নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

স্মৃতিতে মুড়ির টিন বাস

প্রিয় বন্ধুরা, কোনোএক সময়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলা যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাসের কথা আপনাদের মনে আছে কি? আমার মনে হয় আমার সমবয়সী যারা আছেন, কেবলমাত্র তাদেরই মনে আছে বলে আমার বিশ্বাস! আর যাদের ১৯৮৪-৮৫ সালের পর জন্ম হয়েছে, তারা সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী মুড়ির টিন বাসের নামই শুধু শুনেছে। কিন্তু কখনই মুড়ির টিন বাসে চড়ে দেখেনি এবং ওই ঐতিহ্যবাহী যানবাহন মুড়ির টিন বাসের ইতিহাসও অজানা।

তবে আমি মনে করি বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কারোর কাছে কোনোকিছু অজানা থাকার কথা নয়! কারণ বর্তমান যুগে সবার হাতে হাতেই অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম মোবাইল ফোন। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল মানেই সারা দুনিয়া হাতের মুঠোয়। আর এই অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে ‘ক’ লিখে সার্চ করলেই, ‘ক’র মর্মার্থ জানা হয়ে যায়। আর দুনিয়ার সবকিছু অজানা খবর তো মোবাইল স্ক্রিনে নিমিষেই ভেসে উঠেই। তারপরও যাদের কাছে সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী মুড়ির টিন বাসের ইতিহাস অজানা, তাদের জন্যই আজকে আমার এই লেখা। তাই আজকে কোনোএক সময়ের বাংলার ঐতিহ্যবাহী যানবাহন মুড়ির টিন বাসের কিছু স্মৃতি, কিছু জানা-অজানা ইতিহাস সবার মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

মনে পড়ে সে-সময়ের মুড়ির টিন বাসের কথা। ওই মুড়ির টিন বাস স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ও ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করতো। আর সেসময় নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা শ্যামবাজার হয়ে সদরঘাট যাওয়ার একমাত্র জনপ্রিয় যানবাহন-ই ছিলো, ঐ মুড়ির টিন। ঐ বাসটাকে আবার অনেকেই স্টার্ট বাসও আলতো। কারণ ঐ মুড়ির টিন বাস হাতে হ্যান্ডেল মেরে স্টার্ট দেওয়া হতো। তাই মুড়ির টিনের পাশাপাশি অনেকে ঐ বাসটাকে স্টার্ট বাসও বলতো। ১৯৮৪ সালের দিকেও এই মুড়ির টিন বাসে চড়ে পঞ্চবটী, ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা, শ্যামবাজার হয়ে সদরঘাট যেতাম। শুধু আমিই নয়, আমার মতো এমন হাজারো মানুষ ঐ মুড়ির টিন বাসে চড়েই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ আসা-যাওয়া করতো।

একসময় আমি আর আমার বড় দাদা ফতুল্লা কাঠের পুল মিলন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতাম। তখন আমাদের ফ্যামেলি বাসা ছিলো, নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা গোয়াল পাড়া। ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল থেকে আমাদের বাসার দূরত্ব ছিলো প্রায় ৪ কিলোমিটার। প্রতিদিন এই ৪ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করা সম্ভব ছিলো না। আবার তখনকার সময়ে নারায়ণগঞ্জ-টু-ঢাকা যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাসে ০.৬০ পয়সা খরচ করে আসা-যাওয়া করাও ছিলো ব্যয়বহুল খরচ! তবুও সময় সময় পয়সার মায়া ত্যাগ করে সময়মত মিলের ডিউটি জন্য মুড়ির টিনে বসে করেই ফতুল্লা পর্যন্ত আসতে হতো।

যদিও তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা সদরঘাট পর্যন্ত মুড়ির টিন স্টার্টবাসে জনপ্রতি ভাড়া ছিলো ১.৫০ পয়স। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফতুল্লা পোস্ট অফিস পর্যন্ত ভাড়া ছিলো ০.৬০ পয়সা। তবুও এই ০.৬০ পয়সা করে আসা-যাওয়ায় জনপ্রতি ১.২০ পয়সা খরচ করা কিছুতেই আমাদের মত গরিব মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। কারণ প্রতিদিন দুইজনের আসা-যাওয়ায় খরচ ২.৪০ পয়সা তখনকার সময়ের জন্য ছিলো অনেককিছু।বলছিলাম ১৯৮৪ সালের কথা।

তখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই রকমের যানবাহন চলাচল করতো। একটা হলো, সূপিয়ার কোচ, মানে বড় বাস। আরেকটা হলো, মুড়ির টিন নামের স্টার্ট বাস। সুপিয়ার কোচ চলাচল করতো, নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া পুরাতন রেলস্টেশন। আর মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের রুট ছিলো, নারায়ণগঞ্জ কালির বাজার হাইস্কুল থেকে ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা হয়ে সদরঘা পর্যন্ত। তখনকার সময়ে আবার অনেকে যাতায়াত খরচ বাঁচানোর জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে ফতুল্লা থেকে লঞ্চে ঢাকা সদরঘাট আসা-যাওয়া করতো। আর যারা ব্যাবসা করতো, তারা সবসময় মুড়ির টিন স্টার্ট বসেই বেশি যাতায়াত করতো।

এর কারণ হলো, নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, নিতাইগঞ্জ’র যত ব্যাবসায়ী ছিলো, তারা সকলেই ঢাকা শ্যামবাজার থেকে মালামাল ক্রয় করতো। তাদের ক্রয় করা সেই মালামালগুলো মুড়ির টিন বসে করে ফতুল্লা নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসতো। কেউ কেউ আবার সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে ফতুল্লা পৌঁছতো। এভাবেই তখনকার সময়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ীরা দুই পয়সা খরচ বাঁচানোর জন্য এ-পথে সে-পথে আসা-যাওয়া করতো। তো এবার আসি মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস নিজের স্মৃতিতে থাকা বিস্তারিত কিছু আলোচনায়।

সে সময়কার মুড়ির টিন স্টার্ট বাস যাঁরা দেখেননি, তারা হয়তো মনে মনে ভাবছেন! ‘মুড়ির টিন’ বাস আবার কেমন? এর ইতিহাসই বা কী? হ্যাঁ, অবশ্যই মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস আছে। একসময় আমাদের বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা নারায়ণগঞ্জে পাবলিক বাসের যাত্রা শুরু হয় মুড়ির টিন স্টার্ট বাস দিয়ে। এই মুড়ির টিন বাসের ইতিহাস বা কাহিনী শুনেছিলাম, আমার বাবা ও কাকার মুখে।

একসময় আমার বাবা ও কাকা নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড় বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের চাকরি করতো। বাবা অথবা কাকা ছুটিতে বাড়ি গেলে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ির উঠানে বসে স্বপ্নের ঢাকা নারায়ণগঞ্জ শহরের গল্প শুনতো। বাবা ও কাকার মুখে শুনেছিলাম, ঢাকা নারায়ণগঞ্জের ঐতিয্যবহী মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস।

মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের গল্প বা ইতিহাস হলো, ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়, তখন এ অঞ্চলে মিত্রবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু যানবাহন ইংরেজরা এদেশের কিছু বিত্তশালীদের কাছে নিলামে বিক্রি করে দেয়। সেসব যানবাহনের মধ্যে ছিলো, মালা-মাল পরিবহনের ট্রাক, জিপগাড়ি, কাসিম বা কচ্ছপ মার্কা টেক্সি-সহ আরও অন্যান্য তাদের কিছু ব্যাবহারিক ভাঙাচোরা গাড়ি। এসব ভাঙাচোরা গাড়িগুলো তখনকার সময়ের বিত্তশালীরা ইংরেজদের কাছ থেকে কমদামে কিনে রাখে।

তারপর বিত্তশালীরা ওইসব ভাঙাচোরা কাঠের বডি ট্রাকগুলো বাসের আদলে তৈরি করে একধরনের নাকবোঁচা বাস। ভাঙাচোরা ট্রাকগুলোর বাইরের দিকে কাঠের বডির ওপর মুড়ে দেওয়া হয় টিন। একটা ছৈয়া ( ছাউনি) নৌকা যেভাবে বানানো হয়, ঠিক সেভাবেই টিন দিয়ে ট্রাকের চারদিক মুড়িয়ে দেওয়া হয়। যাতে চলন্ত পথে বৃষ্টি এলে যাত্রীরা ভিজে না যায়। সেই থেকেই বাসগুলোর নাম হয় মুড়ির টিন।

আবার ওইসব মুড়ির টিন বাসগুলো হাতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট দেওয়া হতে বলেই, এগুলোর আরেক নাম ছিলো স্টার্ট বাস। যা দেখতে একরকম গৃৃহস্তের ঘরে থাকা মুড়ির টিনের মতনই দেখা যেতো। তাই অনেকেই ঐ বাস গুলোকে মুড়ির টিন বাস বলতো। আবার অনেকে মুড়ির টিন বাসের নাম নিয়ে অন্যমতও পোষণ করে থাকে। তাদের মতে, গৃৃহস্তরা একটা মুড়ির টিনে যেভাবে ঠাসা ঠাসা করে মুড়ি ভরাট করে রাখতো, ঠিক তখনকার সময়ে মুড়ির টিন বসে সেভাবেই ঠাসা ঠাসা করে যাত্রী ভরা হতো বলেই, বাসটির নাম হয় মুড়ির টিন।

কালের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্যবাহী মুড়ির এখন অনেকের স্মৃতিতে নেই বলেই মনে হয়। এখন ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বাস, এই বাস, সেই বাস, ননস্টপ বাস, বিরতিহীন বাস, গেইট লক সার্ভিস বাস, এসি বাস, বলভো বাস, কলম্বো বাস, সরকারি বিআরটিসি বাস-সহ আরও কতরকমের বাস আর বাস। এতো এতো বাসের ভীড়ে সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাস কোথায় যে হারিয়ে গেলো, তা আর নিজের স্মৃতিতেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সময় সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে যেকোনো বাসে চড়ে যেকোনও স্থানে গেলে সেই সময়কার মুড়ির টিন বাসের কথা মনে পড়ে যায়।

পোস্টের ছবি কালেক্ট: ফেসবুক বন্ধু “শাহ আলম শরাফতী” দাদার পোস্ট থেকে।

জীবনের গল্প-৮

জীবনের গল্প-৭- এর শেষাংশ; আমরাও জাকিরিয়া সল্ট মিলে নিয়মিত কাজ করতে থাকি, দৈনিক মজুরি ২৫ টাকায়। এটাই ছিল আমার কোনও এক মিল ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনের প্রথম চাকরি। হোক সেটা লবণের মিল। তাই এই চাকরি নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে এক অনলাইন দিনলিপিতে “জীবনের প্রথম চাকরি” শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাইটের লিংক লেখার মাঝে দেওয়া হলো।

রাস্তার কাজ ছেড়ে মনে অনন্দ নিয়ে ১২ থেকে ২৫ টাকা হাজিরায় গিয়ে লাগলাম, লবণের মিলে। কিন্তু লবণের মিলের কাজ যে ছিল এতো কষ্টের, তা আর আমরা তিনজনের একজনও কাজে লাগার আগে বুঝতে পারিনি। আমাদের দুইজনের আগে থেকে কাজ শুরু করা লোকমানও আমাদের কাছে কিছু খুলে বলেনি। যদি লোকমান আমাদের বলতো, ‘যেই কাজে আছিস সেই কাজেই থাক; লবণের মিলে কাজ করার আশা করিছ না’ তাহলেই আমরা বুঝে নিতাম যে, লবণের মিলে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আমরা আর লবণের মিলে গিয়ে কাজে যোগদান করতাম না।

কিন্তু লোকমান তা না বলে, ও আমাদের প্রতিদিনই কাজে যোগদান করার জন্য তোষামোদ করেছিল। কেন তোষামোদ করেছিল, তা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম, লোকমানও আমাদের কাছে তা খুলে বলেছিল। আমাদের দুইজনকে ছেড়ে লোকমানের একা-একা লবণের মিলে ভালো লাগছিল না, তাই। যাইহোক, এরজন্য লোকমানের সাথে আমাদের কোনদিন মনমালিন্য হয়নি। আমরা তিনজনই মিলেমিশে একসাথে জাকিরিয়া সল্ট মিলে মনোযোগ সহকারে কাজ করতে ছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না, অতিরিক্ত খাটুনির কারণে আর শরীরে ঘা হয়ে যাওয়ার কারণে। এই কাজ করতে গেলে মিলে ঢোকার আগেই সমস্ত শরীরের পান খাবার ‘খয়ের’ মাখিয়ে কাজ করতে হয়। নাহলে শরীরে থাকা একটা ঘামাচি থেকে বড় আকারে ঘা হয়ে যাবে-ই-যাবে। তবু্ও একদিন কাজ করে, আর দুইদিন বসে থেকে অতি কষ্টে কাজ করে যাচ্ছিলাম।

আমাদের শরীরের এ-অবস্থা দেখে সবাই তখন বললো, কাজ করতে করতে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। একসময় হয়েছিলও তা-ই।। কাজের সাথে নিজেদের শরীরও মানিয়ে গিয়েছিল। আমরা যে কাজটা করতাম, সেই কাজের নাম ছিল ‘দৌড়’। লবণের মিলের কাজের এমন আরও নাম আছে। যেমন–খালাসি কাজ, বোজা কাজ, খামালি খাজ, কাচানি বা বেলচা কাজ, দৌড় কাজ, মিস্ত্রি, ফোরম্যান ও রপ্তানি বা ডেলিভারি কাজ। যিনি কাজ চলাকালীন সময়ে দেখবাল করতো, তাঁকে বলা হতো মাঝি বা সরদার। আমরা তিনজনই ছিলাম দৌড়ে। যিনি আমাদের কাজে লাগতে সহায়তা করেছিল, তিনি ইসমাইল মিয়া খামালি কাজ করতেন। উনার নাম ইসমাইল হলেও, মিলের সবাই তাঁকে ইসলাম ভাই বলেই ডাকতো। আমরাও ইসলাম ভাই বলে ডাকতাম।

ইসলাম ভাই’র আরো তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন৷ তখন ইসলাম ভাই বলতেন, ‘আজ থেকে আমরা সাত বন্ধু’। আমরা এক সাথে খেতাম, এক সাথে ঘুমাতাম। মোট কথা সাত মাথা মিলিয়ে হলাম এক মাথা৷ মিলে কাজ করতে হতো আট ঘন্টা৷ ছুটি হতো বিকাল ৫ টায়৷ ছুটি’র পর গা-গোসল করে আর দেরি করতাম না, চলে যেতাম মহেশখালী বাজারে৷ তখন প্রতি কাপ চা’র দাম ছিল চারআনা (২৫) পয়সা৷ সাতজন মিলে চা খেতাম পৌনে দুই টাকা, আর চারআনা দিয়ে চট্রগ্রামের আবুল বিড়ি কিনে নিতাম৷ একেক দিন একেকজন প্রতিদিন বিকাল বেলার চায়ের বিল দিতে হতো। তারপর যেতাম আদিনাথ পাহড়ের উপরে থাকা আদনাথ মন্দিরে। আদিনাথ মন্দিরটি ছিল মহেশখালী বজার হতে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর দিকে। মাঝপথেই জাকিরিয়া সল্ট মিল। সেখানে যাওয়াটা সবার চাইতে আমার একাই যাওয়া হতো বেশি! কারণ, আদিনাথ মন্দিরে নিয়মিত আসা-যাওয়া ফলে মন্দিরের পুরোহিতের সাথে আমার একরকম সখ্য গড়ে উঠেছিল। তখন এমন হয়েছিল যে, আদিনাথ মন্দিরে যদি এক বিকাল যাওয়া না হতো, পরদিন সকালবেলা ঠাকুর মশাই নিজে এসেই আমার তালাশ নিতো। বিকালবেলা মন্দিরে যেতে বলতো। আমিও যেতাম। মন্দিরের পরিবেশটা আমার খুবই পছন্দ হতো তাই। সেসময় আদিনাথ মন্দিরে বসে মন্দিরের ঠাকুর কর্তার সাথে বসে আমার অনেক সময় কেটেছিল।

অনেক সময় সন্ধ্যার পর ঠাকুর কর্তা নিজে অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো। এদিকে একটু দেরি হয়ে গেলেই ইসলাম ভাই-সহ মিলের সবার আমার জন্য অস্থির হয়ে যেতো। কারণ লবণের মিলের ভেতরেও আমি ছিলাম সবার পছন্দের একজন মানুষ। মিলের মাঝি, মিস্ত্রি, ম্যানেজার-সহ শ্রমিকদের কাছে আমি ছিলাম খুবই আদরের এবং পছন্দের। এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল শুধু একটুখানি লেখাপড়া জানতাম বলে। কিন্তু তাদের এই আচরণ দেখে আমার খুবই লজ্জা হতো। আমি তাদের সবসময়ই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু না পারতাম না৷ সবাই আমাকে স্নেহ ভালোবাসার চোখেই দেখে রাখতো। কারোর বাড়িতে চিঠি পাঠাতে হলে, রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর খাতা-কলম নিয়ে আমাকে বসতে হতো। অনেক সময় কার আগে কারটা লিখবো, এই নিয়েও বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি হতো। পরে অবশ্যই সবই ঠিক হয়ে যেতো। এভাবেই মহেশখালী জাকিরিয়া সল্ট মিলে কেটে গেলো প্রায় চার মাসের মতো। একসময় লবণের মিল-সহ মহেশখালী বাজারে থাকা বেশকিছু দোকানদার ও এলাকার কিছু স্থানীয় লোকদের সাথে আমার খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। যদিও মিল কর্তৃপক্ষের নিষেধ ছিল, এলাকার কারোর সাথে সখ্যতা বা বন্ধুত্ব না করার, তবুও আমরা কয়েকজন ছিলাম এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। এলাকার কিছু মানুষের সাথে ছিল সুগভীর ভালোবাসা। তাছাড়া ঢাকার লোক বলে একটা কথা আর সুনাম তো ছিলোই। সেই সুবাদে মিলেও ইজ্জত পেতাম, মিলের বাইরেও ইজ্জত পেতাম। চলতাম, ফিরতাম, ঘুরতাম, খেতাম, কাজও করতাম সমানতালে।

একসময় ঈদু-উল-ফিতরের আগমণ ঘটলো। রোজা আরম্ভ হলো। হঠাৎ করে বাজারে লবনের দাম কমে গেল৷ ছয়-আনা থেকে চার আনায় নেমে আসলো। মিলের কাজও আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। এরমধ্যেই আমার সাথে আসা দুইজনের বাড়ি হতে তাদের ফিরিয়ে নিতে লোক এসে হাজির হলো৷ আমি তাদের দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মায়ের কথা। তাদের কাছ থেকে উত্তর মিলল, ‘তোমার মা আসার সময় আমাদের কিছু বলেনি।’ পরদিন সকালবেলা আমার সাথে আসা দুইজন জাকিরিয়া সল্ট মিল হতে বিদায় নিয়ে মহেশখালী ত্যাগ করলো। ওঁরা চলে যাবার পর আমি হয়ে গেলাম একা৷ তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ইসলাম ভাই, আজাহার ভাই, হানিফ ভাই ও আফাজ ভাই আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। তাঁরা বলতেন, ‘তুই নিতাই আমাদের আপন ভাইয়ের মতো, আমরা খেলে তুই না খেয়ে থাকবি না।’ তাদের এই শান্ত্বনায় কিছুতেই আমার মন ভরছিল না৷ শুধু অামার মায়ের কথাই মনে পড়ছিল। সেদিন মিলেও তেমন কাজ ছিল না, আমিও আর কাজের ধান্দায় থাকলাম না। কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লাম মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখতে। চিঠি লিখে দুপুরের আগেই মহেশখালী বাজারে গিয়ে পোস্ট অফিস থেকে একটা এনভেলপ কিনে ঠিকানা লিখে ডাক বাক্সে ফেলে চলে আসলাম মিলে।

মিলে এসে শুনতে পেলাম, মিল কর্তৃপক্ষ লবণের দাম ঠিক না হওয়া পর্যন্ত মিল বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে কাউকে মিল ত্যাগ করার জন্য চাপ দিবে না। যে থাকার থাকবে, যে যাবার সে অন্যত্র যেতে পারবে। বন্ধ মিলে কেউ থাকলে খাওয়া খরচ মিল কর্তৃপক্ষ থেকে বহন করা হবে। পড়ে গেলাম বিপাকে! সাহস দিচ্ছিলেন, ইসলাম ভাই ও সাথের আরও তিনজন। তাঁরা যেকোনো সাইটে কাজের জোগাড় না করে আর মিল থেকে কোথাও যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছে। আমি থেকে গেলাম তাঁদের সাথেই। এরমধ্যেই মিলের ফোরম্যান সাহেব মিলে যাঁরা-যাঁরা থাকবে তাঁদের নিয়ে নিজ খচরে ঈদ উপলক্ষে মিলের ভেতরেই একটা যাত্রানুষ্ঠান করার কথা জানালেন। এতো আমরা সবাই খুশি হলাম ঠিক, কিন্তু কাজ ছড়া নিজেদের হাত খরচ চালাবো কী করে, তা-ই নিয়েও পড়ে গেলাম দুঃশ্চিন্তায়! তখন মিল বন্ধ হলেও মিল কর্তৃপক্ষ শুধু দুইবেলা খাওয়াতো। দুপুরে আর রাতে। সকালের খাবার ছিল যাঁর-যাঁর কাঁধে। তখন আমরা পাঁচজন সকালের খাবার ও নিজেদের হাত খরচ চালানোর জন্য একটা বুদ্ধি করলাম। বুদ্ধি হলো, মিলের সাথেই একটা খাল ছিল। সাগরের জোয়ার-ভাটার সময় সেই খালের পানিও বাড়ত-কমতো। জোয়ারের পানির সাথে প্রচুর মাছ খালে চলে আসতো, আবার ভাটার সময় পানির সাথে মাছগুলো সাগরেই নেমে যেতো। খালটা ছিল খুবই চিকন। কিন্তু গভীর ছিল।

একদিন আমারা পাঁচজন সেই খালের কিছু অংশ দুইদিকে বাঁধ দিয়ে রাখলাম। জোয়ারের সময় পানি এসে খাল ভরে টবু-টুবু হলো। একসময় ভাটা লাগলো। বাঁধের ভেতরে পানি জমা হয়ে থাকলো। আমরা চারজন দুই ভাগে ভাগ হয়ে খালের পানি সেঁচতে লাগলাম। পানি সেঁচে দেখি, মাছ-আর-মাছ! অনেক মাছ! সেই মাছ টুকরি ভরে মহেশখালী বাজারে নিতেই পথিমধ্যেই সব মাছ বিক্রি হয়ে গেল। প্রথম দিনই মাছ বিক্রি হলো ৫০ টাকার মতো। আহা্! এতো টাকা খাবে কে শুনি! এরপর থেকে আমাদের দেখাদেখি মিলের আরও কয়েকজন ঠিক আমাদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে শুরু করে দিলো। সাথে মিল এলাকার স্থানীয় মানুষেও। সেসময় আমরা বন্ধ মিলের ভেতরে যাঁরা ছিলাম, তাঁরা সবাই দিনের বেলা থাকতাম খালের মাছ ধরার ধান্দায়, আর সন্ধ্যার পর থাকতাম নিজেদের যাত্রাপালার রিয়েসাল নিয়ে ব্যস্ত।

যাত্রার নাম, ‘চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে’। একসময় আমাদের রিয়েসাল শেষ হলো। ডাইরেক্টর ছিল স্বয়ং মিলের ফোরম্যান সাহেব নিজেই। ঈদের বাকি আছে দুইদিন। ফোরম্যান সাহেব যাত্রা করার জন্য মেকাপম্যান-সহ বাজনা দল ও প্রয়োজনীয় যা লাগে তা আনতে গেলেন চট্টগ্রাম। ঈদের আগের দিন থেকে এলাকায় মিলে যাত্রানুষ্ঠান নিয়ে পড়ে গেলো শোরগোল। ঈদের আগের দিন থেকেই যাত্রানুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরি করা-সহ অনেক বড় জায়গা জুড়ে উপরে তেরপাল দিয়ে ছাউনি দেওয়া হলো। সেই যাত্রাপালায় আমি একাই নিলাম দুই চরিত্র। আমাদের সাথে কোনও মেয়ে অভিনেত্রী ছিলো না। মেকাপম্যান ছিলো খুবই দক্ষ। “চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে” যাত্রাপালায় আমাদের থেকেই এক ছেলেকে নায়িকা বেছে নেওয়া হয়েছিল। ছেলেটাকে এমনভাবে মেকাপ করা হয়েছিল, তা দেখে এলাকার সবাই ছেলেটিকে মেয়েই ভেবে নিয়েছিল। আমার চরিত্র ছিলো, চাঁদ কুমারীর সখী। আমাকেও এমনভাবে মেকাপ করা হয়েছিল যে, আমাকে আর কেউ চিনতেই পারছিল না। আমার একা দুই চরিত্রের মধ্যে আরেকটি চরিত্র ছিল দাদা নাতি। ঈদের দিন সেই যাত্রানুষ্ঠান শেষ হতে রাত ভোর হয়ে গিয়েছিল। পরদিন এলাকার পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘নায়িকা কোথা থেকে আনা হয়েছিল।’ আমার বলতাম, ‘চট্টগ্রাম থেকে বায়না করে নায়িকা আনা হয়েছে।’ এটাই এলাকাবাসী বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু সত্য কথা কেউ বলিনি যে, নায়িকা তো আমাদের মধ্যেই একজন ছিল। বলিনি এলাকার দুশ্চরিত্র কিছু মানুষের ভয়ে। সেই মনের ভয় ক’দিন পরে এমনিতেই কেটে গিয়েছিল। এলাকার কেউ তখন আর এসব নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতো না। কিন্তু দেখা দিলো খালে মাছ ধরা নিয়ে নতুন বিপদ!

একসময় মাছ ধরা নিয়ে এলাকাবাসীর সাথে মিলের শ্রমিকদের মারপিট লেগে যাওয়া মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়ে গেলো। তখন আমরা কেউ আর বাজারে যেতে পারতাম না। যদিও বাজারে যেতেম, তাহলে থাকতাম এলাকার কিছু লোকের ভয়ে ভয়ে, গা ঢেক। আবার এলাকাবাসীর সাথে গণ্ডগোল সৃষ্টি হবার পর মিল কর্তৃপক্ষও একরকম ঘাবড়ে যায়। তখন মিল কর্তৃপক্ষ সবাইকে হুশিয়ার করে দেয় এভাবে– “যদি কেউ মিলের বাইরে এলাকার লোকের হামলার শিকার হয়, তাহলে মিল কর্তৃপক্ষ তার দায় নিবে না।” তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে, এখানে আর থাকা যাবে না। এই ভেবে একদিন আমরা পাঁচজন মিল থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। যাওয়া হবে কালুরঘাট। ইসলাম ভাই-সহ আরও তিনজন এর আগে কালুরঘাটই থাকতো। কাজ করতো চট্রগ্রাম পোর্টে জাহাজ থেকে মাল নামানোর কাজ। তাই মহেশখালী থেকে আবার সেখানেই কাজ করার জন্য যাওয়া হচ্ছে।

আমরা মহেশখালী থেকে চট্রগ্রাম কালুরঘাট গিয়ে ইসলাম ভাইয়ের পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা করলাম। আগের বাসা নেই। নতুন করে একটা বাসা ভাড়া করা হলো। রান্নাবান্না করার জন্য সবকিছু সংগ্রহ করা হলো। ইসলাম ভাই, আজাহার ভাই, হানিফ ভাই ও আফাজ ভাই আলরেডি কাজ করা শুরু করে দিলো। আমি জাহাজ থেকে চাল, গম, ভুট্টা-সহ আরও অন্যান্য মালামাল মাথায় করে নামাতে পারবো না দেখে, তাঁরা আমাকে বাসায় রান্না করার দায়িত্ব দিয়ে কাজে চলে যেতো। এর চার-পাঁচ দিন পর একদিন বিকালবেলা আমার বড়দাদা মহেশখালী জাকিরিয়া সল্ট মিলে গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তখন মিল ম্যানেজার আমার বড় দাদাকে আনুমানিকভাবে কালুরঘাটের ঠিকানা-সহ ইসলাম, আজাহার, হানিফ ও আফাজ ভাইয়ের নাম লিখে দেয়। আমার বড়দাদা সেই ঠিকানা মতো গিয়ে আমাকে খুঁজে বের করে এবং ইসমাইল, আজাহার, হানিফ ও আফাজ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিনই দিবাগত রাতে বড়দাদা আমাকে টিকেট-সহ ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দেয়। বড়দাদা চলে যায় আমার ছোট কাকার বাড়ি পার্বত্যচট্টগ্রামের রামগড় গুইমারা বাজার।

আমি পরদিন ভোরবেলা কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে নারায়ণগঞ্জের ট্রেনে চড়ে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ, তারপর পায়ে হেঁটে চলে যাই আদর্শ কটন মিলে। মিলে পৌঁছার সাথে সাথে শুরু হয় ঘরে থাকা মা-বাবা, বড় এক দিদি ও বৌদির কান্না-কাটি। বাবা তখন প্রায়ই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল। এর দুইদিন পরই আবার শুরু করলাম আদর্শ কটন মিলে ১২ টাকা রোজে ডেইলি কাজ। এর দুইমাস পর-ই বাবা পর-পারে পাড়ি দেয় স্বর্গের ঠিকানায়। আমি তখন আদর্শ কটন মিলে ছিলাম না। আমি ছিলাম, কুমিল্লা দাউদকান্দি থানাধীন গৌরীপুর সংলগ্ন মলয় বাজার সন্নিকটে চিনামুড়া গ্রামে সেজো দিদির বাড়ি। বাবার মুখখানা আর শেষ দেখা আমি দেখতে পারিনি। মেজো দিদির বাড়ি থেকে আসলাম এর পরদিন। বাসায় গিয়ে দেখি মায়ের পরনে সাদা কাপড়। বড় দাদার পরনে সাদা মার্কিন কাপড়। হাতে বগলে কুশান। গলায় সাদা কাপড়ে চিকন দড়ির মতো মালার সাথে একটা লোহার চাবি ঝুলানো। সেদিনই সেই বেশ আমারও ধরতে হয়েছিল।

চলবে…

জীবনের গল্প-৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৭

জীবনের গল্প-৬-এর শেষাংশ: সেখানেই ওঁরা কাজ করবে।’ এই বলেই কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের এই নির্মাণাধীন ভবনে রেখে উনার বাসায় চলে যায়। আমারা রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁরমতো ঘুমিয়ে পড়ি। রাত পোহালেই যেতে হবে মহেশখালী।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আমারা তিনজন একসাথে ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। আমরা তিনজন চলে যাবো বলে ম্যানেজার সাহেব স্বইচ্ছায় আমাদের নিয়ে চলে আসলো টিলার নিচে চায়ের দোকানে। চারজন একসাথে বসে চা-বিস্কুট খেলাম। চা-বিস্কুটের দাম ম্যানেজার সাহেব নিজেই দিয়ে দিলেন, আমাদের কাউকে আর দিতে দিলেন না। তিনি আগেও পকেট খরচ করার জন্য নিজের পকেট থেকে সময় সময় আমাদের এক টাকা দুই টাকা করেও দিতেন। কিছুক্ষণ পর হয়তো কন্ট্রাক্টর সাহেব এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। তাই আমাদের জন্য ম্যানেজার সাহেব খুবই আফসোস করলেন। বিশেষ করে আমরা তিনজন ঢাকাইয়া হওয়াতে ম্যানেজার সাহেব আমাদের খুবই পছন্দ করতেন, আদরও করতেন। কাজের ফাঁকে খোঁজখবর রাখতেন। আমাদের পারিবারিক বিষয় নিয়েও আলাপ করতেন। আমাদের কাজ করার সাহস দিতেন। আমরাও ম্যানেজার সাহেবকে সম্মান করতাম। উনার কথা ছাড়া এক পা-ও নড়তাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হয়তো আমরা আর এখানে থাকছি না। তাই ম্যানেজার সাহেবের মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। মহেশখালী গিয়ে সেখানে ভালোভাবে কাজ করার জন্যও ভালো উপদেশও দিলেন। ভালোভাবে চলার জন্য বললেন। মহেশখালী এলাকার স্থানীয় লোকজনের স্বভাবচরিত্র কেমন এবং তাঁদের সাথে কীভাবে চলাফেরা করবো, সে বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনাও দিলেন।

চায়ের দোকানে ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে বলতেই কন্ট্রাক্টর সাহেব বেবিট্যাক্সি চড়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হলেন। আমাদের তাড়াতাড়ি করে টিলায় গিয়ে বেডিংপত্র নিয়ে আসতে বললেন। আমরা টিলার উপরে গিয়ে বেডিংপত্র গোছগাছ করে বেঁধে সবার সাথে দেখা করে টিলার উপর থেকে নিচে নেমে আসলাম। ম্যানেজারের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে কন্ট্রাক্টর সাহেবের সাথে মহেশখালীর উদ্দেশে রওনা হলাম। বেবিট্যাক্সি চড়ে আসলাম কক্সবাজার যাওয়ার নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ডে। তখনকার সময়ে চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজারের বাস ভাড়া ছিল জনপ্রতি ১০ টাকা। বাসে ওঠার আগে কন্ট্রাক্টর সাহেব এক হোটেলে নিয়ে আমাদের নাস্তা খাওয়ালেন।

এরপরই কন্ট্রাক্টর সাহেব-সহ চারজন বাসে উঠে বাসলাম। তখন চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে কয় ঘণ্টা সময় যে লেগেছিল, তা বলতে পারবো না। তবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে প্রায় বিকাল হয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নেমে আবার এক হোটেলে গিয়ে চারজনে ভাত খেয়ে মহেশখালী যাওয়ার ট্রলার ঘাটে আসলাম। তখন কক্সবাজার থেকে মহেশখালী যেতে ট্রলারে জনপ্রতি ২ টাকা করে ভাড়া ছিল। ট্রলারে চড়ে মহেশখালী যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ট্রলার থেকে নেমে আবার এক চায়ের দোকানে চা পান করতে করতে কন্ট্রাক্টর সাহেব লোক মারফত উনার ম্যানেজারকে খবর পাঠালেন। ম্যানেজার সাহেব আসলেন। দুইজনে আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে গেলেন।

থাকার জায়গায়টা হলো, মহেশখালী বাজার থেকে নতুন বাজার যাওয়া রাস্তার পাশে থাকা সরকারি খাদ্য গোডাউন। সেই গোডাউনে তখন সরকারি কোনও খাদ্যশস্য মজুদ ছিল না। অনেক বড় পাকা দালানের গোডাউন। সেই গোডাউনেই হলো আমাদের তিনজনের থাকার জায়গা। সাথে নেওয়া বেডিংপত্র গোডাউনের এক কোণে রেখে কন্ট্রাক্টর সাহেবের সাথে বাজারে আসলাম। তিনি আমাদের হাঁড়িপাতিল-সহ ১০-১২ দিনের চাল, ডাল, তেল, লবণ যা লাগে প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে দিলেন। তিনজনকে নগদ ১০০ টাকা করে হাত খরচ দিলেন। সেখানকার কাজের সাইটে থাকা ম্যানেজারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং কবে থেকে কাজ শুরু হবে তা ম্যানেজার সাথে বুঝ পরামর্শ করতে বললেন। আর আমাদের যখন যা দরকার হয়, তা ম্যানেজারকে দিতে বললেন। এরপর তিনি মহেশখালী থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলেন। আমরা থেকে গেলাম মহেশখালী।

কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর, আমরা তিনজন মহেশখালী বাজার থেকে মাছ-সহ কিছু কাঁচা তরিতরকারি কিনলাম। সাথে রান্না করার জন্য এক গাট্টি লাড়কিও কিনলাম। গোডাউনে এসে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রান্না করার চুলা তৈরি করলাম। একজন মাছ কাটছে। একজন ভাত রান্না করতে চাল ধুয়ে নিচ্ছে। আমি চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। এক তরকারি-সহ ভাত রান্না হয়ে গেল। তিনজনে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁর বিছানা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার আলুসিদ্ধ ভাত রান্না করে খেয়ে-দেয়ে কাজের ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। ম্যানেজার সাহেব উনার সাথে আমাদের কাজের সাইটে নিয়ে গেলেন। আমাদের যেই কাজের জন্য মহেশখালী নেওয়া হলো, সেই কাজটা হলো মহেশখালী থেকে সোজা পশ্চিমে নতুন বাজার পর্যন্ত মোট ১৩ মাইল সিসি ঢালাই রাস্তা তৈরির কাজ।

ম্যানেজারের সাথে কাজের সাইটে গিয়ে দেখা গেল, সেখানকার স্থানীয় লেবাররা সেদিন তখনো কেউ সাইটে আসেনি। ম্যানেজার সাহেব কাজের সাইটে কোথায় কী কী মাল আছে তা দেখিয়ে দিলেন। সেদিন সেখানে ম্যানেজার-সহ আমরা সেখানকার স্থানীয় লেবারদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু কারোর কোনও খবর হচ্ছিল না দেখে ম্যানেজার সাহেব সেদিনের জন্য কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে আমাদের নিয়ে সোজা মহেশখালী বাজারে চলে আসে। সেদিনের জন্য আমরা পুরোপুরি ফ্রি হয়ে গেলাম। আমাদের কাছ থেকে ম্যানেজার বিদায় হবার পর, আমরা মহেশখালী পুরো বাজারটা ঘুরে-ফিরে দেখে চা-বিস্কুট খেয়ে দুপুরের আগে আমাদের গোডাউনে চলে আসি। নিজেরা রান্নাবান্না করে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার তিনজনে মহেশখালী বাজারের দক্ষিণ পাশে সাগর পাড়ে ঘুরা-ঘুরি করে করে সন্ধ্যাবেলা চলে আসলাম নিজেদের থাকার জায়গা গোডাউনে।

পরদিন সকাল হতে-না-হতেই সেখানকার স্থানীয় লেবাররা গোডাউনে এসে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে ওঠালো। তাড়াতাড়ি ভাত রান্না না করেই মহেশখালী বাজারে গিয়ে নাস্তা করে তাঁদের সাথে কাজে যোগদান করি। সেদিন কাজ করে স্থানীয় লেবারদের সাথে পরিচিত হলাম। পরদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি আর থামছিল না। সারাদিন গোডাউনে আর বাজারে ঘুরা-ঘুরি করে সময় শেষ করলাম। এভাবে সেখানে প্রতিদিন হাঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির কারণে সেই কাজ আর আমরা বেশিদিন করতে পারিনি। প্রতিদিন সারাদিনের মধ্যে একবেলাও ঠিকমতো কাজ চলছিল না। ম্যানেজার সাহেবও আমাদের ঠিকমতো বাজার সাদাই করার খরচ দিচ্ছিল না। কন্ট্রাক্টর সাহেবেরও খবর ছিল না। তখনকার সময়ে এখনকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ফোনও ছিল না। কন্ট্রাক্টর সাহেবের ডাক ঠিকানাও আমাদের জানা ছিল না। তাই নিজেদের পকেট খরচের কথা চিন্তা করে গোডাউনে থেকেই কাজ না থাকলে অন্য কাজ খুঁজতে থাকি।

একসময় বাজারে আসা-যাওয়ার মাঝেই এক লোকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল। লোকটির নাম মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া । তিনি মহেশখালী বাজারের উত্তরে জাকিরিয়া সল্ট নামে এক লবণের মিলে কাজ করতো। তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের সব বিষয়-আশয় জানলেন, শুনলেন। আমাদের কোনপ্রকার চিন্তা না করার পরামর্শ দিলেন এবং জাকিরিয়া সল্টে তাঁদের সাথে কাজ করার ব্যবস্থা করে দিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। তিনি জাকিরিয়া সল্টে গিয়ে উনার আরও তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আমাদের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। এরপর দুইদিন যেতে-না-যেতেই তিনি ইসমাইল মিয়া আমাদের কাজ রেডি করেছেন বলে জানালেন। কিন্তু আমরা গোডাউন খালি রেখে তিনজন একসাথে যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ এরমধ্যেই যদি কন্ট্রাক্টর সাহেব চট্টগ্রাম থেকে এখানে এসে আমাদের খুঁজে না পায়, তাহলে হয়তো আমাদের গার্ডিয়ানের ভয়ে মহেশখালী বাজারে থাকা থানায় জিডিও করতে পারে। সেজন্য আমরা তিনজন একসাথে এখান থেকে সরাসরি লবণের মিলে কাজে যোগদান করতে রাজি হয়েছিলাম না।

তখন ইসমাইল মিয়া আমাদের বুদ্ধি দিলেন সপ্তাহে একজন করে রাস্তার কজা ছেড়ে লবণের মিলে কাজে যোগদান করতে। আমরা তা-ই রাজি হয়ে আগে আমাদের সাথে থাকা লোকমান নামে লোকটিকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে কাজ করার জন্য সুপারিশ করি। প্রতিদিন কাজের মজুরি ২৫ টাকা। আহা্! শুধু টাকা আর টাকা! এতো টাকা খরচ করেও শেষ করা যাবে বলে আমারা তিনজনই মনে মনে হিসাব কষতে ছিলাম। পরদিন সকালে লোকমান নামে বন্ধুটিকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে পাঠালাম। লোকমান লবণের মিলে কাজে লেগে গেলেন। আমরা দুইজন রাস্তার কাজেই থেকে গেলাম কন্ট্রাক্টর সাহেবের আগমণের আশায়। কিন্তু না, বেশকিছু দিন গত হয়ে গেলেও যখন আর কন্ট্রাক্টর সাহেব আসছিলেন না, তখন একদিন জাকিরিয়া সল্ট মিলের ইসমাইল মিয়ার শরণাপন্ন হলাম। ওই রাস্তার কাজ থেকে সরিয়ে আনতে আমাদের পক্ষ হয়ে ওই কাজের ম্যানেজারের সাথে আলাপ করার জন্য অনুরোধ করালাম।

তখন ইসমাইল মিয়া তাঁর আরও দুইতিন জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিয়ে একদিন বিকালবেলা ম্যানেজারের সাথে আলোচনা করে আমাদের দুইজনকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে কাজে লাগিয়ে দেয়। আমরাও জাকিরিয়া সল্ট মিলে নিয়মিত কাজ করতে থাকি, দৈনিক মজুরি ২৫ টাকায়। এটাই ছিল আমার কোনও এক মিল ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনের প্রথম চাকরি। হোক সেটা লবণের মিল। তাই এই চাকরি নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে এক অনলাইন দিনলিপিতে “জীবনের প্রথম চাকরি” শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাইটের লিংক লেখার মাঝে দেওয়া হলো।
চলবে…

জীবনের গল্প-৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৬

জীবনের গল্প-৫-এর শেষাংশ: মেজো দিদি মারা যাবার চার-পাঁচ মাস পর জামাইবাবু আরেক বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করে। দিদির রেখে যাওয়া এক বছরের মেয়েটি শেষতক আমাদেরই লালন-পালন করতে হয়। মেজো দিদির মৃত্যুর পর বাবার অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে।

মেজো দিদি মারা যাওয়ার পর বাবার অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, তখন আর বাবাকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলে গিয়ে ঔষধ খরচের টাকাও আনা সম্ভব হচ্ছিল না। চিত্তরঞ্জন মিল কর্তৃপক্ষও বাবার অনুপস্থিতে স্বাক্ষর বিহীন টাকা আমাদের কারোর কাছে দিতো না। মাস শেষে বাবার বেতনের টাকা তোলার জন্যও বাবাকে আদর্শ কটন মিল থেকে রিজার্ভ নৌকা করে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের নদী ঘাটে নৌকা বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। তারপরও মাসের বেতন হাতে পেতে মাস শেষে বাবাকে নিয়ে দুই-তিন চিত্তরঞ্জন কটন মিলে যেতে হতো। এভাবে চলতে চলতে আমাদের সংসারের অবস্থাও দিন-দিন খারাপ হতে থাকে। সেইসাথে আমার লেখাপড়াও মাটির সাথে মিশে যেতে থাকে। মোটকথা তখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে সপ্তাহের প্রত্যেকদিন ১০ টাকা মজুরিতে নিয়মিত কাজ করতে লাগলাম।

একসময় বাবাকে আর কোনও অবস্থাতেই নৌকায় করেও চিত্তরঞ্জন কটন মিলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তখন উপায়ন্তর না দেখে বাবা চিত্তরঞ্জন কটন মিলের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার জন্য অবসরপত্র জমা দেয়। সেই অবসরপত্র মিল কর্তৃপক্ষের কাছে গৃহীত হয় একমাস পর। তারও দুইমাস পর বাবার চাকরির সার্ভিসের বিভিন্ন ভাতা-সহ টোটাল হিসাব হাতে পেয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে আমাদের ৮ সদস্যের সংসার যে কীভাবে চলেছিল, তা আর আমার এই লেখায় তুলে ধরতে পারলাম না, শর্টকাট করে বলে ফেলি।

বাবা চাকরি ছাড়ার দরখাস্ত দেওয়ার পর সংসারের করুণ অবস্থা দেখে আমি আদর্শ কটন মিলের ডেইলি কাজও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ প্রতিদিন কাজ থাকতো না! দুইদিন কাজ হতো, তো দুইদিন থাকতো না। এভাবে তো সে-অবস্থায় অন্তত আমার হচ্ছে না। কারণ হলো, অভাবগ্রস্থ সংসার তো ছিলোই, তারপরও ছিল আমার বাড়তি পকেট খরচ। যেমন– কাজের খাতিরে সহ-লেবারদের সাথে থেকে চা-বিড়ি-পান-সহ আরও নানারকম খরচ আমার এমনিতেই বেড়ে গিয়েছিল। যা দৈনন্দিন জীবনে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ওই লেবারদের সাথে কাজ করতেই গিয়েই, স্কুলে থাকতেই বিড়ি টানার বদভ্যাসটা হয়েগিয়েছিল। কাজ না থাকলে স্কুলে যাবার সময় নারায়ণগঞ্জের কাইয়ুম দু’চারটা পকেটে করে সাথে নিয়ে যেতাম। সময় সুযোগ বুঝে স্কুলের বাইরে গিয়ে ফুছুর-ফাছুর টনে আবার ক্লাসে আসতাম। যখন স্কুলে যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়ে ওঁদের সাথে নিয়মিত কাজ করতে লাগলাম, পান-বিড়ি-সিগারেটও নিয়মিত টানতে লাগলাম। তখন চা-বিড়ি ছাড়া আমার মোটেও চলচ্ছিল না। তাই একদিন কাজ করে দুইদিন বসে থাকাটাও আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্যতামূলক আদর্শ কটন মিলের ডেইলি কাজ ছড়ে দিয়ে নতুন করে এক মসজিদ নির্মাণের কাজে লাগে গেলাম। মসজিদ তৈরি হচ্ছিল আদর্শ কটন মিলের ভেতরেই।

মসজিদের নির্মাণ কাজে সপ্তাহের প্রতিদিনই কাজ চলবে। সপ্তাহে শুধু একদিন সপ্তাহিক ছুটি থাকবে। আমার সাথে মিলের ভেতরে থাকা সমবয়সী আরও দুইজন লেবার ছিল। আমরা তিনজনে দৈনিক ১০ টাকা মজুরিতে নিয়মিত মসজিদ নির্মাণের কাজ করতে থাকি। সেই মসজিদ নির্মাণের কন্ট্রাক্টর ছিলেন চট্টগ্রামের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আমাদের কাজ দেখে সেই কন্ট্রাক্টরের পছন্দ হয়ে যায় এবং তিনি আমাদের চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে ইচ্ছাপোষণ করে। তখন আদর্শ কটন মিলের মসজিদ নির্মাণের কাজের সাথে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় উনার আরও কাজ চলছিল।

আমি ছিলাম ঢালাই মাল বানোর মধ্য সেরা একজন। কন্ট্রাক্টর সাহেব বিশেষ করে আমার কাজ দেখেই পছন্দ করেছিল। তিনি প্রতিদিনই বিকালবেলা কাজ শেষে তাঁর সাথে চট্রগ্রাম যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতো। চট্টগ্রাম গেলে আমরা আরও ২টাকা রোজ বেশি পাবো বলেও কন্ট্রাক্টর সাহেব বলতো। এই ২ টাকার লোভে আমার সাথের দুইজন রাজি হয়ে গেল। কিন্তু আমি রাজি হচ্ছিলাম না, মা যদি যেতে না দেয়, তাই। তাছাড়া বাসায় অসুস্থ বাবা শয্যাশায়ী। সংসারের ভার বড়দাদা একা কোনমতেই সইতে পারবে না, সেই চিন্তাও আমার মাথায় ছিল। কিন্তু প্রতিদিন সাথের দুই জনের খোঁচানিতে আর ঠিক থাকতে পারলাম না, ওঁদের সাথে যাবো বলে কথা দিলাম। কিন্তু আমি আমার মা’কে না জানিয়ে কোনও অবস্থাতেই চট্টগ্রাম যাবো না, তাও বলেছিলাম।

ওঁদের সাথে কথা দিয়ে একদিন মাকে জানালাম চট্রগ্রাম যাবার কথা। মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বাবা বড়দাদা তো না-না-না-এর মধ্যেই থেকে গেল। কিন্তু কন্ট্রাক্টর সাহেব, আর সাথের দুইজনের তাগাদায় একসময় আমিও তাঁদের কথা দিলাম, মা রাজি থাকুক আর না থাকুক; চট্রগ্রাম যাবোই। তবে চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে কন্ট্রাক্টর সাহেবকে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে অগ্রীম দিতে হবে এবং যাওয়ার ভাড়া ও কাজে যোগদান করার আগ পর্যন্ত আমাদের খাওয়া খরচও দিতে হবে। কন্ট্রাক্টর সাহেব তা রাজি হয়ে গেলো। আমরাও খুশিতে হলাম আটখানা। মনে মনে ১২ টাকা খরচের হিসাব কষতে লাগলাম। ১২ টাকা থেকে প্রতিদিন ৫ টাকা খরচ করে বাকি ৭ টাকা বাসায় পাঠাতে পারলেই, মা-ও হবে খুশিতে আটখানা।

মনে মনে এই হিসাব মাথায় রেখে বাসায় আসলাম। মাকে অনেক লোভ দেখালাম, যাবার আগে ১০০ টাকা দিয়ে যাবো বলে কথা দিলাম। আর প্রতিমাসে মানি অর্ডার করে টাকা পাঠাবো, সেটাও বললাম। আমার কথায় মা-ও লোভে পড়ে রাজি হয়ে গেল। আসার একদিন আগে অগ্রীম বাবদ পাওয়া ১০০ টাকা মায়ের হাতে দিলাম। ১০০ টাকা হাতে পেয়ে মা অনেক খুশি হলেন। মা বাবা ও বড় দাদাকে না জানিয়ে তা মনেই রেখে দিলেন। আসার সময় মা আমাকে ২০ টাকা খরচ করার জন্য সাথে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিলেন। আমরা তিনজন আদর্শ কটন মিল থেকে কন্ট্রাক্টরের সাথে চট্রগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। ওঁরা সাথে করে ওঁদের বেডিংপত্র নিয়ে নিলো। আমিও দুটো কাঁথা, একটা বালিশ, দুটো লুঙ্গি-সহ আমার পড়ার বইগুলো গাট্টির ভেতরে ঢুকিয়ে বেঁধে নিলাম। উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম গিয়ে কাজের অবসরে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার। আমার সাথে যে দুইজন লেবার চট্টগ্রাম যাচ্ছে, তাঁদের একজনের নাম ইসরাফিল, অন্যজনের নাম মোহাম্মদ লোকমান হোসেন। আদর্শ কটন মিলের আসার পর থেকে এই দুইজনই আমার খোঁজখবর বেশি রাখাতো। সবসময় কাজও করতাম ওঁদের সাথে। চট্রগ্রামও যাওয়া হচ্ছে ওঁদের ইচ্ছার কারণেই।

একসময় যাঁর যাঁর মা-বাবার কাছে বলেকয়ে কন্ট্রাক্টর সাহেব-সহ আমারা চট্রগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। তখন ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চট্রগ্রামের ভাড়া ছিল জনপ্রতি ২০ টাকা। একসময় ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে কন্ট্রাক্টর-সহ আমরা তিনজন চট্রগ্রাম পৌছলাম। সকালে ট্রেন থেকে নামার পর কন্ট্রাক্টর সাহেব প্রথমে আমাদের তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। তিনজনকে নাস্তা খাওয়ালেন। একটু বিশ্রাম করতে দোতালা বাসার বারান্দায় শুতে দিলেন। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকালবেলা কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের সাথে করে আজডিপুর নামক স্থানে এক টিলার উপরে নিয়ে গেলেন।

সেই টিলার উপরে এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর বাসভবন নির্মাণের কাজ চলছিল, নির্মাণ কাজের কন্ট্রাক্ট ছিল এই কন্ট্রাক্টর সাহেবেরই। সেখা গিয়ে কাজের দেখবাল করার দায়িত্বে থাকা কন্ট্রাক্টরের ম্যানেজারকে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে কন্ট্রাক্টর সাহেব তাঁর বাসায় ফিরে গেলেন। সেদিন সেই টিলার উপরই আরও লেবারদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করে নির্মাণাধীন ভবনে সবার সাথে আমারাও ঘুমিয়ে পড়ি। রাত শেষে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে লেবারদের রান্না করা ডাল-ভাত খেয়ে আমাদের কী কাজ করতে হবে তা জানতে গেলাম, ম্যানেজারের কাছে। ম্যানেজার সাহেব আরও চার-পাঁচজন লেবারদের সাথে টিলার নিচ থেকে উপরে বালু ওঠানোর কথা বললেন।

টিলাটা ছিল পাহাড়ের মতো উঁচু। অনেক উঁচু টিলা হলেও সেখানকার পার্মানেন্ট লেবারদের কাছে যেন কোনও ব্যাপারই মনে হচ্ছিল না। তাঁরা দস্তুরমত বালুর টুকরি মাথায় নিয়ে দৌড়ে টিলার উপরে ওঠানামা করতে লাগলো। কিন্তু সেই কাজ আমাদের তিনজনের পক্ষে তা দুই ঘণ্টাও করা সম্ভব হচ্ছিল না। একসময় আমারা অস্থির হয়ে টিলার নিচেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমাদের এ অবস্থা দেখে সেখানকার স্থায়ী লেবাররা কেউ হাসাহাসি করতে লাগলো।কেউ দৌড়ে গিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে খবর দিলো। ম্যানেজার দৌড়ে টিলার নিচে আসলো। ম্যানেজার সাহেব টিলার নিচে নিচে আসলো। বালুর স্তুপের সামনে এসে ম্যানেজার সাহেব দেখে আমরা তিনজন পাহাড়ের লালমাটির উপর চিৎপটাং হয়ে মরার মতো পড়ে আছি। ম্যানেজার সাহেব আমাদের টেনে ওঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই কাজ আমরা পারবো কি-না?’ আমরা হাতজোড় করে মাথা নেড়ে না-ই করলাম। আমাদের হাতজোড়ে ম্যানেজার সাহেবের দয়া হলো।

ম্যানেজার সাহেবে আমাদের সাথে করে নিকটস্থ রাস্তার পাশে এক দোকানে নিয়ে গেলো। যাঁর যাঁরমতো চা-বিস্কুট খেতে বললো। আমরা ক্লান্ত শরীরে বেশ কয়েকটা পাউরুটি-সহ পান-বিড়ি হজম করলাম। আমাদের সাথে ম্যানেজার সাহেবও চা পান করলেন। এরপর টিলার উপরে নিয়ে হালকা-পাতলা অন্য কাজ আমাদের বুঝিয়ে দিলেন। আমরা তিনজন বুঝিয়ে দেওয়া সেই কাজ মনোযোগ সহকারে করতে লাগলাম। এক সপ্তাহ পর কন্ট্রাক্টর সাহেব কাজের সাইটে আসলেন। সবার কাজের মজুরি বুঝিয়ে দিলেন। আমাদেরও সেই কথামতো দৈনিক ১২ টাকা হারে বুঝিয়ে দিলেন। তা নিয়ে সেখানকার স্থায়ী লেবারদের সাথে কন্ট্রাক্টর সাহেবের একটু মন কষাকষিও হয়েছিল।

সেখানকার লেবারদের কথা হলো, ‘ওঁরা কোনও কাজই পারে না, অথচ ওঁদের মজুরি ১২ টাকা। আর আমাদের মজুরি ১০ টকা হবে কেন?’ ওখানকার লেবারদের কথা শেষে কন্ট্রাক্টর আমাদের কাজের বর্ণনা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওঁরা যা পারে, তা তোমরা আরও দুইবছরেও শিখতে পারবে না। আর আমি ওঁদের ঢাকা থেকে এখানকার কাজের জন্য আনিনি। ওঁদের এনেছি মহেশখালীতে রাস্তা নির্মাণ কাজের জন্য। ওঁরা শুধু আজ রাত পর্যন্তই এখানে থাকবে। গতকাল সকালেই আমি ওঁদের সাথে করে মহেশখালীর উদ্দেশে রওনা দিবো। সেখানেই ওঁরা কাজ করবে।’ এই বলেই কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের এই নির্মাণাধীন ভবনে রেখে উনার বাসায় চলে যায়। আমারা রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁরমতো ঘুমিয়ে পড়ি। রাত পোহালেই যেতে হবে মহেশখালী।

চলবে…

জীবনের গল্প-৭ এখানে।

জীবনের গল্প-১’এখানে।

জীবনের গল্প-৫

জীবনের গল্প-৪-এর শেষাংশ: ওইদিন সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ! বড়দাদা আর মা বাবাকে ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে প্রথমে চিত্তরঞ্জন কটন মিলে আনে। তারপর বাসায় আসলো রাত দশটার সময়। বাবার অবস্থা তখন বেশি ভালো ছিল না। ওইদিন বাসার সবাই মিলে সারারাত বাবার পাশে বসে রাত পার করেছিলাম।

বাবার হাতের অবস্থা দিন-দিন খারাপ হতে লাগলো।একদিন পর-পর আমি নাহয় আমার মা বাবাকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের অফিসের সামনে ফকির মিসকিনের মতো বসে থাকতাম, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাহায্যে বাবার ঔষধ কেনার টাকার জন্য। দুই-তিন দিন ঘুরা-ঘুরির পর একদিন তাঁদের দয়া হতো, নাহয় আরও দুই-তিন গিয়ে অফিসের সামনে ভিক্ষুকদের মতো বসে থাকতে হতো। মাস শেষে মূলবেতন পাওয়া যেতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দয়ার উপর নির্ভর করে। তাও মিলের সব শ্রমিকদের বেতনের পরই পাওয়া যেতো। একারণে আমাদের সংসারে তখন নতুন করে দেখা দিলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সংসার চলতো একমাত্র বড় দাদার বেতনে। তখন বড়দাদা যেই টাকা বেতন পেতো, সেই টাকায় আমাদের ৯ সদস্যের সংসার ১৫ দিনও চলার মতো ছিল না। দোকান বাকি জমতে জমতে একসময় গলা সমান গয়ে গেলো। সাথে শেষ হয়ে যাবার উপক্রম হলো আমার লেখাপড়া। বাবা অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমার স্কুলে যাওয়াও আগের চেয়ে কমে গেলো। সপ্তাহে দুইদিন স্কুলে গেলে বাকি চারদিন স্কুলে থাকতাম অনুপস্থিত। বাসায়ও বই নিয়ে কখনো পড়তে বসতাম, সময়তে পড়তাম না। পড়তে বসতে মনও চাচ্ছিল না, বাবার অসুস্থতার কারণে।

স্কুলে না গিয়ে সারাদিন থাকতে হতো বাবার সাথে, আর মিলের ডেলি কাজ পাবার আশায়। একদিন কাজ পেতাম, দুইদিন বসা থাকতাম। এভাবে কেটে গেলো কয়েকমাস। এভাবে আমার কিছুতেই মন ভালো লাগছে না। তখন সংসারের অভাব আর বাবার হাতের ব্যথার ডাক-চিৎকারে আমার ঘরেই থাকতে মন চাচ্ছিল না। একদিন একটা চুক্তি কাজ পেলাম। কাজটা হলো মাটি কাটার কাজ। আমরা ছিলাম ছয়-সাত জন। দুইদিন মাটি কাটার কাজ করে ৩৫টাকা হাতে পেলাম। সেই টাকা পেয়ে সাথের একজনের সাথে আলাপ করলাম, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে কাঁচা বাদাম এনে বাসায় ভেজে বিকাল বিকাল মিলের গেইটে বসে বিক্রি করলে কেমন হয়!’ লোকটা বললো, “ভালোই তো হবে। বাদামে লাভ আছে! করতে পারলে ভালো হবে।” এর পরদিন আমি ৩৫ টাকা সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নারায়ণগঞ্জ গেলাম কাঁচা বাদাম আনতে। ২০ টাকা দিয়ে ৪ সের কাঁচা বাদাম কিনলাম। ছোট দাঁড়িপাল্লা-সহ প্রয়োজনীয় বাটখারাও কিনে আনলাম। মাকে বললাম, বাদামগুলো ভেজে দিতে। আমার মা তো আগেই মূড়ি ভাজার ওস্তাদ ছিলেন। তাই কীভাবে বাদাম ভাজতে হবে, তা আর মাকে কিছুই বলতে হয়নি। মা বালুর সাহায্যে খুব সুন্দরভাবে বাদাম গুলো ভাজলেন। আমি পরদিন বিকালবেলা একটা মুড়ির টিনে করে বাদাম নিয়ে মিলের গেইটে গিয়ে বসলাম, বিক্রি করার জন্য।

সেসময় আদর্শ কটন মিলের গেইটের সামনে আর কেউ বাদাম বিক্রি করতো না। গেইটের সামনে আমিই ছিলাম একমাত্র বাদামওয়ালা। মায়ের হাতে ভাজা বাদাম গুলো ১০ টাকা সের দামে, আধা ছটাক, এক ছটাক, আধা পোয়া, একপোয়া করে মুহূর্তে সব বাদাম শেষ করে ফেললাম। লাভ হলো ১০-১২ টাকার মতো। পরদিন সকালে আবার কাঁচা বাদাম আনতে চলে গেলাম নারায়ণগঞ্জ। এদিন কাঁচা বাদাম আনলাম ৫ সের। সেগুলো ভাজে আগের দিনের মতো বিকালবেলা আবার মিল গেইটের সামনে গিয়ে বসলাম। এদিনও সব বাদাম বিক্রি করলাম। এভাবে প্রতিদিন সকালবেলা আমি নারায়ণগঞ্জ পায়ে হেঁটে যেতাম, আবার বাদাম মাথায় করে পায়ে হেঁটে বাসায় আসতাম। আমার এরকম কষ্ট দেখে একদিন আমার বড়দাদা আমাকে ৫০ টাকা হাতে দিলেন, বেশি করে বাদাম আনার জন্য। যাতে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ যেতে না হয়। তা-ই করলাম। বড় দাদার দেওয়া ৫০টাকা আর আমার কাছে থাকা কিছু টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে একসাথে ২০ সের (আধা মণ) কাঁচা বাদাম কিনে আনলাম। এতো অন্তত ৫/৬ দিন নারায়ণগঞ্জ যাওয়া-আসার ভেজাল শেষ করলাম।

প্রতিদিন ৪-৫ সের বাদাম মিল গেইটে নগদে বাকিতে মিলিয়ে বিক্রি করতাম। বিক্রি করে যা পেতাম, সব মায়ের কাছে এনে দিতাম। লাভের টাকা থেকে মা কিছু সংসারেও খরচ করতো। টুকটাক বাবার ঔষধে খরচ আনতো। মায়ের পান-সুপারি আনতো। আমি মাঝে-মধ্যে স্কুলে যাওয়া সময় আমাকেও চার আনা, আট আনা দিতো। এভাবেই চলতে থাকলো আমাদের দুর্ভিক্ষের সংসার। তখন আমাদের দুর্ভিক্ষপীড়িত সংসারের দায়িত্ব যেন বড় দাদার সাথে আমার উপরেও বর্তাল। আমি তখন মাঝে-মধ্যে স্কুলে যেতাম। বাবাকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলেও যাতাম। আবার প্রতিদিন বিকালবেলা শ্রমিকদের ছুটি হবার আগেই মিল গেইটে বাদামের টিন নিয়ে বসে থাকতাম। বাদাম বিক্রি শেষে আবার সময়তে সন্ধ্যার পর ওই ডেলি লেবারদের সাথেও কাজ করতাম। তবু্ও আমরা দুই ভাই আমাদের ৯ সদস্যের সংসারে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে কোনো-কোনো দিন রাতে কিম্বা সকালে দুপুরে না খেয়ে থাকতাম।

এরমধ্যেই কুমিল্লা গৌরীপুর থেকে আমার এক বোনের বড় সেজো দিদির বিবাহের প্রস্তাব আসে। ছেলে ভালো। দাবি-দাওয়া নেই। নগদ টাকা, সোনা-দানা কিছুই দিতে হবে না। এমনকি আমাদের এখানে বিবাহ অনুষ্ঠানও করতে হবে না। বিবাহের দিন বড় দিদিকে ছেলে পক্ষ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে তাঁদের নিজ খরচে। এ-বাবদ আমাদের এক টাকাও খরচ করতে হবে না। আমাদের পাশে থাকা গৌরাঙ্গ কাকা-সহ মিল কোয়ার্টারের আরও অনেকেই বিয়েতে মত দিয়ে বলেছে, যদি আমার মা মেয়ে দিয়ে দিতে রাজি হয়; তাহলে আমরা সম্মিলিতভাবে মিলের সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের কাছ থেকে সাহায্য উঠিয়ে বিবাহের কাজ শেষ করবো। সবার কথা শুনে আমার মা ও বড় দাদা আরও দশজনকে সাথে নিয়ে কুমিল্লা ছেলেদের বাড়ি গিয়ে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে আসলো।

এরপর মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেক্রেটারি-সহ ইউনিয়নের আরও সদস্যবৃন্দ বসে মিলের সকল শ্রমিকদের কাছে ১০ টাকা করে চাদা ধার্য্য করে এবং মিলের নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যানেজার সাহেব থেকেও কিছু দাবী করে। এতো সেসময় আমার সেজো দিদির বিয়ে জন্য মিল থেকে প্রায় ১০০০/= টাকার মতো সংগ্রহ হয়ে যায়। তারপরও একেবারে কিছু না দিয়ে তো দিদিকে পরের হাতে তুলে দেওয়া শোভা পায় না। হিন্দুদের বিয়েতে এক রত্তি স্বর্ণ হলেও লাগে, দিতে হয়। আমার বড় বৌদি বললেন, “প্রয়োজনে আমার হাতের চুড়ি, কানের দুল জোরা দিয়ে দিবো, তবুও যেন মায়ার ঠাকুরজির বিয়ে হয়।’

আমার বৌদি ছিলো আমাদের মায়ের মতো। আমার বড়দাদা বিয়ে করেছিল নোয়াখালী জমিদার হাট সংলগ্ন এক গ্রামে। বিয়ে করেছিল, দেশ স্বাধীন হবার পর দাদা ভারত থেকে দেশে ফেরার পর। আমার বড় দাদা বিয়ে করেছে এক গরিবের মেয়ে। মেয়ে পছন্দ করেছিল, নারায়ণগঞ্জ থেকে যেই ভগ্নিপতি আমাদের বাড়ি গিয়েছিল, সেই ভগ্নিপতির পছন্দের মেয়ে বলে কোনও দাবি-দাওয়া ছাড়াই বিয়ে হয়েছিল। তারপরও বিয়ের সময় বৌদির বাপের বাড়ি থেকে বৌদিকে হাতের, কানের, গলার তিনপদ সোনার জিনিস দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সোনার জিনিসগুলো থেকে আমাদের অভাবি সংসারের জন্য আগেই গলার হার বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। বাকি হাতের চুড়ি, আর কানের দুল এই বোনের বিয়েতে দিতে হচ্ছে, বৌদিকে। তারপরও বৌদি এ-ব্যাপারে কোনদিন টু-শব্দও করেছিল না। বরং কোনও অভিযোগ অনুযোগ ছাড়াই তিনি খেয়ে-না-খেয়ে আমাদের অভাবি সংসারে হাসি-খুশিতেই থাকতো।

এখন বোনের বিয়েতে বৌদি হাতের চুড়ি, আর কানে দুল দিয়ে দিলেও হিন্দু বিয়েতে নানারকম নিয়ম পালন করতে হলে আরও অনেক টাকার দরকার। উপায়ান্তর না দেখে বাবা বড় দাদাকে বললো, “নোয়াখালী গিয়ে বাড়ির নিজের অংশটুকু স্থানীয় বাদশা মিয়ার কাছে বিক্রি করে যা পাছ, তা এনে আমার মেয়ের বিয়ের কাজ শেষ কর।” আমাদের বাড়িটার ছিল তিন ভাগ। বাবার একভাগ। আমার দুই কাকার দুইভাগ। আমার দুই কাকা আরও আগেই তাঁদের নিজ-নিজ অংশ এই বাদশা মিয়া নামে কন্ট্রাক্টরের কাছেই বিক্রি করে দিয়েছিল। বাড়ির তিন অংশ থেকে বাকি থেকে যায় আমাদের অংশটুকু। সেই অংশটুকু বাবার সম্মতিতে বড়দা বোনের বিয়ের জন্য বিক্রি করতে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু বাবার স্বাক্ষর ছাড়া কোনও মতেই দাদার কাছে বাড়ি বিক্রির টাকা বাদশা কন্ট্রাক্টর বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছিল না। তখন বড়দাদা বুদ্ধি করে বলে-কয়ে বাড়ি বিক্রির টাকা-সহ বাদশা কন্ট্রাক্টরকে সাথে করে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসে, বাড়ি বিক্রির দলিলে বাবার একটা স্বাক্ষরের জন্য। বাদশা কন্ট্রাক্টর নারায়ণগঞ্জ আমাদের বাসায় এসে দলিলে আমার অসুস্থ বাবার স্বাক্ষর নিয়ে বাবার হাতেই তখনকার সময় ৪০০০/= হাজার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। সেই টাকা সেজো দিদির বিয়েতে খরচ করে বেঁচে যাওয়া যৎসামান্য কিছু টাকা দোকান বাকি-সহ আরও কিছু ধার-দেনা পরিশোধ করা হয়।

সেজো দিদির বিয়ের দিনতারিখ যখন ঠিক হয়, তখন কথা ছিল ছেলের পক্ষের খরচে সেজো দিদিকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই কথামতো ছেলে পক্ষ থেকে মেয়ের সাথে আরও দশজন যাওয়ার ভাড়া বাবদ ১০০ টাকা লোক মারফত বিয়ের একদিন আগেই আমার বড় দাদার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের দিন বড় দাদা-সহ মিলের আরও ৫/৬ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি সাথে করে সেজো দিদিকে ছেলের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমি আদরের ছোট ভাই, তাই সেজো দিদির সাথে আমিও ছিলাম। তখন চিটাগং রোড সংলগ্ন কাঁচপুরে ব্রিজ ছিল না। মেঘনা ব্রিজ ছিল না। দাউদকান্দি ব্রিজ ছিল না। ডেমরা ফেরিঘাট থেকে বাসে গৌরীপুর পর্যন্ত জন প্রতি ভাড়া ছিল মাত্র ৫ টাকা। বাস থেকে গৌরীপুর নেমে শুধু আমিই সেজো দিদির সাথে রিকশায় চড়ে ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর সবাই পায়ে হেঁটে ছেলের বাড়িতে পৌঁছেছিল। সাজো দিদির বিয়ের দিনই একই আসরে একই পুরোহিত দিয়ে ছেলের ছোট এক বোনের বিয়ে হয়। ছেলের ছোট বোনের বিয়ের কার্যসম্পাদন হয় আগে, আমার সেজো দিদির বিয়ে কাজ আরম্ভ হয় পরে।তবে খুব সুন্দরভাবে ঢাকঢোল বাজিয়ে আমার সেজো দিদির বিবাহের কার্যসম্পাদন সমাপ্ত হয়। বিয়ের পরদিন সবাই নারায়ণগঞ্জ চলে আসে। শুধু আমিই থেকে গেলাম সেজো দিদির সাথে। সেজো দিদির বাড়িতে সাতদিন থেকে জামাইবাবু-সহ আট দিনের দিন নারায়ণগঞ্জ চলে আসি।

সেজো দিদির বাড়ি থেকে ৮ দিন পর এসে দেখি, আদর্শ কটন মিলের গেইটের সামনে একজনকে বাদাম বিক্রি করতে। যিনি মিল গেইটে বাদাম বিক্রি করছে, তিনি শ্রমিক কলোনিরই একজনের মেয়ের জামাই ছিলেন। তাঁকে বাদাম বিক্রি করতে দেখে নিজের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপের কারণ হলো, এর আগে শুধু আমিই বাদাম বিক্রি করতাম। এখন মিল গেইটের দুইজন বাদামওয়ালা থাকলে এগের তুলনায় অর্ধেক বাদামও বিক্রি করতে পারবো না, তাই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আগের তুলনায় এখন অর্ধেক বাদাম বিক্রি হলে, তার চেয়ে বাদাম বিক্রি না করে অন্য কাজ করা ভালো হবে বলে মনে মনে ভাবতে লাগলাম। তাই বাসায় যে ক’সের বাদাম ছিল, সেগুলো শেষ করে বাদাম বিক্রি বাদ দিয়ে ১০ টাকা মজুরিতে ডেলি হাজিরায় লেবারের কাজে লেগে গেলাম। কিন্তু তখনও লেখাপড়া শেষ করিনি, ফাইল পরীক্ষার আশায়। একসময় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। টেনেটুনে পাসও করাম। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তিও হলাম।

অনেক কষ্ট করে পুরাতন বই কিনলাম। সপ্তাহে দুই-তিন মিলের কাজ বাদ দিয়ে স্কুলেও যেতাম। এরমধ্যেই লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলে থাকা আমার মেজো বোন জোৎস্না দিদি এক মেয়ে রেখে মৃত্যুবরণ করে। মেজো দিদি মারা যাবার চার-পাঁচ মাস পর জামাইবাবু আরেক বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করে। দিদির রেখে যাওয়া এক বছরের মেয়েটি শেষতক আমাদেরই লালন-পালন করতে হয়। মেজো দিদির মৃত্যুর পর বাবার অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে।
চলবে…

জীবনের গল্প-৬ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

ভুল মানুষেরই হয়

কথায় আছে, ‘ভুল মানুষেরই হয়! ভুল হয় না শয়তানের।’ তাই আমারও ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক! কারণ আমিও তো একজন মানুষ, তাই। তবে জীবন চলার পথে অনেক ভুলই আমার হয়েছিলো। যেমন– চলার পথে রাস্তা ভুলে গিয়ে অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম। ভুল করে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আবার ঠাণ্ডা পানি মনে করে সেভেনাপ গিলে ফেলেছিলাম। ভুল করে টিপ তালার চাবি ঘরে রেখে দরজায় তালা ঝুলিয়ে গিয়েছিলাম। তরকারির রান্না করার সময় লবণ মনে করে চিনি দিয়েছিলাম অনেকবার! ভোররাতে অন্ধকার ঘরে নিজের লুঙ্গি মনে করে গিন্নীর পেটিকোট পরে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম একবার। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া অন্যের স্ত্রীকে পেছন থেকে নিজের স্ত্রী ভেবে নাম ধরে ডেকে ক্ষমাও ছিলাম। নিজের ঘনিষ্ঠ পরিচিত মনে করে অন্যজনকে জড়িয়ে ধরিয়ে সরিও বলেছিলাম। নিজের বাবা মনে করে অন্যজনকে বাবা বলে ডেকে লজ্জায় মাথা নিচু করেছিলাম। ভুল করে দোকানে বা যাত্রীবাহী বাসে মোবাইল ফেলে চলে এসেছিলাম। ভুল করে অপরিচিত নাম্বারে কল করেছিলাম অহরহ! তা এখনও সময় সময় হয়ে থাকে। ভুল করে গুরুজনের সাথে অন্যায় করে মাপও চেয়েছিলাম। হিসাবের খাতায় ভুল তো এখনো হয়। ভুল করে প্রেমে করেছিলাম। তারপর বিয়ে। এমন হাজার রকমের ভুলের মধ্যে কয়েকটা ভুলের কথা আজও ভুলতে পারছি না। যেই ভুলগুলো আজও নিজের মনটাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, সেই ভুলগুলোই আজ সবার মাঝে তুলে ধরলাম।

ভুল-১
তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। সময়টা হতে পারে ১৯৭৪ সাল। তখন আমরা সপরিবারে থাকতাম, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের ভেতরে শ্রমিক কলোনিতে। আমার বড় দাদা চাকরি করতেন আদর্শ কটন মিলে। আর বাবা চাকরি করতেন শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায় চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। একদিন সকালবেলা বাবা চিত্তরঞ্জন মিলের উদ্দ্যেশে বাসা থেকে বের হয়। এরপর আমার মা আমাকে বললো, ‘তাড়াতাড়ি গিয়ে তোর বাবাকে বল, মিল থেকে বাসায় আসার সময় যেন আমার জন্য পান সুপারি নিয়ে আসে।’ ততক্ষনে আমার বাবা বাসা থেকে বেরিয়ে গুদারা ঘটে গিয়ে পৌঁছায়।

আমি মা’র কথা শুনে বাবাকে পান সুপারির কথা বলতে দৌড়াচ্ছিলাম। দৌড়াচ্ছি আর দেখছি বাবা মিলের ডিউটি ধরার জন্য দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। আমিও বাবা বাবা বলতে বলতে একসময় বাবার খুব কাছে পেছন থেকে জোরে বাবা বাবা বলে ডাক দিতেই বাবার মতো লোকটি পেছন ফিরে তাকালো। হায় হায়! এ দেখছি আমার বাবা নয়! লোকটি ছিলো অপরিচিত অন্য একজন পথচারী। কিন্তু পেছন থেকে লোকটিকে দেখতে হুবহু আমার বাবার মতই দেখা যাচ্ছিল। তারপর আমার ডেকে লোকটি দাড়ালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেডা, আমারে কিছু কইতাচস?’ আমি অক্কার মা টক্কা হয়ে শরমে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম, না। লোকটা আমার ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে মুচকি হেসে উনার পথে উনি চলে গেলো।

ভুল-২
একসময় আমি আর আমার বড় দাদা ফতুল্লা কাঠের পুল মিলন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতাম। আমরা দুই ভাই একজোড়া তাঁত পার্মানেন্ট চালাতাম। বড় দাদা কাজ করতো দিনে, আর আমি করতাম রাতে। তখন আমাদের ফ্যামেলি বাসা ছিলো, নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা গোয়াল পাড়া। ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল থেকে আমাদের বাসার দূরত্ব ছিলো প্রায় ৪ কিলোমিটার। প্রতিদিন এই ৪ কিলোিটার পথ পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করে কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। আবার তখনকার সময়ে নারায়ণগঞ্জ-টু-ঢাকা যাত্রীবাহী মুড়ির টিন করে আসা-যাওয়া করাও সম্ভব ছিলো না, টাকার খুবই দাম ছিলো বলে।

যদিও তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা সদরঘাট পর্যন্ত মুড়ির টিন স্টার্টবাসে জনপ্রতি ভাড়া ছিলো ১.৫০ পয়স। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফতুল্লা পোস্ট অফিস পর্যন্ত ভাড়া ছিলো ০.৬০ পয়সা। তবুও এই ০.৬০ পয়সা করে আসা-যাওয়ায় জনপ্রতি ১.২০ পয়সা খরচ করা কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। কারণ প্রতিদিন দুইজনের আসা-যাওয়ায় খরচ ২.৪০ পয়সা তখনকার সময়ের জন্য ছিলো অনেককিছু।

তাই আসা-যাওয়ার খরচ বাঁচানোর জন্য আমরা দুই ভাই মিলের ভেতরেই ব্যাচেলর শ্রমিকদের সাথে আলাদা থাকতাম। প্রতি বৃহস্পতিবার সপ্তাহের বেতন পেয়ে বাসায় যেতাম। শুক্রবার ঘোরাফেরা করে আবার শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ গোয়াল পাড়া থেকে পায়ে হেঁটে ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল মিলে যেতাম। রান্না-বান্না মিলের ভেতরে ব্যাচেলর কোয়ার্টারে নিজেদের টা নিজেরাই করতাম। দশজনের সাথে মিলে-মিশে ম্যাচে খেতাম না। তো প্রতিদিন আমাদের দুই ভাইয়ের রান্না-বান্না টা বেশিরভাগ সময় আমার কাঁধেই পড়তো। কারণ আমি রাতে ডিউটি করে সারাদিনই থাকতাম ফ্রি, তাই। একদিন সকালবেলা ডিউটি শেষ করে মিলের কোয়ার্টারে এসে হাতমুখ ধুয়ে চা দোকানে গেলাম। চা-বিস্কুট খেলাম। সিগারেট টানলাম। চা দোকান থেকে কোয়ার্টারে আসার সময় নিজের প্রয়োজনমতো কয়েকটা সিগারেট সাথে নিয়ে গেলাম।

ব্যাচেলর রুমে গিয়ে ভাতের হাঁড়িতে দুই ভাইয়ের একবেলা খাবারের আন্দাজমত চাল নিলাম। চালগুলো ধুয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে ভাতের হাঁড়ি স্টোভের উপরে বসালাম। স্টোভ জ্বলছে। ভাতের হাঁড়িতে থাকা চাল-সহ পানি গরম হচ্ছে। আমি সারারাত জেগে তাঁতের কাজ করাতে আমার ছিলো ঘুমের ভাব। তখন চোখে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে চৌকির উপরে শরীরটাকে লেলিয়ে দিলাম। হাতে ছিলো একটা সিগারেট জ্বালানো। দুই আঙুলে চিপায় সিগারেট রেখে কাত হয়ে কোমড়ের উপরে হাত রেখে শুয়ে রইলাম। যেই হাত কোমড়ের উপরে ছিলো, সেই হাতেই ছিলো জলন্ত সিগারেট। হাতে সিগারেট নিয়েই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, তা আর একটুও টের পাইনি। এই ঘুমের মাঝেই আমার জ্বালানো সিগারেটটা আঙুলের চিপা থেকে পরনের লুঙ্গিতে পড়ে যায়। সাথে সাথে পরনের লুঙ্গি পুড়তে থাকে। কিন্তু আমি একটুও টের পাচ্ছিলাম না।

টের পেয়েছি তখন, যখন আঙুলের চিপা থেকে সিগারেট পরনের লুঙ্গি পড়ে জ্বলতে জ্বলতে নিজের পা পুড়ছিলো, তখন। সিগারেটের আগুনে যখন পরনের লুঙ্গি পুড়ে পা পুড়ে যাচ্ছিল, তখন ঘুম থেকে জেগে দেখি, আমার পরনের নতুন লুঙ্গিটা জ্বলছে। আবার লুঙ্গির আগুনে আমার দুই পায়ের হাঁটুর উপরিভাগে ঠোসা পড়ে গেছে। ভাতের হাঁড়ির পানিও শুকিয়ে গেছে। তখন বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি লাপ দিয়ে উঠে হাউমাউ করে চিল্লাতে চিল্লাতে লুঙ্গির আগুন নেবাতে থাকি। আমার ডাক চিৎকার শুনে পাশের রুম থেকে আরও কয়েকজন তাঁতি দৌড়ে আসলো। মিল থেকে বড় দাদা-সহ আরও অনেকই এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘটনা কী?’ সাথের শ্রমিক ভাইয়েরা আমার বড় দাদাকে পোড়া লুঙ্গিটা দেখিয়ে বললো, ‘দেহেন বাবু আম্নের ছোডু ভাইয়ে কারবার!’ বড় দাদা কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘এভাবে নতুন লুঙ্গিটার অর্ধেকের বেশি পুড়লো কীভাবে?’ সবাই হাসতে হাসতে বললো, ‘আরে বাবু, শয়তানে বোমা ফাডাইছে!’

ভুল-৩
আমার একটা ভালোবাসার কুকুর ছিল। এখনো আছে। আদর করে ওর নাম রেখেছিলাম ‘ধলু’। আমি থাকি পরের বাড়িতে ভাড়া। এক বাড়িতে শুধু আমিই ভাড়াটিয়া নয়, একসাথে আরও অনেকেই ভাড়া থাকে। আবার ভাড়া বাড়ির পাশে আরও অনেকের বাড়ি থাকে। পাশের বাড়িতেও কুকুর আছে। এমনিতেই একটা কুকুর আরেকটা কুকুর দেখলেই শত্রু ভেবে ঘেউ-ঘেউ করতে থাকে। আমার ভালোবাসার ‘ধলু’ গরিবে ‘ধলু’ হলেও, ও কখনোই নিজেকে গরিব ভাবতো না। পাশের বাড়ির বড়লোকের কুকুর দেখলেই ‘ধলু’র ঘেউঘেউ শব্দে আরও দশটা বাড়ির লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়তো। সাথে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তো আমার পাশে থাকা ভাড়াটিয়ারা। কিন্তু ‘ধলু’ কাউকে কামড় দিতো না। তারপরও পাশের বাড়ির বড়লোকদের জ্বালায় আমার ‘ধলু’কে আর ভাড়া বাড়িতে রাখতে পারলাম না৷ একসময় ভালোবাসার আদরের ‘ধলু’কে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড় নিয়ে ছেড়ে দিই। সময়টা তখন করোনা কালের লকডাউনে আলামত। তখন নদী পারা-পারে নিয়জিত থাকা প্রায় খেয়া নৌকাও ছিলো বন্ধ। কিন্তু নদী পাড় হতে আমার ‘ধলু’র নৌকার প্রয়োজন হতো না। ও সাঁতরে নদীর পূর্ব পাড় থেকে পপশ্চিম পাড়ে চলে আসতে বীরদর্পে। আবার নিয়ে যেতাম শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়। এভাবে তিন-চার দিন এপার-ওপার করার পর এখন ‘ধলু’ শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়েই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।

ক’দিন আগে ‘ধলু’কে দেখতে গিয়েছিলাম নদীর পূর্ব পাড় চৌরাপাড়া এলাকায়। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর ‘ধলু’র সন্ধান পেলাম। নিয়ে গেলাম একটা চা দোকানে। ‘ধলু’কে তিনটা পাউরুটি খাওয়ালাম। আমি চা-বিস্কুট খেলাম। এরপর ‘ধলু’র সাথে খেলা করতে করতে দোকান থেকে বের হলাম। দোকানদার আমার দিকে চেয়েই থাকলো, কিছুই বললো না। আমিও ‘ধলু’র কাছ থেকে কেটে পড়তে পারছিলাম না। ‘ধলু’ কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছিল না। তখন একটা ব্যাটারি চালিত রিকশা ডেকে বললাম, ‘ভাই, আপনার রিকশার যত স্প্রিরিট আছে, সেই স্পিরিটে রিকশা চালাবেন। কারণ এই ‘ধলু’র থেকে আমাকে আড়াল হতে হবে।’ আমার কথা শুনে রিকসাওয়ালা রাজি হলো। আমি রিকশায় উঠলাম। রিকশা চলছে দ্রুত গতিতে। রিকশার পেছনে পেছনে আমার ভালোবাসার ‘ধলু’ও দৌড়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দৌড়াচ্ছে।

এভাবে প্রায় এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর ‘ধলু’কে রাস্তার আরও কয়েকটা কুকুরে আক্রমণ করে ফেললো। ‘ধলু’ অপরিচিত কুকুরগুলোর সাথে ফাইট শুরু করে দিলো। সেই সুযোগে আমি রিকশা নিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে আবার সেই বাজারে সেই দোকানের সামনে আসলাম। দোকানদার তার বেচা বন্ধ করে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি দোকানদারে দিকে চেয়ে লজ্জায় পড়ে গেলাম! দোকানদারে সামনে গিয়ে ১০০/= টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে বললাম, ‘ভাই তখন আমার ‘ধলু’র থেকে কেটে পড়ার টেনশনে ছিলাম। তাই আপনার পাউরুটি আর চায়ের দাম দিতে ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন আপনার রুটি চায়ের দামটা রেখে দিন। দোকানদার মুচকি হেসে আমার হাত থেকে ১০০/=টাকার নোট খানা নিয়ে আমাকে ৬৫/=টাকা ফেরত দিয়ে বললো, ‘ভাই, সত্যি আমি কিছু মনে করেনি। ভুল তো মানুষেরই হয়! আপনারও হয়েছে, তাতে কী আর এমন হয়েছে!’

ভুল-৪
গেলো ক’দিন আগে সকালবেলা অফিসে গেলাম। অফিসের কাজ সেরে টিক দুপুরবেলা বাসায় ফিরলাম। গিন্নী আমার আগেই খেয়ে-দেয়ে আশা সমিতির একটা মিটিংয়ে যোগ দিতে বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে আমাকে বলে গেলো, ‘খাওয়া-দাওয়া কইরা যদি কিছু থাহে, তাইলে ফ্রিজে ঢুকাইয়া থুইও।’ আমি মাথা নেড়ে গিন্নীকে সায় দিলে, গিন্নী তার নিজের কাজে চলে যায়। আমি স্নান করে মনের আনন্দে খেতে বসলাম। মনের আনন্দ শুধু গুড়া মাছের তরকারির জন্য। সেদিন গুড়া মাছ রান্না হয়েছিলো। ভাত খেতে বসে গুড়া মাছের তরকারির ঝোল দিয়ে ভাত মেখে প্রথম নলা মুখে দিয়ে দেখি তরকারিতে লবণ বেশি! মনের আনন্দটা মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেলো। কী আর করা, নামমাত্র দু’মুঠো খেয়ে বাদবাকি তরকারি ফ্রিজে রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠলাম বিকাল পাঁচটার সময়।

ঘুম থেকে উঠেই ভাবছি শখের গুড়া মাছের তরকারির কথা। ভাবলাম স্বাদের তরকারিতে আরেকটু জল মিশিয়ে গ্যাসের চুলায় গরম করলেই তো তরকারির লবণ ঠিক হয়ে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ফ্রিজ থেকে তরকারির বাটি বের করলাম। বাটি থেকে তরকারি গুলো একটা ছোট কড়াইতে ঢেলে এর সাথে পরিমাণমতো জল মেশালাম। গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে তরকারির কড়াই বসালাম। চুলা জ্বলছে। স্বাদের গুড়া মাছের তরকারিও গরম হচ্ছে। আমি ঘরে এসে মোবাইল অন করে অনলাইন বিডিনিউজ ২৪ -এ দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির খবর পড়ছি। কয়েকটা ব্লগে পরিচিত ব্লগারদের লেখা পড়ছি। পোস্টে মন্তব্য করছি। বেশ কিছুক্ষণ পর নাকে পোড়া পোড়া গন্ধ লাগলো! ওমনি মোবাইল রেখেই রান্নাঘরে গিয়ে দেখি আমার স্বাদের গুড়া মাছের তরকারি পুড়ে ছাঁই হয়ে মৌ-মৌ পোড়া গন্ধে পুরো বাড়ি দুর্গন্ধে একাকার। কী আর করা! নিজের কপালে তিন-চারটা থাপ্পড় মেরে চুলা থেকে তরকারির কড়াই এনে খানাডুলিতে রেখে আবার অফিসের কাজে বেরিয়ে গেলাম। রাতে বাসায় এসে দেখি গিন্নী মুখ ভার করে বসে আছে! আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি নরম গলায় বললাম, ‘ভুল তো মানুষেরই হয়!’

ছবি গুগল থেকে সংগ্রহ।

জীবনের গল্প-৪

জীবনের গল্প-৩ এর শেষাংশ: বারবার মনে পড়ছে বই কেনার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখার কথা। টাকার জন্য আমার তখন শোকে ধরে গেল। বই কেনা হলো না, অথচ টাকা খরচ করে ফেললাম! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই টাকা যে করেই হোক জোগাড় করবোই। গেলাম বন্ধুদের সাথে টেলিভিশন দেখতে। বাসায় ফিরে সেদিন আর পড়তে বসিনি। দুইটা আটা রুটি খেয়ে শুয়ে রইলাম।

রাত ভোর হওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে প্রতি দিনের মতো ঘরে বসে স্কুলের পড়া শেষ করি। তারপর, কিছু খেয়ে বই নিয়ে স্কুলের চলে যাই। বই কিনতে গিয়ে সিনেমা দেখে বাসায় আসার পরও আমার কাছে অবশিষ্ট ৭ টাকার মতন থেকে যায়। সেই টাকা আর খরচ করি না, সাথে করেই স্কুলে যাই। আবার সাথে করে নিয়ে আসি। মায়ের কাছেও দেই না, বড় দিদিদের কাছেও না। উদ্দেশ্য ২০টাকা মেলাতে পারলে মায়ের কাছে দিয়ে দিবো, বাবাকে দিয়ে দিতে।

এদিকে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেট যে-ক’জন ছিল, ওঁদের সাথে পুরান ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বই-সহ বাদ থাকা বইগুলো কারোর কাছে পাবো কিনা আলাপও করি। উদ্দেশ্য যদি কারোর কাছে বাদ থাকা বইগুলো পাওয়া যায়, তাহলে আর বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হবে না, অল্প টাকায় হয়ে যাবো। এভাবে নিজেও বাদ থাকা বইগুলো সংগ্রহ করার জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি, কিন্তু পাইনি। যেই বইগুলো আমার কাছে ছিল না, সেই বইয়ের পড়া ক্লাসের ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের বই থেকে কিছু কিছু করে রাফখাতায় লিখে রাখতাম। বাসায় এসে সেগুলো পড়তাম। এভাবেই চলতে থাকলো আমার স্কুলের ক্লাস। একসময় প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও ঘনিয়ে আসতে লাগলো। পড়ে গেলাম দুশ্চিন্তায়! আমি শিওর ছিলাম পরীক্ষা দিলে আমি পাস করতে পারবো না, একশো পার্সেন্ট ফেল। তারপরও নিজের চেষ্টা নিজেই চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

এরমধ্যেই একদিন স্কুল ছুটি হওয়ার পর বাসায় আসার পথেই আদর্শ কটন মিলের ডেলি লেবারদের সাথে দেখা। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজকে সন্ধ্যার পর কোনও কাজ আছে কিনা?’ একজন বললো, “আছে, কয়েক হাজার ইট নৌকা থেকে নামাতে হবে। টাকা নগদ নগদ। মানুষ কম দেখে এখনো মিলের সরদারের কাছে কেউ গিয়ে আলাপ করিনি। যে-কয়জন আছি তাতে নৌকা থেকে এতগুলো ইট নামানো সম্ভব হবে না। তুই যদি কাজ করতে চাস, তাহলে বাসায় গিয়ে খেয়ে-দেয়ে তাড়াতাড়ি করে মিলের গেইটে চলে আয়, আমরা সবাই মিলের সরদারের খোঁজে গেইটের সামনেই আছি।

ওঁদের কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে কোনরকম দু’চারটা খেয়ে, বন্ধুদের সাথে খেলা-ধুলার চিন্তা বাদ দিয়ে সোজা মিল গেইটে গিয়ে হাজির হলাম। ওঁরা ছিল ছয়জন। আমি-সহ হলাম সাতজন। নৌকা ভর্তি ইট। মিলের সরদারের সাথে কথা হলো, সব ইট নৌকা থেকে নামিয়ে মিলের ভেতরে জায়গামতো খামাল দিয়ে রাখতে হবে। আমরা রাজি হলাম, তা-ই করে দিবো। টাকা দিতে হবে ১৫০ টাকা। সরদার এতে রাজি হলো না। সরদার ১২০ টাকা দিতে রাজি। আমরা তা-ই রাজি হয়ে নৌকা থেকে ইট নামানোর জন্য যাঁর যাঁর মতো প্রস্তুতি নিয়ে নৌকার উপরে চলে গেলাম।

সাথের লেবারদের চেয়ে আমি বয়সে সবার ছোট ছিলাম বলে, ওঁরা আমাকে সবসময় হালকা-পাতলা কাজ দিয়ে রাখতো। ওইদিনও আমার কাজ ছিল অন্য লেবারদের মাথায় ইট সাজিয়ে দেওয়া। ওঁরা সবাই আদর্শ কটন মিলের শ্রমিক কলোনিতে থাকা শ্রমিকদেরই ছেলে-পেলে। মিলের ভেতরেই থাকতো। কিন্তু লেখাপড়া করতো না। সারাদিন ঘুরে-ফিরে সময় কাটাতো। নানারকম কাজ করে নিজেদের পকেট খরচ জোগাড় করতো। আদর্শ কটন মিলের ভেতরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পর থেকে এমনিতেই ওঁরা আমাকে কাছে ডাকতো। ওঁরা সবাই বিড়ি-সিগারেট টানতো। চা-পানও খেতো। কিন্তু আমি তখনো এসবের ধারেকাছেও ছিলাম না।

ওঁরা আরও অনেক আগে থেকে আমাকে মাঝেমধ্যে বলতো, “আরে বেডা, লেখাপড়া কইরা কী অইবো? আমাগো লগে থাইক্কা কাম কর! নিজের পকটে টেকা থাকলে হগলতে জিগাইবো, ডাকবো।” কিন্তু আমি আগে ওঁদের কথায় কান দিতাম না, নিজের লেখাপড়া নিয়েই টেনশনে থাকতাম। কিন্তু সংসারের অভাব অনটনের জন্য পেরে উঠতে পারছিলাম না। অনেক পরে হলেও শেষমেশ ওঁদের কথাই আমার কান দিতেই হলো। তাই ওইদিন গৌরাঙ্গ কাকার হাতে মার খাওয়ার পর থেকে ২০ টাকা মেলানোর জন্যই আমি ওঁদের পিছনে ঘুরঘুর করি। টুকটাক কাজও করি। ওইদিনের কাজটা হলো অন্যসব দিনের চেয়ে বড় কাজ এবং বেশি খাটুনির কাজ! পুরো একটা বড় নৌকা থেকে অনেকগুলো ইট নামাতে হচ্ছে।

একসময় নৌকা ভর্তি ইটগুলো আমরা খালি করে ফেললাম। রাত তখন আনুমানিক ১০ টার মতো হবে। আমি সেদিন টাকা পেলাম ২০ টাকা, ওঁরা নিয়ে নিলো ১০০টাকা। আমি ২০ টাকা হাতে পেয়ে মনের আনন্দে বাসায় গিয়ে মায়ের হাতে ২০টাকা দিলাম। মা ২০ টাকা হাতে পেয়ে হা করে আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, “এতো টাকা এত রাতে কোথায় পেলি? চুরি করেছিস নাকি?” আমি হেসে বললাম, ‘না মা, চুরি করিনি। নৌকা থেকে মিলের ইট নামিয়েছি।’ বাবা তখন বাসায় ছিল। আমার কথা শুনে বাবা আমার সামনে এসে বললো, “তাহলে তো তোর আর লেখাপড়া হবে না। তোর মন এখন টাকার দিকে চলে গেছে।” বাবার কথার উপর মা আবার বলে উঠলো, “টাকার দিকে মন যাবে না তো কোথায় যাবে? ওঁর বই নেই, খাতা নেই, কলম নেই, স্কুলের নামমাত্র বেতন দিতে পারি না। সামনে ওঁর পরীক্ষা। তাহলে ছেলে কী করবে? ও ঠিকই করেছে। এখন থেকে ওঁর নিজের খরচ নিজেই জোগার করে নিতে পারবে। ওঁর পেছনে আর কারোর দুই টাকা খরচ করতে হবে না।” এরপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “যা গামছাটা নিয়ে তাড়াতাড়ি গাঙ থেকে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাও।” বাবার কথার উত্তর আমার আর দিতে হয়নি। যা বলার মা-ই বলে দিয়েছে। বাবা চুপ করে ঘরে গিয়ে শুইয়ে রইল। আমি গামছা কাঁধে নিয়ে সোজা শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাটে স্নান করতে চলে গেলাম।

এদিকে মা তাড়াতাড়ি গৌরাঙ্গ কাকার বাসা থেকে একবাটি ভাত চেয়ে এনে আমার জন্য রেডি করে রেখেছিল। তারপর মা আমাকে দুটো রুটি-সহ চেয়ে আনা ভাতগুলো সামনে দিলো। আমার মা সেদিন বুঝতে পেরেছিল যে ছেলে আমার কঠিন খাটুনির কাজ করে এসেছে। এখন ঘরে থাকা এই দুটো রুটিতে আমার ছেলের পেটের এক কোণাও ভরবে না। তাই আমি স্নান করার জন্য ঘরের বাইর হতেই, মা গৌরাঙ্গ কাকার বাসা থেকে ভাত এনে রেখে দিয়েছিল। ভাত খেতে বসে মাকে আস্তে আস্তে বললাম, ‘মা, আজ দেখছি রুটি আবার ভাত? রুটিও করেছ, ভাতও রান্না করেছ?’ মা বললো, ‘আরে না, রুটিই বানিয়ে ছিলাম। তোর জন্য দুটো রুটি রেখেছিলাম। এই কিছুক্ষণ আগে তোর গৌরাঙ্গ কাকার ঘর থেকে একবাটি ভাত হাওলাৎ এনেছি, তুই খা।” আমি আবার আস্তে আস্তে মাকে বললাম, ‘মা, বই কিনতে গিয়ে যেই টাকা হারিয়েছি, তা আজ অনেক কষ্ট করে আপনার কাছে এনে দিলাম। এই ২০টাকা বাবাকে দিয়ে দিবেন।’ মা বললো, “তোর বই নেই। আগে বই কিনে আনবি।” আমি বললাম, ‘মা, আর দু-এক দিন কাজ করতে পারলে বই কেনার টাকা আমার এমনিতেই হয়ে যাবে। আপনি এই টাকা বাবাকে দিয়ে দিবেন।’ আমার কথা শুনে মা বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে, আগে তুই ভাত খেয়ে নে।” রুটি আর ভাত খেয়ে নিজের শোবার জায়গায় গিয়ে চুপচাপ শুইয়ে রইলাম।

পরদিন সকালে যথারীতি ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে যখন ঘরে বই নিয়ে পড়তে বসলাম। আমার এক বোনের বড় মায়াদি সকালের খাবার নিয়ে আমার সামনে রাখলো। খাবার রেখে রাতে মায়ের কাছে দেওয়া ২০টাকা আমার পড়ার টেবিলের উপর রেখে বললো, “বাবা বলেছে এই টাকা দিয়ে বই কিনে আনতে। নাহলে বাবা রাগ করবে।” আমি আর দিদিকে কিছুই বললাম না, দিদির রাখা ২০টাকা বইয়ের ভেতরে রেখে দিলাম। স্কুলের সময় হলে স্কুলে চলে গেলাম। সাথের ক্লাসমেটদের সাথে নতুন বই কেনার ব্যাপারে আলাপ করলাম। ওঁরা বললো, “নতুন বই কিনতে হলে নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে না। ২নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের বাজারেই পাওয়া যাবে।” নিশ্চিত হলাম। স্কুল ছুটির পর একজন ক্লাসমেটকে অনুরোধ করে বললাম, ‘আমার সাথে একটু ২নং ঢাকেশ্বরী বাজারে যেতে হবে।’ ও রাজি হয়ে বললো, “চল যাই।” ওমনি দেরি আর না করে গুদারা নৌকা করে নদী পার হলাম। দুইজনের গুদারা ভাড়া পাঁচ পয়সা করে দশ পয়সা আমি দিবো মনে করে ভাড়া আদায়কারীর সামনে গিয়ে এক টাকার একটা নেট দিতে গেলে ভাড়া আদায়কারী আর রাখলো না।বললো, “যাও!” কিছুই বোঝার চেষ্টা না করে দশ পয়সা বেঁচে গিয়েছে, সেই আনন্দ মনে নিয়ে দুইজনে হাঁটতে হাঁটতে ২নং ঢাকেশ্বরী বাজারে চলে গেলাম, বইয়ের দোকানে।

আমার সাথে টাকা ছিল ২৬ টাকার মতন। চারটা নতুন বইয়ের দাম হয়ে গেল ২৭ টাকার মতো। কিন্তু আমার কাছে আছে এক টাকা কম! সাথে যাওয়া স্কুলের বন্ধুটি বললো, “তোর কাছে কত আছে?” বললাম, ‘এক টাকা কম আছে।’ ওমনি লাইব্রেরির মালিক বললো, “দাও দাও, এক টাকা আর দিতে হবে না, বই নিয়ে যাও।” ২৭ টাকা দোকানদারকে দিয়ে বইগুলো নিয়ে নিলাম। সাথের স্কুল বন্ধুটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই তোর কাছে যাবার গুদারা ভাড়া আছে?’ ও বললো, “আমাদের গুদারা ভাড়া প্রতিদিন দিতে হয় না। আমরা মাসে একবার দেই। তাও সেটা দেওয়া হয় মিল থেকে। দেখলি না, আসার সময় যে গুদারা ভাড়া নেয়নি!’ ওঁর কথা শুনে চিন্তামুক্ত হয়ে দুইজনে আবার নদী পার হলাম। ওঁকে অনেকখানি পথ পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। আমি নতুন বই সাথে করে বাসায় পেলাম। বাসায় গিয়ে আগেই নতুন বইগুলো মাকে বড় দিদি ও বৌদিকে দেখালাম। তাঁরা বই দেখে খুশি হলো। মা জিজ্ঞেস করলো, “বইয়ের দাম কত?” আমি বললাম, ‘বেশি না, ২৭ টাকা।’ মা বললো, “দিলাম ২০ টাকা, বইয়ের দাম ২৭ টাকা। বাদবাকি টাকা কোথায় পেলি?” বললাম ‘আমার কাছে সেদিনের ৭/৮ টাকা ছিল। ওই টাকা মিলিয়ে সব বই একবারেই কিনে আনলাম। আমার আর বইয়ের চিন্তা করতে হবে না।’ আমার কথা শুনে বাসার সবাই খুশি হয়ে গেলো। আমি নতুন বই নতুন করে পড়ার ইচ্ছায় তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে যা ছিলো তা খেয়ে বই পড়তে বসে পড়লাম। সেদিন সন্ধ্যার পরও বাসা থেকে আর বের হইনি। অনেক রাত পর্যন্ত পড়ার টেবিলেই ছিলাম। কারণ ক’দিন পরই পরীক্ষা।

তাই একটু মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া-সহ স্কুলে যাওয়া-আসাও ঠিকমতো করছি। যাঁদের সাথে মাঝেমধ্যে কাজ করি, ওঁদের সাথে আমার আগেরেই কথা; বিকালবেলা যদি কোনও কাজ থাকে, তাহলে যেন দয়া করে আমাকে কাজ দেয়। তাই সময় সময় ওঁরা বিকালবেলা কোনও কাজ পেলে, লোকের শর্ট থাকলেই আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যেতো। আমি ওঁদের সাথে কাজ করতাম। যা কয়টা টাকা পেতাম মায়ের কাছে এনে দিতাম। এভাবে চলতে চলতে একসময় পরীক্ষার দিনতারিখ নির্ধারণ হলো। এক এক করে সব পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট বের হলো। স্কুলের নোটিশ বোর্ডের সবার নিচে আমার নাম দেখলাম। মানে টেনেটুনে পাস করলাম। তাতে আমি একটুও মন খারাপ করিনি, বরং খুশি হয়েছি। এর ক’দিন পরই আমার বাবা দুপুরবেলা উনার কর্মক্ষেত্রে অ্যাক্সিডেন্টে করলো। বাবা কাজ করতো শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলের আউট অফ সাইড ক্যালেন্ডারে। বাবার বাম হাতের চারটে আঙুল থেঁতলে গিয়েছিল।

দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই একদিকে তাড়াতাড়ি করে বাবাকে মিলের গাড়ি দিয়ে নিয়ে যায়, নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল। আরেকদিকে লোক মারফত খবর পাঠায় আদর্শ কটন মিলের ভেতরে আমাদের বাসায়। আমি ছিলাম স্কুলে। বড় দাদা ছিল আদর্শ কটন মিলে নিজের কাছে। খবর পেয়ে আমার মা বড় দুই বোন বৌদি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গিয়ে বড় দাদাকে খবর দিলো। বড় দাদা গেইটপাস নিয়ে তাড়াতাড়ি মিল থেকে বের হয়ে মাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হয়। আমি স্কুল থেকে আসার পথেই লোকমুখে বাবার অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে দৌড়ে বাসায় এসে দেখি, আমার বড় দিদি দুইজন বৌদি, ভাতিজি-ভাতিজা, বাসার সামনে বসে বসে কাঁদছে। আমাকে দেখে তাঁদের কান্না আরও বেড়ে গেলো। তাঁদের সাথে আমিও হাউমাউ করে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম। ওইদিন সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ! বড়দাদা আর মা বাবাকে ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে প্রথমে চিত্তরঞ্জন কটন মিলে আনে। তারপর বাসায় আসলো রাত দশটার সময়। বাবার অবস্থা তখন বেশি ভালো ছিল না। ওইদিন বাসার সবাই মিলে সারারাত বাবার পাশে বসে রাত পার করেছিলাম।

চলবে…

জীবনের গল্প-৫ এখানে।

জীবনেরগল্প-১ এখানে।

খুঁজেছিলাম

সুখ খুঁজেছিলাম কোথাও মেলেনি,
পেয়েছি দুখীর দুঃখকে!
শান্তির মা’কে খুঁজেছিলাম পাইনি,
পেয়েছি অশান্তির মা’কে!

ভালোবাসা খুঁজেছিলাম দুয়ারে-দুয়ারে,
হয়েছি আমি নিরাশা!
প্রেম খুঁজেছিলাম অনেকের দ্বারে-দ্বারে,
দেখেছি কতো তামাশা!

টাকা-পয়সা খুঁজেছিলাম রাস্তায় রাস্তায়,
পেয়েছি অচল কানাকড়ি!
ধনসম্পদ খুঁজেছিলাম মহল্লায় মহল্লায়,
পেয়েছি ফাঁসির দড়ি!

মানুষ খুঁজেছিলাম মানুষের সারিতে,
মানুষ পাইনি কোথাও!
স্রষ্টাকে খুঁজেছিলাম মন্দিরে পুজাতে,
মেলেনি তাঁর দেখা-ও!

জীবনের গল্প-৩

জীবনের গল্প-২ এর শেষাংশ: কিন্তুক আমাদের সংসারে লেগে থাকা দুর্ভিক্ষ তখনও দূর হয়নি। বারোমাসি দুর্ভিক্ষ আমাদের সংসারের লেগেই থাকলো। সেসময় স্কুলে যাওয়ার মতো পোশাকও আমার ছিল না। বাবা ও বড়দাদা মিল থেকে পাওয়া রিজেক্ট কাপড় দিয়ে বড়দি’র হাতে বানানো জামা- হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম। পায়ের স্যান্ডেলও ছিল না।

তারপরও একদিনের জন্যও স্কুল মিস করতাম না, স্কুলে আমি নিয়মিতই ক্লাস করতেছিলাম। ১নং ঢাকেশ্বরী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর নিয়মিত ক্লাস করছি ঠিক, কিন্তু আমার পড়ার সব বই ছিল না। সেসময় নতুন একসেট বই কেনার মতো সাধ্যও আমার বা আমাদের ছিল না। তখন আদর্শ কটন মিলের ভেতরে থাকা যেসব ছেলে-মেয়েরা ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করে সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে, সেসব ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে ওঁদের পুরাতন ছেঁড়া-ফাঁড়া কয়েকটা বই নামমাত্র মূল্যে সংগ্রহ করলাম। আর কিছু বই বাদ থেকে গেলো। মা বললেন বাদবাকি বইগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই কিনে দিবে। মায়ের কথা মেনে নিয়েই ছেঁড়া ফাঁড়া জামা প্যান্ট পরে হাইস্কুলে যেতাম, আসতাম, ক্লাস করতাম। তবে নতুন হাইস্কুলে যেতাম একা। আসতামও একা। কারণ, আদর্শ কটন মিলের ভেতরের কেউ এই হাইস্কুলে তখনও ভর্তি হয়েছিল না। তাই একাই যেতাম, একাই আসতাম। সময়টা তখন ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি নাহয় মার্চমাস হবে।

সেসময় দেশে দেখা দেওয়া দুর্ভিক্ষ কিছুটা দূর হতে শুরু করেছিল। অভাব অনটন আর দুর্ভিক্ষ শুধু লেগে থাকলো আমাদের ৯ সদস্যের সংসারে। কিন্তু খাই বা না খাই, আমার স্কুল ছিল নিয়মিত। স্কুলে যেতাম আসতাম ঠিকই, কিন্তু নিজের কাছে ভালো লাগতো না। সংসারের অভাব অনটনের জন্য আমার মনটা সবসময়ই খারাপ থাকতো। নতুন হাইস্কুলে ক্লাস শুরু করার প্রায় দুইমাস গত হয়ে গেলেও আমার বাদবাকি বইগুলো আর কেনা হচ্ছিল না। বাবা বড়দা বেতন পাবার পর দেখতাম দোকান বাকি দিয়েই সব শেষ হয়ে যেতো। ঘরে থাকতো না চাল, ডাল, আটা, তেল লবণ, লাড়কি খড়ি। তাই আমি স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে আবার লাড়কির চাহিদা মেটানোর জন্য গরুর গোবর কুড়াতাম। সে কুড়ানো গোবর মিলের বাউন্ডারি ওয়ালে চাপ্টির মতো করে লেপ্টে দিতাম। দেখতে দেখা যেতো হুবহু আটার রুটির মতো।এগুলোকে বলা হতো, গোবরের ঘুঁটে। এই গোবরের ঘুঁটে দিয়ে আমাদের সংসারের লাড়কির চাহিদা মিটত। আমার এই কষ্টের বিনিময়ে বাবা বেতন পেলে আমাকে নামমাত্র কয়টা টাকা দিতেন। সেই টাকা আমি খরচ করে খেতাম না। সেই টাকা দিয়ে পড়ার খাতা-কলম কিনে রাখতাম। খাতা-কলম কিনে দুইএক টাকার মতো থাকলে, তা দিয়ে স্কুলে যাঁরা আমাকে প্রতিদিন টিফিনের সময় ডেকে যেতো; বেঁচে যাওয়া সেই টাকা খরচ করে আমি তাঁদের পুরি-শিঙাড়া খাওয়াতাম। ওঁরা খুব খুশি হতো।

সেসময় সংসারের অভাবের কারণে স্কুল বন্ধের দিনে বাসায় বসে থাকতাম না। মিল গেইটে গিয়ে বসে থাকতাম, কাজের আশায়। মিলের কিছু মালামাল নৌকা করে মিলের নিজস্ব ঘাটে আসতো। তখন মালামাল নামানোর জন্য লেবার প্রয়োজন হতো। সেসব লেবারদের সাথে আমিও একজন লেবার হয়ে নৌকা থেকে মালামাল নামাতাম। বড় লেবাররা যদি পেতো ১৫ টাকা, আমাকে দিতো ৫ টাকা। তখনকার সময়ে ৫ টাকার খুবই দাম ছিল। এই ৫ টাকা এনে মায়ের হাতে দিতাম, মায়ের পান সুপারি কেনার জন্য। মা খুবই খুশি হয়ে আমাকে ঝাপটে ধরে কাঁদত। আমার মা সেই টাকা দিয়ে পান সুপারি কিনে খেতেন না। মা সেই টাকা আমার স্কুলের খাতা কলম কেনার জন্য আবার আমাকে দিয়ে দিতেন। সেই টাকা থেকে কিছু খরচ করে কিছু রেখে দিতাম, বাদ থাকা কয়টা বই কেনার জন্য। কিন্তু শত চেষ্টা করেও একসাথে ২০-২৫ টাকা আর জমাতে পারিনি। তাই বাদবাকি বইগুলো আর সংগ্রহ করতে পারিনি। বইগুলো আমার বাদই থেকে গেলো।

একদিন স্কুলে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস চলছিল। তখন আমার কাছে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বই ছিলো না। স্কুলের টিফিন টাইমে আমি এক ক্লাসমেট থেকে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বইটা চেয়ে নিয়ে বসে বসে পড়া মুখস্থ করছিলাম। টিফিনের পরেই ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস। আমি ক্লাসরুমে বসে পড়তে পড়তেই টিফিন টাইম শেষ হয়ে গেল। সব ছাত্রছাত্রী ক্লাসে ঢুকলো। স্যার আসলো। স্যার একেকজনকে প্রশ্ন করছে। যাঁকে প্রশ্ন করছে, সে দাঁড়িয়ে মুখস্থ পড়া বলছে। এবার স্যার আমাকে আঙুল উঁচিয়ে দাঁড়াতে বললো। আমি দাঁড়ালাম। প্রশ্ন করলেন, আমি আর উত্তর দিতে পারিনি। স্যারের হাতে ঠাসঠাস করে বেতের বাড়ি খেলাম কয়েকটা।

সেদিন বাসায় এসে মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে বললাম, ‘মা আমি আর স্কুলে পড়বো না’। মা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?” আমি বললাম, ‘আমার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বই নেই! আজ স্যারের হাতে মার খেয়েছি, দেখেন’! মা দেখলো আমার পিঠে ফুলা লম্বা দাগ লাল হয়ে আছে। মা তেলে-জলে মিশিয়ে আমার পিঠে ঢলে দিলেন। রাতে বাবা বাসায় আসলেন। মা বাবাকে সব বৃত্তান্ত খুলে বললো। বাবা জিজ্ঞেস করলো, “বইয়ের দাম কত?” মা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “বইয়ের দাম কত?” আমি বললাম, ‘২০ টাকার মতো হবে’। বাবার কাছে মাত্র ১৫ টাকা ছিল। সেই ১৫ টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বললো, “এই টাকা দিয়ে ও যেন বই কিনে নেয়”। মা আমার হাতে বাবার দেওয়া ১৫টাকা দিয়ে বললো, “কালই নারায়ণগঞ্জ থেকে বই কিনে আনবি”। আমি বললাম, ‘বইয়ের দাম তো ২০টাকার মতো’। তারপর মায়ের কাছে থাকা আরও ৫টাকা মিলিয়ে আমাকে ২০টাকা দিলেন বই কেনার জন্য। আমার কাছে জমানো ছিল ৫ টাকার মতো। মোট টাকা হয়ে গেলো ২৫ টাকা। আমি মহাখুশি!

রাত পোহালেই শুক্রবার। শুক্রবারে যে নারায়ণগঞ্জে সব দোকান বন্ধ থাকে তা আর আমার খেয়ালে ছিল না। আমি দুপুরে নামমাত্র দু’চারটা খেয়ে স্কুলের জামা-প্যান্ট পরে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে নারায়ণগঞ্জ চলে গেলাম বই কেনার জন্য। প্রথমে কালীর বাজার ঘুরে দেখলাম, এতএত বইয়ের দোকানের মধ্যে একটা দোকানও খোলা নেই। গেলাম ডিআইটি মার্কেট। সেখানেও বইয়ের দোকান খোলা পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম টান বাজার। টান বাজার ঘুরে দেখলাম, বইয়ের দোকান খোলা নেই। কোনও জায়গায় বইয়ের দোকান খোলা না পেয়ে হাঁটতে লাগলাম। উদ্দেশ্য বাসায় ফিরে যাবো।

আসার সময় সামনেই দেখি আশা সিনেমাহল। হলের সামনে লোকে লোকারণ্য। হৈচৈ পাড়া-পাড়ি। আশা সিনেমাহলের সামনেই বড় বিলবোর্ডে আর্ট করা বড় বড় ছবি! আশা সিনেমাহলে চলছে তখনকার সময়ে অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ” দি রেইন” ছায়াছবি। অভিনয়ে ওয়াসিম অলিভিয়া। তা দেখে আমার মনের ভেতরে শয়তান ঢুকে গেলো। আমি আস্তে আস্তে হলে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুকিঙে টিকেট নেই। যা আছে ব্লাকে তো আছে। সেকেন্ড ক্লাস ১০ টাকা। ফাস্ট ক্লাস ১৫ টাকা। এক ব্লেকার আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেকেন্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস বলে চিল্লাচিল্লি করছে। আমাকে নিতে বলছে, “নে নে, টিকেট শেষ! টিকেট শেষ! আমি আর মনটাকে সামলালে পারিনি। শয়তানের কাছে হার মেনে বইয়ের চিন্তা না করে ১০টাকা দিয়ে একটা সেকেন্ড ক্লাসের টিকেট নিয়ে ফেললাম। ব্লেকার আমার হাতে টিকেট দিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি দৌড় দে বেটা শো আরম্ভ হয়ে গেছে”।

তখনকার সময়ের অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ” দি রেইন” ছায়াছবির একটা গান শুনুন!

https://m.youtube.com/watch?v=RxycGP6r2X0

আমি তখন টিকেট হাতে নিয়ে দাঁড়াচ্ছি হলের দিকে। কিন্তু কোনদিকে যে সেকেন্ড ক্লাস, তা আর আমার জানা ছিল না। আমি সোজা ফাস্ট ক্লাসের গেইটে গিয়ে গেইট কিপারকে টিকেট দেখাচ্ছিলাম। গেইট কিপার আমাকে একটা দমক দিয়ে সেকেন্ড ক্লাসে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলো। আমি সেকেন্ড ক্লাসের গেইটে গিয়ে টিকেট দেখানোর পর গেইট কিপার আমার টিকেট দেখে হলের ভেতরে ঢুকতে দিলো। চেকম্যান টিকেট দেখে সিট দেখিয়ে দিলো। আমি আমার সিটে গিয়ে বসলাম। ছায়াছবির ” দি রেইন” দেখালাম সন্ধ্যা ৬ থেকে রাত ৯ পর্যন্ত। শো শেষ হলো। বই কেনার টাকা দিয়ে জীবনের দ্বিতীয়বার সিনেমা দেখে আশা সিনেমাহল থেকে রাত ৯টায় বের হলাম। (জীবনের দ্বিতীয়বার মানে, এর আগেও খুব ছোট থাকতে মায়ের কোলে বসে চৌমুহনী বাজারে থাকা ‘রূপ ভারতি’ সিনেমাহলে “মানুষের মন” ছায়াছবি দেখেছিলাম।) আশা সিনেমাহল থেকে বের হয়ে সামনে থাকা মিষ্টির দোকান থেকে এক টাকার পরোটা ভাজি খেলাম। রাত তখন প্রায় সাড়ে ৯টার মতো। ভাবলাম এতো রাতে পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরা যাবে না। রিকশা নাহয় বাসে চড়েই যেতে হবে। এই ভেবে হাঁটতে হাঁটতে কালী বাজার আসলাম। তখন কালী বাজার থেকে রিকসায় চিত্তরঞ্জন কটন মিল গুদারা ঘাটের ভাড়া ছিল জনপ্রতি ২ টাকা। দুইজন একসাথে ৪ টাকা।

রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাওয়ালা আরেকজন জোগাড় করার জন্য চিত্তরঞ্জন চিত্তরঞ্জন একজন একজন বলে চিল্লাচ্ছিল। কিন্তু চিত্তরঞ্জনের একজন প্যাসেঞ্জার আর পাচ্ছিল না, আমি রিকশায় উঠে বসেই রইলাম। প্রায় আধাঘন্টা হয়ে গেল, রিকশাওয়ালা একজন প্যাসেঞ্জার আর পাচ্ছিল না, আমিও তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারছি না। শেষমেশ আমি নিজের আরেকজনের ভাড়া বেশি দিয়ে একাই রিকশা নিয়ে চিত্তরঞ্জন গুদারাঘাট চলে আসলাম। কিন্তু এতো রাতে গুদারা ঘাটের খেয়া নৌকা ছিল না। নদীর এপার-ওপার মিলিয়ে দু’একটা নৌকা আছে মাঝিদের নিজস্ব নৌকা। চিত্তরঞ্জন গুদারা ঘাটে একটা ছইয়ানৌকা যাত্রীর আশায় বাধা আছে। কিন্তু নদী পার হবার মতো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না বলে, মাঝি বেটাও একজন নিয়ে নদী পাড়ি দিবে না। তখন গুদারা ভাড়া ছিল পাঁচ পয়সা। আর মাঝিদের নিজস্ব খেয়ানৌকায় জনপ্রতি ভাড়া ছিলো চারআনা। তখন গুদার ঘাটেই রাত হয়ে গেলো প্রায় ১১টা।

উপায়ন্তর না দেখে মাঝি বেটার হাতে-পায়ে ধরে দুই টাকা দিয়ে নদী পাড় হয়ে বাসায় গেলাম। বাসার সামনে যেতেই শুনি মায়ের কান্নাকাটি, আর বাবার ও বড় দাদার চিল্লাচিল্লি। মাথা নিচু করে চোরের মতো বাসায় ঢুকতেই, আমার বড় দাদা আমাকে খপ করে ধরে ফেললো। মুহূর্তেই আশে-পাশের বাসার মানুষ জড়ো হয়ে গেলো। বাবা বড় দাদাকে বলতে লাগলো, “ওঁকে মারবি না, শুধু জিজ্ঞেস কর; ও কোথায় গিয়েছিল”। তারপরও বড় দাদা দুই গালে দুটো চড় মেরে জিজ্ঞেস করলো, “বল কোথায় গছিয়েছিলি?” মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম, ‘বই কিনতে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম’। বড় দাদা আবার জিজ্ঞেস করলো, ”বই কোথায়?” বললাম, ‘আজ তো শুক্রবার ছিল, তাই সব বইয়ের দোকান বন্ধ’। “তাহলে টাকা কোথায়? বের কর!” বললো বড় দাদা। ভয়ে ভয়ে মিথ্যে বললাম, ‘টাকা হারিয়ে ফেলেছি।’ এই কথা বলার সাথে সাথে আমার বাবার এক বন্ধ গৌরাঙ্গ কাকা দৌড়ে এসে আমাকে চড়থাপ্পড় মারা শুরু করে দিল। আমি মা গো মা গো বলে চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু না, সেদিন সেসময় আমার মা আর বড় দিদিরাও যেন নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিল। কেউ আমাকে ঐ কাকার হাত থেকে রক্ষা করেনি। আমিও আর সত্য কথা বলিনি, মিথ্যের মাঝেই রয়ে গেলাম। বাসার সামনে একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। বাবার বন্ধু গৌরাঙ্গ কাকা আমাকে সেই কাঁঠাল গাছের সাথে দুইহাত পিছনে দিয়ে বেঁধে রেখেছিল, সত্য ঘটনা উদঘাটনের জন্য। কিন্তু আমি বান্দা সেদিন আর সত্য কথা বলিনি। আমার একটা কথাই ছিল, টাকা প্যান্টের পকেট থেকে হারিয়ে গেছে। তারপরও আমাকে কাঁঠাল গাছের সাথে রাত দুইটা পর্যন্ত বেঁধে রেখেছিল। রাত যখন দুইটা ছুঁই ছুঁই করছিল, মা তখন কেঁদে কেঁদে বাবা দাদাকে বলেকয়ে গৌরাঙ্গ কাকার অনুমতি নিয়ে আমাকে ছেড়ে দিল।

ছাড়া পেয়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম, আমার বাবার টাকা হারিয়েছি তাতে কাকার কী? গৌরাঙ্গ কাকা আমাকে মারল কেন? মা বললেন, “আরে চুপ কর, এই কাকাই তো একসময় তোর প্রাণ বাঁচতে সাহায্য করেছিল। যখন তোর গায়ে গুটিবসন্ত উঠেছিল। তোকে নিয়ে বাড়ি থেকে এখানে আসার পর এই গৌরাঙ্গ ঠাকুরপো তাঁদের ঘরে আমাদের থাকতে দিয়েছিল। আজ নাহয় তোকে দুটো চড়থাপ্পড়ই মেরেছে, তাতে কী হয়েছে? চল ভাত খাবি”। আমি মায়ের কথা না শুনে রাগে কাঁদতে কাঁদতে সোজা মিলে অভ্যন্তরে থাকা খেলার মাঠের দিকে চলে গেলাম। এর ঘণ্টাখানেক পর মা-বাবা দুইজন বাসা থেকে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে মাঠে এসে দেখে আমি মাঠের এককোণে বসে আসি। তখন মায়ের সাথে বাবাকে দেখে আমি আর রাগ করে বসে থাকতে পারিনি। মা বাবার সাথে বাসায় গিয়ে না খেয়েই শুয়ে রইলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার আগের নিয়মেই পড়তে বসলাম। স্কুলের সময় স্নান করে বই নিয়ে স্কুলে চলে গেলাম।

স্কুলে গিয়ে ক্লাসে বসে বসে গতরাতের কথা ভাবতে লাগলাম! ভাবলাম, সত্যি আমি গতকাল দুইটা অন্যায় করেছি। একটা হলো, বই কেনার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখেছি। আরেকটা হলো, গৌরাঙ্গ কাকার উপর অযথা রাগ করেছি। সত্যি অন্যায় করেছি। ভেবেছিলাম অভাবগ্রস্ত সংসারের কথাও। একসময় ক্লাস আরম্ভ হলো। স্কুল ছুটি হলো। বাসায় এসে বইয়ের জায়গায় বই রেখে পরনের জামা-প্যান্ট খুলে ভাত খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে মাঠে গেলাম। সব সমবয়সী বন্ধুরা আমাকে দেখে গতকালের ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো। কেউ আবার জিজ্ঞেসও করলো, “সত্যি করে বলতো গতকাল তুই কোথায় গিয়েছিলি?” কারোর কথার জবাবই দিচ্ছিলাম না, শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কেউ বললো চল, হাতমুখ ধুয়ে লক্ষ্মণখোলা ক্লাবে গিয়ে টেলিভিশন দেখে আসি। কিন্তু আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। বারবার মনে পড়ছে বই কেনার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখার কথা। টাকার জন্য আমার তখন শোকে ধরে গেল। বই কেনা হলো না, অথচ টাকা খরচ করে ফেললাম! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই টাকা যে করেই হোক জোগাড় করবোই। গেলাম বন্ধুদের সাথে টেলিভিশন দেখতে। বাসায় ফিরে সেদিন আর পড়তে বসিনি। দুইটা আটা রুটি খেয়ে শুয়ে রইলাম।

চলবে…

জীবনের গল্প-৪ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

ফেসবুক ট্যাগ কখন করবেন এবং কেন করবেন?

অনেকেই আছেন যারা অনেক দিন ধরেই ফেসবুক ব্যবহার করেই যাচ্ছেন। ফেসবুক মেসেঞ্জারে বন্ধুদের বিকাল-সন্ধ্যা, রাতদুপুরে মেসেজ দিয়েই যাচ্ছেন, দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু বন্ধু তালিকায় থাকা বন্ধুদের পোস্টে ভুলেও লাইক/কমেন্ট করছেন না। এমনকি মাসে একবারও চুপি দিয়ে দেখছেন না, বন্ধুটি কি পোস্ট করেছে। লাইক/কমেন্ট তো দূরেরই কথা!

আবার নিজের একটা ভালোলাগা ভিডিও মেসেঞ্জারে প্রেরণ করছেন। ভাবছেন না যে, আমি যেটা পছন্দ করছি বা আমার যেটা পছন্দ, সেটা আমি যাকে প্রেরণ করছি, তার কাছে ভালো লাগবে কিনা? ধরে নিতে পারেন, তার কাছে সেটা ভালো না-ও লাগতে পারে। সেটা না ভেবেই নিজের ইচ্ছেমতো বলা নেই কওয়া নেই, সময় নেই গময় নেই; দিনরাত মেসেঞ্জারে বিরক্ত করেই যাচ্ছেন। এতে নিজের কাছে ভালো লাগলেও, তা অন্যের কাছে হতে পারে বড়ই বিরক্তির বা অশান্তির মহৌষধ! তবে হ্যাঁ, মেসেজ বা বার্তা প্রেরণ করবেন। কখন এবং কেন করেন? যখন আপনার বিশেষ প্রয়োজন হবে, তখন মেসেজ বা বার্তা প্রেরণ করতে পারেন। নিজের আত্মীয় স্বজনদের ছবি নিজের আত্মীয় স্বজনদের কাছে পাঠাতে পারেন। জরুরি কোন সংবাদ প্রাপকের ইচ্ছায় প্রেরণ করতে পারেন। এছাড়া তো কোন অবস্থাতেই কারোর মেসেঞ্জারে কোনোকিছুই পাঠাতে পারেন না। এটা একরকম বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়!

এবার আসি ট্যাগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায়। আমরা যারা ফেসবুক ব্যবহার করছি। সকলেই লক্ষ্য করছি যে, কেউ কেউ দিন 🐀 রাত সুযোগ পেলেই একসাথে ৫০ জন বন্ধুকে ট্যাগ করে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন? ট্যাগ করার প্রয়োজন-ই-বা কি? আপনি যখন ফেসবুকে একটা পোস্ট করবেন, তখন অটোম্যাটিকলি আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা সকল বন্ধুরা এমনিতেই দেখতে পাবে। তাহলে এরপরও আবাত ট্যাগ করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এটা একরকম গায়ে পড়ে ঝগড়া করার সামিল!

আসলে যারা হরদম ট্যাগ করে যাচ্ছেন, মনে হয় তারা আজও জানেন না যে, ফেসবুক ট্যাগ কি এবং কেন? বিশ্বাস করুন, এটি ঠিকমত ব্যবহার না করা হলে সত্যিই খুব বিরক্ত লাগে। যা যিনি যাকে তাকে দিন 🐀 রাত ট্যাগ করে যাচ্ছেন, তাকে যদি কেউ ট্যাগ করে; তার কাছেও বিরক্তিকর হতে পারে। কেন হতে পরে?

তাহলে আসুন জেনে নেই ফেসবুক ট্যাগ কী এবং কেন?

ট্যাগ এর ইংরেজি (Tag) বাংলা অর্থ হলো, শিকল বা শিকল দ্বারা আটকানো বা মোটা একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা।

তাহলে বুঝতেই পারছেন যে, আপনার কোন পোষ্ট বা ছবিতে যদি আপনি অন্য কোন ফ্রেন্ডকে আটকাতে চান, তাহলে শুধুমাত্র ট্যাগ ব্যবহার করেই আটকাতে পারবেন। তার মানে হলো, আপনি নিজে অন্যায় করে অপরকে ফাঁসানো।

কিন্তু কেন? কেন অযথা নিজের দোষ অপরের ঘাড়ে চাপাবেন? যদি ট্যাগ সম্পর্কে বুঝে থাকেন, তাহলে শুধু শুধু আপনার একটি পোষ্টে অনেক ফ্রেন্ডদের ট্যাগ করবেন না। এর কোনও মানেই হয় না।

এবার জেনে নিন ট্যাগ করলে কি হয়! ট্যাগ করলে আসলে কি হয়?

ধরুন আপনি একটি ছবি আপলোড করে আপনার কোন বন্ধুকে ট্যাগ করলেন। সাথে সাথে আপনার আপলোড করা ছবিটি আপনার ট্যাগ করা বন্ধুর ওয়ালে বা টাইমলাইনে চলে যাবে। এর অর্থ দাঁড়ায় আপনার পোষ্টের সাথে তারাও জড়িত। তাই আপনি তাদেরকে ট্যাগ করেছেন। যা আইনের চোখে জঘন্য অপরাধ। কাজেই নিজের ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে ট্যাগ করবেন না।

হ্যাঁ, ট্যাগ করবেন। কখন করবেন, কী করবেন এবং কাকে করবেন? ট্যাগ করবেন, এলাকার কোনও জরুরি সংবাদ! আচমকা কোনও দুর্ঘটনাজনিত কারোর মৃত্যুর খবর ট্যাগ করতে পারেন। এছাড়াও নিজের পারিবারিক কারোর ছবি আপনার কোনও আত্মীয়স্বজনকে ট্যাগ করতে পারবেন। এই অবস্থায় আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ পরিচিত বন্ধুদের অনুমতিতে ট্যাগ করতে পারেন। এছাড়া অন্য কাউকে নয়। আর এটাই হচ্ছে ফেসবুক ট্যাগের প্রকৃত অর্থ বা নিয়ম।

কিন্তু অনেকেই দেখি অবুঝের মতো নিজের একটা ছবি দিয়ে, ৩০ থেকে ৫০ জনকে ট্যাগ করে দেয়। যা আসলেই ফেসবুকের নীতি বিরোধী ও একপ্রকার স্পাম। তাই কখনোই এই কাজটি আর করবেন না, প্লিজ! আরও জানুন, ফেসবুকে ট্যাগ দ্বারা কাউকে বিরক্ত করা মানে নিজে ব্লক লিস্টে বা আনফ্রেন্ড তালিকায় নাম লেখানো। যদি ভুল বলে থাকি, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে ক্ষমা করে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো অন্যসব বন্ধুদের দিনে রাতে ২৪ ঘণ্টা অযথা মেসেজ আর বিরক্তিকর ট্যাগ করতে থাকুন। এরজন্য ভবিষ্যতে ফেসবুক থেকে পুরস্কারও পেতে পারেন। ধন্যবাদ।

ছবি গুগল থেকে।

জীবনের গল্প-২

জীবনের গল্প-১-এর শেষাংশ: থাকতাম মিলের শ্রমিক ফ্যামিলি কোয়ার্টারে। সময়টা তখন হতে পারে ১৯৭৩ সালের নভেম্বর নাহয় ডিসেম্বর মাস।

গ্রামের বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পর প্রায় মাসখানেক পর্যন্ত আমার কোনও বন্ধুবান্ধব ছিল না এবং মিলের ভেতরে থাকা শ্রমিক কোয়ার্টারের কোনও সমবয়সী ছেলে আমার সাথে কথাও বলতো না। আমিও মিলের ভেতরে থাকা ওঁদের সাথে বেশি মিশতাম না। কারণ আমার নোয়াখালীর ভাষা ওঁরা কেউ বুঝতো না। আমি কিছু বলতে গেলেই আরও চার-পাঁচজন হিহিহি করে হাসতো। ওঁরা আমাকে দেখলেই নোয়াখাইল্লা নোয়াখাইল্লা বলে হাসাহাসি করতে। আবার আমার চেহেরাটা বেশি সুশ্রী ছিল না বলে, ওঁরা আমাকে দেখে ভেংচি দিতো।

আসলে ওঁদের কোনও দোষ ছিল না। দোষ ছিল আমার কুশ্রীত চেহারার। আমার মুখমণ্ডল আরও দশজনের চেয়ে অন্যরকম ছিল। মানে কুশ্রী। চেহারা কুশ্রী হওয়ার কারণ হলো, আমার বয়স যখন চার বছর; তখন নাকি আমি গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় তিনমাস পর্যন্ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে রোগমুক্ত হয়েছিলাম। শুনেছিলাম মা-বাবা ও বড়দাদা আর বোনদের মুখে। এই তিন মাসে গুটিবসন্ত রোগে আমাকে নাকি কঠিনভাবে আক্রান্ত করে ফেলেছিল। সেসময় আমাকে নাকি বাঁচিয়ে রাখার কোনও উপায়ই ছিল না। তবুও মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় নাকি বেঁচে গিয়েছিলাম।

আমার শরীরে নাকি বসন্ত রোগের সাত জাতের মধ্যে সাত জাতই দেখা দেয়েছিল। আগেকার মানুষে বলতো, একজন মানুষের যদি একসাথে সৈয়দ, দাউদ, বরণ রোগ দেখা দিতো, তখন নাকি ওই মানুষটার মরণই হতো। তাই কথায় আছে, “সৈয়দ, দাউদ, বরণ, এই তিন জাত উঠলে হয় মরণ।” আমার শরীরে উঠেছিল সাত জাত। এগুলো হলো, “সৈয়দ, দাউদ, বরণ, ছালাকাটা, মসুরিকাটা লুন্তি ও বসন্ত।” এই রোগ ছিল ছোঁয়াচে রোগ। একবার এক গ্রামে বা মহল্লায় দেখা দিলে, তাহলে পুরো গ্রামের ঘরে ঘরে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তো এবং শতশত মানুষ মারা যেতো। কিন্তু আমি বেঁচে গিয়েছিলাম, আমার মা-বাবার আপ্রাণ চেষ্টার কারণে এবং মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায়। বলে বলে রাখা ভালো যে, আমার এই রোগের কারণে অন্যকোনো পরিবারের মানুষ তখন এই ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়নি। এই রোগের রুগী শুধু আমি একাই ছিলাম।

আমার শরীরে যখন এই রোগ দেখা দেয়, তখন আমি গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। সাতদিন পর্যন্ত আমার মা গ্রাম্য কবিরাজ থেকে ঝাড়ফুঁক, ঔষধ ও পানি পড়া খাওয়ানোর পরও যখন আমি ভালো হচ্ছিলাম না, তখনই আমার মা নিকটস্থ পোস্ট অফিস থেকে বাবাকে টেলিগ্রাফ করে পাঠায়। বাবা তখন মায়ের পাঠানো টেলিগ্রাফ পেয়ে সাথে সাথে ধারদেনা করে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে এসে মা-সহ আমাকে অতি কষ্টে আমার সুচিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যায়। মা আমাকে নিয়ে উঠলো, আদর্শ কটন মিলের শ্রমিকদের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকা পরিচিত একজনের বাসায়। আমাকে নিয়ে যাঁর বাসায় গিয়ে উঠল, ওই লোক ছিল আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বাবার সাগরেদ। আমার এই ছোঁয়াচে রোগ হওয়ার পরও ওই লোক তাঁদের একটা রুম আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। যাতে আমার কোনো সমস্যা না হয়। ওই বাসায় থাকা খাওয়ার কোনও সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল শুধু আমার চিকিৎসার সমস্যা। তখন আমার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, আমাকে দেখে সবাই বলেছিল, আমাকে আর বাঁচানো যাবে না। নিশ্চিত মৃত্যু। আমার মা-বাবাও আমার আশা একরকম ছেড়ে দিয়ে নিকটস্থ ১নং ঢাকেশ্বরী কনট মিলের শ্রমিক কলোনিতে থাকা একজন কবিরাজের শরণাপন্ন হলেন। তিনি শুধু এই রোগেরই চিকিৎসা করতেন। গ্রামের বাড়ি থেকে আমাকে নারায়ণগঞ্জ আনাও হয়েছিল এই কবিরাজকে দেখানোর জন্য।

তখনকার সময়ে এদেশে এই রোগের কবিরাজি চিকিৎসা ছাড়া অন্যকোনো সুচিকিৎসা ছিল না। আমাকে যে কবিরাজ চিকিৎসা করেছিল, তিনি ছিলেন একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তিনি মাশীতলা দেবী’র সাধন করতেন এবং যেখানেই এই রোগ দেখা দিতো, সেখানেই দৌড়ে যেতেন। বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। উনার চিকিৎসায় এই রোগ থেকে সেরে ওঠলে নামমাত্রও কিছু নিতেন না। আমার এই রোগ হওয়ার আগে থেকেই ওই সাধকের পরিবারের সাথে আমার মা-বাবার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাই এই চিকিৎসক আমার সু-চিকিৎসার জন্য এবং আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের বাসায় বসেই মা শীতলা দেবী’র পূজা করতেন এবং আমাকে চিকিৎসা করতেন। উনি প্রচুর মদপান করতেন। শীতলা দেবী’র পূজা সেরে উনি মদ পানের সাথে আমার শরীরও নাকি চেটে খেতেন। শুনেছি মায়ের মুখে।

সেসময় এই গুটিবসন্তের কারণে আমার সমস্ত শরীরই পচন ধরে গিয়েছিল। শরীরের পুরো অংশই ছিল মাংসবিহীন। চৌকির উপর কলাপাতা বিছিয়ে তিলের তেল কলাপাতায় মেখে সেখানে আমাকে শোয়াইয়ে রাখতো। এমনিতেই এই রোগ হলে একরকম চুলকানির মতো রোগ। এই রোগ হলে সমস্ত শরীরই চুলকায়। শরীর চুলকানির কারণে আমি নাকি সবসময়ই আমার দুইহাত দিয়ে মুখমণ্ডল-সহ সারা শরীর সারাক্ষণ খামচাতাম। এজন্য আমার হাত পা চৌকির চার পায়ার সাথে বেঁধে রাখা হতো। যাতে আমি হাত পা দিয়ে শরীর না খামচাতে পারি। তবুও মাঝে মাঝে হাত দিয়ে খামচানোর ফলে, আমার মুখমণ্ডলের মাংস (ত্বক) হাতের নখের খোঁচায় এদিক-সেদিক হয়ে গিয়েছিল। সাথে দু’চোখের মনিতেও গুটিবসন্ত উঠেছিল। তিনমাস মৃত্যুশয্যা থেকে সেরে উঠার পর অন্তত বছরখানেক আমি অন্ধ মানুষের মতো দু-হাত নেড়ে-চেড়ে চলতাম। ওই কবিরাজের সাজেশন মতো পুকুরে জন্মানো বড় আকারের শামুকের জল প্রতিদিন তিনবেলা কয়েক ফোঁটা করে দেওয়ার পর আমার চোখ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুখমণ্ডল থেকে সরে যাওয়া মাংস(ত্বক) আর সমান হয়নি। আমার চেহারা এখনো কুশ্রী।

এই কুশ্রী চেহারা আর নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার কারণে আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে থাকা সমবয়সী ছেলেরা আমাকে দেখে একরকম ঘৃণাই করতো। হাসতো, ভেংচি দিতো। এতে আমার খুব রাগ হতো। অনেক সময় বেশি রাগ হয়ে যেতো। তখন মিল অভ্যন্তরে অনেক ছেলেকে ধামধুম মেরে নিজেদের বাসায় এসে বসে থাকতাম। আর বাড়ি থেকে সাথে আনা পুরানো বইগুলো নিজে নিজেই পড়তাম। এভাবে আস্তে আস্তে নিজে নিজেই নারায়ণগঞ্জের কিছু আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করে ফেললাম। বাসার বাইরে যেতাম। মিলের ভেতরে স্থায়ীভাবে থাকা সমবয়সী ছেলেরাও আস্তে আস্তে আমাকে কাছে ডাকতে শুরু করলো। ওঁদের সাথে খেলতে বলতো। আমিও ওঁদের সাথে মিশতাম, খেলতাম। যখন যা-ই করতাম, বাসায় এসে নিয়মিত পুরানো বইগুলো একা একা নেড়ে-চেড়ে পড়তাম। স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে বলতাম। মা শুনতেন, কিন্তু আমার কথায় সায় দিতেন না। কারণ আদর্শ কটন মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে সব ফ্যামিলিদের মধ্যে আমরাই ছিলাম একেবারে নিকৃষ্ট ফ্যামিলি। মানে অভাবগ্রস্ত ফ্যামিলি।

তখন আমাদের সংসার ছিল মা-বাবা, দাদা-বৌদি, দুকজন ভাতিজা, একজন ভাতিজী, অবিবাহিত দুই বোন ও আমি-সহ মোট নয়জন সদস্যের বিরাট এক সংসার। ইনকাম করার মতো ছিল আমার বাবা আর বড়দাদা। তাও ছিল নামমাত্র বেতন। মাসের প্রত্যেক দিনই তিনবেলার মধ্যে শুধু দুপুরবেলাই আমাদের কপালে ভাত জুটতো। আর দিনের দুইবেলার মধ্যে কোনো-কোনো সময় শুধু একবেলা খেতে পারতাম। আর একবেলা থাকত হতো আকাশ পানে চেয়ে। তখন মিল কর্তৃপক্ষ থেকে প্রত্যেক শ্রমিক ও স্টাফের রেশন কার্ড দেওয়া ছিল। আমাদেরও ছিল। বাবারও ছিল। বড় দাদারও ছিল। রেশন কার্ডে শুধু চাল, গম, চিনি পেতাম। আমাদের সংসার মাসের অর্ধেক সময় রেশন কার্ডের উপর নির্ভর থাকতো। কোনো-কোনো সময় নগদ টাকা না থাকার কারণে রেশন তুলতে পারতাম না। তখন সামান্য লাভে রেশন বিক্রি করে দিতে হতো। ওই রেশন বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে অন্য কারোর রেশন থেকে গম কিনে নিতাম। সেই গম থেকে আটা করে সকাল-বিকাল আটার রুটি খেতাম। সময়টা তখন ১৯৭৩ সালের শেষদিকে। এরই মধ্যে দেশে দেখা দিতে শুরু করলো দুর্ভিক্ষ। এমন অবস্থার মধ্যে আমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করানো যেন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ালো। তবুও আমার পড়ার আগ্রহ দেখে সংসারের অভাব অনটনের মধ্যেও ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে আমার বড়দাদা নিকটস্থ দক্ষিণ লক্ষ্মণ খোলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেয়।

তখন দেশের চারদিকে দুর্ভিক্ষ! জায়গায় জায়গায় মানুষ না খেয়ে মরছে, এমন খবর সবসময়ই সবার মুখে মুখে থাকতো। সেসময় আমাদের মতো কষ্ট এদেশে আর কেউ হয়তো করেনি। দুইবেলা আটার জাউ ছিল আমাদের সংসারের নিয়মিত খাবারের তালিকায়। আর দুপুরবেলা চালের সাথে বেশি করে আলু কুচি দিয়ে ভাত রান্না করা হতো। মানে চালের উপর চাপ কমানো। চাল কম, আলু বেশি। সেসময় অভাব অনটন যে কী তা আমি এতো বুঝতাম না। আমি স্কুলে যাওয়ার সময় তামার দুই পয়সার জন্য মায়ের কাছে চেয়ে কাঁদতাম। কোনও দিন পেতাম। কোনও দিন আবার পেতাম না, কাঁদতে কাঁদতে বই বগলে নিয়ে স্কুলে চলে যেতাম। স্কুলে গিয়ে দেখতাম আরও দশজন সমবয়সী মনের আনন্দে আইসক্রিম খেতো, বুট ভাজা খেতো, এটা খেতো, সেটা খেতো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম, আর চোখের জল ফেলতাম। তবুও পারতপক্ষে কোনও দিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করিনি। আমি আমার ক্লাসে সবসময়ই নিয়মিত ছিলাম। ঘরে খাবার না থাকলেও, আমি বান্দা স্কুলে যেতাম।

সেই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের হাইস্কুলে ভর্তি হলাম ঠিক, কিন্তু সংসারের অভাব অনটন আমাকে দুর্বল করে তোলে। স্কুল থেকে বাসায় আসার পর যখন দেখতাম ভাতের হাঁড়িতে ভাত নেই, তখন কাউকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী ঘেঁষা আদর্শ কটন মিলের খেলার মাঠের এককোণে নিরিবিলি বসে থাকতাম অথবা সমবয়সী বন্ধুদের সাথে খালি পেটে খেলায় মেতে থাকতাম। অনেকসময় সন্ধ্যাবেলা বন্ধুদের সাথে লক্ষ্মণখোলা জনতা ক্লাবে টেলিভিশন দেখতে চলে যেতাম। তখন আদর্শ কটন মিলে টেলিভিশন ছিল না। তখনকার সময়ে টেলিভিশনের খুবই দাম ছিল, মান ছিল, সম্মান ছিল। এখনকার মতো ঘরে ঘরে, মহল্লার আনাচে-কানাচে, হাটবাজারে টেলিভিশন ছিল না। টেলিভিশন ছিল সাতরাজার ধন, মানিক রতন। যা ছিল স্বপ্নের ব্যাপার-স্যাপার।

অনেকসময় টেলিভিশন দেখতে গিয়ে লক্ষ্মণখোলার স্থানীয় ছেলেদের হাতে মাইর-গুতা খেয়ে বাসায় ফিরতাম। বাসায় এসে দেখতাম রাতের খাবার তখনও জোগাড় হয়নি। না খেয়ে ওমনি বই নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে থাকতাম। অনেক রাতে বড় দিদিরা ভাত খেতে ডাকতো। কোনও দিন ওঠে খেতাম। কোনও দিন আর উঠতাম না। না খেয়েই ঘুমিয়ে থাকতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে জল দেওয়া পান্তাভাত খেয়ে আবার পড়তে বসতাম। স্কুলে যাবার সময় হলে শীতলক্ষ্যা নদীতে স্নান করে তাড়াতাড়ি স্কুলে চলে যেতাম। স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে কোনও দিন দেখতাম ভাতের হাঁড়িতে ভাত আছে, কোনও দিন দেখতাম ভাত নেই। এভাবেই সেসময়কার দিনগুলো আমাদের অতিবাহিত হতে লাগলো। দেশের দুর্ভিক্ষও তখন আস্তে আস্তে হাত নেড়ে দূরে যেতে লাগলো। কিন্তুক আমাদের সংসারে লেগে থাকা দুর্ভিক্ষ তখনও দূর হয়নি। বারোমাসি দুর্ভিক্ষ আমাদের সংসারের লেগেই থাকলো। সেসময় স্কুলে যাওয়ার মতো পোশাকও আমার ছিল না। বাবা ও বড়দাদা মিল থেকে পাওয়া রিজেক্ট কাপড় দিয়ে বড়দি’র হাতে বানানো জামা- হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম। পায়ের স্যান্ডেলও ছিল না।

চলবে…

জীবনের গল্প-৩ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

কান্নার প্রতিযোগিতা

করোনা কালে চলছে কান্নার প্রতিযোগিতা,
কান্নার চাপে হারিয়ে গেছে সহমর্মিতা
কাঁদছে কবিদের লেখা কবিতা
কাঁদছে বিশ্বের মানবিকতা
পর্যটনে নীরব নিস্তব্ধতা
কান্নার প্রতিযোগিতা।

কান্নার প্রতিযোগিতায়,
কাঁদে স্বজন হারানোর বেদনায়
কেউ কাঁদে ভুগে ঘাতক করোনায়
কেউ কাঁদে দ্বারে-দ্বারে ক্ষুধার জ্বালায়
কাউ কাঁদে রাস্তায় সন্তানের অবহেলায়
কেউ কেউ নীরবে কাঁদে ধুঁকে ধুঁকে লজ্জায়।

কাঁদছে কেউ নিজের আখের গোছানোর ধান্দায়,
টাকার পাহাড় গড়তে কাঁদছে বসে অট্টালিকায়
জনপ্রতিনিধিরা চোখ মুছে চালের বস্তায়
কেউ কাঁদার অভিনয়ে পরকে ঠকায়
অসাধু ব্যক্তিরা সুযোগে কাঁদায়
কন্নার প্রতিযোগিতায়।

কান্নার প্রতিযোগিতায়,
কান্নায় ভেঙে পড়ছে নমুনা পরীক্ষায়
কান্না থামছে না হাসপাতালের বারান্দায়
চলছে কান্নার প্রতিযোগিতা জায়গায় জায়গায়
কেউ কাঁদে সুখে, কেউ দুখে, কেউ কাঁদে ধান্দায়
প্রতিদিন নতুন যোগ হচ্ছে কান্নার প্রতিযোগিতায়।

ছবি গুগল থেকে।

হে জাতির পিতা

হে জাতির পিতা,
আমি যদি শিল্পী হতাম,
তোমার ছবি এঁকে রাখতাম!
দেয়ালে দেয়ালে তোমার ছবি আঁকতাম,
ছবিগুলো দেখে রাখতে অনুরোধ করতাম।
যাদুঘরে মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করে রাখতাম,
জনমে জনমে মনের মনিকোঠায় রেখে দিতাম!

হে জাতির পিতা,
আমি যদি কবি হতাম!
তোমার নামে কবিতা লিখতাম,
আমার সোনালী ডায়রিতে লিখে রাখতাম!
কবিতার বই ছাপিয়ে সবাইর হাতে দিতাম,
তোমার নাম কাগজে লিখে বাতাসে ওড়াতাম!

হে জাতির পিতা,
আমি যদি ইতিহাসবিদ হতাম!
তোমার নামে ইতিহাস রচনা করতাম,
তুমি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তা লিখতাম।
জীবনভর শুধু তোমার ইতিহাসই লিখে যেতাম,
পৃথিবীর বাইরে থাকা ভিনগ্রহেও প্রচার করতাম।

হে জাতির পিতা,
আমি যদি হিমালয় হতাম!
পর্বতের চূড়ায় পদ্মাসনে বসাতাম,
তোমাকে আমার দেবতা মেনে পূজা করতাম!
আমার মন মন্দিরে তোমার ছবি টাঙিয়ে রাখতাম,
সকাল-সন্ধ্যা-রাতে তোমার ছবিতে ফুল ছেটাতাম।

হে জাতির পিতা,
আমি যদি বিচারক হতাম!
তোমার হত্যাকারীদের শাস্তি দিতাম,
১৫ আগস্টে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতাম!
দুষ্টু মদতদাতাদের বিচারের আওতায় আনতাম,
তোমার সপরিবার হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝালাতাম।

১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ও তার পরিবারের সকল শহীদদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা-সহ সশ্রদ্ধ গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জীবনের গল্প-১

নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন একটি ছোট গ্রামের নাম মাহাতাবপুর। মাহাতাবপুর গ্রামটি হলো নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে। সেই গ্রামের এক হিন্দু পরিবারে আমার জন্ম। আমার জন্ম ৮ই জুন, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। আমার বাবার বাপদাদার আমলটা নিজের চোখে না দেখলেও, তাঁদের সময়টা খুবই ভালো ছিল বলে মনে হয়। কারণ, মাহাতাবপুর গ্রামে আর কারোর বাড়িতে দালান ঘর ছিল না। দালান ঘর শুধু পুরো গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়িতেই ছিল। তাও আবার ঘরগুলো ছিল চাটগাঁর (চট্টগ্রামের) পাহাড়ি মাটির দিয়ে তৈরি। ঘরগুলো দেখতে হুবহু গুদামঘরের মতনই দেখা যেতো। যার কারণে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় আমাদের বাড়ির নাম ছিল মাইডগা গুদাময়ালা বাড়ি। আমার দাদার নাম ছিল পঞ্চনন্দ পাল। বাবার নাম শচিন্দ্র চন্দ্র পাল। আমার বাবার আরও দুই ভাই ছিল। মেজো কাকা যতিন্দ্র চন্দ্র পাল। ছোট কাকার নাম ছিল, শান্তিরঞ্জন পাল। আমরা ছিলাম চার বোন, দুই ভাই। নিমাই চন্দ্র পাল, রাধা (রাধু) রাণী পাল, মায়া রানী পাল’ জ্যোৎস্না রানী পাল, মিলন রানী পাল ও আমি নিতাই চন্দ্র পাল ছিলাম সবার ছোট।

মায়ের মুখে শুনেছিলাম আমার ঠাকুরদা’র কথা। আমার ঠাকুর’দা ছিলেন তখনকার সময়ে ছোটখাটো ব্যবসায়ী। তিনি চাটগাঁ (চট্টগ্রাম) থেকে বিভিন্ন মালামাল পাইকারি এনে নোয়াখালী চৌমুহনী বাজারে বিক্রি করতেন। ঠাকুরদা’র চৌমুহনী বাজারে দোকানও ছিল। মাল রাখার গোডাউনও ছিল। ঠাকুরদা মাসের মধ্যে অন্তত ৬/৭ দিন চট্টগ্রামে থাকতেন। আমাদের বাড়ির দালান ঘরগুলো যেই মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল, সেই মাটি তখনকার সময় আমার ঠাকুরদা নৌকা যোগে চট্টগ্রাম থেকেই এনেছিলেন। ঘর তৈরির কারিকরও ছিল চট্টগ্রামের। ঘরের দেয়াল ছিল দুইহাত পাশ। ঘরের ভেতরে প্রয়োজন মতো কোঠাও ছিল। বর্ষাকালে বন্যা থেকে রেহাই পেতে ঘরগুলো ছিল বাড়ির উঠোন থেকে অনেক উঁচু। আমার ঠাকুরদা’র দেখাদেখি আমার বাবার কাকা জেঠারাও চাটগাঁ থেকে মাটি এনে একই পদ্ধতিতে তাঁদের সীমানায় মাটির ঘর তৈরি করেছিল।

আমার ঠাকুর’দা চাটগাঁ থেকে মাটি এনে ঘর তৈরি করার একটা কারণ ছিল। কারণ হলো, তখনকার সময়ে রড সিমেন্টের খুবই অভাব ছিল। যা ছিল, তা কেবলমাত্র বিদেশে, আর এদেশে যাঁদের তেমন অর্থকড়ি ছিল তাঁদের জন্য ছিল। তবুও বিদেশের মত এই বঙ্গদেশে তখন ঘরের আনাচে-কানাচে সিমেন্ট পাওয়া যেতো না। যাঁদের অট্টালিকা তৈরি করার সামর্থ্য ছিল, তাঁরা দেশীয় তৈরি ছোট আকারের ইট পেক-মাটি দিয়ে অট্টালিকা বা ইটের দালানঘর নির্মাণ করতো। তা আগেকার সময়ের তৈরি পুরানো স্থাপনাগুলো দেখলেই বোঝা যায়। আগেকার দিনের পুরানো দালান ঘরগুলোতে দেখা যায়, দোতলা ঘর তৈরি করা হয়েছে লোহা বা কাঠের মাচার উপর। দেওয়াল বা প্রাচীর বা বাউন্ডারির ওয়াল করা হয়েছে সিমেন্টের পরিবর্তে মাটি দিয়ে। তখনকার সময়ে যদি সিমেন্ট পাওয়া যেতো, তাহলে আমার ঠাকুর দাদাও ইট-সিমেন্টের সমন্বয়ে বাড়ির ঘরগুলো তৈরি করতো। সিমেন্টের অভাবের কারণেই আমার ঠাকুরদা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মতো বাড়ির ঘরগুলো তৈরি করেছে চাটগাঁইয়া মাটি দিয়ে। এই মাটির ঘর আমাদের বাড়ি ছাড়া গ্রামের আর কারোর বাড়িতে ছিল না বলেই, আমাদের বাড়ির ডাকনাম হয়েছিল মাইডগা গুদামওয়ালা বাড়ি। আমি সেই মাইডগা গুদামওয়ালা বাড়ির ছেলে। সেই বাড়িতেই আমার জন্ম! পাঁচ বছর বয়সে সেখানেই আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি।

আমি ছোট থেকে একটু বড় হয়ে দেখেছি, আমার বাবার জেঠাতো ভাই’রা স্বচ্ছল স্বাবলম্বী থাকলেও; একই বাড়িতে আমাদেরই ছিল অভাব অনটনের সংসার। আমার বাবার দুই ভাই শান্তি রঞ্জন পাল ও যতিন্দ্র পাল। তাঁদের মধ্যে শান্তি কাকা একসময় আমার বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জই চাকরি করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি তিনি পার্বত্যচট্টগ্রাম রামগড় গুঁইমারা বাজার নামক স্থানে সপরিবারে বসবাস করছে। যতিন্দ্র কাকা মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে চাঁদপুর থাকতেন। চাঁদপুরেই তিনি বিয়ে-সাদী করে সেখানেই ছিল তাঁর স্থায়ী বসবাস। যদিও খুব ছোটকালে যতিন্দ্র কাকা আমাকে দেখেছিল, কিন্তু আমি বুঝের হয়ে যতিন্দ্র কাকাকে একবারও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শুধু জানতাম যতিন্দ্র নামে আমার আরেকজন কাকা আছে। আমি বুঝের হয়েও আমার ঠাকুরমাকে দেখেছি। ঠাকুরমার আদর পেয়েছি। কিন্তু আমার ঠাকুরদা’কে কখনো দেখিনি। আমার ঠাকুরমা মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে দেশ স্বাধীন হবার কয়েকমাস পরেই পরপারে পাড়ি দিয়ে স্বর্গীয় হন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ যখন স্বাধীন হয়, আমি তখন সাত/আট বছরের নাবালক এক শিশু। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সময়কার স্মৃতিগুলো এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। সে সময়কার কথা আমার মৃত্যুর আগপর্যন্তই মনে থাকবে বলে মনে হয়। মনে পড়ে সে সময়ের কথা। তখন আমাদের সংসারে খুবই অভাব অনটন ছিল। এর আগে থেকেই ছিল আমাদের সংসারে অভাব। তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ! আমাদের গ্রামে আমাদের মতো এতো অভাব অনটন আর কারোর সংসারে ছিল না। পুরো মাহাতাবপুর গ্রামে সবকটা পরিবারে মধ্যে আমাদের পরিবারই ছিল সবসময়ের জন্য অভাবগ্রস্থ। কারণ বাড়ির একটা মাটির ঘর ছাড়া আমাদের আর কোনও জায়গা-জমি ছিল না, তাই। আমাদের সংসার চলতে বাবা এবং আমার বড়দা’র চাকরির বেতনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে বাবা ও বড়দা’র টাকা পাঠানো একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আমাদের সংসারে থাকা সবাই দিনের পর দিন বেশিরভাগ সময় না খেয়েই থাকতে হতো। সময়তে সকালের খাবার রাতে মিলতো। আবার দুপুরবেলায় জুটলেও রাতে জুটতো না।

মুক্তিযুদ্ধের আগে গ্রামের অন্যসব গৃহস্থের জমিতে ধান কাটার সময় আমরা ভাইবোন মিলে ধান কুড়াতাম। সেই কুড়ানো ধানের কিছু চাল দিয়ে পূজাপার্বণে চিড়ামুড়ির চাহিদা মেটাতাম। বাকি চালগুলো নিজেদের সংসারে কয়েকদিনের খোরাকও হয়ে যেতো। এছাড়াও সময় সময় আমিও বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে কচুর লতি, আর সুপারিগাছ থেকে ঝরে পরা সুপারি কুড়িয়ে বড় জেঠার সাথে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। যা পেতাম, তা মায়ের কাছে অথবা বড়দি’র কাছে বুঝিয়ে দিতাম। সেই পয়সা থেকে মা আমাকে পহেলা বৈশাখের আগে চৈত্র-সংক্রান্তির মেলায় কিছু পয়সা দিতেন। আর কিছু দিতে দুর্গাপূজা শেষে লক্ষ্মীপূজার সময়। আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যা দু’চার পয়সা থাকতো, তা আমার মা সংসারেই খরচ করতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গ্রামের কোনো গৃহস্থেরা জমিতে চাষাবাদ করেনি। আর আমিও আগের মতো কিচুর লতি, সুপারি কুড়িয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারিনি। তাই সেসময় আমাদের সংসারে ছিল দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা। অবশ্য এই অবস্থা ছিল, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে বাবা বাড়িতে না আসা পর্যন্ত।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে বাবা খালি হাতে বাড়ি ফিরল। তখন মায়ের শেষ সম্বল একজোড়া কানের দুল বন্ধক রেখে কিছু টাকা সংগ্রহ করা হয়। সেই টাকা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাবা মড়ি বিক্রি শুরু করেন। এই মুড়ির ব্যবসা করেই সেই সময়টা কোনওরকমে টেনেটুনে পাড় হয়েছিল। একসময় দেশ হানাদার মুক্ত হয়ে স্বাধীন হলো। বাবার চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে যায়। ছোট কাকা সপরিবার নিয়ে চলে যায় পার্বত্যচট্টগ্রামের রামগড় গুঁইমারা বাজার। বড়দাদাও শরনার্থী জীবন ত্যাগ করে ভারত থেকে দেশে ফিরে এসে আবার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

এর ছয়মাস পরই আমার চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয় বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়ে ঠিক হয়েছে নারায়ণগঞ্জই। ছেলে (জামাই) নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপাড় লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের শ্রমিক ছিল। ছেলে লোকমুখে আমার এই বোনের গুনগান শুনেই বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। যৌতুক বা অন্যকোনো লেনা-দেনার আবদার ছিল না তাঁর। শুধু বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করে দিতে পারলেই হলো। আমার বাবা ও বড়দাদা তাতেই রাজি হয়ে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করে ফেললো। বিবাহের কার্যসম্পাদন হবে নারায়ণগঞ্জই। এই বোনের বড় রাধারাণী নামে যেই বোন ছিল, ওঁর বিয়ে আরও অনেক আগেই হয়েছিল। রাধু দিদির যখন বিয়ে হয়, তখান আমার বয়স হয়েছিল মাত্র দেড়বছর। সে বোনের বিয়ের কাহিনি শুনেছি মায়ের মুখে। কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র মনে নেই, স্মরণেও নেই।

তবে এই মেজো বোনের বিবাহ অনুষ্ঠানে আমি আমার মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম। মেজো বোনের বিয়ের চার-পাঁচ দিন আগে আমার বড়দাদা নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে এসে মেজো বোন-সহ মায়ের সাথে আমাকেও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গিয়েছিল। দেখেছি এবং মনেও আছে। বোনের বিয়েতে গিয়ে মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জ মাসেক খানেক থেকে, আমাদের গ্রাম ও বাড়ি দেখানোর জন্য বোন-সহ জামাইবাবুকে সাথে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসি। তখন দেশের অবস্থা বেশি ভালো নেই! তখন চোর ডাকাতের উপদ্রবে সারা দেশের গ্রাম শহরের মানুষ একরকম অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। আমার মেজো বোনের জামাই(জামাইবাবু) বাড়িতে থাকাকালীন সময়েও একবার ডাকাতদল আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। সেই ভয়ে আমার জামাইবাবু মেজো বোনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আমাদের গ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে যায়।

সেসময় চোর ডাকাতদের উপদ্রবে আমরা আর গ্রামের বাড়িতে বেশিদিন টিকে থাকতে পারিনি। আমাদের গ্রামে আরও অন্যান্য বাড়ির মধ্যে আমাদের বাড়িতেই ডাকাতদের হানা ছিল বেশি। এর কারণ হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীদের আড্ডা ছিল। এতে আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের অনেকেই মনে করতো যে, আমাদের বাড়িতেই মুক্তিবাহিনীরা ক্যাম্প স্থাপন করেছে। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের বাড়িতেই ডাকাতদের হানা ছিল সবচেয়ে বেশি। ডাকাতদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় আমরা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে চলে এলাম নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে। থাকতাম মিলের শ্রমিক ফ্যামিলি কোয়ার্টারে। সময়টা তখন হতে পারে ১৯৭৩ সালের নভেম্বর নাহয় ডিসেম্বর মাস।

চলবে…

জীবনের গল্প-২ এখানে।

স্বপ্ন দেখা

স্বপ্ন প্রতিটি মানুষই দেখে। কারণে অকারণে দিনে-রাতে স্বপ্ন দেখেই যাচ্ছে। কেউ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের ডানা মেলে এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমিও স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন, প্রতি রাতে। স্বপ্ন দেখি দিনের বেলাতেও। স্বপ্ন দেখা আমার নতুন কিছুই নয়। স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই দেখছি। ছোটবেলা ঘুমের ঘোরে যদি স্বপ্ন দেখতাম, আর যদি সেই স্বপনের দৃশ্যগুলো মনে থাকতো; সেই দৃশ্যগুলো মায়ের কাছে বলতাম। আগেকার সময়ে স্বপ্ন দেখা নিয়েও অনেক কুসংস্কার ছিলো। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখাও অনেকে বিশ্বাস করে থাকতো। আমার মা-ও একজন কুসংস্কার প্রিয় মানুষ ছিলেন। মায়ের কাছে যখন স্বপ্নের দৃশ্যগুলোর কথা বলতাম, তখন আমার মা সেসব দৃশ্যগুলোর বিশ্লেষণ করতেন।

যদি স্বপ্নে কোনও সাপ দেখতাম, তাহলে মা বলতেন, ‘সাবধানে থাকিস! বিপদ হতে পারে।’ যদি মৃত: মানুষ দেখতাম, তাহলে মা বলতেন, ‘আপনা দেখলে পরের হয়, পরেরটা দেখলে নিজেদের হয়। তুই কি মরা মানুষ নিজের কাউকে দেখেছি?’ যদি বলতাম, ‘না মা, আমি স্বপ্নে অপরিচিত একজনকে মরতে দেখেছি।’ তাহলে মা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলতেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে রে! কী জানি হয়! জিজ্ঞেস করতাম, ‘কি হবে মা?’ মা ধমক দিয়ে বলতেন, ‘স্বপ্নে পরের মরা দেখা ভালো না! এতে নিজেদের ঘাড়ে বিপদ এসে ভর করে।’ এরপর থেকে আমার মা খুব টেনশনে থাকতেন। ক’দিন পর দেখতাম আমাদের কারোই কোনও বিপদ হয়নি! তখন মাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘মা, তুমি না বলেছিলে স্বপ্নে পরের মরা দেখলে নিজের কাঁধে বিপদ এসে ভর করে! আজ কয়েকদিন গত হলো, কই আমাদের তো কারোই কোনও বিপদ হয়নি।’ তখন আমার মা আমাকে শান্তনা দিয়ে বলতেন, ‘বিপদ কেটে গেছে,বাবা। সব সময় কি আর স্বপ্ন ফলে? তবে এসব দেখা ভালো না। স্বপ্ন শয়তানেও দেখায়।’ জিজ্ঞেস করতাম তা আবার কেমন স্বপ্ন মা?’ মা বলতেন, ‘শয়তানে তোকে ঘরের বাইরে নিয়ে বলবে হিসু দেয়। তুই যদি শয়তানের কথায় হিসু দিস, তাহলে সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখবি যেই বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলি, সেই বিছানায় হিসু দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছিস।’

আসলেও এমন আকাম-কুকাম মাঝে মাঝে আমার ঘটে যেতো। এরজন্য আমার মা ঠাকুর, মোল্লা, মুন্সি, ওঝা বৈদ্য, গ্রাম্য কবিরাদের কাছ থেকে কেজি খানেক তাবিজ-কবজ আমার গলায় বেঁধে রাখতেন। সেই তাবিজের গাট্টি গলায় ঝুলিয়ে মাসের পর মাস আমার বিছানা ভিজানোর দায়ে সাজা ভোগ করতে হতো। তারপরও হঠাৎ হঠাৎ শয়তানের প্রবঞ্চনায় পড়ে বিছানা ভিজিয়ে রাখতাম। অবশ্যই ছোটবার সেই শয়তান মনে হয় বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাকে ছেড়ে অন্য কারোর কাঁধে চড়েছিল। কিন্তু সেই ছোটবেলার স্বপ্নের শয়তানের শয়তানির কথা আমার আজও মনে আছে। ছোটবেলার স্বপ্নগুলোর কথা যখন মনে পড়ে, তখন একা একা ভাবি!

সেই ভাবনা থেকে আমি এখনো ঘুমের ঘোরে খুবই সাবধানে থাকি। কারণ, ঘুমের ঘোরে সেই ছোটবেলার শয়তানটা যদি আবার ওইসব আকাম-কুকাম ঘটায়! তাই খুব সাবধানে স্বপ্ন দেখি। মা বলতেন, ‘ঘুমের ঘোরে কখনো খাবার খাবি না। ঘুমের ঘোরে খাবার খেলে পেটখারাপ হবার সম্ভবনা থাকে।’ তাই আমি ঘুমের ঘোরে কখনো কোনও রাজপ্রাসাদে যেতাম না। কারণ সেসব রাজপ্রাসাদে অনেকরকমের দামী-দামী খাবার থাকে। যদি লোভে পড়ে খেয়ে ফেলি! তাহলে তো আমার পেটের পীড়া নিয়ে ভুগতে হবে। তাই আমি ওইস নামি-দামি রাজ-রাজাদের প্রসাদে না গিয়ে থেকে যেতাম গরিবের ভাঙা ঘরে। নহয় বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থাকা কোনও বস্তিতে। বস্তিঘরে কোরমা, পোলাও, চিকেন বিরিয়ানি থাকে না। বস্তি ঘরে থাকে পান্তাভাত। ভূলবশত জল ঢালা পান্তাভাত খেয়ে ফেললেও, অন্তত পেটখারাপ হবে না। গরিবের পান্তা ভাতে ভিটামিন আছে। শান্তা ভাতে পেটখারাপ হবার কোনও লক্ষ্মণ দেখা দিবে না।

আবার আমি স্বপ্নে কখনোই প্যারিস, লন্ডন, আমেরিকার শিকাগো শহরেও যাই না, যাইওনি। কারণ আমি গরিব মানুষ! লেখাপড়া কম জানেওয়ালা একজন অধম মানুষ! লন্ডন, আমেরিকা, ফ্রান্স, প্যারিসের ইংরেজি ভাষা আমি জানি না, বলতেও পারি না। ভাষা না জানলে, আর না বুঝলে যে বিপদে পড়তে হয়, সেটা আমার খুব ভালো জানা আছে। তাই আর ঘুমের ঘোরে স্বপ্নেও ওইসব ইংরেজি ভাষাভাষীদের দেশে আমি যেতাম না। আমি বাঙালি। বাংলা আমার মায়ের ভাষা, মাতৃভাষা। তাই আমি স্বপ্নের মাঝে থেকে যেতাম, আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহরের চাঁনমারি বস্তি কিম্বা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে যত্রতত্র ফেলে রাখা দুর্গন্ধময় বর্জ্যের পাশে থাকা বস্তি ঘরে।

ঘুমের ঘোরে কখনো বিমানে চড়িনি, দমবন্ধ হয়ে যাবে বলে। আমার ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে চড়া হতো আগেকার সময়ের গরুগাড়ি, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি, আর গরিবের ভাঙাচুরা রিকশায়, নাহয় নারায়ণগঞ্জ টু সদরঘাট মুড়িরটিন বাসে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে সাবমেরিন চড়ে মহাসাগরের তলদেশে যাইনি কখনো, নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো বলে। যদি সাবমেরিনে চড়ে পানির নিচে গায়েব হয়ে যাই, তাহলে আমার দুখিনী গিন্নী সারাজীবন আমার জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে। তাই অসহায় গিন্নীর কথা চিন্তা করে স্বপ্নে কখনো সাবমেরিনে চড়িনি।

তবে হ্যাঁ, একবার নাসার মহাকাশযান যানে চড়তে চেয়েছিলাম। অত্যাধুনিক রকেটে চড়ে চাঁদের দেশে যেতে চেয়েছিলাম, চাঁদের বুড়ির সাথে দেখা করতে। উদ্দেশ্য ছিলো, চাঁদের বুড়ির যুগযুগ ধরে কাটা সুতাগুলো পাইকারি দরে কেনার। অনেকেই বলতে পারেন, ‘এই সুতা দিয়ে কী হবে?’ কী হবে শুনুন তাহলে–
:আমাদের দেশে এই কাটা সুতার প্রচুর চাহিদা আছে। এদেশের জুট ব্যবসায়ীরা এগুলোকে জুট বলে। এই জুট মেশিনের সাহায্যে আবার তুলা তৈরি হয়। সেই তুলা দিয়ে আবার সুতা তৈরি হয়। আবার লেপ-তোষক তৈরি হয়। আরও নানারকম পদ্ধতিতে নানারকম কাজে ওইসব জুট ব্যবহার করা হয়। গার্মেন্টসের টুকরো কাপড়ের জুট থেকে বড়-বড় কাপরের টুকরা বেছে নিয়ে, ঐগুলা দিয়ে ছোটদের জামা-প্যান্ট-সহ আরও অনেককিছু তৈরি হয়। তাই বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক স্থানে এই জুটের জন্য সময়-সময় খুন-খারাবির মতো কাণ্ডও ঘটে যায়। গার্মেন্টসের জুট আর টেক্সটাইল মিলের জুটের জন্য দলা-দলি সৃষ্টি হয়! সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়! মারা-মারির সৃষ্টি হয়!

এসব জুট একসময় গার্মেন্টস টেক্সটাইল মিলের মালিকরা ময়লা আবর্জনার সাথে ফেলে দিতো। সেই ফেলানো ময়লা আবর্জনার জুট এখন লক্ষলক্ষ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশের শিল্পনগরী এলাকায় এই জুটের জন্য সিন্ডিকেটেরা বড়-বড় নেতাদের পায়ে-পায়ে ঘুরছে। এসব দেখে মনে মনে ভাবতে থাকি, ইশ! যদি চাঁদের দেশে গিয়ে বুড়ির কাটা সুতাগুলো এদেশে নিয়ে আসতে পারতাম! তাহলে তিনদিকে উপকার হতো, লাভবানও হতো।
প্রথমত: ☛ চাঁদের বুড়ি তো যুগযুগ ধরে দিনের-পর-দিন, রাতের-পর রাত সুতা কেটে বোঝাই করে রাখছে। এতে করে চাঁদের বুকে কাটা সুতা হয়ে যাচ্ছে পাহাড় সমান। এর কারণে দিন-দিন রূপালি চাঁদটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের বুড়ির কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে ঐগুলা কিনে আনলে, চাঁদের বুড়িও বেশকিছু টাকা হাতে পাবে। সেইসাথে চাঁদের কিরণ আরও উজ্জ্বল দেখা যাবে এবং চাঁদের ভারসাম্যও কিছুটা রক্ষা হবে।
দ্বিতীয়ত: ☛ চাঁদের বুড়ির কাছ থেকে কাটা সুতাগুলো আমাদের দেশে আনতে পারলে এদেশে জুটের চাহিদা অনেকাংশে মিটে যাবে। জুট নিয়ে খুনা-খুনি, মারা-মারি, দলা-দলি কম হবে। বড়-বড় নেতারাও একটু আরামে ঘুমাতে পারবে। জুট ব্যবসায়ীদেরও ভালো ব্যবসা হবে।
তৃতীয়ত:☛ চাঁদের বুড়ি থেকে নামমাত্র মূল্যে জুটগুলো কিনে এনে আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করলে বেশকিছু টাকা লাভ তো অবশ্যই হবে। সেই টাকা দিয়ে আমার মতো অনেক অভাবী সংসারের অভাব দূর হবে।
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমের ঘোরে ঠিকই নাসার মহাকাশ যানে চড়ে চলে গেলাম চাঁদের দেশে।

নাসার মহাকাশযান থেকে রোবট সাজে সজ্জিত হয়ে রকেট থেকে নেমে যখন চাঁদের বুড়ির সামনে গেলাম, তখন চাঁদের বুড়ি তেড়ে এসে আমার দুইগালে ঠাস-ঠাস দুটো থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞাসা করলো–
:তুই না নেহাৎ গরিব মানুষ? গরিব হয়েও নাসার মহাকাশযান যানে চড়ে পৃথিবী থেকে এখানে আসলি কেন?’
চাঁদের বুড়ির প্রশ্নের জবাবে আমি কান ধরেই বললাম–
:বুড়ি মা, আমিতো আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আগে আপনার পা ছুঁয়ে নমস্কার করে নিই, তারপর নাহয় এখানে আসার উদ্দেশ্যটা বলি!’
আমার কথা শুনে চাঁদের বুড়ি বললো–
:নমস্কার লাগবে না। তুই আমাকে ছুঁতেও পারবি না। তোর সাথে করোনাভাইরাস আছে। তুই আমাকে ছুঁলে আমিও আক্রান্ত হয়ে পড়বো। তাই যা বলার দূরে থেকেই বল! বল উদ্দেশ্যটা কী?
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম–
:বুড়ি মা, আপনার কাটা সুতাগুলো পাইকারি দরে কিনতে এসেছিলাম। আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আপনার সূতো কাটার কৃতিত্বের কথা। তাই ভাবলাম! আপনার কাটা সুতাগুলো পৃথিবীতে নিয়ে আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে বিক্রি করে দিবো। এতো আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদেরও জুটের চাহিদা মিটবে, আর আমার সংসারে লেগে থাকা অভাবও দূর হবে।
এই কথা বলার পরই চাঁদের বুড়ি আমাকে আরেকটা জোরে থাপ্পড় দিয়ে আমার এক কানের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলো। তারপর বললো–
:তুই কি বোকা? এখানে কি কোনও সুতা তৈরির ফ্যাক্টরি আছে? আমার কি খেয়ে-দেয়ে আর কাজ নেই? আমি কি বসে বসে শুধু সুতাই কাটবো?
আমি বললাম–
:তাহলে বুড়ি মা, আমি যে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আপনি একটা বটগাছের নিচে বসে বসে যুগযুগ ধরে শুধু সুতাই কাটছেন! তাহলে আমি কি ভুল শুনেছি?
আমার কথা শেষ হতে-না-হতে আমাকে আরেকটা থাপ্পড় মারতে চাইলো। তা দেখে আমি একটু সরে দাঁড়ালাম। থাপ্পড় আর আমার গালে লাগলো না। দ্বিতীয় থাপ্পড় থেকে রক্ষা পেলাম। তারপর চাঁদের বুড়ি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বললো–
:আমি এখানে আছি চাঁদকে দেখে রাখার জন্য। যাতে রাহু চাঁদকে গিলতে না পারে। আমি হলাম মা বুড়ি। চাঁদকে পাহারা দিয়ে রাখি। তুই যা এখান থেকে!
এই বলেই আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে চাঁদ থেকে নিচে ফেলে দিলো। আমি সেদিন বায়ুমন্ডলে ঘুরতে ঘুরতে খুব কষ্টে বআসায় পৌঁছেছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম একটুও টের পেলাম না। সকাল ১০টায় গিন্নীর পাগলা ঘণ্টার আওয়াজে ঘুম থেকে ওঠে নিজে নিজেই বলতে লাগলাম, আমি বাসায় এলাম কী করে? এই ভাবেই একা একাই হাসতে থাকি। মনে মনে বলি, ‘এ আমি কী দেখলাম! সত্যি কি স্বপ্ন দেখলাম?’