বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

মুক্তিযোদ্ধা আলীম ভাই

mithuu মুক্তিযোদ্ধা আলীম ভাই আমাদের খুব ভালো বন্ধু। পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, থাকেন আমাদের শহর থেকে তিরিশ মাইল দূরের আরেক শহরে। সপ্তাহে কমপক্ষে দুই দিন আলীম ভাই আমাদের বাড়িতে আসেন। আমার উত্তমকে তিনি রঞ্জুদা ডাকেন, আমাকে মিঠু। খুব সহজ সরল মনের এক মানুষ আলীম ভাই, আমাদের বাড়িতে আসলেই নাকি উনার মনে হয়, আপন ভাইয়ের বাড়িতে এসেছেন। রঞ্জুদার সাথে বসে রাজনীতির গল্প, অর্থনীতির গল্প করেন, টিভি তো চলতেই থাকে, খুব ভালো মুভি থাকলে একসাথে দেখেন। দেশী খাবার, দেশী ভাষায় গল্প চলতেই থাকে। আমি উনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো শুনি। আমার লেখা ” চোখ যায় যদ্দুর’ বইটায় উপহার বাণীতে উনাকে মুক্তিযোদ্ধা সম্বোধন করেছিলাম, খুশীতে আলীম ভাইয়ের চোখে জল চলে এসেছিলো।

আমাদের বাড়িতে আলীম ভাই সকালেই আসুন অথবা বিকেলে, সন্ধ্যেবেলাটা উনি মিস করেন না। কারণ সন্ধ্যেবেলায় আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে প্রদীপ আর ধূপকাঠি হাতে সারাবাড়িতে সন্ধ্যাবাতি দেখাই। আমাকে এই সাজে নাকি খুব পবিত্র স্নিগ্ধ মমতাময়ী মায়ের মতো দেখায়। সারা ঘরে বাতি দেখানোর পর প্রদীপ আলীম ভাইয়ের সামনে নিয়ে ধরতে হয়, আলীম ভাই দুই হাত উপুর করে প্রদীপের শিখায় হাত দুটো বুলিয়ে তা নিজের মাথায় আর গায়ে মাখেন। এটা উনি করবেনই, আমি একবার ভুল করে প্রদীপ উনার কাছে না নিয়েই ঠাকুরঘরে ফিরে যাচ্ছিলাম। আলীম ভাই আমার নাম ধরে ডেকে বললেন, মিঠু আজ তো আমি প্রদীপের আলো পাইলাম না!

সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে সারাবাড়ি আলো দেখানোর এই দৃশ্যটা নাকি আলীম ভাইকে উনার শৈশবে টেনে নিয়ে যায়। উনার ছেলেবেলায় উনার নানীকে, আম্মাকে দেখেছেন মাথায় কাপড় দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় বাতি জ্বালিয়ে সারাবাড়ি দেখাতেন। আর উনাদের প্রতিবেশী হিন্দু বাড়িতে দেখতেন, মাসিমা কাকিমারা প্রদীপের শিখা বাচ্চাদের মাথায় গায়ে বুলিয়ে দেয়। আলীম ভাইয়ের কাছে এই দৃশ্যটা খুব ভালো লাগতো। আমাকে সন্ধ্যাবেলায় এই সাজে দেখে উনার ছেলেবেলার নানী আম্মা মাসিমা কাকিমাদের কথা মনে পড়ে!

গতকালও আলীম ভাই এসেছিলেন দুপুরের আগে রঞ্জুদার সাথে দেখা করতে। রঞ্জুদা কোলোনোস্কোপি করিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তাই রঞ্জুদার শরীর কেমন তা দেখতে আসা। এসেই বললেন, আরে আমার রঞ্জুদা তো একদম ফিট আছে। চলেন রঞ্জুদা, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমরা আজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে আসি। আমি বললাম, আলীম ভাই, আমি তো পেঁয়াজ দিয়ে৷ চিনিগুড়া চাল আর মুসুরের ডালের খিঁচুড়ি রেঁধে ফেলেছি, আলুভাজা ডিমভাজা দিয়ে খিঁচুড়ি খান। রেস্টুরেন্টে অন্য একদিন খাওয়া যাবে। আইটেমের নাম শুনেই আলীম ভাই আবার শৈশবে চলে গেলো। আরে মিঠু, আমার আম্মা মুসুরের ডাইলের খিঁচুড়ি রানতো, সাথে ডিম ভাজা। আহা, অমৃত।

তারপর যথারীতি সন্ধ্যা হয়ে এলো, আমি পূজার পোশাক পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে সারা বাড়ি দেখিয়ে আলীম ভাইয়ের সামনে প্রদীপ ধরলাম। আলীম ভাই প্রদীপের শিখা মাথায় গায়ে মেখে বললো, আচ্ছা মিঠু, আমার আম্মা খালা নানীকে দেখেছি সন্ধ্যার আগেই কাপড় পালটে ঠিক এমন করেই ঘোমটা দিয়ে অজু করে নামাজ পড়তে বসতো। আপনি তো আধুনিক যুগের মেয়ে, আপনিও সন্ধ্যার পূজার সময় মাথায় ঘোমটা দেন, তার মানে হিন্দু মুসলমানের একই নিয়ম? দুই ধর্মেই মাথায় কাপড় দিতে হয় সবাইরে?

বললাম, ধর্ম দুইটা হলে কি হবে, মাথায় কাপড় দিয়ে যাঁরে স্মরণ করি, তিনি তো এক এবং অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা। আমরা দুই ধর্মের মানুষেরা নিজেরা কাইজ্জা ঝগড়া করে তাঁরে দুই নামে ডাকি। তাতে তো উনার শ্রেষ্ঠত্ব দুই ভাগ হয় না। দিনের একটা সময়ে তো দুই ধর্মের মানুষই আল্লাহ আর ভগবান নামের একই সৃষ্টিকর্তার কাছে মাথা নত করে কিছু সময়ের জন্য আত্মনিবেদন করে। সারাদিনের করা ভুল ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চায়, সকলের মঙ্গল কামনা করে। আসলে সৃষ্টিকর্তার ঊদ্দেশ্যে মাথা নত করার সময় মাথায় ঘোমটা দিতে হয় চুলগুলো ঢেকে রাখার জন্য, নইলে মনটাকে পুরোপুরি সঁপে দেয়া যায় না, মাথার চুল মুখের সামনে পিছনে এসে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়।

এই জন্যই হিন্দু মুসলমান সকল নারীই সন্ধ্যাবেলা আরাধনা অথবা নামাজ পড়ার সময় মাথায় ঘোমটা দেয়, অই সময়ে তাদের দিকে তাকালে আপনার মতো অনেকেরই মনটায় পবিত্র বোধ হয়। আলীম ভাই শুধু বললেন, ফ্যানটাসটিক। দারুণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চলেন, তাইলে কালকেই রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, নেপালি রেস্টুরেন্টে।

বললাম, আলীম ভাই, আমাকে এই সাজে দেখলেই আপনার আম্মার কথা মনে পড়ে। আগামী রবিবার মাদার’স ডে। রবিবারেই বরং রেস্টুরেন্টে খাওয়ান, একজন মা হিসেবে নিজেকে সম্মানিত বোধ করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না।

স্মৃতি হলো জীবনের মধুরতম দিশা

স্মৃতি ভালোবাসা ও জীবন নিয়ে ৪টি উদৃতি যা আপনার ধারণাকে পরিবর্তন করতে পারে।

১. “স্মৃতি হলো জীবনের মধুরতম দিশা যা আপনাকে পথ দেখায়, এবং কোন কোন সময় স্মৃতিই আপনার আত্মার আলোকিতকারী এবং হৃদয়ের আনন্দদায়ক। তাই তাদের লালন করুন, তাদের কাছে রাখুন এবং তাদের কখনই ম্লান না হতে দিন। কারণ তারাই আপনার অস্তিত্বের অনু স্মারক।”

২. “স্মৃতি হল সেই ধন যা আমরা সারা জীবন আমাদের সাথে বহন করি, তারা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা কে, আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং আমরা যাদের ভালোবাসি। আমরা যতই দূরে যাই না কেন বা কতটা সময় কেটে যায়, আমাদের স্মৃতি সব সময় থাকবে সেখানে আমাদের বাড়ি ফেরার পথ দেখাতে।”

৩. “ভালোবাসা হল আলো যা আমাদের অন্ধকার দিনগুলিকে উজ্জ্বল করে, উষ্ণতা যা আমাদের শীতলতম রাতগুলোকে পূর্ণ করে, এবং নোঙ্গর যা আমাদের জীবনের ঝড়ের মধ্য দিয়ে ভিত্তি করে। এটি এমন একটি শক্তি যা সময় এবং স্থান অতিক্রম করে এবং যখন আমরা এটি খুঁজে পাই, আমরা এটি ধরে রাখি আমাদের সমস্ত হৃদয় দিয়ে, কারণ এটি সকলের সবচেয়ে বড় ধন।”

৪. “জীবন হলো একটি বহুমুখী যাত্রা, এবং স্মৃতিগুলি হলো তার মধ্যে মাইলফলক যা আমাদের পথকে চিহ্নিত করে৷ এর প্রতিটি বিষয় ও বস্তু’কে লালন করুন, কারণ তারা সেই ভালবাসা, আনন্দ এবং সৌন্দর্যের মূল্যবান অনু স্মারক যা আপনার পথকে প্রশংসিত করেছে৷”

মরা ব্যাঙের নাচ

মাঝে মাঝে আমায় বোবায় পায় বলে বাক্যি হরে যায়। মুখে তখন একটা অদৃশ্য ‘কালা হাতে’র মতো সেলোটেপের অস্তিত্ব টের পাই, আর বুকের উপর দিয়ে গোদা পায়ে কেউ নির্ঘাত হেঁটে চলে যায়। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তরে একখানা অক্ষর পর্যন্ত মুখের পেট থেকে খসাতে যন্ত্রণা ও চরম অনিচ্ছা। ফলত অন্তর্জলি যাত্রায় বসা লোককে গঙ্গোদক দেবার সময় যেমন নূন্যতম ঠোঁট ফাঁক করে ঢেলে দেওয়া হয়, আমিও তেমনি আধমরা ঠৌঁট ফাঁক করে উত্তর দেব দেব করতে করতেই টাইম আপ! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই আমি আসলে মুখ ভেটকে গেলাস ভর্তি নিমপাতার রস গেলার মতো একটা এক্সিসট্যান্স। সুতরাং কথা খরচ করতে হলে আমি একেবারেই নাচার।

একই অবস্থা হয় লেখার বেলাতেও। একখানা অক্ষর লিখতেও আঙুল চলে না। খাতায় কলমে লেখা তো কবেই বিগত শতাব্দীর গোলাপফুল আঁকা মরচে ধরা তোরঙের মতো গতায়ু হয়ে চিলেকোঠার ঝুল ধুলোয় কিছুটা কেতড়ে পড়ে আছে। তার উপর ঠাকুমার গায়েহলুদে পাওয়া মাদুরখানা কাঠি ও সুতোর বাঁধন আলগা হয়ে গুটনো আছে মণখানেক ধুলো মেখে। তাকে দেখে মনে হবে একদা অষ্টাদশী বিয়ের কনেটি রূপ-যৌবন ও তৎসহ পেশিটেশি হারিয়ে ঝুল, মানে ঝুলঝুলে চেহারাপ্রাপ্ত। খাতা-কলম জিনিস দুটোর এখন অনেকটা সেই দশা। কেবল মাঝে মাঝে সরকারী ফাইলের অন্তবিহীন গতিহীন লাইনে লাইন লাগানোর জন্য দরখাস্ত-টরখাস্ত লিখতে দরকার লাগে। তো লিখতে ইচ্ছে করে না যেমন তেমন বিষয়, তার থেকেও বড়ো কথা হলো মনে হয় যেন লিখতেই পারব না। – আমি লিখতে জানিই না – কোনো দিন লিখিইনি! এসব ভাবনার পাশাপাশি প্রচন্ড একটা ভয় জেঁকে বসে।

ধরুন, আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। বড়দি ক্লাসে ঢুকছেন, এক্ষুণি রেজাল্ট ঘোষণা হবে। আর ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। মানে চোখ মাথায় উঠে গিয়ে মাথা লাট্টুর মতো ঘুরছে আর থেকে থেকে দ্যাখ বাবাজী দেখবি নাকি করে চোখের সামনে অন্ধকারের ভেতর বিদ্যুত ঝিলিক মারছে। কারণ আমি তো জানি, কী হতে চলেছে! ক্লাস ফাইভে অঙ্কে ছিলাম গ্যালিলিওর জ্যাঠাইমা। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে ঘন্টা পড়ার দশ মিনিট আগে হল থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং অনেক হিসেব করে আমার ধারণা দৃঢ় হলো অঙ্কে চব্বিশ পাবো। কিন্তু সবথেকে বড়ো ট্রাজেডিটা হলো, অঙ্কে মেরেকেটে তিরিশ পেলেও আমি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে গেঁটিয়ে বসতে পারতাম। কেন, কীকরে সে অন্য গপ্প। তো বারফাট্টাই থাক। বড়দি তো রেজাল্ট বলছেন, – বলছেন – ভালো ভালো রেজাল্ট বলা হয়ে গেল, নিজের নামটা কানে শুনলাম না। নাকি নিজের নামটাই ভুলে গেছি রে, বাবা! তাহলে কি আমার ধারণাই ঠিক? টেনশনে নন-সেন্স হবার মুখে প্রায় সব শেষে একটা বিষয়ে ফেল মেরে উত্তীর্ণ হবার ঘোষণায় আমার নাম এক্কেবারে পেত্থমে! হুঁ হুঁ বাবা! এরপরের ঘটনা ইতিহাস। অঙ্ক শিখি যে কাকুর কাছে তাঁর কাছে যথেষ্ট পরিমাণে উত্তমমধ্যম খেয়ে মুখের ভূগোল পাল্টে গেল বটে, ক্লাস সিক্সে কিন্তু এ শম্মাই অঙ্কে হায়েস্ট নম্বর পেল এটাও মনে রাখবেন! তবে জীবনে ওই একটিবার। তারপর মাধ্যমিক পর্যন্ত ঘষটে ঘষটে মাজা ব্যথা নিয়ে অঙ্ক টপকেছি।

কিছু মনে করবেন না, এক কথা বলতে বসে অন্য কথায় কিস্যা বহুদূর চলে এলো। একেবারে “শিবেরগীত” শেষ করে বাঁকের মুখ থেকে ফেরৎ আসছি। যা বলছিলাম, লেখার ভয়ে তো হার্টবিট মাথায় ফিল করি আমি। নানা জায়গাতেই ফিল করি, এমনকি যেখানে হার্ট আছে তার ঠিক উল্টো দিকেও ঢিপ ঢিপ করে। মানে বাম দিকের বুকের পাঁজর পার করে পিঠের দিকে হার্টবিট চলে।

দূর ছাই! আবার ফালতু বকছি! বলছিলাম লেখা ও কথা মাঝে মাঝে মনের ভেতর হুুড়কো লাগিয়ে অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকে। সন্দেহ হয়, অ্যালঝাইমার হলো নাকি! একটা শব্দ, একটা ইনিয়ে বিনিয়ে বাক্য – কিচ্ছু মনে পড়ে না মাইরি! অথচ বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে লিখেছিলেন – ঐক্য বাক্য মাণিক্য। কিন্তু আমার তো সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হার্ট ফুসফুস কিডনি মগজ – সব ছতিচ্ছন্ন। সুতরাং ঐক্য ও বাক্যের হাত ধরাধরি প্রেমের মাণিক্য আসবে কোত্থেকে?

অথচ কথার চাষ চলছে দুনিয়াময়। কত ধরনের কথা। রূঢ়, প্রেমময়, স্নেহময়, তৈল নিষিক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খুব ভালো উপলব্ধি হয় উক্ত ধরনগুলি। আর দরকারী কথা বাদ দিয়ে ফালতু কথায় তীরের মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে, না-কে হ্যাঁ, আর হ্যাঁ-কে না, দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারে এমন এলেমদার কি কম পড়েছে? রাজনীতির লোকেরা আছেন তো! পড় পড় পড় পড়বি পাখি ধপ! – চোখ সরু করে মনে মনে বীজমন্ত্র আওড়ালেও, পাবলিক প্লেসে কথা বলার সময় সাধারণত কপালের চামড়ায় ইস্ত্রি মারা থাকে।

আর যারা কথা বেচে খান, সে সেক্টরটাও নেহাৎ কম যায় না। কাউকে একটুও ছোট করার নটখটামি না করেই হাত তুলছি, ছাড়ুন তো – কথা বেচতেও “এলেম” লাগে আগেই বলেছি! সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে। কত সূক্ষ্ম হিসেব কষতে হয় বলুন তো? দল, অর্থ, টিআরপি, কাকে চটাবে, কাকে রাখবে – তেমন তেমন ঘটনা ঘটে গেলে অচানক চানক্যবাজি সহজ নয়। আরও আছে, শুধু ওরাই যে নন সে যে বাপু আর বলে দিতে হবে না, তা আপনারা খুব ভালো করেই জানেন।

দুঃখ হচ্ছে, “কথা বেচে খাওয়া” লোকজনের কথা বাদ দিলে কথার চাষ অধিকাংশ সময় শব্দদূষণ ছাড়া কিছুই করে না। কারণ ঠিক কথাটা ঠিক সময়ে আমরা সম্মিলিতভাবে বলতে পারি না। হয়তো বা বলতে চাইও না। ছা-পোষা মানুষ আমরা, বাঁশ খেতে চাই না, বড়ো ভয় পাই কার লেজে কখন পা পড়ে যাবে ঠিক কী! হতে পারে সে কোনো গনহত্যা বা এককের উপর অবিচার। হতে পারে কোনো কোটি কোটির ঘাপলা কেস। আমরা ফুটানি করি, ট্রোল করি, ফাজলামি করি – এই পর্যন্ত। আবার ধরুন, হয়তো আপনাকে কেউ বেশ দু-কথা বলল, আপনি ঠিকই বুঝলেন, সে লোক যতই দাঁত কেলিয়ে বলুক না কেন, কথাখানা অপমানেরই। অথচ আপনিও দাঁতটাই কেলালেন, কিন্তু উপযুক্ত যে কথা দিয়ে তাকেও আচ্ছা করে কেলানো যেত, সেটা পরে মনে করে নিজের মনেই ফুঁসবেন। তখন গালাগালটা যে অ্যাকচ্যুয়েলিই কেবল নয়, বরং “দুইচ্যুয়ালি”ই নিজেকেই দেওয়া উচিত সেই মুহূর্তে ফিল করে নিজের গালেই চড় কসাবেন।

কথা না বলেও যথেচ্ছ প্রতিবাদ করা যায় বটে! ভেরকরের বই পড়েছিলাম, সাইলেন্স অফ দ্য সি। অনেকদিন আগে পড়া। স্মৃতি ল্যাং দিতে পারে, তবু যদ্দূর মনে হচ্ছে ঘটনাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে। ফ্রান্সের এক গ্রামে জার্মানীর সৈনিকদের সঙ্গে কেউ একটি কথাও না বলে নিরুচ্চার ঘৃণা দিয়ে তাদের ইগো দুরমুশ করে দিয়েছিল গ্রামবাসী। তাই কথার সঙ্গে সঙ্গে নৈঃশব্দও হাতিয়ার হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে। আমরাও যদি পারতাম, অসৎ রাজনীতির লোকেদের নিঃশব্দে উপেক্ষা করতে!

সংসার রাজনীতিতে কথার চাষাবাদ, সার-চাপান, ল্যাং মারামারি হামেশাই চলে। কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনের কিংবা রামায়ণের যুদ্ধুর ব্রহ্মাস্ত্র, দিব্যাস্ত্র, ব্রহ্মানন্দ অস্ত্র, শিলীমুখ, ঐশিক, অশ্বমুখ ইত্যাদি হরবখতই কথার ধনুকে পরিয়ে বেমক্কা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। তাতে ঘায়েল হয়ে অসার জীবনসহ দিল দরিয়ায় ভেসে যেতে চায় বটে, তবে অচিরাৎ মৃতসঞ্জীবনী আমাদের দিব্যি বাঁচিয়ে তোলে। বেড়ালের নটা জীবন তো সংসার রণাঙ্গনে বাঁচার ফিরিস্তির তুলনায় নস্যি।

তবু এক একসময় দুম করে আঁতে লেগে যায় বইকি! তখন মনে হয় কে আমি, আমি কার। দারা পুত্র, থুড়ি পতি কন্যা কে কার!

সবমিলিয়ে জীবনের সারসত্য আবিষ্কার হয়েছে ধীরে ধীরে। আমাজনের জঙ্গলে খিদে তেষ্টায় কাতর পথহারা আবিষ্কারকের থেকে কম অভিজ্ঞতা লাভ হয়নি সেজন্য। এই অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত প্রত্যেকেরই প্রায় নিজস্ব পাদটীকাটি হলোঃ এযাবৎ ভুবনে ভ্রমে ভ্রমণ করেছি।

যে চুলোর পাড়ে গেলে সত্যি সত্যি মানবজনমের সোনা ফলে তেমন কোনো চুলোর পাড় তো জোটে না। তাই সমাজ ও সংসারের চুলোয় দিবারাত্র পুড়ে কয়লা হতে হতে কখনও কখনও বোবায় ভর করে। অথচ শেষ পর্যন্ত কোথাও যাই না আমরা। অশ্বডিম্ব প্রসব করে কাঁটার মুকুট পরে জীয়ন্তে আমরা জলে ডোবা মৃতদেহ। ফুলে ঢোল উপুড় হয়ে ভাসছি চারদিকে নাচতে নাচতে। পুব থেকে হাওয়া বয় নাচতে নাচতে ঘুরে যাই পশ্চিমে। পশ্চিম থেকে হাওয়ার তালে পুবে। এইভাবে চারদিকে ঘুরে ঘুরে মরা ব্যাঙের নাচন নাচছি – যে মরা ব্যাঙের ভেতর একদা বিদ্যুৎ ছিল।

মরা ব্যাঙকে নাচিয়েছিলেন বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি জীবদেহে বিদ্যুতের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে। কোনো গ্যালভানি কোনো একদিন কি আমাদের আগাপাশতলা এমনই বিদ্যুৎ ফুঁড়তে পারেন না, যাতে আমরা নড়ে উঠতে পারি চরমভাবে বিদ্যুৎবাহিত হয়ে? কে জানে, কখনও হবে কিনা! তা যদি হয় কোনোদিন, তবে হয়তো কথার উৎসমুখ খুলে গিয়ে আমাদের অসহ্য এই নোনাধরা জীবনে আর কখনও তাকে বোবায় পাবে না।

(প্রকাশিত)

চলনবিল

সূর্য কি পোড়ে! সূর্য পোড়ায়
তুমিও পোড়াও তবু কেন যে পুড়ি না!
এ পোড়া দেশ শুধু গল্প শোনায়
আগুনের নদী ঘেরে সামুদ্র সময়।

আসলে সেই কথাগুলো বলা হয়ে ওঠে না, যে গুলো স্বপ্নের মধ্যেও অলিগলি সাঁতরায়। দিন ওঠে, দিন নামে। মানুষের হাতে পায়ে শাখা প্রশাখা। অহংকার কিম্বা নমনীয়তার বৃত্ত ছাড়িয়ে মাটির ভেতর থেকে ছলকায় বিগত গরমের ঘাম, রক্ত, কান্নার শহীদ ইতিহাস। চোখের আড়ালে জমা হয় আশ্চর্য এক হ্রদের গভীর তলদেশে। একসময়ে হ্রদের বহির্গন্ডী উপচে গেলে বাষ্প হয় প্রাচীন পুরাতত্ব।

আসলে কথাগুলো কথা থাকে না চিরকাল। না বলা কথাদের গায়ে জমে যায় অনড় সবুজ শ্যাওলা। রোদ্দুর আছড়ায়, বৃষ্টি অসময়ের নোনা গন্ধ ভাসিয়ে ভঙ্গুর করে দেয় কখনোই না জন্মানো ভ্রুণ শব্দদের। বিরল প্রজাতির ঈগল হয়ে যায় না বলা কথারা। পূর্বী সমুদ্রের ওপরে ঝুলে থাকা বাষ্পের ঝুন্ড আচমকা আকাশ বাইসন হয়ে আছড়ে পড়ে মুখ আর মুখোশের যান্ত্রিক সভ্যতার অ্যাসফল্টের রাস্তায়, মধ্যযুগীয় বাড়ির বদ্ধ উঠানে, মেকি রেস্তোরাঁর রোমান্টিক টেবল্ ল্যাম্পশেডে।

কোনো শুরু ছিল না, তাই শেষও হয় নি
বিকার ছিল না, তাই নির্বিকার হওয়ার প্রশ্নও তোলেনি কেউ;
নিশ্ছিদ্র অন্ধকার কিম্বা ফুটফুটে আলো
মেরুর বরফজ্বলন শেষে ছিল না কোথাও,
এক অলীক ব্রহ্মের রূপক ঘিরে রেখেছিল আব্রহ্মস্তম্ব;
ছিল শুধু সুখ আর শোকের কল্পিত মন্ড।

নির্বিকল্প সমাধির গভীরে হারিয়ে যায় কোনো একলা মাঠকোঠা ঘর। সুখ আর সুখের বৃত্তান্তের ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় উঠে আসে অনিবার্য শৈশবের ফেলে আসা আঁচড়। আস্তে আস্তে সুখের স্মৃতিকণা জমতে জমতে জন্ম নেয় রাজৈশ্বর্যের আলো ঠিকরানো টাইটানিক। আলোর সঞ্চয় পূর্ণ হলে আচমকা মহা বিস্ফোরণ।

দু হাত একত্র করে মহাকাশ উচ্চারণ করে ওহম্! গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে উড়ে যায় শান্তির সাদা পতাকা –

প্রকৃতি রজঃস্বলা হয়…
প্রকৃতি শান্ত হয়…

সম্পদের বাইরে জীবন

rty এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য অর্থ এবং সম্পদের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু অর্থ সম্পদ ধন দৌলত শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমাদের জীবনে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি মানুষ বা সঙ্গী যেকোন অর্থের চেয়ে বেশি মূল্যবান।

আপনি কি শুধু অর্থতেই বিশ্বাস রাখছেন? আপনি কি জানেন সত্যিকার অর্থ বিশ্বাস একটি চরম মাত্রার ভ্রম, তাহলে জেনে রাখুন, অতিরিক্ত অর্থ বিশ্বাস একজন মানুষকে যান্ত্রিক বা বিবেকহীন করে গড়ে তুলতে পারে, আপনি জানেন অর্থ বিশ্বাস কোনভাবেই, ভালবাসা বা বিশ্বাস সুসম্পর্ক বা সুসম্পর্কের উন্নয়ন কোনভাবেই কিনতে পারে না এবং এই জিনিসগুলিই আমাদের প্রতিদিনের দৈনন্দিন জীবনকে সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকার যোগ্য করে তোলে।

আপনি নিশ্চয়ই জানেন ধন-সম্পদ এবং সাফল্যের পিছনে ছুটতে পারা সহজ, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই জিনিসগুলিই শেষ লক্ষ্য নয়। জীবনের আসল লক্ষ্য হল সুখ খুঁজে বের করা, নিজের এবং আমাদের প্রিয়জনদের জন্য একটি সুন্দর জীবন তৈরি করা। আর এটা একা অর্থ দিয়ে অর্জন করা যায় না।

আমরা যদি একটি সুখী এবং পরিপূর্ণ জীবন গড়তে চাই তবে আমাদের চিন্তাভাবনা, আমাদের অগ্রাধিকার এবং আমাদের কাজগুলিকে পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের অবশ্যই দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলা, আস্থা বিশ্বাস ও ভালোবাসা গড়ে তোলা এবং আমাদের জীবনের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

সুতরাং আসুন আমরা মনে রাখি যে বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন হতে পারে তবে এটি একটি সুখী এবং অর্থপূর্ণ জীবনের চাবিকাঠি নয়। পরিবর্তে, আসুন আমরা সেই বিষয়গুলিতে ফোকাস করি যা সত্যই গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভালবাসা, বিশ্বাস এবং সুখে ভরা একটি জীবন তৈরি করে।

মা

664

মা-কে নিয়ে অত বাহুল্য নেই আমার
মা তো মা-ই
সাদা শাড়ী আর অল্প ঘোমটা টানা
সাদা সাদা হাতে হলুদের দাগ
শরীরটা মসলাগন্ধ
সদ্য জন্মানো মেয়ের গায়ে মায়ের বাস
মা আর এমন কি?
মা তো মা-ই।

মা-কে মনে পড়ে
মা’কে ভীষন মনে পড়ে যায়
বাজার থেকে খোলসে মাছ এলে
কিংবা ঈদের সকালে
লাজুক হাসিতে নতুন কাপড়ে
আটপৌরে মা কেমন একদিনের রানী!
অথচ প্রতিদিনের মা
ঘরোয়া মা—সাধারণ, অতি সাধারণ
অনাড়ম্বর মা, প্রয়োজনের সিকি আধুলি
মা তো মা-ই।

মা-কে মনে পড়ে, আবার পড়েও না
নিজের প্রয়োজন ছাড়া খুব তো চিনিনি তাকে
সার্টিফিকেট পরীক্ষার রাতগুলোতে
জেগে থাকা মা
এখনো কেন তেমনি জেগে থাকে?
বোঝে না কেন কতটা অচেনা সে?
না খেয়ে খাবার এগিয়ে দেয়া মা
নিজের অস্তিত্ব বিলীন করা মা
গোপনে নিজের মনকে লুকিয়ে রাখা মা
মা তো মা-ই।

মা-টা বোকা ভারী
প্রতিদান না পেয়েও ভালবাসে
অকারন শংকায় কাঁদে, আমি হাসলে হাসে
তবু আজ মা’কে দেখিনা
শুধু আকাশ বাতাস ঘিরে থাকে যে মুখ
যার নিঃশ্বাসে মিশে আছি
অতি সাধারন কেউ
সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে করে বসবাস
আলাদা করে ভাববার নেই প্রয়োজন
মা তো আসলে মা-ই
এর কমও নয়, বেশীও না
মা মা-ই।

ফেলনা থেকে খেলনা!

34 সেদিন ওয়ালমার্ট গার্ডেন সেন্টারে গেছিলাম, সস্তা দামের বেশ কিছু ফুলের চারা ট্রলিতে তুলেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, গার্ডেন সেন্টারের ফ্লোরে জল কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে এই রঙিন পাতাগুলো। এসোসিয়েট যখন গাছে জল দিয়েছে জলের আঘাতে কিছু পাতা ছিঁড়ে পড়ে গেছে। আমি জলকাদা থেকে প্রায় নেতিয়ে যাওয়া পাতাগুলো তুলে নিলাম। একজন এসোসিয়েটকে দেখিয়ে বললাম, এগুলো আবার টবে পুঁতে দাও, বেঁচে যাবে।

এসোসিয়েট বললো, ধুর এগুলো আরেকটু পরে বস্তায় ভরে ফেলে দেবো। আমি ওগুলো এসোসিয়েটের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে অন্য ফুলের চারার সাথে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাড়িতে এনে পচা-ভালো সবকয়টা পাতাকে অনেক কসরত করে ঠিকই বাঁচিয়ে ফেলেছি। আগামীকাল আমার উত্তমের কোলনোস্কোপির তারিখ, আজ তাকে সারাদিন তরল খাবার খেতে হবে। তাই আজ রান্নাবান্নার ঝামেলা ছিলো না, উত্তমের জন্য সুগন্ধি লিকার চা, মুসুরের ডালের ক্লিয়ার স্যুপ আর মুরগির ক্লিয়ার স্যুপ বানাতেই চূলা অফ। জি বাংলার সিরিয়ালগুলোও বিকেলের আগেই দেখা হয়ে গেছে।

মনটা ফুরফুরে লাগছিলো তাই। বসে গেলাম কমপিউটারে। মাথার মধ্যে অনেক চাপ, কত লেখা জমে আছে, শুরুই করতে পারছিলাম না। আজ শুরু করলাম, একটা লেখা শেষ করতেই দেহ থেকে ক্লান্তি চলে গেলো। খেয়াল হলো, আজ সারাদিনে ঘুমও আসেনি। তার মানে, আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছি। সন্ধ্যের পর মনে হলো, সৃজনশীল কিছু করা যাক। আমি ভুলেই গেছিলাম, কৈশোরে আমাদের সাদামাটা সংসারে আমি নিজের মনেই মূল্যহীন কিছু জিনিসপাতি জোগাড় করে অমূল্য শিল্পকর্ম তৈরি করতাম। যেমন আমাদের ঘরে সোফাসেট ছিলো না৷ টিভি ছিলো না, ফ্রিজ তো ছিলোই না, ছোটো একটা বুকসেলফ ছাড়া দর্শনীয় কিছুই ছিলো না। বুকসেলফটাও মায়ের গল্পের বইয়ে ঠাসা থাকতো, বুকসেলফের উপর ফুলদানি রাখার জায়গাও ছিলো না।

অথচ আমার খুব ইচ্ছে করতো সুন্দর সুন্দর জিনিস দিয়ে ঘর সাজাই। কিন্তু কি দিয়ে সাজাবো, বই দিয়ে তো ঘর সাজানো যায় না। আমরা তখন কালি কলম দিয়ে লিখতাম। কালি থাকতো দোয়াতে, দোয়াত খালি হয়ে গেলে আমার মামীকে দিয়ে দিতাম। মামী ফেরিওয়ালার কাছে পুরানো কাগজ, কালির দোয়াত সের দরে বিক্রি করে দিতো। একদিন মাথায় এলো, আমাদের ফুলদানি নেই, শো কেইস নেই। তাতে কি, কালির দোয়াত আছে, কাপ প্লেট, আয়না চিরুনি জবাকুসুম তেলের বোতল, বসন্ত মালতী লোশন, মায়ের সিঁদুরের কৌটো, তিব্বত স্নো, পন্ডস পাউডারের কৌটা রাখার জন্য তারজালি দেয়া তিন তাকের একট মিটসেফ তো আছে।

34j কালির দোয়াতটাকেই তো ফুলদানি বানাতে পারি, তাজা ফুল কোথায় পাবো, প্লাস্টিকের ফুল আমার পছন্দ না। স্কুলের মাঠে দেখেছি মাঠ জুড়ে দূর্বা ফুল, কাশফুলের মতোই দেখতে। নিয়ে এলাম এক মোঠা দূর্বা ফুল। কালির দোয়াতে দূর্বাফুল ভরে মিটসেফের উপরের তাকে বসাতেই মনে হলো, আমাদের সাদামাটা ঘরটাকে খুব সুন্দর লাগছে। এর কয়দিন পর রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাক এলো। মায়ের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, একা হাতে রান্নার কাজ কুলিয়ে উঠতে না পারলেই মা আমাকে ডাকতো। ছোটোবেলা থেকেই রান্নাঘর আমার খুব প্রিয় স্থান, মন্দিরের মতো। কাজেই মা ডাকলে আমি খুশি হতাম।

সেদিন মা’কে ডিম ভেঙে ফেটিয়ে দিতে হবে। প্রথম ডিমটা হাত ফসকে পড়ে ঠাস করে ফেটে গেলো। আমার হড়বড় কাজে মা অসন্তুষ্ট হলো। তাই দ্বিতীয় ডিমটা খুব সাবধানে একটু একটু করে ফাটানোর চেষ্টা করতে গিয়েই মনে হলো, ডিমের খোসাটা আস্ত রেখে যদি ডিমটা ভাঙতে পারি, তাহলে এই খোসাটার গায়ে পেন্সিল দিয়ে এঁকে পুতুলের মুখ বানাতে পারবো।

যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিলো। সব হিন্দু বাড়িতে তখন এঁটোকাঁটা আমিষ নিরামিষ বাছবিচার করা হতো। সেই হিসেবে ডিম আমিষ, রান্নাঘর থেকে ডিম কোনোভাবেই পড়ার টেবিলে যাওয়ার কথা নয়। কারণ পড়ার টেবিলে বই পুস্তক থাকে, সেখানে দেবী সরস্বতীর অধিষ্ঠান। আমিষ তো পড়ার টেবিলে যেতে পারবে না, পড়ার টেবিল ছাড়া আমি ডিমের খোসায় চিত্রকর্ম করবো কি করে! আমার একটা সুবিধা ছিলো। এঁটোবাসি মাও মানতেন, তবে খুব কড়া বাছবিচার করতেন না। জামায় ভাত পড়লে আমার মামী যেখানে অই জামা পাল্টাতে বাধ্য করতো, মা সেটা করতো না। ভাতটা ঝেড়ে জামার অই জায়গাটা একটু জল দিয়ে মুছে ফেললেই সাতখুন মাফ। আর আমার ভাইদের বেলায় ওটুকুও করতে হতো না, ছেলেদের বেলায় সব ভুলই ক্ষমার যোগ্য ভুল।

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, স্কুলে যাওয়ার আগে নিজের টিফিন নিজেই বানিয়ে নেই। রুটি আলুভাজা, কখনো ঘি দিয়ে রুটি মাখিয়ে তার উপর চিনি ছড়িয়ে নেয়া, সবই নিজেকে করতে হতো। মা একা হাতে মাছ তরকারি কেটে, মশলা বেটে সকাল দুপুরের রান্না সেরে সকাল ১১টার স্কুল ধরতো। আমার টিফিন কি হবে, এসব দিকে নজর দিতে পারতো না। তাই ডিমের খোসার গায়ে ছবি আঁকবো না কি করবো, ডিমের খোসা পড়ার টেবিলে তুলবো না ফেলে দিবো, এসব দিকে মায়ের নজর ছিলো না। ডিমের খোসাগুলো ধুয়ে মিটসেফের এক কোণে শুকাতে দিয়ে স্কুলে চলে গেলাম। স্কুল থেকে ফিরেই বসে গেলাম ডিমের খোসা নিয়ে। মায়ের কাছে পরীক্ষার খাতা দেখার জন্য লাল নীল রঙের পেন্সিল ছিলো। সেই লাল নীল পেন্সিল আর আমার কাজল পেন্সিল দিয়ে এঁকে ফেললাম একটা মেয়ের মুখ, একটা ছেলের মুখ। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

সেই দূর্বা ফুলের দোয়াতের পাশে সাজিয়ে রাখলাম ডিমের শিল্পকর্ম। আমার শিল্পকর্ম নিয়ে ঘরের কেউ মাথা ঘামাতো না। তবে এরপর যতবার ডিম ভাঙার দরকার হতো, হয় মা আমাকে ডাকতো, নয়তো মা নিজেই যত্ন করে ডিমের খোসা আস্ত রেখে ডিম ভেঙে খোসাগুলো আমার জন্য তুলে রাখতো। এরপর তো আমার চিত্রকর্ম শুধু ছেলে আর মেয়ের মুখে সীমাবদ্ধ থাকলো না। ডিমের খোসাতেই লাল নীল কালো পেন্সিলে আকাশ পাখি নদী গোলাপ ফুল কত কি যে এঁকেছি আর অই মিটসেফে সাজিয়ে রেখেছি।

ক্লাস টেনে উঠতেই ডিমের খোসা পর্ব শেষ, ততদিনে নতুন শিল্পকর্ম শুরু করেছি। চাল ডাল কালোজিরা মেথি মৌরি দিয়ে গ্রিটিং কার্ড বানানোর চেষ্টা। আর্ট পেপার তো তখন ছিলোই, স্কুল থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম, গ্রাফ আঁকার জন্য তো স্কুল থেকেই আর্ট পেপার দেয়া হতো। আর্ট পেপারের বাড়তি টুকরোগুলো ফেলে দিতে মন চাইতো না। তখনই কার্ড বানানোর চিন্তা মাথায় এলো।

আর্ট পেপার দুই ভাঁজ করে কার্ডের মতো শেইপ করে কার্ডের উপরে আঠা দিয়ে তার উপর মুসুরের ডাল, চাল, কালোজিরা জিরা মেথি দিয়ে এতো সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করতাম। কেউ ছিলো না আমার যাকে গ্রিটিং কার্ড দেয়া যায়। আমিই বানাতাম, আমার কাছেই রেখে দিতাম।

আজ এতো বছর বাদে সেই কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেলো। রান্নাঘরে গেছি, ছোটো একটা জলের খালি বোতল দেখতে পেলাম। বোতলটা ট্র‍্যাশ ক্যানে ফেলতে গিয়েও থেমে গেলাম। মাথার ভেতর কৈশোর জেগে উঠেছে। পেঁয়াজ কাটার ছুরি দিয়ে বোতলটাকে কাটলাম। কায়দা করে ফুলদানির মতো একটা অবয়ব বানালাম। এরপর মাটি দিয়ে, বেঁচে ওঠা রঙ বাহারের পাতা দিয়ে তৈরি করে ফেললাম ইন্ডোর প্ল্যান্ট পট। টেবিলে ছিলো অর্কিডের শুকনো পাপড়ি, দুটো পাপড়ি লাগিয়ে দিলাম পটের গায়ে।

ফেলনা থেকে খেলনা বানানোর সাথে সাথে আমার ভেতরে হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠলো।

মনে হয়

nita

মানি লোকের মান বড়
বড় তার সম্মান,
অজ্ঞানী বোঝে না মানসম্মান
যতই হোক অপমান।

বিদ্বান লোকের জ্ঞান বেশি
বিদ্যা করে দান,
মুর্খ লোক বোঝে বেশি
বলে সে কে বিদ্বান?

যে শিক্ষিত হয় অহংকারী
রোগে শোকে মরে,
যে অশিক্ষিত হয় দয়ালু
সবাই সম্মান করে।

অহংকারীর অহংকার অলংকার স্বরূপ
অহংকারই সম্বল তার,
নিরহংকারীর সহ্য-ধৈর্য অনেক বেশি
নতশিরে প্রার্থনা স্রষ্টার।

কথায় আছে, মানে আমি মনে করি

কথায় আছে, মানে আমি মনে করি।

“One cannot simply bear titles such as Bangarani, Bangmata, Bangabandhu, Palli Bandhu, or Mother of Humanity and expect to become the Queen of Bengal. Political positions do not necessarily make one a true politician. True leadership is built upon certain ideals that must be thoroughly observed and embodied, and cannot be simply claimed through titles or names alone.”

৩২০১. “কেউ কেবল বঙ্গরাণী, বঙ্গমাতা, বঙ্গবন্ধু, পল্লীবন্ধু, বা মাদার অফ হিউম্যানিটির মতো খেতাব বহন করতে পারে না এবং বাংলার রানী হওয়ার আশা করতে পারে না। রাজনৈতিক অবস্থান অগত্যা একজনকে সত্যিকারের রাজনীতিবিদ করে না। সত্যিকারের নেতৃত্ব নির্দিষ্ট কিছু আদর্শের উপর নির্মিত হয় যা অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং মূর্ত করা, এবং শুধুমাত্র শিরোনাম বা নামের মাধ্যমে দাবি করা যায় না।”

৩২০২. “নেতৃত্ব শুধুমাত্র শিরোনামের মাধ্যমে অর্জিত হয় না; এটি একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্যের প্রতি ধারাবাহিক এবং নিবেদিত কর্মের মাধ্যমে নির্মিত হয়।”

৩২০৩. নেতৃত্ব শুধুমাত্র একটি উপাধি বা পদ নয় যা কাউকে দেওয়া যেতে পারে। এটি এমন কিছু যা অবশ্যই কর্ম, আদর্শ এবং নীতিগুলির মাধ্যমে অর্জন করা উচিত যা একজনের চরিত্রে গভীরভাবে নিহিত রয়েছে। একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদ বা নেতা হতে হলে, একজনকে অবশ্যই কিছু মূল্যবোধকে মূর্ত করতে হবে যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে এবং একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।

বঙ্গরাণী, বঙ্গমাতা, বঙ্গবন্ধু, পল্লীবন্ধু, বা মাদার অফ হিউম্যানিটির মতো খেতাবগুলি সম্মান বা প্রশংসার চিহ্ন হিসাবে দেওয়া যেতে পারে, তবে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাউকে সত্যিকারের নেতা করে না। সত্যিকারের নেতৃত্ব জনগণের কল্যাণের প্রতি অঙ্গীকার, তাদের চাহিদা শোনার এবং সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা এবং বৃহত্তর ভালোর জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইচ্ছার মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়। এটি উৎকর্ষের একটি নিরলস সাধনা, আমাদেরকে গাইড করে এমন মূল্যবোধের প্রতি একটি অটল উত্সর্গ এবং ঐক্য ও অগ্রগতির শক্তিতে একটি অটুট বিশ্বাস। যারা এই আদর্শগুলোকে মূর্ত করে তারাই সত্যিকার অর্থে নেতৃত্বের চাদর দাবি করতে পারে এবং বাংলার রানী হতে পারে।

জিততে গেলে হেরে যাব

চার
শিমূলগাছের শেকড় থেকে উড়ে আসছে পিন্টু; উড়ছে ব’লে অবিরাম সাইকেলচালনার দিনে খোঁড়া গর্ত, ছাগলবাঁধার খুঁটো, একতাল গোবর — কিছুই তাকে থামাতে পারছে না। পৃথিবীর দীর্ঘতম রান-আপ নেওয়া বোলার হয়ত পিন্টুই। মাঠের শেষে একটা ছোট নালা, ওপারে রাস্তা, তার পেছনে ঝোপঝাড়। ব্যাটসম্যান বুঝে পিন্টু অনেক সময় সেই অরণ্য ফুঁড়েও টেক-অফ করে। ক্যাম্বিজ বল আর বাঁশের চটা কেটে বানানো উইকেটের মধ্যে যে দাঁড়িয়ে, তাকে সরানোর জন্যে সে জীবন দিতে রাজি।

ডেলিভারি দিয়েই পিন্টু দাস, ক্লাস সেভেন, গাজন-সন্ন্যাসীর মতো উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। খুব বেশি আত্মাহুতি সহকারে বল করলে এমন হয়। ওদিকে চাঁদ হাফ ক্রিজ পর্যন্ত দেখতে পেল বলটা আসছে। এরপর সে অন্ধ হয়ে যায়। কোথায় ড্রপ, কোন স্ট্যাম্পে পড়বে এসব তথ্য না পেয়ে তার মাথা একশোভাগ আন্দাজের বশে শরীরকে চালিত করে। এবারও হাফ প্যান্টের নীচে ডান হাঁটু ভাঁজ খুলে হালকা এগোল, নজরুলমিস্তিরির বানানো লৌহশালকাঠের ব্যাট মুখ বের করল পায়ের পেছন থেকে এবং ঘটে গেল হলুদ ক্যাম্বিজের সঙ্গে নিখুঁত আঘাতময় হ্যান্ডশেক। মনে হতে পারে বলটাই অংক ক’ষে ছুটে এসে তার ব্যাটে ঘা মেরেছে। একজন দর্শক চেঁচাল, আরে আস্তে বল কর। বাচ্চা ছেলে, লেগে যাবে।
— বাচ্চা ছেলে? হুঃ! পুরো বিটিশ মাল। আউট ক’রে দেখাও দেখি।

চাঁদের জীবন মানে অর্ধেক জানা আর অর্ধেক ভাবনা। কিছুটা বোঝার পর সে বাকিটুকু আইডিয়া ক’রে দ্যাখে — যা ভেবেছিল, মিলে গেছে। সত্যি বলতে, কোনও কিছুরই শেষ দেখা যায় না, তামাম দৃষ্টিগোচর করতে গেলে এক অন্ধত্ব চেপে ধরবে। সত্তার অথৈ জায়গায় চাঁদ দৃষ্টিহীন, সেই তমসার ক্রমপ্রসার হয়ে চলেছে। কল্পনা দিয়ে সে প্রাণপণে নিজের গা-ভর্তি অন্ধকারকে আটকাতে চায়।

পাঁচ
আহ, ব্যাটেবলে হতেই গ্রিপে একটা বিনবিনে ঝাঁকুনি কী যে আরামের! মাঠভর্তি ফিল্ডিং খাটছে আজাদ হিন্দ ক্লাবের পুজো-সেক্রেটারি রঞ্জনমামা, কোলকুঁজো ভাইডি, দোতলাবাড়ির বড়লোক বিশ্বরঞ্জন, ট্রেনে রুদ্রাক্ষ বিক্কিরি করে জয়ন্ত; আর ভালো ক’রে সাত বছরও হয়নি একটা বাচ্চা তাদের টাকাপয়সা, মস্তানি ব্যর্থ ক’রে দিচ্ছে গোটা বিকেল ধ’রে। আরও বেশি শহিদ-মনোভাব নিয়ে রান আপে ফিরে যাচ্ছে পিন্টু, হাবুল এত ছোট সিলি পয়েন্টে উবু হয়েছে যে বোলারের ডেলিভারি তার পেছন শুলিয়ে দেওয়ায় হা-হা অট্টহাস মাঠে। খেলায় এতক্ষণ এলবিডবলিউ ছিল না, এবার “পায়ে লাগলে আউট কিন্তু”। ওমনি রাজনৈতিক নির্দেশ আসছে, পায়ে মার। সেরা চোট্টা মানিক মালো উইকেটের পেছনে হুমড়ি খেয়ে; চাঁদ একটা বল ফসকালেই অফ স্ট্যাম্প হাত দিয়ে ফেলে দাবি করবে — বোল্ড! সেও হচ্ছে না দেখে মানিক বোলারকে ইশারা করল বাম্পার দে, চাঁদ ব্যাকফুটে আসতেই লেগের বেল খসিয়ে দিয়েছে — যাও, হিট উইকেট! মাঠে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার হাততালি, কেউ দৌড়ে যাচ্ছে শয়তানটার ব্যাট কেড়ে নেবে, সেই মুহূর্তে চক্ষুলজ্জাপূর্ণ সেক্রেটারি বলল, ভ্যাহ্‌, ওকে খেলতে দে। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিল একটা ভোটকা-মতো লোক, পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে দেখে বন্ধুকে : পুরো এম এল জয়সিমা!

পিন্টু শুনতে পেয়েছে।
— ল্যাটা ব্যাটসম্যান না? উইকেট গার্ড ক’রে খ্যালে। ডান হাতে খেলুক, চ্যালেঞ্জ দিলাম — এক বলে প্যাভিলিয়ানে ফেরত পাঠাব!

ওসব বাতেলা পরে। এই চাঁদ, এবার ছাড়; পার্টি ক’রে খেলা হবে।

ইশ, আজ তার হাত একদম জ’মে গেছিল; টানা রুখে যাচ্ছিল বলের অপরাধ প্রবণতা। উইকেট ভেঙে যাওয়ার মধ্যে একটা সন্ত্রাস আছে — বাড়ির খোড়ো চালে দাঙ্গার আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো। তখন গৃহস্থ যেভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটছে, ব্যাটসম্যানকেও ক্রিজ ছেড়ে পালাতে হয়। ব্যাটিং ক্রিজ মানে ঠাকুরের থান, লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে ব্যাট ঠুকেছে, একটা কাঁকর জমতে দেয়নি; এবং পরিস্থিতির দাবি মেনে নিজেকে নিয়ে গেছে কখনও কেল্লা কখনও গোলাবারুদের ভূমিকায়।

ছয়
চাঁদপ্রতাপ সারা জীবন চিতোরের দুর্গ হয়েই থাকতে চায়। কলোনি-কিশোরদের দুজন নিতাই আর বলাই ক্যাপ্টেন হয়ে পার্টিভাগ করছিল। নিতাইয়ের বাবা আর বলাইয়ের মা ভাইবোন। মামার ছেলে নিতাই প্রথমেই ডাকল — চাঁদ। ভুল হল, কম্পিটিশান ম্যাচে ভাইডি বা সুরজিতের মতো তাড়ু ব্যাটসম্যান নেওয়া উচিত, চাঁদ তো চার মারতেই পারে না।

টসে জিতে মাসির ছেলে বলাই ব্যাটিং নিতেই খালি গায়ে মায়ের শাড়ি পরা ভাইডি ওপেনিংয়ে। কাপড়ে বল আটকে যাবে আপত্তি আসায় সে মালকোঁচা মেরে নিচ্ছে। এবং বোলারের মুখোমুখি দুপা ফাঁক ক’রে দাঁড়িয়ে মাঝখানে লুচিভাজার ঝাঁঝরি-হাতায় বলটা নিয়ে উইকেটকিপারের মাথা টপকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিল। হু-হু ক’রে রান উঠছে দেখে মাসির ছেলে এই বেআইনি অরাজক ব্যাটিংয়ের প্রতিবাদ করে, খেলা তিন মিনিট বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়।

একা ভাইডিই মামার ছেলের দলের রানকে লোভনীয় জায়গায় নিয়ে গেছে। এবার মাসির ছেলে ওপেনিং-এ দলের শ্রেষ্ঠ হয় ছক্কা নয় ফক্কা প্লেয়ারের সঙ্গে এক দিক ধরে থাকবি-কে নামিয়ে দিল। চাঁদ মর্যাদা সহকারে ঠুকে যাচ্ছে, ক্কচিৎ ব্যাট কাত ক’রে স্লিপের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারি ওয়ান; কিন্তু শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল স্ট্রোক মেকাররা। ফোকলা দাঁতের মতো তাদের মিডল স্ট্যাম্প উড়ে যাচ্ছে, অথবা কারও তীব্র হাঁকড়ানো বাড়ানো হাতে জমিয়ে নিল ফিল্ডার। তখনও সন্ধে মিনিমাম আধঘন্টা দূরে, জিত আঠাশ রান তফাতে, ব্যাটসম্যানেরা প্যাভিলিয়ন নামের ওলটানো জংধরা বাতিল রেলের পাটির ওপর। একা চাঁদ নট আউট ব’লে ম্যাচ খতম হয়নি।

এই রকম সংকটে বাবা-কাকারাও দাঁড়িয়ে যায় মাঠের পাশে, পতৌদি-চন্দ্রশেখর-সেলিমদুরানি পর্যায়ে চলে যায় স্থলযুদ্ধের গভীরতা। ফিল্ডাররা চাঁদকে প্রণাম-দূরত্বে ঘিরে আছে আর সে হোমিওপ্যাথির সূক্ষ্ম মাপে নিজের আবছা চোখদুটো বসিয়ে নিয়েছে ব্যাটের গায়ে। নির্যাতিত ঘাসের গন্ধ, নিকেলের মতো বিকেল, লেগসাইডে শাপলাপাতার সরপড়া পুকুর — সবকিছুর মাঝখানে বল বোলারের চেয়ে ব্যাটসম্যানের ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে বেশি। দর্শকদের মধ্যে এসেছে কানাইস্যার, নিবাধুই স্কুলের গেমস টিচার :
— ওডারে কী কয়, খ্যালা না ক্যালা? তহোন থে’ কুলো পাতে যাচ্ছিস মায়েগোর মতো! মারবি কবে?

পরের বলটা হাঁকাতে যায় চাঁদ, মিস ক’রে এক চুলের জন্যে বাঁচে। ডাঙশের মতো ভারি ব্যাট চাগাতে গেলে ব্যাক লিফট নামার আগেই বল উইকেট ভেঙে দেবে। খালি পায়ে মাটির ঠান্ডা তাত নিতে নিতে সে আবার ঝুঁকে স্টান্স নেয়। পেছনের তিনটে উইকেট আসলে মা-বাবা-দিদিমা, অথবা তার তিন দাদা-দিদি। তাহলে ছোটবোন কী হবে? গোপু একটা বেল, আর একটা বেল কিশমিশ, যদি কোনও দিন ফিরে আসে!

সাড়ে পাঁচটা বাজতেই মাসির ছেলে চিৎকার পাড়ছে : খেলা বন্ধ, ম্যাচ ড্র। মামার ছেলের কড়া প্রতিবাদ — বন্ধ কিনা, একমাত্র আম্পায়ার বলতে পারে। অনেক চাপাচাপির পর রঞ্জনমামা বুঝিয়ে দিল, ব্যাটসম্যানকেই ‘আলোকাভাব’ ব’লে তার কাছে আবেদন করতে হবে। শব্দটা কলোনিতে কোনও জীবজন্তুপশুপাখির মুখে শোনা যায় না, চাঁদ তারক ডাক্তারের বাড়ি দৈনিক বসুমতী পড়তে যায় ব’লে জেনেছে। ক’দিন আগেই তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্টে মনসুর আলি খান পতৌদি গোপালকৃষ্ণণকে অনুরোধ করেছিল। খান না খাঁ; পতৌদি, পাতৌদি নাকি পতাউদি — এসব কনফিউশান মাথায় নিয়েই তাকে দলের চাপে ভারত-অধিনায়ক হতে হয়। তারপর সবাই চাঁদের পিঠ থাবড়ে দিচ্ছে; মাসির ছেলে বলছে, কেন কুলোপাতা প্লেয়াররে নিছিলাম, এবার বুঝিছো? আর ফাস্ট বোলার পিন্টু :
— সুব্রত-র ফুলটস বলও ঠুকে দিচ্ছিলিস কেন, এগিয়ে এসে মারবি টেনে ছয়! আর তো মোটে আট রান বাকি ছিল, জেতার চেষ্টা করলি না?

এখনও দিগ্বিজয়ের সময় আসেনি! ইশকুল, তারপর নাকি কলেজ, তারপর চাকরি, তারপর যতখুশি আইসক্রিম, চিটে গুড়, বুটভাজা বিজয় করো। নাকেমুখে ঘুষি খেয়েও পুরো বারো রাউন্ড টিকে থাকা মানেই কেল্লা ফতে, তারই বয়েসি বলরামকাকুর মেয়ে কর্ণফুলির মতো হঠাৎ নাকমুখ দিয়ে কৃমি উঠে শুঁটি নদীর শ্মশানে যাওয়া নয়। ড্র-ই ভালো, খেলায় থাকুক দু’পক্ষই, বাজিমাত করতে গিয়ে হট ক’রে না হারের মুকুট কিনে ফেলি!

.
(চলবে)

অন্ধভাবে বিশ্বাস করার আগে, সাবধানে যাচাই করে নিন

sha

১. “অহংকার সাময়িক গৌরব আনতে পারে, কিন্তু নম্রতা অনন্ত সম্মান আনে।”

২. “আত্ম-উন্নতির যাত্রা একটি একক পদক্ষেপ দিয়ে শুরু হয়। আজই সেই পদক্ষেপ নিন এবং আপনার কর্মগুলি আপনার পক্ষে কথা বলুক।”

৩.”অন্ধ বিশ্বাস একটি মানসিক ব্যাধি, এবং এর আঁকড়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণা এবং চার্লাটানদের গল্প লুকিয়ে থাকে। তাই, কোনো কিছুকে বিশ্বাস করার আগে বা অন্ধভাবে বিশ্বাস করার আগে, সাবধানে যাচাই করে নিন।”

৪. আপনি যখন মানুষকে গুরুত্ব না দিয়ে অর্থকে গুরুত্ব দেবেন তখন আপনি আপনার জীবনে অর্থ ব্যতীত ভালো মানুষ পাবেন না। কারণ আপনি আপনার জীবনে টার্গেটের পেছনে ছুটে মনুষ্যত্ব হারিয়েছেন যা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।।

উজ্জ্বল স্মৃতির উজ্জ্বল গল্প!

rty ২০১৭ সালের কথা। মৃত্যুপথযাত্রী বাবা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরেছেন। হসপিটাল থেকে একটু সুস্থ করে চলৎশক্তি রহিত বাবাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। বাবার চার সন্তানই বাবার সামনে উপস্থিত। নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন এবং তিন সুপুত্র আর হাড়জ্বালানো কন্যাটিকে সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে রাশভারী রাগী স্বভাবের বাবা শিশুর মতো সহজ সরল হয়ে উঠেছেন। চেষ্টা করছেন শোয়া অবস্থায় কারো সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে এপাশ ওপাশ করতে। হাড় জ্বালানো কন্যা সামনে থাকলে বাবা নিজে নিজে শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করেন, কন্যার কাছে প্রমাণ করতে চান, ৯০ বছর বয়সেও বাবা কারো সাহায্য ছাড়াই চলতে পারেন!

বিশেষ করে যখনই তাঁর পুত্রদের কাছে পান, নিজে নিজেই শোয়া থেকে উঠে বসেন। পুত্ররা বাবার কেরামতি দেখে অবাক হয়, আশ্বস্ত হয়। সাথে যোগ হয়েছে, কথা বলা। শিশু যখন নতুন কথা বলতে শিখে, সারাক্ষণ টর টর করে, বাবাও তেমনি। হাসপাতালে তো অচেতন ছিলেন দিনের পর দিন, তাই নতুন জীবন ফিরে পেতেই কত রকমের কথা বাবার ঠোঁটের আগায় চলে আসতো! কন্যাকে কিছুটা সমঝে চললেও পুত্রদের কাউকে কাছাকাছি পেলেই কাছে ডেকে গল্প করতো।

সেদিনও বড়ো পুত্র, মেজো পুত্রকে বাবার কক্ষে প্রবেশ করতে দেখেই বাবা নিজে নিজেই শোয়া থেকে উঠে বসেছেন। বড়ো পুত্রের হাতে চানাচুর মুড়ি ভর্তি বাটি, বাবাকেও সাধলো মুড়ি। বাবা শিশুর মত উচ্ছ্বল হয়ে সাধু চলিত মিলিয়ে বলল, “অবশ্যই খামু। এমন সুযোগ জীবনে আর আসিবে না। আমার বিদেশ ফেরত পুত্র নিজের বাটি থেকে আমাকে চানাচুর মুড়ি খাওয়াচ্ছে “।
বাবার কথা শুনে আমরা খুব মজা পাচ্ছিলাম।

এরপর দুই পুত্রকে কাছে বসালেন, দুই পুত্রের সাথে বাবা তাঁর ছেলেবেলার গল্প জুড়ে দিলেন। বাবার ছোটো পুত্র তখন নরসিংদী কলেজে অধ্যাপনা নিয়ে ব্যস্ত, আর আমি দুই কান খোলা রেখে পাশের ঘরে ল্যাপটপ খুলে বসেছি এবং বাবা পুত্রের গালগল্প শুনছি। বাবার বলা গল্প থেকে বাবার জীবনের না-বলা অনেক তথ্য উদ্ধার করলাম।

** বাবার ঠাকুরদাদা ছিলেন অঞ্চলের নামকরা তালুকদার, ঠাকুরদাদার মেজাজও ছিলো তালুকদারি। বিশাল বাড়ি, বাড়ি ভর্তি জ্ঞাতি গুষ্ঠি, ভাই বোন স্বজনের মেলা। ঠাকুরদাদার বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে সেই সাথে ধীরে ধীরে তালুকদারি চলে যায়, স্বজনের ভীড় কমে যায় শুধু বংশের তালুকদারী তেজটাই রয়ে যায়। সেই তেজই পুরুষানুক্রমে বাবার মধ্যেও এসেছে। এরপর বললো, বাবার বাপ কাকাদের গল্প। নিজের বাবার সাথে বেশী সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি, কারণ বাবার বয়স যখন তেরো, বাবার বাবা মারা যান।

এক পুরুষে তালুকদারি ফুরিয়ে গেলেও, তালুকদার বাড়ির ছেলেমেয়েদের জেঠা, কাকা পিসীদের সাথে মধুর সম্পর্ক টিকে ছিলো। বাবার ছিলেন পাঁচ কাকা। সোনা কাকা, ধন কাকা, সুন্দর কাকা, সেইজা কাকা, দুদু কাকা।
বাবার সকল কাকাদের তালুকদারি তেজ থাকলেও সেইজা কাকা ছিলেন ব্যতিক্রম। সেইজা কাকা জলের মতো সরল সহজ। সেইজা কাকা ছিলেন গ্রামের শত বর্ষ পুরনো স্কুলের শিক্ষক। সেইজা কাকার মধ্যে শিশুতোষ সরলতা ছিলো। ফলে ছোটো ছোটো ভাতিজা ভাতিজি ভাগ্নের সাথে খুব ভাব ছিলো।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ভাতিজা ভাতিজিদের হাঁক পেড়ে ডাকতেন। স্কুলে শিক্ষক রুমে যে সকল গল্প শুনে আসতেন, বাড়ি ফিরে ভাতিজাদের সাথে সেসব গল্প করতেন। সেই সব শোনা গল্পের মধ্যে একটা গল্পের কথা বাবার আজও মনে আছে। গল্পটা এমনঃ

লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে ডি ঘোষ মহাশয়। যে সময়ের কথা, তখন ভারতবর্ষের গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্কুলের ইন্সপেকশনে বিলাত থেকে আসতেন বড়ো বড়ো স্কুল কলেজের শিক্ষকরা। একবার এক স্কুলের ইন্সপেকশানে এসে কে ডি ঘোষ মহাশয় চুপি চুপি পেছনের দরজা দিয়ে শ্রেণীকক্ষে ঢুকে ছাত্রদের সারিতে একেবারে পেছনের বেঞ্চে বসলেন। সেই ক্লাসে শিক্ষক মহাশয় তখন ছাত্রদের একেকজনকে দাঁড় করিয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন, উত্তর সঠিক না হলে উনার হাতের বেত ছাত্রের পিঠে মারছেন।
এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন,
“জগা, বল দেখি, চিরুনি মানে কি?
জগা প্রথমে কিছু বলে না, ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
শিক্ষক হুংকার ছাড়েন, চিরুনি মানে বলতে না পারলে বেত পিঠে ভাঙবো।
জগা বলে, “চিরনি মানে ফারুনি”
শিক্ষক তেড়ে আসেন, “কী বললি? চিরুনি মানে ফারুনি? আমার সাথে রসিকতা?”

জগার পিঠে বেত পড়ার আগেই ছাত্রদের মাঝ থেকে ইন্সপেক্টর কে ডি ঘোষ উঠে দাঁড়ালেন, শিক্ষককে বলেন, ” থামুন। এই ছাত্রকে বেত্রাঘাত করবেন কেন? সে কী ভুল বলেছে? চিরুনি মানে সে সঠিকই বলেছে। চিরুনি মানে তো ফারুনিই হয়। কাঠ চেরা হয় যা দিয়ে, তাকে বলে চিরুনি। কাঠ চেরা মানে কাঠ ফাড়া। তাহলে আপনিই বলুন, চিরুনির আরেক অর্থ কি দাঁড়ায়? এই ছাত্রটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সে তার বুদ্ধি দিয়ে চিরুনির সমার্থক শব্দ বের করেছে। কোথায় তাকে পুরষ্কৃত করবেন, তা নয়, তাকে তিরস্কার করছেন!”

**জগা নামের সেদিনের বালক পরবর্তিতে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু হয়েছিলেন।**
বাবা গল্পে আরও যোগ করলেন,
“আমরা যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম, এই ইন্সপেক্টর কে ডি ঘোষ কিন্তু আমাদের স্কুল ইন্সপেকশানেও আসতেন। এবার বুঝে দ্যাখ্, তখনকার দিনের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন ছিলো! অক্সফোর্ডে যিনি অধ্যাপনা করেছেন, তিনি গ্রামের স্কুল ইন্সপেকশানে আসতেন। ভাবতে পারিস? আর দুই পাতা ইংলিশ পড়ে আজকালের পোলাপান ডক্টরেট ডিগ্রীর গরম দেখায়!”

কিছুদিন পর বাবা হামাগুড়ি দিয়ে বিছানা থেকে নেমে নিজে নিজেই চেয়ারে বসেন, নিজে হাতে ভাত মেখে খান, চায়ের কাপে চুমুক দেন, আমাদের আশ্বস্ত করেন খুব তাড়াতাড়ি তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটবেন। আমরা চার ভাইবোন আবার যার যার ঘরে ফিরে যাই। বড়দা আর আমি চলে আসি বাবার দেশের বাইরে যার যার নিজের দেশে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি আবার দেশে যাই। ততোদিনে বাবা আবার আগের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন। ঘরে নিয়মিত ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করেন, পত্রিকা পড়েন, কন্যার লেখা বই শিয়রে রেখে ঘুমান।
************************
**বাবা আমাদের ছোটোবেলায় নিজেই আমাদের প্রত্যেককে ইংলিশ পড়াতেন। পড়ানোর সময় যখন কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড হার্ভার্ডের নাম বলতেন, বাবার গলার স্বরে ঝরে পড়তো সমীহ, মুগ্ধতা। সাধ্য তো ছিলো না ওখানে যাওয়ার, হয়তো মনে মনে কল্পনার জাল বুনতেন, হয়তো সাধ হতো কেমব্রিজ অক্সফোর্ডের মাটি ছুঁয়ে দেখার!

২০১৯ সালের জুলাইয়ের শেষে ছয়দিনের সফরে বন্ধু বন্যা আর আমি লন্ডন গেছিলাম। আমার মাসতুতো বোনের বাড়িতে উঠেছি। বোনের বর প্রথম দিনেই আমাদেরকে নিয়ে গেছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে।
কেমব্রিজে পৌঁছে প্রথমেই যাঁর মুখ মনে পড়েছিলো, তিনি আমার বাবা। প্রচুর ছবি তুলেছিলাম। ফেসবুকে তখন ব্যান ছিলাম তাই ছবিগুলো পোস্ট করতে পারিনি। ছবিগুলো পোস্ট করতে পারলে হয়তো আমার মেজদা অথবা ছোটো ভাই বাবাকে কেমব্রিজের ক্যাম্পাসে দাঁড়ানো বাবার হাড়জ্বালানো কন্যার ছবি দেখাতে পারতো!

আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, ২০২১ সালে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বাবার সাথে সেলিব্রেট করবো! তখন কেমব্রিজের ছবি, কুইন ভিক্টোরিয়ার বাড়ির ছবি, বাকিংহাম প্যালেসের ছবি দেখাবো! ২০২০ সালের সেপ্টেমবারে বাবা মারা যান। আসলে কিছু কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়! এবং সেটাই ভালো। স্বপ্নের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত নিয়ে খেলা করতে করতেই আমার অবসর সময় বেশ কেটে যায়।

তৃতীয় রাত

দূরত্ব হাজার মাইলের চেয়েও বেশি। তবুও তোমাকে কাছে পাবার কী তীব্র ইচ্ছে পুষে রেখেছি বুকে! ঘুমভাঙ্গানী গান, একপকেট চাঁদের আলো বুকের ভেতর ঢুকতে চায় আশ্চর্য মধ্যরাত। এইসব গন্তব্যহীন ষ্টেশানে সরল আশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে বয়ঃসন্ধির কাল। ধানক্ষেতের আইল ধরে ছুটে চলেছে কৃষকের নগ্নচুম্বন। দু’চোখে তার সোনালি ধানের আড়ত। অথচ মহাকাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষের হিংসা স্রোত। ভূ তত্ত্বের গঠন প্রণালি নিয়ে আমাদের আর কোন কথা নেই। মসৃণ নাভিপথ ধরে নেমে আসছে তৃতীয় রাত। জিভের আগায় ধরে রেখেছ তৃষ্ণার্থ জল। প্রশ্নটা চলে আসছে সেই আদিকাল থেকেই – নারীর নাভি এতো সুন্দর কেন? রাত ঋতুবতী হলে অন্ধকার খুলে ফেলে স্বীয় বসন। পেটের নদী শুকিয়ে গেলে যে ক্ষুধা জাগে তার পোস্টমর্টেম করে নাই কেহ। রক্ত যখন ঝরছে আঁচড় কেটেছে কোথাও। এখন ঝুলন্ত সময়। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় বাড়ছে দূরত্ব। অতঃপর বিলীন হয়ে যাবো উদভ্রান্ত কোন এক তৃতীয় রাত্রে।

৩০.০৪.২০১৮

কবিতায় নতুন ধারাঃ স্বপ্ন নয় বাস্তবতা

আমার কাছে কবিতার চেয়ে লাবণ্যময় তেমন কিছুই নেই। আমি সুদীর্ঘ দিন যাবত কবিতার সাথে আছি। কবিতা আমাকে হাসায়…. কবিতা আমাকে কাঁদায়… কবিতা আমাকে সজীবতা দেয়, প্রাণের পরশ দেয়।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এখন কবিতার আগের সেই জৌলুশ আর নেই। পাঠক কবিতা পড়েন না, পড়তে চান না। কেন পড়েন না…. এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন! এর কারণ হল, কিছু কবি আধুনিকতার নাম করে কবিতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। তারা শব্দের জোড়াতালি দিয়ে এমন সব কবিতা লিখেন, যার পাঠোদ্ধার বা মর্ম হয়ত কবি নিজেই জানেন না! আর পাঠক কীভাবে এই কবিতা পড়ে আনন্দ লাভ করবেন? তারচেয়ে বরং কবিতা না পড়াই অনেক অনেক ভালো। এটাই হলো বাস্তবতা। এই যখন অবস্থা তখন প্রিয়কবি ফাহিম ফিরোজ কবিতাকে ভিন্নতর কিছু প্রচেষ্টা করছেন। কবিতাকে আবার সম্মানিত পাঠকের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এই চেষ্টার নাম হল, নতুন ধারা।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। এই ভাষায় আমরা কথা বলি, ভাব প্রকাশ করি। এই ভাষাতেই আমাদের হাসি, আমাদের কান্না, আমাদের সাহিত্য সাধনা। তাই আমরা অত্যন্ত গৌরব এবং অহংকারের সাথে বলি, বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। কারণ এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি। আর আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের অধিক পুরানো। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের পেছনে প্রভাব বিস্তার করে আছে সংস্কৃত, উর্দু, ফার্সি, পুর্তগীজ, আরবি এবং ইংরেজি অনেক শব্দমালা।

সরাসরি অথবা পারিভাষিক ভাবে এই শব্দ কে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। এমনকি এখনও চলছে। মূলত একটি ভাষায় অন্য একটি ভাষার শব্দের এই আত্মীকরণ রোধ করা একটি কঠিন কাজ। ফলশ্রুতিতে চেতনে হোক কিংবা অবচেতনে হোক আমরা তাদের উপস্থিতি মেনে নিয়েছি অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। আলোচনার স্বার্থেই এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছি। অন্যথায় নতুন ধারার আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে বলে আমার ধারণা।

জী… আমরা কবিতায় নতুন ধারার কথা বলছি। কবিতায় নতুন ধারা নিঃসন্দেহে একটি আধুনিক চেতনার নাম। একটি বিপ্লবের নাম। স্বাদে, গন্ধে ভরপুর অপূর্ব একটি ব্যঞ্জনার নাম। আর যার হাত ধরে নতুন ধারার সাহিত্য, নতুন ধারার কবিতা আজ কোনো স্বপ্ন নয়; নিতান্ত বাস্তবতা… তিনি হলেন সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টির সার্থক রূপকার প্রিয়কবি ফাহিম ফিরোজ।

যার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নতুন ধারার কবিতা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। নতুন ধারার কবিতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রোগ্রাম করার কথা ভাবছেন। আমরাও বিশ্বাস করি, নতুন ধারার কবিতা নিয়ে যতবেশি সম্ভব আলোচনা হবে, গঠন মূলক সমালোচনা হবে… নতুন ধারাও ততো বেশি সমৃদ্ধ এবং বিকশিত হবে। মূলতঃ নতুন ধারার কবিতার কাঠামোতে থাকবে শিথিলতা বা শৈথিল্য।

এবার আসা যাক, নতুন ধারার কবিতার ইশতেহার প্রসংগে। যে কোনো বিষয়ের সফলতার জন্য দরকার একটি রোড ম্যাপ। যথার্থ নির্দেশনা। নতুন ধারার সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা তার সারথিদের জন্য ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। বলা দরকার যে, বাংলা সাহিত্য জগতে এটাই প্রথম ইশতেহার। এই ইশতেহারে তিনি বলেছেন, “করোনায় যেভাবে বিশ্ব আজ দলিত-মথিত, দ্রুত পরিবর্তিত, মৃত্যু, আর্তনাদ, শোক, একাকিত্ব, সন্দেহ, খাদ্যাভাব, অর্থ সংকট, বেকারত্ব, জন্মহীনতা– অতীত বিশ্বে কখনো এমন ভয়ংকর চিত্রের মুখোমুখি হয়নি মনুষ্য সমাজ। কবে এই অতিমারীর মুন্ড কাটা যাইবো, কেউ নিশ্চিত কইতে পারেনা। চারদিকে জীবাণু হাতিয়ারের ঈংগিত। বিশ্ব জুড়ে লেখককুল তাদের সৃষ্টিতে অতিমারীজনিত বিষয়াদি অগ্রাধিকার দেবেন এডাই সত্য। আধুনিক বিশ্বের মৃত্যু ঘইটছে। নতুন বিশ্ব এখন প্রসারিত। সমস্ত কিছুই দ্রুত আদল বদলাচ্ছে। আধুনিকের মতো অভেদ্য কাব্য নয় এখন, কিঞ্চিত সহজবোধ্য, কবিতার কোনো অংশ কণা লইয়া দীঘল ভাবনার অবসর কম রৈবে। নন্দন তত্ত্ব অনেকাংশে শক্তি হারাবে। শিল্প, ছন্দ, অছন্দ রৈবে। উপমা, রূপকল্পে কাঠিন্য নয়, সহজ স্বাভাবিক রুপ রৈবে বা না থাইকলেও ক্ষতি নাই। কাব্য গঠনে শিথিলতা রৈবে।

যাহা আধুনিকে আছিলোনা। মানুষ মৃত্যু আতংকে কম বেশি ধর্মমুখী হবে। আধুনিকরা যাহা নিষিদ্ধ কৈরছিলো। আস্তিক – নাস্তিক রৈবে। পরিহার্য্য রাজনৈতিক কোন্দল। প্রকৃতি, বিয়ং (রহস্যময়তা), কল্পনা, অলৌকিকতা জরুরি। নতুন শব্দ খেইল, ভোগবিমুখতা, নির্জনতা থাকবে। অসাম্যতার মৃত্যু ঘটিবে। নয়া পৃথিবীর এগিয়ে যাবে প্রগতির চাকা ছুঁয়ে, সবুজ ও মৃত্তিকার মেলবন্ধনে। শুধু ইতিহাস ঐতিহ্য নয়,এবার পুরাকীর্তি গণ্য হবে অধিক। পুরাকীর্তি না থাইকলে সে ইতিহাস মিথ্যাময়।

অথচ আধুনিকতায় ইতিহাসকই কম হৈলেও গুরুত্ব দেয়া হৈছিলো। ১. আত্মীয় আর সম্পর্ক বাচক শব্দের নাম সহ প্রয়োগ অপরিহার্য। ২. জরুরি প্রমিত ভাষার লগে লোকাল ভাষার কোমল মিশ্রণ। এদুটো বৈশিষ্ট্য নতুন পৃথিবীর নতুন ধারায় কবিতায় অনস্বীকার্য। যাহা আধুনিকে দূরের কথা, হাজার বছরের অধিক জীর্ণ বাংলা কবিতায়ও ছিলো না। প্রথমটি কারো কবিতায় থাইকলেও তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। কিন্তু নতুন ধারার কবিতায় সবার জন্য তা পিনাবদ্ধ। বহুরৈখিকতা আবশ্যক। আধুনিকের মতো শুধু মৌল নয়, গৌনদের কথাও কইবে। সমাজ কাঠামো নির্মাণে তাহাদের প্রভূত অবদান। ভালোবাসা, কাম, নারীর সৌন্দর্য ও ক্ষমতায়ন বৈধ। নতুন পৃথিবীতে সব কিছুই নবীকরণ। আধুনিকতার লগে যার দোস্তী ভাব নাই। করোনাকালীন সৃষ্ট সাহিত্যই বিশ্বে ‘নতুন ধারা’। এটা করোনাকালে ধুমকেতুর মত হঠাৎ, দৈবিক সৃষ্টি। কোনো বিবর্তন নয়। বিবর্তন ঘটে ধীরে। জয়তু নতুন ধারা।”

প্রিয় পাঠক, সত্যি কথা বলতে কী, ইশতিহারটি মনোযোগ দিয়ে কয়েকবার পাঠ করুন। আশাকরি তাহলে আপনি নিজেই নতুন ধারার সাহিত্য সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পেয়ে যাবেন। মূলত নতুন ধারা হলো প্রাণ খুলে লেখার একটি ফ্ল্যাটফরম। চাষীরা যেমন মনের সমস্ত মাধুরি মিশিয়ে খেতে-খামারে যেমন খুশি চাষ করে থাকেন, আপনিও আমাদের নতুন ধারার সাহিত্যে যেমন খুশি মজা নিতে নিতে লিখতে পারবেন। স্বাধীন ভাবে শব্দ চয়নের অবারিত সুযোগ পাবেন।

প্রিয়বন্ধুরা, এবার আসুন নতুন ধারার কবিতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিতে চেষ্টা করি। নতুন ধারার মানে নতুন আনন্দ, চিন্তা-চেতনা, ভালো লাগা, মন্দলাগা এককথায় আমাদের নিত্যদিনের জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা থেকে শুরু করে সবধরণের সমস্যা একটি আনন্দঘন ভিন্ন মাত্রার কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করা।

বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাভাষী কবি এবং লেখকগণকে এই ধারায় ঐক্যবদ্ধ করাই ত আমাদের লক্ষ্য। এই ধারার কবিতার গঠন হবে সংক্ষিপ্ত, রস হবে প্রগাঢ়। যাতে কবিগণ থাকবে স্বাধীন। ইচ্ছেমতো প্রমিত শব্দের সাথে হারিয়ে যেতে থাকা আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করতে পারবেন। আর পাঠকও সম্পূর্ণ কবিতা পড়ে রস আস্বাদন করতে পারবেন। এতে অহেতুক শব্দের বাড়াবাড়ি নেই। কঠিন কোনো বাক্য বিন্যাস নেই। কবিতার অর্থ বুঝতে পাঠককে গলদঘর্ম হতে হবে না। ডিকশনারি ঘাটতে হবে না। কবির ভালোবাসা ও বিশ্বাসে কবিতা চারাগাছ এর মতো বড় হবে। আসুন এই কথাগুলো মাথায় রেখে আমরা নতুন ধারায় কবিতা লিখি।

সম্মানিত পাঠক, এবার আসুন, নতুন ধারার কিছু কবিতার উদাহরণ দেয়া যাক। তাতে করে আপনারা নতুন ধারার কবিতা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা লাভ করতে পারবেন।

পঞ্চাশ বছর।। চাষা হাবিব

তখনও ধ্রুবাবর্ত জীয়ন কূপে
ঢালছিল বিবস্ত্র জল;
উড়তে উড়তে উড়নচণ্ডী দেহখান কইতে থাকে
হামার বাড়িত আছিলো বড় বড় মোটকা ভর্তি চাল;
আজ সেই চালে মায়ার চাদর বালিশ চাপাকল
উত্তেজনা আর পঞ্চাশ বছরের পুরান একরত্তি
ছিপছিপে বংশাল শাল। এখনো ঢালে ধ্রুবজল
হামরা হাপসাই যাই;
দমের ভিতর শালখানি গন্ধছড়ায়
দাদার বিড়ির গন্ধ–তামুক–খুঁইনি
পঞ্চাশ বছরের পুরান একরত্তি ছিপছিপে শাল।।

ক্ষুধা/ কবির আহাম্মদ রুমী

ক্ষুধা এক অন্ধকার ভাষা—–
যতিচিহ্ন উপড়ে ফেলা খটখটে নিষিদ্ধ নির্দয় কবিতা।
হাড্ডিতে করোটিতে বাজে রে বাজে
তবলার বোল; ক্ষুধা আদিম আন্ধার – যা–
মাইনসের মাথা নুয়ে দ্যায়- ইশ্বরের কাছে–
একদা মিছিল, পিকেটিং, লিফলেট বিলি পাঁচিলে চিকামারার গনগনে উত্তেজনার ফাঁকেও–
গম্ভীর রাইতে
মুখোমুখি হতাম– আমি ও রাত্রি!

.
ভিকটিম/ রেশম লতা

ভিকটিম, হোগলাপাতা!
গাছ সামলান জরুরি ছাদ থেইকে!
এপার ওপার এক সূতার দুই মাথা
গুরুত্বরা সাঁকো
নড়ে আর লাফায়
মুদি দোকানের সদাই বান্ধনের গেরান শুঁইকেই
খালুর শুক্রবার অতিবাহিত।
বেবাকতের অজানা নাওরন্দী খালের কাহিনী।

বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ / উৎপলেন্দু পাল

বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ
কোথাও কি আগুন লেগেছে ?

একফালি বারান্দায় বেশ শান্তি আছিল
সকালে রইদ পড়তো সন্ধ‍্যায় শিশিরের রেশ
দুই পা ছড়াইয়া বসলে ক্লান্তি শেষের তন্দ্রা
ভাজা বাদামের খোসা ছাড়ানোর আওয়াজ

হাচুইন‍্যার মা’য় গৈঠা দিত দেওয়াল জুইড়া
প্রভা বামনি গোবরের ছিটা ভোর রাইতে
হারুণ মুনসির আজানের সুর বাতাসের গায়
মেরি মাসী মোম জ্বালাইতো ক্রুশের তলায়

কাদের জানি রাইতের আন্ধারে ফিসফাস
দাবার বোর্ডে মাথা চুলকায় গম্ভীর মুখ
কাদের পোষাকে যেন গোপন রক্তের দাগ
অচেনা নিঃশ্বাস জুড়ে শুধু বারুদের ঘ্রাণ

ভাবসাবের কালাজ্বর / নটরাজ অধিকারী
.
গাঁওয়ের ভিতরে ঢুইকা গেছে শহুরের স্বভাব।
অতি গোপনে মিয়া ভাই আর মিয়া ভাই নাই
সে অহন ব্রাদার হইছে। চাচি-খালাম্মা অহন
আন্টি হইয়া ঘুইরা বেড়ায়, রোদচশমা চোখে
পরে সবকিছু রঙিলা দ্যাখে। কালাজ্বর যখন
ঝাপ্টাইয়া ধরে ভাবসাব, আধুনিকতা হারায়।
.
মইত্যা দাদার লাল গরুটা, বিকালকে জাবর
কাটে ; সইন্ধ্যা ল্যাদায়। রাইত বিরাইতে বসে –
হুক্কা টানে উত্তর পাড়ার মইজ্যা কাকু, কাশে ;
বাতাসে কালাজ্বর ভেঙে ভেঙে বিহান আসে।
.
হলুদ ফিতার উপর বসে উদাস রোদ পোহায়
করিমন পাগলীর চুলে ভাবসাবের কালাজ্বর।
.
লতা কাহিনী/ উত্তম কুমার দাস

ফোড়ন ওঠার ঝাঁজ দেইখ্যা লতা মুচকি হাসে…..
পরানের পোলার জিভের স্বাদ গ্যাছে…
তাই লতা আজ সাধ বদল করব…..
স্বাদ থেকে সাধ… জিভ থাইক্কা একদম মনে।

শিউলি পর্ব/ আবুল খায়ের বুলবুল

যতই কওনা কেন ভালো আছো তুমি
কেমনে কইমু কিভাবে আছো?
তা কিন্তু জানি, সালেহা নানীও তা বলে
কথাটা আসলে এইডা নয়
তুমি বুদ্ধির প‍্যাঁচ মাইরা সব সময় কথা কও
এইডা আশৈশবেও তোমাকে জানতাম।
দুখের বানে ভাইসা গেলেও তুমি বলতে
সুখের ফোয়ারায় গোছল করে আসছো।
আসলে কি তুমি আইজও সেই অভ‍্যাসটা ছাড়োনি?

সইত‍্যের উপর মিথ‍্যা দিয়ে সুন্দর কিছু অয় না
মিথ‍্যার মইধ‍্যে কখনও সত‍্যকে মিশাইও না,
তাতে জীবনের সৌন্দর্য ক্ষয়ে ক্ষয়ে ম্লান হয়ে যায়।
ও ফুল ও নিষাদ/মুকুল ম্রিয়মাণ
ও ফুল ও নিষাদ,
হরহামেশা জাগিয়ে তুলছো লালিত মেলানিন;
বিপন্ন বালিহাঁসের মিথুন দৃশ্য থেকে
দূরে সরে যাচ্ছে গায়েরী প্রেমিক।
আর আমার গল্পটাও জমজমাট!
গাঁ-গামালের রেশমী মেয়ে রেশমা
এহোন তোমাগোর মন কাইড়া লয়,
শোনো সুদর্শন ছোকরা হাচা কইতাছি-
একদিন আমারও মন কাইড়া নিছিলো-
সে ঘোলাটে চোখের বরকন্দাজ,
ঢুইকা পড়ছিলো এই বুকের জিরাতে

নতুন ধারায় লেখা কী অসাধারণ সব কবিতা। অযথা শব্দ চয়ন যেমন নেই, তেমনি প্রতিটি শব্দ মেদহীন। বাংলা ভাষার প্রমিত শব্দাবলীর সাথে আঞ্চলিক শব্দের কী অসাধারণ মেলবন্ধন। কবিতাগুলো পাঠক করলেই বুঝা যায়, ইহা কবিদের প্রাণের পরশ দিয়ে লেখা। উপমা, অলংকার, অনুপ্রাস এবং রুপকের নামে কবিতাকে দূর্বোধ্য করে তোলা হয়নি। একেবারেই সহজ-সরল এবং সকল শ্রেণির পাঠকের বোধগম্যর সীমার মধ্যে। এই ধরণের কবিতা নিঃসন্দেহে পাঠককে বেঁধে রাখবে বলে আমার গভীর বিশ্বাস।

তাই আমরা বলছি, নতুন ধারা কবিতার জগতে একটি বিপ্লব। দূর্বোধ্যতা এবং কাঠিন্যের জন্য যে পাঠক কবিতা পড়তে ভুলে গেছেন, কবিতার বই পড়তে ভুলে গেছেন…. আমার দৃঢ় বিশ্বাস নতুন ধারার কবিতা আবার সেই পাঠককে ফিরিয়ে আনবে। আর আমরাও ফিরে পাব কবিতার হারানো ঐতিহ্য। জয়তু নতুন ধারা।।

শেষ করছি নতুন ধারায় লেখা আমার একটি কবিতা দিয়ে—-

সুবাসিত আতর// জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
———————
রাইত পোহালেই যে কবিতার প্রসব অইত জ্বর
সে-ই অহন আজিব আন্ধার রাইতের ঘর!
সখিনা তবুও রোজ রাইতে চিল্লাইতে চিল্লাইতে
কয়-” সবাই তরা সব্বাই সুখ নিবার চাস
দুঃখগুলো কেন আমার বাড়িত পড়ে রয়!

জানস, হামারও অনেক অনেক সুখ আছে
এই যেমনঃ দাঁত ব্যথার সুখ
মেরুদণ্ডের হাড্ডি ক্ষয়ে যাওয়ার সুখ
রোজ রাইতে একলা একলা থাকবার সুখ!

হুন, তবুও আমার কোনো দুখ নেই…
একদিন পাহাড় ছিলাম আর অহন পাথর
তোরা চোখ-মুখে মাইখ্যা নে সুবাসিত আতর!

আমরা গভীর ভাবে বিশ্বাস করি, নতুন ধারার মাধ্যমে কবিতার পালাবদল হবে। নিত্য-নতুন ভাবধারা, রহস্যময় আবেদন এবং আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে নতুন ধারার কবিতা অবশ্যই পাঠক ফিরিয়ে আনবে এবং কবিতা ফিরে হারানো জৌলুশ এবং প্রাণের স্পন্দন।
————————–

অনুশোচনা ছাড়া জীবন যাপনের একমাত্র উপায় হল সততা

ttyu

বিশ্বাস দ্বারা ‍গঠিত চল্লিশটি উক্তি আমাদের সমাজের প্রত্যেক মানুষের জন্য প্রয়োজন কিন্তু আপনার সেই প্রয়োজনের প্রয়োজনটি কখন এসে আপনার সম্মূখদ্বারে হাজির হবে সেইটা কেউ জানেনা। কিন্তু আমরা যদি যথাক্রমে সজাগ থাকি তাহলে এর উত্তরণ অবসম্ভব নয়। তাহলে চলূন লেখার জগতটা ঘুরে আসি দেখে আসি কি লেখা আছে।

১. “বিশ্বাস হল একটি সূক্ষ্ম উদ্ভিদের মতো যা বেড়ে উঠতে সময় এবং মনোযোগ লাগে। কিন্তু ধ্বংস হতে এটি মাত্র এক মুহূর্ত লাগে।” যেমন এই ক্ষমা প্রার্থনা অন্যদের বিশ্বাসকে সম্মান ও রক্ষা করার গুরুত্বের উপর জোর দেয়, কারণ এটি হারানো সহজ কিন্তু ফিরে পাওয়া কঠিন।

২. “সততা এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা বিশ্বাস তৈরি করে, যখন অসততা এটিকে নষ্ট করে। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হল একটি শক্ত ভিত্তি এবং তাসের ঘরের মধ্যে যে পার্থক্য বিরাজমান।”

৩. “সততা হল তেলের মত কিছু যা সমাজের চাকাকে তৈলাক্ত করে খুব নরম ভাবে পরিচালিত করে, আর অসততা হল বালি যা তাদের থামিয়ে দেয়।”

৪.”একজন সৎ ব্যক্তির কথা এবং কাজ রাতের আকাশের তারার মতো সারিবদ্ধ হয়, যখন একজন অসৎ ব্যক্তির গ্রহগুলি এলোমেলোভাবে প্রদক্ষিণ করে।”

৫. “সততা হল একজন সত্যিকারের নেতার বৈশিষ্ট্য, যখন অসততা হল প্রতারকের চিহ্ন। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হল ভেড়ার পোশাকে রাখাল এবং নেকড়ের মধ্যে পার্থক্য।”

৬. “সততা হল যেকোনো সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি, আর অসততা হল সেই বিষ যা ধীরে ধীরে মেরে ফেলতে পারে।” – তবে অসততা দ্বারা একজন লাভবান হয় আরেকজন ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু সততা দ্বারা দুই জনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৭. “সততা শক্তির লক্ষণ, আর অসততা হল দুর্বলতার লক্ষণ। সত্য বলতে সাহস লাগে, কিন্তু মিথ্যা বলতে তার চেয়েও বেশি লাগে।”

৮. “একজন সৎ ব্যক্তি সবকিছু হারাতে পারে, কিন্তু তারা কখনই তাদের সততা হারাবে না। একজন অসৎ ব্যক্তি সব কিছু পেতে পারে, কিন্তু তারা কখনই সম্মান অর্জন করতে পারে না।”

৯. “সততা হল সর্বোত্তম নীতি কারণ এটি আপনাকে আপনার বলা মিথ্যা মনে রাখার থেকে বাঁচায়।”

১০. “সততা হল জ্ঞানের বইয়ের প্রথম অধ্যায়, যখন অসততা হল মূর্খতার প্রথম ধাপ।”

১১. “একজন সৎ ব্যক্তি অন্ধকারে ভরা পৃথিবীতে আলোর প্রদীপের মতো, আর একজন অসৎ ব্যক্তি রাতের চোরের মতো।”

১২. “সততা এমন একটি বিশ্বে একটি বিরল পণ্য যা সততার চেয়ে সাফল্যকে মূল্য দেয়, তবে এটি বিশ্বের সমস্ত সম্পদের চেয়ে বেশি মূল্যবান।”

১৩. “একজন সৎ ব্যক্তি সর্বদা নিজের সাথে শান্তিতে থাকে, যখন একজন অসৎ ব্যক্তি তাদের মিথ্যার দ্বারা ক্রমাগত কষ্ট পায়।”

১৪. “সততা হল একমাত্র নীতি যা কখনই শৈলীর বাইরে যাবে না।”

১৫. “একজন সৎ ব্যক্তির ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যখন একজন অসৎ ব্যক্তি সর্বদা তাদের কাঁধের দিকে তাকিয়ে থাকে।”

১৬. “সততা হল আস্থার দরজা খোলার চাবিকাঠি, আর অসততা হল চিরতরে তালাবদ্ধ করার চাবিকাঠি।”

১৭. “একজন সৎ ব্যক্তির খ্যাতি একটি মূল্যবান গহনার মতো, যখন একজন অসৎ ব্যক্তির খ্যাতি একটি সস্তা নকঅফের মতো।”

১৮. “সততা হল জ্ঞানীর ভাষা, আর অসততা হল মূর্খের ভাষা।”

১৯. “একজন সৎ ব্যক্তি ধোঁয়ায় ভরা ঘরে তাজা বাতাসের নিঃশ্বাসের মতো, আর একজন অসৎ ব্যক্তি বিষাক্ত ধোঁয়ার মেঘের মতো।”

২০. “সততা শুধু সত্য বলা নয়, এটি সত্য জীবনযাপন করা।”

২১. “একজন সৎ ব্যক্তি রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যখন একজন অসৎ ব্যক্তি তাদের রাতগুলি অশান্তিতে কাটায়।”

২২. “সততা হল বিশ্বাসের ভিত্তি, এবং বিশ্বাস হল যেকোনো সফল সম্পর্কের ভিত্তি।”

২৩. “একজন সৎ ব্যক্তির কথার ওজন থাকে, যখন একজন অসৎ ব্যক্তির কথা শূন্য এবং অর্থহীন।”

২৪. “সততা এমন একটি গুণ যা কেনা যায় না, অন্যদিকে অসততা এমন একটি গুণ যা খুব ব্যয়বহুল হতে পারে।”

২৫. “একজন সৎ ব্যক্তিকে তারা কী বলেছিল তা মনে রাখার দরকার নেই, কারণ তারা সর্বদা সত্য বলে।”

২৬. “একজন সৎ ব্যক্তি ঝড়ো সমুদ্রের পাথরের মতো, আর একজন অসৎ ব্যক্তি বাতাসে উড়ে যাওয়া পাতার মতো।”

২৭. “সততা কেবল সত্য বলার জন্য নয়, এটি নিজের প্রতি সত্য হওয়া সম্পর্কেও।”

২৮. “একজন সৎ ব্যক্তির কাজগুলি তাদের কথার চেয়ে বেশি জোরে কথা বলে, যখন একজন অসৎ ব্যক্তির কথা তাদের কাজের চেয়ে বেশি জোরে বলে।”

২৯. “সততা হল আলো যা প্রতারণার অন্ধকারের মধ্য দিয়ে জ্বলে।”

৩০. “একজন সৎ ব্যক্তি একটি আয়নার মতো যা সত্যকে প্রতিফলিত করে, যখন একজন অসৎ ব্যক্তি একটি মজাদার আয়নার মতো যা এটিকে বিকৃত করে।”

৩১. “সততা হল একটি সুখী এবং পরিপূর্ণ জীবনের ভিত্তি, যখন অসততা হল দুঃখ ও হতাশার পথ।”

৩২. “একজন সৎ ব্যক্তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, কিন্তু তারা সবসময় শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী হয়ে আসে। একজন অসৎ ব্যক্তিকে জয়ী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তারা সর্বদা উন্মুক্ত হওয়ার ভয়ে বাস করে।”

৩৩. “সততা একটি বিরল এবং মূল্যবান পণ্য, তবে এটি যেকোনো বস্তুগত সম্পদের চেয়ে বেশি মূল্যবান।”

৩৪. “একজন সৎ ব্যক্তির কথা সোনার মতো, আর অসৎ ব্যক্তির কথা বোকার সোনার মতো।”

৩৫. “সততা হল একটি সফল কর্মজীবনের ভিত্তি, যখন অসততা হল ধ্বংসপ্রাপ্ত খ্যাতির পথ।”

৩৬. “একজন সৎ ব্যক্তি একটি বাতিঘরের মতো যা জাহাজকে নিরাপদে তীরে নিয়ে যায়, আর একজন অসৎ ব্যক্তি একটি পাথরের মতো যা তাদের ধ্বংস করে দেয়।”

৩৭. “সততা হল সেরা উপহার যা আপনি নিজেকে এবং অন্যদের দিতে পারেন।”

৩৮. “একজন সৎ ব্যক্তির চরিত্র হল তাদের সবচেয়ে মূল্যবান অধিকার, যখন একজন অসৎ ব্যক্তির কোন মূল্য নেই।”

৩৯. “সততা শুধুমাত্র একটি নৈতিক নীতি নয়, এটা জীবনের একটি উপায়।”

৪০. “একজন সৎ ব্যক্তি হল গভীর শিকড় বিশিষ্ট একটি গাছের মত যা যেকোনো ঝড়ের মোকাবিলা করতে পারে, আর একজন অসৎ ব্যক্তি হল একটি আগাছার মত যা বাতাসের প্রথম দমকাতেই শুকিয়ে যায়।”

৪১. “অনুশোচনা ছাড়া জীবন যাপনের একমাত্র উপায় হল সততা।”

tyu
Intarlaken Road Switzerland. Nature of beauty.