বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

কালো আগুন

অথবা জাইগোট এর জাত কি
শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু হিন্দু নাকি মুসলিম
কিংবা যে শিশুটি নিষিদ্ধ পল্লীতে জন্ম নিয়ে
জানতে পারে না কে তার পিতা
কিবা তার পিতার ধর্ম
ক্ষুধা নিবারনের জন্য দেহ বিক্রি করাই ছিল
জন্মদাত্রী মাতার ধর্ম
এবং কেউ কখনো হাত ধরে নিয়ে যায়নি মসজিদে
কেউ শোনায়নি পুরোহিতের পুরাণ পাঠ
দেখায়নি যীশুর ক্রুশবিদ্ধের ছবি,
বড় হয়ে সেই শিশুটি জেনে নেয়
ধর্ম কেবল এক জন্মগত অভ্যাস,
তারপর একদিন সব জানে
এবং এও জানে কেন যীশুর পিতাও প্রশ্নবিদ্ধ।

এরই মধ্যে ওদিকে গভীর রাতে
কেওক্রাডাং পর্বতের গুহায়
আবারো আকাশ থেকে নেমে আসতে চায় আকাশদূত,
অত:পর গুহার ভিতরে থাকা কেউ একজন বলে ওঠে
এসো – নেমে এসো হে আকাশদূত
এই পৃথিবীর পরে
শুধু আর একটিবার, শুধু এইবার
নেমে এসো আবার।
নিয়ে এসো আকাশের অনুশাসন বাণী
দৈব বাণী আর মানব জীবনের মূলসূত্র, আদর্শ বাণী
এবং বিধিনিষেধ, বিধিবিধান
পাপ থেকে মুক্তো হওয়ার উপাখ্যান
এবং সকল মানুষের জীবনের বিধান।

আর যদি না আসো নেমে তুমি
হে আকাশদূত!
আমি নিজেই রচনা করবো সেই মহাগ্রন্থ
সেই মহাশাস্ত্র যা মানব জীবনের চলার পথ
তারপর তা প্রকাশ করে দেবো মানুষের মাঝে
এবং বলবো এই হলো আকাশ থেকে নেমে আসা
বিধির বিধান – এই হলো মানব জীবনের জীবন বিধান
মেনে নাও, অনুসরণ করো – তাতেই রয়েছে পরিত্রাণ
রয়েছে মৃত্যুহীন জীবন – পাবে ভালো ভালো খাবার আর পবিত্র সংগিনী।
আর যদি মেনে না নাও হে মানবকূল
জেনে রেখো
কালো আগুনের উত্তাপে পুড়বে অথচ মরবে না
শুধুই কালো আগুন আর শুধুই কালো আগুন।

বৈশাখ থাকুক অন্তরে

28019

চৈত্রের শেষে বৈশাখের যখন ঘটে আগমন,
খুশিতে হয় দিশেহারা দেশের আপামর জনগণ।
ধুমধাম বাদ্য বাজে দেশের আনাচে কানাচে,
পহেলা বৈশাখে নতুন সাজে শিশুরাও নাচে।

বৈশাখের আগমনে শুরু হয় মেঘের ঘনঘটা,
শুভেচ্ছা জানায় বৈশাখ দিয়ে বৃষ্টির ফোটা।
বছরের বৈশাখ মাসে আকাশ থাকে মেঘলা,
সাদা মেঘগুলো হয় কালো বাঁধে জটলা।

তারপর সময় অসময়ে ঝরে ঝর ঝর,
হঠাৎ আসে তুফান উড়িয়ে নেয় বাড়িঘর।
ঝরো হাওয়ার সংকেত আসে নম্বরে নম্বরে,
মহাবিপদ সংকেত উঠে তখন দশের উপরে।

প্লাবিত হয় নিচু জমি জলোচ্ছ্বাস সাগরে,
তচনচ কাঁচা ঘর ফসলের ক্ষতি হয় হাওরে।
কৃষকের পাকা ধান ডুবে যায় পানিতে,
ফসল হারিয়ে কৃষক মরে কাঁদিতে কাঁদিতে।

তবুও আসুক বৈশাখ আসুক বছরে একবার,
হোক সে কালবৈশাখী তবুও থাকুক অন্তরে সবার।

.
ছবি সৌজন্য: প্রখ্যাত সাংবাদিক সাজেদ রহমান।

ইনকাদের মাচু পিচু… পেরুর এন্ডিস!

280865

এ যেন অন্য এক পৃথিবী। ঘন মেঘমালা আকাশ আর মাটির ভালবাসায় সেতুবন্ধন হয়ে জড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় মেঘ দৈত্যদের অলস পদচারণা প্রকৃতির নৈসর্গিক স্তব্ধতাকে স্বপ্নিল ফ্রেমে বন্দী করে তৈরি করেছে বিস্ময়কর প্যানোরমা। প্রথম ক’টা মিনিট কারও মুখে কোন কথা ফুটে না। এ যেন সূরা আর সাকির অনাদিকালের মিলন-মেলা। মাচু পিচু – ইন্‌কাদের হারিয়ে যাওয়া শহর। স্প্যানিশ দখলদারদের হিংস্রতা হতে বাঁচতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তৈরি করেছিল বর্তমান বিশ্বের আন্যতম আশ্চর্য এক স্থাপনা।

চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চূড়াগুলো বাহু লগ্না হয়ে ডুবে আছে মেঘ সমুদ্রে। ইচ্ছে করলেই এক খণ্ড মেঘ হাতে বাড়িয়ে কাছে টানা যায়, আদর করা যায়। গলার সূর উঁচু করে হাঁক দিলে সে হাঁক পাহাড়ে পাহাড়ে আছড়ে পরে, ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে তীর ভাঙ্গা তরঙ্গের মত। চারদিকে এক ধরনের ভৌতিক নীরবতা, সাথে প্রকৃতি এবং মানুষের নীরব বোঝাপড়ার বিশাল এক ক্যানভাস।

ইনকা সাম্রাজ্যের বিশালতার কাছে গিজ গিজ করা পর্যটকদের ফিসফাস হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নিপুণ কারিগরের নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনায় হাতেগড়া পাথরের প্রাসাদগুলো সময়ের স্তব্ধ সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। প্রথম যে ধাক্কাটা এসে মগজে আঘাত হানে তা হল, কি করে এত উচ্চতায় এই বিশাল পাথরগুলোকে উঠানো হল! প্রযুক্তি বলে জাগতিক পৃথিবীতে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণা ঐ নিষিদ্ধ অরণ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। হাত এবং মগজের চাতুর্যপূর্ণ নৈপুণ্যে পাথরগুলোকে উঠানো হয়েছে একটার উপর আরেকটা, শক্ত কাদামাটি দিয়ে আটকানো হয়েছে হাজার বছরের বন্ধনে।

একদিকে রাজপ্রাসাদ, অন্যদিকে সাধারণ ইনকাদের বসতি এবং পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণাগার সবকিছু মিলে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বলা হয়ে থাকে পেরুর মাটিতে স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের আগমনের একশত বছর আগেই এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কারও মতে দখলদার বাহিনীর নৃশংসতার হতে বাচার জন্যে ইনকারা পালিয়ে আশ্রয় নেয় মাচু পিচুতে। পরবর্তীতে বসন্তের মত মহামারিতে বিলীন হয়ে যায় জনসংখ্যা। পরিত্যক্ত হয়ে গাছপালা, পাহাড়ের আড়ালে চাপা পরে যায় ইনকাদের আশ্চর্য সৃষ্টি মাচু পিচু।

১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগ্নহাম ইনকা সভ্যতার উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে বেশ ক’বার এলাকাটিতে জরিপ চালান। এমনই এক আর্কিওলজিক্যাল জরিপে স্থানীয় কুয়্যেচোয়া গোত্রের ১১ বছর বয়সী বালক পাবলিতো আলভারেজ হিরামকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মাচু পিচুর ট্রেইলে। আধুনিক সভ্যতা বিস্ময় এবং হতবাক হয়ে স্বাগত জানায় হিরামের এই আবিষ্কারকে।

চারদিকে হরেক রকম ভাষা আর ক্যামেরার ক্লিক শব্দে নেশা ধরে আসে নিজের অজান্তেই। সরু এবং সংকীর্ণ পথ বেয়ে অনেকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে হাঁটছে ইনকা ট্রেইল জয়ের লক্ষ্যে। এমনই এক মিশনে গেল সপ্তাহে দু’জন ইংরেজ পর্বতারোহী পা পিছলে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের মৃত্যু খাদে। কোন কিছুই মানুষের অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনার অদম্য বাসনা আটকাতে পারেনা, মৃত্যুভয় জেনেও কিশোর হতে শুরু করে বুড়োর দলও নিজকে সাক্ষী করতে চাইছে সভ্যতার এই মহা বিস্ময়ের সাথে।

বেলা গড়াতে ঘন মেঘ কুণ্ডুলি ক্লান্ত বলাকাদের মত উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। পাহাড়ের চূড়াগুলো সহসাই মুক্তি পেল মেঘের আগ্রাসন হতে। সাথে সাথে সূর্যের আলো ভাসিয়ে নিলো লোকালয়। কেউ যেন ছবি তোলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিল ক্ষণিকের জন্যে। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক শব্দ আর ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানো আলোতে মায়াবী পরিবেশে হতে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের নিয়ে এলো জাগতিক পৃথিবীতে।

কিছুক্ষণ আগের কনকনে শীত ছাপিয়ে এবার ঝাঁকিয়ে বসল ভ্যাপসা গরম। ট্যুর গাইডের বিরামহীন বর্ণনা একসময় রাজ্যের বিরক্তির নিয়ে এলো। ভাল লাগছিল না ভাঙ্গা ইংরেজিতে ইন্‌কাদের ইতিহাস। মনে হল যাবার আগে প্রকৃতিকে নিজের মত করে কাছে না পেলে এ যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ছিটকে পরলাম গ্রুপ হতে।

এবার উঁচুতে উঠার পালা। একটার পর একটা বিপদজনক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে শেষ পর্যন্ত সূর্যঘড়ির চূড়ায় এসে হাঁপিয়ে পরলাম। এটাই ছিল জনবসতির সবোর্চ্চ চূড়া। সামনে, পিছনে, ডানে এবং বায়ে শুধুই মৃত্যুফাঁদ। ভারসাম্যের সামান্য হেরফের হলেই আমার আমিত্বে নামবে অমেঘো পরিণতি, ডেথ উদআউট ট্রেইস! চোখ দু’টো বন্ধ করে নিজকে হাল্কা করে নিলাম। পাখীর ডানার মত হাত দু’টো ছড়িয়ে জোড়ে চীৎকার দিতেই সে চীৎকার লক্ষ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো নিজের কাছে। কেন জানি মনে হল আমি এবং আমার ঈশ্বর এখন খুব কাছাকাছি এবং আমার চীৎকার ঈশ্বরের দরবারে পৌছাতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা।

বেলা পরে আসছিল, তাই ফেরার আয়োজন করতে হল।
প্রধান ফটক পার হয়ে বাইরে বেরুতেই দেখা মিলল ২০ ডলারের একটা বাফের। ক্ষুধায় পেট উঁচু-স্বরে কথা বলতে শুরু করে দিল। ঢুকে পরলাম ডান বামে না তাকিয়ে। ইনকাদের পোশক পরা বেশকজন তরুণী মায়াবি হাসি দিয়ে স্বাগত জানালো তাদের আস্তানায়।খুব রসিক মেজাজে ভূরিভোজনের পর উল্টো পথ ধরলাম।

পাহাড় হতে নামতে হবে বাসে চড়ে, তারপর ট্রেন। কুস্‌কো পৌছাতে রাত হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ রইল না।

ট্রেনে বসে হঠান করেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। চারদিকের শুনশান নীরবতা দেখতে ভাল লাগছিল না। নিজকে বুঝাতে পারলাম না কেন এই বিষণ্ণতা! তবে কি এতদিনের লালিত স্বপ্ন আর কোনদিন দেখব না বলেই এই ভাবাবেগ? পৃথিবীর এই অঞ্চলগুলোতে আর কোনদিন পা ফেলব না বলেই হয়ত এ সাময়িক আচ্ছন্নতা। কিন্তু কে জানত দু’বছর পরেই আবার আমাকে আসতে হবে এখানে। মাচু পিচুর পাহাড় এবং মেঘদের লুকোচুরির কোন এক বাঁকে নতুন করে পরিচয় হবে এন্ডিসের দেশ পেরুর সাথে! সে অন্য এক কাহিনী, অন্য এক অধ্যায় যার সাথে এ লেখার কোন সম্পর্ক নেই।

হোটেলে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। রাতের খাবার শেষে সকাল সকাল শুয়ে পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। খুব সকালে বাস ধরতে হবে। পরবর্তী ঠিকানা লেক টিটিকাকা, পেরুর সীমান্ত শহর পুনো।

এদেশ ওদেশ ১৫

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ পঞ্চদশ পর্ব।)

ক্ষমতা দখলের মরীয়া প্রচেষ্টায় জামাত এবার অন্য চাল দিল। সেনাবাহিনীর উচ্চস্তরে তারা তাদের উগ্র ধর্মীয় মতবাদ ছড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করায় মন দিলো আর সফলও হলো। এই পর্বে জামাতের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্বঘোষিত উগ্র ধর্মগুরু মউদুদি। তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দাবার প্রথম চালেই তিনি মাত করে দিলেন মধ্যপন্থার ভুট্টোকে। ক্ষমতার নেশা ধরিয়ে নিজের দিকে টেনে আনতে সমর্থ হলেন সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তা জেনারেল মুহম্মদ জিয়া উল হক কে। তলে তলে সেনাবাহিনীর ধর্মীয়করন শুরু করে দিলেন জিয়া। ১৯৭৬ এর জুলাইয়ে সেনার এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জয়ীরা পুরস্কার পেলেন মউদুদির লেখা প্রচার পুস্তিকা তাফহিমু-ই-কুরান। শুধু তাই নয়, সেই অন্ধ প্রচার পুস্তিকা, যা কিনা কোরানের মহতী আদর্শ থেকে যোজন দূরে এবং শুধুমাত্র যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই লিখিত, সুপারিশ করা হলো সেনার ক্যাপ্টেন ও মেজর পদের প্রোমোশনের পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তক হিসাবে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে পাকসেনা পরিবর্তিত হতে থাকলো অন্ধ ধর্মীয় হানাদলে।

এবার চোখ ফেরানো যাক আরো একবার পূর্বে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেই বাংলাদেশের চেহারা ছিল ধর্ষিতা জননীর মতো। আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ বুলালে দেখতে পাই, Time Magazine USA 17-January -1972 : “In the aftermath of the Pakistani army’s rampage last March, a special team of inspectors from the World Bank observed that some cities looked “like the morning after a nuclear at tack.” Since then, the destruction has only been magnified. An estimated 6,000,000 homes have been destroyed, and nearly 1,400,000 farm families have been left without tools or animals to work their lands. Transportation and communications systems are totally disrupted. Roads are damaged, bridges out and inland waterways blocked.The rape of the country continued right up until the Pakistani army surrendered a month ago. In the last days of the war, West Pakistani-owned businesses—which included nearly every commercial enterprise in the country—remitted virtually all their funds to the West. Pakistan International Airlines left exactly 117 rupees ($16) in its account at the port city of Chittagong. The army also destroyed bank notes and coins, so that many areas now suffer from a severe shortage of ready cash. Private cars were picked up off the streets or confiscated from auto dealers and shipped to the West before the ports were closed.”

এই ছন্নছাড়া অবস্থা থেকে সুস্থ দেশ গড়ে তোলা ছিল সেই সময়কার নেতৃত্বের কাছে চ্যালেঞ্জ। দেশ চালানোর ভার হাতে পেয়েই তাঁরা প্রথম খাদ্য এবং চিকিৎসা এই দুই প্রাথমিক চাহিদার ওপরেই প্রাধান্য ন্যস্ত করলেন। কিন্তু ভাঁড়ার সম্পূর্ণ শূন্য। এ অবস্থায় সাহায্য চাওয়ার আর অন্য কোনো বিকল্পই সামনে খোলা ছিল না। স্বভাবতই সাহায্যের জন্য শেখ মুজিবর রহমান আবেদন জানালেন রাষ্ট্রসংঘ, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম সহ ইউরোপের ধনী দেশগুলির কাছে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে গড়ে তুললেন সখ্য। প্রতিবেশী অন্য দেশগুলির সঙ্গেও সদ্ভাব বজায় রাখার নীতি গৃহীত হলো। পশ্চিম পাকিস্তানের এতদিনের ঔপনিবেশিক নীতি থেকে দেশ কে বার করে আনার জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলো।

জাতীয়তা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র এই চার স্তম্ভের ওপর গড়ে তোলা হলো নতুন সংবিধান, যা অন্য দেশে মুজিবিসম নামে খ্যাতি পেয়ে গেল। ১৯৭৩ সালে স্বাধীণতা পরবর্তী বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম সাধারণ নির্বাচন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করল আওয়ামি লীগ। প্রধানমন্ত্রী হলেন মুজিব। খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জল, বিদ্যুৎ, নিকাশী ব্যবস্থা, ১০ লক্ষ উদাস্তুর পুনর্বাসন লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য পদক্ষেপ নিল নতুন সরকার। প্রায় ৯০ শতাংশ দরিদ্র এবং দরিদ্রেতর মানুষের দেশ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই পরিকল্পনা খুব ভালোভাবে মেনে নিতে পারছিল না সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।

তলেতলে দানা বাঁধল ষড়যন্ত্র। পরাজিত পাকিস্তানের বেশ কিছু এজেন্ট রয়ে গেছিল ছদ্মবেশে। এছাড়া ছিল পাকিস্তানপন্থী জামাত ই ইসলামীর মতো কট্টর মৌলবাদী দল। তাদের মদত দিল আমেরিকা। ১৫ই আগষ্ট, ১৯৭৫, আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টালিজেন্স এজেন্সি এবং পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ আর্থিক ও অন্যান্য মদতে এবং ঢাকাতে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বুস্টারের উপস্থিতিতে খোন্দকার মোস্তাক আহমেদের প্ররোচনা এবং নেতৃত্বে একদল ধর্মোন্মাদ তরুন মিলিটারী অফিসার ট্যাংক ও সবরকম অস্ত্র নিয়ে ঘিরে ফেললো ঢাকায় ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ী। মুজিব সহ তাঁর পরিবারের উপস্থিত সমস্ত সদস্য কে হত্যা করল উন্মাদের দল। বেঁচে গেলেন শুধু পশ্চিম জার্মানিতে প্রবাসী দুই কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও শেখ রেহানা। বাংলাদেশে তাঁদের ফেরা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে সামরিক অভ্যুথানের নায়ক পাকিস্তানপন্থী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ হলেন স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট অব বাংলাদেশ।

আশ্চর্য ইতিহাসের পরিহাস, একই সময়ে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ ডুবে গেল গভীর অন্ধকারে। পিছিয়ে পড়লো উন্নয়নের শুভ প্রচেষ্টা ও ইচ্ছা। খুন হল গণতন্ত্র তিন দেশেই।

(আবার আগামী কাল)

দাম্পত্য

তোমাকে নিয়ে ঢাকায় সেটেল হব
ভেবেছিলাম
কিন্তু ধুলোয় তোমার এলার্জি

সাত পাহাড়ের মাথায় যে বাংলো
দুজন মিলে দেখে এসেছিলাম
দামে পোষালো না

একটা লাইট হাউসের সখ ছিল
দিকভ্রান্ত নাবিকের
দিশা ফিরিয়ে দিতে
আলো হয়ে জ্বলে উঠতে

এত খোঁজাখুঁজির পরেও যুতসই
লাইট হাউস পাওয়া গেল না

পঞ্চগড়ের পাড়াগাঁয়ে পর্ণকুটির
হলেই চলবে
শুধু সামনে এক চিলতে উঠোন

পঞ্চগড় অনেক দূর, হারানোর সম্ভাবনা
এই পরিকল্পনাও বাদ দিতে হলো

বিলেতে যাওয়া যায় হয়তো
কিন্তু বরফের নালায় পদ্ম দীঘির
আমেজ কি পাওয়া যাবে…

ঢেউপাশা গ্রামে মাটির পাতিলে
তরতাজা রসগোল্লা রাখা আছে
তর্জার বেড়া আর ছনের ছাদ,
টুপটাপ বৃষ্টি বুক পর্যন্ত ভিজিয়ে দেয়

নিজস্ব ভূমিতে বেশ আছি
তৃষ্ণায় ডাব আর ক্ষুধায় দুধ সাদা ভাত

বাড়ির পিছনে লাগিয়েছি ধনিয়া
দাপ্তরিক কাজ শেষেও বইবে জীবন
ফ্লেভারের অভাবে মরে যাবে না…

এদেশ ওদেশ ১৪

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ চতুর্দশ পর্ব।)

ঠিক এই সময়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক ঐতিহাসিক রায় বদলে দিল গণতন্ত্রের গতিপথ। ১২ই জুন ১৯৭৫ জনৈক রাজনারায়নের দাখিলিকৃত মামলার রায়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ঘোষণা করল, ইন্দিরা অবৈধভাবে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে ১৯৭১ এর নির্বাচনে রায়বেরিলী থেকে জয়লাভ করেছিলেন। তাই শাস্তিস্বরূপ তাঁর সংসদীয় সদস্যপদ বাতিল সহ ছবছর নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হল। ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল কংগ্রেসে। কারন তখনকার কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়ার “ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া” বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল দলের আপামর সদস্য। ত্বড়িৎ ডাক পড়ল আইনজ্ঞ সিদ্ধার্থর। আইনের নথি ঘেঁটে সিদ্ধার্থ যে নিদান দিলেন, ইন্দিরা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তার প্রয়োগ করলেন। ভারতবর্ষ ডুবে গেল গণতন্ত্রের গভীর লজ্জার অধ্যায়ে- জারী হল জরুরী অবস্থা; এমারজেন্সি।

ভূমি ভাগ হয় না। মানুষই তাকে বিভিন্ন দাগ টেনে বিভক্ত করে নিজের কুমতলব চরিতার্থের উদ্দেশ্যে। কিন্তু চরিত্রগত মিল থেকে যায় সব টুকরোর মধ্যেই। ভারত যখন অন্ধকারে ডুবছে, তখন তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অন্যদেশও তলিয়ে যেতে বসেছে সেই একই কালোয়। বলা যায় প্রায় একই সময়ে ভারতে ইন্দিরা, পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টো এবং বাংলাদেশে মুজিবর রহমান তাঁদের রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু করেন। ভাগ্যের পরিহাস তাঁদের তিনজনকেই মিলিয়ে দিয়েছে অস্বাভাবিক অকাল প্রয়াণে। আশ্চর্যজনক ভাবে তিনজনকেই হত্যার পিছনে কারন হিসেবে কাজ করেছে ক্ষমতা দখলের অত্যাধিক লোভ।

যখন থেকে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরে মিলিটারী স্বৈরশাসন আমদানি হলো, তখনই উপমহাদেশের স্থায়ী অস্থিরতার ভবিষ্যত জন্ম নিয়েছিল। আয়ুব খান জমানা শেষে ইয়াহিয়া খান জমানা এবং বাংলাদেশের জন্মকে কাজে লাগিয়ে সেদেশে তৎপর হয়ে উঠলো কট্টরপন্থী ধর্মীয় দল জামাত-ই-ইসলামী। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ভেঙে বেরিয়ে আসার আসল কারন চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টাই দেখা গেলনা সেখানে। পাকিস্তানী শাসকদের অকর্মণ্যতা, শোষণ, ঔপনিবেশিক আচরণ ও জবরদস্তি ইত্যাকার মূল কারনের অভিঘাত আড়াল করে দায় চাপানো হল, ইসলামিক পথ থেকে বিচ্যুতি এবং ইয়াহিয়া খানের মদ্যপানে আসক্তি। অথচ এই দুই কারনই যে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও হাস্যকর তা বোঝার ক্ষমতা সে দেশের সাধারণ মানুষের ছিলনা অশিক্ষার জন্য।

১৯৭১ এ যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের পরে প্রধাণমন্ত্রীর আসনে বসলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। ক্ষমতায় বসেই তিনি শ্লোগান তুললেন, “Islam is our faith, democracy is our polity, socialism is our economy” । যদি সত্যিই এই নীতি কার্যকর করা যেত তাহলে হয়তো শুধু পাকিস্তান নয়, সমগ্র উপমহাদেশ আজকের এই ভয়ংকর অস্থিরতার হাত থেকে রেহাই পেয়ে সত্যিকারের উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু ভুট্টোর এই প্রতিশ্রুতির অন্তরালে ইতিহাসের অট্টহাসি সেদিন শোনা যায়নি।

আগেই বলা হয়েছে বাংলাদেশ বিভক্তিকরনের দায় হিসেবে দুই অযৌক্তিক কারন কিন্তু রীতিমত পাকা ভিত গড়ে তুললো মৌলবাদের। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে মান্যতা পেতে শুরু করলো ঐ তত্ত্ব। বিদ্রোহ ছড়িয়ে গেল এমনকি সেনার মধ্যেও। ১৯৬৫ র পরে সমাজের নিম্নস্তর থেকে নিযুক্ত কিছু জুনিয়ার অফিসার এই ইস্যুতে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করল। পর্দার আড়ালে সেই প্রথম জামাতের ক্ষমতা দখলের প্রয়াস। কিন্তু তখনো সেনার সর্বস্তরে জামাতের সেরকম প্রভাব না থাকায় অচিরেই বিদ্রোহ দমিত হলো।

(এরপর আগামীকাল)

বলিভিয়ার এন্ডিস …

28056

বেলা পরে আসছে। রওয়ানা হওয়ার উৎকণ্ঠা সবার চোখে মুখে। সূর্যাস্তের পর এন্ডিসের এ এলাকাটা মোটেও নাকি নিরাপদ নয়। বন্য হায়েনা আর অপহরণকারীদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয় অরক্ষিত মাঠ ঘাট। বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। দুর্নীতির হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত এর রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো। সামরিক শাসনে দেশটির রয়েছে বিশ্ব রেকর্ড।

এতগুলো বিদেশী পর্যটক এমন একটা অরক্ষিত এলাকায় আটকে থাকা মানে অপহরণকারীদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মত। ব্যাপারটা ভাল করেই জানা ছিল ট্যুর গাইডদের। চাকা বদল এবং ঠেলেঠুলে বাসটা রাস্তায় তুলতে প্রায় ঘণ্টা খানেক পেরিয়ে গেল। ড্রাইভার জানাল বেলা অনেক গড়িয়েছে, যে পথ ধরে যাচ্ছি সে পথটা সামনে আরও বিপদজনক। ফিরে যেতে হবে আসল পথে। রাস্তার অবরোধের তীব্রতাও নাকি কমে এসেছে ইতিমধ্যে। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রওয়ানা হলাম শেষ পর্যন্ত। তবে এ যাত্রায় পিছন দিকে। আমার কেন জানি মনে হল এ কাহিনীর কোন শেষ নেই। সামনে পেছনে করে অনন্তকাল ধরে চলবে আমাদের যাত্রা! ভাগ্যকে নিয়তির কাছে সঁপে দিয়ে এন্ডিসের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিকে মন ফেরানোর তাগাদা অনুভব করলাম।

আবারও সেই বিভীষিকা। একই লোমহর্ষক জায়গা!!! তবে গাড়ির সংখ্যা দেখে পরিস্থিতি সকালের মত ততটা জটিল মনে হলনা। গাইড এসে জানাল ভয়ের কিছু নেই, কিছু লেনদেন করতে হবে শুধু। তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলন! সবকিছুর শেষ মনে হয় একটা জায়গায় এসে আটকে যায়, পকেট! চোখের সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করলাম মনে হল। বিছানো পাথরগুলো রাস্তা হতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। যদিও বাঁশ জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে গোটা হাইওয়ে। হাতে লাঠি আর মাথায় লাল পটকার বিপ্লবীরা সিংহের মত গর্জন করছে। দেখে মনে হচ্ছে ইশারা পেলে খুব দ্রুত ঝাঁপিয়ে পরবে।

ডান হাতের ব্যাপারটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হয়ে গেল। গাইড‌ জানাল দেসাগুয়াদে্‌রতে যাত্রী প্রতি ১০ ডলার উঠানো হয়েছিল এমন একটা আশংকায়। এ মুহূর্তে কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলোনা। সবাইকে মনে হল একই চক্রের সদস্য, পর্যটকদের পকেট খসানোর সংঘবদ্ধ নীল নক্সা। দৈত্য-দানব আর রাক্ষস-খোক্কসদের তাণ্ডব হতে মুক্তি পেলাম শেষ পর্যন্ত। সামনে নতুন কোন ঝামেলা নেই, এমনটা বলে ট্যুর গাইড আশ্বস্ত করল সবাইকে।

সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম বুক ভরে শ্বাস নিলাম। চোখ বুজে কল্পনা করলাম নিউ ইয়র্কের ছোট রুমটার কথা।

আরও প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। পেছনের ঝামেলা মাথা হতে নামিয়ে যাত্রীদের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পরল জানালার বাইরে রূপকথার এন্ডিসকে নিয়ে। ভেজা মুরগীর মত ঝিমুতে শুরু করলাম আমি। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভিড় করল শরীরে। পাশের সিটটা খালি, দু’পা উঠিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরলাম। পাক্কা এক ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙ্গল। সূর্যটা নেতিয়ে পরেছে ততক্ষণে। চারদিকে শুন শান নীরবতা। এন্ডিসের চূড়াগুলো ডুবে গেছে হাল্কা কুয়াশার কোলে। সূর্যের রক্তিম আভায় কুয়াশা গুলোকে আগ্নেয়গিরির রাক্ষুসে লাভার মত দেখাল।

মাঝে মধ্যে দু’একটা বাড়ি ঘরের চিহ্ন দেখা গেল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। যতই এগুচ্ছি বাড়তে থাকল জনবসতির ঘনত্ব। সামনের সহযাত্রী জানাল ’বিপ্লবীরা’ মাঝ পথে আরও একবার বাসটা থামিয়েছিল। কি একটা কাগজ দেখাতে ছেড়ে দিয়েছে বিনা বাধায়। সহযাত্রীদের জানার কথা নয়, কিন্তু এই বাংলাদেশীর ভাল করেই জানা ছিল ঐ কাগজটার অর্থ এবং মূল্য কি।

রাশিয়ায় পড়াশুনা শেষে ব্যবহারের জিনিসপত্র এবং একগাদা বই পাঠিয়ে ছিলাম জাহাজে করে। চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহাসিক কালো অধ্যায় সমাপ্তি শেষে ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছি। বন্দর হতে বেরুতে না বেরুতে পুলিশ বাহিনী আটকে দিল আমাদের যাত্রা। ড্রাইভার জানাল টাকা দিতে হবে। গাই গুই করে কাজ হলোনা, পরিশোধ করতে হল পুলিশের ’পাওনা’। সব শেষ হতে একটা ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিল ড্রাইভারের হাতে। এটাই নাকি সেই যাদু-মন্ত্র যার বলে পার হওয়া যাবে সামনের সাত সমুদ্র তের নদী।

ঘটনাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকা, কাছের প্রতিবেশী দুই মহাদেশ, অথচ একেবারে উলটো তাদের জীবন যাত্রার মান!

ট্রাফিকের সংখ্যা দেখেই ধারণা করা যায়, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। পাহাড়ের বিপদজনক শেষ বাঁকটা পার হতেই চোখে পরল শহরটা, লা পাস। পাহাড়ি উপত্যকার খাদ ঘেঁষে থরে থরে সাজানো বাড়ি ঘর আর উঁচু দালান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে শহরটা। প্রায় ৮ লাখ লোকের বাস সমুদ্র পৃষ্ট হতে ৩৬৬০ মিটার উচ্চতার এই শহরে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিল স্প্যানিশ দখলদাররা। সময়টা ছিল ১৫৪৮ সাল। এর আগে ইন্‌কাদের কাছে এলাকার পরিচিতি ছিল চকেয়াপো হিসাবে।

গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চকেয়াপো নদীতেই প্রথম সোনা খুঁজে পায় উপনিবেশবাদীরা। ১৮৯৮ সালে লা পাস’কে বলিভিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৪ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মার্কিনীদের সহায়তায় একটা পর একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে সে দেশে। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাষ ব্যাহত করে বলিভিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা। সোনা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের মালিক হয়েও দেশটার সাধারণ মানুষ কখনোই দারিদ্র সীমা হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

সূর্যটা ডুবু ডুবু করছে প্রায়। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দেয়ার মত কণ্টকাকীর্ণ বিশাল এক পথ পাড়ি দিয়ে শহরের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই পরিচিত দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। খোলা আকাশের নীচে আবর্জনা ফেলার বিশাল আয়োজন। সব বয়সের শিশু, নারী এবং পুরুষের দল পিঠে ঝোলা চাপিয়ে হুমড়ি খেয়ে হাতড়াচ্ছে আবর্জনার স্তূপ। উচ্ছিষ্ট নিয়ে শকুন, কুকুর আর মানুষের কামড়া কামড়িতে বিষাক্ত হয়ে উঠছে চারদিকের পরিবেশ।
দারিদ্রের এমন কুৎসিত চেহারা দেখা হয়নি অনেকদিন। এক সময় ঢাকার প্রবেশ মুখ যাত্রাবাড়ীতে দেখা যেত দারিদ্র্যের একই রূঢ় ছবি। পশ্চিম দুনিয়ার পর্যটকের দল হুমড়ি খেয়ে পরল ছবি তোলার জন্যে। আমি দু’চোখ বন্ধ করে ফিরে গেলাম জন্মভূমিতে।

বোমা বিস্ফোরণের মত ভয়াবহ শব্দে কেঁপে উঠল আমাদের বাসটা। অনেকের হাত হতে ছিটকে পরল ক্যামেরা। কিছু বুঝার আগেই ড্রাইভার জানাল পেছনের চাকা পাংচার হয়ে গেছে। একই সাথে জানিয়ে দিল দুঃসংবাদটা, চাকা বদলানোর কোন আয়োজন নেই বাসে।

মূল শহর এখনো মাইল খানেকের পথ। ’এবার আমাদের নামতে হবে এবং নিজ খরচে স্থানীয় যানবাহন ধরে পৌঁছতে হবে শহরের কেন্দ্রবিন্দু সানফ্রান্সিকো প্লাজায়’। ট্যুর গাইড মৃত্যু ঘোষণার মত সংবাদটা প্রকাশ করে মিলিয়ে গেল জনারণ্যে।

ছবিঃ সংগৃহিত।

অক্ষমতাকে সক্ষমতায় পরিণত করা মানুষের কাজ

2787

অন্যকে অনুভব করতে হলে আগে নিজের স্বরূপ কে চিনতে হবে। তাই মানুষকে প্রথম নিজের জায়গাকে পরিষ্কার করতে হয় নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে হয়। নয়তো কখনোই অন্যের ধর্মও আপনার চোখে সুন্দর সৃষ্টি তারা উপলব্ধি হবে না।

আত্মা এই ব্রহ্মাণ্ডের মত বিশালাকৃতির না হলেও তার চেয়ে বিস্তৃত এবং সুবিশাল। মন তারই প্রতিনিধিত্ব করে, মস্তিষ্ক দ্বারা সেই প্রতিনিধিত্ব বাস্তবায়িত হয় এবং মহাবিশ্বের যা কিছু রয়েছে তাকে উপলব্ধি করে। সত্য আর মিথ্যা হচ্ছে হৃদয়ের স্পন্দনের মত; এই দুইটার যেকোনো একটা করবেন হৃদয় স্পন্দনে এসে তা ধাক্কা দেবে তার থেকে আনন্দ এবং দুঃখ নির্গত হয়।

মানুষ ঘুমালে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে না মানুষ যখন জ্ঞান হারা হয় (সেন্সলেস হয়) মানুষ তখন তার জীবদ্দশায় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। জীবন একটি অনুপ্রেরণার ভাণ্ডার প্রকৃতি সে ভাণ্ডারকে আরো উজ্জীবিত করে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। কর্ম মানুষের অনুপ্রেরণা- একটি কর্ম দ্বারা আপনি দাঁড়াতে পারেন এবং মুছে যেতে পারেন। মানুষ মরলেও অমর হয় জীবিতদের পাশাপাশি সেই মানুষ কেউ স্মরণ করা হয় তার সৃষ্টি ও কর্ম দ্বারা।

মানুষের নৈতিক আদর্শ তার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন এটাই তাদের দৃষ্টান্ত যে তারা তাদের যাপিত জীবনে কি ধরনের সাফল্য বয়ে আনবে জীবন তার নৈতিক আদর্শ ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত ও পরিপূর্ণ হয়।

বাস্তবতা হলো অন্ধ বিশ্বাসের দ্বারা আপনার জীবন কোনোভাবেই সাফল্যের শিখরে উঠবে না। এখানে তাত্ত্বিক বাস্তবতার যথাযথ প্রয়োগ যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কারো সাধ্য নেই জীবনকে বাস্তবসম্মত করতে পারে।

প্রত্যেকটি মানুষকে তাদের জীবন ধারায় জীবনের উৎস সম্পর্কে সফলভাবে গাদার করতে হবে। আপনার ভেতরে যে ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ রয়েছে তা যদি সজাগ হয় যথার্থ হয় তবেই আপনি সেই মানুষ। যে জীবনের প্রকৃতজসা আলো খুঁজে পেতে পারেন।

মানুষ যদি তার সন্তানের ভুলকে ক্ষমা করতে পারে তবে অন্যের ভুল ক্ষমা যোগ্য। সে ক্ষেত্রে মানুষ কিছুটা ব্যতিক্রম পশুর ভুল কখনো ক্ষমা করা হয় না। এটা যার যার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার তবে বুঝতে হবে পশু মানুষ নয়। আপনার সন্তুষ্টি একটি পরিবার একটি সমাজ আর রাষ্ট্র গড়ার জন্য যথেষ্ট।

প্রতিনিয়ত নানা ধরনের আলো আপনার জগৎ জীবনে বিকিরণ করছে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই আলোকে বাস্তবতার নিরিখে গণ্য করলে জীবনে এগিয়ে যায়। বৃক্ষের তলদেশের কঠিন শেকড়কে ছিড়তে হয় এবং অন্ধকার সময়ের সকল শেকলকে ভাঙতে হয় আপনি যদি শেকলকে ছিঁড়তে বা ভাঙতে না জানেন তাহলে আপনি পুরোনোকে কখনোই অতিক্রম করতে পারবেন না।

অজ্ঞতা মানুষের দাস; মানুষ যখন অজ্ঞতার দাস হবে তখন তাদের জীবনকে ঘনীভূত অন্ধকার নিষ্পেষিত করবে। আমরা অন্ধকারকে ভয় পেলেও অন্ধকারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই আমরা অজ্ঞতাকে ভয় পেলেও অজ্ঞতার কাজকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেই বিশ্বাসের সময় গ্রহণ করি।

আমাদের অন্তর্জগৎ এমন একটা বিশাল ভূখণ্ড সমান যা কিনা অনায়াসে সবকিছুকে স্থান দেয় কিন্তু গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এটাই মানুষকে ভাবিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট যে আপনি কি গ্রহণ করবেন। সুন্দর নাকি অসুন্দর সহজ পথ নাকি কঠিন পথ।

মা থাকুক মনের মণিকোঠায়

2800

মণিকোঠা শুধুই মণিকোঠা নয়। মনের এই মণিকোঠার আরও নাম আছে। যেমন: মনের মণিকোঠা, অন্তরের অন্তস্তল ও মানমন্দির।

তো যাই হোক, মনের মণিকোঠা বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো, প্রত্যেক মানুষের মনের ভেতরে থাকা একটা কোঠা। এই কোঠার নামই ‘মণিকোঠা’ বা ‘অন্তস্তল’ বা ‘মানমন্দির’।

এই কোঠা ছোট্ট একটা চিলেকোঠাসম নয়। এই কোঠা বাড়ির ঘরের ভেতরে থাকা একটা কোঠাও নয়। এটা একটা বিশাল কোঠা! প্রত্যেক মানুষের মনের ভেতরে থাকা এই সুবিশাল কোঠায় ছোটবেলা থেকে এই মণিকোঠায় সর্বপ্রথম গর্ভধারিণী মা-ই স্থান পেয়ে থাকে। আর যদি ভূমিষ্ট হবার সাথে সাথে গর্ভধারিণী মা মারা যায়, তা হলে যিনি মায়ের আদর দিয়ে ছোট্ট শিশুটিকে লালনপালন করে, তিনিই প্রথমে ছোট্ট শিশুটির মনের মণিকোঠায় স্থান পায়।

তারপর এই মণিকোঠায় স্থান পায় বাবা-সহ নিজের সংসারে থাকা ঘনিষ্ঠজনেরা।

তারপর একটু একটু করে যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হতে থাকে, তখন এই মণিকোঠায় স্থান দেয়া হয় নিজ গোষ্ঠীর আত্মীয়স্বজনদের। পাশাপাশি স্থান পায় সহপাঠী বন্ধুবান্ধব ও পাড়া প্রতিবেশীর অনেকেই। তাই এই মণিকোঠাকে অন্তরের অন্তস্তল বা মানমন্দিরও বলা হয়।

প্রশ্ন করতে পারেন, তবে কি এই মণিকোঠায় আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী বন্ধুবান্ধব ও পাড়া প্রতিবেশী সবাই স্থান পায়? উত্তর হ্যাঁ এবং না দুটোই আসে। যেসমস্ত মানুষ আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব ও পাড়া প্রতিবেশীদের স্থান দিতে পেরেছেন, সে সমস্ত লোকদের বলা হয় মহৎ প্রাণের মানুষ বা মহামানব। আর যারা সবাইকে স্থান দিতে পারে না, তারা নামমাত্র মানুষ বা মানব। এরমধ্যে আমিও কিন্তু একজন। তবে আমি আমার মা-বাবা,ভাই-বোনদের তো মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়েই ছিলাম। এদের সাথে আত্মীয়স্বজন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী ও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেরই স্বইচ্ছায় স্থান দিয়েছি এবং দেবার চেষ্টাও করেছি। এখন আমার মা নেই, বাবা নেই, ভাই নেই, চার বোনের মধ্যে দু’জনেই নেই। আমিও প্রায় শেষ বয়সে আসে যাবো যাবো বলে ভাবছি! তাই আমার এই মনের মণিকোঠা বা অন্তরের অন্তস্তল বা মানমন্দিরে স্থান দেয়া বা স্থান পাবার সময়-সুযোগ নেই।

কিন্তু আমার মতো মানুষ বা মানবের মধ্যে অনেকেই আছে, তাদের মনের মণিকোঠা একেবারেই সবসময়ের জন্যই খালি। এর কারণ হলো, এ সমস্ত মানুষেরা তাদের মনের মণিকোঠায় বা অন্তরের অন্তস্তল বা মানমন্দিরে কাউকে স্থান দিতে পারেনি। অর্থাৎ তারা কাউকে বিশ্বাসই করে না। পৃথিবীর সবাইকে এ সমস্ত মানুষেরা অবিশ্বাসের চোখেই দেখে থাকে। এমনকি তারা বিখ্যাত ধর্মগুরু বা বিখ্যাত আলেম বা খ্যাতিমান জ্ঞানী গুণীদেরও বিশ্বাস করতে পারে না। পারে না মানে একেবারে বিশ্বাস করেই না। তা হলে তারা নিজের মনের মণিকোঠায় আরেকজনকে স্থান দিবে কীভাবে? পারে না।

এ সমস্ত মানুষেরা শুধু নিজের সন্তানদেরই স্থান দিয়ে থাকে। নিজের সন্তানাদি ছাড়া অন্য কাউকে মনের মণিকোঠায় বা অন্তরের অন্তস্তল বা মানমন্দিরে স্থান বা বসাতে পারে না। তাই তাদের মনের মণিকোঠা বা অন্তরের অন্তস্তল বা মানমন্দিরে থাকা সুবিশাল জায়গা সবসময়ের জন্যই খালি পড়ে থাকে। এর বিনিময়ে কিন্তু তারাও কারোর মনের মণিকোঠায় বা অন্তরের অন্তস্তল বা মানমন্দিরে জায়গা পায় না।

কিন্তু এরা মনে করে থাকে যে, আমি সবার প্রিয় মানুষ! সবাই আমাকে সালাম দেয়, সম্মানও করে। আসলে কি এই অবিশ্বাসী মানুষদের মন থেকে ভালোবেসে সালাম দেয়? মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়ে কি সম্মান করে? মোটেই না। হয়তো সালাম দেয় অতি ভয়ে। আর নাহয় সম্মান করে কিছু সুবিধা ভোগের জন্য।

এখন আসি আসল কথায়। আসল কথা হলো, লেখাটা লিখলাম এই কারণে যে, বিশ্ব মা দিবসে বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে দেখি মা-কে নিয়ে কত সম্মানজনক কথা। অনেকেই লিখছে, “আমার পৃথিবী আমার মা”। বাহ্, দারুণ কথা! আসলে কি সত্যি? এমনও-তো হতে পারে যারা এ সমস্ত লেখা বা স্ট্যাটাস দিচ্ছে, তাদের মধ্যে কারো কারোর গর্ভধারিণী মা বৃদ্ধাশ্রমে বসে বসে খোকা খোকা বলে ডাকছে আর কাঁদছে! অথচ মায়ের জন্য ফেসবুকে কত-না মায়াকান্না ভাব দেখাচ্ছে। এমন ভাব দেখানো লাভ কী?

আবার অনেকেই বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে লিখে থাকে, “তোমাকে আমার মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছি”। আসলে কি সত্যি? জানি না! সত্যিই জানি না! সত্যি হতেও পারে, মিথ্যাও হতে পারে।

তো যাই হোক, যে যেভাবে পারুন লিখতে থাকুন। আর যদি পারেন নিজের মনের মণিকোঠায় বা অন্তরের অন্তস্তল বা মানমন্দিরে নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, সহপাঠী, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের বিশ্বাস করে ভালোবেসে স্থায়ীভাবে স্থান দেয়ার চেষ্টা করবেন। কারণ মনের মণিকোঠা বা অন্তরের অন্তস্তল বা মানমন্দিরে ছোট্ট খানি জায়গা নয়। সুবিশাল জায়গা! এতো বড় জায়গায় যেকেউ ইচ্ছে করলে এই পৃথিবীর সবাইকে স্থান বা জায়গা দিতে পারে। যদি স্থান বা জায়গা দেয়ার মতো মন থাকে।

বি:দ্র: লেখাটা পড়ে কেউ মনে কষ্ট নিবেন না। যদি আপনার মানমন্দিরে আঘাত লেগে থাকে, তা হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে ক্ষমা করে দিবেন।

বিশ্ব মা দিবসের শুভেচ্ছান্তে: নিতাই বাবু।

সয়াবিন কি আয়ুর্বেদীয় জাফরান?

28

তেল দিয়ে ভাজে আলু পটল বেগুন
তাই তেলের বাজারে লাগলো আগুন,
শুনেছি তেলের দামও বেড়েছে দ্বিগুণ
দামে সরিষার চেয়ে সয়াবিন বহুগুণ!

সয়াবিন তেল দিয়ে চলে রান্নার কাজ
তাইতো সয়াবিন তেলের সংকট আজ,
হটাৎ সয়াবিনের তেলের বেড়েছে ঝাঁজ
দেশের মানুষের মাথায় যেন পড়েছে বাজ।

আচ্ছা, সয়াবিন কি আয়ুর্বেদীয় জাফরান?
যদি নাহয় জাফরান, সয়াবিনের ব্যবহার কমান!,
বাংলার বাজার সিন্ডিকেট গুলোকে দমান
বেশি ব্যবহার বেশি কেনার অভ্যাস সামলান!

সয়াবিন তেল নয় জীবন বাঁচানোর মহৌষধ
যেমন- দিনে সেবন করতে হবে তিন চামচ ঔষধ,
সেবনে গড়মিল হলেই মনে হয় যমে করবে বধ
আসলে কিন্তু নয়, আসুন সয়াবিনকে করবো রধ।

এদেশ ওদেশ ১৩

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ ত্রয়োদশ পর্ব।)

নিরপেক্ষ বিচারে দেখলে বোঝা যায়, নক্সালাইট মুভমেন্ট প্রতিষ্ঠিতই ছিল ভুল ভিত্তির ওপরে। মাওজেদং এর চীনের বিপ্লব কে অন্ধভাবে অনুসরণ, মাও কে নিজেদের চেয়ারম্যান ঘোষণা, চীনের তত্ব এই জলা জংলা ভূমিতে ইমপ্লিন্টের চেষ্টা, বন্দুকের নলই শক্তির উৎস বলার মত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ, সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র মনীষীদের মূর্তি ভাঙা, স্কুল কলেজে ভাঙচুর এবং সর্বোপরি অতি সাধারণ মানুষ, যারা রাষ্ট্রশক্তির নীচু তলায় কর্মরত, যেমন- নীচুতলার পুলিশ, অধ্যাপক, রাজনৈতিক কর্মীদের অকারণ হত্যা তাদের মানুষ থেকে ক্রমাগতই বিচ্ছিন্ন করছিল। ভারতের মত বিশাল দেশের সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে তাদের লড়াই যে সম্পূর্ণ অসংগঠিত সম্ভবত তারা তা বুঝতে পারেনি বা বুঝতে চায়নি। অথচ ঐ নেতাদের তত্বে আকৃষ্ট হয়ে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র ছাত্রী, যাঁদের বড় অংশই শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন ছিলেন।

একটা ভুল তত্ত্বের ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে নক্সালাইট মুভমেন্ট শুধুমাত্র একটা আলোড়নের সৃষ্টি করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করতে পারল না। দিশাহীনভাবে তারা শুধু হত্যার রাজনীতিই করে গেল, আর এতে সুবিধা হয়ে গেল রাষ্ট্রযন্ত্রের। পরবর্তীতেও দেখা গেছে নক্সালোত্তর মাওয়িস্টরা সেই একই হত্যার রাজনীতির কুম্ভপাকেই আটকে থাকল। অথচ এই বৃহৎ দেশের মূল যে সমস্যাগুলো- শোষণ, দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমজনতার নাভিশ্বাস সবই সেই একই জায়গায় থেকে গেল। এমনকি টিকে থাকার রাজনীতি করতে গিয়ে মাওবাদীরা সেই দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেই হাত মেলালো কোথাও কোথাও। তাদেরও নেতৃত্বের মধ্যে ঢুকে গেল বিলাসিতা, দুর্নীতির বিষ। মাত্র কয়েকটা রাজ্যে স্রেফ তোলাবাজ হয়েই থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে তারা নিঃশেষ হতে থাকল।

৭২ এ এই টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেই অন্য রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেরও নির্বাচন ঘোষিত হল। অথচ অন্য রাজ্যে যখন পাকিস্তানকে হারানোর আনন্দ রেশ, এখানে তখন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ঢেউ। কেন্দ্রে তখন ইন্দিরার বিশ্বস্ততম মানুষটি এক বাঙালি, সিদ্ধার্থ শংকর রায়। পশ্চিমবঙ্গ শাসনের জন্য তাঁকেই পাঠালেন ইন্দিরা। সেই নির্বাচন স্তম্ভিত করে দিল তাবৎ গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের। ভারতও প্রথম দেখল, শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের জন্য সর্বাত্মক ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রয়োগ। প্রচার থেকে ফলঘোষণা পর্যন্ত বিরোধী দলগুলিকে মাথা তুলতে দেওয়া হল না। সামান্যতম বিরোধিতার আভাস পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছিল প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের লুম্পেনরা। নিগ্রহ, হত্যার বন্যা বয়ে গেল রাজ্য জুড়ে। নির্বাচনের দিন অবাধে বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, বিরোধীদের শারীরিক নিগ্রহ চললো। অবধারিত ভাবেই ফল গেল কংগ্রেসের পক্ষে। মুখ্যমন্ত্রী হলেন সেই সিদ্ধার্থ। ইতিহাসের পাতায় বাহাত্তর এক জ্বলজ্বলে কালো দাগ হয়ে রয়ে গেল।

বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর, এই তিন বছর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল দমন পীড়ন। ব্যারিস্টার বাবার সন্তান নিজেও প্রখ্যাত ব্যারিস্টার এই নবাগত সদ্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন শরণার্থী সমস্যা সহ অন্যান্য মূল সমস্যা মোকাবিলার চেয়ে মন দিলেন বিরোধী দমনে। আর বিরোধী স্বর বন্ধ করার এই মহতী প্রচেষ্টায় প্রাণ দিলেন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নাট্যকার, অভিনেতা, কবি সমেত সাধারণ বাড়ীর অতি সাধারণ ছেলেমেয়েরা কেউই রেহাই পেলোনা শাসনদন্ডের প্রহার থেকে। এপার বঙ্গব্যাপী ছেয়ে গেল আতংকের কালো অন্ধকার।

(ফের আগামী কাল)

আবার হলোতো দেখা

সে চলে যাবার পর আজ ভোররাতে পাঁচ বছর পর দেখা করতে এলো। আমি স্বস্বভাব মতো দেখামাত্রই ধুম ধাড়াক্কা জুড়ে দিলাম… কি ব্যাপার বলতো,
দুম করে কোথায় চলে গেলে, আমাকে বলে পর্যন্ত যাবার প্রয়োজন বোধ করলে না?

আমার রাগকে ও থোড়াই গ্রাহ্য করে। আগের মতোই মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

… বলবে তো কোথায় গেছিলে? আবার রয়েও গেলে এতোদিন ধরে?

সে তো হাসি মুখে মুখ বুজেই রইলো।

আমার রাগ তাতে আরো বাড়তে লাগলো,… কতো দিকে কতো ঝামেলা সংসারের, আমি এসব কখনো কোনোদিন করেছি? বাজার হাট, ব্যাঙ্ক পোস্টঅফিস, পারিবারিক দায়িত্ব কর্তব্য কখনো কোনো দিনও করতে দিয়েছো আমায়? তবে আজ এমন আমার আনাড়ি কাঁধে এমন গন্ধমাদন চাপিয়ে দিলে কেন বলো।

এতক্ষণে কথা বললো,… আমি তো তোমাকে সবদিক দিয়ে তৈরি করে দিয়েছি। তুমি সামলাতে পারবে জেনেই তো দায়িত্ব দিয়েছি তোমায়।

… বয়ে গেছে আমার তোমার এইসব এলেবেলে দায়িত্ব নিতে। আমার লেখা পড়া হয়না, কঠিন কিছু বুঝিয়ে দেবার কেউ পাশে নেই, তাছাড়া এটা আমার একার সংসার নাকি! পালাবো একদিন আমি এইসব ঘরবাড়ি সংসার ছেড়ে…

… সত্যি, সেই একই রকম অবুঝ আর রাগী রয়ে গেলে তুমি। আমার কোনো উপায় থাকলে তোমার ওপর এ্যাতো বোঝা চাপাই? বলো, চাপিয়েছি কখনো?

… সেই জন্যেই আমার রাগ হচ্ছে। এখন শক্তি কমে গেছে আমার, গুছিয়ে কিচ্ছুটি করতে পারিনা… আর…

কথা শেষ করতে না দিয়ে ও এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে নরম করে বললো,… অধৈর্য হয়ো না, আমি রয়েছি তোমার সঙ্গে… তবে এখন আমাকে একটু বেরোতে হবে… রাগ কোরোনা…
… আবার! আবার বেরোবে তুমি!

বলতে বলতে ও সদর দরজার দিকে এগোতে লাগলো… আমি হাত ধরেও আটকাতে পারছি না… এই প্রথম আমি কেঁদে ফেললাম, বেশ.. তবে তোমার ফোন নং টা দিয়ে যাও…

ওরও দুচোখ ভর্তি জল, ধরা গলায় বলে গেলো… আর তো আমি মোবাইল ইউজ করিনা গো…

( আমি মৃত্যু পরবর্তী আত্মায় বিন্দু মাত্রও বিশ্বাসী নই। একটা স্বপ্ন দেখলাম এইরকম)

স্মৃতির গলিতে এন্ডিস… এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে

2800

বাঁকটা পার হতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। মাইল দুয়েক দূরে সাদা সাদা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে অপেক্ষমাণ বাসগুলোকে। মনে হল স্বপ্ন দেখছি! যেন অমল ধবল মেঘরাজ্যে সপ্ত ডিঙ্গায় চড়ে উড়ছি আমি, সাথে বসন্তের পাগলা হাওয়া।

জ্যাকেটটা খুলে মাথার উপর ঘুরাতে শুরু করলাম। দূর হতে কেউ-না কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়ই। দু’মাইলের পথ। ইচ্ছে হল দু’মিনিটে পাড়ি দেই। এ মুহূর্তে বিশ্রাম দরকার আমার, সাড়া জীবনের বিশ্রাম। কিন্তু বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর হাড্ডি কাঁপানো কনকনে শীত বাধা হয়ে দাঁড়াল বাস এবং বিশ্রামের মাঝে। মাথার উপর সূর্যটাকেও কেমন যেন ক্লান্ত মনে হল। পুরানো চিন্তাটা আবারও ঘুরপাক খেতে শুরু করল মগজে, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে আমাকে। এ মুহূর্তে কোন ভাবেই ক্লান্ত হওয়া চলবে না।

দূর হতে দু’মাইলের পথ মনে হলেও দূরত্ব বোধহয় এক মাইলের বেশী ছিলনা। ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বাসটার কাছাকাছি আসতেই স্বাগত জানাল পটকা মাছের মত ফুলে উঠা কতগুলো মুখ। ডায়নামাইটের মত বিস্ফোরিত হল ট্যুর গাইড। সাথে গলা মেলাল ড্রাইভার এবং তার হেল্পার। দুএক জন যাত্রীও ইনিয়ে বিনিয়ে কি যেন বলতে চাইল। এতকিছু শোনার মত শরীর ছিলনা। বসে পরলাম ধপাস করে এবং ভুলে যেতে চাইলাম গত কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ।

পাসপোর্টের কথা মনে হতেই হুস ফিরে এলো। লাগেজ খুলে জায়গা মতো হাত দিতেই অনুভব করলাম মূল্যবান ডকুমেন্টটার উপস্থিতি। সব আগের মতই আছে, শুধু জীবন হতে খসে গেছে ৩টা ঘণ্টা। হেল্পার পানি এগিয়ে দিল নাক-মুখের রক্ত পরিষ্কার করার জন্যে। অনিচ্ছা সত্যেও নামতে হল বাস হতে। পরিষ্কার হয়ে বাসে ফিরতেই হাজারো প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সহযাত্রীরা। মূল প্রশ্ন, মেয়েটা কোথায়? ট্যুর গাইড সবার হয়ে অফিসিয়ালি করল প্রশ্নটা।

আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ভিক্টোরিয়া ছিল আমার সহযাত্রী মাত্র। বাসে পরিচয় এবং তার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমার বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেল দুএক জন যাত্রীর।
বাস ড্রাইভার জানাল আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করবে, মেয়েটা না ফিরলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন গতি নেই। ব্যাপারটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম, কি হতো বাসটা যদি এই জনশূন্য এলাকায় আমাকে ফেলে চলে যেত!

এবার আমার প্রশ্ন করার পালা। ভেতরের সব রাগ দলা করে ছুড়ে দিলাম ট্যুর গাইডের মুখে। কঠিন গলায় জানতে চাইলাম, আমাদের ফেলে বাসটা কেন পালিয়েছিল? এই প্রথম জানলাম একটা বাসের মূল্য আমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী। এমন একটা তথ্য দিতে ট্যুর গাইডের গলাটা সামান্য একটু কাঁপল না। হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। এ ধরনের কথাবার্তা তৃতীয় বিশ্বের অনৈতিক এবং মানষিকভাবে পঙ্গু মানুষগুলোর পক্ষেই বলা সম্ভব, এমনটা ভেবে নিজকে সান্ত্বনা দিলাম।

আরও আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করল আমাদের বাসটা। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার কোন হদিস পাওয়া গেলনা। যমজ বাসটা ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ট্যুর গাইড জানাল, মূল রাস্তা হতে বের হয়ে মাইল খানেক গেলে নতুন একটা ট্রেইল পাওয়া যাবে এবং সে পথটা ধরতে পারলে আরও স্বল্প সময়ে লা-পাস পোঁছানো সম্ভব হবে।

আমার কাছে এসব কথা রূপকথার মত মনে হল। এখান হতে জাহান্নামের দিকে রওয়ানা দিলেও আমার কিছু আসে যায়না। মনে মনে ঠিক করলাম লা-পাস পৌঁছার আগে বাস হতে নামছি না আর। অপেক্ষা শেষে বাসটা রওয়ানা দিল উলটো পথে। যতক্ষণ সম্ভব জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফেলে আসা পথটার দিকে। রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে হারিয়ে গেল এন্ডিসের রহস্যময় বাঁকে।

তন্দ্রা মতো আসছিল। কিন্তু সামনে একটা নড়বড়ে সেতুর কারণে বাসটাকে থামতে হল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল সেতুর চেহারা দেখে। দৈত্যের তাণ্ডবে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদীটা পার হতে গেলে সেতুটা অতিক্রম ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ড্রাইভারের তাগাদায় নামতে হল প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। দূর হতে যতটা দুর্বল মনে হয়েছিল বাস্তবে ততটা দুর্বল মনে হলোনা।

কোন দৈব ঘটনা ছাড়াই পারাপার পর্ব শেষ হল। শরীরটাকে ঠেলেঠুলে কোন রকমে বাসে ওঠালাম এবং আবারও ধপাস করে বসে পরলাম আগের জায়গায়। শুরু হল আমাদের যাত্রা। চোখ বুজে মৃতের মত পরে রইলাম অনেকক্ষণ। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল শরীরের উপর।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি টের পাইনি। চোখ খুলে জানালার বাইরে যে দৃশ্য চোখে পরল তা দেখে দূর হয়ে গেল সারাদিনের ক্লান্তি। মাঠ আর মাঠ। ঠিক বুক বরাবর চলে গেছে কাচা পাকা ট্রেইলটা। একদিকে বরফ আচ্ছাদিত এন্ডিসের চূড়াগুলোর নৈসর্গিক প্যানোরমা, অন্যপাশে অঘটনে ভরা পাকা হাইওয়ে। খোলা মাঠে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেড়া এবং আলপাকার দল। মাঝে মধ্যে দুএক জন রাখাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে এন্ডিসের দুর্গম অঞ্চলে আমাদের অনিশ্চিত যাত্রা।

নদীটাকে দেখা গেলনা কাছাকাছি কোথাও। খণ্ড খণ্ড জমিতে ভুট্টার চাষাবাদ দেখে আন্দাজ করা যায় খুব কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে হয়ত। বন্য পশুর লাশ নিয়ে টানাটানি করছে শকুন, চিল আর কায়োটির দল। জানালার বাইরে সূর্যটাকে আগ্নেয়গিরি হতে বেরিয়ে আসা লাভার মত দেখাচ্ছে। বাইরে কি আসলেই এত গরম? জানালাটা সামান্য খুলতেই এন্ডিসের শোঁ শোঁ হাওয়া আর তীব্র শীত এসে ভরিয়ে দিল বাসের ভেতরটা। সামনের সিটে বসা অস্ট্রেলিয়ান স্বামী-স্ত্রী বিনীত অনুরোধ করল জানালাটা বন্ধ করতে।

ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে থাকলে বিরামহীন ধারাবর্ণনায় মাতিয়ে রাখত বাসের নীরবতা। বিন্দু হতে বৃত্তের মত দিগন্তরেখায় ফুটে উঠলো সাদা ধবধবে বাসটার চেহারা। আমাদের যমজ বাস। ট্রেইলটাকে আড়াআড়িভাবে আঁটকে রেখে ঠায় দাড়িয়ে আছে মাঝ পথে। অভিজ্ঞ মন বলছে, সামনে বিপদ!

আসলেই বিপদ, সামনের চাকা ফুটো হয়ে বাসটা প্রায় ছিটকে পরেছে ট্রেইল হতে। কাছাকাছি এসে নিথর হয়ে গেল আমাদেরটাও। যাত্রীরা নেমে গেল অনেকটা জীবন্ত কঙ্কালের মত। আমি বসে রইলাম অনাগত আশংকার হতাশা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ট্যুর গাইড এসে জানাল চাইলে নীচে নামতে পারি।

দুঃসংবাদ যে আসবে তা আমার আগেই জানা ছিল। চাকা বদলানো জ্যাকটা ভেঙ্গে গেছে ! বাস হতে নেমে পরলাম ঘোর নেশাগ্রস্থের মত। মনে হল এ ওঠানামা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে।
নিজেকেই দায়ী করলাম এমন গোলক ধাঁধায় আটকে যাওয়ার জন্যে। তবে ভাল সংবাদ বলতে যা বুঝায় তার একটা হল, রাস্তার ঠিক পাশেই ছোট একটা লোকালয় দেখা যাচ্ছে। এবং হাত পাওয়ালা দুএক জন আদমকে দেখা গেল ঘুরাফেরা করতে।

ইতিমধ্যে স্থানীয় একজন বাইসাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছে কোন এক রহস্যপুরী হতে নতুন একটা জ্যাক আনবে বলে। সময় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সে রাজপুত্রের আর দেখা নেই। ততক্ষণে ক্ষুধা বাবাজি পেটে ঢোল বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। শক্ত কোন খাবার পেটে যায়নি অনেকক্ষণ। আমার হাতে মাত্র দু’টা আপেল। পানির শেষ খালি বোতলটা এখনো ডাস্টবিনে ফেলা হয়নি।

হঠাৎ করে চমৎকার একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। দু’টা বাসের সব যাত্রীদের স্টকের খাবার এক জায়গায় করা হচ্ছে। দু’টা আপেল দিয়ে আমিও যোগ দিলাম অসময়ে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক সংহতিতে। আমি ছাড়া বাকি সবাইকে মনে হল আপদ-কালীন সময়ের প্রস্তুতি নিয়েই যেন ভ্রমণে বের হয়েছে। সবাই পেট পুরে খেয়ে বেরিয়ে পরল পাশের লোকালয় দেখবে বলে। পরনের জ্যাকেটটা বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম একটু ঘুমবো বলে।

১৩ই অক্টোবর, ১৯৭২ সালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে চিলি গামী উরুগুয়ের একটা বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল এন্ডিসের চূড়ায়। ১২ জন সাথে সাথে মারা যায়। বাকিরা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু করে বাচার লড়াই। খাবার হিসাবে মৃত সহযাত্রীদের মাংস ভক্ষণ করতেও বাধ্য হয় অনেকে। এভাবে একটানা ৭২ দিন লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ১৬ জন জীবন্ত ফিরে আসে মূল ভূখণ্ডে। পৃথিবী চমকে উঠে এমন একটা লোমহর্ষক ঘটনার খবর পেয়ে। আমাদের ভাগ্য কি শেষ পর্যন্ত এমনটাই হতে যাচ্ছে?

আবোল তাবোল ভাবনায় মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। প্রথমত আমরা এন্ডিসের চূড়ায় নই, দ্বিতীয়ত পাশেই আছে লোকালয়। মূল রাস্তাটাও বেশী দূর নয়। তাছাড়া এটা ২০০৪ সাল, – এমন কতগুলি যুক্তি দাড় করিয়ে নিজেই নিজকে বোঝালাম আমাদের ভাগ্য অতটা অনিশ্চিত নয়। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যোগ দিলাম বাকি যাত্রীদের কাফেলায়। এই প্রথম ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তুলব বলে।

শীতের দাপট মানুষগুলোর শরীর ঝলসে দিয়েছে বাদামী কাবাবের মত। অনেকেরই দাঁত নেই, নাক দিয়ে বেরুচ্ছে হরেক রকম তরল পদার্থ। দরিদ্রতার সাথে রুক্ষ প্রকৃতি যোগ হলে মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে এন্ডিসের এ অঞ্চলটায় না এলে বোধহয় বুঝা যেত না।

শত বছর বয়সী এক বৃদ্ধার বেশ কটা ছবি তুল্‌লাম। সেশন শেষ না হতেই হাত বাড়িয়ে দিল কিছু পয়সার জন্যে। সাথে কিছু স্থানীয় মুদ্রা ছিল, দশ বলিভিয়ানো দিয়ে বেরিয়ে এলাম আঙ্গিনা হতে। পানির কুয়া পাওয়া গেল একটা জায়গায়। সবার মত আমিও ভরে নিলাম আমার খালি বোতলটা। পানি মনে হল উত্তর মেরুর বরফ গলিয়ে কেউ জমা করেছে। নিথর হিম শীতল ঠাণ্ডা! সময়টা মন্দ কাটল না এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও।

এ ফাকে সহযাত্রী অনেকের সাথে নতুন করে পরিচয় হল। এক অপরের সাথে ছবি তুলে বিরল মুহূর্ত গুলো ধরে রাখার চেষ্টা করল অনেকে। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর ধোঁয়াটে আবহাওয়ার ফাঁক গলে হলিউডের নায়কের মত বেরিয়ে এলো স্বপ্নের সে রাজপুত্র। হাতে বিশাল একটা জ্যাক। এ যেন শত বর্ষ অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির আগমন। খুশীর ফোয়ারা বয়ে গেল যাত্রীদের মাঝে।

28008

বিবাহ বার্ষিকী

বিবাহ বার্ষিকী
বিজন বেপারী

বিশ্বাসের এই হাতটি ধরে
ভালোবাসার দামে,
সকল সংশয় পায়ে ঠেলে
এসেছিলে চলে।

দুটি মেরুর দুটি পথের
মিলন হয়েছিল,
অচেনা এক মসৃণ জীবন
কাব্য পেয়েছিল।

শুভ পরিণয়ের এই ক্ষণে
খুশিতে ভরে মন,
ফিরে আসুক বারে বারে
মধুর খুশির ক্ষণ।

রাগ অভিমান সঙ্গে নিয়ে
দাম্পত্য হোক সুখের,
তোমায় নিয়ে সাতটা জনম
প্রার্থণা এই দীনের।

এদেশ ওদেশ ১২

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ দ্বাদশ পর্ব।)

১৯৭২। সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রে এই বছরের আর কোনো প্রভাব এখন আর নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখনো চমকে ওঠেন এই সালের কথা মনে পড়লেই। সদ্য পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর মনোবল তখন তুঙ্গে। আর সেই গর্বিতচারণ তারা চারিয়ে দিচ্ছে আম জনতার মধ্যে। আসলে এই কৌশল সারা পৃথিবীর সব দেশেই রাজনৈতিক দলেরা কাজে লাগায়। যখনই দেশের অবস্থা টলোমলো হয়, ক্ষোভ ঘনিয়ে ওঠে তখনই দুটো কৌশল কাজে লাগানো হয়। এক, জাতীয় আবেগ, দুই, খেলা। মজার ব্যাপার, এই দুই কৌশলেই আমাদের উপমহাদেশের পেটেন্ট নেওয়া। অতীতে বারবার দেখা গেছে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলেরা ভারত জুজু, ভারতের রাজনৈতিক দলেরা পাক জুজু আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলেরা ভারত জুজু বা পাক জুজুর ভয় দেখিয়ে মানুষের স্বাভাবিক ক্ষোভকে অন্যদিকে চালিত করে তাৎক্ষণিক ভোলানোর চেষ্টা করেন। আর এই জুজুর ভয়ের ওপরের মোড়কটাই হলো ধর্মীয় বিকৃত ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত ভয়। অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষ বিদেশী ভাষায় লিখিত ধর্মগ্রন্থের সদভাবটুকু আত্মস্থ করতে পারেন না না জানার ফলে, আর সেখানেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধি ও ক্ষমতা দখলের জন্য চলে কিছু অসৎ মানুষের বিকৃত ব্যাখ্যা। সম্প্রতি খেলার মত নির্দোষ আমোদেও এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থর চেষ্টা লক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এই তিন দেশের সাধারণ মানুষ ধান্দাবাজ নন। তারা সহজ, সরল, অমায়িক, অতিথিবৎসল। এক দেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষকে কাছে পেলে বুকে জড়িয়ে ধরেন আত্মীয়স্বভাবে। তাদের মধ্যে বিদ্বেষের লেশমাত্রও পরিলক্ষিত হয়না।

৭২ এর নির্বাচন হয়েছিল সমগ্র ভারত ও বঙ্গের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে। আগেই বলেছি সদ্য পাকিস্তান যুদ্ধ জয় হয়েছে। ভারতের আম মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে যুদ্ধজয়ের উন্মাদনা এবং আত্মপ্রসাদ। স্বয়ং বিরোধী দলের নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী সংসদে প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরাকে আখ্যা দিলেন ‘দেবী দুর্গা’। অথচ এই জনসংঘী বাজপেয়ীরই জনক দলের নাথুরাম গডসে একদিন গুলি করে হত্যা করেছিল ইন্দিরার ধর্মপিতা মোহনদাস করমচন্দ গাঁধিকে। যুদ্ধজয়ের উন্মাদনাকে কি সুন্দর কাজে লাগানো যায় এই ঘটনা তার উৎকৃষ্ট প্রমান।

যাইহোক,১৯৭২ এর জুলাইএর সিমলা চুক্তির আগেই সমগ্র ভারত যখন উত্তেজনায় ফুটছে, সেই স্বর্ণসময় কাজে লাগিয়ে ইন্দিরা রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনের ডাক দিলেন। আজকের মত তখনকার নির্বাচন কমিশন এত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত না। তখন কেন্দ্রের শাসকের অঙ্গুলিহেলনেই তারা কাজ করতে বাধ্য হত। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগালেন ইন্দিরা। ইতিমধ্যেই সারা ভারতে মাথাচাড়া দিয়েছে গরীবি, বেকারী, মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারী, ভূমির অনৈতিক বন্টন প্রমুখ সমস্যা। আর এর বিরুদ্ধে পূর্ব ভারতে দানা বেঁধেছে যে ক্ষোভ তা অচিরেই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা। সব মিলে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে খানিক অনুকূল করার প্রয়াস।

১৯৬৭ তে যখন ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বর্দ্ধমান প্লেনামে পাল্টা দলিল পেশ হয়েছিল, তখনই ঘনীভূত হয়েছিল আশংকা। মাত্র কয়েক বছর আগে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে বেরিয়ে আসা নেতারা এই ঔদ্ধত্য সহ্য করতে পারেন নি। যে তরুনেরা এই পাল্টা দলিল পেশ করে বলতে চেয়েছিল যে তখনকার আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ধনীদের করায়ত্ত, তাদের কথা না শুনেই, তাদের পার্টি থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। পরিণামে চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালের নেতৃত্বে তরুনেরা ভুল পথে পা বাড়াল। আগুন জ্বললো পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ভারতে। বাংলার উত্তরভাগের এক গ্রাম নক্সালবাড়ীতে সামান্য এক জমির লড়াই ছড়িয়ে পড়ল সারা প্রদেশে। ১৯৬৯ সাল, সিপিআই-এম তখন যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায়, সে সময়েই কেন্দ্রে জেএফআর জেকব এর নেতৃত্বে পরিকল্পনা হল “Operation Steeplechase” এর। নীল নক্সা অনুযায়ী সেনাকেই কাজে লাগানোর সবকিছু ঠিকঠাক। যদিও তখনও তরুনদের আন্দোলন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছয়নি। কিন্তু ’৬৯ এ হিড়িক পড়ে গেল বহু সাংবিধানিক দলত্যাগের। নক্সালবাড়ীর নামে সাধারণ মানুষ পুরো দলটার নামই দিয়ে ফেললো ‘নক্সাল’।

(আবার আগামীকাল)