রত্না রশীদ ব্যানার্জী এর সকল পোস্ট

রাণীগঞ্জ, পাতালের মেয়ে

পায়ের পাতার নিচে আক্ষরিকে বাস্তবিকই
বহুকাল সত্যি মাটি নেই —-
দাউ-দাউ আগুন শ্মশান।
তবু দৈত্য ব্ল্যাকডায়মন্ড্
তুমুল উদ্যোগী হয়ে
নিত্যদিন অভিসারে যান—-

হৃদয় খোঁড়া তো কবে হয়ে গেছে সারা,
আগুনের চেলি পরে ঠা-ঠা জেগে রাজকন্যারা,
খোঁড়া বুক পরিত্যক্ত খাদান প্রতিহিংসা ফাঁদে,
কালো হীরে লুঠে কেউ বালিটাও ছোঁড়েনিকো খাদে,
উথালি পাথালি তার লুণ্ঠিত ভরা যৌবন
চরাচর জুড়ে তাই জহরব্রতের আয়োজন।

আগুনের আচমন- আগুনের ফুলশয্যা রাতে,
হুড়মুড় এক্সপ্রেস কোন্ দিন ঢুকে যাবে ঠিক
পাতাল কন্যার পাতা আগুনের ফাঁদে…..

**********************************

নিশি

হাওয়ার কুন্ড থেকে উঠে এসে
ফের ওই হাওয়াতেই গা-ভাসানো
অজ্ঞাত ক্রিয়া সমবায়ে,
কঙ্কাল – কোটরে ফের জেগে ওঠার
চিহ্নকামী হঠযোগে ধূম- প্রত্যয়ে,
মূহুর্ত – চূর্ণাংশ-ক্ষনের ভিতরকনিকায়
ঘাইতোলা তিলভোর অঙ্কুরিত দানা,
মাটির বালিশ গালে চেপে
খটাখটখট্ আজনা বাজনা
শুকনো হাড়ে ভেলকি জোড়ে ফের,
এফোঁড় ওফোঁড় চষা কবরিত
হাড়-হিম হাত নড়ে,
নড়ে আর ইশারায় হাঁকেঃ

‘কবর – বাসরে একা জেগে আছি,
আয় পাশে চলে আয় উথালি আমিনা’।

কবন্ধ

মেনে এবং মানিয়ে নেওয়া
আমাদের আয়ত্ত অভ্যাস।
উড়ে যাক্- পুড়ে যাক্–
সিন্থেটিক ম্যাট্রেসে পুরন্ত যৌবন যাক ঝুলে —
মাথাব্যথা করিনা কখনো।

সুবুদ্ধি সুশীল জনের
মাথা- ঘাড়ে স্পন্ডিলোসিস্,
মাথাদের কলোনীতে
মাথা-কাটা মহামারী -যোগ —

মেনে নাও মেহের আলি,
ঝুট্ কিছু নয়, — কিছু নেই —

শুধু, তফাতে গিয়েছে চলে
দল বেঁধে ঝাঁকে ঝাঁকে
উঁচু – রাখা মাথাদের দল।

ক্রিয়ামেধ

বহু মেধা গলাধঃ করে
সভ্যতার সীমানা বিস্তার —-

সময়ই সময় করে
সমন্বয়ে সমস্ত চেনায়।

য-ত-দূ-র চ’ষে গেছো
নেশাগ্রস্থে গোধূলির আগে,
ভয় নেই, আপেক্ষিক সভ্যমুখ
ততটাই তোমাকে তাড়াবে।

কান্নাবিলের দুপুর

কানাবিলে মাঝদুপুরে
হঠাৎ -হঠাৎই
ঝুপ করে নৈঃশব্দ্য ঝাঁপায়,
আমার দশদিকে সত্যি দেখি কেউ নেই আর…..

মাধবডিহির পথে
তুমুল বিরানে
একাপথ একা পেয়ে
দুদ্দাড় আমাকে তাড়ায়….

কাঠফাটা ধূ-ধূ করা নিঝুম প্রান্তর
গিলে গেছে নির্বিকার জনচিহ্নটুকু,
এমনকি রাত্রি জাগা
ঠায় খাড়া কালপুরুষকেও,
তার চেন্ – এ বাঁধা কুক্কুরী সমেত।

মহরম

ও-ই যারা ঘাড় উঁচু সূর্যটা দেখতে চেয়ে
বেমালুম চুর্ করে মালাইচাকিটা,
নাম কাটা পড়ে সেই যোগ্যতার দৌড়-সারিতে
আর পাঁচটা গড়পড়তা কাঁধে কাঁধ দিতে।

রাজপথের সমূহ নির্মিতিই যেন
মুহুর্মুহু বহমান প্রাণমিছিল উগলে দিতে,
এবং এ সংসার যাদের সঙ্গে বাধ্যতায় কালই কাটায়
তারাই বা কিভাবে পেরে ওঠে
ঝিম্ মেরে সেঁটে যেতে চলন্ত রাস্তা বিপরীতে!

আজ নয় ন্যালাখ্যাপা জামবাটি হাতে।
কিন্তু এ্যাতো দিনে কতো কতো ধারই জমেছে
হাওয়া- মাটি- কাঁটা – তার – এর- ওর কাছে,
আর গাছ! তিনি যদি বৈরাগী, তাঁর চেলা নির্মোহ ঘাস,
দান-সাগর ভক্তির তিরতিরে রজত আভাস
পরাস্ত সৈনিকের ভ্রুতে ঝ’রে ঝ’রে
ফের দেয় চালু করে
হাঁটু মোড়া কুর্ণিশের দাস-ইতিহাস।

ওলোটপালোট

দু-এক দানা খানার ছিল সত্যি বড়ো আকাল,
ময়না ছিল আহারে উন্মুখ।
হাতেই ছিল মজুত,তবু বাড়াওনি কেউ তা,
ময়না- নাচন দেখায় ছিল মর্ষকামী সুখ।

সমস্তদিন অভুক্ত পেট দেওয়ালে পিঠ চেপে,
ময়না অনেক গুনে গেঁথে বেচেছে আশনাই,
সন্ধেবেলায় দৃশ্যপটের অবাক ওলোটপালোট,
দেউড়িতে তার শিষমহলের বহতা রোশনাই।

এখন যখন চাইলে সবাই অনেকখানি চোখচাপিয়ে
তত্ত্ব তালাশ সদরে অন্দরে,
কল্কাপাড়ে কপাল ঢেকে মুচকিহাসি ময়না উধাও,
নির্নিমেষে বন- বাদাড়ে -পাহাড়ে-কন্দরে।

চালাক হবার প্রয়োজন নেই, সততার প্রয়োজন

… আমার যতো বিত্ত প্রভু,
আমার যতো বাণী …

দোবো তো তোকে, কিন্তু কি দোবো বাবা? উত্তরপুরুষের মুখোমুখি হয়ে থতমত খেয়ে যেতে হয়। ওদের চাহিদা বুঝিনা তো বটেই, কিন্তু নিজের ভাঁড়ারে কি আছে, সেটাও কি ছাই জানি আমি!!

সবাই একমত হবেন কিনা জানিনা, কারন মানুষের মূল্যবোধ তো এদান্তি খুবই বদলে বদলে গেছে, যেটা বলতে চাইছি সেটা এই যে, মানুষকে নিজে হাতে তার ফলানো ফসলের পুরোপুরি স্বাদ বাধ্যতায় গ্রহন করে যেতেই হয়। চাক, বা না চাক, এড়িয়ে যাবার বাগ নেই। ভাবি হয়তো, গর্তটা খুঁড়ে রাখলাম শত্তুরের জন্য, আলটিমেটলি দেখা যায় আমার নিজের হাতে খোঁড়া গর্তটি চারিত্রিক ভাবে চরম নৈর্ব্যক্তিক হওয়া স্বত্বেও, কিভাবে যেন অভাবনীয় ভাবে ফেভার করে আমাকেই,ঝাড়- গুষ্ঠি – বংশ সমেত। অতি চালাক আমি সচেতন সতর্কতায় বারংবার গর্তটি এড়িয়ে এড়িয়ে যেতে সক্ষম কপালজোরে যদিবা হয়ে গেলুম, মহাকালের কারুকার্যে পরম নিশ্চিন্ততায় তা তোলা হয়ে রয়ে গেল পরবর্তী বংশধরদের ভোগান্তির তালিকায়।

হুট করে যখন সম্পূর্ণ নিষ্পাপ নাবালক বংশধরের কচি করতলে সুদ সমেত বিষফল ঝুপ করে এসে পড়ে, তখন তিনকালধরে পাপ জমানো পাকামাথা শয়তান আমি কুকর্মবাহী ঘাড়খানি এধার ওধার নাড়াতে থাকি, ও অদৃশ্য ভগবানকে গাল পাড়ি। শয়তানও তো ক্ষমতার দিক দিয়ে প্রায় ভগবানের কাছাকাছিই, দিব্য নিজেকে কালপ্রিট রূপে অদৃশ্য রাখতে পেরে যাই। আমার ছানাবড়া চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় সন্তান সন্ততির মরন তড়পানি দেখে যাওয়া ছাড়া, তখন আর কোন গত্যন্তর থাকেনা। তখন, সত্যি বড়ো দেরি হয়ে গেছে। ঈশ্বরেরও সাধ্য নেই, যে কালের চাকাটা উল্টোপানে ঘুরিয়ে দেবেন। তাঁকেও ন্যাচারাল জাস্টিস মেনে চলতে হয়। আলটিমেটলি নেচার উইল টেক ইটস্ ওন কোর্স।

তাই সস্তা হাততালিতে কাজ নেই। টুকরো মিথ্যে দিয়ে আপাতদামী নিরাপত্তা, প্রশংসা,সামাজিক সম্মান নিশ্ছিদ্র করে কাজ নেই, সবচেয়ে বড়ো পাপ নিজস্বার্থে কারো চরিত্রহানী করে পাড়ে উঠে তো গেলাম, পরের কথা পরে ভাবা যাবে, এই এ্যটিচ্যুড এক্ষুনি ত্যাগ করা প্রয়োজন। কারন, তার আর পর নেই…। নাক পর্যন্ত জল উঠে গেলে হালে পানি পাবোনা যে তা নিশ্চিত্।

তবে মানুষ যখন, ভুল করে ফেলতে পারি। সেটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবনেই সব কষ্ট স্বীকার করে প্রয়োজনীয় পেনাল্টি নিজে শোধ করে দিয়ে যাবো, অন্যের ঘাড়ে মিথ্যা অপরাধ দিয়ে পার পেতে চাইলে তা পরবর্তীতে নিজের নিরপরাধ উত্তরপুরুষের ঘাড়ে অন্যায় ঋণভার চাপিয়ে দিয়ে যাওয়া হবে। পাপ তার বাপকেও ছাড়েনা। একটা একটা করে গুনে গুনে শোধ হবে স- ব ঋণ বংশ পরম্পরায়। একের অপরাধে অন্যের শাস্তি।…

এভাবেই বুঝিয়ে বলতেন আমাদের নমস্যা গৌরীদি। আরো আরো উদাহরন সহযোগে, আরো প্রাঞ্জল, আরো মনোগ্রাহী করে। আমি তো ধারেকাছেও পৌঁছতে পারলাম না। স্মৃতি থেকে অক্ষম উদ্ধারের চেষ্টামাত্র :

মানুষ তার উত্তরপুরুষের জন্যে গাড়ি- বাড়ি- ধনদৌলত রেখে যাবার কামনায় যে বদগুন তার জিনের মাধ্যমে পরিবাহিত করে দিয়ে যায়, সেটা অপকর্মের মধ্যে পরিগনিত হয়। বরং পূর্বপুরুষ হিসেবে বংশ পরম্পরায় সৎসংস্কার, শুদ্ধচিন্তা ও পুন্যকর্মের মাধ্যমে জিনবাহিত হয়ে উত্তরপুরুষের অধিকারে আসুক, সেই তার প্রকৃত সম্পদ যা অমূল্য, টাকা দিয়ে যা সাতজন্মেও কিনতে পারা যাবেনা।

চালাক হবার প্রয়োজন নেই, সততার প্রয়োজন।

মহা প্লাবনের দিন

নূহের কিসতি যথেষ্ট তাগড়াই।
তাবৎ প্রাণীকুল এঁটে যায় তাতে।

কিন্তু আমিও যে নৌকো গড়িয়েছি, অগুন্তির বানি গুনে গুনে দিয়ে!
ওঠা তো দূরস্বপ্ন! ছুঁতেই দিই না কাউকে।

আর, তারপর পর তো কেবলই বয়ে বয়ে যায় কথা আর কথা
-কথা- কথা-কথা দিয়ে দিয়ে মধুক্ষর বিহানের বেলা…

এ্য- তো কিসের কথা
মিনিটে সহস্র বার সহস্রের ধারে!

অতঃপর, একটা দিনেরই হঠাৎ এর ছলোৎচ্ছল জল- মিলে- যাওয়া
লোনাস্বাদী সুদুর আশমানী নক্ষত্র গন্ধে
এলোমেলো বাসী চুলের গুছি ধরে ধরে
কি মায়ায় যে প্রভাতী আঙ্গুল বুলিয়ে বুলিয়ে চলে গেলে…
আরও কি কি সব ভালবাসা বলতে বলতে…
ঠোঁটও ঠেকালে কি!
নির্ভুল মনে আছে তিনটে মুনিয়া
কোত্থেকে ঢুঁড়ে এনে তিন চোখে তুলিতে বসালে…
আর.. আর.. কুর্চি ছড়িয়ে দু- চার -পাঁচটা..
আর.. আর… আরো কি সব….ফিসফাসে..
..জানিনা, যাও। আরো আরো কি কি সব…

আমিও অমনি
আদেখলা মায়া- ছোঁয়া পেয়ে
জেগে উঠতে ভুলে গেলাম…
ভুলেই গেলাম একেবারে।

আর ভুল – ঘুমে কাদা মোহনায়
আমার সেই বানি দিয়ে কেনা নৌকো
চড়াৎ চড়াৎ শব্দে
আত্ম ধ্বংসী বেবাক দুফাঁক।

পরাবাস্তব

তোমাকে হারাতে হবে ভাবিনি কখনো।
যেচে তুমি একতরফা প্রতিজ্ঞা কতো
যে, চিত্রমালা- মোতাবেক শৃঙ্গার যতো
দৃশ্যতায় মিলিয়েছো, হয় কি এমনো?

‘হ্যা’, এবং ‘না’, এই দ্বিবিধ বিরুদ্ধতা
উপহারে বুকে চেপে কি করে নক্ষত্র্যে
চোখ গাঁথি? কি করে বা অন্যথা-অন্যত্রে
শিল্পিত এ পাখি চোখ মাখে মলিনতা?

বিলম্ব না সহা পাখি ঠাট্টায় ‘চাতক’
হর- হামেশা তোমার অতুলন ঠোঁটে,
সেই তুমি মেঘেদের ভিন্নমুখী জোটে
মৌসিনরাম ট্যুরে, এবার কাঁহাতক

বুকপোড়া তেষ্টা আর প্রাণপোড়া গানে,
কালান্তরে খুঁজি এই মরণের মানে!

নিত্য কথাবৃত্ত

বহুদিন কোনো কথা নেই। আমার তো অজানা নয়,
‘প্রেম’ ছাড়া বাঁচোনা তুমি তিলেকও।
শুধুই শব্দ বাঁচন- ভূমি,
বেঁচে থাকো গানে- কবিতায় প্রাণবন্ত।

চেয়ে দ্যাখো, কলকল করে কথা বলে
যায় নদী যতো, যতো ঝরনা। সর্বদা
কথার ধুলো উড়িয়ে যায় গাছ- পাতা,
অরন্যে। শ্বেত- মর্মর কথায় উচ্ছলে।

শুধু সে কথায় বাঁচা, শব্দে উচাটন।
একেবারে সেঁধিয়ে জেনেছি হৃদমর্মে
প্রেমময় প্রাণ তুমি শব্দকল্পদ্রুমে
যা বাঁচার বেঁচে নাও, পছন্দে আপন।

বেশিদিন আর দূরে রেখোনা আমায়।
নিত্য কথাবৃত্তে থেকে সত্যি অসহায়।।

চকবন্দি চরাচর (শেষ)

আগামীকাল চাঁদের সাতদিন। মহরম মাসের এই সপ্তম দিবসেই কারবালা প্রান্তরে হজরত হোসেন, তাঁর পরিবার পরিজন ও সৈন্য বাহিনীর খাদ্য পানীয়ের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হল। সবদিক দিয়ে ফোরাত নদী ( ইউফ্রেটিস) ঘিরে ফেলা হলো। নারী শিশু,যারা কস্মিনকালেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, জল দেওয়া হয়নি তাদেরও একবিন্দু জল দেওয়া হল না। শিশু আসগর জল খেতে গেলে তীর ছুঁড়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছে কচি গলার সঙ্গে জল- অঞ্জলিবদ্ধ হাত। এই ঘটনার স্মরণে সারাদিন ব্যাপী পালিত হবে ‘দুফুরে মাতম’।

৮ই মহরম ছিল দুই পক্ষের যুদ্ধ বিরতি। তবু পিপাসার জল দেওয়া হল না এক ফোঁটাও।এদিন পালিত হবে ‘বিজরেন’। ৯ই মহরম আবারও যুদ্ধ শুরু। সমস্ত দিনরাত ধরে চলতে লাগল ভয়ানক আক্রমণ – প্রতি-আক্রমন। এক এক করে পতন ঘটতে লাগল রথী- মহারথী সেনাপতিদের। ১০ই মহরম ‘আশুরা’র দিন। শুক্রবার। হিজরী সন ৬১। ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ। অশেষ দুঃখ – কষ্ট – যন্ত্রণা- শোক – অপমান- লাঞ্ছনা সহ্য করে অসম যুদ্ধে শহিদ হলেন ইসলামি জগতের বাদশা হজরত হোসেন। বয়স হয়েছিল পঞ্চান্ন বছর পাঁচ মাস পাঁচ দিন। এজিদের সেনাপতি বাহাত্তরটি খণ্ডিত মস্তক, যার মধ্যে নবী বংশের শহীদ সতেরো জন এবং অনুগত শিষ্য শহীদ পঞ্চান্ন জন, মোট বাহাত্তরটি খণ্ডিত মস্তক দামেস্কে এজিদের দরবারে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করল। আর অগনিত অশ্বারোহীকে হুকুম দিল লাগাতার ছুটে যেতে মৃত দেহগুলির ওপর দিয়ে যতক্ষণ না সেগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। পরে নবীবংশের অনুগতেরা বহু চেষ্টা করেও বিন্দুমাত্র চিহ্নটুকুও খুঁজে পায়নি। ভক্তজন বিশ্বাস করল স্বয়ং আল্লাহতালা ফেরেস্তা পাঠিয়ে তুলে নিয়েছেন তাঁর বেহেস্তে সরাসরি। সে সময় সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি মর্যাদার সঙ্গে লাশগুলির দাফন করা। সেই না করতে পেরে ওঠা কর্তব্যের ভার আজও গভীর দুঃখের সঙ্গে বহন করে চলেছে মুসলিম জগৎ। প্রতি ১০ ই মহরম তাই হোসেনের তাবুত অর্থাৎ মৃতদেহ বহন করে সূর্য ডোবার আগে দাফন করা হয় নকল কারবাালায়। পালিত হয় মর্যাদা সহকারে ‘মঞ্জিল মাটি’।

কৃষ্ণাকে খুবই আন্তরিক ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তার শ্বশুরমশাই, কিভাবে- কোন্ কোন্ পর্যায়ক্রম অনুসরন করে মহরমের অনুষ্ঠান পালন করে এসেছেন তাঁরা,- “তারপর চোদ্দই মহরমের দিন পালিত হবে ‘চাহারম’ এর অনুষ্ঠান। ব্যস, পুরো চাঁদ শেষ। কিন্তু মহরমের মর্মান্তিক শোক চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে যাবে ভক্তজনের হৃদয় জুড়ে”।
_________________

সন্ধ্যে আটটা নাগাদ শুরু হয়ে গেল জলসা। শুরুতেই দরুদ ( = হজরত মহম্মদের প্রশংসা বাণী) পড়ে নিয়ে অতি সুন্দর দরাজ অথচ সুমিষ্ট গলায় গজল গাইলেন,
– আল্লা, রসুল ও রসুলের প্রিয়আহলে বায়েতদের (= হজরত আলি, ফতেমা ও তাঁদের পুত্রদ্বয় হাসান ও হোসেন) মহিমান্বিত করে। তারপর হাদিসের সুত্র ধরে সরাসরি চলে গেলেন তাঁর গুরু বংশের রচনা করা আরবি- পারসি মিশ্রিত ঊর্দু গজলে :

আয় মোমেনো দিলসে করো গম্ হোসেন কা
ইস্ মাহমেঁ জরুরি হ্যয় মাতম্ হোসেন কা।।
জান ও দিল হাবিব মেঁ সিবতায়নে মুস্তাফা।
রুতবা পয়াম্বরুঁ সে নেহি কম হোসেন কা।।
দিল বন্দে মুস্তাফা মেঁ জিগর বন্দে মুস্তাফা।
হম্ শানে মুস্তাফা মেঁ জিগর বন্দে মুস্তাফা।।
মাহরাজে কুল শাহাদাত সুলতানে কারবালা
মিলে আরজে হক্ পে রুতবা মোসাল্লম
হোসেন কা।।……..
….হে ইমানদারেরা, অন্তর দিয়ে হোসেনের জন্য শোক কর। এই মাসে অপরিহার্য হোসেনের জন্য মাতম্ করা।

একটার পর একটা মূল গজল গেয়ে চলেছেন তিনি, আর তাঁর শিষ্য সেটার অনুবাদে পরিবেশন করছেন বাংলা গজল। মধ্যে মধ্যে রয়েছে তাঁর উদাত্ত গলার ভাষন:
– ‘আশুরা’ কি? আশুরা হল আল্লার সাথে তাঁর বান্দার দহরম-মহরমের দিন। কালে কালে যুগে যুগে সময়ের অন্তরে এই আশুরার দিনটিতেই তো তুমি বেশুমার ফজিলত নসীব করিয়েছো। আমার সাধ্য কি যে তার গননা করি! — হে রহমানের রহিম আল্লা— এই আশুরার দিনেই তো তুমি এই সসাগরা দুনিয়া, চন্দ্র,সূর্য, গ্রহ, তারা সৃষ্টি করেছিলে। — হে গাফুরুর রহিম আল্লা
-এই আশুরার দিনেই তো তুমি প্রথম মানব আদম ও হাওয়া বিবিকে সৃষ্টি করেছিলে, তাদের স্থান দিয়েছিলে বেহেস্তে, আবার অবাধ্য হবার কারনে সময়ান্তরে তাদের নির্বাসিতও করেছিলে এই আশুরার দিনটিতেই,– দীর্ঘকাল সাধনার পর আবার বেহেস্তে স্থান দিয়েছিলে এই আশুরার দিনেই,–হে জলিলুর রহিম আল্লা — এই আশুরার দিনেই সৃষ্টি ধ্বংস হবে তোমার নির্ধারিত, তবে কেন, কোন্ গুনাহ্ র কারনে আমার নবীর লাল হাসান- হোসেন কে এই আশুরার দিনেই অমন জল্লাদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হল? তোমার নাজাত তারা কেন পেতে পারল না?

হে জাব্বারুর রহিম আল্লা, এই আশুরার দিনেই তুমি কুরান শরিফ সমেত বিশ্বের সমস্ত মজহাবের আশমানি কিতাব নাজেল করায়েছ, হজরত নূহ কে তাঁর কিস্তি সমেত তরায়েছ প্রলয়ঙ্করী তুফান ও জলোচ্ছ্বাস থেকে, হজরত ইব্রাহীমকে রক্ষা করেছ শত্রুর অগ্নিকুণ্ড থেকে, হজরত মুসাকে নবি হিসাবে স্বীকৃতি দান করেছো– তুর পাহাড় ভস্মিভূত হয়েছে— অত্যাচারী ফেরাউনের ঘটেছে সলিল সমাধি, তুমিই হজরত আয়ুবকে কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি দিয়েছিলে–
— আরো কত- কত উপহার দিয়েছ তুমি এই আশুরার দিনটিতেই, তবে কেন শুধু ওই দুটি নবির লালের জন্য তুমি কেন হে নির্দয়?

হাউ হাউ করে কাঁদছেন বক্তা। কাঁদছেন সমগ্র শ্রোতৃমণ্ডলী। কাঁদতে কাঁদতেই গজল ধরলেন আবার। বিষয়বস্তু কারবালার অসম যুদ্ধ। গজলের মাধ্যমে এক এক করে বর্ননা করে চলেছেন কিভাবে হজরত হোসেন কুফা যাবার পথ হারিয়ে সপরিবার – সবান্ধব এসে পড়লেন কুরুক্ষেত্র সদৃশ মারণভূমি কারবালা প্রান্তরে, কিভাবে বালিতে ঘোড়ার নাল ঢুকে যাওয়া দেখে বুঝে নিলেন যে এই তাঁর শেষ শয্যার স্থান, আশপাশের গাছ- গাছালি ফেটে রক্ত পড়া দেখে নিশ্চিত্ হলেন আগামীর রক্তক্ষয়ী ভয়াল অন্তিম সংগ্রামের বিষয়ে, কি ভাবেই বা তিনি বক্ষরোমশুন্য সীমার কে দেখে সনাক্ত করলেন যে এই তাঁর নিশ্চিত্ হন্তারক,— এ সমস্ত কিছু বিবৃত হতে লাগল মর্মস্পর্শী গজলের মাধ্যমে। যেমন সুর, তেমন শব্দচয়ন,তেমনি পাল্লা দেওয়া যন্ত্রণাকীর্ণ মরমী গলার আওয়াজ।

সংক্রমিত শোকে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো কৃষ্ণা। আশমানি নরম করে ওর পিঠে- মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

মর্মস্পর্শী গজলের মাধ্যমে বর্ণিত হয়ে চলেছে নিদারুণ কারবালা হত্যাকাণ্ড। কারবালা মরুপ্রান্তর রক্তস্রোতে নিজবর্ণ হারিয়েছে। লালে লাল হয়ে গেছে দশদিক। স্রেফ কারবালা প্রান্তরটির বর্ণনাতেই গজলে ব্যবহৃত হয়েছে অগুন্তি বিশেষণ :
মাসুমে কারবালা, মজলুমে কারবালা, শহিদে কারবালা, পিয়াসে কারবালা, সাবেরে কারবালা, হয়রানে কারবালা, মেহবুবে কারবালা, বাদশাহে কারবালা, সর্দারে কারবালা, শাহানশাহে কারবালা, ওসিয়ে কারবালা, মুর্শেদে কারবালা, মওলায়ে কারবালা, হাবিবে কারবালা, রহমতে কারবালা, কোরবানে কারবালা, নাইয়ারে কারবালা,— এমত আরো বহুবহু বিশেষণ। কারবালা যেন একটা ভৌগলিক স্থানমাত্র নয়, বর্ণনায় মনে হচ্ছে অসংখ্য বীর সেনানীর মতো কারবালা নিজেও একটা সক্রিয় মহাকাব্যিক চরিত্র বিশেষ।…

শোকাবেগের তীব্রতায় কৃষ্ণা কিছুতেই সুস্থ হয়ে বসে থাকতে পারছিল না। সেই যেমন ছোট বেলায় রামলীলা শুনতে গিয়ে আবেগে বিহ্বল হতো।.. ওকে ঘরে নিয়ে এল আশমানী। আসর ছেড়ে যতই ঘরের দিকে এগোচ্ছে কৃষ্ণা, তত যেন ধাওয়া করছে ওই বুক ভেঙ্গে দেওয়া গজলের করুণ সুর – শব্দ- মর্মবাণী :

হ্যায় শবে আশুরা কেয়ামত কি রাত।
রঞ্জেগমে দর্দো মুসিবত কি রাত।।
আয়ে নবিকে লিয়ে আফাত্ কি রাত।
শিব্ তে পয়াম্বর কি শাহাদত্ কি রাত।।…..

কৃষ্ণা বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে, চোখের জলে বালিশ ভিজোতে ভিজোতে, শেষতক ক্লান্ত – অবসন্ন হয়ে ওর চোখ লেগে গেল। আর কেউ না জানুক, ও নিজে জানে ওই চোখের জল শুধুমাত্র হাসান- হোসেনের জন্য নয়। ওই চোখের জলের ভাগীদার তার অসংখ্য কাছের দূরের আপনজনেরা। কোন একটা বিষয় নিয়ে বুক তোলপাড় হলে, সারি দিয়ে সব ধেয়ে আসে তারা। এই পৃথিবীর অকারণ অশান্তি – অপমান-লান্ছনা বিনা দোষে তোলা থাকে যাদের জন্য, সেইসব আপনজনের জন্য যন্ত্রনায় বুক ভেঙ্গে যেতে চায় ওর। আর এটাই তো ওর অসুখ। অগুন্তি সুখ- সমাহারের মধ্যে বসে থেকেও টনটনিয়ে ওঠে বুক।…. ক্রমশ সময় গড়িয়ে যেতে
ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল ও।…..সেই ছোট্টবেলার মতন বাপি ডিউটি থেকে ফিরতেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেমন আদরে গলে যেতো,—- বাপি দেখো, আমাকে না মা-আর দিদা আজ অনেক অনেক কাজ করিয়েছে। দেখো হাত -পা কেমন খড়ি ওঠা সাদা হয়ে গেছে।
– তাই! খুব করে বকে দিচ্ছি ওদের।
– বাপি, আমি তোমাকে খুব দুঃখ দিয়েছি, তুমি আমাকে খু-ব বকো বাপি।
– না- মা, তুমি আমায় দুঃখ দেবে কেন মা! তুমি আমার সোনার মেয়ে, হিরের টুকরো মেয়ে আমার।
-না বাপি, আমাকে কাউকে বলে দিতে হবেনা বাপি,…. কাঁদতে কা্ঁদতে বাপির বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে চললো,…আমি নিজে জানি, আমি তোমাকে খুব খুব দুঃখ দিয়েছি, বাপি।
– তোমাকে কতদিন দেখতে পাইনা… তো মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলে সব বাবারই এমন কষ্ট হয়, মামনি।
– সেটা একটা কারন, সবটা নয় বাপি। আমার জন্য কত লোকের কাছে তোমায় কতকিছু শুনতে হচ্ছে যে…
– সেতো ওই লোকগুলোর ওইরকম বাজে স্বভাব, তাই ওসব বলছে।
-কিন্তু বলছে তো আমার জন্যই। আমিই তোমাকে দুঃখটা নিজে হাতে করে বয়ে নিয়ে এসে দিলাম, বাপি।
– না মা। তোমার জন্য বলবে কেন? ওদের সংকীর্ণ মানসিক গঠনের জন্য বলে। সামাজিক পরিস্থিতির জন্য বলে। সমাজটা তো আমরা এখনো পাল্টাতে পারিনি…
-তাহলে অ-ত অ- ত দিন যে তুমি বাড়িঘর ছেড়ে ছুড়ে খেয়ে- না- খেয়ে, কোথায় কোথায় গা- ঢাকা দিয়ে আন্দোলন করলে, তার কি কোন ফল হল না, বাপি।
– সব ফল কিছু হাতে- হাতে পাওয়া যায় না, মা। ধৈর্য্য ধরতে হয়।
– তাহলে কালকে যে মেহেবুব সাহেব বক্তৃতায় বলছিলেন, হৃদয়ের ভালবাসা আর ভক্তি দিয়ে প্রার্থনা করলে, সব মনস্কামনা পূর্ণ হয়ে যাবে। আমিও যে প্রার্থনা করলাম, পূর্ণ হবে তো, বাপি?
-নিশ্চয়ই। তোমার কোন আশা অপূর্ণ থাকবে না, মা। কিন্তু কি প্রার্থনা করলে, মামনি?
-বেশি না, একটাই। আমি শুধু চেয়েছি, যাতে আমার মা- বাবা – দিদা- ভাইদের সঙ্গে এ বাড়ির সব্বার সুসম্পর্ক তৈরি হবার মতো সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।
– ওরে বাবাঃ! কী করেছো মামনি! এ যে একেবারে সাবিত্রী বা ধ্রুবের প্রার্থনার মতো। খুব সহজ কিছু নয়, মা।
– আমার তাহলে কোন আশা নেই, বাপি?
ফোঁপাতে থাকে কৃষ্ণা।
– আশা তো আছেই। তবে একটু সময় লাগবে।
– কিন্তু আমার হাতে যে বেশি সময় নেই, বাপি। তোমাদের ছেড়ে আমি বেশিদিন বাঁচবো না, বাপি….

…ছুটতে ছুটতে ছোট ননদিনী এসে ডেকে তুুললো কৃষ্ণাকে,….. এই মাত্র খবর এলো তোমার বাবা, এক দাদা আর তমিজদ্দি ভাই বাড়ির কাছে এসে পড়েছেন। আব্বা মহরম দেখার দাওয়াত দিয়েছিলেন।

তখন, সেই সাতসকালে ঘরে বসে থেকেই কৃষ্ণা মানস চক্ষে দিব্যি দেখতে পেল, কাল রাতের সেই চরাচর ব্যপ্ত করা তুমুল অলৌকিক চন্দ্রালোকের বন্যায় যাত্রা শুরু করে সাক্ষাৎ তিন বার্তাবাহী দেবদূতের মতই উজ্জ্বল তারকা চিহ্নিত পথ কেটে কেটে অস্পষ্ট অবয়বে এই ভেদদীর্ণ চরাচরের তাবৎ তুচ্ছতাকে সাহসী ভাবনার ডানায় সাপ্টে নিতে নিতে এক- পা এক- পা করে এগিয়ে আসছেন ওঁরা। ওঁরা তিনজন।

সমাপ্ত।

চকবন্দি চরাচর (৭) উপন্যাসাংশ

মহরমের প্যান্ডেল নিয়ে চাঁদ ওঠার আগে থেকেই উদ্যোগী না হলে চলেনা। আশমানি দ্যাওরদের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেয় সব।
– আর বোলোনা ভাবি, গেল পাঁচ বচ্ছর ধরে চন্দননগর থেকে আলোকশিল্পী নিয়ে এসে প্যান্ডেল – পাড়া সব সাজাচ্ছি। এবছর এমন একটা রগচটা লোক পাঠিয়েছে যে তাকে কিছু বলাই যাচ্ছে না। লাখ টাকার বাজেট, তা তেনাকে কোন সাজেশন দেওয়া যাচ্ছেনা।

– এক এক মানুষ থাকে এমন। ভাবে, তার ওপর কেউ আস্থা রাখছেনা।

– তাই বললে হবে? এতো টাকা খরচ করছি, ভাল- মন্দ কিছু বলতে পাবো না?

– তা আলোর কাজটায় কি চাইছিস তোরা?

– মূল মঞ্চে তো বিশেষ পরিবর্তন করা যাবে না। সেখানে বরাবরের মতোই কারবালা যুদ্ধের দৃশ্য। ঢাল, তরবারি, বল্লম নিয়ে যুদ্ধ। ছুটন্ত ঘোড়া— চলন্ত রথ —

– রথ কি করে আনবি রে! একি মহাভারতের কর্ণ- অর্জুনের যুদ্ধ নাকি! আর, আরবের মরুভূমিতে রথ চলে নাকি!!

– না চলুক। আমরা চালাবো। স্টেজের দুপাশে দুটো কামান ও বসিয়ে দিয়েছি।

– তাহলে তো জাতশিল্পী চটে লাল হবেই।

– অত লাল- নীল হবার কি আছে? দিন বদলাচ্ছে, আর মানুষের চাহিদা বদলাবে না?

– আর এবারে যেন স্টেজের মাঝখানের কাটা হাতের পাঞ্জার নিচে বড় বড় করে “হজরত হোসেন” কথাটা লিখে দিস।

– সে আর বলতে! তবে শুধু শহুরে আনাড়িদের জন্য ওই বাড়তি কাজটা করতে হবে। অদ্ভুত বুদ্ধি! বলে কিনা, “আপনাদের এই অনুষ্ঠান কি কংগ্রেস পার্টি স্পনসর করছে?”

ওর বলার ঢঙে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আশমানির আবারো প্রশ্ন :
-আর গ্রামের চার দিকের চার গেট – এর জন্য কি ভেবেছিস?

জবাব দিতে একসঙ্গে সবাই উৎসাহে ফেটে পড়ে : এইবারের আইডিয়াটা এক্কেবারে সাম্প্রতিক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এই সবে সবে ইয়াহিয়া খানের কবল থেকে মুক্ত হ’ল বাঙালিজাতি – এখন মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাঙালির মাথায় আর কোন আইডিয়া আসতে পারে? বঙ্গবন্ধু মুক্তবাংলায় দাঁড়িয়ে স্যালুট নিচ্ছেন, আলোয় ভেসে উঠছে “জয় বাংলা”।

– এতো গেল পুবপাড়ার গেট।আর গুলো?

– পশ্চিম পাড়ার গেটে থাকবে পুরো সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে পূর্ববঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়েছেন জেনারেল মানেকশ। এখানেও প্রেক্ষাপটে আলোর মালায় লেখা: “সাবাস বঙ্গবন্ধু — জয় বাংলা।”….. আর দক্ষিণ পাড়ায় থাকছে পি- সি- সরকারের ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার আলোকসজ্জা। কিন্তু যত মুশকিল ওই উত্তর পাড়ার গেটসজ্জা নিয়ে, কিছুতে কাজ এগোতে দিচ্ছেনা। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া… কথায় কথায় খালি শরিয়ত টানছে….

– ছেড়ে দাও– কোরান- হাদিসের নির্দেশও যারা মানতে চায়না, কি বোঝাবে তাদের। সবচেয়ে বড় হ’ল হৃদয়ের ভালবাসা। ভালবাসতে কোন আইন জরুরী নয় — “মহব্বত হরওয়ক্ত্ বেদলিল হোতি হ্যয়”।

– ভালবাসা থাকলে কি আর ভাইয়ে ভাইয়ে এত হানাহানি হয়? —
পরমূহুর্তেই আবার সুর পাল্টে বলে,…
– কিন্তু ওদের ভাই ই বা বলছি কেন? ধর্মে মুসলমান হলেই কি ভাই হয়ে গেল? তাহলে তো হজরত হোসেনের হত্যাকারী এজিদ কেও ভাই বলে গলা জড়িয়ে ধরতে হয়, সে যে রীতিমতো পাঁচওয়াক্ত্ নামাজ পড়া মুসলমান। প্রথম ছুরিটা যে হজরত হোসেনের বুকে বসিয়েছিল, সেই সীমারও তো মুসলমান।

– সে তোমরা ভাই বলো আর না বলো, সীমার কিন্তু সত্যি সত্যিই হোসেনের সম্পর্কিত ভাই।
– সে কিগো! এযে ফের কুরুক্ষেত্রের গল্প শোনাচ্ছ….
– গল্প নয়। ইতিহাস। ফতেমার মৃত্যুর পর হজরত আলি সীমারের এক পিসি উম্মুল বানিন্ কে বিয়ে করেন।তো, সীমার খুবই ঈর্ষান্বিত ছিল এই ভেবে যে, তার পিসির সন্তানেরা বর্তমান থাকতেও হজরত আলির উত্তরাধিকারের ইসলামি দুনিয়ার খিলাফত কেবলমাত্র হজরত হোসেনই পাবেন।

– কেন, হাসান পেতেন না?

– তাঁকে তো আগেই বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। কুঁজি বুড়ি মন্হরার মতো কুটনি বুড়ি মায়মুনা এজিদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ছক অনুযায়ী হাসানের স্ত্রী জায়েদাকে দিয়ে হাসানের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়। স্বপত্নী বিদ্বেষ। আরো একটা ব্যাপার ছিল, এজিদ জায়েদাকে বিবাহের প্রলোভন দেখায়। ওরা সম্পর্কিত ভাই – বোন ছিল। কাজ উদ্ধারের পর বিয়েটা কিন্তু আদৌ করেনি।

– এতো পুরো রামায়ন – মহাভারতের গল্প গো!
– এজিদ নিজেও ছিল হাসান- হোসেনের সম্পর্কিত মামা।
– সেই কংসমামার উপাখ্যান?
-হজরত মহম্মদের দ্বাদশ স্ত্রী উম্মে হাবিবা এজিদের আপন পিসি। হাসান- হোসেনের মা ফতেমা তাহলে এজিদের পিসতুতো বোন।

– ওরে ব্বাস্! সম্পর্কের এতো লতাপাতায় জট পাকিয়ে…….
– না। শুধু তাই নয়।এত সহজ নয় হিসেবটা। মূলকারন সুবিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বেষ-বিদ্বেষ জড়িয়ে……..
-একাধিক বিয়ে,নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে, সুস্থ সম্পর্ক তৈরীতে বাধা দেয়, বলো?
– খানিকটা তো দেয়ই। তবে এখানেও সেই একই কথা… হিসেবটা অত সহজ নয়।

তা যদি হতো, তাহলে সীমার যে ভাইদের জন্য হজরত হোসেনকে নিজে হাতে খুন করেছিল, সীমারের শত অনুরোধ স্বত্ত্বেও তারা কিন্তু শত্রু শিবিরে যোগদান করেনি। হোসেনের বৈমাত্রেয় ভাই হজরত আব্বাস আলি ও তাঁর ভাই ও সৈন্যসামন্ত সমেত কারবালা প্রান্তরেই নির্মম শহীদত্ব বরণ করেন। বিশ্বাসঘাতকের দলে নাম লেখাননি।

– দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ, আর নয়তো রামায়নের তরণীসেন।
– বলতে পারিস। তরণীসেনের কাটামুন্ড যেমন রামনাম করেছে, আব্বাসের কাটামুন্ডও “হায় হোসেন– হায় হোসেন” ধ্বনিতে শোকাকুল করে তুলেছিল কারবালার প্রান্তর।

(পরের বারে শেষ)

চকবন্দি চরাচর (৬) উপন্যাসের অংশ

মহরমের চাঁদ উঠতেই পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে আখড়া। মাঝরাত পর্যন্ত চলবে নকল যুদ্ধের মহড়া। ওদিকে খানকায় চলতে থাকবে হৃদয় নিঙড়ে নেওয়া মর্শিয়া গানের মজলিশ।

আশমানির মামাশ্বশুরেরা, অর্থাৎ কৃষ্ণার শ্বশুরবাড়ির লোকজন পির দীক্ষিত সুন্নি মুসলমান। বাড়ি সংলগ্ন সেই পিরের খানকা, তৎসংলগ্ন মসজিদ- মাদ্রাসা, পির ও পিরাশ্রিতের আলাদা কবরস্থান যাকে বলে মাজার,— স-ব স-ব কিছু পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে গুজিয়ে তুলতে সব শিষ্যরা একত্রিত হয়েছে। এঁরা ক্বাদেরিয়া তরিকায় হুজুর পিরের বায়েতি মুরীদ, অর্থাৎ দীক্ষিত মন্ত্রশিষ্য। মহরমের চাঁদ- ভোর নারী-পুরুষ, ছেলে- বুড়ো, প্রত্যেকেই এক বিশিষ্ট ধর্মীয় বাতাবরনের মধ্যে অতিবাহিত করবেন।

গ্রামের মানুষ যে যেমন পারেন হাত বাড়ান। মূল দায়িত্বটি কিন্তু আশমানীর মামাশ্বশুরদের। এঁরাই হুজুর পিরের মূল খাদিম। মহরম চাঁদ উঠলো, তো কী এক শুদ্ধ আধ্যাত্মিক সত্ত্বা এসে ভর করলো এঁদের ওপোর।

এতকাল ধরে মামিশ্বাশুড়িদের দেখিয়ে দেওয়া মতে, মহরমের চাঁদ ওঠার আগেই, ও বিছানা- বালিশের ওয়াড়,কাপড়- চোপড় মাদুর – পাটি, সব – সব কিছু সাবানকাচা করে নিয়েছে। ধুয়ে-মেজে নিয়েছে হাঁড়ি- কড়া- বঁটি- শিলনোড়া, আটাচালুনি, চাকি, বেলুনি,হাতা- খুন্তি স-ব। বাড়ির আর সবার মতো ও নিজেও মাথায় সাবান দিয়ে পাক- গোসল করে নিল। আগামী পনেরোদিন কেউ আমিষ খাবেনা, নারী-পুরুষ এক বিছানায় শোবে না, গায়ে-মাথায় তেল মাখবেনা, পায়ে চটি পরবেনা। কেউ কারো এঁটো খাবেনা। এমনকি একজনের বিড়ির আগুনে অন্যজন বিড়ি ধরাতেও পারবে না। বাধ্যতামূলকভাবে রোজা রাখবে। খাদ্যে- পানীয়ে- আহারে- আচরণে যতটা সম্ভব কৃচ্ছতা পালন করবে প্রত্যেকে। বাড়ির ছেলে- ছোকরা গুলো চাঁদ উঠতেই বাড়ি ছেড়ে কাসিদ্ হতে আখড়ায় গিয়ে জুটেছে।

এসব দিনগুলোয় আশমানীর অভ্রান্তে মনে পড়ে যায় নিজের ছেলেবেলার কথা। প্রায় একই রকম ধুমধামে ওদের গাঁয়ে গাজন উৎসবে চড়ক পুজো হত চৈত্র সংক্রান্তির দিন। এক সপ্তাহ আগে থেকেই ওর কাকারা – ভাইরা সন্ন্যাস নিয়ে হবিষ্যি করতো। একই রকমভাবে দলবেঁধে শিবমন্দিরে একাহারী হবিষ্যি করতো, তেল- সাবান মাখতো না, বাড়ি ঘরে আসতোনা, দোরে দোরে গান গেয়ে ভিক্ষা মেগে সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যা সেজে সিধে সংগ্রহ করতো। বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে আসে স্পষ্ট স-ব ছবি।….একজন মড়া সেজে শুয়ে পড়তো পথের ওপোর, আর দলবল সুর করে গান ধরতো :

শুন শুন সন্ন্যাসী ভাই শুন বিবরণ,
পথের মাঝে মড়া পড়েছে কিসেরই কারন?
মড়া পড়েছে ভাল হয়েছে সন্ন্যাসীদের ভাল,
বুড়োশিবের দয়াতে মড়া উঠে গেল……

এই সময় মড়াসাজা ছেলেটি উঠে বসতেই সবাই মিলে সমস্বরে ধ্বনি দিয়ে উঠবে,
‘ জয় বাবা মহাদেবের চরণের সেবা লাগি,—– মহাদেব’।
এখনো যেন স্পষ্ট কানে বাজে। কী সুন্দর সুন্দর সব গান!…..

আশমানির তন্ময়তা তছনছ করে দিয়ে ওর মামাতো দ্যাওরের দল আকুল প্রশ্ন রাখে,
….মহরমের চাঁদের আজ তিনদিন হয়ে গেল, তুমি যে এখনো নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছো!

……..কেন রে, কি করতে ভুলে গেলাম বলতো?

….. সেই ফেস্টুনটা! সেই যে গো, সেই খাজা পিরবাবার মহরম সম্বন্ধে উক্তিটা! এখনো লিখলেনা,—– তারপর শুকুনো,—- তারপরে তো টাঙাতে পাবো।দেরি হয়ে যাচ্ছে না?

——–সেতো কাল মাঝরাত পর্যন্ত লিখে তবে আমি শুতে গেছি। আজ সেহেরিতে তাই দেরি হয়ে গেল।

ওরা একই সঙ্গে খুশি ও চমকিত। আশমানি ঘরের ভেতর থেকে বার করে আনলো চমৎকার- দর্শন ফেস্টুনটা। একটা বড়ো আয়তাকার লাল শালুর ওপর রূপালী রঙ্ দিয়ে তুলিতে লেখা :

“শাহ্ আস্ত্ হোসেন(হোসেনই হচ্ছেন সম্রাট)
বাদশা আস্ত্ হোসেন(হোসেনই হচ্ছেন
বাদশা)
দিঁন্ আস্ত্ হোসেন(হোসেনই হচ্ছেন ধর্ম)
দিঁনপানা আস্ত্ হোসেন ( হোসেনই হচ্ছেন
ধর্মের আশ্রয়)
সর্দাদ্ না দাদ্ দস্ত্দরে দস্ত্এ এজিদ ( মাথা
দিয়েছেন কিন্তু এজিদের হাতে হাত
মেলাননি)
হক্কাকাকে বিনা এ লা- ইলাহা আস্ত্ হোসেন
(আল্লা ভিন্ন অন্য উপাস্য নেই, — এই
কালামের মূল হচ্ছেন হোসেন)
খাজাপির মৈনুদ্দীন চিশ্তি রহমতুল্লাহের মহরম সম্পর্কিত মূল্যায়ম থেকে উদ্ধৃত।।”

…….. কিরে, দেখেনে ভাল করে।কোন ভুল- টুল থাকলে তাড়াতাড়ি বলবি, হাতে যেন সময় থাকে।

……… কি যে বলো! তোমার ভুল ধরবো আমরা!
….. বেশ। তা তোদের প্যান্ডেল কদ্দুর?
—–ফি বারের মতো চন্দননগর থেকে আলোকশিল্পী তো আনিয়েছি,দেখছি…..
বলতে বলতে জোরালো দলবদ্ধ গানের আওয়াজে দৃষ্টি চলে গেল বাইরের দিকে,….
… ওই দ্যাখো। কবে ‘চাহারম’ তার ঠিক নেই, কাসীদের দল বেরিয়ে পড়েছে চাল তুলতে।

…….সর্বত্র তাইতো হয়। চাঁদ উঠলেই তো কাসীদরা মোর্শিয়া গেয়ে চাল তোলে।

….অন্যত্র কাসীদরা চাল তুলে আখড়ায় রেঁধে খায়, কিন্তু আমরা যে ভাবী খানকা থেকেই সবার খাবার ব্যবস্থা করেছি। চাল তোলার কি দরকার ওদের?

….. অমন ছোটখাটো ব্যাপারে নজর দিস না। মোর্শিয়া গাইতে বেরোলেই তো সবাই সিধে দেবে…… কথা বলতে বলতেই একেবারে দুয়োরে চলে এসেছে মোর্শিয়ার দল। দলে চল্লিশ বছর থেকে শুরু করে দশ বছরের বালকও রয়েছে। কী করুন আর্তি নেমে আসছে মোর্শিয়ার কথা ও সুরে :

ভেঙ্গে দে মা হাতের চুড়ি
মাথার সিঁদুর তুলে নে,
এ জীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে–
হাসেম- বানা রণে গেল
আরতো ফিরে এলনা,
এজীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে—-
তুলা রইলো আলতা- সিন্দূর
আর তো পরতে প্যালাম না,
এ জীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে—-
নয়ালাল মোর রণে গেল
আর তো ফিরে এল না,
এ জীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে—–
বাসি বিয়ে না হইতে
ঘুচলো স্বামীর সুখ রে,
এ জীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে —–

আশমানি একটা বড় পেতলের থালায় করে চাল- ডাল- আলু ও বেশ কিছু সব্জীর সিধে সাজিয়ে ওদের ঝুলিতে ঢেলে দিলে পর ওরা এই গান শেষ করে অন্য একটা মোর্শিয়া গাইতে গাইতে অন্য দুয়োরে এগিয়ে গেল :

ভাই গো হাসান গো, কে দিল জহর গো,
ভাই গো হাসান গো, হায় – হায়- হায়—-
মেজবিবি জায়েদা দিয়েছে জহর গো
ভাই গো হাসান গো, হায়- হায়-হায়—-
মায়মুনা কুটনি এনেছে জহর গো
ভাই গো হাসান গো, হায়- হায়- হায়—-

গানের ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে নামা শোকে থম্ ধরে গেল পুরোটা আবহে।

( ক্রমশ)