বিভাগের আর্কাইভঃ সমকালীন

পরিশুদ্ধ রাজনীতির আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে

অবশেষে বাংলাদেশে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক সচিব খান মুহাম্মদ নূরুল হুদা। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। বলা হচ্ছে, কবিতা খানমের নাম আওয়ামী লীগ প্রস্তাব করেছিল। মাহবুব তালুকদারের নাম এসেছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যিনি নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কে এম নূরুল হককে ওএসডি করে রেখেছিল জামায়াত-বিএনপি জোটের সরকার। পরে তিনি ২০০৬ সালে অবসরে যেতে বাধ্য হন। কী অপরাধ ছিল তার? কেন একজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাডার সদস্যকে ওএসডি করেছিল রাজাকারলালিত একটি জোট সরকার? এ সব বিষয় আলোচনায় আসতেই পারে। রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশে সিইসি পদে নুরুল হুদার নামের সঙ্গে ছিল সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের নামও। সার্চ কমিটির সুপারিশে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আরো যে চারটি নাম ছিল, তারা হলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য আবদুল মান্নান, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক জারিনা রহমান খান ও অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নেতৃত্বাধীন এ কমিটিতে সদস্য করা হয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, পিএসসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) মাসুদ আহমেদ, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য শিরীণ আখতারকে। তারাই দশ সদস্যের শর্টলিস্ট তুলে দেন রাষ্ট্রপতির হাতে। একটি বিষয় স্পষ্ট, এ নির্বাচন কমিশনই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। ফলে, এ কমিশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশের কাছে, জাতির কাছে। এ কমিশন সম্পর্কে বিএনপি ইতোমধ্যে নেতিবাচক কথাবার্তা বলা শুরু করেছে। তারা প্রথমেই বলছে, তাদের করা ওএসডি সচিবকে কেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা হলো!

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না- বিএনপি এখন যে কাদার গর্তে পতিত হয়েছে তাতে তারা ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত আর কোনো সত্যই মানবে না। কাউকেই বিশ্বাস করবে না। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে হতাশা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিএনপি। নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করে দলটি। এমনকি নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে জনতার মঞ্চের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও দাবি করছে বিএনপি। তাদের প্রস্তাবিত তালিকা থেকে একজনকেও নতুন ইসিতে রাখা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে দলটি। অথচ মাহবুব তালুকদার তাদের ঘরানার মানুষ বলেই চাউর রয়েছে।

বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান মিডিয়াকে বলেছেন, আমরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত লোকদেরই ইসিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কমিশন আমরা গ্রহণ করবো না। একইসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনতার মঞ্চের বিতর্কিত আমলা ছিলেন। কাজেই তার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করা যায় না। বিএনপি তাদের নিজের তৈরি ভাঙা সাঁকোর উপর দিয়েই হাঁটছে। তারা এমন করে হেঁটে কতদূর যাবে তা-ই এখন দেখার বিষয়। অন্যদিকে দেশে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই একটি গোষ্ঠী সরকারি শক্তির ছত্রছায়ায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এরা এতই বেপরোয়া যে, তারা যত্রতত্র অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিতে আহত হন দৈনিক সমকালের সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল। পর দিন দুপুরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকা নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল মেয়র হালিমুল হক মিরুর গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন শাহজাদপুর সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসানাত। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে পুলিশ পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরুর বাড়ির সামনে পাহারায় ছিল। তার বাড়ির সামনে দুপুরে বিক্ষুব্ধরা মিছিল নিয়ে আসলে পুলিশের উপস্থিতিতে এবং পুলিশকে ডিঙ্গিয়ে তিনি নিজের শর্টগান দিয়ে বেশ ক’রাউন্ড গুলি ছোড়েন। যার একটি গুলিতে সাংবাদিক শিমুল গুলিবিদ্ধ হন।’ শিমুলের জানাজার পূর্বে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় এমন বক্তব্য দেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। আবদুল হাকিম শিমুল হত্যা মামলায় গ্রেফতার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হালিমুল হক মিরুকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি তাকে রিমান্ড আবেদনের বিষয়ে শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও)।

আসলে কী হচ্ছে বাংলাদেশে? ক্ষমতাসীনদের কিছু পোষ্য কেন এতো সহিংস হয়ে উঠছে? কেন তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে? শিমুল হত্যাকাণ্ডে যেই জড়িত থাকুক তাকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডে যত বড় শক্তিশালী কিংবা প্রভাবশালী জড়িত থাকুক না কেন; অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সরকার সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে রাজনীতির নামে এখন আজব আজব কর্ম করছেন কিছু রাজনীতিক।

শিক্ষার্থীদের হাতে হাত রেখে বানানো হয়েছে ‘পদ্মা সেতু’। শোয়া আরেক ছাত্রের পিঠে চড়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন পাটোয়ারী। ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ছবিতে দেখা যায়, দুই দল শিক্ষার্থী হাতে হাত রেখে ‘সেতু’ তৈরি করেছে এবং আরেক ছাত্র তার ওপর উপুড় হয়ে শুয়েছে। ওই অবস্থায় তার পিঠের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান নূর হোসেন। মানবসেতুতে হেঁটে সমালোচনার মুখে পড়া আওয়ামী লীগ নেতাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অন্যায় করে কেউ পার পাবে না, সে আওয়ামী লীগের যত বড় নেতাই হোক। নূর হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেছেন- ‘চাঁদপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান নূর হোসেন ছাত্রদের দিয়ে যে কাজটি করেছেন সেটি ঘৃণ্য। এ ধরনের ঘৃণ্য, জঘন্য কাজ যারা করে, তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।’

বাংলাদেশে এ সময়ে জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যানের সংখ্যা কত? তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে আওয়ামী লীগ কী করছে কিংবা কী করতে পারছে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দরকার। দরকার মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও শক্তির পথরেখা জরিপের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন এবং সামাজিক জীবন দুটোই আজ এতটা বিপন্ন যে, একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটি নিয়ে ভাবলে লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছানো যাবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর, ক্ষমতাসীন সরকার পক্ষের জবাবদিহিতা করার মতো প্লাটফর্ম অতীতে থাকতো তবে হয়তো দেশ এতোটা লুটেরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি পতিত হতো না। একাত্তরের পরাজিত রাজাকারশক্তি, দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নানাভাবে আনুক‚ল্য পেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। এ কথা আজ অনেকেই ভুলে যেতে বসেছেন। সংবিধান বলছে, ভূমি-মানুষ-সার্বভৌমত্ব-সমাজ রক্ষা এবং এর উন্নতি সাধন করাই একটি সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এর প্রয়োজনে তাদের যতটা দরকার জবাবদিহি করতে কারোরই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। শেষ পর্যন্ত দেশে যে সব দল টিকে থাকবে এবং যারা ক্ষমতায় যাবে, তাদের সবারই এ চিন্তাটি মাথা রাখতে হবে। এ সুযোগ উন্মুক্ত হলে পাল্টে যেতে বাধ্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. হুমায়ুন আজাদের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে, ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’। হ্যাঁ, নিজ সত্তা নিয়ে অন্যদের সময়ে বেঁচে থাকা বড় দুঃখজনক এবং কঠিন কাজ। ১৯৭১ থেকে ২০১৭। একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এর কম সময়ে বিশ্বের অনেক দেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি- সেটা বলছি না। কিন্তু এ দেশটি আরো শান্তিময় হয়ে উঠতে পারতো। আরো নিরাপদ থাকতে পারতো এ দেশের মানুষ।

একটি রাষ্ট্রে সৃজনশীল বিবর্তন সবসময়ই কাম্য হয়। কারণ নান্দনিক পরিবর্তন, ভাঙচুরের মাধ্যমেই এগিয়ে যায় মানবসমাজ। গেলো এক যুগে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ফিল্ডে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে বলা যায়। এর পাশাপাশি অবশ্য নানা শঙ্কা-সংকটও বেড়ে উঠেছে নানাভাবে। মনে পড়ছে প্রখ্যাত কথাশিল্পী শ্রদ্ধেয় শওকত ওসমান একটি সেমিনারে বলেছিলেন, সংস্কৃতির আবিষ্কার এবং আগ্রাসন দুটিই আছে। প্রজন্মকে ঠিক করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোনটা গ্রহণ করবে।

আজকের প্রজন্মকে পরিশুদ্ধ রাজনীতির আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। দাঁড় করাতে হবে রাজনীতিকদেরও। মানুষ এ কাজটি করতে পারে সহজেই। নিজ স্বার্থের জন্য কোনো নেতা কিছু একটা বললেই তা মানতে হবে কেন? মানুষ যতক্ষণ বিবেকবান না হয়- ততক্ষণ একটি জাতি সামনে এগোতে পারে না।

____________________________________
দৈনিক খোলাকাগজ। ঢাকা। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সোমবার।

আমি বসন্ত খুঁজে পাইনি

দিনপঞ্জীর শুকনো পাতা দেখে হিসেব মিলালাম আজ বসন্তের আগমন ঘটেছে। ঋতুরাজের সাক্ষাৎ লাভের আশায় বেরিয়েছিলাম রাস্তায়। গ্রামে ফেলে আসা বসন্তের অতীত স্মৃতি মনে মনে ভাবছিলাম- প্রকৃতি দক্ষিণা দুয়ার খুলে দিয়েছে। দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। বসন্তের আগমনে কোকিল গাইছে গান। ভ্রমরও করছে খেলা। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির আজ এতো বর্ণিল সাজ।
মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম রবিঠাকুরের সেই কবিতার লাইনগুলো-
.
ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল,
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল।
চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়,
বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়
.
এতো কেবলই স্মৃতিগাথা। বাস্তবতা যা দেখলাম তা তো সম্পূর্ণ উল্টো। কোথাও পেলাম না বসন্তের ছোঁয়া। ফুলের সুবাস নেই, আছে নর্দমার গন্ধ। কোকিলের কুহু কলতান শুনতে পাইনি, কেবলই কর্কশ কাকা ধ্বনি আসছিলো কানে। পলাশ-শিমুলের গাছ কোথায়, কেবলই নতুন-পুরনো বিল্ডিং, সামান্য অক্সিজেন প্রদান করবার মতো সাধারণ বৃক্ষও খুঁজে পাওয়া যায় না। খাচায় বন্দী পাখির মতো কিছু ফুলগাছ দেখেছি বড় বড় বিল্ডিঙের বারান্দায়, ছাদে। খাচায় বন্দী পাখিকে কিছু দিয়ে কি আনন্দিত করা যায়? প্রকৃতি ক্রন্দন করছে মানুষের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য। প্রকৃতিতে বসন্তের ছোঁয়া কোথায়?
.
দেখলাম বস্তির ছেলেগুলোকে ডাস্টবিনের নোংরা খাবার খেতে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে গার্মেন্টস কর্মীদের ছোটাছুটি, দরিদ্র মানুষগুলোর করুণ দৃষ্টি, রিক্সাওয়ালাদের ঘামা শরীর আর খিটখিটে মেজাজ, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক, খাদ্যের সন্ধানে ছুটেছে ক্ষুধার্ত কুকুরগুলো, সাথে মানুষও। বসন্ত শব্দটি তাদের কাছে হয়ত অপরিচিত। ফুল আর কোকিলের ডাক তাদের হৃদয় কাড়বে না, তাদের চায় একটুখানি ভাত, এক টুকরো রুটি। গাছে গাছে যদি রুটি ধরত আর কোকিল যদি ভাত ছিটিয়ে বেড়াত তবে হয়ত তারা বসন্তের নামটা জানত ভালোমতোই।
.
মার্সিটিজ গাড়িতে ছুটে চলা মানুষকেও দেখলাম, সাথে কুকুরও। মসজিদ পানে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাওয়া নির্বিকার মুসল্লিদের দেখলাম, বসন্তকে বরণ করতে বাসন্তীরং শাড়ি পরা রমণীদেরও দেখলাম, কপোত-কপোতীদের নির্লজ্জতা দেখলাম— ফুল ফুটুক বা নাই ফুটুক বসন্ত হয়ত এদের জীবনে সবসময় লেগে থাকে কিন্তু সবার জীবনে বসন্ত কবে আসবে জানি না। আমি বসন্ত খুঁজে পাইনি, আমি যে ক্ষুধার্ত, হাড্ডিসার মানুষগুলো দলে। মার্সিটিজ গাড়িতে বসে থাকা সাহেববাবু, মসজিদে ছুটে চলা মুসল্লি, বাসন্তী রং এর পোশাক পরাদের দলে এখনো ভিড়তে পারিনি।

ধর্ম হলো জীবনের নাম

16640992_717544468394925_8334678341358560547_nআদম (আ.) যখন পৃথিবীতে আসলেন তখন মহান আল্লাহ তাঁকে পৃথিবীতে জীবনযাপনের জ্ঞান দান করেছিলেন। কীভাবে তিনি খাদ্য সংগ্রহ করে ক্ষুধা নিবারণ করবেন, কীভাবে বংশবৃদ্ধি করবেন, কীভাবে নবজাতকদেরকে বড় করে তুলবেন, শিক্ষা দিবেন, কীভাবে হিংস্র প্রাণীদের থেকে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখবেন ইত্যাদি বিষয়। এই পৃথিবীতে চলতে যা যা প্রয়োজন সবই তাঁকে শিক্ষা দেওয়া হলো। বাস্তব জীবনে যে যে সমস্যার সম্মুখিন তিনি হতে পারেন তার সবকিছুর সমাধান আল্লাহ তাঁকে শিক্ষা দিয়ে দিলেন। তাঁর জন্য এই শিক্ষাই ছিলো ধর্ম (দীন বা জীবনব্যবস্থা)। অর্থাৎ যথার্থ ধর্ম হলো বাস্তব জীবনের যাবতীয় সমস্যার বাস্তব সমাধান।
.
যুগের পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, সমাজ হয়েছে, রাষ্ট্র হয়েছে তখন ধর্মের বিধানগুলোতেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল ঐ একই। মানুষের সার্বিক জীবনযাপনের বাস্তব সমাধান। জীবনকে সুন্দর করবার মূল মন্ত্রই হলো ধর্ম। ধর্ম সমাজকে শান্তিময় করবে, নতুন নতুন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেবে।
.
কিন্তু বর্তমানে ধর্মকে নির্জীব, মৃত, কাল্পনিক করে ফেলা হয়েছে। কেবল উপাসনা, প্রার্থনা, সোয়াব-গোনাহর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ধর্ম এখন বাস্তব সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারছে না। এর কারণ হলো- ধর্মকে যখন থেকে স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে তখন থেকে ধর্ম তার আসল রূপ হারাতে হারাতে আজ সম্পূর্ণ কাল্পনিক রূপ নিয়ে শুধু মৃত্যু পরবর্তী জীবনের একটি ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। (অবস্থা এমন হয়েছে যে, একে জীবনব্যবস্থা না বলে মরণব্যবস্থা বলাই যথার্থ হয়)। এখন ধার্মিক মানুষগুলো বলছে- সমাজের যা হই হোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি উপাসনা-প্রার্থনা চালিয়ে যাব আর মৃত্যুর পর জান্নাতে যাব। এ দুনিয়া নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই।
.
কিন্তু আমার আহ্বান সত্যানুসন্ধী চিন্তাশীল বিবেকবান মানুষের প্রতি। আসুন আমরা ধর্মের প্রকৃত রূপটি ফিরিয়ে আনি। ধর্ম দ্বারা সমাজকে শান্তিময় করি, সমাজ শান্তিপূর্ণ করতে যা করা হবে, মানুষের শান্তির জন্য, কল্যাণের জন্য যা করা হবে তাই সওয়াবের কাজ, তাই ধর্ম।

নির্বিরোধী পরহেজগার ও আপসকামী ক্রিমিনাল

16473063_1233011506733966_3740051370736959372_n

যারা সমাজের অন্যায়, অবিচার দেখেও তা বন্ধ করার জন্য সংগ্রাম না করে নীরবতা পালন করে, সে আস্তিক বা নাস্তিক, আলেম বা মূর্খ, মুত্তাকী বা বেপরোয়া, নামাযী বা বে-নামাযী যা-ই হোক না কেন, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে অপরাধী, ক্রিমিনাল, মুজরিম।
আল্লাহ মো’মেনদের রিপুজনিত দোষ- ত্রুটি গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন অসংখ্যবার। এই মো’মেন হচ্ছে তারা, যারা সমাজে যারা অন্যায় হতে দেন নি, অন্যায় প্রতিরোধ করছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন।
.
বর্তমানে আমাদের সমাজের পরহেজগার ব্যক্তিরা নামাজ, রোযা ইত্যাদির দ্বারা পুণ্য সংগ্রহ করে তা নিয়ে হাশরের দিন পার পেতে চায়, কারণ এগুলোকেই তারা আমল মনে করেন। কিন্তু সমাজে বিরাজিত অন্যায়কে প্রতিহত করার কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে নেই।
.
তাই সুদখোর মহাজন বা কোনো রাজনীতিক দলের সন্ত্রাসী হয় মসজিদ কমিটির পরিচালক। অনাহারী, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের আর্ত চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও কথিত ধার্মিকেরা মাথা নিচু করে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে ছোটেন, রোযা রাখেন, হজ্ব করেন।
.
আল্লাহ বলছেন, “আমি কি তোমাদের এমন লোকদের কথা বলব, যারা আমলের দিক থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত? (এরা হচ্ছে) সেসব লোক যাদের সকল প্রচেষ্টা এ দুনিয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে মনে ভাবছে, তারা (বুঝি) ভালো কাজই করে যাচ্ছে (সুরা কাহাফ: ১০৩-১০৪)।”
.
আদ-সামুদ ইত্যাদি জাতিগুলোকে আল্লাহ যখন ধ্বংস করলেন তখন তাদের মধ্যে কি পরহেজগার লোক ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। কিন্তু তাদের পরহেজগারির তোয়াক্কা আল্লাহ করেন নি।
.
তিনি বলেন, “তোমাদের পূর্ববতী জাতিগুলোর মধ্যে এমন সৎকর্মশীল কেন রইল না, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে বাধা দিত; তবে মুষ্টিমেয় লোক ছিল যাদেরকে আমি তাদের মধ্য হতে রক্ষা করেছি। আর পাপিষ্ঠরা তো ভোগ বিলাসে মত্ত ছিল যার সামগ্রী তাদেরকে যথেষ্ট দেয়া হয়েছিল। আসলে তারা ছিল মহা অপরাধী।” (সুরা হুদ ১১৬)
.
এখনো এ জাতির মধ্যে অধিকাংশ মানুষই ভোগ বিলাসে মত্ত হতেই উদগ্রীব। আর যারা আলেম, জ্ঞানী তারা বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে মৌন। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে চান না। এগুলোকে তারা দুনিয়াবী কাজ বলে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এভাবে তারা প্রলয় এড়াতে পারবেন না। তারা প্রাকৃতিক বিধান যদি নাও বোঝেন রসুলাল্লাহর সাবধানবাণী অবশ্যই বুঝবেন।
.
তিনি বলে গেছেন, কোন সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কিছু লোক যদি অন্যায় কাজ সংঘটিত করে এবং সেটা পরিবর্তন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্যরা যদি সেটা না করে তাহলে আল্লাহ্ তাদের সবার উপরে আযাব নাযিল করেন [হাইসাম (রা.) থেকে আহমদ]।

স্যার উইলিয়াম ম্যুর

পুঁজিবাদী ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল মস্কো গিয়েছিলেন, কমিউনিস্ট রাশিয়ার রাষ্ট্রনেতা জোসেফ স্ট্যালিনের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে বুদ্ধি পরামর্শ করার জন্য। ক্রেমলিনের বিরাট প্রাসাদে বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে করতে গভীর রাত্রে চার্চিলের ক্ষিদে পেয়ে গেলো, যদিও রাত্রের প্রথম দিকে তারা যে ভোজ খেয়েছিলেন তা রাশিয়ার সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষক জীবনেও দেখেনি। যাই হোক, ক্ষিদে চাপতে না পেরে চার্চিল বলেই ফেললেন যে কিছু না খেলে আর চলছে না। খাওয়া-দাওয়ার পাট আগেই চুকে গিয়েছিলো বলে স্ট্যালিন আর কাউকে ডাকাডাকি না করে উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ভেড়ার একটি আস্ত রানের রোস্ট বের করে এনে টেবিলে রাখলেন।

চার্চিল তো চার্চিলই, এক হাত নেবার লোভ সামলাতে পারলেন না। রোস্ট চিবুতে চিবুতে বললেন “ইস! কবে আমি এমন কোরতে পারবো যে ইংল্যান্ডের প্রতিটি ঘরে ফ্রিজের মধ্যে এমনি ভেড়ার রানের রোস্ট থাকবে”। স্ট্যালিনের গালে এটা ছিল একটা মারাত্মক চড়। অর্থনৈতিক সাম্যবাদের দেশে রাশিয়ার ঘরে ঘরে ফ্রিজের মধ্যে রানের রোস্ট নেই, স্ট্যালিনের প্রাসাদের ফ্রিজে আছে। কিন্তু বলার কিছু ছিল না। স্ট্যালিনকে চুপ কোরে চড়টা হজম করতে হয়েছিল। স্ট্যালিন যখন চার্চিলকে রানের রোস্ট খাওয়াচ্ছিলেন ও খাচ্ছিলেন, তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। হিটলারের বাহিনী মস্কোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। লক্ষ লক্ষ রাশিয়ান অর্ধাহারে অনাহারে থেকে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার সৈনিক প্রচণ্ড শীতে জমে মারা পড়ছে।

অনেকটা অনুরূপ অবস্থায় এই শেষ জীবন-ব্যবস্থার নেতারা কি করেছেন তার একটা তুলনা দেয়া দরকার। এই ইসলাম যখন ইসলাম ছিল- অর্থাৎ বিশ্বনবীর কাছ থেকে যারা সরাসরি শিক্ষা-গ্রহণ করেছিলেন, তাদের অন্যতম, দ্বিতীয় খলিফা ওমরের (রাঃ) সময় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যতদিন দুর্ভিক্ষ ছিলো ততদিন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ যেমন অর্দ্ধাহারে অনাহারে থাকে তিনিও তেমনি থাকতেন। ওমর (রাঃ) প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন না জনসাধারণ এমন অবস্থায় পৌঁছবে যে তারা ভালো কোরে খাবার পরও উদ্বৃত্ত থাকবে ততদিন তিনি গোশত-মাখন এমনকি দুধ পর্যন্ত খাবেন না এবং খানও নি, যা ছিল তখনকার আরবের প্রধান খাদ্য।

তিনি বলতেন “আমি যদি ঠিকমত খাই তবে আমি কী করে বুঝবো আমার জাতি কী কষ্ট সহ্য করছে?” এই অর্ধাহারে অনাহারে থেকে খলিফা ওমরের (রাঃ) মুখ রক্তশূন্য ও চুপসে গিয়েছিল। এই ঘটনা ও ওমরের (রাঃ) ঐ কথা গুলো ঐতিহাসিক সত্য (ইসলামের কঠোর বিরুদ্ধবাদী, মহানবীকে প্রতারক, ভণ্ড বলে প্রমাণ করা চেষ্টায় প্রথম সারির লেখক স্যার উইলিয়াম ম্যুর এর দ্যা আর্লি খেলাফাত বইয়ের এর ২৩২-২৩৩ পৃঃ দেখুন)।

16427802_1385392278187098_7691136718687080291_n

নোটস ফ্রম জ্বরের বিছানা

চুপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে একটা প্রশ্ন মাথায় এল। আচ্ছা, আমরা “রিভিলিং ক্লোদস” কথাটা বলি কেন?

এক
পোশাক শরীরকে আচ্ছাদন দেয় — যে-পরিমানে প্রতিটা মানুষ নিজেকে নিজের মতো করে নগ্নতা আর প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে আড়াল করে। [সেই সঙ্গে নিশ্চয়ই ঢেকে রাখার ধরণটা যতখানি সম্ভব সুন্দর করে তুলতে চায়। তাই বোরখাতেও নানা রঙ আর সুতোর কারুকাজ]। অবাক লাগল ভেবে যে “প্রকাশকারী” আর “জামাকাপড়” এই দুটো শব্দের যাত্রা তো একে অন্যের উলটো দিকে, কাজেই ক্লোদস-এর আগে রিভিলিং বসালে সেটা অক্‌জিমোরোন-এর উদাহরণ হয়ে উঠবে শুধু!

শব্দার্থ আরেকটু খুঁটিয়ে জানার জন্যে ডিকশনারির সাহায্য নেওয়া যাক। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান খোলাখুলি লিখেছে, রিভিলিং জামাকাপড় তাই, যা পরিধানকারীর দেহের অনেকখানি দেখিয়ে দেওয়াকে অনুমোদন দিচ্ছে। কেমব্রিজ ইংরেজি অভিধান বলল, যা প্রথার (usual) চেয়ে বেশি শরীর দেখায়, তাই রিভিলিং। এমন কিছু উন্মোচন করে যেটা আগে জানা বা দেখা ছিল না।

কাজেই, দ্বিতীয়বার আরও বড় করে অবাক হওয়ার সুযোগ সামনে এসেছে! কিছু ড্রেস তাহলে শরীর ঢাকে না মোটেই, বরং উন্মুক্ত করে? রিভিলিং অঙ্গবাস জানলার মতো, নিজেই দেখায়! তার কাজই হচ্ছে…না নিজেকে দেখানো নয়। গোটা অঙ্গকে? উঁহু, তাও নয়। শরীরের শুধু আ-ঢাকা অংশ, অথবা, যা আবৃত হয়েও অনাবরণকে ফুটিয়ে তুলছে — তাকে দেখাবে [এখানে লেখা উচিত ‘না-ঢাকা’ — মানে যা ইচ্ছে করেই অপ্রকাশ রাখা হয়নি]।

খুব অদ্ভুত লাগে শুনতে, না? সাধারণ ভাবনায় মনে আসে, জামাকাপড় দেহের না-ঢাকা অংশ দেখাবে কেমন করে? যেটুকুতে আড়াল থাকবে না, তা তো আপনা থেকেই দৃশ্যমান! সুতরাং, অঙ্গবাসের নিজের ভূমিকাকে এখানে উলটে দেওয়া হয়েছে। যে সান্ত্রী, সে-ই গোপনে সিন্দুক খুলছে! অথচ দেখুন, কম্পিউটার আমাদের কতকিছু দেখিয়েছে, শিখিয়েছে; তবু রিভিলিং কম্পিউটার তো বলি না কেউ!

মজার কথা হল, প্রায় একই ধরণে একটা “সেন্স রিভার্সাল” হয়েছে “রিভিলিং” শব্দের গঠনেও।
“রিভিল” ইংরেজিতে এল ওল্ড ফ্রেঞ্চ reveler বা ল্যাটিন revelare থেকে। শব্দটার দুই অংশ: re মানে আবার, আর velum বলতে veil। সুতরাং, রিভিল-এর মূল অর্থ: পুনরায় আবরণ পরানো বা পুনর্গোপন করা। কিন্তু “re” উপসর্গ এখানে বিপরীত মানেতে ব্যবহার করা হয়েছে — “আবার”-এর বদলে “কখনও নয়” অর্থে। অনেক ভাষাতেই এমন উদাহরণ পাই, বাংলায় যেমন “অপ” একটা নেগেটিভ উপসর্গ। অপ আসছে অপগত থেকে যার মানে বিগত, পলায়িত, প্রস্থিত, দূরীভূত, মৃত, রহিত। তাহলে যার রূপ নেই সে-ই তো অপরূপ হওয়ার কথা? এদিকে আমাদের ভাষায় “অপরূপ” মানে অপূর্ব বা অতুলনীয় সৌন্দর্য, যার সামনে পড়ে কবিদেরও বিশেষণ হাতড়ে বেড়াতে হয়!

[দেরিদা The Animal That Therefore I Am লেখাতে মানুষ আর পশুর প্রতিতুলনায় নগ্ন (naked/nude) আর সজ্জিত (clothed) নিয়ে কথা বলেছেন। ওঁর নজর নিশ্চয়ই রিভিলিং শব্দটায় পড়েনি। তাহলে হয়তো আর একটা প্রবন্ধ পেতাম যেখানে মানুষজাতির মধ্যে আলোচনা সীমিত রেখে দেরিদা বলতেন, কোনও কিছুকেই উন্মোচিত করা যায় না, দেখানোর অর্থ আসলে নতুন করে তাকে ঢেকে দেওয়া। আর এইভাবে নগ্ন-সজ্জিত বাইনারির মধ্যের তফাতটাকে দিতেন অস্পষ্ট করে]।

দুই
বেশ, তাহলে বসন জীবিত এক অস্তিত্ব। সে সক্রিয় কর্তা। পোশাকের এই রকম এক নির্ণায়ক ভূমিকার কথাই পেলাম ওপরের আলোচনায়। কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ হচ্ছে না।

অভিধান একটা উদাহরণ এনেছে “রিভিলিং” শব্দটার ছবি মনে ভালোভাবে গেঁথে দেওয়ার জন্যে — “একজন মানুষ সত্যি সত্যি কী ভাবছে সে-ব্যাপারটা খুব রিভিলিং হয়ে উঠতে পারে তার বলা একটা জোকসের ভেতর দিয়ে”।

তাহলে বোঝা গেল, স্পিচ যেভাবে জীবিত সত্তার বৈশিষ্ট্য, বেশবাস সেরকম তো বটেই। তার ওপর, ঠিক যেমন কথ্য বা লিখিত শব্দের চেতনা আছে, পোশাকও নিজস্ব বোধ বহন করে চলে।

কনজিউমার সংস্কৃতিতে এই ব্যাপারটা আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। জীবের অধিগমন চলছিল জড়ের দিকে এবং উল্টোটাও। মনের যাত্রা হচ্ছে শরীর-পানে আবার বিপরীত স্রোতও মিথ্যে নয়। সেই একই “রোল রিভার্সাল” বা ভূমিকা বদলের গল্প। কেননা, যদি কেউ মনকে কমিয়ে শরীরের মাপে এনে ফেলতে চায়, তাহলে তাকে জড়বস্তুতে সজীবের মহিমা আরোপ করতেই হবে। উদাহরণ হিসেবে পোশাক-ব্যবসাকেই নেওয়া যাক। “অনেস্ট শার্ট” — এই বিখ্যাত ব্র্যান্ডে সততা যেন শার্টের সুতো, রঙ আর ডিজাইনের গায়ে লেগে আছে। স্থানান্তরিত বিশেষণের উদাহরণ, আমরা স্কুলে পড়তাম। অর্থাৎ সততা আপনার ভেতর-সত্তা থেকে “উভর কে” শার্টের শরীরে চলে এসেছে। যে লোকটা জানে সে সৎ নয়, সে-ও (ফলত সকলেই) ওই ব্র্যান্ডের একটা জামা পরে নিতে উদ্বুদ্ধ হবে। একইভাবে “দ্য কমপ্লিট ম্যান”-এ ট্যাগ লাইনটা বোঝায়, রেমন্ডস-এর কাপড়ের সুতোয় বোনা আছে একজন দায়িত্ববান বাবা, যত্নবান সন্তান, আবেগময় প্রেমিক — এক কথায় সম্পূর্ণ পুরুষ সত্তা।

তিন
এই পর্যন্ত এসে আমার নিজের কাছে যে প্রশ্নটা দাঁড়ায়: “প্রকাশকারী পোশাক” (revealing clothes) এই পরিভাষা একটা নারীবাদী পাঠ দাবী করছে কি না।

প্রথমত, “রিভিলিং ক্লোদস” শব্দদুটো এখনও পৃথিবী জুড়ে শুধু মেয়েদের সজ্জার বেলাতেই ব্যবহার করা হয়।
দ্বিতীয়ত, মেয়েদের মন থেকে তার শরীর আরও দূরবর্তী হয়ে গেল মাঝখানে “ড্রেস” নামের “তৃতীয়” ঢুকে পড়ায়। মনের এজেন্ট, মুখপত্র যেন সে — এই অঙ্গাবরণ। তারপর ভোগবাদের মহিমায় নারীর চেয়ে তার পরিচ্ছদ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠল। ধরুন, আপনি একটা মেয়েকে সান্ধ্য পার্টিতে নেমন্তন্ন করেছেন। তার মানে আপনি আসতে বলেছেন তিনজনকে: তার ড্রেস, তার শরীর আর সবশেষে সে নিজে।

তৃতীয়ত, যখন সৎ শার্ট বা সম্পূর্ণ পুরুষের কথা বলা হচ্ছে, পরিচ্ছদের চেতনা আর পরিধানকারীর চেতনা পরস্পরের হাত ধরে আছে, বিদ্যুতের সার্কিটে একটা “সিরিজ”-এ যুক্ত হয়ে থাকার মতো। ফলত পুরুষের সত্তার নেট লাভ হচ্ছে এ-থেকে; যদিও আবেশিত (induced), উদ্ভাস আসছে তার সত্তায়। কিন্তু “রিভিলিং ক্লোদস”-এর চেতনা মেয়েটার মানসিক গুণাবলীর সঙ্গে “প্যারালাল” সার্কিট তৈরি করে আছে, তার দীপ্তি কমিয়ে দিচ্ছে। তাই সত্তা অন্ধকার, তিনের মধ্যে তৃতীয়, মঞ্চে না উঠতে পেয়ে সাজঘরে দাঁড়িয়ে। সমাবেশে যাচ্ছে তার সজ্জা আর সজ্জা কর্তৃক রিভিলড গতরটি। কারণ, এখনও পর্যন্ত আপনি একই সঙ্গে মাইন্ড আর বডিকে সমান উচ্চতায় ধরে রাখতে পারেন না, কেননা সমাজমননে এখনও এ-দুটো বিপরীতগামী বলে কথিত, একে অন্যের আলো নিভিয়ে দেয়, তাই কনজিউমারিজম দুটোর কোনও একটা পক্ষ বেছে নিয়েছে। পুরুষের বেলায় সে মূলত তাদের অর্জিত গুণকে আন্ডারলাইন করে যার মধ্যে অবশ্যই অর্থসম্পদ পড়ছে — আর নারীর ক্ষেত্রে এখনও অনেক সহজ তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া শরীরী সম্পদের ঘোষণায় ব্যস্ত থাকা।

তবে বদল তো আসছেই। মেয়েদের পোশাকের বিজ্ঞাপনকে একদিন অক্‌জিমোরোন-মুক্ত হতে বাধ্য করবে মেয়েরা। রিভিলিং মাইন্ড কথাটা সেখানে বাজবে বাঁশির মতো।

করুণা…..!

আমার কারো করুণার দরকার নেই’ — এটি একটি চরম অহঙ্কারী ধারণা। মানুষ প্রতি মুহূর্তে অন্যের উপর নির্ভরশীল। করুণা, সহমর্মিতা যখন মানবসমাজ থেকে উধাও হয়ে যায় তখন সেটা প্রতিটি মানুষকে নিরাশ্রয় নিরাপত্তাহীন করে তোলে।
.
সে যখন শিশু ছিল তখন সে একটু স্নেহদৃষ্টির জন্য, একটু আদর পাওয়ার জন্য সবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত। অন্যের সহায়তা ছাড়া এক ফোটা পানিও সে খেতে পারত না। আবার বার্ধক্যে একই অবস্থায় সে পতিত হয়।
.
আত্মাহীন সমাজে অর্থ দিয়ে অধিকাংশ বৈষয়িক প্রয়োজন পুরণ করা যায় বলে মানুষ যৌবনে কিছুটা আর্থিক সঙ্গতি প্রাপ্ত হলেই অহঙ্কারী হয়ে ওঠে, আর বলে – আমি কারো করুণা, দয়া চাই না। আমি কারো খাই না। এর পরোক্ষ অর্থ হচ্ছে, সে নিজেও কাউকে করুণা আর দয়া করা থেকে, অন্যকে খাওয়ানো থেকে দায়মুক্ত হতে চায়।
.
একটা সময় ছিল, মানুষ অতিথিপরায়ণ ছিল। অথচ বর্তমানে তারা আত্মীয়-স্বজনকে আপদ মনে করে, মৌখিক সৌজন্য রক্ষা করাকেও কষ্টকর মনে করে। কাউকে কালেভদ্রে সহায়তা করলে সারাজীবন সেই উপকারের কথা অন্যের কাছে বলে বেড়ায়।
.
স্রষ্টা পরম করুণাময়। তার প্রতিভূ মানুষ যদি করুণাহীন ও নির্দয় হয়ে যায় তাহলে কেবল স্বার্থের উপর ভিত্তি করে বেশিদিন সমাজ টিকে থাকতে পারে না। চতুর্মুখী স্বার্থের দ্বন্দ্বে তা মানুষের বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এই সমাজে প্রতিটি মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তে নিজের জীবন ও সম্পদকে অন্য মানুষের হাত থেকে রক্ষার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকতে হয়।
.
বাড়ির দরজায় দারোয়ান রাখতে হয়, সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হয়, রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ রাখতে হয়, সেই পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য ষড় ইন্দ্রিয় খাড়া রাখতে হয়। করুণাহীন সমাজের এটাই বাস্তবতা।

আমাদের মুসলিম সমাজের প্রতি প্রশ্ন-

ইসলাম যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ হয়ে থাকে তাহলে মুসলিম ঘরের সন্তানরা নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকছে কেন? তাহলে কি ইসলামের আদর্শে কোনো ভেজাল ঢুকে পড়েছে? এই ইসলাম বিশ্বনবীর আনিত প্রকৃত ইসলাম নয়?
.
নাস্তিক হবার কারণে কাউকে হত্যা করার বৈধতা আছে কিনা ইসলামে? যদি বৈধতা থাকে তাহলে কী করবেন? দেশের সকল নাস্তিককে হত্যা করবেন? সারা বিশ্বে মুসলিমদের মোট সংখ্যার তুলনায় মোট নাস্তিকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।
.
শুধু নাস্তিক হবার কারণে বিশ্বনবী কি কাউকে হত্যা করেছিলেন?
কেউ রসুলের সমালোচনা করলেও তাকে হত্যা করার বৈধতা আছে কি ইসলামে? শাস্তির বৈধতা যদি থাকেও সেটা কার্যকর করবে কে? যে কেউ শাস্তি প্রদান করতে পারবে নাকি রাষ্ট্র?
.
নাস্তিকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে কেন? নাস্তিকদেরকে বাংলাদেশ ছাড়তে হবে কেন? নাস্তিকদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হবে কেন? ‘নাস্তিকতা-আস্তিকতার লড়াই’ নামে কোনো লড়াই বিশ্বনবী কখনও করেছিলেন কিনা? কিংবা আমাদেরকে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবার হুকুম দিয়ে গেছেন কিনা?
.
বিশ্বনবী ইহুদিদেরকে স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, খৃষ্টানদেরকে মসজিদে এবাদত করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করা হয় নাই। তাহলে নাস্তিকরা কেন ব্যক্তিগতভাবে তাদের অবিশ্বাস লালন করতে পারবে না?
.
সমাজের চাক্ষুষ্মান হাজারো অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ইত্যাদি চলতে দেখেও যারা ‘টু’ শব্দটি উচ্চারণ করেন না, এইসব অন্যায়-অবিচার বন্ধ করার প্রচেষ্টাকে নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব মনে করেন না, তারা ‘নাস্তিক্য’ ইস্যুতে এত সরব হন কেন? যারা নিজেদেরকে উমরের উত্তরসূরী দাবি করে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেবার হুংকার ছাড়েন তারা কেন ঐসব লোকের বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়েন না যারা মানুষের অধিকার কেড়ে খাচ্ছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে, ব্যাংক থেকে টাকা লুট করছে, মা-বোনদের সম্ভ্রম নষ্ট করছে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, ঘুষ-দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে আছে?

তাহলে কোথায় ইসলাম শিখব?

যে দেশে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র কায়েম থাকে সে দেশে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র শিখতে আলাদা স্কুল লাগে না। এমন কি সক্রিয় রাজনীতি করতেও, দেশ চালাতেও ঐ জীবনব্যবস্থার উপর কোনো বাড়তি ডিগ্রি নিতে হয় না। কারণ জীবনব্যবস্থার শিক্ষা ও চর্চা বাস্তব জীবনেই হয়ে থাকে। আলো বাতাসের মতই তার প্রকাশ ও বিস্তার হয় সর্বব্যাপী।

ইসলাম যদি একটি জীবনব্যবস্থা হয়ে থাকে তাহলে সেটা শিক্ষা করতে কেন একটি আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা, আলাদা মাদ্রাসা, সিলেবাস, কারিকুলাম থাকতে হবে? বলে রাখা ভালো, আরবি ভাষা শিক্ষা আর ইসলাম শিক্ষা এক বিষয় নয়।

মানুষ যখন মুখ দিয়ে খেতে পারে না তখন নাক দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে খাওয়াতে হয়। যখন শারীরিক শ্রম তার জীবনযাত্রার অংশ থাকে না তখন জিমনেসিয়ামে গিয়ে স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হয়। তেমনি ইসলাম যখন মুসলমানদের জীবনব্যবস্থা হিসাবে পরিত্যক্ত হয়ে আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তখনই ইসলাম শিখতে মাদ্রাসায় যেতে হচ্ছে।

মুসলিম ছিল বীরের জাতি। সেই বীরত্ব তারা কোনো মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা করে নি। মুসলিম ছিল সত্যবাদী, আমানতদার। সেই চরিত্র তারা কোনো মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা করে নি। মুসলিম ছিল ন্যায়বিচারক। সেই ন্যায়নিষ্ঠা তারা তাদের সমাজ থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষা করেছিল। তাদের শাসক যেমন ছিল, যে আদর্শে দীক্ষিত ছিল নাগরিকরাও তেমন হয়েছে। কেবল জনগণের মনমত চলা শাসকের কাজ নয়, বরং জনগণকে সঠিক পথ দেখানোও তার মহান দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
একইভাবে আমাদের তরুণরা মাদকাসক্ত হচ্ছে, ইভটিজার হচ্ছে, শিক্ষকদের পেটাচ্ছে, সন্ত্রাসী হচ্ছে, রাজনৈতিক ক্যাডার হচ্ছে – তাদের এই চরিত্র শিক্ষা দিতে আমাদেরকে কোনো স্কুল কলেজ বসাতে হয় নি, পৃথিবী যেমন সূর্য থেকে শক্তি নিচ্ছে, তারাও এই সমাজ থেকেই ঐ সব কুশিক্ষা নিজেদের জীবনচর্চায় অঙ্গীভূত করে নিচ্ছে।

কেন জীবন থেকে মানবতা হারিয়ে গেল ?

যখন থেকে মূল্য কেবল অর্থ দ্বারা নির্ধাণ করা শুরু হলো তখন থেকে কিছু অমূল্য সম্পদ মূল্যহীন হতে থাকলো। সত্যবাদিতা, আতিথেয়তা, সেবাপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস ইত্যাদি অমূল্য সম্পদ তার দ্যুতি হারিয়ে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে, অর্থ দ্বারা এগুলির মূল্যায়ন সম্ভব নয় বলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে।
.
মায়ের ভালোবাসা, পিতার অপার স্নেহ, শিক্ষকের জীবনগড়া শাসন ইত্যাদি মহামূল্যবান সম্পদগুলোও আজ সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষকের মর্যাদা আজ বেতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। আমরা যে পাশ্চাত্যদের অন্ধ অনুকরণ করে চলেছি সেই পাশ্চাত্য সমাজে মা-বাবার ভালোবাসা প্রায় অনুপস্থিত। শুধু অর্থ দিয়েই সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালন করে তারা। সন্তানও তাই সে ঋণ অর্থ দ্বারাই পরিশোধ করে, কখনো বা সেটাও করে না। আমাদের সমাজও দিন দিন সেদিকেই যাচ্ছে।
.
তরুণীরা এখন টাকাওয়ালা স্বামী পেতে চায়, মেয়ের বাবা-মায়ের দৃষ্টিও জামায়ের পকেটের দিকেই। ভালোবাসা, সচ্চরিত্র- এগুলোর কোনো মূল্য নেই এখন। ছেলেরাও টাকাওয়ালা শ্বশুর খোঁজে।
.
সমাজে তারই সম্মান বেশি যার অর্থ বেশি। ভোটে জিতে বিত্তশালী ব্যক্তিগুলোই জনপ্রতিনিধি হচ্ছে, চরিত্রবান লোকগুলো সর্বত্র তিরস্কৃত হচ্ছে। লেখকরা লিখছে অর্থের জন্য, ছাত্ররা পড়ছে অর্থ উপার্জনের জন্য, ডাক্তাররা অর্থের জন্য চিকিৎসা করছে (রোগীরা তাদের খদ্দেরে পরিণত হয়েছে), নামের সাথে অনেকের সমাজসেবক, দানশীল ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত করা হলেও দেখা যাচ্ছে মূলত আর্থিক স্বার্থেই সে এগুলো করছে।
.
যখনই কোনো জিনিসের মূল্য কেবল অর্থ দ্বারা নির্ধারণ করা হয় তখন সেটা পণ্যে পরিণত হয়। সেবাগুলো যখন পণ্যে পরিণত হয় সমাজ থেকে তখন মানবতা হারিয়ে যায়। এখন সাধারণ জনগণ খদ্দেরে পরিণত হয়েছে। পুলিশের কাছে তারা খদ্দের, ধর্মজীবীদের কাছে তারা খদ্দের, ডাক্তারের কাছে খদ্দের, আইনজীবি, রাজনীতিবিদ সকলের কাছেই তারা কেবল খদ্দের। এভাবে পাশ্চাত্যের কনজিউমারিজম সমস্ত কিছুকে পণ্য বানিয়ে ফেলেছে আর সাধারণ মানুষকে খদ্দেরে পরিণত করেছে।
.
এই সিস্টেমের কারণে আমাদের সমাজ এখন চরম স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। সমাজ থেকে নীতি-নৈতিকতা সব হারিয়ে যাচ্ছে, চরমভাবে অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে, সমাজ ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। এ থেকে মুক্তি দিতে পারত যে ধর্ম সেই ধর্মকেই বানিয়ে ফেলা হয়েছে পণ্য। ধর্ম বলতে মানুষ এখন বোঝে মোল্লাকে টাকা দেওয়া, মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করা, হজ্জ করা, নামাজ-রোজা করা।
.
এখন সমাজকে বাঁচাতে হলে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে- ধর্ম এসেছে মানুষে কল্যাণে, নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণ করা, মানুষের দুঃখ, কষ্ট হৃদয়ে ধারণ করা ও সেটা দূর করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করাই ধর্মের মূল কাজ। স্বার্থপর মানুষ কখনো জান্নাতে যেতে পারবে না।

সম্পর্ক ডাউনলোডেড

বেঙ্গালুরু থেকে আলোদ্যুতি লিখে পাঠিয়েছে:-

“বাসে মেয়েটার পাশের সিটে একটা ছেলে এসে বসল। প্রথমে তো মেয়েটা শরীর গুটিয়েটুটিয়ে সরে গেছে জানলার দিকে, মুখে কোঁচকানো বিরক্তি। আর পুরুষ মনে মনে অপ্রস্তুত। কিছুক্ষণ যায়, বাসের আচারমাখা ঝাঁকুনিতে ঢিলে হয়ে আসে বিভাজন, মেয়েটার শ্লথ হাত এসে পড়ল ছেলের কোমরের কাছে।

ছেলেটার মনে বেড়ালের গুড়গুড়ুনি শুরু এবার। নিশ্চয়ই ইশারা দিচ্ছে ওপক্ষ, চাইছে আমি সক্রিয় হই — ভেবে যেই একটু তেমন-কিছু-না করতে গেছে, মানে দুটো পায়ের মধ্যে অ্যাঙ্গেলটা কুড়ি ডিগ্রি মতো বাড়িয়ে ডানহাতের কনুই সাইড ওয়াইজ ছ’ইঞ্চি ওপরে তোলা, মেয়েটা ধড়ফড় করে আবার “প্যারেড সাবধান” হয়ে গেল, হল পুনর্কুঞ্চিত ভ্রূ।

সে তো ভয়ে ভয়ে সরেই বসেছিল, পাশের খালি চেয়ারে দাড়িগোঁফ উদিত হোক কি মসৃণকামানো গাল, বিরক্ত তাকে করবেই। তারপর যখন দেখা যায়, ছেলেটা ভদ্রমুখ, মোবাইলব্যস্ত, নিশ্চিন্ত হয়ে নিজেকে একটু কমফোর্ট দিতে চেয়েছে। ব্যস, ওমনি ভুল অনুবাদ, গলত উদ্ধৃতি। আবার তড়াক করে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে পড়তে হল মেয়েটাকে”।

আমার মনে পড়ল কোন হিন্দি সিনেমায় যেন বোমান ইরানি অল্প পরিচিত বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে এইরকম এক আশায় জামাপ্যান্ট খুলে শুধু অন্তর্বাসে সোফায় বসে পড়েছিল।

আলোদ্যুতিকে লিখলাম, ছেলেদের এই আচরণের পেছনে শুধু যে পুরুষতন্ত্র কাজ করছে, এমন তো নয়; তার যৌন-মনস্তত্বও তাকে ভাবাচ্ছে এভাবে। স্পিসিস হিসেবে প্রকৃতিতে তার ভূমিকাই হল রক্তদানের চেয়ে অনেক স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুক্রানুদানের জন্যে তৈরি থাকা। সেখানে গ্রহীতার মান কেমন তা বিবেচনাতেই আসছে না। তার ওপর যদি সে মনে মনে পুরুষতন্ত্রের শক্তপোক্ত ধারক হয়ে থাকে, তবে গ্রহীতার অনিচ্ছেকেও এক চুটকিতে উড়িয়ে দেবে। শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের অবির্ভাব হচ্ছে এখানে। পুরুষের যৌন-আচরণের এই দুটো ভাগকে (প্রকৃতিনির্দিষ্ট ভূমিকা আর অত্যাচারী ভূমিকা) আলাদা করে না বুঝলে সমস্যাটাকে মেটানো সহজ নয়। দ্যাখো, এখানে মেয়েটার রিল্যাক্সড হয়ে বসার একটা গলত মানে করেছে ছেলেটা। কেন? কারণ, সে নিজে ইচ্ছুক বলে ভাবছে অপরপক্ষও ইচ্ছে করবে। এটা কিন্তু জেন্ডার নির্বিশেষে সাধারণ মনস্তত্ব। আমরা প্রত্যেকেই ধারণা আর আশা করি, বাকি মানুষেরা আমার মতো হবে। না হলে বিরক্ত হই, তাকে ভুল প্রমাণ করি, পাল্টাতে চাই।

আলোদ্যুতি আমার ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হল: হ্যাঁ, এটাই প্রাইমরডাল পুরুষ। তার বলপ্রয়োগ আটকাতে গেলে তাকে যে শিক্ষা দিতে হবে সেটা মানবিকতা আর সিভিল রাইটসের। কিন্তু পুরুষের দাতাকর্ণভাব থামাতে তার মাথায় এই কথাটা গজাল-পোঁতা করা দরকার যে তুমি যেভাবে যৌনতাকে দ্যাখো, উঠল বাই তো কটক যাই, সেভাবে একটা মেয়ে ভাবে না। কাজেই নারীর যৌন-উদ্দীপকে সাড়া দেওয়ার এই মনগড়া কাহিনিগুলোকে ফেলে না দিলে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটাই শুধু নষ্ট হবে।

আমি প্রশ্ন করলাম, তোমার কি মনে হয় না মেয়েরাও নিজের প্রাচীন চরিত্রগত কারণে একইভাবে ছেলেদের বুঝতে ভুল করে? যদি তা না ভাবো, বলতে বাধ্য হব যে নারীবাদ মেয়েদের ‘ফার্স্ট সেক্স’ প্রমাণ করার চেষ্টায় আছে।

আলোদ্যুতি হাসিমুখের ইমোটিকন পাঠালো: আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, কথা এখনও শেষ হয়নি। মেয়েরা যেহেতু গ্রহণকারী, তাকে নিষিক্ত ডিম্বানুটাকে বহন করে সন্তানের জন্ম দিতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বড় করতে হবে, তাই তার পক্ষে নির্বিচারে শুক্রানু আহ্বান করা সম্ভব নয়। নারী এমন পুরুষই খুঁজবে যে তার সংসার আর সন্তানকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা আর রিসোর্স যোগাতে পারে। কাজেই তার পক্ষে পূর্বরাগ খুব দরকারি ব্যাপার। এই সময়টাতে আসলে সে গুগল সার্চ করে বুঝে নিতে চাইছে, এই পুরুষ তার সন্তানের বাবা হওয়ার যোগ্য কতটা। কাজেই নারীর পক্ষে সমস্ত বিবেচনা শেষ হওয়ার পর, অন্য সব সিদ্ধান্ত মোটামুটি পাকা হয়ে গেলে যৌনতার অবির্ভাব হয়। এই প্রবণতা থেকে মেয়েরাও ছেলেদের ‘সেক্স ফার্স্ট’-এর মনোভাবকে দেহসর্বস্ব ও ধান্দাবাজির ঘটনা বলে মনে করে। মজার ব্যাপার হল, দু’দলেরই প্রবণতাগুলো এত গাঢ় মনস্তাত্বিক যে, যেখানে যৌনসম্পর্কের লক্ষ্য সন্তান উৎপাদন নয়, সেখানেও একই অধিনিয়ম লাগু থাকবে।

আমি জানালাম: ঠিকই বলেছ। কোনও সফটঅয়্যার ডাউনলোড করার সময় যেমন নেক্সট লেখা তীরচিহ্ন দ্যাখায়, তেমনি ছেলেদের বেলাতে পদ্ধতি হচ্ছে প্রেম থেকে যৌনতা, বা যৌনতা থেকে প্রেম থেকে যৌনতা। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রেম থেকে যৌনতা থেকে সংসার থেকে সন্তান থেকে সংসার। আমি এই চেইনের শেষ মানে “ফিনিশড” অবস্থানটাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, যা ছেলেদের বেলায় যৌনতা আর মেয়েদের জন্যে সংসার।
— সংসার মানে কি ফ্যামিলি?
— হুঁ, পরিবার শব্দটাও বসানো যেতে পারে।
— আমার মতে যৌনতা ফিনিশিং পয়েন্ট নয় পুরুষের। সে এসে থামে সম্পত্তির ধারণায়। যৌনতা থেকে প্রেম থেকে সম্পত্তি।

আমি বললাম, প্রচুর ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে, একদম ঠিক বলেছ। এবার এই ভাবনাগুলোকে প্রয়োগ করার জন্যে আমরা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ভাঙন নিয়ে এগোতে পারি। চিড় খাওয়া বিবাহজ সম্পর্কের উদাহরণ নেব না কারণ সেখানে রাষ্ট্র আর সমাজের চাপ আর অন্যান্য নানা কারণ ভাঙা হাড়ে প্লাস্টারের কাজ করে।

তুমি দেখবে, দুটো বিবাহিত মানুষের মধ্যেকার প্রেম ভেঙে যাওয়ার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। মেয়েটা কিছুদিন পরেই অনুভব করবে, তার প্রেমিক আসলে ভালোবাসে নিজের স্ত্রীকেই। তার কাছে বউই প্রায়োরিটি, প্রেমিকাকে শুধু যৌনসঙ্গী হিসেবে বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। আমার ধারণা, একটা মেয়ে বিশ্বাসই করতে পারে না কোনও পুরুষ নিজের সংসারে বাস করেও মানসিকভাবে বিযুক্ত থাকতে পারে, যেহেতু সেটা সে নিজে খুব কম পারে।

আলোদ্যুতি লিখল, একই ভাবে কোনও ছেলে বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে প্রেম শুরু করলে কিছুদিন পরই তাকে প্রমিসকিউয়াস ভাবতে শুরু করবে। পুরুষের কাছে যেহেতু এন্ড পয়েন্ট হল মেয়েটিকে নিজের সম্পত্তির বানিয়ে ফেলা যার মূলে তার যৌন-সতীত্বের ধারণা কাজ করছে, সেখানে বিবাহিত মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া খুব মুশকিল। ছেলেটা প্রথমে ভাবে, মহিলা মিথ্যে বলছে, হাজব্যান্ডের সঙ্গে সব রকম সম্পর্কই আছে এর। তারপর আবিষ্কার করে মেয়েটি একই সঙ্গে আরও নানা পুরুষে আকৃষ্ট, মানে আপামাথা ‘চরিত্রহীন’।

আমার শেষ মন্তব্য ছিল: তাহলে আলোচনার বাইরের দরজায় পৌঁছে আমরা বলতে পারি — নারী বা পুরুষের জৈব-বাস্তবতা বা বায়োলজিক্যাল রিয়ালিটি থেকেই প্রাথমিকভাবে তার দেহ-মনস্তত্ব গড়ে ওঠে। আর সেই দেহ-মনস্তত্বই তার যৌন-আচরণকে গড়ে দেয়। এর ওপর সামাজিক শক্তিগুলোর প্রভাব থাকে ভীষণ রকম। এইভাবে বুঝতে পারলে ছেলে বা মেয়ে কাউকেই তার সেক্সুয়াল বিহেভিয়ারের জন্যে অতিরিক্ত দায়ি করার দরকার পড়বে না। জেন্ডার-স্পেসিফিক শোষণগুলো থেকে মেয়েরা মুক্তি পেলে সামাজিক চাপের কারণে দুজনের আচরণের যে তফাত, সেটা ঘুচে যাবে। তারপরেও থাকবে দেহ-মনস্তত্বের পার্থক্যটুকু।

আলোদ্যুতি লিখল: কোনওদিন মেয়েদের গর্ভে বাচ্চা নেওয়ার প্রথা বন্ধ হলে দেহকেন্দ্রিক মনোভাবের বিভিন্নতাও অনেকখানি ঘুচে যাওয়ার কথা। তখন এক-আধটা ছুটকো ঘটনা নয়, পুরুষকর্তৃক মেয়েদের ছেড়খানি করার কমপ্লেইনের মতোই ভুরি ভুরি আদম-টিজিংয়ের অভিযোগে উপচে পড়বে থানাগুলো।

— হুঁ, সাম্য আসা মানেই নৈতিক হয়ে ওঠা নয়। কাজেই, সমতার পরিবেশ শোষণও বন্ধ করে না। তবু সেটাই প্রথম পদক্ষেপ। তার সঙ্গে মিথ-মিথ্যে-কুসংস্কার সরিয়ে নারী-পুরুষের একে অন্যকে চিনতে পারা, যেটা তথ্যের কাজ, জ্ঞানের কাজ।

— আর একদিন এই দিকটা নিয়ে নয় কথা বলব আমরা।

মানবসমাজ ও পশুর সমাজের মধ্যে পার্থক্য

এ সমাজে মানুষের নিরাপত্তার জন্য বাহিনী গঠন করতে হয়, চৌকি বসাতে হয়, দিবা-রাত্রি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মানুষের জীবন-সম্পদ পাহারা দিতে হয়; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য আবার প্রয়োজন পড়ে বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার, বডি গার্ডের বা পুলিশ ভর্তি গাড়ি বহরের। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে, আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মানুষ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, উদায়াস্ত একজন মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে দুর্বলকে আক্রমণ করছে, একজন আরেক জনকে জীবন্ত আগুনে দগ্ধ করছে, বাবা মেয়ের ইজ্জতের হানি ঘটাচ্ছে, মেয়ে তার জন্মদাতা পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, আড়াই বছরের শিশুও ধর্ষিত হচ্ছে সে সমাজ আর মানুষের সমাজ নয়? কথিত এই মানবসমাজ আর পশুর সমাজের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ আছে কি?
.
মানুষ পশু নয়, তাই মানব সমাজ আর পশুর সমাজও এক নয়। মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত, স্রষ্টা প্রদত্ত রূহের ধারক, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন অসাধারণ এক সৃষ্টি। তার সম্মান, মর্যাদা অন্য যে কোনো সৃষ্টির চেয়ে বহুগুণ বেশি। একই কারণে মানবসমাজও সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো কেবল মানবসমাজেই দৃষ্টিগোচর হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যে সমাজে অনুপস্থিত থাকে তাকে কখনও মানবসমাজ বলা যায় না।

মানবসমাজের প্রধানত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ‘মানুষ তার স্বীয় ধর্মকে ধারণ করে সে সমাজ নির্মাণ করে। সমাজ পরিচালিত হয় ধর্মের ভিত্তিতে।’ মানুষের ধর্ম হলো মানবতা, মনুষ্যত্ব তথা মানবীয় গুণাবলী, যেমন অন্য মানুষের জন্য তার সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, দয়া, মায়া, সহমর্মিতা ইত্যাদি। ধার্মিক ব্যক্তি তার সত্ত্বাকে বিলিন করে দেয় অন্যের কল্যাণের উদ্দেশ্যে। অন্যের কষ্ট দেখলে, দুর্দশা দেখলে, বিপদ-আপদ দেখলে তার নিজের আত্মায় সে কষ্ট অনুভূত হয়। সমাজের সকল কিছুতেই সে কেবল নিজেকে দেখতে পায়। সমাজের কোনো মানুষ তো দূরের কথা কোনো জীবেরও এতটুকু দুঃখ তাকে পীড়া দেয়, আর সুখ তাকে আনন্দ ও সন্তুষ্টি প্রদান করে। ধার্মিক ব্যক্তি তার জীবন নির্বাহ করে শুধুই অপরের দুঃখ নিবারনের চেষ্টায়। কারণ সে জানে- অপরের কল্যাণে কাজ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবজনমের সার্থকতা। এটাই জেহাদ, এটাই ধর্মযুদ্ধ, এটাই ধর্মের সর্বোত্তম কাজ। এই যে মানসিকতা, সর্বভূতে হিত সাধনার্থে প্রয়াস, অপরের মাঝে নিজেকে দেখা- এটাই মানবসমাজের বৈশিষ্ট্য। এ সমাজে কোনো স্বার্থচিন্তার স্থান থাকে না, শুধু থাকে বিনিময়হীন সেবা। স্বার্থচিন্তা ব্যতিরেখে যে যত বেশি সেবা প্রদান করতে পারে সে তত বেশি মর্যাদার অধিকারী হয়, তত বেশি তার কীর্তি প্রাপ্ত হয়।

অন্যদিকে পশুর সমাজ হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সমাজ পরিচালিত হয় স্বার্থচিন্তার ভিত্তিতে। সেখানে প্রত্যেকেই আত্মস্বার্থে কাজ করে। সবসময় নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত থাকে। অন্যের প্রতি কোনো অনুভূতি থাকে না। এমন কি নিজের স্বার্থ হাসিলের পথে যত অন্যায়-অবিচার, যুলুম দরকার হোক তার কোনো বাছ-বিচার করা হয় না, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য থাকে না। এ সমাজে শক্তিই পরিণত হয় ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডে। প্রত্যেকের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় যে করেই হোক নিজের সর্বোচ্চ স্বার্থ আদায় করে নেওয়া। এখানে আত্মার কোনো স্থান থাকে না, থাকে শুধু দেহ। তাই দেহের প্রয়োজন পূরণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পশু বেঁচে থাকে শুধু উদরপূর্তি করার জন্য। সে সারাদিন চিন্তা করে কোনো পশুকে আক্রমণ করবে, পরাভূত করবে, মাংস ভক্ষণ করবে। পাশাপাশি শঙ্কিতও থাকে এই বুঝি তার ওপর হামলা হলো, এই বুঝি তার থেকে শক্তিশালী কেউ তাকে ঠুকরে ঠুকরে খেল।

আপনি যদি পশুর সমাজে যান, অর্থাৎ কোনো ভয়ংকর বনে-জঙ্গলে প্রবেশ করেন তখন অবশ্যই আপনি খালি হাতে যাবেন না। কারণ সেখানে নিরাপত্তা নেই, যে কোনো সময় প্রাণ চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। বন্য পশুর সামনে হাতজোড় করে দয়াভিক্ষা করলেও নিস্তার পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে দরকার পড়ে পাহারার। কিন্তু যে সমাজ, যে জগতে একজন আরেকজনের জন্য নিজের সত্ত্বাকে বিলিন করে দেয়, অপরের মাঝে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে, অপরের সুখে নিজের তৃপ্তি খুঁজে পায় এমন সমাজে কি পাহারার দরকার পড়ে? বস্তুত পাহারা দিতে হয় পশুর সমাজে, মানবসমাজে তো কেবল সৌহার্দ্র্য, ভ্রাতৃত্ব, দয়া-মায়া, ভালোবাসার সমাহার। সেখানে অনিরাপত্তার ছোঁয়াও লাগে না, তাই পাহারারও দরকার হয় না।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আজকের মানবজাতির! দুর্ভাগ্য কথিত মানবসমাজের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে কী না করতে হয়। এ সমাজে মানুষের নিরাপত্তার জন্য বাহিনী গঠন করতে হয়, চৌকি বসাতে হয়, দিবা-রাত্রি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মানুষের জীবন-সম্পদ পাহারা দিতে হয়; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য আবার প্রয়োজন পড়ে বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার, বডি গার্ডের বা পুলিশ ভর্তি গাড়ি বহরের। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে, আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মানুষ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, উদায়াস্ত একজন মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে দুর্বলকে আক্রমণ করছে, একজন আরেক জনকে জীবন্ত আগুনে দগ্ধ করছে, বাবা মেয়ের ইজ্জতের হানি ঘটাচ্ছে, মেয়ে তার জন্মদাতা পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হচ্ছে সে সমাজ আর মানুষের সমাজ নয়? কথিত এই মানবসমাজ আর পশুর সমাজের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ আছে কি?

সোজা কথা হলো মানবতা-মনুষ্যত্ব হারিয়ে আজকের মানবজাতি ধর্মহীন পশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের সমাজ পরিণত হয়েছে পশুর সমাজে। কারণ পাহারা দেওয়ার দরকার হলেই সে সমাজ আর মানুষের সমাজ থাকে না। এ কারণেই যুগে যুগে যখন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখা গেছে তখন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাহারা বসানোর দরকার পড়ে নি, অস্ত্রের লাইসেন্স করার দরকার পড়ে নি, অস্ত্রব্যবসার জন্য রাষ্ট্রের অনুমোদনের দরকার পড়ে নি। অথচ সমাজে কোনো অন্যায়-অবিচার ছিল না, অনিরাপত্তা ছিল না। এমনটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তখন প্রতিটি মানুষ ছিল মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। আর আজ এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কারণ এখন প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে নিয়োজিত।

মুঠোফোন – 01722 606045।

রাজনীতির লাভ-লোকসান ও মৌলিক অবকাঠামো

সবার সামনে এখন ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচন। কী হচ্ছে, কী হতে পারে। সবার চোখ সেদিকেই। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। এই সার্চ কমিটির প্রধান করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। বর্তমান ইসি গঠনে গতবারও একই দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। এবারো সার্চ কমিটিতে হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক থাকছেন। এবার এই দায়িত্ব পেয়েছেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। গতবারের মতোই সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) পদধারী ব্যক্তিরা থাকছেন এই কমিটিতে। তারা হলেন- পিএসসির এবারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক এবং সিএজি মাসুদ আহমেদ। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য শিরীন আখতারকে সার্চ কমিটিতে নেয়া হয়েছে।

২০১২ সালের সার্চ কমিটি ২২ জানুয়ারি গঠনের পর ৭ ফেব্রুয়ারি ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছিল। তার মধ্য থেকে ৫ জনকে ৮ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপ্রধান। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ‘অনুসন্ধান কমিটির কার্যপদ্ধতি কমিটির সদস্যরা বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা দেব। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের কাছে নাম চাওয়া কিংবা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সাবেক উচ্চপদস্থদের নাম সংগ্রহ করার বিষয়ে সহায়তা চাইলে আমরা দেব।’

এদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। অন্যথায় এ দেশের মানুষ কখনোই এই নির্বাচন কমিশনকে মেনে নেবে না। সেটা আওয়ামী লীগের বশংবদ হবে, তাদের ইচ্ছানুযায়ী হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘নিরপেক্ষতার চরম যে নিদর্শন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদেরকে সেটা দিয়েছেন। আমরা শুধু হতাশ হইনি, আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছি। এই সার্চ কমিটি কী ধরনের নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন, তা এখনই বুঝতে পারছি।’ বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, আমরা বলতে চাই, রাজনৈতিক সংকট নিরসন যদি না করা যায়, তাহলে মানুষকে প্রতারণা করে রাজনীতি চলবে না। বোকা বানিয়ে এই ধরনের সার্চ কমিটি করে, যে সার্চ কমিটি গঠনের সঙ্গে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার কোনো প্রতিফলন নেই, সেখানে এটা কোনো দিন তার কাজ করতে সক্ষম হবে না।’

বিএনপি দলীয়ভাবে বলছে, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে খালেদা জিয়া যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছিলেন সেগুলো আমলে নিয়ে একটা নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি গঠন করতে পারলে সেটা সরকারের জন্যই ভালো হতো। কারণ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে দেশ একধাপ এগিয়ে যেত। কিন্তু সেটি না করে রাষ্ট্রের লাভজনক পদে থাকা ৬ জন ব্যক্তিকে দিয়েই গঠন করা হয়েছে সার্চ কমিটি। এই কমিটির কাছ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আশা করা যায় না। সব মিলিয়ে কোন দিকে যাচ্ছে আগামী দিনের রাজনীতি? এই প্রশ্ন এখন জোরালো হচ্ছে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, ২০১৯-এর নির্বাচনকে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের মূল টার্গেট হিসেবে দেখছে। তারা এই নির্বাচনে যে কোনোভাবে জিতে আসতে চায়। কিন্তু তাদের সেই গণভিত্তি আছে কি?

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এখন চলছে নানামুখী দাবার চাল। কে কোন দিক থেকে ফায়দা হাসিল করে, কার স্বার্থরক্ষা করছে তা বলা খুবই কঠিন।

ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত একটি গোলটেবিল আলোচনা থেকে ‘পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী পরিবর্তন প্রতিরোধে’ সারা দেশে বৃহত্তর শিক্ষা আন্দোলনেরও ডাক দেয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী’ পরিবর্তন এনে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রবেশ করানো হয়েছে অভিযোগ করে সভার আলোচকরা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের মতো ‘ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে’ তুষ্ট করতেই এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু অভিযোগ করে বলেছেন- ‘আমাদের দেশে তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা- বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা। ছোটবেলা থেকেই তাদের আমরা বিভক্তি, বিভাজন শেখাচ্ছি। এখন শেখাচ্ছি সাম্প্রদায়িকতা। এই দ্বিধাবিভক্ত প্রজন্ম কি করে ঐক্যবদ্ধ হবে?’ অভিনেতা ও নাট্য সংগঠক রামেন্দু মজুমদার বলেছেন- হেফাজতে ইসলামের মতো ধর্মীয় গোষ্ঠীর দাবি বিবেচনায় নিয়েই সরকার পাঠ্যবইয়ে এবারের পরিবর্তন এনেছে। তিনি বলেন, ‘থলের বিড়াল তো হেফাজত নিজেই বের করে ফেলেছে। প্রেস কনফারেন্স করে সরকারকে যখন ধন্যবাদ দিল, তখনই বুঝতে আর বাকি থাকল না। শিক্ষামন্ত্রী সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না দিলে তিনি পদত্যাগ করুন।’ অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম অভিযোগ করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী শক্তি কৌশলে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখছে। তিনি প্রশ্ন করেন- ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা শুনবেন? নাকি দুর্দিনে, সংগ্রামে পরীক্ষিত সৈনিক এই সাংস্কৃতিক জোটের কথা শুনবেন?’ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কিংবা গ্রন্থ সম্পাদনায় যুক্ত বিশেষজ্ঞ কারো মতামত না নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিফলনকারী রচনাগুলো বর্জন করা হয়েছে।’ বাংলাদেশে পাঠ্যবই নিয়ে যা হয়েছে, তা দেশবাসী কারো অজানা নয়। সোস্যাল মিডিয়াতে এ নিয়ে ঝড় উঠেছে। তারপরও সরকার এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেছেন, ‘জামায়াত তো সেদিনই ¯েøাগান দিয়েছে- ‘বাংলা হবে আফগান, আমরা হবো তালেবান’। সেদিকেই কি দেশ চলে যাবে? প্রশাসনের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির চক্রটি টাকা দিয়ে সব কিনে নিচ্ছে। এভাবেই তো এসব হচ্ছে।’ তার কথাগুলো কিন্তু ফেলে দেয়ার নয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার চালাতে আর দেশের উন্নয়নের ফিরিস্তি দেখাতেই ব্যস্ত থাকছে। কিন্তু নেপথ্যে একটি বিশেষ মহল কি আমাদের প্রজন্ম, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে তাদের দখলে নিতে চাইছে? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কতটা সতর্কতা অবলম্বন করছেন?

একটি পুরনো বিষয়কে আবার জিইয়ে দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব থেকে ইউনূসের বিদায়ের বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমাদের দেশের কোনো এক স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদক আর ড. ইউনূস মিলে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এরপরই আমেরিকার ফরেন সেক্রেটারি হিলারি ক্লিনটনসহ এদের সবার লবিংয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের টাকা দেয়াটা বন্ধ করে দেয়া হলো।’ পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘উল্টো দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো। যেখানে এক পয়সাও ছাড় হয়নি। বলা হলো- দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে!’ প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, ‘আমরা কিন্তু ড. ইউনূসকে সরাইনি। তিনি মামলায় হেরে গেছেন। মামলা করার পরামর্শদাতা ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তার মেয়ে। উনি মামলায় হারলেন। আইনের কারণে উনার এমডি পদ চলে গেল। এরপর উনি আমাদের ওপর ক্ষেপে গেলেন। সেই ক্ষ্যাপাটা পড়ল আমার পদ্মা সেতুর ওপর।’

আমি আমার এই লেখায় বিষয়গুলো এ জন্য বলছি, তা হলে দেখা যাচ্ছে সরকার যতই ভালো কাজ করুক না কেন- তাদের একটি শত্রুপক্ষ রয়েছে দেশে এবং বিদেশে। এরা আগেও তৎপর ছিল। এখনো আছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়ে আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাতে পারি। ঢাকাস্থ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন- ‘অধ্যাপক ইউনূস যা করেছেন সে জন্য আমি তার প্রশংসা করি।’ একই সময়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে ইউনূসের নাম প্রস্তাব প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত এই পদে মনোনয়নে তিনি সম্মত হলে সব দিক থেকে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’

আমাদের মনে আছে, এর আগে গেল ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করতে গিয়েছিল ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় হাসিনা নোবেল বিজয়ী ইউনূসকে ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্বব্যাংকের প্রধান করার প্রস্তাব দেন তাদের। আমাদের জানা আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কোনো না কোনো আমেরিকান। শেখ হাসিনা এই প্রস্তাব করার পর অনেকে এর বিরূপ মন্তব্যও করেছিলেন। বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ড. ইউনূসকে নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। তার ভাষায় এটা ব্যঙ্গ করেই বলা হয়েছে। কিন্তু কথা হলো এই, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন কিছু বলেন, তখন তিনি তা দায়িত্ব নিয়েই বলেন। মির্জা ফখরুল সবখানেই নেতিবাচক মানসিকতা পোষণের মনোভাব দেখাচ্ছিলেন কেন?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কে কখন কার মিত্র কিংবা শত্রু হয়, তা বলা কঠিন। তবে একটি কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার, দেশের মানুষকে কারা পরিচালিত করতে চাইছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কারা রাষ্ট্রটির মৌলিক আদর্শ বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছেন। এসব বিষয় বিবেচনায় না রাখলে একটি জাতি সামনে এগোতে পারবে না। মনে রাখতে হবে, ঘাপটি মেরে বসে থাকা শক্তি কিন্তু এখনো বসে নেই। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-গুপ্তহত্যা এগুলো কিন্তু সেই অশান্তিরই একটি অংশ। তাই সরকারকে চোখ-কান খোলা রেখেই সব হিসাব-নিকাশ করতে হবে।

___________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। শনিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

শব্দনীড়কে আদর্শ সাহিত্যব্লগ করতে আমার কিছু পরামর্শ

আমি একসময় ব্লগে নিয়মিত ছিলাম। কিন্তু চাকরিগত ও বিভিন্ন কারণে ২ বছর যাবত সমস্ত ব্লগ থেকেই নির্বাসিত আছি। মূলত ব্লগগুলো গতানুগতিকতার ধারায় আমি খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। একঘেয়েমীও লাগছিল। তাই ফেসবুকের একটি ব্যতিক্রমী একটি ‘রঙধনু সাহিত্যগ্রুপ’ [www.facebook/groups/littlemagazinechharpotro] খুলে সাহিত্যের নবদিগন্ত চালুর চেষ্টা করে সফল হয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই আমার আজকের কিছু প্রস্তাব যেমন দিলাম তেমনই এখন আবার শব্দনীড়কে দিয়েই ব্লগে আগমন ঘটেছে আমার। আমার গ্রুপে ঢুকে আরো বহু সৃজনশীল ইভেন্ট দেখার অনুরোধ করছি। এই গ্রুপ এখন ফেসবুকের সবচে সক্রিয় ও সেরাগ্রুপে পরিনত হয়েছে, এডমিন ২১জন। জানিনে এই ব্লগে এডমিন/মডারেটর কতজন। তবে ইভেন্টের সংখ্যানুযায়ী মোডারেটর নিযুক্ত করে তাদের আলাদা আলাদা দায়িত্ব দিলেই বেশি উপকার পাওয়া যাবে। দায়িত্বে কেন্দ্রীয়করণের বদলে বিকেন্দ্রীয়করণেই ফায়দা বেশি পাওয়া যায়। অবৈতনিকভাবে অনেক সাহিত্যিকই ে দায়িত্বপালনে এগিয়ে আসবেন চাইলে।

ব্লগসম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে যে, একটা ব্লগ খুলে শুধু পোস্টিং অপশন চালু করলেই তা জনপ্রিয়তা পায় না। এজন্য দরকার গতানুগতিকতা পরিহার করে গঠনমুলক ও সৃজনশীল ধারার। শুধুই পোস্ট করা আর দু’চারজনের মন্তব্য থাকলেই ব্লক চলে না বা জনপ্রিয় হয় না। সবব্লগেই এই গড্ডালিকাপ্রবাহ চলমান, নতুনত্বের ধারধারে না কেউই। এজন্য যেমন ব্লগের সক্রিয় এডমিন-প্যানেল থাকতে হবে তেমনই নতুন নতুন প্রতিযোগিতামুলক বিষয় চালু করে লেখকদের মাতিয়ে রাখতে হবে। আমার বিশ্বাস আমার অভিজ্ঞতার আলোকে দেয়া নিচের পরামর্শসহ নতুন নতুন ইভেন্ট নিয়ে এগিয়ে এলে শব্দনীড় সবার সেরা হবেই।

শব্দনীড়কে আদর্শ সাহিত্যব্লগ করতে হলে আমার কিছু পরামর্শঃ

১। দেশের প্রতিষ্ঠিত লেখকসহ ব্লগের সাহিত্যিকদের লেখার মানানুযায়ী একটি ধারাবাহিক তালিকা তৈরি করে নির্ধারিত প্রশ্নের ভিত্তিতে একেকজনের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকার প্রচার করা হলে সাড়া পড়বে। এই তালিকা নির্ধারিত এডমিন/মডারেটর বাছাই ও আপডেট করবেন।

২। কবিতা, ছড়া, গল্প, রম্য, কল্পকাহিনী, প্রবন্ধভিত্তিক সাপ্তাহিক ও মাসিক সাহিত্যপ্রতিযোগিতা চালু করলে ব্লগের বিস্ময়কর উত্থান ঘটবে। বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা যেতে পারে। বিভাগভিত্তিক নির্দিষ্ট বিচারক-প্যানেল করে ব্লগের সাহিত্যিকদের এসব পরিচালনায় যুক্ত করা যেতে পারে।

৩। নিয়মিত সাপ্তাহিক সেরাদশ বা বিশজন মন্তব্য/সমালোচককে বাছাই করে নোটিশবোর্ডে ঝুলিয়ে দেয়া যায় বা স্টিকিপোস্ট করা যায়। এতে উৎসাহ বাড়বে লেখকদের।

৪। ব্লগের উদ্যোগে নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক সাপ্তাহিক আলোচনানুষ্ঠান পরিচালনা করা যায়। এতে আমন্ত্রিত একজন সাহিত্যিক মডারেটর/পরিচালক থাকতে পারে।

বাংলাবানান ও শব্দগঠন: ভুল শুধু ভুল

সাহিত্যে সাধু-চলিত ও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার:
অধুনালুপ্ত সংস্কৃতভাষার সন্তানই হচ্ছে বাংলাভাষা। সংস্কৃতশব্দকে বাদ দিলে বাংলাভাষা আর থাকে না। সাধারণত ক্রিয়াপদের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাভাষাকে আমরা সাধু ও চলিতরূপেই চিহ্নিত করি।

আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাভাষা মূলত তিনপ্রকার, যথা:
১. সাধুভাষা:
আমি তোমাদের বাংলাশিক্ষাদান করিব। এটি সাধুভাষার একটি উদাহরণ। ‘শিক্ষাদান’ আর ‘করিব’ হচ্ছে সাধুশব্দ। ‘করিব’ ক্রিয়াকে চলিতরূপে ‘করবো’ করা গেলেও শিক্ষাদানকে কি সম্পূর্ণ চলিতকরণ করা সম্ভব? ‘শিক্ষাদান করিব’কে বড়জোড়া ‘শিক্ষা দেবো’ করাই যায়। তাই সাধুশব্দ বলে পরিচিত ‘শিক্ষা’শব্দকে চলিতশব্দে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। সাধুভাষা হচ্ছে বাংলার মাথা। তাই বাংলাভাষায় সাধুশব্দের সংখ্যাধিক্যই বেশি। সাধুশব্দ ব্যতীত আমরা অস্তিত্বহীন। অথচ অনেকেই পদ্যে সাধুভাষাকে ব্যবহার করতে চায় না। কিন্তু তাকি সম্ভব? সাধুভাষামুক্ত পদ্যরচনা আদৌ সম্ভব নয়। তারা যে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলে, তাই বলবো আজ।

সাধুভাষার হাজারো শব্দ যেমন গদ্যে ব্যবহৃত হয় তেমনই পদ্যেও। গদ্য-পদ্যে আবার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও আমরা করি। তবে পদ্যে এখন সাধুশব্দের ক্রিয়ারূপ একেবারেই অচল ও পরিত্যাজ্য। অনেকে অতীতের রবীন্দ্র, নজরুলসহ বিখ্যাত কবিদের কাব্যে সাধু-চলিতের মিশ্রণ বা সাধুশব্দের প্রয়োগ দেখে আধুনিক পদ্যেও অবলীলায় তা ব্যবহার করতে চান। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ বাংলার দিকপাল কবিরা তা না করলেও তারা তা ভ্রূক্ষেপ করেন না। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, কে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন? কিন্তু এই বোকারা ভাষা বা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসসম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। ভাষা ও সাহিত্যও যে, আমাদের জীবনযাত্রার মতো আধুনিকায়নের পরশে নিয়ত পরিবর্তিত হয় এবং তা আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই, তা তারা সবক্ষেত্রে মানলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রেই শুধু বেঁকে বসেন! ভাষা ও পদ্যের ব্যাকরণগত শৃঙ্খল থাকলেও তাদের স্বাভাবিক বিবর্তন আইন করে যেমন ঠেকানো যায় না তেমনই তা না মানলেও আধুনিক হওয়া যায় না। ভাষা প্রবহমান নদীর স্রোতের মতোই নিয়ত পরিবর্তনশীল।

এর মানে এ নয় যে, আধুনিক পদ্যে বা গদ্যে মোরা, মোদের, হেরিনু, পশিল ইত্যাদি অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করা যাবে, যা আমরা ব্যবহারিক জীবনে ব্যবহারই করিনে! আপনি নিরেট সাধুভাষায়, গল্প, প্রবন্ধ, রম্যাদি লিখতেই পারেন, নাটক, গল্প, উপন্যাসের সংলাপছাড়া গানেও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করতেই পারেন, আপত্তি নেই। কিন্তু চলিতভাষার পদ্যে সাধু-চলিতের মিশ্রণ বা সাধুভাষা যেমন করিয়া, গড়িব, খাইয়াজাতীয় শব্দের প্রয়োগ আধুনিক যুগে হাস্যকর। বড়বড় আধুনিক কবিরাও তা করেন না, যুগের প্রয়োজনে। এক্ষেত্রে অতীত কবিদের উদাহরণ টানা বোকামো। নতুবা কালিদাস, বাল্মীকির ভাষায় লেখার যুক্তিও সামনে এসে দাঁড়াবেই!

২. চলিতভাষা:
আমি তোমাকে বাংলাশেখাবো। এই হচ্ছে ওপরের সাধুবাক্যটির একটি চলিতরূপ। তাই বলে সাধুভাষার ক্রিয়াপদ ‘শিক্ষা’ শব্দটা কি চলিতভাষায় বা পদ্যে ব্যবহার আমরা করি না নাকি করা যাবে না? এমন হাজারো সাধুভাষার শব্দ আছে, যার চলিতরূপ নেই। এসব শব্দ সাধু-চলিত উভয়রূপেই চালু আছে, যেমন-গমন, প্রস্থান, আগমন, যাতায়াত, অংশগ্রহণ ইত্যাদি। চলিতভাষার আবিষ্কার হয়েছে সাধুভাষার মতো ওজনদার, গাম্ভীর্যপূর্ণ দীর্ঘ-উচ্চারণকে সংক্ষিপ্ত করতেই, কথ্য ও লেখ্যরূপকে চটুল করতেই। তাই এখন আমরা গদ্য-পদ্য উভয়ক্ষেত্রেই চলিতভাষাকেই অগ্রাধিকার দেই। পদ্যলিখতেও এখন কেউই সাধুভাষার ক্রিয়াপদকে আর ব্যবহার করে না। এমনকি সাধু-চলিতের মিশ্রণকেও গুরুচণ্ডালীরূপেই দেখা হয়। পশ্চাৎপদ মনমানসিকতার লক্ষণ মনে করা হয়।

৩. আঞ্চলিক ভাষা:
বাংলাদেশের প্রায় জেলাতেই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব ভাষায় এমনকিছু ক্রিয়াপদ ও শব্দ আছে যা সাধু-চলিত উভয়ভাষাতেই চলে। এসব বহুলপ্রচলিত আঞ্চলিক শব্দও তাই পদ্যে ব্যবহার করতে বাধা নেই। যেমন, তোমার ‘বেবাক’ কথা শুনলাম, আর ‘তর’ সয় না, তোমার মতো মানুষ আজ’তক’ খুঁজে পেলাম না, রংপুরে ‘মঙ্গা’ দেখা দিয়েছে, ‘জাউ’ খেতে মন্দলাগে না ইত্যাদি। অনেকেই বলেন, পদ্যে আঞ্চলিক ভাষার শব্দ আনা যাবে না। তা কি ঠিক? আমরা চলিতভাাষায় কয়জনেই বা কথাবলি? ৯০ জনই আঞ্চলিকে আক্রান্ত আমরা, যা আমাদের মজ্জাগত। তাই সেই ভাষাই হচ্ছে আমাদের মূলমাতৃভাষা, এরপরই চলিত বা সাধুভাষার স্থান।রম্যজাতীয় পদ্য সাধু-চলিত বা আঞ্চলিক ভাষায় লিখতেই পারি আমরা। অধিকাংশ বাংলাভাষীর কাছে পরিচিত যেকোনো আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার পদ্যে বা গদ্যে করাই যায়। এটাই প্রমাণ করবে ভাষার প্রবহমানতা বা গতিশীলতা।

শব্দ মানেই ফুল, পদ্য মানেই শব্দফুলের মালাঃ
ভাষার শব্দভাণ্ডার যার যত সমৃদ্ধ তিনি ততই সমৃদ্ধলেখা লিখতে সক্ষম বিশেষত পদ্য। কারণ পদ্যে শব্দচয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক শব্দচয়নই পদ্যকে শ্রুতিমধুর ও সাবলীল করতে সক্ষম। শব্দকে আমরা ফুলের সাথেই তুলনা করতে পারি। বিভিন্ন রঙ ও গন্ধের ফুল যেমন আমাদের মনভরিয়ে দেয় তেমনই সেই ফুল চিরস্থায়ী হয় না। আমরা পছন্দের ফুল দিয়ে পছন্দের মালাগাথি। সবফুল যেমন সবার পছন্দ নয়, সবফুল দিয়ে যেমন মালাগাথা যায় না, মালাগাথি না আমরা, তেমনই মালার ফুল একসময় শুকিয়ে যায়। তখন আমরা আবার নতুনফুল খুঁজি এবং নতুন নতুনফুল দিয়ে সুন্দর সুন্দর মালাগাথি।

আমাদের শব্দভাণ্ডার বা অভিধানে তো হাজারো শব্দ থাকে। আমরা কি সবশব্দ জানি বা সবশব্দের ব্যবহার করি পদ্যে নাকি ব্যবহার করা সম্ভব? আমরা ফুলের মালাগাথার মতন পছন্দের শব্দই খুঁজে নিই এবং শব্দের মালাগেথে পদ্যরচনা করি। অভিধানের অনেক শব্দই দুর্বোধ্য, অপ্রচলিত; তাই বলে তারা তো বাতিলশব্দ নয়! তেমনই অতীতের অনেক শব্দ এখন অপ্রচলিত বা পরিত্যাজ্য। এই আমি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত যেসব শব্দ পদ্যে ব্যবহার করেছি, তার অনেকগুলোই এখন পরিবর্তিত রূপেই চালু হয়েছে। যেমন-পাখী, গাড়ী, বাড়ী, শাড়ী, মত, কোন, গরীব, সরকারী ইত্যাদি শব্দ দিয়ে আমার শতশত পদ্য ছাপা হয়েছে, যা এখন অচল। তাই আমাকেও বাংলা একাডেমির এসবের নতুনশব্দরূপকে মেনে নিয়েই নতুন করেই লিখতে হচ্ছে। এটাই ভাষার আধুনিকতা, প্রবহমানতা। এটা মানতেই হবে, যুগের স্রোতে তালমিলিয়ে চলতেই হবে আধু্নিক লেখকদের।তাই শব্দের রূপ যেমন পালটায় তেমনই ভাষায় নতুন নতুনশব্দের উদ্ভব হয়। আঞ্চলিক শব্দ বা বিদেশাগত শব্দ আমাদের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে থাকে। তাই বলে আমি বাংরেজি বা বাংলিশ কিংবা বিকল্পশব্দ থাকতেও কথায় কথায় ইংরেজিশব্দ মিশিয়ে কথাবলার ঘোরবিরোধী।