বিভাগের আর্কাইভঃ গল্প

গুড়ের চা

সাত
সকাল থেকে এই নিয়ে চার নম্বর ভিখারি। পেট ডুগ্‌রে গলা সরু একটা ন্যাংটো বাচ্চা কোলে তার মা এসে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চাটার দু’নাক দিয়ে মোটা হলদে সিক্‌নি। মাঝেমাঝে নাক টানলে বেরিয়ে পড়ছে সিক্‌নির নীচে দুটো লম্বা লাল ঘায়ের দাগ।

প্রতিবার রান্নার চাল নেওয়ার পর হাঁড়ি থেকে যে ছোট দুই মুঠ তুলে একটা কলসিতে রাখা হয়, সেখান থেকে রেকাবিতে চাল নিয়ে ছোড়দা ঢেলে দিল বৌয়ের পেতে ধরা গায়ের কাপড়ে। চালসমেত শাড়ির অংশ কোমরে গুঁজে নিল সে। তখন মনে হল, কোলের মতো তার পেটেও এক সন্তান।

অন্ধ সেজে আসে অনেকে, ভিক্ষে নিয়েই দে হনহন ক’রে হাঁটা; অনেকের হাতটান খুব, এদিক-সেদিক গেছ কি রান্নাঘরের দাওয়া থেকে বাচ্চার তেলমাখার বাটি নয়ত উঠোনে ছেড়ে রাখা হাওয়াই চটি নিয়ে গায়েব হয়ে যাবে। এমন তাদের মরিয়া সাহস, চার-পাঁচ দিন পরে আবার তোমার বাড়ি, আর ভুলুক-ভালুক তাকাচ্ছে, যদি আরও কিছু গ্যাঁড়ানো যায়।

তবু কোনওভাবে দেশ থেকে দেশে লাখ লাখ মানুষের এই মহাঅভিসরণ, তাদের ক্ষিদে, তাদের মাঙনের হাত-পাতা আর অপমানিত হওয়ার পাঠক্রমকে লঘু করা যাবে না। খালি পায়ে বাদাবন পার হয়ে, রেল লাইন টপকে, দিনে কচুরিপানা-ভর্তি পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে রাতে গ্রামের পর গ্রামের ঘুম না ভাঙিয়ে পোয়াতি বউ, দুধের শিশু বা অশক্ত বাবাকে আঁকড়ে এই নিঃশব্দ স্থানান্তর! তারপর অনেকের চুপচাপ মরতে থাকা… রাতে ঘুমের মধ্যে যেমন শিউলি ঝ’রে পড়ে আর সকালে উঠে এক একটা বুক-কাঁপানো “বলো হরি, হরিবোল”, কাঁচা বাঁশের চালির ওপর শুয়ে কেউ চলে যাচ্ছে শুঁটি নদীর গায়ে জুবলিঘাটা শ্মশানের দিকে। উদ্বাস্তু জীবনের মতো শুকিয়ে গেছে সেই সুবর্ণবতীও, যেখানে এক সময় চাঁদ সদাগরের ডিঙা ভাসত। অন্যদিকে দুটো চাল, একবাটি ফ্যান বা একটা তামার পয়সার জন্যে কলোনি জুড়ে বিষণ্ণ পদক্ষেপ। ভিখারি এসেছে ভিখারির কাছে ভিক্ষে চাইতে!

চতুর্থ কাঙাল স’রে গেছে কি যায়নি, একটা রব উঠল কলোনির বাঁ হাতে মান্নাপাড়ার দিক থেকে। ওমনি বড় রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলো পিটি করার মতো “সাবধান”। মুহূর্তের মধ্যে এক পাল শুয়োরের কালো প্রবাহ এসে পড়ল রাস্তায়। ঘোঁত ঘোঁত শব্দে কান ভ’রে উঠছে, বানের জলের মতো এপাশ-ওপাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে দু’চারটে, তখন পালের পেছনে যে দুজন রাখাল, তারা মুখে চুঃ চুঃ ক’রে লাঠির প্রহারে তাদের তুলে আনছে রাস্তায়।

ঢেউটা এগিয়ে আসতেই চাঁদের বাড়ির দুদিকের দুই কচুবাগানে “শুয়োরে চেনে কচু” প্রবাদ মনে রেখে বরাহদল আক্রমণ শানাল। ওমনি কলোনির মেয়েরা অভিশাপ দিতে শুরু পশুর পালকে, আর ছেলেরা তেড়ে গেল তাদের পরিচালকদের দিকে। এই কচুবনদুটো কলোনির বেশ কয়েকটা বাড়ির খাদ্যভাণ্ডার — কচুপাতাবাটা, নুন-লংকা মাখা কচুভাতে, কচুর সব্জি দেওয়া ডাল অথবা অল্প সরষের তেল খরচ করতে পারলে কচুর লতির বাটিচচ্চড়ি। আবার, বাড়িতে মূল্যবান অতিথি এসেছে তো সদ্য-গজানো অর্ধেক মোড়া কচুপাতার মধ্যে ডালের পুর দিয়ে ভেজে এক উচ্চপর্যায়ের ঝোল-তরকারি হতে পারে। বাজার করার পয়সা না থাকলেও ঘরে বসে তুমি চার-পাঁচটা রান্নার পদ পেয়ে যাচ্ছ।

কাদাজমিতে ঢুকে জানোয়ারগুলো পড়পড় ক’রে কচুগাছের গোড়া ওপড়াতে শুরু করেছে, এদিকে বাতাসে শিস কেটে লাঠির বাড়ি পড়ছে পিঠে, গোঙাচ্ছে তারা। কষ্টে ঘেমে যাচ্ছে চাঁদের বুক। ভগবান এইমাত্র ম্যাজিক ক’রে তাকে ওই চার-পাঁচ ডজন শুয়োরের কোনও একটা বানিয়ে দিলেন, চাঁদের চাম-মাংস-হাড় কেটে কেটে বসছিল লাঠির পরিত্রাহি সপাংগুলো!

আট
জাঙাল লণ্ডভণ্ড ক’রে এগিয়ে যায় ইতরসমাবেশ, মেয়েদের গজগজানির তখনও বিরাম নেই।
এ এক বড় ঘেন্নার জীব — চাঁদের মা দত্তকাকুর বউকে বলছে।
— কলতলায় সবে ঠাকুরির বাসন নামাইছি, যদি আসে মুখ দিয়ে দিতো, ক’ন দিদি! পাপটা তো আমারই লাগতো?
— কাওরাগো ব’লে-বোঝায় তুমি কিছু কোত্তি পারবা না, শান্তর মা। ওগো আবাহোনও নেই, বিসজ্জোনও নেই।

কায়পুত্র নামে ডাকলে তারা খুশি হয়, তবু সবাই কাওরাই বলবে। মান্নাপাড়া পেরিয়ে বাজারের ঠিক আগে চৌবাড়ি ময়দান, মাঠের গায়ে লাগানো কাওরাপাড়া। হয়ত মেরেকেটে দশ ঘর, পঞ্চাশ মানুষ। সব্বাই তীক্ষ্ণ কালো আর শুঁটকো, ছেলেরা নেংটি প’রে পায়খানা সাফাই করে, পোষা জীবগুলোর মতোই পাঁক ঘেঁটে মাছ ধ’রে বেচে বাজারে, মেয়েরা খাটছে ঠিকে-ঝি। ছেলেপেলে স্কুলে যায় না, সিগারেটের খোল দিয়ে তাস বানিয়ে জুয়ো খ্যালে, বিড়ি টানে, নিজেদের মধ্যে মুখখারাপ আর মাথা-ফাটাফাটি সারাক্ষণ।

বয়স্করা বাড়িতে পচাই আর তাড়ি বানাচ্ছে, পাশ দিয়ে হাঁটলে বোঁটকা গন্ধ পাবে। কিন্তু আজকাল ভদ্র সমাজও সন্ধেবেলা বড় রাস্তা এড়িয়ে ঘন দাঁতনগাছের ঝোপ ঠেলে কাওরাপাড়ায় হাজিরা দেয়। এভাবে কালে-কালে গোটা এলাকাই মাতালের দখলে চলে যাবে — এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে দত্তবাড়ির বউ ঠাকুরের বাসন মেজে ঘরে ওঠে। চাঁদের মা কনিষ্ঠ সন্তানকে নির্দেশ দিচ্ছিল, যা, দিদ্‌মারে ডাকে নিয়ে যায়। দ্যাখো গে, কলোনির কোন বাড়িতি যেয়ে ব’সে আছেন। এবার সে রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের ভাতের থালাটি আগাম সাজিয়ে হাঁড়ির বাকি ভাত নিজের পাতে তুলে নিল। তখনই আজকের ছ’নম্বর ভিখারির শুভ মহরত।

অল্প বয়েসি বউটা রান্নাঘরের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখে মা দরজার পাল্লা অর্ধেক ভেজিয়ে এক চিলতে মুখ বাড়ায় — কী চাই?
— দুটো ভাত দেবা, মা গো? কাল দুফোরেত্থে কিসু খাইনি।
— নাম কী তোমার?
— মালোতী
ভেজানো পাল্লা দমাস ক’রে খুলে গেল।
— মিথ্যে কথা কও কিসির জন্যি? তুমি তো মোছলমান।
নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
— যাও, একখান কলাপাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসো।

পাতিলেবুগাছের নীচে উবু হয়ে বসে পড়ে মালতী… না, মোমতাজ। মা নিজের থালা হাতে বেরিয়ে এসে অর্ধেক ভাত কলাপাতায় ঢেলে দেয়, কুমড়ো-পুঁইশাকের ঘ্যাঁট এক খাবলা রাখে ভাতের পাশে, এবং যে মুসুরির ডাল ঢালে পাতের ওপর, তাতে এমন নিফুটি জল যে পাতা ছাপিয়ে উঠোনের ধুলোয় মিশে যায় ডালের অর্ধেক। লেবুগাছের চারটে পাতা ছিঁড়ে চটকে মেখে খাওয়া সেরে মুখ ধুয়ে মোমতাজ যখন আঁচলে হাত মুছছে, মা গিয়ে সামনে দাঁড়াল :

— তোমরা তো পাকিস্তান থে’ আমাদের খ্যাদায় দিছিলে নিজেরা আরামে থাকপা ব’লে। কিন্তু থাকতি পাল্লে কই? সেই তো হিঁদুগো পেছোন পেছোন ইন্ডিয়ায় চলে আসতি হ’লো!
— কাজ জোটে না মা, ভিক্কেও দেয় না কেউ, কিন্তুক সব্বোনাশ করার লোক আছে। যেই মেয়ে হল অ্যাট্টা, খসোম ছাড়ে দে’ চলি গ্যালো। পাকিস্তান-ইন্ডে দিয়ে আমি কী করবো, পেরানে বাঁচা নিয়ে কথা।
— তোমার মেয়েডা কই?
— সে-কবে তার গোর দেয়া সারা!
ব’লে এমনভাবে উঠোনের একদিকে তর্জনী বাড়ায়, যেন ওখানে খুঁড়লে এখুনি মেয়ের মাটিমাখা হাড়গোড় বেরিয়ে আসবে।

চাঁদ দিদিমাকে খুঁজতে বেরোনোর সময় পেছন ঘুরে দেখছিল — শীতের ফ্যাকাসে দুপুরের ভেতর দাঁড়ানো দুই নারী শূন্য চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে…।

হঠাৎ সন্ধ্যা (১ম পর্ব)

selec

প্রচন্ড শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। উঠে দেখি বাবা মাকে মারছেন। মেঝেতে ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরা পড়ে আছে। মায়ের পা থেকে রক্ত ঝরচ্ছে, মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদচ্ছে। আমি দৌড়ে বড় চাচাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম এমন সময় বাবা চেঁচিয়ে বললেন- কই যাস?
-বড় চাচার কাছে !
-এই ভরদুপুরে তাকে ডাকার দরকার কি? চিলেকোঠা থেকে মোতালেব সাহেবকে ডেকে নিয়ে আয়। সে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার।
আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছি আর সূরা একলাস পড়ছি, এ বছর আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম বড় চাচা আমাকে এই সূরা শিখিয়েছেন, বলেছেন- যদি কোন বিপদে আসে এই সূরাটা যেন পড়ি। আমার সামনে এখন মহাবিপদ! মোতালেব আংকেলকে ডাকতে হবে। তিনি কেমন যেন! ডাকতে গেলেই কাছে টেনে নিয়ে কোলে বসায়, আমার বুকে হাত দেয়, চুলের বেণী খুলে দেয়। একদিন সন্ধ্যায় মা বলল- খুকি যাতো মোতালেব সাহেবকে বেগুণী ভাজা গুলো দিয়ে আয়। গিয়ে দেখি মোতালেব আংকেল নগ্ন হয়ে কি যেন করছে! আমাকে দেখে সরল ভঙ্গিতে বলল- ইরা, টেবিলের উপর থেকে তেলের বোতলটা নিয়ে কাছে আয়তো, আমার এখানে একটু মালিশ করে দে। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম- মা এখনই যেতে বলেছে আমার হোমওয়ার্ক করা হয়নি। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন- যা ভাগ, বদ মেয়ে কোথাকার! আমি কোনোমতে দৌড়ে পালালাম।

৬০ বছর বয়সী মোতালেব আংকেল বড় চাচার বন্ধু। চাচী মারা যাবার কিছুদিন পর বড় চাচা বাবাকে বললেন- মোতালেবের কেউ নেই রে…বেচারার না হল ঘর, না হল সংসার। চিলেকোঠার ঘরটা পরিষ্কার করে দে, মোতালেব এসে আমাদের সাথেই থাকুক। বিকেলে আমি, বাবা, মীরা আপা লেগে গেলাম ঘর পরিষ্কার করতে। পরদিন পুরনো একটি টাঙ্ক হাতে মোতালেব আংকেল হাজির হলেন। কালো, বেটে, টাকলা এই মানুষটি দেখে মীরা আপা চুপিচুপি আমাকে বলল- ইরা লোকটির চোখ দেখ! একটি চোখ কেমন সাদা! মনে হয় নষ্ট। আমি লোকটি চোখের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম! মনে হল চোখটি এখনি খোসে পরবে।

বড় চাচার গোলাপ গাছে দুটি কলি এসেছে। আমি প্রতিদিন সকালে ছাদে যাই গাছগুলো দেখতে। মীরা আপা আমাকে বলেছে কাল একটি গোলাপ চুরি করবে, তার প্রিয় একজন মানুষকে দিবে। তবে এ কথা কাউকে বলা যাবে না। এক বোনের গোপন কথা অন্য বোন কাউকে বলে দিলে তখন তারা আর বোন থাকে না। একথা মীরা আপা বলেছে। মীরা আপা এত সুন্দর করে কথা বলে! কথা বলার সময় চোখ ঘুড়িয়ে হাত নাড়িয়ে কথা বলে। কিন্তু মাঝে মাঝে কি যে হয়? সারাদিন দরজা বন্ধ করে থাকে।
প্রতি শুক্রবারে আমি আর মীরা আপা শাড়ি পড়ি, চোখে কাজল দেই, পায়ে আলতা লাগাই, মোড়ের বাচ্চুর দোকান থেকে আচার কিনে আনি। ছাদে দাঁড়িয়ে আচার খেতে খেতে মীরা আপা গুন গুন করে উঠে। তার মিষ্টি কণ্ঠে সুবাস ছড়ায়। তখন আমার কি যে ভাল লাগে মনে হয় আপাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকি।

রাশেদ ভাই আমার বড় খালার ছেলে। খালা মারা যাবার পর খালুর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে রাশেদ ভাই ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে থাকেন। প্রতিদিন বিকেলে আমাকে পড়াতে আসেন। মীরা আপা কেন জানি রাশেদ ভাইকে খুবই অপছন্দ করেন। তিনি রাশেদ ভাইয়ের নাম রেখেছ “অক্টোপাস” রাশেদ ভাইয়ের চুলগুলো নাকি অক্টোপাসের মত।
সেদিনকার কথা, রাশেদ ভাই আমাকে পড়াচ্ছিলেন কোথা থেকে মীরা আপা কাঁচি হাতে এসে বললেন- অক্টোপাস ভাইয়া এখন আমি আপনার চুল কেটে দিব! আপনার কি কোন সমস্যা আছে?
রাশেদ ভাই বোকার মত বলল- না কোন সমস্যা নেই। তবে এর জন্য তোমাকে কোন টাকা দিতে পারব না। আমার কাছে কোন টাকা নেই।
মীরা আপা রেগে গিয়ে বললেন-আপনি জানেন এই চুলের জন্য আপনাকে পাগলের মত দেখায়? আপনি এখনই আমার সামনে থেকে যান সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে আসুন।
-বললাম তো আমার কাছে টাকা নেই। তাছাড়া ওর সামনে পরীক্ষা। আমি এখন যেতে পারবো না।
-রাশেদ ভাই আপনি যদি এখনই চুল কেটে না আসেন তাহলে আপনার খবর আছে! বলেই আপা কেঁদে ফেললেন।
রাশেদ ভাই মন খারাপ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমি আপার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
আপা চোখ মুছে আমাকে বললেন-ইরা, সিঙ্গারা খাবি?
-আপা তুমি কাঁদলে কেন?
-কই? কখন?
-আমি দেখলাম একটু আগে!
-জানিস না আমি অভিনয় শিখছি! কয়দিন পর আমার বিয়ে হবে সবাইকে কেঁদে দেখাতে হবে না?
-আপা আমি তোমাকে বুঝি না ! তুমি রাশেদ ভাইয়ের সাথে কেন এমন করো?
-তোকে বুঝতে হবে না। তুই মন দিয়ে পড়। বাবা সিঙ্গারা এনেছে আমি বড় চাচাকে দিয়ে আসি।

চিলেকোঠার দরজার সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি। কড়া নাড়তেই মোতালেব আংকেল বেরিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -কি হয়েছে রে? যৌবনের আগুনে পানি ঢালতে হবে নাকি? ভেতরে আয় আমি তোকে একটি জিনিস দেখাই।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, মায়ের পা কেটে গেছে, বাবা আপনাকে ডাকছে!
একথা শুনে তিনি অনেক মজা পেলেন হাসতে হাসতে বললেন-শুনলাম তোর বোনকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? কার সাথে পালিয়েছে? তোর বোন নাকি বেশ্যা পাড়ায় নাম লিখিয়েছে। ঠিক হয়েছে, মাগীর খুব দেমাগ ছিল। আমাকে বলে কানা বুড়া!
হঠাৎ এ কথায় আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমার তো মনেই ছিল না গতকাল কলেজে যাবার পর থেকে মীরা আপা এখন অবধি বাসায় ফেরেনি!

(চলবে)

আদর্শ বাবা

ছেলেটি ভারি বিরক্ত করছে। মা কিছুতেই সুস্থ মনে রান্না করতে পারছেন না। কখনও ভাঁড়ারের সবজি ছড়াচ্ছে তো কখনও আবার কলসীর জলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে জল ছেটাচ্ছে ৷পরক্ষণে আবার মায়ের আঁচল ধরে টানাটানি করছে ৷
– কী চাস বলতো? আমাকে রান্না করতে দিবি না নাকি?
মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ছেলেটি তার দুষ্টুমি চালিয়েই চলে।
মা যতই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন – ছেলেটির দুষ্টুমি যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। মা একটু রাগতস্বরে কথা বললে কিছুক্ষণ চুপ থাকছে। তারপর আবার …
কোনোভাবেই ছেলেকে শান্ত করতে না পেরে মা একটু ছলনার আশ্রয় নিলেন আর দশটা মায়ের মতই। ছেলের মুখে-মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন -শোনো বাবা, তুমি যদি ও’ঘরে গিয়ে এখন ঘুমোও – তাহ’লে ঘুম থেকে উঠলেই আমি তোমাকে সন্দেশ খেতে দেবো ৷
সন্দেশের নাম শুনেই খুশিতে ছেলেটির মন যেন পাল্টে গেল ৷
হাসিমুখে বলল -ঠিক বলছো মা? সন্দেশ দেবে তো ?
– হ্যাঁ বাবা। তুমি এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
– আচ্ছা মা ৷
সন্দেশ পাবার আশায় পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেটি তার সমস্ত দুষ্টুমি ভুলে মায়ের কথামত ঘুমোতে চলে গেল পাশের শোবার ঘরে।

মা-ও আপাতত ছেলের দুষ্টুমির হাত থেকে রেহাই পেয়ে রান্নার কাজে মন দিলেন।

পাশের অন্য একটি ঘরে বসে ছেলেটির বাবা বই পড়ছিলেন। মা আর ছেলের কথাবার্তা হয়তো তারও কান পর্যন্ত গিয়েছিল। কী জানি কী ভেবে তিনি বইপত্র গুঁটিয়ে রাখেন। তারপর কাঁধে একটা ফতুয়া ঝুলিয়ে কোথাও একটা যাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।

ব্যাপারটা ছেলেটির মা দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে বললেন – এই ভরদুপুরে তুমি আবার কোথায় চললে ? একটু আগেই তো বলছিলে, এ’বেলায় এই ঠা ঠা রোদে আর কোথাও বেরোবে না ৷
ছেলেটির বাবা গিন্নির কথার উত্তর দিতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন ৷ বললেন – সন্দেশ কিনতে ৷
– সন্দেশ ? কেন ?
– তুমি যে ছেলেকে বললে- ঘুম থেকে উঠলেই তাকে সন্দেশ খেতে দেবে। তা তোমার ভাঁড়ারে কি সন্দেশ আছে ?
– না নেই। তাতে কী ? এই অসময়ে আর তোমাকে এককোশ পথ হেঁটে সন্দেশ আনতে যেতে হবে না ৷
– ঘুমের থেকে উঠেই তোমার কাছে ছেলে যখন সন্দেশ চাইবে তখন কী করবে ?
– ও কি আর তখন ওর মনে থাকবে ৷ শিশু মন৷ ভুলে যাবে। আর যদি চায়ও তো ব’লে দেবো – বাবা রাতে এনে দেবেন ৷
– না, তা হয় না গিন্নি ৷ ওকে যখন তুমি আশ্বাস দিয়েছো ঘুম থেকে উঠলেই সন্দেশ দেবে – সে কথা তো তোমার রাখতেই হবে ৷ তাই ও ঘুম থেকে ওঠার আগে ঘরে সন্দেশ এনে রাখতে হবে যাতে তুমি ছেলের কাছে মিথ্যাবাদী হয়ে না যাও।

গিন্নি চুপচাপ তার পণ্ডিত আর আদর্শবাদী স্বামীর কথা শুনছেন আর নিজের ভুলটা উপলব্ধি করতে পারছেন।

স্বামী আরো বললেন – তা না করলে তোমার প্রতি ওর বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। ভাববে মা তো ওরকম বলেন। তোমার কোনো কথাই তখন আর ও বিশ্বাস করবে না। শিশু বলে তার সাথে ছলনা করলে সে বুঝতে পারবে না বা কিছু হবে না এ’রকম কখনো ভাববে না। এভাবেই মা-বাবা-পরিজনদের কাছ থেকেই শিশুরা নিজের অজান্তে ভাল বা খারাপ সংস্কার পেয়ে পেয়েই বেড়ে ওঠে- যা তার পরবর্তী জীবনে-যাপনে ফুটে ওঠে ৷
স্বামীর কথার মমার্থ বুঝতে পেয়ে গিন্নি মনে মনে প্রতীজ্ঞা করলেন- এমন ভুল আর তিনি ভুলেও করবেন না।

এই আদর্শবাদী বিবেকবান বাবা আসলে কে জানো ? ঠাকুরদাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই ছোট্ট ছেলেটি আর কেউ নয় – স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ৷

যোগি সোসাইটি

স্পর্শিয়া আজ স্কুলে যাবে না। কাল ডিনার করতে করতে বাবা বললেন,
– আগামী দু’দিন স্কুলে যাবার দরকার নেই। আমি তাবাসসুম মিসকে জানিয়ে দেবো।

যোগি সোসাইটির শিশুরা স্কুলে ফাঁকি দেয় না, স্কুল ফাঁকিও দেয় না। ঝড় হোক, ঝঞ্ঝা হোক, হরতাল হোক, বৃষ্টি বা প্লাবন হোক স্কুল খোলা থাকলে অভিভাবকরা পৌছে দেবেনই। স্কুলের প্রতি শিশু এবং অভিভাবকদের দায়বদ্ধতা এতটাই গাঢ় যে, বিকেলে কেয়ামত হবে জানলে সকালে শিশুদের স্কুলে পৌছে দিয়ে হেডমিস্ট্রেসকে অনুরোধ করবে, “ম্যাম, আজ দুটো ক্লাশ বেশী করাবেন, প্লিজ। কেয়ামতের পর ক’দিন পড়াশোনা বন্ধ থাকবে কে জানে!”

স্কুলে যেতে না পারায় স্পর্শিয়ার মন খারাপ হওয়া উচিত কিন্তু হচ্ছেনা। ওর মন বিষন্নতায় ভরে আছে। মা অফিসে যাবার আগে ওর মাথায় হাত বুলালেন, মা’র কণ্ঠে উছলে উঠলো আদর,
– স্পর্শি, লক্ষ্মী মা আমার, তুমি এখন সিক্সথ গ্রেডে পড়ো। মানে ক্লাস সিক্স, প্রব্লেম ফিক্সড। তুমি বড় হয়ে গেছো মা, তাই না!
– হুম।
– এই তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি ওই বিষয়টা খুব ভালো করে ভাবো। তুমি যা বলবে তা’ই হবে।

স্পর্শিয়া হাসি মুখে মাথা দোলায়। মা দু’গালে চুমো খান, বাবা ওকে কোলে তুলে নিয়ে নাকে নাক ঘষে আদর করে দেন। দু’জনে একসাথে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যান। পাঁচতলার এই ১৪শ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে ওর একা থাকার অভ্যাস আছে। প্রতিদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে একাই তো থাকতে হয়। গ্যারেজ থেকে হর্নের শব্দ আসতেই স্পর্শিয়া এক দৌড়ে বারান্দায় যায়, ওদের পার্ল হোয়াইট রঙের গাড়িটা সদর গেট দিয়ে রাস্তায় বের হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা আর মা সদর দরজার সামনে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে হাত বের করে ‘বাই.. বাই’ জানায়, ও হাত নেড়ে জবাব দেয়।

বাবা আর মা দুই অফিসে চাকরী করেন। একসাথে অফিসে গেলেও মা ফিরেন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আর বাবা রাত ৮টায়। স্পর্শিয়া জানে আজ বাবাও মা’র সাথে ফিরবেন, সন্ধ্যায় নাশতা করতে করতে তার সিদ্ধান্ত শুনবেন। এরপর সবাই মিলে বাইরে কোথাও ডিনার করবেন। তাই সময় নষ্ট না করে ও ভাবতে শুরু করে। কিন্তু বহু ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, ছোট্ট মাথায় সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

ঘটনার শুরু চার দিন আগে। ওইদিন ছিলো সাপ্তাহিক ছুটি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাবা আর মা ফিসফিস করে কথা বললেন। লাঞ্চ করতে বসে মা বললেন,
– স্পর্শিয়া, তোমাকে একটা কথা বলছি, খুব মন দিয়ে শোনো।
– বলো, মামনি।
– তুমি আমাকে ভালোবাসো?
– হুমমম।
– তুমি বাবাকে ভালোবাসো?
– হুমমম।
মা বাবার দিকে তাকালেন, বাবা বললেন,
– বাবা আর মা’ও তোমাকে অন্নেক অন্নেক ভালোবাসে। কিন্তু একটা সমস্যা তৈরী হয়েছে..
– কি সমস্যা, বাবা?
– বাবা আর মা’র এডজাস্ট হচ্ছেনা। এখন থেকে বাবা আর মা আলাদা থাকবে।
– ওহ, আমিও আলাদা থাকবো! একা ফ্ল্যাটে?

স্পর্শিয়ার প্রশ্নে মা মিষ্টি হেসে বললেন,
– না, একা ফ্ল্যাটে থাকার বয়স তোমার হয়নি। তুমি ভেবে বলো মামনির সাথে থাকবে না বাবার সাথে।
– এখনই বলতে হবে?
– না, খুব ভালো করে ভেবে বলো।

ওইদিনের কথোপকথনের পর থেকেই স্পর্শিয়া ভাবছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বাবাকে তার ভালো লাগে, মামনিকে ভালো লাগে আর এই ফ্ল্যাটটাও ভালো লাগে। কাউকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ছোট হলেও ওর জানে আছে শেষ পর্যন্ত একজনকেই বেছে নিতে হবে। ওর আর ভাবতে ভালো লাগেনা, ড্রইং রুমে এসে স্মার্ট টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়।

বাবা মা বাসায় ফিরে স্পর্শিয়ার সিদ্ধান্ত শোনার জন্য তাড়াহুড়ো করেন না। ইভনিং ব্রেকফাস্ট খেতে বসে এই প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে যান। রাতে সোসাইটির মালিকানাধীন অভিজাত রেস্তরা ‘যোগিয়ান ডাইন’এ ডিনার করতে করতে বাবা জানতে চান,
– কি ভাবলে মামণি?
– আমি তোমার সাথে থাকবো।

মা জানতে চাইলেন,
– তুমি বাবার সাথে থাকবে?
– তোমার সাথেও থাকবো।

বাবার কণ্ঠে বিরক্তি,
– সেটা তো সম্ভব নয়, মামনি। বাবা বা মা’র মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে, অন্যজনের সাথে ছুটির দিনগুলোতে থাকবে। দু’জনের সাথে তো একসাথে থাকা যাবেনা।

স্পর্শিয়া দৃঢ় উত্তর,
– যাবে।
– কিভাবে?
– ম্যাজিক দিয়ে, আর ওই ম্যাজিকটা আমি জানিইইইই।

মা’র কণ্ঠে রাগ,
– ম্যাজিক বলে কিছু নেই, ম্যাজিক হলো ফাঁকিবাজী।
– মামণি, ম্যাজিক আছে। ম্যাজিকটা সহজ, তোমাকেও শিখিয়ে দিবো।

বাবা আর মা কথা বাড়ান না। স্পর্শিয়ার কথা শুনে ভাবেন কালকের দিনটা যাক, এরপর সিদ্ধান্ত নিবেন। হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু ওখানে তো যোগি সোসাইটিতে বসবাসের যোগ্য করে গড়ে তোলা হবে না। তাই বাবা বা মা- একজনকেই বেছে নিতে হবে ওর।

ম্যাজিক দেখবেন এমনটা আশা করেনি বাবা-মা, কিন্তু পরদিন স্পর্শিয়ার ম্যাজিকে পুরো যোগি সোসাইটি দুলে উঠলো। স্পর্শিয়ার টেবিলে পাওয়া গেলো চিঠি, “বাবা ও মামনি, এই যে দেখো ম্যাজিক, আমি তোমাদের দু’জনের সাথেই আছি আবার কোথাও নেই শুধু আল্লাহর কাছে আছি।” ছোট্ট ডেডবডিটা পাওয়া গেলো বাথটাবে ডুবন্ত, শ্যাম্পুর বোতলের পাশে বাবার স্লিপিং পিলের অনেকগুলো খালি মোড়ক। ম্যাজিকের সম্মোহন কাটতে বাবা-মা’র চোখ অশ্রুতে ভরে এলো।

স্পর্শিয়ার ম্যাজিকের সংবাদ বাতাসে মিশে যোগি সোসাইটির কোনায় কোনায় প্রতিধ্বনি তুললো, সেও ক্ষণিকের জন্য। শুধু যোগি সোসাইটির হর্তাকর্তারা আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন তুললেন, “সেক্যুলার যোগি সোসাইটির এক শিশুর মাথায় জঙ্গীবাদ ঢুকালো কে?” স্পর্শিয়ার মৃত্যুশোকের কান্না ভুলে হর্তাকর্তার আতঙ্ককে ঘরে ঘরে পৌছে দিলো হাওয়া। একদিনেই বাবা-মা ছাড়া অন্য সবার মন থেকে মুছে গেলো স্পর্শিয়া; যেনো স্পর্শিয়া যোগি সোসাইটির কেউ নয়, স্পর্শিয়া নামে যোগি সোসাইটিতে কেউ কখনো ছিলোই না।

.
#যোগি_সোসাইটি
*অসুস্থতার ঘোরে লেখা।

এলিয়েনের সঙ্গে এক বিকাল

287

এখন পড়ন্ত বিকাল। ছাদের বাগানে একা একা বসে আছে আকিব। সে পুরাতন ঢাকার একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসাবে তার সুখ্যাতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, আকিবের আই কিউ অনেক বেশি। ক্লাসে টিচার যখন পড়ান, তখন সে একটি শব্দ শোনার পর পরের শব্দটি বলে দিতে পারে। একটি বাক্য শোনার পর পরের বাক্যটি বলে দিতে পারে। এজন্য ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রী এবং টিচার সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। খুব পছন্দ করে। তাকে নিয়ে গৌরব বোধ করে।

সেই আকিবের কাছে আজকের বিকালটা খুবই নীরস নীরস মনে হচ্ছে। প্রাণহীন লাগছে। বাসার আশেপাশে কোনো খেলার মাঠ নেই। একটু জোরে নিশ্বাস ফেলার মতোন জায়গা নাই। এমনকি রাস্তার ফুটপাত.. তাও নাই। রাস্তার মধ্যে কেবল খানাখন্দ আছে। গাদাগাদি রিকশা, ভ্যান, অটো আছে। ফলে আকিবের মতোন অনেক কোমলমতি শিশুদের আজকাল একই অবস্থা। তার উপর আকিবের স্কুলেও মাঠ নেই। ক্যাম্পাস নেই। বিল্ডিং এর উপর বিল্ডিং। এইরকম পরিবেশ তার ভালো লাগে না। ভালো লাগার কথাও নয়। সে প্রজাপতির মতোন উড়তে চায়। মেঘের মতোন এদিক-সেদিক ঘুরতে চায়। রাজহাঁসের মতোন সাঁতার কাটতে চায়। কিন্তু কিছুই আর হয়ে উঠে না। যে বিকেলগুলো রঙিন হওয়ার কথাছিল, সেই বিকেলগুলো ছাদের বাগানে কাটছে। কাটাতে হচ্ছে।

এমনি মানসিক অবস্থায় আকিব কী মনে করে আকাশের দিকে তাকাল। সাথে সাথে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তার ঠিক মাথার উপরে একটি উড়ন্ত সসার। দ্রুতবেগে তার দিকেই নেমে আসছে। আকিবের শরীরের সমস্ত লোম এক মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে গেল। তার ভাবনার চেয়ে কম সময়ে উড়ন্ত সসারটি একেবারে তার ছাদের ঠিক উপরে চলে এলো। চোখের পলক পড়ার আগেই সসারটি থেকে একজন এলিয়েন বেরিয়ে আসলো।

ভুতপ্রেতের মতোন এতো বিশাল আকারের নয়। আকিবের সমবয়সী হতে পারে। এলিয়েনটি সোজা আকিবের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আকিবও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ালো। করমর্দন করতে করতে এলিয়েনটি বলল, হাই… আকিব, আমি ইকুচু। নেপচুন থেকে এসেছি। তুমি কেমন আছ?
আকিব বলল, আমি খুব ভালো আছি।

ইকুচু বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তুমি মোটেই ভালো নেই। তোমার মন খুউব খারাপ। একা একা ছাদের বাগানে সময় কাটাতে তোমার ভালো লাগে না। আমি নেপচুন থেকে তোমার উপর দৃষ্টি রাখছিলাম। কারণ তুমি আমাদের গ্রহের বিজ্ঞানীদের পছন্দের তালিকায় আছো। তোমার আই কিউ অত্যন্ত বেশি। আচ্ছা আকিব, তোমাদের পৃথিবীতে কি মিথ্যা বলার ট্রেনিং সেন্টার আছে?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শোনে আকিব খুব বিস্মিত হল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে জানাল, নেই।
তাহলে তোমরা এতো সুন্দর করে ইনিয়েবিনিয়ে কীভাবে মিথ্যা বল? তোমরা কি জান না, মিথ্যা বলা মহাপাপ?
আকিব বলল, সব মানুষই এটা জানে। তবুও তারা মিথ্যা বলে। কারণ মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমিও এটা পছন্দ করি না। তবুও মাঝে মাঝে বলি। বলতে হয়।
ইকুচু বলল, মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি… এটিও একটি বড় মিথ্যা আকিব। যাক আসল কথা বলি, আমি একটি মিশনে এসেছি। তোমাকে আমাদের নেপচুন গ্রহে নিয়ে যাওয়ার মিশন। তুমি কি স্বেচ্ছায় যাবে নাকি জোর করে নিয়ে যেতে হবে?

আকিব এবার মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু মুখের মানচিত্রে ভয়-ডর কিছুই প্রকাশ করল না। বুদ্ধি খাটাতে লাগলো। হঠাৎ তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠল। আকিবকে কিছু নির্দেশনা দিলো। সে মোতাবেক আকিব বলল, তোমাদের গ্রহে তো মিথ্যার কোনো স্থান নেই। কিন্তু আমি এখনো মিথ্যা মুক্ত হতে পারিনি। তবে আমি চেষ্টা করছি। যদি আমি সে চেষ্টায় সফল হতে পারি, তাহলে আমার নেপচুন যেতে আপত্তি নেই।

এমন সময় ইকুচুর স্যুটের ভেতর ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হল। আকিবও সেই আওয়াজ শুনতে পেল, কিন্তু কিছুই বোঝে উঠতে পারল না। ইকুচু বলল, হাইকমান্ড নির্দেশ দিয়েছে, তুমি এবার সঠিক বলেছ। আমরা তোমার মিথ্যা মুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব। আমার হাতে আর সময় নেই। বাই আকিব…. বাই…

আকিবের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। তবুও ইকুচু’র দিকে হাত নেড়ে জানালো, বাই ইকুচু… বাই।।

পৃথিবীতে সবাই সাধু

images123

বেশ কিছু রহস্যের গল্প পড়ে
এক সময় নিজেকে গোয়েন্দা ভাবতে শুরু করলাম,
ভাববোই না বা কেন
যেথায় যাই যেখানেই বসি একই কথা –
ভাই আজ চরম শ্বাসরুদ্ধকর একটা গল্প শুনাতে হবে,
কাল অমুকের বাড়িতে অবাক এক কাণ্ড ঘটেছে
চলো না যদি রহস্যের কিনারা করতে পারো!
আর আমার বন্ধু মাজু
ওর নাকি দিনে অন্তত দু’টো গল্প না শুনলে ভাতই হজম হয় না পেটের।
এমনি ভাবেই সকলের খাতির যত্নে দিনগুলি গত হচ্ছিল বেশ।

শীতের এক বিকেলে –
মাজুর আব্বা ডেকে বললেন
দ্যাখো তো বাবা আমার একটা উপকার করতে পারে কি-না!
মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললাম –
আপনার উপকারে লাগতে পারলে নিজেকে তো ধন্য মনে করতাম চাচাজান
কি করতে হবে তাই বলুন!
তিনি বললেন –
বেশ কিছু দিন থেকে নিয়মিত খেজুর গাছের রস পাচ্ছি না
মজার ব্যপার হলো – গাছে হাড়ি লাগানোই থাকে অথচ রস থাকে না
মানুষ খায়, না-কি সাপ বা বাদুর খায়
তাও ঠিক মতো বুঝা যায় না
তুমি যদি বাবা একটু খতিয়ে দেখতে !

বললাম –
বলেন কি চাচাজান!
প্রত্যেক দিন খোয়া যায়?
এমন তো হবার কথা নয়!
বলেই মাজুর চোখ রাঙানিতে থেমে গেলাম
বুঝলাম বিশাল একটা বোকামি করে ফেলেছি
গাছের রস যে ২/৩ দিন অন্তর অন্তর আমরাই খাই
সে কথা স্বীকার করে নিয়েছি অকপটে
যদিও চাচাজান ধরতে পারেন নি।
কথা না বাড়িয়ে তাই বললাম –
চিন্তা করবেন না চাচাজান
নিশ্চয় একটা বিহিত করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ!
ভাবতে লাগলাম ঘটনাটা কি!
চাচাজান বলছেন প্রত্যেক দিন রস থাকে না
অথচ আমরা খাই —-
তাহলে কি ——

পূর্ণ শশী জ্যোৎস্না ঢেলে অকাতরে সাজায়ে চলেছে
নিদ্রাহারা ধরণীর বুক,
বেশ ঝকমকে একটা রজনী!
আমরা চলেছি গোপনে পুকুর পাড়ে রহস্যের সন্ধানে।
কিছু দূর থাকতেই হঠাৎ মনে হলো গাছে কি যেন নড়ছে
সাপ বা বাদুর নয়, নিশ্চয় মানুষই হবে!
টান টান উত্তেজনায় ঘেমে উঠলো শরীর
ফিস ফিস করে মাজুকে বললাম –
ভয় করিস নে, পিছু পিছু আয়!
গাছের গোড়ায় না পৌঁছতেই লোকটি অস্তিত্ব অনুভব করে ফেললো আমাদের
হয়তো বা বুঝেও ফেললো একটা অঘটন ঘটতে চলেছে আজ
আর তাই নাগালের বাহিরে থেকেই আওয়াজ দিলো
’আমি সাজু, খবরদার আঘাত করবি নে কেউ!’
তারপর নীচে নেমে আমাদেরকে চিনতে পেরেই ধমক দিয়ে বলে উঠলো –
আমি তো গাছে উঠেছি কেউ রস চুরি করেছে কি-না দেখার জন্য,
কিন্তু তোরা এখানে কি করছিস?

সাজু মাজুর আপন বড় ভাই
কথা বলতে পারলাম না
তার হাতে এক মাথায় কাপড় প্যাঁচানো একটা নল দেখে মনে মনে শুধু বললাম –
’পৃথিবীতে সবাই সাধু
কেউ প্রকৃত কেউ ভেজাইল্যা আর কেউ ছদ্মবেশী!’

জ্বীনের খিটমিটে হাসি

124

এক সময় ষষ্ঠ শ্রেণীর উপরে অধ্যয়ণরত প্রতিটি ছাত্রেরই
লজিং অথবা বোডিং -এ থেকে লেখাপড়া করার সুবাদে
নিজেস্ব ট্রাঙ্ক থাকতো।
তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র।
তাই —

ক’দিন থেকেই চলতে ফিরতে মনে হচ্ছিল
সব সময় কে যেন আমাকে ফলো করে।
কখনো ডানে কখনো বামে আবার কখনো পিছে ধুপধাপ শব্দ,
ফিরে তাকালে কিছুই নেই
যেন নিজের স্যান্ডেলই গোপনে চটকা মেরেছে,
তবুও ভিতরে ভিতরে একটা জমিদারী ভাব তৈরী হতে লাগলো
কারণ এহেন কর্ম নাকি জ্বীনেরা করে,
শুনেছি একবার যদি জ্বীন কারো বশীভূত হয় তো লালে লাল শাহজালাল,
সুতরাং বুঝতেই পারছেন!

এরই মাঝে অবাক করা এক ঘটনা ঘটলো –
চিঠি রাখবো বলে সেদিন তালা খুলে দেখি
আমার ট্রাঙ্কের কোণায় বেশ কিছু ঝকঝকে পয়সা,
সিকি আধুলী মিলিয়ে সারে নয় টাকার মতো।
তখন টাকার যথেষ্ট মূল্য ছিল –
একটা আধুলীতেই পাওয়া যেতো পূরো এক ছটাক ভাজা ছোলা।
বুঝলাম নিশ্চয় ওই জ্বীনের কান্ড
কাউকে বলা যাবে না,
প্রকাশ করলে নাকি ওরা কোনদিন আর কাছে আসে না
তাই গম্ভীর হয়ে ঘুরি আর ছোলা কিনে দেদারসে আড়ালে একা খাই।
এক বন্ধু থাকতো আমার কাছে
ওকেও ব্যপারটা বুঝতে দিতাম না।

কয়েক দিনে পরে –
সাঁঝের কুপি জ্বেলে দু-বন্ধু পড়তে বসেছি,
এক ফাঁকে হঠাৎ-ই ও’ বললো –
’জানিস তোর ট্রাঙ্কে তালা মারা থাকলেও চাইলে ডালা জাগিয়ে
অনায়াসে কোণায় কিছু রাখা যায়
কিন্তু বের করা যায় না!’
শুনা মাত্রই স্তব্ধ হয়ে গেলাম
মুহুর্তেই হারিয়ে গেলো সেই জমিদারী ভাব,
ঘোরালো এক চিন্তা ছটফট করতে লাগলো মাথায়।
ওর ট্রাঙ্ক ছিলো না
বোকামিটা বুঝলাম যখন
ততক্ষণে ভেসে এসেছে কানে ফোকলা দাঁত অ’লা এক জ্বীনের
বিদ্রুপাত্নক খিটমিটে হাসি।

অনিমেষ

অনিমেষ পাল নৌকার মাস্তুলে পাল খাটাবার কাজ করে, তার কাজ এটুকুই। এর পর ছইয়ের ভিতর ঘুম। অনিমেষ যদি ঘুম জমাত; তাহলে ব্যাংকের কোন ভোল্টে জায়গা হত না। ইদানীং অনিমেষ ঘুমোতে পারছে না, ঘন্টার পর ঘন্টা অসল বসে থাকছে। দুই চোখ বুজে দেখেছে কিন্তু ঘুম আসছে না। সেই মধুর দৃশ্য বারবার ভেসে উঠছে।

রবিন পোদ্দার মাঝি; নৌকার বস কী কুক্ষণে গত সপ্তাহে তার বাড়ি যাওয়া হয়েছিল। এই যাওয়াই কাল হলো। রবিনের স্ত্রী মালতী নিচু হয়ে তার পাতে ভাত বেড়ে দিয়েছিল, মালতীর গোপন অঙ্গের কিছু অংশ সে দেখে ফেলেছিল।

এই দেখানো ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছায় এই দ্বন্দ্ব তার কাটছে না। তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কোনভাবেই এই দৃশ্য তাড়াতে পারছে না। উনিশ বছরের অনিমেষ বড় কষ্টে আছে, কষ্ট কথা কাউকে বলতে পারছে না।

রবিন পোদ্দারের বাড়ি পুনরায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা কিন্তু সেটাও হয়ে উঠছে না।

অনিমেষ বাতাসের গতি বুঝে পাল খাটায় কিন্তু নারীর মনের গতি বোঝা তার সাধ্যের বাইরে।

অতঃপর উনি পকেটে রাখলেন … চেয়ে থাকলাম

3009h রাস্তার পাশে জমিনটায় সবুজ ধান গাছ, বাতাসে হেলেদুলে লুটিয়ে পড়ছে। আমার লাগানো কৃষ্ণচূড়ার গাছটা ফুল ফুটে লাল রক্তিম হয়ে আছে। বাতাস এবং বৃষ্টির ঝাপটায় কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি কিছু রাস্তায়, কিছু ধান ক্ষেতে পড়ে আছে। বৃষ্টিতে ভেজা গন্ধ বিহীন কৃষ্ণচূড়ার কচি কচি পাপড়ি পড়ে রাস্তায় যেনো শহুরে রমণীর গাঢ় লাল রংয়ের লিপষ্টিকের ঠোঁটের আকার ধারণ করেছে।

শিমুল, পলাশ কিংবা কৃষ্ণচূড়ার সময়কাল আমাকে করে পাগলপ্রায়। কতোদিন ভেবেছি শুভ্র-শ্বেত আকাশের নিচে কৃষ্ণচূড়ার মৌসুমে তোমার হাত ধরে দাঁড়াবো। তোমার কালো কালো কেশে ঝরে পড়বে পাপড়ি ঠোঁটে থাকবে গাঢ় লাল লিপষ্টিক। আলতো করে হাত ধরে হেঁটে যাব বাঞ্ছারাম পুকুর, পাড় হতে সেই নামহীন স্বর্গে।

চিকন সরু কাঁদা মাটির রাস্তা। দুই পাশে লম্বা লম্বা দূর্বা ঘাস, মাঝখানে সাদা মিহি বালু। রাস্তার পশ্চিম পাশে নানাজাতের গাছের মাঝে কৃষ্ণচূড়া গাছ তারপর ফসলের জমি। পূর্ব পাশে কচুরি পেনায় ভরপুর বাঞ্ছারাম পুকুর। পেনায় জড়িয়ে লক লক করা কলমি শাক, পুকুর পাড়ে বসত করা লেদু মিয়া রান্না করে খায়। পুষ্টহীন ষাট বছরের লেদু মিয়াকে দেখলে মনে হয়, কলমি শাক খেয়েই কোনো রকম বেঁচে আছে। দরিদ্রতার প্যাচে পড়ে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য কারো কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই এই প্রাণপণ লড়াই। তারপরও দেখা হলে হেসে উঠে জানতে চায় “কেমন আছো বাবা”। আমিও হাসি মুখ করে উত্তর দিই “স্বর্গে আছি” চাচা। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সংসারের অভাব -অনটন তুলে ধরে। দীর্ঘশ্বাস আরো বড় হয় যখন বলে পুত্র সন্তান না থাকায় সংসারের হাল ধরার কোন মানুষ নাই। তারপরও আগে জিনিস সস্তা ছিলো ডাল ডিমে চলে যেতো দিন আর এখন সব।

আওয়াজ শুনে আমার ঘুম ঘুম ভাব ও স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। সন্ধ্যা ৬-১৫ মিনিটের বাস যাত্রীদের আসন গ্রহণ করার জন্য কতৃপক্ষের অনুরোধ। প্রচণ্ড গরমেও বিশ্রামগারে চেয়ারে বসতেই তন্দ্রাচ্ছন্নভাব গ্রাস করে আমাকে। আজ কয়েকদিন হাসপাতালে ইদুর বিড়াল দৌড়ে ক্লান্ত শরীর, তাই আর রাজধানীতে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ডাক্তার দেখানো শেষ হলেই দৌড় দিলাম বাস ধরতে। পকেট হতে মোবাইল বাহির করে দেখি ছয়টার কাছাকাছি, আর আমার বাস ছাড়ার সময় ৬-১৫ মিনিট। অনেক আগে একবার “দেশ বাংলা ট্রাভেল” করে ঢাকা হতে বাড়ি গিয়ে ছিলাম, খুব আরামদায়ক ও নিরাপদ মনে হয়েছে। তাই এইবার আবারও “দেশ বাংলা ট্রাভেল”-এ ভ্রমণে মনস্থির করি। টিকেট হাতে নিয়ে ধাক্কা খাই বাস ভাড়া বৃদ্ধি করেছে শুনে কারণ তেলবাজ এই দেশেও তেলের দাম বেশী।

ব্যাগটা চেয়ারে রেখে বেসিনে যাওয়ার জন্য রওনা হই মুখটায় পানির ঝাপটা দিতে। পরিচ্ছন্ন টয়লেট এবং বেসিন আমাকে অনেকটা স্বস্তি দিলো। টয়লেট হতে বাহির হয়ে দেখি গায়ে একটা বিশেষ বাহিনীর পোষাক পরা মুখের দাড়ি ও মাথার চুলে লাল মেহেদি করা প্রায় পঞ্চাশ বছরের এক লোক টাকা গণনা করতেছে। একটাই বেসিন ওটার সামনে ওনি দাঁড়ানো হাতে নতুন পুরাতন পঞ্চাশ /শত টাকার নোট কচ কচ করে গণনা করছে এবং ভাঁজ করছে। ভাবলেশহীন উনি আমি দেখেও না দেখার ভান করে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হচ্ছে না আমার মুখ ধোঁয়া। রোদে পুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই লোকটা অন্যের ডিম ডাল খাওয়ার টাকা আইনের দোহাই দিয়ে ছিনতাই করে দিন শেষে এই বাস কাউন্টারে হিসাব করে পকেটে নিচ্ছে নিজের উদর পূর্তি করতে। কার হবে এইসব টাকা রিক্সা, অটো রিক্সা, বাস, ট্রাক চালকের নাকি রাস্তার কোনো ফেরিওয়ালার। ভাবতে ভাবতে বাসে উঠে আসন গ্রহণ করি, হেডফোন কানে দিয়ে পাতলা কম্বল জড়িয়ে গান ছেড়ে দিই “এমন দেশটি পাবে…”।

গোশত

– ঘটনাটা অইলো কালামের, মানে টেকপাড়ার ফোচু কালামের। গ্যাদাকালে বারো মাস ওর নাক দিয়া সর্দি গড়াইতো, হালায় ফোচ ফোচ কইরা নাক টানতো, নাম অয়া গেলো ফোচু কালাম।

আকবর চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্তির সুরে বলেন,
– ত্যানা প্যাচাও কেলা! ঘটনা কও, মিয়া।
– ফোচুর তো পড়ালেখা অয় নাই। ক্লাস ফাইবে ইনবারসিটি পাস দিয়া কিছুদিন কামকুম করছে। পরে ঢুইকা গেছে ল্যাংড়া মিজানের পাট্টিতে।
– ও। মাগর কলাইম্যার বাপ বহুত ভালা আদমী আছিলো, টাকা আছিলো না হালার কলিজা আছিলো শরীল ভরা। পেটের ভুড়ি ভরা মহব্বত।

রমিজ মাথা দোলায়। আকবর চাচার সামনে আনন্দ বেকারির কাচ্চা বিস্কুটের প্লেট ও চা এগিয়ে দেয়,
– হ, চাচা। আমরা দুপুইর‍্যা রোইদে গাবাইলেও বকতো না।
– কালাইম্যার কথা জানি কি কইতা ছিলা!
– ল্যাংড়া মিজানরে ক্রস ফায়ার দেওনের পর বহুত দিন কালামে ভাগলপুর আছিলো।
– ভাগলপুরে ওর কে থাকে?
– চাচা, ভাগলপুর মানে ভাইগ্যা গেছিলো। পরে ফিরা নিজে ছিনতাই পাট্টি খুলছে।

আকবর চাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আগের মত পঞ্চায়েতের রমরমা থাকলে কালামকে জুতিয়ে সোজা করে ফেলতেন। কিন্তু ওই দিন আর নাই, মুরুব্বীদের শাসন কেউ মানেনা। রমিজ বলতে শুরু করে,
– পনরো বিশ দিন আগে, ওই যে টানা বিষ্টি অইলো, তহন কালামে একটা বড় দাও মারছে।
– বড় দাও মানে?
– ওইদিন বিষ্টির লেগা দোকানপাট আগে আগে বন্ধ অয়া গেছে। রাস্তায় ভিড় নাইক্কা। রাইত দশটায় রাস্তা ফাক্কা।
– তো?
– কালামে একটা রিকশা আটকাইছে। রিকশায় এক বুড়া কই জানি যাইতাছিলো। বুইড়ার পকেটে হাত দিয়া দেখে বহুত টাকা। কালামে টাকা লয়া টানাটানি করনের সময় বুড়ার গলায় চাক্কু দিয়া দিছে পাড়, বুইড়া মাথা কাটা মুরগির মতন ছটফটায়া স্পট ডেড। রিকশাওলা লাশ ফালায়া রিকশা লিয়া দিছে লৌড়।

আকবর চাচা যেনো বিশ্বাস করতে পারছেন না,
– কও কি ভাতিজা!
– হ, চাচা। পুলিশ ঘটনা লিয়া ঘাটায় নাইক্কা। ওইদিকে কালামও বউ লয়া আন্ডার গাউনে গেছে গা। মাগর, ওর অইছে আজীব ব্যারাম। ওর বউ আয়া সাবেত কবিরাজের কাছে বহুত কান্নাকাটি করছে।
– কুন সাবেত! ওই যে জ্বীন পালে!
– হ, চাচা।
– সাবেত হালারে পালে কে, আবার ওই পালবো জ্বীন! ভাতিজা, কালামের ব্যারামটা কি!

রমিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে কামড় দিয়ে বলে,
– ঘটনার শুরু ছিনতাইয়ের রাইত থেকা। কালামের ঘরে খাওন আছিলো না। ওর ৬বছরের মাইয়াটা গরুর গোশতের ভুনা দিয়া পারোটা খাইবার চাইছিলো। বুইড়ার কাছ থেকা ছিনতাই করা দুইটা ৫শ টাকার বান্ডিল লিয়া বাজারে গিয়া জুম্মনের কাছ থেকে রান আর সিনা মিলায়া গোশত কিনছে। ময়দা আর তেল লিয়া বাড়িতে ফিরছে।

আকবর চাচা বিরক্তি গোপন না করেই বলেন,
– দূর হালায়! তুমি আবার ত্যানা প্যাছাইতাছো কেলা! তোমগো চোদ্দ গুষ্টিতে তো কেউ ত্যানার ব্যবসা করে নাই, তুমি এই অভ্যাস পাইলা কই।

রমিজ কিছুটা বিব্রত হয়, কাঁচুমাচু স্বরে বলে,
– ওর বউ গোশত ভুনা আর পারোটা বানাইছে। পরোটা দিয়া গোশতের টুকরা চাইপ্যা ধইরা মুখে দিয়া চাবাইতে চাবাইতে আৎকা কালামে কয়, “থু: থু: থু: তরে আইন্যা দিলাম গরুর গোশত, তুই বুইড়া মাইনষের গোশত রানলি ক্যান!” বউ তো ভ্যাবাচ্যাকা খায়া গেছে, “বুইড়া মাইনষের গোশত পাইলি কই?” কয়া বউরে দিছে মাইর। বমি কইরা ঘরবাড়ি ভাসায়া দিছে।
– তারপর?
– কালাম অহনে গোশত ছাড়া কিছু খাইবার পারেনা। ওর বউ মুরগি, গরু, খাসি যেইটার গোশত রান্ধে কালাম মুখে দিয়া বমি কইরা দেয়, ওর কাছে সব গোশতই বুইড়া মাইনষের গোশত লাগে।

আকবর চাচা উদাস হয়ে বসে থাকেন, এরপর খুব জোড় দিয়ে বলেন,
– ভাতিজা, ওই রাইতে তুমিও তো কালামের লগে আছিলা। কি আছিলা না!

রমিজ হকচকিয়ে ওঠে। মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্কুটে কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে আকবর চাচার চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে বলে “না”। আকবর চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিদায় নেন, আর তখনই রমিজের মনে হতে শুরু করে ও বিস্কুট চিবুচ্ছে না, চিবুচ্ছে বুড়ো মানুষের মাংস- নোনতা, শক্ত, স্বাদহীন মাংসের রোয়াগুলো আটকে যাচ্ছে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে।

গল্পঃ নায়িকা সংবাদ

images

আমরা একে অপরকে যে ভালোবাসি একথা বলি নি কখনও আসলে তেমনভাবে বলার সুযোগ হয় নি আর কি। তবে আমি আর মিহির আমরা পরস্পর খুব ভালো বন্ধু ছিলাম এ ব্যপারে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।আমাদের সম্পর্কটা সেই ছোটবেলা থেকেই।

ওর সাথে, আমি আমার ছোট ছোট দুঃখ কষ্টগুলো খুব সহজে ভাগ করে নিতে পারতাম। গল্প করতে করতে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব কথা বলতে বলতে আমরা কপোতাক্ষকে সাক্ষী রেখে বহু দূর হেঁটে যেতাম। বহুদূর।

শেষ বিকেল গড়িয়ে যখন বকেরা ঝাঁক বেধে নীড়ে ফিরতো তখন আমরাও ফিরতি পথ ধরতাম। ও বরাবরই বেশ মনোযোগী শ্রোতা আর ভীষণ যত্নশীল ছিল আমার প্রতি। মিহিরের মা’ও ছিলেন খুব বেশি রকমের ভালো মনের মানুষ। আমার দুঃখ কষ্টগুলো তিনি খুব সহজে পড়তে পারতেন, আমাকে অনুভব করতেন অন্তর দিয়ে। তিনি আমাকে একনজর দেখে সবটা বুঝে নিতেন মুহুর্তেই, আমার হাসি আমার আনন্দ আমার কান্না। আমার অভুক্ত শুকনো মুখ দেখে কপট রাগ দেখিয়ে আমার উদর পুর্তির ব্যবস্থা করতেন। আমার কোন আপত্তি তখন ধোপে টিকতো না। তারপর কি জানি কি হলো খালাম্মা হঠাৎ করে অসুস্থ হলেন।

সামান্য উপসর্গ যে ক্যান্সারে রুপ নেবে তা কে ই বা জানতো? ক্যান্সার ধরা পড়ার অল্প কদিন পরে তেমন একটা চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই হুট করে তিনি চির বিদায় নিলেন। ঘটনা আকষ্মিকতায় মিহির কেমন যেন হকচকিয়ে গেল।এত চটপটে আর মেধাবী একটা ছেলের মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখা দিলো। ওর এই অসহায়ত্ব ওকে আরও বেশি আমার কাছাকাছি নিয়ে এলো। দিন দিন আমার প্রতি ওর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকলো। আমিও ঋণ শোধ করার সুযোগ পেয়ে সাধ্য মত ওর পাশে থাকার চেষ্টা করলাম। এদিকে ওর বাবাও চাইতো আমি ওদের বাড়ি যাই। ওকে সংগ দেই স্বান্তনা দেই পাশে থাকি। এসব নিয়ে পাড়া প্রতিবেশি যখন আমার মাকে নানা রসালো কথা শোনাতে শুরু করলো তখন এক প্রকার বাধ্য হয়ে মা ওদের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ করে দিতে বললো।

কিন্তু আমি তবুও লুকিয়ে চুরিয়ে মিহিরদের বাসায় যাই ওদের খোঁজ খবর নেই। টুকটাক রান্না বান্না করে দিয়ে আসি সময় সুযোগ মত।
একদিন মিহির কি কাজে যেন শহরের বাইরে গেল তখন ওর বাবার ব্যবহারে ভীষণ আহত হলাম আমি। মানুষ এত জানোয়ার হয় কি করে? এই ব্যপারটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি বাঁধা দিয়ে ছিলাম সর্বশক্তি দিয়ে কিন্তু অসুরের কাছে আমি পরাস্ত হলাম। আসলে আত্মরক্ষার কৌশল আমার জানা ছিল না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আধাঘন্টা ধরে পাশবিক যন্ত্রণা সইলাম।

মানুষকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে কিছু মানুষ নোংরা সুখ পায়। আসলে এ ধরনের মানুষের মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু থাকে না।

আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে
যখন আমার বাবা মারা গেল খুব ছোট তখন। আমি অত কিছু না বুঝলেও ক’দিনের মধ্যে এটুকু বুঝলাম আমাদের অবস্থান টলে গেছে বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে। আমার নানুরা আমার মাকে আবার বিয়ে দিলো কয়েক মাসের মাথায়। পরিবারটি যৌথ পরিবার ছিল।

বছর পাঁচেক পরের কথা এক ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমি আমার কৌমার্য হারালাম আমারই সৎ বাবার ছোট ভায়ের কাছে। এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে এলেই সে সুযোগ নিতো, আমি ভয়ে লজ্জায় ঘৃণায় কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। তাছাড়া আমি তখন নিজের সম্মান দুটো ভাত আর সামাজিক নিরাপত্তার খাতিরে সব যন্ত্রণা সহ্য করতাম। অনেক পরে জানতে পারি….. থাক সে কথা আর না বলি। অবশেষে শয়তানটার রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর আমি ওর হাত থেকে বাঁচলাম।

মাকে একদিন বলতে শুনেছি হারামজাদা মরছে ভালো হইছে। কিন্তু আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল আমার জীবনে। অসহায় মেয়েদের কত কত বার যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়। তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।

সেদিনের পর আমি আর মিহিরদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। নিজেকে কুৎসিত জীব মনে হতে লাগলো। মনে হলো নিজের রূপ নিজেই পুড়িয়ে ছারখার করে দেই কিন্তু মিহির কষ্ট পাবে এই কথা ভেবে আমি পিছিয়ে এলাম। মা মনে হয় কিছু আঁচ করেছিলো সে হঠাৎ গলায় ফাঁস দিলো। মা কি আমার জন্য গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে কিন্তু পরে বুঝলাম ঘটনা অন্য ছিল। আমার বাবার মৃত সৎ ভাইয়ের মোবাইলে আমার নানারকম ভিডিও চিত্র তার মৃত্যুর কারণ। লোকে তখন আমায় বলতে লাগলো হারামজাদি তোর মরণ হয় না কেন? মরতে পারিস না। মৃত্যু না এলে আমি কি করে মরবো? আমি আত্মহত্যা করার মত মেয়ে নই। এদিকে আমার সৎ বাবা আমার মৃত মায়ের চল্লিশার আগেই নতুন একটি কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললো।

(২)
তমালদা আমায় খুব ভালোবাসার কথা বলতো, সুযোগ পেলেই ঘ্যান ঘ্যান। আমি সংগত কারণেই তাকে পাত্তা দিতাম না। এদিকে মিহির বাড়ি না যাওয়াতে মিহির আমার খোঁজে বাড়ি আসতে লাগলো। আমি ওকে লোক মারফত নানা বাহানায় ফিরিয়ে দিতে লাগলাম কিন্তু কত দিন? আমি আসলে মিহিরকে এই পাপ মুখ দেখাতে চাইছিলাম না। তাছাড়া আমার মা ছাড়া আমি এ বাড়িতে অবাঞ্ছিত। আমি আর পারছিলাম না। “মেয়ে মানুষের রূপ তার, সব চেয়ে বড় শত্রু” মা বলতো।

আমি এক ঝড় জলের রাতে তমালদার সাথে পালিয়ে গেলাম। তমালদা আমাকে কিছু দিন বিয়ের নামে ভোগদখল করে বর্ডার পার করে দিলো। যখন আমার জ্ঞান হলো আমি বুঝলাম আমার আর এ জনমে মুক্তি নেই আটকে গেছি বিশাল ফাঁদে কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ছিল বুঝি অন্য। এরপর….

(৩)
নতুন ছবির প্রচারে জেলা শহরে এসেছি ছবিটির নায়ক, পরিচালক আর আমি। ইদানীং আমার ভীষণ জনপ্রিয়তা। গত কয়েকবছর টপ নায়িকার ইঁদুর দৌড়ে আমিই সেরা। এ জীবনে যত অবহেলা পেয়েছি তা যেন সব পুষিয়ে নেবার সময় এখন। এত ভালোবাসা কোথায় ছিল মানুষের? আসল নাকি সত্যি সে বিবেচনায়, না আনি। নগদ গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের পরিচয়। মাঝে মাঝে ভাবি আর হাসি।
গাড়ি তে চড়ার মুহুর্তে ছোটখাটো ভীড় ঠেলে সানগ্লাস পরা এক মধ্যবয়সী যুবক এলো তার মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি নাকি আমার ভীষণ ভক্ত। অটোগ্রাফ নিতে চায়।
আমি মেয়েটিকে বললাম
– কি নাম তোমার?
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল
– অঞ্জলি। আগে অবশ্য অন্য নাম ছিল।কিন্তু বাবা বদলে দিয়ে তোমার নামে নাম রেখেছে। তুমি কিন্তু বাবার ফেভারিট।
– বাহ!

আমি বাড়িয়ে ধরা খাতাটিতে অটোগ্রাফ দিলাম। দ্রুত ভীড় বাড়ছে খাতা ফেরত দিতে গিয়ে মধ্যবয়সী যুবকটির হাতে হাত স্পর্শ হতে বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার শরীরে। এত চেনা স্পর্শ! আমি সানগ্লাস পরা যুবকটির চোখে চোখ রাখতেই অবাক হলাম আরে এতো. …..আমি মিহিরকে চিনতে পারলাম মুহুর্তেই। এ ক’বছরে অনেক বদলে গেছে সে মোটাসোটা থলথলে ভুড়িতে তাকে চিনতে যে কারও কষ্ট হবে। আচ্ছা মিহির কি আমাকে চিনে?
ভীড় বাড়ছে ক্রমশ। আমার সেক্রেটারী নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকে ঠেলে গাড়িতে তুলে দিলো।

ভীড়ের চাপে মিহির দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। বুকে আমার অন্য রকম ব্যথা। আমি ডাকতে চাইলাম কিন্তু লোক সমাগমে বাড়তেই জনঅরণ্যে আমি আরেকবার মিহিরকে হারিয়ে ফেললাম। মিহিরকে বলা হলো না শুধু তার কাছাকাছি আসার জন্য আমার এই সংগ্রাম। শত কলঙ্ক মান অপমান সয়ে আমার এই ফিরে আসা। মিহির আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।

– ম্যাডাম। ইউনিভার্স মাল্টিমিডিয়া থেকে কল করেছে। আগামীকাল ওরা ছবির চুক্তিটা করে নিতে চায়। সামনের মাসের প্রথম দিকে মহরত।
– সুজানা তুমি ওদের বলে দাও আমি আপাতত আর কোন ছবি করতে চাই না।
– কেন ম্যাম! এই ছবিটা আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হবে আমি শিওর। বড় প্রডাকশন, গল্প ভালো,টানটান চিত্রনাট্য। ব্যানারটাও তো ভালো।
– আমি আসলে একটু একা থাকতে চাই। তুমি একটা ভালো দেখে রিসোর্টের খোঁজ নাও। যেখানে কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না এমন জায়গা। এত লোকের ভীড় আমার আর ভালো লাগছে না।

“কত যে কথা ছিল
কত যে ছিল গান
কত যে বেদনার না বলা অভিমান।
তোমায় ভেবে ভেবে আকাশ হলো সারা।…….”
লতা মঙ্গেশকরের এই গানটি সম্ভবত আমার কথা ভেবে লেখা। আজকাল আর কাঁদতে পারি না। কান্না সব শুকিয়ে গেছে কবে যেন। মাঝে মাঝে বিধাতাকে বলতে ইচ্ছে হয়। প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছে হয় –
– কি ক্ষতি হতো আমাকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন দিলে? আমি তো এজীবন চাই নি। আমি চেয়েছি মিহির হাতে হাত রেখে লক্ষ কোটি দিন কাটাতে। মিহির ভালোবাসায় হারাতে। আর কিছু নয় ব্যস এটুকুই। এই চাওয়া কি খুব বেশি ছিল?

© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক।

তেঁতুলগাছের ভুত

2880 উজাড় বাড়ি আসলে উজাড় নয়। একটা সময় গভীর জংগলে ছাওয়া ছিল। এই বাড়ির নাম শোনামাত্রই এখনও মানুষের গা ছমছম করে। যদিও আগের মতোন ঝোপ-ঝাড় এখন আর নেই। তবে এখনো যে পরিমাণ গাছগাছালি আছে, তাও একেবারে কম নয়। বিশেষ করে নাম না জানা কয়েকটি বড় বড় গাছ। এদের ডালপালাগুলোও এতো বিশাল যে, মাঝারি আকারের গাছের চেয়ে বড়। এখনো এই উজাড় বাড়িতে এমন কয়েকটি জায়গা আছে, যেখানে সূর্যের আলো-কেও অনেক কষ্ট করে প্রবেশ করতে হয়। সেই উজাড় বাড়ির উত্তর পাশে একটি তেঁতুলগাছ আছে। ইয়া বড়সড়। সেই তেঁতুলগাছের তলায় একটা ধানী জমি। সেই জমিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন ডাকসই খেলে। মাগরিবের আজান হলেই যে যার বাড়িতে ফিরে যায়।

প্রতিদিনের মতোন আজও সবাই সেখানে খেলাধুলা করছে। তাদের আনন্দের যেন আর সীমা নাই। কখন যে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে কেউ খেয়াল করেনি। এমন সময় তেঁতুলগাছের ভেতর থেকে একটি আচানক আওয়াজ বেরিয়ে এলো। আর সেই আওয়াজটা হল, তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…! এই ভয়ংকর কথা গুলো সবার আগে যার কানে ঢুকল, তার নাম ঐশী। ঐশী তখন চিৎকার করে বলল, সবাই খেলা বন্ধ কর। আমি তেতুলগাছের ভেতর একটি ভয়ানক আওয়াজ শুনেছি। সাথে সাথে সবাই খেলা বন্ধ করে ঐশীকে ঘিরে ধরে বলল, তুমি কি শুনেছ.. তাড়াতাড়ি বল। আমাদের আর তর সইছে না। এমন সময় আরো জোরসে সেই আওয়াজটি আবার স্পষ্ট শোনা গেলো।

তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…!

ইউশা বলল, এটা নিশ্চয়ই ভুতের গলার আওয়াজ। আমি ইউটিউবে ভুতের গল্প শুনেছি। একদম সেইরকম কন্ঠস্বর। ভুতেরা সব সময় কাঁপাকাঁপা গলায় কথা বলে। এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। সবাই চল… আমরা বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু ছোট্ট মেয়ে আরশি বলল, আমি ওসব ভুতপ্রেত এ বিশ্বাস করি না। বাবা বলেছেন, ভুত বলতে আসলে কিছুই নেই। ওরা কেবল গল্পেই থাকে, বাস্তবে থাকে না। আরশির কথায় সায় জানিয়ে পড়শি বলল, এটাই সঠিক কথা। আমিও শুনেছি। তখন ইউশা বলল, তাহলে তোমরা থাক, আমি চলে গেলাম। এই বলে ইউশা বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। এমন সময় ঐশী বলল, চলো আমরা দাদাভাইকে নিয়ে আসি। দাদাভাই অনেক জ্ঞানী আর সাহসী মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই এই রহস্যের একটা কিনারা করতে পারবেন। সবাই তখন সমস্বরে বলল, সেটাই ভালো হবে। সবাই চলো..চলো..। যাওয়ার সময় সবাই আবার শুনতে পেলো, তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…!

যাক অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ঐশীর দাদাভাই আবদুল হামিদ সাহেবকে নিয়ে ফিরে আসলো। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সবকিছু শোনে ঐশীর দাদাভাই জিজ্ঞেস করলেন, আওয়াজটা কি তেঁতুলগাছের কাণ্ড থেকে এসেছে নাকি শাখা-প্রশাখা থেকে? অন্য কেউ জবাব দেওয়ার আগেই আরশি বলল, আমার যতটা মনে হয়েছে আওয়াজটা তেঁতুলগাছের গোড়ার দিক থেকেই এসেছে। আরশির কথা শেষ হতে না হতেই আবার সেই আওয়াজটি শোনা গেলো। এখন আরও স্পষ্ট এবং পরিষ্কার। তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…! ঐশীর দাদাভাই বললেন, কোনো সমস্যা নেই। আমি সবকিছু বুঝতে পেরেছি। তেঁতুলগাছের গোড়ার দিকে একটা বিশাল গুহা আছে। সেখান থেকেই আওয়াজটা এসেছে। ঐশী আমার টর্চলাইটটা দাও তো বোন। ঐশী দাদাভাইয়ের হাতে টর্চলাইটটি দিয়ে মনে মনে গৌরব বোধ করলো।

সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো তেঁতুলগাছের ভুত ধরার এ্যাকশন। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারপাশে সুনশান নীরবতা। সবাই বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে তেঁতুলগাছের সেই গুহাটার মুখের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঐশীর দাদাভাই সাথে সাথে গুহার ভেতরে টর্চ জ্বালিয়েই হেসে উঠলেন। বললেন, আরে… সাজিদ যে! তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয় বলছি। সাজিদ ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এলো। মাটির দিকে মুখ। সবাই হা হা করে হাসতে লাগলো। ঐশীর দাদাভাই বললেন, সাজিদ কাজটা তুমি ভালো করনি। ভয় দেখানো দুষ্টু ভালো মানুষের কাজ নয়। তাছাড়া এসব গাছের গুহার ভেতরে বিষধর সাপ থাকে। আর কোনোদিন এমন কাজ করো না। সাজিদ মুখে কিছু বলল না, কেবল মাথা নেড়ে সায় জানালো।

ডাংগুলি খেলার দিন

2873 ছোট্র বন্ধুরা, আজ তোমাদের একটি গল্প শোনাবো। গল্পটি তোমাদের স্মৃতির পাহাড়ে বেড়াতে সাহায্য করবে। হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি সম্পর্কে তোমরা বিশেষভাবে জানতে পারবে। তাহলে চলো, গল্পটি শোনা যাক। অনেক অনেকদিন পর আমজাদ সাহেব পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। গ্রামে এসে ইউশা, ঐশী এবং আরশির আনন্দ আর ধরে না। উনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় থাকেন। একটি কারখানায় উচ্চ পদে মোটা বেতনে চাকুরি করেন। বলা যায়, একজন ছেলে, দুইমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসার। সমস্যা একটাই কারখানায় প্রচুর কাজের চাপ থাকে। মালিক পক্ষ ছুটি দেয় না। ছুটি দিতে চায় না। সেইজন্য আমজাদ সাহেবেরও আর গ্রামে যাওয়া হয়ে উঠে না। এবার অনেক বলে-কয়ে পাঁচ দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়েছেন।

আমজাদ সাহেবের গ্রামের বাড়ি অত্যন্ত মনোরম। চারপাশে সবুজে ঘেরা। সারি সারি সুপারি আর নারকেল গাছ। এদের ফাঁকে ফাঁকে আম, জাম, লিচু, কাঁঠালসহ অন্যান্য সকল ফলবান গাছ। এখন মধুমাস৷ প্রতিটি গাছেই থোকা থোকা ফল ঝুলছে। কোনটা পাকা, কোনটা আধাপাকা আর কোনটা কাঁচা। এইসব ফল খেতে গাছে গাছে পাখপাখালির মেলা। কিচিরমিচির আওয়াজ শুনতে কার না ভালো লাগে! এমনি মনোহর পরিবেশে আমজাদ সাহেব দুপুরের খাবার শেষে বাহির বাড়িতে মাদুর পেতে বসে আছেন। বাবার পাশেই বসে আছে আরশি, ঐশী, ইউশা। বিকেল সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আমজাদ সাহেব যখন বাপ-দাদাদের স্মৃতি রোমন্থন করা শুরু করেছেন, তখনই দল বেঁধে আসল পাড়ার সকল ছেলেমেয়ে। তাদের হাতে ক্রিকেট খেলার বল আর ব্যাট। নিমিষেই তারা দু’দলে ভাগ হয়ে খেলা শুরু করে দিল। ইউশাও তাদের সাথে খেলায় যোগ দিল। যারা খেলছে না, তাদের প্রায় সবার হাতে হাতে মোবাইল। কেউ গেমস খেলছে আর কেউ ফেসবুক, ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত আছে। তাদের যেন দুনিয়ার কোনো খেয়াল নাই। আমজাদ সাহেব আপন মনে প্রিয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ কী মনে করে সবাইকে কাছে ডাকলেন।

আমজাদ সাহেবকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ছোট হউক কিংবা বড় হউক এভাবে সবার সামনে বসে বসে কথা বলা সমীচীন হবে না। এই ভেবে তিনিও দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন, বাবুরা তোমরা কী কী খেলা খেলতে পছন্দ কর?

সবাই সমস্বরে জবাব দিল, আমরা বছরের বেশির ভাগ সময় ক্রিকেট খেলি। তবে বর্ষাকালে ফুটবল আর শীতকালে ব্যাডবিন্টন খেলি।

আমজাদ সাহেব ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, আমরা তোমাদের বয়সে কি খেলতাম, তা কি তোমরা জান?
সবাই মাথা নেড়ে জবাব দিল, জী না।
আমজাদ সাহেব আবার বললেন, আমরা ডাংগুলি, বউচি, কানামাছি, ডাকসই, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, হা ডু ডু এসব খেলতাম।

আমজাদ সাহেবের কথা শোনে ছেলেমেয়েরা সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। ভাবখানা এমন যে, তারা কোনোদিন এসব খেলার নামই শোনেনি। বিষয়টি বুঝতে পেরে আরশি বলল, বাবা আমার মনে হয় ওরা এসব খেলে না।

আমজাদ সাহেব বললেন, বুঝতে পেরেছি মা আরশি। আর বাবুরা সবাই শোন, তোমরা ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেল… আমার তাতে আপত্তি নেই। তবে মনে রেখো এগুলো আমাদের দেশীয় খেলা নয়। এগুলো বিদেশি খেলা। আমি যে খেলাগুলোর নাম বললাম সেগুলো হল আমাদের দেশীয় খেলা। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। তোমরা যদি আমাদের নিজ দেশের খেলাগুলো না খেল, তাহলে তো সেগুলো হারিয়ে যাবে। কিন্তু সেসব খেলা কে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমরা দেশ-কে যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি আমাদের দেশীয় খেলা। তোমরা কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?

সবাই মাথা নেড়ে সায় জানালো। কেবল সাজিদ নামের একজন ছেলে বলল, আমরা এসব খেলতে জানি না।

আমজাদ সাহেব মুচকি হেসে বললেন, এ বিষয়ে তোমরা কোনো চিন্তা করো না। আমি যে কয়দিন বাড়িতে আছি, প্রতিদিন বিকেল বেলা আমি তোমাদেরকে সেসব খেলা শেখাবো। শুধু তাই নয়; আমি তোমাদের সাথে খেলবোও৷ তবে আরও একটি কথা এখন থেকে তোমরা কেউ মোবাইলে গেম খেলতে পারবে না। কি সবাই রাজি তো?

আমজাদ সাহেবের কথা শোনে সবাই খুব খুশি হল। করতালির মাধ্যমে সবাই উল্লাস প্রকাশ করলো।

পোকা

10 বাবার যা ভুলো মন- তাই বলে এমনটা হবে ভাবেনি মিতুল। নতুন ক্লাসের নতুন নোট বই প্রয়োজন, বাবা বলেছেন আনবেন, ও অপেক্ষায় ছিল। বাবা নোট বইয়ের বদলে একমুঠো উইপোকা কিনে আনলেন, যত্ম করে স্কুলের ব্যাগে ভরে দিলেন।

মিতুল মা’র কাছে শুনেছে বহুদিন আগে বাবা একটা সমুদ্র কিনেছিলেন। সমুদ্রে তখন প্রবল জলোচ্ছাস, প্রতি মুহুর্তে ঢেউয়ের উচ্চতা বাড়ছে, আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তিনি প্রতিদিন গভীর আগ্রহ নিয়ে সর্বস্বের বিনিময়ে শেয়ার বাজার হতে কেনা সমুদ্রের ঢেউ গুনতেন, উচ্চতা মাপতেন আর ভাবতেন- ঢেউ আকাশ স্পর্শ করলেই সমুদ্রটা বিক্রি করে কিছু জমি কিনবেন।

বিপদের দিনে চাখবেন বলে মা টিনের কৌটায় আশা ভরসার সিরকা মেখে ভাংতি পয়সা ও খুচরো টাকা জমাতেন। সব আশাভরসা খরচ করে মা বাবাকে আরও ক’টা ঢেউ কিনে দিলেন আর স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন- খুব তাড়াতাড়ি একটা চৌকো জমি কেনা হবে। জমির পেছন দিকটায় থাকবে পাকা বাড়ি, সামনে খোলা উঠোন, ওই উঠোনে মিতুল খেলবে। উঠোনের একপাশে বাঁশের মাচায় তরতরিয়ে উঠবে পুঁই আর লাউশাক, কখনও কখনও বড় সিম বা কাকরোল। ছাদের টবে ফুটবে গোলাপ, রাতে ঘ্রাণ ছড়াবে হাস্নুহেনা।

এক সকালে হঠাৎ করেই ক’টা তিমি, হাঙর আর ডলফিন সমুদ্রের সব ঢেউ পান করে গাঙচিল হয়ে উড়ে গেল। সমুদ্র বিক্রয় দপ্তরের ঠিকানাটা রইলো, কিন্তু সমুদ্রের কঙ্কালটাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এরপর থেকেই বাবা যেন কেমন হয়ে গেছেন, এই তো সেদিন এক সপ্তাহ চলার মত চাল কিনতে গিয়ে দুই মাসের ক্ষুধা কিনে ফিরলেন।

সবাই নতুন বই নিয়ে স্কুল যায়, নতুন ব্যাগ, নতুন জুতো, নতুন ড্রেস। শুধু মিতুলের পুরানো ব্যাগ, পুরানো জুতো, পুরানো ড্রেস। পুরানো ব্যাগ ভর্তি উইপোকা। একদিন ক্লাশে হাকিম স্যার মিতুলের কাছে নোটবই চাইতেই ও ক’টা উইপোকা স্যারের হাতে তুলে দিলো। স্যার পোকাগুলো ফেরত দিয়ে হতাশ সুরে বললেন, তিন মাসের বেতন বাকী আর তোর বাবা উইপোকা কিনে টাকা ওড়ায়!

মিতুল ঘরে ফিরে মা’কে প্রশ্ন করে , ‘উইপোকার কি অনেক দাম, মা!’ মা আলু দিয়ে পানি ভুনা করছিলেন, হাঁড়িতে লবণ দিতে দিতে জানালেন, ‘আমাদের মত মানুষ ছাড়া আর সবকিছুরই অনেক দাম।’ মা’র উত্তর শুনে মিতুল অবাক হয় না, এ কথা ও বহুবার শুনেছে, স্বগতোক্তি করে, ‘বাবা অনেক দাম দিয়ে কেনো যে উইপোকা কিনলেন!’ মা হাঁড়ির ঢাকনা খুলতেই একরাশ ধোয়া বেরিয়ে এলো, হাড়িভর্তি ফুটন্ত পানিতে আলুর ক’টা টুকরো লাফাচ্ছে, মা ওই দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘তোর বাবা উইপোকাও চিনে না, তুই ব্যাগে ঘুনপোকা নিয়ে ঘুরছিস, বাবু।’

ম্যালামাইনের হলদে হয়ে আসা পুরানো প্লেটে দু’মুঠো বাসি ভাতের ওপর এক চিমটি লবণ আর এক কাপ পানি ভুনা ঢেলে মিতুলকে খেতে দিলেন, দীর্ঘশ্বাসের শীতলতা ছুড়ে চুলোর আগুন নিভিয়ে বললেন, ‘ওদের দাঁত বড় হয়ে চোয়াল ফুঁড়ে বেরুবে, এর আগেই ওদের ছেড়ে দিস, বাবু।’
‘দাঁত বড় হতে হতে চোয়াল ফুঁড়ে বেরুবে!’ ভাবতেই মিতুলের গায়ে কাঁটা দেয়। মা বলেছেন ওদের কিছু না কিছু কাটতে হয়, না কাটলে দাঁত বড় হয়, হতেই থাকে- চোয়াল ফুঁড়ে বেরোয়, মগজ ফুরে বেরোয়, তারপর মরে যায়।

উই হোক বা ঘুন, পোকাগুলোকে মুক্তি দিতে হবে। পরদিন ক্লাশে সবাই বই খুলে বসে, মিতুল বসে ব্যাগের জিপার খুলে। জিপার খোলা পেয়ে প্রথমে তিনটা পোকা বেরিয়ে আসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর একটা একটা করে পোকা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে, স্বাধীন আশ্রয়ের সন্ধানে পিলপিল পায়ে হেঁটে যায় এদিকে ওদিকে সেদিকে। ক’টা পোকা ফের ব্যাগে ঢুকে যায়- ওদের গন্তব্য পৃথক।

মিতুল জানে না কী ভীষণ কাণ্ড ঘটে গেছে। পোকাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো স্কুলে। মা পোকাদের প্রসবিত ডিম ফুটে বেরিয়েছে শিশুপোকা। দাঁতের যন্ত্রণায় বড় পোকাগুলো সারাটা দিন কুটকুটকুটকুট করে ক্লাশরুমের দরজা, জানালা আর বেঞ্চ কাটে। ছোট পোকাগুলো মনের আনন্দে কাটাকুটিতে মন দেয়, ওদের দাঁতেখড়ি হয় লাইব্রেরির বই কেটে। ওদেরও দাঁত বড় হয়, ধারালো হয়, ওরা স্কুলের দেয়াল কাটে, ছাদ কাটে, অচল নিয়ম ও দোদুল্যমান আদর্শ কাটে। দিনের কোলাহলে পোকার দন্তচর্চার শব্দ পাওয়া যায় না, রাতের নিরবতায় শোনা যায় কুটকুটকুটকুট… কুটকুটকুটকুট… কুটকুটকুটকুট… যেনো মেশিন চলছে।

ক’মাস পরের কথা, পোকার অক্লান্ত দাঁতের চাপে ঝুরো ঝুরো হয়ে ধুলায় মিশেছে পাঠ্যবই, খসে পড়েছে স্কুলের জানালা, গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ভেঙে গেছে দরজা, ধ্বসে পড়েছে দেয়াল। স্কুলের শূন্য ভিটায় ঘুঘু চড়ার কথা, কি আশ্চর্য- ধ্বংসস্তুপের ফাঁকফোকর ভেদ করে জন্মেছে ঘাস, ফুটেছে নাম না জানা ফুল, উড়ছে এক ঝাঁক অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতি।

প্রেম কিংবা টাকা প্রতিভা

সুমনের একটাই ইচ্ছা সেতারা যেচে এসে তার হাত ধরবে। সেতারা নামটা সেকেলে হলেও মেয়েটা সেকেলে নয়। পুরো-দস্তুর মর্ডান। সেতারা না হয়ে সুহাসিনী নাম হলে মানাতো ভালো। নামের সাথে ব্যক্তিত্বের অমিল হলে বেখাপ্পা লাগে। সেতারা নামটাই সেকেলে কিন্তু মেয়েটি সত্যি সত্যিই তারা। আমাদের স্কুলের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। লেখাপড়ায় যেমন গান কবিতা গল্পে নৃত্যেও তারচেয়ে পারদর্শী কেউ নেই। সবচেয়ে মধুর হচ্ছে তার মুখের হাসি সুমন নিশ্চিত জগতে সেতারার মত সুন্দর হাসি কেউ হাসতে পারবে না। সেতারা না হয়ে নামটা সুহাসিনী হলে সোনায় সোহাগা হত।

সুমন নামটা সেকেলে নয় আবার আধুনিক নয়, নামটা মাঝামাঝি ধরনের। সুমন ছেলেটাও মাঝামাঝি। সুমন মেধাবী নয় তাকে অমেধাবীও বলা যাবে না। এ পর্যন্ত ক্লাসে দশের ভিতরেই থেকেছে। গান তার গলায় আসে না কিন্তু গানের কথাগুলো বেশ লিখতে পারে। পদ্য লেখায় কিছুটা মুন্সিয়ানা সুমনের আছে, সেটা অবশ্য সেতারা মাপের নয়। তবুও সেতারা সুমনের দিকে ঝুঁকেছে, সুমনের লেখা একটা গান গাইতে চেয়েছে। একটি অসাধারণ মেয়ে একটি সাধারণ ছেলে প্রতি দুর্বল হচ্ছে; গল্প, উপন্যাসে এটা হয় কিন্তু বাস্তব জীবনে যে এটা সম্ভব সেতারা সুমন এর উদাহরণ।

সুমন সেতারা যখন জুটি বাঁধতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ইমন নামের ছেলেটার বুকের ভিতর আগ্নেয়গিরি লাভা গলতে শুরু করেছে। ইমন কোন কাজের ছেলে না। লেখাপড়ায় টেনেটুনে পাস। অন্য কোনো প্রতিভা এখন পর্যন্ত কারো নজরে আসেনি। কিন্তু সব প্রতিভা যেখানে আত্মসমর্পণ করে সেখানে টাকার প্রতিভা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। ইমনের বাবার প্রচুর টাকা। টাকার জোরে ইমন সব প্রতিভা কিনে নিয়েছে। ইমন নামের আধুনিকতা অনাধুনিকতা এখানে বিবেচ্য নয় কারণ টাকা কারো নামের ধার ধারে না।

সেতারা কিংবা সুমন ইমনের বন্ধু; আদতে শিষ্য তার পিছু পিছু হাঁটে। তার অঙ্গুলিহেলনে বিনা দ্বিধায় সব কাজ করে দেয়। সেতারাকে নিয়ে ইমনের কোন চিন্তা ছিল না, সে ধরে নিয়েছিল সেতারা সে ইতোমধ্যে কিনে নিয়েছে। স্কুল পর্ব কলেজ পর্ব শেষে সেতারা তার বাড়িতেই যাবে। সেতারার পিছনে টাকা বিলাতে সে কখনও কার্পণ্য করেনি, বরং প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিলিয়েছে।

সেতারায় অন্য কেউ ভাগ বসাবে এটা ইমনের চিন্তাতে আসেনি। সেতারা সুমনের ঘনিষ্ঠতায় সে অবাক হয়। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা জুটি হয়ে যাবে এটা ইমন সহ্য করতে পারবে না।

সেতারা সুমনের গান গাওয়া পর্যন্ত হয়তো মানা যায় কিন্তু সেতারা যেচে সুমনের হাত ধরবে এই কথা শুনে এমন মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ইমন ভাবে সুমনের হাত ভেঙ্গে দিলে কেমন হয়; হাত নেই হাত ধরাধরির বালাই নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। টাকা প্রতিভায় ইমন সুমনের হাত ভেঙ্গে দিতে উদ্যত হয় এবং কিছু পরিমাণে সফল হয়।

হাত ভাঙ্গার সিদ্ধান্তের আগে ইমন সেতারার মুখোমুখি হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল
-সুমন চাচ্ছে তুমি তার হাত ধর, তোমার অভিমত কী?
-সুমন চাইলে আমি অবশ্যই তার হাত ধরব।
-আর আমি চাইলে?
-তোমার হাত ধরার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।

ইমন অপমানিত বোধ করে সামান্য একটা মেয়ে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ভেবে জ্বলে ওঠে। উপযুক্ত শিক্ষা দিতে সিদ্ধান্ত নেয়।

ইমনের টাকা সুমনের হাত পুরোপুরি ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়নি, তবে মুচড়ে দিয়েছে। সুমন হাসপাতালে; সেতারা গেছে দেখতে। ইমন ভাবল সেও একবার বন্ধুকে দেখে আসবে। হাসপাতালে পৌঁছে ইমন দেখল সুমনের বেডের পাশে সেতারা বসে আছে; তার দুই হাত দিয়ে সুমনের মুচড়ে যাওয়া হাত শক্ত করে ধরে আছে। এ দৃশ্য দেখে তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে গেল। একটা বিষয় তার উপলব্ধি হল, টাকা প্রতিভা সবসময় সফল হয় না; বিশেষ করে হৃদয় ঘটিত ব্যাপারস্যাপারে।