জাহিদ অনিক এর সকল পোস্ট

জাহিদ অনিক সম্পর্কে

ঝাঁপ দাও হে নক্ষত্র, জাহিদ অনিক ভাল নেই ।

বলড্যান্স

বলরুমে হাইহিল পড়া বেঁটে মেয়েটা অপ্রস্তুত তাকিয়ে দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে-
এখনো কিছু মিনিট হাতে আছে, এক হাতে দস্তানা পড়ে নিয়েছে
অন্যহাতেও পড়বে, নাকি এই হাতের থেকেও খুলে ফেলবে সেই চিন্তা
কিংবা উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজে পাওয়া নিয়ে যখন প্রবল অস্বস্তি-বোধ;
খালি হাতের উপর ভারী একটা হাত রেখে পুরুষালী গলায় জিজ্ঞেস করলাম
– ডু ইউ ড্যান্স, মিসেস — —–
আকস্মিকতায় কিছুটা বেঁকে গিয়ে এক ঝটকায় দস্তানাটা পড়ে,
হাতে হাত রাখতে রাখতে বললে,
– ইলি, মিস ইলি।

স্বল্প-দুর থেকে এতক্ষণ চোখে যে সংশয় ও দ্বিধা রেখা যাচ্ছিলো
কাছে আসতেই সেটা মনে হল সম্মোহনী রূপ নিল
অর্কেস্ট্রা দু’বার কেশে উঠে তালে বাজতে শুরু করলো
মিস ইলি হাতে হাত রেখে চোখ ইশারা করে বললে,
– মিস্টার, এসেই যখন পড়েছ কোমরটা শক্ত করে ধরো, পড়ে যাব তো!

স্যাক্সোফোন বেজে উঠতেই একে অপরের আরও কাছাকাছি চলে গেলাম-
স্টেপগুলো কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিলো, এক-দুই-তিন— তিন-দুই-এক
দু’পা পেছন থেকে সামনে ঘুরতেই মিস ইলি এক ঝটকায় নিজেকে টেনে এনে ফেলল আমার হাতের তালুর উপরে-
ভায়োলিনের দুই স্কেল বেজে উঠতেই মিস ইলির কোমর ধরে-
আলতো ক’রে ছুড়ে ফেললাম উপরের ঝাড়বাতি বরাবর,
স্টেপ গুণে গুণে ফিরে আসতেই শূন্য থেকে আবার হাতের গ্রীবায়-
একদম যেন গলে যাওয়া মোমের মত এঁটে গেলেন মিস ইলি।

অর্কেস্ট্রা একদম চুপ-
গ্র্যান্ড হল জুড়ে শুধুমাত্র কেবল পতিত হওয়া সাদা পোশাকি রমণীদের
ফুসফুস দ্রুত ওঠানামা করার সরল ছন্দিত স্পন্দন-
আর ঘন নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ।

দু’টি ত্রিভুজ চোখ যেন নীলাভ ধোঁয়াশে বিষ হয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলছে মগজ ও রক্তনালী-
পা’এর বিন্যাসের সাথে সমঝোতা করতে পারছে না হাতের কব্জি-
পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে যেন পড়ে যাচ্ছি বলরুম ফ্লোরে;
মনে হলো অনেকক্ষণ – কয়েক হাজার বছর পরে অকস্মাতই অর্কেস্ট্রা আবার বেজে উঠল-
আবার আমরা পা’য়ে পা মেলাতে লাগলাম।

বিদায়ের ভায়োলিন করুণ শব্দে থেমে থেমে বেজে একসময় নিশ্চুপ হয়ে গেল-
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,
মাথা ঝুঁকে জাপানিজ কুর্নিশ করে-
কোথায় যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন মিস ইলি।
তবুও আমি-
এক হাতে একটি হাত, অন্য হাতে একটি চিকন কোমর জড়িয়ে ধ’রে
স্টেপ গুণে যাচ্ছি——– এক-দুই-তিন!

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮

সীমান্তিনী

আমার অভ্যন্তরে এখন আর নেই তুমি
শীতের কুয়াশার মত ক্ষণিকা এখন আর নও তুমি
আজকাল প্রগাঢ় আলিঙ্গনে-
আমাকে ভালোবাসো তুমি;
আমাকে ভালোবাসো তুমি আমার চেয়ে বেশি।
ভালো তুমি বাসো আমাকে- এই মিথ্যে;
সত্যি সত্যি সত্য হোক তিন সত্যে।

প্রিয়,
জনসম্মুখে এই মিথ্যেটুকু বলতে বাধ্য হচ্ছি –
কি করে বলি কেবল বেহায়া স্বার্থপরের মত;
সব ভালো কেবল আমিই বেসেছি; তুমি বাসো নি-
তাই কি হয়? হতে পারে বলো !

সমস্ত মিথ্যের বাইরে কেবল একটি সত্য ছিলেম আমি-
যেভাবে নগ্ন চাঁদ বিস্তার করে আকাশে-
নিজেকে নগ্ন করে দ্যুতি ছড়ায়, জ্যোৎস্না নামায়-
তোমার বুকে তেমনি আরাধ্য হয়ে ছিলাম আমি-
ছিলাম হয়ে এক অবাধ্য প্রেমিক।

জ্যোৎস্নার টানে নিজেকে তুমি করেছো সংবরণ
জল’কে করেছ শাসন শক্ত হাতে-
অতঃপর চন্দ্রদিন শেষ হয়ে এলে-
চাঁদ যেভাবে হারায় জ্যোৎস্না’কে;
আমি তোমাকে- তুমিও আমাকে – যুগপৎ
আকস্মিক পথভ্রষ্ট হয়ে আমরা ভূপাতিত হই
হারিয়ে যাই মৃত্তিকার গর্ভে।

———–
জাহিদ অনিক
০১ লা নভেম্বর, ২০১৮

পূর্বাভাস

ঝিলমিল,
তোমার বৃদ্ধকাল কেটে যাবে অনায়াসেই-
আমার যৌবন বিনাশ করে তোমার জন্য লিখে যাচ্ছি সহস্র সঞ্জীবনী মহাকাব্য।

ঝিলমিল,
আমি বেঁচে থাকবো আমি জানি-
আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে তুমি তোমার নাভিমূলে;
নারীত্বের পবিত্র জলে ধুয়ে মুছে যতন করে –
আমাকে তুমি বাঁচিয়ে রাখবে ফি-মাসে।
আমি জানি, আমাকে তুমি দেবে না বিদায় –
দেব না আমিও;
বিদায়ের অনুমতি কেউই আমরা চাইতে পারি না সমস্বরে।

আগমন ও বিদায় মধ্যবর্তী সময়ের নামঃ জীবন-সংক্ষেপ;
আমার আত্মজীবনী আমি লিখে যাচ্ছি তোমার আঙ্গুলে-
অতি সংক্ষেপ- খুব ছোট ছোট শব্দে-
সাংকেতিক কিছু ভাষা- কিছু লেখাজোকা;
শিখে নিও, শিখে নিও তুমি নির্ভুল সাঁটলিপি।

ঝিলমিল,
আমাকে জানতে জানতে আর নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে
তোমার যখন খুব ইচ্ছে হবে আমাকে একবার ছুঁয়ে দেখবার-
তোমার যখন খুব ইচ্ছে হবে আমাকে একবার স্বচক্ষে দেখবার;
দেখতে আমাকে পাবে না তুমি- চোখের তারায় আমি আর নেই।
আমাকে আরও আরও পড়বার নেশা তোমাকে যখন পেয়ে বসেছে
আবার যখন পড়তে যাবে আমাকে – পারবে না।
আমার সুন্দর মুখটি দেখতে না পেয়ে-
চোখের ত্রিসীমানায় আমাকে না পেয়ে-
ততদিনে তুমি খুইয়ে ফেলেছ চোখের জ্যোতি।

চোখে চুমু খেয়ে বলি, ভয় নেই ঝিলমিল-
এই পর্যায়ের ভিতর দিয়ে আমাকেও হয়েছে যেতে-
অন্ধ আমিও হয়েছি বহুবার;
আলোর দেখা আমিও পাইনি বহুবছর।
চোখ ছাড়াও আমাকে তুমি পড়তে পাবে।

ঝিলমিল,
এই পর্যায়ে তুমি শিখে গেছো একটি বিশেষ পদ্ধতি-
পর্যায়ের নাম অনোপসিয়া, পদ্ধতির নাম ব্রেইল।
তুমি শিখে গেছো সাঁটলিপি- তুমি শিখে গেছো ব্রেইল;
এসো প্রিয়, এবার পড়ো আমাকে,
এসো প্রিয়, এবার আমাকে তুমি অভ্যেস করে নাও।
এসো প্রিয়, এবার আমার বুকে এসে পড়ো তুমি,
তোমার বৃদ্ধকাল কেটে যাচ্ছে অনায়াসেই-
বিশ্বাস করো ঝিলমিল,
আমার যৌবনও হয়ত এতটা মসৃণ ছিল না।

জাহিদ অনিক
(ছবিতে আমাকে দেখা যাচ্ছে নৌকার শেষ মাথায়, পড়ন্ত বিকেলে মেঘনার বুকে)
(২৩ শে অক্টোবর, ২০১৮)

অনন্যোপায়

হাতের খপ্পর থেকে এক ঝটকায় যে কব্জিটা’কে ছাড়িয়ে নেবে
তারপর———
হাঁপাতে হাঁপাতে পিছনে ফিরে দেখবে- কেউ পিছু নিয়েছে কিনা;
এত বেশুমার সাহস কোথায় তোমার!
ভয় হয়? তাই না? আর যদি ফিরে না ডাকি!
বেসামাল তুমি পারবে নিজেকে সামলে নিতে?
মূলত আমার থেকে দূরে গিয়ে বাঁচার তেমন কোনো অবকাশ নেই তোমার।

ধর্মঘটের দিনগুলোতে –
পায়েচলা পথ ধ’রে যতদূরে হেঁটে যেতে চাও
যেতে পারবে? একলা একা?
বাস নেই- অটো নেই— ট্রাম নেই- মেট্রো নেই,
এমনকি আমার পা’য়ে যে পা মিলিয়ে হাঁটবে
সেই আমিও যদি না থাকি? হাঁটতে পারবে তো?
ধরনি ছাড়া হাঁটতে জানো তুমি?
এলোমেলো অবিন্যস্ত- পেঁচিয়ে যাবে না পা?
মূলত আমাকে না ধ’রে- না ছুঁয়ে হাঁটার কোন সুযোগ তোমার নেই।

যদি আমাকে পেতে চাও গরমে তুলে রাখা মোটা কাপড়ের মত
শীতে পেতে চাও ভাঁজ খোলা সুগন্ধি মাখা গরম গাউনের মত;
জানবে তুমি-
অতটা নমনীয়, সুগন্ধি মিহি মখমল আমি নই;
কিছুটা আমি রুক্ষ- চুলে মধ্যে নাক ডোবালে খুঁজে পাবে উৎকট মেছো গন্ধ;
আমাকে ভালোবেসে নাও যেমন আমি আছি- ছিলাম-থাকব।
ঘষেমেজে নিজের মত করে পেতে চাইলে আমাকে আর পেলে কোথায়?
কেননা এই সত্য জেনে ও বুঝে গেছ তুমি –
মূলত আমাকে ভালো না বেসে আর কোন উপায় নেই তোমার।


ছবিঃ Pinterest
২৮ শে অক্টোবর, ২০১৮

পর্ণমোচী

একটি বৃক্ষ আঁকতে গেলে এঁকে ফেলি প্রেমিকার মুখমণ্ডল
শিকড় যেভাবে কামড়ে ধ’রে মাটিকে-
আমাকেও সে জড়িয়ে রাখে আষ্টেপৃষ্ঠে।

প্রথম অঙ্কুরোদগম; দ্বিবীজপত্রী বলতে বুঝি
প্রেমিকার সিক্ত দুটি ঠোঁট।
আমার প্রেমিকা গাছটি’র নাম দিলাম চিরহরিৎ নিম;
ঔষধি চিরুল তাঁর ঠোঁট ভয়ানক তিক্ত-
গা’য়ে মাখি না ভয়ে
আশঙ্কা; অসুখ যদি যায় সেরে!

পূর্ণিমা তিথিতে-
জোয়ার আসে নীমে’র শরীরে আমার
আমি সিক্ত হই তেতো জলে-
হ্যাঁচকা টানে পরিণীতা’র শরীর থেকে ভেঙ্গে নিয়ে হাত
আমি তাড়াই জলবতী মেঘ।

প্রেমিকার কপাল-জমিন যেন প্রকাণ্ড আকাশ;
সেখানে চুমু খায় চাঁদে’র মত এক লাল টিপ।

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮
ছবিঃ pinterest থেকে নেয়া।

পরিবৃত

আমাকে যখন ভালোবাসো তুমি – তোমার সর্বস্ব দিয়ে
আমি তখন আশু দিন গুনি- ভয়ে থাকি সর্বস্ব হারানোর;
আমার চুলে তুমি যখন খেলা করো মেয়েলী আঙ্গুলে-
ইঁদুর বিড়াল খুঁজে বেড়াও চুলের অভ্যন্তরে
আমি তখন তোমার সিল্কের আস্তিনে হাত ঢুকিয়ে
খুঁজতে থাকি বুকের হৃৎস্পন্দন!

তোমার যখন প্রেম চলে আমার সাথে – বর্তমান সময়ে
আমি তখন অতীতে;
প্রাক্তন প্রেমিকার কোমরের মাপের সাথে মেলাতে থাকি তোমার কোমর;
একইরকম নাভি ছুঁয়ে শিহরিত হই।।
তুমি যখন আমাকে ফেলে যাবে ভবিষ্যতে-
তখনো আমি ফিরে যাব অতীতে-
কে থাকবে আমার তখনকার অতীতে? বর্তমানের তুমি নও তো?

অতীত ও বর্তমানের এই খামখেয়ালী খেলায়
তোমাকে ছেড়ে আমার আর অবসর কোথায় – ভবিষ্যতের ভাবনা কিছু ভাবি!
আমার উদ্বায়ী ত্রিকাল অকালে উবে যায়- তোমার ঘাঢ় আচ্ছন্ন নিঃশ্বাসে।

২২ শে অক্টোবর, ২০১৮

অবকাশ

হুইসেল মিলিয়ে যাওয়া ইথার তরঙ্গে-
উত্তরের হিমেল হাওয়ায় সাথে পাল্লা দিয়ে চলে – রাতের অন্ধ ট্রেন।
হাতঘড়ির ডায়ালে তির্যক কাটায় কিসের যেন বিমুখী টান-
একটা ট্রেন যেন চলে যাচ্ছে বুলগেরিয়ান কুকুরের টানে স্লেজ গাড়ি হয়ে-
অনেকটা সময় ধরে থমকে আছে সময়।

হল রুমের ছাদ ফুঁড়ে মাথার উপরে ঢাউস ছাদ-
পায়চারি করা ব্যালকনি ধ’রে প্যাঁচানো সাপের মত সিঁড়ি;
ক্রমশ নেমে গেছে স্পোর্টস রুম থেকে ডাইনিং বরাবর।
কেরোসিন স্টোভে তেলের দম ফুরিয়ে গেলে পোর্চের বাতিটা এত আশ্চর্য সুন্দর লাগে –
আলোর নিচে একদল পোকা কী এত জীবন খুঁটে খায়?
কই আগে তো সেভাবে নজরে আসে নি!

অবকাশ যাপনে এসে এই প্রথম খেয়াল করলাম-
রোদ চশমার প্রয়োজন এখন আর নেই তেমন: হেমন্ত আসি আসি।
সন্ধ্যা নামতেই জলের কলে জমে শিশিরের ফোঁটা।

ছোটখাটো পোকারা অনেক খেয়েছে আলো;
এবার কি তবে সত্যি সত্যি যেতে হবে ফিরে?
ব্যস্ততা, তুমি ফিরে যাও তাসমানিয়া কিংবা আন্দামান;
আসছে তীব্র শীত।

[দিনকয়েক আগে অবকাশ যাপেন রাজশাহী গিয়েছিলাম, ছবিটি মুঠোফোন দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জোহা চত্বর থেকে সন্ধ্যার পরে তুলেছিলাম। ]

অক্টোবরে ১৫,২০১৮

নিপাতন

কে বলে তুমি চাঁদ?
তুমি এক নক্ষত্র
তুমি এক অশুভ অশ্লেষা;
তোমাকে কেন্দ্র করে আবর্তন আমার।

তুমি ঘূর্ণি- তুমি বহ্নি
তুমি আত্মবিমুখী *বলে;
কেন্দ্রমুখী **বলে
আমার পতন তোমার কোলে।


ফুটনোট-
* বলে= কারণে, জন্যে
** বলে= Force, Velocity

#মিথোজীবিতা

তর্জনী উঁচিয়ে মুখের যেখানটা’য় ঠেসে ধরলে চুপ হয়ে যাওয়া বোঝায়-
ঠিক সেখানটায়; উপরের ওষ্ঠে তোমার প্রথম খাঁজ।
কিছুটা বাঁকা- কিছুটা রুক্ষ;
শীতে ফেটে যাওয়া ক্ষত যেন উপশম নেই – যত্ন আত্তি নেই অনেকদিন।
নিজ ওষ্ঠাধর কখনো ছুঁয়ে দিয়েছ আঙ্গুলের ডগায়?
ওটা যেন বর্ষার জল গড়িয়ে চলার অগভীর স্রোতস্বিনী।

যেমনটা তুমি চাইতে কামিজের দর্জির কাছে-
পিঠের দিকে কিছুটা উঠতি – পেটে ঘাটতি – কোমরে ঈষৎ বাড়তি
ঠিক সেরকম মানিয়ে যাওয়া আঁটসাঁট মাংসল অধর-ওষ্ঠ;
খুঁজে পাবে কেবল আমার ঠোঁটেই।
এসো প্রিয়া দমবন্ধ চুমু খাও-
আমাকে বশ করো –
তুমি জানো, আমার আচ্ছন্নতা কেবলই তোমার ঠোঁট।

এসো পুষ্পপত্র, টুপটাপ চুপ করিয়ে দাও আমাকে;
পোড়া অধরে ঠেসে ধরো তর্জনী।
এসো হংস-চঞ্চু, আমাকে খুঁড়ে খাও-
এসো অরণ্য, নিজেকে নিরাভরণ করো আমার অভ্যন্তরে,
তোমার গহীনে টেনে নাও আমাকে-
এসো সীমান্তিনী, অতটা দূরে নয় –
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়;
স্ব-স্ব অস্তিত্বে বাঁচি মিথুন মিথোজীবিতায়।


জাহিদ অনিক
১৭/১০/২০১৮

না-পুরুষোচিত

অকস্মাৎ নিজের কথা ভাবতে বসলে-
টের পাওয়া যায় বিশ্ব ছোট হয়ে গেছে,
একজন পুরুষের জীবন অতটা বিশাল নয়
যতটা চওড়া তার বুকের মাপ হয়ে থাকে।

পুরুষকে ভালোবাসা দিতে শিখে নাও
কেননা পুরুষ কুকুরের মত;
আধাবেলা ভালোবেসে দ্যাখো-
আজীবন তোমায় রেখে দিবে চোখের কোণে।

জ্বর

জ্বর এলে মনে পড়ে-
কলা পাতা- মাটির হাড়ি –
খান-পাঁচেক আঙ্গুলে বিলিকাটা মাথা;
শাল-দুধ ভেবে চোষা পারদের বাল্ব।

শিশু’র নাক চেনে মা’র গা’র গন্ধ-
চেনাচেনা মেছো-মেছো;
পরিণত বয়সে জ্বর হলে –
কপাল চেনে- ঘেঁষে থাকা অচ্ছুত হাত।

অন্তরে দহন হলে –
অসুখের নাম জ্বর নাকি জল?

—————-
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নারী

একজন পরিপক্ব নারীর সামনে
নিজেকে মনে হয় যেন কর ফাঁকি দেয়া ঋণখেলাপি-
কোথায় যেন – কিসে যেন –
রয়ে গেছে এক আজন্মের ঋণ।

পূর্ণবতী নারীকে আমার ‘নারী’ বলতে ভয় হয়,
তক্কে তক্কে থাকি কখন একটু ‘নারী’ বলে একান্তে ডাকতে পাব!
তাকে তাই ডাকি পরিপূর্ণ চাঁদ-
তাকে ডাকি রাত্রির বুকে জলের ছলাৎছল।

সৃষ্টি প্রজাতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর –
সবচেয়ে আরাধ্য –
প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে আমি ভয় পাই;
না থাকে তার কিশোরীর চপলতা
না থাকে বৃদ্ধার স্নেহ-
না সে ভালোবাসে – না করে সে অবহেলা
না টানে কাছে- না ঠেলে দূরে।

আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ,
সবকিছু ডুবে যায় এক প্রাপ্তবয়স্কা’র চোখ সমুদ্রে।
—————————–

কবিতা- জাহিদ অনিক
ছবিতা- শায়মা আপু

মন খারাপের আদ্যোপান্ত

সাধারণত মন খারাপ হলে কবিতা লিখি-
কবিতায় একটা সম্যক্‌ ধারনা লিখে রাখি,
দশ বছর পরেও যেন পড়লে বুঝতে পারি-
ঠিক কেন এবং কি কি কারণে মন খারাপ হয়েছিল।
আর কেউ বুঝবে না, অনেকটা শর্ট হ্যান্ড নোটের মত।

আজও আমার মন খারাপ- ভীষণ খারাপ।
অথচ আজ কবিতায় টুকে রাখবার মত কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না
এই ধরনের অনাহূত মন খারাপকে যদিও পাত্তা দিতে নেই-
তবুও আমি দিব, কারণ আজ আমার মন খারাপ।

আমার অন্যান্য মন খারাপগুলো শুনতে মন খারাপ হলেও,
ওরা আসলে খারাপ না অতটা।
আজকের মন খারাপটা প্রচণ্ড খারাপ,
এতটাই সে হিংসুটে ও বিশ্রী যে আমাকে বলবেও না।
আমিও বেশ শুনব না ওসব। –
যেচে কারও মন খারাপের গল্প শুনতে নেই-
নিজেরটা তো নয়ই।

গতবার যখন মন খারাপ হল, সেটার স্থায়িত্ব ছিল দুই দশমিক আট সেকেন্ড-
উৎপত্তিস্থল ছিল বুকের ঠিক মাঝখানে- একদম সিধা মন বরাবর।
মনো-মিটারে তার মাত্রা ছিল ছয় দশমিক দুই-
জিওমেট্রি ত্রিকোণমিতি – অক্ষাংশ দ্রাঘিমা; এসব আমি বুঝি-
অথচ আজকের মন খারাপের উৎপত্তিস্থল ঠিক খুঁজে পাচ্ছি না-
কখনো মনে হয় মন থেকেই মন খারাপ,
কখনোও বা মনে হয় – নাহ !
মন খারাপ কি কেবল মনের থেকেই হয়?
হাতের, বুকের পেটের এবং ঠোঁটের জন্যও হতে পারে।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এই মন খারাপের কোণ কারণ নেই-
অকারণ এই বিলাসিতায় ভেসে যেতে চাইলে অবশ্য যাওয়া যায়-
যাওয়ার আগে কবিতায় লিপিবদ্ধ করে যেতে হবে-
মন খারাপের বিস্তারিত কারণ- উপসর্গ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা।
ফিরে এসে একলা এক সদস্যের তদন্ত কমিটি বসাতে হবে-
সুরতহাল রিপোর্ট দাখিল করতে হবে মন খারাপের কবির কাছে-
কবি হয়ত হতে পারে কারও ঘরের সাঁজবাতি-
কিন্তু কখনো সখনো সে তো সাইকিয়াট্রিস্ট –
পারবে অন্য কোন কবি- ভালো করে দিতে আমার অকারণ মন খারাপ?

———————————–
@জাহিদ অনিক
২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮

কবি অথবা সার্কাসের জোকার

কবিতা সবার পড়ার দরকার নাই। আমি অনেককে চিনি জানি যারা স্কুলের বই ছাড়া আর কোন কবিতা পড়েন নাই এবং তারা দিব্যি ভালো আছেন। আমার থেকে ভালো আছেন। তাই, সকলের কবিতা পড়ার দরকার নাই। সাধারণ পাঠকের কোন দায় ও দরকার নাই কবিতা পড়বার। কবিতার যে অত গভীরতা সেটা আর কে বুঝবে কবি ছাড়া। সত্যি কথা বলতে, আমি কিছু কিছু কবিতা সাধারণ পাঠকের জন্য লিখি না। কেবল কবিদের জন্যই লিখি। আমার তো মনে হয়, যিনি কবিতা লিখেন একমাত্র তিনিই কবি নন, যিনি কবিতা পড়তে জানেন তিনিও কবি। কেননা, সবাই কবিতা পড়তেও জানেন না।

কবিতার মধ্যে বিষণ্ণতা থাকে, কিন্তু যখন আমি লিখছি তখন আমার মন ভালো থাকে। কবিতার এই দ্বি-মুখী আচরণটা তো একজন সাধারণ বা গণ পাঠক ধরতে পারবেন না। ধরতে পারার কথাও না। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কয়েকটা লাইন পড়ার পরে আমার যদি মনে হয় এই বিচ্ছেদটা আমার, কবি আমার জন্যই লিখেছেন; তাহলে সেটা পাঠ করে আমি আমার তৃপ্তি টুকোই কেবল পাব। কবি যে সত্ত্বা থেকে লিখেছেন সেটা পাব না। সেটা পেতে হলে আমাকে কবিতার মধ্যে ঢুকে যেতে হবে, কবিতার শব্দ অক্ষর অলিগলি ঘুরে পৌঁছে যেতে হবে রবীন্দ্রনাথের বেডরুমে। লাবণ্যকে বিদায় জানিয়েছে অমিত, কিন্তু সেই অমিতকে ধারণ করতে কবির যে কষ্টটা হচ্ছে সেটা অনুভব করতে হবে।

ডেসডিমোনাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার পরে ওথেলো তো আত্মহত্যা করে মুক্তি পেয়ে গেল কিন্তু দুই দুইটা খুন করে শেকসপিয়রের যে অপরাধ-বোধ নেই সেটা কে বলবে? সেই যন্ত্রণাটা অনুভব করতে হবে না প্রিয় পাঠক?
প্রেমের কবিতা যিনি লিখেন তিনি নিজে কতটা অপ্রেমে আছেন সেটা আগে অনুভব করতে হবে-
ক্ষুধার কাব্য যিনি লিখেন তিনি নিজে কতদিন না খেয়ে থেকেছেন- কত রাত তিনি নিজে জল খেয়ে কাটিয়েছেন সেটাও জেনে নিতে হবে। সাহিত্য বিচার লেখা বই না নভেল দিয়ে করা হলেও লেখকের ব্যক্তিগত জীবনকে উপেক্ষা করা একেবারেই উচিত নয়।
সবাই যদি বলেন যে,
কবির ব্যক্তিগত জীবন অচ্ছুত অস্পৃশ্য; ওটা ছোঁয়া যাবে না– তাহলে ঐ বেচারা কবিকে মরতে হবে না খেয়ে, প্রেমের কবিতা লিখতে হবে প্রেম না করেই। মৃত্যুর পরে তোমরা ব্যবচ্ছেদ করলে করবে- তোমাদের কৃপা।

রবীন্দ্রনাথ এত যে প্রেমের গান লিখেছেন তিনি নিজে কতটা প্রেম পেয়েছেন সেটাও ভেবে দেখতে হবে। কিংবা তিনি এই যে এত প্রেম পেয়েছেন, সেগুলো সত্যিই কি প্রেম? ঠিক তিনি যে রকম প্রেম চেয়েছেন সেই রকম প্রেম? মনে তো হয় না। পেলে আর এত কেন লিখবেন? যেটা পাওয়া যায় না সেটাই চাওয়া হয় কবিতায় গানে।
বলা হয়ে থাকে যে, বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথ একই সাথে সর্বস্ব ও সর্বনাশ—
সর্বনাশের মাথায় বাড়ি দেয়ার আগে অবশ্যই অবশ্যই ভাবতে হবে সর্বনাশটা যে হলো, কেন হলো? এত আকুতি আর কারও গানে নেই কেন? রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল-সংগীত, লালনগীতি এরপরে আমরা আর কোন গীতির নাম শুনি না কেন?
আমাদের চাহিদা কি তবে মিটে গেছে? কে মিটিয়ে দিয়ে গেল?
আমার দেখা দশ জন কবির মধ্যে আট জন কবিতা লিখতে চান না। তারা এককথায় শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে লিখেন। এবং সেগুলো গার্বেজ ছাড়া আর কিছুই না।

এইবার, কবির কথা বাদ দিলে আমাদের কথা অর্থাৎ পাঠকের কথা ভাবতে হয়।
পাঠক কারা? যারা পড়েন তারা সবাই কি পাঠক?
যিনি দুই-চারটা কবিতা লিখে ফেললেন তিনিই কি কবি? হাজার হাজার কবিতা লিখে রেকর্ড করতে পারলেই কি তিনি কবি?
ধরুন, কোন একটা কারণে আপনার মনটা বেশ ভারী হয়ে আছে। একটা খাতা কলম টেনে কয়েকটা লাইন লিখলেন। তারপর আপনার মনে হলও যে, “নাহ ! খারাপ হয়নি”।
খারাপ যে হয়নি সেটা তো আপনিই বুঝলেন, কিন্তু কি হয়েছে সেটা কি জানেন? আপনি কি এটাকে কবিতা বলেই ভেবে নিয়েছেন? যদি ভেবে নিয়ে থাকেন, তাহলে আপনার এই কবিতার পাঠক হবে তারাই যারা ঐভাবেই নিজেদের পাঠক ভাবেন।
আজকাল এই যত্রতত্র কবি গজিয়ে ওঠার দায় আর কারও নয়, কেবল ও একমাত্র পাঠকের।

কবিতা তো আসলে চাইলেই কেউ লিখে ফেলতে পারে না, সেটা একটা নিজস্ব কিছু, নিজের মধ্যে ধারণ করার মত।
সবাই প্রেম করছে – প্রেমিকা নিয়ে হাত ধরে ঘুরছে তাহলে আমারও একটা প্রেম করা দরকার; এটা ভেবে নিয়ে কাউকে ভালোবাসার কথা বললে সেটা যেমন শুধু প্রেমই হবে ভালোবাসা হবে না, তেমনি সবাই লিখেছে বলে আমিও লিখব এবং খারাপ তো লিখছি না, এটা ভেবে লিখলে আসলে সেটা সত্যিই হিজিবিজি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
ভালো যেমন সবাই বাসতে পারে না, দুই একজন পারে। বাকীরা প্রেম করে, রিলেশনশিপ করে। তেমনি কবিতাও সবাই লিখতে পারেন না, এক আধজন পারেন বাকীরা খিস্তিখেউড় করেন।

কবিতা কেন লিখতে হয়, কিভাবে লিখতে হয়, কতটুকু লিখতে হয় এসব যেমন ভাববার কোণ বিষয় নয়, তেমনি না ভেবেও লেখা উচিত না। আপনি আপনার কবিতার আয়ু কতটা চান সেটা আপনার ফুসফুসের দমের উপরেই নির্ভর করে।

এত এত কথা কেন লিখলাম সেটা একটু বলা উচিত। আমার এই বালখিল্য-পনা তো কেউ শুনতে বা পড়তে চায় নি। অনেক গার্বেজ তো লিখে ফেলেছি। আসলে এতকিছু লিখলাম কারণ, প্রায় দুই দিন ধরে একটা কবিতা লেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ফলাফল লবডঙ্কা।

আপনারা যারা বই-টই বের টের করছেন, তারা একটু বলবেন, কার পয়সায়? নিজের নাকি প্রকাশকের?
আমি তেমন বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কবিতা লিখি না। লেখালেখি করে দেশটাকে পালটে দেয়ার মত মহৎ কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি লিখি কারণ আমার লিখতে ইচ্ছে করে। মন খারাপ থাকলে লিখি, মন ভালো থাকলেও লিখি।
আপনারাও লেখেন, আপনাদের লেখাগুলো পড়ি। ভালো লাগলে জানাই। ভালো না লাগলেও মাঝেমধ্যে জানাই।
আপনারাও আমার লেখা পড়েন, ভালো লাগলে হাতে তালি দিবেন আর খারাপ লাগলে জানাবেন- সার্কাসের জোকার না হয়ে আর থাকতে পারলাম কই?


পুনশ্চঃ কবির মাহাত্ম্য দেখাতে গিয়ে এখানে সার্কাসের জোকারকে কোনভাবেই হেয় করা হয়নি। কেবল সঙ সাজা যে কবিদের সাজে না সেটাই লেখা হয়েছে। ক্লাউন নিশ্চয়ই একটি অন্য প্রাণ। জোকারের মূল্যও কোনো অংশেই কম নয় ।

————————-
কবি অথবা সার্কাসের জোকার
@জাহিদ অনিক

প্রলাপ

এই যে এত দেখি জীবিকা হরদম –
কোথায় বলো জীবন থাকে? কোন অববাহিকায়?
হাতের তালুতে যেখানে রয়েছে প্রাণ;
জানো কি থাকে সেখানে?- আয়ুরেখা।

এসো জীবন,
আমাকে করো প্রত্যাখ্যান-
ধারণ করো রুদ্রমূর্তি,
বিচ্যুত মেঘ উড়ে যাক অবকাশে-
হৃদয়ে বাজাও বিদায়ের সুর।

ফুরিয়েছে আবেদন-
এই তবে হোক নিবেদন,
আসো নক্ষত্র, কাটাকুটি খেলি-
পরিণত পর্যায়ে সংলাপ হয়ে যাক প্রলাপ।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮