নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

জীবনের গল্প-১৯

Image-6411-8

জীবনের গল্প-১৮-এর শেষাংশ: একসময় আড়াইউল্লা নিয়ম করে কানাই, কালাম-সহ নতুন বউয়ের সাথে তার ছোট ভাইকে নিয়ে আমি চলে আসি নারায়ণগঞ্জ নন্দিপাড়া নিজের বাসায়। এর দুইদিন পরই বৌভাত অনুষ্ঠান। বউভাত অনুষ্ঠানে দুই মিলের লোক-সহ প্রায় ১০০ জন লোকের আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে চলতে লাগলো, স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক জীবন।

তারপর থেকে মা আর বোন মরা ভাগ্নি-সহ স্বামী স্ত্রীর সংসার খুব সুন্দরভাবে চলতে লাগলো। আমি ওয়েল টেক্স মিল থেকে মাসে যেই টাকা বেতন পেতাম, খেয়ে-দেয়ে তা থেকে বেশকিছু টাকা আমার আয় থাকতো। নন্দিপাড়া যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সেই বাড়িতে আরও কয়েকটা ভাড়াটিয়া ছিলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন ভাড়াটিয়া ছিলো ব্যাবসায়ী। আর কয়েকজন ছিলো আমার মতন দিনমজুর। সেসব ভাড়াটিয়াদের সেথে পাল্লা দিয়েই চলছিলো আমাদের ছোট সংসার। সংসারে কোনও কিছু নিয়ে তেমন কোন কথা কাটা-কাটিও হতো না। থাকলে খেতো, না থাকলে পেট মাটিতে চাপে শুয়ে থাকতো। কিন্তু ঝগড়াঝাটি আর নাই নাই হতো না।

সময়টা তখন ১৯৮৬ সালের শেষদিকে। সেসময় বাংলাদেশি শাটিং শ্যুটিং কাপড়ের অনেক চাহিদা ছিলো। মিলেও তেমনই ছিলো প্রচুর কাজ। কাজের এতো চাপ ছিলো যে, অনেক সময় সারারাত আমাকে মিলে ওভারটাইম করতে হতো। ওভারটাইম করতে গিয়ে সারারাত মিলেই থাকতে হতো। ওভারটাইমের টাকা পেতাম সপ্তাহে। আর মূল বেতন পেতাম মাসের ১০ তারিখে। হঠাৎ এক সময় শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে মিল মালিকের সাথে স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের মনোমালিন্য হতে থাকে। মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের সামনে স্থানীয় নেতারা টেবিলে থাপ্পর মারে কথা বলে। এতে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায় যায়। এই মন খারাপ থেকে আস্তে আস্তে মিল মালিকের মিলের প্রতি অনীহা বাড়তে থাকে। মিলেও আসতো খুবই কম! মিলে সুতাও ঠিকমতো দিতো না। এতে তাঁতিদের যেমন পেটে পড়লো আঘাত, তার চেয়ে বেশি ব্যাঘাত সৃষ্টি হলো আমার এবং আমার সংসারের।

কয়েকমাস খুবই কষ্টে সংসার চলতে লাগলো। নতুন করে এক মিলে গিয়ে যে কাজ করবো, সেই সুযোগও পাচ্ছিলাম না; ওয়েল টেক্স মিলের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ার করণে। এদিকে সবেমাত্র নতুন বিয়ে, নতুন বউ সংসারে। কাজকর্মের অবস্থাও বেশি ভালো যাচ্ছিল না। টেনে-টুনে সংসার চালাতে গিয়ে দেনা ঋণগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এভাবে চলতে চলতে এক সময় মিল মালিক চূড়ান্তভাবে মিল লে – আপ ঘোষণা করলো। শ্রমিকদের দেনা পাওনা বুঝে নিতে নোটিশ টাঙিয়ে দিলো। কিন্তু আমরা কেউ দেনা পাওনার হিসাবের জন্য মাথা ঘামাচ্ছিলাম না। আমরা একজোট হলাম, মিল পুনরায় চালু করার জন্য। কিন্তু না, মিল মালিক প্রয়োজনে মিলে বিক্রি করে দিতে প্রস্তুত, কিন্তু মিল চালু করবে না। আমি পড়ে গেলাম বিপাকে।

আবার কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে ঘোরা-ফেরা করতে লাগলাম। আমার ঘোরা-ফেরা ফাইন টেক্সটাইল মিলের ম্যানেজার সাহেব ফলো করলো। আমার বড় দাদার কাছে জানলো যে, আমার কাজ নেই! ম্যানেজার সাহেব কিছু দিনের জন্য আপনাকে তাঁতের কাজ করতে বললে। তারপর সংসারের অভাব দূর করার জন্য ফাইন টেক্সটাইল মিলে তাঁতের কাজ করতে থাকি। বেশ কয়েকমাস তাঁতের কাজ করার পর ঢাকা মিরপুর চিড়িয়াখানা সংলগ্ন একটা মিল থেকে খবর এলো। খবর পাঠিয়েছিল সাত্তার ওস্তাদ। যার সাথে বিয়ের আগে একবার ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে গিয়েছিলাম। তিনিই আমার কাছে লোক মারফত খবর পাঠায়। মিরপুর মিলে জর্জেট সুতার ওড়না তৈরি হবে। কিন্তু মিলটি ছিল একেবারে নতুন। মেশিন সব বসানো হলেও মেশিনে কাপড় উৎপাদন শুরু হচ্ছিল না।তখন ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়।

সিদ্ধান্ত নিলাম, ফাইন টেক্সটাইল মিলের তাঁতের কাজ ছেড়ে মিরপুর সাত্তার ওস্তাদের ওখানেই চলে যাবো। বড় দাদা, মা ও নিজের স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম। রায় পেলাম, ‘ভালো মনে হলে যাও!’ তখন স্ত্রীকে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে থাকার জন্য পরামর্শ দিলাম। স্ত্রী আমার পরামর্শে রাজি হলো। তাকে বাপের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। সে-বছর ছোটখাট একরম বন্যাও দেশে দেখা দিয়েছিল। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে দেখি তাদের অবস্থাও বেশি ভালো নেই। বন্যার কারণে কাজকর্মে নেই। তারপরও আমার সমস্যা দেখে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি মেয়েকে তাদের বাড়িতে রেখে দেয়। আমি দুইদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি।

এর পরদিনই মিরপুরের ঠিকানায় চলে যাই। ওখানে গিয়ে সাত্তার ওস্তাদের সাথে কাজ করতে থাকি। বেতন প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার। শুক্রবার বেতন হতে পেলেই নারায়ণগঞ্জ চলে আসতাম, মাকে বাজার সদাই করে দেওয়ার জন্য। এভাবে মিরপুর ওই মিলে দুই মাসের মত কাজ করেছিলাম। তারপর ওখানে তেমন পোষাচ্ছিল না। তাই একসময় মিরপুর মিলের কাজ ছেড়ে দিই।

মিরপুর মিলের কাজ ছেড়ে আবার নারায়ণগঞ্জ এসে ওয়েল টেক্স মিলের খবরাখবর সংগ্রহ করতে থাকি। কারণ, ওয়েল টেক্স মিলে পাওনা সার্ভিসের টাকার জন্য। তখন জানতে পারি যে, মিল মালিকের ইসলামপুর দোকানে গেলেই সার্ভিসের পাওনা টাকা দিয়ে দিবে। আমাদের সাথের অনেক শ্রমিকরা সেখান থেকে সার্ভিসের টাকা তুলেও এনেছিল। গেলাম ঢাকা ইসলামপুর ওয়েল টেক্স মালিকের দোকানে। রিজাইন দরখাস্তে সই করলাম। সার্ভিসের টাকা পেলাম ৪০০/=টাকা। এরপর মিল মালিক নিয়াজ সাহেব আমার কানের অবস্থা জানতে চাইলেন। বললাম, ‘সেই আগের মতই আছে।’ আমার কথা শুনে ওয়েল টেক্স মিলের মালিক নিয়াজ সাহেব আমাকে আরও ২০০০/=টাকা হাতে দিয়ে বললেন, ‘নিতাই আমি তোমার কাজ খুবই পছন্দ করতাম। তোমাকে আমি পাকিস্তান নিয়ে চিকিৎসা করতাম। যদি মিল চালু থাকতো। কিন্তু তা আর হলো না, তোমাদের নেতাদের কারণে।’

শ্রমিক নেতাদের ব্যাপারে আরও অনেক কথাবার্তা ও বললো। দোকান থেকে আসার সময় আবার ডেকে নিয়ে এক পিস প্যান্টের কাপড় আর এক পিস শার্টের কাপড়ও আমাকে দিয়ে দিলো। আমি সেগুলো নিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নারায়ণগঞ্জ নিজের বাসায় ফিরে আসি। বাসায় এসে ৬০০০/= টাকা মায়ের হতে দিয়ে বললাম, ‘মা, এই টাকা আমার কপাল বিক্রির টাকা। মা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিসের টাকা?’ বললাম, ‘মিলের সার্ভিসের টাকা। মানে ওয়েল টেক্স মিলের চাকরি শেষ!’ তখন আমার মা বুঝতে পেরেছিল। এর একদিন পর আবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে গিন্নিকে নিয়ে আসি নিজের বাসায়। এরপর নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায় মহীউদ্দীন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে কাজ নেই। মিল মালিক ছিলেন, শেখ আব্দুল হাকিম সাহেব। উনার বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে ছাতার কাপড় তৈরি হতো। সেই মিলে মাত্র ১,৭০০/= টাকা বেতনে কাজ নেই। তখন নারায়ণগঞ্জ নন্দি পাড়ার বাসা ছেড়ে মহিউদ্দিন স্পেসালাইজড টেক্সটাইল মিলের সাথেই বাসা ভাড়া নিলাম। বাসা ভাড়া মাত্র ১২০/= টাকা।

সময়টা তখন ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি। কয়েক মাস কাজ করার পরই শুরু হলো সারা দেশব্যপী ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব। বন্যার পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আবার গিন্নীকে নিয়ে রেখে আসি শ্বশুরবাড়িতে। তখন কানাইর কাজ ছিলো না। তাই কানাই সারাদিন আমার সাথেই থাকতো। আমি মিলের সাথে যেই বাস ভাড়া করেছিলাম, সেই বাসা বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিল। তখন মাকে নিয়ে উঠলাম নিকটস্থ পাঠানটুলি ভোকেশনাল টেকনিক্যাল ট্রেনিং স্কুল এ্যাণ্ড কলেজে। আমি আর কানাই সারাদিন যেখানেই থাকতাম-না-কেন, দুইজনে রাতে ভোকেশনাল স্কুলে এসে ঘুমাতাম। তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের আমল। প্রচুর রিলিফ পেতাম। আবার মিলের বেতনও পেতাম। সেই ভয়াবহ বন্যার সময় খুবই ভালোভাবে চলছিলাম। একসময় বন্যার আলামত শেষ হলো। সবকিছু স্বাভাবিক হলো। মিলের কাজকর্ম চালু হলো। কানাইও আবার ওর নিজের কাজে চলে গেলো। আমি অন্য একজন হেলপার নিয়ে কাজ করতে থাকি। সময় ১৯৮৯ সাল। আমার প্রথম মেয়ের জন্ম হলো। নাম, অনিতা রানী পাল। এর কিছুদিন পর কানাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়, ওর এক মামার কাছে।

কানাই ভারত চলে যাবার কয়েক মাস পর আমার মা-ও চলে গেলো পরপারে স্বর্গের দেশে। মা স্বর্গীয় হবার কিছুদিন পর মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলের মালিকের সাথে আমার বেতন নিয়ে লেগে গেলো হট্টগোল। তারপর চাকরি ছেড়ে গ্রাম মহল্লায় লেইস ফিতা বিক্রি করতে লাগলাম। লেইস ফিতা বিক্রি করলাম কয়েক মাস। সময় তখন ১৯৯১ সাল। আমার দ্বিতীয় ছেলে সন্তান জন্ম হলো। নাম, অনিল চন্দ্র পাল। একদিন ওয়েল টেক্স মিলের রফিক নামে একজন ঘনিষ্ঠ তাঁতি আমাকে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জের অদূরে মুন্সিগঞ্জ মুক্তারপুর ফেরিঘাট সংলগ্ন এক মিলে। তখন মুক্তারপুর ব্রিজ ছিলো না। ওই মিলের তাঁত মেশিন ছিলো কোরিয়ার। সেই মিল ভাড়া নিয়ে চালাতেন বিক্রমপুরের এক মালিক। মালিকের নাম মোয়াজ্জেম সাহেব। উনার দোকানের নাম ছিলো এলিগেন্ট ফেব্রিকস। দোকানের নামেই তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম এলিগেন্ট ফেব্রিকস।

সেখানে দুইমাস কাজ করার পর উনি মোয়াজ্জেম সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন ঢাকা সদরঘাটের ওপারে। জায়গাটা হলো কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকা তেলঘাট। মিলের নাম রশিদ স্লিক। সেই মিলেও কোরিয়ান মেশিন। সেই মিলে হেলপার সহ ৫,০০০/= টাকা বেতনে কাজ করতে থাকি। আবার গোদনাইল এলাকা থেকে বাসা ছেড়ে চলে গেলাম কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকায়। সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলাম। সময়টা তখন ১৯৯২ সালের শেষ দিকে। একসময় হঠাৎ ভারতের অযোধ্যায় শুরু হলো বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। আমি তখন কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকায় রশিদ স্লিক টেক্সটাইল মিলেই কাজ করি। বাসা ছিলো মিলের সাথেই এক হিন্দু বাড়িতে। দুই তিন দিন খুবই থমথমে অবস্থা ছিলো। তখন কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিলো যে, ভাড়া বাড়ি থেকে প্রাণভয়ে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মিলের ভেতরে থাকতাম। মিলের ভেতরে অন্তত তিন-চার দিন সপরিবারে অবস্থান করেছিলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-২০ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

এ-কী কারবার?

538_n

করোনা কালে সারাবিশ্ব যখন হচ্ছে ছারখার!
তখন এদেশে চলছে লুটপাট ধর্ষণ বলাৎকার!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকবে মানুষ গড়ার কারিকর,
সেই কারিকর হয়েছে শিকারী, করছে ধরপাকর!
এসব খবর যখন জাতীয় পত্রিকায় আসে,
তখন স্বাধীনতা বিরোধীরা মুচকি মুচকি হাসে!
ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে সরকার যখন সোচ্চার,
তখনও চারদিকে চলছে ধর্ষণলীলা বলাৎকার!
তাইতো দেখি আজ, সদা ভয় সদা লাজ!
শ্লোগানে মুখরিত, ‘ধর্ষণ হলো ঘৃণিত কাজ!’
কেউ বলছে, ‘যতো দোষ ওই নারীদের সাজ!’
তবুও কেউ ভাবছে, ‘বলাৎকার হচ্ছে ফরজ কাজ!’

দোলায় চড়ে দেবী মর্ত্যলোকে … শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি

images-2

সারাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জেও খুব জোরেশোরে চলছে আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পঞ্জিকা অনুযায়ী মূল পূজার শুভসূচনা শুরু হবে ২১ অক্টোবর ২০২০ বুধবার মহা পঞ্চমীতে। পরদিন ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে দেবীর বোধন। ২৬ অক্টোবর মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।

এবার মহালয়া ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর, ৩১ ভাদ্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। মহালয়ার পার্বণ শ্রাদ্ধের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। মহালয়া হয়ে থাকে অমাবস্যা তিথিতে। তখন থাকে ঘোর অন্ধকার। মহাতেজের আলোয় সেই অমাবস্যা দূর হয়ে প্রতিষ্ঠা পায় শুভশক্তি। সেই থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষের সূচনা। তাই দুর্গাপূজার দিন গণনা এ মহালয়া থেকেই শুরু হয়। এর পরবর্তী তিথিগুলো নিম্নরূপ:

পঞ্চমী:
মহাপঞ্চমী মানে বোধনের আগের দিন। অর্থাৎ দুর্গা পুজোর শুরু আর সেই সঙ্গে এক বছরের অপেক্ষার অবসান। এদিন মা দুর্গার মুখের আবরণ উন্মোচনই এই দিনের প্রধান কাজ হিসাবে গন্য হয়। মানে বোধনের আগে কল্পারম্ভ। এসময় ঢাকের শব্দে পূজামণ্ডপ-সহ আশেপাশে শোরগোল শুরু হয়, মা এসে পড়েছেন মর্ত্যে। আর এবার কিন্তু দুর্গাপুজা আশ্বিন নয়, কার্তিক মাসে। অর্থাৎ এবছর ২১ অক্টোবর ২০২০, ৪ঠা কার্তিক বুধবার।

মহাষষ্ঠী:
মহাষষ্ঠী পালিত হবে আগামী ২২ অক্টোবর, ৫ কার্তিক, বৃহস্পতিবার। এদিন দুর্গাদেবীর ষষ্ঠ্যাদিকল্পারম্ভ ও ষষ্ঠী বিহিত পূজা। অর্থাৎ দুর্গা প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মহাসপ্তমী:
দুর্গাপূজা ২০২০ এর মহাসপ্তমী পালিত হবে আগামী ২৩ অক্টোবর, ৬ কার্তিক, শুক্রবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমী বিহত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে।

মহাঅষ্টমী:
মহাঅষ্টমী পালিত হবে আগামী ২৪ অক্টোবর, ৭ কার্তিক, শনিবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর মহাষ্টম্যাদি কল্পারম্ভ ও মহাষ্টমী বিহিত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে। এদিন দুর্গাপূজার অন্যতম পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিপূজা তিথি শুরু হবে ভারতীয় সময় সকাল ১১টা ২৪ মিনিট ২৯ সেকেন্ডে এবং তিথি শেষ হবে সকাল ১১টা ৪৬ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে।

মহানবমী:
দুর্গাপূজার মহানবমী তিথি পালিত হবে আগামী ২৫ অক্টোবর, ৮ কার্তিক, রবিবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে।

বিজয়া দশমী:
এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী পালিত হবে আগামী ২৬ অক্টোবর, ৯ কার্তিক, সোমবার। এদিন দশমী পূজা সমাপনান্তে মা দুর্গার প্রতিমা নিরঞ্জন করা হবে। এদিন সন্ধ্যা লগ্নে প্রতিটি পূজামণ্ডপে উৎসবমুখর পরিবেশে দেবীকে সিঁদুর দানের সাথে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলবে বিবাহিত হিন্দু নারীদের সিঁদুর খেলা। এই সিঁদুর দেবীর কপালে এঁটে পানপাতায় দেবীর মুখমণ্ডল মুছে দিয়ে দেবীকে এবারের মতো বিদায় জানানো হয়। এসময় উপস্থিত সকল হিন্দু বিবাহিত নারীরা মনের অনন্দে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠে। সাথে চলতে থাকে ঢাক-ঢোলের বাজনা। তখন ঢাকের শব্দে কেঁপে ওঠে প্রতিটি পূজামণ্ডপ। এরপরই শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি নেওয়া।

এই শারদীয় দুর্গোৎসবটি হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। যা হয়ে থাকে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে। কিন্তু এবার মহালয়ার তিথি ছিলো ১৭ সেপ্টেম্বর। ৩১ ভাদ্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, বুধবার। কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ছিলো ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে এবার আশ্বিনে দেবীর পূজা না হয়ে, হচ্ছে কার্তিক মাসে।

আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারদীয়া দুর্গাপূজা। এটি বাঙালি হিন্দু সমাজের অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষকের দুর্গাপূজাকে বলা হয় বাসন্তীপূজা। বাসন্তীপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের বাসন্তী পূজাটি অনেকের চোখে পড়ে না। অনেক স্থানে বাসন্তীপূজা হয়ও না।

যাইহোক, এবার ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠীতে দেবীর দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ দুর্গোৎসব। চলবে একনাগাড়ে পাঁচদিন। মহাষষ্ঠীর পরদিনই ২৩ অক্টোবর মহাসপ্তমী। এর পরদিন ২৪ অক্টোবর মহাষ্টমী। এদিন বাংলাদেশের অনেক পূজামণ্ডপে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ২৫ অক্টোবর মহানবমীর পরদিন ২৬ অক্টোবর দিনগত রাতে বিজয়াদশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই বর্ণিল উৎসব।

পঞ্জিকা মতে জানা যায়, এবার দেবী দুর্গা দোলায় চড়ে মর্ত্যলোকে আগমন। গমন গজে (হাতি) চড়ে। অর্থাৎ ধীরগতিতে, শান্ত হাতিতে চড়ে দেবী দুর্গা এবার পাড়ি দেবেন স্বর্গে। দুর্গাদেবীর আগমন ও গমনের মধ্যেও একটি বিশেষ ফল রয়েছে। তাহলে জেনে নেওয়া ভালো যে, দুর্গাদেবী এবার দোলায় আগমন আর গজে চড়ে গমন করার মধ্যদিয়ে কীরূপ প্রভাববিস্তার করতে পারে?

দুর্গাদেবীর আগমন…
শাস্ত্র তথা পঞ্জিকা মতে; এবারের দুর্গাপুজোয় মা আসছেন দোলায় চড়ে। যার ফলে প্রবল মড়ক প্রাক পূজার সময় পর্যন্ত চলবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে পুজোর আগে পর্যন্ত প্রবল মহামারীর পরিস্থিতি থেকে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল।

দুর্গাদেবীর গমন…
শাস্ত্র তথা পঞ্জিকা মতে; এবার দুর্গাদেবীর গমন গজে। অর্থাৎ ধীরগতিতে। গজে চড়ে মায়ের গমন শুভ। অর্থ্যাৎ এর ফলে বিশ্বে শুভ কোনও বার্তা নেমে আসবে। গজের গমনে সাধারণত শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা হয়। তাই এবার তারই প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বে।

কুমারী পূজা…
দুর্গা পূজার কথা আসলেই আগে আসে কুমারী পূজার কথা। এই কুমারী পূজা হচ্ছে দুর্গা পূজারই একটা অংশ। এই কুমারী পূজাটি হয়ে থাকে নারায়ণগঞ্জের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে এবং বাংলাদেশে যতগুলো রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম আছে সেসব মিশনে। নারায়ণগঞ্জের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমটি শহরের চাষাঢ়াস্থ মিশনপাড়াতে অবস্থিত। জানা যায় এবার করোনা ভাইরাসের আলামতের কারণে রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী মাতা ছাড়াই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে।

কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিলো। যা শোনা যায় বুড়ো-বুড়ীদের কাছ থেকে। তবে আগের মতন বর্তমানে কুমারী পূজার প্রচলন তেমন নেই। যা আছে শুধু সারাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতেই। প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, এবারও হবে।

সকাল ১০টা হতে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা শেষে শুরু হয় পূজার্থী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ। পূজা পরিচালনা করেন নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের প্রধান মহারাজ।

জানা যায়, স্বামী বিবেকানন্দ শারদীয় দুর্গোৎসবে এই কুমারী পূজার প্রচলন করেন। নারী মানে মায়ের প্রতীক। তাই কুমারী পূজা মানে স্বয়ং মাকে পূজা করা। পৃথিবীতে দেবী দুর্গাই সর্বশক্তিমান। তাকে লক্ষ্য করেই কুমারী পূজা করা হয়। একজন কুমারীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করাই হলো দুর্গাদেবীকে পূজা করা।

দুর্গা পূজার গ্রন্থের তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারে জানা যায়, এক থেকে ১৬ বছর বয়সী কুমারীকে পূজা করা যায়। তবে শাস্ত্রে ১০ বছরের কুমারী মেয়েকেই কুমারী পূজায় বশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে বয়স অনুসারে কুমারীর নামকরণও করা হয়েছে। বিভিন্ন বয়সের কুমারী মেয়ের জন্য আলাদা আলাদা নামও রয়েছে শাস্ত্রে।

যেমন–
এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা
দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী
তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি
চার বছরের কন্যা — কালিকা
পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা
ছয় বছরের কন্যা — উমা
সাত বছরের কন্যা — মালিনী
আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা
নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা
দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা
এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী
বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী
তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী
চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনায়িকা
পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা
ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা

কুমারী পূজায় যে ধ্যান করতে হয়, “মা তুমি ত্রৈলোক্যসুন্দরী, কিন্তু আজ তুমি কালিকাস্বরূপে আমার সম্মুখে উপস্থিত। তুমি জ্ঞানরূপিণী, হাস্যময়ী, মঙ্গলদায়িনী।”
আর কুমারী পূজার যে প্রণাম মন্ত্র রয়েছে তার অর্থ-
“মা, তুমি প্রসন্ন হলে আমাকে সৌভাগ্য দান করতে পারো। তুমি সকল প্রকারের সিদ্ধি আমাকে দান কর। তুমি স্বর্ণ, রৌপ্য, প্রবাল কত রকমের অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হয়েছ। তুমিই সরস্বতী। আমি তোমাকে প্রণাম করি।”

এবার নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলায় ১৯৬টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে গতবছর নারায়ণগঞ্জ জেলায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিলো ২০৬টি। মহামারী করোনা ভাইরাস প্রভাব বিস্তারের কারণে গতবারের চেয়ে এবার ৯টি কম। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন এলাকায় দুর্গাপূজা হবে ৭টি মণ্ডপে।

শারদীয় দূর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিমা তৈরির কাজ পায় শেষপর্যায়ে। ইতোমধ্যে চারুকারুর শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির কাজও শেষ করে ফেলেছে। রংতুলির কাজ যা বাকি আছে, তা শেষ সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে বলে আশা করছে, প্রতিটি পূজা মণ্ডপের কর্তারা। মণ্ডপ প্রাঙ্গণে তোরণ নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। তবে এবার মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে নারায়ণগঞ্জ শহরের রাস্তায়-রাস্তায় বিশাল-বিশাল তোরণ নির্মাণ হচ্ছে না। সাধারণভাবে যা হচ্ছে, তা কেবল পূজামণ্ডপ প্রাঙ্গণেই।

দুর্গাদেবীকে প্রণাম করার মন্ত্র:
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।

অনুবাদ: যে দেবী সর্বপ্রাণীতে শক্তিরূপে অধিষ্ঠিতা, তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।

বলে রাখা ভালো যে, এবারের প্রতিটি পূজামণ্ডপে দর্শনার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা থাকবে বাধ্যতামূলক। আর পূজা উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ স্থানীয় প্রশাসনও ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে জানা যায়। যাতে করে কোনও ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা না ঘটে এবং পূজা উদযাপন করতে কোনও ধরনের সমস্যা না হয়, সে ব্যাপারেও স্থানীয় প্রশাসন রাখবে সজাগ দৃষ্টি। প্রতিটি পূজামণ্ডপে থাকবে পুলিশ বাহিনীর সদস্য।

শব্দনীড় ব্লগের সবাইকে শারদীয় দুর্গোৎসদের শুভেচ্ছা।
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।

ফেসবুক দিন-দিন জ্ঞানীগুণী ও অসাধু ব্যক্তিদের দখলে যাচ্ছে

952129

বর্তমান সময়ে ফেসবুকের কারিগরি সিস্টেমের সাথে কিছু জ্ঞানীগুণী ও কিছু অসাধু প্রতারক ব্যবহারকারীদের তেলেসমাতি দেখে যেমন অবাক হই, তেমন আবার ভাবতেও থাকি! ভাবনার কারণ হলো, আমার ফিরে দেখা ১৯৭৩-৭৪ সাল ও ২০১১-১২ সালে ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ নিয়ে এবং তখন কী দেখেছি আর এখন কী দেখছি তা নিয়ে।

১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে যখন এদেশে মোবাইল ফোন ছিলোই না, তখন এদেশে মোবাইল ফোনের নামও কেউ জানতো না। আর এখন দেশের আনাচে-কানাচের রাজপ্রাসাদে, বস্তিবাসীর হাতে উন্নতমানের নামী-দামী ব্যান্ডের টাচ্ স্ক্রিন এন্ড্রয়েড মোবাইল। এসব মোবাইলে রয়েছে দ্রুতগতির 4G ইন্টারনেট সুবিধা-সহ আরও কতকিছু! সবকিছুর মধ্যে তেলেসমাতি সুবিধা হলো, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা। এই ইন্টারনেট সুবিধা পেয়ে ধনী-গরিব সবাই বাজার থেকে একটা দামী অথবা কমদামি মোবাইল কিনেই ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করে দিন-রাত ফেসবুক নিয়েই পড়ে থাকে। কি ধনী আর কি গরিব, কি ছেলে আর কি বুড়ো; সবাই এখন ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও ফেসবুক নিয়েই অস্থির সময় পাড় করছে।

আবার কিছু জ্ঞানীগুণী ও কিছু অসাধু ব্যবহারকারীরা ফেসবুকটাকে তাদের দখলে নিয়ে গেছে। যদিও পুরোপুরিভাবে দখলে নিয়ে পারেনি, তবুও তাদের প্রাণপণ চেষ্টা অব্যাহত আছে। তাই ফেসবুকে থাকা এসব জ্ঞানীগুণী ও অসাধু ফালতু ব্যবহারকারীদের তেলেসমাতি সত্যি আমাকে ভাবিয়ে তুলে। ভেবেও কোনও লাভ হবে না বলে জানি! কারণ দিন যত গত হচ্ছে, নিত্যনতুন নামী-দামী ব্যান্ডের এন্ড্রয়েড মোবাইল এদেশের বাজারে আসছে। তাই খুব সহজেই যেকেউ একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল থেকে অনায়াসে ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করে তেলেসমাতি দেখিয়ে যাচ্ছে। তেলেসমাতি দেখাতে পারতোই না, যদি এন্ড্রয়েড মোবাইল এদেশের বাজারে না আসতো; আর হাতে হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল না থাকতো।

এসব দেখে মনে পড়ে, একসময়ের বাটন মোবাইলের কথা! এদেশে যখন মোবাইল ফোন বাজারে আসে, তখন বেশিদামী আর কমদামী সব ব্যান্ডের সব মোবাইলই বাটন মোবাইল ছিলো। বাটন মোবাইলে ইন্টারনেট সুবিধা বলতে GPRS কচ্ছপ গতির 2G ইন্টারনেট ছিলো। সেই কচ্ছপ গতির ইন্টারনেট সুবিধাতেও একসময় মানুষ বর্তমান যুগের অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করতো। কিন্তু ফেসবুকে এতএত তেলেসমাতি কারিগরি সিস্টেম আর এতো জ্ঞানীগুণীদের পদচারণা ছিলো না। ছিলো না, ভুয়া আইডির অসাধু ব্যবহারকারীদের আনাগোনাও। 

সেই সময়কার বাটন মোবাইলে GPRS 2G ইন্টারনেট ব্যবহার করেই ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফেসবুকে রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম। যা এদেশে ফেসবুক আবির্ভাব হবারও অনেক পরে। তা-ও একসময় হঠাৎ করে ওই আইডি টা নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। শত চেষ্টা করেও ফেসবুকের প্রথম আইডি টা আর সক্রিয় করতে পারিনি। তারপর বাধ্য হয়ে ২০১২ সালে পুনরায় বর্তমানে চলমান আইডি টা খুলেছিলাম। কিন্তু বাটন মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার করে এখনকার মতো এমন মজা পেতাম না। বাটন মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার করা মানে, মানুষ হয়ে গরুর মতো মাঠের ঘাস খাওয়া।

যাই হোক, ২০১১-১২ সালে যখন ফেসবুক ব্যবহার করতাম, তখন ফেসবুকের এতো কারিগরি সিস্টেম ছিলো না। যা ছিলো, তা শুধু একে অপরের সাথে সামাজিক যোগাযোগই রক্ষা করতে পারতো। যেমন– নিজের পছন্দের ছবি দিতে পারতো। নিজের টাইম লাইনে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে কিছু লিখতে পারতো। সীমিত শব্দের বার্তা প্রেরণ করা পারতো। তাই মনে হয় বর্তমান ফেসবুক একসময় বিশ্ববাসীর কাছে অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। আগে ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করার সিস্টেম ছিলো না। ভিডিও লাইভ নামের কোনকিছুই ছিলো না। ভিডিও পোস্ট করার কোনও অপশন ফেসবুকে ছিলো না। কারোর কাছে ভিডিও কল তো দূরের কথা, কথা বলারও কোনও সুবিধা ছিলো না। মোটকথা মেসেঞ্জার সফটওয়্যার বা অ্যাপই ছিলো না। আর এখন? এখন ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ ভিডিও কলের জ্বালায় রাতের ঘুম হারাম।

আমি প্রথম যখন ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করেছিলাম, তখন দেখেছি এদেশের অনেক সাধারণ মানুষ-সহ অসংখ্য খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গরা এই ফেসবুককে আঁড়চোখে দেখতো। মানে, দেশের জ্ঞানী-গুণীরা অনলাইনে থাকা ফেসবুককে অপছন্দের একটা সাইট হিসেবে বিবেচনায় রাখতো। আবার অনেকের ধারণা ছিলো, এই ফেসবুক অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অনলাইন থেকে হারিয়ে যাবে। সেই ধারণা নিয়েই দেশের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিরা আগে ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করেনি। এমনকি ফেসবুকে একটু চুপিও দেয়নি। যদিও কোনও খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করেছিলো, তা কেবল পরিচিত ব্যক্তিদের ফেসবুকে ফলোআপ করার জন্যই করেছিলো।

নামী-দামী ব্যক্তিবর্গরা ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করার পর তাদের নিজের আসল নামটাও দেয়নি। তারা ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ করেছিল ছদ্মনামে, আর প্রোফাইল ছবিটি সাজিয়ে রেখেছিল নানান রঙে। যেমন– ফুলের ছবি, গাছে ছবি, পাখির ছবি, ফলের ছবি, গরুর ছবি, ছাগলের ছবি, লাঠির ছবি, লতা-পাতার ছবি ইত্যাদি দিয়ে প্রোফাইল ছবির জায়গাটা ঠেসে রেখেছিল। প্রোফাইল ছবি আর নিজের নাম আড়ালে রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো, অনেকেরই মনের ভয়। সম্মানহানির ভয়। অপমানের ভয়। লোকলজ্জার ভয়। বহু লোকের মাঝে পরিচিতির ভয়। এই ভয় থেকে এখনো অনেক নামী-দামী কবি, সাহিত্যিক, বড়সড় ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাদের দেখাদেখি অসংখ্য অসাধু ব্যবহারকারীরাও তাদেরই পথ অবলম্বন করছে।

একসময়ে ফেসবুককে অপছন্দকারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলো কবি, সাহিত্যিক, লেখক/লেখিকা, বড়সড় ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও অসংখ্য অসংখ্য শিক্ষক/শিক্ষিকা ও শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ। ওনারা সবসময়ই ফেসবুকে থেকে যাচ্ছে আড়ালে আবডালে। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের মতো উনারাও ফেসবুক ব্যবহারকারী। তবে মজার ব্যাপার হলো, এখন আর তাদের কাছে ফেসবুক অপছন্দের নয়! এখন ফেসবুক তাদের কাছে জীবন চলার চাবিকাঠি এবং সকালের নাস্তা, রাতের ঘুম। মোটকথা বাংলাদেশের ফেসবুক এখন তাদেরই দখলে।

সম্মানিত ব্যক্তিবর্গরা এখন ফেসবুকে গ্রুপ বা পেইজ তৈরি করে সাধারণ ব্যবহারকারীদের যোগদানের আহবানও জানায়। যেসব কবিগণ আগে ফেসবুকের নামও শুনতে পারতো না, উনারা এখন কবিতার আসর জমিয়ে, তাঁদের লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়ার অনুরোধ করে। আবার বড়সড় খ্যাতিমান সাহিত্যিকরা তাদের নিজস্ব গ্রুপে সাহিত্যচর্চার আসরও বসিয়েছে। বই প্রকাশনার প্রশাসকরা তাদের ই-মেইল ঠিকানায় লেখা পাঠানোর আহবান জানাচ্ছে। ছোট-বড় রাজনৈতিক নেত্রী বৃন্দরা তাদের অনুসারী বাড়ানোর জন্য ফেসবুকে আইডি খুলে নিজের পরিচয় জানান দিচ্ছে। আবার অনেক অসাধু ব্যক্তি রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের নামে ফেইক আইডি খুলে হাতে ইশারা দিচ্ছে, আমি অমুক, আমি অমুক!

তাই এখন ফেসবুকে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত নির্বাচনী প্রচারণাও চলে। এখন ফেসবুকে দেশের যেকোনো নির্বাচনের নির্বাচনী এলাকার পছন্দের প্রার্থীর একনিষ্ঠ কর্মীরা মিছিলও করছে, আমার ভাই তোমার ভাই, 'কেয়ামত ভাই, কেয়ামত ভাই। কেয়ামত ভাইয়ে চায় কী, কেয়ামত ছাড়া আর কী!

আবার অনেক জ্ঞানী গুণী দীর্ঘদিন ফেসবুককে অবহেলা করে ফেসবুক থেকে দূরে থেকে আফসোস করেও মরছে। তাই উপায়ন্তর না দেখে উনারা এখন ফেসবুকে আইডি খুলে প্রথমেই জানিয়ে দিচ্ছে, আমি কবি, আমি সাহিত্যিক, আমি রাষ্ট্রের এটা, আমি ওটা, আমি সেটা, আমি অমুক, আমি তমুক। এর মানে হলো, উনি অনেক দেরি করে ফেসবুকে এসে একদিনেই সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মন জয় করে ফেলতে চাইছে।

আবার অনেক বড়-বড় কবিরা একটু দেরি করে এসে, নিজের লেখা কবিতা-সহ দিন-রাত পারিবারিক ছবি আপলোড করেই যাচ্ছে। তাদের কাছে ফেসবুক এখন মহামূল্যবান এক সম্পদে পরিণত হয়েছে। অনেকেই আছে প্রতিদিন একবার করে নিজের প্রোফাইল ছবি-সহ কাভার ছবিও পরিবর্তন করছেই। এসব দেখে বোঝা যায়, উনারা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে সারাদিন এই ফেসবুক নিয়েই বসে থাকে।

বর্তমান ফেসবুক পাগল জ্ঞানীগুণীদের সাথে তাল মিলিয়ে অসাধু কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও এরকমই করছে। তবে অসাধু ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কার্যকলাপ ভিন্নরকম। তারা এক-এক সময় এক-এক অপকর্মে ব্যস্ত থাকে। যেমন–কাউকে ঘায়েল করতে হলে ধর্ম অবমাননাকর একটা পোস্ট প্রতিপক্ষের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আবার কারোর পোস্টে গিয়ে খামোখা বাজে মন্তব্য করে সমালোচনার জন্ম দিয়ে ভালো মানুষের ক্ষতি করবে। কারোর সামনাসামনি না পারলেও ফেসবুক হুমকি-ধমকি দিয়ে যাবে। আবার কোনও জনপ্রিয় নেতা-নেত্রীর ভালো কাজের গুনগান তারা গাইবে না। বরং ওইসব জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনা করা-সহ দোষ দিবে, নিন্দা করবে, মিথ্যে অপবাদ দিবে এবং যেভাবেই হোক হেয় প্রতিপন্ন করাই হলো ওইসব অসাধু ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রতিদিনের কর্ম।

তাদের ওইসব কীর্তিকলাপ দেখে ভাবতে থাকি, যদি গুগল প্লাসের মতো কোনোএক সময় এই ফেসবুক চিরতরে হারিয়ে যায়, তাহলে ফেসবুকে দেরি করে আসা এসব কবি, সাহিত্যিক, লেখক/লেখিকা, জ্ঞানীগুণী আর অসাধু ব্যবহারকারীরা কী করবে? মনে হয় হার্ট-অ্যাটার্ক করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। কামনা করি তা যেন না হয়। সবাই বেঁচে থাকুক! সবাই ফেসবুকের নিয়মনীতি মেনে ফেসবুক ব্যবহার করুক! জয়তু ফেসবুক।

ফেসবুক জিন্দাবাদ

1215095_n

ফেসবুকে চলছে তুমুল ঝড়তুফান,
ছদ্মনাম'র ভুয়া আইডিতে সমানসমান।
এখানে চলছে বড় হবার প্রতিযোগিতা,
কি ছেলে, কি বুড়ো, কি মাতা-পিতা।

চলছে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় বাণী,
চলছে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি।
ফেসবুকে কেউ করে সহযোগিতা,
আবার অনেকেই করে বিরোধিতা।

চলছে ছবি আপলোড করার খেলা,
ছবি দিয়েই যাচ্ছে সারাবেলা।
কারোর মেয়ের ছবি, বউয়ের ছবি,
কেউ দিচ্ছে নাতি-নাতনীদের ছবি।

কারোর যায় ইজ্জত সম্মান,
কেউ ভাগ্যগুণে হয়ে যায় মহান।
কেউ হয় অপদস্ত অপমান,
কারোর চলে যায় মানসম্মান।

ফেসবুকে কেউ লিখে কবিতা,
আবার কেউ করে রসিকতা।
কেউ গায় কবির শ্যামের গান,
হিংসায় কারোর চলে যায় প্রাণ।

কেউ দেয় সময়ের সঠিক পরামর্শ,
আবার কেউ দেখায় চরিত্রের আদর্শ।
ফেসবুকে যে না পারে সে-ও পারে,
এরপর দোষ চাপায় অন্যের ঘাড়ে।

ইদানীং ফেসবুকে দেশের রাজনীতি,
চলছে কোন্দল, চলছে স্বজনপ্রীতি।
চলছে ঘাত-প্রতিঘাত, হিংসা অহংকার,
কেউ আবার কাউকে করছে তিরস্কার।

ফেসবুকে চলছে গ্রুপিং দলাদলি,
চলছে হুমকি-ধমকি ফালাফালি।
চলছে ব্যবসা নিত্যপণ্য বেচা-কেনা,
চলছে ধান্ধাবাজি, মেসেঞ্জারেও দেয় হানা।

জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ এ-যুগের ফেসবুক,
ফেসবুক হলো কোটি মানুষের সুখ-দুঃখ!
ফেসবুকে চলে যতো অন্যায়ের প্রতিবাদ,
মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক জিন্দাবাদ!

জীবনের গল্প-১৮

জীবনের গল্প-১৭ এর শেষাংশ: তখন ঠাকুরবাড়ির সবাইর এমনই থমথমে অবস্থা ছিলো। কিন্তু না, সেদিন তেমন কোন খারাপ পরিস্থিতিতে আমার পড়তে হয়নি। খুব সুন্দরভাবে আমি একাই নয়াবাড়ি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে জামাই-আদরে দুইদিন থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি।

বাসায় আসার পর আমার বড় দিদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় গিয়েছিলি।’ সত্যি কথাই বললাম, ‘বিক্রমপুর গিয়েছিলাম।’ বড় দিদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন গিয়েছিলি? ওখানে কি মেয়ে পছন্দ করেছিস? মেয়ে পছন্দ হয়ে থাকলে বল, আমরা দেখতে যাবো।’ বললাম, ‘সময় হোক, পরে বলবো।’ দিদি আর কিছু বললো না। নিজের বাসায় চলে গেলো। এরপর মা বললো, ‘আমি একটা মেয়ের কথা শুনেছি। মেয়েটি নাকি সুন্দর! মেয়ে সুন্দর হলে তোর সাথে মানাবে খুব!’ মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেয়েদের বাড়ি কোথায়?’ মা বললেন, ‘মেয়েদের বাড়ি নাকি নরসিংদী। তোর জোৎস্না দিদির জামাই যেখানে আবার বিয়ে করেছে, সেখানে। মেয়ে পক্ষ থেকে বেশকিছু টাকা-পয়সাও নাকি দিতে পারবে।’ আমার ওই ভগ্নিপতির নাম সুনীল। বললাম, ‘আমার বোন মরা ভাগ্নিটাকে পূজা উপলক্ষে একটা সুতার বাট্টা দিতে পারে না, অথচ এখানে এসে আমার বিয়ের ব্যাপারে নাক গলায়? আমার সাথে দেখা হলেই হয়। তখনই মজাটা দেখাবো।’

আমার কথা শুনে আমার মা আর ভয়ে কিছুই বলেনি, চুপ হয়ে গেলো। এদিন আর নিজের কাজের জাগায় গেলাম না, সন্ধ্যার আগে চলে গেলাম কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে। কালামের সাথে দেখা করলাম। বিস্তারিত সব ঘটনা বললাম। কালাম জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আদরযত্ন কেমন করেছে ওস্তাদ?’ বললাম, ‘ভালোই করেছে।’ আমার কথা শুনে কালাম বললো, ‘তাহলে তো এখন আর কারোর সাথে যাওয়ার দরকার হবে না। আপনি একাই যথেষ্ট,ওস্তাদ!’ কালামের সাথে দেখা করে কানাইর সাথে দেখা করলাম। দুইজনে অনেকক্ষণ ঘোরা-ফেরা করলাম। তারপর আমি চলে গেলাম নিজের বাসায়, কানাই ওর বাসায় চলে গেলো।

পরদিন সকালে আমি মিলে গেলাম। কাজ করলাম। এর দুইমাস পর ওয়েল টেক্স থেকে বাৎসরিক ছুটির ৩,০০০/= টাকা টাকা একসাথে পেলাম। ৩,০০০/=টাকা হতে পেয়ে এর দুইদিন পরই দুইদিনের ছুটির আবেদন করলাম। ছুটি পাস হলে, মাকে কিছু টাকা দিয়ে আবার চলে গেলাম নয়াবাড়ি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে। এভাবে দুই-তিন দিনের ছুটি পেলেই একা-একা চলে যেতাম নয়াবাড়ি গ্রামে। একসময় গ্রামের অনেকেই বিয়ে ছাড়া আসা-যাওয়া দেখে ছিঃছিঃ করতে লাগলো। সবার ধারণা আমি ফাঁকিবাজ! এমনও বলতে লাগলো, ‘ছেলেটা কি সত্যিই বিয়ে করবো? নাকি শুধুই মিছে মজা করার জন্য আসা-যাওয়া আসা-যাওয়া করছে!’ মানুষের কথাগুলো আমার কানে আসলো। আমি মেয়ের বাবা মা’কে নিশ্চিত থাকতে বললাম। আমি তাদের আশস্ত করলাম, ‘লোকে যা-ই বলে বলুক তাতে আপনারা মন খারাপ করবেন না। আমি অর্চনাকে বিয়ে করবই।’

একসময় নয়াবাড়ি আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা আমার বড় দাদার কানে গেলো। বড়দাদা মাকে জানালো। মা বড় দাদাকে তাড়াতাড়ি বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করতে বললো। মায়ের কথায় বড়দাদা ফাইন টেক্সটাইল মিলের কালামকে বললো, ‘তুমি বাড়ি গিয়ে মেয়ের বাবাকে নারায়ণগঞ্জ আসতে বন বলবে।’ বড় দাদার কথা শুনে কালাম বাড়ি গিয়ে মেয়ের বাবাকে সবকিছু খুলে বললে, একদিন মেয়ের বাবা উনার ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে আমাদের বাসায় আসে। তারপর বাসায় খাওয়া-দাওয়ার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয়, কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে; বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করার জন্য। করণ, ফাইন টেক্সটাইল মিলের বেশিরভাগ শ্রমিকই ছিলো সুবচনী এলাকার, তাই। সন্ধ্যার পর ফাইন টেক্সটাইল মিলের ভেতরে অফিসরুমে সবাই বিয়ের আলোচনায় বসলো। মিলের ম্যানেজারও সেখানে উপস্থিত ছিলো। সবাই বসে কীভাবে সুন্দর হবে সেসব বিষয়ে আপাল আলোচনা করতে লাগলো।

আমার বড় দাদার দাবি-দাওয়ার মধ্যে সোনা-দানা কিছুই নেই, মেয়ের বাবা যা পারে তা-ই মেনে নিবে। কিন্তু বিয়ের আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ৫,০০০/= টাকা নগদ দিতে হবে।কিন্তু এতে মেয়ের বাবা নারাজ! মেয়ের বাবা ৩,০০০/= টাকার বেশি দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। আমার বড় দাদাও ৫,০০০/= টাকার কম হবে না বলে জানিয়ে দেয়। এভাবে দর-কষাকষি করতে করতে রাত প্রায় ১২ টার মতো বেজে যায়। উভয়োপক্ষের কেউ যখন কাউকে ছাড় দিচ্ছিল না, তখন আমি লোক মারফত কালামকে বাইরে ডেকে আনলাম। কালামকে বললাম, ‘আমার বড় দাদাকে বুঝিয়ে বলতে, যাতে ৩,০০০/= টাকাই রাজি হয়। আমার কথা শুনে কালাম আমার কথা বলে বড় দাদাকে রাজি করায়। এরপর বাঁধলো বরযাত্রী নিয়ে।

আমার বড় দাদার কথা ১০০ জন বরযাত্রী যাবে এবং আসা-যাওয়ার ভাড়া পুরোটা মেয়ে পক্ষে বহন করতে হবে। এতে মেয়ের বাবা রাজি হচ্ছিল না। মেয়ের বাবার কথা, বরযাত্রী যাবে ৫০ জনের বেশি যাতে না হয়। আর আসা এবং যাওয়া কোনটার ভাড়াই দিতে পারবে না। এতে আমার দাদাও রাজি হচ্ছিল না। তারপর সবার অনুরোধে মেয়ের বাবা যাওয়া বাবদ গাড়িভাড়া ১,০০০/= দিতে পারবে বলে সম্মতি দেয়। এতেও আমার বড় দাদা যখন রাজি হচ্ছিল না, তখন আমি কালামকে আবার ডেকে আনি। কালামকে বললাম, ‘মেয়ের বাবাকে ১,৫০০/= টাকা রাজি হতে বলো। ১,০০০/= টাকা মেয়ের বাবা দিবে, আর বাকি ৫০০/=টাকা আমি গোপনে তোমার কাছে দিয়ে দিবো, তুমি মেয়ের বাবার হাতে দিয়ে দিবে। আমার কথামতো কালাম তাই করলো। মেয়ের বাবাও কলমের কথামতো রাজি হয়ে গেলো। বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হলো। এরপর বাঁধলো বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে।

আমার বড় দাদা টাউনের ভাড়া বাড়িতে কোনপ্রকার নিয়মকানুন করবে না। যা করার মেয়েদের বাড়িতেই করতে হবে। তখন সবার প্রশ্ন, তাহলে বিয়ের আগের দিন যে ছেলে পক্ষের কিছু নিয়মকানুন থাকে, সেসব নিয়মগুলো কীভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে? তখন আমার বড় দাদা বললো, ‘বিয়ের আগের দিন সকালে ছেলে মেয়ের বাড়িতে চলে যাবে, অধিবাসের নিয়ম পালনের জন্য। আর বিয়ের দিন বরযাত্রীদের নিয়ে ঠিক সময়মতো বিয়েবাড়িতে আমরা উপস্থিত হয়ে যাবে।’ এতে মেয়ের বাবা রাজি হয়ে গেলো। এবার বাঁধলো আড়াইউল্লা বা ফিরাউল্টা নিয়ে। আমার বড় দাদা বললো, ‘বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হলে বরযাত্রীদের নিয়ে আমি চলে আসবে। আর আমার ছোট ভাই আড়াইউল্লা বা ফিরাউল্টার নিয়ম পালন করে বিয়ের দুইদিন পর নতুন বউ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ চলে আসবো।’ আমার বড় দাদার কথা মেয়ের বাবা মেনে নিলো। যৌতুক বাবদ ৩,০০০/= টাকা, আর বরযাত্রীদের গাড়িভাড়া বাবদ ১,৫০০/=টাকা মেয়ে বাবা বিয়ের দুইদিন আগে যেভাবেই হোক ফাইন টেক্সটাইল মিলেই পৌঁছে দিবে। বিয়ের কথাবার্তা পাকা-পাকি হলো। বিয়ের দিন ধার্য করা হলো, ১ আষাঢ় ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ।

কিন্তু রাত অনেক হওযাতে পাটিপত্র (সাদা কাগজে অথবা স্ট্যাম্প) করার সুযোগ ছিলো না। তাছাড়া তখন উপস্থিত সবাইর মাঝে মিষ্টি বিতরণ করার মতো উপায়ও ছিলো না। তাই সবাই সিদ্ধান্ত নিলো পরদিন একজন পুরোহিত দিয়ে পটিপত্র করে বিয়ের জোকার (উলুধ্বনি) দিতে। সবার কথামতো তা-ই করা হলো। মেয়ের বাবাকে বড়দাদা সাথে করে বাসায় নিয়ে গেলো। পরদিন সন্ধ্যাবেলা একজন পুরোহিত দ্বারা পাটিপত্র করে ভাড়া বাড়ির সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। রাতে ফাইন টেক্সটাইল মিলেও কিছু মিষ্টি বিতরণ করা হলো। এর পরদিন সকালে মেয়ের বাবাকে ফতুল্লা লঞ্চঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হলে, মেয়ের বাবা বাড়িতে চলে যায়।

এদিকে বড়দাদা আমাকে সাথে নিয়ে আমার বড় ভগ্নিপতির সাথে বিয়ের বিষয়-আশয় নিয়ে আলোচনায় বসলো। জামাইবাবু আমাকে মোটামুটি ১০,০০০/= টাকার একটা হিসাব দেখিয়ে বললো, ‘বরযাত্রীদের আসা-যাওয়া-সহ বিয়ের আগে পরে এই টাকা খরচ হতে পারে। এখন তুমি এই ১০,০০০/= টাকা যেভাবেই হোক অন্তত বিয়ের চার-পাঁচ দিন আগে বড় দাদার কাছে দিয়ে রাখবে।’ আমি জামাই বাবুকে বললাম, ‘আমাকে এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে।’ তখন বিয়ের বাকি আছে ছিলো ১৪/১৫ দিন। আমার কথা শুনে জামাইবাবু বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি এই ক’দিনের মধ্যে টাকা জোগাড় করো। এর বেশি যদি কিছু লাগে তা আমি দেখবো।’

পরদিন ওয়াল টেক্স মিলে গেলাম। কাজের মাঝেই মিলের শ্রমিক নেতাদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করলাম। টাকা লাগবে, তাও বললাম। মিলের নেতারা আমাকে বললো, ‘আপনি ১৫,০০০/=হাজার টাকা অগ্রীম চেয়ে একটা দরখাস্ত লিখে অফিসে জমা দিন, এরপর আমরা দেখছি।’ তাদের কথামতো আমি তাই করলাম। ১৫,০০০/=টাকা অগ্রীম চেয়ে একটা দরখাস্ত লিখে অফিসে জমা দিলাম। পরদিন মিলের মালিক নিয়াজ সাহেব মিলে আসলে, মিলের ম্যানেজার সহ শ্রমিক নেতারা মালিকের সাথে আমার অগ্রীম চাওয়া ১৫,০০০/=হাজার টাকার ব্যাপারে আলাপ করলো। এরপর মালিক নিয়াজ সাহেব ১০,০০০/=টাকা দিতে চাইলে, মিলের নেতারা আমাকে জানালে, আমি এতে রাজি হলাম না। আমি ১৫,০০০/= টাকার কম হবে না বলে জানিয়ে দিলাম।

শেষতক শ্রমিক নেতারা মিলের মালিক ম্যানেজারের সাথে আলাপ আলোচনা করে ১৪,০০০/=টাকা মঞ্জুর করে। এর একদিন পরেই মিল থেকে আমি ১৪,০০০/=টাকা হাতে পেয়ে, মিলের সবাইকে বিয়ের নেমন্তন্ন করলাম। মিলের মালিক নিয়াজ সাহেব ও ম্যানেজার সাহেবকেও নিমন্ত্রণ করলাম। কিন্তু মিল মালিক ম্যানেজার তাঁরা কেউ বিয়েতে যাবে না বলে আমাকে জানিয়ে দেয়। আমি তাঁদের আর বিশেষভাবে অনুরোধ না করে, বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে ৭,০০০/=টাকা মায়ের কাছে দিলাম, জামাইবাবুর কাছে পৌঁছে দিতে। আর বাদ-বাকি ৭,০০০/=টাকা আমার কাছে রেখে দিলাম, আমার নিজের খরচের জন্য। বিয়ের বাকি আছে আরও ১০/১২ দিন। পরদিন বিকালবেলা ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে আমার বড়দাদার সাথে বুঝলাম। ওয়েল টেক্স মিলের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছি, তাও জানালাম। তারপর বড়দাদা ওয়েল টেক্স মিলের মতো কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলের সবাইকে নিমন্ত্রণ করলো। এতে দুই মিলের লোক হলো, ৪০-৪৫ জনের মতো। নিজেদের আত্মীয়স্বজন-সহ বরযাত্রীর সংখ্যা হয়ে গেলো ৬০ জনের মতো। বিয়ের দিন দুই-চার-পাঁচ জন এদিক-সেদিক হলেও, কোনও সমস্যা হবে মনে করে– বড়দাদা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে যা-কিছু লাগে তা যোগাড় করতে থাকে। আমিও নিয়মিত মিলের কাজ করতে থাকি।

একসময় বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলে, ৭দিন ছুটি চেয়ে একটা দরখাস্ত লিখে মিলে জমা দিই। ৭দিন ছুটি মঞ্জুর হলো। দুইদিন পরই বিয়ে। বিয়ের একদিন আগে নিজের বাসার কিছু নিয়মকাজ সেরে কানাইকে সাথে নিয়ে মেয়েদের বাড়িতে উদ্দেশে রওনা দিলাম। লঞ্চ থেকে সুবচনী ঘাটে নেমে বাজার থেকে মিষ্টি পান সুপারি কিনে নয়াবাড়ি গ্রামে কালামদের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। কালামদের বাড়ি থেকে কালামের বড় ভাই, ভাবী, বোন-সহ আরও কয়েকজন মিলে মেয়েদের বাড়িতে গেলাম। এরপর মেয়ের বাড়ি থেকেই হিন্দু বিয়ের ছেলে পক্ষের যা নিয়ম করা দরকার, সবকিছু করা হলো। সেদিন রাতে আমি আর কানাই কালামদের বাড়িতে থাকলাম। পরদিন বিয়ের দিন ১ আষাঢ় ১৩৯৩ বাংলা। বিকাল হতে না হতেই ওয়েল টেক্স, ফাইন টেক্সটাইল মিলের লোকজন-সহ নিজেদের আত্মীয়স্বজন সবাই সুবচনী বাজারে এসে জড়ো হলো।

খবর পেয়ে মেয়ের বাড়ি থেকে লোক গিয়ে চার-পাঁচটা নৌকা করে তাদের বিয়ে বাড়িতে আনা হলো। বিয়ের বাড়ি লোকে লোকারণ্য হলো। মেয়ে পক্ষ থেকে আগত বরযাত্রীদের মিষ্টিমুখ করারানো হলো। বিয়ের লগ্ন রাত ১০.৩০ মিনিট। সময়মতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সাতপাক ঘুরে বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হলো। বিয়ের পরদিন বরযাত্রী-সহ আমার আত্মীয়স্বজন সবাই নারায়ণগঞ্জ চলে আসলো। মেয়ের বাড়িতে আড়াই দিনের নিয়ম পালন করার জন্য থেকে গেলাম, আমি আর কানাই। একসময় আড়াইউল্লা নিয়ম করে কানাই, কালাম-সহ নতুন বউয়ের সাথে তার ছোট ভাইকে নিয়ে আমি চলে আসি নারায়ণগঞ্জ নন্দিপাড়া নিজের বাসায়। এর দুইদিন পরই বৌভাত অনুষ্ঠান। বউভাত অনুষ্ঠানে দুই মিলের লোক-সহ প্রায় ১০০জন লোকের আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে চলতে লাগলো, স্বামী-স্ত্রীর সংসার।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে

124_n

অভিশপ্ত ধর্ষণ

সারাদেশে চলছে ধর্ষণ বিরোধী প্রতিবাদ!
ধর্ষকও ধর্ষণ কার্য্যে পেতেছে নানান ফাঁদ!
একদিকে চলছে ধর্ষণ বিরোধী শ্লোগান,
বিপরীতে চলছে ধর্ষকের ধর্ষণ অভিযান!

যেখানে কেউ মেনে নিতে পারছে না ধর্ষণ!
সেখানে ধর্ষকরা রীতিমতো করছেই ধর্ষণ!
ধর্ষিতা মা-বোনেরা লজ্জায় করছে আত্মহনন।
রাষ্ট্রও কিছুতে পারছে না ওদের করতে দমন!

তাইতো দেখি আজ সকাল-সন্ধ্যা সাজে,
মা-বোনেরা মুখ ঢেকে রাস্তায় চলে লাজে!
মানুষ থুথু ফেলে ধর্ষকের ঘৃণিত কাজে!
ধর্ষকদের জন্য আজ দেশের বারোটা বাজে!

গুমটু ভুটানে ঘুরাঘুরির গল্প

একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ভারত গিয়েছিলাম। সময়টা তখন ১৯৯৩ ইংরেজি ১৪০০ বঙ্গাব্দ। গিয়েছিলাম মস্ত বড় আশা নিয়ে। কিন্তু মনের সেই আশা আর পূরণ হয়নি। খামোখা দেড়বছর নিজের পরিবারবর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছিলাম। লাভের মধ্যে ভাল হয়েছিল আমার বড়দি’র বাড়ি যেতে পেরেছিলাম। আমার বড়দি’র বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া।

বীরপাড়া হলো কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে মিজোরাম যাওয়ার পথিমধ্যে। বীরপাড়া ভুটানের পাহাড় ঘেঁষা চা-বাগানের লীলাভূমি জনবহুল একটা জায়গার নাম। আর আমার বড়দি’র বাড়ি হলো, বীরপাড়া এলাকায় রাবিন্দ্র নগর কলোনি। কোলকাতা থেকে বড়দি’র বাড়ি বীরপাড়া গিয়েছিলাম খুবই বিপদে পড়ে। এমনই এক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম যে, তখন আমার বড়দি’র বাড়িই ছিলো একমাত্র ভরসা। কিন্তু বড়দি’র বাড়ি ছিলো আমার অচেনা। তবে আমার মনে খুবই সাহস ছিলো, মনের বিশ্বাস ছিলো, একভাবে-না-একভাবে আমি আমার বড়দি’র বাড়ি অবশ্যই খুঁজে বের করতে পারবো।

মনের সেই বিশ্বাস নিয়েই একদিন কোলকাতা ধর্মতলা থেকে উত্তরবঙ্গের রকেট বাসের টিকেট নিলাম। তারপর উত্তরবঙ্গের রকেট বাসে চড়ে প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর বীর পাড়ার মাটিতে পা রেখেছিলাম। যদিও কোলকাতা গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর সাথে, কিন্তু কোলকাতা থেকে আমার বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম আমি একা। তবে জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া জায়গাটি ছিলো আমার একেবারেই অপরিচিত অচেনা জায়গা।

তার উপর আবার আন্তর্জাতিক আইনের চোখে আমি ছিলাম পাসপোর্ট বিহীন এক অপরাধী। তবুও আমার মনের ভেতরে একটু ঢর-ভয় বলতে ছিলো না। আমি বাস থেকে বীরপাড়া নেমেই বীরদর্পে একটা মিষ্টির চলে গেলাম। মিষ্টির দোকান থেকে ৪ কেজি মিষ্টি কিনলাম। এরপর একটা রিকশা চেপে সোজা বীরপাড়া রাবিন্দ্র নগর কলোনি বড়দি’র বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। প্রথমে আমার বড়দি আমাকে চিনতে পারছিলো না। বাবা’র নাম, মা’র নাম, বড়দা’র নাম বলার পরই আমাকে চিনতে পেরেছিলো।

যাইহোক, যেদিন বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম, সেদিন আর ঘুরা-ঘুরি করার সময় হাতে ছিলো না। শুধু বড় ভাগিনার সাথে বীরপাড়া বাজার দেখতে গিয়েছিলাম। বড় ভাগিনা’র সাথে বীরপাড়া বাজারটি ঘুরে দেখার সময়ই ভুটান যাবার জীপস্ট্যান্ড দেখলাম। যখন ভুটান যাবার জীপ গাড়িগুলোর হেলপাররা ভুটান ভুটান বলে বলে চিল্লা-চিল্লি করছিলো, তখন আমার মনটা আর মানাতে পারছিলাম না। কিন্তু তখন ভুটান যাবার সুযোগও ছিলো না। কারণ, তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই মনের আকাঙ্খা মনে চেপে ধরে বড় ভাগিনা’র সাথে বীড়পাড়া বাজারটির এদিক-সেদিক ঘুরে অনেক রাতে দিদি’র বাড়ি পৌঁছে ছিলাম। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমানোর জন্য শুয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সারারাত আর চোখে ঘুম আসেনি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম ভুটান যাওয়ার জীপ গাড়ির হেলপাররা যেন আমাকে ডাকছিল। এভাবে ছটফট করতে করতে একসময় ঠিকই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেই মনস্তাপ করেছিলাম ভুটান যাওয়ার। কারণ বাংলাদেশ থেকে শুধু ভুটানের নামই শুনেছিলাম। কিন্তু একসময় যে ভুটানের এতো সামনা-সামনি চলে আসবো, তা কোনদিন কল্পনাও করিনি। তাই ভাবছিলাম, “যেভাবেই হোক, আর যেমন করেই হোক, আমি এখন ভুটানের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। ভুটানের এতো সামনে যখন চলেই এসেছি, তাহলে হেলায় সুযোগ হারাতে আমি রাজি নই! যেভাবেই হোক, আর যে করেই হোক ভুটান আমাকে যেতেই হবে। যদি ভুটানের ভেতরে না যেতে পারি, তাহলে তো আমার ভারত আসাই একরকম মাটি হয়ে যাবে।”

এই ভেবেই সাতসকালে নাস্তা করেই কারোর কাছে কিছু না বলে ভুটানের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। তখন আমার সাথে ভারতীয় তিন-চার শো টাকার মতো অবশিষ্ট ছিলো। এই তিন-চার শো টাকা কিন্তু বাংলাদেশি টাকার মতো সস্তা দরের টাকা নয়! ওই টাকা ছিলো ভারতীয় মূল্যবান টাকা। তা-ও আবার প্রায় চারশো টাকার মতো! সব টাকা সাথে করে বড়দি’র বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলাম বীরপাড়া বাজারের শেষপ্রান্তে, যেখানে থেকে জীপ গাড়িগুলো ভুটানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় তখন সকাল ৯ টার মতো।

আমি বীরপাড়া বাজারে গিয়ে একটা চা’র দোকানে গিয়ে বসলাম। চা- দোকানটা হলো বাজারের শেষ মাথায়, বীরপাড়া ভুটান জিপস্ট্যান্ডের সাথেই। চা-দোকানদারকে এক কাপ চা দিতে বললাম। চা-দোকানদার আমাকে চা বানিয়ে দিলো। আমি দোকানের বাইরে থাকা টেবিলের উপরে বসে বসে চা-পান করছিলাম, আর ভুটান যাওয়ার জীপ গাড়িগুলো ফলো করছিলাম।

জীপ গাড়িগুলো আমাদের দেশের টেম্পো’র মতো। একটা জীপ গাড়িতে ১০ জন করে যাত্রী বহন করে। আমি চা পান করতে করতেই একটা জীপগাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে গুমটু গুমটু বলে ডাকা-ডাকি করতে লাগলো। জীপের ভেতরে যাত্রী ছিলো অর্ধেকের মতো। ওখানে টাইম-বাই-টাইম ঘড়ির কাটা ধরেই যেকোনো যাত্রীবাহী যানবাহনগুলো চলাচল করে। টাইম হবে তো গাড়ি স্ট্যান্ড ত্যাগ করবেই। এতে যাত্রী কম হলেও হায়-আফসোস করার সুযোগ নেই। কম যাত্রী নিয়েই গাড়ি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। সেসময় বীর পাড়া বাজার থেকে গুমটু ভুটানের ভাড়া ছিলো মাত্র ৩ টাকা। বীরপাড়া থেকে ভুটান গুমটু ভুটানের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার মাত্র।

আমি তাড়া-তাড়ি করে চা’র দাম দিয়ে জীপ গাড়ির সামনে গেলাম। নিজের পকেটে হাত দিয়ে টাকার সংখ্যা দেখে নিলাম। দেখলাম, “আমার পকেটে অবশিষ্ট যা আছে, তা দিয়ে সুন্দর ঘুরা-ঘুরি হয়ে যাবে।”

এই ভেবেই মনে সাহস রেখে কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা জীপের ভেতরে গিয়ে বসলাম। প্রত্যেক জিপে ১০ জন করে যাত্রী বহন করলেও, আমি যেই জিপে করে যাচ্ছিলাম সেই জিপে আমি সহ যাত্রী হলাম সাত জন। পাঁচজন ভুটানি মহিলা। আর একজন পুরুষ যাত্রী। পুরুষ যাত্রী বীরপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা। যাবে ভারত-ভুটান সীমান্ত গেইট ঘেঁষা মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে পুজো দিতে।

মাকড়া পাড়া হলো ভারত-ভুটান বর্ডার এলাকার জায়গার নাম। মাকড়া পাড়া ভারতের। আর ভুটানের ভেতরের জায়গাটার নাম হলো গুমটু। মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে প্রতিদিন বীরপাড়ার আশপাশ থেকে অনেক মানুষ পূজা দিতে যায়। আমার সাথে বসা যাত্রী ভদ্রলোকটিও মাকড়া পাড়া পূজা দিতেই সেখানে যাচ্ছিল।

চলন্ত জিপে বসেই লোকটি শুধু আমার দিকেই বেশি তাকাচ্ছিল। লোকটার হাতে কয়েক রকম ফল-ফুল, আর একটা ঝুড়ি। জীপের ভেতরে থাকতেই তিনি আমাকে কি যেন বলবে বলবে ভাব! কিন্তু কিছুই বলার সুযোগ পাচ্ছিল না।

জীপগাড়ি চলছে উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। রাস্তার দুই পাশে বন-জঙ্গল। মাঝেমধ্যে চা বাগান। এর ফাঁকে-ফাঁকে নেপালি শরণার্থীদের ঘরবাড়ি। নেপালিরা ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় শরণার্থী হয়েই থাকে। ওদের কোনও ভারতীয় নাগরিকত্ব নেই। যেই রাস্তা দিয়ে জিপ গাড়ি যাচ্ছিল, সেই রাস্তার দু-পাশেই গহীন বন-জঙ্গল। সেই বনে বন্য হাতিও আছে। ওই হাতিগুলো সবসময় দল বেঁধে চলে। এক বন থেকে আরেক বনে যাবার সময় রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। তখন যানবাহনগুলো দূরে থামিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখে। যাতে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হাতির কানে না যায়।

কারণ, সময় সময় গাড়ির শব্দে বন্য হাতিগুলো ভীষণ ক্ষেপে যায়। আর ক্ষেপে গেলেই ঘটে বিপদ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা পথচারীরা কখনো কখনো এসব বন্যহাতির কবলে পড়ে আহত নিহতও হয়। তাই বীরপাড়া টু গুমটু রোডে চলাচলকারী যানবাহনের ড্রাইভাররাও দেখে-শুনে গাড়ি চালায়। যাতে কোন প্রকার দুর্ঘটনা না ঘটে। বীরপাড়া থেকে ভুটান গুমটু যেতে সময় লাগে মাত্র ৩০ মিনিট। পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম গুমটু।

জীপ থেকে নামার পর যাত্রী পুরুষ লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার বাড়ি কোথায়? কোথায় এসেছেন? কার বাড়ি? কোথায় যাবেন?’ লোকটির প্রশ্ন করা প্রতিটি কথারই ঠিক-ঠিক জবাব দিয়েছিলাম। তখন লোকটা আমার জামাইবাবু ও ভাগিনাদের চিনতে পেরেছিলো, আর আমি যে তাদেরই অতিথি সেটাও স্বীকার করে বললো, ‘আহারে দাদা, আমার হাতে সময় নেই। যদি সময় থাকতো, তাহলে আমি নিজের আমার সাথে করে গুমটু এলাকাটা আপনাকে নিয়ে ঘুরতাম।’ এই বলেই জীপের হেলপারকে ডেকে বললো, ‘এই লোকটাকে ভুটানের ভেতরে নিয়ে যাবে। তিনি আমাদের অতিথি। বাংলাদেশ থেকে এসেছে। উনার ভুটান দেখার খুব শখ! তাই এখানে এসেছে। তোমরা লোকটাকে একটু সাহায্য করবে।’

ড্রাইভার-হেলপার দুইজনেই বললো, ‘ভুটানের ভেতরে যেতে কারোরই পারমিশন লাগে না, দাদা। উনিও যাবে। কোনও সমস্যা হবে না! আপনি নিশ্চিত থাকুন। তারপরও আমরাতো আছি-ই।’ এই বলেই জীপের ড্রাইভার হেলপার আমার সাথের যাত্রী ভদ্রলোকটিকে বিদায় করলো। বীরপাড়া থেকে আসা সব যাত্রীদের ভাড়া আদায় করা হলো। তারপর ড্রাইভার-হেলপার দুইজন আমাকে সাথে নিয়ে ভুটানের ভেতরে যাওয়ার সুবিশাল গেইটের দিকে যেতে লাগলো।

ভারত-ভুটান কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে সুবিশাল একটা গেইট। চেকপোস্ট ছিলো। সীমান্তরক্ষী বাহিনীও ছিলো। সীমান্ত গেইটে দুইজন করে ভুটানি সীমান্ত রক্ষীবাহিনী থাকে। কে আসলো, কে গেলো তার দিকে তাদের কোনও নজর নেই। নজর থাকে তখন, যখন একটা গাড়ি ভেতরে বা বাইরে যাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গেইট জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে। রাতের বেলা বিশেষ কোনও জরুরি কাজে ভেতর-বাইরে যেতে পারমিশন প্রয়োজন হয়।

জিপ গাড়ির চালকের সাথে যখন সীমান্ত গেইট পাড় হচ্ছিলাম, ভয়ে তখন আমার শরীর কাঁপতে শুরু করলো। ভয়ের কারণ ছিলো, “যদি সীমান্তরক্ষী আমাকে ডাক দেয়, আর যদি পাসপোর্ট চায়, যদি আমাকে আটকে রাখে?” কিন্তু না, ওরা আমাদের দিকে একটু ফিরেও তাকায়নি। আরামে চলে গেলাম ভুটান গুমটুর ভেতরে। কী সুন্দর জায়গা! মন চায় রাস্তার মাঝখানে শুয়ে থাকি। খুবই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা! শীতের দেশ ভুটান।

ভুটানিরা বারো মাস একরকম গরম জামা-কাপড় ব্যবহার করে। বারো মাসই ভুটানের আবহাওয়া একইরকম থাকে। তবে বৃষ্টির কোনও মৌসুম না থাকলেও মাঝেমধ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিতে ওরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কারণ, পাহাড়ি জমিগুলো পানির জন্য সবসময় খাঁ খাঁ করে তাই। ওরা বছরে দুই-একবার গোসল করে। ভুটানের বেশিরভাগ মানুষেই মদ্যপায়ী। মানে সবসময়ই মদপান করে থাকে। শুনেছি মদপান নাকি ওদের শরীর গরম রাখার একটা পন্থা।

ভুটানের গুমটুতে একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। সেটা ভারত-ভুটানের যৌথভাবে নির্মাণ করা। বিশাল জায়গা নিয়ে ওই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। গুমটুতে পাথরের অভাব নেই। গুমটুর আশে-পাশে যতোগুলো পাহাড় আছে, সব পাহাড়ই পাথরের পাহাড়। পাথর নাকি এসব পাহাড়ে জন্ম হয়। সামান্য বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধ্বসে অনেক পাথর বের হয়। ঐ পাথরগুলোই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কাজে লাগায়। গুমটুতে সপ্তাহে একদিন হাট বসে। এটা গুমটু এলাকাবাসীর স্থানীয় সাপ্তাহিক হাট।

ওই হাটে বীর পাড়ার অনেক ব্যবসায়ীও অনেকরকম পণ্যসামগ্রী নিয়ে বিক্রি করে। একটা সিনেমা হলও আছে। সিনেমা হলটির নাম, ঔঁ (ওম) সিনেমা। ওই সিনেমাহলে ভারতীয় ছায়াছবি বেশি প্রদর্শিত হয়। ভুটানের নিজস্ব চলচ্চিত্রও আছে। তবে ওরা ভারতীয় চলচ্চিত্রই বেশি পছন্দ করে থাকে। গুমটুতে একটা বৌদ্ধমন্দির আছে। মন্দিরটি একটা পাহাড়ের চূড়ায়। অনেক উঁচু পাহাড়। তবে মন্দিরে ট্যাক্সি বা অন্য গাড়ি চড়েও যাওয়া যায়।

পুরো পাহাড়টা তিনটে প্যাঁচ দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যাতে প্রাইভেট ছোট আকারের গাড়িগুলো মন্দিরের উপরে অনায়াসে উঠতে পারে, আর মানুষও আরামে পায়ে হেঁটে উঠতে পারে। বৌদ্ধমন্দিরটাও খুবই সুন্দর। মনোরম পরিবেশ। হেঁটে-হেঁটে পুরো মন্দিরের চারপাশ দেখলাম। বৌদ্ধমন্দিরের উপর থেকে এদিক-ওদিক তাকালেই চোখে পড়ে উঁচু-নিচু অসংখ্য পাহাড়। কোনও সড়ক মহাসড়ক দেখলাম না, নেইও। তবে একটা রেলস্টেশন আছে, যা দেখার মতো সুন্দর! এখানকার অধিবাসীরা দূর-দূরান্তের দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দেয় গাধার সাহায্য নিয়ে। ওইসব পাহাড়ি এলাকায় মালামাল বহন করা হয় একমাত্র গাধা দিয়েই। গাধাই ওদের মালামাল বহনের একমাত্র বাহন।

বৌদ্ধমন্দির থেকে যখন দূরে দৃষ্টি গেলো, তখন মনটা চাচ্ছিল, চলে যাই অজানার দেশে। কিন্তু যাওয়া আর হলো না। নিজের সন্তানাদির কথা ভেবে। নিজের ছেলে-মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে অনেক সময় পার করে দিলাম বৌদ্ধম মন্দিরের সামনে বসেই। একসময় দুপুরের সময় পেরিয়ে গেলো। দিদি’র বাড়ি ফিরে যাবার সময় হলো। তবুও গুমটু ছেড়ে বীর পাড়া যেতে মন চাচ্ছিল না। মন চাচ্ছিল ওখানেই থেকে যেতে।

বলে রাখা ভালো যে, ভুটান গুমটু এলাকায় আমি কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ঘোরাফেরা করেছিলাম। কিন্তু কেউ আমাকে কিছুই বলেনি, কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি। এমনকি বৌদ্ধ মন্দিরে থাকা লোকজনও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বৌদ্ধ মন্দিরে অনেকক্ষণ ঘুরা-ফেরা করার পর বৌদ্ধমন্দির থেকে পায়ে হেঁটে নিচে নামলাম। আবার গেলাম গুমটু টাউনে।

আসলে আমার চোখে ভুটানের গুমটু এলাকা টাউন নয়। কিন্তু ভুটানিদের কাছে এটা তাদের খুব পছন্দের একটা মিনি টাউন। অনেক ভুটানি গুমটুকে গুমটু টাউনও বলে। ওম সিনেমা হলের সামনে একটা হোটেল ছিলো। হোটেলটি ছিলো খুবই পরিপাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সেসময় সেই হোটেলে ভাত-মাছ-সহ চা বিস্কুটও পাওয়া যেতো।

গুমটু জনশূন্য এলাকা হলেও, রাত ৮টা পর্যন্ত ওই হোটেলটি খোলা থাকতো। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা ওই হোটেলেই বেশি সময় কাটাতো। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা চা পান করা-সহ দুপুরবেলার খাওয়া-দাওয়াও ওই হোটেই করতো। কেউ কেউ রাতের খাওয়াও সেরে নিতো। হোটেলে তিন-চারজন কর্মচারী ছিলো। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছিলাম সব কর্মচারীই ছিলো ভুটানি মেয়ে।

হোটেলের সামনে সারিবদ্ধভাবে চেয়ার-টেবিল বসানো ছিলো। আমি সামনে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে আকার-ইঙ্গিতে চা-বিস্কুটের কথা ববলেছিলাম। পাঁচ মিনিট পরই মেয়েটা একটা প্লেটে করে দুটো বিস্কুট এনে দিলো, সাথে এক গ্লাস পানি। একটু পরে চা-ও এনে দিলো। চা পান করে হাতের আঙুল ঘেঁসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত?’ বললো, ‘দো রুপেয়া ৬০ পয়সা।’

চা বিস্কুটের দাম দিয়ে চলে এলাম ভারত-ভুটান সীমান্ত গেইটের সামনে। সময় তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। সীমান্ত গেইটের বাইরে দেখলাম একটা জিপগাড়ি। ড্রাইভার হেলপার গুমটুর ভেতরেই ছিলো মনে হয়। হয়তো দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলো। ড্রাইভার হেলপার কখন আসবে, আর কখন গাড়ি ছাড়বে কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। জিপ গাড়ির সামনে-পেছনে কোনও মানুষও ছিলো না। এমনিতে জনশূন্য এলাকা। আবার দুপুরবেলা। অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরা-ফেরা করতে করতে ড্রাইভার হেলপার হেলে-দুলে গাড়ির সামনে আসলো।

সীমান্ত ঘেঁষা ভারতের ভেতরে কোনও দোকানপাট ছিলো না। ছিলো বনজঙ্গল আর চা বাগান। কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হলে দাঁড়িয়ে থেকেই অপেক্ষা করতে হবে। না হয় মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে গিয়ে সময় কাটাতে হবে। ড্রাইভার হেলপার জীপের সামনে এসে যাত্রীর খোঁজে যাচ্ছিল, মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরের দিকে। ওদের যাওয়া দেখে আমিও পেছন-পেছন হাঁটতে ছিলাম।

মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরটিও একটা পাহাড়ের চূড়ায়। খুবই সুন্দর! অনেক বড় জায়গা নিয়ে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে। কে-বা কারা এই উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় মন্দিরটি তৈরি করেছিল, তা জানা হয়নি। এ-বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞাসাও করিনি। ড্রাইভার হেলপারের পেছনে পেছনে কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে দেখে চলে এলাম জীপের সামনে। বীর পাড়ার যাত্রী নেই। সেদিন সেসময় হয়তো ওদের বীরপাড়ায় জরুরি কাজ ছিলো। তাই ওরা আমাকে নিয়েই গাড়ি ছেড়ে দিলো। চলে গেলাম বীরপাড়া। বীরপাড়া নেমে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলাম দিদির বাড়ি। এর কয়েকদিন পর আবার ভুটানের আরেকটা জায়গায় দিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম ফুলসিলিং। ফুলসিলিং জায়গাটিও দেখার মতো।

ছবি গুগল থেকে।

জীবনের গল্প-১৭

জীবনের গল্প-১৬-এর শেষাংশ: কালাম নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজার নিয়ে এলো। ঢাকার লঞ্চে না ওঠা পর্যন্ত লঞ্চ ঘাটেই ছিলো। একসময় লঞ্চ আসলে কানাই আর আমি লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে রওনা রওনা হলো। মাঝপথে ফতুল্লা লঞ্চঘাট নেমে নিজের বাসায় চলে গেলাম।

ঈদের ছুটি শেষ হতে একদিন বাকি। একদিন পরই মিল চালু হচ্ছে। হাত থাকা একদিন ছুটি কানাইকে সাথে নিয়েই ঘুরে-ফিরে শেষ করলাম। মিল চালু হলে মিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। এর প্রায় দুইমাস পর কানাই আমার কাজ ছেড়ে অন্য এক জায়গায় কাজে লেগে যায়। কারণ ওর তখন সামান্য বেতনে পোষাচ্ছি না, তাই। কানাই আমার এখান থেকে আরও বেশ কিছু টাকা বেশি বেতনে নারায়ণগঞ্জ দেওভোগে থাকা একটা মিনি গার্মেন্টসে কাজ নেয়। আমি তখন একরকম একা হয়ে পাড়ি। এরপর আমি মিলের সেক্রেটারি হাসেম মিয়ার ভাতিজাকে আমার সাথে হেলপার হিসেবে রেখে দেই। নতুন হেলপার নিয়েই কোনরকমভাবে কাজ করতে থাকি।

এর কিছুদিন পর টাকা-পয়সা নিয়ে আমার বড় দাদার সাথে আমার মনোমালিন্য হয়। সেই মনোমালিন্য থেকে জেদ করে মাকে নিয়ে বড় দাদা থেকে আমি আলাদা হয়ে যাই। কিন্তু বড় দাদার বাসা আর আমার বাসা ছিলো একই মহল্লায় পাশা-পাশি বাড়ি। তখন আমার মায়ের অবস্থাও বেশি একটা ভালো ছিলো না। বসার রান্না-বান্না করতে পারছিল না। রান্না-বান্না করে দিতো আমার এক বোন। যেই বোনকে ফেনী ফুলগাজী বিয়ে দিয়েছিলাম। সেই বোন তখন একই মহল্লায় পাশা-পাশি বাড়িতে ভাড়া থাকতো। মায়ের ওই অবস্থায় আমার বড় বোনও আমাকে বলছিল, ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করতে।

কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না। ওইভাবেই চলতে লাগলো মা ছেলের ছোট সংসার। বাসা ছিলো নারায়ণগঞ্জ নন্দীপাড়া। নন্দিপাড়া ভাড়া বাসা থেকে পায়ে হেঁটে ফতুল্লা ওয়েল টেক্সটাইল মিলে গিয়ে নিয়মিত কাজ করতে থাকি। একদিন মিলে কাজ করতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যায়! সেদিন এক তাঁত মেশিনে নতুন স্যাম্পল কাপড় তৈরির ভীম উঠানো হয়েছিল। সেই কাপড়ের পাইরে “ওয়েল টেক্স ফেব্রিকস” নাম লেখা থাকবে। ওই ভীম আমি মাস্টারের দেওয়া হিসাবমতে ড্রয়ার করে তাঁতে পাঠিয়ে দেই। তাঁতে ভীম উঠানোর পর কাপড়ের পাইরে নামের সুতাগুলো আমাকে ভরে দিতে হবে।

অবশ্য এই কাজটা কানাই থাকতে ও-ই করতো। কানাই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে ওই কাজ আমাকেই করতে হচ্ছিল। তাই তাঁতে ভীম বাঁধার পর মিস্ত্রি আমাকে নামের সুতাগুলো ভরে দিতে বললো। আমি মেশিনের সামনে গেলাম। কাপড়ের ডান পাইরের সুতাগোলে ভরছিলাম। এমন সময় দেখি ডান পাশে থাকা মেশিনের মাক্কু বা স্যাডেল আসা-যাওয়া করার সময় কেমন যেন বাউলি দিচ্ছে। আমি ওই মেশিনের তাঁতিকে মেশিনটা বন্ধ রাখতে বললাম। কিন্তু ওই মেশিনের তাঁতি আমার কথা না শুনে, আমাকে আমার কাজ করতে বলে। তারপরও আমি বললাম, ‘দেখ, মেশিনের মাক্কু কিন্তু ফ্লাইং করবে। মানে মেশিন থেকে মাক্কু বের হয়ে যাবে। আর মেশিন থেকে মাক্কু বের হলেই কারো-না-কারোর শরীরের লাগলে মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হবে।’ কিন্তু না, আমার কথা ওই তাঁতি আমলে নিলো না। তাঁতি আমার কথা না শুনে মেশিন চালুই রেখেছিল।

আমিও পাশের মেশিনের উপরে বসে কাপড়ের পাইরের নামের সুতাগুলো ভরছিলাম। হঠাৎ পাশের চালু মেশিনের মাক্কু ফ্লাই করে আমার ডান সাইটের কানে লাগে। এরপর আমি মেশিন থেকে নিচে পড়ে গেলাম। তারপর কী হয়েছিলো তা আমি একদিন পর জানতে পারলাম। “সেদিন মেশিন থেকে পড়ে যাবার পর মিলে থাকা মালিকের টেক্সি করে সাথে সাথে আমাকে ফতুল্লা বাজারে থাকা এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার ডান কানের উপরিভাগে তিনটে সিলি দিয়ে ছেড়ে দেয়। তারপর ফতুল্লা থেকে সেই গাড়ি দিয়েই আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়।” কিন্তু তখনও আমার জ্ঞান ফিরছিল না। আমার জ্ঞান ফিরেছে রাতে। জ্ঞান ফেরার পর আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মা আমি এখানে কীভাবে আসলাম?’ তখন আমার মা সবকিছু খুলে বললো। আমি শুনলাম!

দুইদিন বাসায় থাকার পর আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলাম। দুই দিনের দিন বিকালবেলা ওয়েল টেক্স মিলের মালিক ম্যানেজার-সহ শ্রমিক নেতারাও আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলো। মা সবাইকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলো। ওনারাও মাকে কোনপ্রকার চিন্তা করতে বারণ করে চলে গেলো। তারপর আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা মুহূর্তেই চলে গেলো কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে। তখন কালাম-সহ আরও কয়েকজন আমার বাসায় এসে শান্তনা দিয়ে গেলো। কানাইও এসেছিল। এই খবর পৌঁছে গেলো সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি কালামদের বাড়িতে। তখন কালামের মা ভাই-ভাবী-সহ ঠাকুরবাড়ির সবাই আমার জন্য নাকি খুব দুঃখ করলো। জানলাম কালামের কাছ থেকে। এরপর তিনদিন বাসায় থাকার পর একসময় মিলে গিয়ে অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজ করতে লাগলাম, তাঁতিদের কথা মাথায় রেখে। কারণ, ওয়েল টেক্স মিলে যেসব ডিজাইন কাপড় তৈরি হতো, সেসব কাপড়ের দক্ষ ড্রয়ার ম্যান তখন আশে-পাশে খুবই কম ছিলো।

তাই অন্যকোনো ড্রয়ার ম্যান দিয়ে সেসব ডিজাইন ভীমের ড্রয়ার তঁতিরা করাতে চাইতো না। মেশিন খালিই পড়ে থাকতো। আর মেশিন খালি থাকলে তাঁতিদের সপ্তাহিক বেতন কম হতো, মিলের প্রোডাকশনও কম হতো। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই পুরোপুরিভাবে সুস্থ না হয়েও আমি মিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করি। এতে মিলের মালিক ম্যানেজার হতে শুরু করে সবাই খুশি হয়ে গেলো। এর বিনিময়ে তাঁতিদের সাপ্তাহিক বেতনের দিন ম্যানেজার সব তাঁতিদের বেতনের পর আমাকে ডেকে নিয়ে বেশকিছু টাকা বকসিসও দিয়ে ছিলো। সাথে চিকিৎসা-সহ যাবতীয় খরচও মিল মালিক বহন করতে লাগলো।

একসময় আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেও, আমার ডান কানে কিছুই শুনতে পেতাম না। তারপর কানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও দেখানো হলো। ডাক্তার কানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলো যে, আমার ডান কানের মনিরগ নিস্তেজ হয়ে গেছে। শতরকম চেষ্টা করলেও তা আর ঠিক হবে না বলে ডাক্তার জানিয়ে দেয়। ডাক্তারের শেষ চেষ্টার পর মিল মালিক নিয়াজ সাহেব বলেছিল, ‘আমি সময় সুযোগ করে নিতাই’কে পাকিস্তান নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবো। এখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে থাকুক।’ এরপর থেকে মালিকের কথামতো নিয়মিত মিলে কাজ করতে থাকি।

একদিন মিলে কাজ করতেছিলাম। কিছুক্ষণ পরই দুপুরের খাবারের সময় মিল একঘন্টা বন্ধ থাকবে। এর কিছুক্ষণ আগে ফতুল্লা পোস্ট-অফিস থেকে ডাকপিয়ন মিলের গেইটে এসে আমাকে তালাশ করে। আমি তখন মিলের ভেতরে কাজ করছিলাম। মিলের দারোয়ান জিন্নাহ ভাই ডাকপিয়নকে মিলের গেইটের বাইরে রেখে আমাকে ডেকে আনে। আমি ডাকপিওনের সামনে আসলে আমার হতে একটা চিঠির খাম ধরিয়ে দিয়ে একটা রেজিষ্টার খাতায় সই নিয়ে চলে যায়। চিঠির খামের উপরে আমার নাম লেখা। প্রেরকের নাম ছিলো অর্চনা রানী সরকার। গ্রাম নয়াবাড়ি। তা দেখে আমি কিছুক্ষণ বিচলিত ছিলাম। সাথে সাথে চিঠির খামটা খুললাম না। চিঠি হাতে নিয়েই মিলের বাইরে চায়ের দোকানে গেলাম। চা-সিগারেটেই টানলাম। তারপর মিলে আসলাম। দারোয়ান জিন্নাহ ভাই, বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, ‘কার চিঠি, কে দিয়েছে, কী খবর!’ আমি কিছু না বলেই সোজা আমার কাজের জায়গায় চলে গোলাম। তারপর আমি খাম ছিড়ে চিঠিটা খুললাম।

চিঠির খাম থেকে চিঠি বের করে পড়লাম। আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবরে তাদের বাড়ির সবাই চিন্তিত। আমার সুস্বাস্থ্য কামনা-সহ আরও বিস্তারিত লেখা পড়লাম। চিঠির নিচে লেখা ছিলো, ‘আপনার ঠিকানা কালাম ভাইয়ের বড় ভাবী থেকে সংগ্রহ করা।’ কালামের বড় ভাবীকে যে ঠিকানা লিখে দিয়েছিলাম, তা ঠিক। আমি কালামদের বাড়িতে যখন বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন আসার দিন সকালবেলা কালামের বড় ভাবীকে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়ে বলেছিলাম, ‘ভাবী, মেয়েটি যদি আমাকে পছন্দ করে থাকে, তাহলে এই ঠিকানায় চিঠি দিয়ে জানাতে বলবেন।’ তাই হয়তো আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়ে কালামের ভাবীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে, স্কুলের সাথে থাকা পোস্ট-অফিস থেকে রেজিস্ট্রিকৃত চিঠি পোস্ট করে। চিটি পড়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেলো! মন চাচ্ছিল মিলের কাজ ফেলে রেখে পরদিনই নয়াবাড়ি গ্রামে চলে যাই। কিন্তু না, তা আর করিনি।

পরদিন বিকালবেলা কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কালামের সাথে দেখা করলাম। চিঠির কথা জানালাম। কালাম খুশি হয়ে আমাকে বললো, ‘আর কদিন পর দুর্গাপূজা শুরু হলে, পূজা উপলক্ষে কানাইকে সাথে নিয়ে ওদের বাড়িতে যেতে।’ কালামের কথামতো আমি একদিন কাইনার কাছে গেলাম। কানাইকে বললাম, ‘পূজার বন্ধ পেলে আমার সাথে নয়াবাড়ি যেতে।’ পূজা উপলক্ষে কাজের খুব চাপ থাকায় কানাই আমার সাথে যেতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। তাই আর কানাইর আশায় থাকলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, কালামও যদি সাথে না যায়, তাহলে পূজার ছুটি পেলে আমি একাই নয়াবাড়ি চলে যাবো। একসময় দুর্গাপূজা আরম্ভ হলো। মিল থেকে দুইদিনের ছুটি পেলাম। কালামকে আমার সাথে যেতে বললাম। কালামও যেতে পারবে না জানালে, আমি একাই চলে গোলাম সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামে।

নয়াবাড়ি গ্রামে গিয়ে সরাসরি ঠাকুরবাড়িতেই উঠলাম। সাথে দুইভাগে কিছু মিষ্টি, পান-সুপারিও নিলাম। একভাগ কালামদের বাড়ির জন্য, আর একভাগ ঠাকুরবাড়ির জন্য। ঠাকুরবাড়িতে একভাগ মিষ্টি পান-সুপারি রেখে আরেক ভাগ মিষ্টি পান-সুপারি কালামদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে, আমি জামাইর মতো বিছানা শরীর লেলিয়ে দিলাম। সেসময় ঠাকুরবাড়ির নারায়ণ সরকারের যেই মেয়েকে কুমিল্লা বিয়ে দিয়েছিল, সেই ময়েও বাড়িতে ছিলো। আমি সরাসরি ঠাকুরবাড়িতে ওঠার পর বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো। না পারে থাকতে বলতে, না পারে আমাকে তাড়িয়ে দিতে। তখন ঠাকুরবাড়ির সবাইর এমনই থমথমে অবস্থা ছিলো। কিন্তু না, সেদিন তেমন কোন খারাপ পরিস্থিতিতে আমার পড়তে হয়নি। খুব সুন্দরভাবে আমি একাই নয়াবাড়ি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে জামাই-আদরে দুইদিন থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

পাগলা কুকুর থেকে সাবধান!

এখনকার সময়টা কুকুরের প্রজনন সময়,
তাই কুকুরগুলো ছোটাছুটি করে সবসময়।
মানুষের মাঝেও কিছু সংখ্যক কুকুর আছে,
এসব কুকুরগুলো থাকে মা-বোনদের আগে-পাছে!
সাবধান! মানুষবেশী কুকুর থেকে হও সাবধান!
যদি একবার কামড়ে দেয় মিলবে না সমাধান!
কারণ এসব কুকুরগুলো বড়ভাইদের লালিত,
এরা বড় বড় নেতা-খেতাদের আদরে পালিত।
এরা হিংস্র হায়েনা, কারো-না-কারোর পোষা,
এরা কুকুরছানা, তাই কুকুরের মতো এদের নেশা।
মা-বোনেরা পাগলা কুকুর হতে সাবধান হও!
পাগলা কুকুর নিধনের জন্য রাষ্ট্রের কাছে কও!

আমার দুঃস্বপ্ন

একদিন রাতে পেটে খুব ক্ষুধা নিয়ে,
চুপচাপ শুয়ে রইলাম পেট মাটিতে দিয়ে।
আমি সেদিন মুহুর্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম,
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম!
দেখলাম পেটের ক্ষুধা সইতে না পেরে,
আমি যেন ঠিক ঠিক যাচ্ছিলাম মরে!
ওমনি এক দরবেশ এসে বললো আমায়,
‘তুই কি খুব কষ্টে আছিস ক্ষুধার জ্বালায়?’

বললাম, ‘হ্যাঁ, ক্ষুধায় আমার জীবন যায়,
একবার বলুন খাবার আমি পাবো কোথায়?’
দরবেশ বললো, ‘চলে যাও পাহাড় পর্বতে,
কেউ আসবে না তোমায় সাহায্য করতে।’
দরবেশের কথায় চলে গেলাম পাহাড়ে,
গিয়ে দেখি সেখানেও মরছে অনাহারে!
বুঝলাম পাহাড়ের মানুষেরও শান্তি নেই,
এখানেও মানুষের প্রতি মানুষের মায়া নেই!

উঠলাম গিয়ে এক উঁচু পাহাড়ের উপরে,
হঠাৎ কে যেন আমায় ফেলে দেয় সাগরে।
সাগরে পড়ে খেলাম কত-না হাবুডুবু,
হয়ে গেলাম শারীরিকভাবে খুবই কাবু!
আমাকে উদ্ধার করে একজন জেলে,
জেলে আর আমাকে দিলো না ফেলে!
আমায় তুলে আনলো তার নিজের ঘরে,
তা দেখে প্রতিবেশীরা হিংসায় মরে!

থাকলাম না আর অসহায় জেলের ওখানে,
আবার চলে গেলাম এক গহীন নির্জন বনে।
দেখি পশুপাখিরা মরছে ক্ষুধার জ্বালায়,
হায় হায় হায় এখন আমি কি করি উপায়!
ঘুরি একা একা অসহায় হয়ে আপন মনে,
হঠাৎ দেখা হলো ক্ষুধার্ত সিংহের সনে!
আমি অসহায় বললাম ঐ সিংহের কানে।
সিংহ কি বুজে আর কি শুনে, কে জানে!

ক্ষুধার্ত হিংহটা চলে গেলো গহীন বনে।
পশুর রাজা সিংহ আমায় আর খেলো না,
হিংস্র পশু আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো না।
আবার হঠাৎ দেখা হয় সেই দরবেশের সাথে,
জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কিছুই পারিসনি খেতে?’
বললামা না বাবা না কিছুই খেতে পারিনি,
দরবেশ বললো চলে যাও লোকালয়ে এক্ষুনি!
দরবেশ বাবার কথায় আবার শুরু করি হাঁটা,

বনের পথ, খালি পা, বিঁধে কতো কাঁটা।
তবুও থামলাম না বনের হিংস্র পশুর ভয়ে,
একসময় বন ছেড়ে চলে এলাম লোকালয়ে।
এসে দেখি হায়, মানুষ মানুষের রক্ত খায়,
আমি আরও হয়ে গেলাম অসহায় নিরুপায়!
একি সবখানে দেখি ভয়ানক কী সব কাণ্ড,
দুর্নীতিতে পুরো রাজ্য হয়ে যাচ্ছে লণ্ডভণ্ড!
যাদের হাতে থাকে রাষ্ট্রীয় যতো ক্ষমতা,

তাদের ভেতরে থাকে না বিন্দুমাত্র মমতা!
যারা হবে এদেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ,
তারাই অনুসরণ করে চলছে মরণের পথ!
যেখানে পাবার কথা নারীজাতি মায়ের সম্মান,
সেখানে হচ্ছে অগ্রগতি মা-বোনেরা অসম্মান।
দেখি কিছু মায়ের জাতি নারীরাও বেপরোয়া,
নিজের স্বামীকে ঘুমে রেখে করে পরকীয়া!
শুনেছি আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নাকি যুবকরা,
দেখছি তাদেরও আজ ধর্ষণ মামলায় হাতকড়া।

যেখানে হবার কথা অপরাধী ধর্ষকের ফাঁসি,
সেখানে উকিল মশাই বাজায় মোহন বাঁশি।
এসব দেখে ভাবি এ আবার কেমন অবিচার?
মিথ্যাবাদী করেই যাচ্ছে সত্যবাদীকে অত্যাচার।
আরও দেখলাম করোনাকালে কতো নেতা,
জনগণের ভোটে জিতে ভাবে শুধু নিজের কথা।
গরিব বাঁচতে রিলিফ দেয় বর্তমান সরকার,
সেই রিলিফ দুর্নীতিবাজ নেতাদেরই দরকার।

অসহায় গরিবরা পায় না রিলিফের সেসব চাল,
গরিবদের কপালে জোটে আঘাত গালা-গাল!
রিলিফের চাল পাওয়া যায় অসাধু নেতার ঘরে,
পাওয়া যায় গর্তে, নেতার পানি ভরা পুকুরে।
খাটের নিচে পাওয়া যায় রিলিফের যতো তেল,
ধরা খেয়ে কতো দুর্নীতিবাজ নেতা খাটলেন জেল।
দেখে মনে হলো ওদের লজ্জা শরম বলতে নেই,
আবার কেউ কেউ বলে ওদের জন্মেরই ঠিক নেই।

ওরা মনে হয় মানুষ নয়, মানুষ বেশী অমানুষ!
ওদের এই জীবনে আর হচ্ছে না কোনও হুঁশ?
ওরা ঠিক হিংস্র জানোয়ার, রাক্ষস রক্তচোষা!
গরিবের রক্ত চুষে খাওয়াই ওদের নেশা পেশা।
একসময় আমার সামনে আসলো সেই দরবেশ,
দরবেশ বললো, ‘এইতো স্বাধীন সোনার দেশ!’
আমি দরবেশ বাবার কথা শুনে ভাবি মনে মনে!
তাহলে কি আবার আমি চলে যাবো বনে?

দেখেছি বনের পশুদেরও আছে মায়া মমতা,
কিন্তু মানুষের মাঝে নেই কোনও মানবতা!

জীবনের গল্প-১৬

জীবনের গল্প-১৫-এর শেষাংশ: সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখাচ্ছিল।

সেসময় কালাম সত্যিই ব্যস্ত ছিলো, টেনশনও ছিলো। কালামের ব্যস্ততা আমাদের জন্যই। কারণ আমরা ওঁদের বাড়িতে উঠেছি অনেকক্ষণ হলো, অথচ এখনো আমাদের ভাত খাওয়া হচ্ছে না, তাই ওঁর যত ব্যস্ততা। তাই ও বাজার থেকে বাড়ি এসে ওঁর মা ভাবীর সাথেও কথা কাটা-কাটি করে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলছে। আমরা ওর সাথে বাড়ি গেলাম। ওকে নিয়েই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ কালামদের ঘরে বসেই দেরি করলাম। এরপর কালামকে সাথে নিয়েই ঘর থেকে বের হলাম, নিকটস্থ কোনও বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। তখন একেবারে সন্ধ্যা হয়ে চারদিক ঘুট-ঘুটে অন্ধকার। ঘর থেকে বের হয়েই কালামকে জিজ্ঞেস বললাম, ‘সামনা-সামনি কোনও হাট-বাজার আছে কিনা?’ কালাম বললো, ‘আছে ওস্তাদ! কেন, বাজারে যাবেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমাদের বাজারে নিয়ে চলো।’ যেই কথা, সেই কাজ। নৌকা চড়ে তিনজন চলে গেলাম, একটা গ্রামের পরই গ্রাম্য বাজারে। বাজার থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আসার সময় আমার প্রয়োজন মতো সিগারেটও নিয়ে নিলাম।

ওদের বাড়ি এসে সোজা পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। তখন ঠাকুরবাড়ির নারায়ণ সরকারও ঘাটে বসা ছিলো। আমাদের দেখে কালামকে বললো, ‘তোর ওস্তাদকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যা। বাড়িটা দেখা।’ এরপর কালাম আমার হাত ধরে টানা-টানি শুরু করলো, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যাওয়া জন্য। কালামের টানা-টানিতে আর থাকতে পারলাম না, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যেতেই হলো। ঠাকুরবাড়ির ভেতরে অনেক বড় উঠান। উঠানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই, আমাদের বসার জন্য একটা ছোটো ছেলে দুইটা পিড়ি একটা হাতল ভাঙা চেয়ার সামনে এনে দিলো। কালাম আমাকে হাতল ভাঙা চেয়ারে বসতে বলে, ওরা দুইজন বসলো, পিড়িতে। আমি চেয়ারেই বসলাম। একটু পরই বড় এক কাঁসার বাটিতে করে কিছু পাকনা পেয়ারা আমাদের সামনে এনে দিলো। আমরা তিনজনই পেয়ারা খাচ্ছিলাম।

ঘাট থেকে বাড়ির মুরুব্বি আমাদের সামনে এসে আরেকটা পিড়িতে বসলো। আমাকে খেটে-খুটে অনেককিছুই জিজ্ঞেস করলো, আমি উনার কথার জবাব দিলাম। তারপর উনি আগামীকাল কালাম-সহ আমাদের তিনজকে ঠাকুরবাড়িতে দুপুরে খাবারের নেমন্তন্ন করলো। আমি না করে বললাম, ‘আগামীকাল সকালেই আমরা এখান থেকে বালি গাঁও চলে যাবো। বালিগাঁ থেকে সন্ধ্যার আগেই আবার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হবো।’ কালাম আমার কথা শুনে বালি গাঁও যেতে বারণ করে বললো, বালি গাঁও যাওয়ার দরকার নেই, ‘ওস্তাদ। আগামীকাল আমাদের বাড়িতে থাকবেন।’ কালামের কথা শুনে কানাইও কেমন যেন আমতা-আমতা করতে লাগলো, কিন্তু কিছু বলছিল না। বুঝলাম, কানাইও বালি গাঁও না গিয়ে এখানেই থাকতে চাচ্ছে। তারপর আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, থাকি-না-যাই তা সকালে দেখা যাবে, এখন চলো পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি।’ পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসে কালামদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনজন একইসাথে ঘুমালাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই কানাইকে বলছি, ‘তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে।’ কানাই আমতা-আমতা করতে লাগলো। ওর ভাব দেখে বুঝতে পারলাম, ও আজকে এখানে বেড়াতে চাচ্ছে। কালামের মা আমার সামনে এসে বললো, ‘আজকের দিনটা এখানে থেকে যাও। কালকে আর জোর করবো না।’ কালামের ভাই ভাবীও বলতে লাগলো। কানাইও বললো ‘আজকে এখানে থাকি। কালকে চলে যাবো। বন্ধ তো হাতে আরও একদিন থাকবেই। আজকে থাকলে আর সমস্যা হবে না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে, থাকলাম। আমার কথা শুনে কালামের মা ভাই ভাবী সবাই খুশি হলো। আমি আর কানাই মুখ ধুতে পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। আমাদের সাথে-সাথে কালামও ঘাটে আসলো। আমরা একটা আমগাছের ঢালা ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। কালাম ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে নারায়ন সরকারকে বললো, ‘ওস্তাদ আজকে এখানে থাকবে।’ ওমনি ঠাকুরবাড়ি থেকে দুইটা মেয়ে হাসতে হাসতে কয়েকটা থালাবাসন হাতে নিয়ে পুকুর ঘাটে আসলো। আমি আর কানাই বসে বসে দাঁত মাজতে ছিলাম।

মেয়ে দুইটা দেখে বুঝা যাচ্ছিল না যে, কোনটা বড় আর কোনটা ছোট। দু’জনকে একই বয়সের মনে হলো। আসলে ওরা ছোট-বড় দুই বোন। কিছুক্ষণ পর কালাম ঘাটে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ মুখ ধুয়েছেন?’ বললাম, না, এখনও ধোয়া হয়নি।, মেয়ে দুইটা তখনও পুকুর ঘটে থালাবাসন ধুইতে ছিলো। কালাম ওদের বললো, ‘তোরা ওস্তাদকে সাইট দেয়, মুখ ধোবে।’ আমি কালামকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘ওদের কাজ ওরা করুক। আমরা পরেই ধুই।’ কালাম আমাকে বললো, ‘ওস্তাদ, ওরা দুই বোন। এইযে, ওর নাম জোসনা, ওর নাম আর্চনা। জোসনা বড়, আর অর্চনা ছোট।’ নাম জানা হলো। দেখাও হলো। কিন্তু এখনো কথা হয়নি।

মেয়ে দুইটা ওদের কাজ সেরে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে গেলো। আমারা ঘাটে নেমে হাতমুখ ধুয়ে অস্তেধীরে কলামদের বাড়ি গেলাম। নাস্তা করলাম। এমন সময় কালাম এসে ওর মাকে বললো, ‘মা ওস্তাদ দুপুরে ঠাকুরবাড়ি খাবে। আমারও ওস্তাদের সাথে যেতে হবে।’ আমি থমকে গেলাম! জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুরবাড়িতে খাবো কেন?’ কালাম, হাসতে-হাসতে বললো, ‘ওস্তাদ নারায়ন সরকার খুব অনুরোধ করছে। তাই আমি বললাম।’ কালামের কথা শেষ হতে-না-হতেই কালামের মা বললো, ‘হ্যাঁ বাবা, আজ খুব ভোরবেলা নারায়ন সরকার আমাদের বাড়ি এসে আপনাকেও অনুরোধ করেছে, যাতে দুপুরবেলা তোমরা ঠাকুরবাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করো। অমত করো না বাবা। বুড়ো মানুষ বলেছে যখন, আজকে দুপুরবেলা ঠাকুরবাড়িতেই খেও।’ কালামের মায়ের কথা শুনে আমি চুপ করে ঘর থেকে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানছি আর চিন্তাও করছি! খালি হাতে নেমন্তন্ন খেতে যাবো না!

কালামকে ডাকলাম। কালাম সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ কিছু বলবেন?’ বললাম, নৌকা রেডি আছে? কালাম বললো, ‘হ্যাঁ ওস্তাদ, নৌকা ঘটলায় বাঁধা আছে। কোথাও যাবেন?’ বললাম, বাজারে যেতে হবে। কালাম বললো, ‘ঠিক আছে যাবো। আগে নাস্তা খেয়ে নিন, তারপর।’ তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে কানাই সহ নৌকা চড়ে সুবছনী বাজারে গেলাম। বাজারে গিয়ে তিনজনে চা-বিস্কুট খেলাম। তারপর মিষ্টি দোকান থেকে দুই কেজি মিষ্টি কিনলাম। সাথে পান সূপারিও কিনলাম। কালাম রাগ হয়ে বললো, ‘এতকিছুর দরকার কী ওস্তাদ?’ বললাম, ‘দরকার আছে কালাম। নেমন্তন্ন খালি হাতে মানায় না। তাছাড়া তোমাদেরও তো মানসম্মান আছে। আমিতো তোমাদের অতিথি।’ কালাম আর কিছু বললো না, চুপ করে থাকলো।

সুবচনী বাজার থেকে কালামদের বাড়ি যেতে যেতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। কানাই মিষ্টির প্যাকেট-সহ পান সুপারি নিয়ে কালামের মায়ের হাতে দিলো। মিষ্টি দেখেই কালামের মা বুঝতে পেরেছে, মিষ্টি কেন অনা হলো! কালাম তাড়াহুড়ো করতে লাগলো, স্নান করার জন্য। গামছা সাবান নিয়ে কালাম-সহ ঠাকুরবাড়ির ঘাটে গেলাম, স্নান করার জন্য। স্নান করতে যাওয়ার সময়ই কালাম আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ, আপনার কাছে কোন মেয়েটা ভালো লাগে?’ আমি একরকম রাগ-রাগ ভাব নিয়েই বললাম, ‘আরে তোমাদের মাথা কি সত্যি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? আমি কি বিয়ে করতে এসেছি? নাকি মেয়ে দেখতে এসেছি!’ কালাম মুখটা কালো করে ফেললো। তা দেখে আমি নিজেই লজ্জায় পরে গেলাম! তারপর কালামের মনটা ভোলো করার জন্য কালামকে বললাম, ‘আচ্ছা, তোমার কাছে কোনটা ভালো লাগে?’ কালাম বললো, ‘ওস্তাদ, মেয় দুইটাই তো দেখার মতো।এখন কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি?’ কালাম আবার কানাইকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কানাই ভাই, আপনার কাছে কোন মেয়েটা ভালো লাগে?’ কানাই বললো, আমার কাছে দুইটাই ভালো লাগে।’ আমি কালামকে বললাম, ‘আমার কাছে ছোটটা ভালো লাগে।’ আমার কথা শুনে কানাই আর কালাম দুইজনেই হাসলো।

পুকুর ঘাটে গেলাম। স্নান করে কালামদের বাড়ি গেলাম। জামা-প্যান্ট পরে রেডি হলাম, ঠাকুরবাড়ি যাবার জন্য। মিষ্টি পান সুপারি কালাম হাতে নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে। আমরা ওর পেছনে-পেছনে হাঁটছি। ঠাকুরবাড়ি গেলাম। কালাম মিস্টির প্যাকেট নিয়ে বড় ঘরের ভেতরে গেলো। মিষ্টি পান সুপারি দেখা আমাদের সমাদর আরও দুইগুণ বৃদ্ধি পেলো। আমরা উঠানে দাঁড়াতেই ঐ হাতল ভাঙা একটা ছেয়ার আর একটা পিড়ি এনে দিলো। কালাম ঘরে গিয়ে মিস্টির প্যাকেট আর পান-সুপারির পোটলা কারোর হাতে দিয়ে আমাদের সামনে উঠানে আসলো। বসার জন্য আরেকটা পিড়িও সাথে নিয়ে আসলো। তিনজনে বসে কথা বলতে বলতেই বড় ঘরে ডাক পড়লো। বড় ঘরে গিয়ে খাটের পর বসলাম। আমাদের সামনে তিনটা প্লেটে সাজানো কিছু মিষ্টি চলে আসলো। কালাম খেলো কানাইও খেলো। কিন্তু আমি খাইনি। কারণ মিষ্টি খেলে আর ভাত খেতে পারবো না, তাই।

কিছুক্ষন পরই ভাত খেতে দিলো। আমরা তিনজন একসাথে বসে ভাত খেলাম। ভাত খেতে বসে কালামের মনের ভাব দেখে বুঝলাম, কালাম মনে হয় মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢোকার পর আমার পছন্দের ব্যাপারটা ওদের কারো কাছে বলেছিল। এইজন্যেই মনে হয়,আমাদের খাওয়া-দাওয়ার সামনে ছোট মেয়েটা বেশি আসেনি। আমাদের খাওয়া-দাওয়া পরিবেশন করেছিল অবিবাহিত থাকা দুই বোনের মধ্যে বড় মেয়েই। খাওয়া-দাওয়া শেষে ঠাকুরবাড়ি থেকে বের হয়ে সামনে থাকা পুকুর ঘাটে গেলাম। পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ বসে গল্প করছে। সাথে কালামের বড় ভাই সালামও আছে। তাঁদের কথাবার্তার ভাবে বুঝলাম, তাঁরা আমাদের নিয়েই আলাপ আলোচনা করছিলো।

সিঁড়ি ঘাটলার উপরে গিয়ে সালাম ভাইয়ের সাথে বসলাম। সালাম ভাই জিজ্ঞেস করলো, কী দিয়ে খাওয়া হলো?’ জবাবে যা যা খেলাম আর যেসব আয়োজন করেছিলো, সবই বললাম। পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসার পরই ঠাকুরবাড়ি থেকে ছোট একটা ছেলে অনেকগুলো পান সুপারি নিয়ে আসলো। সবাই পান খেলো, আমি কানাই আর কালাম পান খেলাম না। কিছুক্ষণ পর সালাম ভাই-সহ আমরা কালামদের বাড়ি চলে গেলাম। কালামের মা জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন খেলে বাবা?’ বললাম, ‘ভালোই খেয়েছি খালা।’ বললো, ‘গরিব হলেও আত্মা আছে লোকটার! তো মেয়ের হতে কিছু দিয়ে এসেছ নাকি?’ আমি আর কিছু বললাম না, কানাই বললো, ‘আমরা কি মেয়ে দেখতে গেছি নাকি, খালা? আমরা নেমন্তন্ন খেতে গেছি।’ কালামের মা আর কিছু বলেনি, ঘরে গিয়ে বসতে বললো। আমি আর কানাই শোবার ঘরে গিয়ে বসতেই কালামের মা একটা পানের ঢালা হতে নিয়ে আমাদের সামনে এসে বসলো। আমাদের পান খেতে বললে, আমরা না করলাম। কালামের আমাদের বিশ্রাম করতে বলে ঘর থেকে চলে গেলো। তখন শেষ বিকালের শেষ সময়। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। তাই বিশ্রাম আর করলাম না, কালামকে সাথে নিয়ে নৌকা চড়ে ঐ গ্রাম্য বাজারেই গেলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যার পর কালামদের বাড়িতে আসলাম।

কালামদের বাড়িতে এসে জামা-প্যান্ট চেঞ্জ করে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। সেদিন পুরো নয়াবাড়ি গ্রাম জানা-জানি হয়ে গিয়েছিল, নারায়ণ সরকারে মেয়েকে দেখতে এসেছে। তাই সেদিন পুকুর ঘাটে অন্যদিনের চেয়ে বেশি মানুষ লক্ষ্য করলাম। অনেক মানুষের সাথে কথা বললাম। অনেককেই সিগারেট দিলাম। কালামও পুকুর ঘাটে বসে বসে উপস্থিত থাকা সকলকে আমার কাজের গল্প শোনালো। অনেকক্ষণ পুকুর ঘাটে আড্ডা দিয়ে কালামদের বাড়ি এসে গেখি কালামে ভাবী আমাদের জন্য খাবার রেডি করে বসে আছে। আমি খাব-না-খাব না বলার পরও সবার সাথে খেতেই হলো। নামমাত্র দুমুঠো খেয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে সিগারেট টেনে ঘরে আসলাম। শোবার ঘরে বসে ঘুমিয়ে থাকার ভাব করছিলাম। এমন সময় কালামের মা আমাদের সামনে এসে বসলো। হাতে পানের ঢালা। আমাদের পান খেতে বললে, আমার না করলাম।

কালাম মা উনার নিজের জন্যই একটা পান বানিয়ে মুখে দিয়ে নিজে নিজেই বললো, ‘ঠাকুরবাড়ির অনেক কাহিনী আছে বাবা।’ শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে বললাম, কেমন কাহিনী, খালা? বললো, “নরায়ন সরকার যেই বাড়িতে থাকে, এটা কিন্তু তার নিজের বাড়ি না। এই বাড়িটা সত্যগুরু নামে এক ঠাকুরের বাড়ি। আর নারায়ণ সরকার হলো, সত্যগুরুর শিষ্য। নারায়ণ সরকারের বাড়ি ছিলো পদ্মার পড়। একসময় নারায়ণ সরকারের বসতভিটা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলে, নারায়ণ সরকার এই সত্যগুরুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সত্যগুরু ঠাকুর জীবিত থাকতে ওই বাড়িতে কোনও চোর চুরি করতে পারেনি। চুরি করতে আসলেই সারারাত আটকা পড়ে থাকতে, যেতে পারতো না। সকালবেলা সত্যগুরু ঘুম থেকে ওঠে চোরকে শাসিয়ে ছাড়ত।’

‘আর পুকুরের ছিল এক অলৌকিক কাণ্ড! কারোর বিয়েসাদী হলে পুকুরপাড়ে এসে থালা-বাসনের কথা বললেই হতো। পরদিন ভোরবেলায় পুকুর ঘাটে থালাবাসন ওঠে থাকত। বিয়ে বা অন্যকোন ধর্মীয় কাজ ছিল মুখ্য বিষয়, এ ছাড়া অন্য কাজের জন্য নয়। কাজ শেষে থালা- বাসনগুলো ভালো করে ধুইয়ে আবার পানিতে ছড়ে দিতো। একদিন ঘটলো এক অন্যরকম ঘটনা। বিয়ের কাজ শেষে পুকুরের থালা-বাসন থেকে একটা কাঁসার থালা কেউ-না-কেউ রেখে দিয়ে, বাদবাকি থালাবাসন যখন পুকুরে দিচ্ছিল; তখন থালা- বাসনগুলো পানিতে ডুবছিলো না। তিনদিন যাবত থালা- বাসনগুলো ওইভাবেই পুকুরে ভাসমান অবস্থায় ছিল। তিনদিন পর থালা- বাসনগুলো পানিতে ডুবেছে ঠিক, কিন্তু কেউ আর কখনো কিছু চেয়ে পায়নি।’ এসব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল সত্যগুরু জীবিত থাকতে।’

‘একসময় সত্যগুরু মারা যায়। সত্যগুরু মারা যাবার পর সত্যগুরুর ফ্যামিলি বেশ কয়েকবছর এই বাড়িতে ছিলো।হিন্দু-মুসলিম রায়টের পর একসময় সত্যগুরুর ফ্যামিলি নারায়ণ সরকারকে এই বাড়ির দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ভারতে চলে যায়। সেই থেকেই নারায়ণ সরকার এই বাড়ি নিজের বাড়ির মতো করে থাকছে।” কালামের মা আমাদের ঠাকুরবাড়ির গল্প শুনিয়ে শুয়ে থাকতে বললে, আমরা আগের রাতের মতো তিনজন একসাথে শুয়ে থাকি। পরদিন সকালবেলা

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়েটা কালামের বড় ভাবীর সাথে বসে বসে গল্প করছে। আমাকে দেখেই চলে যাওয়া প্রস্তুতি নিতেই, কালামের বড় ভাবী ধমক দিয়ে বসতে বললো। মেয়েটিও চুপচাপ বসে থাকলো। কানাই আমার আগেই ঘুম থেকে উঠে আম পাতা মুড়িয়ে কালামদের উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিল। আমাকে দেখেই কানাই মেয়েটির দিকে আমাকে ইশারা দিয়ে দেখালো। আমিও কানাইকে হাতে ইশারা দিয়ে কাছে ডাকলাম। কানাই আমার সামনে আসলে, আমি মেয়েটির সাথে কথা বলার জন্য কানাইকে বললাম। কানাই মেয়েটিকে কিছু না বলে আমাকেই মেয়েটির সাথে কথা বলতে বললো। আমি কানাই উপর রাগ না করে মেয়েটির সামনে গিয়ে ভাবীকে বললাম, ‘ভাবী, আমাদের জন্য কোনকিছুর আয়োজন করবেন না। কিছুক্ষণ পর তো চলেই যাচ্ছি।’ কালামের বড় ভাবী বললো, ‘সকালের নাস্তা রেডি করছি ভাই। নাস্তা না খেয়ে তো আর যেতে পারবেন না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে ভাবী, নাস্তা খেয়েই রওনা দিবো। তো আপনার সামনে মেয়েটি কে?’ ভাবী বললো, ‘ও-তো ঠাকুরবাড়ির সরকারের ছোট মেয়ে।’ আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নাম কি?’ মেয়েটি ওর নাম না বলে আমতা-আমতা করতে লাগলো। ভাবী ধমক দিয়ে বললো, ‘তোর নাম জিজ্ঞেস করছে, তুই তোর নাম বলছিস না কেন? নাম বলতে কি টাকা-পয়সার দরকার হয়?’ ভাবীর ধমক শুনে মিয়েটি নিজের নাম বললো। কয় ভাই-বোন বললো। লেখাপড়া কতটুকু বললো। কোন স্কুলে পড়ছে তা-ও বললো। কানাই আমার সামনেই দাঁড়িয়ে শুনছিলো। তারপর বললাম, তুমি এখন বাড়ি যাও, আবার দেখা হবে, কথাও হবে।

মেয়েটি মাথা নিচু করে বাড়িতে চলে গেলো। আমারা হাতমুখ ধুয়ে নামমাত্র কিছু খেয়ে কালামদের বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। নৌকায় উঠার আগে ঠাকুরবাড়ি গেলাম। ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে বাড়িতে থাকা সবার কাছে বলেকয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। কালাম নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজার নিয়ে এলো। ঢাকার লঞ্চে না ওঠা পর্যন্ত লঞ্চ ঘাটেই ছিলো। একসময় লঞ্চ আসলে কানাই আর আমি লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে রওনা রওনা হলো। মাঝপথে ফতুল্লা লঞ্চঘাট নেমে নিজের বাসায় চলে গেলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৭ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

দুঃখ আমার

আমি মাটির কাছে চেয়েছিলাম, এক চিমটি ভিটেমাটি,
মাটি আমাকে দিলো তাড়া, হাতে নিয়ে এক লাঠি!
পাইনি মাটি, তবুও দেহে মাখি এই জন্মভূমির মাটি,
এখন আমি বাস্তহারা, তাই দিন-রাত করি খাটা-খাটি!

সূর্যের কাছে চেয়েছিলাম, একটুখানি তেজস্ক্রিয় আলো,
আমার চাওয়াতে সূর্যটা হলো রাগ, মুখটা করলো কালো!
তাই হয়ে গেলাম জনমদুখী, ভাগ্যটা আর হয়নি ভালো!
হয়ে রইলাম অধম, ভাবছি এটা কি একটা জীবন হলো?

ফুলের কাছে ফুল চেয়েছিলাম, পেলাম কাঁটার আঘাত,
সেই আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হলো মন, করিনি প্রতিঘাত!
কাউকে পারিনি দিতে ফুল, সবাই করলো কুপোকাত,
সমাজে আমি হলাম নিষিদ্ধ, হলাম এই সমাজে বেজাত!

মানুষের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিলাম, তা-ও পাইনি,
মানুষ ফেলে দেয় চরম বিপদে, তবুও প্রতিবাদ করিনি!
সমাজের কাছে চেয়েছিলাম অসাম্প্রদায়িকতার বাণী,
সমাজ দেয় নিজ ধর্মের শ্লোগান, করে শুধু হানা-হানী!

কন্যা সন্তান মাথার বোঝা নয়– স্বর্গের লক্ষ্মীদেবী

অনেক সময় খবরের কাগজে, আর ফেসবুক থেকে জানা যায়, কন্যা সন্তান নাকি অনেকেরই মাথার বোঝা। আবার সময় সময় শোনাও যায়। মাঝে-মাঝে স্বচক্ষে দেখাও যায় কন্যা সন্তান জন্মদানে সদ্যজাত শিশুটি মায়ের উপর কত-না অত্যাচার নেমে আসে নির্বিচারে! আবার অনেকেই বিয়ে-শাদি করার পর স্ত্রীর গর্ভে থাকা প্রথম সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে, তা নিয়েও ভাবতে থাকে; মাসের পর মাস! যাঁদের বর্তমান যুগের আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করানোর মতো সাধ্য থাকে, তাঁরা সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেই জেনে নেয় ছেলে না-কি মেয়ে হবে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করার পর তাঁদের ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। আর যাদের আর্থিক দুরাবস্থা তারা মনের ভেতরে ছেলে নাকি মেয়ে, মেয়ে নাকি ছেলে জপতেই থাকে। আবার কারোর সহজ-সরল স্ত্রী পরপর দুটি মেয়ে সন্তান জন্ম দিলেই শ্বশুরালয় থেকে শুনতে হয় অনেক কটুবাক্য। আবার অনেক মেয়েদের উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। কোনো-কোনো মেয়ে পরপর দু-তিন বার কন্যা সন্তান জন্ম দিলে স্বামী কর্তৃক, শ্বাশুড়ি কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে পিত্রালয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। অনেক মেয়েরা মিথ্যে অপবাদ শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে নিজের জীবনের উপরও কষাঘাত শুরু করে স্বেচ্ছায়। অনেক মেয়েরা আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়, স্বামীর কটুকথায়।

আসলে যে সবকিছুর মালিক মহান সৃষ্টিকর্তা, তা সুস্থ মস্তিষ্কে একবার ভেবেও দেখে না, আমার মতন এমন অনেক বোকারাম পুরুষেরা। অনেক পুরুষ মানুষই সন্তান জন্মদানের সব দায়দায়িত্ব বিয়ে করা সহজ-সরল একটা মেয়ের উপরই বাতলে দেয়। তারা মনে করে সন্তান জন্মদানে স্ত্রী বা বিবাহিত নারীর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আসলে কিন্তু তা নয়! সন্তান দেওয়া না দেওয়া একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তার দয়ার উপরই নির্ভর করে বলে আমি মনে করি। তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা কাউকে পরপর ৬ থেকে ৭ টি ছেলে সন্তানও দিয়ে থাকে।

যার ৬ থেকে ৭ টি ছেলে, সেই ব্যক্তি একটা কন্যা সন্তানের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে কত-না প্রার্থনা করে। কিন্তু না, মহান সৃষ্টিকর্তা যাকে যা দেবার তা-ই দিয়ে থাকে। আবার যাদের ঘরে পরপর ৬ থেকে ৭ টি মেয়ে থাকে, তারা একটা ছেলের জন্য কতরকমের চেষ্টাই না করে থাকে। কতো মাজারে মন্দিরে গিয়ে মানত করে। কিন্তু না, তাতেও কাজ হয় না। যার ভাগ্যে যা আছে, আর মহান স্রষ্টা যাকে যা দেওয়ার দরকার মনে করে তা-ই হয়ে থাকে। একসময় আমি নিজেও কন্যা সন্তান হওয়াতে অঝোরে কেঁদেছিলাম। তবে আমার স্ত্রী কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় তাকে একটা কটুবাক্যও উচ্চারণ করিনি। কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর আমি শুধু কেঁদেছিলাম নিজে একজন সহায়সম্বলহীন হওয়াতে।

আমি বিয়ে করেছিলাম ১৯৮৬ সালে। বাংলাবর্ষে পহেলা আষাঢ়। বিয়ে করেছিলাম একজন খেঁটে খাওয়া গরিবের মেয়েকে। তা-ও আবার গরিবের মেয়েটিকে নিজের পছন্দমতো জেনেশুনেই জীবনসঙ্গিনী করেছিলাম। ১৯৮৯ সালে আমাদের সংসারের এক নতুন অতিথির আগমণ ঘটে। তখন আমার মা জীবিত ছিলেন। কথায় আছে, “মায়ে রাখে মেয়ের খবর। বাবা রাখে ছেলের খবর!” যখন আমার সহধর্মিণীর প্রসবব্যথা উঠে, তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আমি ছিলাম আমার কাজে। আমার সহধর্মিণীর প্রসবব্যথার অবস্থা টের পেয়ে আমার মা তাড়াতাড়ি বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছ থেকে ১০০/= টাকা ধার করে পুত্রবধূকে নিয়ে চলে গেলেন নারায়ণগঞ্জ পুরাতন ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। অথচ আমি জানি না। আমি প্রতিদিনের মতো রাত ৮টায় ডিউটি শেষ করে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাত ১১টায় বাসায় ফিরি। বাসায় গিয়ে শুনি, মা আমার সহধর্মিণীকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে গেছে।

ওমনি আর দেরি না করে আমি দৌড়ে গেলাম, আমার মালিকের কাছে। উনাকে বলে-কয়ে কিছু টাকা নিয়ে চলে গেলাম ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। গিয়ে দেখি মা আমার জন্য অপেক্ষা করে হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে। মাকে বসা দেখেই দৌড়ে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা তুমি এখানে এভাবে বসে আছো কেনো?’ মা বললো, ‘তোর অপেক্ষায় বসে আছি বাবা। আয় ভেতরে আয়।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বউমা কোথায়?’ মা বললো, ‘ভেতরেই আছে। তোর মেয়ে হয়েছে বাবা।’

মায়ের মুখে মেয়ে হবার কথা শুনেই আমি কাঁদতে লাগলাম। আমার চোখে জল দেখে মা জিজ্ঞেস করলো, ‘ওরে অভাগা, তুই কাঁদিস কেন? এতো খুশির খবর! তোর তো হাসার কথা। তুই না হেসে কাঁদছিস?’ বললাম, ‘মা আমি কাঁদছি আগামী দিনের চিন্তা করে, মা। মেয়ে যখন বিয়ের উপযুক্ত হবে, আমি অধম মেয়ে বিয়ে দিবো কী করে, মা?’ মা বললো, ‘আরে অভাগা, তুই সেই চিন্তা করিস নে। যার চিন্তা সে-ই করবে। চল, ভেতরে চল। সন্তানের মুখ দেখে ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেয়ের দীর্ঘায়ু প্রার্থনা কর।’ এই বলেই মা আমার হাতে ধরে টেনে হাসপাতালে শুয়ে থাকা আমার সহধর্মিণীর কাছে নিয়ে গেলো। গিয়ে দেখি, আমার সহধর্মিণীর পাশে আমার সদ্যোজাত কন্যা সন্তানটি শুয়ে আছে। কিন্তু আমি তখনও কাঁদছিলাম।

মা আমার সদ্যোজাত মেয়েটিকে কোলে নিয়ে আমার সামনে এনে বললো, ‘নে কোলে নে! ওকে আশীর্বাদ কর।’ আমি আমার সদ্যোজাত কন্যা সন্তানটিকে কোলে নিয়ে মনে মনে মহান সৃষ্টিকর্তাকে বললাম, ‘হে প্রভু, তুমিই দিয়েছো, তুমিই একটা বিহিত করে দিও। আমি দয়াল অধম। মেয়ে বিয়ে দেবার মতো আমার কোনও সাধ্য নেই। যা করার তুমিই করবে, প্রভু।’ এই বলেই মেয়ের দু’গালে দুটো চুমু দিয়ে আবার আমার মায়ের কোলে দিয়ে দিলাম।

পরদিন সকালবেলা হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলো। হাসপাতালের বিল হলো ২০০/= টাকা। আমার সাথে আছে মাত্র তিনশো টাকা। এই তিনশো টাকা থেকে দুইশো টাকা হাসপাতালের বিল পরিশোধ করলাম। কিন্তু নার্স ও ডাক্তারদের বকসিস দেওয়া বাদ ছিলো! তাঁরা কিছু বকসিস চাইলে তাঁদের দিয়ে দিলাম একশো টাকা। তখন আমি হয়ে গেলাম খালি! মানে পকেট শূন্য! তারপর মা’র কাছে যে কয় টাকা ছিলো, তা দিয়ে কোনরকম বাসায় ফিরে গেলাম।

মেয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। আমার মা একসময় না ফেরার দেশে স্বর্গীয় হলো। এরপর ১৯৯১ সালে আরও এক ছেলে আমাদের সংসারের আসলো। মেয়ে এসএসসি পাস করলো। ছেলেও নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলো। আমি তখন পাবনা সিরাজগঞ্জ বেলকুচি। ফরিদপুর থেকে মেয়েকে দেখতে এলো। আমার কাছে খবর পৌঁছতেই আমি দ্রুত নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি। ছেলে পক্ষের কোনও দাবিদাওয়া ছিলো না। ছেলে পক্ষের কথা, যেভাবে পারি সেভাবেই মেয়েকে উঠিয়ে দিতে পারলেই হলো। তারপরও তো কিছু-না-কিছু লাগেই। হিন্দু বিয়ে বলে কথা। কিন্তু তখন আমার কাছে কানাকড়িও ছিলো না। সম্বলের মধ্যে ছিলো, নিজের সহধর্মিণী খেয়ে-না-খেয়ে মেয়ের জন্য আট আনা স্বর্ণের কানের দুল। সেটাই ছিলো একমাত্র সম্বল।

আমার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলো। আমি তাঁদের শরণাপন্ন হলাম। বিস্তারিত খুলে বললাম। তাঁরা কোনও প্রকার চিন্তা করতে বারণ করলেন। তারপরও কি চিন্তা দূর হয়? চিন্তায় এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকি। একসময় ব্রাক সমিতি থেকে ৪০,০০০/=টাকা কিস্তিতে ওঠালাম। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা জোগাড় করে দিলো মেয়ের হাতের শাখা বাঁধাই করে। নিজের বড় ভগ্নিপতি দিলো হাতের পলা। ভাগ্নি জামাই দিলো মেয়ের গলার হার। দুই শালা দিলো ছেলের আঙটি। এভাবে মিল-তাল করে বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেললাম। দুইশো লোকের আয়োজনও করলাম।

তখন ছিলো বৃষ্টির মৌসুম। আমরা যেখানে ভাড়া থাকতাম, সেই জায়গাটা হলো একটা সরকারি মিলের শ্রমিকদের পরিত্যক্ত কোয়ার্টার। অনেক বড় জায়গা জুড়ে কোয়ার্টার। জায়গাটি ছিলো নিচু জায়গা। একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো। বিয়ের বাকি এক সপ্তাহ। শুরু হলো বৃষ্টি আর বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি! তা-ও আবার একাধারে রাতে দিনে চারদিন। পুরো এলাকা হয়ে গেলো বন্যা কবলিত। বিয়ের বাকি তিনদিন। বিয়ের কেনাকাটাও প্রায় শেষপর্যায়ে। ঘরে হাঁটুপানি। তার উপর আবার বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ছিলো না। একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে, আবার কখন আসবে, তার নিশ্চয়তা ছিলোই না। মানে বিদ্যুৎ যখনই চলে যায়, ফিরে আর আসে না। আসে আবার চলে যায়, এ অবস্থাই চলতে থাকে। আমি আমার মহান সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলাম, “হে প্রভু তুমি আমার সহায় হও! তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই!” মহান সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আমার ডাক শুনলেন। আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন।

রাত পোহালেই বিয়ের দিন। বৃষ্টি নেই। এমনকি আকাশে একছিটে কালো মেঘ পর্যন্ত নেই! বিদ্যুৎও আগের মতো আসে– যায় না। মানে লোডশেডিং বলতে নেই! আমার প্রতিবেশী সবাই তখন বলতে লাগলো, “নিতাই বাবু’র মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে মনেহয় জেনারেটর চালু করে রেখেছে! আর মহান সৃষ্টিকর্তা হয়তো নিজেই বৃষ্টি বন্ধ করে রেখেছে।” এসব ধারণা ছিলো আমার আশে-পাশে থাকে পরিবারগুলোর। অথচ ক’দিন আগেও অনেকে বলেছিল, ‘যেভাবে বৃষ্টি আর লোডশেডিং, এভাবে চলতে থাকলে নিতাই বাবুর মেয়ের বিয়ে পিছিয়ে যাবে।’ কিন্তু না, মহান সৃষ্টিকর্তা আমার সহায় ছিলো। তাই মহান সৃষ্টিকর্তা বিয়ের আগের দিন থেকেই আমার মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন হওয়ার জন্য সবকিছু ঠিক করে দিয়েছেন। শুধু বাদ রেখেছিলেন বাজনা। তবে বাজনাও কিন্তু মুহূর্তেই জোগাড় হয়ে গিয়েছিলো।

অনেকেরই জানা আছে যে, আমাদের হিন্দু বিয়ে বাজনা ছাড়া হয়-ই না। কিন্তু আমি কোথাও বাজনাওয়ালা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাজনার ব্যবস্থা করতে না পেরে একপর্যায়ে বাজনা ছাড়াই মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন করার চিন্তাভাবনা করে রেখেছিলাম। হঠাৎ পরিচিত এক লোকের সাথে সাক্ষাৎ! তার কাছে বাজনার ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করতেই, তিনি তার হাতে থাকা মোবাইলে কল দিয়ে বললেন, ‘আমার এক পরিচিত লোকের মেয়ের বিয়ে। যেভাবে হোক তাড়াতাড়ি চৌধুরীবাড়ি এসে দেখা করো।’ আমাকে বললো, ‘দাদা এখানেই একটু অপেক্ষা করুন, বাজনাওয়ালা আসছে।’ উনার কথামতো সামনে থাকা এক চা-দোকানে গিয়ে দু’জনে বসলাম। চা-পান করতে করতে রিকশায় চড়ে বাজনাওয়ালা আমাদের সামনে এসে হাজির হলেন। বাজনাদারকেও চা-পান করালাম। এরপর বলে-কয়ে ২,৫০০/=টাকায় বাজনা ঠিক করলাম। অধিবাসের দিন বিকালবেলা থেকে তারা আমার বাসায় আসবেন। বিয়ের বাজনা বাজিয়ে পুরো এলাকা সরগরম করে তুলবে।

বিয়ের দিন সকালবেলা বাবুর্চি আসলেন। রান্না-বান্নার কাজ শুরু করলেন। আমি গেলাম পরিচিত এক চা-দোকানে চা-পান করার জন্য। এমন সময় আমার বড়’দা আমার সামনে এসে কাঁদা কাঁদা স্বরে বললো, ‘ধুতরা গোটা (ধুতরা গাছের ফল) জোগাড় করতে পারিনি!’ হায়! হায়! বলে কী! হিন্দু বিয়ের কার্যসম্পাদন করার জন্য ৮টা ধুতরা গোটার প্রয়োজন হয়। এই ধুতরা গোটা কেটে দুভাগ করে ভেতরের বীচিগুলো ফেলে দিয়ে তা দিয়ে সরিষার তেলের প্রদীপ জ্বালানো হয়। তাই ধুতরা গোটা ছাড়া তো পুরোহিতের কাজই হবে না। মোটকথা বিয়ের কাজই অসম্পন্ন থেকে যাবে।

দাদার ব্যর্থতার কথা শুনে আমি তখন মনে মনে ভাবতে লাগলাম! এমন সময় যেই চা’র দোকানে বসে চা-পান করছিলাম, সেই দোকানের মালিকের নাম জহির মিয়া। জহির ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা জহির ভাই, ক’দিন আগেও আপনার বাসার সামনে কয়েকটা ধুতরাগাছ দেখেছিলাম। তা কি আছে?’ জহির ভাই বললো, ‘আরে দাদা, এইতো দুইদিন আগে সব ধুতরাগাছ উপরে ফেলে বাসার সামনেই ফেলে রেখেছি। আপনি একটু কষ্ট করে আমার বাসার সামনে গিয়ে দেখুন, ধুতরা গাছে গোটা আছে কিনা!’ সাথে সাথে বড়দাদা-সহ আমি গেলাম জহির ভাইয়ের বাসায় সামনে। গিয়ে দেখি কয়েকটা ধুতরাগাছ এদিক-সেদিক হয়ে পড়ে আছে। তখন গাছগুলো ওলট-পালট করে দেখি গোটা আছে। তা-ও আবার আকারে একটু বড়সড় গোটা। খুঁজতে লাগলাম! এক-এক করে ৮টা ধুতরা গোটা-ই পেলাম। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, চার-পাঁচটা গাছে মধ্যে কেবল ৮টা গোটা-ই ছিলো। আর একটা গোটাও গাছগুলোতে ছিলো না।

ভাবলাম, মহান সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার মেয়ের বিয়ের জন্যই এই গোটাগুলো রেখে দিয়ে ছিলো। যা এখন আমি খুঁজে পেলাম। মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে গোটাগুলো সাথে নিয়ে জহির মিয়ার চা-দোকানে এসে বসলাম। জহির ভাই জিজ্ঞেস করলো, ‘পেয়েছেন, দাদা?’ বললাম, ‘হ্যাঁ জহির ভাই, পেয়েছি। তা-ও আবার আমার প্রয়োজন মতোই পেয়েছি।’ জহির ভাই বললো, ‘তা ঠিক বুঝলাম না, দাদা।’ বললাম, ‘আমার মেয়ের বিয়ে কার্যসম্পাদন করার জন্য দরকার ৮টা গোটা। আপনার বাসার সামনে ফেলে রাখা গাছগুলোতে এই ৮টা গোটাই ছিলো। তা যেন মহান সৃষ্টিকর্তা নিজে আমার মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদনের জন্যই রেখে দিয়েছিলেন। মহান সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

এরপর ধুতরা গাছের গোটাগুলো বাসায় নিয়ে গেলাম। রাতে বরযাত্রী আসলো। আমার ছেলে বোনের বিবাহ অনুষ্ঠানের ভিডিও করে রাখার জন্য ভিডিও ক্যামেরা আনলো। পুরোহিত আসলো। নিমন্ত্রণ দেওয়া লোকের সমাগম ঘটলো। খাওয়া-দাওয়া হলো। তারপর মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় বৃষ্টি, বিদ্যুত ও আরও অন্যান্য ঝায়-ঝামেলা ছাড়াই সুন্দরভাবে আমার মতো গরিবের মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন হয়েছিল।

কিন্তু আমি বোকারাম মেয়ে ভূমিষ্ঠ হবার পর অযথা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলাম! নিজের ঘরে আগত লক্ষ্মী দেবীকে নিজের মাথার বোঝা মনে করেছিলাম। মাথার বোঝা মনে করেছিলাম, নিজের কিছুই ছিলো না বলে। চিন্তা ছিলো শুধু একটাই! তাহলে মেয়ে বড়ো হলে বিয়ে দিবো কী করে, আর একেবারে খালি হাতে মেয়েকে পরের হাতে তুলেই বা দিবো কীভাবে! এসব চিন্তাই আমি বেশি চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু তখন একবারও ভাবার সময় আমি পাইনি যে, মহান সৃষ্টিকর্তাই তো সৃষ্টি করেছেন নারী-পুরুষ। যা করার তিনিই তো করবেন। এতে আমার মতন অধমের কী করার সাধ্য আছে? আমার কোনও সাধ্য নেই! ছেলে হোক আর মেয়েই হোক, বিয়ে হবে কি হবে না; সব মহান সৃষ্টিকর্তার হুকুমেই হয়। আমার মতন বোকারামরা শুধু-শুধু ভেবেই মরি। আসলে কন্যা সন্তান কারোর মাথার বোঝা নয়! কন্যা সন্তান স্বর্গ হতে আসা ঘরের লক্ষ্মীদেবী।

এ কেমন হট্টগোল?

শুনেছি এই সুন্দর পৃথিবীটা নাকি গোল!
তাইতো বুঝি আজ সবখানে এতো গণ্ডগোল!
জাগায় জাগায় লেগে আছে যতো হট্টগোল!
শুনি ধর্ষিতার কান্না, দুর্নীতিবাজদের শোরগোল!

শুনেছি এই সুন্দর পৃথিবীটা নাকি ঘুর্ণায়মান!
তাই আজ মায়ের জাতিদের করছে অবমূল্যায়ন!
যেখানে মায়ের জাতি পাবার কথা মায়ের সম্মান,
সেখানে আজ করছে নারীদের অবলীলায় অসম্মান!