নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

জীবনের গল্প-১৫

জীবনের গল্প-১৪-এর শেষাংশ: দুইদিন পর থেকে কাজ জয়েন্ট করবো বলে, অফিস থেকে বের হলাম। নিচে এসে সব তাঁতিদের সাথে দেখা করে মিল থেকে বের হওয়ার সময় মিস্ত্রি আমার হাতে ২০০/= টাকা দিয়ে বললো, এটা আজকের কাজের মজুরি। ২০০/= টাকা থেকে কানাইকে ১০০/= টাকা দিয়ে মিল থেকে বের হয়ে বাসায় চলে গেলাম।

বাসায় গিয়ে বড় দাদাকে সবকিছু জানালাম। বড়দাদা খুশি হলেন। মাও খুশি হলেন। পরদিন সকালে ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কানাইকে নিয়ে কাজ করলাম। কাজ সেরে বড় দাদাকে সাথে নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, আমি ফরিদপুর যাওয়ার পর যেই লোক কাজ করেছিলো; আগামীকাল থেকে ফতুল্লার ঐ লোকই এখানে কাজ করবে। জানানোর পর ম্যানেজার সাহেব রাগ করিনি। রাগ না করার কারণও ছিলো, কারণ হলো, ফাইন টেক্সটাই মিলের কাজ হলো চুক্তিতে। ভীম প্রতি ৭০ টাকা। এতে প্রতিমাসে আমি ২০০০/= টাকার বেশি রোজগার করতে পারতাম না। আর এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানে বেতনভুক্ত। কাজ হোক আর না হোক, মাস শেষে আমার মূল বেতন হতে আসবেই। ম্যানেজার সাহেব আমার বেতন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, বেতন কত? বললাম, ‘বেশি না স্যার, মাত্র ৬০০০/=টাকা। তা শুনে ম্যানেজার সাহেব খুব খুশি হলেন।

এরপর ফতুল্লা গেলাম, কথা বলে রাখা ওই লোককে খুঁজতে। তাঁকে খুঁজে বের করে আগামীকাল সকাল থেকেই ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করার জন্য বললাম। তিনি তাতে রাজি হলেন, খুশিও হলেন। আমরা দুইজন বাসায় রওনা দিলাম। বাসায় যাওয়ার পথেই কানাইর সাথেও ওঁর বেতন নিয়ে ফয়সালা করে ফেললাম। কানাইকে প্রতিমাসে ১৫০০/=টাকা দিতে হবে। ও অবশ্য ২০০০/=টাকা চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওঁর সারাদিনের টুকটাক খরচ আমার উপর নিয়ে ওঁকে ১৫০০/= টাকায়ই রাজি করলাম। কানাইরও এটা ছিলো প্রথম বেতনভুক্ত চাকরি। তাই আর ও বেশি মন খারাপ করেনি বরং খুশিই হয়েছিলো। এর পরদিন থেকেই ওয়েল টেক্সে কাজ করা শুরু করি। দুইদিন পরই মিলের দুইজন অপরিচিত শ্রমিক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো মিলের বাইরে। মিলের বাইরে গিয়ে এক চায়ের দোকানে আমাকে বসতে দিলেন, তাঁরাও বসলেন। তাঁদের একজনের নাম, মোহাম্মদ হাসেম মিয়া। আরেকজনের নাম, নূরমোহাম্মদ।

আমি মনে মনে ভাবছি, তাঁরা কি আমার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করবে নাকি! কিন্তু না, তাঁরা আমাকে বললো, ‘আপনি এখানে এসে সব শ্রমিকদের বাঁচালেন। এতে আমরা খুবই খুশি! তবে দাদা একটা কথা ছিলো–যদি কারোর কাছে না বলেন, তাহলে আপনাকে খুলে বলতে পারি!’ তাঁদের কতা শুনে আমি বললাম, ‘বলুন, কী বলতে চান?’ আমার কথায় তাঁরা হাসলে! বললে, ‘আমরা একটা কাজ করতে যাচ্ছি, আশা করি আমাদের সাথে থাকবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা এমন কী কাজ যে, আপনারা আমার সহযোগিতা চাচ্ছে?’ বললেন, ‘আমরা অলরেডি মিলে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করে ফেলেছি! তার কাগজপত্র দুইএক দিনের মধ্যে হতে আসলেই, আমরা মিল গেইটে সাইনবোর্ড টাঙাবো। এখন খরচ বাবদ আপনাকে সবার সমতুল্য পরিমাণ চাঁদা দিতে হবে।’ তাঁদের কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে খুবই খুশি হলাম! তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাঁদা কত?’ বললো, ‘বেশি না দাদা, মাত্র ৭০০/=টাকা।’ আমি বললাম, ‘আমিতো কেবলমাত্র মিলে জয়েন করলাম দাদা। ৭০০/=টাকা নিতে হবে আমার বেতন হলে।’ আমার কথায় তাঁরা দুইজন খুশি হয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা, তা আপনি বেতন হলেই দিবেন; কিন্তু এব্যাপারে কারোর সাথে কিছু বলবেন না। যদি বলেন, তাহলে হয়তো এক কান, দুই কান হতে হতে মালিকের কানে চলে যেতে পারে। তাতে আমাদের সকলের সমস্যা হতে পারে!’ এই বলেই চা দোকান থেকে উঠে মিলে গিয়ে কাজ করলাম।

মিলের কাজ সেরে সারাদিন পর বাসায় গেলাম। মিলের ইউনিয়নের ব্যাপারে বড় দাদার সাথে আলাপ করলাম। আমার কথা শুনে আমার বড়দাদা খুশি হলেন! এর কয়েকদিন পরই মিলের গেইটে বড় একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হলো। সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা, ওয়েল টেক্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন তা দেখে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মাথা নষ্ট হলেও, মিলের শ্রমিকদের হইহুল্লোড় আনন্দ-ফুর্তি শুরু হয়ে হলো। মিল মালিক নিরুপায় হয়ে একসময় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনেও নিলো। মিলের সব শ্রমিকদের চাকরিও পাকাপোক্ত হলো। একসময় পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের ঘন্টা বেজে উঠলে, ফাইন টেক্সটাইল মিল থেকে ঐ কালাম একদিন আমার সাথে দেখা করতে ওয়েল টেক্সে আসে। কালাম এসে এই ঈদে ওঁদের বাড়ি বেড়াতে যেতে অনুরোধ করলো। আমি ঈদের ছুটিতে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কালামকে কথাও দিলাম। কালাম খুব খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলো।

এর দুইদিন পরই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। এর আগেই কানাইকে বলে রেখেছিলাম, ঈদের দিন সকলেই সেজেগুজে ওঁদের বাসা থেকে আমার বাসায় চলে আসতে। কানাই আমার কথার বরখেলাপ করলো না, ঈদের দিন সকালে ঠিক সময়ে কানাই আমার চলে আসলো। আমি মায়ের কাছে বলে-কয়ে কানাইকে সাথে নিয়ে সুবচনীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মিনিবাসে চড়ে গেলাম ফতুল্লা। নামলাম ফতুল্লা লঞ্চঘাটের সামনেই। লঞ্চঘাটের টোল দিলাম জনপ্রতি আট আনা করে দুইজনের ১টাকা। বালিগাঁওর লঞ্চ ফতুল্লা ঘাটেই যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলো। তাড়াতাড়ি লঞ্চে উঠে দুইজন উপরেই দাঁড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো। ফতুল্লা থেকে সুবচনী যেতে কয়েকটি ঘটে যাত্রী ওঠানামা করে। ফতুল্লার পর বক্তবলী। এরপর কাঠপট্টি, বেতকা, তালতলা, সুবচনী। সবশেষে বালিগাঁও। কালাম এর আগের বার যাওয়ার সময়টা ঠিক রেখে সময়মতো লঞ্চঘাটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। লাঞ্চ সুবচনী ঘাটে ভিড়ানোর পর আমারা লঞ্চ থেকেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লঞ্চের যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা লঞ্চ থেকেই কালামকে হাতে ইশারা দিয়ে সুবচনী ঘাটে নামলাম। লঞ্চ থেকে নেমেই আমি কানাইর হাতে ৩০০/= টাকা দিয়ে বাজারের ভেতরে পাঠালাম, পান-সুপারি-সহ কিছু মিষ্টি ও কিছু ফলফলাদির জন্য। আমি আর কালাম একটা চা দোকানে ঢুকলাম, চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। কানাই আমার কথামতো সবকিছু ঠিকঠাক মতো কেনাকাটা করে চায়ের দোকানে আসলো। চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে কালামদের নিজেদের নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকার মাঝি সেজেছে কালাম নিজেই। নৌকা চলছে হেলেদুলে।

বর্ষাকালে সুবচনীর খালটা ঠিক নদীর মতো দেখা যায়। সেসময় খালে খুব স্রোত থাকে। সুবচনীর খানটা যখন পাড় হচ্ছিলাম, আমার তখন ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার মনের ভয়টা টের পেয়েছে আমার বন্ধু কানাই। কানাই আমাকে শক্ত করে ধরে বসল। তবু আমার ভেতর থেকে ভয় যাচ্ছিল না। খাল পাড় হয়ে নৌকা যখন ফসলি জমির ওপর দিয়ে ছুটলো, তখনই আমার মন থেকে কিছুটা ভয় দূর হলো। নৌকা চলছে, আর আমি নৌকা থেকে আশে-পাশে থাকা গ্রামের ঘরবাড়িগুলো দেখছিলাম, মন ভরে। নৌকা থেকে পানির নিচের দিকে চেয়ে দেখি, বর্ষার স্বচ্ছ পরিস্কার পানির ওপর থেকে জমির নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে কতরকমের উদ্ভিদ ঢেউয়ের সাথে হেলে-দুলে নাচছে। নৌকা চলছে, কথাও চলছে কালামের সাথে। আমি নৌকার কার্নিশে বসে পানির সাথে জলকেলি খেলা খেলছি। কখনও আবার ভেসে থাকা জাতীয় ফুল শাপলা টেনে তুলছি। এভাবে নৌকা চলতে-চলতে একসময় আমরা কালামদের বাড়ির সামনে চলে আসলাম।

বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ার আগেই কালাম বলছে, ‘এসে গেছি ওস্তাদ! কালামের কথা শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে দেখি, এ কী কাণ্ড! এখানে এত মানুষ কেন? আমি কালামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালাম, বাড়ির ঘাটে এত মানুষ কেন?’ কালাম বলল, ‘ওস্তাদ, আপনারা নারায়ণগঞ্জের মানুষ। আবার হলেন আমার ওস্তাদ! তাই এতো মানুষ! এর আগে আমাদের বাড়ি এসেই তো সবার মন জোগাড় করে ফেলেছেন। আপনারা আসবেন, তা আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ি এসেই গ্রামের সবাইর কাছে বলেছিলাম। আবার আজ নৌকা নিয়ে বাড়ি থেকে সুবচনী যাওয়ার সময়ও বাড়ির সবার কাছে বলে গিয়েছিলাম। তাই পাশের বাড়ির পোলাপানও ঘাটে অপেক্ষায় আছে। নামেন নামেন ওস্তাদ!’ ১০/১২ জন ছেলে-বুড়ে দেখে নিজের কাছে কেমন যেন শরম-শরম লাগছিল আমার। তবু নির্লজ্জের মতোই কানাই আর আমি নৌকা থেকে নেমে পাড়ে ওঠলাম। নৌকা থেকে নামার সময় মিষ্টি আর ফলগুলো কালাম হাতে নিয়ে নিল। সেদিন কালামদের ঘরটা আগে থেকেই পরি-পাটি করে রাখা হয়েছিল। ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে সামনে দিল দুই গ্লাস সরবত। সাথে আমাদের নেওয়া কিছু মিষ্টিও দিলো। কানাই আর আমি খেলাম। কালামের মা বড় ভাবীর সাথে কথা বললাম। কালামদের ঘর থেকে বের হলাম। সামনেই ঠাকুরবাড়ির বিশাল পুকুর। আমার উদ্দেশ্য হলো ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসবো।

কালামদের নয়াবাড়ি গ্রামটি দেখতে ঠিক সেন্টমার্টিনের একটা দ্বীপের মতো। আয়তনে বেশি একটা বড় না হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে কম নয়। পুরো গ্রামটির মাঝখানেই ঠাকুরবাড়ির এই বিশাল পুকুরটি। প্রতিদিন সকাল-বিকাল পুরো গ্রামের লোক এই পুকুর ঘাটলায় বসে আড্ড দেয়। খেলা-ধুলাও চলে। কেউ লুডু। কেউ ষোলগুটি। কেউ তাসখেলা।আমরা পুকুর ঘাটে আসার সময় কালামের বড়ভাই সালামও আমাদের সাথে ছিল। তখন ঘাটলায় চলছিল গ্রামের ছেলে-বুড়োদের আড্ডা। বর্ষাকাল, গ্রামের মানুষের কাজকর্ম নেই, তাই সময় কাটানোর আড্ডা। আমাদের দেখেই সবাই তাকিয়ে আছে। দুই-একজন লোক আবার হাতের তাস রেখে দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি ঘাটলায় যাদের দেখতে মুরুব্বির মতো, তাদের নমস্কার জানালাম। যাঁরা এর আগের বার আমাদের দেখেনি, তাঁদের মধ্যে একজন লোক কালামের বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কারা? বাড়ি কোথায়? কী করে?’ আরও অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলো। কালামের বড়ভাই, মুরুব্বিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এরা একজন আমার ছোট ভাই কালামের ওস্তাদ, আরেকজন বন্ধু। কালাম যেই মিলে কাজ করে, সেই মিলের ওস্তাদ। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ঈদের বন্ধ পেয়ে আমাদের বাড়ি এসেছে বেড়াতে।’ কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে মুরুব্বি দুইজন হ্যাণ্ডশেক করলো। সিঁড়ি ঘাটলায় বসতে বললো। আমরা দুইজন বসলাম।

আমি ঘাটে বসেই সত্যগুরুর বাড়িটির দিকেই বেশি ফলো করছিলাম। কারণ, বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিল, তাই। আগের দিনের তৈরি বাড়ি, সাথে তিন চারটা ঘর। আবার বাড়ির ভেতরে একটা বড় ঠাকুরঘ। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটলা! বাড়ির চারদিকে গাছগাছালি ভরা। আমরা ঘাটে বসা থাকতেই ওই বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে আসলো। ওদের দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, ওরা দুই বোন। ধারণা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য কানাইকে বললাম, ‘কানাই, মেয়ে দুইটি কে? তুই সালাম ভাইয়ের কাছ থেকে একটু জেনে নে।’ কালাম তখন ঘাটলায় ছিলো না। কালাম গেছে আবার সুবচনী বাজারে। আমাদের সাথে বসা আছে কালামের বড়ভাই সালামা মিয়া। আমার কথায় কানাই সালাম ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে। কিছুক্ষণ পর কানাই আমার কাছে এলো।

আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে কানাই, সালাম ভাই কী বললো?’ আমার কথার উত্তরে কানাই বললো, ‘সালাম দাদা বললো, ‘তোকে এই গ্রামেই বিয়ে করাবে, বুজলি।’ আমি বললাম, ‘বলে কী? তো মেয়ে কোথায়? মেয়ে দেখাতে বল! যদি আমার পছন্দ হয় তবে বিয়ে করতেও পারি! আমার মায়ের খুবই কষ্ট হচ্ছে রে কানাই। বিয়েটা তাড়াতাড়িই করতে হবে।’ কানাই আমার কথার জবাবে বললো, ‘মেয়ে তো কয়েকবারই এখানে বসে বসে দেখেছিস। এবার বল, পছন্দ হয়েছে কিনা?’ আমি কানাইর কথায় অবাক হয়নি! কেন হয় নি? সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখা যাচ্ছিল!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৬ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

ঝামেলা মুক্ত

শূন্য হাতে এসেছিলাম এই ভবে,
ছিলাম শিশু, হলাম যুবক, হলাম বৃদ্ধ–
সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার এভাবে!

তবুও ভাবি, “কেউ অবশিষ্ট জীবন নিয়ে,
এ-কে মারি, ও-কে ধরি, সম্পদের পাহাড় গড়ে–
ভাবে নাতো একবার, কী হবে এসব দিয়ে?
মৃত্যুর পরে ঘরে বাইরে হিসাব চলবে,
কী আছে সম্পদ, কত আছে টাকা–
আত্মীয়স্বজন সবাই সম্পদের হিসাব কষবে!”

আমার নেই সম্পদ, নেই টাকাকড়ি,
শূন্য হাতে এসে শূন্যতেই থাকি–
আমি ঝামেলা মুক্ত, হিসাবের না ধার ধারি!

চা-পাতার কাল্পনিক ইতিহাস

একদা এক রাজা সপরিবারে তাঁর মুল্লুক ভ্রমণে বের হলেন। রাজ ভ্রমণ বহনে ছিলো ঘোড়ার গাড়ি টমটম। ভ্রমণ সঙ্গী হলেন, সেনাপতি, উজির, নাজির, কোতোয়াল-সহ কয়েক দল সৈন্যসামন্ত। রাজা-রানি ছিলেন, টমটম গাড়িতে। উজির, নাজির, কোতোয়াল ছিলেন, তাদের পরিবহন করার মতো গাড়িতে। ভ্রমণ যাত্রাকালে রাজার গড়ি বহরের দুইপাশে ছিলো ঘোড়ারোহী বিশ্বস্ত সৈন্যদল। গাড়ি বহরের পেছনে ছিলো যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষ সৈন্যবাহিনী। ভ্রমণ যাত্রার সর্ব প্রথমে ছিলো, রাজার বিশ্বস্ত সেনাপতি ও বিশেষ ধরনের বাদ্য বিশারদ ব্যান্ডপার্টির দল। ব্যান্ডপার্টির দল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাস্তার আশেপাশের মানুষদের জানিয়ে দিচ্ছিল, ‘রাজা মহাশয় কোনোএক জায়গায় যাচ্ছে।’ বাজনার তালে-তালে হেলে-দুলে রাজার গাড়ি বহরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। একসময় গাড়ি বহর এগিয়ে যাচ্ছিল এক বনের ভেতর দিয়ে।

বনটি ছিলো খুবই সুন্দর পরিপাটি। সুন্দর গাছ-গাছালী আর নানাজাতের পাখ- পাখালিতে ছিলো বনটির অন্যরকম এক সৌন্দর্য আকর্ষণ। বনের সেই সৌন্দর্যে রাজাকে করেছিলো মুগ্ধ! রাজা সেই বনের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি করতে চাইলেন। ওমনি উজির, নাজির, কোতোয়াল সেনাপতিকে যাত্রাবিরতি করতে বললেন। সেনাপতি উজির নাজির কোতোয়াল সাহেবের হুকুম পেয়ে সেই বনের মাঝে যাত্রাবিরতি করলেন। রাজা-রানি টমটমগাড়ি থেকে নেমে বনের মাটিতে পা রাখলেন। সাথে যাওয়া সফরসঙ্গী দাস-দাসীরা রাজা-রানি বসার জন্য চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে বিছিয়ে দিলেন। রাজা-রানি কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলেন। এ-ই ফাঁকে সাথে যাওয়া দাস- সাসীরাও রাজাকে সন্তুষ্টি করার জন্য হালকা কিছু খাবারের আয়োজন করে ফেললেন। কিছুক্ষণ পর রাজা-রানি চেয়ারে এসে বসলেন, শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্য। দাস-দাসীরা আয়োজন করা সেসব খাবার রাজা-রানির সামনে এনে দিলেন। সেসব খাবারের সাথে কিছু গরম পানিও ছিলো। কারণ রাজা তখন ঠাণ্ডাজনিত রোগে ভুগছিলেন, তাই গরম পানির সুব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

সারি সারি সাজানো বিছানো চেয়ার-টেবিলের একপাশে বসা ছিলেন রাজা-রানি। অন্যপাশে বসা ছিলেন রাজার উজির, নাজির, কোতোয়াল, সেনাপতি। সবার সামনেই খাবার দেওয়া হয়েছিল। রানি-সহ সবাই মনের আনন্দে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল আর খাবার খাচ্ছিলো। কিন্তু রাজা তখনো চেয়ে চেয়ে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। একসময় বনের খোলা বাতাসে রাজার সামনে থাকা গরম পানিতে নাম না জানা গাছের একটা পাতা উড়ে এসে পড়লো। গরম পানিতে গাছের পাতাটি পড়ার সাথে সাথে পুরো পাত্রের পানি লালচে হয়ে গেলো। তা দেখে রাজা রীতিমতো অবাক হয়ে বিষ্ময় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলো। কিন্তু তা রাজার রানি-সহ সফরসঙ্গী কারোই দৃষ্টিগোচর হলো না। সবাই মনের আনন্দে হাউত-মাউত করে খাবার খেয়েই যাচ্ছিল।

এদিকে রাজা পানির পাত্রে থাকা গরম পানির এ অবস্থা দেখেই যাচ্ছিল। যতই সময় যাচ্ছিল, ততই গরম পানির রং আরও লাল হতে লাগলো। রাজাও ভাবতে লাগলো, ঘটনাটা কী? কিন্তু রাজা অনেক চিন্তাভাবনা করেও গরম পানির লাল রং হয়ে যাবার রহস্য উদঘাটন করতে পারলেন না। সামনে থাকা আরও আরও খাবারও খাচ্ছিলেন না। রাজা ওই পানি নিয়েই ভাবতে লাগলেন! রাজা ভাবতে ভাবতে একসময় লাল হয়ে যাওয়া গরম পানিতে ডানহাতের তর্জনী আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখতে লাগলেন। নেড়ে-চেড়ে দেখতে দেখতে একসময় রাজা পানিতে ভিজে যাওয়া হাতের তর্জনী আঙুলটা মুখে দিলেন। তর্জনী আঙুল মুখে দেওয়ার পর রাজা গাছের পাতা পড়ে লাল হয়ে যাওয়া পানি পরম তৃপ্তি পেলেন!

তৃপ্তি পাবার পর রাজা ভিজে যাওয়া আঙুলটা চুষতে লাগলেন। রাজা নিজের আঙুল চুষতে চুষতে মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘বেশ তো! দারুণ স্বাদের পানি হয়েছে তো! এরকম পানি তো আমি জীবনেও পান করিনি?’ এ-ই বলেই পাত্রে থাকা সবটুকু পানিই রাজা পান করে ফেললেন। কিন্তু আর কোনও খাবারই খেলেন না। তখন সফরসঙ্গী উজির সাহেব রাজার না খাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। রাজা বললেন, ‘আজ একমুহূর্তে এমন একধরনের পানি আমি পান করেছি, এতেই আমার আজকের খাবারের চাহিদা মিটে গেলো। আর কোনও কিছুরই দরকার হবে না। এই পানি পানেই আমার চলবে।’ এরপর সফরসঙ্গী সবাই কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘এখানে আয়োজন করা খাবারের মধ্যে কোনধরনের পানি ছিলো? যা খেয়ে আপনি পরম তৃপ্তি পেলেন?’ জবাবে রাজা বললেন, ‘আমার সামনে থাকা গরম পানি পান করেই আমি পরম তৃপ্তি পেয়েছি। তবে গরম পানি ছিলো স্বচ্ছ সাদা। আর আমি পানি করেছি লাল রঙের গরম পানি।

রাজার কথা শুনে সফরসঙ্গী দাস-দাসী ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। ভয়ের কারণ হলো, পানি দেওয়া হয়েছিলো সাধারণ গরম পানি। আর রাজা বলছে লাল গরম পানি! দাস-দাসীরা কাঁপতে কাঁপতে ভাবতে লাগলো, ‘লাল রঙের পানি এখানে আসলো কী করে?’ সফরসঙ্গী বিশ্বস্ত দাস-দাসীদের শারীরিক কাঁপুনি দেখে রাজা হাসতে হাসতে অভয় দিয়ে বললো, ‘তোমরা কেউ ভয় পেও না। আমার সামনে থাকা পানির রং লাল হওয়ার পেছনে একটা গাছের পাতার ভূমিকা আছে। ওই পাতা গরম পানিতে পড়ার সাথে সাথে পানির রং লালচে হয়ে গেছে। আর এই লালচে পানি পান করে আমি এতোটাই তৃপ্তি পেয়েছি যে, আমার ঠাণ্ডা লাগা ভাব দূর হয়েছে। আমার মানসিক অবস্থা চাঙা হয়েছে। শারীরিক ক্লান্তির অবসান ঘটেছে।’

তখন রাজার সফরসঙ্গী সবাই আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কোন গাছের কোন পাতা? যে পাতায় গরম পানি লাল হয়ে গেলো এবং পানি পানে পরম তৃপ্তি অনুভব করছেন?’ তখন রাজা পানির পাত্র থেকে নাম না জানা গাছের পাতাটি উঠিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বললো, ‘আজকে আমার ভ্রমণ এখানে এই বনেই শেষ করলাম। তবে যথাশীঘ্র বন থেকে রাজমহলে ফিরে যাচ্ছি না। সবাইকে খুঁজে বের করতে হবে, এই পাতাটি কোন গাছের পাতা? যতক্ষণ না পর্যন্ত এই পাতার গাছটিকে খুঁজে বের করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই বনেই থাকতে হচ্ছে। কাজেই, আপনারা সবাই বনের ভেতরে ঘুরে-ফিরে এই বিশেষ ধরনের পাতার গাছটির সন্ধান করুন। যিনি প্রথমে খুঁজে বের করতে পারবেন, তাকে আমি উপযুক্ত বকসিস দিবো!’

রাজার এই ঘোষণায় সফরসঙ্গী উজির, নাজির, কোতোয়াল, সেনাপতি সৈন্যদলের সৈন্যরা, দাস-দাসীরা সবাই গরম পানিতে পড়া পাতার গাছটি খুঁজে বের করতে পুরো বনটা ওলট-পালট করে ফেলতে লাগলো। কিন্তু সন্ধান পাচ্ছিল না। একসময় এক দাসী গরম পানিতে পড়া পাতার গাছটি খুঁজে পেলো। রাজা নিজ হাতে থাকা পাতাটির সাথে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মিলিয়ে নিশ্চিত হলেন, ঠিক এই গাছেরই পাতা। গাছটি ছিলো আকারে খুবই ছোট। তবে ঝাপটা। পুরো বনে এই একটা গাছই পাওয়া গিয়েছিল। তখন রাজা মনের আনন্দে ওই দাসীকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করলেন এবং খুঁজে পাওয়া গাছটিকে বন থেকে মাটি-সহ উঠিয়ে রাজার মহলের পাশে রোপণ করতে হুকুম দিলেন। রাজার হুকুম বলে কথা! হুকুম দিতে দেরি হয় ঠিক! কিন্তু কাজ হতে দেরি হয় না!

তারপর বন থেকে ছোট আকারের গাছটিকে মাটি সহকারে উঠিয়ে রাজার মহলের একপাশে রোপণ করে রাখা হলো। দিনে দিনে গাছটিও তাজা হতে লাগলো। গাছের ডাল-পালাও গজাতে শুরু করলো। রাজাও গাছের পরিচর্যা করার জন্য লোক নিয়োগ-সহ পাতা নিয়ে গবেষণা করতে গবেষকও নিয়োগ দিলো। গবেষকরা প্রথমে গাছের শুকনো পাতা শিলপাটায় বেটে গুড়ো করলো। তারপর পানি লাল হয় কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য গুড়ো গুলো গরম পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু গরম পানি কিছুতেই লাল হলো না। তারপর আবার ওই গাছের কিছু কচিপাতা শিলপাটায় বেটে রোদে শুকানো হলো। সেই শুকনো গুড়ো গুলো গরম পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলো। যখনই গরম পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলো, তখনই পানি লাল রং ধারণ করতে লাগলো। একপর্যায়ে পাত্রে থাকা গরম পানি লালচে হয়ে গেলো। সেই পানিতে কিছু মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে গবেষকরা পান করে দেখলো।

গাছের কচিপাতার শুকনো গুড়ো মিশ্রিত লালচে গরম পানি করার পর সবাই তখন মহানন্দে দিশেহারা। সবাই জিভে তা মেরে বলতে লাগলো, “আহা্ কী মজা!” সেই মজার খবর মুহুর্তেই পৌঁছে গেলো রাজার কাছেও। সাথে গরম লালচে পানিও পৌঁছে গেলো। রাজা লালচে গরম পানি পানে সেদিনের বনের ভেতরের চেয়েও আরও বেশি তৃপ্তি পেলো। তারপর থেকে গাছটি নিয়ে শুরু হলো জোর গবেষণা আলোচনা-সহ গাছের বংশবৃদ্ধি করার জোর তৎপরতা। সেই থেকে আস্তে আস্তে দেশে দেশে শুরু হলো ওই গাছের বংশবৃদ্ধি-সহ সহজ উপায়ে গাছের পাতা গুড়ো করার কৌশল ও ব্যবহার। একসময় সেই গাছের সেই পাতার গুড়ো দেশে দেশে মানুষের হাতে হাতে ফ্রি বিতরণ করা হতো। সাথে দেওয়া হতো এর স্বাদ বাড়ানোর জন্য কিছু মিষ্টিজাতীয় চিনিও। উদ্দেশ্য ওই গাছের পাতার গুড়োর চাহিদা বাড়ানো এবং মানুষকে এর নেশায় আসক্ত করানো। তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়েছে। দিনে দিনে তুলনামূলকহারে এর ব্যবহারও অনেক বেড়েছে! চাহিদাও বেড়েছে প্রচুর!

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, একসময়ের ফ্রি পাতার গুড়োর নেশায় আজ আমরা সবাই আসক্ত! আজ আমরা ঘরে বাইরে ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো সবাই সেই বিষ্ময়কর গাছের পাতার রসের নেশায় এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, সকাল থেকে শুরু করে দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা আমাদের আরও অন্যান্য খাবারের সাথে ওই গাছের পাতার সুমধুর রস পান করতেই হচ্ছে। তা-ও আবার আমাদের দেশ-সহ বিশ্বের সব দেশের সব অঞ্চলে সমানতালেই চলছে ওই বিষ্ময়কর গাছের পাতার রস পান। যা সারাবিশ্বে আজ এটাকে একধরনের মহৌষধ বলেও গণ্য করা হয়। কেননা, ওই গাছের পাতার গরম পানি না হলে আমাদের আর হয়ই না। মোটকথা বিয়ে-সাদীতে, অতিথি আপ্যায়নে, রাজনৈতিক মঞ্চে, অফিস-আদালতে, দেশের অর্থনৈতিক চাঙা-সহ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণেও ওই বিষ্ময়কর গাছের পাতার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলেও বিশ্বাস। এখন সবার জানার কৌতুহল থাকতে পারে যে, তাহলে ওই বিষ্ময়কর গাছটির নাম কি? ওই বিষ্ময়কর গাছটির নাম, চা গাছ। আর পাতাটির নাম, চা-পাতা।

জানা যায় এই গাছটির আদি জন্মভূমি গণচীন। বর্তমানে এটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য উৎকৃষ্ট স্বচ্ছ গরিম পানীয় হিসেবেও গণ্য করা হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে আমাদের দেশের সিলেট অঞ্চলে ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চাষ।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখার সর্বশেষ গুটিকয়েক লাইনের তথ্যটুকু উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ। আর পুরো লেখা নিজের ধারণা মতে সাজিয়ে লেখা।

ছবি সংগ্রহ গুগল থেকে।

ক্ষুধা- প্রেম ও ঘুম

কিছু কথা আছে, ঠিক এমন– “ক্ষুধায় মানে না মরা ভাত, প্রেম মানে না জাত-বেজাত, ঘুমে মানে না ভাঙা খাট।”
উপরোল্লিখিত কথাগুলো এই বঙ্গদেশে প্রচলিত হয়েছে কবে থেকে, তা আমার জানা নেই। তবে মনে হয় কথাগুলো প্রচলিত হয়েছে এভাবে–

১। ক্ষুধা:
শুরু করি একজন ভিখারি দিয়ে। কারণ আগেকার সময়ে সমাজের সবচেয়ে ক্ষুধার্ত ব্যক্তি ও সবসময়ের জন্য অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি ভিখারি বা ভিখারিনী বা ভিক্ষুকদেরই বলা হতো। কারণ যারা পেশাদার ভিক্ষুক বা ভিখারি, তাদের ঘরে ছয়মাসের খাবারের ধান-চাল মজুদ থাকলেও তারা প্রতিদিনই ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়ে দ্বারেদ্বারে ঘুরে বেড়ায়। যে যা-ই দেয়, তা তারা হাত পেতে খুশি মনে নিয়ে নেয়। কেউ টাকা, কেউ পয়সা, কেউ ধান, কেউ চাল, কেউ ছেঁড়া-ফাঁড়া কাপড়চোপড়ও দিয়ে থাকে।

যারা ভিক্ষুককে চাল দেয়, তারা সবাই কিন্তু একরকম চালের ভাত খায় না। কেউ মিনিকেট চালের ভাত, কেউ পায়জম চালের ভাত, কেউ বাসমতী চালের ভাত, কেউ ইরি চালের ভাত খায়। ভিখারিকেও একেক জনে একেকরকম চাল ভিক্ষা দিয়ে থাকে। যে যেই চালই ভিক্ষা দিক-না-কেন, সবার দেওয়া চালই ভিখারি তার কাঁধে ঝুলানো ঝুলিতে একসাথে মিশিয়ে রাখে। তাই গ্রাম বাংলায় আরেকটা কথা প্রচলিত আছে, “ভিক্ষার চাল আকাড়াও ভালো।” কারণ, ভিখারির ক্ষুধা নিবারণের জন্য দুমুঠো চাল হলেই হয়। সেই চাল কাড়া না-কি আকাড়া, তা ভিখারি দেখেও দেখে না। এমনকি মোটা চিকন, ভালো-খারাপও বাছাই করার ভিখারির টাইম থাকে না। সেদিকে ভিখারির দেখারও দরকার নেই। ভিখারির দরকার পরিবারের সকলের দুবেলা আহারের সমপরিমাণ চাল। তা দিয়ে পরিবারের সকলের ক্ষুধা নিবারণ হলেই হয়। এর বেশিকিছু ভিখারির দেখা আর ভাবার দরকার নেই।

সেইসব বার-মিশালি চাল দিয়ে ভাত রান্না করার পর যদি ভাতের সাথে কালো কুচকুচে ভাতও থাকে, তাও ভিখারির পরিবার দুরছাই বলে ফেলে দেয় না। পরিবারের সকলেই ক্ষুধা নিবারণের জন্য মোটা-চিকন, মরা-তাজা চালের ভাত স্বাচ্ছন্দ্যে আহার করে জীবন বাঁচায়। তাই কথায় আছে, “ক্ষুধায় মানে না মরা ভাত।” এই প্রচলিত কথা শুধু যে একজন ভিখারির জন্যই তা কিন্তু নয়! এই কথাটা সবার জন্যই। কেননা, ক্ষুধা শুধু একজন ভিখারিরই থাকে না, ক্ষুধা ধনী গরিব সকলেরই থাকে। আর একজন মানুষের যখন ক্ষুধা লাগে, তখন ক্ষুধার জ্বালা কেউ সহ্য করতে পারে না। এই ক্ষুধার জ্বালা মেটানোর জন্য দরকার শুধু খাবার। অনেকেই আছে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বাসি-পঁচা খাবারও খামচে খেয়ে ফেলে। তাই কথায় বলে, “ক্ষুধায় মানে না মরা ভাত।”

২। প্রেম:
কথায় আছে, “প্রেমের পবিত্র শিখা চিরদিন জ্বলে। স্বর্গ হতো আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে।” যার নাম প্রেম মানে পিরিতি, প্রেম মানে মোহাব্বত, প্রেম মানে ভালোবাসা। অনেকেরই রজকিনী চণ্ডিদাস’র প্রেম কাহিনী জানা আছে। তারপরও লেখার ভাব প্রকাশের কারণে রজকিনী চণ্ডিদাস’র প্রেম কাহিনী আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে টানতে হচ্ছে। রজকিনী ছিলো দাস’র মেয়ে। মানে ধোপা’র মেয়ে। ধোপা হলো, যারা পাড়া প্রতিবেশির পুরানো কাপড়চোপড় ধোয়ার কাজ করে থাকে, হিন্দু সমাজে তাদের ধোপা বলে। এই ধোপার মেয়ে ছিলো রজকিনী।

আর চণ্ডিদাস ছিলো এক ব্রাহ্মণের ছেলে। ব্রাহ্মণ হলো হিন্দু সমাজে উচ্চ বংশ। সে-সব ব্রাহ্মনদের পুরোহিতও বলে থাকে। অনেকে গোসাই, ঠাকুর, কর্তা বলেও সম্বোধ করে থাকে। তাদের নামের শেষে চক্রবর্তী টাইটেল বসানো থাকে। তো চন্ডিদাসও ছিলো একজন ব্রাহ্মণের ছেলে ব্রাহ্মণ। তখোকার সময়ে হিন্দু সমাজে জাতে- গোত্রে মিল না থাকলে বিয়ের কথা ভাবাই যেতো না, বিয়ে করা তো দূরের কথা! কিন্তু চণ্ডিদাস ধোপার মেয়ে রজকিনীর রূপে মগ্ন হয়ে মনে মনে তাকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু তখনকার সময়ে হিন্দু সমাজে তা কখনোই মেনে নিবে না! তবুও ব্রাহ্মণের ছেলে চণ্ডিদাস সে-সব নিয়মের তোয়াক্কা করেনি। নিয়মের তোয়াক্কা না করে ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস রজকিনীকেই মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলে। অবশ্যই শেষতক রজকিনীকে প্রেমিক চণ্ডিদাস জীবনসঙ্গিনী করতে পারেনি। তবুও ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস রজকিনীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে মরতে ছিলো।

একসময় দূরের এক গাঁয়ে রজকিনীর বিয়ে ঠিক হলো। বিয়েও হলো। বিয়ের পর রজকিনী পালকি চড়ে শ্বশুরালয়ে যাচ্ছিলো। ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস পাগলের মতো হয়ে শেষবারের মতো রজকিনীকে দেখতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। পালকির ভেতরে রজকিনী। চার বেহারা কাঁধে করে পালকি নিয়ে যাচ্ছে। ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস একদৃষ্টে চেয়ে আছে। অনেক দূর চলে গেলেও চণ্ডিদাস উঁকি মেরে দেখেই ছিলো। যখন আর রজকিনীর পালকি দেখা যাচ্ছিলো না, তখন ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস রাস্তার পাশে থাকা একটা গাছে উঠল। গাছে উঠে প্রিয়তমা রজকিনীকে বহন করা পালকি তেখতে লাগলো। পালকি চোখের আড়াল হলেই, ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস আরও একটু উঁচুতে উঠতে থাকলো। এভাবে একটু একটু করে গাছের শেষ মাথার উপরে উঠে উঁকি মেরে রজকিনীর পালকি দেখতে লাগলো। একসময় গাছের উপরিভাগের ডাল ভেঙে নিচে পড়ে ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।

এমন হাজারো প্রেমকাহিনী এই সুন্দর পৃথিবীতে অনেক আছে। তা অনেকেরই জানা আছে। এই প্রেমের কারণে কতো মানুষ নিজের মা-বাবাকে ত্যাগ করে। নিজের ধর্মকেও বিসর্জন দিয়ে ফেলে। কি হিন্দু, কি মুসলিম, কি খ্রিস্টান, কি বৌদ্ধ আর মেথর চাঁড়াল। প্রেমে কোনও ধনী গরিব, ধর্ম-কর্মই মানতে চায় না। মানেও না। তাই এপার বাংলা ওপার বাংলায় প্রেম নিয়ে এই কথাটা প্রচলিত আছে, “প্রেমে মানে না জাত-বেজাত।”

৩। ঘুম:
কথায় আছে, “ঘুমে মানে না ভাঙা খাট।” কথাটা প্রচলিত হয়েছে মনে হয় এভাবে– একজন মনুষ সারাদিন পরিশ্রম করার পর যদি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে না পারে, তাহলে ওই মানুষ পরদিন আর কাজ করার শক্তি পাবে না। হোক সে বীর পালোয়ান, আর নাহয় হোক কোনো দুর্বল ব্যক্তি। সবাইকেই নিজের শরীর ঠিক রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। তাই একজন রুগী ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে, বিজ্ঞ ডাক্তার রুগীকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, “রাতে ঘুম কেমন হয়?” রুগী যদি বলে, ‘ঘুম কম হয় বা ঘুম হয়-ই না!’ তখন বিজ্ঞ ডাক্তার রুগীকে রোগ নিরাময়ের ঔষধের সাথে ঘুমের ঔষধও দিয়ে থাকে।

তাছাড়াও একজন মানুষের যখন ঘুমের ভাব হয়, তখন ওই মানুষটি যেখানে সেখানেই ঘুমিয়ে পরতে পারে। কি রাস্তা আর কি যাত্রীবাহী যানবাহন! তাই অনেকেই বলে, “যেখানে হয় কাইত, সেখানেই পোহায় রাইত।” মানুষের দৈনন্দিন জীবন নামের গাড়িটা চালাতে গিয়ে অনেকেই সারারাত জেগে পরিশ্রম করে। যারা রাত জাগা পাখি, তারা রাতের পরিশ্রমের ফাঁকে একটু সময় পেলেই নিজের শরীরটা লেলিয়ে দেয় ঘুমের নেশায়। তখন সেখানে কোনও খাট পালঙ্ক থাকে না। আর কর্মক্ষেত্রে খাট-পালঙ্ক থাকার কথাও নয়। কি ফ্লোর, কি মাটি আর কি ময়লা আবর্জনার স্তুপ, ঘুমের নেশায় ক্লান্ত শরীরটাকে লেলিয়ে দিয়েই বিভোর ঘুমে মুহূর্তেই আছন্ন হয়ে পরে। তাই কথায় আছে, “ঘুমে মানে না ভাঙা খাট।” এভাবেই “ক্ষুধায় মানে না মরা ভাত”, “প্রেম মানে না জাত-বেজাত”, “ঘুমে মানে না ভাঙা খাট” এই কথাগুলো প্রচলিত হয়ে আজও রয়ে গেছে মানুষের মুখে-মুখে।

জীবনের গল্প-১৪

জীবনের গল্প-১৩-এর শেষাংশ: দুইদিন পর থেকে কাজ জয়েন্ট করবো বলে, অফিস থেকে বের হলাম। নিচে এসে সব তাঁতিদের সাথে দেখা করে মিল থেকে বের হওয়ার সময় মিস্ত্রি আমার হাতে ২০০/= টাকা দিয়ে বললো, এটা আজকের কাজের মজুরি। ২০০/= টাকা থেকে কানাইকে ১০০/= টাকা দিয়ে মিল থেকে বের হয়ে বাসায় চলে গেলাম।

বাসায় গিয়ে বড় দাদাকে সবকিছু জানালাম। বড়দাদা খুশি হলেন। মাও খুশি হলেন। পরদিন সকালে ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কানাইকে নিয়ে কাজ করলাম। কাজ সেরে বড় দাদাকে সাথে নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, আমি ফরিদপুর যাওয়ার পর যেই লোক কাজ করেছিলো; আগামীকাল থেকে ফতুল্লার ঐ লোকই এখানে কাজ করবে। জানানোর পর ম্যানেজার সাহেব রাগ করিনি। রাগ না করার কারণও ছিলো, কারণ হলো, ফাইন টেক্সটাইল মিলের কাজ হলো চুক্তিতে। ভীম প্রতি ৭০ টাকা। এতে প্রতিমাসে আমি ২০০০/= টাকার বেশি রোজগার করতে পারতাম না। আর এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানে বেতনভুক্ত। কাজ হোক আর না হোক, মাস শেষে আমার মূল বেতন হতে আসবেই। ম্যানেজার সাহেব আমার বেতন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, বেতন কত? বললাম, ‘বেশি না স্যার, মাত্র ৬০০০/= টাকা। তা শুনে ম্যানেজার সাহেব খুব খুশি হলেন।

এরপর ফতুল্লা গেলাম, কথা বলে রাখা ওই লোককে খুঁজতে। তাঁকে খুঁজে বের করে আগামীকাল সকাল থেকেই ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করার জন্য বললাম। তিনি তাতে রাজি হলেন, খুশিও হলেন। আমরা দুইজন বাসায় রওনা দিলাম। বাসায় যাওয়ার পথেই কানাইর সাথেও ওঁর বেতন নিয়ে ফয়সালা করে ফেললাম। কানাইকে প্রতিমাসে ১৫০০/= টাকা দিতে হবে। ও অবশ্য ২০০০/= টাকা চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওঁর সারাদিনের টুকটাক খরচ আমার উপর নিয়ে ওঁকে ১৫০০/= টাকায়ই রাজি করলাম। কনাইরও এটা ছিলো প্রথম বেতনভুক্ত চাকরি। তাই আর ও বেশি মন খারাপ করেনি বরং খুশিই হয়েছিলো। এর পরদিন থেকেই ওয়েল টেক্সে কাজ করা শুরু করি। দুইদিন পরই মিলের দুইজন অপরিচিত শ্রমিক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো মিলের বাইরে। মিলের বাইরে গিয়ে এক চায়ের দোকানে আমাকে বসতে দিলেন, তাঁরাও বসলেন। তাঁদের একজনের নাম, মোহাম্মদ হাসেম মিয়া। আরেকজনের নাম, নূরমোহাম্মদ।

আমি মনে মনে ভাবছি, তাঁরা কি আমার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করবে নাকি! কিন্তু না, তাঁরা আমাকে বললো, ‘আপনি এখানে এসে সব শ্রমিকদের বাঁচালেন। এতে আমরা খুবই খুশি! তবে দাদা একটা কথা ছিলো–যদি কারোর কাছে না বলেন, তাহলে আপনাকে খুলে বলতে পারি!’ তাঁদের কতা শুনে আমি বললাম, ‘বলুন, কী বলতে চান?’ আমার কথায় তাঁরা হাসলে! বললে, ‘আমরা একটা কাজ করতে যাচ্ছি, আশা করি আমাদের সাথে থাকবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা এমন কী কাজ যে, আপনারা আমার সহযোগিতা চাচ্ছে?’ বললেন, ‘আমরা অলরেডি মিলে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করে ফেলেছি! তার কাগজপত্র দুইএক দিনের মধ্যে হতে আসলেই, আমরা মিল গেইটে সাইনবোর্ড টাঙাবো। এখন খরচ বাবদ আপনাকে সবার সমতুল্য পরিমাণ চাঁদা দিতে হবে।’ তাঁদের কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে খুবই খুশি হলাম! তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাঁদা কত?’ বললো, ‘বেশি না দাদা, মাত্র ৭০০/=টাকা।’ আমি বললাম, ‘আমিতো কেবমাত্র মিলে জয়েন করলাম দাদা। ৭০০/= টাকা নিতে হবে আমার বেতন হলে।’ আমার কথায় তাঁরা দুইজন খুশি হয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা, তা আপনি বেতন হলেই দিবেন; কিন্তু এব্যাপারে কারোর সাথে কিছু বলবেন না। যদি বলেন, তাহলে হয়তো এক কান, দুই কান হতে হতে মালিকের কানে চলে যেতে পারে। তাতে আমাদের সকলের সমস্যা হতে পারে!’ এই বলেই চা দোকান থেকে উঠে মিলে গিয়ে কাজ করলাম।

মিলের কাজ সেরে সারাদিন পর বাসায় গেলাম। মিলের ইউনিয়নের ব্যাপারে বড় দাদার সাথে আলাপ করলাম। আমার কথা শুনে আমার বড়দাদা খুশি হলেন! এর কয়েকদিন পরই মিলের গেইটে বড় একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হলো। সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা, ওয়েল টেক্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন তা দেখে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মাথা নষ্ট হলেও, মিলের শ্রমিকদের হইহুল্লোড় আনন্দ-ফুর্তি শুরু হয়ে হলো। মিল মালিক নিরুপায় হয়ে একসময় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনেও নিলো। মিলের সব শ্রমিকদের চাকরিও পাকাপোক্ত হলো। একসময় পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের ঘন্টা বেজে উঠলে, ফাইন টেক্সটাইল মিল থেকে ঐ কালাম একদিন আমার সাথে দেখা করতে ওয়েল টেক্সে আসে। কালাম এসে এই ঈদে ওঁদের বাড়ি বেড়াতে যেতে অনুরোধ করলো। আমি ঈদের ছুটিতে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কালামকে কথাও দিলাম। কালাম খুব খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলো।

এর দুইদিন পরই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। এর আগেই কানাইকে বলে রেখেছিলাম, ঈদের দিন সকলেই সেজেগুজে ওঁদের বাসা থেকে আমার বাসায় চলে আসতে। কানাই আমার কথার বরখেলাপ করলো না, ঈদের দিন সকালে ঠিক সময়ে কানাই আমার চলে আসলো। আমি মায়ের কাছে বলে-কয়ে কানাইকে সাথে নিয়ে সুবচনীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মিনিবাসে চড়ে গেলাম ফতুল্লা। নামলাম ফতুল্লা লঞ্চঘাটের সামনেই। লঞ্চঘাটের টোল দিলাম জনপ্রতি আট আনা করে দুইজনের ১টাকা। বালিগাঁওর লঞ্চ ফতুল্লা ঘাটেই যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলো। তাড়াতাড়ি লঞ্চে উঠে দুইজন উপরেই দাঁড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো। ফতুল্লা থেকে সুবচনী যেতে কয়েকটি ঘটে যাত্রী ওঠানামা করে। ফতুল্লার পর বক্তবলী। এরপর কাঠপট্টি, বেতকা, তালতলা, সুবচনী। সবশেষে বালিগাঁও। কালাম এর আগের বার যাওয়ার সময়টা ঠিক রেখে সময়মতো লঞ্চঘাটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। লাঞ্চ সুবচনী ঘাটে ভিড়ানোর পর আমারা লঞ্চ থেকেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লঞ্চের যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা লঞ্চ থেকেই কালামকে হাতে ইশারা দিয়ে সুবচনী ঘাটে নামলাম। লঞ্চ থেকে নেমেই আমি কানাইর হাতে ৩০০/= টাকা দিয়ে বাজারের ভেতরে পাঠালাম, পান-সুপারি-সহ কিছু মিষ্টি ও কিছু ফলফলাদির জন্য। আমি আর কালাম একটা চা দোকানে ঢুকলাম, চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। কানাই আমার কথামতো সবকিছু ঠিকঠাক মতো কেনাকাটা করে চায়ের দোকানে আসলো। চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে কালামদের নিজেদের নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকার মাঝি সেজেছে কালাম নিজেই। নৌকা চলছে হেলেদুলে।

বর্ষাকালে সুবচনীর খালটা ঠিক নদীর মতো দেখা যায়। সেসময় খালে খুব স্রোত থাকে। সুবচনীর খানটা যখন পাড় হচ্ছিলাম, আমার তখন ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার মনের ভয়টা টের পেয়েছে আমার বন্ধু কানাই। কানাই আমাকে শক্ত করে ধরে বসল। তবু আমার ভেতর থেকে ভয় যাচ্ছিল না। খাল পাড় হয়ে নৌকা যখন ফসলি জমির ওপর দিয়ে ছুটলো, তখনই আমার মন থেকে কিছুটা ভয় দূর হলো। নৌকা চলছে, আর আমি নৌকা থেকে আশে-পাশে থাকা গ্রামের ঘরবাড়িগুলো দেখছিলাম, মন ভরে। নৌকা থেকে পানির নিচের দিকে চেয়ে দেখি, বর্ষার স্বচ্ছ পরিস্কার পানির ওপর থেকে জমির নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে কতরকমের উদ্ভিদ ঢেউয়ের সাথে হেলে-দুলে নাচছে। নৌকা চলছে, কথাও চলছে কালামের সাথে। আমি নৌকার কার্নিশে বসে পানির সাথে জলকেলি খেলা খেলছি। কখনও আবার ভেসে থাকা জাতীয় ফুল শাপলা টেনে তুলছি। এভাবে নৌকা চলতে-চলতে একসময় আমরা কালামদের বাড়ির সামনে চলে আসলাম।

বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ার আগেই কালাম বলছে, ‘এসে গেছি ওস্তাদ! কালামের কথা শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে দেখি, এ কী কাণ্ড! এখানে এত মানুষ কেন? আমি কালামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালাম, বাড়ির ঘাটে এত মানুষ কেন?’ কালাম বলল, ‘ওস্তাদ, আপনারা নারায়ণগঞ্জের মানুষ। আবার হলেন আমার ওস্তাদ! তাই এতো মানুষ! এর আগে আমাদের বাড়ি এসেই তো সবার মন জোগাড় করে ফেলেছেন। আপনারা আসবেন, তা আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ি এসেই গ্রামের সবাইর কাছে বলেছিলাম। আবার আজ নৌকা নিয়ে বাড়ি থেকে সুবচনী যাওয়ার সময়ও বাড়ির সবার কাছে বলে গিয়েছিলাম। তাই পাশের বাড়ির পোলাপানও ঘাটে অপেক্ষায় আছে। নামেন নামেন ওস্তাদ!’ ১০/১২ জন ছেলে-বুড়ে দেখে নিজের কাছে কেমন যেন শরম-শরম লাগছিল আমার। তবু নির্লজ্জের মতোই কানাই আর আমি নৌকা থেকে নেমে পাড়ে ওঠলাম। নৌকা থেকে নামার সময় মিষ্টি আর ফলগুলো কালাম হাতে নিয়ে নিল। সেদিন কালামদের ঘরটা আগে থেকেই পরি-পাটি করে রাখা হয়েছিল। ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে সামনে দিল দুই গ্লাস সরবত। সাথে আমাদের নেওয়া কিছু মিষ্টিও দিলো। কানাই আর আমি খেলাম। কালামের মা বড় ভাবীর সাথে কথা বললাম। কালামদের ঘর থেকে বের হলাম। সামনেই ঠাকুরবাড়ির বিশাল পুকুর। আমার উদ্দেশ্য হলো ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসবো।

কালামদের নয়াবাড়ি গ্রামটি দেখতে ঠিক সেন্টমার্টিনের একটা দ্বীপের মতো। আয়তনে বেশি একটা বড় না হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে কম নয়। পুরো গ্রামটির মাঝখানেই ঠাকুরবাড়ির এই বিশাল পুকুরটি। প্রতিদিন সকাল-বিকাল পুরো গ্রামের লোক এই পুকুর ঘাটলায় বসে আড্ড দেয়। খেলা-ধুলাও চলে। কেউ লুডু। কেউ ষোলগুটি। কেউ তাসখেলা।আমরা পুকুর ঘাটে আসার সময় কালামের বড়ভাই সালামও আমাদের সাথে ছিল। তখন ঘাটলায় চলছিল গ্রামের ছেলে-বুড়োদের আড্ডা। বর্ষাকাল, গ্রামের মানুষের কাজকর্ম নেই, তাই সময় কাটানোর আড্ডা। আমাদের দেখেই সবাই তাকিয়ে আছে। দুই-একজন লোক আবার হাতের তাস রেখে দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি ঘাটলায় যাদের দেখতে মুরুব্বির মতো, তাদের নমস্কার জানালাম। যাঁরা এর আগের বার আমাদের দেখেনি, তাঁদের মধ্যে একজন লোক কালামের বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কারা? বাড়ি কোথায়? কী করে?’ আরও অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলো। কালামের বড়ভাই, মুরুব্বিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এরা একজন আমার ছোট ভাই কালামের ওস্তাদ, আরেকজন বন্ধু। কালাম যেই মিলে কাজ করে, সেই মিলের ওস্তাদ। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ঈদের বন্ধ পেয়ে আমাদের বাড়ি এসেছে বেড়াতে।’ কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে মুরুব্বি দুইজন হ্যাণ্ডশেক করলো। সিঁড়ি ঘাটলায় বসতে বললো। আমরা দুইজন বসলাম।

আমি ঘাটে বসেই সত্যগুরুর বাড়িটির দিকেই বেশি ফলো করছিলাম। কারণ, বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিল, তাই। আগের দিনের তৈরি বাড়ি, সাথে তিন চারটা ঘর। আবার বাড়ির ভেতরে একটা বড় ঠাকুরঘ। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটলা! বাড়ির চারদিকে গাছগাছালি ভরা। আমরা ঘাটে বসা থাকতেই ওই বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে আসলো। ওদের দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, ওরা দুই বোন। ধারণা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য কানাইকে বললাম, ‘কানাই, মেয়ে দুইটি কে? তুই সালাম ভাইয়ের কাছ থেকে একটু জেনে নে।’ কালাম তখন ঘাটলায় ছিলো না। কালাম গেছে আবার সুবচনী বাজারে। আমাদের সাথে বসা আছে কালামের বড়ভাই সালামা মিয়া। আমার কথায় কানাই সালাম ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে। কিছুক্ষণ পর কানাই আমার কাছে এলো।

আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে কানাই, সালাম ভাই কী বললো?’ আমার কথার উত্তরে কানাই বললো, ‘সালাম দাদা বললো, ‘তোকে এই গ্রামেই বিয়ে করাবে, বুজলি।’ আমি বললাম, ‘বলে কী? তো মেয়ে কোথায়? মেয়ে দেখাতে বল! যদি আমার পছন্দ হয় তবে বিয়ে করতেও পারি! আমার মায়ের খুবই কষ্ট হচ্ছে রে কানাই। বিয়েটা তাড়াতাড়িই করতে হবে।’ কানাই আমার কথার জবাবে বললো, ‘মেয়ে তো কয়েকবারই এখানে বসে বসে দেখেছিস। এবার বল, পছন্দ হয়েছে কিনা?’ আমি কানাইর কথায় অবাক হয়নি! কেন হয় নি? সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখা যাচ্ছিল!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৫ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

মেহনতি মানুষের জয় হোক

রাজা ডেকে বলে, ‘শুনো রে বাপু নিত্য গোপাল!
তোর এ কেমন কপাল? তোকে দেখি চিরকাল,
খেটেই যাচ্ছিস সকাল-বিকাল!
বল, এ তোর কেমন কপাল?’

নিত্য গোপাল বলে, ‘শুনেন শুনেন রাজা মহাশয়,
আমি যদি না-ই খাটি ক্যামনে হবে আপনার জয়?
দরিদ্রদের হয় রক্ত ক্ষয়,
রাজার হয় রাজ্য জয়!

রাজা হলেন রাগ! বললো, ‘বলিস কি নিত্য গোপাল?
এখান থেকে ভাগ! গরিবের রক্তে ফিরেনি মোর কপাল!
আমার হলো রাজ কপাল!
কার এমন সাত কপাল?’

নিত্য গোপাল বলে, ‘রাজা মহাশয়, সবারই এক কপাল!
ভাগ্য দোষে হয় কাঙাল! রাজারও আছে একাল-সেকাল!
অর্থে দূর হয়না জঞ্জাল!
দারিদ্রতাই সুখের কপাল!’

রাজা হেসে বলে, ‘হাহাহাহা দরিদ্রদের আবার সুখ?
কষ্টে তোদের দিন চলে, বারোমাস দেখি তোদের দুখ!
এটা আবার কেমন সুখ?
রাজার থাকে রাজ্যের সুখ!

নিত্য গোপাল হাসে! হিহিহিহি, ‘এই সুখ তো সুখ নয়!
যেদিন স্রষ্টার হুকুম আসে, সেদিন সবকিছুতেই কয়!
রাজাও একদিন ফকির হয়!
মেহনতি মানুষের হবে জয়✌!’

জীবনের গল্প-১৩

জীবনের গল্প-১২-এর শেষাংশ: খেলাম শরবত। এরপর কালামের মা আমাদের হাতমুখ ধুয়ে আসার জন্য বললো। কলাম হাতমুখ ধোয়ার জন্য আমাদের নিয়ে গেলো, একটা পুকুরের সিঁড়ি ঘাটে। পুকুরের সিঁড়ি ঘাটটা হলো এক হিন্দু বাড়ির। পুকুর ঘাট থেকে হাত-পা ধুয়ে কালামদের বাড়িতে আসলাম। ভাত খেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম।

কালামদের ঘরে খাওয়া-দাওয়া করে মনে করেছিলাম, সেদিনই নারায়ণগঞ্জ ফিরে যাবো। কিন্তু বিশ্রাম করতে গিয়ে তা আর হলো না, ফেরা। ঘুম থেকে জেগে ওঠতেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আমার সাথে কানাইরও একই অবস্থা। কানাইও আর সজাগ পায়নি। কানাইকে ডেকে ওঠালাম। বললাম, ‘তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নেয়, এখনই বের হবো।’ আমার কথা শুনে কালামের মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই রাত করে নারায়ণগঞ্জ যেতে বারণ করলে, আমরা দুইজন এক রাতের জন্য থেকে যাই কালামদের বাড়িতেই। এরপর কালাম আমাদের সাথে করে ঠাকুরবাড়ির পুকুর ঘাটে নিয়ে আসলো।

এই ঠাকুরবাড়িই বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়ে আছে, যা আগে কালাম আমার কাছে অনেক বলেছিল। কিন্তু মেয়ে দেখার মন-মানসিকতা নিয়ে কালামদের ওখানে আমরা যাইনি। আমরা গিয়েছি বেড়াতে। যখন কালামদের বাড়ি থেকে সন্ধ্যাবেলা এই ঠাকুরবাড়ির পুকুর ঘাটে আসি, তখন দেখলাম ঠাকুরবাড়ি থেকে কয়েকজন মহিলা আমাদের দেখে কেমন যেন হাঁকাহাঁকি করে চুপেচাপে দেখছিল। তখন ছিলো ভরা বর্ষা মৌসুম। নয়াবাড়ি গ্রমের চারদিকে পানি আর পানি। হাট-বাজারে যেতে হলে নৌকা ছাড়া আর কারোর উপায় ছিল না। আর রাতবিরেতে গ্রামের মানুষ অন্তত বর্ষাকালে অনেকেই বেশি একটা ঘোরা-ফেরাও করতো না। রাতের খাবারের আগপর্যন্ত এই ঠাকুরবাড়ি সিঁড়ি ঘাটেই বসে আড্ডা দিতো, সময় কাটাতো।

কালামের সাথে আমরা যখন পুকুর ঘাটে গেলাম, তখনও পুরো সিঁড়ি ঘাটলা ছিলো লোকে গিজগিজ। কালামের সাথে আমাদের দুইজনকে দেখে সিঁড়ি ঘাটলা থেকে কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়ে কানাই আর আমাকে বসতে দিলে, আমরা দুইজন বসলাম। ঠাকুরবাড়ি থেকেও একজন মুরুব্বি এসে আমাদের সাথেই বসলেন। কালামকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর ওস্তাদের বাড়ি কোথায়, ঘর কোথায়, জাত সম্প্রদায় কী, মা-বাবা আছে নাকি নেই, ভাই-বোন ক’জন, কী কাজ করে ইত্যাদি।’ আমি কিছুই বললাম না, যা বলার কানাই আর কালামই বলেছিলো। এরপর ঠাকুরবাড়ির ওই মুরুব্বি আমাদের দুইজনকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যেতে বললে, আমি আর গেলাম না, কালামের সাথে কানাইকে পাঠালাম। কানাই কালামের সাথে গিয়ে তাঁদের ঘরে গিয়ে বসলে, আমাকে ডেকে আনতে একটা ছোট শিশকে সিঁড়ি ঘাটলায় পাঠালো। কিন্তু তখনও আমি ওই ঠাকুরবাড়িতে আর পেলাম না, সিঁড়ি ঘাটলায় বসে আরও মানুষের সাথে কথা বলতে থাকি। আমার সাথে কালামের বড় ভাইও বসা ছিলো। কালামের বড়ভাইও বলেছিল, ‘যাও ঘুরে দেখে আসো।’ তারপরও আমি ঠাকুরবাড়ি গেলাম না, পুকুরঘাটেই ছিলাম।

কিছুক্ষণ পর কানাই আর কালাম বড় এক বাটি ভরে গাছের পাকা পেয়ারা সিঁড়ি ঘাটলায় নিয়ে আসলো। আমাকে দুটো দিয়ে বাদবাকিগুলো ঘাটলায় থাকা দুইএক জনকে দিলো। সবাই পেয়ারা খাচ্ছিল। আমি কানাইকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই বাড়িতে এতক্ষণ কি করলি?’ কানাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘তোর ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল।’ বললাম, ‘বলে কী পাগলটায়! আমার ব্যাপারে জেনে তাঁদের কী হবে?’ কানাই বললো, ‘তোর জন্য কালাম যেই মেয়ের কথা মিলে থাকতে বাবার বলেছিল, ওই মেয়েটাকে আজ দেখলাম! খুবই সুন্দর!’ আমি আর কোনও কথা বললাম না, সোজা পুকুর ঘাটে এসে কালামকে বললাম, ‘কালাম বাড়ি চলো, ঘামাবো।’ আমার কথায় কালাম আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে আমাদের নিয়ে ওঁদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। বাড়িতে আসার সাথে সাথেই রাতের খাবার রেডি হয়ে আছে কালামদের ঘরে। কোনরকম হাতমুখ ধুয়ে কালাম-সহ বসে রাতের খাবার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে হালকা কিছু খাবার খেয়ে কালামের মা-বাবা, ভাই-বোন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির বাইরে আসলাম। এমন সময় কানাই বললো, ‘ঠাকুরবাড়ির সবাইর থেকে বলেকয়ে আসি।’ আমি কানাইকে আর ওই বাড়িতে যেতে দিলাম না, সোজা কালামদের নৌকায় উঠে বসলাম। কালাম-সহ কালামের বড় ভাইও আমাদের সাথে নৌকায় উঠলো। উদ্দেশ্য আমাদের ঢাকার লঞ্চে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কালাম আমাদের নিয়ে নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজারে আসলো। আমরা নৌকা থেকে নেমে কালাম-সহ ওঁর বড়ভাইকে সাথে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। লঞ্চ আসতে আরও দেরি হবে বলে অনেকেই বলছিল। সেই সময়টুকু কালামের বড়ভাইয়ের সাথেই কথাবার্তা বলে পাড় করতে চাচ্ছিলাম।

এমন সময় কালামের বড়ভাই বলছিল, “মেয়েটা ভালো। কিন্তু গরিব। ওঁদের নিজস্ব জায়গা-জমি নেই। বাড়িটাও সত্যগুরু নামে একজন ঠাকুরের। তবে সত্যগুরুর আরও অনেক বছর আগে মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পরিবারের সবাই একসময় এই বাড়ি তাঁদের দান হিসেবে দিয়ে যায়। তারপর থেকে তাঁরা আজ অনেক বছর যাবত গ্রামের আরও দশজন মুসলমানের সাথে মিলেমিশে এই বাড়িতে বসবাস করছে। বাড়ির মুরুব্বির নাম নারায়ণ সরকার। উনার চার মেয়ে দুই ছেলে। মেয়েগুলো বড়, ছেলে দুটো মেয়েদের ছোট। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরও অনেক আগে। ছেলের বাড়ি নোয়াখালী জমিদারহাট। এখন অবিবাহিত আছে তিন মেয়ে। করলাম আরও অনেক আগেই তোমার কথা বলেছিল। কিন্তু তুমি তো ওই বাড়িতে গেলেই না। কেন গেলে না, তা আমার মাথায় ঢুকছে না। মেয়ে যখন দেখতে এসেছ, তখন মেয়েদের বাড়িতে গেলে না কেন?”

আমি কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে হেসে বললাম, ‘দাদা, আমিতো আপনাদের এখানে কোনও মেয়ে দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। আমি এসেছি কালামকে দেওয়া কথা রক্ষা করতে। অন্যকিছু মনে করে আমি আসিনি, দাদা। অবশ্য কালাম-সহ ফাইন টেক্সটাইল মিলের আপনাদেরই গ্রামের আবুল মুন্সি, আপনার চাচা জব্বার কাকাও এই বাড়ির কথা অনেকবার বলেছিল। কিন্তু আমি তাঁদের কিছুই বলিনি। কারোর সাথে কথাও দেইনি। তাছাড়া এখনো আমার বিয়ের বয়স হয়নি দাদা। এই বয়সে বিয়ে করবো, এ চিন্তা আমি কখনোই করি না। যদি কপালে থাকে তাহলে কেউ আবার বাধাও দিতে পারবে না, যেকোনো একভাবে-না-একভাবে হবেই হবে।’ কালামের বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে একসময় বালিগাও থেকে সুবচনী লঞ্চঘাটে লঞ্চ এসে ভিরলো। কানাই আর আমি লঞ্চে উঠে এক জায়গায় দাড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো।

ফতুল্লা লঞ্চঘাটে নেমে নারায়ণগঞ্জ গেলাম। এরপর কানাই গেলো ওঁদের বাসায়, আমি আমার বড়দা’র বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। এর একদিন পরই ঈদের ছুটি শেষ হয়ে মিল চালু হলো। সব শ্রমিকরা যাঁর যাঁর বাড়ি থেকে এসে মিলে হাজির হলো। তখন ফাইন টেক্সটাইল মিলের বেশিরভাগ তাঁতিই ছিল সুবচনী এলাকার। আমরা যে ঈদের বন্ধে কালামদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তা পুরো নয়াবাড়ি গ্রাম-সহ ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিকের বাড়ি পার্শ্ববর্তী কড়পাড়া গ্রাম পর্যন্ত জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। মিল চালু হবার পর সে বলে, ‘আমাদের বাড়ি গেলে না কেন? ও বলে আমাদের বাড়ি গেলে না কেন?’ বললাম, ‘আরে দাদারা, আমাদের কি আর কারোর বাড়ি চেনা আছে? তাছাড়া সারা গ্রামই তো আমাদের কাছে সাগরের মতো মনে হলো। এই অবস্থা দেখে কারোর বাড়িতে আর যেতে মন চায়নি দাদা। আবার সুদিনে একবার যখন যাবো, তখন সবার বাড়ি খুঁজে খুঁজে বের করে ঘুরে আসবো।’ অনেকেই আবার জিজ্ঞেস করছিল, ‘মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি-না? মেয়েদের বাড়িতে গিয়েছিলাম কি-না ইত্যাদি।’ এরকম আলাপ আলোচনার মধ্যে এসব কথা আমার বড়দ’র কানে পৌঁছে গেলো। বড়দা বাসায় গিয়ে বৌদির কাছে বললো। এরপর বৌদি আমার মায়ের কাছে বললো।

বিক্রমপুর বেড়াতে যাওয়ার কথা, মেয়ে দেখার কথা বৌদির কাছে মা শুনে আমাকে আর কিছুই বলেনি। জিজ্ঞাসাও করেনি যে, কোথায় গেয়েছিলি! জিজ্ঞেস করেছিল আমার বৌদি। বিক্রমপুর থেকে আসার দুইদিন পর বৌদি আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ঠাকুরপো মেয়ে কেমন দেখলে?’ আমিতো একেবারে হক্কার-মা-টক্কা হয়ে গেলাম! বৌদিকে বললাম, ‘তোমার কাছে কে বলেছে যে, আমি মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম?’ বৌদি বললো, ‘চুপেচাপে কি আর বেশিদিন চলা যায়, ঠাকুরপো? চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। তো মেয়ে কেমন? পছন্দ হলে বলো, আমরা একদিন গিয়ে দেখে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে আসি!’ বললাম, ‘দূর বৌদি, সব মিথ্যে কথা। যেই বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেই বাড়ির সাথে একটা ঠাকুরবাড়ি আছে। সেই বাড়িতে তিনটা মেয়ে আছে। কিন্তু আমিতো আর মেয়ে দেখতে যাইনি। তিনটা থাকুক আর দশটা থাকুক। তাতে আমার কী? আমার কথা বিশ্বাস না হলে কালই কানাইকে বাসায় নিয়ে আসবো, তুমি কানাইকে জিজ্ঞাসা করবে।’ এই বলেই সেদিনের মতো বৌদিকে বুঝিয়ে দিলাম।

পরদিন কানাইকে নিয়ে বাসায় আসলাম। আমার বড় বৌদি কানাইকে জিজ্ঞাসা করলে, কানাই বললো, ‘নিতাই তো ওই বাড়িতেই যায়নি। আমি গিয়েছিলাম বলে আমার সাথে ও অনেক রাগারাগি করেছিল। তোমরা যা শুনেছ, তা ভুয়া খবর।’ কানাইর কথা শুনে বৌদি ও মা বিশ্বাস করলো। এরপর এব্যাপারে আর কোনদিন কোনও কথা হয়নি। নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ গোয়ালপাড়া থেকে আসা-যাওয়া করে ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতেছিলাম।

একদিন হঠাৎ করে ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল মিল থেকে এক লোক এসে আমাকে খুঁজতে লাগলো। খুঁজে বের করে বললো, ‘মিলন টেক্সটাইল মিল এখন “ওয়েল টেক্স” নামে পরিচিত। মিলটি একজন পাকিস্তানি মালিক কিনে নিয়ে সেখানে নতুন কোরিয়ান মেশিন বসিয়েছে। বর্তমান ওয়েল টেক্সের মালিকের নাম নিয়াজ সাহেব। উনি খুবই ভালো লোক। এখন মিলের ম্যানেজার রমিজ উদ্দিন সাহেব তোমাকে অতিশীঘ্র দেখে করতে বলেছে।’ লোকটার কথা শুনে বললাম, আজ আর যেতে পারবো না। আপনি ম্যানেজার সাহেবকে বলবেন, নিতাই আগামীকাল বিকালবেলা এসে দেখা করবে।’ আমার কথা শুনে লোকটা চলে গেলো। কিন্তু আমি ভাবতেছিলাম! নতুন মিল। কোরিয়ান মেশিন। এখানেই বা কাকে দিয়ে যাই। এসব নিয়েই ভাবছিলাম!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৪ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

শূন্য আমি

শূন্য আমি ধন্য আমি
নেই যে বাড়ি ঘর,
পরের বাড়ি আমার বাড়ি
নিজের দেহখানাও পর!

পর পর সকলই পর
আপন বলতে নেই,
কর্মই আমার বড় আপন
কর্মতেই ধন্য হই।

কর্মতে হয় বেলা শেষ
ধর্মতে রাখি ভক্তি,
নিশ্বাসে নেই বিশ্বাস আমার
সততায় খুঁজি মুক্তি!

জীবনের গল্প-১২

জীবনের গল্প-১১-এর শেষাংশ: যদি কারোর মন চায়, তাহলে ব্লগ সাইট লিঙ্কে ক্লিক করে সেদিনের সেই লেখাটা পড়তে পারবেন। আশা করি ভালো লাগবে। আর আমার জীবনের গল্প-১২ পর্ব নিয়ে পরবর্তীতে হাজির হচ্ছি শব্দনীড় ব্লগের প্রিয় মানুষগুলোর মাঝে।

বিয়ের পরদিন মেয়েটি বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পর থেকে আমার আর কিছুই ভালো লাগছিল না। সেদিন আর মিলেও গেলাম না। কানাইকে সাথে নিয়ে চলে গেলাম বড় দাদার বাসায়। সেখান থেকে বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যার পর। পরদিন সকালে কানাইকে সাথে নিয়ে দুইজনে মিলে গেলাম। আমি আর কানাই কাজ করছিলাম। এমন সময় মিলের দারোয়ান আমার সামনে এসে বললো, ‘তোর লোক এসেছে।’ দারোয়ানের কথায় হঠাৎ চমকে গেলাম! চমকে গিয়ে মিলের বাইরে গিয়ে দেখি ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল মিলের সাত্তার মিস্ত্রি। উনার সাথে মিলন টেক্সটাইল মিলে অনেকদিন কাজ করেছিলাম। এই সাত্তার মিস্ত্রিকে আমি ওস্তাদ বলেই ডাকতাম। মিলন টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাবার পর উনি চেলে গেলেন বাড়িতে। উনার বাড়ি কুমিল্লা। এরপর থেকে উনার সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ। অনেকদিন পর উনার সাথে এ-ই দেখা।

সাত্তার ওস্তাদের সামনে গিয়ে হাত জোড়ে নমস্কার জানালাম। উনি আমার নমস্কার গ্রহণ করে বললো, ‘তোমার বড়দাদা নিমাই বাবু কোথায়?’ বললাম, ‘দাদা তো মিলের ভেতরে কাজ করছে।’ উনি সাত্তার মিস্ত্রি আমার বড় দাদাকে ডেকে আনতে বললো। আমি কানাইকে মিলের ভেতরে পাঠালাম, বড় দাদাকে ডেকে আনতে। এই ফাঁকে সাত্তার ওস্তাদের সাথে অনেক কথা হলো। কীভাবে আমাদের ঠিকানা সংগ্রহ করলো। কীভাবে এখানে আসলো। এখন কোথায় কী করছে ইত্যাদি বিষয়ে। সাত্তার ওস্তাদ বললো ‘তিনি ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী নামে এক জায়গায় একটা মিলে কাজ করছে। মিলের নাম, আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিল। মিলটি দুই বছরের জন্য মিলন সাহেবের ভাড়া নেওয়া। এখানে এসেছেন আমাকে সেই মিলে নিয়ে যেতে।’ এরমধ্যেই আমার বড় দাদা মিল থেকে বেরুলো। সাত্তার ওস্তাদকে দেখে কোলাকুলি করলো।

তারপর সাত্তার ওস্তাদ-সহ আমরা মিলের সাথে থাকা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। চা-বিস্কুটের ওর্ডার দিলাম, চা-বিস্কুট আসলো। চা-বিস্কুট খেতে খেতে সাত্তার ওস্তাদ আমার বড় দাদাকে বললো, ‘নিমাই দা, আমি এখন মিলন সাহেবের ভাড়া নেওয়া এক মিলে চাকরি করি। মিলটা ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী। সেখানে ভালো ড্রয়ার ম্যান নেই। ড্রয়ার ম্যানের অভাবে মিলে ঠিকমতো উৎপাদন হচ্ছে না। তাই মিলন সাহেব নিতাইকে ওই মিলে নিতে পাঠিয়েছে। এখন আপনার সম্মতি পেলেই আমি নিতাইকে সাথে নিয়ে ফরিদপুর রওনা হবো।’ আমার বড়দাদা সাত্তার ওস্তাদের সব কথা শুনে বললো, ‘ও-তো এখানে পার্মানেন্ট চাকরি করছে। আবার বর্তমানে মা’কে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকছে। তাছাড়া ও এখান থেকে হঠাৎ চলে গেলে, মিল বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবণা আছে। যদি ও ওখানে যাতে চায়, তাহলে এই মিলের জন্য ওঁর মতো একজন ড্রয়ার ম্যান এখানে দিয়ে যেতে হবে। তা না হলে, ওঁর বেতনের টাকা মিল মালিক আটকে দিবে। আর ওযদি ওখানে যায়, তাহলে ওঁর ভাড়া নেওয়া বাসাও ছেড়ে যেতে হবে। তারজন্য ওঁকে অগ্রীম বাবদ অন্তত ২০০০/= টাকা দিতে হবে। যাতে ও এদিকের দেনা-পাওনা সবকিছু মিটিয়ে যেতে পারে।’

বড়দা’র কথায় সাত্তার ওস্তাদ বললো, ‘ঠিক আছে দাদা, আমি আজই এ-বিষয়ে মিলন সাহের সাথে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করে আগামীকাল আবার আপনার কাছে আসছি।’ এই বলেই সাত্তার ওস্তাদ সেদিনের মতো আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা চলে গেলো। এরপর আমার বড়দাদা আমাকে বললো, ‘তুই মিলের কাজ সেরে এই মিলের জন্য আজই একজন ড্রয়ার ম্যান খুঁজে বের কর। যাতে এই মিলের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।’ বড়দা’র কথামতো আমি মিলের কাজ সেরে কানাইকে নিয়ে চলে গেলাম, ফতুল্লা আগের মিলন টেক্সটাইল মিল এলাকায়। সেখানে গিয়ে পরিচিত একজন ড্রাইভার ম্যানের সাথে কথা বলি। উনি কিল্লারপুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে আমার কাজের জায়গায় যেতে রাজি হলো। পরদিন সাত্তার ওস্তাদ আমার জন্য মিলন সাহেব থেকে ২০০০/= টাকা অগ্রীম বাবদ নিয়ে ফাইন টেক্সটাইল মিলে আসলো।

মিলে এসে আমার বড়দা’র হাতে ২০০০/=টাকা দিয়ে বললো, ‘নিমাই দাদা আমি নিতাইকে নিয়ে আগামীকালই ফরিদপুর রওনা দিতে চাই।’ আমার বড়দা বললো, আগামীকাল যেতে পারবে না। দুইদিন পর যেতে পারবে। এই সময়ে মধ্যে মিলে একজন ড্রয়ার ম্যান দিতে হবে এবং ওঁর বাসা ভাড়া পরিশোধ করে বাসা ছেড়ে আমার বাসায় সবকিছু পৌঁছাতে হবে। তাহলেই আমি এই ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিক ও ম্যানেজারের কটুকথা থেকে রেহাই পাবো।’ আমার বড় দাদার কথায় সাত্তার ওস্তাদ রাজি হয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে গোলো। তারপর বড়দা সাত্তার ওস্তাদ থেকে পাওয়া ২০০০/= টাকা আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘এই মিলের জন্য একজন ড্রয়ার ম্যান আগামীকালই নিয়ে আসতে। আর বাসা ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে বাসার মালা-মাল গোয়ালপাড়া বাসায় নিয়ে যেতে।’ দাদার কথামতো আমি তা-ই করলাম। এই দিনই শ্যামসুন্দর সাহার বাসার ভাড়া পরিশোধ করে রাতা-রাতিই বাসার মালা-মাল দাদার বাসায় নিয়ে গেলাম। মাকেও ফরিদপুর যাওয়ার ব্যাপারে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম।

পরদিন সকালবেলায় ফতুল্লা গেলাম। ফতুল্লা থেকে ওই ড্রয়ার ম্যানকে সাথে নিয়ে কিল্লারপুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে আসলাম। আমার কাজটা ওই লোককে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলাম। তারপর আমার পনেরো দিনের মতো কাজের পাওনা টাকা বড়দা’র কাছে দিয়ে দিতে ফাইন টেক্সটাইল মিলের ম্যানেজার সাহেবকে অনুরোধ করলাম। তারপর ম্যানেজার সাহেব ও মিলের সবার কাছে বলেকয়ে মিল থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় গেলাম। পরদিন অগ্রীম পাওয়া ২০০০/= টাকা থেকে ১০০০/= মায়ের হাতে দিয়ে কাঁথা-বালিশের গাট্টি-সহ কানাইকে নিয়ে সাত্তার ওস্তাদের কথামতো ঢাকা ফুলবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডেই সাত্তার ওস্তাদ আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে বলে বলেছিল। আমরা ফুলবাড়িয়া পৌঁছার আগেই সাত্তার ওস্তাদ আমাদের জন্য টিকিট সংগ্রহ করে আমাদের জন্য অপেক্ষা দাঁড়িয়ে করছিল। আমরা ফুলবাড়িয়া পৌঁছার সাথে সাথে সাত্তার ওস্তাদ আমাদের সামনে এসে নাজি হলো। তারপর ফুলবাড়িয়া থেকে কিছু হাল্কা-পাতলা খেয়ে বাসে উঠে নিজেদের সিটে গিয়ে বসলাম।

বাস থেকে ফফরিদপুর রাজবাড়ীর পৌঁছালাম সন্ধ্যার একটু আগে। বাস থেকে নেমে রিকশা চড়ে গেলাম, গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে। এই মিলটি ফরিদপুর শহরের এক বড় ব্যবসায়ীর। শখ করে নিজের বাবার নামে মিলের নামকরণ করে। মিলের মেশিনগুলো ছিলো ইন্ডিয়ান। সেদিন মিলের শ্রমিকদের ম্যাচে রাতের খাবার সেরে শুয়ে থাকলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মিলের পাশে থাকা একটা চায়ের দোকান থেকে চা-পানি খেয়ে মিলের ভেতরে গেলাম। মিলের সবাই আমাদের দুইজনকে দেখে কেমন যেন হাঁকা-হাঁকি করতে ছিল। মিলের শ্রমিকদের ধারণা ছিল, আমরা হয়তো দুইদিনও এই মিলে কাজ করতে পারবো না। এরকম ধারণা নিয়েই শ্রমিকরা হাঁকা-হাঁকি করেছিল। যখন আমরা দুইজনে আমাদের কাজ রেডি করে কাজ করা শুরু করলাম, তখন মিলের সবাই আমাদের দুইজনের চারপাশে এসে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজের নমুনা দেখছিল।

আমি যেই কাজটা করতাম, সেই কাজে আমি খুবই দ্রতগামী ছিলাম। একসময় পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্যে যতগুলো প্রাইভেট টেক্সটাইল মিল ছিলো, সেসব মিলে যত ড্রয়ার ম্যান ছিলো, সবার থেকে আমিই ছিলাম সেরা ড্রয়ার ম্যান। তাই ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলেও আমার দ্রুত কাজ করা দেখে মিলের সবাই অবাক হয়ে গেলো। প্রথম কাজটা করেই প্রশংসার ফুলঝুরি কুড়িয়ে ফেললাম। সাত্তার ওস্তাদও খুশি হয়ে গেলো। এরপর ওই মিলে আমিই হয়ে গেলাম সবার পছন্দের মানুষ। মিলের বাইরেও ছিল আমার প্রশংসা। তাছাড়া ঢাকার লোক বলে একটা কথা তো ছিলোই। যেখানেই যেতাম, সম্মান পেতাম। মিলের ভেতরেও থাকতাম স্পেশালভাবে। সেই মিলের পাশের বাড়িঘরের অনেক ছেলেকেও কাজ শিখাইয়েছিলাম। ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে প্রায় ছয়মাসের মতো ঠিকমতো কাজ করেছিলাম। এরপর একসময় মিলন সাহের ওই মিলে সূতা দেওয়া বন্ধ করে দিলে, সাত্তার ওস্তাদ-সহ আমি আর কানাই নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি।

ক’দিন ঘুরে-ফিরে আবার কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ নিয়ে নিই। ফাইন টেক্সটাইল মিলেও আমি সবার প্রিয় মানুষ ছিলাম। মিলের অধিকাংশ শ্রমিক ছিলো বিক্রমপুর মালিকের পাড়াপ্রতিবেশি ও নিকটাত্মীয় স্বজন। তখনকার সময়ে এদেশে এতো গার্মেন্টস ছিলো না। ছিলো শুধু প্রাইভেট টেক্সটাইল মিল। তাই তখন কাজের যেমন চাহিদা ছিলো, কাজের লোকের সম্মানও ছিলো। সেই সম্মানের সুবাদে অনেক শ্রমিকদের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ পেতাম। অনেকের বাড়িতে যেতাম। আবার অনেকের বাড়িতে যেতাম না। তো ফাইন টেক্সটাইল মিলেরই আমার এক সাগরেদের বাড়ি ছিলো বিক্রমপুর তালতলা সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামে। ওঁর নাম ছিল কালাম মিয়া। কালাম ছাড়াও আরও অনেক লোকই ছিলো সুবচনী এলাকার। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল কালাম মিয়া। কালাম আমাকে ওস্তাদ ওস্তাদ বলের ডাকতো। ঈদ আসলে ঈদের বন্ধে ওঁদের বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ করতো। এক ঈদকে সামনে রেখে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কথা দিলাম। চার-পাঁচ দিন পরই ঈদ-উল-ফিতর। একসময় মিলের সবাই ঈদের বন্ধ পেয়ে যাঁর যাঁর বাড়ি গেলো। কালামও বাড়ি যাবার আগে বারবার আমার হাতে ধরে ওঁদের বাড়িতে যাওয়া জন্য অনুরোধ করলো। তখন কালামকে বলেছিলাম, ‘ঈদের দিন যেকোনো সময় আমি আর কানাই তোমাদের বাড়িতে হাজির হয়ে যাবো। এব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।’

আমার কথা বিশ্বাস করে কালাম মিল থেকে ঈদের আগের দিন বাড়ি গেলো। বাড়ি গিয়ে ওঁর মা-বাবার কাছে বললো, ‘ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার ওস্তাদ আসবে।’ ওই কথা এক কান দুই কান তিন কান হয়ে পুরো নয়াবাড়ি গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। ওঁদের বাড়ি যেতে হলে ফতুল্লা লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে সুবচনী বাজারে নামতে হয়। তারপর সুবচনী থেকে নৌকায় চড়ে নয়াবাড়ি গ্রামে যেতে হয়। তাই কালাম ঈদের দিন সকালবেলা সুবচনী বাজারে এসে পরিচিত সব নৌকার মাঝিদের বলে রেখেছিল, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার ওস্তাদ আসবে। ওস্তাদের কাছ থেকে যেন নৌকা ভাড়া রাখা না হয়।’ ঈদের দিন আমি মায়ের কাছে বেড়াতে যাবো বলে কানাইকে সাথে নিয়ে সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে ফতুল্লা লঞ্চঘাটে আসি। তখন ফতুল্লা থেকে সুবচনীর ভাড়া ছিলো মাত্র ১৭ টাকা। লঞ্চঘাটে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ঢাকা থেকে লঞ্চ ছেড়ে এসে ফতুল্লা লঞ্চঘাটে ভিড়লো। আমরা লঞ্চে উঠলাম। সুবচনী যেতে যেতে দুপুর পার হয়ে গেলো। লঞ্চঘাটে লঞ্চ ভিড়লো। আমরাও লঞ্চ থেকে নামলাম। সামনেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে আছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছো?’ কালাম বললো, ‘আমি ওস্তাদ অনেকক্ষণ যাবত এখানে আনাগোনা করছিলাম, আপনাদের অপেক্ষায়।’ তারপর কালামকে নিয়ে এক চায়ের দোকানে গেলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে বাজারের ভেতরে গেলাম। কালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে মিষ্টির দোকান কোথায়? কালাম আমাদের মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেলো। দুই সের মিষ্টি নিলাম। কালামের মা-বাবার জন্য পান-সুপারি কিনলাম। বেশি করে সিগারেট কিনে নিলাম। তারপর ওঁদের নিজেদের নৌকা চড়ে ওঁদের বাড়ির ঘাটে নামলাম। আমরা কালামদের বাড়িতে যাবার আরও অনেক আগে থেকেই আমাদের দেরি দেখে ওঁর মা-বাবা, বড় ভাই-সহ বাড়ির সবাই পায়চারি করতে ছিল। আমরা ওঁদের বাড়ির ঘাটে যাবার সাথে সাথে পুরো নয়াবাড়ির ছোট-বড় অনেক মানুষ ঘাটে জড়ো হয়ে গেলো। এতো মানুষ দেখে আমি যেন লজ্জায় পড়ে গেলাম! মাথা নিচু করে কালামের সাথে ওঁদের ঘরে গিয়ে বসলাম।

ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে ওঁর মা-বাবা, বড় ভাই ও বোনের সাথে পরিচয় হলো। তারপর চিনির সাথে লেবুর শরবত সামনে এসে গেলো। আসলো আমাদের টাকা দিয়ে কেনা মিষ্টিও। খেলাম শরবত। খেলাম মিষ্টি। এরপর কালামের মা আমাদের হাতমুখ ধুয়ে আসার জন্য বললো। কলাম হাতমুখ ধোয়ার জন্য আমাদের নিয়ে গেলো, একটা পুকুরের সিঁড়ি ঘাটে। পুকুরের সিঁড়ি ঘাটটা হলো এক হিন্দু ঠাকুর বাড়ির। পুকুর ঘাট থেকে হাত-পা ধুয়ে কালামদের বাড়িতে আসলাম। ভাত খেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৩ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১১

জীবনের গল্প-১০-এর শেষাংশ: তখনকার সময়ে টেক্সটাইল মিলে আমার এই কাজের প্রচুর চাহিদা ছিলো। একটা টেক্সটাইল মিলে মনোমত ১০০জন তাঁতি থাকলেও একজন মনের মতো ড্রয়ার ম্যান থাকতো না। ড্রয়ার ম্যান বা রেসিং ম্যানের কাজটা ছিলো খুবই খেয়ালি ও ধৈর্যশালী কাজ। এই কাজটা করতে হয় নির্ভুলভাবে!

ফতুল্লা কাঠেরপুল “মিলন টেক্সটাইল” মিলে আমরা দুই ভাই কাজ করে যা পাচ্ছিলাম, তা দিয়ে খুব সুন্দরভাবেই আমাদের সংসারটা চলছিল। হঠাৎ একসময় মিলের মালিক ‘মিলন সাহেব’ আর্থিক সংকটে পড়ে মিল বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, আমরা পড়ে গেলাম বিপাকে! তখন আমার বড়দাদা হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল “ফাইন টেক্সটাইল” নামে নতুন এক মিলে কাজ নিয়ে নেয়। মিল মালিকের নাম ‘ফারুক সাহেব’। ফারুক সাহেবের বাড়িও ছিল বিক্রমপুর। কাপড়ের ব্যবসা ছিল ঢাকা ইসলামপুর। ফাইন টেক্সটাইল মিলটা সবেমাত্র নতুন। তাই মিলে তাঁতি-সহ আরও অন্য সেকশনেও লোকের অভাব ছিল। তাই আমার বড়দাদা আমাকে ফাইন টেক্সটাইল মিলে তাঁতের কাজ করতে বললে, আমি বড়দা’র কথামতো ফাইন টেক্সটাইল মিলে প্রথমে তাঁতের কাজই করতে থাকি।

ফাইন টেক্সটাইল মিলের ড্রয়ার ম্যান ছিল নরসিংদীর একজন। তিনি একবার ছুটি নিয়ে বাড়িতে গেলে উনার আর মিলের খবর থাকতো না। তখন মিলের তাঁতি-সহ মিল মালিকেরও বারোটা বেজে যেতো। এই ঝামেলার কারণে মিল মালিক ওই লোককে বাদ দিয়ে অন্য একজন লোককে নিয়োগ দিতে বলে। মালিকের কথামতো মিল ম্যানেজার মিলের সকল শ্রমিকদের বিষয়টি জানালে, আমার বড়দাদা ম্যানেজার সাহেবকে বললো ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে দিতে। বড়দা’র অনুরোধে ম্যানেজার “রাজু আহমেদ” ইন্টারভিউ হিসেবে দুই-তিন দিনের জন্য ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে করতে বললে, আমি পড়ে যাই বিপাকে। কারণ, সেসময় আমার সাথে কাজ করার হেলপার ছিল না। আর হেলপার ছাড়া ড্রয়ার ম্যানের কাজটাও করা যায় না। মিলন টেক্সটাইল মিলে যেই হেলপার ছিল, সেই হেলপারকে আমি নিজেই মিলন টেক্সটাইল মিল সংলগ্ন আরেকটা মিলে আরেকজন ড্রয়ার ম্যানের সাথে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলাম।

উপায়ন্তর না দেখে আমি নিকটস্থ নগর খাঁনপুর গিয়ে আগের পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে একজন লোকের দরকার বলে জানাই। তখন নগর খাঁনপুর মহল্লার পরিচিত এক বেকার ছেলের সন্ধান পাই। ওই ছেলেকে বলে-কয়ে সাথে নিয়ে ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে থাকি। যেই ছেলেটাকে আমার সাথে কাজ করার জন্য এনেছি, সেই ছেলেটা টেক্সটাইল মিলের কাজ আর কখনো করেনি। আমার সাথেই প্রথম টেক্সটাইল মিলে কাজে আসা। ছেলেটার নাম, “কানাই লাল সাহা।” নতুন হেলপার কানাইকে নিয়েই ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ শুরু করি। প্রথম দিনের প্রথম কাজেই মিলের তাঁতিদের অনেক প্রশংসা আর বাহাবাহা কুড়ালাম। তিন-চার দিন পর ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিক মিলে আসার পর আমার ব্যাপারে তাঁতিদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে, মিলের সকল তাঁতিরা এই কাজে আমাকেই রাখতে বললো। তাঁতিদের কথা শুনে মালিক ফারুক সাহেব আমাকে সবসময়ের জন্য ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে বললে–আমি কানাইকে নিয়ে রেগুলার ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে থাকি।

কানাইকে সাথে নিয়ে কাজ করতে করতে একসময় কানাই হয়ে গেলো আমার প্রিয় বন্ধু। অবশ্য কানাই আমার বয়সের দিক দিয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোট ছিলো। কিন্তু হাতে-পায়ে ছিলো আমারমতো উঁচা-লম্ব। দুইজন একসাথে চলাফেরা করলে কে বড় আর কে ছোট, অনেকেই বুঝতে পারতো না। যেখানেই যেতাম কানাইকে সাথে নিয়েই যেতাম। যখন যা-কিছু খেতাম, কানাইকে নিয়ে খেতাম। এভাবে দুই-তিন মাস কাজ করার পর আমার আর নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা গোয়ালপাড়া থেকে আসা-যাওয়া করে কাজ করতে ভালো লাগছিল না। বিষয়টি আমার মাকে জানালাম। মা আবার বড়দা’কে জানালো। বড়দাদা মা-কে বললো, ‘ওঁর যদি এখান থেকে আসা-যাওয়া করতে সমস্যা হয়, তাহলে ওঁকে বলবেন মিলের সাথে নগর খাঁনপুর আগের মহল্লায় একটা বাসা নিতে। আমি এখেই থাকবো।’ বড়দা’র কথা মা আবার আমাকে বললো। আমি তখন কানাইকে বললাম, ‘আমার জন্য একটা বাসা ঠিক করতে।’ কানাই নগর খাঁনপুর পুকুরপাড়ে ওঁদের বাসার সাথেই শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে আমার জন্য একটা বাসা দেখে। এরপর আমি কানাইকে সাথে নিয়ে শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে গিয়ে বাসা দেখি। বাসা ভাড়া প্রতিমাসে ১৫০ টাকা। বাসাটা ছোটো ছিলো বলেই বাসা ভাড়া ১৫০/= টাকা। আমার পরিবারের সদস্য বলতে ছিলাম আমি, মা, আর বোন মরা ভাগ্নী। বাসাটা ছোট হলেও, আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিলো মনে করে বাড়িওয়ালাকে কথা দিলাম, এই বাসা আমিই নিবো।

তখন কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইলে কাজ করে প্রতিমাসে বেতন পেতাম ২০০০/=টাকার মতো। বাজারে চাউলের মূল্য ছিল প্রতি সের ৫-৬ টাকা। তাতে হিসাব করে দেখলাম, যেই টাকা বেতন পাবো, তাতে মাকে নিয়ে সুন্দরভাবে চলতে পারবো। সময়টা ছিলো বোধহয় ১৯৮৪ সালের। একসময় বাসা ভাড়া ঠিকও করে ফেললাম। বাসা ভাড়া ঠিক করে যেদিন বাসায় ঢুকবো, সেদিন ছিল শুক্রবার, ঠিক দুপুরবেলা। সেদিন দাদার বাসা থেকে কিছু দরকারি মালা-মাল নিয়ে ভ্যানগাড়ি করে নগর খাঁনপুর মহল্লায় আসলাম। মালা-মালের মধ্যে তেমন কোন দামী কোনও আসবাবপত্র ছিলো না। তারপরেও মোটামুটি যা ছিলো, গরিব সমাজে চলনসই ছিলো। আমি আর কানাই, দুইজনে মিলে মালা-মালগুলো ভ্যানে করে বাসার সামনে আনলাম। বাসার সামনেই ছিলো পুকুর। পুকুর পাড়েই ছিলো শ্যামসুন্দর সাহার বাড়ি। বাড়ির সামনে যখন ভ্যানগাড়ি রাখলাম, তখন অমার চোখ পড়ল শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতেই থাকা একটা মানুষের উপর। মানুষটা ছিলো এক মেয়ে মানুষ।

মেয়েটা খুবই সুন্দর ও রূপসী ছিলো। গায়ের রং ছিলো ফর্সা। মায়াবী চেহারা। যেন হাতে গড়া এক মাটির মূর্তি দেবী দুর্গা। হাটু পর্যন্ত তাঁর মাথার চুল। অপরূপ এক রূপবতী। আমি চেয়ে চেয়ে মেয়েটাকেই শুধু দেখতেছিলাম। মেয়েটার নজরও ছিলো আমাদের দিকেই। মেয়েটা খানিক পরপর শুধু আমাদের দিকেই আনা-গোনা করতে লাগলো। মেয়েটির এমন আনা-গোনা দেখে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। তখন আর ভ্যানগাড়ি থেকে এই সামান্য মালামাল নামাতে ভাল লাগছিল না। লজ্জা লাগার কারণও ছিলো। কারণটা ছিলো, যেই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম, সেই বাড়িতে আরো দুই-তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া ছিলো। তাঁরা সবাই ছিলো ছোটখাট ব্যবসায়ী। তাঁদের ঘরে জিনিসের অভাব ছিলো না। তাঁদের সাথে তো আমার মত গরিব মানুষের খাপ খাবে না বলেই, আমার কাছে কেমন যেন লজ্জা- লজ্জা লাগছিল। ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম,কী যে করি! কানাই’র কথায় কেন এই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম! অবশ্য এর আগেও আমরা সপরিবারে এই নগর খাঁনপুরেই ভাড়া ছিলাম। সেই আগের চেনাজানা বলেই কানাই’র কথায় আবার এই এলাকায় শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে আসলাম বাসা ভাড়া নিয়ে। কিন্তু এখন তো এই বাড়িতে আমার মতন অধমেকে মানাবে না। এসব নিয়ে একা একাই ভাবছিলাম।

এমন সময়ই কানাই বলছে, ‘কি রে! মালগুলি ধর! তাড়াতাড়ি করে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাই। খানিক পর তো আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আবার বাজারে যেতে হবে না? নতুন বাসা, কতকিছুর দরকার হবে! সবই তো তোর আস্তে আস্তে কিনতে হবে।’ কানাই’র কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে দুইজনের দ্রুত টুকিটাকি মালা-মাল ভ্যানগাড়ি থেকে নামানো শুরু করলাম। একটু পরে ওই মেয়েটা আমাদের সামনে আসলো। সামনে এসেই বললো, ‘আপনারা দুইজনে না পাড়লে আমিও কিছু-কিছু নিয়ে যাই? মামা (শ্যামসুন্দর সাহা) আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের সাথে ভ্যানগাড়ি থেকে ধরা-ধরি করে নামাতে।আমি চুপ করে ছিলাম, কোন কথা’ই বলিনি। কানাই বললো, ‘না না থাক, তোমার লাগবে না, যা আছে সেটা আমরা দুইজনেই পারবো, তুমি যাও।’ তারপরেও মেয়েটা হাড়ি-পাতিলের বোস্তাটা হাতে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আমার ভাড়া করা বাসায় নিয়ে রাখলো। বাকি মালগুলো কানাই আর আমি দুইজনে নিলাম। সাথে সাহায্যকারি রিকশওয়ালাও ছিলো।

আমার মা গোয়ালপাড়া থেকে আসলো বিকালবেলা। মা আসার আগেই দুইজনে জিনিসপত্রগূলো ঘরের ভিতরে সব গোছ-গাছ করে রেখেছিলাম। মালপত্রগুলি গোছানোর সময়ও মেয়েটা বারবার একটু পরপর আমাদের সাহায্য করার জন্য আমার ঘরের সামনে যাওয়া-আসা করছিল। কিন্তু আমরা কিছু বলছি না দেখে, আমার ঘরের ভেতরে আসছে না, বাইরে থেকেই আনা-গোনা করছিল। একটু পরে মা বললেন, ‘যা রান্না করার জন্য কিছু বাজার-সদাই করে নিয়ে আয়।’ মাকে বললাম, ‘বাজারের ব্যাগটা দিন, আর কী কী আনবো বলেন।’ কী কী লাগবে মা বললেন, আর ওমনি ব্যাগ নিয়ে কানাই আর আমি দুইজনে বাজারের চলে গেলাম। মজিদ খাঁনপুর বাজার থেকে কিছু বাজার-সদাই করে বাসায় ফিরলাম। মা রাতের খাবার তৈরি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রাতের খাবারে কানাইকে আমাদের সাথে খেতে বললাম। কানাই ঠিক সময়মত আমার বাসায় এসে হাজির হলো। মা দুইজনকে ভাত খেতে দিলেন। আমরা দুইজন ভাত খাচ্ছিলাম। এমন সময় আবার মেয়েটা এসে মাকে বললো, ‘মাসিমা কী রান্না করলেন এত তাড়াতাড়ি?’ ‘ইরি চাউলের ভাত, মুশরের ডাইল রান্না করেছি।’ মা জবাব দিলেন। মেয়েটা বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে একটা কাঁসার বাটি করে কিছু তরকারি এনে দিলেন, আমার মায়ের হাতে। মা প্রথমে রাখতে চায়নি। মেয়েটা তখন রাখার জন্য অনুরোধ করলো। তখন মা ওর অনুরোধে তরকারির বাটি রাখলো। সেই তরকারি আমাদের দুইজনকে ভাগ করে দিলো। আমরা দুইজন খেলাম। খাওয়া-দাওয়া সেরে হাত-মুখ ধুয়ে বাহিরে গেলাম। বাড়ির সাথেই চা’র দোকান, মুদি দোকান ছিলো। দোকান থেকে দুইজনে চা-সিগারেট টেনে আমি বাসায় আসলাম। কানাই ওঁদের বাসায় চলে গেলো।

এরপর মেয়েটার বিষয়-আশয় জানলাম। মেয়েটা কে? ওঁদের বাড়ি কোথায়? ওঁরা কয় ভাই, কয় বোন। মেয়েটি ছিলো এক দুখিনী মায়ের দুখিনী। মেয়েটার নাম মণিকা, (ছদ্মেমনাম) ৷ মেয়েটার বাবা জীবিত ছিলো না! মেয়েটা এই বাড়িওয়ালার বাসায় থেকে কাজ করে। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর। ওঁরা একভাই একবোন। মা জীবিত আছে। ওঁর মা-ও অন্য একজনের বাসায় কাজ করে। একসময় মেয়েটি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছিলাম না। তারপরও আমি বাসায় গেলে মেয়েটা সবসময় আমার পেছনে পেছনেই থাকতো। আমি ভীষণ ভয় পেতাম! কারণ, যদি কিছুর থেকে কিছু রটে যায়? তাই সবসময় ভয়ে ভয়ে মেয়েটাকে এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আমার মা মেয়েটাকে খুভ ভালোবাসতো, পছন্দও করতো।

আমারও পছন্দ হতো, ভালো লাগতো। তারপরও আমি বান্দা পাত্তা দিতাম না। এড়িয়েই যেতাম। একসময় মেয়েটি নিজেই কানাই’র কাছে আমার প্রতি ওঁর ভালোবাসার কথা বললো। কিন্তু না, আমি সবসময়ই দূরে দূরেই থাকতাম। কারণ, আমি মনে করতাম, সেসময় আমার বিয়ের বয়স হয়নি। তারপর ছিলো সংসারের অস্বচ্ছলতা। একসময় মেয়েটার বিয়ে ঠিক হলো। মেয়েটি রাজি ছিলো না। শেষমেশ মেয়েটিকে আমি নিজের বলেকয়ে বিয়েতে মত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। আমার অনুরোধে মেয়েটি বিয়েতে রাজি হয়। বিয়ের দিন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার পর, মেয়েটিকে বরের হাতে আমি নিজেই উঠিয়ে দেই। এই নিয়ে গত কয়েক বছর আগে অনলাইনে থাকা এক ব্লগ সাইটে “এক বিকেলের ভালো লাগা সারাজীবনের স্মৃতি” শিরোনামে একটা ব্লগ লিখেছিলাম। তা লেখার মাঝে লিংক দিয়ে দিলাম। যদি কারোর মন চায়, তাহলে ওই ব্লগ সাইট লিঙ্কে ক্লিক করে সেদিনের সেই লেখাটা পড়তে পারবেন। আশা করি ভালো লাগবে। আর আমার জীবনের গল্প-১২ পর্ব নিয়ে পরবর্তীতে হাজির হচ্ছি, শব্দনীড় ব্লগের প্রিয় মানুষের মাঝে।
চলবে…

জীবনের গল্প-১২ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

খুঁজি যারে

আমি খুঁজি যারে, পাই না যে তারে!
খুঁজি ঘরে-বাইরে, গ্রাম থেকে শহরে,
মহল্লার অলি-গলিতে, হাট-ঘাট-বাজারে,
মাটির মূর্তিতে, মন্দিরে, কোথাও পাইনা তারে!

কেউ বলে আছে, এখানে-সেখানে-ওখানে,
পাহাড়ে, পর্বতে, হিমালয়ে! পাই না কোনোখানে!
তবুও খুঁজি মথুরায়, গয়া-কাশি, বৃন্দাবনে।
কোথায় পাই তারে? দেখি- সে দেহের মধ্যখানে।

ভালোবাসা মানে কী

ভালোবাসা মানে, বেঁচে থাকার যেতো আশা।
ভালোবাসা মানে, কেউ সফল, কেউ নিরাশা।
ভালোবাসা মানে, চোখে দেখা ঝাপসা কুয়াশা।
ভালোবাসা মানে, একরকম ভয়ংকর সর্বনাশা।

ভালোবাসা মানে, হাসি গানের কতো তামাশা।
ভালোবাসা মানে, আনন্দ উল্লাসের রঙ্গতামাশা।
ভালোবাসা মানে, কাঁদতে হয় দিনরাত হরহামেশা।
ভালোবাসা মানে, পাগলের মতো হয় বেদিশা।

ভালোবাসা মানে, বাসর ঘরে আনন্দের মেলামেশা।
ভালোবাসা মানে, মাদকের মতো মরণ নেশা।
ভালোবাসা মানে, কতো অভিমান কত গোশশা।
ভালোবাসা মানে, গুরুদশা, ভগ্নদশা, চল্লিশা, মরণদশা।

এর নাম হলো, স্নেহভালোবাসা স্বাদের ভালোবাসা!

জীবনের গল্প-১০

জীবনের গল্প-৯-এর শেষাংশ: এভাবে চলতে চলতে একসময় নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব অনেক হয়ে গিয়েছিল। একসময় চানাচুর বিক্রি বাদ দিলাম। নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সীদের সাথে রিকশা চালানো শিখলাম। রিকশা চালানো শিখে নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

সংসারে অভাব দূর করার জন্য প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত রিকশা নিয়ে শহরের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকতাম। রিকশা চালিয়ে যা পেতাম, মায়ের কাছে এনে দিতাম। মা সংসারে খরচ করতো। তখন হঠাৎ করে এদেশে এক ধরণের নতুন রোগ দেখা দিলো। রোগের নাম ‘ঝিনঝিনা’ রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ হঠাৎ করে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যেতো। ওই রোগের একমাত্র ঔষধ ছিলো, রুগীর শরীরে পানি ঢালা। তখন আমরা নগর খাঁনপুরেই থাকতাম। সেসময় ‘ঝিনঝিনা’ রোগের ভয়ে প্রতিদিন ঠিকমতো রিকশা চালানো হতো না। ভয়ে ভয়েই বেশি থাকতাম। মহল্লায় থাকা আরও বন্ধু-বান্ধদের সাথেই সারাদিন ঘুরাফেরা করতাম। মহল্লার কেউ ‘ঝিনঝিনা’ আক্রান্ত হলে তাঁকে সবাই ধরাধরি করে পুকুরপাড় সিঁড়ি ঘাটলায় বসিয়ে রুগীর শরীরে পানি ঢালতাম। রুগী যতক্ষণ না পর্যন্ত সুস্থ না হতো, ততক্ষণ পর্যন্ত রুগীর গায়ে-মাথায় পানি ঢালতেই থাকতাম। এভাবে আমরা ‘ঝিনঝিনা’ রুগীকে সুস্থ করে তুলতাম।

আমরা কয়েকজন বন্ধু ছিলাম নগর খাঁনপুর মহল্লার সেচ্ছাসেবী হিসেবে। তখন ওই রোগের ভয়ে মহল্লার হিন্দুরা দলবেঁধে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা হরির নাম সংকীর্তন করতে করতে পুরো মহল্লার আনাচে-কানাচে চক্কর দিতো। মহল্লার ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও সকাল-বিকাল আল্লাহু আল্লাহু জিকির করতে করতে মহল্লার আনাচে-কানাচে ঘুরতো। প্রায় দিনেক ১৫ দিন পর একসময় ওই রোগ আস্তে আস্তে নিস্ক্রিয় হলো। যাঁর যাঁর সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমিও আবার নিয়মিত প্রতিদিন রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

আমি যেই মালিকের রিকশা চালাতাম, উনার নাম ছিলো, লেচু মহাজন। সবাই উনাকে লেচ্চা মহাজন নামেই চিনতো। নতুন রিকশা চালানো শেখা থেকেই আমি লেচ্চা মহাজনের রিকশাই চালাতাম। একসময় আমার সাথের অনেক রিকশাওয়ালারা রিকশা চালানো বাদ দিলেও, আমি আর বাদ দিতে পারছিলাম না, অন্যকোনো ভালো একটা কর্ম না জানার কারণে। তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ নতুন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো। দেশের চারদিকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনী গাড়ি নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে শুরু করলো। কারোর মাথায় লম্বা চুল দেখলে চুলের মুঠি ধরে কেচি দিয়ে ধানকাটার মতো কেটে দিতো। মায়ের জাতি নারীদের পেট দেখা গেলে পেটে আলকাতরা লাগিয়ে দিতো।

ওই বিপদে আমি নিজেও একবার পড়েছিলাম। রিকশায় প্যাসেঞ্জার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ২ নং রেল-গেইট সংলগ্ন ডায়মন্ড সিনেমাহলের সামনে গেলাম। হঠাৎ করে সেনাবাহিনীর আমার রিকশার সামনেই গাড়ি থামালো। তখন আমার মাথার চুল অনেক লম্বা ছিলো। আমাকে দেখামাত্রই দুইজন সেনাবাহিনী আমার চুলের মুঠি ধরে ঘেচাং ঘেচাং করে কেটে দিলো। এমনভাবে ঘেচাং ঘেচাং করলো, তখন মাথা ন্যাড়া করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সেদিনের রোজগার মাটি দিয়ে গ্যারেজে রিকশা জমা দিয়ে গেলাম সেলুনে। সেলুনের নাপিত আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। বললাম, ‘ভাই হাসাহাসি বাদ দিয়ে মাথাটা ন্যাড়া করে দিন।’ নাপিত আমার মাথা ন্যাড়া করছে, আর বিস্তারিত জানতে চাচ্ছে। বললাম, নাপিতের কাছে বিস্তারিত ঘটনা। মাথা ন্যাড়া করে বাসায় আসলাম। মহল্লার সবাই আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। সাথে বন্ধুরা জানতে চাইলো, ‘ঘটনা কী?’ সব বৃত্তান্ত খুলে বললাম। বাসায় আসার পরও ওই হাসা-হাসির পালায় পড়লাম। বৌদি হাসে, বড়দিদি হাসে। বড় দাদাও হাসতে লাগলো। এরপর আর ভয় করতাম না, নির্ভয়ে বুকেরপাটা টান করে রিকশা নিয়ে শহরে ঘুরতাম। অবশ্য এর কয়েকদিন পর সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর আনা-গোনাও কমে গেলো। যে যাঁর মতো শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে কাজ করতে লাগলো।

এর কিছুদিন পর হঠাৎ করে ফেনী থেকে আমার অবিবাহিত বড় বোনের বিয়ের সম্বন্ধ আসলো। ছেলে পক্ষের কোনও দাবি-দাওয়া নেই, কোনরকম বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দিতে পারলেই হলো। ছেলেটা আমার মায়ের গুরুদেবের পরিচিত ছিল বলে আমার মা মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু হিন্দু বিয়ে বলে একটা কথা তো ছিলোই। একেবারে গাছ-পা খালি-পা করে করে তো, বিয়ে দেওয়া যায় না। তাই আমার মা নগর খাঁনপুর মহল্লার হিন্দু মুসলমান সকলের হাতে-পায়ে ধরে মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইতে শুরু করলো। আমাদের বাড়িওয়ালা আমার বোনের বিয়ের সাহায্যের জন্য আমাদের হয়ে নগর খাঁনপুররের বিশিষ্টজনদের কাছে গেলো এবং বিয়ে যাতে সুন্দরভাবে হয়, সেজন্য তাদের পরামর্শ চাইলো। তখন নগর খাঁনপুর মহল্লায় থাকা বিশিষ্টজনরা সম্মিলিতভাবে গরিবের মেয়ের বিয়ের জন্য সকলকে সাহায্য করার অনুরোধ করে একটা সাদা কাগজে দরখাস্তের মতো লিখে দিলো। সেই কাগজ সাথে নিয়ে আমি আর আমার মা বোনের বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য নারায়ণগঞ্জ শহরের অলিগলিতে, মার্কেটে মার্কেটে গিয়ে ধনী-গরিব সকলের কাছে সাহায্য চাইতে লাগলাম। কেউ দিতো, কেউ আবার দিতো না। তবুও দ্বারেদ্বারে যাওয়া বন্ধ করলাম না, যেতেই লাগলাম। সাহায্য উঠাতে লাগলাম।

এভাবে বেশকিছু টাকা সংগ্রহ করলাম। আর নগর খাঁনপুর থেকেও কেউ লেপ, কেউ তোশক, কেউ ঘটি-বাটি, কেউ নগদ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে লাগলো। যে যা দিতো সব আমাদের বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছেই জমা থাকতো। একসময় বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হলো। বিয়ের ১০/১২ দিন বাকি থাকতে আমি বোনের বিয়ের জন্য সাহায্য উঠাতে চলে গেলাম, নোয়াখালী নিজের গ্রামে। গ্রামে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের কাছে বোনের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইলে, গ্রামের সব হিন্দু বাড়ির লোকজন একত্রিত হয়ে কেউ ২০ টাকা, কেউ ২৫ টাকা এমন করে ২০০টাকার মত মিলিয়ে আমার হাতে তুলে দিলো। তারপর গেলাম, আমার মাসিমা’র বাড়িতে। মাসিমা’র বাড়ি ছিলো নোয়াখালী সোনাপুর রেলস্টেশনের পূর্বদিকে রাজুরগা গ্রামে। আমার বোনের বিয়ের কথা শুনে আমার মাসিমা আর মাসতুতো ভাই-বোন মিলে আমাকে ২০০টাকার মতো হাতে দিলো। আমি সেই টাকা নিয়ে তিনদিন পর নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি। তারপর কোনোএক সুন্দর লগ্নে কোনও ঝায়-ঝামেলা ছাড়াই সবার সাহায্য সহযোগিতায় বোনের বিহাহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরদিনই জামাইবাবু দিদিকে নিয়ে ফেনী ফুলগাজী নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আমাদের সংসার কিছুটা স্বচ্ছলভাবে চলতে থাকে। বড়দাদা কাজ করতো কিল্লার পুল এলাকায় এক টেক্সটাইল মিলে। আর আমি প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে শুরু করে রাতদুপুর পর্যন্ত রিকশা নিয়েই পড়ে থাকতাম নারায়ণগঞ্জ শহরের পাড়া-মহল্লার আনাচে-কানাচে।

একসময় আমার বড়দাদা কিল্লার পুল সংলগ্ন টেক্সটাইল মিলের কাজ ছেড়ে হাজীগঞ্জ আইইটি স্কুল নামক স্থানে এক নতুন টেক্সটাইল মিলে কাজ নেয়। সেসময় আমি রিকশাই চালাতাম। আমার বড়দাদা আমার পরিশ্রম দেখে আমাকে প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বড় দাদার সাথে কাজ শেখার জন্য বললো। কাজ শিখে রিকশা চালানো ছেড়ে দিতে বললো। বড় দাদার কথামতো আমি তা-ই করতে থাকি। সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রিকশা চালাতাম, আর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বড়দা’র সাথে টেক্সটাইল মিলের তাঁতের কাজ শিখতাম। একসময় তাঁতের কাজ পুরোপুরি শিখেও ফেললাম। তখন রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়ে বড়দাদা যেই মিলে কাজ করতো, সেই মিলেই কাজ করতে লাগলাম। আমি তখন ২০ বছরের এক যুবক। হাতে-পেয়েও ছিলাম উঁচা-লম্বা। শরীরের দিক দিয়েও ছিলাম আরও দশজনের চেয়ে স্বাস্থ্যবান এক জবরদস্ত যুবক।

সেসময় বাংলাদেশে নতুন একধরনের পলিয়েস্টার সূতার আগমণ ঘটলো। পলিয়াস্টার সূতার কাপড়ের খুবই চাহিদা ছিলো। রেডিওতে প্রতিদিন পলিয়েস্টার সূতার গুণাগুণ প্রচার করা হতো। সেসময় এই বঙ্গদেশের জেলা-শহরগুলোর আনাচে-কানাচে কচুগাছের মতো টেক্সটাইল মিল গড়ে উঠতে শুরু করলো। কোরিয়া, জাপান থেকেও কাপড় তৈরির অত্যাধুনিক মেশিনপত্র আসতে লাগলো। কাপড়ের কারিকর (তাঁতি)-সহ টেক্সটাইল মিলের বিভিন্ন কাজের লোকের চাহিদা বেড়ে গেলো। ঠিক সে-সময়ই আমি হলাম একজন সুদক্ষ তাঁতি। তাঁতের কাজ যেখান থেকে শেখা, সেখানেই অনেকদিন মনোযোগ সহকারে তাঁতের কাজ করলাম। একসময় আমার আর তাঁতের কাজ ভালো লাগছিল না। কারণ তাঁতের কাজ করতে হয়, দিনে-রাতে। এক সপ্তাহ দিনে, এক সপ্তাহ রাতে। রাতজাগা কাজটা আমার ভালো লাগছিল না। শিখলাম উইভিং ডিপার্টমেন্টের (তাঁত বিভাগ) অন্য এক কাজ। সেই কাজটা শুধু দিনেই করতে হয়। তাই খুব মন দিয়ে ওই কাজটা শিখেছিলাম। কাজটার নাম রেসিং ম্যান। কেউ ড্রয়ার ম্যানও বলে। আবার কেউ বলে, ব-গাঁথা বা বয়া-গাঁথা বা হানা-ব ভরা বা শানা-ব ভরা। কাজটা শিখেছিলাম ঠিক, কিন্তু এই কাজটা কোনও মিলে পার্মানেন্ট করতে পারছিলাম না। ওই কাজ শিখেও কাজ জোগাড় করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাঁতের কাজেই করতে লাগলাম।

একসময় বড়দাদা নগর খাঁনপুর থেকে বাসাও ছড়ে দিলো। নতুন করে বাসা ভাড়া নিলো নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা এলাকায় গোয়ালপাড়া। বড়দাদা বাসা ছাড়ার সাথে সাথে নতুন করে ফতুল্লা কাঠের পুল এলাকায় থাকা একটা টেক্সটাইল মিলে কাজ নিয়ে নিলো। আমাকেও সাথে নিলো। ওই মিলে মাত্র ৭টা পাওয়ার লোম (তাঁত) ছিলো। মিলের নাম ছিলো, মিলন টেক্সটাইল মিলস্। মালিকের নাম ছিলো, মিলন সাহেব। মালিকের বাড়ি ছিলো বিক্রমপুর। দোকান-সহ ব্যবসা ছিলো ঢাকা ইসলামপুর। ওই মিলে আমরা দুই ভাই একজোড়া তাঁত পার্মানেন্ট নিয়ে নিলাম। আর বাদবাকি তাঁত আরও কয়েকজন কারিকর (তাঁতি) চালাতো। আমার বড় দাদা করতো দিনে, আমার কপালে পড়লো, সেই রাতেই ডিউটি। তবুও বাধ্য হয়ে করতাম। কিন্তু রাতের কাজ আমার ভালো লাগতো না। তাই শখ করে যেই কাজটা আরও আগে শিখেছিলাম, সেই কাজটা আমাকে দেওয়ার জন্য একদিন মালিক মিলন সাহেবকে বললাম। কিন্তু সেই কাজটা তখন মিল এলাকার আবুল নামের একজন লোকে করতো। সেই লোক আবার আরও দুই-একটা মিলে চুক্তিতে কাজ করতো।

একসময় আমার বড়দাদা ওই আবুল নামের লোকটার সাথে আমার ব্যাপারে আলাপ করলো। তখন ওই লোক নিজের ইচ্ছায় মিলন টেক্সটাইল মিলের ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে বুঝিয়ে দিলো। আমি স্থানীয় একটা ছেলেকে(হেলপার) নিয়ে ওই শখের রেসিং-এর কাজটা করতে থাকি। মিলন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতে করতে একসময় নারায়ণগঞ্জ শহরে আনাচে-কানাচে থাকা ছোট-বড় প্রাইভেট টেক্সটাইল মিলে আমার নাম ছড়িয়ে পড়লো। যেখানে যেই মিলেই নতুন পাওয়ার লোম (তাঁত) আসতো আমাকে সেই মিলে কাজ করার জন্য মালিক পক্ষ থেকে অফার দিতো। কিন্তু কোনও মিলে পার্মানেন্ট কাজ বা চাকরি করার কথা দিতাম না। তবে মিলন টেক্সটাইল মিলের কাজের ফাঁকে ফাঁকে হেলপার নিয়ে অন্য মিলে গিয়ে চুক্তিতে কাজ করে দিতাম। তখনকার সময়ে টেক্সটাইল মিলে আমার এই কাজের প্রচুর চাহিদা ছিলো। একটা টেক্সটাইল মিলে মনোমত ১০০জন তাঁতি থাকলেও একজন মনের মতো ড্রয়ার ম্যান থাকতো না। ড্রয়ার ম্যান বা রেসিং ম্যানের কাজটা ছিলো খুবই খেয়ালি ও ধৈর্যশালী কাজ। এই কাজটা করতে হতো নির্ভুলভাবে!
চলবে…

জীবনের গল্প-১১ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৯

জীবনের গল্প-৮-এর শেষাংশ: বাসায় গিয়ে দেখি মায়ের পরনে সাদা কাপড়। বড় দাদার পরনে সাদা মার্কিন কাপড়। হাতে বগলে কুশান। গলায় সাদা কাপড়ে চিকন দড়ির মতো মালার সাথে একটা লোহার চাবি ঝুলানো। সেদিনই সেই বেশ আমারও ধরতে হয়েছিল।

বোনের মৃত্যুর পর, আর বাবার মৃত্যুর পর আমার মা একরকম আধ-পাগলের মতো হয়ে গিয়েছি। বোন মরা ভাগ্নীটা আমাদের সংসারে থেকে আস্তে আস্তে হাঁটি-হাঁটি পা-পা, করতে লাগলো। আমিও লেখাপড়া বাদ দিয়ে বড় দাদার সাথে সংসারের বোজা ভাগাভাগি করে মাথায় নিয়ে নিয়মিত কাজ করতে ছিলাম। এরমধ্যে কতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান হয়, আসে-যায়! ওইসব ধর্মীয় উৎসবে মিলের ভেতরে থাকা সমবয়সীরা কতো নতুন নতুন জামা-কাপড় পরে, আনন্দ-উল্লাস করে! কিন্তু আমাকে সবসময়ই থাকতে হয় কাজের ধান্দায়। ঘরে এসে বসে থাকি একমুঠ ভাতে আশায়। এভাবে চলতে চলতে একসময় আদর্শ কটন মিল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণা আসলো, মিলের পুরাতন মেশিনপত্র বিক্রি করে মিল আধুনিকায়ন করা হবে। এই ঘোষণার ফলে মিলের সব শ্রমিকরা ছাটাই হয়ে গেলো। শ্রমিকরা চাকরি ছেড়ে যাঁর-যাঁরমতো হিসাব বুঝে নিতে লাগলো। আমার বড় দাদার অবস্থাও আরও দশজনের মতো হলো। কিন্তু তখনো মিল কর্তৃপক্ষ মিলের ভেতর থেকে ফ্যামিলি কোয়ার্টার ছাড়ার কোনও ঘোষণা দিচ্ছিল না। তাই মিল থেকে বড় দাদার হিসাব বুঝে পেলেও, আমরা মিলের ভেতরেই থাকতে ছিলাম।

তখন মিলের ভেতরে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে বাসাভাড়া ছিল না ঠিক, কিন্তু বড় দাদা চাকরি ছিল না বলে সংসারের অভাব আরও বেড়ে গিয়েছিল। বড় দাদা সার্ভিসের যে ক’টা টাকা এককালীন পেয়েছিল, তা সুদের টাকা আর দোকান বাকি দিতে গিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সংসারের বড় বোঝাটা তখন আমার মাথার উপরেই ঠেসে বসেছিল। আমি তখনো আদর্শ কটন মিলে ডেইলি কাজে ছিলাম। সেসময় ১২ টাকা থেকে দৈনিক মজুরি ১৫ টাকা হয়েছিল। একদিন ঠিক দুপুরের আগে একটা বাঁশের মাচার উপর দাঁড়িয়ে একজন মিস্ত্রিকে টিন উঠিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ বাঁশের মাচা ভেঙে আমার ডান হাতের তালুর একপাশে নতুন টিনের কোণা ঢুকে হাত কেটে যায়। সাথের লোকজন ধরাধরি করে মিলের ভেতরে থাকা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার প্রথমেই আমার হাতে ৭টা সেলাই করলো। তারপর ব্যথা কমানোর জন্য ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে লোক মারফত বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আমার এই অবস্থা দেখে আমার মা জ্ঞানহারা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শুনেছিলাম, আমার জ্ঞান ফেরার পর বৌদির কাছে, বড় বোনের কাছে। সেই হাত এক্সিডেন্টে আমি অন্তত একমাস কাজ করতে পারিনি। তবে এক্সিডেন্ট হওয়ার চার-পাঁচ দিন পর মিলে গিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিয়েছিলাম। এর বিনিময়ে মিলের সরদার দয়া করে আমাকে প্রতিদিন অর্ধেক হাজিরা হিসাব করে সপ্তাহের দিন দিয়ে দিতো। ওই নামমাত্র টাকা পেয়ে সাথে সাথে বড় দাদার হাতে দিয়ে দিতাম। বড় দাদা তা দিয়ে নগদ-বাকিতে মিলিয়ে সংসার চালাতেন, আর সারাদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন।

বড় দাদা ঘুরতে ঘুরতে একসময় একটা কাজও পেয়ে গেলেন। কাজ পেয়েছেন আদর্শ কটন মিল ঘেষা মাউরা মিল নামে একটা ছোট কাপড়ের মিলে। সেই মিলে দিনরাত কাজ করে যেই টাকা পেতো, সেই টাকা দিয়েই কোনরকমভাবে সংসার চলতে লাগলো। আমিও আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলাম। একসময় আমি যখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠি, তখন আমার বড় দাদা ওই এক্সিডেন্টের ভয়ে আমাকে আর আদর্শ কটন মিলের ডেইলি কাজে যেতে দিতেন না। দাদার ইচ্ছা আমাকে তাঁর সাথে রেখে কাপড় বুনানোর (তাঁতে) কাজ শেখাবেন। তাই সুস্থ হয়ে দাদার কথামতো প্রতিদিন বড় দাদার সাথে নিকটস্থ মাউরা মিলে যেতাম। দাদার সাথে কাজ শিখতাম।

একদিন হঠাৎ করে বড় দাদার এক বন্ধুর ছেলে মুন্সিগঞ্জ রিকাবি বাজার সংলগ্ন কমালাঘাট থেকে আদর্শ কটন মিলে তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসে। লোকটার নাম সুনিল। ওই লোক (সুনিল) বড় দাদার সাথে দেখা করে আমাদের সংসারের ভালো-মন্দের খবর নেয়। আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বড় দাদা সব বৃত্তান্ত খুলে বলে। তারপর সুনিল কাকা আমাকে কমলাঘাট একটা বড় বাণিয়া দোকানে চাকরি দিতে পারবে বলে বড় দাদাকে কথা দেয়। সুনিল কাকার কথায় আমার বড় দাদা খুশি হয়ে আমাকে সুনিল কাকার সাথে কমলাঘাট যেতে বলে। আমার ইচ্ছা না থাকা স্বত্বেও বড় দাদার কথায় সুনিল কাকার সাথে আমাকে বানিয়া দোকানে চাকরি করতে কমলাঘাট যেতে হয়।

গেলাম মুন্সিগঞ্জ কমলাঘাট। লাগলাম বাণিয়া দোকানে কর্মচারীর কাজে। খাওয়া-দাওয়া দুপুরে রাতে বাণিয়া দোকানের মালিকের বাসায়। সকালের খাবার দোকানের সাথে থাকা এক মিষ্টির দোকানে। প্রতিদিন নাস্তা বাবদ ১ টাকা। তখনকার সময় কমলাঘাটে থাকা মিষ্টির দোকানগুলোতে একটা পরোটার দাম ছিল চারআনা। পরোটার সাথে ডাল-ভাজিও চারআনা। আমি প্রতিদিন নগদ ১টাকা হাতে পেয়ে দুটো পরোটা আটআনা, আর ডাল অথবা ভাজি নিতাম চারআনার। মোট বারো আনা নাস্তা, আর বাকি থাকা চারআনা দিয়ে আধা প্যাকেট কমলাঘাটের নামকরা হোসেন বিড়ি কিনে নিতাম। রাতে দোকানের দোতালায় ঘুমাতাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা খেয়ে দোকানে থাকতাম। দুপুরের একটু আগে মালিকের বাড়ি থেকে মাথায় করে খাবারের ভাত নিয়ে আসতাম। আবার রাতে দোকান বন্ধ করে মালিক-সহ আমরা আরও দুইজন কর্মচারী মালিকের বাড়িতে যেতাম। রাতের খাবার একসাথে খেয়ে আবার দোকানে এসে ঘুমিয়ে পড়তাম।

কমলাঘাট ওই বাণিয়া দোকানে যে-ক’দিন ছিলাম, খাওয়া-দাওয়ার দিক দিয়ে ভালোভাবেই ছিলাম। কিন্তু মাকিল কিছুর থেকে কিছু হলেই গালমন্দ করতে, বকা-ঝকা করতো। এতে আমার মনটা সবসময় খারাপ হয়ে থাকতো। একদিন সুনিল কাকার সবকিছু খুলে বললাম। আমার কথা শুনে সুনিল কাকা তেলে-বেগুনে জেলে উঠলো। ওইদিনই সুনিল কাকা আমার জন্য আরেক মালিকের সাথে আলাপ করলে। তখন মালিক আমাকে তাঁর দোকানে নিয়ে যেতে বললো। পরদিন সুনিল কাকা আমাকে ওই দোকানে নিয়ে গেলেন। এই দোকানের কাজ হলো, তেলের টিনে মুখ ঝালাই করার কাজ। এখানে আরও ৮জন কর্মচারী আছে। ওঁরা কেউ লেখাপড়া জানতো না। মালিকও লেখাপড়া জানতেন না। মালিকের নাম জগদীশ বাবু। উনার এক ভাইও এই কাজে মালিকের সাথেই থাকতো। থাকা, খাওয়া-দাওয়ার জন্য বড় এক গোডাউনে মতো দোকানঘর ছিল। আমার সম্বন্ধে সুনিল কাকা থেকে আগেই শুনেছিল, আমি একটু-আধটু লেখা-পড়া জানি। তাই কাজের মালিক আমাকে এখানে রাখতে চায় এবং এ-দিনই তাঁর এখানে চলে আসতে বলে। মালিকের কথা শুনে সুনিল কাকা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি এখানে থাকবো কি-না?’ আমি সুনিল কাকার কথায় রাজি হলাম। সাথে সাথে সুনিল কাকা আমাকে নিয়ে আগের বাণিয়া দোকানে যায়। বাণিয়া দোকানে গিয়ে দোকান মালিককে জানিয়ে দেয়, ‘নিতাইকে আমি অন্য জায়গায় কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি। নিতাই আজ থেকে আর আপনার দোকানে কাজ করবে না।’ এরপর আমাকে তেলের মুখ ঝালাইয়ের মালিকের দোকানে এনে দিয়ে যায়। ওই তেলে মুখ ঝালাইয়ের দোকানে আমি প্রায় মাসেক ছয়মাস কাজ করে একবার জগদীশ দাদাকে বলে-কয়ে ছুটি নিয়ে আমাদের বাসায় আসি।

আদর্শ কটন মিলে আসার পর দেখি আমার সমবয়সীরা আদর্শ কটন মিলে নতুন কন্ট্রাক্টারের আন্ডারে কাজ করছে। তা দেখে আমি আর কমলাঘাট ঝালাই কাজে গেলাম না। আমি সমবয়সীদের সাথে আদর্শ কটন মিলে দৈনিক ১৫ টাকা মজুরিতে কাজ করতে থাকি। তখন আদর্শ কটন মিলের পুরাতন মেশিনপত্র বিক্রির পর নতুন মেশিনপত্র আসতে শুরু করলো। মিলের ডিপার্টমেন্টগুলো নতুন করে মেরামত করার জন্য নতুন করে কাজ শুরু হলো। যেই কন্ট্রাক্টর সাহেব এই কাজ পেয়েছিল, উনার নাম ছিল মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন। আমরা কাজের সাইটে সব লেবাররা তাঁকে বিল্লাল ভাই বলেই ডাকতাম। উনি আমার কাজের খুব প্রশংসা করতেন এবং সব লেবারদের চেয়ে আমাকেই বেশি আদর করতেন। আমি ছিলাম ঢালাই মাল বানানোর জন্য এক্সপার্ট। তাই যেদিন ঢালাই কাজ হতো, সেদিন কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাকে হাত খরচ বাবদ ৫-১০ টাকা খুশি হয়ে দিয়ে দিতো। আমিও খুশিতে নিয়মিত প্রতিদিন কাজ করতে লাগলাম।

একসময় আদর্শ কটন মিল কর্তৃপক্ষ মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টার থেকে সবাইকে বাসা ছেড়ে দিতে বললে, আমরা পড়ে যাই বিপাকে। তখন আমার বড় দাদা শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় নগর খাঁনপুর এলাকায় বাসা ভাড়া ঠিক করে। এরপর আমরা সপরিবারে আদর্শ কটন মিল থেকে নগর খাঁনপুর ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠি। আমি নগর খাঁনপুর থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে আদর্শ কটন মিল ওই বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করতে থাকি। আমার কাজ করার এমন ইচ্ছা দেখে সম্মানিত বিল্লাল কন্ট্রাক্টর সাহেব প্রতিদিন মিলের কাজ শেষে আমাকে চার-পাঁচ টাকা করে গাড়িভাড়া বাবদ দিয়ে দিতো। রোজের মজুরি তো থাকতই। সপ্তাহে কাজ করে যা পেতাম, তা বাসায় এসে মায়ের কাছে, নাহয় বড় দাদার কাছে দিয়ে দিতাম। তারপরও আমাদের সংসার চলছিল না। কারণ আদর্শ কটন মিল থেকে আসার পর বড় দাদার কাজ ছিলো না। তখন আমার মা নগর খাঁনপুর মহল্লায় থাকা এক বাড়িতে রান্না-বান্না করার কাজ নিলো। এর ক’দিন পরই বড় দাদাও নগর খাঁনপুরের সাথেই কিল্লার পুল সংলগ্ন একটা টেক্সটাইল মিলে কাজ জোগাড় করে সেই মিলে কাজ করতে লাগলো। আর আমি কাজ করতে থাকি আদর্শ কটন মিলে বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের কাজ।

প্রতিদিন নগর খাঁনপুর থেকে আদর্শ কটন মিলে সকাল-সন্ধ্যা আসা-যাওয়ার মাঝে নগর খাঁনপুর মহল্লার কয়েকজন সমবয়সীদের সাথে পরিচয় হলো। ওঁরা কেউ রিকশা চালক, কেউ ঝালমুড়ি বিক্রেতা, কেউ ভ্যানগাড়ি চালক, কেউ কমলাপুর রেলস্টেশনের চানাচুর বিক্রেতা। একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি আদর্শ কটন মিল থেকে নগর খাঁনপুর বাসায় আসছিলাম। আসার পথে রুহিদাস নামে একজন সমবয়সী চানাচুরওয়ালা আমাকে ডাক দিলো, ‘এই শোন!’ আমি ওঁর সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি ভাই? বলেন, কি বলতে চান!’ আমাকে বললো, ‘তুই কোথায় কাজ করিছ?’ বললাম, ‘নদীর ওপার আদর্শ কটন মিলে।’ আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কাজ?’ বললাম, রাজমিস্ত্রীর যোগালি কাজ।’ আমার কথা শুনে চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস হাসতে লাগলো। ওঁর হাসি দেখে আমার মাথাটা চেন করে গরম হয়ে গেলো। আমি তখন রাগের মাথায় ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হাসলেন কেন, ভাই?’ আমার রাগ দেখে ও তখন থতমত হয়ে বললো, ‘আরে না, এমনি হাসলাম! যোগালি কাজ করে কি আর পেটের ভাত জুটবে? এর চেয়ে বরং তুই আমার সাথে চানাচুর বিক্রি কর, ভালো ইনকাম হবে।’ তখন আমার মাথা কিছুটা ঠাণ্ডা হলো! আমি বললাম, ‘চানাচুর বিক্রি করতে কত টাকা চালান লাগে, ভাই?’ চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস বললো, ‘তোর কাছে টাকা না থাকলে, আমি নিজেই তোকে চালান-সহ সবকিছু ঠিকঠাক করে দিবো।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা, বাসায় গিয়ে আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করে নিই।’ এই বলেই চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় এসে মাকে সবকিছু বললাম! মা বললো, ‘তুই যেটা করতে পারবি, সেটাই করবি।’

মায়ের কথা শুনে আবার বাসা থেকে বের হয়ে চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাসের খোঁজ নিয়ে ওঁদের বাসায় গেলাম। মায়ের সম্মতির কথা জানালাম। রুহিদাস আমার কথা শুনে বললো, ‘তোর কাছে অল্পকিছু টাকা আছে?’ আমি সত্য কথা বললাম, ‘না!’ আমার কথা শুনে রুহিদাস বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আগামীকাল তোকে চানাচুর বিক্রি করার সবকিছু ঠিক করে দিবো। তুই সকালে আমার সাথে দেখা করবি।’ পরদিন সকালে রুহিদাস আমাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ গেলো। নারায়ণগঞ্জ থেকে একটা টুকরি, ছোট একটা দাঁড়িপাল্লা, ছোট ছোট কয়েকটা বাটখারা, চানাচুর বানানের জন্য একটা পট, বড় সাইজের দুই প্যাকেট চানাচুর, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ছটাকখানি ভিট লবণ, সরিষার তেল, পেঁয়াজ কাটার জন্য ছোট একটা ছুড়ি কিনলো। মোট খরচ হলো, ১০০ টাকার মতো। এরপর দুইজনে আবার বাসায় আসলাম। বাসায় এসে রুহিদাস সবকিছু টুকরিতে সাজালো। এরপর আমাকে রুহিদাস বললো, ‘তুই বাসা থেকে খেয়ে আয়। আসার সময় একটা গামছা নিয়ে আসবি। তারপর আমরা আস্তেধীরে চানাচুর নিয়ে বের হবো।’ আমি বাসায় গেলাম। ভাতা খেলাম। ভাত খেয়ে একটা গামছা কাঁধে ফেলে রুহিদাসের বাসায় আসলাম। তারপর সন্ধ্যার একটু আগে দুইজনে একসাথে চানাচুর সাজানো টুকরি মাথায় নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন গেলাম। রুহিদাস রেলস্টেশনে বসে চানাচুর সাজানো টুকরির দুইপাশে ছিদ্র করে গামছা বেঁধে দিয়ে বললো, ‘ট্রেন আসলে তুই এক বগিতে উঠবি। আমি অন্য বগিতে উঠবো। প্রত্যেক স্টেশনে নামবি। ট্রেনের এক বগি থেকে অন্য বগিতে উঠবি। এভাবে ট্রেন যখন কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দুইজন একসাথ হবো।’

একসময় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে ট্রেন আসলো। যাত্রী ওঠা-নামা করার সময় রেলস্টেশনেই ১০/১২টাকা বিক্রি হয়ে গেলো। ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে সামনে লাগানো হলো। আমরা দুইজনে ট্রেনের দুই বগিতে ওঠালাম। রুহিদাস যেভাবে আমাকে বলেছিল, ঠিক সেভাবেই চানাচুর চানাচুর বলে চিল্লাতে চিল্লাতে ট্রেনের বগিতে বগিতে চানাচুর বিক্রি করতে করতে একসময় কমালাপুর গিয়ে পৌঁছলাম। রুহিদাস আর আমি একসাথ হলাম। রাত তখন ৮টার মতো বাজতে লাগলো। কিন্তু তখনও সব চানাচুর শেষ হয়নি। আমদানি করলাম ৬০ টাকার মতো। রুহিদাস বললো, ‘চিন্তা করবি না! ট্রেন আবার নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার সময় সব চানাচুর শেষ হয়ে যাবে।’ এর কিছুক্ষণ পরই আবার ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার ট্রেন ছাড়ার সময় হলো। আমরা দুইজন দুই বগিতে উঠে গেলাম। ট্রেন ছাড়লো। আবার চানাচুর বিক্রি করা শুরু করলাম।

সেদিন চানাচুর বিক্রি হয়েছিল ১২০ টাকার মতো। আমি রুহিদাসকে ১০০ টাকা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রুহিদাস তখন ওঁর ১০০টাকা ফেরত নেয়নি। রুহিদাস বললো, ‘এই টাকা দিয়ে আগে নিজের চালান করে নে। তারপর আমার টাকা পরিশোধ করবি।’ এরপর থেকে প্রতিদিন নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ টু কমলাপুর– কমলাপুর টু নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে আমি চানাচুরওয়ালা সেজে ট্রেনের এই বগি থেকে ওই বগিতে চানাচুর বিক্রি করতে লাগলাম। অনেক সময় সারারাত পর্যন্ত কমলাপুর রেলস্টেশনে ঘুরে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করতাম। এর মাঝেই একদিন আদর্শ কটন মিলে গিয়ে বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে চার-পাঁচ দিনের পাওনা টাকা নিয়ে আসলাম। রুহিদাসের দেওয়া চালান বাবদ ১০০টাকা ফেরত দিলাম। এভাবে চলতে চলতে একসময় নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব অনেক হয়ে গিয়েছিল। একসময় চানাচুর বিক্রি বাদ দিলাম। নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সীদের সাথে রিকশা চালানো শিখলাম। রিকশা চালানো শিখে নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

চলবে…

জীবনের গল্প-১০ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

শব্দনীড় ব্লগের প্রিয় ব্লগারবৃন্দ লক্ষ্য করুন!

একসময় যখন এদেশে মোবাইল ফোনের আগমণ ঘটে, আমি তখন টেক্সটাইল মিলে কাজ করি। মিলটা ছিলো গোদনাইল পানির কল এলাকায়। মিলের নাম গাজী টেক্সটাইল মিলস্। মিল মালিকের নাম ছিলো, সামছুল হক গাজী। উনাকে এলাকার সবাই গাজী সাহেব বলে ডাকতো। সময়টা তখন ২০০৬ সাল। তবে এর আগে থেকেই মনে হয় এদেশে মোবাইল ফোন এসেছিল। কিন্তু আমার দেখা ২০০৬ সালে গাজী টেক্সটাইল মিলের মালিক গাজী সাহেবের হতে। তাই আমি এদেশে মোবাইল ফোনের আগমণ ২০০৬ সালই উল্লেখ করেছি।

সে-সময় মিলের মালিক ঢাকা থেকে একটা নতুন মোবাইল ফোন কিনে আনে। মোবাইলটা প্রায় এক মুঠুম হাত লম্বা ছিল। মোবাইলটার কালার ছিলো কালো। উনি সময় সময় বাসা থেকে বের হয়ে মিলের গেইটের সামনে এসে মোবাইল ফোনটা কানে চেপে ধরে কথা বলতো। ঘরের বাইরে এসে কথা বলার কারণও ছিলো! কারণ হলো, তখনকার সময়ে নেটওয়ার্ক সমস্যা বেশি ছিলো। যদিও উনার মোবাইলের সিমকার্ড গ্রামীণ ফোন ছিলো, তবুও তখন ঘরের ভেতরে বসে নেটওয়ার্ক পাওয়া যেতো না। তাই তিনি মোবাইল ফোন কানে চেপে ঘরের বাইরে এসে বকবক করতো। আর মিলেই সব শ্রমিকরা হা করে তাকিয়ে থাকতো! অবাক হয়ে দেখতো! কান পেতে উনার কথা শুনতো। সবার সাথে আমিও মিল মালিকের সামনে গিয়ে উঁকি মেরে দেখতাম। আর ভাবতাম! মনে মনে আক্ষেপ করে বলতাম, ‘ঈশ! যদি আমি একটা কিনতে পারতাম!’

আমার মনের সেই আক্ষেপ মনে হয় মহান সৃষ্টিকর্তা সেসময়ই শুনে ফেলেছিল। তাই মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় মাসেক দুইমাস পর পরিচিত এই দোকান থেকে ২০০৬ ইংরেজি সালেই Nokia-1110 মডেলের একটা মোবাইল কিনতে সক্ষম হই। তাও অর্ধেক নগদ, অর্ধেক বাকিতে। সেইসাথে একটা বাংলালিংক সিমকার্ডও কিনলাম। মোট দাম হলো, ৩,৬০০+৫০০= ৪,১০০/=টাকা। দোকানদারকে নগদ দিলাম ২,০০০/=টাকা। আর বাদবাকি টাকা মাস শেষে বেতন পেলে পরিশোধ করবো বলে কথা দিলাম। এরপর থেকে শুরু করলাম, নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকা অপরের সাথে কথা বলা এবং মেসেজের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে বার্তা পাঠানো। পরের মাসে মিলে বেতন পেয়ে মোবাইলের বাকি টাকা পরিশোধ করলাম।

ওই মোবাইলটা বেশকিছু দিন ব্যাবহার করার পর আর ভালো লাগছিলো না। কারণ, Nokia-1110 মডেল মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যেতো না, তাই। তারপর ২০০৭ ইংরেজি সালে Nokia N-73 মডেলের পুরাতন একটা মোবাইল কিনলাম। সেই মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে থাকি, মনের আনন্দে! কিন্তু তখনকার সময়ে মোবাইল ইন্টারনেট ছিলো স্লো-মোশনে। মানে ধীরগতিসম্পন্ন 2G স্প্রিরিট। মানে, “গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে– গাড়ি চলে না” এমন অবস্থা!

সে-সময়ে নেটওয়ার্ক ভিত্তিক ইন্টারনেটের সুবিধা ছিল GPRS সার্ভিস। GPRS এর পূর্ণরূপ হলো, General Packet Radio Service. সে-সময় নোকিয়া বাটন মোবাইলের সেটিং থেকে কনফিগারেশন সেটিং করে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। নিজেও সে-ভাবেই সেটিং করে ইন্টারনেট ব্যহার করতাম। অনেক সময় নিজে নিজে কনফিগারেশন সেটিং করেও ইন্টারনেট সংযোগ পেতাম না, তখন সরাসরি ব্যবহার করা নেটওয়ার্ক কোম্পানির হেল্পলাইন 121- এ কল করে কনফিগারেশন সেটিং পাঠাতে বলতাম। তখন তাঁরা অটোমেটিক কনফিগারেশন সেটিং পাঠালে, তা মোবাইলে সেভ করে নিতাম। এরপর বুকেরপাটা টান করে অনলাইনে থাকা বিভিন্ন সাইটে প্রবেশ করতাম। এটাই ছিলো আমার তখনকার সময়ে নিয়মিত অভ্যাস।

কিন্তু দীর্ঘদিন Nokia-N-73 ব্যবহার করার পর মোবাইলটি আর ভালো লাগছিল না। ভালো না লাগার করণ ছিলো শুধু একটাই। তাহলে Nokia N-73 মডেল মোবাইলে বাংলা লেখা যেতো না। আবার মোবাইল স্ক্রিনেও বাংলা লেখা প্রদর্শিত হতো না। এটাই ছিল ভালো না লাগার কারণ!

এরপর ২০১১ সালে আমার একমাত্র ছেলে খুব শখ করে Nokia c-3 একটা মোবাইল কিনে। তখনকার সময়ে Nokia মোবাইলের ছিলো, মোবাইল জগতে সেরা মোবাইল। মানে Nokia’র জয়জয়কার সময়। তারপর আবার নতুন মডেল Nokia c-3। সেই মোবাইলটা আমার ছেলে বেশিদিন ব্যাবহার করে যেতে পারেনি। বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে ছেলেটা ২০১১ সালের ২০ জুলাই পরপারে চলে যায়। রেখে যায়, ওর শখের Nokia c-3 মোবাইলটি।

ছেলের রেখে যাওয়া মোবাইলটা আমি বেশকিছু দিন ঘরে রেখে দিয়েছিলাম। একদিন দেখি মোবাইলের ব্যাটারি ফুলে গেছে। তখন মোবাইলটা মেকারের কাছে নিয়ে গেলাম। মোবাইল মেকার বললো, ‘এতো দামী মোবাইল ব্যবহার না করে ঘরে ফেলে রাখলে একসময় মোবাইলটাও নষ্ট হয়ে যাবে।’ মোবাইল মেকারের কথা শুনে নতুন ব্যাটারি সংগ্রহ করে আমি নিজেই ব্যাবহার করতে থাকলাম। যাতে ছেলের রেখে যাওয়া মোবাইলটা সবসময় ভালো থাকে। (তা এখনো ভালো আছে।)

এরপর থেকে Nokia C-3 মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করা শুরু করি। কিন্তু Nokia c-3 মোবাইলেও বাংলা লেখা যেতো না। মনের আক্ষেপ আর আফসোস শুধু মনেই থেকেই যেতো। তারপরও বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সার্চ করা ছিল আমার প্রতিদিনের রুটিন মাফিক কাজ। সে-সব কাজের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ব্লগে উঁকি মারা। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া-সহ আরও অনেককিছু। তবে বেশকিছু অনলাইনভিত্তিক দিনলিপি বা ব্লগে সময়টা বেশি ব্যয় করতাম। বিভিন্ন ব্লগ সাইটে ব্লগারদের লেখাগুলো পড়তে খুবই ভালো লাগতো। এই ভালো লাগা থেকে নিজেরও লিখতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু সমস্যা ছিলো, একমাত্র মোবাইল।

তারপরও একসময় Nokia c-3 মোবাইল দিয়ে অনলাইনে থাকা একটা ব্লগে রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম। কিন্তু Nokia C-3 মোবাইলে তো বাংলা লেখা যায় না! তবুও খামোখেয়ালিভাবে কোনরকম ইংরেজি বর্ণ দিয়ে স্বল্পসংখ্যক শব্দের একটা লেখা জমা দিলাম। ব্লগে লেখা জমা দিয়ে বেশকিছুদিন আর ব্লগে লগইন করিনি, লজ্জায়! লজ্জার কারণ হলো, আমার লেখা পড়ে ব্লগের সবাই যদি হাসাহাসি করে, তাই। সেই লজ্জা মনে রেখেই বেশকিছু দিনের জন্য ব্লগ থেকে লাপাত্তা ছিলাম।

এর কয়েক মাস পর অনেক কষ্ট করে মনের স্বাদ মেটানোর জন্য Symphony W-82 মডেল-এর একটা নতুন মোবাইল কিনলাম। মোবাইলটা কিনেই, সেইদিনই ঐ ব্লগে লগইন করলাম। উদ্দেশ্য হলো, আমার জমা দেওয়া লেখাটার অবস্থা দেখা। লগইন করে দেখি সম্মানিত ব্লগ মডারেটর লেখার শিরোনাম বাংলায় লেখার জন্য বলছে। Symphony W-82 এন্ড্রোয়েড মোবাইলে বাংলা লেখা যেতো। তারপরও গুগল প্লে স্টোর থেকে একটা বাংলা Keyboard অ্যাপ ডাউনলোড করে লেখার শিরোনাম লিখলাম, “আমিও মানুষ”। লেখার শিরোনাম বাংলায় লিখে, ব্লগে জমা দিয়ে আবার কিছুদিনের জন্য ব্লগ থেকে গা-ঢাকা দিলাম। গা-ঢাকা দেওয়ার প্রায় কয়েকমাস পর আবার ব্লগে লগইন করলাম। লগইন করে দেখি আমার লেখা প্রকাশ হয়েছে। লেখার নিচে মন্তব্যের বক্সে কয়েকজন সম্মানিত লেখক মূল্যবান মন্তব্যও করেছে। সেসব মন্তব্যের উত্তর দিতে গেয়েই, আজ অবধি ব্লগ আর ব্লগিংয়ের মাঝেই আটকা পড়ে আছি। ব্লগে লিখছি, পড়ছি, দেখেও যাচ্ছি।

এরপর থেকে অনেক সম্মানিত লেখক/লেখিকাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গড়েছি। অনেক লেখক/কবিদের বাড়িতে গিয়েছি। সেই থেকে এপর্যন্ত ব্লগ, ব্লগিং এবং ব্লগের পোস্টের মন্তব্য বিষয়ে সামান্যতম ধ্যানধারণাও মোটামুটি অর্জন করতে পেরেছি। একসময় ঐ ব্লগের সবার মন জয় করে একটা সম্মাননাও পেয়েছি। তা থাকুক ছোট সম্মাননা, হোক বড় কোনও সম্মাননা। কিন্তু সম্মাননা পেয়েছি। পেয়েছি ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করে। আর নিয়মিত সবার পোস্টে মন্তব্যের বিনিময়ে। আর আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহরবাসীর সমস্যা নিয়ে লেখার কারণে।

যাক সে কথা, আসল কথায় আসা যাক! আসল কথা হলো, স্বনামধন্য শব্দনীড় ব্লগের ব্লগারদের উদ্দেশ্যে কিছু বলা।

প্রিয় সম্মানিত শব্দনীড় ব্লগের ব্লগারবৃন্দ, একটু লক্ষ্য করুন! আপনারা যারা আমার আগে থেকে এই শব্দনীড় ব্লগে লিখেন, তাঁরা অবশ্যই ব্লগ বিষয়ে আমার চেয়ে ভালোই জানেন। তা আর নতুন করে নতুন কিছু উপস্থাপন করার কোনও দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। তবে আমরা যারা এই স্বনামধন্য শব্দনীড় ব্লগে লেখালেখি করছি, সবাই জানি যিনি ব্লগে লিখেন; তাকে “ব্লগার” বলে। তবে সহ-ব্লগারগণ একে অপরকে লেখক/লেখিকা/কবি বলেই বেশি সম্বোধন করে থাকে। যা আমি নিজেও করে থাকি। যেহেতু একই প্লাটফর্মে একে অপরের সাথে লেখা শেয়ার করছি, তাই। তারপর পছন্দ অপছন্দের মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেও যাঁর যাঁর মনের ভাব জানান দিচ্ছি।

কেউ আবার কারোর লেখায় কোনও বানান ভুল হলে তাও মন্তব্যের ছোট বক্সে লিখে জানাচ্ছি। লেখা কেমন হয়েছে, তাও অনেকে মন্তব্যের মাঝে জানিয়ে দিচ্ছে। এসব কিন্তু একজন ব্লগারের প্রতি সহ-ব্লগারের দায়িত্ব কর্তব্যের খাতিরেই হচ্ছে। আর ব্লগে খাতির বা সুসম্পর্কটা কিন্তু একে অপরের পোস্টের মন্তব্যের খাতিরেই তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ ব্লগে ব্লগিংয়ের মানেই হচ্ছে, নিজের লেখার পাশাপাশি সহ-ব্লগারদের লেখা বা পোস্ট পড়ে লেখার বিষয়ে গঠনমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে আলোচনা করা। সহ-ব্লগারকে আরও সুন্দর করে লেখার উৎসাহ দেওয়া।

এভাবেই আস্তে আস্তে একে অপরের লেখা পড়তে আগ্রহ বাড়ে। লেখা পড়ে লেখার ভালো মন্দ বিস্তারিত আলোচনা মন্তব্যের মাঝে প্রকাশ করে। এতে একজন সহ-ব্লগারের লেখার যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনি মন্তব্যকারীদের লেখা পড়ে মন্তব্যও করতে আগ্রহ বেড়ে যায়।

আমি মনে করি, যেকোনও ব্লগের ব্লগার অথবা লেখক/লেখিকার লেখায় মন্তব্য হলো একরকম চুম্বকের আকর্ষণের মতন। চুম্বক যেমন লোহাকে কাছে টানে, তেমনিভাবে মন্তব্যকারীকে পোস্টদাতা বা লেখক/লেখিকা ভালোবেসে ফেলে, একমাত্র মন্তব্যের বিনিময়ে। সেই ভালোবাসা দিনে দিনে এতোই গভীরে চলে যায় যে, উদাউট কয়েকটা লেখায় একজন প্রিয় মন্তব্যকারীর মন্তব্য না দেখলে আর ভালো লাগে না। এমনকি ব্লগেও লিখতে মন চায় না। কারণ অনলাইন ভিত্তিক ব্লগ, বা দিনলিপিতে যে যেভাবেই লিখুক-না-কেন, লেখা প্রকাশের পর যদি কেউ লেখার নিচে মন্তব্য না করে, তাহলে ব্লগার বা লেখক/লেখিকাদের লেখাই যেন মাটি হয়ে যায়।

তাই একজন ব্লগার খুব পরিশ্রম করে লিখে লেখা ব্লগে প্রকাশ করে এবং গুটিকয়েক মন্তব্যের আশায় বার বার ব্লগে লগইন করে দৈনিক মন্তব্যের তালিকায় চোখ রাখে। নিজের লেখায় কেউ মন্তব্য করেছে কিনা তা খুব মনোযোগ সহকারে দেখে। যদি একজন সহ ব্লগারদের সুন্দর একটা মন্তব্য দেখে, তাহলে লেখক/লেখিকা বা ব্লগার ব পোস্টদাতার মনটা আনন্দে ভরে উঠে। তারপর নিজের পোস্ট বা লেখায় যিনি মন্তব্য করেছে, তার লেখা পড়ে সেও একটা মন্তব্য জুড়ে দেয়।

এভাবেই তৈরি হয় একজন ব্লগারের প্রতি আরেকজন ব্লগারের ভালোবাসা বা আন্তরিকতা। তারপর একে অপরের সাথে গড়ে উঠে সুন্দর সুসম্পর্ক। এটা আমরা অনেকেই বুঝি! আবার অনেকে বুঝেও সহ-ব্লগারের লেখা বা পোস্ট তো পড়েই না, বরং সহ- ব্লগারের পোষ্ট করা লেখা দুরছাই বলে উপেক্ষা করে মন্তব্যও আর করে না।

এতে কি হয় জানেন? এতে নিজের লেখায়ও কেউ মন্তব্য করতে চায় না, করেও না। আমি মনে করি এটা একরকম হিংসা, কৃপণতা, আর নিজেকে অহংকারী হিসেবে পরিচয় দেওয়া। এতে ক্ষতিটা অহংকারী ব্যাক্তিরই বেশি হচ্ছে বলে আমি মনে করি। কারণ নিজে যেমন অহংকারী হিসেবে নিজেকে খ্যাতিমান মনে করছেন, তেমনই নিজের পোস্টের পাঠক সংখ্যা-সহ মন্তব্যের ছোট বাক্সটাও পড়ে থাকছে খালি।

ব্লগপোস্টের মন্তব্যের বাক্স তো খালি থাকবেই! এর কারণ হলো, শুধু নিজের পোস্টে অন্যের করা মন্তব্যেগুলোর কোনরকম দায়সারা মন্তব্য “ধন্যবাদ, শুভকামনা, সাধুবাদ, ভালো থাকবেন” ইত্যাদি লিখেই সরে যাচ্ছেন। কিন্তু অন্যের পোস্টে একটিবারও চুপি দিয়ে দেখছেন না। আর মন্তব্য তো দূরেরই কথা! কারণ, আপনি একজন অহংকারী ব্লগার বা লেখক/লেখিকা, তাই।

ইদানিং দেখতে পাচ্ছি স্বনামধন্য শব্দনীড় ব্লগে মন্তব্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। আজ থেকে কয়েক দিন যাবত লক্ষ্য করছি, যদি কোনও ব্লগারের পোস্টে মন্তব্য করে, সেই মন্তব্যেরও সময়মত জবাব দেওয়া হয় না। অনেকে তো মন্তব্যের জবাব দেয়ই না। তা কি ঠিক?

শব্দনীড় ব্লগের সম্মানিত প্রিয় ব্লগারবৃন্দ,
আমি একজন সময়হীনা। মনে খেটে খাওয়া মানুষ। তাই হাতে অজস্র সময় থাকে না। তারপরও আমি নিজের পোস্টের মন্তব্যের জবাব একটু দেরি করে দিলেও, আপনাদের সকলের পোস্ট পড়ি। পারলে অল্পসংখ্যক শব্দে ছোট একটা মন্তব্যও করে থাকি।

কিন্তু দুঃখের কথা দুঃখের সাথে বলতে হয়, অন্যের পোস্টে করা মন্তব্যগুলোর জবাব বা রিপ্লাইও কেউ যথাশীঘ্র দেয় না। এটা কি ঠিক? এটা কি ব্লগিং করার নিয়ম? এটা কি সহ-ব্লগারদের নীতি?

জেনে রাখুন শব্দনীড় ব্লগের ব্লগারবৃন্দ,
আপনি নিজের পোস্ট ছাড়া সহ-ব্লগারদের পোস্টে যাচ্ছেন না। সহ-ব্লগারদের লেখা পড়ে মন্তব্য করছেন না। এতে কিন্তু আপনার নিজেরই ক্ষতিটা বেশি হচ্ছে। মানে আপনার লেখা বা পোস্ট সহ-ব্লগাররাও পড়বে না, মন্তব্যও করবে না। আমি মনে করি একটা মন্তব্য মানে একরকম দেনা বা ঋণের মতো। এই ঋণ শুধাতে হয়। সহ-ব্লগারদের পোস্ট বা লেখা পড়ে একটা মন্তব্য করে সহ-ব্লগারকে ঋণী করতে হয়। তবেই যার লেখা পড়ে মন্তব্য করে ঋণী করলেন, তিনি আপনার ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়ে আপনার লেখা পড়ে একটা সুন্দর মন্তব্য লিখে সেই ঋণ পরিশোধ করবেই করবে। তাই আমি নিজেই মনে মনে বলে থাকি, ‘কেউ যখন আমার পোস্ট বা লেখা পড়ে মন্তব্য করে না, তাহলে আমি কেন সময় নষ্ট করে অন্যের লেখা পড়ে মন্তব্য করবো?’ এটা অনেকের মতো আমারও ব্যক্তিগত ভাবনা!

পরিশেষে:
শব্দনীড় ব্লগের প্রিয় সম্মানিত ব্লগার/লেখক ও লেখিকাবৃন্দ, আমি আগেও বলেছি, এখনো বলি, ‘আমি এক সময়হীনা অধম ব্যক্তি। নিয়মিত ব্লগে সময় দিতে পারি না। তাই যথাসময়ে আপনাদের মূল্যবান লেখায় বা পোস্টে আমি মন্তব্য করতে পারি না। এজন্য আমি নিজে থেকে আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আপনারা যারা শব্দনীড় ব্লগে নিয়মিত আছেন, তাঁদের আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করবো, সহ-ব্লগারদের লেখা পড়ুন! সুন্দর একটা গঠণমূলক মন্তব্য করুন। মনে রাখবেন, সহ-ব্লগারদের পোস্টে আপনার করা একটা মন্তব্য মানে, আপনার নিজের লেখা বা পোস্টে দশটা মন্তব্য পাওয়া। শব্দনীড় ব্লগের সবাইকে ধন্যবাদ!

ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। সবার জন্য অফুরন্ত শুভকামনা থাকলো।