আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

অণুগল্প : মায়াপোলাও

মায়াপোলাও

আড়াই মাস ধরে মিজানের খুব পোলাও খেতে ইচ্ছে করছে। অর্থাভাবে খাওয়া হচ্ছেনা। ইচ্ছে করলে হোটেলে খেয়ে নিতে পারে। কিন্তু হোটেলে বসলে ছেলেমেয়ে দুটোর কথা মনে পরে, বৃদ্ধ মা আর শরীফার কথা মনে পরে।

টানাটানির সংসার। পাঁচজনের জন্য দুইবেলা পোলাও রান্না করতে হাজার টাকা খরচ। একবেলা তো আর খাওয়া যাবেনা।

মাসের প্রথম সপ্তাহ। বিষ্যুদবার রাতে আলুভর্তা ও ডাল দিয়ে ভাত খেতে খেতে শরীফাকে বলে-
: কাইল পোলাও রাইন্দো, সকালে মুরগী আর পোলায়ের চাউল আইনা দিমু।
: এতদিন ধইরা জি আকলাইতাছে, হোটেলের পোলাও খাইলেই পারতা। খামাখা বাড়তি খরচ।
: তোমাগো ছাড়া কিছু খাই?হোটেলে খাইলে গলা দিয়া পোলাও নামবো!
: এই অভ্যাসটাই ভালা লাগেনা, আমগো থুইয়া একা দাওয়াত পানিতেও যাওনা।
: বাদ দাও, এক কেজি খাসির গোশতও আনুম। ঝাল কইরা আলু দিয়া রাইন্দো।
: আইচ্ছা।
: না না ঝাল দিও না, তোতন খোকন জি ভইরা খাইতে পারবো না।

শুক্রবার ভোর। বাড়ি ওয়ালার ডাকে ঘুম ভাঙে। বাড়িওয়ালা বলেন, ‘নাতির জন্মদিন। দুপুরে সামান্য খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করছি। তোমগো দাওয়াত। না করা পারবা না।” মিজান হাসি মুখে দাওয়াত কবুল করে।

মিজান জুম্মার নামাজে যাবার আগে শরীফার হাতে একহাজার টাকা দেয়। বাড়িওয়ালার দাওয়াতের সালামি। ছেলেমেয়ে আর মাকে নিয়ে দাওয়াতে যেতে বলে। শরীফা বিষণ্ন কণ্ঠে জানতে চায়-
: তুমি যাইবা না?
: না, তুমিই কও এক হাজার টাকা সালামি দিয়া কি পাঁচটা মানুষ খাওন যায়!
: তুমি না গেলে আমিও যামু না।
: শরীফা, বাড়িওয়ালা সব ভাড়াইটার ভাড়া বাড়াইছে। আমগো বাড়ায় নাই। আমগো ভালা পায়। না যাওনটা কি ঠিক অইবো!
: তুমি কি খাইবা?
: আমি একশো টাকা দিয়া হোটেলে তেহারী খায়া নিমু। দাওয়াতে গেলে তো পাঁচ শো দিতে অইবো।

মিজান জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদে বসে ভিড় কমার অপেক্ষা করে। বহুদিন পরে আজ বাচ্চারা, মা ও শরীফা পোলাও খাবে। পোলাওয়ের সাথে টিকা কাবাব, রুই মাছ ভাজা, মুরগির রোষ্ট, মাংসের রেজালা, বোরহানি আর জর্দা ও আছে। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করে।

সে মসজিদ থেকে বের হয়ে টং দোকানে বসে। আয়েশ করে চা’য়ে ডুবিয়ে বানরুটি খেতে থাকে। মাথার ভিতরে পোলাও খাবার ইচ্ছেটা আবার জেগে ওঠে। তার মাথার ভিতরে যেন সিনেমা চলছে- একটা শীতল পাটিতে প্লেটে প্লেটে সাজানো হালকা গরম সাদা পোলাও, মুরগি ভাজা, আলু দিয়ে রান্না করা মাংসের রেজালা, পেয়াজ কুচি, রসে জবজবে লেবু, কলাপাতা রঙ কাঁচা মরিচ- সে, তোতন-খোকন, মা, আর শরীফা মিলে গোল হয়ে বসে খাচ্ছে। নিজের অজান্তেই তার চোখ দুটো ভিজে আসে। শুক্রবারের ছুটির দুপুরে মিজানের ভেজা চোখ আরো ভিজিয়ে দিতে টং দোকানদারের চায়না মোবাইল সেটে এন্ড্রু কিশোর গেয়ে চলেন-
পূর্ণিমাতে ভাইসা গেছে নীল দরিয়া
সোনার পিনিশ বানাইছিলা যতন করিয়া
চেলচেলাইয়া চলে পিনিশ, ডুইবা গেলেই ভুস…

#অনুগল্প
#গ্রন্থ: লংকা কিন্তু জ্বলছে না/আবু সাঈদ আহমেদ

ডানকানা মাছ

ঘুমিয়ে যাও। হারিয়ে যাও স্বপ্নে। তোমার মাটিকাটা মজুরী রোজ ৩০০টাকা। স্বপ্নে ভাত খাও। চালের কেজি ৩২টাকা, ডালের ৮২, পামওয়েল৬০, ফিনফিনে লবন সস্তা ভীষণ। বিড়িটা জেগে জেগেই ফুঁকো।

তিন ছেলে ইশকুলে যায় না। রেল লাইনে মারবেল খেলে। মাল টানে। এটা সেটা টোকায়। আধটানা সিগারেটের ফিল্টারে টান দেয়। খুকখুক কাশে। তাদের এড়িয়ে রাজপুত্তুর আর বার্বি ডলের দল ইশকুলে যায়।

বউ অন্য ভাতারের সাথে ভেগেছে। নতুন ভাতার রিকশা চালায়, ছয়শো টাকা কামায়। মোটা চালের ভাত নরম তেলেপিয়া আর বেগুনের ঝোলে মাখায়। প্রতি গ্রাসে ফেলে আসা সন্তানদের কথা মনে পড়ে কি পড়ে না!

মাটিকাটা শ্রমিক, তুমি ঘুমিয়ে যাও। স্বপ্নে হারিয়ে যাও। ছেলেবেলার পুকুরে ডানকানা মাছ ধরো। এক দুপুরে সারাজীবনের জন্য ডানকানা মাছ হয়ে যাও। তারপর ভেসে ভেসে বালি খাও, মাটি খাও, শ্যাওলা খাও।

অণুগল্প : দাফন

হুনছো ঘটনা! আমি হালায় পুরা তব্দা খায়া গেছি। আফজলের ফার্মাসীতে আড্ডা দিতাছি। এশার জামাত পইড়া মন্নাফ হাজী আইলো। আড্ডা দিলো। হাকিমপুরী জর্দা দিয়া পান খিলাইলো। ফজরের ওয়াক্তে জানলাম মইরা গেছে।

পঞ্চাতের গোরস্তান। আমি, পান্নু, সাপু, আলম, তাইজু কব্বর খুদতাছি। তারাতারি কব্বর না দিলে মুর্দার আজাব অয়। জোহরের পরে দাফন।
১২টার মৈদ্যে কব্বর খুদা শ্যাষ। কব্বর থেকা য্যান রোশনাই বাইড়াইতাছে। মন্নাফ হাজীর আমল বালা।

আলি বেপারী গোরস্তানেই চা আর বাখরখানি পাঠাইছে। খাইতাছি আর বাতচিত করতাছি। আচমকা পান্নু হালায় কয় “চাচ্চা, জীবনে এত্ত সোন্দর কব্বর খুদি নাই। একটু হুয়া দেহি কিমুন লাগে! নসীবে আল্লাহ কিমুন কব্বর রাখছে কে জানে!! ”

পান্নু কব্বরে হুয়া ঘুম দিতাছে। তাইজু কইলো, “মাম্মা, কব্বরে হুইয়া পোংটামি করিছনা, উইঠা আয়।” মাগার পান্নু আর উইঠা আইলোনা।

আফসোস, মরনের আগে পান্নু হালায় জাইনা যাইতে পারলোনা সোন্দর কব্বরটা অর নসীবে আছিলো, হাজী সাবের নসীবে না।

#অণুগল্প

সাঈদ বাঙাল ভনে শুনে মূর্খ জন… বাংলা নববর্ষ প্রসঙ্গে…

প্রথমত: পয়লা বৈশাখ বাঙালের সার্বজনীন উৎসব ছিলো না। পয়লা বৈশাখ ছিলো বাঙালের দায়মুক্তির প্রহসন। রাজা, জমিদারদের খাজনা পরিশোধ আর মওকুফের মাধ্যমে নতুন দাসত্বের সূচনার জন্য পয়লা বৈশাখের জন্ম। পয়লা বৈশাখকে পয়দা করার ক্ষেত্রে বাঙালের ঐতিহ্য প্রাধান্য পায়নি, প্রাধান্য পেয়েছে সম্রাট আকবরের খাজনা আদায়ের সুযোগসুবিধার হিসাব নিকাশ।

দ্বিতীয়ত: বাঙালি বইলা যারা নিজেদের খুব গর্বিত ভাবেন, যারা নিজেদের আর্য রক্তের ধারক-বাহক হিসাবে আভিজাত্য প্রকাশ করেন তারা প্রকৃতপক্ষে সুবিধাবাদী দালাল। কারন ভূমিপুত্র বাঙাল থেকে বিশেষ হতে যাওয়া, বিশেষ হয়ে ওঠার কালচারেই বাঙালি গোষ্ঠীর জন্ম। বাঙাল পরিচয়ে তারা হীনমন্যতায় ভুগতো। এই কালচাঁড়াল বাঙালরা মোগল আমলে নায়েব হতে ছুটেছে আর ইংরেজ আমলে বাবু হতে চেষ্টার কসুর করেনি। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে আর নিজেদের পিঠে শিক্ষিত লেবেল এটে এরাই ভূমিপুত্র বাঙালদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছে এবং আসছে। এই বাঙালিরাই লুঙ্গি আর ধূতিকে অসভ্য পোশাকে পরিণত করেছে, আবার প্যান্টুলুন আর চোস্ত পায়জামা-শেরোয়ানিকে সভ্য পোশাকের মর্যাদা দিয়েছে। গিলে করা পাঞ্জাবি ছাড়া আজও তথাকথিত বাঙালি কালচাঁড়াল বাবুর চলেই না।

তৃতীয়ত: বাঙালি নয়, একমাত্র বাঙালরা এই ভূখণ্ডের প্রকৃত ভূমিপুত্র। বাঙালের যা কিছু অর্জন এমন কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত তাতে ভাগ বসিয়েছে এই ভূইফোঁড় বাঙালি গোষ্ঠি। বঙ্গবন্ধু ৭মার্চ যে ভাষণ দিয়েছিলেন সে ভাষণের শব্দ চয়ন আর ভাষা প্রমিত ছিলোনা, ছিলো নিপাট বাঙালের ভাষা। বাঙালই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলো, আজও তারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অবহেলিত, অপাঙ্কতেয়, রাজনীতির মাখন মালাই খাবার জন্য বাঙালি বাবুদের মত কখনো হামলে পরেন নাই।

চতুর্থত: পয়লা বৈশাখ বাঙালের দায়মুক্তির প্রহসন হিসেবে শুরু হলেও এখন তা বাংলাদেশের বাঙালের একমাত্র সার্বজনীন সামাজিক ও জাতীয় উৎসব। বাঙাল এই উৎসবকে নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে, নিজের আয়ত্তে নিয়েছে। কিন্তু বাঙালের এই সার্বজনীন উৎসবকে কালচাঁড়াল বাঙালিরা নিজেদের দখলে নিতে চেষ্টা করবে না, তা কি হয়! তাই তারা বাঙালের নিত্যদিনের পান্তাকে পরিণত করেছে উৎসবের খাবারে, বাঙাল যে মৌসুমে সচেতনভাবেই ইলিশ পরিহার করে তখন ঐতিহ্যের তকমা এটে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশের মিশেল দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে তথাকথিত ঐতিহ্য। আগে অবহেলিত বাঙালরা বিস্মিত হতো- ‘বাবুরা দেখি পান্তা খায়।’ আর এখন খলবলিয়ে হাসে আর বলে- ‘ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা উচিত।’

পঞ্চমত: বাঙালের ঐতিহ্য হলো শুভ কিছু পালনে মিষ্টি খাওয়া ও খাওয়ানো। নববর্ষে মিষ্টি আর দইয়ের সাথে চিড়া, মুড়ি, মুড়কি, খই, বাতাসা, ওখরা, তিলের খাজা, কদমা, পিঠি খাওয়া এবং খাওয়ানো বাঙালের ঐতিহ্য। এছাড়া যে কোনো উৎসব উপলক্ষ্যে ভালো খাবার খাওয়াও বাঙালের চরিত্র। লোকগান ও যাত্রাপালাও বাঙালের একান্ত ঐতিহ্য।

ষষ্টত: কেউ যদি ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে আর বাঙালের কালচারের দোহাই দিয়ে পান্তা-ইলিশের কথা, বটতলায় রবীন্দ্রসংগীত আর কেলোয়াতি গান শুনে বাঙালি কালচার নবায়নের তথাকথিত হাজার বছরের তত্বকথা শোনায়- তাদের বোঝান সেটা বাঙালির কালচার হতে পারে, এই দেশের জনসংখ্যার ৯৯.৯৯% বাঙালের কালচার নয়। তারপরেও যদি তর্ক করে, বাঙালের ঐতিহ্যবাহী প্যাদানি দিতে ভুলবেন না।

সপ্তমত: নববর্ষ পালন করুন নিজের মত। শিকড়ে ফিরতে হলে সঠিক ঐতিহ্যে ফিরুন, ভুল ঐতিহ্যে নয়। নতুন প্রজন্মকে দেশী খাবার, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আপনার- আমার সকলের।

পুনশ্চ:
রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ, কেলোয়াতি গানও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষার নামে সাত সকালে গাছের তলায় রবীন্দ্রনাথ গাওয়া আর কেলোয়াতি গান গাওয়াকে বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা ‘শিক্ষিত না-বাবু না-বাঙাল গোষ্ঠী’র হুতাশনের বেশী কিছু নয়।

পূনর্প্রকাশ

খবিশ যিশু

খবিশ যিশু

মেজাজ চরম খারাপ। টানা ১৫ ঘণ্টার কাজ সাইরা ফিরতাছি। যখন হাইওয়েতে নামলাম মোবাইলের ঘড়িতে রাইত ১২:৪০ বাইজা গেছে। আরও একঘণ্টার পথ যাইতে হইবো। হাইওয়ে টু জেলা শহরের লিংক রোডে একটাই বাস। হেল্পার চিল্লাইতাছে লাস টিপ… লাস টিপ… (লাস্ট ট্রিপ)। বাস আছে দেইখা মেজাজ কিছুটা ঠাণ্ডা হইলো। কিন্তু সিগারেটে দুইটা টান দিয়া বাসে উইঠা ড্রাইভারের চেহারা দেইখা মিজাজ আবার চরমতম খারাপ হয়া গেলো।

এই ষাটোর্ধ ড্রাইভারের চেহারা চিনি। যারা আমার মত নিয়মিত বেশী রাইতে ফিরেন তারা বাধ্য না হইলে তার বাসে উঠেন না। কারন ড্রাইভার সাহেব নির্লিপ্ত খবিশ প্রকৃতির। মাঝ রাইতেও সিট পূর্ণ হইবার পরে রড পূর্ণ হইবার অপেক্ষায় বইসা থাকেন। সিটের যাত্রীরা বাস না ছাড়ার কারনে গালাগালি করলে বা নাইমা গেলেও বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নাই। রড পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বাস ছাড়বেন না।

৫৬সিটের বাস অর্ধেকও পূর্ণ হয়নি, অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি সিট পূর্ণ হওনের জন্য আরও বিশ মিনিট আর রড পূর্ণ হওনের জন্য আরও একঘণ্টা লাগবো। এক্কেবারে ‘সাগর যেদিকে চায় অভাগা শুকায়া যায়’ পরিস্থিতি।

মেজাজ খারাপ কমানির জন্য বিভিন্নজনের বিভিন্ন তরিকা আছে। আমার তরিকাটা একটু আজীব কিসিমের। যে কারনে মেজাজ বিগড়াইছে আমি তার মধ্যে মজা বা পজিটিভ কিছু খুঁইজা বাইর করি। যেমন পকেট মারিং হইছে, মেজাজ খারাপ না কইরা ভাবি অন্তত একজন পেশাগত দক্ষতা দিয়া কিছু টাকা অর্জন করছে। তো চরমতম খারাপ মেজাজরে ঠাণ্ডা করতে মাঝের সিট ছাইড়া বাসের সামনের বা সাইডের লম্বা সিটে বসলাম। যাতে খবিশ ড্রাইভার সাহেব আর তার কাজকাম পর্যবেক্ষণ করতে পারি।

ড্রাইভারের একটা চোখ ঘোলা। গলায় সস্তা মাফলার। মাথায় শাদা টুপি, কিছুটা নোংরা। গায়ে হাতকাটা খয়েরি সোয়েটার। শাদা শার্টের কলার আর ফুল হাতা বাইড়ায়া আছে। বাম হাতে সিকো ঘড়ি, ঘড়িরও বহুত বয়স হইছে বুঝা যায়। ডাইন হাতের দুই আঙ্গুলে দুই আংটি, একটা আকিক আর অন্যটা সম্ভবত মুন। যতদূর জানি জৌতীষ মেজাজ আর মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য মুন পাথর প্রেসক্রাইব করেন। মুন পাথরের দেখি বস্তুগুণ কড়া– এই লোকরে পুরা নির্লিপ্ত খবিশ বানায়া ফেলছে।

বাসের সিট পূর্ণ হইছে। এখন রড ধইরা দাড়ায়া যাওনের যাত্রীর অপেক্ষা। সিটের যাত্রীরা বাস ছাড়ার জন্য ড্রাইভাররে তাগাদাসূচক গালি দিয়া যাইতাছে। নিয়মিত যাত্রী গো গালির ঝাঁঝ আরও বেশী। আমিও চিল্লাইলাম তবে ভিন্ন সুরে ‘বুড়া ড্রাইভারও বাড়িতে যাইবো। হের ঘরেও বউ পোলাপান আছে। শখ কইরা কেউ এই বয়সে আধা রাইত পর্যন্ত গাড়ি চালায় না। যাগো তারা আছে তারা নাইমা গেলেই পারেন।’ এইবার কিছু গলা থাইমা গেলো, আর কিছু গলা ড্রাইভারের লগে আমারেও টার্গেট করলো। ড্রাইভার একবার আমার দিকে চাইতেই একটা অমায়িক হাসি দিলাম আর মনে মনে উচ্চারণ করলাম ‘খবিশ’।

যথারীতি রড পূর্ণ হওনের জন্য ড্রাইভার বইসা রইলেন। বাইরে হেল্পার চিল্লাইতাছে ‘লাস টিপ…. লাস টিপ….’ চলছে, ভিতরে বাস ছাড়ার তাগাদাসূচক গালি চলছে। খবিশ ড্রাইভারের কোনো ভাবান্তর নাই। শুধু দুই তিনবার আড়চোখে আমারে দেখলেন। তিনি রড আর দরজা’র স্পেসটা ভর্তি হওনের পরে বাস ছাড়লেন। বাসের ভিতরটা পুরা নীরবতায় বদলায়া গেলো যেনো জাতিসংঘের বিশ্বশান্তি অধিবেশন শুরু হইছে।

খালি রাস্তায় তুমুল গতিতে বাস ছুটছে। হেডফোনে একের পর এক দিল তামাম করা গজল বাজছে। আমার স্টপেজ আসার পরেও নামলাম না। আইজ লাস্ট স্টপেজ পর্যন্ত যামু। খবিশ ড্রাইভাররে জিগামু প্যাসেঞ্জারগো কষ্ট দিয়া কি আনন্দ পান! প্যাসেঞ্জাররা যে গালিগালাজ করে তা কি তার কান দিয়া ঢুকে না! আইজ তার কাছ থেকা কিছুটা নির্লিপ্ততার পাঠ নিমু।

লাস্ট স্টপেজ লঞ্চ ঘাটায় বাস থামলো। মাঝরাইতেও লঞ্চ ঘাটের আশপাশ জমজমাট, হোটেল আর টং দোকানগুলি খোলা। বাস থামতেই যাত্রীরা দ্রুত নাইমা গেলেন। হেল্পার একটা বিড়ি ধরাইলেন। আর জনাব খবিশ নামলেন সবার পরে আমার পিছে পিছে।

বাস থেকা নাইমা হ্যাণ্ডশেকের জন্য ড্রাইভারের হাতের দিকে হাত বাড়ায়া দিলাম-
: আসসালামু আলাইকুম, চাচা একটা কথা আছিলো।

অভ্যাসবশেই তিনি হাত বাড়ায়া দিছিলেন, কিন্তু সালামের জবাব দিলেন না, চেহারা পুরাই নির্লিপ্ত-
: কি কথা?
: এই যে সবসময় প্যাসেঞ্জার গো দেরী করান, সিটিং সার্ভিসরে রডিং সার্ভিস বানান, আপনের সমস্যাটা কি!
: সমস্যা আবার কি! আমারটা আমি করি, আপনের কি?
: আমার কিছুই না। শুধু জানবার ইচ্ছা করতাছে আপনারে যে প্যাসেঞ্জাররা গালিগালাজ করে তা খারাপ লাগে না?
: খারাপ লাগবো না ক্যান! লাগে। কিন্তু গালিগালাজের কাম করি বইলাই তো তারা গালিগালাজ করে।
: বাহ! গালিগালাজের কাম না করলেই পারেন?
: তাতে তো পেট চলবো না।
: মানে! গালিগালাজ খায়া পেট ভরান!!

তিনি নির্লিপ্ত হয়া কয়েক সেকেণ্ড তাকায়া রইলেন। তারপর নির্লিপ্তভাবে কইতে শুরু করলেন-
: সবাই গাইল পারে, জানতে তো চায় না কেউ। আপনের জাননডা খুব দরকার!
: হ, খুব দরকার।
: ছয় বচ্ছর আগে ডেরাইবারি ছাইড়া দিছিলাম। দুই বচ্ছর আগে রোড এক্সিডেন্টে পোলাডা মইরা গেছে
: তারপর?
: চাইর মাইয়ার বিয়া দিয়া দিছি আগেই। চাইর মাইয়ার পরে একটাই পোলা। দুইটা পোলাপাইন রাইখা মইরা গেলো। সংসার চলবো কেমনে! আবার গাড়ি ধরলাম। হাঁপানির লেগা বেশীক্ষণ চালাইতে পারিনা। গাড়ি মেশিং চলে, আমার বডি চলেনা, বয়স হইছে।
: হাঁপানি নিয়া গাড়ি চালান?
: হ। আগের মহাজন একটা ব্যবস্থা কইরা দিছে। তার লাইনের গাড়ি বন্ধ হয় রাইত দশটায়। আমারে জমা ছাড়া রাইতে গাড়ি চালাইতে দেয়।
: ভালোই তো–
: হ, ভালাই। তেলের খরচ আর হেল্পারের দেড়’শ টাকা বাদ দিয়া যা থাকে হেইডা আমার ইনকাম। হাঁপানির লেগা বেশীক্ষণ গাড়ি চালাইতে পারিনা আর তেলের খরচ বাঁচানোর লেগা পুরা বাসভর্তি প্যাসেঞ্জার লই। দুই ট্রিপ মারার তেলে প্রায় তিন ট্রিপের সমান টাকা আয়ে।
: কয়টা ট্রিপ মারতে পারেন?
: কোনো দিন দুইটা, কোনোদিন তিনটা। চাইরটাও হয়, তবে খুব কম।
: সংসার চলে?

তিনি নির্লিপ্ততার সাথে জবাব দিলেন-
: চলে। থামতে থামতে চলে। আমি মইরা গেলেও চলবো। তবে কেমনে চলবো জানিনা।

মানুষের সাথে মিশা যাওনের একটা সুদোষ আমার আছে। তারে জানাইলাম আমার স্টপেজ ছাইড়া প্রায় চাইর কিলোমিটার দূরের লাস্ট স্টপেজ পর্যন্ত আসছি শুধু তার লগে কথা কইতে। তিনি প্রতিক্রিয়াহীন। দুইজনে ফুটপাতের এক হোটেলের টুলে বইসা ডিমভাজা দিয়া গরম গরম পরোটা খাইতাছি। তুমুল আড্ডা চলতাছে। কি এক সাধারণ কথায় নির্লিপ্ততা ভেদ কইরা তার মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখলাম। আমার পুরা শরীর ঝাকি দিয়া কাঁইপা উঠলো, এই হাসি তো অবিকল লেফকোসিয়ার এথেনটিস গীর্জার দেয়ালে আঁকা যীশুর হাসি। জেলা শহরের লঞ্চঘাটের পাশে ফুটপাতের হোটেলের টুলে এই মাঝরাইতে খবিশের ছদ্দবেশে আমার লগে বইসা আছেন মহান যীশু! ওহ খোদা!!

___________
#সৌন্দর্যগ্রস্থ-১০

মূলে যাবোনা, আমরা ঢাল ধরে ঝুলেঝুলে প্রতিবাদ জানাবো!

মূলে যাবোনা, আমরা ঢাল ধরে ঝুলেঝুলে প্রতিবাদ জানাবো!

রাজনীতি পঁচে গেছে, আইনের শাসন মরে গেছে বহু আগে, বিচারব্যবস্থা পরিণত হয়েছে কৌতুকে, সামাজিক নিরাপত্তা- সম্প্রীতি- পারিবারিক বন্ধন- নীতিনৈতিকতার স্থান দখল করেছে বিদ্বেষ। সামাজিক সংঘগুলো পরিণত হয়েছে ছদ্মবেশী রাজনৈতিক সংগঠনে আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করা হয়েছে, হচ্ছে।

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বিশেষত মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো নব্বই দশকের মধ্যভাগ হতে নীতিশিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে, প্রায় ওই সময় হতেই স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল আর মুভি পারিবারিক বন্ধন শিথিল করেছে আর ভায়োলেন্স শিখিয়েছে, এর পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভয়াবহ- শুধু মাদ্রাসার শারিরীক নির্যাতন আর যৌন হেনস্থা ও নির্যাতন আমাদের চোখে পরে, কারণ, আমাদের মধ্যে একটা গোষ্ঠী আগে থেকেই মাদ্রাসা বিরোধী আর অন্য গোষ্ঠীটার কাছে মাদ্রাসা পবিত্র স্থান। অথচ মূলধারার স্কুল হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অবস্থা আরো ভয়াবহ, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডেও যৌন হেনস্থা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আধুনিক আর প্রগতিশীল হতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও আচারকে ক্ষ্যাত বলে বর্জন করে হয়ে উঠেছি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আর হীনমন্যতায় ভোগা প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেমের মোড়কে আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ফেরি করা হয়েছে চরম বিদ্বেষ আর ফানুসিক স্বপ্নসম্ভার। এসব একদিনে হয়নি, বহুদিনের পরিকল্পনার ফসল আজকের এই উন্নাসিক বাংলাদেশ। এই দেশে মানুষ নেই, আছ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ভোক্তা। এই রাষ্ট্রে পলিসি মেকার আর রাজনীতিক নেই, আছে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেটদের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নের দাস।

এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে সর্বগ্রাসী নৈরাজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাচ্ছি চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে। এমন একটা সময় আমরা অতিক্রম করছি যেন এদেশে সন্তান জন্ম দেওয়া পাপ, কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়া মহাপাপ।

ওভার এন্ড আউট

অণুগল্প : ভুতোলোজি

ভুতোলোজি

‘ভুত একটি সাইন্টেফিক প্রাণী, ভুতকে অস্বীকার করা মানে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা..’

এটুকু শুনেই রবীন্দ্রনাথ ভাষা হারিয়ে ফেললেন। চোখের পলক পড়ছেনা। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে আছে। ফেলবার্ট ভুতস্টাইন যোগ করলেন, ‘পৃথিবীতে ভুত এবং মানুষের বিকাশ একই সময়ে শুরু, মানুষ ও ভুত সমসাময়িক প্রাণী।’

আড়াইটা ঢেকুর (তিনটেই হতো, তবে শেষ ঢেকুরটা পুরো গিলতে পারেননি, অর্ধেকটা গলায় আটকে আছে)তুলে রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন-
: ভুত আর মানুষের বিকাশ সমসাময়িক?

বাচ্চাদের অর্থহীন প্রশ্ন শুনে বড়রা যেমন করে হাসে ভুতস্টাইনও তেমন খ্যাঁকখ্যাঁকিয়ে হেসে উঠলেন, হাসি থামিয়ে বললেন-
: মিস্টার টেগোর, অবশ্যই সমসাময়িক। অন্যান্য হোমিনিড গোত্র থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে আলাদা প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্স অর্থাৎ মানুষের উৎপত্তি। তবে, বিজ্ঞান বলে ২৩ থেকে ২৪লক্ষ বছর আগে শুরু হওয়া বিবর্তনে হোমো ক্যাটগরিতে অনেক প্রজাতিরই উদ্ভব ঘটেছিলো। এর মধ্যে ভুত, মানুষ আর হোমোসেক্স ছাড়া বাকী প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

রবীন্দ্রনাথ জোড় দিয়ে বললেন-
: স্যার ভুতস্টাইন, আপনার এসব তথ্য কিন্তু প্রমাণ করেনা যে ভুত আছে। সাইন্টিফিক প্রাণী হওয়া তো পরের কথা।

ভুতস্টাইন নড়েচড়ে বসলেন, যেনো ক্লাশ নিচ্ছেন এমন করে বলতে শুরু করলেন-
: তত্বকথায় যাবো না। সহজ করে বলি। ডারউইনের বিবর্তনবাদ বলে যে, লক্ষ লক্ষ বছর আগে বানরদের একটি প্রজাতি গাছ থেকে মাটিতে নেমে এসেছিলো। তারা দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে শিখেছিলো। এরাই মানুষেরর পূর্বপুরুষ। ক্লিয়ার?
: জ্বি, পরিস্কার বুঝতে পারছি।
: ভেইরি গুড, বানরদের একটা প্রজাতি মাটিতে নেমে এসেছিলো, ওই সময়ে অন্য আরেকটা প্রজাতি গাছের মগডালে উঠে বাস করতে শুরু করেছিলো। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনে মানুষ হাঁটতে শেখে, আর মগডালে ওঠা প্রজাতিটি অদৃশ্য হয়ে ভাসতে শেখে। হোমো গ্রুপের স্যাপিয়েন্স যেমন মানুষ, তেমন মামদোপিয়েন্স প্রজাতিটিই হচ্ছে ভুত।

রবীন্দ্রনাথ বহুক্ষণপর স্বস্তি পেলেন, হাসতে হাসতে বললেন-
: হোমো মামদোপিয়েন্স-এর কথা তো কোনো বিজ্ঞানী বলেননি, এমন কিছু নেই।

আবার খ্যাঁকখ্যাঁকিয়ে হেসে উঠলেন ভুতস্টাইন-
: অহংকার পতনের মূল। লক্ষ লক্ষ বছর আগে জেনেটিক রোগ অহংকারোসিসে আক্রান্ত হয়েই মানুষের পূর্বপুরুষের অধঃপতন ঘটেছিলো। মানে গাছ হতে মাটিতে ধপ্পাস।
: মানে?
: মানেটা ভেরি সিম্পল, আপনার কি ধারণা বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, নায়ক, গায়ক, কবি সাহিত্যিক শুধু মানুষরাই হতে পারে ! অবশ্য, আপনার এই মনোভাবকে দোষ দেওয়া অন্যায়, এটা তো অহংকারোসিস রোগের সংকীর্ণচিন্তানিয়াম উপসর্গ।

রবীন্দ্রনাথ উত্তেজিত হননা, কিন্তু মানুষের প্রতি এ অপমানে তিনি রাগে থরথর করে কাঁপছেন, আধগ্লাস নিমপাতার রস এক চুমুকে শেষ করে বললেন-
: ইউ হ্যাভ নো অধিকার টু অপমান হিউম্যান। যা বলতে চান স্পিক সরাসরি।

ভুতস্টাইন রবীন্দ্রনাথের রাগকে পাত্তা না দিয়ে বললেন-
: পৃথিবীর জ্ঞানে বিজ্ঞানে যে জাতি সবচে বেশী এগিয়ে আছে তা হচ্ছে ভুতজাতি। ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্বের ১৬হাজার বছর আগেই প্রেতউইন এ তত্ব দিয়ে গেছেন। প্রেতউইন একজন ভুত। নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের ১৯হাজার বছর আগে দানোটন মধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং ভুতদের ক্ষেত্রে মধ্যাবিকর্ষণ শক্তির ৩৪টি সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এমন উদাহরণ আছে হাজার হাজার। শুধু বিজ্ঞান নয়, সাহিত্য শিল্পকলাতেও ভুতজাতি মানুষের তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছে।

সাহিত্য শিল্পকলার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিতে রাজী নন রবীন্দ্রনাথ, তিনি বললেন-
: যে না ভুত জাতি! তার আবার সাহিত্য আর শিল্পকলা!! লেজ নাই বাঁদরের লেজরাজ নাম!

ভুতস্টাইন খুব জোড় দিয়ে বললেন-
: তাচ্ছিল্য করবেন না। আমাদের নমস্য সাহিত্যিক শাঁকচুন্নীন্দ্রনাথ পাকুড়ের ‘ভুতাঞ্জলি” নকল করে ‘গীতাঞ্জলী” লিখে কোন মানুষ লেখক না কি নোবেল প্রাইজও পেয়েছেন, আপনি জানেন!

এ কথা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তিনি মাঝে মাঝে চোখ খুলে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন, এরপর ‘ভুতাঞ্জলী’ উচ্চারণ করেই ফের অজ্ঞান হয়ে পরছেন। এদিকে ভুতস্টাইনও রাগে হাওয়ায় ভাসছেন, সব সহ্য হয়, কিন্তু ভুত জাতির অপমান আর মানুষের অহংকার মেনে নেওয়া যায় না। ভুত মানেই যে বিজ্ঞান- আজ এটা কবুল না করানো পর্যন্ত এখান থেকে তিনি নড়বেন না, এক্কেবারে নড়বেন না।

_________________
#ভুতবিজ্ঞান/০৫০৪২০১৯

পিতাগোরাসের মহাউচ্চতর গণিত

পিতাগোরাসের মহাউচ্চতর গণিত

অটো হইলো গিয়া ব্যাটারিচালিত টেম্পু। অটোতে চড়লে সবসময় সামনের সিটে অর্থাৎ ড্রাইভারের লগে বসি। স্বভাবদোষে তাগো লগে কথা কই, তাগো কথা শুনি, তাগোর চোখ দিয়া আরেকটা দুনিয়ার কোনাকাঞ্চিতে উকি মারি, তাগো দুনিয়াটা বুঝবার চেষ্টা করি আর নিত্যনতুন ‘চোখের আলো দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’ দেখি।

সকাল ৮টায় মফস্বলের রাস্তায় অটোতে উঠছি। যথারীতি ড্রাইভারের লগে বইছি। রাস্তার অবস্থা ভাঙাচুরা, ছালবাকলা উঠা নেড়িকুত্তার মতন। সামনে এক মালবাহী ট্রাক। শামুকের গতিতে আগাইতাছে ট্রাক, আধমরা শামুকের গতিতে পিছনে পিছনে ছুটছে অটো। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য কইরা ‘এই রাস্তা যে কবে ঠিক অইবো!’ কইতেই তিনি মৌখিকভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেক কিছু করলেন, ট্রাক ও ট্রাক ড্রাইভাররেও ছাড়লেন না। এই শীতের মদ্যে তারে ফরজ গোছল করতে অইবো ভাইবা খারাপই লাগলো। আচমকা তার ফোন বাইজা উঠলো, স্পীকার মুডে দিয়াও কানের লগে কমদামী মোবাইল সেটটা চাইপ্পা ধইরা হুংকার দিয়া উঠলেন-
: অই! তুই ফোন করছোস ক্যা! অই হারামির বাইচ্চা, ক ফোন করছোস ক্যা?
: ও আব্বা, তুমি চাইরশো টাকা দেওনা আব্বা। বেরাকের কিস্তি দিমু। আব্বা দাওনা, আব্বা।
: হারামির বাইচ্চা হারামি! আমার কাছে টাকা নাই। তোর পিরিতের জামাই কই!
: কামে গেছে, উই আইলেই দিয়া দিমু। ও আব্বা, দাওনা আব্বা।
: আমার কাছে টাকা নাই। থাকলেও তুই হারামীরে দিতাম না।

ওপাশে ‘আব্বা, ও আব্বা’ কাতর অনুনয় শেষ হওনের আগেই তিনি লাইন কাইটা দিলেন। ট্রাকের পিছনে থাইমা থাইমা অটো আগে বাড়তাছে। ধুলার ঠেলায় নাক ঢাইক্যা ঘটনা বুঝার চেষ্টা করতাছি। তিন চার মিনিট পরে ড্রাইভার স্পিকার চালু কইরা মোবাইল সেট কানে চাইপ্পা রাইখা ফোন দিলেন, হুংকারের মাত্রা আগের থিকা বেশী-

: অই হারামীর বাচ্চা হারামী, টাকা কহন লাগবো?
: আব্বা, বেরাকের কিসতি দিমু। ১১টায় লাগবো।
: তুই কেউরে অটো ইসটানে (স্ট্যাণ্ডে) পাডা, ১০০০টাকা দিতাছি।
: আব্বা, তুমি চাইরশো টাকা দাও, বেশী দিওনা আব্বা। তোমার গাড়ি জমার টাকায় টান পরবো।
: হারামীর বাচ্চা, আমারে লয়া চিন্তা করণের ঢং করবি না। ছয়শো টাকা দিয়া মুরগীর গোশতো কিন্যা খাইস। আর চাইরশো টাকা আইজ বিকালে শোধ না দিলে তগো দোজখ কইরা ছাড়ুম, মনে রাহিস।

ড্রাইভার লাইন কাইটা ফোনসেট পকেটে রাইখা নিজেই কইতে শুরু করলেন-
: বুঝলেন ভাই, মাইয়ার লাইগা কইলজা পোড়ায়। আবার গোস্বাও অয়।
: কেন গো ভাই!
: বহুত আদর কইরা বড় করছিলাম। পড়ালেখা শিখাইছিলাম। গালস (গার্লস) ইস্কুলের স্যারেরা কইতো মেট্টিকে (মেট্রিক/এসএসসি) গুল্ডেন জিপি ফাইব পাইবো। বড় জায়গায় সম্বন্ধ ঠিক কইরা রাখছিলাম।
: পরীক্ষা দেয় নাই?
: দুইটা পরীক্ষা দিছিলো। তারপর ভাইগ্যা গেছে। এক আকাইম্মা ব্যাডায় ভাগায় নিছিলো। অবশ্যি ব্যাডায় তিন মাস দইরা গার্মেন্টে কাম করে। গার্মেণ্টে কাম কইরা কি ছয় পেটের সংসার চলে! তার মইদ্যে মাইয়াটা পোয়াতি হইছে। অহনে পেরেম-পিরিতি চাবাইয়্যা চাবাইয়্যা খা।

অটো চলতাছে। ময়লা নীল সোয়েটার আর মাথায় রিকণ্ডিশন ময়লা মাফলার প্যাঁচানো এক মহাপুরুষ অটো চালাইতাছেন। যিনি মাইয়ার কাছ থেকা চাইরশো টাকা না পাইলে দোজখ বানায়া ফালাইবেন মাগার ছয়শো টাকা মুরগীর গোশতো খাইতে দিবেন। এইসব অংকের হিসাব দুনিয়ার কোনো স্কুল-কলেজ-ভার্সিটতে শিখায়না, এইসব সুপার হায়ার ম্যাথ অর্থাৎ মহাউচ্চতর গণিত জনকের কলিজায় থাকে। পিথাগোরাসের জ্যামিতি পিতাগোরাসের জ্যামিতির মতন সূক্ষ্ম হইবার পারবোনা কোনোদিন। অটো থেকা নাইমা আবদার করি-
: চলেন, এই ঠাণ্ডায় দুই ভাই মিলা একটু চা খাই।
: না ভাই, চা লাগবো না।
: ভাই রে, দুই অচিন মুসাফির চল্লিশ কদম একলগে হাটলে ভাই হয়া যায়, আপনের অটোর চাক্কা কতবার ঘুরছে হিসাব করেন। আমরা তো চাচাতো ভাই হয়া গেছি। লন, চা খাই!
: হেহেহেহেহে

দু’জন মিলা চা খাইতাছি। আসলে একজন মহাপুরুষের লগে কিছুটা সময় থাকা আর তারে চা খাওয়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইতাছিলাম না। চায়ের মাঝখানে তিনি সিগারেট ধরাইলেন, তার শস্তা দামের সিগারেটের কড়া গন্ধও কেমন মিশকাম্বার আতরের ঘ্রাণের মতন লাগে। হঠাত দেখি পোস্টারের মহাপুরুষদের মতন তার মাথার পিছনে বিশাল হলুদ আলোর বৃত্ত- উরররররেএএএ সুন্দর!

#সৌন্দর্যগ্রস্থ-৬

অণুগল্প : অবিশ্বাসের ভয়

অবিশ্বাসের ভয়

: ভুতে বিশ্বাস করো?
: নাহ, ভুতে বিশ্বাস করিনা। এক্কেবারে না।
: তবে যে ভুতকে ভয় পাও!

আসাদ কাকা তিনবার শাদা দাঁড়িতে আঙুল বুলালেন। এক চুমুকে অর্ধেক গ্লাস পানি খেলেন, এরপর একটা হাই তুলে বললেন-
: বিশ্বাস করিনা বলেই তো ভয় পাই রে, বাবা।

একটু কেশে নিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন-
: তখন আমার বয়স উনিশ কি বিশ। বর্ষা আরম্ভ হয়েছে মাত্র। যে দিনের কথা বলছি, ওই দিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়েছে। রাতেও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ভারী বৃষ্টিতে মাছ নদীর নিচে চলে যায়, তবে এমন টিপটিপ বৃষ্টিকে তারা পাত্তাটাত্তা দেয়না। আমি টেঁটা নিয়ে বের হলাম।

: একা বের হলে? তুমি না ভুত ভয় পাও, কাকা!

: ভুতকে ভয় পাই, কিন্তু বিশ্বাস তো আর করিনা। এমন রাতগুলোতে বোয়াল, শোল আর গজার মাছ বিলের ধারে ঘাপটি মেরে থাকে। এসব মাছ ভুনা দিয়ে ভাত বা খিচুরি খেতে কি যে স্বাদ! তাই প্রায় রাতেই মাছ মারতে বের হতাম।

গল্পটা যেনো খাবারের দিকে যেতে শুরু না করে তাই তাড়াতাড়ি বিস্ময় প্রকাশ করলাম-
: একাই মাছ মারতে গেলে!
: একাই বের হয়েছিলাম। যাওয়ার পথে তোর নিবারণ কাকাকেও ডেকে নিলাম। ওর আবার ভুতে খুব বিশ্বাস। তাই রাতে মাছ মারতে গেলে গলায় রসুনের মালা, হাতে কুপি আর এক টুকরো লোহা সাথে রাখতো। এসব সাথে থাকলে না কি ভুত কাছে আসেনা।

কাকা আরেক চুমুকে গ্লাসের বাকী পানিটুকু শেষ করলেন, এক মুট মুড়ি মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললেন-
: বিলের ধারে গিয়ে টর্চের আলো ফেলে মন ভরে গেলো। মাছ আছে। টেঁটায় পরপর দুটো বোয়াল মাছ গেঁথে ফেললাম। বিশাল বড় বোয়াল। ওদিকে নিবারণের টেঁটায় বিধেছে একটা শোল মাছ, সাইজে আধ হাত হবে।নিবারণ বড় মাছ মারার জন্য আরও কিছুটা সময় থাকতে চেয়েছিলো, কিন্তু শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি।

: এরপর কি তোমরা ফিরে এলে?

: না ফিরে করবো কি! এ বৃষ্টি তো থামবেনা। ফেরার পথে নিবারণকে একটা মাছ দিলাম। ও দু’টো মাছই চাইলো। বললো, বউয়ের সাথে বাজী ধরেছে যে আজ দু’টো মাছ নিয়েই ফিরবে। বাজিতে হারলে বিপদ, কারণ ওর বউ তন্ত্র সাধন করে। দিব্যি দিয়ে বলেছে দুটো মাছ না আনলে তাকে বলি দিবে।

: তুমি মাছ দিলে?

: মাথা খারাপ! তোদের কাকী আমাকে আস্ত রাখবে ভেবেছিস! নতুন বিয়ে করেছি, বীরত্ব দেখানোর একটা ব্যপারও আছে। তবে নিবারণ নাছোড়বান্দা, ওর গলার রসুনের মালার দিব্যি খেয়ে, লোহার টুকরার দিব্যি খেয়ে, আগুনের ওপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করে মাছটা চাইলো। শেষে কিনে নিতে চাইলো। কিন্তু আমি বেঁঁচবো কেনো!

মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে আমিও বললাম-
: ঠিকই তো! তুমি বেঁচবে কেনো!

কাকা এবার বালিশে হেলান দিলেন, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
: বাড়ির কাছাকাছি আসতেই নিবারণ একটানে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে দিলো দৌড়। পিছু পিছু আমিও দিলাম ছুট। ওকে ধুতি ধরে থামানোর চেষ্টা করলাম, লাভ হলোনা। ধুতি খুলে আমার হাতে চলে এলো। দেখলাম ন্যাংটো নিবারণ দৌড়ে তাল গাছটার ওপর উঠে গেলো।

: তুমি ভয় পাওনি!

নারকোলে ছোটো একটা কামড় দিয়ে আরেক মুঠ মুড়ি মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে কাকা বললেন-
: ভয় পাবো না মানে! তখন হঠাৎ মনে এলো নিবারণ তো বিয়েই করেনি। তাছাড়া ও গেছে শহরে, ফিরবে এক সপ্তাহ পর। মনটা খুবই খারাপ হলো, একটা বাড়তি বোয়াল মাছের জন্য এতোগুলো মিথ্যে কথা বললো ভুতটা! শেষে মাছের বদলে ছেড়া ধুতিটা আমার হাতে রেখেই পালালো! একটুও লজ্জাবোধ নেই!

কাকার চোখে চোখ রেখে বললাম-
: তবে যে খুব বললে ভুতে বিশ্বাস করো না!

কাকা রেগে গেলেন-
: একটা বোয়াল মাছের জন্য যে ভুত নিজের পরিচয় গোপন করে, রসুন, লোহা আর আগুন ছুঁয়ে মিথ্যে বলে তাকে বিশ্বাস করতে হবে! তাকে বড়জোড় ভয় পাওয়া যায়। কিন্তু বিশ্বাস! ইমপোসিবল… নো নো.. নেভার… নেভার…

কাকা উত্তেজিত হলে ইংরেজিতে কথা বলেন। হাই প্রেশারের রোগী কাকাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, মেঘ বিকেলের আবছায়া রোদের আভায় ওই তালগাছের পাতাগুলো স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। হালকা বাতাসে দুলতে দুলতে তালপাতারা খসখসিয়ে যেনো একে অন্যকে বলছে – ‘সত্যিই তো, ভুতকে বড়জোড় ভয় পাওয়া যায়, কিন্তু বিশ্বাস? কাভি নেহি।

অণুগল্প : ঋণশোধের এওয়ার্ড!

ঋণশোধের এওয়ার্ড!

সংবাদপত্রের অফিসে চাকরি করি। প্রতিদিনই অফিস থেকে বের হতে রাত গভীর হয়ে যায়। বাসের জন্য বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। তবে সুবিধে হলো বাস প্রায় ফাঁকা থাকে আর রাস্তাও ফাঁকা। দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয় না। আজ কিছুটা ব্যতিক্রম- মাঝরাতেও আগারগাঁও থেকেই যানজটের শুরু।

যানজটের গুষ্ঠি উদ্ধারে ব্যস্ত। এক সুবেশী যুবক এসে পাশের সিটে বসেছে তা খেয়াল করিনি। সামনের এতোগুলো সিট ফাঁকা থাকতেও পাশে এসে বসায় ভীষণ বিরক্ত হলাম। লক্ষ্য করলাম যুবকের গায়ে আকাশী শার্ট আর কালো ইংলিশ ফুলপ্যান্ট। গাঢ় নীল টাই। বোঝাই যাচ্ছে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে সেলসে কাজ করে।

যানজট ছুটার লক্ষণ না দেখে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিতেই অসাধারণ মিষ্টি কণ্ঠস্বর-
: আসসালামু আলাইকুম, স্যার।

চোখ মেলে দেখি ওই যুবক, তার সালামের উত্তরে বললাম-
: ওয়ালাইকুম আসসালাম।

যুবকের স্বরে বিনয় গলে পরছে-
: স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, একটা অনুরোধ করতে পারি!

মনে মনে বললাম ‘ধ্যাত!’, কিন্তু ভদ্রতা বজায় রেখে বললাম-
: কি অনুরোধ?
: স্যার, একটা ভুতের গল্প শুনবেন!

প্রচণ্ড বিস্মিত হলাম, সাথে রাগও, মাঝরাতে মশকরা! জানতে চাইলাম-
: হঠাৎ ভুতের গল্প শোনাতে ইচ্ছে হলো কেনো?
: স্যার, এটা আমার ডিউটি। প্লিজ শুনুন স্যার, একটা ভুতের গল্প।
: আমাকে ভুতের গল্প শুনিয়ে আপনার লাভ কি?
: স্যার, আমার টার্গেট প্রতিদিন তিন জনকে ভুতের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখানো। গত তিন মাসে মাত্র সাত জনকে ভুতের গল্প শোনাতে পেরেছি। কিন্তু তাদের একজনও ভয় পায়নি। তাই তিন মাসের বেতন আটকে আছে, বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে দিন কাটছে স্যার।

বেতন আটকে থাকার কষ্ট বাঙালি মাত্রই জানে, তার কষ্ঠে কষ্ঠিত হয়ে বললাম-
: ভুতের গল্প শোনানোর চাকরি! এ আবার কেমন চাকরি!
: স্যার, ইদানিং প্রায় প্রতিটা এফএম রেডিও আর বেশ ক’টা টিভি চ্যানেলে ভুত বিষয়ে অনুষ্ঠান হয়-
: হ্যা, সে অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে আপনার গল্প কে শুনবে!
: কিন্তু স্যার, সেসব গল্প তো শুধুই গল্প। সেসব গল্পে ভুত সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়া হচ্ছে। এমনসব গল্প প্রচার করছে যে অল্প বয়েসী বাচ্চাদেরও ভুতের ভয় কেটে যাচ্ছে। ভুতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

তার কথায় সত্যতা আছে, আমার বাচ্চা ছেলেটা এসব অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে এখন আর ভুতকে ভয় পায়না। একটা খালি আড়াইশো গ্রামের সরষে তেলের বোতল বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমোয়, রাতে ভুত এলে ধরে আটকে রাখবে বলে। তো সেই যুবকের কাছে জানতে চাইলাম-
: ভুতের ভয় পাওয়া বহাল থাকাটা কি জরুরী?
: স্যার, অবশ্যই জরুরী।
: কেনো জরুরী?
: স্যার, ভয়ই যদি না থাকলো, তবে ভুত থেকে লাভ কি! প্রকৃতির নীতির বিরুদ্ধে যাওয়া কি ঠিক!

তার কথায় বিমোহিত হলাম, জানতে চাইলাম-
: আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন? এনজিও’তে কি?
: এনজিও’তে নয় স্যার। আমি জিপিবি’র কর্মী।

মাথায় রক্ত উঠে গেলো, জিপিবি মানে গ্রামীন ফোন, বাংলাদেশ। এই মোবাইল ফোন কোম্পানি ভুতের ভাবমূর্তি রক্ষায় নেমেছে! মিনিটে মিনিটে মেসেজ দিয়ে তাদের আর পোষাচ্ছে না! এখন বাসে বাসে প্যাকেজ বিক্রির ধান্ধা! এর মধ্যে তিন মাস ধরে বেতন দেয় না, ছি: এতো অধ:পতন। রাগ নিয়েই বললাম-
: আপনি জিপিবিতে কাজ করেন- মানে গ্রামীন ফোন বাংলাদেশ?
: দু:খিত স্যার। আমি গ্রামীন ফোনের কর্মী নই, ভুত বিষয়ক অধিকাংশ অনুষ্ঠানই স্পন্সরর করে এই কোম্পানি। এই কোম্পানি আমাদের শত্রুপক্ষ।

বিষ্ময়ে জানতে চাইলাম-
: তবে জিপিবি আবার কোন কোম্পানি!
: স্যার, জিপিবি একটি সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, এর পুরো নাম ‘গোস্ট প্রমোশন ব্যুরো।’ ভুতের ভাবমূর্তি উদ্ধারে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।
: ভেরি ডিসগাস্টিং! মানুষ খেতে পায়না, আর ভুতের ভাবমূর্তি উদ্ধারে যতসব রং ঢং! ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত।

চেঁচিয়েই কথাগুলো বললাম। বাসের ড্রাইভার ও ভিতরের যাত্রীরা ঘটনা বোঝার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। যুবক কান্না চাপার চেষ্টা করছে-
: সর‍্যি, স্যার। ভুল হয়ে গেছে। গল্প শুনবেন না বললেই পারতেন। পেটের জ্বালায় এই চাকরী করি, স্যার। ভালো একটা চাকরী পেলে কি আর মাঝরাতে বাসে বাসে ঘুরি, স্যার!

কান্নায় আটকে আসা গলায় সে আরও জানালো-
: ঘরে বউ ছেলেমেয়ে না খেয়ে আছে- তিন মাসের বেতন আটকে আছে। আমার কষ্ট আপনি কি বুঝবেন স্যার! আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়..

যুবক মানুষের কান্না খুব হৃদয়স্পর্শী ব্যাপার। তাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবো বুঝতে পারছিনা, যানজটে থেমে আছে বাস। বাসের সকল যাত্রী ও ড্রাইভার আমাদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে যুবক বললো – ‘স্যার, আমরা ভুত হতে পারি, কিন্তু মানসম্মান আমাদেরও আছে…।’ এই কথার পরপর দু’টো ঘটনা ঘটলো- যুবক উড়ে বাসের দরজা দিয়ে বের হয়ে হাওয়ায় মিশে গেলো। এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে ড্রাইভার জানলা দিয়ে লাফিয়ে দৌড় লাগালো, এক্সিডেন্ট করলে যেমন করে পালায় আর কি!

যানজট ছুটে গেছে। এখনও মাঝ রাস্তায় বাস দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার ফিরেনি। অন্য বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ ওই সুমধুর কণ্ঠস্বর- ‘স্যার! আমাদের গায়ের চামড়া কেটে পাপোশ বানিয়ে দিলেও আপনার ঋণ শোধ হবেনা। আফসোস! ভুতদের চামড়া নেই। আজ ড্রাইভার যে ডরটা ডরাইছে তাতে জিপিবি’র মহাপরিচালক খুশী হয়ে সবার বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দিয়েছেন। একমাসের সমপরিমাণ বোনাসও দিয়েছেন। ভুতের ভাবমূর্তি রক্ষায় আপনাকে জিপিবি ব্রেভারি এওয়ার্ড-এর জন্য মনোনীত করা হয়েছে।’

খুশী হওয়া উচিত, কিন্তু হতে পারছি না। মাথার ভিতর কে যেনো বলছে- ‘এওয়ার্ডের টুটটুট করি। ঋণশোধের গুষ্টি কিলাই, এখন বাড়ি যাবো কিভাবে! ধুত্তোরি…!’

রবীন্দ্রনাথের মুক্তি চাই

রবীন্দ্রনাথের মুক্তি চাই

রবীন্দ্রনাথ মগ্ন ছিলেন বর্ষায়। অবশ্য বসন্ত বন্দনাও কম করেন নি। তাই বর্তমানে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা সাজসাজ রবে বসন্ত উদযাপন করে জেনে ‍তিনি যতটা খুশী হলেন তার চাইতে বেশী বিস্মিত হলেন। বিস্ময় নিবারণের জন্য ভগবানের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তিনি বসন্তের আগের রাতে ঢাকার পথে পথে ঘুরতে এলেন। রবীন্দ্র সরোবরের কাছে এক বাড়ির কাছাকাছি দাঁড়াতে লেবুর ঘ্রাণ পেলেন।

হিম হিম হাওয়া, রাতের নির্জনতা আর লেবুর ঘ্রান মিলেমিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করলো কবির মনে।তিনি উপরের দিকে তাকাতেই দেখলেন দোতালার এক ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে লেবুর ঘ্রাণটা আসছে। টবে থিরথির করে কাঁপছে লেবুর পাতা। ক’টা পাতা কি এক বিষণ্নতায় ঝরেও গেছে- নিচের গেটের কাছে এলোমেলো পরে আছে। তিনি দুটো পাতা তুলে নিলেন।

লেবু কঁচলালে তেতো হয়, কিন্তু লেবু পাতা কচলালে ঘ্রাণ আসে- লেবুর ঘ্রাণ। কবি লেবু পাতা কঁচলে ঘ্রাণ নিচ্ছেন আর হাঁটছেন। ধানমন্ডি থেকে হাঁটতে হাঁটতে সাইন্সল্যাবের মোড়টা ঘুরতেই টহল পুলিশের মুখোমুখি-
: এই যে বুড়া চাচা, থামেন-
: আমাকে বলছেন?
: আপনারে কইতাছি না তো কারে কইতাছি, আর কেউ আছে..
: জ্বি, বলুন-!
: বুড়া মানুষ হয়া এতো রাইতে রাস্তায় কি করেন?
: বসন্তের আগের রাতে বেড়াতে এসেছি, আমি রবীন্দ্রনাথ..

‘আমি রবীন্দ্রনাথ’ কথাটা শুনেই টহল পুলিশের দলটা হেসে উঠলো, এরপর একজন রসিকতা করে বললো-
: রবীন্দ্রনাথ বা বাবান্দ্রনাথ?
: বাবান্দ্রনাথ মানে?
: ন্যাকা, কিচ্ছু বুঝেন না! আপনি কি বাবা মানে ইয়াবার ব্যবসা করেন না কি! এখন সাপ্লাই দিতে বের হইছেন!
: বাবা মানে পিতা হয় জানতাম, ইয়াবা কি- এটাই তো জানা নেই..

টহল পুলিশের দল থেকে দুজন অতি উৎসাহে রবীন্দ্রনাথের দেহ তল্লাশি করতে শুরু করলো। এক্কেবারে চিরুনি তল্লাশি। মানে তাদের আঙুলগুলোকে চিরুনি বানিয়ে রবীন্দ্রনাথের দাড়ি গোফেও তল্লাশি চালালেন কিন্তু ইয়াবা তো দূরের কথা, ক’টা পাকা দাঁড়িও ঝরলো না। টহল পুলিশের দলটির মধ্যে একটা হতাশভাব চলে এলো।

রবীন্দ্রনাথ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলেন- কি আশ্চর্য! আগামীকাল সকালেই তাকে পূঁজো করা শুরু হবে, অথচ আগের রাতে তাকে মাদক ব্যাবসায়ী মনে করে তল্লাশী! ঘোর ভেঙে দু’পা এগুতেই- টহল পুলিশের দলনেতা আবার তাকে ডাক দিলেন-
: এই যে বুড়ামিয়া, একটু সামনে আসেন তো!

রবীন্দ্রনাথ সামনে আসতেই তার হাত ধরে দলনেতা বললেন-
: হাতের মধ্যে এইটা কি কচলাইতাছেন?
: লেবুপাতা।
: লেবুপাতা কচলাইতাছেন ক্যান! পিনিক হয়!
: পিনিক কি!
: ওরররে বুড়ামিয়া! তুমি তো দেখি সেয়ানা মাল! পিনিক চিনো না!
: সত্যিই চিনিনা, পিনিক কি কি?

দল থেকে একজন বলে উঠলেন- থানায় নিয়া পাছার মধ্যে কয়টা লাগাইলেই বুঝবা পিনিক কারে কয়! রবীন্দ্রনাথ ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছেন, দলনেতা বললেন-
: লেবুপাতা কচলায়া কচলায়া ঢাকা শহরের মধ্যে মাঝরাতে হাঁটতাছেন, সন্দেহজনক। চলেন থানায় চলেন।

রবীন্দ্রনাথ কিছু বলবার আগেই দলটি তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গাড়িতে তুলে নিলো।
.
বসন্তের প্রথম সকালে টিভি চ্যানেলগুলোতে একের পর এক অনুষ্ঠান। পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় বসন্ত বন্দনা। ঢাকা শহরের ক’শ বছরের বাঙালির আজ হাজার বছরের ঐতিহ্য পালনের হুল্লোড়। এসবের মধ্যে পত্রিকার ভিতরের পাতার ছোট্ট সংবাদটি প্রায় সবারই চোখ এড়িয়ে গেলো- ‘লেবুর ঘ্রাণযুক্ত গাঁজা সহ এক বৃদ্ধকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রবীন্দ্রনাথ নামে ঐ বৃদ্ধকে মাঝরাতে সাইন্সল্যাব সড়কে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরির সময়ে আটক করে পুলিশ। …..।’ কেউ জানলো না, বসন্তের প্রথম সকালে হাজতখানায় বসে কবিগুরু আবৃত্তি করছেন- আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/খুশিতে ঠেলায় ঘোরতে এ জীবনে/কট খেয়ে গেছি হায়, কখন যে ছাড়ে… ধুর্বাল… কখন যে ছাড়ে! ধুর্বাল…. ধুর্বা… লললল। মাঘমাস ঠেসে গেছে.. কোকিল ফেঁসে গেছে.. বসন্ত এসে গেছে… ধু…. র্বাআআআ.. ল.. ধু…. র্বাআআআ.. লল.. ধু…. র্বাআআআ.. ললল।

গন্ধ

ফরিদ মুৎসুদ্দী ছোট অফিসের বড়কর্তা। জীবন যাপনে সাদামাটা। সিগারেট, পান বা চায়ের অভ্যাস নেই। সপ্তাহে ছয়দিন মদ খান।

প্রতিদিন তিনি অফিস শেষে ‘মদিরা বার এন্ড রেষ্ট্যুরেণ্ট’-এ যান। ডান দিকের কোনার টেবিলে বসেন। গ্লাসের অর্ধেক বরফকুচিতে ভর্তি করেন। তিন টুকরো লেবু চিপড়ে নেন। গ্লাসে এক পেগ করে ভদকা ঢালেন। ঠান্ডা হবার জন্য দশ মিনিট অপেক্ষা করেন। তারপর ছোট ছোট চুমুক দিয়ে পান করেন। গুনে গুনে চার পেগ।

ভদকার গন্ধ মুখে বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। তবু তিনি ঝুঁকি নেন না। মদ খাওয়া শেষে বেশী পেয়াজে মাখানো একপ্লেট বাদাম খান। ওয়েটার কাইয়ূমের কাছে রাখা টুথপেস্ট আঙ্গুলে নিয়ে দাঁতে লাগান। ঘড়ি দেখে পাঁচ মিনিট বসেন। কুলি না করেই বাড়ির উদ্দেশ্যে বার ত্যাগ করেন।

শুক্রবারে তিনি ঘরে থাকেন। পরিবারকে সময় দেন। জুম্মার নামাজ আদায় করেন। দাওয়াতে যান। কোনক্রমেই মদ স্পর্শ করেন না। শুক্রবারে মদিরা বার বন্ধ থাকে, তবে রেষ্টুরেন্ট খোলা থাকে।

এক শুক্রবারে তিনি মদিরা বার এন্ড রেষ্টুরেন্টে হাজির হলেন। প্রতিদিনের মত শান্ত, স্থির। ম্যানেজারকে চার পেগ ভদকা দিতে অনুরোধ করলেন। নিয়মিত কাষ্টমার বিধায় ম্যানেজার তাকে স্টাফ রুমে নিয়ে গেলেন। তিনি চার পেগ খুব দ্রুত খেলেন। বিল পরিশোধ করে বেরুবার পথে ম্যানেজার বাঁধা দিলেন-
: স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, আপনি মনে হয় বেশ টেনশ্যানে আছেন! আমি বলতে চাইছি যে…
: আমার তাড়া আছে, হসপিটালে যাব। সংক্ষেপে বলুন।
:স্যার, আপনি মুখ হতে মদের গন্ধ দূর করতে ভুলে গেছেন।
: গন্ধ দূর করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, আমার মা ঘন্টা দুয়েক আগে… সিটি হসপিটালে… মারা গেছেন। আমি বাসায় …মা..গন্ধ থাকলে আর…
কথা শেষ করতে পারলেন না, অঝোর কান্নায় ভেসে গেলেন।

ফরিদ মুৎসুদ্দী জানেন না, কিছু কিছু গন্ধ দূর করার প্রয়োজনীয়তা কখনও ফুরোয় না। মা’রা মরে গেলেও সন্তানদের মুখের গন্ধ পান- হোক সেটা শিশুকালে পান করানো বুকের দুধের বা বেয়ারা মদের।

লেখালিখি নিয়ে ৩টা পর্যবেক্ষণ/মোটিভেশনাল স্পিচ

১.
লেখালিখি মোটেও কঠিন কাজ নয়। যার অক্ষরজ্ঞান আছে সে’ই লেখালেখি করতে পারেন। কারণ, মানুষ মাত্রই পরস্পর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে, গল্প বলে, ঘটনা বলে, এমন কি প্রতিটি মানুষই নিজের সাথে কথা বলে- এগুলোই লিখুন। নিজে লিখুন, নিজের মত করে লিখুন।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে- লেখালিখিকে তবে কঠিন কাজ বলা হয় কেনো। এই উত্তর দেবার আগে একটা উদাহরণ দেই- ছোটোবেলায় আপনার যে বন্ধুটি বাই সাইকেল চালিয়ে ভাব নিতো, সেও বলতো বাইসাইকেল চালানো সহজ, কিন্তু ব্যালেন্স রাখা কঠিন। অর্থাৎ ঘুরিয়ে বলা যে, বাইসাইকেল চালানো সহজ কম্ম নয়। মনে করে দেখুন, প্রথম যেদিন কাঁপা কাঁপা হাতে সাইকেলের হ্যাণ্ডেল ধরেছেন ওইদিন প্রথম দুই চক্কর খুব ভয় লেগেছে, তৃতীয় চক্কর থেকে ভয় কেটেছে আর পঞ্চম চক্করে গিয়ে তো মনে মনে বলেছেন- এটা এতো সোজা! লেখালিখির বিষয়টাও ঠিক তাই- প্রথমে ক’পাতা লিখুন, এরপর নিজেই বুঝবেন লেখালেখি কতটা সহজ।

কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছেন, আর মনে মনে বলছেন- ‘ওরে গর্দভ মোটিভেশনওয়ালা, লেখালিখি যদি এতোই সহজ হোতো তবে লেখকরা এমন ভাব নেয় কেনো যে লেখালিখি খুব কঠিন।’ খুবই সহজ উত্তর, পেশার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়ানো মোটেও কাজের কথা নয়, ‘কে হায় টিপস বলে নিজের পেটে লাথি কষানোর সুযোগে দানে ভালোবাসে!

এবার খুব বিজ্ঞের মত কেউ কেউ প্রশ্ন করবেন- ‘লেখালিখি যদি এতোই সহজ তবে তবে ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথ নেই কেনো! প্রতিটা পরিবারে পারিবারিক নজরুল নেই কেনো!’ বিনয়ের সাথেই বলছি- এটি ভুল প্রশ্ন, ভুল উদাহরণ। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন তার নিজের লেখা, আপনাকে লিখতে হবে আপনার নিজের লেখাগুলো। দ্বিতীয়ত, ঘরে ঘরে লেখক জন্মানোর মূল বাঁধা হচ্ছে ‘লেখালিখি কঠিন কাজ’ এই মানসিকতা।

এই পর্যন্ত যেহেতু পড়েছেন সেহেতু নিচের টুকুও পড়ুন, কাজে দিবে-

১. খোদ বিশ্বকাপ ফুটবলে কয়েক শো ফুটবলার খেলেন, কিন্তু ফোকাস থাকে বড়জোড় বিশ পঁচিশ জনের ওপর। এর মানে কিন্তু বাকীরা ফেলনা নন। লেখক হিসেবে বিশেষ হয়ে উঠতে হলেও একটু বাড়তি সময় দিতে হবে, ভাবতে হবে, পড়তে হবে, এবং সবথেকে বড় বিষয় হোলো- প্রশ্ন করতে হবে, তুলতে হবে।

২. যে বিষয়ে লিখবেন সে বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান যতটা বেশী পারা যায় ততটা অর্জন করুন, অভিজ্ঞতা নিন। তারপর লিখুন। ড্রইং রুমে বসে বিপ্লবের গল্পটা লেখা যায়, অনেকেই লিখেন। কিন্তু যে মিছিলে ছিলো, আন্দোলনে নির্যাতনের শিকার হয়েছে সে যখন বিপ্লবের গল্পটা ড্রইং রুমে বসে লিখবে, তাতে রাজপথের উত্তাল ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। আর দশটা গল্প থেকে তা বিশেষ হয়ে উঠবে।

৩. লেখক হবার জন্য এবং লেখার জন্য- এ দুটো ক্ষেত্রেই লেখকের দরকার নিজের সাথে কথা বলার অভ্যেস গড়ে তোলা। প্রতিদিন নিজের সাথে কথা বলুন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বলুন। নিজেকে সময় দিন।

শেষে একটা অনুরোধ, আমার মত অধম এই কথাগুলো বলছে বলে যদি মানতে দ্বিধা জাগে, তবে ভাববেন- এ কথা মার্ক টোয়াইন বলে গেছেন, অথবা শেক্সপিয়ার বা রবীন্দ্রনাথ। এতেও সংকোচ লাগলে ভাবুন না হয় এ জবানী (জাওয়ানি নয়) সবিতা ভাবির।

অণুগল্প : মদভাই

মদভাই

‘মদিরা বার এন্ড রেষ্টুরেন্ট’- ঐতিহ্যবাহী অভিজাত বার। বিকাল তিনিটায় খুলে। পাঁচটায় জমে ওঠে। সন্ধ্যায় বসার জায়গা পাওয়া কঠিন। এই বারে নিয়মিত কাষ্টমার অনেক। তারা সকলেই অনন্য। তারা না আসা পর্যন্ত ম্যানেজার চেয়ারগুলো খালি রাখেন। আজ চার টেবিলের আখ্যান শোনাই।

ডান পাশের তিন নম্বর টেবিল। আটজন বসে আছেন। তিনজন হুইস্কী, চারজন ভদকা আর একজন বিয়ার খাচ্ছেন। প্রতিদিনের মত জমজমাট আলোচনা চলছে- কার্লমার্ক্স, লেলিন, ট্রটেস্কি, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব।

প্রতিদিনের মত আজও রাত বাড়বে, আলোচনা বাড়বে, নেশা বাড়বে, বিপ্লবীরা তাল সামলে দাঁড়াতে না পেরে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়বে, বলবে- সরি, কমরেড। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

ডানপাশের শেষ টেবিল। দু’জন মুখোমুখি বসেছেন। প্রতিদিনের কাস্টমার। ফিসফিস করে কথা চলছে। হাসছে। সাত পেগ করে রয়াল জিন খাবে। ওরা দু’জন কখনও মাতাল হয়না, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় না। মদ গিলতে গিলতেই কাজের খোঁজে ফোন দেয়। মাছ শিকারের প্রাথমিক কথাবার্তা বলে।

মদিরার ম্যানেজার ভালো করেই জানেন এরা শহরের নামজাদা কন্টাক্ট কিলার। খুন করেন, খুন করান। মাছ শিকারের খেলা খেলেই এরা আয় করে- ভাত খায়, মদ গিলে।

বামপাশের শেষ টেবিল। তিনজন বসে আছেন। একজন নিয়মিত। বাকীরা অনিয়মিত। নিয়মিত জনের সাথে প্রতিদিনই দু’তিনজন অনিয়মিত লোক থাকেন। তারাই মদের বিল দেন। নিয়মিতজন একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। তিনি প্রতিদিনই অনিয়মিতদের একটি গল্প শোনান-
: তিন পেগ খেলেই জীবনান্দের মত লিখতে পারি। কিন্তু লেখা হয়না।
: লিখেন না কেন?
: লোভ, বুঝলে লোভ।
: লোভ মানে?
: মানে আরো দু’পেগ খেয়ে নিলেই রবীন্দ্রনাথের মত লিখতে পারি। বাড়তি দু’পেগ পেটে ঢাললেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাই, আই স্যয়ার। তবু লেখা হয়না।
: কেন?
: আবার সেই লোভ। আরো ভালো লেখার আশায় বাড়তি দু’তিন পেগ গিলি। তারপরেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ জীবনান্দের মত ছাইপাশ লিখে জঞ্জাল বাড়িয়ে লাভ কি! লিখতেই যদি হয় তবে রসময় গুপ্তবাবুর মত লিখ, টাচি, জীবন্ত প্রাণবন্ত।

এই টেবিলের বিপরীতে বসেন অধ্যাপক শেখর। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকেন। চার পেগ ভদকা আর চার পেগ জিন খান। নেশা ধরেনা। মুরগীর ঝাল ফ্রাই দিয়ে পরোটা খেতে শুরু করলেই নেশা ঝিম ধরে। খাওয়া শেষ হবার আগেই নেশায় বুঁদ। বিল পরিশোধ করে পুরো মানিব্যাগটা ওয়েটারকে টিপস হিসেবে দিয়ে যান। অবশ্য, পরের দিন বারে এসে ঐ ওয়েটারকে ডেকে ভাংতি পয়সা সমেত মানিব্যাগ ফেরত নেন।

মদিরা বার এন্ড রেষ্টুরেন্ট একটি সাম্যবাদী প্রতিষ্ঠান। এখানে বিপ্লবী, কনটাক্ট কিলার, কবি, অধ্যাপক আর সাধারণ কাষ্টমার সবাই সমান, সবাই সবার মদভাই।

ফিল

মেট্রিক পরীক্ষা শেষ। নিজেদের লায়েক ভাবতে শিখেছি। দীর্ঘ ছুটি কাটছে আড্ডায়, বই পড়ে। ঘনিষ্ট বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম মদের স্বাদ নিব। রাসেলের বাড়ি সারাদিন খালি থাকে। ওর রুমে মদ খাব। কামাল বলল- ‘ঘরে মদ খাওয়া আর জিলাপি খাওয়া সমান। বিকালের খোলা ছাদ, মান্নাদের গান, আড্ডা আর কাবাব দিয়ে মদ- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ রাসেলের রুমে মদ পানের মুখেখড়ি অনুষ্ঠানে সবাই ছিলাম, কামাল ছিলনা। কি কাজে যেন আটকে গিয়েছিল।

কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ। এবার সিদ্ধান্ত হল কক্সবাজারে যাব। কামাল বলল- ‘দোস্ত, মজাই মজা। সারা রাত সৈকতে বসে জম্পেশ আড্ডা, ননস্টপ মদ, রবীন্দ্রনাথের গান- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ কামালের কক্সবাজার যাওয়া হয়নি। পরীক্ষার ফিস দিবার পরে ছাপোষা বাবার কাছে কক্সবাজার যাবার টাকা চাইতে পারে নাই। রাসেল আর আমি টিউশনি করতাম, বলেছিলাম-
: কামাল, তুই চল, তোর টাকা আমরা দিব।
: দোস্ত, মদে চুমুক দিলেই বুকের ভিতরে খচখচ করবে। টিউশনির টাকায় প্রতিদিনই তোরা চা- সিগারেট খাওয়াস, লাঞ্চ করাস, মদ খেতে পারব না।’ আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম, সৈকতে মদও খেয়েছিলাম, কামাল ছিল না।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ। দীর্ঘ ছুটি। সিদ্ধান্ত হল পূর্ণিমায় জাহাজে করে বরিশাল যাব। কামাল ভীষণ উত্তেজিত- ‘মাঝরাত।জাহাজের নীরব ছাদ। চাঁদের আলো ঢেউয়ের চুলে বিলি কাটছে। লালনের গীত আর গোলাম আলীর গজল। আড্ডা চলছে, পাল্লা দিয়ে মদ চলছে- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ বরিশালে গিয়েছিলাম, টাকা যোগার করতে পারে নাই বলে কামলের যাওয়া হয় নাই।

ভার্সিটিতে ঢোকার পরে কামালের সাথে যোগাযোগ কমে আসে। একটা সময় পুরো বন্ধ হয়ে যায়। হঠাত একদিন নিউমার্কেটে দেখা-
: কামাল, কেমন আছিস? এখন কি করছিস?
: দোস্ত, ব্যাস্ত আছি। শর্টকাটে বড়লোক হবার একটা লাইন পেয়েছি। টার্গেট পাঁচকোটি টাকা।
: পাঁচকোটি টাকা দিয়ে কি করবি?
: দোস্ত, তিন কোটি ব্যাঙ্কে ডিপোজিট। দু’কোটিতে বাড়ি। বাড়িতে একটা বিশাল ঘর রাখব বইয়ে ঠাসা। ঘরের কোনায় ছোট্ট বার। সাউন্ড সিস্টেম আর এক হাজার সিডি।
: এসব দিয়ে কি করবি?
: দোস্ত, অবসর সময়ে ইজি চেয়ারে বসে দস্তয়ভস্কি পড়ছিস। সাউন্ড সিস্টেমে খুব হালকা ভলিউমে পিয়ানো বাজছে। পড়ার ফাঁকে ব্লাডি মেরিতে চুমুক দিচ্ছিস – ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।
: তোর বাড়ি , তোর ঘর- ফিল করে আমার কি লাভ?
: হারামজাদা, এটা একটা কথা বললি। বিয়ে করলে বউটা ছাড়া পুরো বাড়ি তোদের দখলে দিয়ে দিব,খোদার কসম।
: তাহলে ঠিক আছে, হা: হা: হা:
: দোস্ত, আহম্মকের মত হাসিস না। মদ, বই, মিউজিক সব একসাথে, এক ছাদের নিচে, এক ঘরে- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।

কামাল এখন কোটিপতি। অতীতের সূত্র ধরে ওকে যত বলি ‘ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ ও বলে- ‘দূরে গিয়ে মর ব্যাটা, দূরে গিয়ে মর।’ – গল্পটা এভাবে শেষ করতে পারলে বেশ হত, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল-
শেষ পর্যন্ত কামাল শর্টকাটে বড়লোক হতে পারে নাই। বসের ইশারায় র‍্যাব ওকে মেরে ফেলে। এরপর থেকে আমরা মদ খেতে পারি না। মদ খেলেই কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে- ‘ফিল কর দোস্ত, ফিল কর।’ মদের বদলে আমরা কামালের তীব্র মৃত্যু যন্ত্রণা ফিল করি। দম বন্ধ হয়ে আসে। ফিসফিসানি থামেনা, বেড়েই চলে- ফিল কর দোস্ত, ফিল কর… ফিল কর দোস্ত, ফিল কর…