বিভাগের আর্কাইভঃ সমকালীন

মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিসংগ্রাম ও আগামী

দেশে আবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এর আগেও অনেকবার হয়েছে। এতবার কেন হচ্ছে? এর কোনো জবাব নাই। জবাব নাই এ জন্য, আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করি না। জবাব নাই এ জন্য, আমরা নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করি। জবাব নেই এ জন্য, আমরা জানি না আমাদের প্রকৃত গন্তব্য কোথায়?

আমি মনে করি আমাদের মুক্তিসংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তির সংগ্রাম মূলত শেষ হয় না। যারা এ সংগ্রাম করেন- তারা আসলে একটি পর্ব শেষ করেন। বাকি পর্বটি অন্য কাউকে শেষ করতে হয়। অন্য কাউকে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়। আমাদের অনেকেই তা পারছি না। আর পারছি না বলেই অপশক্তি সেই স্থান দখল করে নিচ্ছে। কীভাবে নিচ্ছে- তার নমুনা আমরা এখন প্রায়ই দেখছি।

একটি সংবাদ আমাদের সম্প্রতি চমকে দিয়েছে। ২০১৬-এর বিজয় দিবসে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে আজীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদীর হাত থেকে সম্মাননা নিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ। ১৭ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাঈদীপুত্র মাসুদ।

গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর সকালে পিরোজপুরের জিয়ানগরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন মাসুদ সাঈদী। এরপর সকাল ৮টায় একটি বিজয় শোভাযাত্রা বের করা হয়। এতে তার নেতৃত্বে উপজেলা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আওয়ামী লীগ, প্রেস ক্লাব, মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। শোভাযাত্রা শেষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, কুচকাওয়াজ ও প্যারেড প্রদর্শন হয়। এরপর দুপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেন তিনি।

অনুষ্ঠানের ছবি নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাঈদীপুত্র মাসুদ। ১৬ ডিসেম্বর দেওয়া একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জিয়ানগর উপজেলা কমান্ড কাউন্সিলের সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। পুরস্কার নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান উপজেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব বেলায়েত হোসেন, বর্তমান উপজেলা ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপন কুমার রায়, সাবেক কমান্ডার মাহবুবুল আলম হাওলাদার (আমার আব্বার মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী), মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার ফকির। উপস্থিত আছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাকির হোসেন বাচ্চু, ইন্দুরকানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম মিজানুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট এম মতিউর রহমান, সেক্রেটারি মৃধা মো. মনিরুজ্জামানসহ মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ।’

১৭ ডিসেম্বর অন্য আরেকটি পোস্টে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাঈদীর পুত্র মাসুদ লিখেছেন, ‘মহান বিজয় দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে উপজেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠান। স্মৃতিচারণা করছেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জিয়ানগর উপজেলার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আব্দুল লতিফ হাওলাদার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জিয়ানগর উপজেলার বর্তমান ডেপুটি কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু স্বপন কুমার রায়, যুদ্ধকালীন পাড়েরহাট ক্যাম্প কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোকাররম হোসেন কবির।’

এই হলো আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকে কেমন দেখছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় র‌্যালিতে সাঈদীপুত্রের অংশগ্রহণের ছবি নিজের ফেসবুক পেজে তুলে দিয়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ লিখেছেন, ‘বিজয়ের ৪৬তম বছরের প্রথম সকাল হতবাক করেছে। রাজাকারপুত্র এবং মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে বিজয় দিবস উদযাপন করছে! আর আমরা দেখছি! কী সুন্দর সকাল হওয়ার কথা ছিল আজ, তাই না!’
শাওনের পোস্টে মন্তব্যের ঘরে সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লিখেছেন- ‘শহীদ বীর আলতাফ মাহমুদের কন্যা কাঁদছে, কেন? সবই তো আগের মতোই আছে!’ সেখানে একজন তাকে প্রশ্ন করেন, “আগের মতোই আছে? পূর্ব পাকিস্তানের মতন? তাহলে ‘বাংলাদেশ’ নামটা হয়েছিল কোন দুঃখে?” উত্তরে বুলবুল লিখেছেন, ‘আমি এখন যুদ্ধরত, জিতলে কথা হবে, অনেক।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যে মুক্তিসংগ্রামের কথা বলেছেন- সেই যুদ্ধ চলছে। অবশ্যই চলছে। এ যুদ্ধ না চললে একটি জাতি তার অতীত ভুলে যায়।
এর পরের সংবাদ থেকে আমরা জানছি- জিয়ানগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদীর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মাননা নেওয়ায় ক্ষমা চেয়েছেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সমীর কুমার দাস বাচ্চু। পিরোজপুর প্রেসক্লাবে জিয়ানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে করা সংবাদ সম্মেলনে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চান। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলেন, ‘মাসুদ সাঈদী মুক্তিযোদ্ধাদের যে সম্মাননা দিয়েছেন তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে কালিমা লেপন করা হয়েছে।’ ক্ষোভের সঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধাও কি ছিল না বিষয়টিতে প্রতিবাদ করার। যেসব মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা আমরা এখনও জানি না। তবে এটুকু জানি, আমাদের চারপাশে বৈভব দেখিয়ে এমন অনেকেই এখন দখলের ত্রাস সৃষ্টি করছে। আমরা দেখছি- প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, আবেদনকৃত ও তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরীক্ষণ হচ্ছে। তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে উপজেলা, জেলা-মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটি করেছে সরকার। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ জানুয়ারি এসব কমিটি গঠনের আদেশ জারি করে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ে এর আগে গঠিত সব কমিটি বাতিল করেছে।

আদেশে বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাইয়ের আওতাধীন কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা প্রতিনিধি এসব কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না। যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি (সংসদ সদস্য ছাড়া) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত হবেন। বলা হয়েছে ‘এই কমিটিকে ইতোপূর্বে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল কর্তৃক প্রেরিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তথ্যাবলি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নির্দেশিকা ২০১৬ অনুরসণ করে যাচাই-বাছাই করতে হবে।’

মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ও একেক সময় একেক রকম তথ্য পাওয়া পাওয়া গেছে। এরশাদের আমল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ দফায় তালিকা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সনদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন প্রায় ২৬ হাজার। এর মধ্যে সাময়িক সনদ পেতে ১৭ হাজার এবং যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আরো ৮ হাজার আবেদন নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এ সংখ্যা ছিল প্রথম দফায় ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জন। পরে তা ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনে উন্নীত হয়। এর আগে ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভোটার তালিকায় ৮৬ হাজার এবং ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের খসড়া তালিকায় ছিল ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জনের নাম।

এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮৬-৮৭ সালে জাতীয় কমিটি কর্তৃক প্রণীত তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তিবার্তা (লাল মলাটে) পত্রিকায় প্রকাশিত নামের তালিকাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়। লাল মুক্তিবার্তায় ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় মুক্তিবার্তার লাল মলাটের বাইরে যারা মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছেন তাদের অনেকে এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যমান গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় প্রায় ৪০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়েছে। ডিজিটাল ডাটাবেজ তালিকায় যাদের বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাই হোক, মুক্তিযোদ্ধারা আসলে কেমন আছেন? বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দিন কাটাচ্ছেন অনাহারে অর্ধাহারে। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত। সম্পদ ও কর্মহীন অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার তাদের পরিবারের সদস্যদের খাদ্যের জোগান দিতে এখনো ভিক্ষাবৃত্তি, দিনমজুরি, রিকশা চালানোসহ অনেক কঠোর পরিশ্রমের পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবনযাপন করছেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ধ্বংস করে, মনগড়া কল্পিত ও মিথ্যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করে আদর্শহীন, দুর্নীতিবাজ একটি শ্রেণি ব্যক্তি ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত, নষ্ট ও ধ্বংস হয়েছে এদের হাতেই।

অন্যদিকে রাজাকার আলবদর গোষ্ঠীর নেতারা টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাকেও। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে একটি বিশেষ অংশগ্রহণ ছিল নারী সমাজের। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের ৩০ লাখ মানুষের গণহত্যার শিকার হয়, যার অন্তত ২০ শতাংশ নারী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সরকারি নথিপত্রে এর কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। বিভিন্ন ভাষ্যমতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ মা-বোন নির্যাতিত হয়েছেন। কিন্তু মাঠভিত্তিক গবেষণা চালাতে গিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের গবেষণাকর্মীদের মনে নিশ্চিত ধারণা জন্মেছে মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা যা এতদিন বলা হয়ে আসছে, আসলে তা এর চেয়েও অনেক বেশি।

তবে এতদিন পর তথ্য-প্রমাণ দিয়ে হয়তো এসব প্রমাণ করার সুযোগ কম। তাছাড়া নির্যাতিতরা সামাজিক সম্মান ও নিরাপত্তার কারণেই চান না এতদিন পর এসব নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি হোক। এসব কারণেই অনেক নির্যাতিত নারী তাদের ওপর নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী গবেষণাকর্মীদের কাছে মুখে মুখে বললেও তা টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করতে বা লিপিবদ্ধ করতে দিতে চাননি।

আজ যে সাঈদীপুত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দিচ্ছেন, একাত্তরে কেমন ছিল সেই সাঈদীর ভূমিকা? আমাদের মনে আছে প্রসিকিউশন তাদের স্টেটমেন্টে বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা সাঈদী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাড়েরহাট বন্দরের বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে নিয়মিত যৌননির্যাতন করতেন। বিপদ সাহার বাড়িতেই আটকে রেখে অন্যান্য রাজাকারসহ ভানু সাহাকে নিয়মিত ধর্ষণ করতেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। একসময় ভানু সাহা দেশত্যাগে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।

স্টেটমেন্টে আরো বলা হয়, সাঈদী একাত্তরে অসংখ্য হিন্দুকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিলেন, নামাজ পড়তেও বাধ্য করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করে এবং কেউ কেউ ভারতে চলে যান।
এই হলো আমাদের মুক্তিসংগ্রামের একটি খণ্ডচিত্র। কী মূল্য দিয়ে কেনা আমাদের স্বাধীনতা! অতীতে যে তালিকাগুলো হয়েছে সেগুলো কি স্বচ্ছ ছিল। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অনেক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকলেও তাতে ঠাঁই হয়নি কুড়িগ্রামের বীর প্রতীক তারামন বিবির নাম। ২০০৫ সালের ২১ মে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় ৩৭৫৫ নম্বর থেকে ৩৮৭৪ নম্বর পৃষ্ঠায় কুড়িগ্রাম জেলার ৩ হাজার ৬১৪ জন মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এ তালিকায় বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবির নাম নেই, তা ধরা পড়ে জেলা পোর্টাল তৈরি করতে গিয়ে। এই হলো আমাদের তালিকার অবস্থা!

মুক্তিযোদ্ধারা চিরদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন না। কিন্তু তাদের কর্ম, তাদের স্বপ্ন, তাদের গৌরবগাথা আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে। জাগ্রত থাকবে তাদের চেতনা। থাকতেই হবে। না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না। বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকবে না। সেই প্রত্যয় এবং ঐতিহ্যের শক্তিই প্রজন্ম ধরে রাখতে চায়।
তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। আমরা দেখছি আজ রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। বুলি পাল্টে এরাই হতে চাইছে মুক্তির নিয়ামক। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সম্মান চান। যে দেশে কোটি কোটি টাকা লুটেরা শ্রেণি প্রতিদিন লুটপাট করে সেই দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধা যথার্থ সম্মানী ভাতা পাবেন না, তা মেনে নেওয়া যায় না। তাই হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়, রাষ্ট্রীয় সম্মান, রাষ্ট্রের মানুষের সম্মান বাড়ানোর জন্যই জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক পুনর্বাসন খুবই দরকারি। দরকার পরলোকগত মুক্তিযোদ্ধদের পোষ্য, সন্তান, পরিবারকেও সার্বিক সহযোগিতা করা। কারণ একাত্তরের বীর সেনানীরা বারবার জন্ম নেবেন না।

আগেই বলেছি, মুক্তিসংগ্রাম একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশকে সেই শক্তি ও সাহস নিয়েই এগোতে হবে। এ প্রজন্মকে করতে হবে সেই মন্ত্রে দীক্ষিত।

________________________________________
দৈনিক খোলাকাগজ। ঢাকা। ২০ জানুয়ারি ২০১৭ শুক্রবার প্রকাশিত

স্বার্থচিন্তা যেভাবে ঐক্যের অন্তরায়

সমষ্টিগত জীবন বা রাষ্ট্র পরিচালনায় খ্রিস্ট ধর্মের ব্যর্থতায় উদ্ভূত সমস্যার ফলে পশ্চিমা সভ্যতা আবিষ্কৃত বিভিন্ন জীবনব্যবস্থা তথা তন্ত্র-মন্ত্র সারা বিশ্বজুড়ে গ্রহণ করার ফলে মানুষের নৈতিকতায় একটি সাঙ্ঘাতিক পরিবর্তন এসেছে। আর তা হলো ভৌগোলিক রাষ্ট্র ধারণা বা যার যার সীমানার স্বার্থ সংরক্ষণ। ফলে মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা সীমাবদ্ধ হয়ে গেল একটি সীমার ভেতর। অর্থাৎ একটি ভূ-খণ্ডের মানুষ তাদের নিজস্ব গণ্ডি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই সীমার বাইরে যারা রয়েছে তাদের প্রতি কোন প্রকার দায়বোধকে তারা অস্বীকার করে বসলো। এতে করে ভৌগোলিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করলো। অপরদিকে নিজস্ব ভূ-খণ্ডের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বাকি রাষ্ট্রের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে তারা মোটেও ভাবছে না।

ব্যাপারটা এমন যে আমাকে সুখে থাকতে হবে, সেটা যদি অন্যের মৃত্যুর মধ্য দিয়েও হয়। স্বাভাবিকভাবেই একেকটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রের এই ধারণা তাদেরকে প্রচণ্ড স্বার্থপর করে তুললো। তাতে করে স্বার্থ উদ্ধারে যাই করা হোক না কেন, তার সবই নীতিগতভাবে সঠিক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। শক্তির জোরে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, লুণ্ঠন, শক্তিশালী দেশ কর্তৃক দুর্বল দেশের প্রতি চাপিয়ে দেওয়া দাসখত চুক্তি সব কিছুই এর মধ্যে পড়ে। তাই কে কার চাইতে শক্তিশালী হতে পারে এই নিয়ে দেখা দেয় প্রতিযোগিতা। আবার ভিন রাষ্ট্রের আক্রমণে অন্তরায় সৃষ্টি কিংবা ভয় দেখানোর জন্যও তারা প্রতিযোগিতায় নামলো। যার ফলে পৃথিবীতে দেখা দিয়েছে ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা। এতে করে দেখা যায় সাধারণ জনগণকে না খাইয়ে রেখে হলেও বহু রাষ্ট্র পাল্লা দেওয়ার জন্য মারনাস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলছে। কৃষি, আবহাওয়া, চিকিৎসা ও শিক্ষাখাতে কম অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে অস্ত্র ক্রয় ও নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কারের পেছনে।

এই যে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার পেছনে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলা, এটা শেষ পর্যন্ত মানুষকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বা এর শেষ কোথায়? এটা কি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে তার সম্মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? মোটেও নয়। এই প্রতিযোগিতা মানুষকে পশুর কাতারে নামিয়ে দিচ্ছে।

অপরদিকে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখতে পাব আমাদের হয়েছে ভিন্ন রোগ। অন্যরা যেখানে ভৌগোলিক রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কাজ করে না, তেমনি আমরা জাতীয় ঐক্যহীনতা ও যথার্থ শিক্ষার অভাবে আরো ক্ষুদ্র পর্যায়ে নেমে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে আবদ্ধ হয়ে গেছি। আমরা জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে নিমজ্জিত হয়ে যা-ই করছি তাকেও বৈধ বলে জ্ঞান করা হচ্ছে। সার্বজনীন স্বার্থের পরিবর্তে ভৌগোলিক স্বার্থে আটকে যাওয়ার চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থে নেমে যাওয়ার এই অবস্থাটি আরো মারাত্মক এবং বিপজ্জনক। এতে আগের অবস্থায় যে দ্বন্দ্বটা রাষ্ট্র পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিলো তা এখন ব্যক্তি পর্যায়ে নেমে এসেছে। অর্থাৎ দায়িত্ববোধও ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে গেছে। তাই অন্যদের তুলনায় আমাদের অবস্থা আরো করুণ, আরো দুঃখজনক। তাই শুধু ব্যক্তিস্বার্থ নয়, আমরা কি পারি না ভৌগোলিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে? কেননা আমরা এই পৃথিবীর যে যে প্রান্তেই থাকি না কেন আমরাতো একই দম্পতি অর্থাৎ আদি পিতা আদম (আঃ) ও আদি মাতা হাওয়া (আঃ) থেকে আগত, সুতরাং সে হিসেবে আমরা সবাই ভাই-বোন, আমাদের প্রত্যেকের অনুভূতিও একই রকম। পৃথিবীর সব জায়গার পরিবেশ একরকম নয়। প্রাকৃতিক সম্পদও সব স্থানে সমপরিমাণে পাওয়া যায় না। সুতরাং আমরা একই পৃথিবীর মানুষ নিজেদের ভাই-বোন মনে করে কি পারি না সমবণ্টন করে মিলে মিশে শান্তিতে বসবাস করতে? পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মই কি এ শিক্ষা দেয় না? তাহলে আমরা কোথায় চলেছি? কেনই বা পৃথিবীর বুকে কল্পিত সীমারেখা টেনে বিভক্তি বাড়াচ্ছি? আমরা কি সমষ্টিগত ঐক্যের কথা চিন্তা করতে পারিনা?

ন্যায়বিচার যখন গণমানুষের শেষ ভরসা

শেষ পর্যন্ত রসরাজ জামিন পেয়েছেন। গত বছরের ২৯ অক্টোবর ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার ছবি পোস্ট করার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ফেসবুকে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলায় জামিনে কারামুক্ত হয়ে আড়াই মাস পর বাড়ি ফিরছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রসরাজ দাস। ঘটনা পরিক্রমায় এখন জানা যাচ্ছে মিছেই রসরাজকে ফাঁসানো হয়েছিল। ওই হামলার ঘটনায় নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান আঁখিকে গ্রেফতার করা হয়েছে অতিসম্প্রতি। এর আগে আঁখির ব্যক্তিগত সহকারী উত্তম কুমার দাস (২৫) ও ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মনোরঞ্জন দেবনাথকেও (৪০) আটক করে পুলিশ।

মিডিয়ার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, হরিপুর ইউনিয়ন থেকে ১৪-১৫টি ট্রাক ভরে মানুষ আসার পর নাসিরনগরের হিন্দু পল্লীতে হামলা হয়। যেসব ট্রাকে হামলাকারীরা এসেছিল সেগুলোর ব্যবস্থা ও অর্থের জোগান চেয়ারম্যান আঁখি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করে।

এরই মধ্যে নাসিরনগরের ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তকারীরা জানতে পারেন রসরাজের মোবাইল ফোন থেকে ধর্মীয় অবমাননার ছবি আপলোড হয়নি। ওই ছবি সম্পাদনা করা হয়েছিল হরিণবেড় বাজারে আল আমিন সাইবার পয়েন্ট এন্ড স্টুডিও থেকে, যার মালিক জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি। জাহাঙ্গীর আলম তার সাইবার ক্যাফে থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটি প্রিন্ট করে লিফলেট আকারে তা এলাকায় বিতরণ করেন। গত বছরের ২৮ নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তা স্বীকারও করেন। জাহাঙ্গীর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আশুতোষ দাসের নাম বলেন, যিনি রসরাজের ফেসবুক আইডি ও পাসওয়ার্ড জানতেন। কী জঘন্য সংবাদ! কী হীন মানসিকতা! বাংলাদেশে আসলে চলছে একটি দূরাচারী কালচার! এর মূল হোতা কে? কারা এর নেপথ্যে?

খুলনার রূপসা উপজেলায় এক কীর্তন গায়ককে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে প্রফুল্ল বিশ্বাসের (৬০) লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জানান রূপসা থানার পরিদর্শক জিয়াউল হক। তিনি বলেছেন, পিঠাভোগ গ্রামের পালপাড়ায় এক অনুষ্ঠানে কীর্তন গেয়ে রাত ১২টার দিকে বাড়ি ফেরেন। স্ত্রী বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ায় রাতে একাই বাড়িতে ছিলেন। এরকম গুপ্ত হত্যা চলছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। নদীতে লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এর প্রতিকার কি? সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার মামলার রায় হয়েছে। রায়ে নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালত ৩৫ আসামির ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এই রায়কে দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা ‘দৃষ্টান্তমূলক’ বলে অভিহিত করেছেন। নিত্যদিন মানুষ খুনের ঘটনায় যে নারায়ণগঞ্জ খবরের শিরোনাম হতো; সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বালু উত্তোলন, নদী দখলের কারণে নেতিবাচক খবর হতো নারায়ণগঞ্জ।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায়ে জনগণ সন্তুষ্ট হবে। এই ঘৃণ্য অপরাধে যে একটা ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল সেই ভীতি দূর হবে। সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার মামলার রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন। আইনমন্ত্রী বলেন, যারা এ ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত এর সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালত পেয়েছেন। আমি যতটুকু আইন জানি, যদি হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হয় তাহলে ফাঁসি দেয়াটা হচ্ছে ফার্স্ট পানিশমেন্ট। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায়ে সব আসামির শাস্তি বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা আরো বাড়িয়েছে বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। বিচারপতি সিনহা বলেছেন, ‘অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন, সে দায়মুক্তি পাবে না। চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলা প্রভাবশালী আসামি র‌্যাবের কতিপয় কর্মকর্তা লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, যা সমগ্র জাতিকে স্তম্ভিত করেছে।’ দেশের বিচারাঙ্গনের শীর্ষ পদে নিজের দায়িত্ব নেয়ার দুই বছর পূর্তিতে দেয়া এক বাণীতে এই মত প্রকাশ করেন তিনি। বাণীতে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মামলা জট, আইনের সংস্কার, বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত ও জনবল সংকট, বিচার বিভাগের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজের মত তুলে ধরেন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের ভূমিকা অপরিহার্য মন্তব্য করে তিনি বলেন, সংবিধানের মূল চেতনায়, বিচার বিভাগ এর সীমার বাইরে গিয়ে অন্য বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।

‘তেমনিভাবে আমিও প্রত্যাশা করি রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ বিচার বিভাগের দায়িত্ব পালনে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না। দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে অপরিহার্যভাবে সৃষ্ট শীতল সম্পর্ককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করলে প্রত্যেক বিভাগের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রভূত কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে’- যোগ করেন তিনি। মাননীয় প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে সব আদালতে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ২৪০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। একই সময় ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে দেশের সব আদালতে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৮। তিনি বলেছেন, ‘বিগত ২ বছরে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪০২টি। ফলে নিষ্পত্তির হার ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।’ একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে অপরাধ প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন ধরনের অপরাধ হচ্ছে। সেই তুলনায় আইনের শাসন যথার্থভাবে সফল করা যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না, তার কারণ খুঁজতে হবে। আমরা দেখছি- একটি শ্রেণি মানুষের স্বপ্ন দখল করতে মরিয়া। সরকার অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ধমক দিয়ে কথা বলবেন আর সরকারের এমপি, মন্ত্রীরা এমন হীন কর্মের মদদ দেবেন- তা তো চলতে পারে না। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বখাটে, দখলদার, লুটেরা সবাই মানবতার ভিন্নপক্ষ। এরা সব সময়ই সত্য এবং ন্যায়ের বিপক্ষে। বিএনপি-জামায়াতের অমানবিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্তি চেয়েছিল মানুষ। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে পড়া হাইব্রিড লুটেরা ও বখাটে শ্রেণি রাষ্ট্রের মানুষকে আরো অতিষ্ঠ করে তুলছে। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জরুরি ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যে কোনো জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির বিষয়গুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সে জাতি নৈতিকভাবে বলিষ্ঠ হতে পারে না। সুবিচারের দরজা অবারিত হতে হবে সবার জন্য। এখানে ধনী-দরিদ্র, ক্ষমতাবান-অক্ষম, এমন কোনো শ্রেণি বিভেদের প্রশ্ন কখনোই আসা উচিত নয়। অথচ বাংলাদেশে তেমনটিই হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি সেক্টরে বেড়ে ওঠা বেনিয়া শ্রেণি নিয়ন্ত্রণ করছে সাধারণ মানুষের জানমাল। কালো টাকার মালিকরা তাদের ব্যবহার করছে লাঠিয়াল হিসেবে। একটা কথা আমরা জানি এবং মানি, সুবিধাবাদীরাই আগুন লাগা বাড়ির অবশিষ্টাংশ লুটপাট করে নেয়। ওয়ান ইলেভেনের সময়ও আমরা এমন কিছু নব্য লুটেরা দেখেছি। এখন তো দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তাহলে আমাদের এমন ছোবল দেখতে হবে কেন?

বাংলাদেশে পেশিশক্তি ও কালো টাকার এই যে মহড়া দেখানোর প্রতিযোগিতা, তা ধ্বংস করে দিচ্ছে দেশের মননশীল মানুষের মেরুদণ্ড। প্রজন্ম সাহস পাচ্ছে না দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। বরং তাদেরই কেউ কেউ টেন্ডার, চাঁদাবাজি, ভাগ-বাটোয়ারায় অংশ খেতে কক্ষচ্যুত হয়ে দলীয় সন্ত্রাসী বনে যাচ্ছে। অথচ আমরা জানি, এই বাঙালি জাতির তরুণ প্রজন্মই বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাহলে আজ এই প্রজন্মের এত সামাজিক অবক্ষয় কেন? এর কিছু কারণ আছে। তার অন্যতম হলো রাষ্ট্র মেধাবী প্রজন্মকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে বারবার কার্পণ্য দেখিয়েছে। ফলে পচনশীল সমাজ ব্যবস্থার ছত্রছায়ায় অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত নেতৃত্বের দাপট গণমানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশের দখল নেয়ার অপচেষ্টা করেছে। দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে মানুষ যে চেষ্টা করছে না, তা কিন্তু নয়। তারপরও নিষ্পেষণের করাঘাতে মানুষ বারবার পরাজিত হয়েছে লুটেরা শ্রেণির কাছে। একটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য দেশপ্রেম কতটা অপরিহার্য, তা বিশ্বের যে কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পারি।

আমরা জানি, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত দ্বিগুণের বেশি হয়েছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। ভূমি বাড়েনি। বরং বাসস্থানের অন্বেষণ হরণ করছে ক্ষেতের জমি। তাই জনবহুল এ রাষ্ট্রে অভাব-অভিযোগ বাড়ছে। হয়তো আরো বাড়বে। তাই যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা, মননশীল সমাজ গঠন এবং আইনসিদ্ধ সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণ ছাড়া এ সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। এ সত্যটি বিশেষ করে দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের অনুধাবন করতে হবে। মানুষের আশ্রয় হচ্ছে ন্যায়বিচার। তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে কোনো মূল্যে। খুনি যে কাউকে ক্ষমা করে না- তা আমরা দেখছি। আমরা দেখছি, ক্ষমতাসীনদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের রূপ। টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহম্মেদ হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলার প্রধান আসামি সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিন ভাইকে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বহিষ্কৃৃত অপর তিন ভাই হলো- শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র শহিদুর রহমান খান মুক্তি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা এবং টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও আওয়ামী লীগের সদস্য জাহিদুর রহমান খান কাকন। তাদের বহিষ্কারের পর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শহরে আনন্দ মিছিল করেছে।

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিন ভাইকে দল থেকে বহিষ্কার করায় ফারুক আহম্মেদের স্ত্রী নাহার আহম্মেদ স্বস্তি প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি স্বামীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি, মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহম্মেদকে হত্যা করে শহরের কলেজ পাড়ায় তার বাসার সামনে ফেলে রাখা হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী নাহার আহম্মেদ বাদী হয়ে টাঙ্গাইল মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা দীর্ঘদিন তদন্তের পর সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানাসহ চার ভাইয়ের নাম উঠে আসে। পরে এমপি রানাকে প্রধান আসামি করা হয়।

এগুলো কিসের আলামত? সরকারকে তা ভাবতে হবে। না ভাবলে আরো বড় খেসারত তাদের দিতে হতে পারে।

_____________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। শনিবার, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

আমরা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

প্রতিটি মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ঠিক যেন আদর্শ একটি পরিবারের মতোই। মাথা, হাত, পা, চোখ, কান, নাক, পেট ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ঐ পরিবারের সদস্য। এই সদস্যগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সুদৃঢ় ঐক্য বিদ্যমান। একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে অন্যসকল অঙ্গ কষ্ট পায় এবং তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসে, কেউ কোনো অভিযোগ তোলে না। এই পরিবারে যদি কখনো অনৈক্য দেখা দেয়, যদি একে অপরের ক্ষতি করার চেষ্টায় মত্ত হয়, এক হাত যদি অন্য হাতকে কেটে ফেলতে উদ্যত হয়, এক পা যদি অন্য পা ভাঙ্গার মনস্থির করে, মুখ যদি পেটকে খাদ্য দেওয়া বন্ধ করে দেয় তবে ঐ পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে অর্থাৎ শরীর হয়ে পড়বে অসুস্থ এবং এক পর্যায়ে শারীরিক মৃত্যু ঘটবে। মৃত্যুর পর হাত, পা, নাক, কান, মুখ, পেটসহ সকল অঙ্গেই পঁচন ধরবে।

একটি দেশ, একটি জাতি, একটি সমাজও মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির মতোই। একটি সমাজের প্রতিটি মানুষ যখন সকল অনৈক্য ভুলে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তখন সেটি হয় সুস্থ, সবল ও শান্তিপূর্ণ আদর্শ সমাজ। আর যখন ঐ মানুষগুলিই একে অপরের ক্ষতি করার চিন্তা করে, নানা অজুহাতে অন্য ভাইয়ের উপর আক্রমণ করে, হত্যা করে, অন্যের সম্পদ ধ্বংস করে তখন তা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে ফলে ঐ দেশ, ঐ সমাজ বা ঐ দেশের প্রতিটি সদস্যের গায়েই পঁচন ধরবে, কেউই এই পঁচন থেকে বাঁচতে পারবে না। আজ আমাদের সমাজে অনৈক্য আর বিভেদের দেওয়াল এমনভাবে তোলা হয়েছে যে, আমরা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, কাজেই এখনই যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয়া হয় তবে ধ্বংস থেকে কেউই বাঁচতে পারবো না।

কিছু পরিবার মিলে একটি পাড়া, কিছু পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি গ্রাম এভাবেই একটি ইউনিয়ন, থানা, জেলা, বিভাগ নিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ। আমরা চাইলেই হয়তো অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত দেশকে পরিবর্তন করতে পারবো না কিন্তু সৎ মানুষিকতা নিয়ে উদ্যোগী হলে অন্তত আমাদের পাড়া, আমাদের গ্রাম, আমাদের থানাটিকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যের ভিত্তিতে শান্তির নীড় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। আসুন আমরা উদ্যোগ নিই- আমাদের গ্রামের প্রত্যেকেই দল, মত, পথ, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ হব। কেউ কারও উপর হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, গাছ কর্তন করব না, কারোর কোনো ক্ষতি করব না, একে অপরের সহযোগিতা করব, আমাদের গ্রামে কেউ না খেয়ে থাকবে না, আমাদের গ্রাম হবে শান্তির গ্রাম। এভাবে যদি আমরা আমাদের গ্রামকে সমগ্র বাংলাদেশে একটি আদর্শ গ্রাম হিসাবে পরিচিত করতে পারি, তবে অন্য গ্রামগুলিও আমাদের অনুসরণ করবে।

রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও শিক্ষার মানদণ্ড

এটা আমরা সবাই জানি, একটি জাতি শিক্ষিত হলে সেই রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন ঘটে। মানুষ যখন তার অধিকার বিষয়ে সচেতন হয় তখন সে অনেক দাবিও আদায় করতে পারে। অথবা নিজেই চেষ্টা করে ফেরাতে পারে নিজের ভাগ্য। কিন্তু একটি প্রজন্মকে সঠিকভাবে শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে কি? কিংবা তাদের সঠিক তথ্য জানিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে কি? এমন অনেক কথাই আসছে। বাংলাদেশে দুটি শিক্ষাপদ্ধতি বিদ্যমান। একটি স্কুল শিক্ষা আর অন্যটি মাদ্রাসা শিক্ষা। বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডও রয়েছে। এ যে দুটি পদ্ধতি, তা কি পরস্পরবিরোধী নয়? এ নিয়ে অনেক কথাই বলা যেতে পারে। শিক্ষা বিষয়ে আমাদের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা একটু পড়া যাক-

ক. রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

এখানে আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর বলতে আমরা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত প্রাইমারি শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝতে পারি। সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা হবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত, অবৈতনিক, বাধ্যতামূলক এবং দেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য একই পদ্ধতির। কিন্তু আমরা প্রাথমিক পর্যায়েই দেখছি- প্রাইমারি স্কুলের পাশাপাশি কওমী মাদ্রাসাগুলো বাংলাদেশে চালু আছে। সেই সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। বিভিন্ন ধারার অপরিকল্পিত শিক্ষা, শিক্ষাক্রম ও দর্শন পড়ানো হচ্ছে। শিক্ষার অর্থায়ন, ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়হীনতা প্রকট রূপ ধারণ করছে কোথাও কোথাও।
বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার যে ধারাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেটা হচ্ছে আলিয়া মাদ্রাসার ধারা। সরকার যখন মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের কথা বলে, তা মূলত আলিয়া মাদ্রাসার ধারাকেই বুঝিয়ে থাকে। হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসা সরকারের নজরদারির বাইরে এবং তারা কোনো প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা চায়ও না।

বেশ শঙ্কার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের একটি রক্ষণশীল আধুনিক মুসলমানরা নিজেদের জন্য শহরগুলোতে গড়ে তুলেছেন এক ধরনের মাদ্রাসা ব্যবস্থা। যেগুলো ‘ক্যাডেট মাদ্রাসা’ ও নানা নামে পরিচিত। এসব প্রতিষ্ঠানে কখনও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় আধুনিক পাঠদান করা হয়। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ আধুনিক। এখানে সহশিক্ষা চালু আছে এবং মেয়েদের আলাদা ঘরে শিক্ষা দেওয়া হয় না। টিভি-কম্পিউটার-নাটক-নৃত্য-স্পোর্টস-ছবি আঁকা এগুলোর কোনোটাই এখানে ধর্মবিরোধী নয়। খালি একটি বিষয়ই তারা লক্ষ রাখেন, সেটা হচ্ছে ‘ইসলামের পুনরুজ্জীবন’ এবং সমাজে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে আদর্শগতভাবে ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা। ইসলাম তাদের কাছে একটি মৌলবাদী বিশ্বাস। সে দিকে থেকে এই ধারাটিকে ‘আধুনিক রাজনৈতিক ইসলাম’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এবং সেই সঙ্গে ক্রমশ মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী মানসিকতাও গড়ে তোলা হয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে যেসব জঙ্গি কার্যক্রম সাধিত হয়েছে- এসব ঘটনার হোতারা কিন্তু এ আধুনিক ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত।

সবচেয়ে বেদনার বিষয় হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা যেমন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সংবিধানের খণ্ডিত রূপও তারা স্বীকার করে না। বিজয়, স্বাধীনতা, শহীদ দিবসে দল বেঁধে ফুল দেওয়া, প্রভাতফেরি, কুচকাওয়াজ ও মাঠে যাওয়া, জাতীয় সংগীত গাওয়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চেতনামূলক কর্মসূচি আয়োজনকে তারা ইসলামবিরোধী মনে করে। বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ধারণা একমুখী, অনেকটা এ অঞ্চলে ইসলাম বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভাষা ও স্বাধীনতা সম্পর্কে তাদের ধারণা খণ্ডিত। তারা সুযোগ পেলেই তাই ধর্মের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা দখলের কথা বলতেও কসুর করে না। আরো শঙ্কার কথা হচ্ছে- এ ভূতের আছর এখন প্রাথমিক শিক্ষাস্তরেও পড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি সাপ্লাইকৃত সরকারি বইয়ে যে ভুল দেখা গেছে- তা নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় কথা হছে প্রতিদিন। নতুন পাঠ্যপুস্তকে ভুলের জন্য শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্ট সরকারের দুই মন্ত্রণালয়ের কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না। তারা একে অন্যের উপর দোষ চাপাচ্ছেন।

ফলে পাঠ্যবইয়ের ভুল-ত্রুটি পর্যালোচনায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) একটি কমিটি করলেও কারা দায়ী, তা বই বিতরণের পর আজ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়নি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এনসিটিবির প্রাথমিক উইংয়ের ২৪টি পদের ২০টিতেই নিজেদের ‘অযোগ্য’ কর্মকর্তাদের বসিয়ে রাখায় প্রাথমিকের বইয়ে ভুল থেকে গেছে। অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছেন, গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেরিতে পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার তা যাচাই-বাছাই না করেই ছাপাখানায় পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

এদিকে, প্রাথমিকের বইয়ে ভুল নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্বিগ্ন ও বিব্রত হয়েছে। তা জানিয়ে এ ভুলের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে তারা।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘২০১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু ভুল সম্পর্কে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হওয়ার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্বিগ্ন ও বিব্রত। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এর দায় এড়াতে পারেন না।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীরবতার সমালোচনা করে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এবার প্রাথমিকের বইয়ে বেশি ভুল থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কোনো তৎপরতাই দেখাচ্ছে না, অথচ এনসিটিবি তাদের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান।’

এভাবেই চলছে পরস্পরকে দোষাদোষী। কিন্তু এ প্রজন্ম কি তা চাইছে? না চাইছে না। দেশবাসী উন্নয়ন চাইছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন উন্নয়নের কথা। সম্প্রতি একটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের জেলা-উপজেলায় উন্নয়ন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘আজকে আমরা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদবিরোধী যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, এক্ষেত্রেও আমি মনে করি প্রত্যেকের একটা সামাজিক চেতনা গড়ে তোলা উচিত, সচেতনতা সৃষ্টি করা উচিত। এজন্য জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য সব শ্রেণি পেশার মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন- ‘দল-মত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ, সকলের সহযোগিতা আমি কামনা করি। সহযোগিতা চাই এ জন্য যে, দেশকে আমরা যে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এ গতি যেন থেমে না যায়। এ উন্নয়নের গতিধারা সবসময় যেন অব্যাহত থাকে।’

প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন- ‘বাংলাদেশকে আজকে আর কেউ দরিদ্রের দেশ বা দুর্যোগ-দুর্বিপাকের দেশ বলে অবহেলা করতে পারে না। বরং আমাদের উন্নয়ন আজকে তাদের কাছে দৃশ্যমান।’ এসময় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এবার এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য) গ্রহণ করা হয়েছে।

‘উন্নয়ন যেন টেকসই হয় এবং জনগণ যেন সুফল পায় সে বিষয়টি মাথায় রেখেই নিয়মিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করে যাওয়া হচ্ছে।’ যোগ করেছেন তিনি। উন্নয়ন মেলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেলার ফলে জনগণ জানতে পারবে তাদের অধিকারটা কী এবং যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে তারা অবহিত হতে পারবে। আমরা মুখে বলে যাচ্ছি এসডিজি। কিন্তু এটা কোন কোন খাতে সে বিষয়টা সম্পর্কেও মানুষ জানতে পারবে।’

শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রত্যেক জেলায় কিছু নিজস্ব ইতিহাস, ঐহিত্য এবং পর্যটনের বিষয় রয়েছে। এসব বিষয় তুলে ধরা এবং যেসব এলাকায় যে যে পণ্য উৎপাদিত হয় সেসব পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের ওপর সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলবো। আমরা বাঙালিরা কখনো ভিক্ষুক জাতি হবো না।’

এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। তাই জাতির প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানিয়ে বড় করে তুলতে হবে। যারা আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে- তাদের পড়াশোনা করতে হবে। রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্বের জন্য কিছু পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। আর তা হচ্ছে বিশ্বরাজনীতি নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা। জানা এবং বোঝা বিশ্বরাজনীতির পরিবেশ, পরিস্থিতি। গ্রন্থাদি পাঠ। বিজ্ঞ রাজনীতিকদের জীবন র্শন ঘনিষ্ঠভাবে অবলোকন করা। এ দেখার মাঝে লুকিয়ে থাকে জীবনের জাগরণ। যে জাগরণ আরো সহস্র জীবনকে জাগায়। ডাক দেওয়ার সাহস জোগায়। মার্কস, লেনিন কিংবা মাও সে তুংয়ের আদর্শ মানা না মানা পরের কথা। আগে জানতে হবে- তারা কী বলেছিলেন। কী ছিল তাদের মুখ্য চেতনা। সমাজ বদলে শত বছর আগে কী ভেবেছিলেন সেই সময়ের আলোচিত রাজনীতিকরা। কী দর্শন রেখে গেছেন তারা।

আমাদের এখনো অনেক পথ বাকি। আজ যারা বাংলাদেশকে ডিজিটাল করে গড়ে তোলার কথা বলছেন, তাদের আগে এনালগ হাতগুলো মজবুত করতে এগিয়ে আসতে হবে। যে হাতগুলো এ পর্যন্ত বদলে দিয়েছে এ বাংলাদেশ। সেফ এন্ড সিকিউরড ইনভেস্টমেন্ট জোন গড়ে তুলতে মনোযোগী হতে হবে। কারণ সামাজিক নিরাপত্তা না পেলে কোনো প্রজন্মই শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। বাংলাদেশে এখনো অন্যতম সমস্যা নিরক্ষরতা। শিশুশ্রম এবং শিশুমৃত্যুর হার, নারীর বঞ্চনা, পুঁজিপতিদের দাপট এসব বিষয়গুলো তো আছেই। সমাজ বদল করতে হলে এর কাঠামো ঠিক করতে হবে আগে। মানুষকে শিক্ষিত সচেতন করার পাশাপাশি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনে রাখতে হবে এনালগ হাতগুলোই ডিজিটাল আলোর প্রধান রশ্মি। আর যদি ভুল শিক্ষা কিংবা আদিম শিক্ষার বীজ রোপণ করা হয়- তাহলে এর ফসল কী উঠতে পারে তা ভাবতে হবে সবাইকে।

_____________________________________
দৈনিক খোলাকাগজ। ঢাকা ॥ ১৬ জানুয়ারি ২০১৭ সোমবার।

কোথায় বান্ধি ঘর?

যে সমাজে নিরাপত্তা নেই, যে সমাজে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি তো দূরের কথা আড়াই বছরের বালিকা পর্যন্ত ধর্ষিতা হয়, সাত বছরের বালিকা যেখানে গ্যাং রেপের শিকার হয় সেখানে ভবিষ্যত প্রজন্মকে বড় করে তোলা কিংবা নিজে একটুকু ভালো থাকার আশায় একটা চাকুরি, সুন্দরী স্ত্রী, একটা বাড়ি করার স্বপ্ন বড় বেমানান জিনিস।

এখানে সন্ত্রাসী, র‌্যাব পুলিশ যোগসাজস করে ৭টা মানুষকে তুলে নিয়ে হত্যা করে ফেলে। লাশ গোপন করার জন্য পেট ফেড়ে শরীরে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়, ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলা হয় সেই সমাজে সুদ-ঘুষের হারাম উপার্জন দিয়ে সন্তান বড় করে লাভ কী? কোথায়, কোন পৃথিবীতে আমরা তাদেরকে রেখে যাচ্ছি? একটিবার ভেবে দেখেছেন আমাদের চলে যাওয়ার পর তারা কোথায়, কোন দুনিয়ায় গিয়ে পড়বে?

আমরা কিন্ত মনে করছি আমরা তাদের ভালোটাই করার চেষ্টা করছি। তাদেরকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করছি, আরাম-আয়েশের জীবন দিচ্ছি। কিন্তু তাদের উপকার করতে গিয়ে আমরা যে খাল কাটছি সেই খাল বেয়ে একদিন কুমির আসবে আপনার আপনার আমার সন্তানকে গিলে খেতে। সেই কাজটা আমরাই করে যাচ্ছি। আমরা ঘুষ দিয়ে চাকুরি নিচ্ছি, টেন্ডার বাগাতে বড় কর্তাদেরকে খুশি রাখার চেষ্টা করছি। এভাবে অসৎপথের একটা জোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে।

আজকে পুলিশের কিংবা সরকারি চাকুরি করতে যতটাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে তার পরিমাণ আগামী দশ বছর পরে কতগুণ বৃদ্ধি পাবে সেটা আপনারাই চিন্তা করুন। আপনার আমার সন্তানের উপর তখন চাপটা কত পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে সেটাও ভেবে দেখুন। আর তারাও অনুরূপ আত্মসার্থ বিবেচনা করতে গিয়ে একসাথে কয়টা খুন করতে পারে সেটাও অনুমান করুন। খুন করে গুম করাতো তখন আরো স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যাবে। রাখঢাক করে অবৈধ উপার্জন হবে না। বরং কে কত মারতে পারে সেটা দিয়ে মর্যাদা নির্ণয় হবে।

সুতরাং, আসুন চিন্তা করি কোথা বাঁধছি ঘর? কিসের উপর বানাচ্ছি স্বপ্নের আবাসন? কোনদিকে ঠেলে দিচ্ছি আগামী প্রজন্মকে? অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে তাদেরকে আপাত ভালো রাখতে গিয়ে কত বড় ক্ষতি করছি সেটাও আসুন ভেবে দেখি।

তাহলে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারল কি?

ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলা হলেও ভোটার কিন্তু ধর্মবিশ্বাসীরাই। সেই ভোটারদেরকে মই হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাবার স্বপ্ন দেখে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো।
.
মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হয়। একই ধর্মনিরপেক্ষ সিস্টেমের অধীনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ও নির্বাচনে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও ধর্মভিত্তিক দলগুলো খাঁটি মো’মেন বনে যায়, আর অন্যান্য দলগুলোকে বলা হয় কাফের।
.
তারা অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর মতই হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও, পোড়াও, ভাঙচুর করে তার নাম দেন জিহাদ, আর ভোটযুদ্ধের ব্যালট পেপারকে বলেন জান্নাতের টিকিট। অর্থাৎ যে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পরিত্যাগ করে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল তা আর ব্যক্তিগত জীবনে থাকল না। রাষ্ট্র যখন ধর্মকে অবজ্ঞা করে দূরে সরিয়ে দিল, সেটাকে লুফে নিল ধর্মব্যবসায়ীরা। রাষ্ট্র যখন মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক খাতে কাজে লাগাল না, ধর্মব্যবসায়ীরা তখন সেটাকে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের মাধ্যম বানিয়ে নিল।
.
মানুষ ধর্মের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। মানুষের ঈমান এক বড় শক্তি। সেই মহাশক্তিটি উঠে গেল একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হাতে। আজ পর্যন্ত ধর্মের নামে যত দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরেছে, সবকিছুর ঘুড়ির নাটাই হচ্ছে এই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তারা বিভিন্ন ইস্যুতে ইত্তেজনার পারদ চড়ায়, ইসলাম গেল ইসলাম গেল জিগির তুলে মানুষকে উন্মাদনায় মাতায়, জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর করে, পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তবু রাষ্ট্র তাদেরকে তোয়াজ করে চলতে বাধ্য হয় কারণ ঐ ঈমান নামক মহাশক্তি তাদের হাতে।
.
তাহলে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারল কি?

বিকল্প সিস্টেমের কথা কেন ভাববেন?

evangelical-divide
একটি গান আমরা সকলেই শুনেছি- ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে শুধাই, বল আমারে তোর কি রে আর কূল কিনারা নাই।’ উত্তাল পদ্মার যেন কোনো কুল-কিনারা নেই, সে ভেঙেচুরে ভাসিয়ে নিতে চায় সবকিছু। তার বিশালতার মাঝেও হিংস্রতা স্পষ্ট। আজ দুনিয়াময় গণতন্ত্রের নামে যে সিস্টেমটি চলছে তা যেন ওই উন্মত্ত পদ্মারই স্বভাব ধারণ করেছে। সে একদিকে নিজেকে উদার ভাবে, পরমতসহিষ্ণুতার দীক্ষা প্রদান করে, অধিকারের কথা বলে, অন্যদিকে সবার জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সে সমস্ত পৃথিবীকে পদানত করে রাখতে চায়, মানুষের সাথে, মানবতার সাথে তার প্রতারণা সুস্পষ্ট।

দুনিয়াময় আজ গণতন্ত্রের নামে যা চলছে সেখানে কেবল অনৈক্যের সুর, ভাঙ্গনের সুর। পরিবার ভাঙছে, সমাজ ভাঙছে, দল ভাঙছে, রাষ্ট্র ভাঙছে। অনৈক্য, শত্রুতা, বিদ্বেষ, হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাত ও ধ্বংস- গণতন্ত্রের এই অশুভচক্রে আটকা পড়েছে রাষ্ট্রসমূহ। পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র রপ্তানি করতে গিয়ে পরাশক্তিধর শোষক রাষ্ট্রগুলো প্রকাশ্যে দখলদারিত্ব চালাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ জনপদকে বিরানভূমিতে পরিণত করছে। প্রয়োজনে চালানো হচ্ছে গণহত্যা। এদিকে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো না পারছে এহেন গণতন্ত্রকে হজম করতে, না পারছে উগরে দিতে। জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, ভাঙচুর, অবরোধ-হরতাল এসব দেশের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে। ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশ্চাত্যের পানে বাড়ানো ভিক্ষার হাত দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। পদানত রাষ্ট্র আরও পদানত হচ্ছে। চূড়ান্তবিচারে লাভবান হচ্ছে একমাত্র পাশ্চাত্য শোষক রাষ্ট্রগুলোই, যেখান থেকে এ শোষণযন্ত্রের সূচনা হয়েছিল।

স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র বরাবরই এক বৃহৎ ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গণতন্ত্রের আশায় বুক বেঁধেছে লাখো মানুষ। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে গণতন্ত্রের দাবিতে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে। উত্তপ্ত স্লোগানে স্লোগানে গরম হয়ে উঠেছে রাজপথ। বুলেটে ঝাঝরা হয়েছে কত বুক। তারপর একসময় শোনা গেল গণতন্ত্র নাকি মুক্তি পেয়েছে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বিজয়ের আস্ফালন করল। নব্বই এর দশকে যাত্রা শুরু করল কথিত গনতন্ত্র। কিন্তু যে শান্তির জন্য এতকিছু, তার এতটুকু চিহ্নও কি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনামলের কয়েক দশকের ইতিহাসে আমরা পেয়েছি? গণতন্ত্র চলছে, পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হচ্ছে, ক্ষমতা পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু দেশবাসীর ভাগ্যের কাক্সিক্ষত কোনো পরিবর্তন নেই।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে যা চালানো হয় তাকে এক কথায় ‘সর্বনাশা’ বললে অত্যুক্তি হয় না। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক দল হিসেবে পরিচিত। তারা কথিত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনে যোগ দেয়, গণতান্ত্রিকভাবে জয়লাভ করে ক্ষমতায় বসে। সবার মুখেই গণতন্ত্রের বুলি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- কোনটা গণতন্ত্র আর কোনটা স্বৈরতন্ত্র সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত এরা ঐক্যমতে পৌঁছতে পারল না। যে দল ক্ষমতায় বসে তার কাছে গণতন্ত্রের মানে একরকম, যে দল পরাজিত হয় তার কাছে অন্যরকম। ইদানিং শুরু হয়েছে- ‘গণতন্ত্রের আসল রূপটা কী’ এই নিয়ে বিতর্ক। সরকার যেখানে দেশে গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই দেখছে না, সেখানে বিরোধী পক্ষগুলোর অভিযোগ হলো দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সরকার বলছে, এই দেখো, দেশ চলছে একশভাগ সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন হচ্ছে সংবিধান মেনে, বিচারবিভাগ কাজ করছে স্বাধীনভাবে, যে কেউ সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে পারছে, দাবি আদায়ের আন্দোলনও করছে অনেকে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়নের জোয়ার বইছে। মানুষ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো আছে। এটাই গণতন্ত্র। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষটি বলছে, না, দেশের কোথাও গণতন্ত্র নেই। দেশ চলছে স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়লাভ করলেই কেবল সে সরকার বৈধ হয়। এ সরকার সেই শর্ত পূরণ করে নি। এ বিতর্ক আজকের হলেও, খেয়াল করলে বোঝা যাবে, একই ধরনের বিতর্ক আমাদের দেশে দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। সম্প্রতি এ ধরনের বিতর্কে নতুন একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। গণতন্ত্র জরুরি নাকি উন্নয়ন জরুরি- কোনটা আগে? যদি গণতন্ত্র জরুরি হয় তাহলে কোন গণতন্ত্র? সীমিত গণতন্ত্র (Controlled democracy) নাকি বিস্তৃত পরিধির গণতন্ত্র (wide space democracy)? এসব নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। সব কিছুতেই যারা গণতন্ত্রের সার্থকতা খুঁজেন, তাদের নিজেদের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই, তা কি হয়? ইদানীং তাই দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার জোর চেষ্টা চলছে। রাজনীতিক দলের বা অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটাভুটির মাধ্যমে। কিন্তু যে গণতন্ত্র রাষ্ট্রে ব্যর্থ, তা দলে সফল হবে এমন আশা তো করা যায় না। পরিণাম- কাদা ছোঁড়াছুড়ি, চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি, শক্তিশালী সিন্ডিকেট, এক কমিটিকে আরেক কমিটির অস্বীকার। কোনো কোনো জেলায় দশকের পর দশক চলে যায়, কমিটি গঠন করতে পারে না। মারামারি, খুনোখুনি ও আতঙ্কের কারণে শেষ পর্যন্ত আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দল চলে। কাজের কাজ এই হয় যে, গণতন্ত্রের ব্যর্থতার ফুটো আরও বড় হয়।

এই সর্বনাশা বহুরূপী পুঁজিবাদী গণতন্ত্র জাতিটাকে শেষ করে দিল। একদিকে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় টিকে থাকার নগ্ন প্রতিযোগিতা, হামলা-মামলা, খুন-খারাবি, হয়রানি, দমন-পীড়ন; অন্যদিকে গণতন্ত্রের নামে হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ভাঙচুর, মানুষ পোড়ানোসহ যার যা খুশি বলা, যার যা খুশি লেখা ও যার যা খুশি করার মানসিকতা এ জাতিকে একটি মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে দেয় নি। স্রোতস্বিনী নদী যেমন তার স্রোতের টানে একটু একটু করে তীরের গাছপালা, গ্রাম-গঞ্জ, বাজার ও জনপদ ধ্বংস করে নিজেকে বিস্তৃত করে, তেমনি চলমান সর্বনাশা গণতন্ত্র এ জাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে চলেছে।

গণতন্ত্রের উৎপত্তি ইউরোপে। মধ্যযুগের বর্বরতা কাটিয়ে উঠার জন্য এমন একটি সিস্টেম ইউরোপের প্রয়োজন হয়েছিল। ধর্মের নামে চালানো চার্চের অধর্মের অপশাসন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্যশীল জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপীয়ানরা তাই গণতন্ত্র আবিষ্কার করে। পরবর্তীতে শিল্পবিপ্লবের ফলে গণতন্ত্র পরিণত হয় পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে। তার কুফল থেকে মানুষকে বাঁচাতে আবার একদল সমাজচিন্তক আবিষ্কার করেন সমাজতন্ত্র। সেই সমাজতন্ত্রও যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, সমস্ত পৃথিবীকে পুনরায় গ্রাস করে নিল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। ঔপনিবেশিক আমল শেষ হয়ে গেলে, নব্য নাম্রাজ্যবাদীরা সাম্রাজ্যবাদের আধুনিকতম পদ্ধতি হিসেবে গরীব দেশগুলোতে গণতন্ত্র রপ্তানি করতে শুরু করল। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল সেই ব্রিটিশ, যাদের অপশাসন, দমন-পীড়ন ও শোষণের দাগ তখনও ভারতের বুকে দগদগ করছে। যাদের দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক আমলে একবারের জন্যও গণতন্ত্রের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় নি। যুগে যুগে এ উপমহাদেশের মানুষের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতির যোগসূত্র রচিত হয়েছে ধর্মের দ্বারা। সেই ধর্মকেই অবাঞ্ছিত করে রেখে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের নামে এমন একটি সিস্টেম তারা চাপিয়ে দিল যার সাথে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, রুচি-অভিরুচি, কৃষ্টি-কালচার ও ধ্যান-ধারণার বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য নেই। আমাদের দেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কটাবস্থা ও বিভিন্ন জটিলতার প্রধান কারণ এটাই। এছাড়াও রয়েছে প্রাচ্যের এই দেশগুলোর দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে চালানো পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের বহুমুখী শোষণ। গণতন্ত্রের প্রধান কুফল- জাতির ঐক্য বিনষ্টকরণ। যে জাতিতে যত বেশি অনৈক্য, সেই জাতিকে শোষণ করা তত সহজ। গণতন্ত্র এ কাজটি খুব সহজ করে দিয়েছে। আর সে কারণেই গণতন্ত্রের জন্য পাশ্চাত্যের এত মায়াকান্না।

আজ সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। পশ্চিমাদের গণতন্ত্রের তত্ত্বকথা অনেক শোনা হয়েছে। সেগুলো যে ‘শাখের করাত’ ছাড়া কিছুই নয় তা প্রমাণ হতে বাকি নেই। সুন্দর সুন্দর শব্দজাল বিছিয়ে জাতিকে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থানে আটকে রাখা হয়েছে। তাই আর সংজ্ঞা দেখে নয়, ফলাফল দেখে বিচার করতে হবে। আর নির্লিপ্ত থাকা চলে না। সবাইকে বসতে হবে। রাজনীতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সকলে মিলে আসুন আমরা একটি ঐক্যমতে পৌঁছাই। আমাদের বিশ্বাস, কৃষ্টি-কালচার, রুচি-অভিরুচি অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং প্রাকৃতিক সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত এমন একটি সিস্টেম দাঁড় করাই যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের মতো ভাগ্যবরণ করা থেকে রক্ষা করবে, সেটা যে তন্ত্রই হোক না কেন।

আমার কালে

প্রবাহমান সময়ের গতিধারায় এমন এক কালে আমি পৃথিবীতে এসেছি,
আমার কালে ধর্মগুরুরা ধর্ম বেচে জীবনধারণ করেন,
শাসকেরা শাসিতের সাথে ছল করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে,
রাজনীতিকরা ওয়াদাই করে ভঙ্গ করার জন্য,
স্বার্থই হচ্ছে রাজনীতির ভিত্তি, জনসেবাকে পেশা মনে করে,যত বড় শিক্ষিত তত বেশি অহঙ্কারী,
ধনীরা হাজারো অবৈধ উপায়ে সম্পদ কুক্ষিগত করে দরিদ্রকে বঞ্চিত করে,
নারীরা চরমভাবে পদদলিত অথচ তাদেরকে স্বাধীন বলে প্রতারণা করা হয়,
অসৎ লোকগুলো সমাজে সম্মানিত,
সরল লোকগুলো বোকা বলে পরিগণিত,
বিচারক শক্তিমানের পূজারী,
নিরপরাধ লোক শাস্তি পায়,
অর্থের বিনিময়ে পানি পান করতে হয়,

২২ মাসের শিশু ধর্ষিতা হয়,
যুদ্ধের কোনো ধর্ম নেই,
যুদ্ধে বেসামরিক লোক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়,
বেওয়ারিশ লাশ বেসুমার,
যে কেউ যে কোন সময় গুম হয়ে যায়,
চিকিৎকরা রোগীকে মক্কেল, ক্লায়েন্ট মনে করে,
তাদের সাথে প্রতারণা করে,
ব্যবসায়ীরা খাদ্যে বিষ দেয়,
পণ্যে ভেজাল দেয়,

ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রহার করে,
শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে গণ্য করা হয়,
স্ত্রী স্বামীকে-স্বামী স্ত্রীকে,
পিতা-পুত্রকে হত্যা করে,
সন্তানরা বাবা-মাকে বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়,

অশ্লীলতাকে ফ্যাশন মনে করে,
গালিকে বুলি মনে করা হয়,
সাহিত্যিকরা আজগুবি সাহিত্য তৈরি করেন,
ধর্মকে অধিকাংশ মানুষ কাল্পনিক মনে করে,

সন্তানের ভরণপোষণ করাকে পিতা-মাতা বিনিয়োগ মনে করে,
নব প্রজন্ম বিয়ে করাকে প্রাচীনপন্থা মনে করে,
সমকামিতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করা হয়,

কুৎসা রটনা করে মানুষের চরিত্র হনন করাকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মনে করা হয়,
বিক্রি করা জমিকে আরো বহুজনের কাছে বিক্রি করা হয়,
আতঙ্ক ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ছাড়া সমাজে কাউকে সম্মান করা হয় না,
অর্থ আর ক্ষমতাই সম্মানের মাপকাঠি,
উকিল উভয়পক্ষ থেকে টাকা খায়,
বিয়ের দেনমোহর আজীবন অপরিশোধিতই থাকে,
শ্রমিক ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবিতে আন্দোলন করলে গুলিতে ঝাঁঝরা হতে হয়,
শহরগুলো অলস আর অন্তর্মুখী জনতায় পরিপূর্ণ,
প্রতিবেশী বলে কিছু নেই, নাগরিক সম্পর্ক বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ায় সমাপ্ত,
.
পৃথিবীকে কাল্পনিক বেড়া দিয়ে শতশতভাগে বিভক্ত করে সম্পদ ও জনসংখ্যার প্রাচুর্য ও ঘাটতি সৃষ্টি করে তাকেই স্বাধীনতা বলে আখ্যা দেওয়া হয়…………
এভাবে বলতে গেলে আরো আরো বহু কিছুতেই পরিপূর্ণ আমার কাল।
.
এই ঘোর কলিকালের বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম।

টিকফা কী? কেন আমরা টিকফা চুক্তির বিরোধিতা করি?

‘টিফা’ বা ‘টিকফা’-এর বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী গতকাল গার্মেন্টস এক্সেসরিজ এবং প্যাকেজিং উৎপাদকদের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবার সময় জানিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ ‘টিকফা’ চুক্তি স্বাক্ষর আমেরিকার বাজারে জি এস পি সুবিধা অক্ষুন্ন রাখার জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। চুক্তিটিকে চূড়ান্ত আকার দেয়ার কাজ শেষ হয়েছে এবং তা এখন স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।

টিকফা কী?

টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা।‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment FrA বা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে হয় — ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। ‘টিফা’ চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে দশক কালেরও আগে থেকে। এই চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে আবার ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। দেশের বামপন্থি শক্তিসহ অন্যান্য নানা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি স্বাক্ষর করা এখনো সম্ভব হয়নি। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন ‘টিকফা’ তথা TICFA বা Trade and Investment Co-operamework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

চুক্তিটি কার জন্য?

চুক্তিটি আমেরিকার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের। এই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র করেছে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও। চুক্তিটির ধারা উপধারাও আমেরিকার তৈরি। আমেরিকা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে নাছোড়বান্দা এবং তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এজন্য সে বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। এর মাঝে এদেশে ও আমেরিকায় কয়েক দফা সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু ‘টিফা’ চুক্তির বিষয়টি সব আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে থেকেছে। তারা এমনও বলেছে যে, ‘টিফা’ চুক্তি স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পরবে। যেহেতু বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রশ্নাতীত এবং এই অসামঞ্জস্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগের’ স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে করা চুক্তিটির দ্বারা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের একতরফা সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে এই সমালোচনা নিরসনের জন্য ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ’-এর সাথে ‘সহযোগিতা’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে যে সব প্রস্তাবনা ও ধারা রয়েছে সেগুলোর জন্য চুক্তিটি অসম ও মার্কিন স্বার্থবাহী।

টিকফা চুক্তিতে কী আছে?

‘টিকফা’ চুক্তিতে কি কি ধারা রয়েছে তা দেশবাসী জানে না। এই চুক্তি নিয়ে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে টিফার চুক্তি সংক্রান্ত কিছু তথ্য ফাঁস হয়ে যায়, যেটাতে দেখা যায় অন্যান্য দেশে যে সমস্ত টিফা চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের ধারা উপধারা গুলো মিলে যায়। এই আলোচনা সেই ফাঁস হওয়া ড্রাফটের উপর করা হয়েছে। যদিও সেই ড্রাফ্‌ট পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে তবে মুল ভাবনা এই আলোচনার বাইরে যাবেনা বলেই মনে হচ্ছে। এই চুক্তির খসড়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধন সুদৃঢ় করার উল্লেখ থাকলেও চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায় এবং অনুচ্ছেদে বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতসমূহে বিশেষ করে সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করবে। বেসরকারি খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত “বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন” প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল ও পরামর্শ সরবরাহ করবে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সার্ভিস সেক্টরের কথা উল্লেখ রয়েছে, ‘পণ্য’ উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত রাখা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে, তা শুধু সেবা খাতেই। তারা কোনো পণ্য এ দেশে উৎপাদন করবে না। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিবে এবং বিদ্যমান শুল্ক এবং অশুল্ক বাঁধাসমূহ দূর করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশকে দেশীয় শিল্পের/কোম্পানির প্রতি সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষণ নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। টিকফা চুক্তিতে বলাই আছে বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরিত “দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি” অনুযায়ী মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির উপর কোন কর আরোপ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাসকরণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া টিকফা চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে মেধাস্বত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন।

চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সমস্যা কি?

চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে দেশের সেবাখাত সমূহ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। এতে করে দেশীয় কোম্পানিগুলোর স্বার্থও বিঘ্নিত হবে। অবাধ মুনাফা অর্জনের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো সেবা যেমন টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বন্দর প্রভৃতি ও পণ্যের দাম বহুগুনে বৃদ্ধি করবে। সেবাখাতে বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করলে বাংলাদেশ তার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে কম মূল্যে সেবা দানের যেসব কর্মসূচী নিয়ে থাকে তা সঙ্কুচিত হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে সুকৌশলে বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করে অনুন্নত দেশকে বাণিজ্য সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থাকছে। দোহা এজেন্ডা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষিতে ৫% এর বেশি ভর্তুকি দিতে পারছে না অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কৃষিতে ১৯% এর বেশি ভর্তুকি দিয়ে তাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে কিন্তু বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করছে অথচ আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য উদারনীতি গ্রহণে নানা চুক্তির মাধ্যমে বাধ্য করছে।

মেধাস্বত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন হলে তা উন্নত দেশগুলোর মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করবে যাতে দরিদ্র দেশগুলোর কাছ থেকে অবাধে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের আইনি বৈধতা পাওয়া যায়। উন্নত প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতির অধিকারী হবার পর তারা এই জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা চায় যেন অবশিষ্ট বিশ্ব প্রযুক্তি ও উৎপাদনের জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। টিফা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মেধাস্বত্ব আইন মানতে বাধ্য করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে ২০১৬ সালের আগেই মেধাস্বত্ব আইন মেনে চলতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার (TRIPS) এবং অন্যান্য প্রচলিত মেধাস্বত্ব আইনের যথাযথ এবং কার্যকরী রক্ষণাবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। দোহা ঘোষণা ২০০০ অনুযায়ী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বাণিজ্যবিষয়ক মেধাসম্পদ স্বত্ব চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এবং ২০১৬ পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে ছাড় পেয়েছে এবং এই সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রফতানি করতে পারছে। কিন্তু টিকফা এ সে ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার সফটওয়্যার সহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে গিয়ে বিভিন্ন পণ্য এবং প্রযুক্তির দাম অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাবে। মেধাস্বত্ত্ব আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবে না, আমাদেরকে কয়েক গুন বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে রপ্তানি সম্ভাবনা হারাবে। দরিদ্ররা ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাবে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হবে কেননা দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশেই তাদের ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প ধংস হয়ে যাবে। আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা লুট করবে।

‘টিকফা’ চুক্তির খসড়ায় পণ্য ও পুঁজির চলাচলকে অবাধ করার কথা এবং সেই সূত্রে মুনাফার শর্তহীন স্থানাস্তরের গ্যারান্টির কথা বলা হলেও শ্রম শক্তির অবাধ যাতায়াতের সুযোগের কথা কিছুই বলা হয়নি। অথচ শ্রম শক্তিই হলো আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান সম্পদ যার রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে বিপুল আপেক্ষিক সুবিধা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘খোলাবাজার’ নীতিটি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে রাজি নয়। তারা তা প্রয়োগ করতে প্রস্তুত কেবল পুঁজি এবং পণ্য-সেবা পণ্যের ক্ষেত্রে, যে ক্ষেত্রে তার রয়েছে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি আপেক্ষিক সুবিধা। অন্যদিকে, টিকফাতে ‘শুল্ক বহির্ভূত বাধা’ দূর করার শর্ত চাপানো হলেও ‘শুল্ক বাধা’ দূর করার কথা বেমালুম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্যের ক্ষেত্রে, গড় আন্তর্জাতিক শুল্ক যেখানে ১২%, যুক্তরাষ্ট্রের তা ১৯%।

পেটেন্ট আইন মানতে হলে সমস্যা কী?

পেটেন্ট কোন প্রতিষ্ঠানকে মেধাসত্ত্ব দিয়ে দেয়। ফলে সে সেই মেধাসত্ত্বের ভিত্তিতে সেই পেটেন্টের সাথে সম্পর্কিত যে কোন বাণিজ্যে সে রয়্যালটি দাবী করতে পারে। যেমন নিমের পেটেন্ট করা আছে আমেরিকার তাই নিম গাছ থেকে উৎপাদিত যে কোন পণ্যে সে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়্যালটি দাবী করতে পারবে। বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন দেশের নিজস্ব জীববৈচিত্রের অনেক জীব-অণুজীব এবং উদ্ভিদ প্রজাতি এখন বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্টের দখলে। ভারত উপমহাদেশের শতাধিক গাছগাছড়া যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। পেটেন্ট আইন বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। পেটেন্ট এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এখন আর শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফল ফসল এবং গাছ গাছড়ার উপরও বিস্তৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইনে বলা আছে, “কোন কিছুর পেটেন্টের বেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অলিখিত উৎসের অনুসন্ধানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই”। এর মানে হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশের প্রচলিত উৎপাদন প্রনালী, জীববৈচিত্র্য, কৃষকদের নিজস্ব শস্যবীজ ইত্যাদি শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং অর্থের জোরে পেটেন্ট করে নিতে পারবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের উন্নত জেনেটিক টেকনোলজির মাধ্যমে ডি এন এ ফিংগার প্রিন্ট নির্ণয় করে অন্য দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিজ সম্পদকে নিজের বলে পেটেন্ট করিয়ে নেবে। কৃষিতে পেটেন্ট বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের শস্য বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে। মেধাস্বত্ব আইন অনুযায়ী রয়্যালটি পাবে আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর ধ্বংস হবে দেশী প্রজাতি, পরিবেশ এবং কৃষি উৎপাদন কাঠামো। বীজ এবং কৃষি পণ্যের দাম অনেকগুন বেড়ে যাবে বলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তৈরি পোশাক শিল্পকেও ব্র্যান্ড নামে ব্যবহূত এদেশের তৈরি এ্যাকসেসরিজের জন্য সংশ্লিষ্ট মার্কিন কোম্পানিকে রয়্যালটি দিতে হবে। বাসমতি চাল, চিরতার রস, নিমের দাঁতন ইত্যাদি হেন বস্তু নেই যা আগেভাগেই মার্কিনীসহ বিদেশি কোম্পানিরা পেটেন্ট করে রাখেনি। মেধাস্বত্ব অধিকারের ধারা প্রয়োগ করে তারা এসবকিছুর জন্য রয়্যালটি প্রদানে বাংলাদেশকে ‘টিকফা’ চুক্তি মাধ্যমে বাধ্য করতে চায়।

টিকফাতে শ্রমিক বান্ধব ধারাও কী আছে?

মোটেও না। টিকফার প্রস্তাবনায় মানবাধিকার, শ্রমের মান এবং শ্রমজীবীদের অধিকার ও পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার লক্ষ্য শ্রমজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় বরং এগুলোকে নন- ট্যারিফ (অশুল্ক) বাধা হিসেবে ব্যাবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মানবাধিকার, শ্রম পরিবেশের মান ইত্যাদি বিষয়কে অশুল্ক বাধা হিসাবে চিহ্নিত করে মার্কিনীরা ‘টিকফা’ চুক্তি দ্বারা বাংলাদেশকে উত্তরণ অসাধ্য প্রতিকূলতায় আটকে ফেলার ফন্দি করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরে তারা আমাদের মতো দেশে ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়ে, নিজ নিজ দেশে নির্মম ও অমানবিক শ্রম-শোষণ চালিয়ে, শ্রম পরিবেশের ক্ষেত্রে দাস সুলভ মান বজায় রেখে এখন উন্নত ধনী দেশে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা উন্নয়নের পথ গ্রহণ করা মাত্রই সমানে সমানে প্রতিযোগিতায় নামার কথা বলে আমাদের ওপরে তাদের মতো সমান মাত্রার শর্তাবলী চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ যেন, হাত-পা খোলা মোটা তাজা মানুষ কর্তৃক পেছনে হাত বাঁধা অনাহারী মানুষকে সমানে সমানে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো!

চুক্তির জন্য কেন এতো গোপনীয়তা?

বাংলাদেশের সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ‘বিদেশের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন; তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’ যেহেতু টিকফা কোন নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি নয় তাই সে চুক্তির ধারা গুলো প্রকাশ না করাটা সংবিধান বিরোধী। ‘টিকফা’ চুক্তির ধারাসমূহ নিয়ে গোপনীয়তা ও রাখঢাক করার যে চেষ্টা চলছে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্শিক।

টিকফা চুক্তি কী বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়াবে? বাংলাদেশের পণ্য রফতানী বাড়াবে?

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে, সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বে আমাদের পণ্য রফতানিও। এশিয়ার দুটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি গণচীন এবং ভারত তার রফতানির যথাক্রমে ২১ এবং ১৯% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করলেও তারা এই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানির সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানিতে প্রধান বাঁধা হচ্ছে শুল্ক বাধা। বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫.৩% শুল্ক দিতে হয় অন্যদিকে চীনকে পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৩%। তাহলে দেখা যাচ্ছে চীন টিফা চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পণ্য রফতানি করতে পারছে। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে কিন্তু টিকফা এগ্রিমেন্টে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি কারণ প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় দেশ নিজ নিজ বাজারে পণ্য প্রবেশে নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাঁধা দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অশুল্ক বাঁধা খুব সামান্যই।

যুক্তরাষ্ট্র কেন এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এতটা আগ্রহী?

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাইরে স্বল্পোন্নত দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যই আমেরিকা সহযোগিতামূলক উদ্যোগের ছদ্মাবরণে টিফা বা টিকফার মত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো করার চেষ্টা করছে। যদি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায় তবে আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ফোরাম ডব্লিউ,টি,ও এ আমেরিকা তার আধিপত্যবাদী বাণিজ্য নীতি বাঁধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই লক্ষ্যেই পাকিস্তান,সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইরাক, উরুগুয়েসহ বিশ্বের ৩০ টিরও বেশি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই টিফা চুক্তি সাক্ষর করেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিপরীতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য এসব ফোরামে বাংলাদেশ যাতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারে সেজন্য বাংলাদেশকেও টিকফা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে যুক্তরাষ্ট্র কেননা টিকফা স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার প্রশ্নে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করে গণচীনের অব্যাহত উন্নয়ন ও পরাশক্তি হিসেবে চীনের অভাবনীয় অগ্রগতি ঠেকাতে এবং দক্ষিন এশিয়ার বিশাল বাজারের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বঙ্গোপসাগরে এবং ভারত মহাসাগরে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখতে হবে। আর বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আঞ্চলিক পার্টনার বানাতে আগ্রহী। ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকার কাছ থেকে অধিকতর সহযোগিতার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাচ্ছে কেননা এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ মার্কিন বলয়ে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য যে, দোহায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে গৃহীত ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার’ মূল বিষয়গুলো হলো—অ-কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্তকরণ, কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, মেধাজাত সম্পত্তি অধিকার (ট্রিপস) এবং সার্ভিস বা পরিবেশ খাতে বিনিয়োগ উদারিকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে মার্কিনের স্বার্থের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের গুরুতর বিরোধ আছে। অথচ ‘সোফা’ চুক্তির সুবাদে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মার্কিনের পক্ষে এবং স্বল্পোন্নত দেশের বিপক্ষে বাংলাদেশকে দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপাক্ষিক ‘সোফা’ চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারবে। একথা সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অভিন্ন ও সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক ও বহুপাক্ষিক নানা ফোরামে অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু টিফার মতো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তা স্বাধীন মতো করতে পারবে না। শুধু তাই নয় বহুপক্ষীয়ভাবে যে কোনো বিরোধ নিরসনের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। ‘টিকফা’ চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুপাক্ষিক ভাবে প্রচেষ্টা চালাবার সুযোগ নিরঙ্কুশভাবে পাবে না। উপরন্তু বাণিজ্য সমস্যা বহুপক্ষীয়ভাবে সমাধানের বদলে তা মার্কিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষিয়ভাবে সমাধানের ফাঁদে পড়বে বাংলাদেশ। একপক্ষ প্রবল শক্তিশালী হলে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান স্বাভাবিক কারণেই দুর্বলের নয় বরং সবলের পক্ষেই যায়। সে কারণে বাংলাদেশকে সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে।

জি এস পি সুবিধার পাবার প্রশ্নের সাথে কি টিকফা চুক্তি যুক্ত?

ঢাকায় নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা গত ২৮ জুলাই আবারো এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “টিকফা চুক্তি সই না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে না। “টিকফা চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দরকষাকষিকে ‘অস্বস্তিকর’ বিষয় উল্লেখ করে তিনি জানতে চান, “এতে খারাপ কী আছে? আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না।” টিকফার সাথে জি এস পি সুবিধার কোন সম্পর্ক নেই। দোহা নীতি অনুসারে আমেরিকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা যেটাকে সাধারণভাবে জি এস পি সুবিধা বলা হয়। আমেরিকা ঠিকই বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিয়েছে তবে তাতে ঐসব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার রপ্তানির পরিমান খুবই কম। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে এর বাইরে রাখা হয়েছে। সেই সব পণ্যের জন্য জি এস পি সুবিধা থাকা আর না সমান কথা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হয় তার ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসিয়ে রেখেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের গড় আমদানি শুল্ক হার শতকরা ১ ভাগের মতো। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ। এই শুল্কহার আন্তর্জাতিক বিধিরও পরিপন্থী। এই শুল্ক এমনিতেই বাতিল হওয়া দরকার। এবছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কবাবদ প্রদান করেছে প্রায় ৫৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে আসে তার ৬ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের যোগান দিচ্ছে।

জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে রচিত ‘টিকফা’ চুক্তি পুরোটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা আরেকটি সর্বনাশের বার্তা। দেশের গলায় আরেকটি ফাঁস পরানোর এই পাঁয়তারা দেশপ্রেমিক জনগণকে রুখতে হবে। এ কর্তব্য সব দেশপ্রেমিকদের।

কৃতজ্ঞতাঃ ‘টিফা’ চুক্তি দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিবে; মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী টিকফা চুক্তি সই করা হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী; বিবাগী বাউল। আনু মোহাম্মাদ। এই লেখাটি তৈরিতে তাঁদের লেখার অনেক অংশ এবং তথ্য সরাসরি অবিকৃত অবস্থায় অথবা ঈষৎ সম্পাদিত অবস্থায় ব্যবহার করা হয়েছে।

পিনাকি ভট্টাচার্য
১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:০২।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৪।
বিষয়বস্তুর স্বত্বাধিকার ও সম্পূর্ণ দায় কেবলমাত্র প্রকাশকারীর।

জনগণের শক্তির উত্থান চাই দেশের সুসম উন্নয়ন দেখতে চাই

adজনগণের শক্তির সত্যিকারের উত্থান চাই, দেশের সুসম উন্নয়ন দেখতে চাই।
আমি কেউ নই। আমি এই স্বাধীন দেশের একজন মামুলি নাগরিক মাত্র। আমার রঙ নীল, গোলাপি বা সাদা নয়। আমার রঙ তামাটে গৌড় বর্ণ। আমার মন এদেশের মৃদুমন্দ বাতাসে যেমন দোলে, তেমন ঝড়ের বেগে তাণ্ডবে মাত্তেও অপেক্ষা করে না। গেঁয়ো ভুত, জানিনা সম্মান দিতে, যার সম্মান প্রাপ্য নয়। আবার গেঁয়ো বলেই ভাষা ব্যবহারে সচেতন হতে কখনো কখনো ব্যর্থ !

১৯৭১ সাল ডিসেম্বর ১৬, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের নাম যুক্ত হল। দীর্ঘ ৯ মাস স্বাধীকার আন্দোলন করে বাঙ্গালী জাতির এক অংশ স্বাধীন হল। কিন্তু যে আশা নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে নেমেছিল লক্ষকোটি তরুণ, সাথে ছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান নামক প্রদেশের প্রায় সকল নাগরিক; সাধারণ লোকেদের অস্ত্র চালানোর সাহসেই কিনা, কি যেন হল তারা আবার গর্জে উঠল। মাত্র ৩ বৎসর পর স্বাধীনতার মুল নায়কের প্রায় গোটা পরিবার এক অভ্যুত্থানে মৃত্যুবরণ করলে, বিখ্যাত আওয়ামীলীগ পরিবারের কিছু নেতা সরকার গঠন করলেও পিছনে থাকল দেশের সেনাবাহিনী। এরপর স্বাধীনতার যুদ্ধের মাঠে দ্বিতীয় পুরুষ হিসাবে আলোচিত, যিনি কিনা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাঙ্গালীর মনে স্থান করেছিলেন যুদ্ধকালীন সময়েই; সেই জিয়াউর রহমানের কাছে একসময় ক্ষমতা চলে এলো। সেনাশাসন থেকে জণগনের শাসনে দেশ রুপান্তরিত হল ১৯৭৯ সালের এক সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু জাতিকে আবার সেনাশাসনের নিগূঢ় জালে আবদ্ধ হতে হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ।

এরশাদ সাহেব পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় এলেন। এরপরের আলোচ্য নিয়েই আমার আজকের প্রতিপাদ্য। দেশ স্বাধীনের ১০ বৎসরের বেশী অতিক্রান্ত হয়েছে ইতিমধ্যে। দেশের বাস্তবতায় কিছু দালাল স্বার্থপর শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। যারা ক্ষমতাকে সামনে রেখে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যবে সেই গ্রাম্য পরকীয়ার কাহিনীর মত। “দেখে যখন ফেলেছিস তুইও লাগা !” মানে আমার চুরি যখন ধরেই ফেলেছিস তো, তুইও চুরি কর। অথবা আমি যখন রাজনীতি করতে এলাম তুইও আয়।

সেনাশাসকদের সাথে গোপন আতাত করে কত বড়মাপের নেতা যে ডিগবাজি দিলেন বা খেলেন তার ইয়ত্তা নাই। কোরবান আলি, শাহ মোয়াজ্জেম, মিঃ মওদুদ আহমেদ, হুদা সাহেব, জাফর সাহেব, অধ্যাপক মতিন সাহেব … কে নাই! আছেন আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক, হটাৎ গজানো রাজনীতিক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কর্মচারী, উকিল, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শ্রমিকনেতা, কবি-সাহিত্যিক, গায়ক-শিল্পী, কে নাই ! সবাই নিজের আখের গোছাতে ‘রাষ্ট্রের উন্নয়নের মুলো’ জনগণের ঘাড়ের উপর ঝুলিয়ে দিয়ে, এরশাদ সাহেবকে সাহায্য করলেন। দীর্ঘ ৯ বৎসর কখনো সেনাশাসন, কখনো জনগণের পাঁচমিশালি গণতন্ত্র দিয়ে পার হল এই সময়। আর এই সময়ের মুল দর্শন হল ‘নিজে চুরি কর, ধরা খাইলে কিছুটা দান কর’।

মিথ্যার ছড়াছড়ি, চরিত্রহীনতার এক অলিখিত উৎসবে দেশ মেতে উঠল। বামপন্থিদের আন্দোলন হয়ে পড়ল চাঁদার উপর নির্ভরশীল। বিষয়ভিত্তিক এবং চাঁদা প্রাপ্তির উপর তার প্রবলতা এবং আয়ুষ্কাল নির্ধারিত হত। ফলে জনগণের ভিতর যে প্রতিবাদ করার সাহস, যা বরাবর বামদের নিকট থেকে সুচিত হত; তাও বিলীন হয়ে গেলো। এক কথায় রাজনীতি হয়ে গেলো চাটুকারিতার আর স্বার্থপরদের আখড়া। এরশাদ জনগণের এই চারিত্রিক অধঃপতনে ঘি ঢেলে গেলেন ক্রমান্বয়ে। নিজের দালালদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে উনি রাষ্ট্রের রূপরেখার কিছুটা বিকৃতভাবে চালু করলেন। যেমন ১৯ জেলা ভেঙ্গে ৬৪ জেলা করলেন। কেউ এর প্রতিবাদ করলেন না। কারণ নিজেদের নেতা হওয়া সহজ হবে ভেবে। হলোও তাই!

কিন্তু আমাদের স্বাধীন দেশের পরিপত্রে কি এইরকম কিছু ছিল? প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরন করার কথা ছিল। কিভাবে ছিল? জেলাগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো করার কোন কথা বা পরিকল্পনা ছিল কি ? না ছিল না। যা ছিল তা হল, থানা এমন কি ইউনিয়নকে শক্তিশালি করার প্রস্তাবনা। ৪ স্তর শাসন ব্যবস্থা চালু করার কথা। ইউনিয়ন – থানা- জেলা-কেন্দ্র।

কিন্তু জেলাকে ভেঙ্গে এমন এক অবস্থা করা হল যে, থানাকে আর আলাদা করে কোন অবস্থান দেখানো যায় না; বা উলটো দিকে দেখলে জেলার স্বাধীন অস্তিত্ব হয়ে পড়ল দুর্বল। এমন জেলাও বর্তমানে আছে, যা আগে আসলে একটি থানা ছিল। তখন যদি ৩ স্তর বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা করা হত ‘ ইউনিয়ন – জেলা – কেন্দ্র’; এতে কিছুটা হয়ত বাস্তব ভিত্তিক হতে পারত। কিন্তু এরশাদ সাহেব এর তখন ‘তৈলমর্দন’, পছন্দের এক নং তালিকায়। উনি নতুন মুখের বাণী আর নতুন হাতের তৈল মর্দন চান। সাথে উনার আশৈশব নারীর প্রতি দুর্বলতাতো আছেই। উনি চালু করলেন থানা গুলোকে উপজেলা নাম দিয়ে উপজেলা সরকার পদ্ধতি। “প্যাঁচের উপর প্যাঁচ। জিলাপি ই হয় না, বানালেন আমিত্তি”।

নির্বাচিত উপজেলা নেত্রীত্ব বানালেন। নেতা হল কিন্তু ক্ষমতা কই? ক্ষমতা রইল কেন্দ্রেই। ছোট্ট এই দেশে নেতার ছড়াছড়ি। এত নেতা, আর এত মত যে! কেউ কাউরে মানেনা, শুধুই বিতর্ক আর বিতর্ক। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের ২০ বৎসরের মধ্যে রাষ্ট্রের কাঠামো এত জগাখিচুড়ি বানিয়ে দিয়ে গেলেন যে, এখন যারা দেশ চালাতে আসছেন; তারা দেশের কোন কাম করতে পারেন না। কোন্দল মিটাতেই ব্যস্ত। একটা টেন্ডার হলে তার নিষ্পত্তি করতে পারা যায় না… কে কাজ করবে। লাভের লাভ নেতা, পাতিনেতা, উপনেতা, সহনেতা, সহ উপনেতা, উপ উপনেতা কত বাহারি নেতার দেশে পরিনত হল এই দেশ !

অবশেষে সবকিছুর একটা শেষ আছে। এরশাদ সাহেবকে গদি থেকে নামালেন এদেশের কিছু তরুণ ছাত্রনেতা একজোট হয়ে। ডাকসু এর কিছু তরুণ নেতা এই কাজকে পরিণতি দিল। সাথে ছিল জনগণের সাবলীল সমর্থন। দেশে একটি গণতন্ত্রের বাতাসের প্রবাহ দেখা গেলো। সংবিধানকে সংশোধন করে জাতির পিতার শেষকৃত কর্মকে দুই পায়ে দলে রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হল। যদিও এই শাসন ব্যবস্থা দিয়েই রাষ্ট্র তার শুরু করেছিল। কিন্তু বাকশাল করতে গিয়ে সেই ব্যবস্থা পালটে দেয়া হয়েছিল। দেয়া হয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্রের ১ম সংবিধানকেও। কিন্তু ৩য় বিশ্বের একটি দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত না সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা ভালো ফল দিবে তার উপর কোন গবেষণা চলল না। হুজুগে বাঙ্গালীর নেতারাও হুজুগে হবে, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে? দেশে গণতন্ত্রের ২য় পর্যায় শুরু হলো জনগণের গণজাগরণ তথা অভ্যুত্থানের মাঝে দিয়ে।

সংবিধানে একটি পরিবর্তন এলো। সাময়িক শাসন ব্যবস্থায় একটি সুন্দর নির্বাচন হল। জনগণের রায় সুন্দর ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু তাবেদার এক শক্তি যারা নিয়ন্ত্রণ করে পত্রিকা, শিল্প মাধ্যম তাদের প্রচারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত হল। ফলে নাখোশ হল একটি গ্রুপ, সাথে তাদের পিছনের চালিকাবৃন্দ। কিন্তু শাহাবুদ্দিনের সাময়িক সরকারের সাফল্য জনগণের মাঝে একটি ধারণাকে স্পষ্ট করে দিল যে, তত্ত্বাবধায়ক বা সাময়িক শাসন ব্যবস্থার মাঝে একটি নির্বাচন করলে, জনগণের মত সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হয়। বরাবরের মত তৎকালীন বিএনপি সরকার জনগণের এই মনোভাব বুঝতে দেরি করল। একটি আন্দোলন আবার গড়ে উঠল। এইবারের আন্দোলনে সহিংস রুপ দিলো আওয়ামীলীগের জোট আর জামাতে ইসলামী দলের লোকেরা। গণঅভ্যুত্থানে ফেরত পাওয়া গণতন্ত্রে দেশের লোক ১৭৩ দিন হরতাল দেখল। সরকারকে বাধ্য করল তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে জায়েজ করে, এক নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায়। একটি ক্ষণ্ডকালীন সংসদে তত্ত্বাবধায়ক বিল পাশ করা হল ১৯৯৬ সালে। সেই বিলে সাময়িক নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে ১ নং পছন্দ দেয়া হল মাত্র অবসরে যাওয়া বিচারপতিকে। আর এই বিষয়টি মাথায় নেয়া হল সম্ভবত বিচারপতি সাহাবুদ্দিন এর নিরপেক্ষতাকে সামনে রেখে। নইলে বিচারকদের এমন পদে দেওয়ার দুঃসাহস কারই করার কথা নয়। এরপর ঐ ক্ষনকালীন সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে দেশে আবার জাতীয় নির্বাচন দেয়া হল। ৩ টি নির্বাচন এই ভাবেই হল। জনগণ কিছুটা বিভ্রান্তিতে পরলেও সানন্দেই মেনে নিয়েছিল এই পদ্ধতি। কারন আমাদের মত বিপুল সংখ্যক নেতাদের দেশে এবং তাদের উত্থাপিত হাজারো মত পার্থক্যের এই দেশে, নির্বাচনকালীন শাসন ব্যবস্থা নিয়ে একটি যথাযোগ্য সমাধান জনগন পেয়েছিল; এবং জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। কোন আইন তখনই সুন্দর বলে বিবেচিত হয়, যখন আইনের গ্রহণযোগ্যতা জনসম্মুখে প্রস্ফুটিত হয়ে ধরা দেয়। সেই বিচারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই আইনটি বিশ্বে বিরল হলেও প্রতিষ্ঠিত একটি ভালো আইন বলেই বিবেচিত ছিল।

২০০৬ সালে আবারো সেই গুষ্টির(১৯৯১ সালের পরাজিত শক্তি) ক্ষমতা যাওয়ার পথ নিরঙ্কুশ করতে তৎপর হল দেশী বিদেশি এজেন্টগণ। তারা জনগণের ভোটকে মুল্য না দিয়ে, মুল্য দিলেন সরকার ব্যবস্থা কে। আবার তারাই জনগন সকল ক্ষমতার উৎস বলে চিৎকার দিয়ে দেশ মাতিয়ে বেড়াতে থাকলেন! ফলে সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রে আবারো রক্তপাত ঘটল। এরপর সেনাবাহিনীকে সামনে নিয়ে এক বীভৎস জগাখিচুড়ি মার্কা শাসন জনগন পেল। নামহীন এক সরকার অনেক জোড়া তালি দিয়ে দেশ শাসন করল ২ বৎসর। হয়ত আরও দীর্ঘ হতে পারত। কিন্তু একটি ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে যে জনরোষ ঢাকাসহ সারাদেশে শুরু হয়েছিল, তাতে সেনাবাহিনীর সমর্থনে দেশ চালানোর সাহস আর দেখায়নি সেই সরকার। তাদের বীভৎস জগাখিচুড়ি মার্কা শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার, তা করে একটি নির্বাচন দিলেন। জনগন একটি সরকার পেল। অনেক ক্ষমতাধর সরকার!!

এই সরকার ক্ষমতায় এসেই কিছু পথ নিজেদের করে নিলেন। প্রথমেই বিচার বিভাগকে নিজেদের তাবেদার করে ফেললেন। যা গত ৩৮ বৎসরে কেউ করেনি। দেশের সকল স্বাধীন বিভাগ গুলোতে নিজেদের তাবেদার লোক বসিয়ে একটি এমন অবস্থা তৈরি করেছে যে, দেশ চালানোর জন্য যে ন্যূনতম স্বাধীন মত প্রয়োজন, তাও বিলীন করে দিয়েছে। বিচার বিভাগ, পি এস সি, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন সহ এমন কোন বিভাগ নেই, যাদের নিজেদের কোন স্বাধীনসত্তা জনগণের কাছে এখন স্পষ্ট। এমন কি টিআইবি নামক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাতেও নিজেদের লোক বসিয়ে এক হাস্যকর অবস্থা তৈরি করেছে; কি দেশে, কি বিদেশের মানুষদের কাছে। এই সকল তাবেদার লোকদের নিজেদের কোন মত নাই। তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া মতই তাদের মত বলে গোঁজামিল দিয়ে চালান। আর নির্বাহী ব্যবস্থায় এমন করেছেন যে, কারো যদি মামার শালার নানাও অন্য দল করে তার পদোন্নতি বা পদায়ন সব বাদ। হয় ওএসডি নয় বাধ্যতামূলক অবসর। আর নতুন চাকুরিতে ঢোকার সময় পুলিশ ভেরিফিকেশন বলে যে গোপন তদন্ত হত, সেখানে ব্যক্তির আত্মীয় সজন যদি সরকারি দলের সাথে জড়িত না থাকেন; তার চাকুরি হয় না। সেনাবাহিনীও এর ব্যতিক্রম নয় ! ফলে জনগণের কাছে আজ বাকস্বাধীনতার সামান্যতম লেশমাত্র অবশিষ্ট নাই।

জনগন দেখছে স্বৈরাচারিতার নগ্ন শাসন, নির্বাচিত সরকারের দ্বারা।এই সরকারের আরও একটি মারাত্বক জন বিরোধী কাজ হল, মন্দের ভালো বলে জনগণের কাছে সানন্দে গৃহীত নির্বাচনকালীন শাসন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা। জনগন ভিতরে ভিতরে খুব কষ্টে থাকলেও, রাষ্ট্রের সকল অঙ্গে সুবিন্যস্তভাবে সাজানো তাবেদারকুল সরকারকে আসল অবস্থান তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। জনরোষ তাই ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে, সুযোগের অপেক্ষায়। হেফাজতের মত আধারাজনৈতিক জাগরণে এর লক্ষন দেখা গেছে খুব স্পষ্ট। হেফাজতের জমায়েতকে তাড়িয়ে দিয়ে যদি তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা হয়, তাহলে সেইটা হবে মারাত্বক ভুল। হেফাজতের কর্মকাণ্ডকে যদি কোন সিগন্যাল হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তবে সরকার ঠিক পথে চলবে বলেই আমার বিশ্বাস !

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এর পরিত্রাণ কি? আসলেও এর থেকে জনগণের মুক্তি কি আসবে? এর উত্তর দেয়া খুব সহজ নয়। কিন্তু সব কিছুর একটা শেষ আছে। আমাদের শুরু করতে হবে আবারো প্রথম থেকে বা একেবারে গোরার নিকট থেকে। যেমন উপজেলা গুলোকে বন্ধ করে দিয়ে ইউনিয়নকে রাষ্ট্রের পেরিফেরি ইউনিট করতে হবে। ইউনিয়ন- উপজেলা-জেলা-কেন্দ্র এর মাঝে সমন্বয় করতে হবে। নেতাদেরও গ্রেড করে দিতে হবে। ইউনিয়ন নেতারা কমপক্ষে ৫-১০ বৎসর ইউনিয়নে সেবা দিলেই কেবল উপজেলা লেভেলে নেতা হতে পারবে। প্রতিটি ধাপ উৎরাইতে এমন করে ৫-১০ বৎসর এর একটা সীমা দিয়ে দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৈরি নেতাদেরও গ্রেড পদ্ধতিতে আনতে হবে। এমন কি সরকারি বরাদ্দও এই গ্রেড পদ্ধতিতে ফেলে দেশের উন্নয়নকে সমন্বয় করার দিন এসেছে। যেমন একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারেঃ

• ৫ লাখ টাকার একটি জন উন্নয়ন মুলক কাজ হয়েছে কোন ইউনিয়ন লেভেলে। সেই কাজ করে উদ্বোধন করবেন সেই এলাকার চেয়ারম্যান। সাথে তার এলাকার অন্য প্রতিনিধি থাকবেন। উপরের অন্য কেউ সেখানে গিয়ে সেখানে বা তার পক্ষে কেউ গিয়ে মাতবরি করতে পারবে না। করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত করতে হবে।
• ৫০ লাখ টাকার কাজ উপজেলা লেভেলে হলে সেখানের উদ্বোধন করবে উপজেলা প্রতিনিধিরা। উপরের অন্য কেউ সেখানে গিয়ে সেখানে বা তার পক্ষে কেউ গিয়ে মাতবরি করতে পারবে না। করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত করতে হবে।
• ৫ কোটি টাকার কাজ জেলা লেভেলে হলে তার সকল দায়িত্ব থাকবে জেলা নেত্রীত্বের। উপরের অন্য কেউ সেখানে গিয়ে সেখানে বা তার পক্ষে কেউ গিয়ে মাতবরি করতে পারবে না। করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত করতে হবে।
• ৫০ কোটি টাকার কোন কাজ দেশের যেকোন এলাকায় হলে, তা সমন্বয় করবে একজন সংসদ। উপরের অন্য কেউ সেখানে গিয়ে সেখানে বা তার পক্ষে কেউ গিয়ে মাতবরি করতে পারবে না। করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত করতে হবে।
• জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ৫০ কোটি বা তার উপরের অংকের অর্থে চালিত কাজ উদ্বোধন করবেন সেই বিষয়ের মন্ত্রী বা অন্য যেকোন মাপের মন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সভার অনুমতি নিয়ে।
• কোন নির্বাহী কর্মকর্তা এই সকল উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করতে পারবেন না। তারা সকল কাজে তদারকি করতে পারবেন, সাহায্য করতে পারবেন।
• ফলে নেতাদের সম্মান রক্ষিত হবে। নিচের লেভেলে দলীয় পরিচয়ে কেউ ভোট করবে না। তবে ভোটে জেতার পর কেউ যদি কোন দলে যোগ দেয়, পরেরবার আর ঐ নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু যেখানে দলীয় নির্বাচন করা যায় সেখানে প্রতিযোগিতা করতে কোন বাঁধা থাকবে না।
• অরাজনৈতিক নির্বাচন কোন লেভেল পর্যন্ত হবে তা সংসদে আলোচনায় ঠিক করে নেয়া যাবে। আমার মনে হয় শুধু মাত্র ইউনিয়ন লেভেল এই অরাজনৈতিক নির্বাচন করা যায়। উপজেলা লেভেলে নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করা যেতে পারে। ইউনিয়ন লেভেলের কোন নেতা যদি রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন, সেক্ষেত্রে সে উপজেলা লেভেল ছাড়া নির্বাচন করতে পারবে না।
• ভোট যেহেতু গোপন ব্যালটে হবে, তাই প্রান্তিক জনগন সরাসরি রাজনীতি না করেও সমর্থন দিতে পারবে। প্রান্তিক উন্নয়ন কাজকে ত্বরান্বিত করতে পারলে, দেশের সুসম বণ্টন নিশ্চিত করা সহজ হবে।
• রাজনীতির বর্তমান ধারাকে লাগাম টেনে ধরতেই হবে। এক নেতার সব খাওয়া সব করার চলমান এই বিধান, দ্রুত সমূলে উৎপাটন করে ফেলতেই হবে। এই কাজে আমরা যত দেরি করব, সকল ক্ষেত্রে সুসম উন্নয়নে দেশকে ততই পিছিয়ে দিবো।
• বর্তমান ধারায় অপকর্মে আমরা দ্রুত অনেক উন্নতি করেছি। সকল দলেই এর অবস্থান উপরের দিকে। কেউ কারো চেয়ে কম নয়,বরং প্রতিযোগিতায় সবাই একধাপ উপরে।

কিন্তু এদেশের জনগন স্বাধীনতার ৪৩ বৎসর পর এসে, আর এই চলমান অবস্থানকে সমর্থন দিতে চাচ্ছে না। গ্রাম-শহর ঘুরে ফিরে আমার অভিজ্ঞতায় বলে, মানুষ পরিবর্তন চায় এবং প্রাথমিক ধাপ ইতি মধ্যেই শুরু হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। স্বাধীনতার ৫০ বৎসর সামনে। অনেকদিন আমরা হেলায় পার করে ফেলেছি। এভাবে আর চলতে দেয়া যায়না। চলা যায়ও না। তাই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমাদের কে সাহসের সাথে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিতে হবে। ১৯৯০ থেকে ২০১৩ এই ২৩ বৎসরে দেশ এগিয়েছে যে হারে, দুর্নীতি, চালাকি, বাটপাড়ি, লুচ্চামি এই সকল বিষয়ও বেড়েছে সমান তালে। রাজনীতি এই সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দিয়েছে। বাঙ্গালী জাতির দুর্ভাগ্য এখানেই। পথ যারা দেখায়, তারাই অন্ধকারের সুড়ঙ্গে নিক্ষেপ করে নির্দ্বিধায় ! তাই আগামী নির্বাচনে –

• যে দল আমাদের এই সকল সুড়ঙ্গ পথ বন্ধ করার অঙ্গীকার করবে।
• রাজনীতির কালো থাবা থেকে জনগণকে সহজ সরল পথ করে দিবার অঙ্গীকার করবে।
• একটু ভালমন্দ সুন্দর নির্মোহভাবে দিন গুজরানের আলোকবর্তিকা সামনে তুলে ধরবে।
• সৎ চরিত্রবান পরবর্তী উত্তরসূরিদের জীবন গড়তে সাহায্য করবে।

জনগন তাদেরকেই দেশ শাসনের দায়িত্ব দিবে। বাঙ্গালী জাতি হিসাবে আসলেই খুব অল্পতেই তুষ্ট। এই পরীক্ষা তারা বারবার দিয়েছে, আরও একবার না হয় দিবে। কিন্তু তাবেদার-চাটুকার পরিবেষ্টিত বর্তমান ধারাকে আর সহ্য করা যাবে না, করা উচিত হবেনা। এর দ্বারা শুধু ৩য় শক্তি উত্থানের যারা স্বপ্ন দেখেন, তাদেরকে বলছি আসলে এই পথ সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ এই সকল সামান্য শর্ত মেনে নিয়ে দেশ শাসনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। তার জন্য ১ম-২য়–৩য় শক্তি কোন বাঁধা নয়।

জনগণের শক্তির সত্যিকারের উত্থান চাই। দেশের সুসম উন্নয়ন দেখতে চাই।

সূত্র : অন্তর্জাল। মূল লিখাটি এখানে। শেয়ারিং অর্থ আমি ব্লগিং বুঝি।
রাজনীতিতে আমার ধারণা কম। প্রশ্ন এলে আমি বিব্রত হই; অজ্ঞতায় লজ্জা পাই।

asdtyuiiiiioppa

শহীদ রুমী স্কোয়াড :: আমরা আপনাদের পাশে

নিষ্প্রাণ এই সর্বংসহা রাজ্যে
অন্তর্ঘাতী আমাদের এই গান।
শহীদ রুমী স্কোয়াড এর জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবীতে আমরণ অনশনের ৬৯ ঘন্টা জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবীতে ২৬ মার্চ রাত ১০ টা ৩০ মিনিটে জাতীয় জাদুঘরের সামনে শহীদ রুমী স্কোয়াডের ডাকে শুরু হওয়া আমরণ অনশন কর্মসূচি পার করলো এর ৬৯ তম ঘন্টা। গণজাগরণ মঞ্চের ২১ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশ থেকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামাত-শিবিরের নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ২৬ মার্চ পর্যন্ত যে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছিলো। সরকার সেটি না মানায় এবং এখনো পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়ায়, শহীদ রুমী স্কোয়াডের সাত তরুণ এই অনশন কর্মসূচীর সূচনা করেন। ২৭ মার্চ সকাল থেকে এখন পর্যন্ত স্বতপ্রণোদিত হয়ে এই অনশনে যোগ দিয়েছেন আরো ১২ জন; অনড় এই দাবীতে অনশনে যোগদানকারীর সংখ্যা এখন মোট ১৯ জন। এদের মধ্যে আলিফ প্রধান এবং মানিক সূত্রধরের শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে ডাক্তাররা তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন। দুঃখের বিষয় মানিক সূত্রধরের অবস্থা আরো খারাপ হওয়ায় তাকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়; তিনি এখন সেখানে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

রাত আটটায় অনশনকারীদের সঙ্গে সপরিবারে সংহতি প্রকাশ করতে আসেন জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক এবং দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। অনশনকারীদের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটান তিনি; আজ শহীদ শাফী ইমাম রুমীর ৬২ তম জন্মদিন উপলক্ষে স্কোয়াডের আয়োজনে ৬২ টি মোমবাতি প্রজ্বলন এবং তার স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, ‘আজ দুপুরে সিলেট থেকে না খেয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি আমি। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় শহীদ রুমী আমার সহপাঠী ছিলো; তার স্মরণে আজকের তরুণরা তাদের দেশকে ভালোবেসে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এদের প্রাণের মূল্য অনেক বেশী; দেশ থেকে জামাত শিবির নামের আবর্জনা দূর করতে হবে; সেই পরিষ্কার দেশের মাটিতে দেশপ্রেমের ফুলগাছ লাগাবে এরাই। আর তাই এদেরকে যেকোন মূল্যে বাঁচাতে হবে।’
এর আগে সন্ধ্যা সাতটায় অনশনকারীদের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে আসেন গণজাগরণ মঞ্চের প্রধান সমন্বয়ক এবং প্রগতিশীল ছাত্রজোট এর নেতৃবৃন্দ। তারা প্রজন্ম ৭১ এবং মৃত্যুঞ্জয় স্কোয়াডের পক্ষ থেকে অনশনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন।

এসময় তিনি অনশনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় চলমান পরিস্থিতি নিয়ে যেকোন ধরণের বিভ্রান্তি এবং ভুল বোঝাবুঝি দূর করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, যেহেতু সবাই একই উদ্দেশ্যে কাজ করছে, তাই কোনরকম ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলে তিনি শহীদ রুমী স্কোয়াডের কাছে ‘ওপেন সরি’।

শহীদ রুমি স্কোয়াডের পক্ষ থেকে সংহতি সমাবেশের আহবানে পাওয়া গেছে বিপুল সাড়া, সাংগঠনিক পর্যায় থেকে সারা দেশ থেকে ১১৬ টি সংগঠন তাদের সংহতির কথা প্রকাশ করেছেন আমাদের সাথে। যার মধ্যে ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে আছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। এছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে দেশ বিদেশের অসংখ্য মানুষ সংহতি প্রকাশ করেছেন আমাদের সঙ্গে, যার একটি বড় অংশ যার যার অবস্থান থেকে এই কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

২৮ মার্চ বিকেল পাঁচটায় স্কোয়াডের ডাকা সর্বাত্মক সংহতি সমাবেশে অনশনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং বিক্ষুব্ধ নারী সমাজ-এর বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের সাংস্কৃতিক কর্মীরা। ঐ রাতে অনশনকারীদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতীন এবং জাতীয় পতাকার নকশা কারী শিবনারায়ণ দাস। তারা অনশনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা ব্যাক্ত করেন।

২৯ মার্চ সকালে সংহতি প্রকাশ করতে আসেন মঞ্জুরুল আহসান খান। দুপুরে সংহতি জানাতে আসেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছু জালাল, মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শহীদুল হক মামা এবং আক্কু চৌধুরী।

২৬ মার্চ রাতে এই কর্মসূচির সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে সংহতি প্রকাশ করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্কোয়াড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অধিকার মঞ্চ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন বোধন, পরবর্তীতে আরও সংহতি প্রকাশ করেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ডক্টরস ফর হেল্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, সামহোয়্যার ইন ব্লগ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পাঠচক্র, জাগরুক গণ পাঠাগার, বঙ্গবন্ধু চেতনা পরিষদ, বিপ্লবীদের কথা, সেক্টর ১৩, ফাঁসির মঞ্চ, তারুণ্য তের, রাস্তা, জেনারেশন এফ, দেশ মৃত্তিকা, সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গন, গণসংহতি আন্দোলন, রাগমা, আমরা, মাতৃভূমি সামাজিক সংগঠন, হৃদয়ে সীতাকুণ্ডু, বটতলা নাট্যদল, ব্ল্যাক স্কোয়াড, প্রজন্মে দায়ভার, শব্দনীড়, ব্লগারস ফোরাম, স্বাধীন বাংলা ব্লগার ব্রিগেড। এছাড়াও এসএমএসের মাধ্যমে সিলেট গণজাগরন মঞ্চ থেকে জানানো হয়েছে সংহতির কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে সংহতির কথা।

কর্মসূচী:
শহীদ রুমি স্কোয়াডের আমরণ অনশনের কর্মসূচী চলবেই এছাড়াও শহীদ রুমি স্কোয়াড আজ ২৯ মার্চ, ২০১৩ থেকে সারাদেশ ব্যাপী এই দাবীর স্বপক্ষে গণ অনশন শুরু করার আহবান জানিয়েছে। এই গণ অনশনে দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সকল ছাত্র ছাত্রী এবং সকল মানুষকে – যারা মনে করেন যুদ্ধপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন, প্রতিরোধ করা প্রয়োজন তাদের যোগ দেবার আহবান করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩০ মার্চ, শনিবার দেশের সকল স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের এই কর্মসূচির সাথে একাত্মতা জানিয়ে কালো ব্যাজ ধারণ করে এক ঘন্টার জন্য প্রতীকী অনশনের আহ্বান জানানো হচ্ছে। যারা এই প্রতীকী অনশনে অংশ নেবেন তাদের সবাইকে অনশনের ছবি শহীদ রুমী স্কোয়াডের এর ফেইসবুক পেইজে পোস্ট করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

গণজাগরণ মঞ্চ থেকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি – ৩১ মার্চ ২০১৩ এ- সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবীতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সংগৃহীত গণস্বাক্ষর জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকারের কাছে পেশের উদ্দেশ্যে বিক্ষোভ মিছিল-এ সকল স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে শহীদ রুমী স্কোয়াড।
স্কোয়াডের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হচ্ছে, গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং সমর্থন দলটির আছে। আর তাই, আমরণ অনশনের যে কর্মসূচি দলটির পক্ষ থেকে পালন করা হচ্ছে, সেটি যে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচিগুলোর সম্পূরক, সেটিও জানানো হচ্ছে স্পষ্টভাবে। কোনভাবেই তাই এই কর্মসূচি বা এই সংগঠনটিকে গণজাগরণ মঞ্চের থেকে আলাদা কোন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে না দেখার জন্য স্পষ্টভাবে জানানো হচ্ছে।

যুদ্ধাপরাধী সংগঠন এবং তাদের সহযোগী হিসেবে জামাত-শিবিরের রাজনীতি স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আমরা জানি, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সেটি যে কোন মুহূর্তে, যে কোন উপায়েই সম্ভব। আর তাই আমাদের এই প্রাণের দাবীর পক্ষে আমাদের অবস্থান অনড়, এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে অহিংস উপায়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কঠোর প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে আমরা বেছে নিয়েছি আমরণ অনশনকেই। আমাদের আশা এতে সবার সমর্থন আমরা পাবোই।

আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে তাই আমরা আজ বলতে চাই, বিজয়, নাহলে মৃত্যু- একমাত্র এই এই পথেই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। আর তাই অহিংস উপায়েই দাবী আদায়ের সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নিয়ে আজ আমরা রাজপথে; আশা আছে বিজয়ের, তবে মৃত্যুর ভয়ে এখন আর ভীত নই আমরা কেউ।




সর্বশেষ তথ্য জানতে : ফেসবুক পেজ – শহীদ রুমী স্কোয়াড।

২০১৩ শুভ না অশুভ? পড়লে পড়ুন না পড়লে ক্ষতি নেই

2012-12-28 আগামী সোমবার যে খ্রিষ্টীয় বছরটি শেষ হবে, সেই বছরটি মহাজোট ওরফে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলন কাবু করতে না পারলেও দেশ পরিচালনায় নানা ব্যর্থতা, অব্যবস্থা, অদক্ষতা এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেওয়ার অব্যবহিত পর পিলখানা ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরকার দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিল। বিরোধীদলীয় নেতা এখন যা-ই বলুন, সেটাই ছিল বাস্তবসম্মত। সেদিন পিলখানায় সেনা অভিযান চালালে আরও বেশি রক্তপাত হতো। পরবর্তী সময়ে জঙ্গিবিরোধী সফল অভিযান, নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন, কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা সত্ত্বেও তিন বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রাখাও সরকারের সাফল্য হিসেবে বিবেচিত।

কিন্তু মেয়াদের চতুর্থ বছরে এসে কতগুলো ভুল পদক্ষেপ সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বলা যায়, সরকার এখন সফলতা ও বিফলতার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এ মুহূর্তে সামান্য ভুল যেমন সরকারের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তেমনি হিসাব করে পা রাখলে সংকট উত্তরণও কঠিন হবে না বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

২০১২ সালের যে ঘটনাগুলো সরকারের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেগুলো হলো: সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল, মন্ত্রিসভার রদবদল নিয়ে টানাপোড়েন, কক্সবাজারে বৌদ্ধপল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, হল-মার্ক ও সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শিক্ষাঙ্গনে অশান্ত পরিবেশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং বিশ্বজিৎ দাসের খুন হওয়া।

গত ফেব্রুয়ারিতে সাগর-রুনি হত্যার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘাতকদের পাকড়াও করার ঘোষণা দিলেও গত ১০ মাসেও তা কার্যকর করতে পারেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বদল হলেও খুনিদের ধরতে পারেনি সরকার। তদুপরি বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনা ছিল বছরজুড়ে তপ্ত আলোচনার বিষয়।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিলেও সরকার যথাসময়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়; এমনকি ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক চুক্তিটি বাতিল করার পরও নীতিনির্ধারকদের চৈতন্যোদয় হয়নি। তখন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জোর আওয়াজ তুলেছিলেন যে, বিশ্বব্যাংক ঋণ না দিলে জনগণের কাছ থেকে চাঁদা তুলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন, ১৯৭১ ও ২০১২ এক নয়, শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধু নন যে ‘যার যা আছে’ ডাক দিলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। অবশেষে বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত মেনে নিয়ে এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেও বছরের শেষ নাগাদ তা কোনো সুফল দেয়নি। সর্বশেষ দুই আবুলকে সন্দেহের তালিকায় রেখে অভিযুক্ত বাকি সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। গ্রেপ্তার হয়েছেন সেতু বিভাগের সাবেক সচিব ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব কাজী মোহাম্মদ ফেরদাউস। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের ওপরই পদ্মা সেতুতে তাদের অর্থায়ন নির্ভর করছে।

মহাজোট সরকারের দুটি প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল: যুদ্ধাপরাধের বিচার ও পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন। যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া মোটামুটি ভালোভাবেই চলছে। বছরের শেষে এসে স্কাইপ কেলেঙ্কারির পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগ সাময়িক ধাক্কা দিলেও দ্রুত আদালত পুনর্গঠন করে বিচার-প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু চরায় আটকে গেছে। এর মধ্যে অত্যাশ্চর্য কিছু না ঘটলে বর্তমান সরকারের আমলে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়া কঠিন বলেই পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন।

গত বছর ও চলতি বছরের শুরুতে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে খোদ সরকারি দলের সাংসদেরা সমালোচনায় মুখর হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় ঈষৎ পরিবর্তন আনেন। প্রথমে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে ভাগ করে ওবায়দুল কাদের ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে যথাক্রমে যোগাযোগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আগে ক্ষমতাসীন দলে এ দুই নেতাই সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলওয়ের কালো বিড়াল ধরার আগেই নিজে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে দপ্তর হারান। বর্তমানে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে তিনি বিরোধী দলের রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতির জবাব দানে ব্যস্ত।

বছরের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় আরেক দফা পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিলেও দলের ও মহাজোটের দুই প্রভাবশালী নেতা তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন সরকারের শেষ বেলায় মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে মন্ত্রিসভায় পরিচ্ছন্ন ও দক্ষ ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার শেখ হাসিনার দ্বিতীয় চেষ্টাও সফল হয়নি। নতুন মন্ত্রীদের কারও কারও বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আসতে শুরু করেছে।

বছরের শেষার্ধে এসে সরকারকে যে বিষয়টি সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে, সেগুলো হলো: হল-মার্ক ও সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি। একটি অখ্যাত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি করতে পেরেছে ব্যাংক কর্মকর্তা ও পর্ষদের যোগসাজশে। সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ঘন ঘন যাতায়াত নিয়ে খোদ সংসদীয় তদন্ত কমিটিই প্রশ্ন তুলেছে। পর্ষদের একজন সদস্য তিন কোটি টাকা উৎকোচের বিনিময়ে হল-মার্কের কাগজপত্র ধামাচাপা দিয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে কী পরিমাণ দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে, তার ক্ষুদ্র একটি অংশই পত্রিকায় আসছে। পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে গতি আনতে পারবে, না জঞ্জাল বাড়াবে তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

২০১২ সাল জুড়েই উচ্চ শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত ছিল, উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর, বুয়েট, রুয়েট ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। থেমে থেমে আন্দোলন হয়েছে জগন্নাথ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার প্রথমে সমস্যা উপেক্ষা করতে চাইলেও পরবর্তী সময়ে উপাচার্য বা সহ-উপাচার্যকে বিদায় দিতে বাধ্য হয়। এর পাশাপাশি সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য ও আত্মঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি সরকারের ভাবমূর্তি হিমাঙ্কে নামিয়ে দিয়েছে।

মেয়াদের মাঝামাঝি সরকার দলীয় সাংসদদের বেপরোয়া আচরণ লক্ষ করা গেলেও এখন অনেকই আগামী নির্বাচনের কথা ভেবে খামোশ হয়ে গেছেন। কিন্তু ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’ ছাত্রলীগের মাস্তানি-সন্ত্রাসী তৎপরতা এতটুকু কমেনি। সরকার-সমর্থক এ ছাত্রসংগঠনটির সন্ত্রাস ও দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়ে যায় যে, নানা হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও তাদের লাগাম টেনে ধরা যায়নি। যার সর্বশেষ উদাহরণ ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধের দিন পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাস হত্যা। এ ঘটনা এতই নৃশংস ও নির্মম যে গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।

এ রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে গত ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও বিহারে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা দেশবাসীকে হতবাক করে দেয়। বাংলাদেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণের ঘটনা এই প্রথম। ধারণা করা হয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে স্বার্থান্বেষী মহল বাংলাদেশে বৌদ্ধদের আক্রমণের লক্ষ্য করে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, গোয়েন্দা বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলায় অংশ নেন বলে অভিযোগ আছে।

তবে এসব বিপর্যয় ও বিতর্ক সত্ত্বেও ২০১২ সালে অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার কথা স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও গবেষণা সংস্থাগুলো। ইকোনমিস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, খালিজ টাইমস-এর মতো পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যকে বিস্ময়কর হিসেবে অভিহিত করেছে; দেশের ভেতরে এবং বাইরের বিশ্লেষকেরাও মনে করেন, রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদটা একটু কম হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও গতিশীল হতো; সেক্ষেত্রে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্য আয়ের দেশ হওয়া অসম্ভব নয়। তবে এ অগ্রগতির সঙ্গে বৈষম্যটা হ্রাস না পেলে এক দেশ দুই সমাজে পরিণত হবে, যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।

নানা টানাপোড়েন বিপর্যয়-বিপন্নতায় সরকার ২০১২ সালটি পার করেছে। ২০১৩ সালে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে, পরিস্থিতি কীভাবে সরকার সামাল দেবে; সেটাই এখন দেখার বিষয়। ২০১৩ সালে সরকারের জন্য বড় তিন চ্যালেঞ্জ—সব শঙ্কা ও সংশয় কাটিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনা, আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ শেষ করা।

সরকার এ তিনটি অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে প্রস্তুত আছে কি? যদি তারা যুক্তির ভাষায় চলতে চেষ্টা করে এবং নির্বাচনের ব্যাপারে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করতে পারে, তাহলে ২০১৩ সালটি সবার জন্য শুভ হবে বলেই আমাদের ধারণা। আর যদি সরকার গোঁয়ার্তুমি করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চায়, দলীয় মাস্তানদের নিবৃত্ত না করে, তাহলে দেশ কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হবে, যা সরকার ও দেশের জন্য শুভনা-ও হতে পারে।

লিখেছেন: সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
মূল পাতায় যেতে হলে লিঙ্ক এ ক্লিক করুন।
২০১৩ শুভ না অশুভ? দৈনিক প্রথম আলো।

57883_na

প্রচ্ছদ এবং আহ্বান: নিজ ভাবনা

we-are-all-one-eelssej

we-are-all-one-eelssej

we-are-all-one-eelssej

প্রিয় সহযোদ্ধা। নতুন পুরাতন সবাইকে শুভকামনা এবং প্রীতি। শব্দনীড় ব্লগে এখন অনেক নতুনদের নিত্য আনাগোনা। তাঁদের অনেককে বিভিন্ন ব্লগে (যদিও নিতান্তই আলস্যের কারণে ভিন্ন কোন ব্লগে যাবার সুযোগ আমার হয়না) সুপরিচিত। অথবা অনেকেই তাদের ব্লগিং জীবনের যাত্রা শুরু করেছেন এই শব্দনীড়েই। আমরা যারা সামান্য পুরাতন, নিত্যদিন আমরা তাঁদের যে কোন প্রয়াশকে অকৃপণ অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছি। পরিচ্ছন্নতা পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের যে আত্ম প্রত্যয়ের শপথ নিয়ে শব্দনীড় এর অভিযাত্রা … আজ বছরের উপর হতে চললো, শব্দনীড় তা ধরে রাখতে পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস। দায়িত্ব নিয়েই বলছি, পোস্ট মডারেশন বা মন্তব্য মডারেশনের মতো খড়গ সম্মানিত ব্লগারদের উপর চাপিয়ে দেবার মতো নীতি বা নৈতিকতায় শব্দনীড় বিশ্বাস করে না। বিষয়টি বিরক্তিকরও বটে। তবু সাময়িক কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে এ ব্যবস্থাটুকু নিতান্তই বাধ্য হয়ে চালু করেছে শব্দনীড়। এটা আমরা বুঝি। আনন্দের সংবাদ হচ্ছে ইতিমধ্যে অনেকেই যারা সুস্থ্য ধারার ব্লগিং এ স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা তাঁদের পোস্ট নন মডারেশন আওতার বাইরে থেকে সরাসরি প্রথম পাতায় পোস্ট প্রকাশ করার অধিকার সংরক্ষণ করছেন। যারা নতুন আসছেন তাঁদেরকে প্রোফাইলে ছবি আপলোডের বিষয়টি স্বয়ং নীড় সঞ্চালক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের পোস্টে। একজন ব্লগারের সাথে সঞ্চালনা পরিষদের সম্পর্ক থাকবে আন্তরিক। ব্লগারকে বুঝতে হবে সঞ্চালক অর্থ শিক্ষক-ছাত্র কিংবা হেড মাষ্টার গোত্রীয় নয়। শ্রেফ ব্লগ বিষয়ক সাহায্যকারী অভিভাবক মাত্র। যিনি অহর্নিশি ব্লগে চোখ রাখেন বিনিদ্র ভাবে, তাকে আমরা শাষণ কর্তা না ভেবে বরং শুভাকাঙ্খী ভাবতে পারি।

একটি সহায়িকাঃ প্রোফাইলে আপনার ছবি আপলোড।

প্রত্যুষে যখন নিজের পিসি নেট এর সংস্পর্শে আসে এবং শব্দনীড় এর দরোজা খুলে যায়, আমার মতো অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন সাথে আছেন অনলাইনে … জন নিবন্ধিত, … জন অতিথি। কল্পনা করে নিতে সময়ের অপব্যয় হবে না যে, এই অতিথিদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন নিবন্ধিত। সরাসরি লগিন না করে ব্লগ এবং ব্লগের লিখা দেখছেন। অনিবন্ধিতদের প্রতি আমরা আন্তরিক ভাবে আহ্বান জানাতে পারি, আসুন মিলি… বন্ধুত্বের নিবিড় ছায়াতলে। যারা এই শব্দনীড়ে লিখছেন, যাদের সৃষ্টি আপনারা দেখছেন, আপনি আমি আমরা আমাদের স্বীয় চিন্তা চেতনা বোধ এবং মননে গড়ে তুলি একটি নন্দিত প্লাটফর্ম। যেখানে অদৃশ্য সূতোর বন্ধনে দৃঢ় হবে সকলের আত্মিক বন্ধন। চেতনার উন্মেষে আমাদের পরিচয় হোক আমরা শব্দনীড় পরিবার

যে উদ্দেশে আজকের এই বিরক্তিকর পোস্টের অবতারণা সেটাই এখনো বলা হয়ে উঠেনি। শুরু’র কথা এখন না হয় শুরু করি। একজন আম ব্লগার হিসাবে আপনাদের সম্মুখে একটি বিশেষ বিষয়ের উল্লেখপাত করার ইচ্ছে এতোদিন মনে পুষে রাখলেও না বুঝে উঠার কারণে আলোকপাত করতে পারিনি। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে আমি সঠিকটাই বুঝেছি। আসুন আমার অবাধ্য মগজ কি বুঝেছে সেটা আপনাদের সাথে শেয়ার করি।

icon01

আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি প্রথম পাতায় সঞ্চালক নির্বাচিত (যদি থাকে) তার উপর চলমান একটি পোস্ট বক্স রয়েছে হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডে। এটিকে ইংরেজী তে বলা হয় ফীচার ইন ফীচারড কন্টেন্ট স্লাইডার। আপনি যেখানে নতুন পোস্ট লিখছেন ঠিক তার নীচে Featured Content Slifer Options নামে একটি ঐচ্ছিক ঘর রয়েছে। আমরা যদি স্লাইড ফীচার (চলমান পোস্ট) আকারে আমাদের পোস্ট দেখতে চাই তাহলে ইচ্ছে করলে আমরা এখানে একটি টিক চিহ্ন এঁকে অপশনটি চালু করে দিতে পারি।

এই গেলো সুবিধার কথা। কিন্তু মূল বিষয়টি হলো আজকের এই পোস্টে আমি আমার একটি পোস্টের স্থির চিত্র ব্যবহার করেছি। কেন করেছি তার উত্তর হলো লক্ষ্য করে দেখুন লাল রঙে তীর চিহ্নে আমি দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি একটি সামান্য প্রচ্ছদ থাকায় চলমান বারে পোস্টটি একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। অথচ আরো বেশ কয়েকটি পোস্ট পেরিয়ে যাবে পার্থক্যটা তখন বোঝা যায় পার্থক্যের মধ্যে পার্থক্য কোথায় !!

ইদানীং আমার চোখ বেশ অল্প সংখ্যক ব্লগারকে তাঁদের নিজস্ব লিখায় প্রচ্ছদ ব্যবহার করতে দেখছে। হয় তাঁরা প্রচ্ছদ আপলোডের বিড়ম্বনা সইতে চান না, অথবা সময় স্বল্পতা তাঁদের প্রচ্ছদ বিমূখী করেছে। আমার মত ই যে চূড়ান্ত হবে তা নয়, সামান্য হোক আর অসামান্যই হোক একটি প্রচ্ছদ একটি লিখার পরিভাষা হয়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে পারে সমার্থক। দর্শক পাঠক সার্থক পোস্টটিকে দেখেন বিশেষ নজরে। আমরা সবাই যদি আমাদের লিখায় একটি প্রচ্ছদ অন্তত ব্যবহার করি অবশ্যই যা হতে হবে পোস্টের মাপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর বর্তমান সুবিধা চালু থাকা পর্যন্ত যদি স্লাইডে পোস্টটিকে নির্বাচিত করি তাহলে স্লাইড বক্সের আজকের এই অসৌন্দর্য্য (ক্ষমা চাই) বহুলাংশে হ্রাস পাবে। তো আসুন আমরা আমাদের প্রতিটি লিখায় অন্তত একটি প্রচ্ছদ ব্যবহারের অনুশীলন শুরু করি। বদলে দেই স্লাইড বারের আদল

নিচের এই কথাগুলোন আমারই একটি পোস্টের। একটা পোষ্ট = একটা দায়িত্ব। নতুন ব্লগার এবং আমার মতো পুরোনো এবং আমারই মতো অলস ব্লগারদের জন্য ফির উৎসর্গ করি।

আমরা যারা নিয়মিত কিংবা অনিয়মিত লিখি
প্রবীন হই কিংবা আধা প্রবীণ হই –
আমরা আমাদের নিয়ে থাকি সর্বদা ব্যস্ত।
নবীন ব্লগারদের লিখা চোখে পরলেও সযত্নে এড়িয়ে যাই।
আমরা কি ঠিক কাজটি করছি?

আমরা অবশ্যই যেমন সুস্থ্য আলোচনা চাইবো বা আশা করবো, তেমনি ভুল বা দৃষ্টিনিন্দিত হলেও তা প্রকাশ করবো। এবং সেটাই উচিত করণীয়। নইলে লিখক তাঁর লিখার মানের অবস্থান নিয়ে শন্কায় থাকতে বাধ্য।

মন্তব্য।
লিখক মাত্রই সেটার আশা কিংবা অপেক্ষা করেন।

ইদানীং ব্লগে নাম মাত্র কয়েকজন ছাড়া প্রত্যেকেই আমরা ঝাড়া গদবাঁধা ছোট্ট স্তুতি মন্তব্য সাজিয়ে পালাই। যেন নিরবে সরব উপস্থিতি জানিয়ে যাই, আমি এসেছিলাম। অথবা নিরব আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলাম আমার একটা লিখা আছে – দয়া করে পড়বেন। যেন বিকিকিনির ঘরে ক্রেতাকে জানাই নিমন্ত্রন। (বিনয়ের সংগে বলছি, আমার মতের সাথে অন্যের দ্বিমত থাকলে থাকতেও পারে) ফিরেও আর সেই ফেলে আসা ব্লগটিতে খুব কম জনেই ফেরেন।

এমনকি নতুন ব্লগার বন্ধুদের ঘরে ঢুকতেও আমাদের দ্বিধা কাজ করে প্রচুর। অথচ আমাদের অন্তঃপ্রাণ চেষ্টাই বলুন আর উত্তরসুরীই বলুন,
তা কিন্তু তাঁরাই।

যে কোন লিখা ছাপার অক্ষরে এলে- লিখকেরও একটা দায় বর্তে যায়, “জবাব দিন” শব্দটার কাছে। লিখককে তড়িৎ না হলেও ভেবে সুস্থির হয়ে একটা উত্তর সাজাতে হয়। হোক তা সৌজন্য কিংবা ব্যাখ্যা।

আমি মনে করি ‘একটা পোষ্ট = একটা বিশাল দায়িত্ব’।
আমরা যেন অন্যকে ফাঁকি দিয়ে আগামীতে নিজের বা নিজেদের শূন্যের মধ্যে ফেলে না দিই –
শ্রদ্ধা দিয়ে সবাইকে উৎসাহ দেয়ার নামই হলো
শুভ ব্লগিং।

mad-men-silouhette-e1274462078328