বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

আক্কেল সেলামী

873947

শীতের কোনো এক সন্ধ্যা! বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম যাবো, আমার অনেকদিনের ইচ্ছা বিনা টিকেটের যাত্রীদের মত আমিও ট্রেনে যাই। তাই ভাইয়ের গাড়িতে না গিয়ে চলে গেলাম ফেনী রেল ইস্টিশনে। অপেক্ষার প্রহর শেষে ১৮:০৫’র ট্রেন আসলো ১৯:১০টায়। টিকিট ছাড়াই উঠে পড়লাম ‘ঠ’ বগিতে। ভিতরে দেখা হল আমার এক বন্ধুর সাথে। সে সিলেট থেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি যে বিনা টিকেটের যাত্রী তার বৌর সামনে কেমনে বলি তাই সিগারেট খাওয়ার নাম করে আমি চলে এলাম দরজার পাশে। শীতের সন্ধ্যা বেলার বাতাস লাগছে; আমি চাদর মুড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছি আর কল্পনার রাজ্যে নিজেকে হারিয়ে দিলাম। হঠাৎ চা ওয়ালার ডাক; আমার ঘোর কেটে গেলো। এক কাপ চা খেয়ে দরজার পাশে পা দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। জোৎস্না রাতে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগে মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার পিঠের সাথে নরম কি যেন লাগছে, পিছনে তাকাতেই দেখলাম তিনটা মেয়ে আমার মাথার উপর দিয়ে বাহিরে উঁকি দিতে চেষ্টা করছে। আমি কিছু না বলে বাহিরের দিকে মনোনিবেশ করলাম। তারা আমাকে উঠানোর জন্য কখনো গণ্ডার ( ঠান্ডা পড়ছিল) আবার কখনো চাচা ( চাদর মুড়িয়ে বসেছিলাম) বলে কটূক্তি করছিল। অনেক চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে নরম সুরে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকছিল। আমিও নাছোড় বান্দা, শুনেও না শোনার ভান করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। শেষ মেশ উপায় না পেয়ে আমার পিঠের উপর হাত রেখে ডাকছিল। তারপর আমি উঠে জানতে চাইলাম-

কি সমস্যা?
আমরা দরজার সামনে দাঁড়াবো, আপনি সরেন।
আমি বললাম- মাইয়াদের ইয়েনে আইয়ুন নিষেধ।
আন্নেরা ইয়েনতুন যান।
একজন বলল-
আমরা এইখান থেকে যাব না, any problem?
আমি- ইংরাজি বুঝিনা, বাংলায় কন।
তারা হাসতে হাসতে আমাকে ক্ষেত, পাগল-ছাগল বললো, আমরা না গেলে আপনার কি সমস্যা?
আমি- আঁরতুন সিট নাই, হিল্যেই আঁই ইয়নে বইছি।
তারা- আমাদের সিটে গিয়ে বসেন।
আমি – না।
তারা- তাহলে আমাদের পিছনে দাঁড়াই থাকেন।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
তারা ইংরেজি বাংলা মিশ্রণে ছেলেদের নিয়ে বকবক করেই চলছে।

[১৫মিনিট পর]
আমি – এইযে আপনারা সরেন।
একজন- No.
আমি ইংরেজীতে কয়েকটা বাক্য তাদের উদ্দেশ্যে বললাম।
তাদের একজন- বাহ্ ! বেশি চালাক।
আমি- চেষ্টা করছি, এখন চলে যান।
আবার তারা ভুলভাল ইংরেজী বলছে।
আমি – আপনারা কি করেন?
অনেক ভনিতার পর তাদের একজন- আমি JSC দিলাম, উনি আগ্রাবাদ মহিলা কলেজে HSC 1st year আর অন্যজন অনার্সে ভর্তি হবে। আপনি কি করেন?
আমি – এম.এ, এল.এল.বি পড়ছি।
তারায় মাথায় হাত দিয়ে ভাইয়া অনেক ডিস্টার্ব করেছি, sorry..
আমি – its ok.
চলে গেলো তারা।

আমি সিগারেট ধরালাম আর মনে মনে হাসলাম, এই বয়সের মেয়েরা বুঝি পাখির বাসায় পাখা গোছানো ছোট পাখির মত উড়াউড়ি করতে চায়, এক পর্যায় হঠাৎ করে নিচে পড়ে যায়। যাইহোক, কিছক্ষণ পরে আসলো দুইজন। ( মনে হচ্ছিল ৩০ কি ৩২ বছরের দুইজন মোহনীয় মহিলা)
না তারা মহিলা নয় হিজড়া।
হিজড়া- এই দাঁড়া, দাঁড়া আমার পেয়ারে লাল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
হিজড়া এসে আমার একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো-
টাকা দে; নইলে তোর ঠোঁট কামড় ধরবো।
আমি তাড়াতাড়ি একশ টাকা বের করে দিলাম।
টাকা নিলো না। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো আমি কি শুরু করবো?
আমি ওদের হাত থেকে বাঁচার জন্য দুইশত টাকা দিলাম। তারপর আমার গালে একটা টোকা দিয়ে চলে গেল।

ট্রেন ও এসে ইস্টিশনে থামলো। ৮০ টাকা দিয়ে টিকেট না করে ২০০ টাকা হিজড়া কে দিতে হলো।

ঘোর

index-1

সারারাত ঘুম আসেনি। ভোরের মসৃণ হাওয়া ঘরে ঢুকতেই মনের ভেতর এক ধরণের মায়া তৈরী হয়, আজও হলো। ভেন্টিলেটরে চড়ুই পাখির কিচিরমিচির, বাইরে দোয়েল পাখির শিস। গায়ে একটা কাঁথা জড়িয়ে নিলাম, শীত করছে। শ্বাসকষ্টটা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে গেছে, ফের ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর জানা নেই, যে মৃত্যুকে ভয় পায়না তাকে বেঁচে থাকার ভয় দেখাতে হয়, যে যন্ত্রণা উপভোগ করে তাকে সুখ দিয়ে বিব্রত করতে হয়। শ্বাসকষ্টের বোকামীর জন্যও মায়া হচ্ছে। চোখ বন্ধ করছি, ঘুম আসছে না, ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি জমাট বাঁধছে তন্দ্রার ঘোর।

বিশাল একটা ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি আমি আর শুভময়। ঘরের দেয়ালগুলো দুধ সাদা, সিলিংয়ের রং সমুদ্রনীল। একপাশে বইয়ের আলমিরা, আলমিরায় হেলান দেওয়া দুটো গিটার। সিডি প্লেয়ারে সুজাত হুসাইন খানের কণ্ঠে ভর করেছে কবির দাস, সেতারের মখমল রিনিঝিনির সাথে সঙ্গত করে গাইছেন, ‘মোকো কাহা ঢুন্ড রে বান্দে, ম্যায় তো তেরি সাথ রে”, কণ্ঠে দরাজ দরদ নিয়ে গেয়ে যাচ্ছেন একের পর এক গজল, আলাপের ঢংয়ে। প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে, গরম সাদা ভাত আর ঝাল খাসি ভুনা দিয়ে ভাত খাচ্ছি। শুভময় ওর সুখের কথা বলছে, কষ্টের কথা বলছে, দীপান্বিতার সাথে অভিমানের কথা বলছে। এর মাঝেই খুব মন দিয়ে খাচ্ছে, হঠাৎ ওর বামহাতটা আমার কপালে রেখে বললো,
– তোর আবার জ্বর এসছে।
– হয়তো।
– হয় তো না, সত্যিই।
– শুভময়, তুই ভাত খেয়ে নে।

শুভময়ের কণ্ঠে কোমলতা খেলা করে,
– তুই খাবি না!
– না, রে। আর খেতে ভালো লাগছে না। তুই খেয়ে নে শুভময়।
– খেয়েছি, আমি যাই। দরজাটা খুলে দে।

ওর জন্য দরজা খুলতে যাবো, শরীর ব্যাথায় কুকড়ে উঠলাম। চোখ খুলে বিভ্রান্ত, বিছানা জুড়ে রৌদ্র, ঘরে আমি একা। দরজা বন্ধ, শুভময় নেই। কি আশ্চর্য!

আবার ব্যাথা বাড়ছে, মাথার দু’পাশে দুই দিনমুজুর ইটের পরিবর্তে প্রতিটি শিরা উপশিরা আর পেশীগুলো ভাঙছে… ভাঙছে.. ভাঙছে। রাতের নির্জন সালামিনোস স্ট্রিট, দ্রুতগামী একটা গাড়ি মটর সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো, তাদের খুব তাড়া আছে হয়তো। পলকা কাগজের মত ছিটকে পড়লাম অনেকটা দূরে- উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পারলাম না, সেই কবেকার কথা, আজও স্পষ্ট।

স্মৃতির সিনেমোস্কোপে ঘুরছে রিল, এম্বুলেন্সের সাইরেন.. হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের ব্যস্ততা, চোখ খুলে রাখতে পারছি না। আবছায়া হয়ে হাসপাতালের সব মুখ। আবহ সঙ্গীতের মত শুধু বেজে চলেছে গ্রিকভাষী কারো ইংরেজি মন্তব্য “তেক মেন্তাল প্রিপারেশন, ইউ ক্যান নত সারভাইভ..তেক মেন্তাল প্রিপারেশন, ইউ ক্যান নত সারভাইভ… তেক মেন্তাল প্রিপারেশন, ইউ ক্যান নত সারভাইভ… “, তার বয়েসী গ্রীক মুখশ্রী.. ফর্সা মুখ জুড়ে দেবতা ক্রোনোসের মত শাদা দাড়ি.. তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে.. চারপাশের সব শব্দ অস্পষ্ট হয়ে আসছে..বোধ তার সকল অহংকার নিয়ে সমর্পিত হচ্ছে বোধহীনতার কাছে। সমর্পনের মাঝখানে উঠে এলো বহুদিন আগের এক ছুটির দিন। বেইলি রোডের ব্যস্ততাশূন্য দুপুর। রোদ মেঘ আর হাওয়ায় মিলেমিশে একাকার বাইরে, সুইসের ভেতর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া। ভিকারুননিসার কণ্ঠে আহ্লাদ,
– নটরডেম, তুমি একদিন নদী দেখাতে নিয়ে যাবে?
– তুমি যাবে?
– হ্যা, যাবো। বুড়িগঙ্গা নদী নয়, অন্য কোনো নদী..। আমার খুব নদী দেখতে ইচ্ছে করছে, তোমার সাথে নদী দেখতে না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।

নটরডেম পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে ভিকারুননিসার চোখে, গাঢ় স্বরে বলে-
– আমার সাথে নদী দেখতে না পেলে মরে যাওয়াটা কাজের কথা নয়।
– জানিনা কিসের কথা, নদী দেখতে না পেলে আমি মরে যাবো, ঠিক ঠিক মরে যাবো।
– ভিকারুনিসা, এই একটা জীবনে আমাদের বহু মরে যাওয়া বাকী, যেখানে সেখানে মরে যাওয়াগুলো অপচয় করা ঠিক না।
বিভ্রান্ত চোখে তাকায় ভিকারুননিসা,
– তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
নটরডেম কোনো উত্তর দেয় না, দুজনের গ্লাসে গলে আইসকিউব, কোক আরও শীতল হয়ে আসে। নিরবতা ভেঙে নটরডেম বলে,
– শঙ্খ নদী দেখতে যাবে? তুমি আর আমি।
– শঙ্খ নদী! কোথায় এই নদী!
– বহু দূর! দুপাশে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, সবুজ যে কত রকমের হতে পারে, পাহাড়ের চূড়োয় কখনো বা মেঘ, আর পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা লক্ষ্মী এক নদী- শঙ্খ। তুমি সাঙ্গু নামেও ডাকতে পারো।
– ভীষণ সুন্দর, তাই না!
– হুম।

ভিকারুননিসা মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে,
– ওই নদী কতদূর?
– বান্দরবান।
– ওহ! অনেক দূর?
– হুম।
– নটর ডেম, আমি তোমার হাত ধরে বসে থাকবো, সারাক্ষণ। নদীর তীরে- তোমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাটবো। তুমি কিন্তু বকতে পারবে না।
– বকবো না।
– দেখো, একদিন ঠিক ঠিক যাবো, তোমার সাথেই যাবো।

নটর ডেমের স্বরে দীর্ঘশ্বাস আড়ালের চেষ্টা,
– ততদিন নদী যেনো ডুবে না যায়। ততদিন তুমিও না হারাও।
হেসে ওঠে ভিকারুননিসা,
– হি.. হি.. হি.. আমি হারাবো না। হি.. হি.. হি.. নদী আবার ডুবে না কি!
– নদী ডুববে না কেনো। নদীও ডুবে যায়। শেষতম ভ্রমণ শেষে উড়তে ভুলে যায় পাখি। প্রেম মরে যায়, জেগে থাকে চোরাটান।
– আর?
– বিচ্ছেদ দিগন্তে যায়, বিরহ তত দীর্ঘ নয়।

ভিকারুননিসা দাঁতে নোখ কাটে, নটর ডেমের হাতে হাত রাখে, স্বরে কৌতূহল,
– তোমার খুব মন খারাপ, নটর ডেম?
– নাহ, মন খারাপ না।
– তোমাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবেনা তো!

নটর ডেম হেসে ওঠে,
– তুমি কি আমায় ছেড়ে যাবে, ভিকারুননিসা!

বেইলে রোডের ব্যস্ততাশূন্য ছুটির দুপুরে নেমে আসে কি অরণ্যের নির্জনতা! দু’জন দু’জনের চোখে খুঁজে যায় নির্ভরতা, অল্প বয়সের ভুল জানেনা কোনো নির্ভরতাই চিরস্থায়ী নয়। ঝাপসা হয়ে বেইলি রোড, শ্বাসকষ্ট বাড়ছে, মাথার ব্যাথা আরও তীব্র হচ্ছে। চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। কপালে হাত রাখে শুভময়। জানতে ইচ্ছে করেনা এতক্ষণপর কোথা থেকে এলো, শুভময় বলে,
– তোর জ্বরটা কিন্তু বাড়ছে।
– বাড়ুক।
– কাউকে ডাকি?
– না, কাউকে ডাকতে হবেনা।

শুভময় সিডি প্লেয়ারের ভল্যুউম কমিয়ে দেয়, নিয়াজ মোহম্মদ চৌধুরী গাইছেন “তোমার যাবার সময় বুঝি হয়ে যায়/আমার দেবার কিছু বাকী রয়ে যায়/এভাবে চলে যাবে তুমি।” গান বাজছে, শুভময়ের চেহারাটা ভিকারুননিসার মত হয়ে আসে, অথবা এতক্ষণ সেই ছিলো ছদ্মবেশে, খুব করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,
– নিজের প্রতি এত অবহেলা কেনো, তোমার?
– জানিনা।
– আমার ওপর রেগে কেনো নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো নটর ডেম?
– আমি কারো ওপর রেগে নেই। নিজেকে কষ্টও দিচ্ছি না।
– দিচ্ছো তো!
– সে তোমার ভুল ধারণা, ভিকারুননিসা। আমার কাছে সবকিছু উপভোগ্য। এমন কি, তুমি যে চলে গেছো তাও আজ উপভোগ্য।
বাইরে একটা কাক ডাকছে, খুব কষ্ট করে মুহুর্তের জন্য চোখ মেলতেই দেখলাম ঘরে রোদ নেই, বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে! অথবা চোখই মেলিনি, সব বিভ্রম। ভিকারুননিসা কথা বলে ওঠে,
– আমার চলে যাওয়া তোমার কাছে উপভোগ্য?
– হুম। তবে, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো সবকিছু অর্থহীন, আমি যেনো এক আমূল ডুবে যাওয়া নদী, শেষতম ডানা ভাঙা পাখি।
– তারপর?
– তারপর বহুদিন পর, ছাই থেকে হয়ে উঠি ফিনিক্স পাখি, মনসুখিয়ার ডাকে।
– মনসুখিয়া কে?

নটর ডেম এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বহুক্ষণ পর কানের কাছে কথা বলে ওঠে শুভময়, কষ্ট করে তাকাতে দেখি শুভময় নেই। শুভময়ের থাকার কথাও না, ষোলো বছর আগে যে মরে গেছে তার উপস্থিতি শুধুই বিভ্রম। তবু আজ হঠাৎ, বহুদিন পর, সারাদিন থেকে থেকে শুভময় ডাক দিয়ে যাচ্ছে। ভিকারুননিসা জানে, আমি তার নাম কেটে দিয়েছি বহু আগে, তবু কেনো বারবার সে আসে! মোবাইলের মেসেজ এলার্ট বেজে ওঠে, আঙুলের সকল ব্যাথা তুচ্ছ করে মোবাইল সেটটা হাতে নেই, মেসেজ খুলতেই মনের ভেতর ডেকে ওঠে রোদ্ররঙা ফিঙে, প্রিয় অভ্রবকুল লিখেছে, “ইশ! এভাবে কেউ অসুস্থ হয়! সুস্থ হয়ে ওঠো তারাতারি, কি মনসুখিয়ায় যাবে না!” অভ্রবকুল কি জানে সেই আমার মনসুখিয়া! কোনো প্রয়োজন নেই জানার, একটা জীবন কেটে যাক মৌলিক বিভ্রমে।

#মনসুখিয়া-২

প্রণয়চূর্ণ … [মনসুখিয়ার নতুন পর্ব]

index-1

১.
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছে একদিন আগে। অফুরন্ত অলস অবসর। সকালে দেরী করে ঘুম থেকে জাগবে, তাই একটা টাওয়েল ভাজ করে ল্যান্ডফোনের উপর দিয়ে রেখেছে নটরডেম, যাতে এনালগ সেটের কর্কশ আওয়াজে ঘুম না ভাঙে। ১৯৯২ সালে দেশে ডিজিটাল ফোন ছিলো না। রাত জাগার অভ্যাস তার পুরানো, ঘুম না আসায় বই পড়তে শুরু করেছিলো সে, কখন যে ঘুমের দখলে চলে গেছে বুঝতেও পারেনি। ওর ঘুম হালকা হয়ে এলো ক্রিইইইং… ক্রিইইইং… ক্রিইইইং… শব্দে। বহুক্ষণ বুঝতে পারছিলো না শব্দটা স্বপ্নে হচ্ছে কি ফোন বাজছে। দু’তিনবার থেমে আবার টানা বাজতেই ঘুম ঘুম চোখেই ফোন রিসিভ করলো নটরডেম,
– হ্যালো।

ওপাশে নিরবতা, আরও দু’বার হ্যালো বলতেই ওপাশে কলকলিয়ে উঠলো ভিকারুননিসা,
– হিহিহি… হিহিহি… এই সাত সকালে কে ফোন করেছে বলে মনে করেছো?

প্রিয়তম কণ্ঠ শুনে নটর ডেমের ঘুম কেটে যায়, তবুও ঘুম ঘুম স্বরে বলে,
– ওহ তুমি! আমি ভেবেছিলাম পপি ফোন করেছে।

ফোনের ওপাশে হাসি থেমে যায়, গম্ভীর কণ্ঠ,
– পপি কে?
– কেউ না।
– সত্যি করে বলো, নটরডেম।
– সেটা জানলে তুমি রাগ করতে পারো।
– রাগ করলে করবো, তবুও বলো।
– বাদ দাও।

ভিকারুননিসার কণ্ঠে জেদ,
– বাদ দিবো না, পপি কে? বলো, পপি কে?

অপরাধীর মত স্বরে ঢোক গিলে নটরডেম বলে,
– জানতেই যখন চাইছো তখন বলছি, পপি মানে.. পপি হলো.. পপি ওই যে..
– ঢং করবে না। একটুও ঢং করবে না। পপি কে?
– পপি হলো চিত্রনায়িকা ববিতার ডাক নাম। উনি আমাদের কাছাকাছি বাসায় থাকতেন, তাই নামটা জানা।
– আমাকে বোকা পেয়েছো? উনি তোমাকে ফোন করবেন কেনো?
– স্বপ্ন দেখছিলাম, ববিতা গাইছেন, “ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না.. “আর তখনই ফোন বেজে উঠলো যে…

ফোনের ওপাশে বোমা বিস্ফোরণ,
– তুমি একটা.. তুমি একটা.. তুমি একটা..
– হাহাহাহাহাহা, আমি একটা কি?
– তুমি একটা রোগা জাম্বু।
– হাহাহা, এইটুকুই?
– আজ সামনে আসো, তখনই বুঝাবো তুমি আর কী কী।

ভিকারুননিসার সকল অভিমান, রাগ, খুনসুটি নটরডেমের বুকে একরকমের বোধ তৈরী করে। শিরায় শিরায় প্রবাহিত এই সুখের মত অসুখের বিস্তার প্রকাশের যথাযথ শব্দ তার অজানা। ও শুধু অনুভবের গভীরতা বোধ করে, মোহগ্রস্থ হয়। এ জীবন তার সকল অপ্রাপ্তিময় যাপন নিয়েও দোলায়িত হয় সুখে, ভালোলাগায়, আনন্দে আর ভালবাসায়। উচ্ছাস মিশ্রিত সতেজতায় জানতে চায়,
– আজ দেখা হবে? সত্যি!
– শোনো, বাবা কালকের ফ্লাইটে আয়ারল্যান্ড গেছেন। মা’কে কোচিং আর বান্ধবীর বাড়ির কথা বলে আজ সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারবো। তুমি আসবে, নটরডেম? কতদিন তোমাকে দেখি না।
– ক’টায় দেখা হচ্ছে?
– সাড়ে তিনটায়, সাগর পাবলিশার্সের সামনে থেকো।
– ভিকারুনিসা, আড়াইটা থেকেই সাগর পাবলিশার্সে থাকবো। কিছু বই কিনবো। এরপর তুমি এলে দু’জন মিলে বেইলি রোড থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাবো, ওখানে দুটো বই জমা দিয়ে নতুন দু’টো বই নিবো। তারপর রিকশায় ঘুরবো।

কলকলিয়ে ওঠে ভিকারুননিসা,
– ঠিক আছে, রোগা জাম্বু হিহিহিহি..
– হাহাহাহা, লাভ্যু পপি।

ফোন রাখতেই নটর ডেমের মনটা বন্ধনহীন অথচ সংযত উল্লাসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই চারদিকে সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে। বিছানায় কুঁচকে যাওয়া চাদরটাকেও মনে হয় শিল্পকর্ম। শুরু হচ্ছে আরেকটা নতুন দিন। দোতলার ছাদের রেলিংয়ে শিস দিচ্ছে দোয়েল। নটরডেম খোলা ছাদে হাটছে, ভোরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। ও জানে প্রতিটা ভোরের ঘ্রাণ আলাদা এবং নতুন। সূর্যটা পুরানো হলেও প্রতিদিনের রোদের রঙ ও তেজ নতুন। ছাদের টবে ফোটা বেলী ফুলের ঘ্রাণের সাথে বাখরখানির ঘ্রাণ মিশে যেতেই বুঝতে পারে বাড়ির উল্টোদিকে শমসের চাচার বাখরখানির দোকানে রুটি বানানো শুরু হয়েছে, দোকানের সামনে বসে মাঠা বিক্রি করছে জগৎ কাকা। আর ঘণ্টাখানেক পর রহমান কাকার কনফেকশনারি দোকান থেকে ভেসে আসবে ক্বারী আবদুল বাসিতের কোরআন তেলওয়াতের শব্দ। মনে সরোদের সুরের মত রিনরিনে কৌতূহল জন্মায়- ভোরে ঘুম ভাঙাবে বলে কি ভিকারুননিসা সারারাত জেগে ছিলো, এখন বাজে মাত্র পৌনে ছ’টা।

২.
মা জেগেছেন। নিচ তলায় রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে। সকালে মা’র চেহারায় এক অবর্ণনীয় সুন্দর লাবণ্য খেলা করে। মা’র শরীর থেকে কোমল আভা বিচ্ছুরিত হয়। এই অলৌকিক আভার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়- অন্য কোথাও। পুরানো আমলের দোতলার ছাদের উত্তর পাশ থেকে রান্নাঘরটা দেখা যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মা’কে দেখে নটরডেম। সে জানে রান্নাঘরের ছোট্ট তিন ফিট বাই তিন তিন ফিটের জানালা দিয়ে মা উপরে তাকাবেন, তারপর রান্নাঘরের দরজায় এসে অপার্থিব নান্দনিক একটা হাসি ছড়িয়ে প্রশ্ন করবেন, “চা খাবি, বাপ?” আজও ব্যতিক্রম হলো না, চোখাচোখি হতেই দরজায় এসে হাসি দিয়ে মা জিজ্ঞেস করলেন,
– চা খাবি, বাপ?
– হুম, তুমি খেয়ে অর্ধেকটা দিও।
– নিচে আয়।

নটরডেম সিড়ি ভেঙে নিচে নামে, সিড়িগুলোর একপাশে ফুলের টব, নয়নতারা ফুটে আছে আর ঘাসফুল ফুটবো ফুটবো করছে। মা’র শখের জিনিস, একটা ছোট্ট ডাল ভাঙলেও উনার চোখ এড়ায় না। মা তার পোষা টবের গাছগুলোর সাথে কি কথা বলেন, গাছগুলো কি বলে, “আজ কেউ আমার ফুল ছিঁড়েছে? দেখেছো!” বা “তোমার ছেলে আমার ডাল ভাঙলো কেনো- জিজ্ঞেস করো”। নটরডেমের জানতে ইচ্ছে করে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে অস্বস্তি লাগে। নিচে নেমে রান্নাঘরের সিড়িতে বসতেই প্রতিদিনকার মত মা বলেন,
– তোকে আলাদা মগে চা দিচ্ছি রে বাপ।
– না, মা। তোমার মগের অর্ধেকটা খেয়ে দাও।
– কারো এঁটো’টা খেতে হবেনা।
– মা, তোমার খাওয়াটা খাবো। চায়ের সাথে তোমার মুখের জর্দা দেওয়া পানের ঘ্রাণ লেগে থাকে যে, ওমন চা কোথায় পাবো!

মা মনে মনে খুশি হন, বাইরে প্রকাশ করেন না। আজ চা খাওয়ার আগে বললেন,
– আগে নাস্তাটা খেয়ে নে।

মা এক চুলোয় পরোটা ভাজলেন, আরেক চুলোয় মাংসের বাসি তরকারি হালকা আঁচে একটু পোড়াপোড়া করলেন। প্লেট আর বাটিতে সাজিয়ে রান্না ঘরেই খেতে দিলেন। নিচ তলার চৌকো উঠোনে কয়েকটা কাক নেমে এসেছে। এরা রোজ আসে মুড়ি, রুটি, পরোটা বা বাসি ভাতের লোভে। একটা বিড়ালও আসে। নটরডেম পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাদের দিকে দিচ্ছে, নিজেও খাচ্ছে। পায়ের সাথে শরীর ঘষছে বিড়ালটা, মা ওকে বাসি ভাত ঝোল মাখিয়ে খেতে দিলেন।

মা আজ ছাই রঙা পাড়ের হালকা নীল জমিনের একটা ঢাকাই শাড়ি পরেছেন। শাড়ি থেকেও মা মা ঘ্রাণ আসছে। নটরডেমের ভীষণ ইচ্ছে করে ভিকারুননিসার কথাটা মা’কে বলে। কিন্তু কথাটা আলজিভ পর্যন্ত এসে থমকে যায়। মা কি কিছু বুঝতে পারছেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
– কিছু বলবি বাপ!
– নাহ।
– আজ কি কোথাও যাবি? তোর জন্য নোনা ইলিশ আলু দিয়ে রান্না করবো ভেবেছি।
– মা, দুপুরে বের হবো। খেয়েই বের হবো। তবে ফিরতে একটু দেরী হবে।
– দেরী হবে! একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস বাবা।
– ৯টার মধ্যে ফিরবো। এরপর এক সপ্তাহ আর কোথাও যাবো না।

নটরডেম নাস্তা করছে, মা নাস্তা বানানো রেখে চা খান আর ওর চুলে বিলি কেটে দেন, নিজের মনেই বলেন,
– মনের ভেতর কি যে লুকিয়ে রাখিস, তা তুইই জানিস, বাপ। আচ্ছা, ভিকারুননিসা কে?
নটরডেমের বুকের ভেতর দশ লাখ সৈন্যের মার্চপাস্ট শুরু হয়, নিজে কে সামলে নিয়ে বলে,
– মা, ধরো ও কেউ না অথবা সবকিছু। কিংবা শুধুই বিভ্রম। তোমাকে একদিন ঠিক ঠিক বলবো।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেন, “এ বড় রঙিন বয়স বাপ, বড় রঙিন বয়স। সুর ভুল হলে মানিয়ে নেওয়া যায়, তাল কাটলেই গণ্ডগোল।”

৩.
কুঁচকানো কালো টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট শরীরে চাপিয়ে নটরডেম আড়াইটা বাজার দশ মিনিট আগে বেইলি রোডে পৌছায়। সাগর পাবলিশার্সে বসে আছেন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। নটরডেম টানা দু বছর ধরে এই দোকান থেকে বই কিনলেও তাকে কমই দেখেছে। তিনি প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘চরমপত্র’ পাঠ করতেন। স্বাধীনতা অর্জনের দেড়যুগ পর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিভিন্ন মঞ্চে ওই সব চরমপত্র পাঠ করা হত, মিছিলের আগে বা পরে চরমপত্র টনিকের মত কাজ করতো, রক্তে দোলা দিত- নটর ডেমের স্পষ্ট মনে আছে। কারণ, ওই সব মিছিলে স্কুলে পড়ুয়া সেও দু’হাত তুলে শ্লোগান দিত, পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তো, পুলিশের লাঠি চার্জ আর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ার আক্রমণ হতে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিত, ফের আন্দোলনে নামতো।

সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমাকে জাগাও’ কবিতার বই দুটো ক্যাশ কাউন্টারে রাখতেই তিনি জিজ্ঞেস করেন,
– তোর পরীক্ষা কেমন হইছে?
– জ্বি, ভালো।
– প্রতি মাসে যে বই কিনোস, টাকা কি বাবার কাছ থেকা নিস?
– না, টিউশনির টাকা থেকে কিনি।
– বাহ! ভালো ভালো।

সামান্য ক’টা কথাতেই নটরডেমের মন ভালো হয়ে যায়। বই কিনে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ায়। আকাশে মেঘ জমছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। শ্রাবণ মাস, যে কোনো সময় ঝুম বৃষ্টি নামবে। বাতাসটা বৃষ্টির আঁচে ভেজা। আচ্ছা, এই মেঘলা আকাশ দেখে ভিকারুননিসা কি আসবে! বা সে আসার আগেই কি বৃষ্টি নামবে!

৪.
সাড়ে তিনটা বাজতে আরও ত্রিশ মিনিট বাকী, প্রতিটা মিনিটকে ঘণ্টার সমান মনে হচ্ছে। সময়ের নিয়ম সে চলবেই, তাই সাড়ে তিনটাও বাজলো। ভিকারুননিসার দেখা নেই, পৃথিবীর সব বিষাদ নটরডেমের বুকে জমা হয়, চোখে জমে মেঘ। তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। এর ঠিক আট মিনিট পর ভিকারুননিসা উপস্থিত হয়, মেঘলা দিনে সাদা আর লেমন গ্রিন রঙে ম্যাচ করা ড্রেসে আর খোলা চুলে তাকে নিটোল সুন্দর লাগছে। রিকশা থেকে না নেমে ইশারায় নটর ডেমকে উঠতে বলে। নটরডেম রিকশায় উঠে হুড ফেলে দেয়, সে চায় চারপাশে সবাই দেখুক এক কাঠুরের পাশে বসে আছে রাজকন্যা, এই পৃথিবী সাম্যের।

রিকশা ছুটছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দিকে, হাওয়ার দাপট বেড়েছে। নটরডেমের কেনা বই দু’টো দেখে ভিকারুন নিসা প্রশ্ন করে,
– নটর ডেম, এত বই পড়ো?
– নাহ, বইয়ে শুধু চোখ বুলাই, আমার একমাত্র পাঠ্য তুমি। কিন্তু হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা বলে অনেকটাই বুঝতে পারি না।
– হিহিহি.. আচ্ছা তুমি কি হতে চাও?
– যেমন?
– কেউ ডাক্তার হয়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিসিএস ক্যাডার, কেউ লেখক, তুমি?

ভিকারুননিসার চোখে চোখ রেখে নটর ডেম বলে,
– অতো জটিল কিছু হতে চাই না। আমি হতে চাই ধরো তোমার চুলের ক্লিপ, জামার বোতাম, বা গলার চেইনের লকেট! অথবা আমৃত্যু এক জোড়া হুক।
– অসভ্য একটা। খুব অসভ্যতা শিখেছো, তাই না!
– আরে অসভ্যতা নয়, অথবা ধরো তোমার ছায়া। সকালে আর বিকেলে প্রলম্বিত ছায়া, দুপুরে পায়ের নিচে জমাটবদ্ধ, আজকের মত মেঘলা দিনগুলোতে প্রায় অদৃশ্য, দেখাই যায়না এমন।
– অদৃশ্য হতে হবে না, আমি সবসময় তোমায় দেখতে চাই।
– হাহাহা, তবে ছায়া নয়, তোমার স্নানের অশেষ সাবান বা গায়ে মাখার অল সিজন লোশন।

লজ্জায় ভিকারুননিসা কিছুটা বিব্রত হয়ে ওঠে, তার ফর্সা চেহারায় লালাভ আভা, কণ্ঠে কপট শাসন,
– ধ্যাত! চুপ করো। তোমায় আজ অসভ্যতায় পেয়েছে।
– হ্যাঁ, চলো এই একটা জীবন কাটিয়ে দেই অসভ্যতায়- মরে যাই, ফের জন্মাই, সেও অসভ্যতায়।
– ছি: নটরডেম, অসভ্যতা কি ভালো!
সিরিয়াস হয়ে ওঠে নটর ডেম,
– প্রিয় ভিকারুননিসা, তুমি কি জানো অসভ্যতা শব্দটাই সভ্যতার মিথ্যে আবিষ্কার, ফাঁপা আস্ফালন।
– মানে?
– মানে, তুমি যা অসভ্যতা বলছো সেটাও ভিন্ন মাত্রার সভ্যতা। অরণ্যে যে মানুষরা নগ্ন থাকে তাদের সভ্যতার রুচিটা আলাদা, আমরা যারা শরীর ঢেকে রেখে সভ্য হই তাদের রুচিটা আরেক রকম।
– তাই?
– তাই নয় তো কি! যে অরণ্যেবাসী কাঁচা মাংস খায়, সুযোগ পেলে মানুষের মাংস খেতে দ্বিধা করেনা, তারাও হাসে কাঁদে, শিশুদের স্নেহ করে, বুনো জন্তুর আক্রমণ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে সঙ্গী সাথী ও পরিবারের সদস্যদের একা রেখে কাপুরুষের মত পালায় না।
– সত্যি?
– হ্যা, সত্যি। তারাও ভালবাসে, পরস্পরকে আদর করে। তাদের সংসারেও আসে নতুন অতিথি, জন্মের প্রথম কান্নায় আনন্দে ভাসে সংসার, অরণ্যের আদিম চারদিক।

ভিকারুননিসা বিভ্রান্ত স্বরে জানতে চায়,
– নটর ডেম, তুমি আমাকে অসভ্য হওয়ার লোভ দেখাচ্ছো?
– না, লোভ দেখানোটা এক ধরণের সভ্য মানুষের কাজ। অবশ্য লোভকে মানসিক বিকারও বলতে পারো, অসভ্যতা আর মানসিক বিকারে যোজন যোজন ফারাক।
রিকশা চলছে। অফিস ছুটির দিন বলে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা। কিছুক্ষণ কারো মুখেই কথা নেই, হাওয়ায় ভিকারুননিসার চুলে মাঝে মাঝেই উড়ে এসে নটরডেমের মুখে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে, নটরডেম ভাবছে এ রিকশা যেনো অনন্তকাল চলতেই থাকে, চলতেই থাকে- একটা জীবন এভাবে কেটে গেলে কোনো ক্ষতি নেই। নিরবতা ভাঙে ভিকারুননিসা, কণ্ঠে কৌতূহল,
– নটরডেম, ওই অসভ্যতায় কি গ্রীষ্মের গরমে ব্যবহারের জন্য ফ্রিজ আছে? এসি?
– নাহ নেই, ওই সভ্যতায় এসব জিনিস খুব বেশী অসভ্য। তাছাড়া ঠাণ্ডা খেলেই তোমার টনসিল ফোলে, তোমার খুব কষ্ট হয়।
– ফুলুক, ঠাণ্ডা খেতে না পেলে মরেই যাবো।
– মরবে না, সেখানে আছে বিশল্যকরণী চুমো।
– হিহিহি, শখ কত! কিন্তু এর আগেই বাবা কান ধরে টেনে নিয়ে আসবে, হু।
– প্রেমিকার বাবা আর বড়ভাইগুলো সভ্যতার সঙ্কট, এক একটা মিনি সাইজ হিটলার।
– হিহিহি।

এলোমেলো কথায় যায় সময়। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা বাজতেই নটর ডেম বলে,
– চলো তোমাকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসি।

ভিকারুননিসা কিছু বলে না। নটরডেমের বাম হাতের পাতাটা নিজের ডান হাতে মুঠো করে ধরে রাখে, যেনো আর কখনোই ছাড়বে না। এই স্পর্শ নটরডেমের হৃদয়ে ও মগজে ছড়িয়ে দেয় ভালোলাগার অনুরণন, সুখের মত অসুখ প্লাবন হয়ে আছড়ে পড়ে মনে। নটরডেম প্রার্থনা করে সারাটা জীবন যেনো এভাবে কেটে যায়, দু’জনের পথচলা যেনো কোনোদিন অতীত না হয়। প্রতিদিন যেনো ভিকারুননিসা তাকে ডাকে, মনে মনে ‘সতত ডানার মানুষ’ হতে সে ভিকারুননিসাকে বলে- “অনুকম্পা হলে ডেকে নিও আমায় যে কোন সময়/আমি তো অতীতকাল নই যে ফিরে আসতে পারবো না কখনো।’

৫.
ফিরে আসা সহজ নয়, যতটা সহজ ফিরে যাওয়া। ভিকারুননিসা সাম্যের পৃথিবীতে কাঠুরেকে বাদ দিয়ে খুঁজে পেয়েছিলো রাজপুত্র। সে পেয়েছিলো ক্ষণিকের চটুল প্রেম কোনো এক ঢাকা কলেজের কাছে। প্রেম নেই, তার প্রেমশূন্য সংসার টিকে আছে। অথবা সংসার নয়, সংসারের ফসিল। বহু দিন, বহু বহু দিন অনুকম্পা হয়নি তার, সময় হয়নি তার কাঠুরেকে ডাকার। সভ্যতা ও অসভ্যতা চলেছে যে যার মত, ঘড়ির পেন্ডুলাম দুলেছে দুই দিকে অবিরাম, সময় যাচ্ছে চলে উদ্দেশ্যহীন।

এক তুমুল বর্ষনের রাতে ছাদে উঠে আকুল হয়ে কেঁদেছিল নটরডেম। আত্মহননের শিল্প শিখে নিয়েছিলো সে। প্রতিদিন কতবার যে নিজেকে ভস্ম করে উড়িয়ে দিয়েছে হাওয়ায় হাওয়ায়, অবলীলায়। নিজেকে অবহেলা করতে করতে সে ভুলে গিয়েছিলো অবহেলা কাকে বলে। কত ভোরে মনে হয়েছে ফের বেজে উঠবে টেলিফোন, কিন্তু বাজেনি। নিজেকে হনন আর দহনে ভস্ম করা যার অভ্যাস, তার গোপন করা অযুত দীর্ঘশ্বাস গুমরে ওঠে হাওয়ায় হাওয়ায়। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে অভ্রবকুল, ডাকে মনসুখিয়া, যার বুক চিরে বয়ে যায় এক নদী, জোছনা রঙা রৌদ্রনদী।

অণুগল্প-৫৫৩ // কে এই কাশেম??

90

প্রচন্ড বৃষ্টি। আপাদমস্তক রেইনকোটে আবৃত শিহাব। বাইক নিয়ে একটা মার্কেটের সামনে আরো কয়েকজন বাইক রাইডারদের সাথে ভিজছে। বাধ্য হয়েই সবাইকে ভিজতে হচ্ছে। মার্কেটের ভিতরে এত পরিমান মানুষ, আর কেউ ঢুকতে পারছে না। বাতাসের বেগও অনেক, তাই সামনে না এগিয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় খোলা আকাশের নিচে ভিজতে থাকে শিহাব।

একটা সিগারেট টানতে পারলে ভালো লাগতো। ভাবতেই বড্ড ‘ধুমপানের তেষ্টা’ জাগলেও নীরব থাকে সে। মফস্বল সাংবাদিকদের কখনো কখনো নীরব থাকতে হয়।

দ্রুত বেগে একটা সিএনজি অটোরিকশা রাস্তার জমা জল ছিটিয়ে শিহাবকে পাশ কাটায়। ভিজিয়ে দেয় শিহাবকে। কিছু ছিটা চোখে পড়ে, জ্বলে উঠে বাম পাশের চোখ। আপনাতেই অশ্রাব্য একটা গালি এসে যায়। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দে পরিণত হবার আগেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে।

মফস্বল সাংবাদিকেরা একটু মন খুলে, ইচ্ছামত কাউকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিও দিতে পারে না। প্রকাশ্যে তো নয়ই। সবসময় একটা নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থাকতে হয় তাদেরকে।

শিহাব যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার ঠিক ওপাশেই সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। সেদিকে চোখ যায় শিহাবের। কেন জানি কাশেমের কথা মনে পড়ে। এই অফিসের পিওন। তবে পিওন হলেও খুব ক্ষমতাশালী। মূলত অফিসটির সার্বিক কার্যক্রম সে-ই আসলে নিয়ন্ত্রণ করে। কয়েকটা বাড়ির মালিক এবং নামে বেনামে ওর আরও অনেক সম্পত্তির কথা শুনেছে শিহাব।

কাশেমের এই অবৈধ প্রভাবের জন্য এই এলাকা এবং পাশের এলাকার মফস্বল সাংবাদিকদের কি কোনো ভূমিকা নেই? এরা প্রায় প্রতিদিন কিংবা যখন ইচ্ছা হলো অথবা কেউ কেউ মাসের নির্দিষ্ট কোনো দিনে কাশেমের সাথে ‘চা পান’ করতে আসে। চলে বন্ধুত্বপূর্ণ গল্পগুজব, চায়ের সাথে সিগারেট আর যাবার সময় খাম। এই তিন এর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটা ‘সাইক্লিক অর্ডার’। তা থেকে মফস্বল সাংবাদিকেরা কেনো জানি আর সহজে বের-ই হতে পারেন না।

জমির শ্রেণি পরিবর্তন সহ নানারকম অবৈধ কাজে আসে প্রচুর অবৈধ টাকা। এই টাকা দিয়েই সিস্টেমের ভিতরে থেকে কাশেমরা নিজেদের জন্য এক আলাদা রাজত্ব তৈরী করে। সবাইকে ম্যানেজ করেই অবশ্য। মফস্বলে আবার সবাই কেনো জানি দ্রুত ম্যানেজ ও হতে পছন্দ করেন।

তবে কি কোনো সাংবাদিক এই কাশেমদের বিরুদ্ধে লেখেন না? সিস্টেমের এই অনিয়ম তুলে ধরেন না তাদের প্রতিবেদনে?

এরকম প্রশ্নে একটু বিব্রত হয় শিহাব। নিজের ভিতরের শিহাব আর মফস্বল সাংবাদিক শিহাবের ভিতরে চলে ক্ষণিকের টানাপোড়েন। শেষে ভিতরের শিহাবই উত্তর দেয় মফস্বল সাংবাদিকের পক্ষ হয়ে,

– হ্যা, নিউজ হয়তো। কেউ কেউ করে। এরা হলো যারা বছর ধরে প্রতিমাসে কাশেমের থেকে খাম নেয়। এভাবে জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত লাগাতার খাম গ্রহন শেষে, কোনো কারণে যদি নভেম্বর মাসে কাঙ্খিত খাম দেয়া বন্ধ করে কাশেম..

ঠিক এর পরের দিনই পত্রিকায় বক্স করে বিশাল নিউজ! শিরোনাম?

” সাবরেজিষ্ট্রি অফিসে সর্বময় ক্ষমতাধর কে এই কাশেম??”

বাইনচোত!! কে এই কাশেম?
এখন কাশেমকে আর চেনো না? মুফতে চা-সিগারেট খাওয়া আর মাসে মাসে খাম নেবার সময়তো কাশেমই ছিলো ধ্যান-জ্ঞান। এখন আর চেনো না?

ভিতরের শিহাবের গালিতে কিছুটা ম্রিয়মান হলেও নিজেকে সামলে নেয় মফস্বল সাংবাদিক শিহাব। কারণ ভিতরের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক শিহাবেরই জিত হবে। সবসময় ভিতরের মানুষটার কথামতো চলে মফস্বল সাংবাদিকতা করা যায়না।

#মামুনের_অণুগল্প_৫৫৩

মামুনের অণুগল্প: রাজ ভিক্ষুক

608620

২৮ রমজান। ভোর সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বের হয় শিহাব। সেহরি খেয়ে মাত্র দু’ঘন্টা ঘুমুতে পেরেছে। ঠিক ছ’টায় সহকর্মীর ফোন,
– ভাই, চেয়ারম্যান এর বাসায় সাতটায় যাবার কথা না? বের হলাম আমি।

ঘুম জড়ানো কন্ঠে ‘আচ্ছা’ বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে শিহাব। কিন্তু দশ মিনিট যেতেই আরেক সহকর্মীর ফোন। অগত্যা উঠতেই হয়। দ্রুত রেডি হয়ে বেরও হয়।

তিনজন মফস্বল সাংবাদিক যখন ঘুম জড়ানো চোখে মহাসড়ক ধরে বাইক নিয়ে তুমুল বেগে ছুটছে, ঘড়ির কাটায় সময় তখন ছ’টা পঞ্চাশ।

স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান এর বাসার সামনে তিনজনের বাইক এসে থামে। ইতোমধ্যে সাতটা দশ পার হয়েছে। চেয়ারম্যান এর বাড়ির সদর দরোজা বন্ধ। দরজার সামনে কিছু ‘জেনারেল ভিক্ষুক’ অপেক্ষা করছে। ঈদ উপলক্ষে তাদের চেয়ারম্যানের থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য নিতে এরা অপেক্ষা করছে সেই ভোরবেলা থেকে।

গেটের দারোয়ানকে তাদের আগমনের কারণ জানায় শিহাব। উত্তরে দারোয়ান জানায় চেয়ারম্যান ঘুম থেকে ন’টায় উঠবেন। এখন গেট খোলা যাবে না। নিজেদের ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দেবার পরও গেটম্যান জানায় তার কিছু করার নেই।

অপেক্ষমান বাকি দুই সহকর্মীর কাছে এসে একটু রাগ হয় শিহাব। নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতে জানায়,
– কামালের কথা শুনে এই ভোরবেলায় আসলাম। এখন নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?

যে সহকর্মী ফোন দিয়ে শিহাবের ঘুম ভাঙ্গিয়েছিলো, বিব্রত কন্ঠে সে উত্তর দেয়,
– সাতটার পরে নাকি চেয়ারম্যানকে আর বাড়িতে পাওয়া যাবেনা, কামালই তো বললে আসতে।

‘ঘোৎ’ জাতীয় শব্দ এবং আরও কয়েকটি ‘চো’ মিশ্রিত শব্দ মিলিয়ে নিজের রাগ প্রকাশ করে শিহাব। এদিক ওদিক তাকায়। রোদ বেড়ে গেছে। ছায়া আছে এমন জায়গার খোঁজ করে সে। প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। বসার কোনো জায়গাই নেই। সদর দরজার শেডে কিছু ছায়া আছে, সেখানে ভিক্ষুকদের সারিবদ্ধ অবস্থান। ওখানে অপেক্ষা করার প্রশ্নই আসেনা।

ইউপি চেয়ারম্যান এর বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা। সেদিক তাকিয়ে সামনের দিকে হেঁটে চলে শিহাব। ওর পিছু নেয় বাকি দুই সহকর্মী। বাড়ি পার হলে একটা মুদির দোকান। বন্ধ। সামনে দুইটা বেঞ্চ পাতা। সহকর্মী দু’জন বাইক নিয়ে সেখানে ‘স্ট্যান্ড’ করায়। শিহাব আগেই বেঞ্চে বসে গেছে। ঘুমে চোখ জ্বালা করছে তার।

জ্বলছে বুকের ভেতরেও। সামান্য ক’টা টাকার জন্য এত ভোরে এসে এখন কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। চাইলে দারোয়ান বিশাল বাড়ির ভিতরের ‘ওয়েটিং রুমে ‘ ওদের বসাতে পারতো। সেটা না করাতেই অপমানের তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভব করে শিহাব। মোবাইল বের করে চেয়ারম্যান এর নাম্বারে কল করে। মোবাইল ‘সুইচড অফ’।

বাকি দুই সহকর্মী নিজেদের মোবাইলে মগ্ন। মাথা নিচু করে f আকৃতি নিয়ে ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। মুদি দোকানের বেঞ্চে বসে অদূরে অপেক্ষমান ভিক্ষুকদের সারির দিকে তাকিয়ে থাকে শিহাব। ওদের তাড়া নেই। ওদের নিস্প্রভ চোখে হয়তো ঘুম না হওয়ায় জ্বালা ধরানো অনুভবও নেই। নেই হয়তো বুকের ভিতরে ‘অপমানের তীক্ষ্ণ খোঁচা। ওরা এভাবেই অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত। ওরা ভিক্ষুক।

‘তুমি কি? ওরা যদি ভিক্ষুক হয়, তাহলে তুমিও তো ভিক্ষুক!’

নিজের মনের এই মন্তব্যে মৃদু হেসে মনকে শিহাব জানায়,
– না, আমি ‘রাজ ভিক্ষুক’।

আমাদের দেশে ঈদ এলেই মফস্বল সাংবাদিকেরা ভিক্ষুকে পরিণত হয়। ঈদকে সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং জনপ্রতিনিধিদের থেকে ‘ঈদ সালামি’ গ্রহনের হিড়িক পড়ে যায়। যে যেভাবে পারে ‘ঈদ শুভেচ্ছা’ প্রদানের ছদ্মবেশে আসলে থাকে নগদ টাকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা। এটা এখনকার মফস্বল সাংবাদিকতার এক ‘ট্রেন্ড’ এ পরিণত হয়েছে। এছাড়া আর করারই বা কী রয়েছে? সব মফস্বল সাংবাদিকেরা তো তাদের ‘হাউস’ থেকে বেতন পান না। নিজের টাকার তেল পুড়িয়ে সারা বছর সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে তারা। তাদের সংসার কীভাবে চলে? কিংবা ঈদ সহ অন্যান্য পার্বনে মফস্বল সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দ কীভাবে উদযাপন করে তারা? এই খবর যেমন তাদের কর্মস্থলের মালিক সম্পাদকগণও নেন না, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সেসবের খোঁজ নেবার কোনো প্রয়োজন মনে করেন না। এক একসময় শিহাবের মনে হয়, ‘আদৌ মফস্বল সাংবাদিকেরা’ মানুষ কিনা?’

ঠিক পৌণে ন’টায় ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে শোরগোল শুনে সেদিকে আগায় শিহাব। এর ভিতরে মুদি দোকানদার এসে তার দোকান খুলেছে। দোকানের চারপাশে কাপড়ের পর্দা টানিয়ে দিয়েছে। এটা মুদি দোকান হলেও এখানে চা বিক্রী হয়। পর্দার আড়ালে ইতোমধ্যে কয়েকজন এসে চা ও সিগারেট পান করেছে শিহাবদের পাশে বসে। পর্দার ভিতরে থেকে তারা রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করেছে।

হট্টগোলের জায়গায় এসে শিহাব দেখে, একজনকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে অনেক নারী-পুরুষ লাগাতার চেচামেচি করে যাচ্ছে। বিশাল ভুঁড়িওয়ালা একজনের হাতে লাঠি। সে বেঁধে রাখা লোকটিকে মারতে গিয়েও মারছেনা। কেবল ভয় দেখাচ্ছে। এই লোক নাকি রিক্সা চুরি করেছিলো। আজ তাকে হাতেনাতে ধরতে পেরে এই বিচারের আয়োজন।

শোরগোল শুনে নিজের বাড়ির দো’তলার বারান্দায় আসেন ইউপি চেয়ারম্যান। কি হয়েছে জানতে চান। রিক্সা চোর ধরা পড়েছে শুনেই আগ্রহ হারান তিনি। তাঁর কাছে হয়তো এটা কোনো চুরিই না। আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই তো অনেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চাউল, গম এবং সর্বশেষ করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ চুরির অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজনকে তো এই অভিযোগে শাস্তিও দেয়া হয়েছে।

চেয়ারম্যানকে দেখে সদর দরজার সামনে গিয়ে উপরে তাকিয়ে তাকে সালাম দেয় শিহাব। মাস্কে ঢাকা নিজের চেহারা দেখায় মাস্ক থুতনিতে নামিয়ে দিয়ে। সালামের উত্তর দিয়ে চেয়ারম্যান অন্দরমহলে প্রবেশ করেন। দুই সহকর্মীকে নিয়ে শিহাব দারোয়ানের সাথে আবার কথা বলে এবং ভিতরে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু দারোয়ান এবারও তার অনীহা প্রকাশ করে। সে জানায় চেয়ারম্যান যতক্ষণ নিচে না নামবেন ততক্ষণ এই গেট খোলা হবেনা।

এবারও বিড়বিড় করে শিহাব মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে সদর দরজা থেকে সরে আসে। তবে এবার ‘চো’ শব্দের পরিবর্তে শিহাব ‘মা’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে।

সাড়ে ন’টার সময় দুইটা মটরবাইক গেটের সামনে আসে। এদের দেখেই দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। এরা চেয়ারম্যান এর খাস লোক। এদেরকে সাধারণত ‘ভাইলোক’ বলা হয়। এই ‘ভাইলোক’দের একজন শিহাবের পরিচিত। মফস্বল সাংবাদিকদের সাথে ইউপি চেয়ারম্যানদের ‘টক-ঝাল-মিষ্টি’ জাতীয় সম্পর্ক। যদিও সাংবাদিকের কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে নেই, তারপরও অনেক সাংবাদিকই কোনো না কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং জনপ্রতিনিধিদের কুকর্ম কিংবা কোনো ‘ফাঁক’ খুঁজে পেলে, সেখানে ‘ভরে দেবার লোভ’ অধিকাংশ সাংবাদিকেরাই সম্বরণ করতে পারেন না। আর এইসব ক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যানদের রক্ষা করতে সাংবাদিক ও ইউপি চেয়ারম্যানের মাঝে ‘মিডল ম্যান’ হিসেবে কাজ করেন এসব ‘ভাইলোক’।

পরিচিত সেই ‘ভাইলোক’ এর কল্যাণে শিহাবরা চেয়ারম্যান এর বাড়ির একতলার ‘ওয়াটিং রুমে’ বসার সুজোগ পায়। ঘড়ির কাটা তখন কাটায় কাটায় সকাল দশটার ঘরে।

ওয়েটিং রুমে বেশ বড় সোফাটায় শরীর এলিয়ে বসে পড়ে শিহাব। বাকি দু’জনও ওকে অনুসরণ করে। ভিতরে আরো অনেক লোক দেখতে পায় শিহাব। এরা কখন যেন ভিতরে প্রবেশ করেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ভিক্ষুকদের দল আরো অনেক বড় হয়েছে। ভিতরে এবং বাহিরে উভয় ‘ভিক্ষুক’ দলই চেয়ারম্যানের অপেক্ষায়।

সাড়ে দশটায় তিনি উপরমহল থেকে নেমে এলেন। ওয়েটিং রুমের সাথেই তার অফিস রুম। সেখানে ঢুকে যান তিনি। যাবার আগে শিহাবদের দেখে হাত দিয়ে বসার ইশারা করেন। তার পিছনে ‘ভাইলোক’রা অফিসে প্রবেশ করে দরোজা বন্ধ করে দেয়।

এভাবে অপেক্ষার প্রহর বাড়তেই থাকে। এর ভিতরে RAB এর ভেস্ট পরা এক কনস্টেবল পিছনে ব্যাগ হাতে এক ‘মুন্সি’কে নিয়ে চেয়ারম্যান এর অফিস দরোজায় নক করেন। দরজা খুলে যায়। ওনারা দু’জন প্রবেশ করতেই সব ‘ভাইলোক’রা বের হয়ে আসে। শিহাবদের সামনে প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে সেখানে বসে গল্পে মেতে ওঠে তারা।

একটু পরে স্থানীয় থানার গাড়ি এসে থামে চেয়ারম্যান এর সদর দরোজায়। এক এস আই সাথে একজন কনস্টেবলকে নিয়ে অফিস রুমে প্রবেশ করে। দরোজা বন্ধ হয়।

এরপর ঘড়ির কাটা ঘুরতে থাকে। RAB এবং পুলিশ সদস্যগণও বের হন না। শিহাবদেরও ভিতরে প্রবেশ করা হয়না। সোয়া এগারোটার সময় চেয়ারম্যান একা বের হন। শিহাব এবার এগিয়ে গিয়ে চেয়ারম্যানকে সালাম দেয়। চেয়ারম্যান বলেন,
– একটু বসেন ভাই। পুলিশ বিদায় করে আপনাদের ডাকতেছি।
একথা বলেই অফিস রুমের বাইরের বাথরুমে ঢুকে যান চেয়ারম্যান।

আবার সোফায় শরীর এলিয়ে দেয়া। শিহাবের ভ্রুর কুঞ্চন আরো গভীর হয়। সাথের এক সহকর্মী জানায়,
– বাথরুমে কয় ঘন্টা লাগায় এবার কে জানে?
– আরে, নোট আলাদা করতে গেছে টয়লেটে। আলাদা আলাদা খামে ভরতে যতক্ষণ। বেশীক্ষণ লাগবেনা।
দ্বিতীয় সহকর্মী উত্তর দেয়।

একবার ভাবে শিহাব যে চলেই যায়। কিন্তু সাথের এক সহকর্মীকে বলতেই সে জানায়,
– এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম, খালি হাতে যাবোনা আজ। পরে যা করার করা যাবে। পুরা দিনটাই মাটি হবে আজ এখন এভাবে চলে গেলে।

সাড়ে এগারোটায় RAB কনস্টেবল তার মুন্সিকে নিয়ে বের হয়। এরপর এস আই তার কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে। এবার শিহাবদের অফিস রুমে ডাক পড়ে। কিন্তু দরজার কাছে যেতেই পরিচিত ‘ভাইলোক’ এসে জানতে চায়,
– কয়জন আপনারা?
শিহাবের সাথের সহকর্মী উত্তর দেয়,
-তিনজন।

শুনে ‘ভাইলোক’ আবার ভিতরে যায় শিহাবদের দরোজায় দাঁড়া করিয়ে রেখে। একমিনিট পরে বের হয় সে। এক হাজার টাকার তিনটা নোট হাতে নিয়ে এক এক করে শিহাবদের হাতে গুঁজে দেয়। ‘ওয়েটিং রুমে’ অপেক্ষমাণ সকল মানুষের সামনে হাতের মুঠোতে এক ইউপি চেয়ারম্যান এর ‘ঈদ সালামি’ এক হাজার টাকার নোট নিয়ে বিব্রত হয় শিহাব। এভাবে খাম ছাড়া টাকা দেয়ায় নিজেকে কেমন উলঙ্গ মনে হয় শিহাবের। একবার ভাবে টাকাটা ছুড়ে ফেলে দেয় ‘ভাইলোক’ এর মুখের উপর। কিন্তু সবসময় মন যা চায় আমরা কি তা করতে পারি?

কোনোমতে দরজায় রেখে আসা জুতো জোড়া পায়ে দেয় শিহাব। মানিব্যাগে নোটটা রাখে। সদর দরোজা দিয়ে বের হবার সময় আবারও বাইরে অপেক্ষমান ‘জেনারেল ভিক্ষুকদের’ দিকে তাকায় শিহাব নামের এক ‘রাজ ভিক্ষুক’। এরা এখনও অপেক্ষা করছে। হয়তো সারাদিনই অপেক্ষা করবে এরা। কিছু পাক বা না পাক।

নিজেদের বাইক স্টার্ট দেবার সময় থানার গাড়িটি শিহাবদের অতিক্রম করে। ড্রাইভারের পাশে বসা পরিচিত এস আই’র সাথে শিহাবের চোখাচোখি হয়। সে নির্লজ্জ হাসি হাসে। শিহাবের কাছে মনে হয় যেন ভেংচি কাটলো তাকে।

নিজের বর্তমান পেশাকে ঘিরে সামগ্রিক কর্মকান্ডে নানাবিধ ভাবের উদয় হয় শিহাবের মনে। অক্ষম ক্রোধ, আর্থিক অস্বচ্ছলতায় ঈদকে ঘিরে ভিক্ষাবৃত্তি, সত্য প্রকাশে মানসিক টানাপোড়েন সহ সদ্য প্রায় পাঁচ ঘন্টা অপেক্ষার পর সবার সামনে হাজার টাকার একটি নোট প্রাপ্তি- এসব কিছু মিলিয়ে মহাসড়ক ধরে ৮০ কি.মি. বেগে দ্রুত ছুটে চলা শিহাবের মনে হয় বাইক নিয়ে সোজা আইল্যান্ডে গিয়ে ধাক্কা দেয়। এই ‘রাজ ভিক্ষুক’ এর জীবন আর ভালো লাগেনা।

এবার ‘চো’ এবং ‘মা’ গোত্রের সাথে ‘খা’ জাতীয় শব্দের মিশেলে এক মফস্বল সাংবাদিকের নিজের ভিতরের ক্রোধ ও হতাশা বের হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু তাতে ঈদ ‘কালেকশনে’ বের হওয়া শিহাব নামের এক ‘রাজ ভিক্ষুক’ এর ভিতরের জ্বলুনি কি একটুও কমে?

#রাজ_ভিক্ষুক_মামুনের_অণুগল্প_৫৫৩

মামুনের অণুগল্প: একটা শুকরই যথেষ্ট

1841955

শিহাব একজন গণমাধ্যমকর্মী। একজন মফস্বল সাংবাদিক। একদিন কোনো কারণ ছাড়াই ভাবনাবিলাসের উদভ্রান্তিতে আপ্লুত হয়। একার সাথে একা কথা বলে এবং ভাবলাবিলাসের শেষ প্রান্তে গিয়ে ভাবতে থাকে…

একজন সাংবাদিক তাঁর দৃষ্টি দিয়ে সব কিছুকে দেখেন। শুধু দেখেই ক্ষান্ত হন না, দেখার বাইরেও যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেগুলোও পর্যবেক্ষকের চোখ দিয়ে নিরীক্ষা করেন। সর্বশেষে সমাজের ভিতরে তাঁর পরীক্ষালব্ধ উপাত্তগুলির ফলাফল প্রকাশ পায় তার প্রতিবেদনে। এদিক থেকে, সাংবাদিকও বুদ্ধিজীবীদের অন্তর্ভুক্ত।

এখন এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর কয়েকটি জিনিস অবশ্যই নিজের ভিতরে থাকতে হয়। কারণ একটি সমাজ তাঁর লেখনীর ভিতর দিয়ে উঠে আসবে। অতএব, সাংবাদিককে একটি আদর্শ মেইনটেইন করতেই হবে। তাঁর দেখার স্বচ্ছতা থাকতে হবে এবং তাঁকে সত্যবাদী হতে হবে। এই দু’টো থাকলেই তাঁর দ্বারা অন্যরা উপকৃত হবে।

কিন্তু আজ শিহাব নিজের চারপাশে এ কি দেখতে পাচ্ছে? ঐতিহাসিক বিকৃতিতে অংশ নেয়া এবং ভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের পদলেহনমূলক মনোভাবাপন্ন হয়ে সত্যকে গোপন করে অনেককেই হলুদ সাংবাদিকতায় নিজেদের নিয়োজিত করা! শুধু সাংবাদিকগণ কেনো, অন্যসব জ্ঞানী-গুণি ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণির অনেকেরই একই মনোবৃত্তি। নিজ নিজ জায়গায় নিজ পেশার দায়িত্বশীলতার দিকটি ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্রাহ্য করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন সবাই!

বাম-ডান কিংবা সাদা-গোলাপী প্যানেলে বিভক্ত হবার ট্রাডিশন তো শিহাব সেই তার কলেজ জীবন থেকেই দেখে আসছে। দুই পরিবার কেন্দ্রিক আমাদের দেশীয় রাজনীতির প্ল্যাটফর্মে আমাদের জ্ঞানী-গুণীরা ভাগ হয়ে তাঁদের কলম ধরছেন। কিন্তু সব বিভেদ ভুলে গিয়ে দেশের পক্ষে এক হয়ে তাঁদের কলম ধরা হয় না। এজন্যই সুন্দরবন রক্ষা করার আন্দোলনে পক্ষে-বিপক্ষে বুদ্ধিজীবিদেরকে দেখা গেছে। দেখা গেছে তেল-গ্যাস রক্ষা করার ক্ষেত্রেও! অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করার আন্দোলনের যৌক্তিকতা খুঁজতে গিয়েও পক্ষে-বিপক্ষের দল ভারী হয়। মোট কথা দলীয় লেজুড়বৃত্তি যেন আমাদের এইসকল বুদ্ধিজীবিদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে।

এ থেকে উত্তরণের পথ কোথায়??
ভেবে কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে স্বভাবগত ভাবেই শিহাব ক্রুদ্ধ হয়।

ক্রোধ নিজের প্রতি। নিজের পেশাগত দায়বদ্ধতা সঠিকভাবে পালন করতে না পারায় নিজের প্রতি ক্ষোভ এই ক্রোধের কারণ। ক্রোধ অন্যদের প্রতিও। সিস্টেমের প্রতি। নিজের পেশারসাথে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ‘ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অক্ষমতার’ প্রতিও।

ক্রোধান্বিত হয়ে শিহাব ভাবে, ‘আমার চারপাশে গ্রুপিং, নষ্ট রাজনীতি আর মানুষের সীমাহীন ইর্ষায় দমবন্ধ করা এক অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হয়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। চেনা মানুষগুলোর অচেনা মুখ মানুষের আকৃতি থেকে সরে গিয়ে কেবলি শয়তানের রূপ লাভ করেছে। শয়তানের রূপ কিরকম? শয়তান শুকরের আকৃতির, গলায় একটা লানতের ঘন্টা বাঁধা থাকে।’

অবাক বিস্ময়ে চমকে উঠে শিহাব!
একটা শুকরই যথেষ্ট তাঁর ভয়াবহতা নিয়ে আশেপাশে থাকা। শিহাবের চারপাশে তো অগুনতি। সেগুলোর ভিতরে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা অবস্থায় রয়েছে সে!

ভাবনাবিলাসের ভ্রান্তিজালে থেকে শিহাব আশা করে, এই দুঃস্বপ্ন খুব দ্রুত কেটে যাবে…

.
#মামুনের_অণুগল্প_একটা_শুকরই_যথেষ্ট

মামুনের ছোটগল্প: আমি এবং সেই মহিলা

8399_n মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার হলো ‘বিশ্ব মা দিবস’। পৃথিবীর সবচেয়ে দৃঢ় সম্পর্কের নাম ‘মা’। সবচেয়ে পবিত্র ও মধুর শব্দের নাম ‘মা’। যদিও মাকে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা জানানোর কোন দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না। তবুও মাকে গভীর মমতায় স্মরণ করার দিন আজ। জগতে মায়ের মতো এমন আপনজন আর কে আছেন! তাই প্রতি বছর এই দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয় মমতাময়ী মায়ের মর্যাদার কথা।

মাকে ভালোবাসা আর তার প্রতি হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধার বিষয়টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিশ্ব মা দিবসের ইতিহাস শতবর্ষের পুরনো। যুক্তরাষ্ট্রে আনা জারভিস নামের এক নারী মায়েদের অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

১৯০৫ সালে আনা জারভিস মারা গেলে তার মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জারভিস মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সচেষ্ট হন। ওই বছর তিনি তার সান ডে স্কুলে প্রথম এ দিনটি মাতৃ-দিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯০৭ সালের এক রোববার আনা মারিয়া স্কুলের বক্তব্যে মায়ের জন্য একটি দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় মা দিবসের যাত্রা।

আমার জন্য প্রতিটি দিবসই আমার মায়ের জন্য শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। বাবাকে নিয়ে আমার অনেক গল্প-কবিতা লেখা থাকলেও ‘মা’কে নিয়ে তেমন লেখা হয়নি। তবে কয়েক বছর আগে একটি ইংরেজী গল্প ‘My mom only had one eye’ এর ছায়া অবলম্বনে আমার নিজের মতো করে তিন পর্বের একটি ছোটগল্প এ দেশীয় প্রেক্ষাপটে লিখেছিলাম। আক্ষরিক অনুবাদ না করে কল্পনায় নিজের থেকে কাহিনীর প্রয়োজনে কিছু সংযোজন করেছি। আজ সকল মায়েদের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে তিন পর্বের ছোটগল্পটি আরও একবার শেয়ার করলামঃ-
________________
১.
প্যাকেটটা একটু আগে গেট থেকে দিয়ে গেলো। আমার মেয়েদের পাঠানো ভালোবাসা। হ্যাঁ। ভালোবাসা যখন অনুভবের বিষয় থাকে না, তখন সেটা দেখানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধাশ্রমের আপাত নিরাপদ কক্ষে বসে ভাবছি আমি শিহাব। জীবনের এই মোড়টিতে এসে ফেলে আসা পেছনের জীবন, ছানি পড়া ডান চোখের ঝাপসা জীবনের মত অস্পষ্ট.. অবোধ্য অনুভবে অসার অনুভূত হয়। যে চোখটি আমার নিজের নয়, সেটি দিয়েই সব কিছু দেখি আজকাল। আর দেখারই বা রয়েছে কি? এই যে, দুই মেয়ে বিশেষ বিশেষ দিনে ভালোবাসা পাঠায়.. সাত সমুদ্র আর তের নদী পার হয়ে প্যাকেটবন্দী ভালোবাসা বাসি হয়ে কাছে আসে আমার!
আদৌ কাছে আসে কী?
নাহ! কেবলি সামনে আসে।
সামনের আয়নায় নিজেকে দেখি। যার যার জীবনে অভ্যস্ত মেয়েরা নিজেদের কাছের মানুষদের নিয়ে সুখী হতে চাইল। দেশের বাইরে তাদের আলাদা ভূবনে, ওদের মা চলে যাবার পর, কেন জানি নিজেকে ওদের সাথে মানাতে চাইলাম না। একজন মহিলা আর একটি চোখ, আক্ষরিক অর্থেই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল, সেই ছেলেবেলা থেকেই। তখন তাড়না ছিল অবচেতন মনে। তবে এর আসল অনুভব হলো বিয়ের আরো অনেক পরে। সবকিছু মিলিয়ে বউটা একা রেখে যাবার পর, মেয়েদের কাছে একজন বাবার বাবা থাকাটা ম্লান হতে দেখি.. অনুভবও করি। আর সেই পিছু তাড়া করা অনুভব তখন তীব্র হতেই, নিজের একসময়ের চাকরীর সুত্রে এই আশ্রমের সাথে ঝুলে থাকা লিংকের সুবিধাটুকু কাজে লাগিয়ে, নিজের জন্য এই আপাত নিরাপদ জায়গাটিতে ঠাঁই নিয়েছি। এদের গ্রুপে চাকরি করতাম আমি একসময়।

মেয়েদের পাঠানো গিফটের ওপর হাত বুলিয়ে বাবু দুটিকে অনুভব করতে থাকি আমি.. একজন বাবা! দৃষ্টি আমার দেয়ালের আয়নায়.. সেখানে পরিচিত শিহাবের অপরিচিত এক চোখের ভেতরে তাকিয়ে থেকে এক বাবা পেছনে হারাতে থাকেন। সময়ের এক একটি লেয়ার দ্রুত সব অনুভব সমেত বাবার সামনে পলকের তরে থেমে সামনে আগায়! বাবা পিছায়.. বাবা থেকে স্বামী.. স্বামী ব্যাচেলর যুবক.. এভাবে কখন যেন স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সামনে দাঁড়ানো সেই বাবুবেলায় ফিরে যায়! সেখানে একজন মহিলা আমার সামনে। মুখোমুখি একই ভূবনে একমাত্র সংগী এমন দুজন মানব-মানবী।

নিজের মনে ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে ডুবে থাকি ষাটোর্ধ একজন আমি। একজন বাবা তার বাবুবেলায় ফিরে গিয়ে, নিজের সাথে কথা বলেন। যে মহিলাটির সামনে মুখোমুখি দাঁড়ানো আমি, সেই মহিলাটি আমার মা ছিলেন!

২.
এক প্রাইমারি স্কুলের মাঠে মুখোমুখি আমি একজন মহিলার। একজন ছেলে তার মায়ের। তখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ি আমি। ক্লাশ ওয়ান পড়ুয়া আমি প্রচন্ড জেদে ফেটে যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে। সামনে দাঁড়ানো মহিলাটিকে আমি জ্ঞান হবার পর থেকে বুঝতে যখন শিখেছি, তখন থেকেই কেন জানি ঘৃণা করে আসছি। যদিও এই পৃথিবীতে কেবল এই মা-ই আমার একমাত্র আপনজন। আমার যখন এক বছর বয়স, তখন বাবা অন্য এক মহিলার প্রেমে পড়ে মাকে ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে মা আজ পর্যন্ত আমাকে আগলে রেখেছেন। আমরা যে বস্তিতে থাকি, আমার স্কুল সেখান থেকে একটু সামনে। বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাবার পর, মা এই স্কুলের বোর্ডিং এ থাকা শিক্ষক এবং ছাত্রদের জন্য রান্না করে দেবার কাজ শুরু করেন।

মায়ের একটি চোখ নেই। এজন্য সবাই আমাকে কানার ছেলে বলে ডাকে। সেজন্যই মাকে আমি ঘৃণা করি। কেবল এই একটি সম্বোধনের জন্যই পৃথিবীর সব থেকে প্রিয় মানুষটি আমার কাছে সব চেয়ে ঘৃন্য মানুষে পরিণত হয়েছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার গত দিনের কথা মনে পড়ে। গতকাল ছিল প্যারেন্টস ডে। সবার বাবা-মায়েরা স্কুলে এসেছিলেন। কত আনন্দ। কিন্তু আমি সারাটিক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ করেছি, মা যেন এখানে না আসেন। কিন্তু আল্লাহ আমার বাবু মনের প্রার্থনা কেন জানি শুনলেন না। মা এলেন। অন্যদের পাশে গিয়ে বসলেন। একটা ঘোরের মধ্যে সময়গুলি কিভাবে যেন কেটে গেল।

অন্যদের সাথে মা চলে গেলে সেদিন খেলার মাঠে বন্ধুদের একজন বললো, ’এ্যাই, তোর মায়ের এক চোখ নাই। তুই কানা বগীর ছা।‘ তার সাথে অন্যরাও তাল দেয়। সবাই আমাকে ঘিরে গোল হয়ে বলতে থাকে, ‘কানা বগীর ছা’ ‘কানা বগির ছা’। সেই সময়টায় আমার মনে হচ্ছিল মাটি ফাঁক হয়ে যাক। আমি যদি এই মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম! একই সাথে মনে এটাও জাগল, ‘মা কেন অদৃশ্য হয়ে যায় না আমার জীবন থেকে?’

আজ স্কুল মাঠে একা মাকে সামনে পেয়ে সব কিছু মনে পড়ে যায়। একটা নিস্ফল ক্রোধ আমার বাবু মনের এপিঠ-ওপিঠ ঘুরে ঘুরে পাক খেতে থাকে। মায়ের একমাত্র চোখের দিকে তাকিয়ে আমি হিসহিস করে বলি, ‘তুমি সবার সামনে আমাকে জোকার বানাও কেন? তোমাকে দেখে সবাই হাসে.. বুঝ না তুমি? কেন আসো আমার স্কুলে? তুমি মরতে পার না?’

মা চুপচাপ সব শুনলেন। কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাসও ফেললেন না কিংবা গোপনও করলেন না। শুধু এক চোখে হৃদয়ের সকল মমতাটুকু এনে আমাকে ছুঁয়ে গেলেন! আমি প্রচন্ড রেগে ছিলাম, তাই এইমাত্র মাকে কি বললাম, সেটা আমার বাবু মনের অনুভবে এলো না।

সেদিন থেকে আমার ভেতরে একটা জেদ চাপে। আমি মায়ের জীবন থেকে, যেখানে মাকে সবাই চেনে-জানে, সেই এলাকা থেকে এমনকি মায়ের সাথে যে ঘরটিতে আমি থাকি, সেখান থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাইলাম। একটা তাড়না আমাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কঠোর অধ্যবসায়ে নিমজ্জিত করায়। পড়ালেখা ছাড়া আর কোনো দিকে আমার মনযোগ থাকে না। আর এই সবকিছু কেবলি একজন এক চোখা মা’র ছেলে হিসেবে নিজেকে দেখাতে না চাওয়ার জন্যই.. কারো কাছ থেকে ‘কানা বগীর ছা’ সম্বোধন যাতে শুনতে না হয়, সেজন্যই করি আমি।
পরবর্তী বছরগুলোতে মায়ের সাথে থেকেও যেন একজন ‘আউটসাইডারে’ পরিণত হই আমি। এভাবে স্কুলের গন্ডী পার করে কলেজে পা রাখি। সেখানে অসাধারণ রেজাল্ট করার কারণে স্কলারশিপ পাই।

দেশের বাইরে এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে যাবার দিনটিও একদিন এসে যায়। যাবার দিনেও সেই একচোখা মহিলা আমার পিছু ছাড়েনি। বিমানবন্দরে বিদায় দিতে এসে এক পাশে অন্যদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি একবারও তার দিকে ফিরে তাকালাম না। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মৃদু স্বরে কথা বলতে বলতে একসময় ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকে গেলাম সেই মহিলার সামনে দিয়ে।

একজন মা বিমানবন্দরে একজন অচ্ছুৎ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ! তাঁকে সচকিত করে যখন বোয়িং ৭৪৭ রানওয়ে ত্যাগ করে, তখনো তার সম্বিত ফিরে না। একজন মা যখন সন্তানের কাছে সামান্য একটি অঙ্গহানির কারণে মায়ের দরজা হারিয়ে ফেলেন, তখন আক্ষরিক অর্থে একজন মা কি আসলেই মা থাকেন?

৩.
দেশের বাইরে আমার সময় কেটে যাচ্ছিল এক অন্য আবহে। আমার নতুন বন্ধু হলো। এদের ভেতরে একজন ‘প্রিয় বন্ধু’ও হলো। আমার জীবনকে নতুন উদ্যমে প্রেরণা দিতে সে আমার হাত ধরলো। আমাদের ভেতর ভালোলাগা গড়ে উঠলো। তা একসময় ভালোবাসায় রুপ নিলো। আর কখন যে ভালোবাসা পুড়ে পুড়ে প্রেম হলো, আমি নিজেই জানলাম না। তবে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে এই মেয়েটি আমার পুরো স্বত্বা জুড়ে রইলো। আমাদের দু’জনের পড়া-লেখা শেষ হলো। দুজনেই ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরতে উদগ্রীব হলাম।

আমি কখনো আমার হবু জীবনসঙ্গিনীকে আমার মা’র সম্পর্কে কিছুই বললাম না। সে একবার আমার রক্তের সম্পর্কের কে কে আছে জানতে চাইলে, আমি বললাম কেউ নেই আমার। আমি একা। তখন ভুলেও আমার এক চোখা মাকে একটুও মনে পড়ল না।

দেশে ফিরলাম দু’জন। আমার প্রিয় বন্ধুর বাবা-মা এয়ারপোর্টে আমাদেরকে রিসিভ করলেন। তাদের বাসায়ই উঠলাম। আমার সম্পর্কে তারাও একই প্রশ্ন জানতে চাইলেন। আমার উত্তরও ছিল একই। আমার হবু শ্বশুরের উচ্চবিত্ত আর চাকচিক্য আমাকে আরো ধাঁধিয়ে দিলো। খুব দ্রুতই আমি একটা ভালো জব অফার গ্রহণ করলাম।

আমাদের দু’জনের বিয়ে হলো। সময় ফুরফুরে মেজাজে বয়ে যেতে লাগল। আমি আমার মা’কে একবারও দেখতে গেলাম না। দু’জনে ভিন্ন দুই শহরে থাকলেও এতটা দূরত্ব ছিল না যে, আমি যেতে পারতাম না। কিন্তু দূরত্ব ছিল আমার মনে। আমার চাওয়া-পাওয়ার প্রাণকেন্দ্রের ইচ্ছেপালকে ধুলো জমেছিল। তাই মনের অগোচরেও আমি সেই মহিলাকে নিয়ে একবারও ভাবলাম না। সময় বয়ে গেলো। আরো ধুলোর আস্তরণ পড়ল আমার মনের আরশিতে একজন এক চোখের গরীব মহিলাকে কেন্দ্র করে।

আমার দুই কন্যা একে একে পৃথিবীতে এলো। তারা বুঝার মত বড়ও হলো। আমার অনেক উন্নতি হলো। আমি একটা চমৎকার বাড়ি বানালাম। গাড়ি কিনলাম। আমার ভূবন একদা’র আমার বসবাসের সেই বস্তি জীবনের তুলনায় যোজন যোজন দূরত্বের ছিল।

একদিন সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে আমি মেয়েদের নিয়ে বাসায় আমার একান্ত মুহুর্তগুলি কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ ডোরবেলের আওয়াজ। সোফায় দুই মেয়েকে পাশে নিয়ে বসে মৃদু খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিলাম। বড় মেয়ে দরজা খুলতে গেলে ছোটজনও পিছু নিলো। দরজা খুলেই বড় মেয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে এলো। ওর দেখাদেখি ছোটজনও একই কাজ করতেই, আমি সামনে আগালাম। উন্মুক্ত দরজার ওপাশে আজ এতগুলি বছর পরে আমি সেই মহিলাকে দেখলাম! বয়সের ভারে আরো নুয়ে পড়েছে। তার জীর্ণ মলিন পরিচ্ছদ আরো মলিন হয়েছে। শূন্য চোখের গহ্বরটি তাঁকে আরো ভয়ংকর কদাকার করে তুলেছে। আসলেই হঠাৎ দেখে যে কেউই ভয় পাবে।

তবে কয়েকমুহুর্ত পার হলে, আমার মেয়েরা সাহস করে সামনে এলো এবং এবারে ভয়ের পরিবর্তে তারা সেই কদাকার মহিলার প্রতি উপহাসের হাসি হাসলো। আমার ভেতরে কিছু একটা কি যেন ছিড়ে গেলো। আমি ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে তাঁকে বললাম, ‘তোমার এত বড় সাহস কি করে হলো আমার বাসায় আসার? আমার মেয়েদেরকে তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছে, এখুনি এখান থেকে বের হয়ে যাও!’

সেই মহিলা তার ভালো চোখটি দিয়ে এক পলক আমাকে এবং আমার মেয়েদেরকে দেখলো। এই প্রথম সে আমার মেয়েদেরকে দেখছে। আমাকেও আজ এতগুলি বছর পরে দেখলো। মুখে লজ্জার হাসি ফুটিয়ে সে বললো বড্ড শান্ত স্বরে, ‘ওহ! আমাকে মাফ করবেন, আমি ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছি।‘ এক মুহুর্তও সে আর না দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। একবারও পেছনে ফিরলো না।

আরো কয়েকমাস পরে, আমার সেই ছেলেবেলার স্কুল থেকে একটি চিঠি এলো আমাদের ব্যাচের ‘রি-ইউনিয়নের’ দাওয়াত নিয়ে। আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই সেখানে যাবার ব্যাপারে মনঃস্থির করলাম। আমার বউকে মিথ্যে বললাম যে, অফিসের কাজে আমাকে ‘অমুক’ শহরে যেতে হবে।

নির্দিষ্ট দিনে আমি ‘রি-ইউনিয়নে’ অংশ নিলাম। ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে নিয়ে একটা দিন এবং রাত চমৎকার কেটে গেলো। পুরনো স্মৃতিতে রোমন্থনযোগ্য অনেক কিছু এলেও আশ্চর্যজনকভাবে আমার মা একবারও আমার মনে এলো না। হাতে অনেক সময় আছে ফিরবার। তাই শ্রেফ কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে আমি আমার ছেলেবেলার সেই পুরনো বসবাসের জায়গায় গেলাম। আমাদের প্রতিবেশী কয়েকজন তখনো বেঁচে ছিলেন। ওনারা আমাকে চিনলেন। এদের ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন। আমাকে চিনতে পেরে তিনি আবার তার ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর, একটা মুখবন্ধ খাম হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে চিঠিটি দিয়ে জানালেন যে, গত রাতে আমার মা- সেই এক চোখা মহিলা মারা গেছেন। এলাকার সবাই রাতেই শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন। শুনে আমার ভেতরে কোনো ধরণের অনুভূতি জাগলো না। আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রুও বের হলো না।
আমি আমার বর্তমান জীবনের উদ্দেশ্যে ফিরে যেতে আমার রাস্তায় ফিরে চলি হেঁটে হেঁটে। আমার হাতে সেই মহিলা যিনি আমার গর্ভধারিনী ছিলেন, তার লেখা চিঠি! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত খামের মুখ খুললাম। অস্পষ্ট হলেও আমার একদার পরিচিত হস্তাক্ষর মুহুর্তে আমার দৃষ্টিগোচর হলো। সেই মহিলা আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখেছেন-

‘প্রিয় বাবুটা আমার!
আমি সবসময়েই তোমাকে ভেবেছি। প্রতিটা মুহুর্ত তোমার মঙ্গলচিন্তায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি। আমি আবারো দুঃখ প্রকাশ করছি বাবুটা, সেদিন ওভাবে না জানিয়ে তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার মেয়েদেরকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য।

তুমি ‘রি-ইউনিয়নে’ আসবে জেনে আমি খুবই খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু আমি এতটা-ই অসুস্থ ছিলাম যে, ঐ অনুষ্ঠানে গিয়ে তোমার সাথে দেখা করার মত শক্তি আমার শরীরে ছিল না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত বাবুটা যে, সেই ছেলেবেলা থেকে কেবল আমার জন্য তোমাকে অন্যের কাছে হাসির পাত্র হতে হয়েছে।

যে কথা কখনো তোমাকে বলিনি প্রিয় বাবুটা আমার, আজ বলছি শোন। একেবারে বাবু বয়সে এক দুর্ঘটনায় তোমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। একজন মা হিসেবে আমি এটা কল্পনাও করতে পারিনি যে, একটা মাত্র চোখ নিয়ে তুমি বড় হবে! তাই আমার একটা চোখ তোমাকে দিয়েছিলাম তখন।

আমি অত্যন্ত গর্ববোধ করেছিলাম যে, আমার দেয়া চোখ দিয়ে আমার ছেলে আমার জন্য সমগ্র বিশ্বকে দেখবে! আমি যখন থাকবো না, তখনও আমি এই পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবো-অনুভব করবো! আসলে সেটাই কি হচ্ছে না?

তোমার মেয়ে দুটি খুব সুন্দর! ওদের জন্য অনেক অনেক আদর রইলো। দুঃখ তোমার বউকে দেখতে পেলাম না। ওকেও আমার ভালোবাসা জানিও।
আমার হৃদয়ের সকল ভালোবাসা তোমার জন্য রেখে গেলাম প্রিয় বাবুটা!
তোমার মা।‘

আমি শেষ লাইনটা পড়ার পর যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, রাস্তার মাঝামাঝি সেখানেই স্থাণুর মত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। রাস্তায় অপেক্ষামান গাড়ির বিকট আওয়াজ আমাকে সরতে বলছিল, আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। শেষে এক পথচারী এসে টেনে আমাকে ফুটপাতে নিয়ে রেখে এলেন।

আমার মন পুড়ে যাচ্ছিল.. কোথায় কোথায় যেন চিরে যাচ্ছিল। হাত থেকে সেই মহিলার লেখা চিঠিখানা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেলেও আমি সেটা ধরার জন্য সামনেও আগাতে পারছিলাম না। এক অবোধ্য অনুভবে বিলীন হতে হতে আমার ভেতরে কেবলি এই কথাটিই বার বার বেজে চলছিল, ‘সেই মহিলা আমার মা ছিলেন!’ একজন এক চোখা মহিলা, যাকে আমি সারাটা জীবন ঘৃণাই করেছি কেবল। অথচ আমার জন্য শেষ সময় পর্যন্তও কেবল ভালোবাসাই রেখে গেছেন তিনি।

মায়েরা কি এমনই হয়?

সময়ের বুক থেকে আবারো নিজের ধুসর বর্তমানে ফিরে আসি আমি শিহাব। সেই বৃদ্ধাশ্রমের নিজের আপাত নিরাপদ কক্ষে। আয়নায় দেখা সেই অচেনা চোখটিকে আজ বড্ড চেনা লাগছে। ঐ চোখটি যে আমার মায়ের! একজন মায়ের চোখ কেমন হয়? অর্ধেক জীবন পার করেও সেটা আমার বুঝে আসেনি। যখন বুঝে এলো, তখন সেই বুঝ আমার কোনো কাজে এলো না।
কথায় বলে, ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি করে থাকে। আজ এক বৃদ্ধাশ্রমে একজন বাবা তার বিগত সময়ের ভুল ভাবনার খেসারত দিচ্ছেন বড্ড তীব্রভাবে। সব কিছু থেকেও আমার কিছুই নেই। অনুভবে রয়েছে, বাস্তবে কেবলি শূণ্যতা! যে শূণ্যতায় কখনো নিঃশেষ হয়েছে একজন এক চোখের মহিলা। জীবনভর ভালোবাসার প্রতিদানে সে কেবলি ঘৃনাই পেয়ে গেছে। তবুও শেষ সময় পর্যন্ত তার প্রিয় বাবুটার জন্য ভালোবাসাই রেখে গেছে সে।

বেলা শেষে কোনো প্রিয়জন ফিরে এসে ডাকবে আমায় কিংবা পাশে এসে নীরবে শুধু চলে যাওয়া প্রহরকে অনুভব করাবে, এমন কোনো অনুভবে আজকাল আমি উদ্দীপ্ত হই না। এ আমার নিজের কর্মফল.. আমি নিজেই অর্জন করেছি এই নিঃসঙ্গতা!

তাই আমাকে এভাবেই থাকতে হবে। আয়নায় দেখা আমার মায়ের চোখ আমার এই দুরবস্থায় কেন জানি ভিজে আসে। তার প্রিয় বাবুটার এই নিঃসঙ্গতা কেন জানি তাঁকে পীড়া দেয়। অসহ্য কষ্টকর মুহুর্তগুলিতে তাই যে চোখটি আমার নয়, সেটি কেঁদে চলে। আমার নিজের চোখটি অনেক আগেই কেন জানি নিষ্প্রাণ পাথরে পরিণত হয়েছে। তাই আমার অনুভূতি-অনুভব সকল ইচ্ছেপালকের নিউক্লিয়াস ইদানিং সেই একচোখা মহিলার আমায় ভালোবেসে দান করা চোখকে ঘিরেই চলতে থাকে…।

মূল গল্পঃ My mom only had one eye ‘র ছায়া অবলম্বনে লেখা।
#আমি_এবং_সেই_মহিলা_মামুনের_ছোটগল্প।

মামুনের অণুগল্প : হারানো শহর

8990_n

প্রচন্ড উচ্চতা ভীতি আছে আমার।
ছেলেবেলায় দেখতাম, বন্ধুরা সবাই কি অবলীলায়
আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে, তরতর করে স্টিলের সিঁড়ি বেয়ে কলোনির পানির ট্যাঙ্ক এর ছাদে চড়ে বসতো! ওদের উপহাসে যদিও কখনওবা উঠতে চাইতাম আমি, একতলা উচ্চতায় উঠতেই, পায়ের তলায় শিরশিরে অনুভবে সারা শরীর আমার অবসন্ন হয়ে যেতো। মনে হতো এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।

ওর সাথে প্রথম পরিচয়ও হয়েছিলো এরকম এক পরিবেশে। একবার পাহাড় দেখার খুব শখ হলো আমার। অনেক সাহস করে লেক সংলগ্ন এক পাহাড়ে (মাটির টিলা ও বলা যায়) অন্যদের পিছু নিয়ে উঠলাম! মাটি কেটে ধাপ ধাপ করে বানানো সিঁড়ি। কোনোদিকে না তাকিয়ে কেবলই উঠে যাচ্ছিলাম।

যাইহোক, চূড়ায় উঠলাম অবশেষে। রেলিং দিয়ে ঘেরা ওই জায়গাটুকু। রেলিং এর এপাশ থেকে নিচের শহরটা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগলো। এরপর মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে রেলিং এর আরো কাছে গেলাম। এখানটায় পাহাড়ের শরীর থেকে মাটি কেটে নেয়া হয়েছে। ক্ষত বিক্ষত পাহাড়ের শরীর সরাসরি নেমে গেছে প্রায় ৩শো’ ফুট নিচে। কি এক আকর্ষণে একটু ঝুঁকে একদম নিচের খাদ দেখতে চাইলাম। ভুলে গেলাম আমার উচ্চতা ভীতির কথা। মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলাম রেলিং টপকে প্রায় ৩শো’ ফুট নিচে! কেউ একজন পিছন থেকে আমার হাত আঁকড়ে ধরলো শক্তভাবে। হয়তো কিছু সময়ের জন্য চেতনা হারিয়েছিলাম আমি।

একটু স্বাভাবিক হতেই আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সেই নারী মৃদু হেসে বললো,
– এ্যাক্রোফোবিয়ার পেসেন্ট হয়ে পাহাড়ে উঠলেন কেনো?

এই ছিলো ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম দেখা। জলতরঙ্গের মতো ওর ঠোঁট থেকে বের হওয়া কথা শুনা। আসলে কিছুই শুনছিলাম না আমি। ওর ঠোঁটের নড়াচড়াই মুগ্ধ ভাবে দেখছিলাম।

ওর নামটা না-ই বললাম। সে তার কলেজের বান্ধবীদের সাথে এসেছিলো। একটু দূরে দাঁড়ানো তারা মিটিমিটি হাসছে। একটু বিব্রত হলাম। দেখলাম ঘাসের ওপর বসা আমি। সে আমার হাত ধরে আছে। সেদিকে তাকাতেই ও আলতো করে আমার হাত ছেড়ে দিলো।

এরপর যা হলো, একটু সিনেম্যাটিকই বলা যায়। ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো! ক্রমে তার বেগ বাড়বে এটা বুঝে নিচে নেমে যাবার তাড়া অনুভব করলাম। কিন্তু নামার সময় পিচ্ছিল মাটির সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। ভেবে ভয় পেলাম। সে ও হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝলো। আবারও আমার হাত ধরে বললো,
– একা তো নামতে পারবেন না। একসাথে নামি চলুন।

এরপর আর বলার কিছু থাকে? এক অদ্ভুত বিভ্রমের আবেশে হাঁটছিলাম আমি ওর পাশাপাশি। ঠোঁটে গোপন হাসি আর মৃদু কলরব নিয়ে ওর বান্ধবীরা আমাদের পিছু নেয়। হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম। একপলক উপরে তাকালাম। মেঘবালিকাদের কষ্টে ছেয়ে ছিলো আকাশটা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ইলশেগুঁড়ি ভালোলাগায় আমাদের দু’জনের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোলাগা মিশছিলো গিয়ে লেকের জলে! এমনই মনে হলো আমার। এই শহরটাকে তখন মনে হচ্ছিলো কেবলি আমার!

এভাবেই প্রথম পরিচয় আমাদের। এরপর.. অনেক সময় পার হলো। বন্ধু হয় সে আমার। একসময় বন্ধুত্ব হয়ে যায় ভালোবাসা। এক অদেখা ভালোবাসা। যা থাকে শুধু অনুভবে। যদিও আমরা কেউ কাউকে বলতে পারিনি ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসা আমাদের দু’জনকে র‍্যাপিং কাগজে সযত্নে মুড়ে রেখেছিলো। প্রতিটি ভরা বর্ষার দিনে চকচকে পেভমেন্ট ধরে হেঁটে চলতাম আমরা। হাতে হাত রেখে। ওর শরীরের সুরভি মেখে থাকতো সেই পথে। আমাদের দু’জনকে দেখে হয়তো সেই চকচকে পেভমেন্ট আর জন্মে মানুষ হতে চাইতো!

এর পরের গল্প অন্য রকম। বন্ধুত্বের গতি আরো বেড়ে যায়। জীবিকার তাগিদে দু’জন দুই শহরে। মোবাইল তখনো আসেনি। টেলিফোনে কাছেদূরে অনুভবে সময় কাটে। কষ্টের হাহাকার বাড়ে সময়ে না পেলে, কাজে ব্যস্ত থাকলে। অভিমানে দু’পক্ষের-ই মন ভিজে যায়।

তারপর একটা ঝড় নেমে আসে একদিন। রেল লাইন দু’দিকে বেঁকে যায়। শুধু কষ্ট আর অভিমান খেলা করে। ক্ষীন একটা যোগাযোগ ভগ্ন সম্পর্ক হয়ে টিকে থাকে। নিয়তি বলে একটা কথা রয়েছে না? পারিবারিকভাবে ওর বিয়ে ঠিক হয়। আমাকে পছন্দ করেনি ওর অভিভাবকেরা। সে ও সবাইকে কষ্ট দিয়ে একবারে আমার কাছে চলে আসতে চায় না।

আমি শেষবারের মতো ওকে দেখতে চাই।

শেষবার ওর সাথে যখন দেখা হয়, সে মেঘবতী কন্যা হয়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিলো। পিছন থেকে ওর এলোচুলের গোছা, কানের পাশে গন্ধরাজ গোঁজা। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সব হারানোর অশ্রুধারা আমার দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো। ওর দিকে তাকালাম। এক জোড়া মুগ্ধ চোখ অপেক্ষা করছে দেখতে চাইলাম। মনটা ব্যকুল হলো। ভাবলাম হয়তো ভুল ভেবেছি। ওর চোখে ভালোবাসার আলো জ্বলে উঠতে দেখলাম কি? কিন্তু আমার হাতদুটো ধরে, একটু ছুঁয়ে দিয়ে, নিজের গন্তব্যে সে চলে যেতে চাইলো আবার দেখা হবে বলে।
ট্রেন স্টেশনে বিষন্ন মন নিয়ে পৌঁছালাম। কি এক হারানোর শূন্যতা ছিল মনে। জানতাম এখন ওকে চলে যেতে দিলে, আমি আর কখনোই পাবো না ওকে!! ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্যে, এই প্ল্যাটফরমে আর কোনো ট্রেণ আসবে না।

ট্রেন এসে পৌঁছালো স্টেশনে। ও চলে গেলো…

আমার উচ্চতা ভীতির কারণে আমরা কখনো আর পাহাড়ে উঠিনি। ও বলতো, ‘পাহাড় আর সমুদ্র পাশাপাশি থাকে। উপর থেকে নিচে দেখার দরকার নাই তোমার। তুমি নিচ থেকে উপরে দেখবে। আমি তোমার পাশে হাত ধরে বসে থাকবো। আমরা সোনালী ডানার চিল আর সমুদ্রের ঢেউ দেখবো পাশাপাশি বসে!’

আমি আর কখনোই উপর থেকে নিচে দেখিনি। ও আমাকে ছেড়ে এতটা উপরে চলে গেলো, নিচে থেকে দেখা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় রইলো না!

সেই থেকে একাকি সাগরপাড়ে প্রতীক্ষায় আছি ওর! পাশাপাশি বসে সোনালী ডানার চিল দেখে দেখে সাগরের গর্জণ শুনবো বলে।।

আজ ও নেই
আমারও কোনো শহর নেই।।

.
#হারানো_শহর_মামুনের_অণুগল্প_৫৫১

অণুগল্পঃ তিন শহর

1649171_n

ফ্রাঙ্কফুর্ট। জার্মানি।
ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুর ম্যাসেজ। আর এক মহাদেশ পার হয়ে আসতেই হ্যান্ডসেট স্ক্রিনে মৃদু কাঁপন অনুভব করে দূরের বন্ধু। মৃদু হাসি নিয়ে বিছানায় পাশ ফিরে আরাম অনুভব করে সে। ভালো লাগাটুকুও চোখ বন্ধ করে উপভোগ করে।

স্ক্রিনে বন্ধুর মুখ।
‘পারুর সাথে একবার কথা বলতে চাই। আমার ফোনই ধরছে না সে। তোর বুবুকে বল না..।’

সময় যেন থমকে যায়। নিঃশ্বাসগুলো বিশ্বাসের ওপার থেকে এপারে আসতে বাঁধা পায়। সমস্যার গভীরে চিন্তা-ভাবনাকে ঠাঁই দেবার আগেই বেদনারা ঘিরে ধরে দূরের বন্ধুকে। সে মোবাইলের দর্পণে কাছের বন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। উপায় খোঁজে।

মধ্যরাত। পারুর শহর।
একা এক প্রিয়দর্শিনী ঘুমন্ত ওর নিজ শহরের নিমগ্নতা, যোগীর গভীর ধ্যানমগ্নতায় অনুভব করছে। ফ্ল্যাট লাগোয়া ইউক্যালিপটাস গাছের পাতার ফাঁক গলে নেমে আসা চাঁদের আলোয়, ওর দীর্ঘ এলোচুল কেমন মায়াবী! নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে… দর্শকের বুকের গভীরে উষ্ণ রক্তের তান্ডব নৃত্য অনুভব করায়।

কালচে আগুন!
অহর্নিশি পোড়ায়। কাছে টানে। এমনই আগুন।

কি এক রহস্যময়, গোপন আবেশে পারুর অধর কোণে ফুটে ওঠা মৃদু হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই, হ্যান্ডসেটে মৃদু কম্পন।

‘পারু! ফোন ধর… একবার।’

এতটুকুই কথা। কত ব্যথা। কথার ভিতরেও কতটা যে না বলা কথা রয়েই গেল! রেখে গেল কিছু একটা। অনুভবে নাকি কল্পনায়?
বাস্তবে নয় কি? কেন?

পারুর হাসিই পারুর কান্না। সেই কান্না ধীরে ধীরে মৃদু হাসির কম্পনে চোখ স্পর্শ করার আগেই, মধ্যরাতের এক রহস্যময়ী অপ্সরী, নিজের শহরে বসে ভাবে-
‘ওকে যদি আমি ভালোই না বাসি, তবে ওর কষ্ট অনুভব করে, আমারও কষ্ট পাবার কোনো অধিকার নাই।’
রুপালী তরল চাঁদের প্রবল বর্ষণে ভিজে যেতে থাকে পারু…

মধ্যরাত। কাছের বন্ধুর নিজের শহর।
টপ ফ্লোরে নিজের ‘সাময়িক বন্দীশালায়’ বসে এই মহানগরের ভিন্ন এক রুপ দেখছে সে। আলোয় ঝলমলে নগরীর নিচেই কতটা অন্ধকার। অনুভূতিতে খোকলা। বিশাল এক অজগরের মত প্রকাণ্ড হা করে থেকে, সকাল-সন্ধ্যা ওর বুকে বিচরণ করা যান্ত্রিক মানুষগুলোর অনুভূতিকে খেতে থাকে। সেই আলো-অন্ধকারের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে সে ভাবে-
‘পারু ম্যাসেজের উত্তর দিলো না!’ 🙁

হৃদয়ের গভীরে কিছু একটা পুড়ছে। পোড়া গন্ধ পায় সে। কাছের বন্ধুর ভিতরে কোথায় যেন সহস্র জ্বলন্ত মোমবাতি গলে গলে পড়ছে। পুড়ছে। পোড়াচ্ছে!!

‘ওহ! ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন?‘
নিজের পারুর কথা ভেবে ভেবে সে উদাস হয়।

একটা আক্ষেপ সারা জীবন থেকেই গেলো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র না পাওয়ার বেদনাগুলোর এলোমেলো পথ চলার নামই কি জীবন নয়?

এব্যাপারে, কারো কারো ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকতেও পারে। তবে অহংকার যাদের জীবনে অলংকারের মত জড়িয়ে থাকে, তাদের জীবনের বেশীরভাগ পথই এমন এলোমেলো চলতে হয়।

বিস্মরণ_অণুগল্প_৪১৮

শপিং মল থেকে বের হবার পথে পরিচিত হাজারো অচেনা শরীরের ভিড়ে খুব কাছের হারানো একজনের, শরীর ছুঁয়ে ভেসে বেড়ানো পরিচিত সুগন্ধি দূরের কারো কথা মনে করিয়ে দেয়। কখনো কখনো একটা পরিচিত মানুষ কিভাবে একটা পারফিউম হয়ে যায়! ভেবে বিস্মিত হবার পাশাপাশি, একটু কি ব্যথিতও হয় মন? সামনে একটু হেঁটে ডানপাশের ওয়েস্ট পেপার বিনে নিজের গোটা মনটাকে-ই ফেলে বাইরের আলোয় দৃশ্যমান শিহাবের নিজেকে বড্ড নিশ্চিন্ত মনে হয়। তারপরও ঘ্রাণটুকু আরো অনেকক্ষণ সাথে জড়িয়ে থাকে ওর মনে।

পার্কটাকে বামে রেখে, দুই সারি শিরিষ গাছ দু’পাশে রেখে মাঝ দিয়ে পথ। ইটের সলিংয়ের ওপর হাল্কা পলেস্তারা পারেনি যেমন জুতোর শব্দকে আরো মোলায়েম করতে, তেমনি পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলির গোমর বন্ধ রাখতেও। আজকাল সবাই সব জানে। তবে কতটুকু মানে?

পাশাপাশি অনেকগুলি বেঞ্চের একটায় একজন একা। বসে আছে। দৃষ্টি সামনে.. মন হারিয়েছে দূরে কোথায়ও।
কোথায়?
মেয়েটি নিজেও জানে কি?

চমৎকার শাড়ি। স্লিম ফিগারে বেশ মানানসই। কপালের লাল টিপ শেষ বিকেলের আলোকচ্ছটায় চেহারাকে উজ্জ্বল, আরশির চকচকে আভার মত রাঙিয়ে তুলেছে! সামনে দু’পাশ থেকে ছেড়ে দেয়া চুল বাতাসে উড়ছে। খোঁপার সাদা জবা অতিরিক্ত শুভ্রতায় শিহাবকে ধাধিয়ে দেয় পলকের তরে। তবে দ্বিতীয় পলক পরতেই পরবর্তী প্রহর থেমে যায়। নিঃসঙ্গ মেয়ে আপন মনে হাসে। একা একা। একটু বেঁকে থাকা ঠোট অস্ফুট বেদনায় ধীরে ধীরে মেলে যায়। সারিসারি মুক্তোদানার ঝলকে আবারো প্রহর থেমে যায়। হাসছে নীরবে। অথচ ওর দু’চোখে রাজ্যের বিষন্নতা দেখতে পেয়েছে শিহাব। সামনে দিয়ে পাশ কাটানোর সময়। খুব পরিচিত কিন্তু ঠিক কিসের মতো ঘ্রাণ কেন জানি মনে পড়তে চায় না। অথচ শপিং মল থেকে বের হবার সময়ও নামটা মনে ছিল.. পারফিউমটার।

আর পারফিউমটা যার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সুগন্ধি হয়ে ভাসতো বাতাসে, সেই মেয়েটির নামও এখন মনে আসছে না।

মনটা যে ওয়েস্ট বিনে ফেলে এসেছে, ভুলে যায় শিহাব।।

বিস্মরণ_অণুগল্প_৪১৮

করোনায় আক্রান্ত প্রবাসী ছেলের মা‘কে চিঠি

3993

প্রিয় আম্মা,
কেমন আছেন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। মোবাইলটা হাতে থাকলে ফোন করতে পারতাম কিন্তু হাসপাতাল এর নিয়ম সকাল এবং বিকাল এই দুই সময় মোবাইল রোগীকে দেওয়ার, শৃঙ্খলিত জীবনের এইটিই নিয়ম। একটু একটু কাশি আর জ্বর নিয়ে বাসা ছেড়ে আসলাম আজ ১৫ দিন, প্রথম প্রথম চলার শক্তি ছিলো, মনেরও শক্তি ছিলো এখন কাশি আর জ্বর বাড়ার সাথে সাথে চলার শক্তি আর কথা বলার শক্তিও লোপ পাচ্ছে। নার্স ও ডাক্তার নিয়ম করে আসে দেখে ঔষধ দেয় তা খেয়ে আমি যেন আরো কবরের কাছাকাছি যাচ্ছি। কী যেন এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে মাটির নিচে বন্ধ ঘরে আদর করে ডাকছে। সাদা সাদা পোশাকের চোখ মুখ বন্ধ করা ডাক্তার নার্সকে সেই কবরের দূত মনে হয়। তখন আরো বেশী মনে পড়ে মায়ের মুখ, কচি কচি দুই ছেলে আর আপনার বউমার নিষ্পাপ মুখটা। আমি শিশুকালে পিতৃহীন হয়েছি এখন মনে হয় আমার দুই ছেলেও তাই হবে। এগার বছর আগে ঘর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়ে মুক্ত কারাগারে বন্দী হই।

দেশে যাবো যাবো বলেও কোনো এক অদৃশ্য পিছুটানে যেতে পারিনি। আপনি কী এখন বয়স্ক নারী দেখতে কেমন মা আপনার মুখটি, ছেলে দুইটাও বড় হয়েছে তাদের মা ভালোবাসার অপ্রাপ্তিতে বিরক্ত হতে হতে এখন কথাও বলা ছেড়েছে। মারে, কষ্টটা দিন দিন আরো যেন বাড়ছে সেই কষ্ট সহ্য হয় না মা, তাই মনে হয় শরীর হতে দম পাখি উঠে গেলেই বাঁচি। এইটি কেমন হাসপাতাল বুঝে আসে না মাছি মশা তো দূরের কথা এক জটলা হাওয়াও আসার পথ নাই, যেন এটা আরেক কবর দুনিয়ার উপর। এখন হতে আর কথা বলার সুযোগ হবে না, কী করে বলবো আমি তো শক্তিই পাচ্ছি না। আজ সকালে কষ্ট করে উঠে দাড়ালাম বড্ড ইচ্ছে করলো আকাশ দেখতে। সাদা পর্দা সরাতে গিয়ে আমার গায়ে জড়িয়ে যায় পর্দাটা, দেখলাম অবিকল একটা লাশ দাড়িয়ে আছে আলো বাতাস পাওয়া এই স্বার্থময় দুনিয়ায়।

আকাশে কোথাও একটু মেঘ নাই কোথাও একটা উড়ন্ত পাখি নাই জমাট বাঁধা বরফের মত শীতল পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে খুব মন চায় মা। এখন আমার দালান বাড়ি আছে, চাষ করার জমি আছে, বসে বসে খাওয়ার জন্য ব্যাংকে টাকা আছে। অথচ প্রবাস নামক এই যাযাবর জীবনে শেষ মুহূর্তে এসে করোনা নামক এক শক্তি বলছে চলো যাই মাটির ঘরে। মাগো মরণকে যদিও খুব ভয় লাগে তারপরও মরতে খুব ইচ্ছে করে তোমার কোলে। আমার এই রুমটায় এখনো কোন রোগী সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরতে দেখি নাই অথচ রোজ মরে দুই একজন। এই মরণ দেখে দেখে বুকটা ভেঙ্গে যায় ভয়ে, না জানি কখন আবার আমার ডাক আসে। “ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশী দিন তোদের মাজারে।” অতিদূরে রোগীটা আফ্রিকার কোন দেশের হবে হয়তো, রোজ কান্না করে বুক ভাসায় তার বুক-ফাটা কান্দনে আমিও কান্নায় চিৎকার করে তোমায় ডাকি মা-জননী ।

(প্রথম কিস্তি)
উৎসর্গঃ করোনায় মৃত প্রবাসী এনামকে।

ফেসবুক পোষ্ট | অনুগল্প

ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। কয়েকদিন ধরে লাগাতার। অনেক দিন এমন বৃষ্টি হয়নি। আর কিছুদিন এভাবে বৃষ্টি হলেই বোধহয় বন্যা হয়ে যাবে। জানলার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসেছে সেলিম। হাতে মোবাইল ফোন। ফেসবুকের নিউসফিড জুড়ে শুধু রোম্যান্টিক পোষ্ট। বৃষ্টি নিয়ে কত কী লেখা। সেসব দেখে সেলিম খুব বিরক্ত। এই বৃষ্টিতে কত মানুষের ফসল নষ্ট হল, কত মানুষ কাজে যেতে পারেনি, কত মানুষের ঘরে রান্না হচ্ছে না – সেই খবর কজন রাখে। সবাই দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে আনন্দে মেতেছে!
মা চা দিয়ে গেল। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সেলিম ভাবছে একটা সুন্দর ফেসবুক পোষ্ট দেওয়া উচিত। যেন মানুষ রোম্যান্টিকতায় না ডুবে গরিব মানুষদের কথা ভাবে। পাড়া প্রতিবেশীদের সাহায্য করে। যেই ভাবা সেই কাজ। গরম চায়ে আরেকবার চুমুক দিয়ে মোবাইল কীবোর্ডে খটখট করে আঙ্গুল চালিয়ে একটা জ্ঞানগর্ভ পোষ্ট লিখলো সে। অনেক নীতি নৈতিকতার কথার পাশাপাশি বৃষ্টিতে খুশি হওয়া মানুষদের একটু ভৎসর্নাও করলো। খুব আবেগী ভাষায় জানালো মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কর্তব্যের কথা।
পোষ্ট দেওয়ার সাথে সাথে লাইক কমেন্টের ঝড় উঠলো। অনেকে শেয়ারও করলো। একজন সেলিমকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে এমন ভালো মানুষ আজকাল দেখায় যায় না। আরেকজন লিখেছে আপনার মত মানুষ আছে বলেই সমাজটা টিকে আছে। গর্বে সেলিমের বুকটা চওড়া হয়ে গেল। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করলো তার। বারবার ফেসবুক নোটিফিকেশন চেক করতে থাকলো। একটাও লাইক কমেন্ট শেয়ার মিস করতে চায়না সে।
ঠক ঠক ঠক। বেশ কয়েকবার সদর দরজায় ঠোকা পড়লো। সেলিম একটু বিরক্তই হল। এই বৃষ্টির দিনে আবার কে এসেছে! চিৎকার করে মাকে বললো দরজা খুলতে। এখন সে তার পোষ্ট নিয়ে খুবই ব্যস্ত। মা বললো রান্না ছেড়ে যেতে পারবে না। তাই একান্ত বাধ্য হয়েই সেলিম উঠলো। তবে স্ক্রীন থেকে চোখ সরছে না। দরজা খুলতেই দেখলো পাশের পাড়ার হারেসা চাচী। সিমেন্টের বস্তা মাথায় দিয়ে এসেছে। শরীরের বেশিরভাগ অংশ বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। ঠান্ডায় কাঁপছে। সেলিম চিনে ওকে। স্বামী নেই মহিলার, ছোট ছোট তিনটে বাচ্চা আছে। খুব অভাবী। চেয়ে চিনতে খায়।
ঠান্ডায় একটু কাঁপতে কাঁপতে হারেসা চাচী বললো – ‘বাবা, কয়েকদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়িতে কিছু খাবার নেই। তোর মাকে বল কিছু দেবে আমাকে’। সেলিম তখনও মোবাইলে ব্যস্ত। টিউশনির স্যার কমেন্ট করেছে সেলিমকে নিয়ে তার গর্ব হচ্ছে। কি রিপ্লাই দেবে সেটাই ভাবছে সেলিম। স্যারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভালো কিছু রিপ্লাই দিতে হবে। হারেসা চাচী আবার বললো। সেলিম যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। হারেসা চাচী আবার বলতে যাবে তেমনি সেলিম চেঁচিয়ে উঠলো, ‘বৃষ্টির দিনেও তোমাদের শান্তি নেই। একটু আরামে থাকতেও দেবে না। দাঁড়াও মাকে বলছি।’ বলেই দ্রুতবেগে পা চালিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

জলাতঙ্ক-১

তখনও মোবাইল ফোনের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ল্যান্ড ফোনের কানেকশনও সহজলভ্য হয়নি। বাড়ির ল্যান্ড ফোনসেট আমার ঘরে ছিলো। মাঝরাতে প্রায়শই ফোন বেজে উঠত, প্রবাসী আত্মীয় স্বজন কল করতেন, আবার পাড়া প্রতিবেশীদের কলও আসতো, মাঝরাতে তাদের ডেকে দিতে হত। এই অভিজ্ঞতা সম্ভবত ওই সময়ের ল্যান্ড ফোন ব্যবহারকারীদের প্রায় সকলেরই রয়েছে। সেদিন ফোন বেজে উঠলো রাত প্রায় তিন’টার দিকে, ফোন রিসিভ করতেই ওপাশে উদ্বিগ্ন কণ্ঠ,
– সাঈদ?
– হ্যা।
– তুই এক্ষণি বাসায় আয়, এক্ষণি, দেরী করিস না।
হালকা ঘুম থেকে জেগে বুঝতে পারছিলাম না কে কল করেছে, কৌশলে জানতে চাইলাম,
– কি হয়েছে?
– রোমেল কিছু একটা খেয়েছে, ওকে মেডিক্যালে নিয়ে যেতে হবে। জলদি আয়।
বাড়িতে ম্যানেজ করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের হলাম, এরপর আঞ্জুমান থেকে এম্বুলেন্স নিয়ে সোজা রোমেলের বাড়ি। রোমেলের বাড়িতে কান্নার মৃদু আওয়াজ। রোমেলের বড় ভাই, আমি আর আরেক বন্ধু (বিখ্যাত এক অভিনেতার পুত্র) মিলে অচেতন রোমেলকে পাঁজাকোলা করে স্ট্রেচারে শোয়ালাম। রাতের নিরবতাকে ফালি ফালি করে এম্বুলেন্স ছুটলো ঢাকা মেডিক্যালের জরুরী বিভাগে।
রোমেল ঘুমের ওষুধ খেয়েছে ডিউটি ডাক্তারকে জানাতেই জরুরী বিভাগের দু’জন ওয়ার্ডবয় তাকে নিয়ে একটা বেডে শুইয়ে দিল। এরপর মাঝারি সাইজের প্লাস্টিকের একটা ফানেলের নল প্রায় পুরোটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। রোমেল সাড়াহীন। বড় ভাই কান্না করছে। আমরা দুই বন্ধু ঘটনা দেখে যাচ্ছি। ফানেলের মুখে অনেকখানি সাদা পাউডার ঢেলে এরপর পানি ঢালা শুরু হলো। একজন ফানেলে পানি ঢালছে, আরেক ওয়ার্ডবয় বেডের ওপর উঠে দাঁড়ালো, এরপর প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে রোমেলের পেটে পাড়া দিতে থাকলো। কি আশ্চর্য! এই প্রথম রোমেলের নড়াচড়া দেখলাম, ও বমি করা শুরু করলো। কিন্তু বমি কোথায়, সাবানের ফেনা ফেনা পানি। প্রথমবারের পর দ্বিতীয়বার আবার ফানেল সেটের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, রোমেল চিঁচিঁ করে ওয়ার্ডবয়দের বললো,
– ভাই, একটু আস্তে হালকা করে করেন, ব্যাথা পাই।

এক ওয়ার্ডবয় চেঁচিয়ে উঠলো,
– আস্তে করুম ক্যান। আরও জোড়ে জোড়ে করুম, মরতে যাওনের সময় খেয়াল আছিলো না।
দু:খজনক সত্য হলো, দ্বিতীয়বারের ওয়াশটা হলো মর্মান্তিক। ওয়াশ তো নয় যেনো থার্ড ডিগ্রী রিমান্ড। এরপরের তিন থেকে চার মাস রোমেল পানি খেতেই ভয় পেত। আর আমি! ওই পরিবেশে রোমেলসহ আরও দু তিনজনকে ওয়াশ দিতে দেখে এবং ক্রমাগর তাদের বমি করতে দেখে ট্রমায় চলে গিয়েছিলাম, পানি খেতে নিলেই ওসব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতো, পেট উগরে আসতো বহুদিন। এক চুমুকে পানি খেতে পারতাম না, যেনো পেট উগরে বমি না আসে তাই ছোট ছোট চুমুকে পানি পান করতাম। পানির অপর নাম জীবন হলেও তখন পানি ছিলো সাক্ষাৎ আতঙ্ক।

আজ আর বমি আসেনা, তবে ওই ছোট ছোট চুমুকে পানি খাওয়ার অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে।

আলাপন-৫০ (ডুডুভন ক্রক্ক)

নাহিদ সাহেবের ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ ফিরছে বিছানায়।
একবার ঘুম এসেছিল কিন্তু তন্দ্রার ভেতরে কাকে যেন দেখার পর ঘুম ভেঙে গেলো। তাওতো ঘন্টা তিনেক আগের কথা। এখন রাত ৩টা বাজে। হঠাৎ ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় শব্দ হতে শুরু করলো। ওই শব্দটার ভেতরে প্রচন্ড কষ্ট এবং ভয়ের কম্পন বুঝা যায়। নাহিদ সাহেব বাসায় একা। তার স্ত্রী সন্তান কিছু দিনের জন্য শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। এতো রাতে একা একা, লাইট অফ করা, তার মধ্যে এই ঘড়ঘড় শব্দ কেমন যেন লাগছে। আরেকটি শব্দ ওই ঘড়ঘড় শব্দটাকে ধমক দিয়ে বললো, চুপ!

ঘড়ঘড় শব্দটা থেমে গেলো। এখন যেই শব্দটা ধমক দিয়েছিলো সেই শব্দটা মোলায়েম সুরে ডাক দিলো, নাহিদ সাহেব! আপনি জেগে আছেন আমি জানি।
নাহিদ সাহেব ওই মোলায়েম কন্ঠের উত্তরে বললেন, কে কথা বলছেন?
উত্তর এলো, আমি ডুডুভ ক্রক্ক।
নাহিদ সাহেব বললেন, ও আচ্ছা – কিন্তু ঘড়ঘড় শব্দটা কিসের?
ডুডুভন উত্তর দিলো, ওটা একটা পাপাত্মা।
– এখানে এসেছে কেন? আর এমন শব্দ করছে কেন?
– সে খুব কষ্টে আছে, ওই আত্মাটা শান্তি পাচ্ছে না
– কেন?
– ভয়ানক এক শাস্তি চলছে আত্মাটার যা সে সহ্য করতে পারছে না।
– তা আমি ওই শব্দ শুনেই বুঝতে পেরেছি কিন্তু কেন এই ভয়ানক শাস্তি?
– সেটা ওই আত্মাটার কাছ থেকেই শুনুন।
আবার ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় শব্দ হতে শুরু করলো। ঘড়ঘড় শব্দটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওভাবেই কথা বলতে চেষ্টা করছে। ভারী ঘড়ঘড় কাঁপা ভয়ার্ত কন্ঠে ওই আত্মাটা কথা বলতে লাগলোঃ
– আমি আজ এই ভয়ানক শাস্তি সহ্য করতে না পেরে আপনার কাছে এসেছি। আমাকে বাঁচান।
– আমি কি করে একটি আত্মাকে শাস্তি থেকে বাঁচাবো?
– শুনুন, আমি জীবিত থাকা অবস্থায় অনেক বেঈমানি করেছি। এক মহৎ ব্যক্তিকে সপরিবারে হত্যা করেছি। অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছি। আজ তাই আমার এই অবস্থা। আমাকে বাঁচান।
– কিন্তু আমি কি করে বাঁচাবো?
– আমি এই দেশের মানুষ না। আমাকে আমার দেশে পাঠিয়ে দিন।
– আপনার দেশ কোনটা?
– যেই দেশের সাথে এই দেশের যুদ্ধ হয়েছিল সেটাই আমার দেশ।
– তার কি প্রমাণ আছে?
– প্রমাণ খুঁজলেই পাবেন আর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমার বাবা এবং মা এর কবর ওই দেশেই আছে। আমি ওই দেশের লোক। আমাকে ওই দেশে পাঠিয়ে দিন।
– আশ্চর্য! কি করে তা সম্ভব? আর এখন এই দেশে কি হচ্ছে আপনি কিছু জানেন?
– জানি, সব জানি
– কি জানেন?
– আমি যেই মহৎ ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলাম তাঁর বংশধরদের আমার বংশধরেরা অনেকবার হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্র করছে।
– কি কি ষড়যন্ত্র করছে? কবে থেকে করছে?
– ষড়যন্ত্র অনেক আগে থেকেই চলছে ।
– কিছু রিসেন্ট ষড়যন্ত্রের কথা বলুন।
– একটি সেতুতে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ, সেতুতে মাথা লাগবে সহ নানা ধরণের গুজব, ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ওই মহৎ ব্যক্তির অবয়ব ভাঙার চেষ্টা……
– কিন্তু একটি গণমাধ্যম……
– জানি জানি, ওই প্রতিবেদনটার ষড়যন্ত্র সুদূর প্রসারিত এবং সুকৌশলে করা হয়েছে,
– কেমন?
– দেখুন ওখানে ওই মহৎ ব্যক্তির পক্ষে প্রতিবেদন দিয়ে প্রথমেই এই দেশের প্রধানকে বোকা বানাতে চেষ্টা করেছে। তারপর একটি বাহিনীর প্রধানকে টারগেট করে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।
– কিন্তু এটা সুদূর প্রসারিত ষড়যন্ত্র কি করে?
– যেহেতু দেশের প্রধানের পক্ষে অর্থাৎ ওই মহৎ ব্যক্তির পক্ষে কথা বলে একটি বাহিনীর প্রধানকে অপরাধী হিসেবে প্রকাশ করার চেষ্টা- এই কৌশলে দেশের প্রধান এবং ওই বাহিনীর প্রধানের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত এর সূত্রপাত ঘটানোই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য।
-কেন এমন কৌশল অবলম্বন করলো?
– রিসেন্টলি পাশের দেশে কি হচ্ছে তা জানেন না?
– তা তো জানি
– ওই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে সুকৌশলে যদি এমন কিছু এদেশে ঘটে কিন্তু এ দেশে সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই কারণ ইতোমধ্যে সবাই ওই প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে শুরু করেছে।
– দুইজন মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধানো তো শয়তানের কাজ।
– ওরা তো মানুষরূপী শয়তান। আমিও তাই ছিলাম। আমার বংশধরেরাও তাই হয়েছে কিন্তু ওরাতো জানে না আমি কি কষ্টে আছি। আমাকে বাঁচান।
– কি করে বাঁচাবো বলুনতো?
– আমার শাস্তি খুব অল্পই কমবে যদি আমার সম্মাননা বাতিল করে কিন্তু আমি এই পুরো শাস্তি থেকে রেহাই পেতে চাই।
– বলুন কি করতে হবে?
– আমার বংশধরদের এই দেশ থেকে বহিষ্কার করুন আর আমার কবর তুলে ওই দেশে নিয়ে গিয়ে আমার মা-বাবার পাশে স্থান্তরিত করুন – এ ছাড়া এ শাস্তি থেকে আমি রেহাই পাবো না।
– কিন্তু আপনার বংশধরদের কি করে দেশ থেকে বহিষ্কার করা যাবে?
– কেন? এক লেখিকাকে বহিষ্কার করা হয় নি?
– সে তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে
– ভালো করে সংবিধান ঘাটুন। আমার বংশধরদের বহিষ্কার করারও উপায় পেয়ে যাবেন কারণ ওরা অতীতে কি কি করেছে সব আমি জানি। আর আমার এই প্রার্থনা দুটি গ্রহণ করলে সব ষড়যন্ত্র থেমে যাবে এবং ওই গণমাধ্যমও ঠিক হয়ে যাবে।
হঠাৎ কন্ঠটা ভারী ঘড়ঘড় কাঁপা ভয়ার্ত কন্ঠে পরিনত হতে লাগলো।
ডুডুভন ক্রক্ক ওই আত্মাটিকে বললো, তুমি চলে যাও।
আত্মাটি চলে গেলো।
ডুডুভন বললো, নাহিদ সাহেব – ওই আত্মাটার শাস্তি বাড়তে শুরু করেছে তাই চলে যেতে বললাম।
নাহিদ সাহেব বললেন, কিন্তু সে যে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য দুটি প্রার্থনা করে গেলো এখন এগুলো কি করে করা যায়?
– শাস্তি পাচ্ছে পাক না, শাস্তি পাওয়ার কজ করেছে তো শাস্তি পাবে না?
– না, কিন্তু তার আকুতি খুব করুন। তার এই প্রার্থনা দুটি কবুল করতে হবে।

মামুনের_অণুগল্প: চিত্রার হাতে ত্রিশ টাকা

1452041_n

জীবনে সর্বপ্রথম সৌমিত্রের আয় হয়েছিল জয়েন করার দ্বিতীয় দিনে। তখন স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। শিক্ষক-প্রভাষকগণ এক এক শ্রেণীর ইনভিজিলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সৌমিত্র নিজেও সেদিন স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব নিয়েছিলো।

পরীক্ষা শেষ হলে শহরের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার আগে হেড ক্লার্ক শরৎ বাবু ওর রুমে আসেন। এবং ত্রিশটি টাকা দিয়ে রেজিস্টারে ওর স্বাক্ষর নিয়ে নেন। কিসের টাকা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন,
– ইনভিজিলেটর হিসেবে আপনার আজকের সম্মানী, স্যার।
একটু অবাক হয়েছিল সৌমিত্র। ভালোও লাগছিল। নিজের প্রথম সলিড আয়! যদিও চট্টগ্রাম থেকে এই প্রতিষ্ঠানে সে এসেছে ঢাকাগামী বাসের ডাইরেক্ট প্যাসেঞ্জার হিসেবে। তখন ভাড়া ছিল একশত পনের টাকা। সেই ১৯৯৮ ইং সালের কথা। আবার ফিরবার পথেও একইভাবে যাওয়া। তখন অবশ্য এতো টাকা লাগে না। কারণ ফিরতি পথে পথের মাঝ থেকে সৌমিত্রকে উঠতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম আর ঢাকার মধ্যবর্তী এক সীমান্ত এলাকায়।

সেদিন বাসায় ফিরে মায়ের হাতে জীবনের প্রথম উপার্জন তুলে দিয়েছিল সৌমিত্র। মা কতটা খুশী হয়েছিলেন? তবে তাঁর ঝলমলে চেহারায় যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল সে দৃশ্য কি ভুলবার মতো? মা সেই টাকাগুলো খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। নিজের প্রথম সন্তানের প্রথম আয় বলে কথা! হোক না পরিমাণে সেটি খুবই কম।
হঠাৎ করে নিজের মনে বেহায়া ভাবনাগুলো আরো কিছু চিন্তার উদ্রেক করায়!

– আচ্ছা চিত্রা কি এই ত্রিশ টাকা পেলে খুশী হতো?
– মা আর চিত্রা থাকাবস্থায় সে কাকে টাকাটা দিতো?
– মাকে দিলে কি চিত্রা মেনে নিতো? কিংবা চিত্রাকে দিলে মা?
উফফ! অসহ্য।
নিজের রিভলবিং চেয়ার থেকে উঠে পড়ে রুমের ভিতরে পায়চারি করে সৌমিত্র। বেহায়া ভাবনাদের ততোধিক কুচক্রীসুলভ প্রশ্নগুলো থেকে নিস্তার পেতে চায় হয়তো। কিন্তু প্রশ্নগুলোও ওর পিছু পিছু সাথে সাথে থাকে। এদেশের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মতই বিশ্ব-বেহায়া সেগুলোও। তাই এতো সহজে মুক্তি পাওয়া যায় না।