আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

ডোম

3115 আমার বড় ভাই প্রায়ই বলে আমাদের পূর্বপুরুষ ডোম ছিল, শ্মশানে মরা পোড়াত। আমাদের বংশের সবাই এটা অবিশ্বাস করলেও আমি খুব বিশ্বাস করি, কারণ আমার রক্তে আগুন; পোড়াতে ভালোবাসি। প্রতি কয়েক মাস অন্তর একবার আমাকে পোড়াতে হয়, পোড়াতে পোড়াতে এখন দক্ষ হয়ে উঠেছি। যদিও একবার নিজের পুড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল।

গৌতম ঘোষের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় দেখেছি শত্রুঘ্ন সিনহা হাতের লাঠি দিয়ে মরাকে চেপে ধরছে। যাতে উঠে দৌড় লাগাতে না পারে। মরা পোড়ানোর সুযোগ এখনো হয়ে উঠেনি কিন্তু কাঠের মাথাকে লাঠি দিয়ে চেপে ধরতে আমার ভালো লাগে। কমলকুমার মজুমদারের ব্রাহ্মণ, দোসর অর্থাৎ পত্নী না পেয়ে মরেনি। কাঠ, কাগজ কিংবা অন্যান্য আবর্জনা সঙ্গী ছাড়া অবলীলায় মরে যায়।

শীত আগত আগামী কয়েক মাস পোড়ানো সম্ভব হবে না, আজ শেডের যাবতীয় জঞ্জাল পুড়িয়ে শেষ করে ফেলছি। মরা পোড়ানো চাকরি হিসাবে মন্দনা, অতীতকালের কথা বলতে পারবো না কিন্তু বর্তমানে ফিনারেল সার্ভিসের কর্মীদের খুব সমীহের চোখে দেখা হয়। শেষকৃত্য পুন্যের কাজ; নিষ্ঠার সাথে এমন কাজ সবার করা উচিৎ।

ভদকা

নিদানের দিনে সে আমাকে যত্ন করে সোমরস পান করিয়েছিল। তখন বেকার; টিউশনির যে তরুণীর সাথে প্রেম হব হব করছে, সে হঠাৎ পছন্দ বদলে ফেলল। ফকিরের পুত্রের সঙ্গে প্রেমে তার পোষাবে না। পছন্দের সাথে সাথে বদলে গেল টিউশন মাস্টার।

বিপর্যস্ত আমি মেসের ম্যানেজারের ভয়ে পালিয়ে থাকি। রাস্তায় তার সাথে দেখা, অনেক বছর পরে। স্কুলের মাস্তান ছিলাম সে ছিল আনকোরা, মাস্তানি দেখাতে গিয়ে পাছায় লাথি মেরে ছিলাম। সে কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। স্কুলে তার দিন যন্ত্রণায় কেটেছে; আমার আনন্দে।

আমি তাকে চিনিনি সে ঠিকই চিনেছে। সামাজিকতার শেষে যখন নিজের দুরবস্থা বর্ণনা করছি, তার চোখে সহমর্মিতা দেখেছি অথবা দেখার ভুল।

সব শুনে দুপুরের খাবারের জন্য পাঁচ তারকায় নিয়ে গেল। দীর্ঘদিন এমন খাবার খাইনি। পাশের টেবিলে সোমরস পান হচ্ছে আমি লোভাতুর চোখে তাকাচ্ছি। আমার চোখ অনুসরণ করে সে বলল ‘খাবি নাকি’! আমি হ্যাঁ বললে সে বলল ‘আমার একটা শর্ত আছে’। আমি অবাক চোখে তাকালে সে বলল ‘তুই যত দামী মদ খেতে চাস খাওয়াব; কিন্তু খাওয়া শেষে সবার সামনে তোর পাছায় লাথি মারব’!

বাংলা মদ দুয়েক বার চেখে দেখেছি বিদেশি মাল স্বপ্নেও দেখিনি, এই সুযোগ একবার চেখে দেখা যায়। পাছায় লাথি দিতে চায়; দিক। জীবনের পাছায় এমনিতেই লাথি খেয়ে আসছি। শর্তে রাজি হয়ে গেলাম।

পুরো এক বোতল ভদকা গলাধঃকরণের পরে টলোমলো অবস্থা, তবু শর্ত ভুলিনি। দাড়িয়ে বললাম ‘এবার নিশ্চিন্তে লাথি কষাতে পারিস’! সে আমার মুখের দিকে চাইল, বললো ‘না থাক তুই আর লাথির যোগ্য নস’। বিল মিটিয়ে সে চলে গেল, ভদকার নির্যাস নিয়ে আমি অনেকক্ষণ বসে থাকলাম।

আমাদের আবু স্যার

হাবিবুর রহমান আবু স্যার পান খেতেন; কেমন পান খেতেন সেটা না দেখলে বুঝা সম্ভব না। চেইন স্মোকার বলে একটা টার্ম আমরা ব্যবহার করি কিন্তু পানখোরের জন্য কোন টার্ম আছে কিনা জানি না। থাকলে স্যার এই টার্মের জন্য যোগ্য প্রার্থী হতেন। পান ছাড়া তাকে কোনদিন দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। স্যার ক্লাসে যখন কথা বলতেন তাঁর থেকে দূরে থাকতে হত কিন্তু দূরে থাকা সম্ভব না কারণ আবু স্যার চেয়ারে বসে কিংবা টেবিলে ঠেস দিয়ে লেকচার দিতেন না, তিনি হেঁটে হেঁটে লেকচার দিতেন প্রতিটি বেঞ্চের সামনে এসে তাঁর বক্তব্য পেশ করতেন।

তাঁর কথার চোটে আমাদের স্কুল ড্রেসের অবস্থা কেরোসিন হত। পান, চুন এবং জর্দার মিশেলে যে মালাই তৈরি হয় সে মালাই থেকে কোনদিন বাঁচতে পারিনি।

স্যারের পানস্ত্র থেকে বাঁচতে চাইতাম ঠিকই কিন্তু স্যারের ক্লাসের মজা কোনদিন মিস করতে চাইতাম না। স্কুলে স্যারের চেয়ে ভাল, জনপ্রিয় কেউ ছিল না। আমি নিশ্চিত যদি প্রিয় শিক্ষদের প্রতিযোগিতা হয় স্যার নির্দ্বিধায় প্রথম হবেন।

স্যার ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন কিন্তু আমরা তাঁকে বিজ্ঞানে চাইতাম, অর্থনীতির স্যারের অনুপস্থিতির বিকল্প অন্য কেউ এলে আমরা মনমরা হয়ে যেতাম কিন্তু স্যার এলে অর্থনীতি আমাদের কাছে ঝলমলে হয়ে উঠতো। বাংলার ক্লাসে তাঁর বিকল্প ছিল না, কখনো সখনো গনিতেও তিনি পারদর্শীতা দেখাতেন।

ইংরেজী বিজাতীয় ভাষা; কিন্তু খুব মূল্যবান, আমাদের মাঝে কেউ যদি দু-চার লাইন ইংরেজি বলতে পারতো, তাকে আমরা বিলেতের রাণীর মত সমীহ করতাম। কারণ আমাদের জ্ঞান ইয়েস, নো, ভেরি গুডে সীমাবদ্ধ ছিল। স্যারের কাছে ইংরেজী ছিল ডালভাত, তিনি যেভাবে ইংরেজী বলতেন অনেক ইংরেজও হয়তো বলতে পারত না।

অন্য সব বিষয়ে মেট্রিকে পাশের সম্ভাবনা হয়তো আছে কিন্তু ইংরেজী ডুবাবে নিশ্চিত, স্যারকে এই কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেন। বলতে ভাল লাগছে স্যারের কারণে ইংরেজীতে ভাল নাম্বার পেয়েছিলাম। স্যার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন কিন্তু অবৈতনিক; অর্থাৎ শিক্ষার বিনিময়ে কোন পয়সা নিতেন না।

অমিতাভ বচ্চনের জয়প্রিয়তা আকাশচুম্বী, বোম্বে ফ্লিমে তাঁর অবস্থান এক থেকে বিশ, বাকীরা একুশ থেকে। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে স্যারের অবস্থান ছিল এক থেকে একশ বাকীরা একশ এক থেকে শুরু।

শিক্ষক বলতে আমরা যে আদর্শ মানুষের চিন্তা করি, আমাদের কল্পনায় যে আদর্শ শিক্ষকের অবয়ব ভেসে ওঠে স্যার ঠিক তেমনি ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য আমরা স্যারের কালে জন্ম নিয়েছিলাম; তাঁর ছাত্র হতে পেরেছি।

পিনাকীর দুই দিদি

আমাদের বন্ধু পিনাকীর দুই কাজিন ছিল এই দুই কানিজের জন্য পিনাকীর সাথে বন্ধুত্ব করার একটা প্রতিযোগিতা ছিল, বন্ধুত্ব হয়ে গেছে; কিন্তু কে কত ঘনিষ্ঠ, বিশ্বস্ত বন্ধু প্রমাণের জন্য পুনরায় প্রতিযোগিতা হত।

পিনাকী চালাক ছিল আমরা যে তার কাকাত দুই বোনের জন্য প্রয়োজনাতিরিক্ত খাতির যত্ন করি বুঝতে পারত, কিন্তু ভাবেসাবে বুঝতে দিত না। আমাদের খাতির যত্ন সে এনজয় করত।

বলাবাহুল্য তার বোনেরা আমাদের পাত্তা দিত না, কারণ বয়সে আমরা ছোট এবং চালচুলোহীন। আমরা প্রেমে বিশ্বাসী ছিলাম; প্রেমের কাছে বয়স কিংবা অবস্থা বিবেচ্য হয় না। মহান প্রেমিক যারা ছিলেন তাদের চালচুলোর কোন বিবরণ পাওয়া যায় না।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে এক মাসের ব্যবধানে পিনাকীর দুই দিদির বিয়ে হয়ে যায়, দুই দিদির বিয়েতে পিনাকী মনমরা, সেটা দিদি বিয়োগে না বন্ধুত্বে ধার কমে যাওয়ার ভয়ে বুঝা না গেলেও সে যে বিমর্ষ স্পষ্ট দেখা গেল।

আমাদের দুই প্রেমিকা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় আমরাও মনমরা কিন্তু এর জন্য পিনাকীর সাথে বন্ধুত্বের কোন হেরফের হল না। পিনাকীর মা অর্থাৎ আমাদের মাসীমা নিজের ছেলের মত যত্ন করে বিভিন্ন পদ রান্না করে খাওয়াতেন, এই নিখাদ ভালবাসা মিস করতে চাইতাম না।

তার দিদিরা পুজোয় বাড়ি আসত ভাইয়ের জন্য কোন উপহার নিয়ে এলে ভাইয়ের বন্ধুদের কখনো ভুলত না।

আমরা দুই দিদির পায়ে প্রেমের অর্ঘ্য দিতাম, দিদিরা সেই অর্ঘ্য স্নেহের সিন্দুকে জমা রাখত। একদিন আবিষ্কার করলাম আমরা আসলে স্নেহের কাঙাল ছিলাম; আমাদের কাঙালপনা ঘুচিয়ে দিতে পিনাকীর দুই দিদি কোন কসুর রাখত না।

পিনাকী এখনো আমাদের বন্ধু, সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। তার দুই দিদি আমাদের অতিপ্রিয় বড় দুই বোন।

টিকর বাড়ির টিলা

একজন বলল আপনার প্রিয় জায়গার নাম বলুন।
আমি বললাম ‘টিকর বাড়ির টিলা’
-বলেন কী কবরস্থান কী কারো প্রিয় হতে পারে?
-আমার পারে, কারণ এই কবরস্থানে আমার শৈশব প্রোথিত আছে, লাশের সারি দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি, শুভ্র কাফনের চেয়ে পবিত্র বস্ত্র আর কিছু হতে পারে না, সংসারের হাজার চাওয়া পাওয়া ‘টিকর বাড়ির টিলা’য় এলে শান্ত; কারণ লাশের কোন অনুযোগ থাকে না। যে ক্যাডবেরি খেত আর যে লেবেঞ্চুস চুষতো ‘টিকর বাড়ির টিলা’য় তারা একাসনে থাকে। যেখানেই জন্ম হোক শেষ পর্যন্ত তাকে ‘টিকর বাড়ির টিলা’য় ফিরতে হবে।

স্বপ্ন দেখি ‘টিকর বাড়ির টিলা’র অখ্যাত কোন কবরে শোয়ে আছি, প্রবল বৃষ্টিতে কবরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছে, অসীম মমতায় মিউনিসিপাল কর্মী পুনরায় দেয়াল গড়ছে। চতুর্দিকে পরিত্যক্ত হাজার কবর, দশ বছরেও কেউ খোঁজ নেয় না কিন্তু ‘টিকর বাড়ির টিলা’র মিউনিসিপাল কর্মী কখনো মমতা দেখাতে কার্পণ্য করে না।

শৈশব স্মৃতি রাজাকার

হঠাৎ মনে পড়ল; শৈশবে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। আমাদের অস্ত্র ছিল বাঁশের গুলতি। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে পাকি জারজদের স্মৃতি মনে জ্বলজ্বল করছে। পাকিরা পালিয়েছে দেশে রয়ে গেছে তাদের দুষ্কর্মের সাথী।

এখানে সেখানে রাজাকারের বাচ্চা গুলো ধরা পড়ছে, মানুষ ইচ্ছেমতো চড়, কিল, থাপ্পর দিচ্ছে। রাজাকার কি জিনিস আমরা জানিনা, দেখিনি কোনদিন। প্রায়ই দেখতাম মেছো বাঘ কিংবা খাটাশ পাড়ায় দেখা দিয়েছে, মানুষ দলবেঁধে বাঘ খাটাশ পিটিয়ে মেরে ফেলত। আমরা খুব ছোট; রাজাকার ধরার উত্তেজনা আমাদের ছুঁয়ে যেত কিন্তু আমাদের রাজাকারের কাছাকাছি ভিড়তে দেয়া হতো না। আমরা ভাবতাম রাজাকাররা হয়তো বাঘ খাটাশের চেয়েও ভয়ঙ্কর পশু।

একবার এক বন্য শুয়োর মানুষের তাড়া খেয়ে সভ্য পাড়ায় এসে ঢুকে পড়ল শুয়োর দেখে আঁতকে উঠল সবাই তবুও অসহায় প্রাণীর যাতে কোনো বিপদ না হয় সবাই মিলে পাকড়াও করে পুনরায় বনে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

কয়েকদিন পরেই আমাদের পাড়ায় এক রাজাকার ধরা পরল এবার আমাদের ঠেকায় কে যেভাবেই হউক এই পশুকে দেখতে হবে। আমরা গুলতি যুদ্ধ থামিয়ে রাজাকার দেখতে গেলাম। রাজাকার দেখে খুব আশাহত হলাম; তাকে কোন ভয়ংকর প্রাণী মনে হল না; দেখতে ঠিক মানুষের মত। যে-ই রাজাকার দেখতে আসছে চড় দিচ্ছে, লাথি দিচ্ছে, থুথু দিচ্ছে। পাড়ার মস্তান লুঙ্গি উল্টিয়ে রাজাকারের গায়ে পেশাব করছে তবু তাকে কেউ ধমক দিচ্ছে না। শুয়োর ঘৃণিত প্রাণী তার নাম নিলেই ওযু নষ্ট হয়ে যায় তবু বিপদে পড়া শুয়োরকে এই মানুষেরাই নিরাপদে বনে পৌঁছে দিয়ে ছিল। একে খাটাশের মত মেরে ফেলছে না কিন্তু ঘৃণা উগড়ে দিচ্ছে। রাজাকাররা শুয়োরের চেয়েও ঘৃণিত এই প্রথম জানলাম…

নদীর জন্য এলিজি

উনচল্লিশ বছরে পরে
অভিশাপ মুক্ত হতে নদীর পাড়ে এলাম;
নদী কই এখানে তো ঝলমলে বিপণী!

কৈশোরের আবেগে অনিচ্ছা সত্ত্বে
জল বিয়োগ করেছিলাম
সেই পাপ উনচল্লিশ বছর ধরে কুরে কুরে খাচ্ছে।

অনিচ্ছার পাপ আমাকে স্বস্তি দেয়নি;
যারা ধর্ষণ করে হত্যা করে ফেলল
তারা কী করে সুখে থাকে!

ক্ষমা চাইবার আগেই নদীকে হত্যা করা হলো
জল বিয়োগের পাপ নিয়ে কবরে যেতে হবে।

ধর্ষকদের মৃত্যু হবে না, তারা অমর;
আরো অসংখ্য নদী ধর্ষিতা হওয়ার অপেক্ষায়।

বিরহী বধু

সূর্যের শেষ রশ্মি বাড়ির পথে হাঁটলে
হিমফুল ভাবে বেড়িয়ে আসি;

হিমের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোট নদী
শুকিয়ে যায়। মাঝির নৌকা অলস
চরে আটকে গেলে বিরহী বধু অপেক্ষার
প্রহরে শেষে মূর্ছা যায়।

কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে সূর্য পুনরায় ফিরে আসে
হিমফুল হারিয়ে যায় সুদূরে। নদীর যৌবন
ফিরে এলে মাঝি বাইতে থাকে নাও।
জ্ঞান ফিরেও বধুর অপেক্ষা ফুরোয় না,
সমতলের মাটি ভরাট হয় তবু
আসে না তার প্রেমের প্রহর।

অতীত

কাদা মাটির ছেলে
এখনও মাটির গন্ধ গায়ে

সেই আমি দুদণ্ড
টিকতে পারলাম না;

সামান্য কাদায়
পিছলে গেলাম। বৃষ্টির
নিমন্ত্রণ কোনদিন অস্বীকার
করিনি, একসাথে অনেক
দুপুর খুনসুটি করে
কাটিয়েছি। সেই আমি
বৃষ্টি সহ্য করতে পারি না
আকাশে আঁধার দেখলে
কম্প দিয়ে জ্বর আসে।

মাটির ঘরের জানালায়
বৃষ্টির ছাট, উঠানের কলাগাছে
জলের ঝাপটা।

মন হরণ করা দৃশ্য
এখন অতীত। ইটের দালানে
কাঁচের জানালা;
বন্দিশালায় বৃষ্টি আছড়ে
পড়ে; ছুঁতে পারি না।

নাকের জায়গায় নাক আছে
গন্ধ নেই, কাঁচের জানালা
থেকে ফুলের বাগান অনেক দূরে।

অনিমেষ

অনিমেষ পাল নৌকার মাস্তুলে পাল খাটাবার কাজ করে, তার কাজ এটুকুই। এর পর ছইয়ের ভিতর ঘুম। অনিমেষ যদি ঘুম জমাত; তাহলে ব্যাংকের কোন ভোল্টে জায়গা হত না। ইদানীং অনিমেষ ঘুমোতে পারছে না, ঘন্টার পর ঘন্টা অসল বসে থাকছে। দুই চোখ বুজে দেখেছে কিন্তু ঘুম আসছে না। সেই মধুর দৃশ্য বারবার ভেসে উঠছে।

রবিন পোদ্দার মাঝি; নৌকার বস কী কুক্ষণে গত সপ্তাহে তার বাড়ি যাওয়া হয়েছিল। এই যাওয়াই কাল হলো। রবিনের স্ত্রী মালতী নিচু হয়ে তার পাতে ভাত বেড়ে দিয়েছিল, মালতীর গোপন অঙ্গের কিছু অংশ সে দেখে ফেলেছিল।

এই দেখানো ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছায় এই দ্বন্দ্ব তার কাটছে না। তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কোনভাবেই এই দৃশ্য তাড়াতে পারছে না। উনিশ বছরের অনিমেষ বড় কষ্টে আছে, কষ্ট কথা কাউকে বলতে পারছে না।

রবিন পোদ্দারের বাড়ি পুনরায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা কিন্তু সেটাও হয়ে উঠছে না।

অনিমেষ বাতাসের গতি বুঝে পাল খাটায় কিন্তু নারীর মনের গতি বোঝা তার সাধ্যের বাইরে।

রোদ কিংবা এক টুকরো জীবন

কবরের বর্ষপূর্তি আনন্দের হল না
এক বছর আমার তেমন কষ্ট হয়নি,

জীবিত কালের প্রাপ্য সাজা ভোগ
করতে হচ্ছে না দেখে ভেবেছিলাম

প্রতিটি ধর্মালয়ে হয় মিথ্যা বয়ান
প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ গালগল্পে ভরপুর।

মরে গেলে শুধুই ঘুম। স্বর্গ নরক
মস্তিষ্কের অলীক কল্পনা, বাস্তবে নেই।

এই প্রথম সাপের ছোবল খেলাম;
এই প্রথম কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো

বিরাটকায় আজদাহা। এই প্রথম
আগুনে পুরোপুরি ভষ্ম হয়ে গেলাম।

আমার প্রাপ্য সাজা শুরু হয়ে গেছে
তবু কোন আফসোস হচ্ছে না।

অনুশোচনায় পুড়ছে না হৃদয়, কারণ
আমি কোন মহৎপ্রাণ ছিলাম না।

সাপের ছোবল, আগুনে ছাই হওয়ার
কাজ সম্পন্ন করেই কবরবাসী হয়েছি।

সাপের ছোবল খেতে খেতে মনে খেয়াল
জাগে, যদি ধর্মালয়ে মাথা ঠুকতাম

পবিত্র গ্রন্থ বিশ্বাস করে সরল পথে
যাতায়াত করতাম, তবে কী সাপের বদলে

অন্যকিছু পেতাম। না; আফসোস নয়
শুধু কৌতূহল। একটু রোদে জীবন কী

ভিন্ন হত! জীবনের ওই পিঠ দেখা হল
না, জানা হল না সূর্যের ঠিকানা।

কবি

মতি উদ্দিন শখের কবি। পান-সুপারি, বিড়ি-সিগারেট, শরাব কিংবা তহুরা অন্য কিছুতে তার আসক্তি নেই। শুধু কবিতা। কবিতা তার আরাধ্য। কবিতা ছাড়া অন্য কোন প্রার্থনা নেই।

মতি উদ্দিন নির্বিরোধী মানুষ; কারো সাতেপাঁচে থাকেন না। কাজ, ঘর এবং সংসার। এর বাইরে কবিতা।

তার সময় কম, কাজ এবং সংসারের বাইরে কবিতার জন্য সময় বের করা প্রায় সম্ভব হয় না। তবু তিনি কবি; আড়াই ফর্মার কবিতার বইয়ের জনক।

নতুন পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্ছে, কাজ সংসার সামলিয়ে পাণ্ডুলিপি সামলাতে তার গায়ের ঘাম ঝরছে। পাণ্ডুলিপি তৈরি করা পাহাড় কাটার চেয়েও কঠিন, ভারী পাথর বয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়েও কঠিন। গত কয়েকদিন ধরে এই কঠিন কাজ তিনি করছেন।

সব কাজ শেষ হলে স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে তিনি বসেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজ একত্র করে মমতার অক্ষর সাজান। কাটাকুটি করেন।

দীর্ঘ আড়াই মাসের পরিশ্রমে পুনরায় আড়াই ফর্মা পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেল, আনন্দে তার চোখে জল এল। পাণ্ডুলিপির খুশিতে একটা সিগারেট ধরালেন; অথচ তিনি সিগারেট খান না। অনভ্যাসের দরুন ক্রমাগত কাশতে থাকলেন, স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্ত্রী সাহিত্য প্রেমী নন কিন্তু স্বামীর কবিতা পাগলামিতে তার সায় আছে। বেচারা কবিতায় থাকলে ভাল থাকে। স্বামীর জন্য চা বানিয়ে আনলেন।

রাতের শেষ প্রহরে স্ত্রীর চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার মাথায় নতুন কবিতা ভর করল, তিনি পুনরায় টেবিলে বসলেন।

পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছে, স্ত্রী জেগে দেখলেন কবিতার টেবিলে মাথা রেখে স্বামী ঘুমাচ্ছেন। আহারে কবি, তার মায়া হতে লাগলো। তিনি ডাকতে গেলেন কিন্তু দেখলেন স্বামী জাগছেন না।

কবিতার টেবিলে মতি উদ্দিনের মৃত্যু হল। স্ত্রী দেখলেন সাদা কাগজে কবিতার এক লাইন; ‘মৃত্যু তুমি চায়ের কাপে এলে’… স্ত্রী ভয় পেলেন। তিনি গ্যাসের চুলায় কাগজ জ্বালিয়ে ফেললেন।

মতি উদ্দিনের স্ত্রীর পুনর্বিবাহ হলো মাস তিনেক পরে, ভদ্রলোকও কবি। সার্বক্ষণিক কবি। স্ত্রীকে সারাক্ষণ কবিতায় ব্যস্ত রাখেন… স্ত্রী মাঝেমধ্যে নতুন স্বামীকেও চা বানিয়ে খাওয়ান।

ফেরা

জগতের অপর পাড়ে
হেঁটে হেঁটে কতকিছু খরিদ করলাম।

আমার সঞ্চয়ে আছে
স্ট্যাচু অফ লিবার্টি
আইফেল টাওয়ার
বুর্জ আল খালিফা
ব্লু মস্ক
বার্লিন ওয়াল
বাকিংহাম প্যালেস।

আছে
ইজিপ্টের দুই প্রস্থ পিরামিড
আর বেবিলনের সেই ঝুলন্ত উদ্যান।

শাহজাহানের স্মৃতি বিজড়িত তাজমহলে
প্রেমের ওয়াদা করে
প্রেমিকাকে নিয়ে নায়েগ্রা ফলসে উড়াল দেই।

আমস্টারডামের রেড লাইট ডিস্ট্রিকে
এক নীল নয়না কয়েক ঘণ্টার সার্ভিস শেষে
পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ে রাজি হয়ে যায়।

মরক্কোর গ্রাম্য কুটিরে তাজিন খেয়ে
হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে
তের ঘন্টার বিশ্রাম।

প্রফুল্ল মনে আমি যখন ঢাকার আকাশে
তখন মনে পড়ে; আনসার মাঠের মন গাছ
ছাড়া আর কোনো সঞ্চয় অবশিষ্ট নেই।

সবকিছুই মেকি; মন গাছ জগতের একমাত্র সত্য,
যত দূরে যাই, বার বার ফিরে আসি আনসার মাঠে।

জীবনচক্র

Life

আমার পিতা কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন
আলনায় যেখানে তাঁর পাঞ্জাবি ঝুলানো থাকতো;
সেখানে ঝুলছে বড় ভাইয়ের চেক শার্ট।
আলনায় তাকালে বাবা ক্ষণিকের জন্য উঁকি দেন,
কিন্তু চেক শার্টই বাস্তবতা। বাবা ক্রমেই বিস্মৃত হচ্ছেন।

কদুর লতি বিরূপ আবহাওয়া অবজ্ঞা করে
উঁকি দিচ্ছে, ভোরের পাখি আমার মা এখন শয্যাশায়ী।
এই দুদিন আগেও আগাছা পরিষ্কারে সক্ষম ছিলেন।
কদু অকৃতজ্ঞ নয়, পরিচর্যার বিনিময়ে
নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে মরিয়া।

কদুর পরিপূর্ণ অবয়ব দেখলে মা খুশি হতেন
কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। উঠোন মা থেকে এখন অনেক দূরে।

পুকুরের ওইপাশে পেয়ারা গাছ ছিল, সীমানা নিয়ে
পাশের বাড়ির সাথে ঝগড়া। একরাতে ক্রোধে তারা
পেয়ারা গাছ কেটে ফেলে। বড় আপা চোখের পানি
আটকাতে পারে না। পেয়ারা গাছের কাছে
তার অনেক স্মৃতি জমে আছে।

সাইকেলের চেনে পা আটকে গেলে অনেক রক্ত ঝরেছিল,
চাচা বলেছিলে সাইকেল বদলে
অন্য সাইকেল কিনে দিবেন। বড় ভাই নাছোড়বান্দা
জীবন গেলেও সাইকেল ছাড়বেন না।
এই সাইকেলের দুই চাকায় তার কৈশোর যৌবনে পৌঁছেছে।
একদিন এক ট্রাক সাইকেল দুমড়ে মুচড়ে দিল, অল্পের জন্য
বেঁচে গেলেন বড় ভাই। সাইকেল ছাড়তে হল,
চাইলেই সবকিছু ধরে রাখা যায় না
অনেক কষ্টে বুঝতে পারলেন।

সাড়ে পাঁচে প্রথম লুঙ্গি পরি, হেদায়েত উল্লাহ হাজম
সুন্নতে খতনায় মুসলমান বানিয়ে ছিল।
শিশ্নের যন্ত্রণায় লুঙ্গি অনেক আরামদায়ক।
জীবনের প্রথম লুঙ্গি টিনের ট্রাংকে অনেকদিন সংরক্ষিত ছিল।

গত শীতে ট্রাংকের গুপ্তধন খুঁজতে গিয়ে দেখি
লুঙ্গির অবস্থা নড়বড়ে, ফেলে দিতে অনেক কষ্ট পেয়েছি।

এক সময় ঘুড়ির পিছনে দৌড়াতাম। এখন সার্টিফিকেট
ফাইলবন্দি করে অফিসে অফিসে দৌড়াচ্ছি।
জুতোর তলা ক্ষয় যাচ্ছে, হালকা হয়ে যাচ্ছে মাথার চুল।
আমি জীবন ধরতে চাচ্ছি, জীবন পিছলে যাচ্ছে…

পুরাতন ভৃত্য কিংবা নতুন মোবাইল

মোবাইল ফোনে আমি টুকটাক লেখালেখি করি। প্রযুক্তির উৎকর্ষ আমাকেও প্রভাবিত করেছে। কলম আর কাগজের সঙ্গম যেন ভুলে গেছি, হয়তো বিশ্বাস করবেন না; চেষ্টা করে দেখেছি কাগজে লিখতে গেলে কলম চলে না, যদিওবা চলে পড়তে গিয়ে অক্ষর গুলো চিনতে পারিনা। হাতের লেখার এমন দুরবস্থা হয়েছে যে ব্যস্ত ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনও আমার চেয়ে সহজবোধ্য মনে হয়। চর্চার অভাবে হাতের লেখা মরে গেছে, মরে গেছে লেখার গতি।

মোবাইল অথবা আইপ্যাডে লিখতে যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি কাগজ-কলমে এখন আর তেমন স্বচ্ছন্দতা আসে না। অর্থাৎ কাগজ কলমে লিখে আগের মত আরাম পাই না। কাগজের বুকে সোনালী অক্ষরের জন্য মনটা কাঁদে; কিন্তু নিরুপায়। প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু ধ্বংস করে ফেলেছে, অনেক অকৃত্রিম জিনিস কৃত্রিম প্রযুক্তি গিলে ফেলেছে। যেমন ইচ্ছে করলেও শৈশবের পুকুরে সাঁতার কাটতে পারিনা কৃত্রিম ঝর্ণায় এখন মুক্তি খুঁজি।

মোবাইল ফোনে মাঝেমধ্যে লেখি, কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে আমার ফোনটা আগের মতো সাড়া দিচ্ছে না। আমি যে তালে আংগুল টিপে যাচ্ছি সে তালে অক্ষর গুলো স্ক্রিনে ভেসে উঠছে না। আমি ভাবলাম সমস্যা কী আমার না ফোনের। আমার বয়স পঞ্চাশের উপর শরীরের উচ্ছলতা অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। মনের উচ্ছলতা যদিও পনেরো-ষোলো বছরের কিশোরের মত তবু মোবাইল ফোন হয়তো আমাকে বৃদ্ধই ভাবছে।

মোবাইল ফোন আমাকে বৃদ্ধ ভাবছে ব্যাপারটা আমার অহং এ আঘাত করল। আমি বৃদ্ধ নই প্রমাণ দিতে মোবাইল ফেলে আইপ্যাডে লিখতে শুরু করলাম, দেখলাম আইপ্যাডের সাড়া মন্দ নয় আমার সাথে সমান তালে পাল্লা দিতে পারছে। বুঝা গেল মোবাইলে আমার বৃদ্ধত্ব সমস্যা না সমস্যাটা মোবাইলের।

হিসাব করে দেখলাম আমি বৃদ্ধ হইনি বৃদ্ধ হয়েছে মোবাইল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে একই মোবাইল ব্যবহার করছি। তার যা নির্ধারিত আয়ু আমাকে সার্ভিস দিতে গিয়ে ব্যয় করে ফেলেছে। এখন সে আর আগের মত পাল্লা দিতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ পড়তে গিয়ে মনের ভিতরে যে বেদনা জেগেছিল এখন সে বেদনা অনুভব করছি। আমার প্রিয় মোবাইল প্রভুর বেদনা উপশম করতে গিয়ে নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিল। পাঁচ বছরের সাথী মোবাইলকে ফেলে দিতে হবে। তার সাথে যত সময় কাটিয়েছি নিজের স্ত্রীর সাথে ভাব, ভালোবাসায় তত সময় কাটাইনি। তাকে ফেলে দিতে ব্যথিত হচ্ছি কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার এর কোন উপায় নেই। বাস্তব হচ্ছে অচল মাল চলে না। মানুষ মানুষকে ফেলে যায়, পরিত্যাগ করে। একদিন আমাকেও হয়তো এভাবে কেউ ফেলে দেবে; আর মোবাইল তো এক নিষ্প্রাণ যন্ত্র, পরিত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোন সমাধান নেই।
আমার মোবাইল ঠিক মতো কাজ করছে না খাবার টেবিলে এমন কথা দুই একবার উচ্চারণ করেছি; দেখলাম কেউ কোনো সাড়া দিচ্ছে না। আমার পকেটের অবস্থা ভালো না কিছুদিন হলো দেশ থেকে ফিরেছি। ধার দেনা হয়ে গেছে এসব শোধ না করে নতুন মোবাইল কেনা সম্ভব না। ভেবেছিলাম স্ত্রী-সন্তানদের কেউ দয়াপরবশ এগিয়ে আসে; দেখলাম এই ব্যাপারটায় কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। পুনরায় ভাবনা মনে এলো আমি নিজেও কি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, অচল হয়ে গেছি; আমাকেও কি ফেলে দেয়ার সময় এসেছে! পাত্তা না পেয়ে অভিমানে কাজে চলে গেলাম।

রাতে কাজ থেকে ফিরেছি, স্ত্রী যথারীতি খাবার নিয়ে হাজির। কোন ভনিতা ছাড়াই খাবার খেলাম। কথাবার্তা আজ আর তেমন এগুলো না। রাত বারোটার পরে টেলিভিশনের ক্রাইম পেট্রোল গিলে যখন ঘুমোতে গেলাম বালিশে মাথা রাখতে গিয়ে শক্ত কিছু অনুভব করলাম। স্ত্রীর সাথে ঝগড়ার ইচ্ছায় যেই চিৎকার দিতে যাব দেখলাম চৌকা একটা প্যাকেট বালিশে ঘুমিয়ে আছে। প্যাকেট খুলে আমি অবাক, নতুন মডেলের মোবাইল। আনন্দে চোখে জল এসে গেল।

কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার পরেই ছেলে মেয়ে এবং স্ত্রী মিলে পরিকল্পনা করেছে কিভাবে আমাকে সারপ্রাইজ দেয়া যায়। আমার ছেলে মেয়েরা বাংলা পড়তে পারে না, স্ত্রী ডিগ্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে না পারলেও বাবার লেখালেখি যাতে নির্বিঘ্নে হয় সে ব্যাপারে সবসময় সচেষ্ট। আমি রাত জেগে লেখালেখি করলে স্ত্রী ঘুমোতে যাবার আগে কফি বানিয়ে যেতে ভুলে না।

পুরাতন মোবাইলে আগের মতো সার্ভিস দিচ্ছে না এটা তাদেরকেও চিন্তিত করেছে তাই লেখালেখি এবং অন্যান্য কাজ নির্বিঘ্ন করতে তৎক্ষণাৎ নতুন মোবাইল ক্রয় করে এনেছে। বাবার প্রতি ছেলে-মেয়েদের এমন ভালোবাসা পুনরায় আপ্লুত করেছে।

মানুষ হওয়ার একটা সুবিধা আছে এক মানুষ অন্য মানুষের জন্য মায়া, আদর, ভালবাসা অনুভব করে। ভালবাসার উপর বিশ্বাস রাখতে গিয়ে মনে হল, বৃদ্ধ হলে আমাকে হয়তো ফেলা হবে না আদর করে কবরে শুইয়ে রাখা হবে। পুরনো মোবাইলকে আমি ফেলে দিতে পারিনি, সযত্নে একটা কৌটায় রেখেছি; যেখানে আরো কিছু মূল্যবান জিনিষ রাখা আছে।