বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

দৈনন্দিন ব্যস্ততায় বন্ধুকে হারিয়ে ফেলবেন না যেন!

out.

যদি জানতে চাওয়া হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল সম্পর্কের নাম কি? চোখ বন্ধ করে অনেকেই বলবেন বন্ধুত্ব। বন্ধু মানে আত্মার আত্মীয়, যে আত্মীয়তা কখনো কখনো রক্তের বন্ধনকেও ছাড়িয়ে যায়। “বন্ধুত্ব” হচ্ছে দুই অথবা তার অধিক কিছু মানুষের মধ্যে একটি সম্পর্ক যাদের একে অপরের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা রয়েছে।”

বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? সেটা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন রকমের মতভেদ আছে। আছে বন্ধুত্বের রকমফেরও! নিশ্চয়ই ভাবছেন, বন্ধুর আবার রকমফের কি? বন্ধু তো বন্ধুই! একটু দাঁড়ান। আর খানিক সময় থমকে থেকে ভাবুন তো, আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটির বন্ধু তালিকায় প্রথম নামটিই কি আপনার? সেও কি আপনাকে আপনার মতোই বন্ধু ভাবছে?

আসলে বন্ধুত্ব কোনো সূত্রের মাপকাঠিতে মাপা যায় বলে মনে হয় না l তবে বন্ধুত্ব হলো ভালবাসার একটি নির্যাস, সু-সময় কিংবা অসময়ের সঙ্গী। বন্ধু জীবনে অক্সিজেনের মতো। যে কথা কাউকে বলা যায় না, সেই গোপন কথার ঝাঁপি নিশ্চিন্তে খুলে দেয়া যায় বন্ধুর সামনে। বন্ধু কখনো শিক্ষক, কখনো দুষ্টুমির সঙ্গী। বন্ধু মানে বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস আর ছেলেমানুষি হুল্লোড়। সব ধরণের মানবিকতা বোধ ছাপিয়ে বন্ধুত্বের আন্তরিকতা জীবনের চলার পথে অন্যতম সম্পদ। বন্ধু হলো যাকে বিশ্বাস করা যায় চোখ বন্ধ করে, ভরসা করা যায় নিজের থেকেও বেশি, নির্ভর করা যায় সবচেয়ে বেশি।

সামান্য ভুল বোঝাবুঝি থেকে সহসাই বন্ধুত্বের সম্পর্কে ফাটল ধরতে দেখা যায়! যে ব্যাপারটা সামান্য আলোচনার মাধ্যমেই মিটে যেতো, তাকে বছরের পর বছর মনের মধ্যে পুষে রেখে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার দৃষ্টান্তও নিতান্ত স্বল্প নয়।

বন্ধুতে ভালো শ্রোতা হোন। বন্ধুর সাথে আড্ডায় কেবল নিজের কথাগুলোকেই প্রাধান্য দেবেন না। আলোচনায় উৎসাহিত করুন। বন্ধুর সমস্যাগুলো কে গুরুত্ব দিন। বন্ধু মানেই কেবল আমার সবটুকু কথা তাকে বলে ফেলা নয়! বরং তার কথা গুলোকেও আপন করে নেয়া!

বন্ধুত্বে বিশ্বাস রাখুন। তৃতীয় কোন ব্যক্তির বক্তব্যের জের ধরে সম্পর্কে ফাটল ধরাবেন না। মুখোমুখি আলোচনায় বসুন, সরাসরি জানতে চান। প্রয়োজনে তৃতীয় ব্যক্তিকে সামনে রেখে তথ্যের সত্যতা যাচাই করুন। অকারণে দায়ী করবেন না। বন্ধুর কোন কিছু অপছন্দ হলে অন্যের কাছে সমালোচনা না করে সরাসরি বলুন। শুনতে তিক্ত হলেও ফলাফল মধুর হবে। বন্ধুর বিশ্বাস করে বলা গোপন কথাগুলো খুব সহজেই অন্যকে বলে ফেলবেন না।

বন্ধুত্বকে শ্রেণীভেদ, সম্পদ, ক্ষমতা, পদমর্যাদার নিক্তিতে পরিমাপ করবেন না। বন্ধুর সীমাবদ্ধতাকে তার দুর্বলতা ভাববেন না। সামান্য একটু করুণা সুদীর্ঘ বন্ধুত্বকে নষ্ট করে দিতে যথেষ্ট। বন্ধুকে করুণা নয়, সম্মান দিন। সমালোচনা করুন, তবে কটূক্তি নয়। বন্ধুর সমালোচনা বন্ধুরা করবে নাতো করবে কে? তবে সমালোচনার ভাষা নির্ধারণে সচেতন হোন। একবার ভুল করলে তাকে ছুঁড়ে দেবেন না। শুধরে নিতে উৎসাহ দিন। প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ান। বিনয়ী হোন।

ভুল করলে সরি বলুন। এতে আপনি ছোট হয়ে যাবেন না। বন্ধুত্বের মাঝে ইগো আনবেন না। ছোট্ট একটা সরি দূরত্বকে এক নিমেষেই দূর করতে পারে। মনে রাখবেন, এই ইগোতে কেবল বন্ধুকেই হারাবেন না, নিজেও হেরে যাবেন।

বন্ধুত্বকে সময় দিন। দৈনন্দিন ব্যস্ততায় বন্ধুকে হারিয়ে ফেলবেন না যেন! আপনার বন্ধু আর আপনার মাঝখানে কেবল এক মুঠোফোন দূরত্ব। বন্ধুকে মনে করুন, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করুন।

হাতখানা বাড়িয়ে দেখুন, বন্ধুরা সব পাশেই আছে। চুপিচুপি, লুকিয়ে। হয়তোবা সেই বন্ধু প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করছে কখন আপনি তার বন্ধুত্বের গুরুত্ব ও মূল্য দেবেন।

শেষে বলি বন্ধু হল : -“A clove of love – A pinch of concern – A speck of care – A sack of support – A ray of hope – A spoonful of trust – A drop of loyalty – A spread of friends – A circle of activities Mix them well, and with a bit of effort, Friendship is Formed.”

বস্তা পচা যে কোন কিছুই আলোচনার দরজা উন্মুক্ত রাখে

১. একজন মানুষের নেতিবাচক প্রভাব ও গল্প সর্বদা আলোচনা শীর্ষে অবস্থান করে। যেখানে একজন মানুষের ইতিবাচক কর্ম আচরণ উদ্দেশ্য ও স্বভাব থেকে যায় জনসমাগমহীন নিরবতার আড়ালে।

তাই আমি মনে করি বস্তা পচা যে কোন কিছুই আলোচনার দরজা উন্মুক্ত রাখে।

২. আমাদের ক্যারিয়ারের কঠিন যাত্রায়, আমরা প্রায়শই কঠিনতম পথ অতিক্রম করি, অপরিমেয় হতাশার মুখোমুখি হই এবং বেদনাদায়ক পরিস্থিতি সহ্য করি।

তবুও, সতর্কতার সাথে চলুন, কারণ সাফল্যের অন্বেষণে, আমাদের সেই বন্ধনগুলি ছিন্ন করা উচিত নয় যা আমাদের লালিত স্বপ্নের উদ্ভাসিত পথ হিসেবে পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের সাথে আবদ্ধ করে। যা একবার ভেঙ্গে গেলে, সেগুলি মেরামত করা কঠিন হয়ে যায়, আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সত্যিকারের পরিপূর্ণতা কেবল পেশাদার বিজয় নয়, বরং সুরেলা সংযোগগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে যা আমাদের আত্মাকে লালন করে।

অভিমান

ria

নীল আকাশের চাঁদটার থেকে অভিমান তুলে নিয়ে, যদি ইচ্ছে করে উড়ে যাই হাওয়া পথ ধরে! সেই যে পথে কবে ভেসে গেছি ছোট্ট আমি। বৃষ্টির ফোঁটা জলে মিশে নিয়ে গেছে সবটুকু আলো, এই আমাকে অন্ধকারে রেখে।
এখন ছায়ারা শুধু ভিড় করে অবরে সবরে। ভাবছি মেঘেদের কাছ থেকে বৃষ্টি নেবো আর আনমনে মেখে নেবো। দুদিন ধরেই দু’চোখের প্লাবনে ভেসে গেছে মেঘমন। জানি, এ চোখের মেঘ সরাবার বৃথাই প্রয়াস।

ইচ্ছে করে গাছেদের শিরা থেকেও সবুজের ঢেউ নিতে। হৃদয় মাঝে ফুল সাজে রেখো দেবো। আর যদি হৃদি-নদে তালে তালে নাও খানি ভাসে আর ভাসানের উৎসবে যদি চিতার ছাই ওড়ে, তবে উড়ে যাক, পুড়ে যাক সব দীর্ঘশ্বাসে। বিসর্জনের ঢাক বাজুক আবার।

মন, তুই শুধু রাত হলে খুঁজে নিস জোনাকির আলো।

দেশ হতে মহাদেশে … সাগর হতে মহাসাগরে!

fft

সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া।
সামার ব্রেকের পর পুরো-দমে ক্লাস চলছে। প্রকৃতিতে শরতের আগমনী বার্তা। একদিকে পাতা ঝরছে, অন্যদিকে দিনগুলো ছোট হয়ে আসছে। তেমনি এক দিনে ডিন অফিস খবর দিল আরও ৫জন বাংলাদেশি আসছে আমাদের কলেজে। ইউক্রেইনের ঝাপারোজিয়া শহর হতে রেলে করে আসছে ওরা। ষ্টেশনে কলেজের বাস যাচ্ছে ওদের আনতে। আমাদের কেউ যাবে কিনা জানতে চাইলে আমি রাজি হয়ে গেলাম।

ষ্টেশনেই পরিচয় ওদের পাঁচজনের সাথে। এই পরিচয় একে একে গড়াবে অনেক বছর। পাড়ি দেবে অনেক পথ, অতিক্রম করবে অনেক দেশ মহাদেশ। এবং সম্পর্ক তুই তুকারিতে গড়িয়ে চিরদিনের জন্যে স্থায়ী হবে।

সে পাঁচজনেরই একজন। ৪ বছরের তিন বছর একই কলেজে একই ডর্মে থেকে এক সময় ছিটকে যাই। ৩ বছর [পর আবারও দেখা হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে। আমি যে বছর মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি সে তখন কম্যুনিকেশনের উপর ডক্টরেট করছে।
এরপর দুজনের পথ দুদিকে গড়িয়ে যায়…

ভাগ্যচক্রে আবারও আমাদের দেখা হয়। এ যাত্রায় খোদ বাংলাদেশে। ও আমারই মত ইউরোপের লম্বা পর্ব শেষ করে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে এসেছে। নতুন পরিবেশ পরিস্থিতিতে বন্ধুত্বের শিকড় আরও লম্বা হয়।

প্রফেশনাল তাগিদে ও চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের আবু ধাবিতে। আমিও পাড়ি জমাই তাসমান পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। যোগাযোগ অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে।

আমাদের চলমান জীবন যেন কোথাও যেন স্থায়ী হতে চায়না…ভাগ্য আমাকে নিয়ে আসে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এক সময় জানতে পারি সে সপরিবারে মাইগ্রেট করেছে কানাডায় এবং চাকরি নিয়ে চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।

গোলাকার পৃথিবীর কক্ষপথ ধরে আমরাও হাঁটছি। এবং সে পথ আমাকে একসময় টেনে আনে মেগা শহর নিউ ইয়র্কে। কোন এক সুন্দর সকালে ও হাজির হল আমার দরজায়। দরজা খুলতে বাঁধভাঙ্গা আবেগ এসে আমাদের নিয়ে গেল কৈশোরে। কত বছর পর দেখা! শুরু হল নতুন এক জীবন। ওখানে আগ হতে যোগাযোগের মধ্যমণি রহমান ছিল। তিন জনই কাজ করি। কর্মদিন সহ প্রায় প্রতিদিনই দেখা হত আমাদের। আড্ডা হত কুইন্সে আমার বাসায়। এভাবে কেটে যায় একে একে ৫টা বছর…

এবার আমার পালা। ওদের দুজনকে নিউ ইয়র্কে রেখে আমি চলে আসি আমেরিকার বুনো পশ্চিমে। মাঝে মধ্যে কথা হলেও দেখা হয়না।

অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট নবায়ন করতে যে যাত্রায় নিউ ইয়র্ক যেতে হয়েছিল। তখন মধ্যরাত। শান্ত হয়ে গেছে মেগা শহর নিউ ইয়র্ক। ফ্লাইট হতে বেরুতেই দেখি ওরা দুজন দাঁড়িয়ে আছে। আবারও দেখা, আবারও সেলিব্রেশন।

শেষপর্যন্ত সেও ছেড়ে যায় নিউ ইয়র্ক। এ যাত্রায় তার গন্তব্য ছিল সূর্যস্নাত ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অর্লান্ডো। আগে হতেই বাড়ি কেনা ছিল, তাই গুছিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি।

রাত প্রায় ১১টার উপর। আমি জানি সে সকাল সকাল বিছানায় যায়। এ যাত্রায় কথা ছিল গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্যে বাইরে অপেক্ষা করবে। নিউ ইয়র্কের মতই ফ্লাইট হতে বেরিয়ে কিছুটা পথ আগাতে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আগের মত…যেমনটা ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গে, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সাউথ ডেভনে, নিউ ইয়র্কে।

তিনটা দিন হুট করেই পার হয়ে গেল। এ যাত্রায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চষে বেড়ালাম ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ডিজনি এনিমেল কিংডম, ড্রিম পার্ক সহ অনেক জায়গা। ডেইটনা বীচের আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে আসতেই মনে হল আমাদের বিদায়ের এটাই পারফেক্ট ভেন্যু। এটাই যেন আমাদের শেষ দেখা না হয় তেমন প্রতিজ্ঞা করেই বিদায় জানিয়েছি একে অপরকে। আমি জানি বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে…কে জানে হয়ত আফ্রিকার কোন গহীন জঙ্গল অথবা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনে।

আমার রবীন্দ্রনাথ

_11

সদ্য রবীন্দ্র তিথি গেলো। সবাই তাঁকে নিয়ে পোস্ট করছেন। আমারও শখ হলো পোস্টাতে। একটা বছর তিন-চারের পুরোনো, প্রকাশিত লেখা।

আমার রবীন্দ্রনাথ
ভালো বই শিক্ষকের সমান। যে মানুষ বই পড়েন তাঁর অনেক শিক্ষক। আমাদের মাথার উপর অনেক দিকনির্দেশক ছায়ার হাত ছিল। সেইসব হাত আমরা ঠেলে সরিয়েছি। অধীত জ্ঞান আর বিদ্যাকে জীবনে ক’জনই বা প্রয়োগ করতে পারি? শুধু সব অনুভবের অনুভবী সর্বগ্রাসী রবীন্দ্রনাথকে সবটুকু ঠেলে ফেলতে পারি নি।

আজ ঘর-বারের এমন ওলঢাল দেখে তোমাকেই রবিঠাকুর, মনে পড়ে যায় গো ! সামনে – কাছে – দূরে অজস্র যে পথ ও জীবন, – সব দিকেই তোমার বাণীমূর্তি। তোমায় কত সামান্য পড়েছি, কত সামান্য পরিমাণে ভেবেছি। তোমার ভাব আর অনুভবকে ধারণ ও বহন করতে না পারার দীনতা আমার। তবু যেটুকুও ধরা দাও – সে তোমারই প্রসাদ গুণ।

“সহজ পাঠ” দিয়েই জীবনের শুরুতে সুষমাকে চিনেছিলাম। তারপর “শিশু”, “শিশু ভোলানাথ”…! বইএর পাতা থেকে চট করে আঙুলটা সরিয়ে নিয়ে রহস্যময় হাসিটি হেসে, ‘দাঁড়াও, এক্ষুনি আসছি। ততক্ষণ তুমি …” বলেই ধাঁ হয়েছিলে।

তারপর এই অকূল সমুদ্র-তীর। কড়া রোদে পুড়ে যাচ্ছি, তেষ্টায় ছাতি ফাটছে। পা পুড়ে যাচ্ছে তপ্ত বালিতে। কত কথাই বলে চলেছি তোমার উদ্দেশ্যে, সেসব কথার পাতা হাওয়ার পাগল উড়িয়ে দিল এদিক ওদিক। অথচ দেখ, একটা যদি মেঘছায়া দিন হতো ! … ধরো, খুনসুটির বাতাসে চুল উড়ছে – আঁচল উড়ছে… গাছের ডালে সবুজ কচিকাঁচারা কী উজ্জ্বল! আহা! কেন এমন করে পা ভেজানো নীলাম্বুরাশি আমায় খুশী দিল না বলো তো?

শুধু দেহে নয়, মনেও তো বাঁচতে চাওয়া! আমার মনের কোনে – বাইরে দূরে – আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যত – আমার সকাল সন্ধ্যা – আমার গ্রীষ্ম বর্ষা – সব স-ব-খানে, আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় তোমার পদছাপে চোখ রেখে পথের নির্দেশ পেতে চাইলাম। ভাঙা নৌকায় বৈঠাহীন ঝড়ের রাতে তুমি একটিবার এলে না, ব্যর্থ অভিসার! তবু তোমাকেই বিশ্বাস করতে চেয়েছি যে, সবই শেষ পর্যন্ত পরমের দিকে এগিয়ে যায়।

সারা শ্রাবণ মাথায় নিয়ে একা জিওল রাস্তায় গোধূলি ভেঙে চললাম কোনো এক শৃঙ্গজয়ের দিকে তাকিয়ে। তুমি কুপি জ্বেলে দোরে এলে, আর যদিও তোমার খোয়াই সাজানো ভেজা দুয়ারে বসতে পারলাম এক মুহূর্ত, তবু ভবিতব্য এই যে, বর্ষাভেজা হাঁসশরীর সেই গেরস্থালীর পালকই ঝেড়ে চলেছে।

কার জীবন কে যাপন করছে তা-ই বুঝি না! তোমার কুমুদিনীকে মনে পড়ে যায়। জাগরণে কাতরাতে কাতরাতে জ্বালা জ্বালা চোখ খুলে প্রস্তুত হই। তার মতো করে ভাবি যে স্বামীসঙ্গে সফল করে তুলব আজকের যাপন, তোমার লাবণ্যর মতো পেলব করে তুলব – ইহ গচ্ছ ইহ তিষ্ঠ – সে দিনটি। অথচ সেই দম দিয়ে দেওয়া পুতুল। ক্রমাগত ছুট ছুট রান্নাঘর – নিজের ঘর ( নিজের!) – খাবার না দেখেই মুখ থেকে দু-গ্রাস পেটে চালান। তারপর ঘাম মুছতে মুছতে চক-ডাস্টার। যদি পড়াতে চাইলাম কবিতা, কিংবা কম নম্বর পাওয়া মেদুর চোখের ছাত্রীটির মধ্যে ফটিককে দেখে কাশের ডাঁটা চিবুতে চিবুতে নদীর ধারে হাঁটতে চাইলাম, অমনি সিলেবাস দরজার সামনে কড়া চোখে এসে দাঁড়াল। … দিনশেষে দেখি সব প্রস্তুতি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছেন “মধুসূদন”। তোমার কথা মানলে হয়তো এও ব্যর্থ নয়!

অন্ধকার ঘরে কখনো কখনো তুমি সাগর সেন বা দেবব্রত-র গলায় বেজে চলো। সারারাত। আমি যখন তোমাতেই বাস করি, যখন আবদার করি, সপসপে ভিজে কাঁপতে থাকা আমাকে তুমি শুশ্রূষায় টেনে ভিজে মাথা মুছিয়ে দাও তোয়ালেতে – তখন আমার পিতা তুমি। আমার জ্বরো কপালে জলপট্টি দিয়ে কখনো তো পাশে বসেছ মায়ের মতো! আর ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যখন বেজেছে, ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু হে প্রিয়’, পরানসখা, আমার হাত ধরে পথ চলার অঙ্গীকার চেয়েছি।

তুমি ‘আসছি’ বলে চলে গেলেও আমি বাধ্য ছাত্রীর মতো সেই পাঠ থেকে তোমার অসীমের দিকে যেতে চেয়েছি – তোমাকেই ছোঁব বলে। সেই এক রহস্যময় হাসি আমার প্রাণে সুর তুলল। নির্জন, একান্ত নিজের দুপুর আর রাতগুলোতে উপভোগ করি তোমার নির্মাণের পাকা কতবেল; সেসব সেই ধুলোবেলা থেকেই সব উপকরণে মজে উঠেছে।

মাটির ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে একদিন দেখে ফেলেছি “জনহীন প্রান্তর” পার হয়ে “জ্যোৎস্না সমুদ্রের” চাঁদের নৌকো আমার ঘাটে এসে লাগতে। ‘সহজ পাঠ’ কতটা সহজ হলে মদিরতার মউল ফুল ছড়িয়ে পড়ে বালিকা হৃদয়েও। কাল যে ডাল খালি ছিল আজ কী করে ফুলে ভরে বিস্ময়ের পরম্পরায় সে অবাক ঘোর আজও কাটল না। গাছের ভেতর রয়ে গেল সম্ভাবনার কুঁড়ি। বায়োস্কোপে একটার পর একটা পালটে যাওয়া ছবির মতো কবিতায় পরতের পর পরতে কল্পনার দৃশ্যপট খুলে গেছে। আবার গদ্যে অনুপ্রাসের ঠমকে বোষ্টমী, বিশ্বম্ভরবাবু, শম্ভু, নিস্তারিণী দেবীর কাহিনীর রসের ভাঁড় টুপিয়ে হাতের খুদে তালু শুধু ভরে দেয় নি, মনের কোণে ছন্দের মৌমাছিও চাক বেঁধে ফেলেছিল। তাই স্বীকারোক্তির পায়রা উড়িয়ে দিই – মধুর তোমার শেষ যে না পাই -।

তুমি ডাক শুনেছিলে ‘জীবন দেবতার’। আমি আসি তোমার ডাকে। “স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা পান করাবে …” – তাই কি ডেকেছ, আমার প্রিয়টি?

আধভাঙা চাঁদ ভাসিয়ে দিচ্ছে চরাচর। পিউ কাঁহা বুকের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা রোদনপুঞ্জ ভেঙে দিচ্ছে কাতরতা দিয়ে। বেদনার সুখ এত মধুর! তুমি এত শেখাও তাকে কী করে আঁজলা ভরে চুমকে পান করতে হয়। বেদনাকে সানন্দ নান্দনিক করে তুলে কতখানি বিশ্বজনীন করা যায় তা তুমিই দেখালে। তবু শিখতে পারি নি, বরং নৈর্ঋতে বা ঈশানের দিকে পালিয়েছি কতবার! তার মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে পারি নি। তুমি আমার পালিয়ে যাওয়ার পথে পথে গাছ হলে, হাঁফধরা কর্মক্লান্ত চাষির মতো একটু জিরিয়ে নিতে বসেছি তোমারই ছায়াতলে।

তুমি শিখিয়েছ ‘আমি ‘ও ছোট নই। তুমি বললে ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।’ ‘অসীম ধন’ তোমার হাতে, সে ধনে আমারও যে সত্ত্ব – ইচ্ছাপত্র লিখলে। তাই নিজেকে চিনতে নিজেকেই চিঠি লিখি ; ভাঁজের পর ভাঁজ খুলে, রেখার পর রেখা টেনে সম্পূর্ণ করে দেখতে চাই। এসবের সঙ্গে তোমাকেও পড়ে চলেছি, চিনে চলেছি। তুচ্ছ এই আমার ‘আমি’কে চেনাজানারও শেষ নাই। একটা ক্ষয়া হলদেটে পাতার আকাশের সীমা ছোঁয়ার ক্ষমতা কোথায়?

তোমার কড়ে আঙুল ধরে আসন বগলে ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর ধপধপে উঠোনের লেবুতলায় গিয়ে বসেছিলাম। তুমি অপেক্ষায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে। একদিন বাসস্টপে বাসে তুলে দিয়ে হাত নাড়লে।… বাড়ি ফিরতে দেরি হলে শাসন করলে। তারপর যেদিন জানলা জুড়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার দিন, বুকের ভেতর চাঁদ আটকালো – সেদিন আবার বুঝলাম তোমার কাঁধের বিস্তার। সহর্ষ রাত কাটিয়েছি নির্ঘুম। ডালপালা মেলে তুমিও সারারাত জেগে থেকে প্লাবন সামলালে। আনন্দে – বেদনায় – হতাশায় – জয়ে – পরাজয়ে তুমি আমার কাছে দু-এক কলিতেই ফিরে ফিরে আসো আমার ধারণ ক্ষমতা খুব সামান্য বলে! আমার খরচের বহর, চার্বাক মেনে ঋণের পর ঋণ জমে যায় তোমার কাছে। শুধতে ভারি ভয়েই গেছে! সেই ঋণেই তো জীবন চলছে।

তবু এই দরিদ্র আমি কতবার বলেছি, ‘তোমায় কিছু দেব বলে চায় যে আমার মন / নাই বা তোমার থাকল প্রয়োজন’। দ্যাখো, মন কেমন টুসটুসে হয়ে গেল! ভালো লাগার কবোষ্ণ হাত পাঁজর ছুঁয়ে গেলে চিরকাল কেন কান্না পেল, ঠাকুর?

জিততে গেলে হেরে যাব

সাত
— চাঁদ, যা দিদিকে ডেকে আন তো। রুটিক’টা বেলে দিক।
— এই ছোড়দা, দিদিকে ডাক।
— আমার বয়ে গেছে।

শিউলিকে পাচ্ছ না? দ্যাখো গে’ খুকুর কাছে ব’সে। খুকুর খোঁজ নেই? সে নিশ্চিত শিউলিদের ঘরে। চাঁদ তিনটে ফ্যানাভাতের গন্ধ, সাত সুপুরিগাছ আর তেইশটা রোদ্দুর পেরিয়ে সুশীলকাকুর বাড়ি পৌঁছে গলা খাঁখারি দিল। বারান্দায় উপুড় টিনের কৌটো, পাঁচছটা পুরনো পুঁতির মালা থেকে ভালো পুঁতিগুলো ছিঁড়ে শিউলি মাটিতে রাখছে… নাকি নিজেই খ’সে যাচ্ছে টাপুস-টুপুস; আর খুকু, ভালো নাম অশোকা, সেগুলো লাল কারে গেঁথে নিলেই নতুন মুক্তোহার!
— খুকুদি, তোমার বন্ধুকে মা ডাকছে।
— আমার বন্ধু সবাই। তুইও তো।
— আমি তোমার ভাই না? সবুজ রঙের ফ্রক পরা বন্ধুকে ডাকছে।

দুজনে এক-নদী হেসে গড়িয়ে পড়ল।
— এখানে সবুজ ফ্রক পরা কোনও মেয়ে নেই।
— না না সবুজ না, নীল।

এবার ফুঁসে উঠবে দাঁতের ফেনা-ঘেরা হাসির সমুদ্র।
— হোই রঙকানা, মাসিমা যাকে ডাকছে তার নাম বল।

নাম মুখে আনার নিয়ম নেই, খুকুদি ভালো ক’রেই জানে। কিন্তু চাঁদের বুদ্ধি কি কিছু কম?
— তালিবোশ্‌শ’য় রোশ্‌শি, রস্‌সোউ, ল’য় রোশ্‌শি।

আট
শিউলি কদবেলমাখা ক’রে সবাইকে দেওয়ার সময়ে দিদিমা বলেছিল :
—আমার ভাগেরডা তুই নে গে, বুনডি। আমার দাঁত কদবেল খালি ট’কে যায়।
এ-বাবা, ফলস দাঁত আবার টকে কী ক’রে! বাসু অবাক।
— তোমাগো ফলস দাঁত আছে যে জানবা?

তার এই আনজাস্ট এনরিচমেন্ট ঠেকাতে চাঁদ পেছন থেকে ডিঙি পেড়েছে বুঝে শিউলি টপাৎ ক’রে গোটা দলাটা মুখে পুরে দুটো বিশেষণ ছুঁড়ে দেয় : ১/ ছোঁচা ২/ পাতকুড়োনি, আর উড়ে আসা কিলের কথা ভেবে কুঁচকে রাখে পিঠ।

ওসবে না গিয়ে ভাই তার বাঁহাত খুঁজছে… শিউলি হাত মুঠো ক’রে পেছনে লুকোলো। ছেলেটা তখন মগ জলদস্যু, এক চোখে কালো কাপড়ের ঠুলি, দিদির কব্জি কামড়ে ধরেছে। ওর গজদাঁত দিয়ে ঝরঝর ক’রে পানখাওয়া রক্ত পড়ছিল নিশ্চয়ই, নাহলে মুঠো চিৎকার ক’রে খুলে যাবে কেন? ওমনি চাঁদ নিজের বাঁহাতের কড়ে আঙ্গুল শিউলির কনিষ্ঠায় পেঁচিয়ে ছেড়ে দেয় — আড়ি!

আড়ি, বলতে গেলে, ভালো। বাড়িতে যখন ঢের সারে বাচ্চা, তাদের ক্লোজড গ্রুপে দাঙ্গা ঠেকাতে আক্রোশকে খসখসে অভিমানে মুড়ে ফেলার নামই আড়ি। আর অভিমান কিছুদিন পরে বাতাসের জলীয় বাষ্প শুষে খামের ভেতরের রাগটাকে পচিয়ে দেবে। হয়ত তখনও রাস্তায় কারফিউ, কিন্তু বাগানের দুই গাছই মাথা দুলিয়ে ‘রাজি’ বলছে।

বড়দের কি আড়ি হয় না? গত বছর মান্নাপাড়ায় ভাড়াটে-বাড়িওলা তুমুল ক’রে দুজনেই কোর্টে কেস ঠুকে দিয়ে এল। মহকুমা আদালতে ডেট পড়ে; কোনও দিন এনার উকিল গায়েব, কোনওদিন ওনার। একই ট্রেনে কোর্টে হাজির হয়ে ঠনঠনে রোদে শিরিষতলায় দুজন-দুদিকে-মুখ ব’সে থেকে থেকে আবার একই ট্রেনে একই বাড়ি।

তার মধ্যে হঠাৎ বাড়িওলা শসা কিনে কলাপাতা-সমেত বাড়িয়ে দিয়েছে ভাড়াটের দিকে। সে আড়ষ্ট হাতে গ্রহণ ক’রে রোদের তেজ কমলে নিল দুটো চা। পাশাপাশি ভাঁড়ে চুমুক, ছেলের পরীক্ষা বা বাজারদর নিয়ে শৌখিন কথা; ভেতরে ভেতরে তখন ওই কবিতাটা হচ্ছে — কে বলে তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য, অশুচি…।

মায়া ভেবেচিন্তেই চাঁদকে পাঠিয়েছিল দিদিকে ডেকে আনতে, তারপর সে ‘ও গৃহস্থ’ ডাকা লোকটার কাছে গিয়ে বসে :

— আপনার ছোট পুত্র আর বড় কন্যার তো মুখ-দেখাদেখি বন্ধ আজ দুই সপ্তা।
— ও, আড়ি? আড়ি-তে গাইছে দুজন? দুরূহ কাজ কিন্তু, শমের আধ মাত্রা পরে ধরতে হবে। গাইতে পারলে অন্যরকম চার্ম তৈরি হয়! যেমন, ‘আজু বহোত সুগন্ধ পবন সুমন্দ মধুর বসন্ত্‌’, রাগ বাহার। হাতে তালি দিয়ে নির্মল দেখাতে থাকে — ধা দেন্‌ তা, তেটে কতা, গদি ঘেনে, ধা-আজু বহোত…।

আট
রেল স্টেশন থেকে কাঁচা রাস্তায় নামল দুটো পালতোলা নারী-পুরুষনৌকো। দেখে পুকুরঘাটে কাপড়-আছড়ানো ঘোমটা স্থির, বটতলায় বিড়িটানা আঙুল নেমে এল ঠোঁট ছুঁতে গিয়ে — কতটা লম্বা দেখেছ, কী সুন্দর জুতো, কী ভারি-ভারি গয়না, সঙ্গে আবার চাকর, তার কাঁধে কত বড় ব্যাগ! সব পয়সাওলাই রাস্তার চোত্‌রাপাতা-চোরকাঁটা বাঁচিয়ে, কুকুর-মানুষের গু বুঝে পা ফেলে তারপরেও দুটি হোঁচট খেয়ে গ্রামের কুটুমবাড়ি পৌঁছোয়। কিন্তু কলকাতার বড়লোকদের কাঁধের পেছনে আলোর ঝালর থাকে — জাদুকর ম্যানড্রেক! তারা কোথাও হাজির হলে আচমকা বায়ুপ্রবাহ বেড়ে যাবে; শিমূলগাছ দুটো তুলোফল ঝরাতে গিয়েও — থাক বাবা, যদি মাথায় লাগে; শালিখপাখি ঘেঁটি বেঁকিয়ে পাড়ার বেড়ালকে জিগ্যেস করবে — কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, আইডিয়া আছে?

চাঁদ বাড়ি ফিরে দ্যাখে ভবানীপুরের মাসি উঠোনে চৌকিতে ব’সে হ্যাঁচ্চাই এক ব্যাগ খুলে জিনিস বের করছে তো করছেই — বাবার জন্যে সাধনা-র চ্যবনপ্রাশ, দিদিমার জন্যে নতুন থান, চাঁদের কেডস, গোপুর জন্যে বর-বউ পুতুল, শিউলির ফ্রক… মায়ের কিছু নেই? এই যে, দুকেজি সরষের তেল! দেখতে দেখতে উঠোনটাই দোকান, পাড়ার লোকেরা নেড়েচেড়ে দেখছে জিনিসপত্র, মাসি উঁচু গলায় দাম শোনাচ্ছে, তার মধ্যে দিদিমা : সঞ্জুভাই, বালতিতে জল ভরো, অশ্বিণী চান করবে। উঠোনে আর একটা জলচৌকিতে মেসো গা আগ্‌লা ক’রে বসলে চাঁদ আর গোপু ছোট ছোট থাবায় তার আঁচিলখচিত পাহাড়-পিঠে তেল ড’লে দিচ্ছে। বদলে দুজনের চ্যাটচেটে হাতে পাঁচ পাঁচ দশ নয়া।

রানীর রাজপুত্রকন্যা নেই, সেই যন্ত্রণার ওপর সে ধনসম্পদের ডাকটিকিট চিটিয়ে রাখতে চায়। মায়াকে বিদ্রূপ করে বছর-বছর বাচ্চা বিয়োনোর জন্যে, আবার খুব ইচ্ছে দিদির একদুটো সন্তান নিজের পরিচয়ে মানুষ করবে। তারা ঘটাং-ঘটাং কাশবে না, চপর-চপর ভাত চেবাবে না, কুজড়িমুজড়ি জামাকাপড় প’রে বেরোবে না রাস্তায়, কলকাতার সবচেয়ে ভালো স্কুলের ছাত্র হবে।

দিদির ‘হ্যাঁ’ না পেয়ে রানী নিমতিতা কলোনিতে আসা কমিয়েছে, এলে দুকেজি সরষের তেলের হিংসেঝাঁঝ ছড়িয়ে যায়।
শিউলি ভাইয়ের পেছন পেছন বাড়ি ফিরে মাকে ধরল।
— মাসি এই আমাদের বাড়ি এসে আবার এই বারাসাত চলে যাচ্ছে কেন?
— যাচ্ছে পদ্মর সঙ্গে দেখা করতে। দুই বাঁজায় ব’সে পরের সংসারের মুন্ডুপাত করবে না?

নয়
ঋজুদার মতো পদ্মপিসির গল্পটাও অ্যাডাল্ট, শিউলি দিদিমাকে তুইয়ে-তাইয়ে শুনে নিয়েছে :

সাত-আট বছর বয়েসেই পদ্মকুঁড়ির বিয়ে হল পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলের সঙ্গে। রাত্তিরে সে ঘরে ঢুকলেই বউ আপাদমস্তক চেঁচাত। কিছুদিন পরে মা ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দিল; প্রথম জন ফিরল তার মাসির শ্বশুরবাড়ি, সিদ্ধান্তপাড়ায়।

আস্তে আস্তে সে-মেয়ে বড় হয়, অতি নম্র, মাটি দিয়ে হাঁটলে মাটিতে আওয়াজ হবে না; আর এমন রূপসী, পুকুরঘাটে গেলে বৌঝিরা কথা থামিয়ে তাকিয়ে থাকে। তখন খবর পেয়ে তার বর লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্মর কাছে আসতে লাগল। এদিকে তোমাদের বাড়িতে অনেক দিনের পুরনো এক কুরির মেয়ে ছিল, সে জন্ম-বোবা।

— কুরি মানে কী, দিদ্‌মা?

কুরি হচ্ছে ময়রা। কাজের মেয়ে হলে কী হবে, জোচ্ছোনার ভীষণ দাপট। বাড়িতে ভিখারি এলে নাদু চাল-আলু দিতে গেছে, সে বারান্দায় ব’সে ইশারা করছে — অত চাল দিয়ো না। শীত হোক বর্ষা হোক, জ্যোৎস্না শুতো বাড়ির বারান্দায়। সে ধরে ফেলল, পদ্মর বর গভীর রাতে তার কাছে আসে, পদ্ম নিঃসাড়ে দরজা খুলে দেয়, আবার শেষ রাতে ঘর থেকে তাকে লুকিয়ে বের করে।

যদি মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসে পড়ে, কী হবে! হিন্দুদের মধ্যে দুই বিয়ে তখনও করে কেউ কেউ, কিন্তু এক বউয়ের হাল হয় রক্ষিতার মতো। বাণীনাথ শালীর মেয়েকে বললেন, জামাকাপড় গোছাও। বাগেরহাটে গরীব বাপমা-র কাছে ফিরে গেল পদ্ম, সেখান থেকে দেশভাগের পর দুই ভাই বৈদ্যনাথ আর অজিতের সঙ্গে হিন্দুস্তানে।

কিন্তু দুঃখের কথা কি জানিস? পদ্মপিসির কোনওদিনও সন্তান হতো না। শরীর খারাপই হতো না ওর। তোদের ঠাকুর্দা জানত না, বলার সাহসও কেউ দেখায়নি।

— দিদ্‌মা, পিসি এখনও শাঁখাসিঁদুর পরে ক্যান্‌?
— বরের তো কোনও দিশে-হদিশ নেই, আইনমতোন ছাড়াছাড়িও হয়নি। ওই শাঁখাসিঁদুর নিয়েই চিতেয় উঠতি হবে পদ্মর।

শিউলি কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে ব’সে থাকে। তারপর হাসি পায় তার ঠোঁটদুটোর :
— বলো দিদ্‌মা, সারা জীবন মাছ খাতি পারবে পদ্মপিসি!

.
(চলছে)

হারপিক

০১
বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার পূর্বদিকে গেলেই ভাগলপুর গ্রাম। অবশ্য এখন আর গ্রাম নয়। আধা শহর। কিছুটা গ্রাম আর কিছুটা শহর। বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের আশেপাশের এলাকায় ঢুকলে যে কেউ আর ভাগলপুরকে এখন গ্রাম বলবে না। একটা কমপ্লিট আধুনিক শহরের মেজাজ নিয়ে সে যেনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুরম্য পরিকল্পিত বিল্ডিং এর সাথে আছে সুদৃশ্য কারুকাজ মণ্ডিত মসজিদ, ক্যাফেটরিয়া, লন, পাওয়ার হাউজ, নয়নাভিরাম বাগানের পর বাগান। শহরের কী নেই এখানে! মেডিকেলের সামনের রাস্তাটির দুই পাশেই দোকানের সারি। অসংখ্য ফার্মেসি। খাবার হোটেল। বেশ চওড়া দাম। আর হবেই বা না কেনো – এসব হোটেলে যারা খেতে আসেন তাদের প্রায় সবাই রোগীদের আত্নীয় স্বজন। আজ আছে কাল নেই। বিপদে পড়ে হোটেলে খেতে আসেন। সবাই জানে এসব খাবারে জমিতে সার দেওয়ার মতো করে গ্যাস্ট্রিক বাড়ে। তবুও কোনো উপায়ান্তর নেই। আর সেই সুযোগে হোটেল মালিকেরা কাঁচা ঘাস কাটার মতো বেশ নগদ কামাই করে নেন। শহর আর গ্রামের পার্থক্যটা বুঝি এখানেই! শহরে বিভিন্ন প্রজাতির ধান্ধা করা যায়। গ্রামে এতোটা যায় না।

মেডিকেল কলেজের অদূরেই আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাসা। অবশ্য কেউ কেউ বাড়িও বলে থাকেন। আমাদের দেশের একসময় প্রচলিত রেওয়াজ ছিলো শহরে হলে বাসা। আর গ্রামে হলেই বাড়ি। এখন অবশ্য এই সংজ্ঞাটা কিছুটা পাল্টে গেছে। এখন টিনের ঘর, খড়ের ঘর, ছনের ঘর এসব কে লোকে বাড়ি বলে। আর যে বাড়ি গুলো শহরের বাড়ির মতো পাকা, আধাপাকা সে সব কে বাসা বলে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এখন গ্রামেও বাড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাড়িটি বনেদি গোছের। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে চারপাশে চারটি ঘর। পূর্ব এবং পশ্চিমের ঘর দুটি আধা পাকা। উত্তরে-দক্ষিণে কাঁচা। অবশ্য এই দুটি ঘর প্রায় সব সময় খালি পড়ে থাকে। কেবল ঈদের সময় ছেলেরা, মেয়েরা সবাই বাড়িতে আসলে ব্যবহৃত হয়। বাড়ির চারপাশে পাকা দেয়াল। সুউচ্চ। পূর্বদিকের ঘরের সামনেই বিশাল আঙ্গিনা। পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের জন্য খুব পয়মন্ত। খেলার মাঠ হিসাবে সারাদিনই জমজমাট থাকে। এরপরেই একটি বিশাল দীঘি। লোকে বলে কুমির দীঘি। জনশ্রুতি আছে, এই দীঘিতে একবার একটি ছেলেকে কুমিরে ধরে। কুমিরটি ছেলেটিকে না খেয়ে মুখের উপর নিয়ে সারা দীঘিতে চক্কর দিচ্ছিলো। ছেলেটির চিৎকারে হাজার হাজার লোক দীঘির পাড়ে জমায়েত হয়। কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য দীঘির জলে ঝাপ দিতে সাহস পায়নি। এরপর লাঠিতে ভর দিয়ে হঠাৎ কোথা থেকে এক বৃদ্ধা আসলেন। তিনি জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন, দীঘির পানিতে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিলে ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব। বুড়ির এই কথা কেউ বিশ্বাস করলো। কেউ করলো না।

শিকদার সাহেবের জান্নাতবাসী বাবা বললেন, আর কোনো রাস্তা নেই বুড়ি মা? বুড়ি খট খট করে জানালেন, আছে বাপু। আর একটি রাস্তা আছে। এই ছেলের বদলে অন্য একজন লোককে পুকুরে বিসর্জন দিতে হবে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তা কি করে সম্ভব? অবশেষে অনেক জোগাড় যন্ত্র করে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিয়ে ছেলেটিকে বাঁচানো হয়।যাওয়ার সময় বুড়িমা বলে গিয়েছিলেন, একটা শানবাঁধানো ঘাট বানিয়ে দাও বড়ে মিয়া। এই ঘাটই আমার সীমানা। গোসল করার সময় কেউ যেনো ভুলেও এই সীমানা লঙ্ঘন না করে। সেই থেকে দীঘির ঘাট শানবাঁধানো। অবশ্য বাড়ির পেছনেও একটি পুকুর আছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই দুইটিতে গোসল করে। মেয়েরা পশ্চিমের পুকুরে আর পুরুষেরা পূর্ব পাশের দীঘিতে। এটা আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাবার করা নিয়ম। তিনি খুব কড়া মানুষ ছিলেন। এখনও গ্রামের বয়স্করা উনার বিষয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি বলেন।

সেই বাবার একমাত্র সন্তান আঃ রশিদ শিকদার। তিনিও নম্র, ভদ্র অমায়িক মানুষ। পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। একজন সাদা মনের সফল মানুষ। পাঁচ সন্তানের জনক। দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে। সবাই বড় হয়ে গেছেন। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ভালো চাকুরী করেন। হাই সেলারী পান। এতো কিছু সফলতার মাঝেও একটা বিষয় শিকদার সাহেবের মনের মধ্যে মাঝে খচ খচ করে। গ্রামের কিছু উঠতি পরিবারের লোকজন তাদেরকে প্রতিহিংসার চোখে দেখেন। সুযোগ পেলেই নানাভাবে হেনস্থা করেন। ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। শিকদার সাহেব এই সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে মনে মনে যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছেন। তিনি তাদের প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার করেন না। আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। তবুও তিনি প্রতিহিংসার এই অনল পুরোপুরি নিভাতে পারছেন না।

০২
এই শিকদার বাড়িতে বিগত কয়েকদিন যাবৎ একের পর এক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বাড়ির সব মানুষের মুখের দিকে চাওয়া যায় না। আতংকের পর আতংক। কেউ জানে না কখন কী ঘটে যায়! এই জন্য সবার মুখের মানচিত্রে এক গভীর চিন্তার রেখাপাত। বাড়ির গৃহকর্ত্রী আয়েশা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আজ বড় ছেলে নাফিস শিকদার বউ, ছেলেমেয়েসহ বাড়িতে আসার কথা। সকলেই তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আয়েশা বেগম তরকারিতে লবণ দিবেন এমন সময় ছোট মেয়ে তাজমুন নাহার দীনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। মা, মা—- ওমা । কি হয়েছে রে? একটু বিরক্ত হয়েই বললেন আয়েশা বেগম বললেন। আজকাল তরকারি রান্না করার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে উনি খুব ক্ষেপে যান। বয়স হয়েছে। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। তেল দিলেন না পানি দিলেন! হলুদ দিলেন না মরিচ দিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মা, আমার মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছি না। দীনা বললো।কী বলছিস? কোথায় রেখেছিলি? কেনো? খাটের উপর।তুই আসার আগের দিন মানে পরশু আমার মোবাইলটাও খাটের উপর থেকে হারিয়ে যায়। কতো খুঁজাখুঁজি করলাম। পেলাম না। আজ আবার তোরটা গেলো। দেখ্‌ তো মা বাথরুমে হারপিকটা ঠিক আছে কিনা? মায়ের আদেশ পালন করার জন্য দীনা দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এই দীনা মেয়েটি খুবই লক্ষ্মী। খুব সুন্দর দেখতে। ছিমছাম গড়ন ।এতো বড় হয়েছে। বি সি এস পাশ করে এখন একটি স্বনাম ধন্য সরকারি কলেজের প্রভাষক। তবুও এতোটুকু অহংকার নেই। শিশুর মতো সহজ-সরল। শিকদার সাহেবের পরিবারে দীনাই একমাত্র অবিবাহিত। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিনই সম্বন্ধ আসে। ভালো ভালো ঘর। সুপাত্র। তবুও শিকদার সাহেব রাজি হন না। সবাইকে বলেন, মেয়ে মাত্র চাকুরী পেয়েছে। আর কিছুদিন যেতে দিন।

একটু পরে দীনা আবার রান্নাঘরে ছুটে এসে প্রায় চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, মা হারপিকের কৌটা আছে; কিন্তু ভেতরে এক ফোঁটা হারপিকও নেই। কি বলিস মা! গতকালই তো আনা হয়েছে। এর আগেও আরও তিনটি হারপিকের একই পরিণতি হয়েছে। আয়েশা বেগম বললেন। দীনা কী বলবে কিছুই ভেবে পেলো না। শেষে বললো, মা ইলা কোথায় গেছে? ইলাকে দেখছি না কেনো? আয়েশা বেগম বললেন, কোথায় আর যাবে? হয়ত দীঘির পাড়ে খেলছে! দীনা আর কথা না বাড়িয়ে দীঘির দিকে হাঁটা দিলো।

এই ইলা দীনার ভাগ্নি। আপন বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। খুব আদরের। পুরো বাড়িতে ছোট মানুষ বলতে ওই একজনই। ইলা তার মা-বাবার সাথে নানু বাড়িতেই থাকে। তার মা-বাবা দু’জনেই চাকুরী করে। মা সরকারি প্রাইমারী স্কুলে এবং বাবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দুজনই সারাদিন অফিসে থাকেন। প্রায় সন্ধ্যায় ফিরেন। নানা-নানীর সাথে তার সারাদিন কাটে। কখনও একলা। জন্মের পর থেকে এভাবেই চলছে ইলার জীবন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। খুব মেধাবী। ওর ক্লাসে বরাবরই প্রথম হয়। দুষ্টুমিতেও একদম পিছিয়ে নেই। সকলের সেরা। অবশ্য গুণীজনেরা হামেশাই বলে থাকেন, মেধাবিরা একটু- আধটু দুষ্টু হবেই। মেধা ছাড়া দুষ্টুমিরা করা যায় না।

দীনা দীঘির পাড়ে এসেই ইলাকে পেয়ে গেলো। ডাকসই চলছে। দীনাও মুহূর্তেই শৈশব ফিরে পেয়েছে। তারও খেলতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন ডাকসই খেলা হয়নি। অনেকদিন—।। ইলাকে বললো, আমাকে খেলতে নিবি? ইলা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। বললো, তুমি খেলবে মানে? তুমি কি আমাদের মতো শিশু নাকি? দীনাও মজা করে বললো, হুম শিশু ইতো। দেখিস, আমি কোনোদিন বুড়ি হবো না। ইলা আর কিছু বললো না। দীনার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। দুজনের মনেই আনন্দ আর ধরে না। একটু পরে ইলার ছোট মামা আসবে।। শহর থেকে। আরশি আসবে। ঐশী আসবে। ইউশা আসবে। কতো গল্প হবে বস্তা বস্তা। খেলা হবে। কবিতা আবৃত্তির আসর হবে। চাঁদনী রাতে কানামাছি হবে। লুকোচুরি খেলা হবে। মজার উপর মজা। আনন্দের উপর আনন্দ। এতো আনন্দ— ইলা রাখবে কোথায়?

০৩
গত কয়েকদিন ধরে ইলা বমি করছে। কিছুক্ষণ পর পর। কেবল বিকেল হলে একটু ভালো থাকে। কিছুদিন ধরে ইলার খাবারের প্রতি খুব অরূচি। কোনো কিছুই খেতে চায় না। এর সাথে যোগ দিয়েছে বমির ভয়। ওর এখন বদ্ধমূল ধারনা জন্মে গেছে কোনোকিছু খেলেই বুঝি বমি হয়ে যাবে। ইলার বাবা জায়েদ করিম নিজেই একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি ঔষধ দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি। সাথেই ভাগলপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেখানেও ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইলা ভালো হচ্ছে না। ইলার বাবা এখন ঠিক করেছেন ইলাকে একটা ফুল চেকআপ করাতে হবে। মেয়েটি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে।

পরের দিন আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ইলার ছোট মামা এবং মামীর মোবাইল দুটিও পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন আরেকটি হারপিক কেনা হয়েছিলো। সেটির পূর্বের দশা হয়েছে। হারপিকের কৌটা আছে; ভেতরে কোনো লিকুইড নেই। এসবের সাথে যোগ দিয়েছে একটি অভিপ্রেত খস খস শব্দ। শব্দটি একেকবার একেক জায়গা থেকে আসে। মাঝে মাঝে আসে না। শব্দ লক্ষ করে গেলেও সেখানে শব্দের উৎসের কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। ইলার ছোট মামি শহুরে মেয়ে। তিনি ঠিক করেছেন এই বাড়িতে আর থাকবেন। মোটামুটি সবারই একটা ধারনা পাকা হয়েছে যে, এই বাড়িতে কোনো দুষ্টু ভূতের আছর পড়েছে। সে-ই এই সব কর্মকাণ্ড গোপনে করে বেড়াচ্ছে। আঃ রশিদ শিকাদার সাহেব প্রবীণ হলেও চিন্তা-চেতনায় একজন কমপ্লিট আধুনিক মানুষ। তিনি কোনো ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তিনিও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন। গ্রামে দু’একজন যারা চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করে তাদেরকে উনি অনেক প্রেসার দিয়েছেন কেউ মানুষ চুরি করেছে কিনা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তিনি কোনো তথ্যই উদ্ধার করতে পারেননি।

আর ইলার নানীও বসে নেই। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা এইসব কর্মকাণ্ড ভুত-প্রেত ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তাঁর ছোট ভাইকে দিয়ে ভিন গাঁ থেকে একজন ডাকসাইটে ভূত তাড়ানোর ওঝা কাম কবিরাজ নিয়ে আসলেন। বাড়ি জুড়ে হুলস্থূল কাণ্ড। ওঝা তাঁর সাগরেদদের দিয়ে পুরো বাড়ির চারপাশে তাঁর হাতের আশা দিয়ে রেখা টেনে দিলেন। সবাইকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করে দিলেন। কেউ যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যান, তাহলে তাঁর রক্ত বমি হবে। সাথে মারা পড়বে। অতঃপর ভেতর বাড়ির উঠানে আগুন জ্বালানো হলো। বেশ বড় আগুনের কুণ্ড। কয়লা আর কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন। ওঝা ঘোষণা করে দিয়েছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাড়িতে থাকা সমস্ত ভূত-প্রেত কে এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে মারা হবে। সেই দৃশ্য সবাই সচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। উত্তেজনার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। কেবল আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের এসব ভণ্ডামি ভালো লাগছে না। তিনি বারবার গিন্নীকে নিষেধ করেছেন। কিন্তু গিন্নী তাঁর কথা শোনেনি। দীনাও বাবার সাথে সহমত। কিন্তু মা –কে কিছু বলতে সাহস পায়নি।

ওঝা মন্ত্র পড়া শুরু করে দিয়েছেন। আগুনের মধ্যে ধূপ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধূপের গন্ধে সমস্ত বাড়ি মৌ মৌ করছে। সবার চোখে-মুখে আনন্দ, উত্তেজনা, ভয়, আতংক। ইলা দীনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি, ঐশী এবং ইউশাও। তিথি, নাবিলা, সিয়াম, সিফাত ওদেরও আজকে বাড়িতে বেড়াতে আসার কথা। বিভিন্ন ধরনের বাদ্য যন্ত্র বাজছে। ওঝাকে এখন অতিমাত্রায় উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে। তিনি ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা বশে আকাশের দিকে লাফ দিচ্ছেন। খামচি দিয়ে একটা একটা করে ভূত ধরে আনছেন। আর চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আগুনে নিক্ষেপ করছেন। আগুনে পোড়ার পর ভূতের আত্মা সাঁই সাঁই করে পালিয়ে যাচ্ছিলো। সেই পালিয়ে যাওয়ার শব্দ সবাই স্বকর্ণে শুনতে পেলেন। এভাবে সমস্ত ভূত মারা যাওয়ার পর ওঝা বাড়ির প্রত্যেক ঘরে, ঘরের সামনে পেছনে, আনাচে কানাচে ধূপের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলেন। সবশেষে তিনি ঘোষণা করলেন, আপনাদের বাড়ি আজ থেকে সর্ব প্রকার জিন, ভূত-প্রেত মুক্ত হলো। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া আমি বাড়ি এমন ভাবে বন্ধন করে দিয়েছি যে, ভূত কেনো, ভূতের বাপ-দাদার সাধ্য নেই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে।। অবশেষে তিনি ইলাকে বিশেষ ভাবে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, আর কোনোদিন এই মেয়ের বমি হবে না।

ইলার নানী মনে মনে খুব স্বস্তি পেলেন। দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলেন। দীনা কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো। বিশ্বাসও করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মনকে এই বলে প্রবোধ দিলো যে, আচ্ছা দেখাই যাক না কি হয়! সবকিছু ভালো হলেই তো ভালো!!

০৪
কিন্তু ওঝা চলে যাওয়ার ঘণ্টা দুই পড়েই যখন ইলা বমি করতে লাগলো, তখন দীনার সমস্ত বিশ্বাস কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। এদিকে দীনার ছুটি শেষ হয়ে গেছে। আগামীকালই সে ময়মনসিংহ ফিরবে। ইলাও দীনার সাথে ময়মনসিংহ আসার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। শুধু অপেক্ষা করছে কখন, কিভাবে কায়দা করে আন্টিকে প্রস্তাবটি দেওয়া যায়। ইলার দৃঢ় বিশ্বাস আন্টি নিশ্চয় না বলতে পারবেন না। ইলার ছোট মামারাও আগামীকাল ঢাকা চলে যাবেন। যাওয়ার আগে ইলার ছোট মামা তাঁর নানীর জন্য একটি সুন্দর মোবাইল হ্যান্ড সেট, কিছু খাবার-দাবার, সাবান-হারপিক সহ সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি জিনিস কিনে এনেছেন।
পরদিন সকাল বেলা দীনা বাথরুমে গিয়ে দেখতে পায়, হারপিকের বোতল শেষ। অথচ গতকালই কিনে আনা হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে খবরটি পরিবারের প্রায় সবার কাছে পৌঁছে যায়। এক ধরনের আতংক এমনিতেই সবার মাঝে বিরাজ করছে। তাঁর উপর এসব ঘটনায় সবাই এখন রীতিমত বিব্রত। চেষ্টা তো আর কম করা হয়নি। কিছুতেই কিছু হলো না। দীনা বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রাম হতে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেসে ময়মনসিংহ আসবে। ইতোমধ্যে টিকেট সংগ্রহ করা হয়েছে। ইলাও দীনার সাথে আসছে। ইলার আম্মু আসতে দিতে চায়নি। আব্বুও। তবুও ইলার জিদের কাছে তারা পেরে উঠেনি। সে আসবেই। তাছাড়া ডাক্তারও বলেছেন ওর বায়ু পরিবর্তন খুব জরুরি। আরও একটি কারণ আছে, অফিস ফেরত দীনা বাসায় একা একা থাকে, সময় কাটতে চায় না। ইলা থাকলে বেশ হয়।

ট্রেনে উঠার আগমুহূর্তে ইলা একবার স্টেশনে বমি করে দিলো। দীনার জন্য এটা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও তাঁর চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আশার কথা বমি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তারা ট্রেন ছাড়ার পূর্বেই উঠতে পেরেছে। পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক দীনার সুপরিচিত। সিনিয়র কলিগ। নাম জনাব কছিম উদ্দিন। দীনার কলেজেরই সহকারি অধ্যাপক। জনপ্রিয় কবি এবং কথা সাহিত্যিক। হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে মাস্টার্স ১ম পর্বের ভাইভা নিয়ে ফিরছেন। সদালাপী মানুষ। সহজ, সরল প্রকৃতির। দীনাকে দেখে খুব খুশি হলেন। দীনাও খুব খুশি। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে গতি বাড়তে লাগলো। পরিষ্কার আকাশ। কোথাও একরত্তি মেঘও নেই। চমৎকার প্রাকৃতিক আবাহন। সবে বসন্ত উকি দিয়েছে। রেললাইনের দুই পাশে প্রায়ই শিমুলের ফুল দেখা যাচ্ছে। গাছে গাছে নতুন পাতা, ফুল ও কুঁড়ি। বমি করতে করতে ক্লান্ত ইলা একটু পরেই আন্টির শরীরে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কছিম উদ্দিন স্যার দীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাথের মেয়েটি কে?স্যার ও আমার ভাগ্নি। একমাত্র বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটি বুঝি ট্রেনে উঠার আগে বমি করছিলো? জী স্যার। কিছুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে অনেক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কী রকম? দীনা সবিস্তারে প্রত্যেকটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। ইলার বমি করা, মোবাইল হারিয়ে যাওয়া, খসখস, শব্দ করা, ওঝার ভোজবাজি কোনোকিছু বাদ দেয়নি। ট্রেন ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে এসে থেমেছে। কছিম উদ্দিন স্যার প্রত্যেকটি ঘটনা অত্যন্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করলেন।

ইলা এখনও ঘুমুচ্ছে। দীনা একটু পর পর ইলার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কছিম উদ্দিন স্যার কী যেনো ভাবছেন। উনি কবি-সাহিত্যিক মানুষ। ভাবাভাবিই উনার কাজ। তাই দীনা উনাকে বেশি ঘাঁটালেন না। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। অবশেষে দীনাই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কি ভাবছেন? কছিম উদ্দিন স্যার সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, ও তোমার ঘটনাটাই ভাবছিলাম দীনা। কিছু পেয়েছেন স্যার? দীনা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো। হুম, ঘটনাটির এক ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করিয়েছি। তুমি হয়ত মানতে চাইবে না। কারণ তুমি ইলাকে খুব ভালোবাসো। আমি মানবো না কেনো স্যার? আপনি বলুন। যুক্তিসংগত হলে আমি অবশ্যই মানবো। কছিম উদ্দিন স্যার বলা শুরু করলেন, তোমাদের বাড়ির এই সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী হলো এই মেয়েটি। প্রত্যেকটি হারপিক ইলাই খেয়েছে। দীনার মোটেই সহ্য হলো না। সে শুরুতেই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো। কী বলেন স্যার। আপনার কথা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অসম্ভবের উপর অসম্ভব। এ হতেই পারে না। দীনার সুতীব্র প্রতিবাদ দেখে কছিম উদ্দিন স্যার হাসতে লাগলেন। প্রাণ খোলা হাসি। হাসতে হাসতে শেষে বললেন, আমার কথা যে ১০০% ঠিক আমি সেটা দাবী করছি না। আমি যা বলছি, সেটা আমার একটা হাইপোথিসিস। সাধারণতঃ ভুল হওয়ার কথা নয়। ঠিক আছে তুমি যেহেতু শোনতে প্রস্তুত নও, তাহলে আর আমি বলছি নে। দীনা সাথে সাথে তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসে বললো, না স্যার। আপনি বলুন। আমি ধৈর্য ধরে শুনবো।

০৫
কছিম উদ্দিন সাহেব বললেন, প্রথমতঃ ইলা কোনো একদিন কৌতূহল বশত সামান্য পরিমাণ হারপিক ছেঁকে দেখেছে। মুখে নিয়েই ও বুঝতে পারে হারপিকের স্বাদটি তেতো নয়। কিছুটা টক টক। তবে সব মিলিয়ে স্বাদ মন্দ নয়। সেই থেকে শুরু। ও একটু একটু করে হারপিক খেতে শুরু করে দেয়। পরিমাণ সামান্য হওয়ায় এটা ওর শরীরে আস্তে আস্তে মানিয়ে যায়। একটা সময় এটা ওর নেশায় পরিণত হয়। ও হারপিকে আসক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখনই পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে, তখনই ওর লিভার সেটা কাভার করতে পারছে না। ফলে বমি দেখা দেয়। লিভারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার ধারণ ক্ষমতার বাইরে এবং অযোগ্য কোনোকিছু রাখবে না। বমির মাধ্যমে সেটা বের করে দেবে। অবশ্য এখানে মূল অনুঘটক হলো মস্তিষ্ক। সে-ই প্রথম সংকেত দেয়। এজন্য বমি মানুষের জন্য অনেক সময় বিরাট উপকারী হয়ে থাকে। বমি না হলে পাকস্থলী ফুলে যাবে। প্রসাব, পায়খানার নানা জটিলতা দেখা দিবে। এমন কি মৃত্যুও হতে পারে।

আমি কি একটি প্রশ্ন করতে পারি স্যার? দীনা বললো।
হুম। কেনো নয়। অবশ্যই করতে পারো।
হারপিক খেলে তো স্যার ওর মারা যাওয়ার কথা?
একদম খারাপ বলোনি তুমি। কিন্তু হয়েছে কি তুমি যদি পরিমাণের কম বিষও খাও; তোমার শরীরে সামান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কিন্তু তুমি মারা যাবে না। তারপর আস্তে আস্তে বিষের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়িয়ে দাও। একটা সময় দেখবে তোমার শরীর এই মারাত্বক বিষকেই কনজিউম করে নিচ্ছে। কিছুদিন আগের একটি ঘটনা, তুমি হয়ত শোনে থাকবে একটি লোককে কিং কোবরা কামড় দেয়। সবাই অস্থির। চিৎকার, চেঁচামেচি, ডাক্তার এসব চলছিলো। কিন্তু যাকে কামড় দিয়েছে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে হাসছিলো। পরে দেখা গেলো লোকটির কিছুই হয়নি। আসলে কথায় বলে না, শরীরের নাম মহাশয়। যাহা সহাবে সে তাহাই সয়।
দীনা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। স্যার বলতেই থাকলেন, দ্বিতীয়তঃ মোবাইল চুরির বিষয়টি। দীনা তোমাকে বলতে ভয়ই পাচ্ছি। কারণ তুমি খুব রিয়েক্ট করো।

না স্যার। আমি আর রিয়েক্ট করবো না। আপনি বলুন।
স্যার আবার বলা শুরু করলেন। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমিই বলেছো ইলার মা-বাবা দুজনেই চাকুরী করেন। উনারা ইলাকে সময় দিতে পারেন না। তোমার মা-বাবাই উনার একমাত্র সঙ্গী। তুমি খেয়াল করলেই দেখবে স্কুলের সময়টা ওর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসায় আসলেই ও একদম বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তোমার মা-বাবা ওকে পর্যাপ্ত দিতে পারছেন না। উনারাও নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। উনাদের দিয়ে ইলার বা-বাবার অভাব পূরণ হচ্ছে না। ইলা অনেক সময় তোমার আম্মুর মোবাইল অথবা তোমার আব্বুর মোবাইল দিয়ে ওর মা বাবাকে কল দিতে চেয়েছে। কিন্তু নানা কারণে দিতে পারেনি। হয়ত মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। কিছু মনে করো না দীনা হয়ত ওর নানা-নানী ওকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়নি। অথবা ওর বাবা-মা কল রিসিভ করেনি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কারণে মোবাইল নামক এই যন্ত্রটির প্রতি ইলার মন বিষিয়ে উঠেছে। আসলে বিষণ্ণতার চেয়ে বড় ঘাতক আর নেই। যে বয়সে তার মা-বাবার আদর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন; সেটা সে পাচ্ছে না। তাই ও এখন দিন দিন ক্ষেপে যাচ্ছে এবং একরকম মানসিক সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুমি একটু খেয়াল করলেই দেখতে ইলা অনেকদিনই তার মাকে চাকুরী ছাড়তে বলেছে। এই কথা শোনে দীনা বললো, স্যার আপনি জানলেন কিভাবে? আমার সামনেই ও অনেকদিন এই কথা বলেছে। স্যার আর একটি প্রশ্ন করি। হুম একটি নয়। তোমার যতো জিজ্ঞাস্য আছে সব বলো।

স্যার মোবাইল গুলো ও কী করেছে? খুব কঠিন প্রশ্ন দীনা। উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে আমার ধারণা, মোবাইল গুলো সে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছে। ওর জিদ একটাই, সে যেহেতু এই মোবাইল দিয়ে কথা বলতে পারবে না। সুতরাং অন্য কাউকেও কথা বলতে দিবে না। হতে পারে স্যার। এখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, তুমি ওকে হাতে নাতে ধরতে চাও দীনা?
জী স্যার। কিন্তু কিভাবে?
এখন তুমি বাসায় ফেরার সময় ওর সামনেই একটি হারপিক কিনবে। সেটা নিয়ে তোমার টয়লেটে রাখবে। তারপর দেখো কী হয়! এই বলে স্যার হা হা হা হেসে উঠলেন। সেই সুউচ্চ হাসির শব্দে ইলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ট্রেনও ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে পড়েছে। সবুজ বাতি দেখা যাচ্ছে।

০৬
দিন দুই পরে একদিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। কলেজ রোড পানিতে সয়লাব। কলেজ রোডের বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে এটিও অন্যতম। অবশ্য আশার কথা হলো এই সময়টাতে রিকশার কোনো অভাব হয় না। অসময়ে দুধের মাছের মতো। যেমন খুশি দাম হাঁকানো যায়। ইচ্ছা হলে যাও, না হলে না যাও। দীনা রিকশার ভাড়া ঠিক করছিলো। এমন সময় কছিম উদ্দিন স্যার। তিনি অফিসে যাবেন। কাকতালীয় ভাবে দুজনেরই সকাল নয় টায় ক্লাস। দীনা সালাম দিলো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কি খবর দীনা?

স্যার বিশ্বাস করবেন না, আপনার কথাই মনে ভাবছিলাম। সেদিন আপনার কথা মতো আমি একটি হারপিক কিনে তবেই বাসায় গিয়েছিলাম। তারপর স্যার আপনার কথাই ঠিক স্যার। আমি হাতেনাতে ধরেছি। ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি ওকে তেমন কিছু বলিনি স্যার।
তুমি ঠিক করেছো। ওকে এখন তুমি সঙ্গ দাও। সব সময় অব্জারভেশনে রাখবে। ওর পছন্দ মতো চকলেট, চুয়িংগাম, চকলেটবার মাঝে মাঝে ওকে খেতে দেবে। মনে রাখবে ও এখন এক প্রকার নেশায় আসক্ত। তুমি ওকে এখানে এনে খুব ভালো করেছো। আমার সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিও।
অবশ্যই আলাপ করিয়ে দেবো। স্যার আরও একটি কথা, সবগুলো মোবাইল কুমির দীঘিতে পাওয়া গেছে। কিন্তু স্যার একটি বিষয় বুঝতে পারলাম না।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, কোন্‌টা?
এই যে স্যার একটা খসখস শব্দ প্রায়ই হতো!!

ওটা কিছু নয়। ইঁদুর, বিড়াল, চিকা ওরা এমন শব্দ করে থাকে। বিশেষ করে ওই সময়টাতে তোমার কেউ স্বাভাবিক চিন্তা করোনি। তাই যে কোনো স্বাভাবিক শব্দ তোমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এই কছিম উদ্দিন স্যার স্বভাব সুলভ হা হা হা করে হেসে উঠলেন। দীনাও সেই হাসিতে যোগ দিলো।।

আসলে গল্পটি এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ হয়েও হইল না শেষ! ইলার হারপিক খাওয়ার এই ঘটনা এক কান, দুই কান করতে করতে সারা গ্রামে সাড়া তুললো। কিছু মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিলো এই মেয়েটির মধ্যে একটি সহজাত ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বলেই সে হারপিকের মতো বিষ খেয়ে হজম করতে পেরেছে। বেশ আর যায় কোথায়? সরল বিশ্বাসে অনেকেই ইলার কাছে পানি পড়া সহ বিভিন্ন কাজে আসতে লাগলো। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে কথা!!
——————-

মনে পড়ে!

out. ৩০শে জানুয়ারি, ২০১১।
ওয়ালমার্ট কানেকশন সেন্টারে কাজ করছিলাম। এক বুড়ি মহিলা এলো উনার একটা ফোন লাইনের সার্ভিস দুই বছরের জন্য নবায়ন করাতে। আমি সিম কার্ডটা চাইলাম, বুড়িমা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট বের করে আমায় দিলেন। আমি প্যাকেট খুলে সিমকার্ড বের করে কার্ডের সিমকার্ডের কুড়ি ডিজিট নাম্বার কমপিউটারে এন্ট্রি করছি আর ভাবছি, দুই বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করলে বুড়িমা একটা ফ্রি ফোন পাবে। বেশ ভালো হবে, এই পুরনো হয়ে যাওয়া চকোলেট বার পালটে একেবারে নতুন স্মার্ট টাচ ফোন পাবে।

বুঝতে পারছি না, বুড়িমা আদৌ ফোনের স্ক্রিন টাচ করে ফোন ব্যবহার করতে পারবে কিনা! একটু এদিক ওদিক হলেই ফোন নিয়ে ছুটে আসবে, “এটা কী ফোন দিয়েছো? স্ক্রিন লাইট জ্বলে না, আঙুল টাচ করার আগেই ফোনের কী-প্যাড চলে যায়!” ডিসপ্লেতে সাজানো ফোন দেখিয়ে বুড়িমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ ফোন সেটটা তোমার পছন্দ? বুড়িমা বললো, আমার নতুন ফোন চাই না, এই পুরানো ফোনটাই থাকুক।

বললাম, নতুন ফোনের জন্য তোমাকে পয়সা দিতে হবে না, ফ্রি। বুড়িমা বলে, ফ্রি ফোন চাই না। আমার এই পুরানো ফোনটাই ভালো। এটা আমার স্বামীর ফোন। বললাম, হ্যাঁ, স্বামীর ফোন তাতে সমস্যা কি! তুমি এই ফোন কোম্পানির সম্মানিত গ্রাহক, দুই বছরের জন্য ফোন সার্ভিস নবায়ন করছো, তাই ফোন কোম্পানি তোমাকে নতুন ফোন উপহার হিসেবে দিচ্ছে। পুরানো ফোনটাও তোমার কাছেই থাকবে, স্বামীর জন্য বরং নতুন ফোনটাই নিয়ে যাও। নতুন ফোন হাতে পেয়ে নিশ্চয়ই তিনি খুশি হবেন। খুব সহজ এটার ব্যবহার, আমি শিখিয়ে দিবো।

বুড়িমা বললো, রিটা তোমার আন্তরিক ব্যবহারের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আসলে আমার স্বামী এক মাস আগে মারা গেছেন। তার ফোন লাইনটা দুই বছরের জন্য রিনিউ করাতে এসেছি যাতে আমার কখনো মনে না হয়, মানুষটা নেই! আমি যতো দিন বেঁচে আছি, আমার হাজব্যান্ডের ফোনটাও থাকবে, এবং এই ফোনটাই থাকবে। আমার স্বামীর দেহ এখন মাটির নীচে, ধীরে ধীরে তাঁর দেহ মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু এই ফোনটার গায়ে আমার স্বামীর হাতের পরশ লেগে আছে, তাই না? যতদিন ফোনটা আমার কাছে থাকবে, ফোনের গায়ে আমার স্বামীর হাতের স্পর্শটুকু তো বেঁচে থাকবে।

নতুন ফোন নিলে তো নতুন ফোনের গায়ে আমার স্বামীর পরশ পাবো না! বুড়িমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি দুঃখিত। না বুঝে তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেলেছি! বুড়িমা উলটো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, তুমি দুঃখিত হবে কেন! তুমি তো ভুল করোনি, বরং আমাকে উসকে দিতে চেয়েছো, নতুন স্মার্ট ফোন নিয়ে বুড়োকে যেন চমকে দেই! আমারই কপাল খারাপ, অল্পের জন্য বুড়োকে চমকে দেয়ার সুযোগ হারালাম— বলে কী সুন্দর হাসি দিলো।
*************************

** ১২ বছর পর আজ হঠাৎ করেই সেদিনের বুড়িমার কথা মনে পড়ে গেলো। বুড়িমা কি আজও বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলে কি আজও তার স্বামীর ফোনটা হাতে নিয়ে স্বামীর স্পর্শ অনুভব করে? নাকি এখন বুড়ো বুড়ি স্বর্গের বাগানে পাশাপাশি বসে পৃথিবীতে কাটিয়ে যাওয়া সুখের স্মৃতি নিয়ে খুনসুটি করছে!

–ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার

মানুষের চেয়ে বলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি

tyu •”মন্দ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দার্শনিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের একটি বিষয়, পণ্ডিত এবং চিন্তাবিদেরা মন্দের প্রকৃতি এবং মানুষের আচরণের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন৷ কেউ কেউ যুক্তি দেন যে মন্দ মানুষের অবস্থার একটি অন্তর্নিহিত অংশ, অন্যরা পরামর্শ দেয় যে এটি সামাজিক বা পরিবেশগত কারণগুলির একটি। অনেক বিতর্ক এবং আলোচনা সত্ত্বেও, মন্দ একটি শক্তিশালী এবং বাধ্যতামূলক শক্তি রয়ে গেছে যা আমাদের বিশ্বকে এবং নিজেদের সম্পর্কে আমাদের বোঝার গঠন অব্যাহত রাখে।”

• “শয়তান অনেক ধর্ম এবং বিশ্বাস ব্যবস্থায় একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে, প্রায়শই প্রলোভন এবং দুর্নীতির একটি শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। খ্রিস্টধর্মে, উদাহরণস্বরূপ, শয়তানকে একটি পতিত দেবদূত হিসাবে দেখা হয় যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং মানবতাকে বিপথে নিয়ে যেতে চায়। শয়তানের প্রভাব বিভিন্ন জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে দেখা যায়, সাহিত্য এবং শিল্প থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন পর্যন্ত, এই রহস্যময় চিত্র এবং মন্দ শক্তির প্রতি আমাদের চলমান মুগ্ধতাকে প্রতিফলিত করে।”

• “যদিও মন্দ ধারণাটি প্রায়শই ব্যক্তি বা ধর্মকারী গোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত থাকে, তবে সিস্টেমেটিক এবং কাঠামোগত কারণগুলির ভূমিকা বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ যা ক্ষতি এবং কষ্টের জন্য অবদান রাখে৷ এর মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে যা বৈষম্যকে স্থায়ী করে৷ , বৈষম্য এবং সহিংসতা। এই সমস্যাগুলোর জটিল এবং আন্তঃসংযুক্ত প্রকৃতির স্বীকৃতি মন্দকে মোকাবেলা করার জন্য এবং ন্যায়বিচার ও সহানুভূতি প্রচারের জন্য কার্যকর কৌশল বিকাশের জন্য অপরিহার্য।”

• “দৃষ্টিহীনতার অভাব মানুষকে তার অদৃষ্টের দিকে ধাবিত করে আর যা কল্পনা করেনা তাই ঘটে যেখানে অদৃষ্ট বলতে ভাগ্য আসলে ব্যক্তির কর্মের ওপর ভিত্তি করেই অপরাধগুলো প্রকাশ হয়। কে কি বলে সেখানে মন দিয়েন না আপনি যে কাজ করছেন সে কাজটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে দিকে প্রকাশ রাখুন। আমাদের সমাজে হয়ে যাওয়া মানুষের চেয়ে বলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি যারা যা ইচ্ছে তাই বলে যায় আর যারা সেসব দেখছে এবং শুনছে প্রতিউত্তর করছে না তারা তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দ্বিগুণ আকারে প্রশস্ত করছে আর যারা বারবার বলছে তারা যে কোন একটা খাদে পড়ে ওপরে ওঠার শক্তি হারাবে। “

ছোট্ট মন

riaa

আমার ছোট্ট মন কেমন আছিস তুই ? আমি খুব ভালো আছি জানিস! এইসব কবিতা আর গল্প-উপন্যাসে আর গানে ডুবে থাকি। বেশিরভাগ সময়টা এই ভাবেই কেটে যায়। খালি যেদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙে, ছাদে যাই কিছু পাখির খাবার দানা নিয়ে। ছড়িয়ে দিই, জানিস পাশের স্কুল বাড়িটায় অনেক পায়রা থাকে। আমার দানা ছড়ানো দেখে সেই পায়রাগুলো আসে আপন মনে দানা খায় আর আমি তাদের পালকের থেকে মন তোর গন্ধ নিই।

এইসব ভোরবেলাগুলো এখন অনেক আলাদা। তবে একটা ভালো ব্যাপার কি আজকাল ভোরবেলা খুব কম আসে। রাতের পর রাত কেটে যায় ওই আকাশের তারা গুনে। ওই যে এক আকাশ তারা দিয়ে গেছিস সেই কোন ছোট বেলায়, বলেছিলি তোর আর কি চাই, এক আকাশ ভরা তারা দিলাম তোকে। জানিস আজও আমি আমার পছন্দের একটা একটা করে তারা রোজ গুনে তুলে রাখি। তারপর কোথা দিয়ে বেলা বয়ে যায় বুঝতেই পারি না।

সারাদিন কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখি। শুধু যেদিন খুব বৃষ্টি হয়, সেদিন নিজে সেই ছোট্ট বেলার মতো বৃষ্টিতে ভিজি। তুই তো জানিস বৃষ্টি আমার কত পছন্দের। বৃষ্টির সাথে কত স্মৃতি, কত মজার দিন। তোর মনে আছে বৃষ্টি শেষে কাগজের নৌকা বানাতাম আর বৃষ্টির জমা জলে সেই নৌকা ভাসাতাম, আর যদি আমার ভাসানো নৌকা ডুবে যেত কি ভীষণ কাঁদতাম আমি। প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটায় আমি অনুভব করি রে তোকে। মেলে দি নিজেকে, একটু জল- আলো-বাতাস পাক “ভুলে থাকা” স্বপ্ন গুলো।

আমার সেই ছোট্ট মন কোথায় হারিয়ে গেলি তুই?

বিশ্বাসীদের বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ এমন হওয়া উচিত

“যেকোনো ধর্মের আধ্যাত্মিকতার প্রকৃত পরীক্ষা তার উপাসনালয়ের মহিমার মধ্যে নয়, বরং সমাজের সবচেয়ে দুর্বল সদস্যদের প্রতি দেখানো উদারতা ও সমবেদনার মধ্যে। আমরা যদি সত্যিই আমাদের বিশ্বাসের প্রতি নিবেদিত হই, তবে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে তারা যারা আমাদের উপাসনালয়ের বাইরে ভিক্ষুকের সাজে বসে থাকে, তারা কেবল প্রকৃতিগতভাবে ভিক্ষুক নয়, তারাও মানুষ যারা আমাদের ভালবাসা, সম্মান এবং সমর্থনের যোগ্য। তবেই আমরা সত্যই আমাদের ধর্মের ঐশ্বরিক নীতির অনুসারী বলে দাবি করতে পারি।”

রংবাহারি ফুলের মেলা

বাগানের ফুলটি জানে
ফুটলে ভালোবাসা হয়

যুঁইফুলের গন্ধ মেখে
অমৃতপাত্রে হাত রাখি।

বাহারি পাতার ঝাড়ে
মৃদু কম্পন খেলে যায়

দুটো পদ্মের পাপড়ি
খসে পড়ে মৃদু ঠোঁটে।

গভীর গন্ধে ঘন শ্বাস
হাতের পাতায় মুখটি

গাল থেকে ঝরে পড়ে
চুয়া চন্দন আর আবীর।

ট্রেজার বক্স!

out.t ২০১২ সালে মা মারা যায়। মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার পর আমি আমেরিকা ফিরে আসি। ফেরার সময় ছোটো একটা স্যুটকেসে মায়ের কিছু শাড়ি, শেষ বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, হাসপাতালে ওটিতে নেয়ার আগে মায়ের হাত থেকে খুলে রাখা শাঁখা পলা চুড়ি, মায়ের কপালের টিপ, হাসপাতালের বেডে মায়ের মাথা আঁচড়ে দেয়ার সময় ঝরে পড়া তিন চারটি সোনালি চুল, মায়ের ব্যবহার করা ওয়ারিদের ফোনটা, মায়ের দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগে কাগজে নেয়া মায়ের পায়ের আলতা মাখা ছাপ এবং আরও কিছু মেমেন্টোর সাথে মায়ের নিজস্ব একটা ট্রেজার বক্স এনেছিলাম।

সুটকেসটা এনে রেখে দিয়েছিলাম আমার বিছানার পাশের টেবিলের নীচে, আর খুলিনি। বাবা মারা গেলো ২০২০ সালে। এই বছর দেশে গেলাম, আমেরিকা ফেরার সময় বাবার বহু ব্যবহৃত একটা শার্ট, একটা লুংগি আর একটা মাফলার হাত ব্যাগে ভরে এনেছি। বাবার শার্ট লুংগি মাফলার মায়ের জিনিস ভর্তি সুটকেসে ভরে রাখবো ভেবে ১১ বছর পর আজ সুটকেসটা খুলেছি। সেখানে পেলাম মায়ের দুটো শাড়ি পাকিস্তান আমলের, এখনও ঝকঝকে। একটা কালো নক্সি পাড়ের, অন্যটা লাল আর রূপালি জরির নক্সি পাড়ের।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই শাড়িগুলো পরে মা স্কুলে যেতো। শাড়ির পাড়ের সাথে রঙ মিলিয়ে ব্লাউজ পরতো। আরেকটা শাড়ি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা থাকতে মা রঙ তুলি দিয়ে ডিজাইন করেছিল, বলতো ফেব্রিকের শাড়ি। সে সময় তিনটা ভয়েলের থানে মা রঙ তুলি দিয়ে এঁকেছিলো। একটা ছিলো সাদা থানের উপর, একটা হাল্কা কমলা, আরেকটা হালকা বেগুনি থানের উপর করা। সাদা আর কমলা শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে, হাল্কা বেগুনি শাড়িটা আমার খুব পছন্দের ছিলো বলেই হয়তো মা এই শাড়িটা তুলে রেখেছিলো।

একটা শাড়ি পেয়েছি, আমাদের বিয়ের পর আমার উত্তম বেলী রোড থেকে শাড়িটা কিনে মা’কে দিয়েছিলো। জামাইয়ের দেয়া প্রথম শাড়ি, মা রেখে দিয়েছিলো। আড়ং থেকে কেনা কাপড়ের তৈরি একটা পেন এন্ড পেপার হোল্ডার খুঁজে পেলাম। এটিও মা’কে দিয়েছিলো আমার উত্তম, মা তুলে রেখেছিলো। সুটকেসে কয়েকটা ছোটো রঙিন টাওয়েল পেলাম। আমিই হয়তো আমেরিকা থেকে নিয়ে গেছিলাম। মা কত যত্ন করে রেখেছে। আমার বাবা মা’কে ভালোবেসে যখন যা দিয়েছি, মা ভালোবাসার জিনিস ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন, ভালোবেসে আগলে রেখেছেন।

কখনো বলেননি, সস্তার জিনিস দিয়েছি, কখনো বলেননি সেইলে কেনা জিনিস দিয়েছি, কখনো বলেননি ডেট এক্সপায়ার্ড জিনিস দিয়েছি। মা জিনিস হাতে নিয়ে সেখানে মেয়ে, জামাই আর নাতনিদের ভালোবাসা অনুভব করতেন, জিনিসের গায়ে দামের ট্যাগ খুঁজতেন না, এক্সপিরেশন ডেট খুঁজতেন না। এই জন্যই মায়ের ট্রেজার বক্সে থাকা শত বছরের পুরানো জিনিস আজও জ্বল জ্বল করছে।

আজই প্রথম মায়ের ট্রেজার বক্সটা খুলে দেখলাম। ট্রেজার বক্স ঠাসা অমূল্য রতন। একটা কৌটোর মুখ খুলতেই বের হলো লুডুর গুটি আর ছক্কা পাঞ্জা। এই গুটি আর ছক্কা পাঞ্জাটা মায়ের তরুণী বয়সের, যখন মা অবসরে তার ননদ জায়েদের সাথে অবসরে লুডু খেলতো। একটা কৌটো খুলে পাওয়া গেলো বেশ কিছু ঝকঝকে সেফটি পিন, পঁচিশ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে এনে দিয়েছিলাম। আরেক পাউচে পাওয়া গেলো অন্য সাইজের আরও কিছু সেফটি পিন, কখনো আমিই হয়তো আমেরিকা থেকে নিয়ে গেছিলাম। একটি ছোটো কৌটো ভর্তি চকচকে এক টাকার কয়েন। তিনটি ছোটো ছোটো পাউচ আমার মেজো কন্যা মিশা দিয়েছিলো দিদাকে। প্রতিটি পাউচে আছে নতুন একশো টাকার নোট। পেলাম একটা সানগ্লাস, এটাও মিশা দিয়েছিলো দিদাকে। আমেরিকা থেকে দেশে যাওয়ার সময় মিশা সবসময় ওর দিদার জন্য টুকিটাকি হাবিজাবি অনেক কিছু নিতো। আমাদের কারোরই ধারণা ছিলো না, মা প্রতিটি জিনিস এতো যত্ন করে ট্রেজার বক্সে রেখে দিতো।

বক্সের ভেতর এবার পেলাম একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট। প্যাকেট খুলে একটা একটা জিনিস বের করি আর থমকে যাই! প্যাকেটের ভেতর সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, খুব সম্ভব আমার জন্যই মা এই প্যাকেটটা রেখেছিলো। কারণ মা জানতো একমাত্র আমিই স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসি, হাতড়ে হাতড়ে স্মৃতি খুঁজি, স্মৃতি কুড়াতে ভালোবাসি। প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর থেকে বের করলাম ছোটো একটা পকেট এলবাম। এলবামে আমাদের আনন্দময় বিভিন্ন সময়ের ছবি যেখানে মা আছে, আমার মেয়েরা আছে, মাসি পিসী ঠাকুমা আছে।

ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমার জীবন থেকে আনন্দময় সবই হারিয়ে যাবে মা জানতো, তাই ছবিগুলো যত্ন করে তুলে রেখেছে আমার জন্য। পেলাম প্রফেশনাল জ্যোতিষী দিয়ে তৈরি করা আমার দুই মেয়ে মৌটুসি আর মিশার কোষ্ঠি, খুব যত্ন করে রাখা। মা কেনো নাতনিদের কোষ্ঠি করিয়েছিলো কে জানে! মা তো জানতেও পারেনি, মায়ের আদরের নাতনিদের কোষ্ঠিতে কি লেখা ছিলো! দুটো এনভেলাপ পেলাম, একটিতে আমার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের রেজিস্ট্রেশন কার্ড, আরেকটিতে বিএড পরীক্ষার প্রবেশ পত্র। দেখে আমার দুই চোখ ফেটে জল এলো। মায়ের ট্রেজার বক্সে আমার বিএডের রেজাল্টের কপি নেই, তাই প্রমাণ নেই তিন কন্যা জন্মের পর বিএড করেছি, বিএড পরীক্ষায় ৭৯৩ পেয়েছি।

আরও অনেক কাগজপত্রের মাঝে তিনটা আলাদা ছোটো প্যাকেট পেলাম, পত্রিকার কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে লাল সূতো দিয়ে বাঁধা। এক প্যাকেটের গায়ে মায়ের নাম লেখা, আরেক প্যাকেটের গায়ে আমার নাম লেখা, তৃতীয় প্যাকেটের গায়ে দাদু দিদিমার নাম লেখা। মায়ের নামের প্যাকেট খুললাম আগে, বেরিয়ে এলো মায়ের বিভিন্ন বয়সের পাসপোর্ট সাইজের ছবি। তেতাল্লিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বিভিন্ন সময় পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলতে হয়েছে।

একটা ছবি মায়ের প্রথম বয়সের, পরের গুলো আরও পরের। প্রথম বয়সের ছবিটায় মা’কে দেখে মনেই হয় না, এটা আমার সুন্দরী মা। আমার মায়ের উপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত একটু উঁচু ছিলো, আর ঠোঁট দুটো পাতলা ছিলো বলে দাঁত দুটো দেখা যেতো। ছবি তোলার সময় ঠোঁট চেপে দাঁত ঢাকতে গেলে আমার সুন্দরী মায়ের চেহারা বদলে অসুন্দরী হয়ে যেতো। সেই ছবির চেহারা মায়েরও পছন্দ হতো না, আমারও না। এইজন্য মা প্রয়োজন ছাড়া কক্ষনো ছবি তুলতো না।

আজ আমার মায়ের সব বয়সের ছবিগুলোই খুব সুন্দর লাগলো। মা’কে কত বলেছি, মা দাঁত দেখা যাক। তোমার সামনের দাঁতদুটো দেখেই তোমাকে চিনি, ঠোঁট চেপে দাঁত ঢাকতে হবে কেনো! তবুও মা ছবি তোলার সময় সিরিয়াস হয়ে যেতো। একটা ছবি দেখে আমি আজ ফিদা হয়ে গেলাম। পাকিস্তান আমলে তোলা ছবি। মায়ের পরনে সেই শাড়ি, গলায় সেই ঝিনুক লকেটের হার। এই শাড়িটা ছিলো আমার খুব পছন্দের, নাম দিয়েছিলাম ইস্পাহানি শাড়ি। কারণ পাকিস্তান আমলে আমাদের বাসায় যে ইস্পাহানি চায়ের সাদা সবুজ বাক্স আসতো, এই শাড়ির প্রিন্টটা দেখতে ইস্পাহানি চায়ের প্যাকেটের মতো লাগতো।

মুক্তিযুদ্ধের পরে এই শাড়িটা আমি আর দেখিনি। মা’কে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, ইস্পাহানি শাড়িটার কথা। মা বুঝতেও পারতো না, ইসপাহানি শাড়ি কোনটা। আমি মনে করিয়ে দিতাম, অই যে ‘৭০ সালে আমরা প্লেনে চড়ে কলিকাতা গেলাম, তুমি ইস্পাহানি শাড়িটা পরেছিলা। অইটাই ইস্পাহানি শাড়ি। মা বলতো, কি জানি কি কস, ইসপাহানি শাড়ি, বাপের জন্মেও এমন নাম শুনি নাই। নিশ্চয়ই ছিঁড়ে গেছে। আর মায়ের গলার এই হারটার কথা অনেক মনে পড়ে। ঝিনুকের উপর জোড়া ময়ুর ডিজাইনের লকেট। আমার বিয়ের সময় মায়ের যত গয়না ছিলো, সব ভেঙে আমার বিয়ের গয়না গড়িয়ে দিয়েছে। ঝিনুক লকেটওয়ালা এই হারটাও ভাঙতে হয়েছিলো।
এই একটা ছবি আমাকে আজ এতো কাঁদালো!

এরপর খুললাম আমার নামের প্যাকেট। এখানেও পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ক্লাস এইটে যখন পড়ি, আমার পাসপোর্ট করানোর জন্য এই ছবি তোলা হয়েছিলো। তখন কী বেকুব ছিলাম আমি, বারো- তেরো বছরের এক কিশোরীকে তার মা বললো, শাড়ি পরে ছবি তোল। অমনি কিশোরী মায়ের শাড়ি পরে, মাথার চুল টেনে ঝুঁটি বেঁধে, চোখে কাজল, কপালে কাজলের বড় টিকা, গলায় পুঁতির মালা পরে ছবি উঠালো! কী বোকা দেখাচ্ছিলো ছবিতে, ভাগ্যিস দালাল বলেছিলো, এই ছবি দিয়ে পাসপোর্ট হবে না। আমি বললেই আমার মেয়েরা পাসপোর্টের জন্য তুলতো এভাবে ছবি? অথচ মায়ের কথায় আমি শাড়ি পরে স্টুডিয়োতে গিয়ে ছবি তুলেছি। এত বছর পর নিজের ছবি দেখে নিজেই খিলখিল করে হেসে ফেলেছি।

এরপর দাদু দিদিমার প্যাকেট খুললাম। সেখানে দাদুর একটা ছবি, দিদিমার তিন বয়সের তিনটা ছবি। একটা ছবিতে দিদিমার স্বাক্ষর আছে, শ্রী চারুলতা রায়। স্বাক্ষর পড়ে খুশিও হলাম, হেসেও দিলাম। আমার দিদিমা ঠাকুমা দুজনেই প্রাইমারি স্কুল পাশ। এটা আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের, কোন্ আমলের নারী উনারা, বেঁচে থাকলে দিদিমার বয়স আজ একশ তিন হতো, ঠাকুমার হতো একশ বিশ। দিদিমার স্বাক্ষরে নিজের নামের আগে শ্রীমতি না লিখে শ্রী লিখেছে দেখে হাসি পেয়েছে। ঠিকই আছে, শ্রীমতি হলেও আমার দিদিমা শ্রীমতিদের মতো মিনমিনে ছিলেন না, চলনে বলনে ঠাটে বাটে শ্রী মহাশয়দের মতোই তেজস্বী ছিলেন।

মনে পড়ে গেলো, দিদিমা আর মা পাকিস্তান আমলে কত যে বেড়াতো, প্রায় দিন মা মেয়ে রিকশায় চড়ে চলে যেতো সিনেমা দেখতে, আমার সব মনে আছে কারণ দিদিমা আর মা যেখানেই যেতো আমাকে সাথে নিতো।
আরেকটা ছবি পেলাম, মায়ের মামার ছবি। পোশাকে দাঁড়ানোর ভংগিতে কী স্মার্ট মায়ের মামা! দেশ স্বাধীনের পর আমাদের হাল দেখে কে বলবে, আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষগুলো চলনে বলনে শিক্ষায় সম্পদে কতখানি পরিপূর্ণ ছিলো! পেলাম আমার মিশা কন্যার হাতে লেখা চিঠি। অস্ট্রেলিয়া থাকতে মিশা ওর দিদা দাদুকে খুব মিস করতো, তাই চিঠি লিখতো।

পাঁচ বছরের মিশা বাংলা বর্ণ পরিচয় ছাড়াই বাংলায় চিঠি লিখতো, এটা দিদার কাছে হয়তো অষ্টমাশ্চর্য বিষয় ছিলো তাই ট্রেজার বক্সে চিঠিগুলো রেখে দিয়েছে। মিশা চিঠির শেষে ‘ইতি মিশা’ না লিখে লিখতো, ‘ইতিহাস মিশা’! সেই থেকে মিশার নাম হয়ে গেছিলো, ইতিহাস মিশা। চিঠি দুটো দেখে আবার ঝাঁপিয়ে কান্না এলো। আমাদের সে-ই প্রাণোচ্ছল পাগলি আহ্লাদী মিশা আজ সত্যিই ইতিহাস মিশা হয়ে গেছে! জীবনের বাস্তবতা ইতিহাস মিশাকে পুরো বদলে দিয়েছে। আমার পাসপোর্ট সাইজের কিশোরী বয়সের ছবিগুলো পত্রিকার যে কাগজ দিয়ে মোড়ানো ছিলো, সেই কাগজে বড় হরফে লেখা,” গ্রন্থমেলা অনন্য সুন্দর, বিশ্বে নন্দিত”!

এটা পড়ে আমার অদ্ভুত এক ভাবের উদয় হলো। মা একই সময়ে বিভিন্ন জনের ছবি কাগজে মুড়িয়ে তিন সেট প্যাকেট বানিয়েছে, আমার ছবির প্যাকেটটা কিভাবে গ্রন্থমেলার মোড়কে ঢুকে গেলো!
তবে কি সেদিনই নির্ধারিত হয়ে গেছিলো, আমার লেখা বই একদিন এই অনন্য গ্রন্থমেলায় ঠাঁই পাবে!

মায়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই!
আরও কত স্মৃতি মায়ের ট্রেজার বক্সে। আমাদের অস্ট্রেলিয়ার ছবি, মৌটুসির নাচের ছবি, হারমোনিয়াম বাজিয়ে মৌটুসী ফাংশনে গান গাইছে, ছোট্টো মিশা আমি আজ কানাই মাস্টার আবৃত্তি করছে, পুতুলের মতো দেখতে মিশা—-

মিথীলার ছবি, ছোট্টো মিথীলার কত ছবি—-
ছবিগুলো দেখে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো। ট্রেজার বক্সটা সযতনে আবার সুটকেসে রেখে সুটকেসের ডালা বন্ধ করে দিলাম।

ভালোবাসা যেথায় বিরাজ করে!

r03 একটা ভালোবাসার গল্প বলি।
অদিতি পাল টুম্পাকে আমার ফেসবুক সিনিয়র-জুনিয়র বন্ধুদের অনেকেই আমার নিলাজি কইন্যা নামে চিনে। আমার নিলাজি কইন্যা টুম্পা, সেই ছোট্টো বেলা থেকে আমাকে মামী বলে চিনেছে জেনেছে ভালোবেসেছে।
টুম্পার মা’কে আমি কমলদি ডাকি, কমলদি আমাকে বৌদি ডাকে। আমার উত্তম যখন কেমিস্ট্রির লেকচারার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলো, কমলদি থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। তখন থেকে উত্তমকে স্যার ডাকা শুরু, উনার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্যার ডেকেছেন।

কমলদিরা মাস্টার্স শেষ করার আগেই স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে কানাডা চলে যায় পিএইচডি করতে। এরপর স্যারের সাথে কমলদির আবার দেখা হয় গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসে। কমলদি সেখানে সিনিয়র কেমিস্ট হিসেবে কর্মরত, স্যার যোগ দিলেন আরএনডি বিভাগের প্রধান হিসেবে। কমলদি এক বিকেলে পরীর মতো ফুটফুটে এক বাচ্চাকে নিয়ে আমাদের কোয়ার্টারে এলেন স্যারের বউ বাচ্চার সাথে দেখা করতে। আমি তখন সবে জাহাঙ্গীরনগর থেকে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স শেষ করেছি। একই সাবজেক্টের স্যারের পুচকি বউকে কমলদি বৌদি ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আর পুচকে পরীটাকে বললেন, টুম্পা এই যে তোমার মামী, আর আমার স্যার হচ্ছেন তোমার মামা। আর মৌটুসি তোমার বন্ধু।

প্রথম দিনেই দুই বছরের ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা পরীটা আমাকে ভালোবেসে ফেললো। মামী ওর ধ্যান জ্ঞান ভালোবাসা। এরপর মিশা জন্ম নিলো, ততদিনে কমলদি ঢাকা আরেক ফার্মাসিউটিক্যালসে জয়েন করেছেন।
টুম্পার সাথে সহজে দেখা হয় না, কিনতু টুম্পা আমাকে ভোলে না।

এরপর আমরা ঢাকা চলে এলাম, অস্ট্রেলিয়া গেলাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরলাম, আবার আমেরিকা চলে এলাম। ততদিনে কমলদি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু, দিদি, আপনার জন হয়ে গেছে। আর টুম্পা? মামার সাথে খাতির নাই, মামার বউ মামী হয়ে গেছে ওর বন্ধু গাইড ফিলোসোফার আরও আরও অনেক কিছু। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার টুম্পা কলেজ জীবন থেকেই চুপি চুপি ভালোবেসেছে ওরই ক্লাসফ্রেন্ড পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার এবং থিয়েটার কর্মী সুদর্শন সঞ্জীবকে। চুপি চুপি নয়, ভালোবাসার কথা মামীকে জানিয়েছে। সেই থেকে আদর করে ওকে আমি নিলাজি কইন্যা ডাকি।

পৃথিবীতে এখনও একমাত্র এই নিলাজি কইন্যাটি আমাকে নি:শর্ত নি:স্বার্থভাবে ভালোবাসে। আমি যদি ওর কাছে কাঠফাটা রোদে এক পশলা বৃষ্টি চাই, ও মেঘ খুঁড়ে আমার জন্য বৃষ্টি নিয়ে আসবে। আমি যদি ওর কাছে ডুমুরের ফুল চাই, বাঘের দুধ চাই, ও যেখান থেকে পারুক আমার জন্য সব নিয়ে আসবে। সাত বছর আগে সঞ্জীবের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে, ওর বিয়েতে যাবো বলেই আমি বাংলাদেশে গেছিলাম। কমলদি অঞ্জনদা আর টুম্পা মিলে সে কি আদর আর সম্মান দিয়েছে আমাকে, কেউ বিশ্বাসই করবে না যে ওদের সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই!

সঞ্জীব টুম্পার ঘরে একটা পরীর মত বাচ্চা এসেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য ওরা এখন লন্ডন চলে গেছে। এটুকু ছিলো ভালোবাসার ভূমিকা, এবার উপসংহার।

ক্যান্সারের থাবায় কমলদি মারা গেছেন গত বছর অক্টোবার মাসে, আমি তখন দেরাদুনে ছিলাম। কমলদি যখন হসপিটালে ছিলেন, ফেসবুকে টুম্পার আহাজারি দেখে বিমর্ষ বোধ করতাম, আবার কখনো আশার কথা শুনলে মনটা আনন্দে ভরে যেতো। অথচ আমি টুম্পাকে কল দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতাম না। মাঝে মাঝে মেসেঞ্জারে পজিটিভ মেসেজ পাঠাতাম, ফিংগার ক্রস করতাম যেন কমলদি সেরে ওঠে। আমারই মেয়ের বয়সী টুম্পা, আজ মাকে যমের হাত থেকে রক্ষা করতে কী যুদ্ধটাই করছে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা টুম্পা জিততে পারেনি, ধরে রাখতে পারেনি ওর প্রাণপ্রিয় মা”কে। সেদিনও টুম্পা বলেছে, মামী মায়ের কষ্ট দেখতে পারছি না। তুমি একটু ঠাকুরকে বলো না, তোমার কমলদিকে ভালো করে দিতে। তোমাকে তোমার কমলদি এত ভালোবাসে, তোমার কথা ভগবান শুনবে।

সেই বিকেলে আমি সবে শিখ মন্দিরে প্রার্থনা করে এসেছি, ” হে ঈশ্বর, কমলদির দেহের কষ্ট কমুক, কমলদি দেহে আরাম পাক। গেস্ট হাউজে ঢুকতেই বাংলাদেশ থেকে টুম্পার ফোন, ” মামী গো, মা তো চলে গেলো”! ব্যস এরপর টুম্পার সাথে আর কথা হয়নি। এবার বাংলাদেশে গেলাম। টুম্পা লন্ডনে, ওর বাবা মানে অঞ্জনদা নিজের বাড়িতে। আমি অঞ্জনদার সাথে দেখা করতে যাবো শুনে টুম্পা আমাকে আগেই বলেছিলো, মামী, আমি নাই তো কি হয়েছে, ঘরে তোমার কমলদি আছে। তুমি তোমার কমলদির বিছানায় বসবে, কমলদির ছবিতে হাত বুলিয়ে দিও। তোমার কমলদি কিন্তু খুব খুশি হবে। আমি গেছি, কমলদির শূন্য ঘরে শূন্য বিছানায় বসেছি। অঞ্জনদার সাথে কথা বলছি, লন্ডন থেকে টুম্পা ভিডিও কল দিয়েছে ওর বাবাকে। ভিডিও কলেই কী কান্না, ওর কান্না দেখে মনে হচ্ছিলো আমার মৌটুসি কাঁদছে!

কান্না থামলো, ওর বাবাকে বললো, বাবা মায়ের আলমারির দরজা খোলো। মেয়ের নির্দেশ পালন করলেন অঞ্জনদা। এবার টুম্পা আমাকে বললো, মামী, এই আলমারিতে মায়ের শাড়ি শাল আরও অনেক কিছু রাখা আছে। তুমি তোমার পছন্দমতো মায়ের একটা শাড়ি নাও, আমি চাই মায়ের একটা চিহ্ন তোমার কাছে থাকুক। মা খুব ভালোবাসতো তোমাকে, তুমি মায়ের চিহ্ন নিয়ে যাও।

বললাম, টুম্পা শাড়ি নিতে হবে না। মায়ের চিহ্ন সযত্নে থাকুক তোর জন্য। কমলদি আমার হৃদয়ে থাকবে।
টুম্পা বললো, মামী তুমিও তো আমার মা, মায়ের চেয়ে তো কম না। প্লিজ, আমি চাই মায়ের একটা শাড়ি তুমি নাও।

আলমারির দরজা অর্ধেক খোলা, ভেতরে অন্ধকার। অঞ্জনদা সবে ফোনের টর্চ জ্বালিয়েছেন যেন আমি আলমারির ভেতরটা দেখতে পাই। আমি অঞ্জনদাকে থামিয়ে দিলাম। আলমারির অন্ধকার তাকে হাত ঢুকিয়ে প্রথম যে প্যাকেটে হাত স্পর্শ করলো, সেই প্যাকেটটাই টেনে নিলাম। প্যাকেটের গায়ে আলো পড়তেই আমি চমকে গেলাম। শাড়ির গায়ে লেখা, ” ভালোবাসি মা”! আমার চোখের সামনের দেয়ালে কমলদির যে ছবিটা আছে, এই শাড়িটাই উনার পরনে। টুম্পা বললো, মামী, এই শাড়িটা গত বছর মা’কে মাদার’স ডেতে দিয়েছিলাম। এটাই আমার দেয়া শেষ শাড়ি, এটাই মায়ের শেষ ছবি। এরপর তো মাকে নিয়ে হাসপাতাল আর বাসা করেই কেটে গেলো।

অনেকক্ষণ চোখের জল আটকে রেখেছিলাম, আর আটকাতে পারলাম না। চোখ ভিজে গেলো। টুম্পাকে বললাম, তুই একটু আগেই বললি, আমি তোর মায়ের চেয়ে কম না। এইজন্যই বোধ হয়, এই শাড়িটাই আমার হাতে এসেছে। আমেরিকা ফিরে এসেছি। শাড়িটা খুব যত্ন করে রেখেছি।

আজ এসেছে সেই লগন। ‘ভালোবাসি মা’ শাড়িটা পরে ভিডিও কল করেছি টুম্পাকে। গত পরশু টুম্পার বাবা লন্ডন গেছেন মেয়ে জামাই নাতনির সাথে দেখা করতে। মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য গেছেন, তাই টুম্পা সপরিবারে বাবাকে নিয়ে লন্ডন শহর ঘুরছে। ভিডিও কলে আমাকে ওর মায়ের শাড়িতে দেখে কী যে খুশি, কী যে খুশি। বললাম, ‘ভালোবাসি মা’ শাড়ি আর টিপ পরে নেপালি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খেতে যাচ্ছি। এই প্রথম মনে হলো, সন্তানের কাছে মাদার’স ডের মান রাখতে পেরেছি।

জীবন পরিবর্তন নিজের চিন্তাশক্তি ও কর্ম

জীবন পরিবর্তন নিজের চিন্তাশক্তি ও কর্মের উপর প্রতিনিধিত্ব করে গড়ে ওঠে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা আশার আলো দেখায় তেমনি কিছু উদ্ধৃতি আজ আপনাদের মাঝে প্রকাশ করলাম আশা করছি আজকের ৩৩টি উদ্ধৃতি আপনার জীবন চলার পাথেয় হবে।

৩৩ টি উদ্ধৃতি।
১৭৮১. “সততা শুধু আপনি যা বলেন তা নিয়ে নয়, আপনি যা বলেন না তা নিয়ে। এটি কেবল আপনি যা করেন তা নয়, এটি আপনি যা করেন না তা সম্পর্কে। এটি নিজের প্রতি সত্য হওয়া সম্পর্কে, এমনকি যখন কেউ দেখছে না।”

১৭৮২. “সততা হল একটি বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য চরিত্রের ভিত্তি। এটি কেবলমাত্র মূল্যবোধের একটি অখন্ডতা নয় যা একজন ব্যক্তি ধরে রাখার দাবি করে, কিন্তু এমন একটি উপায় যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বেঁচে থাকে। সত্যিকারের সততা শুধুমাত্র কোনটিতেই প্রদর্শিত হয় না বলেন এবং করেন, কিন্তু সেই সাথে যা বলা বা না করা বেছে নেওয়া হয় তাতেও। এর জন্য প্রয়োজন কঠিন বা অজনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও যা সঠিক তার পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস এবং নিজের কাজের জন্য নিজেকে দায়বদ্ধ রাখা। সংক্ষেপে, সততা হল একজনের কথা, কাজ এবং বিশ্বাসের সারিবদ্ধতা এবং সততা, স্বচ্ছতা এবং সত্যতার জীবনযাপনের জন্য অটল প্রতিশ্রুতি।”

১৭৮৩. “জ্ঞানের সৌন্দর্য হল এর কোন সীমা নেই, এবং আপনি যত বেশি শিখবেন, ততই আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি এখনও কতটা আবিষ্কার করতে পারেন।”

১৭৮৪. “সুখ একটি গন্তব্য নয়, তবে একটি যাত্রা যা নিজের মধ্যে পাওয়া যায়। এটি মনের একটি অবস্থা যা কৃতজ্ঞতা, দয়া এবং জীবনের উত্থান-পতনকে আলিঙ্গন করার ইচ্ছার মাধ্যমে চাষ করা হয়।”

১৭৮৫. “সাফল্য কেবল আপনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য নয়, তবে আপনি যে ব্যক্তি হয়ে উঠছেন সে সম্পর্কে। এটি বাধা অতিক্রম করার, ব্যর্থতা থেকে শেখার এবং একজন মানুষ হিসাবে বেড়ে উঠার ক্ষমতা।”

১৭৮৬. “শব্দের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করা যায় না। তাদের অনুপ্রাণিত করার, নিরাময় করার, অনুপ্রেরণা দেওয়ার এবং জীবনকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে। সেগুলিকে বুদ্ধিমানের সাথে ব্যবহার করুন এবং সর্বদা হৃদয় থেকে কথা বলুন।”

১৭৮৭. “জীবন একটি ফাঁকা ক্যানভাসের মত, এবং আমরা শিল্পী। এটা আমাদের উপর নির্ভর করে এমন একটি মাস্টারপিস তৈরি করা যা আমরা পৃথিবীতে দেখতে চাই সৌন্দর্য, ভালবাসা এবং আনন্দকে প্রতিফলিত করে।”

১৭৮৮. “সাহস হল ভয়ের অনুপস্থিতি নয়, বরং এটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা। এটি আমাদের স্বপ্নকে অনুসরণ করার এবং অনিশ্চয়তা এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবনকে পূর্ণভাবে বাঁচানোর সংকল্প।”

১৮৯. “আমরা নিজেদের এবং অন্যদের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার দিতে পারি ক্ষমার উপহার। এটি অতীতকে ছেড়ে দেওয়া, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং বর্তমানকে খোলা অস্ত্রে আলিঙ্গন করার চাবিকাঠি।”

১৭৯০. “ভালোবাসা হল সার্বজনীন ভাষা যা আমাদের সকলকে সংযুক্ত করে। এটি সীমানা, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসকে অতিক্রম করে এবং এক সময়ে বিশ্বকে এক হৃদয়ে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে।”

১৭৯১. “কল্পনার শক্তি সীমাহীন। এটি আমাদের বড় স্বপ্ন দেখতে, আমাদের লক্ষ্যগুলি কল্পনা করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে দেয় যা আশা, সম্ভাবনা এবং বিস্ময়ে ভরা।”

১৭৯২. “দয়া শুধু একটি অঙ্গভঙ্গি নয়, বরং জীবনের একটি উপায়। এটি সাহায্যের হাত প্রসারিত করার ইচ্ছা, খোলা হৃদয়ে শোনা এবং অন্যদের সহানুভূতি, সম্মান এবং সহানুভূতির সাথে আচরণ করা।”

১৭৯৩. “সাফল্যের পথটি সবসময় সহজ নয়, তবে এটি সর্বদা মূল্যবান। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, উত্সর্গ এবং শ্রেষ্ঠত্বের অন্তহীন সাধনা।”

১৭৯৪. “মহান কাজ করার একমাত্র উপায় হল আপনি যা করেন তাকে ভালবাসুন। আপনি যদি এটি এখনও খুঁজে না পান তবে খুঁজতে থাকুন। স্থির হবেন না। হৃদয়ের সমস্ত বিষয়ের মতো, আপনি যখন এটি খুঁজে পাবেন তখন আপনি জানতে পারবেন।”

১৭৯৫. “জীবন খুব ছোট যে জিনিসগুলিতে সময় নষ্ট করা যায় না। এমন জিনিসগুলিতে ফোকাস করুন যা আপনাকে আনন্দ দেয়, যে লোকেরা আপনাকে উপরে তোলে এবং যে অভিজ্ঞতাগুলি আপনার হৃদয়কে গান করে।”

১৭৯৬. “সাফল্য একটি একক যাত্রা নয়, বরং একটি সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা৷ নিজেকে এমন লোকেদের সাথে ঘিরে রাখুন যারা আপনাকে বিশ্বাস করে, আপনাকে সমর্থন করে এবং আপনাকে আপনার সেরা হতে চ্যালেঞ্জ করে৷”

১৭৯৭. “একজন ব্যক্তির সাফল্যের সত্যিকারের পরিমাপ তাদের কৃতিত্বের মধ্যে নয়, তবে তারা অন্যদের জীবনে যে প্রভাব ফেলে তার মধ্যে। এটি ভালবাসা, উদারতা এবং উদারতার উত্তরাধিকার যা তারা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।”

১৭৯৮. “কৃতজ্ঞতা হল আমাদের জীবনে প্রাচুর্য আনলক করার মূল চাবিকাঠি। যখন আমরা আমাদের যা অভাবের পরিবর্তে আমাদের যা আছে তার উপর ফোকাস করি, তখন আমরা আমাদের জীবনে আরও আশীর্বাদ, আনন্দ এবং শান্তি আকর্ষণ করি।”

১৭৯৯. “সাফল্য একটি গন্তব্য নয়, কিন্তু আত্ম-আবিষ্কারের একটি যাত্রা। এটি আমাদের অনন্য উপহার, আবেগ এবং উদ্দেশ্য আবিষ্কার করার এবং বিশ্বে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে তাদের ব্যবহার করার প্রক্রিয়া।”
১৮০০.”আমাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কটি আমাদের নিজেদের সাথে আছে। যখন আমরা নিজেদেরকে ভালবাসতে, গ্রহণ করতে এবং মূল্য দিতে শিখি, তখন আমরা আমাদের জীবনকে পূর্ণভাবে বাঁচতে সক্ষম হই।”

১৮০১. “আমরা অন্যদের দিতে পারি সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হল আমাদের উপস্থিতি। এই মুহূর্তে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত এবং নিযুক্ত থাকা হল জীবনের পবিত্রতাকে সম্মান করা এবং আমাদের চারপাশের লোকদের প্রতি আমাদের ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা।”

১৮০২.”চ্যালেঞ্জগুলি বাধা নয়, বরং বৃদ্ধি এবং রূপান্তরের সুযোগ। তারা আমাদের স্থিতিস্থাপকতা, সাহস এবং অধ্যবসায়ের শক্তি শেখায়।”

১৮০৩. “বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য হল এটি আমাদের একে অপরের কাছ থেকে শিখতে, আমাদের পার্থক্যগুলি উদযাপন করতে এবং এমন একটি বিশ্ব তৈরি করতে দেয় যা আরও সমৃদ্ধ, আরও প্রাণবন্ত এবং আরও অন্তর্ভুক্ত।”

১৮০৪. “সাফল্য হল অন্য কারো থেকে ভালো হওয়ার বিষয়ে নয়, বরং নিজেদের সেরা সংস্করণ হওয়ার বিষয়ে। এটি আত্ম-উন্নতি, বৃদ্ধি এবং আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা।”

১৮০৫. “দয়ার শক্তি হল যে এটি প্রেম এবং করুণার একটি ঢেউয়ের প্রভাব তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। দয়ার একটি ছোট কাজ অন্যদেরকে একই কাজ করতে অনুপ্রাণিত করতে পারে এবং ইতিবাচকতার একটি চেইন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।”

১৮০৬. “সাফল্যের চাবিকাঠি ব্যর্থতা এড়ানো নয়, বরং এটিকে বৃদ্ধি এবং শেখার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করা। এটি ব্যর্থতাকে ধাক্কা হিসাবে নয়, বরং বৃহত্তর সাফল্যের একটি ধাপ হিসাবে দেখার ক্ষমতা।”

১৮০৭. “অধ্যবসায়ের শক্তি হল যে এটি আমাদের বাধা এবং চ্যালেঞ্জগুলিকে অতিক্রম করতে, কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে এবং আমাদের লক্ষ্য এবং স্বপ্নগুলিতে পৌঁছানোর অনুমতি দেয়। এটি যাত্রা কঠিন এবং রাস্তা দীর্ঘ হলেও চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা।”

১৮০৮. “প্রমাণিততার সৌন্দর্য হল যে এটি আমাদের নিজেদের প্রতি সত্য হতে, আমাদের অনন্য গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্যগুলিকে আলিঙ্গন করতে এবং সততা এবং উদ্দেশ্যের সাথে আমাদের জীবনযাপন করতে দেয়।”

১৮০৯. “সত্যিকারের সুখের চাবিকাঠি বাহ্যিক বৈধতা খোঁজার মধ্যে নয়, বরং আত্ম-ভালোবাসা এবং গ্রহণযোগ্যতার বোধ গড়ে তোলার মধ্যে রয়েছে। এটি হল নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে, ত্রুটিগুলি এবং সমস্ত কিছুকে আলিঙ্গন করার এবং আত্মবিশ্বাস ও সহানুভূতির সাথে আমাদের জীবনযাপন করার ক্ষমতা।”

১৮১০. “দয়ার শক্তি হল যে এটি আমাদের চারপাশের বিশ্বকে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে। এটি সহানুভূতি, সহানুভূতি এবং সম্মানের সাথে অন্যদের সাথে আচরণ করার এবং আমরা যেখানেই যাই সেখানে ভালবাসা এবং ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস।”

১৮১০. “প্রকৃতির সৌন্দর্য হ’ল এটি আমাদের চারপাশের বিশ্বের বিস্ময় এবং মহিমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি একটি সূর্যাস্তের সৌন্দর্য, ঢেউয়ের শব্দ বা বনের স্থিরতায় শান্তি এবং সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়ার ক্ষমতা।”

১৮১০. “ব্যক্তিগত বৃদ্ধি এবং বিকাশের চাবিকাঠি হল অস্বস্তিকে আলিঙ্গন করা এবং আমাদের আরামদায়ক অঞ্চলের বাইরে পা রাখা। চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তার মাধ্যমেই আমরা আমাদের প্রকৃত সম্ভাবনা আবিষ্কার করি এবং নিজেদের সেরা সংস্করণ হয়ে উঠি।”

১৮১০. “সমাজ ও সম্প্রদায়ের শক্তি হল যে এটি আমাদেরকে একত্রিত করে, অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে এবং একটি সাধারণ লক্ষ্যের দিকে কাজ করার অনুমতি দেয়। এটি সহযোগিতা এবং সমর্থনের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি।”