বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

অণুগল্প : নারী_রহস্যময়ী

বারো ঘন্টা কঠিন ডিউটি করে কাপড় পাল্টানোর মেলে না অবকাশ। ম্যাসেঞ্জারে মৃদু আওয়াজ। আমান ডিভাইস হাতে নেয়। সদ্য বন্ধু হওয়া এক নারীর মুখ ডিসপ্লেতে গোলাকার।

আয়নায় বিস্মৃত বন্ধুর মুখ? স্মৃতির প্ল্যাটফর্মে ঘুরে আসা ..পলকেই! নাহ! এই মুখ কষ্ট দেয়নি আগে।

অচেনা নারী শুধায় কালো অক্ষরে আলো জ্বেলে,
– কেমন আছ?

পরিচিত কোনো টোন কি ছুঁয়ে যেতে চায় আমানকে?
নাহ! এই টোন আগে কখনো কষ্ট দেয়নি আমানকে।
নির্জলা সত্যি বের হয় আমানের বুক চিরে,
– খুব খারাপ আছি। তুমি কে?

ওপাশে নীরব নারী।
জানার তীব্রতা মানুষেরই থাকে। একজন নামানুষ হয়েও এই আকাংখাটা আমানেরও বড্ড তীব্র। তাই কি ব্যকূল হওয়া?
– বললে না, কে তুমি?
– বললাম তো ফেসবুক বন্ধু।

সরব হয় নারী।

– তা তো জানি। তুমি দেখতে নারীর মতো- বলছ বন্ধু। আসলেই কি তুমি তাই? তুমি কি নারীর আদলে সত্যিই নারী?
– হ্যা!
– শুনে খুশী হলাম। বন্ধু বুঝে আসে? না এমনিতেই বলছ ‘বন্ধু’?
– বুঝিনি তোমার কথা। কি করছ এখন?
– এক অচেনা নারী যে বলছে বন্ধু, কিন্তু বন্ধু তার বুঝে আসে না, তাকে নিয়ে অণুগল্প লিখছি। বলতো, নারী বন্ধু হতে পারে? না বন্ধু কখনো নারী হয়?
– বুঝি না আমি।
– হ্যা! এটা সত্য বলেছ। কখনোই বুঝ নি তুমি! বুঝলেও বুঝার মাঝে কিছু বাকি রয়ে যায় তোমার। নও রহস্যময়ী তবু ভান কর যেন রহস্যময়ী। তোমার কোন কোন রহস্যটা বুঝতে বাকি রয়েছে, বলতো আমায়?

ওপাশে শ্মশান নীরবতায় অচেনা নারীর নীরব প্রস্থান।
আমান কি ব্যথিত হয়?
নাহ! ব্যথাগুলি তো সেই কবে পারুকে খুঁজতে চলে গেছে.. পারুর পিছুপিছু। ফিরেনি আজো।
তাই ব্যথা নাই। বোধ নাই।
কিছুই নাই এখন।।

#নারী_রহস্যময়ী_অণুগল্প_৪৫৭

অতৃপ্তি_অণুগল্প

“কোন অমরার বিরহিনীরে চাহনি ফিরে
কার বিষাদের শিশিরনীরে এলে নাহিয়া”

নিঃসঙ্গ শীতে কুয়াশায় খোলা ছাদে শিহাব একা। শুনছে এক প্রেমিক পুরুষের হৃদয় নিঙ্গড়ানো প্রেম-নির্যাস! সেই সাথে নিজের স্ট্যাটাস আপডেট করছে…

“আমি গত ঊনিশটি বছর এক নিভৃত জীবনযাপন করে চলেছি। প্রথমে এক নামানুষে পরিণত হয়েছি। এরপর ছায়ামানুষ। তবে একজন মানুষ হতে চেয়েছিলাম। এরপরে একজন শিহাব। এরপর ধীরে ধীরে একজন হামানুষ।

আমি আমার কাছের মানুষদের সাথে আমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন যত্ন অনুভব করি নাই, সম্পর্কগুলির যত্ন করি নাই। তাই আমি কিছুই হতে পারি নাই। একজন সন্তান- ভাই- স্বামী- বাবা… কিছুই না। সব থেকেও কিছুই নাই আমার। পারুও নাই। যার জন্য সবকিছু নাই হলো, সে কোথায়?

সবাই নাই হয়ে যায় কেন?
আমি যখন অনুভব করলাম, আমি কিছুই হতে পারব না, নিজেকে একটু একটু করে চিনতে শুরু করলাম।

একদিন
এক গোধুলিবেলায় আমার স্রষ্টাকে বললাম,
– তুমি আমাকে কিছুই হতে দিলে না। তবে কেন এত অনুভূতি দিয়েছ? আর দিলেই যখন, তা প্রকাশ করার ক্ষমতাও আমাকে দাও।

তিনি আমাকে দিলেন। তিনি কাউকেই নিরাশ করেন না। চাইতে জানলেও দেন, না জানলেও দেন। দেওয়াই তার কাজ। আমি লিখবার ক্ষমতা আমার স্রষ্টার কাছ থেকেই চেয়ে নিয়েছি। অনেকেই লেখেন। তারা সবাই অনুভূতি সম্পন্ন। তবে সবাই প্রখর অনুভূতি সম্পন্ন নন।
আমার স্রষ্টা আমাকে শেষের দলে রেখেছেন। নিজেই বললাম বলে ক্ষমা চাইছি।

অনুভূতির প্রখরতায় প্রতি মুহুর্তে অবর্ণনীয় কিন্তু বোধ সম্পন্ন বেদনায় ক্লিষ্ট হই আমি। কষ্টকর মুহুর্তগুলি আমাকে লিখবার তাড়নায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। জীবন জীবিকার গোলামির কেড়ে নেয়া, আমার সোনালী সময়গুলো, কি অবলীলায়ই না নষ্ট হয়। আমি একই সময়ে আমার ব্রেইনে দুই ‘প্যারালাল অনুভূতি অনুভবক্ষম’ একজন লেখক। অতিরিক্তটি আমি স্রষ্টার থেকে চেয়ে নিয়েছি।

মানুষের হৃদয় আমার বিচরণস্থল। হৃদয় জীবনের কথা বলে। আর জীবনের পথেই মানুষ চলে। ‘হৃদয় ওরিয়েন্টেড’ এক কর্মশালার শিক্ষানবিশ কারিগর আমি। দক্ষ থেকে দক্ষতর… আরো অনেক দক্ষ হতে চাই। আমার হৃদয় এক ‘প্যান্ডোরার বাক্স’। সেখানে আশা আমার একমাত্র ভেলা।

তবে কি আমি একজন আশাবিলাসী?

শুধু অনুভূতি, তা যত প্রখরই হোক না কেন, লেখক হওয়া অনেক কঠিন। পাঠকের চিন্তা-ভাবনার সব থেকে সরল পথটি ধরে, গল্পকে অল্প অল্প করে সামনে নিতে না জানলে, পাঠক আগ্রহ হারাবেন। সহজবোধ্য- ছোট ছোট- অতি ‘ফ্যামিলিয়ার’- জীবনের চোখে পড়া বা না পড়া, এমন সব অণুমুহুর্তগুলোকে একজন দক্ষ চিত্রকরের মত পাঠকমনে চিত্রায়ণ করতে হবে, করতে জানতে হবে।

আমি কি জানি?
আমি কি একজন দক্ষ চিত্রকর হতে পেরেছি?
পারু জানতো, সে থাকলে বলতো।
বলতো?

আমি লিখবার ক্ষমতা আমার স্রষ্টার কাছ থেকে চেয়ে নেয়াতে, অন্য কিছু চাইতে আমার ভীষণ লজ্জা করে।
না হলে আমি পারুকে চাইতাম! ”
… …
পারু হারানোর বেদনার মত, জীবনে কিছু না কিছু অতৃপ্তি থেকেই যায়। শিহাব ভাবে ওর নিজের জীবনের গল্প..

“আমার অনেক গল্প আছে
নষ্ট গল্প অল্প স্বল্প? তা ও আছে-
গল্পের ফেরিওয়ালা আমি
ফেরি করে বেড়াই আনন্দ-বেদনা
কখনো বা দু:খের মোড়কে কষ্ট।

কখনও বা স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আমি
দু:স্বপ্নের রাতকে বানাই স্নিগ্ধ সকাল
আমার অনেক গল্প আছে
দু’একটা হয়তো বা নষ্ট।

এক শব্দকারিগর আমি
যার ছিলো অঢেল গল্প
এখন নিজেই সে এক নষ্ট গল্প।”

#অতৃপ্তি_অণুগল্প_৪৬১

★ রবি ঠাকুরের গানের কলি

ছোটগল্প_কুহকী_প্রহর

‘অনেক প্রহর নিঃসঙ্গ
সাঁওতালি গানের সুরে,
কাটিয়ে দিলাম তোমায় ভেবে
ঝাউ মহুয়ার বনে’

– তপনের মায়াবী কন্ঠের সুরলহরী ভেসে চলেছে বদ্ধ কেবিনের যান্ত্রিক শীতল বাতাসে। এখন লাঞ্চ টাইম। খেতে ইচ্ছে করছে না। কি মনে করে গান শুনতে ইচ্ছে হল।

এই তুমিটা কে?
যাকে উদ্দেশ্য করে শিল্পী গেয়ে চলেছেন? শ্রোতার মনে এই গানটি শুনলেই প্রথম যে অনুভূতি জেগে উঠে তা হল- একটি নির্জন দুপুরে অপেক্ষার প্রহরগুলো বুকে নিয়ে কেউ একজন, কারো আসার মুহুর্তপানে চেয়ে আছে… তীব্র তীক্ষ্ণ অনুভবে। এক ফরেস্ট হীল ভালোলাগা কারো পদভারে মূর্ত হবে বিষন্ন ঘোরলাগা ভালোবাসায়।

এমন কেউ কি শিহাবের রয়েছে?
হ্যা! আছে তো।
কল্পনায় এবং বাস্তবেও। তবে তাঁরা দুজন কি একজন – এই ব্যাপারটি শিহাব ভাবতে গেলে কেমন তালগোল পাকিয়ে ফেলে।

মাথার দুই পাশে দুই বেনী ঝুলিয়ে যে মেয়েটি চৌদ্দ বছর আগে বেনী ঝুলানোর আনন্দ দিয়ে শিহাবকে প্রগলভ করে তুলেছিল, কদাচিৎ সে কল্পনায় কাছে আসে। কল্পনার সেই মেয়েটির কোনো নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। সেদিন কবি রুকসানা হকের একটি কবিতা পড়েছিল। চমৎকার সেই কবিতাটিতে যেন শিহাবের সেই মেয়েটির বর্ণনাই ছিল…

” তোমাকে রাখতে চাই না মেঘ ভালবাসায় খোদার কসম,
স্নানের শেষে ভেজা চুলে যদিও বা লেগে থাকে
তোমার চোখের কাঁপন, তবুও
রাখতে চাই না তোমায় জল করে চুলের ভেতর।
স্মৃতির মত করে তোমাকে ঘাটতে চাই না আর
তুমি না হয় থাকলে আমার একচিলতে দুঃখময় আকাশ হয়ে।”

হ্যা! শিহাবের জন্য ঐ আবছায়া মুখটি একচিলতে দুঃখময় আকাশ ই এখন… তখন… সবসময়!
রুমু হল ওর দুই বেনীওয়ালা সেই জন যে আনন্দ সাগরে প্রশান্ত ঢেউয়ের মাঝে নিজেকে খুঁজে ফেরায় শিহাবের সহচরী। এভাবেই কেটে চলেছে নিরন্তর সময়গুলো।

দুই মেয়েকে নিয়ে রুমু অন্য শহরে থাকে।
শিহাব আরেক শহরে। ইচ্ছে করে নয়। জীবিকার প্রয়োজনে আজ এই দূরত্ব। মাসে দু’বার একদিনের জন্য ছুটি নিয়ে এলে রুমুর সংসারটিতে এক অনানুষ্ঠানিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাবা-মা-কন্যাদের হাসি-আনন্দ দুঃখ-বেদনার মুহুর্মুহু কিছু আনন্দ-মধুর প্রহর কখন যে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শেষ হয়ে যায়! কেউই টের পায় না। এভাবে অনুভব করাও যায় না।

একটু আগে বসের রুম থেকে এসেছে। মনটা প্রচন্ড খারাপ লাগায় আক্রান্ত। এই মানুষটির রুমে ডাক পড়া মানেই হৃদয়ে কিছু অশান্তির জায়গা করে দেয়া… নিকষ কালো কিছু মুহুর্তকে ঘিরে বার বার বেদনায় পাক খাওয়া।
আসলে ইমিডিয়েট বসের সাথে সম্পর্ক ভালো না থাকলে সেখানে চাকরি করে শান্তি নেই। এটি শিহাবের পঞ্চম চাকুরি। বিগত চৌদ্দটি বছরে এর আগে চারবার অফিস বদল করেছে। প্রতিবারই সেই একই কাহিনী। বস ভালো না…

রুমু কিছু জিজ্ঞেস না করলেও অন্যান্য আত্মীয়রা প্রতিবার চাকরি ছেড়ে দেবার পরই নিরবে ওকে যেন জিজ্ঞেস করে, ‘ হুম… শুধু তুমি ই ভালো, তাই না?’ সবার অনুচ্চারিত প্রশ্নবোধক চোখের চাহনি দেখে দেখে শিহাবের কাছে তাই ই মনে হয়।
শেষবার রুমু শুধু বলেছিল, ‘ এভাবে আর কত? মেয়েরা বড় হচ্ছে। তুমি একটু কষ্ট করে…’

রুমু এরকমই। কথা শেষ করে না। অনুভূতিগুলো কেন জানি শিহাবের সামনে কখনোই পুর্ণতা পায় না। কিন্তু কিভাবে যেন শিহাব সেটা বুঝে যায়। তাইতো আজ চার বছর ধরে একই অফিসে রয়েছে সে। এটা একটা ‘ওয়ার্ল্ড রেকর্ড!!’ ‘গিনেজ বুক অভ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ এ ব্যাপারটি স্থান পাবার মতই।
ভাবনা চিন্তার এই পর্যায়ে এসে শিহাব হাসে।
হ্যা, হাসির ভিতরেই আসল শিহাব লুকিয়ে থাকে। কিন্তু এরকম মুহুর্ত ওর জীবনে খুব কমই আসে। নিজেকে তাই আসল রূপে দেখাটা খুব অল্পই হয়ে থাকে শিহাবের।

রুমুর চাওয়াতেই আজ এতগুলো বছর একই অফিসে কাটাচ্ছে। যখনই ভাবে, ‘ধুত্তুরি, ছেড়ে দিচ্ছি না কেন?’ তখনই চোখের সামনে দুই বেনীওয়ালা একটি মুখ ওকে বলে,’ তুমি একটু কষ্ট করে…’ এরপর আর কিছুই করার থাকে না শিহাবের।
সকল অপমান তিরষ্কার বেমালুম হজম করে যায়।
আসলেই কি হজম হয়?

এখন সময় এমনই খারাপ যে নতুন করে একটা চাকরি খুঁজে পাওয়াটাই খুব কষ্টসাধ্য। প্রথমতঃ শিহাবের বয়সের ব্যাপারটি। এরপরে রয়েছে যে ট্রাকে শিহাব জব করে, সেখানে কিভাবে যেন একে অন্যের সাথে ‘লিংকড’। এই তো সেদিন এক বায়ার কিউ.সি এসে ওকে দেখেই বললেন,’ আরে, শিহাব সাহেব যে। এখানে কতদিন?’ তার হাসিমুখের আড়ালে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গটুকু শিহাবের নজর এড়ালো না। সেদিনই বসের কেবিনে যথারীতি ডাক পড়ে ওর। আগের ফ্যাক্টরীর কিছু অনাকাংখিত মুহুর্তকে আবারো নতুন ভাবে নতুন করে কিছুটা রং মাখানো অবস্থায় বসের মুখ দিয়ে শুনতে হয়।

বস মানুষটি কেমন?
সকল বস-ই কি এমন ? শিহাব ভাবে। এই মানুষটির সামনে গেলে ইদানিং কেমন এক ভয়ই কাজ করে ওর ভেতরে। ভয় লজ্জার… অপমানের… চাকুরির অনিশ্চয়তার… আরো অনেক বোধের অবোধ্য কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলো নিজের মনে নিজে অনুভব করা যায়। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কষ্টকর অনেক কথাই শিহাবের হৃদয়ে জমে আছে। কিন্তু কি লাভ সেগুলোকে ভেবে আরো কষ্ট পাবার?

এখন খুবই দুঃসময়। দেশের অবস্থা খারাপ। প্রতিটি পরিবার চরম আতংকে ভুগছে। এর ভিতরে ইটপাথরের এই নগর জীবনে হুট করে চাকরিটা চলে গেলে ফ্ল্যাট বাসায় রুমুর সংসারের কি অবস্থা হবে ভেবে মাটি কামড়ে শিহাব পড়ে আছে। অসহ্যকর প্রতিটি মুহুর্ত এখন আগের থেকে আরো বেশী তীব্র দহনে ওকে দগ্ধ করে। মাস গেলে এক কাড়ি টাকা হাতে পায়। একদিনেই সকলের ধার দেনায় আর সারা মাস জীবনধারণের উপকরণগুলোর পেছনে কিভাবে যেন শেষ হয়ে যায়। আবারো বাকিতে পথচলা শুরু হয়… আবারো নিষ্ঠুর প্রতিটি মুহুর্তে প্রতিটি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মরে যাওয়া…

এর ভিতরেই একচিলতে আনন্দময় আকাশ ছিল শিহাবের অবরুদ্ধ অনুভূতিগুলো অক্ষরে রূপ দিয়ে একটু শান্তি পাওয়া। বেশ কয়েকটি ব্লগে সে লিখে থাকে। তার নিজের নামেই। ফেসবুকভিত্তিক কয়েকটি গ্রুপেও লেখালেখি করে আসছে। তাঁকে না দেখলেও ওর লেখার সুবাদে অনেকের সাথেই হয়েছে সখ্যতা।
আজ সেই আনন্দের আকাশটিও কালো মেঘে ঢেকে গেল!

একটু আগে ওকে বস ডেকেছিলেন। সে ব্লগে লেখে এটা জানতে পেরেছেন। একজন ব্লগারের নির্মম হত্যার ঘটনাটি উল্লেখ করে বললেন,’আপনি লিখুন আর যাই করুন, আপনার জন্য আমাদের কোম্পানি পরবর্তীতে যে কোনো ধরণের তদন্তের সম্মুখীন হোক তা আমরা চাই না। আজ থেকে আপনার লেখালেখি বন্ধ করুন। না হলে চাকরি ছেড়ে অন্য কোথায়ও চলে যান।’

মানুষের কত ধরণের অজ্ঞতা থাকে। ওর নিজের বসকে দেখে শিহাবের সেটাই মনে হল। সে কোনো ধরণের রাজনৈতিক লেখা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় অথবা অপরের চিন্তা-ভাবনায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, এমন লেখা লিখে না। তারপরও ওর বস ‘ব্লগার’ শব্দটির প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত চিন্তা-ভাবনায় তাড়িত হয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন।

দুপুরের খাবার ওর সামনে পড়ে আছে। পেটে ক্ষুধা কিন্তু মনে নেই। মনের খোরাক মেটানোর সেই ‘খাবার’ তো আজ থেকে সে গ্রহন করতে পারবে না।
কি করবে শিহাব?
কি করা উচিত এই মুহুর্তে?
ভাবনাগুলো ক্রমশঃ দিশেহারা করে তোলে শিহাবকে। চরম এক আতংক দুঃসহ সময়কে সাথে নিয়ে ওকে ঘিরে যেন নৃত্য করতে থাকে।

মোবাইলে রিঙ বেজে উঠে।
রুমুর ফোন। রিসিভ করে।

‘হ্যালো!
– হ্যালো! কেমন আছো?
‘ভালো। তুমি কেমন আছো?’
-ভালো। খেয়েছ?

এভাবে একটি কেবিনের ভিতরের একটু আগের দমবদ্ধ পরিবেশ ভালোলাগার একজনের বিনা তারে ভেসে আসা ভালোবাসায় স্বাভাবিক হতে থাকে। শিহাবের ভ্রুর কোঁচকানো রেখাগুলোও একই সাথে সমান হয়। হৃদয়ের প্রতিটি ভালোলাগার কোষে কোষে দোমড়ানো মোচড়ানো কুহকী প্রহরগুলো একটু একটু করে ভাললাগাদের ফিরে আসায় উজ্জীবিত হতে থাকে। তবে এই অনুভূতি থাকবে কিছুক্ষণ।
তারপর?
আবারো একটা ভীতিকর পরিবেশে জীবনযাপনের বোধগুলো অসময়ের ভিতর দিয়ে পরিবাহিত হবে।

তবে শিহাব কেন আরো ভালো একটি জায়গায় নতুনভাবে শুরু করছে না? কিংবা লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে না?
প্রথমটির সমস্যাগুলো একটু আগেই নিজের মনে ভেবেছে। আর দ্বিতীয়টির উত্তর হল, শিহাব নিজের মনের আনন্দে লেখালেখি করে। তাই পেশা হিসেবে নেবার প্রশ্নই আসে না। আর সে এমনই বা কি লিখে?
আবারো হাসে শিহাব। নিজের মনে এই প্রশ্ন উদয় হওয়াতে একটু কি লজ্জাও পায়?

বসা থেকে উঠে শিহাব।
জানালার কার্টেন সরিয়ে বাইরের খোলা তাজা বাতাসকে প্রবেশের সুযোগ দেয়। জানালার নিচেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। লাল সবুজের একটা গালিচা নিমিষে মনকে ভালোলাগায় আপ্লুত করে তোলে। একটা কবিতা লেখার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু নিজের হাতে ইচ্ছেটির গলা টিপে মেরে ফেলে শিহাব। তবে কেন জানি নির্দয় হতে পারে না। একটু আরাম দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। বুকের গভীর থেকে বের হয়ে আসে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস । নামেই এরা দীর্ঘ। কিন্তু আদতে এগুলো হৃদয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়ার অপমৃত্যুকে ঘিরে জমে থাকা ছোট ছোট অণুশ্বাস। প্রচণ্ড কষ্টকর এবং তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন।
কিন্তু আমরা ক’জনই বা এগুলোর খবর রাখি?

আমরা অনেককেই বাইরে থেকে তাদের চাকচিক্য দেখে ধোঁকা খাই। কিন্তু সেই মানুষগুলো তাদের একান্ত অবরুদ্ধ কর্পোরেট জীবনে নিজেদেরকে নিয়ে আসলেই কেমন থাকে কখনো আমরা জানতে পারি না। জানতে চাইও না। এই ইটপাথরের নগর জীবন তাদের ভিতরের সকল রস-কষ নিংড়ে তাদেরকে রোবটে পরিণত করে চলেছে। একটা ‘সিস্টেমেটিক’ জড়বদ্ধতা মানুষগুলোকে ক্রমশঃ বোধহীন বানাবার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। এর মাঝ থেকে শিহাবের মত দু’ একজন যা ও বা ফিরে আসতে চেষ্টা করে-অন্যদেরকে ফেরানোর নিরন্তর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তাদেরকেও এক সময় থেমে যেতে হয় যে কোনো অনাকাঙ্গখিত কারণে।

নিজের মনের ভিতরের ভয়কে জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় একজন ‘মিড-লেভেলের’ কর্মকর্তা। তবে হয়তো কেবলই একজন কর্মকর্তা হলে সে হয়তো একে জয় করেই ফেলতো। কিন্তু একজন শিহাব যে এক একজন বাবা ও!

একজন শিহাবকে ঘিরে অণুক্ষণ একজন দুই বেনীওয়ালার হরিণী আঁখি নিরবে বলে যায়,’… একটু কষ্ট করে… থাকো না… কিছুদিন।‘
সুদিন কি কিছুদিন পরে? দুই কন্যার হাসিমুখ প্রতি পনের দিন পর, প্রশান্তি বইয়ে দিতে অপেক্ষা করে একজন শিহাবের জন্য। একজন বাবার জন্য।

তাই নিজের হৃদয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র ঝড়-ভয়-ভীতি-অসহায়ত্বকে নিজের মনেই কবর রচনা করে একেবারে শান্ত থাকার চেষ্টা করে শিহাব। এজন্যই একজন রুমুকে কখনোই কিছু জানতে দেয় না সে। অনেক সময় নিজেকেও কিছু জানতে দেয় না। তাই তো প্রচন্ড মন খারাপের সময়ে রুমুর ফোনের, ‘কেমন আছো?’ প্রশ্নের উত্তরে অতি স্বাভাবিক উত্তরটিই চকিতে বের হয়ে আসে,’ ভালো আছি।’ একটুও গলা কাঁপে না। অনুভূতির তারতম্যে হয়তো রুমু বুঝে যাবে সে ভালো নেই।

আসলেই কি রুমুরা কখনো বোঝে?

শিহাবেরা আসলেই কি ভালো থাকে?

(শেষ)

অণুগল্প_ নিজস্ব_বৃত্তে

ঘোর কুয়াশায় ঢাকা সকাল। মনে হচ্ছে ভোর। আসলে সোয়া আটটা। ভার্সিটির নির্জন কাটাপাহাড়ের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছিলো হীরক আর তৃণা। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই একে অন্যের ছায়ার মত। দুই বন্ধু, দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। দু’জন ভারী শীতের কাপড় আর ঘন কুয়াশার আড়ালে দুটো ছায়ার মত পাশাপাশি হাটছে। স্টেপগুলি ভারী। পা জমে আছে। হীরকের শুধু নাক আর মুখের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। তৃণার মুখ খোলা। তার গায়ের উলেন কার্ডিগানটা বেশ গরম, আরাম।

হীরকের সারা বছর ভোরে গোসলের অভ্যাস। ওর একটু বেশিই ঠান্ডা লাগছিল। সে তৃণার দিকে ফিরে হাসল, ‘একটু কাছে আয় তো… আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখ। দেখ, এখানে কি শীত। আমাকে তোর কার্ডিগানের ভিতরে নে। উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে রাখ।’

তৃণা হীরকের এই বেকায়দা কথাবার্তাগুলির সাথে পরিচয়ের শুরু থেকে পরিচিত। হীরককেও সে খুব ভালো চেনে। এখন যদি তৃণা এক পা- ও কাছে যায় হীরক গালি দিতে শুরু করবে, ‘বেহায়া, শয়তানের অস্ত্র তোরা!.. ‘ সে মৃদু হাসল। কিছু বলল না।
অবশ্য আজ হীরককে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। উদাস। কিছু ভাবছে। তৃণা হাঁটতে হাঁটতে তাকে এক পলক দেখে।

হীরক অন্যমনষ্কভাবে বলল, ‘আমি সবসময়েই তোর আশে পাশে আছি। আমি তোকে ভালোবাসি।’ একটু থেমে তৃণার দিকে তাকিয়ে আবার পথের দিকে চোখ ফিরাল। হিসাবের সুরে বলল, ‘ভালোবাসা কি আমি তোর কাছ থেকে শিখেছি? তোকে এতো অপমান করেছি, তারপরও তুই আমার। আবার তুই ও আমাকে অপমান করেছিস, তারপরও আমি তোর। আমিই একটু বেশী করেছি, তাই আমি তোকে একটু বেশী ভালোবাসি। তুই একটু কম বাসিস।’

কিছুক্ষণ দু’জন চুপচাপ হাটতে থাকল। সামান্য পথ। মাঝামাঝি চলে এসেছে। দুই পাশের পাহাড়ের অপরূপ নির্জনতার অপার্থিব সুখ তাজা ফুলের ঘ্রাণের মত নি:শ্বাসে বুক ভরে নিচ্ছিলো ওরা। পাখিরা ঘর ছাড়ছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে।

হীরক হঠাৎ কথা বলে উঠল, ‘ভালোবাসা আর ঘৃণা হাত ধরাধরি করে হাঁটে। ‘ একটু থেমে বলল,’আমার একটা স্বপ্ন- তোর হাত ধরে এই কাটাপাহাড়ের ভিতর দিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যাওয়া। হেঁটে যেতে যেতে বাতাসে তোর খোলা চুল উড়বে । দু’একটা চুল তোর চোখ ঢেকে দিবে। তোর শরীর থেকে বুনো ফুলের ঘ্রাণে আমি মাতোয়ারা হবো। আমি ঘাড় বেঁকিয়ে তোর দিকে ফিরে তোর নিঃশ্বাসের দূরত্বে চলে আসবো! ‘

হীরকের কথাগুলি যেন আর কোথাও থেকে ভেসে আসছিল! শব্দের উৎস গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল। তৃণা নি:শব্দে হীরকের অনুভুতিগুলি অণুসরণ করছিল। সে একটু একটু কাঁপছিল। মুখটা গরম হয়ে গেছে। সে একেবারেই চুপচাপ মাথা নিচু করে হাটতে থাকল।তার ভয় হচ্ছিল। সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, যেন সে কিছুতেই তার বন্ধুর জীবনে পদস্খলনের কারণ না হয়। সমস্ত মন দিয়ে তৃণা হীরকের ইচ্ছেগুলো অনুভব করছিল। হীরক অস্পষ্ট গলায় একমনে বলে যাচ্ছিল, ‘এরপর…এরপর তোর চোখের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলোকে আলতো করে সরিয়ে দেবো। যাতে তুই আমাকে দেখতে পারিস।’ হীরক তৃণার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল,’ তুই কি আমাকে পুরোপুরি কখনো দেখেছিস?পুর্ণ দৃষ্টি দিয়ে? আমাকে তোর দেখতে ইচ্ছে করে না?’

তৃণা নি:শ্বাস গোপন করল। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সীমা মানবে। বিয়ের এক মূহুর্ত আগেও কেউ কারো দিকে আর কখনো হাত বাড়াবে না। হীরকের স্বর স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। অনেকটা গল্প বলার মত। হীরক বলছিল, ‘তোর ঠোটের উপরে ঘামে ভেজা ত্বক একটু একটু করে কাঁপছে…তুই অস্ফুটে আমায় কিছু বলতে চাইছিলি?

তৃণার ঠোঁটে একটু হাসির রেখা ফুটল। ঠান্ডায় গরমের দিনের কল্পনাতে সুখ খুঁজছে হীরক। সে বলল,’বলতে চেয়েছিলাম -“ভালো লাগছে তোর?” ‘

হীরক মুখ তুলে একবার আকাশ দেখল। বলল, ‘মুহুর্তটা একটা প্রচন্ড কামনার ভাব উদ্রেক করেছিল আমার… এই নির্জন পাহাড়ঘেরা জায়গায় শুধু তুই আর আমি… কত কিছুই তো হতে পারত… ক্ষণিকের পদস্খলন… কিন্তু একটা স্বর্গীয় অনুভূতি এসে আমাকে বদলে দিল। আমি শুধু তোর নাকের পাশের তিলটিকে আলতো ছুঁয়ে দিলাম….আবার তোর হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম… একটা প্রশান্ত সবুজ উদ্যানের দিকে।’ জ্যাকেটের পকেটে রাখা হাতগুলির মুঠি খুলে দিল সে। বাইরে আনল না।

এক মূহুর্ত চুপ থেকে কিছু ভাবলো হীরক। একটু হাসল। বলল, ‘বন্ধুর হাত ধরাটাই আসল ব্যাপার। ওখানে সকল শান্তি… পরম নির্ভরতা।’

জ্যাকেটের দুই পকেটে দুই হাত গুঁজে স্বপ্নচোখে হীরক পথের শেষে তাকিয়ে আছে – দৃশ্যটা দেখে তৃণা পূর্ণশ্বাস ফেলে হাসল, ‘ হ্যা ‘..

শহীদ মিনারে চলে এসেছে ওরা।
হীরক একটু হেসে বলল, ‘আলহামদুলি’ল্লাহ! আমরা ফিরতে পারলাম!’

সে মুখ থেকে মাফলার সরিয়ে ফেলল। পিঠের হালকা ব্যাগের ফিতা ঠিক জায়গায় নিতে নিতে বলল, ‘আমি তোকে অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক… ভালোবাসি! তুই কি বুঝিস?’

তৃণা হাসল,’হ্যা ‘..সে হীরকের গল্পের শেষে পরিবর্তনটা লক্ষ্য করছিল। হীরক বাস্তবে হাত কখনও বাড়ায়নি ঠিকই, অন্যদিন হীরকের বুনো সব চিন্তা আর ইচ্ছে তৃণাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ভোগ করত। আজ সে শান্তি পেয়েছে.. তার খুব ভালো লাগছিল।

হীরকের মুখে কিছুটা বিষাদের আভাস। সে বলল, ‘একটা জিনিস দেখ, অন্য বন্ধুরা যারা তোর আর আমার কথা জানে, ওরা মনে করে আমরা আর দশজনের মত। কিন্তু – ‘

কিন্তুটা তৃণা জানে। এই কিন্তুটার জন্যই সে হীরককে বেশি ভালোবাসে। সম্মান করে। সতেজ একটা হৃদয়। স্বচ্ছ বিবেক। অনেক কিছুই সে অন্যদের চেয়ে অন্যভাবে দেখে। এই যে এই ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন তা কেবল বাস্তবে না ছুঁয়ে থাকার জন্য। সে তার অনুভুতির স্বীকৃতি চায়, কিন্তু, পাপকে সে মেনে নিতে পারে না। সে কল্পনাতে জীবন কাটায়, কিন্তু মিথ্যা বলেনা। ঠকায় না। তাকে নিয়ে অন্য বন্ধুদের মত অন্যদের সাথে ফান করে না। এই নারকীয় উল্লাসের পৃথিবীতে মানুষটা ভিন্ন।

শুরুটা তাদের অন্যদের মতই দেখাচ্ছিল। অন্য দশটা সম্পর্কের মত পরিণতি তারা চায়নি। যা হবে ফেয়ার হোক। চারপাশের পৃথিবীর সমস্ত অনাচারে ব্যথিত মন দুটি স্বেচ্ছায় সব চেনা জানা কিছু থেকে, সমস্ত বাজে অভ্যাস থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে এনেছে। তাদের পৃথিবী স্বচ্ছ, সুন্দর।

‘আত্মাকে শুদ্ধ করার জন্য আমাদের যুদ্ধটা কি ওরা জানে? দেহ থেকে শুরু হয়ে আবার হৃদয়ে ফিরে আসাটা যে কতটা টাফ, সেটা ওরা কখনোই বুঝবে না।’

তৃণা বলল,’ওদেরকে কী দোষ দেবো? বাইরে থেকে আর ভিতর থেকে তো দেখতে এক হয় নারে ‘
হীরক জেদী গলায় প্রতিবাদ করল,’না! দোষ ওদের। ওরা ভালোটা ভাবতে পারে না। এজন্যই বীণা দল ছেড়ে চলে গেছে, তোর আমার ব্যাপার নিয়ে। শিহাব আমার সাথে আলগা। তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। মিনা ও দূরে। অবশ্য শুরুতে এরা কেউ ই আমার কাছে ছিল না।’

একই কষ্ট তৃণার ও মনে। সে বলল,’ আমি সবাইকে ভুলে গেছি। ‘
হীরক জিজ্ঞেস করল,’আমাকেও? আমার তোকে দরকার।”
তৃণা হাসল,’আছি ইনশাআল্লাহ। ‘
হীরক সুখী হাসি হাসল, ‘ আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা, চল ক্লাসে যাই।’

ওরা মিনা, বীণা, শিহাব সবার সাথে একই ক্লাসে গিয়ে বসল। নিজেদের মত।

#নিজস্ব_বৃত্তে_অণুগল্প_৪৫৮

অণুগল্প_উত্থান_পতন

চলন্ত রিক্সায় দুই যুবক। পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ওদের হ্যাণ্ডসেটে বেজে চলা বাপ্পী লাহিড়ীর গানের কলি ভাসে বাতাসে। কেমন স্মৃতিকাতরতায় আপনাতেই ভেসে যায় মন!

শীত তেমন জাকিয়ে বসেনি। এখন ক্লান্ত মধ্যদুপুর। শেষ হবো হবো করছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। মেঘবালিকাদের মন খারাপ। ক্যাম্পাসের লম্বা পিচঢালা রাস্তা দু’পাশে জারুল গাছের ছায়ায় নিজের কায়া বিসর্জন দিয়েছে। একা একজন মানুষ। উদ্দেশ্যহীন হেঁটে চলেছে। স্কুল ও কলেজের গেট অতিক্রম করতেই, চিকন সুপারি গাছগুলোর পিছনে কাকচক্ষু জল নিয়ে নীরবে নিজের অস্তিত্ব কে জানান দেয়া দীঘিটি দৃশ্যমান হলো।

সেদিকে তাকাতেই চিনচিনে ব্যথার এক গভীর গহবরে যেন প্রবেশ করলো রাহাত। ওপাড়েই ওই যে দেখা যায় শিমুল গাছটিকে! যখন ফুলে ফুলে গাছটি ছেয়ে থাকত, শিমুলে আগুন জ্বেলে ফাগুনের বয়ে যাওয়া মাতাল সমীর… সময়ের বুকে রেখে যাওয়া স্মৃতিদের ডানা ঝাপটানোর সেই আওয়াজ -এ সব-ই পড়ন্ত হেমন্তের এক বিকেল বেলায় রাহাতের সামনে মুহুর্তে এসে হাজির হয়।

ওইখানে একসময় ওর বাড়ি ছিল। প্রথমে একটি ঘর, এরপর রিতাকে নিয়ে সেই ঘরটিকে বাড়ি বানাতে কি আপ্রাণ চেষ্টাই না করেছিল সে। আইনের ফাঁকফোকর আর সংশ্লিষ্ঠ মানুষগুলোর ভিতরের বিদ্যমান লোভ, একদিন ওকে ওদের ‘বাড়ি’ থেকে উচ্ছেদ করে।

এরকমই এক শীতের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে নামবে মুহুর্তে- রিতার হাত ধরে বাচ্চাদেরকে নিয়ে, রাহাত কে চলে আসতে হয়েছিল। পিছনে কুয়াশাচ্ছন্ন এক পথ, যে পথে কখনোই হয়তোবা আর হাঁটা হবে না!

একটা কুকুর। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওর পিছু পিছু আসছে। একবার ফিরে তাকায় রাহাত। বিস্মৃতির আড়ালে আরেকটি কুকুর দৃশ্যমান হয় হঠাৎ। যখন ওর বাড়ি ছিল, সেই কুকুরটি রোজ আসত ওর বাড়ির সামনে। সকাল-বিকাল কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। কুকুরদের ও কি নিয়মের ভিতরে চলতে হয়? রাহাত জানে না। তাই ভাবনাটা সেদিকে যেতেও চায় না। তবে অন্য কিছু ভাবনা বয়ে চলে। কুকুরটিকে প্রতিদিন সে নিজের ভাড়া দেয়া মুদি দোকান থেকে একটা করে বনরুটি খাওয়াতো। সেই থেকে পশুটি ওর ন্যাওটা। ফজরের আজানের সময়ে মসজিদে যাবার সময়ে, পথের পাশে কুকুরটি ঘুমে থাকত। রাহাত অতি সন্তর্পনে শব্দ না করে ওকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করেও দেখেছে। কুকুরটি ওর শরীরের ঘ্রাণে কিভাবে যেন জেগে যেত! মসজিদ পর্যন্ত পিছু পিছু আসত।

সেই বিপর্যয়ের দিনে রাহাত আশেপাশে কাউকে পেলো না। কুকুরটি ঠিকই হাজির হয়েছিল। রাহাতের সকল মালামাল যখন রাস্তায় ফেলে দেয়া হচ্ছিল, একমাত্র কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করছিল আর ওর পাশে পাশে লেজ নেড়ে কুই কুই করছিল। সেদিন রাহাতের অন্য পরিচিত মানুষেরা তাঁদের লেজ দু’পায়ের মাঝে লুকিয়ে পালিয়েছিল। অথচ একই দোকান থেকে তাদের পেটেও বনরুটি প্রবেশ করেছে। তারা মনে রাখেনি, কুকুর মনে রেখেছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তবে কখনো কখনো কিভাবে যেন মানুষ নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়, সেদিন দেখেছিল রাহাত।

একবার এক পীরের কাছে বায়াত হয়েছিল। একজন পীর ভাই ছিল ওর। ওর বাসায় আসত যেত। পরিবারের সদস্যের মত ছিল সে। সেই দিন প্রভাবশালী এই ‘ভাই’টিকে ও পাশে পায়নি রাহাত।

এক শীতের রাতে এক আন্ডার কন্সট্রাকশন বাসায় বউ-ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাত কাটাতে হয়েছিল অভুক্ত অবস্থায়। সে রাতে কাছের আত্মীয়েরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হয়ত ভয়ে পালিয়েছিল। কুকুরটি সারা রাত দু’পা সামনের দিকে বিছিয়ে ওর মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল। অভুক্ত সন্তানদের ক্লিষ্ট চেহারা দেখে নীরবে জল গড়িয়েছিল রিতার চোখ বেয়ে।

সেদিন আরেক লোকের জায়গায় সাময়িক ভাবে রাহাতের মালামাল দখলকারীরা ফেলে দিচ্ছিল। সেই অতি পরিচিত লোকটিও তার জায়গা থেকে মালামাল দ্রুত সরিয়ে নিতে বলেছিল। তাঁর প্রাইভেট কার ঢুকতে পারবে না সেই চিন্তায় তিনি ব্যস্ত ছিলেন!

সেই সময় কেটে গেছে। নিজের অবস্থান বেশ সুদৃঢ় করেছে বিগত বছরগুলিতে। কয়েকদিন আগে সেই লোকের ছেলে একটা চাকরির জন্য এসেছিল রাহাতের কাছে। বিয়ে করে বউকে নিয়ে খুবই অসহায় অবস্থায় আছে সে। মা-বাবার অমতে বিয়ে। রাহাত পরিচিত এক জায়গায় বলে ক’য়ে ছেলেটির চাকরির ব্যবস্থা করেছে। এমন-ই রাহাত। বিবর্ণ সময়ের তিক্ত অনুভব নিজের মনে পুষে রাখলেও, তিক্ততার আস্বাদ অন্যদেরকে পেতে দেয় না সে।

বিকেলগুলো সব একই থাকে, বদলে যায় শুধু আমাদের দেখার ভঙ্গিটি। সময়ের বুকে বয়ে চলা পীড়িত অসময় কতটা দীর্ঘস্থায়ী? ওর রুক্ষ কর্কশ অনুভূতিতে প্রলেপ দেয়, এমন কিছু আদৌ আছে কি?

#উত্থান_পতন_অণুগল্প_৪৫৬

অণুগল্পঃ “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”

ল্যাপটপ ভাজ করে একটু দূরে সরিয়ে রেখে সুবোধ বরুয়া টিভি অন করলো। একটা চব্বিশ ঘণ্টা খবরের চ্যানেল। ওটার এক সিনিয়র রিপোর্টার ঢাকা থেকে উখিয়ায় গিয়ে কাজ করছে। সাথে এক তরুণী; সে স্থানীয় প্রতিনিধি। তরুণীটি রাখাইন বাংলা জানে। একজন রোহিঙ্গা বালকের সব হারানোর কাহিনি তারা রেকর্ড করছে!

বালকটি কি বলছে সুবোধ কিছু বুঝতে পারছেনা; সম্ভবত অনেকেই না। একটু পর তরুণীটি দর্শক-শ্রোতার জন্য তা শুদ্ধ বাংলায় সংক্ষেপে অনুবাদ করে শুনালো।

“বালকটির নাম সামসুল; বয়স নয় বছর। রাখাইনে ওর পরিবার মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল। তিনদিন আগে হঠাৎ গেরুয়া রঙের লোকজন এসে তার বাবা মাকে গুলি করে মেরেছে। তাতেও তারা থামেনি। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেহ থেকে তাদের কলিজা বের করে এনেছে। আড়াল থেকে সে সবই দেখেছে। তারপর পাঁচ বছরের ছোট ভাই এর মুখ চেপে ধরে সামসুল ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। পড়শী শ্যাম চন্দ্রসহ আরো কয়েকজন বন্ধুও ছিল। তারা তিন দিন হেঁটে নাফ নদির এপাড়ে এসেছে। এই তিনদিন ছোট ভাইটির মুখে ন্যূনতম কিছু দিতে পারেনি। সে জানেনা ভাইকে কিভাবে বাঁচাবে। তাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে সামসুল কিছুক্ষণ আগে খাবারের খোঁজে বের হয়েছিলো! খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখে, আদরের ছোট হারিয়ে গেছে “!

এটুকু অনুবাদ করেই তরুণী থেমে গেলো। আসলে সে থামেনি; বাকহীন থেকে নিযুত কথা বলে গেছে! সুবোধ দেখলো, তরুণীটি যে হাত দিয়ে তার নিজের চোখ ঢেকেছে তা থরথর কাঁপছে; হাতের ভিতর ঢেকে থাকা মুখখানাও।

সুবোধ ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে এক ঝাপটা জল দিয়ে আবার টিভির সামনে বসলো। এবার তরুণীটিকে নয়; নিজের বিবেককে সে কাঁপতে দেখলো! একটা বিশ্বকে কাঁপতে দেখলো। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো; তাঁর চোখ দুটি এখন নাফ নদি ! এই নাফজল গেরুয়া নয়; বর্ণহীন! তবে মিঠা থেকে নোনা হয়ে গেছে!

সুবোধ আবার টিভির পর্দায় চোখ রাখলো। ক্যামেরাম্যান নয় বছরের নিঃস্ব শিশুটিকে ফোকাস করেছে। পাশে তারই মতো আরেক জন। ওরা নিরুদ্দেশে হাঁটছে! নেপথ্য কন্ঠে বলছিল, রাখাইনের দুই নিঃস্ব শিশু যাচ্ছে!

কিন্তু সুবোধ শুনতে পেল ঈশ্বর বলছেন, “সামসুল বা শ্যাম নয়; মহামতি বুদ্ধ যাচ্ছেন”!

“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”!

দ্য_ফরবিডেন_সিটি_মামুনের_অণুগল্প

দ্য_ফরবিডেন_সিটি
এক নিষিদ্ধ নগরীতে বসে এক নিষিদ্ধ সময়ে এই অণুগল্পটি লিখেছিলাম।

অনেক অনেক বছর আগে, শেষবার যখন আমরা দু’জন পাশাপাশি ছিলাম, ওর মাংসল বুক থেকে বরুনার মতো আতরের গন্ধ বের হয়েছিলো।

অনেকগুলি বছর পার হয়ে আজ সে পুরাদস্তুর কেবলি একজন মহিলা, অন্য কারো।

আজও তার সেই মাংসল বুক রয়ে গেছে, আগের চেয়ে অনেক স্ফীত এবং উদ্ধত যদিও, কিন্তু সেখানে এখন আতরের পরিবর্তে কেবলি দুধের গন্ধ.. ওর বাবুদের খাবার জিনিস।

এক জীবনে আমার না আতরের গন্ধ পাওয়া হলো, না সে আমার হলো! আমি তার বাবু হয়েও ওর দুধের ঘ্রাণে আপ্লুত হতে পারলাম না!

আজ আমি সবকিছু হারিয়ে এক দুর্বিণীত রুপান্তরিত অন্যপুরুষ। আমার সামনে আসাটা আজ তার জন্য ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় নাজায়েজ। অথচ অনেকগুলি রাতে, এই নাজায়েজ পুরুষের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছুঁয়ে দেয়নি সে, এমন কোনো জায়গা অবশিষ্ট ছিলো না! আজ সে বিরাট ধার্মিক-ভদ্রমহিলা।

আর আমি?
আমি তার জন্য এক ‘ফরবিডেন সিটি’ বৈ অন্য কিছু নই।

__________________________
#দ্য_ফরবিডেন_সিটি_মামুনের_অণুগল্প

গণতন্ত্র_এবং_পশ্চাৎতন্ত্র_কথন_অণুগল্প

অফিসে হারুন সাহেব প্রতিদিনই দুপুরের চা শিহাবের সাথে খেতে আসেন ওর ডেস্কে। আদা দিয়ে লাল চা। আজ আবার আবহাওয়াটা ও সেরাম। মানে আদা চা’র জন্য আরকি।

যথাসময়ে তিনি হাজির। চা খেতে খেতে হালকা কথা বার্তা তো হতেই পারে। আজো হচ্ছে। তবে খাবার সময়ে একেবারে চুপ করে খাওয়াও নাকি নবীর সুন্নতের পরিপন্থী। আবার খাবার মুখে নিয়ে ভয়ংকর আওয়াজে কথা বলা কিংবা মুখে চা বা পানীয় নিয়ে গার্গল টাইপের কথা বলাও অভদ্রতা।

শিহাব সাধারণত এই টাইপের মানুষদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। ওর বউ এবং বাচ্চারাও তার এই অনুশাসনের বাইরে নয়।

শীত একটু বেশী লাগাতেই বোধ হয় আজ হারুন সাহেব নিজেই চা’টা নিয়ে গার্গলের মত করে পান করতে লাগলেন। শিহাবের মাথার ও হাতের পশম (অন্য সব জায়গার ও) রাগে নাকি ঘৃনায় খাড়া হয়ে গেল। সে অনেক কষ্টে রাগ কমিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। কখনও রাগ করবেনা বলেছিলো সেদিন বউয়ের কাছে।

কিন্তু এটা সবসময় মনে থাকে না। ইদানিং মনের যেন কি রোগ হয়েছে। মনের খবর রাখেন যারা, তাদেরকে দেখানো দরকার।

চা পানের সাথে সাথে, এক পর্যায়ে দেশের চলমান রাজনীতির কথাও এসে গেলো। হারুন সাহেব গণতন্ত্র নিয়ে বেশ ফালাফালি করছিলেন। আলাপের এক পর্যায়ে শিহাব বললো,
: গণতন্ত্র যে একটা বোগাস জিনিস তা জানেন?
: কিভাবে? ব্যাখ্যা করুন ?
: তাহলে শোনেন। আমাদের দেশে গণতন্ত্রে মেজরিটি জণগণের ভোটে সরকার গঠন হয়, ঠিক?
: ঠিক।
: মনে করেন ১০ কোটি ভোটারের ভিতর ৫৫% ভোট পেয়ে একদল সরকার গঠন করলো। তাহলে সেই দেশের বাকী ৪৫% ভোটার কিন্তু সরকার গঠনকারী দলকে চায় নাই। তাহলে For the People… Of the People… By the people সম্পূর্ণভাবে কিভাবে সম্পন্ন হয়? এটা শুধু সেই ৫৫% এর জন্য হয়।

হারুণ সাহেব চুপ করে রইলেন। শিহাব আলাপ চালিয়ে গেলো-
: আমাদের এখানে দরকার একনায়কতন্ত্র। ব্যাখ্যা চাইলেন না, শুনেন তবে। ধরেন, এক পরিবারে বাবা, মা ও চার সন্তান। দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। একদিন বাবা সবাইকে ডেকে বললেনঃ ” আমি বাজারে যাচ্ছি। কে কি খাবে বল?
বড় ছেলেঃ আমি খাশীর গোশত খেতে চাই বাবা।
বড় মেয়েঃ আমি গরুর মাংসের ভুনা খাবো।
ছোট ছেলেঃ বাজারে চাঁদপুরের ইলিশ পেলে শর্ষে বাটা দিয়ে খেতে চাই।
ছোট মেয়েঃ রুই মাছের মুড়ি ঘন্ট খাবো বাবা।
সবারটা শুনে ওদের মা বললেনঃ এ মাসে অনেক খাই খাই করেছো। আজ নিরামিশ নিয়ে এসো।”

গল্প শেষ করে হারুন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো শিহাব-
: তো এখন এই পরিবারের কর্তা কার মন রক্ষা করে বাজার নিয়ে আসবে বলেন?
: আপনি ই বলেন।
: তিনি যদি সবার মন রক্ষা করে চলতে চান, তবে যে খরচ হবে তাতে করে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। আর যে কোনো একজনের পছন্দের খাবার আনলে, অন্যরা মুখ ভারী করে উঠে যাবে। তখন একটা বিশ্রী কান্ড হয়ে যাবে।
: তাহলে কি করতে হবে?
: এই পরিবারের কর্তা যদি গণতান্ত্রিক উপায়ে এদের মতামত নিয়ে চলতে চান, তবে তার প্রশাসন কলাপ্স হয়ে যাবে। কারণ ওনার সন্তানদের ভিতর সেই মানার যোগ্যতা নেই। এজন্য তিনি সবার পছন্দ শুনে বাজারে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে দেখলেন ভালো কৈ মাছ পাওয়া গেছে। সেটার কয়েক কেজি কিনে আনবেন। এরপর খাবার টেবিলে জলদ্গম্ভীর স্বরে বলবেন, ‘আজ এইটাই খাবার মেনু। চুপচাপ সবাই খেয়ে উঠে চলে যাও’।

এবার উত্তর দেন হারুন সাহেব-
: এটা তো গণতন্ত্র হলো না।
: না, হল না। এটা একনায়কতন্ত্র ওরফে পুটকিতন্ত্র। আরে মশাই, রাখেন আপনার গণতন্ত্র! আগে মানার যোগ্যতা অর্জন করেন। তারপর গনতন্ত্র ফলাইয়েন। এর আগে আর একটা কথাও বইলেন না। যতদিন মানতে পারবেন না, ততদিন ‘মারা খেতে’ থাকেন।।

#গণতন্ত্র_এবং_পুটকিতন্ত্র_কথন_অণুগল্প_৪৫৫

অণুগল্পঃ মিডলাইফ ক্রাইসিস

বালকগুলি মহিলাটার পেছনে পেছনে এমন ভাবে হাঁটছিল যে মনে হচ্ছিল, ওরা হ্যামিলনের এক মহিলা বাঁশীওলাকে অনুসরণ করছে। ওদের হৈ হল্লোর শুনে মোত্তালেব মিয়া এক পলক তাকিয়ে আবার কাজে মন দেয়। মূল রাস্তা থেকে পঞ্চাশ ষাট গজ দূরে মাঠে সে নিড়ানির কাজ করছিল। কি জানি কী মনে করে কয়েক সেকন্ড পরে সে আবার তাকায়। চশমাহীন চোখে আবছা দেখলেও মহিলাটিকে সে খুব সহজেই চিনতে পারে। নিড়ানি বন্ধ করে দ্রুত পায়ে মহিলার দিকে সে এগিয়ে যায়।

-এই পোলাপান, যাহ্‌ যাহ্‌। মোত্তালেব মিয়া ধমক দিয়ে বালকগুলিকে দূরে সরিয়ে দেয়।

সে মহিলার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পারলে যেন গায়ে গা লাগিয়ে দেয়। তার “ছুঁক ছুঁক” ভাব দেখে মহিলাটি মুচকি হেসে শরীর এগিয়ে দিয়ে বলে,
-ছুঁইবেন? নেন। ম্যালা দিন হইলো আমার ঘরে আহেন না যে?

মোত্তালেব মিয়া অবশ্য সুচতুরভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়;
-এই ভর-দুপুরে কই যাও মোছাম্মত সিতারা বেগম?
-উপজেলা হাসপাতালে যামু মাতব্বর সাব। পাড়ার এক মাসী অসুস্থ হইয়া ওইখানে ভর্তি আছে।
-হাসপাতাল থেইকা ফিরবা কখন? নাকি আজ ফিরবানা?
-ফিরমু। রাত নয়টা দশটা বাইজা যাইতে পারে
-ঐ সময় আমি স্কুলটার ওইখানে থাকমুনি; তুমি আইসো। আসবা তো সিতারা বেগম? মোত্তালেব মিয়া ফিস ফিস করে জানতে চায়।
-পুরা সাতশ টাকা লাগবো! ঠোঁটের কোণে হাসি মেখে সিতারা বেগম জবাব দেয়।

অল্প দূরে থাকা ছেলেগুলোর দলনেতা খুব নিচুস্বরে বলে,
-জানস তোরা ওই বেটি কেডা?
-তিন নাম্বার দাদি? ছেলেগুলির একজন উল্টা প্রশ্ন করে।
-ওই রকমই। আগের মরা দাদিটা লাল পরী হইয়া ফিরা আইছে। দাদারে আদরও করতে পারে; আবার ঘাড় মটকাইয়াও দিতে পারে।

দলনেতার শেষ মন্তব্যে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে এবং একসাথে উল্টা পথে দৌড় দেয়।

মোত্তালেব মিয়া; সাতান্ন পেরিয়ে আটান্ন চলছে তাও প্রায় চার মাস হয়ে গেলো। সে শিমুলিয়া গ্রামের মত-মাতব্বর এবং সিতারার নিয়মিত খদ্দের। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু এবং পরে এক কিশোরীকে দ্বিতীয় স্ত্রী করে ঘরে আনা- সব কথাই আবেগের সময় সিতারাকে সে বলে দিয়েছে। “এমন বুড়ো পুরুষকে কোন বাচ্চা মেয়ের ভালো লাগবে?” সিতারা বেগম ভাবে। অতঃপর মোত্তালেব মিয়ার হাতে এক খিলি পান গুজে দিয়ে সে উপজেলার পথে হাঁটা ধরে।

অল্প কিছুক্ষণ পরে পেছনে তাকিয়ে সিতারা বেগম শব্দ করে হেসে ওঠে। কারণ শিমুলিয়া স্কুলের কাছে আজ রাতেই দেখা করার কথা ঠিক হলেও মোত্তালেব মিয়া এখন তার পিছু নিয়েছে। তার শাড়ির ভিতরের সম্ভাব্য যে অংশে মোত্তালেব মিয়ার চোখ আটকে আছে সেখানে মৃদু ঢেউ তুলে সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। হাসপাতালে পৌঁছার আগেই বড় একটা কবরস্থান। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে তার বিকেল হয়ে যায়। ডানে বামে সামনে পেছনে সে তাকিয়ে দেখে, সাড়ে তিন হাত মাপের ঘরগুলি এবং শূন্যপথটা ছাড়া কোথাও কিছু নেই।

তবে সিতারা বেগম বেশ অনুভব করে, যতদিন শরীর আছে তার নিজের ভিতর হেমিলনের বাঁশিওলার একটা অস্তিত্ব আছে যা মোত্তালিব মিয়ার রক্তস্বল্পতায় ভোগা কিশোরী বউটার মধ্যেও নাই! তাই তার পেছনে শিমুলিয়া গ্রামের এই মধ্যবয়সী পুরুষটা দৌড়াচ্ছে আর হাঁফাচ্ছে; হাঁফাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে!

চোর_এবং_নাকফুল_মামুনের_অণুগল্প

[আসুন, আজ একজন চোরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আপনাদের। গল্পটি রি-পোষ্ট….।। ]

অন্ধকারের ও কী নিজস্ব কোনো আলো থাকে? কেন জানতে চাইছি?
বলছি, একটু পরেই।
.
এক লোড শেডিং এর রাত। মফঃস্বল শহরের ছোট্ট একটা প্ল্যাটফর্ম। শেষ ট্রেন দাঁড়ানো। অল্প কিছু যাত্রী ওয়েটিং রুমে। এদের বেশীরভাগই বরযাত্রী। মশার আক্রমন থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত সবাই। বিরক্ত, বিব্রত আর ঘরে ফেরায় উন্মুখ।
.
ওয়েটিং রুম ছাড়িয়ে কালো ধাতব বিবর্ণ বয়স্ক ট্রেনটির অবয়ব অন্ধকারেও কিভাবে যেন চোখে পড়ে। এজন্যই বলছিলাম অন্ধকারেরও বুঝি নিজস্ব কোনো আলো থাকে। ব্রডগেজ দু’সারি লাইনের ওপারে একটা প্রাচীন চাম্বল গাছ। ওটার পিছনে চোরের মতো লুকানো আমি। নির্নিমেষ চেয়ে আছি ওয়েটিং রুমের খোলা দরোজার দিকে।
.
এক প্রবাসী ভদ্রলোকের হাত ধরে যখন স্টেশনের মূল গেট দিয়ে সুস্মিতা হেঁটে আসলো, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না – স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। এত দূর থেকেও দেখলাম ওর বিষণ্ন নাকফুল নির্নিমেষ চেয়ে আছে আমার পানে… দীর্ঘক্ষণ আমি জগত সংসারের সকল আলোআঁধারি ভেদ করে দেখতেই লাগলাম!
.
রাতের ট্রেনের দীর্ঘ হুইসেল বিষাদের সুরভি মেখে মেখে, বাতাসে ভেসে ভেসে আরও বিষণ্ণ করে তুলেছিলো সে রাতের কুহকী প্রহর! সেই থেকে বিষণ্নতার প্ল্যাটফর্মের একমাত্র স্টেশনমাস্টার এই আমি!
.
অনেক কিছুই করার ছিলো আমার। ছিলো অনেক কিছুই দেবার। ছিলো না কেবল কারও কাছ থেকে কিছুই চাওয়া-পাওয়ার অধিকার। কারণ ঐ যে আগেই বলেছি, চোরের মতো ছিলাম। লুকোনো স্বভাব নিয়ে এক জীবনে সেভাবে কখনোই সামনে আসতে পারলাম না আমি!
.
সেই থেকে এক চোরের অনুভবে-কল্পনায় একটি নাকফুল, নৈশব্দের প্রহরগোনা ভালোলাগায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে আজও বিষণ্নতায় ছুঁয়ে যাওয়া একটি রংগীন চাদর! যার বর্ণে বর্ণে লুকোনো এক বিচ্ছিন্ন অতীত.. যা ক্রমশঃ শীতের নরম রোদের মায়াবী কোমল আদর হয়ে অন্তর্চক্ষু বুজিয়ে দিয়ে যায়!
.
সেই থেকে শূন্যতায় ডুবে আছি আমি
যার বুক জুড়ে
শুধু তুমিই
শুধু তুমি!

.
‘পিরিতি আরতি পিরিতি সারথি, পিরিতি গলার মালা রে…।’

আহ হারে পিরিতি! বিষম পিরিতি 😀
.

কতটা ভালোবাসি – বলাই হলো না তাকে।।

#চোর_এবং_নাকফুল_মামুনের_অণুগল্প

অণুগল্প : অভিমানী

প্রতিবারই দু’পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের ভিতরের মেঠো পথটাতে ঢোকার সময় একটু থামি। পা দুটো কেন জানি থেমে যায়।আমার গ্রাম… আমার ভিতরের আমি এই মাটির গুণে আজকের আমিতে পরিণত হয়েছে। কেমন মায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছি এখান থেকেই।

যেখানটায় কিছু পাকা ধান বাতাসের ঝাপ্টায় মাটির সাথে মিশে আছে, তার অদুরেই তিনটি গরু। সাদাটা হলুদটার সাথে শিং দিয়ে শক্তি পরীক্ষা করছে। কালোটা বিরক্ত হয়ে পাকা ধান খাচ্ছে। দু’জন ধান কাটার কামলা মাথায় কাটা ধান নিয়ে যাবার পথে, ধান খেয়ে যাওয়া গরুটার কাজ দেখে পাশের খালি মাথার জনকে কিছু বলে। সে এক চিৎকার দেয়। কালোটা ধান খাওয়া বাদ দিয়ে একটু সরে যায়।

পিছনের সারি বাধা গাছ-পালার মাথার উপরে নীল আকাশ। সাদা তুলার মেঘের সাথে কিছু কালো মেঘ যেন গ্রামটাকে ভালোবেসে ছায়া দিয়ে রাখছে। বড় সহজ-সরল যে এই মাটির মানুষগুলি!

অদূরে একটা বাড়ী। একজন লোক লাঠির দু’পাশে বাঁধা ধানের আটি নিয়ে কিছুটা বাঁকা হয়ে হাঁটছে। বিড়ি ফুঁকছে আর কাশছে। কাশির দমকে দমকে ব্যাথায় নীল হয়ে যাচ্ছে সে। তারপর ও কষে একটান মারছে বিড়িতে।

কাঁধের ব্যাগটাকে আরো একটু রিল্যাক্স করে নিলাম। সামনেই আমার বাড়ি! মা ওখানে। মায়ের কাছে ছাড়া আর রিল্যাক্স কোথায়?

উঠানে ঢুকতেই ছেলে-মেয়েদের জটলা চোখে পড়ে। নিজেদের অলস সময় পার করছে ওরা। আনন্দ-উল্লাসে। কাটছে প্রহর নিঝুম নিমগ্ন সুখে! একটু দাঁড়াই। ওদের উচ্ছলতায় ভেসে ভেসে ফিরে যাই আমার সময়ে।

খেলার ছলে হয়ত কেউ একজন আরেকজনকে ব্যথা দিয়েছে। গাল ফুলিয়েছে অভিমানী বাবুটার মন! একটু দূরে সরে গেছে সে। প্রথমটায় কেউ খেয়াল করে না। শেষে অভিমানী বাবুর অপরিহার্যতা অনুভব করতেই, একজন কাছে আছে। একটু ছুঁয়ে দিতে চায় তাঁকে। সরে যেতে চায় সে। সে যতই সরে, ক্ষমাপ্রার্থী বাবুটা আরও কাছ ঘেঁষে। একসময় দু’জন পাশাপাশি। কিছুক্ষণ। শেষে হাসিতে মুক্তা ঝরে অভিমানীর! আবার জটলায় ফিরে সে। সবার মন আনন্দে উদ্ভাসিত। ভুলে যায় সবাই।

একটু খচ করে উঠে মনের কোথায় ও। পিছনে ফেলে আসা আর এক অভিমানীর কথা মনে পড়ে। ওর ক্ষুদ্ধ দু’চোখের তারায় তারায় অভিমানের জমাট কান্না। সেগুলো বর্ষণের অপেক্ষায় রেখে এসেছে সে। ঝরেছে কি সেই জমাট ধারা? জানতে ইচ্ছে হয়.. বড্ড।

কি করলে অভিমান ভাঙ্গবে বন্ধুর! জানি না আমি। বাবুদের জীবন কত সহজ। সরল। মুহুর্তেই চলে মান-অভিমান পর্ব। আবার মুহুর্তেই মান ভাঙ্গানোর পালা। বড় বাবুরা কেন এত সহজে গলে না? ওদের অভিমানের জমাট লাভাস্তর পার হওয়াটা কি অনেক কঠিন?

হয়ত। হয়ত না।
অপেক্ষা করছি অভিমানী! ভুল করে করেই মানুষ ‘মানুষ’ হয়ে উঠে। তাই ভুলকে অপরাধ ভাবলে, মানুষ হওয়াটা আর হয়ে উঠে না।

দরজা খুলে মা বের হন। একজন মায়ের মুখ আর অভিমানী কারও বিস্মৃত মুখ একাকার হয়ে যায়। নিজের ভেতরের জমাট লাভাস্তর গলে গলে যায়। দু’দন্ড শান্তি পেতেই মায়ের কাছে আসা। পিছনে রেখে আসা এক বনলতার নিরব চোখের তারায়, জমাট অভিমানী ভালবাসা- আমার ভুলগুলো গলিয়ে দেয়.. নদী হয়ে বয়ে যায় সেই হৃদয় অবধি!

অঝোর ধারায় ভিজে চলি আমি… :(

#অভিমানী_অণুগল্প_৪৫৪

অণুগল্প : অনুচ্চারিত_অনুভব

অনেক সময় নিজেকে চেনা যায় না। শিহাবের প্রায়ই এমন অনুভব হয়। বিস্মরণ! আত্মবিসর্জন? প্রশ্ন হল স্বেচ্ছায় না মনের ভুলে এমনটি হয়।

‘কখনো কি নিজেকে চিনতে চেয়েছ তুমি?’

উত্তর দেয়াটা হয়না সেভাবে। কারণ চায়নি তো সে কখনো। নিজেকে চিনতে। মুখ যা বলে, মন সেভাবে ভাবে না। একই সাথে বহমান এক প্যারালাল জীবন। কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করে?

বিবেক-ই কি ভাবায় আমাদের? বিবেক কাকে বলব? অনুভূতিতে সে কেমন?

বিবেক জুতার নিচ থেকে উপরে উঁকি দেয়া এক পেরেক বৈ কিছু নয়। প্রতি মুহুর্তে সদা জাগ্রত। স্থির কি বহমান-যে কোনো অবস্থায় সে নিজের তীক্ষ্ণ উপস্থিতি জানিয়ে যায়। অন্যরা পাশে থেকেও একটু ও অনুভব করে না। এ এক অনুচ্চারিত অনুভব!

সেদিন এক রিক্সাওয়ালা অতিরিক্তের আরো অনেক বেশী ভাড়া চেয়ে বসে। শিহাব ভদ্রভাবে সচরাচর প্রতিদিনের দেয় ভাড়া অফার করে। জবাবে রিক্সাওয়ালার উত্তর, ‘সে তো নুহ নবীর আমলের। যান মিয়া, হাইট্টা যান। এক টাকা ও লাগবে না।’

প্রতিটি মানুষ নিজের অনুচ্চারিত অনুভবের দাস। এ ক্ষেত্রে কেউ কথা না বাড়িয়ে চলে যাবে। তবে মনে মনে জঘন্য গালিগালাজ করবে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে। শিহাবের সদা জাগ্রত বিবেক ওকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে। এই রিক্সাওয়ালা উদ্ধত। একে একেবারে কিছু না বলে ও ছেড়ে দেয়া যায় না। সে লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে, ‘ ভদ্রভাবে কথা বলছি, তোমার ভাল লাগছে না, তাই না? ইচ্ছে হলে যাবে, নাহলে যাবে না, বাড়তি কথার প্রয়োজন নাই। চুপ, একদম…’

এই চুপের আগ পর্যন্তই ঠিক ছিল। কিন্তু মুখ আর মন ঠিক এই মুহুর্তে কেউ কারও বশে নেই। ক্রোধের আগুন প্রকৃতিগত ভাবেই সুপ্ত থাকে। শিহাবের কথার টোন আর চোখ পাকানো দেখে, অপর পক্ষ সামান্য ঘি ঢেলে দেয় তার নিজের ভিতরের সুপ্ত ক্রোধের কারণে।
ব্যস! আগুন জ্বলে উঠে। দুই দিকেই।
অত:পর..

‘..হারামজাদা থাপড়ায়ে তোর দাত ফালায়ে দেবো..’ ইত্যকার সম্ভাষণ শেষে ঘাড়ে ধাক্কা দেবার অপচেষ্টায় লিপ্ত হওয়া.. পথচারি অন্যদের হস্তক্ষেপে সাময়িক সুরাহা। সাময়িক একারণেই, আবারও এমন ঘটবে। নিশ্চিত।

কিছুদূর হেঁটে যায় শিহাব। নিজের রুটের বাসে সিটে বসার পর.. বিবেকের আগমন।
‘ধুর শালার, কি করলাম? এতটা করাটা ঠিক হয়নি। ধাক্কা না দিলেও পারতাম :( …’
গালাগালির কথাটা মনে আসাতেই অনুতাপের আগুনটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে!

বাস ভর্তি যাত্রি। যার যার অনুভবে। তার তার মত। শিহাবের সাথের মানুষটিও ওর ভিতরের আগুন একটুও অনুভব করে না। বিবেকের আগুনে সবাই-ই জ্বলে। একা একা।

সবার জুতোর সোল ভেদ করে বিবেক মাথা বের করে রাখে।

________________________
#অনুচ্চারিত_অনুভব_অণুগল্প_৪৫৩

অণুগল্প : পর পুরুষ

পারিবারিক ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফেরে কণা। রিপোর্ট হাতে নিজেদের রুমে ঢুকে দেখে, শাহেদ খবরের কাগজ পড়ছে।

নিরবে শাহেদের দিকে বাড়িয়ে দেয় রিপোর্ট কার্ড। শাহেদ হাতে নেয়। খবরের কাগজ নিচে অলস পড়ে রয়। মনযোগ দিয়ে পড়ে। শেষ হতেই একজন বাবা কণার দিকে তাকায়। আনন্দে উদ্বেলিত এক বাবার চোখ কেমন হয়? এমনই কি?
শাহেদের এই মুহুর্তের মত?

মা-বাবার আনন্দঘন সময় কাটে এক মায়াবী বিকেলে। প্রহরগুলি কেটে যায় দুরন্ত বাতাসের দোলায়।

সন্ধ্যা নামে। শাহেদ কোথাও যেতে রেডি হয়েছে। কণা কাছে আসে। ওর ডান হাত শাহেদ আলতো ছুঁয়ে দেয়.. কাছে টানে। কপালের ওপর নিজের অধর ছুঁয়ে দেয় শাহেদ। বলে, ‘আসি।’
বিদায় চুম্বন?

কণা হেসে বলে, ‘এমন ভাবে বলছ যেন আর আসছ-ই না।’ হাসে শাহেদ। তাকায় কণা। শাহেদের চোখে হাসি নেই। ও দু’টো রঙ পরিবর্তন করেছে।

সম্পূর্ণ অন্য এক ভিন্ন চোখে তাকায় শাহেদ। কণার সম্পূর্ণ অচেনা লাগে ওকে। ধীরে ধীরে তখন শাহেদ বলে চলেছে,
– হ্যা কণা! আমি চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমার পথ এ পর্যন্তই ছিল।

কোনো অনুতাপ নেই। নেই কোনো বিষণ্নবোধ। সম্পূর্ণ নির্বিকার থেকে কণার দিকে পিছন ফিরে শাহেদ। দরজা সেদিকে।

‘দাঁড়াও!’
কণার ডাকে শাহেদ থামে। পেছন ফেরে। কণা নিজের গর্ভে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– এর কি হবে?

শাহেদ চুপ থাকে। ওর ভিতরে কি ভাঙ্গাচূরা চলে?

– আমাকে পাঠানো হয়েছিল ‘আমাদের প্রতিনিধি’ তোমাদের পৃথিবীতে রেখে যাবার জন্য।

এটুকু বলে একটু থামে শাহেদ। কণার চোখে তাকিয়ে বাকিটুকু বলে,
– আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি কেবল, তোমার সাথে কোনো ধরণের বন্ডেজ নেই আমার।

কণার হতবিহবল ভাবটা কাটতে চায় না। ও জিজ্ঞেস করে, ওর সামনে দাঁড়ানো সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষকে,
– কে তুমি? আমার মানুষটি কোথায়?
– তোমার মানুষটি আর নেই। তোমার জন্য দুঃখপ্রকাশ করলে তোমার মানুষটি যদি ফিরে আসত, অবশ্যই করতাম আমি। কিন্তু তা হবার নয়।

দরজার চৌকাঠ ধরে একটু থামে সে। শাহেদের অনুরুপ নিয়ে যে মানুষটি চলে যেতে চাচ্ছে, কণাকে ছেড়ে, সে ম্লান হেসে জানায়,
– তবে আমি আমার কাজ সম্পূর্ণ করিনি। তোমার মানুষটির স্পার্ম-ই তোমার গর্ভে। সে তোমার সন্তানের বাবা। তার মৃত্যুর পূর্বেই আমি সংরক্ষণ করেছি। বাবুটার যত্ন কর। ও তোমাদের বাবু। আমাদের জগত জানবে সে আমাদেরই মানুষ। এটাই তোমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করার একমাত্র পথ ছিল।

দরজা খুলে অচেনা মানুষটি বাইরে পা বাড়ায়। কণা নিরবে সামনে আগায়। দরজা ধরে শেষ প্রশ্ন করে,
– তুমি কে?

দূরে চলে যেতে যেতে, দূরের কোনো পৃথিবীর অবাক করা মানুষটি, পেছন না ফিরে জানায়,
– আমি পর পুরুষ!

রাতের অন্ধকার ছুঁয়ে ছুঁয়ে, একজন অচেনা মানুষের ফিরে যাবার ক্লান্ত পদধ্বনি, নিমিষে মিলায় বাউরি বাতাসে। সব চুপচাপ চারিধার… এক নিশ্চুপ মাঝরাতে।।

___________________
#পর_পুরুষ_মামুনের_অণুগল্প

অণুগল্পঃ কাছে দূরে

পাতা ঝরার দিন।
ঝরছে হলুদ পাতারা মুষলধারে। গাছগুলো কেমন নেংটো হয়ে আছে। রুপার সেদিকে তাকালে কেন জানি লজ্জা লাগছে। তারপরও ‘নেংটো’ এই শব্দটা ওর বোধের আরো গভীর থেকে ওকে কেন জানি এক চৌম্বকীয় আবেশে তড়িতাহত করে তুলতে চাইছে।

হঠাৎ শিহাবের কথা মনে হল ওর!
এই ফাল্গুনের শিমুলে আগুন জ্বলা দুপুরবেলায়, তিরতির করা শব্দের নিঃশব্দ অনুরণন- রুপার দ্বাবিংশ বছরের শরীরকে কেন যেন উত্তেজিত করে তোলে। একটি শক্তিশালী পুরুষালী কর্কশ স্পর্শ ওকে এলোমেলো করে তুলুক… ওর মাখন নরম কমনীয়তা লন্ডভণ্ড হোক কারোর দ্বারা! এমনটি-ই যেন চাইছে এই মন।

দূর থেকে নিঃসঙ্গ কালো পিচঢালা পথ ধরে শিহাবকে আসতে দেখে। নিমিষে এক ঝলক উষ্ণ অনুভব ততোধিক উষ্ণ শোণিতে পরিবাহিত হয়। বিবশ করে তোলে রুপাকে। রক্তিম শিমুলের চেয়েও লাজরাঙ্গা হয়ে উঠে! মুখ নিচু করে থাকে কিছুক্ষণ। শিহাবকে নিয়ে ওর একটু আগের ভাবনাগুলোকে জেনেই যেন, সেনাবাহিনীর মত মার্চ করে এসে লজ্জারা ঘিরে ধরে ওকে।

কাছের মানুষ আরো কাছে এলে অনুভূতিগুলো আরো প্রবল হবার পরিবর্তে নিষ্ক্রিয় কেন হয়ে যায়? কত কথা বলার আছে! কিন্তু শিহাব কাছে এলে কেন জানি বলা হয়ে উঠে না।

কাছে-দূরের এই অনুভূতি-ই কি ভালোলাগা?
না কি ভালোবাসা!
এই কি প্রেম!

অণুগল্প : তুমি_আমার_নও

এক সময় আলাদা কেউ মনে হতো শাহেদকে আমার কাছে। মাত্র কয়েকটা বছর আগে। বিয়ের পর কত সুখী হয়েছিলাম আমরা একে অন্যকে পেয়ে! সংসার নামের বন্ধুর পথটিকে এতটুকু ভয়ের মনে হয়নি আমার কাছে। পথ হারানোর দুশ্চিন্তা হয়নি। দূরত্ব হবে দু’জনের ভিতর এমন আশংকা ও ছিল না।

কী গভীর বিশ্বাস নিয়ে আমাদের বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছিল। কত দামী ছিল সেই সম্পর্ক। কখনো আর কেউ এই সম্পর্কের মাঝখানে এসে দাঁড়াতে পারে, কখনো কি মনে হয়েছিল আমার?

অথচ কত সহজে সব বদলে গেল!

কার্ল মার্ক্সের শ্রেণি সংঘাত মনে পড়তে ভেতরটা তেতো লাগতে শুরু করল আমার। টিকে থাকার অবিরাম সংগ্রাম.. দখল প্রতিষ্ঠার জন্য মুহুর্মুহু সংঘাত.. অসহনীয় সম্পর্কের বাঁধন.. অসহ্য!

হতাশ আমার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস ছিটকে বেরিয়ে এলো লাভার মতো।
‘কেন এমন হয়? কি করব আমি এখন? জীবন্মৃতের এই জীবন সে কি করে বইবো আমি?’
আতংকিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, ‘আরও অনেক বছর যদি বাঁচতে হয়?’

‘পুরুষ!! শরীরের দায়ে না পড়লে নারী কখনো পুরুষকে কি সইত, বইত?’ বিস্মৃতির অপর পাশে ভালবাসার অলৌকিক সুখের মুহুর্তগুলোকে রেখে এপাশে ছলকে ছলকে উঠতে লাগল ঘৃণা.. প্রত্যাখ্যাত প্রেম তীব্র রোষে ফুঁসতে লাগল।

বারান্দার কোণে রাখা চেয়ারটা থেকে ছিটকে উঠে ডাইনিং রুমের ভেতর দিয়ে সোজা নিজের রুমের দিকে হেটে গেলাম। কিছু একটা করতে হবে। মাথায়, শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। বিয়ের আগে এমন যন্ত্রণা হলে ঘর কাপিয়ে গান শুনতাম। দ্রুত ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটতে হবে..

লম্বা পিচের রাস্তার পেভমেন্ট ধরে হাটবার কালে, সেই কথাটি আবারো মনে পড়ে গেল- শাহেদ আমার আপন ছোট বোনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে!

কাকে বলব আমি?
________________

#তুমি_আমার_নও_মামুনের_অণুগল্প।