ট্যাগ আর্কাইভঃ সাঈদ এর অণুগল্প

ডানকানা মাছ

ঘুমিয়ে যাও। হারিয়ে যাও স্বপ্নে। তোমার মাটিকাটা মজুরী রোজ ৩০০টাকা। স্বপ্নে ভাত খাও। চালের কেজি ৩২টাকা, ডালের ৮২, পামওয়েল৬০, ফিনফিনে লবন সস্তা ভীষণ। বিড়িটা জেগে জেগেই ফুঁকো।

তিন ছেলে ইশকুলে যায় না। রেল লাইনে মারবেল খেলে। মাল টানে। এটা সেটা টোকায়। আধটানা সিগারেটের ফিল্টারে টান দেয়। খুকখুক কাশে। তাদের এড়িয়ে রাজপুত্তুর আর বার্বি ডলের দল ইশকুলে যায়।

বউ অন্য ভাতারের সাথে ভেগেছে। নতুন ভাতার রিকশা চালায়, ছয়শো টাকা কামায়। মোটা চালের ভাত নরম তেলেপিয়া আর বেগুনের ঝোলে মাখায়। প্রতি গ্রাসে ফেলে আসা সন্তানদের কথা মনে পড়ে কি পড়ে না!

মাটিকাটা শ্রমিক, তুমি ঘুমিয়ে যাও। স্বপ্নে হারিয়ে যাও। ছেলেবেলার পুকুরে ডানকানা মাছ ধরো। এক দুপুরে সারাজীবনের জন্য ডানকানা মাছ হয়ে যাও। তারপর ভেসে ভেসে বালি খাও, মাটি খাও, শ্যাওলা খাও।

গন্ধ

ফরিদ মুৎসুদ্দী ছোট অফিসের বড়কর্তা। জীবন যাপনে সাদামাটা। সিগারেট, পান বা চায়ের অভ্যাস নেই। সপ্তাহে ছয়দিন মদ খান।

প্রতিদিন তিনি অফিস শেষে ‘মদিরা বার এন্ড রেষ্ট্যুরেণ্ট’-এ যান। ডান দিকের কোনার টেবিলে বসেন। গ্লাসের অর্ধেক বরফকুচিতে ভর্তি করেন। তিন টুকরো লেবু চিপড়ে নেন। গ্লাসে এক পেগ করে ভদকা ঢালেন। ঠান্ডা হবার জন্য দশ মিনিট অপেক্ষা করেন। তারপর ছোট ছোট চুমুক দিয়ে পান করেন। গুনে গুনে চার পেগ।

ভদকার গন্ধ মুখে বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। তবু তিনি ঝুঁকি নেন না। মদ খাওয়া শেষে বেশী পেয়াজে মাখানো একপ্লেট বাদাম খান। ওয়েটার কাইয়ূমের কাছে রাখা টুথপেস্ট আঙ্গুলে নিয়ে দাঁতে লাগান। ঘড়ি দেখে পাঁচ মিনিট বসেন। কুলি না করেই বাড়ির উদ্দেশ্যে বার ত্যাগ করেন।

শুক্রবারে তিনি ঘরে থাকেন। পরিবারকে সময় দেন। জুম্মার নামাজ আদায় করেন। দাওয়াতে যান। কোনক্রমেই মদ স্পর্শ করেন না। শুক্রবারে মদিরা বার বন্ধ থাকে, তবে রেষ্টুরেন্ট খোলা থাকে।

এক শুক্রবারে তিনি মদিরা বার এন্ড রেষ্টুরেন্টে হাজির হলেন। প্রতিদিনের মত শান্ত, স্থির। ম্যানেজারকে চার পেগ ভদকা দিতে অনুরোধ করলেন। নিয়মিত কাষ্টমার বিধায় ম্যানেজার তাকে স্টাফ রুমে নিয়ে গেলেন। তিনি চার পেগ খুব দ্রুত খেলেন। বিল পরিশোধ করে বেরুবার পথে ম্যানেজার বাঁধা দিলেন-
: স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, আপনি মনে হয় বেশ টেনশ্যানে আছেন! আমি বলতে চাইছি যে…
: আমার তাড়া আছে, হসপিটালে যাব। সংক্ষেপে বলুন।
:স্যার, আপনি মুখ হতে মদের গন্ধ দূর করতে ভুলে গেছেন।
: গন্ধ দূর করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, আমার মা ঘন্টা দুয়েক আগে… সিটি হসপিটালে… মারা গেছেন। আমি বাসায় …মা..গন্ধ থাকলে আর…
কথা শেষ করতে পারলেন না, অঝোর কান্নায় ভেসে গেলেন।

ফরিদ মুৎসুদ্দী জানেন না, কিছু কিছু গন্ধ দূর করার প্রয়োজনীয়তা কখনও ফুরোয় না। মা’রা মরে গেলেও সন্তানদের মুখের গন্ধ পান- হোক সেটা শিশুকালে পান করানো বুকের দুধের বা বেয়ারা মদের।

ফিল

মেট্রিক পরীক্ষা শেষ। নিজেদের লায়েক ভাবতে শিখেছি। দীর্ঘ ছুটি কাটছে আড্ডায়, বই পড়ে। ঘনিষ্ট বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম মদের স্বাদ নিব। রাসেলের বাড়ি সারাদিন খালি থাকে। ওর রুমে মদ খাব। কামাল বলল- ‘ঘরে মদ খাওয়া আর জিলাপি খাওয়া সমান। বিকালের খোলা ছাদ, মান্নাদের গান, আড্ডা আর কাবাব দিয়ে মদ- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ রাসেলের রুমে মদ পানের মুখেখড়ি অনুষ্ঠানে সবাই ছিলাম, কামাল ছিলনা। কি কাজে যেন আটকে গিয়েছিল।

কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ। এবার সিদ্ধান্ত হল কক্সবাজারে যাব। কামাল বলল- ‘দোস্ত, মজাই মজা। সারা রাত সৈকতে বসে জম্পেশ আড্ডা, ননস্টপ মদ, রবীন্দ্রনাথের গান- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ কামালের কক্সবাজার যাওয়া হয়নি। পরীক্ষার ফিস দিবার পরে ছাপোষা বাবার কাছে কক্সবাজার যাবার টাকা চাইতে পারে নাই। রাসেল আর আমি টিউশনি করতাম, বলেছিলাম-
: কামাল, তুই চল, তোর টাকা আমরা দিব।
: দোস্ত, মদে চুমুক দিলেই বুকের ভিতরে খচখচ করবে। টিউশনির টাকায় প্রতিদিনই তোরা চা- সিগারেট খাওয়াস, লাঞ্চ করাস, মদ খেতে পারব না।’ আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম, সৈকতে মদও খেয়েছিলাম, কামাল ছিল না।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ। দীর্ঘ ছুটি। সিদ্ধান্ত হল পূর্ণিমায় জাহাজে করে বরিশাল যাব। কামাল ভীষণ উত্তেজিত- ‘মাঝরাত।জাহাজের নীরব ছাদ। চাঁদের আলো ঢেউয়ের চুলে বিলি কাটছে। লালনের গীত আর গোলাম আলীর গজল। আড্ডা চলছে, পাল্লা দিয়ে মদ চলছে- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ বরিশালে গিয়েছিলাম, টাকা যোগার করতে পারে নাই বলে কামলের যাওয়া হয় নাই।

ভার্সিটিতে ঢোকার পরে কামালের সাথে যোগাযোগ কমে আসে। একটা সময় পুরো বন্ধ হয়ে যায়। হঠাত একদিন নিউমার্কেটে দেখা-
: কামাল, কেমন আছিস? এখন কি করছিস?
: দোস্ত, ব্যাস্ত আছি। শর্টকাটে বড়লোক হবার একটা লাইন পেয়েছি। টার্গেট পাঁচকোটি টাকা।
: পাঁচকোটি টাকা দিয়ে কি করবি?
: দোস্ত, তিন কোটি ব্যাঙ্কে ডিপোজিট। দু’কোটিতে বাড়ি। বাড়িতে একটা বিশাল ঘর রাখব বইয়ে ঠাসা। ঘরের কোনায় ছোট্ট বার। সাউন্ড সিস্টেম আর এক হাজার সিডি।
: এসব দিয়ে কি করবি?
: দোস্ত, অবসর সময়ে ইজি চেয়ারে বসে দস্তয়ভস্কি পড়ছিস। সাউন্ড সিস্টেমে খুব হালকা ভলিউমে পিয়ানো বাজছে। পড়ার ফাঁকে ব্লাডি মেরিতে চুমুক দিচ্ছিস – ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।
: তোর বাড়ি , তোর ঘর- ফিল করে আমার কি লাভ?
: হারামজাদা, এটা একটা কথা বললি। বিয়ে করলে বউটা ছাড়া পুরো বাড়ি তোদের দখলে দিয়ে দিব,খোদার কসম।
: তাহলে ঠিক আছে, হা: হা: হা:
: দোস্ত, আহম্মকের মত হাসিস না। মদ, বই, মিউজিক সব একসাথে, এক ছাদের নিচে, এক ঘরে- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।

কামাল এখন কোটিপতি। অতীতের সূত্র ধরে ওকে যত বলি ‘ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ ও বলে- ‘দূরে গিয়ে মর ব্যাটা, দূরে গিয়ে মর।’ – গল্পটা এভাবে শেষ করতে পারলে বেশ হত, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল-
শেষ পর্যন্ত কামাল শর্টকাটে বড়লোক হতে পারে নাই। বসের ইশারায় র‍্যাব ওকে মেরে ফেলে। এরপর থেকে আমরা মদ খেতে পারি না। মদ খেলেই কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে- ‘ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ মদের বদলে আমরা কামালের তীব্র মৃত্যু যন্ত্রণা ফিল করি। দম বন্ধ হয়ে আসে। ফিসফিসানি থামেনা, বেড়েই চলে- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর… ফিল কর দোস্ত, ফিল কর…

রবীন্দ্রনাথের বার্থডে পার্টিতে গণ্ডগোল: আটক ১

দু পেগ হুইস্কি খেয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “হুইস্কি খেয়েছিলাম বিলেতে, আহা কি স্বাদ! দু চুমুক দিতেই আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে… ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে..।” সুকুমার রায় ফোঁড়ন কাটলেন- “কবিগুরু, আপনি এখনও ঢলছেন।” আমেরিকান বিয়ারের ক্যান খুলে চুমুক দেবার আগে দৃপ্তকণ্ঠে সুকান্ত বললেন, “কমরেড, চিয়ার্স। বিয়ারের সাথে পূঁজিবাদ মেশাবেন না।” মধুসূদন নীরবতা ভেঙ্গে নাটকের ঢংয়ে বললেন- “লা ম্যুর ফ্রান্স, লা ম্যুর ফ্রান্স.. ওয়াইনতো নয় যেন আগুনেরই গোলা রে.. আগুনেরই গোলা।’ কেষ্টা বলল- “কত্তা, শেষ লাইনটা মমতাজ ম্যাডামের গান, কপিরাইট আইনে আটঁকি যাবেন যে!” এদিকে মীরা বাঈ ঠুমরির সুরে গেয়ে চলেছেন- বন্ধু যখন বউ লইয়া/আমার বাড়ির সামনে দিয়া/রঙ্গ কইরা হাইটা যায়/বুকটা ফাইট্টা যায়… বুকটা ফাইট্টা যায়..”

শরতচন্দ্র মদের গেলাস নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। ছোট চুমুক দিচ্ছেন। বিষন্ন, চোখ ছলছল। কাজী নজরুল ঘাড়ে হাত রাখতেই নিজেকে সামলাতে পারলেন না, হুরহুর করে কেঁদে দিলেন-
: দাদা, আমি এখানে কেরু এন্ড কোংয়ের ভদকা গিলছি, গলা দিয়ে নামছে না..
: কেন? কি হয়েছে?
: আমার দেবদাসটা না জানি কোথায় চোলাই গিলচে, তারপিন তেল খাচ্চে। হয়তো মদ খেতে না পেয়ে তৃষ্ণায় ছটফটাচ্চে..।
শরতবাবু কান্না চাঁপার ব্যার্থ চেষ্টা করে কাজী নজরুলকে জড়িয়ে ধরলেন। নজরুল পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে লাগলেন। কেষ্টা ফিসফিসিয়ে বলল, “কত্তা, রংধনু হলে জাপটে ধরুন, না হলে ছেড়ে দিন। একন দেয়ালেরও চোক আচে যে, কোতায় কোন ষিষি ক্যামেরা কে জানে!”

বঙ্কিম বাবু একে সাহিত্যিক, তার’পরে আইনের লোক সরকারি আমলা। তিনি ভীষণ চটেছেন- ডিজে নাই তার নাম আবার পার্টি! সি বিচে যেন শিখিনি- কোনটা টপলেস আর কোনটা বিকিনি! অবনীন্দ্রনাথ এক গ্লাস ব্লাডি মেরি তার হাতে দিয়ে কানে কানে জানালেন-
:আংখেইল, ডিজে পার্ঠি হবে- ব্যাবস্থা করেছি। আইঠেম সং পারফর্ম কৌরবে ম্যাডাম পার্বটি, আই মিন পারু… হু লালা হুলালা…
: ওয়াও! ওয়েলডান মাই ফ্রেন্ড। মাইন্ড ইঠ- উই আর নট আংখেইল এন্ড ভাইপৌ ঠুডেই। ইন গ্লোবাল ভিলেইজ উই আর চুনিলাল।
: আংখেইল, সরি ড্যুড, ডৌন্ট ওউরি বি হ্যাপ্পি… ঠেক ড্রিংক্স বি হ্যাপ্পি.. ইয়ো… ইয়ো।”
কেষ্টা অবনীন্দ্রকে থামিয়ে বলল- “আস্তে কত্তা, আস্তে। কি যা তা কচ্চেন! হুশ করি কন। হ্যাপীকে নিয়ে ইউটুবে এশকেনডিল চইলচে যে! আপনার গুপন এশকেনডিল ফাঁস হলি ঠাকুর বাড়ির মান-সম্মান থাকবি!”

বুফে ডিনার শেষ। মীরা বাঈ পেমেন্ট নিয়ে চলে গেছেন। শুরু হল পার্বতী ম্যাডামের উদ্দাম গান-
“সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুলেডোরে বাঁধা ঝুলনা
ইয়ো বেইব চিকনি চামেলীর দোপাট্টা খুলোনা খুলোনা খুলোনা
মুন্নি বদনাম হুয়ি ঠাকুর তেরি লিয়ে…”
ডিজে পার্টির উন্মাদনার তালে নাঁচে-গানে ভেসে গেল সবাই। আলখেল্লা পরে নাঁচতে সমস্যা হচ্ছিল বলে রবীন্দ্রনাথ শর্টসের সাথে টিশার্ট পরে নিলেন। সুবিধার জন্য লম্বা দাড়ি রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনিটেল করলেন। শরতচন্দ্র ধুতির নিচে স্কিন টাইট জিন্স পরে এসেছিলেন- নিজের দু:খ ভুলে সবাইকে মজা দিতে ড্যান্স ফ্লোরে স্ট্রিপারদের মত নাচের তালে তালে ধুতি খুললেন। মধুসূদন নাচতে গিয়ে এর ওর গায়ে ঢলে পরছেন। কাজী নজরুল তেজী মানুষ- নাঁচের নামে তালে তালে এমনভাবে হাত পা ছুড়ছেন যে তার পাঁচফুটের মধ্যে কেউ যেতে পারছে না। বঙ্কিম বাবু আর অবন ঠাকুর পার্বতীকে কেন্দ্র করে নাঁচছে, তাকে ছুঁতে চাইছে। কিন্তু পার্বতী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মত পিছলে যাচ্ছে।

রাত গভীর হয়েছে। কেউ স্বাভাবিক অবস্থায় নেই- সব বেহেড মাতাল, নেঁচে যাচ্ছে। হঠাত কেষ্টা লাঠি নিয়ে মাঝখানে ঝাপিয়ে পরে সবাইকে মারতে শুরু করল, হুংকার দিয়ে বলতে লাগল- “এই পারু গান থামাবি না। ইতরের দল, রবীন্দ্রনাথের বার্থডের লেট নাইট পার্টি করো! শালা ভন্ডমীর জায়গা পাওনা! মুখোশ পরে মেকাপ নিয়ে এক একজন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মধুসূদন হয়ে গেছ। শুয়োরের বাচ্চা শুয়োর! সবকটার মাথা ফাঁটাবো- এই পারু, তুই গান চালিয়ে যা।” ঘটনার পরের দিন টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে জানা গেল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবস উপলক্ষ্যে ঘরোয়াভাবে আয়োজিত ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠান চলাকালে চাকরের লাঠির আঘাতে দেশের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয়, প্রখ্যাত এবং প্রতিশ্রুতিশীল কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী গুরুতর আহত হয়েছেন, চাকরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। নিজের প্রয়াণ দিবসে এ সংবাদ শুনে মেঘের আড়াল হতে “যা কিছু ঘটে তবেই রটে কেষ্টা বেটাই চোর” বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেসে উঠেছিলেন কি না জানা যায় নাই।
——-

২২ শ্রাবণ, ১৪২২, ০৬ অগাষ্ট, ২০১৫

নোট ২

লিলুয়াপুর থানার ওসি(তদন্ত) কিছুতেই মানতে চাইছেন না যে,

ক. রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তার ৭০% সেন্টিমেন্টাল আবর্জনা, ২০% অতি ঐশ্বরিক, ১০% প্রকৃত রবীন্দ্রনাথ এবং অতুলনীয়।

খ. বয়স বাড়লেও প্রচন্ড জ্বরে বা রোগে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, অতি আপনজনেরা বিছানার পাশে বসে ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও হাত ধরেন বলে প্রতিটি মানুষের বছরে অন্তত একবার রোগে ভোগা উচিত।

গ. শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার মাঝে বাবা-মা’র নাম ও স্বামীর নাম ছাড়া আর কোনো মৌলিক পার্থক্য নাই।

ঘ. ইলিশ মাছ ভাজা, পুটি ও ট্যাংরা মাছের চচ্চরি, মটরশুটি আলু টমেটো দিয়ে শোল মাছের ঝোল যে অপছন্দ করে তার আদর্শ খাদ্য বেবি সেরিয়াল ও ইশুবগুলের ভূষির চিনি ছাড়া শরবত।

ঙ. আলহাজ্ব হাসানুল হক ইনুই বামদের শফি হুজুর এবং হাজী রাশেদ খান মেনন হলেন বাবুনগরী।

চ. সহ্যের সীমা আছে, অসহ্যেরও সীমা আছে, অসহ্যের সর্বশেষ সীমা অতিক্রান্ত হবার পরেই সুদিন আসবে।

ছ. এই দেশে সবাই যার যার ক্ষেত্রে মুক্তমনা, তবে যারা মুক্তমনার সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরে আর যারা সার্টিফিকেটধারীদের সাইজ করার জন্য খুঁজে বেড়ায় তারা লুপ্তমনা ও গুপ্তমনা।

জ. কেউ স্মার্ট হয়ে জন্মায়না, লেটেস্ট মডেলের স্মার্ট প্রযুক্তিপণ্য ক্রয় ও ব্যাবহারই মানুষকে স্মার্ট করে তোলে।

ঝ. মানুষ দেবতা হয়ে জন্মায়, বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুয়তান হতে থাকে।

ঞ. পশুর মত বাঁচার চাইতে মানুষের মত স্বেচ্ছায় মরে যাওয়া উত্তম।

– এটা একটা সুসাইড নোট। অথচ শেষ পয়েন্টে স্পষ্ট লেখা আছে-
ট. থানার ওসি মানবেন না এটা সুসাইড নোট, ঝামেলা ছাড়া দ্রুত লাশ দাফন করতে চাইলে তাকে টাকার নোট দাও।

সেসময় -২

: মিজাইন্যারে ইয়াদ আছে! আফসু মাহাজনের শাড়ীর দোকানের ম্যানেজার আছিলো। আমগো দোকানের উলটা দিকে বইতো।
: মিয়া, তুমি বিতলা মিজানের কথা কইতাছো! ঐ যে ইন্দুরের উতপাতের সময়ে এক দামড়া ইন্দুরের পুঁটকিতে সিলি কইরা দিছিল?
: হ, হ, বিতলা মিজান, এক ইন্দুরের পেরেসানীতে বেবাগ ইন্দুর ভাগছিল, আফসোস, বুঝলা মিয়া, আফসোস..
: কেলা! যুদ্ধ শ্যাষ, আফসোস কিয়ের! বিতলা হালার খবর কি!
: মিজানের চাচাতো ভাই তাইজু আইছিল কাইলকা, বহুত কথা কইলো ।
: কি কইলো? বিতলা হালায় যুদ্ধে গেছিলো না কি?
: না, বউ রাইখা বিতলা হালায় যুদ্ধে যাওনের নিওত করছিল। মাগার পর্থম বাচ্চা হইছে। তাও আবার পোলা। মায়া কাটায়া আর যুদ্ধে যাইতে পারে নাই।
: এইবার বিতলা হালার বিতলামী যদি কমে! ঢাকায় আইবো কবে- তাইজু কইছে?
: তাইজু কইলো মিজাইনা ওর দোস্ত ভূপেনরে বউ-বাচ্চাসহ নিজের বাড়িতে ছাপায়া রাখছিল। রেজাকাররা এই খবর মিলিটারিরে দেয়। মিলিটারি মিজানের বাড়িতে আয়ে।
: বিতলা হালায় বুঝি মিলিটারির পুঁটকিতে সিলি কইরা দিছিলো- ইন্দুরের মতন?
: দূর মিঞা, আগে কথা শুনো, মিলিটারি পরথমে মিজানের পাঁচ মাস বয়সের পোলাটারে বন্দুকের বেনেটে গাইথা বারিন্দায় ঝুলায়া রাখছে। তারপরে মিজানের বিবি শাহনাজ আর ভূপেনের বিবি দিপালীর ইজ্জত লুটছে।
: কও কি হালায়?
: হ, তারপরে বেরাশ ফায়ার কইরা বেবাকরে মারছে। মারনের আগে মিজানের সামনে বাচ্চা পোলার মাথাটা বুট দিয়া থেতলায়া দিছে।
: হালারা কি মানুস না খবিস!

বিজয়ের চারদিন পরে সদরঘাটে পুড়ে যাওয়া এক শাড়ীর দোকানে দুজন প্রবীণ মানুষ পরস্পরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। অকারণেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তারা জানেন কোন কোন প্রশ্নের কোন উত্তর হয়না।

সেসময় -১

ফজলউদ্দীন খোন্দকার রুপগঞ্জ জামে মসজিদের পেশ ইমাম। পঞ্চাশ বছর বয়স। জোয়ান বয়েসে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলে শ্লোগান দিয়ে জেল খেটেছেন। পাকিস্তান স্বাধীন হবার পরে বুক ভরে শ্বাস নিয়েছেন। নিজের দেশ, নিজের পাক জমিন।

ইমামতি নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট আছেন। এই সময়ের রাজনীতি বুঝেন না, এই বয়সে বুঝার ইচ্ছাও নেই। যতটুকু বুঝেন তা নিজের মত করেই বুঝেন। পাঁচ মাস আগে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ। দিনে দিনে জামাতে মুসল্লীর সংখ্যা কমছে। আজ এশার জামাতে হাজির ছিলেন মাত্র ষোলজন। সবার চেহারায় আতংক। লক্ষণ ভালো না।

পাকিস্তান মিলিটারিবাহিনী গতকাল নিতাইগঞ্জ থেকে এই গ্রামে এসেছে। প্রাইমারী স্কুলে ক্যাম্প করেছে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। ঘোষ পাড়ার অনেকে মিলিটারির নাম শুনে পালিয়েছে।

হেকমত উল্লাহ মুদী দোকানদার। তিনি মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্বও পালন করে। প্রতিদিন এশার নামাজ শেষে ইমাম সাহেবের সাথে থাকে। গল্পগুজব শেষে রাত গভীর হলে বাড়ি ফিরে। আজ পোয়াতী বউয়ের ব্যাথা উঠেছে বলে ফরজ নামাজ আদায় করেই চলে গেছে।

ইমাম সাহেব তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করে সালাম ফিরাতেই মোয়াজ্জিন হেকমতের গলা শুনলেন, “হুজুর, দরজাটা খুলেন, দেরী কইরেন না, মহাবিপদ..।” ইমাম সাহেব দরজা খুললেন। রক্তাক্ত হেকমতের সাথে মসজিদে মিলিটারি ঢুকলো। ইমাম সাহেবের ঘর সার্চ করে একটা ট্রানজিস্টার পেতেই হেকমত কোঁকাতে কোঁকাতে জানালো, “স্যার, এই ট্রানজিস্টার দিয়াই ইমাম সাহেব আর হাম মিলকে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতা হ্যায়।”

একটা সস্তা ট্রানজিস্টারর আর আট বছরের এতিম নাতীসহ ইমাম সাহেবকে মসজিদের দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মেজর সারাফাত আলী খান ফজর ওয়াক্তের অপেক্ষা করছেন।

ফজরের ওয়াক্তে আজ আজান হয়নি। তবু বিশ-পঁচিশ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করতে চলে এসেছেন। মিলিটারি দেখে মসজিদে না ঢুকে দূরে জাম গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছেন। মেজর এদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি মসজিদের দরজায় দাড়ানো ইমাম সাহেবকে কোরান ছুঁয়ে শপথ করালেন। সবাই যেন শুনতে পায় এমন স্বরে স্পষ্ট বাংলায় জানতে চাইলেন-
: তুমি স্বাধীন বাংলা বেতার শুনো?
: শুনি।
: তোমার দুই ছেলে মুক্তি?
: জ্বি মুক্তি।
: তুমি মিথ্যা না বলে স্বীকার করলে কেন?
: কোরান ছুঁয়ে মিথ্যে বলবো কেন!

মেজরের কাছে এ কথার উত্তর নেই। তিনি কথা না বাড়িয়ে হেকমতকে ইমাম সাহেবের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেন। মাথা নিচু করে ম্রিয়মান গলায় বললেন ‘ফায়ার’। ইমাম সাহেব, তার আট বছরের নাতী আর মোয়াজ্জিন হেকমতের বুক চিরে বেরিয়ে গেল কয়েকটা বুলেট। মসজিদের দরজায় ঢলে পরলো তিনটা দেহ।

যন্ত্রণাকাতর হেকমত রক্তজমাট বাঁধা কাটা ঠোঁট, থেতলানো হাত আর বুকে বুলেট নিয়ে নিত্যদিনের মত সুরেলা গলায় ফজরের আযান দিতে লাগলেন- আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম.. আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম..।

ইমাম সাহেবের জোব্বা খামচে ধরে নাতি বলছে-“নানা, বুকের ভিতর জ্বলি যাচ্ছি, পানি খাবাম। তুই একটু পানি দে..” ইমাম সাহেব নাতির মাথায় নিস্তেজ হতে থাকা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, “আরেকটু সহ্যি কর নানাভাই, ফিরিশতারা তোর জন্যি মিঠা শরবত লয়ি খাড়ায়া আছে যে …”

হেঁট

লোডশেডিং। ভীষন গরম। মাঝরাতে ছাদে গিয়ে বসেছি। হঠাৎ আমার সামনে এসে দাড়াল লম্বা এক ভুত।

ভুত: ভুঁতেঁ বিঁশ্বাঁস কঁরেঁনঁ?

আমি: না, একটুও বিশ্বাস করিনা।

ভুত: ভুঁতঁকে ভঁয় পাঁন?

আমি: ভয় পাই মানে!! অবশ্যই পাই। তোমাকে দেখে ভয়ে সারা শরীর কাঁপছে।

ভুত: হিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁ ভুঁতে বিঁশ্বাঁস কঁরেঁন নাঁ অঁথঁচ ভূঁতকেঁ ভঁয় পাঁন হিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁহিঁ….

আমি: এ্যাই তুমি এই এলাকার এমপি-কে বিশ্বাস কর?

ভুত: মাঁথাঁ খাঁরাঁপ!! নাঁ, তাঁকেঁ এঁকটু্ঁও বিঁশ্বাঁস কঁরিঁনা।

আমি: এমপি-কে ভয় পাও?

ভুত: ভঁয় পাঁই মাঁনে। অবঁশ্যঁই পাঁই। উঁনাঁর কঁথা শুঁনেই সাঁরা শঁরীঁর ভঁয়ে কাঁপঁছে।

আমি: হা..হা…হা…হা..হা…হা…এমপি-কে বিশ্বাস করনা অথচ এমপি-কে ভয় পাও..হা..হা…হা…হা..হা…হা…

ভুত: আঁপনি আঁমাঁকে এমপি-এঁর সাঁথে তুঁলঁনা কঁরঁতে পাঁরঁলেঁন!!! আঁমাঁর মঁতন নিঁরীঁহ এঁকটা মাঁমঁদো ভুঁতকে এঁকা পেঁয়ে এঁভাবে অঁপমাঁন কঁরতে পাঁরলেঁন!!!! আঁপনি আঁমাঁর মাঁথা পুঁরো হেঁট কঁরে দিঁলেঁন…হেঁট মাঁথা আঁমি আঁর ঘাঁড়ের উঁপর রাঁখবো নাঁ…আঁপনি আঁমাঁর মাঁথা পুঁরো হেঁট কঁরে দিঁলেঁন…হেঁট মাঁথা আঁমি আঁর ঘাঁড়ের উঁপর রাঁখবো নাঁ…হেঁট মাঁথা আঁমি আঁর ঘাঁড়ের উঁপর রাঁখবো নাঁ…

এই কথা বলতে বলতে ভুতটা নিজের মাথা খুলে পায়ের গোড়ালীর সাথে আটঁকে হাঁটতে হাঁটতে ছাদের কার্নিশ থেকে লাফ দিল। তখনও গোড়ালীর কাছে আটকে থাকা মাথাটা খুব করুণ সুরে বলছিল ‘আঁপনি আঁমাঁর মাঁথা পুঁরো হেঁট কঁরে দিঁলেঁন…হেঁট মাঁথা আঁমি আঁর ঘাঁড়ের উঁপর রাঁখবো নাঁ…আঁপনি আঁমাঁর মাঁথা পুঁরো হেঁট কঁরে দিঁলেঁন…হেঁট মাঁথা আঁমি আঁর ঘাঁড়ের উঁপর রাঁখবো নাঁ…হেঁট মাঁথা আঁমি আঁর ঘাঁড়ের উঁপর রাঁখবো নাঁ…হেঁট মাঁথা আঁমি আঁর ঘাঁড়ের উঁপর রাঁখবো নাঁ…

মদারু

প্রতি বিষ্যুদবারে ফজল খন্দকার ভাবেন সাড়ে পাঁচটার মধ্যে অফিস থেকে বের হবেন। বাড়ি ফিরে পোশাক বদল করবেন। তারপর আট’টায় মদিরা বার এন্ড রেষ্ট্যুরেন্টে ঢুকবেন। পিয়াজ দিয়ে বাদাম মাখানোর সাথে আয়েশ করে কেরুর ভদকা খাবেন। ফরেন ভদকা সাধ্যে কুলোয় না। তাই তিনি ‘ মায়ের দেয়া বাংলা পানি গলায় ঢেলে নে রে ভাই, দিনদু:খনি মা যে তোদের কেরুর বেশী সাধ্য নাই’- ভাবাদর্শে বিশ্বাসী- এতে নেশা হয়, দেশপ্রেমও অঁটুট থাকে। তবে কোন বিষ্যুদবারেই তিনি সাড়ে আটটার আগে অফিস থেকে বেরুতে পারেন না।

আজ তিনি কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছেন। অফিসের বসকে বলে বিকাল ৪টায় ছুটি মঞ্জুর করিয়েছেন। কিন্তু ছটার আগে মনে হয়না হাতের কাজ শেষ করতে পারবেন। তবে যে করেই হোক ছ’টার মধ্যে বের হতে হবে। গতকাল মদ খেয়ে বাড়ি ফিরার সময়ে মতিঝিল বিমান অফিসের সামনে নেমে গিয়েছিলেন। সংকল্প করেছিলেন ভোরে সারসপাখিগুলোকে আকাশে উড়িয়ে তারপর ঘরে ফিরবেন। কিন্তু সফল হন নাই। রাত তিনটার দিকে পুলিশের ভ্যান এসে তাকে থানায় নিয়ে পেট ওয়াশ করানোর আর পিছনে ডিম ঢুকানোর ভয় দেখিয়েছে। রীতিমত তিন হাজার টাকা গচ্চা দিয়ে ভোরে ছাড়া পেয়েছেন। মাতাল অবস্থায় না থাকলে দশ হাজার টাকার কমে পুলিশ কি ছাড়তো!

আজ ফজল খন্দকারকে কেউ থামাতে পারবে না। পুলিশ কেন, সেনাবাহিনীও এলেও না। প্রথমে ভরপেট মদ খাবেন। তারপর মতিঝিলের শাপলাফুলকে ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ছেড়ে দিয়ে আসবেন। ধূলিবালি ধোঁয়া আর শব্দদূষণে শাপলা ফুলটা যে কিভাবে এখনও না মরে দাঁড়িয়ে আছে ভাবা যায় না! তারপর প্রেসক্লাবের সামনে কদম ফোয়ারাকে কুরিয়ার সার্ভিসে শ্রীকৃষ্ণের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিবেন। এরপর দোয়ল চত্বরে গিয়ে দোয়েল দুটোকে গ্রামের দিকে উড়িয়ে মতিঝিলে ফিরে আসবেন। সারসগুলোকে ভদকার দেশ রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় পাঠাবেন। তিনি অবাক হন- এই বাসঅযোগ্য শহরে সারস, শাপলা, দোয়েল, কদমকে বন্দী রাখা যে প্রকৃতিবিরোধী অপরাধ এ সরল সত্যটা এতদিনে কেউ বুঝতে পারে নাই! তিনি না হয় লোকাল ভদকা খেয়ে গতকাল রাতে বুঝেছেন, বড় বড় শালা সম্বুন্ধী আর ভাসুরের দল নিত্য ফরেন ভদকা গিলেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না!

ফজল খন্দকার দ্রুত হাতের কাজ শেষ করে অফিস থেকে বের হতে চাইছেন। কিন্তু তার দেরী হয়ে যাচ্ছে, কোম্পানীর হিসাব মিলাতে গিয়ে বারবার ভুল হচ্ছে- খুব ছোট ছোট ভুল।

নষ্টা-লজিক

রাজধানীর এক পুলিশ চেকপোস্টে ভিপিএন, প্রক্সি ও সার্ভারকে আটক করা হয়েছে। মোটর সাইকেলে পুলিশ বক্স অতিক্রম করার সময়ে তাদের আটক করা হয়।

ভিপিএন, প্রক্সি আর সার্ভারকে মোটর সাইকেলসহ আটকের সংবাদে দেশের সকল মিডিয়া চেকপোস্টে হাজির হয়েছে। পুলিশের কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিশ্বজয়ের ভাব নিয়ে ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন।

একজন হাবিলদার একটা তথ্য জানাতে বহু কষ্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলার সুযোগ পেলেন-
: স্যার, আমরা যে ভিপিএন, প্রক্সি আর সার্ভারকে আটক করেছি তারা বলছে..
: তোমাদের অভিনন্দন, তাদের কোন কথা শুনবেনা। যা বলার রিমান্ডে বলবে। এখন শক্ত করে বেঁধে রাখ।
: কিন্তু স্যার, তারা বলছে যে-
: তারা কি বলছে যে তারা ভিপিএন, প্রক্সি, সার্ভার নয়। তারা আসলে ফেসবুক, গুগোল আর হোয়াটসএপ!
: না, স্যার, তারা বলছে যে তাদের নাম..
: তাদের নাম? ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার আর ইউটিউব!
: না, স্যার, তারা বলেছে তাদের নাম ভূপেন পোদ্দার, রক্সি গোমেজ আর সারোয়ার হোসেন। সার্জেন্ট স্যার ভূপেনকে ভিপিএন, রক্সিকে প্রক্সি আর সারোয়ারকে সার্ভার সন্দেহে আটক করেছেন।
: ধ্যাত, বলিস কি! ভূপেন? মানে সংখ্যালঘু, রক্সি গোমেজ? সেও সংখ্যালঘু! হারামাজাদারা করেছিস কি! সারোয়ার অবশ্য সংখ্যাগুরু, দাড়ি থাকলে জঙ্গী বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
: জ্বী স্যার, কিন্তু বাকী দুজনকে নিয়ে একটা কিছু ভাবুন..
: তারা সংখ্যালঘু – এটা ভালো করে চেক করেছিস?
: স্যার, আমি তাদের প্যান্ট খুলে চেক করেছি। কিন্তু সার্জেন্ট স্যার ভালো করে হাতিয়ে হাতিয়ে দেখে বললেন প্লাস্টিক সার্জারী করে ছোটকালে ফেলে দেয়া অংশ জোড়া লাগিয়েছে, তারা আসলে আইএস এজেন্ট।
: তবে, তিনজনকে সরাসরি আমার রুমে নিয়ে আয়, চেক করে দেখি, আহা কতদিন আয়েশ করে ঐসব হাতাই না.. নস্টালজিক.. নস্টালজিক..

আধাঘন্টা পরে টিভি মিডিয়া আর অনলাইন নিউজ পোর্টালে নিউজ হল-
‘ব্রেকিং: প্রক্সি, সার্ভার ভিপিএন আটক: রুদ্ধদ্বার কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন মন্ত্রী।’

মদভাই

‘মদিরা বার এন্ড রেষ্টুরেন্ট’- ঐতিহ্যবাহী অভিজাত বার। বিকাল তিনিটায় খুলে। পাঁচটায় জমে ওঠে। সন্ধ্যায় বসার জায়গা পাওয়া কঠিন। এই বারে নিয়মিত কাষ্টমার অনেক। তারা সকলেই অনন্য। তারা না আসা পর্যন্ত ম্যানেজার চেয়ারগুলো খালি রাখেন। আজ চার টেবিলের আখ্যান শোনাই।

ডান পাশের তিন নম্বর টেবিল। আটজন বসে আছেন। তিনজন হুইস্কী, চারজন ভদকা আর একজন বিয়ার খাচ্ছেন। প্রতিদিনের মত জমজমাট আলোচনা চলছে- কার্লমার্ক্স, লেলিন, ট্রটেস্কি, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব।

প্রতিদিনের মত আজও রাত বাড়বে, আলোচনা বাড়বে, নেশা বাড়বে, বিপ্লবীরা তাল সামলে দাঁড়াতে না পেরে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়বে, বলবে- সরি, কমরেড। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

ডানপাশের শেষ টেবিল। দু’জন মুখোমুখি বসেছেন। প্রতিদিনের কাস্টমার। ফিসফিস করে কথা চলছে। হাসছে। সাত পেগ করে রয়াল জিন খাবে। ওরা দু’জন কখনও মাতাল হয়না, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় না। মদ গিলতে গিলতেই কাজের খোঁজে ফোন দেয়। মাছ শিকারের প্রাথমিক কথাবার্তা বলে।

মদিরার ম্যানেজার ভালো করেই জানেন এরা শহরের নামজাদা কন্টাক্ট কিলার। খুন করেন, খুন করান। মাছ শিকারের খেলা খেলেই এরা আয় করে- ভাত খায়, মদ গিলে।

বামপাশের শেষ টেবিল। তিনজন বসে আছেন। একজন নিয়মিত। বাকীরা অনিয়মিত। নিয়মিত জনের সাথে প্রতিদিনই দু’তিনজন অনিয়মিত লোক থাকেন। তারাই মদের বিল দেন। নিয়মিতজন একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। তিনি প্রতিদিনই অনিয়মিতদের একটি গল্প শোনান-
: তিন পেগ খেলেই জীবনান্দের মত লিখতে পারি। কিন্তু লেখা হয়না।
: লিখেন না কেন?
: লোভ, বুঝলে লোভ।
: লোভ মানে?
: মানে আরো দু’পেগ খেয়ে নিলেই রবীন্দ্রনাথের মত লিখতে পারি। বাড়তি দু’পেগ পেটে ঢাললেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাই, আই স্যয়ার। তবু লেখা হয়না।
: কেন?
: আবার সেই লোভ। আরো ভালো লেখার আশায় বাড়তি দু’তিন পেগ গিলি। তারপরেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ জীবনান্দের মত ছাইপাশ লিখে জঞ্জাল বাড়িয়ে লাভ কি! লিখতেই যদি হয় তবে রসময় গুপ্তবাবুর মত লিখ, টাচি, জীবন্ত প্রাণবন্ত।

এই টেবিলের বিপরীতে বসেন অধ্যাপক শেখর। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকেন। চার পেগ ভদকা আর চার পেগ জিন খান। নেশা ধরেনা। মুরগীর ঝাল ফ্রাই দিয়ে পরোটা খেতে শুরু করলেই নেশা ঝিম ধরে। খাওয়া শেষ হবার আগেই নেশায় বুঁদ। বিল পরিশোধ করে পুরো মানিব্যাগটা ওয়েটারকে টিপস হিসেবে দিয়ে যান। অবশ্য, পরের দিন বারে এসে ঐ ওয়েটারকে ডেকে ভাংতি পয়সা সমেত মানিব্যাগ ফেরত নেন।

মদিরা বার এন্ড রেষ্টুরেন্ট একটি সাম্যবাদী প্রতিষ্ঠান। এখানে বিপ্লবী, কনটাক্ট কিলার, কবি, অধ্যাপক আর সাধারণ কাষ্টমার সবাই সমান, সবাই সবার মদভাই।

দাগ

ভোর হচ্ছে। নরম হাওয়া। জগে উঠছে জেলা শহরের বাসস্ট্যান্ড। দুটো বাসের হেল্পার চেচাচ্ছে ‘এয়াই ঢাকা.. টংগী.. মহাখালী..সায়েদাবাদ।”
আনকোরা ভোরে লোকটা ক্লান্ত শ্রান্ত। বিধ্বস্ত। ঘামে ভেজা হাফ হাতা শার্ট শরীরে লেপ্টে গেছে। এক হাতে পুরান মডেলের নোকিয়া মোবাইল সেট। শীর্ণ দু’হাতে মারের দাগ। লালচে হয়ে ফুলে আছে।

লোকটা ঢাকা যাবে। কিন্তু ভাড়া নেই। মারের দাগ দেখে বাস চালকের মায়া হয়। লোকটা জানায় কারা যেন তাকে শেষ রাতে মাইক্রবাসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। চোখ বাধার আগে রোলার দিয়ে দু’হাতে পিটিয়েছিল। ক্রসফায়ারে হত্যা করা হবে বলে চোখ বেঁধে তাকে নিয়ে ঘুরেছে। কিভাবে কোথায় হত্যা করা হবে আলোচনা করেছে। পিস্তলের বাট দিয়ে কপালে ও মাথায় আঘাত করেছে। ভোরে বাসস্ট্যান্ড হতে একটু দূরে নামিয়ে দিয়েছে। সাবধান করেছে বড় ভাইদের বিরুদ্ধে না যেতে।

হেল্পার ডেকে যাচ্ছে। বাস চালক লোকটিকে সাথে নিয়ে চা খায়। বাসে উঠার আগে বলে “ভাই, পিছনের সিটে বয়া ঘুমান। সায়েদাবাদ আইলে হেল্পার ডাইকা তুলব।”

লোকটা পিছনের সিটে জানালার পাশে বসে। সে এবার একটা ঘুম দিতে চায়। মৃত্যুর মত গাঢ় ঘুম। আর জেগে না উঠার মত ঘুম।

বি: দ্র: এটা নিছক অণুগল্প। বাস্তবের সাথে কোন মিল নেই।

গল্প : এ কি করলেন রবীন্দ্রনাথ!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ফেসবুকে ‘মরি যাইম…মরি যাইম… নজ্জায় মরি যাইম…’ লিখিয়া পোস্ট করিলেন। অতঃপর গুনগুনাইয়া ‘নহ মাতা নহ কণ্যা নহ বধূ সুন্দরী রুপসি’ গাহিতে গাহিতে নায়লা নাইমের ফেসবুক পেইজে ঢুকিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে আপলোডিত ছবিসমূহ গভীর মনযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন। মনে মনে ভাবিলেন সানি লিওনের মতন নায়লা নাইমের নাম লিখিতেও দুইবার দন্তন্য ব্যাবহার করিতে হয়। অফসোস, দুইজনের নামের পারস্পরিক মিল থাকিবার পরেও বাঙ্গালি নায়লা নাইম এই আধুনিক যুগেও ফিরিঙ্গি সানি লিওনের উদারতা অর্জন করিতে পারেন নাই, ষোল কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙ্গালি করে উদার করনি। তিনি কোন ছবিতে লাইক বা মন্তব্য করিলেন না। কে জানে হয়তো তাহার একটা নির্দোষ লাইক বা মন্তব্যকে ভিত্তি করিয়া অনলাইন নিউজ সাইটগুলি ‘নায়লা নাইমের সাথে বৃদ্ধ বয়সে এ কি করলেন রবীন্দ্রনাথ! (ভিডিওসহ)’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করিবে।

কিছু দিন পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে সমকামিতা আইন পাশ হইলে ফেসবুক সমর্থন জানাইতে রঙধনু এপস চালু করিয়াছিল। তিনি রঙধনু প্রসংগে খুব ভাবিয়া চিন্তিয়া ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ লিখিয়া একখানা নিষ্পাপ নি:ষ্কলংক পোস্ট দিয়াছিলেন। পোস্ট প্রদানের আধাঘন্টার মধ্যেই প্রায় সকল অনলাইন নিউজসাইট ‘রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাঙ্গালি রংধনু (ভিডিওসহ)’, ‘মধুসূদন দত্তকে যে গোপন কারণে অর্থ সাহায্য দিতেন রবীন্দ্রনাথ (গোপন ভিডিওসহ)’, ‘রবীন্দ্রনাথের রংধনু প্রস্তাব শুনে আজীবনের জন্য নির্বাক হয়ে গেলেন নজরুল’ এবং ‘রংধনু প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় উপেনের দুই বিঘা জমি কেড়ে নিলেন রবীন্দ্রনাথ (ভিডিওসহ)’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করিয়াছিল। প্রগতিশীল ভক্তদের অনেকে ফটোশপে তাহার শ্বেত-শুভ্র দাড়িকে রংধনুর সাতরংয়ে রাঙ্গাইয়া নিজেদের প্রোফাইল পিক হিসাবে ব্যাবহার করিয়াছিল। আবার একদল নামের বিকৃতি ঘটাইয়া তাহাকে ‘পুটুন্দ্রনাথ’ বানাইয়া তাচ্ছিল্য করিয়াছিল, পুটুমনা বলিয়া হাস্যরসের বস্তুতে পরিণত করিতে ছাড়ে নাই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় নায়লা নইমের পেইজ ঘুরিয়া জ্যাকুলিন মিথিলার ফটো এলব্যামে সামান্য বিশ্রাম লইয়া নিজের পেইজে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি অগ্র-পশ্চাত না ভাবিয়াই পোস্টখানা আপলোড করিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসিয়া বিষ্ময়ের সহিত দেখিলেন পোস্ট প্রকাশের সাথে সাথেই সৈয়দ হক মহাশয় মন্তব্যে লিখিয়াছেন-‘ইহাই বাংলাভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ অতিউত্তরাধুনিক (Post Ultra Modern) কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র একলাইন লিখিয়াই প্রমাণ করিয়াছেন তিনিই অতিউত্তরাধুনিক(Post Ultra Modern) কবিতার প্রধান খেলারাম। বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ বি টিমের উত্থানে কবি গভীর কষ্টে কষ্টিত। লজ্জায় কবিগুরু নিজের মৃত্যু কামনা করিতেছেন। তাহার কষ্ট এতই প্রবল যে ‘মরে যাব… মরে যাব’ না লিখিয়া তিনি ‘মরি যাইম…মরি যাইম…’ লিখিয়াছেন। ‘মরি যাইম’ শব্দযুগলে ভাবের যে গভীর ব্যাঞ্জনা তাহা ‘মরে যাব’ শব্দযুগলে নাই। কবির লজ্জা এতই গাঢ় যে ‘লজ্জা’ শব্দটি উচ্চারণ করতেও তিনি লজ্জাবোধ করিতেছেন। তাই লজ্জার পরিবর্তে তিনি ‘নজ্জা’ লিখিয়াছেন। এখন হইতে ইহাই সহস্রাধিক নাগরিক কমিটির অফসিয়াল শ্লোগান।’ আবদুল গাফফার চৌধুরী মহাশয় এই মন্তব্যের নিচে লিখিয়াছেন-‘হক সাহেব, তুমি কেন ঘষো আমি তাহা জানি। শিল্পী-সাহিত্যিকদের রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার, সুযোগ সুবিধা প্রদান আর বিদেশ ভ্রমণের ডিপার্টমেন্ট কিন্ত এখন আমিই দেখি।’ ইহার পরেই শফিক রেহমান মহাশয় লিখিয়াছেন – ‘রবিবাবুর লজ্জা নজ্জা হইলেও তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ কিন্তু লজ্জা-ই রহিয়াছে। অবশ্য তসলিমার ‘ক’ প্রকাশিত হইবার পরে সৈয়দ হকের লজ্জা একেবারে নজ্জা হইয়া গিয়াছিল।কি নজ্জা! কি নজ্জা!’ সুকুমার রায় লিখিলেন-‘এতই যখন লজ্জা তখন ধুতির উপরে দুইটা জিন্সের প্যান্ট পরিলেই হয়। ধুতির গিঁট ঢিলা থাকিলে লজ্জা তো নজ্জা হইবেই।’ তিনি আর পরের মন্তব্যগুলি পড়িবার উতসাহ পাইলেন না।

দুঃখে-ক্রোধে-অভিমানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ‘মরি গেছি… মরি গেছি… পুরাপুরি মরি গেছি…’ লিখিয়া নতুন পোস্ট দিলেন। এই পোস্ট পড়িয়া ভক্তরা কান্নাকাটি করিয়া ফেসবুকের টাইমলাইন ভিজাইয়া ফেলিল। তাহাদের চোখের পানি ফেসবুকের সীমা অতিক্রম করিয়া ল্যাপটপ ট্যাব মোবাইলের স্ক্রিন দিয়া প্রবল বেগে বাহিত হইতে লাগিল। ‘নিখিল বাংলাদেশ লিংক দেন আন্দোলন’-এর সভাপতি মহাশয় পোস্টে মন্তব্য করিলেন- ‘মরে গেছেন কিভাবে বুঝিলেন! মরার লিংক দেন।’ ‘বাংলাদেশ জামায়াতে মিল্লাতে কাঠমোল্লা ফাউন্ডেশন’-এর আমির মহাশয় লিখিলেন- ‘আপনার মৃত্যুর পক্ষে প্রমাণ পেশ করুন।’ হাজার হাজার ভক্ত ‘ফ্রেন্স, রবিগুরু কবিন্দ্রনাথ এইমাত্র মরে গেসেন, যারা কষ্ট পাইসো তারা লাইক দাও, যারা কান্না করসো তারা কমেন্ট দাও আর যারা কষ্ট পাইসো আবার কান্নাও করসো তারা শেয়ার করো। ফ্রেন্স, দেখিয়ে দাও মরা কবিন্দ্রনাথের জন্য কতগুলা লাইক’- লিখিয়া পোস্ট শেয়ার করিল। শাহরিয়ার কবির মহাশয় এই মৃত্যুর প্রতিবাদে পাকিস্তান দূতাবাস এবং ফরহাদ মজহার মহাশয় ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচী ঘোষণা করিলেন। ইনু আর মেনু মহাশয় ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া ‘দুনিয়ার রবীন্দ্রনাথ এক হও লড়াই কর। রবীন্দ্রনাথের রক্ত বৃথা যেতে দিবনা’ শ্লোগান লিখিয়াই পোস্ট আপডেট করিলেন। স্যার জাফর ইকবাল মহাশয় লিখিলেন- ‘আমি মৃত্যু ঠিক বুঝিনা। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ মারিয়া যাইবেন তাহা মানিয়া লওয়া যায়না।আমরা কি এমন রবীন্দ্রনাথ চাহিয়াছিলাম!’ সিপিগ্যাং গ্রুপের রাসেল রহমান দু:খ ভারাক্রান্ত মনে পোস্টে মন্তব্য লিখিলেন- ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সোনার তরী’তে ধান তুলিয়াছিলেন এবং ‘নৌকাডুবি’ লিখিবার পরেও আমরা তাহাকে পোন্দাই নাই। কারণ উনি বুড়ো মানুষ, আমাদের পোন্দানি সহ্য করিতে পারিবেন না। আজ তিনি বিনা পোন্দানীতেই মরিয়া গেলেন। আমরা যথাযথ শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্যের সহিত তাহার বিদেহী আত্নাকে নিয়মিত পোন্দাইবো।’ বাঁশেরকেল্লার পোস্টে রবীন্দ্রনাথের টুপি পরহিত ছবি দিয়া দাবি করা হইল মৃত্যুর পূর্বে তিনি তোওবা করিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহন করিয়াছিলেন। জামাতে ইসলামি তাহার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করিয়া নরেণ মোদিকে সমবেদনা জানাইল। বিএনপির দুদু মহাশয় লিখিলেন- ‘এই সরকারের আমলে রবীন্দ্রনাথও নিরাপদ নহেন। তাহার শ্রাদ্ধের পরেই তীব্র আন্দোলন শুরু হইবে।’ লীগের হাছন মাহমুদ মহাশয় স্ট্যাটাসে লিখিলেন – ‘রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর জন্য খালেদা জিয়া দায়ী। খালেদা জিয়া শিফন শাড়ি পরিধান করিবার কারণে এলার্জীতে আক্রান্ত হইয়া রবীন্দ্রনাথ মরিয়াছেন।’ মাহবুবুল হানিফ মন্তব্য করিলেন- ‘শ্রাদ্ধের মেনু কি? খাসির কাচ্চি না চিকেন বিরানী? হঠাত মৃত্যুর জন্য রবীন্দ্রনাথকেও আইনের আওতায় আনিয়া বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার করা হইবে। ডিংকাচিকা… ডিংকাচিকা… ডিংকাচিকা…ট্যাওট্যাও… ট্যাও…ট্যাওওওওও…।’ অনলাইন নিউজসাইটগুলি ব্রেকিং নিউজ করিল-‘যে ১০টি কারনে মারা গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভিডিওসহ)’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় আর সহ্য করিতে পারিলেন না। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পের হাত ধরিয়া ব্যাকুল হৃদয়ের সকল মিনতি উজার করিয়া গাহিতে লাগিলেন-
”সোনাবন্ধু তুই আমারে ভোঁতা দাও দিয়া কাইট্টালা
পিরীতের খেতা দিয়া চাইপ্পা ধইরা মাইরালা…’

না মানুষ

এস আই বদরুল তিন মাস আগে ঢাকার এক থানায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন। ভালো জায়গায় ট্রান্সফার তো এমনি এমনি হয়না, সিস্টেম করতে হয়। এই সিস্টেমে সাত লাখ টাকা খরচ, কিন্তু বদরুল পাঁচ লাখ টাকার মধ্যেই কাজ সেরে ফেলেছেন। বদরুলের চাচা রুলিং পার্টির স্থানীয় নেতা, এমপির সাথে তুই তোকারি সম্পর্ক। বদরুল ছাত্রজীবনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল। সব মিলিয়ে সিস্টেম ব্যায় দুই লাখ টাকা কম হয়েছে।

বদরুল ঢাকার পোস্টিংয়ে যোগ দিয়েই সিস্টেম ব্যয় পাঁচ লাখ টাকা সুদে আসলে উসুলের মিশন শুরু করে দিয়েছে। চাকুরী পাবার জন্য যে টাকা ব্যয় হয়েছিল তা এখনও উঠে নাই। জনতার বন্ধু পুলিশ, বদরুল পুলিশ, সুতরাং সেও জনতার বন্ধু। তাই সিস্টেম ব্যয় তোলার জন্য সে তার বন্ধু জনতার উপরেই নির্ভর করছে। ওসি সাহেবের কসম- বাকীরাও একই কাজ করেন। আইজিপি স্যার ব্যাপারটা জানেন না- বদরুলের মোটেও বিশ্বাস হয়না।

বৃহস্পতিবার বদরুলসহ অন্য পুলিশদের চাঁদরাত। তারা এই পবিত্র দিনের বিকেলের শেষ হতেই থানা এলাকার অর্থশালী এবং সম্মানীত পরিবারের কিশোর ও তরুণ সদস্যদের আটকে ততপর হন। নিজের খরচে পকেটে ইয়াবা, গাঁজা বা ফেন্সিডিল ঢুকিয়ে দেন। মোবাইল চেক করার নামে নীলছবিপূর্ণ মেমোরীকার্ড ঢুকিয়ে দেন। তারপর অভিভাবকদের থানায় ডেকে আনেন। অবশ্য যাদের প্রভাবশালী আত্নীয় স্বজন আছেন তারা থানায় আসেন না, উল্টো ধমক-ধামকে থানার ওসিকে অতিষ্ট করে তোলেন। এই ধমকের চোটে প্রভাবশালী আটককৃতদের ছেড়ে দেন। কাউকে কাউকে দায়িত্ব নিয়ে বাসা পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আসেন। যারা থানার বখরা বকেয়া রেখে বা না দিয়ে অবৈধ ব্যবসা করেন বৃহস্পতিবারে টার্গেট করে তাদেরও ধরা হয়। অতঃপর উভয়পক্ষের সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বখরার নতুন রেট নির্ধারিত হয়, বকেয়া বখরা পরিশোধ হয়। আড়ালে আবডালে একত্রে দ্রুত চুমুকে মোহনজল গিলাও চলে।

সাধারণ যারা আছেন, যে কোন মূল্যে নিজেদের মান সম্মান রক্ষায় সদা জাগ্রত-তারা প্রধান টার্গেট। বদরুল বাহিনী তাদের বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখান। যেমন- শনিবার ও রবিবার কোর্ট বন্ধ- দুইদিন হাজতখানায় আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। চলবে অবিরাম পিটানি আর ডিম থেরাপি। রবিবারে আদলতে তুললেও লাভ নাই কারণ এই মামলায় জামিন হবেনা, উল্টো রিমান্ডে দেওয়া হবে। হাজিরা দিতে দিতে জীবন যাবে। সাত বছরের জেল থেকে খোদাও রক্ষা করতে পারবে না। এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে অভিভাবকরা চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন তখন অন্য কোন সহযোগী বা থানার দালাল বন্ধু হয়ে এগিয়ে আসেন। নরম কণ্ঠে অভিভাবকদের ভরসা দেন, দৃপ্ত কন্ঠে জানান- টাকা পয়সা খরচ করতে পারলে ওসি সাহেবকে রিকোয়েস্ট করে ছাড়ানো যেতে পারে। অভিভাবকদের কেউ কেউ দর কষাকষি করেন, কেউ কেউ করেন না। বদরুল জানে শুধু তার থানাতেই নয়, ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি থানায় বৃহস্পতিবার বিকেল হতে মধ্যরাত পর্যন্ত জনতার সাথে পুলিশের এমন বন্ধু বন্ধু খেলা চলে।

বদরুল বহু পরিশ্রম করে গত তিন মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা উঠাতে পেরেছে। একটা টার্গেটও ব্যর্থ হয় নাই। এভাবে চললে সিস্টেম ব্যয়ের অবশিষ্ট তিন লাখ টাকা আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যে উঠে যাবে। চাকরী নেবার সময়ে যত খরচ হয়েছিল তা উঠাতে এমন কঠোর পরিশ্রম জারি রাখতে হবে। তারপর নিজের ভবিষ্যতের জন্য ক্যাশ জমাতে হবে- একটা বাড়ি, একটা ব্যবসা, সন্তানদের ভালো ইশকুলে লেখাপড়ার খরচ জোগানো কি মুখের কথা। এক একটা দিন বদরুল ভাবে বছর পাঁচেক মন দিয়ে ডিউটি করে চাকুরী ছেড়ে দিবে; ছোটখাটো ব্যবসা করবে বা বিদেশে চলে যাবে- যেন তার সন্তান বড় হয়ে জিজ্ঞেস করতে না পারে “বাবা, তুমি পুলিশ না মানুষ!”

ড্রাকুলা

: মামুর বেটা, তুকে কে বুললো যে কাউন্ট ড্রাকুলা মইরেছে?

: ক্যান, শিনেমায় দেইখেছি, তুমি দাখ্যো নাই?

: শিনেমায় দেখালেই হলো না কি!

: শিনেমায় দেখালে হবেনা ক্যানে?

: মামুর বেটা, শিনেমায় দেখায় হিরোইন আসমান থেকে ঝপাক করে নেমে হিরোর সাথে কপাক কপাক ড্যানষ করে। তুর হেরোইন ঝপাক করে নেমে তুর সাথে কপাক কপাক ড্যানষ করেছিলো না কি?

: তুমি কি বুলছো কাউন্ট ড্রাকুলা মরে নাই?

: হুম, মরে নাই। জিন্দা আছে। গন্ডায় গন্ডায় ছিলে-পুলে নাতি- নাতনি লিয়ে এ দেসে ষুখের শংশার পেতেছে। ওর বংষ দিনে দিনে কত বড় হয়েছে, জানিশ!

: কি বুলছো তুমি! ডরে আমার বুক যে ধুকপুকাচ্ছে! ওরা আমাদের দেসে কি করে?

: কাউন্ট ড্রাকুলা পংগু হাশপাতালের শামনে একটা ব্লাড ব্যাঙ্ক দিয়েছে। ডাইরেক্ট রক্তের বিযনেশ করে। ওর তিনশো ত্রিশটা ছিলে-পুলে শংশদে শার্ভিশ দেয়। নাতি নাতনিরা পুলিস রেবে বিসাল বিসাল পদে চাকুরী করে। ব্যাবশা করে। রাজনীতি এদের ফ্যামিলী বিযনেশ।

: মামুর বেটা, তুমি কাকে লাড়তে কাকে লাড়ছো! আসল ড্রাকুলাদের ক্ষেপিয়ে তুলছো।

: ক্ষেপাবো ক্যানে! আমিতো তাদের পক্ষে এডভ্যাটাইস করছি। আমার সাথে টপাক টপাক কইরে শোলোগান দে- যায় যদি যাক প্রাণ, ড্রাকুলার গোষ্ঠী ভগবান।

: যায় যদি যাক প্রাণ, ড্রাকুলার গোষ্ঠী ভগবান।