আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

ব্রেক্সিট

ব্রেক্সিট

বনিবনা হচ্ছিল না ঠিকই
তবু সমঝোতা করে নিয়েছিলাম
অপছন্দের পছন্দ স্বীকার করে
দিনকে দিনের পথে চালিয়ে নিচ্ছিলাম

বিভক্ত মানুষও সামাজিকতা
মেনে নেয়, মেজাজিও
মানিয়ে নেয়, সংসার মানেই আপোষ,
সন্ধি, জীবনে অভ্যস্ততা
চলে আসে, জীবনকে প্রবাহিত হতে
হয়, গন্তব্যে ছুটতে হয়

সংসার মানেই ছুটে চলা,
গন্তব্যে চলা
সন্তান সন্ততি
দুপাড়ের সেতুবন্ধন,
অনেক বিভ্রম চূড়ান্তে পৌঁছায় না
তাদের মুখ চেয়ে, অনেকবার
হারানোর চেষ্টা করেও
ফিরতে হয়েছে, জেনেছিলাম
চাইলেই হারানো যায় না

মনান্তর পরেও ফিরেছি
ভোরের দুয়ার খুলেছি
ভাঙ্গা সেতু মেরামতে দুজনেই
হাত লাগিয়েছি, পুনরায়
শুরু করেছি, সব কিন্তু হারায় নি
কিছু কিছু জমা আছে মায়ার খাতায়
অন্ধকারের উল্টা পিঠে আলো থাকে
বহুবার বহুবর্ণে ফিরে গেছি

এমন কি হলো এখন পরিপূর্ণ
মুক্তির দাবী তোমার, মুক্তি শব্দটা মধুর
কর্ণে আঘাতে আরাম বোধ হয়
চাইলেই কি মুক্তি মিলে, মুক্তি কি
হাতের মোয়া মুখে পুরে
স্বাদ নেয়া যায়, এতো সহজ নয়

ময়ূরী হয়ে পেখম মেলবে, পর্যবেক্ষকের
ভুমিকায় থাকবো, তা হবার না
জল গড়িয়েছে কতটুকু তার পরিমাপ
না করে থামছি না
তিল তিল জড়ো করা কড়িতে
যে আয়না কিনেছিলাম দুজনের
মুখাবয়ব উৎকীর্ণ হয়েছিল
তা চুর্ণ করে অন্য আয়নায় ফেসিয়াল
তা হতে দিতে পারি না

বাকি দিনগুলি যদি যৌথ দিন
নাও হয় তবু ব্রেক্সিট হবে না
বারবার এক্সটেনশনে যাবো
বারবার সংসদ বসাবো,
চূড়ান্ত ত্যাগে সম্মত হবো না

অন্যদের ব্রেক্সিট হউক, অন্যরা
সংসদ পাশ কাটাক,
সংসার বিশ্বাসী, আইন বিশ্বাসী
আইনের গত্যন্তর সিদ্ধ হবে না

মুক্তি শব্দটা আপাতত উহ্য থাকুক,
ব্রেক্সিট ঝুলে থাকুক হাজার বছর
মুক্তির মুক্তি হবে না
আমি বারংবার
রোদ্রবারের চেষ্টা করে যাবো

জীবনের ববিতা

জীবনের ববিতা

সবাই যখন শাবানা শাবানা বলে
সাবানের মতো মুখে ফেনা তুলত
আমি তখন ববিতায় মজে ছিলাম
আহা কি মাদকতা, পপি ফুলের
মাদকতায় কৈশোর পেরিয়েছি

মনে পড়ে লাভ ইন সিংগাপুরে
অন্তর্বাস দেখা যায় শুনে হুমড়ি
খেয়ে পড়েছিলাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি
অন্তর্বাসের দেখা মেলেনি, হতাশ হই নি
রবার্ট ব্রুসের অভিজ্ঞতা ধার করে
সপ্তমবার চেষ্টা করেছি, বিফল
হলেও আশা হারাই নি অষ্টমবারে
সফল হয়েছি, আচমকা নিজের মনে
অন্তরের ছোঁয়া পেয়েছি, ববিতার ছোঁয়ায়
জীবন বদলে গেছে, অদম্য কৈশোর থেকে
প্রাণিত যৌবন তার স্পর্শে কেটে গেছে

মনে পড়ে পাশের বাড়ির আপার আদলে
ববিতা খুঁজতাম, আপার প্রশ্রয় সত্ত্বেও
সীমারেখা অতিক্রম করি নি, আমার ববিতা
পুত-পবিত্র, কালিমার কোন দাগ তাকে ছোঁবে না

আপার বিয়ের পরে ববিতা তিরোহিত হবে
ভাবনায় ‘অনন্ত প্রেম’ দেখি, রাজ্জাক
হয়ে পলাতক তার কাছে ধরা দেবো এমন
স্বপ্ন আন্দোলিত করে, যতই পলাতক মন
ববিতা জড়াতে চায়, ববিতা ততই দূরে সরে

‘অনঙ্গ বউ’ দূর প্রদেশের যাত্রী ধরা ছোঁয়ার
অনেক উর্ধ্বে, তবু জীবন ববিতাময়তা
মাড়াতে পারে না, এক বিকেলে অস্পষ্ট
ছায়ায় তার দেখা পাই, ববিতা যেচেই চলে আসে
আমি পরিপূর্ণ হই, অন্তর্বাসের উন্মোচনে প্লুত হই

২৪ বছর ধরে ববিতাময় মন্দ কাটছে না
‘অনঙ্গ বউ’ আগলে রাখে বাড়ির আঙ্গিনা…

খগেন নাপিত

খগেন নাপিত

খগেন নাপিতের কাছে চুল কাটা বড় মজার
খগেনের রসবোধ অসাধারণ
পরশির অন্দরমহল, রাজনীতির অলিগলি
আদিরস, এমনভাবে পরিবেশন করে যে
মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না

প্রতিমাসে একবার খগেনের দারস্থ হতে হয়
খগেন অবলীলায় কানমলে দেয়
কৈশোরে লজিং মাস্টারের কানমলায়
ক্রোধিত হতাম, মনেমনে বলতাম
ফিরিয়ে দেবো, অকারণের কানমলা
ফিরিয়ে দেয়ার আগেই লজিং মাস্টার
গত হয়েছে তার জানাজায় গিয়ে
আফসোস এবং অনুশোচনা
একসাথে অনুভব করেছি

অকারণ কানমলা ফিরিয়ে দেয়া হয় নি
তবু খগেনের কানমলায় লজিং মাস্টার
স্মরণে এসে যায়

খগেনের কাছে মাসে একবার ধর্না দিলেও
কোনদিন সামাজিকতার চিন্তা করিনি
একে ছোটজাত তাও মালাউন
চুল কাটাতে দেই এটুকই যথেষ্ট

চন্দ্রভ্রমণের তাণ্ডবে যখন
খগেন লাশ হয়, জ্ঞাতি ভাইয়েরা যখন
শ্মশানে নিয়ে যায়, আমি যেতে পারিনি
নাপিতের শেষকৃত্যে উপস্থিত হওয়া
আমাকে মানায় না

নাপিত, মুচি, ডোম, মেথর
প্রয়োজনে এদের কাছে যাওয়া যায়
আদতে এদের থেকে দূরে থাকতে হয়
এরা নিম্নজন, অচ্ছুৎ
এদের ছোঁয়াচ থেকে বেঁচে থাকাই আভিজাত্য

খগেন বেশ মজার মানুষ ছিল
রসবোধ ছিল অতুলনীয়
তবু সে নিম্নজাত, তার জন্য
আমার আভিজাত্য বিসর্জন দিতে পারি না

ক্রাইস্ট চার্চ স্মরণে

ক্রাইস্ট চার্চ স্মরণে

মসজিদের জমিনে যারা সেজদায় ছিল
তারা মানুষ ছিল
অস্ত্র হাতে যারা এসেছিল
তারা মানুষ সদৃশ
কিন্তু বিস্তর ফারাক
অথবা কোন মিল নাই

দুপেয়ে সবাই যে মানুষ হয় না
তার প্রমাণ পেয়েছি নাইন ইলেভেনে
কিংবা সেভেন সেভেনে

ক্রাইস্ট চার্চের ঘাতক
নাইন ইলেভেনেরই উত্তরসূরি
তাদের বংশের

তারা একসাথে এক মায়ের পেটে
জন্ম নিয়েছে, কিংবা মাতৃ বিহীন
কোন প্রক্রিয়ায় তাদের প্রসব হয়েছে
মায়ের সন্তান ঘাতক হয় না

কোন মাতৃ যদি জানে
তার সন্তান মানবের সেজদার ব্যাঘাত ঘটাবে
তাহলে তার জন্মের পরিধি বাড়তে দেবে না
বিষ প্রয়োগে আতুর ঘরে অন্ত ঘটাবে
মাতৃরা এমনি মানবতাবাদী
মানবের অমঙ্গলের কোন কর্ম
তারা হতে দেবে না, দেয় নি

ক্রাইস্ট চার্চের ঘাতক
মানবজন্ম পায় নি
বিধাতার সৃষ্টির ছোঁয়া তাদের কপালে
নসিব হয় নি
তাই বিধাতার সৃষ্টি তছনছে
তারা বদ্ধপরিকর

মানুষ সদৃশ দুপেয়ে
এসব জীব বিধাতা বধেও
পিছপা হবে না
গড এদের কাছে নিরাপদ না
ভগবান নিরাপদ না
এদের কাছে খোদাও নিরাপদ না

অথচ খোদার নামে ভগবানের নামে
গডের নামে এরা নিজেদের ন্যায্যতা
প্রমাণে সচেষ্ট হয়, এরা বিধাতাকে অহরহ
বিক্রি করে এদের তাণ্ডবের কাছে
বিধাতাও অসহায়

নাইন ইলেভেনের বংশবিস্তার হচ্ছে
দিনে দিনে দেশে দেশে পঙ্গপালের
মতো তারা ছড়িয়ে পড়ছে

এদের রুখতে হবে বিধাতা এবং তার সৃষ্টি
একজোট হতে হবে
ধর্মের নামে বর্ণের নামে গোষ্ঠীর নামে
ভেদাভেদের অন্ত ঘটাতে হবে

পৃথিবীর দায়িত্ব মানুষকে নিতে হবে
বুঝতে হবে বিধাতা মানুষকে
প্রতিনিধিত্বে পাঠিয়েছেন
তার যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে উঠতে হবে

এসব দুপেয়ে হারিয়ে যাবে
হারিয়ে যাবে নাইন ইলেভেনের ঘাতক
মানুষ থেকে যাবে, মানুষকে থাকতেই হবে।

ক্যাসিনোর টেবিল

ক্যাসিনোর টেবিল

ক্যাসিনোর টেবিলে
আমাকে যখন ফেরি করা হয়
লজ্জিত হই
নিজের জন্য নয়
উন্মাদ আদমের জন্য

তাদের হায়া খুইয়ে ফেলেছে
উলঙ্গতা ঢাকতে
অর্ধ উলঙ্গ হাওয়ার
হাত থেকে পরিবেশিত
সুরায় স্বস্তি খুঁজে

স্বস্তির বিপরীত প্রান্তে যারা পৌঁছে গেছে
সহজে তারা ফিরতে পারে না
কখনো বক্ষ জুড়ে হাহাকার ধ্বনিত হয়
কিন্তু এই হাহাকার পরিণতি পায় না
অথবা পরিণতির সদিচ্ছা রাখে না

পথ চিনে নিতে হয়, বেখেয়ালে ভুল পথে
হাঁটা হলে, সম্বিৎ ফেরার সাথে সাথে
ফিরে আসো নিজস্ব ট্র্যাকে

যদি ভেবে থাকো ভুল পথেই পৌঁছে যাবে, ভুল
সহজ সরল পথ ছাড়া মঞ্জিলে মকসুদে কেউ
পৌঁছায় নি, তেমন সম্ভাবনা ভাবনার অতীত

ক্যাসিনোর টেবিলে সবসময় আমিই জিতি
আমাকে হারাতে পারে
এমন শক্তি রাখে না আদম

ক্ষণিকের স্বস্তি হতে পারে অর্ধনগ্ন হাওয়া
কিন্তু পরাজিত আদম চিরদিন অক্ষম র’য়ে যায়

তাকে আমি জয়ী ভাবি
যে মাড়াতে পেরেছে আমার মোহ
সহজ সরল পথে যে পৌঁছাতে পেরেছে বাড়ি

সে-ই জয়ী যে ক্যাসিনোর টেবিল ছেড়ে
পারিবারিক বলয়ে ফিরে যায়

পরিবারের হাওয়ার হাত থেকে
এককাপ ধুমায়িত গরম কফি
খেতে খেতে যে পড়ে জীবনের পাণ্ডুলিপি
তার চেয়ে সফল আদম আমি জীবনে দেখিনি

প্রার্থনা

প্রার্থনা

কাঠফাটা মাঠ অপেক্ষায় আছে
তপ্ত বুকে হাহাকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে
বহু জনমের অভিতাপ সইতে সইতে
তার মধ্য স্থিতি হয়ে গেছে ভীষণ নাজুক

সইবার মতো ধৈর্য অবশিষ্ট নাই
সামাল না দিতে পারলে
পরিপাশের ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে

পুকুরের মাছ অপেক্ষায় আছে
তার জলকেলির সঙ্গী ছুটছে ঠিকই
কিন্তু মনমরা মনে উছলানোর যুক্তি পাচ্ছে না

এককালের যৌবতী দীঘি পুকুরের
তলদেশে হয়ে আছে, যৌবন গিয়েছে কবে
যা আছে অবশিষ্ট তাতে জলকেলি
দীর্ঘস্থায়ী হবে না নিশ্চিত

অশ্বত্থের শিকড় অপেক্ষায় আছে
তার শরীরের পরতে পরতে কাঠিন্য
বাসা বেধেছে, জীবনের সময়
সংকীর্ণ হচ্ছে দেখে অসহায় অশ্বত্থ
পাখিদের দিচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত শুশ্রূষা

অপেক্ষায় আছে মাঠের দোয়েল
দূরে ধান কাউনের বন
ক্ষয়িষ্ণু মনে উড়বার শক্তি হারিয়েছে
বেদনার পাখায় জেঁকে বসেছে অনীহা

অপেক্ষায় আছে একজোড়া প্রবীণ
তালপাতা পাখায় অন্ত হচ্ছে না
জীবনের ক্লান্তি, শেষ যাত্রার পরিপাটি
আয়োজন ভেস্তে যাচ্ছে
কাঙ্ক্ষিত নিরিবিলি অবসরে
কেবলই হানা দিচ্ছে বিগত মুদ্রাদোষ

অপেক্ষায় আছে শিশু কোলে অসহায় মা
শুকিয়ে যাচ্ছে তার দুধের নহর
তৃষ্ণার্ত শিশুর গালে মায়াবী চুম্বন
অন্তে অমঙ্গল আশঙ্কায় কেঁপে উঠছে বুক

অপেক্ষায় আছে সদ্য জোড় বাঁধা প্রেমিক প্রেমিকা
হৃদয়ের অলিগলি ঠিকঠাক মিলে গেলেও
সম্পন্ন হচ্ছে না আনুষ্ঠানিক অভিষেক
একসাথে সিক্ত হওয়ার বাসনা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে

অপেক্ষায় আছে দিগন্ত চরাচর
শিক্ষকের ছাতা, বাঁশবন
বেদেনীর ঝুরি, অপেক্ষায় আছে
শ্রমিকের ঘাম, বরজের পান
নিদ্রাহীন পথের কুকুর অপেক্ষায় আছে

হে মহামহিম মেঘ তোমার অভাবে
মর্ত্যে কারবালা অবস্থা
মানুষের মনে, পশুদের বনে
মহামারী বিরাজ করছে
পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে মাঠ
প্রান্তর শুকিয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে
মানব হৃদয়, সেখানে জড়ো হচ্ছে
লোভ, ঈর্ষা, রেষ
পানির অভাবে মানুষ আজ
মানুষ হত্যায় উদ্যত

হে প্রিয় মেঘ দয়া করো
পুনরায় সিক্ত করো মানব হৃদয়
তোমার কন্যা বৃষ্টিকে
এখনি মর্ত্যে পাঠাও

বৃষ্টি জলে ধুয়ে যাক যাবতীয় পঙ্কিলতা
নতুন ভোরের দোর খুলুক পবিত্র ধরণি

ঠাণ্ডা মেয়েটা

ঠাণ্ডা মেয়েটা

ঠাণ্ডা মেয়েটা বহু পেরেশানির পরে
একটু স্থিত হতে চেয়েছিল
গেরস্থের ঘরে হতে চেয়েছিল ক’দিনের মেহমান
তেমন কোন চাওয়া ছিল না
কোন রকম জোরাজুরিও করেনি
ঝঞ্ঝাট সময়ের তাড়ায় অতিষ্ঠ
নিঝঞ্ঝাট কিয়ৎক্ষণ বসতে চেয়েছিল

শান্ত সমাহিত দীঘির মত কাটাতে
চেয়েছিল পক্ষকাল
জিপসি কন্যার মতো এ ঘাট ও ঘাট
করতে করতে ক্লান্তি নেমেছিল
দুচোখ জুড়ে, একটু অবসরের লিপ্সা
তাকে ঘরমুখি করেছিল

গেরস্থের দরজার ফাঁক দিয়ে
চুপি চুপি ঢুকে
খাটের নীচে, কাবার্ডের আড়ালে
তোষকের তুলায়
জুতোর বাক্সে
এমনকি লকারের অন্ধকারে
নিজেকে আড়াল করেছিল

কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি
নির্দয় গেরস্থ ঠিকই টের পেয়ে গেছে
ঠাণ্ডার অমন সৌকুমার্য মুখাবয়বও
ভুলাতে পারেনি গেরস্থের পাষাণ হৃদয়

দারুণ কাঠিন্য দেখিয়ে সে লেলিয়ে দিয়েছে
ইলেকট্রিক হিটার
ঠাণ্ডা পালিয়েছে, কিন্তু যাওয়ার প্রাক্কালে
অভিশাপ দিয়ে গেছে
ঠাণ্ডার ছোঁয়াচ থেকে কেউ রক্ষা পাবে না

কেউ রক্ষা পায় নি, সর্দি কাশিতে
ব্যতিব্যস্ত গেরস্থের পুরো পরিবার

গৌতমের অফিস

গৌতমের অফিস

আমার বন্ধু গৌতম মুচি ছিল
তার রোজগার বেশ ভাল
আমরা প্রায়ই তার রোজগারে চা খেতাম

প্রাইমারি পেরিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের
অষ্টম ক্লাসে তার শিক্ষার পরিসমাপ্তি হলে
বাবার ইচ্ছায় পৈত্রিক ব্যবসায় লেগে যায়

বাবা আর ভার বহণে অক্ষম
সংসারের কিছু ভার তোমার কাধে নাও
ভার নিতে গৌতমের আপত্তি ছিল না কিন্তু
বন্ধুদের সাথে স্কুলে দেখা হবে না বলে
কিছুটা মন খারাপ, বাবার সিদ্ধান্ত
আমাদের সাথে শেয়ার করলে আমরাও
বাবার মতের সাথে একমত হই, মাঝে মাঝে
তার অফিস ঘিরে আড্ডা হবে বলে তাকে
আশ্বস্ত করি, আমরা তখন প্রগতির পাঠ নিচ্ছি

স্কুলে আসা যাওয়ার রাস্তায় গৌতম জুতো সেলাই করে
আমরা তার রোজগারে চা পান করি

দীর্ঘদিন পরে আমাদের প্রগতি চিন্তায় ভাটা পরলে
গৌতম তিরোহিত হয়, মুচির পয়সায় চা-পান
আমাদের আত্মায় অভিদংশন করে

গৌতম এখন আমাদের জুতো পালিশ করে
বারো টাকার মজুরীর বদলে বিশ টাকা ছুড়ে মারি
চায়ের টাকা যেভাবেই হউক শোধ করতে হবে
খেজুরে আলাপও আর হয় না

মুচির ছেলের সাথে ক্বচিৎকালে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল
অস্বীকার অন্তে আমরা নবজীবনের পথে হাঁটি
আমাদের বৌ’দের মনে আভিজাত্য হানা দেয়
সিংগাপুরে শপিং কিংবা কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত
এসব গল্প করতে করতে গৌতম তিরোহিত হয়

গৌতম কোন কালেই আমাদের বন্ধু ছিল না
মুচির পয়সায় পা-চান জীবনেও ঘটেনি

পাণ্ডুলিপির ভাল থাকা

পাণ্ডুলিপির ভাল থাকা

গাছের পাতা শেষ পর্যন্ত ভাল থাকে
আকাশের পাখি শেষ পর্যন্ত ভাল থাকে
নদীর মাছ শেষ পর্যন্ত ভাল থাকে

ভাল থাকে ঘাসের শিশির
কুয়াশার পাহাড়

প্রাচীন বটবৃক্ষের ডালে যে একজোড়া তক্ষক
তারাও ভাল থাকে

খেয়া নৌকার মাঝি ফিকে বিকেলে
মনখারাপের পরেও ভাল থাকে

নাজিম পোদ্দার বাজার ফিরতি পথে
মৌরলা মাছের ঝোলে ভাল থাকে

নুনু কাটার কটাই হাজম
ঝুরিতে ক্ষুরধার ক্ষুর
দিন শেষে সেও ভাল থাকে

ভাল থাকে বাগানের ফুল
ভাল থাকে ফড়িঙের পিছে
ছুটে চলা দুরন্ত শৈশব

আল বাধে শুয়ে থাকা বাছুর
নির্ভাবনায় ভাল থাকে

আজানের শব্দে দ্রুত হেঁটে চলা
ইমাম কিংবা গীর্জার সদর দরজার
বিপরীতে ক্রুশ বিদ্ধ যীশুর শিষ্য
তারাও ভাল থাকে

দিনের শেষে পাণ্ডুলিপি
সময়ে তুমিও ভাল থাকো

মুদ্রিত পাণ্ডুলিপিতে
আমিও মন্দ থাকি না

আহত ঐতিহ্যের নদী

আহত ঐতিহ্যের নদী

স্পর্ধার নদী আজ হয়েছে বিলিন
উজাড় হয়েছে সেই কুসুমের বাগ
পেখম মেলেনা আর ময়ূরী ময়ূর
গায়ের কাপড়ে আঁকা মলিনতা দাগ

মসৃণ পথে যায় বিপণী বিলাস
মেকি আলোর নীচে নৃত্যপটীয়সী
অথচ এখানে ছিল মায়াবতী দীঘি
হরণ হয়েছে তার জ্যোতিময় শশী

এই মাঠ মাঠ ছিল দালানের অতীত
বুকের রক্ত ঢালে দুরন্ত কিশোর
পথপাশে পড়ে থাকা সোনালি শৈশব
ইটের আঁধার ঢাকে ফেলে আসা সুর

নদী নাই দীঘি নাই মাঠ আর নাই
আহত ঐতিহ্যে তবু আমি হেঁটে যাই

দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু : এক আত্মঘাতী কবির প্রতিকৃতি-১

দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু : এক আত্মঘাতী কবির প্রতিকৃতি-১

দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু গত হয়েছেন মাস দেড়েক হয়ে গেছে, তাঁকে নিয়ে শোক কিংবা তাঁর সৃজনী নিয়ে উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না, যত দিন যাচ্ছে মঞ্জুর ভুত আর বেশী করে জাঁকিয়ে বসছে তাঁকে ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না।

এমন না যে জীবিত কালে তিনি খুব উচ্চারিত ব্যক্তি ছিলেন বরং বিপরীত, তিনি তাঁর বলয়ের বাইরে খুব একটা আলোচিত হতেন না। তবু এখন কেন তিনি আড়ালে যাচ্ছেন না, কেন তাঁকে স্মরণ অন্তে যাপিত জীবনে প্রত্যাবর্তন করা যাচ্ছে না! কেন তিনি বারবার মননে হানা দিচ্ছেন, কেন তাঁর চিৎকার কর্ণ বিদীর্ণ করে পারে আছড়ে পরছে! কেন বারবার স্মরণ পারে তিনি বলছেন আমি ছিলাম, আমি থেকে যাবো!

কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় তিনি কখনোই তাঁর বলয়ে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর বিস্তার ছিল সর্বব্যাপী। বিলেতের সব সাহিত্য আসরে, আড্ডায়, উৎসবে, পার্বণে তিনি ছিলেন। বিলেতের সাহিত্য পাড়ার সাথে তাঁর তেমন কোন সংযোগ ছিল না, সম্ভব হলে এসব তিনি এড়িয়ে চলতেন। তিনি বলতেন এসবে কিচ্ছু হয় না, মূর্খদের আড্ডা, অনুষ্ঠান, উৎসবে সাহিত্যের বিন্দুমাত্র ফায়দা হয় না। তবু বিলেতের কোন অনুষ্ঠান তাঁকে ছাড়া অপূর্ণ থেকে যেতো। যদি ভাগ্যগুণে তিনি উপস্থিত হতেন যেকোনো অনুষ্ঠান ভিন্ন মাত্রা পেতে। তাঁর উপস্থিতি আয়োজকদের বাড়তি চাপে ফেলতো, আয়োজকরা আপ্রাণ চেষ্টা করতেন ভাল এবং নান্দনিক অনুষ্ঠান উপহার দিতে।

তাঁকে কেউ অস্বীকার করতে পারতো না, ধারালো মুখের জন্য প্রকাশ্যে অপ্রিয় হলেও তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব কেউ মাড়িয়ে যেতে পারত না। প্রকাশ্যে যারা নাম নিতে দ্বিধা করতো গোপনে কিংবা অপ্রকাশ্যে তাঁকে পড়তে হুমড়ি খেয়ে পড়তো।

বিলেত পাড়ায় অনেকেই তাঁকে সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলতো। তাঁর সঙ্গ, কথাবার্তা অনেকের পছন্দ হতো না। তিনি নিজেকে ছাড়া সবাইকে অল্প মেধার মনে করতেন। এখানে কোন সাহিত্য হয় না, কাগজ হয় না। এখানকার সম্পাদকরা সম্পাদনার কিছু জানে না, যারা ছোট কাগজ করছে বলে দাবী করে তারা জানেই না ছোট কাগজ কি। ছোট কাগজের সম্পাদকদের তিনি সম্পাদক না বলে সংকলক বলতেন, বলতেন এরা ভাল করে সংকলনও করতে পারে না। এখানের পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতাকে তিনি রঙিন আবর্জনা হিসাবে চিহ্নিত করতেন। তিনি মনে করতেন সাহিত্য বিশুদ্ধ হতে হবে, আবর্জনা মুক্ত হতে হবে। তিনি মৌলবাদকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন, মৌলবাদের সাথে কারো সামান্য সম্পৃক্ততা থাকলে তিনি তাকে বর্জন করতেন।

হুমায়ুন আজাদের কর্মকাণ্ড তাঁর খুব পছন্দের ছিল। হুমায়ূন আজাদের সাহিত্য কর্মকে তিনি প্রকৃত সাহিত্য কর্ম মনে করতেন। ”পাকসার জমিন সাদবাদ” নিয়ে আমাদের আপত্তির বিপরীতেও তাঁকে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখেছি। তাঁর মতে মৌলবাদীদের চিত্রায়ন যেভাবে হওয়া উচিৎ হুমায়ূন আজাদ ঠিক সেভাবেই তাদের চিহ্নিত করেছেন। তাদের চিহ্নিত করণে এরচেয়ে শুদ্ধ ভাষা আর হতে পারে না। আল মাহমুদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিপরীতে কবি হিসাবে স্বীকৃতি দিতে তাঁর আপত্তি ছিল। তাঁর মতে একজন মৌলবাদী কোনভাবেই কবি হতে পারে না, আধুনিক বাংলা কবিতায় আল মাহমুদকে অন্তর্ভুক্ত না করে হুমায়ূন আজাদ সঠিক কাজই করেছেন।

তিনি বলতেন জীবনে একটা কবিতা লিখলেই হবে, হাজার হাজার অনর্থক কবিতা প্রসবের কোন মানে হয় না। দিস্তা দিস্তা বই ছাপিয়ে কি লাভ যদি না একটা পঙক্তি লোকের মনে থাকে। আবার বলতেন লোকের মন যুগিয়ে যারা লেখার চিন্তা করে তারা নিম্ন মেধার, আপনাকে আপনার যুগের চেয়ে অগ্রসর হতে হবে। আপনার মৃত্যুর বহুবছর পরে কেউ যদি এক পঙক্তি পড়ে জেগে উঠে তবেই আপনি সার্থক।

সাহিত্য নিয়ে তাঁর বিভিন্ন পরিকল্পনা ছিল, তিনি নিরীক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন। প্রথাগত ছন্দের বাইরে গিয়ে কবিতা লিখতে প্রায়ই উৎসাহ দিতেন। তাঁর লেখার সূচনাকালে যদিও তাঁকে প্রথার হাত ধরে চলতে হয়েছে কিন্তু যখনই চলা শিখে ফেলেছেন প্রথাকে ছুড়ে ফেলেছেন অথবা অস্বীকার করেছেন। তাঁর হাতে জন্ম হয়েছে নতুন গদ্য ভাষা, মুক্ত গদ্যের ভুবনে তিনি অনন্য। সাহিত্যের নতুন এই বিষয় তাঁর হাত ধরেই বিকশিত হয়েছে।

তিনি অনুগল্প লিখেছেন, ছোটগল্প লিখেছেন কিন্তু এসব অনু কিংবা ছোটগল্প পাঠের শেষে কিছুটা দ্বিধা থেকে যায়। এসব গদ্য ধর্মী লেখাকে কি গল্প বলা যায় না এসব তাঁর প্রবর্তিত নতুন ধারার কবিতা! তাঁকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি তিনি খোলাসা করেন নি, বলেছেন আপনার যা মনে হয় তা মেনে নিয়ে পড়ুন। তাঁর কবিতা পাঠে গল্পের স্বাদ পাই, গল্পে পাই কবিতার স্বাদ।

আমার সাথে তাঁর দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বন্ধুকে যেভাবে বন্ধু ভাবা যায় ঠিক সেভাবে তাঁকে ভাবতে পারি নি, তিনিও আমাকে ঠিক সেভাবে আস্তায় নিতে পারেন নি। আগেই বলেছি তিনি প্রচণ্ড মৌলবাদ বিরোধী ছিলেন। মৌলবাদের সাথে সামান্য সম্পৃক্ততা থাকলে তিনি তাঁকে বর্জন করতেন। আমার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না অর্থাৎ মৌলবাদী কি না এ বিষয়ে তাঁর খটকা ছিল। যখনই মনে হতো আমি মৌলবাদে প্রভাবিত হয়ে গেছি কথা বন্ধ করে দিতেন, ফোন করলে ধরতেন না। যোগাযোগের চেষ্টা করলে এড়িয়ে যেতেন। আবার কখনো আমার কোন লেখায় মৌলবাদ বিরোধী অনুষঙ্গ পেয়ে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ফোন করতেন দীর্ঘদিনের অনালাপ জনিত ক্ষোভ নিমেষেই কেটে যেত। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধের কথা শোনাতেন, বিভিন্ন পরিকল্পনা কথা বলতেন। আমি উৎসাহ পেতাম।

মৌলবাদ নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা আছে । আমি আমার মতো মৌলবাদকে ঘৃণা করি, আমার মতো যুদ্ধ করি। তাঁর চিন্তার সাথে নিরানব্বই শতাংশ চিন্তা মিলে যায় আরো এক অংশের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি বোঝাতেন, একটার পর একটা উদাহরণ দিতেন। মৌলবাদ যে দেশ ও জাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর এটা বুঝাতে তাঁর ক্লান্তি লাগতো না।

প্রায়ই তাঁর সাথে বিলেতের রঙিন আবর্জনা নিয়ে আলাপ হতো, অর্থাৎ বিলেতের সাপ্তাহিক কাগজগুলোর সাহিত্য পাতা, এতে যে কি পরিমাণ অপচয় হচ্ছে তা তাঁকে বিমর্ষ করতো। গণ্ড সম্পাদকরা কি নির্বোধের মতো রঙের অপচয় করছে তাতে তিনি কষ্ট পেতেন, বলতেন এসবের কি কোন মানে হয়। আমি আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব যুক্তি দিতাম, পরবাসে এসব যে অপচয় নয় বরং নান্দনিকতার ধারাবাহিকতা এটা বোঝাবার চেষ্টা করতাম। তিনি বিরক্ত হতেন আমার সাহিত্য রুচি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন। তাঁকে খুশি করার জন্য অনেকসময় একমত হতাম, বলতাম বাদ দিয়ে দিবো, রঙিন আবর্জনায় আর লিখবো না। এখন থেকে বিশুদ্ধ ছোট কাগজে মননিবেশ করবো। তিনি খুশি হতেন ছোট কাগজ কি, কিভাবে করা লাগে বলে যেতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। শব্দপাঠ করার প্রাক্কালে তাঁর কিছু পরামর্শই কাজে লাগিয়েছি। বেশীর ভাগই সম্ভব হয় নি, বাস্তব কারণেই হয় নি।

তিনি নিজেও একটা ছোট কাগজ করেছিলেন ধীশ্বর নামে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই কাগজ কি তাঁর কাঙ্ক্ষিত কাগজ হতে পেরেছে, তিনি বললেন না আমি মাত্র এক শতাংশ কাগজ করতে পেরেছি। তবে শত শতাংশ কাগজের চেষ্টা আমি করে যাবো। দুর্ভাগ্য ধীশ্বর দ্বিতীয় সংখ্যার মুখ দেখে নি হয়তো তাঁর কাঙ্ক্ষিত লেখা পাওয়া যায় নি কিংবা এক শতাংশের বেশী মানের কিছু হচ্ছে না দেখে ধীশ্বর পর্ব বাদ দিয়েছেন।

আমি কবিতা লিখতে শুরু করি বেশ দেরীতেই, ছড়াতে ছিলাম। ছড়াও যে ভাল লিখতাম তাও না। কোনদিন কবিতা লিখবো চিন্তা করি নি। হঠাৎ কবিতা ভুত আমাকে জেঁকে বসে, লিখে ফেলি কিছু কবিতা। এসব আদৌ কবিতা কি না সন্দেহ থেকে যায়, সন্দেহ এড়াতে একে ওকে ইনবক্সে কিংবা মেইলে শেয়ার করতে শুরু করি। বেশীর ভাগই পরিচিত এবং অগ্রজ শ্রদ্ধাভাজন কবি। বেশ কয়েকজন উৎসাহ জনক মন্তব্য করেন, কেউ কেউ পরামর্শ দেন আমি সবকিছু আমলে নিতে চেষ্টা করি। কবি মঞ্জুকে পাঠাই তিনি কোন সাড়া দেন না, আমি অপেক্ষা করি। না কোন সাড়া নাই। একদিন লজ্জায় মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করি, মঞ্জু ভাই আমার কবিতা কি পড়েছেন। তিনি বললেন আপনার কবিতা আমি পড়ি কবি, এর আগে আমার নামের সাথে কবি শব্দ তিনি উচ্চারণ করেন নাই। আমি লজ্জায় মিইয়ে যেতে থাকি।

সমুদ্রের শয্যাপাশে

সমুদ্রের শয্যাপাশে

খোলা পিঠে ধাক্কা দিচ্ছে সূর্য
নিয়তি ঠোকরাচ্ছে-
দূরত্বে
গভীর নীল সমুদ্রের খাড়ি, বালুকণা
মৃতদেহের ওজনের
ভার বহনে অক্ষম।
জীবনের হাসি খেলায়
একটা কর্কশ কুক্কটী
ডেকে উঠে মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে
শেষ মুহূর্ত অবলোকনের আশায় দৌড়াই
সামনেই তড়পায় আত্মা!

কালো প্রাচীরের আঁধারে
জেগে উঠবো ভেবে
মনে- মনঃসংযোগ করি
কিন্তু কেউ আটকে রাখে
তার চাপে হৃদয় আচ্ছন্ন হলে
ফুসফুসে অনুভব করি হাওয়া শূন্যতা
জল তেষ্টায় সাঁতরাই
খোলা আকাশের কাঙ্ক্ষা মনে জাগলে
ফুসফুস হাঁসফাঁসে ক্ষীণ হয়
অসহায় কিছু একটা আঁকড়াতে চাই
কোনও ব্রথেলের বেশ্যা যেমন
সঙ্গমের শেষে আঁকড়ায় নিজস্ব অস্তিত্ব

স্বপ্ন শেষে
আরক্ত চোখ খুলে দেখি
মাঠের ওপারে পড়ে আছে ভয়ঙ্কর দৃশ্যাবলী
ভুল হলে ক্ষমা করো-
এই বার বর্ণিত হবে কিছু অদেখা দৃশ্য
সমুদ্রের শয্যাপাশে এককালে ছিল কিছু
অশ্বথ বৃক্ষ, উঁচু টিলার মত জায়গায়
এখনো রয়েছে কবর
যে সমুদ্র একদা পা ধুইয়ে দিতো
সে ধীরে ধীরে সরে গেছে, সেই শোকেই

ক্ষয়িত হয়েছে অশ্বথের হৃদয়
অশ্বথ বৃক্ষের কবরে মানুষের আহাজারি
শুনতে শুনতে চোখ আর্দ্র হয়ে উঠলে
পাখিরা অভিশাপ দেয় নোনাজলের সমুদ্রকে
তখন কতিপয় সী-গল উড়ে এসে
অশ্বথ বৃক্ষের কবরে সাথে প্রাকৃতিক কর্ম

এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য আসলে জীবনেরই অংশ
পৃথ্বীর মাটিতে এমন গল্প খুঁজলেই
পাওয়া যাবে, বন বাদাড় উজাড় হওয়া
এখন আর বড় কিছু না
বন্যা, মহামারি, খরার কালের মত
আমরা এখন হরিদ্বর্ণ কালও ভুলতে বসেছি
আমিষের এই যুগে নিরামিষের স্মৃতি বেখাপ্পা মনে হয়

আর তাই
অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ব্যস্ত মনুষ্য সময়
আমাদের সকল পথ
যাচ্ছে অস্ত্রের দিকে
অসহায় আমরা
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি
নিজেদের অধঃপতন!

৩৪ বছর আগের একটা ছড়া

আজ থেকে ৩৪ বছর আগে একটা ছড়া লিখেছিলাম
ছড়াটি এরকম ছিল…

পৃথিবীতে শান্তি
আসবেই আসবে
সুখী হয়ে শিশুরা
হাসবেই হাসবে…

অস্ত্রের যুদ্ধ
হবে জেনো বন্ধ
একদিন শেষ হবে
সংঘাত দ্বন্দ্ব…

চলে যাবে একদিন
আছে যত অন্যায়
হিংসার শেষ হবে
ভালবাসা বন্যায়…

ছড়া লেখার পর পরেই আশা করেছিলাম পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বইবে… ৩০ ততোধিক বছর পেরিয়ে গেছে… শান্তি অধরা থেকে গেছে… তবু আশা ছাড়ি নি…

আমার ছেলের বয়েস প্রায় সতেরো তার কলেজের একটা পেপারের জন্য রচনা লিখছে একটা লাইন পড়ে স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম… Peace will come here on earth, children will laugh, the fear of war will soon come to an end, the world will be at peace…

আজ থেকে তিরিশ বা ততোধিক বছর পরে ছেলে হয়তো তার ছেলেকে এমন কিছু লিখতে দেখবে, এভাবে স্মৃতিকাতর হবে… তবে শান্তির আশা ছাড়বেনা… বংশ পরম্পরায় আমরা শুধু আশাই করে যাবো… আশাবাদ ছাড়া যাবে না…

রমজান মাসের ভিক্ষাবৃত্তি …

রমজান মাসের ভিক্ষাবৃত্তি …

ভিক্ষাবৃত্তি বা লিল্লাহ যে একটা কলা (আর্ট) তা জানতে এবং বুঝতে হলে আপনাকে রমজানের পুরোমাস বিলেতের বাংলা চ্যানেল দেখতে হবে… দেখতে হবে কি প্রকারে এই কলার মাধ্যমে কিভাবে মানুষকে প্রলোভন দেয়া হয়… কিভাবে প্রয়োগ করা হয়… আমাদের দরজায় নিয়মিত, অনিয়মিত যে ভিক্ষুক দাঁড়ায় তাকে, তাদেরকে প্রায়ই আমরা তাড়িয়ে দেই, বিরক্ত হলে ধমকে দেই, চূড়ান্ত বিরক্তিতে দৌড়ানি দেই অর্থাৎ ভিক্ষুকের সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি কিন্তু টিভি পর্দার ভিক্ষুকের সাথে এর কোনটাই সম্ভব না… সে, তারা আপনাকে সোজা নরকের রাস্তা দেখিয়ে দেবে… ভিক্ষা, লিল্লাহ না দিয়ে পার পাবেন না… আপনি ধর্ম পরায়ণ বেহেশতে যাওয়ার খায়েশ রাখেন আপনাকে ভিক্ষা দিতেই হবে, টিভির ভিক্ষুকদের ভিক্ষা না দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব… আপনার আপন ভাই না খেয়ে আছে, আপন বোনের পরনে ছেঁড়া শাড়ী… টাকার অভাবে আপনার চাচার চিকিৎসা হচ্ছে না… আপনার মামা, খালা, ফুফু কিংবা আপনার অন্য কোন নিকট আত্মীয় দারিদ্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত, মানবেতর জীবন যাপন করছে… এদের দিকে খেয়াল না দিলেও চলবে… আপনি বরং সোমালিয়ায় পানির কল বসান, সিরিয়ায় সেহরির সামগ্রী পাঠান… আপনার দরিদ্র প্রতিবেশীর ঘরে তিনদিন ধরে রান্না হয়নি দুধের বাচ্চারা খিধেয় কাঁদছে… আপনি এতে ব্যথিত হওয়ার কোন কারণ নাই আপনাকে বেহেশতে যেতে হবে তার জন্য আপনাকে এতিমখানায় টাকা দিতে হবে, মসজিদে টাকা দিতে হবে, মাদ্রাসায় টাকা দিতে হবে… আপনার ঘরে কেউ অভুক্ত আছে, আপনার প্রতিবেশী কেউ অসুখে মরছে এসব আপনি কেন পরোয়া করবেন… আশেপাশে যাই ঘটুক সেসব ভুলে আপনি গাজার চিন্তা করুন, সিরিয়ার চিন্তা করুন, রোহিঙ্গার চিন্তা করুন… আপনাকে বেহেশতে যেতে হবে… আপনার থেকে হাজার মাইল দূরের এতিমখানা, মাদ্রাসা, মসজিদ আপনাকে বেহেশত পাওয়াবে… আপনি মুক্ত হস্তে স্বামীকে না জানিয়ে দান করুন… মদের পয়সা, সুদের পয়সা, মিথ্যা বেনিফিটের পয়সা দান করুন, করতেই থাকুন… আপনাকেই বেহেশত ডাকছে…

রমজান মাসে টিভি চ্যানেলে ভিক্ষা দেয়া মানেই নিশ্চিত বেহেশত, এখনই পরীক্ষা করে দেখুন… বিফলে মূল্য ফেরত…

ইস্তার

ইস্তার

ইস্তার খাইলাম পেট ভইরা
লরতাম পারি না
চানা পিঁয়াজা জাও খেজুর
কুন্তা ছাড়ি না

খাইতে খাইতে পেট অইছে
ভেটকি মাছর লাখান
এর পরেও বউরে কই
আখনি থুরা আন

আখনি খাইলাম গোস্ত দিয়া
আখনি আছিল মজার
চাওলর গুরির ফিন্নি দেখি
আমার মোকা চার

ফিন্নি খাইলাম এক বাটি
খাইলাম থুরা আম
খাওয়ার চোটে গাত ঝরে
দরদরাইয়া ঘাম

কুরসা কাঠল বর্তন ভরা
কেমনে সামলাই লোভ
খইয়র লগে মাখাই মাখাই
খাওয়াত দিলাম ডুব

যত খাই মজা লাগে
আরো খাইতাম চাই
দইয়র লগে গোলাপজাম
চপচপাইয়্যা খাই

রোযার মাসো খানির কুনু
হিসাব বুলে নাই
পান মুখদি আমি অখন
পতার মোকা চাই…

(সিলেটী ডায়লেক্টে লেখা)