বিভাগের আর্কাইভঃ প্রবন্ধ

ছড়াদাদুর পাঠশালা ৮

ছড়াদাদু বললেন- তিনরকম ছন্দ আর অনুপ্রাস নিয়ে মোটামুটি আলোচনা করা হল। এবার আমরা যাব মুক্তকছন্দে। মুক্তক বা মুক্তছন্দ আসলে কোনো ছন্দ নয়। ছন্দের আঙ্গিক বিন্যাস মাত্র। তিনটি ছন্দেই মুক্তক পদ রচনা করা যায়। এটি যে কোনো ছন্দে প্রতি লাইনের পর্বসমতা কম-বেশি করে লেখা হয়।
যেমন –
খবরটা নয় /উড়ো-৪+২
চিনদেশেতে /আছে সে এক/ পাঁচবছরের/ বুড়ো।৪+৪+৪-২
খরায় জ্বরায়/ ভিজে ভিজে-৪+৪
থমকে আছে /বয়সটা তার /
একটু বাড়ে/নি যে।৪+৪+৪+২
এটা স্বরবৃত্তে লেখা একটি মুক্তপর্বের ছড়া। তো ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছো তো?
আদৃতা বলে- কিছুটা। তবে অন্য ছন্দের আর একটা উদাহরণ পেলে আরো পরিস্কার হয় যাবে।
দাদু বলেন – এবার তাহলে রবীন্দ্রনাথের কবিতাই বলি-
প্রিয়া তারে রাখিল না/ রাজা তারে/ ছেড়ে দিল পথ-৮+৪+৬
রুধিল না /সমুদ্র পর্বত ৪+৬
আজি তার রথ……৬

আসলে মুক্তছন্দে ছন্দকে ঠিক রেখে ইচ্ছেমত ভাবের প্রসার ঘটিয়ে ইচ্ছানুযায়ী মাত্রা, পর্ব, ছন্দের অন্ত্যমিল এবং স্তবকসহ কবিতার পুরো বিন্যাসকে নিজেরমত করে সাজিয়ে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথই প্রথম পয়ার ভেঙে অসমপর্বের এই ছন্দের প্রবর্তন করেন।
এই মুক্তকছন্দের সাথে গদ্যছন্দের সাদৃশ্য আছে। গদ্যকবিতার ছন্দেও ভাষাগত পরিমিতি, ভাবের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ ধ্বনিপরিমিতি মেনে সচ্ছন্দ গতিশীলতা বজায় রাখতে হয় যাতে পড়ার সময় হোঁচট খেতে না হয়।
দীপেন বলে – দাদু একটা গদ্য কবিতার উদাহরণ দিন।
– বলা-ই যায় না
শুধু দলাদলা কষ্টরা
দীর্ঘশ্বাস বেয়ে নেমে আসে।
দেখ, এখানে হয়তো ছন্দের নির্দিষ্ট রূপ নেই তবু এর চলনে রয়েছে একটা সচ্ছন্দ গতিশীলতা যা অক্ষরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। ছাড়ো এসব।

দাদু একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন- আমরা যেহেতু শুধুমাত্রা ছড়া বা ছোটদের কবিতা লেখার কায়দাকানুন নিয়ে কথা বলার জন্য পাঠশালা খুলেছি, তাই ও’গুলো লিখতে গেলে যতটুকু ছন্দ-অলঙ্কার জানার দরকার সেটুকুই শুধু বলা ভাল। যা যা আলোচনা হল তা কি তোমাদের বোধগম্য হয়েছে?
ওরা হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়ল।
দাদু বললেন- এবার তাহলে আমাদের ছড়া আর ছোটদের কবিতা লেখায় হাত দিতে হবে।
আগামিদিন আমরা সেপথেই এগুবো। আজ ওঠা যাক।
(চলবে)

ছড়াদাদুর পাঠশালা ৭

আজকের আলোচনা হবে অনুপ্রাস নিয়ে – ছড়াদাদু বলেন।
ওরা পাঁচজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
তবে তার আগে তিনপ্রকার ছন্দের মধ্যে পার্থক্যটা সংক্ষেপে একটু করা যাক।
-ঠিক। – ওরা সম্মতি জানায়।
-স্বরবৃত্তে রুদ্ধদল একমাত্রা আর মুক্তদলও একমাত্রা।
মাত্রাবৃত্তে রুদ্ধদল দুইমাত্রা আর মুক্তদল একমাত্রা।
অক্ষরবৃত্তে শব্দের শুরুর রুদ্ধদল একমাত্রা আর শব্দের শেষের রুদ্ধদল দুইমাত্রা।
পর্বের ক্ষেত্রে স্বরবৃত্ত চারচার চালে চলে। মাত্রাবৃত্ত চার, পাঁচ, ছয় ও সাত মাত্রার চাল হতে পারে। আর অক্ষরবৃত্তে মুলত চারমাত্রার চালে চলে। এটাকে আট বা দশ মাত্রা হিসেবেও গোনা যায়।
স্বরবৃত্ত চটুল, মাত্রাবৃত্ত শান্ত আর অক্ষরবৃত্ত গম্ভীর। স্বরবৃত্ত শ্বাসাঘাত বা ঝোঁকপ্রধান, মাত্রাবৃত্ত ধ্বনিপ্রধান আর অক্ষরবৃত্ত তানপ্রধান ছন্দ।
আর একটা কথা যদিও আমরা ছড়ার আলোচনায় বসেছি, তবু তোমার জ্ঞাতার্থে এখন মুক্ত বা গদ্যছন্দ নিয়ে দু’চার কথা বলবো।
– আদৃতা বলে – খুব ভাল হয় তাহলে।
দেখ, ছন্দ তো মূলত তিনপ্রকার। গদ্য বা মুক্ত ছন্দ আসলে কোনো ছন্দ নয়। মাত্রাসমতা ঠিক রেখে পর্ব কম-বেশি করে লেখা হলে মুক্তছন্দ আর টানাগদ্যে লেখা হলে গদ্যছন্দ।
অক্ষরবৃত্তই এই কাজের উপযুক্ত। তবে অন্য ছন্দও অসম্ভব নয়। এ বিষয়ে আলোচনা আর না এগিয়ে আমরা অনুপ্রাসে যাই।
দাদু একটু থেমে বলেন- -অনুপ্রাস হল একধরনের শব্দালংকার। অনু শব্দের অর্থ পরে বা পিছনে আর প্রাস শব্দের অর্থ বিন্যাস, প্রয়োগ বা নিক্ষেপ। একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছের একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে সুন্দর ধ্বনিসাম্যের সৃষ্টি হয় তার নাম অনুপ্রাস। এর ফলে সৃষ্টি হয় একটি সুন্দর ধ্বনি সৌন্দর্যের। যেমন ধরো-
“কাক কালো কোকিল কালো কালো কন্যার কেশ।” এখানে ক বর্ণটি ৭ বার ব্যবহৃত হয়েছে। এটাই হল অনুপ্রাস।
অনিক জানতে চায় – এই অনুপ্রাস কত রকম হতে পারে ছড়াদাদু?
– তিনরকম- ছড়াদাদু বললেন- অন্ত্যানুপ্রাস, বৃত্ত্যনুপ্রাস এবং ছেকানুপ্রাস।
কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তারই পুনরাবৃ্ত্তিতে যে অনুপ্রাস অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস। অর্থাৎ কবিতার দু’টি চরণের শেষে যে শব্দধ্বনির মিল থাকে তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে।
যেমন – হাঁস বলে – ও হাঁসিনী,
দু’জন মিলে পুকুর-বিলে
বল্ কতদিন ভাসিনি?
এখানে হাঁসিনী আর ভাসি নি। একে অন্ত্যমিলও বলা হয়ে থাকে।

একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বা বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে বহুবার ধ্বনিত হলে যে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় বৃত্ত্যনুপ্রাস।
যেমন: কাক কালো কোকিল কালো কালো কন্যার কেশ। বা চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।
এখানে প্রথমটিতে ক এবং দ্বিতীয়টিতে র বা আর বৃত্তের মত বৃহুবার উচ্চারিত হয়েছে।

আর দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে একইক্রমে মাত্র দু’বার ধ্বনিত হলে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম ছেকানুপ্রাস। একে আদ্যানুপ্রাসও বলা হয়ে থাকে। এ ধরণের অনুপ্রাসের বাস্তব ব্যবহার বাংলায় খুব বেশি দেখা যায় না।
যেমন: অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আসলে এগুলো তো অলঙ্কার। হলে ভাল লাগে। শব্দচলনে একটা সমধ্বনির অনুরনণ আসে। পড়তে ভাল লাগে।

আদৃতা জানতে চায় – ছড়ার ক্ষেত্রে অন্ত্যমিলটা বাধ্যতামুলক। কিন্তু অন্যগুলো না হলে কি কোনো ত্রুটি হয় ছড়াদাদু?

দাদু বলেন- অন্ত্যমিল বাধ্যতা মূলক ঠিকই কিন্তু অন্তে মিল না রেখেও যে লেখা যাবে না তা কিন্তু নয়। ছন্দচলনটা ঠিক থাকলে ওটা গৌণ হয়ে যায়, তা ইদানিং কোনো কোনো ছড়াকার তো দেখিয়েছেন।
-তাই? মামুন বিস্মিত হয়।
-একটা উদাহরন দিতে পারবেন দাদু? – অনিক বলে।
– শোন তবে- দাদু বলেন-
দুয়ারে নীরবে দাঁড়িয়ে বাতাস
বাড়িয়ে বাউল-ডানা,
হৃদয় নাড়িয়ে চলে যায় দুরে
বলে যায় নানা কথা।
এখানে দেখ লাইন শেষে অন্ত্যমিল নেই। কিন্তু দাঁড়িয়ে, বাড়িয়ে, নাড়িয়ে -অনুপ্রাসের ব্যবহারে আর স্বরবৃত্তের চলনে লেখাটি ছন্দময় হয়ে উঠেছে।
ওরা একসাথে -বাহ্ – বলে ওঠে।
দাদু বলেন – আসলে কবিতা বা ছড়া রচনার প্রধান শর্ত হল সাবলীল আর নির্ভুল ছন্দ। অন্ত্যমিল নয়। (চলবে)

ছড়াদাদুর পাঠশালা ৬

আজও ছড়াদাদুর পাঠশালা বসেছে। দাদুর বাড়ির দক্ষিণদিকের খোলারমাঠের ঘাসের উপর সবাই বসে পড়েছে হাত পা ছেড়ে।

দাদু বলেন- স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত হল, আজ অক্ষরবৃত্ত। তাই তো?
ওরা বলে – হ্যাঁ,
– শোনো, অক্ষরবৃত্তে মুক্তদল একমাত্রা ও রুদ্ধদল যদি শব্দের শুরুতে বা মধ্যে থাকে তাহলেও এক মাত্রা হয়। কিন্তু, যদি শব্দের শেষে থাকে তাহলে দুইমাত্রা হয়।
এর সাথে মাত্রাবৃত্তের সামান্য মিল আছে। এ দুটি ছন্দে একটি প্রধান পার্থক্য হলো, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ রুদ্ধদল সবসময় দুইমাত্রা। কিন্তু, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শুধুমাত্র শব্দের শেষের রুদ্ধদল দুইমাত্রা, বাকিগুলো একমাত্রা। যেমন-
‘‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি”।
বিশ্লেষণে দাঁড়ায় – হে +বঙ্ +গ +ভান্+ডা+রে+ত+ব / বি+ বি+ধ+ র +ত+ন –
এখানে বঙ্গ- বঙ্+গ, ভাণ্ডার – ভান্+ডার,। শব্দের শুরুতে বলে এই বঙ্ ও ভান্ এক মাত্রা করে হবে কিন্তু রতন- র+ তন্, এখানে রুদ্ধদল- তন্ শব্দের শেষে বলে দুইমাত্রা পাবে।
তোমাদের বিষয়টা বোঝাতে পেরেছি কি?
অরনি বলে – হ্যাঁ দাদু, বুঝতে পেরেছি।
আদৃতা বলে – স্বরবৃত্তে তো চারচার মাত্রার পর্ব, মাত্রাবৃত্তে চার,পাঁচ, ছয় ও সাত মাত্রা, কিন্তু অক্ষরবৃত্তে পর্ব ভাগ হয় কিভাবে?
-এটাই আমি বলব ভাবছিলাম। তুমি সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্ন তুলেছ। শোন তবে-
‘‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব/ বিবিধ রতন-৮+৬
তা সবে অবোধ আমি/ অবহেলা করি”। ৮+৬
বা
হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/ পৃথিবীর পথে,৮+৮+৬
সিংহল সমুদ্র থেকে/ নিশীথের অন্ধকারে/ মালয় সাগরে।৮+৮+৬
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতার আবৃত্তি ধীরগতি ও একটু গম্ভীর হয়।
অক্ষরবৃত্তের বৈশিষ্ট্যগুলো একটু বলুন দাদু – অনিক বলে।
দাদু বলেন- এই ছন্দের প্রতিটি পর্বে জোড়সংখ্যক মাত্রা থাকে। পর্বে মাত্রা সংখ্যা দুই থেকে শুরু করে চার, ছয়, আট, দশ যে কোনো সংখ্যক রাখা যায়। এক্ষেত্রে মানতে হয় জোড়ে জোড়, বিজোড়ে বিজোড়।
আদৃতা বলে – কি রকম দাদু?
– জোড় মাত্রার শব্দের পাশে জোড় মাত্রার শব্দ এবং বিজোড় মাত্রার শব্দের পাশে বিজোড় মাত্রার শব্দ বসানো। পরে ইচ্ছেমতো লাইন তৈরি করলেও ছন্দের ক্ষেত্রে কোনো ক্রুটি হয়না।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল আসলে চার মাত্রার । চারের যে-কোনও গুণিতকের সঙ্গে দুই যোগ করলে যে-সংখ্যাটা মিলবে, তত সংখ্যার মাত্ৰা দিয়েই অক্ষরবৃত্তের লাইন তৈরি করা যায়।
দীপেন বলে – যেমন?
দাদু জানান- হাসিমাখা/ মুখ
এ হল ৪+২=৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। এর সাথে আরও চার মাত্রা জুড়ে দিয়ে – হাসিমাখা/ মুখখানি/ দেখি
৪+৪+২=১০ মাত্রা। এভাবে মাত্রা বাড়াতে হয়।
আদৃতা বলে – তাহলে চতুর্দশপদীগুলোর মাত্রা মুলত ৪+৪+৪+২ হবে।
-একদম ঠিক বলেছো। ওটাকেই যুক্ত করে ৮+৬ বলা হয়।
মামুন জানতে চায় – সব ছন্দের ক্ষেত্রে মাত্রার সাথে কিছু অপূর্ণমাত্রা যেমন ১, ২, বা ৩ মাত্রা বেশি রাখতে হয় কেন?
দাদু বলেন-পড়ার সময় একটু দম ফেলার জন্য এই মাত্রাঘাটতি রাখতে হয়। যদি পূর্ণমাত্রা রাখা হয় তাহলে তো থামার ফাঁক পাওয়া যায় না তাই । ওদের যদি না জুড়ে দেওয়া হত, তাহলে প্রথম লাইন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় লাইন শুরু করতে হত।
– বাহ্, এইবার বুঝলাম। অতিপর্ব আসলে কেন রাখতে হয়। – মামুন বলে।
দাদু বলেন – আজ তাহলে ওঠা যাক। আবার পরের দিন।
সকলে উঠে পড়ল।
(চলবে)

কবিতা কেন ছন্দহীন হবে?

ছন্দ থেকে মুক্তি মানেই ছন্নছাড়া।

মহাজগতে সবকিছুই ছন্দ মেনে চলে। ছন্দই প্রকৃতি। তাই কোনোকিছুই ছন্দহীন চলতে পারে না।
ছন্দহীনতা ধ্বংসের পূর্বরূপ।
পৃথিবী তার নির্দিষ্ট ছন্দগতিতে ঘুরছে। এর ছন্দপতন হলেই ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।

কবিতাকে ছন্দ থেকে মুক্তি দেওয়া যায় না। গদ্যেরও নিজস্ব ছন্দ আছে। ছন্দ হল সুষম বাঁধাহীন চলার গতি। সেটা ঠিকঠাক না থাকলে পাঠক হোঁচট খাবে। ফলে পড়তে আর ভাল লাগবে না।

ছন্দ মানে লাইন শেষে অন্ত্যমিল নয়। অন্ত্যমিল বন্ধন হতে পারে।
ছন্দ আসলে বাঁধা-বন্ধন হীন মসৃন পথ। কবিতা তার থেকে সরে যাবে কীভাবে? তাহলে ভাব-শব্দ সব তো খেই হারিয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। পাঠযোগ্যতা হারিয়ে ফেলবে।

আমরাও শিশুকাল থেকে ছড়ার ছন্দ আওড়াতে আওড়াতে ছন্দেছন্দে বেড়ে উঠি। তাই জীবন যখন ছন্দহীন হয় আমরা সইতে পারি না।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছুই যখন ছন্দহীন নয় তখন কবিতা কেন ছন্দহীন হবে? আর আমরাই বা কেন তাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে ছন্দহীন করতে যাব?

ছড়াদাদুর পাঠশালা ৫

আজকের আলোচনা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ- অরনি বলে।
ছড়াদাদু বলেন- হ্যাঁ, তবে শুরু করা যাক।
একটু থেমে বলেন – মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্তদল একমাত্রা ও রুদ্ধদল দুইমাত্রার হয়। যেমন ধর – গন্ধ =গন্+ ধ, এখানে গন রুদ্ধদল। ধ মুক্তদল। স্বরবৃত্তে গন্ধ শব্দটি দুইমাত্রা। কিন্তু মাত্রাবৃত্তে গ+ন+ধ, মানে তিনমাত্রা।
আদৃতা বলে – মানে যুক্ত বর্ণগুলো দুইমাত্রা হয় মাত্রাবৃত্তে।
-একদম ঠিক বলেছো তুমি।
তবে স্বরবৃত্ত যেমন শুধুমাত্রা চারচার মাত্রার পর্ব মেনে চলে মাত্রাবৃত্ত কিন্তু তা নয়।
দীপেন বলে – তাহলে?
– এটি চার, পাঁচ, ছয় এমনকি সাতমাত্রার পর্বচলনেও হয়। চারমাত্রার চলনটি একটু দ্রুতলয়ের।
মামুন বলে -যেমন?
– ফিটফাট/ বাবু সেজে/ পায়চারি/ রাতদিন- ৪+৪+৪+৪ অথবা, ছিপখান/ তিন দাঁড়/ তিনজন/ মাল্লা- ৪+৪+৪+৩।
“দুর্গম গিরি/ কান্তার মরু/ দুস্তর পারা/ বার। ৬ + ৬ + ৬ + ২।
এটি ছয়মাত্রার পর্বে ও শেষে দুইমাত্রার অতিপর্ব।
দুর্গমগিরি-র লাইনটি ছড়াদাদু এবার একটু টেনে পড়লেন।
-দেখ মাত্রাবৃত্তের রুদ্ধদলও যেহেতু দুইমাত্রা তাই এদের পূর্ণতা দিতে একটু টেনে পড়তে হয়।
আবার দেখ- এইখানে তোর/ দাদির কবর/ ডালিম গাছের/ তলে
অনিক বলে- ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্ত।
-হ্যাঁ, তবে মজাটা হল – এই+খা+নে+তোর/ দা+দির +ক+বর/ ডা+লিম+গা+ছের/ ত+লে -৪+৪+৪+২
– আদৃতা বলে।
দাদু বলেন- কিন্তু সবক্ষেত্রে এটা হয়না। তবে অনেকে মাত্রাবৃত্তের সাথে স্বরবৃত্তকে গুলিয়ে ফেলে।
আসলে মাত্রাবৃত্তকে একটু টেনে পড়তে হয়, তবে আর সমস্যা হয় না।

এই নিয়মে ছয় মাত্রার ৩টি পর্ব আর দুই মাত্রার ১টি অতিপর্ব আছে। এখানে প্রতিটি রুদ্ধদল দুইমাত্রা।
অতিপর্ব ছাড়াও লেখা যেতে পারে।
“তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়/
লুটিয়ে দিতে পারি/ পিতার তরবারি/”৭ + ৭=১৪ দেখ,
এখানে দুটি সাত মাত্রার পর্ব, কোন অতিপর্ব নেই।
(চলবে)প্রকাশিত।

ছড়াদাদুর পাঠশালা ৪

আজ ছড়াদাদুর পাঠশালা বসেছে বাড়ির পেছনের মাঠে। সবুজ ঘাসের বিছানায় বসে পড়েছে ছাত্র-ছাত্রিরা।
দাদু বলেন-তাহলে শুরু করা যাক।
মামুন বলে- আজ হবে ছন্দ ও অলঙ্কার।
– হ্যাঁ, প্রথমেই বলি- নতুনদের মধ্যে ছন্দ আর অন্ত্যমিল নিয়ে একটা গোলমেলে ধারনা আছে। ছন্দ বলতে ভাবে দুটি লাইনের শেষে মিল। আসলে সেটি হল অন্ত্যানুপ্রাস বা অন্ত্যমিল। ওটা কখনই ছন্দ নয়।
ছন্দ হল কবিতা বা ছড়ার শব্দচলনের একটি বাঁধাহীন নিয়মনির্ভর গতি। ঘড়ির কাঁটা যেমন একটি নির্দিষ্ট মাত্রা ও পর্বের সমতা মেনে চলে তেমনি আর কি। আর
এই মাত্রাসমতা বজায় রেখে যদি কবিতা বা ছড়া লেখা হয় তবেই সেটি হয় ছন্দবদ্ধ লেখা।
যেমন – ফিটফাট / বাবু সেজে/ পায়চারি/ রাতদিন,
কানাকড়ি / মিলবে না/ পকেটেতে/ হাত দিন।
এই এক একটা ভাগ হল পর্ব। আর প্রত্যেক পর্বে যতগুলো দল আছে সেগুলোর প্রতিটি হল এক একটি মাত্রা। এটি চারমাত্রার মাত্রাবৃত্তে লেখা হয়েছে।
-আচ্ছা দাদু ছন্দ আর লাইনশেষে মিলের পার্থক্য তো বোঝা গেল। এবার বলুন ছন্দের বিভাগ নিয়ে।
– ছন্দ মূলত তিন রকম – স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর অক্ষরবৃত্ত। স্বরবৃত্তই প্রধানত ছড়ার ছন্দ। কিন্তু অন্য ছন্দেও যে লেখা যাবে না তা নয়।
ছন্দ আলোচনার আগে তোমাদের জানতে হবে দল বিষয়ে।
অরনি বলে – বলুন
– একটি শব্দের যতটুকু একবারে উচ্চারণ করা যায় সেটাই একটি দল বা সিলেবল বা মাত্রা।
অনিক বলে- একটা উদাহরণ দিন দাদু।
– যেমন ধরো, ছন্দ। একে ভাঙলে পাওয়া যায় ছন্ + দ। এতে দুটি দল আছে। দলকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়। রুদ্ধদল ও মুক্তদল।
যে দল ব্যঞ্জনান্ত সেটি রুদ্ধদল।
আর স্বরান্ত দল হল মুক্তদল।
দীপেন বলে – দাদু একটু উদাহরণ যোগে বলুন না।
– ছন্দ শব্দটির ছন্ হল রুদ্ধ দল আর দ হল মুক্তদল। ছন্ – এর শেষ বর্ণ -ন-তে যদি স্বরধ্বনি যুক্ত হত তাহলে ছনো হত ( ছ+ ন+অ/ও)
যেমন দ +অ/ও হয়েছে।
একইভাবে বিদ্যালয় ভাঙলে পাই বিদ্+দা+লয়। এখানে বিদ্ ও লয় রুদ্ধদল আর দা মুক্তদল। এবার তোমরা দু’একটা দল বিভাজন করো তো। বল – বৃষ্টিপাত কীভাবে ভাঙবে।
আদৃতা বলে- বৃষ্+টি+পাত।
মামুন বলে – বৃ্ষ ও পাত রুদ্ধদল। টি হল মুক্তদল।
দাদু খুশি হয়ে বলেন- একদম ঠিক। তার মানে তোমরা বুঝেছ।
সকলে একসঙ্গেই হ্যাঁ বলল।
দাদু বলেন- এবার আসি ছন্দে। স্বরবৃত্ত ছন্দে রুদ্ধদল দল ও মুক্তদল দুটিই এক মাত্রার মুল্য পায়। আর তোমরা মনে রাখবে স্বরবৃত্ত সবসময় চারমাত্রার চালে চলে। যেমন –
জ্বলছে আগুন/ মনে বনে/
টলছে প্রাণী/কুল,
কীসের পাপে /সৌর তাপে/
ফোটায় বিষের/ হুল!
জ্বল+ছে-আ+গুন/ ম+নে-ব+নে/
টল্+ছে-প্রা+ণী/ কুল,
কী+সের্-পা+পে/সৌ+র-তা+পে/ফো+টায়-বি+ষের/ হুল।
৪+৪+৪+১
৪+৪+৪+১
এইভাবে চরণদুটির মাত্রা বিভাজিত হয়েছে।
অরণি বলে – শেষের একমাত্রা?
– ওটাকে বলে অতিপর্ব। কবিতার প্রতিটি লাইনে সমমাত্রার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই হলো পর্ব। পঙ্ক্তি শেষের পর্বাংশকে অতিপর্ব বলা হয়। এ ধরনের পর্বাংশ লাইনের শুরুতে থাকলে আমরা তাকে উপপর্ব বলি।
এই অতি বা উপপর্ব এক, দুই, তিন মাত্রার হয়। আবার অতিপর্ব ছাড়াও চরণ নির্মিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে চারমাত্রার একটি পর্ব তৈরি হয়।যেমন-
ভুতের ছড়া/ লিখতে হবে/ সম্পাদকের/ ফরমায়েশে… ৪+৪+৪+৪
উপপর্ব হল-
কথা কইতে গেলে দোষ
সাপের বিষাক্ত ফোঁসফোঁস…
এখানে কথা ও সাপের হল দুইমাত্রার উপপর্ব।
এবার আসি স্বরবৃত্তের বৈশিষ্ট্যে। এটি দ্রুত লয়ের ছন্দ।
এই ছন্দের মূলপর্ব বা পূর্ণপর্ব চার মাত্রাবিশিষ্ট। মুক্তদল এবং রুদ্ধদল উভয়ই একমাত্রাবিশিষ্ট। পর্বগুলো ছোট এবং দ্রুতলয়বিশিষ্ট। এই ছন্দে যতি এবং দল ঘন ঘন পড়ে বলে বাগযন্ত্র দ্রুততা লাভ করে। প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষর শ্বাসাঘাতযুক্ত।
এই ছন্দের প্রয়োজনে ৫ মাত্রাকে সংবৃত উচ্চারণে ৪ মাত্রার মত আবৃত্তি করা যায়, আবার কোথাও এক মাত্রা কম থাকলে বিবৃত উচ্চারণ করে এক মাত্রাকে দুই মাত্রায় টেনে নেয়া যায়।
আদৃতা বলে – যেমন?
-আগে জেনে নাও -পর পর তিনটি রুদ্ধদল থাকলে চারমাত্রার মর্যাদা পেয়ে যায়। যেমন -ঝম ঝম ঝম / বৃষ্টি পড়ে। ৩+৪
এখানে ঝমঝমঝম তিনটি রুদ্ধদল। কিন্তু চারমাত্রার গতিতে খাপ খেয়ে গেল। মানে ভেতরে ভেতরে ঝমঝমাঝম হলে গেল।

পাঁচমাত্রার স্বরবৃত্তের একটা উদাহরণ দিন দাদু – দীপেন বলে।
– দাঁড়িয়ে আছে /বাড়িয়ে দু’হাত…
দাঁ+ড়ি+য়ে -আ+ছে/ বা+ড়ি+য়ে -দু+হাত ৫+৫। এরকম ইয়ে যুক্ত শব্দ অনেক সময় ৫ মাত্রা হলে পড়ার সময় চারমাত্রার মতই চলনটা পেয়ে যায়।
দাদু একটু থামলেন। তারপর বললেন- এপর্যন্ত যা যা বললাম তোমাদের বোধগম্য হয়েছে তো?
ওরা সবাই হাঁসূচক ঘাড় নাড়ল।
(চলবে)

ছড়াদাদুর পাঠশালা ৩

পরের রবিবারেও যথারীতি শুরু হল ছড়াদাদুর পাঠশালা। আজ একজন নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছে। মামুন মালিতা।

ছড়াদাদু বললেন- তাহলে ছড়ার কি কি বৈশিষ্ট্য থাকে সে বিষয়ে একটু বলি-
ওরা একসাথেই বলে ওঠে- হ্যাঁ, বলুন।
দাদু গলাটা একটু পরিস্কার করে নিয়ে শুরু করেন-
আধুনিক ছড়া’র কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন ধরো-
প্রথমতঃ ছড়ায় যুক্তিসঙ্গত কোনো বিশেষ ভাব বা ভাবের ধারাবাহিকতা থাকে না।
দ্বিতীয়তঃ ছড়া ধ্বনি প্রধান, সুরাশ্রয়ী এবং নিটোল রস ও চিত্রাত্মক হলেও তত্ত্ব বা উপদেশ সরাসরি থাকেনা। একটি তীর্যকভাবে সেটা ফুটে ওঠে মাত্র।
তৃতীয়তঃ ছড়ার ছন্দ প্রধানতম শ্বাসাঘাত প্রধান স্বরবৃত্তেই হয়ে থাকে। তবে মাত্রাবৃত্তেও লেখা যেতে পারে।
চতূর্থতঃ ছড়া মেদহীন দৃঢ় সংক্ষিপ্ত এবং সহজ সরল। ভাষা লঘু আর চটুলতাময় স্নিগ্ধ সরসতায় ভরা।
এছাড়া ছড়া সর্বদাই আবৃত্তিযোগ্য।
চারপাশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘটা অসংগতিগুলোর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কৌতুক বা কটাক্ষের মাধ্যমে উদ্ভট এবং নাটকীয় উপস্থাপিত ছড়ায়।
আসলে অর্থ নয় সুরময়ী শব্দই হল ছড়ার প্রাণ।
দাদু একটু থামলেন।
মামুন কাঁচুমাচু করে বলে -ছড়াদাদু আমার একটা প্রশ্ন আছে।
– বলে ফেল। তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেই তো এই পাঠশালা। অবশ্য মনে রেখো আলোচনার সব কথাই কিন্তু আমার ছড়াভাবনাজাত। এযাবৎ ছড়া লিখে লিখে যেটুকু বুঝেছি, তাইই তোমাদের জানাচ্ছি মাত্র।
মামুন বলে – আচ্ছা, ছড়া আর ছোটদের কবিতার মুল পার্থক্যটা কোথায়? এটা আমার বড্ড গুলিয়ে যায়।
-ছড়া আর ছোটদের কবিতার মধ্যে প্রভেদ হল- ছড়ার বিষয়বস্তু উদ্ভট, অসঙ্গত আর শিশু কবিতা বা ছোটদের কবিতার বিষয়বস্তু সাধারণত সুসঙ্গত হয়ে থাকে।
শিশু-কবিতায় বর্ণনা প্রাধান্য পায় বলে আকার অনেকসময় ছড়ার থেকেও দীর্ঘ হয়ে যায়।
ছড়া প্রধানত স্বরবৃত্তে লেখা হয় কিন্তু ছোটদের কবিতা যে কোনো ছন্দে লেখা হয়ে থাকে।
ছড়ার পরিণতি আকস্মিক। অন্যদিকে শিশু-কবিতার পরিণতি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত।
অনিক বলে – এবার তাহলে ছড়ার প্রকারভেদ সম্পর্কে বলুন ছড়াদাদু।
-একদম ঠিক বলেছ তুমি। ছড়া দু ‘ রকমের। লোকছড়া আর আধুনিক ছড়া।
এই লোকছড়া বা লৌকিক ছড়ার রচয়িতার নাম জানা যায় না। সময় এবং মেধার বিবর্তনের ভেতর দিয়ে এ’ছড়া আজও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে চলেছে। যেমন- ছেলেভুলানো ছড়া, ঘুমপাড়ানি ছড়া এইসব।
আর কোনো লেখকের লেখা ছড়াই হল আধুনিক বা সাহিত্যিক ছড়া। উপযোগিতার বিচারে এছড়াকে দুভাগে ভাগ করা যায়- ছোটদের ছড়া ও বড়দের ছড়া।
আবার অর্থ ও ভাবগত দিক দিয়ে আধুনিক ছড়াকে নানাভাগে ভাগ করা যায়। যেমন – ব্যঙ্গাত্মক ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, সমকালীন ছড়া, ভূতের ছড়া, শিশুতোষ ছড়া, পুজোর ছড়া, বিজ্ঞানের ছড়া, আজগুবি ছড়া, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আবার আঙ্গিকগত ভাবে লিমেরিক ছড়া, ষটপদী ছড়া, ছড়াক্কা চতুষ্পদী ছড়া প্রভৃতিও হতে পারে।
দাদু একটু ঢোক গিলে বললেন – এছাড়া রয়েছে আবোলতাবোল বা ননসেন্স ছড়া।
দীপেন বলে – সুকুমার রায় তো বাংলায় এই ননসেন্স ছড়া লিখেছেন।
– হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
অরণি বলে – ছড়াদাদু, ছড়ার বিষয়-আশয় সম্বন্ধে এবার একটু বলুন।
দাদু বলেন- চারপাশের সবকিছুই ছড়ার বিষয় হতে পারে। সেটা কতটা ছড়া হয়ে উঠবে সেটা নির্ভর করে যিনি লিখবেন তার প্রাজ্ঞতার উপর।ব্যক্তি সামাজ প্রকৃতি বিজ্ঞান ধর্ম রাজনীতি মন সবকিছুর মধ্যেই ছড়ার বিষয় লুকিয়ে রয়েছে। ছড়াকারকে সেটা সুচারুরূপে প্রকাশ করতে পারলেই হল। মানবমনের আনন্দ, মজা, ক্ষোভ, কষ্ট বা অন্য কোন তীব্র অনুভূতি সবই ছড়ার বিষয়।
আদৃতা উশখুশ করছিল। দাদু বুঝতে পেরে বলেন – সন্ধে কিন্তু হয় হয়। আজকে পাঠশালা বন্ধ করলে বোধহয় ভাল হয়।
আদৃতা বলে – হ্যাঁ। আগামি রবিবার আবার হবে।
অনিক বলে – ছড়াদাদু, এরপর কোন বিষয়ে পাঠ দিতে চান?
-ছন্দ ও অলঙ্কার। ( চলবে)

ছড়াদাদুর পাঠশালা ২

প্রথমেই আমাদের জেনে নিতে হবে ছড়া কী? -ছড়াদাদু বললেন- ”
হাঁস বলে – ও হাঁসিনী,
দু’জন মিলে পুকুর-বিলে
বল কতদিন ভাসিনি?
এটার মধ্যে আমরা কি পাচ্ছি? শব্দের চলার একটা বাঁধাহীন গতি। ভেতরে ভেতরে অনুপ্রাস আর চমৎকার অন্ত্যমিল। আসলে ছড়া এরকমই। ছন্দবিশারদের ভাষায় বললে ছড়ার সংগা দাঁড়ায় – ছন্দ অনুপ্রাসের মাধ্যমে সহজসরল ভাবে মনের ভাব যথার্থ শব্দবন্ধে যখন প্রকাশিত হয় তখন তাকে ছড়া বলা যায়। ছড়া আসলে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারময় পদ্য। আসলে ছন্দ আর অন্তমিলের মেলবন্ধনে হালকা চালে সহজ শব্দের সুচারু ব্যবহারে বিষয়কে প্রকাশ করবার জন্যে যে পদ বা পদসমষ্টির সৃষ্টি করা হয় তাকে ছড়া বলে।

দীপেন বলল- আচ্ছা ছড়াদাদু, অনুপ্রাসটা কি?
ছড়াদাদু বলেন- এবিষয়ে এক্ষুনি বলছি না। পরে সময়মত বলব। যা বলছিলাম। ছড়ার শ্রেনিবিভাগ।
আদৃতা বলে – হ্যাঁ, এটাই বলুন আগে। তাহলে একটা ধারাবাহিকতা থাকবে। তবে ছড়া কবিতা আর পদ্যের মধ্যকার পার্থক্যটা আগে বলে নিলে ভাল হয়।
-তুমি ঠিক বলেছো। ধরো তোমরা সকালবেলায় একটা পাখিকে ডাকতে দেখলে গাছের পাতার আড়ালে বসে।
দৃশ্যটার একটা বর্ণনা লিখলে-
গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে-
সকালবেলায় পাখি ডাকে।
সরাসরি ঘটনার বিবরণ দেওয়া হল ছন্দ ও অন্ত্যমিলের মাধ্যমে। এটা হল পদ্য।
অনিক বলে – আর ছড়া?
– ডাকছে পাখি ডাকছে রে-
খোকন ছবি আঁকছে রে।
ছন্দ ও অন্ত্যমিলের সমবায়ে এ পদদুটিও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু পদ্য থেকে এর বক্তব্য আর প্রকাশ ভঙ্গী আলাদা। সেটা খেয়াল করেছ তোমরা? এখানে দৃশ্যপটকে ভিন্নভাবে উত্থাপন করে হয়েছে।
দীপেন বলে- এটাই কি ছড়া?
– না, এটাকে ছড়া না বলে শিশুতোষ কবিতা বলতে আমি পছন্দ করি। আর ছড়া?
” পাখি ডাকে সুখে আর শিশু ডাকে মাকে,
পেট ডাকে খিদে পেলে, মেঘ ডাকে কাকে?”
এটাকেই ছড়া বলা যায়। এখানে দেখ পাখির অনুষঙ্গটা একটা মজার মোড়কে বেঁধে ছন্দ আর অনুপ্রাসের সুষম আবরণে মুড়ে প্রকাশ করা হল।
আদৃতা বলে – তাহলে বলছেন ছড়ায় একটা মজা আনার চেষ্টা থাকে।
– অবশ্যই। সেটা কখন ব্যঙ্গও হতে পারে। মোদ্দা কথা ছড়াকার তার দেখা ঘটনা বা বিষয়কে একটু মজার ছলে তীর্যকভাবে উপস্থাপন করবেন।
অরণি জানতে চায় – আর কবিতা?
– যদি লেখ – এ মধুর ক্ষণে..
পাখি ডেকে যায়
বনে না কি মনে!
এটা একটা ছন্দ-অনুপ্রাসযুক্ত কবিতা। আবার যদি লেখ- “পাখির ডাকের মত তোমার আহ্বান শুনি”
এটা একটা অন্ত্যমিলহীন কবিতা।
আসলে কবি তার দর্শনকে ভাব আর বোধের রসে ভিজিয়ে রহস্যময় ভাবে উপস্থাপন করেন।
রবীন্দ্রনাথের মতে- রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।
জীবনানন্দ দাশের মতে- উপমাই কবিতা।
মালার্মে বলেছেন- শব্দই কবিতা।
-বাহ, দারুণ। আদৃতা বলে- পদ্য, ছড়া, ছোটদের কবিতা আর কবিতার মধ্যকার পার্থক্যগুলো বেশ বোঝা গেল। (চলবে, আপনাদের সাড়া পেলে।)

ছড়াদাদুর পাঠশালা ১

-আমরা এসে পড়েছি ছড়াদাদু…
-আমিও তো তোমাদের অপেক্ষায় বসে আছি। চলো বেরিয়ে পড়া যাক। বাঁওড়ের পাশে গিয়ে বসি। তারপর….

ছড়াদাদুর একটা পিতৃদত্ত নাম নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তিনি ছড়াদাদু নামে এতই জনপ্রিয় যে আসল নামটাই যেন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। প্রবীণ এবং প্রতিষ্ঠিত ছড়াকার তিনি। শিশু আকাদেমি, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার সবই তিনি পেয়েছেন।

শিশুর মত হাসিখুশি সরলতায় ভরা তার মন। একদল তরুণ ছড়া লেখায় উৎসাহি ছেলেমেয়েরা এসেছে ছড়া লেখার কায়দাকানুন জানতে।

ছড়াদাদুও আশ্বাস দিয়েছেন সপ্তাহের শেষ দিন অর্থাৎ রবিবার বিকেলে ছড়াদাদুর পাঠশালা বসবে।
কথামত ছাত্ররাও হাজির। আজকে থেকেই শুরু হবে পাঠশালা। গভীর আগ্রহ আর আনন্দে দীপেন দে, অনিক আঢ্য, আদৃতা নাথ আর অরণি মন্ডল কথামত এসে হাজির হয়েছে।

ওরা বাঁওড়ের পাশে দূর্বাঘাসের উপর বসে পড়ে।

ছড়াদাদু শুরু করলেন তার ছন্দছড়ার পাঠশালা।
(চলবে)

শেষপ্রশ্নের কমল

(১)

শরৎ সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট হল নারী চরিত্রের বৈচিত্র্যময় সম্ভার। সেই সম্ভারের এক উজ্জ্বল সংযোজন “শেষ প্রশ্ন”-এর কমল। শরৎ সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্রগুলির মধ্যে কমল যেন অদ্বিতীয়। মনে হয় কোন ভিন গ্রহের বাসিন্দা। কিংবা অন্য কোন যুগের। সে যুগের ঠিকানা আমাদের ঠিক জানা নেই। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় পুরুষের আশা আকাঙ্খা বংশরক্ষার প্রয়োজনীয় গণ্ডীতেই যেখানে নারী জীবনের সব স্বাধীনতার সীমায়িত পরিসর, যেখানে তার মধ্যেই সামঞ্জস্য করে নিতে হয় অন্তরাত্মার সাথে বাস্তবের, সাধের সাথে সাধ্যের; সেখানে কমলের মত নারী চরিত্র সত্যিই এক উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। কমল একাধারে শাশ্বত ও আধুনিক।

(২)

কমলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট, কমল ভালোবাসতে পারে। হ্যাঁ নারী বরাবরই পুরুষকে ভালোবেসে চলে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কমল তার ভালোবাসাকে অন্যান্যদের মত “শুধু আমারই ভালোবাসা” বলে কোনো শীলমোহর লাগিয়ে তালা বন্ধ করে রেখে দেয় না। নিন্দুকের কথা কানে না তুলে সে তার ভালোবাসাকে নীল আকাশের মুক্তির ক্ষেত্রে স্থাপন করতে পারে।

এখানেই সে অনন্য। তাই শিবনাথ যখন তাকে এক কথায় প্রবঞ্চিত করে মনোরমাকে জীবনসাথী করে নেয় তখনও সে কত সহজে বলতে পারে- “সত্য যাবে ডুবে। আর যে অনুষ্ঠানকে মানিনে তারই দড়ি দিয়ে ওকে রাখব বেধে? আমি? আমি করব এই কাজ?” কমলের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না।অথচ এ যুগের আধুনিকা নারীরা কত সহজেই বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও স্বামীরই অর্থে প্রতিপালিত হয়েও গর্ব অনুভব করে থাকে। শরৎচন্দ্র “বেলা”র চরিত্রে যাদের ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু কমলের কথায়, “মনই যদি দেউলিয়া হয়, পুরুতের মন্ত্রকে মহাজান খাড়া করে সুদটা আদায় হতে পারে কিন্তু আসল তো ডুবল।” আশ্চর্য্য লাগে অধিকাংশ নারীই এই সত্যটাকে কত সহজেই ভুলে থাকে।

কমলের কথার সূত্র ধরে মনে হয় সত্যিই তো, এ জীবনে সুখ দুঃখের কোনোটাই শেষ সত্য নয়। সত্য শুধু প্রতিক্ষণের আন্তরিক অনুভবের চঞ্চল মুহূর্তগুলির আসা যাওয়া ছন্দটুকু। বুদ্ধি এবং হৃদয় দিয়ে সে মুহূর্তগুলিকে পাওয়াই তো সত্যিকার পাওয়া।তাই কমল জানত সে শিবনাথের কাছে যা পেয়েছিল, যতটুকু পেয়েছিল সেই তার অশেষ ধন। তাই যা পায়নি তা নিয়ে কাঁদাকাটি করতে তার শিক্ষায়, রুচিতে বেঁধে যায়।

কমল এটাও জানত পুরুষের কাছে কমল যতটুকু পায় তা তার নারীত্বের চরম ঐশ্বর্য্যের প্রতিফলনেই পায়। ফাঁকি দিয়ে নয়। রূপ দেখিয়ে মন ভুলিয়ে নয়। আর তাই পুরুষ যখন কমলকে ভালোবাসে, ভালোবাসতে পারে, সেই পারাটাও সম্ভব হয় কমলের স্বাধীন সত্তাজাত নারীত্বের অশেষ মহিমায়। এবং সেইখানেই কমলের নির্ভরতা। নির্ভরতা আবিশ্ব এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থগুলির প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধতার মধ্যেও।তাই তো হরেন্দ্র, শিবনাথ পরিত্যাক্ত নিঃসঙ্গ কমলের অবিচল দৃঢ়তায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবত “এত বড় নিঃসহায়তাও এই রমণীকে লেশ মাত্র দূর্বল করিতে পারে নাই। আজও সে ভিক্ষা চাহে না- ভিক্ষা দেয়।”

কমলের এই নির্ভরতার ক্ষেত্রটিকে অজিত উপন্যাসের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে কিছুটা ধরতে পেরেই বলেছিল, মেয়েরা যে বস্তুটিকে তাদের ইহজীবনের যথাসর্বস্ব বলে জানে, সেইখানে তোমার এমন সহজ ঔদাসীন্য যে, যত নিন্দেই করি, সে-ই যেন আগুনের বেড়ার মত তোমাকে অনুক্ষণ আগলে রাখে। গায়ে লাগবার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।”

না, সত্যিই কমল পুরুষের ভোগের বস্তু নয়। বস্তুত কোনো প্রকৃত নারীই কখনো পুরুষের ভোগের বস্তু হতে পারে না।নারীত্বের পূর্ণ মহিমায় পুরুষকে বিকশিত করে তোলার মধ্যে দিয়েই নারী প্রকাশ করতে পারে আপন অন্তরাত্মার মাধুরীকে। সেই তার চারিত্রশক্তি। সেই শক্তির পূর্ণ উদ্বোধনেই নারী জীবনের সার্থকতা। আর সেইখানেই তার আসল নির্ভরতা। কমল সেই নির্ভরতারই অব্যর্থ প্রতিচ্ছবি।

(৩)

কমল তার পিতার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিল জীবনে কখনো কোনো কারণেই মিথ্যা চিন্তা, মিথ্যা অভিমান, মিথ্যা বাক্যের আশ্রয় না নেওয়ার। এই বৌদ্ধিক শিক্ষাই কমলকে পদ্ম পাতায় বৃষ্টির জলের মত স্বচ্ছ করে তুলেছিল।তাই তো শিবনাথকে একদিন কমল যেমন ভালোবাসা দিয়েছিল, তেমনি আর একদিন শিবনাথের শঠতার প্রতিদানে তার প্রতি নির্মমতার বদলে কত সহজেই শিবনাথের সকল দোষ সকলের চোখের আড়ালে নিঃশব্দে নিঃশ্বেষ করে মুছে ফেলে দিতে পেরেছিল। সেই মুছে ফেলার মধ্যে না ছিল বিদ্বেষ, না ছিল জ্বালা, না ছিল ক্ষমা করার দম্ভ।

অজিতকে সে তাই কত সহজেই বলতে পেরেছিল গাছের পাতার শুকিয়ে ঝরে যাওয়াটাও যেমন সত্য ঠিক তেমনি সত্য সেই ক্ষত স্থানে আবার নতুন পাতায় ভরে ওঠা। বোঝাতে চেয়েছিল বাইরের শুকনো পাতা মরে গিয়েও গাছের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যে কামড়ে এঁটে থাকে সেইটাই হল মিথ্যে। সেই মিথ্যে জীবনের মোহ কমলের জন্য নয়।আশুবাবুকেও কমল তেমনি সহজে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে, “দুঃখ যে পাইনি তা বলিনে, কিন্তু তাকেই জীবনের শেষ সত্য বলে মেনেও নিইনি। শিবনাথের দেবার যা ছিল তিনি দিয়েছেন, আমার পাবার যা ছিল তা পেয়েছি- আনন্দের সেই ছোট ছোট ক্ষণগুলি মনের মধ্যে আমার মণি- মাণিক্যের মত সঞ্চিত হয়ে আছে। নিষ্ফল চিত্তদাহে পুড়িয়ে তাদের ছাই করেও ফেলিনি, শুকনো ঝরনার নীচে গিয়ে ভিক্ষে দাও বলে শূন্য দুহাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকিনি। তাঁর ভালোবাসার আয়ু যখন ফুরালো তাকে শান্ত মনেই বিদায় দিলাম, আক্ষেপ ও অভিযোগের ধোঁয়ায় আকাশ কালো করে তুলতে আমার প্রবৃত্তিই হয় না”এই সেই স্বচ্ছতা যার কথাই বলছিলাম। ঠিক সেই একই স্বচ্ছতায় কমল; আজকের অন্ধকার কালকের সকালের আলোয় যদি দূর হয়ে যায় তবে সেই “আলোকিত প্রভাতকেই সত্যি” বলে ভালবেসে জড়িয়ে ধরতে পারার আশায় বেঁচে থাকে।

অজিতকে তাই কমল একদিন বলেছিল “একদিনের আনন্দ যেন না আর একদিনের নিরানন্দের কাছে লজ্জাবোধ করে।” এখানেই কমলের শূচিতা। নির্মলতা। কমলের তাই মনে হয়, কোন আনন্দেরই স্থায়িত্ব নেই। আছে শুধু তার ক্ষণস্থায়ী দিনগুলি। সেই তো মানব জীবনের চরম সঞ্চয়। এখানেই কমলের অনন্যতা।

(৪)

কমল সেই দিপ্তীটুকু অর্জন করেছিল, জীবনের অর্থটাকে স্পষ্ট চোখে সোজাসুজি দেখতে পেলে চরিত্রের মধ্যে যে আলোটা জ্বলে ওঠে। কমল তাই জানত মানুষ শুধুমাত্র নরও নয়। নারীও নয়। নর নারী মিলেই তবে সে এক। তাই সে এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিল যে, মানুষের মধ্যে যারা বুঝেছিল নর নারীর ভালোবাসার ইতিহাসটাই হচ্ছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো সত্য ইতিহাস, তারাই সত্যের খোঁজ পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি। আর যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বেই নারীর চরম সার্থকতা; সমস্ত নারী জাতিকেই তারা ছোট করেছিল। এবং সেই থেকেই বিবাহের স্থায়িত্বের মধ্যে নারীর স্বাধীন ব্যাক্তি সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে পুরুষতন্ত্র।নারীও যেদিন থেকে বিবাহ বন্ধনকেই জীবনের সর্বস্ব বলে মেনে নিয়েছে সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছে নারী জীবনের চরম ট্র্যাজেডি। দুঃসহ স্থায়িত্বের মোটা দড়ি গলায় বেঁধে মরতে হয়েছে নর নারীর স্বাধীন ব্যাক্তি সত্তাজাত নির্মল ভালোবাসাকে।

এই স্বাধীন ব্যাক্তিসত্তাজাত ভালোবাসাকে নির্মল হৃদয়ে নির্মোহ আনন্দে দীক্ষিত করে পূর্ণ জীবনবোধে উত্তীর্ণ করার সাধনাই কমলের ধর্ম।

এই ধর্মের জন্য সে সমাজের চোখরাঙানিকেও যেমন সহজ ভঙ্গিতে উপেক্ষা করতে পারে তেমনি ব্যক্তিগত দুঃখ যন্ত্রনাকেও অবলীলায় হাসিমুখে অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে পারে সামনের দিকে।এই নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে চলার তাগিদেই কোনো আদর্শকেই সে শেষ প্রশ্ন বলে শিরোধার্য করে থেমে যেতে পারে না।
তাই তো কত নিঃসঙ্কোচেই সে বলতে পারে “একদিন যাকে ভালোবেসেচি কোনোদিন কোনো কারণেই আর তার পরিবর্তন হবার জো নেই, মনের এই অচল অনড় জড়ধর্ম সুস্থও নয়, সুন্দরও নয়।”

তাই কমল কোনো কিছুতেই ভেঙ্গে পড়েনা। ভেঙ্গে পড়া আদর্শের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেই নতুন আদর্শের সৃষ্টির আশা তার চিত্তে দৃঢ় প্রত্যয়ে জেগে থাকে। আবার
সেই আদর্শের কাজ শেষ হলে আরও মহত্তর আদর্শের জন্ম হবে। এই প্রত্যয়েই সে বলে, “এমনি করেই সংসারে শুভ শুভতরের পায়ে আত্মবিসর্জন দিয়ে আপন
ঋণ পরিশোধ করে। এই তার মুক্তি পথ।”

শ্রীশুভ্র

বই বিমুখ বাঙালি

রাস্তা ঝাঁট দিয়ে অর্থ উপার্জন বরং অনেক সহজ। কিন্তু লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন আদৌ সহজ নয়। পেশা হিসাবে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে ও সংসারধর্ম পালন করে বহু মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু পেশা হিসাবে লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করে সংসারধর্ম পালন করতে খুব কম মানুষকেই দেখা যায়। তাও জীবনের অনেক বছরের সংগ্রামের পর, জনপ্রিয়তার নিরিখে একমাত্র কোন কোন লেখক সাহিত্যিকের পক্ষেই পেশা হিসাবে লেখালেখিকে আঁকড়ে ধরা সম্ভব হয়। তাদের সংখ্যা গুটি কয়েক। কিন্তু বাকি যাঁরা আজীবন লেখালেখির সাধনায় ব্যস্ত পেশা হিসাবে তাঁদেরকে অন্য কোন না কোন কাজকেই বেছে নিতে হয়। আর নয়তো স্বামী বা স্ত্রীর আয়ের উপর নির্ভর করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় লেখালেখির একান্ত সাধনাকে। না রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার পেশার প্রতি কোনরকম কটাক্ষ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয় আদৌ। বা পেশা হিসাবে ঝাড়ুদারীর সাথে লেখালেখির কোন তুলনা টানাও নয়। বলার কথা শুধু এইটুকুই যে একজন ঝাড়ুদারের পক্ষেও সংসার চালানো সম্ভব হয়। কিন্তু একজন লেখককের পক্ষে সেই একই কাজ দুঃসাধ্য। কিন্তু কেন? প্রশ্নটি সেখানেই।

বিনা পয়সায় কেউই রাস্তা ঝাঁট দেয় না রোজ। সখের স্টান্টবাজি দেওয়া রাজনীতিবিদদের পরিস্কার রাস্তায় একসাথে একধিক নতুন ঝাঁটাসহ টিভি ক্যামেরার ফুটেজ খাওয়ার নির্ধারিত দিন ছাড়া। কিন্তু বিনে পয়সায় লেখা প্রকাশের জন্যে কোন লেখকেরই উদ্যোমের কোন অভাব দেখা যায় না কখনো। একজন ঝাড়ুদার বিনা পয়সায় যে কাজ করেন না, একজন লেখক কেন সেই কাজ পয়সা ছাড়াও অম্লানবদনে করতে এগিয়ে যান? প্রশ্ন এখানেও। তবে কি রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজটিকে অর্থমূল্য বিচার করার যে আত্মসম্মান একজন ঝাড়ুদারের থাকে, একজন লেখকের তাঁর লেখাটিকে অর্থমূল্য বিচার করার মতো সেই ন্যূনতম আত্মসম্মানটুকুও কি থাকে না? থাকলে তিনি বিনে পয়সায় তাঁর লেখাকে প্রকাশকের হাতে তুলেই বা দেন কি করে? এর সহজ একটি উত্তর এই মনে হয়, পাব্লিকের রাস্তা ঝাঁট দিয়ে কারুর মনে ব্যক্তিগত আনন্দ হয় না। তাই বিনা পয়াসায় সেই কাজ করতেও কেউ এগিয়ে আসে না। ভোটের ঠেকায় স্টানটবাজির দলীয় উদ্যোগ ছাড়া। কিন্তু পাব্লিকের কাছে বিনা পয়সায় হলেও নিজের লেখাটি পৌঁছিয়ে দিতে পারলেই একজন লেখকের ব্যক্তিগত আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না বল্লেই হয়। না এইটুকুই সব নয়। আরও একটি বড়ো কারণ রয়েছে। একজন ঝাড়ুদার জানেন, প্রয়োজনে পাব্লিকই নিজেদের গরজে অর্থের বিনিময়ে তাকে দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করিয়ে নেবে। নয়তো একদিন রাস্তা দিয়ে চলাচলই দুস্কর হয়ে উঠবে। ঠিক তেমনই একজন লেখকও জানেন তাঁর লেখা পড়ার গরজে পাব্লিক কোনদিনও তাঁর কাছে ছুটে আসবে না, অর্থ মূল্যে লেখা কেনা তো দুরস্থান।

এই যে পড়ার প্রতি অনাগ্রহ, না পড়লেও জীবনের কোথাও কোন অসুবিধা ঘটার কোন কারণই ঘটে না, ঘটবে না কখনোই; এই বোধ ও বিশ্বাস থেকেই লেখকের কাছ থেকে অর্থমূল্যে লেখা কিনে পড়ার মতো পাঠক থাকে না। এই সত্যটুকু সবচেয়ে ভালো জানেন একজন প্রকাশক। তাই স্কুল কলেজ বিশ্বাবিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের বিষয়ে তিনি যত আগ্রহী হবেন, একজন লেখকের গল্প কবিতা প্রবন্ধ প্রকাশের বিষয়ে তাঁর যে কোন ব্যবসায়িক আগ্রহ থাকবে না সেতো বলাই বাহুল্য। ডিগ্রী লাভের জন্যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বই কেনার আগ্রহ থাকুক বা নাই থাকুক, প্রয়োজনটুকু এতটাই সর্বাত্মক যে না কিনে উপায় নাই। তা সে যতই অগ্নিমূল্য হোক না কেন। খেয়ে পড়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে যে কোন একটি ভালো ডিগ্রী এতই মহার্ঘ্য। কিন্তু একটি ভালো গল্প বা উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ বা গবেষণা গ্রন্থ রোজকার বেঁচে থাকার জন্যে আদৌ জরুরী নয়। কিন্তু একটি পরিস্কার রাস্তা অনেক বেশি জরুরী। তাই সমাজের কাছে একজন লেখকের থেকেও একজন ঝাড়ুদারের প্রয়োজনীয়তা এত বেশি।

আবারও বলি, ঝাড়ুদারের সাথে লেখকের কোন লড়াই বা প্রতিতুলনা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমাদের সমাজে একজন লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা কতখানি সেইটুকু অনুসন্ধান করাই বর্তমান লেখার মূল উদ্দেশ্য। অনেকেই হইহই করে উঠবেন হয়তো। তা কেন? তাহলে এত পত্র পত্রিকা এত বইপত্র, এত বইমেলা এসব কিসের জন্যে? খুবই সত্য। কিন্তু এসবই বই প্রকাশের সাথে যুক্ত প্রকাশক সম্প্রদায়ের জন্যে। এইগুলি না থাকলে তাদের ব্যবসায় গণেশ উল্টানো অবধারিত। অনেকেই প্রতিবাদ করবেন এই বলে যে তাঁরা যথেষ্টই বইপত্র কেনাকাটি করেন। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও। তাহলে সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন ওঠেই বা কি করে? ওঠে, কারণ এই যে এত লেখা, এত লেখক, তার মধ্যে কয়জন শুধু তাঁর লেখাকেই পেশা হিসাবে আঁকড়ে ধরে বহাল তবিয়তে আছেন? আমরা সবাই জানি, সেই মাত্র কয়েকজনের সংখ্যাটাই কি মারাত্মক ভাবে কম। আমরা এটাও জানি, অধিকাংশ লেখকই অন্য কোন না কোন পেশার সাথে যুক্ত থেকেই কেবল মাত্র নেশা আর ভালোবাসা হিসাবেই লেখালেখি চালিয়ে আসছেন। অধিকাংশ বিখ্যাত লেখকই অন্য কোন পেশায় গ্রাসাচ্ছাদনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করে তবেই লেখালেখির নেশাকে টেনে নিয়ে চলেন। সেই লেখা থেকে সামান্য কিছু আয় যদিও কখনো সখনো হয়ও, তা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সুরাহা ঘটানোর জন্যে যথেষ্ট নয়। এইখানেই আমাদের সমাজে একজন লেখকের মূল অপ্রাসঙ্গিকতা। অন্য যে কোন পেশাজীবী মানুষের যে সামাজিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যেমন ডাক্তার, উকিল, প্রযুক্তিবিদ, মিস্ত্রী, শিক্ষক, আমলা থেকে শুরু করে দোকানি এমন কি আমাদের লেখার শুরুতে যে ঝাড়ুদারের উপমা টানা হয়েছে, তাদের; একজন লেখকের কি সেই একই সামাজিক প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান এই সমাজে? সামাজিক এই প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতেই কোন কাজের প্রাসঙ্গিকতার নির্ধারণ হয়ে থাকে।

তাই লেখালেখি ও লেখকের কোনরকম প্রাসঙ্গিকতাই গড়ে ওঠে নি আমাদের সমাজে। অবশ্যই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য পেশার পাঠপুস্তকের লেখকরা আমাদের এই আলোচনার মধ্যে পড়েন না। মনের খোরাক জোগানো, চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত করা, জীবনবোধের বিস্তার ঘটানোর জন্যে যে সব লেখালেখি ও তার লেখকরা দুঃখের বিষয় হলেও আজও সামাজিক ভাবেই ব্রাত্য। তাদের সাধনা ও পরিশ্রম, সমৃদ্ধি ও অর্জনের কোন রকম অর্থমূল্যই তৈরী হয়ে ওঠেনি আমাদের সমাজে। এই যে কোনরকম অর্থমূল্য তৈরী না হওয়া এটাই প্রমাণ করে একটি সমাজে লেখক শ্রেণীর অপ্রাসঙ্গিকতার। শুরুর সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করলে বলতে হয়, ঝাড়ুদার প্রাসঙ্গিক কিন্তু লেখক অপ্রাসঙ্গিক।

কিন্তু কেন এই অবস্থা? সেটি মোটামুটি ঠিকমতো বুঝতে গেলে একবার ফিরে তাকাতে হবে আমাদের ইতিহাসের দিকেই। আধুনিক বাংলার ইতিহাস, সাগর পারের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের হাতে গড়ে দেওয়া ইতিহাস। হাজার হাজার বছর ব্যাপি গড়ে ওঠা একটি জনপদের ধারাবাহিক অগ্রগতির সামাজিক ইতিহাস নয়। সেই ইতিহাস পলাশীর প্রান্তরেই কবরস্থ। তারপর ব্রিটিশের স্কুলে পড়াশুনো করে মেকলের এ বি সি ডি মুখস্থ করে ব্রিটিশের তৈরী ডিগ্রী বগলদাবা করে আমাদের সুসভ্য হয়ে ওঠা। এটাই আধুনিক বাংলা ও বাঙালির সার্বিক ইতিহাস। যদিও সেই ইতিহাস পর্যালোচনার পরিসর নেই বর্তমান আলোচনায়, তবুও এই ইতিহাসটুকুর সামগ্রিক গুরুত্ব অনুধাবন না করতে পারলে আজকের বাঙালি সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিটুকু ছোঁয়া যাবে না আদৌ। ব্রিটিশের স্কুলে এ বি সি ডি মুখস্থ করে এক একজন অকস্ফোর্ড কেম্ব্রিজ ডিকশনারীর বিশেষজ্ঞ হয়ে ম্যকবেথ প্যরাডাইস লস্ট আবৃতি করে আমরা শিখেছি কি করে মনমতো একটি সরকারী কি বেসরকারী চাকুরী বাগিয়ে নিতে হয়। এবং শিখেছি সেই বাগিয়ে নেওয়ার পথে প্রতিযোগিতার রাস্তা সাফ করতে কখন কাদের পায়ে সঠিক পরিমাণে তৈলমর্দন জরুরী। কবি কত তীব্র আক্ষেপেই না বলেছিলেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ কর নি’। এই যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞতা, একটি সমাজের এই যদি আধুনিকতার সার্বিক চেহাড়া হয়, তবে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সেই সমাজের উঁকি দেওয়ার আগ্রহ কতটুকু থাকবে সে কথা বলাই বাহুল্য। ডিগ্রী আর মাসিক উপার্জনই যে সমাজের সবকিছু বিচারের মানদণ্ড সেই সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। একজন লেখক ঠিক ততখানিই বড়ো লেখক, যত বড়ো তাঁর ডিগ্রী ও যত বেশি তাঁর মাসিক উপার্জন। তারপর তো তিনি একজন লেখক! তারও পরে তাঁর জনপ্রিয়তা। লেখা ও লেখকের সামাজিক কোন প্রাসঙ্গিকতা না থাকলেও। এই হচ্ছে বাংলার সামগ্রিক চিত্র।

ব্রিটিশের স্কুলে সুসভ্য হয়ে ওঠা বাংলা আরও একটি শিক্ষা অর্জন করে নিতে পেরেছে সহজেই। দেশের অধিকাংশ জনগন যত বেশি পরিমানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তত বেশি আরামেই দিন কাটবে এ বি সি ডি মুখস্থবিদ ডিগ্রীধারীদের। তাই বৃটিশ চলে যাওয়ার পর সাড়ে সাত দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আজও অধিকাংশ বাঙালিকেই আমরা অশিক্ষিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছি। সমাজে অশিক্ষিত জনসংখ্যার পরিমাণ যত বেশি হবে লেখকের লেখার পাঠকও তত কম হবে। এতো জানাই কথা। ফলে আমাদের সমাজে একজন লেখকের সামাজিক অপ্রাসঙ্গিকতা কতখানি ব্যাপক সেটি অনুধাবন করতে গেলে এইসব বিষয়গুলির দিকেও সার্বিক নজর দিতে হবে। হবেই। কিন্তু ইউরোপের স্বাধীন দেশগুলির মতোই আমরাও যদি কালের ধারাবহিকতায় একটি স্বাধীন জাতির স্বাধীন সমাজের মতোই মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে দিনে দিনে সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারাতে বিকশিত হয়ে ওঠার সুযোগ ও পরিসর পেতাম, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির সাথে স্বাধীনভাবে মোলাকাতের মধ্যে দিয়ে পুষ্ট হয়ে উঠতে পারতাম, তাহলে আমাদের আপন স্বাধীকারে অর্জিত সমৃদ্ধির পথেই আমরাও একদিন অধুনিক যুগে পা রাখতে পারতাম। আধুনিক যুগের চৌহদ্দিতে সেই প্রবেশ ঘটত আমাদের নিজেদের পায়ের দৃপ্ত পদক্ষেপেই। ব্রিটশের তৈরী করে দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে নয়। এই যে ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে বাঙালির একাংশের আধুনিক হয়ে ওঠার অভিশপ্ত ইতিহাস, এই ইতিহাসেই নিহিত আমাদের সার্বিক ব্যর্থতার আজকের চিত্রগুলি। পরিতাপের কথা আমাদের ইতিহাসের এই দিকটি ও তার গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষিত মানুষদেরই কোনরকম বাস্তব ধ্যান ধারণা গড়ে ওঠে নি আজকেও। তার মাশুলই গুনছি আমরা প্রতিদিনের সমাজ ও জীবন বাস্তবতায়।

কিন্তু বাঙালির পাঠাভ্যাস ও তার জীবনে বইয়ের প্রকৃত অবস্থা, বাঙালি জনমানসে একজন লেখকের অস্তিত্ব ও সম্মান, এইসব বিষয়গুলি প্রকাশক মাত্রেই ভালো জানেন। তাই লেখককে একটি সৌজন্য সংখ্যা ধরিয়ে দিয়েই তিনি কোনরকমে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন একটি সাময়িকী। কিন্তু বই প্রকাশের প্রয়োজন হলেই প্রকাশকের মাথায় হাত। কে কিনবে লেখকের বই? কয়টি সংখ্যা বিক্রী হবে? বই প্রকাশকের লগ্নীই বা কি করে মুনাফার মুখ দেখবে? তিনি তো আর দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলে বসে পড়েননি? তখনই প্রকাশক লেখকের কাছেই তাঁর বই প্রকাশ করে দেওয়ার নানান রকম স্কীমের ফাঁদ পাতেন। লেখক একবার শুধু ধরা দিলেই হলে। প্রকাশকের লক্ষ্মীলাভ নিশ্চিত। ফেল কড়ি মাখো তেল। তোমারই পয়সা। তোমারই বই। আমি শুধু লাভের বখড়া রেখে বই ছাপিয়েই ক্ষান্ত। তরপর তোমার বই বিক্রীই হোক আর নাই হোক। মাথাব্যাথা আমার নয় তোমার।

কিন্তু লেখকেরই বা এত মাথা ব্যাথা কেন? কি হবে লিখে? কিই বা হবে সেইসব লেখা জমিয়ে বই প্রকাশ করে? নিজের বা নিজের স্ত্রী কিংবা স্বামীর কষ্টার্জিত অর্থ অপচয় করে? প্রথমত লেখক কেন লেখেন? লেখেন নিজের কথাগুলি বলার জন্যে। সে তো ঘরের দেওয়ালের দিকে মুখ করেও বলা যায়। বলাই যদি হয় উদ্দেশ্য। কিন্তু না। শুধু বলাই তো আর উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য অন্য একজনকে শোনানো। বেশ তো, বাড়িতে যিনি শুনতে চান, তাঁকে শুনিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তার জন্যে আবার কষ্ট করে সময় ব্যায় করে লেখাই বা কেন। কারণ তো শুধুই লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যেই নয়। কারণ সেই লেখাটিকে সংরক্ষণ করে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তিজাত আনন্দের মধ্যেই। সেই আনন্দই হলো সংযেগের আনন্দ। একজন লেখক তখনই লেখক, যখন তিনি পাঠকের সাথে সেই সংযোগ সূত্রটি গোড়ে তুলতে পারেন ঠিকমত। প্রত্যেক লেখকের অস্থিমজ্জায় এই সংযোগেরই সাধনা। লেখক চান তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে বহুজনের সাথে সংযোগ স্থাপনের। এই যে বহুজনের সাথে সংযোগ স্থাপনের একন্ত অভীপ্সা ও নিরন্তর তাগিদ, সেই তাগিদেই একজন লেখক বাজারের সব রকম নিয়মকেই শিরোধার্য্য করে নিতে বাধ্য হন। তাই বাধ্য হন বিনা পারিশ্রমিকেও লিখতে। বাধ্য হন নিজের কষ্টার্জিত অর্থে হলেও সামর্থ্য থাকলে বই ছাপাতে। বাধ্য হন অন্য কোন পেশায় নিযুক্ত হতে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ারই জন্যে। আমাদের সমাজ ও বইয়ের বাজারের কাছে লেখক তাই দাসত্বের শৃঙ্খলেই বেঁধে ফেলেন নিজেকে। না ফেললে যে তাঁর মুক্তি নাই। কেননা তাঁর মুক্তি তাঁর লেখার মধ্যে দিয়েই বহজনের সাথে সংযোগসূত্র গোড়ে তুলতে পারার মধ্যেই।

কিন্তু সার্বিক অশিক্ষিত মানুষের সমাজে মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতার পরিসরে এমনকি স্বল্পসংখ্যক শিক্ষিত মানুষের জীবনেও লেখকের কোন লেখার সাথে এই সংযোগ সূত্র গড়ে তোলার কোন রকম প্রাসঙ্গিগতাই নাই আমাদের দেশ ও সমাজের জীবনে। তাই সাধারণ ভাবেই কি অশিক্ষিত কি শিক্ষিত সব ধরণের মানুষের কাছেই একজন লেখক ও তাঁর লেখা মূলত অপ্রাসঙ্গিক ও ব্রাত্য হয়েই পড়ে থাকে। পড়ে থাকে অনাদরে অবহেলায়। এইকারণেই আমাদের দেশে মানুষের বইপত্র পড়ার অভ্যস প্রায় নাই বললেই চলে। বইপত্রের পাঠক থাকলেই বইয়ের বাজার থাকতো। আর বইয়ের বাজার যত শক্তিশালী হবে ততই লেখকদের সমাদর ও প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাবে। কেবল মাত্র তখনই একজন লেখক লেখাকেই পেশা করে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ন্যূনতম চাহিদা পুরণ করতে পারবেন অন্তত। যখন লেখকও হয়ে উঠবেন সমাজেরই প্রাসঙ্গিক একটি অংশ।

অনেকেই হয়তো বলবেন আসলে ইনটারনেট প্রযুক্তির বিপ্লবের কারণেই মানুষের বই পড়ার অভ্যাস কমে গিয়েছে। অনেকেই দোষ দেবেন বোকাবাক্সেরও। কিন্তু আমাদের আলোচনা এই দুইটি বিষয়কে বাদ রাখলেও সর্বাংশেই সত্য। অর্থাৎ নেটে আসার আগে থেকেই বাঙালির পাঠভ্যাস এরকমই লজ্জাজনক ভাবেই কম ছিল। বোকাবাক্স আসারও আগে যে বইয়ের বাজার খুব বিরাট ছিল, না বিষয়টি আদৌ সেরকম নয়। আর ছিল না বলেই কলকাতা বইমেলের জন্ম হয়েছিল। মেলার হুজুগেও যদি কিছু পরিমানে অবিক্রীত বইয়ের সৎকার করা যায়। বাংলায় বইমেলার দাপট দেখে একথা মনে করার কোন কারণই নাই যে বাঙালি বই পাগল জাতি। বরং ঠিক এর উল্টো। বাঙালি বইয়ের থেকে দূরে থাকতেই বেশি অভ্যস্থ বলে বইকেই বাঙালির ঘরের সামনে হাজির হতে বইমেলায়র মাঠে এসে উপস্থিত হতে হয়েছে। অধিকাংশ উন্নত দেশে ও জাতিতে মানুষ সারা বছর ধরেই যে পরিমাণে বই কেনে ও পড়ে, তাতে কিন্তু সেইসব দেশে বইয়ের প্রকাশককে সারা বছর ধরে বাৎসরিক বইমেলার জন্যে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না। তাই সেই সব দেশে বইমেলার হুজুগও বেশি দেখা যায় না। সেখানে মানুষ হুজুগে পড়ে বই কেনে না। কেনে বই পড়ার জন্যেই। পড়ে জীবনের সাথে বইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই। পড়ে তার জীবনকে জানার ও অনুধাবনের একান্ত তাগিদেরই তীব্র সংবেদন থেকেই। সেখানে বই ও লেখালেখির বিরাট বাজার বিদ্যমান। এবং হ্যাঁ ইনটারনেট বিপ্লবের পরেও। কারণ ইনটারনেট একটি মাধ্যম। ছাপাখানার মতোই। সেই মাধ্যম বইয়ের বজার সঙ্কুচিত করার বদলে বরং প্রাসরিত করেই চলেছে। আরও বেশি করে কদর বেড়েছে তাই লেখকদেরও। তাই উন্নততর দেশে ও জাতিতে লেখকের প্রাসঙ্গিকতা সমাজের অস্থিমজ্জাতেই প্রোথিত। হ্যাঁ আমাদের দেশের সেই ঝাড়ুদারদের মতোই প্রাসঙ্গিক। কিংবা হয়তো বা তার থেকেও বেশি।

শ্রীশুভ্র

কবিতা সবার জন্য ভালোবাসার প্রস্ফুটিত ফুল

কবিতা হচ্ছে ভালোবাসার প্রস্ফুটিত ফুল। সাহিত্যকাননের সর্বাপেক্ষা সুন্দর ফুল কবিতা। আর সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী শাখাও কবিতা। বস্তুতঃ পৃথিবীতে আগে শুধু কবিতাই ছিল। পৃথিবীর সবকিছু তখন কবিতার মতোই সুন্দর ছিল। আর তখন সবকিছু কবিতার ভাষায় লিপিবদ্ধ হতো। মানুষ ছন্দে-ছন্দে কথা বলতে ও শুনতে ভালোবাসতো। রাজদরবারে শোভা পেতেন বড়-বড় কবি। তারা মনের আনন্দে কবিতা-রচনা করতেন। মানুষ তখন কবিতাই চিনতো। মানুষ তখন কবিতাই ভালোবাসতো। মানুষ তখন কবিতাই পড়তো। আর এই কবিতা ভালোবেসেই মানুষ রচনা করে গান। আজকের গীতিকবিতাও এই কবিতারই দান। সবখানে শুধু কবিতা। সেই সময় পৃথিবী ছিল কবিতাময়! সেকালে অনেক ধর্মগ্রন্থও কবিতার ভাষায় রচিত হয়েছে। তাও যাকে বলে একেবারে সঙ্গীতধর্মী-কবিতা। প্রমাণস্বরূপ পড়ে দেখতে পারেন প্রাচীনধর্মগ্রন্থ ‘যাবুর’।

বলছিলাম, প্রাচীনকালে মানুষ শুধু কবিতাই লিখতো। তখনকার সাহিত্য বলতে ছিল একমাত্র কবিতা। তখন মানুষ বৃহৎ কবিতাগ্রন্থরচনা করতো—বৃহৎ একটি কবিতা—বৃহৎ একটি কাহিনীকবিতা—যাকে বলা হতো কাব্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—বাল্মীকির ‘রামায়ণ’, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত ‘মহাভারত’, কাশীরাম দাসের অনূদিত ‘মহাভারত’, ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ আর কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’। প্রাচীনযুগের ধারাঅনুযায়ী মধ্যযুগেও রচিত হয়েছে বড়-বড় কাব্য। যেমন, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদ্মাবতী ইত্যাদি। আর এই মধ্যযুগেই মুসলমান-কবিরা সৃষ্টি করলেন অনুপম গাঁথুনি ও সুরে ‘পুঁথিসাহিত্য’—এটাও কিন্তু কবিতার ভাষায়—আর তা ছন্দে-ছন্দে।

গদ্য এলো আধুনিকযুগে। আর তখনই সৃষ্টি হলো ‘ছোটগল্প’ আর ‘উপন্যাস’। আর এটি মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের বেশি জানার, বেশি পড়ার আর বেশি লেখার চিন্তাভাবনা থেকেই জন্ম নিলো গদ্য। আজ গদ্য সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। মদীয় আলোচনা শুধু কবিতাকেন্দ্রিক।

কবিতা আজ অবধি সাহিত্য-নন্দনকাননের প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো অবিরাম গতিতে শুধুই সুবাস ছড়াচ্ছে। আর এই সুবাসে মোহিত হচ্ছে মানুষ—সর্বস্তরের পাঠক—আর কবিতাপ্রেমীপাঠকসমাজ।
কবিতার একটি শক্তি আছে—আর এই শক্তির দ্বারাই কবিতা তার পাঠকসমাজকে এখনও কবিতার মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। আধুনিকযুগে বিলাসীমানুষের জীবনযাত্রায় কতরকমের ইলেকট্রনিক সামগ্রী! এর যন্ত্রণায় কবিতার মরে যাওয়ারই কথা! কিন্তু সকল আগ্রাসন মোকাবেলা করে কবিতা আজও নিজস্ব যোগ্যতায় ও শক্তিতে মানুষের মাঝে বেঁচে আছে—আর তা বেঁচে থাকবে চিরকাল।

কবিতার একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আর এই ভাষা সর্বসাধারণের মুখের ভাষার মতো নয়। এটি তার চেয়ে উন্নত ও শিল্পিত। আর এই ভাষাশৈলী আবিষ্কার করেছেন অগণিত কবি। পৃথিবীর সকল ভাষাই তার কবিদের কাছে ঋণী। কবি-লেখকরা যুগে-যুগে, সর্বকালে ভাষামাধুর্যের একমাত্র প্রতিনিধি ও নির্ভরযোগ্য আবিষ্কর্তা। তাঁদের হাতেই ভাষা পেয়েছে সৌন্দর্যবৃদ্ধির অতলীন স্পর্শ। আর কবিরা তাই সর্বকালে-সর্বদেশে ভাষার প্রকৃত-বন্ধু। কাজেকাজেই, আমরা যদি কায়মনোবাক্যে আমাদের ভাষাকে ভালোবাসি—তাহলে, সেইসঙ্গে আমাদের কবিদেরও ভালোবাসতে হবে। আর ভালোবাসতে হবে তাঁদের রচিত কাব্য ও গ্রন্থসমূহ।
কবিতার ভাষা একেবারে সাদামাটা বা অলংকারবিহীন হলে চলবে না। এখানে, একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, সাধারণ একজন স্ত্রীলোক কোনোপ্রকার গহনাপত্র পরলো না বা সামান্য গহনা পরলো, তাকে বেশি সুন্দর লাগবে? নাকি যে পরিমাণ মতো চমৎকার ডিজাইনের সব সোনার অলংকার পরলো তাকে? আপনিই বলুন কাকে? আর আপনার বিবেক কী বলে? নারীদেহ যেমন সোনাভরণে সুশ্রী হয়ে ওঠে, তেমনি সুষুমামণ্ডিত ভাষামাধুর্যে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে কবিতাদেহ। আর এই কবিতাদেহকে নিয়মিত ভাষা-অলংকার দিয়েই সাজিয়েগুছিয়ে রাখতে হবে।
রমণী এমনি-এমনি সুন্দর হয় না। তার যোগ্য স্বামী তাকে সুন্দর আভরণে-ভূষণে সজ্জিত করে তোলে। তখন সে সবার চোখে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কবি স্বাধীন। আর তিনি ভাষারাজ্যের একজন সম্রাট। তার মধ্যে যেন কখনও ভাষাদীনতা বা ভাষাকার্পণ্য প্রকাশ না পায়। রমণীদেহের মতো কবিকে তার কবিতাদেহ ছন্দে, ভাবসম্পদে, চিত্তাকর্ষক-বিষয়বস্তুতে, নির্মাণ-সৌকর্যে ও সর্বোপরি ললিত-মাধুর্যে সাজিয়েগুছিয়ে তার পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। মনে চাইলেই একটাকিছু লিখে দিলেই তা কবিতা হয়ে যায় না। সাধারণ গদ্য লেখা সহজ। কিন্তু ছোটগল্প-রচনা করা অনেকের জন্যই তা একেবারে দুঃসাধ্য। কারণ, ছোটগল্পের ভাষাও যে কবিতার মতো! সবখানে প্রয়োজন কবিতার ভাষা—আর সবচেয়ে মূল্যবান এই কাব্যিকভাষা। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প কেন এতো জনপ্রিয়? কারণ, তিনি বাংলাভাষার শক্তিমান কবি। তাঁর হাতে কাব্যিকভাষা পেয়ে তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলো যেন হয়ে উঠেছে একেকটি সুন্দর কবিতা।

আমরা যারা কবিতা-রচনা করছি, সর্বাগ্রে তাদের ভাষা ঠিক করতে হবে। ভাষাই হলো কবিতার মূল বা চালিকাশক্তি। আর ভাষাই হলো একজন কবির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই, প্রয়োজনে কবিকে তার আগের ভাষা সংশোধন করতে হবে। কবিতার ভাষা হতে হবে কুমারীমেয়ের মতো আকর্ষণীয়। আর সুবোধ-সুন্দর বালকের মতো সুশ্রী।

কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজন। আধুনিককালে বেশিরভাগ কবিই অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দে তাঁদের কবিতা বা কাব্য রচনা করেছেন। তবে উত্তর-আধুনিককালে অনেক কবিই ছন্দের বেড়াজাল ভেঙে গদ্যছন্দে কবিতানির্মাণ শুরু করেন। তাঁদের দেখাদেখি বর্তমানে গদ্যকবিতার সচল-প্রচলন ঘটেছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গদ্যছন্দে কবিতা-রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত ‘পুনশ্চ’ ও ‘পত্রপুট’ নামক কবিতাগ্রন্থ দুটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে সেখানেও রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব একটি ছন্দ রয়েছে। তাই, ছন্দের ব্যাপারে একজন কবিকে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে।

কবিতায় ছন্দের চেয়েও জরুরি এর ভাবসম্পদ। আর এই ভাবসম্পদই হলো কবিতার মূলশক্তি। এর মধ্যে শক্তিশালী বক্তব্য থাকতে হবে। প্রত্যেক কবিতারই একটি বক্তব্য আছে। তবে সব কবিতার বক্তব্যই পাঠকের কাছে প্রাধান্য পায় না। আর সব কবির বক্তব্যই পাঠকের কাছে আবেদনসৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। একবার একজন বিশিষ্ট-কবি এক কথিত-কবির কবিতা-সমালোচনা করতে গিয়ে লিখলেন, “আপনার কবিতার বক্তব্য চমৎকার হয়েছে!” তিনি ঠিকই লিখেছেন। কিন্তু তখন সেই কথিত-কবি নামক অ-কবি ভয়ানক ক্রোধে লিখলেন, “আমি বক্তব্য দেইনি। আমি কবিতা লিখেছি!” মূর্খ আর কাকে বলে? কবিতার মধ্যে যে একটি বক্তব্য থাকে—তা এই অ-কবি মূর্খটি জানে না। এইজাতীয় মূর্খ যদি কাব্য-রচনায় নিয়োজিত হয়—তাহলে, কাব্যের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার।

কবিকে হতে হবে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উন্নতদৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ও ভাষাবিষয়ে দক্ষ। যাদের ভাষাজ্ঞান সীমিত ও দুর্বল—তারা কবি হবেন কীভাবে? আর কবিকে সারাজীবনের জন্য হতে হবে একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। কোনো সাম্প্রদায়িক অমানুষ কখনও কবি হতে পারবে না।

কবিতা সুগন্ধীফুলের মতো। আর কবিতার রয়েছে সুঘ্রাণ। এতে সর্বস্তরের পাঠক আমোদিত হয়ে থাকে। কিন্তু যে-ফুলের ঘ্রাণ নেই—সে ফুলে ভ্রমর বসে না, মধুমক্ষিকা সেখানে ছুটে যায় না। ভাষাহীন, শ্রীহীন ও রূপবিহীন শব্দের গাঁথুনি কখনও পাঠকের দৃষ্টিআকর্ষণ করতে সক্ষম হবে না। তাই, কবিতাকে সুগন্ধীফুলের মতো করে প্রস্ফুটিত করতে হবে। তাহলে, কবিতার সুঘ্রাণে আমোদিত ও বিমোহিত হয়ে পাঠকসমাজ একনিমিষে ছুটে আসবে কবিতার বিশাল সাম্রাজ্যে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১০/০৬/২০১৬

ঈশ্বর বিশ্বাস

********প্রাককথন*******

যে কোনো বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই আমাদের মধ্যে জন্ম দেয় ঐ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের! অর্থাৎ বিষয়টি সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞানের অভাব থাকলেই হয় আমরা সেটির সম্বন্ধে মনগড়া প্রচলিত ধারণাকে বিশ্বাস করি! অথবা সেই ধারণাটিকে অবিশ্বাস করি!
আর এইভাবেই সীমিত বুদ্ধিতে বিষয়টিকে বুঝে নেবার প্রয়াসে নিজেদের সান্ত্বনা জোগাই!

যতদিন প্রমাণ হয়নি পৃথিবী সূর্য্যের চারিধারে ঘুরছে ততদিন শুধুমাত্র সত্য জ্ঞানের অভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে আমরা বিশ্বাস করতাম সূর্য্যই পৃথিবীর চারধারে ঘুরছে! বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্বন্ধে এই হল শাশ্বত বাস্তব চিত্র! অর্থাৎ প্রকৃষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতে যখন কোনো সত্যকে জানি, অনুধাবন করতে পারি; তখন কিন্তু আর, কোনো বিশ্বাসের কিংবা অবিশ্বাসের ওপর আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় না! তাই ঈশ্বর আছেন কি নেই, থাকলে তিনি সাকার না নিরাকার এই বিষয়ে আমাদের ধারণাও সেই মনগড়া বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপরেই নির্ভরশীল! অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও রূপ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা সেই বিশ্বাস অবিশ্বাসের গণ্ডীতেই অন্ধের মত ঘুরপাক খায়! কারণ বিজ্ঞান বা দর্শন আজও অভ্রান্ত ভাবে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেনি! যদিও বিশ্বের সব দর্শন চিন্তার আদি উৎসই হল বিশ্বসত্যের রহস্যকে কেন্দ্র করে! এবং বিজ্ঞানও সেই রহস্য উন্মোচনে সদা সক্রিয়!

*********(এক)*********

জীবজগতে স্বপ্রাণ বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যে একমাত্র মানব মনই বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা দিয়ে প্রশ্ন করতে জানে! অন্যান্য কোনো প্রাণীই প্রশ্ন করতে জানে না! তারা প্রাপ্ত জীবনকে বিনা প্রশ্নেই গ্রহণ করে! কারণ তাদের চেতনায় কোনো বিস্ময় বোধ নেই! কিন্তু মানুষ তাঁর চেতনা উন্মেষের ঊষা লগ্ন থেকেই জগতের দিকে চোখ মেলে ছোটো বড়ো বিভিন্ন বিষয়ে বিস্মিত হতে থাকল! যত তার বিস্ময় তত তার প্রশ্ন তত তার নতুন নতুন জিজ্ঞাস্য! কিন্তু যত প্রশ্ন ততই তো হাতের কাছে চট জলদি উত্তর নেই! এক একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে লেগে গেছে কত প্রজন্ম! কত অণ্বেষন! কত পরীক্ষা নিরীক্ষা! কত ভুলের পাহাড় পেড়িয়ে এক একটি উত্তর!জীবনযাপন ও জীবন রক্ষার প্রয়োজনে মানুষ দেখল এই বিশাল জগতে প্রবল প্রকৃতির অসীম শক্তির কাছে সে কত অসহায়! কতই দূর্বল তার সমস্ত প্রয়াস! প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে তার উপলব্ধি হল কোনো বিরাট শক্তি রয়েছে এর পেছনে! সেই অদৃশ্য অপ্রত্যক্ষ কিন্তু প্রবল শক্তির তুলনায় তার ক্ষুদ্রতা অসহায়তা তাকে বাধ্য করল উত্তরহীন এই প্রশ্নের কাছে বিনীত হতে! সেই অজানা শক্তির কাছে সে সমস্ত জাগতিক বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবার প্রার্থনা নিয়ে উপস্থিত হলো! এই ভাবে প্রকৃতির বিশালতায় প্রবল শক্তির মহিমায় তার মধ্যে ধীরে ধীরে এই শক্তির প্রতি জেগে উঠল বিস্ময়! এবং শ্রদ্ধা! শুরু হল এই শক্তির পূজা! জন্ম হল ঈশ্বরের! মানুষের বিশ্বাসে!

**********(দুই)*********

সভ্যতার সেই আদি যুগে ঈশ্বর ভাবনা ছিল মূলত প্রাকৃতিক শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার একান্ত প্রয়াস যাতে প্রতিদিনের জীবনযাপন ও জীবন রক্ষা সহজ সাধ্য হয়! সাধারণ মানুষ চিরকালই শান্তিতে থাকতে পছন্দ করে! এবং অজানা আশঙ্কার ভয় তাকে সব সময়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়! কারণ তার অধিকাংশ প্রশ্নেরই উত্তর ছিল না হাতের কাছে! তাই বিভিন্ন সাম্ভব্য অসাম্ভব্য বিপদ আপদ থেকে উদ্ধারের আর্জি নিয়ে সে প্রাকৃতিক বিভিন্ন শক্তির কাছে উপস্থিত হলো! এই ভাবেই সৃষ্টি হতে থাকল এক এক প্রাকৃতিক দেবদেবীর! গড়ে উঠল পূজার নানাবিধ উপাচার! যা জাতি ধর্ম বিশেষে স্বভাবতই বিভিন্ন! কিন্তু উদ্দেশ্য ও মূল ভাবনায় সাযুয্য সম্পন্ন!চিন্তা ভাবনার ব্যাপ্তীর সাথে স্বভাবতই মানুষের মনে হতে থাকল এই সব প্রবল প্রাকৃতিক শক্তির অন্তরে নিশ্চয়ই কোনো অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাক্তিসত্ত্বা আছে! যার সচেতন ইচ্ছার সৃষ্টি এই জগত সংসার! এবং যার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল সমস্ত মানব জীবন! ফলত মানুষের মনে হতে থাকল এই ব্যাক্তিসত্ত্বাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে বিভিন্ন ইচ্ছাপূরণ সম্ভব! শুরু হল ঈশ্বরবন্দনা ঈশ্বর পূজো! বিভিন্ন জনগোষ্ঠিতে বিভক্ত মানব সভ্যতায় এই ভাবে গড়ে উঠল ঈশ্বরতত্ব! চিন্তাশীল মানব তার বুদ্ধিবৃত্তিতে খুঁজতে থাকল এই জগত সৃষ্টির রহস্য! শুরু হল দর্শন চর্চা! এবং তার পর বিজ্ঞানের হাত ধরেও আজও চলেছে বিশ্বতত্ব রহস্য উন্মোচনের সাধনা!

*********(তিন)*********

একদিকে কাল্পনিক ঈশ্বরকে খুশী রেখে জাগতিক জীবনে সুখে থাকা আর অন্য দিকে বিশ্বরহস্য উদ্ধারে চিন্তা শক্তি নিয়োগ করা, এই দুই পথেই চলতে থাকল মানুষ! কিন্তু তবু মানব জীবনে প্রার্থিত সুখ শান্তি আসল না! সমাজ জীবন হতে থাকল কলুষিত! তখন, যারা এর কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেন তারা অনুধাবন করলেন মানুষের স্বভাব প্রবৃত্তিতে এমন অনেক কু-প্রবৃত্তি আছে যেগুলি সংযমের শৃঙ্খলে না বাঁধলে সমাজ জীবন সুস্থ হতে পারে না! সেই প্রবৃত্তিগুলিকে শাসনে রেখে পারস্পরিক উন্নতির ও শান্তির জন্য তাঁরা চালু করলেন কিছু অনুশাসন! কালক্রমে এই সব অনুশাসনে জনগণকে শৃঙ্খলিত করার জন্য যোগ করা হলো ঈশ্বর ভাবনাসাধারণ মানুষকে বোঝানো হল অনুশাসনগুলি না মানলে ঈশ্বর রুষ্ট হবেন! মানলে তিনি হবেন সন্তুষ্ট! জীবনে যদি প্রার্থিত সুখ নাও আসে পরলোকে স্বর্গবাস সুনিশ্চিত! কিংবা পরজন্মে থাকা যাবে রাজার হালে! জীবন যাপনের জন্য সৃষ্টি হল বিভিন্ন নিয়ম নীতি! বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এই বিষয়গুলি নিয়ে গড়ে উঠল নানা লোকাচার! অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত ধীশক্তি সম্পন্ন এক এক জন মানব বিশ্বসত্য সম্বন্ধে তাঁদের মতবাদ প্রচার করলেন! কেউ কেউ এগিয়ে এলেন সমাজ সংস্কারে! গড়ে উঠল তাঁদেরকে কেন্দ্র করে এক একটি শিষ্য সম্প্রদায়! কালক্রমে এই সব সম্রদায়ের বিস্তারে গড়ে উঠল এক একটি ধর্ম গোষ্ঠী! ঈশ্বর ভাবনা বদ্ধ হল গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত মতবাদে!

**********(চার)********

ফলে কালক্রমে আমাদের ঈশ্বর ভাবনা সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে গেল! শৃঙ্খলিত হল ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন ভাবনা– সাম্প্রদায়িক সমষ্টি বদ্ধতার বেড়াজালে! এবং সৃষ্টি হল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের ঈশ্বর ভাবনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব! এবং প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের ধ্যান থেকে দূরে সরে এসে, বিশ্বতত্বের রহস্য অনুসন্ধান ছেড়ে আমরা সাম্প্রদায়িক ধর্মের কূটকাচালিতে নিমগ্ন হলাম! ঈশ্বরের সম্বন্ধে আমাদের ব্যস্ততা পড়ে থাকল শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত সুখ কামনার চৌহদ্দিতেই! আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থখরচ করে পূজো দিই আর ঈশ্বরের কাছে প্রাথনা করি নিজের সুখ সাচ্ছন্দের!সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল প্রত্যেক সম্প্রদায়ের বিশ্বাসে তাদের ঈশ্বরই শ্রেষ্ঠ! এবং মহৎ! এবং অন্য সম্প্রদায়ের ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছেই মহাপাপ! ভাবতে অবাক লাগে, কাল্পনিক এক ঈশ্বর নিয়ে এই মানব বিশ্বে মানুষের পরস্পরের মধ্যে কত হানাহানি রক্তপাত! কত রাজনীতি! কত সাম্রাজ্যর উত্থান পতন! কত প্রাণ বলি হল অকালে! অথচ আজও মানুষের কল্পিত ঈশ্বর মানুষের কাছেই রয়ে গেল অধরা! আজও প্রমানিত নয় তার অস্তিত্ব! আজও জানা গেল না তিনি সাকার না নিরাকার? এবং এই না জানার কারণেই বিভিন্ন কল্পিত মতবাদের খাঁচায় তাকে আবদ্ধ রাখতে হয়! পাছে তাকে নিয়ে কল্পনার ফানুসটি ফুটো হয়ে যায়! তাইতো কল্পিত বিশ্বাসেই তার অস্তিত্ব!

শ্রীশুভ্র।

পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা!


ধীরে ধীরে আমরা আধুনিক হচ্ছি, শিক্ষিত হচ্ছি কিন্তু মানুষ হওয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি মনে করি এর পেছনে পারিবারিক শিক্ষার অভাবই মূল কারণ সাথে সামাজিকতা! যা দেখে আমরা শিখছি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সনদধারী হওয়া সহজ কিন্তু মানুষ হতে গেলে পারিবারিক শিক্ষার বিকল্প কিছু নেই। আমার মতে ‘পৃথিবীর সব চেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে পরিবার, আর সব চেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছে মা’।আগে পরিবারের সবাই এক সাথে বসবাস করতো এই থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারতাম, এখন পরিবার ছোট থেকে ছোট হচ্ছে আর আমাদের বাচ্চাদের পৃথিবীটাও আমরা ছোট করে দিচ্ছি। একটা সীমানার মাঝে ওদের বন্দি করে রাখছি, রুটিন মাফিক একটা যান্ত্রিক জীবন উপহার দিচ্ছি।

শুধু মাত্র পারিবারিক শিক্ষায় ক্যারিয়ার গড়া যাবে না সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটাও খুব জরুরী, কিন্তু বর্তমানে যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়া হয় তাতে আমাদের শিক্ষার হারই বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু শিক্ষিত মানুষের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাচ্চাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে হবে, শুধু পাশ করতে হবে, ক্লাশে রুল নাম্বার এক হতে হবে, এই চিন্তাই থাকে পিতা-মাতা বা পরিবারের সবার মাথায়। যখন ছাত্র এই সব করতে না পারে তখন চাপ বৃদ্ধি করা হয়, কয়েকটা কোচিং এর ব্যবস্থা করা হয় আর স্কুল যাওয়ার আগে কোচিং স্কুল ফেরত আসার পর অন্য কোচিং আর সন্ধ্যার পর আরেক কোচিং বাচ্চার খেলাধুলার সময়টা কোচিং এর মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে ইদানিং মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাব, আইপ্যাড এই গুলোর শিক্ষার উপকরণ বলে চালিয়ে দিচ্ছি কিন্তু একবারও কি খোঁজ নিচ্ছি আমাদের বাচ্চারা এই সব থেকে কি শিক্ষা নিচ্ছে । আর সাথে ৩ থেক ৫ কেজি ওজনের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দিচ্ছে, ব্যাগের বোজা বইতে বইতে বাচ্চাটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা। এতো রকমের চাপ অনেক বাচ্চাই বহন করতে পারেনা এবং এই থেকে মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পরছে, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করলে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
আমাদের আগামী প্রজন্মকে “প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষাটার গুরুত্ব দিতে হবে” তাবেই উত্তম প্রজন্ম সৃষ্টি হবে যারা আগামী দিনে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তা না হলে বর্তমানে যে দুর্নীতি পরায়ন “জনগোষ্ঠি!” (যার পরিমান সামান্য যারা আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন) নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আঁধারের দিকে সেখান থেকে বাহির হওয়া যাবে না।

আমি সৌদিতে কম্পিউটার ব্যবসায় জড়িত, কম্পিউটার মেন্টেনেস এর কাজ করে থাকি গত কাল দোকানে অনেক কাষ্টমার আসে কম্পিউটার মেন্টেনেস করার জন্য দিয়ে যায় আবার অনেকে উনাদের কম্পিউটার নিয়ে চলে যায় কিন্তু কে যেন হাতের ছোট একটা ব্যাগ ভুলে রেখে যায়, প্রচুর ব্যস্তছিলাম তাই আধা ঘন্টা পর তা আমার নজরে আসে ব্যাগটি আসলে কার তা সঠিক ভাবে নিশ্চত হতে পারতেছিনা, ব্যাগ খুলে দেখতে চেষ্টা করলাম কোন আইডি পেলে তো ছবি দেখে চিনতে পারবো এবং তাই হলো সৌদি সামরিক বাহিনীর এক সদস্যের ব্যাগ যিনি মাগরিবের পরে দোকানে এসেছিল, তার ব্যাগে ৪ হাজার রিয়ালের মতো যা বাংলাদেশী টাকায় ৮০ হাজারের উপরে,সাথে আইফোন ৭, একটি গাড়ীর চাবি, এবং অন্যন জিনিসপত্র, কম্পিউটার নেয়ার সময় ম্যামু করেছিল, সেখান থেকে ২/৩ জনকে ফোন করে তার পর নিশ্চিত হয়ে ব্যাগের আসল মালিককে পেয়েছি, এবং দোকার বন্ধ করার আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে উনার ব্যাগ উনাকে ফেরত দিয়েছি, এই শিক্ষাটা আমি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নয় আমার পরিবার থেকে পেয়েছি।

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…….

“আলো আমার, আলো ওগো, আলোয় ভূবন-ভরা, আলোয় নয়ন- ধোয়া আমার, আলোয় হৃদয়- হরা। নাচে আলো, নাচে ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে—বাজে আলো বাজে, ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে” এত আলো! চারিদিকে! যে আলোর স্রোতে পাল তুলেছে বিশ্বভূবন! যে আলোর সাজে সাজতে ভালোবাসে মানুষের অন্তর্দীপ্ত বিবেক, সভ্যতার সেই ঊষা লগ্ন থেকেই! সেই আলোতেই কি আমরা আমাদের চেতনার সব ঘরদূয়ারগুলো ধুয়ে নিতে চাইনা? মন মননের মাস্তুলে সেই আলোর পাল তুলে ভালোবাসার উজানে কে না চায় পাড়ি দিতে? কিন্তু বাস্তবে কি সত্যিই তাই ঘটে? আমাদের চারপাশের এই চেনা অচেনার জগতসংসারের আটপৌরে জীবনের দৈনন্দিন চৌহদ্দিতে? অন্তত গড়পড়তা হিসেবের চেনা জানা পরিসংখ্যান কি সেই কথাই প্রমাণ করে? নাকি মানুষের ইতিহাস একটু অন্য চিত্রই তুলে ধরে? অনেকেই বলেন আলো অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, শুভ অশুভের দ্বৈরথ আর তার মধ্যেই পথ করে এগিয়ে চলা, চরৈবেতি চরৈবেতি- এটাই জগতসংসারের মূল স্বরূপ। খুবই সত্যি কথা! কিন্তু এগিয়েই চলা তো? নাকি এগনোর তালে তালে তলে তলে আবার সেই শুরুর বলয়েই ফিরে আসা? কোনাো একটি স্থানাঙ্ক কে কেন্দ্র করে যে ঘূর্ণন, তার প্রতিটি মুহূর্ত্তই কিন্তু পূর্ববর্তী ক্ষণ ও স্থানাঙ্ক থেকে ক্রমাগত এগিয়ে চলাই। কিন্তু সমগ্র পথের হিসেব নিলে স্পষ্ট হয়, সে এগনো আসলে কিন্তু আবার সেই শুরুর মুহূর্ত্তেই ফিরে আসা। সভ্যতার চরৈবেতি ঠিক সেই রকম এগনো নয়ত?

যে আলোর কথা বলছেন বিশ্বকবি, সেই আলো যদি সত্যিই আমাদের আপামরের হৃদয়বীণায় বাজত তবে কবির কথাতেই প্রশ্ন করা যায়, আজও ‘বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে’ কাঁদে কেন? কাঁদে যে সে’তো রোজ সকালের প্রভাতী আলোয় প্রভাতী সংবাদে চোখ রাখলেই কান পেতে শোনা যায়। তাহলে কোথাও কি কোনো গন্ডগোল রয়ে যাচ্ছে? তাইতো মনে হয়। একটু ভাবলে বুঝতে পারি, গন্ডগোলটা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে! আমাদের লোভ লালসা ঈর্ষা দ্বেষ ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির উদগ্র তড়ণা আর রক্তের কোষে কোষে হিংসার অনির্বাণ প্রবৃত্তি- আমাদেরই চারদিকে অন্ধকারের যে বলযটি তৈরী করে রাখে; সেই বলয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না চৈতন্যের আলো! মানব সভ্যতার এইটিই নিদারুণ অভিশাপ! এবং মানুষের ইতিহাস মূলত এই অন্ধকার বলয় থেকেই উত্তরণের প্রাণান্তকর প্রয়াসের ইতিহাস। এই অভিশাপ মুক্তির দূর্বার স্বপ্নের ইতিহাস। কিন্তু তবু কি সফল হয় সেই প্রয়াস? সার্থক হয় হয় আলোর স্বপ্ন? ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন জনপদ, বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন যূগে সেই সাফল্যকেই পাখির চোখ করে এগনোর প্রয়াস করে চলেছে। কিন্তু চললেও আজও কত অন্ধকার ক্রমাগত ঘিরে ধরে আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে। আর তখনই প্রশ্ন জাগে তাহলে কি আমরা আসলেই এগনোর পথ ধরে চলতে চলতে আসলে সেই একই অন্ধকারকে প্রদক্ষিণ করে চলছিনা?

চলছিই তো। চলছে বলেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরেও হাজার হাজার যুদ্ধ সংঘঠিত করেও আজও ধর্ম সংস্থাপন অধরাই রয়ে গেল। হাল আমলের দু দুটি বিশ্বযুদ্ধ- যা নাকি অশুভ শক্তির পরাজয়ে শুভ শক্তির জয় বলে ইতিহাস বন্দিত, সেও ধর্ম সংস্থাপনে ব্যার্থ পুরোপুরি। মানুষের যূদ্ধ আজ অব্দি ক্ষমতার হাতবদলের যুদ্ধ, ধর্ম স্থাপনের যুদ্ধ নয়! মারণাস্ত্রের ব্যবহারে ধর্ম স্থাপন অসম্ভব। বস্তুত মারণাস্ত্রই অধর্মের প্রমাণ। তাই দিয়ে কি করে সম্ভব ধর্ম প্রতিষ্ঠা? তাই কুরুক্ষেত্রও ব্যর্থ- অন্ধকারের বলয়ে চৈতন্যের আলো প্রজ্জ্বলনে। ব্যর্থ কারণ আমাদের চরৈবতি মূলত একটি ঘূর্ণন প্রক্রিয়া মাত্র। তা আমাদের কোনো ভিন্নতর স্তরে বা নতূনতর ভূবনে পৌঁছিয়ে দিতে পারে না। কেননা আমরা আজও লোভ লালসা ঈর্ষা দ্বেষ জনিত ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির উদগ্র সেই তারণা আর আমাদের রক্তের অন্তর্গত হিংসার অনির্বাণ প্রবৃত্তির কবল থেকে আমাদের নিজেদেরকেই মুক্ত করতে পারিনি। পারিনি বলেই আমাদের চারপাশের এত নিত্যনতুন অন্ধকারের নীরেট বলয় আমাদের চৈতন্যের শুভ আলোকে বিকশিত হতে দেয় না!

আর তখনই মাথা তুলে দাঁড়ায় অন্ধকারের বিষাক্ত ফণা! তার বিষাক্ত ছোবলে যত্রতত্র নিরবে নিভৃতে কাঁদতে থাকে বিচারের বাণী তার নির্বাক অভিমান নিয়ে। বৈষম্য শোষণ অত্যাচার নিপীরণ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে দূর্বলের জীবন। আর বিভেদের মন্ত্র আউড়িয়ে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে মিথ্যার জাল বিছিয়ে অপপ্রচারের দুন্দুভি বাজিয়ে অন্ধকারের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে যাবতীয় অশুভ শক্তি, অশুভ আঁতাতের হাত ধরে। এটাই তো এই পৃথিবীর শাশ্বত ইতিহাস! মানুষের অতীত। মানুষের বর্তমান। আর ভবিষ্যতের মলিন দিশা। অন্ধকারের এই যে ভয়াবহ আরতি, তা আমাদের ঘরসংসার সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস সর্বত্রই প্রতিদিনের সত্যি! যে সত্যি’র ভয়াবহ চিত্র শিহরিত করে তুলবে যে কোনো শুভবোধ জাগ্রত মানুষের বিবেককে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর অবস্থান, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির তৃতীয় বিশ্বে দরিদ্র্যের অবস্থান, একমেরু বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বের অবস্থান; সেই সব সত্যিরই এক একটি ভয়াবহ চিত্র! যা আমাদের কেবলই ক্লান্ত থেকে ক্লান্ততর করে তোলে। আর ঠিক সেই প্রেক্ষিতেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমরা, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডীতেই গুছিয়ে নিতে চাই নিজেদের আশু ভবিষ্যৎ! অন্ধকারের মূল বীজটি ঠিক এইখানেই বপন করতে থাকি আমরা, হয়ত নিজের অজান্তেই! আর তাই আমাদের যে এগিয়ে চলার কথা ক্রমাগত সামনের দিকে- স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর আলের অভিমুখে; সেই চলা কার্যত কেবলই ঘুরতে থাকে ঐ অন্ধকারের বীজটুকুকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে। তাই আলো অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, শুভ অশুভের দ্বৈরথের মধ্যে দিয়ে যে চরৈবেতি- এগিয়ে চলা; বস্তুত তা আমাদের কোনো আলোর জগতে পৌঁছিয়ে দিতে পারে না আদৌ।

তাইতো বিশ্বকবি মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দেওয়ার জন্যে প্রার্থনা করে বলেন, ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলোর ঢাকা ধুইয়ে দাও’। এই ধুলোর ঢাকাই সেই অন্ধকার যা আমাদের এগিয়ে চলাকে কেবলই অন্ধকারেরই চারপাশে আবর্তিত করতে থাকে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় একটিই। যার সূত্র দিয়ে গিয়েছিলেন সর্বপ্রথম স্বয়ং বুদ্ধদেব; মৃত্যর পূর্বে প্রিয় শিষ্যদের বলে গিয়ে ছিলেন- “আত্মদীপভব” আর তাইতো বিশ্বকবি গাইলেন, ‘যে যন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে, আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপাল এই অরুণ আলোর সোনার কাঠি ছুইয়ে দাও’। কবির কথায়, আমাদের পরাণ-বীণায় যে অমৃতগান ঘুমিয়ে আছে, যার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান; তাকেই আলোকের এই ঝর্ণাধারার আনন্দে জাগিয়ে তুলতে হবে। হয়তো তবেই আর গোলক ধাঁধার আবর্তে নয়, আমাদের এগিয়ে চলা সত্যই সম্মুখ পানে অগ্রসর হওয়া হবে।

কিন্তু কি ভাবে সম্ভব এইভাবে জাগিয়ে তোলা? কি ভাবে সম্ভব বুদ্ধদেব কথিত ‘আত্মদীপভব’ হয়ে ওঠা! পথ কিন্তু একটিই! আর সেটি হল মানুষ গড়ে তোলার প্রকৃত যে শিক্ষা, সেই শিক্ষা বিস্তারকে করে তুলতে হবে সর্বব্যাপী। যে কাজে আজও হাত দেওয়াই হয়নি! সেই কাজটির সার্থকতার সাথে সাথেই মানুষের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত আলোর অভিসারে সমাজ সংসারে বদলাতে থাকবে নারীর অবস্থান। ছিন্ন হতে থাকবে দারিদ্র্যের অভিশাপ। আর তখনই একমাত্র সম্ভব প্রকৃত আলোর অভিমুখে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে সর্বজনীন অগ্রসরণ! যে অভিমুখ হিংসা দ্বেষ লোভ লালসা ঈর্ষা ও ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির বিপরীত অবস্থানে মুক্তি দেবে আমাদেরকে, সমস্ত অন্ধকার থেকে। আর তখন ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধ বলে মিথ্যা প্রচারের দুন্দুভি বাজানো সম্ভব হবে না। ধর্ম সংস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হবে না কোনো কুরুক্ষেত্রের। আর সেইদিনই বেজে উঠবে ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’। আমরা সবাই মিলে নিঃসংশয়ে বলতে পারব, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে…..’

শ্রীশুভ্র