বিভাগের আর্কাইভঃ প্রবন্ধ

শরৎসাহিত্যের দিগন্তে

বাংলাসাহিত্যের অঙ্গনে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব এক যুগান্তকারী ঘটনা সন্দেহ নেই। বস্তুত তিনিই প্রথম, আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে লেখাপড়া জানা আপামর শিক্ষিত বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন বললে মোটেও অতিশয়োক্তি করা হয় না। তাঁর হাত ধরেই বাঙালির ঘরে ঘরে আধুনিক সাহিত্যের হাতেখরির সূচনা। তাঁরও পূর্বে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, বঙ্গসাহিত্যের পথিকৃত হলেও তিনি আপামর বাঙালির হৃদয় জয় করতে পারেননি- শরৎচন্দ্রের মতোন এমন সার্বিকভাবে। এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আজ যে সর্বগ্রাসী প্রভাব বাংলা ও বাঙালির জীবনে; তারও সূচনা শরৎসাহিত্যের পরবর্তী অধ্যায়ে। যদিও কবিগুরু শরৎচন্দ্রের পূর্ববর্তী। কথাটা শুনতে প্রথমে খটকা লাগলেও একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ঘটনাটা সত্য।

রামমোহন বিদ্যাসাগরের হাত ধরে বঙ্গসাহিত্যের যে আধুনিক যুগের সূচনা হয়, তা মূলত সংস্কৃত জানা উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর হেম মধু বঙ্কিম নবীনের হাত ধরে তার সীমা বিস্তৃততর হতে থাকলেও, তাতে বাংলার জনমানসের প্রতিভাস ছিল সামান্যই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যর প্রথম পর্বেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল অনেকটাই। কারণ তা যতটা না বিশ্বমানবের ইশারা সম্ভূত, ততটা বঙ্গজীবনের অস্থিমজ্জায় জায়মান নয়। শরৎচন্দ্রই প্রথম, যিনি বাংলার নাড়ির স্পন্দনে টান দিলেন তাঁর সাহিত্যবোধের একেবারে নিভৃততম অন্তর্লোক থেকে। বিশেষত আমাদের খেয়াল রাখা প্রযোজন, বাংলা কথাসাহিত্য প্রধানত ইউরোপীয়ান সাহিত্যের গর্ভসঞ্জাত। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা উচিত, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় শসক প্রভু ইংরেজদের হাত ধরে এদেশে আসা ইংরেজি সাহিত্যের আঁতুরেই বাংলা কথাসাহিত্যের ভুমিষ্ঠ হওয়া। ফলে সেই আমদানী করা সাহিত্য প্রকরণের বাংলার নাড়ির স্পন্দনে স্পন্দিত হতে যে, শরৎসাহিত্য অব্দি অপেক্ষা করতে হয়ে ছিলো তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই।

শরৎচন্দ্রের অবিসংবাদী জনপ্রিয়তার হাত ধরেই বাংলার ঘরে ঘরে সাহিত্যের অধিষ্ঠান ঘটে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলার জনমানসে বাংলাসাহিত্যের প্রতি যে বিপুল ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়, তারই সূত্রে একদিকে যেমন হেম মধু বঙ্কিম নবীনের সাহিত্যকাল থেকে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকাল অব্দি সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনই শরৎ পরবর্তী সাহিত্যের গর্ভসঞ্চারও ঘটতে থাকে। আর ঠিক এরই প্রেক্ষিতে, বাঙালির সাহিত্য দীক্ষার বিস্তারের হাত ধরেই, বঙ্গজীবনের পরতে পরতে ধীরে ধীরে সর্বময় হয়ে উঠতে থাকল রবীন্দ্র প্রভাব।

শরৎচন্দ্রই প্রথম বাংলা ও বাঙালির নাড়ির স্পন্দনকে ইউরোপ আগত এই আধুনিক কথাসাহিত্যের প্রকরণে স্বার্থক ভাবে ধরতে পেরেছিলেন। এটাই তার বিপুল জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বঙ্গজীবনের চালচিত্রে বাঙালির মানসভূবনকে খুব ভেতর থেকে অনুভব করেছিলেন তিনি। আর সেই অনুভবের স্বর্ণশিখায় তুলে আনলেন বঙ্গনারীর অন্তর ঐশ্বর্য্যকে। রূপময় করে তুললেন তার ব্যাথা বেদনা আশা আকাঙ্খাকে অনুপম কথনশৈলীর নিপুণ ব্যঞ্জনায়। জয় করে নিলেন বাঙালির হৃদয়।

শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিগত জীবনযাপন, বিশেষ করে তাঁর বেড়ে ওঠার ধরণের মধ্যে থেকেই তিনি অর্জন করে ছিলেন তাঁর এই অনুভব শক্তির স্বাতন্ত্র্য দীপ্তি। স্বতন্ত্র্য ছিল তাঁর বাল্য ও কৈশর আর পাঁচটি বঙ্গসন্তান থেকে। আর সেই ছিল তাঁর মূলধন। সেই সূত্রেই খুলে গিয়েছিল তাঁর দেখার দৃষ্টি, অনুভবের তীক্ষ্ণ ক্ষমতা। তিনিই তাই মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজকে খুব স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করলেন, একেবারে অন্দরমহল থেকে।

আর সেই অন্দরমহলের রূপঙ্কর রূপেই দেখা দিলেন বাংলাসাহিত্যের আঙিনায়। বাংলাসাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব, যেকোনো ভাষার সাহিত্যের পক্ষেই দৃষ্টান্তস্বরূপ। বস্তুত ঊনবিংশ শতকের বঙ্গীয় বর্ণহিন্দুসমাজের সমাজ মানসিকতার প্রতিচ্ছবিটি তাঁর সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত হতে থাকল অনুপম ভঙ্গিতে। আর সেই অননুকরনীয় ভঙ্গিতেই বাংলার জনমানসে শরৎপ্রভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল দ্রুতবেগে।

যে কাহিনীটি দিয়ে বঙ্গসাহিত্যে তাঁর জয়যাত্রা, সেই “বড়োদিদি” শরৎসাহিত্যের অন্যতম দিকদর্শনও বটে। যে পথে পরবর্তীতে এগিয়ে গিয়েছিল তাঁর জনপ্রিয়তার জয়রথ। বাংলাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রই প্রথম তুলে আনলেন বাংলার সমাজসংসারে বঙ্গনারীর প্রকৃত ভূমিকাকে। পুরুষতান্ত্রিক এই বঙ্গসমাজে সংসারের অন্তঃপুরে পরাধীন নারী, পুরুষতন্ত্রের অধীনতার মধ্যে থেকেও কিভাবে পুরুষকেই বল ভরসা যুগিয়ে, সেবা যত্ন করে পুষ্ট করে তোলে, সে সত্য শরৎচন্দ্রই প্রথম এমন স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করালেন আমাদের। তাঁর সাহিত্যের অনুপম মুকুরেই বঙ্গনারী প্রথম অনুভব করল- তার শক্তির সুষমাকে। শরৎচন্দ্রের মধ্যে আবিষ্কার করল প্রকৃত দরদী হৃদয়বেত্তার এক অনুপম লেখককে। দেরি হল না শরৎভক্ত হয়ে উঠতে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল তাঁর জনপ্রিয়তা।

শরৎসাহিত্যে নারীর মাতৃত্ব বাৎসল্য প্রেম, তার মায়া মমতা এবং পুরুষের প্রতি তার একনিষ্ঠ কর্তব্য প্রেরণা বস্তুত বাংলার জল হাওয়ার মতোই সজীব সজল করুণামিশ্রিত হয়ে দেখা দিল। সেখানেই নারীও প্রত্যক্ষ করল আপন জীবনের সুকুমার অন্তঃস্বরূপ। ঊনবিংশ শতকের বাংলার নারীকে প্রত্যক্ষ করতে হলে তাই ওল্টাতেই হবে শরৎসাহিত্যে পাতার পর পাতা।

কিন্তু এখানেই থেমে থাকলেন না লেখক। বর্ণহিন্দু সমাজজীবনের নানান অনৈতিকতার প্রেক্ষাপটে হাজারো বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ সংসারজীবনের মধ্যে অবরুদ্ধ নারীমনের নিভৃত আর্তি লেখকের দরদী কলমের নিবিড় সহানুভুতির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে লাগল বর্ণময় উদ্ভাসনে। আমরা পরিচিত হতে থাকলাম, রাজলক্ষ্মী, কমললতা, কিরণময়ী, কমল, অন্নদাদিদি, সুনন্দা, সাবিত্রী, অচলা অভয়াদের সাথে।

“মণি-মাণিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসেবে নারীর মূল্য বেশী নয়, কারণ, সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটা নিত্য-প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই। কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধ করি একফোঁটার জন্যে মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করেন না। তেমনি – ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইহাঁর যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে- আজ নহে। আজ ইনি সুলভ।”

বলেছিলেন শরৎচন্দ্র, ‘তাঁর নারীর মূল্য’ প্রবন্ধের একেবারে শুরুতেই। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীজীবনের অবরুদ্ধ কান্না শরৎসাহিত্যের স্রোতধারায় স্রোতস্বিনী হয়ে উঠল অচিরেই। কারণটা এখানেই যে, তিনি জগতসংসারে নারীর প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করেতে পেরেছিলেন, একেবারে তাঁর জীবনবোধের ভিত্তিমূল থেকেই। যেখানে কোনো রকম ফাঁকি ছিল না। ছিল না মেকি সহানুভুতির আতিশয্য। তাঁর দরদী মনের মুকুরে ধরা পড়ল নারীর অন্তর্বেদনার অন্তর্গূঢ় আর্তি! সেই আর্তিই উঠে এল তাঁর কুশলী কলমের জাদুতে। একে একে সৃষ্টি হল শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, পল্লীসমাজ, গৃহদাহ, শেষপ্রশ্নের মতো যুগান্তকারী সব উপন্যাস!

তাঁর গল্প উপন্যাসের পরতে পরতে প্রবাহমান বাঙালী হিন্দুসমাজের সেকালের জীবনযাত্রার যে চালচিত্রকে তিনি প্রস্ফূটিত করে গেছেন তাঁর অনুপম গদ্যশৈলীতে, সে তাঁর নিজস্ব প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভিজ্ঞতা সম্ভূত! এবং তাঁর দরদী মনের সমবেদনা সঞ্জাত! সেইজন্যেই তাঁর কাহিনীগুলি পাঠকের অন্তরে এমনই জীবন্ত হয়ে ওঠে অনুভবের সজল সরসতায় রসসিক্ত হয়ে। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঞ্জীবনী আলোয় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সমাজের চরিত্রহীনতাকে। দেখেছিলেন সমাজবাস্তবতার কষ্ঠিপাথরে অমলিন মনুষত্বের অম্লান রূপকে। সেই রূপের ক্যানভাসেই ভাস্বর করে তুলেছিলেন তাঁর অন্নদাদিদির মতো সতীসাদ্ধী নারী থেকে, মুজরো করা পিয়ারী বাঈজীরূপী অনন্ত প্রেমিকা রাজলক্ষ্মীকে।ন্যায়পরায়না তেজস্বী আপোষহীন সুনন্দা থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল নারীসত্তার অবিনশ্বর আত্মা কমলকে। নারীমনের অগম রহস্যের দোলাচলে, সমাজ সংসারের বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়া নারীজীবনের দূর্নিবার অসহায়তার পরাধীনতার কাছে ক্ষতবিক্ষত হওয়া অসামান্য রূপসী তীক্ষ্ণ বুদ্ধীমতী কিরণময়ী থেকে প্রেমের ঘাতপ্রতিঘাতে জর্জরিত অচলাকে। তিনি দেখেছিলেন সমাজের নিচতাকে। সমাজের ক্ষুদ্রতাকে। আর সেই নিচতার যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া অসহায় নারীর আপাত ক্ষুদ্রতার মধ্যেও তাঁর অন্তরাত্মার মহত্বকে। সেই দেখার চোখই তাঁকে তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক করে তুলেছিল। এখানেই শরৎচন্দ্রের অনন্য বৈশিষ্ট।

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শ্রী দেবীপদ ভট্টাচার্যের মতে, “কথন বয়নের কুশলতা, চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য, মনোজগতের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ শরৎচন্দ্রকে কালজয়ী হতে সহায়তা করেছে। কিন্তু আরেকটি দিকও বিস্মৃত হওয়া চলে না। অবিচার ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে এত বড়ো দরদী শিল্পী তাঁর পূর্বে বা পরে দেখতে পাই না!”

সামাজিক অবিচার ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে শরৎচন্দ্রের দরদী কলম নিষ্পেষিত মানবাত্মার মর্মবেদনাকে সহানুভুতির মরমী আলোয় আলোকিত করলেও, তিনি কোনো প্রতিরোধের দিশা বা বিপ্লবের দিশা দেখান নি। হয়তো সেটা সাহিত্যিকের সত্যিকারের কাজও নয়। কিন্তু তিনি তাঁর নিপিড়ীত অবরুদ্ধ চরিত্রদের মধ্যেও বিপ্লব বা প্রতিরোধের আগুন জ্বলে উঠতে দেন নি। যে পুরুষ শাসিত সমাজে তাঁর সৃষ্ট নিষ্পেষিত নারী চরিত্রদের অন্তর্বেদনাকে তিনি দরদী কলমে ফুটিয়ে তোলেন, সেই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনোরকম প্রতিরোধের প্রত্যয় ফুটে ওঠে না তাঁর সৃষ্টি করা সেই সমস্ত চরিত্রদের মননে ও চেতনায়। এইখানেই শরৎদিগন্তের সীমানা।

সামাজিক অন্যায় অবিচারে নিষ্পেষিত মানবাত্মার সকরুণ বেদনার মরমী চিত্রকর তিনি। কিন্তু বিচারের বাণীকে নিরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুথবদ্ধ প্রতিরোধের কোনো প্রত্যয় ফুটিয়ে তোলেন না তাঁর সৃষ্টির দিগন্তে। কারণটা যতটা না তাঁর ব্যক্তিগত জীবন দর্শনের সংঘটনে, ততটা তাঁর সাহিত্যিক পরিমিতি বোধের সুদৃঢ় প্রত্যয়ে। তিনি যে কালপ্রবাহের, যে সমাজসংসারের, যে যুগধর্মের জীবনযাত্রার চিত্রকর; সেই প্রেক্ষাপটে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিষ্পেষিত বাঙালি মননে প্রতিরোধ প্রতিবিধানের কোনো বীজমন্ত্র জায়মান ছিল না। সমাজজীবনের ভিত্তিমূলেই যার অস্তিত্ব ছিল না, তাকে লেখকের কল্পনা থেকে ধার করে বা বিদেশী সাহিত্য থেকে আমদানী করে বলপূর্বক সাহিত্যের অন্তঃপুরে ঢুকিয়ে দিলে, তা কখনোই সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠতো না। তা হয়ে উঠত হয়ত কোনো রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো। আহত হতো সাহিত্যের পরিমিতি। এখানেই প্রকৃত সাহিত্যিকের পরিচয়। কারণ সাহিত্যিকের কাজ সাহিত্যের দর্পনে সমাজসংসারের অন্তর্গূঢ় অন্তর্বেদনকে প্রতিফলিত করে তা পাঠকের জায়মান জীবনবোধে নতুন করে প্রস্ফূটিত করে তোলা।

আর এখানেই সার্থক শরৎচন্দ্রের সাহিত্য কীর্তি। প্রায় একটা শতাব্দীর বঙ্গ জীবনের চিত্রকার তিনি, এবং প্রায় একটা শতাব্দী বাঙালি মননে রাজত্ব করে গিয়েছেন স্বমহিমায়। সমাজবদলের দায়িত্ব সাহিত্যিকের নয়, সামাজিক ক্ষতগুলিতে মরমী আলো ফেলে পাঠকের চেতনায় জীবনবোধের সঞ্চারণ ও প্রসারণ ঘটানোই তাঁর কাজ। আর সেই কাজে বিপুল ভাবেই সফল তিনি। সফল বলেই তারপর আমরা পেয়েছি তারাশঙ্কর থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ থেকে বিভুতিভূষণ, বাংলা কথাসাহিত্যের সীমানা বিস্তৃত হতে থেকেছে ক্রমশই। তাঁর সাহিত্য বিচিত্রগামী হলেও সর্বত্রগামী হয়নি বলে, আক্ষেপ ছিল কবিগুরুর। আর শরৎচন্দ্র বাংলাসাহিত্যের ভবিষ্যত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলে গেলেন, “….এই অভিশপ্ত, অশেষ দুঃখের দেশে নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে, রূশ সাহিত্যের মতো যেদিন সে সমাজের নিচের স্তরে আরো নেমে গিয়ে তাদের দুঃখ-বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে সেদিন এই (বাংলা) সাহিত্য-সাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।” এখানেই উপলব্ধি করতে পারি আমরা কত বড়ো দ্রষ্টা ছিলেন এই মহান শিল্পী। বাংলা কথাসাহিত্যের প্রথম ভগীরথ!

শ্রীশুভ্র।

নারীবাদ পূনর্নিমাণ

নারী মাত্রেই নারীবাদী নন। নারীবাদী মাত্রেই নারী নন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজবাস্তবতায় নারীবাদ নারীর অন্তিম অর্জন না প্রাথমিক শর্ত সেই নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু এটা খুব সত্যি, নারীবাদ পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর অন্যতম প্রতিরোধ। কিন্তু বর্তমান ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বিশ্বে নারীবাদ কি আদৌ নারীর রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পেরেছে? এই প্রশ্নগুলির সাথে আমরা কতটুকু পরিচিত। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সাথে এই প্রশ্নগুলিই বা কতটুকু সংশ্লিষ্ট? আমি বলছি আমাদের সাধারণ জনসাধারণের কথা। আমাদের দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনচর্চার সামাজিক পরিসরে নারীবাদের প্রাসঙ্গিকতাই বা কতখানি? এবং নারী নিজে কি ভাবে দেখে থাকে এই বিষয়গুলি? না বিষয়টি এতটাই ব্যাপক ও বৈচিত্রময় যে, এক কথায় এর কোন উত্তর হয় না। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের পরিসরে, আমাদের সামজিক রীতিনীতির পরতে পরতে উত্তর রয়ে গিয়েছে প্রতিটি প্রশ্নেরই। পিতৃতন্ত্রের স্বরূপ ও ইতিহাস নির্ণয়ের দিকে না গিয়েও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, কালের নিয়মেই পিতৃতন্ত্রের প্রকরণ ও অনুষঙ্গেও বদল ঘটেছে বিস্তর। আধুনিক প্রযুক্তির বিপ্লব ও ধনতন্ত্রের একচ্ছত্র বিশ্বায়নেই ঘটেছে এই পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তন কতটা পিতৃতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতিগত আর কতটা বাইরের সরূপগত সেটি বিতর্কের বিষয় অবশ্যই। তবে একথা বলা যায়, আবিশ্ব বিভিন্ন দেশেই নারী সুরক্ষার বিষয়ে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন দিনে দিনে নারীবাদীদের হাত শক্ত করে পিতৃতন্ত্রের আস্ফালনে কেবলই লাগাম পড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে আর হচ্ছে না সেটি পরের বিষয়। কিন্তু এই যে নারী সুরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন আইন তৈরী হওয়া, এটি কিন্তু আবিশ্ব নারীবাদের প্রসারের সরাসরি অভিঘাত। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজ বাস্তবতায় এই অভিঘাতের ধরণ ও পরিমানও ভিন্ন। এক দেশের সাথে আরেক দেশের এই বিষয়ে যে পার্থক্য থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নারীবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলির বাইরেও একটি পরিসর রয়ে যায়। যেখানে অর্থনৈতিক স্বাধিকারও একটি নারীর স্বঅভিভাবকত্ব সুনিশ্চিত করতে পারে না। এই না পারার কারণগুলিই পর্যালচনা করা সবচেয়ে বেশি জরুরী। সাধারণ ভাবে আর্থিক স্বনির্ভরতাই যেখানে নারীমুক্তির চাবিকাঠি, সেখানে বাস্তব পরিস্থিতি যে দেশে দেশে সমাজে সমাজে ভিন্ন এবং এক একটি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণতই বিপ্রতীপ অবস্থানে অবস্থানরত সেকথা কম বেশি আমরা জানি সকলেই। কিন্তু কেন হয় এরকমটি? অনুসন্ধান করে দেখা দরকার সেটাও।

উন্নত বিশ্বের সমাজ ও অনুন্নত বিশ্বের সমাজ বাস্তবতার ভিন্নতার কারণে দুই সমাজের নারীবাদের প্রকৃতি ও নারীর প্রকৃত অবস্থান ভিন্নরূপ হতে বাধ্য। আবার বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও জাতপাতের বিভেদ এবং অর্থনৈতিক শ্রেনীবিন্যাস এই পার্থক্যগুলির পিছনেও কাজ করতে থাকে। সামাজিক পরিকাঠামোয় একটি মেয়ে কিভাবে বেড়ে উঠবে, কিভাবে তার চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটতে থাকবে, এবং বংশগত ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার কিভাবে তার সংস্কার ও বিশ্বাসকে রূপ দিতে থাকবে; এই সবগুলি বিষয়ই হিসাবের মধ্যে ধরতে হবে। আর এই বিষয়গুলি দেশ সমাজ ও সম্প্রদায়গত ভাবে এতই বৈচিত্রপূর্ণ যে নারীবাদের প্রকৃতি ও নারীর প্রকৃত অবস্থানও এত বিভিন্ন রকমের। কিন্তু মুশকিল ঘটে তখনই, যখন আমারা এই জটিল বিষয়টিকে একরৈখিক মাত্রায় সরল করে নিয়ে দেখতে ও দেখাতে যাই। তাই শুধুমাত্র আর্থিক স্বনির্ভরতাই নারীর স্বঅভিভাবকত্ব নিশ্চিত করতে পারে না। পাশ্চাত্য সমাজে নারীর অবস্থান ও প্রাচ্যের নারীর অবস্থানজনিত কারণে এই দুই সমাজের নারীবাদের প্রকরণও ভিন্ন। কিন্তু যাঁরা সেটি বিস্মৃত হয়ে আন্তর্জাতিক নারীবাদের প্রবক্তা হয়ে উঠতে চান, তাঁরা ভুল করেন প্রথমেই। ইউরোপ আমেরিকার মেয়েদের সাথে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মেয়েদের সংস্কার ও বিশ্বাস, চাহিদা ও প্রত্যাশার ভিন্নতা খুবই সুস্পষ্ট। সেই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করা যাবে কি করে। তাই বস্তুত আন্তর্জাতিক নারীবাদ বলে কিছু হয় না। এক একটি দেশে, রাষ্ট্রে, সমাজে ও সম্প্রদায়ে এবং জাতিগত গোষ্ঠীতে নারীর অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। তার জীবনবোধ ও মূল্যবোধও বিভিন্ন। তার সমস্যা ও সম্ভাবনার দিগন্তও বিশিষ্ট রকমভাবেই ভিন্ন। তাই তাদের চেতনায় নারীবাদ কখনোই একরৈখিক হতে পারে না। আমাদের সেই সত্যটি অস্বীকার করলে চলবে না কিছুতেই। এবং এর সাথে যুক্ত করতে হবে যুগলক্ষ্মণকেও। অর্ধ শতাব্দী পূর্বের নারী আর আজকের নারীর ভুবন, সে- যে দেশগত ঐতিহ্য ও সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারই বহন করুক না কেন; এক নয় কখনোই। তাই নারীবাদও পাল্টাতে থাকে, থাকবে দশক থেকে দশকে।

পিতৃতন্ত্রের মধ্যেই সবচেয়ে মুখ্য যে বিষয়টি সুপ্ত ভাবে লুকিয়ে থাকে, সেটি হল নারীগর্ভের উপর পুরুষের সত্ত্বাধিকার। কম বেশি, দেশ কাল সমাজ নিরপেক্ষ ভাবে সবখানেই এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য। এবং মানব সভ্যতার আরও বিশেষ করে বললে বলা যায় এইটিই আধুনিক মানব সভ্যতার মূলস্বরূপ। বয়সসন্ধির পরপরই ছেলে মেয়ে উভয়ই এই বিষয়টি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে যায়। সচেতন হয়ে যায় এমন ভাবেই যে বিষয়টি তাদের বিশ্বাস ও সংস্কারের ভিতের মধ্যেই দৃঢ় হয়ে গেঁথে যায়। তাই এই নিয়ে প্রশ্ন করার সচেতনতা জন্মায়ই না সাধারণত। জল হাওয়া মাটি আকাশের মতোই স্বতঃসিদ্ধ সত্য হয়ে যায় তাদের কিশলয় ধারণায়। আর সেই বিশ্বাসই তাদের আজীবন সংস্কারে পরিণত হয়ে ওঠে যৌবন পর্বেই। নারীবাদ এই বিশ্বাস ও সংস্কারকেই প্রশ্ন করে। যে বা যারা সেই প্রশ্নের সরিক হয়ে উঠতে থাকে, সমাজ সংসার তাদেরকেই নারীবাদী বলে দেগে দিতে চায়। দেগে দেয়ও। বিশেষত আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পারিবারিক সংস্কৃতি ও সমাজিক রীতিনীতিগুলি এমনভাবেই ছেলেমেয়েদের উপর খবরদারি করতে থাকে যে, তাদের স্বাধীন চিন্তার ও অনুভববের পরিসরটিই ক্রমে সংকুচিত ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে থাকে। তাই তারা প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। একটি মেয়ে বা ছেলে এই রকম অবরুদ্ধ পরিসরে বেড়ে উঠতে থাকে বলেই পিতৃতন্ত্রের ভিতটা এতটাই মজবুত থাকে। আর সেই মজবুত ভিতটাই মেয়েদরকে গুরুত্বপূর্ণ জীবনপ্রশ্নগুলি থেকে দূরবর্তী করে রাখে। তাকে নির্বাক নিরব করে গড়ে তোলে। মেয়েরা শিখে যায়, না- প্রশ্ন করতে নাই। চিন্তা করতে নাই। অন্যরকম ভাবে ভাবতে নাই। অন্যরকম হতে নাই। এই নিরব আত্মসমর্পণ, পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যের কাছে, এটিই তৃতীয় বিশ্বের মেয়েদের আসল ইতিহাস। এবং বর্তমানও। হ্যাঁ প্রযুক্তি বিপ্লবের এই একুশ শতকেও। এই যে অন্যরকম হতে নেই, এই যে সংস্কার এইটিই একটি মেয়েকে নিরব করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ। আর তারপরেও যদি কাজ না হয়, তাহলেই সেই মেয়েটিকে দেগে দেওয়া যাবে নষ্ট তসলিমা বলে। এইটিই পিতৃতন্ত্রের রাজনৈতিক ছক। কজন মেয়ের মধ্যে সেই মানসিক শক্তি ও চারিত্রিক দৃঢ়তা আছে, যে এই ছকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে? বেড়িয়ে আসতে চাইবে চেনা এই ছকের ঘোরতর বাস্তবতার থেকে? মেয়েরা সাধারণতঃ এবং খুবই স্বাভাবিক ভাবেই তাই অন্যরকম হতে চায় না। বরং কেবল একটি দরদী পুরুষের স্বপ্ন দেখতে চায়, যে আদরে সোহাগে সুরক্ষিত করে রাখবে তার প্রেয়সীর জীবন। সেটাই তো ভালোবাসার মাপকাঠি। আমাদের সমাজ সংসার সেই মাপকাঠিটিই প্রতিটি মেয়ের চেতনায় গেঁথে দেয় সফল ভাবে। কেননা তবেই সেই মেয়েটির গর্ভের উপর পিতৃতন্ত্রের সত্ত্বটুকু আরোপ করা যাবে সহজে ও নিশ্চিন্তে।
আর তাই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের এই দেশগুলিতে আর্থিক স্বনির্ভর নারীও অন্যরকম করে ভাবতে পারে না। অন্যরকম হয়ে উঠতে পারে না। যেখানে সে তার গর্ভের উপর পিতৃতন্ত্রের সত্ত্বাধিকার আরোপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে নিজের মতো করে। বই পড়া নারীবাদী তত্ব মুখস্থ করে নয়, বা নয় সেমিনারে শোনা নারীবাদের আলোচনাকে অন্ধের মতো অনুসরণ করে। সেইখানে নিজেকে দেখার মতো সাহস ও অধ্যাবসায় নিরানব্বই শতাংশ নারীরই থাকে না। উচ্চশিক্ষা কিংবা অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা যতই থাকুক না কেন। আর সেইখানেই কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিকত, কি আর্থিক স্বয়ম্ভর, কি স্বামীর অর্থে প্রতিপালিত; সব নারীর চেতনাতেই চলতে থাকে পিতৃতন্ত্রের আরোপিত কার্ফিউ। বরং যে মেয়ে যতবেশি শিক্ষিত ও আর্থিক সয়ম্ভর সে তত বেশি তার থেকে শিক্ষিত ও অর্থবান মনের মানুষ কল্পনা করতে থাকে। যার আদরে সোহাগে সুরক্ষার নিশ্চয়তার নিশ্চিত পরিসরে তুলে দিতে পারবে আপন নারীগর্ভের স্বত্তাধিকার সম্পূর্ণ করে। হ্যাঁ নিরানব্বই শতাংশ নারীই এইখানেই নারী জন্মের মূল সার্থকতা খুঁজে পেয়ে কৃতার্থ হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে যাদের জীবনে এই প্রত্যাশা এইরকম মসৃণ ভাবে পরিপূর্ণ হয় না, তারাই বিলাপ করতে থাকে নারী হয়ে জন্মানোর জন্যে। দোষারোপ করতে থাকে আপন ভাগ্যের উপর। তবুও অন্যরকম হয়ে উঠতে পারে না। ভাবতে পারে না অন্যভাবে। অনুধাবন করতে পারে না, গণ্ডগোলটা ঠিক কোথায় ঘটে গিয়েছে। কিভাবে ঘটেছে, বা কেনই বা ঘটলো। এই সমাজ বাস্তবতায় আমাদের দেশীয় পরিস্থিতিতে নারীবাদের চর্চা নেহাৎই ইউরোপ আমেরিকা থেকে আমদানী করা শৌখিন অবসর বিনোদন মাত্র। কিংবা কখনো সখনো সেটাই খ্যাতির চৌকাঠে পা রাখার কৌশল বা পেশাগত দক্ষতা পরিচর্যার একটি মাধ্যম মাত্র।

না নারীর এই অক্ষমতার কারণ নারী নয়। একেবারে শৈশব থেকেই মেয়েদেরকে গড়ে তোলার সাংসারিক ও সামাজিক প্রকরণই এই ঘটনার জন্যে দায়ী। আমাদের সমাজে আমরা মেয়েদেরকে সর্ববিষয়ে খাটো করে গড়ে তুলি। কে কত কলেজ বিশ্বাবিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জন করলো, কিংবা নির্দিষ্ট পেশাগত দক্ষতায় কত পারদর্শী হয়ে উঠলো সেটাই শেষ কথা নয়। যে আত্মপ্রত্যয় ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের নির্যাসে স্বাধীন ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে আমাদের সমাজে আমাদের সংসারে মেয়েদেরকে সচেতন ভাবেই তার থেকে অনেক দূরবর্তী করে রেখে দেওয়া হয়। স্বাধীন ব্যক্তিত্ব বলতে ইচ্ছে মতো পেশা নির্বাচন কি স্বামীর অর্থে খেয়াল খুশির মতো শপিং করতে পারাই বোঝায় না। স্বাধীন ব্যক্তিত্ব তাই, যা একটি মানুষকে তার দেহ মন সত্ত্বার কোনটিকিই কোনদিন কোন ভাবে কোথাও কারুর কাছে বন্ধক দিতে প্ররোচিত করে না। এই যে স্বাধীন ব্যক্তিত্ব, দুঃখের বিষয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অনুন্নত সমাজব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ করা যায় কদাচিৎই। আর করলেই সমাজ তাকে একঘরে করতেই উঠে পড়ে লাগে। তাই এই দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে নারীর দশা দশচক্রে ভগবান ভুতের মতো আজো।

পিতৃতন্ত্রের এই ঘেরাটোপে নারীকে খর্ব করে রেখে নারীর গর্ভের উপর পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম রাখার আবহমান সংস্কৃতির সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ারই হলো সাম্প্রদায়িক ধর্ম। কম বেশি সকল ধর্মই এই অপকর্মে যথেষ্ঠ পরিমাণে কার্যকরি। এবং পারদর্শী। আজকের প্রযুক্তির এই অভুতপূর্ব সাফল্য ও অগ্রগতির যুগেও সাম্প্রদায়িক ধর্ম নারীর উপর পিতৃতন্ত্রের কর্তৃত্ব কায়েম রাখার বিষয়ে প্রবলভাবেই শক্তিশালী। তাই ধর্ম ও পিতৃতন্ত্র এই বিষয়ে একে অপরের পরিপূরক। আর লিঙ্গরাজনীতির শুরুই এই দুইয়ের অশুভ আঁতাত থেকে। তাই ব্যক্তিগত ভাবে যে কোন নারীর পক্ষেই এই অসম লড়াইয়ে জয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব। আর সেই জন্যে তো নারীবাদকে সেই অসম্ভব কাজটিতে মেয়েদেরকে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগানোর কাজে স্বচেষ্ট হতে হয়েছে। আরও বেশি করে হতে হবে। আরও বেশি করে হতে হবে কারণ বিষয়টি, আগেই দেখানো হয়েছে আদৌ এক রৈখিক কোন সমস্যা নয়। তাই পথ ও পদ্ধতি সকল সমাজেই সকল সম্প্রদায়েই একরকমও হতে পারে না। সেই কারণেই নারীবাদকেও হয়ে উঠতে হবে আরও বেশি বাস্তববাদী। এখানে আবেগ সর্বস্ব শ্রেয়বাদের ভুমিকা যত কম হয় ততই ভালো। বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলায় বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা কেন্দ্রিক বিবেচনার প্রয়োজন। প্রয়োজন নারীশিক্ষা বিস্তারের মধ্যে দিয়েই কাজ শুরু করা। নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার নিশ্চয়তা বৃদ্ধির সাথে তার আত্মপ্রত্যয়ের উদ্বোধনে কাজ করে যেতে হবে নারীবাদকে। এক এক অঞ্চলে এক এক ভাবে। আত্মপ্রত্যয়ের উদ্বোধনের পথেই অর্জিত হবে আত্মশক্তির। লিঙ্গরাজনীতির ঘেরাটোপ কেটে নারীমুক্তির জন্যে যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। একমাত্র তখনই পিতৃতন্ত্রের আস্ফালন ও আধিপত্যের কাছে নিঃশর্ত ও নিরব আত্মসমর্পন না করেও নারী তার নিজস্ব ভুবনে লড়াই করে বেঁচে থাকার সাহসটুকু খুঁজে পাবে। সেইদিনই একজন নারীর কাছে মুক্তির দিন। গর্বিত হওয়ার দিন। পথ দেখানোর দিন বাকিদেরকে।

—-শ্রীশুভ্র

মানুষই শ্রেষ্ঠ ধর্ম—তাই মানবতাই হোক আমাদের সবার ধর্ম

পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় হলো মানুষ। আর মানুষই সবচেয়ে দামি। তাই, মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়ে তাঁকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে। জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসাবে মানুষকেই প্রধান্য দিতে হবে। জীবনে-মরণে মানবহৃদযন্ত্রে একমাত্র মানুষকেই ধারণ করতে হবে। এই মানুষই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আর মানুষকে ভালোবাসলেই ধর্মপালন হয়ে যায়। এই মানবপ্রেমের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নাই। মানবতাই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম আর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এর চেয়ে বড় কাজ আজ অবধি পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি।

আমার ধর্ম মানবতা। আর আপনার ধর্ম? আর আপনাদের? আশা করি সকলেই বলবেন: আমাদের ধর্ম মানবতা। আজকের দিনে মানবধর্মের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নাই। আর এই যুগে এসে ধর্মের জন্য মানুষকে পর করে দেওয়া যে কতটা মূর্খের কাজ—তা একবার গভীরভাবে না ভাবলে আমাদের আজ আর চলবে না।

আপনি ধর্মপালন করবেন খুব ভালো কথা। সারাদিন আপনি ধর্মপালন করুন। কেউ আপনাকে বাধা দিবে না। আপনি নীরবে-নিভৃতে-একান্তমনে আপনার ধর্মসাধনা চালিয়ে যান। কিন্তু আপনি কোনো মানুষকে আঘাত করে আপনার ধর্মপালনের কাজ শুরু করবেন না। মানুষকে আঘাত করলে আপনার ধর্মই হবে না। আপনি ধর্মপালন করবেন কীভাবে? আর মানুষকে আঘাত করাটাই হলো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অধর্ম।

সকল ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। আর মানুষের চেয়ে পৃথিবীতে কোনো ধর্ম বড় নয়। মানুষ সবার সেরা। আর আপনি যে ধর্মের কথা বলেছেন তাও তো মানুষের জন্য। তবে আপনি কেন অন্যধর্মের বা যেকোনো মানুষকে আঘাত করে ধর্মপালন করতে চাইবেন? এটি অধর্মেরই নামান্তর। কাজেই, আপনি মানুষকে মেরে কখনও ধর্মপালন করতে পারবেন না। এতে ধর্মপালন হবে না। আর এতে শুধু অধর্মই বাড়বে।

আপনি আগে মানুষ হন পরে ধর্মপালন করতে আসবেন। এখন দেখি, অনেকেই ধর্ম না বুঝে এটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। শুনেছি, লেবু নাকি বেশি নাড়াচাড়া করলে বা কচলালে একেবারে তিতা হয়ে যায়। ঠিক তেমনিভাবে আজ একটি শ্রেণী ধর্মকে এতো বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, আর এটি নিয়ে সীমাহীন নাড়াচাড়া করছে যে, এদের অত্যাচারে ধর্ম আজ তিক্ততার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এরা ধর্মকে সাধারণ মানুষের কাছে হাসির পাত্র করে তুলেছে। এদের জন্যেই মানুষ এখন ধর্মকে অশ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে। আপনি যদি সত্যিকারের ধার্মিক হয়ে থাকেন—তাহলে ধর্ম নিয়ে বেশি চিৎকার ও চেঁচামেচি করবেন না। কারণ, এতে আপনার ধর্ম লোকসমাজে ঠুনকো হয়ে যাবে, আর হেয় প্রতিপন্ন হবে। আপনার ধর্মকে আপনি যদি সামান্য পরিমাণ ভালোবেসে থাকেন—তাহলে আজ থেকে আর ধর্ম নিয়ে এতো বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। আপনি ধর্মপালন করুন। আপনি আপনার ধর্মে একেবারে মশগুল হয়ে থাকুন। কে আপনাকে ধর্মপালনে বাধা দিচ্ছে? কিন্তু তাই বলে আপনার ধর্মকে আপনি অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করবেন না। এটি এই আধুনিকযুগের পৃথিবীর মানুষ মানবে না। এর ফল ভালো হবে না। এর ফল কখনও ভালো হয়নি। এই আধুনিকযুগে আপনি একজন মানবতাবাদী হয়ে উঠুন। আর সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। দেখবেন, আপনি আপনার মনের অজান্তেই ধার্মিক মানুষে পরিণত হয়েছেন।

ধর্ম বাড়াবাড়ির জিনিস নয় কিংবা মাতামাতির কোনো বিষয়ও নয়। এটি নীরবে পালন করতে হয়। এটি আপনমনে সাধনা করতে হয়। আসলে, ধর্ম একেবারেই আপনমনে সাধনার জিনিস। আর
আপনি যদি ধার্মিক হয়েই থাকেন—তাহলে পৃথিবীর সকল ধর্মের ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। এতে আপনার ও সকলের মঙ্গল হবে। আপনি যদি কারও ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান কিংবা অবজ্ঞা করতে চান—তাহলে অন্যে আপনার ধর্মকেও অবজ্ঞার চোখে দেখতে শুরু করবে। এতে শুরু হবে ধর্ম নিয়ে সংঘাত। আর আপনি আপনার কদর্য ব্যবহারের দ্বারা নিজধর্মকে অপমান করলেন। আর পৃথিবীতে ধর্মের নামে অশান্তির বীজবপন করলেন। এই অপরাধ আপনার।

আপনি ধার্মিক হতে চাইলে সবার আগে মানুষকে ভালোবাসুন। মানুষকে অবজ্ঞা করে কেউ ধার্মিক তো দূরের কথা মানুষও হতে পারবে না। কারণ, মানুষ ধর্মের চেয়ে বড় সম্পদ।
আপনি যে-ধর্মেরই অনুসারী হন না কেন—আপনি সবার আগে সর্বধর্মের মানুষকে ভালোবাসুন। আর সকল ধর্মের উপরে মানুষ আর মানবতাকে স্থান দিন। তাহলে আপনি প্রকৃত ধার্মিক ও মানুষ হতে পারবেন।

পৃথিবীতে মানবতা শব্দটি এখনও টিকে আছে। কিন্তু মানবতা মানুষের মধ্যে কতখআানি রয়েছে তা আজ বিচার্য বিষয়। চারিদিকে এখন মানবতা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার দুঃসংবাদ শুনতে পাচ্ছি। আর মানুষের হাতেই এখন মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষ ধ্বংস করছে মানুষের শান্তির আবাসভূমি। এই মানুষ মানবতার মহাবাণী ভুলে লালনপালন করছে আর আশ্রয়প্রশ্রয় দিচ্ছে—মানবতাবিরোধী সাম্প্রদায়িকতাকে, ধর্মীয় উন্মাদনাকে, আর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকে! এরচেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে?

মানুষের পৃথিবীতে মানুষের জন্য মানবতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও জরুরি। কিন্তু কিছুসংখ্যক মানুষ এটি কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এরা ধর্মের নামে মানুষহত্যা করছে। এরা ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ঘোষণা করে অসহায় মানুষকে হত্যা করছে। নারী ও শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে পৃথিবীতে আরও বেশি পাশবিকতার জন্ম দিচ্ছে।

মনে রাখবেন: ধর্মের উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি আর শ্বাশ্বত কল্যাণ। আর আপনি কী করলেন বা কী করছেন? আপনি জেনেশেুনে ধর্মের নামে মানুষহত্যা করছেন। আর এটিই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অধর্ম। আপনি ধর্মীয় উন্মাদনা বন্ধ করুন। মানুষকে ভালোবাসুন। আর সবার আগে মানুষকে ভালোবেসে মানবতাবাদী হন। আর এতে আপনি সত্যিকারের ধার্মিক হতে পারবেন। আর আপনি জোরেশোরে চেঁচিয়ে বলুন: আজ থেকে আমার ধর্ম মানবতা। আমি মানবতাবাদে বিশ্বাসী মানুষ। আমি মানুষকে ভালোবাসি। আর মানুষ ছাড়া আমার কোনো ধর্ম নাই। আজ থেকে মন্যুষত্বই হোক আমাদের পরম ও একমাত্র ধর্ম।

আপনার ধর্ম কিংবা ধর্মগুরু যদি আপনাকে সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি হতে বলে—তাহলে, আপনি কালবিলম্ব না করে আজ-এক্ষুনি সেই ধর্মত্যাগ করুন। আর সেই মানবতাবিরোধী-বিধিবিধান আপনি স্বজ্ঞানে-সজ্ঞানে-স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করুন। ধর্ম মানে জীবনকে আরও সুন্দর করা। কিন্তু আপনার ধর্ম যদি আপনাকে আরও কুৎসিত কিংবা আরও অসুন্দর করে তোলে—তাহলে, আপনি সেই ধর্ম দিয়ে কী করবেন? আপনি ধর্মত্যাগ করুন। এতে আপনার ধর্ম ও সাধারণ মানুষজন উভয়ই রক্ষা পাবে। আপনি ধর্মের নামে কাউকে হত্যা করতে পারেন না। কারণ, ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। আর ধর্মের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসুন। এই পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই আপনার আত্মীয়স্বজন। আপনার সমস্ত আপদেবিপদে একমাত্র মানুষই আপনার পাশে ছুটে আসবে। এক্ষেত্রে আপনার পাশে আপনি আর-কাউকে খুঁজে পাবেন না। তাই, ধর্মের চেয়ে আগে মানুষকে বেশি ভক্তি করতে শিখুন। আর ধর্মের জন্য কিংবা ধর্মগুরুর নির্দেশে আপনি মানুষহত্যা কেন করবেন? এতে আপনার কী লাভ? আপনার সবচেয়ে আপনজন কে? ধর্ম না মানুষ? অবশ্যই মানুষ। একমাত্র মানুষই আপনার পরমাত্মীয়। আর আপনি মূর্খের মতো সেই পরমাত্মীয়কে অবহেলা করে ধর্মের মতো একটি সাধারণ বিষয়কে মাথায় নিয়ে মানুষহত্যায় মেতে উঠবেন? এটি কোনো মানুষের কাজ নয়। আর এটি কোনো সভ্যসমাজের কোনো সভ্যমানুষের আচরণিক বৈশিষ্ট্য নয়। তাই, এইজাতীয় সমস্ত শয়তানী এখনই পরিত্যাগ করুন। আর জীবনে আরেকবার শুনে রাখুন: এই পৃথিবীতে সকল ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। মানুষ বড়। আর মানুষ বড়। আজ তাই, এই পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বড় আর-কিছু দেখছি না।

আপনার ধর্ম যদি আপনাকে বিপথগামী করে—তাহলে, আপনি নির্দ্বিধায় আপনার ধর্মের সেইসব অমানবিক বিধিবিধান পরিত্যাগ করে অতিসত্বর মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। মানুষই আপনার স্বজন। আর এখানেই আপনার মুক্তি মিলবে।

আপনাকে আমি অহেতুক ধর্মত্যাগ করতে বলছি না। কিন্তু আপনার ধর্ম কিংবা ধর্মগুরু যদি আপনাকে মানুষ হতে বাধা দেয়, আর জঙ্গি হতে সাহায্য করে—তবে আপনার ধর্ম রেখে লাভ কী? কারণ, ধর্মপালন করে শয়তান হওয়ার চেয়ে ধর্মত্যাগ করে মানুষ হওয়া অনেক ভালো। আপনি যদি ধার্মিক হতে চান—তবে আপনি আগে মানুষকে ভালোবাসুন। দেখবেন, এতে স্রষ্টা খুশি হয়ে আপনার দরজায় কড়া নেড়ে আপনার কুশল জিজ্ঞাসা করতে ছুটে আসবেন। এটাই ধর্ম। আর এটাই চিরসত্য। আর এটাই মানবতাধর্ম। আপনি সামান্য ধর্মের জন্য এই মানুষকে অস্বীকার না করে মানুষকে ভালোবাসুন। আর মনে রাখবেন: মানুষ আর মানবতাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আসুন, সবাই এই পবিত্র ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করি।

আজ থেকে একমাত্র মানবতাই হোক আমাদের সবার ধর্ম।

জয় হোক মানবতার।
আর জয় হোক মনুষ্যত্বের।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
১১/০৮/২০১৭

নাট্যমঞ্চ


কলাম করা একটি চারা গাছ এনেছিলাম। সময়টা শুধুই মনের দাবি। কখন, কোনদিন, কোন বার, কোন সময়ে? আকাশে কালমেঘ যখন স্বচ্ছ আকাশটাকে আধা জ্বলন্ত চুল্লির ধোয়ায় চোখে জল নিয়ে আসে ঠিক তেমনি। চোখের জল ছাড়া কিছুই বলতে পারি না। মনেও পড়ে না। শুধু বেদনার জল, স্মৃতির ছলছলানির কথাই স্মরণ হয়।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কলামের চারা থেকে ফল আহরন করবো না। যেদিন পরিপক্কতা পাবে কিংবা যেদিন ফল দিয়ে সে তৃপ্ত হবে সেইদিন নেব। চারা গাছে একদিন মুকুল এলো এর পর ফলের পথে পথ চলতে শুরু করলো। একদিন ফল পরিপক্কতার রূপ ধারন করলো। লোভ সামলানোটা কষ্টের রুপে বেদনা হয়ে উপস্থিত হলো। সকল বেদনার অবসান ঘটিয়ে মনকে সান্ত্বনা দিয়েই অপেক্ষায় রাখেছি।
ফলের ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ সুগন্ধি। গাছের নিকট যাই আর ফলের পানে চোখ মেলে তাকাই। মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে দেই। একদিন ভাবতে থাকলাম। ফল পূর্ণতা পেয়ে গাছের নিচে পড়ুক। কলামের চারা নয় নাড়ীর চারা নিয়ে অন্য কোথাও বপন করবো।

দিন গেলো মাস গেলো। চারা গাছের নীচে চারার চারা দেখতে পেলাম। কি সতেজ চারা গাছের পাতা, কাণ্ড। খুব মায়া হলো মাটির বুক চিরে কিভাবে চারাটি অন্য স্থানে স্থানান্তর করি। দিনে দিনে মায়া বেড়েই চললো। আর হলো না চারা গাছটি উত্তোলন করে অন্যত্র বপন করা।

দিন,মাস, বছর পেরিয়ে চারা আর চারা নেই যৌবনের জোয়ারে ভাসছে। যার নিকট থেকে তার বেরিয়ে আসা আজ সে তার থেকেও অনেক অনেক বড় হতে চলেছে। কলামের সেই গাছটি আজ চারা গাছের আড়ালে খাবারের অভাবে শুকিয়ে গেছে। কোন মায়া মমতাই নেই। হায়রে চারা বৃক্ষ, যেখান থেকে তোর আসা সেই রাস্তাকে এভাবেই তিলেতিলে ধবংস করে দিলি।

একদিন কলামের গাছটির পাতা,মূল,কাণ্ড টলতে শুরু করেছে। অবহেলা অযত্নে আর কতদিন। খাবারের অভাবে আজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এতো গুলো ফল জন্ম দিয়েও আজ সে খাবারের অভাবে ঠিক ফাঁস দেয়া মানুষের মতো শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সেদিন রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে কি লাভ হলো। যেই রক্ষক আজ তাকেই ভোগ করে নিলো।

সৃষ্টির সৃষ্টতা সত্যই বড় অদ্ভুদ। একদিন সেও হয়তো এভাবেই কারো না কারো ভোগের সামগ্রী হয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানাবে। আসলে ভবিষ্যত নিয়ে কেউ ভাবে না। বর্তমানকেই স্বর্গ ভেবে ভুলে যায় সৃষ্টির রহস্য। সৃষ্টি মাঝেই যে ধবংস সে কথা ভুলে যায় ক্ষণিকের আহলাদে, স্বার্থে। সত্য এটাই চলে যেতে হবে সবার। জীবনটা নাট্যমঞ্চের চেয়েও কঠিন নাট্যঙ্গায়ন।

“জন্মিলে মরিতে হবে রে, জানে তো সবাই
তবু মরণে মরণে অনেক
ফারাক আছে ভাই রে, সব মরণ নয় সমান।।”— প্রতুল মুখোপাধ্যায়

ভালোবাসা উৎসরিত নৈতিকতা

ভালোবাসা উৎসরিত নৈতিকতা

অত্যন্ত সহজ ভাবে বললে, ভালো’কে ভালো এবং খারাপ’কে খারাপ বলতে পারা বা চিহ্নিত করতে পারাই নৈতিকতা। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টা আপেক্ষিক। শুধু মাত্র আপাত ভালো’কে ভালো মানুষ আর খারাপ’কে খারাপ মানুষ বলাটা যথাযথ নৈতিকতার পরিচয় বহন করে না। দরকার মানুষকে বোঝা।

প্রত্যেকটা মানুষের সাথে জড়িয়ে আছে কিছু দায়িত্ব। সে দায়িত্ব ভালোর জন্য ভালোর, খারাপের জন্য ভালোর, ভালোর জন্য খারাপের এবং খারাপের জন্য খারাপের যে কোন রকম হতে পারে। এই দায়িত্ব বোধ ও আবার ভালো খারাপ দু’রকমই হতে পারে। অথবা হতে পারে দুইয়ের মিশ্রণ। মানুষের সব রকম কর্মকাণ্ড প্রকাশ্য নয়। প্রকাশ্যে ভালো মানুষ হতে পারে অন্তরালে খারাপ অথবা অন্তরালে ভালো কাজ করা একজন ও প্রকাশ্যে খারাপ হিসেবে পরিচিত হতে পারেন।

একজন মানুষ আসলে কতটা ভালো অথবা কতটা খারাপ তা তার নিজের চেয়ে ভালো কারো জানা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোন মানুষের পক্ষেও খুবই রহস্যময় এবং জটিল বিষয় এটা বোঝা যে তিনি আসলে কতটা ভালো বা কতটা খারাপ। কারন ভালো বা খারাপ মানুষ মূল্যায়ণের আদর্শ মাপকাঠি যে আদর্শে তৈরি তা সব মানুষের কাছে আদর্শ নয় এবং কোন নির্দিষ্ট আদর্শ সব মানুষের কাছে সুনির্দিষ্টও নয়। আর তাই নৈতিকতার সংজ্ঞাও সব মানুষের কাছে এক নয়।

মানুষের ক্ষেত্র ব্যাতিত অন্য সকল বিষয়ের নৈতিকতাও মানুষের উপরেই নির্ভরশীল কেননা তা মানুষেরই সৃষ্টি। মানুষ নিজেদের জন্য যথাযথ আদর্শ স্থির করতে না পারলেও পারিপার্শ্বিক সকল কিছুর মূল্যায়নের জন্য একাধিক বা বহুবিধ আদর্শ তৈরী করতে সমর্থ হয়েছে যা তারা নিজেদের জন্য সুবিধাজনক ভাবে প্রয়োগ করতে সচেষ্ট।

এই ব্যক্তি আদর্শ এবং বস্তু বা বিষয়ের আদর্শের এই ব্যবধানই তৈরী করেছে মানুষের সাথে মানুষের বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব। তাই আদর্শের প্রকৃত অর্থে সর্বজন স্বীকৃত কোন আদর্শ মানদণ্ড নেই।

কিন্তু এ জগতে মাত্র একটাই বিষয় চিরন্তন আর তা হচ্ছে ভালোবাসা। কারন ভালোবাসা সর্বজন স্বীকৃতির মুখাপেক্ষী নয় বরং নিজেই সর্বজনীন। মানুষ ভালোবাসা ব্যতীত মৃত।

নৈতিকতার জন্ম হোক মানুষের প্রতি মানুষের এবং আপনজনের, পরিবারের, সমাজের, দেশের, পৃথিবীর তথা মহাবিশ্বের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থেকে।

ভালোবাসা উৎসরিত নৈতিকতাই শাশ্বত !