বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

সন্ধ্যা বেলার তারা

star

খুব ছোট তখন –
সন্ধ্যা হলেই কুপি জ্বালিয়ে বসতাম খোলা উঠোনে,
বাবাই পড়াতেন অতি যত্নে।
বুঝানোর ফাঁকে রোজ শুনাতেন ‍উপদেশ বাণী,
দিতেন স্নেহের পরশে গেঁথে
মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য জ্ঞান।
আমাকে নিয়ে অনন্ত আশা পুষতেন তিনি মনে।
বুঝতাম না –
হয়তো বা তাই সুযোগে পেলেই উঠতাম দুষ্টুমীতে মেতে
আর তখন তর্জনী উচিয়ে তিনি বলতেন
’ওই যে দেখছো অগণিত তারা,
মরে গিয়ে আমি অমনই এক তারা হয়ে রবো আকাশে!’

একটু বড় হয়েই বুঝতে পারলাম
মানুষই শুধু মরণশীল নয়, এ পৃথিবীটাই নশ্বর।
আর সেই যে বাবার তারা হবার কথাটা! নিছক অভিমান মাত্র।
বাবা চলে গেলেন একদিন।
তারপর –

আজ ঢের বয়স হয়েছে আমার
তবু কেন জানি সন্ধ্যা হলেই দৃষ্টি চলে যায় আকাশে,
দেখি এক ঝলমলে তারা
আর ভাবি, বাবা মিথ্যা বলেন নি
পাশেই ঘুমিয়ে আছে আরেকটি তারা হয়তো আমারই অপেক্ষায়!

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা

Eid Mubarak

ঈদ ঈদ ঈদ, রাত পোহালেই ঈদ! মানে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। সারা বিশ্বে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বছরে দুটি পবিত্র ঈদ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে সুখ। ঈদ মানে খুশি।

ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহা দুটি ঈদ’ই শান্তি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয় বলে আমি বিশ্বাস করি। এ-ও বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি ঈদ-এ হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি ভুলে মানুষ মানুষের প্রতি সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। প্রতিটি ঈদ’ই ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জীবনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে এবং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই ঈদের আনন্দে মেতে ওঠে।

বলে রাখা ভালো যে, “আমি একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী (হিন্দু)। তাই বলে কী? এদেশের প্রতিটি ঈদ উৎসব’ই আমার উৎসব! সকলের মতো আমিও ঈদ’র আনন্দে মেতে উঠি। প্রতিটি পবিত্র ঈদ’র বন্ধ খুবই দারুণভাবে হেসে-খেলে উপভোগ করতে পারি। কারণ, সরকার আমাদের কিছুকিছু পূজা-পার্বণের বন্ধ দিলেও, আমি আমার কর্মস্থল থেকে কোনও পূজোর বন্ধ বা ছুটি পাই না। কাজেই বছরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দুটি পবিত্র ঈদ’ই আমি খুব আনন্দে উপভোগ করি। তাই প্রতিটি ঈদ উৎসব’ই আমার উৎসব মনে করি”।

আসুন আমরা এই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে হিংসা, অহংকার, বৈষম্য ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সবাই পবিত্র ঈদ’র আনন্দটা ভাগাভাগি করে নিই! সবাই মিলে মেতে উঠি পবিত্র এই ঈদ’র আনন্দে! মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, ঈদ সকলের জীবনে বয়ে আনুক সুখ সমৃদ্ধি ও অনাবিল আনন্দ।

পরিশেষে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে আমার সকল মুসলমান বন্ধুবান্ধব ও দেশের সকল ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও “ঈদ মোবারক”!

ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছান্তে: নিতাই বাবু।
৩০শে রমজান, ২ই মে-২০২২ইং।

ঈদ মোবারক

2796

ঈদ এলেই ঘরে ঘরে হয়নারে ঈদ
মনে পোষে অহংকার কারো বাড়ে জিদ।
সবার আকাশে বাঁকা চাঁদ সে তো হাসেনা
দ্বারে দ্বারে ঈদ তাই খুশি নিয়ে আসেনা।
ঈদ সে তো ঈদ নয় রেখে দিয়ে ব্যবধান
ঈদ মানে সাম্য -সম্প্রীতি অবদান।
বৈষম্যটা যত ধনি আর গরিবে
পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মিয়-করীবে।
আশেপাশে খাবে সব সুখে যাবে নিদে
তবেই তো বলা চলে ‘ঈদ মোবারক’ ঈদে।

ভূমিহীন ছিলাম না, বর্তমানে ভূমিহীন

27924-1 আমি ভূমিহীন ছিলাম না। এদেশের আরও দশজনের মতো আমারও বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছিলো। বাড়ি ছিলো। সুন্দর পরিপাটি উঠোন ছিলো। থাকার মতো ঘর ছিলো। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর ধরে আমরা এদেশে ভূমিহীন নাগরিক হয়ে বসবাস করছি। বর্তমানে আমার বাবা, মা, বড় দাদা, বেঁচে নেই। আমার বাবার পুরিতে পুরুষ বলতে আমিই একমাত্র পুরুষ। আমরা ছিলাম দুই ভাই, চার বোন। দু বোনের মধ্যে দুইজন পরলোকে, আর দুই বোন এখনো বেঁচে আছে। আমি ছিলাম আমাদের সংসারে সবার ছোট। আমি ভূমিহীন বাস্তুহারা হয়ে পরের বাড়িতে ভাড়া থেকে কোনোরকমভাবে বেঁচে আছি।

ভূমিহীন হওয়ার ইতিহাস:
আমার নাম শ্রী নিতাই চন্দ্র পাল। তবে সবাই আমাকে “নিতাই বাবু” বলেই ডাকে। তাই আমি নিতাই বাবু নামে সবার কাছে, আর সবখানে এই নামে পরিচিত। আমার বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছিলো নোয়াখালী জেলার বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাবপুর গ্রামে। আমার জন্ম ১৯৬৩ সালের ৮ জুন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণি পাস করে সবেমাত্র চতুর্থ শ্রেণিতে ক্লাস শুরু করেছিলাম। তখনই লেগে যায় স্বাধীনতার দাবিতে তুমুল যুদ্ধ। তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান’র (বর্তমান বাংলাদেশ) আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর।

চলতে থাকে যুদ্ধ আর যুদ্ধ। চারদিকে জ্বলতে থাকে আগুন, আর পাক বাহিনীদের গুলিতে মরতে থাকে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। আমার বাবা তখন চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। আর বড়দা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিলে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে দু’জনেই বাড়িতে আসতে পারছিলেন না। এরমধ্যে বাবাকে না জানিয়ে আমার বড়দা চলে যায় ভারতে। ভারতে গিয়ে বড়দা নাম লেখায় কোনোএক শরণার্থী শিবিরে। এর একমাস পর বাবা অতি কষ্টে সহকর্মীদের কাছ থেকে ধারদেনা খালি হাতে বাড়িতে আসে। বাড়িতে এসে ধারদেনা করে মুড়ির ব্যবসা শুরু করে।

মনে পড়ে, একদিন বাবার সাথে আমিও বাজারে যেতে বায়না ধরলাম। বাজারটা ছিলো আমাদের বাড়ির পশ্চিমে আমিষারা বাজার। আমার মর্জিতে বাবা আর আমাকে সাথে না নিয়ে পারলেন না। খুব খুশি মনে বাবার সাথে চলে গেলাম আমিষারা বাজারে। বাজারে আরও আরও মুড়ির ব্যবসায়ীদের সাথে আমার বাবাও মুড়ির বস্তা খুলে দাঁড়িপাল্লা রেডি করে মুড়ি বিক্রি করার জন্য দাড়িয়ে আছে। আমিও দাড়িয়ে আছি বাবার সাথেই। আরও আরও মুড়ির ব্যবসায়ীদের মতো আমার বাবাও মাত্র কয়েক সের(কেজি) মুড়ি বিক্রি করেছে মাত্র। এমন সময়ই বাজারে লেগে যায় হুলুস্থুল, আর দৌড়াদৌড়ি!

কী হলো? লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে, আর বলছে, ‘পাকবাহিনী বাজারে হানা দিয়েছে’। আমার বাবা তাড়াতাড়ি করে মুড়ির বস্তা বেঁধে ফেললো। কিন্তু মুড়ির বস্তা মাথায় উঠিয়ে দেয়ার মতো কোনও লোক এগিয়ে আসছিল না। আমি বাবার জামা চেপে ধরে দাড়িয়ে আছি। এমন সময়ই দুই-তিন জন পাকবাহিনী এসে তাদের হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে আমার বাবার বুকে পিঠে তিন-চারটা বাড়ি মারল। তখন আমি হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। আমি তখন ভেবেছিলাম ওরা পাকবাহিনীরা হয়তো আমার বাবাকে মেরেই ফেলবে। এই ভেবে আমি কাঁদতে কাঁদতে যিনি (পাকবাহিনী) আমার বাবাকে রাইফেল দিয়ে মারছিল, তার পায়ে জড়িয়ে ধরে বাবাকে না মারার জন্য আকুতি মিনতি করতে লাগলাম।পাকবাহিনী যিনি বাবাকে মারছিলেন, তিনি আমার কান্না দেখে বাবাকে আর না মেরে চলে যায়।

পাকবাহিনীরা চলে যাবার পর দেখি, আমার বাবা তখনও মুড়ির বস্তার পাশে মাটিতে শুয়ে আছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবার হাত ধরে টানতে লাগলাম। বাবা তখন আমাকে ধরে আস্তেধীরে উঠে বসলো, কিন্তু দাঁড়াতে পারছিলেন না। বাবার দু’চোখ বেয়ে তখন জল ঝরছিল। মুহুর্তের মধ্যেই পুরো বাজারের চারদিক তখন মানুষ শূন্য হয়ে গেলো। মুড়ির বস্তা মাথায় উঠিয়ে দেয়ার মতো কোনও লোক ধারেকাছেও নেই। অনেকক্ষণ পর একজন মহৎ মানুষ আমাদের সামনে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি তখন কেঁদে কেঁদে ও-ই লোকটাকে আমাদের মুড়ির বস্তাটা বাবার মাথায় উঠিয়ে দেয়ার জন্য মিনতি করলাম। আমার কান্না আর আমার বাবার অবস্থা দেখে লোকটার দয়া হলো। লোকটা ধরাধরি করে বাবার মাথায় মুড়ির বস্তাটা উঠিয়ে দিলে। তারপর আমি আর আমার বাবা সেদিন খুব কষ্ট করে বাড়িতে ফিরে আসি।

বাড়িতে আসার পর আমার বাবা পুরোপুরিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো। বাবার সেই অসুস্থ শরীর সুস্থ হয় প্রায় একমাস পরে। একমাস পর বাবা আবারও অন্যের কাছ থেকে ধারদেনা করে এক মণ মুড়ির ধান কিনে আনে। সেই ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে নিজেদের ঢেকিতে ধান ভাঙে। সেই ধান ভাঙানো চাল দিয়ে আবার মুড়ি তৈরি করে ভয়ে ভয়ে গ্রামের আশেপাশে থাকা বাজার গুলোতে গিয়ে মুড়ি বিক্রি শুরু করে। এরপর থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরোটা সময় আমাদের সংসার এভাবেই কষ্টেসৃষ্টে চলতে থাকে।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এদেশের নিরস্ত্র মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীদের পরাস্ত করে বিজয়ের নতুন পতাকা উত্তোলন করে। দেশ পরাধীন মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায়। এর দিনেক পনেরো দিন পর আমার বাবা গ্রামের বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয় এবং নিজের কর্মস্থলে যোগদান করে। আমার বড় দাদাও ভারত থেকে এসে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিলে নিজের কর্মস্থলে যোগদান করে।

মাসেকখানি পর আমার বাবা ও বড়দা যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসের বেতন একসাথে পেয়ে যায়। আর সেই টাকা থেকে কিছু টাকা তাঁরা হাতে রেখে বাদবাকি টাকা বাড়িতে পাঠায়। সেই টাকা হাতে পেয়ে আমার মা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ধারদেনা করা মানুষের দেনা পরিশোধ করে কোনরকমভাবে সংসার চালাতে থাকে। এভাবে কেটে গেলো আরও কয়েকটি মাস।

এরমধ্যে গ্রামে দেখা দেয় চোর-ডাকাতের উৎপাত। সেই উৎপাত আমাদের বাড়িতেই বেশি দেখা দিলো। কারণ, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় থেকে গভীর রাত পর্যন্ত স্থানীয় মুক্তিবাহিনীরা আড্ডা দিতো। এই আড্ডাকে অনেকেই মনে মনে ভাবতো, আমাদের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীরা ক্যাম্প বসিয়েছে। আসলে কিন্তু তা নয়! মূলত মুক্তিবাহিনীরা সন্ধ্যাকালীন সময়টাই শুধু আমাদের বাড়িতে বসে আমার বড় জেঠার সাথে সময় কাটাতেন।

যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আড্ডার মূলকারণ ছিলো আমার বড় জেঠা। আমার বড় জেঠামশয় একসময় তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের পুলিশে চাকরি করতেন। তিনি উর্দু ও হিন্দি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। আবার তিনি ছিলেন খুবই রসিক মানুষ। রসিকতা ছিলো আমার জেঠার নিত্যসঙ্গী। সেই কারণে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীরা প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পরপর আমাদের বাড়িতে এসে বাড়ির উঠোনে বসে গল্পগুজব করতো। তাদের সেই গল্পের ফাঁকে আমার মা, নাহয় আমার জেঠিমা চা’র আয়োজন করে সবাইকে চা দিতো। চা পান করার সাথে চলতো হুক্কা টানার ব্যবস্থা। এভাবে রাত গভীর পর্যন্ত চলতো সেই আড্ডা।

সেই আড্ডাই কাল হয়ে দাঁড়ায় দেশ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে। স্থানীয় রাজাকার বাহিনীরা মনে করতো আমাদের বাড়িতেই ছিলো মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। এরকম মনে করা থেকেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গ্রামের আরও আরও বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতেই ছিলো ডাকাতদের সবচেয়ে বেশি হানা।

একপর্যায়ে চোর-ডাকাতের উৎপাত থেকে বাঁচতে আমার জেঠা-সহ আমার বাবা কাকারাও পুরো বাড়ি স্থানীয় বাদশা মিয়া নামে এক কন্ট্রাক্টরের কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়। আমার দুই জেটা চলে যায় ভারতে, দুই কাকার মধ্যে ছোট কাকা চলে যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম গুঁইমারা বাজার। মেজো কাকা পারি জমায় চাঁদপুর। আমরা মনে হয় ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সপরিবারে চলে আসি নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলে। সেই থেকে আমরা হয়ে যাই ভূমিহীন।

বড়দা’র চাকরির সুবাদে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি আদর্শ কটন মিলের শ্রমিক কলোনিতে। ১৯৭৪ সালে আমি লক্ষ্মণ খোলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুল চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। লেখাপড়া অতি কষ্টে ঠিকঠাকমতো চলছিলো। প্রাইমারি পাস করে ঢাকেশ্বরী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়েও ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আদর্শ কটন মিলের শ্রমিক কলোনিতে থাকা অবস্থায় আমার বাবা পরলোকগমন করেন। শেষ হয়ে যায় আমার লেখাপড়া!নতুন করে শুরু হয় বড়দা’র পাশাপাশি সংসারের আহার যোগাড়ের ধান্দা।

লেখাপড়ার পাশাপাশি আদর্শ কটন মিলের গেইটে বাদাম বিক্রি-সহ আরে অন্যান্য কাজ করতে থাকি। সময়তে রাজ জোগালির কাজ, আবার সময়তে আদর্শ কটন মিলে দৈনিক ১২ টাকা হাজিরায় কাজও করেছি অনেকদিন। কিন্তু কয়েক মাস পর হঠাৎ আদর্শ কটন মিলস সরকার কর্তৃক যখন বিক্রি হয়ে গেলে, আমরা সপরিবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ি।

তখন আমার লেখাপড়ার ইতি টেনে সপরিবারে চলে যাই শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় নগর খাঁনপুর। নগর খাঁনপুর ছোট একটা ঘর ভাড়া করে থাকতে থাকি। এই ভাড়া থাকাকালীন অবস্থাতেই অবিবাহিত দুই বোনের বিয়ে দিই, মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য তুলে। তখন আমার বড়দা কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে তাঁতের কাজ করে। আমি চালাতাম নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা। রিকশা চালানো বড় পরিশ্রম! প্রতিদিন রিকশা চালানো যেতো না। যেদিন রিকশা না চালাতাম, সেদিন কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে বড়দা’র সাথে তাঁতের কাজ শিখতাম। একসময় আমি তাঁতের কাজ শিখে রিকশা চালানো বাদ দিয়ে টেক্সটাইল মিলে কাজ করতে থাকি।

এরপর ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি বিক্রমপুর সুবচনী নয়াবাড়ি গ্রামের এক দরিদ্র হিন্দু পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করি। শুরু করি নতুন জীবন নতুনভাবে আবিষ্কার করার চেষ্টা। কিন্তু না, ভাগ্য আমার অনুকূলে ছিলো না। আমার এক মেয়ে এক ছেলে। দশ দুয়ারে হাত পেতে মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় মেয়ে বিয়ে দিয়েছি, ২০০৭ সালে গোপালগঞ্জ সদর থানার এক গ্রামে। ২০১১ সালের মে মাসে আমার একমাত্র ছেলে হঠাৎ মারা যায়।তখন আমরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে যাই নিঃস্ব এতিম। আমাদের সমাধিতে প্রদীপ জ্বালানোর মতো আর কেউ রইল না।

আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভাবনা:
বর্তমানে দুঃখ-কষ্টের মাঝেই পরের বাড়িতে ভাড়া থেকে দিনাতিপাত করছি। বয়স হয়েছে ৬০ এর কাছাকাছি। চাকরি করি ছোটখাটো একটা সমবায় সমিতিতে। বেতন নামমাত্র বললেই চলে। নিজের সহধর্মিণীও ছোটখাটো একটা গার্মেন্টসে চাকরি করছে। সহধর্মিণীর শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়! ক’দিন পর পরই অসুস্থ হয়ে পড়ে। দু’জনেরই জীবনের পথচলা হয়তো শেষ হতে চলছে। কিন্তু ভবিষ্যত কী? যদি এরই মধ্যে সহধর্মিণী দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যায়? তা হলে তো এই বুড়ো বয়সে আমি পথের কাঙাল। আর যদি আমার কালকেই চাকরিটা চলে যায়, তা হলে আমার আবার রিকশা নিয়ে শহরে ঘুরতে হবে। আর নাহয় ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে, তা একশো-তে-একশো। আর যদি আমি দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যাই, তা হলে আমার সহধর্মিণী বুড়ো বয়সে হবে ভিখারিণী। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তাই আমি মনে করি উপায় শুধু একটাই। আর তা হলো মমতাময়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করা।

আমার বর্তমান মনোবাসনা:
বর্তমানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তিনি আমার মতো এদেশের হাজার হাজার অসহায় গরীব ভূমিহীন মানুষকে ঘর উপহার দিয়েছেন। হয়তো আরও দিবেন। মমতাময়ী জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, “এদেশে কেউ গৃহহীন ভূমিহীন থাকবে না”৷ তা হলে এদেশের আরও আরও অসংখ্য ভূমিহীনদের মধ্যে আমিও একজন ভূমিহীন নাগরিক। আমিও তো একটা ঘর পাওনা।

যদি আমি অধম মমতাময়ী জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের একটা ঘর পেতাম, তা হলে ভবিষ্যতে ভিক্ষা করা থেকে বাঁচতাম। আর জীবনের অবশিষ্ট সময়টুকু নিশ্চিন্তে কাটাতে পারতাম। খেয়ে থাকি আর না খেয়ে থাকি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘরে তো প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু আমার এই আর্জি এই বাসনা কি কখনো পূর্ণ হবে। আমার এই আর্জি কি মমতাময়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হবে? এজন্য কেউ কি আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করবে?

নিতাই বাবু
০১/০৫/২০২২ইং।

আমাদের জীবন গল্পের চেয়েও অনেক বড়

2794 ১. আমাদের জীবন গল্পের চেয়েও অনেক বড়। আমাদের জন্ম লগ্ন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলবে লড়াই, বেঁচে থাকার এই লড়াইয়ে টিকে যাওয়া মানুষগুলো পৃথিবীকে সংরক্ষণ করে ক্ষমতা যোগায় লিড দেয়। তাই গল্প যেমন কাল্পনিক নানারকম বৈচিত্র্যময় রহস্যময় রসদ জড়িয়ে থাকে তার বিপরীত কবিতা কিছুটা কল্পনা এবং অনেকটা বাস্তবতার সংমিশ্রণে একজন মানুষের জীবনচরিত উপস্থাপন করে। এটি হোক লেখোকের আর হোক তার ওস্তাদের বিষয়ের উপরে অন্য মানুষের ভ্যাগ ধারণা থেকে নেয়া। তবে কবিতা এক স্বতন্ত্র সত্তা যার দ্বারা স্থাপিত হয় হৃদয়ের উর্বরতা।

দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূরক ও বাস্তবতা সম্মত দর্শন সর্বদা জ্ঞান বিবেক সত্য ন্যায় পরায়নতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে বিকশিত হয়। এখানে প্রজ্ঞাবান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির দাঁড়ায় যা রচিত হয় তা পৃথিবীকে অবশ্যম্ভাবীভাবে সজাগ করে তোলে। হৃদয়ের ভিতর এমনভাবে সেই বিষয়বস্তুগুলো গেথে দেয় যা তাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে। সেটা হোক রাজনৈতিক দর্শন সেটা হোক মানব দর্শন আর তা হোক সৃষ্টি দর্শন কিংবা হোক জীবন চরিত।

মানব সমাজকে উন্নততর করতে গেলে জ্ঞান-বুদ্ধি প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়। সকল একাডেমিক শিক্ষাই মানুষকে প্রজ্ঞাবান করেনা বিবেকবান করেনা সত্য বলতে সাহস যোগায় না। কিন্তু দর্শনের জায়গা থেকে একজন মানুষ যখন তার দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে তাকায় তখন সেই ক্ষমতাটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে আরেকটি মানবের হৃদয়ে গঠিত হয়। যার দরুন একজন মানুষ অনুন্নত ধ্যান ধারণা থেকে উন্নত স্বতন্ত্র ও নীতিনির্ধারকের পর্যায়ে পৌঁছে। এভাবে একজন গুণী মানুষের বাক্যগুলো দর্শনের আলোতে পৃথিবীব্যাপী প্রচারিত হয়। আর মানুষ সেখান থেকে হয়ে যায় সজাগ ও সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত ও জ্ঞানকোষের আহরণকারী।

২.
মানুষ কিছুটা নির্ভরশীল পরায়ণ। মানুষ যদি তার দৈনন্দিন জীবনকে নতুন করে দেখতে চায় তবে দশটি যেনতেন বই না পড়ে একটি ভালো বই পড়া উচিত যার দ্বারা সে পৃথিবীকে নতুন করে উপভোগ করতে পারবে এবং মানব সমাজকে নতুন করে তার আপন বসন দ্বারা চিনতে পারবে এটাই একজন মানুষের প্রকৃত জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে যেভাবে তিনি তার জবাব জীবনকে পরিচালনা করছেন তার বিপরীতে যদি সেই মানুষটি তার আপন জ্ঞান দ্বারা এই জগৎটাকে চিনতে পারেন তবে একজন মানুষের জগৎ জীবনে সাফল্য এবং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নতুন একটি সুযোগ তৈরী হতে পারে।

৩.
জীবন একটি স্বতন্ত্র সত্তা। তবে এই জীবন ও অস্তিত্ব টিকে থাকে অন্যের সহযোগিতায় যেখানে একজন মানুষের জীবনে তাঁর প্রিয়জনদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেভাবে বেঁচে আছি এবং জন্মগ্রহণ করেছি জীবন তার চেয়েও বড় কিছু। এখানে টিকে থাকতে হলে লড়াই এর কোন বিকল্প নেই। এখানেই একজন মানুষের থেকে প্রাণিজগতের আলাদা গুরুত্ব বহন করে।

৪.
ভাগ্য যদি কল্পনা জগতে প্রতিষ্ঠা হতো তবে ভাগ্যের কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত না। ভাগ্য নির্ধারিত হয় কর্মপরিকল্পনা দ্বারা। আমরা যদি কর্ম পন্থা অবলম্বন না করে পথ চলি তাহলে অবশ্যই আপনার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে না। ভাগ্য সম্পর্কে যদি বলি তাহলে আমি বলতে পারি যে ভাগ্য একটি রূপক শব্দ। কর্ম হচ্ছে বাস্তবতা।

আপনি ভাগ্যের মাধ্যমে কখনোই আপনার পথ প্রশস্ত করতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার কর্ম আপনাকে দিকনির্দেশনা না দেয়। আপন কর্মের দ্বারাই মানুষ পৃথিবীর এমন উচ্চতায় পৌঁছে যেখানে আর একজন মানুষ তার দাস হিসেবে পরিচালিত হয়। আপনি যদি আপনার জীবনে চাকরি করার নিয়তে শিক্ষা গ্রহণ করেন তাহলে আপনি কখনোই জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে পারবেন না। আপনি তো এখন অর্থের জগতেই ঘনায়মান হবেন। মানব সভ্যতাকে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই জ্ঞানের প্রয়োজন বুদ্ধিমান মানুষের প্রয়োজন প্রজ্ঞাবান মানুষের প্রয়োজন এই মানুষের দ্বারাই পৃথিবী শক্তিশালী হয় এবং নতুন নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে। কিন্তু আমরা আমাদের প্রাচীন ধারণা থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত বেরিয়ে আসছে না পারব আর এসব কে গ্রহণ করতে না পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোনভাবেই সত্যের দর্শন উপলব্ধি করতে পারবো না।

এই দর্শন তাই হল জাগতিক দর্শন যার দ্বারা মানুষের উপকৃত হয় যার দ্বারা মানুষ কেন অর্জন করে জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে যায় এবং সভ্যতার বিকাশ ঘটে। যে বই দ্বারা সমাজ উপকৃত নয় যে বই দ্বারা সমাজের বিভাজন ঘটে যে বই দ্বারা রাষ্ট্রের কোন উপকার হয় না রাষ্ট্রের উন্নতি হয় না এ বৈঠকে এক সাইডে রেখে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই জীবনটাকে পরিচালনা করা উচিত রাষ্ট্রকে পরিচালনা করা উচিত এবং সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো বিকল্প নেই।

৫.
পৃথিবীর এই ভ্রাম্যমান আদালতে আমরা যেভাবে অন্যায়ের সাথে জড়িত যেভাবে অপরাধের সাথে জড়িত আছে তবে কোন হত্যাযজ্ঞ ক্লোরালের সাথে জড়িত এর জন্য নির্দিষ্ট একটি বিধান রয়েছে যে বিধানটি একটি রাষ্ট্রের আইন দ্বারা পরিচালিত হয় আমরা যদি সেই আইন অমান্য করে এবং সেখানে নতুন কোন প্রাচীন ধ্যান-ধারনা ধর্মীয় বিধিবিধান এর মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করে তবে সে আইনের ক্ষমতা এবং বর্তমান জগতে ধীর গতিতে এগিয়ে যাওয়া চিন্তা-চেতনার উপরে নির্মিত আইন অনেক পার্থক্য তৈরী করে।

বর্তমান আইনে তোমার বিচার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেটাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সমাজ রাষ্ট্র এবং দেশের জন্য এজন্যই আমরা বরাবরের মতো প্রাচীন ধ্যান-ধারণাকে পেছনে ফেলে নতুন সভ্যতার যে মুক্তির পথ রয়েছে তার তারাই জীবন দর্শন এর মাধ্যমে সেই আইন কে গ্রহণ করি এমনটা যদি না হয় তাহলে মানুষ তার বিকল্প নেই এবং ন্যায় বিচার হবে অন্ধকারের পথ প্রদর্শক।

৬.
জীবন একটা পাণ্ডুলিপি, আপনি যখন ভালো থাকেন খুব ভালো থাকেন। তখন আপনি নানা ধরনের পথ ভ্রষ্ট কাজের ভিতর জড়িয়ে যান এমনটা হয় অতিরিক্ত স্বাধীনতা আর মুক্ত জীবন যাপনের জন্য। আপনাকে যদি কেউ সরল বিশ্বাসে মুক্ত জীবন যাপন করার ক্ষমতা দেয় তবে আপনি তার বিশ্বাসের গুরুত্ব না দিয়ে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অপরাধের পথ বেছে নেন। যার দ্বারা সে মানুষটি ক্ষতিগ্রস্থ হবে যার দ্বারা সে মানুষটি কষ্ট পাবে যার দ্বারা সে মানুষটি অত্যন্ত বেদনার্ত জীবন উপহার পাবে।

তবে আমরা যখন অপরাধ করি আমরা যখন অন্যায় করি ভুল করি তখন আমরা আমাদের প্রথম সময়ের কথা উপলব্ধি করতে পারে না আমরা কতটা ভালো আছি আর আমি কতটা মন্দ কাজ করতে যাচ্ছি এরকম চিন্তা-চেতনা যদি খারাপ কাজ করার পূর্বে একবার করতো তাহলে সে মানুষটি কখনোই ভুল পথে পরিচালিত হতো না। তবে সঙ্গদোষে ও মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হয় সে মানুষটা যদি তার আচরণে মুগ্ধ না হয়ে তার আচরণে ক্ষুব্ধ হতো তবে তাই আর কখনোই সে ভুল পথ কে অনুসরণ করার চিন্তা করত না।

কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের জীবন যাপনে আমাদের কাজে কর্মে সবকিছুই উল্টো পথের পথিক হয়ে আমরা যেভাবে ঢেকে রাখা জিনিসকে দেখার চেষ্টা করি সেটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এজন্যই আমরা প্রতিনিয়ত অন্যায়ের পথে ভেসে গিয়ে নতুন করে জন্ম দেয় বিপদ নতুন করে সৃষ্টি করি নানাবিধ সমস্যা এবং আমাদের জীবনকে অতিবাহিত হয় নানা ধরনের জটিলতা থেকে উত্তরণ একমাত্র মৃত্যু ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব হয় না। এমন জীবন কখনোই চাইনা আমরা যে জীবন ব্যথায় কাটুক কষ্টে কাটুক যন্ত্রণায় কাটুক। অথচ দিন শেষে আমরা সেই পথেই সবচাইতে বেশি চলাচল করি। আমরা কি অনুভব করতে পারি না এই পথ বিপদজনক এই পথে চলতে গেলে আমাদের অনেক ক্ষতি হবে।

এই পথে চলতে গেলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পথে নেমে আসবে বিরূপ প্রভাব আমাকে আমরা কি একবারের জন্য হলেও কখনও অনুভব করতে পেরেছি না পারিনি না পারার কারণ একটাই আমাদের মানসিকতা আমরা যেটা ভাবি সেটাই করার চেষ্টা করি আমরা যেটা দেখি নি সেটাই দেখার চেষ্টা করি আমরা যেটা বুঝি না সেটা না বুঝে তার উল্টোটা বলার সবচেয়ে বেশি প্রবণতা দেখায় বলেই আমরা আমাদের অধঃপতন স্বচক্ষে দেখতে পাই।

৭.
মানুষ প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ যখন তার হৃদয় থেকে উন্নততর চিন্তাগুলো দৈনন্দিন জীবনের পথে ব্যয় করে তখন মানুষ হয়ে ওঠে তার জগতের সবচেয়ে উত্তম ও সেরা। আবার এই মানুষ প্রাণী জগতের সব থেকে নিকৃষ্ট জীব হতে পারে। যখন সে তার সঠিক কর্মপন্থা কে বাদ দিয়ে অসৎ পথে সকল ধরনের কর্মকাণ্ড অবলম্বন করে। আমরা সভ্যজগতের বাসিন্দা তার সাথে সাথে আমাদের মধ্যে যে রিপু গুলো রয়েছে সেগুলো যখন প্রকাশ হয় তখন এই সভ্যতার জগত থেকে অন্ধকারের আচ্ছন্নতা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে যা একজন বিবেকবান মানুষের কাছে অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও বিরক্তিকর। মানুষ যখন সময়ের সাথে সাথে তার আপন জগতকে নিয়ে এগিয়ে চলে তখন তার নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়গুলো প্রতিদিনকে রোজনামচায় প্রতিলিপি স্বরূপ উঠে আসে।

বিশ্বাসের জায়গা থেকে আমরা যখন একটি দায়িত্ব নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবো তখন সেই বিশ্বাসটা হাজারো বিপদগ্রস্ত পথ পাড়ি দিয়ে হলেও সেটি অটুট ও অক্ষুণ্ন রাখা একজন সত্যিকারের মানুষ এর জন্য অপরিহার্য বলে দাবী রাখে।

৮.
মন ও মনস্তাত্ত্বিক দর্শন দ্বারা যদি আপনি আবেগের দ্বৈতনীতি সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন পৃথিবীতে উপস্থিত করতে চান সেই ক্ষেত্রে মহাজাগতিক যে সকল চিন্তাভাবনা ধ্যান-ধারণা মানবের মনের ভিতর উদ্ভব হয় তা থেকে আপনার দৈনন্দিন জীবনের সকল সমস্যা দূর করা সম্ভব। মনীষীরা যা দিয়েছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমরা তাদের চিন্তা ভাবনা এবং তাদের দর্শন যদি অন্তরের অন্তস্থল থেকে গ্রহণ করি তাহলে জানতে পারি আবেগ হচ্ছে একটা স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ।

এই দৃষ্টি কোন ব্যক্তির গভীর অন্তস্থল থেকে উৎসারিত একটি দুর্বল রিপু তার দৈনন্দিন জীবনে প্রথম ছোঁয়ার মতোই স্পর্শ কাতর এক্ষেত্রে সে যদি এই দর্শনটা গ্রহণ করে তবেই। আমরা প্রতিদিনের রোজনামচায় যে সকল কাজকর্ম করি এবং অন্যের আপাদমস্তক যেসকল বিনয়ী মনোভাবকে উপলব্ধি করি তারমধ্যে সুখ-দুঃখ ভালো-মন্দ বিলাসিতার সকল উপকরণ আবদ্ধ। জীবনের ব্যাপকতা অসীম হলেও সংকীর্ণ এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুই সুদুরপ্রসারী।

আমরা দুনিয়ার বাস্তবতাকে যখন আনকোরা ভেবে ছুড়ে ফেলেদিতে থাকি তখন পরবর্তী জীবনের যে সকল প্রার্থী রয়েছে তা এক নিমিষে শেষ হয়ে যায়। মানুষ ভাবে মৃত্যুর পরে কোন এক জীবন রয়েছে সে জীবনে আমাদের হিসাব-নিকাশ রয়েছে সেখানে একটি সিংহাসন রয়েছে সেই সিংহাসনে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আসিন এই সৃষ্টিকর্তা আমাদের জগত জীবনের সকল হিসাব গ্রহণ করবে পাপ কর্ম মন্দ কর্ম ভাল কর্ম সৎকর্ম সকল কিছুর হিসাব নিবে। কিন্তু যারা এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী নয় তাদের জগজ্জীবন কতটা ন্যায় পরায়ন কতটা যুক্তিসঙ্গত কতটা সুন্দর এবং কতটা কঠিন সেটা আমরা পৃথিবীর মানুষ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে নানা দেশ থেকে নানা প্রান্ত থেকে উপলব্ধি করি। সৃষ্টির শুরু থেকে আমরা সর্বদা একে অন্যের প্রতি যেভাবে বিষোদগার করে আসছি জ্ঞান বৃদ্ধির পর থেকেই আমরা সেটা আরো কঠিন করে তুলেছি।

প্রতিদিনের মত আমরা যেভাবে একজন আরেকজনের পিছনে ছুটে চলি কারো ভাল করতে অথবা কারো কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে অথবা অথবা আঘাত করতে এটা দিনদিন এতটাই ব্যাপক হয়েছে যে আমরা একে অন্যের পাশে বসে থাকলেও কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা। এটা বিশ্বাস এর চেয়ে অবিশ্বাসের যুগ হিসেবে ঘোষণা করা যায়। মানুষ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নানা ভাগে বিভক্ত ধর্মের মধ্য দিয়ে যতগুলো ধন্য তা প্রকাশ হয় তা অত্যন্ত সরুপ এরা একে অন্যে নিজের ধর্মীয় জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে থাকে কিন্তু সেই ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা এসবকে মান্য করে না তাদের নিয়ম-নীতি শৃঙ্খলা অত্যন্ত দৃঢ়।

এ সকল মানুষেরা সিজোফ্রেনিয়া রোগের মতো ভয়ঙ্কর এবং তারা সর্বদায় এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে যার বাস্তব স্বরূপ দেখা যায় নানা ধরনের কাল্পনিক কল্পকাহিনীর মধ্যে তারা জীবনকে অতিবাহিত করে থাকেন এই দৃষ্টিকোণের মানুষেরা অত্যন্ত বিপদজনক এবং এদের দ্বারা সামাজিক জীবন কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে তাদের কোনো ভূমিকায় থাকেনা। কিছু কিছু রাষ্ট্রে এই শ্রেণীর মানুষদের কে সমাজের বোঝা হিসেবে গ্রহণ করে। তবুও তারা একটি দেশের স্বাধীন নাগরিক তাদের যে অধিকার নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব রাষ্ট্র সে দায়িত্ব থেকে কখনোই সরে আসে না।

পঞ্চাশ

আমি ভাবতেই পারছি না কখন পঞ্চাশ বছর হলো,
এইতো সেদিন পটুয়াখালীতে
বাবা ডেপুটি জেইলর ছিলেন-
গ্রাম ফেলে আসা চাচা আমাদের বাসায় থেকেই
মাদ্রাসায় পড়তেন-
দাদা দাদি ফুপুও ছিলেন আমাদের বাসায়।

এইতো সেদিন রাজশাহী বগুড়া দিনাজপুর কুষ্টিয়ায়
সরকারী কোয়ার্টার্সে শৈশব কাটালাম-
আর খুলনা যশোর কুমিল্লায় যৌবনকাল-
তারপর ঢাকা বিয়ে চাকরি সংসার কিন্তু,
আমি বুঝতেই পারছি না এরই মাঝে চলে গেছে পঞ্চাশটি বছর-
এরই মধ্যে পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পঞ্চাশবার,
নিজেকে প্রদক্ষিণ করেছে
আঠারো হাজার দুইশত পঞ্চাশবার,
অথচ মাত্র পঞ্চাশবার
অথবা পঞ্চাশটি বছর
পঞ্চাশটি বৈশাখ
পঞ্চাশটি বসন্ত
সত্য যে এর মাঝে দশটি বছর আমি ছিলাম না।

শৈশব থেকেই বাবা মসজিদে নিয়ে যেতেন-
বৃহস্পতিবার বিকাল তিনটায় মার্কাজ মসজিদ –
শুরু হতো তাবলীগ জামাতের বয়ান-
এ জীবন জীবন নয়
মৃত্যুর পরে এক মৃত্যুহীন জীবন
এ নারী নারী নয়
অপেক্ষা করছে সত্তুর হাজার বেহেস্তি হুর
যারা সমুদ্রে থুথু ফেললে
সমুদ্রের লবণাক্ত পানি
মধুর চেয়েও সুমিষ্ট হয়ে যায়,
আকাশে উড়ে চলা পাখিটি
আকস্মিক ভুনা গোস্ত হয়ে মুখের সামনে চলে আসবে।

অত:পর তিন চিল্লা ছয় চিল্লা নয় চিল্লা
এবং শুরু হলো অবজ্ঞা এবং অনীহা
পৃথিবীর প্রতি অবজ্ঞা
টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ির প্রতি অবজ্ঞা অনীহা
হুরের লোভে একাধিক নারী-সংগমের প্রতি অনীহা

কিন্তু কি লাভ হলো-
এইভাবে ভালো থেকে-
যৌবনে নারীবিদ্যা না শিখে-
কি লাভ হলো দারু পারুর স্বাদ না নিয়ে।
আজ কেন মনে হয় এইসব অবদমিত
ইচ্ছেগুলো পুরণ করি,
তা না হয় করলাম
কিন্তু জৈষ্ঠের পাকা পেপে আর মাঘের পাকা পেপে কি এক স্বাদ হয়?
এ জীবন নিয়ে বড় কষ্ট হয় আক্ষেপ হয়
তিন ছয় নয় চিল্লা কিংবা মাগরিবের বয়ান
আমার যৌবন ফিরিয়ে দেবে না
সত্তুর হাজার হুরের একজনকে স্বপ্নেও দেখলাম না
আমার শৈশব কৈশোর যৌবন
চুরি করেছেন আমার পিতা এবং কিছু ধর্মগুরুরা
পিতার জীবন চুরি করেছেন তার পিতা এবং ধর্মগুরুরা।

সময় এখন আমার হাতে ধরা দিয়ে বলে
চট করে দশ কাটলে ফট করে তুমি ষাট
তারপর এদিকে মাত্র দশ কিন্তু তুমি পুরো সত্তুর
তার ওপারে গেলেও যেতে পারো
কিন্তু তারপরই থুরথুর।

সময় পঞ্চাশে এসে একবার পিছু ফিরে তাকালো
চল্লিশ কিছু একটা বলেছিল
কিন্তু আমি বলেছিলাম কেবল অর্ধেক,
আরো অর্ধেক – দ্রুত চলো।

পঞ্চাশ
হায় পঞ্চাশ
কি অবাক করা পঞ্চাশ
কি আক্ষেপের পঞ্চাশ

সাবাস পঞ্চাশ!
সচেতন হওয়ার পঞ্চাশ
ঘুরে দাঁড়ানোর পঞ্চাশ

হে জ্ঞানী পঞ্চাশ
নিজেকে জানার পঞ্চাশ
মানুষ হওয়ার পঞ্চাশ।

এদেশ ওদেশ ১১

শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ একাদশ পর্ব।

৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ন মাস, আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মাত্র ১৩ দিন। মুখে যতই লম্ফঝম্প করুক, পাকিস্তানের সামরিক পরিকাঠামো যথেষ্ট মজবুত ছিল না। অন্যদিকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ক্ষোভের বিস্ফোরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিকামীতায়। মুক্তিবাহিনীর যে দ্বিতীয় শাখা গেরিলা বাহিনী তারা তৈরী করেছিল, তা মূলত ছিল কিশোরদের নিয়ে। রাস্তায়, গলিতে, গ্রামের শুঁড়িপথে, পাহাড়ী এলাকায়, জঙ্গলে পাকিস্তান আর্মিকে আচমকা আক্রমণ করে তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি সাধণই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। আর সামনে পেছনে আক্রমণ সামলানোর মত অভিজ্ঞতা পাকিস্তানী সেনার ছিল না। এছাড়া পাক শুষ্ক জলবায়ু তে অভ্যস্ত পাঠান ও পাঞ্জাবীরা বঙ্গীয় জলীয় আবহাওয়া বরদাস্ত না করতে পেরে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত। আর এর ওপর ছিল ভারতের বেসরকারী বিরোধিতা। ফল যুদ্ধ অচিরেই তাদের হাতছাড়া।

৭১ এর মার্চে যখন পাক সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিম্বা অত্যাচার চালাতে শুরু করল, তখন স্বাভাবিকভাবেই ভারত প্রথমে সরকারীভাবে নাক গলায় নি। আমেরিকা হুমকি দিয়ে রেখেছিল, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন বিষয়ে কেউ যেন নাক না গলায়, বিদ্রোহীদের (গণতন্ত্রের পীঠস্থান ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা ভোটে জেতাদের বিদ্রোহী আখ্যাই দিয়েছিল।) কেউ যেন সাহায্য না করে। কিন্তু সরকারীভাবে সাহায্য না করতে পারলেও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ চলছিলই। এই সময়ে পাক সেনা ও তাদের সহযোগীদের অত্যাচারে হু হু করে আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে আসতে শুরু করল বিপুল পরিমাণে শরণার্থী।

এপারের মানুষের সঙ্গে ওপারের বাঙালির আত্মীয়তা কোনোদিনই কোনো সীমানা মানেনি। তাই সবচেয়ে বেশী বাস্তুহারা এলো আসাম আর পশ্চিমবঙ্গে। স্বাধীণতার পরবর্তী বিপর্যস্ত আর্থিক অবস্থার প্রভাব এ বঙ্গেও পড়েছিল। বেকার সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, শিল্পসমস্যা, ভূমিসমস্যায় এপারের বাঙালির দৈনন্দিন কাঠামো নাজেহাল। তবুও স্বজনের ওপর অত্যাচার দেখে দুহাত বাড়িয়ে তারা ঠাই দিল ঘরহারাদের। এপারের অতিরিক্ত জমিতে তারা বাসা বাঁধতে শুরু করল। মুজিব গ্রেপ্তারের পরে বেশ কিছু প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা এপারে পালিয়ে এসেছিলেন। এখান থেকেই ঘোষিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীণ বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল কলকাতাতেই। সব জেনেও মানবতার খাতিরে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এপারের বামপন্থী দলগুলো তো সক্রিয় সাহায্যে নেমে পড়েছিল অসহায় সেই মানুষগুলোর পাশে।

ভারতের এই ইনডাইরেক্ট সমর্থন পাক সরকার বা তার গুরু ইয়াংকি সরকার ভালোভাবে মেনে নেয় নি। তাই ডিসেম্বরে পাকিস্তান ভারতের সেনাঘাটিতে আক্রমণ করার পরে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করলে আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে ভারতকে শায়েস্তা করার কথা ঘোষণা করে দিল। এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোজা তারা আমেরিকাকে হুমকি দিল, যদি আমেরিকা উপসাগরীয় অঞ্চলে বা ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নৌবহর পাঠিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করে তাহলে রাশিয়াও তাই করবে এবং ফলশ্রুতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব দায়ভার আমেরিকার ওপরেই বর্তাবে। হুমকিতে কাজ হল এবং ইউএসএ পিছিয়ে গেল। দুর্বল পাকিস্তান তেরদিনের বেশী যুদ্ধ টানতে পারল না। কিন্তু নাছোড় আমেরিকা তখন হাতে না মারতে পেরে ভাতে মারার পরিকল্পনা করে ভারত ও সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধের প্রাচীর তৈরী করল সহযোগী দেশদের নিয়ে। ফলত যুদ্ধ পরবর্তী এই দুই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠল।

আগে থেকেই ভারত বিভিন্ন সমস্যায় বিব্রত ছিল। তার ওপরে এই যুদ্ধ স্থায়ী প্রভাব ফেলল। কিন্তু সদ্যগত যুদ্ধের ফল ঠিক তখনই বোঝা যায়নি। ১৯৭১ এর বিপুল ভোটে জেতা ইন্দিরার অসম্ভব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এই জেতার ক্যারিশমাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭২ এর বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এর প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।

(আবার আগামী কাল)

এদেশ ওদেশ ১০

শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ দশম পর্ব।)

নিজের শিকড় যদি অজানা থাকে, তাহলে বর্তমানের সংকটের স্বরূপ বোঝা যায়না। আমজনতা এমনিতেই এতরকম সমস্যায় জর্জরিত যে জন্মের আগের ঘটনা সম্পর্কে আগ্রহী হয়না। কিন্তু অসুখ যখন দুরারোগ্য আকার নেয়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ড জানা জরুরী হয়ে পড়ে নাহলে সঠিক চিকিৎসা জোটে না।

ইন্দিরা গান্ধী যেদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন সে দিনটা ছিল ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১। ঠিক তার পেছনের বছরে ১৯৭০ থেকে সমস্যার শুরু হয়েছিল, যখন পাকিস্তানের নিম্ন পার্লামেন্ট কক্ষ মজলিস ই শুরা র ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৯ টিই জিতে নিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লিগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে তারা যেই শাসন ক্ষমতার দাবীদারত্ব পেশ করল, ওমনি বেঁকে বসল হেরে যাওয়া জুলফিকার আলি ভুট্টো র নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি। পাকিস্তানকে তারা কিছুতেই নাপাক বাঙালিদের হাতে তুলে দেবেনা।

ভাবুন একবার, ভোটে এতদিন লড়াইয়ের সময়ে, শোষনের সময়ে যারা নাপাক ছিল না, ক্ষমতা হস্তান্তরিত করার পরিস্থিতি আসতেই তারা অপবিত্র অধার্মিক হয়ে গেল! আসলে, পশ্চিমীদের এছাড়া অন্য উপায় ছিলো না। গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে তারা পরাজিত। পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া বিশেষ গর্হিত নয় এটা শিশুও জানে। তাহলে?

পাকিস্তান তখন নিজেই দুখানা বৃহৎ দুষ্কর্মে জড়িয়ে ছিল। প্রথম যেনতেনপ্রকারে পুর্বকে শোষণ আর তার নানা কৃৎকৌশল, ফন্দিফিকির। আপাত নিরীহ পূর্ব এটা জেনে গেলে বিপদ এতদিনের শাসকদের। তাই আপত্তি। আর দ্বিতীয় আপত্তি আরোও জোরালো কারনে, যার পেছনে আমেরিকা।

রাশিয়া সহ পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী দেশগুলোকে তাঁবে আনা আমেরিকার ব্যবসায়ী মহলের কাছে ছিল জরুরী এজেন্ডা। অথচ ক্রমাগত আরব ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছিল রাশিয়া। ধর্মীয় ছদ্মবেশে গেরিলা বাহিনী তৈরির জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করলো উদ্বিগ্ন আমেরিকা। জঙ্গীবাদের জন্ম সেই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানেই হলো। বার্থ সার্টিফিকেটে বাবা আমেরিকা, মা পাকিস্তান। এখন এই হাই প্রোফাইল গোপন তথ্য পূর্ব জেনে ফেললে সব পন্ড হবে এই আশঙ্কায় গড়ালো গভীর ষড়যন্ত্র। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্বতে সৈন্য পাঠালেন, অস্বীকার করলেন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে।

নিত্য বনধ, আইন অমান্যের মধ্যেই ২৫শে মার্চ মাঝরাতে মুজিব কে গ্রেপ্তার করে উড়িয়ে আনা হল মূল পাকিস্তানের জেলে। ঘোষণা হল জরুরী অবস্থা। বিপুল সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরীহ জনতার ওপরে। একদল আওয়ামী লিগ নেতা পালিয়ে এলেন ভারতে। ভারত থেকেই তাঁরা গঠন করলেন মুক্তি যোদ্ধা নিয়মিত এবং গেরিলা বাহিনী। ত্বড়িৎ গতিতে কিছু পাক এজেন্ট ছাড়া প্রায় আপামর পূর্বীয় মানুষ এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলেন। সরকারি হিসেবে শুধু নিয়মিত যোদ্ধাই ছিলেন ১৭৬০০০। ভারতে থেকেই গঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এইসব ঘটনাক্রমে ভারত পাকিস্তানের চক্ষুশূল হয়ে উঠলো।

অন্যদিকে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন শরনার্থী পালিয়ে এল ভারতে। এই বিপুল শরনার্থীর ঢল সহ্য করার ক্ষমতা তখন নড়বড়ে ভারতীয় অর্থনীতির ছিল না। স্বভাবতই ভারত সাহায্য চাইল বিশ্বের। কিন্তু আমেরিকার চাপে একমাত্র রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশ সাহায্যে রাজী হলো না।

পাক সেনা, আলবদর, রাজাকার যৌথ অত্যাচারে ও সরাসরি যুদ্ধে মারা গেল প্রায় ৩০০০০০০ বাংলাদেশী। প্রায় ন মাস পরে অধৈর্য পাকিস্তান ভারতের সেনাঘাঁটির ওপরে হামলা চালালো। বাধ্য হয়ে ৩৬৫০০০ পাক আর্মির বিরুদ্ধে ৫০০০০০ সৈন্য নামিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলো ভারত।

৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ মাত্র তেরো দিন স্থায়ী হলো দুই প্রতিবেশীর লড়াই, যা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী পৃথিবীর হ্রস্বতম যুদ্ধ। অসংখ্য ক্ষয়ক্ষতির পরে নতি স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তান। বাংলাদেশে নামলো একচোখে স্বজন হারানোর জলের ধারা, অন্যচোখে স্বাধীনতার আনন্দের উচ্ছাস। মুজিব কে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো স্বৈরশাসক। কিন্তু নতুন ইতিহাস সূচনার মধ্যেও রয়ে গেল ভয়ংকর দানবের জন্মের বীজ।

(চলবে)

গল্পে গল্পে জীবনের কথা

ggtyu

কতদিন চলে গেল দেখতে দেখতে।
এই তো সেদিন শুরু হলো জীবনের এক নতুন অধ্যায়। তারপর শুধু যায় আর যায় দিন। যেন কিছু থেমে থাকে না। আসলে জীবনের নতুন বা পুরাতন বলে কিছু নেই। জীবনে যখন যেটা ঘটে সেটা মানিয়ে নিয়ে চলাটাকেই জীবন বলে। হয়তো এতে করে জীবনে কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা আসে যা জীবনের ভুলগুলো শুধরে নিতে সাহায্য করে।

প্রতিটি মানুষ তার মনে নিজস্ব এক জগতে তৈরি করে,
যেখানে সে সময় বা অসময়ে বিচরণ করে, সেই জগৎ টাকে সাজায়। এখানে শুধু তার ভালো লাগাটায় রাখে। ভালো মানুষদের রাখে বড় কথা তার সবচেয়ে আপনজনদের এই জগতে রাখে। মানুষের যেমন ভালোর আলাদা জগত আছে, তেমনই আছে দুঃখ ও কষ্টের এক ভিন্ন জগৎ, যে জগতে কারোর স্থান নেই। সে একাই এখানে বসবাস করে। কেউ আসতে চাইলেও তাকে ফিরিয়ে দেয় সে।

ছোট বেলায় যখন শুনতাম রূপকথার গল্প, দাদা বা দাদির কাছে নাম না জানা আঞ্চলিক গল্প তখন সেই গল্পের মত জীবনকে ভাবতাম। যে জীবনটা কত সহজ। কিন্তু এতদিন পর এসে মনে হচ্ছে এ জীবন এত সহজ
নয় গল্পে বা উপন্যাসে যত সহজ করে বলা হয়।

এ জীবন বড়ই কঠিন এক যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। টাকার অভাবে যখন কলেজে ভর্তি হতে পারিনি তখন আব্বাকে অহেতুক দোষ দিয়েছি। যে কেন আমাকে টাকা দিতে পারি নি, কেন আমাকে পড়াতে চায় না। কিন্তু এতটা বছর পর এসে আমি নিজে থেকেই বুঝতে পারছি যে কেন আব্বা তখন আমাকে টাকা দিতে পারি নি। কেন পড়াতে চায় নি। আব্বা চেয়েছিলেন যা পড়েছি, তা অনেক হয়েছে এখন একটু আব্বার সাথে কাজ করে সংসারের হাল ধরি। কিন্তু আমি কি করছি।

আমি কাজ করছি ঠিকই, টাকা তো সংসারে দিই নাই, বরং নিজেই নিজের অভাব গুলো পূরণ করছি আর যতটা পারছি পড়েছি। তাতেও তো আব্বাকে খুশি করতে পারি নি, কারণ তিনি তা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন আমরা যেন আমাদের ভবিষ্যতের জন্য কি করি। কিন্তু আমরা তা করি নি।

জীবনটা বুঝি এমনই। ভুল তো ভুলই।
অতীত তো শুধুই অতীত তাকে বদলানো যাবে না।
যা এতদিন পর চরমভাবে উপলব্ধি করছি।

মহিমান্বিত রজনী

27924

ছোট থেকে বড় হই
এই পরিবেশে বাস
বারো মাসে রোজা রাখি
হাতেগুনে এক মাস।
একে মিলে সত্তর
নেকি হয় বোনাসে
ইবাদতে, মুত্তাকী
ক্ষমা পাবে গুনা সে।

তিনি ‘রব’ জানি তার
মহিমা অপার
রমাজান নিয়ে আসে
বিশেষ এক ছাড়।
রোজা রাখি আল্লাহকে
রাজি খুশি করিতে
রহমতে নিয়ামতে
খালি ঝুড়ি ভরিতে।

লাওহে মাহফুজ ছিলো
পবিত্র কোরআন
ধরনিতে নিয়ে এলো
মাহে রমাজান।
হাজার মাসের চেয়েও
মহিমান্বিত রাত
ক্ষমা পেতে আল্লাহর
কাছে তুলি দুই হাত।

প্রতি বছর পবিত্র ঈদ কেন ১০-১১ দিন আগে হয়?

27924 আচ্ছা, প্রতিটি ঈদ কেন প্রতিবছর ১০-১১ দিন আগে হয়? যেমন: গত হয়ে যাওয়া ঈদ-উল-ফিতর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৪ই মে ২০২১ইং। একবছর পরপর যদি ঈদ হয়, তা হলে তো এ বছর ১৪ ই মে অথবা মে মাসের ১৫ তারিখ পবিত্র ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তা-ই নয় কি? কিন্তু সেটা না হয়ে এবার কেন ২ বা ৩ মে ২০২২ ইং ঈদ-উল- ফিতর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটা একটু ভাবার বিষয় নয় কি?

তবে হ্যাঁ, এবিষয়ে ভাবনা-চিন্তার কিছুই নেই! কারণ, এখানে সবকিছুই চাঁদের হিসাবে অর্থাৎ চান্দ্র মাসের হিসাবেই হচ্ছে। তাই প্রতিবছর গত বছরের ১০-১১ দিন আগেই পবিত্র মাহে রমজান-সহ ঈদ-উল-ফিতর অথবা ঈদ-উল-আযহা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোনো-কোনো বছর মাহে রমজান শীতকালে আরম্ভ হয়। আবার কোনও বছর প্রচন্ড রোদে ঝড়-বৃষ্টি আর বান-তুফানেও মাহে রমজান আরম্ভ হয়ে থাকে। কিন্তু ইংরেজি অথবা বাংলা সনের কোনও নির্দিষ্ট সময়ে হচ্ছে না। এর কারণ শুধু একটাই। আর তা হলো চন্দ্র মাসের হিসাব।

আমরা জানি ইংরেজি ৩৬৫ দিনে একবছর। আবার কোনো-কোনো বছর ৩৬৬ দিনেও হয়ে থাকে। আর তা হয় প্রতি চার বছর পরপর। আরও সহজভাবে বললে বলতে হয়, যেকোনো ইংরেজি সালকে অর্থাৎ ২০২০ সালকে ৪ দিয়ে ভাগ করলে যদি ভাগফল শেষে অবশিষ্ট কোনও সংখ্যা না থাকে, তা হলে সে বছর বা সেই ইংরেজি সালই হবে ৩৬৬ দিনে। যাকে বলে লিপ ইয়ার। ঐ বছরই ফেব্রুয়ারি মাস ২৮দিনের পরিবর্তে ২৯ দিন হবে। যেমন: ২০২৪÷৪= ৫০৬ এখানে ভাগফলের শেষে কোনও অবশিষ্ট সংখ্যা নেই। তার মানে হলো, ২০২৪ ইংরেজি সাল হবে ৩৬৬ দিনে, আর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস হবে ২৯দিনে। সোজা কথায় ২০২৪ ইংরেজি সাল হবে লিপ ইয়ার।

এবার আসি আমাদের বাংলা সন নিয়ে আলোচনায় : জানা যায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা একাডেমি ইংরেজি বর্ষের সাথে মিল রেখে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলা সনের হিসাব সংস্কারের একটি সুপারিশও প্রণয়ন করেছে। পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায় যে, বাংলা সনের প্রস্তাবিত সংস্কারে বৈশাখ থেকে আশ্বিন ৬ মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে। ফাল্গুন ব্যতীত কার্তিক থেকে চৈত্র ৫ মাস হবে ৩০ দিনের। ২৯ দিনে ফাল্গুন ধরা হবে। বছরে দিনের সংখ্যা ৩১x৬ (১৮৬) + ৩০ x ৫ (১৫০) +২৯= ৩৬৫ ঠিক রাখা হয়। বাংলা একাডেমির ভাবনা মতে এ প্রস্তাবের ফায়দা হল ৮ ফাল্গুন ও ২১ ফেব্রুয়ারি, ১২ চৈত্রে ২৬ মার্চ, ২৫ বৈশাখে ৮ মে, ১১ জ্যৈষ্ঠে ২৫ মে এবং ১ পৌষে ১৬ ডিসেম্বর প্রাতিষঙ্গিক হবে। কিন্তু একসময় বাংলা বর্ষেও কোনো-কোনো মাস ৩২ ও ২৯দিনেও হতো। তবে এখন আর সেটা নেই। তবু্ও কিছুকিছু হিন্দুরা সেই আগেকার বাংলা বর্ষপঞ্জিই অনুসরণ করে আসছে। এর পেছনে আবার একটা কারণও আছে। কারণ হলো, ইংরেজি তারিখ গণনা শুরু হয় রাত ১২টার পর সময় ০০ থেকে। আর বাংলা তারিখ গণনা শুরু সূর্যোদয়ের সাথে। তাই অনেক হিন্দুরা ক্যালেন্ডারের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদযাপন না করে এর পরদিন তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ সবই পালন করে থাকে।

তা করুক, সেটা যার যার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির আওতায় পরে। তা হলে বুঝাই গেলো যে বাংলা এবং আন্তর্জাতিক ইংরেজি সাল হুবহু একই নিয়মে চলছে। ব্যতিক্রম শুধু ইংরেজি চার বছর পরপর লিপ ইয়ার। যা হয় ৩৬৬ দিনে।

এবার হিজরি সন নিয়ে আলোচনা : হিজরি সন হল চাঁদের হিসাবে। যাকে বলা হয় ইসলামি চন্দ্রমাস। এই হিজরি সাল হলো ইসলামী চন্দ্র পঞ্জিকায় ব্যবহৃত পঞ্জিকা। জানা যায় যার প্রথম বছর শুরু হয়েছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সেই থেকে হিজরি মুহররম মাসকে ইসলামি নববর্ষের প্রথম মাস ধরা হয়।

জানা যায় হিজরি সালের এই প্রথম বছরে মহানবী ও তার সাহাবীরা মক্কা থেকে ইয়াসরিবে (বর্তমানে মদিনা) দেশান্তরিত হন। এই ঘটনাটি ইসলামি পরিভাষায় হিজরত নামে পরিচিত যা ইসলামে প্রথম মুসলিম সম্প্রদায় (উম্মাহ) সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রাখার জন্য স্মরণীয়। তাই মনে হয় এই হিজরত থেকেই হিজরি নামকরণ করা হয়েছে।

তো যাই হোক, বাংলা এবং ইংরেজি সালের সাথে ব্যতিক্রম হলো, মাস এবং বছরের দিন। হিজরি মাস চাঁদের হিসাবে হওয়াতে বছরের প্রতিটি মাসই ২৯.৫০ মানে সাড়ে ঊনত্রিশ দিনে হয়ে থাকে। যেমন: ৩৫৪÷১২=২৯.৫, আবার ৩৫৫÷১২=২৯.৫৮৩৩৩৩। সে হিসাবে হিজরি চন্দ্র পঞ্জিকায় একবছর গণনা করা হয়, ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে। তা হলে দেখা যায় ইংরেজি সাল ৩৬৫দিন—হিজরি চন্দ্র পঞ্জিকা ৩৫৪দিন হলে ইংরেজি থেকে হিজরি ১১ দিন কম হয়। এই ১১দিন কম থাকার কারণে প্রতিবছর ইংরেজি বাংলা সালের নির্দিষ্ট কোনো তারিখে ঈদুল ফিতর অথবা ঈদ-উল-আযহা উদযাপন হয় না। প্রতিবছরই গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০ বা ১১ দিন আগেই মাহে রমজান-শ ঈদুল ফিতর ও ঈদ-উল- আযহা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু হিজরি ইসলামি চন্দ্র পঞ্জিকা ঠিক তারিখেই হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে গতবছর, মানে ২০২১ সালে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৪ মে ২০২১ ইং। আর এবার পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে হয়তো ৩ মে ২০২২ইং অথবা একদিন আগে। তা হবে চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে।

শুভেচ্ছান্তে: নিতাই বাবু। আমি একজন হিন্দু। লেখায় ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। পরিশেষে সবাই পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানবেন।

এদেশ ওদেশ ৯

শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ নবম পর্ব।

গণ হিস্টিরিয়া। ব্যাপারটা যদি সপক্ষে ঘটে, তাহলে যেকোনো দেশের শাসকদের খুবই পছন্দের। কিন্তু বিপরীতে গেলেই তার রূপ মারাত্মক। দেশের বৃহত্তম অংশের মানুষ কোনো কারনে কোনো ইস্যুতে অংশগ্রহণ করলে সেখানে আর যুক্তিতর্ক বা ইস্যুর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। সাধারণত ক্রমক্ষীয়মান জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য বা সাদা কথায় বলা ভালো, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অপদার্থতা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেবার জন্য শাসকদল এটা করে থাকে।

১৯৬২র চীন যুদ্ধ বা ৬৫র পাকিস্তান যুদ্ধের অহমিকা তখন অস্তমিত। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অকস্মাৎ মৃত্যুর পরে দিল্লীর ক্ষমতার অলিন্দে ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া। একপক্ষ ভাবলো নেহরুর সাদাসিধে সুন্দর মেয়েটাকে নাম কা ওয়াস্তে প্রধানমন্ত্রী করে দেশ শাসন করবে। বাদ সাধল অন্যপক্ষ। তারা সরাসরি ক্ষমতা ভোগের সপক্ষে। ৬৬তে সরাসরি লড়াই হয়ে গেল মোরারজী দেশাই এর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর, প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবীদারত্ব নিয়ে। দেশাইকে হারিয়ে ইন্দিরা হলেন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী।

১৯৬৭র ফেব্রুয়ারীর শেষে সাধারণ নির্বাচনে ২৮৩ আসন জিতে ইন্দিরা যখন সরাসরি ক্ষমতায় এলেন, তখন দেশের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২.৪ শতাংশ। অথচ উন্নয়ণের দিকে নজর না দিয়ে নিজেরই দলের ক্ষমতালিপ্সুদের সামলাতেই সময় চলে যাচ্ছে।

অন্যদিকে বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার সমর্থন পেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে পাকিস্তান। তাসখন্দের বিষম চুক্তির ফলে জম্মু কাশ্মীরের বড় অংশ হাতছাড়া। তার ক্ষোভ কাজে লাগাচ্ছে দেশের বিরোধী দলগুলো। আর্থিক উন্নয়ন থেমে থাকার জন্য দেখা দিচ্ছে খাদ্যাভাব। বেকার সমস্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। শিল্পবিপ্লবের প্রতিশ্রুতি আকাশ কুসুম কল্পনা।

মাত্র দুবছরের মধ্যেই ইন্দিরার জনপ্রিয়তা তলানিতে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে একটাই দাওয়াই তখনো জানা, আর সেটা হলো যুদ্ধ। মৌলবাদের বিষ ছড়িয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার কৌশল যদিও ৪৬ এই জানা গেছিল, কিন্তু সঠিক চর্চার অভাবে তার যথাযথ উন্নতি হয়নি, অথচ পাকিস্তান তখন এব্যাপারে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে।

এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই মেঘ না চাইতেই জল। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেললো উদ্বাস্তু সমস্যা।

তারচেয়েও বড় উদ্বেগের কারন ছিলো, ঘরের পাশে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর এর ঘাঁটি গাড়ার হুমকি। এটা হলে উপমহাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ভারসাম্য যে নষ্ট হয়ে যাবে তা বুঝতে সময় লাগেনি ঝানু রাজনীতিবিদদের।

ঠিক ওই অবস্থায় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রহসন অন্তে মুজিব গ্রেপ্তার। আর্মি ও হন্তারক দালালদের দাপাদাপি। আর একঝাঁক মুক্তিকামী গ্রেপ্তার এড়িয়ে পালিয়ে এলেন এপারে। গড়লেন স্বাধীন সরকার।

যুদ্ধের ঠিক আগে ইন্দিরা, উদ্বাস্তু সমস্যা এবং উদ্ভুত রাজনৈতিক ও মানবাধিকার হত্যার পরিস্থিতি নিয়ে দরবার করলেন স্বয়ং আমেরিকায় গিয়ে। কিন্তু হোয়াইট হাউসের কাছে তখন সুবর্ণ সুযোগ উপমহাদেশ করায়ত্ত করার। ইন্দিরাকে দেখা করার সময়ই দিলেন না তৎকালীন ইউএস প্রেসিডেন্ট।

অপমানিত, ক্ষুব্ধ ইন্দিরা দেশে ফিরেই যুদ্ধ ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।

(চলবে)

এদেশ ওদেশ ৮

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ অষ্টম পর্ব।)

ক্ষমতার নেশা সবচেয়ে মারাত্মক। যার মধ্যে এ নেশা বাসা বাঁধবে, সে মঙ্গলের পথ ছেড়ে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যেকোনো পথ গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধাগ্রস্ত হবে না, হোক তা অমানবিক কিম্বা অসাংবিধানিক।

পৃথিবীর ইতিহাস বলে, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য, নিজের অপদার্থতা ও কুশাসনের ক্ষোভ আড়াল করার জন্য ক্ষমতার কারবারীদের প্রধান রাস্তা দুটি। যুদ্ধ এবং অকারণ ধর্মীয় উন্মাদনার বেড়াজালে মানুষকে জড়িয়ে মত্ত করে দেওয়া।

৬০ এর দশকে বা তার আগের কুশাসনের গলিত কুষ্ঠ তখন দগদগে ঘা হয়ে ফুটে উঠছে দু দেশেরই গায়ে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দানা বাঁধার চেষ্টা করছে নকশাল আন্দোলন সহ অন্যান্য ক্ষুব্ধ আন্দোলন। অন্ধ্রপ্রদেশে কিছুদিন আগে হয়ে গেছে তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ। বাংলায় তেভাগা। এই পরিস্থিতিতে ক্ষীয়মাণ আয়ু নিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হওয়ার জন্য বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে চারু মজুমদার বেরিয়ে এলেন সিপিআইএম থেকে, গড়লেন এমএল। দলে দলে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র ছাত্রীরা কম বয়সের বিপ্লবী নেশায় সেই দলে যোগ দিল। অথচ একটা এত বড় রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে কোনো জনভিত্তি ছাড়াই যে বিপ্লব সম্ভব নয়, তা সেই দলের শীর্ষ. নেতৃত্ব বলেন নি। যে চীন কিছুদিন আগেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছিল, তার চেয়ারম্যান কেন আমাদের চেয়ারম্যান হবেন তা বোঝেনি সাধারণ জনতা। অথবা চীন, চেয়ারম্যান, বুর্জোয়া, পাতিবুর্জোয়া, শ্রেনী শত্রু ইত্যাদি বহু নতুন শব্দে তখন তারা বিভ্রান্ত। শহুরে কিছু মানুষের কথায় তারা যে বিপ্লবে সামিল হবেনা তা জলের মত পরিষ্কার। অথচ সব জেনেশুনেও নকশালবাড়ী থেকে স্ফুলিঙ্গ তৈরী হলো অসময়ে।

মজার ব্যাপার ঘটাল অন্য কমিউনিস্ট দলগুলি। মুখে বিরোধিতার কথা বললেও তাদের মতাদর্শ থেকে সরে এসে অন্য দল গড়ে তুলে আগুনচুমু খাওয়া ছেলেমেয়েগুলোর সব তথ্য তারা তুলে দিতে শুরু করলো শাসক দলের হাতে।

একদিকে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পরবর্তী অধ্যায়ের ক্ষমতা দখলের খামচা খামচি, অন্যদিকে কুশাসনের ফলে জনগনের দুর্বিষহ অবস্থা। ইন্দিরার দলগত ভিত্তি তখনো শক্ত নয়। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে দরকার ছিল একটা গণউন্মাদনার, যাতে সাময়িক ভাবে হলেও মানুষের নজর অন্যদিকে ঘোরানো যায়।

(আবার আগামীকাল)

পবিত্র মাহে রমজান মাসে করণীয় কী?

27924 রমজান মাসে কি শুধুই রোজা রাখা? রমজান মাসে কি শুধু সময়মতো সেহরি খাওয়া আর সূর্যাস্তের সময় ইফতার কারা? এসব প্রশ্নগুলো শুধু আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আমার মনে হয় সেহরি খাওয়া, রোজা রাখা আর ইফতার করার পাশাপাশি প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের করণীয় অনেক কিছু আছে।

আমার বিশ্বাস : বিশ্বনবী যখন পানাহার করতেন, তখন তিনি তাঁরই আশেপাশে থাকা গরীব মানুষের কথা ভাবতেন! খুব ভাবতেন! তিনি ভাবতেন, “আমার আরও আরও গরীব উম্মতদের মাঝে কেউ-না-কেউ হয়তো না খেয়ে আছে”। না খেয়ে থাকা যে কতো কষ্ট, তা মহানবী খুব ভালো করে বুঝতে পারতেন। এই ভাবনা থেকেই হয়তো বছরে বারো মাসের মধ্যে শুধু এক মাস প্রতিদিন একবেলা করে পানাহার বর্জন করার আদেশ করার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা’ ( আল্লাহতালা) কাছে আবেদন করলেন। আর মহানবীর সেই উপলব্ধি, সেই ভাবনা, সেই আদেশ সেই আবেদন তখনই মহান সৃষ্টিকর্তা ( আল্লাহতালা) সম্মতি প্রধান করে মুসলিম জাহানের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় আইনে পরিণত করে মাহে রমজান মাস সিয়াম সাধনার (রোজা) মাস হিসেবে পবিত্র ‘কুরআন’ এ নাজিল করেন।

মহানবীর উপলব্ধি ও ভাবনা : নবীজি প্রতিদিন যখনই যেকোনো কিছু পানাহার করতেন, তখনই তিনি আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গরীব ক্ষুধার্ত মানুষের কথা ভাবতেন! তিনি ভাবতেন, হয়তো আমার উম্মত কেউ-না-কেউ না খেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছে। হয়তো আমার উম্মতদের মধ্যে কারোর-না-কারোর পুরো পরিবারই না খেয়ে আছে। যারা না খেয়ে আছে তাদের মুখে খাবার তুলে দেয়াটাও তো আমাদের মধ্যে যাদের অনেক আছে, তাদের সকলের কর্তব্য দায়িত্ব। কিন্তু শুধু মুখে মুখে বললে কেউ-না-কেউ হয়তো এর গুরুত্ব দিবে না। তাই তিনি মহানবী মহান সৃষ্টিকর্তা’র ( আল্লাহতালা) কাছে বলে-কয়ে এই হিজরি বারোমেসে মধ্যে একটা মাস সকল উম্মতের জন্য সিয়াম সাধনা’র (রোজা) পাশাপাশি দানখয়রাতের মাস হিসেবে ধর্মীয় আইনে পরিণত করেন। যাতে প্রতিদিন মাত্র একবেলা পানাহার না করে তিনবেলা যারা পানাহার করতে পারছে না, তাদের কষ্টটা অনুভব করতে পারে। ক্ষুধার জ্বালা যে কী, তা যেন মহানবী’র সকল উম্মতগণ বুঝতে পারে।

কিন্তু সেই বুঝ কি কেউ বুঝতে পারছে? নবীজির সেই অনুভব কি কে অনুভবে আনতে পারছে? অনেকেই পুরো রমজান মাসে সিয়াম সাধনা (রোজা) করে থাকে। নিয়মিত সেহরি খাচ্ছে বা করছে। নিয়মিত পাচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছে। সূর্যাস্তের সময় বা ইফতারের সময় নিয়মিত ইফতার করছে। ইফতার পার্টির আয়োজন করছে। নিয়মিত তারাবীহ নামাজ আদায় করছে।

কিন্তু তারা কি একবার ভাবছে যে, অনেকে রোজা রেখেও সূর্যাস্তের সময় ইফতার করতে পারছে না, তাদের জন্য যতসামান্য ইফতার সময়মতো পাঠিয়ে দেই? কেউ কি ভাবছে যে, আমাদের চারপাশে অনেক অসহায় মানুষেরা দিনকেদিন না খেয়ে দিন-রাত পার করছে, তাদের জন্য কিছু একটা করি? আমাদেরই পাশের বস্তির শিশুরা ঈদের দিন টাকার অভাবে নতুন জামা-কাপড় পরতে পারবেন না, তাদের জন্য সমমূল্যে কিছু জামা-কাপড় কিনে পাঠিয়ে দেই?

তাই আমি মহানবী বিশ্বনবী’র চিন্তা-চেতনা, সঠিক ভাবনা, সঠিক উপলব্ধি নিয়ে ভাবি! অনেককে দেখি মহানবী’র মুখমণ্ডলে থাকা পবিত্র দাঁড়ি অনুসরণ করে নিজেও দাঁড়ি রাখে। মহানবী’র পবিত্র পোশাকপরিচ্ছদ অনুসরণ করে নিজেও সেইরকম পোশাকপরিচ্ছদ ব্যবহার করে। এতে নাকি ধর্মীয় সুন্নত। পবিত্র কুরআন শরীফ বুকে রেখে মহানবী’র খাস উম্মত মনে করে করে মজলিশে ময়দানে গলা ফাটিয়ে নবীজি’র আদেশ-উপদেশ প্রচার করে। তাঁরাও কি তাঁদের গরীব আত্মীয়স্বজন ও না খেয়ে থাকা মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ কিছু করে থাকে? সিয়াম সাধনা রোজার মাস তো শুধু বছরের একটা মাস মাত্র। আরও তো এগারোটা মাস আছে। সেসব মাসেও তো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য দরিদ্র অসহায় গরীব মানুষ। যদি ধর্মপ্রাণ মুসলমান আর মহানবী’র উম্মত হয়ে থাকেন, তা হলে শুধু মাহে রমজান মাসই নয় বরং বছরের পুরো বারোমাসই সমাজের অসহায় দরিদ্র গরীব মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা কি আপনার দায়িত্ব কর্তব্য নয়?

রমজান মাসে কি শুধুই রোজা রাখা? রমজান মাসে কি শুধু সময়মতো সেহরি খাওয়া আর সূর্যাস্তের সময় ইফতার কারা? হ্যাঁ, তা ঠিক আছে। কিন্তু সিয়াম সাধনা’র পাশাপাশি আপনার চারপাশে থাকা দরিদ্র গরীব মানুষগুলোর কথাও ভাবা উচিৎ বলে মনে করি। আপনার যা আছে তা থেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ কিছু আপনার গরীব আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে সাহায্য করুন। যদি আপনি সম্পদশালী হয়ে থাকেন, তাহলে তো দয়াল নবী’র আদেশ আপনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন, এমনটাই আশা রাখি।

মনে রাখা ভালো যে, এই মাহে রমজান মাস হলো বরকতের মাস। এই বরকতের মাসে যত দান করা যায়, ততই সওয়াব। যতই বেশি দানখয়রাত করা যায়, ততই নাকি আখেরাতে এবং এই দুনিয়ায় জীবদ্দশায় সুখশান্তি ভোগ করা যায়।

বি:দ্র: আমি একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী। আমি হিন্দু। আমার এই লেখায় যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, তা হলে অপমান অপদস্ত না করে ক্ষমা করে দিবেন।

এদেশ ওদেশ ৭

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ সপ্তম পর্ব।)

এদিকে ভারত রাষ্ট্রে তখন রাজনৈতিক ঝড়ের আসন্ন পূর্বাভাস। স্বাধীনতার পরে যখন একে একে স্বপ্ন ঝরে পড়তে শুরু করলো স্বভাবতই মানুষ বিমুখ হতে শুরু করলো শাসকদের থেকে। বহু প্রতিশ্রুতি দেখা গেল শুধুই মিথ্যাচার।

ল্যাম্পপোষ্টে একজনও মজুতদারকে ঝোলানো হলো না, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস হাতছাড়া হতে শুরু হলো, সম্পদ জমতে শুরু করলো চরম ধনীদের সিন্দুকে। সুভষের মতো নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবীকে দেশে ফিরলে ইংরেজের হাতে তুলে দেওয়ার ঘৃণ্য মুচলেকা দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে এসে গেল। অপুষ্টি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা বাড়তে লাগলো হু হু করে।

ষাটের দশকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ঘা মারলো দু দুখানা যুদ্ধ। পাকিস্তানের সঙ্গে জিতলেও চীনের কাছে হেরে ভারতখন্ড তাদের হাতে তুলে দিয়ে মাথা নীচু করে পিছিয়ে আসতে হলো। যুদ্ধ পরবর্তী যাপনচিত্র হয়ে উঠলো ক্রমশঃ ঘন কালো।

মারা গেলেন দুজন খ্যাতনামা প্রধানমন্ত্রী। জওহরলাল নেহরু এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী। কংগ্রেসের মধ্যে ক্ষমতা দখলের উদগ্র লোভ আবার প্রকাশ্যে এসে গেল। দিল্লীর মসনদ দখলের চেষ্টায় সব দুষ্কর্ম বৈধতা পাচ্ছিল।

সমস্ত বাধা সরিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিছু হটিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতা দখল করলেও পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন না হয়ে আরো অধগামী হতে থাকলো।

ঠিক এই সময়েই পরপর দুবার ভাগ হয়ে গেল কমিউনিস্ট পার্টি শুধুমাত্র আদর্শগত বিরোধের মাশুল দিয়ে। নরম, মধ্য ও চরমপন্থার বিরোধের সুযোগে শাসক কংগ্রেস তাদের ধ্বংস করতে উদ্যত হলো। কিন্তু মানুষ অপ্রত্যাশিত ভাবে মধ্যপন্থী কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করলো।

৬৮ র বর্দ্ধমান প্লেনামে বিকল্প দলিল পেশ করে চারু মজুমদারের চরমপন্থী গোষ্ঠী হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলো। অন্যরা তাদের এই কাজকে হঠকারিতা আখ্যা দিলেও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে গেল এই মতাদর্শ। আগুন জ্বলার আগে বাতাস তখন থমকে দাঁড়িয়ে।

অবস্থা সামাল দিয়ে নিজের অপ্রতিহত শাসনদন্ড প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্দিরার তখন দরকার ছিল একটা ঝড়ের। অথচ সমগ্র উপমহাদেশ তখন কাঁপছে স্থিতিশীল সুশাসনের অভাবে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই ৭০ এর নির্বাচন হলো পাকিস্তানে। জনরায়ে ব্যাপক হার সেখানকার শাসকেরা মেনে না নিয়ে নির্বাচনের রায় ভন্ডুল করে পূর্ব অংশে সর্বার্থে মিলিটারি শাসন জারীর কুচেষ্টা করে লেলিয়ে দিল আলবদর, রাজাকার ও আর্মি। তছনছ হয়ে গেল সামাজিক, অর্থনৈতিক বন্ধন। কাতারে কাতারে শরনার্থী পালিয়ে আসতে শুরু করলো এপারে।

এমনিতেই এপার বাংলার অর্থনীতি ভারতের সাথে জুড়েই তখন বিপর্যস্ত। তার ওপর এত বিপুল পরিমাণে শরনার্থীর চাপে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো।

এপারের বাঙালি কিন্তু অসীম সহ্যশক্তি নিয়ে জায়গা ছেড়ে দিতে লাগলো তাদের। কমিউনিস্ট পার্টিরা তাদের সমর্থনে পাশে দাঁড়াল। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে শিবির গুলোতে হানা দিতে লাগলো মহামারী, ক্ষুধা। প্রচুর মানুষ মারা গেল এপারে এসেও। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এতদিন চুপ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল, নড়েচড়ে বসতেই হলো তাদের এবার।

(আবার কাল)