১.
বিছানার ডান পাশে পূবের জানালা। রোজ ভোরে দু’টো দোয়েল জানালার কার্নিশে বসে শিস দেয়- তারপর কোথায় যে যায় কে জানে। আজও ঘুম ভেঙেছে দোয়েলের শিসে, আকাশের আলোতে তখনও আবছায়া অন্ধকার।
ব্যাথায় পর্যদুস্ত পা নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ছাদে উঠে চারদিকে তাকিয়ে ভোর দেখি। প্রতিটা ভোর গভীর মায়াময় ও রহস্যপূর্ণ, প্রতিটা ভোরের শরীরে লেগে থাকে রাতের আভা আর দিনের উচ্ছাসের ঘ্রাণ।
ছাদের এক কোনে পাখিদের জন্য ঝোল মাখা বাসিভাত, সিঁড়ি কোঠার ছাদে খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেই- এই নাস্তার আয়োজনের কথা পাখিরা জানে। যে যার সময় মত এসে খায়। এক একটা দিন দেরী হলে চেঁচামিচি করে প্রতিবাদ জানায়, হয়তো তাদের ভাষায় বলে, ‘আজ আবার নাস্তা দিতে দেরী করছো, আমাদের কি কাজকর্ম নেই! অফিস-টফিস নেই না কি!’
ছাদে দুটো বিড়াল শরীর টান করে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। পাখিরা আগে ভয় পেত, এখন তেমন পাত্তাটাত্তা দেয় না। ওরা জেনে গেছে বিড়ালদের জন্য আলাদা খাবার আছে, তবু যদি ক্ষিধে পায় তবে দুলকি চালে হেটে এসে ঝোল মাখা ভাতে ভাগ বসাবে- অলস দু’টো কখনোই পাখি শিকারের কষ্ট সইতে যাবে না।
ভোর দেখে ছাদ থেকে নামছি, সিঁড়ি সতর্ক করে,
– মানুষ একটু সাবধানে নামো। পায়ে ব্যথা পাবে তো..
– একটু আধটু ব্যথা পাওয়া মন্দ না, কি বলো তুমি!
– একটু আধটু ব্যথা পাওয়া মন্দ নয়, কিন্তু ব্যথা পোষা তো খারাপ অভ্যেস। মানুষ, তুমি ব্যথা পুষছো কেনো!
পা ভেঙে সিঁড়িতে বসি, বলি,
– শোনো সিঁড়ি, আমি কোনো কিছুই পুষছি না। পোষ মানানোর গুণ আমার নেই।
সিঁড়ি হেসে ওঠে,
– এই যে ভোর বেলা পাখিদের খাবার দিচ্ছো, পাখিরা আসছে, তোমাকে ভয় না পেয়ে বিশ্বাস করছে, এটাও তো এক ধরণের পাখি পোষা। বিড়াল দুটো পায়ে পায়ে ঘুরে, বাসায় কবুতরগুলো তোমার হাতে বসে খায়, তুমি হাত বাড়ালেই খরগোশ দম্পতি হাতের তালুতে মাথা ঘষে। সদর দরজার বাইরে বসে থাকে তিন চারটা কুকুর, তুমি বের হলেই সদর রাস্তা পর্যন্ত যেনো গার্ড দিয়ে নিয়ে যায়- ওদেরও তো পুষছো, কি পুষছো না!
– না, গো। ওরা আছে, থাকছে- এটুকুই। যদ্দিন আমার পাশে থাকতে ওদের ভালো লাগবে, তদ্দিন থাক। যেদিন ওদের ইচ্ছে হবে চলে যেতে, যেখানে খুশি চলে যাক, যেখানে খুশি থাক। এটা মোটেও পোষ মানানো নয়।
এ যুক্তি সিঁড়ি মানতে চাইলো না,
– এটা যদি পোষ মানানো না হয় তবে রোজ ভোরে, দুপুর আর রাতে খাবার দেবার জন্য এত উতলা হও কেনো!
– ওরা যে অপেক্ষায় থাকে, আশায় থাকে।
কিছুক্ষণ নিরবতা, নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করি,
– সিড়ি, তুমি ভালো আছো তো!
– হ্যা, যদ্দিন চোখের ওপর ছাদ না দিচ্ছো, বেশ ভালো আছি। আকাশের কত যে রঙ, দিনে রাতে আকাশ দেখি। তোমাদের যাওয়া- আসা দেখি, বাতাসের উস্কানিতে নায়লনের রশিতে শুকোতে দেওয়া ক্লিপে আটকানো কাপড়ের উড়ার জন্য ছটফটানো দেখি আর দেখি তোমাদের আসা যাওয়া।
– তোমার দুপাশে শ্যাওলা জমেছে, দুটো ঘাসফুল গাছও জন্মেছে দেখছি!
– হ্যা। শ্যাওলাগুলো পরিস্কার করে দিতে বোলো, ঘাসফুলগুলো থাক।
– তুমি কি ঘাসফুল পুষবে, সিড়ি!
সিড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
– সবাই তো কত কিছুই পোষে- প্রকাশ্যে গোপনে। আমি না হয় ঘাসফুলই পুষি।
শ্যাওলা পরিস্কার করানোর আশ্বাস দিয়ে নামছি, সিড়ি বললো,
– যাও, একটু ঘুমাও। শেষ রাতে অল্প একটু ঘুমিয়েই জেগে উঠেছো, এত কম ঘুমোলে চলে!
নিচে নেমে কবুতরগুলোকে বাজরা আর খরগোশ দম্পতিকে ঘাস দিয়ে ঘরে ফিরলাম। ঘুম প্রয়োজন, গভীরতম ঘুম। শোয়া মাত্র চোখ ভেঙে ঘুম এলো। বাড়ির আমগাছে ক’টা বুলবুলি ডাকছে, শালিক ঝগড়া করছে- যেনো বহুদূর থেকে এসব শব্দ ভেসে আসছে। মাঝখানে একবার ঘুম ভাঙলো, জানলা দিয়ে ছিটকে আসা রোদ পায়ের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে।
টনেটনে ব্যাথাগ্রস্থ পায়ের ওপর সকালের রোদের নরম উত্তাপ- আহা রে, আহা রে জীবন। ঘুম ঘুম মাথার ভেতর গুলাম আলী গেয়ে উঠলেন- ‘খা কার জখম দোয়া দি হামনে/বাস ইয়ু উমার বিতা দি হামনে.. (আঘাতের বিনিময়ে দোয়া দিয়েছি আমি/আর এভাবে আয়ু যাপন করছি আমি..)।
মাথার কাছে সাইলেন্ট মুডে রাখা মোবাইল সেট হাতে নেই, স্ক্রিনে তাকাই- ছ’টা মিসকল। রুবাই কল করেছিলো। মেসেজ আইকনে ক্লিক করতেই রুবাইয়ের মেসেজ পেলাম- ‘মামা, তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে, জরুরী।’
২.
ফোন শব্দহীন করে রাখার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হলো। নিশ্চয়ই জরুরী কিছু- তা না হলে রুবাই কি এতবার কল করতো! এদিকে ঘুমও জরুরী, পায়ের জখমে নরম উত্তাপ দানের জন্য রোদের প্রতি দোয়া করাও গুরুত্বপূর্ণ –ডিপ্লোম্যাটদের মত সব দিক ঠিক রাখতে শুয়েই কল করলাম, দু’বার রিং হত ধরলো রুবাই,
– আসসালামু আলাইকুম, মামা। তোমাকে কি বিরক্ত করছি!
আজকাল বাচ্চারা ‘তোমাকে কি বিরক্ত করছি!’ ধরণের পশ্চিমা ভদ্রতা খুব শিখছে। শিখে ততটা লাভ হচ্ছে না, বরঞ্চ সঙ্কটে পড়ছে- বাচ্চাগুলো না পারছে চাচা-মামার ওপর পুরোপুরি অধিকার ফলাতে না পারছে অধিকার ছাড়তে। আমার মত মফস্বলের অনাধুনিকদের এসবে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। রুবাইয়ের উত্তরে বললাম,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। অবশ্যই বিরক্ত করেছিস, খুব বিরক্ত করেছিস..
ওর কণ্ঠে অনুতাপ,
– সর্যি মামা, তুমি এখনও ঘুমাচ্ছিলে! সর্যি.. আমি বুঝতে পারিনি..
– এখন তোর সর্যি শুনে ভাঙা ঘুম জোড়া লাগবে! কেনো ফোন করেছিস বলে ফেল, মা।
– আজ কি একবার আমাদের বাসায় আসতে পারবে?
– বাসায় আসতেই হবে! ফোনে বলা যায় না!
– না, মামা, ফোনে বলা যাবে না। তোমার সমস্যা থাকলে বলো আমিই চলে আসবো।
রুবাই চলে এলে বেশ হত- যন্ত্রণাকাতর পা’টা আরাম পেত। কিন্তু ওকে আসতে বলা মানেই প্রকট ঝামেলাকে দাওয়াত দেওয়া। বারবার বলেছি- এলোমেলো করে রাখাটাও এক ধরণের গুছিয়ে রাখার আর্ট, যারা এলোমেলো করে রাখে তারা জানে কোন জিনিসটা ঠিক কোথায় আছে। কিন্তু এই তত্বের বারোটা বাজিয়ে ও ঘরে এসেই টেবিল গুছাবে, সারা ঘরে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা বইগুলো তুলে শেলফে রাখবে। লেখার কাগজ গুছাবে, পাতা মুড়ে চিহ্ন দিয়ে মাথার কাছে রাখা বইগুলোর ভেতর থেকে পেন্সিল বের করে পেন পটে সাজাবে। ধমক দিলে খিলখিলিয়ে হাসবে।
মেয়ে, ভাগ্নি আর ভাস্তিদের মধ্যে মা ভাবটা প্রবল, আরও প্রবল মুরুব্বীয়ানা, রুবাই এর বাইরে নয়। দ্রুত জবাব দিলাম,
– না রে মা, কষ্ট করে আসার দরকার নেই। আমিই আসবো।
– তোমার পা ভালো আছে তো!
– খুব ভালো আছে। এখন শুয়ে শুয়ে রোদ পান করছে।
– রোদ পান করছে?
– হ্যা, সবাই কি আর গালিব যে শরাব পান করবে!
– হিহিহি, তবে দুপুরে এসো কিন্তু।
– ঠিক আছে, অবশ্যই আসবো। এখন আমি ঘুমাবো, তুই ঠিক সাড়ে বারোটায় কল দিয়ে জাগিয়ে দিবি। যতক্ষণ কল না ধরবো কল দিতেই থাকবি.. দিতেই থাকবি.. দিতেই থাকবি..
– হিহিহি… আচ্ছা মামা..
ফোন রেখে রোদের দিকে মনোযোগ দিলাম- ভীষণ সুন্দর রং। সূর্যটা অগ্নিপিণ্ড, এ রোদ বহুদূর হতে ছুটে আসা হলকা। দীর্ঘ পথযাত্রায় ভস্ম করে দেওয়ার প্রকট ক্ষমতা সে হারিয়েছে, রপ্ত করেছে মুগ্ধ করার কৌশল- আজকের এই রোদ মমতায় জোছনার অধিক।
গৌতম ঘর ছেড়েছিলেন পূর্ণিমায়, বুদ্ধত্ব লাভের পথে পথে পূর্ণিমা থেকে পূর্ণিমায় তাঁর সন্তরণ। আত্মা মুক্তি পেলে দেহ মূল্যহীন এ বিশ্বাসে তিব্বতের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মৃতদেহ কেটে পাখিদের খাওয়ায়। কি আশ্চর্য, ‘চারিদিকে এখন সকাল—/রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল’ সকালে ঘুম প্রত্যাশি মনে কোথা হতে এলেন জ্যোৎস্নামুগ্ধ বুদ্ধ দেব, কোথা হতে এলেন রহস্যময় তিব্বতের সন্ন্যাসী আর আকাশমুখি সৎকার প্রথা!
চোখ বন্ধ করলাম, ঘুম আসুক, প্রবল ঘুম। ঘরে হাওয়া ঢুকছে, হাওয়ার শরীরে পানির ঘ্রাণ– আজ কি বৃষ্টি হবে! মাথার ওপর একঘেয়ে সুরে পাখা ঘুরছে.. চড়ুই ডাকছে, গাছের পাতায় হাওয়ার ঝাপটে খসখসানি, ফেরিওয়ালার সুর.. ‘মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়/ সকালবেলার রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়।’
চোখ জুড়ে ঘুম জমেছে, জড়িয়ে আসছে চোখ, ফোন ফের সাইলেন্ট মুডে রেখে পাশ ফিরলাম, মাছির গানের মত অলস শব্দ তবু সওয়া যায়, চিল চিৎকার নয়।
৩.
‘মা, কল করার প্রয়োজন নেই, জেগেছি।’ রুবাইকে মেসেজ পাঠিলাম। আড়মোড়া ভেঙে জানালার পাশে বসলাম। এখন রোদ নেই, আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে, ‘ঘণ রিমঝিম রিমঝিম নামিল দেয়া’ অবস্থা।এক পশলা বৃষ্টি হয়েও গেছে, ঘুমিয়ে থাকার জন্য বুঝতে পারিনি। জানালার ভিজে গ্রিলে পতনের অপেক্ষায় উন্মুখ বৃষ্টির ফোঁটা। এতটুকু স্বচ্ছ ফোঁটা, তাতেও প্রতিবিম্বিত হচ্ছে বিশাল আকাশ আর বৃক্ষের সবুজ।
এক একটা দিন আসে আলস্য ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। জড়ত্ব পেয়ে বসে। গাছের নিচে বসে গৌতম ধ্যান করছেন, প্রখর রোদ এসে পড়েছে মাথায়। তাপ বাড়ছে, ধ্যান ভাঙছে না। এক শামুকের মায়া হলো, উঠে এলো মাথায়। গৌতমের একটু আরাম হোক, ধ্যান না ভাঙুক। এরপর ১০৮টা শামুক উঠে এলো, টুপির মত আবৃত করলো গৌতমের মাথা।
গৌতমের ধ্যান ভাঙলো, ততক্ষণে শামুকরা প্রাণ হারিয়ে জড় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এটা গল্প, গ্রিক শিল্পের প্রভাবে বুদ্ধের চুল ঢেউ খেলানো হতে হতে শিল্পীর হাতে শামুকের রূপ নিয়েছে, ভাবুক রচনা করেছে কাহিনী। তবু শামুকের গল্প ভালো লাগে, এক একটা দিন ইচ্ছে করে বুদ্ধের মত ধ্যানমগ্ন না হতে পারি, অন্তত মৃত শামুকের মত অলস হই, আলস্য যাপন করি- এ আর হয় না, বেলা ফুরোয়.. দিন যায়।
বৃষ্টি শুরু হবার আগেই বের হতে হবে। দশ/পনেরো মিনিট মাঝারি ধরণের বৃষ্টি হলেই মফস্বলের এই সরু রাস্তায় পানি জমবে, কসরৎ করেও বেশী দূর যাওয়া যাবে না। পানি নেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আলস্য ঝেড়ে দ্রুত তৈরী হয়ে নিলাম। দরজার বাইরে এসে চশমা খুলে পকেটে রাখলাম- পাঁচ হাত দূরের জিনিসও এখন ঝাপসা। যতদূর তাকাই সব ঝাপসা, ঝাপসা রঙের নড়াচড়া- যেনো অপটু হাতে নির্মিত এবস্ট্রাকট এনিমেশন।
পাড়ার মোরে এসে জয়নালের দোকানে দাঁড়াই, গোল্ড লিফের প্যাকেটে ভরে পাঁচটা বেনসন লাইট সিগারেট এগিয়ে দেয়। প্রেমিকার সামনে বেনসনের প্যাকেট থেকে সিগারেটে বের করে আগুন ধরিয়ে টান দেওয়া অল্পবয়সী ছেলে ছোকড়াদের ফ্যাশন, আবার প্রেমিকার মিষ্টি ধমকে সিগারেট ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনার মুখে বেনসনের মত দামি সিগারেট কেনাও অপচয়। তাই কম দামে যে সিগারেটই কিনুক তাদের প্যাকেটটা চাই বেনসনের। বেনসন কিনেও আমাদের জন্য বরাদ্ধ অন্য ব্রান্ডের প্যাকেট।
– বাই, চা দিমু?
– হু
জয়নাল স্বচ্ছ কাচের কাপে রং চা এগিয়ে দিলো, লিকার কড়া নয় বলে রঙ সোনালি। কাপটা মিনারেল ওয়াটারের মত স্বচ্ছ বলে চায়ের রঙটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। এই কাপে অন্য কাউকে চা পরিবেশন করা হয় না, কাপটা শুধুই আমার। কাপটার সাথে জড়িয়ে আছে চার বছর আগের এক মধ্যরাত।
ওই রাতে অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে, আর কোনো শব্দ নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা’। বৃষ্টির সিম্ফোনি ভেদ করে শোনা গেলো জয়নালের কণ্ঠ, সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিরতিহীনভাবে ডাকছে ‘বাই, একটু বাইরে আয়েন, বাই..।’ মা দরজা খুলে জানতে চাইলেন, ‘কি হইছে রে জয়নাল?’ জয়নালের কণ্ঠে অসহায়ত্বের স্পষ্ট ছাপ, ‘চাচী, বড় বাই’রে একটু ডাইক্যা দেন।’
তখনও একটা পা প্রায় অকেজো হয়ে যায়নি, চোখের দৃষ্টিসীমাও এখনকার মত করুণ নয়। এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে দ্রুত বের হয়ে এলাম,
– কি হইছে জয়নাল?
– বাই, মাইটারে অহনেই হাসপাতালে লয়া যাইতে হইবো, নাইলে মাইয়াটা বাঁঁচবো না বাই।
প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করলাম না, ঘরে ঢুকে মানিব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে মা’কে ‘আমি একটু আসছি’ বলে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। জয়নালের সাথে নিরবে হাঁটছি, মনে মনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি- ওর দোকান থেকে সিগারেট কিনি, চা খাই- এইতো সম্পর্ক। অথচ এমন দুর্যোগের রাতে ও আমার কাছেই এলো কেনো।
রাত একটু বাড়লেই মফস্বলে রিকশা পাওয়া কঠিন, একে মধ্যরাত তারপর ওপর টানা বৃষ্টি, বাজারের স্ট্যান্ডেও রিকশা বা অটো কিছুই পাওয়া যাবে না। ক’জন অটো চালকের নাম্বার সেভ করা আছে, প্রথম কলটা দিলাম আতিককে। তিন চারবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো,
– ভাই, এত্ত রাইতে ফুন দিছেনযে!
– আতিক, অটো লয়া এক্ষুনি জয়নালের দোকানের সামনে চইলা আয়, দেরী করিস না।
আতিককে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না, কিছু পরিস্থিতিতে কথা বলার সুযোগ দিতে নেই। জয়নালের পাঁজাকোলা করে মেয়েকে এনেছে। ছ/সাত বছর বয়স, পেটের ব্যাথায় কুকড়ে যাচ্ছে, বাচ্চাটার কান্না করতেও কষ্ট হচ্ছে , কোঁকাচ্ছে ‘বাবা গো, ব্যাথা করে.. আমি মইরা যামু, বাবা।’
অবিরাম বর্ষণের মধ্যরাতে মফস্বলের জনশূন্য রাস্তায় এক যন্ত্রণাকাতর শিশুর কাতর কান্না ‘আমি মইরা যামু, বাবা’ কতটা বিদ্ধ করে, এফোঁড়ওফোঁড় করে দিতে পারে তা প্রকাশের ভাষা কারো জানা নেই। সবকিছু ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, ভাষার এ সীমাবদ্ধতা কোনো দিন দূর হবে না।
আতিক দ্রুত চলে আসায় রক্ষা, জেলা সদরের হাসপাতাল দূরে নয়, ঘনঘন হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটছে অটো। জয়নাল মেয়ের পিঠে হাত বুলাচ্ছে আর কাতর স্বরে পাঠ করছে, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিম্মা ইনদাকা ওয়া আফিজ আলাইয়্যা মিন ফাদলিকা ওয়ানছুর আলাইয়্যা রাহমাতাকা ওয়ানজিল আলাইয়্যা বারকাতাকা।’
জয়নালের দোয়া পাঠ শুনছি, জয়নাল এই দোয়ার তরজমা হয়তো জানেনা, জানার দরকার নেই। ওর কাতরতাই বলে দিচ্ছে, হে আল্লাহ! তোমর কাছে যা আছে আমি তাই তোমার কাছে চাই। তোমার অনুগ্রহের একটু ধারা আমার দিকে প্রবাহিত করো আর তোমার রহমতের একটু বৃষ্টি আমার ওপর বর্ষণ করো আর তোমার বরকতসমূহ থেকে একটুখানি আমার প্রতি নাজিল করো।
এমারজেন্সিতে ঢুকতেই ডাক্তার ছুটে এলেন, ইঞ্জেকশন দিয়ে ব্যাথা কমালেন। আতিক নিজের অটোতে বসে ঘুমোচ্ছে। সকাল ৮টায় জরুরী ভিত্তিতে এপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন করা হলো। ডাক্তার জয়নালের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভয়ের কিছু নেই।
এক সপ্তাহ পর জয়নাল দোকান খুললো। বিকেলে চা খেতে গেলাম, জয়নাল ড্রয়ার থেকে স্বচ্ছ কাচের দামী একটা কাপ বের করে হাসি মুখে চা বানিয়ে দিলো। বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম,
– টং চায়ের দোকানে এই দামী কাপ পোষাইবো, জয়নাল!
জয়নাল হাসি বিস্তৃত করে জানালো,
– এই কাপ খালি আপনের লেগা, বাই। আমার মাইয়া চয়েছ কইরা কিনছে।
এরপর জয়নালের দোকানে অন্য কোনো কাপে আর চা পান করা হয়নি। জয়নালের মেয়ের ‘চয়েছ’ করা কাপে যতবার চা খাই, মাথার ভেতর লুইজ আর্মস্ট্রং মায়াবী কণ্ঠে গেয়ে চলেন-
I hear babies cry
I watch them grow
They’ll learn much more
Than I’ll never know
And I think to myself
What a wonderful world…
চায়ে আয়েশ করে দ্বিতীয় চুমুক দিতেই পেছন থেকে আতিকের কণ্ঠ শোনা গেলো,
– বাই কি সদরে যাইবেন?
– না, মণ্ডল পাড়ায় যামু।
– চলেন, অনেক দিন আপনারে লইয়া যাই না।
পেছনে পার্ক করা অটো জয়নালের দোকানের সামনে নিয়ে এলো, চা শেষ করে বললাম,
– আতিক, বিষ্টি তো আইতাছে, এদ্দূর যাবি!
– আপনারে লয়া যামু, অন্য কেউ অইলে যাইতাম না।
– অন্যরা কি দোষ করলো?
– আপ্নে আর অন্যরা কি এক অইলো!
অটোতে চলতে শুরু করেছে। সিগারেট ধরাই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আতিক ওর সুখ দুঃখের কথা বলছে। কিছু কানে ঢুকছে, কিছু ঢুকছে না। মগজের স্তরে স্তরে ঝাঁপি খুলে বসেছে কলেজবেলা- এমন এক একটা বৃষ্টির দিন আরামবাগ থেকে হাঁটতে হাঁটতে রাজারবাগ হয়ে শান্তি নগর পেরিয়ে নটর ডেম পৌছতো বেইলি রোডে। ভিজে জবজবে অবস্থায় সুইসের গেটে দাঁড়ালেই একজন ভিকারুননিসা বেরিয়ে আসতো, তার মুখে একসাথে আনন্দ ও বিরক্তির মেঘমাল্লার, তার কণ্ঠে সাঁঝের ইমন কল্যাণ,
– আবার বৃষ্টিতে এভাবে ভিজেছো নটরডেম, জ্বর আসবে যে!
– তুমি জলপট্টি হলে একটা জীবন জ্বর হয়েই কাটিয়ে দিবো..
– তাই!
– নয় তো কি!
না, একটা মাত্র মানব জীবন জ্বর হয়ে যাপনের চক্রে আটকে যেতে হয়নি, যার জলপট্টি হওয়ার সাধ ছিলো সে অন্য কারো প্যারাসিটামল হওয়ার হাতছানি এড়াতে পারেনি।
(অসমাপ্ত)