আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

বালিশ

বালিশ

একজন লোক একটা বালিশ কিনেছিলো। যেমন তেমন বালিশ নয়, ৫,৯৫৭ টাকা দামের বালিশ। তুলে তুলে, নরম নরম, আরাম আরাম। বাড়ির সদর দরজা থেকে ঘরের ভেতর ওই বালিশ তুলতে কুলিকে দিতে হয়েছিলো ৭৬০ টাকা।

ধনী পিতার একমাত্র সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করলে যেমন গর্ব আর আনন্দ ভর করে, বালিশ কিনে লোকটিরও তেমন বোধ হলো। এমন একটা বালিশ কেনার গর্বে প্রথম দু’দিন তার বিন্দুমাত্র ঘুম হয়নি। এরপরের দু’দিন ঘুম হয়নি বালিশ কেনার আনন্দে। ১২ মন ধানের দামে কেনা বালিশ, এমন গর্ব আর আনন্দ মোটেও বেমানান নয়।

কবি বলেছেন চিরদিন সবার সমান নাহি যায়। গর্ব আর আনন্দে চারদিন কেটে যাবার পর লোকটির মনে ও মগজে ভর করলো ভয়। প্রতিটা রাত সে জেগে থাকে বালিশ চুরি হয়ে যাবার ভয়ে।

জেগে থেকে থেকে লোকটির চোখের নিচে জমেছে কালি। গাল গেছে ভেঙে। মিজাজ হয়েছে খটমটে। বন্ধ হয়েছে কাজ, নেই রোজগার। এক একটা নিদ্রাহীন রাতে রূপপুর ছুঁয়ে তার দিকে ভেসে আসে চেরনোবিল বিস্ফোরণের হাওয়া, এক একটা নিদ্রাহীন রাতে তার দিকে ধেয়ে আসে অনাগত সন্তানের বিকলাঙ্গ দেহের ঘ্রাণ, নিস্ফলা ক্ষেতের কান্না..।

নীলমাছি

নীলমাছি

পায়ের কাছে জানলা খোলা। বাইরে ঝাঝা রোদ। গ্রীষ্ম দুপুরের তালুফাটা গরম। জানালার গ্রীলে তিন চড়ুই শলাপরামর্শ করছে। ধীর গতিতে পাখা ঘুরছে।

কাঁথা মুড়ে শুয়ে আছি। তিন দিন ধরে ভীষণ জ্বর। আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। তৃষ্ণা পাচ্ছে, বরফ চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। জ্বর বাড়ছে আর বিছানাটা কেমন সবুজ মাঠ হয়ে যাচ্ছে। দূর্বা ঘাসের ঘ্রাণ, মাথার কাছে ফুটে আছে ঘাসফুল। ফড়িংয়ের ঝাক উড়ে গেলো- এলোমেলো। একটা চকচকে নীল ডুমো মাছি নাকের কাছে অনেকক্ষণ ভনভনালো। কোথায় উড়ে গিয়ে ফিরে এলো। কাঁথার উপরে বসলো-
: আবার জ্বর বাঁধিয়েছো?
: জ্বর কি ছবির ফ্রেম না পুকুরের ঘাট যে বাঁধাবো?
: হাহাহাহাহা… ভনভনানিতে রাগ করেছো?
উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মাছি কথা শুরু করলো-
: ভনভনিয়ে কি খুঁজছিলাম জানো?
: কি?
: পাকা ল্যাংড়া আমের রসের ঘ্রাণ।
প্রচন্ড বিরক্ত হলাম-
: আমি কি ল্যাংড়া আম?
: ধ্যাত, ল্যাংড়া আম হবে কেনো! সেই জ্বর জ্বর দুপুরের কথা মনে নেই!
: কোন দুপুরের কথা?
: সেই যে চারদিন আগে তোমার দাদিজান মারা গেছেন। উনার চেহলাম। দুপুরে কয়েকজনকে খাওয়ানো হবে। মা কুঁচো চিংড়ি দিয়ে করলাভাজী, পুঁইশাক দিয়ে বড় চিংড়ি, লাউ দিয়ে ইলিশ মাছ, আলু-বেগুন দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছেন। রুইমাছের তরকারীতে জিরা ভেজে গুড়ো করে দিয়েছেন। সজনের ডাল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শোক আর ঘ্রাণে উথলে ওঠা দুপুর। নামাজ শেষে মিলাদ, তারপরে খাওয়ানোর পর্ব শুরু হবে। মনে আছে?
: হ্যা, মনে আছে। তুমি এসব জানো?
: জানবো না কেনো! আমিও যে ছিলাম।
: নীলমাছি, তুমিও ছিলে?
: হুম। সেদিন তোমার বেশ জ্বর। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা মাথায় পানি দিচ্ছেন। জ্বর কমছে বাড়ছে, এক্কেবারে ছেড়ে যাচ্ছে না। ঘরের এক কোনে শুয়ে আছো- গুটিশুটি ছোটো মানুষ।
: হুম, গায়ে লেপ। দাদিজানের কাফনের মত শাদা কভার। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ।
: তোমার স্মৃতি খুব টনটনে। মেহমানদের জন্য ফল আনা হয়েছে- ল্যাংড়া আম, শক্ত কোষের কাঁঠাল আর তরমুজ। বাবা এক টুকুরো আম কেটে তোমার মুখে দিলেন। সেই আমের রস টুপ করে শাদা কাভারে পরলো।
: বাবা মারা গেছেন বাইশ বছর হয়ে এলো। সে কথা থাক, তোমার কথাই বলো-
: গরমে আর ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। চিন্তা না করেই লেপের কভারে পরা দু’তিন ফোঁটা রস খেতে শুরু করলাম। অবাক হয়ে খাওয়া দেখছিলে।
: খাবার দেখছিলাম না, তোমার নীল শরীরে আলোর ঝিলিমিলি দেখছিলাম।
: খাওয়া শেষে ভাবলাম একটু জিরোই। তুমি অসুস্থ বাচ্চা- আমায় কি আর ধরতে পারবে!
: হিসেবে ভুল করেছিলে-!
: হ্যা, ভুল করেছিলাম। হঠাৎ মুঠোর ভিতরে ধরে ফেললে। সে কি ভয়! জীবন হারানোর আশংকা! পায়ে সুতো বেধে আমৃত্যু উড়াবে- ভাবতেই বুক ফেঁটে কান্না এলো।
: আহারে! হাহাহাহাহাহাহা…
: হাসছো কেনো! তখন কি জানতাম যে কয়েক মুহূর্ত দেখে ছেড়ে দিবে!
: আজ সেসব কথা ভনভনাতে এসেছো?
: রূপকথার অভিশাপে অমরত্ব পেয়েছি। মরে যাই- আবার একজীবনের স্মৃতি নিয়ে জন্মাই। আজ দুপুরে সেই দুপুরের কথা মনে হতেই ছুটে এলাম।
: নীল মাছির আগমন, শুভেচ্ছায় স্বাগতম। তা কি দেখলে?
: তোমার মুখে এখনো আমের রসের ঘ্রাণ লেগে আছে।
: এখনো ঘ্রাণ লেগে আছে? কত বছর আগের কথা! সময় চলে গেছে কত!
: ধ্যাত! সময় যাবে কোথায়! সময় তার প্রতিটা বিন্দুতে স্থির।
: নীলমাছি, সময় কোথাও যায়না?
: না, যায়না। সময় প্রতি বিন্দুতে স্মৃতি সঞ্চিত করে রাখে।
: আর আমাদের যে বয়স বাড়ে? দিন ফুরোয়?
: বয়স বাড়বে না কেনো বলো! তোমাদের মানুষ হবার কত তাড়া। পায়ের তলায় সর্ষে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শুধু যাওয়া আর যাওয়া।
: সবাই তো যায়, কি যায় না?
: যেয়ে লাভ কি! সময়বিন্দুকে অতিক্রম করে যেতে যেতে একদিন একেবারে থেমে যাওয়া। থেমে যাবার আগে মনে হওয়া- এই ইঁদুর দৌড়, এই দিনযাপন অর্থহীন… সব অর্থহীন! শুনতে পাওয়া কে যেনো ডাকনাম ধরে ডেকে বলে “তোমার না মনসুখিয়া যাবার কথা ছিলো!”

কথা খুঁজে পাইনা। নীল মাছি বিজ্ঞের মত বলে-
: এসব কথা থাক। এত ঘনঘন তীব্র মাথাব্যাথা আর গাঢ় জ্বর আসার লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। তুমি কি পুষছো?
: জ্বরের লক্ষণ বিচার পরে করো। ও নীল মাছি, মনসুখিয়ায় কবে যেতে পারবো! ছুঁতে পারবো অভ্রজোনাকের পাখা!

নীল মাছি কোনো উত্তর দেয় না। জ্বর বাড়ছে, তৃষ্ণা তীব্রতর হচ্ছে। ঘরের সিলিং কখন নীলাকাশ হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে কত প্রিয়মুখ। সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে আম কাটছেন বাবা। ধবেধবে শাদা পাঞ্জাবী হাওয়ায় উড়ছে যেন মনসুখিয়ার নিশান।

চান্দ

চান্দ

: বাপু, রাইতের বয়স বাড়িলে পাহাড়ের মাথায় চান্দ নামিয়া আসিতো। বুদ্দার বাপ গলায় মাহুয়া ঢালিয়া কাহিতো, “বুদ্দার মা, আমি চান্দের সুবাস পাই, আমি জোৎসনার ঘিরান পাই…”

: তারপর?

: বাপু, তিন দিন ভুখা। তার লগে কাজিয়া কারিলাম। সে গলায় মাহুয়া ঢালিয়া কাহিলো, “আজ রাইতে চান্দ নামিয়া আসিলে তাহাকে শিকার কারিবো। পেট ভরিয়া খাইবো।”

: তারপর?

: বাপু, চৈত মাসের রাইত। পেটে খিদা। আসমানে বিশাল চান্দ। তিন বছরের বুদ্দা খিদায় কান্দিতে কান্দিতে নিন্দ গেছে। সে বুদ্দাকে চুম্মা খায়া বাহির হ ইলো। সে শিকার করিয়া আনিলে আমরা পেট ভরিয়া চান্দ খাইবো।

: তারপর?

: বাপু, মানুষটা সে রাইতে পাহাড় চূড়ায় এক চান্দ শিকার কারিয়া সুখের ঘর বান্ধিয়াছে। সে ঘরে দুইটা বাচ্চা হইয়াছে।

: তারপর?

: বাপু, আর কি কাহিবো! পুন্নিমার জোৎসনায় পাহাড় ভাসিলে বুদ্দা অস্থির হোয়া উঠে আর কহে, “মা’গো জোৎসনায় আমি মাহুয়ার সুবাস পাই.. শরীরে খুন ঝিলিক দেয়!! আমি চান্দ শিকারীর লগে শিকার শিকার খেলিতে পাহাড় চূড়ায় যামু…”

: তারপর?

: বাপু, আমি সাতারো বছরের বুদ্দাকে চিনিতে পারিনা। আমার ডর লাগে। চান্দের আলোয় বুদ্দার হাতে চিকচিক করে জানোয়ার শিকারের শান দেয়া হাসুয়া…

.
________________________________
গল্পগ্রন্থ: লংকা কিন্তু জ্বলছে না/আবু সাঈদ আহমেদ।

লেজ

লেজ

মন্তাজ মেম্বার জাদরেল লোক। আপদমস্তক জনসেবক। জনসেবার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন রাজনীতি। তার ইউনিয়নের মানুষদের কল্যাণ এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে যে কোন ব্যক্তিকে নিজের কোলে, কাঁধে বা মাথায় তুলতে পারেন। দুঃখে সুখে পাশে এসে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননা। আবার উন্নয়ন আর কল্যাণের রাজনীতির জন্যই মানুষকে খুন করতে পারেন। ভিটি ছাড়া করতে পারেন। মন্তাজ মেম্বার এতটা জাদরেল যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও তার কথার অবাধ্য হবার তাগদ রাখেন না। ইউনিয়নের সবাই জানেন এই মেম্বারকে সমীহ করে চলাতেই সকলের মঙ্গল।

দুলু মিয়া ৭০ বছরের বৃদ্ধ। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। গায়ের বসন এলোমেলো। জিজ্ঞাসাময় দৃষ্টি। কিছুদিন হল মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। বৃদ্ধ দুলু মিয়াকে নিয়ে মন্তাজ মেম্বার বিশাল সমস্যায় জর্জরিত। এই বৃদ্ধ মন্তাজ মেম্বারের কষ্টার্জিত ইজ্জত হুমকীর মুখে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু বৃদ্ধকে তিনি খরচ করে ফেলতে পারছেন না। কারন বৃদ্ধ দুলু মিয়া হলেন মন্তাজ মেম্বারের পিতা।

দুলু মিয়া ধীর পায়ে হাটেন। একা একা সমগ্র ইউনিয়নে ঘুরে বেড়ান। খুব মন দিয়ে হারিয়ে যাওয়া ল্যাঞ্জা (লেজ) অনুসন্ধান করেন। তার শখের লেজটা হারিয়ে গেছে। এই লেজটাকে খুঁজে পেতে হবে। তিনি সারা দিন হারিয়ে যাওয়া লেজের বিরহে কাতর হয়ে থাকেন। মানুষ জনকে প্রশ্ন করেন, “আমার যে ল্যাঞ্জাটা (লেজটা) আছিল, হেইডা কেডা নিছে?” সবাই দুলু মিয়ার এই অনুসন্ধানে নির্দোষ আনন্দ পেলেও মন্তাজ মেম্বার বিব্রত হন। মাঝে মাঝে ভাবেন দড়ি দিয়ে পিতাকে বেঁধে রাখবেন। কিন্তু নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে সেই পথে যাননা।

ইউনিয়ন পরিষদের সভা চলছে। সরকারী কাজের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা। স্থানীয় এমপি নিজে এসেছেন। মন্তাজ মেম্বার এমপির পাশ ঘেষে বসেছেন। ভাগ বাটোয়ারার জটিল আলোচনার মাঝে আচমকা দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন দুলু মিয়া। মন্তাজ মেম্বারের মানসিক ভারসাম্যহীন পিতা। মন্তাজ মেম্বার রাগান্বিত এবং সংকোচিত। কিন্তু মুখে স্মিত হাসি এনে বললেন, “আব্বা, আপনি বাসায় যান। আরাম কইরা ঘুমান। ”কিন্তু দুলু মিয়া স্থির। তিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সকলের চোখের দিকে তাকালেন। তারপর সরাসরি এমপির চোখে রোখ রেখে বললেন, “আমার ল্যাঞ্জাটা কে য্যান চুরি কইরা লয়া গেছে। আমার ল্যাঞ্জাটা পাইতাছি না।”

এমপি: আপনার ল্যাঞ্জা ছিলো না কি?

দুলু মিয়া: আছিল’তো। কুত্তার মতন একটা ল্যাঞ্জা আছিল।

এমপি: চাচা! মানুষের ল্যাঞ্জা থাকেনা। আপনারও ছিলোনা।

দুলু মিয়া: আমার আছিল’তো। কুত্তার মতন একটা ল্যাঞ্জা আছিল।

এমপি: কিভাবে জানলেন যে আপনার ল্যাঞ্জা আছিল?

দুলু মিয়া : ল্যাঞ্জা না থাকলে মন্তাজের মতন কুত্তার বাচ্চারে পয়দা করলাম কেমনে!! তোমার বাবারে জিগাও। তারও একটা ল্যাঞ্জা আছিল।”

এমপি নির্বাক। মন্তাজ মেম্বার মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। সভায় উপস্থিত সকলের চোখের সামনে পিতাদের মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে। সত্যিই কি পিতাদের একটা করে ল্যাঞ্জা ছিল!! কুকুরের মত ল্যাঞ্জা!!

#গ্রন্থ: লংকা কিন্তু জ্বলছে না
#লেখক: আবু সাঈদ আহমেদ।

কীট

কীট

সকালে আকাশে মেঘ ছিলো। তোমার চোখের নিচে জমাট বাাধা কালি রংয়ের আলো — মায়ামায়া বিষাদের মত মসৃণ। কোথা থেকে একটা ছোট পোকা শাদা শার্টে এসে বসেছে। চাল রঙ্গা শরীরের মাঝখানে ছোট রোদ্রোজ্জ্বল কমলা বৃত্ত; বৃত্ত জুড়ে সোনালী আঁকিবুঁকি। পোকা নয়, মামুলি শার্টে তুমুল সুন্দর বসে আছে– শান্ত স্থির। হঠাত ইচ্ছে হলো তোমার কপালে পড়িয়ে দেই এই অনিন্দ্য টিপ, পোকার রূপজীবন ধন্য হোক। এমন সময়গুলোতে কি যে হয়– ভুলেই যাই ট্রেনের শিডিউল।

খুচরো দরে খরচ করেছি জীবন– এলোমেলো, এখানে সেখানে। তোমাকে খুঁজেছি উদ্ভ্রান্ত উন্মাদনায় যত্রতত্র– নীরবে নিভৃতে। শেষ ট্রেনের হুইসেল বাজার ক্ষণিক আগে তোমার দেখা পেলাম, ধ্রুবতারার সমান দূরত্বে। আজ তোমার কপালে টিপ পরানোর ইচ্ছে জেদ করে– কতভাবে যে তাকে হত্যা করছি, তবু সে মরেনা।

একটামাত্র মানুষজন্ম কেটে গেলো অকাট অর্থহীন। আবার জন্মালে যেন পোকা হই– ঠিকঠিক চিনে নেই তোমার কপাল, কপালের মধ্যবিন্দু।

______________________
#অকবিতাগ্রন্থ : পোস্টম্যান থামো।

বুড়োচড়ুই

বুড়োচড়ুই

১.
সবুজ মাঠ। যতদূর চোখ যায় সবুজ ঘাস। কোনো গাছ নেই। লোকালয় নেই। জনপ্রাণী নেই। অপার নীরবতা। মধ্যবিন্দুতে স্থির একা- গন্তব্য মনে নেই। অথচ খুব দ্রুত যেতে হবে।

ঝুপ করে রাত নামে। তীব্র আতংক গ্রাস করে।অন্ধকারের অদেখা দানব তাড়া করছে। টুকরো টুকরো করে গিলে খাবে। জানিনা কখন দৌড়াতে শুরু করেছি– গন্তব্যহীন। দানবের আগুন শ্বাসে পিঠ ঝলসে যাচ্ছে। পা ভারী হয়ে আসছে। খুব কাছে চলে এসেছে দানব..এখনই পিছন থেকে খামচে ধরে খুবলে খুবলে খাবে।

অকস্মাৎ ঘুম ভাঙে, ভয় ভাঙেনা। যেন দুঃস্বপ্নের দানব ঘরের আবছায়ায় ঘাপটি মেরে বসে আছে।

২.
ঘুম ভাঙা স্বপ্নরা ঘুমোয় না, জেগে থাকে। দু:স্বপ্নরা ফিরে ফিরে আসে। পৌনে চারটা বাজে। ঘুম আর আসবেনা। বারান্দায় দাঁড়াই।

শেষ রাতের হাওয়া তুলতুলে নরম। আহ্লাদী, গায়ে গায়ে মাখোমাখো। ল্যাম্পপোস্টের মলিন আলোয় বিষন্ন পথ। তিন কুকুর ঝিমোচ্ছে। আকাশে ছুটির অপেক্ষায় তারার দল। চারদিকের শান্ত নীরবতায় মসৃন ঢেউ তুলে ভেসে আসে ভোরের আজান- খায়রুন মিনান নাউম..খায়রুন মিনান নাউম..।

৩.
মিহি আলোয় দিনের অভাস। ঘরের ঘুলঘুলি হতে বেরিয়ে বারান্দার গ্রীলে বসে ঘুমভাঙা চড়ুই-
: এই যে মানুষ, শুভ সকাল!
: শুভ সকাল! কেমন আছো?
: ভালো নেই গো, মনে ভীষণ জ্বালা।
: হাহাহা, এত্তটুকু চড়ুই! তার আবার মনে জ্বালা!
: আমি ছোট্ট চড়ুই। তাই বলে মন ছোট্ট হবে!- এভাবে বলতে পারলে!
: স্যরি, চড়ুই। মনে জ্বালা কেনো?
: নষ্ট ডিমটা যে আমার ছিলো গো।
: কোন নষ্ট ডিম!
: ঐ যে –
চড়ুই পাখি বারোটা
ডিম পেড়েছ তেরোটা
একটা ডিম নষ্ট
চড়ুই পাখির কষ্ট।
: আহা রে! সে তো বহুকাল আগের চড়ুই পাখির কথা!
: আমি সেই আদ্যিকালের চড়ুই।

বিষ্ময়ের ঘোর কাটেনা-
: আদ্যিকালের চড়ুই? বলো কি!
: হুম। সেই যে বহুকাল আগের এমন ভোরে তোমার মা রান্না ঘর খুললেই এক বিড়াল এসে হাজির হত।
: আরে! তাই তো!
: তোমার মা লাল আটার রুটি বানাতেন। আলু ভাজি করতেন। ছুটির দিনে ঘি মাখানো ময়দার রুটি, সুজির হালুয়া।
: তুমি তখন ছিলে?
: হ্যা, ছিলাম। বাবার হাত ধরে যেতে ইশকুলে। ব্যাগের ভিতরে রঙিন বই, মাথার ভিতরে রাপুনজেল।
: হাহাহা! রাপুনজেলের কথাও জানো?
: জানবো না আবার! সে বয়সে সবাই সুবর্ণরেখা, কাজলরেখা, কলাবতী, সিন্ড্রেলার জন্য পাগল হয়। কিন্তু তোমার চাই রাপুনজেল।
: অবুঝ ছেলেমানুষি!
: ছেলেমানুষি না ছাই! ভেবেছিলে বড় হয়ে ডাইনিবুড়ির কাছে বন্দী সোনালীচুলের রাপুনজেলকে মুক্ত করে দুজনে তারার দেশে চলে যাবে। রাপুনজেলকে খুঁজে পেয়েছ?
: হুম।
: তারার দেশে যাওনি?
: না।
: কেনো?
: এক রাজপুত্র আগেই রাপুনজেলকে জয় করে নিয়েছে। চাষাপুত্র যেতে বড্ড দেরী করে ফেলেছিল।
: আহারে মানুষ! তোমারও তো কষ্ট।

চড়ুইয়ের আদিখ্যেতা সহ্য হয়না, প্রসঙ্গ বদলে বলি-
: বহুকাল আগের একটা নষ্ট ডিমের কষ্ট এখনো বয়ে চলছো?
: খুব প্রিয় কিছু হারানোর কষ্ট ভোলা যায়! রাপুনজেলকে হারানোর কষ্ট ভুলতে পেরেছো?

উত্তর খুঁজে পাইনা। এলেবেলেভাবে জিজ্ঞেস করি-
: আদ্যিকাল হতে এলে কিভাবে?
: কষ্টের তাড়া খেয়ে আদ্যিকাল হতে চলে এসেছি। ঘরের ঘুলঘুলিতে আশ্রয় নিয়েছি।
: কষ্টের তাড়া থেকে বাঁচতে পেরেছ?
: না গো মানুষ, পারি নাই। কষ্ট থেকে বাঁচতে হলে যেতে হবে মনসুখিয়া।
: মনসুখিয়া যাওনি কেনো?
: যাবার পথ চিনি না গো। তুমি খুঁজে পেলে তোমার সাথে সাথে আমিও যাবো। নিবে আমায়?
: তুমি কে যে সাথে নিবো?
: আমি কে! আমি তোমার শনপাপড়ীর ছেলেবেলা, সোনালী চুলের রাপুনজেল, শক্ত করে ধরা বাবার আঙুল, মায়ের আঁচলে বাধা পায়রা মার্কা আধুলি, ঝিমধরা লাটিম, টানধরা চোখদার ঘুড্ডি, লাঠি বিষ্কুট, নানখাটাই, ঝোলা গুড়ের কটকটি— কি নিবে না আমায়?

৪.
সূর্য ওঠে। রোদে চড়ুইয়ের ছোট্ট শরীর ঝিকমিক করে- যেন রাপুনজেলের সোনালী চুল। বাতাসে রুটি আর আলুভাজির ঘ্রাণ। বহুকাল আগের রান্নাঘর হতে মা নাস্তা খেতে ডাকেন। পা বাড়াতেই বারান্দাটা বড় হতে হতে স্বপ্নে দেখা দিগন্তবিস্তৃত মাঠ হয়ে যায়। অদেখা দানব জ্বলজ্যান্ত আলোর ভোরে নতজানু, কষ্টে জারেজার। সে কি দ্বিতীয় সত্বা আমার! চড়ুইয়ের আদ্যিকালের সহচর! সেও খোঁজে মনসুখিয়ার পথ! অভ্রজোনাকের পাখার স্পন্দন!!

সময় ধায়, সকলই ফুরোয়। মনের ভিতরে নীরবতা ভেঙে কে যে গেয়ে চলেন-
” তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়-
তুমি যারে জানো সে যে কেহ নয়, কেহ নয়।

মালা দাও তারই গলে, শুকায় তা পলে পলে
বায়ু পরশন নাহি সয়
পাও নাই পাও নাই পরিচয়…”


_________________________
গদ্যগ্রন্থ: মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

কাঞ্জুইসা মারুফ

কাঞ্জুইসা মারুফ

কৃপণ লোকদের ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় বলে কাঞ্জুস, কিপ্টা বা কিরপিন। মারুফ ভাই একজন মাশহুর কাঞ্জুস। আমাদের পাড়ার বন্ধুদের মাঝে এমন একটা কথা প্রচলিত আছে- যে লোক পিঁপড়ার পেট চিপে চিনি বের করে সেও কিছুটা উদার, মারুফ ভাই তো চিনি বের করে প্রোটিন হিসেবে পিঁপড়াকে ভুনা করে খায়।

আজ সকালবেলাতেই মারুফ ভায়ের সাথে ফার্মেসিতে দেখা। প্রচণ্ড জ্বর, থরথর করে কাঁপছেন। ফার্মেসির সেলসম্যান আজাদকে বলে ওষুধ নিতে এসেছেন। এমন মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করা যায়না, তাই হাসতে হাসতে বললাম-
: মারুফ ভাই, এবার কাঞ্জুসি কিছু ছাড়েন। ডাক্তার দেখান।

জ্বর কাতর চেহারায় মলিন হেসে তিনি উত্তর দিলেন-
: ছোটো ভাই, ফার্মেসি ওয়ালারাই ভালো দেখে। ডাক্তারের কাছে গেলে এই টেস্ট ঐ টেস্ট। বিশাল খরচের ব্যাপার।

গত বছর ক্রিকেট খেলতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেলাম। ব্যাথা মানে মাঠে পরে গিয়ে পায়ের চামড়া ছিলে গিয়েছিল। তখন মারুফ ভাই ডাক্তারকে দেখানো ছাড়া কোনো ওষুধ খেতে নিষেধ করেছিলেন। আজ উনাকে ওইসব উপদেশবাণীর কিছুটা ফেরত দেওয়া ফরজ। মনে মনে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, তার আগেই তিনি বললেন-
: চা খাইবা সাঈদ, তোমার তো আবার চায়ের নেশা।
: তার আগে কন আপনে চা খাওয়াইবেন?
: হ, আমিই খাওয়ামু। চলো, একটু চা খাই।

নবাব সিরাজদৌল্লাহর মর্মান্তিক পরাজয়ের পর এটাই বাংলার ইতিহাসে সর্বাধিক মর্মান্তিক পরাজয়ের ঘটনা। আর এবার পরাজয়টা আমার। মারুফ ভাই কি আমাকে চা খাইয়ে তার ‘কাঞ্জুস’ উপাধি বিসর্জনের পথে এগিয়ে যেতে চাইছেন! কি জানি কি হলো, উনাকে জোড় করে বাড়িতে নিয়ে এলাম। ঐতিহাসিক ঘটনাটা ঘটতে ঘটতে ঘটলো না। ঘরে বসতেই মারুফ ভাই একটা অমায়িক হাসি দিলেন, বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম-
: হাসেন কেনো!
: তোমার ঘরে এখনো এমন ছড়ানো ছিটানো এতো বই! ম্যাগাজিন আর পেপার!!

উত্তর না দিয়ে ‘হ্যা’ বাচক হাসি দিলাম। মনে পড়লো কিশোরবেলায় মারুফ ভায়ের ঘরে তো প্রচুর বই দেখেছি। ‘লেবু মামার সপ্তকাণ্ড’, ‘রাণী খালের সাঁকো’, ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ বইগুলো তো প্রথমে উনার কাছ থেকে এনেই পড়েছিলাম। উনি প্রচুর বই কিনতেন, উনার শখ ছিলো বিভিন্ন কালারের পিংপং বল, স্ট্যাম্প আর স্টিকার কালেকশন করার। কৌতূহল কাটাতে জিজ্ঞেস করি-
: এখন কি আর বই পড়েন না? আপনার স্ট্যাম্পগুলো কোথায়!

দীর্ঘনিশ্বাস গোপনের ব্যর্থ চেষ্টা করে উত্তর দিলেন-
: আর বই পড়া! স্ট্যাম্প দামিগুলো বিক্রি করে ফেলেছি, বাকীগুলো কোথায় আছে জানিনা।

স্ট্যাম্পবুকটার প্রতি আমার গভীর লোভ ছিলো। কত সুন্দর সুন্দর সব স্ট্যাম্প, বিভিন্ন দেশের। ইতোমধ্যে চা চলে এসেছে, চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম-
: মারুফ ভাই, আপনাকে একটা কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করি- এমন কাঞ্জুস হইলেন কেমনে! আড়ালে অনেকে অনেক কিছু কয়, ভালো লাগেনা, জবাবও দিতে পারি না।

তিনি মলিন হেসে বললেন-
: তোমার জবাব দিবার দরকার নাই। কঞ্জুসরে তো কঞ্জুসই কইবো, হাজী মোহম্মদ মহসীন কইবো না কি!

আমি নাছোড়বান্দা। আজ যখন একটা মওকা পেয়েছি তখন উনাকে কাঞ্জুসীর বিরুদ্ধে একটা লেকচার দিবোই। আর কাঞ্জুসপনাও কিছুটা হারাম করে ছাড়বো। তাই বললাম-
: বাদ দিলে তো বাদই দিতাম। আপনার কাঞ্জুসী করার কোনো কারণ খুঁইজা পাইনা! ভালো চাকরী করেন। জয়েন ফ্যামিলি। দুইটা মাত্র বাচ্চা। এরপরও এমন কাঞ্জুসী কিভাবে করেন কন তো! কাউরে পাঁচটাকার ঝালমুড়ি খাওয়াইতে গেলে পঁচিশবার চিন্তা করেন। তারপর বলেন ‘সাথে টাকা নাই।’ এইটা কিছু হইলো।

মারুফ ভাই মনে হয় একটু অবাক হয়েছেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর খুব ধীরে বলতে শুরু করলেন-
: সাঈদ, তুমি আমার ইনকামের জায়গাটা দেখছো। কিন্তু খরচের ব্যাপারটা জানো না।
: ধুত্তরি! বাড়ি ভাড়া লাগেনা। তারপরে আবার একান্নবর্তী ফ্যামিলি। আরও দুই ভাই কামায়। এরপরও আপনার এত খরচ যে পাঁচটাকা নিজের জন্যই খরচ করতে পারেন না! টাকা বাঁচাতে দুই দিন পর পর ফার্মেসীর আজাদের কাছ থেকে জ্বরের ওষুধ নেন। ডাক্তার দেখানোর পয়সা নাই!! আজব।

তিনি কি যেন ভাবছেন। কিছুটা সময় নীরবতা। চা-বিস্কুট খাওয়া শেষে মুখ খুললেন-
: শোনো সাঈদ, আমাদের জয়েনড ফ্যামিলি এটাতো জানোই। আমার ছোটো ভাইটা দুই মাস কাজ করলে তিন মাস বইসা থাকে। যেখানেই চাকরী করতে যায় সেখানেই না কি ওরে বাড়তি খাঁটায়। তাছাড়া অফিসের বড় বড় হর্তাকর্তারা অফিস ম্যানেজমেন্ট বুঝেই না, সব বোঝে ও।
: বলেন কি! মান্নানের এই অবস্থা!
: হ্যা। ওতো তোমাদের সাথেই আড্ডা দেয়। ওরে কখনও ব্যস্ত দেখছো! নিয়মিত অফিসে যাইতে দেখছো?
: এইটা তো ওভাবে খেয়াল করি নাই, ভাই। আমি তো ফিরি সন্ধ্যায়। কাল নাইট ডিউটি করছি, তাই আজ ‍ছুটি কাটাচ্ছি..

তিনি আবার বলতে শুরু করলেন-
: যে দুই মাস কাজ করে ওই দু’মাসের বেতন নিজেই খরচ করে। তার বউ আর এক বাচ্চার খরচ আমারেই চালাইতে হয়।
: আপনে একা চালাইবেন কেন? মেজোজন মানে মোস্তাক ভাই কি করেন!
: মোস্তাক গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল আর ওয়াসার বিল দেয়। ওর পক্ষে না কি এর বেশী দেওয়া সম্ভব না। ওর দুই বাচ্চার ভবিষ্যত আছে না!
: বাহ! আপনার পোলাপান কি ভবিষ্যত ছাড়া!
: তেমনই ধরতে পারো। ফ্যামিলির বড় ছেলে। আগে দায়িত্ব নিছি- এখন দায়িত্ব থেকে আর মুক্তি পাইতেছি না।
: আপনাদের আত্নীয়স্বজনদের ডাকেন। প্রয়োজনে আলাদা হয়ে যান।
: ডাকি নাই মনে করছো! একবার আলাদা হইছিলামও। কিন্তু যেইকার সেই।
: মানে!
: মানে হইলো, ছোটো ভাইরে দেখতে হয়। ওর খরচ পুরাটাই চালাইতে হয়। চাকরী পাইলে শোধ কইরা দিবো বইলা লোন নেয়। মেজোজনেরও একই অবস্থা- এই মাসে বাচ্চাদের বেতন আটকায়া থাকে তো, পরের মাসে ইউটিলিটির বিল আটকায়া থাকে। রমজান আর ঈদে কেনাকাটা আটকায়া থাকে। তারপরের মাসে আবার কি জানি কোন ব্যাংক লোনের কিস্তি আটকায়া থাকে। আর বাচ্চাগুলা তো কোনো অপরাধ করে নাই। ওদের খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট সহ্য হয়না। তাই আবার একসাথে হইতে বাধ্য হইলাম।
: আপনেরে দিয়া কিছু হইবো না। চা খাইবেন আরেক কাপ!
: খাইতে পারি।

কি জানি কি মনে করে উনার কপালে হাত দিলাম- বেশ জ্বর উনারে বললাম-
: মারুফ ভাই, একটু শুয়া থাকেন। ভালো লাগবে। একটা নাপা দেই, খায়া জ্বর চাপা দেন।

উনি শুলেন না। নাপা খেয়ে বসেই রইলেন। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন-
: একটা ফ্যামিলির প্রায় পুরা খরচটাই আমারে চালাইতে হয়। পনেরোজন মানুষ। তারপরে আবার দাওয়াত তো লাইগাই থাকে। বাচ্চাদের পড়ার খরচ। তোমার ভাবী মানুষটা দেবীর মত, সবই বুঝতে পারে কিন্তু মুখ ফুইটা কিছু বলেনা। পুরাই মায়ের স্বভাব।
: হ, বুঝলাম।
: কি বুঝলা?
: যেমন ছাগল, তেমনি ছাগী।
: হাহাহাহা… এখন তুমিই কও, আমার ইনকাম কি অনেক!
: যে কাহিনী শুনাইলেন, তাতে অনেক ইনকাম কই কেমনে!!
: ইনকাম আসলে অনেকই। পনেরোজন মানুষের ফ্যামিলি চালাইতে গিয়া চোখে আন্ধার দেখি। যদি শুধু আমার ফ্যামিলিটা হইতো তবে চাইরজনের আরাম কইরা চইলা যাইতো। আমারে কাঞ্জুসী করতে হইতো না।
: সরি ভাই, আপনেরে আর কাঞ্জুস কমু না।
: সরি কওনের কোনো কারন নাই। স্বভাবে পুরাই কাঞ্জুস হয়া গেছি। নিজেই নিজেরা চিনতে পারিনা। ক ত বছর ধইরা ভাবতাছি একবার দুই বাচ্চা আর তোমার ভাবীরে নিয়া রাঙামাটি যামু। কিন্তু খরচ কুলাইতে পারতাছিনা।
: বুঝতে পারতাছি..
: ঘরের ভিতরে মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়া আসে। মনে হয় পালাই। দুই একদিনের জন্য ঢাকার আশেপাশে কোথাও যাইতে ইচ্ছা করে- কিন্তু হিসাব কইরা আর যাওয়া হয়না। এক দুই হাজার টাকাও অনেক টাকা। খরচ বাঁচাইতে গিয়া অফিসের পিকনিকে পর্যন্ত যাই না।

অপার উৎসাহ নিয়া আবেদন করলাম-
: ভাই, আপনি যদি কন তবে মান্নানরে একটা ঘাড়ানি দেওনের ব্যবস্থা করি!
: মাইরা কি আর কাজ করানো যায়! বাদ দাও…
: মাঝে মাঝে তোমাগো মতন দামি শার্ট আর জুতা পরণের ইচ্ছা জাগে। কিন্তু এখন আর দাম দেখিনা, কমদামে টেকসই জুতা কিনি। জ্বরের জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত, কিন্তু মাসের প্রথমে সংসারের বাজার, দোকানের বাকীর বিল, বাচ্চাদের ইশকুলের বেতন দিয়া হাত খালি হয়া যায়। এরপরে মাসের শেষে তো ভয়াবহ অবস্থা। ডাক্তারের কাছে যাওয়া এখন বিলাসিতা মনে হয়।
: আপনার গুণধর দুই ভাই কিছু বলেনা!
: বলেনা মানে! আমার কি কি করা উচিত সবকিছুই কয়, তবে টাকা-পয়সা খরচ আর হিসাবের ব্যাপার উঠলেই তাগো মুখ শুকায়া কালা আমসত্ব হয়া যায়।

দ্বিতীয় দফায় চা এসেছে। দুইজনে চা খাচ্ছি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বিব্রত হবার হাত থেকে বাঁচার জন্য কার্টুন চ্যানেল ছেড়ে দিয়েছি। কথাগুলো বলতে পেরে মারুফ ভাই মনে হয় অনেকটা নির্ভার হয়েছেন। ইলেকট্রিসিটি চলে যেতেই বুঝতে পারলাম বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। চৈত্রের বৃষ্টি। কনকনে হাওয়া।
মারুফ ভাইকে জোড় করে ছাদে তুলে নিয়ে এসেছি, বৃষ্টিতে ভিজবো। মারুফ ভাই ভিজতে শুরু করে দিয়েছেন। আমার প্ল্যানটা অন্যরকম- ডাক্তারকে যখন ফি দিবোই তখন ভালো করে শরীর খারাপ করায়া ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। কারণ, ভাইকে এখন যদি বলি চলেন ডাক্তারের কাছে নিয়া যাই, উনি বিব্রত হয়ে ‘না’ করবেন। তারপর ভাববেন উনারে দয়া দেখাইতাছি। যত্তসব ফালতু সেন্টিমেন্ট। কিন্তু বৃষ্টিতে উনি ভিজছেন আমার উস্কানিতে, সুতরাং সকল দায়িত্ব তো এখন আমারই।

মারুফ ভাই ভিজছেন। কাঁপছেন হয়তো জ্বরে, বা কান্নায়। এইসব অসাধারণ মানুষগুলি কেনো যে এমন হয়! এই মূহুর্তে আমার খুব কাঞ্জুস হতে ইচ্ছে করছে।

_____________
#সৌন্দর্যগ্রস্থ-১৭

বিজ্ঞান মাত্রই ভালো নয়

প্রিয় হৃদি, চলো আজ কিছু বিজ্ঞান শিখি।

রাতের জঠরে ধীরে ধীরে কিভাবে জন্মায় প্রতিটি ভোর
যদি জানতে চাও আকাশে তাকাও, তাকিয়েই থাকো
শেষ তারাটি মুছে যাওয়ার ক্ষণ পর্যন্ত।
প্রাচীন নাবিকের মত তুমিও দেখবে
ধলপহর গিলে খায় আদম-সুরত, কম্পাসের কাটায় ভোর।
ভোরের খোলস থেকে বেরোয় দুপুর
দুপুরের দীর্ঘশ্বাসের বিস্তার সন্ধ্যাবাতির বুকে ছলকে পড়তেই
জেগে ওঠেন বুড়ো নিউটন,
‘প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’
আওড়াতে আওড়াতে সন্ধ্যার শেষ বাঁকে দিনকে খুন করে নির্বিকার রাত,
এভাবেই প্রতিটি মুহুর্তই জন্মামাত্র মরে যায় পরবর্তী মুহুর্তেরঘায়ে-
একে বলে সময়ের খুন-চক্র।

প্রিয় হৃদি, তুমি কি জানো বিজ্ঞান আজ বড় অসহায়
যে পুরোহিত না জানে ধর্ম, না জানে বিজ্ঞান-
সে’ই বিজ্ঞানের পাতায় পাতায় খুঁজে পায় ধর্ম
ধর্মের আয়াতে আয়াতে বিজ্ঞান
যে কবি না জানে কাব্য, না জানে কবিতা-
সে’ই লেখে কবিতার বিজ্ঞান, কাব্যের ফরমুলা
যে প্রেমিক না জানে বিভ্রম, না জানে মোহ-
সে’ই জানে প্রেম মানে বিজ্ঞান, প্রণয় মানেই বায়োলজি
এ হচ্ছে বিজ্ঞানের হীনমন্যতাচক্র–
যার যেখানে আত্মসংকট ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি
সেখানেই টেনে আনে স্বাক্ষীগোপাল বিজ্ঞান।

প্রিয় হৃদি, বিজ্ঞান মাত্রই ভালো নয়
বিজ্ঞানের সকল খুনচক্র ও হীনমন্যতাচক্র
কেন্দ্র করে ঘুরেন নিউটন-
শক্তির রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই
সকল খুনের রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই
সকল হীনমন্যতার রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই
প্রেমও শক্তি – প্রেমের রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই।

এই বিনাশহীন রূপান্তর চক্রকে অস্বীকার করে
এক নগণ্য অন্ধকবি-
স্বপ্নে তোমায় ভলোবাসে, চুমো খায়, আলিঙ্গনে জড়ায়-
সেখানে কোনো খুনচক্র ও হীনমন্যতা নেই
ভালোবাসার প্রতিদ্বন্ধী সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া নেই
প্রিয় হৃদি, বিশ্বাস করো – সেখানে জীবন হতে বড় কোনো বিজ্ঞান নেই।

—————————————————
বিজ্ঞান মাত্রই ভালো নয়/আবু সাঈদ আহমেদ
গ্রন্থ: পোস্টম্যান থামো

অণুগল্প : ছায়ামিতি

ছায়ামিতি

চৈত্রমাস প্রায় শেষ। মাঝ রাত। ঝেপে বৃষ্টি এসেছে। বর্ষণের একটানা ঝিঝিম শব্দ। পায়ের কাছের জানলা খুলে দিতেই ঘরে ভিজে বাতাসের হুল্লোড়। পা ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি রেণু।

জম্পেশ ঘুম হবে। চোখ বন্ধ করে গুণগুণ করছি। হঠাত কনকনে গলা-
: ছাদে গিয়ে মন ভরে ভিজলেই পারো। রাতের বৃষ্টিতে আগে তো খুব ভিজতে!

বিষ্ময়ে চোখ খুলি- বুকের উপরে বসে আছে ছেলেবেলার জ্যামিতি বক্স। লালশাদা। তাতে সোনালী নকশা। বক্স হতে কম্পাস বেরিয়ে এলো-
: বিন্দু চেনো?
: হ্যা, চিনি।
: হি:হি:হি: মডেল বিন্দুর কথা বলছি না। জ্যামিতির বিন্দু চিনো!
: বেশ চিনি। যার অবস্থান আছে কিন্তু কোনো দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও বেধ বা উচ্চতা নেই তাকে বিন্দু বলে। বিন্দু হলো শুন্য মাত্রার সত্বা।

কম্পাস হেসে দিলো-
:আংশিক সঠিক। বিন্দু হলো শূন্য মাত্রার সত্তা। তবে শুন্য মাত্রার আপেক্ষিক সত্তা।
: শূন্য- সেও আপেক্ষিক! হবে হয়তো!
: অবশ্যই আপেক্ষিক। প্রতিটি মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার কেন্দ্রটাই হলো বিন্দু। ইচ্ছে হলে কেন্দ্রবিন্দুও বলতে পারো।
: তাই না কি? জানতাম না।
: ধরো, দাঁড়িয়ে আছো আপন বিন্দুতে অটল। সূর্যালোকে সকালে ছায়া হবে লম্বা। দুপুরে পায়ের কাছে গুটিসুটি, বিকেলে বিষন্ন বিস্তার…
: এ তো সবাই জানে!

কম্পাস হাই তুললো-
: হুমম। এসব সবাই জানে, কিন্তু ছায়ামিতি জানেনা।
: ছায়ামিতি! সে কেমন?
: মানুষ তার আপন বিন্দুকে কেন্দ্র করে বৃত্ত আঁকলে তার ছায়ার সমান দীর্ঘ হয়। আর সময়ের মাপ মতো মানুষের সীমানা ঠিক ততটুকু বিস্তৃত। একদিন মানুষ চিরদনের জন্য চলে যায়, সাথে নিয়ে যায় তার সকল ছায়া।এরপর হতে আর কোনো গুঁটিশুটি নেই, নেই বিষন্ন বিস্তার।

জ্ঞানবাক্য সহ্য হচ্ছেনা, রুঢ় হলাম-
: এসব শুনতে ভালো লাগছে না, অন্য কিছু বলো?
: এই এক সমস্যা। তোমার কখন কি শুনতে যে ভালো লাগে!

কম্পাস উদাস গলায় বলে চলে-
: প্রতিটি মানুষ তার এক জীবনে লক্ষ লক্ষ বৃত্ত আঁকে। প্রতিটি সম্পর্কের অসংখ্য স্বতন্ত্র বৃত্ত আছে।
: প্রতিটি সম্পর্ক কি বৃত্তে সীমাবদ্ধ?
: হ্যা। ইচ্ছে করলেই কেউ টুপ করে বৃত্তের বাইরে চলে যেতে পারেনা, পৃথক বৃত্তে হুট করে প্রবেশ করতেও পারেনা।
: মাঝরাতে এসব শোনাতে এসেছো?

কম্পাস হাওয়ায় বৃত্ত আঁকে, লম্বা শ্বাস নেয়-
: ইশকুলে তোমার গণিত ভালো লাগতো না। তেত্রিশ পেলেই খুশি। অথচ জ্যামিতিতে অসাধারণ ছিলে। ক্লাশ টেনের ফাইনাল পরীক্ষায় শুধু জ্যামিতির উত্তর দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলে- কবিতা লেখার জন্য।
: হুম। কাঠবলদ ছিলাম। বোকামী করেছি। কবিতা নয়, পরীক্ষার নাম্বার অমূল্য,- তখন বুঝিনি।
: অবশ্যই বোকামী। তবে কবিতা আর জ্যামিতির প্রতি তোমার ভালোবাসায় খাদ ছিলো না। বোকাদের ভালোবাসা এমন নিখাঁদই হয়।
: তাই বুঝি! এমন কথা কখনো শুনিনি।
: এবার তো শুনলে। তোমার বৃত্তে সঞ্চিত ভালোবাসার টানেই এসেছি।
: তুমি ভালোবাসার টানে এসেছো! প্রিয়তম মানুষরা কেউ আমার কাছে আসবে না!
: তা জানিনা। লক্ষ লক্ষ বৃত্তগ্রস্থ মানুষের যে অনেক অনেক হিসেব-নিকেশ, বৃত্তের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য বন্ধন আর সীমানা..
: তাতে কি! মানুষই তো বৃত্ত ভাঙে, ভাঙে না?

কম্পাসের হাসি আর থামেনা- : তা যা বলেছো!! বৃত্ত ভেঙে মানুষ বৃত্তের ভিতরেই ফিরে আসে।

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। বক্স হতে চাঁদা চেঁচিয়ে উঠলো –
: ওরেএএ কম্পাস! কাজের কথাটা শেষ করো। বৃষ্টি বাড়ছে – সে খেয়াল আছে?

বর্ষণমুখর রাতে কম্পাস চাঁদা সবাই বলতে শুরু করেছে। মহীয়সী খনা বেঁচে থাকলে বচন দিতেন – “যদি বর্ষে চৈত্রের শেষ/জ্যামিতি বক্সের কথায় রাত্রি শেষ।” কম্পাস খুক খুক করে কেশে নিলো-
: এবার আসল কথাটা বলি- তুমি বৃত্ত মানোনা- সে তোমার ব্যপার। কিন্তু তুমি বৃত্তের রাজ্যে শোরগোল বাধাতে পারো না!
: আমি আবার কখন শোরগোল বাধালাম?
: তুমি অভ্রজোনাককে মুঠোয় পুরতে চাও মমতায়- বেশ কথা। অভ্রজোনাক মনের বৃত্ত ভেঙে মুঠোর বৃত্তে আসবে কি? একবারো ভেবেছো!
: নিজের বৃত্ত ভেঙেছি। আলোর লোভে অভ্রজোনাকের বৃত্ত তো আর ভাঙি নাই।
: কিন্তু ভাঙা বৃত্তের টুকরো-টাকরা নিয়ে অভ্রজোনাকের বৃত্তসীমানায় ঢুকে পরার আশায় জিরো ল্যান্ডে উদ্বাস্তুর মত বসে আছো। এতে অভ্রজোনাকের ভীষণ অস্বস্তি হয়- জানো!
: জানবো না কেন? বেশ জানি। অস্বস্তিকে পাত্তা না দিলেই হয়…

এবার কম্পাস একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে-
: জ্যামিতি বেশ ভালো বুঝতে। একটা বৃত্ত আর একটা বৃত্তের সীমানায় ঢুকে পরলে দুটো বিন্দুতে ছেদ করে- এফোঁড়ওফোঁড় করে যায়- মনে আছে?
: মনে থাকবেনা কেন! বেশ মনে আছে।
: তোমার বৃত্তের ঘায়ে অভ্রজোনাকের এফোঁড়ওফোঁড় হবার ভয়..
: কি যে বলো! অভ্রজোনাক অপন বৃত্তে বিভোর।

কম্পাস আড়মোড়া ভাঙে, হাই তোলে। গভীর মায়ায় তার কন্ঠ আর্দ্র-
: একদিন, ধরো কোনো একদিন, অভ্রজোনাক আপন বৃত্তের সীমানা প্রাচীর তুলে নিলো।
: তাতে আমার কি?
: তুমি তোমার সকল বৃত্ত নিয়ে ঢুকে পোরো। জেনো, অভ্রজোনাকের হাতের রেখায় মনসুখিয়ার জলছবি আছে, আর চোখে রাজ্যপাট।
: প্রিয় কম্পাস, তুমি কি জানো- কবে খুলবে অভ্রজোনাকের সীমানা প্রাচীর?

কম্পাসের আচানক কি ব্যাস্ততা-
: বাইরে বৃষ্টি। এখনই যেতে হবে। চাঁদা কেমন তারা দিচ্ছে- দেখছো না!
: প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম না?
: হয়তো খুলবে একদিন। অথবা কোনদিনই খুলবেনা। তাতে কি! তুমি তো ওর বৃত্তের সীমানায় উদ্বাস্তু হয়ে দিনযাপন করছোই। তোমার আগে কে আর বলো বৃত্ত ভাঙার খবর পাবে!

ক্লাশ টেন, প্রিয় থার্ড বেঞ্চ, জ্যামিতিবক্স সব হাওয়ায় মিলেমিশে যায়। বাইরে শেষরাতের ঝিঝিম বৃষ্টি। বৃত্তের কেন্দ্রে পরে থাকি– একা। জানি মনসুখিয়া আমাকে ডাকেনা- তবু বৃষ্টির একটানা ঝিঝিম শব্দ ভেদ করে মনসুখিয়ার ডাক শুনতে পাই। বিভ্রমও এত প্রিয় হয়! এত মধুর!!

__________________________________
#ভিন্ন মাত্রার গদ্যগ্রন্থ: মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

তোমার ঠোঁটে শুকনো রেখার কারুকাজ

প্রিয় হৃদি, তুমি জানো ব্যাকরণই শেষ কথা নয়। ব্যাকরণ মানেই ভাষার শৃঙ্খল, অথচ ভাষা আজন্ম দিনমজুর, ইটভাঙার মত সে শৃঙ্খল ভেঙে ভেঙে প্রতিদিন বেঁচে থাকে, খায় ও পান করে, প্রতিক্ষণ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তবু ব্যাকরণেই তোমার সকল আস্থা, সমাসবদ্ধ পদের পরিবর্তে সন্ধিবিচ্ছেদই তোমার প্রিয়, সম্প্রদান ও অধিকরণ কারকে নেই মনোনিবেশ।

প্রিয় হৃদি, পৃথিবী বলেছে কথা বহুদিন ব্যাকরণহীন। পৃথিবী শুনেছে কথা বহুদিন ব্যাকরণহীন। পৃথিবী লিখেছে কথা বহুদিন ব্যকরণহীন। তখনও চন্দ্রালোকে ঘাসের শয্যায় বিস্মিত মানব-মানবী ভুলেছে সঙ্গম, তখনও সন্তানকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছেন পিতা শ্বাপদের মুখোমুখি, তখনও শিশুর মুখে স্তন্যের দুধের ঘ্রাণ বুক ভরে শুঁকেছেন মাতা, তখনও স্বজনের মৃত্যুর আহাজারী ছুঁয়েছে আকাশ।

প্রিয় হৃদি, আজও গভীরতম ভাষাসমূহের কোনো ব্যকরণ নেই, কোনো শব্দকোষ নেই, কোনো অক্ষর নেই। হেমন্তের পাতাঝরা রাতে বহুদূর হতে ভেসে আসে কুয়াশায় ভেজা ভেজা তোমার ঘ্রাণ, তোমার চাহনির সূক্ষ্মদেহী আত্মা, তোমার ঠোঁটে শুকনো রেখার কারুকাজ- আর আমি ব্যাকরণ সমৃদ্ধ ভাষা খুঁজে বেড়াই, যে ভাষা তুমি বোঝো, যে ভাষায় তুমি বুঝবে- আমার আরোগ্যহীন রোগ, তোমাকে না পাওয়ার অসুখ।

_________________________________
অকবিতাগ্রন্থ: পোস্টম্যান থামো/আবু সাঈদ আহমেদ।

অণুগল্প : যমজিয়া

যমজিয়া

– কি চাও?
– শর্তহীন প্রণয়।
– প্রণয় কি শর্তহীন হয়?
– প্রণয় আমূল শর্তহীন। মানুষ শর্তযুক্ত করে করে প্রণয়কে পরিণয়ে পরিণত করে।
– পরিণয় কি প্রণয়ের গন্তব্য নয়?
– না। পরিণয় হলো প্রণয়ের মৃতদেহ। প্রণয় দুর্নিবার হাওয়া- শুধু তোমার কাছে যাওয়া।
– বেশ! আমার মাঝে কি যে পেয়েছ তুমি!
– কিছুই পাইনি, আপদমস্তক তোমাকে ছাড়া।
– তারপরেও শর্তহীন প্রণয় চাও?
– চাই, ভালোবাসিবার চাই অধিকার।
– তবে ভালবাসো, শর্ত একটাই- আমি এসবে নেই।
– বেশ, তবে আমিই ভালবেসে যাই–

ছেলেটি ভালবাসে। মেয়েটি পাগলামি দেখে হাসে, বিরক্ত হয়। প্রণয়ের দিন যায় যমজ ভাবনায়- কে কাকে গ্রাস করে! কে কাকে জড়ায় আপন ছায়ায়!

প্রেমমোচন

প্রেমমোচন

১.
কলেজ ফার্স্ট ইয়ার। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। দশ দিনের ছুটি। টেলিফোনে ভিকারুনিসা-
: হ্যালো! নটরডেম! কাল বেইলী রোডে আসতে পারবে?
: কখন?
: বিকেলে। তিনটা থেকে সাড়ে তিনটায়!
: পারবো।
: ভুলে যেও না, প্লিজ।
: ঠিক আছে। তোমাকে চিনবো কিভাবে?
: আমি তোমাকে চিনি, ডেকে নিবো।
: ঠিক সোয়া তিনটায় বেইলী রোড চৌরাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবো। চারপাশে তাকিয়ে দেখব ‘ইশারায় শিস দিয়ে কে ডাকে…’
: ধ্যাত! সুইসে চলে এসো।

১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি হতে প্রতিদিন টেলিফোনে দুজনের এলেবেলে কথা হয়। মুখোমুখি দেখা হয়নি।

২.
বেইলী রোড। ফাস্টফুড শপ সুইসের কর্ণার টেবিল। স্কাই ব্লু কালার কলেজ ড্রেস, চোখে রূপালী চশমা-খলবলিয়ে হাসে ভিকারুননিসা। নেভী ব্লু টিশার্ট আর ওশেন ব্লু জিন্সে নটরডেম গম্ভীর। ছোট ছোট কামড়ে স্যান্ড্যুইচ শেষ হয়ে আসে- দুজনের কথা শুরু হয়না। অকস্মাৎ নটরডেম ব্যাগ থেকে রুপোলী রাংতায় মোড়ানো প্যাকেট ভিকারুননিসা দেয়। ভিকারুনিসা প্যাকেট খুলতে গিয়ে থমকে থামে-
: আমার জন্যে?
: না, টেপির জন্য।
: ধ্যাত, আমাকে টেপি বলবা না-
: টেপিকে অতন্দ্রিলা বলতে হবে! গোলাপবানু!!
: ধুত্তোরি! কি আছে এতে-?
: হুমায়ূনের নন্দিত নরকে, সত্যজিতের সেরা বারো, আর সুনীলের রাজার মুকুট থেকে খসে পরলো বালি।
: থ্যাংক্স।

ব্যাগ থেকে ঢাউস এক প্যাকেট বের করে ভিকারুননিসা। নটরডেমকে হাসিমুখে দেয়। নটরডেম কৌতূহল না দেখিয়ে ব্যাগে ভরে। কোক শেষ হয়ে আসে। দুজন সুইস থেকে বের হয়। ভিকারুননিসা ফিসফিসিয়ে বলে-
: তোমাকে লিফট দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু…
: কিন্তু কি?
: বাবা জানলে খুন করে ফেলবে।
: খুন হবার দরকার নেই, সামনে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা।

শাদা স্প্রিন্টারে চলে যায় ভিকারুননিসা। নটরডেম হাটতে শুরু করে। এক একটা বিকেলে তাকে হাটার নেশায় পায়। যেনো কোনোদিন আর থামবে না।

৩.
মাঝরাত। নটরডেম বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। তার সামনে প্যাকেটখুলে পাওয়া – ১. লেদার জ্যাকেটে বাধাই ভীষণ দামী ডাইরী, ২. অনেকগুলো বিভিন্ন রংয়ের জাপানি বলপয়েন্ট, ৩. টিডিকে অডিও ক্যাসেট ৪. নীল লেটার প্যাডে চিঠি-

“এয়্যাই,
তোমাকে আজীবন নিলয় নামে ডাকতে চাই।
-টেপী
পুনশ্চ:
i. প্রতিদিন ডায়রিতে এক লাইন হলেও আমাকে নিয়ে লিখবে। না লিখলে ঠিক ঠিক মরে যাব।
ii. আমাকে নিয়ে মজার কিছু লিখলে কমলা কালিতে, রাগ হলে লাল কালিতে, কবিতা সবুজ কালিতে আর লিখতে ইচ্ছে না হলে কালো কালিতে লিখবে- প্লিজ কালারগুলো মনে রাখবে। মনে না রাখলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
iii. ক্যাসেটের একপাশে মান্নাদের ‘যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ একদিন গলেও যায়, তবুও তুমি আমার’ আর অন্যপাশে স্টিভি ওয়ান্ডরের ‘আই জাস্ট কল টু সে আই লাভ্যু’ গানদুটো বারবার রেকর্ড করা আছে। ভেবো না তোমাকে আই লাভ ইউ বলছি। পুরো ক্যাসেট শুনবে, না শুনলে আমি ঠিক ঠিক মরে যাব।
– টেপী

নটরডেম এই প্রথম এমন চিঠি পেয়েছে। বেশ কয়েকবার পড়েছে। এ এক অন্যরকম ভালোলাগা। আহ্লাদে পলে পলে মরে যাওয়া ভিকারুনিসার জন্য মনটা কেমন আনচানিয়ে ওঠে, চনমনিয়ে ওঠে।

৪.
এই গল্পের তিনটা সাদামাটা শেষ আছে-
— দুবছর দুজনের ‘তুমি বিনে মরে যাই মরে যাই.. গলে যাই গলে যাই’ টাইপের ধুন্ধুমার প্রেম চলে।
২. একদিন শাদা প্রাইভেটকার যাত্রীসমেত ভিআইপি রোডে ঢুকে পরে। সেখানে রিকশার প্রবেশাধিকার নেই। প্রাইভেটকার আর রিকশা পাশাপাশি চলে বটে, তাতে আজীবনের সাথী হয়ে যায়না, যায়নি।
৩. একুশ বছর পরে ভিকারুননিসাকে নিয়ে প্রতিদিন লেখাপূর্ণ দুটো ডাইরি পৌছে দিতে কফিশপে মুখোমুখি নটরডেম-
: তুমি এখনো ক্ষণে ক্ষণে ঠিক ঠিক মরে যাও?
: এসব জিজ্ঞেস করোনা প্লিজ, আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: কেউ কারো জন্য মরে না। নিজের জন্য মরে, নিজের জন্য বাঁচে।
: তুমি এখনো খুব রেগে আছো, তাই না? এখনো আমায় খুব ভালোবাসো?
সব প্রশ্নের উত্তর হয়না। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। নীরবতা ভাঙে ভিকারুননিসা-
: নটরডেম, কোথায় যাবে? আজ তোমাকে লিফট দেই?
: মনসুখিয়ায় যাব, অভ্রজোনাকের কাছে। সেখানে গাড়ি যাবার পথ নেই।

ঝাঝা রোদের দুপুর। কফিশপে বিরাণ শূন্যতা। প্রথম দিনের মত দুজন নীরব। কফির ফেনা মিইয়ে আসে। ভিকারুননিসা বুঝতে পারেনা- একুশ বছর পরে এইমাত্র কেউ তার নাম মন থেকে চিরদিনের জন্য কেটে দিলো।

চুমুকে চুমুকে কফি ফুরোয়, লো ভলিয়্যুমে বেজে চলেন রবীন্দ্রনাথ–
“যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে– জানি নে জানি নে…

________________________
#গ্রন্থ : মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

ব্রেকিং: শোক সংবাদ

ফেসবুক সেলেব্রেটির হার্ট আট্যাকে মৃত্যুঃ দায়ী ফেসবুক!
|নিজস্ব সংবাদদাতা|

বিশিষ্ট ফেসবুক সেলেব্রেটি, অনলাইন একটিভিস্ট ও ব্লগ কিংবদন্তী ম. গা. চৌধুরী আজ রাত ৯:৪৫ মিনিটে হার্ট আট্যাকে মৃত্যুবরন করেছেন। তুমুল জনপ্রিয় এই ফেসবুক সেলেব্রেটি মৃত্যুকালে স্ত্রী, ফ্রেন্ড লিস্টে ৫০০০ ফ্রেন্ড, লক্ষাধিক ফলোয়ার এবং কয়েকশো ব্লগ পোস্ট আর কয়েক হাজার স্ট্যাটাস রেখে গেছেন।

বিশ্বস্ত সূত্র জানায় তিনি প্রতিদিনের মত আজ সন্ধ্যায় ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস শেয়ার করেন। উল্লেখ্য, আপলোডের সাথে সাথে তার অতি দীর্ঘ পোস্টেও লাইকের সংখ্যা ৩৮৮টা ছাড়িয়ে যেত। প্রথম দশ মিনিটে লাইকের সংখ্যা ১০,০০০ হাজারের সীমা অতিক্রম করত। কিন্তু আজকের পোস্টে প্রথম বিশ মিনিটে কোনো লাইক না দেখে তিনি তীব্র মানসিক আঘাতে ভারসাম্য হারালে অচেতন অবস্থায় স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।

ভক্তরা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ক্ষোভের সাথে জানান আজ সন্ধ্যায় তারা অপেক্ষায় থাকলেও ফেসবুকে ম. গা. চৌধুরীর নতুন পোস্ট দেখতে পান নাই। এর পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। ভক্তরা ফেসবুককে দায়ী করে জুকারবার্গের পদত্যাগ ও তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবীতে ফেসবুকেই শতাধিক ইভেন্ট খুলেছে এবং জার্মানীর দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।

অপরদিকে ম. গা. চৌধুরীর ছোটো ভাই বলেন, “আজ সকালে ভাবী রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যান। ভাইয়া জাতির স্বার্থে খালি বাসায় পুরানো বান্ধবীকে নিয়ে জীববিজ্ঞান ও সহজিয়া দেহতত্ব নিয়ে গভীর গবেষণায় লিপ্ত হন। সন্ধ্যায় ‘ডারউনের উপর লালনের প্রভাব’ বিষয়ে একটি জ্ঞানগর্ভ স্ট্যাটাস শেয়ার করেন। কিন্তু দিনভর গবেষণা কাজের ক্লান্তি আর রাতেই ভাবীর ফিরে আসার ফোন পেয়ে ভাইয়া প্রাইভেসি সেটিংসের ‘অনলি মি (only me) কে ‘পাবলিক (public) না করেই স্ট্যাটাস পোস্ট করেছিলেন। ফলে তিনি ছাড়া অন্য কেউ পোস্ট দেখতে পায় নাই। ভাইয়া নিজের পোস্টে বিশ মিনিটে লাইক না দেখে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পরেন যে প্রাইভেসি সেটিংসের ব্যাপারটা তার চোখ এড়িয়ে যায়। তিনি তিন চারবার “ছাগু জুকারবার্গ, লেঞ্জা ইজ এ ভেরি ডিফিকাল্ট থিং টু হাইড”- বলে জ্ঞান হারান। রাত ৯:৪৫ মিনিটে চিকিতসকেরা তাকে মৃত ঘোষনা করেন।

তার মৃত্যুতে ফেসবুক আর ব্লগ জুড়ে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাকে কেন্দ্র করে পোস্টে পোস্টে ভরে উঠছে ব্লগ আর ফেসবুক। আগামীকাল সকাল ১০টায় ফেসবুকের জানাজা গ্রুপে তার ভার্চুয়াল জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। নিখিল বাংলাদেশ আঁতেল পরিষদ ও সম্মিলিত ঢংস্কৃতিক জোট এক বিবৃতিতে তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে দাফনের দাবী জানিয়েছে।

খগনের জলছাপ

খগনের জলছাপ

১.
খগনের চোখ আকাশের অসীম শূণ্যতায় স্থির। কার্তিক মাসের সকালে সে শুয়ে আছে মাঠে, সবুজ কচি ঘাসের বিছানায়। আধ মাইল দূরে ব্রহ্মপুত্র। বাতাসে ভেসে আসছে ঢেউয়ের ঘ্রাণ। খগেনের শীত শীত লাগছে।

২.
ভাদ্রমাসে বন্যা হয়েছিলো। বন্যার শুরুটা হয়েছে আষাঢ় মাসের শেষে। ব্রক্ষপুত্রে টানা তিন দিন পানি বেড়েছে, এরপর কমে গেছে। এরপর ভাদ্র মাসের মাঝামাঝিতে আবার পানি বাড়লো। বৃষ্টি বাদলা কিছু নেই, কিন্তু পানি বাড়লো হুহু করে। ওই পানিও দুইদিন থম ধরে থেকে নেমে গেলো। এর তিন চারদিন পরই আবার পানি বাড়তে আরম্ভ করলো।

খাউজরানি চরের জেলেরা গত ক’বছর ধরেই এমনটা দেখে আসছে। এবার শেষ দফা পানি বাড়তে শুরু করলো খুব ঢং করে। টানা দু’দিন খুব অল্প অল্প করে পানি বাড়লো। তৃতীয় দিন স্থির। তৃতীয় দিনের রাতে পানি বাড়তে শুরু করলো হুহু করে। সাথে অবিরাম বৃষ্টি। বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যাবেলায় তারা কুপি নিভিয়ে দেয়। তাতে রাত আরও গাঢ় হয়ে নেমে আসে, অন্ধকার বাড়ে, সবথেকে বড়কথা দুর্দিনে কেরোসিন বাঁচে, আলো জমা থাকে। সন্ধ্যা হতেই আকাশ কালো ছিলো, কালো আকাশে কখন যে এতো মেঘ জমেছে তা তাদের জানা হয়নি।

জেলের জীবন জলের জীবন, জলের সাথে তাদের নিবিড় সখ্যতা আর বৈরিতাও সে জলের সাথেই। তারা জলের চরিত্র বুঝে, নিশানা বুঝে, আবদার আহ্লাদ আর রাগও বুঝে। তাই তৃতীয় দিন বন্যার পানি জেলে পল্লীতে ঢুকে ভাসিয়ে দিতে শুরু করলো, তখন প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই করেনি। নদের সীমানায় নদের সাথে জোড়-জুয়ারি চলে, কিন্তু ওই নদের স্রােত তুমুল আক্রোশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পরলে ক্রোধ শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। স্রোতকে বাঁধা দেবার পরিবর্তে নিজেকে রক্ষা করাই প্রধান হয়ে ওঠে।

বানভাসির রাতে জেলে সর্দার কালামের নেতৃত্বে পরিবারের সদস্য, ঘরের কিছু হাড়িপাতিল, চালডাল, সস্তা কাপড় চোপড়, আর ক’টা জাল ও সম্বল ক’টা নগদ টাকা নিয়ে খগেনরা বাঁধের দিকে ছুটেছিলো। তাদের পেছনে পেছনে স্রোতের ধাওয়া। জেলে নৌকা, ঝুপড়ি ঘর- সব ভেসে গেছে স্রােতে, তলিয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্রের পেটে। স্রোতের দাপাদাপি দেখে কে বলবে এখানে একটা জেলে পল্লী ছিলো, ছিলো ভোরে জেগে ওঠা আর রাতে ঘুমিয়ে পড়া। দুপুরের উদাসীনতা, নিত্যদিনের অভাব ও ঝগড়া ফ্যাসাদ, মাঝরাতের আদর- সোহাগ। সবশেষে ফের নদীতে নাও ভাসানো, মাছ শিকার, দাদনের বিনিময়ে সস্তা দামে জীবন ও শ্রম বিক্রি।

৩.
জেলে বংশের ধারা খগনের রক্তে। পৃথিবীতে সকল ধারারই ব্যতিক্রম আছে, রক্তের ধারারও ব্যতিক্রম হয়। খগেন যতটা না জেলে, তার থেকে বেশী যাত্রাপালার অভিনেতা। খগেন মাছ ধরে, দলের সাথে উত্তাল স্রােতে ভাসতে ভাসতে চলে যায় মাঝ নদীতে। চারপাশে অথৈ পানি এবং মাথার ওপর আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না। জাল বাইতে বাইতেই খগেন গলা ছেড়ে গান গায়। যাত্রাপালার সংলাপ আওড়ায়। দলের সবাই যে তা উপভোগ করে এমন নয়। বুড়ো ময়েজুদ্দী কাকা খগেনকে বলেন, ‘পানির লগে পিরিতি না থাকলি মাছ ধরবি কিমুন কইরি, খগেন! তুই এমন কইরি ডায়লুগ কইস নে রে, জালে মন দে.. জালের লগে পিরিতি কর।’

খগেন শীতের মৌসুমে নাই হয়ে যায়। এক অপেরা পার্টির সাথে ঘুরে বেড়ায়। ওই দলে পেটেভাতে খাঁেট, যাত্রা প্রদশর্নীতে পার্ট করার সুযোগ পায়। বড় কোনো পার্ট নয়, বিবেকের পার্ট। কালো আলখেল্লা গায়ে চাপিয়ে মঞ্চে ঢুকে সে তার দেহের সমস্ত শক্তি ও হৃদয়ের সুর কণ্ঠে এনে গেয়ে ওঠে- ‘ ভোলা মওওওনননন, দিন থাকিতে চিনলি না আন্ধার…’। খগেনের গানের দরদভরা হাহাকারে ওর নিজের চোখই ভিজে ওঠে, ওই ভেজা চোখ সংক্রমিত হয় দর্শকদের মনে মনে। আন্ধার চিনে কি হবে, কেনো আন্ধার চেনা প্রয়োজন, দিন থাকতেই কেনো আন্ধার চিনতে হবে, আন্ধার না চিনলে কি এমন ক্ষতি- এসব জটিল প্রশ্ন তাদের সরল মনে জাগে না। তাদের মনের ভেতর শুধুই হাহাকার জাগে- দিন থাকতে আমি কি চিনছি আন্ধার!

৪.
শিক্ষিতজনের মনে এমন একটা ধারণা আছে যে জেলে মাত্রই হিন্দু। এ ধারণা পোষণের জন্য তাদের দায়ী করা অন্যায়। কারণ, পাঠ্যপুস্তকে, বড়বড় সাহিত্যিকদের সাহিত্যে এবং মিডিয়ায় এমন ধারণাই দেওয়া হয়েছে। জেলেদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেখাতে হিন্দু সাহিত্যিকদের সাথে মুসলমান সাহিত্যিকরা যেমন দ্বিধা করেননি, তেমন জেলের সাথে জেলে মিলে যে সমাজ গড়ে উঠেছে, সে সমাজ হিন্দু-মুসলমানের মিলেমিশে থাকায় কোনো দ্বিধা করেনা। এই একসাথে থাকার পশ্চাতে কোনো মহত আদর্শ নেই।

গরীবী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই, মহাজনের চড়া সুদ ও দাদন এবং নদীর গভীর উদারতা তাদের মিলেমিশে বাঁচতে শিখিয়েছে। এরা অসাম্প্রদায়িক নয়, এরা এমন এক জাত, যে জাত স্থূল বা সূক্ষ্ম জাত- পাত, ধর্ম-অধর্ম, প্রগতিশীলতা ও রাজনীতি, শিক্ষার আলো দিক্ষার চেতনা, আদর্শের মূল্য বোঝার আগেই আপন সম্প্রদায়ের বৃত্তে ঘানি টানতে টানতে মরে যায়। মরে যাওয়ার আগে সংসার পাতে, সন্তানের জন্ম দেয় এবং বড় করে তোলে, তাতে বিনাশের মুখে নুন দিয়ে বেঁচে থাকে উত্তরসূরী।

খগেনদের সরদার কালাম। কালামের বয়স বেশী নয়, তবে তার বুদ্ধির ওপর আস্থা আছে সবার। কালাম আর্থিকভাবেও কিছুটা স্বচ্ছল। স্বচ্ছল মানে একটা জেলে নৌকার সিকি আনা মালিকানা তার, বাকীটা মহাজনের। এছাড়া কালাম একটা সময় নজু ডাকাতের সাথে নদীতে ঘুরে ডাকাতি করতো। তার সাহসের কমতি নেই। সবমিলিয়ে সরদারি করার জন্য কালামের মত যোগ্য লোক খাউজরানির জেলে সমাজে ছিলো না। রাতে যখন পানি বাড়তে শুরু করলো, সাথে বিরামহীন বৃষ্টি- তখন কালামের ডাকেই সবার ঘুম ভেঙে ছিলো। কালামকে অনুসরণ করেই তারা দৌড়ে পৌছেছিলো বাঁধের উঁচু সড়কে।

বাঁধের উঁচু সড়কে বহু লোক এসে আশ্রয় নিয়েছে। বানের তোড় জেলে আর চাষাকে এক করে দিয়েছে, জামে মসজিদের অবিবাহিত মোয়াজ্জিন এবং দুই যুবতী বউসহ নজু ডাকাতকে পাশাপাশি ঝুপড়িতে এনে তুলেছে। কালামের নেতৃত্বে জেলেরা ক’ঘণ্টার মধ্যেই কয়েকটা ঝুপড়ি বানিয়ে ফেললো- তাতে বউ, মেয়ে আর বাচ্চাদের রেখে নিজেরা বাইরে বসে রইলো। বৃষ্টি ঝরছে, ভ্রুক্ষেপহীন ও অভিযোগহীনভাবেই ভিজছে তারা।

ঝুপড়ির ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস আসছে, আসছে আসলামের পোয়াতি বউয়ের গোঙানি। কে যেনো নিজের জীবনের প্রতি অভিসম্পাত দিচ্ছে। বলাইয়ের কিশোরি মেয়েটি সৃষ্টি কর্তার বিচারের প্রতি প্রশ্ন তুলে সৃষ্টি কর্তার কাছেই উত্তর জানতে চাইছে। খিদে বা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় কোনো কোনো শিশু কাদছে, মাঝে মাঝে এই জীবনমরণ পরিস্থিতিকে তুচ্ছ করেও হেসে উঠছে কোনো শিশু। শিশুরা সবকিছু তুচ্ছ করার ব্যকরণ জানে, বড়রা জানে চিন্তার জটাজালকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলতে।

ঝুপড়ির বাইরে কালামকে ঘিরে বসে আছে প্রায় পয়তাল্লিশজন জেলে। তাদের বয়স সতের বছর থেকে ষাটের ওপর পর্যন্ত। ঝুপড়ির ভিতর থেকে আসা কোনো শব্দই তাদের স্পর্শ করছে না, একমাত্র আসলাম ছাড়া। ভেতর থেকে আসা গোঙানির শব্দে বলাই মাঝে মাঝেই চোখ তুলে তাকাচ্ছে। অন্যরা ভাবছে অনাগাত দিনের কথা। ঘর তলিয়ে গেছে, নৌকা ভেসে গেছে। যে নদী তাদের খাদ্য যোগায় সে নদীই সব খেয়ে নিয়েছে। নদীও যেনো সুদ কারবারি মহাজন, চক্রবৃদ্ধি সুদ আদায়ে নেমেছে বন্যার লাঠি হাতে, সব হিসেব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিয়ে তবে তার শান্তি, তবে তার স্বস্তি।

কালাম বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, তাকে ঘিরে বসে থাকা জেলেরাও উঠে দাঁড়ায়। কালাম সবাইকে বসার জন্য হাতের ইশারা দেয়, এরপর কয়েকবার কেশে গলা পরিস্কার করে বলে-

– সব ভাইস্যা গেছে। আফসোস কইরা লাভ নাই।

দলের কেউ কোনো জবাব দেয়না। কালাম সবার চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার বক্তব্যের সত্যতা যাচায়ের চেষ্টা করে, কারো চোখে কোনো দ্বিমত নেই। রাতের অন্ধকারেও কালাম দেখতে পায় সবার চোখেই জমাটবাঁধা অনিশ্চয়তা, হতাশা। সে বলতে শুরু করে-

– যা হওনের হয়া গেছে। আফসোস কইরা লাভ নাই। এই বান্দেও (বাঁধে) বেশীদিন থাকন যাইবো না। কাইল থেকা এই বান্দেও পিপড়ার মতন মানুষ বাড়তে থাকবো। পানি যেমুন কইরা বাড়তাছে, পরশু এই বাঁধও পানিতে তলায়া যাইবো।

কালামের কথায় সায় দিয়ে কেশে ওঠেন দলের সবথেকে বৃদ্ধ তোরাব আলী আর হরিলাল। সে একটু বিরতি নিয়ে জানায়-

– পানি আরও বাড়নের আগেই এই রাস্তা ছাড়তে হইবো। উত্তরে ময়দাঘাট উঁচা জমিন। ওইখান থেকে দেড় মাইল দূরে পিরুলি গ্রাম। ওই্ গ্রামের গৃহস্থরা বড়লোক না হইলেও মানুষ ভালা। থাকনের জায়গা পাওয়া যাইবো।

পানিতে ডুবতে ডুবতে যখন আয়ুর প্রতি আস্থা রাখা যায়না, ওই সময় মানুষ খড়কুটোর ওপরও আস্থা রাখে। চরম বিপদের দিনে বিপদমুক্তির আশায় উদভ্রান্ত মানুষ নতুন বিপদের ওপরও আস্থা রাখতে পিছপা হয়না। পিরুলি গ্রামের কথা শুনেও কেউ আপত্তি তোলে না। কালাম এবার আদেশ দেয়-

– কাইল বিয়ানেই (সকালে) পিরুলিতে যামু। নৌকা ঠিক করো। যার যার কাছে টাকা আছে, বাইর করো। কোনো মতলব করলে এই দলে জায়গা হইবো না।

কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনা। এর অর্থ এই নয় যে, তারা সর্দারকে শর্ত ও প্রশ্নহীনভাবে মানে। খুব ছোটো ছোটো বিষয় নিয়েও তারা সর্দারের সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে। সর্দারকে শাসায়। আবার, ওই সর্দারের নেতৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে জান বাজিও রাখে। তারা সর্দারকে মানে, নিজেদের আপন আপন স্বার্থে, নিজেদের কোনো স্বার্থ বিসর্জন না দিয়েই।

সকালে জেলেদের পিরুলি গ্রামে যাওয়ার খবর রাতেই রটে যায় উঁচু সড়কে আশ্রয় নেওয়া অনেকের কাছে। গোছগাছ করার কোনো কিছু না থাকার পরও জেলে পরিবারগুলো গোছগাছ শুরু করে। গোছগাছ করাই মেয়েদের স্বভাব, অথৈ শূন্যতাকেও তারা গোছগাছ করতে পারে।

৫.
পিরুলি গ্রামে পৌছানোর পর কালাম বুঝতে পারে তাদের সাথে মোয়াজ্জিন আর দুই বউসহ নজু ডাকাতও এসেছে। মোয়াজ্জিন সাথে আসাতে কারো কোনো আপত্তি নেই। এমন একজন মানুষ সাথে থাকলে দোয়া পাওয়া যায়, দোয়া করানোও যায়। অপরদিকে নজু ডাকাতের বিষয়ে সবার মনেই একটা কিন্তু আছে। তবে এখন বিবাদ করার সময় নয়, বিবাদে কারো আগ্রহও নেই। কালামও বিষয়টিকে বড় করে তুলেনা। দুই এক’জন নজু ডাকাতের বিষয়ে কথা তুলতে চাইলে সরদার হিসেবে সে তা এড়িয়ে গেছে।

পিরুলি গ্রামের মানুষ ধনী নয়, প্রয়োজনের তুলনায় স্বচ্ছল। একটু বেশী স্বচ্ছল বলেই তারা খাওয়া এবং পরার বাইরের জগৎ নিয়ে ভাবার অবসর পায়। ইয়েমেনি শিশু আর রোহিঙ্গা নারীদের দুর্দশায় প্রবলভাবে ব্যথিত হয়। এদের জন্য কিছু করতে না পারার আক্ষেপও থাকে তাদের মনে মনে। প্রতি জুম্মাবারে পিরুলি জামে মসজিদের ইমাম সাহেব যখন ইয়েমেনি শিশুদের ও রোহিঙ্গাদের রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানান তখন উপস্থিত মুসল্লীরা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই আমিন আমিন বলে ফরিয়াদ মঞ্জুরের আকুল আবেদনে সরিক হন। আশ্রয়ের জন্য এমন একটি গ্রাম বেছে নিয়ে কালাম ভুল করেনি।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল মিয়া বাইকের পেছনে বসে পিরুলি গ্রামে যাচ্ছেন। বাইক চালাচ্ছে তার চ্যালা দিলু। একদল জেলে পিরুলি গ্রামে এসেছে- এ সংবাদ পেয়েই চেয়ারম্যানের পিরুলি গ্রামে যাওয়া। অবশ্য পিরুলি গ্রামের কেউ তাকে খবর দেয়নি। একমাত্র পিরুলিগ্রামেই তাকে সেধে সেধে চেয়ারম্যানি করতে হয়, কেউ তাকে কোনো ব্যাপারেই পোছে না। অথচ ইউনিয়নের অন্য গ্রামগুলোতে সুন্নতে খাৎনা হতে বিয়ের অনুষ্ঠান, ক’লখানি থেকে চেহলামের ফাউ খাওয়রার আয়োজনেও তার দাওয়াত থাকে, তাকে সম্মান করে দাওয়াত করে।

তোফাজ্জল যখন পিরুলি গ্রামে পৌছেছেন তখন মোল্লা বাড়িতে ভাত, আলুর ভর্তা আর খেসারির ডাল দিয়ে জেলেদের খাওয়ানো চলছে। আশপাশের বাড়ি থেকে বাসন. কোসন এসেছে। মোল্লা বাড়ির কর্তা চেয়ারম্যান তোফাজ্জলকে দেখে এগিয়ে এসে হাত মেলালেন। আশপাশের বাড়ির যে ক’জন মুরুব্বী বসে ছিলেন তাদের একজন প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিলেন চেয়ারম্যানের দিকে। চেয়ারম্যান চেয়ারে বসে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন-

– এদের জন্য তো একটা কিছু করা উচিত, কি বলেন মুরুব্বী সকল!

মুরুব্বীদের কেউ কোনো জবাব দিলো না। যেনো তারা কথাটা শুনতেই পায়নি। এটা যে নির্ঘাত অপমান তা তোফাজ্জল বোঝে। তোফাজ্জল এটাও বোঝে যে এসব অপমান গায়ে মাখলে চেয়ারম্যানি করা যায় না। তাই সে গলা খাকারি দিয়ে কালামদের দলের দিকে তাকিয়ে বলে-

– পিরুলির মানুষ আশপাশের দশটা গেরামের মানুষের থেকা হাজারগুণ ভালা। এই গেরাম থেকা কেউ কোনোদিন খালি হাতে ফিরা যায়নি। বিপদে পইরা মানুষ এই পিরুলিতেই আসে। আপনেরাও এইখান থেকা ফিরত যাইবেন না, এই গেরামের মানুষ আপনাগো ফেরত যাইতে দিবো না।

প্রশংসা শুনে স্বয়ং দেবতাও তুষ্ঠ হন, পিরুলির সাধারণ মানুষও হাত তালি দেয়। তোফাজ্জল মনে মনে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দিয়ে ভাবে- কেমন কইরা সাপ মারলাম, লাঠিও ভাঙলাম, তা যদি এরা জানতো! চেয়ারম্যানের জন্য চা আসে, সাথে নোনতা বিস্কুট। চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন, ‘বানে ভাসা এসব লোকদের আগামী দুই দিনের খাবার খরচ সে নিজে বহন করবে।’ সবাই হাত তালি দেয়, শুধু মনসুর মোল্লা হাসতে হাসতে বলেন, ‘কি গো চিয়ারম্যান, তুমি দুই দিন খাওয়াইয়া কয় দিনের টাকা এমপি সাবের কাছ থিকা হাপিশ কইরবা!’ মনসুর মোল্লার এ কথাতে হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। চেয়ারম্যানও হাসেন, মন খুলেই হাসেন, তিনি জানেন এসব গায়ে মাখলে চেয়ারম্যানি করা যায়না।

পিরুলি গ্রামে দুইদিনে ভেতর প্রায় তিরিশটি জেলে পরিবারের থাকার জায়গা হয়ে যায়। বিরাণ জায়গা, গৃহস্থ বাড়ির পিছনে বাতিল হওয়া টিনের ঝুপড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায় পরিবারগুলোর। মাথাগোঁজার ঠাই পেয়েই তাদের গ্রাস করে পেটে প্রতিদিনকার খিদার আগুন নেভানোর চিন্তা।

কালাম জানে পিরুলির মানুষ খুব বেশী হলে এক সপ্তাহ তাদের খাবারের ব্যবস্থা করবে। দিনে দিনে তাদের আগ্রহ কমে যাবে। দয়ামায়াও কমবে। তখন তারা চিন্তা করবে কিভাবে এদের তাড়ানো যায়। মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে আসে একথা সত্য, কিন্তু নিত্যদিন যখন মানুষ একই বিপদ দেখে তখন তাকে আর বিপদ মনে করেনা। পৃথিবী সর্বংসহা, সবকিছু সয়, পৃথিবীর থেকেও সর্বংসহা মানুষ। মানুষ সব কিছু সয়, আবার মানুষেরই সবকিছু সয়।

৬.
পিরুলি গ্রামের মনসুর মোল্লার ছেলে হারুন মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বন্যায় সর্বস্ব হারিয়ে একদল জেলে তাদের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে- এ সংবাদ শুনে সে রোমাঞ্চ অনুভব করে। তার ভেতরের শিক্ষিত মনন শহুরে মানবিকতায় দুলে ওঠে, সে মানবতার ডাকে সাড়া দিতে বন্ধুদের প্রতি আহ্বান জানায়। মানবতার ডাকে সাড়া দিতে আকুল আবেদন জানিয়ে ফেসবুকে ইভেন্ট খোলে।

বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই মানবিক। এদেশের দরিদ্রজনও ভিক্ষুককে দান করেন। পেশাগত প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্বেও মানবিক প্রয়োজনে এক ভিক্ষুকও আরেক ভিক্ষুকের পাশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মানুষ শুধু এটুকু নিশ্চিত হতে চায় যে, দানের টাকাটা যেনো সঠিক জায়গায় ব্যয় হয়, ফ’র্তিতে নষ্ট না হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের প্রতি এখনও মানুষ আস্থা রাখে, তাদের বিশ্বাস করে। হারুন মোল্লার ডাকে সাড়া দিলেন অনেকেই।

হারুন মোল্লা ও তার বন্ধুরা আস্থা এবং বিশ্বাসের ষোলো আনা মূল্য দিয়েই ত্রাণ পৌছে দিলেন পিরুলি গ্রামে আশ্রিতদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার আলো পেয়েই সে আবিষ্কার করলো এ জেলে পরিবারগুলোর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক বন্ধন, ঐক্যের আদর্শ, প্রতিক’লতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার চেতনা। অসাম্প্রদায়িকতা, আর্দশ ও চেতনা- এই তিনটি শব্দ গত একদশকে খুবই আবেগ তাড়িত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই- এই শব্দ সমষ্টিকে বাম রাজনীতিকরা রীতিমত পবিত্র বাণীতে রূপান্তরিত করেছেন। হারুন মোল্লার আবেগের সাথে অনেকের আবেগ মিলেই জেলে পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার ক্ষেত্র তৈরী হোলো।

পিরুলি গ্রামে আশ্রিত অসাম্প্রদায়িকতা, আদর্শ ও ঐক্যের চেতনায় বলিয়ান এক জেলে সমাজের ছবি, ভিডিও ভেসে বেড়াতে লাগলো ফেসবুকে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়াকেও আকর্ষণ করলো এইসব বিবরণ, ছবি আর ভিডিও। সবার আগে একটি টিভি চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিনিধি ছুটলেন পিরুলিতে। প্রায় প্রতিটি হিন্দি ছবিতেই যেমন আইটেম সং থাকে, আজকাল প্রতিটি সংবাদকেই আইটেম নিউজ করে তুলতে হয়। এতে লাভ দুটো- সংবাদ শুধু সংবাদ থাকেনা, বিনোদনও হয়ে ওঠে, আবার সংবাদ ভাইরাল হলে ওই সাংবাদিকও সেলেব্রেটি হয়ে যান। ফলে, সংবাদকে আইটেম করে তুলতে যা যা দরকার তার কোনোটাতেই ছাড় দেওয়ার বোকামি করা হয় না।

জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলের স্থানীয় সাংবাদিক যখন জেলে সর্দার কালামের বক্তব্য ভিডিও করছিলেন, তার পেছনেই ছলো ছলো চোখে দাঁড়িয়েছিলো খগেন। শুধু সে নয়, জেলে পাড়ার সকলেই দাঁড়িয়ে আছে সাংবাদিকের ক্যামেরার মুখোমুখি। খগেনের ছলোছলো চোখের কারণ বলাইয়ের পনেরো বছর বয়সী মেয়ে কমলা। চটে ঘেরা গোছল খানায় বলাইয়ের মেয়ে গোছল করছিলো। চটের এক ফোকর দিয়ে খগেন তা দেখছিলো। কমলার অনাবৃত বুকের দিকে এতোটা মগ্ন হয়ে তাকিয়েছিলো যে, চোখে কমলার গুতো খাওয়ার আগে ঘোর ভাঙেনি। কমলা গোছলখানা থেকে বেরিয়ে চেঁচামেচি শুরু করার আগেই সে এসে দাঁড়িয়েছে কালামের পেছনে। এ ঘটনা সাংবাদিক জানেন না, তার জানারও কথা নয়। খগেনের ছলোছলো চোখ তাকে আকৃষ্ট করলো।

খগেনকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে সাংবাদিক দুটো প্রশ্ন করলেন। খগেন কোনো উত্তর দিতে পারলো না। তার মাথার ভেতর কমলার বুক, গুতো এবং পরবর্তী বদনাম, বিচার ও সাস্তি একসাথে জট পাকাচ্ছিলো। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। সাংবাদিক এবার নিজেই উদ্যোগি হয়ে খগেনকে প্রশ্নের উত্তর শিখিয়ে দিলেন, তিন চারবার মহড়াও দিলেন। যাত্রা পালায় বিবেকের পার্ট করা খগেন এবার বাজিমাৎ করে দিলো। নিজেদের দুদর্শার কথা বলতে গিয়ে সে হুহু করে কেঁদে দিলো। শেষ প্রশ্নের উত্তরের শেষ না করেই সে কান্নায় ভেঙে পরলো। সাংবাদিক মনে মনে হেসে উঠলেন, এই তো চেয়েছিলেন তিনি, এমন একটা ক্লিপ মানেই সুপারহিট, বাম্পার হিট।

টেলিভিশন চ্যানেলটি কালামের পরিবর্তে খগেনের কান্নাজড়িত ভিডিওটি প্রচার করলো। এই ভিডিও করতে কতটা কষ্ট সয়েছেন এবং করেছেন তা জানান দিলেন সাংবাদিক। ওই ক্লিপ প্রচার হতেই খগনের কান্না সংক্রমিত করলো মানুষকে। আরও কিছু টিভি চ্যানেল ছুটে গেলো পিরুলিতে, তাদের উদ্দেশ্য বন্যাক্রান্ত জেলে পরিবারগুলো নয়, তাদের উদ্দেশ্য খগেনকে দিয়ে আরও আবেগ তাড়িত ভিডিও নির্মাণ। মনে মনে ক্রোধ পুষে রাখলেও কালাম জানে খগেনের কান্নাই এখন এই জেলে পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করতে পারে। তাই টেলিভিশন চ্যানেল বা পত্রিকা এলে কালাম নিজেই খগেনকে এগিয়ে দেয়।

খগেন নিজেও বুঝতে পারে সে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এখন দলের সবাই তাকে সমিহ করে। পিরুলি গ্রামের মানুষও তাকে বেশ দাম দেয়। তার থেকে বড় কথা কমলা এখন আর চোখ গুতো দেয়না, চোখে চোখে ইশারা দেয়। চটঘেরা গোছলখানায় ঢোকার আগে খগেনের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, গুণগুণ করে গানও গায়। এসব যে বলাইয়ের চোখে পড়েনা, তেমন নয়। বলাইও কেমন প্রশ্রয় দেয়, খগেনকে ডেকে পিরুলি বাজারে দুবার রং চা আর মিঠা বিস্কুটও খাইয়েছে।

৭.
আশ্বিন মাসের মাঝামাঝিতে পানি শুকায়। পিরুলি ছেড়ে চর খাউজরানিতে ফিরে আসে জেলে পরিবারগুলো। খগেনের কান্না শুধু ত্রাণই যোগায়নি, এমপি ও ডিসি সাহেবের উদ্যোগে জেলেদের জন্য নতুন ঘর তোলার ব্যবস্থা হয়েছে। হারুন মোল্লাসহ আরও দুজন এক্টিভিস্টের প্রচারণায় অর্জিত অর্থের সাথে এসপি সাহেবের দান মিলে জেলেদের জন্য পাঁচটি নতুন নৌকা বানানো গেছে। ত্রাণের সময় যে খাবার এসেছে তা দিয়ে আরও দু’মাস আরমেই চলবে, যে কাপড় আছে তাতে একবছর নতুন কাপড় না হলেও সমস্যা নেই।

এমপি, ডিসি, এসপি আর শহুরে তরুণদের পদচারণায় মুখর খাউজরানিতে বকেয়া সুদ ও দাদনের মহাজনরে নীরব রয়েছেন। পরিস্থিতি ঠা-া হয়ে এলেই তারা বেরিয়ে আসবেন, সুদে আসলে সব বকেয় কানায় কানায় আদায় করে ছাড়বেন। তখন খগেনের কান্না কোনো কাজেই আসবে না। তারা সরকারি ব্যাংকের মত বেওকুফ নন, তারা জানেন ও মানেন সুদ শাস্ত্রে মওকুফ বলে কোনো শব্দ নেই।

কালামের মনেও শান্তি নেই। কারণ, কালামকে সরদার মানতে অস্বীকার করছেনা কেউ, তবে খগেনকেও সরদার মানছে অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে কখনও পড়েনি কালাম। এছাড়া, সুদের মহাজনরা চড়াও হলে সব কালামকেই সামলাতে হবে। মহাজনরা কালামের জিম্মাতেই সবাইকে সুদে টাকা দিয়েছিলেন, খগেনের জিম্মাতে নয়। এছাড়া নজু ডাকাতের উদ্দেশ্যও খুব ভালো নয়। খগেনের মত সেও কমলার চারপাশে ছোক ছোক করে। কমলার বয়স কম, ও জানেনা আগুন নিয়ে খেলা কাকে বলে, আগুন নেভানোর ব্যাকরণ না জেনেই ও দুজনকেই ইশারা দেয়। কিছু একটা ঘটে গেলে তার দায়দায়িত্ব সবাই তখন কালামকেই দিবে, কালামকেই নিতে হবে। এদিকে হারুন মোল্লাও জেলেদের নেতা হবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, সে জানেনা দূর থেকে জেলেদের দেখা আর জেলেদের নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।

খাউজরানির জেলে পাড়ায় আনন্দের হিল্লোলের ভেতর খগেন কমলাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। এবার শীতে সে আর যাত্রাপালায় যাবেনা, কমলাকে রাতভর গান শোনাবে। হারুন মোল্লা মনে মনে ভাবে তার জন্যই জেলে পাড়ায় এমন আনন্দের হুল্লোর, সে এই জেলেদের সুদিন এনে দিবে- সে হবে জেলেদের নেতা। এই আনন্দের হুল্লোড়ে নজু ডাকাতের দুই বউ দিয়ে আর পোষে না, তার মনে আশা একদিন যদি কমলাকে মওকা মত সে পায়। বলাই দিনক্ষণ দেখে কমলাকে খগেনের গলায় বেঁধে দিতে চায়, বলাই জানে খগেনই হবে সর্দার। আর কমলা, সে খগেন আর নজু ডাকাতকে প্রশ্রয় দেয় ঠিকই, হারুন মোল্লার দিকেও তার তীক্ষ্ম কৌতূহল! ওই ছেলে শিক্ষিত বলেই কি এতো দেমাগ! অবিবাহিত মোয়াজ্জিন খাউজরানির চেয়ারম্যানের কাছে আবদার করেছে একটা মসজিদঘর করে দিতে, আল্লাহ যখন মুখ তুলে চেয়েছেন তখন তার কাছে পানা চাওয়া ও আখেরাতের পুঞ্জি ভরতে নামাজ আদায় ও দোয়া খায়েরের জন্য মসজিদের কোনো বিকল্প নেই।

একমাত্র কালামের মনেই ভয়ের স্রােত বয়ে যায়। সে জানে কোনো কিছুই ঠিকমত চলছে না, সংঘাত অনিবার্য।

৮.
খগনের চোখ আকাশের অসীম শূণ্যতায় স্থির। কার্তিক মাসের সকালে সে শুয়ে আছে মাঠে, সবুজ কচি ঘাসের বিছানায়। আধ মাইল দূরে ব্রহ্মপুত্র। বাতাসে ভেসে আসছে ঢেউয়ের ঘ্রাণ। খগেনের শীত শীত করছে। দুই মাস আগেও এখানে থৈ থৈ পানি ছিলো, খগেন সাঁতরে পার হয়েছিলো এ জায়গাটুকু। খুব ছেলেবেলায়, যখন বাবা বেঁচে ছিলেন তখন একবার কোনো এক মেলায় খগেন গিয়েছিলো এ পথ ধরে। তার মাথায় সরষা তেল দিয়ে মা চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন, কপালে গোল করে কাজলের টিপ দিয়েছিলেন যেনো কারো নজর না লাগে। বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এখানে বসে পড়েছিলো সে, বাবা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বাবার মাথায় সস্তা নারকেল তেল আর মাছের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হওয়া গন্ধটা বহুদিন পর অনুভব করে সে।

এখান থেকে দেড় ঘণ্টা হেটে গেলে খাউজরানি, খগেনের গ্রাম। ওখানে নতুন টিনের ঘরে রোদ চনমনায়। এক একটা রাতে কমলা এসে টুপ করে ঢুকে পরে ঘরে। তারপর দুজন ফিসফিসিয়ে কথা বলে, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে নীরব বসে থাকে। এর বেশী কিছু করার সাহস কমলারও নেই, খগেনেরও নেই। গতকাল রাতের কথা ভাবতে ভাবতেই খগেন বাম হাতে মাটি আকরে ধরে। এ মাটি কেমন কোমল, যেনো খোসা ছাড়ানো কমলা বুক। ঘাসের ওপর খুব আলতো করে বাম হাত বোলায় খগেন। খগেনের ডান হাত পরে আছে কিছুটা দূরে। পায়ের রগ কাটার পরও ও পা নাড়তে পারছে। কিছুক্ষণ আগেও খুব ব্যাথা ছিলো, এখন ব্যাথা নেই।

খগেনের কেমন ঘোর ঘোর লাগছে। খুব তেষ্টা পাচ্ছে, কিন্তু পানি খেতে ইচ্ছে করছে না। গোঙানিও আসছে না। বুক ভেঙে কান্না আসছে, পানি চোখ গড়িয়ে গাল ছুঁয়েছে- এ অশ্রু যাত্রাপালার বিবেকের নয়, খগেনের। যে খগেন কালামের মত নেতা বা নজুর প্রেমিকার ভিলেন হতে চায়নি, যে খগেন হারুন মোল্লার প্রতিদ্বন্দ্বি হতে চায়নি, যে খগেন শুধুই খগেন, যার শরীরে মাছের ঘ্রান আর স্রোতের জলছাপ এ অশ্রু ওই খগেনের।

যারা বড় লেখার জন্য তাগাদা দিতেন, তাদের জন্য বড় লেখার এই অপচেষ্টা।

কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া?

কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া?

১.
জোষ্ঠের কাঠফাটা রোদ। হাওয়া নেই। পুরোন শহর। চারদিকের ঘিঞ্জি পাড়া। মাঝে বিশাল বেঢপ মাঠ। বটের ছায়ায় গামছা পেতে শুয়ে আছেন বৃদ্ধ লেইসফিতাওলা। খেলনা একতারের বেহালায় সুর তুলছেন বেহালাওলা-
“মন ডোলে মেরা তন ডোলে,
মেরে দিল কা গায়া কারার রে;
কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া…!!”

প্রতিদিন এই মাঠ পেরিয়ে, বট পেরিয়ে ইশকুলে যায় একলা বালক। ঠিক একা নয়, সাথে থাকে ক্লাশ এইটের ছ’ পিরিয়ডের বইখাতায় পূর্ণ ব্যাগ।

২.
চারদিকে থৈ থৈ রোদ। শুধু বটতলায় ছায়ার সংসার। শান্ত নরম। বালকের স্যান্ডোগেঞ্জি ঘামে ভিজে জবজবে। ভাতের মাড় ও নীল দেয়া শাদা শার্ট শরীরে লেপ্টে আছে। বটের নেমে আসা ঝুড়ি ফিসফিসিয়ে বলে-
: বাবু, একটু দাঁড়াও, ছায়ায় জিরোও-
: আমার যে ইশকুল আছে, হেটে হেটে যেতে হবে আরও পনেরো মিনিট-
: পাঁচ মিনিট থাকো, তারপর পা চালিয়ে যেও, ঘণ্টা পরার আগেই পৌছে যাবে। দুটো কথা জিজ্ঞেস করি?
: বলো- কি কথা তোমার?
: এই যে বেহালাওয়ালা বাজাচ্ছে কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া?– তুমি কি জানো বাঁশীর সুর বাজায় কে?
: বাহ রে! আমি জানবো কেমন করে!
: তোমার ইতিহাস, বিজ্ঞান, পাটিগণিত কোনো বইয়ে লেখা নেই!–কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়ার উত্তর।
: হাহাহাহা বইয়ে এসব থাকে না কি! বইয়ে স্যার নিউটন আছেন, ঐকিক নিয়ম আছে, সম্রাট বাবর ও রবার্ট ক্লাইভ আছেন, রবীন্দ্রনাথ নজরুল বন্দে আলী মিঞা আছেন, এ প্লাস বি হোল স্কয়ার আছে- কিন্তু কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়ার উত্তর তো নেই!
: উত্তর নেই! থাকাটা খুব দরকার ছিলো। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বইয়ে লেখা আছে —- বাজায়ে বাঁশুরিয়া।”
: সে তো আমি জানিনা-
: জেনে আমায় জানিও, এখন ইশকুলে যাও-

বালক ইশকুলের পথে দ্রুত পা চালায়। গলার কাছে তখনও অক্ষত ছোপ ছোপ কিছু শাদা পাউডার- মায়ের স্নেহের টেরাকোটা। ঘামে ভিজেও না মুছে যাওয়া কারুকাজ।

৩.
চার তলার লম্বা করিডোর।শেষ মাথায় বিশাল ক্লাশরুম। থার্ড পিরিয়ড- ইংরেজী ব্যাকরণ ক্লাশ। রিয়াজউদ্দীন স্যার ভয়েস চেইঞ্জ- পড়াতে পড়াতে জানালা দিয়ে আকাশ দেখেন। খা খা নীলাকাশ, মেঘহীন। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, বিড়বিড় করেন- “জীবন একটা প্রেজেন্ট পারফেক্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স। পারফেক্টনেসের জন্য সবাই দৌড়ায় আর দৌড়ায়। এদিকে ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে ঘষে দিন ফুরিয়ে যায় রে আমার দিন ফুরিয়ে যায়…।” টিফিনের ঘণ্টা শোনার অপেক্ষায় ক্লাশ এইট বোঝেনা কিছু। শুধু বালকের মাথায় প্রশ্ন ঘোরে – কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া!!

৪.
টিফিন পিরিয়ড। দুই টাকায় কেনা যায় একটা ঢাউস বাটারবান কিংবা ক্রিমরোল। অথবা এক পিস স্লিম কেক। শাদা বা কমলা রংয়ের নারকোলি মালাই আইসক্রীম আর দপ্তরী চাচার ঝালমুড়ি পাওয়া যায় এক টাকায়। বরফ কুচি তারা, মাছ, ছাতার সাচায় চেপে তাতে বিভিন্ন রং আর চিনির সিরাপ ঢেলে বানানো আইসক্রীম দুটাকা। বালককে প্রলোভন ডাকে, টিফিন পিরিয়ডের অভ্যস্ত ক্ষিধে ডাকে। বালক নির্বিকার- টিফিনের বরাদ্ধ দুটাকা কিছুতেই খরচ করা যাবেনা। তিন দিন টিফিন না খেলেই পাঁচ টাকায় একতারের বেহালা কেনা যাবে। খা খা রোদে পথে পথে বেহালা বাজিয়ে খুঁজবে- কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া!

৫.
একতারের বেহালা পোষ মানে নি। বহুদিন বালক সুর তোলার কসরত করেছে। সুর ওঠেনি- বিভতস ক্রন্দন ছাড়া। ভেঙে যাবার আগে একতারের বেহালা মাঝরাতে হাই তোলে-
: মনা, তোমার জন্য ত্রিকোনমিতি, বেহালা নয়।
: ত্রিকোনমিতির সূত্র কি জানে বাঁশী বাজায় কে?
: না, ত্রিকোণমিতি এসব অর্থহীন প্রশ্নের উওর জানে না। সব কাজের জিনিস জানে।
: তুমি এমন করে বলছো কেনো?
: মনা, পড়ালেখায় মন দাও। বুড়ো বট সেই কবে থেকে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে- পাচ্ছে না। তুমিও পাবেনা- শুধু কষ্ট পাওয়াই সার।

বালকের হাত হতে বেহালা মাটিতে গড়ায়। চৌচির হবার আগে অস্ফুট স্বরে বলে- “তবে চললাম মনসুখিয়ায়, বিদায়।”

বিমূঢ় বালকের চোখে চিকচিক করে ওঠে অশ্রু- জানলা গলে ল্যাম্পপোস্টের বাতির ছিটকে আসা একটুকরো মিহিন আলো অশ্রুতে থমকে থাকে।

৬.
বালক এখন মাঝবয়সী। দিনমজুর। কলম পিষে কেরানীগিরির। এক একটা দুপুরে বুড়ো বট ডাকে, প্রশ্ন করে-
: জেনেছিলে কোন বইয়ে উত্তর আছে?
: বই-তে উত্তর নেই, অভ্রজোনাকের পাখায় আছে।
: অভ্রজোনাক কোথায়! ডাকো তাকে, দুটো কথা কই..
: অভ্রজোনাক আছে মনসুখিয়ায়। সে তো আসেনা। তার কাছেই যেতে হয়–
: তুমি গিয়েছিলে? জেনেছো উত্তর?
: না, যাইনি। সবগুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষায় আছি-
: কার অপেক্ষা? কিসের অপেক্ষা?
: অভ্রজোনাকের ডাকের অপেক্ষায় আছি। সে ডাক পাঠালেই ছুটে যাবো মনসুখিয়ায়…
: সে কি ডাকে না তোমায়?
: মনে পরলে ঠিক ঠিক ডাকবে- দেখে নিও। ততদিন অপেক্ষাযাপন-

বুড়ো বট রিয়াজউদ্দীন স্যারের মত দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বিড়বিড়িয়ে বলে- দিন ফুরিয়ে যায় রে আমার দিন ফুরিয়ে যায়! বটের দীর্ঘশ্বাস মাঝবয়সী বালকের মাথা ছুঁয়ে লিলুয়া বাতাসে ভেসে ভেসে মনসুখিয়ার দিকে ধায়, বিষ্মিত কৌতূহল নিয়ে- “অভ্রজোনাক, কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া? তুমি!”

_____________________
#মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।