বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

যুদ্ধ ৫

274572

আজ শুরু করার আগে প্রথমেই ইউক্রেনে যে দুজন ভারতীয় ছাত্র যুদ্ধের শিকার হয়ে মারা গেলেন তাঁদের স্মৃতিতে শোক ও শ্রদ্ধা জানাই। আমার এই লেখা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আমজনতার ইচ্ছার প্রতিফলন। আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ আমাদের কোনো উপকার করে না। যুদ্ধ শুধুমাত্র বৃহৎ ব্যবসাদারদের মুনাফার রাস্তা সরল করার সাধণ। আর কে না জানে আজকের পৃথিবী ব্যবসাদারদের অঙ্গুলিসঞ্চালনে চলে। এটা পরিস্কার মনে রাখতে হবে আজকের আমেরিকা আব্রাহাম লিংকনের জনকল্যাণের রাষ্ট্র নয়, আজকের রাশিয়া ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের সমাজকল্যাণমূলক সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়। দুটি পরস্পর বিবাদমান দেশই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রিত। দুটি দেশেই বৃহৎ পুঁজিপতিরা আছে। তাদের এই বিবাদ পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অন্য দেশের উপরে কর্তৃত্ব নিয়ে। আমরা, পাকিস্তান বাদে ভারতীয় উপমহাদেশের বাকি রাষ্ট্রের মানুষেরা পুরোনো নীতিতে জোটনিরপেক্ষ থেকেও যুদ্ধের বিরোধিতা করব। এটা সাম্রাজ্যবাদের অপছন্দ হলেও আমাদের কিছু করার নেই। সুতরাং ফেসবুক কর্তৃক টানা বাহাত্তর ঘন্টা ব্লক থাকার পরেও ফের এই লেখা লিখতে বসেছি এবং লিখব। শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বিখ্যাত উক্তি লাইটহাউস হোক – “তোমরা আমাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না”।

আগেও বলেছি আবারও বলছি যুদ্ধ কখনো সাধারণ মানুষের জন্য সদর্থক কোনো বার্তা দেয় না। সবচেয়ে অবস্থা খারাপ হয় সাধারণ মানুষের। অথচ যে মুষ্টিমেয় নীলরক্তের ঝাঁকের স্বার্থে যুদ্ধ হয়, যারা যুদ্ধের ফলে মুনাফায় ফুলেফেঁপে ওঠে, তারা নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য মানুষ বা জীবদের ভয়াবহ অবস্থার অবণতির কথা মাথায় রাখে না। ১৯৪৫ এ শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আরও বহু যুদ্ধ এই গ্রহে সংঘটিত হয়ে গেছে। ৩০শে ডিসেম্বর ১৯২২ থেকে ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৯১ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল। এই সময়ে কোনো বড় আকারের যুদ্ধ হতে পারে নি, কারণ বড় আকারে যুদ্ধ শুরু করার মত পরিবেশ তৈরী হলেই সেই দেশটি সর্বক্ষেত্রে ভেটো প্রয়োগ করে যুদ্ধ আটকে দিত। অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে। পৃথিবী হয়ে গেল শক্তির এক মেরু বিশিষ্ট গ্রহ। এই পর্যায়ে সুপার পাওয়ার হলো আমেরিকা। তার অজস্র অনুগামী দেশ।

এই পর্যায়ে অত্যন্ত শক্তিধর দেশগুলি বলতে গেলে এক প্রকার খোলা লুঠ চালিয়েছে পৃথিবী জুড়ে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মধ্য এশিয়ার দেশগুলি। প্রাকৃতিক পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসে সমৃদ্ধ দেশগুলিতে নিজেদের ইচ্ছামতো শাসক বসিয়ে সেখানকার সম্পদ জোর করে তুলে নিয়েছে শক্তিশালী দেশগুলির জোট। যখনই কোনো দেশের কোনো শাসক এই লুটপাটের বিরোধিতা করেছে, তখনই যুদ্ধের নামে সেই শাসককে হত্যা করা হয়েছে, সেই দেশে নিজেদের পুতুল শাসক বসিয়ে ফের জারি থেকেছে লুঠ। অথচ দেখা গেছে সেইসব দেশে অশান্তি ছড়িয়ে দেশ, শাসক, সাধারণ নাগরিক ও বাকি পৃথিবীর নজর ঘুরিয়ে রাখার জন্য যে সব ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনদের তৈরী করা হয়েছিল তারাই পরে নিজেদের স্রষ্টার বিরোধিতা করে অবশেষে তাদের হাতেই মারা যায়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ওসামা বিন লাদেন, সাদ্দাম হোসেন বা আইএসআইএস দল ও আফগান তালিবান দল। আরও বহু আছে, কিন্তু সে সব বিস্তৃত উদাহরণে আপাতত যাচ্ছি না।

১৯৪৫ এর পরে যে বড় আকারের যুদ্ধগুলির আওয়াজ পৃথিবীকে আশংকিত করেছিল তার মধ্যে প্রধান আমেরিকা – ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সোভিয়েত – তালিবান যুদ্ধ ও পরে আমেরিকা – তালিবান যুদ্ধ এবং NATO বনাম ইরান ও NATO বনাম ইরাক যুদ্ধ। এর মধ্যে দুটি যুদ্ধ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য, কারণ সেই যুদ্ধগুলিতে সুপার পাওয়ারকে পরাজিত করেছিল দুর্বল প্রতিপক্ষ। প্রথম উদাহরণ সোভিয়েত – তালিবান যুদ্ধ। এখানে সমগ্র আফগানিস্তান রাষ্ট্র সেই যুদ্ধে জড়িত ছিল না। বস্তুতঃ আফগানিস্তান দখল করে সেই দেশকে NATO র করিডর তৈরী করতে চাওয়া তালিবানকে দখলচ্যুত করার উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ করে বিফল হয়। এর মূলতঃ দুটি কারণ, প্রথম – সেই সময়ে তারা পাকিস্তানের মাধ্যমে আমেরিকার সর্বাত্মক সাহায্য পেয়েছিল। দ্বিতীয় – হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বত বেষ্টিত সেই দেশে বিগত ছয়শত বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধের কাছে কখনো কোনো শক্তি জিততে পারে নি। যদিও পরবর্তীতে সেই তালিবানদের তাদের স্রষ্টারা কখনো যুদ্ধে দমিয়েছে আবার কখনো ফের ক্ষমতায় বসিয়েছে, যেমন এখন হয়েছে গত বছরে।

গত শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলোর মধ্যে ছিল আমেরিকা – ভিয়েতনাম যুদ্ধ। বিশাল শক্তিধর আমেরিকা আক্রমণ করে বসল এক‌টি মাইক্রোস্কোপিক দেশ ভিয়েতনামকে। পৃথিবী ভেবেছিল কয়েক দিনের মধ্যে ধ্বস্ত হয়ে যাবে ভিয়েতনাম। আরেকটু বিশদে গেলে জানতে হবে প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৫ – ১৯৭৫ পর্যন্ত কুড়ি বছর ব্যাপী চলা সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। সেই সময়ে অন্য ছোট দুর্বল দেশের মত ভিয়েতনামও ছিল প্রবল শক্তিশালী দেশ ফ্রান্সের উপনিবেশ। প্রধানত দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছিল ফ্রান্সের দখলে। আর ফ্রান্সের মদতদাতা ছিল NATO তথা আমেরিকা। উত্তর ভিয়েতনাম যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাহায্য নিয়ে দক্ষিণকে ঔপনিবেশিক দখল মুক্ত করতে চাইল তখনই শুরু হয়ে গেল বিংশ শতাব্দীর আরেক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। কুড়ি বছর স্থায়ী হওয়া এই যুদ্ধে প্রতি ইঞ্চিতে বোমা ফেলে ধ্বংস করেছিল আমেরিকা। ব্যবহার করেছিল ভয়ঙ্কর ধ্বংসকারী নাপাম বোমা সহ সব ধরনের আধুনিক অস্ত্র। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ভিয়েতনামীদের গেরিলাযুদ্ধের কাছে নতি স্বীকার করে নিজেদের ভয়াবহ ক্ষতি স্বীকার করে তাদের পরাজয় মেনে নিয়ে ফিরে যেতে হয়।

“The United States in the Vietnam War began shortly after the end of World War II in an extremely limited capacity and over a period of 20-years escalated peaking in April 1969 with 543,000 American combat troops stationed in Vietnam. By the conclusion of the United States’s involvement in Vietnam, over 3.1 million Americans had been stationed in Vietnam. At home this involvement played a key role in sparking the Civil Rights Movement, hippie culture and wide ranging changes in popular culture.

American Paratroopers of the 173rd Airborne Brigade on patrol in March 1966. The U.S. involvement in South Vietnam stemmed from a combination of factors: Joseph Stalin and Mao Zedong’s pledge in 1950 to support Ho Chi Minh and the Viet Minh’s guerrilla forces against France’s colonial occupation, the U.S. war with Japan in the Pacific, and domestic pressure to act against communism after the loss of mainland China and indecisive conclusion of the Korean War. The U.S. was initially adamantly against providing any aid to France that would prop up France’s struggle to maintain its pre-WWII colonial empire. However, Stalin and Mao’s offering their support to the Viet Minh in 1950, changed the battlefield dynamic and geopolitical character of the conflict from a struggle for independence from a colonial power to one of a global conflict against communist expansionism. It was at the time, in September 1950, that French forces began to be moderately backed by America.

As of 2020, records reported that the conflict resulted in 58,279 U.S. fatalities before the official end of combat operations in 1973. As of 2019 it was estimated that approximately 610,000 Vietnam Veterans are still alive, making them the second largest group of Veterans behind those of the Global War on Terror. The war’s lasting impact can be seen in the thousands of movies, books, and video games centered on the conflict.”

একটা ছোট্ট অংশের অনুভবী মানুষ যুদ্ধ চায় না। তারা কিন্তু কাউকে চোখ রাঙিয়ে অযৌক্তিক কথা বলে না। অথচ বড় অংশের মানুষেরা যারা যুদ্ধ সমর্থন করে তারাই ছোট অংশকে চোখ রাঙায়, গালাগালি দেয়, দেশদ্রোহী বলে। দুপক্ষের সমাধানের মত ও পথ আলাদা। এরা জানে না একটা যুদ্ধ শুধু হত্যাই করে না, দুর্বল জাতির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।

(চলবে)

যুদ্ধ ৪

274572

যুদ্ধ শব্দটা শুনলে বা পড়লে আমাদের মাথায় আসে হলিউডের বা বলিউডের কিছু সিনেমার ছবি। যেখানে দেশাত্মবোধের টগবগে আবেগে মাখামাখি হয়ে আমরা দুটো পক্ষ নিজের থেকেই ভাগ করে ফেলি, ভালো আর খারাপ। মজার ব্যাপার এই ভালোটা সর্বদাই নিজের দেশের উর্দি পরে যে অটোমেটিক রাইফেল হাতে শত্রুদেশের উর্দিপরাদের বিরুদ্ধে গুলি খেতে খেতেও এগিয়ে গিয়ে শেষে বিজয়ের পতাকা তুলে সবাইকে কান্নায় ভাসিয়ে নিজে মারা যায়। কিন্তু এই সোজাসাপটা কল্পনার গতিপথের মত বাস্তব এত সরল নয়। আর তাই একটা যুদ্ধের পিছনে প্রচুর জটিল গলিপথ থাকে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না, কারণ আমজনতার পক্ষে ক্ষমতার অলিন্দের গোলোকধাঁধা বুঝতে পারা একেবারেই অসম্ভব।

১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ পর্যন্ত পাক্কা ছয় বছর একদিনের যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারল না সেই যুদ্ধের ফলে এক শ্রেণীর বৃহৎ ব্যবসায়ী ফুলে ফেঁপে বিকট আকার ধারণ করল। আর এদের অধিকাংশই সেই উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দা যারা পুরো যুদ্ধে নিজেদের গায়ে সাদা রঙের তকমা এঁটে রেখেছিল।

ঠান্ডা যুদ্ধ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হয় নি, হয়েছিল অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক অলিন্দের নীলরক্তের মানুষদের বুদ্ধি আর কার্যকলাপের দ্বারা। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের প্রথম দিন থেকেই তাকে ভেঙে ফেলার কূট ষড়যন্ত্র শুরু করার পিছনে সেই একই কারণ ছিল। উন্নত দেশগুলোর বাজারে তৈরী জিনিস বিক্রি এবং মুনাফা, যার রাস্তা সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্মধারেরা আটকে রেখেছিল। তাই বাইরে থেকে নানারকম নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সোভিয়েতের অন্দরমহলে একের পর এক ক্ষমতার কারবারীকে কিনে ফেলে ইউনিয়নকে ধ্বংসের চেষ্টা হচ্ছিল বহু শতক ধরে। ট্রটস্কি থেকে অনেকে বিফল হওয়ার পরে শেষ সুযোগ এসে গেল গোর্বাচভের হাত ধরে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আসার আগে আজকের অবস্থার আসার রাস্তায় দু একটা ঘটনার কথা বলি।

জন্মলগ্ন থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলিতে নিজেদের মধ্যে বিবাদ চলছিল। এই বিবাদের পিছনেও ছিল উন্নত দেশগুলির ইন্ধন। ভারত – পাকিস্তান বা ভারত – চীনের মধ্যে যত বেশী বিবাদ হবে উন্নত দেশগুলোর তত বেশী অস্ত্র বিক্রি হবে, তত বেশী মুনাফা হবে এটা মূল বিষয়। তাছাড়া পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার নামে আমেরিকা ও চীন হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বিক্রি করে পাকিস্তানকে প্রায় দেউলিয়া করে দিয়েছে এটা পাকিস্তানের গরীব নাগরিক জানতে পারে নি। ভারত যেহেতু নিরপেক্ষ রাজনীতির অবস্থান নিয়েছিল প্রথম থেকেই, তাই ভারতকে দমিয়ে বাণিজ্য বাড়ানোর এই চেষ্টা বহু দশক সফল হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

জন্মলগ্নের পরেই ১৯৪৯ এ পাকিস্তানের দ্বারা ভারতের জমি দখল, ১৯৬২ তে চীন – ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৫ তে ফের পাকিস্তান – ভারত যুদ্ধ এসবের পিছনে ভারতের জমি আগ্রাসনের ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে বহু ডলার ও পাউন্ডের অস্ত্র বিক্রি করতে পেরেছিল উন্নত দেশগুলো। যদিও দেখানো হয়েছিল ভারত নাকি সোভিয়েতের অনুগামী এবং পাকিস্তান বা চীন আমেরিকার। কিন্তু আসল ঘটনা হলো মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ছিল পশ্চিমী দেশগুলোরই। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের এরকম আগ্রাসন ছিল না। আর তাই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবক্তা ও নেতৃত্বে থাকা ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে নি, যতটা করেছিল উন্নত দেশগুলোর। মূলতঃ সোভিয়েত কে আটকানো ও ভাঙার প্রচেষ্টাতেই ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৪৯ এ ইউরোপের বারোটি দেশ নিয়ে আমেরিকা গঠন করেছিল NATO. এর উদ্দেশ্য বলা হয়েছিল সেই জোটের মধ্যে থাকা কোনো দেশের প্রতি আক্রমণ হলে তা প্রতিরোধ করা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল সদস্য দেশ দিয়ে অন্যের ভূমি দখল করতেও তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সেই সময়ে এই কাজের বিরোধিতা করে আমেরিকার রোষে পড়ে ভারত। কিন্তু সোভিয়েতের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বের কারণে ভারতের সরাসরি কোনো ক্ষতি করার সুযোগ পায় নি। যা পেল ১৯৭১ সালে।

পাকিস্তান তাদের অঙ্গরাজ্য তথা উপনিবেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক হামলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি নষ্ট শুরু করল ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ এবং আচমকা ভারতের পশ্চিম প্রান্তে হামলা করে বসে তারা ডিসেম্বরে। এই মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েক কোটি শরণার্থী প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে যা পাকিস্তানের অপছন্দ ছিল। তাদের উসকে দিয়ে আমেরিকা ভারত আক্রমণ করিয়ে দিল যা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল ভারত এবং মাত্র তেরদিন চলার পরে ১৬ই ডিসেম্বর পরাজিত হলো পাকিস্তান। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ হতো না। কারণ যুদ্ধ ঘোষণার পরেই পাকিস্তানের সাহায্যের জন্য আমেরিকা তথা NATO পাঠিয়ে ছিল তাদের যুদ্ধ জাহাজের সারি সপ্তম নৌবহর। সেদিন সত্যিই সেই নৌবহর এসে পৌঁছে গেলে আজ ভারত বা বাংলাদেশ নামে দুটো আলাদা দেশ থাকত না, সম্পূর্ণ একটা দেশ হয়ে যেত পাকিস্তান। এই দুর্ঘটনা থেকে সেদিন বাঁচিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমেরিকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের হুমকি দেয় সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে তারা ভারতের পিছনে আছে। এতে সাহস হারিয়ে পিছিয়ে যায় আমেরিকা। জন্ম হয় নতুন সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ।

(চলবে)

তাসমান পাড়ের গল্প

2719216

ইউরোপের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে চলুন এবার তাসমান পাড়ের গতিহীন জীবনে ঘুরে আসি। জীবন সেখানে আসলেই অচল। ছবির মত সুন্দর, হিজল তমাল দিঘীর মত শান্ত ও উঁচু উঁচু পাহাড়ের মত নিশ্চুপ ও স্থবির। ইউরোপের কোলাহলময় জীবন অনেক ব্যস্ত। ওখানে গাড়ি ঘোড়া বাস ট্রেনে চড়ে একদেশ হতে অন্য দেশে যেতে অতিরিক্ত কিছুর দরকার হয়না। চাই কেবল ইচ্ছা ও সময়। কিন্তু তাসমান পাড়ের দুই দেশে আসা যাওয়ার একটাই মাধ্যম, সাগরের উপর ভাসমান মেঘমালার বুক-চিড়ে যাওয়া। চলুন সেটাই করি।

টাইম মেশিনে চড়ে চলুন ফিরে যাই ২২ বছর আগে। ২০০০ সাল। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অলিম্পিকের জন্যে তৈরি হচ্ছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। সবার মত আমিও কাঁপছি সে উত্তেজনায়। ১৯৮০ সালে মস্কোতে যে সুযোগ মিস করেছি এ যাত্রায় তা না করতে ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

কিন্তু হায়, আমি ও আমার দোতারার দুই সুরের গান আবারও অলিম্পিক মিস করা নিশ্চিত করে দিল। সেপ্টেম্বরের শুরুতে অলিম্পিক আর আমাকে আমেরিকায় ঢুকতে হবে একই মাসের ১৫ তারিখের ভেতর। তারিখের হেরফের হলে দেশটায় আমার মাইগ্রেশন প্রসেস ইনভেলিড হয়ে যাবে।

১৯৯৯ সালের নভেম্বরের শেষদিকে কাগজপত্র চূড়ান্ত করে অপেক্ষা করছি মাত্র শুরু হওয়া অস্ট্রেলিয়া জীবনের ইতি টানার। আমার জীবনের যা কিছু ঘটে সবই ঘটে এই সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৯৫ সালের একই মাসে জীবন যুদ্ধের শেষ অধ্যায় লেখার জন্যে হাজির হয়েছিলাম এই দ্বীপে।

অচেনা দেশ। প্রাথমিক সাহায্য পাওয়ার মত কেউ ছিলনা। লাগেজ নিয়ে কোথায় উঠবো তারও কোন ঠিক ছিলনা। অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াতে যাচ্ছি সিডনি কিংসফোর্ড স্মিথ এয়ারপোর্টে পা রেখেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। তবে এ নিয়ে আমি বিশেষ যে চিন্তিত ছিলাম তা নয়।

অতীতে বহুবার এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। অপরিচিত দেশ, অজানা ভাষার মত বাধা কাটিয়ে ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেক প্রান্ত ঘুরে এসেছি। অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি সরকারী স্পন্সরে। স্কিল মাইগ্রেশনের বৈধ কাগজপত্র হাতে। তাই দ্বিধা থাকলেও ভয় ছিলনা। তাছাড়া পকেটে ছিল খরচ করার মত দুই হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড স্টালিং।

মার্টিন প্যালেসের কাছে জর্জ স্ট্রীটের উপর সস্তা এক হোটেলে উঠেছিলাম বাধ্য হয়ে। দুদিন পর ভোজবাজির মত বদলে গেল সবকিছু। আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর সন্ধান পাওয়ার একদিনের মাথায় দেশটার সোশ্যাল সিকিউরিটিতে নাম লিখিয়ে অন্তত প্রাথমিক খরচের কিছু অংক নিশ্চিত করতে সক্ষম হই। আরও একদিন পর মেডিকেয়ার/মেডিকেইডে তালিকাভুক্ত হয়ে নিশ্চিত করি চিকিৎসা পর্ব। শহরের পুবদিকে প্রথমে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে রেন্ডউইক, পরে ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলেসের পাশে কেনসিংটনে এলাকার দিনগুলো ভালই কাটছিল।

চার বছর কেটে যায় সিডনি শহরে। শহরকে নিজের শহর ও দেশকে নিজের দেশ ভাবতে শুরু করছি কেবল। দু’বছরের মাথায় নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট পাওয়ায় নিশ্চিত হয়ে যাই এই শহর এ দেশই হতে যাচ্ছে আমার শেষ ঠিকানা।

গোলমাল বাধে অন্য জায়গায়। মারুবার এনজাক পেরেডের উপর একটা ফ্লাটে থাকি। ফ্লাট-মেট হিসাবে বন্ধু পাভেল যোগ দিয়েছে কেবল। ইংল্যান্ডে এমবিএ করা পাভেল নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিতে কম্পিউটার সাইন্সে কি একটা কোর্স করতে দেশ হতে এসেছে কেবল। আমার মত অনেক ঘাটে পোড় খাওয়া পাভেলের সাথে সম্পর্কটা ফ্ল্যাট-মেট হতে বন্ধুত্বে রূপ নিতে সময় লাগেনি। দুজন দুদিকে কাজ করি। পাশাপাশি ইউনিতে দৌড়ায় পাভেল। দুজনের জীবন বয়ে চলছে অনেকটা নদীর মত।

আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে এসেছি। পাভেল এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। কোর্সের শেষদিকে এসে চিন্তাটা তাকে চেপে ধরল। দেশে ফেরার ইচ্ছা ছিলনা তার।

ক্লাস হতে ফিরে খাবার টেবিলে বসে সংবাদটা দিল। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশ আমেরিকা তার দেশে প্রতিবছরের মত এবারও ডিভি লটারি অফার করছে। পাভেল ইউনির লাইব্রেরি হতে প্রিন্ট করে এনেছে দুটো ফর্ম। একটা তার ও অন্যটা আমার জন্যে। নিজে পূরণ করে কেবল আমার সই নিয়ে নিজেই পোস্টে পাঠিয়ে দেয় ডিভি দরখাস্ত। খুব দ্রুতই ভুলে যাই এমন একটা কাজ আমরা করেছিলাম।

কোর্স শেষ করে পাভেল দেশে ফিরে যায়। আমিও মন দেই আমার কাজে। ইতিমধ্যে বেশকিছু স্বদেশীর সাথে পরিচয় হওয়ায় জীবন আরও সহজ হয়ে যায়। মাছে-ভাতের একজন বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ান হওয়ার লড়াই শুরু করি সর্বশক্তি দিয়ে।

হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস হতে একটা খাম পেয়ে অবাক হয়ে যাই। কারণ ততদিনে স্মৃতি হতে মুছে গেলে ডিভি পর্ব।
খাম খুলে হতভম্ব! আই এম আ উইনার।

আগামী পর্বে সমাপ্ত।

যুদ্ধ ৩

274572

১৯২৯ এ বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার পিছনে যে কারণগুলি ছিল তা আগে কিছুটা বলেছি। ইউরোপের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়ার জারতন্ত্রের উচ্ছেদ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ফ্লু মহামারী, একের পর এক বিপর্যয়। বস্তুত পৃথিবীর ক্ষমতার মেরু পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে আগের সুবিধা ভোগকারী দেশগুলো ক্রমশই নিজেদের বাণিজ্যিক জমি হারাচ্ছিল। এর ফলে তাদের দেশের মাথাপিছু আয় যেমন কমে যাচ্ছিল তেমনই বৃহৎ পুঁজি মালিকরা ক্রমাগত লোকসানের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছিল। ওইসব দেশগুলিতে বাণিজ্যিক বৃদ্ধির মাত্রা শূণ্যের নীচে নেমে আসছিল। ফলস্বরূপ বিশ্বজুড়ে শুরু হয়ে গেল আর্থিক মন্দা। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ দশ বছর ধরে এই ভয়াবহ মন্দায় একের পর এক বড় বাণিজ্য সংস্থা বন্ধ হয়ে গেল। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার ফলে বাড়তে থাকলো জন বিক্ষোভ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, খাদ্য সংকট, আর দেশগুলোর মাথাদের অবস্থা সামলানোর প্রয়াসে ঘন ঘন বৈঠক। কিন্তু সমাধান কিছুতেই যখন হচ্ছিল না তখনই আরেক উন্মাদ জার্মানির হিটলার ও ক্ষমতালোভী মুসোলিনি তাদের দেশের কিছু অংশের মানুষের স্বার্থে ঘোষণা করে দিল যুদ্ধের। রে রে করে উঠলো ইউরোপের এতদিনের উন্নত দেশগুলো। একে তাদের দেশের অবস্থা খারাপ, তার ওপরে হিটলারের জার্মানি তাদের অংশের বাণিজ্যিক জমি দখল করে নিলে তাদের অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে উঠবে এই আশংকায় ইউরোপের বাকি দেশ জড়িয়ে পড়ল যুদ্ধে। অবশ্য তাদের এ ছাড়া অন্য গতি ছিল না।

হিটলারের প্রবল অত্যাচারী নাৎসী বাহিনী অস্ট্রিয়া থেকে এক এক করে তাদের দেশগুলি দখল করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘ বর্ণনা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। কিছু আজকের পরিস্থিতি বোঝাতে গেলে যে সামান্য আলোচনা দরকার আমি সেটুকুই শুধু এখানে করব। প্রথমে আমেরিকা ও রাশিয়া সেই যুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল। রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত ছিল আগেই। কিন্তু সেই আগ্রাসী যুদ্ধের লোভ ছড়িয়ে গেল। জার্মানি ও ইতালির পরে অক্ষশক্তিতে যোগ দিল তুরস্ক ও জাপান। তুরস্কের যোগ দেওয়ার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের উন্নত দেশগুলির আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে আসা। আর জাপানের উদ্দেশ্য একইভাবে ব্রিটেন ও আমেরিকা অধিকৃত চীনের আগ্রাসন থেকে বেরোনো। হিটলার ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলিতে সাফল্য পাওয়ার পরে রক্তের গন্ধ পাওয়া হিংস্র জন্তুর মত আরও পাওয়ার লোভে ভুল করে বসল। সেটা হলো অনেকগুলো ওয়ার ফ্রন্ট খুলে ফেলা। একদিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অন্যদিকে আফ্রিকার দেশগুলোর উপনিবেশ দখলের উদ্দেশ্যে সেখানে যুদ্ধ শুরু। কিন্তু সবচেয়ে বিপর্যয়কারী ভুল হলো রাশিয়া আক্রমণ।

যে দুর্ভেদ্য রাশিয়াকে নেপোলিয়ন দখল করতে পারেন নি, যে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছিল, সেই রাশিয়া আক্রমণ করার হঠকারিতা করল হিটলার। অন্যদিকে তারই শরিক জাপান আমেরিকা
আক্রমণ করে আরেক ভুল করল। পৃথিবীর দুই সুপার পাওয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় একদিকে যেমন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্ব জুড়ে, অন্যদিকে হিটলারের জার্মানির অন্তিম ক্ষণের সূচনা হয়ে গেল। এখন প্রশ্ন হলো এই যুদ্ধে লাভ হলো কার?

‘This study analyzes the important increase in the rate of profit which occurred in the United States during World War II. The gap between the predepression trend line, from 1900 to 1929, and the postwar line, from 1946 to 1989, is estimated as a shift of 15.8% in absolute terms (to be compared with an average of 29.0% over the whole period). Using a production function analysis, we demonstrate that this transformation can be explained by an acceleration in the rate of “autonomous progress” between 1930 and 1945. We identify a sudden and nonneutral discontinuity in the process of technical change, characterized by an autonomous substitution of equipment for structures.’

কিছু বোঝা গেল? ১৯৩৯-১৯৪৬ গ্রেট ডিপেসন থেকে লাভজনক অবস্থায় উত্তরণ কিভাবে সম্ভব হলো? বিশেষ করে যুদ্ধের এত ক্ষয়ক্ষতি সামলে? সাধারণ্যে এত কূটকচালি পোষায় না, তাই কেউ যুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে পারে না। বিংশ শতক থেকে যুদ্ধ বাজার নিয়ন্ত্রিত এক ঘটনা মাত্র। সেটা না জেনেই মানুষ দু হাত তুলে যুদ্ধ সমর্থন করতে থাকে।

‘An additional reason for contributing to the growth of the financial base and the accelerating flow of gold as an immediate consequence of the outbreak of war in Europe was that Britain and its allies paid for war materials and other supplies that sent gold domestically. United States. These two factors led to a strong expansion of the financial base and funding.’

আশাকরি আর বিস্তৃত কিছু বলার থাকবে না। উপরের এই রিপোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই। যাইহোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়ে গেল পৃথিবীতে। পৃথিবী হলো ক্ষমতার দুই মেরু বিশিষ্ট গ্রহ। আগেকার বিভিন্ন শক্তির খেয়োখেয়ি থাকলো না। ইউরোপ তার ক্ষমতার রাজমুকুট হারালো। এবারে তাদের হতে হলো আমেরিকার অনুগামী। পাশাপাশি রাশিয়া থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে উত্তরিত বিশালতম দেশটি গড়ে তুললো আরেক স্বতন্ত্র শক্তি। তার অনুগামীর সংখ্যাও বহু। শুরু হয়ে গেল ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ঠান্ডা লড়াই।

(চলবে)

কুদালি ছড়া

ছোটবেলা আমাদের এক হাটুনদী ছিল। আমরা ‘কোদালি ছড়া’ নাম দিয়েছিলাম। আমাদের বয়স যখন দশ তখনো এই নদী আমাদের হাটু ডুবাতে পারেনি। হাটুর বয়সী নদীর জন্য অত্যাধিক দরদ ছিল। এই নদী ইয়ার কিংবা দোস্ত ছিল। তার বুকে সারাক্ষণ দাপাদাপি করতাম। এখন আমাদের বয়স পঞ্চাশের অধিক, অনেকের হাটুতে বাত এসে ভর করেছে, ব্যথায় ভাল করে হাঁটাচলা করতে পারি না। যে নদী তখন আমাদের হাটুর সমান ছিল, এখন সে প্রত্ন গবেষকদের আগ্রহের বিষয় হওয়ার কথা কিন্তু এখানে চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখন এই নদী পেরুতে গেলে আমাদের কোমর ডুবে যাবে।

আমাদের মধ্য বয়সে সে যৌবনপ্রাপ্ত হচ্ছে, এজন্য ঈর্ষা বোধ করলেও শ্লাঘা অনুভব করছি। আমরা জীবনে অনেক উচ্চে যেতে চেয়েছিলাম, গতির ঘোড়ায় চড়ে এভারেস্ট মাড়াতে চেয়েছিলাম। আমাদের খুব তাড়াহুড়া ছিল, অতি অল্প সময়ে অতি অধিক এর পিছনে আমরা ছোটাছুটি করছিলাম। তার কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, সে অতি ধীরে তার চলা অব্যাহত রাখছিল। আমরা খরগোশ গতিতে কিছু দূর গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে জানতো কচ্ছপের জয় হয়, আজ সে জয়ী হয়েছে। আমাদের খেলার সাথী পুনঃ যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে দেখে খুব ভালো লাগছে।

বিকেলে ভোরের গল্প … শেষ পর্ব

2714379

বরাবরের মতই ব্রিটেনের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। প্রথম দেখায় মনে হবে নিশ্চয় বর্ষাকাল এখন। উত্তর সাগর হতে মেঘমালা সহসাই উড়ে এসে ভিজিয়ে দেবে সবকিছু। শরীর হয়ে ধুয়ে মুছে ফেলবে লম্বা জার্নির ক্লান্তি।
এ ধরণের আবহাওয়া টিপিক্যাল ব্রিটেনের জন্যে। যতবার এ দ্বীপপুঞ্জে এসেছি ততবারই মেঘাচ্ছন্ন সকাল স্বাগত জানিয়েছে। তাই অবাক হইনি এ যাত্রায়। বিষণ্ণতায় ভরা এ সকাল যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবেনা সেটাও জানা ছিল। কারণ মেঘের ওপাশেই আধির আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে গ্রীষ্মের ঝলমলে রোদ।

দশটা বাজার সাথে ভোজবাজির মত বদলে যায় সকালের বিষণ্ণ চেহারা। কুয়াশার চাদরে মোড়া উত্তর সাগর জেগে উঠবে ঘুম হতে। বাস, ট্রেন আর ফেরী গুলো কানায় কানায় ভরে উঠে পর্যটকদের পদভারে।

ব্যস্ততা বাড়ছে ইমিগ্রেশন বুথ গুলোতে। কাঁধে ব্যাক-প্যাক আর হাতে ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এগুচ্ছে ওদিকে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ গুলোর জন্যে আলাদা একটা লাইনের ব্যবস্থা আছে। তুলনামূলক কম ভিড় থাকে ওখানটায়। যেহেতু বাংলাদেশ কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ তাই ওখানেই আমাদের লাইন ধরতে হয়।

পাসপোর্টের পাতাগুলো এদিক সেদিক করে কোন প্রশ্ন না করেই ৬ মাসের ভিজিটির ভিসা ইস্যু করে স্বাগত জানাল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে। হালকা একটা হাসি দিয়ে আমিও ধন্যবাদ জানালাম।

ইমিগ্রেশন ঝামেলা বলতে যা বুঝায় তা প্রথমবার এ দেশে প্রবেশ করার সময় সেরে নিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার এ নিয়ে আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

অতিরিক্ত কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল সে যাত্রায়। নিজের ব্রিটেন ভ্রমণকে জাস্টিফাই করতে হয়েছিল। কেন এসেছি, কোথায় থাকবো, কতদিন থাকবো এসব প্রশ্নের উত্তর সাবলীলভাবে দেয়ার পর গুনে ২ মাস ১০ দিনের ভিসা দিয়েছিল। পকেটে ১০ ডলার নগদ নিয়ে টুরিস্ট হিসাবে এ দেশে ঢোকা নিমিষেই বানচাল হয়ে যেত যদি ইমিগ্রেশন আমার ওয়ালেট পরখ করতে চাইতো।

তেমন কিছুই করেনি। আমি সোভিয়েত দেশে সরকারী স্কলারশিপে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি এবং আমার ডিগ্রীলাভ ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার চাইতেও অনেক জরুরি এটাই ছিল আমার ডিফেন্স আর্গুমেন্ট।

ইমিগ্রেশন হতে বেরিয়ে রেল ষ্টেশনে এসে ভাবনায় পরে গেলাম। এখনও অনেক সকাল। কাউকে ফোন করে ঘুম ভাঙ্গানোর সময় হয়নি। বন্ধু হাসানকে ফোন না করে লন্ডনের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আবারও ট্রেন ধরতে হবে। এ যাত্রায় ব্রিটেনের আন্তঃশহর ট্রেন। এসেক্সের হারউইচ হতে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশন।

দেড় ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। জানালার পাশে বসলে ব্রিটেনের কান্ট্রি সাইড খুব কাছ হতে দেখা যায়। ছোট ছোট উপশহর, ফসলের মাঠ, কাউবয়দের ক্যাটেল নিয়ে ব্যস্ততা, সবকিছু মগজে আটকে যায় স্থায়ী স্মৃতি হিসাবে।
সকালের লোকাল ট্রেন। বলতে গেলে খালিই ছিল যাত্রার শুরুতে। কিন্তু ঘাটে ঘাটে থামার কারণ যাত্রীদের ভিড় বাড়তে শুরু করল। এ পথেই যে অনেকে চাকরি করতে লন্ডন যায় তার আলামত সবখানে। আমার উদ্দেশ্য একই। তবে পার্থক্য হচ্ছে, চাকরি করার আগে তার সন্ধান করতে হবে।

লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে নেমে হাতের ব্যাক-প্যাকটাকে বালিশ বানিয়ে প্লাটফর্মের এক কোনায় শুয়ে পরলাম। আমার মত আরও অনেকে একইভাবে সময় কাটাচ্ছে। দশটা বাজার আগ পর্যন্ত বন্ধু হাসানকে ফোন না করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ও অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে। সকালে বিছানা ছাড়ে অনেক দেরী করে।

শুয়ে শুয়েই ফিরে গেলাম একই ষ্টেশনের এক ঘটনায়। বেশ ক’বছর আগের ঘটনা। ব্রিটেন তখন লণ্ডভণ্ড আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির হুমকিতে। যত্রতত্র বোমা ফুটছে। আকাশে বাতাসে ভয়ের রাজত্ব। রাস্তা-ঘাট, বাজার-বন্দর, ষ্টেশনগুলোতে পুলিশদের অতিরিক্ত নজরদারি। সাথে কেডাবরা ডগ। সন্দেহ হলেই পুলিশ আটকে দিচ্ছে অনেক কিছু।

প্রতিবারের মত সেবারও লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে বসে অপেক্ষা করছি বেলা গড়ানোর। দশটা বাজার সাথে সাথে হাতের ব্যাক-প্যাকটা বাইরে রেখে ঢুকে গেলাম পাশের টেলিফোন বুথে। একটা পর একটা নাম্বার ডায়াল করে চালিয়ে গেলাম চাকরি সন্ধানের কাজ। মূলত সিলেটী ভাইদের রেস্টুরেন্টের কাজই ছিল আমার মূল টার্গেট। বেশকিছুটা সময় টেলিফোন বুথে কাটিয়ে বাইরে আসতে চোখ ছানাবড়া। পুলিশ!

একগাদা পুলিশ ঘিরে রেখেছে আমার ব্যাক-প্যাক। ক্যডাবরা ডগের সাহায্য নিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। আমি কাছে আসতে চীৎকার করে আদেশ দিল যেখানে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার। আমি একেবারেই বোবা। কোথা দিয়ে কি শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। পুলিশই বা কেন আমার ব্যাক-প্যাক ঘিরে রেখেছে তার আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারলাম না।

একজন এগিয়ে এসে জানতে চাইল ব্যাগটা আমার কিনা। স্বীকার করতে আমাকে ঘিরে ফেললো। জানতে চাইলো কি আছে ব্যাগে এবং কেন আমি এক ঘণ্টার উপর একে বাইরে ফেলে রেখেছি।

সোভিয়েত দেশের টুরিস্ট আমি। ব্যাগ বাইরে রেখে ফোনে বন্ধুদের সন্ধান করছিলাম এতক্ষণ। অনেক কষ্টে বুঝানো গেল। ব্যাক-প্যাকে বিস্ফোরক কিছু নেই এমনটা নিশ্চিত হওয়ার পর আমাকে খুলে বলল ঘটনা প্রবাহ। মালিকানা না থাকায় কেউ একজন পুলিশে ফোন করেছিল। পুলিশের সন্দেহ হয়ত আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ব্যাগ ভর্তি বিস্ফোরক রেখে গেছে বড় ধরণের নাশকতার অংশ হিসাবে।
আমাকে খুবই নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সবকিছু পরিষ্কার হওয়ার পর পুলিশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। প্রস্তাব দিল আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার। ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাক-প্যাক গুটিয়ে বিদায় জানালাম লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনকে। উৎসুক জনতার অনেকে আমার দিয়ে তাকিয়ে আই এর এ’র চেহারায় দেখছিল।

ষ্টেশনের ঘড়ির কাটা ততক্ষণে ১০টায় পৌঁছে গেছে। বন্ধু হাসানকে ফোন করার সময় হয়েছে।

জানতাম ও রাগ করবে আমার হঠাৎ আগমনে। গেলবার কথা দিয়েছিলাম পশ্চিম বার্লিন নেমেই ওকে ফোন করবো এবং ও আমার জন্যে হারউইচ ষ্টেশনে অপেক্ষা করবে।

যেখানে আছি সেখান হতে এক পা না নড়ার নির্দেশ দিয়ে বন্ধু হাসান রওয়ানা দিল আমার সন্ধানে।

– শেষ।

বিকেলে ভোরের গল্প … পর্ব ১৪

271186

ট্রানজিট ভিসা নিয়ে ভ্রমণের এই এক সুবিধা; ঝামেলা যত তা ইমিগ্রেশন পুলিশেই সীমাবদ্ধ থাকে। কাস্টম পুলিশদের বিশেষ কোন মাথাব্যথা দেখা যায়না। কারণ তারা জানে সাথে যাই থাকুক তা নিয়ে বেশিদূর যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ট্রেন জার্নির ট্রানজিট অবশ্য আকাশ পথের চাইতে একটু ভিন্ন। এমন ভিসায় ট্রেন হতে নেমে যতদূর চোখ যায় ততদূরই যাওয়া যায়। আকাশ পথের মত বিশেষ একটা জায়গায় আটকে রাখেনা। রেলপথের ট্রানজিট টাইম সেনসিটিভ। আমার বেলায় তা ছিল ২৪ ঘণ্টা।

পশ্চিম জার্মান-নেদারল্যান্ড সীমান্ত পারাপারে কোনদিনও কোন ঝামেলা হয়নি। ইমিগ্রেশন পুলিশ পাসপোর্ট হাতে নিয়ে খুব দ্রুত ভিসার পৃষ্ঠায় একটা সিল মেরে স্বাগত জানায় দেশটায়। ট্রেনের স্টপেজ টাইমও থাকে খুব সীমিত। কারও ইমিগ্রেশনে সমস্যা দেখা দিলে ট্রেন আটকে রাখেনা। বরং কাছের কোন ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আসলে ট্রেনে পুলিশ না উঠলে বুঝারই উপায় থাকেনা আমরা এক দেশ হতে অন্য দেশে প্রবেশ করছি।

সীমান্ত ঝামেলা শেষ হতে বাকি রাস্তা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়ার প্লান মরলাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করেছে। এ পথে হকারদের আনাগোনা নেই যে কিছু কিনব। দিনের আলোতে মাঝে মধ্যে দেখা মিললেও রাতে ওরা আসেনা। সাথে খাবার, পানি সহ যা ছিল তা আগেই শেষ। পকেটে টাকা থাকলেও খাবার যোগার করার উপায় নেই। ফেরীতে উঠার আগে পেটে কিছু পরছে না এ ব্যপারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম।

Rotterdam পার হয়ে Hook Van Holland’এ পৌঁছতে রাত ১০টা বেজে গেল। ফেরী ছাড়তে তখনও এক ঘণ্টা দেরী। ব্যস্ত এ বন্দরে যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার এ পথটা বাকি পথ গুলোর চাইতে একটু লম্বা। বেলজিয়াম হয়ে গেলে ৬ ঘণ্টার কম সময়ে অতিক্রম করা যায় ইংলিশ চ্যানেল। কিন্তু আমার মত অনেকেই এ পথ বেছে নেয় উন্নত ফেরী সার্ভিসের কারণে।

যাত্রী ও যাত্রীদের গাড়ি পাশাপাশি দুটো লাইনে উঠছে ফেরীতে। লম্বা লাইন, কিন্তু খুব দ্রুতই এগুচ্ছে। আমার সামনে একজন ভারতীয়। বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। চোখে চোখ পড়তে মৃদু একটা হাসি দিয়ে ফিরিয়ে দিলাম তার চাউনি। এখন কথা বলার সময় না। ফেরীতে উঠে রাতের ঘুমের জন্যে ভাল একটা জায়গা খুঁজতে হবে। পেটে দিতে হবে কিছু। তারপর না হয় কথা বলা।

ফেরীতে ঘুমের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা আছে। তার জন্যে পে করতে হয়। আমার মত পকেটে ২০০/৩০০ ডলার নিয়ে যারা ভ্রমণ করে তাদের জন্যে এ লাক্সারি সাজে না। তাই ডেকেই খুঁজতে হয় রাতের আশ্রয়।

এ পথে প্রথম যাত্রায় বুঝতে পারিনি এতকিছু। রাতের খাবার আর ফেরীর উপর নীচ সব তলা আবিষ্কারের পর রাত বেশ গড়িয়ে যায়। ঘুমের আয়োজন করতে গিয়ে হতাশ হলাম। কোথাও এক ফোঁটা জায়গা নেই। এমনকি করিডোরেও ঘুমন্ত মানুষের মিছিল। শেষপর্যন্ত লাইভ ব্যান্ড শো আর কাসিনোর রুলেটের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁটাতে হয়েছিল বাকি রাত।

হঠাৎ মনে হল সবকিছুর আগে ভারতীয় যাত্রীর সাথে আলাপটা সেরে নিলে আমারই সুবিধা। অন্তত সাথে আনা লাগেজটা তার জিম্মায় রেখে খাবারের সন্ধানে যাওয়া যাবে। সাথে বোঝাটা টানতে ক্লান্তি লাগছিল। দুনিয়ার বাকি সব অর্থহীন মনে হল ক্ষুধার কাছে।

আকবর আলী। জন্ম ভারতে হলেও এসেছে পর্তুগাল হতে। ওখানকার কোন এক সমুদ্র সৈকতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। সেও একা। কারও সাথে পরিচয় হওয়াটা তার জন্যেও ছিল জরুরি।

উপর তলার ডেকে খালি কিছু স্পট পাওয়া গেল। বিছানা হিসাবে ব্যবহারের জন্যে আমার কাছে হাল্কা একটা কম্বল ও এয়ার বালিশ ছিল। আকবর আলীও আমার পাশে বিছানা পাতলো। সবকিছু তার জিম্মায় রেখে কেবল পাসপোর্ট ও মানিব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম খাবারের সন্ধানে।

রাত যত গভীর হয় ফেরীর জীবন ততই রহস্যময় হয়ে উঠে। হাই ভলিউমের লাইভ মিউজিক, রুলেট ও ব্ল্যাক জ্যাক টেবিলে সুন্দরীদের অর্ধ-নগ্ন দেহ, বারে বোতল আর গ্লাসের টুং টাং আওয়াজ বৈচিত্র্য এনে দেয় রাতের জার্নিতে।

পতিতাদের আনাগোনাও চোখ পরার মত। ওরা কেবিন ভাড়া নিয়ে খদ্দের টানে। ফাঁদ পাতে বার ও কাসিনোতে। স্পেন ও ইতালি হতে আসা অনেক কিশোরীও অতিরিক্ত কিছু আয়ের জন্যে শরীর বিক্রি করে। ওদের কেবিন থাকেনা। নির্জন কোন জায়গা পেয়ে ওখানেই মিলিত হয়।

এ এক বিস্ময়কর অনুভূতি। প্রথম প্রথম খুব অবাক হতাম। কিন্তু অনেকের সাথে মেশা ও আলাপের পর উপসংহারে আসতে বাধ্য হয়েছি, মেয়েদের অনেকের কাছে শরীর আসলে জাস্ট একটা অঙ্গ। হাত পা, চোখ মুখ ব্যবহারের মত শরীরে সে সব অঙ্গও ব্যবহার করে শারীরিক অথবা পকেটের চাহিদা মেটাতে। এ নিয়ে কারও কোন আক্ষেপ নেই। ওদের অনেকের ভাষ্য, শরীর থাকলে তার চাহিদাও থাকবে। সে চাহিদা মেটাতে পুরুষের মত অনেক মেয়েও সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়।

ফেরীতে কেবল পতিতারাই আয়ের জন্যে শরীর বিক্রি করে তা নয়। অনেক মহিলাও one night stand’এর বৈচিত্র্য কাছ হতে উপভোগের জন্যে পুরুষদের বিছানায় নেয়। কাসিনো অথবা বারে বসলে এসবের আলামত অনুধাবন করতে সময় লাগেনা।

অনেক রাত পর্যন্ত সহযাত্রী আকবর আলীর সাথে আলাপ হল। ভারতের গুজরাটে জন্ম হলেও জীবনের অনেকটা সময় ইউরোপে কাটিয়েছেন। চাকরি পর্ব সেরে এখন নিজে ব্যবসা করছেন। বিয়ে করেছেন পর্তুগীজ এক মহিলাকে। ব্যবসা বাড়াতে চাইছেন, কিন্তু লোকবল পাচ্ছেন না। লন্ডন যাত্রার এটাই অন্যতম কারণ। পরিচিত অনেকে আছে ওখানে। এবং তাদের মাধ্যমে সন্ধান করবেন নতুন রেস্টুরেন্টের জন্যে সেফ, ওয়েটার সহ আরও অনেককে।

লন্ডন যাত্রার আমার হেতু জানতে চাইলেন আগ্রহ নিয়ে। খুলে বললাম আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ওখানে কাজ করতে পর্তুগাল যাওয়ার কোন উইন্ডো ছিলনা। ভদ্রলোক খুব করে অনুরোধ করলেন ছুটি কাটাতেও যেন ওনার কাছে যাই। হাতে একটা বিজনেস কার্ড ধরিয়ে নিজের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দিলেন।

সে রাতে আর ঘুম আসেনি। জীবনের অনেক হিসাব সেলুলয়েডের ফিতার মত মগজে কড়া নাড়ছিল। পকেটে ১০ ডলার নিয়ে এ পথে প্রথম জার্নি। কোন এক জার্নিতে নর্থ সী’র উত্তাল ঢেউ, সাথে ফেরীর নিয়ন্ত্রনহীন উদ্দামতা, মানিব্যাগ হারিয়ে খুঁজে পাওয়া, গায়ানীজ ভারতীয় এক যুবতীর সাথে কিছু অন্তরঙ্গ সময়… মনে করার মত অনেক কিছুই ছিল।

সবকিছু ছাপিয়ে কিছু কষ্ট বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, এটাই আমার শেষ যাওয়া। আর কোনদিন আসা হবেনা। লাইভ ব্যান্ডের পর্দা ফাটানো মিউজিক, কাসিনোর রুলেট টেবিলে হঠাৎ জেতা জুয়ারির বাঁধভাঙ্গা উল্লাস, ডেকের চোরাগলিতে পতিতাদের ইশারা…অনেক কিছুই মিস করবো। মিস করবো এসব বাধাহীন সহজ জীবন।

শেষরাতের দিকে কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি।

আগামী পর্বে সমাপ্য…

দেবী

27436

”নিত্য তোমাকে চিত্ত ভরিয়া স্মরণ করি
বিশ্ব বিহীন বিজনে বসিয়া বরণ করি –
তুমি আছো মোর হৃদয় মন হরণ করি।”

তোমার হৃদয়ের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে মনের বিস্তৃত আঙ্গিনা পেরিয়ে ভালবাসার স্রোতে বিবর্তনের ধারায় বিবর্তিত হয়ে তরী ভিড়িয়েছি তোমার কুলে। শূন্য তরী ভরিয়ে দিলে ভালবাসায় কানায় কানায়, কোন কিছু দাবী না করতেই উজাড় করে দিলে দু’হাত ভরে। ঋণী হবার সুযোগ না দিয়ে চির জীবনের জন্য ঋণী করলে হৃদয়ের বন্ধনে মনো মন্দিরে। মোমের আলোয় আলোকিত করে তুললে অবেলায়। ভোরের আলোয় আলোকিত করছো এখনও আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষণ। ভালবাসায় বন্ধুত্বে অদৃশ্যে পাশাপাশি অবস্থান করছো সযত্নে। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ ভালবাসা ও বন্ধুত্বের কাঙাল। প্রতিটি মানুষই বন্ধুত্ব চায়। দুটি মানুষের মধ্যে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করার অকৃত্রিম সম্পর্কের নাম ভালবাসা ও বন্ধুত্ব। যে মানুষটাকে ভালোবাসি, তাকে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে। আমাদের ভালোবাসা যদি হয় কেবল কাউকে দখল করে রাখার কোন চাওয়া, তাহলে তা ভালোবাসা নয়। আমরা যদি শুধু আমাদেরকে নিয়ে চিন্তা করি, শুধু আমাদের প্রয়োজনগুলোই বুঝি এবং অন্যদের প্রয়োজনকে এড়িয়ে যাই, তাহলে আমরা কখনই ভালোবাসতে পারবো না। যাদের ভালোবাসি তাদের প্রয়োজন, চাওয়া, ভালোলাগা এবং কষ্টগুলো আমাদেরকে অবশ্যই গভীরভাবে খেয়াল করতে হবে এটাই প্রকৃত ভালোবাসার পথ। আমরা যখন কাউকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারব, তখন তাকে ক্রমাগত ভালোবেসে যাওয়া থেকে নিজেকে ঠেকাতে পারব না। আমাদের জীবন জীবনের মতই সুন্দর, এই সৌন্দর্যকে অন্য কিছুর সাথে তুলনা করা অর্থহীন কারণ যার সাথে তুলনা করা হয় তা কখনই জীবনের মত বৈচিত্র্যময় নয়। এই বৈচিত্রময়তার জন্যই জীবন মূল্যবান যার জন্য বেঁচে থাকতে ভালো লাগে, অর্থহীন মনে হয় হাজারটা প্রত্যাদেশ।

তারপরও ……
“মাঝে মাঝে হৃদয় জগতে উত্থান-পতন শুরু হয়
পেয়ে হারানোর বেদনার হাহাকারে।
সাধ জাগে ভালোবেসে আবার নতুন করে জীবনটাকে ভরিয়ে তোলার।
কৈশোরের সেই অনুভূতি আবার জাগিয়ে তোলে অবেলায়।
হৃদয় আপ্লুত হয় নতুন ভালবাসার আহ্বানে;
তারপরও সমাজ সংসারের ভয়ে থাকে আত্মগোপনে।
সময়ের মর্মমূলে বিরূপতা যে রক্তাক্ত ছাপ ফেলেছে
তা আজও অন্তর্গত বেদনাকে ধারণ করে আছে হৃদয়ের গভীরে।
তার অদৃশ্য স্পর্শ, নবসৃষ্ট স্মৃতির ঘ্রাণ স্মৃতিকাতর করে তুলে নির্জন প্রবাসে।

স্মৃতিলোকে বার বার ফিরে আসে তার ছবির মায়াবী চোখের করুণ চাহনি।
যৌবনের প্রণয়িনী জ্যোতি এখনও ভাসে তার চোখের তারায়।
যে কিনা আমার সব উপেক্ষা অগ্রাহ্য করেও সর্বস্ব দিয়েছে।
শাড়ির আঁচল উড়িয়ে বাহুডোরে আবদ্ধ হতে –
স্মৃতির বীণায় আজও সুর তোলে ঝঙ্কারের অপেক্ষায়।
নস্টালজিক অনুভূতির অপরিহার্য মানবিক মূল্যবোধের খোঁজে।
ভোতা অনুভূতিগুলোর পুনঃ পুনঃ রোমন্থন করার প্রয়োজনে” নিজকে বিলায় স্বযতনে।

=======
লেখকঃ কাতার প্রবাসী।

বিকেলে ভোরের গল্প … পর্ব ১৩

271204

ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে হ্যানোভারের আকাশ। শহরের বাতিগুলো জানান দিচ্ছে রাত নামছে পৃথিবীর এ প্রান্তে। গ্রীষ্মের রাত এদিকটায় এমনিতেই ছোট। নৈশ জীবনের সবটুকু নিংড়ে নিতে ভিড় জমছে শুঁড়িখানায়, ডিস্কো সহ বিনোদনের সবকটা ভেনুতে। ট্রেনের জানালায় বসে এসব দৃশ্যও চোখ এড়ায় না।

প্ল্যাটফর্মের মাইক্রোফোনে Hook Van Holland গামী ট্রেনের ডিপার্টাচার ঘোষণা আসতে ভাল করে দেখে নিলাম সহযাত্রীদের। অনেকটা সময় কাটাতে হবে ওদের সাথে। অস্বাভাবিক আচরণের কেউ থাকলে গোটা জার্নিটা হতে পারে নরক যাত্রার অভিজ্ঞতা।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাত্রীদের চেহারায় তেমন কারও ছায়া পাওয়া গেলনা। সবাই মালামাল গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে নিজেদের গন্তব্যের জন্যে।
সহযাত্রীদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সংক্ষিপ্ত দূরত্বের যাত্রীরা দিনের আলোতেই নিজেদের ভ্রমণ সেরে নেয়। কেবল আমার মত যারা শহরের পর শহর, দেশের পর দেশ পাড়ি দিয়ে অন্য এক দেশে পাড়ি জমায় তারাই চেপে বসে রাতের ট্রেনে।

দুটো সীট পরেই মাত্র পরিচয় হওয়া দুই তরুণীকে দেখলাম নিজেদের ব্যাক-প্যাক হতে বালিশ বের করে তৈরি হচ্ছে লম্বা জার্নির। সময় গড়ানোর সাথে দুই জনের পরিচয় আবিষ্কার করতে অসুবিধা হলোনা। ওরা সমকামী। একজনের চুল পুরুষদের মত ছোট করে কাটা। শরীর যতটুকু দেখা যায় তার সবটা ঢেকে আছে উল্কিতে। বাকি-জনও পিছিয়ে নেই। পোশাকের ব্যপারে দুজনের কারোই কোন রাখঢাক নেই। হিসাব করলে দেখা যাবে শরীরের ৭০ ভাগেই কোন পোশাক নেই। নিজেদের যৌন আচরণ বাইরে আনার জন্যে এতক্ষণ মুখিয়ে ছিল। ট্রেন ছাড়তেই একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল নিজেদের ভালবাসা সামনে আনতে।

চাইলেও এসব উপেক্ষা করা যায়না। বিশেষকরে আমার মত যারা পূর্ব ইউরোপের রক্ষণশীল সমাজ হতে এদিকটায় আসে। পৃথিবীর সব দেশে সবকালে সমকামীরা ছিল। শতাব্দীর শুরুতে নিজেদের পরিচয় গোপন করায় সামাজিক বাধ্য বাধকতা থাকলেও পৃথিবী এখন অনেক উন্মুক্ত। এসবের অস্তিত্ব এখন আমাদের চারদিকে।

অন্ধকারের চাদরে ঢেকে গেছে বাইরের পৃথিবী। সাথে হাল্কা কুয়াশা। চলমান বাতিগুলো ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনা ভেতর হতে। সাথে দু’তিনটা বই এনেছিলাম রাস্তায় পড়ব বলে। দস্তায়েভস্কির ‘преступление и наказание (ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট)’ বইটা আগেও পড়েছি। রুশ ভাষায় প্রথমবার পড়ার পর সেই যে প্রেমে পড়েছি আজও তা শেষ হয়নি। সময় কাটানোর হাতিয়ার হিসাবে বইটাকে মাঝে মধ্যে ব্যবহার করি।

পড়ার মত যথেষ্ট আলো ছিলনা ট্রেনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠিয়ে রাখতে বাধ্য হলাম। খিদা লাগতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। ব্যাগে খাবার যা অবশিষ্ট ছিল তা খেয়ে আবারও বাইরের দিকে চোখ ফেরালাম। হঠাৎ মনে হল ট্রেনের গতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সামনে থামার মত ষ্টেশন না থাকলে গতি বেড়ে যায়, ব্যপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি। সামনের সীটে কেউ না থাকায় পা উঠিয়ে আরাম করে বসে বসার সিদ্ধান্ত নিলাম। হঠাৎ মনে হল ঘুম আসছে আমার।

…… শতাধিক যাত্রীর অনেকে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকছে অনেকে। সহযাত্রীদের ঘুমের তোয়াক্কা না করে অনেকে কথা বলছে উঁচু স্বরে। দল বেঁধে কেউ কেউ তাস খেলছে। অনেকে নাকে নস্যি নিচ্ছে একটু পরপর। ফেরিওয়ালারা পণ্যের পসার সাজিয়ে দলে দলে হাঁক দিচ্ছে।

…… সাপের মত একে-বেঁকে এগিয়ে চলছে ট্রেন। থর থর করে কাঁপছে সবকিছু। ঘুমাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আগে কখনও মোকাবেলা করেছি মনে করতে পারলাম না। হাতের ব্যাগটা সীটের ডাণ্ডার সাথে তালা চেইন দিয়ে আটকেও নিশ্চিত হতে পারছিনা নিরাপত্তার। হাওড়া ষ্টেশনে এক ফেরিওয়ালা বাধ্য করেছিল এসব কিনতে। এ পথে জার্নি করতে গেলে এসব নাকি বাধ্যতামূলক। কোলকাতা হতে ওড়িশার পূরী যাচ্ছি। লম্বা অন্তহীন পথ। বরাবরের মত আমি একা। কথা বলার কেউ নেই। …শোয়ার ভান করে উপরের দিকে তাকিয়ে ট্রেনের ঝং ধরা ছাদ দেখছি কেবল। দেখছি আর প্রহর গুনছি কবে শেষ হবে এ নরক যাত্রা।

ব্রেকের কড় কড়া আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। স্বপ্ন দেখছিলাম আমি।

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভেতরে যাত্রীদের প্রায় সবাই ঘুমাচ্ছে। বগির মূল বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছে কেউ। কিছুটা চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল যাত্রীদের মাঝে। বাইরে ইমিগ্রেশন পুলিশদের আনাগোনা জানান দিল সীমান্ত অতিক্রম করতে যাচ্ছি আমরা। এ যাত্রায় পশ্চিম জার্মানি হতে নেদারল্যান্ড। পকেটে হাত দিয়ে আবারও পাসপোর্টের অস্বিত্বটা পরখ করে নিলাম।

চলবে।

টিনএজঃ চক্ষুর অন্তরালে নিঃশেষিত জীবন

টিনএজঃ চক্ষুর অন্তরালে নিঃশেষিত জীবন
FB_IMG_1645119692485

টিনএজ কীঃ
ইংরেজি থার্টিন থেকে নাইন্টিন অর্থাৎ তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের টিনএজার বা বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। যদিও টিনএজারদের কিছু বিষয় থাকে যা আরও দু চার বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। এই তেরো থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের। বিশেষ করে একটি ছেলের জন্য।

টিনএজের চরিত্রঃ
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার ছুটি গল্পে টিনএজারদের ব্যাপারে বলেছিলেন “তেরো চৌদ্দ বয়সের ছেলের বালাই আর নাই”। অর্থাৎ এই বয়সটি এতোই দুরন্ত উদ্দীপক উশৃঙ্খল যে তাদের চরিত্রের নির্দিষ্ট কোনো ছবি আঁকা যায়না। এই বয়সে কখন কার কেন মন খারাপ হবে কেউ জানেনা। কার কখন কী ভালো লাগে সেটা সে নিজেও ভাবতে পারেনা। এই সময়টাতে প্রতিটি ছেলে তাদের শারীরিক এবং মানসিক নিত্যনতুন পরিবর্তন লক্ষ্য করে। সেসব পরিবর্তনের কথা সে কাউকে না বলতে পারে, না কেউ বুঝতে চেষ্টা করে। যার ফলে ছেলেরা যথেষ্ট সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।

সঠিক পরামর্শ এবং সিদ্ধান্তের কারণে এই বয়সের সিংহভাগ ছেলে ভুল পথে পরিচালিত হয়ে যায়। কেননা তারা তাদের প্রয়োজন সঠিকভাবে সবার কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এই চঞ্চল উদ্যমী বাঁধনহারা সময়টা হচ্ছে বয়ঃসন্ধীকাল। এটা হচ্ছে চরম অস্থির একটি সময়। এই সময়ের ছেলেদের মানসিক অবস্থা কেউ বুঝতে পারে না।

বয়ঃসন্ধিকালের যে দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে একটি ছেলের জৈবিক চরিত্র। এই জৈবিকতা একটি ছেলেকে হয় ধ্বংস করে দেয় নয়তো পারিপার্শ্বিক সাপোর্ট পেয়ে নিজেকে সুদৃঢ় রাখে। কেননা এই বয়সটা হচ্ছে খুবই স্পর্শকাতর বিশেষকরে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। এই বয়সে জৈবিক চাহিদার যে ঝড়ের সূচনা হয় তা নিজের অনুকূলে নিতে অধিকাংশ ছেলেই ব্যর্থ হয়। তাই এই বয়সের চরিত্র বলতে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে জৈবিক চাহিদার নিয়ন্ত্রণের চরিত্র।

টিনএজ কীভাবে পথহারাঃ
এই বয়সটি যেকোনো ছেলেদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। এই ছেলেরা কখনোই নিজের প্রয়োজন কাউকে সঠিকভাবে বোঝাতে সমর্থ হয়না। একটি বালাক হঠাৎ করেই যখন পুরুষালি চরিত্রে চলে আসে তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার আশেপাশের লোকজন তাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। তার আশেপাশের লোকজন তাকে বয়স্ক কাতারে ফেলে দেয় আর নিজে চিন্তা করে সেতো এখনো ছোট! পরিবেশ মনে করছে ছেলেটি বড় হয়ে গেছে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না কীভাবে সে বড় হয়ে গেলো। এই দ্বিমুখী সংঘর্ষের কারণে ছেলেটির মানসিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। এই অবনতির ধারা অব্যাহত হলে ছেলেটি পথ হারিয়ে ফেলে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে এই বয়সের পথহারা হওয়ার।

ক) বন্ধুমহলঃ
বয়ঃসন্ধির এই চরম মর্মান্তিক অবস্থায় তার পাশে দাঁড়ায় তার বন্ধুরা। সে বড়দের চরিত্রে ঢুকার সাথে সাথে শারীরিক যে কৌতূহল গুলো চোখে পড়ে, তা বিস্তারিত জানার একমাত্র উৎস হয়ে উঠে তার চেয়ে দু চার বছরের বড় বন্ধুমহল। যারা ইতিমধ্যে এই পর্বটি পার করেছে বা করছে। যেহেতু এই বয়সটি হলো চরম কৌতূহলী আকাঙ্ক্ষার সময়। প্রতিটি বিষয়ই এখন তার কাছে নতুন। যা দেখে যা করছে তার কাছে সবই নতুন। খুব কম সংখ্যক ছেলেরা এই শারিরীক সাংঘর্ষিক মনস্তাত্বিক সময়টাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যার ফলে যারা কৌতূহলী তারা বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত জৈবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নতুন শারিরীক যে পরিবর্তন তারা অনুভব করে, তার স্বাদ আস্বাদন করতে গিয়ে নিজেদের উপর অনৈতিক জৈবিক চর্চায় জড়িত হয়ে যায়। যা তাদের শারিরীক এবং মানসিক একটি বিরাট ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়।

খ) সহজ পর্নোগ্রাফীঃ
বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের ধ্বংসের মূল কারণ হচ্ছে সহজ পর্নোগ্রাফী। যেহেতু এই বয়সের ছেলেদের শারীরিক সঠিক জ্ঞান থাকে না। যার ফলে বন্ধুদের খপ্পরে পরে তারা প্রথম পর্নোগ্রাফীতে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে সমাজ এবং রাষ্ট্রের বদৌলতে সহজ পর্নোগ্রাফীতে তারা জড়িয়ে পড়ে। বর্তমান সহজলভ্য তথ্যপ্রযুক্তির কারণে টিনএজারদের এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।

গ) নিষিদ্ধ কৌতূহলঃ
মানবিক গুণাবলীর একটি একটি গুণ হচ্ছে সহজাত কৌতূহল। এই বয়সে নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি অতিমাত্রায় কৌতূহল কাজ করে। যেকারণে বড়রা যা করতে নিষেধ করে তার প্রতি তাদের কৌতূহল কাজ করে। নারীপুরুষের গোপন বিষয় গুলো নিয়ে এই বয়সে তুমুল আগ্রহ জন্ম নেয়। এই আগ্রহ থেকেই কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। সেই কৌতূহল নিবারণ করতে গিয়ে তারা ভয়ংকর এক ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। যে ফাঁদ থেকে সহজে তারা বেরিয়ে আসতে পারেনা।

ঘ) পারিবারিক ছিন্ন বন্ধনঃ
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামাজিক শিক্ষিত লোক খুবই কম। পরিবার গুলোতে জীবন এবং জীবিকাই প্রাধান্য পায় বেশী। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাথা ঘানোর মতো সময় এখানে থাকে না। তাই বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে কোনো ছেলেই সঠিক স্নেহ ভালোবাসা পায় না। যেকারণে এই উন্মাদনার উদ্দাম সময়গুলোতে ছেলেরা পরিবার থেকে দূরে সরে যায় ধীরে ধীরে। পারিবারিক এই দূরত্ব একটি ছেলেকে তার পরিবার থেকে তাকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। যে দূরত্ব আর কখনোই হয়তো ঠিক হয় না।

পারিবারিক ভালোবাসা সহমর্মিতার অভাবে একটি ছেলে খারাপ পরিবেশে জড়িয়ে পড়ে। তার কাছে সুন্দর সম্পর্কের আর কোনো মূল্য থাকে না। নিষিদ্ধ জৈবিক আকৃষ্টতা তার মানবিক বোধ শক্তিকে নষ্ট করে ফেলে। সে উদ্দাম উত্তাল সময়ে ভুলে যায় সামাজিক সম্পর্ক গুলোর কথা। এই নিষিদ্ধ আকৃষ্টতা তাকে টেনে নিয়ে যায় পৈশাচিক জৈবিক তাড়নার দিকে। এবং এক সময় সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সমাজে নানান জায়গায় অপকর্মে পারদর্শী হয়ে উঠে। তাই পারিবারিক সুন্দর সামাজিক বন্ধন এই বয়সের ছেলেদের খুবই প্রয়োজন।

ঙ) সহজলভ্য পতিতাবৃত্তিঃ
সামাজিক বিভিন্ন কারণে নারীদের একটি শ্রেণী পতিতায় পরিনত হয়। জীবিকার জন্য তারা সস্তা পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। এই সস্তা পতিতাবৃত্তির কারণে বয়ঃসন্ধি ছেলেদের একটি বড় অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। যারা এই ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়ে যায় তারা সহজে সেই পথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।

চ) ধর্মীয় অনুশাসন না থাকাঃ
একটি ছেলে জৈবিক তাড়নায় ধ্বংসের মূলে রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনহীন জীবন যাপন। যে পরিবার ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা করে সেই পরিবারের ছেলেরা সহজে এইসব অশ্লীল বিষয় মেনে নেয় না। তারা গোপন বিষয় গোপনে রাখতে শিক্ষা পায়। যার কারণে ধার্মিক পরিবারের সন্তানেরা নিজেদেরকে পাপ থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট হয়। কেননা তারা ছোট থেকেই একটি সুন্দর ধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় বড় হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে অশ্লীলতা কম কাজ করে। যে পরিবারে সঠিক ইসলামী অনুশাসনের চর্চা হয় সেইসব পরিবারের ছেলেরা এইসব কর্মকাণ্ডকে পাপ মনে করে দূরে থাকার চেষ্টা করে। তাই যে পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন নেই সেইসব পরিবারের সদস্যরা এই বয়সে অনৈতিক কাজে বেশী জড়িয়ে পড়ে।

ছ) রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যঃ
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যের কারণে বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের বিভিন্ন অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকার কারণে তাদের মধ্যে বেপরোয়া ভাব কাজ করে। এই বেপরোয়া ভাবের কারণে তারা বাঁধাহীনভাবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে জড়িয়ে পড়ে। এই খারাপ সময়টিতে তারা অশ্লীলতার চরম শিখরে পৌঁছে যায়। যেহেতু পরিবার থেকে বন্ধনহীন এবং সামাজিক ভাবে শক্তি প্রাপ্ত, সেহেতু তারা নিষিদ্ধ জগতে নিঃসংকোচে দাপিয়ে বেড়ায়। এই নষ্ট জীবনযাপন তাদের এক ধ্বংসাত্মক জীবনের মুখোমুখী করে দেয়। যা তারা পরবর্তী জীবনে অনুধাবন করতে পারে।

জ) গুরুত্বহীন জৈবিকতাঃ
আমাদের সমাজে ছেলেরা বালেগ হলে যে, তাদের ভিতরে একটি জৈবিক চাহিদা কাজ করে সেটা সমাজ এবং পরিবার উপেক্ষা করে। সমাজ এবং পরিবার কখনোই এইসব বুঝতে চেষ্টা করে না। তাদের অজ্ঞতার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয় আমাদের দেশে। অথচ এই জৈবিক চাহিদা আর দশটি মানবিক চাহিদার মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি মানুষ প্রচন্ড রোদে হেটে গেলে যেমন পানির জন্য তৃষ্ণার্ত হয়। ঠিক তেমনি যৌবনের প্রথম দিকে ছেলেদের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। যা তাদের গোপন দরজার পাশে নয়তো ভাঙা বাড়ির অন্দরে নিজের নিকৃষ্ট যৌনাচারে লিপ্ত করে। সুতরাং এই জৈবিক চাহিদার কথা আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়।

পরিবারের করণীয়ঃ
একটি ছেলের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সেটি হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুন্দর একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধন সবচেয়ে বেশী কাজ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে খুব কম পরিবারই এমন পাওয়া যায় যারা তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারে। আমাদের সামাজিক কিছু সীমাবদ্ধতা এখনো রয়েছে। এখানে সন্তানের সাথে গোপন বিষয় গুলো খোলামেলা আলোচনা হয় না। এই সময়টিতে একটি মেয়ে পরিবারের অন্য মেয়ে সদস্য থেকে কিছু না কিছু সাপোর্ট পেয়ে থাকে। কিন্তু সেই জায়গায় একটি ছেলে কখনোই সেই সাপোর্টটি পায় না। হতে পারে ধর্মীয় গোঁড়ামি অথবা অজ্ঞতা। তাই পরিবারের বিভিন্ন করণীয় রয়েছে ছেলেদের এই ধ্বংসাত্মক জীবন থেকে রক্ষা করার জন্য।

ক) বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কঃ
পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি ছেলেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। একটি ছেলে যখন নিষিদ্ধ বিষয় গুলো সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পায়, তখন সে তার কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। যখন তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে কী ভালো আর কী খারাপ তখন সে নিজে নিজেই ভালো থাকতে চেষ্টা করবে যতটুকু পারা যায়। তাই সবসময়ের মতো প্রতিটি পরিবারকে আগে এগিয়ে আসতে হবে এইসব ছেলেদের রক্ষা করতে। যখন একটি ছেলেকে বুঝানো হবে কী করলে কী ক্ষতি হতে পারে এবং কখন কী করার সঠিক সময়। তখন এইসব বিষয়ে অজ্ঞ ছেলেরা সঠিক বিষয় গুলো বুঝার চেষ্টা করবে। তাই পরিবারের উচিত তাদের বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে তাদের বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপন করে সমাধান দেওয়া।

খ) ধর্মীয় চর্চাঃ
প্রতিটি পরিবারের উচিত সঠিক ধর্মীয় চর্চা গুলো নিয়মিত করা। প্রতিটি সন্তানকে সঠিক নৈতিক জ্ঞান দেওয়া। সেই সাথে ধর্মীয় বিষয় গুলো সামনে এনে অশ্লীল পাপাচার থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা।

গ) সঠিক নজরদারিঃ
এই বয়সের ছেলেদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করলে ফলাফল খুবই খারাপ হয়। তাই পরিবারের উচিত সন্তানের প্রতি সঠিক নজরদারি। ছেলে কখন কোথায় যায়। কার কার সাথে মেলামেশা করছে। যাদের সাথে মিশছে তাদের পারিবারিক চরিত্র এবং ইতিহাস জানা জরুরী। যদি কোন খারাপ পরিবেশ বা বন্ধুর সংস্পর্শে চলে আসে তবে তাকে সাথে সাথে সাবধান করে দিতে হবে। তাও জোরপূর্বক নয়। সুন্দর এবং চমৎকার উপস্থাপনার মাধ্যমে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, সে যার সাথে মিশছে সে কেন খারাপ। তার সাথে মেশার ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে ভবিষ্যতে। যদি পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাদের সাথে মিশে তাহলে ভবিষ্যতে সে কী কী সুবিধাবঞ্চিত হবে সে ব্যাপারে সঠিক ধারণা দেওয়া। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তার সামনে তুলে ধরতে হবে।

বর্তমান সময়ে ছেলেরা অনেক এগিয়ে আছে। এই বয়স সম্পর্কিত তাদের বিভিন্ন বই পড়তে দেওয়া যেতে পারে। এই বয়সের ক্ষতিকর দিক গুলো তুলে ধরে বিভিন্ন ডকুমেন্টারী দেখানো যেতে পারে। সেই সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হবে। কখনোই তাদের একাকীত্বে থাকতে দেওয়া যাবে না। এই বয়সের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নারী ঘটিত সমস্যা।

বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের প্রথম চার পাঁচ বছরে ছেলেরা প্রচন্ড রকম আবেগী হয়। এই সময়টিতে তাদেরকে সঠিক পরিচর্যা করা না গেলে অনেক সময় ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। আমাদের দেশে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেমের হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। যা পরিবারের অজান্তে বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। পরে পরিবারের হস্তক্ষেপেও এইসব সম্পর্ক টিকিয়েও রাখা যায় না। কেননা চরম উত্তেজনার সময়ে তারা যে ভুল করে। কিছুদিন যাওয়ার পর তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তাই পরিবারের উচিত হবে তাদের সাথে সবসময় সার্বিক যোগাযোগ রাখা।

ঘ) কঠোর না হওয়াঃ
বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের সাথে কখনোই কঠোর আচরণ করা যাবেনা। প্রতিটি পরিবারের উচিত এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখা। অধিকাংশ ছেলেই বয়ঃসন্ধির মানসিক চাপ নিতে পারে না। কোনো ভুলের কারণে যদি ছেলেদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হিতে বিপরীত হয়। হঠাৎ কোনো শারিরীক ও মানসিক আঘাত পেলে ছেলেরা তা আজীবন মনে পুষিয়ে রাখে। পরিবারের যে সদস্য দ্বারা সে হেনস্তা হয় তাকে সে জীবনের তরে ভালো চোখে দেখে না। যারফলে একটি সুন্দর সম্পর্কের মৃত্যুর হয়। বয়ঃসন্ধিকালীন আঘাত ছেলেদের বিপথে যেতে ত্বরান্বিত করে। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে কখনোই ছেলেদের সাথে কঠোর হওয়া যাবেনা। সুন্দর সুদীপ্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাকে এটা বোঝাতে হবে যে আপনি তার ভবিষ্যৎ ভালোর জন্যই পরামর্শ দিচ্ছেন। আপনি যে তার হিতাকাঙ্ক্ষী সেটা তাকে বুঝতে দিতে হবে।

ঙ) সঠিক সময়ে বিয়েঃ
আমাদের দেশে সঠিক সময়ে ছেলেদের বিয়ে দেওয়া হয়না। যার কারণে ছেলেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে খারাপ পথে জৈবিক প্রয়োজন মিটায়। সেটা হতে পারে নিজের শরীরের উপর অত্যাচার করে। অথবা অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক করে। তাই প্রতিটি পরিবারের উচিত ছেলেদের খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনে বিয়ে দিয়ে তাদের সঠিক পথে আনা।

চ) অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি রোধঃ
বর্তমান সময়ের ছেলেরা যে উৎস থেকে সবচাইতে বেশী ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে, তা হচ্ছে অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি। আমাদের বর্তমান পিতামাতারা ছেলেদের ১৩ /১৪ বছর হওয়ার আগেই হাতে হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিচ্ছেন। এই বাধা সর্বোচ্চ এসএসসি পর্যন্ত। প্রতিটি ছেলে কলেজে যাওয়ার সাথে সাথে মোবাইল পেয়ে যাচ্ছে। আর বাবা মায়েরাও ছেলেদের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়ে যান মোবাইল দেওয়ার। কিন্তু এটা খুবই মারাত্মক একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই মোবাইল প্রতিটি ছেলের চরম উন্মাদনার যৌবন জ্বালার দাহ্য বস্তুর মতো। ছেলেদের এই অস্থির মুহূর্তে মোবাইলটি জ্বলন্ত উনুনে কেরোসিনের মতো। যা তাদের জ্বলে পুড়ে শেষ করার জন্য যথেষ্ট। এই মোবাইলের দ্বারা আজ আমাদের সমাজে অপকর্মের ছাড়াছাড়ি। সহজ ইন্টারনেটের কারণে ঘরে দরজা বন্ধ করেই ছেলেরা ডুব দেই নষ্ট দুনিয়ার নীল পর্নোগ্রাফীতে। কোনো মা বাবাই জানতে পারে না তাদের সোনার টুকরো ছেলের তারা কী ক্ষতি করে ফেলেছে। তাই ভার্সিটির আগে কখনোই ছেলেদের এনড্রয়েড ফোন দেওয়া যাবে না। যদি দিতেই হয় তবে স্কুল জীবনে নয়। আর তখনই দিতে পারবেন যখন আপনি নিজেই এই মোবাইলে পারদর্শী হবেন। কেননা আপনাকে অবশ্যই তার উপর নজরদারি রাখতে হবে। কেননা ছেলেকে নজরদারিতে না রাখলে ভবিষ্যতে আপনারই ক্ষতি।

সমাজের করণীয়ঃ
এই বয়সের ছেলেরা সবচেয়ে বেশী যে সাপোর্ট বর্তমানে পাচ্ছে সেটা হচ্ছে সমাজ। সমাজের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে এইসব ছেলেরা দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের কিশোর সমাজকে সঠিক পথে টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজের বিশেষ ভূমিকা পালন করা দরকার।

ক) সহজ পতিতাবৃত্তি বন্ধঃ
সমাজের আনাচে কানাচে সহজলভ্য যে পতিতাবৃত্তি চলে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। যাতে করে কোনো কিশোর হাত বাড়ালেই নষ্ট জায়গার খোঁজ না পায়।

খ) কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণঃ
রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে সমাজে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংস্টার সৃষ্টি করে এক শ্রেণীর স্বার্থবাদী মানুষ। তাদের প্রশ্রয়ে এইসব উঠতি বয়সের ছেলেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে যখন তারা পরিবার থেকে বাঁধাহীন হয়ে যায়। এবং সেই সাথে সমাজের বড়ভাইয়ের আশ্রয় পায়। তখন তারা সহজেই যেকোনো পাপে জড়িয়ে পড়ে। এই জৈবিক পাপ যে কত ভয়ংকর তারা সেই সময় কখনোই টের পায় না। তাই সমাজ থেকে কিশোর গ্যাংস্টার সৃষ্টি বন্ধ করতে হবে।

গ) মুরুব্বীদের শাসনঃ
গত দশ পনেরো বছর ধরে আমাদের সমাজে মুরুব্বীদের শাসন উঠে গেছে। যদিও এর অনেক গুলো কারণ রয়েছে। কিন্তু এটা একটি সমাজে খুবই প্রয়োজন। আগে এক সময় রাস্তাঘাটে ছেলেরা যেমন তেমন ভাবে পোশাক পড়তে বা চুলের ফ্যাশন করে কাটিং দিতো পারতো না। সমাজে ইভটিজিং ছিলো না। কিন্তু এখন রাজনৈতিক পেশিশক্তির কারণে সমাজে রাজনৈতিক নেতার দাপটে সমাজের মুরুব্বীদের ক্ষমতা কমে গেছে। যার ফলে সামাজিক শাসনের যে শিকল ছিলো তা ছিঁড়ে গেছে। এই শাসন শৃঙ্খলা ধ্বংস হওয়ার কারণে সমাজে উঠতি বয়সের ছেলেরা বিভিন্ন অপকর্মের পাশাপাশি অনৈতিক শারীরিক সম্পর্কের জন্য যথেষ্ট সুযোগ এবং সুবিধা নিচ্ছে। এইসব খবর অনেকক্ষেত্রে তাদের পরিবারও জানে না।

ঘ) সৃজনশীলতার বিকাশঃ
আমাদের দেশে একটি সময় ছিলো যখন ছেলেরা দল বেধে বিভিন্ন সামাজিক সংঘটনে কাজ করত। বিশেষ করে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় ক্লাব ছিলো। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ হতো। যা গত দশ পনেরো বছরে স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এইসব সুষ্ঠু সৃজনশীল চর্চা একটি সমাজের ছেলেমেয়েদেরকে সুন্দর পথে চলতে সাহায্য করে। তারা যখন এই জাতীয় বিভিন্ন ভালো কাজে নিমগ্ন থাকে তখন তারা খারাপ পরিবেশ এবং নষ্ট সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে পারে। তাই যদি সুন্দর এক‌টি কিশোর সমাজ চাইলে আমাদের অবশ্যই খেলাধুলাসহ ইসলামী সংস্কৃতির সৃজনশীল সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে।

মুক্তির পথঃ
ক) ধর্মীয় অনুশাসনঃ
বয়ঃসন্ধিকালীন এইসব ছেলেদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে একমাত্র মুক্তির পথ হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসন। সমাজ এবং পরিবারে যদি সঠিক ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা করা হয় তাহলে আমরা খুব সহজেই এই খারাপ পরিস্থিতি থেকে কিশোর সমাজকে উদ্ধার করতে পারি। যদি ছোট থেকেই ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয় তবে তাদের মধ্যে অশ্লীলতা নিয়ে ধর্মীয় ভীতি কাজ করবে। আর যে পরিবারে ধর্মীয় সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয় সেই পরিবারের ছেলেরা সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। আল্লাহর সত্যিকারের ভয় থাকার ফলে তারা দুনিয়াবী পাপ থেকে সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করে। যার ভিতর আল্লাহর ভয় কাজ করে তাকে আল্লাহ নিজেই সাহায্য করে। সুতরাং প্রতিটি পরিবারের উচিত ছেলেদের সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া।

খ) সঠিক সময়ে বিয়েঃ
আমাদের সমাজে এক‌টি ভুল রীতি চালু আছে। তা হচ্ছে ছেলেদের বয়স হয়ে গেলেও সঠিক সময়ে বিয়ে না করানো। একটি ছেলে বালেগ হয় চৌদ্দ পনেরো বছরে। এই বসয় থেকেই ছেলেদের ভিতরে তীব্র জৈবিক চাহিদা কাজ করে। এই তীব্রতা কোনো বাঁধা বা কথা মানে না। এই জৈবিক জোয়ারে ছেলেরা প্রায় পথহারা হয়ে যায়। তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে বা পাপ থেকে দূরে রাখতে হলে অবশ্যই সঠিক সময়ে বিয়ে দিতে হবে। আমাদের দেশে ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে না। অথবা বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ছেলেদের বিয়ে করতে দেওয়া হয় না। এই দীর্ঘ একটি সময় ছেলেরা কীভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবে পাপ না করে? এই পাপের দায়িত্ব প্রতিটি মা বাবাকে নিতে হবে। আগের দিনে ছেলেরা বিয়ে করেও পড়াশোনা করতো। এখন পড়াশোনা শেষ করার পরও আরো দু চার বছর পর চাকরি, এরপর আরো চার বছর পর বিয়ের চিন্তা করে পরিবার। যা মোটেই সঠিক নয়। ছেলেদের আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে জোর দিতে হবে। সেই সাথে পরিবারকেও সাহায্য করতে হবে ছেলেদের সঠিক পথে আসার।

অনেক সময় দেখা যায় ছেলেরা একেবারে খারাপ হয়ে গেলে তারপরে বিয়ে করায়। কিন্তু ততদিনে সব শেষ হয়ে যায়। এইসব ছেলেরা যে বিয়ে করার পরও সঠিক পথে এসেছে তার কোনো প্রমাণ নেই। তাই আমাদের উচিত সঠিক সময়ে ছেলেদের বিয়ে দিয়ে তাদেরকে খারাপ পথ থেকে ফিরে আসতে সাহায্য করা।

সর্বশেষ কথাঃ
বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে একটি ছেলে যে কী পরিমাণ কষ্টে থাকে তা ঐ বয়সী একটি ছেলে ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করতে পারবে না। এই ক্ষুদ্র বয়সে হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া সে সহজে মেনে নিতে পারে না। এর কারণ পরিবার এবং সমাজ তাকে মানসিক ভাবে বড় না করে শারীরিক ভাবে বড় ভেবে ফেলে আচরণ করতে থাকে। যার কারণে সে বুঝে উঠতে পারে না আসলেই সে ছোট না কি বড়।

সেই সাথে নিজের শারীরিক কৌতূহল থেকে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা নিতে সে পা বাড়ায় খারাপ পথে। একান্ত গোপনে এমন সব কিছু করে যা তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এই ধ্বংস হতে পারে শারীরিক হতে পারে নৈতিক, হতে পারে ধর্মীয়। তাই এদের সাহায্য করতে আমাদের প্রতিটি পরিবার এবং সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

এন্ডিসের ভার্টিকেল জার্নি – শেষ পর্ব

2710550

আসুন ছবিটার দিকে একটু ভাল করে তাকাই। বিশেষকরে পাহাড়ের বুকে চলমান পিক-আপ ট্রাক সহ ছবিটার দিকে। এ ছবি আমার নিজের নয়, নেট হতে নেয়া। এন্ডিসের অন্য কোন বাঁকে তোলা এ ছবিই কথা বলবে।

Churin রিসোর্টে দু’দিন কাটিয়ে গিন্নীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক রওয়ানা দিলাম আরও দক্ষিণে। দক্ষিণ পূবে Huancahuasi একটি রহস্যময় লোকালয়। ওদিকে যাওয়ার মাজেজাটা বুঝতে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।

সবকিছু ঠিক থাকলে মাত্র দুই ঘণ্টার বাস জার্নি। সমস্যা হচ্ছে, প্রায় সব সময়ই সবকিছু ঠিক থাকেনা। এন্ডিসের এ অঞ্চলটা খুবই দুর্গম। প্রায়ই ভূমি ধ্বস হয়। আটকে যায় পথঘাট। বৃষ্টির সিজনে বিপদজনক হয়ে উঠে চলাফেরা।

এ যাত্রায় এন্ডিসের উচ্চতা ছিল ইমাজিনেশনের বাইরে। কাঁচা রাস্তা, বিপদজনক বাঁক, সবমিলিয়ে জার্নি অব লাইফ টাইম করতে যাচ্ছি তা যাত্রার প্রথম প্রহরেই বুঝে নিলাম। Churin বাসষ্ট্যান্ডে টিকেট কাটার সময় জানতে চাইল লো ল্যান্ডে আমাদের পয়েন্ট কব কন্টাক্টের ডিটেইলস।

ভেতরটা শুকিয়ে গেল এহেন প্রশ্নে শুনে। উত্তর শুনে গুটিয়ে গেলাম এবং গিন্নীকে অনুরোধ করলাম এ জার্নি ক্যান্সেল করা যায় কিনা।

এন্ডিসের বিপদজনক বাঁকে বাস দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। যদি ঘটে নিকট আত্মীয়দের অবহিত করার জন্যেই পয়েন্ট অব কন্টাক্টের প্রয়োজন। এন্ডিসের দুর্ঘটনায় উদ্ধার মিশন থাকেনা। অনেকটা সাগরের তলদেশে হারিয়ে যাওয়ার মত যানবাহনও হারিয়ে যায়। দুর্ঘটনা হারিয়ে যাওয়া যাত্রীদের নাম পেরুর ন্যাশনাল ডাটাবেজে মিসিং পারসন হিসাবে লিপিবদ্ধ থাকে। কোনদিনও মৃত হিসাবে চিহ্নিত করেনা।

নিউ ইয়র্কস্থ বন্ধু রহমানের নাম ও ফোন নাম্বার দিয়ে কিছুটা আস্বস্থ হলাম কিছু একটা ঘটে গেলে অন্তত দেশ পর্যন্ত পৌঁছবে আমার পরিণতির খবর।

দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে বুকে অন্যরকম সাহসের দরকার হয়। থাকতে হয় পাহাড়ের মতই সমান মনোবল। তা না-হলে এ পথের জার্নি উপভোগ করা যায়না। মৃত্যুভয় গ্রাস করে নেয় নিজের অস্তিত্ব।

জানালার পাশের সীটটা ইচ্ছা করেই নিয়েছিলাম এন্ডিসের মায়াবী দৃশ্য দেখবো বলে। কিন্তু মায়াবী দৃশ্য হরর দৃশ্যে রূপ নিতে বেশিক্ষণ লাগেনি। বাসের চাকা রাস্তায় চলছে না হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে বুঝতে চাইলে বাস হতে নামতে হয়। পথের এক পাশে খোদ এন্ডিস পর্বতমালা, অন্য পাশে অন্তহীন মৃত্যুফাঁদ।

অভিজ্ঞতার ভয়াবহতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে উলটো দিক হতে কোন যানবাহন আসলে। প্রথম দর্শনে ওয়ান-ওয়ে রোড মনে হলেও দুদিক হতেই বাস ট্রাকের চলাচল। রাস্তার যেদিকটায় পাহাড় অতিরিক্ত কিছু পাথর সরিয়ে জ্যামিতির জ্যা আকৃতির স্পেস তৈরি করা আছে ক্রসিং’এর জন্যে। প্রতিটা সফল ক্রসিংয়ের পর বুকের ভেতর হতে যেন ১০ মন ওজনের পাথর নেমে যায়। বেশ ক’বার চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে।

হৃৎপিণ্ডের উথাল পাতাল শান্ত হতে ৩ ঘণ্টা লেগে গেল। বিনা ইন্সিডেন্টে পৌঁছে গেলাম এন্ডিসের নতুন উচ্চতায়।

Huancahuasi আসলে কোন শহর নয়। ব্যস্ত জীবন হতে কিছুটা সময় পালিয়ে থাকার সেইফ হেভেন। বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হট স্প্রিং টুরিস্ট আকর্ষণের হট স্পট। গরম পানির ন্যাচারাল ফোয়ারায় শরীর ডুবিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপভোগ করে প্রকৃতির এই দান। পৃথিবীর অনেক প্রান্ত হতে আসা পর্যটকদের দেখা মেলে এখানে।

পাহাড়ের দুই উচ্চতায় দুটি দালানের অবস্থান কিছুটা হলেও কৌতূহলের সৃষ্টি করে। এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের বিলাস বহুল দালান থাকার কথা না। গিন্নীকে জিজ্ঞেস করতে কোন উত্তর না দিয়ে ওদিকেই নিয়ে চলল আমাকে।

তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের অপরাজনীতির মাইলস্টোন হিসাবে দাঁড় করানো যাবে দালান দুটো। এক কথায় লুটপাটের অভয়ারণ্য। পেরুর এক কালের সফল প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুখিমোরের অবকাশ-কালীন প্রাসাদ এখানে। প্রাসাদ বলতে ন্যাচারাল হট স্প্রীংকে দেয়াল দিয়ে আটকে বানানো হয়েছে সুইমিং পুল। পাশে বিলাস বহুল কটেজ এবং হ্যালিপ্যাড।

প্রাসাদের উলটো দিকে একই চেহারা ও আকৃতির আরও একটা প্রাসাদ। এবং সেটার মালিক প্রেসিডেন্টের কন্যা কেইকো ফুখিমোরে। প্রেসিডেন্ট নিজ কন্যার জন্যে জন্মদিনের উপহার হিসাবে বানিয়েছিলেন ডুপ্লিকেটটা।

আলবার্তো ফুখিমোরে। গোটা পেরু যখন বামপন্থী সাইনিং পাথ গেরিলাদের সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি হয়েছিল রাজনীতির দিগন্তে আবির্ভূত হন জপানি ব্যাকগ্রাউন্ডের এই প্রেসিডেন্ট। কঠোর ও নির্মমভাবে নির্মূল করেন Manuel Rubén Abimael Guzmán Reynoso’র সন্ত্রাসী চক্র। পেরুভিয়ানরা ফিরে পায় তাদের স্বাভাবিক জীবন। অনেকে দেবতার আসনে বসায় ফুখিমোরের প্রেসিডেন্সি।

তৃতীয় বিশ্বের লুটেরা রাজনীতিবিদদের তালিকায় নিজের নাম লেখাতে খুব একটা সময় নেননি ফুখিমোরে। Huancahuasi’র দুই দুইটা প্রাসাদ ছিল সাগরে এক ফোটা বৃষ্টির মত। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শেষ টার্মের নির্বাচনে অবৈধ উপায়ে নিজকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। কিন্তু পেরুর জনগণ দেশটার বিচার ব্যবস্থার সহায়তায় ক্ষমতাচ্যুত করে এক কালের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে। আলবার্তো ফুখিমোরে পালিয়ে যান জাপানে। ওখান হতে পেরুর কাছাকাছি দেশ চিলিতে আসেন বিভিন্ন কারণে। চিলির সরকার পেরু সরকারের অনুরোধ ফুখিমোরেকে তুলে দেয় তাদের হাতে।

সেই ফুখিমোরে এখন জেলে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। আলবার্তোর কন্যা কেইকো ফুখিমোরে পেরুর রাজনীতিতে খুবই জনপ্রিয় একটি নাম। দুই দুইবার চেষ্টা করে পরাজিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

গিন্নী আর দশজন পেরুভিয়ানের মত লম্বা সময় ধরে সাতার কাটতে নেমে গেল ফুখিমোরেদের সুইমিং পুলে। সময় চলে গেল চোখের পলকে। দুপুরের খাবারের জন্যে আমাদের কোন হোটেল রেস্টুরেন্টে যেতে হলোনা।

খোলা মাঠে অনেকে দোকান খুলে তৈরি খাবার বিক্রি করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় সবাই আদিবাসী ইনকা। ওদের খাবারেও তার প্রতিচ্ছবি। গিনিপিগ, র‍্যাবিট, লামা, মিষ্টি আলু, বয়েলড বিনস ছিল মেনুর মুল আইটেম।

এন্ডিসের কোন এক চোরা গলিতে সময়টা খুব দ্রুতই কেটে গেল। সূর্যের তাপ হাল্কা হয়ে আসছিল। এন্ডিসের চূড়ায় চূড়ায় মেঘমালাদের ঘোরাফেরা মনে করিয়ে দিচ্ছিল এবার ফেরার পালা।

কেবল ফেরার পথে গিন্নী জানাল এদিকটায় আসার মূল কারণ। এমন এক জার্নিতে তার বাবা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল এন্ডিসের গহীন শূন্যতায়। তার স্ট্যাটাস এখনো …মিসিং ইন এন্ডিস।

2703532

শেষ।

এন্ডিসের ভার্টিকেল জার্নি

270221

ভ্রমণ মানেই উপভোগ। অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার হাতছানি। সীমিত সামর্থ্যের ভেতর যতটুকু সম্ভব ততটুকুই আমি ঘুরে বেড়াই। অন্যদের তুলনায় এই ঘুরে বেড়ানোর পরিসরটা আমার বেলায় একটু প্রসারিত সুযোগ ও সময়ের কারণে। উপভোগ করি বলেই ভ্রমণ করি। কিন্তু এই উপভোগ মাঝে মধ্যে নাইট্মেয়ার হয়ে দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে। চাইলেও স্মৃতির পাতা হতে মুছে ফেলা যায়না।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর উত্তর দিকে Churin নামের ছোট একটা শহর আছে। ছবির মত সুন্দর। চারদিকে এন্ডিস পর্বতমালা। অনেকটা উপতক্যার মত এই শহরে বছর জুড়েই রাজত্ব করে সুনসান নীরবতা।

শীতকালে পর্যটকরা ভিড় জমায়। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ন্যাচারাল জলপ্রপাত প্রকৃতি প্রিয় মানুষদের হাতছানি দিয়ে টানে। হোটেল মোটেলেরও অভাব নেই। এ ছাড়া পেরুভিয়ানদের জন্যে আকর্ষণের আরও একটা কারণ হচ্ছে দেশটার লো-ল্যান্ডে যখন শীত এন্ডিসের উচ্চতায় তখন গ্রীষ্মকাল। এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা আমার জানা নেই। শুধু জানি একই দেশে একই সময় শীত ও গ্রীষ্মকাল পাশাপাশি দাপিয়ে বেড়ায়।

প্রস্তাবটা ছিল আমার গিন্নীর। মধ্য জুনের কনকনে শীতে রাজধানী লিমা কাবু হয়ে থাকে। কুয়াশার ঘোমটা হতে দিনে একবারের জন্যেও মুখ খোলেনা। চারদিকে একধরণের স্থায়ী বিষণ্ণতা। এমন এক পরিবেশে বেশীদিন বাস করলে ডিপ্রেশন চেপে ধরে। গিন্নীর তা জানা ছিল। লিমার মন খারাপ করা আবহাওয়া হতে বেরিয়ে ঝলমলে রোদে যাওয়ার জন্যেই Churin নামটা সামনে আসে। আমার কোন আপত্তি ছিলনা। নতুন কিছু দেখতে নরকে যেতেও প্রস্তুত আমি।

লিমা হতে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার পথ Churin। একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর অন্যদিকে মাইটি এন্ডিস পর্বতমালা, যে কারও মন কাড়াতে বাধ্য।

যাত্রার শুরুতেই সমস্যা। ঘন কুয়াশায় বাসের গতি ডেড-স্লো করতে বাধ্য হচ্ছে ড্রাইভার। এমন ভৌতিক পরিবেশে বাস জার্নি ভয় ধরিয়ে দেয়। যে কোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নিয়েই বাসগুলো রাস্তায় নামে। বুকে অসীম সাহস না থাকলে এ পথে পা বাড়ানো খুব কষ্টের।

লিমা ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জনবসতির ঘনত্ব কমে আসতে শুরু করল। শহরের চাকচিক্য ছাপিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করল পেরু নামের দেশটার বিবর্ণ চেহারা।

ঘণ্টা খানেক চলার পর পীচ-ঢালা রাজপথ ছেড়ে আমাদের ধরতে হবে ইট-সুরকির কাঁচা রাস্তা। গিন্নীর এমন ঘোষণায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। মূল কারণ, আমাদের বাস ধীরে ধীরে উপরে উঠছে।

SYAN নামের এক জরাজীর্ণ শহরে আমাদের প্রথম স্টপেজ। এক ঘণ্টার মত বিরতি। দুপুরের খাবার সেরে নেয়ার শেষ সুযোগ।

প্রশান্ত মহাসাগরের ফ্রেশ মাছ, সাথে ফ্রাইড পটেটো দিয়ে খাওয়া শেষ করে বিল দিতে গিয়ে অবাক। রেস্টুরেন্টের সবাই আমার গিন্নীকে চেনে। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানাল এক সময় এই রেস্টুরেন্টের মালিক ছিলেন গিন্নীর নানী।

সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তায় বের হতে গিন্নী তাড়া দিল দৌড়ানোর। কিছু বুঝে উঠার আগে শুরু করলাম গিন্নীর পিছু নেয়া। দৌড়ে আরও উচ্চতা ডিঙ্গচ্ছি আমরা। মুখ হতে জিহ্বা বেরিয়ে আসার উপক্রম। কিছুটা পথ পাড়ি দেয়ার পর একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে থামলাম আমরা।

বাড়ির সামনের গোপন কুঠুরি হতে ভোজবাজির মত বেরিয়ে এলো একটা চাবি। এবং সেই চাবি দিয়ে মূল ফটকের তালা খুলে ঢুকে পরলাম এন্ডিসের মতই বিবর্ণ চেহারার বাড়িটাতে।

এই বাড়ির মালিকও গিন্নীর নানী। তিনি বেঁচে থাকতে বার বার অনুরোধ করে গেছেন আমরা যেন কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও এখনটায় থামি।

অযত্ন অবহেলার সাক্ষী বাড়ির সবকিছুতে। বুঝা যায় অনেকদিন এখানটায় কেউ আসেনি।

কিছুটা সময় বিছানায় আরাম করে পথের ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করলাম। বাথরুম শেষে রওয়ানা দিলাম উলটো পথে।

এবং এখানেই ছিল পীচ-ঢালা পথের শেষ এবং সমস্যার শুরু।

আকাশের দিকে উঠছি আমরা। হিসাব কষলে ৪৫ ডিগ্রী হবে হয়ত বাসের জিয়োমেট্রি। ঠিক যে ডিগ্রীতে বিমানবন্দর হতে বড় বড় বিমান উড়ে যায়। তলপেটে একধরণের চাপ অনুভব করতে শুরু করলাম। অস্বস্তি বাড়তে লাগলো। সাথে সীমাহীন ভয়। প্রয়োজনে ব্রেক কষলে বাসটা থামানো যাবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ হল।

গিন্নীর দিকে তাকালাম। নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এন্ডিসের বিশালতায় এক ধরণের মায়াবী টান আছে। একবার প্রেমে পরলে সহজে উঠে আসা যায়না।

মাচু পীচুর উচ্চতার কথা মনে হল। একই কায়দায় উপরে উঠেছিলাম। তবে রাস্তা ছিল মসৃণ। ছিল আধুনিক যানবাহনের সব সুবিধা।

কিন্তু এ যাত্রায় এ সবের লেশমাত্র ছিলনা। অথচ জানামতে এদিকটায়ও পর্যটকরা নিয়মিত ভিড় জমায়। বিদেশি না হোক স্থানীয়দের সংখ্যাও কম না।

জীবনে এই প্রথম বাস জার্নিতে বমির ভাব অনুভব করলাম। কখন কোথায় বেরিয়ে আসবে ভাবতে অস্থির লাগলো। গিন্নীকে বলতে ব্যস্ত হয়ে পরল ড্রাইভারকে বুঝাতে। সময়মত না থামলে নোংরা কাজটা হয়ত ভেতরে সমাধা করতে হতো।

বাসের বাইরে পা রাখতে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আমি কি রাস্তায় পা রাখছি, নাকি এন্ডিস পর্বতমালার খোলা ফাঁদে পা দিয়ে চিরদিনের জন্যে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। নীচের দিকে তাকাতে মাথা ভো করে ঘুরে উঠল। গিন্নী পাশে না থাকলে হয়ত পরেই যেতাম।

নিজকে কিছুটা আড়াল করে হর হর করে বমি করে ফেললাম। ড্রাইভারের কাছ হতে যথেষ্ট সময় নিয়েছি তাই গিন্নীর গো-এহেড সিগন্যাল পেয়ে প্যান্টের বোতাম খুলে বাকি কাজটা সেরে নিলাম।

এ যেন অনন্তকালের যাত্রা। ধীরে পিপড়ার গতিতে চলছে আমাদের বাস। ভেতর আমি শক্ত হয়ে প্রহর গুনছি। এক একটা বাঁক পাড় হচ্ছি আর নতুন নতুন ভয় এসে ভর করছে। কি হবে যদি এখানেই আমার ইতি হয়!
বাসের বাকি যাত্রীরা ছিল নির্বিকার। চোখ মুখ ভাবলেশহীন। আমার মত এদিক সেদিক চোখ ঘুরাচ্ছে না। ইট সুরকি আর পাথরের রাস্তা দিয়ে বাসের ভার্টিকেল জার্নিতে ওরা হয়ত অভ্যস্ত। কিন্তু সমতলের মানুষ আমি, কিছুতেই সহজ হতে পারলাম না।

চার ঘণ্টার জার্নি সাত ঘণ্টায় এসে ঠেকল। শেষ কখন তার কোন ইঙ্গিত নেই। গিন্নী ইতিমধ্যে বিরক্ত হয়ে গেছে একই প্রশ্ন বারবার শুনতে গিয়ে। শুধু আশা দিচ্ছে, এই সামনের বাঁকটা পার হলেও আমাদের যাত্রা শেষ।

এন্ডিসের কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে ছবির মত সুন্দর একটা লোকালয়। পর্বতমালার বুক-চিড়ে শেষ বাঁকটা পার হতে চোখের সামনে আছড়ে পরল চুরিনের প্যানোরমা।

ফুটনোট; এক পর্বে শেষ করার ওয়াদা থাকলেও সম্ভব হলনা। আরও একটা পর্ব দিয়ে শেষ করবো লেখাটা। কারণ একই জার্নিতে আমি আরও উপর উঠবো। পাড়ি দেব আরও দুর্গম পথ। আশাকরি সাথে থাকবেন।

বিকেলে ভোরের গল্প … পর্ব ১২

271200

চলন্ত ট্রেনে বসে বাইরের দিকে তাকালে মনে হবে ট্রেন নয়, যেন বাইরের পৃথিবীটাই ছুটছে। বাড়িঘর, মাঠ ঘাট, গাছপালা সবকিছু ক্ষণিকের জন্যে উঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তরেখায়। পড়ন্ত বিকেলের দৃশ্যপট হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে বিশাল ক্যানভাসে আঁকা শিল্পীর নিপুণ কোন শিল্পকর্ম।

সূর্যের রক্তিম আভা আছড়ে পরছে ফসলের মাঠে। কৃষকরা ঘরে ফিরছে তাদের ট্রাক্টর নিয়ে। কাউবয়রা শেষবারের মত সেরে নিচ্ছে ক্যাটেল হেড কাউন্ট। প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনে থেমে আছে একাধিক গাড়ি। নিভু নিভু আলোতেও মাঠে ফুটবল খেলছে অনেকে। শিশু কিশোরের দল বাইক নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরছে। হয়ত ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল ফিরে যাচ্ছে তাদের কুলায়।

এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি। হকার টাইপের কেউ একজনের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শুকনা জাতীয় কিছু খাবার ও কোল্ড ড্রিংকস বিক্রির চেষ্টা করছে। আমার মত যারা বার্লিন হতে উঠে হ্যানোভার অথবা নেদারল্যান্ডস’এর রোটরড্রামে যাচ্ছে তাদের কেউ কেউ সাড়া দিচ্ছে হকারের ডাকে। লম্বা জার্নি। খাবার না কিনলেই নয়।

পূর্ব ইউরোপিয়ানদের সাথে পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের এই পার্থক্যটা খুব প্রকট হয়ে ধরা পরে। বিশেষকরে ট্রেন অথবা বাসের লম্বা জার্নিতে। মহাদেশের পূবের দিকের মানুষ যেখানেই যাক ভ্রমণের সময় তারা ঘরে তৈরি নিজেদের খাবার বহন করবেই।

সোভিয়েত, পোলিশ অথবা চেকদের ভ্রমণ ব্যাগের অপরিহার্য অংশ শুকনো খাবার। রুটি, সালামি, শুকরের বেকন সাথে মাখন এবং সবশেষে পানীয় হিসাবে মগ ভর্তি গরম চা।

মা তার সন্তানকে অথবা স্ত্রী তার স্বামীকে যখন বিদায় দেয় সাথে দেয় জার্নির পুরোটা সময় চালিয়ে নেয়ার মত যথেষ্ট খাবার। ওরা নিজেদের খাবার সদ্য পরিচিত সহযাত্রীদের বিনা দ্বিধায় অফার করতে অভ্যস্ত।

পশ্চিম ইউরোপিয়ানরা তাদের পূব দিকের সগোত্রীয়দের এসব সংস্কৃতির ধারে কাছেও যায়না। ঘরে রান্না করা খাবার কেউ ট্রেনে খেয়েছে এমন দৃশ্য বিরল। বরং এক প্যাকেট চিপস খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টায় কাটিয়ে দেয় এমন যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। মাঝপথে কোথাও থামলে ষ্টেশন হতে একটা স্যান্ডউইচ ও এক বোতল পানিই তাদের শেষ সম্বল। এর অতিরিক্ত কিছু কিনলে যাত্রীর পশ্চিম ইউরোপীয় আইডেন্টিটি নিয়ে প্রশ্ন তুললে অন্যায় হবেনা।

হ্যানোভার। পশ্চিম জার্মানির বেশ বড় একটা শহর। রেল নেটওয়ার্কের বড়সড় একটা হাব। ১৫/২০ মিনিটের যাত্রা বিরতি এ শহরে। একই ট্রেন ধরে বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন শহরে যাওয়ার শুরুটা হয় এখানেই। এ যেন বিমানের কানেক্টিং ফ্লাইটের মত। ইউরোপের বিভিন্ন কোনা হতে দলে দলে ট্রেন আসে। এক ট্রেনের বগি অন্য ট্রেনে লাগিয়ে চলে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে।

পৃথিবীর আর দশটা ট্রেন ষ্টেশনের মতই হ্যানোভারের ব্যস্ততা। মিনিটে মিনিটে ট্রেন আসছে এবং পাশাপাশি ছেড়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের ভিড়ে গিজ গিজ করছে প্লাটফর্ম। নিজদের ট্রেনের সন্ধানে যাত্রীরা এক প্লাটফর্ম হতে অন্য প্লাটফর্মে দৌড়চ্ছে। দম দেয়া পুতুলের মত ঝট করে উঠে পরছে ট্রেনে এবং তাৎক্ষণিক ভাবে মিশে যাচ্ছে যাত্রীদের মিছিলে। বিমানবন্দরের মতই ভারী গলায় দফায় দফায় ঘোষণা আসছে ট্রেনের এরাইভেল ও ডিপার্টচারের বিবরণ।

গ্রীষ্মকাল বলেই হয়ত ভিড়টা একটু বেশি। আমার মত লন্ডনের দিকে কারা যাচ্ছে তা হোক ভ্যান হল্যান্ড পর্যন্ত না গেলে বুঝার উপায় নেই। তবে আমার সহযাত্রী একদল স্প্যানিশ কিশোরীদের ভাবা-সাব দেখে মনে হল ওরা ওদিকে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের ছুটিতে স্পেন হতে অনেকে কলেজ ইউনির ছাত্র ছাত্রী ব্রিটেনের দিকে যায় সামার যবের জন্যে। লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডের অনেক বার রেস্তোরায় ওদের কাজ করতে দেখেছি। দু’য়েক জনের সাথে পরিচয় হয়নি তাও নয়।

আসলে সবকিছুতেই কেমন যেন একটা ছুটির আমেজ। কি মানুষ কি প্রকৃতি কোন কিছু বাদ নেই। সাথে কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন সুখের ইঙ্গিত। দেশ, জাতি, ভাষা অথবা সংস্কৃতি কোন কিছুই বাধা হয়ে নেই সুখের এ মেঠো পথে। আপাদমস্তক শরীর ঢেকে আরব মহিলার পাশাপাশি শরীর উন্মুক্ত করার তীব্র প্রতিযোগিতায় মত্ত ললনারাও চলছে সুখের সন্ধানে। এক ষ্টেশনে উঠে পরের ষ্টেশনেই নেমে পরছে অনেকে। অনেকে আবার সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে দূর দূরান্তে।

পূর্ব বার্লিন হতে হতে কেনা কিছু শুকনো খাবার ছিল সাথে। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে আনা ছোট ফ্লাক্সটাও ভর্তি করে নিয়েছিলাম কালো কফিতে। পেট চো চো করছিল ক্ষুধায়। হ্যানোভারের বিরতিতে গোগ্রাসে গিলে মগটা হাতে নিয়ে সামনে সীটে পা উঠিয়ে বেশ আয়েশ করেই প্রস্তুতি নিলাম জার্নির পরের অংশের।

মহাশয়, এই ট্রেনটা কি হোক ভ্যন হল্যান্ডের দিকে যাচ্ছে?’
জিনসের সংক্ষিপ্ত শর্টস পরা দুজন তরুণী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল আমার দিকে।
আমি নিশ্চয়তা দিলাম ওদিকেই যাচ্ছি আমরা।

চলবে।

বিকেলে ভোরের গল্প … পর্ব ১১

2710576

ঝামেলা পিছনে ফেলে Hook Van Holland গামী ট্রেনটায় চেপে বসতে মাথা হতে পাহাড় সমান কিছু একটা নেমে গেল যেন। নিঃশ্বাসে অক্সিজেনের মাত্রাও যে বেড়ে গেছে তা টের পেতে অসুবিধা হলনা।

লন্ডন পর্যন্ত জার্নিতে আমার আর কোন বাধা নেই। উপলব্ধিটা স্বস্তির আবেশ ছড়িয়ে দিল গোটা শরীরে। যদিও হারউইচ পোর্টে চাইলে বিনা কারণে ব্রিটিশরা আমাকে আটকে দিতে পারে। তবে গেল ১১ বছরে তারা এমনটা করেনি। এ যাত্রায় তেমন কিছু করার কারণ ছিলনা।

সব দেশের মত ব্রিটিশ ইমিগ্রেশনেরও লক্ষ্য থাকে টুরিস্ট ভিসায় কেউ ব্রিটেনে ঢুকে ফিউজেটিভ হয়ে যায় কিনা। আমার পাসপোর্ট সাক্ষী দেবে এ ব্যপারে আমার স্বচ্ছতা।

পশ্চিম জার্মানি ও বেনেলাক্সের ২৪ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসা পৃথিবীর এ অঞ্চলে স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিশ্চয়তাও ছিল স্বস্তি-দায়ক। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট অনেক দেশে এন্ট্রি ভিসা পাওয়া যেত। কিন্তু অবৈধ অভিবাসীদের বিরামহীন ইন-ফ্লাক্স ততদিনে বদলে দিয়েছে অনেক সমীকরণ।

পূর্ব জার্মানির ভিসা অনেকদিন পর্যন্ত ছিল সহজলভ্য (অন এরাইভেল)। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে স্বদেশীদের অনেকে পূর্ব বার্লিন হয়ে পাড়ি জমিয়েছিল পশ্চিম জার্মানির অনেক শহরে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট বেশ ক’বছর ধরেই কালো তালিকাভুক্তির প্রথম দিকে স্থান করে নিয়েছিল ইউরোপের অনেক দেশে। এ নিয়ে অনেক দেশের মিডিয়া ডকুমেন্টারি তৈরি করে তুলে দিয়েছিল পশ্চিমাদের শয়নকক্ষে। স্বভাবতই জন্ম নিয়েছিল ভয় ও এক ধরণের ঘৃণা।

বগিটায় ৩/৪ জন যাত্রী ছাড়া বাকি সব আসন ছিল শূন্য। তবে অবস্থা যে এমনটা থাকবেনা তা পরবর্তী ষ্টেশনে থামলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে।

গ্রীষ্মের এ সময়টা গোটা পশ্চিম ইউরোপ হুমড়ি খেয়ে পরে একটুখানি স্বস্তির সন্ধানে। স্কুল কলেজ ছুটি থাকার সুবাদে মা-বাবাও বেরিয়ে পরে তাদের বার্ষিক ছুটিতে। চারদিকে থাকে উৎসবের আমেজ। এ আমেজের ছোঁয়া পাওয়া যায় তাদের কথায়, কাজে, চলাফেরায় এমনকি পোশাকে পর্যন্ত।

খুবই আরামদায়ক একটা চেয়ারে বসে নিজকে গুছিয়ে নিলাম লম্বা জার্নির জন্যে। জানালার পাশের সীটে না বসলে সময় সহজে কাটতে চায়না। মন্থর হয়ে যায় ট্রেনের গতির সাথে জীবনের গতি। একটা সময় ভয় এসে মগজে বাসা বাধে; মনে হয় এ পথ জীবনেও ফুরাবেনা।

মাইলের পর মাইল পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রেন। এদিক সেদিক অনেক জায়গায় থামছে। দলবেঁধে যাত্রীরা উঠছে। অনেকে নেমে যাচ্ছে। কেবল জার্মান ভাষাই নয়, পৃথিবীর হরেক রকম ভাষায় মুখরিত হয়ে উঠছে ট্রেনের বগি। সবাই কোথাও না কোথাও যাচ্ছে। আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়না ওরা শীতের খোলস হতে বেরিয়ে আলোর সন্ধানে ছুটছে। প্রকৃতিও যেন দুবাহু বাড়িয়ে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সবুজের সমারোহ চারদিকে। পাতায় পাতায় পল্লবিত গাছপালা। সূর্যের আলো আছড়ে পরছে পরতে পরতে।

ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ি ঘর, গাছপালা, মানুষ, পশু পাখি মিলিয়ে যাচ্ছে সেলুলয়েডের ফিতায়। ট্রেনের জানালা এ মুহূর্তে বিরাট ক্যানভাসের কোন ছায়াছবির প্রেক্ষাপটকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

পশ্চিম বার্লিন পার হয়ে ট্রেন আবারও প্রবেশ করল পূর্ব জার্মানিতে। আবারও ছায়া কায়াহীন মূর্তির মত হাজির হল পূর্ব জার্মান পুলিশ। ওরা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ঠায় হয়ে তাকিয়ে থাকে চোখের দিকে। কিছু একটার সন্ধান করে নিজেদের প্রফেশনাল চোখ দিয়ে। চাহনির রশ্মি এতটাই প্রখর কারও ভেতর ইমিগ্রেশন অথবা কাস্টম জাতীয় দুর্বলতা থাকলে তা বেরিয়ে আসতে বাধ্য। সবকিছু ঘটে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর। তারপর খটাস করে পাসপোর্টে এন্ট্রি অথবা এক্সিট ভিসার সিল বসিয়ে মিলিয়ে যায় সূক্ষ্ম বাতাসে।

পশ্চিম বার্লিনের একটা ইতিহাস আছে। বিভক্ত জার্মানির পতনের আগে রাজনৈতিক এনক্লেভ হিসাবে বিবেচিত জায়গাটার আইডেন্টিটি দেশ অথবা শহর হিসাবে ছিলনা। ছিল হিটলারের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ইউরোপের শেষ ফ্রন্টিয়ার।

১৯৪৫ সালের ৯ই মে মিত্র বাহিনীর কাছে হিটলারের পরাজয় অফিসিয়ালি লিপিবদ্ধ করা হয়। একই সালের ১৭ই জুলাই মিত্রপক্ষের চার শক্তি পরাজিত জার্মানির Postdam শহরে মিলিত হয় যুদ্ধ পরিবর্তী জার্মানির ভাগ্য নির্ধারণে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ও সোভিয়েত লৌহমানব জোসেফ স্টালিন Postdam বসেই সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীন সার্বভৌম জার্মানির অভ্যুদয় না ঘটা পর্যন্ত চারভাগে বিভক্ত করে চার শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে এই দেশ।

উত্তর-পশ্চিম দিকের নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্রিটিশরা। ফ্রান্সের ভাগে আসে দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানি। মার্কিনীদের নিয়ন্ত্রণে আসে দেশটার দক্ষিণের অংশ। আর পূব দিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে জোসেফ স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন। বার্লিন শহরকে চারভাগে বিভক্ত করে একই অনুপাতে তুলে দেয়া হয় চার শক্তির হাতে।

সোভিয়েতদের বশ্যতা মেনে নিয়ে জার্মানির পূর্বাংশে জন্ম নেয় পূর্ব জার্মানি। বাকি অংশ পরিচিত পায় পশ্চিম জার্মানি হিসাবে। পূর্ব জার্মানির মাঝখানে বার্লিন শহর অনেকটা দ্বীপের মত অবস্থানে চলে যায়। শহরের পূর্বাংশের নামকরণ করা হয় পূর্ব বার্লিন এবং পশ্চিমাংশ পশ্চিম বার্লিন। গণতান্ত্রিক বিশ্বে পশ্চিম বার্লিন পরিচিতি পায় আইল্যান্ড অব ফ্রীডম হিসাবে। ১৯৬১ সালে বার্লিনকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করার লক্ষে পূর্ব জার্মানরা তৈরি করে ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল।

এখানে বলে রাখা ভাল, অফিসিয়ালি পশ্চিম বার্লিন ফেডার‍্যাল রিপাব্লিক অব জার্মানির (FRG) অংশ নাহলেও এর সমস্ত দায়-দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এই দেশ। বাকি তিন শক্তি বোঝাপড়ার মাধ্যমে হস্তান্তর করেছিল নিজদের দায়িত্ব।

চলবে।

ফুটনোট: আমার এ ভ্রমণের সময়কাল অনেক পুরানো। ঘটনা প্রবাহে অনেক ইনকনসিসটেন্সি থাকতে পারে। যেহেতু প্রফেশনাল লেখক নই তাই ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করব।

বিকেলে ভোরের গল্প … পর্ব ১০

271197

পূর্ব ইউরোপ হতে আসা ট্রেনগুলোর মত এসব ট্রেনে ঘুমের ব্যবস্থা নেই। বসার জন্যে আরামদায়ক চেয়ারই একমাত্র সম্বল। প্রায় সাত/আট ঘণ্টার জার্নি। লম্বা সময় বসে থাকলে ক্লান্তি এসে ভর করে। সেলুলয়েডের ফিতার মত বাইরের দৃশ্য দেখতে গেলে তন্দ্রা এসে যায়। তখন অজান্তেই সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলোকে মিস করি। ওখানে আর কিছু না থাক অন্তত রাতে ঘুমের ভাল ব্যবস্থা থাকে। পরিষ্কার ধবধবে বিছানা, গরম কম্বল, সাথে অন দ্যা হাউস গরম চা, সবকিছু মিলে অন্তত শারীরিক ক্লান্তিটাকে ঠেকিয়ে রাখে।

পশ্চিম বার্লিন হতে ছেড়ে আসা কোন ট্রেনই এক রুটে এক শহরের জন্যে নির্ধারিত থাকেনা। জায়গায় জাগায় থামে এবং এক লকোমোটিভ হতে বগি আলাদা করে অন্য লকোমোটিভে লাগিয়ে দেয়। ভাল করে যাচাই বাছাই না করে বগিতে বসলে বড় ধরণের ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়।

এক গ্রীষ্মে বেলজিয়াম হয়ে লন্ডন যাচ্ছি। বেশ ক’বার যাতায়াতের কারণে ধরে নিয়েছিলাম এ রাস্তার সবকিছু আমার জানা। কোথাও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সে যাত্রায় ভুল হয়েছিল। এবং তা ছিল বড় ধরণের ভুল।

ট্রেনের সাইনে বেলজিয়ামের পোর্ট অব আন্টওয়ার্পের সাইন দেখে ধরেই নিয়েছিলাম গোটা ট্রেনটাই ওদিকে যাচ্ছে। খালি মত বগি দেখে ওখানেই আরাম করে বসে পরি। ভুলটা ধরতে বেশকিছু সময় লেগে যায়।

আমার গন্তব্য ব্রিটেনের ডোভার। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার ট্রেন ওদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু বেলজিয়াম অতিক্রম করে নতুন এক সীমান্তে আসতেই টনক নড়ল। ট্রেন সীমান্তে দিয়ে ফ্রান্সে ঢুকার অপেক্ষা করছে।

হুরমুর করে ইমিগ্রেশন পুলিশ উঠে পরল ট্রেনে। ওদের মুখে ফ্রেঞ্চ ভাষা শুনে পৃথিবী টলে উঠল। এ সীমান্ত হতে টিকেট কেটে ব্রাসেলস ফিরে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট অর্থ নেই পকেটে। সিদ্ধান্ত নেয়ার মত হাতে যথেষ্ট সময়ও ছিলনা। এসব সীমান্তে ট্রেন পনের বিশ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করেনা।

ফ্রেঞ্চ পুলিশ এসে আমার পাসপোর্ট চাইতে সব খুলে বললাম। আমার পাসপোর্টে ফ্রান্সের ভিসা নেই। চাইলেও সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবো না। আবার ব্রাসেলস ফিরে যাওয়ার মত অর্থও নেই পকেটে। পুলিশ তড়িৎ গতিতে ট্রেন হতে নামিয়ে তাকে অনুসরণ করতে বলল।

সীমান্ত চৌকিতে গিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে কেনা লন্ডন-গামী ট্রেনের টিকেটটা চেক করলো। পাশের প্লাটফর্মেই দাঁড়ানো ছিল ব্রাসেলস-গামী রিটার্ন ট্রেনটা। ঐ ট্রেনের গার্ডের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে সংক্ষেপে জানিয়ে দিল আমার অবস্থা। গার্ড জানাল সোভিয়েত টিকেটই আমাকে সাহায্য করবে ব্রাসেলস ফিরে যেতে। ওখান হতে নতুন একটা ট্রেন ধরতে হবে। টিকেটের সাথে সাদা কাগজে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কিছু একটা লিখে ষ্টেপলার মেরে আটকে দিল। ঝামেলা ওখানেই চুকে গিয়েছিল।

এরপর যতবার এ পথে জার্নি করেছি আগ বাড়িয়ে নিশ্চিত করেছি ট্রেনের কোন বগি কোন দেশের কোন বন্দরের দিকে যাচ্ছে। এ যাত্রায়ও কোন ভুল করিনি।

বার্লিন হতে নেদারল্যান্ডস’এর Hook Van Holland’ পোর্টের ড্রাইভিং দূরত্ব প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার। গাড়ি চালিয়ে গেলে ৮ ঘণ্টার পথ। কিন্তু ট্রেন চলে তার নিজ পথে, নিজস্ব গতিতে। দূরত্ব যাই হোক, সময় লেগে যায় অনেক। চলার পথে পশ্চিম জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস’এর অনেক স্টেশনে থামে। ব্যস্ত কোন শহরে ট্রেনের বগি কেটে তা ভিন্ন রুটের লকোমটিভে লাগাতেও সময় লেগে যায়।

এ যাত্রায় আমার পথ পশ্চিম জার্মানির Brunswick, Hanover ও নেদারল্যান্ডস’এর Rotterdam হয়ে দেশটার বন্দর শহর Hook Van Holland। ওখান হতে ওভারনাইট ফেরীতে করে পাড়ি দিতে হবে নর্থ সী। সবকিছু ঠিক থাকলে পরদিন খুব ভোরে পৌঁছে যাব বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের বন্দর Harwich।

চলবে।