মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

কাল পরীর সমাধি-২/৮

tumblr_lvhn1c6LB21qblyj6o1_1280
২।

ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে ২৫০ কিমি পশ্চিমে এই আরযো গ্রাম। গ্রাম ঘেঁসে আদ্দিস আবাবা থেকে আসা কাঁচা রাস্তা নিকেমতা এবং গেতেমা হয়ে বেদেলের দিকে চলে গেছে। গ্রামের একেবারে দক্ষিণে দেদেসা নদীর খুব কাছেই ওবির বাড়ি। বুনো ঘাসের ডাটা এবং শণ দিয়ে ছাউনি দেয়া গোলাকৃতির মাটির দেয়ালের বেশ কয়েকটা ঘর। আরামে থাকার জন্য ঘরের চালের নিচে ঘাসের পুরু আস্তর দিয়ে সুন্দর করে ছেয়ে দেয়া। মাটির মেঝে সুন্দর করে লেপা মোছা। এই এলাকায় ঘরের দেয়াল ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বানায়। শীত গ্রীষ্ম থেকে রক্ষা পাবার জন্য কোথাও মাটির দেয়ালের ভিতরে ঘাসের আস্তর দিয়ে দেয় আবার কোথাও কাঁচা মাটির ইট বানিয়ে সেই ইট গেঁথে দেয়াল বানায়। এমনি এক ঘরে ওবি এবং তার স্ত্রী রামলা থাকে আর এক ঘরে থাকে ছেলে আবেল। অন্য ঘরগুলিতে ফসল বা সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় মালামাল থাকে। আবেল এখন বড় হয়েছে। বিয়ে করে বৌয়ের কাছে চলে যাবে কিন্তু আবেল তার মনোমত পাত্রী খুঁজে পাচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের গোত্রের মধ্যেই এদের বিয়েশাদী হয় তবে যদি ভিন্ন কোন গোত্রের ছেলে বা মেয়ের কাউকে পছন্দ হয় তাহলে সে ছেলে ওই মেয়ের বাবা মাকে প্রস্তাব পাঠাতে পারে এবং কেরেল বা মিনার (প্রেমিক প্রেমিকা) এর বাবা মা এবং মোড়ল যদি সম্মতি দেয় তাহলে সে বিয়ে হতে পারে। সাধারণত মোড়ল খুঁজে দেখে ওই গোত্রের বা গ্রামের সাথে এদের সম্পর্কটা কেমন। যদি বিগত দুই চার পুরুষের মধ্যে কোন দাঙ্গা হাঙ্গামার ইতিহাস না থাকে তাহলে মোড়ল আপত্তি করে না।

আবেল গতবছর তুলা বীজ বা কাটোনসাদ আনার জন্য গাধার পিঠে বসে বনের সিংহ বা অন্যান্য জীব জন্তুদের এড়িয়ে ঘুরা পথে বেদেল হয়ে আটনাগো গিয়েছিল। ওখানকার তুলা বীজ বেশ ভাল তাই বছরে অন্তত একবার আরযো গ্রামের বাসিন্দারা তুলা বীজ কেনার জন্য ওখানে যায়। এই এলাকা আবার একটু ভিন্ন রকম। এখানে বুন্না বা কফি চাষ হয় কিন্তু আখের চাষ খুবই কম। বাড়ির ঘরগুলি ঢেউ টিনের ছাউনি দেয়া, মাটির দেয়াল এবং কাঠের দরজা জানালা, মাটির মেঝে। এখানকার গৃহস্থের অবস্থা আরযো গ্রামের চেয়ে ভাল। এখানে বুন্না চাষ হয়। বাইরে বুন্নার দাম বেশি, আখ দিয়ে এলাকার ঘরে ঘরে কালা কাটি বা বিয়ার (হালকা এলকোহলিক পানীয়) তৈরি হয়।
আবেল আটনাগো গ্রামে বুজিবার বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছল তখন বেলা পড়ে এসেছিল। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হয়নি বলে দিনটা ছিল বেশ গরম। ওই এলাকার রীতি অনুযায়ী বাড়ির যুবতী বড় মেয়েকে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়। আবেল এসে সামনে এক যুবতী মেয়েকে দেখে জানতে চাইল
বুজিবা কোথায়?
বাবা বাড়ি নেই।
তুমি কোথা থেকে এসেছ, কি জন্যে তাকে খুঁজছ?
আমি আরযো থেকে এসেছি, তুলা বীজ নিতে, আমার নাম আবেল।
ও আচ্ছা
বলে বুজিবার মেয়ে মালাইকা জল চৌকির মত একটা টুল পেতে দিল।

তুমি বস আমি আসছি। আবেলকে দেখেই মালাইকার মনে হলো এই সেই পুরুষ যাকে সে এতদিন ধরে খুঁজছে, তাদের এই গায়ে এমন সুপুরুষ আর নেই। যেমন মেদহীন কঠিন চেহারা, তেমনি পেশী, মাথায় ঘন কাল কোঁকড়ান চুল, কুচকুচে কাল গায়ের রঙ দেখতে একেবারে কাটা বাবলার গুড়ির মত। সন্ধ্যা বেলায় এসেছে েখন আবার অত দূরে যাবে কি করে? অতিথিকে আজ এখানে রাতে থাকতে হবে কাল সকালে যাবে এবং এই ব্যবস্থাই করতে হবে। মালাইকা মনে মনে এমন একটা বুদ্ধি এঁটে ফেলেছে। একটু পরে এক হাতে বুন্নার পেয়ালা আর আর এক হাতে পাতার তৈরি পাখা নিয়ে এলো। মালাইকার মা কালিশা এসে দেখে গেল কে কি জন্যে এসেছে। মালাইকার পরনে জংলা ছাপার পেটিকোট আর গায়েও তেমনি ব্লাউজ কিন্তু এই সামান্য ব্লাউজে টগবগে যৌবন কিছুতেই বাধ মানতে চাইছে না। গলায় এবং হাতে নানা রকমের মালা। মালাইকার চেহারার দিকে তাকিয়ে আবেল থেমে গেল। সাক্ষাত কাল বন পরী। গোলগাল ধরনের ঝিম কাল চেহারার মধ্যে সাদা চোখ আর সাদা দাঁত যেন মুক্তার মত চিকচিক করছে। পুরু ঠোট। স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী মাথার চুলে অনেকগুলি চিকন বেণী দিয়ে পিছনে খোপা বাধা, তাতে আবার ছোট ছোট শামুক এবং কড়ির মালা জড়ান। এমন রূপ আবেল জীবনে দেখেনি। গলার মালায় একটা কুমিরের দাঁত আছে। এর মানে হলো সে কোন শক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। রূপের সাথে শক্তি! অবাক হবার মত কথা। এই মেয়ে কি কারো বাগদত্তা? এ কাকে বিয়ে করে সংসার করবে? কি ভাবে সে জানবে এই কথা? কি করে তার মনের কথা একে জানাবে? মুহূর্তের মধ্যেই আবেল ঘামতে শুরু করল। সারাদিনের পথের ক্লান্তিতেও আবেল এতটা ঘামেনি।

মালাইকা লক্ষ করে বলল
নাও আতো, বুন্না (কফি) খেয়ে জুরিয়ে নাও তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে
আবেলের হাতে বুন্নার মাটির পেয়ালা ধরিয়ে দিয়ে পাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছে। মালাইকাও এমন শক্ত সুঠাম পেশীবহুল পুরুষোচিত চেহারা দেখে সেই থেকেই বারবার দেখছে। এমন পেশী যার তার সাথে নির্ভাবনায় এক সাথে এক চালের নিচে দুইজনে মিলে জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। সন্তানেরাও এমনি হবে। আলাপ করতে হবে। একে হাতছাড়া করা যাবে না। যেমন করেই হোক আটকাতে হবে।
কেমন আছ? পথে কোন অসুবিধা হয়েছে?
না তেমন কোন অসুবিধা হয়নি।
তুমি কি শুধু বীজ নিতেই এসেছ? এর আগে তো তোমাকে কখনও দেখিনি!
আগে বাবাই আসত। হ্যাঁ, বাড়ি থেকে এজন্যেই বেড়িয়েছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আরও কিছু নিতে হবে!
আর কি নিবে? আমাদের এখানে শুধু তুলা বীজ ছাড়া আর কিছু নেই!
আবেল ভাবল কেন সুন্দরী তুমি আছ না? তোমার জন্যেই আমি এসেছি।
আচ্ছা ওইজিরিতি, তোমার নাম কি?
আমার নাম মালাইকা।
মালাইকা!
আবেল জানে মালাইকা মানে পরী। তাহলে সে ঠিকই ভেবেছে! তার ভাবনায় কোন ভুল নেই!
বাহ! সুন্দর নাম!
একটু ভেবে মালাইকার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল
তুমি কি কাওকে কথা দিয়েছ?
এই বয়সের ছেলে মেয়েরা (আতো এবং ওইজিরিতিরা) জানে এই কথা দেয়ার মানে কি।
মালাইকা একটু ভেবে বলল
না
তাহলে আমি তোমাকে প্রস্তাব জানালাম। অযোগ্য মনে না করলে আমার কথাটা ভেবে দেখবে।

প্রস্তাবের কথা শুনেই মালাইকার দেহে মনে প্রাণে একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। আহ! কি প্রশান্তি! আমিতো এই চাইছি।
আবেল কথাটা বলেই তার বংশের কিছু বীরত্ব গাঁথা শোনাল। আর এই যে দেখ আমার গলায়ও কুমির আর চিতার দাঁতের মালা।
এবার বল বুজিরা কখন আসবে?
বাবার আসতে হবে না, মা তোমাকে বীজ মেপে দিবে কিন্তু সে তো কাল দিবে!
কেন কাল কেন?
সে কি! বুঝতে পারছ না? রাত হয়ে আসছে এই অন্ধকার রাতে অত দূরে যাবে কি করে? রাতে এখানে থাকবে কাল সকালে বীজ নিয়ে যাবে।
আর আমি যে বললাম সে ব্যাপারে তোমার উত্তর কখন জানাবে?
এখনই
তাহলে বল
দেখ তুমি তো ভিন গায়ের ভিন গোত্রের আতো
এই পর্যন্ত বলে একটু থামল।
হ্যাঁ বল তাতে কি হলো?
তুমি বাবা মার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারবে?
নিশ্চয় পারব
তাহলে এসো।
আবেল মনে মনে ভীষণ খুশি হলো, এতক্ষণ যে ভয়ে ছিল তার কিছুটা দূর হলো। আবার বলছে রাতে এখানে থেকে কাল যেতে। ভালই হবে আরও কিছু বেশি সময় পাবো ওকে দেখতে। রাতের খাবার সময় কি আর কিছু কথা হবে না? শুধু শুধু রাতে থাকার কথা নিষেধ করবে কেন? তবুও একটু লজ্জার ব্যাপার না! থাকতে বলবে আর ওমনিই থাকতে হবে? সে বাড়ি ফিরে যাবে এমন চিন্তা করেই এসেছে।
আবেল বুন্না শেষ করে খালি পেয়ালাটা মালাইকার হাতে দিতে দিতে বলল
না না থাকতে হবে না, আমি আমার গাধা নিয়ে এসেছি ওর সাথেই চলে যেতে পারব।
তা বললেই কি হয়? অন্ধকার রাতে এই পাহাড়ি পথে একা একা এত দূরে যাবার এমন কি দরকার? তোমার কে আছে? দেখেইতো মনে হয় তোমার কোন প্রিয়তমা নেই!
না, কে থাকবে? কেউ থাকলে কি আমার কথা ভেবে দেখার কথা বলতাম তোমাকে? তোমাকে আমার ভীষণ ভাল লেগেছে মালাইকা। মনে হচ্ছে তোমাকে সাথে পেলে আমি জীবনে খুব সুখী হব।
তাহলে আর যেতে চাইছ কেন? থাক, আজ আমি সিগুই এর মাংস রান্না করছি।
তুমি যেভাবে বলছ তাতে আজ আর যেতে পারছি না, এমনিতেও তোমাদের এখানে খুব ভাল লাগছে। বুন্না ক্ষেতগুলা বেশ সুন্দর দেখতে! তবে তুমিই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। এখন মনে হচ্ছে আজ এখানে না আসলে মস্ত ভুল হতো আমি তোমাকে পেতাম না।
কি যে বল তুমি! তোমরা বুন্নার চাষ কর না?
না আমাদের ওদিকে কেউ করে না।
মালাইকা, তুমি খুবই সুন্দর!
তুমিও
বলেই মালাইকা লজ্জা পেয়ে খালি পেয়ালা নিয়ে আড়ালে চলে গেল।
আবেল নিজে নিজেই মালাইকার রেখে যাওয়া পাখা দিয়ে বাতাস নিচ্ছে। [চলবে]

Abel

কাল পরীর সমাধি-১/৮

Terraced_Mountains,_Tigray_Region,_Northern_Ethiopia_(3134131550)

১।
পাথুরি লাল মাটির পাহাড়ি এলাকায় চারিদিকে তুলা, আঁখ, ভুট্টা আর কিছু কাসাভা সহ অন্যান্য ফসলের জমি এবং নানা আকারের, নানা ধরনের ছোট বড় বাওবাব এবং এলোমেলো ডালপালা ছড়ানো এথাল গাছ সহ অন্যান্য নানা গাছপালা বেষ্টিত হালকা জনবসতি পূর্ণ একটি গ্রাম। গ্রামের নাম আরযো। গ্রামের প্রতিটা বাড়িতেই কলার ঝোপ, কয়েকটা পেঁপে গাছ সহ দুই একটা আম, কাঁঠাল, কমলা কিংবা শ্যরন ফলের গাছ দেখা যায়। সৌখিন কারো বাড়ির পাশে চেরি এবং ডুমুরের গাছও আছে, এমনকি কারো বাড়িতে দুই একটা তেঁতুল গাছও দেখা যায়। বাড়ির আশেপাশে মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা মরিচ, টমাটো, সাদা গোল বেগুন, ফণী মনসা, নানা জাতের ক্যাকটাস ঝোপ দেখা যায়। বেশ সুন্দর গ্রাম। অধিবাসীরা অধিকাংশই অবস্থাপন্ন। কৃষি কাজই এদের প্রধান পেশা। নিজেদের উৎপাদিত পণ্য গাধা কিংবা মহিষের গাড়িতে করে দূরে নিকেমতা নামের ছোট শহরে নিয়ে বিক্রি করে এদের জীবন ভালই চলে যায়। মনে সুখ শান্তির অভাব নেই। প্রায়ই পূর্ণিমা রাতে গানের আসর বসে সেখানে নাচ গান পান সবই হয়।

গলায় সিংহের দাঁতের মালা এবং ঈগল ও বাজ পাখির পালকের মুকুট মাথায় শক্ত চোয়াল আর শক্ত কঠিন পেশির শক্তিশালী যে পুরুষটিকে দেখা যায় সেই ওবি এই গ্রামের মোড়ল বা লিয়ের। গলায় সিংহের দাঁতের মালা পড়া এদের গোত্রের মান মর্যাদা এবং শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক। যার মালায় যত বেশি দাঁত থাকে সে তত শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান লিয়ের। এই দেখেই বোঝা যায় সে কতগুলি সিংহ মেরেছে। গ্রাম থেকে একটু দূরে দক্ষিণ দিকে ছোট দেদেসা নদীর পরেই বিশাল দিগেত বোস বা ঘন জঙ্গল। নদীর পার দিয়ে জঙ্গলের আকৃতি বেশ ঘন, উঁচু গাছগাছালিতে ভরা গাছপালার নিচে মিমোসা ও আঠা গাছের ঝোপ। সাথে আছে শন, নল খাগরা, হোগলা, স্বট এবং আখের মত বেশ বড় বুনো ঘাস প্রায় মানুষ সমান উঁচু এবং অন্যান্য ঝোপঝাড়। তবে নদীর কিনার থেকে কিছু দূরে রুক্ষ পাহাড়ি মরু এলাকা। পাহাড়ের আশেপাশে মসৃন বালু সমৃদ্ধ এর্গ এবং আবার কোথাও ছোট বড় নানা সাইজের পাথুরে এলাকা রেগও দেখা যায়। বাওয়াবাব, এথাল গাছ এবং কাটা বাবলা সহ অন্যান্য বেশ বড় বড় গাছপালা মাঝে মাঝে বনের শোভা বৃদ্ধি করেছে। পাহাড়ের ফাকে ফাকে নিচু অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই বৃষ্টির পানি জমে থাকে। এক দুই মাইল জুরে প্রায়ই এমন জলা ভূমি রয়েছে। এই জলাভূমির চারিদিকেও ওইরকম ঘাস এবং মিমোসা ও হিবিসকাস সহ বিভিন্ন রকমের ঝোপঝার। আশেপাশে কালাও এবং ফিলিকি সহ নানা জাতের পাখপাখালির কিচিরমিচিরে দিনরাত এই সব লেক এলাকা মুখর থাকে। বনে বিশেষ করে সিংহ এবং হাতির সংখ্যাই বেশি, কিছু বুনো মহিষ বা সিগুই আছে আর এর সাথে চিতা, নেকরে, জেব্রা, হরিণ, বানর এগুলি তো আছেই। জঙ্গলের ভিতরে এ রকম অনেক ছোট খাট লেক থাকলেও এখানকার বাসিন্দারা মাঝে মাঝেই সম্ভবত রুচি বদলের জন্য দল বেধে পাশের নদীতে পানি পান করতে কিংবা গোসলের জন্য আসলেও সাধারণত নদী পার হয়ে এপারে আসার ইচ্ছা করে না। তবে কখনও কখনও যে নদী সাতরে গ্রামে আসেই না সে কথা বলার উপায় নেই। এইতো সেবার নদীর পাড়ে আখ ক্ষেতে কাজ করার সময় নুবিয়াকে ধরে নিয়ে গেল। সাথে জিঙ্গো, চিকা, মিন্ডি আর দাগুর স্ত্রী এবং আরও কয়েকজন ছিল কিন্তু কিছুতেই তারা ওই বনের রাজা লিউ বা সিংহটাকে কাবু করতে পারেনি। এছাড়াও মাঝে মাঝে গ্রামের মেঠো পথে বা কারো বাড়ির উঠানে সিংহের পায়ের ছাপ দেখা যায়।

বিশাল এলাকা নিয়ে মাইলের পর মাইল জুরে এই বনভূমি। আরযো গ্রাম থেকে পুবে বা দক্ষিণে কোথাও যেতে হলে এই বনের মধ্যে দিয়ে গেলে পথ অনেক কমে যায়। মাত্র দুই মাইল পথ হেটেই ওপাশের কোসি গ্রামে যেতে পারে। তবে উত্তরে বা দক্ষিণে বনের প্রশস্ততা অনেক, প্রায় দশ থেকে বিশ মাইলের মত। শুধু ওই জায়গাটা সরু। বনের পশু এবং গ্রামবাসীরা যাতায়াত করতে করতে মেঠো পথের মত হয়ে গেছে। কিন্তু একা একা এই পথ কোন অবস্থাতেই নিরাপদ নয়। দল বেধে যেতে হলে সবাই এই পথেই যায়। কোসি গ্রাম থেকেও যখন লোকজনেরা কোন কাজে এদিকে আসে তখনও তারা এই ভাবেই দল বেধে আসে। সাথে থাকে নানা রকম অস্ত্র এবং মশাল। দমন করা যাবে না এমন জীবের সামনে পরলে মশাল থেকে আগুন নিয়ে নরম ঘাসের গোলা বাধা তীর ছুড়ে দেয় পশুর দিকে। আগুন দেখে ওরা দূর থেকেই বুঝতে পেরে ভয়ে আর কাছে আসে না। বুনো পথে চলাচলের জন্য এদের জানা আছে প্রচলিত নানা মন্ত্র। সাথে যে মোড়ল থাকে সেই প্রধানত মন্ত্র আওড়ায় এবং সঙ্গীরা তার সাথে সুর মিলিয়ে পথ চলে। বনের ভাষা এরা বুঝতে পারে। কোথায় কোন শব্দ হলে সে কিসের শব্দ তা এরা ভাল করেই জানে। সবচেয়ে ভয় হলো সিংহ আর চিতা নিয়ে। এরা বড়ই ভয়ংকর! চিতা গাছে উঠতে পারে এবং নিঃশব্দে চলাফেরা করে বলে আশেপাশে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না বললেই চলে। দৌড়ে গিয়ে যত বড় গাছেই ওঠা হোক না কেন চিতা ঠিক পিছনে পিছনে উঠে পড়ে। সিংহ গাছে না উঠলেও নিচে দাঁড়িয়ে থাকে এবং তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন ব্যাপার। আমাবস্যা পূর্ণিমা রাতে কিংবা মেঘলা দিনে বিচিত্র সব হাঁক ডাকের শব্দ পাওয়া যায়। তার কোনটা প্রিয়কে কাছে আহবান করার ডাক আবার কোনটা ক্ষুধার ডাক কিংবা কোনটা শত্রুর উপর আক্রোশ তা ডাক শুনেই বোঝা যায়। সন্তান হারা মায়ের করুণ কান্নার সুরও বড়ই বিষাদ নিয়ে বাতাসে ভেসে আসে। গ্রাম থেকে নদী পার হয়ে বনে যাবার জন্য ওবির বাড়ির কাছে নদীর ঘাটে একটা আস্ত গাছের গুড়ি দিয়ে বানান ভেলার মত বাঁধা থাকে।

পশ্চিমে গোরে এবং বেদেলে গ্রাম, উত্তরে নিকেমতা, মান্ডি এবং আমতো গ্রামের সাথে মোটামুটি ভাল ভাব আছে। পূর্ব দিকে বেশ অনেকটা দূরে সেনেন, মুতুলু এবং বিলা গ্রাম। পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে ওদিকে খুব একটা যাতায়াত নেই বললেই চলে। আর ওই জঙ্গল পেরিয়ে আরও বেশ দূরে দক্ষিণে আটনাগো গ্রাম। অনেকদিন ধরে কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা বা অপরোর হয়নি। অনেকদিন আগে ওবির দাদা জীবিত থাকতে যখন ওবি ছোট ছিল তখন দেখেছিল মান্ডি গ্রামের সাথে কি ভয়ংকর দাঙ্গা হয়েছিল। মান্ডিবাসিদের সাথে আমতো গ্রামও যোগ দিয়েছিল তবে পার্শ্ববর্তী পশ্চিমের গোরে এবং বেদেলে গ্রাম ওদের পক্ষে এসেছিল। কত মানুষ মরেছিল সে যুদ্ধে তা গুনে দেখা হয়নি। তবে এটুক মনে আছে অনেকেই মরে গিয়েছিল এবং তাদের এনে নদীর কিনারে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়েছিল। ও পক্ষের কতজন মরেছিল তা জানা যায়নি। নানা রকম নানা আকারের সিফ, জাকিতকা (তরবারি, বর্শা), মহিষের শিং বা গিসকা দিয়ে বানান নানা রকমের অস্ত্র এবং আগুনের গোলা আর বিষ মাখা তীর ধনুক কি ভাবে ব্যবহার করতে হয় তখনই ওবি দেখেছিল। তার দাদা তাকে শিখিয়েছিল।
[চলবে]

সামনে আছে শুভ দিন শব্দনীড়ে যোগ দিন

Coffee-Production

বাহবা! বাহবা! দেখিয়া বড়ই প্রীত হইলাম শব্দনীড়ে এখন ১৮ জন নিবন্ধিত সদস্য এবং ৭৯ জন অনিবন্ধিত সদস্য জেগে আছেন। সবাইকে ধন্যবাদ।

কোথায় গেলে ভাই দিলখুশ মিঞা
কোথায় গেলে ভাই আনু মিঞা
কোথায় গেলে ভাই ফকির ভাই
কোথায় গেলে ভাই তোমরা সবাই?
কই গেলা ভাই নীল দিদি
নিয়া আইস দারচিনি!

একটা কথা, সবাই কিন্তু কফি খেয়ে যাবেন দারচিনি দেয়া কফি!

ও গিন্নী (স্বপ্নে দেখা), দেখ কত মেহমান আইছে, সেদিন যে বাগানের কফি তুইলা আনলাম তাই দিয় অন্তত এক হাড়ি কফি বানাও নীল দিদি দারচিনি নিয়া আইব একটুখানি কফিতে দিও আর সাথে এলাচি বিস্কুট দিও। দেরি কইরো না তারা কত কাম কাজ ফালাইয়া আইছে!

রাইতের আয়োজনেও কিছু বাদ রাখি নাই। বইসা পড়েন।

শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ … আমাদের এইসব দিনরাত্রি

যদি কিছু মনে না করেন পোস্টে যারা স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়ে এই পোস্ট সাদরে গ্রহন করে মতামত জানিয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
আজ অফিস থেকে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল বলে আমি সারাদিন কিছু বলার সুযোগ পাইনি। হোটেল শেরাটনের সামনেই ১ ঘন্টা জ্যামে বসে ছিলাম।
অনেকেই নানা নাম প্রস্তাব করেছেন যেমনঃ

মুরুব্বী-
১. আমাদের এইসব দিনরাত্রি
২. বড় মুখে ছোট কথা
৩. ছোট মুখে বড় কথা
৪. ম্যান ভার্সেস ম্যান
৫. চলতি হাওয়ার পরিপন্থী
৬. জীবন যেখানে যেমন
৭. কাজ নয় কথা বেশী
৮. ঘটন অঘটনে ঘটন চক্র
৯. পথ থেকে পথ … গলি থেকে রাজপথ

দিলখুশ মিয়া-
১. গোল টেবিল বৈঠক
২.সাপ্তাহিক আড্ডা
৩.কথার পিঠে কথা
৪.আমাদের ভাবনা
৫.ওমরের জলসা
৬. মুরুব্বীর জলসা
৭. জলসাাঘর

মোকসেদুল ইসলাম
১। ‘আমি কিছু বলতে চাই’

খেয়ালী মন
১। শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ

জনাব ফকির আবদুল মালেক ভাইকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম নাম বাছাই করার জন্য কিন্তু তিনি যেহেতু কুড়ার গোস্ত দিয়ে খেসারি ডাইলের রুটির নেমন্তন্ন খাইতে গেছে কাজেই তার অবর্তমানে আমিই নাম বাছাই করে নিলাম। এতে খেয়ালী মন এর “শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ” এর সাথে মুরুব্বীর “আমাদের এইসব দিনরাত্রি” এই সংমিশ্রণ ঘটিয়ে “শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চ- আমাদের এইসব দিনরাত্রি”

যেহেতু আমাদের চলা পথের নানা ঝুট ঝামেলা, নানা ঘটনা অঘটন, হাসি কান্না, বলা না বলা কথা, কাজের বদলে কথার খৈ ফুটিয়ে চলছে তাই আমি এই নামটি সঙ্গত মনে করেছি।
কী? কেমন লাগছে?
অবশ্য যদি আর কোন উত্তম প্রস্তাব থাকে তবে তা সাদরে গ্রহনযোগ্য।
সবাইকে আবার ধন্যবাদ!
তাহলে অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী কার্যক্রম প্রথম পোস্ট এর।
দেখা হবে শব্দনীড় রঙ্গমঞ্চে

images (3)

যদি কিছু মনে না করেন

যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা প্রস্তাব নিয়ে আসতে চাই!

আমরা যারা দৈনন্দিন কাজে ঘর ছেড়ে বের হয়ে নানা কিছু দেখি, নানা সমস্যা অনুভব করি যেমন, যানজট, অতিরিক্ত রিকশার জন্য পথে হাটা দুষ্কর, ফুটপাথে যেখানে মানুষের চলাচল করার কথা সেখানে মটর বাইক চলছে, আশেপাশের নানা বিচিত্র মনুষ্য চরিত্র কিংবা নানা বিদঘুটে ঘটনার সম্মুখিন হই ওই সব বিষয় নিয়ে আমাদের কার কি ভাবনা বা আমরা এগুলিকে কে কেমন চোখে দেখছি, কি করেইবা এর সমাধান করা যায় এইসব জরিপ করার জন্য পারষ্পরিক মতামত জানতে একটা নিয়মিত আড্ডার আয়োজন করতে চাই। এতে যার যা মনে হয় সেই এই শিরোনামে পোস্ট দিতে পারেন অর্থাৎ সবার জন্য উন্মুক্ত, এটা যে আমাকে একাই দিতে হবে এমন নয়। আপনি যা ভাবছেন তাই নিয়েই আসুন একটা আড্ডায় বসি।।

যদিও জানি আমাদের সামান্য পরিসরে এই আলাপে এইসব সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না তবুও আমরা সবার সাথে আলাপের মাধ্যমে নানা অজানা তথ্য বা ধারনা পেতে পারব। এই আড্ডার শিরোনামের জন্য আমার মাথায় এই মূহুর্তে কয়েকটা নাম মনে হচ্ছে এর মধ্যে থেকে আপনাদের যেটা ভাল লাগে জানাবেন কিংবা আপনার নিজের কোন প্রস্তাবও নির্দ্বিধায় জানাতে পারেন সবার মতামতের প্রেক্ষিতেই “শিরোনাম” নির্ধারিত হবে। তাহলে আমি যা ভাবছি দেখা যাক,

১। জরিপ ও অনুসন্ধান
২। আমি কিছু বলতে চাই
৩। প্রবহমান আমার দেশ

এবার আপনার পালা, মন্তব্য আকারে জানিয়ে দিন, যথারীতি আগামী ৩ দিন পর্যন্ত আপডেট হতে থাকবে এবং এর পরে ফকির আব্দুল মালেক আমাদের দেয়া নামের মধ্যে থেকে একটা নাম বাছাই করবেন।

আমার সোনার বাংলা

Rihan with Flag
(ছবিতে আগামী প্রজন্ম আমার নাতি জনাব রিজভান রিহান, যার হাতে তুলে দিয়েছি বাংলাদেশের পতাকা)

বাংলার রূপ আমি খুঁজে পেয়েছি
চোখ জুড়ানো সবুজ বনে
স্বর্ণলতা দোলে কুঞ্জবনে পাখির গানে
প্রভাতে সূর্য উঠে গায়ের বাঁকে রক্ত লাল।

বটের ছায়ায় রাখালি বাঁশী বাজে ওই দূরে
জীবন পেয়েছি গানের সুরে
নদীর বাঁকে ভেসে যায় মাঝি তুলে পাল।

চৈতি দুপুরে চাতক পাখি
গগনে চেয়ে থাকে মেলে আঁখি
কল্পনা জাল বুনে গায়ের বধূ
আঁখির কোনে লয়ে হৃদয় মধু।

মেঠো পথের পাড়ে নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে
সবুজ বনানী থাকে আকাশ পানে চেয়ে
চঞ্চল বসন্ত ছড়ায় শিমুল পলাশের লাল।

Flower (1)

বিন্নি ধানের খই

Binni Dhaner Khoi 2_zpswcmfw0sc

কিছুদিন আগে সকালে অফিস যাবার পথে পল্টন এর মোড় থেকে হোটেল ৭১ এর দিকে যাবার সময় দেখলাম ফুটপাথে এক লোক এই হারিয়ে যাওয়া খই নিয়ে বসে আছে। থমকে দাড়ালাম। অনেক কিছু মাথায় এলো। ৫০ টাকা দিয়ে ৫০০ গ্রাম কিনে নিলেম, বাড়িতে মেয়েদের দেখাবার জন্য।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ব্যাগ থেকে বের করে গিন্নীর হাতে দিলাম, সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কোথায় পেলে? দৈ কলা দিয়ে মাখিয়ে আমি আর গিন্নী এর সদ্বব্যাবহার করলাম।
কিন্তু যাদের দেখাবার জন্য আনলাম তারা আজকালের আমার মেয়েরা একটু মুখে দিয়ে আর কোন আগ্রহ দেখাল না। বুঝলাম সবই। এখন জয়জয়কার হলো বার্গার, পিজা, শর্মা এমনি কত কী নামও জানিনা ওরাও যেমন এগুলির নাম জানে না তেমনি।
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী দিনগুলি আজ আর নেই!

Binni Dhaner Khoi 3_zpskyfnoeze

তিন দিনের ছুটি

তিনদিনের ছুটিতে সবাই গেছে বনে কিংবা আজ জোসনা রাতে সবাই গেছে বনে। ওই একই কথা, তিন দিনের ছুটি পেলে যেমন লাগে আজ জোসনা ররাতে সবাই মিলে বনে গেলেও মনে হয় এমনই লাগবে। তাই সবাই শব্দনীড় থেকে ছুটি না নিয়েই যার যার মত কক্স বাজার কিংবা গ্রামের বাড়ি কিংবা অন্তত পাশের কোন আত্মীয়ের বাড়িতে বেরাতে গেছে। যদিও আজকাল সবারই বিদেশি ঢং লেগেছে মনে, আত্মীয়ের বাড়ির চেয়ে দূরে কোথাও যাওয়াতেই যেন আনন্দ বেশী এতে প্রিভেসী নামের আড়াল থাকে আত্মীয়তার বন্ধন ছিড়ে গেলেও ক্ষতি নেই কিন্তু নিজকীয়তার ব্যাঘাত করার কোন প্রয়োজনই নেই!।

গাবতলি টু মহাখালী

Human_hauler

দুইজন, দুইজন মহাখালী, মহাখালী। ডাইরেক্ট ডাইরেক্ট মহাখালী। এই যে একটু চাপেন বইতে দেন, আরে একটু ভিতরে যান না! প্যাসেঞ্জার উঠতে দেন, আরও দুইজন উঠবো। উঠেন ভাই উঠেন, সামনে যান। হ, কইলামতো ডাইরেক্ট, দশ টাকা। সামনে বাড়ান ওস্তাদ।

গাবতলি মহাখালী রুটে গত দুই তিন বছরের নিত্য দৃশ্য। জিনসের ছেড়া একটা প্যান্ট পরনে, গায়ে ময়লা এবং উপরের কয়েকটা বোতাম খোলা হাফ সার্ট, সার্টটা যে কি রঙের তা বোঝা যাচ্ছে না। সারা গায়ে গতরে নোংরা তেল কালি ধুলা মাখা লম্বাটে চেহারা, মাথায় কোঁকড়ানো ঝাঁকরা চুল কতদিন তেল সাবানের ছোঁয়া নেই কে জানে! ১৪/১৫ বছরের ছেলেটা এই কথা গুলি বলে লাফ দিয়ে গাবতলি থেকে মহাখালী চলাচলকারী টেম্পোর পিছনে পা দানিতে পা রাখল। এক হাতে টেম্পোর পিছনের একটা রড ধরা আর এক হাতে টাকা।

ছেলেটা কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেট এর পূর্ব পাশের একটা বস্তিতে মায়ের সাথে থাকে। দুই ভাই দুই বোন। ওরা সবাই ছোট। বাবাকে যতদিন দেখেছে সে স্মৃতি কোন মধুর স্মৃতি নয়। মায়ের সাথে সারাক্ষণ ক্যাচ ক্যাচ মারামারি লেগেই থাকত। রাতে তাহের মৌলবির গ্যারেজে রিকশা রেখে কালা শেখ এর আড্ডায় গাজা টেনে বাড়ি ফিরে এসেই ‘ওই খানকি মাগি ভাত দে’! এই সংলাপ ছাড়া বাবার মুখে অন্তত ওই সময় আর কোন কথা শোনেনি। এমনিতেই মা বেশ নিরীহ গোছের চুপচাপ থাকা মানুষ। এই নিরীহ মানুষটা প্রতিদিন নিয়মিত মার খেতে খেতে এখন আর নিরীহ নেই। পরিস্থিতি তাকে কিছুটা উগ্র হতে বাধ্য করেছে। কতদিন চুপ থেকে এমন মার খাওয়া যায়? গত চৌদ্দ পনের বছর ধরে এই চলে আসছে। আর কত? একবারতো পাড়া পড়শিরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। মাথায়, মুখে এবং হাতে ব্যান্ডেজ করে আধা মরা মাকে ফিরিয়ে এনেছিল। জামালও কাঁদতে কাঁদতে ওদের সাথে গিয়েছিল। একবার ডাইরিয়া হয়ে মা সারাদিনে বার চৌদ্দ বার পায়খানা আর বমি করে করে নেতিয়ে বিছানায় পড়েছিল। বিছানা আর কি! ওই ছেড়া কাঁথায় মুখ গুজে পরে থাকা। প্রতিদিনের মতই গাজার নেশায় বুদ হয়ে এসে ভাত চাইল কিন্তু মার কোন সারা শব্দ না পেয়ে ঘরে ঢুকে মাকে ওই অবস্থায় দেখেই যেন তার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। কষে এক লাথি দিয়ে বলল
কিরে খানকি ভাত চাই হুনস না?
কোন রকম মিনমিন করে মা বলেছিল, হুনছি!
হুনছস তে নবাবজাদীর মত হুইয়া রইছস কেন? ওঠ!
বলেই চুলের মুঠি ধরে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে আসছিল। তখন বার বছরের জামাল পাশেই দাঁড়ান ছিল। মায়ের এই অবস্থা দেখে নিজেকে সামাল দিতে না পেরে পাশে রাখা পাশের বাসার ভাঙ্গা চেয়ারের এক টুকরা কাঠ উঠিয়ে ওই হারামজাদা করস কি? বলেই মেরেছিল বাবার মাথায়।
ওরে বাবারে আমারে মাইরা ফলাইলরে, বলেই এক চিৎকার দিয়ে বাবা জলিল হাওলাদার পড়ে গিয়েছিল
চিৎকার শুনে বস্তির লোকজন ছুটে এসে ভিন্ন চিত্র দেখে হতভম্ব হয়ে থমকে গিয়েছিল। জামালকে জিজ্ঞেস করল
কি হইছেরে?
বলেই কয়েকজন জলিল হাওলাদারের মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হল আবার কয়েকজন বিশেষ করে মহিলারা জামালের মা আর জামালকে ঘিরে ধরল
দিছি আইজকা, জন্মের সাধ মিটাইয়া দিছি হারামজাদারে!
কথাটা বলেই সকলকে শুনিয়ে বলল।
আপনেরা হুনেন, আইজ থিকা আমি আর বাবার লগে থাকুম না। আমি মায়েরে আর ভাই বইনগো নিয়া চইলা যামু
কনে যাবি?
আইজ রাইতে রহিম দাদার বাড়ি থাইকা কাইল একটা বাসা ভাড়া নিমু
বস্তির মালিক রহিম শেখ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। তার নাম শুনে সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
তুই যে আমার হেনে যাবি পরে তর বাপের লগে হাঙ্গামা করব কেরা?
কোন হাঙ্গামা করন লাগব না দাদা, আপনে আমাগো এই রাইতটা খালি জাগা দেন আমরা কাইলই অন্য কুন হানে চইলা যামু
নারে ভাই আমি কি কামে তগো এই ঝামেলায় জরামু?
দাদা, আপনে কি রোজকার কিসসা হুনেন না? রোজ আমাগো এইনে কি অয় জানেন না? আপনের মইধ্যে কি একটুও মায়া দয়া নাই? একটা রাইতের জইন্যে জাগা দিবেন না?
এতটুক ছেলের মুখে এই কথা শুনে রহিম সেখ কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইল। প্রতিবেশীরাও দুই একজনে অনুরোধ করল এই হাবিয়া দোজগের মইদ্ধ্যে থাহার চাইতে না থাহাই ভাল। চাচা আপনে ওগো একটু জাগা দেন জালাইল্য কিছু কইলে দিবেন লাত্থি। বাজার আনবি না, চাইল কিনবি না খালি খাওন দেও! খাওয়ান আহে কইত্থিকা? গাঞ্জা টাইনা আইলেই খাওয়ান পাওয়া যায়? সারাডা দিন বেডির অবস্থা কাহিল আর এর মইদ্ধ্যেই মাইর! অহন পোলা বড় হইছে! বুঝ অহন, কেমন ঠ্যালা। শয়তানের হাড্ডি কুনহানকার!
রহিম শেখ বলল
তোমরা যহন কইতেছ তাইলেতো জাগা দেওন লাগবই, আইচ্ছা জামাইল্য চল তর মায়েরে নিয়া চল আমাগো বারান্দায় থাকবি। আয় আমি তর দাদিরে কইগা।
রহিম শেখ চলে গেল আর তার পিছনে জামাল তার মাকে উঠিয়ে ধরে ভিড়ের মধ্যে থাকা ছোট ভাই বোনদের নিয়ে তার পিছনে পিছনে চলল।
নুর বানু ছেলেকে আঁকড়ে ধরে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল
ও পুত তুই যে আইলি খাবি কি? থাকবি কনে? ঘর ভাড়া দিবি কেমনে?
মা যে কি কও! মনে অয় আমরা রোজ গোস পোলাও খাই আর এহন কিছু পামু না! তুমি চিন্তা কইর না মা, খালেক ওস্তাদ হের টেম্পোতে আমারে কাম দিব কইছে।
টেম্পোর কাম করবি! কি কাম?
হেলপারের কাম
তুই পারবি?
কি যে কও মা
হেই কবে থিকা আমি ওস্তাদের লগে যাই না? তুমি যে আমারে বিচরাইয়া পাওনা আমি কই যাই জান?
কই যাস?
ওইতো, ওস্তাদের লগে যাইতাম। কেমনে কি করে তাই দেখতাম। অহন আমি সব পারি। প্যাসেঞ্জার ডাহা, ভাড়া উঠান তারপরে ওস্তাদরে সিগন্যাল দেওয়া, সব পারি ওস্তাদ কইছে।

রহিম শেখের বারান্দায় সেদিনের মত রাত কাটিয়ে সকালে পাশেই একটা ঘর খালি পেয়ে ওতেই উঠে যেতে চাইল কিন্তু দাদি কিছুতেই যেতে দিতে চাইল না।
আহারে এই অসুইখ্যা মাইয়াডা কই যাইব? যাওনের কাম নাই তরা আমাগো বারান্দার ওই ধারে যে ঘরডা আছে ওই হানে থাক কুন ট্যাহা পয়সা দেওন লাগব না।
সেদিন থেকেই রহিম শেখের টিনের বারান্দার সাথের ঘরে জামাল তার মা এবং ভাই বোনদের নিয়ে থাকা শুরু করল। নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল বেলা সূর্য ওঠার আগে এক মুঠ পান্তা খেয়ে মায়ের আচলে মুখ মুছে বের হয়, রাত দশটা এগারটা বাজলে দুই হাতে বাজার নিয়ে ফিরে আসে। চাউল, ডাল, ডিম, সবজি বা কোনদিন অত রাতে যদি বাজারে থাকে তাহলে একটু গুঁড়া মাছ। দুপুরে ওস্তাদের সাথে বাইরেই খেয়ে নেয়। একদিন রাতে খাবার সময় মা বলল
রুশনীর মা হাউজিঙে সাহেবগো বাড়ি কাম করে, তিন বেলা খাওন দেয় আবার দুই হাজার টাকা মাইনা দেয়, আমারে কইছে করুমনি? আমি তর লগে কথা কইয়া তারপরে কমু কইছি। তুই কি কস?
বলেই ছেলের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
না মা তোমার শরীরের যে অবস্থা তাতে কাম করন লাগব না, আমাগো আর কিছু লাগব না।
মাস গেলে অত গুলা ট্যাহা কি কম? তুই না করস কেন?
না মা, তুমার কামের বেটি হওনের দরকার নাই। আমরা কি তুমারে কোনদিন মায়ের মত কইরা পাইছি কও? তুমি অগো দেখবা, রাইন্ধা বাইরা খাওয়াইবা এইতেই আমাগো হইব। তুমি আমাগো মা হইয়াই থাকো।
এমনে কয় দিন চলব? তুই একলা কত করবি?
এইতো মা ফরিদ আর একটু বড় হইলেই ওরে কোন এক জাগায় লাগাইয়া দিমু
মা অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই রইল। কি ভেবে আর কথা বাড়াল না।
খালেক মিয়া জামালের সব ইতিহাস জানে বলে ওকে বেশ একটু আদর যত্ন করে। কোন ভুল বা বোকামি নীরবে সহ্য করে নেয়, সামান্য একটু বকাঝকা দিয়েই শেষ করে ফেলে। দেখতে দেখতে দুই তিন বছর কেটে গেল। নুর বানুর সংসার ভালই চলছে। ওদিকে জামালও ভাল হেলপার হয়ে উঠেছে। এখন মাঝে মাঝেই টেম্পো নিয়ে এদিক ওদিক সরিয়ে রাখতে পারে। টেম্পো রেখে ওস্তাদ খেতে বসেছে তো এমন সময়ে কোন গাড়ি এসে হর্ন দিলে খালেক মিয়া বলে যা তো জামাল গাড়িটা একটু সামনে আগাইয়া রাইখা আয়।
সব ভালর কি শেষ থাকে? কিছু কিছু ভাল ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়। বিশেষ করে এমন হত দরিদ্রের ভাল কি কোনদিন স্থায়ী হয়, সুখের হয়? সব ভাল গুলা যে শুধু ভালর পাশেই থাকতে চায়! সুখ গুলা শুধু সুখের পাশে সুখীর পাশেই থাকতে চায়। গোলাপ যেমন ফুলদানি ছাড়া আস্তা কুড়ে মানায় না তেমনি অভাগার দিকেও সুখ কখনও ফিরে তাকায় না।

মাঝ রাত থেকেই বৃষ্টি। বস্তির পাশে পানি জমে গেছে। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর ভীষণ আলসেমিতে পেয়ে বসল। উঠতে ইচ্ছা করছে না। মা ডাকল কিন্তু জামালের কোন সারা নেই। মা এসে গায়ে হাত দিয়ে দেখল জ্বর টর হয়েছে কি না। আবার ডাকল কিরে মানিক উঠবি না? কত বেলা হইল তর ওস্তাদ গাড়ি নিয়া বইয়া রইছে। ওঠ। পেটের তাগিদে, ক্ষুধার তাগিদে জামালকে উঠতেই হবে। ওস্তাদের গাড়ি কি আর বইসা থাকব? ও না গেলে ওস্তাদ বোরহানরে ডাইকা নিয়া যাইব। তার মানে আইজ আর খাওয়ানের জন্যে কিছু নিয়া আইতে পারব না। এ কথা মনে আসার সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে পরল।
মা আমি গেলাম
ওস্তাদের বাড়ি এসে দেখে ওস্তাদ গাড়ি বের করে ফেলেছে।
কিরে নবাবজাদা আইজ এত দেরি করলি?
জামাল কিছু বলল না, চুপ করে থাকাই নিরাপদ। গালাগালি যাই করুক রাইতে ফেরার সময় হাতে দুইশ টাকা গুজে দেয়। কোনদিন দুই একটা ট্রিপ বেশি হলে বা রাস্তায় একটু বেশি ভিড় হলে আরও একশ টাকা দিয়ে দেয়। মন ভাল থাকলে কোনদিন গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বাজারে গেলে ওকেও সাথে নিয়ে যায়। নিজের বাজার করে ওখান থেকে ওকেও কিছু দিয়ে দেয়। সেদিনও একটা পাঙ্গাশ মাছ আর কিছু বেগুন কিনে দিয়েছিল। ওস্তাদের সাথে বেয়াদবি করতে নেই। যা বলে বলুক। দোষতো সে নিজেই করেছে! এজন্যে একটু বকাবকি শুনতে পারবে না? বাবা যেমনে মাকে মারত তেমন করে মারে না। মারলেই বা কি করত? তাওতো সইতে হতো! কোন কথা না বলে চুপচাপ একটা কন্টেইনারে গাড়ির জন্য পানি ভরে সিটের নিচে রেখে ন্যাকরা দিয়ে গাড়িটা মুছে বলল
চলেন ওস্তাদ।
মহাখালী, মহাখালী। ওঠেন ফার্স্ট ট্রিপ, ওঠেন। আর একজন। শ্যামলী, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী আর একজন। ওস্তাদ ডাকল। কাছে এসে জানালা দিয়ে ওস্তাদের দিকে তাকাল।
কিরে সীট ভরছে?
না ওস্তাদ একটা খালি আছে
ডাক দে
ডাইরেক্ট মহাখালী, মহাখালী, শ্যামলী, জাহাঙ্গীর গেট একজন একজন
এই আমাকে রাওয়া ক্লাবের সামনে ব্রিজের এ পাড়ে নামিয়ে দিবে।
আচ্ছা দিমুনে।
সীট ভরে গেল। টেম্পোর ছাদে দুইটা টোকা দিয়ে, আগে বাড়ান ওস্তাদ।

শ্যামলী পার হয়ে ডাইনে পঙ্গু হাসপাতাল রেখে রোকেয়া সরণি দিয়ে এসে এয়ারপোর্ট রোডে পরল। সামনে জাহাঙ্গীর গেট। একটু জ্যামে গাড়ি দাঁড়াল। দেন ভাই আপনেগো ভাড়াডা দিয়া দেন।
মহিলা মাথা নিচু করে বলল এই সামনে নামব
হ হ মনে আছে নামাইয়া দিমুনে, ভাড়াডা দেন
জ্যাম ছুটে গেল। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে।
রাওয়া ক্লাবের সামনে এসে ছাদে এক টোকা দিয়ে বলল ওস্তাদ বায়ে রাখেন মহিলা নামব
আস্তে করে টেম্পো বায়ে চেপে থেমে গেল। মহিলা যাত্রী নামল কিন্তু তার ভাড়া এখনও দেয়নি। নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাতের পার্স খুলে টাকা বের করতে বেশ একটু দেরি হলো আর এই ফাকে সকাল বেলা ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি দাড় করিয়ে রাখা সম্ভব না বলে ওস্তাদ একটু একটু করে ডাইনে চেপে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সে মনে করেছে জামাল উঠে পড়েছে। জামাল ভাড়া নিয়ে দৌড়ে টেম্পোর কাছে চলে এসেছে হ্যান্ডেল ধরে লাফ দেয়ার আগেই, পিছন থেকে একটা ল্যান্ড রোভার এসে ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে সামনে ছিটকে পড়ে গেল, হাতের টাকাগুলা বাতাসে ছড়িয়ে গেল সেই সাথে শুধু একটা চিৎকারের শব্দ হলো। এই সাত সকালে এমন ব্যস্ত রাস্তায় কে কার খবর রাখে! ল্যান্ড রোভারটা যে গতিতে আসছিল সেই গতিতেই চট করে ডাইনে চেপে খালেকের টেম্পোর পাশ কাটিয়ে চলে গেল। খালেক জানতেও পারল না এই গাড়িটা কি করে গেল তার জামালের কি হয়েছে? জামাল পড়ে যাবার পরেই ল্যান্ড রোভারের পিছনে যে কার আসছিল সে এগিয়ে এসে সামনের রাস্তায় মানুষ পড়ে রয়েছে দেখে কড়া ব্রেক করল। ব্রেকের শব্দে বাম পাড়ে ব্রিজের নিচে দাঁড়ান কয়েকজন পথচারী দৌড়ে কাছে এসে দুই একজন জামালকে রাস্তার পাশে ফুটপাথে এনে দেখে নাক মুখ কান দিয়ে রক্ত ঝরছে, হৃৎপিণ্ডে কোন স্পন্দন নেই আর বাকিরা ওই গাড়ির নিরীহ ড্রাইভারকে বের করে মারপিট শুরু করল। হঠাৎ এই জটলা দেখে রাস্তার ওপাড়ে মোটর বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সার্জেন্ট এসে এম্বুলেন্স খবর দিল এবং যে গাড়িটা মানুষ দেখে মানবিক কারণে দাঁড়িয়েছিলো তার নামে মামলা ঠুকে দিল। জামাল কোন ভিআইপি নয় বলে তার খবর সংবাদ পত্রেও এলো না বা কেও জানতেও পারল না। ওদিকে খালেক মিয়া স্ট্যান্ডে গাড়ি থামিয়ে জামালকে খুঁজে না পেয়ে অবাক হলো। কি ব্যাপার? এইতো, ব্রিজের ওপাশে প্যাসেঞ্জার নামাল! গেল কোথায়? তবে কি ওখান থেকে গাড়িতে উঠতে পারেনি? ভেবে পিছনে এগিয়ে এসে দেখে যেখানে ও শেষবার থেমেছিল তার পাশে জটলা এবং পুলিশের গাড়ি থেমে আছে। ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দেখে জামালের রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে। রাস্তায় চলাচল এবং রাস্তায় কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের হেলপার পরিচয় না দিয়ে বলল এরে আমি চিনি আমার বাসার লগেই এগো বাসা, এর নাম জামাল।
বিঃদ্রঃ- বাসে কিংবা রিকশায় কিংবা যেখানে ভাড়ার বিনিময়ে কোথাও যেতে হয় সেখানে ভাড়া দেয়ার জন্য আগে থেকেই ভাড়ার টাকাটা বের করে রাখুন যেন ভাড়া নেয়ার জন্য এমন করে কোন জামালকে প্রাণ দিতে না হয়!

মরীচিকা

1 (20)
১।
বাচ্চু মিয়ার দিন খুব একটা ভাল যায় না। একদিন কাজ করতে পারলে দুই দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। ঝাঁর ফুক, গাছ গাছন্ত দিয়ে অনেক দিন চিকিৎসা করান হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি তাই ও পাড়ার মফিজের পরামর্শে কিছু পয়সা জমিয়ে মানিকগঞ্জে বড় ডাক্তার দেখিয়েছে। সে ই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেছে লিভারে সমস্যা দেখা দিয়েছে নিয়মিত ওষুধ খাবেন আর বিশ্রামে থাকবেন। কিন্তু যার দিন আনতে পানতা ফুরায় সে কি করে বিশ্রামে থাকবে আর কি করেই বা নিয়মিত ওষুধ খাবে! হযরত আলির লাকড়ির দোকানে কাঠুরিয়ার কাজ করে কি আর বিশ্রামে থাকা যায়? চার পাঁচজন ছেলে পুলে তার পরে আবার ঘরে অবিবাহিত ছোট এক বোন নিয়ে বড় কষ্টে দিন যায়। ভাগ্য ভাল যে বড় মেয়েটা ঢাকায় ওসমান সাহেবের বাসায় কাজ করে। মাস গেলে কিছু টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় নয়তো সে নিজে বাড়ি এলে বাচ্চু মিয়ার হাতেই দিয়ে যায়। ঢাকা আরিচা রোডের তরা ব্রিজ পাড় হয়ে এসে বায়ে হরিরামপুরের রাস্তায় দক্ষিণে একটু ভিতরে নবগ্রাম খালের পাড়েই বাড়ি।
২।
বোনটা দেখতে শুনতে ভাল অন্তত কাঠুরিয়ার বোন বলে মনে হয় না। কি জানি, কোথায় বিয়ে হয় কে জানে! বোনটার যদি একটি বিয়ে দিতে পারে তাহলে অন্তত একজনের বোঝা কমে যায় কিন্তু চাইলেইতো আর বিয়ে দেয়া যায় না। তবে বাচ্চু মিয়ার ভাগ্য ভাল বলতেই হবে। যেদিন মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে আসছিল তখন বাসে গিলন্ডের ঘটক রমিজ মুন্সির সাথে দেখা।
কি খবর বাচ্চু মিয়া কেমন আছ?
ভাল আর কেমনে থাকি? এইতো মানিকগঞ্জ থিকা পরীক্ষা করাইয়া আসলাম, লিভারে গণ্ডগোল দেখা দিছে।
ও, তাইলেতো চিন্তার কথা, দেখ যতটা পার চিকিৎসা কর। আইচ্ছা ভাল কথা, তোমার একটা বইন আছে না?
হ ভাই আছেতো, ওরে নিয়েই যত চিন্তা, কি যে করি!
একটা ভাল পোলার খোজ আছে, দেখবা?
কনে?
এইতো, আমাগো গেরামেই। খুব ভাল পোলা, মা বাপ ভাই বইন কেও নাই ভাল জমিজমা আছে আবার রাস্তার মোড়ে একটা দোকানও আছে।
এই পোলা কি আমার মত গরীব মাইনসের বইন বিয়া করব? আমার কি দেওনের কিছু আছে? বাড়ির ভিটা আর ২/৩ পাকি জমি এ ছাড়া আর কিছুই নাই হে কথা তুমরা সব জান
না না কিচ্ছু লাগব না। হে খালি একটা ভাল মাইয়া চায়। ঘর সংসার সামাল দিতে পারব এই রকম একটা মাইয়া, তুমার বইনতো দেখতে শুনতে ভালই
কি জানি রমিজ ভাই, যদি তার পছন্দ হয় তাইলে তুমি দেহ
কাইল বাড়ি থাকবা?
হ থাকুম, আর কনে যামু? শরীলডা ভাল না কামে যাইতে পারতেছি না কয় দিন ধইরা
আইচ্ছা তাইলে কাইল আসরের পর আমি পোলারে নিয়া আসুম তুমি থাইকো

৩।
বাচ্চু মিয়ার বোন দেখতে শুনতে বেশ রূপবতী, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ, কোমর পর্যন্ত চুল, পটলের মত চোখ, ধারালো নাক আর কি চাই? তারপরে আবার কাজে কর্মেও তেমনি চোখা। গরীবের ঘর থেকে বের হলে জেল্লা আরও বাড়বে বই কমবে না। রূপ যৌবন ভরা এই মেয়ে দেখে মজে গিয়ে ফজর আলির মনে ধরে গেল আর সাথে সাথে মোল্লা ডেকে বিয়ে পড়িয়ে বৌ বাড়ি নিয়ে এলো। পণ যৌতুকতো দূরের কথা বাচ্চু মিয়ার অবস্থা দেখে চিকিৎসা করাবার জন্য তার হাতে হাজার দুই টাকা দিয়ে এলো।

আম্বিয়া শ্বশুর বাড়ি এসে দেখে তার বাড়িতে দুই একজন কাছের আত্মীয় ছাড়া আর কেও নেই। তারাই বাড়ি ঘর ফসলাদি দেখা শোনা করে, রান্না বান্না করে। বাড়িতে পা দিয়েই আম্বিয়াকে তার স্বামী সব বুঝিয়ে দিল। আম্বিয়াও সব বুঝে শুনে নিল। আত্মীয়রা যারা ছিল তারা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। এতদিন ইচ্ছে মত চলাফেরা করেছে এখন আর সে উপায় থাকবে না। বাড়ির বৌ এসেছে তাহলে সেই গিন্নী হবে এটাই নিয়ম নিশ্চয়ই সে সব কিছু তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিবে! ফজর আলি এত দিন তার নিজের কেও ছিলনা বলে এদের আশ্রয় দিয়েছিল কিন্তু এখন নিজের বৌ এসেছে কাজেই সংসারের চাবি কাঠি তার কাছেই থাকবে এমন ব্যবস্থাই করে দিল। উঠতি সংসার। কয়েকদিনের মধ্যে আম্বিয়া সব কিছু মোটা মুটি দেখে শুনে বুঝে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। রান্না বান্না এখন সে নিজেই করে। স্বামী কি খায় কি খায়না জেনে নিয়েছে।

সকালে উঠে ফজর আলি ঘুরে জমি জমা দেখে এসে নাশতা খেয়ে দোকানে চলে যায়। দোকানের কর্মচারী কুদ্দুস সকালেই দোকান খুলে। ফজর আলি দুপুরে দোকান থেকে এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে দোকানে চলে যায় আবার রাতে বেচাকেনা করে হিসাব নিকাশ সেরে আসে। সকালে বা রাতে পুরনো রাখাল বেলালকে বুঝিয়ে দেয় কোথায় কি করতে হবে।
নানা রকম ফসলাদি কোনটা রোদে শুকিয়ে কোন ঘরে তুলতে হবে কোনটা বাজারে নিতে হবে এগুলিও এক সময় আম্বিয়ার হাতেই চলে আসে। ফসল বিক্রির টাকা পয়সাও আম্বিয়ার হাতেই আসে। এত দিন গরীব ভাইয়ের সংসারে থেকে নিজেকে চেপে রাখতে হয়েছিল। মনের কোন সাধ আহ্লাদ কিছুই করার সুযোগ পায়নি। আজ তার দু হাত ভরা, যা চায় তাই পায় দরকার হলে ফজর আলিকে দিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে এনে নেয়। নিজের ইচ্ছে মত সংসার করার সুযোগ পায়নি। ভাইয়ের বৌয়ের অধীনে থাকতে হয়েছে। এখন সে স্বাধীন। আজীবন অভাবের মধ্যে থাকা আম্বিয়া বেগম হঠাৎ করে হাতে হিসেব ছাড়া টাকা পয়সা পেয়ে অনেক বদলে গেছে আগের মত নেই। স্বামীর জোরে আজ তার আঁচলের চাবি দিয়ে তালা দেয়া লোহার আলমারিতে টাকার বান্ডিল রেখে দিয়েছে তার হিসেব নেয়া বা দেয়ার মত কেও নেও, সেই সব, সবই তার। ফজর আলি এদিকে কোন নজর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না।

৪।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আম্বিয়া বেগম পান বানিয়ে স্বামীর হাতে এনে দেয়। ফজর আলি পান চিবায় আর স্ত্রীর সাথে দিনের ফিরিস্তি নিয়ে আলাপ পরামর্শ করে। পান চিবাতে চিবাতে ফজর আলি বলল
কাইল কিছু টাকা দিও, আমার একটু নবগ্রাম যাওয়া লাগব
টাকা নিয়া নবগ্রামে কি করবা?
ভাইজানরে কিছু টাকা দিয়া আসি
ও, আইচ্ছা যাইও, কত টাকা দিবা?
অন্তত হাজার খানিক দিও, না কি কও?
তুমার যা খুশি দিবা, আমি কি কমু?

এভাবে উদার বোন জামাই বাচ্চু মিয়ার দেখা শুনা থেকে শুরু করে তার সংসারের অনেক দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে তবে সে কোনদিন এ কথা বলতে পারবে না যে তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম তাকে এ কাজে অনুরোধ করেছে বা তাগিদ দিয়েছে। যা দেবার ফজর আলি নিজেই দিয়েছে। ইচ্ছা করলে আম্বিয়া বেগম আরও কিছু বেশিই দিতে পারত কিন্তু স্বামী নিজেই যা করছে তাতেই সে সন্তুষ্ট। বাচ্চু মিয়ার অসুখের চিকিৎসা, তার সংসার চলার ব্যবস্থা সবই বোন জামাই চালাচ্ছে। আম্বিয়া বেগম ভীষণ খুশি। মাস বছর যাবার সাথে সাথে সংসারের যাবতীয় কর্তৃত্ব আম্বিয়া বেগমের হাতে চলে এসেছে। ফজর আলির এত দিকে তাকাবার সময় নেই।
বাচ্চু মিয়া আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আবার ওসমান সাহেবের বাড়ি থেকে মেয়েটাকেও ছাড়িয়ে এনে বিয়ে দিয়েছে। এখন তার ঘরে সচ্ছলতা না এলেও আগের মত অভাব নেই। বড় লোক বোন জামাইর কৃপায় তার দিন ফিরেছে। ছোট দুই ছেলেকে স্কুলে দিয়েছে।

৫।
মানুষ শুধু নিজের স্বার্থই চায়, নিজের সুবিধার জন্য অন্যের অসুবিধার কথা বিচার করতে রাজী নয়। এত দিন অভাবের মধ্যে থেকে বাচ্চু মিয়াও এর বাইরে যেতে পারেনি। বাচ্চু মিয়ার এত কষ্টের দিন কি ভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আর সে জায়গায় নতুন করে সুখ পাখি এসে কেমন করে ডালে বসল সে হিসাব করার কি দরকার? এগুলি যে কোন যাদু মন্ত্র দিয়ে হয়নি সে কথা বোঝার মত ইচ্ছা বা মনোবৃত্তি বাচ্চু মিয়ার হাতে নেই। বাচ্চু মিয়া পরের ধন পেয়ে ফেলে আসা পিছনের হিসেব মিলিয়ে দেখার ইচ্ছা করে না। হঠাৎ করে জেগে ওঠা সচ্ছলতার স্রোতের বান কোথা থেকে আসল কি ভাবে আসল তার কিছু জানার দরকার নেই। শুধু আরও চাই আরও দাও। এটা নেই ওটা নেই, নেই নেই অনেক কিছুই নেই। নেই কথাটা কখনও শেষ হতে চায় না। এত নেই এত দিন কোথায় ছিল? কে জানে এই কাহিনী? কেও জানে না! শুধু জানে ফজর আলি! ফজর আলি তার সুন্দরী স্ত্রীর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হলে বাচ্চু মিয়ার দিকে তার খেয়াল রাখতেই হবে।

এত দিনে তার বাড়ি ঘরের চেহারাও কিছু বদলে গেছে। ফজর আলি যখন আম্বিয়া কে বিয়ে করে তখনকার মত গমের ডাটার চালা দেয়া বাঁশের বেড়ার ঘর আর নেই সেখানে এখন টিনের দোচালা ঘর উঠেছে। ফজর আলি যা দরকার মনে করেছে তা দিয়েছে। ভাই এর যখন যা প্রয়োজন হয়েছে আম্বিয়া বেগমও তার হাতে যা ছিল, তা দিতে কৃপণতা করেনি। করবেই বা কার জন্য? তার কি ছেলে মেয়ে কেও আছে?

এদিকে বাচ্চু মিয়ার মাথায় নতুন ফন্দি এসেছে। ইদানীং বোন এবং বোন জামাইকে ভাল করে খাতির আপ্যায়ন করতে শুরু করেছে। শীতের পিঠা, অঘ্রাণ মাসে হাসের মাংস দিয়ে ফজর আলির প্রিয় চাউলের রুটি, আম কাঁঠালের দিনে আম দুধের নিমন্ত্রণ, এমনি যখন যা আসে সম্বন্ধীর বাড়িতে ফজর আলির নেমন্তন্ন লেগেই থাকে। এ ভাবেই কয়েক বছর চলে গেল
ওদিকে দিন চলে যায় কিন্তু আম্বিয়ার গর্ভে কোন সন্তান সম্ভাবনার দেখা নেই। ফজর আলি কি আর কম চিকিৎসা করিয়েছে, নিজের এবং স্ত্রীর। কিন্তু কোন সুফল পায়নি। আশে পাশে নানা জনে নানা আলাপ করলেও বাচ্চু মিয়ার এতে কোন বিকার নেই, তার মনে হয় আম্বিয়ার বাচ্চা না হলেই ভাল!।

৬।
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দুপুরে খেতে আসার পথে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তা পাড় হবার সময় এক ট্রাকের একটু ধাক্কায় ফজর আলি ছিটকে পড়ে গেল। আঘাত খুব মারাত্মক কিছু নয় মাথায় আঘাত লেগে বেশ ভোগাচ্ছে। এক্সরে, এবং নানা প্যাথলজি টেস্ট করে কোন অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়েনি তবে অবস্থার উন্নতি না দেখে ঢাকায় নিয়ে নিউরোলজিতে টেস্ট করে দেখা গেল স্মৃতি শক্তি কিছুটা ক্ষতি হয়েছে বলে কাওকে চিনতে পারছে না, ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। ওদিকে বাচ্চু মিয়া মনে মনে বুদ্ধি করে বোন জামাইকে দেখা শোনা আর সুচিকিৎসার জন্য নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো। বাড়িতে থাকলে আম্বিয়া একা চতুর্দিক সামাল দিয়ে স্বামীর সেবা যত্ন করতে পারে না তাই বোন সহ বোন জামাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। দোকান থেকে কুদ্দুস এক দিন পর পর নবগ্রাম এসে দোকানের বিক্রির টাকা পয়সা দিয়ে যায়। এ টাকা আগে আম্বিয়ার হাতেই দিত এখন বাচ্চু মিয়াই নিয়ে নেয়। বোন জামাইর জন্য অনেক খরচ। কয়েকদিন পরে পরে ঢাকায় নেয়া, ডাক্তার দেখান, নানা রকম পরীক্ষা করা, ভাল পথ্য এগুলি জোগাড় করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। সবসময় কি বোনের কাছে হাত পাতা যায়?

বাচ্চু মিয়ার সেই কাঠুরিয়ার জীবন আর নেই। বোনের বিয়ের পরে ফজর আলি নিজেই তার দিন ঘুড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু তাতে বাচ্চু মিয়ার মন ভরেনি। ফল খেয়ে কি আর জীবন চলে? আস্ত গাছটা যে তার প্রয়োজন! অনেক দিন থেকেই গাছের দখলের চিন্তায় বিভোর ছিল কিন্তু তেমন সুযোগ আসছিল না। নবগ্রামের খাল পাড়ের বাড়ির বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে হুঁকা টানে আর ভাবে কি করে কি করা যায়।
৭।
ফজর আলির অবস্থা উন্নতির দিকে না গিয়ে দিনে দিনে অবনতির দিকেই যাচ্ছে। এতদিন অন্তত কাওকে চিনতে না পরলেও নিজের কাজ নিজে করতে পারত। খাওয়া দাওয়া, সকাল সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে থেকে বেড়িয়ে ঘুরে ফিরে আসা, ক্ষুধা লাগলে খাবার চাওয়া। কিন্তু ইদানীং তা পারছে না। এক ভাবে বিছানায় পড়ে থাকে। বাচ্চু মিয়া বোনের সাথে এই নিয়েই দিনরাত আলাপ করে কি করা যায়? নানা ভাবে ভেবে দেখে, আবার ঝাঁর ফুক তাবিজ কবজে ফজর আলির গলা ভরে গেছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। যেখান থেকে যেই যে প্রস্তাব নিয়ে আসে তাই করা হচ্ছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।

মানুষের মনের পরিবর্তন হতে খুব বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না ঢাক ঢোল পেটাতে হয় না। সামান্য একটু ছুতা ধরে নীরবেই হয়ে যায়। বাচ্চু মিয়া এবং তার বোন আম্বিয়া বেগমেরও তেমন বেশি কিছু প্রয়োজন হয়নি। এ জন্যে ফজর আলির দুর্ঘটনাটাই যথেষ্ট। বাচ্চু মিয়া বুঝিয়েছে। এর এখন বেচে থাকা আর না থাকায় কোন তফাত নেই। কি হবে বেচে থেকে? চেষ্টা চিকিৎসা কি কম হচ্ছে? বোন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এ কথার মানে বোঝার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ভাই ঠিক কি বলতে চাইছে? একদিন শ্রাবণের এক মেঘলা দিনে আম্বিয়া বেগম যে ঘরে থাকে সে ঘরের বারান্দায় বসে ভাই বোনে কথা হচ্ছে।
এর বাইচা থাকার চাইতে না থাকাই ভাল, কি কস
হ ভাই তাইতো দেখতেছি
এক কাম করবি?
কি কাম ভাই?
এমনিও টিনের চালের নিচে বৃষ্টির শব্দে কিছু শোনা যাচ্ছিল না তবুও বাচ্চু মিয়া খুব সাবধানে এদিক ওদিক দেখে বোনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল
আমার মনে হয় এই যন্ত্রণার চাইতে এর মইরা যাওনই ভাল
তাই কইলেই কি আর হয় ভাই? যতদিন আয়ু আছে ততদিন ঠেকাইব কেরা?
শোন, আমি কই কি মানুষটারে এমনে কষ্ট দিয়া কি হইব, ক?
তাইলে কি করুম?
এক কাম করবি?
কি
এহনতো ঘুমাইতেছে, আশেপাশে কেও নাই, বালিশটা নিয়া মুখে চাইপা ধর, দেখবি সব যন্ত্রণা শেষ হইয়া যাইব!
কি কও ভাই, নিজের স্বামীরে এমনে মাইরা ফালামু?
আরে ধুর বোকা, এইডা কি মাইরা ফালান হইল? এইডা তারে যন্ত্রণা থেইকা মুকতির একটা পথ কইরা দেওয়া হইল, বুঝছস? আমি কেমনে কই তর স্বামীরে নিজে মাইরা ফালা!
আম্বিয়া বেগম ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল।
তুমি কি কও ভাই!
আরে শোন আমি তর ভালর জন্যেই কইতেছি। তুই সব কিছুর মালিক, যত চিকিৎসা করবি তত খরচ হইবো। তুই খালি বালিশটা চাইপা ধরবি আর কিছু করা লাগব না।
নিথর আম্বিয়া বেগম অসহায়ের মত ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল
বাচ্চু মিয়া ছাতা মাথায় তার নিজের ঘরে গিয়ে টিনের একটা বাক্স খুলে একটা সাদা স্ট্যাম্প নিয়ে এসে
নে উঠ, বলে বোনের হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নিয়ে ঘরের ভিতরে ফজর আলির কাছে গেল। ফজর আলি গভীর ঘুমে অচেতন। বাচ্চু মিয়া একটা কলমের কালি ফজর আলির বাম হাতের আঙ্গুলে মাখিয়ে কাগজের এক পাশে চেপে একটা ছাপ নিয়ে নিল। নে এবার এই বালিশটা চাইপা ধর। সব তর নামে কইরা দিমু আর কোন চিন্তা নাই কিন্তু আম্বিয়া বেগমের হাত চলছিল না। ভাইয়ের এই প্রলোভন আম্বিয়াকে সায় দিতে পারছিল না। বাচ্চু মিয়া নিজেই বোনের বালিশটা নিয়ে ফজর আলির নাকে মুখে চেপে ধরল। অনেক দিনের অসুস্থ নির্জীব দুর্বল ফজর আলি কিছুক্ষণ ছট ফট করে নিস্তেজ হয়ে এক সময় থেমে গেল।

৮।
সময়ের প্রলেপ দিয়ে একদিন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসল, আম্বিয়া বেগমের কান্নাকাটি থেমে গেল। মনের কোণে জমা মেঘগুলা আস্তে আস্তে দূর আকাশের অন্য প্রান্তে উড়ে গেছে। আস্তে আস্তে আকাশটা নীল হয়ে আসছে। একটু একটু করে সংসারের কাজ কর্ম রাখাল চাকরের দেখা শোনা করতে পারছে। দুই ভাই বোনে মিলে শোকের যে আস্তরণ তৈরি করেছিল তা মুছে ফেলেছে। বাচ্চু মিয়া তাইজুদ্দিন মুহুরির সাথে দেয়া নেয়ার বিনিময়ে ঘিওর সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বোনের পরিবর্তে সব কিছু নিজের নামে করে নিয়েছে।

বাচ্চু মিয়া নবগ্রামের খাল পাড়ের ছোট্ট বাড়ি ছেড়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে এখন বোনের বাড়িতে উঠে এসেছে। বোনের বাড়ি এখন তার নিজের বাড়ি। তার অবস্থা এখন রমরমা। এই জমি জমা যা আছে সবই তার। হ্যাঁ, যে বোনের বিনিময়ে এত কিছু তাকে কি আর ফেলে দেয়া যায়? এতটা নির্মম হতে পারে না। মা মরা বোনটাকে যে ছোট বেলা থেকেই কোলে করে বড় করেছে, তাকে আগলে রাখতেই হবে। ছেলে মেয়েরা স্কুল ছাড়িয়ে কলেজে যায়। এমন সুযোগ হাতে পাওয়া কঠিন ব্যাপার হলেও সে এই বোনের জন্যেই তা পেয়েছে। কাজেই বোনকে কোন অবস্থায়ই অনাদর হতে দিবে না। শলা পরামর্শ যা করার দুই ভাই বোনে মিলেই করে। বোনের যখন যা প্রয়োজন তা আগে থেকেই হাতের কাছে এনে দেয়। বোনের কোন দুঃখ সে রাখবে না। বোনের কোন অযত্ন হতে দিবে না।

৯।
এমনি করেই অনেক দিন চলে গেল। বাচ্চু মিয়ার বয়স হয়েছে শরীরটাও আর আগের মত নেই, ভাটার টানে পড়ে গেছে। ছেলে মেয়েরাও বড় হয়েছে বিয়ে শাদী করে তারা এখন ঘর সংসার করছে। ফুফুর প্রতি বাবার আদিখ্যেতা তাদের কোন দিন ভাল না লাগলেও বাবার সামনে কিছু বলার উপায় নেই। অনেকদিন ভুগে বাচ্চু মিয়া একদিন এই সব সম্পত্তির মায়া কাটিয়ে সব কিছু ফেলে রেখে চলে গেল। যাবার আগে ছেলেদের ডেকে বলেছিল তোরা ফুফুর অযত্ন করবি না। ছেলেরা বাবার যাত্রা পথে কিছু বলেনি কিন্তু তারা জানত বাবার মৃত্যুর পর কি করতে হবে।

এত দিন আম্বিয়া বেগম ভেবেছে যে ভাই তাকে আগলে রেখেছে সে ভাই চলে গেলে ভাইয়ের ছেলেরা তার দেখা শুনা করবে সে তাদেরকে জমি জমা যা আছে ভাগাভাগি করে দিয়ে যাবে। এক দিন আম্বিয়া বেগম ভাইয়ের বড় ছেলে হারুনকে ডেকে এগুলির একটা বন্দোবস্ত করার কথা আলাপ করল। সব শুনে ছেলে বাবার রেখে যাওয়া টিনের বাক্স খুলে দলিল পত্র বের করে দেখল সবই তার বাবার, ফুফুর কিছু নেই। আম্বিয়া বেগম অবাক হয়ে দূরের আকাশের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। তার কিছু বলার নেই। ছেলে বলল
ফুফু, যা হইছে অনেক হইছে তোমার জইন্যে আমরা গ্রামে মুখ দেখাইতে পারি না। সবাই কয় তোর ফুফু গলা টিপা তগো ফুফারে মাইরা ফালাইয়া তর বাপেরে সব সম্পত্তি দিছে। তাই তুমারে আর আমরা আমাগো সাথে রাখা পারতেছি না আবার তাই বইলা এক্কেবারে ফালাইয়াও দিবার পারুম না। তুমারে ওই উত্তরে বাঁশ ছোপের যে ভিটাডা আছে ওই জাগায় একটা ছাপরা উঠাইয়া দিমু ওই হানে থাকবা। তুমি এই বাড়ি ছাইড়া আমাগো একটু নিরিবিলি থাকবার দেও।
দেখতে দেখতে দূরের আকাশের কাল মেঘগুলা অনেক নিচে নেমে এসে আম্বিয়া বেগমকে ছেয়ে ফেলল। আম্বিয়া বেগম কাল মেঘের নিচে ঢাকা পড়ে গেল, সেখান থেকে তার আর বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই সামনে শুধু ধু ধু মরীচিকা।

আবার দেখা হবে যেদিন মরীচিকার আধার মুছে গিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ হাসতে থাকবে।

বাতায়নে একা

1 (7)

বাতায়নে ভাবি বসে একা
হবে কি আবার দেখা
সেদিন দেখেছি শিউলি তলায়
দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি একা।।

যদি জানতে মনের কথা
তবে ভাবতে বসে আনমনে একা
আমি ভেবেছি তোমার কথা
আবার যদি হয় দেখা।।

শুধু ভেবেছি বসে সে দিন
কেন ভালবেসেছি বলিনি তোমায়
চিঠি লিখেছি মনে মনে
কাগজে হয়নি লেখা।।

জীবনের অণু পরমাণু-৬ (দীর্ঘ হচ্ছে তালিকা)

Art (3)

ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যথা, আশা নিরাশা, সাধ স্বপ্ন, শিক্ষা দীক্ষা, আচার আচরণ কত কি নিয়ে আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই সফল কিংবা বিফল। একবার বিফল হলে সফল হবার স্বপ্ন মুছে যায় কিন্তু সফল হলে যে কোন সময় আবার বিফল হবার ঝুঁকি থেকেই যায় সবই ক্ষণকালের জন্য। সফলতা অর্জন করা যেমন কঠিন তেমনি সফলতা জিইয়ে রাখা তার চেয়েও অধিক কঠিন।

কত প্রিয় জন হারিয়ে যায় আবার কত অচেনা আপন হয়। সত্যিই পৃথিবীর নিয়ম শৃঙ্খলা আর মন মানসিকতা বড়ই জটিল, বোঝা আরও জটিল। একবারই মাত্র পা পিছলে যাওয়া মেনে নিতে পারে দ্বিতীয় বার কোন মতেই মেনে নিতে পারে না। ভদ্রতা মানে দুর্বলতা নয় প্রমাণ করতেই কখনও কখনও অভদ্র হতেই হয় নইলে দুর্বলই থেকে যেতে হয়।
কখনও ঝড় আবার কখনও শান্ত প্রকৃতির কি এক ইচ্ছের খেলা! কাউকে কিছুই বলার কোন সুযোগ দেয় না, কারও কোন মান অভিমান, সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনায় কোন চাঞ্চল্য নেই, সর্বত্রই নির্বিকার। আপন মনে আপন খেয়ালেই মগ্ন।

প্রথমে দোয়া করতাম আমার দাদা মৃত আলাউদ্দিন বিশ্বাসের জন্য পরে যুক্ত হলো দাদি, এর পরে নানা তারপরে নানী, এভাবে তালিকা শুধু দীর্ঘ হতে শুরু করল। একে একে যুক্ত হলো শশুর, চাচা, মামা-মামি, মা, ফুপু, মেয়ে, বাবা, শাশুড়ি সর্ব শেষ গত পরশু যুক্ত হলো আমার চাচী। প্রকৃতির বিধান নতুনের জন্য এই ক্ষুদ্র পৃথিবীতে জায়গা করে দিতে হবে তাই পুরনোদের চলে যাওয়া, রেখে যায় শুধু স্মৃতি যা একদিন মুছে যায়। এমনি করেই চলে যায় দিন, মাস, বছর, জীবন।

স্বপ্ন সুদূর

1 (1)

ওই রূপালি চাঁদ
আর ঝিলিমিলি তারা
ডেকে বলে আমায়
শোনাবে গান রাতের আকাশ।।

যেখানেই তুমি থাক না কেন
এসো না কাছে
এ গানের নিমন্ত্রণে,
শুধু গান গেয়ে আজ
ভরিয়ে দেব দখিণা বাতাস।।

চল না আজ হারিয়ে যাই
সুদূর পানে
একান্ত সঙ্গোপনে
দুজনাকে ভালোবেসে আজ
রেখে যাই শুধু ইতিহাস।।

একটা গান শোনা যেতে পারে কি?

আজকের বসন্তের এই সোনাঝরা বিকেলে শীত শীত আবেশে একটা গান হলে মন্দ কী?
সেই অনেক অনেক দিন আগের কথা যখন পশুর নদী দিয়ে অনেক পানি বয়ে যেত বঙ্গোপসাগরে আর আমি মংলার বাসার বারান্দায় বসে ওই পশুর নদীর বয়ে যাওয়া দেখতাম তখনকার কথা। একবার অফিসের এক প্রটোকল ডিউটি পরেছিল (প্রায়ই হতো)। হিরন পয়েন্টে কোন এক বিদেশি মন্ত্রি পর্যায়ের অতি মূল্যবান ব্যাক্তিদের সাথে মিটিং হবে এবং মিটিং সহ মংলা বন্দরের ঝিনুক জাহাজে করে তাদের যাতায়াত এবং থাকা খাওয়ার যাবতিয় দায়িত্ব আমার। সাথে আমাদের ডাক্তার, সিনিয়র সিকিউরিটি অফিসার, চেয়ারম্যান সাহেবের পিএস সহ অনেক উর্ধ্বতন অফিসাররাও ছিলেন।

রাতের খাবার শেষে সবাইকে রেস্ট হাউসে এবং জাহাজে মিলিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে ছাদে গেলাম। আহ! কী যে অপূর্ব দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভরা পূর্ণিমার চাদের আলোয় দক্ষিণের সাগর আর চারিদিকে সুন্দরবনের গাছপালা। মনে গুঞ্জরিত হচ্ছিল যে কথাগুলি সেই কথাই পকেটের কলম আর ছোট্ট (VIP দের সাথে গেলে কে কখন কি বলে তা মনে রাখার জন্য কাগজ কলম সাথে রাখতে হয়) নোট খাতায় টুকে রাখলাম। দেখে ডাক্তার জিজ্ঞেস করল কি হচ্ছে, লিখছেন? হ্যা এটাই উপযুক্ত সময় আর উপযুক্ত জায়গা লিখে ফেলুন।

সেদিনের মত লিখে নিয়ে সাথে নিয়ে আসলাম। কয়েকদিন পরে শতদলের হাতে দিয়ে বললাম নেন দাদা এবার আপনার কাজ!
সেই স্মৃতি আজ এখানেও চলে এসেছে আজ!

youtu.be/crZtvYj0Wxw