বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

ম্যা’ক্রেটিস

‘২টা মাঝারি সাইজের বুদ্ধিজীবি বিক্রয় করা হবে। ঘাড়ের হাড্ডি নরম, সহজেই সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। মেরুদণ্ড ফ্লেক্সিবল। হাতের রেখা মুছে গেছে। দীর্ঘদিন পাম ওয়েল বিক্রি এবং ম্যাসেজ পার্লারে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।’ বুদ্ধিজীবী দু’জন বিমর্ষ দৃষ্টিতে বিজ্ঞাপনটির দিকে তাকিয়ে আছেন। দেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় টানা ৩দিন ধরে বিজ্ঞাপনটি ছাপানো হচ্ছে, কিন্তু কেউ যোগাযোগ করেনি। কারোই বুদ্ধিজীবী কেনার আগ্রহ নেই।

চাহিদা হ্রাস পেলে পণ্যের দাম কমে- চাহিদা ও যোগান তত্বের ওপর দীর্ঘ আলোচনা শেষে নির্ধারিত হলো তিন দিন বিরতি দিয়ে ফের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। তবে এবার প্রথম লাইনটার আগে যোগ হবে, ‘একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি।’

নতুন করে বিজ্ঞাপন প্রকাশের দিনেই প্রথম কল এলো। স্পিকার চালু করে কল রিসিভ করলেন বুদ্ধিজীবীদের একজন-

: হ্যালো। কে বলছেন?
: আমি মোয়াজ্জেম। গাবতলী হাটের গরুর লবিস্ট।
: গরুর লবিস্ট মানে!! আপনি কি গরুর দালাল?
: জ্বি, স্যার। ওই একই হইলো।

প্রচণ্ড বিরক্তি এবং তুমুল কৌতূহল নিয়ে বুদ্ধজীবী জানতে চাইলেন-
: আপনি এখানে ফোন করেছেন কেনো?
: স্যার, একটা রিকুয়েস্ট – দয়া কইরা বিজ্ঞাপনটা আর ছাপায়েন না। পেটে লাত্তি মাইরেন না।
: শাট ইউর মাউথ স্টুপিড। আমরা বিজ্ঞাপন ছাপালে তোর সমস্যা কি!

এসব গালিগালাজ গায়ে না মেখে মোয়াজ্জেম কান্নাজড়িত স্বরে বললো-
: স্যার, আপনাদের বিজ্ঞাপনের কারণে ভেড়ার বাজারে ধ্বস নামছে। ছাগলের দাম কইমা গেছে আর
মোয়াজ্জেমকে ‘ফাক ইউ’ বলে গালি দেবার আগেই মোয়াজ্জেম যোগ করল-
: আপনাদের দুইটারে গরুর হাটে বলদ হিসাবে বেঁচতে তুললে ব্রয়লার মুরগির দাম দিয়াও কেউ কিনবো না।

সব কথা গায়ে মাখলে, গুরুত্ব দিলে বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না। বুদ্ধিজীবী হওয়া কি সহজ কথা! বুদ্ধিজীবীতা এক অতিপক্ক কাঁঠাল, কোষ গলে ল্যাদল্যাদে, বহু বিঁচির গর্বে বলীয়ান ভুতি গরুর প্রিয় খাদ্য, মাছির আবাস।

কওওও

এই শহরে কেউ কথা বলেনা, তবু সব কথা ছড়িয়ে যায় কানে কানে।

মন্ত্রী পরিষদ জিরাফের দামে খরগোশ কেনার সিদ্ধান্ত নিতেই রাজ্য জুড়ে হুহু হাওয়া বয়ে যায় –‘চুপ.. চুপ.. চুপ… বিনে পয়সায় তো আর কিনেনি.. চুপ.. চুপ.. চুপ… খরগোশ বড় হলেই জিরাফ হয়…।’ হাওয়া জানে এই শহরে কেউ কথা বলেনা, এই বলা তার অভ্যাসের দায়।

সিংহাসনের গদিতে মখমল লাগানোর জন্য ডলফিনের দামে সমুদ্রটা বেঁচে দেবার আগে রাজা বললেন, ‘মহাকাশে গড়ে তুলবো প্রজাপতির খামার, মেঘে মেঘে বুনে দিবো সমুদ্রের বীজ- এ নিয়ে আর কোনো কথা নয়।’ রাজাও জানেন এই শহরে কেউ কথা বলেনা, এই বলা তার অভ্যাসের দায়।

সেদিন সন্ধ্যায় আকাশ লাল। ক’দিন ধরেই গুমোট গরম চলছিলো। আকাশের লাল ও গুমোটের গরমে এ শহর প্রতিক্রিয়াহীন, শুধু হাওয়ার অস্বস্তি– ‘চুপ.. চুপ.. চুপ.. প্রজাপতির খামারে আগুন লেগেছে, সমুদ্রের বীজগুলোকে ভস্ম করে দিচ্ছে তাপ.. চুপ.. চুপ.. চুপ.. ভস্ম ছড়ালেই সমুদ্র হয়…।’

সন্ধ্যা শেষে নামে বৃষ্টি, তুমুল ঝমঝমিয়ে। রাজবাড়ির দেয়ালে ঠেসে ধরে প্রজাপতিমন্ত্রীকে গুলি করে কারাগার ভাঙা তিন কয়েদী। প্রজাপতি মন্ত্রীর ছটফটানো পাখায় থুথু দিতেই জিরাফ মন্ত্রীর বিশাল গলা শুকোরের মত ছোট হয়ে আসে, তীব্র শ্বাসকষ্টে খাবি খেতে খেতে দেখে রাজাকে গিলে খাচ্ছে ডলফিন। উথাল পাথাল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে রাজপ্রাসাদ।

এই শহরে কেউ কথা বলেনা, তবু সব কথা ছড়িয়ে যায় কানে কানে। তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হাওয়া সম্বিৎ ফিরে পেতেই বয়ে যায়, বয়ে যেতে যেতে বলে যায় ‘চুপ… চুপ.. চুপ.. … চুপ.. চুপ.. চুপ… চুপ.. চুপ.. চুপ..।’ কথা না বলার অভ্যাস ভুলে বহুদিন পর ডেকে ওঠে এক বউকথা পাখি, ‘কেউ কথা কও.. কেউ কথা কওও.. কওওও…।’

পরিবহন কথা

82730
প্রতীকি ছবি

মিনিট দশেক অপেক্ষা করে বাস পেলাম। বাসে উঠতে না উঠতেই দুজন দীর্ঘদেহী মানবের বাঁধায় থমকে গেলাম; পথ আটকে দাঁড়িয়েছিলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। পরের স্টপে আরও কয়েকজন বাসে উঠছে দেখে ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, সেই দীর্ঘদেহী ব্যক্তিদ্বয়ের কারণে পারলাম না। পিছন ফিরে দেখলাম পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মহিলা ভিড়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে প্রায়। এদিকে নিজেরও বেহাল দশা!

সুযোগ পেতেই ওই মানবদ্বয়ের মাঝ-বরাবর নির্ঝঞ্ঝাটভাবে ঢুকে পড়লাম। পাতলা গোছের মানুষ বিধায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি। দুজনের মাঝে জোর করে ঢুকে শক্ত চাপ সৃষ্টি করলাম। এতে উভয়ের ভুঁড়ি দু’দিকের দুটো সিটে লেগে যাওয়ায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। মূহুর্তেই মুখের লাবণ্যতা হারিয়ে ফেললেন দুজনেই। ব্যথার চটে বেশ কাবু হয়েছেন বটে!

এই ভুঁড়িকষ্ট থেকে বাঁচতে চেষ্টার কমতি রাখলেন না। কিন্তু আমি তো নাছোড়বান্দা, সেখান থেকে সরার নাম-ই নেই। পরক্ষণে তাদের ভুঁড়ির দুর্দশার কথা চিন্তা করে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, দুজনে ভুঁড়িতে হাত বোলাচ্ছে। হাসি পেল কিন্তু হাসলাম না। নয়তো প্রতিবেশী যাত্রীরা ভাববে কারো সর্বনাশ, কারো পৌষ মাস।

অতঃপর একজন সে স্টপেই নেমে গেল; অন্যজন ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ বাসে ছিলাম তার দিকেই খেয়াল ছিল- বেচারা কোন কথা বলেনি। অনেকেই তাকে অতিক্রম করে নামা-উঠার সময় নানান কথা বললেও তিনি উত্তর করেননি। চালকের সহযোগী বারবার ধমক দিচ্ছেন কিন্তু সেই দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক নির্বাক জানালা ভেদ করে উঁচু উঁচু দালানের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ইঁদুর কলের টোপ

Rat “বুঝলে, দিনে দুটো খেতাম, আজ থেকে একেবারেই ছেড়ে দিলাম” বলে বাবা ম্যাচটা মা’র হাতে ফিরিয়ে দিলেন। মা বহুবার বাবাকে সিগারেট ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছেন, বাবা ছাড়েন নাই। তবে বাবা শোভনের সামনে সিগারেট খায় না। বাবার শার্টে গন্ধ লেগে থাকে। কড়া গন্ধটা শোভনেরও ভালো লাগে না। বাবা আর সিগারেট খাবে না- এমন সিদ্ধান্তে মা’র খুশি হবার কথা। কিন্তু মা’র চেহারা মলিন হয়ে এলো। মা’র চোখ দু’টো ছলছল করছে। নাকের ডগায় লালচে আভা। মন খুব বেশী খারাপ হলে মা’র নাকের ডগা এমন লাল হয়ে ওঠে। বাবার সিদ্ধান্তে মা’র কষ্ট পাওয়ার কারণটা শোভন ধরতে পারে না। এবার জন্মদিনে গ্রাম থেকে দাদু ফোন করে বলেছেন, “দাদাভাই, তুমি আট বছরে পড়লে! মাশাল্লাহ। তুমি তো বড় হয়ে গেছো।” তবু শোভন বড়দের ব্যাপারগুলো বুঝতে পারে না।

মা মুখ মুছার ছলে শাড়ির আঁচল দিয়ে ভিজে আসা চোখ আর নাকের ডগা মুছেন, কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন “চা খাবে! একটু চা কইরা দেই!” চা বাবার খুব পছন্দ। বাবা মগভর্তি চা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে বা বিছানায় হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দেয়, বই বা পত্রিকা পড়ে, কোনো কোনো রাতে চায়ের মগ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে, বাড়ির সামনের রাস্তাটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আর আয়েশ করে চা খায়- শোভনের দেখতে খুব ভালো লাগে। শোভনের খুব চা খেতে ইচ্ছে করতো, মা দিতেন না। এখন দেন। যে সকালগুলোতে ঘরে ডিম থাকে না, শোভন নাস্তায় চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খায়। শোভনের এখন বাবার সাথে চা খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওকে বিস্মিত করে বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন, “না, না। এখন কষ্ট করে চা বানাতে হবে না। ভাবছি কাল থেকে সকাল ছাড়া চা খাওয়াটাও বন্ধ করে দিবো, কি বলো!” মা কিছুই বললেন না। বিছানায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনের চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন।

বাবা সত্যিই চা খাওয়া ছেড়ে দিবেন- বড়দের কখন যে কি হয় শোভন বুঝতে পারে না। দু’বছর আগে করোনা ভাইরাস এলো– অফিস বন্ধ, স্কুল বন্ধ। বাবা অনেকদিন অফিসে যাননি। ঘরবন্দী বাবা সারারাত ঘুমোতে পারতেন না। চিন্তা করতেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। তবে শোভনের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। ও বুঝতো বাবা অভিনয় করছে। কারণ বাবার মিথ্যে হাসিতে চেহারার চিন্তারেখাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতো। তখন কি সব হিসেব নিকেষ করে বাবা দিনে পাঁচটা সিগারেট থেকে কমদামী দু’টা সিগেরেটে নেমে এসেছিলেন। মা’ও অনেক চিন্তা করতেন। কিন্তু বাবাকে স্বাভাবিক স্বরে বুঝাতেন, “এতো চিন্তা কইরো না তো। চিন্তার চাপে তোমার কিছু হয়া গেলে আমাদের কি অবস্থা হইবো সেইটা ভাইবো! টেনশন কইরা লাভ নাই, দেইখো সব ঠিক হয়া যাইবো।” বাবা শুধুই হাসতেন। আকুল কান্নার মত করুণ সে হাসি! বিষাদমাখা স্বরে মা’কে বলতেন, “হুম, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের যা যাচ্ছে তা এক্কেবারেই যাচ্ছে। তিল তিল করে গড়ে তোলা সঞ্চয়, তোমার গহনা, শোভনের ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে রাখা ফিক্সড ডিপোজিট- সব.. সব।”

করোনার পর বাবার অফিস খুললো। শোভন ভেবেছিলো সব আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই আগের মত হলো না। বাবা আর মা’ও আগের মত হতে পারলেন না। চেষ্টাও করলেন না। শোভনের বিশ্বাস- ও আগের মতই আছে। আবার মনে সন্দেহও জাগে- সবার মত বদলে গেছে। একরাতে আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন, “আর পারছি না। বাড়িটা বদল করতে হবে।” বাড়ি বদলের কথা শুনে শোভনের মন খারাপ হলো। দুই বেড রুমের এই ফ্ল্যাটে শোভনের নিজের একটা রুম আছে। মা খুব সুন্দর করে রুমটা সাজিয়ে দিয়েছেন। রুমের একপাশের দেয়ালে মিকি মাউজ আর মিনি মাউজ হাসছে। বিছানার পাশের দেয়াল আর পুরো সিলিং জুড়ে বাবা ছোট-বড় অনেকগুলো তারা লাগিয়ে দিয়েছেন। তারাগুলো অন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলে। রাতে ঘুম ভাঙলে শোভনের মনে হয় ও খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। রুমের পাশে গ্রিলঘেরা ছোট বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের রুমনের সাথে কথা হয়। শোভনের মনে পড়ে, রুমনরা গত মাসে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। শোভনদের ফ্ল্যাটে ঢুকার দরজা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত লম্বা জায়গাটার মাঝখানে মা পর্দা টানিয়ে ড্রইং আর ডাইনিং রুম বানিয়েছেন । এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে যাওয়ার কি প্রয়োজন শোভন বুঝতে পারে না।

পরের মাসেই বাড়ি ছাড়া হলো। বাড়ি ছাড়ার আগের দিন বাবা সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল আর শোভনের খাটটা বিক্রি করে দিলেন। নতুন ফ্ল্যাটের জন্য নতুন সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল ও বিছানা কেনা হবে ভেবে শোভন খুশি হয়েছিল। কিন্তু নতুন ফ্ল্যাটে এসে ওর ছোট বুকটা গভীর বিষাদে ডুবে ছিল। এই ফ্ল্যাটে একটা মাত্র বেড রুম। রান্নাঘরের সাথে সামান্য খোলা জায়গায় মা শোভনের পড়ার টেবিলটা গুছিয়ে দিয়েছেন। এই ফ্ল্যাটে শোভনের নিজের রুম নেই- ওর খুব কষ্ট হয়। আবার বাবা-মা’র মাঝখানে ঘুমোতে পারে বলে আনন্দও হয়। স্কুলে যেতে ও আসতে প্রতিদিন সাত তলায় উঠা-নামা করতে হয়। লিফট নেই, ছোট পায়ে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠা-নামা করতে কষ্ট হয়। বাবা-মা’র রুমের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকখানি আকাশ আর গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত যাওয়া পথটা স্পষ্ট দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে বা রাস্তায় তাকালেই শোভনের মন ভালো হয়ে যায়।

বাড়ি বদলের সাথে আরও অনেক কিছুই বদল গেল। আগের ফ্ল্যাটে থাকতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শোভনকে নিয়ে বাবা আর মা বেড়াতে যেতেন। মাঝে মাঝে ফাস্টফুডের দোকানে বসে শোভনকে বার্গার বা ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাই খাওয়াতেন। মা ফুচকা খেতেন। বাবা শুধু চা খেতেন। এখন এক একটা শুক্রবারে বাবা বলেন, “চল বাবাই, একটু ঘুরে আসি।” পার্কের পাশে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে বাবা প্রশ্ন করেন, “বাবাই, তুই কি খাবি- ঝালমুড়ি, ফুচকা, বার্গার না চিকেন ফ্রাই!” শোভনের বার্গার বা চিকেন ফ্রাই খেতে ইচ্ছে করে। বড়দের অনেক কিছু বুঝতে না পারলেও বাবা কোন উত্তরে স্বস্তিবোধ করবেন তা বুঝতে পারে। শোভন বলে, “ঝালমুড়ি খাবো। কাঁচামরিচ ছাড়া ঝালমুড়ি।” যেদিন বেতন হয়, শোভনের জন্য বাবা বার্গার বা ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাই বা পোলাও আনবেনই আনবেন। পোলাও শোভনের খুব প্রিয়, নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর ঈদের দিন ছাড়া মা একদিনও পোলাও রান্না করেনি।

মানুষ শিক্ষাশ্রয়ী প্রাণী। শিক্ষাকে আশ্রয় করে মানুষ বেঁচে থাকে। শিক্ষাই মানুষকে শেখায় মানিয়ে নেওয়া এবং মেনে নেওয়া এক নয়। বেঁচে থাকার অনিবার্য ধাওয়ায় অসহনীয় বাস্তবতার সাথে মানুষ মানিয়ে নেয়। না মেনেও মেনে নিতে বাধ্য হয়, অভ্যস্ত হয়। মানিয়ে নিয়ে এবং মেনে নিয়ে বা না মেনে শোভনদের পরিবার অনাবৃত দুঃসময় অতিক্রম করছিলো। নতুন করে শোভনের বাবা একবেলা ছাড়া চা খেতে চাইছে না, চা ও সিগারেটহীনতার সাথে মানিয়ে নিতে চাইছে– শোভনের মা’র মন শঙ্কায় ভরে উঠে। কাঁপাকাঁপা স্বরে জানতে চান, “তুমি আর সিগারেট খাইবা না, এইটা ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু সবকিছু ছাড়তে ছাড়তে চা’ও একবেলা ছাড়া খাইবা না, এইটা কেমন কথা! কি এমন ঘটছে সেইটা বলবা?”

মা’র প্রশ্ন শুনে শোভনের বাবা বালিশে হেলান দেন। লোডশেডিং চলছে, ফ্যাকাশে চার্জার বাতির আলোয় দেওয়ালে পড়া বাবার ছায়াটাকে আরও ফ্যাকাশে লাগছে। শোভনের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেন, “তুমি শোনো নাই, কারা যেনো আমাদের দিকে দুর্ভিক্ষ ছুড়ে দিচ্ছে।”

মা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন না, স্বাভাবিক স্বরেই বলেন, “দুর্ভিক্ষের আর বাকী আছে কি! জিনিসপত্রের যে দাম, প্রতিটা দানা হিসেব কইরা মুখে তুলতে হইতাছে। মাসে দু’শ চল্লিশ টাকা বাঁচানোর জন্য তুমি সিগারেট ছাইড়া দিবা- ভালো কথা। কও তো আসন্ন দুর্ভিক্ষে বাড়ি ভাড়া, ইলেক্ট্রিসিটি, গ্যাস ও পানির বিল শোধের পর কি আমাদের ডাল-ভাত আর আলুভর্তাটাও ছাইড়া দিতে হইবো!”

শোভনের মনে পড়লো মা ডিম, ব্রয়লার মুরগির মাংস বা চাষের পাঙ্গাস মাছ রান্না করলেও প্রায় দুপুরেই আলুভর্তা, তরকারির ঝোল আর ডাল দিয়ে ভাত খান। বাবা আরও আগে, করোনার সময় থেকে “ভাল্লাগে না” বলে ব্রয়লার মুরগি ও চাষের পাঙ্গাস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। শোভন বুঝতে পারে “ভাল্লাগে না’ নয়, বাবা-মা সংসারের হিসেব মিলাতেই এসব খাবার মুখে তুলেন না, ভাতও কম খান। মা’র প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেন, “কি জানি! ডাল-ভাত আর আলুভর্তাও ছাড়তে হতে পারে, তবে হাওয়া খেয়ে বাঁচা যেতে পারে, দূষিত বাতাস এখনও বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে উঠেনি। যাও একটু চা করো, আগামীকাল থেকে একবেলা চা করলেই হবে।”

মা মোম জ্বালিয়ে নিয়ে রান্না ঘরে যায়। কৌতূহলী শোভন প্রশ্ন করে, “বাবা, দুর্ভিক্ষ হলে কি মানুষ মরে যায়? আমরা বাঁঁচবো তো!” বাবা শান্তস্বরে বলেন, “দুর্ভিক্ষে ধনীলোকরা মরে না রে বাবাই। গরীবরা বাঁচে না। আমরা যারা মরার মত বেঁচে আছি আর মরলে একেবারে বেঁচে যাই, ইঁদুর মারার কলে টোপের মত ঝুলি, তারা দুর্ভিক্ষে বাঁচবো কি মরবো – এ বড় জটিল প্রশ্ন। তবে বাঁচি বা মরি গোর আজাব বাড়তেই থাকবে। এসব কথার মানে বড় হলে বুঝবি। রাত হচ্ছে, এখন ঘুমো বাবাই।”

বাবার কথার অর্থ শোভন বুঝে না। তবু ওর মন খারাপ হয়। মনে মনে ভাবে বেঁচে থাকলে দুর্ভিক্ষের পর ওদের কি আরও ছোট আরও উঁচু কোনো লিফটবিহীন ফ্ল্যাটে চলে যেতে হবে যেখানে ওর পড়ার টেবিল রাখার জায়গাটুকুও হবে না। প্রতিদিন পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঁচুতে উঠতে হবে পরদিন ফের নেমে যাওয়ার জন্য! শোভন চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে চেষ্টা করে, ঘুম আসে না।

নব টোনাটুনি

index

এক ছিলো টোনা আর এক ছিলো টুনি। একদিন টোনা টুনিকে বললো,
– টুনি, ও টুনিইই..

টুনি হাই তুললো,
– হ্যা, বলো।
– আমার খুব ভাপা পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে।

টুনি চোখ পাকিয়ে বললো,
– তোমার কি খেতে ইচ্ছে করছে!
– পিঠা, ভাপা পিঠা।
– তোমার সুগার লেভেল হাই, শরীরে চর্বি জমছে, আর ডায়েট না করে তুমি ভাপা পিঠা খেতে চাইছো! হাও সিলি!!

টোনার মন খুব খারাপ হলো, চোখে পানি চলে এলো, টুনিকে কান্নাভেজা স্বরে বললো,
– তোমার চটপটি খেতে ইচ্ছে হলো, বৃষ্টির মধ্যে আমি গিয়ে কিনে আনিনি! তোমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে হলো, তোমাকে কানিবগের ফাইভস্টার ফুচকা খাওয়াইনি! আর আজ আমি দুটো ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছি বলে..

“এক্কেবারে ঢং করবে না” বলে টুনি ধমকে উঠলো, এরপর ঠোঁটে পায়ের নোখ কাটতে কাটতে বললো,
– ভাপা পিঠা খাবে বললেই তো বানানো যায়না, এর জন্য জিনিসপত্র লাগে। তুমি ঢং না করে জিনিসপত্র এনে দাও, ভাপা পিঠা বানিয়ে দিচ্ছি।

টোনার মনে খুব আনন্দ, চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলো,
– কি জিনিসিপত্র লাগবে?
– চালের গুড়ো লাগবে, গুড় লাগবে, মাওয়া লাগবে, নারকেল লাগবে, মাটির ঢাকনা লাগবে, ওই ঢাকনা বসানোর জন্য হাড়ি লাগবে, গ্যাস সিলিন্ডার লাগবে, আর আমার মোবাইলে ৫জিবি ডাটা লাগবে।

টোনা অবাক,
– ভাপা পিঠা বানাতে ৫জিবি ইন্টারনেট ডাটাও লাগবে?
– হ্যা, লাগবে। বেশী কথা না বলে এখনি বাজারে যাও।

টোনা বাজারে গিয়ে চালের গুড়ো, গুড়, মাওয়া, নারকেল, মাটির ঢাকনা, ঢাকনা বসানোর হাড়ি কিনলো। বাজারের সাথে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আর টুনির মোবাইলে ৫জিবি ডাটা ভরে বাসায় ফিরলো।

টোনার মনে খুব সুখ, আজ ভাপা পিঠা খাবে। ওইদিকে টুনি ইউটিউবে ঢুকে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। বারবার আসছে শুধু নুডলসের রেসিপি- নুডলসের খিচুরি, নুডলসের চাটনি, নুডলসের পুড় দিয়ে বেগুনের স্যান্ডুউচ। খুঁজতে খুঁজতে নুডুলস দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর একটা রেসিপি পেয়ে গেলো। ভিডিওটা খুলতেই মনে পড়লো ঘরে নুডলস নেই। এখন টোনাকেও নুডুলস আনার কথা বলা যাবেনা, খুব রাগ করবে। তাই অন্য রেসিপি খুঁজতে শুরু করলো। কথায় বলে, যেখানে মাহফুজের ভয় সেখানে হিরো আলম হয়, অন্য রেসিপি খুঁজতে যেতেই বাফারিং শুরু হলো, ইনারনেটের গতি এক্কেবারে স্লো হয়্র এলোম

টুনি তো বারবার চেষ্টা করছে, বারবার রিলোড দিচ্ছে, কিন্তু নেট কাজই করছে না। এমন সময় পাশের গাছের বাসা থেকে চড়ুই গিন্নি মাথা উঁচিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো ,
– টুনি ভাবীইইই, টুনি ভাবীইইই আপনার ইন্টারনেট কি কাজ করছে!
– কি যে বলেন ভাবী, ইউটিউবের ভিডিওটা এক ঘণ্টায়ও ওপেন করতে পারলাম না।
– আমি ‘নাজুক দিল’ সিরিয়ালটা দেখছিলাম, হঠাৎ গেলো বন্ধ হয়ে।
– ওহ, তাই! এদিকে আমি দেখছিলাম ভাপা পিঠার রেসিপিটা।

এ কথা শুনেই চড়ুই গিন্নি চেচিয়ে উঠলো,
– হায় খোদাআআ! ভাবীইইই আপনারা একা একা ভাপা পিঠা খাবেএএএএন! আমাদের কথা মনেই পড়লো না ভাবীইইই, আজ চড়ুই না হয়ে বুলবুলি হলে ঠিকই দাওয়াত দিতেন ভাবীইইইই..
টুনি একটু বিব্রত হলেও নিজেকে সামলে নিলো,
– কি যে বলেন, ভাবী! আপনাকে দাওয়াত দিতে হবে কেনো! আপনি তো ঘরের মানুষ, সবাইকে নিয়ে চলে আসবেন।
– থ্যাঙ্কু ভাবীইইই। আপনার হাতে বানানো ভাপা পিঠা খেতে আমরা তো আসবোই ভাবীইইইই, আমাদের উপরের ডালে কাজিন থাকে, ওর ফ্যামিলিকেও সাথে নিয়ে আসবো, ভাবীইইইইই।

টুনি রেগে মনে মনে “ঢং দেখলে শরীরটা জ্বইল্যা যায়” বললেও, মুখে হাসি মেখে উত্তর দিলো,
– অবশ্যই আসবেন।

চড়ুই গিন্নী বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতেই টুনি ধমকের সুরে টোনাকে বললো,
– চড়ুই ভাবী এলে এক্কেবারে রংঢং করবে না, যদি করো তবে চালের গুড়ির ভেতর তোমার মাথা পুরে সিদ্ধ করে মাসালা ভাপা পিঠা বানাবো, মনে থাকে যেনো, হু।

কোকিল পাখির গাওয়া কাকসংগীতের একটা সিডি লো ভলিউমে ছেড়ে দিয়ে টোনা আয়েশ করে শুনছে আর ভাবছে কখন বানানো হবে ভাপা পিঠা। এদিকে বাফারিং হতে হতে টুনির মোবাইলের চার্জ শেষ। মোবাইল সেটটা চার্জে দিয়ে টুনি নারকেল কুড়ালো, গুড় মিহি করে টুকরো টুকরো করলো, চালের গুড়োর সাথে মাওয়া মিশালো, হাড়িতে পানি ভরে চুলোয় বসালো।

সবকিছু ঠিকঠাক করে টুনি মোবাইল অন করলো। মোবাইল অন করে মন খারাপ হয়ে গেলো, দেখে ইন্টারনেট স্পিড তখনও এক্কেবারে কম। যখন মাত্র ভাবতে শুরু করেছে ইউটিউব না খুললে ভাপা পিঠা বানাবে কিভাবে তখনই পূব পাশের বটগাছের চিলটা উপরের ডালে উড়ে এসে বসলো,
– টুনি ভাবী, বাসায় আছেন?

টুনি খুব উচ্ছাসের সাথে উত্তর দিলো,
– ভাইয়াআআআ, এদ্দিন পর আমাকে মনে পড়লো!
– না, ঠিক তা না। রোজই আপনার কথা মনে হয়, কিন্তু..

কথা শেষ করতে না দিয়েই টুনি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
– থাক থাক, আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলতে হবে না, ভাইয়ায়ায়ায়া। আপনার মনে তো শুধু ডাহুক ভাবী, পায়রা ভাবীদের কথা, ভাইয়ায়ায়া।আমার মত ছোট্ট টুনির কথা কি আর মনে পড়বে, ভাইয়ায়ায়ায়া।

চিল প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো,
– টুনি ভাবী, ইন্টারনেটের স্পিড কি ঠিক আছে?
– না, ভাইয়ায়ায়া, ঠিক নেই। খুব স্লো, ভাইয়ায়ায়া।

টুনির এমন বিগলিত অবস্থা দেখে টোনা দু’বার পাখা ঝাপটালো। বিষয়টা বুঝতে পেরে চিল টিটকারি মারলো,
– কত স্লো, ভাবী! টোনার মত? প্রতি মৌসুমেই তো আপনার ডিম পারতে দেরী হয়ে যায়।

লজ্জায় লাল হয়ে টুনি বিব্রত হাসি দিলো, চিল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো,
– এত আয়োজন কার জন্য?
– আপনার ভায়ের ভাপা পিঠা খেতে খুব ইচ্ছে হয়েছে, ভাইয়ায়ায়া। সব রেডি কিন্তু ইন্টারনেট স্পিড কম বলে পিঠা বানাতে পারছি না, ভাইয়ায়ায়ায়ায়া।

চিল ভিরমি খেয়ে দুটো ঢোক গিলে বিস্ময় প্রকাশ করলো,
– ভাপা পিঠা বানাতেও আজকাল ইন্টারনেট লাগে!
– হ্যা, ভাইয়ায়ায়া, ইউটিউবে রেসিপি না দেখলে পিঠা বানাবো কিভাবে!
– ও আচ্ছা।
– ভাইয়ায়ায়ায়া, আজ কিন্তু আপনার দাওয়াত, না বলতে পারবেন না।
– ঠিক আছে টুনি ভাবী। ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হলেই চলে আসবো।

ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হচ্ছে না দেখে টোনার খুব রাগ হলো, কখন ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হবে তা জানতে ও কাস্টমার কেয়ারে ফোন করতেই শালিকের লাস্যময়ী কণ্ঠ,
– আমাদের সার্ভিসে আপনাকে স্বাগতম। মোবাইল রিচার্জের জন্য এক চাপুন, কল রেটের জন্য দুই চাপুন, ইন্টারনেট কেনার জন্য তিন চাপুন, যে কোনো অভিযোগ জানাতে ডিসকানেক্ট বাটন চাপুন।

টোনা ডিসকানেক্ট বাটনে চাপতেই লাইন কেটে গেলো। দ্বিতীয়বার কল সেন্টারে ফোন করতেই ভেসে এলো ফিঙের কণ্ঠ,
“আপনার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যালেন্স নেই, কথা বলতে চাইলে রিচার্জ করুন। দ্রুত ডিম পাড়াতে চাইলে টুনিকে আদর করুন, ইন্টারনেট স্পিড ছাড়া ভাপা পিঠা খেতে চাইলে মা’কে অনুরোধ করুন।”

গুড়ের চা

সাত
সকাল থেকে এই নিয়ে চার নম্বর ভিখারি। পেট ডুগ্‌রে গলা সরু একটা ন্যাংটো বাচ্চা কোলে তার মা এসে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চাটার দু’নাক দিয়ে মোটা হলদে সিক্‌নি। মাঝেমাঝে নাক টানলে বেরিয়ে পড়ছে সিক্‌নির নীচে দুটো লম্বা লাল ঘায়ের দাগ।

প্রতিবার রান্নার চাল নেওয়ার পর হাঁড়ি থেকে যে ছোট দুই মুঠ তুলে একটা কলসিতে রাখা হয়, সেখান থেকে রেকাবিতে চাল নিয়ে ছোড়দা ঢেলে দিল বৌয়ের পেতে ধরা গায়ের কাপড়ে। চালসমেত শাড়ির অংশ কোমরে গুঁজে নিল সে। তখন মনে হল, কোলের মতো তার পেটেও এক সন্তান।

অন্ধ সেজে আসে অনেকে, ভিক্ষে নিয়েই দে হনহন ক’রে হাঁটা; অনেকের হাতটান খুব, এদিক-সেদিক গেছ কি রান্নাঘরের দাওয়া থেকে বাচ্চার তেলমাখার বাটি নয়ত উঠোনে ছেড়ে রাখা হাওয়াই চটি নিয়ে গায়েব হয়ে যাবে। এমন তাদের মরিয়া সাহস, চার-পাঁচ দিন পরে আবার তোমার বাড়ি, আর ভুলুক-ভালুক তাকাচ্ছে, যদি আরও কিছু গ্যাঁড়ানো যায়।

তবু কোনওভাবে দেশ থেকে দেশে লাখ লাখ মানুষের এই মহাঅভিসরণ, তাদের ক্ষিদে, তাদের মাঙনের হাত-পাতা আর অপমানিত হওয়ার পাঠক্রমকে লঘু করা যাবে না। খালি পায়ে বাদাবন পার হয়ে, রেল লাইন টপকে, দিনে কচুরিপানা-ভর্তি পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে রাতে গ্রামের পর গ্রামের ঘুম না ভাঙিয়ে পোয়াতি বউ, দুধের শিশু বা অশক্ত বাবাকে আঁকড়ে এই নিঃশব্দ স্থানান্তর! তারপর অনেকের চুপচাপ মরতে থাকা… রাতে ঘুমের মধ্যে যেমন শিউলি ঝ’রে পড়ে আর সকালে উঠে এক একটা বুক-কাঁপানো “বলো হরি, হরিবোল”, কাঁচা বাঁশের চালির ওপর শুয়ে কেউ চলে যাচ্ছে শুঁটি নদীর গায়ে জুবলিঘাটা শ্মশানের দিকে। উদ্বাস্তু জীবনের মতো শুকিয়ে গেছে সেই সুবর্ণবতীও, যেখানে এক সময় চাঁদ সদাগরের ডিঙা ভাসত। অন্যদিকে দুটো চাল, একবাটি ফ্যান বা একটা তামার পয়সার জন্যে কলোনি জুড়ে বিষণ্ণ পদক্ষেপ। ভিখারি এসেছে ভিখারির কাছে ভিক্ষে চাইতে!

চতুর্থ কাঙাল স’রে গেছে কি যায়নি, একটা রব উঠল কলোনির বাঁ হাতে মান্নাপাড়ার দিক থেকে। ওমনি বড় রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলো পিটি করার মতো “সাবধান”। মুহূর্তের মধ্যে এক পাল শুয়োরের কালো প্রবাহ এসে পড়ল রাস্তায়। ঘোঁত ঘোঁত শব্দে কান ভ’রে উঠছে, বানের জলের মতো এপাশ-ওপাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে দু’চারটে, তখন পালের পেছনে যে দুজন রাখাল, তারা মুখে চুঃ চুঃ ক’রে লাঠির প্রহারে তাদের তুলে আনছে রাস্তায়।

ঢেউটা এগিয়ে আসতেই চাঁদের বাড়ির দুদিকের দুই কচুবাগানে “শুয়োরে চেনে কচু” প্রবাদ মনে রেখে বরাহদল আক্রমণ শানাল। ওমনি কলোনির মেয়েরা অভিশাপ দিতে শুরু পশুর পালকে, আর ছেলেরা তেড়ে গেল তাদের পরিচালকদের দিকে। এই কচুবনদুটো কলোনির বেশ কয়েকটা বাড়ির খাদ্যভাণ্ডার — কচুপাতাবাটা, নুন-লংকা মাখা কচুভাতে, কচুর সব্জি দেওয়া ডাল অথবা অল্প সরষের তেল খরচ করতে পারলে কচুর লতির বাটিচচ্চড়ি। আবার, বাড়িতে মূল্যবান অতিথি এসেছে তো সদ্য-গজানো অর্ধেক মোড়া কচুপাতার মধ্যে ডালের পুর দিয়ে ভেজে এক উচ্চপর্যায়ের ঝোল-তরকারি হতে পারে। বাজার করার পয়সা না থাকলেও ঘরে বসে তুমি চার-পাঁচটা রান্নার পদ পেয়ে যাচ্ছ।

কাদাজমিতে ঢুকে জানোয়ারগুলো পড়পড় ক’রে কচুগাছের গোড়া ওপড়াতে শুরু করেছে, এদিকে বাতাসে শিস কেটে লাঠির বাড়ি পড়ছে পিঠে, গোঙাচ্ছে তারা। কষ্টে ঘেমে যাচ্ছে চাঁদের বুক। ভগবান এইমাত্র ম্যাজিক ক’রে তাকে ওই চার-পাঁচ ডজন শুয়োরের কোনও একটা বানিয়ে দিলেন, চাঁদের চাম-মাংস-হাড় কেটে কেটে বসছিল লাঠির পরিত্রাহি সপাংগুলো!

আট
জাঙাল লণ্ডভণ্ড ক’রে এগিয়ে যায় ইতরসমাবেশ, মেয়েদের গজগজানির তখনও বিরাম নেই।
এ এক বড় ঘেন্নার জীব — চাঁদের মা দত্তকাকুর বউকে বলছে।
— কলতলায় সবে ঠাকুরির বাসন নামাইছি, যদি আসে মুখ দিয়ে দিতো, ক’ন দিদি! পাপটা তো আমারই লাগতো?
— কাওরাগো ব’লে-বোঝায় তুমি কিছু কোত্তি পারবা না, শান্তর মা। ওগো আবাহোনও নেই, বিসজ্জোনও নেই।

কায়পুত্র নামে ডাকলে তারা খুশি হয়, তবু সবাই কাওরাই বলবে। মান্নাপাড়া পেরিয়ে বাজারের ঠিক আগে চৌবাড়ি ময়দান, মাঠের গায়ে লাগানো কাওরাপাড়া। হয়ত মেরেকেটে দশ ঘর, পঞ্চাশ মানুষ। সব্বাই তীক্ষ্ণ কালো আর শুঁটকো, ছেলেরা নেংটি প’রে পায়খানা সাফাই করে, পোষা জীবগুলোর মতোই পাঁক ঘেঁটে মাছ ধ’রে বেচে বাজারে, মেয়েরা খাটছে ঠিকে-ঝি। ছেলেপেলে স্কুলে যায় না, সিগারেটের খোল দিয়ে তাস বানিয়ে জুয়ো খ্যালে, বিড়ি টানে, নিজেদের মধ্যে মুখখারাপ আর মাথা-ফাটাফাটি সারাক্ষণ।

বয়স্করা বাড়িতে পচাই আর তাড়ি বানাচ্ছে, পাশ দিয়ে হাঁটলে বোঁটকা গন্ধ পাবে। কিন্তু আজকাল ভদ্র সমাজও সন্ধেবেলা বড় রাস্তা এড়িয়ে ঘন দাঁতনগাছের ঝোপ ঠেলে কাওরাপাড়ায় হাজিরা দেয়। এভাবে কালে-কালে গোটা এলাকাই মাতালের দখলে চলে যাবে — এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে দত্তবাড়ির বউ ঠাকুরের বাসন মেজে ঘরে ওঠে। চাঁদের মা কনিষ্ঠ সন্তানকে নির্দেশ দিচ্ছিল, যা, দিদ্‌মারে ডাকে নিয়ে যায়। দ্যাখো গে, কলোনির কোন বাড়িতি যেয়ে ব’সে আছেন। এবার সে রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের ভাতের থালাটি আগাম সাজিয়ে হাঁড়ির বাকি ভাত নিজের পাতে তুলে নিল। তখনই আজকের ছ’নম্বর ভিখারির শুভ মহরত।

অল্প বয়েসি বউটা রান্নাঘরের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখে মা দরজার পাল্লা অর্ধেক ভেজিয়ে এক চিলতে মুখ বাড়ায় — কী চাই?
— দুটো ভাত দেবা, মা গো? কাল দুফোরেত্থে কিসু খাইনি।
— নাম কী তোমার?
— মালোতী
ভেজানো পাল্লা দমাস ক’রে খুলে গেল।
— মিথ্যে কথা কও কিসির জন্যি? তুমি তো মোছলমান।
নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
— যাও, একখান কলাপাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসো।

পাতিলেবুগাছের নীচে উবু হয়ে বসে পড়ে মালতী… না, মোমতাজ। মা নিজের থালা হাতে বেরিয়ে এসে অর্ধেক ভাত কলাপাতায় ঢেলে দেয়, কুমড়ো-পুঁইশাকের ঘ্যাঁট এক খাবলা রাখে ভাতের পাশে, এবং যে মুসুরির ডাল ঢালে পাতের ওপর, তাতে এমন নিফুটি জল যে পাতা ছাপিয়ে উঠোনের ধুলোয় মিশে যায় ডালের অর্ধেক। লেবুগাছের চারটে পাতা ছিঁড়ে চটকে মেখে খাওয়া সেরে মুখ ধুয়ে মোমতাজ যখন আঁচলে হাত মুছছে, মা গিয়ে সামনে দাঁড়াল :

— তোমরা তো পাকিস্তান থে’ আমাদের খ্যাদায় দিছিলে নিজেরা আরামে থাকপা ব’লে। কিন্তু থাকতি পাল্লে কই? সেই তো হিঁদুগো পেছোন পেছোন ইন্ডিয়ায় চলে আসতি হ’লো!
— কাজ জোটে না মা, ভিক্কেও দেয় না কেউ, কিন্তুক সব্বোনাশ করার লোক আছে। যেই মেয়ে হল অ্যাট্টা, খসোম ছাড়ে দে’ চলি গ্যালো। পাকিস্তান-ইন্ডে দিয়ে আমি কী করবো, পেরানে বাঁচা নিয়ে কথা।
— তোমার মেয়েডা কই?
— সে-কবে তার গোর দেয়া সারা!
ব’লে এমনভাবে উঠোনের একদিকে তর্জনী বাড়ায়, যেন ওখানে খুঁড়লে এখুনি মেয়ের মাটিমাখা হাড়গোড় বেরিয়ে আসবে।

চাঁদ দিদিমাকে খুঁজতে বেরোনোর সময় পেছন ঘুরে দেখছিল — শীতের ফ্যাকাসে দুপুরের ভেতর দাঁড়ানো দুই নারী শূন্য চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে…।

আদর্শ বাবা

ছেলেটি ভারি বিরক্ত করছে। মা কিছুতেই সুস্থ মনে রান্না করতে পারছেন না। কখনও ভাঁড়ারের সবজি ছড়াচ্ছে তো কখনও আবার কলসীর জলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে জল ছেটাচ্ছে ৷পরক্ষণে আবার মায়ের আঁচল ধরে টানাটানি করছে ৷
– কী চাস বলতো? আমাকে রান্না করতে দিবি না নাকি?
মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ছেলেটি তার দুষ্টুমি চালিয়েই চলে।
মা যতই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন – ছেলেটির দুষ্টুমি যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। মা একটু রাগতস্বরে কথা বললে কিছুক্ষণ চুপ থাকছে। তারপর আবার …
কোনোভাবেই ছেলেকে শান্ত করতে না পেরে মা একটু ছলনার আশ্রয় নিলেন আর দশটা মায়ের মতই। ছেলের মুখে-মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন -শোনো বাবা, তুমি যদি ও’ঘরে গিয়ে এখন ঘুমোও – তাহ’লে ঘুম থেকে উঠলেই আমি তোমাকে সন্দেশ খেতে দেবো ৷
সন্দেশের নাম শুনেই খুশিতে ছেলেটির মন যেন পাল্টে গেল ৷
হাসিমুখে বলল -ঠিক বলছো মা? সন্দেশ দেবে তো ?
– হ্যাঁ বাবা। তুমি এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
– আচ্ছা মা ৷
সন্দেশ পাবার আশায় পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেটি তার সমস্ত দুষ্টুমি ভুলে মায়ের কথামত ঘুমোতে চলে গেল পাশের শোবার ঘরে।

মা-ও আপাতত ছেলের দুষ্টুমির হাত থেকে রেহাই পেয়ে রান্নার কাজে মন দিলেন।

পাশের অন্য একটি ঘরে বসে ছেলেটির বাবা বই পড়ছিলেন। মা আর ছেলের কথাবার্তা হয়তো তারও কান পর্যন্ত গিয়েছিল। কী জানি কী ভেবে তিনি বইপত্র গুঁটিয়ে রাখেন। তারপর কাঁধে একটা ফতুয়া ঝুলিয়ে কোথাও একটা যাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।

ব্যাপারটা ছেলেটির মা দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে বললেন – এই ভরদুপুরে তুমি আবার কোথায় চললে ? একটু আগেই তো বলছিলে, এ’বেলায় এই ঠা ঠা রোদে আর কোথাও বেরোবে না ৷
ছেলেটির বাবা গিন্নির কথার উত্তর দিতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন ৷ বললেন – সন্দেশ কিনতে ৷
– সন্দেশ ? কেন ?
– তুমি যে ছেলেকে বললে- ঘুম থেকে উঠলেই তাকে সন্দেশ খেতে দেবে। তা তোমার ভাঁড়ারে কি সন্দেশ আছে ?
– না নেই। তাতে কী ? এই অসময়ে আর তোমাকে এককোশ পথ হেঁটে সন্দেশ আনতে যেতে হবে না ৷
– ঘুমের থেকে উঠেই তোমার কাছে ছেলে যখন সন্দেশ চাইবে তখন কী করবে ?
– ও কি আর তখন ওর মনে থাকবে ৷ শিশু মন৷ ভুলে যাবে। আর যদি চায়ও তো ব’লে দেবো – বাবা রাতে এনে দেবেন ৷
– না, তা হয় না গিন্নি ৷ ওকে যখন তুমি আশ্বাস দিয়েছো ঘুম থেকে উঠলেই সন্দেশ দেবে – সে কথা তো তোমার রাখতেই হবে ৷ তাই ও ঘুম থেকে ওঠার আগে ঘরে সন্দেশ এনে রাখতে হবে যাতে তুমি ছেলের কাছে মিথ্যাবাদী হয়ে না যাও।

গিন্নি চুপচাপ তার পণ্ডিত আর আদর্শবাদী স্বামীর কথা শুনছেন আর নিজের ভুলটা উপলব্ধি করতে পারছেন।

স্বামী আরো বললেন – তা না করলে তোমার প্রতি ওর বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। ভাববে মা তো ওরকম বলেন। তোমার কোনো কথাই তখন আর ও বিশ্বাস করবে না। শিশু বলে তার সাথে ছলনা করলে সে বুঝতে পারবে না বা কিছু হবে না এ’রকম কখনো ভাববে না। এভাবেই মা-বাবা-পরিজনদের কাছ থেকেই শিশুরা নিজের অজান্তে ভাল বা খারাপ সংস্কার পেয়ে পেয়েই বেড়ে ওঠে- যা তার পরবর্তী জীবনে-যাপনে ফুটে ওঠে ৷
স্বামীর কথার মমার্থ বুঝতে পেয়ে গিন্নি মনে মনে প্রতীজ্ঞা করলেন- এমন ভুল আর তিনি ভুলেও করবেন না।

এই আদর্শবাদী বিবেকবান বাবা আসলে কে জানো ? ঠাকুরদাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই ছোট্ট ছেলেটি আর কেউ নয় – স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ৷

যোগি সোসাইটি

স্পর্শিয়া আজ স্কুলে যাবে না। কাল ডিনার করতে করতে বাবা বললেন,
– আগামী দু’দিন স্কুলে যাবার দরকার নেই। আমি তাবাসসুম মিসকে জানিয়ে দেবো।

যোগি সোসাইটির শিশুরা স্কুলে ফাঁকি দেয় না, স্কুল ফাঁকিও দেয় না। ঝড় হোক, ঝঞ্ঝা হোক, হরতাল হোক, বৃষ্টি বা প্লাবন হোক স্কুল খোলা থাকলে অভিভাবকরা পৌছে দেবেনই। স্কুলের প্রতি শিশু এবং অভিভাবকদের দায়বদ্ধতা এতটাই গাঢ় যে, বিকেলে কেয়ামত হবে জানলে সকালে শিশুদের স্কুলে পৌছে দিয়ে হেডমিস্ট্রেসকে অনুরোধ করবে, “ম্যাম, আজ দুটো ক্লাশ বেশী করাবেন, প্লিজ। কেয়ামতের পর ক’দিন পড়াশোনা বন্ধ থাকবে কে জানে!”

স্কুলে যেতে না পারায় স্পর্শিয়ার মন খারাপ হওয়া উচিত কিন্তু হচ্ছেনা। ওর মন বিষন্নতায় ভরে আছে। মা অফিসে যাবার আগে ওর মাথায় হাত বুলালেন, মা’র কণ্ঠে উছলে উঠলো আদর,
– স্পর্শি, লক্ষ্মী মা আমার, তুমি এখন সিক্সথ গ্রেডে পড়ো। মানে ক্লাস সিক্স, প্রব্লেম ফিক্সড। তুমি বড় হয়ে গেছো মা, তাই না!
– হুম।
– এই তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি ওই বিষয়টা খুব ভালো করে ভাবো। তুমি যা বলবে তা’ই হবে।

স্পর্শিয়া হাসি মুখে মাথা দোলায়। মা দু’গালে চুমো খান, বাবা ওকে কোলে তুলে নিয়ে নাকে নাক ঘষে আদর করে দেন। দু’জনে একসাথে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যান। পাঁচতলার এই ১৪শ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে ওর একা থাকার অভ্যাস আছে। প্রতিদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে একাই তো থাকতে হয়। গ্যারেজ থেকে হর্নের শব্দ আসতেই স্পর্শিয়া এক দৌড়ে বারান্দায় যায়, ওদের পার্ল হোয়াইট রঙের গাড়িটা সদর গেট দিয়ে রাস্তায় বের হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা আর মা সদর দরজার সামনে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে হাত বের করে ‘বাই.. বাই’ জানায়, ও হাত নেড়ে জবাব দেয়।

বাবা আর মা দুই অফিসে চাকরী করেন। একসাথে অফিসে গেলেও মা ফিরেন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আর বাবা রাত ৮টায়। স্পর্শিয়া জানে আজ বাবাও মা’র সাথে ফিরবেন, সন্ধ্যায় নাশতা করতে করতে তার সিদ্ধান্ত শুনবেন। এরপর সবাই মিলে বাইরে কোথাও ডিনার করবেন। তাই সময় নষ্ট না করে ও ভাবতে শুরু করে। কিন্তু বহু ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, ছোট্ট মাথায় সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

ঘটনার শুরু চার দিন আগে। ওইদিন ছিলো সাপ্তাহিক ছুটি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাবা আর মা ফিসফিস করে কথা বললেন। লাঞ্চ করতে বসে মা বললেন,
– স্পর্শিয়া, তোমাকে একটা কথা বলছি, খুব মন দিয়ে শোনো।
– বলো, মামনি।
– তুমি আমাকে ভালোবাসো?
– হুমমম।
– তুমি বাবাকে ভালোবাসো?
– হুমমম।
মা বাবার দিকে তাকালেন, বাবা বললেন,
– বাবা আর মা’ও তোমাকে অন্নেক অন্নেক ভালোবাসে। কিন্তু একটা সমস্যা তৈরী হয়েছে..
– কি সমস্যা, বাবা?
– বাবা আর মা’র এডজাস্ট হচ্ছেনা। এখন থেকে বাবা আর মা আলাদা থাকবে।
– ওহ, আমিও আলাদা থাকবো! একা ফ্ল্যাটে?

স্পর্শিয়ার প্রশ্নে মা মিষ্টি হেসে বললেন,
– না, একা ফ্ল্যাটে থাকার বয়স তোমার হয়নি। তুমি ভেবে বলো মামনির সাথে থাকবে না বাবার সাথে।
– এখনই বলতে হবে?
– না, খুব ভালো করে ভেবে বলো।

ওইদিনের কথোপকথনের পর থেকেই স্পর্শিয়া ভাবছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বাবাকে তার ভালো লাগে, মামনিকে ভালো লাগে আর এই ফ্ল্যাটটাও ভালো লাগে। কাউকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ছোট হলেও ওর জানে আছে শেষ পর্যন্ত একজনকেই বেছে নিতে হবে। ওর আর ভাবতে ভালো লাগেনা, ড্রইং রুমে এসে স্মার্ট টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়।

বাবা মা বাসায় ফিরে স্পর্শিয়ার সিদ্ধান্ত শোনার জন্য তাড়াহুড়ো করেন না। ইভনিং ব্রেকফাস্ট খেতে বসে এই প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে যান। রাতে সোসাইটির মালিকানাধীন অভিজাত রেস্তরা ‘যোগিয়ান ডাইন’এ ডিনার করতে করতে বাবা জানতে চান,
– কি ভাবলে মামণি?
– আমি তোমার সাথে থাকবো।

মা জানতে চাইলেন,
– তুমি বাবার সাথে থাকবে?
– তোমার সাথেও থাকবো।

বাবার কণ্ঠে বিরক্তি,
– সেটা তো সম্ভব নয়, মামনি। বাবা বা মা’র মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে, অন্যজনের সাথে ছুটির দিনগুলোতে থাকবে। দু’জনের সাথে তো একসাথে থাকা যাবেনা।

স্পর্শিয়া দৃঢ় উত্তর,
– যাবে।
– কিভাবে?
– ম্যাজিক দিয়ে, আর ওই ম্যাজিকটা আমি জানিইইইই।

মা’র কণ্ঠে রাগ,
– ম্যাজিক বলে কিছু নেই, ম্যাজিক হলো ফাঁকিবাজী।
– মামণি, ম্যাজিক আছে। ম্যাজিকটা সহজ, তোমাকেও শিখিয়ে দিবো।

বাবা আর মা কথা বাড়ান না। স্পর্শিয়ার কথা শুনে ভাবেন কালকের দিনটা যাক, এরপর সিদ্ধান্ত নিবেন। হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু ওখানে তো যোগি সোসাইটিতে বসবাসের যোগ্য করে গড়ে তোলা হবে না। তাই বাবা বা মা- একজনকেই বেছে নিতে হবে ওর।

ম্যাজিক দেখবেন এমনটা আশা করেনি বাবা-মা, কিন্তু পরদিন স্পর্শিয়ার ম্যাজিকে পুরো যোগি সোসাইটি দুলে উঠলো। স্পর্শিয়ার টেবিলে পাওয়া গেলো চিঠি, “বাবা ও মামনি, এই যে দেখো ম্যাজিক, আমি তোমাদের দু’জনের সাথেই আছি আবার কোথাও নেই শুধু আল্লাহর কাছে আছি।” ছোট্ট ডেডবডিটা পাওয়া গেলো বাথটাবে ডুবন্ত, শ্যাম্পুর বোতলের পাশে বাবার স্লিপিং পিলের অনেকগুলো খালি মোড়ক। ম্যাজিকের সম্মোহন কাটতে বাবা-মা’র চোখ অশ্রুতে ভরে এলো।

স্পর্শিয়ার ম্যাজিকের সংবাদ বাতাসে মিশে যোগি সোসাইটির কোনায় কোনায় প্রতিধ্বনি তুললো, সেও ক্ষণিকের জন্য। শুধু যোগি সোসাইটির হর্তাকর্তারা আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন তুললেন, “সেক্যুলার যোগি সোসাইটির এক শিশুর মাথায় জঙ্গীবাদ ঢুকালো কে?” স্পর্শিয়ার মৃত্যুশোকের কান্না ভুলে হর্তাকর্তার আতঙ্ককে ঘরে ঘরে পৌছে দিলো হাওয়া। একদিনেই বাবা-মা ছাড়া অন্য সবার মন থেকে মুছে গেলো স্পর্শিয়া; যেনো স্পর্শিয়া যোগি সোসাইটির কেউ নয়, স্পর্শিয়া নামে যোগি সোসাইটিতে কেউ কখনো ছিলোই না।

.
#যোগি_সোসাইটি
*অসুস্থতার ঘোরে লেখা।

এলিয়েনের সঙ্গে এক বিকাল

287

এখন পড়ন্ত বিকাল। ছাদের বাগানে একা একা বসে আছে আকিব। সে পুরাতন ঢাকার একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসাবে তার সুখ্যাতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, আকিবের আই কিউ অনেক বেশি। ক্লাসে টিচার যখন পড়ান, তখন সে একটি শব্দ শোনার পর পরের শব্দটি বলে দিতে পারে। একটি বাক্য শোনার পর পরের বাক্যটি বলে দিতে পারে। এজন্য ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রী এবং টিচার সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। খুব পছন্দ করে। তাকে নিয়ে গৌরব বোধ করে।

সেই আকিবের কাছে আজকের বিকালটা খুবই নীরস নীরস মনে হচ্ছে। প্রাণহীন লাগছে। বাসার আশেপাশে কোনো খেলার মাঠ নেই। একটু জোরে নিশ্বাস ফেলার মতোন জায়গা নাই। এমনকি রাস্তার ফুটপাত.. তাও নাই। রাস্তার মধ্যে কেবল খানাখন্দ আছে। গাদাগাদি রিকশা, ভ্যান, অটো আছে। ফলে আকিবের মতোন অনেক কোমলমতি শিশুদের আজকাল একই অবস্থা। তার উপর আকিবের স্কুলেও মাঠ নেই। ক্যাম্পাস নেই। বিল্ডিং এর উপর বিল্ডিং। এইরকম পরিবেশ তার ভালো লাগে না। ভালো লাগার কথাও নয়। সে প্রজাপতির মতোন উড়তে চায়। মেঘের মতোন এদিক-সেদিক ঘুরতে চায়। রাজহাঁসের মতোন সাঁতার কাটতে চায়। কিন্তু কিছুই আর হয়ে উঠে না। যে বিকেলগুলো রঙিন হওয়ার কথাছিল, সেই বিকেলগুলো ছাদের বাগানে কাটছে। কাটাতে হচ্ছে।

এমনি মানসিক অবস্থায় আকিব কী মনে করে আকাশের দিকে তাকাল। সাথে সাথে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তার ঠিক মাথার উপরে একটি উড়ন্ত সসার। দ্রুতবেগে তার দিকেই নেমে আসছে। আকিবের শরীরের সমস্ত লোম এক মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে গেল। তার ভাবনার চেয়ে কম সময়ে উড়ন্ত সসারটি একেবারে তার ছাদের ঠিক উপরে চলে এলো। চোখের পলক পড়ার আগেই সসারটি থেকে একজন এলিয়েন বেরিয়ে আসলো।

ভুতপ্রেতের মতোন এতো বিশাল আকারের নয়। আকিবের সমবয়সী হতে পারে। এলিয়েনটি সোজা আকিবের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আকিবও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ালো। করমর্দন করতে করতে এলিয়েনটি বলল, হাই… আকিব, আমি ইকুচু। নেপচুন থেকে এসেছি। তুমি কেমন আছ?
আকিব বলল, আমি খুব ভালো আছি।

ইকুচু বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তুমি মোটেই ভালো নেই। তোমার মন খুউব খারাপ। একা একা ছাদের বাগানে সময় কাটাতে তোমার ভালো লাগে না। আমি নেপচুন থেকে তোমার উপর দৃষ্টি রাখছিলাম। কারণ তুমি আমাদের গ্রহের বিজ্ঞানীদের পছন্দের তালিকায় আছো। তোমার আই কিউ অত্যন্ত বেশি। আচ্ছা আকিব, তোমাদের পৃথিবীতে কি মিথ্যা বলার ট্রেনিং সেন্টার আছে?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শোনে আকিব খুব বিস্মিত হল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে জানাল, নেই।
তাহলে তোমরা এতো সুন্দর করে ইনিয়েবিনিয়ে কীভাবে মিথ্যা বল? তোমরা কি জান না, মিথ্যা বলা মহাপাপ?
আকিব বলল, সব মানুষই এটা জানে। তবুও তারা মিথ্যা বলে। কারণ মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমিও এটা পছন্দ করি না। তবুও মাঝে মাঝে বলি। বলতে হয়।
ইকুচু বলল, মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি… এটিও একটি বড় মিথ্যা আকিব। যাক আসল কথা বলি, আমি একটি মিশনে এসেছি। তোমাকে আমাদের নেপচুন গ্রহে নিয়ে যাওয়ার মিশন। তুমি কি স্বেচ্ছায় যাবে নাকি জোর করে নিয়ে যেতে হবে?

আকিব এবার মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু মুখের মানচিত্রে ভয়-ডর কিছুই প্রকাশ করল না। বুদ্ধি খাটাতে লাগলো। হঠাৎ তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠল। আকিবকে কিছু নির্দেশনা দিলো। সে মোতাবেক আকিব বলল, তোমাদের গ্রহে তো মিথ্যার কোনো স্থান নেই। কিন্তু আমি এখনো মিথ্যা মুক্ত হতে পারিনি। তবে আমি চেষ্টা করছি। যদি আমি সে চেষ্টায় সফল হতে পারি, তাহলে আমার নেপচুন যেতে আপত্তি নেই।

এমন সময় ইকুচুর স্যুটের ভেতর ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হল। আকিবও সেই আওয়াজ শুনতে পেল, কিন্তু কিছুই বোঝে উঠতে পারল না। ইকুচু বলল, হাইকমান্ড নির্দেশ দিয়েছে, তুমি এবার সঠিক বলেছ। আমরা তোমার মিথ্যা মুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব। আমার হাতে আর সময় নেই। বাই আকিব…. বাই…

আকিবের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। তবুও ইকুচু’র দিকে হাত নেড়ে জানালো, বাই ইকুচু… বাই।।

পৃথিবীতে সবাই সাধু

images123

বেশ কিছু রহস্যের গল্প পড়ে
এক সময় নিজেকে গোয়েন্দা ভাবতে শুরু করলাম,
ভাববোই না বা কেন
যেথায় যাই যেখানেই বসি একই কথা –
ভাই আজ চরম শ্বাসরুদ্ধকর একটা গল্প শুনাতে হবে,
কাল অমুকের বাড়িতে অবাক এক কাণ্ড ঘটেছে
চলো না যদি রহস্যের কিনারা করতে পারো!
আর আমার বন্ধু মাজু
ওর নাকি দিনে অন্তত দু’টো গল্প না শুনলে ভাতই হজম হয় না পেটের।
এমনি ভাবেই সকলের খাতির যত্নে দিনগুলি গত হচ্ছিল বেশ।

শীতের এক বিকেলে –
মাজুর আব্বা ডেকে বললেন
দ্যাখো তো বাবা আমার একটা উপকার করতে পারে কি-না!
মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললাম –
আপনার উপকারে লাগতে পারলে নিজেকে তো ধন্য মনে করতাম চাচাজান
কি করতে হবে তাই বলুন!
তিনি বললেন –
বেশ কিছু দিন থেকে নিয়মিত খেজুর গাছের রস পাচ্ছি না
মজার ব্যপার হলো – গাছে হাড়ি লাগানোই থাকে অথচ রস থাকে না
মানুষ খায়, না-কি সাপ বা বাদুর খায়
তাও ঠিক মতো বুঝা যায় না
তুমি যদি বাবা একটু খতিয়ে দেখতে !

বললাম –
বলেন কি চাচাজান!
প্রত্যেক দিন খোয়া যায়?
এমন তো হবার কথা নয়!
বলেই মাজুর চোখ রাঙানিতে থেমে গেলাম
বুঝলাম বিশাল একটা বোকামি করে ফেলেছি
গাছের রস যে ২/৩ দিন অন্তর অন্তর আমরাই খাই
সে কথা স্বীকার করে নিয়েছি অকপটে
যদিও চাচাজান ধরতে পারেন নি।
কথা না বাড়িয়ে তাই বললাম –
চিন্তা করবেন না চাচাজান
নিশ্চয় একটা বিহিত করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ!
ভাবতে লাগলাম ঘটনাটা কি!
চাচাজান বলছেন প্রত্যেক দিন রস থাকে না
অথচ আমরা খাই —-
তাহলে কি ——

পূর্ণ শশী জ্যোৎস্না ঢেলে অকাতরে সাজায়ে চলেছে
নিদ্রাহারা ধরণীর বুক,
বেশ ঝকমকে একটা রজনী!
আমরা চলেছি গোপনে পুকুর পাড়ে রহস্যের সন্ধানে।
কিছু দূর থাকতেই হঠাৎ মনে হলো গাছে কি যেন নড়ছে
সাপ বা বাদুর নয়, নিশ্চয় মানুষই হবে!
টান টান উত্তেজনায় ঘেমে উঠলো শরীর
ফিস ফিস করে মাজুকে বললাম –
ভয় করিস নে, পিছু পিছু আয়!
গাছের গোড়ায় না পৌঁছতেই লোকটি অস্তিত্ব অনুভব করে ফেললো আমাদের
হয়তো বা বুঝেও ফেললো একটা অঘটন ঘটতে চলেছে আজ
আর তাই নাগালের বাহিরে থেকেই আওয়াজ দিলো
’আমি সাজু, খবরদার আঘাত করবি নে কেউ!’
তারপর নীচে নেমে আমাদেরকে চিনতে পেরেই ধমক দিয়ে বলে উঠলো –
আমি তো গাছে উঠেছি কেউ রস চুরি করেছে কি-না দেখার জন্য,
কিন্তু তোরা এখানে কি করছিস?

সাজু মাজুর আপন বড় ভাই
কথা বলতে পারলাম না
তার হাতে এক মাথায় কাপড় প্যাঁচানো একটা নল দেখে মনে মনে শুধু বললাম –
’পৃথিবীতে সবাই সাধু
কেউ প্রকৃত কেউ ভেজাইল্যা আর কেউ ছদ্মবেশী!’

জ্বীনের খিটমিটে হাসি

124

এক সময় ষষ্ঠ শ্রেণীর উপরে অধ্যয়ণরত প্রতিটি ছাত্রেরই
লজিং অথবা বোডিং -এ থেকে লেখাপড়া করার সুবাদে
নিজেস্ব ট্রাঙ্ক থাকতো।
তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র।
তাই —

ক’দিন থেকেই চলতে ফিরতে মনে হচ্ছিল
সব সময় কে যেন আমাকে ফলো করে।
কখনো ডানে কখনো বামে আবার কখনো পিছে ধুপধাপ শব্দ,
ফিরে তাকালে কিছুই নেই
যেন নিজের স্যান্ডেলই গোপনে চটকা মেরেছে,
তবুও ভিতরে ভিতরে একটা জমিদারী ভাব তৈরী হতে লাগলো
কারণ এহেন কর্ম নাকি জ্বীনেরা করে,
শুনেছি একবার যদি জ্বীন কারো বশীভূত হয় তো লালে লাল শাহজালাল,
সুতরাং বুঝতেই পারছেন!

এরই মাঝে অবাক করা এক ঘটনা ঘটলো –
চিঠি রাখবো বলে সেদিন তালা খুলে দেখি
আমার ট্রাঙ্কের কোণায় বেশ কিছু ঝকঝকে পয়সা,
সিকি আধুলী মিলিয়ে সারে নয় টাকার মতো।
তখন টাকার যথেষ্ট মূল্য ছিল –
একটা আধুলীতেই পাওয়া যেতো পূরো এক ছটাক ভাজা ছোলা।
বুঝলাম নিশ্চয় ওই জ্বীনের কান্ড
কাউকে বলা যাবে না,
প্রকাশ করলে নাকি ওরা কোনদিন আর কাছে আসে না
তাই গম্ভীর হয়ে ঘুরি আর ছোলা কিনে দেদারসে আড়ালে একা খাই।
এক বন্ধু থাকতো আমার কাছে
ওকেও ব্যপারটা বুঝতে দিতাম না।

কয়েক দিনে পরে –
সাঁঝের কুপি জ্বেলে দু-বন্ধু পড়তে বসেছি,
এক ফাঁকে হঠাৎ-ই ও’ বললো –
’জানিস তোর ট্রাঙ্কে তালা মারা থাকলেও চাইলে ডালা জাগিয়ে
অনায়াসে কোণায় কিছু রাখা যায়
কিন্তু বের করা যায় না!’
শুনা মাত্রই স্তব্ধ হয়ে গেলাম
মুহুর্তেই হারিয়ে গেলো সেই জমিদারী ভাব,
ঘোরালো এক চিন্তা ছটফট করতে লাগলো মাথায়।
ওর ট্রাঙ্ক ছিলো না
বোকামিটা বুঝলাম যখন
ততক্ষণে ভেসে এসেছে কানে ফোকলা দাঁত অ’লা এক জ্বীনের
বিদ্রুপাত্নক খিটমিটে হাসি।

অনিমেষ

অনিমেষ পাল নৌকার মাস্তুলে পাল খাটাবার কাজ করে, তার কাজ এটুকুই। এর পর ছইয়ের ভিতর ঘুম। অনিমেষ যদি ঘুম জমাত; তাহলে ব্যাংকের কোন ভোল্টে জায়গা হত না। ইদানীং অনিমেষ ঘুমোতে পারছে না, ঘন্টার পর ঘন্টা অসল বসে থাকছে। দুই চোখ বুজে দেখেছে কিন্তু ঘুম আসছে না। সেই মধুর দৃশ্য বারবার ভেসে উঠছে।

রবিন পোদ্দার মাঝি; নৌকার বস কী কুক্ষণে গত সপ্তাহে তার বাড়ি যাওয়া হয়েছিল। এই যাওয়াই কাল হলো। রবিনের স্ত্রী মালতী নিচু হয়ে তার পাতে ভাত বেড়ে দিয়েছিল, মালতীর গোপন অঙ্গের কিছু অংশ সে দেখে ফেলেছিল।

এই দেখানো ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছায় এই দ্বন্দ্ব তার কাটছে না। তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কোনভাবেই এই দৃশ্য তাড়াতে পারছে না। উনিশ বছরের অনিমেষ বড় কষ্টে আছে, কষ্ট কথা কাউকে বলতে পারছে না।

রবিন পোদ্দারের বাড়ি পুনরায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা কিন্তু সেটাও হয়ে উঠছে না।

অনিমেষ বাতাসের গতি বুঝে পাল খাটায় কিন্তু নারীর মনের গতি বোঝা তার সাধ্যের বাইরে।

অতঃপর উনি পকেটে রাখলেন … চেয়ে থাকলাম

3009h রাস্তার পাশে জমিনটায় সবুজ ধান গাছ, বাতাসে হেলেদুলে লুটিয়ে পড়ছে। আমার লাগানো কৃষ্ণচূড়ার গাছটা ফুল ফুটে লাল রক্তিম হয়ে আছে। বাতাস এবং বৃষ্টির ঝাপটায় কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি কিছু রাস্তায়, কিছু ধান ক্ষেতে পড়ে আছে। বৃষ্টিতে ভেজা গন্ধ বিহীন কৃষ্ণচূড়ার কচি কচি পাপড়ি পড়ে রাস্তায় যেনো শহুরে রমণীর গাঢ় লাল রংয়ের লিপষ্টিকের ঠোঁটের আকার ধারণ করেছে।

শিমুল, পলাশ কিংবা কৃষ্ণচূড়ার সময়কাল আমাকে করে পাগলপ্রায়। কতোদিন ভেবেছি শুভ্র-শ্বেত আকাশের নিচে কৃষ্ণচূড়ার মৌসুমে তোমার হাত ধরে দাঁড়াবো। তোমার কালো কালো কেশে ঝরে পড়বে পাপড়ি ঠোঁটে থাকবে গাঢ় লাল লিপষ্টিক। আলতো করে হাত ধরে হেঁটে যাব বাঞ্ছারাম পুকুর, পাড় হতে সেই নামহীন স্বর্গে।

চিকন সরু কাঁদা মাটির রাস্তা। দুই পাশে লম্বা লম্বা দূর্বা ঘাস, মাঝখানে সাদা মিহি বালু। রাস্তার পশ্চিম পাশে নানাজাতের গাছের মাঝে কৃষ্ণচূড়া গাছ তারপর ফসলের জমি। পূর্ব পাশে কচুরি পেনায় ভরপুর বাঞ্ছারাম পুকুর। পেনায় জড়িয়ে লক লক করা কলমি শাক, পুকুর পাড়ে বসত করা লেদু মিয়া রান্না করে খায়। পুষ্টহীন ষাট বছরের লেদু মিয়াকে দেখলে মনে হয়, কলমি শাক খেয়েই কোনো রকম বেঁচে আছে। দরিদ্রতার প্যাচে পড়ে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য কারো কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই এই প্রাণপণ লড়াই। তারপরও দেখা হলে হেসে উঠে জানতে চায় “কেমন আছো বাবা”। আমিও হাসি মুখ করে উত্তর দিই “স্বর্গে আছি” চাচা। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সংসারের অভাব -অনটন তুলে ধরে। দীর্ঘশ্বাস আরো বড় হয় যখন বলে পুত্র সন্তান না থাকায় সংসারের হাল ধরার কোন মানুষ নাই। তারপরও আগে জিনিস সস্তা ছিলো ডাল ডিমে চলে যেতো দিন আর এখন সব।

আওয়াজ শুনে আমার ঘুম ঘুম ভাব ও স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। সন্ধ্যা ৬-১৫ মিনিটের বাস যাত্রীদের আসন গ্রহণ করার জন্য কতৃপক্ষের অনুরোধ। প্রচণ্ড গরমেও বিশ্রামগারে চেয়ারে বসতেই তন্দ্রাচ্ছন্নভাব গ্রাস করে আমাকে। আজ কয়েকদিন হাসপাতালে ইদুর বিড়াল দৌড়ে ক্লান্ত শরীর, তাই আর রাজধানীতে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ডাক্তার দেখানো শেষ হলেই দৌড় দিলাম বাস ধরতে। পকেট হতে মোবাইল বাহির করে দেখি ছয়টার কাছাকাছি, আর আমার বাস ছাড়ার সময় ৬-১৫ মিনিট। অনেক আগে একবার “দেশ বাংলা ট্রাভেল” করে ঢাকা হতে বাড়ি গিয়ে ছিলাম, খুব আরামদায়ক ও নিরাপদ মনে হয়েছে। তাই এইবার আবারও “দেশ বাংলা ট্রাভেল”-এ ভ্রমণে মনস্থির করি। টিকেট হাতে নিয়ে ধাক্কা খাই বাস ভাড়া বৃদ্ধি করেছে শুনে কারণ তেলবাজ এই দেশেও তেলের দাম বেশী।

ব্যাগটা চেয়ারে রেখে বেসিনে যাওয়ার জন্য রওনা হই মুখটায় পানির ঝাপটা দিতে। পরিচ্ছন্ন টয়লেট এবং বেসিন আমাকে অনেকটা স্বস্তি দিলো। টয়লেট হতে বাহির হয়ে দেখি গায়ে একটা বিশেষ বাহিনীর পোষাক পরা মুখের দাড়ি ও মাথার চুলে লাল মেহেদি করা প্রায় পঞ্চাশ বছরের এক লোক টাকা গণনা করতেছে। একটাই বেসিন ওটার সামনে ওনি দাঁড়ানো হাতে নতুন পুরাতন পঞ্চাশ /শত টাকার নোট কচ কচ করে গণনা করছে এবং ভাঁজ করছে। ভাবলেশহীন উনি আমি দেখেও না দেখার ভান করে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হচ্ছে না আমার মুখ ধোঁয়া। রোদে পুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই লোকটা অন্যের ডিম ডাল খাওয়ার টাকা আইনের দোহাই দিয়ে ছিনতাই করে দিন শেষে এই বাস কাউন্টারে হিসাব করে পকেটে নিচ্ছে নিজের উদর পূর্তি করতে। কার হবে এইসব টাকা রিক্সা, অটো রিক্সা, বাস, ট্রাক চালকের নাকি রাস্তার কোনো ফেরিওয়ালার। ভাবতে ভাবতে বাসে উঠে আসন গ্রহণ করি, হেডফোন কানে দিয়ে পাতলা কম্বল জড়িয়ে গান ছেড়ে দিই “এমন দেশটি পাবে…”।

গোশত

– ঘটনাটা অইলো কালামের, মানে টেকপাড়ার ফোচু কালামের। গ্যাদাকালে বারো মাস ওর নাক দিয়া সর্দি গড়াইতো, হালায় ফোচ ফোচ কইরা নাক টানতো, নাম অয়া গেলো ফোচু কালাম।

আকবর চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্তির সুরে বলেন,
– ত্যানা প্যাচাও কেলা! ঘটনা কও, মিয়া।
– ফোচুর তো পড়ালেখা অয় নাই। ক্লাস ফাইবে ইনবারসিটি পাস দিয়া কিছুদিন কামকুম করছে। পরে ঢুইকা গেছে ল্যাংড়া মিজানের পাট্টিতে।
– ও। মাগর কলাইম্যার বাপ বহুত ভালা আদমী আছিলো, টাকা আছিলো না হালার কলিজা আছিলো শরীল ভরা। পেটের ভুড়ি ভরা মহব্বত।

রমিজ মাথা দোলায়। আকবর চাচার সামনে আনন্দ বেকারির কাচ্চা বিস্কুটের প্লেট ও চা এগিয়ে দেয়,
– হ, চাচা। আমরা দুপুইর‍্যা রোইদে গাবাইলেও বকতো না।
– কালাইম্যার কথা জানি কি কইতা ছিলা!
– ল্যাংড়া মিজানরে ক্রস ফায়ার দেওনের পর বহুত দিন কালামে ভাগলপুর আছিলো।
– ভাগলপুরে ওর কে থাকে?
– চাচা, ভাগলপুর মানে ভাইগ্যা গেছিলো। পরে ফিরা নিজে ছিনতাই পাট্টি খুলছে।

আকবর চাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আগের মত পঞ্চায়েতের রমরমা থাকলে কালামকে জুতিয়ে সোজা করে ফেলতেন। কিন্তু ওই দিন আর নাই, মুরুব্বীদের শাসন কেউ মানেনা। রমিজ বলতে শুরু করে,
– পনরো বিশ দিন আগে, ওই যে টানা বিষ্টি অইলো, তহন কালামে একটা বড় দাও মারছে।
– বড় দাও মানে?
– ওইদিন বিষ্টির লেগা দোকানপাট আগে আগে বন্ধ অয়া গেছে। রাস্তায় ভিড় নাইক্কা। রাইত দশটায় রাস্তা ফাক্কা।
– তো?
– কালামে একটা রিকশা আটকাইছে। রিকশায় এক বুড়া কই জানি যাইতাছিলো। বুইড়ার পকেটে হাত দিয়া দেখে বহুত টাকা। কালামে টাকা লয়া টানাটানি করনের সময় বুড়ার গলায় চাক্কু দিয়া দিছে পাড়, বুইড়া মাথা কাটা মুরগির মতন ছটফটায়া স্পট ডেড। রিকশাওলা লাশ ফালায়া রিকশা লিয়া দিছে লৌড়।

আকবর চাচা যেনো বিশ্বাস করতে পারছেন না,
– কও কি ভাতিজা!
– হ, চাচা। পুলিশ ঘটনা লিয়া ঘাটায় নাইক্কা। ওইদিকে কালামও বউ লয়া আন্ডার গাউনে গেছে গা। মাগর, ওর অইছে আজীব ব্যারাম। ওর বউ আয়া সাবেত কবিরাজের কাছে বহুত কান্নাকাটি করছে।
– কুন সাবেত! ওই যে জ্বীন পালে!
– হ, চাচা।
– সাবেত হালারে পালে কে, আবার ওই পালবো জ্বীন! ভাতিজা, কালামের ব্যারামটা কি!

রমিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে কামড় দিয়ে বলে,
– ঘটনার শুরু ছিনতাইয়ের রাইত থেকা। কালামের ঘরে খাওন আছিলো না। ওর ৬বছরের মাইয়াটা গরুর গোশতের ভুনা দিয়া পারোটা খাইবার চাইছিলো। বুইড়ার কাছ থেকা ছিনতাই করা দুইটা ৫শ টাকার বান্ডিল লিয়া বাজারে গিয়া জুম্মনের কাছ থেকে রান আর সিনা মিলায়া গোশত কিনছে। ময়দা আর তেল লিয়া বাড়িতে ফিরছে।

আকবর চাচা বিরক্তি গোপন না করেই বলেন,
– দূর হালায়! তুমি আবার ত্যানা প্যাছাইতাছো কেলা! তোমগো চোদ্দ গুষ্টিতে তো কেউ ত্যানার ব্যবসা করে নাই, তুমি এই অভ্যাস পাইলা কই।

রমিজ কিছুটা বিব্রত হয়, কাঁচুমাচু স্বরে বলে,
– ওর বউ গোশত ভুনা আর পারোটা বানাইছে। পরোটা দিয়া গোশতের টুকরা চাইপ্যা ধইরা মুখে দিয়া চাবাইতে চাবাইতে আৎকা কালামে কয়, “থু: থু: থু: তরে আইন্যা দিলাম গরুর গোশত, তুই বুইড়া মাইনষের গোশত রানলি ক্যান!” বউ তো ভ্যাবাচ্যাকা খায়া গেছে, “বুইড়া মাইনষের গোশত পাইলি কই?” কয়া বউরে দিছে মাইর। বমি কইরা ঘরবাড়ি ভাসায়া দিছে।
– তারপর?
– কালাম অহনে গোশত ছাড়া কিছু খাইবার পারেনা। ওর বউ মুরগি, গরু, খাসি যেইটার গোশত রান্ধে কালাম মুখে দিয়া বমি কইরা দেয়, ওর কাছে সব গোশতই বুইড়া মাইনষের গোশত লাগে।

আকবর চাচা উদাস হয়ে বসে থাকেন, এরপর খুব জোড় দিয়ে বলেন,
– ভাতিজা, ওই রাইতে তুমিও তো কালামের লগে আছিলা। কি আছিলা না!

রমিজ হকচকিয়ে ওঠে। মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্কুটে কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে আকবর চাচার চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে বলে “না”। আকবর চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিদায় নেন, আর তখনই রমিজের মনে হতে শুরু করে ও বিস্কুট চিবুচ্ছে না, চিবুচ্ছে বুড়ো মানুষের মাংস- নোনতা, শক্ত, স্বাদহীন মাংসের রোয়াগুলো আটকে যাচ্ছে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে।

তেঁতুলগাছের ভুত

2880 উজাড় বাড়ি আসলে উজাড় নয়। একটা সময় গভীর জংগলে ছাওয়া ছিল। এই বাড়ির নাম শোনামাত্রই এখনও মানুষের গা ছমছম করে। যদিও আগের মতোন ঝোপ-ঝাড় এখন আর নেই। তবে এখনো যে পরিমাণ গাছগাছালি আছে, তাও একেবারে কম নয়। বিশেষ করে নাম না জানা কয়েকটি বড় বড় গাছ। এদের ডালপালাগুলোও এতো বিশাল যে, মাঝারি আকারের গাছের চেয়ে বড়। এখনো এই উজাড় বাড়িতে এমন কয়েকটি জায়গা আছে, যেখানে সূর্যের আলো-কেও অনেক কষ্ট করে প্রবেশ করতে হয়। সেই উজাড় বাড়ির উত্তর পাশে একটি তেঁতুলগাছ আছে। ইয়া বড়সড়। সেই তেঁতুলগাছের তলায় একটা ধানী জমি। সেই জমিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন ডাকসই খেলে। মাগরিবের আজান হলেই যে যার বাড়িতে ফিরে যায়।

প্রতিদিনের মতোন আজও সবাই সেখানে খেলাধুলা করছে। তাদের আনন্দের যেন আর সীমা নাই। কখন যে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে কেউ খেয়াল করেনি। এমন সময় তেঁতুলগাছের ভেতর থেকে একটি আচানক আওয়াজ বেরিয়ে এলো। আর সেই আওয়াজটা হল, তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…! এই ভয়ংকর কথা গুলো সবার আগে যার কানে ঢুকল, তার নাম ঐশী। ঐশী তখন চিৎকার করে বলল, সবাই খেলা বন্ধ কর। আমি তেতুলগাছের ভেতর একটি ভয়ানক আওয়াজ শুনেছি। সাথে সাথে সবাই খেলা বন্ধ করে ঐশীকে ঘিরে ধরে বলল, তুমি কি শুনেছ.. তাড়াতাড়ি বল। আমাদের আর তর সইছে না। এমন সময় আরো জোরসে সেই আওয়াজটি আবার স্পষ্ট শোনা গেলো।

তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…!

ইউশা বলল, এটা নিশ্চয়ই ভুতের গলার আওয়াজ। আমি ইউটিউবে ভুতের গল্প শুনেছি। একদম সেইরকম কন্ঠস্বর। ভুতেরা সব সময় কাঁপাকাঁপা গলায় কথা বলে। এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। সবাই চল… আমরা বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু ছোট্ট মেয়ে আরশি বলল, আমি ওসব ভুতপ্রেত এ বিশ্বাস করি না। বাবা বলেছেন, ভুত বলতে আসলে কিছুই নেই। ওরা কেবল গল্পেই থাকে, বাস্তবে থাকে না। আরশির কথায় সায় জানিয়ে পড়শি বলল, এটাই সঠিক কথা। আমিও শুনেছি। তখন ইউশা বলল, তাহলে তোমরা থাক, আমি চলে গেলাম। এই বলে ইউশা বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। এমন সময় ঐশী বলল, চলো আমরা দাদাভাইকে নিয়ে আসি। দাদাভাই অনেক জ্ঞানী আর সাহসী মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই এই রহস্যের একটা কিনারা করতে পারবেন। সবাই তখন সমস্বরে বলল, সেটাই ভালো হবে। সবাই চলো..চলো..। যাওয়ার সময় সবাই আবার শুনতে পেলো, তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…!

যাক অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ঐশীর দাদাভাই আবদুল হামিদ সাহেবকে নিয়ে ফিরে আসলো। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সবকিছু শোনে ঐশীর দাদাভাই জিজ্ঞেস করলেন, আওয়াজটা কি তেঁতুলগাছের কাণ্ড থেকে এসেছে নাকি শাখা-প্রশাখা থেকে? অন্য কেউ জবাব দেওয়ার আগেই আরশি বলল, আমার যতটা মনে হয়েছে আওয়াজটা তেঁতুলগাছের গোড়ার দিক থেকেই এসেছে। আরশির কথা শেষ হতে না হতেই আবার সেই আওয়াজটি শোনা গেলো। এখন আরও স্পষ্ট এবং পরিষ্কার। তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…! ঐশীর দাদাভাই বললেন, কোনো সমস্যা নেই। আমি সবকিছু বুঝতে পেরেছি। তেঁতুলগাছের গোড়ার দিকে একটা বিশাল গুহা আছে। সেখান থেকেই আওয়াজটা এসেছে। ঐশী আমার টর্চলাইটটা দাও তো বোন। ঐশী দাদাভাইয়ের হাতে টর্চলাইটটি দিয়ে মনে মনে গৌরব বোধ করলো।

সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো তেঁতুলগাছের ভুত ধরার এ্যাকশন। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারপাশে সুনশান নীরবতা। সবাই বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে তেঁতুলগাছের সেই গুহাটার মুখের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঐশীর দাদাভাই সাথে সাথে গুহার ভেতরে টর্চ জ্বালিয়েই হেসে উঠলেন। বললেন, আরে… সাজিদ যে! তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয় বলছি। সাজিদ ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এলো। মাটির দিকে মুখ। সবাই হা হা করে হাসতে লাগলো। ঐশীর দাদাভাই বললেন, সাজিদ কাজটা তুমি ভালো করনি। ভয় দেখানো দুষ্টু ভালো মানুষের কাজ নয়। তাছাড়া এসব গাছের গুহার ভেতরে বিষধর সাপ থাকে। আর কোনোদিন এমন কাজ করো না। সাজিদ মুখে কিছু বলল না, কেবল মাথা নেড়ে সায় জানালো।