বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

প্রিয় বন্যা

34710074_n

প্রিয় বন্যা
কেমন আছ, ভাল থাক সব সময় সেই কামনা। অনেক দিন পর লিখতে বসেছি।

লিখতে গিয়ে কিছুটা থমকে গেলাম। ইংরেজীতে যত সহজে Dear লিখা যায়, বাংলাতে “প্রিয়” যেন তত সহজে লিখা যায় না। বাংলাতে কাউকে নামের আগে প্রিয় লিখতে গেলে বুকের ভেতর কেমন একটা মোচড় দিয়ে উঠে। ইংরেজী Dear এর যেন অনেক মানে হয়ে উঠে “প্রিয়”। একেকটা ভাষার একেক রকম সীমাবদ্ধতা যেমন আছে তেমন একেক রকম অর্থও আছে।

মনে আছে সেই অনেকদিন আগে টিভিতে বসুন্ধরা হাউজিং এর বিজ্ঞাপনে একটি সংলাপ শুনেছিলাম “লোকেশানটা খুব চমৎকার” পরে তোমাকে বলেছিলাম লোকাশান শব্দে যে ম্যাসেজ(বার্তা) আছে এর বাংলা প্রতিশব্দে সেভাবে প্রকাশ করা যায় না।

কত বছর আগের কথা ২৮ বছর তো হবেই। কত সময় চলে গেছে আমাদের জীবন থেকে… চিঠির মত এমন সুন্দর জিনিস মনে হয় আর নেই। চিঠি লিখা আর চিঠি পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ তা আর কিছুতেই নেই। ডিজিটালের যুগে আমি এখনো মেইল এর চেয়ে চিঠিকেই ভালোবাসি, মনে হয় পরিবর্তনের এই জোয়ারে আমি এখনো এনালগ রয়ে গেলাম।

আমার স্ত্রী সব জানেন, বোঝেন। এও জানেন তোমার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। ইচ্ছে করেই হয়তো মুখ ফুটে বলতে চান না। “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে যন্ত্রনা জাগাতে ভালোবাসে”। এক জন মানুষের জীবনে এবং মনে অনেক মানুষ এর ভুমিকা থাকে। ভাগ্যিস মানুষ অন্যের মন দেখতে পায় না, যদি দেখতে পেত সংসারের সব সুখ উড়ে যেত …

তুমি রবে নিরবে হৃদয়ে মম …

আমি আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্তই রয়ে যাব। সব কিছু ফেলে যদি তোমার আগে চলে যাই তবে একটা অনুরোধ করতে চাই। আমার মৃত্যুর পর যদি আমার লাশ (মানুষ মরে গেলে লাশ হয়ে যায়, এই শব্দটা আমার একদম পছন্দ নয় ) দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যদি তোমার হয় তাহলে আমার সংগ্রহে থাকা “সাগর সেনের” রবীন্দ্র সঙ্গীত গুলো শুনাবে … আমি জানিনা মানুষ মরার পর কোথায় যায়, হয়ত তুমিও …

কেন আজ মৃত্যুর কথা লিখলাম …
আমি তো নতুন স্বপ্ন দেখছি ২০২১ নিয়ে তা তুমি জানো। মান্না দের একটি গানের কলি দিয়েই আজ শেষ করছি “স্বপন যদি মধুর এমন, হোক সে মিছে কল্পনা, জাগিও না, আমায় জাগিও না।”

ভালো থেকো, সুস্থ থেকো, সুন্দর থেকো শুধু নিজের জন্য। আর আমিও ভাল থাকব। ভাল থাকার জন্য যে জীবন আমি বেছে নিয়েছি, ভাল না থেকে কি পারি বলো।
মিতা।

মন কেমনিয়া

272733

এই যে শীতকালীন বৃষ্টি! এলোমেলো হাওয়া! আস্তে আস্তে আলো নেমে যাচ্ছে ওই দূরের নারকোল গাছের পাতার আড়ালে। শীতের হাওয়া বারান্দা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমার ঘরে। দিনান্তের অনন্ত ক্লান্তি অফুরান্ত হাসি নিয়ে বসে আছি ক্যানভাসের সামনে। শীত আদরের চাদর খানি খসে পড়বে রাতের মন-কেমনিয়া রূপকথার মতো। রাতের কুয়াশার মতো ঘিরে ধরবে মায়া। কিছুতেই ফিরতে পারবে না আনমনা মন।

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ৯

270649

বেলা গড়াচ্ছিল তাই পশ্চিম বার্লিনে যা কিছু করার তা শেষকরার তাগাদা অনুভব করলাম। দুপুর ২টার দিকে প্রথম ট্রেন। ওটা ধরতে পারলে হোক ভ্যান হল্যান্ড হতে রাতের ফেরী ধরা যাবে। এবং ইংল্যান্ডের হারউইচ পোর্টে পৌঁছানো যাবে খুব সকালে।

বন্ধু আসাদকে ফোন করলাম। কথা ছিল নেমেই ফোন করে জানাব আমার অবস্থান। এবং দুজনের সময় মিলে গেলে দেখা করবো কোথাও। আসাদ চৌধুরী আমার সোভিয়েত জীবনের বন্ধু। একই ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছি। একবছর আগে কোর্স শেষ করে ও চলে এসেছে জার্মানিতে। পশ্চিম বার্লিনের স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু একটা পড়ছে।

ফোনের অপর প্রান্তে ওর গলা শুনে মনেহল আমি ওর ঘুম ভাঙ্গিয়েছি। আমি জানি ও রাতে কাজ করে। এবং বাসায় ফিরে অনেক রাত করে। ক্ষমা চাইলাম অসময়ে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্যে। এ যাত্রায় দেখা না হলেও ফেরার পথে একরাত তার অতিথি হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে ফোন রেখে দিলাম।

দুপুরের খাবার স্থানীয় এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রওয়ানা দিলাম ওদিকে। সকাল ১১টায় খুলে দুপুর ৩টায় বন্ধ করে শহরের একমাত্র ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্ট হলেও কোন জৌলুষ নেই ওখানে। নেই প্রয়োজনীয় গ্রাহক সার্ভিস। নড়বড়ে ২/৩টা টেবিল সাথে বাঁশের তৈরি টুল। হাতে সময় থাকলে প্রতিবার এখানেই দুপুরের খাবার সেরে নেই।

প্রতিবারের মত এবারও গ্রাহকদের কমতি দেখলাম না। জায়গা না পেয়ে অনেকে দাঁড়িয়েও খাচ্ছে। টেবিলের অপেক্ষায় থাকলে ট্রেন মিস করার সম্ভাবনা আছে, তাই লাইন ধরে অন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে ভারতীয় মালিক তা করতে দিলেন না। খাবার হাতে নিতে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ওখানে বসার জায়গা ছিল। রেস্টুরেন্টের স্টাফদের সাথে অনেকদিনের পরিচয়। এখানটায় আসলে বেশ-ভাল খাতির করে সবাই। খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চায় এ শহরে আগমনের হেতু। এ যাত্রায়ও ব্যতিক্রম হলনা।

রেল স্টেশন ততক্ষণে গিজগিজ করছে যাত্রীদের ভিড়ে। লোকাল ট্রেনগুলো হতে দলে দলে যাত্রীরা নামছে এবং আন্তঃ ইউরোপীয় ট্রেনের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক প্ল্যাটফর্ম হতে অন্য প্লাটফর্মে।

আমার ট্রেনের সময়সূচী ভাল করে যাচাই বাছাই করে প্লাটফর্ম চেঞ্জ করলাম। পশ্চিম জার্মান শহর হ্যানোভার ও নেদারল্যান্ডের রটোরড্রাম হয়ে হোক ভ্যান হল্যান্ড পোর্ট পর্যন্ত পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।

পূর্ব ইউরোপ হতে আসলে পশ্চিম ইউরোপের এ ট্রেন-জার্নি উপভোগ না করে উপায় নেই। মাইলের পর মাইল গ্রাম গঞ্জ শহর বন্দরের বুক চিড়ে ছুটে চলে দ্রুত গতির এ ট্রেন। হরেক রকম মানুষ, বিচিত্র সব ভাষা, সাথে বিভিন্ন দেশের সীমান্ত অতিক্রমের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে বিশাল ক্যানভাসের এ জার্নি সহজে ভুলার নয়।

টিকেটের সাথে বগির নাম্বার মিলিয়ে উঠে পরলাম ট্রেনটায়।

চলবে

যোদ্ধা …

272712

তাঁকে দেখে মনে হয়েছে
সে এক বৃক্ষের জীবন
তাঁর জীবনের সাথে কোন এক অপেক্ষামান
জীবনের মিল রয়েছে।

তার চোখ সৃষ্টির প্রাচীন ইথার স্পর্শ করেছে,
এবং অনেক ধ্বংস দেখেছে,
অনেক গৌরব দেখেছে।

অতীত,
প্রথম প্রেমের আনন্দে তার হৃদয় স্পর্শ করলে
সবুজ পৃথিবী নববধূর মতো জ্বলে ওঠে।

প্রেম যখন গৌরবের নগরীতে
খ্যাতির বিড়ম্বনা নিয়ে আসে,
তখন কোথায় থেকে যেন এক অনাহত দিন চলে আসে
তখন হৃদয় ভেঙ্গে যায়
এবং একাকী তীরবিদ্ধ হরিণীর মতো কুঁকড়ে যায়।

মানুষ যখন একটু আনন্দ আর একটু স্বপ্ন নিয়ে
নিজের পৃথিবী তৈরি করে, তখন সম্পর্কের ক্ষেত্রটা একটা ধাঁধা।

এটি একটি নতুন দিনের জন্ম দেয়।
এই দিন থেকেই শুরু হয়
কোন এক অস্তিত্বহীন শরীর
যা সময়ের গিরিখাদে পড়ে হঠাৎই কোমায় চলে যায়

সময়ের সাহসী এই যোদ্ধারা
খুব সহজে হেরে না গেলেও তাদের সময় যেন
ফড়িং এর জীবন নিয়ে এগিয়েছে।

অথবা যখন স্মৃতির আভা
তার হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে,
তখন দুঃখের শোকার্ত পাখিটি
তার দুর্বল ডানাগুলিকে উড়াতে চাইলেও
ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মৃত্যুর পথে নিয়ে যায়।

আপনি কি আপনার
রেখে যাওয়া অতীত নিয়ে সামনের
দিনগুলিতে বাঁচবেন?
আপনি যদি তা করেন তবে আপনি নতুনকে
কোনভাবেই স্বাগত জানাতে পারবেন না।

যদি বল অতীত আমার শিক্ষা,
তাহলে তুমি নায়ক হতে পারো,
তাহলে তুমি নায়িকা হতে পারো।
এটি করা অবশ্যই সম্মানের বিষয়,
এবং এটি সেখানেই শেষ হওয়া উচিত।

কারণ এই মহাজাগতিক জীবন
মহা রহস্যময় আলোর পাত্র।
প্রত্যেকের জীবন এখানে শিক্ষণীয়
যে শিক্ষা থেকে একটি নতুন সৃষ্টি শুরু করবে।
যা হবে মহান জীবনের চিরন্তন অধ্যায়।

ভুলে যাবেন না যে জীবন প্রগতিশীল
আর দুষ্প্রাপ্য, সে জীবন যখন
এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে
তখন কোন কিছুই মন্দ নয়।

জীবনের এই অসীম সময়ে দাঁড়িয়ে
আপনি যদি আজ নিজেকে
সুখী করতে না পারেন,
তবে আপনার জীবনের সেই নতুন অধ্যায়
কখনোই শুরু হবে না।

জনমের নামে হৃদয়ের ক্যানভাসে
যে নাম লেখা হবে সেই আবদ্ধ জীবনের
উৎকৃষ্ট সাধনায়, সেই দ্বিতীয় জীবনই
আপনার প্রকৃত ভবিষ্যৎ।

মূর্তির ছদ্মবেশে এই জীবন,
যখন প্রেমময় ধূসর পায়রার গোড়ায়,
নদীর মোহনায়, সমুদ্রের ঢেউয়ের আধারে,
বসন্তের কোকিলের সুর তৈরি করবে
তখন জীবন হয়ে উঠবে নতুন স্বপ্ন ভাণ্ডার।

সেই জীবন ভালোবাসার আলোয়
আলোকিত হবে, দুঃখকে অন্ধকারে ফেলে ভালোবাসার ইতিহাস গড়বে।
এর চেয়ে সফল জীবন আর কোন জীবন নয়।

সেই জীবনের চেয়ে সুন্দর
আর কিছু নেই, আমরা এমন জীবন চাই।
যা হাজারো অধ্যায় পেরিয়ে
আপনার মতো এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে।

ভালোবাসায় তুমি

272623

তোমাকে স্মরণ করতে ভালো লাগে
শীতের সকালে হিমেল হাওয়ায়,
রোদের উষ্ণতায় সেজদায় পড়ে।

তোমাকে ভাবতে ভালো লাগে
আমার ভালোবাসায়,
দিন বা রাতে কাজ শেষে।
স্নিগ্ধ আলোর জ্যোৎস্নায়,
কোরান পড়ার মিহি সুরে।

তোমাকে ডাকতে ভালো লাগে
আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে
কারণ তুমি আছো আমার সমস্ত বিশ্বাসে
হৃদয়ের গভীর আঙ্গিনায় কিংবা বাহিরে।

তুমি রহমান, তুমি রহিম, তুমি করিম
তুমি পরম করুণাময়, তুমিই আমাকে সৃষ্টিকারী।

ডায়েরি

271602

সেদিনের দিনগুলো
থমকে যাওয়া মুঠোয়
আটকে দেওয়া সময়ের
নীরব ঘর কুঠোয়।

দিনগুলো সব পিছিয়ে গেছে
সময় চলছে এগিয়ে
সুখ দুঃখের জীবন পথে
স্মৃতি নেয় বাগিয়ে।

ফেলে আসা সময়
ফেলে আসা দিন
রেখে যাওয়া স্মৃতি
কখনও বিষন্ন মন
কখনো রঙিন।

এভাবেই বয়ে যায় সময়
এভাবেই হয় লেনাদেনা
হয় কিছু ঋণ
হয় বেঁচে যাওয়া
হয় বেঁচে থাকা।

কখনো বা অন্ধকার
কখনোবা আলো
প্রদীপের নিচে যার
সবকিছু কালো
মরণের লড়াইয়ে
বেঁচে থাকার আমরণ যুদ্ধ

জীবনের লেনাদেনা যা
এই পথে থেকে যাবে সব
তারপর মিশে যাবে
এই মাটিতেই
হবে তা একদিন নীরবেই শুদ্ধ।

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ৮

2702278

পশ্চিম বার্লিনে ওটাই ছিল আমার শেষ আসা। কোথায় যেন একটা লুকানো কষ্ট বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল কেবল জার্মানি নয়, বরং ইউরোপকে বিদায় জানানোর সময় হয়েছে। মস্কো অথবা সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ট্রেনে করে লন্ডন যাত্রার পথে পোল্যান্ড, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম অথবা নেদারল্যান্ডের পথেঘাটে অনেক স্মৃতি, অনেক না-বলা কথা যা হয়ত জীবনের অন্তিম বেলায় হাতড়াতে গেলে কষ্ট লাগবে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে।

১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে প্রথম আসা পশ্চিম বার্লিনে। বার্লিন দেয়ালের ঝামেলা আর পূর্ব জার্মান ইমিগ্রেশনের লৌহবলয় পার হয়ে এ শহরে পা রাখতেই মনে হল জীবন এখানে অন্যরকম। পূর্ব ইউরোপের তুলনায় বাতাস এখানে অনেক হাল্কা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়না। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মত পদে পদে এখানে কেউ কাউকে নজরদারি করেনা। দুই পরাশক্তির ফোরফ্রণ্ট এ শহরে প্রথমবারের অভিজ্ঞতাটাও ছিল মনে রাখার মত।
মস্কো হতে পূর্ব জার্মান ও নেদারল্যান্ডের ভিসা নেয়ায় যে যাত্রায় পূর্ব বার্লিনে তেমন কিছু করার ছিলনা। সকাল সকাল বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে বসে আছি Zoologischer Garten রেল ষ্টেশনে।

নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড-গামী ট্রেন দুপুরের দিকে। নষ্ট করার মত হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। সাথে বন্ধু রহমান। ও ইতিমধ্যে ঘুরে গেছে এ পথে, তাই অনেক কিছু ছিল তার পরিচিত। কিছু দোকানপাট ইতিমধ্যে খুলে গেছে। শূন্য রাস্তাঘাটেও বাড়ছে গাড়ির ভিড়। ষ্টেশনের পাশেই একটা কফি শপ। ওখান হতে গরম এক কাপ কফি কিনে হাঁটতে শুরু করলাম উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে।

পাশাপাশি বেশকটা ইলেকট্রনিক্সের দোকান। এসব দোকানের মূল ক্রেতা আমার মত পূর্ব ইউরোপ হতে আসা পরিব্রাজকের দল। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে পশ্চিমা ইলেকট্রনিক্সের ব্যাপক চাহিদা। বিশেষকরে উন্নত মানের মিউজিক সেন্টার গুলো। দোকানদার আমাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারল আমরা সোভিয়েত দেশের মানুষ।

উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানালো হরেক রকম পণ্যে সাজানো স্টোরগুলোতে। অলস সময় কাটানোর মোক্ষম জায়গা। এলপি রেকর্ডের বিশাল ভাণ্ডারে চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো যায় বাজারে আসা নতুন নতুন গান শুনে।

হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ফিস ফিস শব্দে বাংলা বলছে। এদিক ওদিক তাকাতে চোখে পরল স্টক-রুমের স্লাইডিং ডোর খুলে কেউ একজন আমাকে ডাকছে। এবং তা বাংলায়। উৎসুক হয়ে ওদিকে পা বাড়ালাম।
বাংলাদেশি সোহেল আহমেদের সাথে পরিচয়টা ওখানেই। গলার স্বর অনেকটা নীচে নামিয়ে ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল পুলিশের ক্যাডাবরা কুকুর আমাকে তাড়া করেছিল কিনা। একটু অবাক হলাম। কারণ আমার জানা ছিল পশ্চিম ইউরোপের পথেঘাটে পুলিশ তাদের ক্যাডাবরা কুকুর টুরিস্টদের লাগেজের পেছনে লেলিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, ড্রাগের সন্ধান!

আমি টুরিস্ট এবং ২৪ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসায় এখানে এসেছি শুনে অবাক হল সদ্য পরিচিত বাংলাদেশি সোহেল আহমেদ। উনার কাছেই পেলাম দলে দলে বাংলাদেশিদের এখানে আসার অনেক অজানা তথ্য।

সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশিদের জন্য দুই জার্মানির একটাতেও ভিসার প্রয়োজন হয়না। সুযোগ নিয়ে সোভিয়েত ক্যারিয়ার এরোফ্লট গাদা গাদা বাংলাদেশিদের নিয়ে আসছে পূর্ব জার্মানিতে। ওখান হতে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে সবাই ভিড় জমাচ্ছে পশ্চিম বার্লিনে। যাদের একটু ইংরেজি জানা আছে তারা ছড়িয়ে পরছে পশ্চিম জার্মানির বিভিন্ন শহরে।

আমি এখানে থাকতে আসিনি শুনে আকাশ হতে পরলেন সোহেল সাহেব। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ওনার বাড়ি ঢাকার রূপগঞ্জে। এবং ঐ এলাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব গোলবক্স ভূঁইয়া সম্পর্কে উনার চাচা। গোলবক্স ভূঁইয়া ছিলেন আমার আব্বার বন্ধু। সব খুলে বলতে সোহেল সাহেব খুব আপন করে নিলেন আমাকে। সময় থাকলে তার বাসায় ঘুরে আসারও দাওয়াত দিলেন। এক রুমের বাসায় আরও দশজন বাংলাদেশির বাস। খুঁজলে পরিচিত আরও অনেককে পাওয়া যাবে বলে আশ্বাস দিলেন।

ইলেকট্রনিক্স ষ্টোরের স্টক-রুম লুকিয়ে লোড-আনলোডের কাজ করেন তিনি। সময় অসময় পুলিশ এসে হানা দেয় অবৈধ অভিবাসীদের খোঁজে, তাই সবসময় নিজকে লুকিয়ে রাখেন স্টক-রুমে।

দেশে গেলে পরিবারের সাথে দেখা করার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান হতে।

কোথায় যেন একটা কষ্ট দানা বাঁধতে শুরু করে প্রবাসে এসব বাংলাদেশিদের কথা শুনলে।

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ৭

270828

বার্লিন দেয়াল। দেশ, মহাদেশ, এমনকি সংসার বিভক্তির দেয়াল দেখেছি। সময়ের প্রবাহে সবই মেনে নিয়েছি। অভ্যস্ত হয়ে গেছি এসব বিবর্তনে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী এই বার্লিন দেয়ালের সামনে যতবার দাঁড়িয়েছি ততবার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেছে অদ্ভুত একটা শীতল শিহরণ। মেনে নিতে কষ্ট হয় কেবল একজন মানুষের কারণে প্রাণ হারিয়ে ছিল কোটি কোটি মানুষ। দেয়ালের সামনে দাঁড়ালে সেলুলয়েডের ফিতার মত চোখের সামনে ভেসে উঠে ১৯৪৫ সাল।

যুদ্ধের পূর্ব ফ্রন্ট হতে রুশদের বার্লিন অভিযানের কাহিনী কেবল সিনেমায় দেখিনি, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক সৈনিকের মুখ হতে শুনেছি এর ভয়াবহতা। আমার ইতিহাস শিক্ষক আনাতোলি স্তেপানভিচ তার যুদ্ধাভিযান শেষ করেছিলেন এই বার্লিন শহরে। আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষ প্রহরে ট্যাংকে চড়ে ঘুরে বেরিয়েছিলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বার্লিন শহরে। এ দৃশ্য বর্ণনা আবেগে থর থর করে কাঁপছিলেন। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছিল অশ্রুধারা। একটা ডকুমেন্টারিও দেখিয়েছিলেন ক্লাসে। সেখানে তিনি ছিলেন। শত শত তরুণ সৈনিকদের মাঝে হ্যান্ডসাম একজন। হাতে বেয়নেট সহ রাইফেল।

আমাদের ডর্মের গার্ড তাতিয়ানা আলেক্সেয়েভনার স্বামী প্রাণ হারিয়েছিলেন বার্লিন যুদ্ধে। তিনি নিজেও ছিলেন বার্লিনের দোরগোড়ায়। নার্স হিসাবে সেবা করেছিলেন যুদ্ধাহত সৈনিকদের। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনলে রক্ত হিম হয়ে আসে।

ব্যাটল ফর বার্লিন মিশনে পশ্চিম হতে আসা মিত্র বাহিনীর বাকি দেশের সৈন্যরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে দখল নেয় শহরে এক অংশ। এই অংশই তখন পশ্চিম বার্লিন হিসাবে পরিচিত ছিল। বার্লিনের পূর্ব অংশের দখল চলে যায় সোভিয়েতদের হাতে। পূব ও পশ্চিম বার্লিনের বিভক্তি নিশ্চিত হয় মিত্র বাহিনীর নিজেদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে।

এর আগে কম করে হলেও ত্রিশ বার অতিক্রম করেছি বার্লিন দেয়াল। হয় চলন্ত ট্রেনে, অথবা পায়ে হেঁটে। ট্রেনের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না হওয়ায় সাধারণত হেঁটেই মোকাবেলা করেছি একই শহরে দুই রাজার শাসন।

দেয়ালের দুই পাশে দুই ধরণের জীবন। পূবের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় সমাজতান্ত্রিক শাসনের কঠিন যাঁতাকলে। পশ্চিমে পুঁজিবাদের বাজার ভিত্তিক খোলা অর্থনীতি। পার্থক্যটা চোখে পরতে বাধ্য।

পশ্চিম বার্লিনে পা রাখা মাত্র চোখ পরবে এর চাকচিক্য। চারদিকে আলোর ঝলকানি। হরেক রকম গাড়ির মিছিল। পাশাপাশি দারিদ্রের অবস্থানও চোখে পরতে বাধ্য। গৃহহীনরাও হাঁটছে পাশাপাশি। ওদের কোন গন্তব্য নেই। এলোমেলো হেটে বেড়ানো মানুষরা মনে করিয়ে ঝলমলে আলোর অন্য-পীঠেই বাস করে অন্ধকার এক জীবন।

শহরের Zoologischer Garten ষ্টেশনের প্লাটফর্মে মাতাল গৃহহীনদের দেখলে একটা সন্দেহ দানা বাধতে বাধ্য; ওরা আসলেই কি বাজার অর্থনীতির বাই-প্রোডাক্ট, না-কি জীবন হতে পালিয়ে বেড়ানো একদল ব্যর্থ মানুষের সেলফ আইসোলেশন।

বার্লিনের পূর্ব অংশেই যত পুলিশ ও ইমিগ্রেশন ঝামেলা। পশ্চিমে এর নাম গন্ধ নেই। দেয়াল সীমান্তে পূর্ব জার্মান পুলিশদের দেখলে মনে হবে দম দেয়া একদল হায়েনা। হায় হ্যালো বলার সংস্কৃতি নেই। চেহারায় সব সময় একটা বিরক্তির ভাব। চোয়াল থাকে শক্ত। বরাবরের মত এ যাত্রায়ও পূর্ব জার্মান পুলিশের হাতে পাসপোর্ট হস্তান্তর করা মাত্র জমে গেল। পাসপোর্ট পাতার ছবির পৃষ্ঠা খুলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। কম করে হলেও দশবার টার্গেট বদল করল। একবার আমার দিকে, আবার পাসপোর্টের দিকে।

এসব দৃশ্যের সাথে আমার অনেকদিনের পরিচয়। তাই অবাক হলাম না। ভিসা নিয়েই দেশটায় পা রেখেছি। তাছাড়া পূর্ব জার্মানিতে অবৈধ অভিবাসীদের কোন চাপ ছিলনা। এ দেশে বাইরের পৃথিবী হতে কেউ থাকতে আসেনা। পুলিশের চোখের তেলেসমাতিতে তাই ভীত হওয়ার কোন কারণ ছিলনা আমার। আমি জানি এভাবেই ওদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।

এই দেয়াল এক অর্থে দুই পরাশক্তির ফোর ফ্রন্ট। তাই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এ নিয়ে সন্দেহ ছিলনা। ট্রেনে করে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করতে গেলে নিরাপত্তার অংশ হিসাবে হোস পাইপ দিয়ে গরম পানি ঝড় বইয়ে দেয়া হয় ট্রেনের তলায়। এভাবেই নিশ্চিত করা হয় পূর্ব জার্মানদের কেউ লুকিয়ে পশ্চিমে যাচ্ছেনা।

কম করে হলেও পাঁচ মিনিট সময় নেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। কোন প্রশ্ন থাকলে তা খাঁটি জার্মান ভাষায় ছুড়ে দেয়। সমস্যা দেখা দিলে এসকর্ট করে নিয়ে যায় গোপন কুঠুরিতে।

না, এ যাত্রায়ও আমার কোন সমস্যা হলোনা। খটাস করে এক্সিট সিল মেরে ফিরিয়ে দিল পাসপোর্ট। তিন চার কদম হাঁটলেই পা রাখা হয় পশ্চিম বার্লিনে।

অনেকদিন পর আবারও পশ্চিম বার্লিনে। সকাল প্রায় ১১টা। জীবন ততক্ষণে ফুল স্কেলে এগিয়ে চলছে। চারদিকে গাড়ির মিছিল। বিপণি বিতানগুলোতেও মানুষ গিজ গিজ করছে। পীপ শো গুলোতেও ভিড়। ওখানে কাউন্টারে জার্মান মার্ক ঢাললে ছোট একটা জানালা খুলে যায়। মেয়েদের লাইভ কাপড় খোলা দেখার বিনোদনের জায়গা। কাছেই অনেক হার্ড-কোর পর্ণের মুভি থিয়েটার। বার্লিনের পূব পাশে এসব অকল্পনীয়। অনেক ক্ষেত্রে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুই সমাজ ব্যবস্থার পার্থক্য বাস্তবতা উপলদ্বি করার পারফেক্ট প্রেক্ষাপট।

দুইটার দিকে আমাকে নেদারল্যান্ড গামী ট্রেন ধরতে হবে। ব্যায় করার মত কিছুটা সময় আছে হাতে। দেশে ফোন করতে হবে। মার সাথে কথা বলা হয়না অনেকদিন।

প্রতিবার পশ্চিম বার্লিনে পা রেখে প্রথম যে কাজটা করি তাহলো ফোন করে বাড়ির সবাইকে অবাক করে দেয়া। পূর্ব ইউরোপের কোন দেশ হতেই এমনটা সম্ভব ছিলনা। ফোন করতে গেলে আগ বাড়িয়ে পোষ্ট অফিসে বুক করে আসতে হয়। ওরা ফোন করার সময় সীমিত করে দেয়। আমার ১২ বছরের সোভিয়েত জীবন কেবল দুইবার সক্ষম হয়েছিলাম দেশে কথা বলতে। তাও কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। এমনটাই ছিল সমাজতান্ত্রিক রীতিনীতি।

চলবে

শেষ বেলার গান ৩

‘যখন ভাঙলো … ভাঙলো মিলনমেলা ভাঙলো …’। সেই কবে অদূর ভবিষ্যতের কোনো এক দিন বা রাত্রির হিসাব ধরে মানুষ আনন্দের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। একে একে গোনা হতে থাকে দিন, সপ্তাহ, মাস। আর অবশেষে সেই অমোঘ মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে।

মঞ্চ তখন প্রস্তুত। তার আভরণ সব এসে পৌঁছে যাচ্ছে। শেষ টেনশনের ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে পরিচালকের হাতের আঙুল বেয়ে ঠোঁট থেকে ওপরের স্ট্রাসের কাঠামোর দিকে। প্রস্তুত কুশীলবেরা তাদের সংলাপের নিবিড় অনুশীলনের পরে। আলো শিল্পী, আবহ শিল্পী, প্রসাধন শিল্পী, মঞ্চ শিল্পী, পোষাক শিল্পীরা বেজায় ব্যস্ত হয়ে ডাউন রাইট থেকে আপ লেফট প্রতিমার চক্ষুদানে টেনে চলেছে তুলির আঁচড়। ড্রপসিন অপেক্ষায় ঝোলে আর কিছু পরেই মালাবদল।

এত ব্যস্ততা, এত শোরগোল, এত চিন্তার জমাট বুনন ছিঁড়ে এক সময়ে সব আলো নিভে যায়। কুশীলবেরা ফিরে গেছে নিজের চিলতে বাসে পরের অধ্যায়ের প্রস্তুতির জন্য। মানুষের আপাত মিলনমেলা ভেঙে যায়, তবু জারি থাকে খোঁজ।

খোঁজ জারি থাকে মানুষ আর নিহিত ভালোবাসার। খোঁজে কেটে যায় সম্পূর্ণ এক নষ্ট জীবন। অন্তরালে সূর্য ডাকে, “আয়…আয়…ও অবয়ব আয় তোকে ঔজ্জ্বল্য দিই, উত্তাপ দিই। আয় রে ছায়া তোকে দিই রোদ্দুর।” আঘাতের পরে আঘাতে বোধশূন্য ছায়াবয়ব সেই একচিলতে আশাতেই বাঁচে … হাঁটে … এগিয়ে চলে সামনের উন্মোচন উৎসবের সন্ধানে। ঠোঁটের কিনারে, মস্তিষ্কের সুপ্ত কোষে কে যেন গেয়ে চলে, “চলো মুসাফির বাঁধো গাঁঠরি রাস্তা বহোত দূর হ্যায়! চরৈবেতি … চরৈবেতি …”

বোধের তফাৎ হলেই বোধগম্যতা দূরে সরে যায়। শিক্ষায়, মননে, চিন্তায়, কল্পনায় মিল হলে সেটাই বাড়ী হয়ে ওঠে। বোধ বেঁচে ওঠে নিজের মত করে। ভালবাসে প্রবল আবেগে। গভীরে চলে যায়, সমস্ত শরীর মন একাকার করে চুমু খায় ভালবাসাজনকে বন্যার জলের তোড়ে। সেখানেই তৈরী হবে তার সম্পূর্ণ নিজস্ব বাড়ী, তার একান্ত নিজস্ব ঘর।

হে বন্ধু … হে পথিক!

কখনোকি জীবনের লাভ-ক্ষতি
খুঁজেছ পথিক!
যদি খুঁজে ফিরতে
তাহলে অবশ্যই জানা হতো
কি করা দরকার আর কি না করা উচিত!

কখনো কি ব্যথা ভেঙ্গে
পাহাড়ে উঠেছ পথিক?
আমি যতবারই উঠেছি
ততোবারই জীবনের বেতাল
সে পথ সংকুচিত হয়েছে।

কিছুটা ভুল আমারও ছিল,
কিছুটা ভুল তোমারও ছিল।
তুমি হয়তো তা স্বীকার করো না।
তবে, যদি কোনদিন বিবেকের সাথে
বোঝাপড়া করে বসে পড়ো
লাভ-ক্ষতির হিসাব টা পেয়ে যাবে
ভুলটা কোথায় কিভাবে হয়েছিল।

আমরা নিজেরা নিজেদেরকে
চিনতে পারিনা বলেই হয়তো অস্তিত্বের
রেখায় জীবনের পটভূমিকা বদলায়।
অতোটা সহজে বিদ্রোহী হইওনা
বিদ্রোহী হওয়ার কিছু নিয়ম থাকে,
নীতি থাকে পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকে
এটা হয়তো ভুলে যাও সবাই;

আজ নিজেকে কিছুটা বিদ্রোহী লাগছে
অন্তরের গোপন কুঠিরে
জীবনের এই পথে এসে
আজ বড্ড ক্লান্ত,জরাগ্রস্ত, বড্ড অসহায়।

এজন্যই হয়তো নিজেকে
কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত লাগছে
কোন কিছু নিয়ে অনুতপ্ত হওয়া
অনুভূতি শূন্য হওয়া…

সময়ের সেই সংকোচিত অন্ধকার
যখন মানুষকে গ্রাস করে, চতুর্দিক থেকে
তখন আলোর রেখাগুলো কোনভাবেই
চোখকে উজ্জ্বল করতে পারেনা;
আলোকিত করতে পারে না।
আর সৌন্দর্যের উপমায় ভরে দিতে
পারেনা অন্তঃসারশূন্য অস্তিত্বের কলরব।

এটা হয়ত তোমরা জানো না।
শয়তান আমাদের থেকে ভুল করিয়ে নেয়!
এটা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়;

আসলে আমরা আমাদের হতাশা
আমাদের লোভ, লালসা, এমনকি
প্রত্যাশার বিপরীতে কিছু পেলেই
নিজেরা হয়ে যাই বেপরোয়া
নিজেরা হয়ে যাই মানুষ থেকে শয়তান।

তোমরা বুঝতে চাওনা
শয়তান একটি রূপক শব্দ।
যে কিনা নিজের ভেতরেই বিদ্যমান।
নিজের অন্তর, নিজের অস্তিত্ব, নিজের কর্ম
এমন কী নিজের খামখেয়ালীপনাই এর জন্য দায়ী।

আর সময় যখন ভুলকে ধরিয়ে দেয়
তখন নিজেদের অপরাধটা চাপিয়ে দিই
শয়তানের ঘাড়ে’ (!)
এদিকে (!) শয়তানরা ব্যাটা বড্ড অসহায়।
আসলে মানুষের চেয়ে বড় শয়তান কে হতে পারে?

আর এটাই সেই সুযোগ,
নিজেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার এর চেয়ে
ভাল সুযোগ আর কি হতে পারে।
যা কিনা একজন অপদার্থ বিবেক
বুদ্ধিহীন মানুষকে বদলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

অন্তরে যদি বিভেদ থাকে
অন্তর যদি কলুষিত থাকে তবে সেই অন্তর
তবে সেই বিবেককে
অতঃপর সেই হৃদয়কে নিয়ন্ত্রনহীন
রাখার জন্য সেই মানুষটাই একমাত্র দায়ী।

হে মানুষ তোমার কি প্রয়োজন?
সেটা তুমি নিজেই জানো না।
তুমি কি বুঝতে পারছো
এই না-জানার জন্যই অন্তরের খেয়ালী শয়তান
আমাদের থেকে ভুল করিয়ে নেয়।

তবে হ্যাঁ, একটা কথা মনে রেখো,
কেউ কারো পিছে না লাগলে
কোনদিনও তার পিছে অন্য কেউ লাগে না।
আমরা যখন সে বিষয়টা অন্যের কাছে আড়াল করতে যাই
তখনই শুরু হয় তার প্রতিক্রিয়া।

এটাই জীবন;
জীবন যখন খামখেয়ালিতে পরিপূর্ণ
হঠকারিতায় পরিপূর্ণ, উশৃংখলতায় পরিপূর্ণ
তবে জেনে রেখো সে জীবন
অপরাধের বোঝা বহন করতে, করতে
কোন একটা সময় হঠাৎ করে ধুলিস্যাৎ হয়
যার কোন অস্তিত্ব থাকে না, চিহ্ন থাকে না।

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ৬

270188

ইউরোপ তুলনামূলক ছোট মহাদেশ। দেশ অনেক, কিন্তু একদেশ হতে অন্যদেশ আকাশ পথে রওয়ানা দিলে ভ্রমণ খুব একটা দীর্ঘ হয়না। ট্রেন জার্নির অবস্থাও একই রকম। ঘাটে ঘাটে সীমান্ত অতিক্রম করার ঝামেলা না থাকলে এক কোনা হতে অন্য কোনায় যেতে খুব একটা সময় লাগার কথা না।

প্রতিবারের মত এ যাত্রায় আমি রওয়ানা দিয়েছি পূর্ব ইউরোপের সেই সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে। পোল্যান্ড হয়ে পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিন পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে গোটা একটা দিন ও দুটো রাত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যায় হয়েছে বিভিন্ন সীমান্তে। একদিকে ইমিগ্রেশন অন্যদিকে কাস্টমস। তার উপর পোলিশ সীমান্তে ট্রেনের চাকা বদল। এসব বাধা না থাকলে দ্রুত গতির ট্রেনে সময় নিশ্চয় কমে আসতো। তবে এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ ছিলনা।

গ্রীষ্মের এ সময়টা গোটা ইউরোপ নতুন সাজে সজ্জিত হয়। কেবল প্রকৃতিই নয়, মানুষগুলোও শীতের খোলস হতে বেরিয়ে নিজেদের তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বিশেষকরে মেয়েরা। পরিবর্তনটা প্রথম চোখ লাগে তাদের পোশাকে। উপভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এসব দৃশ্য।

এ পথে অনেকবার ট্রেন ধরে ইংল্যান্ড গেছি। কখনো হল্যান্ড হয়ে, কখনো আবার বেলজিয়াম হয়ে। প্রতিটা জার্নি ছিল ইউনিক। হরেক রকম মানুষের সাথে দেখা হয় লম্বা এ পথে। ভাষার বৈচিত্র্য এতটাই বেশী মাঝে মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলতে হয় ট্রেনের কোঅর্ডিনেশন নিয়ে।

বার্লিন হতে একবার নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড গামী ট্রেনে চেপে বসেছি। বরাবরের মত সীটে বসে বাইরের পৃথিবী দেখছি। লম্বা এসব জার্নিতে জানালার পাশে বসলে এমনিতেই তন্দ্রা এসে যায়। পশ্চিম জার্মান শহর হ্যানোভারে ট্রেন ভাগ হয়ে যায়। কিছু বগি আলাদা করে জোরা লাগানো হয় বেলজিয়াম-গামী ট্রেনের সাথে। আমি ভুল ওয়াগনে বসে আছি তা বুঝতে পারিনি। বেলজিয়াম সীমান্তে ইমিগ্রেশন পার হয়েছি বিনা বাধায়, কারণ আমার ট্রানজিট ভিসা ছিল BENELUX এর। যা বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড সহ লুক্সেমবার্গকেও কভার করছিল। ট্রেন ব্রাসেলস আসার পরও সন্দেহ হয়নি। ভেবেছিলাম হয়ত ব্রাসেলস হয়ে রটোড্রামের দিকে যাবে। নতুন সীমান্তে ফ্রেঞ্চ ভাষা শুনতেই ভয়টা চেপে ধরল। আমি ভুল পথে রওয়ানা দিয়েছি।

আমি নিজকে আবিষ্কার করলাম ফ্রান্সের সীমান্তে। দেশটার ইমিগ্রশনের হাতে পাসপোর্ট তুলে দিতেই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। ফ্রান্স যাওয়ার ভিসা নেই আমার। ট্রেন হতে নেমে বর্ডার পোস্টে যেতে বাধ্য করলো আমাকে। সবকিছু খুলে বললাম ওখানে। নতুন করে বেলজিয়াম হয়ে নেদারল্যান্ড যাওয়ার অর্থ ছিলনা আমার পকেটে। হাতের টিকেট উলটে পালটে দেখে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কি যেন একটা লিখে দিল ওরা। সান্ত্বনা দিল, হাতের টিকেট দিয়েই নাকি শেষ গন্তব্যে যাওয়া যাবে। এবং উৎকণ্ঠার চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে ছিলাম হোক ভ্যান হল্যান্ড বন্দরে।

পূর্ব বার্লিনের কফি শপটায় বসে অলস কিছু সময় কাটাতে বাধ্য হলাম। প্রতিবারই তাই করি। এ শহরে দেখার মত তেমন কিছু নেই। যা দেখার তা দেখতে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। শহরের সবকিছুতে যুদ্ধের স্মৃতি।শহরের প্রতিটা দেয়াল, রাস্তা-ঘাটের নিজস্ব কিছু কথা আছে। আছে ধ্বংস ও মৃত্যুর কাহিনী। দেশটার কম্যুনিস্ট সরকার সযত্নে লালন করে চলছে এসব কথা। নতুন প্রজন্মের জন্যে সৃষ্টি করে রেখেছে মগজ ধোলাই কারখানা।

এসব কথা বাইরে আসেনা। রাস্তায় হাঁটলে বুঝা যাবেনা। কিন্তু বাতাসে কান পাতলে এখনো শোনা যাবে ১৯৪৫ সালের মে মাসের তাণ্ডব। শোনা যাবে পূব দিক হতে আসা সোভিয়েত ট্যাংক বহরের ভারী আওয়াজ। পূর্ব বার্লিনে প্রথম বার পা রেখেই এর অলিগলি হেটে নিয়েছি। Brandenburg Gate, Reichstag Building’র মত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও অনুভব করার চেষ্টা করেছি ইতিহাসের স্পন্দন।

সকাল সাড়ে নয়টায় ব্রিটিশ এম্বেসি তার ভিসা কার্যক্রম শুরু করে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই ওদিকটায় রওয়ানা দেয়ার তাগাদা অনুভব করলাম। খোলার সাথে সাথে ঢুকতে পারলে তালিকায় প্রথম হওয়া যায়। এবং ঘণ্টা খানেকের ভেতর ভিসা প্রক্রিয়া শেষ করে বাকি কাজ করার যথেষ্ট সময় হাতে থাকে। অবশ্য আমার মত পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশ হতে ভিসা প্রার্থীর সংখ্যা এখানে একেবারে হাতে গোনা। মূলত যারা আসে তারা বয়স্ক পূর্ব জার্মান। নির্দিষ্ট একটা বয়সের পর পূর্ব জার্মানদের পশ্চিম ইউরোপের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তাও এক লম্বা প্রক্রিয়ার পর। বাইরের জানালা গলে ভেতরে চোখ বুলাতে মন হালকা হয়ে গেল। ভিসা সেকশনে তেমন কেউ নেই।

এম্বেসির মূল ফটকে চুল হতে মাথা পর্যন্ত পরখ করার পর পাসপোর্ট পরীক্ষা করলো। এর আগেও এখান হতে ভিসা সংগ্রহ করেছি। ওটাই ছিল আমার ক্লিয়ারেন্স। ভেতরে ঢুকে চেনা পথ গলে হাজির হলাম ভিসা সেকশনে। যান্ত্রিক একটা হাসি দিয়ে এক সেট ফর্ম চাইলাম। পালটা কোন হাসি না পেলেও ফর্ম পেতে দেরী হলোনা।

লম্বা ফর্ম। প্রশ্ন অনেক। তবে এসবের উত্তর আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অনেকটা যান্ত্রিক কায়দায় পূরণ করে দ্রুত জমা দিলাম কাউন্টারে। সাথে ফী।

মিনিট দশেক পর কাউন্টারে ডাক পরলো। তাদের প্রশ্ন একটাই; মস্কো হতে ভিসা না নিয়ে কেন এখানে এসেছি? উত্তর আমার মুখস্থ ছিল। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে মস্কো প্রায় ৮/৯ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি, এবং তা উলটো দিকে। তাছাড়া মস্কো যেতে আমার মত বিদেশীদের ভিসা লাগে। ওখানে হোটেলে থাকতে গেলে ইন্টারনাল ভিসা দেখানো বাধ্যতামূলক। মস্কোস্থ ব্রিটিশ দূতাবাসে ভিসার জন্যে লম্বা লাইন দিতে হয়। এবং তার জন্যে সকাল ৭টার ভেতর ওখানে হাজির হতে হয়।

ব্রিটিশদের কনভিন্স করার জন্যে আমার কারণ গুলো যথেষ্ট ছিল। প্রথম বার ভিসা নেয়ার সময়ই তা বুঝে নিয়েছিলাম। নিশ্চিত না হয়ে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে ভিসা নিতে আসতাম না।

ব্রিটিশ দূতাবাস হতে ভিসা নিয়ে বের হতে ১১টা বেজে গেল। ইতিমধ্যে পূর্ব বার্লিন শহর জেগে উঠেছে। চারদিকের ব্যস্ততা চোখে পরতে বাধ্য। তবে এসব ব্যস্ততা কোন অর্থেই পশ্চিম ইউরোপের ব্যস্ত কোন শহরের মত না। শ্রীহীন সোভিয়েত গাড়ি, চাকচিক্যহীন ধীরগতির ট্রাম, লম্বা ট্রলি-বাস ও সাথে বিক্ষিপ্ত জনমানুষের চলাচল কোনভাবেই পাশের পশ্চিম বার্লিনের চেহারার সাথে মেলানো যাবেনা। একই মহাদেশে যেন ভিন্ন দুই পৃথিবী। রাস্তায় দেখা মানুষের চেহারা ও পোশাকেও পার্থক্য ধরা পরতে বাধ্য। এখানের সবকিছুই কেমন মলিন এবং অনেকটা স্থবির।

ইতিহাস ভূগোল ভেবে নষ্ট করার মত সময় ছিলনা আমার হাতে। বেশকিছুটা হাঁটতে হবে শহরের রাস্তা ধরে। তারপর উঁচু একটা দালানের লিফট ধরে উঠতে হবে বেশকিছুটা উপরে। গন্তব্য, নেদারল্যান্ড দূতাবাস। ওখানেও ভিসা নিতে হবে।

চলবে

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ৫

2702211

পোল্যান্ড হতে রওয়ানা দিয়ে ট্রেনে খুব একটা ঘুমাতে পেরেছি তা নয়। চার বিছানার কম্পার্টমেন্টে দুটোই ছিল খালি। একমাত্র সহযাত্রী ওয়ারশ হতে যোগ দিয়েছে। প্রয়োজনীয় কিছু কথা ছাড়া তেমন কোন বাক্যালাপ হয়নি। উঠার সাথে সাথে ব্যাগ হতে ভদকার বোতল নামিয়ে বসে গেছে নিজ কাজে।

পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে এ আজব সংস্কৃতি। ট্রেনে ওভার-নাইট জার্নি ও ভদকার সাথে তাদের সম্পর্কটা যেন অবিচ্ছেদ্য। ওরা এ কাজটা করবেই। ট্রেনে উঠা মাত্র পরনের কাপড় ছেড়ে রাতের পোশাক পরে বের করবে বোতল। এবং তা চলতে থাকবে স্টক না ফুরানো পর্যন্ত। মাতলামির চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পরবে। এবং শুরু করবে নসিকা্র মাল্টি ডিরেকশনাল মিউজিক।

এ যাত্রায় আমাকেও যোগ দেয়ার অনুরোধ করেছিল সহযাত্রী। ধন্যবাদ জানিয়ে আমার লম্বা জার্নির কথা জানাতে আর বেশী জোরাজুরি করেনি।

খুব ভোরে জার্মান পুলিশের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ডাকের তীব্রতা এতটাই রুক্ষ যাদের হার্টে সমস্যা তাদের বেলায় তা হয়ত চরম কোন পরিণতি ডেকে আনতে বাধ্য। আমি অবশ্য এসবের সাথে ইতিমধ্যে আপোষ করে নিয়েছি। মেনে নিয়েছি জার্মানরা এমনই।

ঢাকার সদরঘাটে দেখা ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের মত গলায় একধরণের ট্রে ঝুলিয়ে পঙ্গপালের মত ওরা ঢুকে পরে ট্রেনের বগিতে। চোখেমুখে মনুষ্যত্বের কোন ছায়া থাকেনা। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে সাইন্স ফিকশনের একদল রোবট। আন্তর্জাতিক সীমান্তের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে জার্মান ভাষাকে ব্যবহার করে ইমিগ্রেশন ভাষা হিসাবে। এবং তা ভয়াবহ কর্কশ।

মুখের ভাষা যে খুব একটা লম্বা হয় তা নয়। খুব সীমিত ও সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় ইমিগ্রেশন পর্ব। পাসপোর্ট চাইবে। হাতে নিয়ে দ্রুত পাতা উল্টাবে এবং ছবির পৃষ্ঠায় এসে থেমে যাবে। এক মিনিটের জন্যে স্থির হয়ে যাবে তাদের শরীর। পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে সামনের মানুষটির দিকে। দু’একবার তাকাবে পাসপোর্টের ছবির দিকে। এবং এসব শেষ হওয়ার পর খটাস করে সিল মারবে পাসপোর্টে। ভালমন্দ কিছু না বলে চলে যাবে পরের জনের কাছে।

চব্বিশ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসা সেন্ট পিটার্সবার্গ হতেই নেয়া ছিল। তাই বর্ডার পুলিশের হরেক রকম সাইকোলজিক্যাল কেরামতিতে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারণ ছিলনা।

পাসপোর্টে ওরা যে সীলটা মারে তার শব্দও ছিল সীমিত; পূর্ব জার্মানির সংক্ষিপ্ত নাম DDR (Deutsche Demokratische Republik) ও তারিখ। আমার বাংলাদেশি পাসপোর্টের মোটা আকৃতির মূল কারণ ছিল পূর্ব জার্মান সীমান্তের এই সিল।

অদ্ভুত দেশ এই পূর্ব জার্মানি। আরও অদ্ভুত ছিল দেশটার রাজধানী পূর্ব বার্লিন। অনেকের মতে ডি ফ্যাক্টও সিটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে মিত্র বাহিনী চারভাগে ভাগ করে নেয়। একভাগের নিয়ন্ত্রণ নেয় পূবদিক হতে আসা সোভিয়েত বাহিনী, যা পরিবর্তীতে পূর্ব জার্মানি নামে আত্মপ্রকাশ করে। বাকি জার্মানির নিয়ন্ত্রণ নেয় মিত্রবাহিনীর বাকি দেশগুলো, যা পশ্চিম জার্মানি হয়ে টিকে থাকে।

পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিনের জন্মও এই কনফ্লিক্টের মাঝে। বার্লিন শহরকেও একই কায়দায় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় মিত্রবাহিনী। পকেট শহর হিসাবে পশ্চিম বার্লিনের অস্তিত্ব অনেকটাই ছিল দুই পরাশক্তির আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফসল।

পোলিশ সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব জার্মানিতে পা রাখলে এরাইভেল সিল মেরে স্বাগত জানায় দেশটার ইমিগ্রেশন পুলিশ। রাজধানী পূর্ব বার্লিন পৌঁছে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করার সময় এক্সিট ভিসা দিয়ে বিদায় দেয় পূর্ব জার্মানি। আরও পশ্চিমে যেতে যাইলে পশ্চিম বার্লিন সীমান্ত অতিক্রম করে আবারও ঢুকতে হয় পূর্ব জার্মানিতে। এবং আবারও এরাইভেল সিল। পাশের দেশ পশ্চিম জার্মানিতে ঢুকার সময় এক্সিট সিল দিয়ে বিদায় জানায় পূর্ব জার্মানি।

ইতিমধ্যে কম করেও হলেও ত্রিশ বার এ পথ পাড়ি দিয়েছি আমি। একমাত্র পূর্ব জার্মান ইমিগ্রেশন সীলের কারণে আমার পাসপোর্ট ৪ বার নবায়ন করতে হয়েছিল। একসাথে ষ্ট্যাপলার করা পাসপোর্টগুলো দেখলে যে কারও মনে সন্দেহ জাগার যথেষ্ট কারণ ছিল। এ নিয়ে আমার ভোগান্তির ইতিহাসও কম ছিলনা।

খুব ভোরে পূর্ব বার্লিন ষ্টেশনে এসে ট্রেন থামল। বাইরের পৃথিবী তখনো জেগে উঠেনি। শহরের উঁচু উঁচু দালানগুলোর মাথা ডুবে ছিল কুয়াশার চাদরে।

বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের শুরুতেও শীতের প্রকোপ মুছে যায়না পৃথিবীর এ প্রান্তে। বিশেষকরে সকালের দিকে। অবশ্য চারদিকের গাছপালার দিকে তাকালে প্রকৃতির পরিবর্তন সহজেই চোখে পরে। এত সকালে কোথাও যাওয়ার তাগাদা থাকেনা, তাই ট্রেন ষ্টেশনে বসেই কাটাতে হয় কয়েক ঘণ্টা।

৯টায় ব্রিটিশ এম্বেসির ভিসা সেকশন খুলবে। ওটাই আমার প্রথম গন্তব্য। সময় মত ভিসা পাওয়া গেলে দৌড়াতে হবে নেদারল্যান্ড দূতাবাসে। সকালের ব্যস্ততা শেষ করতে দুপুর গড়াবে। এবং তারপরই অতিক্রম করতে যাবো বার্লিন দেয়াল।

সকাল ৬টার ভেতর ষ্টেশনের পাশে কফি শপটা তাদের দরজা খুলে দেয় গ্রাহকদের জন্যে। দোকানের বাইরে বেশকটা চেয়ার টেবিল বসিয়ে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়। প্রতি গ্রীষ্মে এক কাপ কফি নিয়ে অনেকক্ষণ উপভোগ করি পূর্ব বার্লিনের সকাল। এ যাত্রায়ও বাদ দিলাম না।

দরজা খুলে কাউন্টারের বৃদ্ধাকে guten morgen সম্বোধন করতেই এক ঝিলিক হাসি দিয়ে বসতে অনুরোধ করলো। পূর্ব ইউরোপে এ ধরণের হাসি খুবই বিরল। বিশেষকরে গ্রাহক-সেবায়। মনটা হাল্কা হয়ে গেল। রাতের ক্লান্তিও যেন কিছুটা দূর হলো। কফির মৌ মৌ গন্ধ সুবাসিত হয়ে উঠলো চারদিক।

চলবে।

বন্ধুর শূন্যতায়…….

মন আজ ‘বিয়োগান্ত’ বেদনায় মলিন।
হারিয়েছে ছন্দ, হারিয়ে সুর, তাল লয়
হারিয়েছে হৃদয়ের যত ভাব ভালবাসা
হারিয়েছে সুখ স্বপ্ন, হারিয়েছে আশা।
আজ কোন সুসংবাদ নেই
আছে দুঃসংবাদ।
প্রেম কিছুটা মধুর, কিছুটা বেদনা বিধুর।
কিছুটা কাল্পনিক, কিছুটা বাস্তব।
কিছুটা হতাশার, কিছুটা আশার।
এগুলো নিয়েই তো জীবন।
তারপরও বন্ধুর শূন্যতা মাঝে মাঝে মনকে-
নাড়া দেয় অব্যক্ত বেদনায়……………….।

বন্ধুত্ব, সে অনেকটাই আদিম প্রবৃত্তি। একমাত্র সম্পর্ক যার নেপথ্যে কোনও কারণ নেই। মানুষের পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়েও যে ছিল, আছে এবং থেকেও যাবে।
“বন্ধু মানে মেঘলা দুপুর শিশির ভেজা ভোর
বন্ধু মানে মনের মাঝে অনেকখানি জোর
বন্ধু মানে ভীষন কষ্ট একটু অভিমান
মনের মাঝে কোথায় যেন অনেকখানি টান . . . . . . . . . ।”

এক অকারণ অনুভূতির নাম বন্ধুত্ব? হাতে হাত রেখে পাশাপাশি চলাটাই বন্ধুত্ব? বন্ধুত্ব মানে বয়সের সাথে বয়সের মিল নয়, বন্ধুত্ব মানে মনের সাথে মনের, গোপনে হয়ে যাওয়া পরিচয়…..বন্ধুদের। জীবনের সংকটে বন্ধুই ছুটে যান বন্ধুদের কাছে। আবার আনন্দ, উল্লাস কিংবা দিন শেষের অবসরেও এরা ভালোবাসেন বন্ধুত্বের কলতান শুনতে। বন্ধুত্বের পরিপূরক সম্পর্কের মাঝে এরা খুঁজে পান জীবনযাপনের ভিন্ন রস। সেই অকৃত্রিম বন্ধু যেন অকালে হারিয়ে না যায় সেই কামনাই করি। কারন বন্ধুত্ব মানে দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা, সমালোচনা করা অপমান বা কটাক্ষ করার মানসিকতা না। একেবারে আলাদা মর্যাদা, আলাদা একটা আবেদন। বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক যার সাথে কোন সম্পর্কের তুলনা হয় না।

হে বন্ধু

271169

আপনি কি কখনো জীবনের
ভালো-মন্দ সম্বন্ধে বিবেচনা করেছেন?
যদি আমাকে খুঁজে বের করতে বলা হয়,
আমি জানতাম, কি করবেন এবং করবেন না!

আপনি কি কখনও ব্যথায়
কাতরাতে কাতরাতে পাহাড়ে উঠেছেন?
যতবারই আমি সেখানে ওঠার চেষ্টা করেছি
জেগেছি জেগেছি তীর্যক শক্তি নিয়ে।
জীবনের সেই পথে কষ্ট ছিল যন্ত্রণা ছিল
তাই যতবার ওঠার চেষ্টা করেছি উঠেছি
জীবনের পথ সংকুচিত হয়েছে।
বারবার নিজেকে অস্তিত্বশীল জেনেও
অস্তিত্বহীন মনে হয়েছে।

এখানে আমারও কিছু ভুল ছিল,
আমার সাথে ও কিছু ভুল হয়েছে, অন্যায় হয়েছে।
আমার বিশ্বাস আর অজ্ঞ হওয়াটাও ভুল ছিল;
এটা আমাকে অসংখ্যবার কষ্ট দিয়েছে
আপনার সাথে কিছু ভুল ছিল
আপনার দ্বারা এটা স্বীকার নাও হতে পারে.

কিন্তু যদি কখনো বিবেক দিয়ে
বোঝাপড়া করতে বসেন অবশ্যই বুঝতে পারবেন।
লাভ-ক্ষতির হিসাব পাবেন
কোথায় এবং কিভাবে এটা ভুল হয়েছে
আপনি ভুল স্বীকার করতে বাধ্য নন।

কিন্তু এটা হবে আপনার জন্য অহংকার।
প্রতিটি মানুষের মনে রাখা উচিত যে
অহংকারের পথ সংকীর্ণ, এটি ধ্বংসাত্মক,
এটি ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

মানুষের জীবন ধ্বংস করার জন্য
অহংকারই যথেষ্ট।
হ্যাঁ, আপনার মনে হতে পারে
এটা আমার কাছে বেশ বাজে শোনাচ্ছে,
মনে হচ্ছে বিষয়টি আমার জন্য নয়।
আপনি যদি অহংকারী হন
তবে আপনি এই অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন।

নিজের অহংকার সম্পর্কে সচেতন না হলে
অন্যের কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত।
জেনে নেয়া উচিত অন্যের অহংকার
সম্পর্কে বিতর্কিত হওয়া নির্বুদ্ধিতা।
আমরা নিজেরা বোঝাপড়া করা উচিত
এটি আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে থাকতে পারে
কারণ কেউ এটি চিনতে পারে না।

অহংকার জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
ও সৌন্দর্যের রেখাগুলোকে বদলে দেয়
বদলে দেয় জীবনের প্রেক্ষাপট।
তবে এত সহজে বিদ্রোহী হবেন না
বিদ্রোহের কিছু নিয়ম আছে,
নীতি আছে, পরিবেশগত অবস্থা আছে
হয়তো সবাই ভুলে যাবে;

আজ নিজেকে একটু বিদ্রোহী মনে হচ্ছে
হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠে
জীবনের এই পথে চলতে, চলতে …
আজ বুঝি বড্ড ক্লান্ত, ঠিক সেই
শত বছরের বৃদ্ধের মতো বুদও অসহায়।

হয়তো সেজন্যই নিজেকে
একটু অনিয়ন্ত্রিত মনে হচ্ছে
আমরা আজ আবেগগতভাবে
‘অবিশ্বাস’ অনুভব করছি তা করতেই পারি
আমরা আমাদের মনের খেয়ালে
অনেক কিছুই দেখতে চাই
স্বীকার করছি আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।

সময়ের সেই সংকুচিত অন্ধকার
যখন আশেপাশের মানুষগুলোকে গিলে খাচ্ছে
তারপর একরকম আলোর রেখা
ঝাপসা হয়ে যায়, চোখ জ্বলতে পারে না
আলোকিত করতে পারে না।
আর সৌন্দর্যের উপমা মেটাতে পারে না
অস্তিত্বের কোলাহল।

আপনি এটা জানেন
শয়তান আমাদের পথভ্রষ্ট করে
এটা বাজে কথা ছাড়া আর কিছুই নয়;
আসলে আমরা হতাশ
এমনকি আমাদের লোভ লালসা
আশার নিরাশার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে
যখন হিপোক্রেট হয় তখন আমরা
নিজেরাই বেপরোয়া হয়ে যাই,
আমরা নিজেরাই শয়তান হয়ে যাই।
তাই তো জীবনের পথ এতটা অমসৃণ ভঙ্গুর দুর্দশাগ্রস্ত।

হে বন্ধু, তুমি বুঝতে চাও না
শয়তান একটি রূপক শব্দ।
যা নিজের মধ্যেই বিদ্যমান
আপনার নিজের হৃদয়, আপনার নিজের অস্তিত্ব, আপনার নিজের কর্ম
এমনকি তার নিজের ইচ্ছাও এর জন্য দায়ী।

এবং সময়ের সারাংশ থেকে যখন আমরা
নিজেরাই শয়তানের উপর দোষ চাপিয়ে দিই।
তখন আমরা আমাদের অপরাধ
লুকিয়ে রাখি আর শয়তানের ঘাড়ে চেপে
আহা, শয়তানরা কত অসহায়।
আসলে মানুষের চেয়ে বড় শয়তান আর কে হতে পারে!

আর এটাই সুযোগ,
বরং নিজেকে বাঁচানোই ভালো
এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কি হতে পারে?
যার বিবেক অন্ধ, তাকে পরিবর্তন করা যায় না
অজ্ঞ মানুষ সময়ের সাথে পাল্লা দিতে পারেনা
সেক্ষেত্রে অজ্ঞ মানুষ
ভুল পথ বেছে নেয়ার জন্য যথেষ্ট।

যদি অন্তরে বিভক্তি থাকে
যদি হৃদয় অপবিত্র হয়, যে
অভ্যন্তরীণভাবে, তবে, সেই বিবেক
তখন সেই হৃদয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়
এটা রাখার দায়িত্ব একমাত্র তার।
হে মানুষ, তোমার কি দরকার?
আপনি নিজেও জানেন না।
না জানার দোহাই দিয়ে এই বুঝি?
শয়তান আমাদের পথভ্রষ্ট করে।

তবে একটা কথা মনে রাখবেন, হ্যাঁ।
যদি কেউ কাউকে অনুসরণ না করে
আর কেউ তাকে অনুসরণ করে না।
তার প্রতিক্রিয়া শুরু হয় যখন আমরা
এটি অন্যদের থেকে লুকানোর চেষ্টা করি।

এটাই জীবন;
যখন জীবন বাতিক পূর্ণ
বেপরোয়া, বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ
তবে জানুন সেই জীবন
অপরাধের বোঝা বয়ে বেড়াতে
মুহূর্তের মধ্যে ধূলি-ধূসর হয়, অস্তিত্বহীন হয়।
যার কোন অস্তিত্ব নেই এবং কোন চিহ্ন নেই।

শেষ বেলার গান ২

মাঝেমধ্যে শাহেনশাহ হয়ে যাই। দু হাতে বিলিয়ে চলি সঞ্চ‌িত নুড়ি পাথর। নিজের মনে নিজেকেই বলি ‘খুশহামদিল – খুশহামদিল’। রাত্রির মধ্যযাম হোক কিম্বা শীতের দুপুরের কৃপণ রোদ্দুর আমার মাথায় তখন ইউক্যালিপ্টাস পাতার তাজ, হাতে ময়ূর পালক।

সামনে নৃত্যরত বিদ্যুৎ মাটির পাত্রে মদিরা দেওয়ার আবছায়ায় গানের ফুলকি উড়িয়ে দেয়, ‘লাগ যা গলে…’। কখনো কি পুরোনো বিষন্নতার গান সত্য হয়ে যায় প্রত্যেক পায়ের জলছাপে। বাদশাহী মেজাজ গাঢ় হতে হতে সূর্যাস্তের শেষ রক্তহংস হয়ে যায়।

‘মুঝকো ইস রাত কো তানহাই মে আওয়াজ না দো…’। নদীর দু পাশের সবুজ ফসল প্রসবিনী ক্ষেত টাইম মেশিনের ফাঁকে পড়ে কখন যে ধূসর হয়ে যায় কেউ তার নিয়ত হিসাব রাখে না। তনহাই বেশি হয়ে গেলে মদিরা আক্রমণ করে মস্তিষ্কের কোষে।

নদীর পাশের পাখি আর হরিণেরা ফিরে যায় যে যার নিজের ঘরের বিশ্বস্ততায়। বাদশাহ ফিরে চলে নিজের ফেলে আসা কবরের শান্ত পাতাঝরা নীরবতায়। বেলা শেষের গান সুর তোলে আবহে।
মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যাই …