বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

অণুগল্প- বাতাসী

আজ থেকে বত্রিশ বর্ষ পূর্বের কথা। বাদামতলীতে বসবাস করতো এক মেয়ে, নাম তার বাতাসী। তাকে অস্বচ্ছলতা খুব যে কুড়ে খেয়েছে সেটাও নয়। গাও গ্রামের মুরুব্বীদের মুখে শুনেছি “ইজ্জ্বত যায় না ধুইলে আর খাছলত যায় না মরলে।” বাতাসী তেমন এক হাওয়াই মিঠাই। মুখে তুলে নিলেই যেন শেষ। কি আজব এ মিঠাই।

বাতাসীর নাম যথার্থই হয়েছে। বাউরা বাতাসের মতো তার সর্বাঙ্গের সাথে মিলেমিশেই পরিপূর্ণ। যে একবার দেখেছে সে এমনটাই যথার্থই বলেছে। বাতাসের স্পর্শ যেমন অনুভবেই পূর্ণ তেমনি বাতাসীকেও যে একবার দেখেছে তার অন্ধ জল খরস্রোতা নদীর জলের মতোই প্রবাহিত হয়েছে।

বেশী সুন্দর আর বেশি কুৎসিত এ দুজনাই যেন সমাজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় অসময়ে। আর যদি নিন্মমধ্য বিত্ত ঘরে এমন ঘটনা ঘটে তবে চোখ বন্ধ করে বলা যায় সমাজপতি, অস্ত্রপতি আর রাজপতিদের দৃষ্টি যেন ঐ নারীর জীবেন শকুণের মতোই তীক্ষ্ণ তীরে রক্তাক্ত। কুৎসিত সে তার ঘর দুয়ার দু জায়গা থেকেই বঞ্চিত হতে হতে একদিন দু’টাকার ইঁদুরের বিষে নিজেকে বিসর্জন দেয়। আর বাহ্যিক সুন্দর যে সে সব ভুলে জলের মতো হয়ে যায়।

ব্যক্তি জীবনে সুখের কথা দূরে থাক তখন বেঁচে থাকার তাগিদেই নিজেকে নিজেরা হাওয়াই মিঠাই হিসেবে গড়ে তোলে অনেকে। আবার কেউ কেউ মর্ডানের নামে আল্ট্রামর্ডান সেজে নিজেকে হাওয়াই মিঠাইয়ে রুপান্তরিত করে নানারুপ ও বর্ণে।

বাতাসী সেই আল্ট্রামর্ডানদের একজন আজ। বয়স সবে মাত্র আঠার বা কুঁড়ি। কচি ডাব, আর জোয়ারের জল নিন্মমুখী ধেয়ে যাওয়া পথে রেখে যাওয়া পলির মতোই। এ যেন সোনায় সোহাগা। অনেকে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি ও বলে। এভাবেই কাটছে বাতাসী দিন গণনা। সমাজের নিচুস্তর থেকে উঁচুস্তরের সবাই যেন তার পা চাটা গোলাম।

সৃষ্টিকে ভুলে কতদিন বেঁচে থাকা যায়? কেউ ভুলে থাকতে পারেনি পারবেও না। মৃত্যু যে অবধারিত।
আজ বাতাসীর বয়স পঞ্চাশ। মুখের চামড়াগুলো নাদুস নুদুস পালিত কুকুরের মতোই ঝুলে গেছে। ছোট্ট বাচ্চারা সেটা টেনে যেন খুব মজা পায়। আজ আর ক্রেতার দৃষ্টি নেই তার দিকে। কেউ মুখ ফিরে ভুল করেও তাকায় না একবার।

কিন্তু কথায় আছে – “ইজ্জ্বত যায় না ধুইলে আর খাছলত যায় না মরলে।” যৌবন নেই তাতে কি হয়েছে। বাতাসীর সর্বাঙ্গে নামিদামি পারফিউম আছে আর আছে তার কামুক ঘ্রাণ কিন্তু শুধু নেই চুম্বকের আকর্ষন।

আজ পাশের বাড়ির ময়নাকে দেখে বাতাসীর খুব ইর্ষা হয়। মনে পড়ে যায় অতীতের কথা; কত জর্জ, ব্যারিস্টার, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, রাজপতি, অস্ত্রপতিদের মুখে হাসি তুলে দিয়ে কত এনাম পেয়েছি। আজ সবাই যেন ঈমানদার হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় তাদের মতো ভাল মানুষ জগতে আর একটিও নেই।

আজ বাতাসী বাড়ির পাশে বয়ে চলা সড়কে সারিসারি পায়খানা স্তুপ করে রাখে। নিজের মলমূত্র নিজেই ত্যাগ করে রাখে। আজ সে নিঃস্ব আজ আর তার কিছুর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই অন্যদেরও। তার আজ শুধু প্রয়োজন পথিক যেন মলমূত্রের দেখে নষ্ট বাক্য উচ্চারণ করে। এই নষ্ট বাক্যই বাতাসীর স্বস্তির একমাত্র ভরসা। যৌবনের টগবগে জয়গান। আসলেই “ইজ্জ্বত যায় না ধুইলে আর খাছলত যায় না মরলে ।”

পানা-পুকুর

– আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
-কেন?
-দম আটকে আটকে আসছে, পানা।

পুকুর পানাকে তার কষ্টের কথা বলছে।

বছর দু’য়েক আগে এক বর্ষার রাতে জলের ধারায় ভাসতে ভাসতে একটা পানা এসেছিল পুকুরে। অসহায়ভাবে আশ্রয় চেয়েছিল।
-পুকুর, তোমার বুকের এক কোণায় আমাকে একটু থাকতে দাও। আমি ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর পারছি না।
পুকুরের তরল হৃদয় বাষ্পায়িত হয়।
-ঠিক আছে। থাক না।
ভালবেসে পানাকে বুকে ঠাঁই দিয়েছিল পুকুর। আদরে-সোহাগে সবুজ সতেজ করেছিল তার দেহ-মন।

পানা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে সংসার সাজাতে মেতে ওঠে। বংশ বিস্তার করতে থাকে। ফুল ফোটায়। তাদের বেগুনি হাসিতে পুকুর মুগ্ধ হয়। পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন কোনো মানুষ বলে – বাহ্ কি সুন্দর লাগছে পুকুরটাকে। ফুলে ফুলে যেন সেজে আছে । তখন পুকুরটি ভারি আহ্লাদিত হয়। পানাকে ডেকে বলে – তোর ফুলের জন্য আমাকে কত মানুষ প্রশংসা করছে দেখ।
পানা হাসে।
পুকুর আবার বলে- হ্যাঁ রে পানা, তোর ফুলের রঙ তো ভারি সুন্দর। দেখে দু’চোখ ভরে যায়।
পানা সহাস্যে বলে- তোমাকে আনন্দ দিতে পেরে আমি ধন্য।
– তাই? কিন্তু কেন রে ?
-হ্যাঁ গো পুকুর। তুমি যে আমার আশ্রয়দাত্রী। মায়ের মত। তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
পুকুর বিনয়ের সাথে বলে- না না। ওভাবে বলিস না। এটা তো আমার কর্তব্য।
পানা সানন্দে বলে- তোমাকে আমার ফুল আনন্দ দিতে পারছে জেনে আমার কী যে ভাল লাগছে। এছাড়া তোমাকে আর কীই বা আমি দিতে পারি। তোমার অতবড়ো বুকে আমার বংশধরদের নিরাপদ ঠাঁই দিয়েছো। আগলে রেখেছো মায়ের মমতায়। তোমার এ ঋণ শোধ করার কোনো সাধ্য তো আমার নেই। শুধু —
পুকুর পানাকে থামিয়ে বলে- ছাড় ওসব। দেখ তোর ছানাপোনারা কেমন সবুজ হয়ে উঠেছে।
– সে সবই তো তোমার ভালবাসায় আর দয়ায় পুকুর।

রাতে যখন চারপাশ নীরব হয়ে যায় তখন পানা আর পুকুর নানা গল্পে মেতে ওঠে।

এভাবেই ওদের দিন যায়। রাত আসে। সময় গড়াতে থাকে জলের মত। আর পানার ছানাপোনা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ছানাদের ছানাপোনা। আর দখল করতে থাকে পুকুরের বিশাল বুকটাকে।

পুকুরের একটু কষ্ট হলেও সব মেনে নেয় সে। কারণ সে-ই তো একদিন ঘর দিয়েছিল পানাকে। বুকের পরে রেখে অাপন করে নিয়েছিল। খুশি হয়েছিল তার একাকীত্বের ফাঁকা বুকে একজন ছোট্ট সাথি পেয়ে। আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দিয়ে।

কিন্তু আজ? পুকুরের সারাবুক পানায় পানায় ভর্তি। যেন পাষাণের মত চেপে বসে আছে। এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই তার জলীয় বুকের কোথাও।

পুকুর আগের মত আর আকাশ দেখতে পায় না। রাতে চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মাততে পারে না। বাতাস তার গায়ে হালকা ঢেউয়ের পরশ বোলাতে আসে না। মাছেরা-হাঁসেরা- দামাল ছেলেমেয়েরা হইচই করে সাঁতার কাঁটতে আসে না। তার সমস্ত বুকই যে আজ পানাদের অধিকারে। পুকুরের মাঝেমধ্যে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ভাবে- পানাকে ঠাঁই দিয়ে কি তবে ভুল করেছে পুকুর?

– আমি আর পারছি না পানা। তুই একটা কিছু কর। আমার বুকের তলটা যে তোদের মরা শেকড়-বাকড়ে ভরাট হয়ে আসছে। আমি দিনদিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তো। পানা, তুই একটা কিছু কর। নইলে – ভয়ার্ত হতাশার সুর পুকুরের গলায়।
– কি করি বলো তো?
– শ্বাস নিতে পারছি না। তুই তোর বংশ আর বাড়াস নে পানা।
– সে কি করে হয় পুকুর!
-তোর আশ্রয়দাত্রীকে এভাবে তোর বংশধররা গলা টিপে মেরে ফেলছে দেখেও চুপ থাকবি?

পানা উত্তর দেয় না।

অণুগল্পঃ মায়ানীল মেয়েটির হাত ধরে চলে গেলো

বেশ লম্বা সময় পর আহমেদ হোসেন দেশে ফিরছে। আগে ঘন ঘন ফিরতো। এয়ারপোর্টে তখন কেউ না কেউ তাকে রিসিভ করতে আসতো। এসব অনেক আগের কথা। শেষ ক’বার এয়ারপোর্টে কেউ আসেনি। বয়স বেড়েছে কিন্তু আহমেদ হোসেনের ইচ্ছের বয়স বাড়েনি। মুখে বলেনা; কিন্তু এখনো মন চায় সন্ধ্যে-বাতি জ্বালিয়ে পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে তার জন্য কেউ একজন অপেক্ষায় থাকুক।

শেষ ফ্লাইটটা এমিরেটস। আহমেদ হোসেন সব সময়ই চেষ্টা করে জোন “এ”-র প্রথম রো-তে আসন নিতে। এবারও ব্যাতিক্রম হয়নি। প্রথম যাত্রি হিসেবে সে এয়ার বাস থেকে নামলো। ডিপ্লোমেটিক সুবিধা নিয়ে সে চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব ফরমালিটিজ শেষ করে ফেললো। লাগেজে প্রায়োরিটি ট্যাগ লাগানো থাকায় খুব তাড়াতাড়ি লাগেজ দুটোও পেয়ে গেলো।

সব কিছুই তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো। কিন্তু আহমেদ হোসেনের কোন তাড়া নেই। মোবাইলের সিমটা পরিবর্তন করে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। যদি কোন কল আসে; বলে, “তুমি নেমেছো? আমি ১ নং গেটে দাঁড়িয়ে আছি”। তার মোবাইলটা বেজে ওঠলো; অপরিচিত নাম্বার। সে আগ্রহ নিয়ে কলটা রিসিভ করলো।

“গুড মর্নিং স্যার। রফিক ফ্রম … ডিপার্টমেন্ট অব ……সিকিউরিটি…….”।

আহমেদ হোসেন আশাহত হলো। মন খারাপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। সিদ্ধান্ত নিলো বন্ধুদের কল দিয়ে বলবে, তোরা এসে আমাকে নিয়ে যা।

আহমেদ হোসেন তার নিজের মনের এমন অদ্ভূত আচরণে কিছুটা অবাক হলো। সেতো নিজেই বহুবার মানুষকে বলেছে, কারো কাছ থেকে কিছু আশা করোনা; এমনকি মায়ের কাছেও। তবুও বন্ধুদেরকে কল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। অন্যপ্রান্ত থেকে প্রিয় বন্ধুর কণ্ঠ ভেসে এলো। আহমেদ বললো, তোকে একটু পরে আবার কল দেবো রে।

আসলে মায়ানীলের মতো কাউকে সে দেখেছে; তাই বন্ধুর সাথে কথা কন্টিনিঊ করেনি। তার জন্য বড় মায়া এই মানবীর। আহমেদ হোসেনের বুকটাকে নীলরঙ নদ বানিয়ে তাতে সে অষ্টপ্রহর চোখের জল ঢালে। সে আরো একটু এগিয়ে গেলো। মানবী মোবাইলে কথা বলছে। মায়ানীলেরই কণ্ঠ। দেশে আসার খবর সে জানে। তাইলে কী মায়ানীল তাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে ? এতো মায়া যার বুকে সে আসতেই পারে ! আরো একটু এগিয়ে গেলো আহমেদ হোসেন। তখনই প্রায় সাতাশ-আটাশ বছর বয়সী একটা মেয়ে এসে মায়ানীলকে জড়িয়ে ধরলো।

যে পাখি “জীবনের সব লেনদেন মেটাতে” পারেনা সে একটু আঁধারেই ঘরে ফিরে! মায়ানীল আড়চোখে আহমেদ হোসেনকে দেখলো। আলো-আঁধারের আহমেদ হোসেনকে আসলে কী সে দেখতে পেলো?

নীলরঙ শাড়ি পরা মায়ানীল মেয়েটির হাত ধরে চলে গেলো!

গাই-বাছুর

মায়ের ডাক শুনেই রনি তিড়িং বিড়িং করে তিন লাফ দিয়ে ছুটে আসে। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আদর খায়।

রনির প্রতিদিন বিকেলটা খুব ভাল কাটে। পাড়ার খেলার মাঠে ছুটোছুটি করে। ইচ্ছেমত খেলেধুলে বেড়ায়। যখন ইচ্ছে করে মায়ের কাছে ছুটে আসতে পারে।

ওরা গেরস্থবাড়ির গাই-বাছুর। গিন্নিমা আদর করে বাছুরটিকে রনি বলে ডাকেন। ভালবেসে গলায় ঘুঙুর পরিয়ে দিয়েছেন তার।

কত্তাবাবা রোজ বিকেলে এই মাঠে রনির মাকে বেঁধে রেখে যান। বাছুরটি মানে রনিও মায়ের সাথে মাঠে আসে। স্বাধীনভাবে ঘোরে। গলায় তখন তার কোনো দড়ির বাঁধন থাকেনা।

রনির হঠাৎ খিদে পেয়ে যায়। মায়ের পেটের নিচে মুখ চালিয়ে সজোরে গুতো মারে পালানে। বাট ধরে আর আনন্দে লেজ নাড়তে থাকে। মা তার সন্তানের সারা শরীর চেটেচেটে আদরে সোহাগে ভরে দেয়।

-মা, এভাবে যদি সারাক্ষণ তোমাকে পেতাম-
-তাহলে?
– তাহলে আমার আর কোনো কষ্ট থাকতো না। কিন্তু মা বাড়ি গেলেই তো কত্তাবাবা তোমাকে আর আমাকে আলাদা করে দেবে। সারারাত তোমাকে ছেড়ে একাএকা থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়।
-আমারও কি ভাল লাগে তোকে ছেড়ে থাকতে?
-ওরা খুব খারাপ। আমার খাবার ওরা জোর করে কেড়ে নিয়ে যায়।
মা নিরুত্তর থাকে।
একটু পরে রনি বলে- আমার খুব খিদে পায়। সারারাত একটুও দুধ খেতে পাইনে তো। পেট একেবারে পিঠের সাথে লেগে যায়। তারপর সকালে যখন আমাকে ছেড়ে দেয় তখন একদৌড়ে চলে আসি তোমার কাছে। বাটে মুখ দিই। তুমি দুধের ধারা যেই দিতে শুরু কর, অমনি ওরা আমাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। আর সবটুকু দুধ নিয়ে যায়। তখন যে আমার কি কষ্ট হয়। খুব রাগ হয় ওদের উপর।
– কি করবে বাছা। ওরা আমাদের যত্ন করে। ভাল ভাল খাবার খেতে দেয়। বিনিময়ে ওই দুধটাই তো ওরা চায়।
– আমার জন্য একটুও দুধ রাখে না বাটে। ওরা ভারি লোভি। স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর।
– দুঃখ কোরো না, একটু বড় হলেই তুমি খড় বিচুলি ঘাস খেতে শিখবে। তখন আর খিদের কষ্ট পেতে হবে না।

রনি আর কোনো কথা বলে না। বুঝতে পারে এমন জীবনটাকে মেনে নিয়েই চলতে হবে। মনমরা হয়ে মায়ের পাশে চুপচাপ শুয়ে থাকে।

বেলা পড়ে আসে। কত্তাবাবা এসে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়। গোয়ালে মাকে বেঁধে রাখে। তারপর রনির দিকে হাত বাড়ায় । আদর করে। রনির অসহ্য লাগে এই ভালবাসা। দুঃখ ক্ষোভে তার ছোট্ট বুকটা যেন দুমড়ে মুষড়ে যেতে থাকে। ও জানে প্রতিদিনের মত ভালবাসার ছল করে গলায় পরিয়ে দেবে একগাছা লোভের দড়ি। তারপর টেনে হেঁচড়ে আলাদা করে দেবে মায়ের কাছ থেকে।

আজও তার ব্যতিক্রম হল না গলায় দড়ি দিয়ে অন্যঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রনিকে।
মা একবার হাম্বা করে ডাক দেয়।

নিরুপায় রনি ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকায়।

একটি নিখোঁজ সংবাদ

মাইকের শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলাম, একটা রিকশায় লাগানো মাইক থেকে ভেসে আসছে “একটি নিখোঁজ সংবাদ”

আজ একটা শুভদিন,অনেক কষ্টে আজ একটা টিওশানি পেয়েছি। এমন একটা দিনে হারিয়ে যাবার কাব্য শুনতে মোটেও ভাল লাগছে না, তাই শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলাম বাথরুমে, অন্য কিছু ভাবার অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু হচ্ছেনা, মাইকটা অনেক দূরে হলেও শব্দগুলো যেন খুব কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছি, অসস্থি লাগছে, ঝিনঝিন করছে মাথাটা। মনে হচ্ছে কানের খুব কাছাকাছি এসে কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে “একটি নিখোঁজ সংবাদ”

সেই ছোটবেলায় একবার মাঠে লাটিম ঘোরানো থেকে শুরু, চকচকে লাল একটা লাটিম কিনে দিয়েছিলেন বাবা, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলতে খেলতে হঠাৎ একটা ঝোপের দিকে ছুটে গেল লাটিমটা, পিছু ছুটলাম, বন্ধুদের ডাকলাম তারাও সাহায্যের জন্য এসে হাত দিয়ে সরাতে লাগল কাটাঘেরা ঝোপঝাড়, প্রায় ঘন্টাখানেক টলটলে চোখ আঁকড়ে ধরে খুঁজলাম অথচ লাটিমের টিকিটাও খুঁজে পেলাম না কোথাও, শেষরক্ষা হলোনা, কষ্ট আমার অবুঝ চোখ গড়িয়ে জল নামিয়ে দিল বুক পর্যন্ত। বেশ কদিন পর আমি ঠিক আমার সেই লাটিমটা দেখেছিলাম অন্য একটি ছেলের হাতে, সেদিন ঠোঁটের কোনের সে হাসিটা এখনো আমার ঠোঁটে। আমি লাটিমটা ফেরত চাইনি, শুধু ভেবেছি আমার কাছে না হোক অন্তত সে আছে, অন্তত কোন নিখোঁজ সংবাদ সে নয়।

প্রায় দশটা বাজে, এগারোটায় ছাত্রের বাসায় যেতে হবে, আধঘন্টার মত সময় হাতে আছে, বাসে যেতে পনের মিনিটের মত সময় লাগবে, আজ প্রথম দিন তাই ভাবছি রিকশাতে চড়েই যাই, অন্তত শার্টের ইনটা ঠিকমত থাকবে।

রিকশাতে চড়েই প্রথমে পকেটে হাত চলে গেল, হ্যা সব ঠিকঠাক আছে, রিকশা চলছে তার আপন গতিতে, হঠাৎ কে আবার ফিসফিসিয়ে বলে উঠল “একটি নিখোঁজ সংবাদ”

সেবার সবে মেট্রিক দিয়েছি, ছুটিতে নানুবাড়িতে গিয়ে সে কি হৈহুল্লোর, সবাই মিলে সেখানকার একটা জোড়া পুকুড়ের ঘাটে ভর দুপুরে পানিতে ঝাপাঝাপি করছিলাম, দেখছিলাম কে কার চেয়ে বেশি সময় পানিতে থাকতে পারে, পানির নিচের পরিবেশটা আমার খুবই ভাললাগে সবসময়ই, ভাবলাম দেখি কে কে উঠেছে, পানি থেকে মাথাটা বের করতেই চোখটা যা দেখল তা কখনোই ভুলতে পারিনি, একটা মেয়ে, নির্ঘাত পরী, টেলিফোনের তারের মত কোমড় পর্যন্ত ভেজা কালো চুলগুলো সেটে আছে দুধরঙা গায়ে, এতক্ষণ সে আমাদের আশেপাশেই ছিল হয়ত, খেয়াল করিনি, অথচ গোসল শেষ করে সে উঠে যাচ্ছিল, বন্ধুদের ডাকে হুস ফেরে, আমি আবার ডুব দেই, ৩০ সেকেন্ডের মত পানিতে ছিলাম তখন। পানি থেকে উঠে আমি আর তাকে কোথাও দেখতে পাইনি, দৌড়ে ঘাটের ওপরে উঠলাম, নাহ কোথাও নেই, এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল মেয়েটিকে সেও দেখেছে তবে তাদের মধ্যে কেউ তাকে চেনেনা। আমি ষ্পষ্ট মনে করতে পারি তার লাল ঠোঁটটার বা পাশের তিলটা অথচ জলজ্যান্ত মানুষটাকে আর কোথাও দেখিনি, কখনো জানতেও পারিনি কে সে! সে ছিল আমার জীবনে মনে রাখার মত আরো একটি নিখোঁজ সংবাদ। ন বছর কেটে গেছে অথচ এখনো তার মুখখানা আমার কাছে স্পষ্ট।
এইতো কিছুদিন আগে নানুবাড়িতে একটা জরুরি প্রয়োজনে গিয়েছিলাম, গাড়ি থেকে নামার সময় বামদিকে টিকেট কাউন্টারের পাশের সিগারেটের দোকানে তাকালাম অনিচ্ছায়, অন্যদিকে ফিরিয়েও নিয়েছিলাম চোখ, হঠাৎ মনে হল আমি কিছু একটা দেখেছি যা আমার খুব চেনা, হ্যা সেই মেয়েটি,সেই টেলিফোনের তার, কিছু না ভেবেই পা চালালাম, একটু সামনে যেতেই দেখলাম তার পেছন থেকে একটা ছোট বাচ্চা তার শাড়ির আচল জড়িয়ে রেখেছে, অবাক হইনি এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, এতো স্বাভাবিক। অবাক হলাম যখন দেখলাম একটা ছেলে এসে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মেয়েটার হাত ধরে সামনে আসছিল, ছেলেটি আমার সেই বন্ধু যাকে আমি মেয়েটার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আমাকে চিনে ওবন্ধুটি না চেনার ভান করে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল, পরে জানতে পেরেছিলাম মেয়েটি ছেলেটির চাচাতো বোন। খুব হেসেছিলাম, কষ্ট লাগছিল না একফোঁটাও, আমি তাকে পেয়েছি, অন্তত কোন নিখোঁজ সংবাদ সে নয়।

রিকশাওয়ালার ডাকে ঘোর ভাঙলো, ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সামনে এগুলাম,পকেট থেকে ঠিকানাটা বের করে হাতে নিয়ে দেখলাম, ৭৮/এ, হ্যা ঠিকানাটা এ বাড়িরই। বেল টিপতেই দারোয়ান টাইপ একটা লোক গেটের ভেতর থেকে বলল কাকে চাই? আমি পরিচয় দিয়ে বললাম আমি এ বাড়ির বাচ্চার নতুন শিক্ষক, তার মুখটা ছোট হয়ে গেল নিমেষেই, সে বলল আপনি ছোট সাহেবের শিক্ষক! কিন্তু ছোটসাহেবকে তো গতকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না..

ছোট্টগল্পঃ দু’টো বাড়ি

-বনলতা, এই বনলতা…
-বল!
-একটা খবর আছে।
– কী খবর সুরঞ্জনা?

বনলতা আর সুরঞ্জনা। ছোট্ট দুটো বাড়ি। পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। ওদের মধ্যে ভারি মিতালী। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে যখন আর ভাল লাগেনা তখন দু’জনে সুখদুঃখের গল্পে মেতে ওঠে।

সেই দশ বারো বছর আগে বুড়োকত্তা তৈরি করেছিলেন ওদের। তাঁর দুই ছেলের জন্য। কবিতাপাগল কত্তামশায় ভালবেসে নাম রেখেছিলেন সুরঞ্জনা আর বনলতা। জীবনানন্দের কবিতার দুই নারীচরিত্র। সুন্দর ছোট্টছোট্ট দুটো একতলা বাড়ি। হালকা সবুজরঙে ভরে দিয়েছিলেন সারা শরীর।

সুরঞ্জনা বলে – কাল রাতে আমার কত্তা তার গিন্নিকে বলছিল- আমাকে নাকি ভেঙে নতুন করে ত্রিতল করবে।
-তাই নাকি? তাহলে তো তোর ভারি আনন্দ।
-সে তো একটু হচ্ছেই।
– তোর কত্তা ভাল চাকরি করে। শুনেছি উপরিও আছে। তোকে যত্নআত্তি করা ক্ষমতা আছে। আমার কত্তা তো আর চাকরি-বাকরি করে না। ওই ছোট্ট একটু দোকান। – বনলতা থামে।
সুরঞ্জনাও কোনো প্রতিউত্তর করে না।
বনলতা আবার বলে- তা তোর তো নবজন্ম হবে। পূর্বজন্মের প্রিয় সাথিকে তখন মনে থাকবে তোর?
– কী যে বলিস না তুই! মনে থাকবে না? আমরা দুইজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একসাথে কত ঝড়-বৃষ্টি-খরা সহ্য করলাম। কত সুখ-দুঃখের দিন পার করলাম। সেসব কি ভোলা যায়? বড় হলে কি হবে। তুই আমার প্রাণের সাথি ছিলি, আছিস, থাকবি চিরকাল।

সুরঞ্জনাকে ভাঙা হলো। খুব কষ্ট হল তার। তবু বড় হবার স্বপ্নে সব সয়ে নিল দাঁতে দাঁত চেপে।

বনলতাও বিমর্ষ মনে দেখল তার সাথির নিঃচিহ্ন হয়ে যাওয়ার দৃশ্য।
দেখল সুরঞ্জনার ধীরে ধীরে পূনর্জন্ম প্রাপ্তির দৃশ্যও। সে এখন বিশাল এক সুরম্য অট্টালিকা। দিনক্ষণ দেখে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল প্রাসাদের। পার্টি চলল গভীর রাত পর্যন্ত। গর্বভরা চোখে সুরঞ্জনা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল নাচ-গান।

নতুন নামকরণও হল। তার কপালের উপর খোদাই করে বড়বড় ইংরেজি অক্ষরে লেখা হল-সানভিলা।

বনলতা চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, শুনল সবকিছু। সুরঞ্জনা কি ভুলে গেল তার প্রিয় সঙ্গীকে?

রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। বনলতার চোখে তবুও ঘুম আসেনা।
পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে। সুরঞ্জনাও কি ঘুমিয়েছে? না কি…

বনলতা কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকে – সুরঞ্জনা!

সুরঞ্জনা নয় সানভিলার চোখ এখন শুধু আকাশের দিকে। নীচে তাকানোর ইচ্ছে, সময় – কিছুই তার নেই।
-সুরঞ্জনা!
বনলতার ডাক সানভিলার কঠিন কংক্রিট দেহে ধাক্কা ফিরে ফিরে আসে তার কাছে।

অণুগল্প : স্বপ্নপোড়া গন্ধ // রুকসানা হক

পকেটে মাত্র একশ’ পঁয়ত্রিশ টাকা। নিটোলকে বিয়ে করতে কাজী অফিসের সামনে এসে রিকশা থেকে নামলো অর্ণব। সাথে বন্ধু সুদীপ।

প্রায় বিশ, পঁচিশ মিনিট আগে নিটোল এসেছে। একাই এসেছে সে। অফিস বারান্দার এককোণে ওড়না দিয়ে মাথায় আধখানা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে। শুকনো মুখ, টেনশন, দুশ্চিন্তায় হয়তো গলা দিয়ে কিছু নামেনি।

এতটুকু সাজগোজ ও করেনি নিটোল। তার একটা ব্যক্তিগত প্ল্যান রয়েছে, বাসরেই সে প্রথম সাজবে। আজ এমনিতেই বিক্ষিপ্ত মন তার। মাকে বার বার মনে পড়ছে। আজকের এ ঘটনা জানাজানি হলে সবচেয়ে বেশি মূল্য মাকেই দিতে হবে। বাবা মাকে ছেড়ে কথা বলবেন না।

নিরুপায় নিটোল। বিয়েটা আজ অথবা কালই তাকে করতে হবে। দেরি করা চলবে না, তাহলে অঘটন এড়ানো সম্ভব হবে না।

অর্ণবকে দেখে কোনরূপ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি সে। বেশ নির্বিকার ভাবেই শুধু বললো
ঃ আজো তোমার দেরী !
ঃ বিশ্বাস করো সকাল থেকে ছুটাছুটি করছি।
ঃ টাকার জন্য ?
ঃ হ্যাঁ।
ঃ ম্যানেজ হয়েছে?
ঃ না।
ঃ তাহলে দেরি কেনো? সমস্যা নেই, আমার সাথে টাকা আছে।
ঃ চলো ভেতরে যাই। আজ একটা শাড়ি পরলে পারতে।
ঃ না পারতাম না। সমস্যা হতো।

কাজী অফিসের ভেতরে যেতে যেতে সুদীপকে লক্ষ্য করলো নিটোল। বেশ পরিপাটি পোশাক আশাক। পান্জাবী পরেছে, ক্লিন শেভ। পায়ের স্যান্ডেলটাও নতুন। হাতে একটা পলিব্যাগ। মনে হচ্ছে আজ অর্ণব বর নয়, বরং সুদীপই বর।
অর্ণবের উসকোখুসকো চুল, ঘামে ভেজা শার্ট, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। চোখে মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। কে বলবে সে আজ নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে !

নিটোল, অর্ণব দু’জনকেই উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে এখন। এমন বিয়ের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না মোটেই। কথা ছিল পড়াশুনা শেষ করে দু’জন চাকরী বাকরী করে খানিকটা স্থিতিশীল হয়ে বিয়ে করবে।
কিন্তু উপায় ছিল না। প্ল্যান মাফিক কখনোই জীবন চলে না। নিটোলের একটা বিয়ের কথাবার্তা চলছে। দু’দিনের মধ্যেই বাড়ি যেতে হবে। এদিকে গরীবঘরের ছেলে অর্ণব নিজের আর্থিক অসংগতি নিয়ে কখনোই নিটোলের পরিবারের মুখোমুখি হবার সাহস রাখে না।

আজকাল অর্ণব তথাকথিত নৈতিকতার বুলিগুলোকেই ফাঁকা মনে করে। অর্থ যে কখনোই অনর্থের মূল নয়, বরং অর্থহীনতাই অনর্থের মূল তা হয়তো খোদ নীতিবাক্য রচয়িতা নিজেও ভালো করে জানতেন।

মানুষের কথা ও কাজের মাঝে বিস্তর ফারাক থাকে একথাটাও তার দারিদ্রতার অভিজ্ঞতা দিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সে।

নিটোলের পরিবার অর্ণবকে মেনে নিতে পারবে না এ সত্যটা ওরা দু’জনই ভালো করে জানে। অগত্যা বাড়ি যাওয়ার আগেই বিয়েটা সেরে ফেলার পরিকল্পনা করে ওরা। অর্ণব চেয়েছিল মাসের শুরুতে বিয়েটা করতে। তাহলে টিউশনির টাকাটাও হাতে আসতো। একজন ছাত্রের মায়ের কাছে এডভান্স দু’হাজার চেয়েছিল। মহিলা মুখের উপর না করে দিয়েছেন।

পকেট খালি। নতুন বউকে একটা কিছু গিফট ও করতে পারবে না। লজ্জায়, হীনমন্যতায় মাথা হেট হয়ে আসছে তার। নিটোল অর্ণবকে বুঝতে পারছে। তার নিজের ও কষ্ট হচ্ছে। চালচুলোহীন একটা ছেলের সাথে পুরোটা জীবন জড়িয়ে নিচ্ছে। ভালোমন্দ হিসেবটুকু করার ন্যুনতম সময় ও হাতে নেই।

মায়ের কোমল মুখটা মনে পড়ছে, সাথে একটি কঠিন বাক্য।
ঃ মেয়েদের জন্য দেখতে হয় ভাতের ঘর আর ছেলেদের জন্য জাতের ঘর।
অর্থাৎ মেয়েদেরকে বিয়ে দিতে হয় ধনী পরিবারে, যাতে অন্নবস্ত্রের জন্য কষ্ট না পায়, আর ছেলের বউটা আনতে হয় বংশ দেখে, কারণ এই মেয়ের দ্বারাই ছেলের সংসার গড়ে উঠবে।

কিন্তু নিটোল তো জাত ভাত কোনটির ঘরেই হাত দিচ্ছে না। সে অর্ণবের মতো একটি খাঁদহীন প্রেমিকের জীবনে হাত দিচ্ছে। মানুষটাই তো আসল, যাকে নিয়ে সারাজীবন চলতে হবে তাকেই তো খাঁদহীন হতে হবে ! একটা পরিপূর্ণ জীবনের প্রথম শর্ত পারষ্পরিক বুঝাপড়া। এই ক’ বছরে অর্ণবকে বুঝতে বাকি নেই নিটোলের। কত মান অভিমান গেছে, কত সুখ দুঃখ !

সবসময়ই অর্ণবকে দেখেছে চরম ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে।

পুরুষের ধৈর্য্যের বিকল্প কিছু নেই। বাবাকে আজীবন ধৈর্য্যহীন দেখে দেখে অর্ণবকে সে তুলনায় অনেক বেশি পারফেক্ট মনে হয়েছে তার কাছে।

পান্জাবীর পকেট থেকে একটা চকোলেট বার বের করে সুদীপ নিটোলের দিকে এগিয়ে দিলো
ঃ দু’জন ভাগ করে খাও। গলায় জল আসুক।

নিটোলের নির্লিপ্ত চোখ। চকোলেট হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।
রাজ্যের ক্লান্তি অর্ণবের উদাস দৃষ্টিতে।
ঃ তুমি কি ভয় পাচ্ছো? নিটোলই নীরবতা ভাঙলো।
ঃ না, ভয় নয়, দুশ্চিন্তা।
ঃ আমার বোঝাটা খুব ভারী হবে না
ঃ যত ভারীই হোক, বয়ে নেয়ার সাহস রাখি
ঃ পাশ করার পর আমরা দু’জন মিলে একটা সংসার ভালোভাবেই চালাতে পারবো।

নিটোলের স্বপ্নভরা চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া হলো অর্ণবের। মেয়েটা হয়তো ভুল করছে একটা ভুল জীবনকে ভালবেসে। সংসারে টাকার বিকল্প কিছু নেই। জন্ম থেকেই অভাবের কুৎসিত রূপ দেখেছে সে। শুরু থেকে জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল তার, যে কোন উপায়ে অধিক অর্থোপার্জন। মানুষের লক্ষ্য সবসময় কি ঠিক থাকে। গতরাতে বাড়ি থেকে ফোন এসেছে মায়ের শরীর ভালো নেই। দূরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে ন্যুনতম চিকিৎসা দিতে পারেনি তারা। জীবনযুদ্ধে পরাজীত এক হতভাগী মায়ের সন্তান সে। সে নিজেও কি কোনভাবে জয়ী? হয়তো জয়ী। নিটোলের মতো একটি চমৎকার মেয়ের মন জয় করে নিতে পেরেছে। এর চেয়ে বড় জয় আর কি হতে পারে।

একসময় লক্ষ্য ছিল টাকা উপার্জন, যদিও সে লক্ষ্যে বিচ্যুতি ঘটেনি এখনো, তার সাথে যোগ হলো নিটোলকে পাওয়ার ইচ্ছে। মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল নিটোল।

এরপর অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা। একটি সার্জারী, কয়েকটি ক্যামো কিংবা মাকে ভালো রাখার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা। এখন লক্ষ্যটা একমাত্র মা। খবর এসেছে মায়ের অবস্থা ভালো না। আজকের এই বড় ঘটনা না হলে ঘুম থেকে উঠেই বাড়ি চলে যেতো সে। আজকের দিনে নিটোলকে মায়ের কথা জানানো সমীচীন মনে করেনি অর্ণব। নতুন জীবনের স্বপ্ন ভরা দু’টি চোখে কি করে নোনাজল ঢালবে সে ! অসহ্য যন্ত্রণা বুকে চেপে কাজী অফিসে এসেছে আজ।

বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে কাজী সাহেব নির্দেশ দিলেন। ওদের প্রস্তুতি আর কি ? তারা তো প্রস্তুত হয়েই এসেছে। সুদীপ হাতের পলিব্যাগটা নিটোলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো
ঃপাশের রুমে যাও। রেডি হয়ে এসো।
ঃ কি এটা?
ঃ খুলে দেখো।
ত্রস্ত হাতে ব্যাগটা খুলে একটা শাড়ির প্যাকেট, আংটির বক্স, একটা পান্জাবী আর কিছু প্রসাধনি দেখতে পেলো নিটোল। বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখে অর্ণবের দিকে চেয়ে অস্ফুট বললো
ঃ তুমি আমাকে অবাক করেছো। এখন এসবের প্রয়োজন ছিল না।

অর্ণব কোন কথা বলেনি। মাথাটা আরো কিছুটা যেন হেট হয়ে এলো তার। নিজের অক্ষমতার গ্লানি তাকে যেন মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিল। বন্ধুর দানে কৃতজ্ঞতার বদলে চরম অপমান বোধ হচ্ছিল তার, তবুও নিটোলের ভুল ভাঙাতে সাহস হলো না কিছুতেই।

আচমকা অর্ণবের ফোন বেজে উঠলো।
কাজী সাহেব পূণরায় তাগাদা দিলেন।
ফোন রিসিভ করতেই তার সারা অবয়ব কষ্টে ছেয়ে গেলো। হাতের মুঠি প্রচন্ডভাবে শক্ত হয়ে এলো যেন। নিটোলের একটা হাত জোর করে চেপে ধরলো।
ঃ কোন দুঃসংবাদ ? উদ্বিঘ্ন নিটোল জানতে চাইলো।

অর্ণব কোন কথা বললো না। নিটোলের পাশ থেকে উঠে বারান্দায় গেলো। খোলা আকাশের দিকে তাকালো। এই ভর দুপুরেও সারা পৃথিবীতে এত অন্ধকার কেনো ! মাঝে মাঝে অন্ধকারের শক্তি এত প্রবল হয় যে গনগনে সূর্যের উপস্থিতিতেও অন্ধকার দূর হয় না। অর্ণবের ও তেমনটি মনে হলো। বারান্দা ছেড়ে বড় রাস্তায় নেমে এলো সে। এই পথটা জুড়েও গভীর অন্ধকার। কোথায় দিনের আলো ! কোথাও কোন আলো নেই, ছোপ ছোপ অন্ধকার শুধু। নিটোলের কথা মনে হলো। সেখানেও প্রবল অন্ধকার। একসময় এক কোটি তারা জ্বলতো নিটোলের মুখে, এককোটি জোনাকীরা নেচে বেড়াতো নিটোলের সারা শরীর জুড়ে, অথচ আজ এত এত অন্ধকার।

এখন তার লক্ষ্য টাকা উপার্জন নয়, নিটোল নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু।

বাড়ি ফেরার বাস ধরাটাই হয়তো এখন একমাত্র লক্ষ্য তার।

অনেক্ষণ হয়ে গেছে। কাজী সাহেব আবার ডাকলেন। নিটোল সুদীপকে বললো অর্ণবকে ডেকে আনতে। সুদীপ মাথা নিচু করে বসে আছে। একটু আগে অর্ণবের সাথে ফোনে কথা হয়েছে তার।

ঃ কি হলো সুদীপ ? অর্ণবকে ডাকছো না কেনো?

সুদীপের অসহায় দৃষ্টি দেখে এক লাফে চেয়ার ছেড়ে বারান্দায় গেলো নিটোল। অর্ণবকে না পেয়ে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে কেউ একজন বললো “এ মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না”।

ফিরে এসে ধপাস করে চেয়ারে বসলো নিটোল। দু’জনই নীরব। এভাবেই কতটা সময় কেটে গেলো কেউ টের পেলো না। অবশেষে সুদীপই বললো
ঃ চলো ফিরে যাই।
ঃ না।

শাড়ির প্যাকেট নিয়ে পাশের রুমে গেলো নিটোল। পরিপাটী সাজগোজ করে বেরিয়ে এলো। নিটোলকে এমন অভূতপূর্ব রূপে জীবনেও দেখেনি সুদীপ। সে কেঁপে উঠলো।
ঃ অর্ণব আজ আসতে পারবে না নিটোল
ঃ জানি।

নিটোলের চোখে ভিসুবিয়াস জ্বলছে। এই কিছুক্ষণ আগে যে চোখে রাজ্যের স্বপ্ন ছিল সেখানে এখন ভয়ঙ্কর দাবানল। এতদিনের জমানো রঙিন স্বপ্নগুলো পুড়ে পুড়ে ছাই হচ্ছে যেন। এমন স্বপ্নপোড়া গন্ধে সুদীপ আঁতকে উঠলো।

নিটোল দু’চোখে দাবানল নিয়ে সুদীপের চোখে চোখ রাখলো। সে আগুনে সুদীপ পুড়ে ভস্ম হতে চলেছে। নিটোলের গায়ে জড়ানো লাল শাড়িটা আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে কাজীঅফিসের প্রতিটা কোণ পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। নিটোল পুড়ছে, সুদীপ পুড়ছে, স্বপ্ন পুড়ছে। আর জীবনের ঘন অন্ধকারে লক্ষ্য ভ্রষ্ট অর্ণব নিজের কষ্টগুলোকে জীবনের কঠিন লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে বাড়ি অভিমুখে এগিয়ে চলেছে।

তার পকেট ভারি হয়ে আছে নিটোলের পোড়া স্বপ্নগুলোর ধূসর গন্ধে।

নিশপিশ

নিশপিশ

: দোস্তো, পিপড়ার লাইন দেখছিস!
: হ।
: এক টুকরা রোদ আইসা পড়ছে গ্রীলের কোনায়, পিপড়ার লাইন যখন সেই রোদ অতিক্রম করে — দেখছিস?
: হ, কত্তবার দেখছি।
: সেই লাইনের মধ্যে দুই তিনটা দলছুট পিপড়া বেমওকা দৌড়ায়, ছটফটায়া এদিক ওদিকে যায় দেখছিস?
: হ, দেখছি।
: এই পুরো বিষয়টার মধ্যে অসহ্য সুন্দর আছে, একটা অণুগল্প আছে, তেরো লাইনের একটা মাখোমাখো প্রেমের কবিতা আছে, বিপ্লবও আছে–
: কস কি মাম্মা? এক লাইনে এত্ত কিছু? কই?
: ধরতে পারছি না, তবে আছে, এটা নিশ্চিত।

পারভেজ তিনদিন ধরে জানালায় পিপড়ার লাইন দেখছে। কিন্তু সুন্দর, অণুগল্প, কবিতা বা বিদ্রোহ কোনোটাই ধরতে পারছে না। আঙুল দিয়ে পিষে দিলে গাঢ় বেদনা আর প্রতিবাদে কি সব ধরা দিবে! সে জানেনা, আঙুল বড্ড নিশপিশায়।

যাওয়া

১.
সোমনাথবাবু কাউকে ছাড়েন না, সবাই তাকে ছেড়ে যায়। জন্মের পরে নৌকা ডুবিতে বাবা তাকে ছেড়ে গেছেন। দশ বছর বয়সে তিন দিনের জরে মা। এখানে সেখানে ঘুরে তার বেড়ে ওঠা।

মা যাবার পরে হারুন মেকানিকের গ্যারাজে কাজ জুটেছিল। টানা ষোল বছর কাজ করেছেন। হারুন মেকানিক আজব মানুষ- মুখভরা গালি মনভরা দয়া। তাকে একটা ছোট দোকান করে দিয়েছিলেন। এক বর্ষার রাতে হারুন মেকানিকের হার্টের মেকানিজম ফেল করল, চলে গেলেন।

হারুন মেকানিক যাবার আগে তাকে বিয়ে করিয়েছিলেন। সুখের সংসার। ঘর আলো করে দুই মেয়ে এলো- মায়া আর ছায়া। মেয়েদের বিয়ের আগে তাদের মা বিদায় নিল। বড় মেয়ে মেট্রিক পরীক্ষা না দিয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেল, ভুবন দাসের ছেলের সাথে বর্ডার টপকে ওপারে। বাপের সাথে কোন যোগাযোগই রাখল না।

ছোট মেয়েকে সাধ্যমত ধুমধামের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। সে বাপকে ছেড়ে গিয়ে সুখে আছে, শান্তিতে আছে। মেয়ের ঘরে দুটো নাতি- একটার বয়স দশ বছর অন্যটার সাত। প্রতি মাসে অবশ্য এক দুবার বেড়াতে আসে। বাড়িকে মুখর করে তুলে। তারপর স্তব্দ করে চলে যায়।

সবাই সোমনাথবাবুকে ছেড়ে গেছে। তবে পনের বছর বয়সে ধরা মদ খাওয়ার নেশাটা একমাত্র রয়ে গেছে। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে পান করেন। ঘন্টা দুয়েক চুপচাপ বসে থাকেন। কখনও অতিরিক্ত পান করেন না, মাতাল হন না, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারান না। শুধু মনে ও মগজে এক ধরনের ঝিমঝিম শান্তি অনুভব করেন, কষ্ট অনুভব করেন, স্মৃতি রোমন্থন করেন।

২.
আজ সকালে ছোট মেয়ে বড় নাতিটাকে নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সিএনজি চেপে তার কাছে বেড়াতে আসছিল, বাস চাপা দিয়েছে। ছোট নাতি আর মেয়ের জামাই হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। তারাও হয়তো চলে যাবে।

রাত দশটা। তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছেন। হেঁটে হেঁটে। সারাদিন গরম ছিল, এখন টিপটিপ বৃষ্টি। শীতল নিশিহাওয়া। আজিজের দোকান থেকে কেরু এণ্ড কোং-এর একটা পাইট কিনে পাঞ্জাবির পকেটে রাখলেন। ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। পকেটে রাখা পাইটের বোতলে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটতে লাগলেন। ছোট মেয়ে আর বড় নাতির কথা মনে হচ্ছে- ভিতর থেকে কান্না উঠে আসছে। কখনও মনে হচ্ছে রাতের ঢাকার নির্জন পথে ওরা সাথে সাথে হাঁটছে। পরক্ষণেই মগজ বলছে- মায়া, সব মায়া।

সবাই তাকে ছেড়ে চলে যায়, তিনি কাকে ছেড়ে যাবেন বুঝতে পারছেন না। তীব্র অভিমানে পকেট থেকে বোতলটি বেড় করে রাস্তায় ছুড়ে ফেললেন। রাতের নির্জনতায় শব্দ তুলে কাঁচের বোতল ভেঙ্গে চুর হয়ে গেল, বৃষ্টিস্নাত পথে গড়াল মদ। তিনি পঞ্চাশ বছরের সম্পর্ক ভাঙ্গলেন, মদকে পথে ছেড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

৩.
রাত আড়াইটায় সোমনাথবাবু বাড়ি ফিরলেন। সারাদিনের ক্লান্তি মুছতে স্নান করলেন। এখন আর ঘুম হবেনা। চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। পায়ে ব্যাথা অনুভব করছেন। আরামের জন্য টেবিলে পা তুলতে গিয়ে বিস্মিত হলেন – পকেট থেকে ছুড়ে ভেঙ্গে ফেলা পাইটের বোতলটি দিব্যি টেবিলের উপরে রয়েছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি মদ ছাড়তে চেয়েছেন, মদ তাকে ছাড়ে নাই। সবাই ছেড়ে যায় না, ছেড়ে যেতে পারেনা।

বিড়াল-জীবন

– মা, আমরা এখানে- মা —
ঝোঁপের আড়াল থেকে ফিসফিস শব্দে ডাক শুনতে পেয়ে মা এগিয়ে গেল। এতক্ষণে যেন তার প্রাণে জল এল। সেই কখন থেকে বিড়ালটা ছানাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কাছে গিয়েই ছানাদের সারা শরীর চেটেচেটে আদরে ভরিয়ে দিল মা।

-বাছারা আমার – তোরা এখানে কেন?
– ওই বাড়ির বউটা লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলে যে- তাই আমরা ভয়ে ঘর ছেড়ে এখানে এসে লুকিয়ে রয়েছি মা।
মা বিড়াল বলল- ভয় পেয়ো না বাছারা, আমি তো এসে গেছি।

বিড়াল মা মাসখানেক হল দুটি বাচ্চা প্রসব করেছিল একটি বাড়ির গোয়ালঘরের এককোণে রাখা বিচালির মধ্যে। বাড়ির গিন্নি ব্যাপার জানতে পেরেই দুরদুর করে বের করে দেয় সেখান থেকে। তারপর একেএকে তিনচারটি আস্তানা ছাড়তে হয়েছে মালিকের তাড়া খেয়ে।
অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেয়েছিল এই রান্নার কাঠ রাখার ঘরটি। বাচ্চা দু’টোকে মুখে করে এনে মা নিশ্চিন্ত হয়েছিল। ভেবেছিল – আর তাড়া খেতে হবে না। মালিকের থাকা-খাওয়ার ঘর থেকে অনেকটা দুরে নির্বিঘ্নে তার বাচ্চাদের বড় করে তুলতে পারবে।
কিন্তু না, আবারও তাদের আশ্রয় হারিয়ে উদ্বাস্তু হতে হলো।
-মা, এভাবে আর কত ঘর পাল্টাতে হবে আমাদের? বিড়াল ছানাদের মুখে হতাশার সুর। -আমাদের কি কোনোদিন একটা নিজেদের বাড়ি হবে না? যেখানে আমাদের ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হবে না! হাসিখুশি মনে প্রকাশ্যে খেলা করে বেড়াতে পাবরো মা?
-দুঃখ কোরো না বাছারা, এটাই তো আমাদের বিড়াল-জীবন। এভাবেই লাথি-ঝাঁটা খেতে খেতে একদিন ঠিক তোমরা বড় হয়ে যাবে।
– কিন্তু মা এখন আমরা কোথায় যাব? সন্ধে তো হয়ে এল।
– তোমরা আপাতত কিছুক্ষণ এখানেই লুকিয়ে থাকতে লাগো। আমি নতুন আস্তানার খোঁজে বেরোই।
– আচ্ছা মা।
মা-বিড়াল বাচ্চাদের চেটেচুটে আদর করে বেরিয়ে পড়ল নিরাপদ বাসার সন্ধানে।
বিড়াল ছানারা মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

তুই থেকে তুমি

-তুই কে?

-আমি? আমাকে বলছেন!

-তোরে কই নাই কী তোর বাপরে কইছি।

-বাপকে নিয়ে টানাটানি করছেন কেন, আর আপনার কথায় ইতো বুঝা যায়, আপনি আমাকে চেনেন না। তাহলে তুই তোকারি করছেন কেন?

-আরে ভোম্বা ব্যাডা, তোরে আবার স্যার কইতে হইবো!

-দেখেন সামনে এসে গায়ে পড়ে ঝগড়া করছেন কেন?

-অই দুই ট্যাকার পোলা, তোরে জিগাইছি তুই কে, কইলে কইবি না কইলে নাই। মাইয়া মানুষ দেখলেই কথা কইতে হইবো?

-আমি কখন আপনার সাথে কথা বলতে গেলাম, আপনিইতো প্রথমে কথা বলেছেন।

-আবার কথা, যাইবি না ভুঁড়ি গালাইয়া দিমু। যা ফোট….

এই কথায় হাফ ছেড়ে বাঁচলো সফিক। আজ সকালে কার মুখ দেখে যে উঠেছে মনে করতে পারছে না। দুপুরে বড় আপা ফোন দিয়ে বলছে অফিস থেকে এক ঘন্টা আগে বের হয়ে বাসায় যেতে। সবই ঠিক ছিল, হঠাৎ আপার বাসার কাছে এসেই এই রকম বাজে একটা অবস্থায় পড়তে হবে কে জানতো। দেখতে শুনতে ভালো অথচ এমন ফাজিল কোন মেয়ে আগে দেখেছে বলে তার মনে পরে না।

কলিং বেল শুনেই আপা দরজা খুলে দিল।

-আপা ফ্রীজের এক বোতল ঠান্ডা পানি দে তো

-আগে ফ্রেস হয়ে আয় আমি শরবত করে দিচ্ছি, এসে সঞ্চয়িতার পঁয়ত্রিশ নাম্বার পৃষ্ঠাটা খুলে দেখিস।

ছোটবেলা থেকেই আপার এমন অভ্যাস, ছোট ছোট চিরকুট রেখে বিভিন্ন কিছু করাবে, জন্মদিন অথবা অন্য কোন উপলক্ষে উপহার দিবে। আজ সফিকের জন্মদিন না সুতরাং কোন উপহার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফ্রেস হয়ে এসে স্বাভাবিকভাবেই সে সঞ্চয়িতাটা নিয়ে বসার ঘরে এসে পঁয়ত্রিশ নাম্বার পৃষ্ঠা খুললো। যা ভেবেছিল তা’ই, আপা একটা চিরকুট লিখে রেখেছে। “শেষ পৃষ্ঠায় একটা ছবি আছে, পছন্দ হলে বইটা টেবিলের উপর উল্টো করে রাখিস।”

চরম কৌতূহল নিয়ে সফিক আস্তে আস্তে শেষ পৃষ্ঠাটা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলো। এতো সেই মেয়ে যে কিছুক্ষণ আগে তাকে তুই তোকারি করে গেল!

আচ্ছা, তুই তোকারি করাটা আপার কোন বুদ্ধি না তো?

_________________________

১১.০৯.২০১৮

দুই শালিকের গল্প

– মণি,
– আসি বাবা…
একমুঠো চালের দানা নিয়ে বারান্দায় আসে মণিকা। ছড়িয়ে দেয় উঠোনে।

এটা মনিকার প্রতিদিনকার প্রথম কাজ। সকালে মায়ের উঠোন-বাড়ি ঝাড় দেওয়া হয়ে গেলে বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিন মেয়েকে ডাকেন। আর মেয়ে যথারীতি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চালের দানা ছড়িয়ে দেয়।

তারপর বাপ-মেয়ে মিলে ব্রাশ করতে করতে সিঁড়ির পরে বসে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে দু’টো শালিকের খুঁটেখুঁটে দানা খাওয়া।

গত সন্ধেয় কালবোশেখি ঝড়ে উঠোন ঝরা লতাপাতায় ভরে ছিল। তাই আজ মায়ের একটু দেরি হয়ে গেছে উঠোনটা পরিস্কার করতে। আর সেজন্যেই শালিকের খাবার দিতেও আজ একটু বিলম্ব হয়েছেে।

– বাবা, ওরা তো আসছে না?
-আসবে, এক্ষুনিই আসবে। দেখ..
বাবার পেটে আস্তে করে একটা টোকা দিয়ে মনিকা বলল- ওই দেখ বাবা, আসছে।
দু’জনই শালিকের দিকে উচ্ছ্বসিত চোখে তাকায়।
-কিন্তু বাবা, আর একটা কই?
-আসেপাশে কোথাও আছে। দেখ্ এক্ষুনি আসবে।

শালিকটি এল। চালের দানাগুনো দেখল। একটা দানাও ঠোঁট দিয়ে তুলল না। শুধু এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।
-বাবা, ও বাবা, খাচ্ছে না কেন?
বাবাও ব্যাপারটা খেয়াল করছিলেন। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
– দাঁড়া, খাবে ‘খনে।
-খাচ্ছে না তো। ওই দেখ , না খেয়েই চলে যাচ্ছে-
– তাই তো- মনে হয় ওর সাথিকে ডাকতে যাচ্ছে।

কিচ্ছুক্ষণ পরে আবার ফিরে এল শালিকটি। কিন্তু এবারও ঠোঁট ছোঁয়াল না চালের দানায়। শুধু একবার চালের দিকে আর একবার ওদের দু’জনের মুখের দিকে করুণচোখে তাকাল যেন। তারপর গুটিগুটি পায়ে বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেল।

মণিকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল- ও বাবা, চলে গেল তো।

ততক্ষণে স্নান সেরে মাও এসেছেন। তিনজনে মিলে শালিক দু’টোর খোঁজে বাড়ির পেছনের বাগানের দিকে গেলেন।

হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে মণিকা- ওই তো একটা…
ওরা আর একটু এগিয়ে গেল। দেখল- একটা মৃত শালিকের পাশে মাথা গুঁজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শালিকটি।
মা বললেন- গতকালের ঝড়ে কোনোভাবে হয়তো মারা গেছে।

মণিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল সাথিহারা পাখিটির দিকে।

বাবা শক্ত করে মায়ের হাতটি ধরলেন।

অণুগল্পঃ দেড়খানা রুটি

ইটের ওপর হাতুরির কয়েকটা ঠোকা দিয়েই সে খুকখুক করে কেশে ওঠলো। লোকটার নাম সনোজ। তনির সনোজ দা। বয়োবৃদ্ধ; দেখতে ষাটের ওপরে লাগে। লম্বা রোগা গড়ন। পুরানো শ্বাস কষ্টের রোগ আছে। তার জন্য তনির বড় মায়া হয়।

সনোজের দিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে এনে তনি আকাশের দিকে তাকালো। এরপর সে আঁচল দিয়ে নিজের চোখ কচলালো। কপাল বরাবর হাত রেখে সে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যের অবস্থান দেখলো। বেশ বেলা হয়ে গেছে।

-দাদা খাইবেন না? তনি জানতে চাইলো
-তোমার বৌদি তো এখনো খাবার নিয়া আইলোনা। সনোজ জবাব দিল।

দুপুর হলেই তার স্ত্রী কাপড় দিয়ে বিশেষ কায়দায় থালা বেঁধে খাবার নিয়ে আসে। আজ আর আসবে কিনা তনির শঙ্কা হচ্ছে।

সনোজের সাথে কথা না বাড়িয়ে তনি দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। খাবার মানে নরম গুড় দিয়ে রুটি। অমৃতের মতো স্বাদ। সাথে কাঁচা মরিচে কামড় দিতে পারলে আরও স্বাদ হতো। দেড়টা রুটি খেয়ে বাকি দেড়খানা সে রেখে দিলো। মোট তিনটা এনেছিল। সনোজের স্ত্রী যদি খাবার নিয়ে আসে তাইলে বাকি দেড়খানাও সে খেয়ে নেবে । ইট ভাঙ্গা বড়ই কঠিন কাজ; খুব ক্ষুধা লাগে।

তনির পুরো নাম তনিমা বালা। মধ্যবয়সী। তবে গায়ে গতরে সে একেবারে যুবতী। চোখে কাজল পরে সে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যায় পাড়ার যুবক পোলাপান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয় থাকে।

সনোজের মতো তনিও এই জায়গায় বহুদিন ধরে ইট ভাঙ্গার কাজ করে। ছোটকালে বাবা মা জোর করে তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছিল ঠিক; কিন্তু তার সংসার হয়নাই। ভিন্ন কিসিমের মেয়ে সে। ভাবতে জানে, বুঝে নিতে জানে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। আরজ আলী মাতব্বর কয়েকবার পড়েছে। সারাদিন ইট ভেঙ্গে ঘরে গিয়ে সে তার মতো করে হিসেব করে, কতোটা জীবন ভাঙ্গলো আজ !

তনি খেয়েছে তাও প্রায় আধা ঘণ্টা হয়ে গেলো। সনোজের খাবার এখনো আসেনাই। এরকম অনিয়ম ইদানিং মাঝে মধ্যেই হয়। কারণ তার স্ত্রী দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জ্বরে ভুগছে। অল্প অল্প জ্বর; বিকালের দিকে ওঠে। কেউ কেউ বলে, ওটা ক্ষয়রোগ। সনোজই এই খবর সবাইকে বলেছে। তনির মনে হয় তার সনোজ দারও ক্ষয়রোগ আছে। সে নিজের চোখে দেখেছে, মানুষটার কাশির সাথে রক্ত যায়। যাহোক, আজ হয়তো মহিলাটা ভালো নেই; তাই আসেনি। আসতে একটু সময়ও লাগতে পারে। কম করে হলেও তো দুই কিলো পথ। কুমার পাড়ায় বাড়ি।

এক কুড়ির বেশি লোক এখানে ইট ভাঙ্গার কাজ করে। কিন্তু সনোজ সবদিনই সবচেয়ে কম মাইনা পায়। কেমনেই বা বেশী পাবে? গায়ে শক্তি নাই; বেশি ইট তো ভাঙ্গতে পারেনা। ইটের খোয়ার মাপেই না মাইনার মাপ হয়। মাঝে মধ্যে কিছু টাকা বা এটা সেটা সনোজকে কিনে দিতে তনির খুব ইচ্ছে হয়। কেন এমন ইচ্ছে হয় সেই কথাটা তার গোপন সিন্দুকে যত্ন করে রাখা আছে। রাজা রাণীদের যেমন মজবুত গোপন সিন্দুক থাকে; ফকির মিসকিনদেরও তেমনি। আসলে সবারই। অন্যকেউ সেটার চাবির খোঁজ জানেনা। তনিরটাও না!

তনি আবার সূর্যের দিকে তাকালো। সে ভাবলো, এতো বেলা না খেয়ে সনোজ দা ভালো থাকবেনা। রেখে দেয়া দেড়খানা রুটি নিয়ে সে সনোজের জন্য ওঠবে ওঠবে করছিলো, তখনই দূরে তার সনোজবৌদির মতোই কেউ একজন আসছে দেখলো। একটু পর নিশ্চিত হলো, তাইই। হাতে সেই চেনা কাপড়ে বাঁধা থালা।

এক ঢোক জল খেয়ে তনি চোখ বন্ধ করে রইলো। তার ভালো লাগছেনা। কিছুক্ষণ পর ইট ভাঙ্গার হাতুরিটা সে আবার হাতে নিলো। অদূরে সনোজের স্ত্রী আঁচল ভিজিয়ে স্বামীর মুখ মুছতে মুছতে আফসোস করছে, “মুখটা কেমন শুকাইয়া গেছে”!

তনির মন আরও ভার হলো। চোখের সামনেই কিছু কাক তার দেড়খানা রুটি ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলো। অথচ সে তা খেয়াল করলোনা!

হাতুরি হাতে তনিমা বালা মনোযোগ দিয়ে জীবন ভেঙ্গে চলছে।

বড়াই!

পর পর দুইবার বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন আব্দুল কুদ্দুসের মেয়ে মুক্তা, যার রুপ যৌবনে চোখে ছানী পড়ে যেতো সাধারণের। একটু রোদ্দুরে গেলে মুখ মন্ডলের চামড়া ফেটে যেন রক্ত বের হবে, কতো যুবক যে রাস্তার পাশের গর্তে পরে হাত পা ভেঙেছে তার হিসেব নেই।

তবুও সময় বয়ে চলে নিজস্ব গতিতে, সময়ের কাছে সবাই পরাজিত, কেউ বুঝে কেউ বুঝেও বুঝে না সময়ের মূল্য। একদিন এই মুক্তার রুপ যৌবন ও থাকবে না, থাকবে না নিজেকে বয়ে বেড়ানোর শক্তি। কতোজনাই এলো আর গেলো কেউ ধরে রাখতে পারেনি, পারবেও না। আজকের বিদ্যা বালান, স্বরা ভাস্কর, মাধুরী আর সেদিনের শ্রীদেবী। সবাই একদিন পরিত্যক্ত ডাস্টবিন হয়ে পরে রবে, অনেকেই হিনো টাটা গাড়ির মতো পরিত্যক্ত ডিপোতে পরে থাকবে, এটাই বাস্তবতা।

গ্রামের কতজনার মুখে দাদা দাদীর কতো কথা শুনেছি এবং শুনি, তাদেরও রুপ যৌবনে গ্রামে হানাহানি হতো। পাশের বাড়ির হেলাল ভাইয়ের বউ মানে ভাবীকে তো নিজ চোখে দ্যাখা, আজ সবাই শান্ত। কোনো কিছুর বাহাদুরি নেই। আগের মতো মুখে এখন আর তাদের রুচিও নেই, চোখেও ঝাপসা দেখে, তিনবার ডাকলে কোনো রকম একবার সাড়া দেয়।

এটাই সত্য, এটাই চিরন্তন, অন্তিম মুহুর্তে সৃষ্টিকর্তা কোন দায় নেয় না, যত বড় পালোয়ানই হইনা ক্যানো কিংবা যত সুন্দরীই হই না ক্যানো সামান্য একটা উছিলা দিয়ে যেকোন সময় ওপারে পাঠায়ে দিবে। কেউ খুঁজে পাবে না কুদ্দুসের মেয়ের রুপ যৌবন। ভালো কর্ম ছাড়া কেউ মনে রাখবে না, ভালো কর্ম মৃত্যুর পরেও বাঁচিয়ে রাখে যুগযুগান্তর। এসো বাঁচতে হলে ভালো কিছু করি, সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করি, তাঁর দেখানো পথে চলি। কখন যে শেষ কামড় দ্যায় কেউ জানি না।

অণুগল্পঃ আবার পোষ্টমাষ্টার

ফিরিয়া লাভ নাই জানিয়াও বছর কয়েক পর তাহার ক্ষণিক ফিরিবার সাধ জাগিলো। একান্ত করিয়া পাইবার বাসনা হইতে নহে, শুধু এইটুকু বুঝিবার জন্য যে, অতোদিন পরে রতনের মনে কতোখানি জায়গা জুড়িয়া তিনি অবস্থান করিতেছেন।

অত:পর তিনি পুরাতন কর্মস্থলে পৌঁছিলেন । নতুন পোষ্টমাষ্টারের সাথে তাহার আলাপ হইলো; কৌশলে রতনের কথা জানিতেও কার্পন্য করিলেননা। ইহাতে তিনি বুঝিলেন, কোন কিছুই কাহারো জন্য পড়িয়া থাকেনা।

আবারো নৌকায় পাল উঠিলো । তাহার জন্য আর কেহ অশ্রুসিক্ত চোখে পাড়ে দাঁড়াইয়া থাকিবার নাই জানিয়াও তিনি বার বার পিছনে ফিরিয়া তাকাইলেন। তারপর বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া মনে মনে বলিলেন, “এই পৃথিবীতে সত্যিই কেহ কাহারো নহে” !

(দ্রষ্টব্যঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “পোস্টমাস্টার” গল্প)