ট্যাগ আর্কাইভঃ সাঈদ এর অণুগল্প

যমজিয়া

– কি চাও?
– শর্তহীন প্রণয়।
– প্রণয় কি শর্তহীন হয়?
– প্রণয় আমূল শর্তহীন। মানুষ শর্তযুক্ত করে করে প্রণয়কে পরিণয়ে পরিণত করে।
– পরিণয় কি প্রণয়ের গন্তব্য নয়?
– না। পরিণয় হলো প্রণয়ের মৃতদেহ। প্রণয় দুর্নিবার হাওয়া- শুধু তোমার কাছে যাওয়া।
– বেশ! আমার মাঝে কি যে পেয়েছ তুমি!
– কিছুই পাইনি, আপদমস্তক তোমাকে ছাড়া।
– তারপরেও শর্তহীন প্রণয় চাও?
– চাই, ভালোবাসিবার চাই অধিকার।
– তবে ভালবাসো, শর্ত একটাই- আমি এসবে নেই।
– বেশ, তবে আমিই ভালবেসে যাই–

ছেলেটি ভালবাসে। মেয়েটি পাগলামি দেখে হাসে, বিরক্ত হয়। প্রণয়ের দিন যায় যমজ ভাবনায়- কে কাকে গ্রাস করে! কে কাকে জড়ায় আপন ছায়ায়!

ক্যান্সার

মাঝরাত। লোডশেডিং। আরেকটা নির্ঘুম রাত। শোভন সন্তর্পণে জানলা খুলে। একরাশ হিমহাওয়া ঘরে ঢুকে পরে। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। একটানা ঝিঝিম শব্দ।

সে জানালার পাশে বসে। বৃষ্টির হালকা ছাট তাকে ভিজিয়ে দেয়। সে সরে না, বসে থাকে। জীবন সুন্দর, বেঁচে থাকা মায়াময়। শোভনের জন্য এই সুন্দর মায়াময়তার বৃত্তসীমা দশ বছর। সেখান থেকে তিরানব্বই দিন খরচ হয়ে গেছে। দিন যায়, ওষুধের ডোজ, মাথার ব্যাথা বাড়ে, শুধু আয়ুবৃত্ত ছোট হয়ে আসে।

একটানা বৃষ্টি ঝরছে। দ্যুতি ছড়ানো হাসির এক কোমল মুখ মনে পড়ে- পাখিজীবনের মত সরল। সে কি জেগে আছে? কে জানে! কারো তো জেগে থাকার কথা ছিলো না, কথা নেই। বিনা কারণেই শোভনের চোখ ভিজে ওঠে।

রাত বাড়ে। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া অন্য শব্দ নেই। কখন যেন ঘুম ভেঙে পাশে এসে বসেছে রুনা- শোভনের স্ত্রী, ঘরের মানুষ। শোভনের হাত মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে। কারো মুখে কোনো কথা নেই।

অন্ধকার জানে দুজন মানুষ ভেসে যায় আলাদা কান্নায়- গাঢ় অশ্রুপাতের কোনো শব্দ হয়না, হতে নেই।

ভুতের আছড়

: মামা, একটা ভুতের গল্প বল।
: আমাদের বাড়ি পুরানো ঢাকায়। দোতলা পুরাণ বাড়ি। রাতে আমরা কেউ ছাদে যাই না। সন্ধ্যার পরেই ছাদের গেটে তালা দিয়ে দেয়া হয়। মাঝরাতে ছাদে কারা যেন মার্বেল খেলে, প্রতি অমাবস্যার রাতে একজন মহিলা নাঁকি সুরে বিলাপ করে কান্না করেন। ভুতরে বাড়িতে থাকলেও কখনো ভুত দেখি নাই। তবে দিনের আলোতে অনেকবার একটা পরী দেখেছি।
: মামা, তুমি পরী দেখেছো!! কোথায়?
: হ্যা, পরী দেখেছি। সেই পরীকে দেখার জন্য কতদিন হলিক্রস গার্লস কলেজের সামনে দাড়িয়ে থেকেছি।
: ধুত্তরী! মামী জানে?
: ধুত্তরী। বউকে ভুতের গল্প বলতে হয়, পরীর গল্প না। পরীর গল্প বললেই আছড় হয়।
: কি আছড় হয়?
: বউয়ের ঘাড়ে ভুতের আছড় হয়। কোনো ওঝা সেই ভুত ছাড়াতে পারেনা, বড্ড ভয়ানক ভুত। এত ভয়ানক যে…

মামী পর্দার আড়াল থেকে গল্প শুনছিলেন। নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। গল্প শেষ হবার আগেই ঝাড়ু হাতে ঝড়ের গতিতে ঘরে প্রবেশ করলেন। স্পষ্টত: বোঝা যাচ্ছে মামীর ঘাড়ে ভুত আছড় করেছে, ভয়ানক ভুত।

প্রণয়জনিত

১.
ডিসেম্বর, ১৯৯১। কলেজে ছুটি চলছে। শীতের দুপুরগুলো খুব দ্রুত বিকেলে গড়ায়। এমন এক হবো হবো বিকেলে ল্যাণ্ড ফোন বেজে উঠলো, রিসিভার কানে দিতেই প্রিয় কণ্ঠের ফিসফিস-
: হ্যালো, নটরডেম?
: ভিকারুননিসা! এই অসময়ে তুমি!
: সবাই ঘুমোচ্ছে। কোচিং নেই। তাই ফোন দিলাম।
: তাই বলো– একদিন শীত দুপুরে আমরাও এমন ঘুমাবো আর আমাদের মেয়ে..
কথা শেষ করার আগেই ভিকারুননিসার লাজুক কণ্ঠ–
: ইশশ! শোনো নটরডেম, কাল একবার বেইলি রোডে আসবে?
: কেনো গো?
: কতদিন তোমাকে দেখিনা, প্লিজ কাল আসো। তোমাকে না দেখলে ঠিক ঠিক মরে যাবো। আসো প্লিজজজজ…
: আহা রে! কটায় আসবো?
: শার্প সাড়ে তিনটায়। আর শোনো, স্কাই ব্লু জিন্স, হোয়াইট পুলওভার গেঞ্জির সাথে ছাইরঙা ব্লেজারটা পরে আসবে। চুল ভালো করে ব্রাশ করবে– মনে থাকবে!
: মনে থাকবে। কিন্তু শেরোয়ানি পড়ে এলে ভালো হতো, তাই না!
: শখ কত!! ফাজিল একটা। চুপ।
: আচ্ছা চুপ করলাম কিন্তু।
: ঢং কত! নটরডেম, আমি কি পড়ে আসবো বলবে?
: ভিকারুননিসা, তুমি গরু রচনাটা পড়ে এসো, ইংরেজীতে দ্য কাউ।
ঢাকা কলেজের এক সিনিয়র গরু যেভাবে তোমার পিছনে লেগেছে! গরু সম্পর্কে জানা থাকা দরকার..
: হিহিহি, আচ্ছা, তাই করবো। কাল দেরী কোরোনা– এক মিনিট দেরী হলে আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।

২.
বিকাল তিনটা। বেইলি রোড। নটর ডেম অপেক্ষারত। ভিকারুননিসা আসে তিনটা বিশে। ফাস্টফুডশপে মুখোমুখি দুজন–
: ভিকারুননিসা, আকাশী আর শাদা কম্বিনেশনের কার্ডিগানটা বেশ সুন্দর তো! গর্জিয়াস।
: আব্বু আয়ারল্যান্ড ট্যুরের সময় এনেছিলেন। আজ প্রথম পড়লাম। সত্যি সুন্দর?
: হ্যা, সুন্দর।
: আমি কি সুন্দর নই?
: না, তুমি সুন্দর নও।

ভিকারুননিসার মন খারাপ হয়, স্বরে অভিমান এনে বলে-
: তবে কে সুন্দর?
: ‘কে’ সুন্দর জানিনা। ‘কি’ সুন্দর জানি।
: কি সুন্দর বলো নটরডেম?
: আমার বিছানাটা জানালার পাশে। রোজ সকালে একফালি রোদ তেরছাভাবে বিছানার কোনায় লুটিয়ে পড়ে। আর কিছু অংশ ফ্লোরে। সে রোদ সুন্দর।
: ওহ! আর?
: ছাদের রেলিংয়ে পিপড়ার সারি দেখেছো! সারি ছেড়ে দুই একটা পিপড়ার এলোমেলো ছোটাছোটি, তারপর দলে মিশে যাওয়া– পুরো ব্যাপারটাই সুন্দর।
: তাই? আর কি সুন্দর শুনি–
: আবার আকাশের অনেক উঁচুতে চিলের গোল হয়ে উড়া সুন্দর। কাশবনে জোতস্না, নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে গলে যাওয়া চাঁদ, তুমুল বৃষ্টিতে নীরব পথ ধরে হাটা, জোনাকীর আলো, বৃষ্টি ধোয়া সবুজ পাতায় শুঁয়াপোকার অলস চলন, গাছের ডালে ফড়িংয়ের ধ্যান, প্রজাপতির চঞ্চল নাচানাচি, মেঘের চলন, বিকালের মায়াময় ছায়া– সব সুন্দর।
: আর কিছু নেই?
: আছে, এমন কি তোমার কপালে নেমে আসা কয়েকটা অবাধ্য চুল– অবর্ণনীয় সুন্দর।
: এখানেই শেষ?
: চারদিকে সুন্দরের এত ছড়াছড়ি, ক’টার কথা আর বলবো!
: বাহ! বাহ! তোমার কাছে পিপড়া সুন্দর, চিল সুন্দর, কিলবিলে শুঁয়োপোকাও সুন্দর। আর আমি বিশ্রী?

নটরডেমের স্বরে মায়া ঝরে —
: ভিকারুননিসা, তুমি সুন্দর নও। বিশ্রীও নও।
: তবে আমি কি! আজ সত্যটা বলতেই হবে। না বললে ঠিক ঠিক মরে যাবো, হু।
: তুমি সকালের রোদ নও, রোদের উষ্ণতা। শুধু অনুভব করা যায়, ভালোলাগাটা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।
: ইশশ! আর?
: তুমি বৃষ্টি বা নীরব পথ নও, তুমি বৃষ্টিতে নীরব পথে ভেজার অপার আনন্দ।
: আর কি কি — সব বলো..
: তুমি দলছুট পিপড়ার চঞ্চল ছোটাছুটির মত সুন্দর নও– তার আপন দলে মিশে যাবার আকুল পিছুটানের গভীরতা। তুমি অরণ্যের নির্জনতা, বেলী ফুলের ঘ্রাণের তীব্রতা, ভোরের শিউলি আভার মাদকতা।
: নটর ডেম, এভাবে আমাকে ভাবো! আমাকে খুব ভালোবাসো, তাই না!
: আমরা কেউই কাউকে ভালোবাসি না।
: আমি তোমাকে ভালোবাসি.. বাসি..বাসি।
: না, তুমিও আমাকে ভালোবাসো না।
: তবে?
: আমরা আসলে যুদ্ধ করছি, দুজন দুজনকে জয় করার। আপন করে পাবার। এ এক অন্যরকম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয় নেই, হয় ড্র না হয় পরাজয়।
: নটর ডেম, আমি এই যুদ্ধে আমি হারবো না, তুমিও হেরোনা প্লিজ। তুমি হারলে আমি ঠিকঠিক মরে যাবো।
: তুমি থেমে যেওনা। যুদ্ধ শেষ হবার আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে নিজেকে গুটিয়ে নিওনা। মনে রেখো– সব যুদ্ধ থেমে যাওয়া মানে শান্তি নয়। কিছু কিছু যুদ্ধ থেমে যাওয়া মানে অসহ্য যন্ত্রণা আর অশান্তি।
: আমি যুদ্ধে হারবো না। জানি তুমি আমাকে হারতে দিবে না।
: কেউ হারতে চাইলে কি আর তাকে আটকে রাখা যায়!
: ধ্যাত! বাজে কথা বলোনা। ঐ গানটা একবার গুনগুন করে গাও না প্লিজ-
নটর ডেম গুনগুন করে গাইতে শুরু করে–
You fill up my senses like a night in the forest,
like the mountains in springtime, like a walk in the rain,
like a storm in the desert, like a sleepy blue ocean.
You fill up my senses, come fill me again.
Come let me love you, let me give my life to you,
let me drown in your laughter, let me die in your arms…

৩.
হঠাত সেদিন–

ফেসবুক ইনবক্স।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, কেমন আছো? ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট না করলেও, প্লিজ ব্লক কোরো না।

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, কথা বলো প্লিজ। তুমি এখনো রেগে আছো?

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটর ডেম, প্রতিটা ম্যাসেজ সিন হচ্ছে। মানে তুমি পড়ছো। ঠিক করেছো উত্তর দিবেনা!!

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
শোনো নটর ডেম, এ মাসের লাস্ট উইকে দেশে ফিরছি। অক্টোবরের চার তারিখে বিকাল চারটা থেকে সাতটা পর্যন্ত বেইলি রোডের সুইসে অপেক্ষা করবো। জানি তুমি আসবেনা, তবুও অপেক্ষা করবো। যদি হঠাত তোমার ইচ্ছা হয়, যদি আসো।

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, তোমার কন্টাক্ট নাম্বারটা দিবে! আমার সেল নাম্বার ০১৭৫*******। ৪তারিখের কথা ভুলে যেওনা প্লিজ।

০৩ অক্টোবর, ২০১৬
কাল বিকেল চারটায় সুইসে থাকবো। আমার কন্টাক্ট নাম্বার আবার দিলাম ০১৭৫*******।
প্লিজ, এসো, ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।

৪.
৪অক্টোবর, মধ্যরাত, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার।
: নটর ডেম, শেষ পর্যন্ত এলেই না। অথচ একদিন এক পলক দেখার জন্য কত ছটফটানি ছিলো।
: কে বললো আসিনি!
: এসেছিলে?? সত্যি!
: হুম। জামদানি শাড়িতে তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছিলো। তোমার বয়স ততটা বাড়েনি।
: ক’টা পর্যন্ত ছিলে?
: তুমি আমার সামনে দিয়েই সাড়ে সাতটায় মুখ কালো করে চলে গেলে। আমি আরো আধঘণ্টা ছিলাম।
: দেখা করলে না কেনো?
: তুমি দেখা করার কথা বলোনি, শুধু আসতে বলেছিলে।
: ধ্যাত! এটা কি আলাদা করে বলতে হবে?
: অবশ্য বললেও দেখা করতাম না।
: কেনো? জানতে পারি?
: না, পারো না।
: ও। আচ্ছা। এতোটা কাছে– তবু দেখা না করে থাকতে পারলে?
: হাহাহাহাহা
: কান্না পাচ্ছে। তুমি হাসছো কেনো– এটা জানতে চাইতে পারি?
: হ্যা পারো-
: বলো।
: মাত্র তিন বছর না যেতেই তুমি খুঁজে পেলে রাজপুত্র। হঠাত করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলে। কোনো কিছু জানাওনি। একবার দেখা করে বললে আমি তোমাকে আটকাতাম না। তীব্র কষ্ট পেতাম, সে কষ্ট আড়াল করে হাসিমুখে মেনে নিতাম।
: সর‍্যি, এক্সট্রিমলি সর‍্যি..
: ফোনেও কোনো কথা বলোনি, আমার স্বর শুনলেই লাইন কেটে দিয়েছো। এক একটা দীর্ঘ দিন আর দীর্ঘতম রাত কেটে গেছে শুধু এটুকু আশা করে যে তুমি একবার ফোন দিবে, একবার অন্তত বলবে তুমি আর আমার নও। একবার শুধু তোমার গলার স্বর শুনবার ছছটফটানি। সেই তুমি দুই যুগ পরে জিজ্ঞেস করছো ‘দেখা না করে থাকতে পারলাম!!’ হাহাহাহা, কোয়াইট ফানি!
: সর‍্যি, নটরডেম। এভাবে বলো না।
আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: ‘সর‍্যি’ হবার মত কিছু আর আজ অবশিষ্ট নেই। তুমিময় একটা ডাইরি ছিলো, সেটা তো দু’বছর আগেই ফিরিয়ে দিয়েছি।
: তুমি এখনো রাগ পুষে আছো?
: নাহ! মনসুখিয়ার যাত্রীকে রাগ পুষে রাখতে নেই। রাগ পুষে রাখলে অভ্রজোনাক পথ ভুলিয়ে দেয়, দূরে সরে সরে যায়।
মনসুখিয়ায় অভ্রজোনাকের কাছে পৌছতেই হবে– এ আমার একার যুদ্ধ।
: মনসুখিয়া কোথায়– জানতে চাইতে পারি?
: হ্যা পারো।
: মনসুখিয়া কোথায়?
: বলতে ইচ্ছে করছেনা।
: ওহ! অভ্রজোনাক কে?
: বলবো না।
: অভ্রজোনাক কি আমি?
: নো, নেভার। তুমি এখন যে কোনো একটা নাম– এর বেশী কিছু নও।
: তবু একবার, শুধু একবার তোমার সাথে দেখা করতে চাই। উত্তর দাও প্লিজ..
: আমি আর কোনো উত্তর দিবোনা। গুড বাই। ভালো থেকো। আর সাবধান– ডানহাতের বুড়ো আঙুলে ব্যাথা পাওয়া কাজের কথা নয়।
: এই ব্যান্ডেজও খেয়াল করেছো?

নটরডেম আর কোনো উত্তর দেয়না। রাত গভীর হয়, হাভানা সিগারের গাঢ় ধোয়া পাক খেয়ে খেয়ে হাওয়ায় মিলায়।

৫.
মনসুখিয়ায় যাবার পথ নটর ডেমের চেনা নেই, অভ্রজোনাকের মনের ঠিকানাও অজানা। দিনের শেষে রাত আসে, ফের দিন। একদিন রাতশেষে দিন আর আসবেনা— ইশ! তার আগেই যদি যাওয়া যেত মনসুখিয়ায়–হীরকফুলের আলোয় আলোয়, অভ্রজোনাকের কাছে অভ্রজোনাকের পাশে।

মনসুখিয়ায় যাবার আগেই যদি ফুরোয় দিন; ওগো রাতের হাওয়া, নটরডেমের হয়ে অভ্রজোনাকের কানেকানে বলে দিও–
Hell is living without your love
Ain’t nothing without your
Touch me
Heaven would be like hell
Is living without you…

.
__________
#মনসুখিয়া/২৬

টান

মোয়াজ্জেন মোহম্মদ তোবারক হোসেন কখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন নাই। বাইশ বছর যাবত লাশ গোছল করান। গোছল শেষে যত্ন করে কাফন পরিয়ে দেন। অনাবৃত চেহারায় কর্পূর লোবান ছড়িয়ে চোখে সুরমা পরিয়ে দেন।

মোতালেব মিঞা স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছিলেন। অচল অবস্থায় দশ বছর শয্যাশায়ী ছিলেন। ভোরে মারা গেছেন। মোয়াজ্জেন তোবারক হোসেন লাশকে গোছল করানোর জন্য ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেন। শরীরে পানি ঢালতেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত মোতালেব মিঞা জড়ানো স্বরে বিরবির করে উঠলেন-
: তোবারক রে, কব্বরে যাইতে ইচ্ছা করেনা।
নিজেকে সামলে নিয়ে তোবারক একবার সূরা ইয়াসিন আর তিনবার সূরা নাস পাঠ করে। বুকে সাহস ফিরে আসে-
: কাকা, কব্বরে না গেলে যাইবেন কই?
: ফ্রিজে ভইরা রাখতে ক। দুনিয়াটা বড় টানে রে..।
: কাকা, আপনেরে কিন্তু কব্বরে যাইতে হইবোই।
: ক্যান?
: আপনে তো মইরা গেছেন, কব্বর ছাড়া গতি নাই।
মোতালেব মিঞা হিমশীতল হাসি দিয়ে হিসহিসিয়ে ওঠেন–
: তোবারক, তুই বাইচ্চা আছোস! তোরা বাইচ্চা আছোস!

মোয়াজ্জন তোবারক হোসেন উত্তর খুঁজে পান না। লাশের গায়ে পানি ঢালার সাহসও হয়না। সময় বয়ে যায় জোহরের দিকে।

মদাঞ্জলী

মদাঞ্জলী

১.
বহুবছর পর বালক বারে ফিরেছে। একটা সময় এই বার ছিলো প্রতি দিনের গন্তব্য। কতশত বিবর্ণ বিকেল ডান কোনার টেবিলে নিদ্রাহীন রাতের কাছে খুন হয়েছে। গ্লাসের বাইরে জমে থাকা ঘামের প্রতি বিন্দুর একাকীত্ব গুনে গুনে কেটেছে সময়। চুমুকে চুমুকে জেগেছে বিষাদের ঘোর।

সব দরজা বন্ধ হয়। বারের দরজাও বন্ধ হত। শহরে মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙে রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে বাড়ি ফেরা। সোডিয়াম আলোয় বিষণ্ন সড়ক। মাথার ভিতরে গানের আসর। নিস্পৃহ বুকের ভিতরে ডি এল রায় গুনগুনাতেন “মনরে কৃষি কাজ জানোনা/এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা..।” সবাই কি আর সোনা হয়! আবাদ করেও কেউ কেউ পতিত জমিই রয়ে যায়।

২.
বালক বারে ঢুকে কাউন্টারে দাঁড়ায়। আধো আলো আধো অন্ধকারে ম্যানেজার বিষ্ময়পূর্ণ হাসি দিয়ে উচ্ছসিত–
: আরে এতো বছর পরে তুই! এতোদিন কোথায় ছিলি?
: রুবেল ভাই, কোথাও ছিলাম না।
: হাহাহা, আবার হেঁয়ালিভরা কথা বলছিস! কত বছর পরে এলি বলতো?
: এগারো বছর হবে। ভাই, আমি কি কর্নার টেবিলে বসতে পারবো!
: কর্নার টেবিলের মায়া এখনো ছাড়তে পারিসনি! টানা তিন বছর প্রতিটা দিন ঐ টেবিলে বসেছিস। সবার জানা হয়ে গিয়েছিলো– কেউ বসতো না।
: আজ বসা যাবে?
: গেস্ট আছে। একটু ওয়েট কর। ব্যবস্থা করছি। (তিনি পাশে বসা ক্যাশিয়ারকে ইশারা দিলেন)। এত দিন পরে কি মনে করে এলি?
: বলতে ইচ্ছে করছেনা। তোমার কাছে সিগারেট আছে!
: সিগারেট ধরলি কবে? হাতে নিয়ে বসতে দেখেছি, কখনো তো টানতে দেখিনি।
: ধরি নাই। আজ প্রবল তৃষ্ণা পাচ্ছে। ধোঁয়ার তৃষ্ণা, পানির তৃষ্ণা।
: কোনো কারণে মন খারাপ! চাপে আছিস! কষ্ট ভুলতে চাইছিস!
: মদ খেয়ে কষ্ট ভুলে কোন পাগলে!! বরঞ্চ কষ্ট আর যন্ত্রণা উপভোগ করা যায়।
: কষ্ট আর যন্ত্রণা উপভোগের জিনিস!! আর ইউ ক্রেজি!
: পুরো জীবনটাই উপভোগ্য। তীব্র কষ্ট, অসহ্য যন্ত্রণা, গভীর বিষাদও জীবনের অংশ। তারাও উপভোগ্য, তীব্রতরভাবে তাদের উপভোগ করতে হয়।
: তোর সাথে কথা বললে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। এই এগারো বছরে কি একটুও ড্রিংক করিস নাই!
: করেছি, খুব বেশী হলে সাত আটবার– কখনোই পাঁচ পেগের বেশী নয়।
: বলিস কি! এত কম! তোর লিমিট তো নয় পেগ।
: হাহাহাহাহা তোমার মনে আছে!
: হ্যা, ভুলা যায়! তুই তো ভোলার মত ক্যারেক্টার না।
: হাহাহাহা, মানুষ দিব্যি ভুলে যায়, ভুলে গেছে, ভুলে আছে।
: না রে, মানতে পারলাম না। তোকে এড়িয়ে চলা সহজ, ভোলা অসম্ভব।
: তাই! কেনো?
: যারা এড়িয়ে চলে তারাও বোঝে তুই তাদের কতটা ভালবাসিস। কতটা মায়া করিস।
: হাহাহাহা, যতই ভাবের কথা বলো আজ থেকে আমার লিমিট হলো বারো পেগ এবস্যুলেট ভদকা আর বারোটা বেনসন রেগুলার।
: হাহাহাহা আচ্ছা। প্রসঙ্গ ঘোরানোর অভ্যসটা আগের মতই আছে। আজ প্রথম তিন পেগ তোকে গিফট করলাম।

বালক বিষ্ময় গোপন করে। এতো ভালোবাসা, এতো স্নেহ জমা হয়ে আছে! ওহ মাই আঈভ (আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান)!

৩.
কর্নার টেবিল। আলো আলো অন্ধকার। খয়েরি কাঁচের বিশাল দেয়াল। এখান থেকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যভুক রাত্রি দেখা খুব প্রিয়। বাইরে ব্যস্ত সড়ক। ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে যাচ্ছে গাড়ির সারি। আবার চলছে। সন্ধ্যায় জ্বলে উঠবে হেড লাইট– আলোর মালা।

বিয়ারের বড় গ্লাস। অর্ধেক বরফের মিহি কুঁচিতে ভরা। বাকী অর্ধেকে ভদকা আর টমেটুজুসের মিশ্রণ ঢেলে নেড়ে নেয় বালক। গ্লাসের গায়ে ঘাম জমে। ঘামের প্রতিবিন্দুতে আপন প্রতিবিম্ব। অস্পষ্ট। প্রতিটা প্রতিবিম্বই কি ভীষণ একা! নিঃসঙ্গ! গ্লাসের গা বেয়ে নামতে নামতে রিনরিনিয়ে ওঠে-
: কর্নার টেবিলে আবার ফিরে এলে?
: কর্নার টেবিলে ফিরিনি তো। নিজের কাছে ফিরেছি।
: এ কেমন ফেরা?
: একজন মানুষ অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে নিজের কাছে ফেরে। সরল ফেরা।
: কি জানি! এত জটিল কথা বুঝতে পারিনা। তোমার ছাদে এখনো শালিখের দল দুপুরে ভাতদানা খেতে আসে?
: আসে। হররোজ আসে।
: খোঁড়া শালিখটা আসে?
: না, বহুবছর হলো আসেনা।
: আহা রে, কোথায় চলে গেছে কে জানে!
: হয়তো মানুষের মত সেও ফিরে গেছে নিজের কাছে।
: কি জানি! তুমিও আবার চলে যাবে। আর কখনোই ফিরবেনা। কতদিন তোমার পথ চেয়ে ছিলাম।
: স্ট্রেঞ্জ!! আমার পথ চেয়ে ছিলে!
: বা রে! তিন বছর প্রতিটা দিন এসেছো। কতদিন পুরো বারে তুমি একা। আমি নীরবে দেখে গেছি। হঠাত আসা বন্ধ করে দিলে– পথ চেয়ে থাকবো না?
: আমরা সবসময় ভুল জনের জন্য পথ চেয়ে থাকি; আত্না দিয়ে ভুল জনকে ভালোবাসি। তাই বলে তুমিও!
: সে সব কথা থাক! এবার যাবার আগে বলে যেও।
: তোমাকেই বলে যাবো ‘যাই, গ্লাসের প্রিয় ঘাম’ ..হাহাহাহা। খুশি?
: হুম। তোমার প্রিয় একটা কবিতা শুনবে?
: প্রিয় কবিতাও মনে রেখেছো!! শোনাও তবে–
: যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!
সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে
বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে
সমুদ্রের জলে,
নক্ষত্রের তলে!
রাত্রে, অন্ধকারে!
তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,
আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

৪.
চুমুকে চুমুকে গ্লাস শেষ হয়ে আসে। নতুন গ্লাস ভরে ওঠে। সিগারেটের ধোঁয়া আলো আঁধারে মিশে যায়। গ্লাসের মিহি বরফকুচি গলে যেতে যেতে ফিসফিসিয়ে বলে–
: মানুষ, তোমার কি হয়েছে?
: জানিনা, সত্যিই জানিনা।
: ইচ্ছে করে সবাই মিলে তোমাকে একদিন মাতাল বানিয়ে দেই। চিৎকার করে মনখুলে সব বলো। চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দাও। ক্লান্ত হয়ে বাচ্চাদের মত হুহু করে কাঁদো। তারপরে বেঘোরে ঘুমোও। শান্তির ঘুম– লাশের মত।
: প্লিজ, মাতাল বানিয়ে দাও। মনসুখিয়ার কাছে যাবার আগে একবার মাতাল হতে চাই। আপদমস্তক মাতাল।
: তোমাকে মাতাল বানাবার সাধ্য কারো নেই। তুমি রক্তে মাংসে আত্নায় মনসুখিয়ায় মাতাল হয়ে আছো। মনসুখিয়ার ডাক শোনার জন্য কান পেতে আছো।
: আলো আধারির দোহাই– শুধু একবার মাতাল করে দাও। একবার ঘুমোতে দাও মৃত্যুর মত গাঢ় আর প্রত্যাখ্যানের মত গভীর ঘুমে।
: সম্ভব নয়। তীব্র কষ্টে মাতাল হতে চাইছো মনসুখিয়ায় পৌছানোর পথ পাচ্ছোনা বলে.. অভ্রজোনাক তোমায় ডাকছেনা বলে। একবার ডাকলে সব ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে ছুটে যাবে মনসুখিয়ায়, অভ্রজোনাকের কাছে।
: হবে হয়তো! অথচ দিনশেষে এ জীবন অর্থহীন আর মৃত্যুরও কোনো অজুহাত নেই, তাই না!
: হুম। গন্তব্যের পথ চেনো না। এদিকে ঘরের ঠিকানাও হারিয়ে ফেলেছো। সবাইকে কোথাও না কোথাও যেতে হয়– তুমি যে কোথায় যাবে?

উত্তর খুঁজে পাইনা। পুড়ে যেতে যেতে সিগারেটের ধোঁয়া খলবলায়-
: নিজের ভিতরে গুমরে গুমরে মরাই তোমার নিয়তি। তোমার ভবিতব্য। গোপন কান্নাই অমোঘ নিদান।

৫.
হঠাত কোথা হতে বহু বছর আগের দুপুরবেলার খোঁড়া শালিকটা উড়ে আসে। আলো আধারির কর্নার টেবিলে বসে। মুখোমুখি। তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। বালকের খোঁড়ামনে দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয়ে পাক খায়। কোনো কারণ ছাড়াই চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। কি আশ্চর্য! শালিখও কাঁদছে না কি? আহা রে!

_______________________
গ্রন্থঃ মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

পুনরুজ্জীবন

গনগনে রোদের দুপুর। হাওয়া নেই। আজিজ মাস্টার নৌকা বানাচ্ছেন। গরমে তালু ফাটার জোগাড়, গা পুড়ে আবলুস কাঠ– কুচকুচে কালো। তবু বিরাম নেই।

মাস্টার পাগল হয়ে গেছেন। বদ্ধ পাগল। লোকে এমনই ভাবেন। হাসাহাসি করেন। ক্ষ্যাপান। তিনি নির্বিকার। নৌকা বানিয়ে চলেন।

পৃথিবী পঁচে গেছে। অসহ্য বদ গন্ধ। মাস্টারের দম নিতে কষ্ট হয়। নাড়িভুঁড়ি উগরে বমি আসে। গজব ধেয়ে আসছে।

নূহ নবী নেই, আসন্ন মহাপ্লাবনে আজিজ মাস্টারই সবাইকে নিয়ে ভেসে পরবেন দরিয়ায়– এক অমল পুনরুজ্জীবনের আশায়।

টার্গেট কিলিং

বাবা, সালাম নিও।
কাল থেকে তোমাদের অবর্ণনীয় কষ্টের দিন শুরু হবে। সবাই তোমাদের দিকে আঙ্গুল তুলবে। ঘৃণার চোখে তাকাবে। বিশ্বাস করো বাবা, আমি কোনো ভুল করি নাই।

আমার পথ যদি ভুল হয়, তবে সাড়ে তিনশ আসনে বসে থাকা দাঁতাল শুয়োরগুলোর পথ মহাভুল। বাঘ ঘাড় মটকে একবারে রক্তমাংস খায়। কিন্তু এই শুয়োররাজের পাল ছারপোকার আর জোঁকের মত প্রতিদিন আমাদের রক্ত খায়। হাড্ডি-মাংস খায়, মগজ খায়, মন খায়, আশা স্বপ্ন ভবিষ্যত খায়।

সবার থালায় দুইবেলা উঠবে জুঁই ফুলের মত শাদা ভাত। মাছ বা মাংসের সালুন আর ডাল। কোনো শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগবে না, দেশের সব শিশু স্কুলে যাবে একই পোশাকে। পড়া শেষে প্রতিটি যুবক চাকরী পাবে। আর একটাও বিচার বহির্ভূত হত্যা হবেনা। ধর্ষিত হবেনা কেউ। কৃষক পাবে ফসলের ন্যায্য দাম। শ্রমিক আর দিনমজুর মমাথা গোঁজার জন্য পাবে আপন দালান ঘর, গার্মেন্টসের সেলাই দিদিমনির শোবার ঘরে গরমের রাতে হাওয়া দিবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। বিনা চিকিতসায় কষ্ট পাবেনা কেউ। দেশের দরিদ্রতম মানুষটিরও দুটো ওমওম স্যুয়েটার থাকবে আর বর্ষায় ব্যবহারের জন্য একটা বর্ষাতি। শুয়োরের পাল পার্সেন্টেজের আবর্জনা খাওয়া ছেড়ে মানুষ হবে। নিজের স্বার্থে ছাত্র যুবকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিবেনা, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অন্ধ ধর্মীয় মৌলবাদের বৃক্ষের চারা ঘরে ঘরে পৌছে দিবেনা। দেশে চিরদিনের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। রাজনীতির পরিবর্তে সংবিধানে স্থান পাবে প্রজানীতি। এসব চাওয়া কি অপরাধ!

বাবা, আমি মানুষ রাজ্যে শুয়োরপ্রধানের পদত্যাগ দাবী করছি। কাদা খোঁচানের তালে তালে সংঘবদ্ধ হয়ে তারা কতটা লুটপাট করছে তার হিসাব দাবী করছি। জনতার রক্তমাংসে তাদের ভোগ দেবার প্রথা অস্বীকার করছি। আমার কোনো দল নেই, আমি সশস্ত্র নই, কোনো দাঁতাল শুয়োর আমার মামা-চাচা বা পলিটিক্যাল বড় ভাই নয়, আমার পরিবারের কেউ পত্রিকার নামজাদা সম্পাদকের সাথে মদের আড্ডায় তুবড়ি ফুটায় না। আমি শুয়োরপ্রধানের পায়ে আত্নাহুতি দিতে প্রস্তুত নই, আমি শুয়োর সাম্রাজ্যের পতন চাই– এগুলোই আমার সব থেকে বড় অপরাধ।

বাবা, খুব কষ্টে একটুকরো কাগজ আর কলম জোগাড় করেছি। মা’র চোখের ছানির অপারেশন তারাতারি করিও। খুব দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো বলে টাকা জমাচ্ছিলাম। অন্তুকে বোলো– ও বের করে দিবে। অন্তুকে কামলা হিসেবে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিও। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে হলেও এই ইতরের দেশ থেকে পালাক — সেখানে দাশের মত মারা গেলেও অন্তত একটা সান্ত্বনা পাবে। তোমার প্রেশার ও সুগারের দিকে খেয়াল রেখো। যে এই চিঠি তোমার হাতে পৌছে দিচ্ছে তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে ভুলো না- সে একজন কনস্টেবল। টাকা না দিলে ৫০হাজার টাকা আদায় করে ছাড়বে। তারপরে থানার সেকন্ড অফিসার আর ওসিকে লেলিয়ে দিবে। তখন লাখ টাকার কাফফারা গুনতে হবে।

কাল সকালে পেপার পড়োনা, বাবা। অস্ত্র উদ্ধারে গিয়ে ক্রস ফায়ারে জঙ্গী নিহত হবার নাটকের ভিলেনের চরিত্রে আদরের ছেলের নাম সহ্য করতে পারবেনা।

বাবা, তোমরা ভালো থেকো। ভালো থাকার জন্য মুখ আর চোখ বন্ধ রেখো– সমগ্র সংবিধান জুড়ে এখন এই ধারা ছাড়া আর কোনো ধারা নেই, উপধারা নেই।

ইতি-
মর্তুজা।

পুনশ্চ: আলু মটরশুটি আর শিংমাছ দিয়ে মা’র হাতে রান্না করা তরকারি মাখিয়ে গরম ভাত খেতে খুব ইচ্ছে করছে। যত দামই হোক, আমার টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে বড় সাইজের দেশী শিং মাছ এনো তো বাবা। সাধ্যে কুলোয় না বলে কতদিন খাওয়া হয়নি। দেখো, মা’র রান্নার ঘ্রাণ পেলে কবর ফুরে ভাত খেতে হাজির হয়ে যাবো।

ডেটিং

দ্রুত সব কাজ গুছিয়ে নিচ্ছি। হিসেব-নিকেশ, দেনা-পাওনা, স্বপ্ন-স্বপ্নহীনতা– সব। টেনশন নিয়ে ডেটিংয়ে যাবার কোনো অর্থ হয়না।

জানালার বাইরে নীলাকাশ। কোথাও ফুটেছে কাশ। বাতাসে কাঁঠালচাঁপা ফুলের ঘ্রাণ। জানালার গ্রীলে দুটো চড়ুই। টেবিলে একফালি রোদ– রোদের রং এত মায়াবী! উত্তাপে এতো আনন্দ! সবকিছু ভীষণ অন্যরকম- সুন্দর, অনাবিল, খুব বেশী মায়াময়।

কাজে মন দেই। দেড় মাসের মধ্যে সব শেষ করতে হবে। নিশ্চিন্ত হবার মত শেপে নিয়ে আসতে হবে। তারপর ডেটিংয়ের প্রস্তুতি আরো দেড়মাস।

ঠিক তিনমাস পরের যে কোনো একদিন সে আসবে– জড়াবে ভালোবাসায়, বিভোর আলিঙ্গনে, প্রিয়তমা মৃত্যু আমার। অথবা আমিই যাবো তার কাছে।

কিছু কিছু কথা রাখতে হয়, কিছু কিছু প্রতিজ্ঞা ভাঙতে নেই।

ব্রেক

ইন দ্য ইয়ার অফ নাইটিন নাইনটি ট্যু, রাতের বেলা রিয়াজের ফোন-

: হ্যালো, দোস্ত, সকাল দশটায় তুই আর মিঠু একটু কলেজে আয়, প্লিজ দোস্ত।
: কেনো?
: কাল তানজিনার সাথে ডেট। বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবো। তুই আর মিঠু ছাড়া ভরসা পাই না।

ভালোবাসার পবিত্রকাজে সাহায্য কইরা সোয়াব হাসিলের জন্য সকাল দশটায় মটর সাইকেল নিয়া কলেজের পিছনে হাজির হইয়া বেআক্কেল বইনা গেলাম। দেখি আরো বারোটা মটর সাইকেল, রিয়াজ তানজিনা ছাড়া সব মিলায়া আমরা ত্রিশজন রিয়াজের ডেটিং সহায়তা সৈনিক।

রিয়াজ বুদ্ধিমান সাবধানী পোলা। মগজ চুরি হওয়ার ডরে সব বুদ্ধি হাটুতে লুকায়া রাখে। সে রিস্ক নেয় নাই– কেউ যদি আসতে মিস করে তাই সাবস্টিউট রাখছে। মাগার কেউ মিস করে নাই।

বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাত্রা করলাম। রিয়াজ আর তানজিনা অটোরিক্সায়। অটোরিক্সাকে গার্ড দিতাছে বারো মটর সাইকেল। পুরা বরযাত্রী বরযাত্রী আমেজ।

২.
বোটানিক্যাল গার্ডেনের ফাঁকা জায়গায় বইসা রিয়াজ আর তানজিনা কথা কইতাছে। আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ায়া গার্ড দিতাছি। হঠাত রিয়াজ ইশারা করলো। কাছে যাইতেই কইলো–
: দোস্ত, তোরা ওর সাথে একটু গল্প কর, আমি যামু আর আমু।

সবাই গল্প করতাছে। মাগার রিয়াজ আর আসেনা। দেড় ঘণ্টা পরে আমি আর মিঠু খুঁজতে বাইরালাম। দুই ঘণ্টা পরে তারে পাওয়া গেলো মালির ঘরে– ছয় ফিট দুই ইঞ্চি লম্বা রিয়াজ কানে ধইরা দাঁড়িয়া আছে। ফুল ছিড়ার শাস্তি ভোগ করতাছে। শাস্তি দাতা মালি সাড়ে চার ফুট উচ্চতার তালপাতার সেপাই, তুমুল ভাব নিয়া রেডিও শুনতাছে। মালিকে ধমকে রিয়াজরে ছাড়িয়া আনলাম। রিয়াজ আর স্বাভাবিক হইতে পারলো না। ডেটের বদলে সবাই মিলা আড্ডা দিলাম কতক্ষণ।

৩.
এবার ফিরার পালা। কিন্তু অটো নাই। তানজিনারে সাড়ে চারটার মধ্যে বান্ধবীর বাড়িতে পৌছায়া দেবার দায়িত্ব পড়লো আমার উপর। দেড় ঘণ্টার রাস্তা। মোটর সাইকেলে দিলাম টান। এদিকে ব্রেকে সমস্যা– সাইকেলের ব্রেক না, আমার ব্রেক। বারবার খালি ব্রেক ধরি। ব্রেক ধরতে ধরতে ভয়াবহ এক্সিডেণ্ট ঘইটা গেলো। দুইজনে টানা সাত বছর ভুগলাম– ‘তাই না তানজিনা! জান্টুশ! একটু চা বানাও, চুমায়া চুমায়া খাই..’

: অসভ্য, ইতর! দুই বাচ্চার বাপ হয়ে গেছো, এখনো এমনি করে কথা বলা যায়না!

ভোকাট্টা

ঘুড্ডিটা ভাকাট্টা হয়ি গেসে। আউলা বাতাসে পাক খাতি খাতি ভাসি ভাসি যাসসে। কুথায় গিয়ে গোত্তা মারি পরিবে কে জানে! সে নিজেও জানেনে। তার কাজ হচ্ছি ভাসি যাওয়া, এক সুতা ছিড়ে অন্য সুতার গিট্টুতে আটকে যাওয়া। গাছের ডালে পাতায় লটকি থাকা’- মাজেদ বয়াতি কথাগুলো বলে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। রফিকের চায়ের দোকানে উদাস দুপুরে এক ভোকাট্টা ঘুরির সাথে সকল কাস্টমার নিজেদের মিল খুজে পায়। সবাই যেন বারবার ভোকাট্টা হওয়া ঘুরি। শুধু ভেসে যাওয়া, নতুন গিট্টুতে আটকে থাকা, আবার ভেসে যাওয়া, সংসারের মায়ার লতায় পাতায় লটকে আছে। মাজেদ বয়াতি চিনাবার আগে নিজেদের নিজেরাই চিনতো না।

রফিকের চায়ের দোকানের টুলে বসেই দোতারা বাজিয়ে বয়াতি গেয়ে ওঠেন-
উত্তরে বয় দখিন দিকের হাওয়া
এবার হবে যাওয়া আমার যাওয়া,
এক জীবনে সব হবেনা পাওয়া
পরাণ পাখি জানে শুধু ভেসে যাওয়া…’
মাজেদ বয়াতীর দরাজ সুরে প্রকাশ্য দুপুরে নিস্তেজ হাট খুন হয়ে যায়। তাকে ঘিরে ভীড় জমে ওঠে, কারো কোথাও যাওয়া হয়না। শুধু ভোকাট্টা ঘুরিটা মাজেদ বয়াতীর গান আর ভীড়কে তুচ্ছ করে ভেসে যেতে থাকে..দূরে..বহুদূরে…।

সুপারম্যানের আন্ডারওয়্যার

মাসুদ রানা, শার্লক হোমস, ওয়াটসন, কিরীটি রায়, বোমক্যাশ, ফেলুদা, টেনিদা, দস্যু বনহুর ব্যাস্ত মানুষ। কিছুটা সময় বের করেছেন। জংগলে দল বেধে কাটাবেন। রাতে হৈ চৈ করবেন। একটু অবসর উপভোগ করবেন। চিন্তা নেই, তাদের শিষ্যরা আজকাল অপরাধের আগেই অপরাধী ধরে ফেলছে।

রাতে তাবুর নিচে ঘুমোতে গিয়ে ফেলু মিত্তির প্রথম বুঝতে পারলেন তার লাল আন্ডারওয়ারটা নেই। মহামূল্যবান আন্ডারওয়্যার। সুপারম্যানের কমোডের ফ্ল্যাশ রহস্য সমাধান করার জন্য গিফট পেয়েছিলেন। সেই আন্ডারওয়্যারে নিকোবর দ্বীপপূঞ্জে জলদস্যূ জলি রোজার্সের গুপ্তধনের সাংকেতিক নকশা আছে। ডায়মন্ডের দুইটা বোতাম দিয়ে বিভিন্ন সংকেত অাঁকা আছে। এঞ্জেলিনা জুলির অরিজিন্যাল অটোগ্রাফ আছে।

এখানে যারা আছে তারা কেউই ফেলুদার আন্ডারওয়ার চুরি করবেনা। তবু তদন্তের স্বার্থে সবাইকে সন্দেহ করতে হচ্ছে। তারা সবাই ভালো ভাবে অনুসন্ধান চালালেন। নিজের নিজের প্যান্ট খুলে চেক করলেন। শুধু ওয়াটসনের প্যান্টের জিপার জ্যাম হওয়াতে খোলা যায় নাই। জিপারে জ্যাম লাগার ব্যাপারটা খুব রহস্য ও সন্দেহ জনক।

তদন্তের ফলাফল শুন্য। অথচ এই আন্ডারওয়ারটাই ফেলুদার সবেধন নীলমনি, অমূল্য সম্পদ।

মাসুদ রানা হোমসের কাছ থেকে একটা হাভানা চুরুট নিয়ে জ্বালালেন। তারপর ফেলুদাকে বললেন-
: আপনি শেষ কবে আন্ডারওয়ারটা পরেছিলেন?
: আজ সকালে।
: তারপর খুলে রেখেছিলেন কোথায়?
: রানা ভাই, আমি সেটাই মনে করতে পারছিনা।
: ফেলু বাবু, আপনি সুপারম্যানের মত আন্ডারওয়ারটা প্যান্টের উপরে পরেছিলেন?
: হ্যা, কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?
: কারণ, এখনো লাল প্যান্টের উপরে আপনি লাল আন্ডারওয়ার পরে আছেন। স্কীন টাইট বলে বোঝা যাচ্ছেনা।
: আপনি বুঝলেন কিভাবে?
: যখন চুরুট জ্বালালাম, তখন আপনার আন্ডারওয়ারের ডায়মন্ডগুলো চিকচিক করে উঠেছিল।

সবাই স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে খুলে ফেলা নিজের নিজের প্যান্ট পরে নিলেন। ফেলুদা প্যান্টের উপর থেকে লাল আন্ডারওয়্যার খুলে বাক্সে লক করে রাখলেন। রানা মনে মনে বললেন, আজ সুপারম্যানের আন্ডারওয়্যারের নামে কেমন সবার প্যান্ট খুলিয়ে ছাড়লাম। শুধু বোকা ওয়াটসনই প্যান্ট না খুলে অর্ধেক জিপার খুলেছিল। এখন জিপার লাগাতেও ভুলে গেছে। ও ওভাবেই থাক।

বিভ্রম

১.
ফাগুন মাইস্যা রইদ্দের মইদ্যে কেমুন কেমুন আউলা ঝাউলা ফূর্তি ফূর্তি একটা ভাব আছে। মনের ভিতরে ডাইকা ওঠে কোকিল আর লিলুয়া হাওয়ায় প্রেমপিরিতির ডাক। কিন্তুক আঠারো বছরের এহছানের বমি আইতাছে। আইজ তিন তালার ছাদ ঢালাই। এহছান মালের টুকরি লইয়া উঠতাছে ঠিকই, ওর পা টলটলাইতাছে।

দুপ্পুরবেলা হারুন কণ্ট্রাক্টর এহছানের পিঠে থাবড়া মাইরা কয়-
: আব্বে হালায়! গাঞ্জা খাইছোস না কেউ তর গোয়া মারছে? এমুন কাপতাছোস কেলা! চোখ লাল কেলা! তর হইছেটা কি?

এহছান জবাব দেয়না। ফ্যালফ্যালায়া চায়া থাকে। হারুন কণ্ট্রাক্টর থাবড়া মারতে গিয়া থাইমা যায়, কপালে হাত রাইখা চিল্লায়া ওঠে- “মামদার পো, জ্বরে তর গা পুইড়া যাইতাছে। হালায় ময়মনসিংগা খাচ্চর, তুই আমার লগে কাম চোদাছ!”

২.
কন্ট্রাক্টর এসিস্টেন্টরে কাম বুঝায়া দেয়। ইঞ্জিনিয়ার ছাদ ঢালাই শেষ হওন পর্যন্ত থাকতে কইছিলো, ও জবাব দিছে ‘আমার লেবার মইরা যায়, ঢালাই শ্যাষ হওনের মায়রে চুদি।” ঢালাই বন্ধ হওনের ডরে ইঞ্জিনিয়ার আর কিছু কওনের সাহস পায় নাই।

অজ্ঞান এহছানরে লয়া কণ্ট্রাক্টর হাসপাতালে ছুটে। এমার্জেন্সিতে কি এক ইঞ্জেকশন আর স্যালাইন দেয়। আধাঘণ্টা পরে এহছান বিড়বিড়ায়া কি জানি কয়। কন্ট্রাক্টর হাফ ছাইড়া বাঁচে। এহছানরে হাসপাতালে ভর্তি করায়া ওর বাপরে খবর দেয়।

৩.
এহছানের জ্বর কমতাছে না। মাঝেমইদ্যে জ্ঞান ফিরতাছে। ঘোর লাগা চোখে এদিক ওদিক চায়া কি জানি কি কয়, কারে যানি খুজে, আবার চোখ বন্ধ কইরা অজ্ঞানের মতন পইড়া থাকে।

এহছান বুঝবার পারে ওর আম্মায় কপালে পানিপট্টি দিতাছে। ঘোরের মদ্যেই দুই তিনবার চোখ খুইল্যা আম্মারে দেখে। এহছানের মনে অয় আম্মার হাতটা শক্ত কইরা ধরলেই জ্বর কইমা যাইবো। ও আম্মার হাতটা শক্ত কইরা ধরে। কিন্তুক আম্মায় হাত ছাড়ানির লেগা পাছড়াপাছড়ি শুরু করে। আম্মায় যত পাছড়াপাছড়ি করে ও ততই পোলাপানগো রকম শক্ত কইরা চাইপ্যা ধরে।

জ্বরের ঘোরে এহছানের মনেই পড়েনা আম্মায় গেছে, আষ্ট বচ্ছর আগে আম্মায় এক্কেবারে মইরা গেছে।

ইলিশতত্ব

কার্তিক মাস। ইলিশের মৌসুম শেষ হইয়া আসিয়াছে। এইবার জ্বালে খুব ইলিশ পড়িয়াছিলো। তথাপি জ্বেলে পাড়ার অসিত, বাসেত, মঙ্গল, কুদ্দুসের ঘরের অভাবে সুখ হাসিয়া উঠে নাই।

ইলিশ মৌসুম শেষ হইবার পূর্বেই তাহারা মহাজন করিম মোল্লা ও সিধু পোদ্দারের নিকট হইতে আগাম মৌসুমের জন্য দাদন লইয়াছে। দাদন না লইয়া কি করিবে! চলতি মৌসুমের দাদনের টাকা লাভসমেত পরিশোধ করিবার পরে তাহাদের ঘরে অন্নের সংস্থান নাই। এই দাদনচক্রে আটকা পড়িলে বাহির হইবার পথ নাই, মৃত্যু পর্যন্ত ডাঙ্গায় তোলা ইলিশের মতন তড়পানি সার।

কার্তিক মাসের মধ্যভাগে অবিরাম বর্ষণ। সাগরে চার নাম্বার বিপদ সংকেত। বর্ষণে আর ঝড়ের হাওয়ায় পদ্মা উত্তাল। এই অবসরে হরেনের ঘরের দাওয়ায় অসিত, বাসেত, দুগগা, কুদ্দুস, মোখলেস, নরেন আড্ডারত। তাহারা একই নৌকায় ইলিশ শিকার করে। আকস্মাত অসিত বায়না ধরিয়া বসে-
: বাসেত কাহা, চলো ক’টা মাছ মারি লইয়ে আসি..
: কি রে অসিত! পাগল হইয়েছিস! এই উথালপাথাল পদ্মায় মাছ মারিবো কিবায়!
: ক্যানে! সমিস্যা কি!!
: একে সিগনিল, তাইর মইদ্যে মাছ তো গাঙের নিচে চইলে গেছে..
: চলো কাহা, মন কইছে মাছ আজ পাবোই, ঘরের মানুষগুলানরে আইজ পরাণভরি ইলিশ খাওবো, বুইঝলে!
: হ রে অসিত, এবার এত্তো ইলিশ ধইরলাম, বাড়ির গ্যাদা ছাওয়াল-পাওয়ালগো খাওয়াতি পাইরলাম না। কি কপাল নিয়া যে জন্মাইলাম!

কপালের চিন্তায় মেঘময় আকাশের সকল বিষন্নতা যেন তাহাদের মুখ চাপিয়া ধরে, আড্ডা জুড়িয়া নিখাদ নীরবতা নামিয়া আসে।

২.
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পদ্মার প্রমত্ত ঢেউয়ে হারাণের নৌকা দুলিতেছে। জাল ফেলা হইয়াছে। বৃদ্ধ হারাণ বৃষ্টিকে আড়াল করিয়া বিড়ি ধরায়, লম্বা একটা সুখটান দিয়া অট্টহাসিতে ফাটিয়া পড়ে–
: হোহোহোহোহো! ভাইবে দেইখলাম আমরাও ইলিশ মাছ। মহাজনের দাদনের জাল আমাগের টাইনে টাইনে তুলে…

বাসেত হাসিয়া বলে-
: তা যা কইয়েছো কাহা! তুমি দেইখছি পণ্ডিত হইয়ে গেছো–

হারাণ উন্মাদের মতন হাসিতে হাসিতে চিৎকার করিয়া কহে-
: পণ্ডিতির দেইখিছিস কি! আমি জানিনা ভাইবেছিস! দুইন্যাতে জাত হইলো দুইটা- মহাজন আর হরিজন, ইলিশ আর ইলিশ শিকারী.. আর কুনু জাত নাই, পাত নাই, ধম্ম নাই…

হারাণের কথায় নৌকায় হাসির হুল্লোড় পরিয়া যায়। তাহারা লক্ষ্য করেনা হারাণের ইলিশ তত্বের কথা শুনিয়া পদ্মার প্রমত্ত ঢেউগুলি লজ্জায়-ক্রোধে- আক্রোশে এক একটা নতুন ঢেউয়ের নিচে ডুবিয়া যায়, মুখ লুকায়।

(খসড়া)

ব্রেকিং: শোক সংবাদ

ফেসবুক সেলেব্রেটির হার্ট আট্যাকে মৃত্যুঃ দায়ী ফেসবুক!
|নিজস্ব সংবাদদাতা|

বিশিষ্ট ফেসবুক সেলেব্রেটি, অনলাইন একটিভিস্ট ও ব্লগ কিংবদন্তী ম. গা. চৌধুরী আজ রাত ৯:৪৫ মিনিটে হার্ট আট্যাকে মৃত্যুবরন করেছেন। তুমুল জনপ্রিয় এই ফেসবুক সেলেব্রেটি মৃত্যুকালে স্ত্রী, ফ্রেন্ড লিস্টে ৫০০০ ফ্রেন্ড, লক্ষাধিক ফলোয়ার এবং কয়েকশো ব্লগ পোস্ট আর কয়েক হাজার স্ট্যাটাস রেখে গেছেন।

বিশ্বস্ত সূত্র জানায় তিনি প্রতিদিনের মত আজ সন্ধ্যায় ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস শেয়ার করেন। উল্লেখ্য, আপলোডের সাথে সাথে তার অতি দীর্ঘ পোস্টেও লাইকের সংখ্যা ৩৮৮টা ছাড়িয়ে যেত। প্রথম দশ মিনিটে লাইকের সংখ্যা ১০,০০০ হাজারের সীমা অতিক্রম করত। কিন্তু আজকের পোস্টে প্রথম বিশ মিনিটে কোনো লাইক না দেখে তিনি তীব্র মানসিক আঘাতে ভারসাম্য হারালে অচেতন অবস্থায় স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।

ভক্তরা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ক্ষোভের সাথে জানান আজ সন্ধ্যায় তারা অপেক্ষায় থাকলেও ফেসবুকে ম. গা. চৌধুরীর নতুন পোস্ট দেখতে পান নাই। এর পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। ভক্তরা ফেসবুককে দায়ী করে জুকারবার্গের পদত্যাগ ও তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবীতে ফেসবুকেই শতাধিক ইভেন্ট খুলেছে এবং জার্মানীর দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।

অপরদিকে ম. গা. চৌধুরীর ছোটো ভাই বলেন, “আজ সকালে ভাবী রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যান। ভাইয়া জাতির স্বার্থে খালি বাসায় পুরানো বান্ধবীকে নিয়ে জীববিজ্ঞান ও সহজিয়া দেহতত্ব নিয়ে গভীর গবেষণায় লিপ্ত হন। সন্ধ্যায় ‘ডারউনের উপর লালনের প্রভাব’ বিষয়ে একটি জ্ঞানগর্ভ স্ট্যাটাস শেয়ার করেন। কিন্তু দিনভর গবেষণা কাজের ক্লান্তি আর রাতেই ভাবীর ফিরে আসার ফোন পেয়ে ভাইয়া প্রাইভেসি সেটিংসের ‘অনলি মি (only me) কে ‘পাবলিক (public) না করেই স্ট্যাটাস পোস্ট করেছিলেন। ফলে তিনি ছাড়া অন্য কেউ পোস্ট দেখতে পায় নাই। ভাইয়া নিজের পোস্টে বিশ মিনিটে লাইক না দেখে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পরেন যে প্রাইভেসি সেটিংসের ব্যাপারটা তার চোখ এড়িয়ে যায়। তিনি তিন চারবার “ছাগু জুকারবার্গ, লেঞ্জা ইজ এ ভেরি ডিফিকাল্ট থিং টু হাইড”- বলে জ্ঞান হারান। রাত ৯:৪৫ মিনিটে চিকিতসকেরা তাকে মৃত ঘোষনা করেন।

তার মৃত্যুতে ফেসবুক আর ব্লগ জুড়ে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাকে কেন্দ্র করে পোস্টে পোস্টে ভরে উঠছে ব্লগ আর ফেসবুক। আগামীকাল সকাল ১০টায় ফেসবুকের জানাজা গ্রুপে তার ভার্চুয়াল জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। নিখিল বাংলাদেশ আঁতেল পরিষদ ও সম্মিলিত ঢংস্কৃতিক জোট এক বিবৃতিতে তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে দাফনের দাবী জানিয়েছে।