আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

প্রেম কিংবা টাকা প্রতিভা

সুমনের একটাই ইচ্ছা সেতারা যেচে এসে তার হাত ধরবে। সেতারা নামটা সেকেলে হলেও মেয়েটা সেকেলে নয়। পুরো-দস্তুর মর্ডান। সেতারা না হয়ে সুহাসিনী নাম হলে মানাতো ভালো। নামের সাথে ব্যক্তিত্বের অমিল হলে বেখাপ্পা লাগে। সেতারা নামটাই সেকেলে কিন্তু মেয়েটি সত্যি সত্যিই তারা। আমাদের স্কুলের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। লেখাপড়ায় যেমন গান কবিতা গল্পে নৃত্যেও তারচেয়ে পারদর্শী কেউ নেই। সবচেয়ে মধুর হচ্ছে তার মুখের হাসি সুমন নিশ্চিত জগতে সেতারার মত সুন্দর হাসি কেউ হাসতে পারবে না। সেতারা না হয়ে নামটা সুহাসিনী হলে সোনায় সোহাগা হত।

সুমন নামটা সেকেলে নয় আবার আধুনিক নয়, নামটা মাঝামাঝি ধরনের। সুমন ছেলেটাও মাঝামাঝি। সুমন মেধাবী নয় তাকে অমেধাবীও বলা যাবে না। এ পর্যন্ত ক্লাসে দশের ভিতরেই থেকেছে। গান তার গলায় আসে না কিন্তু গানের কথাগুলো বেশ লিখতে পারে। পদ্য লেখায় কিছুটা মুন্সিয়ানা সুমনের আছে, সেটা অবশ্য সেতারা মাপের নয়। তবুও সেতারা সুমনের দিকে ঝুঁকেছে, সুমনের লেখা একটা গান গাইতে চেয়েছে। একটি অসাধারণ মেয়ে একটি সাধারণ ছেলে প্রতি দুর্বল হচ্ছে; গল্প, উপন্যাসে এটা হয় কিন্তু বাস্তব জীবনে যে এটা সম্ভব সেতারা সুমন এর উদাহরণ।

সুমন সেতারা যখন জুটি বাঁধতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ইমন নামের ছেলেটার বুকের ভিতর আগ্নেয়গিরি লাভা গলতে শুরু করেছে। ইমন কোন কাজের ছেলে না। লেখাপড়ায় টেনেটুনে পাস। অন্য কোনো প্রতিভা এখন পর্যন্ত কারো নজরে আসেনি। কিন্তু সব প্রতিভা যেখানে আত্মসমর্পণ করে সেখানে টাকার প্রতিভা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। ইমনের বাবার প্রচুর টাকা। টাকার জোরে ইমন সব প্রতিভা কিনে নিয়েছে। ইমন নামের আধুনিকতা অনাধুনিকতা এখানে বিবেচ্য নয় কারণ টাকা কারো নামের ধার ধারে না।

সেতারা কিংবা সুমন ইমনের বন্ধু; আদতে শিষ্য তার পিছু পিছু হাঁটে। তার অঙ্গুলিহেলনে বিনা দ্বিধায় সব কাজ করে দেয়। সেতারাকে নিয়ে ইমনের কোন চিন্তা ছিল না, সে ধরে নিয়েছিল সেতারা সে ইতোমধ্যে কিনে নিয়েছে। স্কুল পর্ব কলেজ পর্ব শেষে সেতারা তার বাড়িতেই যাবে। সেতারার পিছনে টাকা বিলাতে সে কখনও কার্পণ্য করেনি, বরং প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিলিয়েছে।

সেতারায় অন্য কেউ ভাগ বসাবে এটা ইমনের চিন্তাতে আসেনি। সেতারা সুমনের ঘনিষ্ঠতায় সে অবাক হয়। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা জুটি হয়ে যাবে এটা ইমন সহ্য করতে পারবে না।

সেতারা সুমনের গান গাওয়া পর্যন্ত হয়তো মানা যায় কিন্তু সেতারা যেচে সুমনের হাত ধরবে এই কথা শুনে এমন মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ইমন ভাবে সুমনের হাত ভেঙ্গে দিলে কেমন হয়; হাত নেই হাত ধরাধরির বালাই নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। টাকা প্রতিভায় ইমন সুমনের হাত ভেঙ্গে দিতে উদ্যত হয় এবং কিছু পরিমাণে সফল হয়।

হাত ভাঙ্গার সিদ্ধান্তের আগে ইমন সেতারার মুখোমুখি হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল
-সুমন চাচ্ছে তুমি তার হাত ধর, তোমার অভিমত কী?
-সুমন চাইলে আমি অবশ্যই তার হাত ধরব।
-আর আমি চাইলে?
-তোমার হাত ধরার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।

ইমন অপমানিত বোধ করে সামান্য একটা মেয়ে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ভেবে জ্বলে ওঠে। উপযুক্ত শিক্ষা দিতে সিদ্ধান্ত নেয়।

ইমনের টাকা সুমনের হাত পুরোপুরি ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়নি, তবে মুচড়ে দিয়েছে। সুমন হাসপাতালে; সেতারা গেছে দেখতে। ইমন ভাবল সেও একবার বন্ধুকে দেখে আসবে। হাসপাতালে পৌঁছে ইমন দেখল সুমনের বেডের পাশে সেতারা বসে আছে; তার দুই হাত দিয়ে সুমনের মুচড়ে যাওয়া হাত শক্ত করে ধরে আছে। এ দৃশ্য দেখে তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে গেল। একটা বিষয় তার উপলব্ধি হল, টাকা প্রতিভা সবসময় সফল হয় না; বিশেষ করে হৃদয় ঘটিত ব্যাপারস্যাপারে।

আব্বা

আমার আব্বা তাঁর দশ সন্তানকে কী কিছু শিখিয়ে যেতে পেরেছিলেন! সেরকম চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয় না। প্রথাগত সদুপদেশ হয়তো শুনিয়েছেন অনেকবার কিন্তু আমল করার জন্য জোর করেননি। আমার আব্বার স্বভাবে জোর জবরদস্তি ছিল না।

তবে একটা কথা মন্ত্রের মত সবসময় আওড়ে যেতেন সেটা হচ্ছে ‘ভাল থাকা’। বলতেন ‘নিজে ভাল থেকো, অন্যকে ভাল রেখো’। তিনি সারাজীবন তাই করেছেন চরম দরিদ্রবস্থায়ও তিনি ভাল থেকেছেন, তাঁর ছেলে-মেয়েরা যখন যোগ্য হয়ে উঠেছে তখনো তাঁর ভাল অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ তিনি উচ্ছ্বসিত হননি, দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাননি।

আমার আব্বা অল্পে তুষ্ট মানুষ ছিলেন। জীবনের প্রতি তাঁর তেমন চাওয়া ছিল না। উচ্চাকাঙ্ক্ষার পিছনে দৌড়াতে হয়নি বলেই তিনি সৎ থাকতে পেরেছিলেন। আল্লাহ এবং তাঁর নবীর (সাঃ) প্রতি আব্বার ছিল শর্তহীন বিশ্বাস, আমাদের জানামতে কখনো কোন নামাজ কাযা করেননি। আল্লাহ যতটুকু নিয়ামত তাঁর জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন আব্বা তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর জীবনে কোনদিন দুঃখবোধ ছিল না, নিজের প্রতি হতাশা ব্যক্ত করতে কোনদিন দেখিনি।

আব্বার অনেককিছু আমরা পাইনি কিন্তু ভাল থাকার মন্ত্র আমাদের দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। আমরা ভাই-বোনেরা নিজেদের মত ভাল থাকি, অন্তত নিজেদের ভালোর জন্য অন্য কারো মনোবেদনার কারণ হই না।

শৈশবের পুকুর

আগুনে যখন ঝলসে যাচ্ছে গায়ের চামড়া
আমি নানা বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটছি।

পুকুরের জলে শৈশব ভেসে থাকতো
আড়াই ঘন্টা সাঁতারেও ক্লান্তি নেই, ঘাট থেকে
মা ডাক দিত ‘উঠে আয়, জ্বর এসে যাবে’
তবু উঠতাম না দেখে মামা পুকুরে নেমে
তুলে আনত। পরের দুদিন জ্বর। তখন অন্য আহ্লাদ।

আগুনে চামড়া ঝলসে যাচ্ছে, কেউ ডেকে বলছে না
‘উঠে আয়, কয়লা হয়ে যাবি’। আড়াই ঘন্টা পুড়ছি
বাঁচাতে মা কিংবা মামা ছুটে আসছে না।

সমুদ্র বিলাস

সমুদ্র ডেকেছিল বলে পাহাড়ে গেলাম;
যেদিন পাহাড় ডাকে; নোনাজল আছড়ে
পড়ে আমার আঙ্গিনায়। সী-গলের ডানায়
উড়াল দিতে দিতে ভাবি; এত কালো শোক, আরো
কয়েক ফোটা নোনাজলে কী শরীর জুড়াবে!

পাহাড়ের চূড়ায় বসে যখন নীচের দিগন্ত দেখি;
নীল বেদনা হৃদয়ে এসে ভিড় করে। বাতাসের
শিস জমাট কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে পর্যুদস্ত
করে দেয়। শিথিল শরীর শুনে সমুদ্রের গর্জন;
বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে রাশি রাশি নোনাজল।

পাহাড়, সমুদ্র ডাকে; ডাক উপেক্ষা করি।
হৃদয়ের ক্রন্দনের কাছে বারবার যেতে নেই।

মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ আমাদের_বন্ধু

গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু, বাপ, দাদার আদি পেশা জুতা সেলাই; অর্থাৎ তারা মুচি। তার বাবা কাকারা চৌমুহনার মোড়ে ঝুপড়ি ঘরে বসে জুতা সেলাই করে।

মুচির ছেলের সাথে বন্ধুত্ব তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না, এখনো সম্ভব নয়; তবুও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অবশ্য হওয়ার বিবিধ কারণ ছিল।

প্রধান কারণ হচ্ছে গৌরাঙ্গ ছিল দরাজ দিল, বন্ধুদের জন্য খরচ করতে কৃপণতা দেখাতো না। আমরা সপ্তাহে পাঁচ শিকা খরচ করতে পারতাম না, সে অনায়াসে পাঁচ সাত টাকা খরচ করে ফেলত। অন্য কারণের মধ্যে ছিল সে ভালো গান গাইতো, ভালো ছবি আঁকতো। পদ্য লেখায় তার বেশ মুন্সিয়ানা ছিল।

সে ছিল তার ঠাকুরদার আদরের নাতি। তাদের পরিবারের কেউ জীবনে স্কুলে যায়নি। জন্ম থেকেই তাদের জুতা পাঠ শেখানো হয়, অক্ষর পাঠ তাদের জন্য বিলাসিতা। গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা দেখলেন এই ছেলের জুতা পাঠে মন নেই, জুতা সেলাই করতে দিলে এই ছেলে সুঁই দিয়ে মাটিতে ছবি আঁকতে লেগে যায়। জুতা সেলাইয়ের চেয়ে গানে মনোযোগ বেশি, মুখে মুখে বেশ ভাল পদ্য বানাতে পারে।

ঠাকুরদা নাতির প্রতিভায় মুগ্ধ। ভাবলেন একে স্কুলে পড়াতে পারলে নিশ্চয় বংশের গৌরব হবে। চাই কি কালে কালে জজ ব্যারিস্টার হয়ে যেতে পারে। একদিন সন্ধ্যায় তিনি ঘোষণা করলেন নাতীকে তিনি স্কুলে পাঠাবেন; তাঁর এই অদ্ভুত ঘোষণায় গৌরাঙ্গের বাবা, কাকারা অবাক হল। স্কুল কেন আরেকটু বড় হলে তো পুরোদস্তুর রোজগারে লেগে যেতে পারবে। কিন্তু বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস তারা করল না।

স্কুলে ভর্তি হবে বললেই তো আর হলো না, মুচির ছেলে অন্ত্যজ জাত; অভিজাত যারা তারা নিশ্চয়ই চাইবে না মুচির ছেলে তাদের ছেলেদের সাথে পড়ুক। নাতিকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে গৌতমের ঠাকুরদা অনেক ঝামেলায় পড়লেন।

অনেক স্কুলে সিট নাই অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হল কিন্তু হাল ছাড়লেন না গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা, দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে এসময় জাতপাত, উঁচু-নিচু চিন্তা করে আর বিভাজন বাড়ানো যাবে না। গৌরাঙ্গকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। গৌরাঙ্গ তৃতীয় শ্রেণীতে আমাদের সহপাঠী হয়ে গেল। আমাদের কোনো কোনো অভিভাবক গাঁইগুঁই করেছিলেন বটে কিন্তু প্রধান শিক্ষকের প্রতাপের কাছে পরাস্থ হতে হল।

প্রধান শিক্ষক তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন ঠিক, আমরা করলাম না। জুতা সেলাই এর ছেলেকে বন্ধু ভাবতে কোথায় যেন দ্বিধা থেকে গেল। অথচ আমাদের কারোরই বয়স দশ হয়নি।

সমাজ বাস্তবতা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, বোধে এমনিতেই এসে যায়। জুতা সেলাই যে অতি নিম্নমানের কাজ, মুচিরা যে অতি নিম্ন জাত দশ বছর হওয়ার আগেই এসব জেনে গেছি।

গৌরাঙ্গের সাথে কেউ মিশে না, পাশে বসে না, সে একেবারে পেছনের বেঞ্চে একা বসে থাকে। কিছুদিন পরে দেখা গেল তার হাতে অফুরন্ত টাকা। আমরা চার আনার বাদাম কিনতে পারি না, সে দিব্যি এক টাকার বাদাম কিনে ফেলে। বাদামের লোভে আমরা তার পাশে ভিড়লাম, সে আমাদের নিরাশ করল না; ভাগ দিতে শুরু করল। ক্রমে সে আমাদের বন্ধু, আমাদের একজন হয়ে গেল।

গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা বেশ মালদার ছিলেন, তিন পুত্রের রোজগারে তাঁর দিন ভালই কাটছিল। আদরের নাতির পকেট খরচের জন্য প্রতি সপ্তাহে দশ টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে তাদের বাড়িতে চোলাই বাংলা মদের আসর বসতো। ঠাকুরদা, বাবা, কাকারা একসাথে বসে মদ্যপান করত, কখনো কখনো মা, কাকীরাও সঙ্গ দিতে হাজির থাকতো। মদের আসরে বাচ্চাদের হাজির হওয়ার কোন বিধি-নিষেধ না থাকলেও গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা তাকে কাছে ভিড়তে দিতেন না। মদ্যপান কিংবা বিড়ি-সিগারেট থেকে দশ হাত দূরে রাখতেন।

অচিরেই গৌরাঙ্গের অন্যান্য প্রতিভা আমাদের সামনে প্রকাশ হতে থাকল। গান, আঁকা, পদ্য লেখায় সে অনন্য ছিল। আন্তস্কুল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সে স্কুলের জন্য সুনাম কুড়াতে লাগল। আমরা তার বন্ধু থেকে ভক্ত, গুণমুগ্ধে পরিণত হলাম। নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সহজাত গুণ তার ছিল; একদিন লক্ষ করলাম সে আমাদের দলপতি হয়ে সামনে হাঁটছে, পিছন পিছন আমরা তাকে অনুসরণ করছি।

নবম শ্রেণী পর্যন্ত গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু ছিল, দলপতি ছিল কিন্তু এর পরে তার প্রতি আমাদের মোহ ভঙ্গ হল। সে যে অন্ত্যজ শ্রেণী প্রমাণ রাখল। তার ঠাকুরদা কিংবা বাবা-কাকারা আদতে যে মুচি কোন সন্দেহ থাকল না।
রিতা রায়ের বাবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। রীতা রায় সুন্দরী, স্মার্ট সে আমাদের প্রেমিকা। আমাদের প্রত্যেকের মনে রীতা রায় থাকে। এই রীতা রায় কে প্রেমের আহ্বান জানালো মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ। রীতা রায় অবাক হলো ঠিকই কিন্তু উত্তেজিত হলো না কিম্বা রাগ করল না, শুধু গৌরাঙ্গ কে ডেকে বলল ‘এ হবার নয়’।

রীতা রায় রাগ করেনি কিন্তু আমরা ক্রোধে ফেটে পড়লাম, মুচির ছেলের এত সাহস রীতা রায় কে প্রেমপত্র লিখে। রীতা রায় কে প্রেমপত্র লেখার অধিকার একমাত্র আমাদের। মুচির ছেলের স্পর্ধার একটা হেস্তনেস্ত অবশ্যই হতে হবে। নিমিষেই ভুলে গেলাম সে আমাদের বন্ধু, গত কয়েক বছরে হাজার টাকার বাদাম সে আমাদের খাইয়েছে। ভুলে গেলাম আমরা তাকে দলপতি মেনে অনেক অসম্ভব কে জয় করেছি।

ইতোমধ্যে দেশে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে, সবকিছু নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন নিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধা প্রধান শিক্ষক স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি অবসরে চলে গেছে। যে স্বপ্নবান পুরুষ স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে জাতিকে একটা দেশ উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে একদিন সূর্যোদয় হয়েছিল এখন স্থায়ী অমাবস্যা আসন গেড়েছে। আশা জাগানিয়া শুরু দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

আমাদের শহরের সবচেয়ে দুষ্টগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে যে পাকিস্তানের লেজুড় ছিল সে এখন স্কুলের দায়িত্বে। ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়েকে প্রেমপত্র লেখার দায়ে গৌরাঙ্গের বাবা-কাকারা জেলে। রাজাকার প্রধান শিক্ষক গৌরাঙ্গের ঠাকুরদাকে আসতে বলেছে। মুচির বাচ্চাদের পায়ের নিচে থেতলে দিতে হবে।

গৌরাঙ্গকে সাথে নিয়ে ঠাকুরদা এলে প্রধান শিক্ষকের কথায় রীতা রায় স্কুলের বারান্দায় থুতু ফেলেছে। গৌরাঙ্গ এবং তার ঠাকুরদা রীতা রায়ের থুতু চেটে খেয়েছে। মুচির বাচ্চার জন্য স্কুলের বারান্দা চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের গুস্সা প্রশমিত হওয়ায় বাবা চাচারা শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছে।

গৌরাঙ্গ তার বংশের জন্য সুনাম কুড়াতে পারেনি। সে এখন চৌমুহনার ঝুপড়ি ঘরে একমনে জুতা সেলাই করে। আমরা কখনও কখনও তার ঝুপড়ি ঘরে হাজির হই, জুতা পালিশ করতে সে কসুর করে না।

(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)

মেঘাচ্ছন্ন দিনের বিড়ম্বনা

4097

মেঘাচ্ছন্ন দিনে মেঘ হৃদয়ের
মেয়েকে জিজ্ঞেস করি
বৃষ্টির খবর। ঈশানে; রাজা প্রলয়
প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, মেঘের
জবাবের পুর্বেই তিনি
জোরেশোরে এসে পড়লেন।

প্রথম ধাক্কায় উড়ে গেল
কদলী বৃক্ষ। দাদাজানের
পুকুরে পাতা ছিল মৎস শিকারির
জাল; রাজা প্রলয় তার বুক
বিদীর্ণ করে পাশের বাড়ির
সফেদা গাছের সাথে কুস্তি
করলেন।

আমার প্রেমিকা শরীফা এহেন
কুস্তিতে আমোদ পেল। প্রলয়
যখন তাদের বাড়ি ছেড়ে পাশের
ক্ষেতে হামলে পড়েছে তখন
শরীফা সফেদা কুড়াতে যেই
বৃক্ষের নীচে এল; মেঘ জানালেন
প্রলয়ের পরে বৃষ্টি আসে।
শরীফা আমাকে বৃষ্টি নিমন্ত্রণ
জানাল।

আমি প্রেমিক হিসাবে লাজুক,
গড়িমসি করছি দেখে রাজা প্রলয়
পুনরায় ফিরে এলেন, ধাক্কা দিয়ে
বারান্দা থেকে উঠানে ফেলে
কোন কিছু বোঝার আগেই
লুঙ্গি খানা উড়িয়ে নিলেন।

দাম্পত্য

তোমাকে নিয়ে ঢাকায় সেটেল হব
ভেবেছিলাম
কিন্তু ধুলোয় তোমার এলার্জি

সাত পাহাড়ের মাথায় যে বাংলো
দুজন মিলে দেখে এসেছিলাম
দামে পোষালো না

একটা লাইট হাউসের সখ ছিল
দিকভ্রান্ত নাবিকের
দিশা ফিরিয়ে দিতে
আলো হয়ে জ্বলে উঠতে

এত খোঁজাখুঁজির পরেও যুতসই
লাইট হাউস পাওয়া গেল না

পঞ্চগড়ের পাড়াগাঁয়ে পর্ণকুটির
হলেই চলবে
শুধু সামনে এক চিলতে উঠোন

পঞ্চগড় অনেক দূর, হারানোর সম্ভাবনা
এই পরিকল্পনাও বাদ দিতে হলো

বিলেতে যাওয়া যায় হয়তো
কিন্তু বরফের নালায় পদ্ম দীঘির
আমেজ কি পাওয়া যাবে…

ঢেউপাশা গ্রামে মাটির পাতিলে
তরতাজা রসগোল্লা রাখা আছে
তর্জার বেড়া আর ছনের ছাদ,
টুপটাপ বৃষ্টি বুক পর্যন্ত ভিজিয়ে দেয়

নিজস্ব ভূমিতে বেশ আছি
তৃষ্ণায় ডাব আর ক্ষুধায় দুধ সাদা ভাত

বাড়ির পিছনে লাগিয়েছি ধনিয়া
দাপ্তরিক কাজ শেষেও বইবে জীবন
ফ্লেভারের অভাবে মরে যাবে না…

উড়াল পাখি

উড়াল পাখির পাশের সীটে
তুমি যখন সুগন্ধ ছড়াচ্ছ;
মায়ের মুখ স্মরণে কান্নায়
বুক ফেটে যাচ্ছে।

পরবাস অভিশাপ; কিন্তু
গত্যন্তর নেই, পাপী পেট
নির্দয়; সাহারায় ছুড়ে ফেলে।

আমি কাঁদছি; সুগন্ধি ভ্যানেটি
ব্যাগে রাখা টিস্যু অশ্রু মুছে
দিচ্ছে। বাম হাতের পাঁচ আঙুল
ডান হাতের পাঁচ আঙুল জড়িয়ে
ধরলে বুঝতে পারি সাড়ে ছয়
হাজার কিলোমিটার
পাড়ি দিতে হবে।

কপিলা ছাড়া কুবের কী
অজানার সাহস করত, আমার
কপিলা এভাবেই আঙুল আঁকড়ে রাখো।

শিল্পের বড়াই কিংবা মানুষের অসুখ

বারান্দার গ্রিলের উপর দিকে
চড়ুই দম্পতি বাসা বেধেছে,
পুকুরের দক্ষিণে এক পায়ে দাঁড়ানো তালগাছ
তার আগায় ঝুলছে বাবুইয়ের শিল্পিত বাসা।

আমি মাঝে মাঝে পালক কুড়াই
মাঝে মাঝে পাখিদের শিল্পভাবনা পড়ি

বাবুইয়ের পালকে কোন আভিজাত্য দেখি না,
দেখি না কোন বড়াই।
চড়ুইয়ের পালকে নেই হীনমন্য দাগ,
লজ্জায় ম্লান হতে দেখি না।

পাখিদের নেই আভিজাত্য কিংবা লজ্জাবোধ
দালান, শিল্প চিন্তায় সময় নষ্ট করে না
একমাত্র মানুষই বিলাসী অসুখে ভোগে…

নীল চোখের কৃষ্ণ বালিকা

ব্রুজ খলিফার চুড়ায় নীল চোখের
কৃষ্ণ মেয়েটা যখন মৃদু ধাক্কা দিল
আমি পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলাম।

একশ পঁচিশতলা থেকে পড়ে গেলে
মরে যেতাম নিশ্চিত। মরে গেলে মেয়েটার
নীলাঙ্কিত মুখ দেখা হত না।

‘সরি’র সাথে হয়তো দুঃখের যোগ আছে
আমার কিন্তু আনন্দ অনুভূত হল
মেয়েটার বিব্রত মুখে আনন্দ দেখলাম।

আমরা একসাথে সেলফি উঠালে ব্রুজের
চুড়াও আনন্দে শীৎকার করল। চুড়া
থেকে পাতালে নেমে আমরা ভিন্ন পথিক।

হাজার বার ‘সরি’ উচ্চারণে আমিও বিব্রত
মনে কোন খেদ নেই বুঝাতে পুনরায় ধাক্কার
আমন্ত্রণ জানালাম, মেয়েটা হৃদয়ে মৃদু

ধাক্কা দিয়ে ঘানায় উড়াল দিল। ব্রুজ খলিফার
করিডোরে ধাক্কা হয়ে আমি বসে থাকলাম।

দিদি

সে আমাকে দিদি ডাকে;
কেন ডাকে!

বয়সে হয়তো কয়েক মাসের
বড় হতে পারি

দিদির বদলে অন্য ডাক;
কিংবা কিছু না ডাকলেও চলত।

সে সামনে এলে
বুক ধরফর করে

আড়াল হলে উৎসুক চোখ
এ দিক সে দিক খুঁজে।

তার জন্য বিপর্যস্ত
অন্য কিছু ভাবতে পারি না।

সে আমার পাশের বাসার ভাই
যখনতখন
ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করে।

মানবিক হৃদয়

তোমরা রাশিয়ার ইউক্রেন গ্রাস দেখছ
আমি দেখছি
নাতির চিকিৎসার জন্য
আস্তুম উল্লা
তার শেষ সম্বল টুকু বিক্রি করে দিচ্ছে,
আস্তুম নিজ দেশে উদ্বাস্তু।

ইউক্রেনের শিশুদের আলিঙ্গনে
এগিয়ে আসছে হাজার হাত
আস্তুমের নাতি বেডের অভাবে
মেঝেয় রাত যাপন করছে…

ইউক্রেনের জন্য হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে
আস্তুমের নাতির মৃত্যুকে
নিয়তির বেশি কিছু ভাবছি না…

দূর প্রদেশের বৃক্ষের মৃত্যু
আমাদের কাঁদায়, নিজের আঙ্গিনার গাছে
জল ঢালতে অপারগ,
সৌখিন মানবিকতা আমাদেরই মানায়।

মুদি কর্মচারী

গালর্স স্কুলের প্রবেশ পথে টং দোকান;
একটা ছেলে গলায় গামছা ঝুলিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকে।

ছেলেটা পাশের মুদি দোকানের কর্মচারী
যার জন্য দাঁড়ায়, তার দূরত্ব চাঁদের কাছাকাছি;
তবু সে দাঁড়ায়।

চাঁদ কখনো তার দিকে নজর ফেরাবে না
জেনেও ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে, গামছায়
মুখের ঘাম মুছে।

মেয়েরা সবুজ পরিধান করে দল বেঁধে আসে;
খলবলিয়ে হাসে। ছেলেটা গাঢ় সবুজ অনুসন্ধান করে
তার চোখের উজ্জ্বল্য বাড়ে।

বিপরীত দৃশ্য

মানুষের ঘরে কারনে অকারনে উঁকি দেয়া স্বভাব
ভাণ্ডারে অনেক বিসদৃশ দৃশ্য জমা আছে।

যখন কোথাও উঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকে না
তখন সে একমনে দৃশ্যান্তরে যায়। বিপরীত দৃশ্যে

নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে আহত হয়
তার শরীর থেকে রক্ত ঝরে। গত পরশু

আবদাল মোল্লার পোয়াতি স্ত্রী মৃত সন্তান
প্রসব করে। সে জানে শিশু মৃত্যুর কারণ;

তারও দুদিন আগে চোখে সে দেখেছে
আবদাল মোল্লার ডান পা সজোরে লাথি মারছে।

নিন্মাঙ্গে রক্ত দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল
তবু মগজে দৃশ্য জমা হয়ে গেছে।

সে সাক্ষী দিতে পারতো কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্য;
বদমাশ ছাড়া কেউ মানুষের ঘরে উঁকি দেয় না।

বদমাশের সাক্ষ্য সম্পূর্ণ মূল্যহীন। তার সাক্ষ্যের
অপেক্ষা না করে বউও দুদিন পরে মরে গেল।

শহরকে কাধে নিয়ে

শহরকে কাধে নিয়ে হাটছিলাম, ক্রমে হালকা থেকে ভারি হচ্ছিল। এক সময় যে গাছের সাথে প্রাণের সখ্য ছিল সে গাছ খুঁজতে গিয়ে দেখি দানব দালান তার নির্দয় থাবা মেলেছে। প্রতিজ্ঞা ছিল ব্রজেন দাসকেও ছাড়িয়ে যাব; ইংলিশ চ্যানেল পুনরায় পরাভূত হবে। যে পুকুরে ব্রজেনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম সে পুকুর এখন চকচকে আলোর বিপণি। নর্তকীর জেল্লায় পরপুরুষের বদ নজরকে নিজের আভিজাত্য ভাবে।

কিশোরী প্রেমিকা প্রমোদ ভ্রমণে বড় কষ্টে রাজী হয়েছিল, শহরের পাশের লেকে চৌকা নৌকায় হাতে হাত রেখে প্রেমের প্রতিজ্ঞা করেছিল। প্রেমিকার প্রতিজ্ঞা অচিরে কচু পাতার পানির মত গড়িয়ে তলদেশে মিশে গেছে। প্রেমিকার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চুলে পাক ধরেছে। লেকের চারপাশে মিথ্যা প্রেমিকার ছড়াছড়ি, চৌকা নৌকা এখন ইঞ্জিন চালিত যন্ত্র। প্রাকৃতিক দৃশ্যে কামড় বসিয়েছে লোভী বনিক, তার ধর্ষিত চোখে সম্ভ্রম হারিয়েছে লেক। রিসটের চাকচিক্যে লেকের প্রকৃতিক সৌন্দর্য ম্লান।

শহরকে কাধে নিয়ে অনেকদূর যেতে পারতাম; এখন এক ফুট গেলে দেবে যাই।