বিভাগের আর্কাইভঃ গল্প

নিমতিতা সরকারি কলোনি

এগারো
“ও-গৃহস্থ, আমার কলোমডা কোথায় বোলতি পারো?… ও-গৃহস্থ, আমার চ্যাবোনপ্রাশের কৌটো পাচ্ছি না”। মনে হবে ভাষকের বয়েস পঁচিশ বছরে আটকে, তেমনি নেশাধরানো গলা। ‘ও-গৃহস্থ’ ডাকে ঘর-উঠোন ভ’রে আছে সারাদিন। মায়াও “একটা কাজ যদি করার উপায় থাকে” এই নকল উষ্মা ঠোঁটে নিয়ে রান্নাঘর থেকে এসে জিনিস খুঁজে দিয়ে যাচ্ছে – কলোম তো নিজির বালিশির তলেই চাপা দিয়ে রাখিছেন।… ডান হাতখান টেবিলের দিকি বাড়ালিই চ্যাবনপেরাশ পাওয়া যায়”। তারপর ফিরে যেতে যেতে মুচকি হেসে শুনিয়ে যাচ্ছে, “শিব মন্দিরটা নড়ে, তবু ওমুক ভট্টাচার্য নড়ে না”।

সেনহাটির সিদ্ধান্তপাড়া গ্রামে তাদের বারবাড়িতে এক গেরুয়া-রঙ শিবদেউল ছিল যার পেছনের বারান্দায় গুচ্ছের চামচিকের বাসা। কর্তাকে নিয়ে বউ যে পারিবারিক প্রবাদ তৈরি করেছে, তাতে মানুষের দেবত্ব (নড়ে না) আর ভগবানের জ্যান্তভাব (নড়ে) প্রমাণিত হয়।

আপাতত একজন মধ্যবিত্ত ভগবানের পেছনে ফোঁড়া উঠেছে। কলোনির অধিবাসীবৃন্দের গায়ে এমন ছরবেছর ফোট গজায় আর চোখে আঞ্জনি। বাসুদেব আর সঞ্জু তারক ডাক্তারের বাড়ি পৌঁছে দেখেছিল, তিনি লুঙি প’রে বেকায়দাভাবে উপুড়, উরুর শুরুতে সবুজ তেলে ভেজানো তুলো লাগানো। ফোঁড়ার মুখ বেরিয়েছে কিনা, বেরোলে ক’টা মুখ, পেকে গেছে কি, পাকলে ফাটবে কবে, কোন তোকমা লাগালে তখনি পুঁজ টেনে নিয়ে ঘা শুকিয়ে দেয় — এমন চর্চায় নিমতিতা সারাক্ষণ গমগম করে। কখনও স্কুল থেকে কোনও হাফ-ছুটি কিশোর খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরছে, তার হাফ প্যান্টের ভেতর থেকে থাই বেয়ে নামা সরু রক্ত দেখে মেয়েরা হাতে মুখচাপা। তো উপুড়শোয়া ডাক্তার একটা ট্যাবলেট ফয়েল থেকে ছিঁড়ে অর্ধেক ভেঙে বাসুর হাতে দিয়েছিল। ওই তাতেই চাঁদের জ্বর সর্বশান্ত হল।

কিন্তু ইঁট পর পর থিয়ে ক’রে সাজিয়ে ঠেলে দিলে যেমন ধারাবাহিক পতনের লাইন আঁকা হয়, তেমনিই ছেলেটার শরীর। জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর মায়ের হাতে তিনচার গাল হাঁসের ডিমের ঝোল-ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছিল, এখুনি কেঁদে জেগে গেল বুকে সাঁই-সাঁই শব্দ নিয়ে। আঁতকে উঠল সন্তান পাহারা দেওয়া দুই মহিলা : “সব্বোনাশ! ও নাদু, ছেলের যে হাঁপির টান উঠিছে!” কাজেই, ব্যস্ত হাতে রান্নাঘরের দরজার শেকল খোলার শব্দ হয়। ফুলকাটা পেতলের বাটিতে সরষের তেল নিয়ে তাতে একমুঠো মাষকলাই ফেলে জনতা স্টোভে বসিয়ে দিল দিদিমা। আর মা ক্রমাগত “চাঁদ আস্তে… চাঁদ চুপ কর…অ্যাখোনি কমে যাবেনে, শোও সোনা… ঘুমোনোর চেষ্টা করো, আচ্ছা, কাল সকালে উঠে অ্যাট্টা নতুন জিনিস খাওয়াবানে তোমারে, ও চাঁদ, শুনলি?…”।

মা তো বোঝে না, শুতে গেলেই দম বন্ধ হয়ে যাবে। মুখ দিয়ে বাতাস টানার চেষ্টা করতে করতে চাঁদের গলা শুকিয়ে এখন কাশি হচ্ছে, প্রতিধ্বনিময় ঘং ঘং — স্টেশানে লোহার তারে ঝোলানো কাটা রেললাইনে হাতুড়ির বাড়ি মারলে যেমন ঘন্টা বাজে। যত শ্বাসকষ্ট বাড়ে, তত সমস্ত পৃথিবীর ‘পরে রাগ তৈরি হয় তার। বোন অবহেলায় নিঃশ্বাস নিচ্ছে, মহানন্দে নাক ডাকছে দিদি, অথচ আমার বুকই আমার শত্রু! পিপারমেন্টের মতো ঠান্ডা হাওয়া চারদিকে, শুধু আমার জীবনেই কেন বাতাস বাড়ন্ত হয়ে যায়? দিদিমা শীতল আঙুলে গরম মাসকলাইয়ের তেল মাখিয়ে তার বুকেপিঠে ড’লে দেয়, তালে তালে ফুসফুস-অ্যাকর্ডিয়ান থেকে নানা সুরের সিম্ফনি…ফুসফুস-জারুলগাছে অনেক পশুপাখালির ডাক। কারও কোলে কোলাব্যাঙের মতো ঝুলে থাকলে কিছুটা আরাম পাওয়া যেত, কিন্তু দিদিমার কাঁখ থেকে তাকে পিছলে যেতে হয় বারবার, মাও একটু পরে হাঁপাতে থাকে, “নাম বাবা, আমি কি পারি, তুমি না বড় হয়ে গেছো!” এখন নিঃশ্বাস নিতে গেলেই চাঁদের পিঠের পেশিতে খিঁচ লেগে দম আটকে আসছে। তখুনি হালকা খুটখুট শব্দ হয় কোথাও, আর মায়া মাথায় ঘোমটা টেনে বসে।

— ও মা, তোমার জামাই দরজায় টোকা দেচ্ছে!
— ওরে না, কালো মেনিডা রাতবিরেতে অমোন দুয়োর হাঁচড়ায়।

নিজের স্বামীকে কীভাবে কতটা চিনেছে, বাইশ বছর বয়েসে বৈধব্যগ্রস্তকে সে বোঝাবে কী ক’রে! একশোটা কাঠের ডাঁটিওলা ছাতা থেকে মায়া স্বামীর ছাতাটি এক মিনিটে চিহ্নিত করে দেবে। স্কুলে যাওয়ার পাঞ্জাবি প’রে ভুলুকভালুক তাকালেই বোঝে হাতঘড়িটা খুঁজছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন কলবল করতে করতে হেঁটে আসছে ট্রেনযাত্রীরা, একজন নীরব মানুষের জুতোর আওয়াজ সে মোড়ের মাথাতেই শনাক্ত ক’রে ফেলে। তিন মাসের পোয়াতি জানলায় ব’সে যেমন দূর-মাঠের ঘাসের গন্ধ পায়, স্বামীর ব্যাপারে দিনরাত তেমন গভীর ইন্দ্রিয়শক্তি নিয়ে জেগে থাকে মায়া।

ঘরে ঢুকে নির্মলচন্দ্র ছেলেকে কোলে তুলে নিজের গায়ের লম্বা পুরোনো শালটি তার পিঠের ওপর জড়িয়ে নেয়। পাশের ঘরে ফিরে যেতে যেতে বলে, রাত দুটো বাজে গেছে, তোমরা হেরিকেন নিভোয় শুয়ে পড়ো।

বারো
বাবার গায়ে সারাক্ষণ পুজো-পুজো গন্ধ। যদিও নির্মল বাড়ির পুজো আর স্কুলের সরস্বতীঅর্চনা ছাড়া কোথাও পৌরোহিত্য করে না। কেউ অনুরোধ করলে বলে, আমাদের বংশে যজমানিবৃত্তিতে নিষেধ আছে। বাবার কাঁধে কন্ঠার হাড়দুটো জেগে থাকে। সেই খোঁদলে নিজের থুতনি বসিয়ে নেয় চাঁদ। বাবার তলপেট সামান্য উঁচু, সেখানে তার পাছাটি আশ্রয় পায়। যেন এক উল্টোনো ইজিচেয়ারে শুয়ে সে এই প্রথম সুষুপ্তির ভাবনা ভাবতে পারে।

এদিকে সারা রাত ঘুম ভাঙে আর ঘুম জোড়ে মায়ার, পাশের ঘরে মৃদু পদপাত তবু থামে না। প্রতি অর্ধ-প্রহরে ছেলেকে বিছানায় শোয়াতে যায় বাবা, আর সে চিৎকার ক’রে কেঁদে আবার কোলে উঠে আসে। বাচ্চা কোলে এই অনন্ত পায়চারির মধ্যে শুকনো পাতা মশ-মশ ক’রে বাড়ির পেছন দিয়ে শেয়াল দৌড়ে যায়, রাতের পাখি ডেকে ওঠে আজাদ হিন্দ সংঘের বটগাছে, আর ভেসে আসে মান্নাপাড়া থেকে কীর্তন-আসরের গান — ও মন, ওরে পাগল মন, তুই চিনলি না আপন। পদকর্তার গলা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে :
গৌরীদাসের সঙ্গে চৈতন্যের মিলন হল কোথায়? এ-নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর বহুমত, কেউ বলছেন শ্রীখণ্ডে, কেউ কাটোয়ায়, কেউ বা কাঞ্চননগর। আমরা বলি, কোন কালে দেখা? কেননা, স্থান গুরুত্বের নয়, কথা হল কাল।
যেথা যেথা নিত্য হরিনাম-সংকীর্তন।
সেথা নিত্য নবদ্বীপধাম, নিত্য বৃন্দাবন।।

বাণীনাথ ভট্টাচার্যের দুই ছেলের ছোট নির্মল, দাদা করুণাময়। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি করুণা ভাইকে বললেন, নিমু আমি হিন্দুস্তানে চলে যাব সপরিবারে। তুই আমার সম্পত্তির অর্ধেক অংশ বাবদ টাকা দিয়ে দে। নির্মল নগদ যা ছিল কুড়িয়েবাড়িয়ে ব্যাংকের জমা টাকা ভেঙে দাদাকে দিয়ে দিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে তাকেও ভিটে ছাড়তে হল। নারায়ণশিলার নিত্যপুজোয় যাতে বাধা না পড়ে, এক ব্রাহ্মণ পরিবারকে বাড়িতে বসিয়ে পরিবর্তে কিচ্ছুটি না নিয়ে দেশ ছাড়ল লোকটা।

তখন পদাবলী-কথকের গলা :
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দাদি বন্ধু ও শিষ্যদের নিয়ে নগর-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন, বদনে হরিনাম — এমনি সময়ে গৌরীদাস উপস্থিত। তাঁকে দেখেই গৌরাঙ্গের মনে পড়েছে শ্রীরাধার কথা। কেননা, এই গৌরীদাস তো আর কেউ নন, তিনি বৃন্দাবনের সুবল। মহাপ্রভু গৌরীকে জড়িয়ে ধরে “রাধা রাধা” ব’লে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লেগেছেন।

তাদের হিন্দুস্তানে চলে আসার তোড়জোড় চলছে, পাশের গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে মাদারে মুখুজ্জে এসে বলে কি, নির্মল আমাকে তুমি কিছু টাকা দাও তো দত্তপুকুরে ভালো জমি পাওয়া যাচ্ছে, তোমার জন্যে রাখি। নির্মল তার হাতে নিজের শেষ সম্বল দু’হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়েছিল। এ-বঙ্গে এসে দ্যাখে কলোনির জমি সরকারি, কিনতে এক পয়সাও লাগে না। আদাড়ে নামে বেশি পরিচিত মাদারেকে সে আর টাকার কথা শুধোয়নি। যা গেছে, গেছে।

তখন মান্নাপাড়ার কথকঠাকুর :
আহা, সে কী অশ্রু! দৃশ্য দেখে কোনও ভক্ত বলছেন, প্রভুর দুচোখ বেয়ে মুক্তো গড়িয়ে পড়ছে। আবার কোনও ভক্ত বলছেন — না না, গড়িয়ে পড়ছে মুক্তি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভক্তিরূপ গাল বেয়ে মুক্তি গড়িয়ে পড়ছে গো!

এবার জোকার উঠল — হরে হরে কৃষ্ণ, নিতাই নিত্যানন্দে জয় জয়! বলো শ্যামো অঙ্গে, গৌর অঙ্গে বলো জয়। নির্মল টের পায়, শ্বশ্রূমাতা মাটির হাঁড়িতে গোবরজল নিয়ে ছড়া দিচ্ছে উঠোনে। ফার্স্ট ট্রেন ঘটঘট ক’রে স্টেশানে ঢুকল। মাঘী পূর্ণিমা লাগবে সকাল সাতটায়। বচ্ছরকার দিন ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। তবু তার গলার বাঁশি-শব্দ এখন অনেক আবছা। সন্তর্পণে শোয়াতে গিয়ে নির্মল দেখে গাল ভিজে ভিজে, কয়েক দানা কৃষ্ণপ্রিয় অশ্রু বাবার চোখ থেকে খ’সে গিয়ে লেগেছে সন্তানের মুখে।

সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ উপাধি-র মানুষটা বিড়বিড় করে গীতগোবিন্দ ভাঁজছিল — চন্দনচর্চিত নীল কলেবর পীত বসন বনমালী। কিন্তু জয়দেবের দ্বিতীয় চরণ কেলি চলন্মণি কুণ্ডল মণ্ডিত গণ্ডয়ুগস্মিত শালী-র জায়গায় হঠাৎ মাথায় এল — মাটির বুকে চাঁদের নিমাই, ধরতে গিয়ে জাত খোয়ালি। এটা কোনও বাউলগানের লাইন, নাকি নিজেই সে লিখেছে কখনও! অযাচিত এমন এক সৃষ্টিমুহূর্তেই হয়ত ছোটছেলের নাম রাখা হয়েছিল অযাচক। এখন ঘুমে বিভোর তীক্ষ্ণ-করুণ মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, কে জানে জীবনের কাছে কত-কতবার হাত পাততে হবে এই শেকড়-ওপড়ানো শিশুকে; প্রার্থনা, মাঙন, কাতর অনুরোধে ভ’রে থাকবে কিনা এর পরমায়ু! বৈরাগী নামের বোঝা চাপিয়ে একটা দুর্বল ফুসফুসকে আগে থেকেই ক্লান্ত ক’রে তুলব?

চাঁদের ভালো নাম তবে চন্দন, যে সব রকম সৎকারেই লাগে — এই ভেবে তাকে বিছানায় নামাল নির্মলচন্দ্র। বালিশে নতুন নামের গন্ধ নিয়ে সে স্বপ্নের দিকে বয়ে যাক…।

(শেষ)

হঠাৎ সন্ধ্যা (৫ম পর্ব )

new-1

বরাবরের মত সেদিনও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। কলপাড়ে মুখ ধুতে গিয়ে দেখি বাবা উঠানে দাঁড়িয়ে কাদের চাচার সাথে কথা বলছেন। কাদের চাচা পেশায় একজন বাবুচি। তার রান্নার সুনাম আশে পাশে ১০ মহল্লা পর্যন্ত আছে। লোকে বলে তার কাছে চারটি জ্বিন আছে। বড় কোন অনুষ্ঠানে জ্বিনদের রান্নার দায়িত্ব পরে। জ্বিনদের মধ্যে একজন আবার অন্ধ। সেই অন্ধ জ্বিনের মাংসের রেজেলা নাকি বেহেস্তের খাবারকেও হার মানায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সে মাংসের রেজালা কখনো কেউ খেয়ে দেখেনি। রান্না করতে বললে কাদের চাচা মাথা নিচু করে বলে- আইজ রান্না করা জাইবো না, আইজ একটু সমস্যা আছে!
বাবা উঁচু আওয়াজে কাদের চাচার সাখে কথা বলতে লাগলেন। এমন সময় মোতালেব আংকেল তাদের সাথে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে দূর থেকে হাত উঁচিয়ে ডাকলেন। অন্য সময় মোতালেব আংকেল ডাকলে সাড়া দেই না। কিন্তু এখন বাবা সাথে আছেন না গিয়ে উপায় নেই। কাছে যেতেই মোতালেব আংকেল দাঁত বের করে বললেন-কেমন আছ ইরা?
-জ্বি, ভাল।
-তোমার কি মন খারাপ?
-জ্বি না।
-তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে মন খারাপ। যাই হোক বিয়ের দিন মেয়েদের মন খারাপ করে থাকতে হয় না। এতে অমঙ্গল হয়। চেষ্টা কবরে সব সময় হাসি-খুশি থাকতে। সবার সাথে নিজে থেকে কথা বলতে। ঠিক আছে?
মোতালেব আংকেলের কথা শুনে আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। শরীর জুড়ে জ্বরের স্রোত বয়ে গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। গলা শুকিয়ে গেল। এমন সময় বাবা ফের চেঁচিয়ে বললেন-দাঁড়িয়ে মূর্তি হয়ে গেছিস? মুখ দিয়ে কথা বের হয় না? একটা মানুষ কিছু বলছেন সেদিকে কোন খেয়াল নেই, উনি মূর্তি মানবী হয়ে গেছেন। মেয়ে গুলো কোন ভদ্রতা শেখেনি। যা ভেতরে যা, গিয়ে তোর মাকে চা দিতে বল। এক ঘন্টা আগে চা চেয়েছি। তারও মুখে বন্ধ।
আমি দ্রুত সেখান থেকে রান্না ঘরের দিকে গেলাম। রান্না ঘরে ঢুকে দেখি মা মশলা বাটছে। আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন-ইরা, চুলার উপরে গরম চা আছে কাপে ঢেলে বাবাকে দিয়ে আয়। আমি মায়ের কথা অনাগ্রহ করে এক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি জানি মা আমার সাথে চোখ মেলাতে পারছেন না। তবুও আমি মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না।সকল না বলা কথা কন্ঠে আটকে গেল।

আজকাল বড় চাচা সারাদিন বই নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন। আশে পাশে কি ঘটছে তা নিয়ে খবর রাখেন না। সারাদিন নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখেন। আমি বড় চাচার ঘরে ঢুকে দেখি তিনি চেয়ারে বসে বই পড়ছেন। আমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে গেলেন। আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন-তুই! তুই কখন এলি? কোথায় ছিলি এতোদিন? আমি হতাশ গলায় বললাম-বড় চাচা, আমি ইরা! মীরা নই। তুমি আজকাল এই ভুলটা খুব বেশী করছ। আমাকে মীরা মনে করছো। মীরা আপা চলে গেছে ১০ বছর হয়েছে। বড় চাচা চশমা খুলতে খুলতে বললেন-তুই দিন দিন একদম মীরার মত হয়ে যাচ্ছিস। তোর আর মীরার চেহরা একই রকম, দেখে বুঝা যায় না কে ইরা, কে মীরা? আচ্ছা বাদ দে, কিছু বলবি না হলে পরে আসিস আমি এখন খুব ইমপরটেন্ট একটা বই পড়ছি।
-বড় চাচা, আমিও তোমার সাথে জরুরী একটা কথা বলার জন্য এসেছি।
-বল, তোকে ২ মিনিট টাইম দেয়া হলো। ২ মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করে চলে যা।
-তুমি কি জানো আজ আমার বিয়ে?
-জানি।
-তাহলে কার সাথে বিয়ে সেটাও জানো?
-জানি
-জানি, জানি, করবে না! কার সাথে বিয়ে সেটা অন্তত বলো?
-কেন, তোর পাগল বাপ তোকে বলেনি।
-না।
-তোকে বিয়ের কথা কে বললো?
-মোতালেব আংকেল।
-তাহলে তাকে গিয়েই জিজ্ঞাসা কর কার সাথে বিয়ে?
এ পর্যায়ে বড় চাচা বই বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। আমার সামনে এসে বললেন-তোর বাপ সারাজীবন আমার কথা শোনেনি। তার পাগলামিতে আমি অতিষ্ট। সে কখন কি করে সে নিজেও জানে না। দুই-তিন দিন আগে আমার ঘরে এসে বলল-ভাইজান, ইরার বিয়ের পাকা কথা বলে আসলাম। ছেলের বাপ মস্তবড় ব্যবসায়ী, নাম আসলাম তালুকদার। রায়পুরে বাড়ী, বাজারে অনেক গুলো দোকান আছে। টাকার কুমির। আমি বললাম-ভাল করেছিস। দেখে শুনে তুইও একটা বিয়ে করে নে। এ কথা শুনে সে চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আমি জানি তোর বাপ এখন তোর বিয়ে নিয়ে পরেছে তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমি দোয়া করি তুই সুখী হ বলেই বড় চাচার গলা ধরে এলো। তিনি মাথা নিচু করে ফেললেন, চোখ দিয়ে টপ টপ পানি পরতে লাগলো। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে বড় চাচার পা জড়িয়ে ধরলাম। হাউমাউ কেদেঁ ফেললাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলাম-আমাকে বাঁচাও বড় চাচা, আমি মরে যাব, আমাকে বিয়ে দিও না, কিছু একটা করো! আমাকে বাঁচাও! বড় চাচা আমার মাথায় হাত রাখলেন। ভেজা গলায় বলতে লাগলেন-চলে যা, তোর দুই মিনিট শেষ, এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।

চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে দেখি মা আমার ঘরে বসে আছে। তার হাতে নিজের বিয়ের পুরাতন শাড়ী সাথে কিছু রুপার গহনা। আমাকে দেখে বলতে লাগলেন-তারাতারি গোসল করে শাড়ীটা পরে নে। সময় মত রেডি না হলে তোর বাবা হুল্লো করবে। দেরি করিস না। আমি মায়ের হাত থেকে শাড়ীটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

আট-দশটা বিয়ের মতো এ বিয়ে নয়। কোন ধুম-ধাম নেই, নেই কোন সানাইয়ের সুর। হৈই-হৈলো, বিয়ে বাড়ীর আমেজ কিছুই নেই।পাশের বাড়ীর মিতা দিদি আর পাড়ার কিছু মুরুব্বি ছাড়া কোন আত্নীয়-স্বজন চোখে পরলো না। সব কিছুর মূলে ছিল বাবা অর্থনৈতিক সমস্যা। এই বাড়ী ছাড়া বাবার হাতে আর কিছুই নেই। সব মদ খেয়ে শেষ করেছেন। শেষ সম্বল বাড়ীটাও বিক্রি করবেন আমি চলে যাবার পর। মিতা দিদি মীরা আপার বান্ধুবী ছিলেন। স্বামী মারা যাবার পর একমাত্র ছেলের হাত ধরে ফের বাপের বাড়ী চলে আসেন।পরিচিত মহিলাদের মধ্যে তিনিই এক মাত্র আমার বিয়েতে এসেছেন। ঘরে ঢুকেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু খেয়ে বললেন তোর কপালটা অনেক ভালরে অনেক বড় ঘরে বিয়ে হচ্ছে। সবাই অনেক ভাল। তোকে অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি মৃদু হেসে বললাম-তুমি কিভাবে জানলে? তারাতো আমাকে দেখেইনি।
-সেকি বলছিস? কদিন আগেই তো তোকে দেখে গেল। তোর মনে নেই, মীরার কথা শুনে যারা চলে গিয়েছিল তারাই আবার তোকে নেবার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে। ছেলে তোকে খুব পছন্দ করেছে। তোকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে রাজি নয়।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মিতা দিদি একা ধারে কথা বলে চললো। বাদ যোহর বরপক্ষ চলে এলো। মোতালেব আংকেল সবাইকে নিয়ে ঘরে বসালেন। বাবা খুব শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। চেচিঁয়ে মাকে বলতে লাগলেন-এতোক্ষন লাগে? তারাতারি ইরাকে নিয়ে আসো। বরপক্ষ কি রাতে থাকতে এসেছে? বিয়ে করে নিয়ে চলে যাবে।
মিতা দিদি আমার মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে সকলের সামনে নিয়ে গেল। চেয়ার টেনে বরের সামনে বাসাতেই জাকির মাস্তান দরজা দিয়ে ঢুকলেন। জাকির মাস্তানকে দেখে বাবা উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন-বাবা জাকির, কাজী.. কাজী সাহেব কোথায়?

(চলবে)

পরিবহন কথা

82730
প্রতীকি ছবি

মিনিট দশেক অপেক্ষা করে বাস পেলাম। বাসে উঠতে না উঠতেই দুজন দীর্ঘদেহী মানবের বাঁধায় থমকে গেলাম; পথ আটকে দাঁড়িয়েছিলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। পরের স্টপে আরও কয়েকজন বাসে উঠছে দেখে ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, সেই দীর্ঘদেহী ব্যক্তিদ্বয়ের কারণে পারলাম না। পিছন ফিরে দেখলাম পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মহিলা ভিড়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে প্রায়। এদিকে নিজেরও বেহাল দশা!

সুযোগ পেতেই ওই মানবদ্বয়ের মাঝ-বরাবর নির্ঝঞ্ঝাটভাবে ঢুকে পড়লাম। পাতলা গোছের মানুষ বিধায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি। দুজনের মাঝে জোর করে ঢুকে শক্ত চাপ সৃষ্টি করলাম। এতে উভয়ের ভুঁড়ি দু’দিকের দুটো সিটে লেগে যাওয়ায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। মূহুর্তেই মুখের লাবণ্যতা হারিয়ে ফেললেন দুজনেই। ব্যথার চটে বেশ কাবু হয়েছেন বটে!

এই ভুঁড়িকষ্ট থেকে বাঁচতে চেষ্টার কমতি রাখলেন না। কিন্তু আমি তো নাছোড়বান্দা, সেখান থেকে সরার নাম-ই নেই। পরক্ষণে তাদের ভুঁড়ির দুর্দশার কথা চিন্তা করে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, দুজনে ভুঁড়িতে হাত বোলাচ্ছে। হাসি পেল কিন্তু হাসলাম না। নয়তো প্রতিবেশী যাত্রীরা ভাববে কারো সর্বনাশ, কারো পৌষ মাস।

অতঃপর একজন সে স্টপেই নেমে গেল; অন্যজন ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ বাসে ছিলাম তার দিকেই খেয়াল ছিল- বেচারা কোন কথা বলেনি। অনেকেই তাকে অতিক্রম করে নামা-উঠার সময় নানান কথা বললেও তিনি উত্তর করেননি। চালকের সহযোগী বারবার ধমক দিচ্ছেন কিন্তু সেই দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক নির্বাক জানালা ভেদ করে উঁচু উঁচু দালানের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

নিমতিতা সরকারি কলোনি

আট
অনেক দূরের নক্ষত্রমণ্ডল থেকে ফিরে আসছিল চাঁদ, রিকশা ক’রে। অন্ধকার মহাজগতে চাকার নীচে খোয়ার মতো ছায়াপথ আর গ্রহাণুপুঞ্জের ঝাঁকুনি খেয়ে, রিকশার হ্যান্ডেলের লাগানো টেমি-র আলোয় রাস্তা দেখে দেখে…। হঠাৎ এক একটা উল্কা ছুটছে চারদিক সাদা ক’রে দিয়ে। তখন বোঝা যাচ্ছিল, ধ্রুবলোকের কোথাও ব’সে সিংহ কেশর ঝাঁকাচ্ছে; কোথাও রথের মেলায় তেলেভাজার দোকানে বেসন ফ্যাটানো হচ্ছে; কোথাও পাহাড়ি কেল্লার ছাদ থেকে জরির পোশাক পরা একটা মেয়ে হাত নাড়াচ্ছে তার দিকে।

রিকশাওলা তাদেরই স্টেশান-বাজারের মোতিউরদা, যার কাঁধের গামছায় জ্বলছে নিভছে অনেক জোনাকি। “তারাক’টা বেঁদে নিয়ে আসলাম বলো, কেরোসিনির যা দাম!” ব’লে সে এতক্ষণ বাঁহাতের ব্রেকে আটকে রাখা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র খুলে দেয় আর শোঁ-শোঁ ক’রে নীচে নামতে থাকে তিনচাকা গাড়ি। চাঁদের বাড়ির হারিকেন বাধ্য হয়ে রাত ন’টাতে নিভে যেত, কেননা রেশানে এ-সপ্তাহে ‘কেরাসিন’ দেবে তো পরের সপ্তাহে দেবে না, আর মা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, “বেলাক-এ তেল কেনা অন্যাই”। দারিদ্র সবচেয়ে ভালো মুখ লুকোতে পারে নৈতিকতার পিঠে। এখন, থকথকে কুয়াশার মধ্যে অবতরণ করতে করতে সে গুনতে থাকে — বড়ঘর, রান্নাঘর, খোপের ঘর, পায়খানা। মোট চারটে তারাজোনাকি যেই চাইতে যাবে মোতিউরদার কাছে, দেখা যায় রিকশা আলো ক’রে চাঁদের গা ঘেঁষে সেই মহাকাশ-দুর্গের মেয়েটা!

নয়
ঘোষপাড়া, চড়কপাড়া, মান্নাপাড়া — এভাবে চলল এ-দেশিয়দের ফাঁকাফাঁকা দালান, সাধারণত হলুদ রঙের, রোয়াকবিশিষ্ট, নিঃঝুম। চওড়া কাঁচা রাস্তাগুলো খেঁকিকুকুর-প্রধান; দুচার পা অন্তর ছোট ছোট মাঠ; আর আছে হরিসভা, ক্লাব নয়তো পুষ্করিণী। বাসিন্দাদের মধ্যে ভুঁড়িয়াল টাকমাথা লোক বেশি; কোমরে আলগোছে ফিতেবাঁধা পাজামা, মাথার চুল-টানা বা পিঠ চুলকোনোর জন্যে বিকেলে কচুরি কিনে দেওয়ার শর্তে বাচ্চাদের ডাকছে। খুব খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া হয় এখানে, সকালে কর্তা, তারপর ছেলেমেয়ে, দুপুরে গিন্নি, শেষে সেটি চলে যায় পাশের বাড়ি এবং শ্লীলতাহানির সংবাদের মতো বিধ্বস্ত হয়ে রাতে ফেরত আসে।

অঞ্চলের নাম নিবাধুই। অদ্ভুত নামে আকৃষ্ট হয়ে সুকুমার সেন খোঁজতলাশ ক’রে জানিয়েছিলেন, দুশো বছর আগে আশশ্যাওড়া, আলকুশি, জার্মানিলতার ঝোপে ঢাকা; শিমূল, বাবলা, অক্ষয়বট, বেল, টককুলের বৃক্ষে ছাওয়া এলাকাটির নাম রাখা হয়েছিল নির্বান্ধবপুর। সেখান থেকে নিবন্ধপুর… নিবদ্ধপুর… নিবধই…নিবাধই হয়ে আপাতত নিবাধুই-তে থেমেছে। পুরোনো ও বর্ধিষ্ণু গ্রামটি ১৮৪৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় ছেলেদের হাইস্কুল পেয়েছিল। চার বছর পরে তিনি এখানে বালিকা বিদ্যালয়ও বসিয়ে দিয়ে যান। বিদ্যাসাগরের নিজের সঞ্চয় থেকে অর্থসাহায্য আসত স্কুলদুটোয়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও দীর্ঘদিন ভাতা পাঠিয়েছেন। বর্তমানে এই লোকবসতি “তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া” গাইছে, শরিকি সম্পত্তি ভাগ হতে হতে এক ভিটেতে তিন-চার পরিবার মাথা গুঁজলে কী আর করা! পাড়ায় কত-না শিক্ষকের বাস, নাট্যকারের ভদ্রাসন; তবু ধরা যাচ্ছে না বাউন্ডারি ওয়ালের সংস্কার, বাড়ির কলি ফেরানো বা পুকুরঘাটে সিঁড়ি মেরামতির কাজগুলো। বাথরুমের কাঠের দরজা ভাঙলে পুরোনো ফ্রেমে একপাল্লার টিন যোতা চলছে।

মোতিউরের রিকশা প্যাঁক ক’রে হর্ন মারে, সাড়ে দশটার অন্ধকার শূন্য রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়ায়, আর ডান হাতে ভেসে ওঠে দোলপূর্ণিমার ফাংশানের মাঠ। তারপর জোড়াবটতলা পার হল, যেখানে সারা দুপুর গাছের ঝুরি ধ’রে ঝুল খেতে খেতে এতবার বটনিম্নস্থ পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চারা যে এই শুনশান রাতেও দুটো পরিচ্ছন্ন ঝুপ শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠে মোতিউর দ্যাখে পুকুরের ওপর তির্যক ফলবাগান থেকে নারকোলমুন্ডু খ’সে পড়ে হাসতে হাসতে ভেসে যাচ্ছে জলে।

মান্নাপাড়ার কালীবাড়ি পৌঁছে রিকশা থামবে জানা কথা; এখানে প্রণাম না সেরে কোনও নতুন বউ শ্বশুরবাড়ি ঢোকে না। কিন্তু ভগবানই জানে কখন কোন বৃষ্টিতে চাঁদের সারা গা জবজবে ভিজে আর অসম্ভব বাতাসে জামাটা খুলে উড়ে যেতে চাইছে… গেলও বোধ হয়। এদিকে চুমকিপাড় ওড়নার রাজবালিকা মা-কালীকে গড় ক’রে উঠে দাঁড়াতেই চাঁদ দেখল তার ছিপছিপে গলায় দিদিমার মুখ বসানো! অবাক হওয়ার সময় নেই, উড়নচন্ডে হাওয়া এবার খুলে ফেলেছে তার হাফপ্যান্টের প্রথম বোতামটা…।

দশ
লেপের নীচে অসুস্থের ঘেমো শরীর মুছিয়ে দিতে দিতে সঞ্জু ভাবছিল — সেরে উঠুক, তারপর যা খ্যাপাবো না! একটু আগে রোগি দিদিমাকে জিগেস করেছে, সিঁদুর পরোনি কেন? সন্ধেবেলা কাঁদল আমার মাথাটা খুঁজে পাচ্ছি না ব’লে। যখন পাশ ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কী রাগ —“আস্তে চালাও, মোতিউরদা”, অথচ একমাস হয়ে গেল রিকশাওলা মোতি ট্রেনে কাটা পড়েছে। ধুম জ্বরের মধ্যে এত মজার মজার প্রলাপ বকছিল চাঁদ যে শীতলাতলায় চার আনার বাতাসা মানত করতে হল ছোটভাইকে সারাক্ষণ চড়-থাপ্পড় মারা ছেলেটার।
তখন মা বলল, কাঁদতিছিস কেন, এই সঞ্জু? এই বোকা, ভাইয়ের জ্বর নামে গেছে ব’লেই তো ঘাম দেচ্ছে। কালই দ্যাখবা, তোমারে আবার চিমটি কাটবেনে পড়তি ব’সে।

জননী তারপর রান্নাঘর থেকে এইমাত্র আসা দিদিমার সঙ্গে ইশারাময় সংলাপে ডুবে গেল।
— পালি, নাদু?
— ও মা, কী পাবো!
— সত্যি কোচ্ছিস, গন্দো পাসনি?
— তুমি পাইছো?
— একছিটেও না। আমি ভাবলাম আমার বুঝি সোদ্দি…।
— উনোনে ক’টা মরিচ পোড়াইছিলে?
— তিন-তিনডে। ডালি অ্যাট্টা ফ্যালায় সোম্বোরা দিলিই কাশতি কাশতি পেরান যায়! ফাটানে ঝাল।
— তার মানে তুমি যা ভাবিছো তাই!
— নালি আর কলাম কী?

স্বাভাবিক শত্রু কিন্তু আপৎকালে একজোট দুই রমণী গালে-হাত চোখ-দীঘল ক’রে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একজনের ঈষৎ গর্বিত গলা শোনা যায়, “আমার চাঁদ হয়ত এট্টু রোগা, কিন্তু মুখটা-মাথাটা টলটল করে”। দিদিমা, যেন নিজেরই প্রশংসা হল, ব্লাশ করে যথারীতি : “বোলতি নেই, যা ফনফনায় উঠিছে, তোর মতোন নাম্বা হবে”। তারপরই মুলিবাঁশের বেড়া কেটে বানানো জানলা দিয়ে কুটিল দৃষ্টি ছোঁড়ে বলরাম দাসের বাড়ির দিকে : “বলা-র বউখান তো না, য্যান্‌ পুতোনা রাক্ষসী”।

এখন সব চোখই দৃষ্টিহীন এই উপনিবেশে। শুধু বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পা-দুটো ছাড়িয়ে নিল মা-মেয়ে। অসুস্থ সন্তানের মাথার কাছে ব’সে তারা কত রাত ভোর করেছে তার হিসেব হয় না।

(আর একটু)

হঠাৎ সন্ধ্যা (৪র্থ পর্ব )

eted-2

না, সেদিন সন্ধ্যায় জাকির মাস্তান আমাকে তুলি নিতে আসেনি। বরং সেদিন তার উপকারের কথা ভুলবার মত নয়। বাবা মদ খেয়ে বাড়ী ফিরছিলেন। বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে ডান হাত ভঙ্গে নেন। জাকির মাস্তান তাকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে মোটর সাইকেলে বাড়ীতে নিয়ে আসেন। তাই সেদিন দরজায় দাঁড়িয়ে জাকির মাস্তানকে দেখে যতটা ভয় পেয়েছি তার চেয়ে বেশী আতংকিত হয়েছি বাবার ভাঙ্গা হাত দেখে। ভাঙ্গা হাত নিয়ে বাবা ঘরে ঢুকতেই চেঁচাতে লাগলেন- কই মরছিলি? দরজা খুলতে এতক্ষণ লাগে? ঘরে বসে বসে কি করিস? পিড়িত করিস? বেশী পিড়িত ভাল না। একটা পিড়িত করে পালিয়েছে। আরেকটার সুর উঠেছে।

আমার খেয়াল রাখিস? আজ জাকির না থাকলে কি হত সে চিন্তা আছে? জাকিরকে ঘরে নিয়ে যা, বসতে দে, চা, পানির ব্যবস্থা কর। আমি আসছি বলেই বাবা চিলেকোঠার দিকে রওনা হলেন। তার রোগ-কষ্ট এখন একটি মানুষ ঠিক করতে পারবেন সে হল মোতালেব আংকেল। বাবার কাছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এক পাশে এবং মোতালেব আংকেল অন্যপাশে। তার হোমিও বিদ্যার যাদু না পেলে বাবা এখন ঠিক হবেন না।

আমি জাকির মাস্তানের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললাম- জাকির ভাই, ভেতরে আসুন। একটা গামছা দিচ্ছি মাথা মুছে ফেলুন। এ কথা শুনে সে মাথা নিচু করে বললো-আমি ঠিক আছি ইরা, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
– জাকির ভাই, আপনাকে নিয়ে কেউ ভাবছে না। বাবা আপনাকে বসতে বলেছে তাই ভেতরে এসে বসুন আমি চা নিয়ে আসছি। আমার কথা শুনে জাকির মাস্তান বাধ্য ছেলের মত ঘরে এসে বসলেন। ইনিয়ে বিনয়ে বলতে লাগলেন -আমি খুব লজ্জিত ইরা, সেদিনের কাজটি আমার মোটেও উচিৎ হয়নি। আমি কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, না বোঝার ভঙ্গিতে বললাম কোন কাজটির জন্য লজ্জিত?
জাকির মাস্তান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-ওই যে, সেদিন তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছি! বিশ্বাস করো আসলে আমার কোন বাজে উদ্দেশ্য ছিল না। মজা করতেই চিঠিটা দেয়া।
– আচ্ছা, তার মানে আপনি আমাকে ভালবাসেন না! মজা করতেই চিঠি দিয়েছেন?
– না, তা নয়। তুমি ভুল বুঝছো!
– আপনি কি ঠিক বুঝছেন? আপনার এই ঠিক বুঝার জন্য আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
– আমি না হয় তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবো।
– আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আমার মনে হয় না সে এসব কিছু মনে রেখেছেন! নেশাগ্রস্ত মানুষ কোন কিছু মনে রাখেন না। যে কাউকে যখন তখন বন্ধু বানিয়ে ফেলে। যাই হোক, আপনার চায়ে কয় চামচ চিনি দিব?
আমার কথা শুনে জাকির মাস্তান আরো কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু বললেন না, নিরীহের মত তাকিয়ে রইলেন। আমিও আর কোন কথা না বলে রান্না ঘরে চলে এলাম।

মানুষ বড়ই অদ্ভুদ প্রাণী। উপরে দেখতে যেমন ভেতরে তেমন নয়। কয়েক বছর আগে দোকানদার বাচ্চু মারা যাবার পর কিছু মানুষ বাচ্চুর দোকানে লুট চালায়। মানুষ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকে, সেদিন কেউ এগিয়ে না আসলেও এগিয়ে আসে জাকির মাস্তান, পিটিয়ে ব্যাঙ বানিয়ে দেয় সব গুলোকে। মার খেয়ে লোক গুলো কোয়াক কোয়াক শব্দ করতে থাকে। সেদিনের পর থেকে জাকিরের নামের পাশে মাস্তান টাইটেল বসে যায়। তাছাড়া জাকির মাস্তান সম্পর্কে আরো কিছু শোনা যায়। লোকে বলে নির্বাচনের দিন জাকির মাস্তান নাকি চেয়ারম্যানকে থাপ্পর দিয়ে মুখে থেকে পান ফেলে দিয়েছে। সে নিয়ে অবশ্য চেয়ারম্যান কিছু বলেনি। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে চেয়ারম্যান বলে জাকির নটি বয়, ভেরি নটি বয়!

প্রেমে পড়ার কিছু লক্ষন থাকে। জাকির মাস্তান যে আমার প্রেমে ডুবে যাচ্ছে এটা তার চোখ থেকে বুঝা যায়। শুধু মজা করে মানুষ কাউকে প্রেমপত্র দেয় না, প্রেমপত্রে লিখে না ‘ইরা, তোমাকে দেখলে আমার বুকে ব্যাথা হয়‘ হয়তো এই ব্যাথা সারাতে জাকির মাস্তান প্রতিদিন আমাদের বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, কলেজের যাবার সময় পিছু নিত। তার সিগারেটের উচ্চ ধৌঁয়া জানান দিত আমাকে ঘিরে তার কতো হতাশা! আমি সব কিছু বুঝতাম কিন্তু কিছু করার ছিল না। মীরা আপা যে কাজ করেছে তার পুনরাবৃত্তি ঘটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায় আছে, আমি চাই না সে অন্ধকারে কেউ হারিয়ে যাক।

(চলবে)

পড়ুন-হঠাৎ সন্ধ্যা (৩য় পর্ব)
পড়ুন-হঠাৎ সন্ধ্যা (২য় পর্ব)
পড়ুন-হঠাৎ সন্ধ্যা (১ম পর্ব)

নিমতিতা সরকারি কলোনি

পাঁচ
জ্বর, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? খগবতীর মৃত্তিকা হইতে। মাটি থেকে মানুষের পায়ের আঙুল বেয়ে আস্তে আস্তে উরু, কোমরে উঠে যাই। ওদিকে হাতের তালু থেকে নাক-গলা হয়ে মাথায়। তারপর দুই ঢেউ এক সঙ্গে ভেঙে পড়ি বক্ষতটে।
এই তরঙ্গ উইপোকার, তার আস্তরণে ঢেকে গেছে সমস্ত শরীর। ভেতরে ব’সে বন্ধ-চোখ গাঢ়-শ্বাসের বাল্মীকি।

— তারক ডাক্তাররে একবার খবর দি’, নাদু? আমার কাছে দেড্‌টা টাকা আছে।
— তুমি থোও দিন! সোদ্দি-গাগরোম; রাত্তিরি সাবু খাক, কাল সকালে ঝজ্‌ঝরে হয়ে যাবেনে।

বিকেলবেলা হঠাৎ শরীরে তাত এসে চাঁদের চলাফেরার সংবিধান বদলে দিল। এখন রঘুনাথের মাঠে বালক-বালিকাদের কিট্টু আর গাদি খেলা; রাস্তা দিয়ে ছেলেরা ঢ্যাব-ঢ্যাব ক’রে বল ড্রপ খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চৌরাস্তার মুচির কাছ থেকে সেলাই ক’রে পাম্প দিয়ে মাঠে নামাবে। এখন পড়ন্ত রোদে পাখির ডাক থেকে মনখারাপ খুঁটে নেওয়ার সময় নয়। বরং মা চমকে উঠে জিগ্যেস করবে, আমাদের বাড়ির মাথার ওপর দিয়েই ডেকে গেল নাকি? না না, ফুলিদের বাড়ির ওপর দিয়ে। “বড় বাঁচা বাঁচিছি। মাসের শেষে আসোজন-বসোজন সামলাতি হোলি আর দেখতি হ’তো না!”

জ্বরে ঘুম পায়, ঘুমে দেহতাপ বাড়ে আর আকাশে থইথই করে ফুল্লকুসুমিত অন্ধকার। সেই তমসা কেন্নোর মতো উথলে চাঁদের নাকমুখ দিয়ে ঢুকে যায়, ফুসফুস ভ’রে ওঠে আলকাতরার পাপড়িতে। দিদিমা গল্প করেছে, একবার ঘুমে-কাদা কোনও বাচ্চার কান দিয়ে কেন্নো ঢুকে তার মগজে বংশবিস্তার করেছিল। তারপর পড়া পারেনি ব’লে মাষ্টারমশাই যেই ছেলেটার চুলের মুঠো ধ’রে টান দিয়েছে, চুল সমেত ব্রহ্মতালু, মানে নারকেলের অর্ধেকটা মালা স্যারের হাতে উঠে এল। তখন দেখা যায়, ঘিলুর জায়গায় গিজগিজ করছে শুধু কেন্নো!
সেই থেকে কেউ চুলের মুঠি ধরলে চাঁদ সামান্য চিন্তায় থাকে! কিন্তু এখন যে ত্রস্ত মেয়েলি আঙুল তার মাথার ঢেউয়ে ডুবে গেল… নেমে এল কপালে, গলায়… সে যেন নিজেরই উদ্বিগ্ন হাত :

— ও শিউলি, শিগরির মারে ডাক। ভাইয়ের গা তো পুড়ে যাচ্ছে!

ছয়
প্রথমে জলেচুলে সোহাগ জমবে না, মাথাভর্তি গাঁজানো কেশরাশিতে জল স্লিপ ক’রে বেরিয়ে যাবে। তখন, তিমিরের বাবাকে এতদিন ডাকা হয়নি কেন ব’লে দানা বাঁধবে একটা বিক্ষোভ। ছেলে রেলে গ্যাংম্যানের চাকরি পেলেও আশি-পার বৃদ্ধ এখনও জাত-ব্যবসা ছাড়েনি, হাতে নাপিতের বাক্স দুলিয়ে কুঁজো-হেঁটে চলে আসে কেউ খবর পাঠালেই, আর প্রাণভয়ে ছোটদের কান্না শুরু হয়। ক্লিপ-মেশিনে পটাং পটাং করে ঘাড়ের চুল ছিঁড়তে থাকে অসিত পরামানিক, রক্তকুচি ফোটে সার দিয়ে; তখন স্কন্ধে ফটকিরিপাথর ঘ’ষে একগুচ্ছ জ্বলুনি ফ্রিতে উপহার। এবার সে ময়লা ধুতি গুটিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে শিশু-মাথা চেপে ধরল — চুলে কাঁচি চালাবে। অপরিচ্ছন্ন উরু ও কুঁচকির গন্ধে সেই জানু মধ্যবর্তী স্থানে হাঁচতে থাকে বাচ্চারা।

রাত যত বাড়ের দিকে, চাঁদের শরীরে ঘুমের বদলে ঘোর জন্ম নিচ্ছিল। বাবা স্কুল ছুটির পরে অপারিশ্রমিকের কোচিং পড়িয়ে ফিরেছে, মা ডাকল : এট্টু জপ ক’রে দিয়ে যান না ছেলেডার মাথায়। নির্মলচন্দ্র নিজের জ্বর-সমান উষ্ণ করতল সন্তানের কপালে রেখে অতি মৃদুস্বরে শ্লোক আওড়ান। উপনয়ন হওয়ার আগে গায়ত্রী-আদি কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করা নিষেধ। কিন্তু অবাধ্য ছেলের কানে একবার পৌঁছোলে সে হাজার কানমলা খেয়েও সারাদিন ওটাই চেঁচিয়ে বেড়াবে।

আসলে, কনিষ্ঠ পুত্র প্রায় বাবার মতো স্মৃতিধর। আজ থেকে অর্ধ শতক আগে খুলনার অন্তঃপাতী সেনহাটি গ্রামে নির্মলের স্মরণশক্তি ছিল সুবিদিত। যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, এমনই এক শীতের দিন স্কুল ইন্সপেক্টর এসেছেন পরিদর্শনে। ক্লাসে ঢুকে প্রথম বেঞ্চে বসা ছোট্টখাট্টো চেহারার ধপধপে সাদা বালকটিকে দাঁড় করালেন : বলো, বর্ণপরিচয় বলো। খোকা বুঝতে পারল না কোন ভাগ তাকে আবৃত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব অ, আ, হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ই থেকে শুরু হয়ে ঝরঝরিয়ে রাখালের দুষ্টুমির গল্প পর্যন্ত ব’লে প্রথম ভাগ শেষ করল। পরীক্ষককে তবু অপেক্ষমান দেখে সে ঐক্য-বাক্য-মাণিক্যে মহরত ক’রে দ্বিতীয় ভাগ ধ’রে এগোয়, একদমে মুখস্থ বলতে বলতে শেষ অধ্যায় “চুরি করা উচিত নয়”-এর অন্তিম লাইন “তা-হা ক-র না-ই, এ-জ-ন্য, তো-মা-র এ-ই পু-র-স্কা-র।” উচ্চারণ-শেষে হাঁ ক’রে শ্বাস নিচ্ছে যখন, ইন্সপেক্টর এগিয়ে এলেন কয়েক পা, হাত বাড়িয়ে ছাত্রের কপালে রগের ওপর এক দুই এবং তিন — তিনটে টোকা দিয়ে নিশ্চুপে কক্ষত্যাগ করলেন।

সাত
বাসি বেলিফুলের মতো দুমড়ে গেছে ঠোঁটদুটো, দুই গাল ভস্মে-আগুনে মিশে নিভুনিভু উনুন। জ্বরের তাড়সে কাঁপছে গোটা মুখ। মা ক্রমাগত মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছে, ঘটি থেকে ধারানি-করা স্রোত কচুপাতা বেয়ে নীচের বালতিতে প’ড়ে চক্রবৎ ঘটিবাহিত হয়ে উঠছে মাথায়। আর দিদিমা গেলাসের জল থেকে চাঁদের চোখের পাতা, ঠোঁট ভিজিয়ে চলেছে।
— ও ভাই, খুব কষ্ট হচ্ছে? এই অ্যাখোনি তোমার জ্বর নামে যাবেনে। কিছু ক’বা নাকি, ও সোনা?

রোগি জাগন্ত কিনা বোঝা যায় না। ঘরে টিনের চালের নীচে পুরোনো শাড়ির যে নিরাপত্তামূলক পর্দা টাঙানো (টিকটিকির লাদি বা আরশোলার ডিম যাতে বিছানায়-খাবারে না পড়ে), তার চোখ সেখানে স্থির। পর্দায় দেখা যাচ্ছে, জলের শিরা-উপশিরা চাঁদের মুণ্ডটি সমস্ত কোণ থেকে জাপটে ধরল — যেমন বলখেলার মাঠে যাওয়ার রাস্তায় রেলের পরিত্যক্ত ভীমবাহু কেবিনকে একটা ধৃতরাষ্ট্র অশত্থগাছ মরণ-আলিঙ্গনে আঁকড়ে থাকে। চাঁদ লক্ষ করছিল, এই বলশালী জাপটাজাপটি তার পাতলা ঘাড় আর নিতে পারছে না। একটু পরেই জলের তোড়ে চাঁদের মাথা ঘাড় থেকে খুলে বালতিতে পড়ে ডুবে গেল। ওমনি তারও দুচোখ দৃষ্টিহীন…।

বাড়িতে একটা কান্নার কোরাস উঠল কি তখুনি? কেউ কি চেঁচিয়ে বলছে, ওরে বাসু দৌড়ে যা বাবা, তারকডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয়? বলরাম দাসের বাড়ির রেডিয়োতে এখনও অনুরোধের আসর শুরু হয়নি, আর সাড়ে ন’টার আগে তারক ঘুমোবে না। কিন্তু বুক-ভরা ইচ্ছে থাকলেও বাসু এক-পা নড়তে পারছে না! ডাক্তারের প্লটের ঠিক আগে ডানহাতে যে-বাড়ির দরজায় মরচেপড়া তালা, আগাছা গজিয়ে গেছে উঠোন জুড়ে, যেখানে দিনেদুপুরে চন্দ্রবোড়া সাপের বাচ্চা কিলবিল করে, সুতরাং সন্ধে থেকে রাস্তাটুকু বড়-বড় হাতহালি দিয়ে হাঁটে সবাই, সেই আস্তানার ইতিহাস কীভাবে ভুলবে বাসুদেব? দেবী — তারই-বয়েস ফর্সা সুন্দরী মেয়েটা সুইসাইড করেছিল সরস্বতীর পুজোর দুপুরে। স্কুল থেকে একপেট খিচুড়ি বেগুনভাজা খেয়ে এসে খবরটা শোনে বাসু এবং ছুটে গিয়ে ডেকরনের ফ্রকপরা মেয়ের ভারি সাদা দুই পা, বগলের বাদামি লোম আর মুখ থেকে ডান দিকে বেরিয়ে যাওয়া কালো জিভ… সব অনুপুঙ্খ দেখে ফ্যালে। এখন এই গভীর রাতে বাসু হাততালি দিলে যদি তালাবন্ধ ঘরের ভেতর থেকে পাল্টা ক্ল্যাপিং-এর শব্দ ওঠে! পাড়ায় এমন প্রহেলিকা ঘটে যাচ্ছে বারবার। কেলেকুষ্টি বাপ-মায়ের কালোকোলো শিশুদল জন্ম নিতে নিতে হঠাৎ এক খইসাদা সন্তান প্রকাশ পায়। উপনিবেশের জনতা অবাক হয়ে দ্যাখে, খাওয়ায়-পরায়, তারপর একদিন অপঘাতে বা আচম্বিতে মৃত্যু হয় তার। যেমন বাসন্তীপুজোর তিন দিন পর বলরামের মেয়ে শীলা নাকমুখ দিয়ে কৃমি উঠে চিতেয় উঠল; “আমি পাপী, তাই বিদায় নিলাম” লিখে রেখে দেবী দিল গলায় দড়ি; মনসাবাড়ির রাজপুত্র মানিক ঢলে পড়ল গোখরোর বিষে…।

বলব সেসব কথা, চাঁদের জ্বরটা আগে ফণা নামিয়ে নিক।

(অসমাপ্ত)

ইঁদুর কলের টোপ

Rat “বুঝলে, দিনে দুটো খেতাম, আজ থেকে একেবারেই ছেড়ে দিলাম” বলে বাবা ম্যাচটা মা’র হাতে ফিরিয়ে দিলেন। মা বহুবার বাবাকে সিগারেট ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছেন, বাবা ছাড়েন নাই। তবে বাবা শোভনের সামনে সিগারেট খায় না। বাবার শার্টে গন্ধ লেগে থাকে। কড়া গন্ধটা শোভনেরও ভালো লাগে না। বাবা আর সিগারেট খাবে না- এমন সিদ্ধান্তে মা’র খুশি হবার কথা। কিন্তু মা’র চেহারা মলিন হয়ে এলো। মা’র চোখ দু’টো ছলছল করছে। নাকের ডগায় লালচে আভা। মন খুব বেশী খারাপ হলে মা’র নাকের ডগা এমন লাল হয়ে ওঠে। বাবার সিদ্ধান্তে মা’র কষ্ট পাওয়ার কারণটা শোভন ধরতে পারে না। এবার জন্মদিনে গ্রাম থেকে দাদু ফোন করে বলেছেন, “দাদাভাই, তুমি আট বছরে পড়লে! মাশাল্লাহ। তুমি তো বড় হয়ে গেছো।” তবু শোভন বড়দের ব্যাপারগুলো বুঝতে পারে না।

মা মুখ মুছার ছলে শাড়ির আঁচল দিয়ে ভিজে আসা চোখ আর নাকের ডগা মুছেন, কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন “চা খাবে! একটু চা কইরা দেই!” চা বাবার খুব পছন্দ। বাবা মগভর্তি চা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে বা বিছানায় হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দেয়, বই বা পত্রিকা পড়ে, কোনো কোনো রাতে চায়ের মগ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে, বাড়ির সামনের রাস্তাটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আর আয়েশ করে চা খায়- শোভনের দেখতে খুব ভালো লাগে। শোভনের খুব চা খেতে ইচ্ছে করতো, মা দিতেন না। এখন দেন। যে সকালগুলোতে ঘরে ডিম থাকে না, শোভন নাস্তায় চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খায়। শোভনের এখন বাবার সাথে চা খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওকে বিস্মিত করে বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন, “না, না। এখন কষ্ট করে চা বানাতে হবে না। ভাবছি কাল থেকে সকাল ছাড়া চা খাওয়াটাও বন্ধ করে দিবো, কি বলো!” মা কিছুই বললেন না। বিছানায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনের চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন।

বাবা সত্যিই চা খাওয়া ছেড়ে দিবেন- বড়দের কখন যে কি হয় শোভন বুঝতে পারে না। দু’বছর আগে করোনা ভাইরাস এলো– অফিস বন্ধ, স্কুল বন্ধ। বাবা অনেকদিন অফিসে যাননি। ঘরবন্দী বাবা সারারাত ঘুমোতে পারতেন না। চিন্তা করতেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। তবে শোভনের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। ও বুঝতো বাবা অভিনয় করছে। কারণ বাবার মিথ্যে হাসিতে চেহারার চিন্তারেখাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতো। তখন কি সব হিসেব নিকেষ করে বাবা দিনে পাঁচটা সিগারেট থেকে কমদামী দু’টা সিগেরেটে নেমে এসেছিলেন। মা’ও অনেক চিন্তা করতেন। কিন্তু বাবাকে স্বাভাবিক স্বরে বুঝাতেন, “এতো চিন্তা কইরো না তো। চিন্তার চাপে তোমার কিছু হয়া গেলে আমাদের কি অবস্থা হইবো সেইটা ভাইবো! টেনশন কইরা লাভ নাই, দেইখো সব ঠিক হয়া যাইবো।” বাবা শুধুই হাসতেন। আকুল কান্নার মত করুণ সে হাসি! বিষাদমাখা স্বরে মা’কে বলতেন, “হুম, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের যা যাচ্ছে তা এক্কেবারেই যাচ্ছে। তিল তিল করে গড়ে তোলা সঞ্চয়, তোমার গহনা, শোভনের ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে রাখা ফিক্সড ডিপোজিট- সব.. সব।”

করোনার পর বাবার অফিস খুললো। শোভন ভেবেছিলো সব আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই আগের মত হলো না। বাবা আর মা’ও আগের মত হতে পারলেন না। চেষ্টাও করলেন না। শোভনের বিশ্বাস- ও আগের মতই আছে। আবার মনে সন্দেহও জাগে- সবার মত বদলে গেছে। একরাতে আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন, “আর পারছি না। বাড়িটা বদল করতে হবে।” বাড়ি বদলের কথা শুনে শোভনের মন খারাপ হলো। দুই বেড রুমের এই ফ্ল্যাটে শোভনের নিজের একটা রুম আছে। মা খুব সুন্দর করে রুমটা সাজিয়ে দিয়েছেন। রুমের একপাশের দেয়ালে মিকি মাউজ আর মিনি মাউজ হাসছে। বিছানার পাশের দেয়াল আর পুরো সিলিং জুড়ে বাবা ছোট-বড় অনেকগুলো তারা লাগিয়ে দিয়েছেন। তারাগুলো অন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলে। রাতে ঘুম ভাঙলে শোভনের মনে হয় ও খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। রুমের পাশে গ্রিলঘেরা ছোট বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের রুমনের সাথে কথা হয়। শোভনের মনে পড়ে, রুমনরা গত মাসে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। শোভনদের ফ্ল্যাটে ঢুকার দরজা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত লম্বা জায়গাটার মাঝখানে মা পর্দা টানিয়ে ড্রইং আর ডাইনিং রুম বানিয়েছেন । এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে যাওয়ার কি প্রয়োজন শোভন বুঝতে পারে না।

পরের মাসেই বাড়ি ছাড়া হলো। বাড়ি ছাড়ার আগের দিন বাবা সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল আর শোভনের খাটটা বিক্রি করে দিলেন। নতুন ফ্ল্যাটের জন্য নতুন সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল ও বিছানা কেনা হবে ভেবে শোভন খুশি হয়েছিল। কিন্তু নতুন ফ্ল্যাটে এসে ওর ছোট বুকটা গভীর বিষাদে ডুবে ছিল। এই ফ্ল্যাটে একটা মাত্র বেড রুম। রান্নাঘরের সাথে সামান্য খোলা জায়গায় মা শোভনের পড়ার টেবিলটা গুছিয়ে দিয়েছেন। এই ফ্ল্যাটে শোভনের নিজের রুম নেই- ওর খুব কষ্ট হয়। আবার বাবা-মা’র মাঝখানে ঘুমোতে পারে বলে আনন্দও হয়। স্কুলে যেতে ও আসতে প্রতিদিন সাত তলায় উঠা-নামা করতে হয়। লিফট নেই, ছোট পায়ে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠা-নামা করতে কষ্ট হয়। বাবা-মা’র রুমের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকখানি আকাশ আর গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত যাওয়া পথটা স্পষ্ট দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে বা রাস্তায় তাকালেই শোভনের মন ভালো হয়ে যায়।

বাড়ি বদলের সাথে আরও অনেক কিছুই বদল গেল। আগের ফ্ল্যাটে থাকতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শোভনকে নিয়ে বাবা আর মা বেড়াতে যেতেন। মাঝে মাঝে ফাস্টফুডের দোকানে বসে শোভনকে বার্গার বা ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাই খাওয়াতেন। মা ফুচকা খেতেন। বাবা শুধু চা খেতেন। এখন এক একটা শুক্রবারে বাবা বলেন, “চল বাবাই, একটু ঘুরে আসি।” পার্কের পাশে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে বাবা প্রশ্ন করেন, “বাবাই, তুই কি খাবি- ঝালমুড়ি, ফুচকা, বার্গার না চিকেন ফ্রাই!” শোভনের বার্গার বা চিকেন ফ্রাই খেতে ইচ্ছে করে। বড়দের অনেক কিছু বুঝতে না পারলেও বাবা কোন উত্তরে স্বস্তিবোধ করবেন তা বুঝতে পারে। শোভন বলে, “ঝালমুড়ি খাবো। কাঁচামরিচ ছাড়া ঝালমুড়ি।” যেদিন বেতন হয়, শোভনের জন্য বাবা বার্গার বা ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাই বা পোলাও আনবেনই আনবেন। পোলাও শোভনের খুব প্রিয়, নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর ঈদের দিন ছাড়া মা একদিনও পোলাও রান্না করেনি।

মানুষ শিক্ষাশ্রয়ী প্রাণী। শিক্ষাকে আশ্রয় করে মানুষ বেঁচে থাকে। শিক্ষাই মানুষকে শেখায় মানিয়ে নেওয়া এবং মেনে নেওয়া এক নয়। বেঁচে থাকার অনিবার্য ধাওয়ায় অসহনীয় বাস্তবতার সাথে মানুষ মানিয়ে নেয়। না মেনেও মেনে নিতে বাধ্য হয়, অভ্যস্ত হয়। মানিয়ে নিয়ে এবং মেনে নিয়ে বা না মেনে শোভনদের পরিবার অনাবৃত দুঃসময় অতিক্রম করছিলো। নতুন করে শোভনের বাবা একবেলা ছাড়া চা খেতে চাইছে না, চা ও সিগারেটহীনতার সাথে মানিয়ে নিতে চাইছে– শোভনের মা’র মন শঙ্কায় ভরে উঠে। কাঁপাকাঁপা স্বরে জানতে চান, “তুমি আর সিগারেট খাইবা না, এইটা ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু সবকিছু ছাড়তে ছাড়তে চা’ও একবেলা ছাড়া খাইবা না, এইটা কেমন কথা! কি এমন ঘটছে সেইটা বলবা?”

মা’র প্রশ্ন শুনে শোভনের বাবা বালিশে হেলান দেন। লোডশেডিং চলছে, ফ্যাকাশে চার্জার বাতির আলোয় দেওয়ালে পড়া বাবার ছায়াটাকে আরও ফ্যাকাশে লাগছে। শোভনের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেন, “তুমি শোনো নাই, কারা যেনো আমাদের দিকে দুর্ভিক্ষ ছুড়ে দিচ্ছে।”

মা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন না, স্বাভাবিক স্বরেই বলেন, “দুর্ভিক্ষের আর বাকী আছে কি! জিনিসপত্রের যে দাম, প্রতিটা দানা হিসেব কইরা মুখে তুলতে হইতাছে। মাসে দু’শ চল্লিশ টাকা বাঁচানোর জন্য তুমি সিগারেট ছাইড়া দিবা- ভালো কথা। কও তো আসন্ন দুর্ভিক্ষে বাড়ি ভাড়া, ইলেক্ট্রিসিটি, গ্যাস ও পানির বিল শোধের পর কি আমাদের ডাল-ভাত আর আলুভর্তাটাও ছাইড়া দিতে হইবো!”

শোভনের মনে পড়লো মা ডিম, ব্রয়লার মুরগির মাংস বা চাষের পাঙ্গাস মাছ রান্না করলেও প্রায় দুপুরেই আলুভর্তা, তরকারির ঝোল আর ডাল দিয়ে ভাত খান। বাবা আরও আগে, করোনার সময় থেকে “ভাল্লাগে না” বলে ব্রয়লার মুরগি ও চাষের পাঙ্গাস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। শোভন বুঝতে পারে “ভাল্লাগে না’ নয়, বাবা-মা সংসারের হিসেব মিলাতেই এসব খাবার মুখে তুলেন না, ভাতও কম খান। মা’র প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেন, “কি জানি! ডাল-ভাত আর আলুভর্তাও ছাড়তে হতে পারে, তবে হাওয়া খেয়ে বাঁচা যেতে পারে, দূষিত বাতাস এখনও বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে উঠেনি। যাও একটু চা করো, আগামীকাল থেকে একবেলা চা করলেই হবে।”

মা মোম জ্বালিয়ে নিয়ে রান্না ঘরে যায়। কৌতূহলী শোভন প্রশ্ন করে, “বাবা, দুর্ভিক্ষ হলে কি মানুষ মরে যায়? আমরা বাঁঁচবো তো!” বাবা শান্তস্বরে বলেন, “দুর্ভিক্ষে ধনীলোকরা মরে না রে বাবাই। গরীবরা বাঁচে না। আমরা যারা মরার মত বেঁচে আছি আর মরলে একেবারে বেঁচে যাই, ইঁদুর মারার কলে টোপের মত ঝুলি, তারা দুর্ভিক্ষে বাঁচবো কি মরবো – এ বড় জটিল প্রশ্ন। তবে বাঁচি বা মরি গোর আজাব বাড়তেই থাকবে। এসব কথার মানে বড় হলে বুঝবি। রাত হচ্ছে, এখন ঘুমো বাবাই।”

বাবার কথার অর্থ শোভন বুঝে না। তবু ওর মন খারাপ হয়। মনে মনে ভাবে বেঁচে থাকলে দুর্ভিক্ষের পর ওদের কি আরও ছোট আরও উঁচু কোনো লিফটবিহীন ফ্ল্যাটে চলে যেতে হবে যেখানে ওর পড়ার টেবিল রাখার জায়গাটুকুও হবে না। প্রতিদিন পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঁচুতে উঠতে হবে পরদিন ফের নেমে যাওয়ার জন্য! শোভন চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে চেষ্টা করে, ঘুম আসে না।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

0555

পর্ব – ৩

মিলুর বাবা সত্যানন্দ বরিশাল শহরের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অল্প বয়সে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর পক্ষে নন তিনি। বাড়িতে ভাল মত পাঠ দিয়ে তবেই স্কুলে ভর্তি করতে চান ছেলেদের। তাই স্কুলে যাবার বয়স হলেও মিলুকে স্কুলে ভর্তি না করে বাড়িতেই প্রাথমিক পাঠ দেওয়া চলতে থাকে।
সকাল বেলায় সাংসারিক কাজের চাপে মা ছেলেকে পড়ানোর সুযোগ পান না।
তাই প্রতি সন্ধ্যায় মায়ের কাছে পড়াশুনো করে মিলু। পড়াশুনো সেরে মিলু আর অশোক ঠাকুরমার কাছে বসেছে প্রতি সন্ধ্যার মত আজও। মা রান্নাঘরে ঢুকেছেন রাতের খাবার তৈরীর জন্য। ঠাকুরমা গল্প করছেন তাদের ছেড়ে আসা ভিটেমাটির। অশোক এখনও অবুঝ শিশু। সে ঠাকুরমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েই পড়েছে হয়তো। মিলু কিন্তু গভীর মনযোগে শুনছে।
ঢাকায় পদ্মারই এক শাখানদী কীর্তিনাশার তীরে বিক্রমপুরের গাঁওপাড়া গ্রামে ছিল তাদের আদি বাড়ি। ঠাকুরমা সে সব স্মৃতি ভূলতে পারেননি। তাই সুযোগ পেলেই মেতে ওঠেন রোমন্থনে। গ্রামখানি কীর্তিনাশার জলে তলিয়ে গিয়েছিল।

সেই বিক্রমপুর আর পদ্মা নদীর গল্প, রাজা রাজবল্লভের একুশ চূড়াযুক্ত প্রাসাদ ‘একুশ রত্ন’ – এর গল্প শুনতে শুনতে বালক মিলু হারিয়ে যায় অতীত কল্পনার রাজ্যে।
হঠাৎ ধাক্কা খায় তার স্বপ্নের পথচলাতে।
মিলু দেখে মেঝ পিসেমশাই তাদের সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি তার শ্বাশুড়ি মাকে বললেন – মেঝ বৌঠান কী রান্না ঘরে ?
জামাতার হঠাৎ আগমনে প্রথমটায় একটু হতচকিত হয়ে যান শ্বাশুড়ি। সামলে নিয়ে বলেন- তুমি কখন এলে বাবা ?
– এই এলাম। মেঝ বৌঠানকে খুব দরকার। উনি কি রান্না ঘরে ?
– হ্যাঁ।
মিলুর দিকে তাকিয়ে বললেন – যাও তো বাবা তোমার মাকে একবার ডেকে নিয়ে এসো তো।
মিলু মাকে ডাকতে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মিলুর মা আসেন। সাথে সাথে মিলুও।
– আরে ঠাকুর জামাই যে। তা এই অসময়ে হঠাৎ আগমনের হেতু কী?
মিলুর মা একটু অবাক হয়েই জানতে চান।
– না এসে আর উপায় আছে ? আপনার কবিতা চাই এক্ষুনী।
– এখন কীভাবে দেব। লেখা আছে নাকি?
– সে জানি নে। পত্রিকা নিয়ে দাদা প্রেসে চলে গেছেন। পান্ডুলিপিতে আপনার লেখা না দেখেই ছুটে এলাম। আপনার লেখা ছাড়া ব্রহ্মবাদী বের হোক সে আমি মেনে নেব না।
– আপনার দাদা আমাকে কয়েকদিন আগে একটা লেখা দিতে বলেছিলেন কিন্তু কাজের চাপে আর লিখে উঠতে পারি নি। এই সংখ্যাটায় আমার লেখা নাইবা থাকলো।
ঠাকুরজামাই মনোমোহনবাবুও নাছোড়বান্দা।
অগত্যা মিলুর মা বললেন – আচ্ছা তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখি।
শ্বাশুড়ি মায়ের কোলে ছোট ছেলে ঘুমিয়ে গেছে দেখে – দিন মা ওকে ঘরে শুইয়ে দিই বলে তাকে কোলে তুলে নিলেন।
মনোমোহন বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন – আসুন ঘরে একটু বসবেন ক্ষণ।
ঘরে গিয়ে অশোককে শুইয়ে দিলেন।
ঠাকুর জামাইকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে
খাতা আর কলম নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
মিলুও খাতা পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসে যায়।

মিলুর বাবা সত্যানন্দ বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। তার মেঝ ভগ্নিপতী মনমোহন চক্রবর্ত্তীকে নিয়ে পত্রিকা সম্পাদনার সকল কাজ করেন। এরা দুজনেই বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট মানুষ।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে সলজ্জ ভাবে কাগজটি এগিয়ে ধরেন ঠাকুর জামাইয়ের দিকে – দেখুন। ভাল হয়নি। রান্না করতে করতেই লিখলাম।
কাগজখানা হাতে নিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগেন মনোমোহনবাবু –

খোকার বিড়ালছানা

সোনার ছেলে খোকামণি, তিনটি বিড়াল তার,
একদণ্ড নাহি তাদের করবে চোখের আড়।
খেতে শুতে সকল সময় থাকবে তারা কাছে,
না হ’লে কি খোকামণির খাওয়া দাওয়া আছে?
এত আদর পেয়ে পেয়ে বিড়াছানাগুলি,
দাদা, দিদি, মাসি, পিসি সকল গেছে ভুলি।
সোনামুখী, সোহাগিনী, চাঁদের কণা ব’লে
ডাকে খোকা, ছানাগুলি যায় আদরে গলে।
“সোনামুখী” সবার বড় খোকার কোলে বসে,
“সোহাগিনী” ছোটো যেটি বসে মাথার পাশে।
মাঝখানেতে মানে মানে বসে’ “চাঁদের কণা”,
একে একে সবাই কোলে করবে আনাগোনা।

তারপর বললেন – বাহ্ অপূর্ব বৌঠান অপূর্ব। আপনী সত্যি স্বভাবকবি। তা না হলে রান্না করতে করতে এত সুন্দর কবিতা লেখা সম্ভব?
মিলুর মা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন কিন্তু সে সুযোগ না দিয়েই মনমোহনবাবু আসি বলেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

মিলু ছবি আঁকার মাঝেও উৎকণ্ঠার সাথে সমস্ত ঘটনার দিকে খেয়াল রাখছিল। মায়ের এত তাড়াতাড়ি এত সুন্দর একটি কবিতা লিখতে পারার ক্ষমতা দেখে সেও অবাক হল। গর্বিত হল মায়ের জন্য। কোনো কথা সে বলল না। শুধু বিস্ময় ভরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

IMG_20221018_090555

পর্ব – ২
একান্নবর্তী পরিবারের ছেলে মিলু। মা বাবা কাকা কাকিমা জ্যেঠা জ্যেঠিমা পিসিমা ঠাকুমা খুড়োতো জেঠাতো ভাই বোন মিলে সে যেন হাটখোলা। সারাক্ষণ হই হট্টগোল লেগেই থাকে। কর্মসূত্রে কেউ কেউ বাড়ির বাইরে থাকলেও তাদের আসা-যাওয়া চলত নিয়মিত।
ছোট্ট মিলুর ভালো লাগে না এত ভীড়। নির্জনতায় নীরবে থাকাটাই যেন তার প্রিয়। মা জ্যেঠিমা ঠাকুরমা পিসিমার চোখ এড়িয়ে সে মাঝে মাঝে চলে যায় বাগানে। গাছেদের মাঝে ঘুরে বেড়ায় একাকী। কখনো বা বাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপলকে চেয়ে থাকে সামনের মিশনের দিকে। সেখানে সারি সারি ঝাউগাছ তাকে বড় টানে। আবার কখনো উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

অবিভক্ত ভারতের পূর্ববাংলার ছোট্ট এক মফস্বল শহর বরিশাল। তারই এক কোণে গ্রামীন পরিবেশে পাঁচ সাত বিঘে জমির ওপর তাদের বিশাল টিনের চাল দেওয়া বাড়ি। চারদিকে ছড়ানো আম-জাম-নারকেল-সুপারী-কাঁঠাল-কলাসহ নাম না জানা অসংখ্য বুনোগাছ আর লতাগুল্ম-ঘাস। বালক মিলুর সাথে এদেরই যেন প্রাণের মিতালী।

পাড়ার সমবয়সীদের সাথে এখনও তার তেমন চেনাজানা হয়নি। কারণ যকৃতের কঠিন অসুখে পড়ে ডাক্তারের পরামর্শে দীর্ঘদিন তাকে বাইরে বাইরে থাকতে হয়েছে। হাওয়া পরিবর্তনের জন্য মা ও মাতামহের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে কলকাতা-দিল্লি-লখনৌসহ পশ্চিমের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাস্থ্যনিবাসে। সে কারণেই হয়তো পড়শি সমবয়সী বা বাড়ির সবার সাথে এখনও সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া সে স্বভাবগতভাবেই নির্জনতা প্রিয়।

আজও বর্ষার পড়ন্ত বেলায় যথারীতি মিলু হাঁটতে হাঁটতে উঠোন পেরিয়ে বাগানের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎই চোখে পড়ে – কেউ একজন উঠোনের ঘাসগুলো কাটছে। সেদিকে এগিয়ে যায় মিলু।

আসলে বর্ষাকালে উঠোনে বড়বড় ঘাস জন্মেছে। বাবা কাজের লোক হিসেবে গাঁয়ের গরীব চাষা ফকিরকে ডেকেছেন সেই ঘাস কাটার জন্য। ফকির কাস্তে হাতে পরিস্কার করছে সেই ঘাসগুলো। মিলু ফকিরকে চেনে। বাড়ির নানা কাজবাজ করতে প্রায়ই সে আসে। মিলুর সাথে তার গল্পসল্পও হয় মাঝেমধ্যে। ফকির কাকাকে মিলুর ভালই লাগে। এই তো সেদিন কাজ করতে করতে ফকির মিলুকে কীর্তিনাশা নদীতে নৌকা বাওয়া ও মাছ ধরার গল্প করেছিল। অবাক হয়ে শুনেছিল মিলু। আর ছোট্ট শিশুমনে ইচ্ছে জেগেছিল – নদীতে নৌকো বেয়ে বেড়ানোর আর ফকির কাকার মত মাছ ধরার। কিন্তু চাপা স্বভাবের মিলু মুখ ফুটে বলে নি সে কথা।

ফকির কাকা মিলুকে দেখে বলে – কী গো দাদাবাবু? তুমি এখানে ?
মিলু বলে – ওগুলো অমন করে কেটে ফেলছো কেন? কেটো না কাকা।
– আপনের বাবা যে আমারে আঙিনে সাফছুতোর করতি কইয়ে গেইছেন দাদাবাবু।
– সবুজ সবুজ ঘাসগুলো কি সুন্দর লাগে দেখতে – আর তুমি…
কাতর কণ্ঠে মিলু বলে – না না ঘাসগুলো তুমি কাটবে না।
-চিন্তা কইরবেন না দাদাবাবু, কিছুদিন পরেই আবার নতুন সবুজ কচিঘাস জম্মাবে।
ফকির বোঝানোর চেষ্টা করে মিলুকে ৷
কে শোনে কার কথা?
– না না তুমি কাটবে না ঘাসগুলো। ওরা বুঝি কষ্ট পায় না ?
ছোট্ট মিলুর কষ্ট যেন কমতেই চায় না।

কথাবার্তা শুনে ঠাকুরমা আর জ্যেঠিমা এগিয়ে আসেন।
অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তারা মিলুকে ঘরে নিয়ে যান।

(চলবে)

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

IMG_20221017_203813পর্ব-১

অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়। –

বাবার ভরাট গলায় উপনিষদের আবৃত্তি শুনতে শুনতে ঘুম ভাঙে মিলুর। শুয়ে শুয়েই দেখে – মা পাশে নেই। প্রতিদিনের মত তিনি সূর্য ওঠার আগেই উঠে পড়েছেন – বুঝতে পারে। আড়মোড়া খেয়ে বিছানায় বসে। বাবার দিকে তাকায়। তিনি পাশের খাটে যোগাসনে বসে একমনে আওড়ে চলেছেন মন্ত্র। ছোট ভাই আশোক তখনও আঘোরে ঘুমচ্ছে ৷ ছোট্ট মিলু আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে পড়ে। ধীর পায়ে বাবান্দায় আসে। চোখ দু’টো রগড়ায়। হঠাৎ তার চোখে পড়ে ভোরের সূর্যের সোনালী আভা গাছগাছালির পাতার ফাঁক দিয়ে বারান্দায় এসে পড়েছে। মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকায়। এগিয়ে যেতে থাকে বারান্দার পুবকোণের দিকে।

হঠাৎ ভেসে আসে মায়ের কন্ঠস্বর। বড় মিষ্টি মায়ামাখা সেই কণ্ঠ।
তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে
মলিন মর্ম মুছায়ে ৷ –
প্রার্থনা সঙ্গীতটি গুনগুন করে গাইতে গাইতে স্নান সেরে এলোচুলে মা বারান্দায় উঠছেন।

মিলু একবার মায়ের দিকে তাকায়। মা-ও তাকান ছেলের দিকে। গান থামিয়ে বলেন- উঠে পড়েছ ?
মিলু কোনো উত্তর দেয় না। সে যেন মায়ের কথা শুনতেই পায়নি। গুটিগুটি পায়ে পুব-বারান্দার চৌকাঠে গিয়ে বসে ৷ মা-ও আর কোনো প্রশ্ন না করেই ঘরের ভেতরে চলে যান ৷
ছোট্ট মিলু গাছপালা ভরা সামনের বাগানের দিকে তাকায়। পাতার ফাঁক গলে আসা ভোরাই আলো মৃদু হাওয়ায় যেন নেচেনেচে বেড়াচ্ছে সারা বারান্দায়।
অবাক বিস্ময় চোখে মেখে চুপচাপ বসে সেই অপরূপ দৃশ্য দেখতে থাকে মিলু। হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে ঘু.ঘু শব্দ। দৃষ্টি ফেরায়। দেখে দুটো ঘুঘু পাখি ভীত পায়ে হেঁটে হেঁটে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা শালিক দোয়েল চড়ুই ওড়াউড়ি করছে। অন্যদিকে গুল্মঝোঁপের পাশে একটা ডাহুকী দুটো ছানা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে বসে বসে দেখতে দেখতে ছোট্ট মিলুর উদাসী মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

খেয়ালই করতে পারে না – কখন তার ঠাকুরমা এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ও দাদুভাই –
কানে যায় না ঠাকুরমার ডাকও।
ঠাকুরমাও তার আদরের নাতির এই ভাবলুতাকে ভাঙতে চান না। তিনিও চুপচাপ তার পাশে বসে পড়েন।
কিছুক্ষণ পরে ঘর থেকে বৌমার ডাক কানে আসে- মা মিলুকে নিয়ে আসুন।

এবার ঠাকুরমাকে বাধ্য হয়েই ধ্যান ভাঙতে হবে নাতির। গায়ে স্নেহের হাত রেখে ডাকেন – দাদুভাই ও দাদুভাই মা ডাকছেন। এখন যে উঠতে হবে। হাত মুখ ধুঁতে হবে। কিছু খেতে হবে। চলো।

মিলু কোনো কথা না বলেই বাধ্য ছেলের মত উঠে পড়ে।

(চলবে)

হঠাৎ সন্ধ্যা (৩য় পর্ব )

selected

সেদিন হঠাৎ সন্ধ্যা নেমে বসলো। আকাশ কালো করে মেঘেরা ঝুম ঝুমিয়ে গাইতে লাগলো। আচমকা বিদ্যুৎ ঝলকানি মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। মনে হয় কেউ জগৎকে আলোকিত করার বৃথা চেষ্টা করছে। এই আলো নিভুর খেলায় মীরা আপাকে খুব মনে পড়ছে। বৃষ্টির দিনে আমি আর আপা বাড়ীর পেছনে আমড়া গাছ তলায় চলে যেতাম। আঁচল ভরে আমড়া কুঁড়িয়ে আনতাম। আপার হাতে জাদু ছিল। আপা বেশী করে কাঁচা মরিচ দিয়ে আমড়া মাখাতো। আপার ঝাল ঝাল আমড়া মাখা অমৃত মনে হতো। সেই স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। কিন্তু আজ আপা নেই, গাছটিও নেই। গাছও হয়তো মানুষের ভালবাসা বুঝে। তাই আপার মত সেও অভিমান করে চলে গেছে। যে চলে যায় সে কখনো ফেরে না। আপাও চলে গিয়েছে তার রাজকুমারের হাত ধরে হয়তো সেও ফিরবে না।

মনের শত শত কল্পনা ভেঙ্গে গেল সদর দরজার শব্দের আঘাতে। এই বৃষ্টি সন্ধ্যাবেলায় কে এলো? বাবাতো এতো আগে বাড়ী ফেরেন না। অনেক রাতে যখন মায়ের কান্নার শব্দ শোনা যায় তখন বুঝি বাবা এসেছে। আজকাল বাবা খুব রাতে বাড়ী ফেরেন। পৈতৃক ব্যবসাটা ধংস করে মদ খাওয়টা ভালই শিখেছেন। আসলে বাবা যে হোমিওপ্যাথিক বিদ্যা শিখছেন এটা তার ফলাফল। মোতালেব আংকেল যে হোমিওপ্যাথিক বিদ্যার নামে বাবাকে মদের নেশায় ডুবিয়েছেন সেটা আর কেউ না জানলেও আমি জানি। আজকাল বাবার মাতলামি সবাইকে আরোও অতিষ্ট করে তুলেছে। জানিনা মা কিভাবে সহ্য করে। তবে এজন্য আমি মাকে দোষ দেই তার অতিরিক্ত পতিভক্তি বাবাকে আরো হিংস্র করে তুলেছে। সেদিনকার ঘটনা- বাবা মদ খেয়ে অনেক রাতে বাড়ী ফিরছেন। রাস্তার কুকুরটা বাবাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। বাবা সেখানে দাঁড়িয়ে হইচই করতে লাগলেন। বলতে লাগলেন-হারামজাদা আমার বড়ো মেয়েকে খেয়েছিস এখন আমাকে খাবি? আমি তোকে গুলি করে মারবো। এ বলেই বাবা গালি দিতে দিতে বাড়ীতে ঢুকলেন। হিংস্র হয়ে আলমারী থেকে বন্দুক বের করে আবার রাস্তায় নেমে পড়লেন। কুকুরটিকে গুলি করে মারলেন। তারপর শান্ত হয়ে হয়ে ঘরে ফিরে মাকে বললেন- মাগী একটি ছেলে জন্মাতে পারিস নাই। তোর মেয়েকে নিয়ে রাশেদ পালায়। শালাকে গুলি করে রাস্তায় ফেলে এলাম। ফের যদি তোর মেয়েকে রাশেদের সাথে দেখি ওই শালীকেও গুলি করে মারবো। বাবা এতেই চুপ রইলেন না। কথায় কথায় বন্দুক বের করতেন বলে পরের দিন আবারো বন্দুক নিয়ে হট্টগোল শুরু করলেন। বড় চাচার সামনে বন্দুক রেখে বললেন- তিনি এই পুরনো বাড়ীতে আর থাকতে চান না। বাড়ীটা বিক্রি করে একটি নতুন বাড়ী কিনতে চান। মোতালেব আংকেলের এক পরিচিত লোক বাড়ীটা কিনতে আগ্রহী সে মোটা টাকা দিতে চাচ্ছে তার কাছে বাড়ীটা বিক্রি করে নতুন বাড়ী কিনবেন। বড় চাচা তার এমন পাগলামি দেখে কিছু বললেন না। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলেন। বাবা তখন কিছুটা হতাশ হলেও পরে লোক ডেকে বাড়ী মাপতে লাগলেন।

আমাদের বাড়ীটা অনেক পুরোনো। উঠান পেরিয়ে সদর দরজায় যেতে হয়। এই বৃষ্টি সন্ধ্যায় একা একা সদর দরজা খোলার সাহস হয় না কিন্তু আমাকে যেতে হবে। আজ দু-দিন হলো মা জ্বরে কাবু। জানি বড় চাচাকে ডাকলেও কাজ হবে না। তিনি সারাদিন নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখেন। ডাকলেও সাড়া দেন না। তাকে ডাকার বৃথা চেষ্টা না করে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সকল ভয় ভেঙ্গে দরজা খুলতেই আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমার সামনে জাকির মাস্তান দাঁড়িয়ে আছে।

(চলবে)

হঠাৎ সন্ধ্যা ১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

হঠাৎ সন্ধ্যা ২য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

নিমতিতা সরকারি কলোনি

তিন
তারক অধিকারীই উদ্বাস্তু-মোকামে বাস করা একমাত্র বদ্যি। কেউ কোনওদিন তার ডিগ্রি জানতে চায়নি; ‘নেয়েচি’-খেয়েচি’ বলা ঘটি পরিবার সরকারি কলোনিতে ভিড়ল কীভাবে, সে রহস্যের গিঁট খুলতেও লোকের বয়ে গেছে। কামদেবপুরে তার ডিসপেনসারি, সেখানে গরীব মুসলমানদের সাক্ষাৎ খোদা এই তারকেশ্বর। দুহাতের আঙুলে সাতখানা পাথর আর সমান সংখ্যক সন্তানের মালিকটির কলম ব্যবহারের অভ্যেস নেই, ট্যাবলেট ফয়েল থেকে ছিঁড়ে খবরের কাগজে মুড়ে রোগির হাতে ধরায়, সঙ্গে ঝাঁঝালো মিষ্টি ‘মিক্‌চার’। সবাই তার হাতযশের কথা মানে, এবং যারা চিকিৎসা সত্ত্বেও মরে গেল, তাদের আপনজনের পাশে দাঁড়িয়ে তারক স্বগতোক্তির মতো ব’লে দেয় — রোগটা ঘ্যাঁজ্‌ড়া হয়ে গেছলো। খুলনা-যশোর এই শব্দ চেনে না, ঘ্যাঁজ্‌ড়াকে মহাভারতের কোনও অপরাজেয় রাক্ষস ভেবে নিয়ে মানুষ সংযত থাকে।

চাঁদ যখন অধিকারীবাড়ির পাশ দিয়ে বায়ুবেগী, চেম্বার সেরে বাড়ি পৌঁছে সবে সাইকেল থেকে নামছিল ডাক্তারবাবু। তার ফেরার খবর কীভাবে যেন পেয়ে যায় পাড়ার বাচ্চারা, সাইকেলের পেছনে এর মধ্যেই দশ-বারো জনের জমায়েত। কাগজের ঠোঙা থেকে লজেন্স বের ক’রে সে প্রত্যেকের মুঠোয় একটা ক’রে গুঁজে দিতে লাগল। একটু পরে এসে জুটবে রাস্তার কুকুরের দল, খেয়ে উঠে এক-থাবা ক’রে মাছের কাঁটামাখা ভাত তাদের মুখে ধ’রে দেবে ডাক্তার। চাঁদকে দেখতে পেয়ে সে যেই হাত বাড়িয়েছে, কেঁপে পিছিয়ে গেল ছেলেটা। বাইরের কারও কাছ থেকে কিছু নেওয়া ব্রাহ্মণবাড়িতে মুরগির মাংস তোলার মতোই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। কেননা, দানগ্রহণ মানে নিজেকে ভিখারি প্রমাণ করা, পরিবারের সম্মান ধুলোয় মেশানো। এর শাস্তিও পিঠে বেত ভাঙার মতো সর্বোচ্চ রকমের হয়ে থাকে।

তারক ডাক্তারের ভাইয়ের নাম নারায়ণ ছবিয়ালা। কপালে অনেকগুলো চিন্তাশীল ভাঁজ সমেত শিবনেত্র চোখ, দাদার কাছে আসা-যাওয়া করে একই রকম একখানা সাইকেলে চেপে। দুজনের জামাকাপড়ও সেম টু সেম : টেরিকটনের পাঞ্জাবি, ধুতি; পাঞ্জাবিতে কান্তা সেন্ট আর চারটে ক’রে পেতলের বোতাম লাগানো। নারায়ণ অধিকারী আগে ছিল ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফার : বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে ছবি তুলিয়া থাকি। আচমকা ক্যামেরা বিক্রি ক’রে ফটো বাঁধানোর দোকান দিয়েছে কাশিমপুর বাজারে। পেছনের গল্পটা টিপুদা জানে।

কলোনির আপামর কাজে ডাক-পড়া, জলেস্থলে চরকি-কাটা ছেলের নাম টিপু, যার পদবি বলতে লাগে না, পাড়াসুদ্ধু মানুষের জন্যে ইয়োরস ফেথফুলি হয়ে আছে। কোনও বয়স্থা মেয়ে যদি মায়ের কাছে যাত্রা বা গানের জলসা দেখার জেদ ধরে — “পা খুব লম্বা হইছে, না? বাবা শুনতি পালি ঠ্যাং কাটে নেবে। ও আচ্ছা, টিপু নিয়ে যাবে? তালি যাও, ঘুরে আসো”।

টিপু ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন বাড়ি-বাড়ি ভাইফোঁটা নিয়ে কুল করতে পারে না। মাথার চুলে ধানক্ষেত, কপাল মোটা হয়ে যায় ঘি-চন্দনে।

তো, মাস দুয়েক আগে চাঁদের শিউলিদিদি তাকে ফোঁটা দেওয়ার পর খাটে বসে লুচি-আলুরদম খেতে খেতে টিপু শুনিয়েছিল :
মুখার্জিপাড়ায় সিতু মুখার্জির মা মারা গেল না? ছবি তোলার জন্যি নারানকাকুরে ডাকে (ভালো কথা। তারপর?)। কাকু সেদিন ঠিক মার খাতো (ওমা, কেন!)। সিতুর বড়ভাই কংগ্রেস তো! সে শাসানি দিছিল, “ফেরার সময়ে ক্যামেরাটা নন্দসায়রের জলে ফেলে দিয়ে যাস। আর কোনওদিন ফটো তুলতে দেকেচি তো তোর খবর আচে! ফ্রেমে বাঁদিয়ে জবার মালা পরিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে দোবোখুনি” (হি হি, টিপু তো জোরদার ঘটিভাষা শিখে গেছে! কিন্তু নারানদার দোষটা কী হলো, কোবি তো?)।

কাকুর সেই প্রথম মরা মানুষির ফটো তোলা। ক্যামেরার পেছনে যেয়ে ডেডবডিরে ব’লে বসিছে “রেডি”? শুনে সবাই হয়রান (ধ্যাস্‌, টিপু বানায় বানায় কচ্ছে)! কিন্তু তাতেও নারানকাকুর চেতনা হয়নি। মাথা তো কালো কাপড়ে ঢাকা। সে এবার আরেট্টু গলা তুলিছে, “এস্‌মাইল”!

চার
যিশুর রুপোলি ক্রসের মতো জেট প্লেন ঝিলিক দেয় আকাশে। তার ধোঁয়া-লেজ প্রথমে কেকের সাদা ক্রিম, আস্তে আস্তে ছানাকাটা দুধ হ’য়ে আকাশেই ভাসতে থাকে। রাস্তায় কমলালেবুর খোসা দেখে চাঁদ তুলে পকেটে পুরে নিল (বোনের চোখে রস দিয়ে দেব), তারপর ঢুকে পড়ল লখাইদিদির বাড়ি। বারান্দায় কেউ নেই, দরজা খোলা পেয়ে সে সোজা ঘরে পৌঁছে দ্যাখে মাসিমাও জেট-প্লেনস্বরূপ, মুখ দিয়ে কড়া গন্ধের ধোঁয়া বেরচ্ছে। ভট্‌চাজবাড়ির পোলাকে দেখে সেই বাষ্প থতমত, আর কোথা থেকে লখাই এসে প’ড়ে “কী হইছে রে, দিদিমা আমাগো বাড়ি আসলি দেখতিই তো পাতিস” বলতে বলতে তাকে ঠেলে ঘরের বাইরে ক’রে দেয়।

এভাবে বারবার চাঁদের ব্যর্থতায় দুঃখিত রোদ্দুর তেঁতুলগাছের পাতা বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। যেমন পাড়ার নাইটগার্ডদের একদল ঘুমোতে গেলে অন্যদল পাহারায় দাঁড়ায়, রোদ রেখে যাচ্ছিল ছায়াকে। ব্যাপারটা বাবার মুখে শোনা জয়দ্রথের উপাখ্যানের সঙ্গে পুরো মিলে যাচ্ছে। সূর্যাস্তের পর বিধবাদের ভাত খাওয়ার নিয়ম নেই ব’লে অভিমানী বৃদ্ধা সন্ধে পর্যন্ত আত্মগোপনে, তাকে জটিল ব্যূহের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে পাড়ার কোনও দুর্যোধন পরিবার! সুতরাং দিদিমাকে বের ক’রে আনার একমাত্র উপায় হল… নিজের ডানহাতের তর্জনীর দিকে তাকায় চাঁদ, কিন্তু সেখানে কোনও সুদর্শন চক্র দেখতে না পেয়ে আবার মুষড়ে পড়ে।

বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এখানে রাস্তা চারভাগ হয়ে কলোনির অচেনা চার দিকে ছড়ানো। সে মরিয়া হয়ে বড় রাস্তা ধ’রেই ধাবমান, হঠাৎ কী মনে হতে ডান দিকে তাকায়… একটা চেনা চেহারা সরকারবাড়ির দুর্গামণ্ডপে পা ঝুলিয়ে বসে আছে না! কষ্টিপাথর গায়ের রঙ, বেঁটেখাটো শরীর, শুধু চোখদুটো যেন কালিপুজোয় চোদ্দপ্রদীপের ঢল থেকে বেছে এনে বসানো। যত অশ্রুই রাখো, ধ’রে যাবে।

— ওই যে দিদি, বর অ্যাতোক্ষণে তুমারে নিতি আসিছেন।
দিদিমার চেয়েও বয়স্কা সরকারজেঠুর ফোকলাদাঁতি কোলকুঁজো মা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
— তুমি কীরম জামাই, বউ ঘোনো ঘোনো পলায় যায় ক্যান!”
— আমি কিছু করিনি। মা’র সঙ্গে ঝগড়া…।
— তা বোল্লি তো শোনবো না, মোনি। নিজের ইস্‌তিরি যহোন, যত্ন ক’রে রাখতি হবে। বড় হয়ে ছুঁড়ি বউ অনেক পাতি পারো, কিন্তু কথাডা মিলোয় নিয়ো, এই বুড়ির মহোব্বতের মোটে ধারেকাছেও কেউ আসতি পারবে না।

চাঁদ দ্যাখে, দিদিমা কিশোরীর মতো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে সারাক্ষণের সহচর পানের ডাবরটি হাতে সে নাতির পেছন পেছন নিঃশব্দে মণ্ডপ থেকে নেমে যায়।

রাস্তায় পড়তেই ওদের দুপাশ দিয়ে যেন ভূতের তাড়া খেয়ে ফোঁশ ক’রে উড়ে গেল দুই কিশোর; যাদের চালু নাম বাবু-হাবু। এবং অচিরেই তাদের পাঁচ-ছয় তুলসী চক্রবর্তী দূরত্বে ফুটে উঠল তৃতীয়জন — ভুঁড়ি, ফটফটিয়া চপ্পল, হাতে কঞ্চি আর কোমর থেকে বিপজ্জনক নেমে যাওয়া লুঙি নিয়ে; প্রচলিত নাম জুতোনিমাই। বাচ্চা মানুষ করাকে কেন্দ্র ক’রে কলোনিতে খুবই জনপ্রিয় এই দৌড় প্রতিযোগিতা সারাদিনে দু’ থেকে তিন বার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

শোনা যাচ্ছিল, নিজের ছেলেদের পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জানোয়ারের বাচ্চার নামে ডাকার পর হাঁফাতে হাঁফাতে তাদের কেটে কুচিকুচি ক’রে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে জুতোনিমাই। ধরতে পারলে তবে তো ভাসান? যমজ ভাইদুটো ঘুম ভাঙতেই আজাদ হিন্দ ক্লাবের চাতালে এসে বসে, পাশের শীতলা মন্দিরের ঘট থেকে পয়সা গেঁড়িয়ে মটরভাজা কিনে খায়, কুকুর পেলেই ঢিলোয়, দাঁড়াশ সাপ দেখলে ডান্ডাপেটা ক’রে মারে, শেষে শান্ত হয়ে চাতালে ইঁট দিয়ে ঘর কেটে মাথা গুঁজে ষোলোগুটি খেলতে লেগে যায়। সাধারণত এই সময়েই চিতবাঘের চরিত্র নিয়ে দুজনের ঘেঁটিভাঙার লক্ষ্যে গুঁড়ি মেরে এগোয় তাদের জনক, অথচ ঠিক আগের সেকেন্ডে কীভাবে টের পেয়ে ছাগলের বাচ্চার মতো তিড়িং ক’রে লাফিয়ে পালায় ওরা। তারপর তিনজনের ছুট ক্রীড়াসূচি মেনে।

রান্নাঘরে লোহার মতো ভারি গাঢ় খয়েরি রঙ কাঁঠালপিঁড়িতে বসে বড় বড় ভাতের দলা মুখে পুরছিল দিদিমা। সম্পত্তি বলতে এই পিঁড়ি আর ওই পানের ডাবরই সে ওদেশ থেকে আনতে পেরেছিল। চাঁদ কোলের ওপর লেপ টেনে বড়ঘরের খাটে বসে আছে। ছেলেদের পাকড়াতে আবারও ব্যর্থ জুতোনিমাই বাড়ির পাশ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখন :
“আমি শালা পেত্যোহো পঞ্চাশটা লোকেরে জুতো পরাই, এদিকি হারামিদুটো কিছুতি একজোড়া চটি পা’য় দেবে না, গোড়ালিতি বাবলাকাঁটা ফুটোয় খোঁড়াতি লাগিছে! ইচ্ছে ক’রে ছাড়ে দিলাম…।”

(আর একটু)

নব টোনাটুনি

index

এক ছিলো টোনা আর এক ছিলো টুনি। একদিন টোনা টুনিকে বললো,
– টুনি, ও টুনিইই..

টুনি হাই তুললো,
– হ্যা, বলো।
– আমার খুব ভাপা পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে।

টুনি চোখ পাকিয়ে বললো,
– তোমার কি খেতে ইচ্ছে করছে!
– পিঠা, ভাপা পিঠা।
– তোমার সুগার লেভেল হাই, শরীরে চর্বি জমছে, আর ডায়েট না করে তুমি ভাপা পিঠা খেতে চাইছো! হাও সিলি!!

টোনার মন খুব খারাপ হলো, চোখে পানি চলে এলো, টুনিকে কান্নাভেজা স্বরে বললো,
– তোমার চটপটি খেতে ইচ্ছে হলো, বৃষ্টির মধ্যে আমি গিয়ে কিনে আনিনি! তোমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে হলো, তোমাকে কানিবগের ফাইভস্টার ফুচকা খাওয়াইনি! আর আজ আমি দুটো ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছি বলে..

“এক্কেবারে ঢং করবে না” বলে টুনি ধমকে উঠলো, এরপর ঠোঁটে পায়ের নোখ কাটতে কাটতে বললো,
– ভাপা পিঠা খাবে বললেই তো বানানো যায়না, এর জন্য জিনিসপত্র লাগে। তুমি ঢং না করে জিনিসপত্র এনে দাও, ভাপা পিঠা বানিয়ে দিচ্ছি।

টোনার মনে খুব আনন্দ, চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলো,
– কি জিনিসিপত্র লাগবে?
– চালের গুড়ো লাগবে, গুড় লাগবে, মাওয়া লাগবে, নারকেল লাগবে, মাটির ঢাকনা লাগবে, ওই ঢাকনা বসানোর জন্য হাড়ি লাগবে, গ্যাস সিলিন্ডার লাগবে, আর আমার মোবাইলে ৫জিবি ডাটা লাগবে।

টোনা অবাক,
– ভাপা পিঠা বানাতে ৫জিবি ইন্টারনেট ডাটাও লাগবে?
– হ্যা, লাগবে। বেশী কথা না বলে এখনি বাজারে যাও।

টোনা বাজারে গিয়ে চালের গুড়ো, গুড়, মাওয়া, নারকেল, মাটির ঢাকনা, ঢাকনা বসানোর হাড়ি কিনলো। বাজারের সাথে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আর টুনির মোবাইলে ৫জিবি ডাটা ভরে বাসায় ফিরলো।

টোনার মনে খুব সুখ, আজ ভাপা পিঠা খাবে। ওইদিকে টুনি ইউটিউবে ঢুকে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। বারবার আসছে শুধু নুডলসের রেসিপি- নুডলসের খিচুরি, নুডলসের চাটনি, নুডলসের পুড় দিয়ে বেগুনের স্যান্ডুউচ। খুঁজতে খুঁজতে নুডুলস দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর একটা রেসিপি পেয়ে গেলো। ভিডিওটা খুলতেই মনে পড়লো ঘরে নুডলস নেই। এখন টোনাকেও নুডুলস আনার কথা বলা যাবেনা, খুব রাগ করবে। তাই অন্য রেসিপি খুঁজতে শুরু করলো। কথায় বলে, যেখানে মাহফুজের ভয় সেখানে হিরো আলম হয়, অন্য রেসিপি খুঁজতে যেতেই বাফারিং শুরু হলো, ইনারনেটের গতি এক্কেবারে স্লো হয়্র এলোম

টুনি তো বারবার চেষ্টা করছে, বারবার রিলোড দিচ্ছে, কিন্তু নেট কাজই করছে না। এমন সময় পাশের গাছের বাসা থেকে চড়ুই গিন্নি মাথা উঁচিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো ,
– টুনি ভাবীইইই, টুনি ভাবীইইই আপনার ইন্টারনেট কি কাজ করছে!
– কি যে বলেন ভাবী, ইউটিউবের ভিডিওটা এক ঘণ্টায়ও ওপেন করতে পারলাম না।
– আমি ‘নাজুক দিল’ সিরিয়ালটা দেখছিলাম, হঠাৎ গেলো বন্ধ হয়ে।
– ওহ, তাই! এদিকে আমি দেখছিলাম ভাপা পিঠার রেসিপিটা।

এ কথা শুনেই চড়ুই গিন্নি চেচিয়ে উঠলো,
– হায় খোদাআআ! ভাবীইইই আপনারা একা একা ভাপা পিঠা খাবেএএএএন! আমাদের কথা মনেই পড়লো না ভাবীইইই, আজ চড়ুই না হয়ে বুলবুলি হলে ঠিকই দাওয়াত দিতেন ভাবীইইইই..
টুনি একটু বিব্রত হলেও নিজেকে সামলে নিলো,
– কি যে বলেন, ভাবী! আপনাকে দাওয়াত দিতে হবে কেনো! আপনি তো ঘরের মানুষ, সবাইকে নিয়ে চলে আসবেন।
– থ্যাঙ্কু ভাবীইইই। আপনার হাতে বানানো ভাপা পিঠা খেতে আমরা তো আসবোই ভাবীইইইই, আমাদের উপরের ডালে কাজিন থাকে, ওর ফ্যামিলিকেও সাথে নিয়ে আসবো, ভাবীইইইইই।

টুনি রেগে মনে মনে “ঢং দেখলে শরীরটা জ্বইল্যা যায়” বললেও, মুখে হাসি মেখে উত্তর দিলো,
– অবশ্যই আসবেন।

চড়ুই গিন্নী বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতেই টুনি ধমকের সুরে টোনাকে বললো,
– চড়ুই ভাবী এলে এক্কেবারে রংঢং করবে না, যদি করো তবে চালের গুড়ির ভেতর তোমার মাথা পুরে সিদ্ধ করে মাসালা ভাপা পিঠা বানাবো, মনে থাকে যেনো, হু।

কোকিল পাখির গাওয়া কাকসংগীতের একটা সিডি লো ভলিউমে ছেড়ে দিয়ে টোনা আয়েশ করে শুনছে আর ভাবছে কখন বানানো হবে ভাপা পিঠা। এদিকে বাফারিং হতে হতে টুনির মোবাইলের চার্জ শেষ। মোবাইল সেটটা চার্জে দিয়ে টুনি নারকেল কুড়ালো, গুড় মিহি করে টুকরো টুকরো করলো, চালের গুড়োর সাথে মাওয়া মিশালো, হাড়িতে পানি ভরে চুলোয় বসালো।

সবকিছু ঠিকঠাক করে টুনি মোবাইল অন করলো। মোবাইল অন করে মন খারাপ হয়ে গেলো, দেখে ইন্টারনেট স্পিড তখনও এক্কেবারে কম। যখন মাত্র ভাবতে শুরু করেছে ইউটিউব না খুললে ভাপা পিঠা বানাবে কিভাবে তখনই পূব পাশের বটগাছের চিলটা উপরের ডালে উড়ে এসে বসলো,
– টুনি ভাবী, বাসায় আছেন?

টুনি খুব উচ্ছাসের সাথে উত্তর দিলো,
– ভাইয়াআআআ, এদ্দিন পর আমাকে মনে পড়লো!
– না, ঠিক তা না। রোজই আপনার কথা মনে হয়, কিন্তু..

কথা শেষ করতে না দিয়েই টুনি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
– থাক থাক, আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলতে হবে না, ভাইয়ায়ায়ায়া। আপনার মনে তো শুধু ডাহুক ভাবী, পায়রা ভাবীদের কথা, ভাইয়ায়ায়া।আমার মত ছোট্ট টুনির কথা কি আর মনে পড়বে, ভাইয়ায়ায়ায়া।

চিল প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো,
– টুনি ভাবী, ইন্টারনেটের স্পিড কি ঠিক আছে?
– না, ভাইয়ায়ায়া, ঠিক নেই। খুব স্লো, ভাইয়ায়ায়া।

টুনির এমন বিগলিত অবস্থা দেখে টোনা দু’বার পাখা ঝাপটালো। বিষয়টা বুঝতে পেরে চিল টিটকারি মারলো,
– কত স্লো, ভাবী! টোনার মত? প্রতি মৌসুমেই তো আপনার ডিম পারতে দেরী হয়ে যায়।

লজ্জায় লাল হয়ে টুনি বিব্রত হাসি দিলো, চিল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো,
– এত আয়োজন কার জন্য?
– আপনার ভায়ের ভাপা পিঠা খেতে খুব ইচ্ছে হয়েছে, ভাইয়ায়ায়া। সব রেডি কিন্তু ইন্টারনেট স্পিড কম বলে পিঠা বানাতে পারছি না, ভাইয়ায়ায়ায়ায়া।

চিল ভিরমি খেয়ে দুটো ঢোক গিলে বিস্ময় প্রকাশ করলো,
– ভাপা পিঠা বানাতেও আজকাল ইন্টারনেট লাগে!
– হ্যা, ভাইয়ায়ায়া, ইউটিউবে রেসিপি না দেখলে পিঠা বানাবো কিভাবে!
– ও আচ্ছা।
– ভাইয়ায়ায়ায়া, আজ কিন্তু আপনার দাওয়াত, না বলতে পারবেন না।
– ঠিক আছে টুনি ভাবী। ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হলেই চলে আসবো।

ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হচ্ছে না দেখে টোনার খুব রাগ হলো, কখন ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হবে তা জানতে ও কাস্টমার কেয়ারে ফোন করতেই শালিকের লাস্যময়ী কণ্ঠ,
– আমাদের সার্ভিসে আপনাকে স্বাগতম। মোবাইল রিচার্জের জন্য এক চাপুন, কল রেটের জন্য দুই চাপুন, ইন্টারনেট কেনার জন্য তিন চাপুন, যে কোনো অভিযোগ জানাতে ডিসকানেক্ট বাটন চাপুন।

টোনা ডিসকানেক্ট বাটনে চাপতেই লাইন কেটে গেলো। দ্বিতীয়বার কল সেন্টারে ফোন করতেই ভেসে এলো ফিঙের কণ্ঠ,
“আপনার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যালেন্স নেই, কথা বলতে চাইলে রিচার্জ করুন। দ্রুত ডিম পাড়াতে চাইলে টুনিকে আদর করুন, ইন্টারনেট স্পিড ছাড়া ভাপা পিঠা খেতে চাইলে মা’কে অনুরোধ করুন।”

নিমতিতা সরকারি কলোনি

এক
নিমগাছে নতমস্তক হয়ে পড়েছে রোদ্দুর। পুকুরপাড়ে পোঁতা খুঁটির ডগায় ব’সে মাছরাঙা ভাবছে, মাছ ধরতে গেলে সেই তো পায়ে ঠান্ডা লাগবে। কার বাড়ি যেন রেডিয়োতে “বলো না সহজ ক’রে আমায় পেরেছ তুমি বুঝতে”, আর প্রত্যেক গাছের নীচে শুকনো পাতার কবিতাপাঠ।
তখন কলোনির রাস্তা দিয়ে একটা বাচ্চা ছুটছিল।
— ও চাঁদ, কুথায় যাস?
— দিদ্‌মারে খুঁজতি।
ব’লে সে দুটো হাঁচি দেয়। আবার ছোটে।

বলরাম দাসের ভিটের দিকে যাওয়া নেই। শত্তুর পরিবার, দিদিমা হাজার ম’রে গেলেও ও-মুখো হবে না। পরের বাড়ি নবীন বিশ্বাস।
— ও নবীন, তুমি কী কাজ করো?
— মাসিমা, আমার ব্যারাকপুর টেশেনের গা’য় টেশেনারি দোকান।
— কী নারী ক’লে? ভগোবান য্যান্‌ তোমারে সুবুদ্ধি দেন!

হলুদ গায়ের রঙ আর টানা নাকচোখের নবীন; তার সুবুদ্ধি আছে, আবার নেইও। বিক্রিবাটার পয়সা ঘরেই এনে রাখে, তারপর পাড়া-টহলে বেরোয়। প্রত্যেক বাড়ির পাশ দিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াবে আর উঠোনে কি কলতলায় মেয়েমানুষ দেখলেই এগিয়ে এসে, “বুঝলে, আজ আমার চোখির সামনে তিনডে লোক এক বুড়ির হার ছেনতাই ক’রে দোড় মাল্লো”। এভাবে নীচু গলায় বিরামহীন গল্প শুরু হল, ওদিকে সে-মেয়ে একগাদা জামাকাপড়ে বল-সাবান মাখিয়ে রেখেছে, কাচবে কখন? অথবা,
— দাদা যাই, উনোনের ভাত এইবার পুড়ে যাবেনে!
— আরে, কী ঘটনা হইছে শোনো…

নবীনের বউ কাজল বাইরে থেকে খুব সাদামাটা আর রুগ্ন, কিন্তু তার হৃদয়পিঞ্জর মানুষের জন্যে ভালোবাসা আর একটা মানুষের ’পরে অভিমানে টাপেটোপে ভ’রে আছে। সূর্য মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল তবু কাজল কিছু খাবে না, গ্যাসের অসুবিধে কিন্তু ডাক্তার-কবিরাজ করবে না; আধো-অন্ধকার রান্নাঘরে বসে শুধু রেঁধে যায় — পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে ভুরভুর গন্ধের মুসুরির ডাল, বড়ি দিয়ে কচি লাউডগার তরকারি, গোটা সরষে দিয়ে ডুমো কুমড়োর ছেঁচকি, পোস্তো দিয়ে কড়কড়ে পলতা পাতার বড়া…। কাজলের মেয়ে সুধা সারাক্ষণ পাড়াময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে গলাভর্তি অট্টহাসি নিয়ে। মিন্টুর ঠাকুমা যে বলেছিল, “ও সুদা, শুদা শুদা হাসিস ক্যান”, সেটাই তার এক-লাইনের আত্মজীবনী। সোনাব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে সবার ঘরে ঢুকে পড়ছে সুধা — কমলাপিসি, আজ কী রাঁধলে গো? মান্তির মা, নিমবেগুন আর পেঁপের ঝোল খেয়ে খেয়ে তোমার অরুচি ধরে না? এক ঘন্টা পরে সে তরকারির বাটি হাতে আবার পৌঁছে যাবে — মা দেছে বিশ্বনাথমামার জন্যি… মা দুঃখীপিসিরে খাতি বোল্লো।

চাঁদকে ছিটে-বেড়ার গেট ঠেলে ঢুকতে দেখে থমকে দাঁড়াল সুধাদিদি :
— কী ব্যাপার, বিদ্যেসাগোর?
— তোমাগো বাড়ি আমার দিদ্‌মা আইছে?
— যাহ, চাঁদের বুড়ি হারায় গেছে!
সুধা পাকা ফুটির মতো ফেটে পড়ল হাসিতে।

দুই
শীতের দুপুরে বাতাস এত ঝাঁঝরা হয়ে থাকে শূন্যতায়, প্রজাপতি উড়তে গিয়ে একটুতেই থ’কে যাচ্ছে। সব উঠোনের রোদ্দুরেই চুলের উকুনবাছা নারীসমাজ দৃশ্যমান। ভক্তবাড়ির পুঁচকে ছেলে কালিদাস ঘেঁটুফুলের ঝোপে নিজের পেছছাপের ধারা দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টায় ব্যস্ত। ফোঁত ক’রে নাক ঝেড়ে রাস্তা দিয়ে আবার ছুটল চাঁদ। এবার বীরেন-ধীরেনের খোলা বাড়ি, মানে দু’হাত অন্তর কচাগাছ পোঁতা নেই প্লটের সীমানা ঘিরে। কয়েক মাস ওদের বাবা মারা গেছে।

আস্তে আস্তে মরে যাওয়াটা কলোনির দস্তুর। যে কাশে, কেশেই যায়; যার হাগা, বারবার গিয়ে বসছে চাড়ি বসানো খাটা-পায়খানাতে। একদিন চাঁদের মা বিকেলে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলবে, মালাকারবাড়ির প্রভাতের বুকির রোগডা আবার ঠ্যালা দেছে। ঠোঁট দিয়ে ফিতের একটা দিক চেপে থাকায় কথাটা ভালো বোঝা যাবে না। তারপর একরাতে ভাত খেতে ব’সে গরাস মুখে তুলতে গিয়ে আবার পাতে নামিয়ে রাখবে, “বিরু-ধিরুর বাবা মনে হয়…”। সকালে এবাড়ি থেকে একজন, ওবাড়ি থেকে আর একজন ধীর পায়ে হাজির হচ্ছিল মালাকার-বাড়ির দরজায়। মাতব্বর-গোছের কেউ, প্রায়ই যার নাম বলরাম দাস, চেঁচিয়ে বলছিল, “ওরে বের ক’রে উঠোনে এনে শোয়াও। ঘরের মোদ্দি থাকলি পেরানডা বেরোতি পাত্তিছে না”। শোনামাত্র প্রভাতের বউ কুক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। যেন পুজো শুরু হবে কিন্তু দুব্বো তোলা হয়নি মনে পড়ায় কেউ ডেকে আনছে পাড়ার ডাক্তারটিকে। সে আসলে হিন্দি সিনেমার পুলিশ অফিসার, শেষ দৃশ্যে নায়ক ভিলেনকে মেরে পাট-পাট করে দেওয়ার পর হাজির হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত খলনায়ককে হাতকড়া পরিয়ে দেয়।

বাঁহাতের তিন আঙুলে আলগোছে রোগির কব্জি ধরে নিজের কব্জির ঘড়ির দিকে ঠায় তাকিয়ে ছিল তারকডাক্তার। তারপর মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টোয় — ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।

প্রিয় টিম হেরে যাওয়ার শোক বুকে বয়স্ক প্রতিবেশীরা ফিরে আসছিল — মৃত্যুর সঙ্গে ফাইনাল ম্যাচে পরাজয় নিয়ে মাঠ বা রেফারিকে দায়ি না ক’রেই। তখনও বীরেন-ধীরেনের মা উঠোনে উবু হয়ে শবদেহের পরামর্শ নিতে ব্যস্ত। “বাড়িতি চাট্টে পেট, কী করি কও তো! কোইলকাতায় বাসনমাজার কাজ ধরবো? না আড়তে যেয়ে পচা আলু পচা পেঁয়াজ বাছার জোন খাটতি শুরু করি? আড়ত ভালো, দিনিদ্দিন টাকা; কিন্তু তোমার বেয়াই জগন্নাথ সাহা গা পর্‌শো ছাড়া কথা কোতি পারে না। হারামির হাতদুটো জগন্নাথ ঠাকুরির মতোন ঠুঁটো হয়ে যায় না ক্যান!

সুতরাং কলোনিতে বিধবা গিজগিজ করছে। তাদের বরেরা কেন যে এমন আপোষে মরে যায়! চারদিকে সাদা থান আর প্রত্যেক আঁচলের নীচে তিন-চারটে শুকনো কিশোর মুখ। সময়ের অনেক আগে ডিমের খোলা ভেঙে গেছে, তলতলে কুসুম হয় ভ্যান টানছে কাদা রাস্তায়, নয় দাদ-হাজার মলম নিয়ে উঠে পড়েছে লোকাল ট্রেনে। আর বারো-তেরো বছর থেকেই মেয়েদের জিভের নীচে তরল থলি, অপছন্দের শব্দ শুনেছে কি তাক করে নীল থুতু ছিটিয়ে দেবে। যে বাড়িতে দুতিনটে মেয়ে, খবরদার তাদের লেজে পাড়া দিতে যেয়ো না।

(আরও আছে)

হঠাৎ সন্ধ্যা (২য় পর্ব )

selected

দেখতে দেখতে ১০ বছর হয়ে গেল মীরা আপার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর মাঝে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। আমি কিশোরী থেকে যুবতী হয়েছি। বড় চাচার গোলাপ গাছটি ঝরে গেছে। পাড়ার জাকির মাস্তান আমাকে প্রেমপত্র দিয়েছে। মোড়ের দোকানদার বাচ্চু মারা গিয়েছে। পাত্রপক্ষ আমাকে কয়েকবার দেখতে এসেছে। হতে গিয়েও আমার বিয়েটা হয়নি। আরো কতো কিছু তা বলে শেষ করা যাবে না। তার মাঝে একটি ঘটনা আমার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সে ঘটনাও সময়মত বলা হবে।

মীরা আপা চলে যাবার পর থেকে রাশেদ ভাইকেও পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই ধরে নিয়েছে মীরা আপা রাশেদ ভাইয়ের সাথে পালিয়েছে। এ নিয়ে বাবা কম পাগলামি করেননি। বোকা মানুষ সব কিছু নিয়ে হট্টগোল করে। বুদ্ধিমানেরা তাদের চিন্তা শক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান করে। বাবা পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ করেছেন। এমনকি পীর-ফকির, কবিরাজ, সাধু- সন্যাসি কেউ বাদ যায়নি। তবু আপাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একবার এক ফকিরকে আনা হলো। তিনি অনেক যোগ-বিয়োগ করে বললেন কোন এক জালিম মীরা আপাকে আটকে রেখেছে তাকে পেতে হলে শুক্রবার বাদ জুম্মা দুইটি কালো ছাগল জবাই করে মিসকিন খাওয়াতে হবে, বাবা তাই করলেন কিন্তু আপা ফিরে এলো না বরং পাড়ার রটে গেল মীরা আপাকে কে যেন পতিতালয়ে আটকে রেখেছে। বাবা এতেই খান্ত হলেন না মায়ের পুরোনো গয়না বিক্রি করে লাইসেন্স করা বন্দুক কিনে এনে বললেন- রাশেদ হারামজাদাকে আমি গুলি করে মারব! কত বড় সাহস আমার মেয়েকে নিয়ে পালায়!

দিন দিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে লাগলো। আমার যেন কষ্টের অন্ত রইলো না। পাত্রপক্ষ যতবার দেখতে এসেছে আপার কথা শুনে আর এগোয়নি। আমাকে একা একা বাইরে যেতে হত। কলেজে উঠার পর জাকির নামের এক মাস্তান আমাকে প্রেমপত্র দিয়ে বসলো। কলেজের যাবার সময় সে আমার পিছু নিত। এই ঘটনা বাবা একদিন রাস্তায় দেখে ফেলল তাতে জাকির মাস্তানের কোন ক্ষতি হয়নি বরং আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল। বাবা বাড়ীতে এসে হুংকার দিয়ে বললেন কাল থেকে আর কলেজে যেতে হবে না। তোর পড়াশুনা বন্ধ। একটা গেছে গোল্লায়, আরেকটা যাচ্ছে চুল্লায়! একথা শুনে সবচেয়ে খুশী হলেন যে তার নাম “মোতালেব”। আমার জীবনের কলঙ্ক অধ্যায়ের নায়ক এই মোতালেব আংকেল।

ছেলেবেলা থেকেই এই মোতালেব আংকেলকে আমি প্রচুর ভয় পেতাম। তার অশালীন কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট ছিলাম। তার ব্যাপারে কখনো কাউকে কিছু বলতে পারিনি। এমনকি বাবাকেও না। কারন বাবার নেশা ছিল হোমিওপ্যাথিক বিদ্যা অর্জন করার। তিনি ছিলেন মোতালেব আংকেলের একমাত্র ছাত্র। বাবা তাকে পীর মানতেন। বাবা সব সময় বলতেন- মোতালেব ভাই একজন টেলেন্ট মানুষ। হোমিওপ্যাথিক বিদ্যায় তাকে টক্কর দেয় এমন কোন বাপের বেটা এখনো জন্মায়নি। তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পীর আর আমি তার মুরিদ। হা হা হা !!! তাই বাবাকে তার সম্পর্কে কিছু বলা অর্থহীন। হয়তো মীরা আপাও কিছু বলতে পারেনি এজন্য রাশেদ ভাইয়ের হাত ধরে পালিয়েছে।

আপনাদের বলেছিলাম আমার জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের গল্প বলবো। সময়টা ছিল আপা চলে যাবার একমাসের মাথায়। সে সময় বাবা চরম মাত্রার পাগলামি শুরু করলেন। যখন তখন আমাকে এবং মাকে ধরে মারতেন। ভয়ে তাদের ঘরের সামনে যেতাম না। রাতে একা একা আপার রুমে ঘুমাতাম। আপার ঘরটা ছিল একেবারে শেষে দিকে। সে রাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল রাতে খাবার শেষ করে রুমে গিয়ে দেখি বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভয়ে ভয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়তেই হঠাৎ কেউ একজন আমার মুখ চেপে ধরলো। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ছাড়াতে পারিনি। সেই ভয়াল রাতে কথা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। আমার সর্বস্ব শেষ হয়েছিল সেই রাতে। তীব্র ব্যাথার স্রোত বয়েছিল সমস্ত শরীর জুড়ে। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল আমি মারা যাচ্ছি। সেই রাতে আমাকে বাঁচানোর মত কেউ ছিল না। হৃদয় ভেঙে চুরমার করা বজ্রকম্পনকে থামনোর সাধ্য ছিল না করো। বিদুৎ চলে আসতেই আলোর ঝলকানিতে দেখতে পেলাম মোতালেব আংকেল মুখ। তিনি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে আছেন। আমার স্বত্তাকে ধ্বংস কারার নেশার মেতেছেন। তার ক্ষুর্ধাত হিংস্র ভয়াল থাবা থেকে সেদিন নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি।

(চলবে)

হঠাৎ সন্ধ্যা (১ম পর্ব) পড়তে ক্লিক করুন