মাসুদুর রহমান (শাওন) এর সকল পোস্ট

মাসুদুর রহমান (শাওন) সম্পর্কে

মাসুদুর রহমান (শাওন) এর জন্ম ১৯৯৭ সালে, টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার সবুজে ঘেরা ছায়াঢাকা পঞ্চাশ গ্রামে। পিতার নাম মোঃ মজনু মিয়া, মাতা মোছাঃ খুকুমণি। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, বর্তমানে আনন্দমোহন কলেজ'এ (ময়মনসিংহ) বাংলা সাহিত্যে অনার্সে অধ্যায়নরত। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ছড়া লেখার মাধ্যমে সাহিত্যে প্রবেশ। কবিতা ছাড়াও ছোট গল্প লিখে থাকেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ দ্বারা প্রভাবিত।

আবার একদিন

নায়া আহামেদের আঁকা ছবি।

পৃথিবীর পথে কত হাহাকার, চিতার দাহে পোড়ে প্রণয়িনীর মন,
মায়ের দু’চোখ ভেজে অশ্রুর স্রোতে, কান্নার গুঞ্জনে ব্যথিত সময়।
লাশের মিছিলে উড়ে পথের ধুলা, শোকের খবরে প্রান্তর সয়লাব,
দুষিত গন্ধে ভরে উঠে বুক, কেবল অন্ধকার নামে মানুষের দেহে।
তবু ডাকে পাখি, ঘুমহীন চোখে এখনও জাগে স্বপ্নের লোভ,
বিষাদে মোড়ানো চাদরে তবু প্রেমের ওম, বাঁচিবার স্বাদ।
আবার ফুটবে ফুল নতুন ভোরে, সুবাসে মুছে যাবে সব ক্লান্তির দাগ,
এইসব স্তব্ধতা ভেঙ্গে যাবে কোলাহলে ফের, সকল রাত্রির পর।
আবার মেঘেরা মেলবে ডানা রোদ্দুরের সকল আকাশ জুড়ে,
নীলাভ জোৎস্নায় ভিজবে নগর মানুষের সকল দুয়ার।
এই দুর্যোগ শেষ কথা নয়, ঘুচে যাবে ট্র্যাজেডির সব অধ্যায়,
আবার পৃথিবী শান্ত হবে শান্তির আলিঙ্গনে, হাসবে মানুষ বিজয়ের শেষে।।
.
২২/০৩/২০২০

বোধ

ঘটনা অনেক আগের, তখন আমার শৈশবকাল, বৈশাখের পাকা ধান কাটা হয়ে গেলে খোলা মাঠে ঘুড়ি উড়াতাম। গোপালপুর হাঁট থেকে দাদাকে দিয়ে লাল, নীল কাগজ আনিয়ে, বল্লা গোটার আঠা দিয়ে একটা ঘুড়ি বানিয়েছিলাম। তখন সাধারণত গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকতো, পড়াশোনার চাপও থাকতোনা তাই কাজ বলতে ছিল ঘুড়ি উড়ানো। সারাদিন উদাম গায়ে দৌড়ে দৌড়ে ঘুড়ি উড়াতাম, বিকেলে ঘুড়ির নাটাই গাছের সাথে বেঁধে সবাই মিলে ফুটবল খেলতাম, কোনদিন আবার বৃষি্ট হলে ঘুড়ি উড়ানো হতোনা তবে ফুটবল খেলা হতো ঠিকই আর দিন শেষে দিঘীতে গোসল করে বাড়ি ফিরতাম।
.
একদিন আমার শখের ঘুড়িটা ভুল করে বারান্দায় রেখে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি, মাঝরাতে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি একটা ছোট বাচ্চা কুকুর আমার ঘুড়ির উপর আয়েশ করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে, এটা দেখে আমার প্রচন্ড রাগ চাপে মাথায়। কী করা উচিত না ভেবেই মোটা একটা লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত কুকুরটাকে দিলাম কষে এক বাড়ি। বাচ্চাটার মাজায় লাগলো আর লাফিয়ে পড়ে গেলো দু/তিন হাত দূরে, আর তার অসহায় সুরে কেঁউ-কেঁউ করে উঠলো কয়েকবার, তার করুণ আর্ত চিৎকারে হয়তো সেদিনের অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছিলো, হঠাৎ কান্নার শব্দে উঠানের আম গাছে থাকা কয়েকটা পাখিও চেঁচা-মেচি শুরু করে দিয়েছিলো কিন্তু এরপরও সেটাকে আর সেখানে থাকতে দেইনি তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সকালে দেখলাম বাচ্চাটা ঠিকমতো হাঁটতে পারছেনা।
.
তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে, তখন আর সেই দূরন্ত শৈশব নেই, ঘুড়ি উড়ানো, মাঠে ফুটবল খেলা সব কালের যাত্রায় হারিয়ে গেছে। একদিন কুষ্টিয়া থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম, মধুপুর বা গোপালপুরের কোন গাড়ি পাইনি। অগত্যা টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত আসতে হলো অন্য একটা গাড়িতে। এলেঙ্গা নেমে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় ১০ টা ছুঁই ছুঁই, কিছুক্ষণ রাস্তায় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু আমার গন্তব্যের কোন গাড়ি আসলোনা। তখন গাড়ির আশা ছেড়ে ভাবলাম মাসজিদে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকালে চলে যাবো এই ভেবে ওখানের একটা মাসজিদের বারান্দায় গিয়ে ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। হালকা তন্দ্রা আসছে এমন সময় কারো ডাকে তন্দ্রা কাটলো মাথা তুলে দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ। তারা মাসজিদ কমিটির লোক, তারা আমাকে চলে যেতে বললো, এটা হলি আর্টিজেনে জঙ্গি হামলার পরের ঘটনা তখন দেশ ব্যাপী সতর্কতা চলছিলো। কোন ভাবেই তাদের বুঝাতে পারলাম না কিছু। নিরাপত্তার অজুহাতে তারা অবশেষে তাদের অপারগতার কথা জানালো, দু/একজন ক্ষিপ্তও হলো। রাগে দুঃখে বেড়িয়ে পড়লাম ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায়, ভয়ে শঙ্কায় চোখ দিয়ে পানি আসছিলো, রাস্তায় এসে ল্যামপোস্টের নিচে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে একটা কুকুর দু/তিনবার ডেকে উঠলো। তখন কেন জানিনা মনের অজান্তেই সেই কুকুরটার কথা মনে পড়ে গেলো….
.
৩০/০৩/২০২০
#StayAtHome #StaySafe

অন্তরালে

তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, বাড়ী থেকে যেয়েই পরীক্ষা দেই। সকাল ৯ টার দিকে বের হলে ফিরতে ফিরতে ৯ টা বা কোন কোন দিন আরও বেশি রাত হয়ে যায়। নাসীরাবাদ কলেজে পরীক্ষা হচ্ছে যার কারণে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড হয়ে আসতে কিছুটা দেরী হয় তাছাড়া প্রান্তিক পরিবহণের সার্ভিসও খুব একটা ভালোনা। তাই আমি আর আমার বন্ধু কামরুল বরাবরই আকুয়া বাইপাস হয়ে আসি।
.
প্রথমে ইসলাম পরিবহণ অথবা রাজিব পরিবহণে মুক্তাগাছা পর্যন্ত আসি তারপর সেখান থেকে সিএনজি হয়ে কালিবাড়ী তারপর সেখান থেকে আবার সিএনজি অথবা মাহিন্দ্রায় আসি মধুপুর পর্যন্ত। ছাত্র হবার অজুহাতেই হোক আর টাকা কম থাকার কারণেই হোক বরাবর ভাড়া দিতে আমরা একটু কার্পণ্যই করি, মানে দশ/পাঁচ টাকা করে কম দেই। এতে করে জন প্রতি কোন কোন দিন মূল ভাড়া থেকে প্রায় ২০ টাকা করে বেঁচে যায় তা দিয়ে আবার মধুপুর থেকে বাড়ী পর্যন্ত আসা যায়।
.
মুক্তাগাছা থেকে সিএনজিতে চড়লাম, তখন ট্রাফিক পুলিশ একটা আইন করে দিয়েছে, সিএনজিতে চারজনের বেশি নেয়া যাবেনা। অথচ তখনও কেউ কেউ পাঁচজন পর্যন্ত নেয়াটা বহাল রেখেছে। আমরা যে সিএনজিতে উঠলাম তিঁনিও প্রথমে চারজন তুলে পরে কিছুদূর এসে আবার পাঁচজন মিল করে রওয়ানা হলেন। যার কারণে কিছুটা দেরী হলো আর এর জন্য পিছনের ছিটে বসা এক ভদ্রলোক ড্রাইভারকে অনেক বকা ঝকাও করলেন কিন্তু তিঁনি কিছু বললেন না।
.
কিছদূর আসার পর ড্রাইভারের ফোন বেজে উঠলো, তিঁনি ফোন রিসিভ করে কানে দিলেন আর তাতেও পিছনে থাকা ভদ্রলোক বিস্তর রেগে গেলেন যার কারণে তিঁনি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে হ্যান্ডেলের উপরের দিকে সিএনজিতে যে একটু গর্তের মতো জায়গা থাকে সেখানে লাউড স্পিকার দিয়ে রেখে গাড়ীর গতি কমিয়ে দিলেন। ও পাশ থেকে ছোট একটা মেয়ের গলা শোনা গেলো সে তখন বলছেঃ
-আব্বা, তুমি কোনসুম আবা…? আম্মারতো অসুখ বাড়ছে, আমার জোন্যে আইজকা ব্যাগ আনবাই… লোকটা আস্তে করে “আচ্ছা আনমুনে” বলে বললো তোমার মার কাছে দেও। ওপাশ থেকে পিচ্চির মা বলতেছেঃ
-তোমারেতো আইজকা যাবার না করলাম, এহনতো আমার জ্বরটা বাইড়া গ্যাছেগা, ডাক্তার কইছিলো সেলাইন দেওন লাগবো, আর ও এহন ব্যাগের জোন্যে কান্দিতাছে…
-আমি আওয়ার সোময় ডাক্তার নিয়া আমুনি, এইডা শেষ ট্রিপ, এহন রাহো চলতি গাড়ি।
এই বলে লোকটা ফোন রেখে দিলো, সামনের ছিটে বসার কারণে তাঁদের কথোপকথন আমি ভালোভাবেই শোনলাম। পরে সিএনজি থেকে নামার সময় তিঁনি একা একাই বললেন “আমি চারজন করেই আনি আর চলতি গাড়ীতে মোবাইলও ধরিনা, আসলে আইজকা বাড়ীতে সমস্যা।” সেদিন আর অন্যদিনের মতো কম টাকা দিতে পারিনি। আর জানিনা পিছনের ভদ্রলোক কথোপকথনগুলো শুনেছিলেন কিনা…
.
১৫/০৪/২০২০
#StayAtHome #StaySafe
বিঃদ্রঃ করোনার এই কঠিন সময়ে এই শ্রেণীর মানুষের কাজ কর্ম নেই, আসুন খোঁজ নেই তাঁরা কিভাবে দিন কাটাচ্ছে, আসুন আমরা সবাই যার যার সাধ্য অনুযায়ী এদের পাশে দাঁড়াই…

নবান্ন

যতদূর এই বাংলার মাঠে চোখ যায়, দেখি সোনার ফসল,
জেগে আছে দিন রাত মাটির বুকে, সহজ শিশুর মতো।
সবুজ পাতা তার হয়েছে হলুদ, নুয়ে গেছে শীষ পাকা ধানের ভারে,
একলা ফড়িং যেন পেয়েছে খুঁজে তার সাথী, এইসব ফসলের নিমন্ত্রণে।
নতুন গন্ধ আজ এসেছে গ্রাম জুড়ে পথে পথে পাড়ায় পাড়ায়,
কৃষকের দরদী গলার গান, ছড়ায়েছে যেন এই বাংলার হাওয়ার ভিতর।
.

ছবিঃ বাড়ীর পিছনে, আমারই তোলা,
সময়ঃ বিকেল ৪:১০, ১৯/১১/২০১৬
০১/০৫/২০২০

আমার খুব ইচ্ছে করে

আমার খুব ইচ্ছে করে, “কেউ একজন আমাকে কবি বলে ডাকুক”,
যদিও সত্যি বলতে আমি কোন কবি নই,
তবুও খুব ইচ্ছে করে কেউ একজন আমাকে ইচ্ছুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করুক, “কবি, আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখবেন…?
জানেন, আপনার কবিতা হতেই কেবল আমি কপালে কালো টিপ পড়েছি, এইযে দেখছেন হাত ‍দু’টোয় মেহেদি পড়েছি তাও কেবল আপনার কবিতায় উপমা হবার জন্য।”
তারপর তার শাড়ির আঁচল দেখিয়ে প্রশ্ন করুক, “কবি, আমার শাড়ির ভাঁজগুলো আপনার কবিতায় তুলে ধরবেন…?”
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সে আরও বলুক,
“জানেন কবি, আমি শাড়ি পড়তে জানিনা তবুও কেবল আপনি কবিতা লিখবেন ভেবেই শাড়িটা পড়েছি।”
.
কেউ একজন আমাকে তার চুলের খোঁপা দেখিয়ে একটু সরল কণ্ঠে বলুক,
”আমি জানি আমার চুল বিশেষ কিছু নয়, তবুও আপনার কবিতার অংশ করবেন এই আশায় ত্রিশ মিনিট ধরে খোঁপা সাজিয়েছি, দেখেন একটা গোলাপও গেঁথেছি।”
সে আরও বলুক, “খোঁপা চুল নিয়ে বোধহয় ভালো কবিতা হয়না!, আচ্ছা খোঁপা খুলে ফেললাম”
এই বলে সে তার চুলগুলো এলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করুক, “কবি, এবার হবে কি…?”
.
আমার খুব ইচ্ছে করে কেউ একজন আমার পাশে এসে বসুক কেবল একটা কবিতার আশায়,
আমার হাত ধরে সে একটু মৃদু হেসে বলুক, “কবি, আমি হাসতে জানিনা, তবুও এইতো হাসলাম শুধুমাত্র কবিতার জন্য।”
তারপর সে আরও বেশি কাছে এসে ভাসা ভাসা সাদা কালো চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলুক,
“আমার চোখে কাজল খুব বেমানান সে আমি জানি, তবুও কাজল পড়েছি আপনার কবিতায় উপমা হবো বলে।”
সে তার হাতের আঠাশটা কাচের চুড়ি আমাকে ধরতে দিয়ে বলুক, “সবগুলো চুড়ি কেবল আপনার কবিতার পঙক্তির জন্য পড়া।”
তার অমলিন হালকা লালচে ঠোঁট জোড়া সম্মুখে এনে ভয়ে ভয়ে বলুক, “আমার ঠোঁট দু’টো নিয়ে কেবল একটা শব্দ লিখলেই হবে।”
.
আমি জানি, সত্যি বলতে আমি কোন কবি নই, তবুও চাই কেউ একজন আমাকে এভাবেই বলুক,
“কবি, কেবল আপনার কবিতা হয়ে শুধু আমিই থাকতে চাই, আমাকে করবেন আপনার কবিতা…?”
তখন আমি তার পায়ের আলতা ছুঁয়ে বলবো, “কবিতার জন্যতো তোমার পা’দুটোই সার্থক উপমা, আমি ঠিক তোমাকেই লিখবো আমার সমস্ত কাব্য জুড়ে।”
সে ভেজা ভেজা চোখ তুলে বলুক, “জানেন, আলতাও পড়েছিলাম কেবল কবিতার জন্য তবে ইচ্ছে করেই বলিনি যদি ভুল…”
কথা শেষ না হতেই তার লাজুক ঠোঁটে আঙুল চেপে বলবো “না বলাটাই ভুল হয়েছে, এমন যেন আর না হয় কোনদিন, চোখের কাজল মুছোনা জলে।”
.
২৬/০৩/২০২০