আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

পারবি!

সময় তুই আমারে আবার সেই জীবনে নিয়া চল-

যেই জীবনে সব চাইতে বড় পাওয়া আছিল আটআনা দামের লেবেনচুষ, মালাই আইসক্রীম আর একটাকা দামের কুলফি বরফ…

যেই জীবনে আস্ত একটা ছুটির দুপুরে মহল্লার অন্য পোলাপাইনের লগে গিয়া ফুটবল খেলা মানেই আছিল স্বাধীনতা…

যেই জীবনে গুড্ডি উড়াইতে গিয়া বুন করতে না পারার মধ্যে আছিল বিকাল ভরা আনন্দ…

যেই জীবনে দোস্ত’গো লগে কাইজা কইরা সারা জীবনের লেগা কাট্টি লওয়ার মেয়াদ আছিল খুব বেশী হইলে দুই তিন ঘন্টা…

যেই জীবনে গুড্ডি ছিড়া গেলে, লাট্টুর লত্তি হারায়া গেলে আর খেলনা ভাইঙ্গা গেলে দু:খে চোখ ভইরা পানি আইতো…

যেই জীবনে আব্বার কান্দ আছিল দুনিয়ার সব চাইতে উঁচা পর্বত আর আব্বার কান্দে চইড়া শূণ্যে হাত বাড়ান মানেই আছিল আকাশ ছোঁয়া…

যেই জীবনে আম্মারে জড়ায়ে ধরলে আর কোন ভয়ডর থাকতোনা, আম্মা বুকের লগে চাইপা ধরলেই মনে অইতো দুনিয়ার কেউ আমারে কিছু করতে পারবোনা…

সময়, আমি তোর লগে ঐ জীবনে ফিরা যাইতে চাই। পারবি!- আমারে লয়া যাইতে!!

অকবিতা ৫

যাও-
এখনই বারান্দায় দাঁড়াও
আকাশে তাকাও।

এই হেমন্ত সন্ধ্যায়
এই ধানপাকা মৌসুমে
এই শীত শীত হাওয়ায়
তোমার বারান্দা জুড়ে ফিনফিনে কুয়াশায়
সবকিছু তুচ্ছ করে ২৫বছরের পুরানো স্কচ রঙা চাঁদ।

জোছনা নয়
চারদিক ভেসে গেছে স্কচে
এই মাতাল সভায় বুঁদ হয়ে বসেছেন তরল ঈশ্বর
আজ তার আপন আমলনামা মেলানোর দিন।

#অকবিতা

সাঈদের তিনটা অকবিতা… আজ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাগ

কীট

সকালে আকাশে মেঘ ছিলো। তোমার চোখের নিচে জমাট বাঁধা কালি রংয়ের আলো — মায়ামায়া বিষাদের মত মসৃণ। কোথা থেকে একটা ছোট পোকা শাদা শার্টে এসে বসেছে। চাল রঙ্গা শরীরের মাঝখানে ছোট রৌদ্রোজ্জ্বল কমলা বৃত্ত; বৃত্ত জুড়ে সোনালী আঁকিবুঁকি। পোকা নয়, মামুলি শার্টে তুমুল সুন্দর বসে আছে– শান্ত স্থির। হঠাত ইচ্ছে হলো তোমার কপালে পড়িয়ে দেই এই অনিন্দ্য টিপ, পোকার রূপজীবন ধন্য হোক। এমন সময়গুলোতে কি যে হয়– ভুলেই যাই ট্রেনের শিডিউল।

খুচরো দরে খরচ করেছি জীবন– এলোমেলো, এখানে সেখানে। তোমাকে খুঁজেছি উদ্ভ্রান্ত উন্মাদনায় যত্রতত্র– নীরবে নিভৃতে। শেষ ট্রেনের হুইসেল বাজার ক্ষণিক আগে তোমার দেখা পেলাম, ধ্রুবতারার সমান দূরত্বে। আজ তোমার কপালে টিপ পরানোর ইচ্ছে জেদ করে– কতভাবে যে তাকে হত্যা করছি, তবু সে মরেনা।

একটামাত্র মানুষজন্ম কেটে গেলো অকাট অর্থহীন। আবার জন্মালে যেন পোকা হই– ঠিকঠিক চিনে নেই তোমার কপাল, কপালের মধ্যবিন্দু।

.
নক্ষত্র এক্সপ্রেস

তোমার সমস্ত উঠোন, ঘর, ঘরের দেয়াল, সিলিং, বিছানাপত্তর, ড্রেসিং টেবিলের আয়না, মামুলি পাপোশ কানায় কানায় ভরে যাচ্ছে নক্ষত্রে— ঘরের দরজায় নক্ষত্র বোঝাই ট্রেন এসে থামছে একের পর এক।

আমি ছিন্নবস্ত্র পরিব্রাজক– আত্না ও হৃদপিণ্ডের বিনিময়ে নক্ষত্র এক্সপ্রেসের একটা টিকেটও কিনতে পারিনি– এতই দুর্মূল্য।

আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা

আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দের ১৭টি বাংলা অর্থ আছে গুগল অনুবাদে। কিন্তু ১৭টি বাংলা অর্থের কোনোটাই আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার চরিত্রকে যথাযথ প্রকাশে সক্ষম নয়। আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দটি অক্ষত রেখেই এই গোত্রের সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে যাচ্ছি-

১.
৯০ দশকের আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্রের চরিত্র :

১৯৯১ হতে ৯৪ সাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শ্রেণিভুক্ত বিজ্ঞাপনের ‘আবশ্যক’ শ্রেণিতে প্রায় প্রতিদিন সংবাদদাতা/সাংবাদিক চাই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত। এসব বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিলো অনেকটা এমন- ‘জাতীয় পর্যায়ের একটি সাহসী সংবাদপত্রের জন্য ‘নির্ভীক সাংবাদিক আবশ্যক। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি/এইচএসসি। অভিজ্ঞতা নিষ্প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ, পরিচয়পত্র, টেপ রেকর্ডার ও ক্যামেরা প্রদান করা হবে। পোস্ট বক্স নং *****’

সাহসী সংবাদপত্রের নির্ভীক সাংবাদিক হতে যারা আবেদন করতেন তাদের কাছে ফিরতি চিঠিতে প্রশিক্ষণ ফি, পরিচয়পত্র ফি দাবি করা হত। এই ফি প্রেরণ করলে টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরার মূল্য চাওয়া হত। এসব ফি প্রেরণের পরে আবেদনকারীরা বুঝতে পারতেন যে ‘সাহসী সাংবাদিক’ হতে গিয়ে তারা অসহায়ভাবে প্রতারিত হয়েছেন। কারণ, পত্রিকাটি মোটেও জাতীয় পর্যায়ের নয়, দ্বিতীয়ত পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়না, তৃতীয়ত পত্রিকাটির প্রধান বাণিজ্য হচ্ছে এসএসসি-এইচএসসি অর্থাৎ ১৬ থেকে ১৮বছর বয়সীদের কাছে ‘সাহসী সাংবাদিক’-এর নিয়োগ বাণিজ্য, চতুর্থতঃ পত্রিকাটির আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে চাঁদাবাজী।

২.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার রিপোর্টার :

জাফর মীরের নাম শুনেছেন? না শুনলেও কিছু যায় আসেনা। কারণ তিনি বিশাল মাপের ক্রাইম রিপোর্টার। ভাবছেন উনি কোন পত্রিকার রিপোর্টার? পত্রিকার নামও শোনার দরকার নেই। কারণ ঐ পত্রিকার নাম পত্রিকার মালিক কাম সম্পাদক আর তার কাছের ক’জন ছাড়া কেউই শোনেন নাই। পত্রিকাটি দৈনিক হলেও মাসে হয়তো তিন চার দিন প্রিন্ট হয়। কিন্তু তার জন্য তো জাফর মীরের ‘সাহসী সাংবাদিকতা’ বন্ধ হয়ে থাকতে পারেনা।

জাফর মীর যতক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকেন ততক্ষণ গলায় মোটা ফিতে দিয়ে সাংবাদিকের আইডি কার্ড ঝুলিয়ে রাখেন, তার মোটর সাইকেলের সামনে সাধরণের চাইতে বড় করে লিখা থাকে ‘সাংবাদিক’, তিনি থানায় ওসির রুমে সালাম দিয়ে এসে কনস্টেবলের সাথ আড্ডা দেন আর সিগারেট ফুঁকেন। এরই মাঝে থানায় দুই একটা কেসে মধ্যস্ততা করে পকেটে কিছু ভরেন। তারপর সংবাদ অর্থাৎ পার্টি খুঁজে বেড়ান। পার্টিকে সাংবাদিক আর সংবাদপত্রের শক্তি দেখিয়ে ঘটনা চেপে যাওয়ার জন্য টাকা আদায় করেন।

জাফর মীর আয়কৃত টাকার একটা অংশ পত্রিকার সম্পাদক কাম মালিককে প্রদান করেন। আর যেখানে সে নিজে ধান্ধাটা সামাল দিতে পারবেনা সেখানে সম্পাদককে পার্টনার করেন।

জানলে অবাক হবেন যে, এই গোত্রের অনেক সম্পাদক ও সাংবাদিকের নিজের বিলাসবহুল গাড়ী আছে। অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট আছে। ব্যাংক ব্যালেন্স যে আছে তা অনুমান করা যায়। প্রকৃত সাংবাদিকরা যেসব ক্ষমতাবানের কাছে সহজে পৌছতে পারেন না, সেই ক্ষমতাবান আর প্রভাবশালীদের সাথে এই গোত্রের ক’জন সম্পাদক আর সাংবাদিকদের অহরহ উঠবোস।

৩.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক :

বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং সেনা প্রধানের পরে যদি ক্ষমতাবান কেউ থাকেন তিনি হলেন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক। অধিকাংশ আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রে মালিক এবং সম্পাদক একজনই। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে- সম্পাদকের পরে নির্বাহী সম্পাদক বা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দিয়েও কিছু কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্রগুলো চলে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, একুশে টিভির প্রধান নির্বাহী ও সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, এমন কি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীও এত প্রতিপত্তি নিয়ে চলেন না, যে প্রতাপে অধিকাংশ আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার মালিক কাম সম্পাদকরা চলাফেরা করেন।

কর্পোরেট বা সফল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বা নিয়োগপ্রাপ্ত না হলেও এই গোত্রের পত্রিকার পেশাজীবী সম্পাদকরা অধিকাংশই নিজের গাড়িতে চেপে অফিসে আসেন। গাড়ির পিছনের ড্যাশবোর্ডে এমনভাবে নিজ পত্রিকার কয়েকটি কপি রাখেন যেন বাইরে থেকে দেখা যায়, পত্রিকার পাশেই রাখেন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নেত্রীর ছবি সংবলিত স্যুভেনির। নিজের ক্ষমতা বোঝাতে এই সম্পাদকদের কারো কারো গাড়ির ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড সুন্দর করে কভার দিয়ে ঢাকা থাকে সবসময়, যা কখনই খোলা হয়না। ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড সুন্দর করে কভার দিয়ে ঢাকা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সম্পাদকদের গাড়ি ফকিরাপুল-সচিবালয়-মতিঝিলের পাশাপাশি অভিজাত গুলশান, বারিধারা, বনানী আর উত্তরাতেও দাপিয়ে বেড়ায়।

এই সম্পাদকদের প্রধান পেশা হচ্ছে তদবীর করা। এছাড়া বিভিন্ন ‘টার্গেট’ নির্ধারণ করে তাদের কাছ থেকে তাদের ভাষায় মোটা অংকের ‘দাও’ মারা।

৪.
ফকিরাপুল ওয়ানস্টপ সার্ভিস :

ফকিরাপুল হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা শিল্পাঞ্চল। ফকিরাপুলেই আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা শিল্প বিকশিত হয়েছে এবং অবারিতভাবে এখনও হচ্ছে। ১২ফুট বাই ১২ফুট অর্থাৎ ১৪৪স্কোয়ার ফিটের একটি রুমে ২০টি দৈনিক পত্রিকার অফিস একমাত্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ফকিরাপুলেই সম্ভব। এই অফিসগুলো সবই আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার। অবশ্য, ফকিরাপুলের আশেপাশের এলাকাতেও বেশকিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার অফিস আছে।

৫. এখন প্রশ্ন হলো পত্রিকাগুলোর আয়ের খাত কি?

এই পত্রিকাগুলোর প্রধান আয়ের খাত নিম্নরুপ-

ক. ব্ল্যাক মেইল
খ. তদবির
গ. ডিএফপি করা থাকলে সরকারি বিজ্ঞাপন
ঘ. বেসরকারি বিজ্ঞাপন
ঙ. প্রচার সংখ্যা বেশী দেখিয়ে সরকারি কাগজ বিক্রয় (প্রকাশিত হয় ২০০ কপি, কিন্তু প্রচার সংখ্যা দেখানো হয় ৩০,০০০ হতে ১,০০,০০০ কপি)

চ. ধান্ধা

৬.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হয় কিভাবে?*

আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলো প্রকাশের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পত্রিকার নাম এবং কোন ধরনের সংবাদ যাবে বলে দিলেই তারা চাহিদা মাফিক সংবাদপত্র ছাপিয়ে দেয়। তারাই বিভিন্ন পত্রিকা হতে সংবাদ কপি পেস্ট করে নিজেদের মত সাজিয়ে রাখে। তবে ধান্ধা সংক্রান্ত রিপোর্টগুলো লিখার জন্য আলাদা পারিশ্রমিক প্রদান করতে হয়।

৭.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোর প্রচার সংখ্যা কত?*

আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোর প্রচার সংখ্যা নূন্যতম দুইশত। এই পত্রিকাগুলো সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে এবং পত্রিকার ধান্ধা আছে এমন জায়গায় প্রেরণ করা হয়। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এই সংখ্যা বাড়তে পারে। সাধারণতঃ কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার প্রচার সংখ্যাই ১০০০-এর উপরে নয়।

৮.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা কিভাবে বের করবেন?*

প্রথমেই পত্রিকার একটি ডিক্লারেশন বের করুন অথবা ডিক্লারেশন আছে এমন একটি পত্রিকা কিনে ফেলুন। নিয়মিত প্রকাশিত হয়না এমন ডিক্লারেশন পত্রিকার অভাব নেই। সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে এবার ডিএফপি‘র মিডিয়া লিস্টে নাম তালিকাভুক্ত করতে তিন মাস পত্রিকাটি প্রকাশ করে পৌছে দিন ডিএফপি’সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। পত্রিকা সম্পাদনা আর সাংবাদিকতা বিষয়ে আপনার ধারণা না থাকলেও সমস্যা নেই। আপনার জন্য আছে ফকিরাপুলের ওয়ানস্টপ সার্ভিস- সম্পাদনা থেকে যথাস্থানে পত্রিকা পৌছে দিবে তারাই আর সেটাও খুব কম খরচে। সব খরচ সহ দুইশত কপি পত্রিকা ছেপে দিবে ফর্মাভেদে ২০০০ থেকে ৩৫০০টাকায় মাত্র।

৯.
প্রকাশ করবেন না কি একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা!! করবেন না কি আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদিকতা!! ভেবে দেখুন, পৃথিবীর আর কোথাও পত্রিকা প্রকাশে এমন ওয়ানস্টপ সার্ভিস নেই, পত্রিকার এমন মারমার কাটকাট বাণিজ্য নেই।

মায়ামুক্তি

: বুঝলি নগেন, মায়া সব মায়া। দারা পুত্র পরিবার, তুমি কার? কে তোমার?
: গুরুজী, মায়ার ছোট বোন ছায়াকে ছাড়া বাচপো নানে।
: ছায়ার কথা কচ্ছিস! সে যে আরো বড় মায়া রে… কঠিন মায়া…
: গুরুজী ছায়া ছাড়া বাঁচি থাকি কি হপে! আমি মরি যাপো।
: ধুর! মরবি ক্যানে! এত করে যখন জিদ ধইরেছিস তবে তোকে মায়ামুক্ত কইরে দিব।
: গুরুজী, আমাকে কি করতি হপে?
: তোর কিচ্ছু করতি হবেনানে। তবে আমার খরচ না দিলি, জিনিসপত্তরের খরচতো দিতি হবে, না কি নগেন!
: নিঘঘাত দিপো, নিঘঘাত দিপো।
: তুই বারো হাজার দিবি, আর আমার খরচ দশ হাজার- ইচ্ছা হলি দিবি, ইচ্ছা না হলি দিবিনা।

নগেন পরের দিন দুপুরে গঞ্জের হাটে গোয়ালের গরু বেঁচে। বিকেলে গুরুজীর পবিত্র হাতে একত্রে বাইশ হাজার টাকা তুলে দেয়। গুরুজী কথা রাখেন। সেদিন রাতেই ছায়াকে নিয়ে পালিয়ে মায়ার কষ্ট থেকে নগেনকে মুক্তি দিয়ে যান।

অকবিতা ৪

যখন-
গোড়ালির হাড়ে চিড় ধরেছে
ভাঁজ ভাঙতে কুকড়ে ওঠে হাঁটু
পায়ের পাতায় তীব্র ক্ষরণ
যিশু নও জেনেও নিয়তি গেঁথে যায় তারকাটা
পা হতে কপাল পর্যন্ত ক্লান্তিহীন
তখন-
পৃথিবী ঘুরছে সাবলীল, থেমে নেই চারপাশ।

বস্তুত
সকল সংকট ও শোকে
পতন ও উত্তরণে
মিলন ও আনন্দে
সঙ্গম ও বিচ্ছেদে
কিরণ ও তমসায়
স্থবির ও ঘূর্ণিপাকে
নির্লিপ্ততাই পৃথিবীর আদিধর্ম
নিঃস্পৃহতাই সময়ের মূলনীতি।

সমুদয় দীনতা ও কাঙালপনা
উচ্ছাস ও অধোগমন
পীড়ন ও প্রণয়াকাঙ্ক্ষা
যাপন ও আত্মহত্যা
রোদ্দুর ও জোছনার ঋণ
মানুষের আজন্ম দায় ও অনারোগ্য মাথাব্যাথা।

পৃথিবী, সময় ও মানুষের ব্যাকরণ ভেঙে
আপন শরীর ও আত্নাকে তুচ্ছ করে করে যে বাঁচে
তার আজ খুব জ্বর, তেষ্টা ভীষন
অথচ তার গন্তব্য বহুদূর- যার কাছে পরে আছে মন।

গড্ডালিক

গল্পটি শুরু থেকে শুরু করা যায়, শেষ থেকেও শুরু করা যায়। কল্পনার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বা পক্ষপাতিত্ব থাকলেও সত্য ঘটনার ক্ষেত্রে লেখক মাত্রই নিরপেক্ষ। তাই গল্পটি মাঝ হতে অর্থাৎ জ্যামিতির ভাষায় যাকে বলে মধ্যবিন্দু হতে শুরু করছি।

মদনানন্দ মদাশ্বর একজন তন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ। সুবিধা হয় বলে সবাই মদনা ওঝা নামেই ডাকে। এই নামে ডাকলেও তার প্রতি সমীহ ও ভীতির কোনো কমতি নেই। সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে তার প্রতাপ। তার কাছেই সবাই ছুটে যায়। তবে আজ মদনা ওঝা ছুটছেন, গন্তব্য আশোক রায় চৌধুরীর বাড়ি। চলতে চলতে তিনি আকাশ কাঁপিয়ে বাতাস দাপিয়ে জপ করছেন, “মা তারা… মা তারা.. অশোক মাস্টার রে, ওরে মাস্টার আমি আসছি, তারা.. তারা.. মা তারা।” তার জপে এক ধরণের উত্তেজনা ছড়িয়ে পরছে শেষ হেমন্তের হিমহিম সকালের মখমল রোদে, মফস্বলের শিশিরসিক্ত মেঠো পথে। রোদ-ছায়ার সাথে শিশিরের সবটুকু সরলতা মিলেমিশে নিপাট নরম তরলতাময় উত্তেজনা ও বিস্ময় সংক্রমিত হচ্ছে মানুষের মনে মনে, ‘আহা অশোক মাস্টার! আহা অশোক মাস্টার.. আহা..।

অশোক রায় চৌধুরী একজন অঙ্ক শিক্ষক- এমন একটি মাত্র বাক্যে অশোক স্যারের পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। তিনি অষ্টম শ্রেণিতে সাধারণ গণিত এবং বিজ্ঞান পড়ান। নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রদের পড়ান ক্যালকুলাস, বিজ্ঞান আর ইংরেজি ব্যাকরণ। সুতরাং তিনি শিক্ষক। তবে আর দশজন শিক্ষক হতে তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি সাধারণ নন, তিনি বিশেষ।

অশোক রায় চৌধুরী কেনো বিশেষ- এ প্রশ্নের উত্তরও একটি মাত্র বাক্যে দেয়া সম্ভব নয়। অশোক স্যারের আদিপুরুষ ছিলেন শুদ্ধ আর্য, মাতাও তাই। বাপ-দাদার মত তার গায়ের রঙও হলুদাভ শাদা। খাড়া নাক। শক্তপোক্ত দেহের গঠন, ছয় ফুটের কাছাকাছি উচ্চতা। মধ্য পঞ্চাশ বছর বয়সেও সটান মেরুদণ্ড। শরীরে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব পাওয়া জমিদার বাড়ির রক্ত প্রবাহিত হবার আভিজাত্যের ছটা। পাঞ্জাবি বা হাওয়াই শার্ট নয়, তিনি সব সময় ইন করে হালকা রংয়ের শার্টের সাথে গাঢ় রংয়ের প্যান্ট পরেন। কোমড়ে গাঢ় চকোলেট কালারের বেল্ট। পায়ে ঝকঝকে চকমকে পালিশ করা কালো জুতো। যে জনপদে শিক্ষক মানেই সীমাহীন কথা বলা, থামতে না জানা সেখানে তিনি কথা বলেন মেপে মেপে, প্রমিত বাংলায়, শুদ্ধ ইংরেজিতে। গণিত, বিজ্ঞান আর ইংরেজি তিনি শুধু পড়ান না, নিজের আত্মায় ধারণ করেন। যত কুসংস্কার, যত বিজ্ঞানহীন বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণা, যত অসভ্য আচার আচরণ, ঝাড়ফুঁক তন্ত্রমন্ত্র- সবকিছুর বিরুদ্ধে তার সোচ্চার অবস্থান। এই গভীর বিজ্ঞানমনস্কতা আর যুক্তিভিত্তিক চিন্তা তিনি ছাত্রদের মন ও মগজে গেঁথে দিয়েছেন। ছাত্রদের সবাই তাকে অনুসরণ করে, অনুকরণ করে।

ছ’মাস ধরে অশোক স্যার মানসিকভাবে অসুস্থ। প্রথম পর্যায়ে অসুস্থতার লক্ষণগুলোকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। যেমন হঠাৎ করেই তিনি গলায় টাই পরতে শুরু করলেন। এতে কেউ অবাক হয়নি, ভাবখানা এমন যে এটাই স্বাভাবিক। বিপত্তি বাঁধলো যখন টাই-এর সাথে থ্রি পিসের কমপ্লিট স্যুট পরা শুরু করলেন। গ্রীষ্মের তালুফাটা গরমে শার্ট-প্যান্টের ওপরে ওয়েস্ট কোট, কোট, টাই পরে ক্লাশ নিতে গিয়ে দু’বার জ্ঞান হারালেন। স্কুল কমিটি তাকে এসব পরতে নিষেধ করায় প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “কোয়্যাইট ইমপৌসিব্যল, আই এম নট এন আনসিভিলাইজড পারসোন।” এর পাশাপাশি হাতে মাখিয়ে ভাত খাওয়ার পরিবর্তে চামুচ ও কাঁটা চামুচ দিয়ে খেতে শুরু করলেন। একদিন বুড়ো পিসি বলেছিলেন, “ওরে অশোক, হাতে মাখিয়ে আরাম করে খা বাবা।” স্যার ক্ষেপে জবাব দিয়েছিলেন, “ইট ইজ সিম্পলি হৌরিব্যল।” হৌরিবলকে হরিবোল ভেবে পিসি থেমে গিয়েছিলেন। একদিন দুই ডজন ডোর বেল এনে টেবিলে লাগালেন। এরপর দিনে-রাতে ইচ্ছে হলেই স্যুইচ টেপেন, ডোর বেলের সার্কিটে কর্কশ স্বরে বেজে ওঠে বিটোভেন বা মোৎসার্ট, অশোক স্যার চেঁচিয়ে ওঠেন, “ওহ গড! হোয়াঠটা বিউঠি..।”

প্রেম আর ষড়যন্ত্রের মত মানসিক রোগও গোপন থাকেনা, অশোক স্যারের মানসিক রোগও গোপন থাকেনি। রাজধানীর নামকরা দুই সাইকিয়াট্রিস্ট (মনরোগ বিশেষজ্ঞ বললে ততটা ভাবগম্ভীর শোনায় না) তার চিকিৎসা করছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। শূন্য বললে ভুল হবে, বলা ভালো মাইনাস। সময় গেছে আর স্যার অসুস্থ হতে অসুস্থতর হয়ে পরছেন।

স্যারের দুই ছেলে প্রবাসী। স্ত্রী গত হয়েছেন একযুগ। প্রবাসী পুত্ররা প্রতিদিনই বাবার খোঁজ খবর নেন। তবে এক বুড়ো বিধবা পিসিই স্যারের দেখাশোনা করেন, যত্ন নেন। দিনে দিনে পিসি নিশ্চিত হয়েছেন অশোককে ‘তেনারা’ ধরেছেন। সম্মান বা ভীতি থেকেই পিসি ভুতের নাম নিচ্ছেন না। তেনাদের হাত থেকে ভ্রাতুষ্পুত্রকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র মদনা ওঝা। মদনা ওঝাকে ডাকার কথা বহু আগেই পিসি তুলেছিলেন। কিন্তু অশোক এবং তার পুত্রদ্বয় এ আবদার বারবার নাকচ করে দিয়েছেন। যতবার আবদার নাকচ হয়েছে ততবার পিসির অশ্রু বিসর্জনের বেগ বেড়েছে, খুনখুনে কান্নার দৈর্ঘ্য বেড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, এই ব-দ্বীপে পিসি-মাসির ক্রন্দন কৌশল কখনও ব্যর্থ হয়নি। অশোকের বেলায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

পুরানো জমিদার বাড়ির সদর দরজার সামনে বেশ ভিড়। হৈচৈ নেই, ফিসফিসিয়ে কথা চলছে। হাওয়ার মৃদু কিন্তু বিরতিহীন গুঞ্জরণ। ভুতের প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকার পরও এরা বিশ্বাস করে যে স্যারের কাঁধে সওয়ার হওয়ার মত ভুত এখনো জন্মায়নি। দূর থেকে জটলা দেখে মদনা ওঝা হাঁকডাক থামিয়ে দিয়েছিলেন। খুব নিরবে জটলার কাছে এসে ‘জয় মা তারা.. জয়া মা তারা… অশোক আমি এসেছি” হুংকার দিতেই সবাই বাড়ির ভেতরে ঢোকার জন্য পথ করে দিলো। বুক চিতিয়ে তিনি বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। সবার চোখ দরজার ভেতরের খোলা চত্বরে দিকে। আজ স্যারের ভুত ছাড়ানো হবে।

বাড়ির চত্বরে মদন ওঝার মুখোমুখি বসেছেন অশোক স্যার। মদন উচ্চস্বরে কঠিন কঠিন সব মন্ত্র পাঠ করে পরিবেশ সরগরম করে তুলেছেন। তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে কোনো এক জন্তুর হাড় দিয়ে স্যারকে কেন্দ্র করে একটা বৃত্ত এঁকে দিলেন। এরপর ধূপের ধোয়া মুঠোয় ভরে স্যারের দিকে ছুড়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন-
: তোর নাম কি?

স্যারের চোখ দুটো মুহুর্তেই বেশ বড় হয়ে গেছে, ঠোঁটে ধূর্ত হাসি-
: নাম বলবো না। মদনা, তুই ভুত চিনিস, ভুতের নাম জানিস না! হাহাহাহাহা..

এ হাসি স্যারের নয়, অপার্থিব হাসিতে উপস্থিত সবার ভেতর ভয়ের শিহরণ বয়ে গেলো। মদনা ওঝা ধূপের ধোয়া মুঠোয় ভরে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেন, এরপর ওই অদৃশ্য ধোঁয়া স্যারের মুখে ছুড়ে দিতেই স্যার যেনো ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলেন। ওঝা পর পর তিনবার একই কাজ করলেন, স্যার ব্যাথায় কুঁকড়ে যেতে যেতে সম্পূর্ণ অপরিচিত কণ্ঠে বললেন-
: বলছি.. সব বলছি মদনা। কষ্ট দিস না, আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে যে.. ওহ মদনা থাম..

ঠোঁটে ক্রুর হাসি এনে ওঝা প্রশ্ন করলো-
: তোর নাম কি?
: আমার নাম মলমবাঁশ।

হাসি মিলিয়ে ওঝার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করেছে, লাল চোখে ক্রোধের ঝলকানি। তিন আঙুলে ধূপের ছাই নিয়ে অশোকের দিকে ছুড়ে মারতেই সে কি জান্তব চিৎকার, গলা কাটা পাঠার মত ছটফটাচ্ছে অশোক। ওঝার আঁকা অদৃশ্য গণ্ডি থেকে বের হতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। কণ্ঠে পৃথিবীর সমস্ত তাচ্ছিল্য এনে মদন বললো-
: কি রে! এখন কেমন লাগে! তোর এতো স্পর্ধা! মদনানন্দ মদেশ্বের সাথে রসিকতা করিস!

কথা শেষে উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে ফের ধূপের ছাই ছুড়ে দিলেন অশোকের চেহারায়। অশোকের জান্তব কণ্ঠে ভয়-
: আমাকে এভাবে শাস্তি দিস না মদন। আমার নাম সত্যিই মলমবাঁশ। তোর সাথে রসিকতা করার স্পর্ধা আমার নেই, তুই ক্ষমা কর, ছেড়ে দে.. আমায় ছেড়ে দে..

উৎসুক দর্শনার্থীদের মধ্যে একটু আলোড়ন খেলে গেলো, যেনো বলতে চাইছে ‘এই না হলে মদনা ওঝা!’ তবে এই আলোড়ন মদনকে স্পর্শ করেনি, তার কণ্ঠে অবিশ্বাস-
: তোর নাম সত্যিই মলমবাঁশ?
: হু
: এটা কেমন নাম?
: আমাদের নাম এমনই হয় রে মদন..

বিশ্বাস, অবিশ্বাস এবং দ্বিধার ঘুরপাকে খাবি খাচ্ছে ওঝা। চেহারায় এসবের প্রকাশ না ঘটিয়ে জানতে চাইলেন-
: এটা কোন দেশি নাম?
: ইতালীয় নাম।

ওঝা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। দীর্ঘশ্বাস মানেই বেদনার নয়, কোনো কোনো দীর্ঘশ্বাস নির্ভার স্বস্তির প্রকাশ, ওঝার কণ্ঠে স্বস্তিময় কৌতূহল-
: ইটালী থেকে এসেছিস?
: হু
: তোর নামটা আবার বল-
: আমার নাম মলমবাঁশ, আমি নাবিক কলম্বাসের বড় ভাই।

ওঝার স্বরে বিস্ময়-
: কোন কলম্বাস?
: পৃথিবীতে কলম্বাস একজনই, যে ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলো।
: ওহ.. মা তারা.. মা তারা..

কণ্ঠে সমস্ত রাগ এনে ওঝা জিজ্ঞেস করলো-
: তুই ওর ভেতর ঢুকেছিস কবে?
: বহু আগে, বহু বহু আগে।
: বহু আগে মানে কবে?
: পৌনে দু’ বছর আগে। তখন অবশ্য ও ছিলো না, ছিলো ওর পিতামহের প্রপিতামহ, মানে দাদার দাদা। তার কাঁধে সেই যে চেপেছি, আর নামিনি। বংশানুক্রমে শুধু কাঁধ বদল করেছি।

মদনানন্দ মদেশ্বর তার তান্ত্রিক জীবনে এমন ভুতের সাক্ষাৎ পায়নি, তাই তাড়ানোর আগে জিজ্ঞাসাবাদে তার ক্লান্তি নেই-
: ওর দাদার দাদার কাঁধে চেপেছিলো কেনো?

এবার স্যারের কণ্ঠে বিরক্তি-
: আমাকে ডাকলে, আদর-সোহাগ করে কেউ কাঁধে চাপাতে চাইলে আমি তার কাঁধে চাপবো না!
: মানে?
: তবে খুলেই বলি। মাত্র চার পাঁচশো বছর আগেও আমরা মানে ইউরোপের লোকেরা মনে করতাম তোদের দেশের পথেঘাটে সোনা, হিরে, মণি-মুক্তা, জহরত পরে আছে। তোরা সেসবের মূল্য দিসনা। আমার ভাই কলম্বাস এসব সোনা, রুপা, হিরে, জহরত লুট করার জন্যই ভারতবর্ষে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু লোভে পরে ম্যাপ চুরি করে ভারতবর্ষে চলে এলাম আমি।
: তারপর?
: ভুল মানচিত্রের খপ্পরে পরে কলম্বাস পৌছে গেলো আমেরিকায়। সেখানকার পথে পথে না আছে সোনা, না আছে রূপো, না আছে হিরে জহরত। তবে লুট করা যাদের স্বভাব তাদের রুখবে সাধ্য কার! কলম্বাসের পর ইউরোপীয়রা ওখানকার লোকদের কঁচুকাটা করে, হত্যা করে, জবর দখল করে গড়ে তুললো উপনিবেশ। এরপর-

কথার মাঝখানে থামিয়ে দিলেন ওঝা। কোথাকার কোন কলম্বাস – এর প্রতি তার আগ্রহ নেই, সে জানতে চায় মলমবাঁশের কথা-
: ওরে, তোর কথা বল-
: আমার কথাই তো বলছি। কলম্বাস আমেরিকায় যা করেছে, ভারতবর্ষে তা করতে পারিনি। অথচ লুটে নেবার জন্য ধন সম্পত্তির অভাব ছিলো না। এখানকার মানুষদের সাহস, ঐক্য, জেদের কাছে মার খেতে খেতে, শরীরে মলম লাগাতে লাগাতে মরে গেলাম। কিন্তু অতৃপ্ত লোভের কারণে মুক্তি পেলাম না, ভুত হয়ে বাঁশঝাড়ে নির্বাসনে গেলাম। সময়-সুযোগের অপেক্ষায় প্রতিটি দিন কিভাবে যে কেটেছে। তবে এসময়ই আমার নাম তার প্রথম স্বার্থকতা খুঁজে পায়।
: এরপর কি হলো?
: আমি লুটতে না পারলে কি হবে, আমার জাতভাই ইংরেজরা এসে লুটতে শুরু করলো। তোমাদের ভাষায় বলে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই, ওই সমীকরণ অনুযায়ী লুটেরা ইংরেজরা আমার মাসতুতো ভাই। এই মাসতুতো ভাইদের সাহায্য করতে নির্বাসন থেকে ফিরলাম। সাথে নিয়ে এলাম চোখা চোখা গাঁটওয়ালা ক’টা বাঁশ। ওসব বাঁশে ভালো করে মলম মাখালাম, যাতে কারো পশ্চাদ্দেশে ঢুকানোর সময় ব্যাথা না পায়। ব্যাথা টের পায় মলম শুকানোর পর।
: বাঁশ দিয়ে কি করলি?
: আমি কিছু করিনি। অশোকের দাদার দাদা তখন আপন পশ্চাদ্দেশে বংশদণ্ড ঢুকানোর জন্য অস্থির। সে সভ্য হতে চাইলো..

মদনার স্বরে বিস্ময়-
: বলিস কি রে! অশোকের দাদার দাদা অসভ্য ছিলো না কি!
: হাহাহাহা, তার ধারণা সে অসভ্য ছিলো। আমি এসে তার পাগড়ী খুলে দিলাম, ধুতি খুলে দিলাম, পাঞ্জাবি খুলে দিলাম..
: ছি: ছি: ছি: তুই একজন ভদ্দরলোককে ন্যাংটো করে দিলি!
: ন্যাংটো করবো কেনো! ওকে আমি টুপি খুলে হ্যাট পরালাম, ধুতি খুলে পাৎলুন আর পাঞ্জাবি খুলে কোট পরালাম। তাকে বুঝালাম ইংরেজরা যা করে যা বলে সেটাই সভ্যতা, বাকী সব অন্ধকার অসভ্যতা। সেক্ষেত্রে ন্যাংটোর কথা যদি বলিস তবে অশোকের পিতামহের পিতামহ মানসিকভাবে ন্যাংটোই ছিলেন। তা না হলে কি আর কাঁধে চেপে বসতে পারি, এসব উদ্ভুট্টি ধ্যান-ধারণা শিখাতে পারি।

বিস্ময়ের পর বিস্ময়ের ধাক্কায় মদনা ওঝা রীতিমত বিপর্যস্ত, তন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ না হলে এতোক্ষণে হাল ছেড়ে দিত। বিপর্যস্ততা গোপন করেই তিনি জানতে চাইলেন-
: অশোককে ছেড়ে যাবি কি না বল?

অশোক স্যারের ভেতর হতে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে মলমবাঁশ-
: হাহাহাহাহাহাহাহাহা ধরলে তো ছাড়ার প্রশ্ন আসবে। আমি ওর কাঁধে চেপে আছি সত্য, তবে ওকে ধরিনি। ওই তো বংশগতভাবে আমাকে ধারণ করে আছে। ও আমাকে ছেড়ে দিক। আমাকে ছেড়ে দিতে বল মদনা হাহাহাহাহাহা..

ছেলেভুলানো কথায় আর যাকেই ভুলানো যাক মদনা ওঝাকে ভুলানো যায় না। ধূপের ছাই বুড়ো আঙুলে নিয়ে অশোকের কপালে তিলকের মত পরিয়ে দিলেন। অশোক ছটফটাচ্ছে। মদনার কণ্ঠে হুংকার-
: অশোককে তুই ছাড়বি কি না বল-!
: ছাড়বো.. ছাড়বো..। মনে রাখিস মদনা, যে ভুত রক্তে মিশে যায়, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়- ওই ভুত কখনও ছাড়েনা। কারণ, মানুষই ওই ভুতকে লালন-পালন করে, ধারণ করে, বাঁচিয়ে রাখে। ওই ভুত মানুষকে ধরেনা, মানুষই ওই ভুতকে ধরে, এমনভাবে ধরে যে ভুতের মৃত্যু মানেই ওই মানুষের মৃত্যু।

অশোক স্যারের কাঁধ থেকে মলমবাঁশ বিদায় নিয়েছে। স্যার ফের ক্লাশ নিতে শুরু করেছেন। তিনি এখন আর কমপ্লিট স্যুট পরে ক্লাশ নিতে যান না। আগের মত হালকা কালারের ফুল স্লিভ শার্ট, গাঢ় রংয়ের ইংলিশ প্যান্ট আর কালো জুতো পরেই স্কুলে যান, ক্লাশ নেন। মানসিকভাবে অসুস্থ থাকা সময়ের কোনো স্মৃতি তার নেই। ওদিকে মদনা ওঝার নাম-ডাক এবং প্রভাব আরও বেড়েছে। ইদানিং সে ইংরেজিতেও মন্ত্র পাঠ করে। ব্ল্যাক ম্যাজিক, ভুডোইজম, প্যারা নরমাল এক্টিভিটিজের আর্ট-কালচার বিষয়ে কথা বলে। সাধনার অংশ হিসেবে জেলা সদরের মহিউদ্দীন দর্জির কাছ থেকে সে দুই সেট ইংলিশ স্যুট বানিয়েছে। এক একটা গাঢ় তমসার রাতে নিমগ্ন তন্ত্র সাধনার মাঝে ইউরোপের কামরুপ কামাক্ষ্যা হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে.. “আয়.. আয়.. আয়..।”

দোলনা

খুরশীদা আর মিজান রিকশা দিয়ে যাচ্ছে। সাথে তাদের প্রথম সন্তান। মিজান বাম হাতে খুরশীদার ডান হাত ধরে রেখেছে। ঢাকা শহরের জামে হোঁচট খেতে খেতে এগুচ্ছে রিকশা।

: আপনে বাবুরে একটা দোলনা কিন্যা দিবাইন?
: কিন্যা দিবাম, বুঝছুইন।
: বাবুরে একদিন চিড়িয়াখানায় লয়া যাইবাইন?
: হ, যাইবাইম, তুমারেও লয়া যাইবাইম।
: আমাগো বাবুরে কুনুদিন বকবাইন না, মারবাইন না।
: না, আমরা কি পাষান যে বাবুরে মারবাম!

দুজনে হুহু কান্না আটকে কথা বলে চলছে। প্রথম সন্তানের প্রতি অপার মমতায় আপ্লুত হচ্ছেন প্রথম মাতা-পিতা। অথচ তারা এখনও সন্তানের চেহারা দেখেন নাই। হয়তো কোনদিন দেখবেন না। কারন চরম অভাবের সংসারে দারিদ্র সবসময় স্নেহ আর ভালবাসাকে পরাজিত করে, খুন করে।

জাম কেটে কেটে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে সস্তায় এবরশন করানোর ক্লিনিকের ঠিকানায়। খুরশীদা আর মিজান অশ্রুসজল। নিরুপায়। তাদের মনের গহীনে এক দোলনায় হাসতে হাসতে দোল খাচ্ছে প্রথম সন্তান, তাদের বংশধর।

গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ

বিজ্ঞজন কহিলেন পার’তো গূঢ়গম্ভীর বিষয়ে একখানা মোটাসোটা গ্রন্থ রচনা কর। এলেবেলে যাহা লিখিবার হুমায়ুন আহমেদ দুই হাতে লিখিয়া গিয়াছেন। তোমার না লিখিলেও চলিবে।

বলিলাম, “স্পনসর পাইলে সাড়ে চারিশত পাতার একখানা গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ লিখিয়া দিতে পারি। এই গ্রন্থ বিক্রয় করিয়া স্পনসরের অর্থ মুনাফা সমেত ফিরত আসিবে- শতভাগ লিখিত নিশ্চয়তাও দিতে পারি।”

বিজ্ঞজন সন্দেহযুক্ত মন আর বিষ্ময়যুক্ত দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসিলেন, “গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ রচনা করা কি এতই সহজ?”

বিনয়ের সহিত উত্তরিলাম, “সকলের নিকট সহজ নহে, কাহারো কাহারো নিকট অতি সহজ বটে। আজকালের কিছু কিছু গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ পড়িয়া আমার দৃঢ় আত্নবিশ্বাস জন্মাইয়াছে।”

বিজ্ঞজন কি বুঝিলেন তিনিই জানেন। অতিশয় মনযোগ সহকারে জিজ্ঞাসিলেন, “তোমার গূঢ়গম্ভীর পরিকল্পনা কিরুপ?”

কণ্ঠে সকল গাম্ভীর্য আনিয়া বলিলাম, আমার গ্রন্থের নাম হইবে “নান্দনিকতা ও খাদ্যপ্রানঃ রবীন্দ্র দর্শনে রেসিপি ভাবনা।” এই পুস্তকের ৩২৫ পৃষ্ঠা ভরিয়া কেকা ফেরদৌসীর সাক্ষাতকার থাকিবে। ২৮ পৃষ্ঠা জুড়িয়া দন্ত ভাঙ্গিয়া যায় এমন ভাষায় নান্দনিকতা আর খাদ্যপ্রাণ বিষয়ে আলোচনা থাকিবে, যেন অসীম সাহসী পাঠক তিন পৃষ্টা পাঠ করিবার পরে চতুর্থ পৃষ্ঠা পাঠ করিবার দুঃসাহস না পায়। ৬০ পৃষ্ঠা জুড়িয়া থাকিবে প্রাণময় খাদ্য আর খাদ্য গ্রহন করিবার কালে কিরুপ রাবীন্দ্রিক/নান্দনিক বাঙ্গালী পোষাক পরিধান করিতে হইবে তাহার রঙ্গীন ছবি। অবশিষ্ট ৩০ পৃষ্ঠা জুড়িয়া থাকিবে কোন খাদ্য গ্রহনের সময়ে কাহার কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের কোন গান শ্রবণ করিতে হইবে ও কোন মিউজিক ভিডিও দেখিতে হইবে তাহার তালিকা।”

বিজ্ঞজন ততধিক গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসিলেন, “তোমার ধারনা এই পুস্তক লোকে কিনিবে? কেনো কিনিবে!”

আত্নবিশ্বাসের সহিত বলিলাম, “অবশ্যই কিনিবে। কারন ইহাতে রবীন্দ্রনাথ আছেন, গূঢ়গম্ভীর নান্দনিকতা আর বিজ্ঞানময় খাদ্যপ্রাণ আছে, রেসিপি আছে, ফ্যাশান আছে, শোবিজ মানে সঙ্গীত আর মিউজিক ভিডিও আছে, তাতপর্যময় বাঙ্গালীত্ব আছে। এইসব লইয়া যদি বিশ-ত্রিশ’টা টিভি চ্যানেল বছরের পর বছর চলিতে পারে, দৈনিক পত্রিকা/সাপ্তাহিক/পাক্ষিক ম্যাগাজিনের সাহিত্য পাতা/ লাইফস্টাইল/ফ্যাশন/পুষ্টি/ঐতিহ্য বিভাগ অনায়াসে দশকের পর দশক চলিতে পারে তবে সকল কিছু লইয়া এক মলাটের ভিতর আমার রচিত গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ লোকে কিনিবে না কেন! আলবাত কিনিবে, লাইন ধরিয়া কিনিবে।”

বিজ্ঞজন প্রসন্ন চিত্তে বলিলেন, “আমি স্পনসরের ব্যাপারে মোবাইল কোম্পানী আর মসলা উতপাদনকারী কর্পোরেট কোম্পানীর সহিত যোগাযোগের চেষ্টা করিবো। এই পরিকল্পনা লইয়া আর কাহারো সহিত আলাপ করিওনা, গোপন রাখিও।”

আপনারা আমার নিকটজন বলিয়া সবিস্তারে জানাইলাম। তাহা ছাড়া এই বাজারে সাড়ে চারিশত পৃষ্ঠার একখানা গ্রন্থ কিনিবার জন্য পূর্ব প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে, হোক না তাহা গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ।

গ্রাস

: আজ পূর্ণিমা, জানো?
: হি: হি: হি:
: পূর্ণিমা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান আছে-
: হি: হি: হি:
: হুমায়ুন আহমেদের হিমু পূর্ণিমা রাতে জোছনা খায়-
: হি: হি: হি:
: আজ সারা রাত তুমি আর আমি আর পূর্ণিমা
: হি: হি: হি:
: তুমি আমি আর কবিতা, গান, মুগ্ধতা..
: হি: হি: হি:
: দুজন হাত ধরে বসে থাকব সারারাত…
: হি: হি: হি:
: বারান্দার চেয়ারে বসে কেটে যাবে রাত, চন্দ্রাস্ত দেখার পরে তোমার ছুটি…
: তেইলে আসল কাম করবেন কখন?
: তুমি আজ বসে থাকবে, এটাই তোমার আসল কাজ।
: কন কি! হাত ধইরা বইয়া থাকনের লেগা কেউ মাইয়া মানুষ ভাড়া করে!
: আমি কবি, আমি করেছি।
: আপনে আপনার কবিতা ঠাপায়া মুড়ি খান। আমারে যাইতে দ্যান। দেরী অইলে কাস্টমার পামু না।
: যাবে কেন? থাকো। তোমার টাকা তুমি পাবে।
: আপনে আসল কাম না কইরা টাকা দিলে আমি নিমু ক্যান! চামেলি মাগী অইতে পারে, কিন্তু ফাউ ট্যাকা লয় না, গতর খাটায়া মজুরী লয়।

বারান্দার দুই চেয়ার এবং বেডরুমের ডিম লাইটের ঘোলা আলো জানে কবির রোমান্টিসিজম আর চামেলীর মজুরী তত্ব – কে কাকে গ্রাস করেছিল।

হায়রে গুজব

আজবপুর ইউনিয়ন নিবাসী মর্জিনার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। মর্জিনার পিতা বজলু মেম্বারের সাথে শত্রুতার জেরে আইডিটি হ্যাক করা হয়েছে। ওই আইডি থেকে ইনবক্স রোমান্সের যেসকল স্ক্রীনশট প্রকাশ করা হয়েছে সেসব সত্য নয়, আরজু মেম্বারের ছেলের সাথে তোলা ছবিগুলো ফটোশপে এডিট করা।

মর্জিনার পর ফেসবুক আইডি হারালেন পিতা বজলু মেম্বার। ধারণা করা হচ্ছে আরজু মেম্বারের লোকজন আইডিটি হ্যাক করতে পারে। বজলু মেম্বারের আইডি থেকে চেয়ারম্যান আক্কাস আলীর সাথে মেসেঞ্জারে অর্থ আত্মসাৎ ও চাঁদাবাজী বিষয়ক আলাপের যে স্ক্রিনশট প্রকাশিত হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। চেয়ারম্যান আক্কাস আলী ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকের মালিক ও আইডিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়ার দাবী জানিয়েছেন।

আবারও আইডি হ্যাক। ভীষমগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান আক্কাস আলীর ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। হ্যাক হওয়া আইডি থেকে টাকা পাচার, টেন্ডারবাজী, জমি দখল ও অস্ত্রব্যবসা নিয়ে স্থানীয় এমপি’র সাথে আক্কাস আলীর মেসেঞ্জার আলাপের স্ক্রিনশট প্রকাশ করা হচ্ছে। এছাড়া আইডিতে শেয়ার করা দু’টো কল রেকর্ডে চেয়ারম্যানের সাথে চাঁদা ও জুয়ার টাকার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে এমপি’র উত্তপ্ত কথোপকথন শোনা গেছে। চেয়ারম্যান আক্কাস আলী দাবী করেছেন এমপি’র সাথে সম্পর্ক নষ্ট করার লক্ষ্যে আইডি হ্যাক করা হয়েছে। এদিকে আক্কাস আলী নামে কাউকে চেনেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এমপি সৈয়দ মোদাব্বের খান চৌধুরী।

উপজেলা চেয়ারম্যানের আইডির পর হ্যাক হলো ভীষমগঞ্জ-খাদকপুর আসনের সাংসদ সৈয়দ মোদাব্বের খানের ফেসবুক আইডি। হ্যাকের পর ওই আইডির টাইমলাইনে সাংসদের সাথে ক’জন নারীর আপত্তিকর ভিডিও শেয়ার করা হয়। পরবর্তীতে ভিডিওগুলো মুছে দিয়ে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাথে আড্ডা ও মদ্যপানের ছবি শেয়ার করা হয়। এছাড়া তিনজন মন্ত্রীর সাথে তদবির বাণিজ্য ও কাজের জন্য ঘুষের রেট নির্ধারণ নিয়ে আলাপের ফোনকল রেকর্ডটি ভাইরাল হয়ে পরে। সাংসদ জানিয়েছেন এসব গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। অবশ্য, তিনজন মন্ত্রীই হ্যাকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ফটোশপে বানানো ভয়েজকল রেকর্ড দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করা যাবেনা। জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে এই হ্যাকিং সংকট মোকাবেলা করবে।

দুর্বিষহ হয়ে উঠছে হ্যাকিং পরিস্থিতি। একই দিনে তিন মন্ত্রীর ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছে দুষ্কৃতকারীরা। হ্যাক হওয়া আইডিগুলোর টাইমলাইনে শেয়ার করা হচ্ছে মন্ত্রী ও সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতির বিবরণ। হ্যাকের শিকার হওয়া তিন মন্ত্রীই দাবি করেছেন এসব পোস্ট, মেসেঞ্জার আলাপ, ফোনকল রেকর্ড সবই ফটোশপে তৈরী করা। মন্ত্রীদের সমর্থকরা ‘ফেসবুকের ফাঁসি চাই’ ও ‘ফটোশপের ফাঁসি চাই’ শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। এদিকে ‘সাপ নয়, কেঁচো খুঁড়লে বেরিয়ে পরবে বিশাল বিশাল ডায়নোসার’ বলেছেন বিশ্লেষকরা।

হ্যাকিং বিষয়ে যথাযথ তদন্ত শেষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. বায়বীয় চৌধুরী। হ্যাক হওয়া আইডিগুলোর টাইমলাইনে শেয়ার হওয়া তথ্য সত্য প্রমাণিত হলে মন্ত্রীদেরও ছাড় দেওয়া হবেনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও জানান, হ্যাকিং প্রতিরোধে ফেসবুক নিষিদ্ধ করার চিন্তা ভাবনা চলছে। সেক্ষেত্রে বিটিভি দিয়ে ফেসবুক চালানোয় কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না।

যোগী সোসাইটির মাঠ

ফাঁকফোকর পেলে ঢুকে পরাই আলোর স্বভাব, হাওয়ারও। যেখানে ঢুকতে পারেনা সেখানেই অন্ধকারের রাজত্বে উস্কানি দেয়, দমবন্ধ গুমোট করে তোলে। যোগী সোসাইটির মাঠেও আলো নিজ চরিত্র ভুলে শুদ্ধ হয়ে ওঠেনি, হাওয়াও।

হেমন্তের মিহি কুয়াশায় বিভোর মাঝরাত। ভরা পূর্ণিমা। জোছনায় ভেসে গেছে যোগী সোসাইটির চতুষ্কোণ মাঠ। মাঠের তিন দিকে ঘণ ঝোপঝাড়, বড় বড় ক’টা বট গাছ। ওখানে জোছনার জোড় খাটেনি। ওখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে ভয় ভয় আবছায়া, ঝোপঝোপ অন্ধকার। সতর্ক সংকেতের মত জ্বলছে-নিভছে জোনাকি।

যোগী সোসাইটির সদস্যরা গোল হয়ে বসেছে। জোছনায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবার চেহারা। চেহারাগুলোতে গাঢ় ক্ষুধা আর সীমাহীন উত্তেজনার ছাপ। বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে বৃদ্ধ এক নারী। তার হাত বাঁধা, পা বাঁধা, মুখ বাঁধা, শুধু চোখ দু’টো খোলা।

যোগী সোসাইটির জননী আতঙ্কিত চোখে আকাশ দেখছে। মিহি মিহি মেঘ জোছনায় ভেসে যাচ্ছে। ঝিঝি ডাকছে। হাওয়ায় পাকা ধানের মাতাল ঘ্রাণ। খুব দূর থেকে ভেসে আসছে কান্নার করুণ সুর। কান্নাটা কি ধীরে ধীরে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ধেয়ে আসছে! চমক ভাঙে, ঘিরে থাকা সন্তানদের দিকে তাকান জননী, ছলো ছলো চোখে ঝাপসা সব মুখ।

শুদ্ধতম এক রাজ্যের স্বপ্ন রক্তে রক্তে সংক্রামিত করেছিলেন জননী। তিনি শিখিয়েছিলেন তার পক্ষ ছাড়া বাকীসব অশুদ্ধ- হোক মানুষ, হোক নদী, হোক ফুল, হোক পাখি, হোক আকাশ, হোক গান, হোক কবিতা, হোক গান, হোক মত, হোক পথ। ‘শুদ্ধে রাজ্যে অশুদ্ধের কোন স্থান নেই’ ব্যাধিতে আক্রান্ত অনুসারীরা শুদ্ধতার নামে একের পর এক খুন করেছে নদী, পাখি, ফুল, ফল, ভ্রুণ, পিতা, মাতা, ভাই, বোন, বন্ধু, আত্নীয় স্বজন।

শুদ্ধতার বিষয়ে যেই সংশয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সেই অশুদ্ধতার অভিযোগে খুন হয়ে গেছে। খুনের পর লাশের সৎকার অনর্থক ভেবেই তারা পান করতে শিখেছে রক্ত এবং মাংস। মাংস খেতে খেতে খেতে খেতে তারা অশুদ্ধ মানুষের মাংস ভক্ষণে আসক্ত হয়ে পরেছে।

প্রোটিন ও মদের কোনো শুদ্ধাশুদ্ধ ভেদ নেই জেনেই যোগীয়ানরা স্বগোত্রীয়দের মাংসও খায়। খেতে না পেলে উন্মাদ হয়ে ওঠে। এটি জেনেই জননী সবাইকে নিরামিষভোজী হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যে বাঘ পেয়েছে রক্তের স্বাদ তার জিভে কি আর শরবত রুচে!

গত দু’মাস ধরে মানুষের মাংস খেতে না পেয়ে যোগীয়ানরা দানবের মত ক্ষুধার্ত উন্মাদের। অবশেষে জননীকেই তুলে নিয়ে এসেছে। বহুদিন অশুদ্ধ মানুষদের মাংস খেয়ে খেয়ে শুদ্ধতার যতটুকু ঘাটতি, আজ তা পূরণ করে নেওয়া যাবে। জননী শুদ্ধতাময়ীর মাংসে আছে অশুদ্ধতা নাশের সব উপাদান।

বৃত্ত থেকে একজন উঠে এসে আমূল একটি ছুরি জননীর চোখে ঢুকিয়ে দেয়। জননী কেঁপে উঠেন, তার মুখ বাঁধা বলে আর্তচিৎকারটা শোনা যায়না। একটানে বের করে আনলে ছুরিটার কোনায় দেখা যায় চোখের খণ্ডিত অংশ লেগে আছে। পরম ভক্তিতে চোখটি খেয়ে যোগী বলে, “মা গো, তোমার চোখ বেঁচে রইলো আমার চোখে, নয়ানে নয়ানে।” মুহুর্তে সবাই হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পরে জননীর মাংস খেতে। অবশ্য খাওয়ার আগে ভক্তি ভরে জননীকে জানায়, “মা গো, তুমি এখন আমাদের সবার রক্তে মিশে গেছো। এতোদিন তুমিই ছিলে আমরা, আজ আমরাই তুমি। শুদ্ধ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ছাড়বোই ছাড়বো।”

যোগী সোসাইটির চতুষ্কোণ মাঠে নেমে এসেছে অসীম ক্ষুধা। জননীর কঙ্কাল চুষতে চুষতে পরস্পরের শরীরের দিকে তাকাচ্ছে শুদ্ধতম যোগীর দল – আহ! ক্ষিধে! অসহ্য ক্ষিধে! ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার মত দানবিক ক্ষিধে।

#অণুগল্প

গিরগিটি

: চেরমেন, বেনার আনিছি। মিছিলের জন্যি রেডী হও।

: মেম্বর, বেনার কে লিখিছে?

: কে লিখিবে! ডিজিটাল বেনার বানিয়িছি। ৪০ টেকা ইসকুয়ার ফুট।

: কামের কাম করিছো। বেনারে লিখিছো কি?

: সন্ত্রাসীদের কালো হাত ভেংগে দাও, গুড়িয়ে দাও।

: মেম্বর, আমার ছবি দিয়িছো?

: কি যে কও! চেরম্যানের ছবি ছাড়া বেনারের দাম আছে নাকি!

: মিছিলের লোক আনিছো? কতজন আনিছো!

: দশ বারো জন। তারা ফজুর দোকানে বসি বসি বিনি পয়সায় চা গিলছি, বিড়ি টানছি। আর কয়জন আসিবি কে জানে!

: দশ বারো জন নিয়ি মিছিল করিবা! মান ইজ্জত থাকিবি?

: চেরমেন, কি করিবো কও। হারুণ মাস্টররে ছাত্রদের লয়ি আসতি কয়ছিলাম।

: মাস্টরে আসবি না!

: মাস্টরে কয় আমরা দুজন নাকি সন্ত্রাসীগো পালের গোদা, শামীম উসমান। আমাদের ঢংয়ের মিছিলে সে লুংগী তুলি মুতি দেয়। ভাবিতি পারো! তার কত বাড় বাড়িছে।

: মেম্বর, এক কাজ করো দেখিনি, তাজুলরে কও গোপুনে হারুণ মাস্টরের বাড়িতে চাইরটা ককটেল মারিতে, আর ফজুর দোকানের পিছনের দেয়ালে দুইটা…

: কী কও চেরমেন! লোকে সন্দেহ করবি যে!

: ধুত্তরী মেম্বর, লোকে সন্দেহ করবি কেন! ককটেল মারিবার সমুয় তুমি আর আমি ফজার দোকানে চা গিলিতে থাকিবো যে।

: এহন ককটেল পাবো কিবাই?

: তোমার ছাওয়ালের কাছে আছে, আমার ছাওয়ালের কাছেও আছে। কার থিকা নিবা সিটা তোমার বিবেচনা, বুঝিছো!

: চেরমেন, হারুণ মাস্টররে সই করি একটা মারিতে কবো না কী!

: মেম্বর, তুমিতো দেখি চেরমেনী চাল চালিতি চাচ্ছো!

বিকালের মিছিল সন্ধ্যা মিলাবার আগে বের হলো। চেয়ারম্যান নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মেম্বর আর এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা চেয়ারম্যানের দুপাশে ব্যানার ধরে দৃপ্ত পদে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশাল মিছিল। লোকে লোকারণ্য। মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে শত শত কন্ঠে শ্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে- সন্ত্রাসীদের কালো হাত ভেংগে দাও গুড়িয়ে দাও, সন্ত্রাসীদের আস্তানা ভেংগে দাও গুড়িয়ে দাও, হারুণ মাস্টরের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না, হারুণ মাস্টর মরলো কেন সন্ত্রাসীরা জবাব দে।

অকবিতা ৩

সকল বিভ্রমই প্রেম নয়-
যার দশদিকে দশপথ খোলা
সে যায় না কোথাও, তার হয়না যাওয়া।

রাজার বাড়িতে উৎসব
যুবরাজ সব করে রব
রবে রবে নগর পুড়ে, দেবালয় ভস্ম হয়
পোড়া লাশের ঘ্রাণ- আহা মানব কাবাব, আহা মৌতাত, আহা নেশা,
যার দশদিকে দশপথ খোলা
তার যাওয়া নেই, আসা নেই, শুধু বসে বসে দেখা।

রাজমাতা গাঢ় অশ্রুবতী
মমতাময়ী বিশল্যকরণী
স্পর্শে মুছে দেন ফোস্কা, দগদগে ঘা, পোড়া দাগ
স্বজন হারানোর গভীরত্ম ব্যাথা- আহা আহাজারি, আহা কান্না,
আহা মাঝরাতে গুমড়ে ওঠা দীর্ঘশ্বাস-
যার দশদিকে দশপথ খোলা
তার পোড়ানো আত্মা, ভস্মীভূত দেহ, চোখ দু’টো খোলা।

উৎসবে ক্লান্তি নেমে এলে
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি এসে
সোনার খাটে বসে ছুলছুতো গপ্পো শোনায়
ফের জেগে ওঠার সংকল্পে যুবরাজ ঘুমোয়- আহা মহারাণীর আঁচল তল,
আহা মায়ের ওম, আহা অব্যর্থ রক্ষা কবজ, আহা জয়ো হে.. জয়ো হে.. জয়ো জয়ো হে…
যার দশদিকে দশপথ খোলা
সব পথ ছুঁয়ে যায় তাকে, সে স্থির, মৌনতায় অনুভূতিহীন।

সকল বিভ্রমই প্রেম নয়-
মহারাণী ও যুবরাজ জানে
সকলেই সকলের প্রতিপক্ষ
রাজাখেলা শেষে সবাই হন্তারক,
যার দশদিকে দশপথ খোলা
সে যায় না কোথাও, মহারাণী, তার দিকে ধেয়ে আসে সব, শবের স্রোত।

#অকবিতা

তালাশ

রজবের চায়ের দোকান। সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত জমজমাট। কত কিসিমের লোক আসে। বসে। আড্ডা দেয়। ঝামেলা পাকায়, ঝামেলা সারায়।

মফিজ পুলিশের ইনফর্মার। চায়ে চুমুক দেয় আর ধূর্ত চোখে ধান্ধা তালাশ করে। মোবাইল ফোনে ইয়ারদোস্তের মত থানার সেকেন্ড অফিসারের সাথে কথা বলে।

তিন নম্বর রোডে আফসু ফেন্সি বেচে। সেখানে ফেন্সি গিলে কয়েকটা ছেলে কড়া মিষ্টি চায়ের তালাশে রজবের দোকানে আসে। চা খায়। চকোলেট চুষে। আফসু মাঝে মাঝে মফিজকে থানার মাসোহারা বুঝিয়ে দিতে আসে।

সলিম আর জব্বর জমির দালাল। জমি তালাশ করে, কাষ্টমার তালাশ করে। মুখে মুখে লাখ লাখ টাকা কমিশনের হিসাব কষে। হিসাব শেষে বিবর্ণ মুখে একটা গোল্ডলিফ কিনে দুজনে ভাগ করে খায়।

এগারোটায় দোকান বন্ধ করলে বারান্দায় এক পাগল এসে শোয়। তার নোংরা গা থেকে মাঝে মাঝে গোলাপের তীব্র গন্ধ বের হয়। রজব নিজে এই গন্ধ পেয়েছে। রজব পাগলের কাছে সুদিনের বিধান তালাশ করে। প্রায়ই পাগলের পা ধরে বসে থাকে। বুক ভাসিয়ে কাদে। পাগল হাসে আর ফিসফিসিয়ে বলে, ” মাইনষের বাচ্চারা উপায় জানি গেলি পাগল হয়্যি যায়। উপায় জানতি নাই। উপায় তালাশ করতি হয়। উপায় তালাশ করতি হয়।’

কি যেন কি তালাশ করতে করতে গুমড়ে গুমড়ে ভেসে যায় মধ্যরাতের ফতুর হাওয়া।