি এই কংগ্রেস কোনোদিনই সংগঠিত দল ছিলনা, আদতে এ এক মঞ্চ। আর শাসকের কাছে অগ্রাধিকার পাওয়ায় বেশ কিছুটা ক্ষমতা সম্পন্ন। তাই এর মারফত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার জন্য শীর্ষ স্তরের নেতৃত্বে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা ও হরেক বৈধ বা অবৈধ কৌশল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই বোঝা গেছিল ইংরেজ আর তাদের এই ব্যায়বহুল উপনিবেশ ধরে রাখবে না। তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে কার হাতে? স্বাভাবিকভাবেই প্রিয়পাত্র কংগ্রেস ই দৌড়ে এগিয়ে।

(চলবে)

দিনমজুর

indi

শুনুন মহাজন, ‘আমিতো দিনমজুর
সদা গায়ে খেটে মরি,
কাজ শেষে মোর পাওনা
বুঝিয়ে দিবেন খুব তাড়াতাড়ি।’

মহাজন বললো, ‘আচ্ছা আচ্ছা তা হবে
এখন কাজ করো গিয়ে,
দেখো কাজে দিও না ফাঁকি
মজুরি নিও কাজ ষোলআনা বুঝিয়ে দিয়ে।’

দিনমজুর, ‘আচ্ছা মহাজন ঠিক আছে
আপনার কাজ হবে ষোলআনা,
কাজে আমি দিব না ফাঁকি
যদিও পেটে না থাকে মোর দানা।’

‘বেশ! বেশ! বেশ! খুশি হলাম শুনে
এখন যাও।’ বললো মহাজন,
দিনমজুর দিলো দৌড়, শুরু করল কাজ
সে যে হায় দিনে আনে দিনে খান।

হলো দুপুর শেষ হলো বেলা
মজুরের বাড়ি ফেরার পালা,
মজুরি পেতে গেল মহাজনের বাড়ি
দেখামাত্রই মহাজন মুখটা করলো কালা!

‘হায়রে, কী জ্বালা কী জ্বালা’
মহাজন বললো রেগেমেগে,
আজ নেই তো টাকা-কড়ি
কালকে তোকে দিবো সবার আগে।’

হায়! হায়! হায়!, এখন কী উপায়?
ঘরে তো তার নেই দানা,
অবলা নারী পথ চেয়ে আছে
ভাবছে, ‘ফিরবে স্বামী সাথে নিবে খানা।’

কী আর করা নিরুপায় হয়ে দিনমজুর
ধীরে ধীরে চললো পায়ে হেঁটে,
বাড়ির সামনেই পুকুরে স্বচ্ছ পানি
ইচ্ছেমতো সে ভরে নিলো পেটে।

অপেক্ষায় থাকা দিনমজুরের সহধর্মিণী
জিজ্ঞেস করলো, ‘সে কি গো,
এসেছো খালি হাতে বুঝি?
তা হলে এখন খাবো কী গো?’

দিনমজুর বলল, ‘আমি গিলেছি পানি
তুমিও গিলবে তা-ই জানি,
করার তো কিছুই নেই যে গিন্নি
যাও পুকুরে গিলে নাও পানি।’

‘আমরা তো গরিব দিনমজুর
মালিক মোদের হুজুর মহাজন,
কেউ দেয় না ঘাম না শুকোতে মজুরি
এখন সবাই এমন, চলছেই এমন!’

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৯

27392

বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট হতে তেল আভিভ শহর ২০ কিলোমিটার পথ। অবেলায় ট্যাক্সি ক্যাব ছাড়া দ্বিতীয় কোন মাধ্যম নেই ওখানে যাওয়ার। টুরিস্ট ব্যুরোর বুথ হতে যাবতীয় তথ্য নিয়ে রওয়ানা দিলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। গড়পড়তা সময় ও ভাড়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ায় ক্যাবিদের হাতে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাটা দূর হয়ে গেল।

ট্যাক্সি ক্যাবের লাইন অনেক সময় একটা দেশের আয়না হিসাবে কাজ করে। ট্যুরিজমের প্রতি একটা দেশ অথবা জাতির কমিটমেন্টের পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায় লাইনের স্বচ্ছতা ও ড্রাইভারদের আচার ব্যবহারে।

ঢাকা এয়ারপোর্টের কথা মাথায় রেখেও যদি অন্য কোন এয়ারপোর্টের কথা মনে করতে চাই প্রথম আসবে সোভিয়েত কালে মস্কোর শেরমেতেয়াভা এয়ারপোর্ট। ওখানে সরকারী ট্যাক্সি লাইনের ছায়ার নীচেই বাস করতো একদল প্রতারক। যাত্রীদের সস্তা ভাড়ার লোভ দেখিয়ে অচেনা কোন গন্তব্যে নিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। না জেনে ওসব ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই চরম মাশুল গুনতে বাধ্য হত সে সময়।

ভেতরে যাত্রীদের ভিড় থাকলেও ট্যাক্সি লাইনে তেমন ভিড় ছিলনা। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর ডিসপাচার আমাকে খালি একটা ট্যাক্সি ধরার ইশারা দিল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষার পর ড্রাইভার বেরিয়ে এসে শুভেচ্ছা বিনিময় করল। বড় লাগেজটা নিজ হাতে ট্রাংকে উঠিয়ে আমাকে ভেতরে আসার আহবান জানাল।

প্রথম দর্শনেই বুঝে নিলাম ড্রাইভারের জাতিগত পরিচয়। রুশ!
কেবল চেহারায় না, গোটা শরীরে একধরনের ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘনের ছাপ। চোখে মুখে রুক্ষতার ছোঁয়া, মুখের ভাষাও তরবারির মত ধারালো ও কর্কশ।

আমার মুখে খাঁটি উচ্চারণের রুশ ভাষা শুনে একটু ভড়কে গেল। প্রথমে মনে করেছিল আমি তাদেরই একজন এবং এদেশেরই স্থায়ী বাসিন্দা। ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার সাথে সদর্পে ফিরে গেল রুশ চেহারায়। পরিচয়ের দুই মিনিটের মাথায় তুই তোকারির সাথে আলাপচারিতায় অশ্লীল রুশ শব্দ ব্যবহারের বন্যা বইয়ে দিল।

নিজের জন্যে এ ছিল মারাত্মক সাবধান বাণী। আমার জানা ছিল ইসরায়েলি নাগরিকদের একটা বিরাট অংশের আদিবাস সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য। রুশ এখানে খুবই প্রচলিত ভাষা। কথায় কথায় অপরিচিত কারও কাছে নিজের রুশ কানেকশন উন্মোচন না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।

আর দশটা পশ্চিমা শহরের মতই এয়ারপোর্ট হতে তেল আভিভ যাওয়ার রাস্তা। দ্রুত গতির রাস্তাটায় কোন ট্রাফিক লাইট নেই। অনেকটাই মার্কিন ফ্রীওয়ে গুলোর মত। ২০ কিলোমিটার পথ হলেও গতির সীমাবদ্ধতার কারণে সময় লেগে গেল।

ঝাঁপিয়ে রাত নেমে গেছে তেল আভিভে। ট্যাক্সি ক্যাবের ঘড়িটায় রাত প্রায় ৯টার মত। হাতের ঘড়িটায় ইসরায়েলি সময় সেট করে নতুন আরও একটা দেশে পা রাখার মানসিক প্রস্তুতি নিলাম।

রাত মাত্র ৯টা। অথচ তেল আভিভ অনেকটাই নীরব। চারদিকে এক ধরণের ভৌতিক নীরবতা। হঠাৎ দেখায় মনে হবে ব্যস্ত একটা দিনের পর ক্লান্ত অবসন্ন মানুষ সকাল সকাল বিছানায় চলে গেছে। রাস্তার দুপাশের স্কাই স্ক্রাপারগুলোতেও কোন বৈচিত্র্য নেই। মূর্তিমান আতংকের মত নিজেদের অবস্থান জানান দিলেও তাতে নেই প্রাণের স্পন্দন। পার্থক্য কেবল শহরের বিলবোর্ড গুলো। চারদিকে হিব্রু ভাষার ছড়াছড়ি। ইংরেজির দাপটও চোখে পড়ার মত। তবে আরবি একবারেই অবহেলিত। হতে পারে কল্পনায় আমি তেল আভিভে সদ্য ফেলে আসা সান ফ্রান্সিসকোর মত ঝলমলে আলো আর মধ্যরাতের বাঁধভাঙ্গা যৌবন দেখতে চেয়েছিলাম। তাই প্রথম দেখায় কিছুটা হলেও হতাশ হলাম।

27398

দশটার উপর বেজে গেল বেন ইয়াহুদা স্ট্রীটের উপর সেন্ট্রাল হোটেলটায় পৌঁছতে। রুম আগেই বুক করা ছিল। তাই চেক-ইন ঝামেলায় অতিরিক্ত সময় বায় করার তাগাদা ছিলনা।

টিপস সহ ১৮০ সেকেল (ইউএস ডলারে ৫৬ ডলার) ট্যাক্সি ভাড়া চুকিয়ে হোটেল ফটকে আসতে হতাশ হলাম। তালা ঝুলছে মূল ফটকে। সামনের সবকটা বাতি নেভানো। ভেতরটাও অন্ধকার।

আমার জন্যে দেশটা একেবারেই নতুন। রীতিনীতি দূরে থাক দেশটার সাধারণ মানুষগুলো সম্পর্কেও তেমন ধারণা নেই। ইসরায়েল বলতে এতদিন জেনে এসেছি বেনইয়ামিন নেতনিয়াহু, এরিয়াল শ্যারণ আর ইয়াহুদ বারাকের মত রাজনীতিবিদদের। তাই রাত ১০টার পর হোটেলের ঘুমন্ত মানুষগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকার কোন পথ বের করতে পারলাম না। হাতের সুটকেস মাটিতে ফেলে অনেকক্ষণ ঠায় বসে রইলাম।

রাত গড়াচ্ছিল। যেকোনো ভাবে ভেতরে যাওয়ার তাগাদাটা অজগর সাপের মত তেড়ে ফুরে উঠছিল। আমি বুকিং দিয়েই এ হোটেলে এসেছি এবং আমার আগমনের সময়ও ওদের ইমেইল করে জানিয়েছি। ইউরোপ আমেরিকার কোন হোটেল হলে ওরা দরজা খুলে আমার অপেক্ষায় থাকত। সৌজন্য বোধ বিদায় নিয়ে এবার ক্রোধ চপে বসল মগজে। আঙ্গুলের সব শক্তি এক করে কলিং বেলে টিপ দিলাম।

বেশ ক’বার টিপলাম। কারও কোন সাড়া শব্দ নেই। হোটেলের কোন লবি আছে বলেও মনে হলোনা। ভেতরে একধরণের ভয় দানা বাধতে শুরু করল। কি হবে যদি আদৌ কেউ দরজা না খোলে!
লোহার গেইট ধরে সজোরে ধাক্কা দেয়া শুরু করলাম।
খুট করে একটা আওয়াজ হল। দূরের সিঁড়িতে একটা অনুজ্জ্বল আলোর রেখা ফুটে উঠল। সাথে হালকা পায়ে সিঁড়ি ভাঙ্গার শব্দ। কেউ একজন এগিয়ে আসছে।

পরিচয় না দিলেও যা বুঝার তা আমি বুঝে নিলাম। রুশ ভাষায় অশ্লীল একটা গালি দিয়ে চেইন লাগানো তালাটা খুলতে শুরু করল। এ যাত্রায় ভাষা ব্যবহারে সতর্ক হয়ে গেলাম। আমি একজন আমেরিকান এবং সামনের লোকটা আমার ট্যাক্সের পয়সায় লালিতদের একজন, ভাবনটা সামনে আনতে সবকিছু সহজ হয়ে গেলাে।

এবার কর্কশ ভাষায় জানতে চাইলাম আমার বুকিং সম্পর্কে ধারণা থাকলে দরজা খুলতে এত দেরী হচ্ছিল কেন! রুশ অরিজিন মানুষদের ভোকাবুলারিতে ক্ষমা বলতে কোন শব্দ নেই, হোক তা ইহুদি, তাতার অথবা আজেরি। তাই আমার হোটেল গাইডের মুখ হতে এমন কোন শব্দ আশা করলাম না।

কাউন্টারে তার ভাইয়ের থাকার কথা এ সময়ে, এমন একটা তথ্য দিয়ে এড়িয়ে গেল আমার প্রশ্ন। আসলে কাউন্টার বলতে তেমন কিছু নেই হোটেলে। সিঁড়ির কোনায় একটা টেবিল, পাশে একটা কফি মেশিন ও ছোট মত একটা বক্সে কিছু ব্রসিউর, এসব নিয়েই হোটেলের রিসিপশন। সস্তা হোটেল খোঁজার মূল্যটা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেল, চিন্তাটা মাথায় আসতে আরও সাবধান হওয়ার তাগাদা অনুভব করলাম।

নিজকে আনাতোলি স্তেপানভিচ হিসাবে পরিচয় দিল। এটা নাকি তাদের পারিবারিক ব্যবসা। দুই ভাই পালা করে দায়িত্ব পালন করে থাকে। সাধারণত রাত ১০টার পর এদিকটায় নাকি কেউ আসেনা, তাই চোখ কান খোলা রাখে না মূল ফটকের দিকে। হাতে একটা টর্চ-লাইট নিয়ে দুজনে দোতলার সিঁড়ি ভাঙ্গতে শুরু করলাম। বাকি বোর্ডারদের সবাই ঘুমাচ্ছে তাই করিডোরের বাতি জ্বালানো আনাতোলির কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হলোনা। তর্ক করার ইচ্ছা ছিলনা, তাই সবকিছু নীরবে হজম করতে বাধ্য হলাম।

রুমের অবস্থাও অনেকটা আনাতোলির মত। কোথাও কোন চাকচিক্য নেই। রাত কাটানোর জন্যে নূন্যতম যা দরকার তার বাইরে কিছু নেই। অনলাইনে বুকিং দেয়ার সময় এমন কিছু ঘটবে তার কিছুটা হলেও আন্দাজ ছিল। কারণ একটু ভাল হোটেলের ভাড়া ছিল এ হোটেলের চাইতে দুই তিন গুন বেশী।

হোটেলের কোয়ালিটি নিয়ে আমার তেমন কোন মাথা ব্যথা কোন কালেই ছিলনা। কোলকাতার সদর রোডের সস্তা হোটেলের খাটিয়া অথবা বলিভিয়ার রাজধানী লা পাসের শ্রীহীন হোস্টেলের লোহার বেড, কোন কিছুতে সমস্যা দেখিনি। দিনশেষে মাথা গোজার একটা ঠিকানাই যথেষ্ট ছিল।

চলবে।

ফিরিয়ে দাও

27829

আমি ফেরত চাই আমার বিশ্বাস
ফেরত চাই আমার সবুজ মনন
আমার অবুঝ মন
আমার সহজ দৃষ্টি
ফেরত চাই আমার রাঙাদিন
আমার স্বপ্নিল রাত
আমার শব্দের বালখিল্যতা
আমার মমতা
আমার প্রাণের ছায়া…. জীবনের মায়া।

নরক যন্ত্রণা

IMG_20

দুঃখ থেকে কান্না আসে
সুখ থেকে হাসি,
বেশি দুঃখে বুক ছাপড়ায়
আনন্দে বাজায় বাঁশি!

খাবার যদি না থাকে ঘরে
ক্ষুধা বাড়ে অকারণ,
পকেটে যদি না থাকে কড়ি
জীবন থাকতেও হয় মরণ।

সংসারের অশান্তি নরক যন্ত্রণা
থাকুক যতই ধনসম্পত্তি,
টাকা-পয়সায় বাড়ায় বিলাসিতা
অশান্তিতে ভুগে দম্পতি।

দুনিয়াতে দুঃখ-কষ্ট নরক যন্ত্রণা
ধনসম্পত্তিতে শান্তি হয়না,
জীবদ্দশায় যদি না পায় শান্তি
স্বর্গেও শান্তি মেলেনা।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৮

27364a তেল আভিভ বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট। হিব্রু এক্রোনেম ন্যাটবাগ। পৃথিবীর আর দশটা উন্নত দেশের মত গুছালো ও পরিচ্ছন্ন একটা এয়ারপোর্ট। প্রথমে দেখায় ভাল না লেগে উপায় নেই। নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টের মত ব্যস্ত না হলেও সামগ্রিক ব্যস্ততা চোখে পরার মত। পৃথিবীর সব প্রান্ত হতে বিমান নামছে। দলবেঁধে টুরিস্টরা আসছে। ধার্মিকদের সংখ্যাও কম না। গায়ের পোশাক দিয়ে অনেককে আলাদা করা যাচ্ছে।

অজানা আশংকাটা আবারও ফিরে এলো। আদৌ কি ঢুকতে পারবো দেশটায়! ধর্মীয় সমস্যায় জর্জরিত একটা দেশে ধর্মীয় পরিচয় অন্য যে কোন পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। কাগজে কলমে আমি একজন মুসলমান। এবং ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলে একজন সন্দেহজনক ব্যক্তি। অবশ্য সন্দেহ করার মত তেমন কিছু ছিলনা আমার চেহারা সুরতে অথবা সাথে আনা তল্পিতল্পায়।

আমি একজন পরিব্রাজক। পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই, বন্দরে বন্দরে নোঙ্গর ফেলি। এ পর্যন্ত বৈধ ভিসা থাকাবস্থায় কোন দেশ আমাকে তার সীমান্ত হতে ফিরিয়ে দেয়নি। বরং একজন সুস্থ স্বাভাবিক পরিব্রাজক হিসাবে স্বাগত জানিয়েছে। বিনিময়ে আমিও এমন কোন কাজ করিনি যা আমার পরিচয়ে কালিমা আটতে পারে।

ফ্লাইট হতে বেরিয়ে লাগেজ কারুসেলে যাওয়ার পথেই সিদ্ধান্তটা নিলাম, ঢুকতে না দিলে পাশের দেশ মিশরে চলে যাব। ওখানেও অনেক কিছু দেখার আছে। হয়ত নষ্ট হবে পকেটের কিছু পয়সা। তা নিয়ে ভাবতে চাইলাম না।

273630b

একজন মার্কিন নাগরিককে ইসরায়েল তার সীমান্ত হতে বিনা-কারণে ফিরিয়ে দেবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। ইসরায়েল নামের দেশটার অস্তিত্বের প্রতি অঙ্গে মিশে আছে আমার মত মার্কিনিদের ট্যাক্সের পয়সা। এ নিয়ে টালবাহানা করার কোন অধিকার নেই ইসরায়েলিদের। ধারণাটা মগজে স্থায়ী করার চেষ্টা করলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে নিজকে এখন হতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে ভাবার চেষ্টা করবো। কোথাও কেউ সমস্যা তৈরির চেষ্টা করলে সরাসরি যোগাযোগ করবো জেরুজালেমের মার্কিন দূতাবাসে।

ট্রলিতে সুটকেস, হাতব্যাগ আর ল্যাপটপ উঠিয়ে রওয়ানা দিলাম ইমিগ্রেশনের দিকে। পাশের সীটের যাত্রী সারাহ এসে ইসরাইল’এ সাদর অভ্যর্থনা জানালো। কোন ধরণের সাহায্যের প্রয়োজন হলে জানাতে অনুরোধ করল। আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে উত্তর দিলাম অজানা অচেনা দেশের ভাল-মন্দ আমি নিজের মত করে উপভোগ করতে চাই। দুজন দুদিকের লাইনে দাঁড়িয়ে ইতি টানলাম পরিচয় পর্ব। মেয়েটা ইসরায়েলি নাগরিক, তাদের জন্যে আলাদা লাইন।

সিরিয়াল আসতে ছোট একটা বুথে বসা ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে ইশারা দিল। হাতে পাসপোর্ট নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম। বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় করার চেষ্টা করলাম। কাজ হলোনা। ইমিগ্রেশন অফিসারদের জাতটাই এরকম। ওরা সহজে স্বাভাবিক হয়না। যখন তখন হাসেনা। কিছুক্ষণ ঠায় হয়ে তাকিয়ে থাকে চেহারার দিকে। যা বুঝার তা বুঝে পেলে খটাস করে একটা সীল মারে।

– তুমি কি কোন গ্রুপের সাথে ট্রাভেল করছ?
– না, আমি কোন গ্রুপের সাথে নেই। একা এসেছি
– এর আগে কোনদিন এসেছ ইসরায়েলে?
– না, এই প্রথম
– কতদিনের জন্যে এসেছ?
– বেশি হলে দুই সপ্তাহ

পাঁচ মিনিটের বেশী স্থায়ী হলোনা আমাদের কথাবার্তা। হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে স্মরণ করিয়ে দিল কাগজটা যেন না হারাই। কারণ ওটাই দেশটায় ঢুকার ভিসা। যে হোটেলে থাকতে চাচ্ছি ওরাও দেখতে চাইবে কাগজটা। ফেরার পথে ইমিগ্রেশনও দেখতে চাইবে ইস্যু করা ভিসা।

ইসরায়েল ঘুরে দেখার তিন মাসের ভিসা আমার হাতে। প্লান বলতে যা ছিল তা বাস্তবায়নের কোন অসুবিধা রইলো না।

কাস্টমসের গ্রিন চ্যানেল ধরে বেরিয়ে গেলাম কোন প্রশ্ন ছাড়াই। কেউ ফিরেও তাকালও না আমার দিকে। ভিতরে জমে থাকা সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিমিষে উবে গেল।

টার্মিনাল গেটের সামনে এসে আবারও দেখা পেলাম সারার। সেও বুঝে নিয়েছে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। ফোনটা তার হাতে ধরিয়ে দু’একটা ছবি তুলে দেয়ার অনুরোধ করলাম। সমস্ত মুখ বিস্মৃত করে একটা হাসি দিল। ইসরায়েল নামের দেশটায় তোলা প্রথম ছবি সারার হাত ধরেই জন্ম নিলো।

এয়ারপোর্টের ভেতরের আলোর সাথে বাইরের আলোর কনট্রাস্টটা ছিল চোখে পরার মত। খুবই অল্প ও অনুজ্জ্বল। দেখতে অনেকটা ৭১সালে দেখা দাদাবাড়ি যাওয়ার মদনগঞ্জ লাইনে মোল্লারচর ষ্টেশনটার কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে বাস্তবে এতটা বিবর্ণ ছিলনা। ভেতরের আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যায়, বাইরে এলে তা নিঝুম কোন দ্বীপের মত দেখায়।

2735631c
– চলবে।

এদেশ ওদেশ ৫

(বর্তমানে পাকিস্তান অশান্ত। আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমার “এদেশ ওদেশ” নিবন্ধে লিখেছিলাম এরকম ঘটনা ওখানে বারবার হয়, কেন হয়। প্রকাশিত সেই পূর্ণ নিবন্ধের কিছুটা অংশ মাঝে মধ্যে তুলে দেব। পাঠকের দেখুন কিছু বোঝেন কি না।)

মজার ব্যাপার হলো, চরম দক্ষিণপন্থার মৌলবাদকে প্রতিরোধ করতে পারত যে বামপন্থী কমিউনিস্ট দল, তারাই জন্মলগ্ন থেকেই অদ্ভুত মতাদর্শগত দ্বন্দ্বে সর্বদাই লিপ্ত থাকত, আর কিছু সময় অন্তরই টুকরো হতে থাকত। নরম কমিউনিস্ট, মধ্যপন্থী কমিউনিস্ট, চরমপন্থী কমিউনিস্ট। আবার এক জাতীয় মতাদর্শেও বহু আলাদা আলাদা আণুবীক্ষণিক দল। অথচ, ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দলগুলো টুকরো হওয়া তো দূরের কথা বিভিন্ন শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে বেড়েই চলছিল। এর আরেক কারন হলো, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও, বহু বামপন্থী দলও সেই ভোটবাদী হয়ে ধর্মীয় ওড়নায় মাঝেমধ্যে মাথা ঢাকতে শুরু করেছিল। মানুষ এটাও ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ফলতঃ বাড়বাড়ন্ত মৌলবাদের।

ওপারের দেশ পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় কাছাকাছি হয়েও স্বতন্ত্র কারনে বিভাজিত হচ্ছিল।

সীমানার ওপারে বিভাজনের সমস্যা বুঝতে আরোও পিছিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর প্রথম ধর্ম ভিত্তিক দ্বেষ এবং তার আধারে যুদ্ধ ছিল ক্রুশেড। খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্মের এই বিবাদও আধারিত ছিল সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক মূলতঃ ভূমি দখলের লড়াই। আসলে তখন ওই জাতীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে যুদ্ধে পরস্পর বিবাদমান প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত করে মুসলমান শাসকদের সাম্রাজ্য দখলের ফন্দির হোতা ছিল ইউরোপ। ধর্মীয় জিগির তুলে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা সেই শুরু।

চারশো বছর অতিক্রান্ত তবু সেই অপচেষ্টা সমানে অব্যাহত। ইউরোপের সাম্রাজ্য সূর্য অস্তমিত হলে আসরে নামলো আমেরিকা। পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বহাল রাখার জন্য তারা যেকোনো কুকাজ করতে পিছপা হলো না। ধর্মীয় জিগির তুলে হোক কিম্বা সুশিক্ষিতের ছদ্মবেশে হোক দুনিয়ায় তাদের থাবা কায়েম হচ্ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর সময়ে পরমানু শক্তিধর আমেরিকা নিজের স্বার্থে বিভিন্ন দেশে নিজের প্রতিনিধি বসানোর চেষ্টা করছিল। ফলস্বরূপ তেলসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া আর দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে দ্রুত বিভিন্ন উপায়ে শাসক পরিবর্তন ঘটছিল। আগেই বলেছি ভারতীয় উপমহাদেশ সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এর চতুর্দিকে শক্তির আকর এর খনি। তাই ইরান, ইরাক, তুরস্ক, সৌদি আরব, লেবানন, আরব আমীরশাহী, ইজরায়েল সমেত মধ্য এশিয়া করায়ত্ত করার পরেও তাদের দরকার ছিল উপমহাদেশের মালিকানা। একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে চীন হয়ে উঠছিল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি।

ভারত নিজেকে জোট নিরপেক্ষ ঘোষণা করেও রাশিয়ার মিত্রজোটে সামিল হয়ে গেল। অতএব পাকিস্তান কে যেন তেন উপায়ে নিজের দিকে টানতেই তার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে লাগলো আমেরিকা। সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক সবরকম সাহায্য অবাধে আসতে লাগলো। মধ্য এশিয়ায় অবাধ্যদের শায়েস্তা আর রাশিয়াকে সহবত শেখানোর জন্য তৈরী হল ফ্রাঙ্কেস্টাইন সাদ্দাম হোসেন, বিন লাদেন ইত্যাদি এবং তাদের সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী।
পাকিস্তানেও গণতন্ত্র ভন্ডুল করে নিজের জোহুজুর কে বসানোর জন্যই এভাবেই সাদ্দাম বা লাদেন যুগের কয়েক দশক আগেই হয়েছিল আমেরিকার প্রচ্ছন্ন মদতে সেনা অভ্যুত্থান।

জিন্নাহ্ যুগ যে পাকিস্তানের স্বর্ণযুগ ছিল, তা বলব না। কিন্তু এই সময়ে অন্তত সেই দেশের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মীয় শাখার বিবাদ ছিলনা। ছিল গণতন্ত্র। ছিলনা আমেরিকা বা কোনো বৃহৎ শক্তির চাটুকারবৃত্তি। উচ্চশিক্ষিত এই মানুষটির সম্পর্কে বিরোধী মৌলবাদীরা যাই প্রচার করুক, কিম্বা শাসক হিসেবে তাঁর সাফল্য অসাফল্যের যতই চুলচেরা বিচার হোক, মানুষ হিসেবে জিন্নাহ্ সাহেব ছিলেন সাচ্চা। নরমপন্থী চিহ্নিত করে জিন্নাহ্ কে গান্ধীর মতোই ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে ক্ষমতাহীন করার কাজ তলেতলে শুরু হয়ে গেছিল তাঁর জীবিতকালেই।

জিন্নাহ্ শাসনের অন্তকেই ধরা যেতে পারে উপমহাদেশের কালো অধ্যায়ের সূচনা। জেনারেল আইয়ুবের সময় থেকেই পারস্পরিক দ্বেষে বিভাজিত হতে থাকল প্রাচীন ঐতিহ্যের সুসভ্য সমাজ।

(যদি কেউ সত্যিই পড়েন তাহলে বাকি অংশ পরে দেব)

কোথায় নিয়ন্ত্রণ?

image-15

সবকিছু আজ চলে গেছে
নিয়ন্ত্রণের বাইরে,
নিয়ন্ত্রণ তো নেই এখন
নিজের ঘর সংসারে।

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে
খোদ দেশের সরকার,
সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে
দেশের হাট বাজার।

নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখছে এখন
নেতা-নেত্রীর ক্যাডার বাহিনী,
তাদের দমাতে হিমশিম খায়
দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি দূর্নীতি
সব ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে,
তবুও সভা মিটিং ডাকা হয়
কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের আহ্বানে।

দ্রুতগতির গাড়ি যখন-তখন
রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ হারায়,
মরে মানুষ কাঁদে স্বজন
ড্রাইভার-হেলপার পালায়!

নদীতে মালবাহী জাহাজগুলো
চলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে,
তাইতো দেখা যায় আচমকা
ধাক্কা লাগে লঞ্চ-স্টিমারে।

দেশের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ রাখে
দেশের ব্যবসায়ী সংগঠন
সেটাও নিয়ন্ত্রণ হারা এখন
সাধারণ মানুষের হয়েছে মরণ।

স্বাস্থ্য সেবার নিয়ন্ত্রণ রাখে
দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়,
করোনা কালে এখানেও হয়েছিল
বছরের সেরা মহাপ্রলয়।

ত্রাণসামগ্রী বিতরণের নিয়ন্ত্রণ থাকে
জনপ্রতিনিধিদের হাতে
সেই ত্রাণ নিয়েও খেলেছিল খেলা
ধরাও পড়েছিল হাতেনাতে।

নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়েছিল
প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার,
কেউ পেয়েছিল কেউ পায়নি
তাতে যায় আসে কার?

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৭

27341

আকাশ পথে লম্বা জার্নির এই এক অসুবিধা। এক সময় মনে হবে এ পথ কোন দিন শেষ হওয়ার নয়। চলছি তো চলছিই। ব্রেকফাস্টের পর লাঞ্চ আসে, লাঞ্চের পর ডিনার, মাঝখানে চা-কফি পর্ব। দিন গড়িয়ে রাত নামে। সময়ের হেরফেরে সে রাত শেষ হতেও সময় লাগে না।

ফ্লাইট হোস্টেসদের এলোপাথাড়ি চলাফেরা, কিছু কিছু যাত্রীদের কারণে অকারণে হোস্টেসদের বিরক্ত করা, সর্বোপরি ফ্লাইট ফ্লোরে জমতে থাকা আবর্জনার স্তূপ একসময় মগজে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। মনে হয় এসব দৃশ্য আমি অনন্তকাল ধরে দেখছি। সহযাত্রীদেরও মনে হয় কতকালের চেনা।

ইন-ফ্লাইট মুভি দেখায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না কাছের সীট হতে ভেসে আসা ম্যারাথন কান্নার কারণে। বয়স হয়ত ১ মাসও হয়নি, এমন একটা শিশুকে নিয়ে আকাশ জার্নি করার কোন জাস্টিফিকেশন খুঁজে পেলাম না। বিশেষকরে জার্নি কাফেলায় যখন অপ্রাপ্তবয়স্ক একাধিক শিশু থাকে।

কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম টের পাইনি। পাশের সীটের মেয়েটা এক মিনিটের জন্যেও বইয়ের পাতা হতে চোখ সরায়নি। মাঝখানের সীটটা খালি, শরীর আলগা করে হেলান দিয়ে বসতে ঝিমুনি এসে গেল। কখন চোখ বুজে ঘুমাতে শুরু করেছি বুঝতে পারিনি। বাইরে দিন কি রাত সেটা বুঝারও উপায় ছিলনা। জানালার উপর পর্দা এঁটে গভীর রাত মেইনটেইন করছিল ফ্লাইট হোস্টেসরা।

যাত্রীদের চঞ্চলতাই বলে দিচ্ছিল আমরা খুব একটা দূরে নেই। শেষবারের মত খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পরলো হোস্টেসরা। দুদিকের বাথরুমে লম্বা লাইন ধরে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছে যাত্রীরা। জানালার ঢাকনা সরিয়ে বাইরে তাকাতে নিকস কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। মনিটর ম্যাপে চোখ ফেরাতে ধারণা পেলাম আমাদের বর্তমান অবস্থান। আরও প্রায় ২ ঘণ্টার পথ।

তারিখ ও দিনের কোন হদিস ছিলনা। হাতের ঘড়িও সময় দেখাচ্ছিল আমেরিকার মাউন্টেন জোনের সময়। এবার আমি নিজেই অনুরোধ করলাম জানালার পাশের সীটটার জন্যে। সহযাত্রী সানন্দে ছেড়ে দিল তার নিজের সীট।

জানালার বাইরে রাতের আকাশ। নিকষ কালো অন্ধকার। এদিক সেদিক দুয়েকটা তারা মিটমিট করছে। নীচের দিকে তাকাতে নিশ্চিত হয়ে গেলাম ল্যান্ড করতে যাচ্ছি আমরা।

রাত নেমে এসেছে পৃথিবীর এ প্রান্তে। স্বরলিপি-হীন এক ধরণের আবেগ এসে মগজে চেপে বসল। যে দেশটার জন্যে সারা জীবন ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই লালন করিনি সেখানেই নামতে যাচ্ছি। জীবন কি জিনিস বুঝে উঠার অনেক আগ হতে বুঝতে শিখেছি একটা জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখে শোষণ করছে আরেকটা জাতি। এখানে জন্ম নিয়ে একটা শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে পায় উদ্বাস্তুর তকমা। নিজ গৃহে ওরা পরবাসী। স্বপ্ন-হীন একটা জাতি তিল তিল করে বেড়ে উঠে প্রতিরোধ আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে তামা হয়ে।

আকাশ হতে বুঝার উপায় ছিলনা কোনটা ইসরায়েল আর কোনটা তাদের দখলে থাকা পশ্চিম তীরের প্যালেস্টাইন। আলোর ঝলকানি যাচাই বাছাই করলে হয়ত আন্দাজ করা যেত প্যালেস্টাইনের সীমানা। ওখানে জীবন থাকলেও নেই জীবনের ছন্দ। তাই আলোর ঝলকানি ওখানে প্রত্যাশিত ছিলনা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ঠিক মাঝখান হতে।

চলবে।

দুখী আমি

Village

দুখী আমি অভাগা আমি
লোকে বলে আমি ভিখারি,
ভিক্ষুক চাইলে দেয়না ভিক্ষা
তারাই নাকি এই সমাজে হাজারী।

দিনমজুর আমি অভাবী আমি
লোকে বলে আমি নাকি দুখী,
পরের ধন খায় লুটেপুটে
তারাই নাকি এই সমাজে চিরসুখী।

কাঙাল আমি জঞ্জাল আমি
এই সমাজের মানুষের কাছে,
কাঙালিদের খাবার কেড়ে খায়
তারাই নাকি থাকে ক্ষমতার আগে-পাছে।

রাক্ষস আর শয়তান

27744

ছোডবেলা সইন্ধ্যার পর বুড়া-বুড়িগো সামনে বইয়া হেগো মুহে শোলক(কিচ্ছা) হুনতাম। শোলক হুনতে খুব ভালা লাগত। হুনলে খালি হুনতেই মন চাইত। হুনতাম রাইক্ষস’র শোলক। হুনতাম শয়তানের শোলক। হুনতাম রাজা-প্রজা আর ধনী-গরিবগো শোলক। হেসুম খালি হুনতামই। কিন্তু তরজমা বা বিশ্লেষণ করনের মতন বয়স তহন অয় নাই দেইখ্যা হেগো মুহে শোলক হুইনাই খালি খালি চিন্তা করতাম, আর রাইক্ষসের ডর মনের মধ্যে পুইষা রাখতাম।

হেই ডরে সইন্ধ্যার পর আর ঘরেই তুনে বাইর অইতাম না। বেশি রাইতে যদি মুতায় ধরতো, তহন শয়তান আর রাইক্ষসের ডরে মা’রে ডাইক্যা উঠাইতাম। মা’র লগে বাইরে যাইয়া মুইতা দুই চোক বন্ধ কইরা দৌড় দিয়া ঘরে আইতাম। হের পরও বাইর অইলেই মনে অইতো এই বুঝি রাইক্ষসে আমারে খাইলো, আর শয়তানে ধরলো!

অহনে বড় অইছি। বুজের অইছি। হগল কিছু বুঝি, জানি। হিল্লাইগা অহনে আর হেসব শোলক কিচ্ছা হুনি না। কারোর মুহে হুনলেও আঁইস উডে। হুইন্না একলা একলাই আঁসতে থাহি, আর ভাবতে থাহি। অহনে বুঝি ঐ রাইক্ষস-টাইক্ষস হাছা বইলতে কিচ্ছু নাই। মাইনষের তুনে বড় রাইক্ষস এই দুইন্নাত নাই। আর ঐ যে শয়তান? মাইনষের তুনে বড় কুনো শয়তানও নাই।

কাজেই কথার কথা অইলো, মানুষই রাইক্ষস, মানুষই শয়তান।

দেশী ভাষায়,
নিতাই বাবু
৩০/০৩/২০২২ইং।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৬

27292

যাত্রীর মিছিল শেষ হতে লম্বা সময় লেগে গেল। অনেকে একাধিক হ্যান্ড লাগেজ ও শিশু নিয়ে প্রবেশ করায় তাদের বসাতে যথেষ্ট সময় ব্যায় করতে হল এয়ার হোষ্টেসদের। আমার দু লাইন সামনে ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে এক ইসরায়েলি পরিবার বসায় রাতের ঘুম কেমন হতে পারে কিছুটা আন্দাজ করে নিলাম।

সামনে পেছনে যতদূর তাকালাম কোথাও খালি কোন সীটের দেখা পেলাম না। মনে মনে কিছুটা হতাশ হলাম। খালি কোন সীট পেলে ওখানে ঘুমের আয়োজন করতে পারতাম। অতীতে অনেক ফ্লাইটে এ সুবিধা নিয়েছি। আমার চার সীটের লাইনটা তখনও খালি। মনে মনে দোয়া করলাম অন্তত একটা সীট যেন খালি যায়।

একদম শেষমুহূর্তে একজন এসে জানান দিল জানালার পাশের সীটটা তার। ২০-২৫ বছর বয়সী অনিত্য সুন্দরী এক ইহুদি মেয়ে। চমৎকার একটা হাসি দিয়ে গুছিয়ে নিলো নিজের সীট। কোন ভণিতা না করে নিজের পরিচয় দিল। সারাহ, জন্মগত ইসরায়েলি। সান ফ্রানসিস্কোর কোন এক ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল সায়েন্সের ছাত্রী। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। জন্ম হাইফা শহরে হলেও তার মা-বাবা এখন তেল আভিভের বাসিন্দা। ওখানেই যাচ্ছে।

নিজেকে একজন টেলিকম প্রকৌশলী হিসাবে পরিচয় দিতে খুশি হয়ে জানালো তার এক ভাইও এই লাইনের প্রকৌশলী। ইসরায়েল প্রথম যাচ্ছি জানতে পেরে আমাকে জানালার পাশের সীটে বসার আহবান জানালো। ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের অস্বীকৃতি জানালাম। লম্বা জার্নিতে আমি আইলসের সীটে বসতেই পছন্দ করি। তাতে মধ্যরাতে বাথরুম চাপলে আসা-যাওয়ায় অনেক সুবিধা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম গোটা ফ্লাইটের দুটা সীটই কেবল ফাঁকা। এবং তা আমাদের সারিতে।*

ফ্লাইটের ঝামেলা শেষ করে আকাশে উঠতে উঠতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল। ততক্ষণে নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে বাইরের আকাশ। ইউনাইটেডের সুপরিসর বিমান রানওয়ে ছেড়ে আকাশে ডানা মেলতে কোন ঝামেলা হয়নি।

উড্ডয়নের মুহূর্তটা যেকোনো আকাশ জার্নির উৎকণ্ঠার সময়। ফ্লাইট ইতিহাসে যতো দুর্ঘটনা তার অধিকাংশই ঘটে হয় উঠা অথবা ল্যান্ড করার সময়। তাই আশংকা উৎকণ্ঠা ক্ষণিকের জন্যে হলেও মগজ চেপে ধরে। অতিরিক্ত ধাক্কা ধাক্কি ভয় ধরিয়ে দেয়। এ সময় কেবিন ক্রুরাও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সব সংশয় সব ভয় নিমিষে উবে যায় যখন বিমান তার প্রয়োজনীয় উচ্চতায় পৌঁছে সোজা হয়ে চলতে শুরু করে।
এ যাত্রায়ও কোন ব্যতিক্রম হলোনা।

চারদিকে যাত্রীদের কোলাহল। হিব্রু ও আরবি ভাষায় নিচু স্বরে কথা বলছে সবাই। খুব কাছে বাচ্চাদের কেউ বিরামহীনভাবে কাঁদছে। মা চেষ্টা করছে সন্তানকে সান্ত্বনা দিতে। কথা বলছে আরবি ভাষায়। ভাষা বুঝা না গেলেও মা ও সন্তানের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। কারণ এ ভাষা চিরন্তন।

প্রচণ্ড খিদায় পেট চো চো করছিল। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে খাওয়া ম্যাকডোনাল্ডের বিগ ম্যাক ততক্ষণে হজম হয়ে গেছে। লম্বা জার্নি, তাই খাবার যাই হোক খেতেই হবে। অরুচি এখানে অপশন না। পরের খাবার কখন আসবে তারও কোন ঠিক নেই। কারণ বাইরে এখন রাত হলেও দূরত্ব অতিক্রম করার সাথে সময় বদলে যাবে। জীবন হতে হয়ত নীরবেই খসে যাবে একটা রাত অথবা দিন।

এক কাপ কফি দিয়ে শেষ হল ডিনার। প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশিই খেলাম। সহযাত্রী সারাহ’র আহারে আছে অনেক রকম বিধিনিষেধ। তাই তার মেনুর বেশকিছু আইটেম জোর করে ধরিয়ে দিল আমার হাতে। ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর গোটা কেবিন জুড়ে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। ফ্লাইটের মূল বাতি ততক্ষণে নিভে গেছে। কান্নারত শিশুর শেষ চীৎকারও মিহি হয়ে এসেছে। এবার ঘুমের পালা।

পার্সোনালাইড মনিটরে মুভি দেখার আয়োজন শেষ করে আমিও কম্বলের নীচে মুখ লুকালাম। এত সহজে ঘুম আসবেনা আমার। তাছাড়া এভাবে বসে ঘুমানোর সাথে আমার বৈরিতা অনেকদিনের।

হরেক রকম ভাষায় শতাধিক মুভি সেভ করা আছে ফ্লাইট নেটওয়ার্কে। রাতের জন্যে সংক্ষিপ্ত একটা তালিকা তৈরি করে নিলাম। এক চ্যানেলে ফ্লাইটের মতিগতি মনিটর করার ব্যবস্থা আছে। কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড হয়ে নর্থ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের স্পেনের উপর দিয়ে উড়ে যাবে আমাদের ফ্লাইট। ঘণ্টার হিসাবে প্রায় ১৬ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে এখানটায়।

চলবে

নাগরিক

তোমার মুখের কোমল চুমু নিয়ে পালাচ্ছে
হায় প্রিয়তমা, বিষণ্ণ দুপুরের গান!
এই রোদে সিংহের পিঠ ছুঁয়ে গড়াচ্ছে
বামজোটের হাড়গোড়ে শাদা বাঁশি,
বাঁশির নাচঘরে-সমস্ত ঠোঁটের মিছিল
মুঠোমুঠো মৃদুশ্বাসের নিগূঢ় সম্বন্ধ এনে
এই নগরে নাগরিক হয়ে আমিও লড়ছি
বিনয়ী সুরে-সুরে শাদা ভাতের মতো;

পেট্রলপাম্পটা পেরোচ্ছে পণ্যের ট্রাক
কিছু শুভ্রবালকের মতো গন্ধ আসে
পশমঘাসের বুনোটে ঘামঘেরা বয়স
আমাদের শরীর, আমাদের রুটিরুজি

অথচ ধূর্ত পুঁজিপতি ব্যাপারী, সরকার
বিপরীত লাভবানে দোকান দোকান খেলছে…

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৫

27299

সান ফ্রানসিসকো। অদ্ভুত সুন্দর একটা শহর। ঘন কুয়াশা, মৃদু শীতের বসন্ত, গোল্ডেন গেইট ব্রিজ আর নটরিয়াস আলকাট্রাস জেলখানার এই শহরে বছর-জুড়ে লেগে থাকে টুরিস্টদের ভিড়। গোটা শহরের একটা স্ন্যাপ শট পেতে উঁচু হতে দেখার কোন বিকল্প নেই। ক্ষণিকের জন্যে হলেও থমকে যেতে হয়। প্রকৃতি ও মানুষের আজন্ম ভালবাসার এই শহরকে প্রথম দেখায় ভাল না লেগে উপায় নেই। ল্যান্ড করতে চাইলে সব ফ্লাইটকেই সানফ্রানসিসকো বে’র খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতে হয়।

ভাল লাগার এসব খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলোর সবটা ক্যামেরায় ধরা যায়না, বরং হ্রদয় খুলে উজাড় করে নিতে হয়। এবং এ ধরে রাখা ক্ষণিকের জন্য নয়, বেঁচে থাকার বাকি দিনগুলোর জন্যে। উপরে পরিষ্কার নীল আকাশ, নীচে বে’র পানিতে মৃদু-মন্দ ঢেউ; সবমিলিয়ে উপভোগ করার মত একটা বিকেল।

272831

সূর্য পরে আসছিল। নির্ধারিত সময়ের একমিনিট হেরফের না করে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট আলতো করে ছুঁয়ে ফেললো সান ফ্রানসিস্কোর মাটি।

তেল আভিভের কানেন্টিং ফ্লাইট রাত ১১টায়। নষ্ট করার মত হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। ভাবছিলাম এদিক ওদিক ঘুরে তারপরই কেবল চেক-ইন করবো।

27291

অতীত অভিজ্ঞতার শিক্ষা, এয়ারপোর্টের সময়কে বিশ্বাস করতে নেই। নিমিষেই বদলে যেতে পারে সবকিছু। তার উপর ইমিগ্রেশন পার হয়ে লম্বা লাইন ধরে ভেতরে ঢুকার ভেতরও ছিল অনিশ্চয়তা। কোথায় কখন সমস্যার জন্ম হয় পূর্বাভাষ করার কোন উপায় ছিলনা। তাছাড়া আমি যাচ্ছি এমন একটা দেশে, যেখানে প্রতিদিনের জীবন ডুবে থাকে সমস্যার অথৈ সাগরে। একদিকে প্যালেষ্টাইনিদের প্রতিরোধ, পাশাপাশি ইসরায়েলি সৈন্যদের নির্মমতা। সবমিলিয়ে ইসরায়েল নামের দেশটায় যাওয়া যেমন কঠিন, বেরিয়ে আসাও খুব একটা সহজ না। বিশেষকরে আমার মত জন্মগত মুসলমানের জন্যে।

বিশেষ কোন ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন ও স্ক্যানিং পার হয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে।

দেখলে মনে হবে আলোর হাঁট জমেছে টার্মিনালে। সাথে মানুষের স্রোত। হরেক রকম মানুষ। যেন সাদা, কালো, বাদামি, এশিয়ান সহ গোটা বিশ্বের খণ্ড একটা মানচিত্র এখানে। এলোমেলো হাঁটছে সবাই। কেউ হাতে টিকেট নিয়ে দৌড়চ্ছে নিজ গেটের দিকে। আমার মত যাদের হাতে অফুরন্ত সময় তারা পথভ্রষ্ট পথিকের মত এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কেউ কেউ ঢুকে পরছে ট্যাক্স ফ্রি দোকানগুলোতে। শেষ মিনিটের কেনাকাটা সেরে অনেকে তৈরি হচ্ছে লম্বা জার্নির। সে জার্নির দূরত্ব অনেকের জন্য হয়ত আফ্রিকার গহীন জঙ্গল অথবা ব্রাজিলের আমাজন নদী পর্যন্ত।

টুকটাক কেনাকটি আমিও সেরে নিলাম। যদিও ডিনারের সময় অনেকটা বাকি, তবু ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্টে আগাম কিছু খেয়ে নিলাম। সব প্রয়োজনীয়তা শেষ করে ফ্লাইট যখন আকাশে উড়বে রাতের খাবার পরিবেশনে তখনো অনেক দেরী। অতীতে কলোম্বিয়ার বগোটা হতে নিউ ইয়র্ক ফেরার পথে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা এড়াতেই অসময়ের এ ডিনার।

27279

ইউনাইটেডের ৯৫৪নং ফ্লাইট জি৯৬ গেইট হতে ছেড়ে যাবে। হাতে তখনো নষ্ট করার মত ২ ঘণ্টা সময় আছে। হাতের ছোট ব্যাগ আর কাঁধের ঝুলন্ত ল্যাপটপটা শেষবারের মত চেক হাঁটা দিলাম নির্দিষ্ট গেইটের দিকে। কাছাকাছি আসতেই বিস্মিত হলাম। বেইসমেন্টে মূল ফটক। পাশাপাশি অন্যান্য ফ্লাইটে ঢুকার চাইতে তেল আভিভ গামী ফ্লাইটে ঢুকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাসপোর্ট চেক, তার উপর নতুন করে স্ক্যানিং। গায়ের শেষ তুলাটা পর্যন্ত খুলে রাখতে হল স্ক্যানিং মেশিনের বেল্টে।

সান ফ্রানসিস্কো শহরে জানতাম চীনাদের ঘনবসতি। এই প্রথম খুব কাছ হতে অনুভব করলাম এর সত্যতা। ইমিগ্রেশন ও স্ক্যানিং মেশিন অপারেটরদের সবাই চীনা। মাঝে মধ্যে বিনা কারণে এশিয়ান ব্যাকগ্রাউন্ডের ইমগ্রেশন অফিসাররা ঝামেলা বাধায়। সামান্য ত্রুটিকে বিশাল কোন কিছুতে রান্না করতে ভালবাসে। এ দৌড়ে চীনারা সবসময় এগিয়ে। তারপর দাঁড় করানো যাবে ভারতীয়দের। এসব ব্যপারে আমার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি অনেক ভারী। তাই কিছুটা হলেও জানা ছিল কি করলে ঝামেলা এড়ানো যায়।

ওরা কিছু বলার আগেই আমি পরনের কাপড় ছাড়া বাকিসব বেল্টে রেখে দিলাম। অফিসার অন ডিউটিকে খুব সন্তুষ্ট দেখাল। প্রয়োজনের চাইতে একমিনিটও দেরী হবোনা ঝামেলা শেষ করতে। বেল্ট হতে সবকিছু কুড়িয়ে আসল জায়গায় ফিরিয়ে নিতে বেশকিছুটা সময় পার হয়ে গেল। খুব সাবধানে গুনে গুনে সবকিছু যত্ন করে প্যাক করলাম। বিশেষ চোখ রাখলাম পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাসের দিকে।

এক মিনিটের জন্যেও ভুলে গেলাম না আমি কোথায় যাচ্ছি। ভাল করে জানা ছিল কথা ও কাজে সামান্য হেরফের হলেই আমাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে। আমি আমার ইসরায়েল যাওয়ার উদ্দেশ্য ও বিধয়ের স্টোরি সোজা করে নিলাম। মনে বিশ্বাস ছিল, সত্য বললে কোথাও কোন সমস্যা হবেনা।

বোয়িং’এর বিশাল এক ফ্লাইট। শত শত যাত্রী। সবাই নিজ দেশে যাচ্ছে। তিন ধর্মের দেশ ইসরায়েল। যাত্রীদের পরনের পোশাক দেখেই বুঝা যায় কে কোন ধর্মের। ইহুদিদের মাথার টুপি জাতীয় টেফিল্লিন নামে পরিচিত বস্তুটা বলে দেয় ওদের পরিচয়। মুসলমান বলতে যে দু’চারজন ছিল তাদের সবার পরনে ট্রাডিশনাল আরবি পোশাক। দু’চারজন ভারতীয় পোশাকেও তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সাদা আমেরিকানদের কেউ ভ্রমণ করছে বলে মনে হলনা।

চলবে

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৪

273019

কেবল বৈধ কাগজপত্র ও আর্থিক সংগতি থাকলেই ইসরায়েলের মত সমস্যাসংকুল দেশে যাওয়া যায়না। সমস্যার আগ্নেয়গিরিতে বাসকরে দেশটা। কখন সে আগ্নেয়গিরি হতে লাভা বিস্ফোরিত হবে কেউ জানেনা।
একদিকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন, ইসলামিক জেহাদের মত পশ্চিম তীরের সংগঠন, উত্তরে লেবাননের হেজবল্লাহ, গোলান হাইটসের ওপারে সংঘাতময় সিরিয়া। সবমিলিয়ে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির সাথেই হতে পারে দেশটার তুলনা। তবে গেল ক’বছর ধরে সব ফ্রন্টেই শুনশান নীরবতা। মাঝেমধ্যে স্যাটলারদের সাথে প্যালেষ্টাইনিদের সংঘাত সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও তা অল-আউট ইন্তেফাদায় গড়ায়নি। রাজনৈতিক বাস্তবতা সহসাই পরিস্থিতি বদলে দেবে তেমন অবস্থাও ছিলনা।

মনের গভীরে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও অজানাকে জানার, অচেনাকে দেখার পুরানো ইচ্ছাটারই জয় হল। দুদিনের অনুসন্ধানের পর মনের মত রুট ও দামে টিকেট পাওয়া গেল।
জুলাই ১৯, ২০১৯ সাল। চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমে বছরের এ সময়টায় সূর্যের দাপাদাপিতে কেউ ভাগ বসাতে পারেনা। একটানা গরমে জীবন অনেকসময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। মাঠ-ঘাট, চারিদিকে পাহাড় পর্বতেও চলে সূর্যের রাজত্ব।

আজকেও এর ব্যতিক্রম হলোনা। এয়ার ট্রাভেলের নিখুঁত আবহাওয়া। বিকাল ৪টায় ফ্লাইট হলেও দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় সানপোর্ট এয়ারপোর্টে হাজির। লাগেজ বলতে মধ্য সাইজের একটা সুটকেস ও হাল্কা একটা হাতব্যাগ। জানতাম মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন দেশে এটা গরমের সময়। অনেক জায়গায় রাতে বেশ ঠাণ্ডা পরে। তাই দু’ধরণের আবহাওয়ার জন্যেই কাপড় নিতে হল।

নিউ মেক্সিকোর আলবুকুরকে হতে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রানসিসকো তিন ঘণ্টার সরাসরি ফ্লাইট। ইউনাইটেড এয়ার লাইন্সে ক’মাস আগে একই পথে ভ্যানকুভার ঘুরে এসেছি। চরম বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই কোম্পানির ফ্লাইটে আর উঠবো না। কিন্তু সময় ও দামের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হল এ যাত্রায়।

দু’ঘণ্টা সময়ের পার্থক্যের কারণে সান ফ্রানসিসকো পৌঁছানোর পর একই দিন রওয়ানা দিব তেল আভিভের পথে। অযথা এয়ারপোর্টে সময় নষ্ট করতে হবেনা, এটাই ছিল ফ্লাইট সিলেকশনের আসল কারণ। এ যাত্রায় ইউনাইটেড হতাশ করেনি। আলবুকুরকে হতে ফ্লাইট ছাড়তে একমিনিটও দেরী হয়নি।

পথে দু’একবার ঝাঁকি লাগলেও গোটা ফ্লাইট ছিল শান্ত। যাত্রীদেরও তেমন ভিড় ছিলনা। ইন-ফ্লাইট সার্ভিস বলতে এক কাপ কফি অথবা এক গ্লাস সফট ড্রিংক। তা নিয়েই ইদানীং সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

এই স্বল্পতার হেতু জানতে চাইলে ওরা বলে টিকেটের দাম কম, তাই সার্ভিসও কম। অথচ সময় ছিল যখন তিন ঘণ্টার জার্নিতেও গরম খাবারের ব্যবস্থা থাকতো। অবশ্য ফ্লাইটে উঠলেই ক্ষুধা চাপতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আমার কোন কালেই ছিলনা। জানালার সীটটায় বসে বাইরের পৃথিবী দেখতে দেখতে কখন পৌঁছে গেছি টের পাইনি।