বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে উন্নয়ন বিসর্জন

2821a

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দুর্মূল্যের কথা করেছি শ্রবণ
দাম বেড়েছে চাল ডাল তেল মরিচ আলু পটল লবণ,
রোজগার তো বাড়েইনি খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ এখন।
দিনমজুররা সীমিত মজুরিতে খেতেও পাচ্ছে না তেমন।

বড়লোকরা তো টেরই পায় না, তারা করে নিত্য ভ্রমণ
কেউ যায় সিঙ্গাপুর, কেউ আমেরিকা, কেউ যায় লন্ডন,
দ্রব্যাদির দাম যতই বাড়ুক, তারা করে রাজকীয় ভোজন
ইলিশ মাছ ভাজা, রুই মাছের ঝোল, মাংসও থাকে কমন।

দুর্মূল্যের জাঁতা কলে মরছে দেশের যতো গরিব জনগণ
নুন আনতে ফুরোয় পান্তা, দেখা যায় গ্রাম শহরে এমন,
আগে গরিবেরা খেতো আটার রুটি ধনীরা হাসতো তখন
সেই আটা গরিবের হাত ছাড়া, ধনীরাই খায় যখনতখন।

দুর্মূল্যের বাজারে সবকিছু বদলে হয়েছে পরিবর্তন
গরিবের ফুটপাতে ভিড় জমায় শহরের নামি মহাজন,
রিকশাওয়ালাকে ছোটলোক বলতো কতো বিশিষ্টজন
এখন তারাই চশমা পরে রিকশা চালায় রাত হয় যখন।

ডাস্টবিনে ফেলা পচা খবর খেয়ে যারা বাঁচাতো জীবন
সেই ডাস্টবিনে খাবার না পেয়ে হচ্ছে অনেকেরই মরণ,
৭৪-এর দুর্ভিক্ষে আটার জাউ গরিবরা করেছিল ভক্ষণ
দুর্মূল্যের এই নীরব দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মরছে কতোজন?

মন্ত্রী বলে প্রতিদিন তিনবেলা মাংস খেতে পারে প্রতিজন
সরেজমিনে দেখা যায় দুবেলা ভাতই পায় না মানুষজন,
দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে কচুরিপানা খেতে দিচ্ছে ভাষণ
সয়াবিনের পরিবর্তে বাদাম তেল খেতেও বলছে এমন।

কিন্তু হায়! এসব কি পারা যায়? হে রাষ্ট্রীয় গুণীজন
সিন্ডিকেট রুখতে হবে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আছেন যতক্ষণ,
একদিকে দুর্ভিক্ষের হাতছানি অন্যদিকে হচ্ছে উন্নয়ন
দ্রব্যমূল্যের দাম কমাতে না পারলে শত উন্নয়ন বিসর্জন।

.
ছবি: নিজ এলাকার এক দরিদ্র পরিবার।
বি:দ্র: লেখার সাথে মেলাতে এই ছবিটি আপলোড করেছি মাত্র। কিন্তু লেখার সাথে ছবিটির কোনও সম্পর্ক নেই।

কর্ম দোষে ভাগ্যের অবনতি

1522

সৎ কর্মে ভাগ্য ফিরে হয় ভাগ্যবান
অসৎ কর্মে দুঃখ-কষ্ট হয় কতো অপমান
স্রষ্টা দিয়েছে দৃষ্টি বিবেক বুদ্ধি জ্ঞান
সেই জ্ঞান বিলিয়ে দিয়ে হও বুদ্ধিমান।

মনে নেই ভক্তি মুখে হরিনাম ভগবান
মিছে ভক্তি মেলে না মুক্তি দূষিত প্রাণ
শত কষ্টেও যদি গাহে স্রষ্টার গুনগান
স্রষ্টা বলে তুমিই পাবে বিস্তর সম্মান।

কেউ সৎ কর্মে করে বড় গাফলতি
আবার কেউ অসৎ পথে করে মাতামাতি
দুঃখ এলে ভাগ্যকে বলে এটাই নিয়তি
আসলে কর্ম দোষেই হয় ভাগ্যের অবনতি।

মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ আমাদের_বন্ধু

গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু, বাপ, দাদার আদি পেশা জুতা সেলাই; অর্থাৎ তারা মুচি। তার বাবা কাকারা চৌমুহনার মোড়ে ঝুপড়ি ঘরে বসে জুতা সেলাই করে।

মুচির ছেলের সাথে বন্ধুত্ব তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না, এখনো সম্ভব নয়; তবুও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অবশ্য হওয়ার বিবিধ কারণ ছিল।

প্রধান কারণ হচ্ছে গৌরাঙ্গ ছিল দরাজ দিল, বন্ধুদের জন্য খরচ করতে কৃপণতা দেখাতো না। আমরা সপ্তাহে পাঁচ শিকা খরচ করতে পারতাম না, সে অনায়াসে পাঁচ সাত টাকা খরচ করে ফেলত। অন্য কারণের মধ্যে ছিল সে ভালো গান গাইতো, ভালো ছবি আঁকতো। পদ্য লেখায় তার বেশ মুন্সিয়ানা ছিল।

সে ছিল তার ঠাকুরদার আদরের নাতি। তাদের পরিবারের কেউ জীবনে স্কুলে যায়নি। জন্ম থেকেই তাদের জুতা পাঠ শেখানো হয়, অক্ষর পাঠ তাদের জন্য বিলাসিতা। গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা দেখলেন এই ছেলের জুতা পাঠে মন নেই, জুতা সেলাই করতে দিলে এই ছেলে সুঁই দিয়ে মাটিতে ছবি আঁকতে লেগে যায়। জুতা সেলাইয়ের চেয়ে গানে মনোযোগ বেশি, মুখে মুখে বেশ ভাল পদ্য বানাতে পারে।

ঠাকুরদা নাতির প্রতিভায় মুগ্ধ। ভাবলেন একে স্কুলে পড়াতে পারলে নিশ্চয় বংশের গৌরব হবে। চাই কি কালে কালে জজ ব্যারিস্টার হয়ে যেতে পারে। একদিন সন্ধ্যায় তিনি ঘোষণা করলেন নাতীকে তিনি স্কুলে পাঠাবেন; তাঁর এই অদ্ভুত ঘোষণায় গৌরাঙ্গের বাবা, কাকারা অবাক হল। স্কুল কেন আরেকটু বড় হলে তো পুরোদস্তুর রোজগারে লেগে যেতে পারবে। কিন্তু বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস তারা করল না।

স্কুলে ভর্তি হবে বললেই তো আর হলো না, মুচির ছেলে অন্ত্যজ জাত; অভিজাত যারা তারা নিশ্চয়ই চাইবে না মুচির ছেলে তাদের ছেলেদের সাথে পড়ুক। নাতিকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে গৌতমের ঠাকুরদা অনেক ঝামেলায় পড়লেন।

অনেক স্কুলে সিট নাই অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হল কিন্তু হাল ছাড়লেন না গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা, দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে এসময় জাতপাত, উঁচু-নিচু চিন্তা করে আর বিভাজন বাড়ানো যাবে না। গৌরাঙ্গকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। গৌরাঙ্গ তৃতীয় শ্রেণীতে আমাদের সহপাঠী হয়ে গেল। আমাদের কোনো কোনো অভিভাবক গাঁইগুঁই করেছিলেন বটে কিন্তু প্রধান শিক্ষকের প্রতাপের কাছে পরাস্থ হতে হল।

প্রধান শিক্ষক তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন ঠিক, আমরা করলাম না। জুতা সেলাই এর ছেলেকে বন্ধু ভাবতে কোথায় যেন দ্বিধা থেকে গেল। অথচ আমাদের কারোরই বয়স দশ হয়নি।

সমাজ বাস্তবতা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, বোধে এমনিতেই এসে যায়। জুতা সেলাই যে অতি নিম্নমানের কাজ, মুচিরা যে অতি নিম্ন জাত দশ বছর হওয়ার আগেই এসব জেনে গেছি।

গৌরাঙ্গের সাথে কেউ মিশে না, পাশে বসে না, সে একেবারে পেছনের বেঞ্চে একা বসে থাকে। কিছুদিন পরে দেখা গেল তার হাতে অফুরন্ত টাকা। আমরা চার আনার বাদাম কিনতে পারি না, সে দিব্যি এক টাকার বাদাম কিনে ফেলে। বাদামের লোভে আমরা তার পাশে ভিড়লাম, সে আমাদের নিরাশ করল না; ভাগ দিতে শুরু করল। ক্রমে সে আমাদের বন্ধু, আমাদের একজন হয়ে গেল।

গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা বেশ মালদার ছিলেন, তিন পুত্রের রোজগারে তাঁর দিন ভালই কাটছিল। আদরের নাতির পকেট খরচের জন্য প্রতি সপ্তাহে দশ টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে তাদের বাড়িতে চোলাই বাংলা মদের আসর বসতো। ঠাকুরদা, বাবা, কাকারা একসাথে বসে মদ্যপান করত, কখনো কখনো মা, কাকীরাও সঙ্গ দিতে হাজির থাকতো। মদের আসরে বাচ্চাদের হাজির হওয়ার কোন বিধি-নিষেধ না থাকলেও গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা তাকে কাছে ভিড়তে দিতেন না। মদ্যপান কিংবা বিড়ি-সিগারেট থেকে দশ হাত দূরে রাখতেন।

অচিরেই গৌরাঙ্গের অন্যান্য প্রতিভা আমাদের সামনে প্রকাশ হতে থাকল। গান, আঁকা, পদ্য লেখায় সে অনন্য ছিল। আন্তস্কুল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সে স্কুলের জন্য সুনাম কুড়াতে লাগল। আমরা তার বন্ধু থেকে ভক্ত, গুণমুগ্ধে পরিণত হলাম। নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সহজাত গুণ তার ছিল; একদিন লক্ষ করলাম সে আমাদের দলপতি হয়ে সামনে হাঁটছে, পিছন পিছন আমরা তাকে অনুসরণ করছি।

নবম শ্রেণী পর্যন্ত গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু ছিল, দলপতি ছিল কিন্তু এর পরে তার প্রতি আমাদের মোহ ভঙ্গ হল। সে যে অন্ত্যজ শ্রেণী প্রমাণ রাখল। তার ঠাকুরদা কিংবা বাবা-কাকারা আদতে যে মুচি কোন সন্দেহ থাকল না।
রিতা রায়ের বাবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। রীতা রায় সুন্দরী, স্মার্ট সে আমাদের প্রেমিকা। আমাদের প্রত্যেকের মনে রীতা রায় থাকে। এই রীতা রায় কে প্রেমের আহ্বান জানালো মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ। রীতা রায় অবাক হলো ঠিকই কিন্তু উত্তেজিত হলো না কিম্বা রাগ করল না, শুধু গৌরাঙ্গ কে ডেকে বলল ‘এ হবার নয়’।

রীতা রায় রাগ করেনি কিন্তু আমরা ক্রোধে ফেটে পড়লাম, মুচির ছেলের এত সাহস রীতা রায় কে প্রেমপত্র লিখে। রীতা রায় কে প্রেমপত্র লেখার অধিকার একমাত্র আমাদের। মুচির ছেলের স্পর্ধার একটা হেস্তনেস্ত অবশ্যই হতে হবে। নিমিষেই ভুলে গেলাম সে আমাদের বন্ধু, গত কয়েক বছরে হাজার টাকার বাদাম সে আমাদের খাইয়েছে। ভুলে গেলাম আমরা তাকে দলপতি মেনে অনেক অসম্ভব কে জয় করেছি।

ইতোমধ্যে দেশে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে, সবকিছু নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন নিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধা প্রধান শিক্ষক স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি অবসরে চলে গেছে। যে স্বপ্নবান পুরুষ স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে জাতিকে একটা দেশ উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে একদিন সূর্যোদয় হয়েছিল এখন স্থায়ী অমাবস্যা আসন গেড়েছে। আশা জাগানিয়া শুরু দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

আমাদের শহরের সবচেয়ে দুষ্টগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে যে পাকিস্তানের লেজুড় ছিল সে এখন স্কুলের দায়িত্বে। ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়েকে প্রেমপত্র লেখার দায়ে গৌরাঙ্গের বাবা-কাকারা জেলে। রাজাকার প্রধান শিক্ষক গৌরাঙ্গের ঠাকুরদাকে আসতে বলেছে। মুচির বাচ্চাদের পায়ের নিচে থেতলে দিতে হবে।

গৌরাঙ্গকে সাথে নিয়ে ঠাকুরদা এলে প্রধান শিক্ষকের কথায় রীতা রায় স্কুলের বারান্দায় থুতু ফেলেছে। গৌরাঙ্গ এবং তার ঠাকুরদা রীতা রায়ের থুতু চেটে খেয়েছে। মুচির বাচ্চার জন্য স্কুলের বারান্দা চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের গুস্সা প্রশমিত হওয়ায় বাবা চাচারা শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছে।

গৌরাঙ্গ তার বংশের জন্য সুনাম কুড়াতে পারেনি। সে এখন চৌমুহনার ঝুপড়ি ঘরে একমনে জুতা সেলাই করে। আমরা কখনও কখনও তার ঝুপড়ি ঘরে হাজির হই, জুতা পালিশ করতে সে কসুর করে না।

(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)

পাঁচ বালতি জমি

2817s

পাঁচ বালতি জমি আমার
পরের বাড়ি থাকি,
জমিতে করেছি ফুলের চাষ
ধান থাকলো বাকি।

আস্তেধীরে চাষ করবো সব
আলু পটল বেগুন,
এসবের নাকি ফলন ভালো
দামেও চড়া দ্বিগুণ।

পাঁচ বালতি জমিতে আমার
তুলসী দেখায় শোভা,
তুলসী লাগে দেব পূজায়
ফুলও লাগে জবা।

একটা গাছে ফুটেছে রক্তজবা
আর একটায় কামিনী,
তা দেখে বাড়ির সবাই খুশি
খুশি মোর অর্ধাঙ্গিনী।

.
ছবি নিজের মোবাইলে তোলা।

আলাপন -৬০

indexa

ক্রিং ক্রিং……ক্রিং ক্রিং (ফোন বাজছে)
অথৈঃ হ্যালো
রিমনঃ কি করছেন
অথৈঃ “গানস অন রোজেস” এর “নভেম্বর রেইন” গানটি শুনছি
রিমনঃ বাহ! দারুণ একটা গান। অসাধারণ লিরিক্স। গিটারের অপুর্ব এক সলো আছে এই গানে।
অথৈঃ “ডায়ার স্ট্রেইটস” এর “সুলতান্স অব সুইং” শুনেছেন?
রিমনঃ কেন নয়? এই গানে ক্লাসিক এক গিটার সলো বাজিয়েছেন মার্ক নফলার।
অথৈঃ হ্যা, দারুণ গিটার সলো। একেবারে ক্লাসিক…….তা আমাকে মনে পড়লো বুঝি?

রিমনঃ ফোন করেছি একটা কথা বলার জন্য।
অথৈঃ হ্যা বলুন
রিমনঃ আপনার হাসি মাখা মুখটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ডিলিট করে একটি গম্ভীর মুখের ছবি দিলে ভালো হবে।
অথৈঃ কেন বলুন তো!
রিমনঃ ওই ছবিটা দেখলে আমি আপনার ওপর রাগ করতে পারি না।
অথৈঃ আপনি আমার ওপর রাগ করতে চান কেন
রিমনঃ আপনাকে ভুলে যেতে চাই তাই আপনার ওপর আমি রেগে থাকার চেষ্টা করি কিন্তু যতোবার ওই ছবিটা দেখি ততোবার আমি রাগ করতে ভুলে যাই।
অথৈঃ কেন ভুলে যেতে চান আমাকে?
রিমনঃ আপনাকে ইনবক্স করে জানতে চেয়েছিলাম – কেমন আছেন। তিন মাস হয়ে গেলো কিন্তু আপনি উত্তর দেন নি। মনে মনে হয়তবা ভাবছেন…..ও আর এমন কি কবি যে তার ইনবক্সের উত্তর দিতে হবে? এইসব কবিরা……

অথৈঃ বাংলার রবীন্দ্রনাথ আর ইংলিশ শেক্সপিয়ারকে কতটুকু পড়েছে কে জানে……
রিমনঃ জন কীটস, পিবি শেলি কিংবা পাবলো নেরুদা…..
অথৈঃ অথবা অক্টাভিওপাজ তো পড়েছে বলে মনেই হয় না…..পারস্য প্রতিভা……
রিমনঃ কিংবা ওয়ার্ল্ড লিটারেচার কতোটুকু জানে কে জানে…….
অথৈঃ শুধু অন্তমিল মিলিয়ে লিখলেই যে……
রিমনঃ কবিতা হয়ে যায় না তা এইসব কবিরা বুঝে কিনা………?
অথৈঃ ছন্দ, মাত্রা, পর্ব, রুপক, অনুপ্রাস…….
রিমনঃ অথবা কবিতাকে কি করে অলংকার পরাতে হয় তা জানে কিনা…….

অথৈঃ না, মানে….
রিমনঃ কবিতায় যে দর্শন থাকে তাও বোধহয় জানে না
অথৈঃ ইয়ে মানে…….
রিমনঃ শপেনহার, বার্গসা বা হেগেলের দর্শন এইসব কবিরা পড়েছে কি?……..
অথৈঃ না, তা না, আসলে আমি……
রিমনঃ রুবাই, সিজো, কাসিদা, হাইকু, লিমেরিক এইসব কবিরা লিখতে জানে কি?…..
অথৈঃ আসলে আপনাকে আমি এমন মনে করিনি
রিমনঃ না, আমি আসলে কবি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কবি হবার ইচ্ছে নেই
অথৈঃ কিন্তু আমিতো আপনার একটি কবিতা আবৃত্তি করেছি
রিমনঃ সেটাতো অনেক অনুনয় বিনয় অনুরোধ করার পর করেছেন কিন্তু আপনি অনেক ভালো আবৃত্তি শিল্পী

অথৈঃ তাই নাকি
রিমনঃ আমার কবিতার অল্পপ্রাণ মহাপ্রাণ ধ্বনির সঠিক উচ্চারণ, নাসিক্য বর্ণের সঠিক উচ্চারণ, তাল, লয়, প্যাটার্ন অব ডেলিভারি, ক্লাইম্যাক্স এন্টিক্লাইম্যাক্স অসাধারণ ভাবে করেছেন।
অথৈঃ বাহ! আপনি দেখছি আবৃত্তিও বুঝেন
রিমনঃ কেন নয়? এখনকার কবিরা আবৃত্তিও করতে জানে
অথৈঃ হুম, এখনকার কবিরা স্মার্ট কবি
রিমনঃ পাঞ্জাবি-পায়জামা, ঝোলানো ব্যাগ আর চটি স্যান্ডেল ছেড়ে এখনকার কবিরা জিনস প্যান্ট, পোলো শার্ট আর কেডস পরতে জানে
অথৈঃ কিন্তু ব্যাগে যে কবিদের খাতা কলম বই লাগে!
রিমনঃ ওগুলো এখনকার কবিরা স্মার্ট ফোনেই সেরে ফ্যালে।
অথৈঃ তাইতো দেখি ইদানীং

রিমনঃ আচ্ছা, যেদিন আমাদের আবৃত্তি প্রশিক্ষকের অফিসে আমাদের সকলের ইনভাইটেশন ছিলো সেদিন আপনি আমাকে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। সেই কথাটা কি আজ বলবেন?
অথৈঃ যেটা বলতে চেয়েছিলাম সেটা আসলে অবাস্তব এবং অসম্ভব তাই বলি নি
রিমনঃ আসলে অনেক বাস্তব বিষয়কে আমরা অবাস্তব হিসেবে ধরে নেই এবং অনেক সম্ভব ব্যাপারকে আমরা অসম্ভব মনে করি
অথৈঃ বিয়ে হওয়ার পরে, স্বামী সন্তান সংসার হওয়ার পরে যদি অন্য কাউকে ভালোবাসতে মন চায়। যদি মনে হয় অন্য কাউকে মনের কথা বলা যায়। যদি মন হয় জীবনে বড় ভুল হয়ে গেছে। যদি অন্য কাউকে খুব করে কাছে পেতে ইচ্ছে করে তাহলে কি করে তা সম্ভব?

রিমনঃ সকালের সূর্যটাই দুপুর এলে রৌদ্র হয়ে যায়। দুপুরের রৌদ্র যদি কারো ভালো লাগেও তাহলে সমাজের বিধি মানতে গিয়ে তাকে ছাতা খুলে মাথার উপর ধরতে হয়। কিন্তু দুপুরের রৌদ্রকে ভালোবাসাতে কোনও অপরাধ নেই। শুধু ছাতার আড়ালে থেকেই রৌদ্রকে ভালোবাসতে হয়। কেবল ওই রৌদ্র গায়ে মাখতে গেলেই সমাজের সব বিধি নিষেধ।

অথৈঃ কেন যে বিধাতা কখনো কখনো সঠিক সময়ে ভুল কাজ করে থাকেন আর ভুল সময়ে সঠিক কাজটি করে থাকেন! কেন যে বিধাতা কঠিন বাস্তবতা নিয়ে খেলেন, হাসেন, নিশ্চুপ থাকেন তা মানব জগতের কেউ কি বুঝতে পারে? হায় বিধাতা, তোমাকে আর কতকাল মানবজাতি খুঁজে খুঁজে বেড়াবে? হায় বিধাতা, আমার জীবনে কেন তুমি সেই সঠিক সময়ে ভুল কাজটি করলে।

জীবন থাকতেও ফেসবুক মৃত্যুর পরও ফেসবুক

download (1)

লেখার শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকেই ভাবছেন, “জীবন থাকতেও ফেসবুক, মৃত্যুর পরও ফেসবুক”, তা কী করে হয়? হ্যা, সত্যি তা-ই হয়! কীভাবে হতে পারে তা নিজে ভাবার আগে দয়া করে আমার আজকের এই লেখাটা মনোযোগ সহকারে পুরোটা পড়ুন, তা হলেই আপনারা ক্লিয়ার হয়ে যাবেন। তো চলুন, শুরু করা যাক!

বন্ধুরা, বর্তমানে ফেসবুকে একটা আইডি নেই এমন মানুষ কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ স্কুলের ছাত্র হোক, কলেজের ছাত্র হোক, চাকরিজীবী হোক যেকোনো পেশার লোকেই হোক-না-কেন, ফেসবুকে একটা আইডি সবারই চাই চাই ৷ এমনকি লেখাপড়া না জানা অনেক লোকেও কিন্তু বর্তমানে ফেসবুকে পারদর্শী হয়ে উঠছে৷ তা কি আমি মিথ্যে বলছি? মোটেই না। যা বলছি, তা একশো-তে-একশো সত্য এবং বাস্তব!

আমার দেখা এমন লোক আছে নিজের নাম লেখতে কলম ভাঙে চারটে! ওই লোকও বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারী। তা-ও আবার তার ফ্রেন্ড লিস্টে হাজার চারেক ফ্রেন্ড! ওইসব ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে জানতে চাইলাম, “কীভাবে মেসেজ দিন? কীভাবে আপনার অনুভূতি গুলো বন্ধুদের জানান? কীভাবে অন্যের একটা ছবির উপর মন্তব্য করেন”? উত্তরঃ পেলাম, “আরে বাবু এটা কোনও ব্যাপারই না! শুধু nice, good, goodmorning, fine এইসব লেখাগুলো অন্য কারোর মন্তব্য থেকে কপি করে এনে পেস্ট করলেই তো হয়ে যায়। আর কীলাগে বাবু”? উল্টা আমাকেই প্রশ্ন করে!

আবার কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, –’আচ্ছা, আপনি ফেসবুকে এতো ঘনঘন পোস্ট করেন কেন’? উত্তর আসে, “ভাল্লাগে না! একেবারেই ভাল্লাগে না! মোবাইল চালু থাকলে হাত শুধু ফেসবুক অ্যাপটাতে চলে যায়। আর খালি হাতে ফেসবুকে ঢুকবো, তা কী করে হয়? তাই খালি হাতে না ঢুকে একটা পোস্ট করেই ফেসবুকে টু মারি”!
–আচ্ছা, সারাদিনে আপনার ১০-১২ পোস্ট দেখতে আর পড়তে আপনার বন্ধুদের বিরক্তিকর ভাব আসে না?
উত্তর আসে, “তা জানি না”!
–আপনি আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা কতজন বন্ধুর পোস্টে লাইক/কমেন্ট করেন?
উত্তর আসে, ‘আমিতো দাদা সময়ই পাই না। খানিক পর পর নিজের পোস্ট দেখতে দেখতেই তো সময় শেষ হয়ে যায়। পরেরটা কী দেখার আর সময় থাকে”?

এসব শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না! আর আমি অবাক বা হতভম্ব হলেও তাদের কিছুই যায় আসবে না, এটাও বাস্তব কথা। আরও বাস্তব কথা হলো, ডিজিটাল যুগে তো সবারই ডিজিটালি হওয়া দরকার আছে। তা-ই নয় কি?

হ্যা, তাই দেখা যায় মানুষের জীবনের একটা বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান যুগের বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই ফেসবুক। শুধু মানুষের জীবনের বড় অংশই নয়, ফেসবুক এককথায় একরকম জাতির মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, ফেসবুকের একটা স্ট্যাটাস বা পোস্টকে কেন্দ্র করে যখন সারাদেশে হুলস্থুল লেগে যায়, তখন স্বয়ং রাষ্ট্রের সিংহাসনও যেন কেঁপে ওঠে। ওই কাঁপনে সারাদেশ অনেকদিন পর্যন্ত কাঁপতে থাকে। তাই বর্তমান সরকার এই বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কে কোন ধরনের স্ট্যাটাস বা পোস্ট করে, সেদিকে খুব গুরুত্বের সাথে নজর রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে। এখন কেউ একটা পোস্ট করে গুজব রটাবেন? তাহলে কিন্তু সাথে সাথেই খবর হয়ে যাবে! তাই বর্তমান বিশ্বের এই ফেসবুককে বলছি, জাতির মেরুদণ্ড।

কিন্তু আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে এই ফেসবুক এদেশে মেরুদণ্ডহীন অবস্থাতেই ছিলো। তখন যে কারোই একটা গুজবের স্ট্যাটাস বা পোস্টে দেশটাকে এতটা কাঁপাতে পারেনি। এখনকার মতো ফেসবুক তখন এতটা জনপ্রিয়ও ছিলো না। আমি ২০১১-১২ সালের কথা বলছি! তখন খুব কম মানুষই ফেসবুক ব্যবহার করতো। যদিও আমাদের দেশে ফেসবুক নোট চালু হয়, ২০০৬ সালের আগষ্টের ২২ তারিখ। যা ছিলো মূলত একটি সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার প্লাটফর্ম মাত্র। এর পর থেকে ধীরেসুস্থে বাংলার মানুষের কাছে ফেসবুক জনপ্রিয় হতে সময় লেগেছিল কিছু বছর। ফেসবুক এদেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে শুরু করেছিল তখন, যখন বাটন মোবাইলের পাশাপাশি এ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম টাচ্ মোবাইল এদেশের বাজার আসে।

অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম টাচ্ মোবাইল বাজারে আসার আগে এদেশে ফেসবুকের পথচলা যেমন ছিলো কচ্ছপগতি, তেমনই ছিলো অনেক মানুষের কাছে অপছন্দের। তখন এদেশের অনেক কবি সাহিত্যিক ফেসবুকের নামও শুনতে পারতো না। শুধু কবি সাহিত্যিকই নয়, তখন অনেক শিক্ষিত মানুষের কাছেই ফেসবুক ছিলো অপছন্দের। ২০০৬ সাল থেকে দিন আর মাস ও বছর যতো গড়িয়েছে, ফেসবুক সব পেশার মানুষের কাছে পছন্দের হয়ে ততো পৌঁছেছে। এখন কবিদের কবিতার আসর, আর সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চার পেইজের অভাব নেই। এমনও কবি সাহিত্যিক আছে, তারা সারা দিনরাত শুধু ফেসবুক নিয়েই পড়ে থাকে। এই অবস্থা কিন্তু কবি সাহিত্যিকের বেলাতেই নয়, এ অবস্থা সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যেই লক্ষণীয়। এর কারণ হলো, বর্তমানে দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছেই ফেসবুক খুবই জনপ্রিয় ও খুবই পছন্দের, তাই।

বর্তমানে এই ফেসবুককে অনেকে নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরি হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে। তাই আমাদের বাংলাদেশে বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই ফেসবুকের এখন জয়জয়কার অবস্থা। ফেসবুক ছাড়া এখন বেশিরভাগ মানুষের জীবন চলে না। জীবন যেভাবেই চলুক-না-কেন জীবনের সাথে একটা ফেসবুক আইডি থাকলে অনেকেরই মনটা অনেক ভালো লাগে বলে জানা যায়।

আর ভালো তো লাগবেই। বর্তমানের মতো ফেসবুকে আগে এতকিছু ছিলো না। দিন যত যাচ্ছে, ফেসবুক মানুষের সুবিধার্থে, মানুষের কল্যাণে, মানুষের ভালো লাগার জন্য আরও অনেক সিস্টেম চালু করছে। ভালো লাগার কারণ আরও আছে। বর্তমানে ফেসবুকে ব্যবসা বাণিজ্য, খবর, বিনোদন, অনলাইন কেনাবেচা, মেসেজ আদান-প্রদান, হিন্দুদের রামায়ণ, গীতা পাঠ, মহাভারতের বাণী, পবিত্র বাইবেলের বাণী, মুসলমানদের পবিত্র কুরআন পাঠ সবই আছে। তাই অনেক মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘুমঘুম চোখে আগেই ফেসবুকে একটু টু মেরে নেয়। তারপর সকালের নাস্তা খাওয়া। এরপর সারাদিনের জন্য ঘাপটি মেরে বসে ফেসবুকে। চলে রাতদুপুর পর্যন্ত।

বর্তমানে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, “আপনি ফেসবুকে কী করেন”? উত্তর আসবে এরকম, “আরে ভাই, এই ফেসবুক পাইয়া খবরের কাগজ কেনা ছাইড়া দিছি। আজকাল খবরের কাগজে খবর নাই। খালি খালি অ্যাডভ্রাইজ। আর বেশিরভাগ বাসি খবর! মানে আগের দিনের খবর পরেরদিন। আর ফেসবুকে টাটকা খবর পাওয়া যায় ভাই”।

আসলেও তো সত্যি! ফেসবুকের খবর কিন্তু টাটকা খবরই! যেমন: মহল্লার খবর, দেশের খবর, কালোবাজারি খবর, নিজ এলাকার বিয়ের খবর, জন্মদিনের খবর, জন্মদানের খবর, হানিমুনের খবর, ভ্রমণের খবর, মৃত্যুর খবর, নিজ ঘরের খবর, সকালে খাবারের খবর, দুপুরের খাবারের খবর, রাতে শোবার খবর, মার খাওয়ার খবর, মার দেয়ার খবর-সহ আরও অনেক টাটকা খবরই পাওয়া যায়।

শুধু খবরই না, বর্তমানে ফেসবুকে খবর, বিনোদনের পাশাপাশি সাহায্য চাওয়া, স্বজনদের সন্ধান করা,পাত্র-পাত্রী খোঁজ করা, ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণ করা, রাষ্ট্রনায়কদের সাথে যোগাযোগ করা, এলাকাভিত্তিক দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, পছন্দের নেতাদের গুনগান গাওয়া, মিথ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, দুর্নীতিবাজদের সমালোচনা করা, প্রশ্নপত্র ফাঁস করা, যেকোনো নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া-সহ আরও কতো কী! মোট কথা জীবন মরণ, ধর্মকর্ম, প্রেম-ভালবাসা, চোর ধরা ডাকাত ধরা, গোমড়ফাঁস করা-সহ এই ফেসবুক যেন এক মহাকিতাবে পরিণত হয়েছে ৷ যেমন পুরোটা ফেসবুকে চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা।

এমন প্রতিযোগিতামূলক ফেসবুকে অনেক সময় দেখা যায় লাইকের প্রতিযোগিতা। এই লাইক প্রতিযোগিতায় যুবতী মেয়েরাই সবচাইতে এগিয়ে থাকে বেশি! এই প্রতিযোগিতায় আরো অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তাদের আইডি বা পেইজে দেখা যায় লাইকের পাহাড় তৈরি হয়। এছাড়াও প্রতিযোগিতায় আছে সুপারস্টার, মডেলতারকা, অভিনেতা, অভিনেত্রী, লেখক/লেখিকারাও। লাইক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ নিজেও ৷

মার্ক জুকারবার্গের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল সেই ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সাল থেকে। আজও তিনি থেমে নেই৷ যদিও প্রথম প্রথম এই ফেসবুক ছিলো শুধু একে অপরের সাথে সহজে যোগাযোগ কারা। তা-ও ছিলো শুধু আমেরিকায় বসবাসকারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এরপর বিশ্বের সব দেশের মানুষের সুবিধার কথা মাথায় রেখে ২০০৫ সাল থেকে আস্তেধীরে অদ্য পর্যন্ত সারা বিশ্বেই ফেসবুকের পদচারণা৷ তাই আগের চেয়ে আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে এই ফেসবুক। তবুও থামছেন না মার্ক জুকারবার্গের প্রতিযোগিতা।

ফেসবুক নির্মাতার প্রতিযোগিতা দেখে ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও কিন্তু থেমে নেই। সমান তালে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রতিযোগিতাও চলছে। প্রতিযোগী বৃদ্ধ হোক আর শিশুই হোক, ফেসবুকে প্রতিযোগিতা চলছে, চলবেই। এই প্রতিযোগিতার অবসান ঘটবে তখন, যখন একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর বয়স বেড়ে একেবারে খনখনে বুড়ো হয়ে যাবো। তাহলে বলতে পারেন, ফেসবুকেরও তো বয়স বাড়ছে, বুড়ো হচ্ছে! হ্যাঁ ফেসবুকেরও বয়স বাড়ছে ঠিক! কীভাবে বয়স বাড়ছে, তার একটা হিসাব কষা দরকার।

হিসাব হলো, ধরা যাক শুরু থেকে যারা ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলো তাদের এখন বয়স প্রায়ই চল্লিশের কোঠায়। বর্তমানে সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ফেসবুকে আছেন। তবে একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, এখন থেকে একজন মানুষের ৮০ বছর বয়স হলে জন্মলগ্ন থেকে ফেসবুকের বয়স তখন কত হবে? হিসাব কষে দেখা যায় ৯৮ বছরের উপরে ফেসবুকর বয়স হয়ে যায়৷ বর্তমান যুগে এই দুনিয়ায় ৯৮ বছর খুব কম মানুষ’ই বেঁচে থাকে৷

এখন মনে করুন ফেসবুকে থাকাকালীন সময়ে যদি কারোর মৃত্যু হয়, তাহলে এই মৃতব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টটার অবস্থা কী হবে? মৃত্যু ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট বা আইডিটা কী বেঁচে থাকলো? নিশ্চয় না! এককথায় ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টটাও কিন্তু মৃত্যুবরণ করলো! তাহলে কী হলো? তাহলে তো হয়ে গেলো ফেসবুকে তার একটি ‘সমাধি’ বা ‘করব’।

কবর হয়ে থাকার কারণও আছে। এর মূলকারণ হলো এই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক স্বইচ্ছায় কারোর প্রোফাইল মুছে ফেলতে নারাজ। তা ব্যবহারকারী মৃত্যুবরণ করলেও। এই ফেসবুক ওয়েবসাইটি সকল ব্যবহারকারীর প্রোফাইল সন্মান রক্ষার্থে চিরদিন স্মৃতি করে করে রাখতে চায়।

যদি তা-ই হয়, তাহলে আমি নিজেওতো একজন নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহারকারী। আমারও তো একদিন মৃত্যু হবে। কারণ আমি মহান স্রষ্টার সৃষ্টি জীব। জীবের মৃত্যুই নিশ্চিত। যখন ওপারের ডাক আসবে, এই পৃথিবীর সবকিছু ফেলে আমাকে পরপারে যেতেই হবে। আমার মৃত্যুর পর আমার যা-কিছু থাকবে, তা কেউ-না-কেউ ভোগদখল করবে। কিন্তু আমার স্বাদের ফেসবুক আইডি খানা কেউ ভোগদখল করতে পারবে না। ফেসবুক কর্তৃপক্ষও তাদের স্বইচ্ছায় আমার ফেসবুক এ্যাকাউন্ট মুছে ফেলবে না। কাজেই আমার মৃত্যুর পর আমার আত্মীয়স্বজনরা শবদেহ দাহ করতে নিয়ে যাবে, নারায়ণগঞ্জ মাসদাইর পৌর শ্মশানে। সেখানে পুরোহিতের মন্ত্র পাঠে আমার শবদেহ মহা ধুমধামে আগুনে সূচিত করবে। তারপর হয়তো বছরে একবার নিজের ঘনিষ্ঠ কোনও সজন শ্মশানে গিয়ে আমার স্মরণের প্রদীপ জ্বালাবে। আর এই বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক আমার আইডি টার অবস্থা কী হবে, তা একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায়।

বোঝা যায় যে, আমার মৃত্যুর পর বিশ্ববিখ্যাত ফেসবুক আমার আইডি খানা বর্তমানে যেমন আছে, ঠিক সেভাবেই রেখে দিবে। কিন্তু আমিতো নেই! তাহলে? তাহলে আমার মৃত্যুর পর এই পৃথিবীর একটা জায়গায় আমার সমাধি তো আগেই হয়েছিল। তারপরও বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও আমার আইডি খানা সমাধি বা করব হয়ে থাকবে। এতে কোনও ভুল নেই। কাজেই আমার জীবন থাকতেও ফেসবুক থাকবে, আমার মৃত্যুর পরও আমি ফেসবুকে থেকেই যাচ্ছি। জয় ✌ ফেসবুক। জয় ✌ হোক বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের। জয় ✌ হোক সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীদের।

বি: দ্র: আমার এই লেখাতে ফেসবুক এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ছোট করা হয়নি। বরং ফেসবুক নির্মাতা-সহ বিশ্বের সকল দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সম্মান দেখানো হয়েছে। কাজেই পুরো লেখা না পড়ে কেউ বিদ্রুপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন বলে আশা করি।

ছবি সংগ্রহ ইন্টারনেট থেকে।

মায়ের কাছে ছেলের খোলা চিঠি

2811a

মাগো,
সালাম নিও। খুব জানতে করে তুমি কেমন আছ? কতদিন গেছে, কত রাত যাচ্ছে… একের পর এক সূর্য পূব আকাশে উঠছে আর পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছে। এ বিশ্বচরাচরের সবকিছু কোনো না কোনোভাবে চলছে…. চলে যাচ্ছে। কোনোকিছুই থেমে থাকছে না, কেবল থেমে আছে আমি। তোমাকে দেখতে যেতে না পারার অসহ্য কষ্ট আর যন্ত্রণা বুকে জড়িয়ে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, দেহে তবুও আমি রোজ রাতে ঘুমাই। ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়ার আগে কেবলই তোমার মুখ চেয়ে থাকি। মনে মনে তোমার মুখোমুখি বসি। তোমার কোলে আধশোয়া হই। আমার চোখে, মুখে, চুলে তোমার কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করি।

জানো মা, এই প্রবাস জীবনে আমি যতবার খেতে বসেছি, একবারও তৃপ্তি সহকারে খেতে পারিনি। কীভাবে তৃপ্তি পাব মা, তোমার হাতের রান্না যে একবার খেয়েছে… সেকি তা কোনোদিন ভুলতে পারবে? পারবে না। আমিও পারিনি। থানকুনি পাতার সাথে শিং মাছের ঝুল, মলা, ঢেলার চর্চরি, মিষ্টি কুমড়ার ফুলের বড়া, সজনে পাতার ফ্রাই, কলমি শাক… এসবের কথা মনে হলে এখনো আমার জিবে জল চলে আসে। ইচ্ছেঘোড়াটা লাগাম ছিঁড়ে তোমার কাছে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু পারে না।

জানো মা, এখানে এই মরুভুমির জীবন আমার মোটেই ভালো লাগে না। আশেপাশে কোনো জনবসতি নেই। যতদুর চোখ যায় কেবল বালুকারাশি। মাঝে মাঝে খেজুর গাছ। থোকা থোকা খেজুর ঝুলছে। খাওয়ার কেউ নেই। মাঝে মাঝে সরকারি গাড়ি আসে, খেজুর নিয়ে যায়। এই নিঃশব্দ মরুভূমিতে আমরা ক’জন বাঙালি প্রবাসি একসাথে থাকি মা। মরুভূমির জাহাজ নামে বিখ্যাত উট চড়াই। তুমি শোনে খুশি হবে, আমরা একজন আরেকজনের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করি। একজন হাসলে সবাই হাসি, একজন কাঁদলে সবাই কাঁদি!

তুমি বলো মা… এমনটা কি হওয়ার কথা ছিলো? তুমি আর বাবা শরীরের রক্ত পানি আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করেছিলে। আমাকে ঘিরে তোমাদের চোখে কত রঙিন স্বপ্ন ছিল। আমি সরকারি চাকুরি করব, মাস শেষে মোটা মাইনে পাব… আমাদের সংসারে আর কোনো দুঃখ থাকবে না। অথচ অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! অসংখ্য চাকুরির পরীক্ষায় প্রথম হয়েও স্বদেশে আমার ভাগ্যে চাকুরী জুটলো না। দালানের খপ্পরে পড়ে সেই আমি এখন সৌদি আরবের মরুভূমিতে উটের রাখাল।

জানি মা, আমার বকবক শোনতে শোনতে এতক্ষণে নিশ্চয়ই তোমার কান্না পাচ্ছে। তোমার পায়ে পড়ি মা, দুঃখ করো না। এতো কষ্টের মাঝেও আমি আল্লাহর রহমতে, তোমাদের দোয়ায় এই ভেবে ভালো আছি যে, প্রতি মাসে দেশের জন্য সামান্য হলেও কিছু রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছি। আমার জন্য দোয়া করো। কদমবুসি নিও।

ইতি
তোমার সৌদি প্রবাসী আদরের সন্তান
অচল ওরফে জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

মাথায় কি মাছ রেখে দেব?

মাথায় কি মাছ রেখে দেব?

না গো, কাতলের মুড়ো খেতে চায় না বাড়িতে
তুমি শুধু কানকো ফেলে ব্যাগে ভরে দাও, ডগি-টা রয়েছে

রান্নাঘরে বাজার নামিয়ে এক ঝটকায়
স্নানখাওয়া সারি
অফিসের গেটে মাছওলা বড় এক
ভেটকির আঁশ ছাড়িয়েছে
বাবু, মাথায় কি মাছ রাখতে হবে?
নারে ভাই, পাঁচ-ছ’ টুকরো করো,
ক্যান্টিনের আশপাশে বেড়ালবাচ্চা ব’সে থাকে

তারপর মহাবিদ্যালয় থেকে ফোন এল : বিকেলে আসিস, কতদিন গল্প হয় না!
বিভাগে ঢোকার মুখে খসখস ক’রে মাছওলা পিস করছে রূপচাঁদা —
মাছ ছাড়া মাথা লিখছি, স্যার
নয়ত টিচার-ছাত্র কেউ নম্বর দেবে না

বন্ধু নেই, চিরকুট রেখে গেছে দেখে রাগ হয়
ওহো, আজ না জলসা আছে
সংস্কৃতিভবনে?
টিকিটঘরের নীচে বঁটি নিয়ে অধিষ্ঠান মাছওলা, যদিও কোথাও নদী নৌকো ভাটিয়ালি চোখে পড়ল না
এই বৃষ্টিহীন মুখ নিশ্চিহ্ন ঘেঁটির দিকে তাকিয়ে সে বলে , মাছ রাখলে ভালো দেখাবে কি!
তার চেয়ে জমা দিয়ে অনুষ্ঠানে যান
মাঝখান থেকে ফেঁড়ে ডবল প্লাস্টিকে মুড়ে দেব
রাস্তাঘাটে এক ফোঁটা রক্ত গড়াবে না

এদেশ ওদেশ ১৮ তথা প্রথম অর্ধের শেষ পর্ব

(কয়েকদিন ধরে লিখলাম ১৯২০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ” প্রথম অর্ধ। মাত্রই গুটিকয়েক পাঠক পড়লেন, মতামত দিলেন। মৌলবাদের স্বরূপ নিয়ে লিখতে গিয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্বরূপ লেখায় এসেছে, হয়তো এটা দলভক্তদের পছন্দ হয় নি, অথবা তাঁরা দলের বিরুদ্ধে লেখা পড়তে ভয় পেয়েছেন। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ অষ্টাদশ এবং শেষ পর্ব। কেউ পড়ুন বা না পড়ুন দ্বিতীয় অর্ধ আমি লিখবই)।

২২শে জানুয়ারি, ১৯৯৯, উড়িষ্যার কন্ধমাল জেলা। সূর্যোদয়ের সময়েই স্টেশন ওয়াগনে ঘুমন্ত অবস্থায় ১০ বছরের বালক ফিলিপ আর ছয় বছরের বালিকা কন্যা টিমোথি সমেত সস্ত্রীক পুড়িয়ে মারা হলো খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারক অস্ট্রেলিয় গ্রাহাম স্টেইনস কে। বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় বাধ্য হয়ে তৎকালীন উড়িষ্যা সরকার গ্রেপ্তার করল উত্তর প্রদেশের এটওয়ার বাসিন্দা বজরঙ্গ দলের সদস্য দারাসিং কে। কিন্তু ততক্ষণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে কন্ধমাল জেলায়। একদিকে মাওবাদী অন্য দিকে সঙ্ঘ পরিবারের উস্কানিতে আক্রান্ত আদিবাসী জন সমাজ। আর এভাবেই ২০০৭, ২০০৮ বারবার উড়িষ্যা আক্রান্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।

কিন্তু সম্ভবত স্বাধীনতা পরবর্তীতে ভারতের সবচেয়ে শিহরণকারী ঘটনা অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস। ধ্বংসের ১০ মাস আগেই তৈরী হয়েছিল ব্লুপ্রিন্ট। কোনো যে সে লোকের অভিযোগ নয়, একথা বলছেন খোদ ভারতের ইন্টিলিজেন্স ব্যুরোর জয়েন্ট ডিরেক্টর মলয় কৃষ্ণ ধর। “Babri Masjid demolition was planned 10 months in advance by top leaders of RSS, BJP and VHP and raised questions over the way the then prime minister P V Narasimha Rao, had handled the issue. I was directed to arrange the coverage of a key meeting of the BJP/Sangh Parivar and that the meeting proved beyond doubt that they (RSS, BJP, VHP) had drawn up the blueprint of the Hindutva assault in the coming months and choreographed the ‘pralaya nritya’ (dance of destruction) at Ayodhya in December 1992… The RSS, BJP, VHP and the Bajrang Dal leaders present in the meeting amply agreed to work in a well-orchestrated manner. The tapes of the meeting were personally handed over by me to my boss, I have no doubt that my boss had shared the contents with the prime minister (Rao) and the Home Minister (S B Chavan).There was silent agreement that Ayodhya offered “a unique opportunity to take the Hindutva wave to the peak for deriving political benefit.”

৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২, তিন শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলী মনোহর যোশী এবং বিনয় কাটিয়ারের উপস্থিতিতে বিতর্কিত পরিকাঠামোর ভেতরে সীমিত সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে ঢুকে পড়ল কয়েক হাজার উন্মত্ত কর সেবক। ধূলোয় গুঁড়িয়ে গেল প্রাচীন ঐতিহাসিক গর্বের স্থাপত্য। কর সেবকদের প্রকাশ্যে সেদিন অভিনন্দন জানিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের সরকার। মৌলবাদ মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসলো আরো একবার উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ভারতেও।

(প্রথম অর্ধ শেষ)

মেঘাচ্ছন্ন দিনের বিড়ম্বনা

4097

মেঘাচ্ছন্ন দিনে মেঘ হৃদয়ের
মেয়েকে জিজ্ঞেস করি
বৃষ্টির খবর। ঈশানে; রাজা প্রলয়
প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, মেঘের
জবাবের পুর্বেই তিনি
জোরেশোরে এসে পড়লেন।

প্রথম ধাক্কায় উড়ে গেল
কদলী বৃক্ষ। দাদাজানের
পুকুরে পাতা ছিল মৎস শিকারির
জাল; রাজা প্রলয় তার বুক
বিদীর্ণ করে পাশের বাড়ির
সফেদা গাছের সাথে কুস্তি
করলেন।

আমার প্রেমিকা শরীফা এহেন
কুস্তিতে আমোদ পেল। প্রলয়
যখন তাদের বাড়ি ছেড়ে পাশের
ক্ষেতে হামলে পড়েছে তখন
শরীফা সফেদা কুড়াতে যেই
বৃক্ষের নীচে এল; মেঘ জানালেন
প্রলয়ের পরে বৃষ্টি আসে।
শরীফা আমাকে বৃষ্টি নিমন্ত্রণ
জানাল।

আমি প্রেমিক হিসাবে লাজুক,
গড়িমসি করছি দেখে রাজা প্রলয়
পুনরায় ফিরে এলেন, ধাক্কা দিয়ে
বারান্দা থেকে উঠানে ফেলে
কোন কিছু বোঝার আগেই
লুঙ্গি খানা উড়িয়ে নিলেন।

এদেশ ওদেশ ১৭

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ সপ্তদশ পর্ব।)

“After giving careful and serious consideration to all the materials that are on record,the Commission is of the view that the RSS with its extensive organisation in jamshedpur and which had close links with the Bharatiya Janata Party and the Bharatiya Mazdoor Sangh had a positive hand in creating a climate which was most propitious for the outbreak of communal disturbances.

In the first instance, the speech of Shri Deoras (delivered just five days before the Ram Navami festival) tended to encourage the Hindu extremists to be unyielding in their demands regarding Road No. 14. Secondly, his speech amounted to communal propaganda. Thirdly, the shakhas and the camps that were held during the divisional conference presented a militant atmosphere to the Hindu public. In the circumstances, the commission cannot but hold the RSS responsible for creating a climate for the disturbances that took place on the 11th of April, 1979
— Jitendra Narayan in a report on Jamshedpur riots of 1979”

সভ্যতা এগিয়ে চলার গর্ব করেছে, আর পাশাপাশি সভ্যতাকে নগ্ন করার চেষ্টা হয়েছে বারবার। ওপরে উদ্ধৃত ১৯৭৯ সালে জামশেদপুরে ঘটিত দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত কমিশনের রিপোর্টের একটি অংশ। বারবার দেখা গেছে উস্কানি কখনো দেওয়া হয়েছে, আবার কখনো উস্কানি দেবার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। ভারতের প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সাধারণত মিলেমিশেই থাকেন। বহু জায়গায় মুসলমানেরা দুর্গাপুজো করেন যেহেতু এটা একটা অন্যতম বৃহৎ উৎসব। আবার মুসলিমদের বিভিন্ন পরবে অন্য ধর্মের মানুষ দাওয়াত রক্ষার জন্য যান। রাষ্ট্র শাসনের তাগিদে ইংরেজের ডিভাইড এন্ড রুলের শিকার হয়ে প্রাক স্বাধীণতা যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই দুই সম্প্রদায় প্রথম বিবাদে জড়িয়ে গেছিল। অথচ এর জন্য সাধারণ মানুষকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না। স্বাধীণতার হাত ধরেই এসেছিল সাম্প্রয়ায়িকতা। এসেই সে পাকাপাকি মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসল।

বিহারে জামশেদপুর রায়ট, ভাগলপুর রায়ট, ২০০২ এ গুজরাত রায়ট, একের পর এক সন্দেহ, অবিশ্বাস, নরমেধযজ্ঞ। আর বারবার প্রমাণিত হয়েছে এর পেছনে আছে মৌলবাদী আর এস এস এর পাকা মাথারা। অসংখ্য শিকড় ছড়িয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের। মুখ্য রাজনৈতিক মুখ হলো ভারতীয় জনতা পার্টি। এছাড়া, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ, ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ, ভারতীয় রেলওয়ে সঙ্ঘ, ফিশারম্যানস কো অপারেটিভ সোসাইটি, সংস্কার ভারতী, অধিভক্তা পরিষদ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, অখিল ভারতীয় শৈক্ষিক মহাসংঘ, ন্যাশনাল মেডিকোস অর্গানাইজেশন, অখিল ভারতীয় পূর্ব সৈনিক পরিষদ, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ, ভিত সলাহকার পরিষদ, লঘু উদ্যোগ ভারতী, সহকার ভারতী, দীনদয়াল শোধ সংস্থান, ভারতীয় বিকাশ পরিষদ, বিবেকানন্দ মেডিক্যাল মিশন, সেবা ভারতী, সক্ষম, নীলে, হিন্দু সেবা প্রতিষ্ঠান, লোক ভারতী, সীমা সুরক্ষা পরিষদ, রাষ্ট্রীয় সেবা সমিতি, শিক্ষা ভারতী, বজরং দল, ধর্ম জাগরণ সমিতি, মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ, হিন্দু মুন্নানি, হিন্দু রাষ্ট্র সেনা, একাল বিদ্যালয়, সরস্বতী শিশু মন্দির, বিদ্যা ভারতী, বিজ্ঞান ভারতী, বারানসী কল্যান আশ্রম, অনুসূচিত জাতি জমাটি আরক্ষণ বাঁচাও পরিষদ, ভারত-তিব্বত মৈত্রী সঙ্ঘ, বিশ্ব সংবাদ কেন্দ্র, হিন্দুস্তান সমাচার, ভারতীয় বিচার কেব্দ্র, হিন্দু বিবেক কেন্দ্র, বিবেকানন্দ কেন্দ্র, ইন্ডিয়া পলিসি ফাউন্ডেশন, ভারতীয় শিক্ষণ মন্ডল, অখিল ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনা ইত্যাদি শাখা সংগঠন মাটির তলায় শিকড়ের মত ভারতের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। একযোগে যখন গোয়েবলসীয় কায়দায় এই এতগুলি সংগঠন কোনো প্রচার চালায়, তখন আম অশিক্ষিত আদমির মাথায় তার গ্রহনযোগ্যতা বিচারের কথা মাথায় আসেনা। ফলে দাঙ্গার আগুন জ্বালানো এখানে খুবই সহজ কাজ, যা উপমহাদেশের সব দেশেই বারবার দেখা গেছে।

২০০২ এর গুজরাত দাঙ্গা সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য কখনোই বাইরে আসেনি। শুধু সরকারি পরিসংখ্যান থেকেই যা জানা যায় তাতে মেরুদন্ডে বরফের স্রোত বইয়ে দিতে যথেষ্ট। ২৭শে ফেব্রুয়ারী অযোধ্যা থেকে আগত করসেবক ভর্তি ট্রেনে আগুন লাগায় পুড়ে মারা যান ৫৮ জন নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা করসেবক। আগুন জ্বলে ওঠে সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ইন্ধন যোগানে। দাঙ্গা লাগে, মারা যান দুই সম্প্রদায়ের ১০৩৪ জন, আহত ২৫০০, নিখোঁজ ২২৩। অন্যান্য সূত্রের খবর শুধু মারাই গেছিলেন প্রায় ২৫০০ মানুষ। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল শিশুদের, হয়েছিল অসংখ্য ধর্ষণ। এই রায়টের পরিপ্রেক্ষিতে অসংখ্য মামলা হয়েছিল। যার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মামলা হল, বেস্ট বেকারি মামলা, বিলকিস বানু মামলা, অবধূতনগর মামলা, দানিলিমদা মামলা, এরাল মামলা, প্রভাগড় ও ধিকভা মামলা, গোধরা ট্রেন মামলা, দীপদা দরওয়াজা মামলা, নারোদা পাটিয়া মামলা, পেরজুরি মামলা, কৌশরবানু গণ ধর্ষণ মামলা ইত্যাদি।

(আবার আগামী কাল)

স্বপ্ন

2822aa

স্বপ্নদের কোনো ডানা নেই, তারা উড়তে পারে না। তাদের তাড়িয়ে নিতে হয় পুব থেকে পশ্চিমে। মুখোমুখি ডুবতে চাওয়া সূর্যের দিকে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে, একঝাঁক চড়ুইয়ের মতো ব্যস্ততা নিয়ে।

চিবুকের চিঠিতে রাখা আছে এক কল্প ছবি। স্বপ্নরাজ্যে মেঘ-বাতাসের ভেজা শিমূলের ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে উপোসী অধর। ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো স্রোতহীন চোখ গুনে যায়, সাগর জলে ঢেউয়ের পরে ঢেউ। অপেক্ষায় থাকে, হয়তো একদিন, ডুবতে চাওয়া সূর্যের দিকে অপলক তাকিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াবে স্বপ্নেরা।

অপেক্ষার রঙ নীল। অপেক্ষা বুক জুড়ে, উঠোন জুড়ে।

*****
সামান্য চেষ্টা আমার তুলিতে।

এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে… বলিভিয়ার পথে…

28202

উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে ১৮ জন যাত্রী নিয়ে বাসটা নড়তে শুরু করল শেষ পর্যন্ত। স্বস্তির পাশাপাশি এক ধরনের নীরবতা গ্রাস করে নিলো বাসের পরিবেশ। কারও মুখে কথা নেই। সবাই ক্লান্ত এবং সামনে কি অপেক্ষা করছে এ নিয়ে চিন্তিত।

প্রায় ৫ ঘণ্টার জার্নি। কথা ছিল সকাল ৮টায় পুনো হতে রওয়ানা হয়ে দুপুরের খাবার খাব লা-পাস গিয়ে। হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম। সকাল ১১টা। সবকিছু ঠিক ঠাক চললে বিকাল ৪টার ভেতর লা-পাস পৌঁছাবার কথা। মনে মনে হিসাব কসে সিদ্ধান্ত নিলাম একটু দেরী হলেও গন্তব্যে পৌঁছেই লাঞ্চ করব। সাথে ক’টা আপেল, কলা এবং দু’বোতল পানি আছে, চলে যাবে আপাতত।

বাসে হিটার চালু আছে, পরনের গরম কাপড় খুলে হল্কা হয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টি হতে মিলিয়ে গেল সীমান্ত শহরটা। যানবাহন আর মানুষের এলোমেলো চলাফেরা বদলে দিল এন্ডিসের সুশৃঙ্খল চূড়াগুলো। পাহাড় আর পাহাড়! কোল ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। মাঝে মধ্যে ভূতের মত উদয় হচ্ছে দু’একজন আন্ডিয়ান তরুণ-তরুণী। হাতে চাষাবাদের যন্ত্রপাতি। কৃষিকাজ হচ্ছে হয়ত কোথাও। কিন্তু যতদূর চোখ যায় লোকালয়ের কোন চিহ্ন দেখা গেলনা।

আকাশটাকে আজ একটু বেশী রকম নীল মন হল। ভার্টিকেল এঙ্গেলে চোখ ঘোরালে শূন্যে উড়ে যাওয়া চিল গুলোকে মনে হবে স্থির হয়ে উড়ছে। দু’একটা চিল মাঝে মধ্যে গোত্তা মেরে নীচে নামছে শিকারের ধান্ধায়। রাস্তার সমান্তরালে বয়ে যাওয়া নদীটার দু’পাশে হঠাৎ করে আবাদি জমির উদয় হল। আলু, পেয়াজ আর ভুট্টার খণ্ড খণ্ড জমি। গাছের খোল ব্যবহার করে নদী হতে পানি উঠানোর ব্যবস্থা মনে করিয়ে দেয় জীবন এখানে বয়ে যাওয়া নদীর মত অত সহজ নয়। প্রতি খণ্ড চাষাবাদের পেছনে নিশ্চয় লুকিয়ে আছে পাহাড়ি মানুষের খেটে খাওয়া জীবনের দীর্ঘশ্বাস।

নেশা ধরে আসে প্রকৃতির এই অন্তহীন ক্যানভাস একাধারে গিলতে গেলে। বাসের একটানা যান্ত্রিক শব্দে তন্দ্রা-মত এসে গেল। সকালে ঘটে যাওয়া উটকো ঝামেলা গুলো এ ফাকে মাথা হতে নেমে গেল। পাশে বসা বিপদজনক সুন্দরীকেও এন্ডিসের বিশালতার কাছে ছোট মনে হল। গাঁটের পয়সা খরচ করে এতদূর এসেছি এন্ডিসের সান্নিধ্য পেতে, স্থানীয় মানুষ এবং তাদের জীবনের সাথে পরিচিত হতে। সে দিকে মনোনিবেশ করে ভুলে গেলাম সুন্দরীর উপস্থিতি।

এন্ডিস! শব্দটার ভেতর লুকিয়ে আছে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা সাথে অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার স্বপ্নিল হাতছানি। পাহাড় পর্বত ঘুরে বেড়ানো যাদের নেশা তাদের ধমনীতে এই নামটা এক ধরনের কম্পন তৈরি করে, যার উৎপত্তি প্রকৃতির প্রতি অকৃপণ ভালবাসা হতে। এন্ডিসের উপর শত শত বই, আর্টিকেল এবং ডকুমেন্টারি দেখেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করেছি এর কাব্যিক কল্পনায়। কিন্তু চোখে দেখার কাছে এগুলো এ মুহূর্তে অর্থহীন মনে হল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া রাস্তাটার বর্ণনাও মনে হল বই, আর্টিকেল অথবা ডকুমেন্টারিতে জীবন্ত করতে পারেনি। বাইরের স্তব্ধতাকে মনে হল অতি যত্নের সাথে কেউ লালন করছে হাজার বছর ধরে। পাহাড়ের চূড়া গুলোকে মনে হবে নীরব সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে কোটি বছর উপর। কোন একটা চূড়ায় উঠে চীৎকার দিলে হয়ত শত শত প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে, ভাঙবে সহস্রাব্দের ভৌতিক নীরবতা।
আমাদের বাসটা উঁচু নিচু এবং আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে ছুটে চলল প্রচণ্ড গতিতে।

’তুমি কি একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছ?’ ভিক্টোরিয়ার প্রশ্নে ছুটে গেল তন্দ্রা। নতুন কোন সমস্যার প্রসঙ্গ টানতে যাচ্ছে সে, গন্ধ পেলাম গলার সতর্ক সূরে।
’পাহাড় ছাড়া এ মুহূর্তে অন্যকিছু লক্ষ্য করছি না আমি’, অনেকটা তিরিক্ষি মেজাজে উত্তর দিলাম। উত্তরে সে যা বলল তা সত্যি ভাবিয়ে তুলল আমায়।

দু’লেনের রাস্তা, অথচ যানবাহন চলছে শুধু এক লেনে। অর্থাৎ বিপরীত দিক হতে কোন গাড়ি আসছে না। ভিক্টোরিয়ার ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। বাংলাদেশের মানুষ আমি। কিছুদিন আগে হাসিনার লাগাতার পর্ব ’উপভোগ’ করে এসেছি মাত্র। পূর্বাভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি, সামনে সমস্যা। আকাশের পাখী গুলোকেও দেখলাম শুধু একদিকে উড়ে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। অন্য যাত্রীদেরও দেখলাম নড়েচড়ে বসতে।

কৌতূহলী হয়ে উঠছে সবাই। দূর হয়ে যাওয়া উৎকণ্ঠা গুলো বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে এলো নতুন করে। ছোট দু’একটা পাথর দিয়ে শুরু। কিছুদূর যেতেই বাড়তে থাকল পাথরের সংখ্যা এবং এর আকৃতি। নিবিড়ভাবে বিছানো আছে সমস্ত পথজুড়ে। যেন বিশাল আয়তনের শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু তাতে বাসের চাকা বিশেষ কোন বাধা পেলনা। এগুতে থাকলাম আমরা।
বিশাল একটা বাঁক পেরুতেই দৃশ্যটা ভেসে উঠল দিগন্ত রেখায়।

হাজার হাজার গাড়ি। যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। থেমে আছে লাইন ধরে মাইলের পর মাইল। ছোটখাটো পাথর নয়, বিশাল আকারের বোল্ডার দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে পথ। এক কদম সামনে বাড়ার উপায় নেই। আমাদের যমজ বাসটা পেছনে এসে হুমড়ি খেয়ে থেমে গেল। সোজা কথায় আটকে গেছি আমরা। এন্ডিসের এই গহীন রাজ্যে জিম্মি হয়ে গেছি গরীব দেশের গরীবিপনার কাছে।

আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সবার মাথায়। আবারও আমার মাথা জুড়ে পুরানো চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে শুরু করল, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়াকে দেখে মনে হল বেশ উপভোগ করছে সে নতুন বাস্তবতা। ‘আমি জানতাম এমনটা হবে, এ জন্যেই এদিকে আসা’, উৎফুল্ল হয়ে জানাল সে। কথা বলে জানা গেল ওকালতির পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে বই লিখছে। এ অঞ্চলে ভেনেজুয়েলান নেতা হুগো সাভেজের প্রভাব তার আগ্রহ। বলিভিয়ায় এবো মরালেস নামের নতুন এক নেতার উত্থান হয়েছে, যে আদর্শ হিসাবে বেছে নিয়েছে হুগো সাভেজের কথিত সমাজতান্ত্রিক পথ। তার উত্থানকে কাছ হতে দেখার জন্যেই এই জার্নি।

উদ্ভট পোশাক দেখে মেয়েটা সম্পর্কে আজেবাজে ধারণা করায় নিজকে অপরাধী মনে হল এ মুহূর্তে। ’চল সামনে গিয়ে দেখে আসি’, আহ্বান জানাল সে। বাসের ট্যুর গাইড ইতিমধ্যে সাবধান করে দিয়েছে এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চার হতে দূরে থাকতে।
’চল’, সায় দিয়ে নেমে পরলাম বাস হতে। সাথে যোগ দিল আরও গোটা তিনেক সহযাত্রী।
চারদিক চোখ বুলাতেই কেন জানি ঢাকার কথা মনে হয়ে গেল। রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে আটকে একদিন ৫ ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল কাঁচপুর ব্রিজের উপর। সামনে শেখ হাসিনার সমর্থনে মিছিল, কিছুক্ষণ পর শুরু হল ধাওয়া আর পালটা ধাওয়া, সাথে নির্বিচার ভাংচুর।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই।

এন্ডিসের শোঁ শোঁ বাতাস আর চোখে মুখে শীতের কনকনে ঝাঁপটা ফিরিয়ে আনল কঠিন বাস্তবতায়। হঠাৎ করে কেন জানি গান গাইতে ইচ্ছা করল আমার, প্রিয় সেই গানটা; ’নাই টেলিফোন নাইরে পিওন নাইরে টেলিগ্রাম…।

ভিক্টোরিয়া ফিস ফিস করে বলল, ‘মন খারাপ করে লাভ নেই, বরং উপভোগ কর যা দেখছ, এমন অভিজ্ঞতার সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়টা নাও আসতে পারে‘।

বয়স বাড়ছে

28074

দিন যাচ্ছে তো হুহু করে বয়স বেড়ে যাচ্ছে
মাথার কালো চুলগুলো সাদা হয়ে যাচ্ছে
কিন্তু বয়স বাড়ছে তো বাড়ছেই।

দেখেছিলাম দুধদাঁত পড়ে নতুন গজাচ্ছে
বয়স বাড়ার সাথে এগুলোও পড়ে যাচ্ছে
কিন্তু বয়স বাড়ছে তো বাড়ছেই।

যৌবন কালের শারীরিক শক্তি কমে যাচ্ছে
ভালো খাবার খেলেও নিঃশক্তি মনে হচ্ছে।
কিন্তু বয়স বাড়ছে তো বাড়ছেই।

শরীরের টানটান চামড়ায় চর পড়ে যাচ্ছে
চোখের দৃষ্টিও দিনদিন যেন কমে যাচ্ছে
কিন্তু বয়স বাড়ছে তো বাড়ছেই।

শরীরের পশমগুলো সাদা হয়ে যাচ্ছে
পশমের সাথে ভ্রূ গুলোও সাদা হচ্ছে
কিন্তু বয়স বাড়ছে তো বাড়ছেই।

খাবারের তালিকা থেকে কিছু বাদ হচ্ছে
পেটের ক্ষুধাও দিনদিন যেন কমেই যাচ্ছে
কিন্তু বয়স বাড়ছে তো বাড়ছেই।

আত্মীয় স্বজনদেরর ডাকাডাকি কমে যাচ্ছে
সহধর্মিণীও দিনদিন অবহেলার ভাব দেখাচ্ছে
কিন্তু বয়স বাড়ছে তো বাড়ছেই।

.
ছবি: নারায়ণগঞ্জ পৌর শ্মশান ও পৌর গোরস্থান।

এদেশ ওদেশ ১৬

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ ষোড়শ পর্ব।)

ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জোর গলায় গণতন্ত্রের কথা বলে এসেছেন অথচ তারপরেই ধর্ষিত হয়েছে সেই গণের জন্য, গণের দ্বারা, গণের কৃত তন্ত্র। পীড়িত নাগরিকের কাছে মূলত ক্ষমতা থেকে ক্ষমতার পরিবর্তনের সময়েই গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। আর গণতন্ত্রের ছত্রছায়াতে নিঃশব্দে রোপিত হয়েছে বিষবৃক্ষ। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে স্ব উদ্দেশ্য সিদ্ধির মারপ্যাঁচ এতটাই জটীল অঙ্ক যে তার জট খুলতে তাবড় চিন্তাবিদও হিমসিম খেয়ে যান।

১৯১০, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে, মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে এক তরুন কলকাতায় এলেন চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। কলকাতায় তিনি থাকতে শুরু করলেন শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী নামে জনৈক তরুনের বাসায়। এই শ্যামসুন্দর ছিলেন তৎকালীন সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির সদস্য। স্বভাবতই মারাঠী আকৃষ্ট হলেন সশস্ত্র বিপ্লবের আদর্শে। সান্নিধ্যে এলেন বিখ্যাত বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের। ডাক্তারী পড়া শেষে নাগপুরে ফিরে যাওয়ার পরে কিছুদিন সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ইস্তফা দিয়ে ২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৫ বিজয়া দশমীর দিন রোপণ করলেন এক চারাগাছ, পরবর্তীতে যা মহীরুহ হয়ে ঘন অন্ধকারের সৃষ্টি করল। সেদিনের সেই মারাঠী তরুনের নাম কেশব বলীরাম হেডগেওয়ার, আর সেই চারাগাছটি হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।

ভয়ংকর অদ্ভুত উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচারক এই দল, প্রথম থেকেই নিজেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে মান্যতা দিতে অস্বীকৃত হয়েছে। অথচ প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মসূচীকে সমর্থন এবং অংশগ্রহণ ছিল সঙ্ঘের অন্যতম কাজ। অর্থাৎ এই সময়ে এই সংগঠনের ভয়ংকর উগ্র হিন্দুত্ববাদকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রসারিত করছিল কংগ্রেস। অপরদিকে মুখে রাজনৈতিক অচ্ছুত বললেও কং রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম কে কাজে লাগিয়ে বড় হচ্ছিল বিষবৃক্ষ। মধুচন্দ্রিমা শেষ হল ১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই সরাসরি অ্যাডলফ হিটলারকে সমর্থন করে বসল সঙ্ঘ। হিটলারের বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করল তারা। মজার ব্যাপারটা হল, এই সঙ্ঘই আবার অপরদিকে ছিল প্রবল ইহুদী সমর্থক, যারা আবার কিনা ছিল হিটলারের শত্রু। এই দ্বিচারিতার মধ্যেই প্রথমবার নিষিদ্ধ হল এই সংগঠন।

দ্বিতীয়বার এই সংগঠন নিষিদ্ধ হল ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮ এ, বহু মহারথীর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে সঙ্ঘের এক সদস্য নাথুরাম গডসে প্রকাশ্য প্রার্থনা সভায় যখন গুলি চালিয়ে খুন করলেন মোহনদাস করমচন্দ গাঁধি কে। এই হত্যার পেছনে প্রকাশ্যে যে মত প্রচারিত হয়েছিল, তা হল গাঁধির মুসলমান তোষণ, কিন্তু প্রচ্ছন্নে ছিল আরো মস্তবড় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের খেলা, যা বোঝার ক্ষমতা নাথুরাম সমেত বিরাট অংশের ক্যাডারদের তথা অশিক্ষিত ভারতবাসীর ছিল না।

এই উগ্র সঙ্ঘ কেই ভারত সরকার বারবার ডেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সঁপেছে। ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৭১ বারংবার কখনো আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, কখনো রাজধানীর যান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, কখনো গুরুত্বপূর্ণ প্যারেডে অংশগ্রহণ করার জন্য সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছে এঁদের। আবার মতের অমিল হলে নিষিদ্ধকরণও হয়েছে বারবার। তৃতীয় দফায় সঙ্ঘ নিষিদ্ধ হল জরুরী অবস্থার সময়ে অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একসারিতে। আর চতুর্থতম নিষিদ্ধকরণ তো এখন ইতিহাস।

কালো ছায়া ঘনিয়ে উঠছিল এক ভয়াবহ বিতর্কে। সেই প্রাগৈতিহাসিক রামের জন্মের স্থান নিয়ে ইচ্ছাকৃত বিতর্ক তুলে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় জানপ্রাণ লড়িয়ে দিল সঙ্ঘ ও তার সহযোগী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি। হিন্দু সমর্থন হারানোর আশংকায় ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকা নিল তৎকালীন কংগ্রেসী নরসীমা রাও সরকার। প্রচার তুঙ্গে তুলে ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২ সকালেই হামলা হল উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ওপর। বাবরের আমলের ঐতিহাসিক স্থাপত্য ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল অন্ধ মৌলবাদের হাতুড়ির আঘাতে। আজকের সিরিয়ায় বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপত্যের ওপরে মৌলবাদী সংগঠন যে অন্ধ আঘাত করে চলেছে, সেদিনের বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে তার কোনো পার্থক্যই ছিল না। সমগ্র উপমহাদেশে সেদিন সূর্য ওঠেনি, সকাল হয়নি, মানুষ পিছিয়ে গেছিল ফের অন্ধকার যুগে। লজ্জায় মুখ ঢেকে ছিল সভ্যতা।

(আবার আগামীকাল)