বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

মামুনের অণুগল্পঃ তৃতীয় জনম

27599 ★ রাত শেষ হতে না হতেই জিসান বেশ তাড়াহুড়া করে বিছানা ছাড়লো। মা ভালোই বুঝলেন, কোথাও দৌড় লাগাবে। তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল, আজ কনসার্ট দেখতে যাবার কথা। সে তো শুরু হবে দুপুর তিনটায়!

একের পর এক আলমিরার প্রায় সব কাপড়ই বিছানার উপর ঝাঁপ দিয়ে একটার উপর আরেকটা পড়ে এক রংগীন পাহাড় হয়ে গেল। এরপর সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে একটা ছোটখাটো নানা রং এর সমুদ্র হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত ব্যালকনির কাপড় শুকানোর স্টিলের আলনা থেকে সাদা গেঞ্জি আর গাঢ় নীল জিন্সটাই হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো অস্থির ছেলেটা।

পিছনে যা কিছুই সে এলোমেলো করে রেখেছে, তার জন্য তাকে এ পর্যন্ত কখনোই ভাবতে হয়নি। কাজেই এলোমেলো সে প্রাণ খুলেই করে। বাসায় ফিরে আবার গুছানো দেখার তৃপ্তিটাও বেশ উপভোগের ব্যাপার।
যাদু!

ভবিষ্যতের ব্যাপারে দুর্ভাবনার কিছু এখনো হয়নি। ওর স্বপ্ন, ধ্যান, জ্ঞান একটাই- ছোট থেকে একসাথে বড় হওয়া বন্ধুর দল।
আর সব?
আছে নিশ্চয়, এত খেয়াল কি দরকার?

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখেন। ঠিক এখানটায় দাঁড়িয়ে, এক যুগ আগে অন্য আর একজনের চলে যাওয়া দেখেছিলেন। সামনে পিছনে সে ও ছেলের মতই দেখতে ছিল। ছেলের ফিরে আসার নিশ্চয়তাটুকু থাকলেও, সেই মানুষটির ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই জেনেও বহুদিন অপেক্ষা করেছিলেন।

এখন ও কি করেন না?

বৈধব্যের কি নির্দিষ্ট কোনো রং আছে?
একজন মানুষের চলে যাওয়াতেই কেন জীবনের রং বদলে যায়। এক নারী সাথীহারা হলে কি আর নারী থাকে না?
আকাশের বিস্তৃত নীলের মাঝে হারিয়ে এক মা তার দুঃখগুলোকে অনুভব করতে চান। দুঃখগুলো হারিয়ে যাক আকাশের নীলে! এক মায়ের আড়ালে বাস করা এক নারী তার সুখগুলোকে অনুভব করতে চায়, কিন্তু দু:খগুলো যে দেহধারী এই মায়ের চারপাশে ছড়ানো রয়েছে। তাই সুখগুলো আর অনুভব করা হয় না।

দু:খ জীবনের তরফ থেকে মায়ের জন্য উপহার।

মায়ের আড়ালে যে নারী বিদ্যমান- একজন বাবার চলে যাওয়ায়, সেই নারী যে কিভাবে নিষ্প্রভ হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যান, আমরা কি কখনো অনুভব করি?

মায়ের কাছে এক পলকের জন্য মনে হয়-
‘নারীর জীবনে পুরুষ কোনো না কোনো ভাবে থেকেই যায়। জিসানের বাবার চলে যাবার পর, সে এখন তার বাবার প্রচ্ছায়া হয়ে আছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এক যুবতী নারী এক মায়ে পরিণত হন।

জিসানের মা। তিনিও হয়েছেন।
সামনের সময়গুলিতে হয়ত ছেলের কাছে এক মা ও বিস্মৃত হবেন!’

ভোরের স্নিগ্ধ বেলা শুরুর ক্ষণে, এক দেহের দুই নারী, তার তৃতীয় জনমের অপেক্ষায় প্রহর গোনেন।

বৈধব্য এক বিবর্ণ আঁধার।
সাদার প্রলেপে একে যতই দৃশ্যমান করার চেষ্টা করা হোক না কেন, জীবন নিজের থেকে কখনোই একে একটুও রং দেয় না। এর ভেতরের অন্ধকার থেকেই যায়।

এক নারী তার দ্বিতীয় জনমে এক মায়ে পরিণত হন। তৃতীয় জনমে তবে একজন মা কি হন?

.
#তৃতীয়_জনম_মামুনের_অণুগল্প

মামুনের অণুগল্প: নীল কাব্য

276025

★ এক শীতের সকালে বড্ড উষ্ণ হয়ে আছেন তারিক মোহাম্মদ। ভোরেই খালের পানিতে স্নান সেরেছেন। অনুভূতির গভীর থেকে ক্রমাগত উষ্ণতর এক প্রস্রবণে ভেসে বেড়ানোর রহস্য কি ওই স্নানের সাথে জড়িত?

সাড়ে আটটা বাজে। স্কুল ঘরের কাছে আসতেই প্রশ্নটি আবারো মনে এলো। তার এই বয়সে এসে মানুষ শীতল এবং শান্তিপ্রদ এক অনুভবে বিলীন হতে চায়। সেখানে তিনি কেন এক ‘জ্বালাধরা’ অথচ বড্ড কাম্য এবং অনুভূতিতে রস্য, এমন কিছু গোপন ইচ্ছেপালকের ছোঁয়ায় থেকে থেকে তাড়িত হচ্ছেন?

তারিক মোহাম্মদ। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। এক সাধারণ মানুষ। আজ অনেকগুলো বছর এক অজ পাড়াগাঁয় জীবনের অণুগল্পগুলি লিখে চলেছেন।

গ্রামের এক স্কুল ও কলেজের সিনিয়র শিক্ষক। তবে মিলির কাছে তিনি ছিলেন শুধুই তারেক।
ছিলেন? এখন কি নেই? মিলি কোথায়? তিনি সেখানে নেই কেন?

ফারজানা মিলি।
একই বিশ্ববিদালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী মিলি। যেন পাশের বাড়ির মেয়েটি! বড্ড কাছের মানুষ ছিল তারিকের। আচ্ছা, কাছের মানুষ দূরে কেন চলে যায়? পাশাপাশি এবং কাছাকাছি থাকার মুহুর্তগুলো নিজেরাও কি বড্ড একঘেয়েমির শিকার?

টিচারস রুমে।
নিজের চেয়ারে বসে এলোমেলো ভাবছেন তারিক। বড্ড বর্ণাঢ্য জীবন তার! এইতো বেশ আছি। আমরা মনে মনে যা ভাবি, চেতন-অবচেতনের আরো গভীরেও কি সেই একই ভাবনা বয়ে চলে? তারিক কি আসলেই বেশ আছেন!

নিজের ডেস্ক। হাবিজাবি অনেক কিছুর সাথে অবহেলায় পড়ে আছে এক নীল খাম। অবহেলা না ইচ্ছেকৃত অবহেলার অপব্যবহার? জগতের ভিতর অন্য এক জগত। এক নীল খাম মিলি নামের এক তরুনীর চামড়ার হৃদয়ের সাথে মিশে থাকা সময়ের ঘ্রাণে মিলেমিশে,পরম আরাধ্য এবং চরম অসহ্যকর এক প্রগাঢ় অনুভবে তারিককে বিলীন করে চলে।

কোন্ সময়ের ঘ্রাণ? এই সময় না সেই সময়? কতগুলো সময় পার করলে কাউকে পাওয়া হয়ে ওঠে? তারিক কি সময়ের সাথে চলতে পেরেছিলেন?

শীতের এক বেলা শুরুর সময়, একজন তারিক মোহাম্মদ, বিগত এক দু:সময়ের নীরব পীড়নে একটু একটু কেঁপে উঠেন। দৃশ্যমান চিন্তাজগতে তার মনে হয় শীতের কারণে এমনটি হচ্ছে বুঝি। তবে তার অদৃশ্য চিন্তাজগতে অন্য কিছু মনে হয়। নিজের মস্তিষ্কে এক ‘প্যারালাল অণুচিন্তায়’ আক্রান্ত তারিক, এই মুহুর্তে তার মনের আসল সত্যটি বড় তীব্রভাবে অনুভব করেন। নীল খাম থেকে কিছু কালো হরফ বের হয়ে তাকে আরো নাড়িয়ে দিয়ে হেলিয়ে দিতে চায়। গুটি গুটি কালো অক্ষরগুলো হৃদয়ের তীব্র রক্তক্ষরণে সিক্ত হয়েছিল বুঝি। তাই এমন রক্তলাল অনুভব! প্রখর অনুভবে কষ্টের নিলীমায় ডুবে যেতে যেতে তীব্র ‘সাইনাস পেইনের’ অনুভূতি এনে দেয়।

কষ্টগুলো এতোটা কষ্টময় কেন?
“স্যরি।
অনেক ভাবলাম। তুমি যে জীবন চাইছ, আমি তা মেনে নিতে পারছি না। তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হবে। অনেক অনেক কষ্ট! কতটা তুমি কি বুঝ? বুঝার মাঝেও কিছু কি বাকী রয়ে যায় এখনো তোমার!


তবুও আমাকে যেতে হচ্ছে…।”
মিলির লেখা শেষ চিঠি। আজো সব মনে আছে তারিকের।

ডেস্কের তালা খোলেন। হাতের ছোয়া লাগে নীল খামে। সময়ের ঘ্রাণে তিনি উদ্দীপ্ত হন। এক বিশেষ সময়ে ফিরে যান। এই খামটি মিলি নিজের কালো ব্লাউজের ভেতর থেকে বড্ড নির্বিকার ভাবেই বের করে তাকে দিয়েছিল। ঠিক ওর হৃদয়ের ওপরে মনের বড্ড কাছাকাছি ছিল খামটি। বেশ কিছু সময়।

সে একটি নীল খামও হতে পারল না!!
প্রচন্ড এক আক্ষেপ মহাজাগতিক রশ্মির লেজ ধরে কোন্ সুদূর থেকে হৃদয় পানে ধেয়ে আসে! তারিক কষ্টের সাগরে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবেন, মিলির হৃদয়ের কাছে, মনের গোপন দরজাটির কাছাকাছি, কত থাকতে চেয়েছে মন! তবে মিলি বরাবরই কাছে-দূরের মানুষের মত আচরণ করেছে। নারীর স্বভাবজাত রহস্যময়ী আচরণ ছিল কি?

তারিক আজ এতোগুলো বছর পর, দৃশ্যের ওপারের দৃশ্য দেখবার চেষ্টা করেন। মনের ভেতরের মনকে দেখা কিংবা মনের অতল তলে অবগাহনের চেষ্টা কি এতটাই সহজ?

‘মিলির জীবনে আমি একটি নীল খাম হয়েও কিছুক্ষণ থাকতে পারলাম না!’

তারিকের অদৃশ্য চিন্তাজগত এই অনুভূতিতেই পাক খেতে থাকে। তার ‘প্যারালাল চিন্তাজগতের’ অন্যপাশে এক কবির উদয় হয়। একই মানুষের দুই ভূবনের অনুভূতির তীব্রতায় তারিক মোহাম্মদ এবং মিলির তারেক কেঁপে কেঁপে ওঠেন। গ্রামের এক স্কুল ঘরের টিচারস রুমে.. এক শীতের সকালে.. একা একা।

হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অক্ষরে রুপ নেয় বড্ড নির্মমতায়। অন্য এক তারিক মোহাম্মদ নীল খামে বেদনার নীল কাব্য লিখে চলেন জীবন ক্যানভাসের পাতায় পাতায়!

‘একটি নীল খাম
আর বিবর্ণ এক চিঠি,
অনেক বসন্তব্যাপী কিছু সুপ্ত অনুভূতির লুপ্ত চেতনায়
বদ্ধ দেরাজে এখনো বিরাজমান।
যদিও ওর বুকে লাঙ্গল চষা যরীন হরফগুলো
এখন লুপ্তপ্রায়।

কবে কোন হৃদয় পুড়েছিল বলে-
ধোঁয়াটে ঘ্রাণে মিশে থাকা
সময়ের ঘ্রাণে আপ্লুত এক নীল চিঠি
এই পড়ন্ত বেলায় এসে এখনো
বুকের গভীরে জ্বালা ধরায়।

নীল খামে নীল অনুভূতি প্রেরণকারিণী,
এখন যদিও বিস্মৃতির অন্তরালে। তবুও
স্মৃতিরা জাবর কাটে দুঃস্বপ্নের রাতকে ঘিরে।
আর বদ্ধ দেরাজে মৃত স্বপ্নরা
আশা জাগানিয়া খেলা খেলে।
নীল খাম নীল কাব্য হয়ে
বেদনার অণুগল্প লিখে চলে।’

স্মৃতির মিনারে দাঁড়িয়ে এক প্রেমিক পুরুষ, এক নীল খামে জীবনের হারানো সুরকে খুঁজে পেতে চান। খুঁজে পাবেন কি?

#নীল_কাব্য_মামুনের_অণুগল্প

মামুনের অণুগল্প : সেতু

2757

★ অনেক দিন পরে ওরা দু’জন একসাথে টিভি দেখছে। কণা আর শিহাব। এখন তো ভারতীয় চ্যানেলগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য। আর শিহাবের পরিবারে বউ আর ছেলেমেয়ের। এদের ভিড়ে কদাচিৎ নিজের দেশীয় চ্যানেলগুলোতে পাঁচ দশ মিনিট একটু ঢু’ মারতে পারলেও নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান ভাবে শিহাব।

স্টার প্লাস নামের একটি চ্যানেলে সিরিয়াল চলছে। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে কেন্দ্র করে তাঁর স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের বাকী সদস্যদের বউটির প্রতি তাদের কর্মকাণ্ড দেখাচ্ছে। দেখতে দেখতে হঠাৎ কণা বলে,
– আমার ভাগ্যে এমন আন্তরিকতা জুটলো না । দু’বার মা হলাম, সময়গুলো এমনি এমনিই চলে গেলো। অবহেলায় আর অনাদরে।

কণা কি বুঝাতে চাইছে শিহাব ভালোভাবেই উপলব্ধি করে। অন্য সব বিষয়ের মতো যে কোনো প্রসঙ্গে শিহাবের মৃত বাবা-মা কে টেনে না আনলে কণার দিন কেনো জানি ভালো যায় না। এক সাথে থাকলে কোন্ পরিবারে একটু আধটু টক্কর কিংবা মনের অমিল হয় না? কিন্তু সেগুলোকে সামনে এনে বার বার কাউকে আঘাত করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? শিহাব ভাবে। আজ কেনো জানি ওর মাথার তাঁর ছিড়ে যায়। প্রচন্ড এক ক্রোধ ওকে পেয়ে বসে। আজ কিছু একটা ঘটেই যেতো। ঠিক ঐ মুহুর্তে যদি ছোট মেয়ে রুপা বাবার কাছে না আসতো।

মেয়ে হুবহু মায়ের কপি। উপরের ঠোঁটের ডান পাশের তিলটিও কণার মত। মেয়েকে দেখে ধীরে ধীরে শান্ত হয় শিহাব। মেয়ে বাবার পাশে বসে। বাবার পাতলা হয়ে আসা চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। কেমন ঘুম ঘুম অনুভবে একটু আগের ক্রোধের শেষ অংশটুকুও জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। কণার দিকে ফিরে তাকায়। তিল সমৃদ্ধ ওর তিলোত্তমার প্রতি কেন জানি প্রচন্ড এক ভালোবাসা জেগে ওঠে। টিভি পর্দার দিকে নিবিষ্ট কণার ঝগড়াটে মুখচ্ছবিও শিহাবের আরো ভালো লাগে। অথচ একটু আগেই কল্পনায় ওকে মেরে ধরে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো।

ভাগ্যিস রুপা এসেছিল। সংসারে স্থিতি অবস্থা বজায় রাখতে কাউকে না কাউকে তো নিরব হতেই হয়। শিহাব সব সময়ে নিরবতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু কতক্ষণ এবং কতবার? তবে যখনই সীমা পার হয়ে এপার ওপার কিছু একটা করার ভাবনায় পেয়ে বসে, তখন মেয়েদের অস্তিত্ব টনিকের মতো কাজ করে। শান্ত করার এক আশ্চর্য নিদ্রাকুসুম তেলের মতো। ওদের দু’জনের মাঝে মেয়ে দু’জন সেতুবন্ধনের কাজ করে।

মামুনের ৫০টি অণুগল্প // গল্প নং-৫

অণুগল্প: চোর ১৩৮

প্রতিদিনের মতো অফিস ফেরত একজন বাবার ভূমিকায় শিহাব। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে নিজের বেডরুমে। কণা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে। স্বাভাবিক নি:শ্বাস পতনের শব্দ এবং কিছু অংগের উত্থানপতনে বুঝা যায় সে গভীর ঘুমে।

ঘুমের ভান নয়।
ভান শব্দটা এজন্যই শিহাবের মনে এসেছিলো রুমে প্রবেশের মুখে। কণা প্রায়ই এমন দুষ্টুমি করে ওদের ছোট বাবুটাকে সাথে নিয়ে। হঠাৎ করে নৈশব্দের নিঝুম নিমগ্ন ক্ষণে, একাকী বিচরণরত শিহাবকে চমকে দেয় কণা। কখনো ছোট বাবুটা। এভাবেই চলে নাগরিক জীবনে বেমানান কিছু বাবাদের সংসার সংসার খেলার মাঝে, কিছু আনন্দঘণ মুহুর্ত! কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া। রিফ্রেশমেন্ট?
কণা ইচ্ছাকৃত করে?

সম্পর্কগুলি নিত্য নতুন টানাপোড়ণে ভোগে। দগ্ধ হয়। ক্ষয় হয়। তাই অনবরত এর পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। কণা বুঝে? তাই সহজ করতে এমন করে? বিবাহিত জীবনের কুড়ি বছর পার করে এসে ও কি সেই প্রথম দিকের অনুভবকে জাগিয়ে তুলতে চায়?

শিহাব কি বুঝে?
কখনো কি নিজে কণার মতো সম্পর্কগুলির ক্ষতের মলম হতে চেয়েছে? সম্পর্কের মাঝের ক্ষয় রোধে তুমি নিজে কি ভূমিকা নিয়েছো? আদৌ নিয়েছো কি?

নিজের কাছ থেকে এমন প্রশ্নে বিব্রত শিহাব হাসে। নি:শব্দে। এটা নিজের মনে হাসা। ইদানিং এভাবেই হাসে অনেকে। নিজের থেকে লুকোতেই অনেক বাবারা ও এমন করেন।

ছোট্ট বাবুটা ঘুমন্ত মায়ের পাশে বসে হোমওয়ার্ক করছে। শিহাব নিরবে পাশে বসে। একটু দেখে। এটা মেয়ে বাবু। তবে পুরোদস্তুর ছেলেদের পোশাক পরে আছে। কান টুপি ও পরেছে একটা। দুষ্ট এক ছেলের পোশাকে দুষ্টু মেয়েটি স্কুলের কাজে মগ্ন। তার ভিতরেও বাবার পাশে বসাটা অনুভব করে। সে ও বাবার দিকে না তাকিয়ে নিজের মনে হাসে। ওর হাসি নিজের থেকে নিজেকে লুকোতে নয়। নিজেকে জাহির করতে। বাবার অনুপ্রবেশ তার ব্যস্ততার ভিতরেও অনুভবের ‘নোটিফিকেশনে এক্সিকিউট’ হয়েছে, ধরা দিয়েছে ঐ নিরব হাসির দ্বারা।

শিহাব মোবাইলে পাওয়ার ব্যাংকের সংযোগ দিতে দিতে স্বগতোক্তি করে,
– তরকারি চুরি করে খেয়ে এলাম।
বাবুটা এবার বাবার দিকে তাকায়। তবে তার হাত কাজ করে চলে। ইরেজার দিয়ে পেন্সিলের লেখা মুছছে। সে প্রশ্ন করে,
– তুমি তো এমনিতেই খেতে পারো। চুরি করা লাগে কেনো?

মোবাইলে চোখ, কী’র উপর আংগুল, শিহাব প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– আমার চুরি করে খেতেই ভালো লাগে। আমার ভিতরের চোরটা এই কাজ করে।

পাশের রুমে বড় কন্যাকে হাউস টিউটর পড়াচ্ছে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ছোট বাবুটা হেসে হেসে অল্প আওয়াজে বাবাকে বলে,
– আস্তে বলো পাপা, স্যার শুনবে।
– শুনুক। সবার ভিতরেই একটা করে চোর থাকে।
– সবার ভিতরে? স্যারের ভিতরে ও চোর আছে?

ছোট বাবুটার প্রশ্নের উত্তরে শিহাব একটু থামে। ভাবে? শেষে উত্তর দেয়,
– হ্যা। আছে।
– সে কি চুরি করে?
– ধরো, সে নিজের পাপাকে ফোন করে বললো যে বই কিনতে হবে, হাজারখানিক টাকা পাঠাও। তার বাবা টাকা পাঠিয়ে দিবে। সে আড়াইশো টাকা বইয়ের পিছনে খরচ করলে বাকী সাড়ে সাতশো’ টাকা বন্ধুদের কে নিয়ে বিড়ি ফুঁকে শেষ করবে। এটা তার ভিতরের চোরটা করে।
– এটা তো স্যারের বাবাকে মিথ্যে বলা হলো, তাই না পাপা? এই চোরটা তোমার চোরের চেয়েও খারাপ।
– হ্যা বাবা।

বাবুটার পরবর্তী প্রশ্নে শিহাব বিব্রত হয়,
– পাপা, তুমি কি কখনো দাদা ভাইয়ের সাথে এমন করেছো?
কি উত্তর দেবে ভাবতে সময় নেয় শিহাব। তবে বাবুটাই ওকে উদ্ধার করে। সে হোমওয়ার্ক করা অবস্থায় লজ্জিত হেসে বলে,
– আমার ভিতরেও একটা চোর আছে পাপা! 🙂

– হ্যা আছে। 🙂 তোমার চোরটা কি করে?
– আমার চোরটা অনেক কিছু করে। তুমি ঘুমিয়ে গেলে তোমার মোবাইল দিয়ে গেমস ডাউনলোড করে। আপুর ভিতরের চোরটা ও আম্মুর মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে ঘুরে ফিরে আবার তার একাউন্ট ডি-এক্টিভেট করে রাখে। ও মাই গড! আমি তো অনেকের ভিতরের চোরকে দেখতে পাচ্ছি পাপা! জান্নাতি, আমেনা, মিতু- ওদের ভিতরের চোরগুলি ক্লাসে কি করে আমি এখন জানি পাপা 🙂
শিহাব ছোট বাবুটার উচ্ছ্বাসিত অনুভবে ধীরে ধীরে ভালোলাগায় কোমল হতে থাকে। সময় বয়ে চলে। নিরুদ্বেগ সময়। আবারো প্রশ্ন বাবুটার,
– পাপা, সব চেয়ে বড় চোর কাদের ভিতরে থাকে?

উত্তর দিতে গিয়ে থামতে হয়। বাবাদের কখনো কখনো ভেবে চিন্তেও উত্তর দিতে হয়। শিহাবও দেয়,
– যারা একসাথে অনেক মানুষকে মিথ্যে বলে, কথা দিয়ে কথা রাখে না-তাদের ভিতরের চোরগুলি সবচেয়ে বড়।
– তারা কারা? আমি কি চিনি তাদের?

ছোট্ট বাবুটার মাথার চুল নেড়ে আদর করে শিহাব। মুখে বলে,
– আরেকটু বড় হলে তুমি নিজেই তাদেরকে চিনে নেবে। এটা মনে করো তোমার একটা এসাইনমেন্ট।

শিহাবের মন তখন নিরবে ভাবে, ওর বসবাসের ভূ-খন্ডে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে, নির্দিষ্ট কিছু মানুষ, একসাথে অনেক মানুষকে মিথ্যে বলে, সময় হলে কথা দিয়ে কথা রাখে না। এখন এটা একটা ‘ট্রেন্ডে’ পরিণত হয়েছে। এই নির্দিষ্ট মানুষগুলিকে ‘রাণী মৌমাছি’র মতো ঘিরে আমজনতার প্রদক্ষিণ, এই ‘ট্রেন্ড’কে ‘সিস্টেমে’ পরিণত করেছে।

সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে নিত্য নতুন বড় চোরেরা শূণ্য জায়গাগুলি দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ভেবে ব্যথিত হন একজন বাবা। উত্তরপুরুষের জন্য এমন চোরসমৃদ্ধ একটি ভূ-খন্ড রেখে যেতে হচ্ছে!

আচ্ছা, সিস্টেম পাল্টানো যায় না? শুরুর শুরুটা তো অন্ততো করে যাই আসুন..

#চোর_অণুগল্প_১৩৮

ছোটগল্পঃ ও কেনো এতো সুন্দরী হলো?

20595_n

একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর করে বাবা-মার সাথে ছিলাম। দেশের অন্যতম এক সমৃদ্ধ বিভাগীয় শহরে পরিপূর্ণ জীবন আমলা বাবার নিয়ন্ত্রণে বেশ আনন্দময়। ইচ্ছেঘুড়ির নাটাই বাবার হাতে থাকলেও যথেচ্ছা উড়াবার স্বাধীনতা ছিল আমার। উড়াচ্ছিলাম। বাউরি বাতাসে নিজেও ভেসে যাচ্ছিলাম।

এ অবস্থায় বর্ডার সংলগ্ন একটি স্কুল ও কলেজের দায়িত্ব চাপলো আমার ঘাড়ে। দায়িত্ব নিলাম। সুন্দরভাবে পালন করলাম। উপভোগও করলাম সেই সময়টুকু।

পরিবারের বড় ছেলে। লেখাপড়া শেষ। সুন্দর চাকরি। বিয়ের জন্য আদর্শ বয়স। বাবা-মা বিয়ের জন্য অত্যন্ত তৎপর। বাবা সরকারি চাকুরীজীবি হবার কারণে, আমাদের বেড়ে ওঠা এবং মেলামেশা ছিল বাবার কলিগ পরিবারগুলোর সাথেই। সবার ভিতরে থেকেও, এই বিশেষ সার্কেলটি ছিল ক্ষমতার দম্ভে পরিপূর্ণ প্রাচুর্যের অধিকারী এক আলাদা শ্রেণি। যেখানে অন্য শ্রেণির সাথে শ্রেণি সংঘাত ওভাবে না থাকলেও এক আলাদা সমীহ জাগানিয়া অনুভবে তাড়িত হত অন্যরা।

যাইহোক, মা-বাবা থেকে আলাদা আরেক শহরে চাকুরির কল্যাণে নির্বাসিত একাকি জীবন কাটাই সপ্তাহের ছয় দিন। আর আর্কের টুলুর গান শুনি, ‘এই একেলা জীবন, ভালো লাগে না আমার…’। নিজের ভিতরেও একজন প্রিয়দর্শিনীর অভাব অনুভব করছিলাম।

একদিন মায়ের ফোন। তখন গ্রামীন ফোনের পোষ্ট পেইড যুগ। আমার বর্ডার সংলগ্ন কলেজের আবাসিক ভবনে আ্যান্টেনা দিয়ে কোনমতে নেটওয়ার্ক পাই। মা আমাকে শহরের বাসায় চলে আসতে বললেন। খুবই নাকি ‘আর্জেন্ট’।

বাসায় পৌঁছাতেই আমাকে বলা হলো, ‘আমরা মেয়ে পছন্দ করেছি, আজ অমুক আংকেলের বাসায় তোমাকে দেখবেন মেয়ে পক্ষ।’ আমাকে স্রেফ জানানো হলো। এক মুহুর্তে নিজেকে কোরবানির পশুর মত মনে হলো। একটু গাইগুঁই করার চেষ্টা করলেও লাভ হলো না। বাবার সামনে ‘না’ বলার মত সক্ষমতা তখনও অর্জন করিনি।

খুব কাছের ক’জন বন্ধু ছিল আমার। মনের কষ্টটা ওদেরকে শেয়ার করতে চাইলাম। আমাদের আবাসিক এলাকা থেকে একটু দূরে অন্য আরেক এলাকায় থাকতো তারা। এটাও এক সরকারি কলোনি। বাবার কলিগদের বাসস্থান।

এক ভরা দুপুরে গেলাম ওদের কাছে। সিগ্রেটের ধোঁয়ায় নিজেদেরকে ঝাঁপসা করে দিয়ে আমার টেনশনের কথাটা উপস্থাপন করলাম। বাবা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছেন। এখন মেয়েপক্ষ আমাকে পছন্দ করলেই গেছি।
বন্ধুরা আমাকে টিপ্পনি কাটার পাশাপাশি হইহই করে আমাকে নিয়ে পড়লো। আমার অবস্থা কেন জানি ওদের আনন্দের খোরাক হলো। হয়ত এমনই হয় বন্ধুর বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে।

আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম ডি-টাইপের বিল্ডিং এর সামনের এক চিলতে সবুজের ওপর বসে। এল-টাইপের পিচের রাস্তা মাঠটাকে আবাসিক ভবনগুলির থেকে আলাদা করেছে। ফাগুনের পাতা ঝরার দিন। রাস্তার দু’পাশের প্রাচীন বৃক্ষগুলি এলোমেলো বাতাসে নিরবচ্ছিন্ন পাতা ঝরিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তাকে দেখলাম!

ছেলেবেলা থেকেই সুন্দরের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ। নারীর সুন্দর মুখশ্রী এবং রঙ তাদের ফিগারকে উহ্য রেখেই আমার অনুভবে দোলা দিয়ে যেত। ‘দুধে আলতা গাত্রবর্ণ ‘ কিংবা টোকা দিলে যেসব নারীর শরীরে রক্ত জমে যায়, এমন লাল-সাদা বর্ণ আমার ভিতরে আলাদা আবেদন জাগাতো (আমাকে বর্ণবিদ্বেষী ভাবাটাও কিন্তু ভুল হবে)। আমার ভিতরের ভালোলাগাটা ওভাবেই প্রকৃতিগতভাবে জন্মেছে, সেখানে আমার দায় কোথায়?
ডি-টাইপের এক তলা থেকে যখন সে বের হলো, প্রথম দর্শণেই আমার ভিতরের আমি নিজেকে জানালাম, ‘আমার পাঁজরের হাড় থেকেই একে বানানো হয়েছে! ওকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ন।’

পিচের রাস্তা দিয়ে গ্রীবা উঁচু করে উদ্ধত এবং নমনীয়’র মাঝামাঝি এক ভংগীতে সে হেঁটে যাচ্ছিলো। রাস্তার অপর পাশ দিয়ে আমাদের পাশ কাটানোর সময় সে আমাদের দিকে ফিরে তাকালো। ওর দৃষ্টিতে কি ছিল জানি না, আমি লুটপাট হয়ে গেলাম!

আমার ভিতরে কোথায় যেন বেজে চলছিল, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’!

বাবার পছন্দের মেয়েকে দেখতে যেতে হবে, সে কেমন হবে, আমার তাকে কতটুকু ভালো লাগবে, তাদের আমাকে পছন্দ হবে কিনা ইত্যকার ভাবনা-চিন্তায় বিব্রত মন আমার। মনের আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে। ঝড় না উঠেও বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে। ঠিক এমন এলোমেলো সময়ে আঁচল উড়িয়ে সে খোলা চুলে আমার সামনে এলো! আমি মুগ্ধ হলাম। ভালোলাগা ভালোবাসার আগুনে পুড়ে প্রেমে পরিণত হলো!

আমার ভাবনার চোয়াল শক্ত হতে থাকলো। জীবনে এই প্রথম ‘পছন্দের মেয়ে দেখা’ বিষয়ে বাবাকে ‘না’ বলার মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।

সেদিন। আসরের নামাজের পর। আমাদের পুরা পরিবার সেই ‘অমুক’ আংকেল’ এর বাসায়। বাবাকে না বলা হয়নি আমার। যেতেই হলো।

বসার ঘর। ভাইদের সহ বাবা-মা ভিতরে সবে আসন গ্রহন করেছেন। দরজার মুখে দাঁড়ানো আমি। নিজেকে নিয়ে প্রবেশ করব। ভিতরে একবার অলস দৃষ্টি বোলালাম। আবারও মুগ্ধতা!

তবে এবার আমি অবাক হলাম! দুপুরের বাউরি বাতাসে আমাকে লুটপাট করা হেঁটে যাওয়া এলোকেশী সেই মেয়েটি মাথায় সবুজ একটি ব্যান্ড পরে বসে আছে। আমাদের চার চোখের মিলন হলো ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’!

মুহুর্তে প্রাণে আমার মন জেগে ওঠে। এতদিনের পরিচিত পৃথিবীটা একটুখানি বদলে যায় ‘ওকে’ অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ সামনে পেয়ে। অপুর হৈমন্তিকে ‘পাবার’ মত আমিও ‘পাইলাম’ অনুভবে তাড়িত হলাম!

এরপর.. অনেকগুলি বসন্ত কেটে গেলো পাওয়া-না পাওয়ার গোলকধাঁধার ধোঁয়াশা ভূবনে। তবে ভালোবাসা আর প্রেম আমাদের ছেড়ে যায়নি কখনো। আমরা মানে আমি আর আমার লাল বউ, জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ে, স্রেফ ভালোবাসায় মেখে মেখে- হৃদয়ের এপিঠ ওপিঠ তন্নতন্ন করে সুখ খুঁজেছি। কখনও হতাশ হইনি। সে আমাকে আগলে রেখেছে। মায়ায়, ভালোলাগায় আর মুগ্ধতায় যে নিরন্তর প্রেমময় আবহ তৈরী করে রেখেছে সে, যার বাইরে আমার কখনোই যাবার প্রয়োজন পড়েনি। অচল আমার থেকে সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সে আমাকে আরো কাছে টেনে ওর বুকে ছোট্ট চড়ুই বাবুর মত আগলে রেখেছে।

এখনো সে আমার ভালোলাগার প্রথম প্রহর! এখনও সে শীতের নরম রোদের মত মায়াবী কোমল! সে উষ্ণতায় চোখ মুদে যাওয়া এক শীতের সকালে রোদ আর সাদা মেঘের ভিতরের মৃদু খুনসুটি। এরকম আরও অনেক অনেক বহু অনেক কিছুই সে!’

‘ওকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ ‘- হাসপাতালটির সামনে বাস থেকে নামার সময় ভাবে শিহাব। ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে ধীর পায়ে এলোমেলো শিহাব কখন যে বিশেষায়িত এই হাসপাতালের দেড় তলার ‘টেস্ট রিপোর্ট ‘ নেবার কিউতে দাঁড়িয়েছে.. ধীরে ধীরে পেছন থেকে কিউতে সবার সামনে এসেছে, বলতে পারবে না। সময় ছিল স্থির.. মনের ভিতর ঝড় উঠেছে। গভীর সমুদ্রে ডুবে যাবার প্রচন্ড ‘সাইনাস পেইন’ অনুভবের প্রখর সীমায়। কিন্তু খড়কুটো ধরে ভেসে থাকার মত কিছুই নেই। অন্য সব কিছুর মত শিহাবের লাল বউ-ই ওর জন্য আঁকড়ে ধরার একমাত্র খড়কুটো। সে-ই যখন ডুবে যাচ্ছে, কাকে আঁকড়ে ধরবে শিহাব?

বায়োপ্সি রিপোর্ট হাতে ভাঙ্গাচুরা একজন শিহাব হৃদয়ের গভীরতম জায়গা থেকে নিজের ইশ্বরের কাছে মিনতি জানায়, ‘ওকে ছাড়া আমি একমুহুর্তও থাকতে পারব না, আমাকে একা করো না!’

এক বিশেষায়িত হাসপাতালের দেড় তলা একটি কক্ষে ইশ্বর নিজের আলো এবং আঁধার দিয়ে একজন শিহাবকে জড়িয়ে রাখে। বাইরে সুর্য ডুবন্ত প্রায়। চলে আলো-আঁধারের মাঝে নিরন্তর দখল নেবার অন্তহীন খেলা।।

.
#মামুনের_ছোটগল্প

জলির প্রেমিক

জলির সাথে আমার প্রেম আছে, একতরফা প্রেম; জলি পাত্তা দেয় না। জলির বাবা ম্যাজিস্ট্রেট, আমার বাবাও একেবারে হেলাফেলার কেউ নয়। জেলার সবচেয়ে বড় চাউলের আড়ত আমাদের। চাউলের কারবার ছাড়াও দুটো সিএনজি ফিলিং স্টেশন আছে। আরো আছে ট্যানারি বা চামড়ার ব্যবসা।

টাকা পয়সা যা আছে একজন ম্যাজিস্ট্রেট কে কর্মচারী রাখা কোন ব্যাপারই না। তবু জলি আমাকে পাত্তা দেয় না। সামনে আমার বাবাকে সবাই সমীহ করে, বাবার সামনে গলা উঁচু করে কথা বলতে কেউ সাহস করে না। সে ডিসি কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটই হোক না কেন। কিন্তু আমরা জানি আড়ালে সবাই তাকে খালুয়া বলে, পশুর খালের ব্যবসার জন্য আড়ালে বাবার নাম ‘খালুয়া রশীদ’

অথচ আমরা অভিজাত পরিবারের সন্তান, আমাদের পূর্বপুরুষ বাগদাদ থেকে এদেশে এসে আস্তানা গেড়ে ছিলেন। বাবার নাম সৈয়দ রশীদ হায়দার, আমার নাম সৈয়দ রফিক হায়দার। ঈর্ষীত মানুষ আমাদের কাঙ্খিত মর্যাদা দিতে চায় না। আমাদের প্রচুর টাকা-পয়সা। আমরা দুহাতে খরচ করি, দান করি। জেলার এমন কোন মসজিদ মাদ্রাসা স্কুল হাসপাতাল নেই যেখানে আমরা মুক্ত হস্তে দান করিনি। তবু আমরা কাঙ্খিত সম্মান পাই না, মানুষ আমাদের পছন্দ করে না।

আমার বাবা সাংঘাতিক দরাজ দিল। যেভাবে আয় করেন সেভাবেই ব্যয় করে যান। আগেকার দিনে এমন মানুষকেই দানবীর হিসাবে আখ্যায়িত করা হতো কিন্তু ঈর্ষিত মানুষ আমাদের উদারতা কিংবা দান দেখে না। কোন এক কালে চামড়া রপ্তানিতে কিছু হেরফের করেছিলেন বাবা, ছাগলের চামড়ার সাথে কিছু কুকুরের চামড়া মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বাবার নাম ‘কুত্তা রশীদ’ কিংবা ‘খালুয়া রশীদ।

বাবার চামড়ার ব্যাবসায় আমার তেমন আগ্রহ নেই, আমাদের ছোট চাচা ওটা দেখাশুনা করেন। ট্যানারি ফ্যাক্টরির ধারেকাছেও আমি যাইনা, তবুও আমার গায়ে নাকি চামড়ার পচা গন্ধ আছে।

জলির বাবার সাথে আমার বাবার দারুন দোস্তি। একজন ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও কৃপাপ্রার্থী মত বাবার আশেপাশে ঘুরঘুর করেন। জলিদের বাসায় আমার অবাধ যাতায়াত, যখন ইচ্ছা তখনই যেতে পারি। জলির বাবা-মা আমাকে খুবই পছন্দ করেন, ভবিষ্যৎ জামাতা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছেন। বাবার সাম্রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি, আমার কাছে তাদের মেয়ে সুখে থাকবে এ ব্যাপারে তারা শতভাগ নিশ্চিত।

ম্যাজিস্ট্রেটের বাস্তব জ্ঞান সাধারণ মানুষের চেয়ে উন্নত, অস্বীকার করার উপায় নেই। বিষয় বুদ্ধির হিসাবে আমার চেয়ে যোগ্য পাত্র তাদের মেয়ের পক্ষে জোগাড় করা অসম্ভব সেটা তারা খুব বুঝতে পারছেন। আফসোস মেয়ে এটা স্বীকার করতে চাচ্ছে না। মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা ক্রমাগত করে যাচ্ছেন, অনড় মেয়ে এক চুলও নড়ছে না।

তার একটাই কথা খালুয়ার ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না তার গায়ে চামড়ার পচা গন্ধ। আমাকে অপমানের জন্য যেন এটুকুই যথেষ্ট নয়। চেহারা নাকি বাঁদরের মতো, কথা বলার ঢং জানি না, মুখে দুর্গন্ধ, কথা বলার সময় থুথু বেরোয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি নাকি চরম অশিক্ষিত।

অশিক্ষিত কথাটা মিথ্যা নয় দুই বার চেষ্টা করেও এসএসসি পাশ করতে পারিনি। তৃতীয় বার চেষ্টা করতে মন সায় দেয়নি। এসএসসি পাশ করিনি কিন্তু সিভিতে ডিগ্রী পাস লেখা আছে। বাবা আমার জন্য এসএসসি ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রির সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে রেখেছেন। জেনুইন সার্টিফিকেট, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও ভুল প্রমান করতে পারবে না।

টাকা থাকলে সবই হয়, সার্টিফিকেট কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটকেও পোষ মানানো যায়। কিন্তু অঢেল টাকা দেখিয়েও মামুলি একটা মেয়েকে বশ করতে পারছি না।

জলি আমার সম্বন্ধে অশিক্ষিত ছাড়া যা বলেছে চরম মিথ্যা। অশিক্ষিত হতে পারি অসংস্কৃত নই। গড়পড়তা মানুষের মুখের চেয়ে আমার মুখশ্রী সুন্দর। সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কথা বলার জন্য আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে যায়। মুখে দুর্গন্ধ চরম শত্রুও তা বলতে পারবে না। কথা বলার সময় থুথু বের হয় এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কেউ সতর্ক করে দেয় নি।

জলি আমাকে পছন্দ করে না মেনে নিতে পারি, মিথ্যাচার মেনে নিতে পারি না। আমি চাইলে জলিকে উঠিয়ে নেয়া কোন ব্যাপার না, তার ম্যাজিস্ট্রেট বাবাও আমাকে ছুঁতে পারবে না। কিন্তু জানি জোর করে প্রেম ভালবাসা হয় না, আমি অশিক্ষিত কিন্তু অসভ্য, অসংস্কৃত নই…

সত্যি ভূতের গল্প

মোকাম্মিল বলল সে ভূত দেখেছে; আমরা অবাক চোখে তাকালাম। সে বলল গতরাত বাথরুমে যাওয়ার জন্য যেই উঠানে পা রেখেছে অমনি একটা ভূত টান দিয়ে লুঙ্গি খুলে দৌড়ে পালিয়ে গেছে। আমি বললাম ‘লুঙ্গি খুলে ফেলেছে, নিশ্চয় মেয়ে ভুত’! ফজল বলল ‘তুই ভূতের চেহারা দেখেছিস’? মোকাম্মিল বলল চেহারা ঠাওর করার আগেই পালিয়ে গেল।
বাবুল বলল ‘তুই ভয় পাসনি’?
‘না, আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দিয়েছি ভয় পাইনি’।
আক্কাস বলল ‘ভূত কি তোকে ছুঁয়েছে’? ‘
ছুঁয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না।
যদি ছুঁত তুইও ভুত হয়ে যেতি, তোর উপর ভূতের আছর পড়তো।
তাহলে বোধহয় ছোঁয়নি, আমি তো ভূত না। আমি মোকাম্মিল।

জমে উঠলো ভূতের গল্প কে ভূত দেখেছে। ভূতের কাছাকাছি এসেছে বলতে সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠলো।

ফজলের গল্প এরকম- খালার বাড়িতে বেড়াতে গেছে, সন্ধ্যা হয় হয়। খেলার মাঠ থেকে ফিরে পুকুরে গেছে হাত পা ধুতে, হাত পা ধুয়ে যেই ফিরে আসবে অমনি কে তাকে ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দিল। কে ধাক্কা দিয়েছে কিছু ঠাওর করতে পারল না। ভিজা কাপড় নিয়ে পুনরায় উঠে আসবে অমনি আবার ধাক্কা। তৃতীয়বারও সেই একই ঘটনা। খালু মাগরিবের নামাজ পড়ে ফিরছিলেন তিনি এসে তাকে পুকুর থেকে উদ্ধার করলেন। খালা তাকে সন্ধ্যার দিকে পুকুরে যেতে বারণ করলেন। খালাত বড় ভাইয়ের সাথে রাতে বিষয়ে আলাপ করলে তিনি জানালেন এ নিশ্চয়ই আব্দুলের ভূত বেশ কয়েকমাস আগে এক সন্ধ্যায় এই পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল।

বাবুলের গল্পটা আরেকটু বিচিত্র। সে যে ভূত কে চিনে, সে বড় মায়াবী। মায়া কাড়া চেহারা তার। সে কাউকে ভয় দেখায় না, লুঙ্গি খুলে না, ধাক্কা দেয় না। বরং ফুল ছড়িয়ে দেয়। সে এলে ফুলের গন্ধে বাড়ি মৌ মৌ করে ওঠে। ঘটনা এরকম অনেকদিন আগে বাবুলের আম্মা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান, জ্ঞান ফিরলে তিনি বলতে থাকেন, রাবেয়া কে দেখেছেন। রাবেয়া তাকে অনেকগুলো ফুল দিয়ে গেছে। রাবেয়া বাবুলের বোন, অনেকদিন আগে হঠাৎ জ্বরে মারা গেছে। বাবুলের আম্মা ঘনঘন রাবেয়াকে দেখতে থাকলেন। আম্মার দেখাদেখি বাবুলও একদিন রাবেয়াকে দেখতে পেল। তাদের পাক ঘরের জানালার ওপাশে মান্দার গাছে বসে আছে। সে রাবেয়া বলে ডাক দিলে জানলা দিয়ে অনেকগুলো ফুল ছুড়ে দিল। বাবুল এখন প্রায়ই রাবেয়াকে দেখে।

আক্কাস বলল তার উপর ভূতের আছর আছে। তাদের বাড়ির পিছনে তেঁতুলগাছ। একদিন দুপুরে গাছে নীচে পাটি পেতে ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখল তেঁতুল গাছ দুলছে। গাছের দিকে তাকালে দেখল দৈত্যের মত একটা জন্তু গাছে পিঠ চুলকাচ্ছে। তার বিকট চেহারা, মুখ থেকে হাতির মত দাঁত বেরিয়ে এসেছে, রঙ কয়লার চেয়েও কালো। তার কপালে একটাই চোখ। সে বাবাগো বলে দৌড় লাগালে সেই বিকট জন্তু হাত লম্বা করা তাকে থামাল। বলল ঘাড় মটকে খাবে সে চিৎকার করে কান্না শুরু দৌড়ে এল তাদের পোষা কুকুর ভুলু। কুকুর দেখে ভূতটা পালিয়ে গেল।

আক্কাসের গল্প অদ্ভুত লাগছে। প্রথমত দিনের বেলা ভূত দেখা সম্ভব না। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কেউ দিনে ভুত দেখেছে বলে শোনা যায়নি। দ্বিতীয়ত একটা পুচকে কুকুরকে দেখে দানবের মত ভূত পালিয়ে গেল ব্যাপারটা বিশ্বাস যোগ্য না। আক্কাসকে বললাম তুই মিথ্যা বলছিস, সে আল্লাহর নামে কিরা কাটলো। তাতেও যখন বিশ্বাস করছি না তখন বলল ভুলুকে জিজ্ঞেস করে দেখ। ভুলুকে সাক্ষী মানলে আমাদের কিছু করার থাকে না, সে অতি অনুগত, বিশ্বস্ত কুকুর। আমাদের খুব ভালো বন্ধু।

তার কথা বিশ্বাস করা ছাড়া কোন উপায় থাকলো না, তবু একবার বলেছিলাম তুই নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিস। সে এমন রাগ করল যে তা দেখে ভুলুও ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। আমি আর কথা বাড়ালাম না।

সবাই এবার আমার দিকে তাকালো, আমার ভূতাভিজ্ঞতা জানতে চাইলো। আমার কথা শুনে তারা নিরাশ হলো। আমি এখনো কোন ভূতের পাল্লায় পড়িনি। তারা আমার দিকে অবজ্ঞার চোখে চাইল। তাদের চোখ দেখে বুঝতে পারলাম ভূত দেখিনি অর্থাৎ আমার জীবন ষোল আনাই মিছে।

তাদের সবাই ভূতের অভিজ্ঞতা আছে আমার নেই, এই প্রথম বন্ধুদের কাছে আমার মাথা হেঁট হলো। জীবন অসার লাগলো। বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা হল। এগারো বছর বয়সেও ভূতের অভিজ্ঞতা হয়নি; এটাকে কি জীবন বলে!

যে করেই হোক ভূতাভিজ্ঞতা আমার হতে হবে। শুনেছি ভূত রাতের বেলা খাটের নিচে থাকে, আড়াই ফুটি পেত্নীকে কখনো-সখনো বাথরুমে দেখা যায়। এসডিও বাংলার দেয়াল ঘেঁষে যে বটগাছ তার ডালে ডালে নাকি ভূতের বাস। ভূতের খুঁজে সম্ভাব্য সব জায়গায় রাতে-বিরাতে হানা দেওয়া হল, ফলাফল শূন্য। ভূতের দেখা মিলল না, ভূত আমার সাথে মোলাকাতে রাজি হলো না।

আমি ঠিক করেছি ভূতাভিজ্ঞতা না নিয়ে বন্ধুদের কাছে যাব না। কিন্তু কিভাবে অভিজ্ঞতা হবে ভেবে কোন কুল পাচ্ছি না। কার কাছে একবার শুনেছিলাম গোরস্থান ভূতের বাড়ি, ভাবলাম গোরস্থানে গেলে নিশ্চিত ভূত পাওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

একদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে দরজা খুলে গোরস্থানের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। আধা মাইল দূরের গোরস্থানে পৌঁছে দেখলাম শুধুই অন্ধকার। কোথাও কোনো ভূত নেই, নিরাশ হয়ে ফিরে আসবো এমন সময় দেখলাম একটা কবরের কাছে আলো জ্বলছে আর নিভছে। হঠাৎ আলোয় দেখলাম ধোঁয়া উড়ছে। আলো লক্ষ করে কাছে পৌঁছালে দেখলাম চারজন লোক গোল হয়ে বসে তামাকের মত কি একটা টানছে, বাতাসে বদ গন্ধ। আমি যে তাদের এত কাছে চলে গেছি কেউ খেয়াল করলো না, আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম এই তোরা কি ভূত। আমাকে দেখে তারা ভূত দেখার মত চমকে উঠলো, তারপর যে যেদিকে পারে দৌড়।

ভূতের দেখা না পেয়ে ফিরে আসছি, হঠাৎ এক কবরে আমার পা আটকে গেলো। যতই উঠাতে চাই ততই দেবে যায়, শেষমেষ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। আমি ভীতু না, খুব কম ভয় পাই কিন্তু কবরে ঢুকে ভীষণ ভয় পেলাম। কবর অবশ্য খালি কয়েকটা হাড় ছাড়া আর কিছুই নাই। অনেক চেষ্টা করেও উপরে উঠতে পারলাম না। কান্নাকাটি চিৎকার-চেচামেচি করেও কোন ফল হলো না। শেষমেষ হাড় গুলো একপাশে সরিয়ে ওখানেই শুয়ে পড়লাম।

সকালে আমাদের বাসায় হুলুস্থুল অবস্থা। ছেলে চুরি হয়ে গেছে, আম্মা ভাই-বোনদের কান্না শুনে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই হাজির, তারপর খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য পাওয়া গেল, প্রাতঃভ্রমণে বেরোনো একজন কবর থেকে উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। পরবর্তী কয়েক দিন বিড়ম্বনার মাঝে কাটল। বাসার দরজার লক বদলে গেল, চাবি চলে গেল আম্মার বালিশের নীচে। যে কোন দিন শাসন করার চিন্তাও করেনি আমার তিন বছরের ছোট ভাই সেও আমাকে শাষন করে গেল। এত ঝামেলার পরেও আমার ভূতাভিজ্ঞতা হল না, আফসোস…

সীতেশের প্রেমিকা সমাচার

সীতেশ যখন বলল আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। আমি বললাম ‘যা ব্যাটা ঝুলে পড়’। সে অবিশ্বাসের চোখে তাকালো, আমি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু; কোথায় সমবেদনা দেখাব উল্টা আত্মহত্যার উস্কানি দিচ্ছি।
আমি বললাম ‘তুই মরে যা’, ‘ব্যাটা লাড়কি তোকে ছেড়ে অন্যের গলে মালা পড়িয়েছে তোর মরে যাওয়া উচিৎ’।

শিখার সাথে সাড়ে উনচল্লিশ দিনের প্রেম শেষমেশ বিয়েতে গড়াল, অবশ্য সীতেশের সাথে নয় নিতাইয়ের সাথে। বিয়ের আগ পর্যন্ত সীতেশ জানতো না শিখা দুই ডাল থেকেই পেড়ে খাচ্ছে। নিতাই জুয়েলারির মালিক; গয়নার কমতি রাখবে না বলে ওয়াদা করেছে, শিখা তাতেই কুপোকাত।

সীতেশের আত্মহত্যার খায়েশ নতুন নয় শিখার আগে যার সাথে প্রেম ছিল সে ছেড়ে যাওয়ায়ও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। সেই মেয়ের নাম ছিল নুপুর। বলাবাহুল্য নুপুর এখন আমার প্রেমিকা, সীতেশের এটা অজানা। নুপুরের আগে দীপা, দীপার আগে টিঙ্কু।

সীতেশের প্রেমিকা বেশিদিন টেকে না তাতে কি; ছেড়ে গেলে কিছুদিন মনমরা থাকে ঠিক কিন্তু নতুন জোসে প্রেমিকা যোগারে লেগে যায়। শিখার বিয়ের তৃতীয় দিনই সীতেশ নতুন প্রেমিকা যোগার করে ফেললো।

আমার কাছে নতুন প্রেমিকার গুণগান করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে, আমি বললাম ‘তুই না শিখার জন্য আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলি’। সেই কথায় আমার উপর কি রাগ, জীবনে আর মুখ দর্শন করবে না।

তেরোদিন পরে পুনরায়; দোস্ত এবার সত্যি সত্যি মরে যাব, বুঝলাম এই প্রেমিকাও তাকে ডাম্প করেছে।

ভালোবাসার রকমফের

জিতেনের হয়েছে বড় সমস্যা; রুমকি কে মুখ খুলে বলতে পারছে না। অথচ বললেই ল্যাঠা চুকে যেত।

জিতেন রুমকি কে নয় রুমিকে ভালোবাসে কিন্তু রুমকি জিতেন কে নিজের খরিদ করা মাল ভেবে বসে আছে। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করে।

রুমি জিতেনের চোখাচোখি কয়েকবার হয়েছে, রুমির চোখে প্রণয়ের আভাস আছে। এগোনো যে যাবে সে ব্যাপারে জিতেন নিশ্চিত।

এখন শুধু রুমকি বিপদ পার হওয়া। জিতেন আজ ঠিক করে এসেছে যে ভাবেই হোক সত্য কথা বলে যাবে। রুমকির শাষনে জিতেন অতিষ্ঠ, খোলাশা করা ছাড়া মুক্তি নেই।

রুমকির সাথে রুমিকেও দেখা যাচ্ছে। এদুটি প্রাণী একসাথে ছাড়া চলতে পারে না, এদের গাঁটছড়া জীবন একজনকে টান দিলে অন্যজনও এসে পড়ে। জিতেন ভাবে আজকে রুমির সামনেই রুমকিকে বলে দিতে হবে, ঝামেলা ঝেড়ে ফেলতে হবে।

পার্কের বেঞ্চে পাশাপাশি তিনটে প্রাণী বসা, এই মুহূর্তে যে আলাপ সম্পন্ন হয়েছে। জিতেনের পক্ষে তা হজম করা মুশকিল হচ্ছে। জিতেন রুমকিকে বলতে পেরেছিল, রুমকি যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। রুমকি বলল ‘অনেকদিন থেকেই তোমাকে এই কথা বলতে চেয়েছিলাম তোমার সাথে আমার মিল হবে না, আমি রুমিকে ভালোবাসি, আমরা একসাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখি’।

জিতেন রুমির মুখের দিকে তাকালো, চোখের দিকে তাকাল সেখানে স্পষ্ট সমর্থনের ইঙ্গিত। অর্থাৎ রুমকির সাথে যৌথ জীবনে রুমির আপত্তি নেই।

জিতেন বিভ্রান্ত, তার মুখে কোন কথা সরলো না। সে কিছুক্ষণ কথা না বলে বসে থাকল তারপর উঠে ধীরে ধীরে চলে গেল। রুমকি রুমি হাত ধরাধরি করে বসে অনেকক্ষণ জিতেন এর চলে যাওয়া দেখল।

মামুনের অণুগল্পঃ হৃদয়ের জোছনায় বসে থাকা

251934_n

দাম্পত্য জীবনের অতি পরিচিত টুকটাক অণুমুহুর্তগুলো আসলেই অনেক দামী। অনেক আগে নিচের অণুগল্পটি লিখেছিলাম। এরপর অনেক সময় পার হয়েছে। আমিও বদলে গেছি- পেশা এবং বাহ্যিক অবয়বে। কিন্তু ভিতরের অনুভবক্ষম আমি তো সেই একই রয়েছি। যদিও এখনকার অনুভব আর আগের মতো লেখা হয় না। এখন লেখালেখি কেবলি পেশার কারণে। মফস্বল সাংবাদিকের আড়ালে আমি হারিয়ে গেছি।

আমার অনেক প্রিয় অণুগল্পটি আরও একবার শেয়ার করলাম..


‘নিজেকে নিজের মতো স্বার্থক করে নাও, সফলতার মাপকাঠি যেহেতু আপেক্ষিক তাই সবার ক্ষেত্রে সফলতা সম্ভব নয়। জীবনের গল্প সুখ-দুঃখের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এটাই তো জীবন।’

খুব প্রিয় এবং কাছের একজন মানুষ বলেছিলেন কথাগুলো। বাসায় এলে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলেই দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনা মাথায় জুড়ে বসে শাহেদের। পাশের সোফায় এবং ডিভানে বসে হিন্দী সিরিয়ালে মগ্ন ওর পরিবারের অন্যরা।

ওর কাছের মানুষদের চিন্তাগুলো কি তাদের নিজ নিজ ভূবন গড়ে নেয়ায়, সেখানে শাহেদের অবাধ যাতায়াত নেই দেখেই বোধহয়, ডাইনিং টেবিলে বসলেই তাঁর নিজ চিন্তাগুলি ওকে সঙ্গ দেয়? বন্ধুর মত!
চিন্তাবন্ধু নাম দেয়া যায় কি একে?

একবার বউয়ের দিকে তাকায়। সে তখন টিভির পর্দায়। বড় মেয়ে মোবাইলে ব্যস্ত। তবে এর ভিতর দিয়ে পর্দার চরিত্রগুলিতে মনোনিবেশ, কি মা’র সাথে টুকরো আলাপ- সিরিয়াল সংক্রান্তই বেশীরভাগ। এরা এক একজন ‘সিরিয়াল বিশেষজ্ঞ’। মেয়ে যে আসলে মোবাইলে কি দেখে বা চালায়, শাহেদ আজকাল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

ছোট ছেলেও ব্যস্ত। এরা দু’ভাইবোন সারাদিন ইংরেজি f আকৃতির মত ডিসপ্লের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকে। অফিস যাওয়া আসার পথে, এমন বাসভর্তি f দের চোখে পড়ে আজকাল শাহেদের।

ছেলে এখন গেমস খেলছে।
ওদের সবার একটা আলাদা জগত গড়ে উঠেছে। শাহেদের জগত কোনটা? সে তো এদেরকে নিয়েই এক জগতের সন্ধানে জীবন পার করছে। ওরা কি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা? ওদের প্রবেশ পথে কি শাহেদের জন্য এমন সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে ‘No Tresspassing’?

অফিস দিনের প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা খেয়ে ফেলে যাওয়া আসা মিলিয়ে। বাকিটুকুতে যা সময় দেয়া সবাইকে। হাতে থাকে বন্ধের দিন। ঘুমকাতুরে শাহেদ আবার বন্ধের দিনে ঘুমে কাটায় প্রায় দিনের অর্ধেক।

‘এই সাইনবোর্ডের দায় তোমার কি নেই একটু ও?’

নিরবে ভাতের দলা নাড়াচাড়া করছে দেখে টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মিলি জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? রান্না ভাল হয়নি নাকি?

শাহেদ নিরুত্তর থেকে মাখানো ভাতের এক দলা মুখে দেয়। উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মিলি। একটু কি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সে? সিরিয়ালের ‘ক্রুশিয়াল মোমেন্ট’ চলে যাচ্ছে? ভ্রুর হাল্কা কুঁঞ্চন কেন তবে? অবশ্য আজকাল শাহেদ অনেক ভুলভাল দেখে। বকে এবং ভাবেও সেভাবে নিজের মনে।

এত ভুল কেন জীবনে? মস্তিষ্কের প্রশ্নের উত্তর দেয় না মন। মিলি কিছু জিজ্ঞেস করায় মন আর সে, দু’জনেই ওর দিকে ফিরে তাকায়,
– অফিসের হোটেলের রান্না খেয়ে খেয়ে এখন আমার রান্না ভাল লাগছে না আর?

ভাতের প্লেট একটু দূরে ঠেলে দেয় শাহেদ। বাউলে পানি ঢেলে হাত ধোয়। প্লাস্টিকের বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করে। তৃষ্ণা মেটে?

এরপর মিলির দিকে তাকিয়ে বলে,
– সিরিয়ালগুলিতে আজকাল এসবও শিখাচ্ছে নাকি?
– মানে?

নাকের উপরটা গিরগিটির শরীরের মত লাল হয়ে উঠে মিলির। এক্ষুনি রেগে যাবে। শাহেদ সামাল দেয় এই বলে,
– তুমি ভাল করেই জানো যে তোমার রান্নার সামনে আর কেউ দাঁড়াতে পারে না আমার কাছে। তারপরও আউল ফাউল কথা কেন বলো?

আগের রঙ ফিরে পায় নাকটি। তবে ওখানেই সব শেষ হয় না। সিরিয়াল গুরুত্ব হারিয়েছে নারীর কাছে! সে এখন আবেগী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যখন মিলি জানায়,
– দেখলাম তো, কখনো তোমার খাবার হোটেল থেকে কিছু এনেছ আমাদের জন্য?

‘আমাদের জন্য’ শব্দ দুটি বলা কি ছেলেমেয়েদেরকেও নিজের দিকে টানার অপচেষ্টা?

তবে সে সফল হয়। ওর দুই বাচ্চার কান হরিণের মত। সবসময় খাড়া এবং সজাগ থাকে। তবে এদের সাথে হরিণের পার্থক্য এক জায়গায়, হরিণ যে কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ শব্দের উৎস খুঁজে বের করতে সজাগ হয়। ছেলে আর মেয়ে, তাদের বাবার বিপক্ষে যায় এমন সব কথায় f পজিশন থেকে I অবস্থানে চলে আসে।

এদিকে, দুই ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে আক্রমনে নামে মিলি,
– বৃহস্পতিবার দুপুরে খাও না তো, তরকারিটা আমাদের জন্য নিয়ে এলেও তো পারো? বিল তো দেয়াই লাগে।

এবার অসহ্য লাগে শাহেদের মিলির কথাবার্তাগুলো। মস্তিষ্ক বিপদ সংকেত দেয়। ক্রোধ বিপদজনক সীমার দিকে এগিয়ে চলেছে। শাহেদের ইচ্ছে করে মিলিকে এগুলি বলতে,
– তুই আর তোর মা হলি খয়রাতির জাত। জীবনে খাওয়া ছাড়া কিছু বুঝলি না?

বউয়ের মা’কে এক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়েই অহেতুক টেনে আনা হয়। যঅদিও ভদ্রমহিলারা বেশীরভাগ সময়েই আরোপিত অভিযোগের সাথে সামান্যটুকুরও সংশ্রব রাখেন না। তারপরও বউকে কথার আঘাতে তীব্রভাবে ঘায়েল করতেই ওনাদেরকে আনার লোভটুকু স্বামীরা কেন জানি সম্বরণ করতে পারে না।

কিন্তু মিলির দিকে তাকাতেই সব ভুলে যায় শাহেদ । নাকের নিচটা ঘেমে ভিজে আছে মিলির। তীক্ষ্ণ চোখে শাহেদকে দেখছে সে। ফ্যানের বাতাসে চুল উড়ছে তাঁর। অবাধ্য দু’একটা চুল চোখের উপর পড়েই সরে যাচ্ছে। ডান গালের তিল! এসব কিছু মিলিয়ে মিলিকে দেখে শাহেদের রাগ পড়ে যায়.. ধীরে ধীরে। সেই অদৃশ্য সাইনবোর্ডটির অস্তিত্ব এই মুহুর্তে আর অনুভব করে না সে একটুও!

মিলিও কি শাহেদের এখনকার পরিবর্তনটুকু লক্ষ্য করছে?
মিলিকে ধরে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে শাহেদের। আপনাতেই শাহেদের টোন চেঞ্জ হয়ে যায়, নিজেও টের পায়না কিভাবে কি বলছে সে,
– আসলে টানাটানির ভয়ে আনি না আমি। অন্য কিছু না।

মিলি অবাক হয়! লোকটা একটুও গালাগাল করলো না আজ! কিন্তু ক্রোধের শুরুটার সকল উপসর্গ শুরু হয়েছিল। দেখেছেও সে। আবার কেন জানি তীক্ষ্ণ রেখাগুলো সমান হয়ে মিলিয়েও যায়। ঐ দু’টি চোখে সেই প্রথম দিনের ভাললাগার চমক এই কিছুক্ষণ আগে দেখেছে সে। শাহেদের চোখে।
চোখ?
কোন চোখ?
একজন পুরুষের কতগুলি চোখ থাকে?

তবে শাহেদের চোখে তাকালে সেই প্রথম থেকেই নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার ইচ্ছে হতো মিলির! আজ বহুদিন পর সেই ইচ্ছেটার জন্ম হচ্ছে দেখে মিলিও অবাক হয়। ওর পুড়ে যেতে ইচ্ছে করে!

‘নাহ! আমার মানুষটা আমাকে এখনো আগের মত ফিল করে! আমিও করি। ওকে আমার আরো সময় দেয়া দরকার।’
নিজের খোলস বদলে এক অতিপরিচিত মিলি উঠে দাঁড়ায়। শাহেদকে জিজ্ঞেস করে,
– চলো, হাঁটতে বের হই। তুমিই তো বলো সবসময়- after dinner walk half a mile, কি? বলো না?

মেয়ে এবং ছেলের অবাক চাহনির সামনে শাহেদ দাঁড়িয়ে মিলির প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– হ্যা 🙂 বলেছি অনেকবার আমি। চলো, বের হই।

রাতের প্রথম প্রহরে নির্জন পিচ ঢালা পথে, এক জোড়া নব-দম্পতি হাত ধরে হেঁটে চলে। কিছুক্ষণ আগে ওদের খোলস বদল হয়েছে। হৃদয়ের পলেস্তারা খসে খসে- হৃদয়গুলো নতুন হৃদয়ে পরিণত হয়।

হৃদয়ের পুনর্গঠন!
পুনর্জনম বললে ভুল হবে কি?

অবিভাজ্য |পর্ব ৬-৭| মনসুখিয়া সিরিজ

৬.
মেরিন ড্রাইভ, এক্সোটিক সাম্পান হোটেলের চার তলা, বারান্দায় তিন জন বসে আছি। সি ভিউ বারান্দা, অনেক দূর পর্যন্ত সমুদ্র দেখা যায়, খুব দূর থেকে ছোট ছোট ঢেউ একের সাথে এক যোগ হতে হতে ধেয়ে আসছে, সাদা ফেনা নিয়ে আছড়ে পড়ছে তটে, আবার ফিরে যাচ্ছে।

মা বললেন,
– এভাবে রুবাইকে আনা কি ঠিক হলো! আমিও তো এতকিছু জানতাম না।
– সব কিছু ঠিক হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই, মা। তবে শাফাকাতের কাছে একটা চিঠি দিয়ে এসেছি, আজ আপাকে পৌছে দিবে।
– চিঠিতে কি লিখেছো?
– বেশি কিছু নয়।

পকেট থেকে ডুপ্লিকেট কপি বের করে মা’কে দিলাম, চিঠিতে লেখা আছে-

প্রিয় আপা,
সালাম নিও।
জানি তুমি আর দুলাভাই হন্যে হয়ে রুবাইকে খুঁজছো। থানা থেকে পীর-ফকিরের বাড়ি কিছুই বাদ রাখনি। রুবাই ছোট থাকতে সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলেই পারতে, এখন রুবাই আর রাফির মতামত ছাড়া সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতে পারো কি না- নিজেদের প্রশ্ন কোরো। এই যে দু’জনে একসাথে রুবাইকে খুঁজছো, একে অপরকে সামলাচ্ছো, হাত ধরে কাঁদছো- এডজাস্টমেন্টের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো!

চিন্তা কোরো না, রুবাই ভালো আছে।
ইতি
রুবাইয়ের মামা
এক্সোটিক সাম্পান, কক্সবাজার।

রুবাই জানতে চাইলো,
– এ চিঠি পড়ে বাবা-মা কি সিদ্ধান্ত বদলাবেন?
– জানিনা রে মা। তবে বিপদ মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, পরস্পরকে নতুন করে চিনতে শেখায়। বিপন্নতায় আর সঙ্কটে মানুষের পারস্পরিক দূরত্ব কমে আসে। তাই আশা করতে পারিস- হয়তো কাল সকালেই দেখবি তোর বাবা-মা কক্সবাজারে চলে এসেছেন।

রুবাই বিশ্বাস করতে পারছে না,
– যদি না আসে?
– তবে আর কি, তোকে নিয়ে মনসুখিয়ায় চলে যাবো।
– মনসুখিয়াটা আবার কোথায়?
– মনসুখিয়া আছে মনসুখিয়ায়। যাবার হলে তোকে জানাবো।

মা পান চিবুচ্ছেন। রুবাই নানুর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। সমুদ্রে সন্ধ্যা নামছে, বারান্দা থেকে ঢেউয়ের গড়ে ওঠা আর ভেঙে পড়া দেখছি, ফেনিল স্রোতের আছড়ে পড়া আর ফিরে যাওয়া দেখছি। ভিকারুননিসা একদিন গুনগুনিয়ে গেয়েছিলো ‘আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায় /তোমার হাতটি ধরে।’ তারপর সমুদ্র দেখার কত যে ছেলেমানুষী পরিকল্পনা, দু’জনে হাত ধরে সারারাত সৈকতে বসে চন্দ্রযাপনের স্বপ্ন। সমুদ্রে সে আসে কি না জানা নেই, বহু আগেই সে নটর ডেমের কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে হাত।

৭.
আপাকে দেওয়া চিঠির খামে গ্রিন লাইনের তিনটা টিকিটও ছিলো। আজ সকালেই রাফিকে নিয়ে আপা আর দুলাভাই এক্সোটিক সাম্পানে উপস্থিত হয়েছেন।

রুবাইয়ের মুখোমুখি হতেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাবা-মা’র সে কি কান্না। আপা এক ফাঁকে উঠে এসে আমার দু’গালে চড় কষিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।

এসব কান্না সংক্রামক, তাই ‘কাজ আছে’ অজুহাতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোট ট্রাভেল ব্যাগটা আগেই রিসেপশনে রেখে এসেছি, এখন নিরবে প্রস্থানের পালা।

মেরিন ড্রাইভ ধরে অটো ছুটছে। পথ ফিসফিসিয়ে বলে, ওগো মানুষ, আজও তোমাকে মনসুখিয়া ডাকেনি! একটা মাত্র মানুষ জীবন, ফুরিয়ে যাচ্ছে, মনসুখিয়া কি জানেনি!

পথের কানে কানে বলি, চাঁদের আলো আমাকে অসংখ্যবার খুন করেছে, রোদও খুন করেছে। এই ঢেউ, নোনা হাওয়া, সাদা ফেনাও বারবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছে, এমন কি তুমিও খুন করেছো। জানো পথ, মৃত্যুর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু যেদিন মনসুখিয়া আমায় খুন করলো, সেদিন জানলাম খুন হওয়াই বেঁচে থাকা। মনসুখিয়া যদি একবার ডাকে, চিরদিনের জন্য খুন করে, ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে উড়িয়ে দেয় হাওয়ায় হাওয়ায় তবে বেঁচে যাই।

পথ সুধায়,
– মনসুখিয়া জানে?
– মনসুখিয়া সব জানে, তবু ডাকে না, তার নিরবতা জুড়ে অভিমান খেলা করে।
পথ আবার ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,
– মানুষ, যাচ্ছো কোথাও!
পথের কানে কানে বলি,
– আমার সকল যাওয়াই মনসুখিয়ার দিকে যাওয়া।
– আমাকেও সঙ্গে নিও, নিবে তো!

এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না, হাতের ডানপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি, বায়ে মুখর সমুদ্র। পথকে বলি,
– ওগো পথ, যদি মনসুখিয়া ডাকার আগেই হারিয়ে যাই, যদি সকল দিন ফুরোয় আমার
তবে মনসুখিয়াকে বোলো, তার ডাক শুনবার অপেক্ষায় থেকে থেকে যে পথ হয়ে গেছে, সে’ই আমি।

(শেষ)

অবিভাজ্য/পর্ব-৫ [মনসুখিয়া সিরিজ]

তিন তলার গ্রিল দেওয়া বারান্দায় বসে আছি, রুবাই চা বানিয়ে এনেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস বললাম,
– রুবাই, তুই বোকা বা বেকুব- এ আলোচনা পরে হবে। আগে বল তো কি হয়েছে!

নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বললো,
– তুমি সত্যিই কিছু জানো না!
– না।
– বাবা আর মা সেপারেট হয়ে যাচ্ছেন।
– বলিস কি!
– হ্যা। গত সপ্তাহে ব্যারিস্টার আংকেল এসেছিলেন। আমার সাথে, রাফির সাথে কথা বলেছেন। রাফি তো ছোট, একবার বাবার কাছে থাকবে একবার মায়ের কাছে- এ ভেবে খুব আনন্দে আছে।

রুবাইয়ের অবস্থা এখন আজকের বৃষ্টির মত, ওর কান্না বাড়ছে কমছে, মাঝে মাঝে থামছেও, কিন্তু চেহারায় মেঘের মত কান্না জমে আছে।

রুবাইকে বলা যায়, বাবা-মার সেপারেশন একটি স্বাভাবিক ঘটনা, এতে কান্নাকাটি করার কিছু নেই। দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক ও প্রাপ্ত মনষ্ক মানুষ সিপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। নিজের পিঠ চাপড়ে নিজেকে বলতে পারে ‘যা সিমরান যা, জি লে আপ্নি জিন্দেগি’। তাদের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, সেপারেশন বিষয়টা এতই সরল! দু’জন মানুষের মধ্যে নৈকট্য গাঢ় হতে যেমন সময় দরকার হয়, তেমন দূরত্ব তৈরী হতেও সময়ের প্রয়োজন। ইচ্ছাতে হোক বা অনিচ্ছাতে, দীর্ঘ দিনের সংসার যাপনে একে অন্যের অংশে পরিণত হয়।

পুরুষ এলবাট্রস তরুণ বয়সে সাড়া না পাওয়া পর্যন্ত একাধিক নারীকে প্রেম নিবেদন করে, কিন্তু জোড় বাধার পর আর বিচ্ছিন্ন হয় না, একে অপরের অংশ ও অংশীদার হয়ে ওঠে। সঙ্গী মারা গেলে একা একাই কাটিয়ে দেয় বাকীটা জীবন। মানুষ মহান ও মানবিক, মানুষ বিবেচক ও বুদ্ধিমান, মানুষ এলবাট্রস নয়। মানুষের নৈকট্যের সম্পর্কেই থাকে ফাঁক ও ফাঁকি, সুপ্ত থাকে বিচ্ছেদবৃক্ষের বীজ!

রুবাইয়ের বাবা-মা’র সেপারেশনের কথা শুনে ভীষণ অপ্রস্তুত হলাম, জিজ্ঞেস করলাম,
– তোর বাবা-মা’র সিদ্ধান্ত কি চূড়ান্ত?
– হ্যা। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাদের বুঝাতে পারিনি। তারা আমাকে ভুল বুঝেছে, আমার ওপর রাগ করেছে, বকেছেও।
– তোর বাবা-মা সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলো কেনো?
– তাদের না কি এডজাস্ট হচ্ছে না।
– এতদিন পর এডজাস্টমেন্টের সমস্যা!

সংসার মানেই স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজের সিম্ফোনি, পরস্পরের স্পেসে পরস্পরকে সুষম স্পেস বন্টনের শিল্প। রুবাইয়ের বাবা-মার বিশ বছরের সুখের সংসার, সাত হাজার তিন’শ দিন একসাথে কাটানোর পর, পরস্পরের শ্বাসের ঘ্রাণ পর্যন্ত মুখস্থ হয়ে যাবার পর এডজাস্টমেন্টে সমস্যা!

মানুষ সঙ্গী হিসেবে বেটার হাফকে কামনা করে না, কামনা করে ‘পারফেক্ট ওয়ান’কে। পারফেক্ট ওয়ানকে খুঁজতে গিয়ে ‘বেটার ওয়ান’কে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে। কেউ কেউ এক বেটার ওয়ান হতে আরেক বেটার ওয়ানে আশ্রয় নেয়, তারপর আবার আরেক নতুন বেটার ওয়ান। এই চক্রে যোগ দেওয়ার পরিস্থিতি আপা-দুলাভায়ের নেই। রুবাই বড় হয়েছে, রাফিও ছোট নয়- এখন শুধু দু’জনের টোনাটুনির সংসার নয়। সেপারেশনের পক্ষে বিপক্ষে রুবাই-রাফির মতামতও গুরুত্বপূর্ণ।

ভাবনায় ছেদ পরে, রুবাইয়ের কণ্ঠে কাতরতা,
– মামা, তুমি একটা কিছু করো।
– আমার কিছু করার নেই। বেকুবদের বুঝানো যায়, কিন্তু জ্ঞানী বেকুবদের বোঝায় এমন সাধ্য কারো নেই। ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে তোর বাবা মা’র এখন মেধা বেশী বুদ্ধি কম অবস্থা, এদের কে বুঝাবে বল!
– তবুও মামা কিছু একটা কি করা যায় না! তুমি কি করতে পারো না! আমার সুসাইড করতে ইচ্ছে করছে।

রুবাইয়ের চোখে তাকালাম, পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে বাবা-মা’র অফুরন্ত আদরে বড় হয়েছে। বাবা মা আলাদা থাকবেন, নিয়ম মেনে ক’দিন মা’র সাথে আর ক’দিন বাবার সাথে থাকতে হবে- এটা মেনে নিতে পারছে না। বাবা-মা ওর কাছে অবিচ্ছেদ্য অবিভক্ত সত্বা, ওর পক্ষে এমন বিভাজন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

সবচে বড় কথা বাবার পাশে একজন নতুন মা অথবা মায়ের পাশে একজন নতুন বাবার কথা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। জেলা শহরের মফস্বলীয় পারিবারিক বন্ধন আর সামাজিক সংস্কৃতি এখনও এসব সহজে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। রুবাইকে বললাম,
– সুসাইড করে কোনো লাভ হবে না। শুধু তুই মরে যাবি। ভুত হয়ে বাবা-মা’কে ভয়ও দেখাতে পারবি না, যে ভীতু তুই। তবে তুই একটা ঝুঁকি নিতে পারিস।
– কি ঝুঁকি মামা!
– কাল রাতে সাদা কাগজে লিখবি ‘প্রিয় বাবা ও মা, তোমাদের সেপারেশনের আগে আমিই সেপারেটেড হয়ে গেলাম।’ তারপর পরশু ভোরে বিছানার ওপর চিঠিটা চাপা দিয়ে মোড়ে চলে আসবি। নানু আর মামার সাথে তুই কক্সবাজারে বেড়াতে যাবি।

রুবাই এডভেঞ্চারের ঘ্রাণ পেয়েছে,
– নানু তো আম্মুকে জানিয়ে দিবে!
– তুই নানুকে কিছু বলিস না, আমিও বলবো না। যাওয়ার দিন তোকে তুলে নিলে নানু জানবে। তখন সব খুলে বলা যাবে।
– আচ্ছা মামা, কাপড় তো নিবো।
– না রে মা, তবে ধরা পরে যাবি। প্ল্যান ভেস্তে যাবে।

রুবাই কি ভাবছে বুঝা গেলো না, শান্ত স্বরে বললো,
– এতে কাজ হবে?
– হতেও পারে, না’ও হতে পারে। তুই তো ক’টা দিন আনন্দে কাটাতে পারবি, ওটাই কম কি!
– মামা, আরেক কাপ চা খাবে?
– দে, সাথে একটা নাপা দিস তো মা।
– জ্বর আসছে আবার!
– হুম, মাথা ব্যাথাও বাড়ছে।

বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। রুবাই বিষণ্ন দৃষ্টিতে ইলেক্ট্রিকের তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ভিজে জবুথবু তিনটা কাক তারে বসে আছে, বৃষ্টির এই মন হুহু করা বিকেলে ওদের আর কোথাও যাওয়ার নেই।

(অসমাপ্ত)

অবিভাজ্য (পর্ব ৪)/ [মনসুখিয়া সিরিজ]

৪.
মণ্ডল পাড়ার মোরে এসে অটো ছেড়ে দিতে হলো। তিন চার মিনিটের পথ হেঁটে যেতে হবে। বৃষ্টি বাড়ছে কমছে কিন্তু থামছে না। আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাতেই বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমলো। হাঁটতে শুরু করলাম।

বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট টানার অন্যরকম মজা আছে, স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর এ খাদ্যটি তার ভয়াবহ সকল উপকরণ নিয়েই কখনো কখনো স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারে। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় এসে কলবেলে চাপ দিলাম, দরজা খুললো রুবাই,
– মামা, তুমি তো ভিজে গেছো!
– বৃষ্টির দিন, ইচ্ছে না হলেও একটু আধটু ভিজতে হয়।
– তুমি ইচ্ছে করেই ভিজেছো..
– এখন জেরা করবি না ঘরে ঢুকতে দিবি!

আপা ছুটে এলেন, হাতে তোয়ালে, পৃথিবীর সকল বিরক্তিকে কণ্ঠে জমা করে বললেন,
– বৃষ্টি কমলে আসা যেত না! পুরো ভিজে গেছিস।
– পুরো ভিজিনি, কিছুটা ভিজে গেছি, ওটা কিছু নয়।
– কিছু নয় বললেই হলো, কাপড় চেঞ্জ কর।
– ধ্যাত, আপা, কি যে বলো! শরীরের তাপে পাঁচ মিনিটে সব শুকিয়ে যাবে।
– ফের জ্বর বাঁধিয়েছিস।
– হু। আমি বাঁধাইনি, জ্বরই আমাকে বাঁধিয়েছে। এখন ছাড়ছি না বলে চলে যেতে পারছে না।
– ফাজলামি করবি না, আমি তোর বড় বোন, বিয়াইন না। টাওয়েল ধর।

আপা বিরক্ত হয়ে নিজে ঘরে গেলেন, রুবাই আমার চুল মুছে দিতে দিতে বললো,
– মামা, দুপুরে তো খেয়ে আসোনি, ভুনা খিচুড়ি খাও। সাথে আছে ইলিশ ভাজা, শুটকি ভর্তা, আমের আচার আর মুরগির ঝাল ভুনা।

মেনু শুনেই জিভে পানি চলে এসেছে, পেটে জেগেছে রাক্ষসের ক্ষিধে। মন অহং মেশানো স্বরে বলে উঠলো, ‘তোমাকে কেন্দ্র করেই এই আয়োজন, তুমি কতটা গুরুত্বপূর্ণ দেখো।’ বহুদিন ধরে মাথার ভেতর বাস করেন এক ছদ্মবেশী সুফী, তিনি মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘নফসের জালে যে আটকে যায়, নিয়তি তাকে নফসের রাজ্যেই পাঠায়। তার আর মনসুখিয়ায় যাওয়া হয়না!’ রুবাই আবার বলে,
– ডাইনিং টেবিলে বসো মামা, আমি খাবার গরম করে আনছি।
– না রে মা, খাবো না।
– কেনো!
– আজ আমার খুব রবীন্দ্রনাথ পাচ্ছে, তিনি বলেছেন, ‘ আমি বহু বাসনায় খিচুড়ি যে চাই/ বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে..’
– হিহিহি.. রবি ঠাকুর এমনটা বলেছেন..
– হ্যা, উনি আরও বলেছেন, ‘না চাহিতে মোরে যা করেছ দান/ খিচুড়ি ইলিশ শুটকির গান..

অট্টহাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে রুবাই বললো,
– হিহিহি.. তুমি না মামা! .. হিহিহি

ওর চুলে হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করি,
– এত জরুরী তলব কেনো মা!
রুবাইয়ের কণ্ঠে বিষন্নতা গোপনের ব্যর্থ চেষ্টা,
– জানো মামা, আমি খুব বোকা..
– কে বললো?
– সবাই বলে, আমিও বুঝতে পারি।
– কিভাবে বুঝতে পারিস!
– এটা বোঝা যায়, তুমিও তো জানো আমি বোকা, জানো না!

দীর্ঘশ্বাস গোপন না করেই বললাম,
– মা গো, তুই ভুল জানিস, আমি মোটেও তোকে বোকা বলে মনে করি না।
অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুবাই, এতক্ষণ চোখ ছলছল করছিল, এখন এক ফোঁটা করে অশ্রু চোখের নিচে নেমে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় স্থির হয়ে আছে।

কত আর বয়স ওর- এখনো সতেরো অতিক্রম করেনি। এই বয়সে মান-অভিমানগুলো তীব্র হয়, বুঝা-পড়াগুলো হয় আবেগে টইটম্বুর। চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলাম,
– তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করছিস না!
– বিশ্বাসও করছি না, অবিশ্বাসও করছি না। বিভ্রান্ত হচ্ছি। বোকারা সবকিছুতে বিভ্রান্ত হয়– তাই না মামা!

কঠিন একটা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া যায়, তা ঠিক হবে না, চোখের পানি গাল বেয়ে ঠোঁটের কাছে নেমে এসেছে, মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম,
– শোন, আগে চোখ মুছ, এরপর তোর বিভ্রান্তি কাটাচ্ছি।

বাচ্চাদের মত দুই হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছলো, যেনো কিছুই হয়নি এমন কণ্ঠে বললাম,
– আমার কথা শুনলে তুই’ও আমাকে বোকা বলতে পারিস।

ঠোঁটে হাসির হালকা আভাস এনে বললো,
– আমি কক্ষনও তোমাকে বোকা বলবো না, কক্ষনো না।

নিশ্চিন্ত হবার ভঙ্গিতে বললাম,
– তুই যেহেতু আমাকে বোকা বলবি না, তবে তোকে মন খুলে সব বলা যায়। খুব ভালো করে শুনে রাখ- এই পৃথিবীতে একজনও বোকা মানুষ নেই, একজনও নয়। তবে জাত বেকুব অনেক আছে, এছাড়া প্রতিটি মানুষই জীবনে কখনো না কখনো বেকুবি করে- কেউ কম, কেউ বেশী।
– বোকা আর বেকুব কি এক নয়, মামা?
– মোটেও এক নয়। ধর, একজন জানে আগুনে হাত দিলে পুড়বে, এরপরও সে আগুনে আঙুল বাড়িয়ে দিলো এবং পুড়লো, এটা কিন্তু বোকামীও নয়, বেকুবিও নয়।
– তবে এটা কি?
– এটাকে বলতে পারিস বিশ্বাসের ওপর কৌতূহলের জয়। কিন্তু সে যদি ফের কৌতূহলের বশে আগুনে হাত দেয় তবে সেটা বেকুবি। আবার আগুনে অন্য রকম ঝাপ দেওয়াও আছে।

রুবাই কিছুটা বিভ্রান্ত, পৃথিবীতে অসংখ্য সুন্দর দৃশ্য আছে, প্রবল শোকেরও মাধুর্য মিশ্রিত নিরব সৌন্দর্য আছে, ষোলো সতেরো-আঠারো বছরের কোনো বালিকার ভেজা চুল, কান্নায় ফোলা চোখ, ঠোঁটে হাসির মৃদু আভাস, দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি মিলেমিশে এক সুন্দরতম অবয়ব। রুবাইয়ের প্রশ্ন,
– আগুনে অন্য রকম ঝাপ দেওয়া মানে?
– পুড়বে জেনেও কাউকে বাঁচাতে আগুনে ঝাপ দেওয়া, একে তুই বেকুবি মিশ্রিত মহত্ত্ব বলতে পারিস। এখন বল, তুই কি বেকুব!
– নাহ, মামা। তুমি যা বললে তাতে আমাকে বেকুব বলা যায় না, তবে বোকা তো অবশ্যই।
– বেশ কথা তুই বোকা, দুই একটা বোকামির কথা বল তো, মা..

রুবাই বলতে শুরু করলো,
– মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করি.. আর গভীর ভাবে চিন্তা করতে পারি না.. আমার কথা কাউকে ভালো করে বুঝাতে পারিনা আর..
– আর?
– আর কোনো কিছুই বদলে দিতে পারি না।
– ওহ, এসব! তবে খুব মন দিয়ে শোন..

ওর চেহারায় ফের বিষাদ জমতে শুরু করেছে, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– মামা, চা খাবে? চা খেতে খেতে বলো! আমিও খাবো-
– ঠিক আছে, তুই নিজে রান্না করবি। আর চা নিয়ে আসার আগে ভালো করে চোখ ধুয়ে আসবি, তোর চোখে মনে হয় পোকা কামড়াচ্ছে..
রুবাই ‘হিহিহি’ করে হেসে উঠলো,
– তুমি যা বলো না মামা! কান্না পাচ্ছিলো, এখন চোখে পোকার কামড়ের কথা শুনে হাসি পাচ্ছে।

রুবাই চা বানাতে গেল, ওর ঘরটা যত্ম করে গুছানো। টেবিলের ওপর পাঠ্য বই, হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার, সাদাত হোসেন, হ্যারি পটার, টিনটিন জড়াজড়ি করে শেলফে বিশ্রাম নিচ্ছে। উপন্যাসের পাশে জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানের কবিতাসমগ্রসহ আরও ক’জন জনপ্রিয় কবির কবিতার বই। এ বয়সটাই তো কবিতা পাঠের, কবিতা উদযাপনের। ও কি জানে কবিতা পাঠ করতে হয় ক্ষুধার্ত অবস্থায়, শরীরে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে।

অকস্মাৎ মনে হলো- রুবাই কি নিজেকে উপন্যাসের কোনো চরিত্র ভাবতে শুরু করেছে অথবা কবিতার কোনো মানবী- কিছুই অসম্ভব নয়। ওর কষ্টটা কি মনের গভীর থেকে উৎসারিত বা শুধুই কষ্ট বিলাস– চা পান করতে করতেই জানা যাবে।

(অসমাপ্ত)

অবিভাজ্য (পর্ব ১ হতে ৩)/ [মনসুখিয়া সিরিজ]

১.
বিছানার ডান পাশে পূবের জানালা। রোজ ভোরে দু’টো দোয়েল জানালার কার্নিশে বসে শিস দেয়- তারপর কোথায় যে যায় কে জানে। আজও ঘুম ভেঙেছে দোয়েলের শিসে, আকাশের আলোতে তখনও আবছায়া অন্ধকার।

ব্যাথায় পর্যদুস্ত পা নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ছাদে উঠে চারদিকে তাকিয়ে ভোর দেখি। প্রতিটা ভোর গভীর মায়াময় ও রহস্যপূর্ণ, প্রতিটা ভোরের শরীরে লেগে থাকে রাতের আভা আর দিনের উচ্ছাসের ঘ্রাণ।

ছাদের এক কোনে পাখিদের জন্য ঝোল মাখা বাসিভাত, সিঁড়ি কোঠার ছাদে খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেই- এই নাস্তার আয়োজনের কথা পাখিরা জানে। যে যার সময় মত এসে খায়। এক একটা দিন দেরী হলে চেঁচামিচি করে প্রতিবাদ জানায়, হয়তো তাদের ভাষায় বলে, ‘আজ আবার নাস্তা দিতে দেরী করছো, আমাদের কি কাজকর্ম নেই! অফিস-টফিস নেই না কি!’

ছাদে দুটো বিড়াল শরীর টান করে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। পাখিরা আগে ভয় পেত, এখন তেমন পাত্তাটাত্তা দেয় না। ওরা জেনে গেছে বিড়ালদের জন্য আলাদা খাবার আছে, তবু যদি ক্ষিধে পায় তবে দুলকি চালে হেটে এসে ঝোল মাখা ভাতে ভাগ বসাবে- অলস দু’টো কখনোই পাখি শিকারের কষ্ট সইতে যাবে না।

ভোর দেখে ছাদ থেকে নামছি, সিঁড়ি সতর্ক করে,
– মানুষ একটু সাবধানে নামো। পায়ে ব্যথা পাবে তো..
– একটু আধটু ব্যথা পাওয়া মন্দ না, কি বলো তুমি!
– একটু আধটু ব্যথা পাওয়া মন্দ নয়, কিন্তু ব্যথা পোষা তো খারাপ অভ্যেস। মানুষ, তুমি ব্যথা পুষছো কেনো!

পা ভেঙে সিঁড়িতে বসি, বলি,
– শোনো সিঁড়ি, আমি কোনো কিছুই পুষছি না। পোষ মানানোর গুণ আমার নেই।

সিঁড়ি হেসে ওঠে,
– এই যে ভোর বেলা পাখিদের খাবার দিচ্ছো, পাখিরা আসছে, তোমাকে ভয় না পেয়ে বিশ্বাস করছে, এটাও তো এক ধরণের পাখি পোষা। বিড়াল দুটো পায়ে পায়ে ঘুরে, বাসায় কবুতরগুলো তোমার হাতে বসে খায়, তুমি হাত বাড়ালেই খরগোশ দম্পতি হাতের তালুতে মাথা ঘষে। সদর দরজার বাইরে বসে থাকে তিন চারটা কুকুর, তুমি বের হলেই সদর রাস্তা পর্যন্ত যেনো গার্ড দিয়ে নিয়ে যায়- ওদেরও তো পুষছো, কি পুষছো না!
– না, গো। ওরা আছে, থাকছে- এটুকুই। যদ্দিন আমার পাশে থাকতে ওদের ভালো লাগবে, তদ্দিন থাক। যেদিন ওদের ইচ্ছে হবে চলে যেতে, যেখানে খুশি চলে যাক, যেখানে খুশি থাক। এটা মোটেও পোষ মানানো নয়।

এ যুক্তি সিঁড়ি মানতে চাইলো না,
– এটা যদি পোষ মানানো না হয় তবে রোজ ভোরে, দুপুর আর রাতে খাবার দেবার জন্য এত উতলা হও কেনো!
– ওরা যে অপেক্ষায় থাকে, আশায় থাকে।

কিছুক্ষণ নিরবতা, নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করি,
– সিড়ি, তুমি ভালো আছো তো!
– হ্যা, যদ্দিন চোখের ওপর ছাদ না দিচ্ছো, বেশ ভালো আছি। আকাশের কত যে রঙ, দিনে রাতে আকাশ দেখি। তোমাদের যাওয়া- আসা দেখি, বাতাসের উস্কানিতে নায়লনের রশিতে শুকোতে দেওয়া ক্লিপে আটকানো কাপড়ের উড়ার জন্য ছটফটানো দেখি আর দেখি তোমাদের আসা যাওয়া।
– তোমার দুপাশে শ্যাওলা জমেছে, দুটো ঘাসফুল গাছও জন্মেছে দেখছি!
– হ্যা। শ্যাওলাগুলো পরিস্কার করে দিতে বোলো, ঘাসফুলগুলো থাক।
– তুমি কি ঘাসফুল পুষবে, সিড়ি!

সিড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
– সবাই তো কত কিছুই পোষে- প্রকাশ্যে গোপনে। আমি না হয় ঘাসফুলই পুষি।

শ্যাওলা পরিস্কার করানোর আশ্বাস দিয়ে নামছি, সিড়ি বললো,
– যাও, একটু ঘুমাও। শেষ রাতে অল্প একটু ঘুমিয়েই জেগে উঠেছো, এত কম ঘুমোলে চলে!

নিচে নেমে কবুতরগুলোকে বাজরা আর খরগোশ দম্পতিকে ঘাস দিয়ে ঘরে ফিরলাম। ঘুম প্রয়োজন, গভীরতম ঘুম। শোয়া মাত্র চোখ ভেঙে ঘুম এলো। বাড়ির আমগাছে ক’টা বুলবুলি ডাকছে, শালিক ঝগড়া করছে- যেনো বহুদূর থেকে এসব শব্দ ভেসে আসছে। মাঝখানে একবার ঘুম ভাঙলো, জানলা দিয়ে ছিটকে আসা রোদ পায়ের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে।

টনেটনে ব্যাথাগ্রস্থ পায়ের ওপর সকালের রোদের নরম উত্তাপ- আহা রে, আহা রে জীবন। ঘুম ঘুম মাথার ভেতর গুলাম আলী গেয়ে উঠলেন- ‘খা কার জখম দোয়া দি হামনে/বাস ইয়ু উমার বিতা দি হামনে.. (আঘাতের বিনিময়ে দোয়া দিয়েছি আমি/আর এভাবে আয়ু যাপন করছি আমি..)।

মাথার কাছে সাইলেন্ট মুডে রাখা মোবাইল সেট হাতে নেই, স্ক্রিনে তাকাই- ছ’টা মিসকল। রুবাই কল করেছিলো। মেসেজ আইকনে ক্লিক করতেই রুবাইয়ের মেসেজ পেলাম- ‘মামা, তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে, জরুরী।’

২.
ফোন শব্দহীন করে রাখার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হলো। নিশ্চয়ই জরুরী কিছু- তা না হলে রুবাই কি এতবার কল করতো! এদিকে ঘুমও জরুরী, পায়ের জখমে নরম উত্তাপ দানের জন্য রোদের প্রতি দোয়া করাও গুরুত্বপূর্ণ –ডিপ্লোম্যাটদের মত সব দিক ঠিক রাখতে শুয়েই কল করলাম, দু’বার রিং হত ধরলো রুবাই,
– আসসালামু আলাইকুম, মামা। তোমাকে কি বিরক্ত করছি!

আজকাল বাচ্চারা ‘তোমাকে কি বিরক্ত করছি!’ ধরণের পশ্চিমা ভদ্রতা খুব শিখছে। শিখে ততটা লাভ হচ্ছে না, বরঞ্চ সঙ্কটে পড়ছে- বাচ্চাগুলো না পারছে চাচা-মামার ওপর পুরোপুরি অধিকার ফলাতে না পারছে অধিকার ছাড়তে। আমার মত মফস্বলের অনাধুনিকদের এসবে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। রুবাইয়ের উত্তরে বললাম,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। অবশ্যই বিরক্ত করেছিস, খুব বিরক্ত করেছিস..
ওর কণ্ঠে অনুতাপ,
– সর‍্যি মামা, তুমি এখনও ঘুমাচ্ছিলে! সর‍্যি.. আমি বুঝতে পারিনি..
– এখন তোর সর‍্যি শুনে ভাঙা ঘুম জোড়া লাগবে! কেনো ফোন করেছিস বলে ফেল, মা।
– আজ কি একবার আমাদের বাসায় আসতে পারবে?
– বাসায় আসতেই হবে! ফোনে বলা যায় না!
– না, মামা, ফোনে বলা যাবে না। তোমার সমস্যা থাকলে বলো আমিই চলে আসবো।

রুবাই চলে এলে বেশ হত- যন্ত্রণাকাতর পা’টা আরাম পেত। কিন্তু ওকে আসতে বলা মানেই প্রকট ঝামেলাকে দাওয়াত দেওয়া। বারবার বলেছি- এলোমেলো করে রাখাটাও এক ধরণের গুছিয়ে রাখার আর্ট, যারা এলোমেলো করে রাখে তারা জানে কোন জিনিসটা ঠিক কোথায় আছে। কিন্তু এই তত্বের বারোটা বাজিয়ে ও ঘরে এসেই টেবিল গুছাবে, সারা ঘরে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা বইগুলো তুলে শেলফে রাখবে। লেখার কাগজ গুছাবে, পাতা মুড়ে চিহ্ন দিয়ে মাথার কাছে রাখা বইগুলোর ভেতর থেকে পেন্সিল বের করে পেন পটে সাজাবে। ধমক দিলে খিলখিলিয়ে হাসবে।

মেয়ে, ভাগ্নি আর ভাস্তিদের মধ্যে মা ভাবটা প্রবল, আরও প্রবল মুরুব্বীয়ানা, রুবাই এর বাইরে নয়। দ্রুত জবাব দিলাম,
– না রে মা, কষ্ট করে আসার দরকার নেই। আমিই আসবো।
– তোমার পা ভালো আছে তো!
– খুব ভালো আছে। এখন শুয়ে শুয়ে রোদ পান করছে।
– রোদ পান করছে?
– হ্যা, সবাই কি আর গালিব যে শরাব পান করবে!
– হিহিহি, তবে দুপুরে এসো কিন্তু।
– ঠিক আছে, অবশ্যই আসবো। এখন আমি ঘুমাবো, তুই ঠিক সাড়ে বারোটায় কল দিয়ে জাগিয়ে দিবি। যতক্ষণ কল না ধরবো কল দিতেই থাকবি.. দিতেই থাকবি.. দিতেই থাকবি..
– হিহিহি… আচ্ছা মামা..

ফোন রেখে রোদের দিকে মনোযোগ দিলাম- ভীষণ সুন্দর রং। সূর্যটা অগ্নিপিণ্ড, এ রোদ বহুদূর হতে ছুটে আসা হলকা। দীর্ঘ পথযাত্রায় ভস্ম করে দেওয়ার প্রকট ক্ষমতা সে হারিয়েছে, রপ্ত করেছে মুগ্ধ করার কৌশল- আজকের এই রোদ মমতায় জোছনার অধিক।

গৌতম ঘর ছেড়েছিলেন পূর্ণিমায়, বুদ্ধত্ব লাভের পথে পথে পূর্ণিমা থেকে পূর্ণিমায় তাঁর সন্তরণ। আত্মা মুক্তি পেলে দেহ মূল্যহীন এ বিশ্বাসে তিব্বতের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মৃতদেহ কেটে পাখিদের খাওয়ায়। কি আশ্চর্য, ‘চারিদিকে এখন সকাল—/রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল’ সকালে ঘুম প্রত্যাশি মনে কোথা হতে এলেন জ্যোৎস্নামুগ্ধ বুদ্ধ দেব, কোথা হতে এলেন রহস্যময় তিব্বতের সন্ন্যাসী আর আকাশমুখি সৎকার প্রথা!

চোখ বন্ধ করলাম, ঘুম আসুক, প্রবল ঘুম। ঘরে হাওয়া ঢুকছে, হাওয়ার শরীরে পানির ঘ্রাণ– আজ কি বৃষ্টি হবে! মাথার ওপর একঘেয়ে সুরে পাখা ঘুরছে.. চড়ুই ডাকছে, গাছের পাতায় হাওয়ার ঝাপটে খসখসানি, ফেরিওয়ালার সুর.. ‘মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়/ সকালবেলার রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়।’
চোখ জুড়ে ঘুম জমেছে, জড়িয়ে আসছে চোখ, ফোন ফের সাইলেন্ট মুডে রেখে পাশ ফিরলাম, মাছির গানের মত অলস শব্দ তবু সওয়া যায়, চিল চিৎকার নয়।

৩.
‘মা, কল করার প্রয়োজন নেই, জেগেছি।’ রুবাইকে মেসেজ পাঠিলাম। আড়মোড়া ভেঙে জানালার পাশে বসলাম। এখন রোদ নেই, আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে, ‘ঘণ রিমঝিম রিমঝিম নামিল দেয়া’ অবস্থা।এক পশলা বৃষ্টি হয়েও গেছে, ঘুমিয়ে থাকার জন্য বুঝতে পারিনি। জানালার ভিজে গ্রিলে পতনের অপেক্ষায় উন্মুখ বৃষ্টির ফোঁটা। এতটুকু স্বচ্ছ ফোঁটা, তাতেও প্রতিবিম্বিত হচ্ছে বিশাল আকাশ আর বৃক্ষের সবুজ।

এক একটা দিন আসে আলস্য ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। জড়ত্ব পেয়ে বসে। গাছের নিচে বসে গৌতম ধ্যান করছেন, প্রখর রোদ এসে পড়েছে মাথায়। তাপ বাড়ছে, ধ্যান ভাঙছে না। এক শামুকের মায়া হলো, উঠে এলো মাথায়। গৌতমের একটু আরাম হোক, ধ্যান না ভাঙুক। এরপর ১০৮টা শামুক উঠে এলো, টুপির মত আবৃত করলো গৌতমের মাথা।

গৌতমের ধ্যান ভাঙলো, ততক্ষণে শামুকরা প্রাণ হারিয়ে জড় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এটা গল্প, গ্রিক শিল্পের প্রভাবে বুদ্ধের চুল ঢেউ খেলানো হতে হতে শিল্পীর হাতে শামুকের রূপ নিয়েছে, ভাবুক রচনা করেছে কাহিনী। তবু শামুকের গল্প ভালো লাগে, এক একটা দিন ইচ্ছে করে বুদ্ধের মত ধ্যানমগ্ন না হতে পারি, অন্তত মৃত শামুকের মত অলস হই, আলস্য যাপন করি- এ আর হয় না, বেলা ফুরোয়.. দিন যায়।

বৃষ্টি শুরু হবার আগেই বের হতে হবে। দশ/পনেরো মিনিট মাঝারি ধরণের বৃষ্টি হলেই মফস্বলের এই সরু রাস্তায় পানি জমবে, কসরৎ করেও বেশী দূর যাওয়া যাবে না। পানি নেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আলস্য ঝেড়ে দ্রুত তৈরী হয়ে নিলাম। দরজার বাইরে এসে চশমা খুলে পকেটে রাখলাম- পাঁচ হাত দূরের জিনিসও এখন ঝাপসা। যতদূর তাকাই সব ঝাপসা, ঝাপসা রঙের নড়াচড়া- যেনো অপটু হাতে নির্মিত এবস্ট্রাকট এনিমেশন।

পাড়ার মোরে এসে জয়নালের দোকানে দাঁড়াই, গোল্ড লিফের প্যাকেটে ভরে পাঁচটা বেনসন লাইট সিগারেট এগিয়ে দেয়। প্রেমিকার সামনে বেনসনের প্যাকেট থেকে সিগারেটে বের করে আগুন ধরিয়ে টান দেওয়া অল্পবয়সী ছেলে ছোকড়াদের ফ্যাশন, আবার প্রেমিকার মিষ্টি ধমকে সিগারেট ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনার মুখে বেনসনের মত দামি সিগারেট কেনাও অপচয়। তাই কম দামে যে সিগারেটই কিনুক তাদের প্যাকেটটা চাই বেনসনের। বেনসন কিনেও আমাদের জন্য বরাদ্ধ অন্য ব্রান্ডের প্যাকেট।

– বাই, চা দিমু?
– হু

জয়নাল স্বচ্ছ কাচের কাপে রং চা এগিয়ে দিলো, লিকার কড়া নয় বলে রঙ সোনালি। কাপটা মিনারেল ওয়াটারের মত স্বচ্ছ বলে চায়ের রঙটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। এই কাপে অন্য কাউকে চা পরিবেশন করা হয় না, কাপটা শুধুই আমার। কাপটার সাথে জড়িয়ে আছে চার বছর আগের এক মধ্যরাত।

ওই রাতে অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে, আর কোনো শব্দ নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা’। বৃষ্টির সিম্ফোনি ভেদ করে শোনা গেলো জয়নালের কণ্ঠ, সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিরতিহীনভাবে ডাকছে ‘বাই, একটু বাইরে আয়েন, বাই..।’ মা দরজা খুলে জানতে চাইলেন, ‘কি হইছে রে জয়নাল?’ জয়নালের কণ্ঠে অসহায়ত্বের স্পষ্ট ছাপ, ‘চাচী, বড় বাই’রে একটু ডাইক্যা দেন।’

তখনও একটা পা প্রায় অকেজো হয়ে যায়নি, চোখের দৃষ্টিসীমাও এখনকার মত করুণ নয়। এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে দ্রুত বের হয়ে এলাম,
– কি হইছে জয়নাল?
– বাই, মাইটারে অহনেই হাসপাতালে লয়া যাইতে হইবো, নাইলে মাইয়াটা বাঁঁচবো না বাই।

প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করলাম না, ঘরে ঢুকে মানিব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে মা’কে ‘আমি একটু আসছি’ বলে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। জয়নালের সাথে নিরবে হাঁটছি, মনে মনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি- ওর দোকান থেকে সিগারেট কিনি, চা খাই- এইতো সম্পর্ক। অথচ এমন দুর্যোগের রাতে ও আমার কাছেই এলো কেনো।

রাত একটু বাড়লেই মফস্বলে রিকশা পাওয়া কঠিন, একে মধ্যরাত তারপর ওপর টানা বৃষ্টি, বাজারের স্ট্যান্ডেও রিকশা বা অটো কিছুই পাওয়া যাবে না। ক’জন অটো চালকের নাম্বার সেভ করা আছে, প্রথম কলটা দিলাম আতিককে। তিন চারবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো,
– ভাই, এত্ত রাইতে ফুন দিছেনযে!
– আতিক, অটো লয়া এক্ষুনি জয়নালের দোকানের সামনে চইলা আয়, দেরী করিস না।

আতিককে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না, কিছু পরিস্থিতিতে কথা বলার সুযোগ দিতে নেই। জয়নালের পাঁজাকোলা করে মেয়েকে এনেছে। ছ/সাত বছর বয়স, পেটের ব্যাথায় কুকড়ে যাচ্ছে, বাচ্চাটার কান্না করতেও কষ্ট হচ্ছে , কোঁকাচ্ছে ‘বাবা গো, ব্যাথা করে.. আমি মইরা যামু, বাবা।’

অবিরাম বর্ষণের মধ্যরাতে মফস্বলের জনশূন্য রাস্তায় এক যন্ত্রণাকাতর শিশুর কাতর কান্না ‘আমি মইরা যামু, বাবা’ কতটা বিদ্ধ করে, এফোঁড়ওফোঁড় করে দিতে পারে তা প্রকাশের ভাষা কারো জানা নেই। সবকিছু ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, ভাষার এ সীমাবদ্ধতা কোনো দিন দূর হবে না।

আতিক দ্রুত চলে আসায় রক্ষা, জেলা সদরের হাসপাতাল দূরে নয়, ঘনঘন হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটছে অটো। জয়নাল মেয়ের পিঠে হাত বুলাচ্ছে আর কাতর স্বরে পাঠ করছে, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিম্মা ইনদাকা ওয়া আফিজ আলাইয়্যা মিন ফাদলিকা ওয়ানছুর আলাইয়্যা রাহমাতাকা ওয়ানজিল আলাইয়্যা বারকাতাকা।’

জয়নালের দোয়া পাঠ শুনছি, জয়নাল এই দোয়ার তরজমা হয়তো জানেনা, জানার দরকার নেই। ওর কাতরতাই বলে দিচ্ছে, হে আল্লাহ! তোমর কাছে যা আছে আমি তাই তোমার কাছে চাই। তোমার অনুগ্রহের একটু ধারা আমার দিকে প্রবাহিত করো আর তোমার রহমতের একটু বৃষ্টি আমার ওপর বর্ষণ করো আর তোমার বরকতসমূহ থেকে একটুখানি আমার প্রতি নাজিল করো।

এমারজেন্সিতে ঢুকতেই ডাক্তার ছুটে এলেন, ইঞ্জেকশন দিয়ে ব্যাথা কমালেন। আতিক নিজের অটোতে বসে ঘুমোচ্ছে। সকাল ৮টায় জরুরী ভিত্তিতে এপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন করা হলো। ডাক্তার জয়নালের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভয়ের কিছু নেই।

এক সপ্তাহ পর জয়নাল দোকান খুললো। বিকেলে চা খেতে গেলাম, জয়নাল ড্রয়ার থেকে স্বচ্ছ কাচের দামী একটা কাপ বের করে হাসি মুখে চা বানিয়ে দিলো। বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম,
– টং চায়ের দোকানে এই দামী কাপ পোষাইবো, জয়নাল!

জয়নাল হাসি বিস্তৃত করে জানালো,
– এই কাপ খালি আপনের লেগা, বাই। আমার মাইয়া চয়েছ কইরা কিনছে।

এরপর জয়নালের দোকানে অন্য কোনো কাপে আর চা পান করা হয়নি। জয়নালের মেয়ের ‘চয়েছ’ করা কাপে যতবার চা খাই, মাথার ভেতর লুইজ আর্মস্ট্রং মায়াবী কণ্ঠে গেয়ে চলেন-
I hear babies cry
I watch them grow
They’ll learn much more
Than I’ll never know
And I think to myself
What a wonderful world…

চায়ে আয়েশ করে দ্বিতীয় চুমুক দিতেই পেছন থেকে আতিকের কণ্ঠ শোনা গেলো,
– বাই কি সদরে যাইবেন?
– না, মণ্ডল পাড়ায় যামু।
– চলেন, অনেক দিন আপনারে লইয়া যাই না।

পেছনে পার্ক করা অটো জয়নালের দোকানের সামনে নিয়ে এলো, চা শেষ করে বললাম,
– আতিক, বিষ্টি তো আইতাছে, এদ্দূর যাবি!
– আপনারে লয়া যামু, অন্য কেউ অইলে যাইতাম না।
– অন্যরা কি দোষ করলো?
– আপ্নে আর অন্যরা কি এক অইলো!

অটোতে চলতে শুরু করেছে। সিগারেট ধরাই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আতিক ওর সুখ দুঃখের কথা বলছে। কিছু কানে ঢুকছে, কিছু ঢুকছে না। মগজের স্তরে স্তরে ঝাঁপি খুলে বসেছে কলেজবেলা- এমন এক একটা বৃষ্টির দিন আরামবাগ থেকে হাঁটতে হাঁটতে রাজারবাগ হয়ে শান্তি নগর পেরিয়ে নটর ডেম পৌছতো বেইলি রোডে। ভিজে জবজবে অবস্থায় সুইসের গেটে দাঁড়ালেই একজন ভিকারুননিসা বেরিয়ে আসতো, তার মুখে একসাথে আনন্দ ও বিরক্তির মেঘমাল্লার, তার কণ্ঠে সাঁঝের ইমন কল্যাণ,
– আবার বৃষ্টিতে এভাবে ভিজেছো নটরডেম, জ্বর আসবে যে!
– তুমি জলপট্টি হলে একটা জীবন জ্বর হয়েই কাটিয়ে দিবো..
– তাই!
– নয় তো কি!

না, একটা মাত্র মানব জীবন জ্বর হয়ে যাপনের চক্রে আটকে যেতে হয়নি, যার জলপট্টি হওয়ার সাধ ছিলো সে অন্য কারো প্যারাসিটামল হওয়ার হাতছানি এড়াতে পারেনি।

(অসমাপ্ত)

অণুগল্প: ছায়াসত্ব

পূর্ণ চাঁদের রাতে জোছনায় দশদিক ভেসে গেলে হাঁপানির টান তুচ্ছ করে দাদি বলতেন, ‘ফকফক্কা চান্নি রাইত, কি ফকফক্কা চান্নি! আমারে দাওয়ায় শোয়াইয়া দাও..।’

মা উঠোনে মাদুর পেতে তার ওপর কয়েকপ্রস্থ সুতির চাদর বিছিয়ে আস্থায়ী জাজিম বানিয়ে দিতেন। বাবা দাদিকে কোলে তুলে এনে জাজিমে শুইয়ে দিতেন। দাদির খনখনে স্বর, শ্বাস টেনে টেনে বলতেন, ‘এত্ত চান্নি, চাইরদিকে এত্ত চান্নি!’

দাদির চোখ দুটো মরে গিয়েছিল বহু বছর আগে। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতেন– ঘুম আর জাগরণের মাঝমাঝি পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক জড় পদার্থ বিশেষ। হাঁপানির টানে বুকের দ্রুত ওঠানামা জানান দিত- বেঁচে আছেন। অথচ জোছনার মাঝ রাতে তার প্রবল অস্থিরতা- ‘এত্ত চান্নি! বাইরে এত্ত চান্নি!’

প্রতিক্রিয়াশূন্য ঘোলা চোখে চোখ রেখে আমার কৌতূহল – ‘ও দাদি, কানা চউক্ষে তুমি কি দ্যাহো?’ উত্তরে দাদি বলতেন, ‘দাদাবাই, চান্নি দেহি, এত্ত চান্নি!’ মুখের চামড়ায় সহস্র ভাজ বৃক্ষের মত স্থির, শুধু কণ্ঠে গুপ্তজ্ঞান ফাঁসের সতর্কতা– ‘ও দাদাবাই, দ্যাহতো চান্নিতে কি আমার ছায়া পড়ে? চান্নিতে মরা মাইনষের ছায়া পড়ে না।’

‘দাদি গো, চান্নিতে তোমার জ্বলজ্বইল্লা ছায়া পড়ছে’ বললেই দাদি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন- ‘আমি চউক্ষে ছায়া দেহি না ক্যান দাদাবাই?’ তার কণ্ঠে গাঢ় আতঙ্ক – ‘এত্ত চান্নিতে আমার ছায়া পড়ছে, চউক্ষে দেহিনা ক্যান!’

দাদি তার সকল ছায়া ও জোছনাপ্রীতিসমেত মারা গেছেন- বহুদিন হলো। আজ প্রখর রোদ, জুম্মার নামাজের সময় সুনসান রাস্তা, রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, আকষ্মাৎ স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসা দাদি ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ও দাদাভাই, তোমারে কইছিলাম চান্নিতে মরা মাইনষের ছায়া পড়ে না, ভুইল্লা গেছ!’

চোখ মেলে দেই- আশ্বিনের আকাশ ঘন নীল। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো সাদা সাদা মেঘ। একটা পায়রা উত্তর হতে উড়ে গেল দক্ষিণে, সূর্যের নিচে চক্কর দিচ্ছে ক’টা চিল। নিজের ছায়ার খোঁজে মাটিতে তাকালাম- না, কোনো ছায়া নেই, রোদেও আমার ছায়া পড়ে না।

ছায়াসত্ব