বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

ডাংগুলি খেলার দিন

2873 ছোট্র বন্ধুরা, আজ তোমাদের একটি গল্প শোনাবো। গল্পটি তোমাদের স্মৃতির পাহাড়ে বেড়াতে সাহায্য করবে। হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি সম্পর্কে তোমরা বিশেষভাবে জানতে পারবে। তাহলে চলো, গল্পটি শোনা যাক। অনেক অনেকদিন পর আমজাদ সাহেব পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। গ্রামে এসে ইউশা, ঐশী এবং আরশির আনন্দ আর ধরে না। উনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় থাকেন। একটি কারখানায় উচ্চ পদে মোটা বেতনে চাকুরি করেন। বলা যায়, একজন ছেলে, দুইমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসার। সমস্যা একটাই কারখানায় প্রচুর কাজের চাপ থাকে। মালিক পক্ষ ছুটি দেয় না। ছুটি দিতে চায় না। সেইজন্য আমজাদ সাহেবেরও আর গ্রামে যাওয়া হয়ে উঠে না। এবার অনেক বলে-কয়ে পাঁচ দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়েছেন।

আমজাদ সাহেবের গ্রামের বাড়ি অত্যন্ত মনোরম। চারপাশে সবুজে ঘেরা। সারি সারি সুপারি আর নারকেল গাছ। এদের ফাঁকে ফাঁকে আম, জাম, লিচু, কাঁঠালসহ অন্যান্য সকল ফলবান গাছ। এখন মধুমাস৷ প্রতিটি গাছেই থোকা থোকা ফল ঝুলছে। কোনটা পাকা, কোনটা আধাপাকা আর কোনটা কাঁচা। এইসব ফল খেতে গাছে গাছে পাখপাখালির মেলা। কিচিরমিচির আওয়াজ শুনতে কার না ভালো লাগে! এমনি মনোহর পরিবেশে আমজাদ সাহেব দুপুরের খাবার শেষে বাহির বাড়িতে মাদুর পেতে বসে আছেন। বাবার পাশেই বসে আছে আরশি, ঐশী, ইউশা। বিকেল সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আমজাদ সাহেব যখন বাপ-দাদাদের স্মৃতি রোমন্থন করা শুরু করেছেন, তখনই দল বেঁধে আসল পাড়ার সকল ছেলেমেয়ে। তাদের হাতে ক্রিকেট খেলার বল আর ব্যাট। নিমিষেই তারা দু’দলে ভাগ হয়ে খেলা শুরু করে দিল। ইউশাও তাদের সাথে খেলায় যোগ দিল। যারা খেলছে না, তাদের প্রায় সবার হাতে হাতে মোবাইল। কেউ গেমস খেলছে আর কেউ ফেসবুক, ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত আছে। তাদের যেন দুনিয়ার কোনো খেয়াল নাই। আমজাদ সাহেব আপন মনে প্রিয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ কী মনে করে সবাইকে কাছে ডাকলেন।

আমজাদ সাহেবকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ছোট হউক কিংবা বড় হউক এভাবে সবার সামনে বসে বসে কথা বলা সমীচীন হবে না। এই ভেবে তিনিও দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন, বাবুরা তোমরা কী কী খেলা খেলতে পছন্দ কর?

সবাই সমস্বরে জবাব দিল, আমরা বছরের বেশির ভাগ সময় ক্রিকেট খেলি। তবে বর্ষাকালে ফুটবল আর শীতকালে ব্যাডবিন্টন খেলি।

আমজাদ সাহেব ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, আমরা তোমাদের বয়সে কি খেলতাম, তা কি তোমরা জান?
সবাই মাথা নেড়ে জবাব দিল, জী না।
আমজাদ সাহেব আবার বললেন, আমরা ডাংগুলি, বউচি, কানামাছি, ডাকসই, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, হা ডু ডু এসব খেলতাম।

আমজাদ সাহেবের কথা শোনে ছেলেমেয়েরা সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। ভাবখানা এমন যে, তারা কোনোদিন এসব খেলার নামই শোনেনি। বিষয়টি বুঝতে পেরে আরশি বলল, বাবা আমার মনে হয় ওরা এসব খেলে না।

আমজাদ সাহেব বললেন, বুঝতে পেরেছি মা আরশি। আর বাবুরা সবাই শোন, তোমরা ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেল… আমার তাতে আপত্তি নেই। তবে মনে রেখো এগুলো আমাদের দেশীয় খেলা নয়। এগুলো বিদেশি খেলা। আমি যে খেলাগুলোর নাম বললাম সেগুলো হল আমাদের দেশীয় খেলা। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। তোমরা যদি আমাদের নিজ দেশের খেলাগুলো না খেল, তাহলে তো সেগুলো হারিয়ে যাবে। কিন্তু সেসব খেলা কে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমরা দেশ-কে যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি আমাদের দেশীয় খেলা। তোমরা কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?

সবাই মাথা নেড়ে সায় জানালো। কেবল সাজিদ নামের একজন ছেলে বলল, আমরা এসব খেলতে জানি না।

আমজাদ সাহেব মুচকি হেসে বললেন, এ বিষয়ে তোমরা কোনো চিন্তা করো না। আমি যে কয়দিন বাড়িতে আছি, প্রতিদিন বিকেল বেলা আমি তোমাদেরকে সেসব খেলা শেখাবো। শুধু তাই নয়; আমি তোমাদের সাথে খেলবোও৷ তবে আরও একটি কথা এখন থেকে তোমরা কেউ মোবাইলে গেম খেলতে পারবে না। কি সবাই রাজি তো?

আমজাদ সাহেবের কথা শোনে সবাই খুব খুশি হল। করতালির মাধ্যমে সবাই উল্লাস প্রকাশ করলো।

পোকা

10 বাবার যা ভুলো মন- তাই বলে এমনটা হবে ভাবেনি মিতুল। নতুন ক্লাসের নতুন নোট বই প্রয়োজন, বাবা বলেছেন আনবেন, ও অপেক্ষায় ছিল। বাবা নোট বইয়ের বদলে একমুঠো উইপোকা কিনে আনলেন, যত্ম করে স্কুলের ব্যাগে ভরে দিলেন।

মিতুল মা’র কাছে শুনেছে বহুদিন আগে বাবা একটা সমুদ্র কিনেছিলেন। সমুদ্রে তখন প্রবল জলোচ্ছাস, প্রতি মুহুর্তে ঢেউয়ের উচ্চতা বাড়ছে, আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তিনি প্রতিদিন গভীর আগ্রহ নিয়ে সর্বস্বের বিনিময়ে শেয়ার বাজার হতে কেনা সমুদ্রের ঢেউ গুনতেন, উচ্চতা মাপতেন আর ভাবতেন- ঢেউ আকাশ স্পর্শ করলেই সমুদ্রটা বিক্রি করে কিছু জমি কিনবেন।

বিপদের দিনে চাখবেন বলে মা টিনের কৌটায় আশা ভরসার সিরকা মেখে ভাংতি পয়সা ও খুচরো টাকা জমাতেন। সব আশাভরসা খরচ করে মা বাবাকে আরও ক’টা ঢেউ কিনে দিলেন আর স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন- খুব তাড়াতাড়ি একটা চৌকো জমি কেনা হবে। জমির পেছন দিকটায় থাকবে পাকা বাড়ি, সামনে খোলা উঠোন, ওই উঠোনে মিতুল খেলবে। উঠোনের একপাশে বাঁশের মাচায় তরতরিয়ে উঠবে পুঁই আর লাউশাক, কখনও কখনও বড় সিম বা কাকরোল। ছাদের টবে ফুটবে গোলাপ, রাতে ঘ্রাণ ছড়াবে হাস্নুহেনা।

এক সকালে হঠাৎ করেই ক’টা তিমি, হাঙর আর ডলফিন সমুদ্রের সব ঢেউ পান করে গাঙচিল হয়ে উড়ে গেল। সমুদ্র বিক্রয় দপ্তরের ঠিকানাটা রইলো, কিন্তু সমুদ্রের কঙ্কালটাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এরপর থেকেই বাবা যেন কেমন হয়ে গেছেন, এই তো সেদিন এক সপ্তাহ চলার মত চাল কিনতে গিয়ে দুই মাসের ক্ষুধা কিনে ফিরলেন।

সবাই নতুন বই নিয়ে স্কুল যায়, নতুন ব্যাগ, নতুন জুতো, নতুন ড্রেস। শুধু মিতুলের পুরানো ব্যাগ, পুরানো জুতো, পুরানো ড্রেস। পুরানো ব্যাগ ভর্তি উইপোকা। একদিন ক্লাশে হাকিম স্যার মিতুলের কাছে নোটবই চাইতেই ও ক’টা উইপোকা স্যারের হাতে তুলে দিলো। স্যার পোকাগুলো ফেরত দিয়ে হতাশ সুরে বললেন, তিন মাসের বেতন বাকী আর তোর বাবা উইপোকা কিনে টাকা ওড়ায়!

মিতুল ঘরে ফিরে মা’কে প্রশ্ন করে , ‘উইপোকার কি অনেক দাম, মা!’ মা আলু দিয়ে পানি ভুনা করছিলেন, হাঁড়িতে লবণ দিতে দিতে জানালেন, ‘আমাদের মত মানুষ ছাড়া আর সবকিছুরই অনেক দাম।’ মা’র উত্তর শুনে মিতুল অবাক হয় না, এ কথা ও বহুবার শুনেছে, স্বগতোক্তি করে, ‘বাবা অনেক দাম দিয়ে কেনো যে উইপোকা কিনলেন!’ মা হাঁড়ির ঢাকনা খুলতেই একরাশ ধোয়া বেরিয়ে এলো, হাড়িভর্তি ফুটন্ত পানিতে আলুর ক’টা টুকরো লাফাচ্ছে, মা ওই দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘তোর বাবা উইপোকাও চিনে না, তুই ব্যাগে ঘুনপোকা নিয়ে ঘুরছিস, বাবু।’

ম্যালামাইনের হলদে হয়ে আসা পুরানো প্লেটে দু’মুঠো বাসি ভাতের ওপর এক চিমটি লবণ আর এক কাপ পানি ভুনা ঢেলে মিতুলকে খেতে দিলেন, দীর্ঘশ্বাসের শীতলতা ছুড়ে চুলোর আগুন নিভিয়ে বললেন, ‘ওদের দাঁত বড় হয়ে চোয়াল ফুঁড়ে বেরুবে, এর আগেই ওদের ছেড়ে দিস, বাবু।’
‘দাঁত বড় হতে হতে চোয়াল ফুঁড়ে বেরুবে!’ ভাবতেই মিতুলের গায়ে কাঁটা দেয়। মা বলেছেন ওদের কিছু না কিছু কাটতে হয়, না কাটলে দাঁত বড় হয়, হতেই থাকে- চোয়াল ফুঁড়ে বেরোয়, মগজ ফুরে বেরোয়, তারপর মরে যায়।

উই হোক বা ঘুন, পোকাগুলোকে মুক্তি দিতে হবে। পরদিন ক্লাশে সবাই বই খুলে বসে, মিতুল বসে ব্যাগের জিপার খুলে। জিপার খোলা পেয়ে প্রথমে তিনটা পোকা বেরিয়ে আসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর একটা একটা করে পোকা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে, স্বাধীন আশ্রয়ের সন্ধানে পিলপিল পায়ে হেঁটে যায় এদিকে ওদিকে সেদিকে। ক’টা পোকা ফের ব্যাগে ঢুকে যায়- ওদের গন্তব্য পৃথক।

মিতুল জানে না কী ভীষণ কাণ্ড ঘটে গেছে। পোকাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো স্কুলে। মা পোকাদের প্রসবিত ডিম ফুটে বেরিয়েছে শিশুপোকা। দাঁতের যন্ত্রণায় বড় পোকাগুলো সারাটা দিন কুটকুটকুটকুট করে ক্লাশরুমের দরজা, জানালা আর বেঞ্চ কাটে। ছোট পোকাগুলো মনের আনন্দে কাটাকুটিতে মন দেয়, ওদের দাঁতেখড়ি হয় লাইব্রেরির বই কেটে। ওদেরও দাঁত বড় হয়, ধারালো হয়, ওরা স্কুলের দেয়াল কাটে, ছাদ কাটে, অচল নিয়ম ও দোদুল্যমান আদর্শ কাটে। দিনের কোলাহলে পোকার দন্তচর্চার শব্দ পাওয়া যায় না, রাতের নিরবতায় শোনা যায় কুটকুটকুটকুট… কুটকুটকুটকুট… কুটকুটকুটকুট… যেনো মেশিন চলছে।

ক’মাস পরের কথা, পোকার অক্লান্ত দাঁতের চাপে ঝুরো ঝুরো হয়ে ধুলায় মিশেছে পাঠ্যবই, খসে পড়েছে স্কুলের জানালা, গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ভেঙে গেছে দরজা, ধ্বসে পড়েছে দেয়াল। স্কুলের শূন্য ভিটায় ঘুঘু চড়ার কথা, কি আশ্চর্য- ধ্বংসস্তুপের ফাঁকফোকর ভেদ করে জন্মেছে ঘাস, ফুটেছে নাম না জানা ফুল, উড়ছে এক ঝাঁক অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতি।

প্রেম কিংবা টাকা প্রতিভা

সুমনের একটাই ইচ্ছা সেতারা যেচে এসে তার হাত ধরবে। সেতারা নামটা সেকেলে হলেও মেয়েটা সেকেলে নয়। পুরো-দস্তুর মর্ডান। সেতারা না হয়ে সুহাসিনী নাম হলে মানাতো ভালো। নামের সাথে ব্যক্তিত্বের অমিল হলে বেখাপ্পা লাগে। সেতারা নামটাই সেকেলে কিন্তু মেয়েটি সত্যি সত্যিই তারা। আমাদের স্কুলের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। লেখাপড়ায় যেমন গান কবিতা গল্পে নৃত্যেও তারচেয়ে পারদর্শী কেউ নেই। সবচেয়ে মধুর হচ্ছে তার মুখের হাসি সুমন নিশ্চিত জগতে সেতারার মত সুন্দর হাসি কেউ হাসতে পারবে না। সেতারা না হয়ে নামটা সুহাসিনী হলে সোনায় সোহাগা হত।

সুমন নামটা সেকেলে নয় আবার আধুনিক নয়, নামটা মাঝামাঝি ধরনের। সুমন ছেলেটাও মাঝামাঝি। সুমন মেধাবী নয় তাকে অমেধাবীও বলা যাবে না। এ পর্যন্ত ক্লাসে দশের ভিতরেই থেকেছে। গান তার গলায় আসে না কিন্তু গানের কথাগুলো বেশ লিখতে পারে। পদ্য লেখায় কিছুটা মুন্সিয়ানা সুমনের আছে, সেটা অবশ্য সেতারা মাপের নয়। তবুও সেতারা সুমনের দিকে ঝুঁকেছে, সুমনের লেখা একটা গান গাইতে চেয়েছে। একটি অসাধারণ মেয়ে একটি সাধারণ ছেলে প্রতি দুর্বল হচ্ছে; গল্প, উপন্যাসে এটা হয় কিন্তু বাস্তব জীবনে যে এটা সম্ভব সেতারা সুমন এর উদাহরণ।

সুমন সেতারা যখন জুটি বাঁধতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ইমন নামের ছেলেটার বুকের ভিতর আগ্নেয়গিরি লাভা গলতে শুরু করেছে। ইমন কোন কাজের ছেলে না। লেখাপড়ায় টেনেটুনে পাস। অন্য কোনো প্রতিভা এখন পর্যন্ত কারো নজরে আসেনি। কিন্তু সব প্রতিভা যেখানে আত্মসমর্পণ করে সেখানে টাকার প্রতিভা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। ইমনের বাবার প্রচুর টাকা। টাকার জোরে ইমন সব প্রতিভা কিনে নিয়েছে। ইমন নামের আধুনিকতা অনাধুনিকতা এখানে বিবেচ্য নয় কারণ টাকা কারো নামের ধার ধারে না।

সেতারা কিংবা সুমন ইমনের বন্ধু; আদতে শিষ্য তার পিছু পিছু হাঁটে। তার অঙ্গুলিহেলনে বিনা দ্বিধায় সব কাজ করে দেয়। সেতারাকে নিয়ে ইমনের কোন চিন্তা ছিল না, সে ধরে নিয়েছিল সেতারা সে ইতোমধ্যে কিনে নিয়েছে। স্কুল পর্ব কলেজ পর্ব শেষে সেতারা তার বাড়িতেই যাবে। সেতারার পিছনে টাকা বিলাতে সে কখনও কার্পণ্য করেনি, বরং প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিলিয়েছে।

সেতারায় অন্য কেউ ভাগ বসাবে এটা ইমনের চিন্তাতে আসেনি। সেতারা সুমনের ঘনিষ্ঠতায় সে অবাক হয়। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা জুটি হয়ে যাবে এটা ইমন সহ্য করতে পারবে না।

সেতারা সুমনের গান গাওয়া পর্যন্ত হয়তো মানা যায় কিন্তু সেতারা যেচে সুমনের হাত ধরবে এই কথা শুনে এমন মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ইমন ভাবে সুমনের হাত ভেঙ্গে দিলে কেমন হয়; হাত নেই হাত ধরাধরির বালাই নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। টাকা প্রতিভায় ইমন সুমনের হাত ভেঙ্গে দিতে উদ্যত হয় এবং কিছু পরিমাণে সফল হয়।

হাত ভাঙ্গার সিদ্ধান্তের আগে ইমন সেতারার মুখোমুখি হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল
-সুমন চাচ্ছে তুমি তার হাত ধর, তোমার অভিমত কী?
-সুমন চাইলে আমি অবশ্যই তার হাত ধরব।
-আর আমি চাইলে?
-তোমার হাত ধরার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।

ইমন অপমানিত বোধ করে সামান্য একটা মেয়ে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ভেবে জ্বলে ওঠে। উপযুক্ত শিক্ষা দিতে সিদ্ধান্ত নেয়।

ইমনের টাকা সুমনের হাত পুরোপুরি ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়নি, তবে মুচড়ে দিয়েছে। সুমন হাসপাতালে; সেতারা গেছে দেখতে। ইমন ভাবল সেও একবার বন্ধুকে দেখে আসবে। হাসপাতালে পৌঁছে ইমন দেখল সুমনের বেডের পাশে সেতারা বসে আছে; তার দুই হাত দিয়ে সুমনের মুচড়ে যাওয়া হাত শক্ত করে ধরে আছে। এ দৃশ্য দেখে তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে গেল। একটা বিষয় তার উপলব্ধি হল, টাকা প্রতিভা সবসময় সফল হয় না; বিশেষ করে হৃদয় ঘটিত ব্যাপারস্যাপারে।

গোধূলি বেলায় তোমার চেহারা

GS4B

এখানে দুঃখিত হওয়ার কিছুই নেই মিতালি। তুমি আমার মা-বাবার প্রতি রাগান্বিত থাকা স্বাভাবিক। তা ঠিক এক সময় প্রচণ্ড রাগ ছিলো উনাদের উপর, কারণ অনেক কটু কথা আমাকে বলেছে। এখন উনারা মৃত, আর মৃত ব্যক্তির উপর রাগ করে থাকা উচিত নয়। এখন সব সময় উনাদের আত্মার পরম শান্তি কামনা করি। তাছাড়া তুমিই যেহেতু আমার খবর নাওনি সেখানে উনারা বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। যদি পারো মা-বাবার সাথে সাথে আমাকেও ক্ষমা করে দিও, সবাইকে হারিয়ে আমি একটা জীবিত লাশ। শুধু দেহ নামক মেশিনটা বয়ে বেড়াই দেশ বিদেশ।

হাঃ হাঃ হাঃ।
এখানে হাসির কী হলো মিতালি।
তুমি এখন স্পেনবাসী। বাড়ি, গাড়ি, টাকা ও নারী ফুঁ দিলে পেয়ে যাবে।
আগে এক জনের ভালোবাসার মোহ ছিলো এখন কোনো কিছুর প্রতি মোহ নাই আর আমি বহুগামী নই।
তাহলে,কেনো তুমি আমাকে——-রোহিত।
স্পেন যেতে পথে পথে কাটে বহুদিন বহু বিপদে। রোজগার করার উপযুক্ত হতে হতে তুমিও হারিয়ে যাও চিরতরে, তখন নিজেকেও হারিয়ে ফেলি।

নিজেকে হারিয়ে ফেলি কাজের ভিতর। রোজগার করতে গিয়ে কোনো পিছুটান ছিলো না একমাত্র শুধূ ছিলো হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ার ঝনঝন শব্দ। যে শব্দ আমাকে আকুল করতো , কখনো কখনো করতো কান্নায় মাতাল।
কখনো খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করো নাই কেনো ?
খোঁজ নিতে বহুবার চেষ্টা করেছি মিতালি ।
তবে, আমার পরিবারের বারণ ছিলো প্রচণ্ড রকম। রাগ করে চিঠি দেওয়া বন্ধ রাখতাম। কিন্তু আমি যে তাদেরই সন্তান মা বাপকে ফেলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমার মা লিখতো মিতালি একজন বিবাহিত নারী যোগাযোগ করলে তার সমস্যা হবে। আস্তে আস্তে মায়ের যুক্তিসংগত কথায় আমার মন বুঝ মানে। টাকা উপার্জনে মনোযোগী হয়ে প্রচুর টাকার মালিক হই কিন্তু অমনোযোগী হই নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। সময় এবং সুযোগ যেহেতু আমাকে যাযাবর করেছে এইভাবে কেটে যাবে বাকি জীবন।

যাযাবর ভাবছো কেনো নিজেকে। সারা পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় এখন। এক সেকেন্ডে পৃথিবীর এক পান্থ হতে অন্য পান্থের খবর মানুষ নিমিষে পেয়ে যাচ্ছে। এক সেকেন্ডে বিশ্বের যে কোনো পান্থ হতে প্রবাসীদের টাকা এসে যায়।
হাঃ হাঃ হাঃ। তা ঠিক মিতালি। কিন্তু প্রবাসীদের লাশ নিমিষে আসে না। বহু দেনদরবার করে টাকা পয়সা খরচ করে তারপর লাশ আনতে হয়। এই জন্য অনেকের লাশ বিদেশেই পড়ে থাকে। হয়তো আমার লাশও পড়ে থাকবে বিদেশে।

মানুষের ব্যক্তিত্ব হলো একটি দোকান। মুখ হচ্ছে তালা। তালা খুললেই বুঝা যায় এটা কী হিরার দোকান নাকি কয়লার দোকান। সোজা কথা হল, কথা বলা একটি আর্ট বা শিল্প, এর শক্তি বিস্ময়কর। সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে সঠিক শব্দ প্রয়োগ করে সুন্দরভাবে গুছিয়ে বললে যে কাউকে বশ করা যায়। চুপ করে থাকলে, উল্টো দোষী হতে হয় , অনেক সময় ভুল বুঝে মানুষ। জীবন জীবিকাও ঠিক তাই সুন্দর করে সাজাতে হয়, না হয় এলোমেলো হয়ে যায় সব। আর এইটা অনেক সময় টাকা থাকলেও কিছু লোক করতে পারে না তাদের ভিতর হয়তো আমিও একজন। আর তুমি সঠিক সময় সঠিক কাজ করে এবং স্বামীর সাথে সঠিক আচরন করে জীবন সুন্দর করেছো। জয় হয়েছে তোমার।

ফয়জুল মহী।

(শেষ)

বৃক্ষছক

Screenshot

মা বুনেছিলেন লাউ গাছ। এক ছুটির দিনে বাবা বেঁধে দিলেন মাচা। মায়ের যত্নে গাছটা তরতরিয়ে বেড়ে উঠল। মাচার ওপরটা ভরে গেলো খসখসে সবুজ পাতায়। একদিন দেখা গেলো মাচার নিচে ঝুলছে নধর নধর লাউ।

মায়ের যত্ন আর থামেনা। গোড়ায় পানি দেন। সার দেন। মাটি নিড়ান। পাতায় পাতায় হাত বুলান। আদর যত্নে আহ্লাদী লাউগুলো বেড়ে ওঠে দ্রুত। মা লাউ দিয়ে শোল মাছ রান্না করেন। আমরা খাই। লাউ-ইলিশ রান্না করেন। আমরা খাই। লাউ চিংড়ি রান্না করেন, আমরা খাই। খুব ঘনঘন আমাদের ঘরে মাছ বা মাংস থাকে না, সেসব দিনগুলোতে মা লাউ দিয়ে ডাল রান্না করেন। আমরা খাই। আমাদের শরীর থেকে লাউয়ের ঘ্রাণ বের হয়। মাচায় লাউ হয়ে ঝুলছি, মা কাটতে আসছেন- মাঝে মাঝে এমন স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি। সারারাত জেগে থাকি।

বাবার কাছে টাকা না থাকলে মা বিষন্ন মনে লাউ কেটে দেন। বাবা খুব সঙ্কোচে মায়ের গোপন দীর্ঘশ্বাস লাউ বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যান। যেতে যেতে সস্তা শার্টের রংচটা হাতায় চোখ মুছেন। মা আঁচলে মুখ ঢাকেন, কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে থাকেন। বুকের ব্যথাটা যন্ত্রণা দিলে লাউ গাছের পাশে পিড়ি পেতে বসেন। বড় আপা মা’র মাথায় তেল দিয়ে দেয়, আমি পা টিপে দেই। ব্যাথা চেপে মা হাসেন। মলিন হাসি। মন খারাপ হয়।

বাবার সঙ্কোচ বাড়তে থাকে। মা গাছ লাগিয়ে যান। মা’র যত্নে তিনটে পেঁপে গাছ বেড়ে উঠেছে। পুইশাকে ভরে গেছে আরেকটা মাঁচা। কাকরোল গাছে অনেক কাকরোল ধরেছে। মা যে কি খুশি! এক একদিন লাউ বাদ দিয়ে মা পেঁপে রান্না করেন। এক একদিন পেঁপে বাদ দিয়ে পুঁইশাকের চচ্চরি করেন। এক একদিক সব বাদ দিয়ে কাকরোল ভাজেন। আমরা খাই। একদিন খাচ্ছি, এমন সময় রান্নার পাট চুকিয়ে, গাছের মায়া ছাড়িয়ে মা চলে গেলেন। মা খুব বেশী দূরে যান নাই। খুব কাছাকাছি আছেন। বাড়ির পেছনের পরিত্যক্ত জমিতে আমড়া গাছের নিচে তাকে রোপন করে দিলো সবাই।

আমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে আমড়া গাছের নিচে যাই, উঁচু হয়ে থাকা মাটিতে সকাল বিকাল পানি দেই। হাত বুলাই। ওপরের মাটি নেড়ে চেড়ে দেই। ঝরে পড়া পাতা পরিস্কার করি। রোজ ভোরে গিয়ে দেখি- মা গাছের বীজ ফুটে পাতা বের হয়েছে কি না।

এলিয়েনের সঙ্গে এক বিকাল

28868

এখন পড়ন্ত বিকাল। ছাদের বাগানে একা একা বসে আছে আকিব। সে পুরাতন ঢাকার একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসাবে তার সুখ্যাতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, আকিবের আই কিউ অনেক বেশি। ক্লাসে টিচার যখন পড়ান, তখন সে একটি শব্দ শোনার পর পরের শব্দটি বলে দিতে পারে। একটি বাক্য শোনার পর পরের বাক্যটি বলে দিতে পারে। এজন্য ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রী এবং টিচার সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। খুব পছন্দ করে। তাকে নিয়ে গৌরব বোধ করে।

সেই আকিবের কাছে আজকের বিকালটা খুবই নীরস নীরস মনে হচ্ছে। প্রাণহীন লাগছে। বাসার আশেপাশে কোনো খেলার মাঠ নেই। একটু জোরে নিশ্বাস ফেলার মতোন জায়গা নাই। এমনকি রাস্তার ফুটপাত.. তাও নাই। রাস্তার মধ্যে কেবল খানাখন্দ আছে। গাদাগাদি রিকশা, ভ্যান, অটো আছে। ফলে আকিবের মতোন অনেক কোমলমতি শিশুদের আজকাল একই অবস্থা। তার উপর আকিবের স্কুলেও মাঠ নেই। ক্যাম্পাস নেই। বিল্ডিং এর উপর বিল্ডিং। এইরকম পরিবেশ তার ভালো লাগে না। ভালো লাগার কথাও নয়। সে প্রজাপতির মতোন উড়তে চায়। মেঘের মতোন এদিক-সেদিক ঘুরতে চায়। রাজহাঁসের মতোন সাঁতার কাটতে চায়। কিন্তু কিছুই আর হয়ে উঠে না। যে বিকেলগুলো রঙিন হওয়ার কথাছিল, সেই বিকেলগুলো ছাদের বাগানে কাটছে। কাটাতে হচ্ছে।

এমনি মানসিক অবস্থায় আকিব কী মনে করে আকাশের দিকে তাকাল। সাথে সাথে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তার ঠিক মাথার উপরে একটি উড়ন্ত সসার। দ্রুতবেগে তার দিকেই নেমে আসছে। আকিবের শরীরের সমস্ত লোম এক মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে গেল। তার ভাবনার চেয়ে কম সময়ে উড়ন্ত সসারটি একেবারে তার ছাদের ঠিক উপরে চলে এলো। চোখের পলক পড়ার আগেই সসারটি থেকে একজন এলিয়েন বেরিয়ে আসলো। ভুতপ্রেতের মতোন এতো বিশাল আকারের নয়। আকিবের সমবয়সী হতে পারে। এলিয়েনটি সোজা আকিবের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আকিবও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ালো। করমর্দন করতে করতে এলিয়েনটি বলল, হাই… আকিব, আমি ইকুচু। নেপচুন থেকে এসেছি। তুমি কেমন আছ?
আকিব বলল, আমি খুব ভালো আছি।

ইকুচু বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তুমি মোটেই ভালো নেই। তোমার মন খুউব খারাপ। একা একা ছাদের বাগানে সময় কাটাতে তোমার ভালো লাগে না। আমি নেপচুন থেকে তোমার উপর দৃষ্টি রাখছিলাম। কারণ তুমি আমাদের গ্রহের বিজ্ঞানীদের পছন্দের তালিকায় আছো। তোমার আই কিউ অত্যন্ত বেশি। আচ্ছা আকিব, তোমাদের পৃথিবীতে কি মিথ্যা বলার ট্রেনিং সেন্টার আছে?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শোনে আকিব খুব বিস্মিত হল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে জানাল, নেই।

তাহলে তোমরা এতো সুন্দর করে ইনিয়েবিনিয়ে কীভাবে মিথ্যা বল? তোমরা কি জান না, মিথ্যা বলা মহাপাপ?

আকিব বলল, সব মানুষই এটা জানে। তবুও তারা মিথ্যা বলে। কারণ মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমিও এটা পছন্দ করি না। তবুও মাঝে মাঝে বলি। বলতে হয়।

ইকুচু বলল, মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি… এটিও একটি বড় মিথ্যা আকিব। যাক আসল কথা বলি, আমি একটি মিশনে এসেছি। তোমাকে আমাদের নেপচুন গ্রহে নিয়ে যাওয়ার মিশন। তুমি কি স্বেচ্ছায় যাবে নাকি জোর করে নিয়ে যেতে হবে?

আকিব এবার মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু মুখের মানচিত্রে ভয়-ডর কিছুই প্রকাশ করল না। বুদ্ধি খাটাতে লাগলো। হঠাৎ তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠল। আকিবকে কিছু নির্দেশনা দিলো। সে মোতাবেক আকিব বলল, তোমাদের গ্রহে তো মিথ্যার কোনো স্থান নেই। কিন্তু আমি এখনো মিথ্যা মুক্ত হতে পারিনি। তবে আমি চেষ্টা করছি। যদি আমি সে চেষ্টায় সফল হতে পারি, তাহলে আমার নেপচুন যেতে আপত্তি নেই।

এমন সময় ইকুচুর স্যুটের ভেতর ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হল। আকিবও সেই আওয়াজ শুনতে পেল, কিন্তু কিছুই বোঝে উঠতে পারল না। ইকুচু বলল, হাইকমান্ড নির্দেশ দিয়েছে, তুমি এবার সঠিক বলেছ। আমরা তোমার মিথ্যা মুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব। আমার হাতে আর সময় নেই। বাই আকিব…. বাই…

আকিবের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। তবুও ইকুচু’র দিকে হাত নেড়ে জানালো, বাই ইকুচু… বাই।।

স্মৃতি লিখে রাখি

269a

— কি সেলাই করেন!
শীতের রাত, প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে, জেলা সদরের নির্জন ফুটপাতে উদোম শরীরে বসা এক লোক, একপাশে মুচিদের ব্যবহার করার মত বাক্স, নিয়নের আলোয় স্যান্ডেল সদৃশ কিছু সেলাই করছিলেন। প্রশ্ন শুনে মাথা না তুলেই উত্তর দিলেন,
— নসীব।
এমন উত্তর আশা করিনি। বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলাম,
— কার নসিব!

এবার লোকটি মুখ তুলে তাকালেন। চেহারায় বয়সের ছাপ, পরিচর্যাহীন শাদা দাড়িগোঁফ, ভাঁজপূর্ণ ত্বক, কিন্তু নিয়নের আলোতেও তার চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। একটু হেসে বললেন,
— কার নসিব সেলাই করি? আপনা নাসিব.. বাবা, আপনা নাসিব..

খেয়াল করলাম, তার উচ্চারিত ‘নসিব’ হঠাৎ করেই ‘নাসিব’ হয়ে গেছে। এসব ছোটো ছোটো পরিবর্তন সবসময়ই কৌতূহলী করে তোলে। তাকে বললাম,
— আপনার পাশে বসে একটু নাসিব সেলানো দেখি?

তিনি মাথা নিচু রেখেই উত্তর দিলেন,
— আপনার ইচ্ছা। আমার নাসিব সেলানো দেইখা কার কি লাভ!

তার পাশে বসলাম৷ প্রায় দশ মিনিট একটা স্যান্ডেলের সোল তিনি সুতো ছাড়া সেলাই করে গেলেন। সেলাই শেষ করে বক্সের ভিতর সোলটা রেখে আরেকটা সোল বের করে সেলাই শুরু করলেন। স্বভাব দোষে প্রশ্ন করলাম,
— এটা কার নাসিব!
— এটা নাসিব না রে বাবা, এটা জিন্দেগী
— কার জিন্দেগী?
— আপনা জিন্দেগী।
পাঁচ মিনিট জিন্দেগী সেলাই করে বক্সে রাখতে বললাম,
— আসেন, শীতের রাতে গরম গরম ভাত খাই।
— তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

বড় হাসপাতাল, রেলস্টেশন, বাস আর লঞ্চ টারমিনাল সংলগ্ন কিছু হোটেল সারারাত খোলা থাকে। এমন এক হোটেলের উদ্দেশ্যে রিকশা নিলাম, তিনিও বসলেন। শীতে কাঁপছি, তিনি নির্বিকার। উনার খাওয়ার অর্ডার দিলাম, আমি ঘরে ফিরে খাবো। খাওয়া শেষে তাকে ভাড়া বাবদ কিছু টাকা সাধলাম, তিনি নিলেন না। ঠোঁটে শিশুর মত হাসি, বললেন,
— আলহামদুলিল্লাহ! টাকা দিয়া কি করবো! টাকা দিয়া নসিব আর জিন্দেগী সেলাই করা যায় না বাবা..

আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন, বয়সের তুলনায় দ্রুতই হাঁটছেন। অথবা যারা রাতে নির্জন পথে নিজের নসিব আর জিন্দেগী সেলাই করেন তারা হয়তো দ্রুতই হাঁটেন।

.
স্মৃতি লিখে রাখি| ২৫ডিসেম্বর (২৪ডিসেম্বর দিবাগত রাত)

জলে ভাসা পদ্ম আমি

246710

সামিয়া রেখার সেই স্কুল জীবন থেকে সব সুখ দু:খের অংশীদার। এবার সে বেশ অনেকদিন পর এসেছে।
ছুটির দিনের সকালটা নানা রকম রান্নায় ব্যস্ত থাকল রেখা। সামিয়া কাজে হাত লাগাল। দুপুর দুটোর মধ্যে টেবিল ভরে গেল নানান রং, সুগন্ধ আর স্বাদে। আজ মিনার মাহমুদ কোন এক সংবর্ধনায় গেছেন। বান্ধবীকে পেয়ে রেখা বাসায় থেকে গেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় আধশোয়া হয়ে পাশাপাশি বসে অলস আলাপে মন দিলো দুই বান্ধবী।

গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বান্ধবীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল সামিয়া। একটু দ্বিধা নিয়ে শেষে এক সময় বলল, ‘কয়েকদিন আগে এক মহিলা আমার কাছে এসেছিল একটা নতুন বাচ্চা নিয়ে। বাচ্চাটা ওর দরজায় কে যেন রেখে গেছে। ফুটফুটে মেয়েটা। একটু দুর্বল। চোখগুলি বড় বড়। অনেক পাপড়ি। ফর্সা। আমার কাছে আছে। সপ্তাহখানেক হল। আমার ছেলেরা ওকে পেয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।’

রেখার মুখটা সাদাটে হয়ে গেল। চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর আস্তে বলল, ‘মিনার যদি কষ্ট পায়?’

সামিয়া বান্ধবীকে একটু সময় দিল। তারপর সমস্যার ভিতরটা দেখাল বান্ধবীকে।

‘এভাবে থাকলে খারাপ লাগাটা সারাক্ষণ থেকে যাবে। উনার স্বাস্থ্য দেখলাম অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তোকেও দুর্বল দেখাচ্ছে। একবার ফেইস করে ফেল। নেহায়েত রিয়্যাক্ট করলে জোর করার কিছু নাই। আমার তো মেয়ে নাই। আমি রেখে দেব।’

সেই রাতটা রেখা ঘুমাতে পারল না। স্বামীকেও কিছু বলতে পারল না।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়ার আগে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল। জানালা দিয়ে আসা আলো ফ্লোরে পড়ে সারা ঘর আলো হয়ে আছে। মানুষটার ফর্সা মুখটা বাচ্চা ছেলের মুখের মত মায়াভরা। সে অপলক তাকিয়ে রইল।

নিষ্পাপ মুখটার চোখের নিচে কালি দেখে রেখার মনে আবেগ ভরা নদীর বান জাগাল। যে কোন অবস্থায় সে তার স্বামীর সাথে থাকতে চায়। তাকে সুখী দেখতে চায়। আর কাউকে সে তার মানুষের ভাগ দিতে পারবে না। কিছুতেই তাকে ফেলে যেতেও পারবে না। আর কারো সাথে জীবন কাটানোর চিন্তাও সে করতে পারে না।

এত বছরের সঙ্গী! পরম মমতায় দুই হাতে স্বামীর মুখটা বুকে নিয়ে বসে থাকে। সকালের আলোয় রেখার মুখ উজ্জ্বল। সে সিদ্ধান্ত নেয়, বাচ্চাটার কথা স্বামীকে বলবে। ঘুম ভেঙ্গে রেখার আদরটুকু লেখককে বিয়ের সেই প্রথম সময়টাতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়..।

নাশতার টেবিলে স্ত্রীর মুখে বাচ্চাটার কথা শুনে মিনার মাহমুদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সকালটা মনে পড়ল। ব্যথা আর শান্তি একসাথে অনুভব করলেন।

মন দিয়ে অনুভব করলেন স্ত্রীর মনে সন্তান না পাওয়ার গভীর বেদনা। আবিষ্কার করলেন, সন্তানের জন্য প্রকৃতি তার স্ত্রীর মনে যে অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়েছে তা অবলম্বন না পেয়ে লেখককেই আঁকড়ে লতিয়ে উঠেছে!

নতুন বাচ্চাটা এলে তার সেই আদর ভাগাভাগি হবে জেনেও তিনি সস্নেহে স্ত্রীর ইচ্ছায় সম্মতি দিলেন।
অলক্ষ্যে লতার মুখটা কি লেখকের মনে ভেসে উঠল? চিনচিনে একটা ব্যথা?

নাশতা শেষে লেখক ঘর থেকে বের হবার আগে স্ত্রীর মুখ ছুঁয়ে আদর করে হাসলেন, ‘নতুন মানুষ পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে নাতো?’

দোয়েলের মন

: তারপর?
: তারপর দোয়েল পাখিটা উড়তে উড়তে চলে গেছে নীলপরীর দেশে। গিয়ে দেখে নীলপরী রানীর কাপড়ে নীল দিচ্ছে আর ফুলের সুবাস মাখাচ্ছে।
: তারপর?
: এদিকে হয়েছে কি লালপরীতো নীলপরীকে দাওয়াত দিয়েছে। কিন্তু পোলাও মাংস কোপ্তা কাবাব সর্ষে ইলিশ রান্না করবে কিভাবে! সব জিনিসের যা দাম!
: তারপর?
: তখন সাদা প্রজাপতি বলল, ‘শুটকি মাছের ঝাল ভর্তা বানাও, আলুর দম রান্না কর, আম ডাল হলে বেশ হয়, সাথে কাচা মরিচ আর পেয়াজ কুচি তো আছেই। রোজ রোজ মধু খেতে একটুও ভালো লাগে না।’
: তারপর?

: এই না শুনে রাজা বললেন -খাবে তো খাও বেগুন ভাজা আর কাঁচকলা। বেগুন ভাজার কথা শুনে রাণীমা মন খারাপ করলেন। উনার আবার বেগুনে এলার্জি। খুব চুলকানি হয়। কাঁচকলা খেতে হবে বলে রাজপুত্র কান্না শুরু করে দিল। কান্নার ভ্যা ভ্যা শব্দে মন্ত্রীর মুখের লেবেঞ্চুস ধপাস করে মাটিতে পরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তাই না দেখে সেনাপতি খুকখুক করে হেসে দিলেন।
: তারপর?
: রাজা বললেন, ‘তাই’তো বলি মন্ত্রীর দাঁতে পোকা কেনো! সেনাপতি, তুমি এক্ষুণি মন্ত্রীর দাতের পোকাগুলোর মাথা কেটে ফেল।’
: তারপর?
: সেনাপতি বলল -মন্ত্রীর মুখে গন্ধ। সামনেই যাওয়া যায় না। লেবেঞ্চুস খেয়ে তিনি দাঁত মাজেন না। তাই শুনে রাজা বললেন, ‘তবে আগে নিজের নাক কাটো। তারপর মন্ত্রীর মুখের পোকার মাথা কাটতে হবেই হবে।’
: তারপর?
: দোয়েল বলল, ‘সবাই দেখি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। টোনা আর টুনি মজা করে পিঠা খাচ্ছে। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বিয়ে করবে বলে দৈত্য মারতে যাচ্ছে। রাজা আর তার লোকেরা কাটাকাটি করছে, রাজ্যের প্রজাদের লুটপুটে খাচ্ছে, অত্যাচার করছে। দুয়োরাণী বিউটি পারলারে ফেসিয়াল করছে, সুয়োরানী হার্বাল উপটান মাখছে। বাঘের গলায় হাড় ফুঁটলে বক তা বের করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার যে বেশী করে কিশমিশ দেয়া পায়েস খেতে খুব ইচ্ছে করছে সেটা নিয়ে কারো একটুও চিন্তা নেই। আমি কি তোমাদের কেউ নই! আমি কি তোমাদের কিছুই হই না!’
: তারপর?

: এদিকে ছাতা হারিয়ে ব্যাংয়ের মন ভালো নেই। বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি লেগেছে। দোয়েলের কথা শুনে সে বলল, ‘ তেপান্তরের মাঠ পেরুলে দুধের সাগর। সেই সাগর পেরুলে মাখনের পাহাড়। নরম নরম মাখনের পাহাড় পার হলে তবেই রূপকথার দেশ। সে রূপকথার দেশেই পোলাও পাওয়া যায়, কোর্মা কোপ্তা পাওয়া যায়, ইলিশ ভাজা আর রুই মাছ ভুনা পাওয়া যায়। পায়েস পাওয়া যায়। ব্যাংয়ের হারানো সিল্কের ছাতাও পাওয়া যায়, ব্যাংয়ের সর্দির ওষুধও পাওয়া যায়।’
: তারপর?
: দোয়েল বলল – আমি যাব রূপকথার দেশে। পায়েস খাবো। লালপরী নীলপরীর জন্য পোলাও কোর্মা আনবো, ব্যাংয়ের জন্য সিল্কের ছাতা আর সর্দির ওষুধও আনবো।
: তারপর?

: জলদস্যু বলে ‘তবে এই নাও রূপকথার দেশে যাবার মানচিত্র, কাঠের জাহাজ আর দূরবীন।’ দোয়েল পাখি মানচিত্র খুলে দূরবীনে চোখ লাগাতেই আম্মু ডাকতে শুরু করেন, বলেন ‘তাড়াতাড়ি উঠো। সেই কখন সকাল হয়েছে। কাজে যেতে হবে। উঠো.., উঠো..।’
: তারপর?
: তারপর দোয়েল পাখিটা সকাল সকাল কাজে যায়। হোটেল ঝাড়ু দেয়, বেঞ্চ আর টেবিলগুলো মুছে। জগে পানি ভরে। নাস্তা করতে আসা লোকগুলোর টেবিলে টেবিলে পরোটা আর সাথে ভাজি, হালুয়া বা ডিম ভাজা দেয়।
: তারপর?
: আম্মুর মত এই লোকগুলোও বুঝতে পারে না দোয়েলের মন প্রতিটা মুহূর্তে রূপকথার দেশে যাবার জন্য ভীষণ ছটফট করে। টেবিলে বিছানো প্লাস্টিকের কভারকে তার মনে হয় রূপকথার দেশে যাবার মানচিত্র, বেঞ্চকে জাহাজ আর গ্লাসগুলোকে দূরবীন।

মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ আমাদের_বন্ধু

গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু, বাপ, দাদার আদি পেশা জুতা সেলাই; অর্থাৎ তারা মুচি। তার বাবা কাকারা চৌমুহনার মোড়ে ঝুপড়ি ঘরে বসে জুতা সেলাই করে।

মুচির ছেলের সাথে বন্ধুত্ব তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না, এখনো সম্ভব নয়; তবুও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অবশ্য হওয়ার বিবিধ কারণ ছিল।

প্রধান কারণ হচ্ছে গৌরাঙ্গ ছিল দরাজ দিল, বন্ধুদের জন্য খরচ করতে কৃপণতা দেখাতো না। আমরা সপ্তাহে পাঁচ শিকা খরচ করতে পারতাম না, সে অনায়াসে পাঁচ সাত টাকা খরচ করে ফেলত। অন্য কারণের মধ্যে ছিল সে ভালো গান গাইতো, ভালো ছবি আঁকতো। পদ্য লেখায় তার বেশ মুন্সিয়ানা ছিল।

সে ছিল তার ঠাকুরদার আদরের নাতি। তাদের পরিবারের কেউ জীবনে স্কুলে যায়নি। জন্ম থেকেই তাদের জুতা পাঠ শেখানো হয়, অক্ষর পাঠ তাদের জন্য বিলাসিতা। গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা দেখলেন এই ছেলের জুতা পাঠে মন নেই, জুতা সেলাই করতে দিলে এই ছেলে সুঁই দিয়ে মাটিতে ছবি আঁকতে লেগে যায়। জুতা সেলাইয়ের চেয়ে গানে মনোযোগ বেশি, মুখে মুখে বেশ ভাল পদ্য বানাতে পারে।

ঠাকুরদা নাতির প্রতিভায় মুগ্ধ। ভাবলেন একে স্কুলে পড়াতে পারলে নিশ্চয় বংশের গৌরব হবে। চাই কি কালে কালে জজ ব্যারিস্টার হয়ে যেতে পারে। একদিন সন্ধ্যায় তিনি ঘোষণা করলেন নাতীকে তিনি স্কুলে পাঠাবেন; তাঁর এই অদ্ভুত ঘোষণায় গৌরাঙ্গের বাবা, কাকারা অবাক হল। স্কুল কেন আরেকটু বড় হলে তো পুরোদস্তুর রোজগারে লেগে যেতে পারবে। কিন্তু বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস তারা করল না।

স্কুলে ভর্তি হবে বললেই তো আর হলো না, মুচির ছেলে অন্ত্যজ জাত; অভিজাত যারা তারা নিশ্চয়ই চাইবে না মুচির ছেলে তাদের ছেলেদের সাথে পড়ুক। নাতিকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে গৌতমের ঠাকুরদা অনেক ঝামেলায় পড়লেন।

অনেক স্কুলে সিট নাই অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হল কিন্তু হাল ছাড়লেন না গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা, দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে এসময় জাতপাত, উঁচু-নিচু চিন্তা করে আর বিভাজন বাড়ানো যাবে না। গৌরাঙ্গকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। গৌরাঙ্গ তৃতীয় শ্রেণীতে আমাদের সহপাঠী হয়ে গেল। আমাদের কোনো কোনো অভিভাবক গাঁইগুঁই করেছিলেন বটে কিন্তু প্রধান শিক্ষকের প্রতাপের কাছে পরাস্থ হতে হল।

প্রধান শিক্ষক তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন ঠিক, আমরা করলাম না। জুতা সেলাই এর ছেলেকে বন্ধু ভাবতে কোথায় যেন দ্বিধা থেকে গেল। অথচ আমাদের কারোরই বয়স দশ হয়নি।

সমাজ বাস্তবতা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, বোধে এমনিতেই এসে যায়। জুতা সেলাই যে অতি নিম্নমানের কাজ, মুচিরা যে অতি নিম্ন জাত দশ বছর হওয়ার আগেই এসব জেনে গেছি।

গৌরাঙ্গের সাথে কেউ মিশে না, পাশে বসে না, সে একেবারে পেছনের বেঞ্চে একা বসে থাকে। কিছুদিন পরে দেখা গেল তার হাতে অফুরন্ত টাকা। আমরা চার আনার বাদাম কিনতে পারি না, সে দিব্যি এক টাকার বাদাম কিনে ফেলে। বাদামের লোভে আমরা তার পাশে ভিড়লাম, সে আমাদের নিরাশ করল না; ভাগ দিতে শুরু করল। ক্রমে সে আমাদের বন্ধু, আমাদের একজন হয়ে গেল।

গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা বেশ মালদার ছিলেন, তিন পুত্রের রোজগারে তাঁর দিন ভালই কাটছিল। আদরের নাতির পকেট খরচের জন্য প্রতি সপ্তাহে দশ টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে তাদের বাড়িতে চোলাই বাংলা মদের আসর বসতো। ঠাকুরদা, বাবা, কাকারা একসাথে বসে মদ্যপান করত, কখনো কখনো মা, কাকীরাও সঙ্গ দিতে হাজির থাকতো। মদের আসরে বাচ্চাদের হাজির হওয়ার কোন বিধি-নিষেধ না থাকলেও গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা তাকে কাছে ভিড়তে দিতেন না। মদ্যপান কিংবা বিড়ি-সিগারেট থেকে দশ হাত দূরে রাখতেন।

অচিরেই গৌরাঙ্গের অন্যান্য প্রতিভা আমাদের সামনে প্রকাশ হতে থাকল। গান, আঁকা, পদ্য লেখায় সে অনন্য ছিল। আন্তস্কুল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সে স্কুলের জন্য সুনাম কুড়াতে লাগল। আমরা তার বন্ধু থেকে ভক্ত, গুণমুগ্ধে পরিণত হলাম। নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সহজাত গুণ তার ছিল; একদিন লক্ষ করলাম সে আমাদের দলপতি হয়ে সামনে হাঁটছে, পিছন পিছন আমরা তাকে অনুসরণ করছি।

নবম শ্রেণী পর্যন্ত গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু ছিল, দলপতি ছিল কিন্তু এর পরে তার প্রতি আমাদের মোহ ভঙ্গ হল। সে যে অন্ত্যজ শ্রেণী প্রমাণ রাখল। তার ঠাকুরদা কিংবা বাবা-কাকারা আদতে যে মুচি কোন সন্দেহ থাকল না।
রিতা রায়ের বাবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। রীতা রায় সুন্দরী, স্মার্ট সে আমাদের প্রেমিকা। আমাদের প্রত্যেকের মনে রীতা রায় থাকে। এই রীতা রায় কে প্রেমের আহ্বান জানালো মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ। রীতা রায় অবাক হলো ঠিকই কিন্তু উত্তেজিত হলো না কিম্বা রাগ করল না, শুধু গৌরাঙ্গ কে ডেকে বলল ‘এ হবার নয়’।

রীতা রায় রাগ করেনি কিন্তু আমরা ক্রোধে ফেটে পড়লাম, মুচির ছেলের এত সাহস রীতা রায় কে প্রেমপত্র লিখে। রীতা রায় কে প্রেমপত্র লেখার অধিকার একমাত্র আমাদের। মুচির ছেলের স্পর্ধার একটা হেস্তনেস্ত অবশ্যই হতে হবে। নিমিষেই ভুলে গেলাম সে আমাদের বন্ধু, গত কয়েক বছরে হাজার টাকার বাদাম সে আমাদের খাইয়েছে। ভুলে গেলাম আমরা তাকে দলপতি মেনে অনেক অসম্ভব কে জয় করেছি।

ইতোমধ্যে দেশে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে, সবকিছু নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন নিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধা প্রধান শিক্ষক স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি অবসরে চলে গেছে। যে স্বপ্নবান পুরুষ স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে জাতিকে একটা দেশ উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে একদিন সূর্যোদয় হয়েছিল এখন স্থায়ী অমাবস্যা আসন গেড়েছে। আশা জাগানিয়া শুরু দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

আমাদের শহরের সবচেয়ে দুষ্টগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে যে পাকিস্তানের লেজুড় ছিল সে এখন স্কুলের দায়িত্বে। ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়েকে প্রেমপত্র লেখার দায়ে গৌরাঙ্গের বাবা-কাকারা জেলে। রাজাকার প্রধান শিক্ষক গৌরাঙ্গের ঠাকুরদাকে আসতে বলেছে। মুচির বাচ্চাদের পায়ের নিচে থেতলে দিতে হবে।

গৌরাঙ্গকে সাথে নিয়ে ঠাকুরদা এলে প্রধান শিক্ষকের কথায় রীতা রায় স্কুলের বারান্দায় থুতু ফেলেছে। গৌরাঙ্গ এবং তার ঠাকুরদা রীতা রায়ের থুতু চেটে খেয়েছে। মুচির বাচ্চার জন্য স্কুলের বারান্দা চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের গুস্সা প্রশমিত হওয়ায় বাবা চাচারা শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছে।

গৌরাঙ্গ তার বংশের জন্য সুনাম কুড়াতে পারেনি। সে এখন চৌমুহনার ঝুপড়ি ঘরে একমনে জুতা সেলাই করে। আমরা কখনও কখনও তার ঝুপড়ি ঘরে হাজির হই, জুতা পালিশ করতে সে কসুর করে না।

(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)

মামুনের অণুগল্পঃ নষ্ট কষ্ট

28456a

নিউমার্কেটের চারটি প্রবেশদ্বার। পূর্বপাশের পার্কিং এরিয়ায় বসা অবস্থায়ই বাইক স্ট্যান্ড করায় শিহাব। চাবি খুলে নিয়ে ঘাড় লক করে। নামে না, আকাশের দিকে তাকায় একপলক। গুমোট হয়ে আছে। ঘোমটার আড়ালে মেঘবালিকাদের ভ্রু কুঁচকে আছে, স্পষ্ট অনুভব করে।

স্মরণকালের ভয়াবহ তাপদাহ। ঝুলফির দু’পাশ দিয়ে ঘামের ধারা বয়ে চলেছে। বুক ভেসে যাচ্ছে। ভেজা অস্বস্তিকর অনুভব। উফফ! যদি একটু বৃষ্টি হতো।

আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত উঁচু করে ইশ্বরের কাছে অভিযোগ জানাতে উদ্যত হতেই, আচমকা ফ্রিজ হয়ে যায় সে।

হ্যা!
পারু!
পারুই তো!
একটি তুলতুলে বাবু পারুর হাত ধরে নিউ মার্কেটের গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে। এখনো দেখতে একই রকম আছে ও!

কোথায়ও কি কিছু পুড়ছে?
গন্ধ পায় শিহাব। মুহুর্তে আঠারো বসন্ত পিছনে গিয়ে, সেই পারু দৃষ্টিগোচর হয়। অনুভবে.. কল্লনায়!

শিহাবের হৃদয় একটু কি জ্বলে ওঠে? অদৃশ্য পর্দা ভেদ করে আবার সেই মেয়েটির উপস্থিতিতে একটু কি বেসামাল হয়?

ভাবনার অবসরে ওরা কেউ কাউকে দেখতে পায় না। ইজি বাইকে পারু মেয়েকে নিয়ে হারিয়ে যায়। মোড়ের ওপাশের তিন রাস্তার যে কোনো একটি দিয়ে ভিড়ের মাঝে গন্তব্য খুঁজে নেয় পারুকে বহন করা যান্ত্রিক বাহনটি।

আবারো হারালো পারু?

এমন ভাবনা আসায় সম্বিৎ ফিরতেই
ডান পায়ের জোরালো কিক স্টার্টারে। পারুকে অবচেতনে নিয়ে, গলির মোড়ের দিকে ধাবমান শিহাব। রাস্তা জুড়ে চলে যাওয়া পারুর শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করতে চেষ্টা করে সে। সেই আগের মতো- ঠিক যেভাবে পারুর হেঁটে চলা রাস্তা ধরে ধরে.. আরও পরে পারুর বুকের উপত্যকায় নিজেকে ডুবিয়ে ভালোবাসার ঘ্রাণ পাওয়ার জন্য যেভাবে .. ঠিক আঠারো বছর আগে যেভাবে.. আজও সেভাবেই!

মোড়ে এসে আবারো থেমে যায় শিহাব। কেন জানি হারানো মেয়েটির শরীরের সেই হারানো সুরে একটুও উদ্দীপ্ত হয়না। অনুভব করে, পুরো রাস্তা জুড়ে এখন কেবলি শিহাবের বউয়ের ঘ্রাণ! শিহাবের অনুভবের গভীরতর প্রদেশ এখন কেবলি বউময়।

শিহাবের শরীর জুড়েও এখন কেবল বউয়েরই ঘ্রাণ! বাইক ঘুরিয়ে ফিরে চলে সে। বউ অপেক্ষা করছে। হাসে নিজের মনে শিহাব।

হ্যা!
শিহাবের জীবন এখন কেবল বউময়!
থাকুক হারোনো মেয়েটি তার নিজের মতো যা সে চেয়েছিলো।

তারপরও.. শিহাবের কি একটু একটু কষ্ট হয়?

#মামুনের_অণুগল্প

কান্না সুখের যতিচিহ্ণ

Scre

দুই বান্ধবী। দুজনেই বড়লোকের বেটি। একজনের নাম ঝর্ণা, আরেকজনের নাম বর্ণা। নামের মিল থাকার কারণে হাইস্কুল থেকেই দু’জনের বন্ধুত্বের বন্ধন শুরু। দুজন একইসাথে হাইস্কুল শেষ করে একই কলেজে ভর্তি হয়। লেখাপড়ার জীবনে আনন্দের সময়ই নাকি কলেজ জীবন। এই সময়টা খুবই ভাবনা চিন্তার সময়ও বটে। কারণ এই সময়টাতেই যার যার ভাগ্য নির্ধারণ করতে হয়। কে কী হবে! কে কোনটা নিয়ে পড়বে! কে ডাক্তার হবে আর কে ইঞ্জিনিয়ার হবে, এসব নিয়েই থাকে বেশি চিন্তায়!
আবার ধনীর ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ ওইসব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ভাবে অন্যটা। যেমন– কাকে ভালোবাসবে। কাকে ভালোবাসলে জীবনে বেশি সুখশান্তি ভোগ করা যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো ঝর্ণা আর বর্ণা তারা দুজনেই ছিলো ধনীর দুলারি। কাজেই তাদের চিন্তা-ভাবনাও কোন ধরনের ছেলেকে বিয়ে করলে সারাজীবন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। দুই বান্ধবীর মধ্যে ঝর্ণা একটু অহংকারী, আর বর্ণা বড়লোকের মেয়ে হলেও ও ছিলো খুবই বিনয়ী ও শান্ত! এই দুই বান্ধবী প্রায় দিনই কলেজের ক্লাস শেষে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই আলাপচারিতায় মেতে ওঠে।

একদিন কলেজ চলাকালীন সময়ে দুপুরের টিফিনের সময় ঘনিয়ে এলো। টিফিনের সময় সবাই বের হয়ে যার যার মতো খাবার খেতে চলে গেলো। ঝর্ণা ও বর্ণা টিফিন করার এক ফাঁকে শুরু হয় তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনার আলাপ।
ঝর্ণা–কিরে লেখাপড়া শেষ করার পর তুই কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?
বর্ণা–তুই আগে বল, কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?
ঝর্ণা–আমি? আমি একজন হ্যান্ডসাম সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার অথবা বড় ব্যবসায়ী ছেলেকে বিয়ে করবো। যাতে সারাটা জীবন সুখে-শান্তিতে সংসার করে যেতে পারি। আমার সংসারে চাকরবাকর থাকবে। নিজস্ব বাড়ি থাকবে। গাড়িও থাকতে হবে। এবার বল তুই কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?’
বর্ণা–আমার বাড়ি-গাড়ির প্রতি লোভ লালসা নেই। শুধু একজন মনের মত মানুষ হলেই হবে।
ঝর্ণা–বলিস কি? টাকা-পয়সা ছাড়া শুধু মন দিয়ে কী করবি?
বর্ণা–আরে শোন, আমি যেই ছেলেকে বিয়ে করবো ওর মন আর আমার মন একসাথে বেঁধে মিলেমিশে সংসার করবো। টাকা-পয়সা যদি হয় হবে। নাহয় তো নেই। মনের মানুষ তো সবসময় কাছে থাকবে! তাতেই আমি খুশি থাকবো।
–আচ্ছা, যাদের টাকা-পয়সা প্রচুর আছে, তাদের কি মন নেই?
–অনেক আছে। আবার অনেকেরই থাকে না। তো যাদের মন থাকে না, তাদের থাকে ধনসম্পদ আর অর্থবিত্তের প্রতি খুবই নেশা। সেই নেশায় আসক্ত হয়ে তারা সময়তে নিজের স্ত্রী সন্তানকেও দূরে ফেলে দেয়। এমনকি নিজের জন্মদাতা পিতা গর্ভধারিণী মাকেও দূরে রাখে। আবার কেউ কেউ তো মা বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমেই রাখে। আমি বাবা এমনটা চাই না। আমি একটা গরিব মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে চাই। আর এরকম একটা ছেলে আমি নিজেই পছন্দ করে রেখেছি। সময় হলে তোকে বলবো।
–ওহ্ আচ্ছা, তা বল! কে তোর মনের মানুষটি? আমি কি তাকে চিনবো? বল না!
–হ্যাঁ, অবশ্যই চিনবি! ও-ই যে, সেদিন যে ছেলেটার সাথে আমি কথা বললাম, সেই ছেলেটা।
–আরে, ও-ই লোকটা তো নেহাৎ গরিব! কিছুদিন আগে ওর বেতন মওকুফ করার জন্য প্রিন্সিপালের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল। সেটা কি তুই জানিস?
–জানি! আরও জানি, ওর বেতন মওকুফের আবেদন পত্রটি মঞ্জুর হয়নি। তবে বেতন পরিশোধ ঠিকই হয়েছে।
–তা কীভাবে? আমি নিজেই দিয়েছি, ওর বকেয়া বেতনের টাকা। সেই টাকা দিয়েই ও বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছে।
–তুই কিন্তু ভুল করছিস! ভুল করছিস এই কারণে যে, তুই একজন বিত্তশালীর মেয়ে। তোর বাবার অঢেল সম্পত্তি। শহরে নিজেদের ব্যবসা। গাড়ি আছে। তোর বাবার ব্যাংক ভর্তি টাকাও আছে। ও-ই ছেলেটার কী আছে?
–ও-ই ছেলেটার একটা সুন্দর মন আছে। এমন সুন্দর মন আর দশজনেরও নেই।
–আচ্ছা, নিজেদের তো একটা বাড়িও থাকা চা-ই-ই। সেটা কি আছে?
–আছে। তবে ওদের বাড়িঘরে কোনও সময় যাওয়া হয়নি আমার। তো তাও না থাকুক, সমস্যা নেই। একসময় হয়তো হয়েও যেতে পারে। তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। কারণ আমিও শিক্ষিত। ছেলেটা গরিব হলেও শিক্ষিত। বিয়ের পর ভেবেচিন্তে একটাকিছু করা যাবে।
–নিজের ঘরদোর না থাকলে থাকবি কই?
–ছেলেটার মনটাই একটা বিশাল বাড়ি। আর সেই বাড়ির ঘরগুলো হলো ছেলেটার মনের ভেতরে থাকা মনিকোঠা। সেই কোঠাতেই দুজন খুব সুন্দরভাবে থাকতে পারবো। তাছাড়া আমার বাবার তো আছে। আমার বাবা কি আমাদের জন্য কিছুই করবে না।
–মনে কর যদি না-ই-বা করলো?
–তাতেও সমস্যা নেই। ও যদি একটা চাকরি করে, তাহলে আর সমস্যা কোথায়, বল? আর আমিতো শিক্ষিত। আমিও কি বসে থাকবো? দুজনের ভালোবাসা আর দুজনের দুই মন একসাথে বেঁধে নিজেদের ঘর বাঁধার কাজে গেলে যাবো। তার জন্য তুই আমার জন্য চিন্তা করবি না। আমি দোয়া করি তুই তোর স্বামীর সংসারে সবসময় সুখে থাকিস।
এই বলেই সেদিনের মতো দুই বান্ধবীর আলাপচারিতা শেষ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়।

একসময় ঝর্ণার বিয়ে হয় এক আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সাথে। ঝর্ণার বিয়ের দাওয়াত বর্ণা পেয়েছিল। বিয়ের দিন বর্ণা একটা উপহারের বাক্স হাতে নিয়ে ঝর্ণার বিয়ের দাওয়াতে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর বর্ণা ঝর্ণার সাথে দেখা করতে গেলে, ঝর্ণা হাসিমুখে বর্ণাকে কাছে ডাকে। বর্ণা ঝর্ণার কাছে গিয়ে এতোদিনের বন্ধুত্বের শেষ হাসি বিনিময় করে পাশে বসে।

ঝর্ণা বর্ণার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আমিতো এখানে বেশিদিন থাকছি না। বরের সাথেই আমেরিকা চলে যাবো। তোর সাথে তো আর শীঘ্রই যোগাযোগ হবে না। কিন্তু আমার মন, ভালোবাসা সবসময়ই তোর সাথে থাকবে। আর হ্যাঁ, যদি পারিস, তাহলে তোর ভবিষ্যৎ বিয়ের ভাবনাটা পরিবর্তন করে, ভালো ব্যবসায়ী অথবা ভালো একজন প্রবাসী ছেলের দিকে দৃষ্টি দিবি। গাঁও গেরামের ছেলে-পুলেরা তোর মতন মেয়ের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে না, তা আমি শতভাগ নিশ্চিত! তো আর কিছুই আমার বলার নেই, আমার কথাগুলো সময়মতো ভেবে দেখবি’।

ঝর্ণার কথাগুলো বর্ণা শুধু শুনেই গেল, প্রত্যুত্তর কিছুই দেয়নি। শুধু ঘাড় কাত করে হ্যা ভাব প্রকাশ করলো। এরপর ঝর্ণাদের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরে এলো।

এদিকে বর্ণা বিএ পাস করে বাপের ঘরে। আর বর্ণার সেই মনের মানিক ছেলেটিও একই সময়ে বিএ পাস করে, লেখাপড়ার ইতি টানে। বিএ ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ছেলেটা নিজেদের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। ছেলেটার গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা আছে, কিন্তু বসতভিটা ছাড়া আর কোনও জায়গাজমি বর্তমানে নেই। যা ছিলো, তা বাড়ির মুরুব্বি একমাত্র ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পরের জমিতে দিন মজুরের খেটে খায়। তবুও ছেলেটার বাবার মনে কোনও দুঃখ নেই, আছে শুধু আশা! আশা হলো, ছেলেটা যদি ভালো একটা চাকরিবাকরি পায়, তাহলে জীবনের কষ্ট স্বার্থক হবে। এই আশা নিয়েই একমাত্র ছেলের মুখপানে চেয়ে আছে।

ছেলেটা বাড়ি গিয়ে বাবার এতো কষ্ট দেখে আর ভালো লাগছিল না। দুই-তিনদিন বাড়িতে থেকে আবার সে তার আগের গন্তব্যে পৌঁছে। গন্তব্য ছিলো কলেজের পাশে থাকা এক বাড়ির ব্যাচেলর বাসা। একটা ব্যাচেলর বাসায় তিন-চারজন মিলে থাকতো। খাওয়া-দাওয়া হতো মেসে। শহরে এসে ছেলেটা একটা চাকরির জন্য এখানে সেখানে আবেদন করার পাশাপাশি কলেজ বান্ধবী বর্ণার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এভাবে ক’দিন যেতে-না-যেতেই ভালো একটা রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে ছেলেটা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরিটা ব্যাচেলর বাসায় আর মেসে খেয়ে ছেলেটা যখন মনোযোগ সহকারে করতে ছিলো, কলেজ পড়ুয়া বর্ণা নামের মেয়েটির আকুতি-মিনতি শুরু হয়।

বর্ণার আকুতি আর মিনতির কারণও ছিলো। কারণ হলো, বর্ণার বাবা। বর্ণার বাবা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। এই ঘটক, সেই ঘটক, এই পাত্র, সেই পাত্র করতে করতে একরকম মাথা নষ্টের পালা। যত পাত্রই দেখাক, বর্ণার প্রাত্র পছন্দ হয় না। বর্ণার মনের এরকম ভাব দেখে বর্ণার বাবা জিজ্ঞেস করে কোথাও কারো মন দিয়েছে কিনা! প্রত্যুত্তরে বর্ণা তার পছন্দের কথা জানালে, বর্ণার বাবা একরকম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাবার এরকম অবস্থা দেখেই বর্ণা ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

কিন্তু ছেলেটা একরকম নিরুপায়! নতুন চাকরি। বাড়িতে বাবার ঋণের টাকা। তার উপর আবার বাড়িতে ভালো ঘরদোর নেই। এমতাবস্থায় যদি ছেলেটা মা-বাবার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে ওঠে, তাহলে মা-বাবার মনে যদি কষ্ট পায়? ছেলেটা এরকম মনোভাব বর্ণাকে জানালে, বর্ণা বলে, ‘আমিই সবকিছু ম্যানেজ করে নিবো, তাতে কোনও সমস্যা হবে না। বর্ণার মুখে একথা শুনে ছেলেটা মা-বাবাকে না জানিয়ে একদিন কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলে।

কোর্ট ম্যারেজ করে বর্ণাকে নিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে চলে যায়। ছেলের সাথে এক যুবতী মেয়ে দেখে ছেলেটার মা-বাবা কাঁদতে শুরু করে। তখন ছেলেটার আগেই নতুন বধু বর্ণা নতুন শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এতে ছেলেটার মা-বাবার মনটা অনেক হালকা হয়ে যায়। তারপর তাদের চোখের জল মুছে নতুন বউকে সমাদরে ঘরে তুলে। ছেলেটা বর্ণাকে মা-বাবার কাছে সঁপে দিয়ে একদিন পরই আবার শহরের চলে যায়, নিজের নতুন চাকরি বাঁচানোর জন্য।

এর ক’দিন পরই বর্ণার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বুঝতে পারছে যে, নতুন বউ ভাঙাচোরা ঘরে ওঠার পর থেকে গরিবের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর যেন দিনে দিনে আলোকিত হচ্ছে। শত অভাবের মাঝেও যেন অভাব নেই! ঘরে কিছু না থাকলেও কোনও হাহাকার নেই! সবদিক যেন পরিপূর্ণ! এছাড়াও ছেলের বউয়ের আচার-ব্যবহারে শ্বশুর শ্বাশুড়ি দুইজনই মহাখুশি! এভাবেই বর্ণা খেয়ে-না-খেয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির খেদমত করে সংসার পরিচালনা করার ফাঁকে গ্রামের দু’একটা ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে। এতে যেই টাকা পায়, সব টাকাই বৃদ্ধ শ্বশুরের কাছে দিয়ে দেয়। বর্ণার স্বামীও শহর থেকে মাসে একবার বাড়িতে এসে চাকরি বেতনের অবশিষ্ট টাকা বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে বুঝিয়ে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে বর্ণার সংসার।

এদিকে বর্ণার বান্ধবী ঝর্ণা স্বামীর সাথে আমেরিকা গিয়ে সংসার শুরু করলেও, ঝর্ণার সেই সংসার বেশিদিন টিকেনি। বছর খানেক ঝগড়া-ঝাটির মধ্যে সংসার করে অবশেষে প্রবাসী স্বামীকে ছেড়ে দেশে ফিরে আসে। ঝর্ণা দেশে ফিরে এসেই সবার আগে বান্ধবী বর্ণার খবর জানতে বর্ণার বাবার বাড়িতে যায়। ঝর্ণা বর্ণার বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখে বর্ণার মা-বাবা দুজনই গুরুতর অসুস্থ! বর্ণা মা-বাবা একমাত্র মেয়ে। বর্ণা ছাড়া বর্ণার মা-বাবার আর কোনও সন্তান নেই, বর্ণাই একমাত্র সন্তান। কিন্তু বর্ণা নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করাতে তার বাবা বর্ণাকে তাদের অসুস্থতার কথা জানায়নি। না জানালেও বর্ণার মা-বাবা মনে মনে সবসময়ই বর্ণা বর্ণা কাঁদে। কিন্তু প্রকাশ করে না। ঝর্ণাকে দেখে বর্ণার মা-বাবা জানতে চায়, ‘আমাদের বর্ণা কেমন আছে’?

প্রত্যুত্তরে ঝর্ণা বলে, ‘আমিতো এই ক’দিন হয় আমেরিকা থেকে এসেছি, খালু। আমি আপনাদের বাড়ি এসেছি বর্ণার সাথে দেখা করতে। তো ও এখন কোথায়’?

বর্ণার বাবা বিষ্মিত চোখে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী আশ্চর্য! তুমি কি কিছুই জানো না? ও-তো ওর কলেজ বন্ধু ছেলেকে বিয়ে করে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। ওখানেই নাকি স্থায়ীভাবে থাকবে। তুমি কি ওদের গ্রামের বাড়ি চেনো? যদি চেনো, তাহলে গিয়ে বলো, আমাদের দেখে যেতে আর আমার স্থাবর অস্থাবর সবকিছু বুঝে নিতে। ও ছাড়াতো আমাদের আর কেউ নেই’।

বর্ণার মা-বাবার কথা শুনে ঝর্ণা বুঝতে পেরেছে যে, ‘বর্ণা হয়তো স্বামীর সংসারে খুব ভালো আছে। যার কারণে ও-ই গ্রামের ছেলেটার হাত ধরে চলে যাবার পর ও এখানে আর আসেনি। তা-ই যদি হয়, তাহলে বর্ণার ভবিষ্যৎ চিন্তাই কি ঠিক ছিলো’?

এসব ভেবেচিন্তে ঝর্ণা কলেজ পড়ুয়া আরও সহপাঠীদের কাছ থেকে ছেলেটার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে একদিন ছেলেটার গ্রামের বাড়ি রওনা দিলো। সংগ্রহ করা ঠিকানামতো ঝর্ণা ঠিকঠাক পৌঁছে গেলো, বর্ণাদের বাড়িতে। গিয়ে দেখে বাড়ির ঘরের বারান্দায় এক বৃদ্ধ বসে বসে হুক্কা ফুঁকছে। ঝর্ণাকে দেখামাত্র বারান্দায় বসা বৃদ্ধ লোকটা বউমা বউমা বলে ডাক দেয়ার সাথে সাথে বর্ণা ঘর থেকে বের হয়ে বললো, ‘আব্বা ডাকলেন’?
বর্ণনা শ্বশুর বললো, ‘হ্যাঁ বউমা, দেখতো মেয়েটি কাকে খুঁজছে’?

শ্বশুরের কথা কানে যেতেই বর্ণা ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, এ যে ঝর্ণা! বর্ণা আর দেরি না করে দৌড়ে ঝর্ণার কাছে এসে বললো, ‘আমেরিকা থেকে কবে এলি, বল? কেমন-ই-বা আছিস’? ভালো আছিস তো? তোর স্বামীকে সঙ্গে আনিসনি কেন? লোকটা কোথায়? তোর সাথে এসেছে’?
ঝর্ণা বললো, ‘না, ও সাথে আসেনি। আমি একাই এসেছি, ক’দিন হলো মাত্র’।
‘কেন আসেনি’? জানতে চাইল বর্ণা। কিন্তু ঝর্ণা বর্ণাকে সদুত্তর কিছুই দেয়নি, শুধু এড়িয়ে গেল। এসব কথা বলাবলির মাঝেই বর্ণা ঝর্ণাকে ঘরে নিয়ে বসতে দিলো। খাবার দিলো। খাবার খাওয়ার মাঝেই ঝর্ণা বর্ণাকে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর স্বামী কোথায়’?

বর্ণা বললো, ‘ও-তো শহরে চাকরি করে। মাসে একবার আসে। মাঝেমধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও বন্ধ পেলে চলে আসে’। ছুটি শেষে আবার চলে যায়। আমি আমার বৃদ্ধ শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিয়ে বাড়িতেই থাকি। ঝর্ণা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর বাবার বাড়িতে যাসনে কেন? তোর বাবা-মা তো অসুস্থ। আমি আমেরিকা থেকে এসেই তোর খোঁজে তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোর মা-বাবা তোকে যেতে বলেছে। তাদের সমস্ত স্থাবর অস্থাবর হয়তো তোর নামেই দিয়ে দিবে। তুই সময় করে তোর স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যাবি। তোর মা-বাবা হয়তো রাগ-গোস্বা ভুলে গিয়ে তোকে বুকে টেনে নিবে’।

ঝর্ণার কথা শুনে বর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমার মা-বাবাকে দেখতে যাবো। তবে তাদের ধন সম্পত্তির লোভে নয়। গর্ভধারিণী মা ও জন্মদাতা পিতার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আর তাদের ভালোবাসার টানেই যাবো।

এখন বল, তুই কী সুখে আছিস’?
বর্ণার কথার জবাব দিতে গিয়ে ঝর্ণার দুচোখ বেয়ে জল ঝরতে লাগলো! একরকম কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ‘না বর্ণা, আমি ভালো নেই। কলেজ জীবনে আমার ভবিষ্যৎ ভাবনা ছিলো ভুল! তাই আমি প্রবাসী স্বামী পেয়েও সুখী হতে পারিনি, যতটা তুই গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হয়েছিস। আমি সুখী হতে পারিনি এই কারণে যে, আমি একটু বেশি সুখী হতে চেয়েছিলাম। তাই আমি আজ দুখী! বর্ণা তুইই সুখী!

সখিনার স্বপ্ন

27776

০১
সখিনা তাড়াতাড়ি হাত চালায়। এখনও অনেক কাজ বাকি। পাশের বাড়ির মজা পুকুরে একবার যেতেই হবে। ওখানে কলমি শাক পাওয়া যায়। কারো চাষ করা নয় । একদম নিরেট প্রাকৃতিক। ভেজালের যুগে এই ঢের! কলমি শাক কদম আলীর খুব পছন্দ। যেদিন কলমি রান্না হয় ; সেদিন কদম আলী এমন ভাবে খায় যে , এর চেয়ে মজার খাবার আর ত্রিভুবনে নেই। সখিনা ঘোমটার আড়ালে মুখ টিপে টিপে হাসে। আর মনে মনে বলে – বড় লোকেরা কোর্মা পোলাও ও এত মজা করে খায় না। বিয়ের আগে সখিনা ময়মনসিংহ শহরে এক স্যারের বাসায় কাজ করত। স্যারের ছোট ছেলেটি সে কি দুষ্টু ! যাকে বলে কলি কালের পোলা।

এই কদম আলী লোকটা সখিনার স্বামী। বিয়ে হয়েছে দু বছর। তখন সখিনার বয়স আঠার। কদম আলীর আটাশ। এই দু বছরে তাদের কোন সন্তান হয়নি। অবশ্য হয়নি বললে কিছুটা ভুল হবে ; কারণ সখিনা সন্তান নেয়নি। ঝামেলা ঝামেলা লাগে। সে লুকিয়ে লুকিয়ে পরিকল্পনা আপার কাছ থেকে সুখী পিল সংগ্রহ করে নিয়মিত খায়। কদম আলী বিষয়টি বুঝতে পারে না। কদম আলীর সন্তানের প্রতি খুব আগ্রহ। কিন্তু সখিনা কোন ভুল করতে রাজি নয়। সে আধা শহুরে মেয়ে। তাছাড়া কিছুটা শিক্ষিত। গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পাশ দিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে ছিল। বাবার অভাবের সংসার। তা না হলে রাহেলার মত সেও এখন কলেজে পড়ত!

সখিনার বিয়ের দিন তুমুল বৃষ্টি। সারা বাড়িতে কাদা। তবু বিয়ের আনন্দ থেমে থাকেনি। পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে গীত গেয়ে , হাসি তামাশা করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে তুলে। মাঝ রাতে কদম আলীর সাথে সখিনার বিয়ে পরানো হয়। ১০ হাজার টাকা দেন মোহর। নাকের ফুল, কানের দুল আরও ইত্যাদি ইত্যাদি মিলে পাঁচ হাজার টাকা উসুল। মা-বাবা , ভাই, বোনকে কাঁদিয়ে সখিনা শ্বশুর বাড়ি যায় সেদিন শেষ রাতে। তখনও বৃষ্টি পুরোপুরি থামেনি।

বাসর ঘর। এক পাশে মাটির পিদিম। সখিনা প্রায় ২৪ ঘণ্টার অভুক্ত। ঘরের এখানে সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। সখিনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সারা দেহ, মনে ভয় ও আনন্দের অভূতপূর্ব মিলন মেলা। লুঙ্গি পড়া কদম আলী বাসর ঘরে প্রবেশ করে। গায়ে কোন জামা নেই। সখিনা আড় নয়নে স্বামীর দিকে তাকায়। প্রায় অন্ধকারে কদম আলীর কালো শরীর আরও কালো লাগে। সখিনা জড়সড়। মাটির দিকে মুখ। মাথায় বার হাত লম্বা ঘোমটা! কদম আলী সখিনার দু হাত ধরে। ঘোমটা সরিয়ে দেয়।

সখিনা একটু পেছনে যায়। কদম আলী একটু এগিয়ে আসে। বলে, এই ভয় পাছ নাকি? আমি তো তোর স্বামী । নিজের স্বামীকে আবার ভয় কিসের? এই বলে কদম আলী আরও নিবিড় হবার চেষ্টা করে। সখিনা কথা বলে না । কদম আলী ফুঁ দিয়ে বাতি নিবিয়ে দেয়। আবার ডাকে আদুরে গলায় , এই সখিনা! এই সখি!
এই বার সখিনা চুপ থাকতে পারে না। মুরুব্বিদের মুখে শুনেছে, আল্লার পরে নাকি স্বামীর স্থান। আধো আধো গলায় বলে , কি বলেন?
কদম আলী হা হা হা করে হেসে উঠে। বলে, এই তো আমার সখির মুখে কথা ফুটছে। আবার বলে, একখান কথা কইতাম সখি?
সখিনা বলল, কী?
আমারে মোহরানার টাকাটা মাফ কইরা দে।
সখিনা আমতা আমতা করে বলে, মাফ করতে পারি ; তবে আমারও একটা শর্ত আছে।
কি শর্ত? এই বলে কদম আলী সখিনার আরও কাছে আসে।
সখিনা বাঁধা দেয় না। স্বামীকে বাঁধা দেওয়ার চেয়ে বড় পাপ আর নেই। বলে, শর্তটি হল–আমারে সারা জীবন ভাল বাসন লাগব আর —- এইটুকু বলে সখিনা থেমে যায়।
কদম আলী ব্যাকুল চিত্তে বলে , আর কী?
সখিনা কথা বলে না । মনে মনে ভয় পায়। পাছে স্বামী মাইন্ড করে । তাকে স্বার্থপর , লোভী ভাবে।
কদম আলী ব্যাপারটি বুঝতে পারে । বলে, আল্লা তোরে আর আমারে জোড়া মিলাইছে। আমি কথা দিতাছি , তোরে সারা জীবন ভালা বাসবাম। আর কী সেইটা তাড়াতাড়ি কইয়া ফালা। ডরের কিছু নাই।
এইবার সখিনার মন থেকে ভয়ের কালো মেঘ সরে যায়। স্বামীর বুকে মুখ রাখে। বলে , আমারে একটা জামদানি শাড়ী দেওন লাগব। আমার বহুদিনের স্বপ্ন। ময়মনসিংহ থাকতে স্যারের বউকে দেখতাম পড়ত। আহা কি সুন্দর শাড়ি ! স্যারের বউ আমারে সব সময় বলত , সখি, জামদানি শাড়ী পরলে তোমাকে পরীর মত লাগবে। আমি তোমার জন্য একদিন পরী সাজবার চাই। এক নিঃশ্বাসে এত গুলো কথা বলে সখিনা স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে।

কদম আলী একটু হতচকিত হয়। সে জীবনে জামদানী শাড়ীর নাম শুনেনি। কত দাম , কোথায় পাওয়া যায় কিছুই জানে না। একটা গাভীর দুধ ও করগাঁও বাজারে সবজি বিক্রি করে কদম আলীদের সংসার কোন মতে খেয়ে না খেয়ে চলে যায়। ঘরে বৃদ্ধ মা বাবা। ছোট ছোট কয়েকটি ভাই বোন। বড় তিন ভাই বউদের পরামর্শে আলাদা খায়। বলা যায়, সমস্ত সংসারের জোয়াল কদম আলীর কাঁধে। তবু আজকের এই মধুরাতে কদম আলী বউয়ের মন পূর্ণিমার আলোর মত রাঙিয়ে দিতে চায়। বলে, অবশ্যই দিবাম। কি খুশী ত?
সখিনা স্বামীর গলা আরও শক্ত করে ধরে রাখে। বলে, খুব খুশী খুব খুশী! খুব খুশি।
কদম আলী বলে, আমারও একটা কথা আছে।
কী কথা?
আমারে কিন্তু আপনে কইরা কইতে পারবি না। পর পর লাগে।
সখিনা হাসতে হাসতে বলে, না, আমি পারুম না। আমার শরম লাগে।
কদম আলী আরও জোরে সখিনাকে বুকে টেনে নেয়। বলে, আয় তোর শরমটা একটু ভাঙাইয়া দেই।

০২
আজ বাদে কাল ঈদ। ঈদুল ফিতর। এইবারের ঈদ সখিনার জন্য অন্যরকম। আজ কদম বাজার থেকে ফিরলেই দুজনে মিলে ভাঙবে মাটির ব্যাংক। গত দু বছরে জমানো টাকা গুনবে। অতঃপর কদম যাবে শহরে। কিনে আনবে সখিনার স্বপ্নের জামদানি। এখনও কদম আসছে না কেন? সখিনা যত্ন করে ভাত বাড়ে। হাতে নেয় তাল পাতার পাখা । কয়েক দিন যাবত বেজায় গরম । সখিনার শরীরে ঘামাচি। একবার ভেবেছিল কদমকে বলবে একটি ট্যালকম পাউডার কিনার জন্য । পরক্ষণেই মনকে বুঝিয়েছে – তাহলে শাড়ী কিনার টাকা যদি কম পড়ে!

এই সখি, এই সখি, তাড়াতাড়ি ভাত দে – এই বলে কদম আলী ঘরে ঢুকে। সখিনা বলে, অনেক দেরী কইরা ফেললা। শহরে যাইবা না?
যামুরে পাগলী যামু। অনেক আগেই আইতে চাইছিলাম। কিন্তু আইজ অনেক কাস্টমার। মেলা বিক্রি অইছে।
সখিনা খিল খিল করে হাসে। বলে, আমার শাড়ীর জন্যই কিন্ত আল্লা রহমত করতাছে। কদম আলীও হাসে । সে হাসিতে আনন্দ যেমন আছে ; তেমনি আছে গোটা সংসারের কষ্টের মানচিত্র!
দুজনে মিলে ব্যাংক ভাঙল। খুব মজা করে টাকা গুনল। কদম আলীর মনে হল, পৃথিবীতে টাকা গুণার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। সর্বমোট এক হাজার সাতশ একুশ টাকা। কে জানে এই টাকায় শাড়ী পাওয়া যাবে কি না! কদম আলীর বুকটা দুরু দুরু করে। কিন্ত সখিনারে বুঝতে দেয় না। বলে, সখি আমি তাইলে শাড়ী কিনতে যাই । সখিনার চোখে মুখে বিশ্ব জয়ের আনন্দ!

আমারে নিবা না —– এই কথা বলে সখি অন্যদিকে মুখ ফিরায়। আকাশের এক কোণে ঘন কালো মেঘ। অনেক গুলো চিল উড়ছে। ঝড়ের আগমনী বার্তা। সখিনার বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে।
কদম আলী মুচকি হেসে বলে, তর যাওনের কাম নাই । আব্বা রাগ করব । মেয়ে মানুষ শহরের বাজারে পুরুষ মানুষের সাথে চলব এইডা আমারও ভালা লাগে না ।
সখিনা আর কথা বাড়ায় না। শুধু বলে, সুন্দর দেইখা কিনবা কিন্তু।
কদম আলী সখিনার কপালে আলতো করে একটি চুমো খায়। সখিনা দেখে কদমের চোখে জল। বুঝতে পারে এই কান্না কষ্টের নয় ; ভালবাসার। গর্বে সখিনার বুক ভরে যায়। আর কদম আলী জোড় কদমে শহরের দিকে পা বাড়ায়।

০৩
কদম আলী পিকাপে উঠে। বসার সিট নাই। দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। পিকাপের ছাদে মাথা লেগে যায়। গন্তব্য কিশোরগঞ্জ শহর। গৌরাঙ্গ বাজার। ড্রাইভার যথেষ্ট জোরে চালাচ্ছে । কিন্তু কদম আলীর তর সইছে না। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠছে সখিনার মায়াবী মুখ। সেই মুখ যেন কদম আলীরে জাদু করেছে। রাস্তার দু পাশে গাছের সারি। বর্ষার পানি কিছুটা নামতে শুরু করেছে। আকাশের সেই কালো মেঘ এখন আর নেই। কদম আলীর মনে প্রশান্তির ঢেউ। ইতিমধ্যে গাড়ী কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনের পেছনে এসে থামল। কদম আলী সবার আগে নেমে পড়ল।

এই দোস, এই দোস ডাক শুনে কদম আলী পেছনে ফিরে থাকায়। একজন লোক। জীর্ণ-শীর্ণ, রোগা, পাতলা। শরীরের তুলনায় পেট অনেক বড়। হলুদ, কোটরাগত চোখ । মাথার বেশির ভাগই টাক। লাঠি ভর দিয়েও ভাল ভাবে হাঁটতে পারছে না। মনে হয় প্রতিবন্ধী । কদম আলী লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, আমারে কিছু কইছেন?

লোকটি যেন আকাশ থেকে পড়ে। বলে, আমারে চিনতে পারলা না দোস! আমি মরম আলী। ছোট কালে তুমার বাপে আর আমার বাপে আমরারে দোস্তি পাতাইছিল। অবশ্যি না চিনার অই কথা। সেই আমি আর এই আমি এক না। আকাশ পাতাল ফারাক।

কদম আলীর মাথা ঝিম ঝিম করে। পায়ের তলায় মাটি আছে কি না বুঝতে পারে না।
হা ডু ডু খেলায় মরম আলী ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গায়ে সিংহের মত শক্তি। কেউ তাকে আটকাতে পারত না। একি হাল হয়েছে তার ! কদম আলীর বিশ্বাস করতে মন চাইছে না।
কদম আলী, মরম আলীকে জড়িয়ে ধরে। দু জনেরই চোখের জল বাঁধ মানে না। দু বন্ধু মিলে রেল স্টেশনের উত্তর পাশের বড় বট গাছটার নিচে বসে। কদম আলী জিজ্ঞেস করে, দোস এই অবস্থা কেমনে অইল? আমারে একবার খবর দিলা না কেন?

মরম আলী কথা বলে না। চোখের পানি সব প্রশ্নের জবাব দেয় । অবশেষে চোখের জল বুঝি ফুরিয়ে আসে ! মরম আলীর মনের ঝড় কিছুটা থামে। বট গাছে বসা একটি পাখি কদম আলীর হাতে হাগু করে দেয়। মরম আলী পাখিটাকে বিশ্রি একটা গালি দেয়।

কদম আলী আবার জিজ্ঞেস করে, দোস এই শরীল নিয়া শহরে আইছ ক্যান?
মরম আলী ভাবলেশহীন ; অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেয়, – তিনডা কাম ঠিক করছি দোস।
কোন তিনডা?
ভিক্ষা করবাম। চুরি করবাম। এই দুইডাতে কাম না অইলে রেল গাড়ীর নিচে ঝাঁপ দিবাম।
কদম আলীর মাথা ঘুরে যায় । বলে, দোস, একটা কামও ভালা না।
এ ছাড়া আমার যে আর কিছু করার নাই । আল্লা আমারে মরণ দেয় না ক্যান?
এই কথা কইতে নাই দোস । আল্লা নারাজ অইব। আসল ঘটনাডা একটু খোলাসা কইরা কও।

মরম আলী একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। আর তার অন্তরের কষ্ট গুলো বাতাস ভেদ করে কদম আলীর হৃদয়ে এসে ক্ষেপা সাগরের ঢেউয়ের মত আঁচড়ে পড়ে। অতঃপর মরম আলী বলা শুরু করে — দোস,
অনেক সুন্দর মেয়ে দেইখ্যা বাপ মা বিয়া দিছিল। দুই বছরে দুইডা পোলা অইল। সারাদিন কাম করি। সন্ধ্যার সময় অইলে ঘরে আই। বউয়ের সাথে, পোলা পানের সাথে সোহাগ করি। ভালা সুখেই দিন যাইতাছিল। এরপর আমি কডিন অসুখে পড়লাম। ডাকতর বলল, ঠিক মত অসুধ খাইতে না পারলে বাঁচার আশা নাই। বউ–পোলা পানরে খাওন দিতে পারি না। কাপড় দিতে পারি না। শেষতক ভিটে মাটি বেইচা দিলাম। অহন থাহনের কোন জায়গা নাই। বউরে মিয়া বাড়িতে কামে পাডাইলাম। হে অইখানে আর যাবার চায় না। মিয়া সাব নাকি শরীর ধরতে চায়। ওর দিকে তাকানো যায় না। একটা ছিঁড়া কাপড়। বদলাইয়া গোসল দিবার পারে না । দিন রাইত আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে । শুধু চইল্যা যাইতে চায়। ফাঁস দিয়া মরবার কথা কয় । এই ঈদে —–।

কদম আলী আর শুনতে পারে না। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ে । সখিনার কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় সখিনার স্বপ্নের কথা। আস্তে আস্তে হাত ঢুকিয়ে দেয় পকেটে। বের করে আনে এক হাজার সাতশ একুশ টাকা। গুঁজে দেয় বাল্যকালের দোস মরম আলীর হাতে। মরম নিতে চায় না। কদম আলীর দু হাত ধরে কাঁদতে থাকে।


সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরই গ্রাস করবে অন্ধকার। কদম আলীর মনে আলো আর আঁধারের সমান খেলা। এক চোখে বিজয়ের হাসি। বন্ধুর জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ। অন্য চোখে জল। কোনটির দাম বেশি কদম আলী বুঝতে পারে না। তার শুধু মনে হয়, মানুষের জীবনে কেন এমন হয়? বিধাতা তো ইচ্ছে করলেই সবাইকে সুখী করতে পারে।

কদম আলী বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। বাড়ির সামনের আম গাছটার নিচে সখিনা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সখিনাকে দেখে আজ তার পা কাঁপছে কেন? পা আর সামনে চলতে চাইছে না কেন? কদম আলীর অজান্তেই হাত দুটো তার পেছনে চলে যায়। সখিনা হয়ত এই হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে।
——————————————–

মামুনের অণুগল্পঃ কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭

27615

★ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আমি এই কন্ডেম সেলে! মৃত্যুর অপেক্ষায়।

সাড়ে পাঁচ বছর ঠায় কারো বা কিছুর জন্য অপেক্ষা করা তোমার কাছে কেমন মনে হয়? মরছিলাম আমি প্রতি পলে পলে। মুহুর্তে। ঘন্টায়। প্রতিটি সূর্যোদয়ে এবং সূর্যাস্তে!

দুর্ভাগ্য আমার। একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে আমি আয়েশ করে, একটা সুর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত দেখতে পারিনি বিগত বছরগুলোতে।

নিজের সেলে একাকী। দুপুরের খাবার শেষ করে একটু ঝিমানি মত এসেছিল কেবল। ভাত ঘুমে ঢলে পড়া কোনো ক্লান্ত প্রহর কল্পনায় আনতে চাইছিলাম বোধহয়।

এমন সময় ওনারা এলেন। সমন নিয়ে। সময় হয়েছে। অবসান হয়েছে অপেক্ষার। আমি হাসলাম তাদের মুখের ওপর। স্বস্তির হাসি 🙂

একজন ডাক্তার এলেন। অনেক কিছু পরীক্ষা করে কেন জানি আমার বাম হাতের বৃদ্ধ আংগুলটিতে বেশী সময় লাগালেন। আমাকে কি যেন পড়ে শোনালেন। আমি শুনলাম। ঘোরের ভিতর। আমার তখন ঘোর লাগা ঘোর! কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭ এর ঘোর।

আসলে আমি তখন আমার ভিতরের পাহাড়, নদী আর সাগরকে বিদায় জানাতে মগ্ন ছিলাম।

সময় বয়ে চলে একসময় সন্ধ্যা পেরিয়ে মধ্যরাতকে সাথে নিয়ে এলো।

আমি নিজে শুদ্ধ হলাম।
একজন কিছু পাঠ করেছিলেন। আমি নির্নিমেষ চেয়েছিলাম তার ঠোঁটের দিকে।
মুগ্ধ হয়েছিলাম কিনা?
পাগল নাকি!
মুগ্ধ হবার ওটা যথার্থ সময় ছিল কি? এই শেষ সময়েও আমার মেজাজ বিগড়ে দিও না তো।

আমাকে আমার শেষ ইচ্ছের কথা জানাতে বললেন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একজন। ডেপুটি জেলার হবেন হয়তো। কারণ জেলার সাহেবকে চিনি আমি। তিনি আসেন নাই।

কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা জানতে চাওয়া হলেও নিশ্চুপ ছিলাম আমি। তারপরও কিছু একটা হাতে করে এনেছিল এক রক্ষী। আমি ফিরেও চাইলাম না সেদিকে।

সবশেষে প্রার্থনা করার সুযোগ দিতে চাইলে প্রশ্নকর্তার চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কাছে করব?’ তিনি নিশ্চুপ রইলেন।

একসময় জল্লাদরা এলো। আমার হাত পেছনে ভদ্রভাবে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো। বলল, ‘চলুন স্যার!’ আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেও, তারা ছিল নিষ্প্রাণ। পাথরের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন চোখে। জল্লাদদের চোখ পাথরের-ই হতে হয়।

আমাকে যম টুপি পরাতে চাইলে, প্রথমবারের মত আমি সরব হলাম। বললাম,
– আমার এত বছরের থাকার পরিচিত জায়গাটুকু আমি খোলা চোখে যেতে চাই। আমাকে বধ্যভূমির প্রবেশদ্বারের আগে পরিয়ে দিও।

আইনে নেই। তাই পরতেই হল। আমার দু’পাশে দু’জন জল্লাদ আমাকে শক্ত করে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। আমার আপন আঁধার ঘোর অন্ধকারের দিকে আমাকে টেনে নিয়ে চলল!

আমি হেঁটে যেতে যেতে, পাহাড়-নদী-ঝর্ণাদের মনে মনে ডাকলাম, ওরা দূর থেকে আবছা প্রচ্ছায়ার মত নিশ্চুপ রইলো। কাছে এলোনা।

তখন আমি কাছের মানুষদেরকে মনের চোখে দেখার চেষ্টা করলাম। বরাবরের মত আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তারা আরো দূরে সরে গেলেন আমাকে দেখে। এই জগৎ এর একমাত্র অচ্ছুৎ মানুষটি যেন আমি।

সহকারী জল্লাদরা আমাকে সাথে নিয়ে, অল্প ক’টি ধাপ পার হয়ে, আমাকে প্রধান জল্লাদের হাতে ‘হ্যান্ডওভার’ করল।

মনে মনে আমার কাছের মানুষদেরকে শেষবারের মত দেখতে চাইলাম। ‘আমি যাদের যাদের এই জীবনে সবচেয়ে বেশী ভালবেসেছি, সবচেয়ে বেশী আঘাত আমাকে তারাই দিয়েছে’, আমার গলায় ফাঁসির নট যথাস্থানে বাধার সময়ে এই কথাই মনে পড়ল।

সব চুপচাপ। সময় থেমে আছে। নির্দিষ্ট ক্ষণের অপেক্ষা করছে সময়কে ঘিরে অন্যরা।

‘কেবলমাত্র তোমাদের ঘৃণা অবহেলায়ই আজ ঝুলে যেতে হলো আমায়!’- পতনের নিম্নগতির প্রথম অণুমুহুর্তে এই ছিল কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭ এর অণুভাবনা।।

.
#কয়েদি_নাম্বার_৪৪০৮৮৭_মামুনের_অণুগল্প

মামুনের অণুগল্পঃ ফিরতি পথে

27610

★ – এতো রাতে ফোন করলি কেন? তোর হাজবেন্ড কোথায়? তারিকের আওয়াজে বিরক্তির ঝাঁঝ।
– আনহ্যাপি মহিলারাই এত রাতে এইভাবে ফোন করে।

মিলার মুখ গাল কান থেকে গরম ভাপ উঠতে লাগলো, কঠিন গলায় বললো,
– রাত সাড়ে দশটা, তুই তখন বললি বলেই ফোন করলাম। যাকে তাকে রাত্রে ফোন করি না আমি। রিসিভ ও করি না।

তারিকের মেজাজ একই রকম খারাপ,
– তাতে কী? ঘুম ভেঙ্গে দিলি কেন? এখন আমি কি করবো?

মিলা অপ্রস্তুত,
– sorry , ঘুমা। রাখি।
তারিক ধমক লাগালো,
– রাখবি না। সারা রাত কথা বলবি।
– sorry

গম্ভীর হয়ে ফোন কেটে দিলো মিলা।
অনেকগুলো খারাপ অনুভুতি একসাথে হচ্ছে ওর। বিশ্রী লাগছে। সত্যি সত্যি ও বাসায় একা। ঘুম আসছে না। কী বললো তারিক? মিলা কি এই জন্য তারিককে ফোন করেছে?

মনটা খারাপ হয়ে গেলো মিলার।
টিভির, বই এর নেশা ও ছুটে গেছে অনেক বছর আগে। ভালো লাগে না। অনেক বছর ধরে নির্ঘুম রাত, নি:সঙ্গ দিন, কারণে অকারণে লোকজনের খারাপ ব্যবহারকে স্বাভাবিক বলে বুঝে নিয়েছে ও। তবু তারিকের ব্যবহারে খুব অপমান লাগলো।

আবার এক রকম মমতাও যেন টের পাচ্ছিলো। বেচারার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একা মানুষ। আর হয়তো সহজে ঘুমটা আসবেও না।

অপরাধী মনে হতে লাগলো নিজেকে মিলার। মাথা নিচু করে বাগানের চেয়ারটাতে বসে ভাবতে লাগলো ও।
অনেকক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
‘সমস্যা আছে।’

তার মন ওয়ার্নিং দিলো।
সতর্ক মিলা মনে মনে তারিককে দুটো প্রশ্ন করলো,
‘এত কিছু থাকতে কেন তোর মনে হলো আমি আনহ্যাপি? কেমন আছিস তুই?’

ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। চাইলেও টিভি দেখে বা বই পড়ে সময় কাটাতে পারে। হয়তো তাইই করা উচিত। নিজের এলাকার বাইরে পা ফেলাটা বোকামি। তারিকের কথাগুলো মনে পড়লেই নিজের উপর নিজের রাগ লাগতে থাকলো মিলার। তার একা থাকারই অভ্যাস। এক এক সময় এক এক কাজের ভুতে পায় ওকে। তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

বন্ধু বলতে শেয়ারিং কেয়ারিং এর ইনফর্মাল যা ইচ্ছা তাই বলার কেউ মিলার কোনদিন ছিলো না। অনেক বন্ধু নিয়ে একটা কাজ চিন্তায় আসার পর সে ফর্মাল বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেছিলো।

মোটামুটি একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেলেই আইডিয়াটা বলা যাবে ভেবে সে সবার সাথে বেশ নিয়মিত কথাবার্তা বলতে লাগলো।

এই রকম একটা অবস্থায় সে তারিককে পেলো বন্ধুদের আড্ডায়। ভার্সিটিতে পড়ার সময়ে কমন দুই এক জন বন্ধুর আড্ডায় দেখা হয়েছে দুই একবার। সৌজন্যই। ঠিক বন্ধুত্ব নয়। ক্লাসমেট।

আঠারো বিশ বছর পর যোগাযোগে নিজেদের পুরনো দিনের জন্য ভালোবাসাটাই নিজেদের অজান্তে একে অন্যের সাথে শেয়ার করতে শুরু করলো। মধ্যবয়সের সয়ে যাওয়া নি:সঙ্গতা হঠাৎ অসহনীয় হয়ে উঠলো।
তারুণ্য নয়, মন চাইলো প্রথম কৈশোর ফিরে পেতে।

যে যার নিজের অতীতে ফিরে গেলো। হৈ হল্লা, ঝগড়াঝাঁটি, অভিযোগের গোলমালে তাদের আসল বয়সটা কখন হারিয়ে গেলো কেউ খেয়ালই করতে পারলো না। সময়ের সাথে সত্যি সত্যি বুদ্ধি শুদ্ধিও চলে গেলো। যার চিন্তায় যা প্ল্যান ছিলো সমস্তই ভেসে গেলো। দু’জন ব্যস্ত রইলো কথা কাটাকাটি, ঝগড়ায়।
কোন কথাটা বলার, কোনটা নয় খেয়াল ও রইলো না কারো। অবশেষে যখন হুঁশ হলো, তখন দু’জনই সত্যিকার সমস্যায় পড়ে গেলো।

তবে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। পথ তো থাকেই। তারা কানাগলির শেষ থেকে আবার বড় রাস্তায় ফিরে চললো।

তারিকের প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল।
সাধারণত ঘুম ভেঙ্গে গেলে, সহজে আর ঘুমাতে পারে না। এজন্যই মিলার ফোনে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে এতটা চটেছিল। আর রাগটা আরো বেড়ে গেলো কথা শেষ না করেই হুট করে ফোনটা কেটে দেয়াতে।

বছর যদি ৩৬৫ দিনে ধরা হয়, তবে তারিক ২৮৭ দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একজন ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’ রুপে দিন কাটায়। প্রাইভেট কোম্পানির গোলামি বলে কথা। দেশের ভিতরে থেকেই বিদেশে চাকরি করার অনুভূতি! কেমন এক বিশাল প্রাপ্তি মনে হয় তারিকের কাছে। ভিসাবিহীন, খরচাবিহীন মুফতে অনুভূতি লাভ!

নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে এক জেলায় রেখে, নিজে অন্য এক জেলায় থাকে। একা। একটি ১৩০ বর্গফুটের ছোট্ট রুমের ভিতরে রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কাটাতে হয়। এরপর রুমে ঢুকেই কোনোমতে খেয়ে নিয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়া। ছোট্ট একটা টিভি নিজের মত চলতে থাকে। বিনোদনের ব্যবস্থা এই টিভি আর মোবাইল ফোন। প্রায় রাতই টিভি চলতে থাকে, তারিক ঘুমিয়ে পড়ে। মোবাইলে কথা বলার থেকে নেট ব্যবহারই করে বেশী।

আজও নেট ব্যবহার করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল.. মিলার কলটা যখন আসলো, রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গতেই মোবাইলটা পিঠের নিচে আবিষ্কার করে।

ডিসপ্লেতে মিলার নামটা দেখে প্রচন্ড একটা সুপ্ত ক্রোধের ধীরে ধীরে জেগে ওঠাটা টের পায়। বুকের গভীরে একটা আগ্নেয়গিরির গভীর তলদেশ থেকে প্রচন্ড জমাট বাঁধা কিছু নির্বাক অভিব্যক্তি খুব দ্রুত কিছু শীতল অনুভূতিকে সাথে নিয়ে ক্রমেই উপরে উঠতে থাকে। আর উত্তরোত্তর উত্তপ্ত হতে থাকে।

কেন এই রাগ? মিলার সাথে ওর সম্পর্কটা কেমন? দু’জনের ভিতরের এই সম্পর্ককে তারিক কিভাবে দেখছে? নিজের মনে এতোগুলো প্রশ্ন শুধু যে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে এখনই উঠেছে, তা নয়। কাজের ভিতরে কি কাজের অবসরে, এই প্রশ্নগুলো বহুবার ওর মনে উঠেছে। কিন্তু কখনোই সদুত্তর পায়নি।

পায়নি নাকি পেয়েও উপলব্ধি করাতে চায় না?
নিজের বউ বাচ্চা রয়েছে। মিলার স্বামী সন্তান। এসব কিছুকে অতিক্রম করে কেমন এক দুর্বোধ্য সম্পর্কের মায়াজালে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে ক্রমশঃ আরো গভীরে নেমে যাচ্ছে সে।

এই বয়সে কী সে মিলাকে ভালোবেসে ফেলেছে?
জীবনের অনেকটা পথ অন্য কারো হাত ধরে হেঁটে হেঁটে এই বিষন্ন বেলাভূমে নতুন অন্য কাউকে নিয়ে একটি অচেনা ফিরতি পথ ধরে এক আনন্দময় ট্রেইলের কল্পনা করাটা কি ঠিক হচ্ছে? শোভন হচ্ছে?

তবে এই ভাবনায় যে কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে, বিছানায় উঠে বসে ভিতরে ভিতরে কাঁপতে থাকা অবস্থায় তারিক অনুধাবন করে। ওর এই মুহুর্তের চিন্তাধারায় ‘বিষন্ন বেলাভূমি’ এবং ‘অচেনা ফিরতি পথ’ ধরে ‘এক আনন্দময় ট্রেইলের’ কল্পনা করা হয়েছে। বিষন্ন বেলাভূমি কখনো আনন্দময় ট্রেইলের উৎপত্তি ঘটাতে পারে না। আর ফিরতি পথ অচেনা হয় কিভাবে? যে পথে সামনে আগানো হয়েছে, আবার সেই পথে ফিরে যাওয়া হয় বলেই না সেটাকে ফিরতি পথ বলে।

কিন্তু নিজেই নিজের ভাবনাগুলোর উত্তর দেয়। ফিরতি পথ অবশ্যই অচেনা হতে পারে। যখন অচেনা কাউকে সাথে নিয়ে হাত ধরে নিজের চিরচেনা পথে ফিরে আসা হয়, তখন পরিচিত পথটিও অচেনা হয়ে উঠে।

তবে কি মিলা ওর অপরিচিত? যাকে নিয়ে সে জীবনের বাকি পথটুকু এক আনন্দময় ভ্রমনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে চায়!

কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে তারিকের।
একটা ঘোরের ভিতরে চলে যায় সে। ওর এই রুমের বাথরুমের শাওয়ারটির নিচে দাঁড়ালে মাঝে মাঝে সে এই অনুভূতি পেয়ে থাকে। প্রচন্ড পানির গতি, উপর থেকে সারা শরীরে আছড়ে পড়ার অদ্ভু্ত মাদকতার পরশ বুলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি! বেশ আগে ছেলেবেলায় এক বৃষ্টির দিনে প্রচন্ড স্রোতের ভিতরে খালে নেমেছিল সে। অল্প অল্প সাঁতার শিখেছিল। হঠাৎ স্রোতের টানে খালের পানির ঘূর্ণিতে তলিয়ে যেতে যেতে চোখে ভাসছিল পানির ভিতর থেকে গজিয়ে উঠা হোগলা গাছের লম্বা ফুলের হলুদাভ অবয়ব। বৃষ্টির পানির ঠান্ডা অনুভূতিকে ছাপিয়ে কেমন উষ্ণ আরামদায়ক অনুভূতি এনে দিচ্ছিল খালের পানি। আর ডুবে যেতে যেতে নাকে মুখে পানি প্রবেশের সময়ের সেই প্রচন্ড সাইনাস পেইনের অনুভূতিও মুহুর্তে অনুভব করে।

সেবার অবশ্য নিয়তিই ওকে তীরে এনে ফেলেছিল। ওহ! পায়ে যখন মাটির স্পর্শ পেয়েছিল, আর বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকণার শীতল ছুঁয়ে দেয়ার মাঝে ঝাপসা চোখে কালো আকাশকে দেখেও যে অসাধারণ ভালোলাগার অনুভূতি জেগেছিল!
আজ মিলাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময়েও কি এই সবগুলো অনুভূতি ক্রমান্বয়ে তারিককে ঘিরে ধরছিল?

মিলা!
মিলাকে নিয়ে অচেনা ফিরতি পথ ধরে আনন্দময় ট্রেইলের সন্ধান লাভের চিন্তাটা শাওয়ারের প্রচন্ড গতিতে শরীরে পানির স্পর্শের সুখানুভূতি কি এনে দেয় না? আর চলমান বাস্তবতা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট বৃষ্টির শীতল ফোটার সাথে খালের স্রোতে তলিয়ে গিয়ে খাবি খাওয়ার অনুভূতিই কি নয়? আর এসব কিছুকে ছাপিয়ে জীবনের পিছনের ট্রেইল মুছে দিয়ে, এতোদিনের সম্পর্কগুলোকে নষ্ট করে, মিলার হাত ধরে অচেনা ফিরতি পথে চলার মত মনোবলের অভাব সেই তীব্র সাইনাস পেইন হিসেবে কাজ করে।

একটা ১৩০ বর্গফুটের রুমের ভিতরে তারিক নামের এক মধ্যবয়সী নিজের জীবনের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ যেন দিক হারিয়ে ফেলে। অনুভূতিতে একজন সম্পর্কহীনা সকল সম্পর্কের মূল উৎস হতে চেয়েও কেন জানি হতে পারে না। শুধুমাত্র হৃদয়ের অনুভূতি দিয়েতো আর জীবন যেখানে অন্তরীণ, সেই ক্ষেত্রকে অতিক্রম করা যায় না। তাই তারিকও জীবনের বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারে না।

বহু যত্নে হৃদয়ে লালিত একটি ফিরতি পথ ধরে অচেনা কাউকে সাথে নিয়ে পথচলা আর হয়তো ওর হয়ে উঠবে না।।

.

#ফিরতি_পথে_মামুনের_অণুগল্প
মামুনের ৫০টি অণুগল্প // গল্প নং-৮