বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

পিঁপড়ের পাখা

এক.
মাছি আর পিঁপড়ে। দু’জনের মধ্যে ভারি ভাব। রাতে পাশাপাশি থাকে। বাবুদের বাড়ির ভেতরের কোনো এককোণে। আর যখনই সময় পায় গল্প করে। নানা সুখ-দুঃখের কথা বলে।

দুই.
-ও পিঁপড়ে- উড়তে উড়তে এসে মাছি বলে- বাবুদের বারান্দার কোণায় ক’দানা চিনি পড়ে আছে। খাবি তো চল্।
– চল্।
মাছি উড়ে উড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আস্তে আস্তে পিঁপড়ে পৌঁছে যায় খাবারের কাছে।
ওরা দু’জনে একসাথে খাবার ভাগ করে খায়।
পিঁপড়ে বলে- আমার যদি তোর মত ডানা থাকত, তাহলে কি সুবিধেই না হত।
– সে হতো ঠিকই। কিন্তু…
– এই দেখ না, আজ আমার এখানে আসতে কত সময় লেগে গেল। অথচ তুই-
– সে ইচ্ছে করলে একনিমেষেই চলে আসতে পারতাম। শুধু তোকে পথ দেখিয়ে আনার জন্যই ধীরে ধীরে এলাম।
– সে জানি। তাই তো বলছি, ভগবান ভারি একপেশে। তোকে পাখনা দিলেন আর আমাকে খুঁদে খুঁদে একগাদা পা। জানিস আমার মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে। যখন দেখি তুই কি সুন্দর উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।
– কি আর করা যাবে বল? ভগবান যাকে যা দেন, তাই নিয়েই খুশি থাকতে হয়।
-না আমি খুশি নই। ভগবানের কাছে নালিশ জানাব – মাছিকে ডানা দিলে। আমি কি দোষ করেছি? আমাকেও দিতে হবে।
-ভগবান যাকে যা দেন তাতেই তার মঙ্গল। অন্যরকম হলে বিপদ হয়।

তিন.
দু’দিন পিঁপড়ের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি মাছির। আজ তাই সকাল সকাল পিঁপড়ের কাছে উড়ে আসে মাছি।
ডাকে- ও পিঁপড়ে! পিঁপড়ে-!
পিঁপড়ে কোনো উত্তর দেয় না।
-ও পিঁপড়ে- কি হলো তোর? কথা বলছিস নে কেন ভাই?
সহসা পিঁপড়ে হো হো করে হেসে ওঠে।
– অমন করে হাসছিস কেন ভাই?
-এই দেখ মাছি। আমার পাখা উঠেছে।
মাছি অবাক হয়ে তাকায় পিঁপড়ের দিকে। সত্যি তো। পাতলা পাতলা দু’টো পাখনাই তো দেখা যাচ্ছে ওর গায়ে।
-কীভাবে, কখন হলো এসব ?
-তোর কি হিংসে হচ্ছে?
– কি যে বলিস? কিন্তু আমি ভাবছি…
-এই দেখ আমি কেমন উড়বো এখন…
বলেই পিঁপড়ে উড়তে শুরু করলো।
-হা হা হা- এই দেখ আমি কত উপরে উঠে গেলাম উড়তে উড়তে।
-আর যাস নে ভাই।
-কেন রে? আমি তোর চেয়ে ভাল উড়তে পারছি দেখ-
হঠাৎ মাছি দেখে – একটা ছোট পাখি পিঁপড়ের দিকে উড়ে আসছে।
-ও পিঁপড়ে। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় চিৎকার করে ডেকে ওঠে মাছি- সরে যা , ওই পাখিটি তোকে-

কথা শেষ হবার আগেই মাছি দেখে পাখিটির দুই ঠোঁটের ফাঁকে আটকে তার প্রিয় বন্ধু ছটফট করছে।

ঘাসমাটি অন্তরের কাছাকাছি // রুকসানা হক

এতদিনে বুঝি নিরালা খানিকটা নির্ভার হলো। তেতলার ছাদে উঠে ভেজা চোখে দমচাপা শ্বাসটুকু ছাড়িয়ে নিলো আড়াইবছরের নীলআকাশ থেকে। ওখানে অযুত ক্লান্তি ছিল, ছিল বন্ধনের খুব শীতল রং। সুখ ও ছিল ক্লান্তিহীন। ছিল নিবিড় বন্ধন। তাই চোখদু’টো বারবার ভিজে ওঠে।

যেকোন বন্ধনই ছিন্ন করার কষ্টগুলো হয় ভয়ানক। তাই হয়তো নিরালার কষ্টেরা দুঃখের অণুবীজ হয়ে বুকের গহীনে ঝড় তুলছে আজ।

আড়াই বছর !
সময়টা নেহায়েত কম না। স্মৃতিরা ও কম মুখরিত নয়। শুরু থেকেই দীপ্তের সাথে কোথায় যেন একটা ফারাক ছিল তার। হতে পারে এটা নিরালার ইগো, হতে পারে দীপ্তের অধিক ভালবাসার দায়ভার।

বেশি ভালবাসা কখনো কখনো চন্দ্রভুক গল্প হয়ে যায়। গল্পের আড়ালে থাকে আরো কিছু উপগল্প। সেখানে ভালবাসার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে পারষ্পরিক অবুঝাপড়া। দীপ্তের সাথে বুঝাপড়া হয়নি নিরালার। নিজের অহংবোধে যখন ক্ষীপ্রতা ঝড় তোলে, ক্ষয় শুরু হয় সেখান থেকেই।

নিরালার কথোপকথন বাতাসের সাথে ইকো হয়ে আবার নিজের কানেই ফিরে আসে
ঃ শৃঙ্খলের নাম কখনো ভালবাসা হয়না দীপ্ত।
ঃ ভালবাসার ও নাম কখনো নিজের সীমা অতিক্রম করা নয় নীর।

নিজের সীমা বলতে কি বুঝায়, জানে না নিরালা। পুরোটা জীবন জুড়েই ছিল অনতিক্রম্য একটা লেভেল। সেই লেভেলটা ক্রস করতে পারেনি বলেই আশেপাশের মানুষকে ছোট করে ভাবতে শেখেনি সে।

নিরালার চারপাশের মুখগুলোই যেন দীপ্তের একমাত্র এলার্জি। সুখের অনুভূতিকে নিবিড়ভাবে অনুভব করতে গিয়ে নিরালা চারপাশ থেকে খুব যতনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। সে অনুভূতিটার নাম ছিল দীপ্ত।
সেটা কি দীপ্ত জানতো না ?
ঃ তুমি জেনেও কেনো তৃতীয় পক্ষ নিয়ে এতটা মুখর থাকো ? বিরক্তিভরে জানতে চাইলো নিরালা।
ঃ ওরা পঁচা মানুষ। তুমি সংক্রমিত হবে।
ঃ ওরা আমার চারপাশ। তুমি অন্তর। অন্তর শুদ্ধ থাকলে শরীরে সংক্রমণ হয় না।
ঃ ছোটবেলা গুরুজনেরা এদেরকেই মেলামেশার অনুপযোগী ভাবতেন।
ঃ আমি এখন পূর্ণ মানুষ। ছোট নই।
ঃ আমাকে ছাড়াই তাহলে পূর্ণ তুমি নীর ?

দীপ্তের জেদ তার অন্তরের চোখদু’টো অন্ধ করে দিয়েছিল। সে জানতো চারপাশ মানে তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তাকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত নিরালার চারপাশ।

এতসব জটিলতা সরল সমীকরণকে অমিমাংসিত রাখতে বাধ্য করে। নিরালার কাছে তার অন্তর অমীমাংসিতই থেকে যায়।

তেতলার ছাদটা আজ জোছনায় ভেসে যাচ্ছে। ছাদবাগানে টুপটুপ চাঁদনী বৃস্টি। নির্ভার নিরালার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠছে নরম নীল আলোর স্পর্শে। ছাদ থেকে জোছনাভেজা চোখ দু’টো নিচে ঘাসমাটিতে গিয়ে ঠেকলো। তুলতুলে সবুজ ঘাসেরাও ভেজা ভেজা আলোর সাথে লুকোচুরি খেলছে। নিরালার ও খেলতে বড় সাধ হলো। ঘাসের চাদরে যেন তার অন্তর শুয়ে আছে।

নিরালা অন্তর ছুঁতে চায়। প্রচন্ড জেদে জোছনার নীল আলোতে নিজেকে ছেড়ে দেয় ঘাসমাটি অন্তরের কাছাকাছি।

একটা বিকট শব্দে ভয়ার্ত রাতের পাখিরা ক্যাঁচক্যাঁচ করে এলোপাথাড়ি উড়ে যায়।

অণুগল্প : হৃদয়ের_কথা_জানিতে_ব্যকুল

“I’ve been alone with you
Inside my mind
And in my dreams I’ve kissed your lips
A thousand times
I sometimes see you
Pass outside my door
Hello!
Is it me you’re looking for?”

এ পর্যন্ত শুনেই হেডফোন আমানের হাতে। গান বাজতে থাকে।
কিন্তু আমান কি শোনে?

মনের ভিতর বিষণ্নতার চাদর! ছ’তলার ছাদের পানির ট্যাংক। তার উপরে একা আমান। হেডফোন খুলে ফেললেও আমানের মাথার ভিতর, ব্রেইণের ঝিল্লিতে সহ পুরা শরীরের ভিতরেই গানের কলিগুলির দৃশ্যায়ণ হতে থাকে।

শুধু ওর জন্যই যেন বাতাসের প্রফুল্ল মনে বিরহ দানা বাঁধে। চারদিক উন্মুক্ত। মনে হয়, এ জগতসংসারের সেই রাজা। এক মহানগরের বিশালতাও এক নিস্প্রাণ দালানের শীর্ষে থাকা, ক্ষুদ্র এক মানবের হাহাকারগুলোকে গিলতে পারছে না!

এই মুহুর্তে নিজেকে বড্ড ‘আউটসাইডার’ মনে হল আমানের। দরোজার ওপাশ দিয়ে ওর ‘প্রিয়দর্শিণীর চলে যাবার শব্দ নিজের হৃদয়ে অনুভব করে।

নিজের জায়গা থেকে দরোজার ওপাশ কি অনেক দূর?
কতটা দূর? এতোটাই কি দূরত্ব যে কাছের মানুষকেও দূরে ঠেলে দেয়!

কষ্টগুলো মধুমাছি! কোমলে কঠোরে তিতা মিঠা।

চেতনায় জোনাকি জ্বলছে…দূরে কোথায়ও। আলো অনুভব করছে আমান। দৃষ্টির বাইরের সেই আলোয় পথ চলা দায়।

হঠাৎ মনে পড়ে, ওর আজকের এই বিশেষ দিনে, চেনাজানা, কাছে দূরের সকলেই ওকে উইশ করেছে। শুভকামনা জানিয়েছে।

কিন্তু পারু বড্ড নিরব থেকেছে! সে এভাবে নিজেকে নি:শব্দে সরিয়ে নিল!

মনের আড়াল? না দৃষ্টির আড়াল পেতে চাইছে সে!

কেন জানি আজ পারুকে অন্য ‘মেয়েমানষ’ মনে হল। না কাছের, না দূরের। অন্যমানুষ। নিজের না।

কেমন সেই অন্য মানুষের জীবন?
নিশ্চয়ই অন্যরকম…
পারু কি আসলেই ওর কখনো ছিল?

আবার হেডফোন কানে। হৃদয়ের প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে ভয় পাওয়া এক ছায়ামানব গানের ভেতরে ডুবে যায় …

“And I want to tell you so much
I love you.”

আমানের শহরের ইথারে ইথারে ভেসে বেড়ায় এক হৃদয়হীনের ভালোবাসা! যে অন্য শহরের এক ফুলবউয়ের ‘হৃদয়ের কথা জানিতে ব্যকুল’। এক ফুলবউ-পারুর হৃদয়ে এক গোপন দুপুর হয়ে থাকবার প্রত্যাশী। এক ছায়ামানব তার এক বিশেষ দিনে, নিজ হৃদয়ের এপিঠ ওপিঠ তন্ন তন্ন করে সুখগুলোকে খুঁজতে থাকে।

কোথায় ওরা?

_______________________________
#হৃদয়ের_কথা_জানিতে_ব্যকুল_অণুগল্প_৪৮৫

কুকুরছানা

তপু, ও তপু…
ডাকতে ডাকতে বাবা বাড়িতে ঢোকেন।
মা-ও তপুকে ডাকেন। বলেন- দেখ্, বাবা তোর জন্য কী নিয়ে এসেছেন! তপু—

কিন্তু তপুর কোনো সাড়া নেই।
গতকাল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা কুকুরছানাটিকে নিয়েই সে ব্যস্ত। তার পড়ার ঘরের সামনের ছোট্ট ঝুল বারান্দায় বসে ছানাটিকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে তপু।

গতকাল বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল তপু। হঠাৎ রাস্তার পাশে কুকুরছানাটিকে কেঁউকেঁউ করতে দেখে খুব মায়া হয় তার। আদর করে কোলে তুলে বাড়ি নিয়ে আসে।

কিন্তু বাড়িতে আসতেই বাবা-মা’র বাধার মুখে পড়তে হয়। কেউই রাস্তার কুকুরকে ঘরে তুলতে রাজি নয়।
– ওটা এনেছিস কেন? যা আবার রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আয়। – বিরক্তির সাথে মা বলেন।

বাবা বলেন- ওসব দেশি কুকুর ঘরে তুলতে নেই বাবা। তোমার কুকুর পোষার শখ? তো ভাল দেখে একটা বিদেশি কুকুর এনে দেব। তুমি ওটাকে বাইরে রেখে এসো গে যাও।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। তপু ছানাটিকে কোলে করে সোজা চলে গিয়েছিল তার দোতলার পড়ার ঘরে। আদর করে বিস্কুট খাইয়েছিল। ভাতও দিয়েছিল খেতে। রাতে হার্ডবোর্ডের একটা বড় বাক্সের মধ্যে শুইয়ে রেখেছিল।

মা ছেলের পাগলামি দেখে বাবাকে বলেছিলেন- কালই তুমি ওর জন্য একটা বুলডগ এনে দিও। নয়তো ওই রাস্তার কুকুরকে ও কিছুতেই ছাড়বে না।

আজ রবিবার। স্কুল নেই। তাই সকাল হতেই তপু কুকুরছানাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বাবা মা তপুকে ডাকতে ডাকতে তার পড়ার ঘরের দিকে এগিয়ে যান। বাবার হাতে গলায় শেকল পরানো ছোট্ট একটা বুলডগ।

মা বলেন- দেখ্ তপু, বাবা তোর জন্য কি সুন্দর একটা কুকুর এনেছেন।

তপু দেখে। সত্যি তো খুব সুন্দর দেখতে। ধবধবে সাদা বড়বড় লোমে ভরা সারাশরীর। গায়ে হাত দেয়। বাহ্, কি নরম!
বাবা বলেন- দাও ওটাকে। রাস্তায় ফেলে আসি। এটাই এখন তোমার।

তপু একবার কুড়িয়ে আনা কুকুরছানাটির দিকে তাকায়। দেখে- ভয়ে যেন কুঁকড়ে আছে ও। বারবার সভয়ে তাকিয়ে দেখছে শেকলপরা বিদেশি ডগটির দিকে। আর বুলডগটিছানাটিও সরোষে তাকাচ্ছে দেশি ছানাটির দিকে।

তপু বলে- এটাও থাক না বাবা।
মা বলেন- পাগল নাকি তুই? ওইসব দেশি কুকুর কেউ পোষে নাকি? ওকে ঘরে দেখলে লোকে খারাপ বলবে।
বাবাকে উদ্দেশ্য করে মা বলেন- যাও তো, ওটাকে বাইরে রেখে এসো।

তপুুর বাবা পথের কুকুরছানাটিকে ঘৃণাভরে হাতে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
খারাপ লাগলেও বাঁধা দিতে পারে না তপু । শুধু একবার বুলডগ, আর একবার কুড়িয়ে আনা কুকুরছানার দিকে তাকায়।

কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থাকে তপু। তারপর কি ভেবে বুলডগটির শেকল ধরে। উঠে দাঁড়ায়।

হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে সেই কেঁউকেঁউ শব্দ। তাকিয়ে দেখে – কুকুরছানাটি গেটের বাইরে রাস্তার পাশে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে অসহায় করুণ চোখে তপুদের বাড়ির দিকে চেয়ে বসে আছে।

অণুগল্প : চাঁদের_কণায়_ছোঁয়া_প্রহর

১.
প্রতিদিনের মত জীবন। একই। বোধের পাল্লায় মেপে, নির্বোধ অনুভবটুকুই অনুভূত হয়। এভাবেই আছি এখন। জীবন আমার এরকমই অনেকটা আজকাল।

ব্যাংকে কাটালাম লাঞ্চের আগ পর্যন্ত। যাবার পথে বিড়ম্বনা। চলছে চার লেইনের রাস্তার কাজ, সাথে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল পর্যন্ত উড়াল সেতু। ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম। হেমন্তের দুপুরে ফিরবার কালে, অনেকটা পথ হেঁটে ফিরেছি। একা নই। আরো অনেকে এমন সঙ্গী হয়েছেন আমার।

আমার সাময়িক বসবাসের জেলখানার মোড়ের রাস্তার মাথায় চা’র দোকানটি। একটা সিগ্রেট পোড়ানো যেতে পারে ভেবে সামনে আগাই। রাস্তায় প্রচুর মানুষ। কিন্তু দোকানটিতে ভিড় নেই। মোবাইলে সময় দেখি এক পলক। একটা দশ। চোখ ফিরাতেই লোকটিকে দেখি। মাথা নিচু করে বসা। পাশে শূণ্য চা’র কাপ। একটা মাছি উড়ছে। নির্লিপ্ত দোকানদার। রাস্তার জ্যামে আটকে পড়া শ্লথ যানবাহনগুলির দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে আছে। ইদানিং প্রতিদিনই এই দৃশ্য দেখে সে। তাই ওর ঘষা কাঁচের দৃষ্টিতে কোনো বোধের স্ফুরণ জাগে না।

একটা কুকুর কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। আমার উপস্থিতিতে একটু যেন বিরক্ত মনে হল ওকে। একবার চোখ মেলে নিরবে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে, আবার চোখ বুজল। গভীর কুকুরীয় ভাবনাবিলাসে ডুবে গেল সে।

দোকানদারের কাছে এক শলাকা গোল্ড লিফ চাইলাম। সে সিগ্রেট না দিয়ে- নিজের বাম পাশের ট্যাকে গোঁজা গুলের কৌটা বের করে। তর্জনীতে যতটুকু উঠে গুল নিয়ে, নিচের মাড়িতে রেখে ঠোঁট বন্ধ রাখে। গুলের কটু তামাক বাতাসে ভেসে আমার নাসা:রন্ধ্রে সুড়সুড়ি দেয়। এলার্জি আছে গুলে আমার। এখুনি নন-স্টপ হাঁচি শুরু হবে।

লোকটার বাম কানের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে একটা বাম হাতের জোর ঝাপর মারার ইচ্ছেটা দমন করলাম। সাধারণত কোনো দোকানদার খদ্দেরের চাহিদা পূরণ না করে, নিজের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেয় না। তবে খদ্দেরটা আমি বলে কথা। এমনই হয় আমার সাথে সবসময়। কুকুরটার সাথে থেকে ব্যাটার ভিতরেও ওর স্বভাব চলে আসছে হয়ত। কুকুরটা যেভাবে আমাকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেছিল, দোকানদারের নির্লিপ্ততার মাঝে ও একই জিনিস দেখলাম আমি।

বেঞ্চে অল্প পরিচিত লোকটির পাশে বসি। পকেট থেকে সুদৃশ্য লাইটার বের করে, ক্যান্সার স্টিকটি জ্বালাই। একমুখ ধুঁয়া ছেড়ে পাশের রশিদ সাহেবের দিকে তাকাই। এতক্ষণে মুখ তুলে তাকিয়েছেন তিনি। হাসেন। হাসি হাসির জন্ম দেয়। আমাকে ও অর্থহীন হাসি হাসতে হয়। একেবারে অর্থহীন ও নয়। এটা স্বল্প পরিচিত মানুষদের কথোপকথন শুরুর প্রারম্ভিক ওয়ার্ম-আপ হিসেবে ধরা যেতে পারে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি ব্যাপার, সেদিন ফোন করে বললেন জরুরী কথা আছে- বাসায় আসবেন, এলেন তো না?
– জরুরী একটা কাজ পড়েছিল ভাই তাই আসতে পারিনি।
– এখন ফ্রি আছি কিছুক্ষণ। বলতে পারেন। চা খান আরেক কাপ? সিগ্রেট.. আপনার ব্রান্ড কি?
– জি না, এখন আর চা খাব না। :) আর আমি ধুমপান করি না। ধন্যবাদ।

একটু থমকে গেলাম। আমার সাথে সময় ও। কিন্তু একপলক-ই। থমকেই ভাবি, একজন লোক ভর দুপুরে চা’র অফার ফিরিয়ে দেয়, আর সে ধুমপান করে না জেনে তোমার এবং সময়ের থমকানোর কি আছে?
আজকাল একটু বেশী-ই কি ভাবা শুরু করেছি আমি?

মনের বিব্রত ভাবটা কাটিয়ে উঠতেই বুঝি কন্ঠে একটু বিরক্তি টেনে এনে তাকে বলি,
– এর আগেও দুইবার চলতি পথে আমাকে থামিয়ে কিছু বলতে চেয়েছেন, বলতে পারেন নি। তিনদিন রাতে ফোন করেছেন, দিনে কখন ফ্রি থাকব জানতে চেয়েছেন। আমি সময় দিতে চেয়েছি, আপনি সময় মত আসেন নাই। ভিন্ন একটি নাম্বার দিয়ে একবার রাতে ফোন করে চুপ থেকেছেন, আমি বুঝতে পেরেছি ও পাশে আপনি ছিলেন। সমস্যাটি কোথায়?
– আমি দু:খিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে আপনার সাথে খুবই জরুরী একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন.. আজ রাতে আসব অবশ্যই।

আমাকে সালাম দিয়ে রশিদ নামের লোকটি চা’র দোকান থেকে বের হয়ে যায়। তার পিছন দিকটার দিকে চেয়ে থাকি আমি। তিনি সরু পায়ে চলা পথের বাঁকে মোড় ঘুরে অদৃশ্য হবার আগ পর্যন্ত ওভাবেই তাকিয়ে থাকি। দোকানদারও থাকে। চেয়ে দেখি কুকুরটি ও চেয়ে আছে সেদিকে। কখন যেন ঘুম ভেংগে গেছে ওটার ও।

এক মধ্যদুপুরে আমি এক চা’র দোকানে বসে, দোকানদার এবং এক কুকুরকে সাথে নিয়ে, রশিদ নামের একজন মানুষের চলে যাওয়া দেখি। রাস্তায় ট্রাফিক তখন আরো বেড়েছে।

২.
প্রচন্ড গরমে ঘেমে গোসলের মত অবস্থা হয়েছে ফারাহর। যদিও এখন গরমকাল না, তারপর ও। বাসের ভিতরে দাঁড়ানো মানুষ রয়েছে প্রায় সিটে বসা মানুষের সংখ্যার কাছাকাছি। মহিলা সিটে মহিলা এবং শিশুরা বসে আছে। সে নিজে এমন এক স্টপেজ থেকে উঠেছে, ওখান থেকে কখনো-ই সিট খালি থাকে না। মধ্যবর্তী স্টপেজ। আগে থেকে ভর্তি হয়েই বাস আসে।

ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। বিশাল বিশাল ক্যাটারপিলার ট্রাক এবং অন্য সব পাইলিংয়ের যন্ত্রপাতিগুলির দিকে অধিকাংশ যাত্রী-ই তাকিয়ে দেখছে। বিস্ময় তাঁদের চোখেমুখে। রাস্তার ধূলা বাসের জানালা দিয়ে আসছে। কয়েকজন চীৎকার করে জানালা বন্ধ করতে বলতেই, বাকিরা ক্ষেপে ওঠে। ভিতরের গরমে প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামে মন্থর গতির বাসে বসে বসে সবাই মনে মনে ক্ষিপ্ত। তাই কারও ভাল কোনো কথাও কারোর ভাল লাগে না।

মধ্যবর্তী স্টপেজ শব্দটি কিছুক্ষণ আগে ফারাহর মনে এসেছিল। সে নিজেও কি জীবনের এই পর্যায়ে এসে, জীবনের মধ্যবর্তী স্টপেজের অপেক্ষামান একজন যাত্রী নয়? দু’পাশে যাত্রীদের চাপাচাপির ভিতরে যতটুকু নিজেকে রক্ষা করা যায়। বিভিন্ন মানুষ। পুরুষই বেশী। আমাদের এই পুরুষশাসিত সমাজে চলাফেরাটা তাদেরই আয়ত্তাধীন। নারীর বাসায় ফেরা কিংবা বাসা থেকে বের হওয়াটা শারীরিক এবং মানসিক ঝুঁকির মাত্রায় সর্বোচ্চে অবস্থান করে। বাসের হেল্পার কি কন্ডাক্টর, মহিলা যাত্রীদের উঠা-নামার ক্ষেত্রে সাহায্যের নামে হাত ধরে। ফারাহর ও এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রথম দিকে রশিদের সাথে যখন একটু একটু বাইরে বের হতো, তখন ওর হাত ধরার মানুষ ছিল বিধায় এই বিব্রতকর অনুভবে বিলীন হতে হতো না ওকে। ধীরে ধীরে সময় পার হয়। অনেক কিছু আজ আর আগের মত নেই। একসময় নিজেও সে স্কুলের চাকরিটা অনেকটা সময় কাটানোর জন্যই বেছে নেয়। স্কুলের কাজের প্রয়োজনে প্রায় সময়ই ওকে উপজেলা শিক্ষা অফিসে যেতে হয়। সেই সুবাদে এমন নোংরা স্পর্শের অভিজ্ঞতা ওর নিজেরও হয়েছে। আর ভিড়ের ভিতর পুরুষ কেন জানি কোমল নারীদেহের পরশ লাভে খুবই উন্মুখ থাকে। শিকারির মত যেন পুরুষগুলো। অবশ্য সবাই নয়। ব্যতিক্রম সবক্ষেত্রেই আছে। সেটাকে উদাহরণ হিসেবে আনা যায় না।

নিজের এলাকার মোড়ের ফিলিং ষ্টেশনের একটু সামনে বাস থামে। ফারাহ নামে। বাইরের রোদের আঁচ একটু গালকে ছুঁয়ে দিলেও, এতক্ষণের বদ্ধ আবহাওয়া থেকে মুক্তি সারা শরীরে কেন জানি আনন্দের কোমল পরশ বইয়ে দেয়! ঘর্মাক্ত শরীরে ধুলা উড়া বাতাসের ছুঁয়ে দেয়াটা উপভোগ করে সে। শরীরের পরিচ্ছদের বিশেষ বিশেষ জায়গা ঘামে ভিজে গেছে। পথচলতি পুরুষগুলি নির্লজ্জ কামুক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আগে বড্ড কষ্ট হতো। এখন হাসি পায়। শরীরের শরীর সংক্রান্ত অনেক কিছুই তো বিয়ের পরের গত আট বছর ধরে সে দেখছে। এখন তাই রাস্তার পুরুষগুলিকে ‘মানুষ’-ই মনে হয়না ফারাহর। নারীর ভয়তো আসলে ‘পুরুষের’ কাছে নয়। যারা নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করে, এদেরকে কখনো-ই ওর পুরুষ কিংবা মানুষ মনে হয়না। এরা আসলে যে কী, সে নিজেও ভেবে পায় না।

সামনে পি.এস.সি পরীক্ষা। এই কাজেই ওদের স্কুল ও কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম, রেজিষ্ট্রেশনের কিছু পেন্ডিং কাজ সমাধার ভার দিয়েছিলেন ওর উপর। সেটা শেষ করেই আসছে এখন। হাত ঘড়ির ছোট্ট ডায়ালে সময় দেখে। একটা কুড়ি। পায়ে পায়ে স্কুলের দিকে আগায়। খিদে লেগেছে অনেক আগে। সে আবার রাস্তা-ঘাটের কি হোটেলের খাবার খেতে পারে না। এই নিয়ে রশিদের ও কত অনুযোগ। ফারাহকে নিয়ে সে বাইরে কোথায়ও গেলে, তাঁকে একা-ই খেতে হয়। নিশ্চুপ ফারাহ প্রিয় মানুষটার একাকি খাওয়া দেখে কষ্ট পায়। তীব্র মমতা নিয়ে দেখে। কিন্তু রশিদ কেন জানি বিব্রত বোধ করে।

আচ্ছা, রশিদ কি ভাবে- ইচ্ছে করেই ফারাহ এমনটি করে?

ভাবনার জগতে এতটা-ই বুঁদ হয়ে আছে যে, একেবারে সামনে থেকে একটা অটোরিক্সা তীব্র আওয়াজে বেল বাজায়। চমকে উঠে দিশে হারিয়ে ফেলে ফারাহ। অটো রিক্সাটি প্রাণপনে চেষ্টা করেও তাল সামলাতে পারে না। এক পাশের চাকার আঘাতে ফারাহ গলির মোড়ের চা;র দোকানের সামনে পড়ে যায়। একটা আতংক, ভয় আর ব্যথার সম্মিলিত ভজঘট অনুভবের ভিতরে সবকিছু ফারাহর কাছে ধোঁয়াশা লাগে। রিক্সাওয়ালা রিক্সা উলটে রাস্তার অন্য পাশে পড়ে আছে। চা’র দোকানদার নিজের জায়গায় বসে বসে সব দেখে। এইটুকু সময়ের ভিতরে ফারাহ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সেখানে বিকৃত আনন্দের ঝিলিক দেখতে পায়। স্যাডিস্ট ব্যাটা নিশ্চয়-ই। পথচারি দু’একজন রিক্সাওয়ালাকে বকা এবং গালিগালাজ দিতে থাকে। তবে রাস্তায় পড়ে থাকা ওদের দু’জনকে একটু সাহায্য করতে কেউ-ই এগিয়ে আসে না।

– নিন, আমার হাতটি ধরুন। উঠুন।

বক্তার কথায় উপরের দিকে চোখ তুলে তাকায় ফারাহ। এক সুদর্শণ হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে। বাম হাতে তখনো তাঁর জ্বলন্ত সিগ্রেট। ডান হাত বাড়িয়ে রেখেছেন ওর জন্য। ফারাহর দৃষ্টি বাম হাতের সিগ্রেটের উপর দিয়ে ঘুরে আসতেই বক্তা একটু লজ্জা পায়। আলগোছে জ্বলন্ত সিগ্রেট হাত থেকে রাস্তায় পড়ে । পায়ের পাতার চাপে ক্যানসার স্টিকটিকে পিচের সাথে মিশিয়ে দিয়ে তিনি বলেন,

-স্যরি ম্যাডাম। উঠুন।

শিহাব নামের এই ভদ্রলোকের হাত ধরে ফারাহ উঠে দাঁড়ায়। উঠতে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা অনুভব করে। শিহাবের ধরে থাকা হাতে ধীরে ধীরে চাপ বাড়ে। একটু অবাক হলেও শিহাব বুঝতে পারে মহিলা বেশ ব্যথা পেয়েছেন। সে চা’র দোকানের বেঞ্চটির কাছে নিয়ে যায় ফারাহকে। একটু আগে তাঁর স্বামী রশিদ যেখানে বসেছিলেন, সেখানে বসে ফারাহ। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে শিহাবের দিকে তাকায়। মনে ভাবে এইটুকু সাহায্য না পেলে হয়ত রাস্তা থেকে সে উঠতেই পারত না। চকিতে অন্য একটা ভাবনায় কেন জানি ভিতরের ফারাহ লাল হয়ে উঠে।

স্কুলে যাওয়া-আসার চলার পথে শিহাব নামের এই মানুষটির সাথে দেখা হলেও এভাবে কখনো কথা-বার্তা হয়নি ওর। শিহাব ও কখনো চোখে চোখ পড়লে চোখ নামিয়ে নিজের মনে চলে গেছে। অন্য পুরুষদের মত না সে। আজ হাত বাড়িয়ে দেয়া এবং এরপর ফারাহর সেই হাত শক্ত করে ধরায়, লোকটির ভিতরের এতটুকুও উষ্ণতর কাঁপন অনুভব করেনি সে। অন্য কেউ হলে এমন সুযোগে অন্তত নারীর পেলব ছোঁয়ার সামান্য আমেজটুকু ও উপভোগ করতে ছাড়ত না।

একটা খালি রিক্সা ফারাহর বাসার দিকেই যাচ্ছে। শিহাব রিক্সাটিকে থামায়। নীরবে ফারাহর পানে চায়। কিছু বলতে হয় না। সামান্য এইটুকু বিশ্রামে নারী দেহ তাঁর ভিতরের সহিষ্ণুতার রিজার্ভ ফাণ্ড থেকে শক্তি ধার করেছে। এবার আর সাহায্যের প্রয়োজন হয় না ফারাহর। রিক্সায় ওঠার কষ্টটুকু সহ্য করে সে মনের দাঁত চেপে। মুখে ম্লান হাসিটুকু তবু লেগে থাকে। এভাবেই আমাদের নারীরা প্রতিটি পদে পদে পুরুষদেরকে নিজের কষ্টগুলি বুঝতে দেয় না। কষ্ট-ই যদি সহ্য করতে না পারবে, তবে ঈশ্বর নারীকে ‘মা’ বানাতেন না!

রিক্সায় উঠে ফারাহ আর একবার শিহাবের দিকে তাকায়। চোখের তারার আলোয় সে সামনে দাঁড়ানো সুদর্শন পুরুষটিকে বিদায় জানায়। হাসে শিহাব। রিক্সাওয়ালা রিক্সার হুড ফেলতে চাইলে ফারাহ নিষেধ করে। থাক না অন্তত এইটুকু পথ উন্মুক্ত। এ দেশে নারীকে সবসময় ঘেরাটোপের ভিতর রেখে দেবার যে প্রবণতা আমাদের অণূতে অণুতে মিশে রয়েছে, আজ কেন জানি সেটার বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদমূখর অনুভবের সামান্য ঝলক,ওর এই হুড খোলা রাখতে চাওয়ার ভিতরে প্রকাশ পায়।

শিহাব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ফারাহর চলে যাওয়া। বাতাসে ওর চুল উড়ে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজের দিকে তাকায় শিহাব। কি দেখে? পর নারীর শরীরের সাথে সামান্য স্পর্শে ওর ভিতরের কালো সাপ ঠিক কতটুকু জেগে উঠেছে, সেটাও অনুভব করে কি?

৩.
চাঁদেরকণায় ছুঁয়ে থাকা রাতের প্রহরগুলিতে শরীরের সাথে শরীরের মাখামাখি, আদিম হিংস্রতায় জমাট বাঁধা বুনো শিল্পকলায় মেতে ওঠা এক জোড়া নরনারী। ছায়ার উপর থেকে কায়া বার বার স্থান পরিবর্তন করে নিজেদেরকে নিজেদের মতো ফিরে পেতে। নিজেকে ফিরে পাওয়া যায় কি?

যায় না বলেই হয়তো ফিরে যাই আমি শিহাব ফারাহ’র কাছে। ওকে একান্ত কাছে পাবার সময়গুলিতে কেমন এক অপরাধবোধ জাগে মনে, ‘আমাদের সম্পর্কটাকে কিভাবে দেখবো? একি ভালোবাসা নাকি প্রেম- কীভাবে ব্যাখ্যা করবো?’ সেদিন রাস্তায় পড়ে যাওয়া ফারাহকে হাত ধরে তুলতে গিয়েই মনের ভিতরের সুপ্ত আগুনে পুড়ে গিয়ে যে সম্পর্কের সূচনা, এরপর অনেকগুলি রাত, নিঃসংগ বিকাল এবং বিষণ্ন দুপুরে আমরা মনকে দূরে ঠেলে শরীরে জড়িয়ে গেলাম ধীরে ধীরে! নিজেরা নিজেদের শরীরকে ওলটপালট করে খুঁজেছি উদভ্রান্তের মতো; কিন্তু কি খুঁজতে চাই আদৌ সেটা ভাবিনি একটুও।

একি ভালোলাগা? ভালোবাসা? নাকি প্রেম!
ভালোবাসা হলো মনের মিলন। বাবা-মেয়ে, ছেলে-মা কিংবা বাবা-ছেলে কিংবা মেয়ে-মা একে অন্যকে ভালোবাসে। এখানে ভালোবাসা হলো এদের ভিতরের মন ও আত্মার সম্পর্ক। যেখানে দেহের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু প্রেম হলো ভালোবাসা সহ শারিরীক এবং জৈবিক সম্পৃক্ততা।

ফারাহ’র চোখের নীল জোছনা, ওর বুকের উপত্যকার আতরের ঘ্রাণ, আমাকে ক্ষণে ক্ষণে প্রলুব্ধ করেই চলে। আমার রাতের প্রহরগুলি এখন চাঁদের কণায় ছুঁয়ে যাওয়া। আমরা প্রেম করি… ভালোবাসি না… ফিরেও আসি না।

হায় প্রেম!

মামুনের জোড়া অণুগল্প

**

এক পাতা ঝরার দিনের বিশেষ একটি মুহুর্তে, দু’জনে সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘নাহ, এভাবে সম্পর্কটিকে আর ঝুলিয়ে রাখব না।’ প্রায় বছরখানিক হল ওর সাথে আমার প্রেম। দু’জনে নিজেদেরকে এই সময়ের ভিতরে জেনে-বুঝে অনুভবে হ্যা-বোধক অনুভূতির অনুরণনে নিজেরা বিলীন হয়ে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম।

সেদিনই সম্পর্কটিকে ‘দু’জনময়’ করে তুলতে আমরা জীবনের মহাশূণ্যে ঝাঁপ দিয়েছিলাম.. দীর্ঘদিন ভেসে বেড়িয়েছি দু’জনে.. পাশাপাশি!

আরেক ফাগুনের এক বিষণ্ন বেলায়, আমার সাথে ভেসে ভেসে ক্লান্ত সে, একা একা ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি শুনতে দিক পরিবর্তন করলো।

সেই থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে একাকী ভেসে চলেছি নিঝুম নিমগ্ন সুখে।

একজন মানুষ আজীবন একাকী!

#দুটি_পথ_গেছে_বেঁকে_অণুগল্প_৪৮২

**
সৌন্দর্য্য একাধারে নারীর অলংকার এবং অহংকার।
পুরুষের পৌরুষ।

দুইয়ের মিলনে হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ মানুষ!

#পরিপূরক_অণুগল্প_৪৮৩

অণুগল্প : মধ্যবর্তী_বাবা

রাহাতের দিনগুলো ঘড়ির কাটা ধরে কেটে যাচ্ছে। শনি থেকে শুরু হয়ে সেই বৃহস্পতিবারে এই রুটিন শেষ হয়। তাও একদম রাত দশটায়। নিজের পরিবারের সকলে কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে এক জায়গায়, বউ ছেলেমেয়ে আর এক জায়গায়। বাবা-মা ভাইয়েরা অন্য আর এক জায়গায়। এদের সকলের সাথে যোগাযোগ বলতে গেলে সেই এক বিনা তারে কথা বলা।
মোবাইল।

রেখা আগে প্রতিদিন কয়েকবার কথা বলতো। এখন সপ্তাহে কদাচিৎ দু’একবার কথা হয়। তাও ঠেকে গেলে। মোবাইলে টাকা ভরে দিও তো (রাত দশটায় মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলে)। মেয়ে পিম্পি যখন ওর ক্লাশের পড়ালিখায় আটকে যায়, তখন বাবাকে ফোন করে। ইংরেজী কোন শব্দের মানে বুঝছে না কিংবা কেমিস্ট্রির কোনো সংকেত নিয়ে সন্দিহান, তখনই বাবার কাছে জানতে চায়। আর ছোট ছেলে বৃহস্পতিবারে ওর জন্য কোন খেলনাটা নিয়ে আসতে হবে সেটা বলে দেবার জন্য বাবাকে মনে করে। সপ্তাহব্যাপী প্রচণ্ড শারীরিক এবং মানসিক কষ্টে রাহাত বউ, ছেলেমেয়েকে মনে মনে কাছে পাবার চেষ্টা করে। ওরা কি ওদের এই প্রিয় মানুষটির জন্য একটুও কষ্ট অনুভব করে?

নিজে যখন রাহাত ওদেরকে ফোন করে, ওদের ফোন বেজে চলে। ওপাশের মানুষগুলো রাহাতের ফোন রিসিভ কেন করে না? নিজের আব্বাকে বা আম্মাকে ফোন করলে দুটো কি তিনটে রিঙ হবার সাথে সাথেই ওনারা ফোন ধরেন। তাঁরা কি রাহাতের ফোনের অপেক্ষায়-ই থাকেন? অথচ তাদেরকে সেভাবে ফোন করা হয়ে উঠে না।

হঠাৎই রাহাত নিজেকে এক বিরানভূমির মাঝে আবিষ্কার করে। দু’পাশের দিগন্ত বিস্তৃত মরুভুমির এক পাশে নিজের পুর্বপুরুষ, অন্য পাশে উত্তরপুরুষ। সে উত্তরপুরুষের দিকে একটু বেশী ঝুঁকে থাকলেও তারা ওর দিকে কেন জানি ঝুঁকতে চায় না। আর পুর্বপুরুষ ওর দিকে মুখিয়ে থাকলেও রাহাতের সেদিকে ফিরতে কেন জানি আলসেমিতে ধরে। এক বাবা ওর দিকে ফিরে থাকে… সে অন্য এক ছোট বাবার হৃদয়ের উষ্ণতাকে পাবার জন্য- ওর দিকে ফিরে থাকা বাবার হৃদয়কে এখন আর আগের মত অনুভব করতে পারে না।

পারে না? না কি চায় না?

সে নিজে আজ একজন বাবা। সপ্তাহব্যাপী একাকীত্বকে শেষ করে যখন নিজের ছোট বাবার কাছে ফিরে যায়, নিজের বড় বাবার কষ্টটা বাসায় ফিরবার পর নিজের এক দিনের মিলনের আনন্দ উপভোগ করার সময়ে চকিতে অনুভব করে। কিন্তু বড় বাবার কাছে ছেলে হিসেবে ফেরাটা কি আসলভাবে হয়? আদৌ কি ফেরা হয়?

তিনপুরুষের এই চিরন্তন মায়াবী খেলায় রাহাত নামের এক মধ্যবর্তী বাবা নিজেকে বড্ডো অসহায় ভাবে উপলব্ধিতে অনুভব করে নিরন্তর ছটফট করে।

____________________
#মধ্যবর্তী_বাবা_অণুগল্প_৪৭১

ব্যাধি_অণুগল্প

একজন লেখক তার জীবনকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে সাজাতে পারেন। এক একটি অণুগল্প – লেখক জীবনের মুহূর্তগুলোর খন্ডাংশ! নিজের জীবনের অণুগল্পগুলো লিখা শুরু করা দরকার। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে, ভেবে পায়না আমান।

চলমান সময় এক ব্যাধি। সময়ের বুক খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেকে কি নির্বিকার ভাবেই না খেয়ে ফেলছে। ব্যাধি আমানের নিজের শরীরেও বাসা বেঁধেছে। ওর নিজের শরীরের পুষ্টি পেয়ে ধীরে ধীরে ওকেই শুষে নিচ্ছে।

সবসময়ে আমানের সাথেই এমন কেন হয়?

নক্ষত্রখচিত এক নিশ্চুপ আকাশ। থমকে থাকা সময়ের আঁচল ছেড়ে ছুটে আসা দমকা বাতাসের এলোমেলো তোড়ে আমানের চিন্তাস্রোত একটু হলেও যেন এলোমেলো হয়। বেডসাইড টুলের ওপর ছবির একটি ফ্রেম। ওখানে স্মৃতিদের বন্দী করার এক অপচেষ্টা।
স্মৃতিদেরকেও কি বন্দী করা যায়? বন্দী স্মৃতিরা কি ভাবে? আমানের এই মুহুর্তে খুব জানতে ইচ্ছে হলো।

পাশের ফ্ল্যাটে গান বাজছে। এক প্রেমিক পুরুষের হৃদয় নিঙড়ানো শাব্দিক অনুরণন বেশ জোরেই ভেসে আসে, “স্মৃতির মিনারে আজনম, তাই তোমাকে প্রয়োজন ” … …।

রুমুই কি আমানের সেই তুমি? তাকে কেন প্রয়োজন? সে কি নেই? চলে গেছে? চলে যাওয়া মানুষদের ফিরে আসতে কত সময় লাগে?

একটি গান স্মৃতিকাতরতায় ভোগাবার মত কিছু মুহুর্তের জন্ম দেয়। দুপুরের ভাতঘুমে ঢলে পড়ার ঠিক আগমুহুর্তে – বুকের উপর থেকে প্রিয় কবিতার বইটিকে আলতো হাতে পাশে রাখার সময়ে তনুমন যে স্বপ্নিল আবেশে স্নিগ্ধ হয়- এই গানটির এনে দেয়া মুহুর্তেরাও তেমন এক অনুভবে আমানকে বুঁদ করে রাখে।

রুমুও কি আমানের জন্য এক ব্যধি নয়?

একটি খালি ফ্রেমে জোর করে ধরে রাখা কিছু বিশেষ সময়ের স্মৃতি..চিহ্ন.. অণুস্বাক্ষর! এরাও ইদানিং আমানকে কুরে কুরে খায়। নিজের শরীর-মনের ভিতরে-বাহিরে বাস করা কালব্যাধিদের নিরন্তর দংশনে, শ্রবণাতীত চিৎকারে এক নবীন লেখক নিজের কষ্টের কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্ত কষ্টগুলো ওকে অন্যদের মত ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। পাঠক মনে অবর্ণনীয় কষ্ট জন্মদানকারী কষ্টের স্রষ্টা আজ নিজের কষ্টকে অক্ষরে রুপ দিতে অপারগ! নিজের মনের দুয়ার খুলতে গিয়েও কেমন যেন ইতস্তত বোধ হয়। এক বিশেষ মুহুর্তের অপেক্ষা করেন।

একজন লেখকের বিশেষ মুহুর্তগুলো ঠিক কখন আসে?

“আমি যাদের যাদেরকে এই জীবনে ভালোবেসেছি, ভালোবাসার ‘বাই রিটার্ণ’ তারা আমাকে কষ্টই দিয়েছে।” ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে উন্মুখ এক ছায়ামানবের উপলব্ধি!

মানুষের জীবনে স্মৃতিরাই কালব্যাধি। এক কালবেলায় স্মৃতিকাতর এক ছায়ামানব কেন জানি এই মুহুর্তে নিজের শরীরে পুষ্ট হওয়া ব্যাধিটির জন্য অপার মমতা অনুভব করে।।

আল মামুন খানের ৩টি অণুগল্প

কেবল মানুষই আর একজন মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে। অন্য কোনো প্রাণী নিজেদের স্বজাতির সাথে কখনও এই কাজ করে না। ওরা সামনা সামনি যা করার, বলার বা দেখানোর তা করে। কিন্তু মানুষ মুখে মধু, অন্তরে বিষ এই টাইপের হয়।

বিশেষকরে আত্মীয়স্বজনদের ভিতরে এই কষ্ট দেবার প্রবণতা বেশী দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে নিজেদের কাছের লোকেরা পারিবারিক যে কোনো ‘স্ক্যান্ডাল’ বা দুর্ঘটনাকে আড়াল করে রাখবে; কিন্তু তারাই সবার আগে রয়টার কিংবা বিবিসি’র মতো মুহুর্তেই ঘটনাটি চাউর করে ফেলে।

শিহাবের একজন রিলেটিভ আছেন যার কাছে শুধু একবার মোবাইলে এই জাতীয় কোনো তথ্য জানিয়ে শেষে বলতে হবে, ‘কাউকে বইলেন না’। ব্যস! দেশের গণ্ডী পেরিয়ে ১০ মিনিটের ভিতরে সারা বিশ্বময় জানাজানি হয়ে যাবে!

এসব দেখে দেখে একজন মানুষ হিসেবে শিহাব খুবই কষ্ট পায়। একটা কথা ওর মনে বার বার উঁকি দিয়ে যায়, ‘মানুষ! তোমরা এতো পেট পাতলা কেনো?’

শিহাব একবার একটা হিন্দী সিনেমা দেখেছিলো- সেখানে পরেশ রাওয়ালের কাছে কেউ কোনো কথা বললে, সে অন্য কাউকে তৎতক্ষনাৎ সেই কথা না বলতে পারলে, তার পেট ফুলে যেত। এ জন্য সে মানুষ ছাড়া অন্য যে কোন পশু-পাখী বা গাছপালার কাছে গিয়ে সেই ঘটনাটি বলে দিতো।

এক বিশাল জনসভা ডেকে, সবার উদ্দেশ্যে শিহাবের বলতে ইচ্ছে করে, ‘ভাই সব! আপনাদের ভিতর যাদের এই বিশেষ স্বভাবটি রয়েছে, দয়া করে পরেশ রাওয়ালকে অনুসরণ করবেন। তাতে করে আপনাদের আত্মীয়স্বজন সহ অন্যরাও শান্তিতে থাকবে।’

#পেট_পাতলা_মানুষ_অণুগল্প_৪৭২

_________________________

এক বউ দিবসে ফুরফুরা মেজাজ নিয়ে শিহাব কোনাবাড়ী থেকে একটা ম্যাক্সিতে চড়ে চন্দ্রার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হয়েছিলো। তাই যাত্রাপথে আর কোনো চিন্তা নাই। শীতকাল হওয়াতে সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি হয়। এজন্য অন্য ঋতুর মত বৃহস্পতিবারে মাগরিবের নামাজ কাজা হবার কষ্টটা নেই।

একটু ক্ষিদে পেল। তবে রাস্তার খোলা খাবার খাওয়ার অভ্যাস শিহাবের নেই। বাদাম জাতীয় কিছু পেলেও না হয় খাওয়া যেত।

চন্দ্রা নেমে স্ট্যান্ডে এক বাদাম বিক্রেতাকে পেলো। ওর কাছ থেকে ২৫০ গ্রাম বাদাম কিনলো। কাগজের ঠোংগায় বাদাম নিয়ে বিআরটিসি’র দোতলা বাসের উপরের তলায় উঠে একেবারে সামনের দিকের সিটে বসে। সবার উপরে থাকার একটা মজাই আলাদা। এটা যে থাকে সে-ই কেবল বুঝতে পারে। এই উপরে থাকা নিয়েই না দেশের সকল রাজনৈতিক সংকট।

বাদাম খাবার নিয়ম হল আগে ঠোঙ্গা থেকে সব বাদাম নিজের যে কোনো একটা পাত্রে (নিজের পকেটও হতে পারে) রেখে খাবার সময় খোসা গুলো সেই ঠোঙ্গায় রাখা। তাহলে আর বাদামের খোসায় আশপাশ নোংরা হবে না। চলার পথে শিহাব অনেককেই দেখে, বাসের ভিতরে বিদ্ঘুটে আওয়াজ করে বাদাম চাবায় আর এখানে সেখানে খোসা ফেলে। বাদামের লাল রঙের আবরণটাও ফু দিয়ে মানুষের শরীরে ফেলে। এরাও এক ধরণের গিদার। এদেরকে ‘বাংলা ওয়াস’ করা দরকার।

বাদাম খাবার নিয়মানুযায়ী, বাদামের খোসা রাখতে গিয়ে, কাগজের ঠোঙ্গায় একটা লেখার দিকে শিহাবের চোখ পড়ে। লাল কালি দিয়ে সেখানে লেখা,
Read My Lips

ভালো করে এবার ঠোঙ্গাটি চেক করে বুঝলো, এটা একটি প্রেমপত্র, যা এখন বাদামের ঠোঙ্গা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রেমপত্রটির ঠিক মাঝখানে ‘লিপস্টিক’ জাতীয় কিছু দিয়ে কোন প্রেয়সীর ঠোঁটের ছাপ আঁকা রয়েছে। হয়ত কোন এক প্রেমিকের জন্য একজন প্রেমিকার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল এই চিঠি, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

ব্যর্থ ভাবনাটি এজন্যই এসেছে; কারণ যদি সফল প্রেম হতো, তবে আজ এই চিঠিটি এভাবে বাদামের ঠোঙ্গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো না। কারো হৃদয়ের গোপন জায়গায়, খুব নিরাপদ একটি স্থানে এই চিঠিটির আজ থাকার কথা।

কারো গোপন চিঠি পড়া ঠিক নয় জেনেও চিঠিটি পড়লো শিহাব (যেহেতু বাদাম কেনার কারণে ক্রয়সূত্রে ঠোঙ্গাটিরও মালিক হয়েছে সে)। দু’একটি লাইন এমন ছিলো,

“ তুমি অবশ্যই আজ রাত ১০টার পরে ফোন করে আমাকে তোমার সিদ্ধান্তের কথা জানাবে। অনেক কিছু লেখার ছিলো, কিন্তু পারছি না। ঠান্ডা মাথায় আমার কথা, সমস্যার কথা, ভবিষ্যত জীবনের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেও… … … তোমার চিন্তায় আমার আর পড়াশোনা হবে না ”

চিঠির মালকিনের জন্য শিহাবের হৃদয়ে একটু কষ্ট অনুভব করলো। ভাবনায় উন্মুখ হলো একপলক, ‘শেষ পর্যন্ত কেন চিঠিটি পেলোনা যার পাবার কথা ছিল?’ কিংবা ‘যে পেয়েছিলো সে-ই হয়তো বাদামের ঠোঙ্গা চিঠিটির জন্য উৎকৃষ্ট স্থান ভেবেছিলো!’

একটা বড় কষ্টের স্রোত কোথা থেকে জন্ম নিয়ে শিহাবের হৃদয়ের দিকে ধাবিত হয়… দোতলা বাসটিও যেন তুমুল বেগে সেই গতির সাথে পাল্লা দিয়ে সাভারের দিকে এগিয়ে যায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে, ‘তুমি অবশ্যই আজ রাত ১০টার পরে ফোন করে আমাকে তোমার সিদ্ধান্তের কথা জানাবে’… কি ছিলো সেই সিদ্ধান্ত? যার জানানোর কথা সে কি জানিয়েছিলো? কারও শেষ চিঠি কেনো বাদামের ঠোঙ্গায় পরিণত হয়?

কাগজের ঠোঙ্গা হিসেবে ব্যবহৃত এক মলিন প্রেমপত্রকে কেন্দ্র করে, অনেকগুলি জিজ্ঞাসা চিহ্ন পিচ্ছিল ব্যাংগাচির আকৃতি ধারণ করে, শিহাবের ব্রেইণে ঘুরপাক খেতে থাকে।

#শেষ_চিঠি_অণুগল্প_৪৭৩

____________________

মেয়েদেরকে অপমান করা যায় না, শুধু ভালবাসা যায়।
আবার তাদের অপমান সহ্য করাও দায়।

ফাটা বাঁশে আটক শিহাব ভাবে, ‘আমি আমার একাকী জীবনেই খুব ভাল ছিলাম।’

#শাঁখের_করাত_অণুগল্প_৪৭৪

কুকুরছানা

– তপু, তপু…
ডাকতে ডাকতে বাবা বাড়িতে ঢোকেন।
মা-ও তপুকে ডাকেন। বলেন- দেখ্, বাবা তোর জন্য কী নিয়ে এসেছেন! তপু—

কিন্তু তপুর কোনো সাড়া নেই।
গতকাল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা কুকুরছানাটিকে নিয়েই সে ব্যস্ত। তার পড়ার ঘরের সামনের ছোট্ট বারান্দায় বসে ছানাটিকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে তপু।

গতকাল বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল তপু। হঠাৎ রাস্তার পাশে কুকুরছানাটিকে কেঁউকেঁউ করতে দেখে খুব মায়া হয় তার। আদর করে কোলে তুলে নেয়। বাড়ি নিয়ে আসে।
কিন্তু বাড়িতে আসতেই বাবা-মা’র বাধার মুখে পড়তে হয়। কেউই রাস্তার কুকুরকে ঘরে তুলতে রাজি নয়।
– ওটা আবার এনেছিস কেন? যা আবার রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আয়।
বিরক্তির সাথে মা বলেন।
বাবা বলেন- ওসব দেশি কুকুর ঘরে তুলতে নেই বাবা। তোমার কুকুর পোষার শখ? তো ভাল দেখে একটা বিদেশি কুকুর এনে দেব। তুমি ওটাকে বাইরে রেখে এসো। যাও।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। তপু কুকুরছানাকে কোলে করে সোজা চলে গিয়েছিল তার পড়ার ঘরে। আদর করে বিস্কুট খাইয়েছিল। ভাতও দিয়েছিল খেতে। রাতে হার্ডবোর্ডের একটা বড় বাক্সে মধ্যে শুইয়ে রেখেছিল।
মা ছেলের পাগলামি দেখে বাবাকে বলেছিলেন- কালই তুমি ওর জন্য একটা বুলডগ এনে দিও। নয়তো ওই রাস্তার কুত্তাকে ও কিছুতেই ছাড়বে না।

আজ রবিবার। স্কুল নেই। তাই সকাল হতেই সে কুকুরছানাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বাবা মা তপুকে ডাকতে ডাকতে দোতলায় তার পড়ার ঘরের দিকে এগিয়ে যান। বাবার হাতে গলায় শেকল পরানো ছোট্ট একটা বুলডগ।
মা বলেন- দেখ্ তপু, বাবা তোর জন্য কি সুন্দর একটা বুলডগ এনেছেন।
তপু দেখে। সত্যি তো খুব সুন্দর দেখতে। ধবধবে সাদা বড়বড় লোমে ভরা সারাশরীর। গায়ে হাত দেয়। বাহ্, কি নরম ওর শরীর।
বাবা বলেন- দাও ওটাকে। রাস্তায় ফেলে আসি। এটাই এখন তোমার।
তপু একবার রাস্তার কুকুরছানাটির দিকে তাকায়। দেখে- ভয়ে যেন কুঁকড়ে আছে ও। বারবার সভয়ে তাকিয়ে দেখছে বিদেশি ডগটির দিকে। আর ডগটিও সরোষে তাকাচ্ছে ছানাটির দিকে।
তপু বলে- এটাও থাক না বাবা।
মা বলেন- পাগল নাকি তুই? ওইসব দেশি কুকুর কেউ পোষে নাকি? ঘরে ওকে দেখলে লোকে খারাপ বলবে।
বাবাকে উদ্দেশ্য করে মা বলেন- যাও তো, কুত্তাটাকে বাইরে ফেলে এসো।
তপুুর বাবা কুকুরছানাটিকে ঘৃণাভরে হাতে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
খারাপ লাগলেও বাঁধা দিতে পারলো না তপু। একবার বুলডগ, একবার কুকুরছানার দিকে তাকায়।
বুলডগটির শেকল হাতে ধরে। হঠাৎ তপুর কানে ভেসে আসে সেই কেঁউকেঁউ শব্দ।
তাকিয়ে দেখে – কুকুরছানাটি গেটের বাইরে রাস্তার পাশে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে অসহায় চোখে তপুদের বাড়ির দিকে চেয়ে আছে।

প্রেজেন্ট এ্যাপস্ // রুকসানা হক

ধূপছায়ার কঠিন জেদ।
ঃ মায়ের কথা বলো।
ঃ সেই গল্পটার কথা মনে আছে তোমার ? ওই যে…..
নিঝুম এড়িয়ে যেতে চায় ধূপের জেদ। ধূপ ফের বলে।
ঃ মায়ের কথা বলো।
ঃ….. চাঁদ হারিয়ে গেলে যে রাত পড়ে থাকে….
কথা শেষ হয়না নিঝুমের, ধূপ কঠিন গলায় বলে
ঃ গল্পের কথা অনেক শুনেছি। এবার একজন মায়ের গল্প শুনতে চাই।

আকাশের দিকে তাকালো নিঝুম। নিঃশব্দে সন্ধ্যার আলোআঁধারি আকাশে মেঘের তোলপাড় গুনলো। মেঘেরা খন্ডিত হয়, টুকরো টুকরো হয়, তবুও ভাসে। খুব কষ্ট হলে মাটির কাছে জল গুলো জমা রাখে।

নিঝুম মেঘ হয়, খন্ডিত হয় ধূপের কথায়। জল হয়ে ঝরতে চায়। মাটি খুঁজে পায় না। তার পায়ের তলায় রাশি রাশি কংক্রিট।
আনমনে বলে ওঠে
ঃ মা মানে কয়েকটি সন্তানের জননী। মানুষ করার নামে মা ই তাদেরে অমানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
অবাক বিস্ময়ে তাকায় ধূপ। ঘোর লেগে যায়
ঃ মা কোথায়?
ঃ এখানে বা ওখানে ধুঁকে ধুঁকে মরছে।
ঃ সন্তানেরা?
ঃ ব্যস্ত। সব মা সন্তানদের ব্যস্ত বানাতেই তো চায়।
ঃ হ্যাঁ, ব্যস্ত মানুষ বানাতে চায়।
ঃ ব্যস্ততা তাদেরে আর মানুষ রাখে না। ওরা যন্ত্র হয়। অনুভূতি শূণ্য কিছু অমানুষ।

ধূপছায়ার মায়ের ম্যাসিভ এটাক হয়। নিঝুম ভাবে এমন একজন মা যার কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত সন্তান থাকা সত্ত্বেও তিনি পরনির্ভর আজ। গৃহকর্মীদের কাছে থাকেন। সন্তানেরা ব্যস্ততার অজুহাতে মাকে দেখতে আসে না। তিনি জগত সংসারে এখন একা।

নিঝুমের কষ্ট হয়। নিজের মাকে মনে পড়ে। মা এখন কোথায়? সে জানে সব; তবুও অজানার কাছে নতজানু হয়।
ছয় বছরের নিঝুম কোন এক লাল বেনারসি দেখে একা হয়েছিল। ট্রেনের শেষ হুইসেলের মতো বেনারসির আঁচল দুলিয়ে মা সেই অজানায় হারিয়ে গিয়েছিল তার।

এখন আর মাকে ভাবে না সে। বাবার মৃত মুখটাও কেমন ঝাপসা। নিঝুমের ভাবনা ছাড়িয়ে মা হয়তো দূরের কোন গাঁয় শাপলার ঝিলে অশ্রু ঝরান। মৃত বাবা সে অশ্রুতে নেয়ে পবিত্র হন। আর জীবিত বাবার বাকি সন্তানেরা মায়ের আঁচলটায় গিঁট দিয়ে রাখে তাদের সুখের চাবি।

গাঁও গেরামের মায়েরা একা থাকেন না। তাদের সন্তানেরা বড় মানুষ হতে গিয়ে যন্ত্র হয় না। নিঝুমকে একা রেখে গেলেও মা একা থাকেন না। বছর ঘুরতেই তিনি দুকা হন, তারপর তিনকা, চারকা।

ধূপ ঢোক গিলে। সে আর মায়ের গল্প শুনতে চায় না। নীরবে পুড়তে থাকে। অপরাধী হয়।

ম্যাসিভ এটাক তার মাকে শ্বাসরুদ্ধ করতে যেয়েও পারেনি। কারণ তারা আল্লাহ্‌র নামে গরু, খাশী উৎসর্গ করেছিল। মসজিদে মসজিদে হুজুরদের দিয়ে দোয়াদরুদ ও কম করায় নি।
অসুখটা হয়তো গরু, খাশীর ভয়ে ভড়কে গিয়ে মাকে ছেড়ে দিয়েছিল এবারের মতো। বেঁচে যাওয়া এক অথর্ব মা এখন সংসারের বোঝা। সে বোঝা এতটাই ভারী যে উচ্চ শিক্ষিত সন্তানদের কাঁধটা একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো। তারা ভয় পেলো। মা তাদের সব ভয় অন্তরে গোপন করে একা হলেন।

নিঝুমের মাকে খুঁড়ে বের করতে যেয়ে ধূপছায়ার চোখে নিজের মায়ের ছবি ভেসে উঠলো। লজ্জা হলো হয়তো তার। কিন্তু তাও ক্ষণিকের। তার সহোদরেরা যন্ত্র হয়েছে তারই মতো। যন্ত্র মানেই তো অমানুষ — মনুষ্যত্ববোধহীন জড়পিন্ড।

নিঝুম হাসে, ধূপের ঠোঁট জলশূন্য হয়। ঢোক ও গিলতে পারে না আর। ছুটে পালাতে চায়। আড়ষ্ট পা দু’টোকে নাড়াতে পারে না।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নিঝুম। এবার খন্ডিত মেঘ নয়, অবিরাম জলরাশি হয়ে ঝরে। কংক্রিটে নয় মাটিতেই জল গড়ায়।

চার ভাইবোনকে দুই হাতে আগলে রাখতে গিয়ে মা নিজের অজান্তেই উঁচু প্রাচীর তৈরী করে ফেলেছিলেন। এত উঁচু যে, এই প্রাচীর টপকে মনুষ্যত্ববোধ ঘরে এসে ঢুকেনি। চাঁদ হারানো রাতের মতো তাই তিনি এখন একা।

ঃ মায়ের কথা শুনতে চাও না ধূপ?
ঃ চুপ করো।
ঃ কষ্ট না লজ্জা?
ঃ চুপ করো নিঝুম।
ঃ যার মায়ের দু’বার লাল বেনারসি পরার ঘটনা ঘটে এবং তার একবার নিজ সন্তানের সামনেই ঘটে, সেই হতভাগা সন্তানের কথা অন্তত জেনে যাও।
ঃ আমি আর শুনতে চাই না।
কান্নায় ভেঙে পড়ে ধূপছায়া।
ঃ ধূপ আমার মতো সন্তানরা শুধু নয়, ব্যস্ত সন্তানরাও দুর্ভাগা হয় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো এখন ?
ঃ নিঝুম আমি আর পারছি না।

কিভাবে পারবে ধূপছায়ারা ! তাদের সে ক্ষমতা লুপ্ত। ধূপছায়াদের দুর্ভাগ্যকে মানিয়ে নিতে গিয়ে সব মায়েরা আজ অসহায়। শুধু অসহায়ত্বের ধরণটা ভিন্ন।

নিঝুম খোলা আকাশের নীচে পথ চলে। চলতে চলতে কখন যে ট্রেন লাইনের পাশে এসে দাঁড়ায় বুঝতে পারে না। কু ঝিক ঝিক ট্রেনটা কোন এক গাঁয়ের পাশ দিয়ে চলে যায় প্রতিদিন, যেখানে শাপলার ঝিলে আজো নোনা জল গড়ায়।
আর ধূপ ! সে তো আটকে থাকে টাইম মেশিনের স্থবির প্রেজেন্ট এ্যপস্ এ।

কারে_দেখাবো_মনের_দুঃখ_গো_অণুগল্প

কৃষ্ণচুড়ার লালে চারিদিক বর্ণীল। সবুজের কিছু কিছু ঝলক উকি দিয়ে গেলেও, লালের আগ্রাসী প্রখরতায় ওরা বড্ড নিষ্প্রভ।

এই গাছের নিচে-দীঘির পাড়ে, বসে আছে একজন। নিষ্প্রভ.. বর্ণহীন.. ঝরাপাতার বিবর্ণতায় একজীবনের সকল দু:খকে বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ কিছু সময় আগেও ওর জীবন ছিল উচ্ছল- ছল ছল নদীর ঢেউয়ের মতো আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাওয়া বল্গাহীন গতিময়তায়।

যে কোনো কারণেই হোক, নীলার সম্পর্কটা এই কিছুক্ষণ আগেই ভেঙ্গে গেলো! রাসেল নিজেই হৃদয়ের লেনদেন চুকিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। ভালোবাসা কি ফেরতযোগ্য?

তাই তো করে দেখালো রাসেল। দু’জনের হৃদয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভালোলাগার পলেস্তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, যার যার হৃদয়ের অন্যের অংশটুকু খুব ভালোভাবেই নিতে এসেছিল সে! নিজেরটুকু নিয়ে চলে যেতে পেরেছে ভেবে কি এখন তৃপ্ত রাসেল? ওর হৃদয়ে নীলার ভালোবাসার একটুকুও কি ফেরত দিতে পেরেছে সে? ভালোবাসা কি এতই ঠুনকো?

ফাগুনের এই আগুন জ্বলা ভরদুপুরে, এক এলোকেশীর চুলকে নিয়ে উদ্দামতায় মেতে উঠেছে লিলুয়া বাতাস। তাতে যদি ওর বুকের জ্বালা একটু কমে। নিজের চোখের জলে বুক ভেসে যায় নীলার… কিন্তু হৃদয় নামের বিমূর্ত অবয়বে বেদনার পাখিরা কি ওই আগুন জলের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠে দূর আকাশে ডানা মেলে? দুঃখগুলো হারিয়ে যায়? একসময় রাসেল নীলার চুল নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতো! হঠাৎ মনে পড়ে নীলার।

এক নীলাম্বরী, তার নীল বেদনাগুলি চোখের অশ্রু দিয়ে মেপে ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করতে চায়। একটু হাল্কা হতে চায়। ভাবে- ওর ভালোবাসা কি তবে গভীর ছিল না?

ভালোবাসার মানুষকে ধরে রাখতে হলে, কতটা ভালোবাসতে হয়? অন্তরের দুঃখ- ব্যথা কি কিছু দিয়ে মাপা যায়! তেমন নিক্তি কি এই পৃথিবীতে আদৌ রয়েছে?

ভালোবাসা এমন শাঁখের করাত যা যেতে আসতে কেবল যন্ত্রণাই দিয়ে থাকে। তাই বলে কি কেউ ভালোবাসে না? বাসবে না?

বিষণ্ন এক দুপুরে, নিজের মনে এক নিঃসঙ্গ নারী, একা একা ভাবতে থাকে – জীবনের আর কতটুকু সময়?

________________________________
#কারে_দেখাবো_মনের_দুঃখ_গো_অণুগল্প_৪৬২

অণুগল্পঃ মধ্যরাতের সূর্য

দরজার অন্যপাশ থেকে জাভেদ এমন মুগ্ধতা নিয়ে তাকালো যে টুনির চোখ ভিজে এলো। এন্ড্রোপজ, মেনোপজের বয়স দুজনেরই। এমন বয়সে কী এতো ভালোবাসা হয়? প্রশ্নটা অবশ্য সে বেশ কবার করেছে। প্রতিবারই জাভেদের এক জবাব, “চোখে অন্তরের আলো ফেলে আমি তোমাকে দেখি; এই দুনিয়ার কোন কিছুই আমি তোমারচে সুন্দর দেখিনা!”

ঘরে প্রবেশ করে জাভেদ ডাইনিং এ বসলো। বিকেল চারটায় স্কুল শেষ করে পরপর তিনটা বাড়িতে সে টিউশনি করেছে। নন-এমপিও ভুক্ত স্কুলের শিক্ষক; টিউশনি করেই যেটুকু হয়। বউ এর শুকনা মুখ দেখে সে বিষন্ন হলো। এটা অবশ্য নতুন কিছু না। এতো অনটন; কিন্তু কারো কাছ থেকে কোনদিন সে বাকিতে কিছু নেয়না। জাভেদ বুক ফুলিয়ে বলে, “আমার টুনি আছে; আমি কেন মানুষের কাছে অবনত হবো”?

বাজারের ব্যাগ হাতে জাভেদ বের হয়ে গেল। পকেটে মাত্র কুড়ি টাকার একটা নোট। আজ অক্টোবরের ২৮ তারিখ; অথচ সেপ্টেম্বরের বেতনও কেউ দেয়নি। জাভেদ ভাবলো, আজ সে নিজ থেকে চাইবে। তাই প্রথমে স্টুডেন্টদের বাড়ি গেলো। তাদের কেউ একজন যদি টিউশন ফি দেয় তা দিয়ে বাজার করবে। পারলে অল্প কিছু পোলাও এর চাল, সব্জি এবং একটা ব্রয়লারের মুরগি। টুনির ঠান্ডা লেগেছে; কাল রাতে সে ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারেনাই। ঘরে তার ব্লাড প্রেসারের ওষুধও নাই। ওদিকে এক সপ্তাহ আগেই টুনি বলেছিল, ২৯ অক্টোবরে কিছু ভালো মন্দ রান্না করবে। দিনটা বিশেষ কিনা!

পর পর চারজন স্টুডেন্টের বাড়িতে জাভেদ কোন সাড়া পেলোনা। সে আরো বিষন্ন হলো। আর চেষ্টা না করে বাজারে একটা চক্কর দিয়ে সে বাড়ি ফিরে গেলো।

জাভেদের হাতে খালি ব্যাগ। কিন্তু তার বুক পকেটে টুনির জন্য সদাই; সান্দারপল্লী থেকে পনের টাকায় কেনা এক পাতা লাল টিপ।

আজ চুলা জ্বলবেনা। কিন্তু সেদিকে টুনির তেমন ভ্রুক্ষেপ নাই। কারণ তার সম্মুখে দন্ডায়মান এক মহারাজের বুকে এক কোটি লাল সূর্য জ্বল জ্বল করছে। পনের টাকার মহারাজারা দেবতার চে শক্তিশালী হয়!

চায়ের সাথে ওরা শুকনো মুড়ি খেলো। রাত একটু গভীর হতেই টুনি ঠোঁটের কোণে হাসি মেখে বললো, “রাত একটু বাড়লেই ২৯ তারিখ হবে। চলো বাইরে যাই।“ কপালের কাঁচাপাকা চুল সরাতে গিয়ে জাভেদ দেখলো, টুনির অনেক জ্বর। একটু বিস্ময় নিয়ে সে জানতে চাইলো, “কোথায় যাবে”?

“নদীর নির্জন চরে। তোমার সুবর্ণ দিনে আমি মধ্যরাতের সূর্যে পুড়বো”;
টুনি জবাব দিলো।

ঘুড়ি-লাটাই

– কি রে, অমন মন মরা হয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে?
– কিছু না।
– চল, একটু ঘুরে আসবি।

কথা হচ্ছে ঘুড়ি আর লাটাইয়ের মধ্যে। ঘুড়ির মনে সবসময় একটা পরাধীনতার যন্ত্রনা। স্বাধীনভাবে উড়তে না পারার কষ্ট। যেই সে পাখা মেলে মুক্তির আনন্দে আকাশের নীলে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, ভেসে যেতে চায় অজানার সীমানায়, অমনি লাটাইয়ের টান। বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হয় লাটাইয়ের কাছে।
দুঃখ-ক্ষোভ আর অভিমানে ঘুড়ির মনটা বড্ড বিমর্ষ হয়ে যায়। কিন্ত তার তো কিছু করারও নেই। সুতো যে বাঁধা ওই লাটায়ের সাথে।

সেদিন সবে উড়াল দিয়েছে ঘুড়ি। ভাবছে আজ অনেকদূর যাবে। উড়ে উড়ে দেখবে অনেককিছুই। সুতো ছাড়তেও শুরু করেছে লাটাই। হঠাৎ কি যে হয় লাটাইয়ের। গুটাতে থাকে সুতো। ঘুড়িকে ধীরে ধীরে নিচের দিকে আসতেই হচ্ছিল। প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল ঘুড়ি। মনের ভিতরে একটা জিদ চেপে গিয়েছিল ঘুড়ির। আর না। সুযোগ পেলেই ভোকাট্টা হয়ে যাবে সে । লাটাইয়ের সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে ও চলে যাবে অনেক অনেক দুরে। মুক্তির সুখে ভেসে বেড়াবে ইচ্ছেমত।

কিন্তু শেষপর্যন্ত নেমে আসতেই হল তাকে লাটাইয়ের কাছে। আর তখন ক্ষোভ সামলাতে না পেরে ঘুড়ি লাটাইকে বলেই ফেলেছিল- তোমার এই বাঁধন আমার আর ভাল লাগে না। যখন ইচ্ছে আমাকে নিয়ে যা খুশি করবে। ভাল্লাগে না আর।
– রাগ করিস নে ঘুড়ি। আমার এ টান তো ভালবাসার।
– ছাই ভালবাসার। আমাকে সবসময় তুমি তোমার অধীনেই রাখতে চাও। সে আমি ভালভাবেই বুঝেছি।
– না রে পাগল না। আমাদের এ সুতো সম্পর্কের। সম্পর্ক ছিন্ন করে ভাল থাকা যায় না।
– ছাড়ো তোমার সম্পর্ক। এমন পরাধীনভাবে আমি আর বাঁচতে চাই না। একদিন ঠিক তোমার সুতো ছিঁড়ে চলে যাব। স্বাধীনতার সুখে গা ভাসাব আকাশে। উড়ে বেড়াব বাতাসে। যেখানে খুশি সেখানে চলে যাব।
– না, অমন কাজ কখনও করিস নে ঘুড়ি। টানহীন বেঁচে থাকা যায় না। সে জীবন বড় বিপদের।

লাটাই সুতো ছাড়তে ছাড়তে ঘুড়িকে বলে – যা, একটু উড়ে আয়। মন ভাল হয়ে যাবে দেখবি ‘খন।

ঘুড়ি কোনো উত্তর দেয় না। ওর মনের ভেতর একটা গোপন অভিসন্ধি দানা বাঁধতে থাকে। আজ যেভাবেই হোক সে ভোকাট্টা হবে।

ঘুড়ি উড়ছে। উড়ছে। উড়ছে—
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া। আর সাথে সাথে ঘুড়িটি পাশের ঘুড়িটির সুতোয় নিজেকে জড়িয়ে নেয়। হেচকা টান দিয়ে সুতো ছিঁড়ে ফেলে ঘুড়ি। আর সাথেসাথে মুক্তির আনন্দে হো হো করে হেসে ওঠে। চিৎকার করে লাটাইকে বলে- আমি চললাম। তোমার দাসত্ব থেকে আজ আমি মুক্ত। চললাম আমার ইচ্ছেমত —-
লাটাইয়ের বুক একটা অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল। – যাস নে ঘুড়ি। বিপদে পড়ে যাবি। যাস নে।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। ঘুড়ি এখন মুক্তিপাগল। ফুরফুরে তার মন। উড়ছে। শুধু উড়ছে। অসীম যেন তাকে ডাকছে। বন্ধনহীনতার আনন্দদমকায় পাক খেতে খেতে ভাসতে থাকে ঘুড়ি। হা হা হা। কি আনন্দ! কি আনন্দ! এই জীবনই তো সে চেয়ে এসেছে এতদিন ধরে।
উচ্ছল বাতাসের ধাক্কায় ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে ঘুড়ির রঙিন কাগুজে দেহ। তবু ঘুড়ি আপ্রাণ উড়তে চায়।

হঠাৎ দমকা হাওয়ার মত্ততা থেমে যায়। ঘুড়ি আর বাতাসের ভালবাসায় ভর দিয়ে যেন ভেসে থাকে পারছে না। বৈরী হাওয়া তাকে জোর করে ঠেলে দিতে চাইছে নিচের দিকে। শত চেষ্টা করেও ঘুড়ি আর ভেসে থাকতে পারছে না। ছেঁড়া ছেঁড়া দেহের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সমস্ত ভাস-শক্তি।

নিচের দিকে তাকায়। আসন্ন বিপদের আশংকায় কেঁপে ঘুড়ির বুক। দেখে – সে যেখানে পড়তে চলেছে সেখানে অথই কালো জলরাশি। বিশাল বাঁওড়। বড্ড অসহায় বোধ করে ঘুড়ি। ভয়ে বুকের জল যেন শুকিয়ে আসছে তার। এতক্ষণে ঘুড়ি বুঝতে পারে লাটাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সে খুব ভুল করেছে। চিৎকার করে বলে – লাটাই, আমাকে বাঁচাও। আমি বাঁচতে চাই…

লাটাইও বুঝতে পারে তার প্রিয় ঘুড়ির পরিণতী কোনদিকে যেতে চলেছে। কিন্তু কিছুই যে তার করার নেই আর।

– আমি জলে পড়ে যাচ্ছি লাটাই। আমাকে বাঁ..চাও…

নিরুপায় লাটাই কুয়াশাভরা চোখে তাকিয়ে তার ভালবাসার ঘুড়ির দিকে।

অণুগল্পঃ ট্যালেন্ট-হান্ট

“গল্পকার ট্যালেন্ট-হান্ট” অনুষ্ঠানে প্রথম প্রতিযোগীর ওপর দুজন আন্তর্জাতিক বিচারক যারপরনাই বিরক্ত হলো। দেশীয় বিচারকরা এতে বিব্রত বোধ করলো।

-এখানে গল্প কোথায়? প্রতিযোগী গল্পকারের কাছে এক বিচারক জানতে চাইলো
-কেন? এই যে পঁচা গোবর স্তুপের একটা ইমো, তারপর কাঠের খড়মের ইমো, তারপর হুতুমপেঁচার ভেংচির ইমো, তারপর কুঁড়েঘরের কোণায় একটা গাবগাছের ইমো যাতে হেলান দিয়ে একটা গোবরে পোকা খড়ম পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ইমোগুলি সাজিয়ে নিন; যা দাঁড়াবে সেটাই আমার গল্প।

প্রতিযোগী গল্পকারের কথায় দেশি বিদেশী সব বিচারক কিছুক্ষণ “থ” মেরে থেকে একসাথে হো হো করে হেসে ওঠলো। তাদের কেউ একজন খুব ধীরে “স্টুপিড” বললো; তা কেউ শুনলো কেউ শুনলোনা। কিন্তু কথাটা কে বললো তা বুঝা গেলোনা।

একটু দম নিয়ে এক বিচারক প্রশ্ন করলো,
-তাহলে এটা ইমো দিয়ে বানানো গল্প?
-হ্যাঁ এবং সারাবিশ্বে একমাত্র আমিই ইমোর পর ইমো দিয়ে গল্প করছি
-বাহ; খুব ভালো। তো গল্পের নাম কি দিয়েছেন?
-কেন? নাম তো গল্পটার নিচে লিখে দিয়েছি। নামটা হলো, “ভাবের মাঝে বসবাস, ঘরের কোণে গাবগাছ”

উত্তর শুনে বিচারকদের ফিট হবার জো। তারা একে অপরের মুখের দিকে তাকালো এবং দ্বিতীয়বার শব্দ করে হেসে ওঠলো।

-গ্রেট । আপনিই বিশ্বের প্রথম নির্বাক-গল্পকার। মিটমিটি হেসে এক বিচারক মন্তব্য করলো।

এতে বোকা প্রতিযোগী গল্পকার আনন্দে গদগদ হলো!
-আপনার সব গল্পই কী নির্বাক? অন্য একজন বিচারক জানতে চাইলো
-না; আমি মূলত ক্রিয়েটিভ রাইটার
-বাহ; বেশ! এখন একটা সবাক ক্রিয়েটিভ গল্প শুনান। একজন দেশি বিচারক অনুরোধ করলো
-“আকাশেতে গাভীগন, করিতেছে চেচায়ন”, প্রতিযোগী গল্প শুরু করলো
-থামেন। এক বিচারক খুব বিরক্ত হলো এবং বললো, কী সব “পদ্যমদ্য” দিয়ে গল্প শুরু করলেন?

প্রথম প্রতিযোগীর সাথে কথা শেষ হতেই দুজন পুলিশ এসে অনুষ্ঠানটিতে হাজির হলো। হ্যান্ডকাফ পরা মধ্যবয়সী একজন পুরুষকে নিয়ে তারা এসেছে। এই আসামী আসলে “গল্পকার ট্যালেন্ট-হান্ট” অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় প্রতিযোগী।

-কি হয়েছে? একজন বিচারক জানতে চাইল
-এটা আমার দ্বিতীয়বার হ্যান্ডকাফ পরা। দুবারই আমার লিখা গল্পের জন্য। প্রথমবার একটা ফেইসবুক গ্রুপে প্রকাশিত গল্প নিয়ে। সেবার জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এবার আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

এক গ্লাস পানি চেয়ে নিয়ে এক ঢোক গিলে হ্যান্ডকাফ পরা প্রতিযোগী আবার বলতে শুরু করলো,

“সাতদিন আগে নারী নির্যাতন নিয়ে আমার নিজের লেখা একটা গল্প ফেইসবুক ওয়ালে প্রকাশ করেছিলাম। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আমাকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে। মহামান্য আদালত আমার এবং সরকার পক্ষের বক্তব্য শুনে দুটো নির্দেশনা দেয়। এক) আমাকে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া; দুই) তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা। তবে এই নির্দেশনা দেয়ার আগে মহামান্য আদালতকে যখন গল্পটি পড়ে শোনানো হয় তখন আমি কারো কারো চোখের কোণ ভিজা দেখেছিলাম। তখন বিজ্ঞ আদালত মন্তব্য করেন যে, ফেইসবুক ওয়ালের গল্পটা এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য প্রায় শূন্য। তাই আদালত গল্পকারকে রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি দেয় যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ওটা নিছকই একটা গল্প- বাস্তবে অমন কিছু ঘটেনি”।

বক্তব্য শেষ করে হ্যান্ডকাফ পরা প্রতিযোগী বিচারকদের দিকে তাকালো। সে খেয়াল করলো, দেশি বিদেশি সব বিচারক বিস্ময় নিয়ে তার হ্যান্ডকাফের দিকে তাকিয়ে আছে।

আসলে অনুষ্ঠানটির বিচারকরা প্রথম প্রতিযোগীর প্রতি খুবই বিরক্ত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় প্রতিযোগীর প্রতি পুরো বিপরীত। তারা ভাবে, গল্প কতোটা উন্নত এবং জীবন ঘনিষ্ট হলে দেশের আইন আদালত এভাবে রিয়াক্ট করতে পারে। তাদের কাছে গল্পকারের হ্যান্ডকাফটা খুবই দামি লাগে।

আসামী নিজে এবার হ্যান্ডকাফটার দিকে তাকালো। বিচারকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সে তার বন্দি হাত দুটোতে একটা মৃদু ঝাঁকি দিলো। এতে অনিন্দ্য সুন্দর একটা বাজনা বেজে ওঠলো; ঠিক তার মনলতার পায়ের নূপুরের মতো।