মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন এর সকল পোস্ট

তিনদিনের ছুটির দরখাস্ত

পবিত্র ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে নিজ আবাসস্থল থেকে ১৪৫০ কিলোমিটার দূরে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করতে হবে বিধায় তিনদিন শব্দনীডে. আসা হবেনা।
সবাই দোয়া করবেন আমার জন্য।

আসি আমি নিঃশেষ হতে

হৃদয়ের জমিন ক্ষয়ে গেছে তোমার ক্যাকটাস ভালোবাসায়
শেষ রক্ত কণিকা বিলিয়ে দিয়েছি তোমার সতেজতায়
আমি সিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে পড়েছি অদম্য মোহে
রিক্ততার মাঝে স্বপ্নের পালক উড়িয়েছি মুক্ত আকাশে।

সনাতনধারার ভালোবাসা মোহ ভঙ্গের যবনিকাপাতে
আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি গিরিসম অগ্যূৎপাতে
নীলিমার মাঝে আত্মবিসর্জনে উন্মাতাল দিনগুলো আজো মনে পড়ে
ভাবি, কেন ক্যাকটাসের আঘাতেও আত্মসংযম আসেনি মম অন্তরে!

ভাবনার অন্ত্যহীন ধূসর জগতে পাখা মেলে শঙ্খচিল
আমি আজো খুঁজে ফিরি ক্যাকটাস ভালোবাসার স্বপ্নিল
বিগলিত স্বপ্নের মাঝে ক্ষয়ে যাওয় হৃদয়ের জমিনে
আজো থরোথরো কাঁপে কচি কিশোলয়; মৃদু হাওয়ার তানে ।

স্বপ্ন পিপাসু স্বপ্ন বুনি ক্ষয়ে যাওয়া স্বপ্ন মন্দিরে
গহীন অরণ্যে পথ খুঁজি পথ হারাবার ছলে অন্ধকারে
নিঃশেষ ভালোবাসা দিয়েছি উজাড় করে নিঃশেষ হবার তরে
আমি বারবার আসি ফিরে ফিরে; বারংবার নিঃশেষ হবো বলে।

বিমূর্ত ছায়া সঙ্গী

আমি যা পেয়েছি তার তুলনায় তুই অতি নস্যি
কথায় কথায় ক্ষেপে যাওয়া
বাংলা পাঁচের মত তোর চেহারাটা নিয়েও ক্ষেপাতো বন্ধুরা
আমি কখনো গায়ে মাখিনি বলে রক্ষে পাওয়া!
আমার আর পরীর সংসারে কোন কিছুর অভাব নেই
বিত্ত ভৈবব! সব আছে সব
আমার জন্য পরীর ভালোবাসা অফুরান
সন্ধ্যা হবার আগে পথ চেয়ে বসে থাকে কফি হাতে
আমি হীনা এক মুঠো ভাত মুখে নিতে তার বিবেকে বাঁধে
আমি; আমিই তার সব!
তার কল্পনার ছায়া সঙ্গী আমি
আমি ছাড়া যেন তার জীবনটা অচল
এক বিন্দু ভালোবাসা হয়তো খুঁজে পাওয়া দায়
যা দেয়নি আমায় উজাড় করে!
আমার নদীতে ভালোবাসার ঝড়ে প্লাবন প্রতিনিয়ত
আমি ভাসি সুখের গঙ্গায়-
যা চেয়েছি, পেয়েছি তার চেয়ে বেশি
পরী আসলে রূপে গুণে সত্য এক পরীই বটে।
তবুও,
শ্রাবণে প্লাবনে, নিশিথ স্বপনে
নিঃসঙ্গতার ছোট্ট কোন এক আবকাশে
কেন বার বার ভেসে আসে সেই বাংলা পাঁচের মত চেহারাখানি!

শ্বেত-শুভ্র পেঙ্গুইন ভালোবাসা

ধ্রুবতারার সাথে যদি মিশে যায় ভাবনারাশি
জলতরঙ্গের সুরে স্বপ্নের গান; সুর তুলে দেয় হাতছানি
আমি ভেসে যাই, পাল তুলে আনন্দের অথৈ সাগরে
বিনিদ্র রজনী, সহযাত্রী হয়ে ছুটে চলে আমার সাথে
তুষার ঢাকা উত্তরের কোন এক নির্জন প্রান্তরে, পেঙ্গুইন আবাসে
যেখানে রাশি রাশি স্বপ্ন ভাসে শ্বেত শূভ্রমেঘে, নির্জন পবিত্রতায়
সেথায় আমার বাসনার রঙ মিশে যায় শ্বেত শুদ্ধতায়
তুষার ঢেউয়ে ভেসে যায় যত কালিমা রেখা উত্তর হতে দক্ষিণে
আমি খুঁজে পাই আমার চেতনার রং প্রশান্তির আত্মবিশ্বাসে
বারবার আমি ফিরে আসতে চাই শুভ্রতার এই প্রান্তরে
এখানে আসেনি কখনো দক্ষিণের কালিমামাখা ঢেউ,মিথ্যে আশ্বাসে
তাইতো পেঙ্গুইন ভালোবাসা শ্বেত-শুভ্রতায় মহৎ অনাবিল বিশ্বাসে।

বিমূর্ত ছবি

নিরন্তর ছুটে চলি দেশ হতে দেশান্তরে কোন এক অদৃশ্য মায়ায়
অজানাকে জানার জন্যে হন্যে হয়ে ছুটি নিরন্তর শ্রম সাধনায়
গভীর অরণ্যের সেই অজানা জীবটিও ভেসে ওঠে যন্ত্রের দর্পণে
পাতালপুরীর সপ্তাবরণের ছবি জাগে বিজ্ঞানের আলোক নয়নে।

তেপান্তরের মাঠ আজ হাতের মুঠোয়, ঘরে বসেই দেখে নেয়া যায় চারিদিক
নির্বাসনেও তুমি রচিতে পার সুষমায়মণ্ডিত প্রিয়জনের মুখ
গতির চেয়েও আবেগ দ্রুত ছুটে চলে বল্গা হরিণের বেশ
সাধু সন্ন্যাসীজন রচিছে বাসর মধুচন্দ্রিমার আবেশ।

অবনি তোমার রসস্যভেদিতে বিজ্ঞানের নেই কর্ম-ক্লান্তি ক্লেশ
সন্ধানী নাবিক ছুটে চলেছে গ্রহ থাকে গ্রহান্তরে জানার নেশা আছে বেশ
জোনাকির আলোয় ঝিঝির সুরে রচিছে কবি গীতবিতানের ছবি
আপন দর্পণ আলোয় বিমূর্ত ছবি, মূর্ত আলোয় ভেসে ওঠে নিরবধি।

আমি কবি তব রহস্যভেদিতে কর্মক্লান্তির ঘটে যবনিকাপাত
আঁধারেই আঁকি, আঁধারের ছবি আঁধারের মাঝে হারায় স্বপ্নসাধ।

কুজ্ঝটিকা (শেষ পর্ব)

৭.
আমি আগে থেকেই অনুমান করে নিয়েছি নাবিল যে কোন সময় একটা মরন-কামড় দিতে পারে। সে অনুমান মিথ্যে হয়নি। এলাকার কিছু বখাটে ছেলে ঠিক করেছে আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন, ওরা আমার বেশ পরিচিত ছিল বিধায় যে ধারার ঝড় প্রবাহিত হতে পারত তা হয়নি। অল্পতে আকাশের মেঘ কেটে যায়। নাবিলের বাবা তাকে আবার বিদেশ ফিরে যেতে বাধ্য করে। পথের কাটা আর রইলনা বলে বেশ আমোদিত হলাম।

বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো সময়। আমাদের অনেক নতুন নতুন বন্ধু জুটল। আড্ডা এবং পড়া-লেখা সমানতালে চলতে লাগল। সিনিগ্ধা যে এই যাত্রায় পুরোপরি আমার সহযাত্রী একথা বলা চলেনা। আড্ডার নিত্য সঙ্গী হলেও লাইব্রেরিতে আমি একাই পড়তে যেতাম। এক্ষেত্রে আড্ডায় বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলোনা। ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে আমরা অবিচ্ছেদ্য জুটি হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করলাম। প্রতিনিয়ত অবসরে নতুন নতুন পরিকল্পনা বুনে চলেছি নিরন্তর। নিজের মাঝে বাড়তি দায়িত্ববোধে সবার আড়ালে পড়ালেখার মাত্রাটাও বাড়িয়ে দিলাম। ভালো রেজাল্ট করতেই হবে।

পরীক্ষা হল, রেজাল্ট হল। ক্লাস বিমুখ আদিত্যের রেজাল্ট সবাইকে হতচকিত করে তুলল। সবার প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেলাম। সিনিগ্ধা কেমন খুশি হল তা মাঝে মধ্যে বোঝা দায়। আমার ক্লাসে উপস্থিতি যাই হোক কিন্তু জীবনে একদিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলাম কিনা মনে পড়েনা।
প্রান্তিকের বাসায় আমার সাথে আমার আরেক বন্ধু থাকতো নকীব। অলস প্রকৃতির বলে কখনো দশটার আগে তার ক্যাম্পাসে যাওয়া হতোনা। সে আমার রাজনৈতিক সহযোদ্ধাও ছিল বটে। সে ছিল ল’ ফ্যাকাল্টির ছাত্র। সে সময় ল’ ফ্যাকাল্টি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দু নম্বর গেইটের পাশে। সে সুবাধে সিনিগ্ধার সাথে নকীবের মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে যেত। আমিই তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।

অবশ্য তাদের পরিচয়টা আমার বাসায় হয়েছিলো। একদিন বিকেল বেলায় সিনিগ্ধা আমায় হঠাৎ তার ছোট বোন সিন্থি মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, তাকে কয়েকদিনের জন্য পড়া তৈরিতে সহযোগিতা করতে হবে। তার যেহেতু বড় ভাই নেই সিন্থির দাবী আমাকেই সহযোগিতা করতে হবে। সে সুবাধে বেশ কয়েকবার ঘনঘন তাদের বাসায় যেতে হয়েছে। ভালোই কেটে যাচ্ছিলো আমাদের দিনগুলো।

সিনিগ্ধার আচরণটা কেন জানি আজ আমার কাছে অন্যরকম ঠেকল। আচ্ছা আদিত্য, তুই বাংলায় ভর্তি হয়েছিস? কী করবি এই সাবজেক্টে পড়ে। বড়জোর একটা কলেজের শিক্ষকতা!
– হ্যাঁ, আমি একটা কলেজের শিক্ষকই হতে চাই।
– তারপর!
– তারপর, আবার কী।
– তবে তো ভালোই!
আমি কথা আর বাড়াতে চাইনি বলে আর বেশি দূর এগোয়নি। প্রতিদিনের মত আজও আমরা অনেকক্ষণ একসাথে কাটিয়েছি কিন্তু অধিকাংশ সময় সিনিগ্ধাকে বেশ বিষণ্ণ মনে হয়েছে। বিষয়টি যে আমার চোখে পড়েনি তা কিন্তু ঠিক নয়। তবে মন খারাপের বিষয়টি ঠিকভাবে ধরতে পারিনি।
কিছুদিন পর আমাদের বন্ধু শিমুল আমার অন্ধ চোখের পদ্মা খুলে দিল।

আদিত্য তোকে একটা কথা না বলে পারছিনে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। একদিন নকীব তার একটা ডায়েরি আমাকে পড়তে দিল। তার কয়েকটা শব্দ আমার কাছে আজও অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমি আজও বিশ্বাস করতে পারছিনা। তোর সিনিগ্ধার সাথে কথা বলা দরকার।
– কেমন কথা! তার সাথে তো প্রতিদিনই কথা হয়।
– তা তো আমারা কেন, ক্যাম্পাসের সবাই দেখে।
– তবে, আর নতুন করে কী বলব?
– আচ্ছা, সরাসরিই বলি, নকীবের সাথে তার সম্পর্ক ক্যামন?
– নকীব, আমার বন্ধু হিসেবে যেমন থাকা দরকার তেমনই।
– আমার কাছে তেমনটি মনে হয়না।
– তবে, ঠিক আছে কালকেই আমি সিনিগ্ধা থেকে জেনে নেবো।
কিন্তু শিমুলের কথার এক পার্সেন্টও আমার আমার কাছে সত্য মনে হয়নি। সেটি যে ভাবনার বিষয় হতে পারে তাও একবারের জন্য মনে আসেনি।
পরেরদিন সকালে আমরা দুইজন বসে গল্প করছিলাম এমন সময় মনের অজান্তে সিনিগ্ধাকে বললাম, আচ্ছা নকীবকে তোমার কেমন মনে হয়।
– কেন? হঠাৎ নকীবের প্রসঙ্গ কেন?
– না, এমনি বললাম। কিন্তু আজ খেয়াল করলাম, নকীব প্রসঙ্গটিতে তার চেহারায় যে পরিবর্তন তা আর কখনো চোখে পড়েনি। তার চোখে মুখে একটা কেন জানি একটা অপরাধবোধের চাপ ফুটে উঠলো। তখন তাকে একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারলাম না। আচ্ছা, তোমার সাথে কি নকীবের মাঝে মধ্যে দেখা হয়?
– আদিত্য, আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বাধ্য নই।
– মানে?
– মানে, আর কী? জেনো আমি তোমার বন্ধু ছিলাম, এখনো আছি। এর বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করতে যেওনা। আর সকল বিষয়ে মাথা ঘামানোর অধিকার আমি কখনো দেই নি। এই কথা যেন আর কখনো স্মরণ করিয়ে দিতে না হয়। তোমার এতই যেন জানার ইচ্ছা, তবে জেনে রেখো নকীব সম্পর্কে যদি কোন কিছু জেনেও থাক, তা অসত্য নয়।
কথাগুলো বলে সে আর এক সেকেন্ড দাঁড়াবার প্রয়োজনবোধ না করেই বাসার দিকে ছুটে চলল। আমি লক্ষ্য করলাম আমার পায়ের কাছ থেকে যেন একে একে সব মাটিগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়াবার সবশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বেঁচে থাকার স্বপ্ন ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে আসছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ের সেই করুণ চাহনি, ছোটকাল থেকে মায়ের আঁচলে বড় হওয়া সেই সব স্মৃতিগুলো। মা, যেন ডাকছে আমায়। আয়, খোকা ফিরে আয়। সেইদিনের সে ডাক আর উপেক্ষা করতে পারিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফিরে এলাম মায়ের কোলে।

কুজ্ঝটিকা (ষষ্ঠ পর্ব)

৬.
যে বিষয়টি আমার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার নাবিল কখনো সিনিগ্ধার সামনে দাঁড়াতে পারবেনা। এতদিন যে বিন্দুমাত্র প্রেম তো দূরের কথা বলার সাহস দেখাতে পারেনি তাকে নিয়ে কীসের ভয়! দীর্ঘদিন প্রান্তিকের বাসায় থাকতে থাকতে এলাকার পাতি নেতা, বড় নেতা সবার সাথে ইতোমধ্যে কিছুটা সখ্যতাও হয়েছে। সময় মতো কাজে লাগানো যাবে। আর ভয় পেলে কি চলে!
সিনিগ্ধাঃ নাবিলের সাথে কি তোর আর দেখা হয়েছিলো?
– কেন, দেখা হবেনা? সে তো আমার বাসায় গিয়েছিল?
– মানে?
– মানে, আর কী?
– তোর সাথে কি খারাপ আচরণ করেছে?
– না, তেমন কিছু না। একটু ভয় দেখিয়ে কাবু করতে চেয়েছিল। তুই তো জানিস, আদিত্য কাউকে ভয় পায়না।
– আহ রে, আমার ভীর পুরুষ! তবে একটু সাবধানে থাকিস। আমার জন্য তুই অনেক বিপদে পড়েছিস।
– এ তো সামান্য। আমি তো আরও বিপদে পড়তে চাই।
– মানে?
– অতো মানে বুঝার দরকার নাই। চল, পুরো ক্যাম্পাসটা একবার চক্কর দিয়ে আসি।
– জানিস, নাবিলের বাবা কিন্তু ইউনিভার্সিটির টিচার। সেও কিন্তু একসময় ভালো ছাত্র ছিল।
– দেখছি, তুই তো তার অনেক খবর রাখিস!
– সে তো আমাদের ক্যাম্পাস স্কুলেই পড়তো। কিছু বখাটে ছেলের পাল্লায় পড়ে তার এই হাল। স্যার, পরে বাধ্য হয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। এইতো কিছুদিন আগে দেশে এসেছে। বিকেল হলে আমাদের বাসার চারপাশে ঘোরাঘুরি করে তবে বাসায় আসার সাহস নাই।
– বাসার আসার সাহস থাকলে কি সমাদর করতি!
– দূর, বোকা। তার সাথে কিছু হওয়ার থাকলে তো অনেক আগেই হতো। আদিত্য, পরীক্ষা যত ঘনিয়ে আসছে তত দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কিছু একটা করতে হবে।
– একটা কাজ করলে ক্যামন হয়? আড্ডাও হল পড়াও হল। চল, আমরা রুটিন করে অন্তত প্রতিদিন একঘন্টা করে লাইব্রেরিতে বসি।
– আমার যে পড়তে ইচ্ছে করেনা। আর তুই সাথে থাকলে পড়া হবে!
– কেন হবেনা? ওই এক ঘণ্টা আমরা কোন কথা বলব না।
– দেখা যাক, কাল থেকে কিছু একটা করতে হবে। শর্মিরা আজ ক্লাস শেষে আমাদের বাসায় যাচ্ছে, ইচ্ছে করলে তুইও আসতে পারিস। সবাই নানুর বাসায় গেছে, অনেক মজা হবে, চল।
ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় গেইট দিয়ে একটু সামনে গেলেই সিনিগ্ধাদের বাসা, পায়ে হাঁটার পথ। শর্মি, শান্তা, রাহা আমি একমাত্র ছেলে বন্ধু। শর্মির সাথে আগে থেকেই ঘনিষ্টতা থাকলে রাহা আর শান্তার সাথে আরও দুই একবার কথা হয়েছে। ওরা সিনিগ্ধার বেশ ভালো বন্ধু। ছোট্ট বেশ সাজানো গোছানো পরিপাটি বাসা, যা রুচিশীলতার পরিচায়ক।
অনেকক্ষণ কথা হল গল্প হল, খাওয়া দাওয়া হল। এবার ফিরে আসার পালা। তার এলবাম থেকে চুরি করে নিলাম। অবশ্য এটাকে চুরি বললে ভুল হবে। না জিজ্ঞেস করে নিয়েছি, এইটুকু । তখন সিনিগ্ধা বলল, শুন তোদের একটা গান শুনাই। সে টেপ রেকর্ডারে একটা গান ছেড়ে দিলঃ “ আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রেখো, আমায় পড়বে মনে, কাছে দূরে যেখানেই থাকো।”
গানের সুরে আন্দোলিত হতে হতে বাসায় ফিরে এলাম। এইদিনটি আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে রইলো। তাদের বাসার স্বল্প সময়ের সুখ স্মৃতি আমাকে কচি কিশলয়ের মত বার বার অনুরণিত করতে লাগলো। এইদিনটা যেন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। কেন জানি, রবীন্দ্রনাথের মত বার বার বলতে ইচ্ছে করছে, “ আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম। সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ।”

(চলবে)

কুজ্ঝটিকা (পঞ্চম পর্ব)

৫.
মনের মাঝে দারুণ এক বিষণ্ণতা খেলে যাচ্ছে। আমি হারিয়ে যাচ্ছি ভাবনার অতল গহ্বরে। আধোঘুম আধোজাগ্রত এক রজনী পার করে ক্যাম্পাসে এলাম প্রাত্যহিক নিয়মে। জানি, সিনিগ্ধা আসবে আমাদের ডিপার্টমেন্টে। তাই আজ অন্য কোথাও নয়। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, সিনিগ্ধার দেখা নেই তবে কি আজ আসেনি। না এসেছে, সকালের সূর্যোদয় একটু বিলম্বে হল আর তেমন কী?
– কী আদিত্য, কাল আসিস নি যে?
– কী করে বলি, আমি কী না এসে পারি! হ্যাঁ, এসেছিলাম, কিন্তু কিছু কাজ থাকায় এদিকে আসা হয়নি।
– না কি আমাকে এডিয়ে চলার চেষ্টা করছিস?
– এসব কী বলছিস? আর মনে মনে বললাম, তোর জন্যই তো ক্যাম্পাসে বিরামহীন আসা যাওয়া। চল, কোথাও গিয়ে বসি।
– কেন, আর কোন ক্লাস নেই?
– আছে, তবে সেটি না করলেও চলবে। চল।
– ঠিক আছে, চল। আজ মেরিন সাইন্সের ওইদিকে বসবো। জানিস ওইদিকে একটা সুন্দর লেক আছে। গিয়েছিস কখনো?
– না। ওইদিকে আমার যাওয়া হইনি কখনো। মনে মনে ভাবলাম, যাইনি ঠিক আছে, তবে এইটুকু জানি যারা নিরিবিলি বসতে পছন্দ করে তারাই শুধু ওইদিকে গিয়ে বসে। তার নিরিবিলি বসার আহ্বান আমাকে বেশি উৎসাহিত করে তুলল। নিঃসঙ্কোচে তার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম। মনের গহিনে ভেজে উঠলো সেই সুর, ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো, তোমার মনেরও মন্দিরে। গর্ববোধ হল, পরীক্ষা ছাড়াই উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম ‘বি’ ক্লাস থেকে ‘এ’ ক্লাসে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমরা চলে এলাম ক্যাম্পাসের সেই নির্জনতম স্থানটিতে। কেন মানুষ এস্থানটির নাম নির্জন স্থান নাম দিয়েছে সে রহস্য আমার জানা নেই। এটি মোটেও নির্জন নয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা এখানে আসা-যাওয়ায় থাকে বলে বিশেষ কিছু মানুষের দ্বারা সবসময় সরগরম থাকে। অবশ্য যাদের জুটি নেই, তারা তেমন একটা আসেনা বলে অনেকে এটি প্রেম নগর বলে চেনে।
আমরা বসার জন্য সুন্দর একটা জায়গা বেঁচে নিলাম। মানুষের হাঁটা- চলাচল থেকে বেশি দূরে নয় তবে রাস্তা থেকে ভালভাবে দেখা যায়না।
সিনিগ্ধা ভূমিকা ছাড়াই বলল, আজ আমি তোকে যে কথাটি বলতে চাচ্ছি সেটি শুনতে তুই প্রস্তুত আছিস কীনা আমি জানি না। ইদানিং তোকে আমাকে নিয়ে অনেক কথা বলাবলি হচ্ছে আমাদের বন্ধুদের মাঝে। তুই কিছু শুনেছিস?
– হ্যাঁ, শুনেছি। তো কি হয়েছে?
– কিছুই হয়নি। আমি সেগুলো মাথায়ই নিই নি। কিন্তু সমস্যা এখানে নয়।
– তবে কোথায়?
– আমাদের পাড়ার একছেলে আমাকে সেই স্কুল জীবন থেকে জ্বালিয়ে আসছে। সে মনে করছে, আমরা দুইজন প্রেম করছি তাই তোকে দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। গতকালও আমার যাওয়ার পথ আগলে একথাগুলো বলে গেলো। সে আমার কিছুই করতে পারবেনা কিন্তু তোকে নিয়ে আমি ভয় পাচ্ছি। আমাকে সময় দিতে গিয়ে তুই বিপদে পড়ে যাচ্ছিস!
– তুই জানিস না, আদিত্য এসবে ভয় পায়না। কী করতে সেটি আমার জানা আছে।
– ওই তো, সেই ছেলেটি। নাবিল ওর নাম। মনে হচ্ছে এইদিকেই আসছে।
নাবিলঃ সিনিগ্ধা, আমি তোমার বন্ধুটির সাথে একটু পরিচিত হতে চাই। ভাই, একটু আসবেন এইদিকে।
– কেন? ওর সাথে কী কথা? যা বলার আমাকে বল।
– তোমার বন্ধু কি ভয় পাচ্ছে? ভয়ের কিছু নেই। সিনিগ্ধার বন্ধু বলে কথা।
– আমি চাই, তুই এখান থেকে চলে যা।
নাবিল সেই সময় সুবোধ বালকের মত চলে গেলেও ঠিকই সন্ধ্যায় এ আআমার বাসায় এসে উপস্থিত। সাথে আরও দুইজন। সেই দুইজন আমার পরিচিত। আমাদের ব্যাচম্যাট তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ে। ক্যাম্পাসেই তাদের বাসা। তাদের দুইজনের কথা হল, নাবিল সেই ছোটকাল থেকেই সিনিগ্ধাকে পছন্দ করে কিন্তু সিনিগ্ধা তাকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারেনা। তারা আমাকে সরে যাবার অনুরোধ করে তারা বিদায় হল। যাওয়ার সময় নাবিল বলে গেল, আজ শুধু অনুরোধ করলাম। আমি আশা করব, আপনি আমার পথ থেকে সরে যাবেন। তা না হলে কী হতে পারে কল্পনাও করতে পারবেন না।

(চলবে)

কুজ্ঝটিকা (চতুর্থ পর্ব)

৪.

সিনিগ্ধার চিরকুটটি আমার কাছে একটা শ্রেষ্ঠ অর্জন মনে হল। তার প্রত্যুৎত্তর কী, আমার জানা ছিলোনা। শুধু মাথায় কাজ করছে তার জীবনটা আমাকে উৎসর্গ করেছে মানেই হচ্ছে সিনিগ্ধা শুধু আমার। আমি তার ভালোবাসার পরীক্ষায় জয়ী হয়েছি। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। শর্মিকে না দেখিয়ে বুক পকেটে যক্ষের ধনের মত লুকিয়ে রাখলাম আমার পবিত্র অর্জনকে। চিঠি বলি আর চিরকুট যাই হোক এটি আমার জীবনের প্রথম প্রাপ্তি। তার গুরুত্ব প্রকাশ আমার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে রইলো আজও।
হঠাৎ মনে হল সিনিগ্ধাকে তো ঠেকানো দরকার ছিল। আসলাম একসাথে অথচ আমাদের রেখে এভাবে চলে গেলো আমরা কিছুই বললাম না, নিজের কাছে কিছুটা অপরাধবোধ হওয়ায় শুর্মিসহ দুজন বেরিয়ে দেখলাম, সিনিগ্ধা তাদের নির্ধারিত বাসে বাসায় চলে যাচ্ছে। মনে হল লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আমাদের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আমাদের বেরুতে না দেখেই চলে যাচ্ছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হল। এখনকার সময় হলে বাসায় ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারতাম কিন্তু তখন সে সুযোগও ছিলোনা। পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় ছিলোনা। বাসায় গিয়ে ক্ষমা চাইব, সে সৎ সাহস কোন কালে আমার ছিল না।
শর্মি এতক্ষণ আমাকে মনে হয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলো। একটা কথাও বলেনি। নীরবতা ভেঙে সে বলল, কীরে আদিত্য- সিনিগ্ধা এভাবে চলে গেলো কেন? আর কাগজটিতে কী লিখে দিয়ে গেলো দেখি? আর তোর আপত্তি থাকলে আমার দেখার ইচ্ছাও নাই। আমার বান্ধবী কী এখন আমার আছে! এখন তো তোর হাতে তুলে দিলাম।
-যা, এগুলো কী বলছিস। সিনিগ্ধা তোকে অনেক পছন্দ করে। তোর মাধ্যমেই তো ওর সাথে পরিচয়।
– হ্যাঁ, তা বৈ কী। কিন্তু ক্যাম্পাসে তো তোদের সবাই একনামে চেনে।
– কেন চেনবেনা? আমরা তো আর লুকিয়ে আড্ডা দেই না। খোলা ময়দানে বসেই গল্প করি।
– তা বটে। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে যাওয়া তো ভুলে যাচ্ছিস! একবার নন-কলেজিয়েট হলে বুঝবি।
– নন-কলেজিয়েট হবো কেন। চেয়ারম্যান স্যারের সব ক্লাসে তো উপস্থিত থাকি।
– শুধু চেয়ারম্যান স্যারের ক্লাস করলে হবে? অন্য ক্লাস করতে হবেনা!
এভাবে শর্মির সব কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছি বটে কিন্তু সব কথা যেন মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিছুই ধরতে পারছিনা। তাই বললাম, আরে বাদ দে। দেখবি পরীক্ষায় আমি ঠিকই ছক্কা হাঁকাবো।
– জানি, তুই একটু চেষ্টা করলে ভালো করবি, সে কথা আর কেউ না বুঝলেও অন্তত আমি বুঝি।
লাইব্রেরির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এভাবে জ্ঞান দিবি, নাকি চা পানি কিছু হবে। চল, ঝুপড়িতে গিয়ে বসি কিছুক্ষণ।
– না রে, আজ বসতে পারবোনা। বাসায় কিছু কাজ আছে। আমাকে এখনি যেতে হবে। শর্মিও বাসার দিকে চলল।
এখন ভাবনার অন্তহীন গভীরে ডুবে যেতে লাগলাম। এটি কী অর্জন নাকি বিসর্জন। কোন কিছুই মাথায় ডুকছেনা। তবে উৎসাহ যোগাচ্ছে, “জীবনটা তোকে উৎসর্গ করলাম“ এই কথাগূলো। অনভিজ্ঞ জীবনে মনে হল, এ প্রেম নিবেদনের এক অভিনব পন্থা ভেবে উৎসাহিত হলাম। সত্যতা নির্ণয়ের কোন উপায় না থাকায় আমিও আমার ক্ষুদ্র নিবাসে ফিরে এলাম।
পরেরদিন সকালে ক্যাম্পাসে আসার বাসের জন্য অপেক্ষা না করেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম ক্যাম্পাসে। সাত টা পঁয়তাল্লিশ থেকে আমাদের ক্লাস শুরু হতো। কিন্তু ফ্যাকাল্টিতে এসে দেখি তখনও সাত টাও বাজেনি। মনে হয় ফ্যাকাল্টিতে আমিই প্রথম ব্যাক্তি! তখন থেকে সিনিগ্ধার আসার অপেক্ষা। অপেক্ষার প্রহর অতিক্রম করা কতটা কষ্টের একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বোঝে।
ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে, ডিপার্টমেন্টে যাওয়া হয়নি। আমাদের আড্ডার নির্দিষ্ট একটা যায়গা আছে, তার চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগলাম। কখন সিনিগ্ধা আসবে, সে অপেক্ষায়। কিন্তু সিনিগ্ধার আসার কোন নামগন্ধও নাই। তবু যায়গাটি ছেড়ে যেতে মন চাইছেনা। তবুও অপেক্ষা। যদি আসে…।
সাতটা, আটটা, নয়টা, কখন বারটা বেজে গেছে টেরই পাইনি একথা ঠিক নয়। কিন্তু উপায় খুঁজে বের করতে পারিনি বলে, অপেক্ষা ভিন্ন অন্য কোন পথ দেখিনি। এর মধ্যে অনেকে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, শর্মি ক্লাস শেষ করে কথায় যাচ্ছিলো। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো।
– কীরে, আদিত্য। ক্লাসে গেলি না যে?
– ক্লাস করতে মন চাইছিলোনা, তাই যাওয়া হলনা। সিনিগ্ধাকে দেখেছিস?
– কেন? তোর সাথে দেখা হয়নি? সে তো এতক্ষণ আমাদের সেমিনারে বসা ছিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। বললাম, তুই আসিস নি। তাই চলে গেলো।
– যাওয়ার আগে তো একবার এখানে আসতে পারত।
– মানে? এখানে তো তোর সাথেই আসে। তুই নাই কেন আসবে?
– জী, জনাব। আজ ধরা পড়ে গেছেন। ভাবছিলেন, ক্লাসে না গিয়ে লম্বা একটা আড্ডা দেবেন সিনিগ্ধাকে নিয়ে। সিনিগ্ধা বসে আছে আপনার খোঁজে আপনার ডিপার্টমেন্টে, আর আপনি এখানে! বাহ! চমৎকার। বাহ! সিনিগ্ধা এতক্ষণে সম্ভবত আপনাকে না পেয়ে বাসায় চলে গেছে। কী আর করা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চাইলে আমার সাথে আড্ডা দিতে পারেন।
শর্মির সাথে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম বটে, কিন্তু মন যেন ছুটে চলছে সিনিগ্ধার পানে। শর্মির কথায় কিছুটা উৎফুল্ল হলাম কিছুটা, সিনিগ্ধা আমাকে খুঁজতে অনেকক্ষণ আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছিল! অবশ্য আমার তুলনায় সেই আমাকে খুঁজতে প্রায় আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসে। কিন্তু আজ একবারও মনে হয়নি, আজও সে আমার জন্য আমাদের সেমিনারে বসে আছে! কিংবা তার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে তার একবার খবর নিয়ে আসার কথা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজেকে বেশ বোকা বোকা মনে হল। আরও একটি দিনের জন্য অপেক্ষা, ভাবতে ভাবতে শর্মিকে বিদায় দিয়ে বাসারদিকে চললাম।

কুজ্ঝটিকা (তৃতীয় পর্ব)


সিনিগ্ধার চেহারায় বিষণ্ণতারচাপ আছে কিন্তু কথা বলতে গেলে বেশ মিশুক প্রকৃতিরই মনে হয়। সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। রাগও আছে অসম্ভব, তাই কথা বলতে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। দুএকদিনের মধ্যে আমাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে। শর্মি না থাকলেও আড্ডা দিতে কোন সমস্যা হয়না। সরাসরি গ্রাম থেকে এসেছি বলে আমার জড়তাগুলো ধীরেধীরে কাটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি।

ইদানিং আমার ডিপার্টমেন্টে তার আনাগোনা বেড়েছে। ক্লাসের সুযোগে কিংবা ক্লাস করার অনিচ্ছাতে আমাদের বিভাগীয় সেমিনারে তার একটা অস্থায়ী ঠিকানা গড়ে নিয়েছ। তাকে সেমিনারের সামনে দেখলে আর কি মন বসে ক্লাসে! জারুলতলা যেন ডাকছে আমাদের আয়, ছুটে আয়। ক্লাসে রুটিনের সাথে দুজনের নিবিড় আড্ডার একটা ক্লাস যুক্ত হয়েছে। ক্লাসে ফাঁকি চলে, দুজনের গল্পে ফাঁকি চলেনা। এ যেন এক অবধারিত কর্মসূচি। ঝড় বৃষ্টি বাদল কোন কিছুতে ক্লান্তি নেই। ক্যাম্পাসও যেন মেনে নিতে চায়না দুজনের দেখা না হওয়া। অল্পদিনে ক্যাম্পাসের সবার পরিচিত মুখ হয়ে উঠলাম। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি কোনকিছু বাদ যায়না আমাদের আলোচনায়।

ক্যাম্পাসে আমাদের বন্ধুর সংখ্যা বেশ কিছুটা বেড়েছে। গল্প গান বেশ আনন্দে কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। মাঝে মাঝে ভাবি, যে আদিত্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে, সে কি সঠিক পথে এগুচ্ছে! ভুলে গেছে মায়ের স্বপ্ন!। জানিনা এ কোন মায়ার বন্ধনে জড়াচ্ছি? প্রাত্যহিক রুটিনে পরিবর্তন আসে, একটা রুটিনে কখনো পরিবর্তন আসেনা, সিনিগ্ধার সাথে ছুটিয়ে আড্ডা দেয়া। আমার ক্লাসের প্রতি সিনিগ্ধা অনেক যত্নশীল। ক্লাস ফাঁকি দেয়া তার বেশ অপছন্দ। আমার ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ক্লাসের সামনে বসে থাকবে কিন্তু ক্লাস না করে চলে আসাটা সে কোনোমতে মেনে নিতে পারতোনা। কিন্তু নিজের ক্লাসের প্রতি ছিল বেশ উদাসীন। সপ্তাহান্তেও একদিন ক্লাসে যেতো কিনা সন্দেহ। ইদানিং অনেকে সিনিগ্ধাকে আমার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী মনে করে ভুল করতে শুরু করেছে। হঠাৎ আজ সিনিগ্ধার মুখে এ কী শুনি!

জানিস আদিত্য, আমাদের প্রথম বর্ষের পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে।
-জানবোনা কেন? আমাদের পরীক্ষাও তো একসাথে হবে।
-ও, তাইতো।
-পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে তো কী হয়েছে? তুই পরীক্ষা দিবি?
-কেন দেবনা? জানিস না, ফাস্ট ইয়ারে ড্রপ দেয়া যায়না? ভর্তি বাতিল হয়ে যাবে। পরীক্ষা না দিলে বাবা অনেক রাগ করবেন।
– ক্লাসে যাসনা, কী পরীক্ষা দিবি!
– চল, আজ লাইব্রেরি ওয়ার্ক করি।
– ঠিক আছে, চল।
যে কথা, সেই কাজ। দুজনে চললাম লাইব্রেরির দিকে। পথে শর্মির সাথে দেখা হয়ে গেল। কী রে কোথায় যাস? আমাদের তো ভুলেই গেলি।
– এসব কী বলছিস। সবার আগে তো তোর সাথেই দেখা হয়। কিছুক্ষণ আগে তো একসাথে ক্লাস করে বের হলাম।
– তার পর তো কোথায় উধাও হয়ে যাস, আর দেখা যায়না। লুকিয়ে লুকিয়ে জল খাচ্ছিস বুঝি!
– ছি, এসব কী বলছিস?
– সিনিগ্ধা আমার যেমন বন্ধু, তোরও তো তাই।

সিনিগ্ধাঃ তোরা কি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করবি? নাকি লাইব্রেরিতে যাবি, আমি যাচ্ছি কিন্তু।
শর্মিঃ দাড়া, আমিও যাবো।

তিনজন ছুটে চললাম লাইব্রেরির দিকে। একগাদা বই নিলাম। আজ আমরা বেশ মনযোগী স্টুডেন্ট। কিন্তু সিনিগ্ধা যেন কিছুতে পড়ায় মন বসাতে পারছেনা।
জানিস আদিত্য, ইদানিং আমার কিছুতে মন বসছেনা। আমার কাছে কোন কিছুই ভালো লাগেনা। একটা সাদা কাগজ দে, দেখি কিছু লেখা যায় কিনা? কী লিখছে সে দিকে না তাকিয়ে আমি আর শর্মি রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে কিছুটা আলোচনা করছি। সিনিগ্ধা তার নিজের মত লিখছে। হঠাত কোন কথা না বলে, তার লিখা কাগজটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল। কাগজটি লিখা ছিল-
আদিত্য,
আমার কোন কিছু ভালো লাগেনা। আমার ভালো না লাগা জীবনটা তোকে উৎসর্গ করলাম। এ জীবন নিয়ে তুই যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিস। আমাকে বাঁচিয়েও রাখতে পারিস। চাইলে হত্যাও করতে পারিস।

… ইতি
সিনিগ্ধা।

(চলবে)

কুজ্ঝটিকা (দ্বিতীয় পর্ব)

২.
অন্যদিনের তুলনায় আজকের রাতটা বেশ উত্তেজনায় কাটে। হোক না সে এক ব্যর্থ প্রেমের প্রতিচ্ছবি। তাতে কী ! সে একা, এটিই আমার কাছে ধ্রুব সত্য। এক পলকের দেখায় মনে হল, আমার কল্পনার নারীর সব গুণই তার কাছে বিদ্যমান। কেমন পাষাণ হলে এমন নারীকে ছেড়ে কেউ পালাতে পারে! আবার ভাবি, সে না পালালে তো আমার ভাবনার অবকাশও ছিলোনা। মনে মনে ধন্যবাদ জানাই ঐ পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী ছেলেটিকে। আমার কল্পনার সব বৈশিষ্ট্য আছে সিনিগ্ধার কাছে। কেমন নিরীহ মায়া হরিণী চাহনি! এমন ছোটখাটো পাটকাঠির মতো চেহারা। আমার আজন্ম লালিত স্বপ্নের রমণী ঠিক এমনই। সেই ছোট্ট বিড়াল শাবকের মত কোলে লুকিয়ে রাখা যায়। মনে মনে ভাবলাম বিধাতা কারো মনের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেনা। তাইতো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি!
ক্যাম্পাসে এলাম। মন কী বসে ক্লাসে! যদি দেখা হয় কীভাবে শুরু করব। বেশ কিছু শব্দ জাল তৈরি করলাম। বারবার মনে মনে আবৃত্তি করলাম। আবার কী চিন্তা করতে করতে সব ভুলে গেলাম, সব। আবার নতুন শব্দের শব্দ বুনন। আবার নতুন চিত্রকল্প! আবার ভুলে যাওয়া। আবার নতুন সংলাপ…।
এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুটা সময়। ক্লাসের সামনের করিডোর হাঁটাহাঁটি। সিনিগ্ধার গতদিনের বসার জায়গাটা বারবার দেখে নেয়া, এভাবে লম্বা একটা সময় কেটে যায়। পেছন থেকে শর্মিষ্ঠা ডাক না দিলে আজকের পুরো দিনটাই হয়তো এভাবে কেটে যেত।
কীরে আদিত্য, ক্যামন আছিস? ক্লাসে গেলিনা, এভাবে এখানে পায়চারি করছিস কেন? কারো জন্য অপেক্ষা করছিস? চল, ঝুপড়ি থেকে চা খেয়ে আসি। ভাবলাম মন্দ হয়না। যদি সিনিগ্ধার সাথে দেখা হয়ে যায়। তা হলেতো কথাই নেই। তাই বললাম, ঠিক আছে চল।
শর্মির সাথে যাচ্ছি, চা খেতে, কিন্তু মন যেন খুঁজে চলছে অন্য কিছু! আবার শর্মির প্রশ্নে চেতনা ফিরে পেলাম। কীরে আদিত্য, কী ভাবছিস?
কই, নাতো। কী ভাববো!
তোরে আজ অনেক বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। নাকি, ক্যাম্পাসে আসতে না আসতে কারো প্রেমে মজেছিস?

শর্মিদের বাসা এই ক্যাম্পাসেই। তাই সব কিছু তাদের আগে থেকেই চেনা। সিনিগ্ধা আর শর্মি দুজনই উনিভার্সিটি কলেজ থেকে পাশ করেছে। তাদের বন্ধুত্বও তখন থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আজ প্রথম এলাম ঝুপড়িতে। তাও আবার এক মেয়ে বন্ধুর সাথে। ভুলে যাচ্ছি অতীতের সব সংস্কার। মনে বিন্দুমাত্র শঙ্কা নেই। কে আমাকে এখানে চেনে। আমি এক সম্পূর্ণ স্বাধীনসত্তা। আর মনে মনে ভাবলাম, প্রেমে কি ভয় পেলে চলে!
একটা দোকানে বসতে যাবো এমন সময় দেখি, সিনিগ্ধা বসে একটা টেবিলে একা একা। তাকে দেখে যারপরনাই, খুশি হলাম বটে পাছে কিছু ধরা পড়ে সে ভয়ে গম্ভীর হয়ে সৌজন্যতার খাতিরে শুধু এইটুকু বললাম, জী আপনি এখানে? ভালোই হল, চা খেতে খেতে কিছুটা গল্প করা যাবে।
জী, ভালো আছি। আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমরাতো ইয়ারম্যাট। এ কথাগুলো বলে সে শর্মির সাথে কথায় মগ্ন হয়ে গেলো। পাশে বসে নীরব শ্রোতার মত তাদের কথা শুনে গেলাম।
কী বলব! কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা। সকালের সংলাপ, রিহার্সেল, সব ভুলে গেলাম, সব।

(চলবে)

কুজ্ঝটিকা


আমার নাম নিয়ে এখনো আমার কাছে একটা গোলকধাঁধা কাজ করে। কী করে আমার নাম আদিত্য হল! এ নিয়ে আমার মাঝে বিস্ময়ের অন্ত নাই। আমি যেখানে জন্ম নিয়েছি, সেখানে ছিলোনা কোন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, ছিলোনা বিজলিবাতি। নিখাত একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল। আধুনিক নাগরিক জীবন আমার কাছে কুজ্ঝটিকা বৈ অন্য কিছু ছিলোনা। আমি এখনো নিজেকে কুয়োরব্যাঙ ভাবতে সার্থকতা বোধ করি। তার মাঝে এমন একটা আধুনিক নাম আমার কী করে হল!
কুয়ারব্যাঙ নিজের আবাসস্থলকে বিশাল সমুদ্র মনে করে। কারণ সে কখনো সমুদ্র দেখেনি। বুদ্ধি হবার আগে বাবার মৃত্যুতে আমাদের কখনো শোনা হয়নি নাগরিক জীবনের গল্প। মায়ের কাছে শুনবো, মা-ও তো কখনো শহর দেখেননি! গ্রাম আমাদের কাছে আদর্শ হয়ে রইলো চিরকাল। গ্রামীণজীবনের সরলতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাসের মর্যাদায় এখনো পথে খুঁজি নিরন্তর।

যতদূর মনে পড়ে যখন নবম শ্রেণিতে পড়তাম তখন নিজের উদ্যোগে সম্ভত প্রথম শহরে আসি। আমি জন্ম থেকেই কিছুটা ভীতু প্রকৃতির। কারো সাথে নিজের থেকে পরিচিত হওয়া, আলাপ করা কল্পনার অতীত ছিল। নারী হলেতো কথায় নেই, হাজার মাইল দূরে থাকতাম।
একসময় বড়বড় শপিং মলগুলোতে যেতে ভয় পেতাম। কী করে দরদাম করতে হয় কিছুই জানা ছিলোনা। পঞ্চাশ টাকার জিনিস একশ টাকায় কেনার ইতিহাস আমার জীবনে কম নেই। জীবনের শিক্ষার বিশাল একটা অংশ নিজ উদ্যোগেই শিখে নেয়া। মা কখনো তাঁর আঁচল থেকে বেশি দূরে যেতে দিতেন না। মাধ্যমিক উচ্চমাধমিক তাই গ্রামের পাঠশালায় কেটেছে।

বড় কী হব? কী হলে ভালো হবে? কেউ কোনদিন বলে দেয়নি! সহপাঠীদের মধ্যেও কাউকে উচ্চ বিলাসী স্বপ্ন নিয়ে বড় হতে দেখি নি। বরং বন্ধুরা আমাদের আদর্শ মনে করতো। ক্লাসে ফাস্ট সেকেন্ডের মধ্যেই রোল ছিল, কখনো তৃতীয় হয়েছিলাম কিনা মনে পড়েনা। হয়তো সঠিক নির্দেশনা পেলে এগিয়ে যেতে পারতাম বহুদূর।

মনে পড়ে যখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়তাম, তখন একদিন দেখি প্রথম ক্লাসে এলেন ছয় ফুটের মত লম্বা, বেশ সুদর্শন এক যুবক। তিনি আমাদের বাংলা শিক্ষক। অনেক সুন্দর করে কথা বলতেন, অসাধারণ বাচনভঙ্গি। মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকতাম তাঁর দিকে। শুধু আমি নয়, পুরো ক্লাস। মেয়েদেরে কথাতো বলা বাহুল্য। এই প্রথম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। বলা যায় এটি আমার জীবনের প্রথম স্বপ্ন দেখা। যদি স্যারের মত শিক্ষক হতে পারতাম!

সে সময় অনুসারে উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল খারাপ ছিলোনা। কলেজে কিছু নতুন বন্ধু পেলাম, নতুন গল্প পেলাম। তাও যে বেশ সমৃদ্ধ ছিল বলা চলেনা। কলেজের শিক্ষক হতে হলেতো বিশ্ববিদ্যালয় পাশ হতে হবে একথা ভালো ভাবেই বুঝে ছিলাম। তাই মায়ের কাছে এই প্রথম কোন আবদার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেব। মায়ের ইচ্ছা না থাকলেও সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সেই দিন না করেন নি। আত্মীয় স্বজন উৎসাহের তুলনায় নিরুৎসাহিত করেছিল বেশি পরিমাণে। মায়ের হাতছাড়া হবার ভয়!

ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। পাশও করলাম। চাইলে ভালো বিষয় নিয়ে পড়া শুনা করতে পারতাম। ঐ যে কুয়োরব্যাঙ ছিলাম, বড় স্বপ্ন দেখতে শেখা হয়নি। বাংলাতেই ঠিকানা হল। আরেকটা গোপন কথা বলি, প্রেম করেনা এমন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সেটি আমার কল্পনার অতীত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন যুগল দেখে সে বিশ্বাস আরও প্রকট হল। একদিন প্রথম ক্লাসের পর জানতে পারলাম ময়ুখ স্যার আজ ক্লাস নেবেন না। তাই একঘণ্টার একটা বিরতি পেয়ে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি বেশি দিন হয়নি। বাইরে কোথায় যাবো ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে ক্লাসের সামনের করিডোরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম অলস সময় পার করতে। জারুলতলায় তলায় জোড়া জোড়ায় বসে আছে অনেক কপোত-কপোতী। ঠিক একটা জায়গায় গিয়ে চোখটা আটকে গেলো। অনতিদূরে হালকা গড়নের ছোটখাটো একটা মেয়ে একা বসে আছে। আশেপাশে কোন ছেলে চোখে পড়লনা। হয়তো ভাবলাম তার সঙ্গীটি আজ ভার্সিটিতে আসেনি। হঠাৎ পেছন থেকে শর্মিষ্ঠার এক মৃদু ধাক্কায় চৈতন্য ফিরে পেলাম। কীরে কাকে দেখছিস? বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোন মেয়ের সাথে এই প্রথম কথা বলা। এতক্ষণ যাকে দেখছিস, চল পরিচয় করিয়ে দেবো তোর সাথে। ও আমাদের বন্ধু স্নিগ্ধা। শর্মিষ্ঠা এমনভাবে কথা বলছে, আমি যেন তার জনম জনমের পরিচিত! একই ক্লাসের বলে শর্মিষ্ঠা আমার নাম জানত। কিছু না বললেও মনে মনে ভাবলাম শহরের মানুষ মনে হয় এমনই হয়।

শর্মিষ্ঠার ঐ মেয়ের সাথে পরিচিত হবার অনুরোধ সেই দিন উপেক্ষা করতে পারিনি। ইচ্ছা অনিচ্ছার দোলাচলের মাঝে তার সাথে হাটতে শুরু করলাম। জানিস আদিত্য, স্নিগ্ধা কিন্তু একদম নিঃসঙ্গ। ও কলেজে একটা ছেলের সাথে প্রেম করতো। ছেলেটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে থেকে কারো সাথে তেমন কথা বলে না। সবসময় এভাবে একা একা বসে থাকে। কথাটি শুনে সেদিন কী পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম তা ভাষায় রূপ দেয়া আমার পক্ষে সাধ্যের অতীত।

(চলবে)

মেঘপরীদের সাথে

সন্ধ্যা আর আমার স্বপ্নরাজ্যের দ্বার অতি নিবিড় হয় তোমার পরশে
স্বপ্নকন্যারা পরীর মতন ভেসে ভেড়ায় নীল আকাশে
আমি প্রতিটি শিশির ফোটায় মুক্তো রচি বারোমাস
জল কেলিতে এখন আর মন বসেনা, সেতো নাতিদীর্ঘ উপন্যাস।

মেঘের ভেলায় স্বপ্নেরা ভেসে যায় দূর আকাশে
আমি বন্ধনহীন শিকড় ছেড়ে সঙ্গী হই স্বপ্ন সারথির আশে
আমার মাঝে আমি হই লীন, থাকেনা কোন ক্লেশ
যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্র থেকে কিছুটা মেলে শান্তির আবেশ।

মেঘের আড়ালে পূর্ণিমা রচে জ্যোতিময় আলোর মিছিল
থাকেনা তোমার আমার বিচ্ছেদ রেখা; মায়াময় স্বপ্নিল
সেখানেও বাজে সন্ধ্যার মেঘমালায় ঝিঝির ডাকে ঘুমের নূপুর
ক্লান্তি অবসাদ মুছে যায়, থাকেনা যন্ত্রের কোলাহল যেন রাতের মধ্যদুপুর ।

পরীদের সাথেও হয় খুনসুটি, তাতেও আছে ভালোবাসা মাখামাখি
প্রাত্যহিক জীবনের মোহভঙ্গের গান রচেনা তারা, স্বার্থের মায়াজালে হয়ে মুখোমুখি
প্রতিদানে হিসেবে ভালোবাসায় করেনা মিথ্যে অর্ঘ বিতরণ
মেঘের ভেলায় ভাসে, মেঘের ভেলায় রচে ভালোবাসার বিশুদ্ধ উচ্চারণ।

বিগলিত প্রেম

মন একবার বিগলিত হয়ে গেলে তাকে ফেরানো দায়
দূর্গম কন্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথে পাড়ি দিতে হয়না ভয়
কুজ্ঝটিকা রাতে গভীর অরণ্য থেকে কুঁড়িয়ে আনি শিশির মুক্তা
পদানত হইনি কভু, পাখা মেলি অসীম আকাশে বুকে নিয়ে শান্তির বারতা।

যে রূপ দেখেছি মায়া হরিণী কুসুমকোমলা চিরহরিৎ বাংলায়
হীরা জহরত শ্বেত পাথরে গড়া অট্টালিকায় পাইনি সুখ মায়া
ঘুরে ফিরে ভাসে সেই চির চেনা মুখ মনের অন্দরে
নির্বাসনে গেলোও স্বপ্নবাসর রচিবো তোমায় নিয়ে অচেনা বন্দরে।

তোমার চেয়ে রূপসী অনন্যা রয়েছে জগত সংসারে
বিগলিত হয়না দেহ মন সেই রূপ দর্শনে
অরণ্যচারী পথিকের বসেনা মন সুরম্য অট্টালিকায়
খুঁজে ফেরে সুখ, অজানা কোন এক বৃক্ষ ছায়ায়।

তোমাতে আমি মজেছি, আমায় করে নিঃস্ব
কত মনোহর রূপ হেরিলাম, সবই মনে হয় ভীবৎস
আঁধারের মাঝে আছি, আঁধারের মাঝে থাকি, আধারেই খুঁজি সুখ
ভাবিনা কখনো আছে প্রয়োজন তোমার চেয়ে অধিক জ্যোতিময়ী মুখ।

সিন্থিয়া


নির্লিপ্ত হবার মহান ব্রত আমার দীর্ঘদিনের। হৃদ মন্দিরের দেয়াল যত পাষাণ দিয়ে তৈরি করা যায় তাই চেয়েছি অনাদিকাল। খাঁটি এক পর্যটকের মত দেখে যেতে চাই। হয়তো এমন হতে পারলে সুখের অভাব হতোনা কস্মিনকালেও। আমি তেমন সুখের সন্ধানী। চলছিল বেশ।
হঠাৎ এক ঘুর্ণিঝড় যেন সবকিছু এলোমেলো করে দিল। পথের প্রতিটি ধূলিকণা আমার বেশ ভালো বন্ধু ছিল। তাদের দেখতে দেখতে আমার নিরন্তর পথচলা। আমায় না দেখে তারা যেমন থাকতে পারতোনা আমারও তাদের না দেখে যেন থাকা দায় ছিল। নির্মিলিত চোখ আজ উর্মিলিত হল এ কোন যাদুকরী শব্দে!
ক্যামন আছিস সীমান্ত?
জী, ভালো আছি। ভদ্রতার ন্যূনতম বালাই না দেখিয়ে কেটে পড়লাম।
তারপরও সিন্থিয়ার এমন সম্মোহনী সম্বোধন কেন যেন বারবার ধ্বনিত হতে লাগলো হৃদমন্দিরে। হয়তো এমন শব্দ এর আগে শুনিনি বলে তা যে ভাবনার বিষয় হতে পারে তাও ভাবার প্রয়োজন বোধ করিনি। ক্লাসের সবাই আমার আড়ালে আমাকে যে নিরামিষ বলে ডাকে তা যে আমার কানে আসেনি তা নয়। এ নিয়ে চিন্তা করার সময় আমার কোথায়! যার ভাবনা তার সাথে। আমারতো দিন ভালোই কাটে যাচ্ছে। জ্বালা নেই, নেই কোন যন্ত্রণা। সকালে ক্লাসে আসি, ক্লাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে বাসায় ফিরি। ট্রেনে কারো জন্য সীট পাহারা দেয়া, কারো জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করার মত ফালতুসব দায়িত্ব আমার নেই। এমন ছেলেদের ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমার কেন যেন সবসময় একটা প্রশ্ন থেকে যেত। তাদের দেখলে সবসময় নিরীহ অসহায় মনে হত। উঠবস করতেও যেন পাশে বসে থাকা মেয়েটির অনুমতি নিতে হতো। কেমন অসহায়!
সিন্থিয়া আজ ক্যামন আছিস? এ কথা বলে ক্ষান্ত হয়নি, পেছন থেকে হাত টেনে ধরল।
আজও মুখস্ত করা সেই সরল উত্তর, জী ভালো আছি।
কোথায় যাচ্ছিলে?
জী, ক্লাসে যাবো।
নোটিশ দেখিস নি? স্যার আজ ক্লাস নেবেন না। চল, তুই আজ আমাদের চা খাওয়াবি। মা প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকা দেয় ক্লাসে আসতে। আমি অক্ষত সে টাকাটি আবার বাসায় ফিরে মাকে ফেরত দিই। মা যে এতে খুশি হন তা বলা যায়না। আজও তাই পকেটে সে পঞ্চাশ টাকা আছে। তবু বললাম, আমার কাছে কোন টাকা নেই। সিন্থিয়া নাছোড়বান্ধা। সহজে হালছাড়ার পাত্রী নয়। ঠিক আছে আমি খাওয়াবো, চল। উপেক্ষা করার কঠিন বাঁধনে আবদ্ধ হলেও সেদিনে সে ডাক উপেক্ষা করতে পারিনি। যেতেই হল তাদের সাথে। তবে কি পাষাণ গলতে শুরু করেছে…।


সিন্থিয়া রুটিন করে আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসা শুরু করেছে। আমার চেয়ে তার কাছেই আমাদের ক্লাসের খবর বেশি। আমার মাঝে আমি কোন একধরণের পরিবর্তন অনুভব করছি। কখনো তার আসতে দেরী হলে কেন জানি একধরণের অস্থিরতা অনুভব করি। আমিতো বৃক্ষ, ইচ্ছে থাকলেও নিজে তার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খবর নেয়ার সাধ্য নাই। অপেক্ষা করি, অপেক্ষা দীর্ঘতর হয়, অভিমান চেপে রাখি।
আমার অপেক্ষা ব্যর্থ হয়না। আমরা ইদানিং সবার থেকে আড়ালে বসতে পছন্দ করি। কিছু কিছু ক্লাস ফাঁকি দেওয়াও শুরু হয়েছে।
আমার ক্লাস ফাঁকি দেওয়া সিন্থিয়ার বেশ অপছন্দ। তাই কায়দা করে কিছুটা মিথ্যা আয়ত্ব করে নিয়েছি। আড্ডা চলে নিরন্তর। সিন্থিয়ার রিক্সা ছড়ার বেশ শখ। কারণে অকারণে কতবার রিক্সা ছড়েছি, তার পরিসংখ্যান নেই।
আজকাল সিন্থিয়াকে কেন জানি অন্যরকম মনে হয়। কী জানি কী হয়েছে। জিজ্ঞেস করার মত সাহসের অভাব তো আমার সেই জন্মলগ্ন থেকে। তাই জিজ্ঞেস করা হয়না। জিজ্ঞেস করেই বা কী লাভ। সবার তো একটা ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। ও তো আমার বন্ধু বৈ অন্য কিছু নয়। আমার কাছে তার কাজের হিসাব দিতে বাধ্য নয়। ঐ তো এসে গেছে।
চল, তোর সাথে আজ আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। কোন ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলো সিন্থিয়া। অপূর্ব আজ আমাকে প্রেম নিবেদন করে বসেছে। তার সাথে আমার সেই স্কুল থেকেই পরিচয়। শুন তোকে আজ একটা সত্যি কথা বলি, রাগ করবিনা তো? তার সাথে একদিন বাজী ধরে তোর সাথে বন্ধুত্ব শুরু করি। ওই তো অপূর্ব আসছে। চল, তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
অপূর্ব, এই হচ্ছে সীমান্ত। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। দুজনে হাত মেলালাম।
অপূর্ব তাদের সাথে ঘুরতে যাবার আহ্বান জানালো। জরুরি ক্লাসের কথা বলে আমিই কেটে পড়লাম। মনকে প্রবোধ মানালাম, আমদের বন্ধুত্ব তো ঠিকই আছে। তবু নিঃসঙ্গতার মাঝে আলো আঁধারের খেলা চলে বারোমাস। অধিকার চাইনি বলে, ঘূর্ণিঝড় যে উঠেনা তা কিন্তু ঠিক নয়।
রাতের আঁধারে নিঃসঙ্গতার মাঝে আজকাল বেশ অশ্রুপাত হয়। সেটি সবার অলক্ষে হয় বলে, নিজের মাঝে কিঞ্চিত গর্ববোধ আছে তা নিয়ে। সকাল হলে পাষাণ হৃদয়ের মানুষ সেজে অভিনয় করি বন্ধুত্বের মহিমা বর্ণনায়। ইদানিং অনেকে প্রশ্ন করলে সগর্বে সেই সাজানো উত্তর ‘আমরা ভালো বন্ধু।‘ সিন্থিয়াও নিপূন অভিনেত্রী বটে। রুটিন করে দুজনের মন রক্ষা করে চলছে। আমিও মেনে নিয়েছি, আমার চেয়েতো অপূর্বের অধিকার একটু বেশি।


জানিস সীমান্ত, অপূর্বর আবেগগুলো অনেক বেশি আমার কাছে জৈবিক মনে হয়। প্রেম করা মানে তো নিজের স্বক্রিয়তাকে বিসর্জন দেয়া নয়। আমি তোর কাছে আমার নিজেকে অনেক বেশি নিরাপদ মনে করি। নীরব দর্শকের মত কথাগুলো শুনেই গেলাম। স্বান্ত্বনা দেয়া কিংবা কী বলব সে ভাষা খুঁজে পাইনি। তবে গর্ব করার মত একটা কথা আজও আমার হৃদয়ের দেয়ালে অক্ষয় রূপে খোদাই করা আছে,আমি তোর কাছে আমার নিজেকে অনেক বেশি নিরাপদ মনে করি।
নিরাপদ মনেই বা করবেনা কেন, আমি তো এক কঠিন প্রতিজ্ঞার বাঁধনে আবদ্ধ। ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে হৃদয়ের প্রতিটি দেয়াল রচনা করুক ধ্বংসস্তূপ। রক্ত ক্ষরণ হতে হতে বয়ে যাক রক্ত গঙ্গা। আমি রচিবো আজ বন্ধুত্বের বিজয়গাঁথা। আমার কোন দূর্বলতা পাছে ধরা পড়ুক তা কী করে সইবো। আরও একটা কারণ আছে তার প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা, তার চেয়ে আমার নিজের প্রতি আমার অবিশ্বাসের মত্রাটা একটু বেশি। আমি চাইনা আমার কোন আচরণ আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরুক। অক্ষয় হয়ে থাকুক আমাদের বন্ধুত্ব।
আমার এমন কী আছে তাকে সুখি করার। আমি চাই, তার জীবনে এমন কেউ আসুক যে কানায় কানায় সুখের বন্যায় ভাসিয়ে দিক তার জীবন। তার সুখই তো আমার সুখ। যা আমি তাকে দিতে পারবোনা, তার মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে লাভ কী? তার সুখি মুখ আমার আজন্ম সাধনা। দেখে যাক মানুষ, নারী- পুরুষের সম্পর্ক মানে শুধু প্রেম নয়, নারী -পুরুষের সম্পর্ক শুধু জৈবিক চাহিদায় নয়। তারাও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধু হতে পারে। প্লেটোনিক ঝড় চলে নিজের মাঝে। মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হয়না। দুজনে আজ লম্বা একটা নীরব সময় অতিবাহিত করি। অপূর্ব আজ ক্যাম্পাসে আসেনি বলে পুরো সময়টা সিন্থিয়া আমার সাথেই ছিল। ক্লাসে যাবার প্রবল আগ্রহ কারোরই ছিল না।
ক্যাম্পাসেই তাদের বাসা। রিক্সায় তাকে বাসায় দিয়ে এলাম । একধরণের জোর করেই সিন্থিয়া তাদের বাসায় নিয়ে গেলো। তার পরিবারের সবার সাথে পরিচয় হল। বেশ ছোটখাটো গুছানো পরিবার। বাবা একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ভালো বেতন পান। মোটামোটি বেশ কেটে যাচ্ছে সংসার।
বিকেলে বাসায় ফিরে এলাম। কিন্তু বিষণ্ণতা কাটছেনা কোন মতে। বিশাল শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম। কোন কিছুতেই যেন মন বসছেনা। বারবার মনে হতে লাগলো, আমার কি কিছুই করার নেই। কিন্তু পেছন থেকে কে যেন চিৎকার করে বলতে লাগলো, তাকে যে পরিমাণ সুখি দেখতে চাও সে পরিমাণ সুখ দেওয়ার ক্ষমতা তোমার নাই। তুমি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বড়জোর একটা কলেজের শিক্ষক হতে পারবে, তার চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই। ওই যে বাগানে একটা গোলাপ দেখছো, সকালের শিশির ফোটা গোলাপের পাপড়িতে মুক্তোর দেখায়। তার প্রতি লোকের ভালোবাসা অফুরান। শিশির ফোটার আড়ালে যে পচন ধরেছে তা দূর থেকে দেখা যায়না বলে তার ভালোবাসার ঘাটতি নেই। তুমিও তাই। দূরে আছ, বেশ ভালো আছ। কাছে যেওনা। তাকে দেয়ার তোমার কী আছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনে… ।


ইদানিং অপূর্ব আমাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। সিন্থিয়া আমার সাথে মিশুক তা সে পছন্দ করছেনা। সিন্থিয়া না বললেও কথাগুলো আমার কানে এসে যাওয়ায় নিজেকে একটু ব্যস্ত করে নেয়ার চেষ্টা করছি। সিন্থিয়া একটুও বদলায়নি। যে মেয়েটা একদিন বন্ধুদের সাথে বাজী ধরে আমাকে বদলাতে এসেছে সে আজ আরও ঘনিষ্ট হতে চলেছে। তার সকল কথার গোপন বাক্স আমি। এমন কোন কথা নেই যা আমার সাথে আলাপ করেনি। এমন কিছু কথা আছে যা আমার কাছে বিব্রতকর মনে হয়, তাও সে অবলীলায় বলে দিতে পারে।
সিন্থিয়ার এমন আস্থাভাজন হতে পেরে নিজের মাঝে গর্ববোধ হয় মাঝে মাঝে। মনে হয় তার বন্ধু হয়ে বেশ করেছি। বন্ধুর ক্যানভাস অনেক বিশাল। যার সীমা পরিসীমা কেউ কোনদিন ছুঁতে পারেনি, পারবেওনা কোনদিন। স্বামী হওয়ার চেয়ে বন্ধু হওয়া অনেক গৌরবের। তাতে নেই কোন ক্লেশ, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির যোগ বিয়োগের খেলা। পুরোটাই প্রাপ্তি পুরোটাই বিসর্জন। আমি এমন বন্ধু হয়ে বেঁচে থাকতে চাই যুগযুগান্তর।
সিন্থিয়াকে আজ সকাল থেকে বেশ বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। রাতে ফোন করে বলেছিল জরুরি কথা আছে। তাই আমিও কিছুটা উদগ্রীব। সীমান্ত জানিস, আমার কোন কিছুই ভালো লাগেনা। গতকাল অপূর্বের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান ছিল একটা হোটেলে। তার অনেক বন্ধু বান্ধবী সেখানে উপস্থিত ছিল। তোর কাছে গোপন করি এমন কোন শব্দ আমার অভিধানে নেই। আমার মা জানেনা যে কথা সে কথাও তুই জানিস। গতকালের তার আচরণগুলো তোকে বলতেও আমার বিবেকে বাঁধছে। এমন রুপদিয়ে কী হবে যা অন্যের কাজে যদি না লাগে। আমি কোন মতে পালিয়ে এসে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছি। আমার ছোটবোন দীপা পর্যন্ত বলছে আপু তুমি ভুল জায়গায় পা দিয়েছ।

সীমান্ত আমি তোর সাথে আজীবন সঙ্গী হয়ে থাকতে পারলে অনেক অনেক বেশি সুখি হতাম। তোর মত মানুষ হয়না। সীমান্ত আমি ভুল করেছি। সীমান্ত, আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি…। কথাগুলো বলতে বলতে সিন্থিয়া হেঁটে চলল বাসার দিকে।
………………………………………